২০. প্রতিবাদিনী অম্বা

প্রতিবাদিনী অম্বা

শান্তনু-সত্যবতীর জ্যেষ্ঠপুত্র চিত্রাঙ্গদ গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদের সঙ্গে (একই নাম হওয়ায় গন্ধর্বরাজ শান্তনুপুত্রের নাম পরিবর্তনের দাবি করায়) যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। শান্তনুর কনিষ্ঠ পুত্র বিচিত্রবীর্য তখন অত্যন্ত অল্পবয়স্ক বালক। তাঁকেই সিংহাসনে বসিয়ে ভীষ্ম রাজ্যশাসন করতে থাকেন।

বিচিত্রবীর্য যৌবনে পদার্পণ করলে এবং বুদ্ধিমানদের মধ্যে প্রধান হয়ে উঠেছেন দেখে ভীষ্ম তাঁকে বিবাহ করাবার ইচ্ছা করলেন। তারপর ভীষ্ম শুনতে পেলেন যে, অপ্সরার ন্যায় সুন্দরী কাশীরাজের তিনটি কন্যাই একসঙ্গে স্বয়ংবরা হবে। তখন, শত্রু বিজয়ী রথীশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম, মাতা সত্যবতীর অনুমতিক্রমে সারথিবিহীন রথে আরোহণ করে বারাণসীনগরে গমন করলেন। সেখানে গিয়ে ভীষ্ম দেখলেন, সকল দেশ থেকে এসে রাজারা সমবেত হয়েছেন। সেই কন্যা তিনটিও এসেছে। তখন পরিচয়ের জন্য রাজাদের নাম কীর্তন করতে লাগলে, সেই পরমসুন্দরী কন্যারা শান্তনুপুত্র ও একাকী এই ভেবে উদ্বিগ্ন হয়েই যেন তাঁর কাছ থেকে সরে গেল। “ভীষ্ম পরম ধার্মিক, তাতে আবার বৃদ্ধ হয়েছেন, শরীরের মাংসগুলি শিথিল হয়ে পড়েছে এবং চুল পেকেছে। তবুও এ নির্লজ্জ এখানে এসেছে কেন? মিথ্যাপ্রতিজ্ঞ বলে জগতে সকলে একে কী বলবে; আর এই ভীষ্ম অনর্থক ব্রহ্মচারী বলে জগতে প্রসিদ্ধ হয়েছে।” নিকৃষ্ট রাজগণ পরস্পর এই কথা বলতে থেকে এই মন্তব্য করতে লাগলেন। ভীষ্ম তাঁদের কথা শুনে ক্রুদ্ধ হলেন।

তখন প্রভাবশালী ভীষ্ম নিজেই সেই কন্যা ক’টিকে প্রার্থনা করে তাঁদের রথে তুলে বীরতেজে দীপ্তি পেতে থেকে জলদগম্ভীর স্বরে রাজাগণকে বলতে লাগলেন, “রাজগণ! গুণবান বরকে আহ্বান করে এনে, কন্যাকে শক্তি অনুসারে অলংকৃত করে এবং ক্ষমতা অনুসারে যৌতুক দিয়ে অনেকে সেই কন্যা দান করে থাকেন। অন্য লোকেরা বরদত্ত দুটি গোরুর সঙ্গে কন্যা দান করে থাকেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট ধন নিয়ে কন্যাদান করেন, অন্য দল বলপূর্বক কন্যা হরণ করেন, অপর লোকেরা কন্যাকে সম্মত করে বিবাহ করেন, অন্য লোকেরা অসতর্ক অবস্থায় রমণ করে সেই কন্যা লাভ করেন এবং অন্য লোকে যজ্ঞে প্রবৃত্ত থেকে কন্যা গ্রহণ করেন। তোমরা দুজনে দাম্পত্যধর্ম আচরণ করো” এই বলে কন্যা দান করলে, সেই আর্য বিধান অনুসরণ করে কেউ কেউ ভার্যা লাভ করেন। পণ্ডিতবর্জিত সেই বিবাহকেই অষ্টম বিবাহ বলে জানবে।

“কিন্তু ক্ষত্রিয়েরা স্বয়ংবরেরই প্রশংসা করেন এবং তাই করে থাকেন। কেন-না, ধর্মবাদীরা বলেন যে, বিপক্ষদের পরাভূত করে যে কন্যা হরণ করা হয়, সেই ভার্যাই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে পরম প্রশস্ত। অতএব হে রাজগণ! আমি বলপূর্বক এই কন্যা ক’টিকে এখান থেকে হরণ করতে ইচ্ছা করি। আপনারা শক্তি অনুসারে জয় বা পরাজয়ের জন্য বিশেষ চেষ্টা করুন। রাজগণ! আমি যুদ্ধের জন্য কৃতনিশ্চয় হয়ে রইলাম।” ভীষ্ম অন্য রাজাকে এবং কাশীরাজকে একথা বলে নিজেই কন্যা ক’টিকে রথে তুলে নিয়ে পুনরায় রাজগণকে আহ্বান করে সেই কন্যাগুলিকে নিয়ে সত্বর প্রস্থান করতে লাগলেন।

তারপরে সকল রাজাই ক্রুদ্ধ হয়ে আপন আপন বাহু মর্দন করে ওষ্ঠ দংশন করতে থেকে সভা থেকে উঠে পড়লেন। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে অলংকারগুলি পরিত্যাগ এবং বর্ম পরিধান করতে লাগলেন, সুতরাং তাঁরা অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লেন এবং পরিত্যাগের সময় সেই অলংকারগুলি এবং পরিধানের সময় বর্ম ও কবচগুলি নক্ষত্রসমূহের ন্যায় চকমক করতে লাগল। ক্রোধে এবং অধৈর্যে রাজাদের ভ্রুযুগল কুটিল হয়ে উঠল এবং নয়নযুগল রক্তবর্ণ হল। এই অবস্থায় তাঁরা সারথিসজ্জিত এবং উৎকৃষ্ট অশ্বযুক্ত সুন্দর সুন্দর রথে আরোহণ করে অস্ত্র উত্তোলন করে একাকী দ্রুতগামী ভীষ্মের পিছনে পিছনে ধাবিত হলেন। তারপর বহুসংখ্যক রাজার সঙ্গে একমাত্র ভীষ্মের তুমুল ও লোমহর্ষক যুদ্ধ আরম্ভ হল। প্রথমে রাজারা ভীষ্মের প্রতি একসঙ্গে দশ হাজার বাণ নিক্ষেপ করলেন। ভীষ্ম সেই বাণগুলি উপস্থিত হবার পূর্বেই লোমশালী বিশাল বাণবৃষ্টি দ্বারা মধ্যপথেই সেগুলি কেটে ফেললেন। তখন সেই রাজারা সকলে সম্মিলিত হয়ে সকল দিক থেকে ভীষ্মকে পরিবেষ্টন করলেন এবং মেঘ যেমন পর্বতের উপর জলকে বর্ষণ করে সেইরকম ভীষ্মের উপর শরবর্ষণ করতে লাগলেন। ভীষ্ম আপন বাণ দ্বারা বিপক্ষদের বাণবৃষ্টি সর্বপ্রকার নিবারণ করে তিন-তিনটি করে বাণ দ্বারা প্রত্যেক রাজাকে বিদ্ধ করলেন। তারপর প্রত্যেক রাজা পাঁচ-পাঁচটি বাণ দ্বারা ভীষ্মকে বিদ্ধ করলেন। মহাশক্তিশালী ভীষ্মও দু’-দুটি বাণদ্বারা তাঁদের প্রতিবিদ্ধ করলেন। ভীষ্ম বিপক্ষদের শতসহস্র ধনু, ধ্বজ, ধর্ম ও মস্তক ছেদন করতে লাগলেন। সেই যুদ্ধে শত্রুগণও রথচারী ভীষ্মের আত্মরক্ষা ও লঘুহস্ততা প্রভৃতি অমানুষিক কর্ম দেখে তাঁর প্রশংসা করতে লাগল। সর্বশস্ত্রনিপুণ ভীষ্ম বিপক্ষগণকে পরাভূত করে কন্যাদের সঙ্গে হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা করলেন। তখন অসাধারণ শক্তিশালী মহারথ শাল্বরাজা শান্তনুনন্দন ভীষ্মের পিছনে পিছনে ধাবিত হলেন। একটি হস্তী হস্তিনীর পিছনে যেতে লাগলে অপর প্রবল হস্তী যেমন দন্ত দ্বারা তার পশ্চাদভাগে আঘাত করে নিজেই সেই হস্তিনীর পিছনে যায়, শাল্বও তেমন ভীষ্মকে আঘাত করে কন্যাগুলির পিছনে যাবার ইচ্ছা করলেন। মহাবাহু শাল্বরাজ স্ত্রীলাভ করবার ইচ্ছা করেছিলেন, সুতরাং তিনি ক্রোধপ্রণোদিত হয়ে ভীষ্মকে বললেন, “থামো, থামো।”

শত্রুবিজয়ী পুরুষশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম শাল্বরাজের বাক্যে উত্তেজিত হয়ে ধূমহীন অগ্নির মতো ক্রোধে জ্বলতে থেকে, উন্মুক্ত বাণ ও ধনু ধারণ করে ললাট কুঞ্চিত করে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুসারে নির্ভয়ে ও স্থিরচিত্তে শাল্বরাজের দিকে নিজের রথ ফেরালেন। ভীষ্ম ফিরে দাঁড়িয়েছেন দেখে সেই রাজারা সকলেই ভীষ্ম ও শাল্বের সম্মিলনে দর্শক শ্রেণিভুক্ত হলেন। একটা গাভির জন্য দুটি বলবান বৃষ যেমন গর্জন করতে থেকে, পরস্পর অভিমুখীন হয়, সেইরকম বল ও বিক্রমশালী ভীষ্ম ও শাল্ব পরস্পর অভিমুখীন হলেন। তারপরে, নরশ্রেষ্ঠ শাল্বরাজ শীঘ্রগামী বহুসংখ্যক বাণদ্বারা শান্তনুনন্দন ভীষ্মকে আচ্ছন্ন করে ফেললেন। প্রথমেই শাল্বরাজা ভীষ্মকে প্রহার করেছেন দেখে বিপক্ষ রাজারা বিস্মিত হয়ে ‘সাধু সাধু’ এই কথা বলে উঠলেন এবং শাল্বরাজার লঘুহস্ততার প্রশংসা করতে লাগলেন। ভীষ্ম বিপক্ষরাজগণের সেই সকল কথা শুনে ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “থাক থাক।” তারপর তিনি সেই ক্রুদ্ধ অবস্থাতেই সারথিকে বললেন, “যেখানে ওই শাল্বরাজ আছেন, সেইখানে যাও। গরুড় যেমন সর্পবধ করেন, আমি আজ তেমনভাবেই ওই শাল্বরাজাকে বধ করব।” তারপর ভীষ্ম বরুণাস্ত্র সন্ধান করলেন এবং তার আঘাতে শাল্বরাজের চারটি ঘোড়াকেই দুর্বল করে দিলেন। এবং অস্ত্রদ্বারা শাল্বরাজের অস্ত্রগুলিকে নিবারণ করে তাঁর সারথিকে বধ করলেন। তারপর নরশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম কন্যা ক’টিকে হরণ করার জন্য তখনই ঐন্দ্র অস্ত্রদ্বারা শাল্বরাজের অশ্বগুলিকে নিহত করলেন। ভীষ্ম এইভাবে জয় করে, শাল্বরাজের জীবনমাত্র অবশিষ্ট রেখে তাঁকে ছেড়ে দিলেন। তখন শাল্বরাজা আপন রাজধানীতে ফিরে গেলেন। তিনি সেখানে গিয়ে ধর্মানুসারে আপন রাজ্যশাসন করতে লাগলেন। স্বয়ংবর দেখার ইচ্ছায় যেসব রাজা সেখানে এসেছিলেন, তাঁরাও আপন আপন রাজ্যে চলে গেলেন। মহাবীর ভীষ্ম এইভাবে সেই কন্যাগণকে জয় করে হস্তিনানগরে চলে গেলেন। হস্তিনানগরে তখন পিতা শান্তনুর মতো রাজশ্রেষ্ঠ বিচিত্রবীর্য শাসন করছিলেন।

অসাধারণ বিক্রমী ধর্মাত্মা ভীষ্ম নিজে অক্ষত শরীরে থেকে, যুদ্ধে শত্রুদের পরাভূত করে, নানাবিধ বন, নদী, পর্বত ও বৃক্ষসমূহকে অতিক্রম করে পুত্রবধূ ও কনিষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় কাশীরাজের কন্যাগণকে নিয়ে এলেন। আপন কন্যা যেমনভাবে থাকে, তেমনিভাবেই মহাবীর ভীষ্ম সেই কন্যাদের নিয়ে কুরুদেশে গেলেন এবং ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের সন্তোষের জন্য তাদের রাজধানীতে নিয়ে এলেন। তারপর ভীষ্ম, বিক্রম প্রকাশ করে আনীত সর্বগুণসম্পন্না সেই তিনটি কন্যাকেই ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের হস্তে দান করার ইচ্ছা করলেন। বিমাতা সত্যবতীর সঙ্গে পরামর্শ করে বিশেষ যত্ন সহকারে ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের বিবাহের উপক্রম করলেন।

ভীষ্ম কিছুদিন পরেই বিবাহ করাবেন, এমন সময়ে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা হাসতে হাসতে ভীষ্মকে বললেন, “আমি পূর্বেই মনে মনে শাল্বরাজাকে পতিত্বে বরণ করেছিলাম, তিনিও আমাকে পত্নী করবেন বলে স্বীকার করেছিলেন, আমার পিতারও এইরূপ ইচ্ছা ছিল। সুতরাং আমি সেই স্বয়ংবরে শাল্বরাজাকেই বরণ করতাম। হে ধর্মজ্ঞ! আপনি এই সমস্ত বিষয় জেনে যথার্থ ধর্মের অনুসরণ করুন।” কন্যাটি ব্রাহ্মণসভায় একথা বললে, মহাবীর ভীষ্ম তার বিবাহ বিষয়ে ন্যায়সংগত চিন্তাই করলেন। ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম তখনই বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণগণের সঙ্গে আলোচনা করে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে যাবার জন্য অনুমতি দিলেন। তখন সেই অম্বা ভীষ্মের অনুমতি লাভ করে। শাল্বরাজার নগরে গমন করলেন। বৃদ্ধ-ব্রাহ্মণেরা তাঁকে রক্ষা করতে লাগলেন এবং ধাত্রীও তাঁর সঙ্গে গেল। ক্রমে অম্বা সেই পথ অতিক্রম করে শাল্বরাজার কাছে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে বললেন, “মহাবাহু মহামতি রাজা, আমি আপনার উদ্দেশ্যেই এসেছি এবং সর্বদা আপনার প্রিয় ও হিতকার্যে নিরত আছি। অতএব আপনি আমাকে আদর করুন। রাজা, আপনি পাণিগ্রহণ করে আমাকে পত্নী করুন এবং ন্যায় অনুসারে আমার সঙ্গে ধর্মাচরণ করুন। কারণ আমি মনে মনে আপনাকে পতিরূপে চিন্তা করেছি। আপনিও আমাকে তাই বলেছেন।”

তখন শাল্বরাজা ঈষৎ হাস্য করে বললেন, “বরবর্ণিনী, পূর্বে তোমাকে অন্য পুরুষ গ্রহণ করেছে; এ-অবস্থায় আমি তোমাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করতে পারি না। ভদ্রে, তুমি পুনরায় হস্তিনাপুরে ভীষ্মের কাছেই ফিরে যাও। কারণ, ভীষ্ম তোমাকে বলপূর্বক গ্রহণ করেছেন। এ অবস্থায় আমি তোমাকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করি না। ভীষ্ম মহাযুদ্ধে রাজগণকে পরাজিত করে স্পর্শ করেই তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল, তুমি তখন তাতে আনন্দিতই হয়েছিলে। বরবর্ণিনী, আমি অন্যপূর্বা নারীকে ভার্যা করতে ইচ্ছা করি না। কারণ শাস্ত্রজ্ঞ ও পরের উদ্দেশে ধর্মউপদেশকারী আমার মতো রাজা কী করে পরপূর্বা নারীকে আপন ভবনে প্রবেশ করাতে পারেন। সুতরাং ভদ্রে, তুমি ইচ্ছানুসারে গমন করো, তোমার এই সময়টা যেন চলে না যায়।”

অম্বা তমব্রবীদ্রজেন্ননঙ্গ শর পীড়িতা।

নৈবং বদ মহীপাল! নৈতদেবং কথঞ্চল ॥ উদ্‌যোগপর্ব : ১৬৩ : ১১ ॥

তখন কামবাণ পীড়িতা অম্বা শাল্বপতিকে বললেন, “নরনাথ! আপনি এরূপ কথা বলবেন না। কারণ আপনার একথা কোনও প্রকারেই সত্য নয়।

“শত্রুবিজয়ী ভীষ্ম যে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে আমি আনন্দিত হইনি, কিন্তু আমি রোদন করেছিলাম। সেই অবস্থাতেই তিনি রাজগণকে পরাজিত করে বলপূর্বক আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। শাল্বপতি! আমি আপনার অনুরক্তা বালিকা এবং নিরপরাধা। সুতরাং আপনি আমাকে গ্রহণ করুন। কারণ ধর্মশাস্ত্রে ভক্তের পরিত্যাগ করাকে প্রশংসা করেন না। আমি যুদ্ধে অপরাঙ্মুখ ভীষ্মকে বলে তাঁর অনুমতি নিয়ে আপনারই বশীভূত হয়েছি। নরনাথ, আমি শুনেছি যে, মহাবুদ্ধি ভীষ্ম আমাকে বিবাহ করতে ইচ্ছা করেন না তবে ভ্রাতার জন্যই তার এই কন্যাহরণ। রাজা! অম্বিকা ও অম্বালিকা নাম্নী আমার যে দুটি ভগিনীকে ভীষ্ম হরণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাদের দু’জনকেই তিনি তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের হস্তে দান করেছেন। নরশ্রেষ্ঠ শাল্বরাজ! আমি আপনাকে ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের চিন্তাও করিনি, তার জন্য মস্তক স্পর্শ করে শপথ করছি। আমি অন্যপূর্বা হয়ে আপনার কাছে উপস্থিত হইনি। একথা সত্য বলছি এবং সেই সত্যের জন্য হৃদয় স্পর্শ করছি। আমি অনন্যপূর্বা কন্যা এবং আপনার অনুগ্রহপ্রার্থিনী হয়ে নিজে এসে উপস্থিত হয়েছি। সুতরাং আপনি আমাকে গ্রহণ করুন।”

অম্বা একথা বলতে লাগলেও সাপ যেমন খোলস ত্যাগ করে, শাল্বরাজাও তাকে ত্যাগ করলেন। অম্বা নানাবিধ বাক্যে প্রার্থনা করতে থাকলেও শাল্বরাজ তাকে গ্রহণ করলেন না। তারপর কাশীরাজের কন্যা অম্বা অত্যন্ত কাতরা হয়ে বললেন, “নরনাথ! আপনি আমাকে ত্যাগ করলেন বলে আমি এখন যেখানে সেখানে যাব এবং সেইখানে সাধুলোকেরা নিজেদের নিয়ম অনুসারে আমার যথার্থ আশ্রয় হবেন।” শাল্বরাজা অম্বার এই কথাতেও তাকে গ্রহণ করলেন না। শাল্বরাজা বললেন, “সুনিতম্বে, ভীষ্ম তোমাকে গ্রহণ করেছেন, আমি ভীষ্মকে ভয় করি। সুতরাং তুমি এখান থেকে চলে যাও।” অদূরদর্শী শাল্ব এই কথা বললে, অম্বা কাতরা এবং কুররী পক্ষিণীর মতো রোদনপ্রবৃত্তা হয়ে সেই রাজধানী থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। নগর থেকে বাইরে আসতে আসতে তিনি দুঃখিত মনে চিন্তা করতে লাগলেন যে, “আমার মতো গুরুতরা বিপন্না কোনও নারী পৃথিবীতে নেই। বান্ধবেরা আমাকে ত্যাগ করেছেন এবং শাল্বরাজাও প্রত্যাখ্যান করলেন, অথচ হস্তিনাতে আবার আমি যেতেও পারব না। শাল্বরাজাকে লক্ষ্য করেই ভীষ্ম আমাকে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। এখন কী নিজের নিন্দা করি, না সেই দুর্ধর্ষ ভীষ্মের নিন্দা করি? অথবা যিনি আমার স্বয়ংবরের আয়োজন করেছিলেন, সেই মূঢ় পিতার নিন্দা করি? কিংবা এটা আমার নিজকৃত দোষ যে, সেই সময়ে দারুণ যুদ্ধ হতে থাকলে শাল্বরাজার জন্য ভীষ্মের রথ থেকে লাফিয়ে পড়িনি, তারই এই ফল উপস্থিত হয়েছে যে, আমি মূঢ়ের মতো বিপন্ন হয়েছি। ভীষ্মকে ধিক এবং আমার মন্দ ও মূঢ়চিত্ত পিতাকেও ধিক, যিনি বেশ্যার মতো আমাকে বীর্যপণে নিযুক্ত করেছিলেন। আমাকে ধিক, শাল্বরাজাকে ধিক এবং বিধাতাকেও ধিক, যাদের দুর্ব্যবহারে আমি এই গুরুতর বিপদে পড়েছি। মানুষ নিশ্চয়ই আপনার অদৃষ্টের ফল পেয়ে থাকে। কিন্তু আমার এই বিপদের প্রধান কারণই শান্তনু-নন্দন ভীষ্ম। অতএব তপস্যা করে কিংবা যুদ্ধ দ্বারা ভীষ্মের প্রতিশোধ নেওয়াই আমি উচিত বলে মনে করি। কারণ ভীষ্মই আমার সমস্ত দুঃখের কারণ। তবে কোন রাজা যুদ্ধে ভীষ্মকে জয় করতে পারবেন?”

মনে মনে এইরূপ স্থির করে অম্বা নগরের বাইরে এসে পুণ্যবাণ ও মহাত্মা তপস্বীগণের আশ্রমে গমন করলেন এবং তপস্বীগণ পরিবেষ্টিত হয়ে সে রাত্রি সেখানেই বাস করলেন। সেই সময়ে নির্মল হাসিনী অম্বা ভীষ্মকর্তৃক নিজের হরণ ও শাল্বের নিকট প্রেরণ এবং শাল্বকর্তৃক প্রত্যাখ্যান ইত্যাদি সমস্ত বিবরণই যথাযথভাবে ও বিস্তরক্ৰমে মুনিগণের কাছে বললেন। সেখানে শাস্ত্রে ও আরণ্যক উপনিষদে অধ্যাপক, তপোবৃদ্ধ, দৃঢ়ব্রত ও মহাত্মা শৈখাবত্য নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। সচ্চরিত্রা ও বালিকা অম্বাকে এইভাবে শোকার্তা দেখে সেই মহাত্মা শৈখাবত্য মুনি অম্বাকে বললেন, “ভদ্রে! মহাভাগে! আশ্রমস্থ ও তপস্যায় ব্যাপৃত মহাত্মা তপস্বীরা এই অবস্থায় তোমাকে কী করতে পারেন?” তখন অম্বা শৈখাবত্যকে বললেন, “আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন, আমি প্ৰব্ৰজা অবলম্বন করতে ইচ্ছা করি, সেই অবস্থায় দুষ্কর তপস্যা করব। আমি পূর্বজন্মে নিশ্চয়ই মোহবশত যে সকল পাপকর্ম করেছিলাম, অবশ্যই আমার আজকের পরিণাম তারই ফল। তপস্বীগণ, ভীষ্ম আমাকে ত্যাগ করেছেন, শাল্বও প্রত্যাখ্যান করেছেন। সুতরাং আমার এখন কোনও আনন্দই নেই। এই অবস্থায় আমি পুনরায় স্বজনবর্গের কাছে যেতে চাই না। হে নিষ্পাপ মুনিগণ! আমার উপরে আপনাদের দয়া হোক। আপনারা দেবতার তুল্য। সুতরাং আপনাদের উপদেশ অনুসারে আমি এখানে থেকেই তপস্যা করতে ইচ্ছা করি।”

তখন সেই ধার্মিক তপস্বীরা অম্বার বিষয়ে অনেক চিন্তা করলেন। কেউ কেউ বললেন, “একে পিতৃগৃহে নিয়ে যাওয়া হোক।” কেউ কেউ মনে করলেন, “শাল্বরাজার কাছে গিয়ে সেখানেই একে রাখা হোক।” অপরে সে-মত সমর্থন করলেন না। কারণ শাল্বরাজা তাকে পূর্বেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। দৃঢ়নিয়মী তপস্বীরা সকলে তাকে বললেন, “ভদ্রে! তোমার এখন প্রব্রজ্যার প্রয়োজন নেই; তুমি আমাদের হিতবাক্য শ্রবণ করো; তুমি এখান থেকে তোমার পিতার মঙ্গলময় গৃহেই গমন করো। কল্যাণী, তোমার সেই রাজা পিতাই এরপর যা করা উচিত, তা করবেন। তুমি সেখানে সর্বগুণান্বিতা হতে থেকে সুখে বাস করবে। ভদ্রে, পিতা যেমন, তেমন অন্য আশ্রয় তোমার পক্ষে সংগত নয়। কারণ, নারীর প্রথমে পতিই গতি, না হলে পিতা। অর্থাৎ পতি সুস্থ থাকলে তিনিই নারীর আশ্রয়। আর ভাবিনী, তুমি স্বভাবতই কোমলাঙ্গী ও কুমারী এবং বিশেষত রাজকন্যা, অতএব তোমার পক্ষে প্রব্রজ্যা অত্যন্ত কষ্টকর হবে। তারপর তুমি আশ্রমে বাস করতে থাকলে তোমার বহুতর দোষ ঘটার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু পিতৃগৃহে সে সকল দোষ ঘটার কোনও সম্ভাবনা নেই। আগন্তুক রাজারা এই নির্জন গহন বনমধ্যে তোমাকে একাকিনী দেখে প্রার্থনা করবেন। অতএব তুমি এ-বিষয়ে মনে কোরো না।”

অম্বা বললেন, “আমি পিতৃগৃহে অথবা কাশীনগরে পুনরায় যেতে পারব না। কারণ, তা হলে আমি বান্ধবগণের অবজ্ঞার পাত্রী হব। বাল্যকালে পিতৃগৃহে যেভাবে বাস করেছি, সেভাবে আর সেখানে বাস করতে পারব না। অতএব আমার পিতা যেখানে আছেন, সেখানে আর যাব না। তাপসশ্রেষ্ঠগণ, আমি তপস্বীগণের পরিরক্ষিত হয়ে তপস্যা করতেই ইচ্ছা করি। যাতে পরলোকেও আবার আমার এই মহাকষ্টজনক দুর্ভাগ্য আর না হয়। অতএব আমি তপস্যাই করব।”

সেই ব্রাহ্মণেরা যথাযথভাবে এই আলোচনা করছিলেন, এমন সময়ে তপস্বী ও রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সেই তপোবনে এসে পৌঁছোলেন। সেই তপস্বী সকলে স্বাগতপ্রশ্ন, আসন দান ও জলদান প্রভৃতি দ্বারা সেই রাজর্ষির সম্মান করলেন। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন উপবেশন করে বিশ্রাম করলে, তাঁর সামনেই তপস্বীরা আবার অম্বার বিষয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। মহাতেজা হোত্ৰবাহন অম্বার ও কাশীরাজের সেই কাহিনি শুনে উদ্বিগ্নচিত্ত হলেন। মহাতপা, মহাত্মা, রাজর্ষি ও অম্বার মাতামহ সেই হোত্ৰবাহন অম্বার কথা শুনে কৃপাবিষ্ট হয়ে কম্পিতকলেবরে উঠে গিয়ে অম্বাকে কোলে তুলে আশ্বস্ত করলেন। তিনি প্রথম থেকে বিপদ উৎপত্তির সমস্ত বিবরণ অম্বার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন, অম্বাও যথাযথভাবে সমস্ত কাহিনি তাঁকে বললেন। রাজর্ষি হোত্ৰবাহন সেই কাহিনি শুনে দুঃখিত ও শোকার্ত হলেন এবং মনে মনে,অম্বার বিষয়ে কর্তব্য স্থির করলেন। তিনি পীড়িতা অম্বাকে বললেন, “ভদ্রে। তুমি পিতার গৃহে গমন কোরো না, আমি তোমার মাতামহ। আমিই তোমার দুঃখ দূর করব, তুমি আমার কাছেই থাকো। তোমাকে অত্যন্ত শুষ্ক দেখাচ্ছে, তোমার মন নিশ্চয়ই দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তুমি আমার কথা শুনে জমদগ্নিনন্দন তপস্বী রামের কাছে যাও। তিনিই তোমার দুঃখ ও শোক দূর করবেন। ভীষ্ম যদি তাঁর কথা না শোনেন, তবে তিনি যুদ্ধে ভীষ্মকে বধ করবেন। তুমি কালাগ্নিতুল্য তেজস্বী রামের কাছে যাও। সেই মহাতপা রাম তোমাকে অন্য নারীর সমান অবস্থায় স্থাপন করবেন।” তখন অম্বা বারবার অত্যাগ করে এবং মস্তকদ্বারা মাতামহ হোত্ৰবাহনকে নমস্কার করে মধুর স্বরে বললেন, “আমি আপনার নির্দেশে সেই রামের কাছে যাব। তবে লোকবিখ্যাত সেই মহাত্মাকে আমি এখন দেখতে পাব কী? তিনিই বা কি প্রকারে আমার এই তীব্র দুঃখ নষ্ট করবেন। সে যাই হোক, সেখানে যেভাবে যাব, তা আমি জানতে ইচ্ছা করি।” হোত্ৰবাহন বললেন, “ভদ্রে, তুমি গিয়ে দেখবে সত্যপ্রতিজ্ঞ ও মহাবল জমদগ্নিনন্দন রাম মহাবনমধ্যে ভয়ংকর তপস্যায় প্রবৃত্ত রয়েছেন। সেই পরশুরাম অন্যান্য বেদবিৎ ঋষি, গন্ধর্বগণ ও অপ্সরাগণ সর্বদা সেই মহেন্দ্র নামক শ্রেষ্ঠ পর্বতে অবস্থান করছেন। তুমি সেইখানে যাও, তোমার মঙ্গল হবে। তুমি সেইখানে গিয়ে মস্তকদ্বারা তপোবৃদ্ধ ও দৃঢ়ব্রত সেই রামকে নমস্কার করে তাঁকে আমার কথা বোলো। ভদ্রে, তোমার যে কার্য অভীষ্ট, তা তুমি তাঁকে বোলো; আমার নাম বললেই রাম তোমার সে সমস্ত কার্যই সম্পাদন করবেন। সকল অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ও মহাবীর জমদগ্নিনন্দন রাম আমার সখা, আমার উপর প্রণয়শালী ও নির্দোষচিত্ত।”

রাজা হোত্ৰবাহন অম্বাকে যখন এইসব কথা বলছিলেন, তখন রামের প্রিয় অনুচর অকৃতব্রণ সেখানে উপস্থিত হলেন। তারপর সেই স্থানের সহস্র সহস্র মুনি সকলেই গাত্রোখান করলেন এবং সৃঞ্জয়বংশীয় বয়োবৃদ্ধ সেই রাজা হোত্ৰবাহনও উঠলেন। অকৃতব্রণকে অতিথিসৎকার করে মুনিরা তাকে পরিবেষ্টন করে উপবেশন করলেন। মুনিগণের বিভিন্ন আলাপের শেষে মহর্ষিগণ অকৃতব্রণের কাছে রামের বিষয় প্রশ্ন করলেন, “মহাবাহু অকৃতব্রণ, প্রতাপশালী পরশুরাম এখন কোথায় আছেন? আমরা কি সেই বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি?” অকৃতব্রণ বললেন, “প্রভাবশালী রাজা, পরশুরাম সর্বদা আপনার কথা বলেন। তিনি বলেন, সৃঞ্জয়বংশীয় রাজর্ষি হোত্ৰবাহন আমার প্রিয় সখা। আমার ধারণা রাম আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য আগামী কল্য প্রভাতেই এখানে আসবেন। সুতরাং এখানে এলেই আপনি তাঁকে দেখতে পাবেন। রাজর্ষি এই কন্যাটি কী জন্যে বনে এসেছে? এটি কার কন্যা? আপনার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক? এর সমস্ত কাহিনি আমি জানতে চাই।”

হোত্ৰবাহন বললেন, “নিপাপ প্রভু, এটি আমার দৌহিত্রী এবং কাশীরাজের প্রিয়া কন্যা। এটি জ্যেষ্ঠা কন্যা, কনিষ্ঠা অপর দুই ভগিনীর সঙ্গে স্বয়ংররে প্রস্তুত ছিল। কাশীরাজের এই জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম ‘অম্বা’ আর কনিষ্ঠা অপর দুটি কন্যার নাম, ‘অম্বিকা’ ও ‘অম্বালিকা’। কাশীনগরে এই কন্যা ক’টির নিমিত্ত পৃথিবীর সমস্ত ক্ষত্রিয় সমবেত হয়েছিলেন। তখন মহোৎসব চলছিল। তারপর মহাবীর ও মহাতেজা শান্তনুনন্দন ভীষ্ম এসে রাজগণকে পরাজিত করে সেই তিনটি কন্যাকেই হরণ করেন ও তাদের সঙ্গেই হস্তিনানগরে আগমন করেন। ভীষ্ম মাতা সত্যবতীকে জানিয়ে ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের বিবাহ করাবার জন্য পুরোহিত প্রভৃতিকে আদেশ করলেন। তখন সেই বিবাহের আয়োজন দেখে এই কন্যাটি মন্ত্রীগণের মধ্যে ভীষ্মকে বলল, ‘বীর! আমি মনে মনে শাল্বরাজাকে পতিত্বে বরণ করেছি। সুতরাং আমার মন অন্য পুরুষে আসক্ত হয়েছে। অতএব ধর্মজ্ঞ, আপনি আমাকে ভ্রাতার হাতে দান করতে পারেন না।’ ভীষ্ম সেই কথা শুনে মন্ত্রীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে সত্যবতীর মত নিয়ে কন্যাটিকে শাল্বরাজার কাছেই পাঠিয়ে দিলেন।

“তারপর এই কন্যাটি ভীষ্মের অনুমতিক্রমে সৌভপতি শাল্বের কাছে গিয়ে আনন্দিত স্বরে বলল, ‘রাজশ্রেষ্ঠ! আমি মনে মনে পূর্বেই আপনাকে পতিত্বে বরণ করেছিলাম, এখন ভীষ্মও আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আপনি আমাকে পত্নীত্বে গ্রহণ করুন।’ কিন্তু শাল্বরাজা এর চরিত্রে কলঙ্ক আশঙ্কা করে একে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং এ তপোবনে এসেছে এবং তপস্যার প্রতি বিশেষ অভিলাষিণী হয়েছে। এর বংশের পরিচয় পেয়ে আমি একে চিনতে পেরেছি। কন্যাটি এখন ভীষ্মকেই এই দুঃখের কারণ বলে মনে করছে।” অম্বা বললেন, “ভগবান! আমার মাতামহ সৃঞ্জয়বংশীয় হোত্ৰবাহন যা বলেছেন, তা সত্য। কিন্তু তপোধন! মহর্ষি! অপমানের ভয়ে এবং লজ্জাবশত আমি আর আপন কাশীনগরে ফিরে যেতে চাই না। অতএব ভগবান! ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! ভগবান রাম এসে আমাকে যা বলবেন সেই উত্তম কাৰ্যই আমি করব, এই আমার ইচ্ছা।”

অকৃতব্রণ বললেন, “ভদ্রে! অবলে! বৎসে! ভীষ্ম ও শাল্ব এই দুজনের মধ্যে কার এরূপ দুঃখ বিধান তুমি করতে ইচ্ছা করো। কারই বা প্রতিবিধান করবার ইচ্ছা করো, তা আমার। কাছে বলো। তোমার যদি এই মত হয়, তোমার পাণিগ্রহণের জন্য শাল্বরাজাকেই নিয়োগ করতে হবে, তবে মহাত্মা রাম তোমার হিতকামনায় তাঁকেই নিযুক্ত করবেন অথবা ধীমান রাম যুদ্ধে গঙ্গানন্দন ভীষ্মকে জয় করুন। তুমি যদি তা দেখতে চাও, তবে তিনি তাও করবেন। হোত্ৰবাহন ও তোমার বাক্য শুনে রাম এ-বিষয়ে যা করবেন, তা তুমি আজই চিন্তা করে রাখো।” অম্বা বললেন, “ভগবন, ভীষ্ম না জেনেই আমাকে অপহরণ করেছিলেন। আমার মন যে শাল্বরাজার উপরে গিয়েছিল, তা তিনি বস্তুতই জানতেন না। আপনি মনে মনে এই বিষয় বিবেচনা করে এর একটা স্থির করুন এবং ন্যায় অনুসারে কাজ করুন। ব্রাহ্মণ, কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের উপরে কিংবা শাল্বরাজের উপরে অথবা উভয়ের উপরে যা সংগত হয় তা করুন। ভগবন, আমি আমার এই দুঃখের কারণ যথাযথভাবে নিবেদন করলাম, আপনি এখন এ-বিষয়ে ন্যায় অনুসারে প্রতিবিধান করতে পারেন।”

অকৃতব্রণ বললেন, “ভদ্রে! বরবৰ্ণিনি! তুমি যে ধর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে এরূপ বাক্য বললে, তা সংগত হয়েছে। এখন আমার বাক্যও শ্রবণ করো। ভীরু! ভীষ্ম যদি তোমাকে হস্তিনায় না নিয়ে যেতেন, তবে রামের আদেশে শাল্বরাজা তোমাকে মস্তকে গ্রহণ করতেন। ভীষ্ম যেহেতু তোমাকে জয় করে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই জন্যই তোমার উপরে শাল্বরাজার সন্দেহ জন্মেছে। তার উপরে আবার ভীষ্ম পুরুষাভিমানী এবং জয়গর্বিত। অতএব ভীষ্মের উপরে প্রতিবিধান করাননাই তোমার উচিত।” অম্বা বললেন, “ব্রাহ্মণ, আমার মনেও সর্বদা এই অভিলাষই রয়েছে যে, যদি যুদ্ধে ভীষ্মকে বধ করাতে পারি, তা হলেই উপযুক্ত প্রতিকার করা হয়। সে যা হোক মহাবাহু, আমি যার জন্য গুরুতর দুঃখ ভোগ করছি, সেই ভীষ্মকে বা শাল্বরাজাকে কিংবা অন্য যাকে দোষী বলে মনে করেন, তাকেই শাসন করুন।”

পরের দিন জটা ও কৌপীনধারী মুনি পরশুরাম তেজে যেন জ্বলতে থেকে শিষ্যগণে পরিবেষ্টিত হয়ে উপস্থিত হলেন। রজোগুণবিহীন, প্রফুল্লচিত্ত এবং ধনু তরবারি ও পরশুধারী রাম ক্রমশ রাজা হোত্ৰবাহনের কাছে গিয়ে পৌঁছোলেন। তখন তপস্বীরা, মহাতপা হোত্ৰবাহন এবং শোচনীয়া অম্বা ইত্যাদি রামকে দেখে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়ালেন। পরে তারা মধুপর্ক দ্বারা অনাকুলভাবে রামের পূজা করলেন। তখন রাম যথানিয়মে পূজিত হয়ে তাঁদের সঙ্গেই উপবেশন করলেন। তারপর রাম ও হোত্ৰবাহন উপবেশন করে বহু বিষয়ে আলোচনা করলেন। আলোচনার পর হোত্ৰবাহন, ভৃগুবংশশ্রেষ্ঠ ও মহাবল রামের কাছে যথাসময়ে যুক্তিযুক্ত মধুর বাক্যে বললেন, “প্রভু কার্যবিশারদ রাম! এটি আমার দৌহিত্রী এবং কাশীরাজের কন্যা। আপনি ওর কাছ থেকে যথাযথভাবে কর্তব্য বিষয়ে শ্রবণ করুন।”

“ভাল, বলো” রাম অম্বার প্রতি এই কথা বললেন। তারপর অম্বা প্রজ্বলিত অগ্নির তুল্য তেজস্বী রামের কাছে সমস্ত কথা নিবেদন করলেন। তারপর অম্বা পদ্মপত্ৰতুল্য দুই হস্ত দিয়ে রামের মঙ্গলময় চরণযুগল স্পর্শ করে মস্তক দ্বারা নমস্কার করে সম্মুখে দাঁড়ালেন এবং তিনি শোকার্তা ও অশ্রুপূর্ণা নয়না হয়ে রোদন করতে লাগলেন, ক্রমে শরণাগতবৎসল রামের শরণাপন্ন হলেন। রাম বললেন, “রাজকন্যা! তুমি এই সৃঞ্জয়ের যেমন, তেমনই আমারও স্নেহের পাত্রী। তোমার মনে যে দুঃখ আছে, তা বলো, আমি তোমার বাক্য রক্ষা করব।” অম্বা বললেন, “ভগবন! আপনি মহাব্রত। সুতরাং আমি আপনার শরণাপন্ন হলাম! প্রভু, আমি ভয়ংকর শোকপঙ্কার্ণবে মগ্ন হয়েছি, আপনি আমাকে তার থেকে উদ্ধার করুন।”

অম্বার রূপ, নবীন শরীর ও পরম সৌকুমার্য দেখে রাম চিন্তান্বিত হলেন। “এ কী বলবে” এই সন্দেহ করে ভূগুনন্দন রাম দয়ার্দ্র হয়ে দীর্ঘকাল চিন্তা করলেন। পুনরায় রাম অম্বাকে বললেন, “বলো।” তারপর অম্বা যথাযথভাবে সমস্ত বিষয়ই রামের কাছে বললেন। রাম তখন অম্বর সমস্ত কথা শুনে কর্তব্য স্থির করে অম্বাকে বললেন, “ভাবিনী, আমি কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের কাছে সংবাদ পাঠাব। তিনি শুনে নিশ্চয়ই আমার বাক্য রক্ষা করবেন। ভীষ্ম যদি আমার বাক্য রক্ষা না করেন, তবে আমি যুদ্ধে অস্ত্রের তেজে অমাত্যবর্গের সঙ্গে ভীষ্মকে দগ্ধ করব। অথবা রাজপুত্রী, তোমার মতি যদি সেদিকে না থাকে, তবে আমি এই কার্যে বীর শাল্বরাজাকেই নিযুক্ত করব।” অম্বা বললেন, “ভূগুনন্দন, আমার বুদ্ধিপ্রযুক্ত অনুরাগ পূর্বেই শাল্বরাজার উপরে গিয়েছে। এই কথা শুনেই ভীষ্ম আমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর আমি শাল্বরাজার কাছে গিয়েছিলাম এবং স্ত্রীলোকের যা বলা দুষ্কর, সেই কথাই তাঁকে বলেছিলাম, কিন্তু তিনি আমার চরিত্রের উপর সন্দেহ করে আমাকে গ্রহণ করেননি। অতএব ভৃগুনন্দন, আপনি নিজবুদ্ধিতে এখন যা যুক্তিযুক্ত কাজ, তা চিন্তা করতে পারেন। তবে মহাব্রত ভীষ্মই আমার এই বিপদের কারণ। যেহেতু তিনিই তখন বলপূর্বক আমাকে রথে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। অতএব মহাবাহু ভূগুনদন, যাঁর জন্য আমি এই দুঃখ ভোগ করছি এবং আপনার গুরুতর অপ্রিয় আচরণ করছি, সেই ভীষ্মকেই আপনি বধ করুন। ভীষ্ম লোভী, নীচপ্রকৃতি এবং গর্বিত। সুতরাং তাঁর প্রতিশোধ নেওয়াই আপনার উচিত। ভীষ্ম যখন আমাকে হরণ করেন, তখনই আমি মনে মনে সংকল্প করেছিলাম যে ভীষ্মকে বধ করাব। অতএব মহাবাহু রাম, আমার অভিলাষ পূর্ণ করুন। ইন্দ্র যেমন বৃত্রাসুরকে বধ করেছিলেন, আপনিও তেমনই ভীষ্মকে বধ করুন।”

রাম তাঁকে বললেন, “কাশীরাজকন্যে, আমি ব্ৰহ্মবিদগণের প্রয়োজন ভিন্ন ইচ্ছানুসারে অস্ত্র গ্রহণ করব না। অতএব তোমার অন্য কোন কার্য করব, তা বলো। ভীষ্ম ও শাল্ব দু’জনেই বাক্যমাত্র আমার বশীভূত হবেন, আমি তাই করব। তুমি শোক কোরো না। ভাবিনী! ব্রাহ্মণের নিয়োগ ব্যতীত কোনও প্রকারেই আমি অস্ত্র ধারণ করব না, আমি এই শপথ করেছি।” অম্বা বললেন, “মহর্ষি, আপনি বলেছেন যে, আপনি যে-কোনও প্রকারে আমার দুঃখ দূর করবেন। আমার সে দুঃখ ভীষ্মই উৎপাদন করেছেন। অতএব প্রভু! আপনি তাঁকে বধ করুন। বিলম্ব করবেন না।” রাম বললেন, “কাশীরাজকন্যে, তুমি আবার ভেবে বলো, ভীষ্ম তোমার পূজনীয় হলেও আমার অনুরোধে তিনি তোমার চরণযুগল মস্তকে ধারণ করবেন।” অম্বা বললেন, “রাম, আপনি যদি আমার প্রিয় কার্য করার ইচ্ছা করেন, তবে যুদ্ধে ভীষ্মকে বধ করুন। আর আপনি যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তাও আপনার সত্য করা উচিত।”

রাম ও অম্বার এই আলোচনার মধ্যেই পরমধর্মাত্মা অকৃতব্রণ বললেন, “মহাবাহু রাম! আপনি শরণাগত কন্যাটিকে ত্যাগ করতে পারেন না। সুতরাং গর্জনকারী অসুরের মতো ভীষ্মকে যুদ্ধে বধ করুন। ভূগুনন্দন রাম, ভীষ্ম যদি আপনার আহ্বানে এসে বলেন যে, ‘আমি যুদ্ধে আপনার কাছে পরাজিত হয়েছি’ অথবা তিনি আপনার বাক্য রক্ষা করেন, তা হলেই এই কন্যাটির কাজ করা হবে এবং প্রভু বীর, আপনার সেই বাক্যও সত্য করা হবে। মহর্ষি রাম! আপনি সকল ক্ষত্রিয়কে জয় করে তখন ব্রাহ্মণগণের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র যদি ধর্মদ্বেষী হয়, তবে আমি তাকে যুদ্ধে বধ করব। আমি জীবিত থেকে কোনও ভীত বা শরণার্থীরূপে আগতকে কোনও প্রকারেই পরিত্যাগ করতে পারব না। ভৃগুনন্দন, আপনি আরও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে লোক যুদ্ধে সমাগত সকল ক্ষত্রিয়কে জয় করবে, আমি সে তেজস্বীকেও বধ করব। কুরুবংশ শ্রেষ্ঠ ভীষ্ম এইরূপ বিজয়ী। অতএব আপনি যুদ্ধে সেই ভীষ্মের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁকে বধ করুন।”

রাম বললেন, “ঋষিশ্রেষ্ঠ! আমার পূর্বকৃত সে, প্রতিজ্ঞা আমার স্মরণে আছে, তবে এক্ষেত্রে যাতে শান্ত বাক্যে ফল লাভ করা যায়, তাই আমি করব। কাশীরাজকন্যার মনোগত এই কার্য অতি গুরুতর। অতএব ভীষ্ম যেখানে আছেন, এই কন্যাটিকে নিয়ে আমি সেখানে যাব। তাতে সমরশ্লাঘী ভীষ্ম যদি আমার বাক্য রক্ষা না করে, তবে এই গর্বিত ভীষ্মকে বধ করব, এই বুদ্ধিই আমি স্থির করলাম। আমার নিক্ষিপ্ত বাণ প্রাণীগণের দেহে লেগে থাকে না, তা দেহ বিদীর্ণ করে, পূর্বে ক্ষত্রিয়যুদ্ধে তা আপনার জানা আছে।” এই কথা বলে রাম তপস্বীদের ও অম্বাকে নিয়ে ভীষ্মবধের উদ্দেশ্যে কুরুক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করলেন।

সমতল ভূমি থেকে তৃতীয় দিনে পরশুরাম ভীষ্মের কাছে দূত পাঠিয়ে দিয়ে জানালেন যে, তিনি এসেছেন। মহাবল, তেজের সাগর ও প্রভাবশালী রাম রাজ্যের প্রান্তভাগে উপস্থিত হয়েছেন জেনে, ভীষ্ম ব্রাহ্মণগণ, দেবকল্প ঋত্বিকগণ ও পুরোহিতগণে পরিবেষ্টিত হয়ে একটি ধেনু নিয়ে প্রীতি সহকারে বেগে তাঁর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তখন প্রতাপশালী রাম। ভীষ্মকে আগত দেখে তাঁর কৃত প্রণাম গ্রহণ করলেন এবং এই কথা বললেন, “ভীষ্ম, তুমি নিজে বিবাহ করার ইচ্ছা করো না, তবে তুমি কোন বুদ্ধিতে এই কাশীরাজের কন্যাটিকে নিয়ে। এসেছিলে, আবার ত্যাগও করেছিলে। তুমি এঁকে ধর্মচ্যুত করেছিলে, কিন্তু কন্যাটি যশস্বিনীই আছে। কিন্তু তুমি স্পর্শ করেছিলে বলে শাল্বরাজ এঁকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অতএব ভরতনন্দন, তুমি আমার আদেশ অনুসারে এঁকে গ্রহণ করো।”

ভীষ্ম প্রথমে ভেবেছিলেন রাম বিচিত্রবীর্যের জন্য অম্বাকে গ্রহণ করতে বলছেন। তিনি সবিনয়ে রামকে বললেন যে, অন্যের প্রতি অনুরক্তা কন্যা তিনি ভ্রাতাকে দিতে পারবেন না। ভীষ্ম আরও বললেন, কন্যাটি যখনই বলেছে যে, সে শাল্বরাজার প্রতি অনুরক্তা, তখনই তিনি অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন এবং কন্যাটিও সেখানে গিয়েছিল। কোনও ভয়, দয়া, অর্থলাভ বা ইচ্ছা করে ভীষ্ম ক্ষত্রিয়ধর্ম ত্যাগ করবেন না। তখন রাম ক্রোধে ঘূর্ণিতনয়ন হয়ে ভীষ্মকে বললেন, “নরশ্রেষ্ঠ! তুমি যদি আমার এই বাক্য রক্ষা না করো, তবে আমি আজই অমাত্যবর্গের সঙ্গে তোমাকে বধ করব।” ভীষ্ম বারংবার প্রিয়-বাক্য বলে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পরে যখন বুঝলেন যে, গুরু তাঁকেই অম্বাকে গ্রহণ করতে বলে বংশরক্ষা করতে নির্দেশ দিচ্ছেন এবং তখন তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে রামের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন এবং জানালেন যে গুরু অশ্রদ্ধেয় আচরণ কিংবা আদেশ করলে তাঁকে পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং মরুত রাজাও। ভীষ্ম গুরুর যুদ্ধের আহ্বানকে স্বীকার করে নিলেন এবং অম্বার উপস্থিতিতেই সমন্তপঞ্চকে পরশুরাম ও ভীষ্মের মধ্যে সংগ্রাম শুরু হল।

এই অদ্ভুত যুদ্ধ একটানা তেইশ দিন ধরে চলেছিল। যুদ্ধের ফল কখনও একপক্ষের অনুকূলে চলছিল না। কখনও ভীষ্মের মর্মভেদী বাণে রাম আহত ও মূৰ্ছিত হয়ে পড়ছিলেন, আবার কখনও রামের তীক্ষ্ণ ভয়ংকর বাণে ভীষ্ম ভূমিতে পতিত হচ্ছিলেন। এই যুদ্ধে সকল মহাস্ত্র, দৈবাস্ত্র এবং ব্রহ্মাস্ত্র সকল ব্যবহৃত হতে লাগল। বাইশ দিন যুদ্ধ চলার পর ব্রাহ্মণেরা রাত্রে আহত ভীষ্মের স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে ‘প্রস্বাপন’ অস্ত্র প্রয়োগ করতে বললেন। তাঁরা জানালেন যে, রাম এই অস্ত্র ব্যবহার জানেন না, এতে তিনি নিহত হবেন না, কিন্তু অচেতন ও মুছিত হয়ে পড়বেন। পরের দিন যুদ্ধে একটি অবসর লাভ করে ভীষ্ম ‘প্রস্বাপন’ মন্ত্র জপ করে সেই অস্ত্র গ্রহণ করলেন। চতুর্দিকে হাহাকার ধ্বনি শোনা গেল। দেবতারা স্বর্গ থেকে এই অস্ত্রের প্রয়োগ না করার জন্য ভীষ্মের প্রতি নিষেধ করতে লাগলেন। দেবর্ষি নারদ ভীষ্মকে এসে বললেন, “প্রস্বাপনাস্ত্র নিক্ষেপ কোরো না। রাম তপস্বী ও বেদহিতৈষী, ব্রাহ্মণ ও তোমার গুরু। অতএব তুমি কোনও প্রকারেই তাঁর অপমান কোরো না।” অষ্টবসুও আকাশে থেকেই ভীষ্মকে একই উপদেশ দিলেন। ওদিকে রামের পিতৃগণ আকাশ থেকে তাঁকে বললেন, “বৎস, ভীষ্ম একে মহাবীর বিশেষত ক্ষত্রিয় এবং মহাবীর। যুদ্ধ বলে যা পরিচিত, তা ক্ষত্রিয়ের ধর্ম, আর বেদপাঠ ও ব্রহ্মচর্য ব্রাহ্মণের পরম ধর্ম। আমরা পূর্বেই তোমার এই ভয়ংকর যুদ্ধকে নিষিদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু সে অকার্য তুমি করেছ। ভীষ্মের সঙ্গে তোমার যে সংঘর্ষ তাই যথেষ্ট হয়েছে। এখন তুমি এই সমরাঙ্গন থেকে অপসৃত হও। তোমার এই ধনুর্ধারণ যথেষ্ট হয়েছে, এখন এ ত্যাগ করো, তোমার মঙ্গল হোক, তপস্যা করো।” রাম ও ভীষ্ম এই ভয়ংকর যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হলেন।

তারপর রাম ভীষ্মের সমক্ষে অম্বাকে ডেকে অত্যন্ত কাতর বাক্যে বলতে লাগলেন, “ভাবিনী, আমি যে চূড়ান্ত পুরুষকার প্রকাশপূর্বক শক্তি অনুসারে যুদ্ধ করেছিলাম, তা উপস্থিত সকলেই দেখেছেন। অতিরিক্ত পরিমাণে উত্তম অস্ত্র সকল আবিষ্কার করেও এই যুদ্ধে আমি অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে জয় করতে পারলাম না। তুমি ভীষ্মেরই শরণাপন্ন হও, তোমার অন্য কোনও উপায় নেই। কারণ ভীষ্ম মহাস্ত্র সকল নিক্ষেপ করে আমাকে জয় করেছেন।” তখন অম্বা রামকে বলতে লাগলেন, “আপনি যা বললেন, তা সত্য। এই মহাবুদ্ধি ভীষ্ম যুদ্ধে দেবগণেরও অজেয় বটেন। আপনি শক্তি ও উৎসাহ অনুসারে আমার কার্য করেছেন কিন্তু ভীষ্মের শক্তি ও নানাবিধ অস্ত্র অনিবার্য। অতএব যুদ্ধে অস্ত্র দ্বারা ভীষ্মকে জয় করা অসম্ভব। অথচ আমি কোনও প্রকারেই ভীষ্মের কাছে যাব না। আমি সেখানেই যাব, যেখানে গিয়ে আমি নিজেকে যুদ্ধে নিপাত করতে পারব।”

এই কথা বলে অম্বা ক্রোধে অস্থিরনয়না হয়ে তপস্যা করবার ইচ্ছায় ভীষ্ম বধের উপায় চিন্তা করতে চলে গেলেন। যমুনা নদীর তীরে গিয়ে তিনি অলৌকিক তপস্যা করতে আরম্ভ করলেন। তিনি নিরাহারা, বায়ুভক্ষা, কৃশা, রুক্ষা, জটাধারিণী, মলকর্দমযুক্তা, স্থাণুর মতো। অচলা ও তপস্বিনী হয়ে ছয়মাস অতিক্রম করলেন। তারপর এক বৎসর নিরাহারে যমুনার। জলে থেকে জলবাসব্রত সমাপ্ত করলেন। অত্যন্ত ক্রুদ্ধা অম্বা চরণাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ভূতলে থেকে একটি মাত্র গলিত পত্র ভক্ষণ করে অপর বৎসর অতিবাহিত করলেন। এইভাবে তিনি বারো বৎসর তপস্যা করে স্বর্গ ও মর্ত্য সন্তপ্ত করে তুললেন। তখন তাঁর জ্ঞাতিরা এসে বারণ করতে থেকেও তাঁকে তপস্যা থেকে নিবৃত্ত করতে পারল না। তারপর তিনি সিদ্ধচারণ সেবিত বৎসদেশে গমন করলেন এবং সেইস্থানের সিদ্ধচারণ আশ্রমে বিচরণ করতে লাগলেন। কাশীরাজকন্যা অম্বা সেই দেশের পবিত্র তীর্থে অবগাহন করতে থেকে ইচ্ছানুসারে বিচরণ করতে থাকলেন। ক্রমে নন্দাশ্রম, উলূকাশ্রম, চ্যবনাশ্রম, মানস সরোবর, প্রয়াগ, দেবযজন, দেবারণ্য, ভাগীরথী, বিশ্বামিত্রাশ্রম, মাণ্ডব্যাশ্রম, দিলীপাশ্রম, রামহ্রদ, পৈলগর্গাশ্রম এই সকল তীর্থে দুষ্কর ব্রত অবলম্বন করে তপস্যাকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুললেন।

একদিন ভীষ্মের মাতা গঙ্গাদেবী জলস্থিতা অম্বাকে বললেন, “ভদ্রে, তুমি কষ্টভোগ করছ কেন? আমার কাছে সত্য বলো।” অনিন্দিতা অম্বা কৃতাঞ্জলি হয়ে গঙ্গাকে বললেন, “চারুনয়নে, ভীষ্ম যুদ্ধে রামকে জয় করেছেন। অতএব পৃথিবীতে অন্য কোন ব্যক্তি অস্ত্রধারী অবস্থায় ভীষ্মকে জয় করতে সমর্থ হবেন? সুতরাং আমি ভীষ্মকে জয় করবার জন্যই অতিদারুণ তপস্যা করছি। দেবী, আমি যাতে ভীষ্মকে বধ করতে পারি, সেইজন্যই পৃথিবীতে বিচরণ করছি। তাই হবে আমার ব্রতের ফল এবং সেই বিষয়েই আমি বিশেষ যত্ন করছি।” তখন গঙ্গা বললেন, “ভাবিনী, তুমি কুটিল আচরণ করছ। সুতরাং তুমি এই কামনার ফল লাভ করতে পারবে না। কাশীরাজকন্যে, তুমি যদি ভীষ্ম বধের জন্য তপস্যা করতে থাকো এবং যদি এই ব্রতে থেকেই দেহত্যাগ করো, তবে তুমি একটা কুটিলা নদী হবে; কেবলমাত্র বর্ষাকালেই তোমাতে জল থাকবে, অপর আট মাস জল থাকবে না, সুতরাং তোমাকে তখন কেউ নদী বলে বুঝতে পারবে না, আর তুমি মন্দতীর্থা হবে এবং ভয়ংকর জলজন্তু থাকায় তুমি সকল প্রাণীরই ভয় জন্মাবে।” ভীষ্মের মাতা গঙ্গাদেবী ঈষৎ হাস্য করেই যেন কোনও অভিপ্রায়ে অম্বাকে এই কথা বলে তারপর নিবৃত্তি পেলেন।

বরবর্ণিনী অম্বা আবার কখনও অষ্টম মাসে আবার কখনও দশম মাসে জল পর্যন্ত পান করতেন না। তীর্থস্নানের জন্য অম্বা পুনরায় বৎসদেশে উপস্থিত হলেন। তিনি বৎসদেশে বর্ষাকাল মাত্র সম্ভবা, জলজন্তুবহুলা, মন্দতীর্থরূপা ও বক্রা ‘অম্বা’ নামে প্রসিদ্ধ একটি নদী হয়ে গেলেন। আপন দেহার্ধে তিনি হলেন নদী, অপর দেহার্ধে অম্বা রূপিণী কন্যাই থাকলেন। সকল তপস্বী অম্বাকে তপস্যার জন্য কৃতনিশ্চয়া দেখে তাঁকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে তপস্যা দ্বারা কী হবে এরূপ প্রশ্ন করলেন। তখন অম্ব তাঁদের জানালেন, “ভীষ্ম। আমাকে প্রত্যাখ্যান করে পতিধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছেন। সেই ভীষ্মকে বধ করার জন্যই আমার এই উদ্যম, কিন্তু স্বর্গের জন্য নয়। আমি ভীষ্মকে বধ করে শান্তি লাভ করব, এই আমার নিশ্চয়। যাঁর জন্য আমি এই চিরন্তন দুঃখভোগ করছি এবং পতিলোক থেকে বিচ্যুত, আমি স্ত্রীও নই এবং পুরুষও নই, সেই ভীষ্মকে বধ না করে আমি তপস্যার নিবৃত্তি ঘটাতে পারছি না। আমি স্ত্রী হতে পারিনি, তাই পুরুষত্ব লাভের প্রতিজ্ঞা করেছি। আপনারা আর আমাকে বারণ করবেন না।”

সেই সময়ে শূলপাণি উমাপতি মহাদেব আপনরূপে এসে অম্বাকে দেখা দিলেন এবং বর প্রার্থনা করতে বললেন। অম্বা ভীষ্মের পরাজয় প্রার্থনা করলেন। মহাদেব সেই মনস্বিনী অম্বাকে আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি ভীষ্মকে জয় করতে পারবে। আমার বাক্য মিথ্যা হবার নয়, তুমি অন্য দেহ লাভ করে পুরুষত্ব লাভ করবে এবং ভীষ্মকে বধ করবে। এই দেহের সমস্ত বিষয়ই তোমার স্মরণ থাকবে। তুমি প্রথমে দ্রুপদ রাজার কুলে কন্যা হয়ে জন্মাবে, পরে শিখণ্ডী নামে, বিচিত্রযোধী ও সকলের স্বীকৃত মহারথ হবে।” এই আশীর্বাদ করে মহাদেব অন্তর্হিত হলেন। অম্বা বন থেকে কাষ্ঠ সংগ্রহ করে, অগ্নি প্রজ্বলিত করে, অত্যন্ত ক্রোধের সঙ্গে “ভীষ্মকে বধ করার জন্য আমি দেহত্যাগ করছি।” এই বলে অগ্নিতে প্রবেশ করলেন।

প্রসিদ্ধ দ্রুপদরাজার প্রিয়তমা ভার্যা অপুত্রা ছিলেন। সেই সময়ে দ্রুপদরাজা পুত্রলাভের জন্য মহাদেবের আরাধনা করেন। “মহাদেব! আমার যেন কন্যা ব্যতীত একটি পুত্র হয়” এই কথা বলে দ্রুপদরাজা ভীষ্ম বধের জন্য ঘোরতর তপস্যা করতে থাকেন। তিনি আরও বলেন, “ভগবন, ভীষ্মের বৈরনির্যাতনের জন্য আমি একটি পুত্র লাভ করবার ইচ্ছা করি।” তখন মহাদেব এসে বললেন, “রাজা, আপনার একটি স্ত্রী-পুরুষ সন্তান জন্মাবে। আপনি তপস্যা থেকে নিবৃত্ত হোন। আমার বাক্য কখনও অন্যরূপ হবে না।” তারপর দ্রুপদরাজা রাজধানীতে ফিরে মহিষীকে এই কথা বললেন, “মহিষী, আমি পত্র লাভের জন্য কঠিন তপস্যা করেছি। তাতে মহাদেব এসে বললেন, “তোমার এমন একটি সন্তান হবে যে সে প্রথমে কন্যা হয়ে পরে পুরুষ হবে।’ আমি জন্মাবধি পুত্রেরই জন্য বারবার প্রার্থনা করলাম, তাতে মহাদেব বললেন, ‘তোমার দৈবই এমন। সুতরাং তার অন্যরূপ হবে না।’

মনস্বিনী দ্রুপদমহিষী ঋতুকালে সংযতা হয়ে দ্রুপদের কাছে গমন করলেন। পরে দ্রুপদরাজের সংসর্গে যথাসময়ে গর্ভলাভ করলেন। মহিষী গর্ভধারণ করলে মহাবাহু দ্রুপদরাজা ভাবী পুত্রের সুখে সেই প্রিয়তমা ভার্যার পরিচর্যা করতে লাগলেন। তারপর দ্রুপদমহিষী যথাসময়ে একটি পরম রূপবতী কন্যা প্রসব করলেন। তখন অপুত্রক দ্রুপদ রাজার মহিষী প্রচার করলেন যে, এটি আমার পুত্র। তারপর দ্রুপদরাজা পুত্রের ভাবে গুপ্তরূপা কন্যাটির সমস্ত পুত্রকার্য করালেন। জাতকর্মাদি সমাপ্ত হলে সকলে সেই সন্তানটিকে ‘শিখণ্ডী’ বলেই জানল। শুধুমাত্র ভীষ্ম গুপ্তচরের মুখে, নারদের বাক্যে এবং মহাদেবের বাক্যশ্রবণে এবং অম্বার তপস্যার বিষয়ে জানায় তাকে কন্যা বলে জানতে পারলেন।

তারপর দ্রুপদরাজা কন্যাটির লোকশিক্ষা ও শিল্পশিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত কার্য যত্ন করতে লাগলেন এবং সেই কন্যাটি ধনুর্বেদে দ্রোণাচার্যের শিষ্য হল। তখন তার মাতা বরবর্ণিনী মহিষী পুত্রের ন্যায়ই তার বিবাহের জন্য রাজার কাছে অনুরোধ করলেন। দ্রুপদরাজাও কন্যাটিকে প্রাপ্তযৌবনা দেখে এবং তাকে স্ত্রী মনে করে ভার্যার সঙ্গে চিন্তান্বিত হলেন। ক্রমে দ্রুপদ বললেন, “আমার এই শোকবর্ধিনী কন্যাটি যৌবনে পদার্পণ করেছে, অথচ আমরা শিবের বাক্য অনুসারে তাকে গুপ্ত রেখেছি।” মহিষী বললেন, “শিবের বাক্য কোনও প্রকারেই মিথ্যা হবে না। কারণ, ত্রিভুবনের সষ্টিকর্তা কেন মিথ্যা বলবেন। অতএব রাজা, আপনার যদি ইচ্ছা হয় আপনি যত্নপূর্বক যথাবিধানে শিখণ্ডীর বিবাহ সম্পাদন করুন। মহাদেবের বাক্য যে সত্য হবে, এ বিষয়ে আমার ধারণা নিশ্চিত আছে।”

তারপর রাজা ও রাজ্ঞী সেই কার্য স্থির করে দশার্ণরাজার কন্যাকে পাত্রী স্থির করলেন। দশার্ণদেশের রাজা ‘হিরণ্যবর্মা’ শিখণ্ডীকে কন্যা দান করলেন। হিরণ্যবর্মা মহাপ্রভাবশালী, অতিদুর্জয়, দুর্ধর্ষ বিশাল সৈন্যসম্পন্ন ও মহামনা ছিলেন। বিবাহ হয়ে গেল। ক্রমে সেই দশার্ণরাজার কন্যা এবং দ্রুপদরাজের কন্যা উভয়েই যৌবনে পদার্পণ করলেন। শিখণ্ডী ভার্যা নিয়ে পুনরায় কাম্পিল্লনগরে ফিরে এলেন। কিছুকাল হিরণ্যবর্মার কন্যা তাকে স্ত্রী বলে জানতে পারল না। তারপর হিরণ্যবর্মার কন্যা তাকে শিখণ্ডিনী বলে জানতে পেরে পিতৃগৃহ থেকে আগত ধাত্রী ও সখীগণকে জানাল যে উনি পাঞ্চালরাজার কন্যা শিখণ্ডিনী। এই কথা শুনে দশার্ণদেশ থেকে আগত সেই ধাত্রীরা অত্যন্ত দুঃখিত হল এবং কয়েকজন দাসীকে দশার্ণরাজের কাছে পাঠিয়ে দিল। দাসীরা সকলে গিয়ে যথাযথভাবে দশার্ণরাজাকে সকল সংবাদ দিল। শুনে দশার্ণরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন।

এদিকে শিখণ্ডী আনন্দিত হয়ে রাজগৃহে পুরুষের ন্যায় বিচরণ করতে লাগল। নিজের স্ত্রীত্ব তার ভাল লাগত না। কিন্তু বিবাহের কয়েকদিন পরেই সেই ঘটনা শুনে হিরণ্যবর্মা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। তারপর দশার্ণরাজ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে দ্রুপদরাজের গৃহে একজন দূত প্রেরণ করলেন। সেই দূত দ্রুপদরাজের কাছে গিয়ে নির্জনে তাকে বলল, “রাজা! দশার্ণাধিপতি আপনাকে এই কথা বলেছেন যে, তুমি আমাকে প্রতারণা করেছ এবং সেই প্রতারণাতে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি। তুমি এখন সেই প্রতারণার ফল লাভ করো; এই আমি পরিজন ও অমাত্যবর্গের সঙ্গে তোমার উচ্ছেদ করছি। তুমি স্থির থাকো। তুমি আমার শক্তি, বংশ ও চরিত্রের প্রতি অবজ্ঞা করে মানুষের মধ্যে অপূর্ব প্রতারণা আমার উপরে করেছ।”

ধৃত চোরের মুখে যেমন কথা আসে না, সেইরকম দ্রুপদরাজার মুখ থেকে কোনও কথা বার হল না। তারপর দ্রুপদরাজা মধুরভাষী দূতগণদ্বারা ‘ও কথা সত্য নয়’ এই সংবাদ পাঠিয়ে বৈবাহিক হিরণ্যবর্মাকে প্রসন্ন করবার গুরুতর চেষ্টা করলেন। কিন্তু হিরণ্যবর্মা পুনরায় সংবাদ নিয়ে শিখণ্ডিনীকে কন্যা বলেই জানলেন। তখন তিনি যুদ্ধযাত্রার জন্য নির্গত হবার ইচ্ছা করলেন। হিরণ্যরাজা ধাত্রীদের বাক্য অনুসারে আপন কন্যার সেই প্রতারণার সংবাদ মিত্ররাজগণের নিকট প্রেরণ করলেন। তারপর রাজশ্রেষ্ঠ হিরণ্যবর্মা সৈন্য সংগ্রহ করে দ্রুপদরাজার বিরুদ্ধে অভিযানের ইচ্ছা করলেন। রাজা হিরণ্যবর্মা মন্ত্রীগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে মন্ত্রণায় স্থির হল যে, শিখণ্ডিনী যে কন্যা, তা যদি সত্য হয় তবে অন্য রাজাকে পাঞ্চালের সিংহাসনে বসিয়ে শিখণ্ডিনী ও দ্রুপদরাজাকে বধ করা হবে।”

দ্রুপদরাজা তখন স্বভাবতই ভীত ছিলেন, তাতে আবার অপরাধও করেছিলেন। সুতরাং তিনি গুরুতর ভয় পেলেন। অত্যন্ত ভয়াবিষ্ট হৃদয়ে ও উদ্বেগতাড়িত হয়ে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ হিরণ্যবর্মার কাছে দূত পাঠিয়ে নির্জনে গিয়ে শিখণ্ডীর মাতা ও আপন প্রিয়তমা ভার্যাকে বললেন, “অতিমহাবল বৈবাহিক হিরণ্যবর্মা সৈন্য নিয়ে ক্রোধে আমাকে আক্রমণ করতে আসছেন। তুমি ও আমি দু’জনেই এই কন্যাটির বিষয় মোহাবিষ্ট ছিলাম। এখন কী করব? তোমার পুত্র শিখণ্ডীও নিজে কন্যা বলে আশঙ্কিত হয়েছে। ওদিকে হিরণ্যবর্মা এই প্রতারণার বিষয় চিন্তা করে ‘আমি প্রতারিত হয়েছি’ এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যত্নপূর্বক মিত্র, সৈন্য ও অনুচরগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে আমার উচ্ছেদ সাধন করবার ইচ্ছা করছেন। সুন্দরী! সুনিতম্বে! এ বিষয়ে কী সত্য, কী মিথ্যা, তা তুমি বলো, তোমার মুখের সেই শুভবাক্য শুনে আমি ন্যায়সংগত কার্য করব। আমি সংশয়াপন্ন হয়েছি এবং এই বালিকা শিখণ্ডিনী এবং তুমি—তোমরাও গুরুতর কষ্ট ভোগ করতে বসেছ। সকলের মুক্তির জন্য তুমি সত্য কথা বলো। আমি তা শুনেই সত্বর কার্য করব। শিখণ্ডিনী, তুমি ভয় পেয়ো না। আমি কৃপা করে সে-বিষয়ে ন্যায্য কার্য করব! বরারোহে! মহিষী! তুমি আমাকে পুত্রধর্ম থেকে বঞ্চিত করেছ। আমি দশার্ণদেশের রাজা হিরণ্যধর্মাকে বঞ্চিত করেছি। অতএব সত্য কথা বলো, সে-বিষয়ে যা হিতকর, আমি তা করব।”

দ্রুপদরাজা সমস্ত বিষয় জেনেও পরের কাছে নিজের নির্দোষিতা প্রকাশের জন্য প্রকাশ্যে মহিষীর কাছে এই কথা বললে, মহিষী দ্রুপদকে বলতে লাগলেন, “রাজা, আমার পুত্র হয়নি বলে আমি সপত্নীদের ভয়ে এইরূপ করেছি, শিখণ্ডিনী কন্যা হয়ে জন্মেছিল, কিন্তু আমি পুরুষ বলে সকলকে জানিয়েছি। আপনিও আমার প্রতি প্রণয়বশত সে-বিষয়ে অনুমোদন করে কন্যাটির পুত্রকর্ম করেছিলেন এবং দশার্ণরাজের পুত্রের সঙ্গে তার বিবাহও দিয়েছেন। ‘প্রথমে কন্যা হয়ে পরে পুরুষ হবে’ এইরূপ মহাদেবের বাক্যের উপর বিশ্বাস করেই আমি সে কথা বলেছিলাম এবং তার বিবাহে উপেক্ষা করেছিলাম।” কী করে বৈবাহিক হিরণ্যবর্মার সঙ্গে গুরুতর যুদ্ধ না হয়, এই ভেবে দ্রুপদরাজা মনে মনে তখন ইষ্টদেবতার পূজা করতে লাগলেন। তখন দ্রুপদকে দেবতাপরায়ণ ও দেবপূজা করতে দেখে তার মহিষী বললেন, “যিনি মঙ্গলে আছেন তাঁরও সর্বদা যথার্থ ফলজনক দেবতাপূজা করা কর্তব্য, তাতে দুঃখসাগরে পতিত ব্যক্তিদের কথা আর কী বলব। অতএব আপনি দেবপূজা ও গুরুপূজা উভয়ই করুন। দশার্ণরাজের নিবারণের জন্য আপনি প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে দেবপূজা করুন এবং অগ্নিতে হোম করুন। আপনি প্রার্থনা করুন যে, দশার্ণরাজ যেন বিনা যুদ্ধে ফিরে যান। দেবতার অনুগ্রহে এ সমস্তই আপনার হবে। পুরুষকারযুক্ত হলেই দৈব সিদ্ধি লাভ করে। কিন্তু দৈব ও পুরুষকার পৃথক পৃথকভাবে করলে, পরস্পর বিরোধবশত কার্যসিদ্ধি হয় না। আপনি মন্ত্রীগণের সঙ্গে মিলিত হয়েই রাজধানী রক্ষাবশত ইচ্ছানুসারে দেবপূজা করুন।”

পিতা-মাতার এই কথোপকথন শুনে শিখণ্ডিনী লজ্জিত হলেন। “আমার জন্যই এঁরা দু’জনে দুঃখভোগ করছেন”—এই ভেবে সে প্রাণত্যাগে ইচ্ছা করল। শোকপরায়ণা শিখণ্ডী এই সিদ্ধান্ত করে গৃহত্যাগপূর্বক নিবিড় নির্জন বনে গমন করল। ‘স্থূণাকর্ণ’ নামক এক সম্পত্তিশালী যক্ষ সেই বনটিকে রক্ষা করত। এই কারণে মানুষ সে বন পরিত্যাগ করে থাকত। বনের ভিতরে স্থূণাকর্ণের বাড়ি ছিল। চুন ও বালি দিয়ে সেই বাড়ি লেপা ছিল, তার প্রাচীর ও তোরণ উচ্চ ছিল এবং তার থেকে বিন্নার মূল, চন্দন ও ধূপের গন্ধ বার হচ্ছিল। শিখণ্ডিনী সেই বাড়িতে প্রবেশ করে বহুদিন যাবৎ ভোজন না করে শরীর শুষ্ক করে ফেলল। একদিন দয়ালু স্থূণাকর্ণ এসে শিখণ্ডিনীকে দর্শন দান করল এবং বলল, “তোমার এ উদ্যম কীসের জন্য? আমি তোমার উদ্যম সফল করব, বলো, বিলম্ব কোরো না।” তখন শিখণ্ডিনী বারবার সেই যক্ষকে বলল, “আপনি আমার উদ্দেশ্য সম্পাদন করতে সমর্থ হবেন না।” তাতে যক্ষ বলল, “আমি সত্বর তা সম্পাদন করব। রাজকন্যা, আমি কুবেরের অনুচর, তাই বরদান করতে সমর্থ। তাই আমি অদেয় বস্তুও তোমাকে দান করতে সমর্থ। সুতরাং তোমার যা প্রার্থনা, তা আমাকে বললো।” তারপর শিখণ্ডিনী সেই যক্ষশ্রেষ্ঠ স্থূণাকর্ণের কাছে সমস্ত বিবরণ অকপটে আনুপূর্বিক বর্ণনা করল। শিখণ্ডী বলল, “যক্ষ, আমার পিতা বিপদাপন্ন হয়েছেন। সুতরাং তিনি অচিরকালমধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবেন। কারণ অত্যন্ত উৎসাহী, স্বর্ণকবচধারী ও ক্রুদ্ধ দশার্ণদেশাধিপতি রাজা হিরণ্যধর্মা আমারই নিমিত্ত তাঁকে ধ্বংস করতে আসবেন। অতএব যক্ষ, আপনি আমাকে, আমার মাতাকে ও পিতাকে রক্ষা করুন। যক্ষ, আপনি আমার দুঃখ নিবারণের আশ্বাস দিয়েছেন। আপনার অনুগ্রহে আমি অনিন্দিত পুরুষ হতে চাই। মহাযক্ষ, সেই দশার্ণরাজ যে পর্যন্ত আমাদের আশ্রম আক্রমণ করতে না আসেন, তার মধ্যে আপনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করুন।”

দৈববিড়ম্বিত সেই যক্ষ শিখণ্ডীর সেই বাক্য শুনে মনে মনে চিন্তা করে বলল, “আমার দুঃখের জন্য তাই হবে। ভদ্রে, আমি তোমার অভীষ্ট পূর্ণ করব। কিন্তু আমার নিয়ম শোনো। আমি কিছুকালের জন্য আমার এই পুংচিহ্ন তোমাকে দান করব। কিন্তু তুমি যথাসময়ে আবার এখানে আসবে। দেখো, আমি লিঙ্গ বিনিময় করতে সমর্থ হব। কেন-না আমি সংকল্পসিদ্ধ, কামাচারী ও আকাশগামী। সুতরাং তুমি আমার অনুগ্রহে কেবল রাজধানী ও বন্ধুগণকে রক্ষা করো। রাজকন্যে, আমি তোমার স্ত্রীচিহ্ন ধারণ করব। তুমি সত্য প্রতিজ্ঞা করো, তা হলে আমি তোমার প্রিয়কার্য করব।” শিখণ্ডী বলল, “ভগবন! সুব্রত! আমি আপনার পুংচিহ্ন ফিরিয়ে দেব। অতএব নিশাচর, আপনি কিছুকালের জন্য আমার এই স্ত্রীচিহ্ন ধারণ করুন। তারপর দশার্ণধিপতি রাজা হিরণ্যবর্মা ফিরে গেলে আমি আবার স্ত্রী হব, আপনিও পুরুষ হবেন।” এই কথা বলে তারা দু’জনেই সে-বিষয়ে শপথ করল এবং পরস্পরের অভীষ্ট লিঙ্গ বিনিময় করল। যক্ষ স্থূণাকর্ণ স্ত্রীচিহ্ন সকল ধারণ করল এবং শিখণ্ডী সেই উজ্জ্বল যক্ষরূপ প্রাপ্ত হল।

তারপর শিখণ্ডীও দ্রুপদরাজার কাছে গিয়ে যথাযথভাবে সেই সমস্ত বৃত্তান্ত বলল। দ্রুপদ অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলেন। দ্রুপদরাজা মহিষীর সঙ্গে মহাদেবের কথা স্মরণ করলেন এবং দশার্ণরাজের নিকট সংবাদ পাঠালেন, “দশার্ণরাজ, আমার এই সন্তান পুরুষ এবং আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন।” তখন দুঃখ ও শোকযুক্ত দশার্ণরাজ দ্রুত দ্রুপদের অভিমুখে যাত্রা করলেন। তারপর তিনি কাপিল্লনগরের কাছে গিয়ে সেই স্থান থেকে একজন শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণকে সম্মানিত করে দ্রুপদরাজার নিকট তাঁকে প্রেরণ করলেন এবং বললেন, “দূত, আপনি আমার বাক্যানুসারে সেখানে গিয়ে এই রাজাধম দ্রুপদকে বলুন, “দুর্মতি, তুমি যে নিজের কন্যার জন্য আমার কন্যাকে গ্রহণ করেছ, সেই প্রতারণার ফল দেখতে পাবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” রাজশ্রেষ্ঠ হিরণ্যধর্মার আদেশে দূত রাজধানীর মধ্যে গমন করলেন এবং দ্রুপদের কাছে উপস্থিত হলেন। তখন দ্রুপদরাজা সম্মান করে সেই ব্রাহ্মণের কাছে শিখণ্ডীর সঙ্গে একটি গোরু ও অর্ঘ্য নিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ সে পূজা গ্রহণ করলেন না এবং বললেন, “বীর ও রাজা হিরণ্যধর্মা যা বলে দিয়েছেন, তা আপনি শ্রবণ করুন—হে জঘন্যাচার! তুমি কন্যা দ্বারা বঞ্চিত করেছ। এখন সেই পাপের ফল ভোগ করো। দুর্মতি রাজা! আজই সমরাঙ্গনে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো। আমি তোমাকে আজই অমাত্য, পুত্র ও বন্ধবর্গের সঙ্গে উৎখাত করব।” দশার্ণরাজের এই তিরস্কারযুক্ত অনেক কথাই পুরোহিত দ্রুপদরাজাকে শোনালেন। তখন দ্রুপদরাজা সৌহার্দ্যবশত অবনত হয়ে বললেন, “ব্রাহ্মণ, আপনি বৈবাহিক মহাশয়ের বাক্য অনুসারে আমাকে যে সকল কথা বললেন, এর উৎকৃষ্ট উত্তর আমার দূত গিয়ে আপনাদের রাজাকে বলবে।”

তারপর দ্রুপদরাজাও মহাত্মা হিরণ্যবর্মার কাছে একজন বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণকে দূত রূপে পাঠালেন। সেই দূত দশার্ণরাজের কাছে গিয়ে দ্রুপদের বক্তব্য বললেন, “রাজা, আপনি প্রকাশ্যভাবে পরীক্ষা করুন, আমার এই সন্তান পুরুষ। সুতরাং এর স্ত্রীত্ব বিষয়ে কেউ আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলেছে। অতএব তা বিশ্বাস করবেন না।” দূতের মুখে এই কথা শুনে বুদ্ধিমান হিরণ্যধর্মা শিখণ্ডী স্ত্রী না পুরুষ তা জানার জন্য কতগুলি সুন্দরী ও চতুরা যুবতীকে শিখণ্ডীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেই যুবতীরা গিয়ে শিখণ্ডীর পুরুষত্ব ও অতিশয় রমণশক্তির বিষয় জেনে এসে আনন্দ সহকারে দশার্ণরাজের কাছে সে সমস্ত বিষয়ই বলল। হিরণ্যবর্মা সেই পরীক্ষার বিষয় শুনে আনন্দিত হলেন এবং বৈবাহিক দ্রুপদরাজের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর গৃহে কয়েকদিন বাস করলেন। তারপরে হিরণ্যবর্মা আনন্দ সহকারে শিখণ্ডীকে প্রচুর ধন, হস্তী, অশ্ব, গো ও দাসী দান করলেন। তারপর সম্মানিত হয়ে আপন কন্যাকে তিরস্কার করে চলে গেলেন। দশার্ণরাজ হিরণ্যধর্মা ক্রোধশূন্য ও সন্তুষ্ট হয়ে চলে গেলে, শিখণ্ডীও অত্যন্ত আনন্দিত হল।

কিছুকাল অতীত হলে, নরবাহন কুবের প্রজা পরিদর্শন করতে করতে স্থূণাকর্ণের ভবন আগমন করলেন। তৃপ্তির সঙ্গে কুবের দেখলেন, যক্ষ স্থূণাকর্ণের ভবনখানি বিচিত্র মাল্য, চন্দ্রাতপ, ধ্বজ ও পতাকা দ্বারা সুন্দর অলংকৃত রয়েছে। উশীর, চন্দন ও ধূপ দ্বারা সৌরভিত করা হয়েছে এবং চর্ব্য, খাদ্য, পেয় ও মাংস আমোদ বিতরণ করছে। তিনি সেই ভবনে প্রবেশ করলেন। স্থূণাকর্ণের ভবনখানি সকল দিকে অলংকৃত, মণি, রত্ন ও সুবর্ণের মালায় পরিপূরিত। নানাবিধ পুষ্পের সৌরভে আমোদিত এবং ধৌত, মার্জিত ও শোভিত দেখে কুবের অনুচরদের বললেন, “অমিতবিক্ৰম যক্ষগণ। স্থূণাকর্ণের এই বাড়িখানি সুন্দর অলংকৃত হয়েছে। অথচ সেই মন্দবুদ্ধি এখনও আমার কাছে আসছে না কেন? আমার আগমন জেনেও যখন সেই মন্দবুদ্ধি আমার কাছে আসছে না, তখন তাকে গুরুতর দণ্ড দান করাই উচিত বলে আমার ধারণা হচ্ছে।

যক্ষগণ বলল, “রাজা, দ্রুপদ নৃপতির শিখণ্ডিনী নামে একটি কন্যা জন্মেছিল, স্থূণাকর্ণ কোনও কারণে তাঁকে নিজের পুংচিহ্ন দান করেছেন এবং তার স্ত্রীলক্ষণসমূহ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং তিনি এখন স্ত্রীর স্বরূপ ধারণ করে স্ত্রী হয়ে গৃহের ভিতরে রয়েছেন। তাই তিনি লজ্জাবশত আপনার কাছে আসতে পারছেন না। এই কথা শুনে যা ন্যায্য হয় তা করুন।” তারপর কুবের বললেন, “তোমরা স্থূণাকর্ণকে এখানে নিয়ে এসো, আমি তাঁকে দমন করব।” তিনি বারবার একই কথা বলতে লাগলেন। তখন স্ত্রীরূপধারী স্থূণাকর্ণ আহূত হয়ে কুবেরের কাছে আগমন করল এবং লজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তখন কুবের অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে অভিসম্পাত করলেন, “যক্ষগণ, এই পাপাত্মার এরূপ স্ত্রীত্বই থাকুক।” তারপর মহাত্মা কুবের বললেন, “পাপবুদ্ধি ও পাপকর্মা স্থূণাকর্ণ! তুমি যখন যক্ষগণের প্রতি অবজ্ঞা করে শিখণ্ডীকে নিজের পুংচিহ্ন দান করেছ এবং তার স্ত্রীচিহ্ন সকল গ্রহণ করেছ, আর অতি দুর্বুদ্ধি, তুমি যখন এই অপূর্ব বিনিময় করেছ, তখন আজ থেকে তুমি স্ত্রী থাকবে এবং শিখণ্ডী পুরুষ থাকবে।” তখন যক্ষেরা স্থূণাকর্ণের জন্য কুবেরকে প্রসন্ন করল এবং বারবার তার শাপের অবসান প্রার্থনা করল। তখন মহাত্মা ও মহামনা কুবের শাপের অবসান করার ইচ্ছায় অনুচর যক্ষগণকে বললেন, “যক্ষগণ, শিখণ্ডী নিহত হলে, যক্ষ স্থূণাকর্ণ আপন রূপ প্রাপ্ত হয়ে নিরুদ্বেগ হবে।” এই কথা বলে যক্ষরাজ কুবের অত্যন্ত সম্মানিত হয়ে নিমেষে সেই স্থান ত্যাগ করলেন।

স্থূণাকর্ণ অভিশপ্ত হয়ে সেই গৃহেই তখন বাস করতে লাগল। শিখণ্ডীও পূর্ব প্রতিশ্রুতি মতো যথাসময়ে সেই স্থূণাকর্ণের কাছে উপস্থিত হল। শিখণ্ডী স্থূণাকর্ণকে বলল, “ভগবন, আমি এসেছি।” শিখণ্ডীর আগমনে প্রীত হয়ে স্থূণাকর্ণ শিখণ্ডীকে বলল, “আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।” রাজপুত্র শিখণ্ডী সরলভাবে এসেছেন দেখে স্থূণাকর্ণ তার কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথভাবে বলল এবং বলল, “রাজপুত্র আপনার জন্যই কুবের আমাকে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছেন। আপনি ইচ্ছানুসারে গমন করুন এবং যথাসুখে সমস্ত জগতে বিচরণ করুন। আমি মনে করি এটা পূর্ববর্তী দৈব। সুতরাং একে অতিক্রম করা আমাদের শক্তিসাধ্য নয়। কারণ, এই স্থান থেকে আপনার গমন এবং কুবেরের এখানে আগমন প্রায় একসময়েই হয়েছিল।”

স্থূণাকর্ণ এই কথা বললে, শিখণ্ডী অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে রাজধানীতে ফিরে এল। তারপর শিখণ্ডী নানাবিধ গন্ধ, মাল্য ও প্রচুর ধন দ্বারা দেবতা ও ব্রাহ্মণগণের পূজা করল এবং যজ্ঞভবন ও চতুষ্পথগুলির শোভা সম্পাদন করল। এইভাবে পাঞ্চাল দেশাধিপতি দ্রুপদরাজা সিদ্ধকাম পুত্র শিখণ্ডী ও বন্ধুবর্গের সঙ্গে পরম আনন্দ লাভ করলেন। তারপর দ্রুপদরাজা শিক্ষালাভ করবার জন্য স্ত্রীরূপে জাত পরে পুত্রদেহ লাভ শিখণ্ডীকে দ্রোণাচার্যের কাছে সমর্পণ করলেন। শিখণ্ডী পাণ্ডব-কৌরবদের সঙ্গে মিলিত হয়ে চতুষ্পাদ ধনুর্বেদ লাভ করল এবং কালে মহারথ হিসাবে পরিগণিত হল।

অম্বা—সাধারণ আলোচনা

শিখণ্ডীর সম্পূর্ণ জীবনকাহিনি পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের কাছে বর্ণনা দিয়েছিলেন। ভীষ্মকে দুর্যোধন সেনাপতি পদে বরণ করলে ভীষ্ম তাঁকে পূর্বশর্ত হিসাবেই বলেছিলেন, তিনি পঞ্চপাণ্ডবকে বধ করবেন না এবং শিখণ্ডীকেও বধ করবেন না। দুর্যোধন শিখণ্ডীকে বধ না করার কারণ জানতে চাইলে ভীষ্ম জানান যে, তিনি স্ত্রী অঙ্গে অস্ত্রের আঘাত করেন না। শিখণ্ডী পূর্বজন্মে স্ত্রী ছিল। সে কাশীরাজের কন্যা অম্বা দেহে জন্মগ্রহণ করেছিল। ভীষ্ম স্বয়ংবরসভার অপহরণের পর অম্বা তাঁকে জানান যে তিনি শাল্বজার বাগদত্তা। ভীষ্ম কর্তব্য স্থির করে ব্রাহ্মণের সঙ্গে অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে প্রেরণ করেন, কিন্তু শারাজা তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন।

এই পর্যায় থেকে অম্বর পরশুরামের আশ্রয়গ্রহণ, পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধের পর অম্বার কঠিন তপস্যা, মহাদেবের কাছে অম্বার বরপ্রাপ্তি, শিখণ্ডিনীরূপে তার দ্রুপদরাজার গৃহে জন্ম, বিবাহ, স্থূণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গবিনিময় ও পুরুষত্বপ্রাপ্তি, দ্রোণাচার্যের কাছে তার অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা, শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়ে মহারথ হিসাবে গণ্য হওয়া— এর প্রতিটি পর্যায় ভীষ্ম গুপ্তচর মারফত নিয়মিত সংবাদ রেখেছেন। শিখণ্ডিনীরূপে তার জন্মগ্রহণ ভীষ্ম জানতেন বলেই দুর্যোধনকে ভীষ্ম বলে দিয়েছিলেন যে, তিনি শিখণ্ডীকে বধ করবেন না।

যুদ্ধের দশম দিনে অর্জুন শিখণ্ডীকে সামনে রেখেই ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তিনি শিখণ্ডীর পিছনে থেকে ভীষ্মকে অস্ত্রাঘাত করে গিয়েছেন। ভীষ্ম শিখণ্ডী সম্মুখে থাকায় প্রত্যাঘাত করতে পারেননি। রথ থেকে শরশয্যায় পতিত হয়েছিলেন। এর মূল্য অর্জুনকেও দিতে হয়েছিল। এই ছলনার কারণে তিনি আমেধিক পর্বে পুত্র বভ্রুবাহনের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত ও মৃত্যুলাভ করেন।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পরেও শিখণ্ডী জীবিত ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধশেষে সৌপ্তিক পর্বে যখন তিনি শিবিরে নিদ্রামগ্ন ছিলেন, তখন কালরূপী অশ্বত্থামা সেই অবস্থায় তাকে হত্যা করেন। শিখণ্ডর মৃত্যুর পর স্থূণাকর্ণ তাঁর পৌরুষ লাভ করেন। প্রত্যাখ্যাতা রমণীর প্রতিশোধস্পৃহা কতদূর যেতে পারে, অম্বা-শিখণ্ডীর কাহিনি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। ভীষ্মের জীবনের দৈবও ফলল। যে স্ত্রীজাতিকে তিনি সমস্ত জীবন অস্বীকার করে এসেছেন, সেই স্ত্রীজাতির প্রতিনিধিই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল। প্রত্যাখ্যাত অম্বার জীবনের অন্ধকারও শিখণ্ডী জীবনে ঘুচল না। তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হলেন বটে, কিন্তু তার মৃত্যুও ঘটল অন্ধকারে, নিদ্রামগ্ন অবস্থায়। মানবের জীবনে দৈব কতখানি অলঙঘ্য তা অম্বা-শিখণ্ডীর কাহিনির মাধ্যমে ব্যাসদেব পাঠককে বুঝিয়ে দিয়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *