১৫. তিলোত্তমা সম্ভব

তিলোত্তমা সম্ভব

পূর্বকালে মহাসুর হিরণ্যকশিপুর বংশে তেজস্বী ও বলবান নিকুম্ভ নামে এক মহাদৈত্য জন্মেছিল। সেই নিকুম্ভের সুন্দ ও উপসুন্দ নামে দুই পুত্র জন্মেছিল, তারা অত্যন্ত বলবান, ভয়ংকর পরাক্রমশালী, ভীষণ প্রকৃতি ও নিষ্ঠুরচিত্ত ছিল।

তারা অভিন্নমনা ছিল, সর্বদাই একরূপ কর্তব্য স্থির করত, একই কার্যে উভয়েই সম্মত হত এবং উভয়ের সমান সুখ ও সমান দুঃখ ছিল। তারা পরস্পর মিলিত না হয়ে ভোজন করত না, গমন করত না এবং পরস্পর পরস্পরের প্রিয় কার্য করত ও প্রিয় কথা বলত। তাদের স্বভাব ও আচরণ একরকম ছিল, সুতরাং বিধাতা যেন একটিকেই দুটি করে সৃষ্টি করেছিলেন। কার্যে একমতাবলম্বী ও মহাবীর সেই সুন্দ ও উপসুন্দ ক্রমে বড় হয়ে উঠল।

তারপর তারা ত্রিভুবন জয় করবার জন্য একমত ও একনিশ্চয় হয়ে দীক্ষা গ্রহণ করে, বিন্ধ্যপর্বতে গিয়ে ভয়ংকর তপস্যা করতে লাগল। তারা জটা ও বল্কল ধারণ করে ক্ষুধা ও পিপাসায় কাতর থেকে, দীর্ঘকাল তপস্যা করবার উপযুক্ত ক্ষমতাশালী হয়ে পড়ল। তারা কেবলমাত্র বায়ুভক্ষণ করে, আপনাদের মাংস দ্বারা হোম করতে থেকে, কেবল পাদাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা ভূতলে অবস্থানপূর্বক উৰ্ববাহু ও নির্নিমেষ নয়ন হয়ে দীর্ঘকাল তপস্যা করল; তখন তাদের অঙ্গে মল জমা হয়েছিল।

তাদের তপস্যার প্রভাবে দীর্ঘকাল সন্তপ্ত হতে থাকায় বিন্ধ্যপর্বত ধূমোদগার করতে লাগল, সে-ঘটনা যেন অদ্ভুত হতে থাকল। তারপর তাদের ভয়ংকর তপস্যা দেখে দেবতারা ভীত হয়ে পড়লেন। তাই তারা তাদের তপোভঙ্গের জন্য বিঘ্ন করতে লাগলেন। দেবতারা নানাবিধ মণি, রত্ন ও যুবতী স্ত্রী দ্বারা তাদের প্রলুব্ধ করলেন, কিন্তু তারা দৃঢ়তপস্বী হয়েছিল বলে তপোভঙ্গ করল না। তারপর দেবতারা আবার তাদের উপর মায়াপ্রকাশ করলেন— শূলধারী কোনও রাক্ষস তাদের মাতা, ভগিনী ও ভার্যা এবং দাসীপ্রভৃতি পরিজনদের এনে তাদের একেবারে বিবস্ত্র করে আঘাত করতে থাকল। তাদের চুলের অলংকার খুলে পড়তে লাগল এবং তারা ভূতলে লুণ্ঠিত হতে লাগল। তখন সেই সমস্ত স্ত্রীলোক সুন্দ ও উপসুন্দকে সম্বোধন করে “রক্ষা করো, রক্ষা করো” বলে চিৎকার করতে লাগল। তথাপি তারা তপস্যা ভঙ্গ করল না। যখন তাদের মধ্যে কেউই ক্ষুব্ধ বা দুঃখিত হল না, তখন সেই সকল স্ত্রীলোক ও রাক্ষস অন্তর্হিত হল। তারপর সমস্ত লোকের হিতৈষী ও প্রভাবশালী ব্ৰহ্মা তাদের সমক্ষে গিয়ে বরদান করবেন জানিয়ে তাদের সন্তুষ্ট করলেন। তপস্যাতেও দৃঢ়শক্তিশালী সুন্দ ও উপসুন্দ দুই ভ্রাতা ব্রহ্মাকে দেখে তখনই কৃতাঞ্জলি হয়ে অবস্থান করতে লাগল। তখন তারা সম্মিলিতভাবেই ব্রহ্মাকে বলল, “এই তপস্যা দ্বারা আমাদের উপর যদি আপনি সন্তুষ্ট ও প্রসন্ন হয়ে থাকেন, তবে আমরা দু’জনেই যেন মায়াবিৎ অস্ত্রবিৎ, বলবান, কামরূপী ও অমর হতে পারি।” ব্রহ্মা বললেন, “অমরত্ব ব্যতীত অন্য যা বললে, সে সমস্তই তোমাদের হতে পারবে, সুতরাং তোমরা মৃত্যু বিষয় ছাড়া দেবতার তুল্য অন্য সমস্ত প্রভাবই বরণ করতে পারো। ‘আমরা ত্রিভুবনের প্রভু হব’ এই উদ্দেশ্য করেই যেহেতু তোমরা গুরুতর তপস্যা করেছ, সেই হেতুই তোমাদের অমরত্ব বিধান করব না। তোমরা ত্রিভুবন জয় করবার জন্যই তপস্যা করেছ, এই কারণেই তোমাদের অভীষ্ট অমরত্ব বিষয়ে বর দেব না।”

সুন্দ ও উপসুন্দ বলল, “পিতামহ, ত্রিভুবনের মধ্যে স্থাবর ও জঙ্গম যা-কিছু প্রাণী আছে, আমাদের পরস্পর ছাড়া সে সকল প্রাণী থেকে আমাদের ভয় হবে না (এই বর দিন)।” ব্রহ্মা বললেন, “তোমরা যা প্রার্থনা করলে বা বললে, তা তোমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণেই দিলাম, তোমাদের মৃত্যু যেভাবে তোমরা চেয়েছ, সেভাবেই হবে।” ব্রহ্মা তাদের এই বর দিয়ে এবং তপস্যা থেকে তাদের নিবৃত্ত করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন।

দৈত্যশ্রেষ্ঠ দুই ভ্রাতাও বর লাভ করে সমস্ত জগতের অবধ্য হয়ে আপন ভবনেই চলে গেল। তারা বর লাভ করে পূর্ণ মনোরথ হয়ে এসেছে দেখে তাদের বন্ধুবর্গ অত্যন্ত আনন্দ লাভ করল। তারপর তারা জটা খুলে বাবরি করল এবং মহামূল্য অলংকার ও নির্মল বস্ত্র পরিধান করল। আর পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাকে সমস্ত সময় রেখে দিল। তাতে তাদের বন্ধুরা সর্বদার জন্য আনন্দিত হল। “ভক্ষণ করো, ভোজন করো, পান করো, দান করো, গান করো এবং আবাস করো” এইরূপ শব্দ ঘরে ঘরে সর্বদাই হতে লাগল। যেখানে সেখানে বিশাল আনন্দ কোলাহল, আমোদের আহ্বান এবং আনন্দ করতলধ্বনি দ্বারা দৈত্য নগরীটি পরিপূর্ণ হতে লাগল, তাতেই বোঝা যেতে লাগল যে পুরবাসী সকলেই হৃষ্ট ও আমোদিত হয়েছে। কামরূপী দৈত্যরা সেইভাবে আমোদ করতে থাকলে, তাদের সেই নানাবিধ উৎসবের অনেক বৎসরও যেন একটি দিনের মতো চলে গেল।

উৎসব সমাপ্ত হবার পর সুন্দ ও উপসুন্দ মন্ত্রণা করে ত্রিভুবন জয় করার ইচ্ছায় সৈন্যগণকে সজ্জিত হবার আদেশ দান করলেন। তারপর বন্ধুগণ ও মন্ত্রীগণের অনুমতিক্রমে তারা যাত্রাকালীন মঙ্গল আচরণ করে রাত্রিতে মঘানক্ষত্রে যাত্রা করল। তারা গদা, পট্টিশ, শূল, মুগুর ও বর্মধারী বিশাল দৈত্যসৈন্যের সঙ্গে প্রস্থান করল। এই সময়ে স্তুতিপাঠকেরা জয় ইচ্ছা করে মাঙ্গলিক স্তুতি দ্বারা তাদের স্তব করতে লাগল, এই অবস্থায় তারা পরমানন্দে প্রস্থান করল।

কিছু পরেই যুদ্ধ-দুর্ধর্ষ ও কামগামী সুন্দ ও উপসুন্দ আকাশে উঠে দেবলোকে চলে গেল। তারপর দেবতারা তাদের আগমন শুনে এবং ব্রহ্মার সেই বরদান স্মরণ করে, স্বর্গলোক পরিত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। তখন মহাবিক্রমশালী সুন্দ ও উপসুন্দ স্বর্গলোক, যক্ষগণ, রাক্ষসগণ এবং আকাশচর প্রাণীগণকে জয় করে চলে গেল। তারা পাতালবাসী নাগদের জয় করে সমুদ্রতীরবাসী সমস্ত ম্লেচ্ছ জাতিকে জয় করল। তারা ভয়ংকর শাসন প্রচার করে সমস্ত পৃথিবী জয় করতে আরম্ভ করে সৈন্যগণকে ডেকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বাক্যে বলল, “রাজর্ষি মহাযজ্ঞ দ্বারা এবং ব্রাহ্মণেরা হব্যকব্য দ্বারা দেবগণের তেজ, বল ও সম্পদ বৃদ্ধি করে থাকে। অতএব আমাদের সকলেরই সম্মিলিতভাবে সেই অসুরদ্বেষী রাজর্ষি প্রভৃতির সর্বপ্রযত্নে বধ করা উচিত।”

এইভাবে সকলকে আদেশ করে সুন্দ ও উপসুন্দ মহাসমুদ্রের পূর্বতীরে গিয়ে নিষ্ঠুর বুদ্ধি অবলম্বন করে সকল দিকে বিচরণ করতে লাগল। যে-কেউ যজ্ঞ করছিলেন এবং যে-সকল ব্রাহ্মণ যজ্ঞ চালাচ্ছিলেন, তাদের বলপূর্বক হত্যা করে সেই সেই স্থান থেকে চলে যেতে লাগল। আর তাদের সৈন্যরা জিতেন্দ্রিয় মুনিগণের আশ্রমে প্রবেশ করে তাঁদের অগ্নিহোত্রের সমস্ত বস্তু নিয়ে নির্ভয়ে জলে ফেলে দিতে লাগল। তপস্বীরা ক্রুদ্ধ হয়ে যে-সকল অভিসম্পাত করতেন, সেগুলিও ব্রহ্মার বরে তাদের আক্রমণ করতে পারত না। যখন পাথরের উপর নিক্ষিপ্ত বাণের মতো সেই অভিসম্পাতগুলি তাদের কিছুই করতে পারত না, তখন ব্রাহ্মণরা নিয়ত কাৰ্যসকল পরিত্যাগ করে পালিয়ে যেতেন। পৃথিবীতে জিতেন্দ্রিয় ও শমগুণান্বিত যে-সকল তপস্বী ছিলেন, তাঁরা গরুড়ের ভয়ে সর্পগণের মতো সুন্দ ও উপসুন্দের ভয়ে পালাতে লাগলেন। তারা মুনিগণের আশ্রমগুলিকে মথিত ও ভগ্ন করে সেখান থেকে কলম, স্রুক, স্রুব (হোমের উপকরণ বিশেষ) দ্রব্যগুলিকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করত। তখন সমস্ত জগৎই কালনিহত হয়েই যেন শূন্য হয়ে গেল। রাজর্ষি ও মহর্ষিরা অদৃশ্য হয়ে যেতেন বলে সুন্দ ও উপসুন্দ তাদের হত্যা করার ইচ্ছায় সর্বত্র অন্বেষণ করত। তারা মদমত্ত হস্তীর রূপ ধারণ করে গুপ্তস্থানে লুক্কায়িত লোককেও বার করে যমালয়ে প্রেরণ করত। নিষ্ঠুর প্রকৃতি সুন্দ ও উপসুন্দ একবার সিংহ হয়ে, আবার ব্যাঘ্র হয়ে, পুনরায় লুকিয়ে থেকে সেই সেই উপায়ে মুনিগণকে দেখেই হত্যা করত। তখন পৃথিবীতে যজ্ঞ ও বেদপাঠ নিবৃত্ত হল, রাজা ও ব্রাহ্মণ লুপ্ত হল এবং উপনয়ন প্রভৃতি উৎসবকার্য তিরোহিত হল। সর্বত্র হাহাকার হতে লাগল, অবশিষ্ট লোকেরা ভয়ার্ত হয়ে পড়ল, হাটে আর ক্রয়বিক্রয় থাকল না। দেবকার্য উঠে গেল, পুণ্যকার্য ও বিবাহাদি কার্য তিরোহিত হল। কৃষি ও গোরক্ষা নিবৃত্তি পেল, নগর ও আশ্রমগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এবং অস্থিকঙ্কালে পরিপূর্ণা পৃথিবী ভয়ংকরদর্শনা হয়ে পড়ল। পিতৃকার্য উঠে গেল এবং যাজ্ঞিকমণ্ডলে আর স্বাহাবষট্‌কারাদি থাকল না। তখন সমস্ত জগৎ ভয়ংকর মূর্তি হয়ে দুপ্রেক্ষ্য হয়ে পড়ল। ওদিকে চন্দ্র, সূর্য, অন্যান্য গ্রহ, সপ্তর্ষিমণ্ডল, অশ্বিনী প্রভৃতি নক্ষত্র এবং দেবগণ সুন্দ ও উপসুলের সেই কার্য দেখে বিষাদমগ্ন হলেন। এইভাবে সুন্দ ও উপসুন্দ নিষ্ঠুর ব্যবহারে সমস্ত দিক জয় করে, শত্রুশূন্য হয়ে কুরুক্ষেত্রে রাজধানী স্থাপন করল।

তারপর দেবর্ষিগণ ও সিদ্ধ মহর্ষিগণ জগতের সেই গুরুতর দুরবস্থা দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। তখন ক্রোধবিজয়ী, সংযতচিত্ত ও জিতেন্দ্রিয় সেই মহর্ষিরা জগতের উপর দয়াবশত ব্রহ্মলোক গমন করলেন। তাঁরা সেখানে গিয়ে দেখলেন, ব্রহ্মা দেবগণের সঙ্গে বসে আছেন। আর তাকে পরিবেষ্টন করে ব্রহ্মর্ষিরা অবস্থান করছেন। সেখানে শিব, অগ্নি, বায়ু, চন্দ্র, সূর্য, শুক্র এবং ব্রহ্মার মানসপুত্র মরীচি প্রভৃতি ঋষিরাও অবস্থান করছিলেন। তখন বৈখানস, বালখিল্য, বানপ্রস্থ, মরীচিপায়ী, বিষ্ণুপাসক ও মোহশূন্য ব্রহ্মচিন্তকগণ, এরা সকলেই ব্রহ্মার কাছে গেলেন। সেই মহর্ষিরা কাতর হয়ে সকলেই ব্রহ্মার কাছে গিয়ে সুন্দ ও উপসুন্দের সমস্ত কার্যই বললেন। তারা যেভাবে ত্রিভুবনের রাজ্য হরণ করেছিল এবং যেভাবে ও যে ক্রমে তা করেছিল, সে-সমস্তই তারা ব্রহ্মাকে জানালেন। তারপর দেবগণ ও মহর্ষিগণ প্রধানভাবে সুন্দ ও উপসুন্দের অত্যাচার উল্লেখ করে তার প্রতিকারের জন্য ব্রহ্মাকে প্রণোদিত করলেন।

তখন ব্রহ্মা তাঁদের সকলের কথা শুনে একটুকাল কর্তব্য নির্ধারণের বিষয় চিন্তা করে সুন্দ ও উপসুন্দ বধের উদ্দেশ্যে বিশ্বকর্মাকে আহ্বান করলেন এবং বিশ্বকর্মা এসেছেন দেখে তাঁকে আদেশ করলেন, “বিশ্বকর্মা, সকলের প্রার্থনীয়া হয়, এমন একটি রমণী তুমি সৃষ্টি করো।” তখন বিশ্বকর্মা ব্রহ্মাকে নমস্কার করে এবং তাঁর বাক্যের প্রশংসা করে, চিন্তাপূর্বক বিশেষ যত্ন সহকারে একটি অলৌকিক রমণী সৃষ্টি করলেন। সর্বজ্ঞ বিশ্বকর্মা ত্রিভুবনের মধ্যে স্থাবর ও জঙ্গমাত্মক প্রাণীগণের যা-কিছু মনোহর উপাদান ছিল, সে সমস্তই সেই রমণীর জন্য আনয়ন করলেন এবং তার অঙ্গে কোটি কোটি রত্ন সন্নিবেশিত করলেন; এইভাবে তিনি সেই রমণীটিকে সর্বরত্নময়ী এবং দেবদর্পিণী করে সৃষ্টি করলেন। বিশ্বকর্মার গুরুতর চেষ্টায় নির্মিত সেই রমণীটি ত্রিভুবনের সমস্ত রমণীর মধ্যে রূপে অতুলনীয়া হল। কেন-না তার শরীরে এমন সূক্ষ্ম স্থানও ছিল না, যাতে দ্রষ্টৃবর্গের দৃষ্টি রূপরাশির গুণে সংলগ্ন না হত।

কামরূপিণী ও মনোহরাঙ্গী সেই রমণী মূর্তিমতী লক্ষ্মীর ন্যায় ব্রহ্মার নিকটে গিয়ে বলল, “আমি কী করব।” ব্রহ্মা তাকে দেখে আনন্দিত হয়ে স্নেহবশত তাকে এই বর দিলেন, “তুমি সমস্ত প্রাণীর মধ্যে অধিক কমনীয়তা লাভ করো এবং তোমার দেহখানি সৌন্দর্যের গুণে সর্বোৎকৃষ্ট হোক।” ব্রহ্মার সেই বরদানে এবং বিশ্বকর্মার নির্মাণের গুণে সে রমণী তখন সকল প্রাণীর নয়ন ও মন হরণ করল। বিশ্বকর্মা ত্রিভুবনের মধ্যে উৎকৃষ্ট বস্তুর তিল তিল এনে যেহেতু তাকে নির্মাণ করেছিলেন, সেই হেতু ব্রহ্মা তার নাম দিলেন “তিলোত্তমা”। সেই তিলোত্তমা ব্রহ্মাকে নমস্কার করে কৃতাঞ্জলি হয়ে বলল, “প্রজানাথ! আমার দ্বারা আপনাদের কী কার্য সম্পন্ন হবে? আমাকে কেন সৃষ্টি করলেন?”

তখন ব্রহ্মা বললেন, “তিলোত্তমা, তুমি গিয়ে সুন্দ ও উপসুন্দের প্রার্থনীয় এই রূপ দ্বারা তাদের প্রলোভন জন্মাও। যাতে তোমার দর্শনের পর তোমার রূপরাশিকৃত পরস্পর বিদ্বেষ দ্বারা তোমার জন্য তাদের পরস্পর বিরোধ উপস্থিত হয়, তা করো।” “তাই হবে” এই প্রতিজ্ঞা করে এবং ব্রহ্মাকে নমস্কার করে তিলোত্তমা মণ্ডলাকারে দেবগণের প্রদক্ষিণ করতে লাগল। তখন ব্রহ্মা পূর্বমুখ হয়ে, শিব দক্ষিণমুখ হয়ে এবং অন্যান্য দেবতারা উত্তরমুখ করে বসেছিলেন, আর ঋষিরা তাঁদের সকলদিকেই ছিলেন। তিলোত্তমা মণ্ডলাকারে প্রদক্ষিণ করতে থাকলে, শিব এবং ইন্দ্র কিছুকাল ধৈর্য অবলম্বন করে রইলেন; কিন্তু ব্রহ্মা তাকে দেখবার জন্য অত্যন্ত অভিলাষী হলেন। সুতরাং সে যখন তার দক্ষিণ পার্শ্বে গেল, তখন তাঁর দক্ষিণ মুখ জন্ম নিল এবং সেই মুখের পদ্মতুল্য নয়ন দুটি গিয়ে তার উপর পড়ল। এবং তিলোত্তমা পিছন দিকে গেলে ব্রহ্মার পিছনের মুখ জন্ম নিল, আবার সে উত্তরদিকে গেলে, তার উত্তরদিকের মুখ প্রকাশিত হল। এইভাবে ব্রহ্মা চতুরানন হয়ে গেলেন। তারপর ইন্দ্রেরও পিছন থেকে, পার্শ্বদ্বয় থেকে এবং সম্মুখ থেকে এক সহস্র বিশাল নয়ন নির্গত হল। এই কারণে পূর্বকালে ব্রহ্মা চতুর্মুখ, শিব স্থাণু এবং ইন্দ্র সহস্রমুখ হয়েছিলেন। আর প্রদক্ষিণ করার সময়ে তিলোত্তমা যে-যে দিকে যেতে লাগল, সেই-সেই দিকেই দেবগণ ও মহর্ষিগণের মুখ সর্বপ্রকারে পরিবর্তিত হতে থাকল। এবং সেই মহাত্মাদের সকলের দৃষ্টিই ফিরে ফিরে তিলোত্তমার অঙ্গে গাঢ় সংলগ্ন হতে লাগল, কিন্তু ব্রহ্মার তা হল না। দেবতা ও মহর্ষিরা মনে করতে লাগলেন যে, তিলোত্তমার অপূর্ব রূপরাশির প্রভাবে সুন্দ ও উপসন্দের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ অনিবার্য। তারপর তিলোত্তমা চলে গেলে ব্রহ্মা সকল দেবতা ও উপস্থিত ঋষিদেরও বিদায় দিলেন।

সুন্দ ও উপসুন্দ সমগ্র পৃথিবী জয় করে শত্রুশূন্য ও আনন্দিত হয়ে এবং পৃথিবীকে স্ববশে আনতে কৃতকার্য হয়েছিল। তারা দেব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, নাগ ও ভূপালগণের সর্বপ্রকার রত্ন আত্মসাৎ করে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করেছিল। যখন ত্রিভুবনের মধ্যে কোনও লোকই তাদের প্রতিপক্ষ ছিল না, তখন তারা যুদ্ধের উদ্যোগ ত্যাগ করে দেবতার ন্যায় বিহার করতে লাগল। স্ত্রী, গন্ধ, মাল্য, প্রচুর খাদ্য এবং নানাবিধ পেয় বস্তু দ্বারা অত্যন্ত আনন্দ করতে লাগল। তারা অন্তঃপুরের সরোবরে ও উদ্যানে, পর্বতে ও বনে এবং অন্যান্য অভীষ্ট স্থানে দেবতার তুল্য বিহার করতে লাগল। তারপরে তারা কোনও সময়ে বিন্ধ্যপর্বতের সমতলে পুষ্পশোভিত শালবনে বিহারসুখ অনুভব করতে লাগল। অনুচরগণ সর্বপ্রকার উৎকৃষ্ট বস্তু আনয়ন করলে, তারা আনন্দিত হয়ে স্ত্রীদের সঙ্গে মনোহর আসনে উপবেশন করল। তারপর রমণীরা তাদের স্তুতিবাচক গান, বাদ্য ও নৃত্য দ্বারা তাদের সন্তুষ্ট করল এবং তাদের সঙ্গে সম্ভোগপূর্বক সঙ্গম করল।

তখন তিলোত্তমা একখানি রক্তবর্ণ বস্ত্র দ্বারা পুরুষের চিত্তাকর্ষক বেশ ধারণ করে, সেই বনে পুষ্পচয়ন করতে থেকে নদীতীরজাত স্থলপদ্ম চয়ন করতে করতে ধীরে ধীরে যেস্থানে সুন্দ ও উপসন্দ অবস্থান করছিল সেই স্থানে উপস্থিত হল। এদিকে সুন্দ ও উপসুন্দ উত্তম সুরা পান করে, মদে আরক্তনয়ন হয়ে ছিল; তারা তিলোত্তমাকে দেখেই কামপীড়িত হয়ে পড়ল। তাই আসন পরিত্যাগ করে উঠে যেখানে তিলোত্তমা ছিল সেইখানে গেল, দু’জনেই কামমত্ত ছিল বলে দু’জনেই তিলোত্তমাকে প্রার্থনা করল। সুন্দ আপন হস্তে তিলোত্তমার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করল, আর উপসুন্দ তার বামহস্ত ধারণ করল। তারপরে ব্রহ্মার বরদানের মত্ততা, কায়িক বলের মত্ততা, ধন ও রত্নের মত্ততা—এতগুলি মত্ততা দ্বারা অত্যন্ত মত্ত সুন্দ ও উপসুন্দ তারপরে আবার কামমত্ত হয়ে, পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভ্রুকুটি করতে থেকে, পরস্পর পরস্পরকে বলল। সুন্দ বলল, “আমার ভার্যা তো তোমার কাছে মাতার তুল্য।” উপসুন্দও বলল, “আমার ভার্যা তো তোমার কাছে পুত্রবধূর তুল্য।” তারপর তারা বলল, “এ তোমার নয় এ আমারই। তখন তারা তিলোত্তমার রূপে অত্যন্ত মত্ত হয়েছিল বলে তাদের স্নেহ ও ভালবাসা অন্তর্হিত হয়েছিল, এবং তারা অত্যন্ত ক্রোধে অভিভূত হয়ে পড়েছিল।

তখন তারা দু’জনেই তিলোত্তমাকে নেবার জন্য ভয়ংকর গদা ধারণ করল এবং ‘আমি আগে নেব, আমি আগে নেব’—এইরূপ বলতে থেকে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল। সেই আঘাতে দুজনের শরীরই রক্তাক্ত হয়ে গেল। তখন ভয়ংকরাকৃতি সেই সুন্দ ও উপসুন্দ গগনচ্যুত দুটি সূর্যের ন্যায় ভূতলে পতিত হল।

তখন সেই রমণীরা পলায়ন করল এবং সেই অনুচর দৈত্যগণও বিষাদে ও ভয়ে কম্পিত হয়ে সকলেই পাতালে চলে গেল। তখন নির্মলচিত্ত ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে সম্মানিত করার জন্য দেবগণ ও মহর্ষিগণের সঙ্গে সেখানে আগমন করলেন। ভগবান ব্রহ্মা সন্তুষ্ট হয়ে বর দিয়ে তিলোত্তমাকে সন্তুষ্ট করলেন। তিনি বর দিতে ইচ্ছা করে তিলোত্তমাকে বললেন, “তিলোত্তমা, তুমি সূর্যলোকে বিচরণ করবে, কিন্তু সেখানেও কোনও লোকই তোমার তেজের প্রভাবে তোমাকে ভাল করে দেখতে সমর্থ হবে না।”

আদিত্যচরিতলোকান বিচরিস্যসি ভাবিনি।

তেজসা চ সুদৃষ্টাং ত্বাং ন করিস্যতি কশ্চন ॥ আদি : ২৫০: ২৫ ॥

ব্রহ্মা তিলোত্তমাকে এই বর দিয়ে এবং ইন্দ্রকেই আবার ত্রিভুবনের রাজা করে ব্রহ্মলোকে চলে গেলেন। এইভাবে সুন্দ ও উপসুন্দ সম্মিলিত ও সমস্ত বিষয়ে একমত হয়েও তিলোত্তমার জন্য পরস্পর ক্রুদ্ধ হয়ে পরস্পরকে বধ করেছিল।

***

তিলোত্তমার কাহিনি নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন। সদ্যবিবাহিত পঞ্চভ্রাতার মধ্যে দ্রৌপদীকে কেন্দ্র করে পাছে কোনও বিবাদ উপস্থিত হয়—তা রোধ করাই ছিল এই কাহিনি বর্ণনার উদ্দেশ্য। এ-কাহিনির কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। প্রথমত রূপবতী নারীর পুরুষের ক্ষেত্রে কী দুর্বার আকর্ষণীয় তা প্রতিপাদন করা। তিলোত্তমা সুন্দ ও উপসুন্দের সঙ্গে একটি শব্দও বিনিময় করেনি। কোনও অপাঙ্গ দৃষ্টিপাতে সে দু’জনের কাউকে বিচলিত করেনি। তার উপস্থিতিতেই সুন্দ ও উপসুন্দের মনে ভূমিকম্প ঘটেছিল। তাদের বিশ্ববিশ্রুত সৌভ্রাত্র তারা বিস্মৃত হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত বরদানকালে প্রজাপতি ব্রহ্মার অপূর্ব মনস্তত্ত্বজ্ঞান। তিনি এদের ধ্বংসের উপায় দেখেছিলেন। “তারা পরস্পর পরস্পরকে বধ করবে”— এই বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর তিনি বরদান করেছিলেন।

তিলোত্তমা অযোনিসম্ভূতা। দেবশিল্পীর হাতে গড়া অপূর্ব নারীমূর্তি। যদিও তার জন্ম ব্রহ্মার কল্পনায়। দ্রৌপদীও অযোনিজা। তিনি অলোকসামান্য রূপের অধিকারিণী। তিলোত্তমা সুন্দ ও উপসুন্দকে ধ্বংস করেছিলেন— দ্রৌপদী ধ্বংস করেছিলেন সম্পূর্ণ ধৃতরাষ্ট্রের বংশকে। ব্যাসদেব দ্রৌপদীকে স্বাভাবিক মর্তমানবীর মৃত্যু দিয়েছিলেন— তিলোত্তমা সূর্যলোকবাসিনী চিরঅমরা স্বৰ্গবেশ্যা।

তিলোত্তমা কাহিনির মধ্যে অজস্র নাটকীয় উপাদান আছে। ভারতীয় সাহিত্যে তাঁকে নিয়ে কাব্য নাটকাদি রচিত হয়েছে। নারী কী পারে, পুরুষের কাছে তার প্রভাব কী অলঙ্ঘনীয়, তিলোত্তমা তার প্রমাণ। ইতিহাসে এমন দু’-একটি উদাহরণ আছে। ক্লিয়োপেট্রা এই জাতীয় নারী। রবীন্দ্রনাথ ঊর্বশীর বর্ণনায় বলেছিলেন— নহ মাতা নহ কন্যা, নহ বধূসুন্দরী— সে নিত্যই নারী। গী দ্য মোপাসাঁর ‘লা মারলিনো’ বলে একটা ছোট গল্প আছে। এই গল্পের নায়িকা লা মারলিনো (কালো আঙুর) দেখিয়েছিল, তার রূপের প্রভাব মনুষ্যজগৎ ছাড়িয়ে পশু জগতের মধ্যেও কেমন ছড়িয়ে পড়েছিল।

তিলোত্তমার রূপের প্রভাব শ্রেষ্ঠ দেবতাদের মধ্যেও পড়েছিল। ব্রহ্মা চতুরানন হলেন, ইন্দ্র হলেন সহস্রাক্ষ, শিব হলেন স্থাণু। দেবর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, মহর্ষিরা হলেন অতিমাত্রায় বিচলিত। এরপর সুন্দ উপসুন্দের পরিণতি পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারে।

***

পাণ্ডব ভ্রাতাদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ছিলই। কিন্তু নারদ-কথিত তিলোত্তমা সম্ভব কাহিনি দ্রৌপদী সম্পর্কে পাণ্ডবদের আরও দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করেছিল। অর্জুনের প্রতি প্রচ্ছন্ন অনুরাগ থাকলেও দ্রৌপদী পঞ্চস্বামীর ক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে পালন করেছিলেন। তিলোত্তমা সম্ভব কাহিনি পাণ্ডবদের দাম্পত্য জীবনের রীতি স্থির করে দিয়েছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *