১২. মদ্রতনয়া মাদ্রী

মদ্রতনয়া মাদ্রী

মহাভারত অংশাবতার অংশে পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে স্বর্গের ধৃতি নাম্নী দেবী মর্ত্যভূমিতে মদ্ররাজ শল্যের ভগিনী মাদ্রী নামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। স্বয়ংবর সভায় কুন্তীদেবী মহারাজ পাণ্ডুকে বরণ করলেন। প্রজাদের আনন্দ উল্লাসের মধ্যে পাণ্ডু রাজা আপন রাজধানী হস্তিনায় উপস্থিত হয়ে ভার্যা কুন্তীদেবীকে নিজ ভবনে প্রবেশ করালেন।

তারপরে বুদ্ধিমান শান্তনুনন্দন ভীষ্ম যশস্বী পাণ্ডুরাজাকে আর একটি বিবাহ করাবেন বলে স্থির করলেন। তখন তিনি প্রাচীন মন্ত্রী, ব্রাহ্মণ ও মহর্ষিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে চতুরঙ্গ সৈন্য নিয়ে মদ্ররাজের রাজধানীতে উপস্থিত হলেন। ভীষ্ম এসেছেন শুনে বাহ্লীকবংশ শ্রেষ্ঠ শল্য রাজা প্রত্যুদ্‌গমন করে আদর করে তাঁকে রাজধানীতে প্রবেশ করালেন। ভীষ্মকে নির্মল আসন, পাদ্য, অর্ঘ্য এবং মধুপর্ক দান করে মদ্ররাজ তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তখন কুরুশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম মদ্ররাজকে বললেন, “মহারাজ, আমি কন্যাপ্রার্থী হয়ে এসেছি। শুনতে পাই—সচ্চরিত্রা ও পরমসুন্দরী মাদ্রী নামে আপনার একটি ভগিনী আছে; আমি সেইটিকেই যশস্বী পাণ্ডুর জন্য প্রার্থনা করি। কারণ, বিবাহ সম্বন্ধে আপনি আমাদের যোগ্য এবং আমরাও আপনার যোগ্য। এই বিচার করে মহারাজ শল্য, আপনি আমাদের যথানিয়মে আদর করুন।”

ভীষ্মের কথা শুনে মদ্ররাজ তাঁকে বললেন, “আপনাদের বংশীয় বর অপেক্ষা অন্য বর আমার কাছে শ্রেষ্ঠ নয়, এই আমার ধারণা। তবে আমাদের এই বংশে পূর্ববর্তী রাজারা একটি নিয়ম প্রবর্তিত করে গিয়েছেন; তা ভালমন্দ যাই হোক, আমি লঙ্ঘন করতে পারব না। স্পষ্টত তা আপনারও জানা আছে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই; সুতরাং “কিছু শুল্ক দিন” একথা আপনাকে বলা আমার সংগত নয়। হে শত্রুনাশক বীর, এই নিয়মটি আমাদের কৌলিক নিয়ম, সুতরাং তা আমার কাছে অত্যন্ত প্রমাণ। সে-বিষয়ের কথা নিঃসন্দেহ হলেও বলা অসংগত বলে আপনাকে বলতে পারছি না।”

তখন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ভীষ্ম মদ্ররাজকে বললেন, “মহারাজ, কুলধর্ম যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম তা স্বয়ং ব্ৰহ্মাই বলেছেন। অতএব এতে কোনও দোষ নেই, আর আপনার পূর্বপুরুষেরা এই নিয়ম করে গিয়েছেন বলে এটি আপনাদের কৌলিক নিয়মই বটে এবং মদ্ররাজ, আপনাদের এই সাধুসম্মত নিয়ম আমারও জানা আছে।” মহাবীর ভীষ্ম এই কথা বলে স্বর্ণের অলংকার প্রভৃতি কেবল স্বর্ণ এবং বহুতর আশ্চর্য রত্ন কন্যার শুল্করূপে শল্যের নিকট সমর্পণ করলেন। এ ছাড়াও কন্যা-শুল্করূপে ভীষ্ম হস্তী, অশ্ব, রথ, বস্ত্র, অলংকার এবং শুভলক্ষণযুক্ত মণি, মুক্তা ও প্রবাল সমর্পণ করলেন। শল্য সেই সমস্ত ধন গ্রহণ করে আনন্দিত হয়ে আপন ভগিনী মাদ্রীকে অলংকৃত করে ভীষ্মের হাতে সমর্পণ করলেন। বুদ্ধিমান গঙ্গানন্দন ভীষ্ম মাত্রীকে নিয়ে আনন্দিত চিত্তে হস্তিনানগরে আগমন করলেন।

তারপর অভীষ্ট দিন উপস্থিত হলে, বিজ্ঞানুমোদিত মুহূর্তে মহারাজ পাণ্ডু যথাবিধানে মাদ্রীর পাণিগ্রহণ করলেন। বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেলে, পাণ্ডু রাজা অনুরাগিণী ভার্যা মাদ্রীকে সুলক্ষণ গৃহে নিয়ে গিয়ে স্থাপিত করলেন। রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রী—দুই ভার্যার সঙ্গে ইচ্ছা ও সুখ অনুসারে বিচরণ করলেন। পাণ্ডুরাজা একমাস কাল ভার্যাদের সঙ্গে বিহার করে দিগ্বিজয় করার জন্য রাজধানী থেকে নির্গত হলেন। পাণ্ডু ভীষ্ম প্রভৃতি বৃদ্ধগণকে এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধৃতরাষ্ট্রকে নমস্কার করে কুরুবংশীয় অন্যান্য প্রধান লোকের কাছে বিদায় নিয়ে, তাঁদের অনুমোদন নিয়ে যাত্রা করলেন। তখন ব্রাহ্মণগণ ধানদূর্বা নিক্ষেপ করে আশীর্বাদ দ্বারা অভিনন্দন করলে, পাণ্ডু হস্তী, অশ্ব ও রথযুক্ত বিশাল সৈন্যের সঙ্গে প্রস্থান করলেন।

ইন্দ্রতুল্য রাজা পাণ্ডু পৃথিবী জয় করতে ইচ্ছা করে, হৃষ্ট ও সবল সৈন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বহুতর শত্রুর বিরুদ্ধে গমন করতে লাগলেন। কৌরবগণের যশোবৃদ্ধিকারী নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু প্রথমে গিয়ে অপরাধী দশার্ণদেশবাসীকে যুদ্ধে জয় করলেন। তারপর পাণ্ডু নানাবিধ ধ্বজ, বহুতর হস্তী, অশ্ব, পদাতি ও রথযুক্ত বিশাল সৈন্য নিয়ে মগধদেশের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে বহু অন্য রাজার কাছে অপরাধী এবং বলদর্পিত মগধরাজ দধিকে তাঁর গৃহেই বধ করলেন। মগধরাজার প্রচুর ধন ও বাহন গ্রহণ করে মিথিলায় গিয়ে পাণ্ডু বিদেহবাসীকে যুদ্ধ করলেন। তারপর পাণ্ডু কাশী, শুম্ভ্র ও পুণ্ড্রদেশের রাজাকে জয় করে কুরুবংশের যশ বিস্তার করলেন। বাণসমূহ রূপ মহাশিখা এবং অন্যান্য অস্ত্ররূপ সামান্য শিখাযুক্ত শত্রুনাশক সেই পাণ্ডুরূপ অগ্নিতে পতিত হয়ে রাজারা দগ্ধ হয়ে গেলেন।

বিশাল সেনানায়ক পাণ্ড অন্যান্য রাজার সৈন্যসামন্তকে বিধ্বস্ত করে তাদের বশে এনে কুরুবংশীয়দের ভৃত্যের কার্যে নিযুক্ত করলেন। দৈত্যগণ যেমন ইন্দ্রের কাছে পরাজিত হয়ে তাঁকে প্রধান বীর বলে স্বীকার করেছিল, সেইরকম পৃথিবীর সকল রাজাই পাণ্ডুর কাছে পরাজিত হয়ে তাঁকেই প্রধান বীর বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তারপর মণি, মুক্তা, প্রবাল, সোনা, রূপা, উৎকৃষ্ট গোরু, ঘোড়া, রথ, হাতি, গাধা, উট, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, ভাল চামড়া, রঙ্কুলোমের আস্তরণ এবং নানাবিধ অস্ত্র নিয়ে অবনত হয়ে রাজারা কৃতাঞ্জলিপুটে পাণ্ডুর কাছে উপস্থিত হয়েছিলেন। হস্তিনাধিপতি রাজা পাণ্ডু সেই সকল দ্রব্য গ্রহণ করলেন এবং তা নিয়ে আপন রাজ্যের ও রাজধানীর লোকদের আনন্দিত করবেন বলে চললেন। সে সময় হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি বাহনগুলিও আনন্দিত ছিল। রাজশ্রেষ্ঠ শান্তনু এবং বুদ্ধিমান ভরতের কীর্তিকাহিনি প্রায় লুপ্ত হয়েছিল, কিন্তু পাণ্ডু পুনরায় তার উদ্ধার করলেন।

যেসব রাজা পূর্বে কৌরবদের রাজ্য ও ধন হরণ করেছিলেন, হস্তিনাপতি পাণ্ডু তাঁদের নিজের করদ রাজ্যে পরিণত করলেন। ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবগণ পুরবাসী ও দেশবাসীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশ্বস্ত ও হৃষ্ট, আগতপ্রায় পাণ্ডুর প্রত্যুদ্‌ৰ্গমন করলেন। তাঁরা আনন্দিত চিত্তে হস্তিনানগর থেকে কিছুদূরে গিয়ে গ্রাম্যলোক পরিবেষ্টিত সৈন্যগণকে দেখতে পেলেন। নানাবিধ যানে করে নানাবিধ রত্ন আনীত হয়েছিল; হস্তী, অশ্ব, রথ, গো, উট এবং ছাগলেরা আসছিল, ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবগণ সে সৈন্যের শেষ সীমা দেখতে পেলেন না। অম্বালিকার আনন্দবর্ধক পাণ্ডু ভীষ্মের চরণযুগলে নমস্কার করে পুরবাসী ও দেশবাসীদেরও যথাযোগ্য সম্মানিত করলেন। পাণ্ডু অন্যান্য রাজাদের বধ করে চরিতার্থ হয়ে ফিরে এসেছেন বলে ভীষ্ম তাঁকে আলিঙ্গন করে আনন্দাশ্রুপাত করলেন। তারপর পাণ্ডু তূর্য, শঙ্খ ও ভেরির বিশাল শব্দে পুরবাসীকে আনন্দিত করতে করতে হস্তিনা রাজধানীতে প্রবেশ করলেন।

পাণ্ড ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতিক্রমে আপন বাহুবলার্জিত ধনগুলি ভীষ্ম, সত্যবতী ও দুই মাতাকে উপহার দিলেন। এবং বিদুরের কাছেও পাঠিয়ে দিলেন, আর সেই ধন দ্বারা বন্ধুবর্গকেও আনন্দিত করলেন। শচীদেবী পুত্র জয়ন্তকে আলিঙ্গন করে যেমন আনন্দ লাভ করে থাকেন, তেমনি অম্বালিকাদেবীও পুরুষশ্রেষ্ঠ মহাবীর পুত্র পাণ্ডুকে আলিঙ্গন করে আনন্দলাভ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর বিক্রমলব্ধ ধন দ্বারা বহু অশ্বমেধতুল্য তর্পণ প্রভৃতি মহাযজ্ঞ করলেন এবং তাতে প্রচুর পরিমাণে দক্ষিণা দিলেন। তারপর পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে আলস্য পরিত্যাগ করে বনে গমন করলেন। বাসস্থান অট্টালিকা ও মনোহর অলংকারসকল পরিত্যাগ করে বনে গিয়ে সর্বদা সেইখানে থেকে মৃগয়া করতে লাগলেন। তিনি হিমালয় পর্বতের দক্ষিণ পার্শ্বস্থ মনোহর স্থানে বিচরণ করতেন এবং সেই পর্বতের উপরে বিস্তৃত শালবনে বাস করতেন। দুটি হস্তিনীর মধ্যে থেকে ঐরাবতহস্তী যেমন শোভা পায়, পাণ্ডুও তেমন কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে বনে বাস করতে থেকে শোভা পেতেন৷ খড়্গ, বাণ ও ধনুর্ধারী। বিচিত্র কবচে আবৃতদেহে ও পরমাস্ত্রজ্ঞ মহাবীর পাণ্ডুরাজাকে দুটি ভার্যার সঙ্গে বিচরণ করতে দেখে বনবাসী লোকেরা তাঁকে কোনও দেবতা বলে মনে করত।

একদিন পাণ্ডু হরিণ ও হিংস্র জন্তু পরিপূর্ণ মহাবনে বিচরণ করতে থেকে মৈথুন প্রবৃত্ত একটি প্রধান হরিণকে দেখতে পেলেন। তারপর তিনি স্বর্ণখচিত ও শীঘ্রগামী পাঁচটি তীক্ষ্ণ্ণ বাণ দ্বারা সেই হরিণ ও হরিণীকে বিদ্ধ করলেন। কিন্তু হরিণটি আসলে এক অত্যন্ত তেজস্বী ঋষিকুমার ছিলেন। তিনি হরিণরূপে হরিণীরূপিণী নিজ ভার্যার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। হরিণরূপে সেই ঋষিকুমার হরিণীরূপিণী সঙ্গে মিলিত অবস্থাতেই তৎক্ষণাৎ বিকলেন্দ্রিয় ও ভূতলপতিত হয়ে মনুষ্যোচিত বাক্য উচ্চারণ করতে থেকে বিলাপ করতে লাগলেন। মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “কামার্ত, ক্রুদ্ধ, মূঢ় এবং পাপাসক্ত লোকেরাও এ জাতীয় নৃশংস কাজ করে না। অথবা বুদ্ধি দৈবকে লুপ্ত করতে পারে না, কিন্তু দৈবই বুদ্ধিলোপ করে দেয়। অথবা বুদ্ধিমান লোকও দৈব-নিবন্ধন উপস্থিত বিষয় ভোগ করে থাকে। মহাশয়, আপনি চিরধার্মিকদের প্রধান বংশে জন্মেছেন, এ অবস্থায় আপনি কামে ও লোভে অভিভূত হলেন কেন? এবং আপনার বুদ্ধিই বা সৎপথচ্যুত হল কেন?”

পাণ্ডু বললেন, “যে কারণে রাজাদের শত্রুবধে প্রবৃত্তি জন্মে থাকে সেই কারণেই মৃগবধেও প্রবৃত্তি হয়ে থাকে; সুতরাং তুমি মোহবশত মৃগয়ার নিন্দা করতে পারো না। অকপট বেশে এবং অকপট ব্যবহারে মৃগবধ করাও শাস্ত্রকারদের অভীষ্ট, সুতরাং তা রাজাদের ধর্ম, অতএব তুমি ক্ষমা করতে পারো। দেখো মহর্ষি অগস্ত্য মহাবন মধ্যে যজ্ঞে প্রবৃত্ত থেকে বন্য সমস্ত পশুকে প্রোক্ষণ করে মৃগয়া করেছিলেন। বেদে যে ধর্ম দেখা যায়, আমি সেই অনুসারেই তোমাকে বধ করেছি। সুতরাং, তুমি আমাকে নিন্দা করছ কেন? বিশেষত মহর্ষি অগস্ত্যের মৃগবধ দেখে অন্যান্য ঋষিরাও তোমাদের বসা (শরীরের ধাতুবিশেষ) দ্বারা হোম করেছেন।” মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “ধার্মিক লোকেরা ফাঁক পেয়েই শত্রুদের প্রতি বাণক্ষেপ করেন না। কিন্তু বিশেষ কারণে যথাসময়ে শত্রুবধ করাই প্রশস্ত বলে মনে করেন।” পাণ্ডু বললেন, “মৃগ সাবধান হোক বা অসাবধানই হোক, দেখতে পেলেই রাজারা বাহুবলে তীক্ষ্ণ্ণ বাণ দ্বারা বা অন্য উপায়ে তাকে বধ করে থাকেন। অতএব মৃগ, তুমি আমাকে নিন্দা করছ কেন?”

মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “মহারাজ, আপনি আমাকে মৃগ বলে বধ করেছেন, তাতে আমি নিজের জীবনের জন্য আপনাকে নিন্দা করছি না, কিন্তু দয়া করে আমার মৈথুন সমাপ্তির প্রতীক্ষা করা আপনার উচিত ছিল। সকল প্রাণীরই হিতকর এবং সকল প্রাণীরই অভীষ্ট মৈথুনের সময়ে কোনও জ্ঞানী লোক মৃগকে বধ করে থাকে? মহারাজ, আমি পুত্র উৎপাদন করার জন্য আনন্দে এই মৃগীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, আপনি তা নিষ্ফল করে দিলেন। রাজা যারা পরের ক্লেশজনক কাজ করেন না, আপনি সেই পৌরবগণের বংশে জন্মেছেন সুতরাং আপনার পক্ষে এ-কার্য সংগত হয়নি। সকল লোকই গুরুতর নৃশংস কাজের নিন্দা করে থাকেন। কেন-না, তা পাপজনক, সুতরাং তা স্বর্গের প্রতিবন্ধক এবং লোকনিন্দার কারণ। হে দেবতাতুল্য, আপনিও তো স্ত্রীসম্ভোগসুখের মর্ম জানেন এবং শাস্ত্র ও ধর্মের তত্ত্ব অবগত আছেন, এ অবস্থায় আপনি এরূপ নরকজনক কার্য করার যোগ্য নন মহারাজ, নৃশংস কার্যকারী, পাপাচারী এবং ধর্ম, অর্থ ও কামবিহীন লোকেদেরই আপনি দণ্ড দিতে পারেন। এ অবস্থায় হে নরশ্রেষ্ঠ, বনবাসী ফলমূলাহারী, মৃগরূপধারী, সর্বদা শান্তিপরায়ণ এবং নিরপরাধ মুনিরূপী আমাকে বধ করে আপনি আজ কী করে ফেলেছেন বলুন দেখি। সে যাই হোক আপনি যখন আমাকে বধ করেছেন, তখন আমিও আপনাকে অভিসম্পাত করছি। আপনি যখন আমাদের দু’জনকেই বধ করেছেন এবং আপনি অসংযতচিত্ত ও কামমুগ্ধ, তখন আপনারও এইভাবেই জীবননাশ হবে।

“আমি তপস্যায় অসাধারণ ‘কিমিন্দম’ নামে মুনি। মনুষ্যের মধ্যে লজ্জা উপস্থিত হওয়ায় আমি হরিণের রূপ ধরে হরিণীরূপিণী ভার্যার সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। আমি হরিণ হয়ে হরিণদের সঙ্গে নিবিড় বনের মধ্যে বিচরণ করছিলাম। এই অবস্থায় তুমি আমাকে হত্যা করেছ, অতএব তুমি এই কার্যের এইরূপ ফলই পাবে। আমি হরিণ হয়ে হরিণদের সঙ্গে নিবিড় বনের মধ্যে বিচরণ করছিলাম। সুতরাং আমাকে ব্রাহ্মণ বলে জানতে পারোনি। অতএব আমাকে হত্যা করায় তোমার ব্রহ্মহত্যার পাপ হবে না। মূর্খ! আমি কামমোহিত হয়ে মৃগরূপ ধারণ করে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম, এই অবস্থায় তুমি আমাকে হত্যা করেছ। অতএব তুমি এই কার্যের একইরূপ ফল পাবে। তুমিও কামমুগ্ধভাবে প্রিয়তমার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়ে এই অবস্থাতেই প্রেতলোকে গমন করবে। তুমি যে প্রিয়তমার সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হবে, সমস্ত প্রাণীর দুরতিক্ৰমণীয় প্রেতলোকে সেই রমণীই ভক্তি সহকারে তোমার অনুগমন করবে। আমি সুখভোগ করছিলাম, এই অবস্থায় তুমি যেমন আমাকে দুঃখভোগ করালে, তেমন সুখভোগের সময়ে তোমার উপরেও দুঃখ এসে পড়বে।” এই কথা বলে কিমিন্দমমুনি অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় প্রাণত্যাগ করলেন; পাণ্ডুও ক্ষণকালের জন্য বিশেষ দুঃখিত হলেন।

পাণ্ডু নিজের বন্ধুজনের ন্যায় মৃত সেই কিমিন্দমমুনিকে পরিত্যাগ করে এসে, শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে পীড়িত লোকের মতো ভার্যাদের কাছে বিলাপ করতে লাগলেন। পাণ্ডু বললেন, “হায়! অসংযতচিত্ত এবং কামমুগ্ধ লোকেরা সৎকুলে জন্মেও দুষ্কাৰ্যবশতই দুর্গতি ভোগ করে। শোনা আছে যে, আমার পিতা চিরধার্মিকের পুত্র হয়েও কামনিবন্ধন বাল্য অবস্থাতেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন। সেই কামুক রাজার ভার্যার গর্ভে সাক্ষাৎ নারায়ণ বেদব্যাস আমাকে উৎপাদন করেছেন। সেই আমারই আজ এই বিপত্তিঘটক বুদ্ধি জন্মেছে; হায়! মৃগয়ায় গিয়ে ন্যায়বিগর্হিত কার্য করায় দেবতারাও আমাকে পরিত্যাগ করেছেন। অতএব আমি মুক্তির পথই অবলম্বন করব। কেন-না, বন্ধনই গুরুতর বিপদের কারণ সুতরাং পিতা বেদব্যাসের যে সদবৃত্তি আছে, আমিও সেই চিরন্তনী সদবৃত্তি আশ্রয় করব। অতএব আমি নিশ্চয়ই ভার্যা ও পরিজনদের পরিত্যাগ করে এক একটি বৃক্ষমূলে থেকে গুরুতর তপস্যায় আত্মনিয়োগ করব। আমি সমস্ত সংসার পরিত্যাগ করে, মুনি হয়ে ধূলিধূসরিত দেহ হয়ে ভিক্ষা করতে থেকে এই পৃথিবীতে বিচরণ করতে থাকব। প্রয়োজন হলে শূন্য গৃহে আশ্রয় নেব। অথবা বৃক্ষমূলে বিশ্রাম করব; প্রিয় বা অপ্রিয় সমস্ত পরিত্যাগ করব, শোক করব বা আনন্দও করব না; নিজের নিন্দা ও প্রশংসাকে সমান মনে করব। কারও আশীর্বাদের প্রার্থী হব না, কিংবা কারও নমস্কার চাইব না। শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্দ্বদুঃখ সহ্য করব; কোথাও প্রতিগ্ৰহ করব না; কাউকে উপহাস করব না, কিংবা কারও প্রতি ভ্রূকুটি করব না। সর্বদা প্রসন্নবদন হব। সমস্ত প্রাণীর হিতসাধনে নিরত থাকব এবং চতুর্বিধ প্রাণীর মধ্যে স্থাবর বা জঙ্গম কোনও প্রাণীর প্রতি হিংসা করব না। সর্বদাই নিজের সন্তানের মতো সকল প্রাণীর প্রতি সমান ব্যবহার করব। কেবল এক সময়ে দশ ঘরে কিংবা পাঁচ ঘরে ভিক্ষা করব। তাতে ভিক্ষা না পেলে, কখনও তার বেশি ঘরে ভিক্ষা করব না। খেটে ভিক্ষা না পেলে উপবাস করব। অল্প অপেক্ষাও অল্পতর ভোজন করব। লোভবশত বেশি ঘরে ভিক্ষা করব না, পাঁচ ঘরে ভিক্ষা না পেলে অন্তত সাতঘরে ভিক্ষা করব। পাই বা না পাই, গৃহস্থদের প্রতি সমদর্শী থাকব এবং মহাতপস্বী হব। বাইস দিয়ে একখানি বাহুকে কেটে ছেঁটে কৃশ করে এবং চন্দন দিয়ে একখানি বাহুকে সিক্ত করে তাতে অমঙ্গল বা মঙ্গল মনে করব না। পুনঃপুনঃ জীবিত থাকতে চায় এমন কোনও লোকের মতো কি, মুমূর্ষ লোকের মতো কোনও কাজ করব না এবং জীবনের প্রতি আদর করব না বা মরণের প্রতি বিদ্বেষ করব না। মানুষ জীবিত থেকে উন্নতির জন্য যে যে কাজ করতে পারে, সেই সেই কালের সকল কাজই পরিত্যাগ করব। তারপর সেই সংকটের অবস্থায় সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কাজ পরিত্যাগ করব, ধর্ম ও অর্থ একেবারে ত্যাগ করব, আত্মার মল রাগদ্বেষাদি নির্মূল করব এবং বায়ুর মতো কারও অধীন থাকব না। সর্বদা এইরূপ ব্যবহারে চলতে থেকে মুক্তির পথ আশ্রয় করে দেহত্যাগ করব। মৃগমুনির অভিসম্পাতে আমার সন্তানোৎপাদনের শক্তি নষ্ট হয়েছে বলে গৃহস্থধর্ম আমার পক্ষে শোকের আকর, স্বধর্মভ্রষ্ট এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট; অতএব আমি আর গৃহস্থধর্মাচরণ করব না। পুত্রাভিলাষী যে লোক আদৃত বা অবজ্ঞাত হয়ে কাতরনয়নে অন্য পুরুষের কাছে পুত্রোৎপাদন প্রার্থনা করে, সে লোক কুকুরেরই ব্যবহার করে।” এই কথা বলে অত্যন্ত দুঃখার্ত পাণ্ডু গুরুতর নিশ্বাস ত্যাগ করে কুন্তী ও মাদ্রীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “মাতা অম্বালিকা, বিদুর, সঞ্জয়, বন্ধুবর্গের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র, আর্যা সত্যবতী, ভীষ্ম, রাজপুরোহিতগণ, সোমপায়ী ও দৃঢ়ব্রত মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং হস্তিনানগরে আমাদের আশ্রয়ে যে সকল বৃদ্ধ বাস করেন, তাঁদের সকলের কাছে অনুনয় করে তোমরা বলবে যে, পাণ্ডু বনমধ্যে প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেছেন।”

বনবাসে কৃতসংকল্প পাণ্ডুর কথা শুনে কুন্তী ও মাদ্রী তখন একই কথা জানালেন, “মহারাজ, আমরা আপনার ধর্মপত্নী, সুতরাং আমাদের সঙ্গে মিলিত থেকেই আপনি গুরুতর তপস্যা করবার জন্য অন্য আশ্রমও তো অবলম্বন করতে পারেন। তা হলে শরীর মুক্তির জন্য মহাফলজনক ধর্ম অর্জুন করে স্বর্গলাভের পর আপনিই আমাদের ভর্তা হবেন এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা ইন্দ্রিয়দমন করে আপনার স্থানে যাবার কামনাই করব। কামসুখ ও অন্যান্য সুখ ত্যাগ করে গুরুতর তপস্যা করব। কিন্তু হে মহাপ্রাজ্ঞ! নরনাথ! আপনি যদি আমাদের ত্যাগ করেন, তবে আমরা আজই প্রাণত্যাগ করব এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।” পাণ্ডু বললেন, “এই ধর্মসংগত বিষয়ই যদি তোমাদের অভিপ্রেত হয়, তা হলে আমি, পিতা বেদব্যাসের সেই চিরস্থায়ী সদবৃত্তিই অনুসরণ করব। আমি সুখজনক গ্রাম্য আহার ত্যাগ করে গুরুতর তপস্যা করব এবং বল্কল ধারণ ও ফলমূল ভক্ষণ করতে থেকে মহাবনে বিচরণ করব। সন্ধ্যাকালে ও প্রাতঃকালে অগ্নিতে হোম করব, ওই দুই সময়ে স্নান করব, শরীরটাকে কৃশ করতে থাকব। পরিমিত আহার করব এবং কৌপীন ও কৃষ্ণসারের চর্ম ও জটা ধারণ করব। শীত, বায়ু ও রৌদ্রের কষ্ট সহ্য করব এবং ক্ষুধা ও পিপাসার অপেক্ষা রাখব না; বন্য ফলমূল, মন্ত্র ও জল দ্বারা পিতৃগণ এবং দেবতাগণের সাধনা করব এবং নির্জন স্থানে থেকে ভগবানের ধ্যান করব এবং নীবার ধানের চাল ও ফলমূল ভক্ষণ করে জীবন-ধারণ করব। বনবাসী গৃহস্থের সঙ্গেও দেখা করব না, তাঁদের অপ্রিয় আচরণও করব না। আমি মুক্তিলাভের আশায় এই দেহধারণের সমাপ্তি পর্যন্ত এই ভয়ংকর ও অতি ভয়ংকর বিহিত বিষয়গুলি ক্রমিক অবলম্বন করব।”

এই কথা বলে পাণ্ড নিজের ও স্ত্রীদের সকল অলংকার ও মণিমুক্তা সমুদায় দরিদ্র ব্রাহ্মণদের দান করলেন। পাণ্ডুর আদেশে অনুচর ও ভৃত্যগণ হস্তিনাপুরে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাণ্ডুর সমস্ত বৃত্তান্ত বলে অবশিষ্ট ধনগুলি সমর্পণ করল। এদিকে পাণ্ডু ফলমূল ভোজন করতে থেকে সে-স্থান ত্যাগ করে নাগশত পর্বতে চলে গেলেন এবং কিছুকাল পরে নানা পর্বত অতিক্রম করে শতশৃঙ্গ পর্বতে গিয়ে মহাতপস্বী হলেন। ক্রমশ তপস্যা কঠিনতর করতে করতে পাণ্ডু ব্রহ্মর্ষির তুল্য হয়ে পড়লেন। কিন্তু পাণ্ডুর মনে সন্তোষ ছিল না। অন্য ঋষিরা স্বর্গে যাতায়াতের অধিকারী হলেও নিঃসন্তান বলে পাণ্ডুর সে-অধিকার ছিল না। তিনি কুন্তীর কাছে গুরুতর দুঃখপ্রকাশ করে কুন্তীকে অন্য কোনও ব্রাহ্মণের দ্বারা সন্তান উৎপাদনের প্রার্থনা জানালেন। সলজ্জ কুন্তী তাকে কুমারী জীবনে আশীর্বাদরূপে প্রাপ্ত দুর্বাসার অভিকর্ষণের মন্ত্রের বিষয় জানালেন। আনন্দিত পাণ্ডু কুন্তীকে দেব ধর্মকে আহ্বান করতে অনুরোধ জানালেন। এইভাবে ধর্মের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে যুধিষ্ঠিরের, বায়ুর ঔরসে ভীমসেনের এবং ইন্দ্রের ঔরসে অর্জুনের জন্ম হল। সপত্নী মাদ্রীর প্রার্থনায় স্বামী পাণ্ডর আদেশে কুন্তী একবারের জন্য সপত্নীকে সেই অভিকর্ষণ মন্ত্র প্রদান করলেন। মাদ্রী অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আহ্বান করলেন। দুই অশ্বিনীকুমারের ঔরসে মাদ্রী লাভ করলেন যমজ দুই পুত্র, নকুল আর সহদেব। পাণ্ডু আবার মাদ্রীর জন্য কুন্তীর কাছে মন্ত্রের আর-একবার প্রয়োগ চেয়েছিলেন। কিন্তু মাদ্রীর ছলনার জন্য কুন্তী আর অভিকর্ষণ মন্ত্র ব্যবহার করতে অস্বীকার করলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতে মুনিঋষিদের মধ্যে পাণ্ডুর পঞ্চপুত্র লালিত হতে লাগল।

তারপর কোনও এক সময়ে প্রাকৃতিক নিয়মেই বসন্তকাল এল। তখন চৈত্র ও বৈশাখের সন্ধি সময়। সকল বনেই ফুল ফুটেছিল এবং সকল প্রাণীর মনই কামাবেশে অধীর হয়েছিল। এমন সময়ে পাণ্ডু ভার্যার সঙ্গে বনে বিচরণ করছিলেন। সে বনে পলাশ, তিল, আম্র, চম্পক, দেবদারু, স্থলপদ্ম, অশোক, নাগকেশর, তিনিশ, কুরুবক ও অন্যান্য নানাবিধ বৃক্ষ ছিল, সেগুলি আবার ফল ও ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। লতায় আবৃত অনেক পারিজাত বৃক্ষ ছিল, সেগুলির মঞ্জরী প্রকাশিত হয়েছিল, কোকিল ও ভ্রমরগণ রব করে বেড়াচ্ছিল এবং অনেকগুলি জলাশয়ে পদ্মসমূহ শোভা পাচ্ছিল। এহেন বন দেখে পাণ্ডুর মনে কামের আবির্ভাব ঘটল। সেই বনেই হৃষ্টচিত্তে দেবতার ন্যায় বিচরণ করতে লাগলেন। তখন একমাত্র মাদ্রীই সূক্ষ্মবস্ত্র পরিধান করে তাঁর অনুসরণ করছিলেন।

তখন পাণ্ডু সেই সূক্ষ্মবস্ত্রা ও যুবতী মাদ্রীকে বিশেষভাবে দেখতে লাগলেন, তাতেই তাঁর কামানল দাবানলের মতো বৃদ্ধি পেতে লাগল। কিন্তু নির্জনে একাকিনী পদ্মনয়না মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সে কামবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না। পরন্তু তিনিই কামবলে অভিভূত হলেন। তারপর মাদ্রী শক্তি অনুসারে অঙ্গসঞ্চালন করে রাজাকে বারণ করতে লাগলেন, তবুও রাজা বলপূর্বক তাঁকে বশীভূত করে ফেললেন।

স তু কামপরীতাত্মা তং শাপং নাম্ববুধ্যত।

মাদ্ৰীং মৈথুনধৰ্মেন সোহন্বগচ্ছদ্বলাদিব ॥ আদি: ১১৯: ১১ ॥

রাজার চিত্ত কামে আকুল হয়ে গিয়েছিল, তাই তিনি শাপের বিষয় স্মরণ করতেই পারছিলেন না, সুতরাং তিনি বলপূর্বকই মাদ্রীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেন।

পাণ্ডু দৈবপ্রেরিত হয়ে, শাপসম্ভাব্য মৃত্যুর ভয় পরিত্যাগ করে মৃত্যুর জন্যই কামের অধীন হয়ে পড়লেন। সাক্ষাৎ কাল এসে রাজার ইন্দ্রিয়সমূহকে অবশ করে বুদ্ধিকে মুগ্ধ করে ফেলল সুতরাং সে-বুদ্ধি বিবেকের সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেল। সুতরাং সেই পরম ধার্মিক রাজা পাণ্ডু ভার্যা মাদ্রীর সঙ্গে সঙ্গম করেই মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। তারপর মাদ্রী চৈতন্যবিহীন রাজাকে আলিঙ্গন করে বারবার উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদ করতে লাগলেন। সেই আর্তনাদ শুনে কুন্তী নিজের তিন পুত্র ও মাদ্রীর দুই পুত্রের সঙ্গে সেদিকে ছুটে আসতে লাগলেন, যেখানে রাজা সেই অবস্থায় পড়ে ছিলেন। তারপর শোকার্তা মাদ্রী কুন্তীকে চিৎকার করে বললেন, “আপনি একাই এখানে আসুন, বালকগণ ওইখানেই থাক।” মাদ্রীর সেই কথা শুনে বালকগণকে সেখানেই রেখে, “হায়, আমি মরেছি” এরূপ আর্তনাদ করে কুন্তী তৎক্ষণাৎ সেইস্থানে গেলেন।

কুন্তী, মাদ্রী ও পাণ্ডুকে ভূতলে শায়িত দেখে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে শোকবিহ্বল অঙ্গে বিলাপ করতে লাগলেন। “মাদ্রী! রাজা নিজেও সর্বদাই আত্মরক্ষায় যত্নবান ছিলেন, আমি তো তাঁকে সর্বদাই রক্ষা করতাম। এ অবস্থায় উনি মৃগমুনির অভিশাপের বিষয় জেনেও কেন তোমাকে আক্রমণ করলেন? মাদ্রী! রাজাকে রক্ষা করাই তোমার উচিত ছিল, তাতে তুমি এই নির্জন স্থানে কেন ওঁকে লুব্ধ করলে? মাদ্রী! রাজা সেই অভিশাপ স্মরণ করে সর্বদাই বিষণ্ণ থাকতেন, এ অবস্থায় নির্জনে তোমাকে পেয়ে কী প্রকারে তার আনন্দ জন্মেছিল? সে যাই হোক মাদ্রী, তুমিই ধন্যা এবং তুমি আমার থেকে ভাগ্যবতী। যেহেতু তুমি রাজার হৃষ্টচিত্ত মুখখানি দেখেছ।” মাদ্রী বললেন, “দেবী! আমি বিলাপ করতে করতে রাজাকে বহুবার নিষেধ করেছিলাম, কিন্তু ইনি দৈবকে সত্য করবার ইচ্ছায় মনকে বারণ করেননি।”

কুন্তী বললেন, “যাক, আমি জ্যেষ্ঠা, সুতরাং আমিই ধর্মপত্নী। অতএব ধর্মফল প্রথম আমারই হবে। আর ভাবী বিষয়ও অবশ্যই হবে। সুতরাং মাদ্রী! তুমি আমাকে সহমরণ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা কোরো না। আমি এখনই মৃত পতির অনুসরণ করব। তুমি একে ছেড়ে দিয়ে ওঠো। এই বালক ক’টিকে পালন করো।” মাদ্রী বললেন, “আমিই অপলায়ী ভর্তার অনুগমন করব। কারণ আমি এখনও কামসম্ভোগ করে তৃপ্তিলাভ করতে পারিনি। অতএব দিদি, আমাকে অনুমতি দিন। বিশেষত, ইনি কামবেগে আমার সঙ্গে সঙ্গম করেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন, সুতরাং আমি যমালয়ে গিয়ে এঁর সে কামপিপাসা কেন মেটাব না। আর্যে! আমি আপনার পুত্রদের প্রতি নিজের পুত্রদের সমান ব্যবহার করতে থেকে জীবন অতিবাহিত করতে পারব না, তা হলে আমারই পাপ হতে থাকবে। অতএব দেবী, আপনি আমার পুত্র দুটির প্রতি নিজের পুত্রদের মতোই ব্যবহার করবেন। রাজা আমার সঙ্গে রমণ করেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। অতএব রাজার শরীরের সঙ্গে আমার এই শরীরটাকেও সম্যক আবৃত করে দগ্ধ করবেন। আমার এই প্রিয় কাজ অবশ্যই করবেন। আপনি চিরদিনই আমার হিত করে এসেছেন সুতরাং আপনি বালক ক’টির উপর সর্বদা সাবধান থাকবেন। এ ছাড়া আমার আর কিছু বলার নেই।” এই কথা বলেই যশস্বিনী মাদ্রী, মৃত রাজার অনুগমন করবেন বলে যোগ অবলম্বনপূর্বক প্রাণত্যাগ করলেন।

মাদ্রী—সাধারণ আলোচনা

মদ্ররাজকন্যা মাদ্রী অপূর্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ যুবতী নারী ছিলেন। পারিবারিক রীতি অনুযায়ী অর্থশুল্কে তাঁর পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ হয়। কুন্তীর স্থৈর্য, ধৈর্য, মানসিক পরিণতি তাঁর মধ্যে ছিল না । বনবাসের দিনগুলিতেও তাঁর বেশবিন্যাস, নিজেকে সুন্দর করে রাখার প্রবণতা পাঠকের দৃষ্টি অতিক্রম করে না। স্বামীপ্রেম মাদ্রীর গভীর ছিল। তিনি পাণ্ডুর সঙ্গে ছায়ার মতো থাকতে ভালবাসতেন। মৃগমুনির অভিশাপ মাদ্রী জানতেন। তবুও তিনি পুরোপুরি সতর্ক ছিলেন না। নির্জন বনে অতি সূক্ষ্ম বসন পরে পাণ্ডুর সঙ্গে বিচরণ করে, তিনি অনিচ্ছায় হলেও পাণ্ডুকে উদ্‌ভ্রান্ত করে তুলেছিলেন। পাণ্ডু বলপূর্বক তাঁকে আক্রমণ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি দীর্ঘসময় ধরে মাদ্রীকে দেখছিলেন। পুরুষের সে দৃষ্টি মাদ্রীর না বোঝার ছিল না। আসলে ভোগের আকাঙক্ষা তাঁর মধ্যেও ছিল। পাণ্ডুর দেহসংলগ্ন দৃষ্টি তাঁরও ভাল লাগছিল।

কিন্তু অঘটন ঘটে যাবার পরে তিনি ঔচিত্যবোধ নষ্ট করেননি। যে অসংবৃত অবস্থায় তিনি ছিলেন তা তাঁর সম্পূর্ণ জ্ঞাত ছিল। “বালকগণ ওইখানেই থাকুক, আপনি একাই আসুন।” কুন্তীর প্রতি তাঁর এই আহ্বান আমাদের দৃষ্টি অতিক্রম করে না। কুন্তীর বাৎসল্য গুণ তাঁর ছিল না। তিনি অকপটে কুন্তীকে বলেছিলেন, “আমি আপনার সন্তানদের নিজের সন্তানের মতো ভাবতে পারব না। কিন্তু আপনি আমার সন্তানদের নিজ সন্তানের মতো ভাবতে পারবেন।” মাদ্রী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিলেন। কুন্তীর কাছে দেব-অভিকর্ষণ মন্ত্র জানার পর তিনি বুঝেছিলেন, কুন্তী দ্বিতীয়বার তাঁকে এ মন্ত্র দেবেন না। তাই তিনি সূর্যের পুত্র অশ্বিনীকুমারদ্বয়কেই আমন্ত্রণ জানালেন। যমজ নকুল-সহদেবের জন্ম হল।

অংশাবতার খণ্ডে জানা যায় মাদ্রী ধৃতির অংশাবতার। তিনি যোগ প্রাণায়াম জানতেন। তিনি স্বেচ্ছায় নিশ্বাস রোধ করে মৃত্যুবরণ করেন। মাদ্রী ভারতীয় সাহিত্যে প্রথম স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *