১৩. পতিব্রতা-হিড়িম্বা— সাধারণ আলোচনা

পতিব্রতা হিড়িম্বা—সাধারণ আলোচনা

হিড়িম্বর জীবনকাহিনি আমরা কুন্তীর জীবনকাহিনি বর্ণনার শেষে সবিস্তারে বর্ণনা করেছি। এর কারণ হল হিড়িম্বাই সেই একমাত্র নারী, যাঁর প্রণয় পরিণয়, সন্তানের জন্মদান সবকিছুই কুন্তীর উপস্থিতিতেই ঘটেছে। পঞ্চপাণ্ডব দ্রৌপদী ছাড়াও অন্য রমণীকে বিবাহ করেছিলেন। কিন্তু এর কোনোটিই কুন্তীর উপস্থিতিতে ঘটেনি।

হিড়িম্বা প্রথম পাণ্ডববধূ। অথচ তিনি জাতিতে মানব নন, রাক্ষসী। যদিও মানব রূপেই তিনি ভীমসেনকে দেখা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথাও তিনি পরিচয় গোপন করেননি। ভীমসেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের ক্ষেত্রে অথবা কুন্তী-যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি অকপট সারল্যে জানিয়েছিলেন যে তিনি রাক্ষসী, হিড়িম্বরাক্ষস তাঁর ভ্রাতা।

দ্বাপর যুগে রাক্ষস সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতা-ভগিনীর বিবাহ প্রচলিত ছিল। হিড়িম্ব-রাক্ষসের মানব-মাংস ভক্ষণের পর সমস্ত রাত্রি হিড়িম্বার সঙ্গে গান গাওয়া ও হাত ধরাধরি করে নাচার প্রস্তাবে এই ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মোট কথা, মানবের সঙ্গে রাক্ষসীর বিবাহ রাক্ষস সমাজে গর্হিত অপরাধ বিবেচিত হত। পরবর্তীকালে যে সমস্ত রাক্ষসের সঙ্গে ভীমসেনের সংঘর্ষ ঘটেছে, তারা সকলেই ভীমকে হিড়িম্বার ধর্ষণকারীরূপে চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় ভীমকে বিবাহ করে হিড়িম্বা রাক্ষসসমাজে ব্রাত্য, পতিত রূপেই পরিচিত হন।

‘প্রথম দর্শনেই প্রেম’ ভীমসেনকে দেখে হিড়িম্বার সেই দশাই ঘটেছিল। তিনি কুন্তী এবং যুধিষ্ঠিরের কাছে তার অন্তরের অনুভূতি সহজ সারল্যে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি কুন্তীকে বলেছিলেন যে নারীর কামের জ্বালা কুন্তী নিশ্চয়ই বোঝেন। কুন্তী ও যুধিষ্ঠির দু’জনেই বুঝেছিলেন। তাই তাঁরা ভীম-হিড়িম্বার বিবাহের অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এ-বিবাহে শর্ত ছিল পুরুষের দিক থেকেই। যুধিষ্ঠির শর্ত দিয়েছিলেন যে, হিড়িম্বা সমস্ত দিন ভীমসেনের সঙ্গে থাকতে পারবেন কিন্তু রাত্রি আগত হলে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে যেতে হবে ভ্রাতাদের কাছে। ভীমসেনও শর্ত দিয়েছিলেন যে, পুত্র জন্মের পর তিনি আর হিড়িম্বার সঙ্গে থাকতে পারবেন না। দু’জনের শর্তই হিড়িম্বা মেনে নিয়েছিলেন। মিথ্যাচার, কাপট্য তাঁর মধ্যে ছিল না। ঘটোৎকচের জন্মের পর তিনি ভীমসেনের সঙ্গে আর দেখা করেননি।

হিড়িম্বা হস্তিনাপুরে কখনও যাননি, ইন্দ্রপ্রস্থেও নয়। এমনকী তিনি অন্তরিক্ষে হস্তিনাপুর কিংবা ইন্দ্রপ্রস্থ দেখেছিলেন, এমন কোনও ইঙ্গিতও ব্যাসদেব দেননি। রাক্ষসসমাজেও তিনি সমাদৃতা ছিলেন না। অর্জুনের পত্নীগণ, অন্যান্য পাণ্ডব ভ্রাতাদের পত্নীরা অশ্বমেধ যজ্ঞে হস্তিনাপুর গিয়েছিলেন। এমন অনুমানে অসংগতি নেই যে, নির্জন কোনও বনমধ্যে— লোকালয় থেকে অনেকদূরে, কোনও পর্ণকুটিরে হিড়িম্বা ভীমসেনের পুত্রকে লালনপালন করছিলেন। তার অল্প ঘটনাপূর্ণ জীবনে বলার কথা কমই ছিল। কিন্তু পুত্র-পৌত্রকে যেটুকু বলেছেন, সবই পাণ্ডব পরিবার সম্পর্কে। ঘটোৎকচের জীবনকাহিনি আমাদের কাছে সেই চিত্রকেই উদ্‌ঘাটিত করেছে। পাণ্ডবদের যে-কোনও প্রয়োজনে ঘটোৎকচকে উপস্থিত দেখা গেছে। কৃষ্ণের আদেশে পিতৃব্য অর্জুনকে রক্ষা করতে গিয়ে সে কর্ণকে প্রদত্ত ইন্দ্রের একঘাতী অস্ত্রকে আপন দেহে গ্রহণ করেছে। আপন মৃত্যুবরণ করে সে অর্জুনের জীবন রক্ষা করেছে। পাণ্ডবপক্ষ সম্পর্কে তার এতখানি মমতার একমাত্র কারণ হিড়িম্বা। হিড়িম্বা তাঁর পুত্র ঘটোৎকচ এবং পৌত্র অঞ্জনপর্বাকে নিজেদের পাণ্ডব বলে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। পিতা ভীমসেন সম্পর্কে ঘটোৎকচ অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মায়ের কাছ থেকে ঘটোৎকচ পেয়েছিলেন পিতার অপরিসীম বল, বীর্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে গৌরববোধ।

কৃষ্ণ ঘটোৎকচের মৃত্যুর পরে বলেছিলেন সে ব্রাহ্মণদ্বেষী এবং ধর্মবিদ্বেষী ছিল। কৃষ্ণ বলেছেন বলেই আমাদের বিশ্বাস করতে হয়, নইলে ব্যাসদেবের বর্ণনার কোনও অংশে এর সমর্থন মেলে না। ঘটোৎকচ রাক্ষসদের অবিসংবাদী নেতা ছিলেন। তিনি ভয়ংকর বলশালী যোদ্ধা ছিলেন এবং মায়াবিদ্যা জানতেন। কুরুক্ষেত্রে কৌরবপক্ষের সকল যোদ্ধাই তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে সম্মত হননি।

হিড়িম্বা এইভাবেই ঘটোৎকচকে গড়ে তুলেছিলেন। হিড়িম্বা জীবনে কোনও দ্বিতীয় পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করেননি। আপাতকঠিন ভীমসেনের মধ্যে তিনি দেখেছিলেন এক কোমল ভ্রাতৃস্নেহপরায়ণ এবং মাতৃবৎসল পুরুষ মানুষকে। বিবাহে অনুমতি দেওয়ার জন্য যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ছিল। তিনি জানতেন যে তাঁর স্বামীকে যুধিষ্ঠির সবথেকে বেশি ভালবাসতেন।

হিড়িম্বা নিঃসঙ্গ ছিলেন। কিন্তু তিনি স্বামীর সব খবর রাখতেন। সম্ভবত রাক্ষস সমাজ থেকেই তিনি সংবাদ লাভ করতেন। ভীম একটির পর একটি রাক্ষস বধ করেছেন, রাক্ষস-পুরুষেরা ভীমসেন সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা অধিক ক্রুদ্ধ, এ সংবাদও তাঁর অজানা ছিল না। কিন্তু তিনি বিচলিত বোধ করেননি। মানুষ হলেও ভীমসেন যে রাক্ষস পুরুষদের থেকে বলবান, এ বিশ্বাসও তার পূর্ণমাত্রায় ছিল।

কল্পনা করতে ভাল লাগে যে হিড়িম্বা আর রাক্ষসীমূর্তি ধারণ করেননি। যে নারী মূর্তিতে শ্রীময়ী হয়ে তিনি ভীমের কাছে গিয়েছিলেন, সেই মূর্তিতেই তিনি নির্জন কোনও পর্ণকুটিরে জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। তাঁর মন সমস্ত জীবন ছিল নববধূর মতো। সমস্ত কল্পনা ছিল ভীমসেনকে জুড়ে। একচক্রাপুরীর সেই নিবিড় বন, যেখানে তিনি ভীমকে প্রথমবার দেখেছিলেন। পথশ্রমে ক্লান্ত ভ্রাতারা এবং মাতা ভূমিতে নিদ্রাগত এবং ভীম একা প্রহরায় জাগ্রত। জানুতে মাথা রেখে উপবিষ্ট জাগ্রত নৈশ প্রহরী ভীমসেন। সামান্য শব্দ হলেই যিনি চোখ তুলে ভ্রাতাদের ও মাতাকে দেখছেন। ভীমসেনের সেই মূর্তিই হিড়িম্বার শয়নে স্বপনে জাগরণে একমাত্র সঙ্গী। এমন কল্যাণময়ী একনিষ্ঠ নারীচরিত্রও মহাভারতে খুব বেশি নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *