২১. কৃষ্ণ-মহিষী সত্যভামা

কৃষ্ণ-মহিষী সত্যভামা

মহাভারত মূলত কুরু-পাণ্ডবের মধ্যে যুদ্ধের কাহিনি হলেও আরও কয়েকটি বংশ, যেমন মৎস্য, পাঞ্চাল, বৃষ্ণিবংশ এদের জীবনের প্রাত্যহিক সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধের দিনে অবশ্য গোটা ভারতবর্ষ এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিল। এমনকী একই বংশ দু’ভাগে ভাগ হয়ে দু’পক্ষকে বরণ করেছিল। যুদ্ধে নিজপক্ষের জন্য প্রাণ বিসর্জনও দিয়েছিল।

বৃষ্ণিবংশশ্রেষ্ঠ-পুরুষ কৃষ্ণ পাণ্ডবপক্ষের সখা, সুহৃদ, শুভচিন্তক, উপদেষ্টা দিগ্‌দর্শনকারী ছিলেন। যুদ্ধের শেষে কৃষ্ণ বসুদেবকে বলেছিলেন, “পাণ্ডবপক্ষে সাতজন জীবিত আছেন। পঞ্চপাণ্ডব, সাত্যকি আর আমি। কৌরবপক্ষে মাত্র তিনজন অবশিষ্ট আছেন— কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা।” এই একটি বাক্যই পাণ্ডবপক্ষের সঙ্গে কৃষ্ণের একাত্মতা বুঝিয়ে দেয়।

কৃষ্ণ যুগপুরুষ। মহাভারতে তাঁকে সাক্ষাৎ নারায়ণের পূর্ণাংশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ভাগবত এবং পুরাণে কথিত আছে কৃষ্ণের ষোলো হাজার স্ত্রী ছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রধানা আটজন। এই আটজনের মধ্যে প্রধানা চারজন- রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী ও জালহাসিনী। সত্যভামা রাজা সত্রাজিতের কন্যা। সত্রাজিত কৃষ্ণের নামে মিথ্যা কলঙ্কের দায়ে ভীত হয়ে নিজকন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণের স্ত্রীরূপে দান করেছিলেন। ব্যাসদেবের মহাভারতে কৃষ্ণের স্ত্রীরূপে সত্যভামাকেই বারবার দেখানো হয়েছে। সত্যভামা ও দ্রৌপদীর মধ্যে নিবিড় সখিত্বের বন্ধন ছিল। পাণ্ডবদের বনবাসকালে সত্যভামা দ্রৌপদীর দুঃখের ভাগ নেওয়ার জন্য তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদী ও সত্যভামার সাক্ষাৎকার মহাভারতের একটি অত্যন্ত দুর্লভ মুহূর্ত।

পাণ্ডবদের বনবাসকালে বহু মুনিঋষি যুধিষ্ঠিরের কাছে আসতেন। তাঁরা প্রাচীন ভারতবর্ষের বিখ্যাত রাজার কাহিনির বিবরণ পঞ্চপাণ্ডবদের শোনাতেন। একদিন মার্কণ্ডেয় মুনি এমনই উপদেশ দিচ্ছিলেন। এই সময়ে মহিষী সত্যভামাকে নিয়ে কৃষ্ণ সেই সভায় প্রবেশ করলেন এবং প্রফুল্লচিত্ত দ্রৌপদীও সেই সভায় উপস্থিত হলেন। দুই সখী একপ্রান্তে বসে কথোপকথনে মগ্ন হলেন। দীর্ঘকাল পরে দুই সখীর সাক্ষাৎ ঘটেছিল। প্রথমেই কুরুবংশ ও যদুবংশ সম্পর্কে অনেক আলোচনা হল। তারপর সত্যভামা তাঁর দীর্ঘকালীন কৌতুহলটি দ্রৌপদীর কাছে প্রকাশ করলেন। তিনি দ্রৌপদীকে প্রশ্ন করলেন, “দ্রৌপদী, দিকপাল তুল্য মহাবীর, যুবক এবং পরম লোকপ্রিয় পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে তুমি কেমন ব্যবহার করো? কল্যাণী, কীভাবে এই পঞ্চভ্রাতাই তোমারই বশীভূত আছেন? এঁরা তোমার প্রতি কুপিত হন না? পাণ্ডবেরা কেবলমাত্র তোমার বশীভূত নন, তাঁরা সকলেই তোমার মুখাপেক্ষী। আমার কাছে অকপটে সত্য বলো যে, কী ভাবে তুমি এঁদের সকলকে বশীভূত করে রেখেছ? ব্রত, তপস্যা, স্থান, শাস্ত্রোক্ত ঔষধ, নিজের দক্ষতার প্রয়োগ, কোনও জড়িবুটি, বৃক্ষমূল ধারণের প্রভাব, জপ, হোম এবং শাস্ত্রে যা নেই এমন কোনও ঔষধ প্রয়োগ করে তুমি এই সকল দিকপাল স্বামীকে বশ করে রেখেছ। আমিও কৃষ্ণকে সর্বদা আমার অনুগত ও বশীভূত রাখতে চাই, তুমি আমাকে উপায় বলো।” এই বলে সত্যভামা দ্রৌপদীর মুখের দিকে তাকিয়ে নীরব হলেন।

দ্রৌপদী সত্যভামার প্রশ্ন শুনেই ক্ষুব্ধ ও আহত হলেন। কোনও পতিব্রতা নারী যে অন্য পতিব্রতা নারীকে এই ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন, তা তাঁর কল্পনায়ও ছিল না। চন্দ্রভাগা দ্রৌপদী সত্যভামাকে বললেন, “সত্যভামা তুমি অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহারের বিষয় আমাকে প্রশ্ন করেছ, এই স্ত্রীলোকদের ব্যবহারও অসৎ হয়। অসৎ ব্যবহারের বিষয় আলোচনা করাই সংগত নয়। এই ধরনের প্রশ্ন করা অথবা আমার ভর্তাদের বশীভূত করার জন্য কোনও উপায় অবলম্বন করি কি না— এ-ধরনের কোনও সন্দেহ করাই তোমার উচিত নয়। কারণ তুমি বুদ্ধিমতী এবং কৃষ্ণের প্রিয়তমা মহিষী। ভর্তা যখন জানতে পারেন যে তাঁকে বশীভূত করার জন্য স্ত্রী কোনও মন্ত্রপ্রয়োগ বা ঔষধ প্রয়োগে ব্যাপৃত আছেন, তখন গৃহে সর্প প্রবেশ করলে গৃহস্থের মন যেমন উদ্বিগ্ন হয়, ভর্তার মনও তেমনই উদ্বিগ্ন হয়। মন উদ্বিগ্ন হলে গৃহে অশান্তি আসে, আর অশান্ত গৃহে সুখ থাকতে পারে না। তা ছাড়া ভর্তা কখনও মন্ত্রাদি প্রয়োগে ভার্যার বশীভূত হন না। বরং এই জাতীয় ঘটনায় ভর্তার দেহে অতিদারুণ রোগ দেখা দেয়। কারণ, জিঘাংসু লোকেরা মূল বলে বিষ দিয়ে থাকে। পুরুষ জিহ্বা অথবা চর্মদ্বারা যে সকল ঔষধ গ্রহণ করে, তাতে প্রদত্ত বিষচূর্ণ সত্বরই সে পুরুষত্ব নষ্ট করে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ কোরো না।

“সত্যভামা আমি জানি যে, বহু স্ত্রীলোক আপন আপন পতিকে বশ করার জন্য ঔষধ প্রদান করে তাদের পতিকে জলোদর রোগী, শিশ্নরোগী, জরাজীর্ণ, নপুংসক, জড় বা অন্ধ বা বধির করে ফেলেছে। পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কথা অনুযায়ী এই পাপিষ্ঠা নারীরা তাদের ভর্তাদের দেহ-মনে নানা উপসর্গ সৃষ্টি করে থাকে, অতএব স্ত্রীলোকে কোনও প্রকারেই ভর্তার অনভিপ্রেত অথবা অপ্রিয় কোনও কার্য করবে না।

“সত্যভামা আমি মহাত্মা পাণ্ডবদের সঙ্গে কাম, ক্রোধ পরিত্যাগ করে, সপত্নীদের সঙ্গে স্বামীসেবা করে থাকি। আমি অহংকার ত্যাগ করে, মানশূন্য হয়ে পতিদের সেবা করি। ভর্তাদের কখনও আমি কটুবাক্য বলি না, ক্রোধসূচক দৃষ্টিতে তাঁদের দেখি না। কষ্টে উপবেশন, কষ্টে শয়ন, কষ্টে গমন, মন্দ অভিপ্রায় বর্জন করে আমি ভুবন বিজয়ী পাণ্ডবগণের সেবা করি।

দেবো মনুষ্যো গন্ধর্বো যুবা চাপি স্বলঙ্কিত।

দ্রব্যবানভিরূপো বা ন মেহন্যঃ পুরুষো মন॥ বন : ১৯৬: ২২ ॥

“দেবতা, গন্ধর্ব, মানুষ, যুবক, ধনী, সম্যক অলংকৃত কিংবা সুন্দরাকৃতি হলেও অন্য পুরুষে আমার অভিমত হয় না।

“আমি সর্বদাই গৃহকার্য করি এবং ভর্তা স্নান না করলে আমি স্নান করি না। ভর্তা ভোজন না করলে আমি ভোজন করি না এবং ভর্তা শয়ন না করলে আমি শয়ন করি না। ভর্তা—ক্ষেত্র, বন বা অন্য গ্রাম থেকে গৃহে ফিরে এলে আমি উঠে আসন ও জলদান করে তাঁর সংবর্ধনা করি। খাবার বাসন পরিষ্কার করি, খাদ্যবস্তু পরিষ্কার রাখি—বুভুক্ষুকে যথাসময়ে খাদ্য দিই, সংযত হয়ে থাকি, কাউকে তিরস্কার করি না। মন্দ স্ত্রীলোকের সংসর্গ করি না। সর্বদাই পরিজনবর্গের অনুকূল থাকি এবং কখনও অলস হই না।

“পরিহাস ব্যতীত হাসি না, গৃহের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি না এবং গোপন কোনও স্থানে বা গৃহের উদ্যানে দীর্ঘকাল থাকি না। আর অত্যন্ত হাসা, অত্যন্ত ক্রোধ আর ক্রোধের বিষয় পরিত্যাগ করি। সত্যভামা, আমি সর্বদাই পতিসেবায় নিরত থাকি। ভর্তার কোনও প্রকার অহিতই আমার কোনও প্রকারেই অভীষ্ট হয় না। ভর্তা যখন পারিবারিক কোনও কার্যে অন্যত্র যান তখন আমি পুষ্পমালা ও অনুলেপন ত্যাগ করি। ভর্তা যা পান করেন না, ভর্তা যা ব্যবহার করেন না, আমার ভর্তা যা ভোজন করেন না, আমি সে সমস্তই বর্জন করি। আমি ভর্তার উপদেশ অনুসারে ও গৃহিণীর নিয়মে চলি এবং অলংকৃতা, অত্যন্ত পবিত্রা ও ভর্তার প্রিয় ও হিতকার্যে রতা থাকি। আমার শাশুড়িদেবী আমার পরিজন সম্পর্কে যে আচরণের কথা বলে দিয়েছেন এবং ভিক্ষা, উপহার, শ্রাদ্ধ, পৰ্বকালে রন্ধন, মান্য লোকের সম্মান ও আদর এবং অন্য যে সকল গৃহনিয়ম আমার জানা আছে, আমি আলস্যবিহীন হয়ে সেই সমস্তের অনুসরণ করি আর সর্বদা সর্বপ্রযত্নে বিনয় ও গৃহিণীগণের নিয়ম পালন করে চলি।

“পতিদের অপ্রিয় আচরণ করি না। তাঁদের অতিক্রম করি না। কখনও শাশুড়ির নিন্দা করি না। কুন্তীদেবী আমার কাছে পৃথিবীর তুল্যা মাননীয়া। পাণ্ডবদের রাজত্বকালে আয়ব্যয়ের হিসাব আমিই রাখতাম, অতিথিসেবায় সতর্ক থাকতাম। আমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের হস্তী ও অশ্ব সংখ্যা গণনা করতাম। গোরক্ষক, মেষরক্ষক ও অন্তঃপুরকামী ভৃত্য ও পোষ্যবর্গের সকল সংবাদ আমি রাখতাম। আমি চিরদিনই সকলের আগে জাগরিত হই ও সকলের শেষে শয়ন করি। সত্যভামা, এই সব গুরুতর পতি বশীকরণ আমি জানি, কিন্তু অসৎ স্ত্রীলোকদের ব্যবহার জানি না এবং শুনতেও চাই না।”

তখন সত্যভামা দ্রৌপদীর সেই ধর্মসংগত বাক্য শুনে ধৰ্মচারিণী দ্রৌপদীকে বিশেষ আদর করলেন এবং বললেন, “পাঞ্চাল নন্দিনী দ্রৌপদী, আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম। কারণ সখীদের পরস্পর আলোচনা হাসিঠাট্টা-উপহাস ইত্যাদির সঙ্গে ঘটে থাকে।” তখন দ্রৌপদী বললেন, “পতিকে দেবতাজ্ঞান করে তাঁর সেবা করলেই জগতের সকল অভীষ্ট লাভ করা যায়, আর তিনি কুপিত হলে হত্যাও করতে পারেন। কেবল সুখ নয়, সাধ্বী স্ত্রী দুঃখ দ্বারাই সুখ লাভ করেন। তুমি সর্বদাই স্নেহ অনুরাগ দিয়ে কৃষ্ণের সেবা করো। কৃষ্ণ যাতে সর্বদাই মনে করেন—এই নারীর আমি যথার্থই প্রিয়। সতী নারীর পতির সকল কথাই গোপন রাখেন। পুরুষদের সামনে মত্ততা, অনবধানতা মনের ভাব গোপন করবে। আর নির্জনে কখনও প্রদ্যুম্ন বা শাম্বের সেবা করবে না। সৎকুলজাতা পাপবিহীনা সতীস্ত্রীদের সঙ্গেই সখিত্ব করবে আর কোপনস্বভাবা, মত্তা, অধিকভোজিনী, চৌরা, দুষ্টা ও চঞ্চলা স্ত্রীদের বর্জন করবে। এই পথেই তুমি কৃষ্ণকে বশীভূত রাখতে পারবে। পতির পরিচর্যাই তোমার পথ হবে।”

কৃষ্ণের প্রস্থানের সময় উপস্থিত হলে সত্যভামাকে ডেকে পাঠালেন। সত্যভামা দ্রৌপদীকে আলিঙ্গন করে তাঁর ইচ্ছা অনুরূপ মনোহর ও সংগত বাক্য বললেন, “দ্রৌপদী, রাজ্য হারিয়েছ বলে তোমার যেন উৎকণ্ঠা মনোবেদনা বা রাত্রি জাগরণ না হয়। কারণ তুমি দেবতুল্য পতিগণ কর্তৃক বিজিত রাজ্য পুনরায় পাবে। নীলনয়নে, যে কষ্ট তুমি সহ্য করেছ, তোমার মতো চরিত্রগুণ সম্পন্না এবং প্রশস্ত লক্ষণা নারীরা চিরকাল ভোগ করেন না। আমি ত্রিকালজ্ঞ ঋষিদের মুখে শুনেছি যে, অবশ্যই তুমি ভর্তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিষ্কণ্টক ও নিরুপদ্রব এই পৃথিবী পুনরায় ভোগ করবে। দ্রৌপদী তুমি অবশ্যই দেখতে পাবে যে, যুধিষ্ঠির সমস্ত শত্রুতার প্রতিশোধ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বধ করে পৃথিবী হস্তগত করেছেন। বনে আসার সময়ে দর্পমোহিতা যে-সব কৌরব নারী তোমাকে উপহাস করেছিল, অতি অল্পকালের মধ্যেই, সেই সব কৌরব স্ত্রীকে তুমি হতভাগ্য নৈরাশ্যপূর্ণ দেখতে পাবে। তুমি দুঃখসাগরে নিমগ্ন হলে, যারা তোমার অপ্রিয় আচরণ করেছিল, তুমি সুনিশ্চিত ধারণা করতে পারো যে, তারা সকলেই যমালয়ে গিয়েছে।

“তোমার পুত্র যুধিষ্ঠিরজাত প্রতিবিন্ধ্য, ভীমজাত সূতসোম, অর্জুনজাত শ্রুতকর্মা, নকুলজাত শতানীক ও সহদেবজাত শ্রুতসেন, এরা সকলেই ভাল আছে। অস্ত্রশিক্ষা করে বীর হয়েছে এবং দ্বারকানগরীতে অভিমন্যুর মতোই অত্যন্ত আনন্দিত ও প্রীতি সহকারে বাস করছে। আর সুভদ্রাও তোমার মতো প্রীতিসহকারে ও সর্বপ্রযত্নে তোমার পুত্রদের পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তোমার প্রতি সুভদ্রার কোনও বৈরী মনোভাব নেই বরং বিশেষ প্রীতিই আছে, তোমার পুত্রদের বিষয়ে সুভদ্রার মনে কোনও সন্তাপ নেই।

“আপন পুত্ৰ অভিমন্যু ও তোমার পুত্রদের মধ্যে সুভদ্রা কোনও পার্থক্য করেন না, তাই সুভদ্রা তোমার পুত্রদের দুঃখেই দুঃখ এবং সুখেই সুখ অনুভব করে থাকেন। রুক্মিণীদেবী সর্বপ্রযত্নে প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির পরিচর্যা করেন আর কৃষ্ণ ও ভানু প্রভৃতির থেকেও তাদের বেশি আদর করেন। আমার শ্বশুরমহাশয় তাদের খাওয়াপরা বিষয়ে সর্বদা পর্যবেক্ষণ কবেন এবং বলরাম প্রভৃতি অন্ধকবংশীয় ও বৃষ্ণিবংশীয়েরা সকলেই তাদের আদর করেন। কারণ, প্রদ্যুম্ন ও প্রতিবিন্ধ্য প্রভৃতির উপরে তাদের সমান স্নেহ আছে।

এইভাবে কুশল বিনিময়ের পর সত্যভামা কৃষ্ণের সঙ্গে রথে উঠলেন। যাত্রার পর্বে সত্যভামা দ্রৌপদীকে প্রদক্ষিণ করলেন, তারপর দ্বারকার দিকে যাত্রা করলেন।

কৃষ্ণার্জুন-দ্রৌপদী-সত্যভামার নিভৃত আলাপ

মহাভারতে সত্যভামাকে দেখা যায় দ্বিতীয়বার এক অসাধারণ মুহূর্তে। একদিকে রণদামামার নির্ঘোষ অন্য মাধুর্যময় বিশ্রম্ভালাপ, অন্তঃপুরে কৃষ্ণ অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদী সত্যভামার এক অপূর্ব চিত্র সঞ্জয় দেখেছিলেন। সেই সম্মিলনে দুই শ্রেষ্ঠ পুরুষের একাত্মতা— দুই নারীর সমান প্রণয় উপলব্ধি করেছিলেন সঞ্জয়।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও সভায় উপস্থিত শ্রেষ্ঠ পুরুষদের কাছে সঞ্জয় উপস্থিত হয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। সে-সভায় পঞ্চপাণ্ডব, কৃষ্ণ, সাত্যকি, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, শিখণ্ডী, অভিমন্যু— সকলেই উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য শেষ করার পর এবং পাণ্ডবদের বক্তব্য শোনার পর সঞ্জয় হস্তিনায় ফিরে যেতে অনুমতি প্রার্থনা করলেন। যুধিষ্ঠিরের বক্তব্যের পর কৃষ্ণ-অর্জুন সভাকক্ষ ত্যাগ করে অন্তঃপুরে চলে গিয়েছিলেন। তখন সঞ্জয় সংযতচিত্ত হয়ে কৃতাঞ্জলিবদ্ধ অবস্থায় নিজের চরণাঙ্গুলির প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করতে করতে কৃষ্ণার্জুনের অনুমতি দেওয়ার জন্য অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।

যেখানে কৃষ্ণ ও অর্জুন এবং পতিব্রতা সত্যভামা ও দ্রৌপদী ছিলেন, সেখানে নকুল সহদেব কিংবা অভিমন্যুও গমন করেন না। সেখানে অরিন্দম কৃষ্ণ ও অর্জুন— উভয়েই মদ্যমধুপানে মত্ত, চন্দনরঞ্জিত দেহ, মাল্যধারী, উত্তম বস্ত্র পরিধায়ী ও দিব্যাভরণে ভূষিত হয়ে নানারত্ন বিচিত্র ও বিবিধ আস্তরণে আবৃত স্বর্ণময় বিশাল পর্যঙ্কে অবস্থান করছিলেন। সঞ্জয় বললেন, “আমি দেখলাম, কৃষ্ণের চরণযুগল অর্জুনের ক্রোড়ে রয়েছে, আর মহাত্মা অর্জুনের একখানি চরণ দ্রৌপদীর ক্রোড়ে এবং অপরখানি সত্যভামার ক্রোড়ে বিন্যস্ত আছে। অর্জুন চরণ দ্বারা আমার বসার জন্য স্বর্ণময় পাদপীঠ নির্দেশ করলেন; আমি হস্ত দ্বারা তা স্পর্শ করে ভূতলে উপবেশন করলাম।

অর্জুন যখন পাদপীঠ থেকে চরণযুগল তুলে নিলেন তখন আমি দেখলাম, সেই সুন্দর চরণযুগল তলে শুভসূচক দুটি ঊর্ধ্বরেখা রয়েছে। শ্যামবর্ণ, বৃহদাকৃতি ও বৃক্ষর মতো উন্নত স্কন্ধ দুইজন যুবাকে একাসনে উপবিষ্ট দেখে আমার গুরুতর ভয় উপস্থিত হল।

আমি ভাবলাম— ভীষ্ম ও দ্রোণ আশ্রয় করে রয়েছেন এবং কর্ণ আত্মশ্লাঘা করে থাকেন; এইজন্যই অল্পবুদ্ধি দুর্যোধন ইন্দ্র ও বিষ্ণুর তুল্য এই কৃষ্ণ ও অর্জুনকে চিনতে পারেন না। এঁদের দু’জনকে যিনি আজ্ঞাবহ করে রেখেছেন, সেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মনের সংকল্প অবশ্যই সিদ্ধ হবে, এই কথা নিশ্চয় করে তখনই বুঝতে পারলাম। ক্রমে আমি খাদ্য ও পেয় দ্বারা আদর লাভ করে, উপবিষ্ট হয়ে, মস্তকে অঞ্জলিবদ্ধ করে, বক্তব্য বিষয় বলবার জন্য তাঁদের কাছে প্রার্থনা জানালাম। ধনুর গুণবর্ষণে যে হাতে কিন (কড়া) পড়েছিল, অর্জুন সেই হস্ত দ্বারা আপন ক্রোড় থেকে কৃষ্ণের চরণযুগল নামিয়ে রেখে শুভলক্ষণশালী কৃষ্ণকে বলার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

ইন্দ্রের ন্যায় বলবান, বাগ্মীশ্রেষ্ঠ ও সর্বাভরণভূষিত কৃষ্ণ ইন্দ্ৰধ্বজের ন্যায় গাত্রোত্থান করে অর্জুনের ইঙ্গিতক্রমে আমাকে বলতে লাগলেন। উক্তিগুলি প্রথমে কোমল ছিল বলে আনন্দ জন্মেছিল এবং পরে অতিদারুণ হয়েছিল বলে ধার্তরাষ্ট্রগণের পক্ষে ভয় উৎপাদন করেছিল। আমি বাকপটু কৃষ্ণের সেই কথাগুলি শুনলাম; তার প্রথম অংশ অভীষ্ট এবং শেষ অংশ হৃদয়শোষক হয়েছিল। কৃষ্ণ বললেন, “সূত! সঞ্জয়! তুমি গিয়ে আমাদের জ্যেষ্ঠদের অভিবাদন জানিয়ে এবং কনিষ্ঠদের মঙ্গল জিজ্ঞাসা করে পরে কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম ও দ্রোণের সামনে বুদ্ধিমান ধৃতরাষ্ট্রকে এই কথাগুলি বোলো। তোমরা নানাবিধ যজ্ঞ করো, ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দাও এবং পুত্ৰকলত্রদের সঙ্গে আমোদ করে নাও। কারণ তোমাদের গুরুতর ভয় উপস্থিত হয়েছে। সৎপাত্রে ধনদান করো, কামজাত পুত্র লাভ করো এবং প্রিয়জনের উদ্দেশে প্রিয় আচরণ করো। কারণ রাজা যুধিষ্ঠির জয়ের জন্য ত্বরান্বিত হয়েছেন।

ঋণমেত্য প্রবদ্ধং মে হৃদয়ান্নাপসৰ্পতি।

যদ গোবিন্দেতি চুক্রোশ কৃষ্ণা মাং দূরবাসিনম ॥ উদ্‌যোগ : ৫৮: ২২ ॥

“আমি দূরে ছিলাম, তথাপি দ্রৌপদী যে আমাকে গোবিন্দ! গোবিন্দ! বলে ডেকেছিলেন, সেই গুরুতর ঋণ আমার হৃদয় থেকে যাচ্ছে না।

“তেজোময় ও দুর্ধর্ষ গাণ্ডিব যাঁর ধনু এবং আমি যাঁর সহায়, সেই অর্জুনের সঙ্গে তোমাদের শত্রুতা উপস্থিত হয়েছে। যে লোক কালগৃহীত নয়, তাদৃশ কোন লোক আমার সঙ্গে অর্জুনকে যুদ্ধে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা করে? সাক্ষাৎ ইন্দ্রও প্রার্থনা করতে ইচ্ছা করেন না। যে-লোক যুদ্ধে অর্জুনকে জয় করতে পারেন, সে-লোক বাহুযুগল দ্বারা পৃথিবী বহন, করতে পারে, ক্রুদ্ধ হয়ে সকলকে দগ্ধ করতে পারে এবং স্বর্গ থেকে দেবতাদের নিপাতিত করতে পারে। যে লোক অর্জুনের অভিমুখে যেতে পারে তাদৃশ লোক দেবতা, অসুর, মনুষ্য, যক্ষ, গন্ধর্ব ও নাগদের মধ্যেও আমি দেখতে পাই না। বিরাটরাজ্যে একা অর্জুনের সঙ্গে সম্পূর্ণ কৌরবপক্ষের যুদ্ধের কথা আমাদের শোনা আছে। দেহের বল, মনের বল, উৎসাহ, সত্বর কর্তব্যজ্ঞান, অস্ত্ৰক্ষেপে লঘুহস্ততা, বিষণ্ণ না হওয়া এবং ধৈর্য— এ সকল গুণ অর্জুন ভিন্ন অন্য কোনও ব্যক্তিতে নেই।”

সত্যভামা এবং দ্রৌপদীর উপস্থিতিতে প্রিয় সখা অর্জুনের সমক্ষে কৃষ্ণ অর্জুনের এই প্রশংসা করলেন। সঞ্জয় ফিরে গিয়ে বর্ণনাটি অক্ষরে অক্ষরে ধৃতরাষ্ট্রকে শোনালেন।

সত্যভামার মৃত্যু

সত্যভামার সঙ্গে পাঠকের পুনরায় সাক্ষাৎ হয় মুষলপর্বে, যদুবংশের ধ্বংসের সময়। ছত্রিশ বৎসর পূর্বে গান্ধারী যে অভিশাপ দিয়েছিলেন, তা কৃষ্ণের স্মরণে ছিল। এ ছাড়া দেবর্ষি নারদ ও মহর্ষি কণ্বের অভিসম্পাতও তিনি জানতেন। অপূর্ব রূপবান কৃষ্ণপুত্র শাম্বকে স্ত্রীবেশে সাজিয়ে নারদ, কণ্ব ও বিশ্বামিত্রের সম্মুখে উপস্থিত করে সারণ প্রভৃতি যাদবেরা কৌতুকচ্ছলে ঋষিদের প্রশ্ন করেছিলেন, “ঋষিগণ, এটি পুত্র-অভিলাষী বভ্রুর স্ত্রী; অতএব আপনারা ভালভাবে ধ্যানে জেনে বলুন এ কী সন্তান প্রসব করবে?” অপমানিত ঋষিগণ বললেন, “কৃষ্ণের পুত্র এই শাম্ব যদুবংশ ধ্বংসের জন্য ভয়ংকর লৌহময় একটি মুষল প্রসব করবে। সেই মুষল দ্বারা অতি দুর্বৃত্ত তোমরা পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণ ও রাম ব্যতীত যদুবংশ সম্পূর্ণ ধ্বংস করবে। শ্রীমান বলরাম দেহত্যাগ করে সমুদ্রে প্রবেশ করবেন এবং জরা নামের একটি ব্যাধ ভূতলে শয়িত মহাত্মা কৃষ্ণকে বাণ দ্বারা বিদীর্ণ করবে।” ঋষিদের এই অভিশাপ শুনে কৃষ্ণ বলরাম বসুদেবের আদেশে, আহুক ও বভ্রুর নাম সংযোগ করে নগরে ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে সমস্ত বৃষ্ণিবংশ ও অন্ধকবংশীয় নগরবাসীগণ সুরাপান করতে পারবে না। এই আদেশের লঙঘন ঘটলে লঙঘনকারী জীবিত অবস্থাতেই শূলে আরোহণ করবে।”

পরদিন প্রভাতেই শাম্ব মুনিশাপবশত একটি মুষল প্রসব করলেন। মহারাজ উগ্রসেনের আদেশে সেই মুষল পিষে সূক্ষ্ম চূর্ণ করে সমুদ্রজলে নিক্ষেপ করা হল। কিন্তু দ্বারকানগরীতে নানা দুর্লক্ষণ দেখা দিতে লাগল। দ্বারকা নগরীতে উদয়কালে ও অস্তকালে সূর্যকে কবন্ধে-পরিপূর্ণ অবস্থায় দেখা যেতে লাগল। তখন কৃষ্ণের আদেশে সমগ্র যাদববংশ রৈবতক নগরীকে প্রভাসতীর্থে নিয়ে বাস করতে লাগলেন। প্রভাসতীর্থে গিয়ে যাদবগণ তুমুল মদ্যপান করতে লাগলেন। কৃতবর্মার সঙ্গে বলরাম, সাত্যকি, গদ, বভ্রু— এঁরা কৃষ্ণের সামনেই মদ্যপান করতে লাগলেন। তখন সেই মদ্যপানে সভামধ্যে মদমত্ত সাত্যকি উপহাস ও অবজ্ঞা করে কৃতবর্মাকে বললেন, “কোন ক্ষত্রিয় অন্য ক্ষত্রিয় কর্তৃক হন্যমান হয়েও মৃতগণের ন্যায় নিদ্রিতগণকে বধ করে? অতএব হার্দিক্য, তুই যা করেছিস যাদবেরা তা সহ্য করবেন না।” রথীশ্রেষ্ঠ প্রদ্যুম্ন সাত্যকির বাক্যকেই সমর্থন করলেন। কৃতবর্মা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বামহস্তদ্বারা অবজ্ঞার সঙ্গে সাত্যকিকে নির্দেশ করে বললেন, “অর্জুন বাহুচ্ছেদন করলে, ভূরিশ্রবা সেই রণস্থলেই প্রায়োপবেশন করেছিলেন। তখন তুই বীর হয়ে কী প্রকারে অতি নৃশংস বধ দ্বারা তাঁকে পতিত করেছিলি! অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখে নিরুৎসাহ ও ন্যস্তশস্ত্র ভীষ্মকে যে বধ করেছিল, তা গুরুতর কাপুরুষতাই হয়েছে। দ্রোণাচার্য বৃদ্ধ, ব্রাহ্মণ, গুরু, রণক্লান্ত, শোকার্ত ও প্রায়োপবিষ্ট ছিলেন; এই অবস্থায় ধৃষ্টদ্যুম্ন যে তাঁকে বধ করেছিল তা অত্যন্ত নৃশংসতা হয়েছে। মহারথ কর্ণ ভূতলপ্রবিষ্ট নিজের রথচক্র উত্তোলন করছিলেন, সেই সময় অর্জুন তাঁকে যে বধ করেছে সে-কাজ বীর-গর্হিত হয়েছে। বীরাভিমানী ভীম ঊরুদেশে গদাঘাত করে দুর্যোধনকে যে বধ করেছে, বীরেরা সেই কার্যের অত্যন্ত নিন্দা করেন।”

কৃতবর্মার এই প্রকার বাক্য শুনে বীরবিপক্ষহন্তা কৃষ্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে ক্রোধসূচক বক্রদৃষ্টি দ্বারা তাঁকে দর্শন করলেন। সাত্যকি তখন কৃষ্ণকে সত্রাজিৎ রাজার যে স্যমন্তকমণি ছিল, সেই উপাখ্যান কৃষ্ণকে বললেন। কৃতবর্মা ও অরের প্ররোচনায় শতধন্বা সত্রাজিৎকে বধ করেছিলেন (বিষ্ণুপুরাণে ও হরিবংশে স্যমন্তক মণির উপাখ্যান আছে)। তা শুনে তখন সত্যভামা ক্রুদ্ধ হয়ে রোদন করতে করতে কৃষ্ণকে ক্রুদ্ধ করবার জন্য তাঁর কোলের উপর পতিত হলেন। তারপর সাত্যকি ক্রুদ্ধ হয়ে গাত্রোত্থান করে বললেন, “আমি সত্যদ্বারা এই শপথ করছি যে, আমি যদি সেই দুষ্কার্যের প্রতিকার না করি, তা হলে আমি দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর পথে যাব। সুমধ্যমে, দুরাত্মা ও পাপবুদ্ধি যে কৃতবর্মা অশ্বত্থামাকে সহায় করে শিবিরে নিদ্রিত অবস্থায় যাদের বধ করেছিল, তাদেরই মতো এই দুরাত্মা কৃতবর্মার আয়ু ও যশ আজ সমাপ্ত হয়েছে।” এই কথা বলে সাত্যকি দ্রুত গিয়ে কৃষ্ণের সম্মুখেই তরবারি দ্বারা কৃতবর্মার শিরচ্ছেদ করলেন।

সাত্যকি সেইভাবে সকল দিকে অন্যান্যদেরও বধ করতে লাগলে, কৃষ্ণ সাত্যকিকে বারণ করার জন্য সেদিকে ছুটে গেলেন। তখন ভোজ ও অন্ধকেরা সকলেই কালপ্রেরিত হয়ে একযোগে সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করলেন। তাঁরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে সাত্যকির উপর পতিত হচ্ছেন দেখেও মহাতেজা কৃষ্ণ কালের পরিবর্তন জেনে ক্রুদ্ধ হলেন না। তখন মদ্যপান নিবন্ধন মত্ততাযুক্ত সেই ভোজবংশীয়েরা কালপ্রেরিত হয়ে উচ্ছিষ্ট পানপাত্র সমূহ দ্বারা সাত্যকিকে আঘাত করতে লাগল। সাত্যকিকে আঘাত করতে থাকলে, প্রদ্যুম্ন ক্রুদ্ধ হয়ে সাত্যকিকে মুক্ত করার জন্য তাঁর কাছে আগমন করলেন। প্রদ্যুম্ন ভোজবংশীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেন এবং সাত্যকিও অন্ধকবংশীয়দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। এইভাবে বাহুবলশালী সেই বীর প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকি যুদ্ধ করতে থেকে বিপক্ষ বহুতর বলে কৃষ্ণের সম্মুখেই দুজনে নিহত হলেন। সাত্যকিকে এবং পুত্র প্রদ্যুম্নকে নিহত দেখে যদুনন্দন কৃষ্ণ ক্রোধবশত একমুষ্টি শর (তৃণবিশেষ) তুলে নিয়ে পাত্রমিত্র নির্বিশেষে আঘাত করতে থাকলেন। মদমত্ত যাদবেরা পিতা পুত্রকে পুত্র পিতাকে হত্যা করতে থাকল। শর নিমেষে মুষলে পরিবর্তিত হল। সেই রণক্ষেত্রে কৃষ্ণ-বলরাম ব্যতীত কেহই জীবিত থাকল না। সত্যভামার দৃষ্টির সম্মুখেই মুহূর্ত মধ্যে সমস্ত ঘটনা ঘটে গেল।

কৃষ্ণ সারথি দারুককে বভ্রুর সঙ্গে দ্বারকায় অর্জুনের কাছে সংবাদ পাঠানোর জন্য প্রেরণ করলেন। বভ্রু কয়েক পদ অগ্রসর হতে না হতেই ব্যাধ-নিক্ষিপ্ত শরে নিহত হলেন। কৃষ্ণ বলরামের অন্বেষণে গিয়ে দেখলেন যে, বলরাম এক বৃহৎ বৃক্ষের মূলে উপবিষ্ট আছেন। বলরামকে সেখানেই থাকতে বলে কৃষ্ণ বসুদেবকে প্রণাম করার জন্য প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। বসুদেবকে প্রণাম করে বলে গেলেন যে, অর্জুন অন্তঃপুরিকাদের হস্তিনায় যুধিষ্ঠিরের কাছে নিয়ে যাবেন। অন্তঃপুরিকাদেরও বিদায় জানিয়ে তিনি এসে দেখলেন বলরাম বসে আছেন, একটি বৃহৎ শ্বেতসর্প তাঁর মুখ থেকে সাগরে বেরিয়ে যাচ্ছে এবং সাগরও তাকে সাদরে গ্রহণ করছে।

একটি বৃক্ষতলে কাল সম্পর্কে ইতিকর্তব্য চিন্তা করতে করতে কৃষ্ণ নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। জরা নামক এক ব্যাধ মৃগভ্রমে কৃষ্ণের পায়ে তীব্র বাণবিদ্ধ করল। কৃষ্ণ সেই ব্যাধকে অভয় দিলেন এবং তাঁর আত্মা যোগদেহ অবলম্বন করে স্বর্গে উপস্থিত হল। রুক্মিণী, গান্ধারী, শৈব্যা, হৈমবতী ও জাম্ববতী— কৃষ্ণের এই প্রধান মহিষীরা অনুসরণ বিধানে অগ্নিতে প্রবেশ করলেন। আর সত্যভামা ও কৃষ্ণের অন্যান্য প্রিয় ভার্যারা তপস্যা করবার জন্য কৃতনিশ্চয় হয়ে বনে প্রবেশ করলেন। এইখানেই সত্যভামার কাহিনি শেষ হল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *