১১. নিঃসঙ্গ মনস্বিনী কুন্তী

নিঃসঙ্গ মনস্বিনী কুন্তী

কুন্তী সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে মহাভারত সম্পর্কে দু’-একটি কথা মনে রাখা দরকার। ব্যাসদেব একলক্ষ শ্লোকে মহাভারত কাহিনি বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে আরও চব্বিশ লক্ষ শ্লোক লুকোনো আছে আভাসে, অস্পষ্ট ইঙ্গিতে। এই কারণেই মহাভারত সম্পর্কে অজস্র কল্পনা, অসংখ্য অনুমান লুকানো আছে। কারও অপরাধ তাতে হয়নি। মহাভারত হচ্ছে সেই দর্পণ, যাতে মানুষ যেভাবে দেখতে চায়, চরিত্রকে সেইভাবে দেখতে পারে। শুধু একটু সতর্কতা দরকার। ব্যাস যা স্পষ্ট করে লিখেছেন—তাকে পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই।

কুন্তী মহাভারতের এক অসাধারণ চরিত্র। দ্রৌপদী ভিন্ন এতখানি মমতা দিয়ে ব্যাস আর কোনও চরিত্র আঁকেননি। আমাদের দেশের মুনিঋষিদের বিচারধারাও স্বতন্ত্র ছিল। তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যায় কুন্তী, দ্রৌপদীকে স্থান দিয়েছেন। অহল্যা তারা মন্দোদরীকে দিয়েছেন। এই পঞ্চকন্যাই স্বামী ব্যর্তীত অন্য পুরুষ-সংসর্গ করেছিলেন, সীতা সাবিত্রী, গান্ধারীর দময়ন্তীর মতো কেবলমাত্র স্বামীকে নিয়েই জীবন অতিবাহিত করেননি। আসলে দৈহিক শুদ্ধিই কেবলমাত্র ঋষিদের বিচার্য ছিল না। সততা, নৈতিকতা, তেজস্বিতা মনস্বিতা, নারীর মর্যাদা, কালোচিত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা এইগুলিও মুনিঋষিরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। যাঁদের তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় নারী হিসাবে গ্রহণ করেছেন, তাঁরা ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক— একাধিক পুরুষ-সংসর্গ করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তাতে তাঁদের জীবনের ধারা পরিবর্তিত হয়নি। ক্ষণ মুহূর্তের বিহ্বলতা তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। বর্তমান প্রসঙ্গে আমরা কুন্তীকে নিয়েই আলোচনা করব।

কুন্তী মহাভারতের সর্বাপেক্ষা নিঃসঙ্গ নারী। জন্ম হয়েছিল তাঁর রাজবাটীতে প্রথম সন্তান হিসাবে। কিন্তু জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্মদাতা পিতা, আপন প্রতিশ্রুতিপূর্ণ করার জন্য তাঁকে দান করলেন আর-এক রাজাকে। সেখানে পিতৃগোছের মানুষ একটি পেলেও অন্তঃপুরে মাতা না থাকায় মাতৃস্নেহহীন বাল্যকাল কাটল তাঁর। বস্তুত বালিকা বয়স থেকেই রাজবাড়ির গৃহকত্রীর, যাবতীয় দায়িত্ব তার উপরে পড়ল। পালক পিতাও দেখলেন যে গৃহকর্ত্রীর যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে মেয়েটি কেবলমাত্র শৃঙ্খলার পরিচয় নয়—বুদ্ধি, বিবেচনা ও চূড়ান্ত দায়িত্ববোধের পরিচয় দিল। রাজ-অন্তঃপরের সীমাহীন স্বাধীনতা তাঁকে স্বেচ্ছাচারিণী করে তুলল না, সেবায় শুশ্রূষায় সে অসামান্যতার পরিচয় দিল। সমবয়স্কা কোনও নারী নেই, আছে কেবল পরিচারিকারা, তারা আদেশ পালন করে, পরামর্শ দিতে পারে না।

এই অবস্থায় পালক-পিতা কুন্তীভোজ তাঁকে দিলেন ঋষি-শ্রেষ্ঠ দুর্বাসার আতিথ্য সৎকারের দায়িত্ব। দুর্বাসা অত্যন্ত বদরাগী, কথায় কথায় তিনি অভিশাপ দেন। আতিথ্য সৎকারে কোনও ত্রুটি ঘটলে রাজবাড়ির সবংশে ধ্বংস ঘটবে। কিন্তু কুন্তী সে দায়িত্ব পালন করল নিশ্ছিদ্র সেবায়, অনায়াস আন্তরিকতায়। এরপর থেকে বিবাহ, স্বামীর প্রজনন শক্তি হারানো, ছেলেদের প্রতিমুহূর্তে গুপ্তহত্যার আশঙ্কা, দ্যূতক্রীড়া, পুত্রবধূর চূড়ান্ত লাঞ্ছনা, পুত্র-পুত্রবধূর বনবাস, ভয়ংকর যুদ্ধ, কানীন পুত্র ও পৌত্রদের বিনাশ এরপর জ্যেষ্ঠপুত্রকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত দেখা এবং তারপরই আশ্রমে চলে যাওয়া পর্যন্ত কুন্তীর জীবনে প্রায় সবটাই নিঃসঙ্গতা। কিন্তু সমস্ত নিঃসঙ্গতার মধ্যে তাঁর প্রতিটি বিষয়ে কর্তব্যসাধন, তাঁর মহত্ত্ব আমাদের সমস্ত চেতনাকে অভিভূত করে। কিন্তু সারসংক্ষেপে আমরা কুন্তীকে প্রকাশ করতে পারব না। আমাদের ব্যাসদেবকে অনুসরণ করতে হবে—দেখতে হবে ভগবান ব্যাস কীভাবে অতি স্নেহের এই চরিত্রটি পরতে পরতে খুলে আমাদের সামনে এনেছেন, আদিপর্ব থেকেই।

অংশাবতরণ পর্যায়ে ব্যাসদেব জানিয়েছিলেন সিদ্ধি ও ধৃতি নামের দেবীরা মর্ত্যে কুন্তী ও মাদ্রী রূপে অবতরণ করেন। কুন্তীদেবী স্বর্গে সিদ্ধিদেবী নামে পরিচিত ছিলেন। যদুবংশে শূর নামে বসুদেবের পিতা ছিলেন; তাঁর কন্যার নাম ছিল ‘পৃথা’, (সতি পৃথিবৈ অগ্রজাতা সতি—ভারতকৌমুদী) তিনি মর্ত্যলোকে অতুলনীয় সুন্দরী ছিলেন।

সেই শূর, আপন পিসতুতো ভাই নিঃসন্তান কুন্তীভোজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, “আমার প্রথম সন্তান তোমাকে দান করব।”এদিকে শূরের প্রথম সন্তান কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করল; তখন শূর পূর্বপ্রতিজ্ঞা অনুসারে কুন্তীভোজকে সেই পৃথানাম্নী কন্যাটি দান করলেন। কুন্তীভোজ সেই কন্যাটিকে পেয়ে, আপন ভবনে সমাগত ব্রাহ্মণ অতিথির সেবায় নিয়োগ করলেন। এই অবস্থায় পৃথা কোপনস্বভাব ও জিতেন্দ্রিয় কোনও ব্রাহ্মণের শুশ্রূষা করেন।

সেই ব্রাহ্মণের নাম ছিল দুর্বাসা। তিনি ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্ব জানতেন। উগ্ৰস্বভাব ও জিতেন্দ্রিয় চিত্ত ছিলেন। উগ্ৰস্বভাব ও প্রশস্তচিত্ত সেই দুর্বাসাকে কুন্তী সর্ব প্রযত্নে সন্তুষ্ট করেন। কুন্তীভোজের নাম অনুসারে কন্যাটির নাম হয়েছিল কুন্তী। দুর্বাসা সন্তুষ্ট হয়ে কুন্তীর কাছে বশীকরণের একটি মন্ত্র দান করেন। আরও বলেন যে, ভদ্রে আমি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছি। দেবী, তুমি এই মন্ত্রদ্বারা যে যে দেবতার আবাহন করবে। সেই সেই দেবতার অনুগ্রহেই তুমি পুত্রলাভ করবে।”

দুর্বাসা এই কথা বললে, কুন্তী কুমারী হয়েও কৌতুকের বশে সূর্যদেবকে আহ্বান করলেন।

এবং উক্তা চ সা বালা তদা কৌতূহলান্বিতা।

কন্যা সতী দেবমর্কমাজুহাব যশস্বিনী ॥ আদি: ৬২: ১৩৭।

সূর্যদেবও এসে তখনই তাঁর গর্ভাধান করলেন; তাতে তাঁর (কুন্তীর) যথাকালে একটি পুত্র প্রসূত হয়; সেই সময়েই তাঁর কানে দুটি কুণ্ডল এবং শরীরে অভেদ্য কবচ ছিল। সে দেববালকের মতো সুন্দর ও সূর্যের ন্যায় তেজস্বী হয়েছিল; আর মনোহর অঙ্গগুলির দ্বারাই সে অলংকৃত ছিল; ক্রমে সেই বালকটি সমস্ত অস্ত্রধারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছিল।

তখন কুন্তী পিতামাতা প্রভৃতির ভয়ে সেই সুন্দর বালকটিকে গোপনে নিয়ে কোনও পাত্রে করে জলে ভাসিয়ে দিয়ে এলেন। তখন রাধার স্বামী—অধিরথ জলে ভাসমান সেই বালকটিকে নিয়ে আপন পত্নী রাধার পুত্র কল্পনা করল। তারা দুজনে মিলে সেই বালকটির নাম করল—বসুষেণ এবং সেই নামটি সকল দিকে প্রচার করে দিল। সেই বালকটি বড় হতে থেকে বলবান হতে লাগল, সমস্ত অস্ত্রে বিশেষ অভিজ্ঞ হয়ে উঠল এবং সমস্ত বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করল। পরে সেই বালকটি বিজয়ীশ্রেষ্ঠ হয়েছিল। বুদ্ধিমান ও যথার্থবিক্রমী বসুষেণ যে সময়ে পাঠ করতে বসত, সে সময়ে তার ব্রাহ্মণকে কিছুই অদেয় ছিল না।

সুতরাং ইন্দ্র কোনও সময়ে ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করে, পুত্র অর্জুনের হিতার্থে বীর বসুষেণের কাছে গিয়ে তাঁর কুণ্ডল দুটি এবং স্বাভাবিক কবচটি প্রার্থনা করলেন। তখন কর্ণ নিজের শরীর থেকে কেটে সেই কবচ ও কুণ্ডল দুটি ইন্দ্রকে দান করলেন। ইন্দ্র তাতে বিস্ময়াপন্ন হয়ে কর্ণকে একটি শক্তি দান করলেন। এবং বললেন, “হে দুর্ধর্ষ কর্ণ, দেব, অসুর, মনুষ্য, গন্ধর্ব, নাগ ও রাক্ষস প্রভৃতির মধ্যে যার প্রতি তুমি এই শক্তি প্রয়োগ করবে, সেই মরবে।” কবচ ও কুণ্ডল দান করার পূর্বে সেই কুন্তীপুত্রের নাম ছিল বসুষেণ। আর কবচ ও কুণ্ডল দান করার পরে সেই কার্যেই তার নাম হয়েছিল ‘বৈকর্তণ’ এবং ‘কর্ণ’।

কুন্তীপুত্রের জন্মের এই অংশটি বিস্তৃত বিবরণ দিতে হল। কারণ আদিপর্বের আর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাঠে কোনও কোনও পাঠকের ধারণা হয় যে, কুন্তী সদ্যপ্রসূত হয়েছিলেন এবং সূর্যদেব কুন্তীর গর্ভস্থ সন্তানের মুখ দেখে অত্যন্ত তৃপ্ত হন। এবং কর্ণকে জলে বিসর্জন করার আদেশ দান করে স্বর্গে চলে যান। অর্থাৎ কুন্তী স্বাভাবিক দশমাস গর্ভধারণ করেননি। কিন্তু আমরা কুন্তীর মুখেই এর বিপরীত ঘটনা শুনতে পাব।

কুন্তীর নবজাতককে ত্যাগ

বৈশম্পায়ন রাজা জনমেজয়কে ভারত-কাহিনি শোনানোর সময়ে এই বিবরণ দিয়েছিলেন—যদুবংশ শ্রেষ্ঠ শূর নামের এক ব্যক্তি বসুদেবের পিতা ছিলেন; ‘পৃথা’ নামের তার একটি কন্যা জন্মেছিল; জগতে তার রূপের তুলনা ছিল না। এদিকে কুন্তীভোজ রাজা সেই শূরের পিসতুতো ভাই ছিলেন ও সখা ছিলেন। তাঁর কোনও সন্তান জন্মেছিল না; তাই তিনি শূরের কাছে একটি সন্তানদানরূপ অনুগ্রহ প্রার্থনা করেছিলেন। শুরও সন্তান জন্মাবার পূর্বেই প্রথম সন্তান দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। সুতরাং শূর সেই প্রথমা কন্যা পৃথাকে কুন্তীভোজ রাজার হাতে দান করেছিলেন।

সেই পৃথা কুন্তীভোজ রাজার গৃহে দেবতা ও অতিথি সেবায় নিযুক্ত থেকে কোপনস্বভাব অথচ দৃঢ়ব্রত এক ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করেন। যিনি ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব জানতেন এবং যাঁর নাম ছিল—‘দুর্বাসা’। পৃথা সেই কোপনস্বভাব দৃঢ়ব্রত দুর্বাসাকে সর্বপ্রযত্নে সন্তুষ্ট করেন। পৃথার সন্তান হবার প্রতিবন্ধক আছে—ধ্যানে এ সত্য জানতে পেরে দুর্বাসা সেই পৃথাকে আকর্ষণ শক্তিশালী একটি মন্ত্র দান করে বলেছিলেন, “তুমি এই মন্ত্র দ্বারা যে যে দেবতাকে আহ্বান করবে, সেই সেই দেবতার অনুগ্রহেই তোমার পুত্র হবে।” দুর্বাসা এমন বললে, যশস্বিনী কুন্তী কুমারী হয়েও কৌতুকবশত সেই মন্ত্রদ্বারা সূর্যদেবকে আহ্বান করলেন। তারপর সূর্যদেব তখনই মেঘ সরিয়ে নিজের পথ করে আয়তনয়না পৃথানাম্নী সেই কন্যার নিকট উপস্থিত হলেন। অনিন্দ্যসুন্দরী কুন্তী জগতের সৃষ্টিকর্তা সেই সূর্যদেবকে আসতে দেখলেন এবং সেই অদ্ভুত ব্যাপার দেখে বিস্ময়াপন্ন হলেন। সূর্যদেব কুন্তীর নিকটে এসে বললেন, “নীলনয়নে এই আমি এসেছি; বলো, তোমার কী কার্য করব।”

কুন্তী বললেন, “হে শত্রুনাশন, কোনও ব্রহ্মজ্ঞানী আমাকে একটি বর ও একটি মন্ত্র দিয়েছেন। সেই মন্ত্রটির শক্তি জানার জন্য আপনাকে আহ্বান করেছি। এই অপরাধে আমি মস্তক অবনত করে আপনার অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি। কারণ নিজের কাছে অপরাধী হলেও স্ত্রীলোককে সর্বদাই রক্ষা করতে হয়।”

সূর্যদেব বললেন, “পুত্র উৎপাদনের জন্য দুর্বাসা তোমাকে যে বর ও মন্ত্র দিয়েছেন—এ সমস্ত বৃত্তান্তই আমি জানি। সে যাই হোক, তুমি ভয় পরিত্যাগ করে এখনই আমার সঙ্গে সঙ্গম করো! সুন্দরী, তুমি যখন আমাকে ডেকেছ, তখন তোমার দর্শন আমার পক্ষে অব্যর্থ। আর হে ভয়শীলে, এই আহ্বান নিষ্ফল হলেও তোমার দোষ হবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।”

সূর্য অনুনয় করে এইভাবে বহু কথা বললেন; তবুও কুন্তী আমি কুমারী কন্যা এই ভেবে, পিতৃপক্ষের ভয়ে এবং লজ্জাবশত সূর্যের সঙ্গে রমণ করতে ইচ্ছা করলেন না। সূর্যদেব তখন পুনরায় তাঁকে বললেন, “রানি, আমার অনুগ্রহে তোমার কোনও দোষ হবে না। কুন্তী বললেন, “ভগবন, আপনি আমার উপরে প্রসন্ন হোন; আমার কোনও অহংকার নেই। যাতে কন্যাত্বের দোষ ঘটে, তেমন কার্য আপনারও পরিত্যাগ করা উচিত।” সূর্য বললেন, “তোমার ভয় দূর হোক; তুমি শীঘ্রই পুত্র দেখতে পাবে; আর আমার আদেশে তুমিও পুনরায় কন্যাই হবে।”

ব্যপধাতু ভয়ং তেহদ্য কুমারং প্রসমীক্ষসে।

ময়া ত্বঞ্চাপ্যনুজ্ঞাতা পুনঃ কন্যা ভবিষ্যসি ॥ আদি: ১০৫: ১৯ ॥

প্রকাশকর্তা ভগবান সূর্যদেব কুন্তীকে এই কথা বলে তখনই তাঁর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হলেন।

তখনই কুন্তীর সুন্দর একটি পুত্র জন্মাল; তার অঙ্গে কবচ ও দেববালকের ন্যায় সুলক্ষণ ছিল এবং ভবিষ্যতে এই বালকই সকল অস্ত্রজ্ঞশ্রেষ্ঠ বীর হয়েছিল। তার কবচটি স্বাভাবিক ছিল এবং দুটি কুণ্ডলে মুখমণ্ডল উদ্ভাসিত করেছিল এবং সেই বালক কর্ণ নামে ভবিষ্যতে জগতে বিখ্যাত হয়েছিল।

সূর্যদেব পুনরায় কুন্তীকে কন্যাত্ব দান করলেন এবং দান করে তখনই আকাশে উঠে গেলেন। একটি পুত্র জন্মেছে দেখে কুন্তী অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে একাগ্রমনে চিন্তা করলেন যে, কী করলে সকল দিকে মঙ্গল হবে। তখন তিনি বন্ধুগণের ভয়ে সেই দূষিত কার্য গোপন করার জন্য, সেই বলিষ্ঠ বালকটিকে কোনও পাত্রে জলে ভাসিয়ে দিলেন। তখন সূতবংশীয় অধিরথ নিজ ভার্যা রাধার সঙ্গে গিয়ে সেই বালকটিকে তুলে এনে আপনাদের পুত্র বলে কল্পনা করল। এবং সেই বালকটি বসুর (স্বর্ণকুণ্ডলের) সঙ্গেই জন্মেছে বলে তারা নাম রাখল বসুষেণ।

সেই বলিষ্ঠ বালক বৃদ্ধি পেতে থেকে সমস্ত অস্ত্রে উন্নতি লাভ করতে থাকল এবং মধ্যাহ্নকাল পর্যন্ত সূর্যের উপাসনা করত। সেই সূর্যোপসনার সময়ে বুদ্ধিমান ও বীর কর্ণ যখন জপ করতেন, তখন পৃথিবীতে এমন কোনও ধন ছিল না, যা তাঁর ব্রাহ্মণকে অদেয় ছিল।

সেই কারণে কিছুকাল অতীত হলে, একদিন সূর্যদেব ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ এসে স্বপ্নের মধ্যে কর্ণকে বললেন, “বীর, আমার কথা শোনো। এই রাত্রি প্রভাত হলে, দেবরাজ ইন্দ্র ব্রাহ্মণের রূপ ধরে তোমার কাছে আসবেন; তুমি তাঁকে কোনও ভিক্ষাই দান করবে না। কারণ, তিনি তোমার কবচটি ও কুণ্ডল দুটি অপহরণ করবার জন্য স্থিরসংকল্প করেছেন। এই জন্যই আমি তোমাকে পূর্বেই তা বুঝিয়ে দিলাম। সেই সময়ে আমার এই কথা স্মরণ কোরো।”

কর্ণ বললেন, “ব্রাহ্মণ, ইন্দ্র যদি ব্রাহ্মণরূপে এসে আমার কাছে প্রার্থনা করেন, তবে আমি কেন তাঁকে ভিক্ষা দেব না যে, আপনি আমাকে এইরূপ বোঝাচ্ছেন। ব্রাহ্মণগণ দেবগণেরও পূজনীয়। যেহেতু দেবগণ সর্বদাই ব্রাহ্মণদের প্রিয়কার্য করেন। সেই ব্রাহ্মণকে আবার দেবরাজ বলে জানতে পেরে আমি তাঁকে কিছুতেই প্রত্যাখ্যান করতে পারব না।”

সূর্য বললেন, “বীর, যদি তাই হয়, তবে আমার কথা শোনো, ইন্দ্রও তোমাকে বর দিতে চাইবেন; তখন তুমি সর্বশত্রুনাশক শক্তি অস্ত্র চাইবে।” ব্রাহ্মণরূপী সূর্য স্বপ্নের মধ্যে এই কথা বলে সেখানেই অন্তর্হিত হলেন। তারপর প্রভাতকাল হলে কর্ণ জাগরিত হয়ে সেই স্বপ্নের বিষয়ই চিন্তা করতে লাগলেন। এমন সময়ে পুত্র অর্জুনের হিতসাধনে নিরত ইন্দ্র ব্রাহ্মণের রূপ ধরে, ভিক্ষার জন্য উপস্থিত হয়ে, কর্ণের কাছে সেই কবচটি প্রার্থনা করলেন। তখন কর্ণ আপন শরীর থেকে সেই স্বভাবজাত কবচটি কেটে কৃতাঞ্জলি হয়ে, ব্রাহ্মণরূপী ইন্দ্রকে তা দান করলেন। দেবরাজ সেই কবচটি গ্রহণ করে, কর্ণের সেই কার্যে সন্তুষ্ট হয়ে হাসতে হাসতে মনে মনে বললেন, “কী অদ্ভুত সাহস। দেবদানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস ও নাগগণের মধ্যে এমন কাউকেও দেখতে পাই না যে লোক এই অপূর্ব সাহসের কাজ করতে পারে।” ইন্দ্র প্রকাশ্যভাবে বললেন, “কর্ণ, তোমার এই কার্যে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি; অতএব তুমি যা ইচ্ছা করো, সেই বরের উল্লেখ করো।” কর্ণ বললেন, “আপনি শত্রুনাশক শক্তি অস্ত্র আমাকে দান করুন, এই ইচ্ছা করি।” দেবরাজ কর্ণকে শক্তি অস্ত্র দান করলেন এবং বিস্ময়বশত এই কথা বললেন, “কর্ণ, তুমি ক্রুদ্ধ হয়ে দেবদানব, যক্ষ রাক্ষস এবং নাগগণের মধ্যে যার উপরে এই অস্ত্র প্রয়োগ করবে, সেই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। কিন্তু এই অস্ত্র যুদ্ধে কেবল একজন শত্রুকে বধ করে তার পরে আমার কাছে চলে আসবে।” কর্ণকে বরদান করে এই কথা বলে ইন্দ্র অন্তর্হিত হলেন। প্রথমে রাধা ও অধিরথ সেই কুন্তীপুত্রের নাম দিয়েছিল, ‘বসুষেণ!’ তারপর কবচ কেটে দেওয়ায়, তার আরও দুটি নাম হয়েছিল— ‘কর্ণ’ এবং ‘বৈকর্তন’।

কুন্তীর স্বয়ংবর ও বনবাস

উৎসাহ, রূপ ও গুণশালিনী বিশালনয়না কুন্তীভোজকন্যা পৃথা ক্রমশ ধর্মপরায়ণা এবং ব্রতচারিণী হয়ে উঠলেন। রূপ ও যৌবনবতী এবং লজ্জা ও কোমলতা প্রভৃতি স্ত্রীগুণশালিনী সেই তেজস্বিনী কন্যাটিকে গ্রহণ করার জন্য অনেক রাজাই প্রার্থনা জানালেন। তখন পিতা কুন্তীভোজ রাজা অন্যান্য রাজাকে আহ্বান করে সেই কন্যাটিকে স্বয়ংবরে দান করবার ইচ্ছা করলেন।

তারপর বুদ্ধিমতী কুন্তী গিয়ে রাজসভার মধ্যস্থানবর্তী ভরতবংশপ্রদীপ রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুকে দেখতে পেলেন। তার সিংহের ন্যায় দর্প, বিশাল বক্ষঃস্থল এবং বৃষের মতো নয়নযুগল ছিল এবং সূর্য যেমন আপন তেজে অন্যান্য গ্রহকে তিরোহিত করেন পাণ্ডুও তেমনই আপন কান্তিতে অন্যান্য রাজার কান্তি তিরোহিত করে, দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় রাজসভায় অবস্থান করছিলেন। অনিন্দ্যসুন্দরী কল্যাণী কুন্তী সভামধ্যে নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুকে দেখে মনে মনে আকুল হয়ে পড়লেন। পরে রোমাঞ্চিতদেহা চঞ্চলচিত্ত কুন্তী সলজ্জভাবে সখীগণের সঙ্গে গিয়ে পাণ্ডুর গলদেশে বরমাল্য সমর্পণ করলেন। কুন্তীদেবী পাণ্ডুকে বরণ করেছেন দেখে, রাজারা যেমন এসেছিলেন, তেমনই হস্তী, অশ্ব ও রথে আরোহণ করে চলে গেলেন।

তারপর কুন্তীর পিতা কুন্তীভোজ রাজা, কুন্তী ও পাণ্ডুর বিবাহ করালেন। পরে ইন্দ্র যেমন শচীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, তেমনই অত্যন্ত ভাগ্যবান পাণ্ডুও কুন্তীর সঙ্গে মিলিত হলেন। প্রজারঞ্জক কুন্তীভোজ রাজা যৌতুকস্বরূপ নানাবিধ রত্নালংকার দ্বারা সম্মানিত করে কৌরবশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুকে তাঁর রাজধানীতে প্রেরণ করলেন।

পাণ্ডু রাজা নানাবিধ ধ্বজ ও পতাকাধারী বিশাল সৈন্যের সঙ্গে প্রস্থান করলেন; তখন মহর্ষিগণ ও ব্রাহ্মণগণ জয়ধ্বনি ও আশীর্বাদ দ্বারা পাণ্ডুর স্তব করতে লাগলেন; এই অবস্থায় পাণ্ডু আপন রাজধানী হস্তিনায় উপস্থিত হয়ে ভার্যা কুন্তীদেবীকে নিজভবনে প্রবেশ করালেন।

তারপর, বুদ্ধিমান ভীষ্ম যশস্বী পাণ্ডুরাজাকে আর একটি বিবাহ করাবেন বলে স্থির করলেন এবং মদ্রদেশের রাজধানীতে বহলীর বংশশ্রেষ্ঠ শল্য রাজার কাছে তাঁর ভগিনীকে প্রার্থনা করলেন। পাণ্ডু ও মাদ্রীর বিবাহ হয়ে গেল। রাজশ্রেষ্ঠ পাণ্ডু সেই কুন্তী ও মাদ্রী— এই দুটি ভার্যার সঙ্গে ইচ্ছা ও সুখ অনুসারে একমাস কাল বিহার করার পরে দিগ্বিজয় করার জন্য রাজধানী থেকে নির্গত হলেন। প্রথমে দশার্ণ, তারপর মগধ, পরে মিথিলায় গিয়ে বিদেহবাসীকে যুদ্ধে জয় করলেন। পরে কাশী, শুম্ভ্র ও পুণ্ড্রদেশের রাজাকে বধ করে কুরুবংশের যশ বিস্তার করলেন। পৃথিবীর সকল রাজাই পাণ্ডুর কাছে পরাজিত হয়ে তাঁকেই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বলে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। গণনাতীত উপঢৌকন নিয়ে পাণ্ডু হস্তিনায় ফিরলেন। রাজশ্রেষ্ঠ শান্তনু ও বুদ্ধিমান ভরতের কীর্তিকাহিনি প্রায় লুপ্ত হয়েছিল কিন্তু পাণ্ডু পুনরায় তা উদ্ধার করলেন। পাণ্ডু আপন বাহুবল অর্জিত শুভলক্ষণ রত্নগুলি সত্যবতী, ভীষ্ম, মাতা অম্বালিকা ও অম্বিকা, ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুরকে প্রদান করলেন।

তারপরে পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে মিলিত হয়ে আলস্য পরিত্যাগ করে বনে গমন করলেন। হিমালয় পর্বতের দক্ষিণপার্শ্বস্থ মনোহর স্থানে বিচরণ করে তিনি মৃগয়া করতেন। দুটি হস্তিনীর মধ্যে হস্তী যেমন শোভা পায়, তেমনই দুই অপরূপা নারী কুন্তী ও মাদ্রীর বিচরণ করা দেখে লোকেরা পাণ্ডুকে কোনও দেবতা বলে ভুল করত। ইতিমধ্যে দেবতার সঙ্গে মিলনের ফলে কুন্তী ধর্মের পুত্র যুধিষ্ঠির ও বায়ুর পুত্র ভীমসেনের জন্মদান করেছিলেন। যেদিন ভীমসেনের জন্ম হয় সেইদিন ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধনেরও জন্ম হয়। পাণ্ডুমুনির অভিশাপে প্রজনন শক্তি হারিয়েছিলেন।

একদা পাণ্ডু, হরিণ ও হিংস্ৰজন্তু পরিপূর্ণ মহাবনে বিচরণ করতে থেকে, মৈথুনপ্রবৃত্ত একটি প্রধান হরিণকে দেখতে পেলেন। তারপরে তিনি স্বর্ণখচিত, সুন্দর পঙ্কযুক্ত ও শীঘ্রগামী পাঁচটি তীক্ষ বাণদ্বারা সেই হরিণ ও হরিণীকে বিদ্ধ করলেন। বস্তুত এক অত্যন্ত তেজস্বী ঋষিকুমার হরিণরূপে হরিণীরূপিণী নিজ ভার্যার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। হরিণরূপী সেই ঋষিকুমার সেই ভার্যার সঙ্গে মিলিত অবস্থাতেই তৎক্ষণাৎ বিকলেন্দ্রিয় ও ভূতল পতিত হয়ে মনুষ্যোচিত বাক্য উচ্চারণ করতে করতে বিলাপ করতে লাগলেন। মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “কামার্ত, ক্রুদ্ধ মূঢ় এবং পাপাসক্ত ব্যক্তিরাও এইরূপ নৃশংস কার্য করে না। অথবা, বুদ্ধি দৈবকে লুপ্ত করতে পারে না। কিন্তু দৈবই বুদ্ধি লোপ করে দেয়। অতএব বুদ্ধিমান ব্যক্তিও দৈবনিবন্ধন উপস্থিত বিষয় ভোগ করে থাকেন। মহারাজ আপনি চিরধার্মিক প্রধান বংশে জন্মেছেন; এই অবস্থায় আপনি কামে ও লোভে অভিভূত হলেন কেন? এবং আপনার বুদ্ধিই বা সৎপথচ্যুত হল কেন?”

পাণ্ডু বললেন, “যে কারণে রাজাদের শত্রুবধে প্রবৃত্তি জন্মে থাকে, সেই কারণেই মৃগবধেও প্রবৃত্তি হয়ে থাকে; সুতরাং তুমি মোহবশে মৃগয়ার নিন্দা করতে পারো না। অকপট বেশে এবং অকপট ব্যবহারে মৃগবধ করা শাস্ত্রকারদেরও অভীষ্ট। সুতরাং তা রাজাদের ধর্ম; অতএব তা তুমি ক্ষমা করতে পারো। দেখো, মহর্ষি অগস্ত্য মহাবনমধ্যে যজ্ঞে প্রবৃত্ত থেকে, বন্য সমস্ত পশুকে প্রেক্ষণ করে মৃগয়া করেছিলেন। বেদে যে ধর্ম দেখা যায়, আমি সেই ধর্ম অনুসারেই তোমাকে বধ করেছি। সুতরাং তুমি আমাকে নিন্দা করছ কেন? বিশেষত মহর্ষি অগস্ত্যের মৃগয়া দেখে অন্য ঋষিরাও তোমাদের বধ করে তোমাদের বসা (শরীরের ধাতুবিশেষ) দ্বারা হোম করেছেন।” মৃগরূপী ঋষিকুমার বললেন, “মহারাজ! আপনি আমাকে মৃগ বলে বধ করেছেন, তাতে আমি নিজের জীবনের জন্য আপনাকে নিন্দা করছি না। কিন্তু দয়া করে আমার মৈথুন সমাপ্তি পর্যন্ত আপনার প্রতীক্ষা করা উচিত ছিল। সকল প্রাণীর হিতকর এবং সকল প্রাণীর অভীষ্ট মৈথুনের সময় কোনও জ্ঞানী লোক মৃগকে বধ করে থাকে? মহারাজ আমি পুত্র উৎপাদন করার জন্য আনন্দে এই মৃগীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম; আপনি তা নিষ্ফল করে দিলেন। রাজা, যাঁরা পরের জন্য ক্লেশ জনক কার্য করতেন না, আপনি সেই পৌরবগণের বংশে জন্মেছেন; সুতরাং আপনার পক্ষে এ-কার্য উপযুক্ত হয়নি। সকল লোকই গুরুতর নৃশংস কার্যের নিন্দা করে থাকে। কেন-না তা পাপজনক; সুতরাং তা স্বর্গের প্রতিবন্ধক এবং লোকনিন্দার কারণ। হে দেবতুল্য, আপিন তো স্ত্রীসম্ভোগসুখের মর্ম জানেন এবং শাস্ত্রের ও ধর্মের তত্ত্ব বিদিত আছেন; এ অবস্থায় আপনি এমন নরকজনক কার্য করবার যোগ্য নন।

মহারাজ, নৃশংসকার্যকারী পাপাচারী এবং ধর্ম, অর্থ ও কামবিহীন লোকেদের আপনারই দণ্ড দেওয়া উচিত। বনবাসী, ফলমূলহারী মৃগয়াধারী, সর্বদা শান্তিপরায়ণ এবং মুনিরূপী আমাকে বধ করে আপনি আজ কী করে ফেলেছেন, তা আপনি জানেন না। সে যাই হোক, আপনি যখন আমাকে বধ করেছেন, তখন আমিও আপনাকে অভিসম্পাত করছি। আপনি যখন আমাদের দুজনকেই বধ করেছেন এবং আপনি অসংযত ও কামমুগ্ধ তখন আপনারও এইরূপই জীবননাশক অবস্থা উপস্থিত হবে। আমি তপস্যায় অতুলনীয় কিমিন্দম নামে মুনি। মনুষ্যের মধ্যে লজ্জা উপস্থিত হওয়ায় আমি হরিণের রূপ ধরে ভার্যার সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। আমি হরিণ হয়ে হরিণদের মধ্যে নিবিড় বনের মধ্যে বিচরণ করছিলাম। সুতরাং আপনি ব্রাহ্মণ বলে আমাকে জানতে পারেননি। অতএব আমাকে হত্যা করা আপনার পক্ষে ব্রহ্মহত্যা করা হবে না। মূর্খ, আমি কামমোহিত হয়ে মৃগরূপ ধারণ করে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিলাম। এই অবস্থায় আপনি আমাকে হত্যা করেছন। অতএব আপনি আমাকে হত্যা করায় এইরূপ কার্যের ফললাভ করবেন। আপনিও কামমুগ্ধভাবে প্রিয়তমার সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়ে এই অবস্থাতেই প্রেতলোক গমন করবেন। আপনি যে প্রিয়তমা রমণীর সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হবেন, সমস্ত প্রাণীর দুরতিক্ৰমণীয় প্রেতলোকে ভক্তি সহকারে সেই রমণী আপনার অনুগমন করবে। আমি সুখভোগ করছিলাম, এই অবস্থায় আপনি যেমন আমাকে দুঃখভোগ করালেন, তেমনই সুখভোগের সময়ে আপনারও দুঃখ এসে পড়বে।

এই কথা বলে মৃগরূপধারী সেই কিমিন্দম মুনি অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় প্রাণত্যাগ করলেন। পাণ্ডু নিজের বন্ধুজনের ন্যায় মৃত সেই কিমিন্দম মুনিকে পরিত্যাগ করে এসে, শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে, পীড়িত লোকের ন্যায় ভার্যাদের কাছে বিলাপ করতে লাগলেন। পাণ্ডু বললেন, “হায়! অসংযত চিত্ত ও কামমুগ্ধ লোকেরা সৎকুলে জন্মেও দুষ্কাৰ্যবশতই দুর্গতি ভোগ করে। শুনেছি যে, আমার পিতাও চিরধার্মিকের পুত্র ছিলেন। তথাপি তিনিও চিরধার্মিকের পুত্র হয়েও কামনিবন্ধন বাল্য অবস্থাতেই প্রাণত্যাগ করেছিলেন। সেই কামুক রাজার ভার্যার গর্ভে সাক্ষাৎ নারায়ণ ব্যাসদেব আমাকে উৎপাদন করেছেন। সেই আমারই আজ এই বিপত্তিঘটক বুদ্ধি জন্মেছে। হায়! মৃগয়ায় গিয়ে ন্যায়-বিগর্হিত কার্য করায় দেবতারাও আমাকে পরিত্যাগ করেছেন।

অতএব আমি মুক্তির পথই অবলম্বন করব। কেন-না বন্ধনই গুরুতর বিপদের কারণ। সুতরাং পিতা বেদব্যাসের যে সদ্‌বৃত্তি আছে, আমিও সেই চিরন্তনী সদ্‌বৃত্তি আশ্রয় করব। অতএব আমি নিশ্চয়ই ভার্যা ও পরিজনদের পরিত্যাগ করে এক একটি বৃক্ষমূলে থেকে গুরুতর তপস্যায় আত্মনিয়োগ করব। আমি সমস্ত সংসর্গ পরিত্যাগ করে, মুনি হয়ে ধূলিধূসরিত দেহে ভিক্ষা করতে থেকে এই পৃথিবীতে বিচরণ করব। প্রয়োজন হলে শূন্যগৃহে আশ্রয় নেব। আর বৃক্ষমূলে বিশ্রাম করব। নিজের নিন্দা ও প্রশংসাকে সমান মনে করব। কারও আশীর্বাদের প্রার্থী হব না। কিংবা কারও নমস্কার চাইব না। শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্দ্ব দুঃখ সহ্য করব; কোথাও প্রতিগ্রহ করব না; কাউকেও উপহাস করব না কিংবা কারও প্রতি ভ্রূকুটি করব না। সর্বদা প্রসন্ন বদন থাকব; সমস্ত প্রাণীরই হিতসাধনে নিরত থাকব এবং চতুর্বিধ প্রাণীর মধ্যে স্থাবর বা জঙ্গম কোনও প্রাণীর প্রতি হিংসা করব না। সর্বদাই নিজের সন্তানের মতো সকল প্রাণীর প্রতি সমান ব্যবহার করব। কেবল এক সময়ে দশ ঘরে বা পাঁচ ঘরে ভিক্ষা করব। তাতে ভিক্ষা না পেলে, কখনও তার বেশি ঘরে ভিক্ষা করব না। মোটেই ভিক্ষা না পেলে উপবাস করব। লোভবশত বেশি করে ভিক্ষা করব না।মোটেই পাঁচ ঘরে ভিক্ষা না পেলে, অন্তত সাত ঘরে ভিক্ষা করব; পাই বা নাই পাই, গৃহস্থদের প্রতি সমদর্শী থাকব এবং মহাতপস্বী হব। বাইস দিয়ে একখানি বাহুকে কেটেছেঁটে কৃশ করে এবং চন্দন দিয়ে একখানি বাহুকে সিক্ত করে তাতে মঙ্গল বা অমঙ্গল ভাবব না। জিজীবিষু লোকের ন্যায় কোনও কার্য করব না। কিংবা মুমূর্ষু লোকের মতো কোনও কার্য করব না এবং জীবনের প্রতি কোনও আদর করব না বা মরণের প্রতিও কোনও বিদ্বেষ করব না। মানুষ জীবিত থেকে উন্নতির জন্য যা-কিছু কার্য করতে পারে, তৎকাল বিহিত সে সকল কার্যই পরিত্যাগ করব। তারপর সেই সংকট অবস্থাতে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের কার্য পরিত্যাগ করব। ধর্ম ও অর্থ একেবারে ত্যাগ করব; আত্মার মল রাগদ্বেষাদি নির্মূল করব। সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হব, সকল বন্ধন ছিঁড়ে ফেলব, এবং বায়ুর মতো কারও অধীন থাকব না। সর্বদা এরূপ ব্যবহারে চলতে থেকে মুক্তির পথ আশ্রয় করে দেহত্যাগ করব, কিন্তু মৃগমুনির অভিসম্পাতেও আমার সন্তানোৎপাদন শক্তি নষ্ট হয়েছে বলে গৃহস্থধর্ম আমার পক্ষে শোকের আকর, স্বধর্মভ্রষ্ট এব নিতান্ত নিকৃষ্ট; অতএব আমি আর গৃহধর্ম আচরণ করব না, পুত্রাভিলাষী যে লোক আদৃত বা অবজ্ঞাত হয়ে কাতর নয়নে অন্য পুরুষের কাছে পুত্রোৎপাদনের প্রার্থনা করে, সে লোক কুকুরের ব্যবহারই করে।”

এই বলে অত্যন্ত দুঃখিত পাণ্ডু গুরুতর নিশ্বাস ত্যাগ করে কুন্তী ও মাদ্রীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “আমার মাতা অম্বালিকা, বিদুর, সঞ্জয়, বন্ধুবর্গের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র, আর্যা সত্যবতী, ভীষ্ম, রাজপুরোহিতগণ, সোমপায়ী ও দূরবর্তী মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ এবং হস্তিনানগরে আমাদের আশ্রয়ে যে-সকল বৃদ্ধ বাস করেন, তাঁদের সকলের নিকট অনুনয় করে তোমরা বলবে যে, ‘পাণ্ডু বনমধ্যে প্রব্রজ্যা অবলম্বন করেছেন।” বনবাসে কৃতসংকল্প পাণ্ডুর সেই কথা শুনে কুন্তী ও মাদ্রী তখন এক কথা বললেন, “মহারাজ, আমরা আপনার ধর্মপত্নী সুতরাং আমাদের সঙ্গে মিলিত হয়েই আপনি গুরুতর তপস্যা করবার জন্য আশ্রমও তো অবলম্বন করতে পারেন। তা হলে শরীর মুক্তির জন্য মহাফলজনক ধর্ম অর্জন করে স্বর্গলাভের পরেও আপনিই আমাদের ভর্তা হবেন এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা ইন্দ্রিয়দমনপূর্বক আপনার স্থানেই যাত্রার কামনা করব এবং কামসুখ ও অন্যান্য সুখ ত্যাগ করে গুরুতর তপস্যা করব। কিন্তু হে নরনাথ, মহাপ্রাজ্ঞ, আপনি যদি আমাদের ত্যাগ করেন, তবে আমরা আজই প্রাণত্যাগ করব। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।”

পাণ্ডু বললেন, “এই ধর্মসংগত বিষয়ই যদি তোমাদের অভিপ্রেত হয়, তা হলে আমি, পিতা বেদব্যাসের সেই চিরস্থায়ী সদ্‌বৃত্তিরই অনুসরণ করব। আমি সুখজনক গ্রাম্য আহার ত্যাগ করে গুরুতর তপস্যা করব এবং বল্কল ধারণ করে ফলমূল ভক্ষণ মহাবনে বিচরণ করতে থাকব। সন্ধ্যাকালে ও প্রাতঃকালে অগ্নিতে হোম করব; ওই দুই সময়ে স্নান করব, শরীরটিকে কৃশ করতে থাকব, পরিমিত আহার করব এবং কৌপীন কৃষ্ণসার চর্ম ও জটা ধারণ করব। শীত, বায়ু ও রৌদ্রের কষ্ট সহ্য করব এবং ক্ষুধা-পিপাসার অপেক্ষা রাখব না। এইভাবে দুষ্কর তপস্যা দ্বারা শরীরটাকে শুষ্ক করতে থাকব। আর বন্য ফলমূল, মন্ত্র ও জল দ্বারা পিতৃগণ ও দেবতাগণের তৃপ্তিসাধন করব এবং নির্জনে থেকে ভগবানের ধ্যান করব। আর বনবাসী গৃহস্থের সঙ্গেও দেখা করব না বা তাঁদের অপ্রিয় আচরণ করব না। গ্রাম্য গৃহস্থদের কথা আর কী বলব। আমি মুক্তিলাভের আশায় এই দেহধারণের সমাপ্তি পর্যন্ত বানপ্রস্থ শাস্ত্রের এইরূপ ভয়ংকর ও অতি ভয়ংকর বিহিত বিষয়গুলি ক্রমিক অবলম্বন করব।”

পাণ্ডু তখন আপন দেহের অলংকার ও ভূষণ অনুচরদের হাতে প্রদান করে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাঠিয়ে দিলেন এবং সমস্ত বিবরণ তাঁকে নিবেদন করতে বললেন। অনুচরগণ আদেশ পালন করল। রাজপুত্র পাণ্ডু ফলমূল ভোজন করতে থেকে, ভার্যাদের সঙ্গে সে স্থান থেকে নাগশত পর্বতে চলে গেলেন। সেখান থেকে কালকূট পর্বত, গন্ধমাদন পর্বত, ইন্দ্রদ্যুম্ন সরোবর পার হয়ে শতশৃঙ্গ পর্বতে উপস্থিত হলেন। শক্তিশালী পাণ্ডু, শতশৃঙ্গ পর্বতে কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়ে সিদ্ধ ও চারণদের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে উঠলেন। ঋষিপুত্র ও ভ্রাতারা তাঁকে প্রিয়সখার মতো ও ঋষিরা তাঁকে পুত্রের মতন দেখতেন। তপস্যা সাধনা দ্বারা পাণ্ডু ক্রমশ ব্রহ্মর্ষি তুল্য হয়ে উঠলেন।

কোনও সময়ে অমাবস্যা তিথিতে দৃঢ়ব্রতচারী ঋষি ও মহর্ষিরা সম্মিলিত হয়ে ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করার জন্য ব্রহ্মলোক উদ্দেশে যাত্রা করলেন। পাণ্ডু তাঁদের সঙ্গী হলেন। তিনি কুন্তী ও মাদ্রীর সঙ্গে উত্তরমুখ হয়ে স্বর্গেরও উপরে যাবার জন্য মহর্ষিদের সঙ্গে শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে যাত্রা করলেন। ঋষিরা তাঁকে বারণ করলেন, “মহারাজ, আমরা উত্তরমুখ হয়ে, ক্রমশ এই পর্বতরাজের উপরে যেতে থেকে পূর্বে এই মনোহর পর্বতে বহুতর দুর্গম দেশ দেখেছি। আরও দেখেছি যে, দেবতা গন্ধর্ব ও অপ্সরাদের অনেক বিহারস্থান আছে। সেগুলি সর্বদাই বহুতর বিমানে পরিপূর্ণ এবং গীতধ্বনিতে মুখরিত থাকে এবং কুবেরের উদ্যান সকল, সমতল ও বিষমতল স্থানসমূহ, বড় বড় নদী এবং দুর্গম পর্বতগুহা আছে। তারপর এমন অনেক দেশ আছে যেখানে সর্বদাই তুষারপাত হয়; এমনকী সেখানে বৃক্ষ নেই, পশুও নেই, পক্ষীও নেই। কতগুলি দেশ আছে, যেখানে সর্বদাই বৃষ্টি হয়। আবার অনেক দেশ আছে যা অত্যন্ত দুর্গম। সে সকল দেশ পক্ষীও অতিক্রম করতে পারে না; তা অন্য প্রাণী কী করে অতিক্রম করবে। সেখানে কেবল বাতাস বহিত হয়, আর সিদ্ধ মহর্ষিরা যেতে পারেন। আর এই রাজকন্যা দুজন কষ্ট সইতে অক্ষম, সুতরাং এঁরা পর্বতে অবসন্ন হয়ে পড়বেন। অতএব মহারাজ, আপনি আমাদের সঙ্গে আসবেন না।

পাণ্ডু বললেন, “মহাশয়, মুনিরা বলে থাকেন, নিঃসন্তান লোকের স্বর্গে যাবার স্থান নেই। আমি নিঃসন্তান এবং পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হতে পারিনি। পিতৃলোক, দেবতা, ঋষি ও মনুষ্য—এই চারজাতির চতুর্বিধ ঋণযুক্ত হয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে। যজ্ঞ করে দেবঋণ থেকে, বেদপাঠ ও তপস্যা করে ঋষিঋণ থেকে, পুত্র উৎপাদন ও শ্রাদ্ধ করে পিতৃঋণ এবং দয়া প্রকাশ করে মনুষ্যঋণ থেকে মুক্ত হবে। আমি দেবঋণ ঋষিঋণ ও মনুষ্যঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি কিন্তু পিতৃঋণ থেকে এখনও মুক্তিলাভ করিনি। পুত্র-উৎপাদন না করায় আমার মৃত্যুর পর পিতৃগণের পতন হবে। অতএব আমি যেমন পিতার পত্নীর গর্ভে বেদব্যাসের ঔরসে জন্মেছিলাম তেমনই আমার এই পত্নীর গর্ভে কী প্রকারে পুত্র জন্মাতে পারে?”

ঋষিরা বললেন, “মহারাজ, আমরা দিব্যচক্ষু দ্বারা দেখতে পাচ্ছি যে আপনার দেবতুল্য সর্বকল্যাণভাজন ও নিস্পাপ পুত্র রয়েছে। দৈব যা সূচনা করেছে, আপনি কর্মদ্বারা তা সম্পাদন করুন। আপনি ফললাভের জন্য যত্ন করুন, আপনি অবশ্যই গুণবান ও আনন্দজনক পুত্র লাভ করবেন।”

কুন্তী পুত্রদের জন্ম

পাণ্ডু মুনিঋষিদের মুখ থেকে শুনলেন যে, তাঁর উপযুক্ত পুত্র সন্তানের জন্ম হবে আবার মৃগমুনির অভিসম্পাতে নিজের রমণ ব্যাপারে যে বিঘ্ন ঘটেছে তা স্মরণ করে পাণ্ডু চিন্তায় আকুল হলেন। পরে তিনি নির্জনে ধর্মপত্নী কুন্তীদেবীকে বললেন, “দেবী, এই বিপদের সময় তুমি পুত্র উৎপাদনের জন্য চেষ্টা করবে, আমার এ বক্তব্যে সম্মত হও। কুন্তী ধর্মবাদী পণ্ডিতেরা সর্বদা মনে করেন যে, পুত্রই ইহলোক ও পরলোকের ধর্মসংগত আশ্রয়। যজ্ঞ, দান, তপস্যা ও যথানিয়মে বিহিত ব্রত—এর সমস্তগুলি মিলিয়ে অপুত্রকের পাপনাশ করে না। আমি একথা জেনে এবং পুত্রহীন বলেই পুণ্যলোক লাভ করতে পারব না—এই ভেবেই বর্তমানে এটাই কর্তব্য বলে মনে করছি। সুন্দরী, আমি অশিক্ষিত বলেই নৃশংস কার্য করেছি। তার উপরে পূর্বে মৃগমুনির অভিসম্পাতে আমার সন্তানোৎপাদন শক্তি ব্যাহত। এমনকী নষ্টই হয়েছে তা তুমি জানো।

‘কুন্তী, ধর্মশাস্ত্রে দেখা যায় ছয় প্রকার পুত্র পৈতৃক ধনের অধিকারী হয় আর ছয় প্রকার পুত্র পৈতৃক ধনের অধিকারী হয় না। দত্তক, অপবিদ্ধ, কৃত্রিম, স্বয়ংদত্ত, সহোঢ়, পৌত্র (পরাশর) এরা পৈতৃক ধনের অধিকারী হয় না। কেবলমাত্র ঔরস, ক্ষেত্রজ, ক্রীত, পৌনৰ্ভব, কানীন এবং গূঢ়োৎপন্ন পুত্রেরাই পৈতৃক ধনের অধিকারী। পূর্ব পূর্ব পুত্রের অভাবে মাতা পরপর পুত্র লাভ করবার চেষ্টা করবেন অথবা আপৎকালে স্ত্রীলোকেরা উৎকৃষ্ট বর্ণের পুরুষ থেকে কিংবা দেবর থেকে পুত্র লাভ করবার ইচ্ছা করে থাকেন।

“কুন্তী, স্বায়ম্ভুব মনু বলেছেন যে, মনুষ্যগণ ঔরস পুত্র অপেক্ষাও ক্ষেত্রজ পুত্র শ্রেষ্ঠ ও ধর্মফল দান করে বলে তাই লাভ করে থাকেন। কুন্তী আমার নিজের সন্তানোৎপাদন শক্তি নষ্ট হয়েছে বলে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি যে, তুমি সবর্ণ ও উত্তমবর্ণ পুরুষ থেকে পুত্র লাভ করো। এই প্রসঙ্গে তোমাকে শারদণ্ডায়নীর উপাখ্যান বলব। বীরপত্নী শারদণ্ডায়নীকে তাঁর পতি ক্ষেত্রজ জন্মাবার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। শারদণ্ডায়নী ঋতুস্নান করে শুদ্ধ হয়ে রাত্রিতে চতুষ্পথে গিয়ে যোগসিদ্ধ কোনও ব্রাহ্মণকে বরণ করেছিলেন এবং তাঁর দ্বারা পুত্র সন্তান জন্মাবার জন্য হোম করেছিলেন। পরে সেই হোম সমাপ্ত হলে, ব্রাহ্মণের সঙ্গে বাস করেছিলেন; তারপর দুর্জয় প্রভৃতি তিনটি মহারথ পুত্র যথাসময়ে প্রসব করেছিলেন। তুমিও আমার আদেশ অনুসারে কোনও বিশিষ্ট তপস্বী দ্বারা পুত্র উৎপাদনের জন্য সত্বর চেষ্টা করো।”

পাণ্ডু এইরূপ বললে, কুন্তীদেবী কৌরবশ্রেষ্ঠ মহাবীর ও নিজ স্বামী পাণ্ডুকে বললেন, “হে পদ্মনয়ন, আপনি ধর্মজ্ঞ, আমি আপনার ধর্মপত্নী এবং সর্বতোভাবে আসক্ত; সুতরাং আপনি কোনও প্রকারেই আমাকে একথা বলতে পারেন না। অতএব মহারাজ, ধর্ম অনুসারে আপনিই আমার গর্ভে বীরশক্তিসম্পন্ন পুত্র উৎপাদন করবেন। হে নরশ্রেষ্ঠ, আমি আপনার সঙ্গেই স্বর্গে যাব। অতএব তার পূর্বেই পুত্র উৎপাদন করার জন্য আপনি আমাতে উপগত হোন। আপনি ভিন্ন অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে আমি মনে মনেও উপগত হব না। কারণ, জগতে আপনার অপেক্ষা কোনও পুরুষ উৎকৃষ্ট আছে? মহারাজ প্রাচীনগণের কাছে আমি যে পৌরাণিক ও ধর্মসংগত উপাখ্যান শুনেছি, তা আপনাকে বলব।

পূর্বকালে এই পুরুবংশে পরমধার্মিক ব্যুষিতাশ্ব নামে এক রাজা ছিলেন। ধার্মিক ও মহাবাহু ব্যুষিতাশ্ব যজ্ঞ আরম্ভ করলে ইন্দ্রাদি দেবতা ও দেবর্ষিগণ সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজর্ষি মহাত্মা ব্যুষিতাশ্বের সেই যজ্ঞে ইন্দ্র সোমরস পান করে ও ব্রাহ্মণগণ প্রচুর দক্ষিণা লাভ করে মত্ত হয়েছিলেন। ব্রাহ্মণগণ ও দেবগণ তখন নিজেরাই কার্য করেছিলেন এবং ব্যুষিতাশ্ব সকল মানুষকে অতিক্রম করে দীপ্তি পাচ্ছিলেন। মহাযজ্ঞ অশ্বমেধ সমাপ্ত হলে, প্রতাপশালী রাজশ্রেষ্ঠ ব্যুষিতাশ্ব প্রাচ্য, উদীচ্য, পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য রাজগণকে জয় করে বশীভূত করেছিলেন। আর সেই যজ্ঞের ফলে রাজশ্রেষ্ঠ ব্যুষিতাশ্ব দশটা হস্তীর তুল্য বলবান হয়েছিলেন! মনুষ্যশ্রেষ্ঠ ব্যুষিতাশ্বের যশ বিস্তৃত হলে পুরাণজ্ঞ কবিরা তাঁর বিষয়ে গান গেয়ে বেড়াত। ব্যুষিতাশ্ব আসমুদ্র পৃথিবী জয় করে, পিতা যেমন ঔরসপুত্র পালন করেন, তেমনই সকল বর্ণকে পালন করেছিলেন এবং প্রধান প্রধান যজ্ঞ করে ব্রাহ্মণদের ধনদান করেছিলেন।

“মহারাজ, জগতে অতুলনীয় সুন্দরী ভদ্ৰানাম্নী কাষ্ণীবান রাজার কন্যা ব্যুষিতাশ্ব রাজার পরম প্রিয়তমা ভার্যা ছিলেন। শুনেছি যে সেই রাজা ও রানি পরস্পর অত্যন্ত কামাসক্ত ছিলেন। তাতেই কামমত্ত রাজা যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই যক্ষ্মারোগে রাজা অচিরকালের মধ্যে সূর্যের ন্যায় অস্তমিত হয়েছিলেন। সেই মহাবীর রাজার মৃত্যু হলে, তার স্ত্রী অত্যন্ত শোকাকুল হয়েছিলেন। অত্যন্ত শোককাতরা পুত্রহীনা ভদ্রাদেবী অত্যন্ত বিলাপ করেছিলেন। ভদ্রা বলেছিলেন—‘হে পরমধর্মজ্ঞ, সমস্ত স্ত্রীলোকই পতি সংযুক্ত থাকলে, প্রকৃত মানুষী থাকে। আর, যে স্ত্রীলোক পতি ব্যতীতও জীবিত থাকে, দুঃখময় বলে তার সেটা জীবিত থাকাই নয়। হে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ, পতি না থাকলে স্ত্রীলোকের মৃত্যুই ভাল; অতএব আমি আপনার গতিই লাভ করতে ইচ্ছা করি; আপনি প্রসন্ন হোন, আমাকেও নিয়ে যান। মহারাজ আমি আপনাকে ছাড়া ক্ষণকালও জীবনধারণ করতে পারব না। নরশ্রেষ্ঠ, আপনি পরলোকে যাচ্ছেন, আর তো ফিরবেন না। সুতরাং নিরাপদই হোক বা বিপৎসংকুলই হোক, সর্বত্রই আমি আপনার পিছনে পিছনে যাব। আমি ছায়ার মতোই আপনার অনুগত থাকব, সর্বদা বশবর্তিনী হব এবং সকল সময়েই আমি আপনার প্রিয় ও হিতকার্য সাধনে রত থাকব। হে পদ্মনয়ন, আপনার অভাবে আজ থেকে গুরুতর কষ্টদায়ক, এমনকী হৃদয়শোধ মনঃপীড়া আমাকে অভিভূত করবে। আমি দুর্ভাগা কিনা; তাই আমি নিশ্চয়ই পরস্পর সম্মিলিত কতকগুলি স্ত্রীপুরুষকে বিচ্ছিন্ন করেছিলাম; সেই পাপেই আপনার সঙ্গে আমার এই বিচ্ছেদ উপস্থিত হয়েছে। আমি পূর্বজন্মে কতকগুলি রমণীকে পতির সঙ্গে সংযুক্ত করে আবার বিচ্ছিন্ন করেছিলাম; আমার সেই পূর্বজন্মকৃত পাপেই এই দুঃখ জন্মেছে। অতএব আমি আজ থেকে আপনার দর্শনার্থী হয়ে কুশশয্যায় শয়ন করে, দুঃখেই জীবন কাটিয়ে দেব। আমি শোকে ও দুঃখে কাতর হয়ে বিলাপ করছি; অতএব আপনি দর্শন দান করুন এবং আমাকে কর্তব্যের উপদেশ দিন।’ ভদ্রাদেবী সেই শবটিকে আলিঙ্গন করে বারবার এই জাতীয় বহুতর বিলাপ করতে থাকলে আকাশবাণী এই কথা বলল, ‘ভদ্রে, গাত্রোত্থান করো এবং বাসগৃহে গমন করো। এখনই আমি তোমাকে বর দিচ্ছি। হে চারুহাসিনী, আমিই তোমার গর্ভে সন্তান জন্ম দেব। সুন্দর নিতম্বে, তুমি ঋতুস্নান করে, চতুর্দশী বা অষ্টমী তিথিতে নিজের শয্যাতেই আমার সঙ্গে সম্ভোগ করতে পারবে।’ আকাশবাণী এই কথা বললে, পতিব্রতা ভদ্রাদেবী পুত্রার্থিণী হয়ে যথাযথভাবে সেই বাক্যানুরূপ কার্য করলেন। হে ভরতশ্রেষ্ঠ, ভদ্রাদেবী সেই মৃতপতির সংসর্গেই শাল্বদেশীয় রাজার তিন পুত্রকে এবং মদ্রদেশীয় চার পুত্রকে প্রসব করেছিলেন।

“অতএব মহারাজ, আপনি তো তপোবল এবং যোগবলশালী; সুতরাং আপনিও তো আমার গর্ভে মানসপুত্র জন্মাতে পারেন।” কুন্তী একথা বললে, ধর্মজ্ঞ পাণ্ডু ধর্মসংগত উৎকৃষ্ট বাক্য কুন্তীর কাছে বললেন। “কুন্তী তোমার কথা সত্য; তুমি যা বললে পূর্বকালে ব্যুষিতাশ্ব রাজা তাই করেছিলেন। কারণ তিনি দেবতার তুল্য শক্তিশালী ছিলেন। তারপর ধর্মজ্ঞ মহাত্মা ঋষিরা যা প্রত্যক্ষ করেছেন, আমি সেই প্রাচীন ধর্মতত্ত্ব তোমাকে বলব। চারুহাসিনী পূর্বকালে সকল স্ত্রীলোকই অনবরুদ্ধ ছিল এবং তারা ইচ্ছানুসারে অন্য পুরুষের সঙ্গে বিচরণ করত। তাতে তাদের অধর্ম হত না; কেন-না তাই প্রাণীগণের চিরন্তন স্বভাব। মনুষ্যভিন্ন প্রাণীরা আসক্তি ও বিদ্বেশূন্য হয়ে এখনও সেই প্রাচীন ধর্মেরই অনুসরণ করে থাকে।

“মহর্ষিরাও প্রত্যক্ষ করেছেন বলে এই ব্যবহারের আদর করেন এবং উত্তর কুরুদেশে এখনও এই ব্যবহার আদৃত হয়ে থাকে; আর এই আচার স্ত্রীলোকদের প্রতি অনুগ্রহসূচক এবং চিরকালই চলে আসছে। সুন্দরী, খুব অধিককাল হয়নি যিনি এই দেশে এই নিয়ম স্থাপন করেন তাঁর কাহিনি শোনো। উদ্দালক নামে এক মহর্ষি শ্বেতকেতু নামে তাঁর এক পুত্র ছিল। তিনিও মুনি ছিলেন। একদা এক ব্রাহ্মণ সেই উদ্দালকের সমক্ষে শ্বেতকেতুর মাতার হস্ত ধারণ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, ‘চলো, আমরা যাই।’ তারপর, বলপূর্বকই যেন মাতাকে সেইভাবে নিয়ে চলেছে— দেখে শ্বেতকেতু অসহিষ্ণুতাবশত ক্রোধ প্রকাশ করলেন। কিন্তু তখন পিতা উদ্দালক পুত্র শ্বেতকেতুকে ক্রোধকম্পিত দেখে বললেন, ‘বাবা তুমি ক্রোধ কোরো না।’ এই আচরণ স্ত্রীলোকদের চিরাচরিত ধর্ম। জগতে সকল বর্ণের স্ত্রীলোকেরাই অনবরুদ্ধ; সুতরাং গোরুগুলি যেমন স্বেচ্ছাচারিণী, মনুষ্যরমণীরাও তেমন আপন বর্ণে স্বেচ্ছাচারিণীই হয়ে থাকে। তবে তারা কখনও রন্ধনদি গৃহকার্যে অনবধানতা করত না কিংবা ঋতুকালে ভর্তাকে পরিত্যাগ করে অন্য পুরুষের সংসর্গ করত না।” ঋষিপুত্র শ্বেতকেতু সেই প্রাচীন আচার সহ্য করলেন না। জগতের সকল স্ত্রী ও পুরুষের জন্য তিনি এক নিয়ম স্থাপন করলেন। কিন্তু এই নিয়ম কেবলমাত্র মনুষ্য সমাজেই চলেছে; অন্য কোনও প্রাণীর মধ্যে নয়।

‘আজ থেকে যে নারী পতিকে পরিত্যাগ করে অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে তার ভ্রূণহত্যা তুল্য ঘোরতর দুঃখজনক পাপ হবে। আবার কন্যাকালে ব্রতচারিণী এবং বিবাহের পর পতিব্রতা— এহেন ভার্যাকে পরিত্যাগ করে যে পুরুষ অন্য স্ত্রীর সংসর্গ করবে, তারও এই পাপই হবে। আর যে রমণী ক্ষেত্রজ পুত্র উৎপাদন করার জন্য পতির আদেশ পেয়েও সে ‘আদেশ পালন করবে না তারও এই একই পাপ হবে।’

“কুন্তী আমরা শুনেছি যে, সৌদাস রাজা পুত্র উৎপাদন করার জন্য আদেশ দান করলে তাঁর পত্নী ময়ন্তী মহর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে সংসর্গ করেছিলেন। এবং তিনি পতির প্রতি অনুরক্ত থেকেই বশিষ্ঠ থেকে অশ্মক নামে পুত্র লাভ করেছিলেন। ভর্তার সন্তোষের জন্যই তিনি এই কার্য করেছিলেন।

“আর সুন্দরী, কুরুবংশের বৃদ্ধির জন্য মহর্ষি বেদব্যাস থেকে আমাদের জন্মবৃত্তান্ত তোমার জানা আছে। অতএব এই সমস্ত কারণ পর্যালোচনা করে, আমার এই ন্যায়সংগত বাক্য অনুসারে তুমি কার্য করতে পারো। পতিব্রতে, স্ত্রীলোক ঋতুকালেই ভর্তাকে অতিক্রম করবে না; একেই ধর্ম বলে ধর্মজ্ঞেরা জানেন। অবশিষ্ট অন্য সকল সময়েই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা অবলম্বন করতে পারে। সাধুলোকেরা বলে থাকেন যে, এই নিয়মই প্রাচীনকালের ধর্ম ছিল। ধর্মসংগত হোক বা না হোক, পতি পত্নীকে যা বলবেন, পত্নী তাই করবেন ধর্মজ্ঞেরা একথাও বলে থাকেন।

“সুন্দরী, আমি পূর্ব থেকেই অত্যন্ত পুত্রাভিলাষী অথচ মৃগমুনির শাপে নিজ পুত্রোৎপাদনের ক্ষমতা হারিয়েছি। তথাপি যেহেতু সেই পুত্রভিলাষীই আছি, সেই হেতু তোমাকে প্রসন্ন করার জন্য রক্তাঙ্গুলি যুক্ত পদ্মপত্রতুল্য এই অঞ্জলি মস্তকে স্থাপন করলাম। হে বিশালনিতম্বে, তুমি আমার নিয়োগ অনুসারে কোনও তপস্বী ব্রাহ্মণের থেকে গুণবান পুত্র উৎপাদন করো; তোমার জন্যই যেন আমি পুত্রবানদের গতি লাভ করতে পারি।”

পাণ্ডুর কথা শুনে বিশালনিতম্বা ভর্তার প্রিয় ও হিতকার্যসাধনে নিরতা কুন্তীদেবী শত্রুনগরবিজয়ী পাণ্ডুকে বললেন, “ভর্তাকে প্রসন্ন করাই স্ত্রীলোকের উচিত, এই অবস্থায় সেই ভর্তাই যে স্ত্রীকে প্রসন্ন করছেন, তা স্ত্রীলোকের পক্ষে গুরুতর অধর্ম। সে যাই হোক, আমি পূর্বে বাল্যকালে পিতৃগৃহে অতিথি সেবায় নিযুক্ত ছিলাম, তখন দৃঢ়বতী কোপনস্বভাব নিগূঢ়ধর্মতত্ত্বজ্ঞ দুর্বাসা মহর্ষিকে সর্বপ্রযত্নে সন্তুষ্ট করেছিলাম। সেই মহাত্মা দুর্বাসা বশীকরণশক্তি সম্পন্ন এক অতি উৎকৃষ্ট মন্ত্র আমাকে দান করে বলেছিলেন, ‘তুমি এই মন্ত্রদ্বারা যে যে দেবতাকে আহ্বান করবে সেই সেই দেবতাই সকাম অথবা নিষ্কাম হয়ে এসে তোমার বশ্যতাপন্ন হবে। রাজনন্দিনী, সেই সেই দেবতার অনুগ্রহেই তোমার পুত্র হবে।’ মহারাজ! দুর্বাসা পিতৃগৃহে আমাকে তখন এই কথা বলেছিলেন। সে ব্রাহ্মণের বাক্য সত্য ও সেই মন্ত্র প্রয়োগের এই সময় উপস্থিত হয়েছে। অতএব মহারাজ, আপনি অনুমতি করলে, আমি কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারি। মহারাজ, সেই মহাত্মা আমাকে যে মন্ত্র দিয়েছিলেন তার দ্বারা কোনও দেবতাকে আহ্বান করলে, তিনি দেবতার তুল্য পুত্রই দান করবেন। আপনার মঙ্গল হোক; আপনি অনুমতি করুন; কারণ স্ত্রীলোকের পতিই দেবতা। অতএব দেবজ্ঞ বা ব্রাহ্মণ, যার কথা আপনি বলবেন, আমি তাঁকে আহ্বান করব। হে বীর, আপনি যা বলেছেন, আমি তাই করব। তবে দেবতা থেকে সদ্যই পুত্র হবে; আর ব্রাহ্মণ থেকে সময়ান্তরে হবে।

“হে ভারতশ্রেষ্ঠ, কোন দেবতাকে কবে আহ্বান করব? এই অভীষ্ট কার্যে আমি আপনার আদেশের আহ্বান করছি।” পাণ্ডু বললেন, “ধন্য হলাম আমি, অনুগৃহীত হলাম। তুমিই আমাদের বংশের রক্ষক! সেই মহর্ষি দুর্বাসাকে আমি নমস্কার করি, যিনি তোমাকে বর দিয়েছিলেন। কল্যাণী, তুমি অদ্যই পুত্র উৎপাদনের জন্য যথাবিধানে চেষ্টা করো। দেবগণের মধ্যে সর্বপ্রধান পুণ্যবান ধর্মরাজকে আহ্বান করো। তা হলে আমাদের প্রজাপালন ধর্ম কোনও প্রকারেই অধর্মজড়িত হবে না এবং প্রজাগণও সেই পুত্রকে সাক্ষাৎ ধর্ম বলেই মনে করবে। সেই পুত্র কৌরবগণের মধ্যে নিঃসন্দেহে ধার্মিক হবে। কারণ ধর্মরাজ যাকে উৎপন্ন করবেন, সে লোকের মনে অধর্ম আসতে পারে না। তুমি ধর্মকেই প্রধান দেব মনে করে, সংহত হয়ে মন্ত্র ও উপাচার দিয়ে তাঁকে আহ্বান করো।”

পাণ্ডুর আদেশ শিরোধার্য করে, গান্ধারী এক বৎসর যাবৎ গর্ভধারণ করে রয়েছেন এমন সময়ে কুন্তী গর্ভধারণের জন্য ধর্মকে আহ্বান করেছিলেন। কুন্তী ধর্মকে পূজার উপহার দিলেন এবং দুর্বাসা প্রদত্ত মন্ত্র জপ করলেন। ধর্মদেব সেই মন্ত্রের বলে সূর্যের তুল্য উজ্জ্বল বিমানে আরোহণ করে জপরতা কুন্তীর সম্মুখে এসে উপস্থিত হলেন। তারপর তিনি হাস্য করে কুন্তীকে বললেন, “কুন্তী, আমি তোমাকে কী দেব বলো।” কুন্তীও হাস্যমুখে ধর্মকে বললেন, “পুত্র দান করুন।”

পর্বতশ্রেষ্ঠ শতশৃঙ্গের উপরে বহুতর পশু সমাকীর্ণ বনের ভিতরে মহাভাগা কুন্তীদেবী পাণ্ডুর জন্য ধর্মের সঙ্গে সম্মিলিত হলেন। সুন্দর নিতম্বা পতিব্রতা যশস্বিনী কুন্তীদেবী ঋতুস্নান করে, পবিত্র হয়ে, নির্মল বস্ত্র পরিধান পূর্বক ধর্মের সঙ্গে শয্যা গ্রহণ করলেন। সুন্দর নিতম্বা কুন্তীদেবী যোগবলে শরীরধারী ধর্মদেবের সঙ্গে সঙ্গম করে, সমস্ত প্রাণীর হিতসাধনে নিরত একটি পুত্র লাভ করলেন।

জ্যৈষ্ঠমাসে চন্দ্রযুক্ত জ্যেষ্ঠানক্ষত্রে দিবাভাগে অভিজিৎ নামের অষ্টম মুহূর্তে সূর্য আকাশের মধ্যস্থানগত হলে এবং অতিপ্রশস্ত পূর্ণিমাতিথিতে কুন্তীদেবী অত্যন্ত যশস্বী জ্যেষ্ঠ পুত্র প্রসব করেছিলেন। পুত্রটির জন্মমাত্রই আকাশবাণী এই কথাগুলি বলেছিলেন, “এই বালকটি ধার্মিকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, মনুষ্যের মধ্যে প্রধান, বিক্রমশালী সত্যবাদী এবং পৃথিবীর রাজা হবে। পাণ্ডুর এই প্রথম পুত্রের নাম হবে যুধিষ্ঠির। ইনি ত্রিভুবন বিখ্যাত রাজা হবেন এবং যশ, তেজ ও সচ্চরিত্রসম্পন্ন হবেন।” পাণ্ডু সেই ধার্মিক পুত্র লাভ করে পুনরায় কুন্তীকে বললেন, “কুন্তী, লোকে বলে যে, ক্ষত্রিয়জাতি বলে সর্বপ্রধান। অতএব তুমি বলে সর্বপ্রধান একটি পুত্র বরণ করে নাও।” পাণ্ডু একথা বললে বায়ুকে আহ্বান করলেন কুন্তী। তারপর অত্যন্ত বলবান বায়ুদেব মৃগে আরোহণ করে এসে কুন্তীকে বললেন, “কুন্তী, আমি তোমাকে কী দেব। তোমার অভীষ্ট কী, তা বলো।” কুন্তী হাস্য করে লজ্জিতভাবে বললেন, “দেবশ্রেষ্ঠ, বিশালদেহ এবং সকল বীরের দর্পহারী হতে পারে, এমন একটি বলবান পুত্র দান করুন।” সেই বায়ুদেব থেকে ভয়ংকর পরাক্রমশালী মহাবীর ভীমসেন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন তাঁকে লক্ষ্য করেও দৈববাণী এই কথা বলেছিল, “এই বালকটি সমস্ত বলবানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবে। ভীমসেন জন্মগ্রহণ করা মাত্র একটি অত্যন্ত আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল। সেই বালক মায়ের কোল থেকে পতিত হয়ে একখানা পাথরকে চূর্ণ করেছিল। কারণ কুন্তী বাঘের গর্জন শুনে ভয়ে ব্যস্ত হয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়েছিলেন। তখন নিজের কোলে যে সেই বালক ঘুমোচ্ছিল, তা কুন্তীর মনেও ছিল না; তার সদ্যোজাত শিশুর দৃঢ় শরীর পাথরের উপর পড়ে গিয়েছিল। সেই বালক পড়ে গিয়ে নীচের পাথরখানিকে শত খণ্ডে চূর্ণ করেছিল; পাথরখানিকে চূর্ণ করেছে দেখে পাণ্ডু বিস্ময়াপন্ন হয়েছিলেন। যে দিন ভীম জন্মেছিলেন, দুর্যোধনও সেই দিনেই জন্মেছিলেন। চৈত্রমাসে, শুক্লপক্ষে, ত্রয়োদশী তিথিতে বৃহস্পতির উদয়কালে মঘা নক্ষত্রে সিংহস্থ চন্দ্রে, সূর্য আকাশের মধ্যবর্তী হলে এবং অষ্টম মুহূর্তে কুন্তীদেবী অত্যন্ত সাহসী ভীমকে জন্ম দিয়েছিলেন।

ভীমের জন্মের পর পাণ্ডু পুনরায় চিন্তা করলেন, “লোকশ্রেষ্ঠ এবং বীরগণের অগ্রগণ্য আমার একটি পুত্র কী প্রকারে হতে পারে। জগৎ দৈব ও পুরুষকার— এই উভয়ের উপরে আছে, তার মধ্যে পুরুষকারের দ্বারাই যথা সময়ে দৈব পাওয়া যায়। আমরা শুনেছি যে, ইন্দ্র দেবগণের রাজা এবং তাঁদের মধ্যে প্রধান; আর তাঁর বল ও উৎসাহের ইয়ত্তা করা যায় না এবং তেজ ও সাহস অসাধারণ। তপস্যা দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করেই একটি মহাবীর পুত্র লাভ করব। কেন-না, তিনি আমাকে যে পুত্র দান করবেন সে-পুত্র বীরশ্রেষ্ঠই হবে। এবং সে-পুত্র যুদ্ধে মানুষ ও অসুর প্রভৃতিকে জয় করবে। অতএব কার্য, মন ও বাক্য দ্বারা গুরুতর তপস্যা করব।”

তারপরে পাণ্ডু মহর্ষিগণের সঙ্গে পরামর্শ করে কুন্তীকে এক বৎসর যাবৎ একটি মাঙ্গলিক ব্রত করবার জন্য আদেশ করলেন। পাণ্ডু নিজে অত্যন্ত একাগ্রতার সঙ্গে ঘোরতর তপস্যা অবলম্বন করে এক চরণে অবস্থান করতে লাগলেন। তিনি দেবরাজের আরাধনা করবার জন্য কুন্তীর সঙ্গে গুরুতর তপস্যা করতে থাকলেন। বহুকালের পর ইন্দ্র এসে তাঁকে বললেন, “আমি তোমাকে এমন একটি পুত্র দান করব যে, সে ত্রিভুবন বিখ্যাত হবে। ব্রাহ্মণ, গোরু ও বন্ধুবর্গের কার্যসাধন করবে, শত্রুগণের শোক জন্মাবে এবং সমস্ত আত্মীয়গণের আনন্দ উৎপাদন করবে। এহেন সর্বশত্রুনাশক উৎকৃষ্ট একটি পুত্র তোমাকে দান করব।” মহাত্মা দেবরাজ কুরুরাজ পাণ্ডুকে এই কথা বলে অন্তর্হিত হলেন।

ধর্মাত্মা পাণ্ডু দেবগণের এই কথা শুনে কুন্তীকে বললেন, “কল্যাণী, দেবরাজ সন্তুষ্ট হয়েছেন; সুতরাং ভাবী ফল ভালই হবে। অতএব সুন্দরী, তুমি এমন একটি পুত্র উৎপাদন করো যে, সে অলৌকিক কার্য করতে পারে, যশস্বী, শত্রুদমনকারী, নীতিজ্ঞ, উদারচেতা, সূর্যের তুল্য তেজীয়ান হয়; অন্যের অজেয়, সৎক্রিয়ান্বিত, অদ্ভুত আকৃতি ও ক্ষত্রিয়তেজের একমাত্র আশ্রয় হয়। আমরা যখন দেবরাজের অনুগ্রহ লাভ করেছি তখন তাকেই তুমি আহ্বান করো।” পাণ্ডু এই কথা বললে, কুন্তী ইন্দ্রকে আহ্বান করলেন। তখন ইন্দ্র এলেন এবং কুন্তীর গর্ভ উৎপাদন করলেন।

ফাল্গুন মাসে, দিনের বেলায় পূর্বফাল্গুনী ও উত্তরফাল্গুনী নক্ষত্রের সন্ধিক্ষণে একটি বালক জন্মাল। ফাল্গুন মাসে ও ফল্গুনী নক্ষত্রে জন্মেছিল বলে ওই বালকটির নাম হয়েছিল— ফাল্গুন। সেই বালকটির জন্মমাত্রই আকাশমণ্ডল শব্দিত করে মহাগম্ভীর স্বরে একটি দৈববাণী হল; সেই দৈববাণী কুন্তীকে সম্বোধন করে সেই আশ্রমবাসী সমস্ত প্রাণীর সমক্ষে সুস্পষ্টভাবে এই কথা বলল, “কুন্তী, তোমার এই পুত্র কার্তবীর্যাজুনের তুল্য তেজস্বী, শিবের তুল্য পরাক্রমী এবং ইন্দ্রের তুল্য অজেয় হয়ে তোমার যশ বিস্তৃত করবে। বামনরূপী নারায়ণ যেমন অদিতির আনন্দবর্ধন করেছিলেন, নারায়ণের তুল্য এই বালকটিও তেমন তোমার আনন্দবর্ধন করবে। এই বালক যথাসময়ে মদ্র, কুরু, সোমক, চেদি, কাশী ও কুরুষদেশের রাজগণকে বশে এনে কুরুবংশীয় রাজলক্ষ্মীকে বর্ধিত করবে। অগ্নিদেব এরই বাহুবলে খাণ্ডববনে সমস্ত প্রাণীর মেদ ভক্ষণ করে অত্যন্ত তৃপ্তিলাভ করবেন। এই বালকটি ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে, প্রধান প্রধান রাজাকে জয় করে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করবেন। কুন্তী, বলবানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তোমার এই পুত্র পরশুরামের তুল্য উৎসাহী এবং বিষ্ণুর তুল্য পরাক্রমী হয়ে অত্যন্ত যশস্বী হবে। এই বালক যুদ্ধে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করবে এবং তাঁর কাছ থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভ করবে, তোমার এই পুত্র ইন্দ্রের আদেশে দেবদ্বেষী নিবাতকবচনামক দৈত্যগণকে বধ করবে। তোমার এই পুত্র সকল দিব্য অস্ত্র লাভ করবে এবং তাতেই পুরুষপ্রধান হয়ে শত্রুকর্তৃক অপহৃত রাজলক্ষ্মীকে পুনরায় উদ্ধার করবে।”

সেই পুত্রটির জন্মমাত্র কুন্তী এই অদ্ভুত দৈববাণী শুনতে পেলেন এবং উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারিত সেই দৈববাণী শুনে শতশৃঙ্গ নিবাসী তপস্বীদের অত্যন্ত আনন্দ জন্মাল; আর আকাশে বিমানারোহী ইন্দ্রাদি দেবগণের তুমুল দুন্দুভিধ্বনি হতে থাকল, সেই বিশাল শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে পুষ্পবৃষ্টি হল। আর দেবগণ, সর্পগণ, গরুড়াদি পক্ষীগণ, গন্ধর্বগণ, অপ্সরাগণ, সকল প্রজাপতি এবং সপ্তর্ষিগণ অর্জুনের স্তব করতে লাগলেন। ভরদ্বাজ, কশ্যপ, গৌতম, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ এবং সূর্য অস্ত গেলে যিনি উদিত হয়ে থাকেন, মাহাত্ম্যশালী সেই অত্রিও সেখানে আসলেন। মরীচি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, দক্ষপ্রজাপতি, অন্যান্য গন্ধর্বগণ ও অপ্সরাগণ সেখানে উপস্থিত হলেন। স্বর্গীয় মাল্য ও বস্ত্রধারী এবং সমস্ত অলংকারে অলংকৃত অপ্সরাগণ অর্জুনকে লক্ষ্য করে গান ও নাচ করতে লাগল। মহর্ষিরা সেখানে সকল দিক থেকে বালকের মঙ্গলের জন্য ইষ্টমন্ত্র জপ করতে লাগলেন এবং মনোহর মূর্তি তুম্বুক অন্যান্য গন্ধর্বের সঙ্গে পূর্বেই সেখানে এলেন।

ভীমসেন, উগ্রসেন, ঊর্নায়, অনঘ, গোপতি, ধৃতরাষ্ট্র, পূর্ণবৰ্চা, যুগপ, তৃণপ, কাষ্ণী, নন্দি, চিত্ররথ, শালিশিরা, পর্জন্য, কলি, নারদ, ঋত্বা, বৃহত্বা, বৃহক, করাল, ব্রহ্মচারী ও অত্যন্ত গুণবান বিখ্যাত সুবর্ণ, বিশ্বাবসু, ভূমন্য, সুচন্দ্র, শরু এবং মধুরগানকারী হা হা ও হু হু— এই সকল গন্ধর্ব সেখানে গান করতে লাগল এবং সমস্ত অলংকারে অলংকৃতা আয়তনয়না ভাগ্যবতী অপ্সরারা সেখানে নৃত্য ও গীতে প্রবৃত্ত হল।

অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা, গুণাবরা, অদ্রিকা, সোমা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা, মারীচি, শুচিকা, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অম্বিকা, লক্ষণা, ক্ষেমা, দেবী, রম্ভা, মনোরমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুবপু, পুণ্ডরীকা, সুগন্ধা, সুরথা, প্রমাথিনী, কাম্যা ও সারস্বতী— এই আটাশ জন অঙ্গরা সেখানে সম্মিলিতভাবে নাচতে লাগল।

আর মেনকা সহজনা কর্ণিকা পুঞ্জিকস্থলা, ঋতুস্থলা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তী, উম্লোচা, প্রম্লোচা এবং উর্বশী— এই এগারোজন আয়তলোচনা অপ্সরা গান করতে থাকল। ধাতা, অর্যমা, মিত্র, বরুণ, অংশ, ভগ, ইন্দ্র, বিবস্বান, পুষ্যা, মঙ্গলজনক ত্বষ্টা, পর্জন্য ও বিষ্ণু এই বারোজন আদিত্য তৃতীয় পাণ্ডুবের অভিনন্দনের জন্য উপস্থিত থেকে, তাঁর মহিমা বর্ধন করতে থেকে আকাশে অবস্থান করতে লাগলেন। মৃগব্যাধ, সর্প, নির্ঋতি, অজৈকপাদ, অহিব্রধু, পিনাকী, দহন, ঈশ্বর, কপালী, স্থানু, ভগ— এই এগারোজন রুদ্র সেখানে এসে অবস্থান করতে লাগলেন। অশ্বিনীকুমারদ্বয়, অষ্টবসু, ঊনপঞ্চাশ বায়ু, বিশ্বদেবগণ ও সাধ্যগণ সেখানে উপস্থিত হলেন। কর্কোটক, অনন্ত বাসুকি, কচ্ছপ, কুণ্ড ও তক্ষক প্রভৃতি তপস্বী, অত্যন্ত ক্রোধী ও অত্যন্ত বলবান নাগ ও অন্য বহুতর নাগ সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। তার্ক্ষ, অরিষ্টনেমি, গরুড়, অসিতধ্বজ, অরুণ ও আরুণি— এই বিনতা সন্তানগণও সেখানে উপস্থিত হলেন। সেইসব স্বর্গবাসী লোকদের মধ্যে অনেকে বিমানে ও অনেকে পর্বতের উপরে অবস্থান করছিলেন; তপঃসিদ্ধ মহর্ষিরাই কেবল তাঁদের দেখতে পেয়েছিলেন; কিন্তু অন্য লোকেরা তাঁদের দেখতে পাননি। তপঃসিদ্ধ মহর্ষিরা সেই গুরুতর আশ্চর্য ঘটনা দেখে বিস্মিত হয়ে অর্জুনের প্রতি অতিরিক্ত আনন্দ লাভ করলেন।

কিন্তু পাণ্ডু আরও পুত্রলাভের লোভে পুনরায় কুন্তীকে অনুরোধ করবার ইচ্ছা করলেন, কিন্তু কুন্তী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে বললেন, “এরপর বিপদকালেও এইভাবে চতুর্থ পুত্র উৎপাদন করা মুনিরা সংগত বলে মনে করেন না। কারণ তৃতীয়ের পর চতুর্থ পরপুরুষ সংসর্গ করলে সে স্ত্রী, স্বৈরিণী এবং পঞ্চম পরপুরুষ সংসর্গ করলে বন্ধকি বলে গণ্য হয়।

কুন্তী আর পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে রাজি হলেন না। তখন পাণ্ডু মাদ্রীর অনুরোধ অনুযায়ী একবারের জন্য মন্ত্রটি মাদ্রীকে দিতে অনুরোধ জানালেন। মাদ্রী একবার মাত্র মন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারবেন জেনে অত্যন্ত চাতুর্যের সঙ্গে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁদের ঔরসে মাদ্রীর গর্ভে নকুল ও সহদেবের জন্ম হল।

পাণ্ডুর মৃত্যু

শতশৃঙ্গ পর্বতে, স্বামী পাণ্ডু, সপত্নী মাদ্রী, দেবতার ন্যায় কান্তি বিশিষ্ট পাঁচটি প্রিয় পুত্র নিয়ে মুনিঋষিদের নির্জন তপোবনে কুন্তীর দিন শান্তিতেই কাটছিল। কিন্তু কোনও সময়ে বসন্তকাল এল, তখন চৈত্র ও বৈশাখ মাসের সন্ধিসময়, সকল বনেই ফুল ফুটেছিল এবং সকল প্রাণীর মনই কামাবশে অধীর হয়েছিল; এমন সময়ে পাণ্ডু ভার্যার সঙ্গে বনে বিচরণ করতে লাগলেন। সে বনে পলাশ তিল, আম্র, চম্পক, দেবদারু, স্থলপদ্ম, অশোক, নাগকেশর, ভিনিশ কুরুবক এবং অন্যান্য নানাবিধ বৃক্ষ ছিল। সেগুলি আবার ফল ও ফুলে পরিপূর্ণ ছিল; লতায় আবৃত অনেক পারিজাত বৃক্ষ ছিল। সেগুলির মঞ্জরী প্রকাশিত হয়েছিল।

কোকিল ও ভ্রমরগণ রব করে ভ্রমণ করছিল এবং নানাবিধ জলাশয়ও সেখানে শোভা পাচ্ছিল। এহেন বনে পাণ্ডুর মনে কামের আবির্ভাব হল। সেই বনে তিনি হৃষ্টচিত্ত দেবতার মতো বিরাজ করতে লাগলেন। তাতেই তাঁর কামানল দ্বিগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল। তখন একমাত্র মাদ্রীই সূক্ষ্ম বস্ত্র পরিধান করে তাঁর অনুসরণ করছিলেন। পাণ্ডু সেই সূক্ষ্মবস্ত্রা যুবতী মাদ্রীকে বিশেষভাবে দেখতে লাগলেন। নির্জনে একাকিনী পদ্মনয়না মাদ্রীকে দেখে পাণ্ডু সে কামাবেগ রুদ্ধ করতে পারলেন না। মাদ্রী শক্তি অনুসারে অঙ্গসঞ্চালন করে রাজাকে বারণ করতে লাগলেন। কিন্তু রাজা বলপূর্বক তাঁকে বশীভূত করে ফেললেন। রাজার চিত্ত কামে আকুল হয়ে গিয়েছিল; তাই তিনি মৃগমুনির শাপের বিষয় স্মরণ করতে পারছিলেন না। সুতরাং তিনি বলপূর্বক মাদ্রীর সঙ্গে মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেন। পাণ্ডু দৈবপ্রেরিত হয়ে, শাপসম্ভাব্য মৃত্যুর ভয় পরিত্যাগ করে, মৃত্যুর জন্যই কামের অধীন হয়ে পড়লেন। সেই পরমধার্মিক পাণ্ডু রাজা, ভার্যা মাদ্রীর সঙ্গে সঙ্গম করেই মৃত্যুমুখে পতিত হলেন।

তখন মাদ্রী চৈতন্যহীন রাজাকে আলিঙ্গন করে, বারবার উচ্চৈঃস্বরে আর্তনাদ করতে লাগলেন। সেই আর্তনাদ শুনে, কুন্তী আপন তিন সন্তান ও মাদ্রীর দুই সন্তানকে নিয়ে সেদিকে আসতে লাগলেন। রাজা সেই অবস্থায় পড়ে রইলেন। তারপরে শোকার্তা মাদ্রী কুন্তীকে এই কথা বললেন, “আপনি একাই এইখানে আসুন। বালকগণ ওইখানেই থাক। মাদ্রীর সেই কথা শুনে, বালকগণকে সেইখানে রেখে, “হায় আমি মরেছি।” এই আর্তনাদ করে তৎক্ষণাৎ কুন্তী সেখানে এলেন। কুন্তী, মাদ্রী ও পাণ্ডুকে ভূতলে শায়িত দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে শোকবিহুল অঙ্গে বিলাপ করতে লাগলেন।

“মাদ্রী! রাজা নিজেও সর্বদাই আত্মরক্ষায় যত্নবান ছিলেন, আমিও তাঁকে সর্বদাই রক্ষা করতাম; এই অবস্থায় উনি মৃগমুনির অভিশাপের বিষয় জেনেও কেন তোমাকে আক্রমণ করলেন? মাদ্রী! রাজাকে রক্ষা করাই তোমার উচিত ছিল; তাতে তুমি এই নির্জন স্থানে তাকে লুব্ধ করলে? মাদ্রী! রাজা সেই অভিশাপ স্মরণ রেখে সর্বদাই বিষণ্ণ থাকতেন। এ অবস্থায় নির্জনে তোমাকে পেয়ে কী প্রকারে তার আনন্দ জন্মেছিল? সে যাই হোক, মাদ্রী তুমিই ধন্য এবং তুমি আমা অপেক্ষা ভাগ্যবতী। যেহেতু তুমি হৃষ্টচিত্ত রাজার মুখখানি দেখেছ!” মাদ্রী বললেন, “আমি বিলাপ করতে করতে রাজাকে বহুবার নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি দৈবকে সত্য করার ইচ্ছায় মনকে বারণ করেননি।” কুন্তী বললেন, “যাক আমি জ্যেষ্ঠা; সুতরাং আমিই ধর্মপত্নী। অতএব ধর্মফল প্রথম আমারই হবে; আর ভাবী বিষয়ও অবশ্যই হবে। সুতরাং মাদ্রী, তুমি আমাকে সহমরণ থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা কোরো না। আমি এখনই মৃত পতির অনুসরণ করব। তুমি এঁকে ছেড়ে দিয়ে ওঠো। এই বালক ক’টিকে পালন করো।” মাদ্রী বললেন, “আমিই অপলায়ী ভর্তার অনুগমন করব। কারণ, আমি কামসম্ভোগে তৃপ্তিলাভ করতে পারিনি। অতএব দিদি, আমাকে অনুমতি দিন। বিশেষত, ইনি কামবেগে আমার সঙ্গে সঙ্গম করেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। সুতরাং আমি যমালয়ে গিয়ে তাঁর সে কামপিপাসা কেন মেটাব না? আর্যে, আমি আপনার পুত্রদের প্রতি নিজের পুত্রদের সমান ব্যবহার করতে থেকে জীবন অতিবাহিত করতে পারব না; তা হলে আমার পাপ হতে থাকবে। অতএব দেবী, আপনি আমার পুত্র দুটির প্রতি নিজের পুত্রদের মতোই ব্যবহার করবেন। ইনি আমার সঙ্গে রমণ করেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছেন। অতএব রাজার শরীরের সঙ্গে আমার শরীরটাকেও সম্যক আবৃত করে দগ্ধ করবেন। আমার এই প্রিয় কার্যটি অবশ্য করবেন। আপনি চিরদিনই আমার হিত করে এসেছেন; সুতরাং আপনি বালক ক’টির বিষয়ে সর্বদা সাবধান থাকবেন।” এই কথা বলে যশস্বিনী মাদ্রী মৃত রাজার অনুগমন করবেন বলে যোগ অবলম্বনপূর্বক প্রাণত্যাগ করলেন।

মন্ত্রজ্ঞ ও দেবতুল্য সমস্ত মহর্ষি পাণ্ডুর মৃত্যু দেখে পরম্পর মন্ত্রণা করলেন। তপস্বীরা বললেন, “মহাত্মা ও যশস্বী পাণ্ডু রাজ্য ও রাজত্বপদ ত্যাগ করে এই স্থানে এসে তপস্যা করে তপস্বীদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। তিনি এখন শিশু পুত্রগণ ও জ্যেষ্ঠা মহিষীকে আপনাদের নিকট গচ্ছিত রেখে এ স্থান থেকে স্বর্গে গমন করেছেন। সেই মহাত্মার এই পুত্র ক’টি মহিষী, শবদেহ ও মহিষীর শবদেহ—এইগুলি নিয়ে চলুন আমরা তাঁর রাজধানীতে যাই।” উদারচেতা, অণিমাসিদ্ধ ও দেবতার তুল্য ক্ষমতাশালী সেই মহর্ষিরা এই মন্ত্রণা করে পাণ্ডুর পুত্র ক’টিকে ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সমর্পণ করার জন্য, তাদের নিয়ে হস্তিনাপুর গমন করার ইচ্ছা করলেন। তাঁরা সকলে সেই সময়ই পাণ্ডুর পুত্র পত্নী ও শব দুটিকে নিয়ে প্রস্থান করলেন। পুত্রবৎসলা কুন্তী পতিবিরহে বিষণ্ণা থাকলেও আত্মীয়স্বজনদের দেখার আশায় দ্রুত পথ চলতে লাগলেন এবং অল্পকাল মধ্যেই কুরুদেশে গিয়ে বিশাল রাজধানীর দ্বারদেশে উপস্থিত হলেন।

হস্তিনাপুরে প্রবেশের সময় যুধিষ্ঠিরের বয়স হয়েছিল যোলো বৎসর। আগত তপস্বীদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃদ্ধ, জটা ও মৃগচর্মধারী মহর্ষি, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও সমবেত প্রজাদের কাছে পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন, তাঁদের পিতাদের পরিচয় দিলেন, জানালেন যে পাণ্ডু সতেরো দিন পূর্বে পরলোক গমন করেছেন। তিনি ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্রকে পরকর্তব্য পালন করার নির্দেশ দান করে অন্য তপস্বীদের নিয়ে প্রস্থান করলেন।

ভীমের প্রচণ্ড বাহুবল ও দুর্যোধন কর্তৃক বিষদান।

ভীষ্মের ইচ্ছানুসারে, ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বিদুর সমাগত সমস্ত প্রজাকে নিয়ে পাণ্ডু ও মাদ্রীর শ্রাদ্ধাদি কার্য যথাযযাগ্য মর্যাদায় উপযুক্ত আড়ম্বর সহযোগে, চন্দনকাষ্ঠের চিতায় দেহ দুটি ভস্মীভূত করে তর্পণের আয়োজন করলেন। পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে পাণ্ডব মাতা অম্বালিকা পাণ্ডবদের মাতা কুন্তীর রোদনের সঙ্গে সমস্ত হস্তিনাপুরের প্রজাদের ক্রন্দনধ্বনি আকাশ-বাতাস মুখর করে তুলল। তেরো দিন গঙ্গাতীরে অতিবাহিত করে পাণ্ডব ভ্রাতারা মাতা কুন্তীকে নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করল। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা পাণ্ডবদের আবির্ভাবে খুব সন্তুষ্ট হলেন না। এই দেখে ব্যাসদেব মাতা সত্যবতীকে জানালেন দুর্যোধনের (ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র) ব্যবহারে কৌরব বংশের দুর্যোগ অত্যন্ত আসন্ন। তিনি মাতা সত্যবতী এবং দুই বিধবা ভ্রাতৃবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে নিয়ে তপোবনে চলে গেলেন।

কুন্তী তাঁর পঞ্চপুত্রকে নিয়ে পাণ্ডুর প্রাসাদে বাস করতে লাগলেন। কুরুপাণ্ডব ভ্রাতাদের পারস্পরিক আলাপের মধ্য দিয়ে কয়েকদিন কেটে গেল। দেখা গেল, বাহুবলে ভীমসেন সকল ভ্রাতার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। পুরুবংশের ছেলেরা যাতে যথাযযাগ্য সংস্কার লাভ করে, ভীষ্ম সে-কারণে প্রথমে কৃপাচার্যের কাছে ও পরে দ্রোণাচার্যের কাছে সকলকে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণের নির্দেশ দান করলেন। দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষা বিদ্যালয়ে রাজপুত্রেরা তেরো বৎসর ধরে অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষালাভ করেছিলেন। তারপর দ্রোণাচার্যের আদেশে ছাত্রদের অস্ত্রশিক্ষার প্রকাশ্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছিল।

হস্তিনানগরে আপাতচিন্তাহীন এই তেরো বৎসরের মধ্যে কুন্তীর জীবনে দুটি বড় ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটি ভীমসেনকে নিয়ে। পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে কৌরব পাণ্ডব একশো পাঁচ ভ্রাতার মধ্যে বলে ভীমসেন শ্রেষ্ঠ বলে পরিগণিত হয়েছিলেন। দৌড়োনোয়, লক্ষ্য আহরণে, ভোজনে এবং ধূলি ও লোস্ট্রাদি নিক্ষেপে ভীমসেন সকলকে পরাভূত করতে লাগলেন। দুর্যোধন প্রভৃতি সুখে খেলা করছেন, এমন সময়ে ভীম এসে তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকতেন এবং তাঁদের ধরে পরস্পরের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি করাতেন। ধৃতরাষ্ট্রের একশো একটি সবল পুত্রকে ভীমসেন একাকী অনায়াসে পরাভূত করতেন। বলবান ভীম বলপূর্বক ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের ভূতলে নিপাতিত করে আকর্ষণ করতে থাকতেন; আর তাঁরা বিলাপ করতেন এবং তাঁদের জানু, মস্তক ও স্কন্ধদেশ মাটিতে ঘষতে ঘষতে এগুতে থাকত। ভীম জলক্রীড়া করবার সময়ে দুই বাহু দিয়ে দশটি বালককে ধরে নিয়ে জলের ভিতরে ডুব দিতেন ও তারা মৃতপ্রায় হলে ছেড়ে দিতেন। বালকেরা যখন গাছের উপরে উঠে ফল পাড়ত, ভীম তখন পদাঘাত করে সেই গাছগুলিকে সঞ্চালিত করতেন। সেই পদাঘাতে গাছগুলি সঞ্চালিত হলে, বালকেরা ভীত হয়ে ফলের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পতিত হত।

ভীমসেনের এই হিংসাবুদ্ধিহীন বালচাপল্যই তাঁকে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় করে তুলল। ভীমের বল বিখ্যাত হয়ে পড়েছে জেনে শক্তিশালী দুর্যোধনও মনে মনে দুরভিসন্ধি পোষণ করতে আরম্ভ করলেন। ফলে তাঁর মনে পাপবুদ্ধি জন্মাল। তিনি ভাবলেন যে, “কুন্তীর গর্ভজাত পাণ্ডুর মধ্যম পুত্র এই ভীমটা বলবানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়ে পড়েছে; সুতরাং ওকে ছলক্রমে দমন করতে হবে। বলবান, বিক্রমী ও অত্যন্ত উৎসাহশালী এক ভীম, আমরা কৌরবেরা, সম্মিলিত থাকলেও আমাদের জয় করতে ইচ্ছা করে। অতএব সে যখন নগরের উদ্যান মধ্যে নিদ্রিত থাকবে, তখন তাকে আমরা গঙ্গার জলে নিক্ষিপ্ত করব; তারপর তার কনিষ্ঠ অর্জুনকে এবং জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে বলপূর্বক কারাগারে আবদ্ধ রেখে রাজ্যশাসন করব।” পাপমতি দুর্যোধন মনে মনে এই স্থির করে সর্বদাই ভীমসেনের ছিদ্র অন্বেষণ করতে লাগল। তখন দুর্যোধন জলবিহারের জন্য আশ্চর্য আশ্চর্য ও বৃহৎ বৃহৎ বহুতর পটমণ্ডপ নির্মাণ করালেন। সেগুলির ভিতরে সর্বপ্রকার লোভনীয় বস্তু রেখে দিলেন এবং উপরে, বহুতর পতাকা তুলে দিলেন, আর তাতে নানাপ্রকার বহুতর গৃহ নির্মাণ করালেন। গঙ্গাতীরে প্রমাণকোটি নামক স্থানে জলে অধিকাংশ এবং স্থলে অল্পাংশ—সেইভাবে সেই পটমণ্ডপটি নির্মাণ করিয়ে তার নাম রাখলেন—“উদকক্রীড়ন।” তাতে পাককার্যনিপুণ লোকদ্বারা চর্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়—এই চতুর্বিধ খাদ্যবস্তু প্রস্তুত করিয়ে রাখলেন। ভৃত্যেরা এসে গৃহাদি নির্মাণ সমাপ্তির বিষয়ে দুর্যোধনকে জানাল। তারপর, তখনই দুষ্টবুদ্ধি দুর্যোধন পাণ্ডবগণকে বললেন, “চলো, আমরা সকল ভ্রাতারা সম্মিলিত হয়ে উদ্যানশোভিত গঙ্গাতীরে; সেখানে গিয়ে জলবিহারের আমোদ অনুভব করি।”তখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বললেন, “তাই হোক।”

তারপর, কৌরবগণ পাণ্ডবগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে রথে ও দেশীয় বৃহৎ বৃহৎ হস্তীতে আরোহণ করে, রাজধানী থেকে বেরিয়ে এলেন। তখন ভীষ্ম প্রভৃতি প্রাচীন ও প্রবীণ ব্যক্তিদের ত্যাগ করে, উদ্যানে গিয়ে সিংহ যেমন পর্বতগুহায় প্রবেশ করে, তেমন পটমণ্ডপে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করে সকল ভ্রাতা মিলিত হয়ে উপবন দর্শন করতে লাগলেন। তাতে শুভ্রবর্ণ বহুতর দরবার ঘর, চিলেকোঠা ও গবাক্ষ ছিল, জলযন্ত্র ঘর ছিল, রাজমিস্ত্রিরা সকল জায়গা পরিষ্কার করে রাখছিল এবং চিত্রকরেরা চিত্র নির্মাণ করে রেখেছিল। বহুতর জলপূর্ণ দিঘি ও পুষ্করিণী ছিল, তার জল প্রস্ফুটিত পদ্মে আবৃত হয়ে শোভা পাচ্ছিল এবং সে ঋতুজাত নানাবিধ পুষ্পে ভূতল আচ্ছাদিত ছিল। সেই উদ্যানে বসে পাণ্ডবগণ ও কৌরবগণ সেই সেই স্থান থেকে আনীত বহুতর ভক্ষণীয় দ্রব্য ভক্ষণ করতে লাগলেন। তারপর সেই মনোহর উদ্যানে তাঁরা খেলার কৌতুকেই যেন যেখান-সেখান থেকে পরস্পর পরস্পরের মুখে খাদ্যবস্তু দিতে লাগলেন।

তখন মনে ক্ষুরের তুল্য এবং বাক্যে অমৃতের তুল্য পাপাত্মা দুর্যোধন ভীমসেনকে হত্যা করার ইচ্ছায় ভাই ও বন্ধুর মতো নিজেই উঠে ভীমের খাদ্যবস্তুতে কালকূট বিষ মিশিয়ে দিলেন। পরে সেই পাপাত্মা নিজে গিয়ে ভীমের মুখে সেই খাদ্যবস্তু দিয়ে দিলেন; ভীম সেই দোষ না জেনে তা গ্রহণ করলেন। তারপর পুরুষাধম দুর্যোধন সেই ঘটনায় মনে মনে আনন্দিত হয়ে আপনাকে যেন কৃতকার্য বলে মনে করলেন। পাণ্ডুর পুত্রগণ ও ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ সকলে মিলিত হয়ে হৃষ্টচিত্তে জলক্রীড়া করতে লাগলেন। জলবিহার করে পরিশ্রান্ত সেইসব কুরুবালক জলবিহারের পরে নির্মল বস্ত্র পরিধান করে, বিশেষভাবে অলংকৃত হয়ে, রাত্রিকালে সেইসব কেলিগৃহেই বাস করবার ইচ্ছা করলেন। কিন্তু বলবান ভীমসেন অতিরিক্ত ব্যায়াম করায় পরিশ্রান্ত হয়ে, জলক্রীড়ায় ব্যাপৃত সেই বালকগণ নিয়ে তীরে উঠে, প্রমাণকোটীর কোনও স্থানে বাস করবার ইচ্ছা করে, বিষে ক্লান্ত ও মোহিত হয়ে শীতল বাতাস পেয়ে নিশ্চেষ্টভাবে নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। তারপর দুর্যোধন নিজে গিয়ে মৃতপ্রায় ভীমসেনকে লতা দ্বারা বন্ধন করে স্থল থেকে জলে ফেলে দিলেন।

সংজ্ঞাহীন ভীমসেন জলের ভিতরে আপন দেহভারে নাগবালকদের নিপীড়ন করতে করতে নাগভবনে গিয়ে প্রবেশ করলেন। সর্পগণ ভীমসেনকে দংশন করলে জঙ্গম সেই সর্পবিষ স্থাবর কালকেউটের বিষকে নষ্ট করল (এবং নিজেও নষ্ট হল)। কিন্তু সর্পগণ দন্তগুলিকে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলেও বিশাল বক্ষ ভীমসেনের চর্ম অত্যন্ত দৃঢ় বলে তা ভেদ করতে পারছিল না। তারপর ভীম সংজ্ঞা লাভ করে সেই সর্পগণকে মৃত্তিকায় পিষে পিষে মারতে লাগলেন, তখন কতগুলি সর্প ভীত হয়ে পালিয়ে গেল।

কিছু সর্প বাসুকির কাছে গমন করল এবং ইন্দ্রতুল্য নাগরাজ বাসুকিকে বলল, “মহারাজ, আমাদের মনে হয়—এই মানুষটি বিষপান করেছিল, তারপর কোনও লোক একে বন্ধন করে জলে ফেলে দিয়েছিল। কেন-না নিশ্চেষ্ট অবস্থায় আমাদের কাছে এসেছিল; পরে আমরা দংশন করলে জেগেছে, চৈতন্য লাভ করেছে এবং নিজের বন্ধন ছেদ করেছে। এই সর্প নিষ্পেষণকারী বলবান মানুষটি কে আপনি তার পরিচয় নিন।” তখন বাসুকি সেই সর্পগণের সঙ্গে গিয়ে ভয়ংকর প্রতাপশালী ভীমসেনকে দেখলেন। তারপর পরম সজ্জন সেই বাসুকি আপন দৌহিত্র কুন্তীভোজ শূরের দৌহিত্র ভীমকে দেখে তাঁকে গাঢ় আলিঙ্গন করলেন এবং তার উপরে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং বাসুকি সেই সংবাদদাতা নাগকে বললেন, “একে কী দেওয়া যেতে পারে? ধন, রত্ন, অথবা অন্য কোনও বস্তু দেওয়া হবে, তা বলো।” বাসুকি এই কথা বললে সেই নাগ বাসুকিকে বলল, “যদি আপনি সন্তুষ্ট হয়ে থাকেন, তবে ওকে ধন দিয়ে কী হবে? আপনি সন্তুষ্ট হয়ে থাকলে, এই বালক রসায়ন পান করুক; যে রসায়নকুণ্ড সহস্র হস্তীর বল জন্মাতে পারে, এমন গুণসম্পন্ন কুণ্ডই পান করুক। এই বালক যতখানি রসায়ন পান করতে পারে, তাই ওকে দান করুন।” তখন বাসুকি সেই নাগকে বললেন, “তাই হোক।” তারপর নাগগণ রসায়নের কুণ্ড দেখিয়ে দিলে, ভীমসেন পবিত্র ও পূর্বমুখে বসে রসায়ন পান করতে লাগলেন। বলবান ভীমসেন এক এক নিশ্বাসে এক একটি কুণ্ডের রসায়ন পান করতে লাগলেন, এইভাবে তিনি আটটি কুণ্ডের রসায়ন পান করে ফেললেন। তারপর ভীমসেন নাগদের প্রদত্ত উৎকৃষ্ট শয্যায় যথাসুখে শয়ন করলেন।

জলক্রীড়া ও পরিভ্রমণ সমাপ্ত হলে, ভীম ব্যতীত পাণ্ডব ও কৌরবেরা সকলেই “ভীম আমাদের পূর্বেই চলে গিয়েছেন” এই কথা বলতে বলতে রথ, হস্তী, অশ্ব ও অন্যান্য অনেক যানে আরোহণ করে হস্তিনানগরে প্রস্থান করলেন। পাপমতি দুর্যোধন সেখানে ভীমকে না দেখে হৃষ্টচিত্তে ভ্রাতাদের সঙ্গে নগরে গিয়ে প্রবেশ করলেন। কিন্তু ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির আপন হৃদয়ে দুর্যোধনের সে-পাপানুষ্ঠানের বিষয় বুঝতে পারেননি। কারণ, সাধুলোক আপন অনুমানে অন্য লোককেও সাধুই দেখে থাকেন। ভ্রাতৃবৎসল যুধিষ্ঠির তখন মাতা কুন্তীর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করে বললেন, “মা, ভীম এখানে আসেনি? মা, ভীম কোথায় গেল? সকল বন ও উদ্যান খুঁজে দেখেও তো কোথাও ভীমকে পেলাম না। ভীমের কোনও বস্তু বা তাকে আমরা কোথাও দেখতে পেলাম না। তখন মনে করেছিলাম সে আমাদের আগেই এখানে চলে এসেছে। তারপর অত্যন্ত ব্যাকুল হৃদয়ে এখানে এসেছি। আপনি কি তাকে কোথাও পাঠিয়েছেন? মা, ভীমের সংবাদ বলুন। ভীমের ব্যাপারে আমার মন শান্ত হচ্ছে না। কারণ, সে কোথাও ঘুমিয়ে আছে—তা আমি মনে করতে পারছি না; কেউ তাকে বিনষ্ট করেছে বলেই আমার মনে হচ্ছে।”

বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির একথা বললে, কুন্তী ‘হা হা’ করে উঠে ব্যস্ত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “পুত্র! ভীমকে তো আমি দেখিনি। সে এখানে আসেনি। সত্বর তুমি ছোট ভাইদের নিয়ে তার খোঁজ করো।” যুধিষ্ঠিরকে একথা বলে কুন্তী উদ্বিগ্ন হৃদয়ে তখনই বিদুরকে এনে বললেন, “বুদ্ধিমান বিদুর, ভীম কোথায় গেল? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। তার সব কটি ভাই অন্যান্য ভাইদের সঙ্গে মিলে উদ্যান থেকে নির্গত হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে কেবল ভীমই আমার কাছে ফিরে আসেনি। আপনি পাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে নগরোদ্যানে গিয়ে ভীমের অন্বেষণ করুন।” তাঁরা সত্বর বনে গিয়ে উচ্চৈঃস্বরে ‘ভীম! ভীম!’ বলে ডাকলেন এবং সমস্ত বন খুঁজে দেখলেন, কিন্তু কোথাও ভীমের দেখা পেলেন না। সুতরাং তারা নগরে এসে পুনরায় কুন্তীকে বললেন, “মা, আমরা মহাবাহু ভীমসেনকে দেখতে পেলাম না।” কুন্তী বললেন, “ভীমকে দেখলে কোনও সময়েই দুর্যোধনের আনন্দ হয় না। কারণ, দুর্যোধন খল, দুষ্টবুদ্ধি, নীচাশয়, রাজ্যলোভী এবং নির্লজ্জ। সুতরাং, ক্রুদ্ধ দুর্যোধন হয়তো ভীমকে হত্যা করতেও পারে। তাতেই আমার মন আকুল হচ্ছে এবং হৃদয় যেন দগ্ধ হচ্ছে।” বিদুর বললেন, “কল্যাণী, একথা উচ্চৈঃস্বরে বলবেন না। শেষরক্ষা করুন। তিরস্কার করলে হয়তো দুরাত্মা আপনার আরও ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে। মহর্ষি বেদব্যাস বলেছেন, আপনার পুত্রেরা দীর্ঘায়ু হবে। অতএব আপনার পুত্র ফিরে আসবে এবং আনন্দ জন্মাবে।”

জ্ঞানী বিদুর এই কথা বলে আপন গৃহে চলে গেলেন। অত্যন্ত উদ্বিগ্ন কুন্তী পুত্রদের নিয়ে গৃহেই অপেক্ষা করতে থাকলেন। তারপর অষ্টম দিনে ভীম জাগরিত হলেন এবং সেই রসায়ন জীর্ণ করায় তিনি স্বভাবতই বলবান ছিলেন, এখন অসাধারণ বলবান হলেন। তিনি জাগরিত হয়েছেন দেখে সেই নাগেরা সুস্থ থেকে তাঁকে আশ্বস্ত করল এবং বলল, “ভীম, তুমি যখন এই বলবান রসায়ন পান করেছ, তখন তোমার দশ হাজার হস্তীর বল হবে এবং যুদ্ধে তুমি অন্যের অজেয় হবে। তুমি এই অলৌকিক এবং মঙ্গলকর জলে স্নান করে অদ্যই স্বগৃহে গমন করো। কারণ, তোমার বিচ্ছেদে তোমার মাতা ও ভ্রাতারা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে আছেন।”

তখন ভীমসেন সেই জলে স্নান করে পবিত্র হলেন এবং শুভ্রবর্ণ বস্ত্র ও মাল্য ধারণ করলেন। নাগভবনেই নাগেরা কৌতুকী হয়ে তাঁর যাত্রাকালীন মঙ্গলাচরণ করলেন; পরে তিনি বিষনাশক অথচ সুগন্ধি ঔষধের সঙ্গে নাগদত্ত উৎকৃষ্ট অন্ন ভোজন করলেন। নাগেরা তাঁকে বিশেষ আদর করল, আশীর্বাদ করে আনন্দিত করল এবং উৎকৃষ্ট অলংকার দিল। সেই সকল অলংকার পরিধান করে নাগদের নিকট বিদায় নিয়ে, হৃষ্টচিত্তে নাগভবন থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তখন কোনও নাগ তাকে জল থেকে তুলে দিল এবং সেই বনপ্রান্তে এনে রাখল। তারপর ভীমের সাক্ষাতেই তারা অন্তর্হিত হল।

তখন ভীম সেই স্থান থেকে উঠে দ্রুত মায়ের কাছে এলেন। মাতা ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে প্রণাম করে কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের মস্তক আঘ্রাণ করলে, মাতার সঙ্গে ভ্রাতারাও তাঁকে আলিঙ্গন করলেন এবং পরস্পর সৌহার্দ্যবশত বললেন, “অত্যন্ত সৌভাগ্যবশতই আবার তোমাকে পেলাম।” তখন ভীমসেন ভ্রাতাদের কাছে দুর্যোধনের সমস্ত ব্যবহারের কথাই বললেন এবং নাগলোকে যে সকল ভাল বা মন্দ ঘটনা ঘটেছিল, তাও বললেন। তখন যুধিষ্ঠির এই যুক্তিসঙ্গত কথা ভীমকে বললেন, “ভীম, চুপ করো, কোনও প্রকারেই এ ঘটনা তোমার স্পষ্ট করে বলা উচিত নয়। হে পাণ্ডবগণ, তোমরা আজ থেকে বিশেষ যত্নবান হয়ে পরস্পরকে রক্ষা করো।” এই বলে সকল ভ্রাতার সঙ্গে মিলিত হয়ে তখন থেকে আত্মরক্ষায় বিশেষ সাবধান হলেন। আর, পাণ্ডবগণ যখন বুঝতে পারলেন যে, ভীমকে বিষদান দুর্যোধনের কার্য, তখন থেকেই তারা মন্ত্রগোপনে যত্নবান হয়ে, সে-ঘটনা আর প্রচার করলেন না। এদিকে ধার্মিক ও বুদ্ধিমান বিদুর সকল কার্যেই পাণ্ডবদের বুদ্ধি দিতে লাগলেন। দুর্যোধনও ভীম পুনরায় এসেছেন দেখে দুঃখনিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে চিন্তাকুল হয়ে সর্বদাই বিদ্বেষ-সন্তাপ ভোগ করতে লাগলেন।

হস্তিনানগরে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর যে তেরো বৎসর কুন্তী কাটিয়েছিলেন, তাতে দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে দ্রোণাচার্যের শিষ্যদের বিদ্যাশিক্ষা শেষে প্রকাশ্য শিক্ষা প্রদর্শনীর কালে। গদাযুদ্ধের প্রদর্শনীতে ভীম এবং দুর্যোধন ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন দেখে দ্রোণাচার্যের আদেশে অশ্বত্থামা গিয়ে তাঁদের নিবারণ করলেন। তখন, দ্রোণাচার্য রঙ্গভূমিতে গিয়ে, মহামেঘের ন্যায় শব্দকারী গম্ভীর বাদ্যসমূহকে থামিয়ে এই কথা বললেন, “যিনি আমার পুত্র অপেক্ষাও প্রিয়তর এবং সমস্ত অস্ত্রে নিপুণ, বিষ্ণুর তুল্য পরাক্রমশালী ইন্দ্রপত্র সেই অর্জনের শিক্ষা আপনারা দেখুন।”

তখন দ্রোণাচার্যের বাক্য অনুসারে যুবক অর্জুন মঙ্গলাচরণ করে গোধা (ধনুর্গুণের আঘাত নিবারণের উপযোগী চর্মময় আবরণ) অঙ্গুলি এনে বাণপূর্ণ তুণ, ধনু ও সুবর্ণময় কবচ ধারণ করে রঙ্গভূমিতে উপস্থিত হলেন। তখন সূর্য, রামধনু ও বিদ্যুৎসমন্বিত সন্ধ্যাকালীন মেঘের মতো তাঁকে দেখা যেতে লাগল। তারপর অর্জুনের শিক্ষানৈপুণ্য দেখার জন্য রঙ্গভূমিস্থ সমস্ত লোকেরই গুরুতর ব্যাকুলতা দেখা দিল এবং সকল দিকে শঙ্খের সঙ্গে নানাবিধ বাদ্য বাজাতে লাগল। “এই শ্রীমান কুন্তীর গর্ভজাত, ইনি মধ্যম পাণ্ডব, ইনি দেবরাজের পুত্র, ইনি কুরুবংশের রক্ষক। ইনি অস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। ইনি ধর্মজ্ঞদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ। ইনি চরিত্রবানদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ এবং ইনি অন্যের স্বভাব বুঝতেও দক্ষ।” দর্শকগণ এইরকম নানাবিধ বাক্য বলতে লাগল; তা শুনে কুন্তীর বক্ষঃস্থল স্তনদুগ্ধের সঙ্গে আনন্দাশ্রুজলে সিক্ত হয়ে গেল। আর, এই গুরুতর শব্দে ধৃতরাষ্ট্রের কর্ণযুগল পরিপূর্ণ হয়ে গেল। তখন তিনি হৃষ্টচিত্তে বিদুরকে বললেন, “বিদুর, উদ্‌বেলিত সমুদ্রের শব্দের ন্যায় এই গুরুতর শব্দ আকাশ বিদীর্ণ করেই যেন রঙ্গস্থানে হঠাৎ উখিত হল কেন?” বিদুর বললেন, “মহারাজ, পাণ্ডুনন্দন অর্জুন কবচ ধারণ করে এই উপস্থিত হল; তাতেই এই গুরুতর শব্দ হল।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বিদুর, কুন্তীরূপ অরণি (অগ্নি উৎপাদনের কাঠ) থেকে উৎপন্ন তিনটি পাণ্ডবাগ্নি দ্বারা আমি ধন্য অনুগৃহীত ও রক্ষিত হলাম।” রঙ্গভূমির লোক সকল আনন্দিত হয়ে ধৈর্যধারণপূর্বক অবস্থান করতে লাগল। অর্জুন দ্রোণাচার্যকে অস্ত্রের নৈপুণ্য দেখাতে লাগলেন।

আগ্নেয় অস্ত্র দ্বারা অগ্নি, বারুণ অস্ত্র দ্বারা জল, বায়ব্য অস্ত্র দ্বারা বায়ু এবং পর্জন্য অস্ত্র দ্বারা মেঘ সৃষ্টি করলেন। ভৌম অস্ত্র দ্বারা ভূতলে প্রবেশ করলেন, পার্বত অস্ত্র দ্বারা পর্বত সৃষ্টি করলেন এবং অন্তর্ধান অস্ত্র দ্বারা অন্তর্হিত হলেন। ক্ষণকালের মধ্যে উন্নত এবং ক্ষণকালের মধ্যে খর্ব, ক্ষণকালের মধ্যে সারথি, ক্ষণকালের মধ্যে রথী এবং ক্ষণকালের মধ্যে ভূতলে অবতীর্ণ হলেন। গুরুর প্রিয় ও অস্ত্রপ্রয়োেগ নিপুণ অর্জুন যথাবিধ নানা বাণ দ্বারা কোমল ও সূক্ষ্ম বস্তুকে বিদ্ধ করলেন। একটি লৌহনির্মিত শূকর ঘুরছিল। এমন অবস্থায় অর্জুন একটি বাণের ন্যায় পরস্পর অসংযুক্ত পাঁচটি বাণকে একবারেই তার মুখের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিলেন। একগাছি দড়িতে একটি গোরুর শিং ঘুরছিল। অর্জুন তার ভিতরে একুশটি বাণ প্রবেশ করিয়ে দিলেন। অর্জুন, ধনু ও তরবারিতে এইরূপ অনেক গুরুতর কৌশল দেখালেন, তারপর আবার গদা ধারণ করে মণ্ডলাকারে ভ্রমণ করে দেখালেন। তারপরে, অর্জুনের শিক্ষাপ্রদর্শন প্রায় সমাপ্ত হয়ে আসলে এবং লোকের কোলাহল ও বাদ্যধ্বনি মন্দীভূত হলে, দ্বারদেশ থেকে আগত গুরুতর বলসূচক এবং বজ্রাঘাতশব্দতুল্য বাহবা স্ফোটনের শব্দ শোনা গেল। তখন সকলে সন্দেহ করল, একি পর্বত বিদীর্ণ হল? না ভূতল ফেটে গেল অথবা জলপূর্ণ মেঘের গর্জনে আকাশ পরিপূর্ণ হল। রঙ্গভূমিস্থ সমস্ত লোকের মনেই উক্তরূপ বিতর্ক দেখা দিল। তখন ক্ষণকালের মধ্যে সকল দর্শক দ্বারদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করল।

বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্র দৌবারিকগণ প্রবেশের পথ দিলে, শত্রুনগরবিজেতা কর্ণ সেই বিস্তীর্ণ রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করলেন। তিনি তখন স্বাভাবিক কবচ ধারণ করে ছিলেন। দুটি কর্ণকুণ্ডল তাঁর মুখখানিকে উদ্ভাসিত করেছিল। ধনু ও তরবারি ধারণ করে তিনি পাদচারী পর্বতের ন্যায় আসছিলেন। তিনি কুন্তীদেবীর কন্যা অবস্থায় জন্মেছিলেন, তাঁর যশ বিখ্যাত ছিল, নয়নযুগল বৃহৎ ছিল, তিনি তীক্ষ্ণ রশ্মি সূর্যের অংশ এবং শত্রুদমন করতে সমর্থ ছিলেন। সিংহ, হস্তী এবং বৃষের ন্যায় তাঁর বল ও পরাক্রম ছিল। তিনি দীপ্তিতে সূর্যের তুল্য, সৌন্দর্যে চন্দ্রের তুল্য এবং উজ্জ্বলতায় অগ্নির তুল্য ছিলেন। উন্নত শরীর। সুতরাং তাঁকে স্বর্ণময় তালবৃক্ষের মতো দেখা যাচ্ছিল। তার শরীরটি সিংহের ন্যায় কঠিন ও বলিষ্ঠ ছিল, গুণের সংখ্যা করা যেত না এবং যুবক ও সুন্দর ছিলেন। তিনি রঙ্গভূমির সকল দিকে দৃষ্টিপাত করে অনধিক আদরের সঙ্গে দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে প্রণাম করলেন। তখন রঙ্গভূমির সকল লোক নিশ্চল ও স্থিরনয়ন হয়ে কৌতুকপরায়ণ হল এবং ‘এ কে’ এইরূপ ভাবতে থাকায় তাদের চিত্ত উদ্‌বেলিত হল।

বাগ্মীশ্রেষ্ঠ সূর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের ভ্রাতা হয়েও, অর্জুনকে ভ্রাতা বলে জানতে না পেরে মেঘের ন্যায় গম্ভীর স্বরে বললেন, “অর্জুন, সমবেত দর্শকের সমক্ষে তুমি যে কার্য করেছ আমি তার থেকে বেশি করব। সুতরাং নিজের কার্যে তুমি গর্বিত হোয়ো না।” কর্ণের বাক্য সমাপ্ত না হতেই সকল দিক থেকে যন্ত্রচালিত সকল লোেক যেন উঠে দাঁড়াল। তখন কর্ণের প্রতি দুর্যোধনের সৌহার্দ্য জন্মাল; আর অর্জুনের চিত্তে লজ্জা এবং ক্রোধ উপস্থিত হল। তারপর গুরু দ্রোণাচার্যের অনুমতিক্রমে অর্জুনকৃত সমস্ত কাজগুলি যুদ্ধপ্রিয় কর্ণ করে দেখালেন। তখন দুর্যোধন ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দবশত কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, “মহাবাহু! তোমার সুখে আগমন হয়েছে তো? হে গৌরবদাতা! তুমি আমাদের ভাগ্যবশতই উপস্থিত হয়েছ। এখন আমার সঙ্গে বিচরণ করো এবং ইচ্ছা অনুসারে কুরুরাজ্য ভোগ করো।” কর্ণ বললেন, “অন্য সকলে প্রার্থনা করে আমার সঙ্গে যে সখিত্ব করেছে, আমি আপনার সঙ্গে সেই সখিত্ব প্রার্থনা করি। আর অর্জুনের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে ইচ্ছা করি।” দুর্যোধন বললেন, “কর্ণ, তুমি আমার সঙ্গে বন্ধুত্বের কারণে সমস্ত ভোগ করো। বন্ধুগণের প্রিয়কারী হও এবং সকল শত্রুর মস্তকে চরণ স্থাপন করো।’

কর্ণের বাক্যে অর্জন যেন আপনাকে নিন্দিত বলে মনে করে, দুর্যোধনাদি ভ্রাতৃগণের মধ্যে পর্বতের ন্যায় অবস্থানকারী কর্ণকে বললেন, “যারা অনাহূত অবস্থায় এসে সম্মিলিত হয় এবং যারা অনাহুত অবস্থায় এসে বলতে থাকে, তাদের যে লোেক নির্দিষ্ট আছে, কর্ণ, আমি তোমাকে বধ করলে পরে তুমি সেই লোকে যাবে।” কর্ণ অর্জুনের কথা শুনে বললেন, “এই রঙ্গস্থলে সকলের সমান অধিকার। সুতরাং অর্জুন এখানে তোমার বৃথা কতগুলি কথা বলার প্রয়োজন কী? এখানে প্রবল রাজারাও রয়েছেন; আবার ধর্ম বলেরই অনুসরণ করে থাকে। দুর্বলের দুঃখজনক নিন্দার প্রয়োজন কী? বাণ দ্বারাই বক্তব্য বিষয় বলো। আমি আজ বাণ দ্বারা তোমার গুরুর সমক্ষেই তোমার মস্তক ছেদন করব।”

তারপর দ্রোণাচার্যের অনুমতিক্রমে অর্জুন ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ণের কাছে গমন করলেন। তখন দুর্যোধনও ভ্রাতৃগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ণের পক্ষ অবলম্বন করলেন, তখন কর্ণ ধনু ও বাণ ধারণ করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলেন। সেই সময়ে বিদ্যুৎ গর্জন ও ইন্দ্রায়ুধ যুক্ত মেঘসকল এসে আকাশমণ্ডলকে আবৃত করল এবং তার নীচে বকপক্ষীগণ উড়তে লাগল। তারপরে দেবরাজ পুত্র অর্জুনের প্রতি স্নেহবশত রঙ্গ দর্শন করতে এসেছেন দেখে সূর্যও কর্ণের উপরে থাকা মেঘসকলকে সরিয়ে দিলেন। তখন অর্জুনকে মেঘের ছায়ায় আবৃত ও কর্ণকে সূর্যের কিরণে আচ্ছন্ন দেখা যেতে লাগল। যেখানে কর্ণ ছিলেন, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা সেখানে থাকলেন; আর অর্জুনের দিকে দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য ও ভীষ্ম উপস্থিত হলেন। রঙ্গভূমিস্থ সকল লোকই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। স্ত্রীলোকদের মধ্যেও দুই পক্ষ অবলম্বনের প্রবণতা দেখা দিল, কিন্তু কুন্তী কর্ণকে চিনতে পেরে মূৰ্ছিত হয়ে পড়লেন। তখন সর্বধর্মজ্ঞ বিদুর দাসীগণদ্বারা চন্দনজলে সিক্ত করে, কুন্তীর চৈতন্য ফিরিয়ে আনলেন ও তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। তখন কুন্তী চৈতন্যলাভ করে, সেই দুটি পুত্রকে ওষ্ঠ দংশন করতে দেখে, ব্যস্ত হয়ে কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। এই সময়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধের নিয়মাভিজ্ঞ এবং পরম ধার্মিক কর্ণ ও অর্জুনকে ধনু উত্তোলন করতে দেখে কৃপাচার্য কর্ণকে বললেন, “এই অর্জুন কুরুবংশে জন্মেছে, কুন্তীর ও পাণ্ডুর তৃতীয় পুত্র। এ তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করবে। কর্ণ, তুমিও এইভাবে নিজের মাতা, পিতা ও বংশের কথা বললা; আর তুমি যে রাজবংশের অলংকার, তাদেরও উল্লেখ করো। তারপর তোমার সমস্ত বৃত্তান্ত জেনে অর্জুন যুদ্ধ করতেও পারে, না করতেও পারে। কিন্তু রাজপুত্রেরা হীনবংশ ও হীনাচার লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করেন না।”

কৃপাচার্য এই কথা বললে, কর্ণের মুখখানি লজ্জায় অবনত হয়ে বর্ষাজলসিক্ত বিস্রস্ত পদ্মের ন্যায় শোভা পেতে লাগল। তখন দুর্যোধন বললেন, “আচার্য, শাস্ত্রে ক্ষত্রিয়ের তিনটি কারণ দেখা যায়—ক্ষত্রিয়বংশে উৎপত্তি, বীরত্ব এবং বুদ্ধিবলে সৈন্যচালনা। যদি এই অর্জুন রাজা ভিন্ন অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছা না করে, তবে আমি কর্ণকে অঙ্গদেশের রাজপদে অভিষিক্ত করছি।” তারপর দুর্যোধন সেই সময়েই মহারথ ও মহাবল কর্ণকে স্বর্ণময় পীঠে স্থাপন করে মন্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণগণ দ্বারা খই ও পুস্পষক্ত স্বর্ণকম্ভের জলে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। তখন কর্ণ রাজশ্রীযুক্ত হলেন। পরে কেউ তাঁর মস্তকে উৎকৃষ্ট ছত্র ধারণ করল, কেউ চামর আন্দোলন করতে লাগল এবং বৈতালিকগণ জয়শব্দ উচ্চারণ করল। তখন কর্ণ দুর্যোধনকে এই কথা বললেন, “এই রাজ্যদানের অনুরূপ আমি তোমাকে কী দান করব? হে রাজশেষ্ঠ্র, বলো, আমি তাই করব।” তখন দুর্যোধন কর্ণকে বললেন, “আমি তোমার কাছে প্রগাঢ় সখ্য লাভ করতে ইচ্ছা করি।” দুর্যোধনের কথা শুনে কর্ণ তাকে বললেন, “তাই হবে।” তারপর তারা প্রতিনিবন্ধন পরস্পর আলিঙ্গন করে বিশেষ আনন্দ লাভ করলেন।

ঠিক সেই সময়ে অধিরথ যষ্টিতে ভর দিয়ে কর্ণকে ডাকতে ডাকতে যেন রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করল, তখন ভয়ে তার উত্তরীয় বস্ত্র পড়ে গিয়েছিল। ঘাম ঝরছিল এবং শরীর কাঁপছিল। অভিষেকবশত আর্দমস্তক কর্ণ অধিরথকে দেখে, ধনু পরিত্যাগ করে পিতৃগৌরবের কারণে মস্তক অবনত করে নমস্কার করলেন। তখন অধিরথ ব্যস্ত হয়ে বস্ত্রাঞ্চল দ্বারা নিজের চরণ আবৃত করে ‘পুত্র’ বলে অভিহিত করলেন। তারপর অধিরথ স্নেহে আকুল হয়ে কর্ণকে আলিঙ্গন করে অঙ্গরাজ্যে অভিষেকের কারণে তাঁর আর্দ্র মস্তকটি পুনরায় অশ্রুজলে সিক্ত করল। তখন পাণ্ডুনন্দন ভীম কর্ণকে সূতপুত্র বলে মনে করে হাসতে হাসতে বললেন, “সূতপুত্র! তুমি যুদ্ধে অর্জুনের হস্তে বধের গৌরব লাভ করার যোগ্য নও। তুমি সত্বর নিজের উপযুক্ত কশা (চাবুক) ধারণ করো। কুকুর যেমন যজ্ঞে অগ্নির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত নৈবেদ্য পুরোডাশ (পিষ্টক বিশেষ) ভক্ষণ করার যোগ্য হয় না, নরাধম তুমিও তেমনই অঙ্গরাজ্য ভোগ করার যোগ্য নও।” ভীম এই কথা বললে, ক্রোধে কর্ণের ওষ্ঠযুগল একটু স্পন্দিত হল, তখন তিনি নিশ্বাস ত্যাগ করে আকাশস্থ সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।।

তখন মত্তহস্তী যেমন পদ্মবন থেকে উঠে দাঁড়ায়, তেমন মহাবল দুর্যোধন ক্রোধে ভ্রাতৃগণের মধ্য থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সম্মুখস্থ ভীমকর্মা ভীমসেনকে বললেন, “ভীম! তোমার এমন কথা বলা উচিত হয়নি। ক্ষত্রিয়দের বলই শ্রেষ্ঠ, তারপর ক্ষত্রিয়ের বন্ধুর সঙ্গেও যুদ্ধ করা উচিত। আর বীরগণ ও নদীগণের উৎপাদক জানাও দুষ্কর। দেখো, অগ্নি জল থেকেই উৎপন্ন হয়েছিলেন, যিনি সমস্ত চরাচর ব্যাপ্ত করে আছেন, আবার দধীচি মুনির অসুরনাশক বজ্ৰ অগ্নি থেকেই নির্মিত হয়েছিল। রুদ্র থেকে উৎপন্ন, অগ্নি ও গঙ্গাকর্তৃক ধৃত এবং কৃত্তিকাগণ কর্তৃক প্রতিপালিত ভগবান কার্তিক দেবকে সর্বদেবময় বলে শোনা যায়। তারপর বিশ্বামিত্র প্রভৃতি যে সকল ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় থেকে উৎপন্ন হয়েও অক্ষয় ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেছেন, তাঁদের কথাও তুমি শুনেছ। আর অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য কলস থেকে জন্মেছেন, কৃপাচার্য গৌতম মুনির বংশে শরস্তম্ভ থেকে উৎপন্ন হয়েছেন এবং তোমাদের জন্ম যেভাবে হয়েছিল, তাও আমি জানি। কুণ্ডল ও কবচ যুক্ত, সর্বসুলক্ষণলক্ষিত এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী ব্যাঘ্ররূপ কর্ণকে হরিণরূপা নীচ স্ত্রী কীভাবে জন্ম দেবে?

“এই রাজা কর্ণ আজ্ঞানুবর্তী আমার সাহায্যে এবং নিজের এই বাহুবলে সমগ্র পৃথিবীর রাজ্য ভোগ করার যোগ্য, কেবল অঙ্গরাজ্য নয়। আমার এই কার্য যে লোকের সহ্য হয়নি, সে চরণযুগল দ্বারা রথে আরোহণ করুক এবং যুদ্ধের জন্য ধনু আকর্ষণ করুক।” তারপর সমস্ত রঙ্গভূমিতে সাধুবাদের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর হাহাকার উঠল, সূর্যও অস্তাচলে গেলেন। তারপর রাজা দুর্যোধন কর্ণের হস্তধারণ করে সেই রঙ্গভূমি থেকে নির্গত হয়ে চলে গেলেন। পাণ্ডবেরাও সকলে দ্রোণ, কৃপ ও ভীষ্মের সঙ্গে সঙ্গে আপন ভবনে চলে গেলেন। আর রঙ্গস্থ লোক সকলও কেউ অর্জুনের, কেউ কর্ণের এবং কেউ দুর্যোধনের প্রশংসা করতে করতে রঙ্গভূমি থেকে প্রস্থান করল।

এদিকে কুন্তী কর্ণের অলৌকিক লক্ষণ দেখে তাঁকে পুত্র বলে চিনতে পারলেন এবং তিনি অঙ্গদেশের রাজা হলেন জেনে তাঁর মনে আনন্দ জন্মাল। তখন কর্ণকে পেয়ে দুর্যোধনেরও অর্জুনের ভয় সত্বর অন্তর্হিত হল। অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত কর্ণও সর্বদা সন্তোষকর বাক্য দ্বারা দুর্যোধনের সঙ্গে আলাপ করতে লাগলেন। ওদিকে যুধিষ্ঠিরেরও এরূপ ধারণার জন্ম হল যে, কর্ণের তুল্য ধনুর্ধর পৃথিবীতে আর নেই।

জতুগৃহ দাহ

দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণার পালা এল অস্ত্র পরীক্ষার শেষে। যুধিষ্ঠিরকে দূরে সরিয়ে রেখে, সমগ্র কৌরব শক্তি পরাজিত হবার পর, ভীম-অর্জুনের নেতৃত্বে চার পাণ্ডব ভ্রাতা দ্রুপদ রাজাকে ধরতে এগিয়ে গেলেন এবং প্রধানত ভীম-অর্জুনের বিক্রমে অক্ষত অবস্থায় রাজা দ্রুপদকে বন্দি করে এনে দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণা প্রদান করলেন। সন্তুষ্ট দ্রোণাচার্য অর্জুনকে দিলেন প্রয়োগ, উপসংহার সমস্ত বিদ্যার সঙ্গে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অর্থ ‘ব্রহ্মশির’।

ইতিমধ্যে যুধিষ্ঠিরের খ্যাতি, কীর্তি, বিনম্র ব্যবহার, দূরদর্শিতা, ব্রাহ্মণ, অতিথি ও দরিদ্রনারায়ণ সেবা ইত্যাদি গুণ পিতা পাণ্ডুকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। ভীমকে বলে সর্বশ্রেষ্ঠ ও অর্জুনকে সমস্ত অস্ত্রে শিক্ষিত দেখে দুর্যোধন উদ্বিগ্ন হয়ে অনেক পরিতাপ করলেন। তারপর সূতপুত্র কর্ণ, সুবলপুত্র শকুনি এবং দুর্যোধন প্রভৃতি নানা উপায়ে পাণ্ডবগণকে বিনাশ করবার ইচ্ছা করতে লাগলেন। পাণ্ডবেরা বিদুরের মতে থেকে, কোনও বিষয় প্রকাশ না করে, যেমন যেমন উৎপাত উপস্থিত হতে লাগল, তেমন তেমন সে-সকলের প্রতিকার করতে লাগলেন। এদিকে পুরবাসীগণ তখন পাণ্ডবগণকে সর্বগুণসম্পন্ন দেখে তাঁদের গুণগুলি সভায় সভায় বলতে লাগল। এবং তারা নানাস্থানে এবং নানা সভায় সম্মিলিত হয়ে, যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যপালনের যোগ্য ঘোষণা করতে লাগল। তারা বলতে থাকল, “প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ বলে পূর্বে রাজত্ব লাভ করেননি, তিনি এখন রাজা হবেন কী করে? এবং সত্যপ্রতিজ্ঞ ও চিরকুমার শান্তনুনন্দন ভীষ্ম পূর্বে রাজ্য প্রত্যাখ্যান করে আবার কখনও রাজত্ব গ্রহণ করবেন না। অতএব যুবক, সত্যসেবী, দয়াশীল যুধিষ্ঠিরকেই আমরা এখন নিশ্চয় রাজ্যে অভিষিক্ত করব। সেই ধর্মজ্ঞ যুধিষ্ঠির নিশ্চয় শান্তনুপুত্র ভীষ্মকে এবং পুত্রদের সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রকে সম্মানপূর্বক নানাবিধ ভোগ করাবেন।

যুধিষ্ঠিরের অনুরক্ত পুরবাসীদের মুখে এই কথা শুনে, দুর্মতি দুর্যোধন অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। দুরাত্মা দুর্যোধন দুঃখিত হয়ে তাদের বাক্য সহ্য করতে পারলেন না। ঈর্ষায় জ্বলতে জ্বলতে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গমন করলেন। পিতাকে একাকী দেখে, তাঁকে নমস্কার করে, পুরবাসীদের যুধিষ্ঠিরের প্রতি অনুরাগ দেখায় ঈর্ষানলে জ্বলতে থাকা দুর্যোধন পিতাকে বললেন, “পিতঃ, পুরবাসীরা আমাদের পক্ষে যেসব অমঙ্গলের কথা বলছিল, তা আমি শুনেছি; তারা আপনাকে এবং ভীষ্মকে অগ্রাহ্য করে পাণ্ডুর পুত্রকে রাজা করতে ইচ্ছা করে। ভীষ্মরও এই মত যে, তিনি রাজ্যভোগ করতে ইচ্ছা করেন না; সুতরাং পুরবাসী লোকেরা আমাদের গুরুতর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। পাণ্ডু নিজের গুণেই পূর্বে পৈতৃক রাজ্য পেয়েছিলেন; আর আপনি জন্মান্ধ বলে প্রাপ্য রাজা পাননি। সেই পাণ্ডুর পুত্রই যদি আবার উত্তরাধিকার সূত্রে পাণ্ডুর রাজ্য পায়, তবে নিশ্চয় তার পুত্রই আবার রাজ্য পাবে, তারপর তার পুত্র, তারপর তার পুত্র রাজ্য পেতে থাকবে। তা হলে মহারাজ, আমরা রাজবংশে জন্মেও পুত্র-পৌত্রাদির সঙ্গে রাজ্যবিহীন হয়ে রইলাম এবং লোকের অবজ্ঞার পাত্র হতে থাকলাম। অতএব মহারাজ, যাতে আমরা পরপিণ্ডোপজীবী হয়ে সর্বদার জন্য নরক-দুঃখ ভোগ না করি, তেমন কৌশল করুন। মহারাজ, আপনি যদি পূর্বেই এই রাজ্য পেতেন তা হলে পুরবাসীরা অননুরক্ত থাকলেও অবশ্যই আমরা রাজ্য পেতাম।”

জ্ঞানচক্ষু রাজা ধৃতরাষ্ট দুর্যোধনের কথা শুনে এবং মন্ত্রী কনিকের সঙ্গে তাঁর একান্ত আলাপ স্মরণ করে, দ্বৈধচিত্ত ও শোকার্ত হলেন। তখন দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ ও শকুনি— এঁরাও অন্তঃপুর থেকে পরামর্শ করলেন, পরে দুর্যোধন এসে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “মহারাজ! যাতে পাণ্ডবগণ থেকে আমাদের কোনও ভয় না হয়, সেরূপ নিপুণ উপায়ে আপনি তাদের বারণাবত নগরে নির্বাসিত করুন।” ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের কথা শুনে একটুকাল চিন্তা করে তাঁকে বললেন, “দুর্যোধন, পাণ্ডু সর্বদাই ধর্মের অনুষ্ঠান করতেন, আর তিনি জ্ঞাতিবর্গের উপরে বিশেষত আমার উপরে অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তিনি ভোজন প্রভৃতি নিজের কার্যগুলিও নিজে কিছু জানতেন না। সর্বদাই এক নিয়মে থেকে রাজ্যটা আমার হাতেই সমর্পণ করতে চাইতেন। তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠিরও পাণ্ডু যেমন ছিলেন, তেমনি ধর্মপরায়ণ, গুণবান, লোকবিখ্যাত ও পুরবাসীদের প্রিয় হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তাকে আমরা কীভাবে বলপূর্বক এই পৈতৃক রাজ্য থেকে নির্বাসিত করতে পারব? বিশেষত, সে এখন সহায়সম্পন্ন। পাণ্ডু মন্ত্রীগণ ও সৈন্যগণকে সর্বদা ভরণপোষণ করে গিয়েছেন, বিশেষত তাঁদের পুত্র-পৌত্র প্রভৃতিকে প্রতিপালন করে গিয়েছেন। তারপর পাণ্ডু নগরবাসী লোকদের পূর্বে নানাপ্রকারে আপ্যায়িত করে গিয়েছেন, এ অবস্থায় তারা যুধিষ্ঠিরের জন্য বন্ধুবর্গের সঙ্গে আমাদেরকে কেন বধ করবে না?”

দুর্যোধন বললেন, “পিতঃ! আমি আমাদের পক্ষে এরূপ দোষ ঘটবে—এ-কথা পর্যালোচনা করেই ধন ও মান দ্বারা সকল প্রজাকে সন্তুষ্ট করেছি। সুতরাং তারা নিশ্চয়ই প্রধানভাবে আমাদেরই সহায় হবে। তারপর মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে ধনাগারও আমাদেরই অধীনে আছে। অতএব আপনি কোনও কোমল উপায়ে পাণ্ডবগণকে বারণাবত নগরে সত্বরই নির্বাসিত করতে পারেন। মহারাজ, যখন আমার উপরে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন কুন্তীদেবী পুনরায় পুত্রগণের সঙ্গে হস্তিনায় আসবেন।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “আমার মনের ইচ্ছাও তাই, কিন্তু এ অভিপ্রায়টা দূষিত বলেই আমি তা প্রকাশ করছি না। তবে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর ও কৃপ—এঁরা কখনও পাণ্ডবগণের নির্বাসন ইচ্ছা করবেন না। বৎস! ভীষ্ম ভিন্ন অন্যান্য কুরুবংশীয়দের কাছে আমরা ও পাণ্ডবেরা সমান। সুতরাং ধার্মিক ও মনস্বী সেই কুরুবংশীয়গণ কখনও বৈষম্য করবেন না। অতএব আমরা এই মহাত্মা কুরুবংশীয়ের কাছে এবং জগতের কাছে কেন বধ্য হব না?”

দুর্যোধন বললেন, “ভীষ্ম সর্বদাই মধ্যস্থ আছেন, কিন্তু অশ্বত্থামা আমাদের পক্ষেই আছেন। যে পক্ষে পুত্র অশ্বত্থামা থাকেন, দ্রোণও সেই পক্ষেই থাকবেন; এতে কোনও সন্দেহ নেই। তারপর যে পক্ষে দ্রোণ ও অশ্বত্থামা থাকবেন, কৃপও সেই পক্ষেই থাকবেন। কেন-না কৃপ ভগিনীপতি দ্রোণকে এবং ভাগিনেয় অশ্বত্থামাকে কখনও ত্যাগ করবেন না। তবে, বিদুর আমাদেরই ধনে প্রতিপালিত হয়েও গোপনে পাণ্ডবদের সঙ্গে সম্মিলিত আছেন বটে, কিন্তু তিনি একাকী পাণ্ডবদের জন্য আমাদের নির্যাতন করতে সমর্থ হবেন না। অতএব আপনি নিঃশঙ্কচিত্তে কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবগণকে নির্বাসিত করুন এবং অদ্যই যাতে তারা বারণাবতে যায়, তা করুন। নিদ্রানাশক এবং হৃদয়বিদ্ধ শল্যের ন্যায় ভয়ংকর শোকানলকে এই কার্যদ্বারা নির্বাপিত করুন।”

দুর্যোধনের নিযুক্ত বর্ণনানিপুণ মন্ত্রীরা মনোহর বারণাবত নগরে আসন্ন মহাদেবের উৎসব উপলক্ষে বিশাল জনসমাগমের উল্লেখ করল। পাণ্ডবেরা আকৃষ্ট হলেন। পাণ্ডবদের এই আকর্ষণ অনুভব করে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের বললেন, “এই সকল লোক প্রত্যহই আমার নিকট বারবার বলছে যে, জগতে বারণাবত নগর অতি মনোহর। বৎসগণ, তোমরা যদি ইচ্ছা করো তবে পরিজনবর্গ ও অনুচরবর্গের সঙ্গে বারণাবত নগরে গিয়ে দেবতার ন্যায় সেই উৎসবে বিচরণ করো। আর, তোমরা সেখানে মনোহর মূর্তি দেবগণের ন্যায় বিচরণ করতে থেকে ব্রাহ্মণগণকে এবং সর্বপ্রকার গাথকগণকে ইচ্ছানুসারে ধন-রত্নাদি বিতরণ করো। এইভাবে কিছুকাল বিচরণপূর্বক অত্যন্ত আমোদ অনুভব করে কুশলে থেকে পুনরায় এই হস্তিনানগরে আসবে।”

যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় বুঝে এবং আপনাকে নিঃসহায় ভেবে প্রত্যুত্তর করলেন, “তাই হোক।” তারপর ভীষ্ম, বিদুর, দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, বািহ্লক, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা অন্যান্য মাননীয় লোক, মন্ত্রীগণ, ব্রাহ্মণগণ, তপস্বীগণ, পুরোহিত, পুরবাসী এবং গান্ধারীদেবীর নিকট গিয়ে যুধিষ্ঠির কাতর হয়ে বললেন, “আমরা পরিজনবর্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে মনোহর ও বহুজনাকীর্ণ সেই বারণাবত নগরে যাব। আপনারা সকলে প্রসন্নচিত্তে পবিত্রবাক্য উচ্চারণ করুন। আপনাদের আশীর্বাদে পরিপুষ্ট হলে, পাপ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না।” যুধিষ্ঠির একথা বললে তাঁরা সকলেই প্রফুল্ল মুখ হয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, “পাণ্ডবগণ, পথে এবং অন্যসকল স্থানে সকল প্রাণী থেকে সর্বদাই তোমাদের মঙ্গল হোক এবং কোনও স্থানেই যেন তোমাদের কোনও অমঙ্গল না হয়।” তারপর পাণ্ডবগণ রাজ্যলাভের জন্য স্বস্ত্যয়ন এবং অন্য সকল প্রকার মাঙ্গলিক কার্য করে বারণাবতে যাত্রা করলেন।

পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে বারণাবতে চলে গেলে, দুরাত্মা দুর্যোধন অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলেন। তিনি পুরোচন নামক এক মন্ত্রীকে ডেকে এনে, নির্জনে তার দক্ষিণ হস্ত ধারণ করে বললেন, “পুরোহিত আমার এই রাজ্য ধনসমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ। এ রাজ্য আমারও যেমন, তোমারও তেমন, সুতরাং তুমি সেই রাজ্য রক্ষা করো। তুমি ছাড়া অন্য কোনও লোকই আমার সেরূপ অত্যন্ত বিশ্বাসী সহায় নেই যে, তোমারই মতো তার সঙ্গে মিলিত হয়ে পরামর্শ করব। অতএব বন্ধু এই মন্ত্রণা গুপ্ত রাখো এবং নিপুণ উপায়ে আমার শত্রুগণের উচ্ছেদসাধন করো; অতএব আমি যা বলি তা করো। তুমি অশ্বচালিত শীঘ্রগামী রথে আরোহণ করে যাতে অদ্যই বারণাবতে যেতে পারো, তার ব্যবস্থা করো। তুমি সেখানে গিয়ে, উপযুক্ত স্থানে থেকে, এমন একটি চকমিলানো বাড়ি তৈরি করাবে, যাতে প্রচুর মণিরত্নাদি থাকবে। অস্ত্রাগার থাকবে এবং বাইরে সুন্দর প্রাচীর থাকবে। শণগাছ ও ধুনা প্রভৃতি যা কিছু আগ্নেয়দ্রব্য জগতে আছে, সে সমস্তই সেই বাড়ি তৈয়ারির উপাদানের ভিতরে মিশিয়ে দেওয়াবে। তারপরে আবার ঘৃত, তৈল, চর্বি ও গালার সঙ্গে মাটি মিশিয়ে সেই বাড়ির দেওয়ালে লেপ দেওয়াবে। আর সেই বাড়ির সকল দিকে যে সকল উঁচু উঁচু বেদি (বসার জায়গা) করাবে, সেগুলির ভিতরেও শণগাছ, তৈল, ঘৃত, গালা ও আগ্নেয় কাঠ দেওয়াবে।

“পাণ্ডবগণ এবং অন্য লোেক বিশেষ পরীক্ষা করেও যাতে সেই সকল আগ্নেয়বস্তু বুঝতে পারে, এমনভাবে বাড়িখানি করাবে। এমন বাড়ি তৈরি হয়ে গেলে পাণ্ডবগণকে এবং আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কুন্তীদেবীকে বিশেষ আদর করে সেই বাড়িতে নিয়ে বাস করাবে। আর পাণ্ডবদের জন্য উৎকৃষ্ট উৎকৃষ্ট আসন, যান ও শয্যা প্রভৃতি তৈয়ারি করবে, যাতে আমার পিতা সন্তুষ্ট হন। যে পর্যন্ত আগুন দেওয়ার সময় উপস্থিত না হয়, সে পর্যন্ত যাতে বারণাবতের লোকেরা সে-ঘটনা কিছুই জানতে না পারে, সেইভাবে সমস্ত কাজ করাবে। তারপর পাণ্ডবেরা বিশ্বস্ত ও নিরুদ্বেগে নিদ্রামগ্ন হলে, তুমি সেই বাড়িস্থিত দ্বারপ্রান্তিক নিজের ঘরখানিতে আগুন লাগিয়ে দেবে। তোমার ঘর দগ্ধ হতে থাকলে, ক্রমে পাণ্ডবেরাও দগ্ধ হয়ে যাবে; তাতে পাণ্ডবগণের মৃত্যুর জন্য জনসাধারণ আমাদের নিন্দা করতে পারবে না।” “তাই হবে”দুর্যোধনের কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে সেই পুরোচন অশ্বযুক্ত শীঘ্রগামী রথে আরোহণ করে প্রস্থান করল। পাণ্ডবগণ রথে বায়ুর তুল্য বেগবান, ভাল ভাল অশ্ব সংযুক্ত করে তাতে আরোহণ করার পূর্বে ভীষ্ম, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, মহাত্মা দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, বিদুর ও অন্যান্য বৃদ্ধ ব্যক্তিগণের চরণযুগলে নমস্কার করলেন। এইভাবে তাঁরা কুরুবংশীয়গণকে সম্মান প্রদর্শন করে, সমান পর্যায়ের লোকেদের আলিঙ্গন করে, অল্পবয়স্ক লোককর্তৃক নমস্কৃত হয়ে, মাতৃগণকে প্রদক্ষিণ করে এবং তাদের কাছে গমনের অনুমতি নিয়ে বারণাবত রওনা হলেন।

তখন অত্যন্ত বুদ্ধিমান বিদুর, ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবশ্রেষ্ঠগণ এবং পুরবাসীগণ েশাকে কাতর হয়ে পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণের পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। তখন কতগুলি পুরবাসী ও দেশবাসী লোক পাণ্ডবগণকে কাতর দেখে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বলতে লাগল, “সর্বপ্রকার অত্যন্ত মন্দবুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র নিজের পুত্রদের এবং ভ্রাতার পুত্রদের সমান দেখেন না এবং ধর্মের পর্যালোচনাও করেন না।” পুরবাসীগণ চলে গেলে, সর্বধর্মজ্ঞ বিদুর যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে দেবার জন্য বললেন। বিদুর বুদ্ধিমান ও বিদ্বান ছিলেন এবং ম্লেচ্ছভাষা ও সংস্কৃতভাষা দুই জানতেন, আবার যুধিষ্ঠিরও বুদ্ধিমান ও বিদ্বান ছিলেন ও ম্লেচ্ছভাষা ও সংস্কৃতভাষা দুই জানতেন। সুতরাং বিদুর যুধিষ্ঠিরকেই ম্লেচ্ছভাষা দ্বারা তাঁর বক্তব্য বলেছিলে। বিদুর বললেন, “নীতিশাস্ত্র অনুসারিণী বুদ্ধির গুণে শত্রুর উদ্‌ভাবিত কূটকৌশল যে তোক বুঝতে পারে এবং তা বুঝতে পেরে যে উপায়ে বিপদ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, লৌহনির্মিত ভিন্ন শরীরনাশক ধারালো অস্ত্র আছে; এ যে জানে সেই প্রতিকারজ্ঞ লোককে শত্রুরা কখনও নষ্ট করতে পারে না। অগ্নি শুষ্ক বন দগ্ধ করতে করতে বিশাল শুষ্ক বনে গিয়ে লাগে; কিন্তু সে স্থানের গর্তবাসী ইদুর প্রভৃতিকে দগ্ধ করতে পারে না।এইভাবে যে লোক আত্মরক্ষা করে, সেই বাঁচতে পারে। নয়নবিহীন লোক পথ জানতে পারে না এবং দিক-নির্ণয় করতে পারে না। আবার ধৈর্যহীন লোকও সম্পদ লাভ করতে পারে না। আমি এইভাবে তোমাকে বোঝালাম। তুমিও এতেই বুঝতে পারবে। মানুষ গর্তের মধ্যেও প্রবেশ করে যদি শত্রুর প্রদত্ত অগ্নির উত্তাপ ভোগ করে, তবে শজারুর মতো সে গর্তের অপর প্রান্তে গিয়ে, সেই অগ্নির উত্তাপ থেকে মুক্তিলাভ করবে। মানুষ পূর্বেই নানাস্থানে বিচরণ করে পথ চিনে রাখে এবং রাত্রিতে নক্ষত্র দেখে দিক্-নির্ণয় করে; আর আপনার সঙ্গে আপনারাই অপর পাঁচজনকে পথের কষ্ট সহ্য করিয়েও মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করে না।”

এবমুক্তা প্রত্যুবাচ ধর্মরাজো যুধিষ্ঠিরঃ!

বিদুরং বিদুষাং শ্রেষ্ঠং জ্ঞাতিমিত্যেব পাণ্ডবঃ ॥ আদি: ১৩৯: ২৭ ॥

বিদুর এরূপ বললে, পাণ্ডুনন্দন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ বিদুরকে বললেন, “সমস্তই বুঝতে পেরেছি।”

বিদুর এই উপদেশ দিয়ে কিছুদূর পর্যন্ত পাণ্ডবগণের অনুগমন করে, পরে তাঁদের প্রদক্ষিণ করে এবং যাবার অনুমতি দিয়ে আপন গৃহে ফিরে গেলেন। বিদুর ভীষ্ম এবং পুরবাসীরা ফিরে গেলে, কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে এই কথা বললেন, “যুধিষ্ঠির, বিদুর লোকেরা না বুঝতে পারে এমন কথা বললেন। তুমিও তাই হবে’ বলে তার যে উত্তর করলে, আমরা তো তার কিছুই বুঝলাম না। যদি তুমি মনে করো আমরাও তা বুঝতে পারব এবং তাতে যদি কোনও দোষ না হয়, তবে তোমার ও তাঁর আলাপের সমস্ত অর্থই আমি শুনতে ইচ্ছা করি।”

যুধিষ্ঠির বললেন, ‘তোমাদের বাসভবন থেকে অগ্নি উঠবে বলে জেনে রাখতে হবে; আর সে দেশের কোনও পথই যেন তোমাদের অবিদিত না থাকে’ এই কথা ধর্মজ্ঞ বিদুর আমাকে বললেন। আর বললেন—‘তুমি জিতেন্দ্রিয় থাকতে পারলে রাজ্য লাভ করতে পারবে।’ আমিও তাতে উত্তর করেছি যে, আমি সমস্তই বুঝতে পেরেছি।’ কিন্তু দুর্যোধনের উদ্দেশ্য সার্থক হল না। কুন্তীদেবী ও তাঁর পাঁচ পুত্র বিদুরের বুদ্ধিতে ও যুধিষ্ঠিরের প্রজ্ঞায়, ভীমের বলে আশ্চর্যভাবে প্রাণরক্ষা পেলেন। পুরোচন জতুগৃহে পাণ্ডবদের বাস করবার আমন্ত্রণ জানালে যুধিষ্ঠির ঘ্রাণশক্তির দ্বারা বুঝতে পারলেন যে, গৃহটি দাহ্য পদার্থে নির্মিত হয়েছে। ওদিকে বিদুর এক নিপুণ খনক পাঠিয়ে দিলেন। সে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে জতুগৃহের মাটির নীচে দীর্ঘ, প্রশস্ত ও বিস্তৃত গর্ত নির্মাণ করল। পাণ্ডবেরা রাত্রিতে সকলে নিদ্রামগ্ন হলে আপন আপন বাসগৃহ ত্যাগ করে সেই গুহায় রাত্রিবাস করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যে পাণ্ডবেরা বুঝতে পারেননি, পুরোচনের এ বিশ্বাস জন্মাল।

পাণ্ডবেরা ছয় মাস থেকে নিরুদ্বেগ হয়েছেন দেখে এবং তাদের বিশ্বস্তের মতো লক্ষ করে পুরোচন আনন্দিত হল। পুরোচনের আনন্দিত ভাব দেখে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের বললেন, “এই পাপাত্মা পুরোচন আমাদের বিশ্বস্ত বলে মনে করছে। সুতরাং এই নৃশংস পাপাত্মা বঞ্চিত হল। আমাদের পলায়নের এই সময় বলে আমি মনে করি। ওই পুরোচনটাকে অস্ত্রাগারের ভিতর রেখে, তাতে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আমরা ছ’জন অন্যের অলক্ষিতভাবে পালিয়ে যাব।”

তারপরে একদিন কুন্তীদেবী দান করবার ছলে রাত্রিতে ব্রাহ্মণ ভোজন করালেন। তাতে অনেক স্ত্রীলোকও সেখানে আসল। তারা ইচ্ছানুসারে পান, ভোজন, ও ইচ্ছানুসারে বিচরণ করে কুন্তীর অনুমতি নিয়ে রাত্রিতে আপন আপন বাড়িতেই চলে গেল। কিন্তু পাঁচ পুত্রের মাতা এক ব্যাধপত্নী কালপ্রেরিত হয়ে সেই পুত্রগণের সঙ্গে সেই নিমন্ত্রণে ভোজন করার জন্য এসেছিল। সেই ব্যাধপত্নী পুত্রদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, মদ্যপান করে, মত্তা এমনকী মদে বিহ্বল হয়ে সকল পুত্রের সঙ্গে অচৈতন্য মৃতপ্রায় থেকে সেই বাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর প্রবল বাতাস বইতে লাগলে এবং সমস্ত লোক ঘুমিয়ে পড়লে, তখন যে ঘরে পুরোচন শুয়েছিল, ভীম সেই ঘরেই প্রথম আগুন লাগিয়ে দিলেন, তারপরে তিনি জতুগৃহের দ্বারেও আগুন ধরিয়ে দিলেন। তারপরে সেই বাড়ির সকল দিকেই আগুন লাগিয়ে দিলেন, তাতে সে বাড়িখানা সমস্তই জ্বলে উঠল। পাণ্ডবগণ মাতা কুন্তীর সঙ্গে সত্বর গিয়ে সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তারপর সেই আগুনের দারুণ উত্তাপ এবং গুরুতর শব্দ হতে লাগল; তাতে পুরবাসীসকল লোক জেগে উঠল এবং তারা আগুনে বাড়িখানা পুড়ছে দেখে বলতে লাগল, “দুর্যোধনের প্রেরিত পাপাত্মা ও দুষ্টবুদ্ধি পুরোচন বিশ্বস্ত পাণ্ডবগণের বিনাশের জন্যই এই বাড়িখানা করিয়েছিল, এখন দগ্ধও করাল। হায়! ধৃতরাষ্ট্রের বুদ্ধিটা সকলের নিকট বিশেষ সম্মত নয়; যিনি নির্দোষ পাণ্ডবগণ-কে শত্রুর ন্যায় দগ্ধ করালেন। ভাগ্যবশত পাপাত্মা ও দুষ্টবুদ্ধি পুরোচনটা দগ্ধ হয়েছে, এই পুরোচন নিরপরাধ, বিশ্বস্ত ও নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণকে দগ্ধ করেছে।”

সেই সকল বারণাবতবাসী এই বিলাপ করতে থাকলে, অগ্নিদগ্ধ সেই জতুগৃহের চারপাশে অবস্থান করতে লাগল। এদিকে পাণ্ডবেরা সকলে ও মাতা কুন্তীর সঙ্গে সুরক্ষিতভাবে সেই সুরঙ্গ-পথ দিয়ে বাইরে নির্গত হয়ে অন্যের অলক্ষিত অবস্থায় দ্রুত গমন করতে লাগলেন। কিন্তু সেই নিদ্রার ব্যাঘাতে এবং ভয়ে ভীম ভিন্ন অপর পাণ্ডবগণ এবং কুন্তীদেবী আর পথ হাঁটতে পারছিলেন না। তখন ভয়ংকর বেগ ও পরাক্রমশালী ভীমসেন মাতাকে ও সকল ভ্রাতাকে বহন করে পথ চলতে লাগলেন। মাতা কুন্তীকে কাঁধে নিয়ে নকুল ও সহদেবকে কোলে করে এবং যুধিষ্ঠির ও অর্জুনকে বাহুতে ধারণ করে মহাবল ভীমসেন শরীরের বেগে গাছ ভেঙে এবং পায়ের আঘাতে ভূতল বিদীর্ণ করে বায়ুর ন্যায় বেগশালী হয়ে অতিদ্রুত গমন করতে লাগলেন। দ্রুত বেগশালী ভীম মাতা কুন্তী ও ভ্রাতাদের নিয়ে সুড়ঙ্গ-পথের শেষে গঙ্গাতীরে উপস্থিত হলেন। সেখানে বিদুর একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে মন ও বায়ুর ন্যায় দ্রুতগামী সর্বপ্রকার বায়ুর বেগ সহ্য করতে সমর্থ এবং পতাকাযুক্ত একটি কলের নৌকা নিয়ে গঙ্গাতীরে অপেক্ষমাণ রেখেছিলেন, সেই নৌকাখানিকে বিশ্বস্ত লোকেরা মঙ্গলময় গঙ্গাতীরেই নির্মাণ করেছিল। যুধিষ্ঠিরের বিশ্বাস উৎপাদন করার জন্য ব্যক্তিটি বারণাবত যাত্রার পূর্বে বিদুর ম্লেচ্ছ ভাষায় যুধিষ্ঠিরকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার আবৃত্তি করল এবং বলল, “সেই বিদুর আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং সেই সংকেত দ্বারাই আপনি আমাকে বিশ্বস্ত লোক বলে মনে করুন। আর সর্ববিষয়জ্ঞ বিদুর পুনরায় আপনাকে জানানোর জন্য আমাকে বলেছেন, “হে কুন্তীনন্দন! কর্ণ, ভ্রাতৃগণের সঙ্গে দুর্যোধন এবং শকুনিকে নিশ্চয় আপনি যুদ্ধে জয় করতে পারবেন। জলপথে চলার উপযুক্ত এবং জলে সুখগামিনী এই নৌকাখানি আপনাদের সকলকে এই শত্রুপূর্ণ দেশ থেকে মুক্ত করবে, এতে সন্দেহ নেই।” তারপর সেই লোক কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবগণকে দুঃখিত দেখে, তাঁদের নৌকায় তুলে নিয়ে, গঙ্গায় চলবার সময়ে পুনরায় বলল, “বিদুর আপনাদের মস্তকাঘ্রাণ এবং স্নেহালিঙ্গন করে বারবার এই কথা বলে দিয়েছেন। তোমরা সুস্থভাবে ও নির্বিঘ্নে পথ অতিক্রম করা।” এই কথা বলে বিদুরের প্রেরিত সেই লোকটি নরশ্রেষ্ঠ ও মহাবীর পাণ্ডবগণকে নৌকায় করে গঙ্গা পার করে দিল। গঙ্গা পার করে দিয়ে সেই লোকটি তীরে উখিত পাণ্ডবগণের প্রতি জয়োচ্চারণ ও আশীর্বাদ করে, যেখান থেকে এসেছিল, সেইখানেই চলে গেল। তাঁরা নৌকা পরিত্যাগ করে, রাত্রিতেও নক্ষত্র দেখে পথ জেনে দক্ষিণ দিকে গমন করতে লাগলেন। পাণ্ডবগণ আশ্রয়স্থান লাভ করবার জন্য যত্নবান হয়ে, নিবিড় বনে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তারপর তাঁরা পরিশ্রান্ত, পিপাসার্ত এবং নিদ্রায় কাতর হয়ে পুনরায় ভীমসেনকে বললেন, “এর থেকে আর কোনও দুঃখ বেশি হতে পারে যে, আমরা বনের মধ্যে দিক নির্ণয় করতে পারছি না এবং চলতেও পারছি না। পাপাত্মা পুরোচন দগ্ধ হল কি না, তাও জানতে পারলাম না এবং অজ্ঞাতভাবে এই ভয় থেকে কী করে মুক্ত হব, তাও বুঝতে পারছি না।” যুধিষ্ঠির ভীমকে পুনরায় তাঁদের বয়ে নিয়ে যেতে বললেন। ভীমসেন কোমলাঙ্গী মাতা কুন্তীদেবীকে পিঠে নিয়ে অতি কষ্টে নদীর তীরে এবং উচ্চনীচ জায়গায় বয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। সন্ধ্যাকালে তিনি একটা ভয়ংকর নদীর কাছে উপস্থিত হলেন। সেখানে ফলমূল ও জল অল্প ছিল। তখন প্রবল তৃষ্ণায় ভীম ভিন্ন অন্য পাণ্ডবগণ পরিশ্রমে, পিপাসায় এবং প্রবল নিদ্রার আবেশে গমন করতে সমর্থ হলেন না। তখন কুন্তী অত্যন্ত কাতর হয়ে পুত্রগণকে বললেন, “আমি পঞ্চপাণ্ডবের মাতা হয়ে এবং তাদের মধ্যে থেকেও পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়লাম।” কুন্তীর আক্ষেপ শুনে, যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞায় ভীম জল আনার জন্য যাত্রা করলেন। ভয়ংকর, নির্জন ও বিশাল বনের মধ্যে বিশাল ছায়াযুক্ত এক বটগাছের নীচে তিনি মাতা ও ভ্রাতাদের বিশ্রামের জন্য রেখে গেলেন। সারসগণের রব শুনে ভীমসেন এক জলাশয়ে উপস্থিত হয়ে জলপান ও স্নান করে, ভ্রাতাদের জন্য জল নিলেন। অনেক অনেক পদ্মপত্র দ্বারা পৃথক পৃথক বেঁধে, সে পুটকগুলিকে আবার উত্তরীয় বস্ত্রে নিয়ে জল আনয়ন করলেন। তিনি মাতাকে ও ভ্রাতৃগণকে ভূতলে নিদ্রিত দেখে, শোকে কাতর হয়ে অনেক বিলাপ করলেন। ভীমসেনকে সবথেকে বেশি আঘাত করেছিল যে, শত্রুসমূহবিজয়ী বসুদেবের ভগিনী, কুন্তীরাজের কন্যা, সর্বসুলক্ষণসম্পন্না, বিচিত্রবীর্য রাজার পুত্রবধু, মহাত্মা পাণ্ডু রাজার ভার্যা, পাণ্ডবদের মাতা, পদ্মকোষের ন্যায় গৌরবর্ণা, অত্যন্ত কোমলাঙ্গী এবং মহামূল্য শয্যায় শয়ন করার যোগ্যা কুন্তীদেবী বনমধ্যে ভূতলে শয়ন করে আছেন। ইনি এরূপ শয়ন করার যোগ্য নন; এঁকে এই অবস্থায় দেখে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ভীমসেন পরপর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা যুধিষ্ঠির ও কনিষ্ঠ তিন ভ্রাতাকে ভূতলে নিদ্রিত অবস্থায় দেখলেন। যে, গভীর ঘন জঙ্গলের মধ্যে পথক্লান্ত, পিপাসার্ত পাণ্ডবেরা উপস্থিত হলে, যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীমসেন জল আনতে গেলেন এবং ভীমসেন ফেরবার পূর্বেই কুন্তী ও অন্য চার পাণ্ডব ভ্রাতা নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। প্রত্যাগত ভীম তাঁদের প্রহরায় জাগরূক রইলেন— সেই বন আসলে হিড়িম্ব রাক্ষস ও তাঁর ভগিনী হিড়িম্বার দখলে ছিল।

মানবদেহের গন্ধে হিড়িম্ব রাক্ষস লুব্ধ ও উজ্জীবিত হয়ে পড়ল। সে ভগিনী হিড়িম্বাকে এই মানুষদের ধরে আনতে পাঠাল। অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীর বেশে উপস্থিত হয়ে হিড়িম্বা দেখল কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবগণ নিদ্রাভিভূত আর বলিষ্ঠ দেহ ভীমসেন জেগে আছেন। তখন তরুণ শালবৃক্ষের ন্যায় উন্নত এবং জগতে অতুলনীয় সুন্দর ভীমসেনকে দেখেই হিড়িম্বা কামাতুরা হয়ে পড়ল এবং ভাবল এই পুরুষটির আকৃতি প্রয়াগের বটবৃক্ষের ন্যায় স্কুল ও দীর্ঘ, সিংহের ন্যায় স্কন্ধ, কান্তি উজ্জ্বল, শঙ্খের ন্যায় গ্রীবা এবং পদ্মের ন্যায় নয়ন। সুতরাং, এই বলিষ্ঠ পুরুষই আমার উপযুক্ত পতি হবেন। সুতরাং ভ্রাতার হিংস্র স্বভাবযুক্ত আদেশবাক্য আমি কখনও পালন করব না। কারণ, পতি-স্নেহ যত প্রবল, ভ্রাতার সৌহার্দ্য তত প্রবল নয়। এদের বধ করলে এবং ভক্ষণ করলে আমার ও ভ্রাতার একটুকালমাত্র তৃপ্তি হবে; সুতরাং বধ না করে আমি অনেক কাল আমোদ করব।

এই ভেবে কামরূপিণী হিড়িম্বা উত্তম মানুষীরূপ ধারণ করে ধীরে ধীরে মহাবাহু ভীমসেনের কাছে উপস্থিত হল। দিব্য অলংকারে অলংকৃত হিড়িম্বা লজ্জাবশতই যেন অবনত হয়ে, ঈষৎ হাস্য করে ভীমসেনকে এই কথা বলল, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ। আপনি কে? কোথা থেকেই বা এসেছেন? দেবতার মতো এই রূপবান পুরুষেরাই বা কারা? হে সুন্দর, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা এক অত্যন্ত কোমলাঙ্গী এই মহিলাটিই বা আপনার কে হন? ইনি এই বনে এসে আপনগৃহে যেমন শয়ন করে তেমনই নিরুদ্বেগে শয়ন করে আছেন। এই নিবিড় বন রাক্ষস সেবিত। এই বনে পাপাত্মা হিড়িম্ব রাক্ষস বাস করে। আপনাদের মাংস খাবে বলে, আমার ভ্রাতা দুরভিসন্ধিসম্পন্ন সেই রাক্ষসই আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আপনাকে দেবপুত্রের মতো দেখে, আমি অন্য পুরুষকে, পতি করতে ইচ্ছা করি না। ভীমসেন তখন সেই শায়িত পুরুষ ও নারীকে যথাক্রমে ভ্রাতা ও মাতা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। ইতিমধ্যে ভগিনীর বিলম্ব দেখে রাক্ষস হিড়িম্ব সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে দেখল যে, তার ভগিনী সুন্দরী রমণীর রূপ ধারণ করে ভীমসেনের প্রেম প্রার্থনা করছে। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হিড়িম্ব ভীমসেনকে যুদ্ধে আহ্বান করে। পাছে মাতা ও ভ্রাতাদের নিদ্রাভঙ্গ হয়, এই কারণে ভীমসেন তাকে টানতে টানতে শতহস্ত দূরে নিয়ে যান। কিন্তু পরস্পরের প্রচণ্ড গর্জনে কুন্তী ও পাণ্ডবদের নিদ্রাভঙ্গ হয়। অর্জুন ভীমসেনকে সহায়তা দেবার ছলে উত্তেজিত করতে থাকেন। উত্তেজিত ভীমসেন হিড়িম্ব রাক্ষসকে মাথার উপর তুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বধ করেন।

হিড়িম্বার প্রার্থনানুযায়ী কুন্তী ও যুধিষ্ঠির ভীমসেন ও হিড়িম্বার মিলন অনুমোদন করেন। ভীম শর্ত দেন যে পুত্রজন্মের পর তিনি আর হিড়িম্বার সঙ্গে থাকতে পারবেন না। হিড়িম্বা তাতেই সন্তুষ্ট হন। এক বৎসর পরে ভীম-হিড়িম্বার পুত্র ঘটোৎকচের জন্ম হয়। জন্মলাভ করার পরেই সে বৃদ্ধিলাভ করতে থাকে। তাকে দেখতে বড় অদ্ভূত হয়। তার নয়নযুগল বিস্তৃত, মুখমণ্ডল বিশাল, কর্ণযুগল শঙ্কুর (পেরেকের) ন্যায় সূক্ষ্মাগ্র। শব্দ ভয়ংকর, ওষ্ঠ তাম্রবর্ণ, দন্ত সুতীক্ষ্ণ, কণ্ঠস্বর বিকট, ধনুর্বিদ্যা অধিক, তেজ গুরুতর, শরীর বিশাল, মাথায় ভয়ংকর, নাসিকা দীর্ঘ, বক্ষ বৃহৎ, জানু ও গুফের পশ্চাদ্ভাগ বিশাল ও গোল এবং আকৃতি অতিভীষণ ছিল। আর সে মানুষ হয়ে জন্মেও অমানুষ (রাক্ষস) এবং অন্যান্য রাক্ষস ও পিশাচগণকে অতিক্রম করে তখনই অতিভীষণ হয়েছিল। রাক্ষসীরা গর্ভধারণ করেই সদ্য প্রসব করে এবং সেই সন্তানও সদ্যই কামরূপী ও বহুরূপী হয়ে থাকে। প্রচুর পরিমাণে কেশযুক্ত সেই হিড়িম্বাপুত্র তখনই পিতা ও মাতাকে নমস্কার করে তাদের চরণ ধারণ করল। তাঁরাও তার নামকরণ করলেন। সেই হিড়িম্বা পুত্রের মাথা ঘটের মতো এবং খাড়া চুল ছিল বলে হিড়িম্বা তাকে ‘ঘটোৎকচ’ বলে ডাকল। তাতেই সকলে তাকে ‘ঘটোৎকচ’ বলে ডাকত। সেই ঘটোৎকচ পাণ্ডবদের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিল বলে সে তাদের সর্বদা প্রিয় এবং আত্মীয়ের মধ্যে গণ্য হয়েছিল। ভীমের সঙ্গে সহবাসের সময় অতীত হয়েছিল বলে হিড়িম্বা পাণ্ডবগণের কাছে বিদায় নিয়ে এবং একটি শপথ করে স্বস্থানে চলে গেল। বিশাল শরীর ঘটোৎকচ কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডবগণকে যথানিয়মে অভিবাদন করে এবং তাঁদের সম্বোধন করে বলল, “হে নিষ্পাপগণ! আমি আপনাদের কী করব, তা নিঃশঙ্কভাবে বলুন।”ঘটোৎকচ এই কথা বললে, কুন্তী তাকে বললেন, “তুমি কুরুবংশে জন্মেছ, সাক্ষাৎ ভীমের তুল্য হয়েছ এবং পঞ্চপাণ্ডবের জ্যেষ্ঠপুত্র হয়েছ, অতএব পুত্র, তুমি আমাদের সাহায্য করো।” কুন্তী এই কথা বললে ঘটোৎকচ প্রণাম করে তাঁকে বলল, “পূর্বকালে যেমন রাবণ ছিলেন, তাঁর পুত্র ইন্দ্রজিৎও তেমনই মহাবল ছিলেন, আমিও তেমনই মনুষ্যলোকে আকারে ও বলে পিতার তুল্য বিশিষ্ট হয়েছি। অতএব কার্যের সময়ে আমি পিতৃগণের কাছে উপস্থিত হব।” এই কথা বলে, রাক্ষসশ্রেষ্ঠ ঘটোৎকচ বিদায় নিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল।

কুন্তীর বরাক্ষস বধে ভীমকে প্রেরণ

পাণ্ডবগণ বনপথে গিয়ে বহুতর মৃগ বধ করে, সে বন থেকে বেরিয়ে, সত্বর গমন করতে লাগলেন। তাঁরা সকলেই জটা, বল্কল ও মৃগচর্ম ধারণ করে, তপস্বীর বেশে মৎস্য, ত্রিগর্ত, পাঞ্চাল ও কীচকদেশের ভিতর দিয়ে, মনোহর বনপ্রান্ত এবং সরোবর দেখতে থেকে, কোথাও কুন্তীর সঙ্গে, কোথাও কুন্তীকে বহন করে নিয়ে, কোথাও ধীরে এবং কোথাও বেগে গমন করতে লাগলেন। উপনিষদ, বেদ, বেদাঙ্গ ও নীতিশাস্ত্র পাঠ করতে থেকে যেতে যেতে তাঁরা পথে বেদব্যাসকে দেখতে পেলেন।

তখন কুন্তীর সঙ্গে তারা সকলেই মহাত্মা বেদব্যাসকে নমস্কার করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়ালেন। তখন বেদব্যাস বললেন, “রাজপুত্রগণ, আমি পূর্বেই তোমাদের এই বিপদের বিষয় মনে মনে জানতে পেরেছি যে, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা অন্যায় করে তোমাদের নির্বাসিত করেছে। তা জেনেই আমি তোমাদের মঙ্গলসাধন করবার জন্য উপস্থিত হয়েছি। তোমরা এর জন্য দুঃখ কোরো না, এ সমস্তই তোমাদের সুখের জন্য হচ্ছে। তোমরা এবং তারা সকলেই আমার কাছে সমান। তবুও দীনতা ও শিশুত্ব নিবন্ধন বন্ধুগণ অধিক স্নেহ জন্মিয়ে থাকে। এখন, তোমাদের উপর আমার অধিক স্নেহ জন্মেছে। তাই আমি স্নেহপূর্বক তোমাদের হিত করবার ইচ্ছা করছি। শোনো, মনোহর অথচ রোগপীড়াবিহীন একটি নগর সামনেই আছে। পুনরায় আমার আগমনের প্রতীক্ষা করে তোমরা এই গুপ্তবেশেই এখানে বাস করো।”

পাণ্ডবদের আশ্বস্ত করে, একচক্রাপুরীর দিকে যেতে যেতে ব্যাসদেব কুন্তীকে আশ্বস্ত করে বলতে লাগলেন, “কুন্তী, বেঁচে থাকো; সর্বদা ধর্মপরায়ণ পুরুষশ্রেষ্ঠ তোমার এই পুত্র যুধিষ্ঠির ধর্ম অনুসারে পৃথিবী জয় করে, ধর্মরাজ হয়ে, পৃথিবীর সকল রাজাকে শাসন করবে। যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জুনের শক্তিতে বিনা বাধায় সমুদ্রবেষ্টিত সমস্ত পৃথিবী জয় করে ভোগ করবে। এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমার ও মাদ্রীর পুত্রেরা সকলেই মহারথ; সুতরাং, এরা সর্বদাই আপন রাজ্যে প্রসন্নচিত্তে সুখে বিচরণ করবে। নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ এই পৃথিবী জয় করে, প্রচুর দক্ষিণা দিয়ে, রাজসূয় ও অশ্বমেধ প্রভৃতি যজ্ঞ করবে। তোমার এই পুত্রেরা ভোগ সম্পাদন ও সুখ সম্পাদন করে বন্ধুবর্গের প্রতি অনুগ্রহ করতে থেকে পৈতৃক রাজ্য ভোগ করবে।”

এই কথা বলে মহর্ষি বেদব্যাস পাণ্ডবগণকে কোনও ব্রাহ্মণের বাড়িতে প্রবেশ করিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “তোমরা এইখানে থেকে আমার প্রতীক্ষা করো। আমি আবার আসব। দেশ ও কাল বুঝে চলতে পারলে তোমরা বিশেষ আনন্দ লাভ করতে পারবে।”তখন সকল পাণ্ডব কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, “তাই হবে।” তখন ভগবান বেদব্যাস যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানেই চলে গেলেন।

মহারথ পাণ্ডবগণ একচক্রা নগরীতে গিয়ে মনোহর নানাবিধ স্থান, বন, নদী ও সরোবর দেখতে থেকে, সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে অনতিদীর্ঘকাল বাস করেছিলেন। তখন তাঁরা সকলেই ভিক্ষা করতেন এবং আপন আপন গুণে নগরবাসীগণের প্রিয়দর্শন হয়ে পড়লেন। তাঁরা দিনের বেলা ভিক্ষা করলে রাত্রির প্রথমভাগে কুন্তীর কাছে ভিক্ষালব্ধ ধন সমর্পণ করতেন। কুন্তী তা ভাগ করে দিলে, তাঁরা পৃথক পৃথকভাবে ভোজন করতেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতি চারজন কুন্তীর সঙ্গে ভিক্ষালব্ধ বস্তুর অর্ধ ভোজন করতেন; আর অপরাধ একা ভীমসেনই ভোজন করতেন। সেই রাজ্যে তারা বহুদিন বাস করলেন। তারপর, একদিন যুধিষ্ঠির প্রভৃতি চারজন ভিক্ষা করতে গেলেন; কিন্তু কোনও কারণবশত ভীম কুন্তীর সঙ্গে সেই বাড়িতেই থেকে গেলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণের বাড়িতে ভয়ংকর আর্তনাদ হতে লাগল। তাদের সেই আর্তনাদ কুন্তী দয়া ও সৌজন্যবশত সহ্য করতে পারলেন না। তখন কুন্তী দয়াপরবশ হয়ে ভীমকে বললেন, “বৎস! আমরা এই ব্রাহ্মণের বাড়িতে আদৃত ও দৈন্যহীন হয়ে দুর্যোধনের অজ্ঞাতভাবে অতিসুখে বাস করছি। যে ব্যক্তি উপকারীর প্রত্যুপকার করে, সে-ই মহাপুরুষ। সুতরাং, অন্যে এর যে উপকার করত, তার থেকে বেশি তোমাদের করতে হবে। নিশ্চয়ই এই ব্রাহ্মণের কোনও দুঃখ উপস্থিত হয়েছে, তাতে আমি যদি এর সাহায্য করতে পারি, তা হলে বাস্তবিক প্রত্যুপকার করা হবে।”

ভীম বললেন, “এঁর যে কারণে দুঃখ উপস্থিত হয়েছে, যদি অতিদুষ্করও হয়, তবুও তা করবার চেষ্টা করব।” কুন্তী ও ভীম পরস্পর এরূপ আলোচনা করছিলেন, তখন আবার তাঁরা ভার্যার সঙ্গে সেই ব্রাহ্মণের আর্তনাদ শুনলেন। তারপর, ঘরের ভিতরে বাছুর বাঁধা থাকলে, গোরু যেমন সেখানে সত্বর প্রবেশ করে, কুন্তীও সেইরূপ অন্তঃপুরে দ্রুত প্রবেশ করলেন। কুন্তী গিয়ে দেখলেন সেখানে ভার্যা ও পুত্র এবং কন্যার সঙ্গে ব্রাহ্মণ অবস্থান করছেন; বিষাদে তাঁর মুখখানি মলিন হয়ে গিয়েছে। ব্রাহ্মণ বলছিলেন, “এ জীবন মলের মতো অসার, অনর্থক, দুঃখভোগের কারণ। পরাধীন এবং অত্যন্ত অপ্রিয়প্রাপ্তির হেতু; অতএব একে ধিক। বেঁচে থাকলেই গুরুতর দুঃখ, গুরুতর সন্তাপ এবং শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি পরম্পরভাব নিশ্চয়ই উপস্থিত হয়ে থাকে। একমাত্র জীবই ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করে, আবার এগুলি না পেলে গুরুতর দুঃখ অনুভব করে। কেউ কেউ বলেন, পুরুষার্থের মধ্যে মুক্তিই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তা কোনও প্রকারেই হবার নয়। তবে, পাওয়া যায় অর্থ; তাতে আবার সমস্ত নরক ভোগ হয়। অর্থলাভের চেষ্টায় গুরুতর দুঃখ, অর্থলাভ হয়ে তদপেক্ষা দুঃখ এবং অর্থের প্রতি মমতা জন্মালে পর, তা নষ্ট হলে, আরও গুরুতর দুঃখ। অভীষ্ট বস্তুর সঙ্গে যার যতগুলি সংযোগ হয়—বিধাতা তার হৃদয়ে ততগুলি শোক-শঙ্কু (পেরেক) প্রবেশ করিয়ে রাখেন। অতএব আমি ভার্যার সঙ্গে অল্পকালের জন্য দারুণ জীবন লাভ করে, একে আর ত্যাগ করতে পারলাম না। আমি তেমন কোনও উপায় দেখছি না, যার দ্বারা এই বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করি। অথবা স্ত্রীপুত্রদের সঙ্গে একেবারে পরলোকে পালিয়ে যাই। ব্রাহ্মণী, আমি পূর্বে যে চেষ্টা করেছিলাম, তা তুমি জানো। যেখানে কোনও বিপদ ছিল না, আমি সেখানে যেতে চেয়েছিলাম; তুমি আমার সে-কথা তখন শোনোনি। দেশান্তরে যাবার জন্য আমি বারবার প্রার্থনা করলে, তুমি বলেছ, এখানেই জন্মেছি ও বড় হয়েছি এবং আমার পিতাও এখানে ছিলেন। বহুকাল পূর্বে তোমার পিতা ও মাতা বৃদ্ধ হয়ে স্বর্গে গিয়েছিলেন, ভূতপূর্ব বন্ধুগণও স্বর্গে গিয়েছিলেন; তবে আর সে দেশে বাস করার ইচ্ছা ছিল কেন? তুমি বন্ধুদের সঙ্গে একদেশে বাস করার ইচ্ছায় আমার কথা শোনোনি। হায়! এখন আমার সেই দারুণ দুঃখনাশ উপস্থিত হল। অথবা, এটা আমারই বিনাশ হোক। কারণ, আমি নৃশংসের মতো নিজে জীবিত থেকে কোনও বন্ধুকেই পরিত্যাগ করতে পারব না। যিনি সর্বধর্মিণী, সর্বদা ইন্দ্রিয় সংযমশালিনী, যিনি মাতৃতুল্যা, দেবতারা যাঁকে আমার সখী করে নির্মাণ করেছেন, যিনি সর্বদাই প্রধান আশ্রয়, পিতা ও মাতা যাঁকে সর্বদার জন্য আমার গৃহস্থ ধর্মের অংশভাগিনী করে দিয়েছেন, আমি যাকে বরণ করে এবং যথানিয়মে মন্ত্রপাঠ পূর্বক পরিণয় করে এনেছি, যিনি সকুলোৎপন্না, সৎস্বভাবসম্পন্না, সন্তানের জননী, সচ্চরিতা এবং কোনও অপকার করেননি। আর সর্বদাই যিনি আমার অনুকুল হয়ে চলে থাকেন, এমন ভার্যাকে আমি পরিত্যাগ করতে পারব না। তারপর, আমি নিজেই বা কী করে কন্যাটিকে পরিত্যাগ করতে সমর্থ হব; যে এখনও বালিকা, যার এখনও বয়স হয়নি বা স্ত্রীলোকের কোনও চিহ্ন হয়নি এবং আমি পিতৃকুলের সঙ্গে যার দ্বারা দৌহিত্র সম্পাদিত স্বর্গলাভ করারই আশা রাখি, আর নিজেই যাকে উৎপাদন করেছি, সেই বালিকা কন্যাকে আমি কী করে ত্যাগ করতে পারি?

“পুত্রের উপরই পিতার অধিক স্নেহ, কতকগুলি লোক তাই মনে করেন, আবার কন্যার উপরেই অধিক স্নেহ হয় বলে অন্য লোকেরা মনে করেন, কিন্তু আমার কাছে দুই তুল্য। যার পুত্রের উপর স্বর্গলাভ নির্ভর করে এবং সে সর্বদাই সুখের কারণ আমি সেই পুত্রটিকেই বা কী করে ত্যাগ করব? এই পুত্র দ্বারাই আমি পরম আনন্দ এবং স্বর্গলাভের ইচ্ছা করি। জন্মের পর যার মুখ দেখে পিতৃলোকেরা স্বর্গে গিয়েছেন এবং আমিও যার প্রভাবে পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হয়েছি, আমি সেই প্রিয় ও বালক পুত্রটিকে কী করে ত্যাগ করতে পারি? সে আমার জ্যেষ্ঠপুত্র, সে আমার বংশরক্ষক এবং আমার শ্রাদ্ধ ও তর্পণের একমাত্র অধিকারী; আমি সেই পুত্রকে কী করে ত্যাগ করব। অতএব আমার, আমার পত্রের, তোমার এবং তোমার কন্যার সকলের এই প্রাণত্যাগের সময় উপস্থিত হয়েছে। কোপনে তুমি যে আমার কথা শোনোনি, এখন তার ফলভোগ করো। কেবল আমি নিজে মরতে পারব না, অথবা একমাত্র পুত্রটিকে, বা একমাত্র তোমাকে কিংবা একমাত্র কন্যাটিকে পরিত্যাগ করতে পারব না। অথবা আমাদের সকলের রক্ষার জন্য আমি নিজে জীবিত থেকে নৃশংসের মতো অন্য কোনও বন্ধুকে এনে দিতে পারব না। তারপর, আমি তোমাদের ত্যাগ করলে নিশ্চয়ই তোমরা জীবিত থাকতে পারবে না। তোমাদের কোনও একজনকে ত্যাগ করলে তা নৃশংসের কাজ হবে এবং তা সজ্জন গর্হিত। সুতরাং, আমি দারুণ কষ্টে পড়েছি, এ-বিপদ থেকে উদ্ধারের কোনও উপায় নেই। যা হোক, সকলের একসঙ্গে মরা ভাল, কিন্তু আমার জীবিত থাকা উচিত নয়।”

ব্রাহ্মণী বললেন, “আপনি কখনও মূর্খ লোকের মতো বিবাদ করবেন না কিংবা বিষাদ প্রকাশ করবেন না। কারণ আপনি বিদ্বান; সুতরাং আপনার এটা বিষাদ করবার সময় নয়। এই জগতে সকল লোকেরই মৃত্যুমুখে পতিত হতে হবে, এটা নিশ্চিত ঘটনা, সুতরাং নিশ্চিত বিষয়ে সন্তাপ করবার কোনও কারণ নেই। ভার্যা, পুত্র ও কন্যা—এ সমস্তই মানুষ নিজের ইচ্ছার জন্য করে থাকে। অতএব আপনি বিষাদ ত্যাগ করুন, আমিই সেখানে যাব। স্ত্রীলোকের পক্ষে চিরকাল উৎকৃষ্ট কার্য হল, সে প্রাণ পরিত্যাগ করেও ভর্তার হিতসাধন করবে। সুতরাং, আমার দ্বারা সেখানে সেকার্য সমাপ্ত হলে, তা আপনারও সুখজনক হবে আর, আমারও ইহলোকে যশ ও পরলোকে অক্ষয় ফল জন্মাবে। লোকে যে জন্য ভার্যা ইচ্ছা করে, তা আপনি আমাতে পেয়েছেন। কেন-না আপনি পুত্র ও কন্যা দুই পেয়েছেন এবং আপনিও আমাতে পুত্রকন্যা জন্ম দিয়ে ঋণশূন্য করেছেন। এখন আপনি সেই পুত্রকন্যার ভরণ-পোষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে সমর্থ; কিন্তু আমি আপনার মতো তাতে সমর্থ নই। প্রাণেশ্বর! স্বামী! আপনি না থাকলে আমার এই শিশুপুত্র ও কন্যা কেমন হয়ে যাবে, আমিই বা কী রকম হয়ে যাব। আপনি চলে যাবেন, পুত্রটিও বালক; এ-অবস্থায় আমি বিধবা অনাথা হয়ে, সৎপথে থেকে, কী করে এই দুটিকে বাঁচাব, আপনার বংশে সম্বন্ধ করার অযোগ্য, অথচ গর্বিত লোকেরা যখন এই কন্যাটিকে চাইবে, তখন আমি কী করে একে রক্ষা করব। ভূতলে মাংস ফেলে রাখলে, পক্ষীগণ যেমন তা প্রার্থনা করে, তেমনই সকল পুরুষ পতিহীনা রমণীকে প্রার্থনা করে। হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! দুরাত্মারা আমাকে প্রার্থনা করে যখন সৎপথ থেকে বিচলিত করবে, তখন আমি সে-সৎপথে থাকতে পারব বলে বোধ হয় না। আপনার বংশে এই একটি মাত্র কন্যা, এর এখনও বিবাহ হয়নি, এ-অবস্থায় আমি কী করে একে সৎপাত্রে দান করতে সমর্থ হব। এই বালকটির কোনও অভিভাবক থাকবে না, সুতরাং এ সর্বপ্রকার সচ্চরিএ থেকে ভ্রষ্ট হবে, তখন আপনার মতো আমি একে অভীষ্ট পথ দেখাতে পারব না। শূদ্রেরা যেমন বেদলাভের প্রার্থনা করে, তেমনই অযোগ্য লোকেরা আপনার এই অনাথা বালিকা কন্যাটিকে প্রার্থনা করবে। আমি যদি সদ্‌গুণসম্পন্না এই কন্যাটিকে দান করতে ইচ্ছা না করি, তবে কাক যেমন যজ্ঞস্থান থেকে হবি হরণ করে, তেমনই তারাও বলপূর্বক কন্যাটিকে হরণ করবে। ক্রমে, পুত্রটি আপনার বংশের অযোগ্য হয়ে গেছে, কন্যাটিও অযোগ্য পাত্রের অধীন হয়ে পড়েছে, তা আমি দেখতে থাকব; অথচ নিজের কোনও ক্ষমতা না থাকায় আমাকে অবজ্ঞার পাত্র মনে করব না। অথচ গর্বিত লোকেরা আমাকে অবজ্ঞাই করতে থাকবে। তখন আমি নিশ্চয়ই আত্মহত্যা করে মরব। তখন আপনার ও আমার উভয়ের অভাবে, জলাভাবে মৎস্যের ন্যায় পরিবারটি বিনষ্ট হবে। এইভাবে আপনার অভাবে তিনটি লোক বিনষ্ট হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সুতরাং, আপনি আমাকেই ত্যাগ করুন। ব্রাহ্মণ, পুত্রবতী স্ত্রীদের পরম সৌভাগ্য যে, তাঁরা ভর্তার পূর্বে পরলোকগম করেন। ভর্তার জন্য জীবন উৎসর্গ করা নারীদের পরম সৌভাগ্য। আমি যা করতে ইচ্ছা করছি, তা সাধুসন্মত ধর্ম, এবং আপনার বংশের অভীষ্ট ও হিতজনক। অভীষ্ট সন্তান, ধন, সুহৃদ, প্রিয়লোক ও ভার্যা, এ সমস্তই আপদ থেকে উদ্ধার পাবার জন্য। বিপদ নিবৃত্তির জন্য ধনরক্ষা করবে, সে ধন দ্বারা ভার্যা রক্ষা করবে এবং ধন ও ভার্যা দ্বারা আপনাকে রক্ষা করবে—সাধুরা এই কথাই বলেন।

“ভার্যা, পুত্র, ধন এবং গৃহ—এ সমস্তই লৌকিক ও অলৌকিক ফলের জন্য নিয়োগ করবে। একদিকে সমস্ত বংশ, অপর দিকে বংশবর্ধক নিজে। আপনি আমার দ্বারাই জীবন রক্ষা করুন, আপনার বস্তু দ্বারাই আপনাকে উদ্ধার করুন, আমাকে অনুমতি দিন; আমার সন্তান দুটি প্রতিপালন করতে থাকুন। ধর্মজ্ঞেরা ধর্ম নিশ্চয় করার সম্বন্ধে বলেছেন যে, স্ত্রীলোক অবধ্য। আবার রাক্ষসগণকেও তারা ধর্মপরায়ণও করেছেন, অতএব সে রাক্ষস আমাকে না-ও মারতে পারে। পুরুষের বধ নিশ্চিত, আর, স্ত্রীলোকের বধ সংশয়িত, সুতরাং, আপনি আমাকে পাঠিয়ে দিন। আমি ভোগ করেছি, প্রিয় বস্তু পেয়েছি, ধর্ম আচরণ করেছি এবং আপনার কাছ থেকে প্রিয়তম সন্তান লাভ করেছি। সুতরাং এখন আর মৃত্যু আমাকে সন্তপ্ত করতে পারবে না। আমার পুত্র জন্মেছে, আমি বৃদ্ধ হয়ে উঠেছি এবং সর্বদাই আপনার প্রিয় কামনা করেছি। এই সকল পর্যালোচনা করে আমি এখন মৃত্যুর জন্য উদ্যম করছি। আর্য, আপনি আমাকে পরিত্যাগ করেও অন্য স্ত্রী লাভ করতে পারবেন এবং তা থেকেই পুনরায় আপনার গৃহধর্ম প্রতিষ্ঠিত হবে। হে মঙ্গলাস্পদ! পুরুষের বহুস্ত্রী গ্রহণ করা অধর্ম নয়; কিন্তু পূর্ব পতি ছেড়ে অন্য পতি গ্রহণ করা স্ত্রীলোকের গুরুতর অধর্ম। আপনি এই সমস্ত পর্যালোচনা করে এবং আত্মত্যাগ করাকে নিন্দনীয় মনে করে আপনাকে, বংশ এবং সন্তান দুটিকে উদ্ধার করুন।”

ব্রাহ্মণী এই কথা বললে, ব্রাহ্মণ তাকে আলিঙ্গন করে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে তার সঙ্গে ধীরে ধীরে অশ্রুবিসর্জন করলেন। অত্যন্ত দুঃখিত পিতা ও মাতার কথা শুনে কন্যাটি নিতান্ত দুঃখিত হয়ে তাঁদের বলল, “আপনারা অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে অনাথের মতো কেন এরকম আত্মত্যাগ করছেন? আমার কথা শুনুন, শুনে যা সংগত হয়, তা করুন। আপনাদের তো ধর্ম অনুসারে আমাকে ত্যাগ করতেই হবে; এ-বিষয়ে তো কোনও সন্দেহই নেই; অতএব ত্যক্তব্যা আমাকে ত্যাগ করে, একা আমার দ্বারাই সকলকে রক্ষা করুন। লোকে এই জন্যই সন্তান ইচ্ছা করে যে, সন্তান বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। তার সময় উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং নৌকার ন্যায় আমার দ্বারা আপনারা বিপদ সাগর থেকে উত্তীর্ণ হোন। পুত্র ইহলোকে বিপদ থেকে আর পরলোকে নরক থেকে উদ্ধার করে; অতএব পুত্র সর্বপ্রকারেই উদ্ধার করে থাকে এ জন্যই জ্ঞানীরা পুত্র বলে থাকেন। পিতৃলোকেরা আমাতেও দৈৗহিত্র আশা করেন বটে; কিন্তু আমি নিজেই পিতার জীবন রক্ষা করে তাঁদের পরিত্রাণ করব। আপনি পরলোকে চলে গেলে আমার এই বালক ভ্রাতাটি অচিরকালের মধ্যে বিনষ্ট হবে। পিতা স্বর্গে গেলে এবং আমার ছোট ভাইটি মরে গেলে, পিতৃলোকের পিণ্ডলোপই হবে, এবং তা অত্যন্ত অপ্রিয় ব্যাপারই হবে। শশাকে আমার মৃত্যু হওয়া উচিত নয়, অথচ পিতা, মাতা, ভ্রাতা—এরা সকলেই আমাকে পরিত্যাগ করলে, আমি নিশ্চয়ই সংসারে গুরুতর দুঃখ পেয়ে শোকেই মারা যাব, আপনি বিনা রোগে মারা গেলে আমার মাতা, শিশু ভ্রাতা, আপনার বংশ এবং পিতৃলোকের পিণ্ড—এ সমস্তই নষ্ট হবে, কোনও সন্দেহ নেই। পুত্র আত্মস্বরূপ এবং ভার্যা সুহৃদস্বরূপ; কিন্তু কন্যা কেবলই কষ্টেরই কারণ। অতএব আপনি সেই কষ্ট থেকে আমাকে রক্ষা করুন, আমাকেই ধর্মার্থে নিযুক্ত করুন। না হলে আমি বালিকা এবং দীনা; সুতরাং আমাকে যে-কোনও জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। অথবা আমি নিজেই অত্যন্ত দুষ্কর কার্য করে এ বংশের উদ্ধার করব এবং নিজের জন্মকে সফল করব। অথবা হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ! আপনি আমাকে ত্যাগ করে যেখানে যাবেন, তাতে আমি বড়ই দুঃখিত হব; অতএব আমারও অপেক্ষা করুন। আপনি আমার জন্ম সফল করার জন্য এবং ধর্ম ও পুত্র রক্ষার জন্য আত্মরক্ষা করুন; আমাকে তো ত্যাগ করবেনই; সুতরাং এক্ষণে আমাকেই ত্যাগ করুন। এর থেকে গুরুতর দুঃখ আর কী হতে পারে যে, আপনি স্বর্গে গেলে পর আমরা কুকুরের মতো পরের কাছে অন্নভিক্ষা করতে থেকে সর্বত্র ছুটে বেড়াব। আপনি বান্ধবগণের সঙ্গে অনায়াসে এই কষ্ট থেকে নিস্তার পেলে আমি সুখী হব এবং মরেও জগতে অমৃতার মতোই থাকব। আপনি এখান থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলেও আপনার প্রদত্ত জল দ্বারাই দেবগণ ও পিতৃগণ আপনার হিতকারী হবেন, একথা আমরা শুনেছি। পিতা এই দুই পক্ষ শুনে, আপনার নিজের ও মাতৃদেবীর এবং আপন পুত্রের যাতে হিত হয় তা করার চেষ্টা করুন। মাতা ও পিতার অপর গুণবান সন্তানও জন্মাতে পারে; কিন্তু সন্তানের পিতা-মাতা পুনরায় কখনও হয় না।”

কন্যাটির এইরূপ বিলাপোক্তি শুনে পিতা, মাতা ও সেই কন্যাটি—তিনজনেই অত্যন্ত বিলাপ করতে লাগলেন। সকলে রোদন করতে দেখে তাঁদের সেই বালক পুত্রটি উৎফুল্ল নয়ন হয়ে, মধুর ও অস্পষ্টভাবে বলল, “বাবা! মা! ভগিনী! আপনারা কাঁদবেন না।” এই কথা বলে সে হাসতে হাসতে যেন এক এক করে তাদের সকলের কাছে গেল। তারপর সেই বালকটি হাতে একটি তৃণ ধরে, প্রহৃষ্ট হয়ে, পুনরায় বলল, “আমি এর দ্বারা সেই নরখাদক রাক্ষসকে বধ করব।” দুঃখে আকুল হয়ে থাকলেও সেই বালকের গদগদ বাক্য শুনে তাদের গুরুতর আনন্দ জন্মাল।

“জিজ্ঞাসা করবার এই সময়” বুঝে কুন্তী তাঁদের কাছে গিয়ে, মৃতপ্রায় সেই লোকগুলিকে অমৃত দ্বারাই যেন বাঁচাতে থেকে, এই কথা বললেন, “আপনাদের এই দুঃখের কারণ কী, তা আমি জানতে ইচ্ছা করি। জেনে যদি তা দূর করতে পারি, তবে দূর করব।”।

ব্রাহ্মণ বললেন, “তপস্বিনী, আপনি যা বললেন, তা বলা সজ্জন-সংগতই বটে; তবে এ দুঃখ দূর করা মানুষের অসাধ্য। তথাপি এই দুঃখের কারণ যথাযথভাবে আপনাকে বলছি; ভদ্রে, আপনি এই দুঃখ দূর করতে পারুন বা না-ই পারুন, শুনুন। এই নগরের কাছে অত্যন্ত বলবান একটি রাক্ষস বাস করে, তার নাম ‘বক’, সে এই নগরের অধীশ্বর। সেই দুর্বুদ্ধি রাক্ষস দেববিরোধীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং সে মানুষের মাংস খেয়ে পরিপুষ্ট ও বলবান হয়ে এই দেশ রক্ষা করছে। সেই বলবান রাক্ষস দেশ ও নগর রক্ষা করে বলে আমাদের অন্য কোনও রাজ্য বা প্রাণী থেকে কোনও ভয় নেই। প্রচুর অন্ন, দুটি মহিষ, আর এগুলি নিয়ে যেতে পারে এমন একটি মানুষ, এগুলিকে রাজা সেই বকরাক্ষসের খাদ্যরূপে বেতন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। প্রতিদিন এক একটি পুরুষ এই খাদ্য নিয়ে বরাক্ষসের কাছে যায়। বহু বৎসর পর এক- এক ব্যক্তির এই পালা পড়ে থাকে; এ থেকে নিস্তার পাওয়া দুষ্কর। যারা এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাবার চেষ্টা করে, পুত্ৰকলত্রাদির সঙ্গে তাঁদের বধ করে বরাক্ষস ভক্ষণ করে। বেত্ৰকীয় নামক রাজধানীতে এক রাজা আছেন, তিনি প্রজারক্ষার নীতি অনুসরণ করেন না এবং নিতান্ত অল্পবুদ্ধি; সুতরাং, তিনি সেরূপ উপায় করেন না, যাতে এ সকল লোক চিরকাল নিরুপদ্রবে বাস করতে পারে। আমরা যারা সর্বদাই উদ্বিগ্ন হয়ে সেই দুর্বল রাজার নিকৃষ্ট আশ্রয়ে বাস করি, তারা সকলেই এই বিপদ ভোগ করার যোগ্য। ব্রাহ্মণেরা কার অধীনে বাস করেন? কারই বা ইচ্ছানুসারে চলে থাকেন? কারও নয়; তাঁরা পক্ষীগণের মতো ইচ্ছানুসারে চলে বাস করবেন। মানুষ প্রথমে রাজাকে, তারপর ভার্যাকে এবং তারপর ধন আশ্রয় করে। এইভাবে এই তিনের আশ্রয় করে জ্ঞাতি ও সন্তানদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে। কিন্তু আমি এই তিনটিরই বিপরীত পেয়েছি; তাই এই বিপদ উপস্থিত হওয়ায় আমরা অত্যন্ত সন্তপ্ত বোধ করছি। বংশ নাশক সেই পালা আজ আমার উপস্থিত হয়েছে; সুতরাং, সেই খাদ্য এবং একটি পুরুষ আজ আমাকেই দিতে হবে। আমার এমন কোনও ধন নেই, যার দ্বারা একটি পুরুষ কিনে দিতে পারি এবং কখনও কোনও বন্ধুজনকে আমি দিতে পারব না। অথচ সেই রাক্ষসের হাত থেকে রক্ষা পাবার কোনও উপায় দেখছি না। অতএব আমি বিশাল ও দুস্তর দুঃখসাগরে অত্যন্ত নিমগ্ন হয়ে পড়েছি। এখন স্থির করেছি, আমরা সকলে মিলে রাক্ষসের কাছে যাব; তারপর সেই নীচাশয় রাক্ষস আমাদের সকলকে এক সঙ্গে ভোজন করবে।”

কুন্তী বললেন, “ব্রাহ্মণ, আপনি এই ভয়ে কোনও রকমেই দুঃখ করবেন না। কারণ, সেই রাক্ষসের হাত থেকে মুক্তির জন্য আমি একটা উপায় দেখেছি। আপনার একটি মাত্র বালক পুত্র এবং একটি মাত্র ক্ষুদ্র কন্যা, এদের বা আপনার পত্নীর কিংবা আপনার গমন করা আমার অভিপ্রেত নয়। আমার পাঁচটি পুত্র আছে; তার একটি পুত্র আপনার জন্য সেই পাপাত্মা রাক্ষসের উপহার নিয়ে সেখানে যাবে।”

ব্রাহ্মণ বললেন, “তপস্বিনী, আমার এবং আমার আত্মীয়বর্গের জন্য, একে ব্রাহ্মণ তায় আবার অতিথি, এহেন ব্যক্তির প্রাণনাশ আমি কোনও রকমেই স্বীকার করতে পারি না। এরূপ আচরণ অসদ্‌কুলোৎপন্ন বা পাপিষ্ঠা স্ত্রীলোকের হতে পারে না যে, ব্রাহ্মণের জন্য আপনাকে বা আপন পুত্রকে সমর্পণ করে। আপনার পত্রকে সমর্পণ করা অপেক্ষা নিজেকে সমর্পণ করাই ভাল এবং তাই আমি ইচ্ছা করি। কারণ ব্রহ্মহত্যা ও আত্মহত্যা—এ দুয়ের মধ্যে আত্মহত্যাই ভাল। ব্রহ্মহত্যায় গুরুতর পাপ হয়; সুতরাং তা না জেনে করলেও, তার থেকে নিস্তার নেই; সুতরাং আমার আত্মহত্যা তদপেক্ষা ভাল। আর আমি নিজেই নিজের মৃত্যু কামনা করছি না; অন্যে যদি আমাকে বধ করে তাতে আমার কোনও পাপ নেই। কিন্তু আপনার ও আপন লোকের জীবনের জন্য যদি আমি ব্রহ্মহত্যা করি, তবে তার নিষ্কৃতির উপায় দেখি না এবং তা নৃশংস ও ক্ষুদ্র লোকের কাজ। গৃহাগত ও শরণাগত ব্যক্তিকে মৃত্যুপথে সমর্পণ করা এবং প্রার্থী লোকের হত্যা করা—এই কার্যগুলিকে জ্ঞানীরা নৃশংস বলে নিন্দা করেছেন। মানুষ কোনও কারণেই নিন্দিত বা নৃশংস কাজ করবে না—প্রাচীন ধর্মজ্ঞ মহাত্মারা এই কথাই বলে থাকেন। আজ নিজ পত্নীর সঙ্গে নিজের বিনাশ করা বরং ভাল। আমি কখনও ব্রাহ্মণবধের অনুমোদন দিতে পারি না।”

কুন্তী বললেন, “ব্রাহ্মণ, আমারও এই দৃঢ় ধারণা যে ব্রাহ্মণগণকে রক্ষা করতে হয়। তারপর, আমার যদি একশত পুত্রও হত, তবুও কোনও পুত্ৰই আমার বিদ্বেষের পাত্র হত আমি বিদ্বেশবশক সে পুত্রকে পাঠাতে চাইছি না। সে রাক্ষসও আমার পুত্রকে বিনাশ করতে পারবে না। কারণ, আমার সে পুত্র বলবান, মন্ত্রসিদ্ধ এবং তেজস্বী। সুতরাং আমার যে পুত্র রাক্ষসের কাছে তার সমস্ত খাদ্য পৌঁছে দেবে, এবং তার হাত থেকে আপনাকে মুক্ত করবে, এ আমার নিশ্চয় ধারণা। অনেক রাক্ষসই আমার বীর পুত্রের সঙ্গে যুদ্ধে মিলিত হয়েছিল এবং বলবান ও বিশালাকৃতি অনেক রাক্ষসকে সে বধ করেছে। এ আমি নিজেই দেখেছি। তবে ব্রাহ্মণ, আপনি এই বিষয়টি কারও কাছে কোনও কারণেই বলতে পারবেন না।কারণ হয়তো অনেকেই কৌতুকবশত সেই মন্ত্র শিক্ষা করে আমার পুত্রদের প্রতারিত করবে। আর, গুরুর অনুমতি ব্যতীত আমার পুত্র যাকে এই মন্ত্র শিক্ষা দেবে, সে ব্যক্তি সে- মন্ত্র দ্বারা কোনও কার্যই করতে পারবে না, এই সে গুরুর মত।” কুন্তী এরূপ বললে সেই ব্রাহ্মণ আপন ভার্যার সঙ্গে আনন্দিত হয়ে কুন্তীর সেই অমৃততুল্য বাক্যের অনেক প্রশংসা করলেন। তারপর কুন্তী ও ব্রাহ্মণ এক সঙ্গে গিয়ে ভীমকে বললেন, “ভীম, এই কার্য তুমি সম্পাদন করো।” তখন ভীম তাদের বললেন, “তাই করব।”।

ঠিক সেই মুহূর্তে যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবগণ ভিক্ষা নিয়ে উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির ভীমের মুখ-চোখের চেহারা দেখেই তার মনের ভাব বুঝতে পারলেন। তিনি নির্জনে গিয়ে কুন্তীকে জিজ্ঞাসা করলেন, “মা, ভীম পরাক্রম ভীমসেন কোনও বিশেষ কার্য করার ইচ্ছা করছেন? তা কি আপনার অনুমতিক্রমে? না নিজেই করবার ইচ্ছা করছেন?

কুন্তী বললেন, “শত্ৰুসন্তাপক ভীমসেন আমার আদেশেই ব্রাহ্মণের জীবন রক্ষার জন্য এবং এই নগরকে মুক্ত করবার জন্য গুরুতর কাজ করবে।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “মা, আপনি কেন এই গুরুতর সাহস করলেন? সজ্জনেরা পুত্র পরিত্যাগের প্রশংসা করেন না। কেন আপনি পরের পুত্রের জন্য নিজের পুত্রকে ত্যাগ করবার ইচ্ছা করছেন? আপনি পুত্রত্যাগ করতে প্রবৃত্ত হয়ে লোকবিরুদ্ধ এবং বেদবিরুদ্ধ কার্য করছেন। আমরা সকলেই যার বাহুবলের ভরসা করে সুখে নিদ্রা যাই এবং নীচাশয় দুর্যোধন প্রভৃতির অপহৃত রাজ্য পুনরায় উদ্ধার করবার ইচ্ছা করি, যে মহাবীরের বল চিন্তা করে দুর্যোধন শকুনির সঙ্গে দারুণ উদ্বেগে সমস্ত রাত্রি নিদ্রা যায় না, যে মহাবীরের বাহুবলে আমরা জতুগৃহ ও অন্যান্য পাপাত্মাদের হাত থেকে মুক্তি লাভ করেছি এবং পুরোচন নিহত হয়েছে এবং যার বাহুবলের ভরসা করে আমরা দুর্যোধন প্রভৃতিকে নিহত করে এই ধনরত্ন পূর্ণ পৃথিবী লাভ করেছি বলে মনে করি। আপনি কোন বুদ্ধি অবলম্বন করে তাকে ত্যাগ করার উপক্রম করেছেন? দারুণ কষ্টে কি আপনার জ্ঞান ও চৈতন্য লোপ পেয়েছে?”

কুন্তী বললেন, “যুধিষ্ঠির, তুমি ভীমের বিষয়ে সন্তাপ কোরো না, আমিও বুদ্ধির দোষে এই কার্য করিনি। পুত্র! আমরা এই ব্রাহ্মণের গৃহে সুখে বাস করছি, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা জানতে পারেনি এবং এই গৃহস্থ আদর করেন বলে আমাদের কোনও দৈন্য নেই। যুধিষ্ঠির আমি পর্যালোচনা করেই সেই উপকারের এই প্রত্যুপকার স্থির করেছি। কারণ, সেই পুরুষ, যার ব্যবহারে কৃত উপকার নষ্ট হয় না। আবার উপকারীর যতটুকু প্রত্যুপকার করে, সৎপুরুষ তদপেক্ষা বহুগুণ অধিক প্রত্যুপকার করবেন; সুতরাং ব্রাহ্মণের জন্য এই কাজ করলে ভীমের গুরুতর ধর্ম হবে বলে আমি জানি। তখন জতুগৃহে ভীমের গুরুতর বিক্রম এবং হিড়িম্ব রাক্ষসের বধ দেখে আমার ভীমের প্রতি বিশ্বাস জন্মেছে। ভীমের বাহুবল দশ হাজার হাতির বলের অধিক; সেই হেতু সে বারণাবত থেকে হাতির মতো তোমাদের ক’জনকে বহন করে নিয়ে এসেছে। ভীমের সমান বলবান বর্তমানে অন্য কেউ নেই। যে ভীম যুদ্ধে শ্রেষ্ঠ বলবান স্বয়ং দেবরাজকেও অতিক্রম করতে পারে। পূর্বে ভীম জন্মমাত্রই আমার কোল থেকে পর্বতের উপরে পড়ে গিয়েছিল। তখন তার শরীরের ভারে একখানা পাথর ভেঙেছিল। ভীমের শরীরে সেই রকম বল আছে, স্থির বুদ্ধিতে তা জেনেই, তারপর ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকার করতে ইচ্ছা করেছি। আমি অজ্ঞানত লোভ বা মোহবশত এই বিষয় স্থির করিনি, জ্ঞানপূর্বকই এই ধর্মের কার্য করাবার উপক্রম করেছি। যুধিষ্ঠির, এই কার্য করলে, দুটি বিষয় সম্পাদিত হবে; প্রথমত, বাস করার জন্য উপকারের প্রত্যুপকার; আর দ্বিতীয়ত, গুরুতর ধর্ম। যে ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের যে-কোনও প্রয়োজনে সাহায্য করেন, সে ক্ষত্রিয় সর্বমঙ্গলময় স্বর্গলাভ করেন; এই আমার ধারণা। ক্ষত্রিয়, অপর ক্ষত্রিয়কে মৃত্যু থেকে রক্ষা করে ইহলোকে ও পরলোকে বিশাল কীর্তি লাভ করেন। ক্ষত্রিয়, বৈশ্যের সাহায্যে জগতের সর্বত্র প্রজাবর্গকে অনুরক্ত করতে পারেন। ক্ষত্রিয় শরণাগত শূদ্রকে বিপদ থেকে মুক্ত করলে, তিনি ইহলোকে ধন সম্মানিত ও রাজসম্মান লাভযযাগ্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন। যুধিষ্ঠির, অসাধারণ জ্ঞানী ভগবান ব্যাসদেব পূর্বে আমার কাছে এই কথা বলেছিলেন। সেইজন্যই আমি এই কার্য করেছি।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “মা, আপনার এ কার্য যুক্তিসংগত হয়েছে। কেন-না, আপনি যখন এ সমস্ত বুঝেই দয়াবশত বিপন্ন ব্রাহ্মণের জন্য এটা করেছেন। নিশ্চয়ই ভীম রাক্ষস বধ করে আসবে। যেহেতু, আপনি ব্রাহ্মণের উপরে সর্বতোভাবে দয়াশালিনী হয়েছেন। কিন্তু নগরবাসী যাতে ভীমের পরিচয় না পায়, সেইরূপ আপনি ব্রাহ্মণকে বলে দেবেন এবং যত্নপূর্বক বুঝিয়ে দেবেন।”

কুন্তীর দূরপ্রসারী দৃষ্টি সফল হয়েছিল। ভীম বকরাক্ষসকে নিধন করে ব্রাহ্মণকে আশু বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন; একচক্রা নগরকেও বকরাক্ষসের ভয়ংকর ভীতি থেকে উদ্ধার করেছিলেন।

দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভা

আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের গৃহে আগত ব্রতচারী অপর এক ব্রাহ্মণের মুখে পাণ্ডবেরা পাঞ্চালদেশে দ্রৌপদীর অদ্ভুত স্বয়ংবর বৃত্তান্ত শুনলেন। ব্রাহ্মণ দ্রুপদ রাজার মহাযজ্ঞে ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর উৎপত্তি ও দ্রৌপদীর অযোনি-জন্মের কথাও বললেন।

পাণ্ডবেরা বললেন, “দ্রুপদরাজার পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নের যজ্ঞাগ্নি থেকে এবং দ্রৌপদীর যজ্ঞবেদি থেকে কী প্রকারে সেই অদ্ভুত উৎপত্তি ঘটেছিল। ধৃষ্টদ্যুম্ন কী প্রকারে মহাধনুর্ধর দ্রোণের কাছে অস্ত্র শিক্ষা করলেন? কী প্রকারেই বা দ্রোণ ও দ্রুপদ পরস্পর সখা হয়েছিলেন, আর কার দোষেই বা তারা পরস্পর শত্রু হলেন?”

ব্রাহ্মণ বলতে লাগলেন, “গঙ্গার নির্গমস্থানে সর্বদা ব্রতপরায়ণ এবং অত্যন্ত তপস্বী ও বিদ্বান ভরদ্বাজ নামে এক মহর্ষি ছিলেন। একদিন তিনি গঙ্গাস্নান করতে গিয়েছিলেন; কিন্তু তাঁর পূর্বেই ঘৃতাচী নামে এক অপ্সরা গঙ্গায় এসে স্নান করে উঠেছিল ঋষি তাঁকে দেখলেন। তখন নদীতীরের উন্মুক্ত বায়ু ঘৃতাচীর বস্ত্র অপহরণ করল; সেই অবস্থায় তাকে দেখে ঋষি কামার্ত হয়ে পড়লেন। তিনি কুমার বয়স থেকেই ব্রহ্মচারী ছিলেন, তথাপি ঘৃতাচীর প্রতি চিত্ত আসক্ত হওয়ায় তাঁর শুক্ৰস্থলন হল। তা তিনি একটা কলসিতে রাখলেন। সেখান থেকে দ্রোণ নামে একটি পুত্র জন্মাল। সেই দ্রোণই সমস্ত বেদ ও বেদাঙ্গ পাঠ করেছিল।

এদিকে ভরদ্বাজের সখা পৃষামের এক রাজা ছিলেন। তাঁর দ্রুপদ নামের এক পুত্র সেই সময়েই জন্মেছিল। সেই দ্রুপদ প্রতিদিন ভরদ্বাজের আশ্রমে গিয়ে দ্রোণের সঙ্গে খেলা করতেন এবং অধ্যয়ন করতেন। তারপর পৃষৎ পরলোকগমন করলে, দ্রুপদ রাজা হলেন। দ্রোণও শুনলেন যে পরশুরাম নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করবার ইচ্ছা করেছেন। পরশুরাম বনে প্রস্থান করছেন এমন সময়ে দ্রোণ তাকে গিয়ে বললেন, “হে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ, আমি ধনার্থী হয়ে এসেছি, আমার নাম দ্রোণ।”

পরশুরাম বললেন, “ব্রাহ্মণ, আমি এখন কেবল এই শরীরটাকেই অবশিষ্ট রেখেছি। অতএব অস্ত্র বা শরীর এর একটিই নিতে পারেন।”

দ্রোণ বললেন, “সমস্ত অস্ত্র তার প্রয়োগ ও উপসংহার আপনি আমাকে দান করুন।”

পরশুরাম বললেন, “তাই হোক।” এই কথা বলে পরশুরাম দ্রোণকে সেই সমস্ত দান করলেন, দ্রোণও তা পেয়ে কৃতকার্য হলেন। দ্রোণ পরশুরামের কাছে অভীষ্ট ব্ৰহ্মাস্ত্র লাভ করে অত্যন্ত হৃষ্টচিত্ত হলেন এবং মনুষ্যের মধ্যে সর্বপ্রধান যোদ্ধা হলেন। তারপর, প্রতাপশালী দ্রোণ দ্রুপদ রাজার কাছে গিয়ে বললেন, “পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি আমাকে সখা বলে মনে করুন।”

দ্রুপদ বললেন, “অশ্রোত্রীয় শ্রোত্ৰীয়ের, অরথী রথীর এবং অরাজা রাজার সখা হন না, সে যাই হোক, আপনি এই সখিত্বের জন্য কী চাইছেন?”

বুদ্ধিমান দ্রোণ মনে মনে দ্রুপদের প্রতি কর্তব্য নিশ্চয় করে কৌরবদের রাজধানী হস্তিনায় গমন করলেন। দ্রোণ উপস্থিত হলে, ভীষ্ম তাকে নানাবিধ ধন দান করে তার কাছে আপন পৌত্রগণকে শিষ্যরূপে সমর্পণ করলেন। তারপরে, দ্রোণ, সেই সকল শিষ্যকে কাছে এনে দ্রুপদ রাজার দুঃখ উৎপাদনের জন্য এই কথা বললেন, “হে নিস্পাপ শিষ্যগণ, শিক্ষকের বেতন বিষয়ে আমার মনের মধ্যে যা আছে, তোমরা অস্ত্রশিক্ষা করে তা আমাকে দেবে বলো।”

তখন অর্জুন প্রভৃতি শিষ্যগণ বললেন, “তাই হবে। তারপর, পাণ্ডব প্রভৃতি শিষ্যগণ অস্ত্রশিক্ষা করে যখন দ্রোণের অভীষ্ট পূরণের জন্য কৃতনিশ্চয় হলেন; তখন দ্রোণ আবার বললেন, “পৃষৎ-এর পুত্র দ্রুপদ নামে এক ব্যক্তি ছত্রবতীর রাজা; তোমরা সত্বর তাঁর কাছে থেকে তাঁর রাজ্য এনে আমাকে দান করো।” তারপর, পাণ্ডবেরা যুদ্ধ জয় করে, মন্ত্রীদের সঙ্গে দ্রুপদকে বেঁধে এনে দ্রোণকে দেখালেন।

দ্রোণ বললেন, “রাজা, আমি পুনরায় আপনার সঙ্গে সখিত্ব প্রার্থনা করেছি; অথচ আপনার মতে, অরাজা রাজার সখা হতে পারে না। অতএব আমি আপনার সঙ্গে রাজত্ব করার জন্য এই যত্ন করেছি, আর আমি উত্তর তীরের রাজা হলাম।”

দ্রোণ একথা বললে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ অস্ত্রজ্ঞ শ্রেষ্ঠ অথচ ব্রাহ্মণপ্রধান দ্রোণকে বললেন, “মহামতি দ্রোণ, আপনার মঙ্গল হোক, আপনি যেমন বলেছেন, তেমনই হবে; আপনার ইচ্ছানুযায়ী চিরসখিত্ব আমি স্বীকার করলাম।”

মুখে স্বীকার করলেও দ্রুপদ দ্রোণকৃত অপকার মুহূর্তের জন্যও বিস্মৃত হলেন না। উৎকৃষ্ট পুত্র লাভের জন্য তিনি প্রথমে ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ উপযাজের কাছে, পরে উপজের পরামর্শ অনুযায়ী যাজের কাছে গিয়ে তার যন্ত্র করার জন্য আবেদন করলেন। বহুতর গোরু দক্ষিণার বিনিময়ে যাজ যজ্ঞ করতে সম্মত হলেন। তারপরে, যথানিয়মে যাজ পুত্রযাগ যজ্ঞের কার্যারম্ভ করলেন। যজ্ঞ শেষ হলে, যাজ দ্রুপদের মহিষীকে বললেন, “রাজ্ঞী পৃষৎ! আপনি আসুন, আপনার দুটি সন্তান উপস্থিত হয়েছে।”

রানি বললেন, “ব্রাহ্মণ, আমি এখন মুখ ধুইনি এবং স্নান না করায় এখনও অঙ্গে তৈলের সুগন্ধ রয়েছে; অতএব যাজ, একটু অপেক্ষা করুন; পুত্র আমার প্রিয় হলেও এখনই আমি হব্য গ্রহণ করতে পারি না।”

যাজ বললেন, “যাজ পাক করেছেন, উপযাজ অভিমন্ত্রিত্ব করেছেন; সুতরাং এই হবি কেন অভীষ্ট ফল জন্মাবে না? অতএব রানি, আপনি আসুন বা থাকুন।” যাজ এই বলে অভিমন্ত্রিত হবি অগ্নিকে নিক্ষেপ করলে তৎক্ষণাৎ অগ্নির ন্যায় উজ্জ্বলবর্ণ, ভয়ংকরাকৃতি এবং কিরীট, উত্তম বর্ম, তরবারি, বাণ ও ধনুর্ধারী, দেবতার তুল্য একটি কুমার গর্জন করতে করতে সেই অগ্নি থেকে উত্থিত হল। এবং তখনই সেই কুমার উৎকৃষ্ট রথে আরোহণ করে গমন করল। তাতে পাঞ্চালগণ আনন্দিত হয়ে সাধু সাধু বলে কোলাহল করতে লাগল। তখন এই পৃথিবী আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে পাঞ্চালগণকে ধারণ করতে অসমর্থ হয়ে উঠলেন। আর এই সময়ে গগনচর অদৃশ্য এক মহাপ্রাণী এই কথা বলল যে, “দ্রোণবধের জন্য উৎপন্ন এই রাজপুত্র পাঞ্চালগণের ভয় দূর করবে এবং যশ জন্মাবে, আবার রাজাদেরও শোক নষ্ট করবে। তখন যজ্ঞবেদির মধ্য থেকে একটি কন্যা উত্থিত হল; তার নাম ‘পাঞ্চালী’।

কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদি মধ্যাৎ সমুত্থিতা।

সুভগা দর্শনীয়াঙ্গী স্বসিতায়তলোচনা!

শ্যামা পদ্মপলাশাক্ষী নীলকুঞ্চিত মূৰ্দ্ধজা।

তাম্র-তুঙ্গী-নখী সঞশ্চারুপীন পয়োধরা ॥ (আদি : ১৬৮ : ৪৪-৪৫)

“আর, যজ্ঞবেদি মধ্য থেকে একটি কন্যা উত্থিত হল; তার নাম ‘পাঞ্চালী’। দেহের কান্তি মনোহর, অঙ্গ সকল সুদৃশ্য, নয়নযুগল সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ এবং সুদীর্ঘ, শরীরের বর্ণ শ্যাম, নয়নযুগল পদ্মপত্রের ন্যায়, কেশকলাপ কুঞ্চিত ও কৃষ্ণবর্ণ, নখসমূহ তাম্রবর্ণ ও উন্নত, ভ্রূযুগল মনোহর, আর স্তন দুটি সুন্দর ও স্কুল।”

আগত ব্রাহ্মণের কাছে পাণ্ডবগণ পাঞ্চালীর এই অলৌকিক আবির্ভাব কাহিনি শুনলেন এবং আরও শুনলেন যে এই অসামান্যা রমণীর স্বয়ংবর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। পাণ্ডবদেরও সেই সভা দেখার আগ্রহ জন্মাল। কুন্তী তাঁর পুত্রদের মানসিক ভাবের পরিবর্তন বুঝতে পারতেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ডেকে বললেন, “যুধিষ্ঠির আমরা এই মনোহর নগরে আনন্দে বিচরণ করে ভিক্ষান্ন লাভ করতে থেকে এই ব্রাহ্মণের বাড়িতে দীর্ঘকাল আছি। এখানকার মনোহর বন-উপবন আমাদের দেখা হয়েছে। এখন আগের মতো আর ভিক্ষান্ন পাওয়া যাচ্ছে না। যদি তোমার মত হয়, তবে চলো, আমরা পাঞ্চাল দেশে যাই। সেখানে নূতন বস্তু দেখতে পাব। যুধিষ্ঠির আমি শুনেছি, পাঞ্চাল দেশে অনায়াসে ভিক্ষা পাওয়া যায় এবং রাজা দ্রুপদ ব্রাহ্মণদের বিশেষ হিতকারী। আর এক জায়গায় দীর্ঘকাল থাকাও উচিত নয়। যদি তোমার মত হয়, তবে আমরা পাঞ্চাল দেশে যাই।” যুধিষ্ঠির কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সঙ্গে আলোচনা করলেন। তাঁরাও সকলেই সম্মত হলেন। তখন কুন্তী এবং পাণ্ডবেরা গৃহস্বামী ব্রাহ্মণের অনুমতি নিয়ে একচক্রাপুরী ত্যাগ করলেন। গৃহত্যাগের পূর্বে ব্যাসদেব আবার দেখা দিলেন। তিনি জানালেন যে, এক তপস্বীর অনিন্দ্যসুন্দরী কন্যা পতির অভাবে মহাদেবের পূজা করছিল। সে পাঁচবার মহাদেবকে প্রার্থনা জানিয়েছিল যে, আমাকে উপযুক্ত পতি দিন। মহাদেব আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, তুমি পাঁচবার আমার কাছে পতি প্রার্থনা করেছ। পরজন্মে তোমার শ্রেষ্ঠ পঞ্চপতি হবে। শোনা যায়, সেই তপস্বীর কন্যাই পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা হয়ে আবির্ভূত হয়েছে। সেই তোমাদের পঞ্চভ্রাতার পত্নী হবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তোমরা পাঞ্চাল রাজ্যে গমন করো।”

ব্যাসদেবের মুখে এই কাহিনি শুনে এবং অন্য ব্রাহ্মণদের মুখে স্বয়ংবরসভার রোমহর্ষক বর্ণনা শুনে পাণ্ডবেরা মাতা কুন্তীর সঙ্গে পাঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হবার জন্য যাত্রা করলেন। ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে পাঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হয়ে তারা এক কুম্ভকারের গৃহে আশ্রয় লাভ করলেন। পাণ্ডব ভাতারা সমস্ত দিন ভিক্ষা সংগ্রহ করতেন এবং সেই ভিক্ষালব্ধ অন্নে কুন্তী সংসার পরিচালনা করতেন।

নির্দিষ্ট দিনে পাণ্ডবেরা ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হলেন। ভারতবর্ষের এবং ভারতের বাইরেরও শ্রেষ্ঠ রাজাগণ পাঞ্চালীকে লাভ করার জন্য স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন ভগিনী দ্রৌপদীকে নিয়ে রাজসভায় উপস্থিত হলেন এবং পণ বা লক্ষ্যবস্তু ঘোষণা করলেন। রাজারা একে একে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে লাগলেন এবং ব্যর্থ হতে থাকলেন। অঙ্গরাজ কর্ণ লক্ষ্য-বিদ্ধ করার উপক্রম করতে গেলে দ্রৌপদী উচ্চৈঃস্বরে বললেন, নাহং বরয়ামি সূতম্‌

“আমি সূতকে বরণ করব না।” অন্য শ্রেষ্ঠ রাজারাও, যেমন জরাসন্ধ, শিশুপাল, শল্যও ব্যর্থ হলে ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন উঠে দাঁড়ালেন। নিন্দা, সতর্কবাণী, উৎসাহ চারদিক থেকে বর্ষিত হতে লাগল। অর্জুন অনায়াসে লক্ষ্যভেদ করলেন এবং প্রকাশ্য সভায় দ্রৌপদী অর্জুনের গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিলেন। ক্রুদ্ধ, ক্ষুব্ধ রাজন্যবর্গ বধ করার অভিপ্রায়ে তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। একটি বৃহৎ বৃক্ষকে পত্রশূন্য করে ভীমসেন অর্জুনের পার্শ্বে আবির্ভূত হলেন। যুদ্ধে রাজাদের পরাজয় ঘটল। অর্জুন ভীমসেন এবং দ্ৰৌপদীকে নিয়ে কুটিরে ফিরলেন।।

এদিকে পুত্রেরা আসল না, ভিক্ষা করার সময়ও চলে গেল দেখে, কুন্তীদেবী পাণ্ডবদের নানাবিধ অনিষ্টের আশঙ্কা করতে লাগলেন, ভাবলেন, “ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা চিনতে পেরে পাণ্ডবদের বিনষ্ট করেনি তো? কিংবা মায়াবী, ভয়ংকর ও অক্ষুণ্ণ বৈরী রাক্ষসেরা মেরে ফেলেনি তো? হায়! মহাত্মা বেদব্যাসের ‘উক্তিগুলি’ কি বিপরীত হল?” পুত্রস্নেহাকুল কুন্তীদেবী এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করতে লাগলেন। অপরাঃ শেষে অর্জুন ব্রাহ্মণগণে পরিবেষ্টিত হয়ে, মেঘাবৃত সূর্যের মতো সেই কুম্ভকারের গৃহে প্রবেশ করলেন। মহাপ্রভাবশালী মনুষ্যশ্রেষ্ঠ ভীম ও অর্জুন সেই কুম্ভকারের কর্মশালায় গিয়ে, কুন্তীকে লক্ষ্য করে, আনন্দিত চিত্তে দ্রৌপদীর বিষয় জানালেন, “মা ভিক্ষা এনেছি।” কিন্তু কুন্তী ঘরের ভিতরে ছিলেন বলে ভীমার্জুনকে না দেখেই বলে ফেললেন, “তোমরা সকলে মিলেই তা ভোগ করো।” পরে তিনি দ্রৌপদীকে দেখে বললেন যে, “হায়! আমি বড় কষ্টের কথা বলে ফেলেছি।” তারপর কুন্তী দ্রৌপদীর হাত ধরে অধর্মের ভয়ে ভীত হয়ে, চিন্তা করতে থেকে দ্রৌপদীর হাত ধরে যুধিষ্ঠিরের কাছে গেলেন এবং তাকে এই কথা বললেন, “পুত্র, তোমার কনিষ্ঠ সহোদর ভীম ও অর্জুন এই দ্রুপদ রাজার কন্যাটিকে আমার কাছে ভিক্ষা বলে দিতে চেয়েছিল তখন আমি অনবধানতাবশত ভিক্ষা মনে করে তার উপযুক্ত কথাই বলে ফেলেছি যে, তোমরা সকলে মিলে ভোগ করো। আমার এই কথা কী প্রকারে সত্য হতে পারে; এ-বিষয়ে যা সংগত হয়, যাতে এঁর পাপ না হয়, সেই পাপে ইনি নরকে না যান, সেইরূপ উপায় বলো।”

যুধিষ্ঠির প্রথমে অর্জুনকে দ্রৌপদীকে বিবাহ করার প্রস্তাব দিলেন, অর্জুন দৃঢ়ভাবে সেই প্রস্তাবে অসম্মতি জানান। যুধিষ্ঠির অন্য ভ্রাতাদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন যে সকল ভ্রাতার চিত্ত প্রবল কামাবেগে অস্থির হয়েছে। তখন তিনি ব্যাসদেবের কথা স্মরণ করেই পরস্পর ভেদের ভয়ে ভ্রাতৃগণকে বললেন, “কল্যাণী দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই ভার্যা হবেন।” এই সময়ে, দীর্ঘকাল পরে কৃষ্ণ ও বলরাম সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে পিসিমা কুন্তী, জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করে আত্মপরিচয় দিলেন। মহাভারত অনুসারে পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণ-বলরামের প্রথম সাক্ষাৎ দর্শন এখানেই। অর্থাৎ অর্জুনের বয়স যখন আটাশ, তখন তাঁর থেকে ছ’ মাসের বড় কৃষ্ণের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটল।

পরদিবস প্রভাতে ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেব চার ভ্রাতা সন্ধ্যাকালে ভিক্ষা করে এসে সেই ভিক্ষান্ন সকল যুধিষ্ঠিরের কাছে সমর্পণ করলেন। উদারস্বভাবা কুন্তীদেবী সেই অন্ন পাক করে দ্রৌপদীকে বললেন, “ভদ্রে, তুমি এর অগ্রভাব নিয়ে দেবতাদের উপহার ও ব্রাহ্মণদের ভিক্ষা দাও। আর, যে সকল লোক সকল দিকে ভোজনার্থী হয়ে আছে, তাদেরও দাও; তারপর যা থাকবে, তা দু’ভাগ করো, তার এক ভাগকে আবার চার ভাইয়ের জন্য চারভাগ, আমার এক ভাগ, তোমার এক ভাগ—এইভাবে ছয় ভাগ করো। তারপর এই যিনি শ্রেষ্ঠ হস্তীর ন্যায় বলিষ্ঠাকৃতি, গৌরবর্ণ, যুবক এবং বিশালদেহ এই ভীমকে সেই অর্ধ দাও। কেননা ইনি মহাবীর কিনা, তাই সর্বদাই অধিক ভোজন করে থাকেন।” সচ্চরিত্রা দ্রৌপদী কুন্তীদেবীর কথাগুলিকে ভাল বলে মনে করলেন; তাই তিনি রাজকন্যা হয়েও আনন্দিত হয়েই কুন্তীর আদেশে অনুরূপ কার্য করলেন।

বহু আলাপ আলোচনার পর, বাদপ্রতিবাদের পর, ব্যাসদেব কর্তৃক দ্রুপদের কাছে দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত, মহাদেবের আশীর্বাদ ইত্যাদি শ্রবণ ও দর্শনের পর পঞ্চ ভ্রাতার সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ স্থির হল। প্রত্যেকবার বিবাহের পর ব্যাসদেব দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করে বলতেন, “সুমধ্যমা বভুব কন্যেব গতে গতেহহনি।” “তুমি পুনরায় কন্যা হও।” এইভাবে

পতিশ্বশুরতা জ্যেষ্ঠে পতি দেবতাহনুজে।

মধ্যমেষু চ পাঞ্চাল্যাতিয়ং ত্রিতয়ং ত্ৰিষু ॥ আদি : ১৯১: ২৩ ॥

“যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর পতি ও কেবল ভাশুর হলেন এবং সহদেব তাঁর পতি ও কেবল দেবর হলেন, আর ভীম, অর্জুন ও নকুল—এঁরা প্রত্যেকেই তাঁর পতি ভাশুর ও দেবর হলেন।” বিবাহ হয়ে গেলে, দ্রুপদ রাজা পাণ্ডবগণকে নানাবিধ উৎকৃষ্ট ধন এবং এক-একশত রথ যৌতুক দিলেন; তার প্রত্যেক রথে সোনার ঝালর ও সোনার লাগামযুক্ত চারটি করে অশ্ব ছিল।

মহাত্মা দ্রুপদ রাজার মহিষীরা কুন্তীর কাছে গিয়ে, আপন আপন নাম উল্লেখ করে, আপন আপন মস্তকে তাঁর চরণযুগলের স্পর্শ করাতেন। দ্রৌপদী পট্টবস্ত্র পরিধান করে মাঙ্গলিক কার্য সম্পাদন করে, শাশুড়ি কুন্তীর কাছে গিয়ে, তাঁকে প্রণাম করে, তাঁর সম্মুখে অবনতা ও কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়াতেন। কুন্তীও বাৎসল্যবশত, সুরূপা, সুলক্ষণা, সৎস্বভাব ও সদাচার পুত্রবধূ দ্রৌপদীকে আশীর্বাদ করতেন, “শচী যেমন ইন্দ্রের, স্বাহা যেমন অগ্নির, রোহিণী যেমন চন্দ্রের, দয়মন্তী যেমন নলের, ভদ্রা যেমন কুবেরের, অরুন্ধতী যেমন বশিষ্ঠের, লক্ষ্মী যেমন নারায়ণের আদরের পাত্রী, তুমিও তেমনই ভর্তাদের আদরের পাত্রী হও। ভদ্রে, তুমি চিরজীবী ও মহাবীর পুত্র প্রসব করো, বহুবিধ সুখ লাভ করো, গুণবতী ও ভাগ্যবতী হও, নানাবিধ ভোগ করো এবং পতিদের যজ্ঞপত্নী ও পতিব্রতা হও। অতিথি অভ্যাগত, সাধু, বালক, বৃদ্ধ ও গুরুজনদের যথানিয়মে সেবা করতে থাকে এবং এই অবস্থায় যেন তোমার চিরদিন চলে যায়। কুরুজাঙ্গল দেশে যে সকল রাজ্য ও নগর আছে, তাতে তুমি ধর্মানুরক্ত হয়ে রাজার সঙ্গে অভিষিক্ত হও। মহাবীর স্বামীরা বিক্রম প্রকাশ করে যে সকল রাজ্যজয় করবেন, সে সমস্তই তুমি অশ্বমেধ মহাযজ্ঞে ব্রাহ্মণদের দান করো। গুণবতী, পৃথিবীতে যে সকল উৎকৃষ্ট রত্ন আছে, সে সমস্তই তুমি লাভ করো এবং কল্যাণী, তুমি সুখে থেকে শত বৎসর জীবিত থাকো। বধূ, আজ যেমন পট্টবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় তোমাকে অভিনন্দিত করছি, তেমন পুত্র জন্মালে পর ভাগ্যবতী অবস্থায় আবার তোমায় অভিনন্দিত করব।”

পাণ্ডবেরা ও কুন্তী জীবিত আছেন এবং পাণ্ডবদের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিবাহ হয়েছে, এই সংবাদ কৌরবসভাতেও আলোড়ন তুলল। বহু আলোচনার পর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের আনয়নের জন্য বিদুরকে নানাবিধ মূল্যবান ধন-রত্ন-বস্ত্রাদি দিয়ে মহারাজ দ্রুপদের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানেও বহু আলোচনার পর কৃষ্ণের পরামর্শ অনুসারে পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরে ফিরে এলেন। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র তাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিকর্ণ, চিত্রসেন, দ্রোণাচার্য ও কৃপাচার্যকে পাঠিয়ে দিলেন। প্রজারা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন; পাণ্ডবেরা ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও অন্যান্য পূজনীয়দের প্রণাম করে অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন এবং গান্ধারীর আদেশে বিদুর তাঁদের পাণ্ডুর প্রাসাদে বাস করার জন্য নিয়ে গেলেন।

ভীষ্মের পরামর্শে এবং ধৃতরাষ্ট্রের আদেশে পাণ্ডবেরা জলেজঙ্গলে পরিপূর্ণ ইন্দ্রপ্রস্থে কঠিন পরিশ্রমে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করলেন। বিভিন্ন বর্ণের মানুষ এসে সেখানে বাস করতে লাগলেন। খাণ্ডবদাহে অর্জুন কর্তৃক বরাভয় প্রদত্ত ময়দানব একটি অপরূপ সভাগৃহ নির্মাণ করে দিলেন। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্বের প্রথম বৎসরেই ব্রাহ্মণের গোধন রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত দাম্পত্য-নিয়ম ভঙ্গ করে অর্জুনকে বারো বৎসর বনবাসে যেতে হল। বনবাসকালে তিনি প্রথমে নাগকন্যা উলূপীকে, পরে মণিপুররাজ চিত্রবাহনের কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে এবং শেষে কৃষ্ণ-ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ করেন এবং বনবাসের শেষে সুভদ্রাকে নিয়েই ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে আসেন। অর্জুন দ্রৌপদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে দ্রৌপদী অভিমান মিশ্রিত প্রণয়পূর্বক তাঁকে বলেন, “পার্থ, যেখানে সুভদ্রা রয়েছেন আপনি সেখানেই যান। কারণ, কোনও বস্তুু দ্বিতীয়বার বন্ধন করলে, পূর্বের বন্ধন শিথিল হয়ে যায়।” অর্জুন তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন এবং বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। তখন অর্জুন দ্রুত গিয়ে সুভদ্রাকে গোপবধূর পোশাক পরিয়ে কুন্তীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন বিশালরক্তনয়না বীরপত্নী উত্তম রমণী সুভদ্রা সেই বেশে অত্যন্ত শোভা পেতে থেকে, প্রধান ভবনে গিয়ে, কুন্তীকে প্রণাম করলেন। কুন্তীদেবী সর্বাঙ্গসুন্দরী সুভদ্রার মস্তকাঘ্রাণ করে অসাধারণ আশীর্বাদ করলেন। তারপর পূর্ণচন্দ্রমুখী সুভদ্রা সত্বর গিয়ে দ্রৌপদীকে নমস্কার করলেন এবং বললেন, “আমি আপনার দাসী।” তখন দ্রৌপদী উঠে কৃষ্ণের ভগিনী সুভদ্রাকে আলিঙ্গন করে প্রীতিসহকারে বললেন, “তোমার পতি শত্রুশূন্য হউন।” সেই আশীর্বাদের উত্তরে আনন্দিত সুভদ্রাও বললেন, “তাই হোক!”

দ্যূতক্রীড়ায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা

ইন্দ্রপ্রস্থে কুন্তীর দিন সুখে শান্তিতেই কাটছিল। পিতৃহীন পুত্র রাজা হয়েছে, ভ্রাতাদের সঙ্গে তার অটুট সৌহার্দ্য। দ্রৌপদী ও অন্য পুত্রবধূরা সর্বদা সেবা তৎপর। বিধবা কুন্তী কিছুকালের জন্য স্বামীর অকালমৃত্যুর দুঃখ ভুলতে পেরেছিলেন। রাজসূয় যজ্ঞও শেষ হল। প্রজারা যুধিষ্ঠিরের ধর্মজ্ঞান, প্রজ্ঞায়, সুবিবেচনায় আনন্দে দিন অতিবাহিত করছে। চারপুত্র রাজসূয় যজ্ঞের পূর্বে কর্ণসহ সমস্ত ভারতের রাজন্যবর্গ (আত্মীয় ও বন্ধু রাজা ভিন্ন)-কে পরাজিত করে রাশি রাশি ধন সম্পদ রাজা যুধিষ্ঠিরের হাতে তুলে দিয়েছেন ময়দানব করে দিয়েছেন। এক অপূর্ব সভাকক্ষ—যা অকল্পনীয় ও অভাবিত সুন্দর।

সভাকক্ষের অসাধারণ শ্ৰী, সৌন্দর্য ও সম্পদে দুর্যোধন ঈর্ষাকাতর হয়ে হস্তিনায় ফিরে গেছেন। তার তখন ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন কী ভাবে পাণ্ডবদের এই সম্পদ কেড়ে নেওয়া যায়। তারপর একদিন বিদুর এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। জানালেন ধৃতরাষ্ট্র পাশা খেলার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞা ছিল রণে এবং দ্যূতক্রীড়ায় কেউ আহ্বান করলে তা অস্বীকার না করার। অতএব ভ্রাতাদের ও অন্তঃপুরিকাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি হস্তিনায় চললেন দূতক্রীড়ায় অংশ নিতে। দুর্যোধনের পক্ষে অক্ষক্রীড়ায় অংশ নিলেন কপট অক্ষক্রীড়ায় নিপুণ ধূর্ত মাতুল শকুনি। পূর্ণ সভাকক্ষে ক্রীড়া আরম্ভ হল। প্রথম চাল থেকেই যুধিষ্ঠির হারতে লাগলেন। শকুনির কপট নিক্ষেপে ত্রয়োদশ চালের মধ্যেই পাণ্ডবেরা সর্বরিক্ত হয়ে গেলেন। এয়োদশ চালে যুধিষ্ঠির নিজেকে বাজি ধরলেন এবং হারলেন। ইতিপূর্বে তিনি ভীম, অর্জুন, নকুল-সহদেবকে বাজি ধরে হেরেছিলেন। পাণ্ডবেরা কৌরবদের ক্রীতদাস হয়ে গেলেন। কুন্তী চিকের আড়াল থেকে খেলা দেখছিলেন এবং বিষয় থেকে বিষণ্ণতর হচ্ছিলেন।

চতুর্দশ চালে যুধিষ্ঠির যে পণ রাখলেন, তা কুন্তীর স্বপ্নের অতীত ছিল। যুধিষ্ঠির উবাচ।

নৈব হ্রস্বা ন মহতী নাতিকৃষ্ণা ন রোহিনী।

নীলকুঞ্চিত কেশী চ তয়া দীব্যাম্যহং ত্বয়া ॥ সভা : ৬২ : ২৯ ॥

“যুধিষ্ঠির বললেন, “যিনি খর্বা নন, দীর্ঘাও নন এবং অত্যন্ত কৃষ্ণবর্ণা, রক্তবর্ণাও নন, আর যার কেশকলাপ কৃষ্ণবর্ণ এবং বক্র, সেই দ্রৌপদী দ্বারাই আমি আপনার সঙ্গে খেলা করব।”

শুনে সমস্ত সভা ‘ধিক ধিক’ বলতে থাকল। বিদুর প্রাণহীনের মতো দুই হাতে মস্তক ধারণ করে নিঃশব্দে বসে রইলেন। শকুনি কপট পাশার চাল ফেলেই বললেন, “এও জিতলাম।” কৌরবরা উল্লাস প্রকাশ করতে লাগল এবং দুর্যোধন বিদুরকে আদেশ করলেন, “দাসী দ্রৌপদীকে সভাস্থলে নিয়ে আসুন।” বিদুর ধিক্কার দিয়ে দুর্যোধনকে বললেন, “যুধিষ্ঠির পূর্বে হেরে গিয়ে দ্রৌপদীকে পণ রেখেছিলেন, সুতরাং তিনি তখন ‘অস্বামি’ ছিলেন এবং দ্ৰৌপদীও বিজিতা হতে পারেন না।” দুর্যোধন বিদুরের কথায় কর্ণপাত না করে প্রাতিকামীকে গিয়ে দ্রৌপদীকে সভামধ্যে নিয়ে আসার আদেশ দিলেন। প্রাতিকামী দু’বার গেলেও দ্রৌপদী সভায় এলেন না।

তখন দুর্যোধন দুঃশাসনকে আদেশ করলেন, “দাসী দ্রৌপদীকে সভামধ্যে নিয়ে এসো।”

তখন দ্রৌপদী রজস্বলা ছিলেন এবং তাঁর পরিধানে একটিমাত্র বসন ছিল। তা-ও রক্তসিক্ত! সেই অবস্থায় অন্তঃপুরে প্রবেশ করে, অন্তপুরিকাদের সমস্ত প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে, কেশাকর্ষণ করে দুঃশাসন দ্রৌপদীকে সভামধ্যে টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। এরপরে যা ঘটল তা বিশ্বসাহিত্যের কোথাও ঘটেনি। কুন্তী স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, তাঁর আপন গর্ভজাত সন্তান কর্ণ দুঃশাসনকে আদেশ করলেন, “দাসী দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করো।” কুন্তীর পাঁচভুবন বিজয়ী পুত্র মাথা নিচু করে বসে আছেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীকে নগ্না করার জন্য তাঁর বসন ধরে টানছেন। কুরুবৃদ্ধেরা নিঃস্তব্ধ, নীরব। সমস্ত সভাগৃহে কম্পিত হতে থাকল ভীমের কঠিন শপথ যুদ্ধেক্ষেত্রে তিনি দুঃশাসনের বক্ষেরক্ত পান করে এ অপরাধের শাস্তি দেবেন। দুর্যোধন দ্রৌপদীকে কুৎসিত ইঙ্গিত করে বাম উরুর বস্ত্র উন্মোচন করে তাকে সেখানে বসার আমন্ত্রণ জানালেন। ভীম আবার গর্জন করে বললেন, গদাঘাতে তিনি দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন। দুঃশাসন কিন্তু দ্রৌপদীকে বিবসনা করতে পারলেন না। অন্তরিক্ষ থেকে ধর্মদেব দ্রৌপদীকে বসন দিতে লাগলেন। সভাগৃহ স্তূপীকৃত হয়ে উঠল সেই বসনস্তূপে। চোখ বন্ধ করে দ্রৌপদী অনাথবন্ধু কৃষ্ণকে ডাকতে লাগলেন। সমস্ত রাজ্য জুড়ে অশুভ প্রাণীদের চিৎকার শোনা যেতে লাগল। ভীতসন্ত্রস্ত ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীকে সন্তুষ্ট করতে বরদানের ছলে দুর্যোধন বিজিত সমস্ত ধনসম্পদ ফিরিয়ে দিলেন, তার স্বামীদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলেন। প্রথম পর্যায়ের লাঞ্ছনা, অসম্মান শেষ হলেও দুর্যোগ কিন্তু কাটল না। বিদায় নিয়ে যুধিষ্ঠির ভ্রাতা, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে রওনা হলেন। পথিমধ্যে ধৃতরাষ্ট্রের দূত এসে আবার তাঁরা ন্যূতক্রীড়ার জন্য হস্তিনাপূরে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রতিজ্ঞা রাখতেই যুধিষ্ঠিরকে আবার দ্যূতক্রীড়ায় বসতে হল। এবার শর্ত খুব সহজ ও সরল। পরাজিত পক্ষ বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাসে কাটাবে, এর মধ্যে অজ্ঞাতবাস পর্বে ধরা পড়লে আবার বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস। যুধিষ্ঠির খেললেন এবং হারলেন। পাণ্ডবেরা দ্রৌপদী সহ বনবাস যাত্রার জন্য প্রস্তুত হলেন। এই বিদায়পর্বটিতে কুন্তীর খানখান হয়ে ভেঙে পড়া হৃদয়ের বড় অপূর্ব বর্ণনা ব্যাসদেব দিয়েছেন।

যুধিষ্ঠির বনগমনের জন্য সভাসদদের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। তখন বিদুর বললেন, “মাননীয়া কুন্তীদেবী রাজার তনয়া, কোমলাঙ্গী, বৃদ্ধা এবং সুখভোগে অভ্যস্তা; সুতরাং তিনি বনে গিয়ে বাস করতে পারবেন না। অতএব তিনি সসম্মানে আমার বাড়িতেই এখন বাস করবেন। পাণ্ডবগণ, তোমরা এটা জেনে রাখো; তোমাদের সর্বপ্রকার মঙ্গল হোক।” “তাই হোক” এই কথা বলে পাণ্ডবেরা সকলেই বললেন, “হে নিস্পাপ বিদুর, আপনি আমাদের যা বলবেন, আমরা তাই করব। কারণ, আপনি আমাদের পিতৃতুল্য পিতৃব্য; অতএব আমাদের আরও যা কর্তব্য হয়, তারও উপদেশ দিন।”।

বিদুর যথোচিত যাত্রাকালীন উপদেশ দান করলেন।

তারপর দ্রৌপদী যাত্রা করবার সময়ে কুন্তীর কাছে এবং সেখানে অন্য যে সকল স্ত্রীলোক ছিলেন, তাঁদের কাছে গিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বনগমনের অনুমতি চাইলেন। যথাযযাগ্য নমস্কার ও আলিঙ্গন করে গমন করার ইচ্ছা করলেন। তখন পাণ্ডবগণের অন্তঃপুরে বিশাল আর্তনাদ হতে লাগল। কুন্তী দ্রৌপদীকে গমন করতে দেখে, অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে, শোকাকুল কণ্ঠে অতিকষ্টে বলতে লাগলেন, “বৎসে, তুমি এই গুরুতর বিপদে পড়ে শোক কোরো না। তুমি স্ত্রীলোকের সমস্ত ধর্মই জানো এবং সদস্বভাবশালিনী ও সদাচারসম্পন্না। মৃদুহাসিনী, তোমার ভর্তাদের বিষয়ে তোমার কী করতে হবে, তা আমার বলে দেবার কোনও প্রয়োজনই নেই। কারণ তুমি সমস্ত গুণদ্বারা পিতৃমাতৃ—উভয় কুলই অলংকৃত করেছ। হে নিষ্পপে! এই কৌরবেরা ভাগ্যবান, যাদের তুমি দৃষ্টি দ্বারা দগ্ধ করোনি। সে যাই হোক, আমার মঙ্গলচিন্তায় রক্ষিত হয়ে তুমি নির্বিঘ্নে পথে গমন করো। অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে সতী স্ত্রীদের বিহ্বলতা সংগত নয়। তুমি, অসাধারণ ধর্ম কর্তৃক রক্ষিত হয়ে থেকে শীঘ্রই মঙ্গললাভ করবে। বনবাসের সময় আমার পুত্র সহদেবকে তুমি সর্বদাই পর্যবেক্ষণ কোরো, যাতে এই মহামতি সহদেব এই বিপদে পড়ে অবসন্ন হয়ে না পড়ে।” পরিধানে একখানি মাত্র বসন ছিল, তাও রক্তাক্ত ছিল এবং চুলগুলি খোলা ছিল; এই অবস্থায় দ্রৌপদী “তাই হবে” এই কথা বলে নির্গত হলেন। তখন নয়নজল পড়ে তার গণ্ডদ্বয় প্লাবিত হচ্ছিল।

এইভাবে দ্রৌপদী উচ্চেঃস্বরে রোদন করতে করতে গমন করতে লাগলেন। কুন্তীও তাঁর পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন; তারপর কুন্তী পুত্রগণকে দেখতে পেলেন, তখন তাঁদের বস্ত্র ও অলংকার হরণ করে নিয়েছিল, সমস্ত অঙ্গ মৃগচর্মে আবৃত ছিল, তাঁরা লজ্জায় একটু অবনতবদন হয়ে যাচ্ছিলেন; শত্রুরা আনত হয়ে তাদের পরিবেষ্টন করে যাচ্ছিল এবং বন্ধুরা শোক করছিল। অত্যন্ত বাৎসল্যশালিনী কুন্তী সেই অবস্থায় পুত্রদের কাছে গিয়ে প্রত্যেককে আলিঙ্গন করতে থেকে বার বার বিলাপ করে বললেন, “যাদের চরিত্র ধর্মময় এবং যারা সদ্‌ব্যবহারে অলংকৃত, উদারচেতা, ঈশ্বরে দৃঢ়ভক্ত ও সর্বদা যাগে ব্যাপৃত, তাদেরই বিপদ আসল! এ কী প্রকার দৈব বিপর্যয়! আমি কার অভিসম্পাতে তোমাদের এই দুরবস্থা দেখছি! বৎসগণ! আমি তোমাদের প্রসব করেছিলাম বলে এটা আমারই ভাগ্যের দোষ! না হলে, তোমরা উত্তম উত্তম গুণসম্পন্ন হয়েও অত্যন্ত দুঃখ ও কষ্ট ভোগ করবে কেন? বৎসগণ! মানসিক বল, দৈহিক বল, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং প্রভাবের গুণে তোমরা প্রবল হয়েও ধনের অভাবে কৃশ হতে থেকে কী প্রকারে দুর্গম অরণ্যে বাস করবে। আমি যদি আগে জানতাম যে, নিশ্চয়ই তোমাদের বনবাস হবে, তবে আমি পাণ্ডুর মৃত্যুর পর শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে কখনও হস্তিনায় আসতাম না। আমি তোমাদের পিতাকে ধন্য মনে করি, যিনি পুত্র সম্বন্ধে মনঃপীড়া না পেয়েই প্রিয়তম স্বর্গলাভের ইচ্ছা করেছিলেন; আমার সেরূপ তপস্যা কোথায়? আর, ভবিষ্যৎ বিষয়ে অভিজ্ঞ স্বর্গগতা ধর্মজ্ঞা মাদ্রীকেও আমি আজ সর্বপ্রকারে ধন্যা ও মঙ্গলবতী বলে মনে করি। কারণ, যিনি পতিসম্ভোগ ও ভাগ্যবিষয়ের জ্ঞান ও স্বর্গলাভ দ্বারা আমাকে বঞ্চিত করে গিয়েছেন। আর আমি জীবনের প্রতি মমতা করেছিলাম, তাই এই দারুণ ক্লেশ ভোগ করছি; সুতরাং আমাকে ধিক। পুত্রগণ! আমি তোমাদের অতিকষ্টে লাভ করেছিলাম, তাই তোমরা আমার অতি প্রিয় এবং সচ্চরিত্র; সুতরাং আমি তোমাদের ত্যাগ করতে পারব না, তোমাদের সঙ্গেই বনে যাব। হা দ্রৌপদী! তুমি আমাকে কেন ত্যাগ করছ? হায়! জগতে প্রাণের বিনাশ থাকলেও বিধাতা অনবধানতাবশত আমার প্রাণের বিনাশ করেননি; তাতেই আয়ু আমাকে ত্যাগ করছে না।

“হা কৃষ্ণ! হা দ্বারকাবাসী! তুমি কোথায় আছ? হে রামানুজ! তুমি আমাকে এবং এই নরশ্রেষ্ঠদের দুঃখ থেকে কেন রক্ষা করছ না। এরা সকলেই সচ্চরিত্র, ধর্ম, উদারতা, যশ ও বীর্যশালী; সুতরাং এরা দুঃখভোগ করার যোগ্য নয়; অতএব এদের প্রতি দয়া করো। ন্যায়জ্ঞ ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতি কুলপতিগণ বিদ্যমান থাকতে এই বিপদ কী করে উপস্থিত হল? হা পাণ্ডু! হা মহারাজ! আপনি কোথায় আছেন? শত্রুরা দ্যূতে পরাজিত করে সচ্চরিত্র পুত্রদের নির্বাসিত করছে; এ অবস্থায় আপনি কেন উপেক্ষা করছেন। সহদেব! তুমি নিবৃত্ত হও; কারণ, তুমি তো আমার শরীর থেকেও প্রিয়। হে মাত্ৰীনন্দন! কুপুত্রের মতো তুমি আমাকে পরিত্যাগ কোরো না। তোমার এই ভ্রাতারা যদি সত্য রক্ষা করতে চায়, তবে এরাই বনে গমন করুক; আর তুমি রাজধানীতে থেকে আমাকে পরিত্রাণ করার ধর্ম লাভ করো।”

কুন্তী এরূপ বিলাপ করছিলেন, এই অবস্থায় পাণ্ডবগণ তাঁকে শান্ত করে প্রণামপূর্বক বিষণ্ণচিত্তে বনেই প্রস্থান করলেন।

কৃষ্ণের সন্ধি প্রস্তাবে বিরোধী কুন্তী

এর পরে তেরো বছর কুন্তী হস্তিনাপুরে বিদুরের গৃহে বাস করেছিলেন। তাঁর সঙ্গীসাথি কেউ ছিল না। পুত্রদের অথবা পুত্রবধূর সঙ্গে সাক্ষাতের কোনও উপায় ছিল না। কখনও কখনও বিদুরের মুখে ভাসাভাসা পুত্রদের সংবাদ পাচ্ছিলেন। কুন্তী সারাজীবনই নিঃসঙ্গ। বাল্যে পিতা শূরসেন কুন্তীভোজ রাজার কাছে তাঁকে দান করলে সে-পরিবারে তিনি মাতৃস্নেহহীন শিশুর মতোই বড় হয়ে উঠেছিলেন। বিবাহের পরেও তিনি স্বামীকে পেলেন না। কেবলমাত্র সপত্নী মাদ্রীর জন্যই নয়, কিমিন্দম মুনির অভিসম্পাতের কারণে তিনি স্বামী থাকতেই স্বামীহারা। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর থেকেই কুন্তী আরও নিঃসঙ্গ হয়ে গেলেন। মাদ্রী আপন গর্ভজাত দুই পুত্র, নকুল ও সহদেবের দায়িত্ব কুন্তীর উপর দিয়ে সহমৃতা হলেন। পঞ্চপুত্রের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ল কুন্তীর উপর। কুন্তী সে দায়িত্ব পালন করেছেন। জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠিরের বিচারবিবেচনা ও ধর্মবোধের উপর কুন্তীর গভীর আস্থা ছিল। আস্থা ছিল ভীমের অসাধারণ শারীরিক শক্তি ও অর্জুনের অসাধারণ লক্ষ্যবেধ ক্ষমতায়। তবু কুন্তী একাকিনী এবং তাঁকে শত্ৰুপুরীতে বাস করতে হয়েছে।

ইতিমধ্যে কুন্তী পেয়েছেন দুটি সুসংবাদ। প্রথমত, শর্তানুসারে তাঁর পুত্রগণ বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস যথাবিধানে পালন করে সময় অতিক্রান্ত হলে আত্মপ্রকাশ করেছেন। দ্বিতীয়ত, অর্জুনপুত্র অভিমন্যুর সঙ্গে বিরাট রাজকন্যা উত্তরার শুভ পরিণয় ঘটেছে। যখন মাতৃহৃদয় দীর্ঘ তেরো বৎসর পরে পুত্রদের ও পুত্রবধূর সঙ্গে মিলনে উৎসুক—তখনই কুন্তী শুনলেন যুধিষ্ঠিরের পুরোহিতের দৌত্য ব্যর্থ হয়েছে। শর্ত পালন করে যুধিষ্ঠির নিজ রাজ্য ফিরে পেতে প্রার্থনা করেছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। এরপর কৌরবপক্ষ থেকে সঞ্জয়কে দূত করে পাঠানোর সংবাদও তিনি পেয়েছেন। কৌরবদের মূল বক্তব্য ছিল, পাণ্ডবেরা বনেই সুখে শান্তিতে থাক, তারা যেন রাজ্য ফিরে পাবার কোনও প্রচেষ্টা না করে। কুন্তী সংবাদ পেলেন পাণ্ডব পক্ষের দাবি নিয়ে কৃষ্ণ কৌরবসভায় আসছেন। দীর্ঘকাল পরে মাতুলপুত্র কৃষ্ণের সঙ্গে পিসিমা কুন্তীর সাক্ষাৎ ঘটল।

কুন্তীদেবী সূর্যের মতো নির্মলতেজা কৃষ্ণকে আগমন করতে দেখে পুত্রগণকে স্মরণ করে কৃষ্ণের গলা জড়িয়ে ধরে রোদন করতে লাগলেন। যিনি বলবান পাণ্ডবদের মধ্যে বিচরণ করতেন, সেই কৃষ্ণকে বহুকাল পর দর্শন করে কুন্তী অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। অতিথি সৎকারের পর যুদ্ধনায়ক কৃষ্ণ উপবেশন করলে কুন্তী শুষ্কমুখে অশ্রু গদগদভাবে তাঁর কাছে বলতে লাগলেন, “কৃষ্ণ। পাণ্ডবেরা বালাকাল থেকেই গুরুশুশ্রূষায় নিরত, পরস্পর সৌহার্দ্যশালী, লোকপ্রিয়, সমানচিত্ত এবং লোকমধ্যে থাকবার যোগ্য হয়েও বিপক্ষগণের শঠতায় রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে নির্জন বনে গিয়েছিল। বৎস কেশব! ক্রোধহর্ষবিহীন, ব্রাহ্মণহিতৈষী, সত্যবাদী ও বনগমনের অযোগ্য মহাত্মা পাণ্ডবেরা প্রিয় বস্তু ও রোদনপ্রবণতায় আমাকে পরিত্যাগ করে বনে গমন করবার সময়ে গ্রন্থির সঙ্গে আমার হৃদয় আকর্ষণ করেছিল; পরে তারা সিংহ, ব্যাঘ্র ও হস্তীগণে পরিপূর্ণ মহাবনে কীভাবে ছিল? পাণ্ডবেরা বাল্যকালেই পিতৃহীন হয়েছিল, কিন্তু তখন আমিই তাদের লালনপালন করেছিলাম। সুতরাং তারা পিতা ও মাতা দুজনকেই না দেখে কী করে মহাবনে বাস করল? কৃষ্ণ! পাণ্ডবেরা বাল্যকাল থেকে শঙ্খ, দুন্দুভি, মৃদঙ্গ ও বংশীর শব্দে জাগরিত হত। সুতরাং জনার্দন, যারা পূর্বে আপন গৃহে অট্টালিকার ভিতরে মৃগচর্মময় কোমল শয্যায় শয়ন করে হস্তী, অশ্ব ও রথের শব্দে এবং ব্রাহ্মণদের মাঙ্গলিক আশীর্বাদে বিশেষত আদরযোগ্য ও আদৃত বৈতালিকগণের স্তুতিবাদে অভিনন্দিত হয়ে জাগরিত হত এবং পরে রত্ন, বস্ত্র, অলংকারদ্বারা ব্রাহ্মণগণের পূজা করত, তারা মহাবন মধ্যে হিংস্র জন্তুগণের নিষ্ঠুর শব্দ শুনে নিশ্চয়ই নিদ্রা যায়নি। কারণ তারা তো সেই ধরনের শব্দ শোনায় অভ্যস্ত ছিল না। মধুসূদন, যারা মধুর গীতে জাগ্রত হত, তারা কীভাবে হিংস্র জন্তগণের বিকট শব্দে জাগ্রত হয়েছে?”

“কৃষ্ণ, যিনি লজ্জাশীল, যথার্থ ধৈর্যশালী, জিতেন্দ্রিয়, প্রাণীগণের প্রতি দয়ালু এবং কাম ও দ্বেষ জয় করে সজ্জনপদ্ধতির অনুসরণ করে থাকেন; যিনি অম্বরিয, মান্ধাতা, যযাতি, নহুষ, ভরত, দিলীপ, উশীনরপুত্র শিবি ও অন্যান্য প্রাচীন রাজর্ষিগণের দুর্বহ ভার বহন করার যোগ্য; আর যিনি সৎস্বভাব ও সদাচারসম্পন্ন, ধর্মজ্ঞ ও সত্যপ্রতিজ্ঞ, যিনি সর্বগুণসম্পন্ন, শত্রুবিহীন, ধার্মিক, নির্মল স্বর্ণকান্তি এবং ত্রিভুবনের রাজা হবার যোগ্য; যিনি ধর্মে, শাস্ত্রজ্ঞানে, আচারে সকল কৌরবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সেই প্রিয়দর্শন ও দীর্ঘবাহু যুধিষ্ঠির কেমন আছেন?

“কৃষ্ণ, যে পাণ্ডুনন্দন দশ সহস্র হস্তীর সমান বলশালী, বায়ুর তুল্য বেগবান, মহাবল, কোপনস্বভাব এবং সর্বদাই ভ্রাতৃগণের প্রিয় ও প্রিয়কারী যে বীর জ্ঞাতিবর্গের সঙ্গে কীচক, ক্রোধবশ, হিড়িম্ব ও বকরাক্ষসকে বধ করেছেন, যিনি পরাক্রমে ইন্দ্রের তুল্য, বলে বায়ুর সমান, ক্রোধে রুদ্রের তুল্য এবং ভয়ংকর মূর্তি ও বীরশ্রেষ্ঠ; যে পরন্তপ, জিতেন্দ্রিয় ও অসহিষ্ণু পাণ্ডুনন্দন, ক্রোধ, শক্তি ও অসহিষ্ণুতা পরিত্যাগ করে জ্যেষ্ঠভ্রাতার শাসনে অবস্থান করেন; বৃষ্টিনন্দন, সেই মহাত্মা, অসাধারণ তেজা, বীরশ্রেষ্ঠ ও ভয়ংকর মূর্তি ভীমসেনের বিষয়ে তুমি আমার কাছে বলো। পরিঘের ন্যায় বিশালবাহু ও বলবান মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন এখন কেমন আছেন?

“কৃষ্ণ, যে অর্জুন দ্বিবাহু হয়েও সহস্র বাহুশালী ও অতীত কার্তবীর্যার্জুনের সমান; যিনি তেজে সূর্যের তুল্য, ইন্দ্রিয়দমনে মহর্ষির সমান, ক্ষমায় পৃথিবীর তুল্য এবং বিক্রমে ইন্দ্রের সমকক্ষ; কৃষ্ণ, যিনি বাহুবলে সকল রাজার সমক্ষে কৌরবগণের বিশাল, উজ্জ্বল ও প্রসিদ্ধ রাজ্য বর্ধিত করেছেন; অপর পাণ্ডব সকলেরা যাঁর বাহুবল অবলম্বন করে রয়েছেন, যিনি সকল রথীর শ্রেষ্ঠ ও যথার্থ বিক্রমশালী; কৃষ্ণ, যুদ্ধে যাঁর সম্মুখে গিয়ে কোনও লোকই জীবিত অবস্থায় ফিরতে পারে না; যিনি সকলের বিজেতা, কিন্তু নিজে অজেয় বলে জিষ্ণু নামে অভিহিত, এবং ইন্দ্র যেমন দেবগণের প্রধান আশ্রয়, সেইমতো যিনি পাণ্ডবদের প্রধান আশ্রয়; তোমার ভ্রাতা ও সখা সেই অর্জুন এখন কেমন আছেন—

যোহপাশ্রয় পাণ্ডবানাং দেবানামিব বাসবঃ।

স তে ভ্রাতা সখা চৈব কথমদ্য ধনঞ্জয়ঃ ॥ উদ্‌যোগ : ৮৩ : ৩৪ ॥

“কৃষ্ণ, যিনি সর্বভূতে দয়ালু, লজ্জাশীল, মহাস্ত্রবিৎ, কোমলস্বভাব, কোমলমূর্তি, ধার্মিক, মহাধনুর্ধর, বীর, যুদ্ধশোভী, ভ্রাতৃগণের শুশ্রূষাকারী ধর্ম এবং অর্থ বিষয়ে নিপুণ, সেই যুবা সহদেব আমার বিশেষ প্রিয়। মধুসূদন, ভ্রাতারা সর্বদাই মহাত্মা ও মঙ্গলময় চরিত্র সহদেবের চরিত্রের প্রশংসা করে থাকেন। বৃষ্টিনন্দন, জ্যেষ্ঠানুবর্তী, বীর যুদ্ধনায়ক এবং আমার শুশ্রূষাকারী সেই মাদ্রীনন্দন সহদেবের মঙ্গল আমার কাছে তুমি বলো।

“কৃষ্ণ, যিনি কোমল ও সদৃশমূর্তি, অথচ বীর সকল ভ্রাতার প্রিয়, এমনকী বাইরের প্রাণস্বরূপ এবং বিচিত্রযুদ্ধকারী, মহাধনুর্ধর, মহাবল ও সুখে লালিতপালিত, আমার বৎস সেই নকুল কুশলে আছেন তো? মহাবাহু, যিনি সুখভোগের যোগ্য, কিন্তু দুঃখভোগের যোগ্য নন এবং কোমলমূর্তি অথচ মহারথ, আমি সেই নকুলকে আবার দেখতে পাব তো? বীর, যে আমি নিমেষকালও নকুলের বিচ্ছেদে ধৈর্যলাভ করিনি, সেই আমিই এখন জীবনধারণ করছি।

“জনার্দন, দ্রৌপদী মহাকুলসম্ভূতা, রূপবতী ও সর্বগুণসম্পন্না! সুতরাং, তিনি আমার সকল পুত্র অপেক্ষা প্রিয়তরা। সত্যবাদিনী দ্রৌপদী পুত্রলোক ছেড়ে পতিলোক পাবার জন্য প্রিয় পুত্রগণকে পরিত্যাগ করে পতিগণের অনুগমন করেছিলেন। কৃষ্ণ, আমি সকল প্রকার অভীষ্ট বস্তু দান করে যাঁর আদর করতাম সেই মহাকুলসম্ভূতা ও সর্বকল্যাণ রাজ্ঞী দ্রৌপদী কেমন আছেন? হায়! মহাবীর, মহাধনুর্ধর, মহাযোদ্ধা ও অগ্নিতুল্য পঞ্চপতি লাভ করেও দ্রৌপদী দুঃখভাগিনী হলেন। কৃষ্ণ, আমি এই চতুর্দশ বৎসর যাবৎ পুত্র বিরহসন্তপ্তা সত্যবাদিনী দ্রৌপদীকে যে দেখতে পাইনি। মানুষ নিশ্চয়ই ধর্মকর্ম দ্বারা সুখভোগ করে না। যেহেতু দ্রৌপদী সেরূপ চরিত্রবতী হয়েও স্থায়ী সুখভোগ করছেন না। যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল বা সহদেবও দ্রৌপদী থেকে আমার প্রিয় নয়। সুতরাং সেই আমি দ্রৌপদীকে যে সভাগত অবস্থায় দেখেছিলাম, তার থেকে অধিক কোনও দুঃখ আমার আর পূর্বে হয়নি। ক্রোধী ও লোভী দুষ্ট দুর্যোধন দুঃশাসন দ্বারা রজস্বলা ও কবস্ত্রা দ্রৌপদীকে শ্বশুরগণের কাছে সভায় নিয়ে গিয়েছিল, তা যে কৌরবেরা সকলেই দেখেছিলেন। এবং তখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র, বাহ্লিক, কৃপাচার্য, সোমদত্ত ও অন্যান্য কৌরবেরা প্রতিকারহীন অশক্ত অবস্থায় দেখেছিলেন। তবে সেই সভায় সকলের মধ্যে আমি বিদুরকে প্রশংসা করি। মানুষ ব্যবহার দ্বারা সজ্জন হয়, কিন্তু ধন বা বিদ্যা দ্বারা নয়। কৃষ্ণ, অগাধ বুদ্ধি, গম্ভীরস্বভাব ও উদারচেতা বিদুরের অলংকারস্বরূপ স্বভাবটি ত্রিভুবনেই বিখ্যাত হয়ে পড়েছে।” পূর্বের কথা স্মরণমাত্রই কুন্তী নানাবিধ দুঃখের কথা বলতে লাগলেন, “অরিন্দম কৃষ্ণ, প্রাচীন, নিকৃষ্ট রাজারা সেই যে পাশক্রীড়া ও মৃগয়া প্রভৃতি করে গিয়েছেন, তা কি তাদের সুখজনক হয়েছিল? যাতে মঙ্গল না হয় সেইভাবে ধার্তরাষ্ট্রেরা সভার মধ্যে কৌরবগণের কাছে দ্রৌপদীকে যে কষ্ট দিয়েছিল, তাই আমাকে চিরকাল দগ্ধ করছে। জনার্দন, নগর থেকে পাণ্ডবদের নির্বাসন ও প্রব্রজ্যা বিরাট রাজধানীতে অজ্ঞাতবাস ও অবরুদ্ধ অবস্থা, পুত্রদের সেইসব গুরুতর কষ্ট আমি দীর্ঘকাল সহ্য করেছি। দুর্যোধন পাণ্ডবদের যে প্রতারিত করেছে, তার চোদ্দো বছর চলছে। সুতরাং, আমাদের যদি পুণ্যফল ক্ষয় না হয়ে থাকে, তবে দুঃখের পর সুখও হতে পারে। পাণ্ডব ও ধার্তরাষ্ট্রদের মধ্যে কখনও আমার স্নেহের কোনও তারতম্য ছিল না। সেই সত্যবশতই আমি পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমাকে এই যুদ্ধ থেকে অক্ষত অবস্থায় বিমুক্ত এবং হতশত্রু ও রাজলক্ষ্মীযুক্ত অবস্থায় দেখব। কারণ ধার্তরাষ্ট্রেরা পাণ্ডবগণকে পরাজিত করতে পারবে না; যেহেতু পাণ্ডবগণের সমস্ত সম্বলই একইরকম আছে। আমি নিজেকে বা দুর্যোধনকে নিন্দা করি না, কিন্তু পিতাকেই নিন্দা করি। আমি যখন বাল্যকালে গুটি হাতে নিয়ে খেলা করতাম, সেই অবস্থাতেই তোমার পিতামহ আমাকে তাঁর সখা মহাত্মা কুন্তীভোজ রাজার হাতে দান করেছিলেন। পিতা আমাকে বঞ্চনা করেছেন, ভাশুরও (ধৃতরাষ্ট্র) আমাকে প্রতারণা করেছেন। সুতরাং, আমি অত্যন্ত দুঃখিতা, আমার বেঁচে থাকার ফল কী? তবে অর্জুনের জন্মের দিন রাত্রিতে দৈববাণী আমাকে বলেছিল যে, ‘তোমার এই পুত্র পৃথিবী জয় করবে এবং এর যশ স্বর্গও স্পর্শ করবে। আর এই অর্জুন মহাযুদ্ধে কৌরবগণকে সংহার করে রাজ্যলাভ করে ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনটি মহাযজ্ঞ করবেন।’ আমি সেই দৈববাণীর বক্তা দেবগণের উপর দোষারোপ করি না; বরং ধর্মস্বরূপ, বিশ্বস্রষ্টা ও সর্বব্যাপী নারায়ণকে নমস্কারই করি। ধর্মই সর্বদা লোকদের রক্ষা করেন। আমি বিশ্বাস করি, সেই ধর্ম যদি থাকেন, তবে সেই দৈববাণী যেরূপ বলেছিল, সেইভাবে তুমিও সে সমস্তই সম্পাদন করবে। বৈধব্য, অর্থনাশ ও জ্ঞাতিদের সঙ্গে শত্রুতা আমাকে সেরূপ সন্তপ্ত করে না, পুত্রদের বিরহ যেভাবে সন্তপ্ত করছে। সর্বাস্ত্রধারী-শ্রেষ্ঠ গাণ্ডিবধন্বা অর্জুনকে না দেখে, আমার মনে শান্তি নেই। চোদ্দো বছর যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেবকে না দেখে আমার মনে শান্তি নেই। মানুষ মৃত ব্যক্তিদের শ্রাদ্ধ করে। বাস্তবিক পক্ষে তারাও আমার কাছে মৃত, আমিই তাদের কাছে মৃত। তুমি মহাত্মা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বোলো যে, তোমার গুরুতর ধর্ম নষ্ট হচ্ছে, অতএব পুত্র, স্বধর্মকে নষ্ট কোরো না। যে নারী, পরের আশ্রয়ে জীবনযাপন করে, তাকে আমি ধিক্কার দিই, অনুনয়লব্ধ জীবন না থাকাই ভাল।

“অতএব তুমি অর্জুনকে এবং সর্বদা উদ্‌যোগী ভীমসেনকে বোলো, ক্ষত্রিয় রমণী যে জন্য পুত্র প্রসব করে, এই তার সময় এসেছে। তোমরা থাকতেই যদি এই উপস্থিত সময় নিষ্ফলে অতীত হয়, তা হলে তোমরা লোকসম্মানিত সাধু হয়ে অতি নিষ্ঠুর কার্য করবে। বৎসগণ, তোমরা ভোজ্যলাভের জন্য অনুনয়-বিনয় করলে, আমি তোমাদের চিরকালের জন্য ত্যাগ করব। কারণ, সময় উপস্থিত হলে, জীবনও ত্যাগ করা উচিত। সর্বদা ক্ষত্রিয়ধর্মে নিরত নকুল ও সহদেবকে বলবে যে, তোমরা জীবন ত্যাগের উপক্রম করেও বিক্রমার্জিত ভোগ বরণ করো। কারণ, পুরুষোত্তম! বিক্রমলব্ধ বস্তুসকল ক্ষত্রিয় ধর্মাবলম্বী লোকের মনকে সর্বদাই আনন্দিত করে।”

কৃষ্ণ বললেন, “পিসিমা! আপনার মতো নারী জগতে কে আছেন? আপনি রাজা শূরের তনয়া এবং আজমীঢ়বংশে এসেছেন। হংসী যেমন এক হ্রদ থেকে অন্য হ্রদে আগমন করে, আপনিও তেমন এক মহাকুলে জন্মে অপর মহাকুলে এসেছেন, এবং রাজ্ঞী, সকল প্রকার মঙ্গলভাগিনী ও স্বামীর পরম আদরের পাত্রী হয়েছেন। আপনি বীরের পত্নী হয়েছেন, বীরপুত্র প্রসব করেছেন এবং সর্বগুণসম্পন্ন হয়েছেন। সুতরাং আপনার মতো মহাপ্রাজ্ঞা নারীর সুখ ও দুঃখ উভয়েই সহ্য করতে পারেন। ওদিকে পাণ্ডবেরাও নিদ্রা ও তন্দ্রা, ক্রোধ ও হর্ষ, ক্ষুধা ও পিপাসা এবং হিম ও আতপ সহ্য করে সর্বদা বীরের সুখে নিরত আছেন। আর বীরসুখপ্রিয় পাণ্ডবেরা সর্বদাই গ্রাম্য সুখ ত্যাগ করেছেন এবং মহোৎসাহী পাণ্ডবরা অল্পেতেও সন্তুষ্ট হবেন না। বুদ্ধিমান লোকেরা সুখ ও দুঃখের পরাকাষ্ঠার সেবাই করেন বলে গুরুতর ক্লেশ ও অলৌকিক সুখভোগ করেন এবং গ্রাম্য সুখপ্রিয় লোকেরা মাধ্যমিক সুখ ও দুঃখ ভোগ করে থাকে। প্রাচীন জ্ঞানীরা কষ্ট ও ভোগের চরম অবস্থাতেই নিরত হতেন, কিন্তু তারা মাধ্যমিক অবস্থাতেও নিরত হতেন না, কারণ মুনিরা বলেন যে, কষ্ট ও ভোগের চরম অবস্থাপ্রাপ্তিই সুখ এবং তার মধ্যম অবস্থায় দুঃখ। সে যাই হোক, দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবেরা আপনাকে প্রণাম করে আপনার কুশল অবস্থা জানতে চেয়েছেন এবং সর্বকুশলতার প্রার্থনাও করেছেন। আপনি অতিদ্রুত পাণ্ডবগণকে নীরোগ, সর্ববিষয়ে কৃতকার্য, হতশত্রু, রাজলক্ষ্মীবৃত এবং সমস্ত জগতের অধীশ্বর দেখতে পাবেন।”

কৃষ্ণ এইভাবে আশ্বস্ত করলে মনের কষ্ট ও মোহ দূর করে কুন্তী বললেন, “মহাবাহু মধুসূদন, পাণ্ডবগণের হিতকর, মঙ্গলজনক কার্য ধর্মের হানি না করে তুমি করবে। পরন্তপ কৃষ্ণ, তোমার সত্যপরায়ণতা, বংশমর্যাদার প্রসিদ্ধি আমি জানি। মিত্রের কার্য, কার্যের ব্যবস্থা, বুদ্ধি ও বিক্রমের বিষয়ে তোমার প্রভাব আমি জানি। তোমার উপাসনাই আমাদের বংশের ধর্ম, তুমিই সত্য, তুমি মহা তপস্যা। তুমি রক্ষক, তুমিই মহাব্রহ্ম এবং তোমাতেই সমস্ত রয়েছে। তুমিই পাণ্ডব-কৌরবগণের গতি, সমস্ত জগৎই তোমাকে প্রার্থনা করে।”

মহাবাহু কৃষ্ণ কুন্তীর অনুমতি নিয়ে, তাঁকে প্রদক্ষিণ করে দুর্যোধনের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।

কৌরবসভায় কৃষ্ণের শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হল। দুর্যোধন প্রমুখ দুষ্ট চতুষ্টয় কৃষ্ণকে বন্দি করার ষড়যন্ত্র করল। কৃষ্ণ ঘোরমূর্তি ধারণ করলেন। সভাস্থ সকলে ভয়ে চোখ বুজলেন। কৃষ্ণ সাধারণ রূপ গ্রহণ করে ঋষিদের অনুমতি নিয়ে সাত্যকি ও বিদুরের হাত ধরে সভা থেকে বেরিয়ে এলেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে ফিরে যাবার পূর্বে কুন্তীকে প্রণাম করে কৃষ্ণ তাঁকে কৌরসভার সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন।

কুন্তী বললেন, “কেশব, তুমি যুধিষ্ঠিরকে আমার এই কথা বলল। ‘পুত্র, তুমি মন্দমতি শ্রোত্রীয় ব্রাহ্মণের মতো কেবল ধর্মেরই চিন্তা করছ। ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা নির্দিষ্ট করেছেন তুমি তার দিকে মন দাও। তিনি তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের সৃষ্টি করেছেন। সেইজন্যে বাহুবলই ক্ষত্রিয়গণের উপজীব্য। সর্বদা নির্দয় কর্মে নিযুক্ত থেকে তাঁদের প্রজাপালন করতে হয়। রাজা যদি উপযুক্ত রূপে দণ্ডনীতি প্রয়োগ করেন তবেই চার বর্ণের লোক স্বধর্মপালন করেন। এমন মনে কোরো না যে কালপ্রভাবেই রাজার দোষগুণ হয়। রাজার সমস্ত কর্ম অনুসারেই সত্য ত্রেতা দ্বাপর বা কলিযুগ উৎপন্ন হয়। তুমি পিতৃ-পিতামহের রাজধর্মের পালন করো, তুমি যে ধর্ম আশ্রয় করতে চাইছ তা রাজর্ষিদের ধর্ম নয়। দুর্বল বা অহিংসাপরায়ণ রাজা প্রজাপালন করতে পারে না। আমি সর্বদা এই আশীর্বাদ করছি যে তুমি যজ্ঞ, দান ও তপস্যা করো, শৌর্য, প্রজা, বংশ বল ও তেজ লাভ করো। মহাবাহু, সাম দান, ভেদ বা দণ্ডনীতির দ্বারা তোমার পৈতৃক রাজ্যাংশ উদ্ধার করো। তোমার জননী হয়েও আমাকে পরদত্ত অন্নপিণ্ডের প্রত্যাশায় থাকতে হয় এর চেয়ে দুঃখ আর কী আছে? কৃষ্ণ, আমি বিদুলা ও তার পুত্রের কথা বলছি, তুমি যুধিষ্ঠিরকে শুনিয়ো৷”

“বিদুলা নামে এক যশস্বিনী তেজস্বিনী ক্ষত্রিয় নারী ছিলেন। তাঁর পুত্র সঞ্জয় সিন্ধুরাজ কর্তৃক পরাজিত হয়ে দুঃখিত মনে শুয়ে আছেন দেখে বিদুলা বললেন, তুমি আমার পুত্র নও, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তুমি ক্রোধহীন ক্লীবতুল্য, তুমি যাবজ্জীবন নিরাশ হয়ে থাকতে চাও। নিজেকে অবজ্ঞা কোরো না, অল্পে তুষ্ট হোয়ো না, নির্ভীক ও উৎসাহী হও। রে ক্লীব, তোমার সকল কীর্তি নষ্ট হয়েছে, রাজ্য পরহস্তগত হয়েছে, তবে বেঁচে আছ কেন? লোকে যার মহৎ চরিত্রের আলোচনা করে না সে পুরুষ নয়, স্ত্রীও নয়, সে কেবল মানুষের সংখ্যা বাড়ায়। যার দান শৌর্য তপস্যা বিদ্যা বা অর্থের খ্যাতি নেই সে তার মাতার বিষ্ঠা মাত্র। পুত্র নির্বাপিত অগ্নির ন্যায় কেবল ধূমায়িত হোয়য়া না, মুহূর্তকালের জন্য জ্বলে ওঠো, শত্রুকে আক্রমণ করো।

“বিদুলার পুত্র সঞ্জয় বললেন, আমি যদি যুদ্ধে মরি তবে সমস্ত পৃথিবী পেয়েও আপনার কী লাভ হবে। অলংকার, সুখভোগ বা জীবনেই বা কী হবে? বিদুলা বললেন, যিনি নিজের বাহুবল আশ্রয় করে জীবনধারণ করেন তিনিই কীর্তি ও পরলোকে সদ্‌গতি লাভ করেন। সিন্ধুরাজের প্রজারা সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু তারা মূঢ় ও দুর্বল, তাই রাজার বিপদের প্রতীক্ষায় নিশ্চেষ্ট হয়ে আছে। তুমি যদি নিজের পৌরুষ দেখাও তবে অন্য রাজারা সিন্ধুরাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন। তাঁদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তুমি গিরিদুর্গ থেকে সুযোগের প্রতীক্ষা করো, সিন্ধুরাজ অজেয় অমর নন। যুদ্ধের ফলে তোমার সমৃদ্ধিলাভ হবে কিংবা ক্ষতি হবে তার বিচার না করেই যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। আমি মহাকুলে জন্মগ্রহণ করে তোমাদের মহাকুলে এসেছি, আমি রাজ্যের অধীশ্বরী মঙ্গলময়ী ও পতির আদরিণী ছিলাম। সঞ্জয়, আমাকে আর তোমার পত্নীকে যদি দীনদশাগ্রস্ত দেখ তবে তোমার জীবনে প্রয়োজন কী? শত্রুদের বশে আনতে পারলে ক্ষত্রিয় যে-সুখ লাভ করেন সে-সুখ ইন্দ্রভবনেও নেই। যুদ্ধে প্রাণবিসর্জন অথবা শত্রুর বিনাশ—এ ছাড়া ক্ষত্রিয়ের শান্তিলাভ হতে পারে না।

“সঞ্জয় বললেন, আপনি আমার প্রতি নিষ্ঠুর, আপনার হৃদয় কৃষ্ণলৌহ দ্বারা নির্মিত। আমার ধন নেই, সহায়ও নেই, কী করে জয়লাভ করব? এই দারুণ অবস্থা জেনেই আমার রাজ্যোদ্ধারের ইচ্ছা নিবৃত্ত হয়েছে। আপনি পরিণত বুদ্ধি, যদি কোনও উপায় জানেন তো বলুন, আমি সর্বতোভাবে আপনার আদেশ পালন করব। বিদুলা বললেন, তুমি পর্বে েয বীরত্ব দেখিয়েছ তা আবার দেখাও, তা হলেই রাজ্য উদ্ধার করতে পারবে। যারা সিন্ধুরাজের উপর ক্রুদ্ধ, যাদের তিনি শক্তিহীন করেছেন, অপমানিত করেছেন, যারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করতে চায়, তাদের সঙ্গে মিত্ৰতা করো। তুমি জানো না, আমাদের রাজকোষে অনেক ধন আছে। তোমার অনেক সুহৃদও আছেন, যাঁরা সুখ-দুঃখ সইতে পারেন এবং যুদ্ধ থেকে পালান না।

“বিদুলার কথায় সঞ্জয়ের মোহ দূর হল, তিনি বাক্যবাণে তাড়িত হয়ে জননীর উপদেশে যুদ্ধের উদ্‌যোগ করলেন এবং জয়ী হলেন। কোনও রাজা শত্রুর পীড়নে অবসন্ন হলে তাঁকে তাঁর মন্ত্রী এই উৎসাহজনক তেজোবর্ধক উপাখ্যান শোনালেন, বিজয়েচ্ছ রাজা ‘জয়’ নাম এই ইতিহাস শুনবেন। গর্ভিণী এই উপাখ্যান বার বার শুনলে বীরপ্রসবিনী হন।”

কুন্তী-কর্ণ সংবাদ।

কৃষ্ণ চলে গেলে বিদুরের মুখে কুন্তী শুনলেন, যুদ্ধ অনিবার্য। জ্ঞাতি, বন্ধু, আত্মীয়বর্গ মধ্যে ভয়ংকর বংশ বিনাশক যুদ্ধ আরম্ভ হবে। কুন্তীদেবী হিতৈষী বিদুরের সেই কথা শুনে দুঃখিত হয়ে নিশ্বাস ত্যাগ করে মনে মনে আলোচনা করতে লাগলেন—“যার জন্য এই যুদ্ধে জ্ঞাতিবধ করা হবে এবং বন্ধুবর্গের পরাভব ঘটবে, আমি সেই অর্থের প্রতি ধিক্কার করি! হায়! পাণ্ডবগণ, চেদিগণ, পাঞ্চালগণ ও যাদবগণ সম্মিলিত হয়ে কৌরবগণের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন, এর থেকে অধিক দুঃখ আর কী আছে? আমি যুদ্ধ হলেও দোষ দেখতে পাই, আবার যুদ্ধ না হলেও পাণ্ডবদের ক্ষতি দেখতে পাই। সুতরাং নির্ধনের বরং মরণ ভাল, কিন্তু জ্ঞাতিনাশক জয় ভাল নয়। এই চিন্তা আমার মধ্যে অত্যন্ত দুঃখ এনে দিয়েছে। মহাযোদ্ধা শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ ও কর্ণ এই তিনজনেই দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবেন বলে আমার ভয় আরও বাড়ছে। তাঁদের মধ্যে শিষ্য-হিতৈষী দ্রোণাচার্য কখনও শিষ্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না। পিতামহ ভীষ্ম তাঁর পৌত্রদের সম্পর্কে স্নেহ ত্যাগ করতে পারবেন না, কিন্তু ভ্রান্তদর্শী পাপমতি একমাত্র কর্ণই দুর্মতি দুর্যোধনের মোহানুবর্তী হয়ে সর্বদা পাণ্ডবদের প্রতি বিদ্বেষ করে। কর্ণ সর্বদাই পাণ্ডবগণের গুরুতর অনর্থের জন্য, অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে, আর সে অত্যন্ত বলবান। তাই কর্ণই এখন আমার উদ্‌বেগ জন্মায়। অতএব আজ আমি কর্ণের কাছে গিয়ে তার মনটাকে পাণ্ডবগণের প্রতি প্রসন্ন করবার চেষ্টা করে তাতে সমর্থ হব বলে আশা করি।

“আমি যখন পিতৃভবনে বাস করলাম, তখন পরিচর্যা করে ভগবান দুর্বাসাকে সন্তুষ্ট করেছিলাম; তাতে তিনি আমাকে একটি বর দিয়েছিলেন যে, ‘তুমি এই মন্ত্রদ্বারা যে দেবতাকে আহ্বান করবে তিনিই আসবেন। তারপরে কুন্তিভোজ রাজা আমাকে আদর করে অন্তঃপুরে রাখলেন, আমিও সন্দেহাকুল চিত্তে নানাবিধ চিন্তা করতে লাগলাম। ক্রমে স্ত্রীস্বভাব ও বালক স্বভাববশত আমি সেই মন্ত্রের বলাবল ও দুর্বাসার বাক্যের বল পরীক্ষা করবার জন্য বারবার তার উপায় চিন্তা করলাম। তখন একজন বিশ্বস্ত ধাত্রী আমাকে রক্ষা করত এবং সখীরা আমাকে পরিবেষ্টন করে থাকত; আমিও সর্বপ্রকার দোষ পরিত্যাগ করে চলতাম এবং পিতার কাছে সচ্চরিত্র জানাতাম। অথচ তখন ভাবলাম—কী করে আমার দেবাতাহ্বান সুসম্পন্ন হবে, কী করেই বা আমি অপরাধিনী না হয়ে পারব—এইসব ভেবে সেই দুর্বাসাকে নমস্কার করে কৌতুক ও মূর্খতাবশত সেই লব্ধ মন্ত্র দ্বারা তখনই সূর্যদেবকে আহ্বান করলাম। তারপর আমি কন্যা হয়েও সূর্যদেবকে পেলাম এবং তাঁর সঙ্গে সংসর্গ করলাম। তখন কন্যাকালে আমার যে গর্ভ হয়েছিল এবং যাকে আমি পুত্রের মতো দশমাস উদরে রক্ষা করেছি, সেই কর্ণ এখন নিজের হিতকর ও ভ্রাতৃগণের হিতজনক বাক্য কেন রক্ষা করবে না?”

কুন্তীদেবী এভাবে উত্তমরূপে কর্তব্য স্থির করে আশার উপরে নির্ভর রেখে, কর্তব্য সম্পাদনের জন্য গঙ্গার দিকে গমন করতে লাগলেন। তারপরে কুন্তীদেবী গঙ্গাতীরে সেই দয়ালু ও সত্যপরায়ণ পুত্রের বেদপাঠধ্বনি শুনতে পেলেন। কর্ণ তখন পূর্বমুখ ও উর্ধ্ববাহু হয়ে’ জপ করছিলেন; সেই সময়ে কুন্তীদেবী আপন কর্তব্য সম্পাদনের জন্য উপস্থিত হয়ে কর্ণের জপসমাপ্তির প্রতীক্ষা করে তার পিছনে দীনভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বৃষ্ণিবংশে উৎপন্না ও কুরুবংশীয় পাণ্ডুর পত্নী কুন্তী তখন সূর্যের তাপে পীড়িত এবং পদ্মমালার মতো শুষ্ক হতে থেকে কর্ণের উত্তরীয়বস্ত্রের কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুকাল পরে কর্ণ, নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত জপ করে পিছনে ফিরে কুন্তীকে দেখে অভিবাদন করে কৃতাঞ্জলি হয়ে দাঁড়ালেন। তারপরে মহাতেজা, অভিমানী ও ধার্মিকশ্রেষ্ঠ সূর্যনন্দন বিস্মিত ও অবনত হয়ে ন্যায় অনুসারে সবিনয়ে কুন্তীকে বললেন, “রাধার গর্ভজাত অধিরথের পুত্র আমি কর্ণ আপনাকে অভিবাদন করছি; আপনি কী জন্যে এসেছেন? বলুন, আমি আপনার কী করব?”

কুন্তী বললেন, “তুমি কুন্তীর গর্ভজাত, রাধার গর্ভজাত নও, কিংবা অধিরথও তোমার পিতা নন এবং তুমি সারথির বংশেও জন্ম গ্রহণ করোনি। কর্ণ! তুমি সেই বৃত্তান্ত আমার কাছ থেকে অবগত হও। পুত্র, তুমি কুন্তিভোজ রাজার গৃহে আমার কন্যা অবস্থায় জন্মেছিলে। আমি তোমাকে প্রথমে গর্ভে ধারণ করেছিলাম। সুতরাং তুমি পার্থই বটে। এই যিনি জগৎপ্রকাশ করেন ও তাপ দান করেন, সেই সূর্যদেবই তোমাকে আমার গর্ভে উৎপাদন করেছিলেন। এখন তুমি অস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ হয়েছ। পুত্র! দুর্ধর্ষ! তুমি কবচকুণ্ডল ধারণ করে এবং দেবশিশুর শোভায় শোভিত হয়ে আমার পিতার গৃহে জন্মেছিলে। পুত্র, সেই তুমি ভ্রাতৃগণকে না চিনে মোহবশত ধার্তরাষ্ট্রদের যে সেবা করছ, তা তোমার পক্ষে কোনও মতেই সংগত হচ্ছে না। পুত্র, পিতৃলোক ও স্নেহময়ী মাতা যে সন্তুষ্ট থাকেন, তাই মানুষের পক্ষে ধর্ম, ধর্মশাস্ত্র তাই বলে।

“বৎস, পূর্বে অর্জুন অর্জন করেছিলেন, পরে অসাধু ধার্তরাষ্ট্রেরা লোভবশত হরণ করেছে, এখন তুমি আবার বলপূর্বক তাদের কাছ থেকে নিয়ে এসে যুধিষ্ঠির-গামিনী রাজ্যসমৃদ্ধি ভোগ করো। আজ কৌরবেরা দেখুক যে, ভ্রাতৃসৌহার্দ্যবশত কর্ণ ও অর্জুন মিলিত হয়েছেন এবং তা দেখে দুর্জনেরা অবনত হয়ে পড়ুক। রাম ও কৃষ্ণের মতো আজ কর্ণ ও অর্জুন মিলিত হোন। বৎস, তোমরা দুজন মিলিত হলে, জগতে তোমাদের কী অসাধ্য থাকে? কর্ণ, তুমি পঞ্চভ্রাতা কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে, মহাযজ্ঞবেদিতে দেবগণ বেষ্টিত ব্রহ্মার ন্যায় নিশ্চয়ই শোভা পাবে। বৎস, তুমি সর্বগুণসম্পন্ন এবং সর্বজ্যেষ্ঠ। সুতরাং শ্রেষ্ঠ বন্ধুগণের মধ্যে আর যেন তোমার উপরে ‘সূতপুত্র-শব্দ’ প্রয়োগ না হয়। কেন-না তুমি পৃথার পুত্র ও বলবান।” তারপর সূর্যমণ্ডল থেকে একটি বাক্য নির্গত হল। সে বাক্যটি সূর্যদেবই পিতার মতো বলেছিলেন এবং তা দুরতিক্ৰমণীয় এবং স্নেহসূচক ছিল; কর্ণ তা শুনলেন। ‘নরশ্রেষ্ঠ কর্ণ! কুন্তীদেবী সত্যই বলেছেন; তুমি সেই মাতৃবাক্য পালন করো; তুমি সেই বাক্য পালন করলে, তোমার সর্বপ্রকার মঙ্গল হবে।’

মাতা কুন্তী ও পিতা স্বয়ং সূর্যদেব একথা বললেও কর্ণের বুদ্ধি বিচলিত হল না।

কর্ণ বললেন, “ক্ষত্রিয়ে, আমি আপনার বাক্যের আদর করি না এবং আপনার আদেশ পালন করাও যে আমার ধর্মের কারণ হবে, তাও স্বীকার করি না। যেহেতু আপনি আমার উপর অত্যন্ত কষ্টজনক অন্যায় ব্যবহার করেছেন। জননী! আপনি আমাকে যে ত্যাগ করেছিলেন, তাই আমার যশ ও কীর্তি নষ্ট করেছে। আমি যদিও ক্ষত্রিয় হয়ে জন্মে থাকি, তবুও আপনার জন্যই ক্ষত্রিয়ের যোগ্য সংস্কার লাভ করিনি। অতএব শত্রু এর থেকে বেশি ক্ষতি আমার কী করবে? আপনি দয়া করবার সময়ে দয়া না করে—এখন সংস্কারের কাল অতীত হয়েছে, এখন দয়া করে আমাকে ধর্মে প্রেরণ করতে এসেছেন। আপনি পূর্বে মাতার ন্যায় আমার হিতসাধনের চেষ্টা করেননি। কিন্তু আজ সেই আপনি কেবল নিজের হিতের জন্যেই আমায় হিতের উপদেশ দিচ্ছেন। কোন লোক কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত অর্জুনকে ভয় না করে? অতএব আমি পাণ্ডবদের সভায় গেলে কোন লোক আমাকে ভীত বলে মনে না করবে? আমি পূর্বে পাণ্ডবদের ভ্রাতা বলে পরিচিত ছিলাম না, এখন যুদ্ধকালে ভ্রাতা বলে পরিচিত হয়ে যদি পাণ্ডবপক্ষে যাই, তবে ক্ষত্রিয়গণ আমাকে কী বলবেন? ধার্তরাষ্ট্রেরা আমার সুখ অনুসারে সর্বপ্রকার অভীষ্ট বস্তু বিভাগ আমাকে দিয়েছেন এবং আমার সম্মান করেছেন, এখন আমি তাঁদের সেই কার্যগুলিকে কী করে নিস্ফল করতে পারি? যাঁরা পরের সঙ্গে শত্রুতা ঘটিয়ে সর্বদা আমার আনুগত্য করেন এবং বসুগণ যেমন ইন্দ্রের কাছে অবনত থাকেন, সেই রকম যাঁরা সর্বদাই অবনত থাকেন, আর যাঁরা আমার শক্তির উপর নির্ভর করেই শত্রুদের সমক্ষে অবস্থান করবেন বলে আশা করেন, আমি আজ সেই ধার্তরাষ্ট্রদের সকল আশা কী করে ছিন্ন করব? যারা অকুল যুদ্ধসাগরের কুলে যাবার ইচ্ছা করে আমাকে ভেলা হিসাবে গ্রহণ করে সেই দুস্তর যুদ্ধসাগর উত্তীর্ণ হবার ইচ্ছা করছেন, আমি কী করে ত্যাগ করব তাঁদের? সে যাই হোক, ধার্তরাষ্ট্রদের উপজীবীদের এই প্রত্যুপকার করবার সময় উপস্থিত হয়েছে। সুতরাং, প্রাণের আশা ত্যাগ করেও আমি তার মধ্যে প্রবেশ করব।

“অনবস্থিতচিত্ত ও পাপিষ্ঠ সে সব লোক রাজার অনুগ্রহে পরিপুষ্ট ও কৃতার্থ হয়ে রাজার কার্যকাল উপস্থিত হলে সে দিকে দিকপাত না করে বিকৃত হয়ে যায়, সেই ভর্তৃ পিণ্ড অপহারী অকৃতজ্ঞ, রাজার বিষয়ে অন্যায্য কার্যকরী ও কৃতঘ্নদের ইহলোকও থাকে না, পরলোকও থাকে না। অতএব আমি আমার সমস্ত শক্তি ও শিক্ষানৈপুণ্য অবলম্বন করে এবং সৎ পুরুষোচিত দয়া ও চরিত্র রক্ষা করতে থেকে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের জন্য আপনার পুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করব; আমি আপনার কাছে একথা সত্য বলছি। সুতরাং আপনার সমস্ত বাক্য আমার হিতকারী হলেও এখন আমি তা আর রক্ষা করতে পারব না। তবে, আপনার এই উদ্যম আমার কাছে ব্যর্থ হবে না। কারণ, আপনার পুত্রদের মধ্যে এক অর্জুন ব্যতীত যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল ও সহদেব যুদ্ধে আমার কাছে বধ্য হলেও কিংবা তাদের বধ করতে পারলেও তা আমি করব না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সৈন্যের মধ্যে অর্জুনের সঙ্গে আমি প্রাণপণ যুদ্ধ করব। কারণ, আমি যুদ্ধে অর্জুনকে বধ করে যুদ্ধশিক্ষার ফল লাভ করব, কিংবা অর্জুনকর্তৃক নিহত হয়ে যশস্বী হব।

ন তে জাতু নশিষ্যন্তি পুত্রাঃ পৎচ যশস্বিনি।

নিবর্জন সাকর্ণা বা সার্জুনা বা হতে মখি ॥ উদযোগ : ১৬৩ : ২৩ ॥

“যশস্বিনী! জননী! মোটের উপর আপনার পঞ্চপুত্র কখনও নষ্ট হবে না। কারণ অর্জুন নিহত হলে আমাকে নিয়ে পাঁচ পুত্র থাকবে, কিংবা আমি নিহত হলে অর্জনকে নিয়ে পাঁচ পুত্র থাকবে।”

কর্ণের এই কথা শুনে কুন্তী দুঃখে কম্পিত হতে থেকে অত্যন্ত ধৈর্যশালী পুত্র কর্ণকে আলিঙ্গন করে বললেন, “কর্ণ, তুমি যা বললে, তাই হবে। এই যুদ্ধে কৌরবেরা ক্ষয় পাবেন। হায়! দৈবই প্রবল৷ বৎস শত্রুদমন, তুমি অর্জুন ভিন্ন অপর চার ভ্রাতার অভয় দান করেছ। অতএব প্রতিজ্ঞা করো যে, যুদ্ধে তাদের তুমি ছেড়ে দেবে।” কর্ণ মাথা নেড়ে তা স্বীকার করলেন। তারপর কী কর্ণকে বললেন, ‘বৎস! তুমি নীরোগ হয়ে থাকো এবং তোমার মঙ্গল হোক।” কর্ণও সন্তুষ্ট হয়ে কুন্তীকে অভিবাদন করলেন। তারপর তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে গেলেন।

কুন্তী কর্তৃক কর্ণের পরিচয় উদ্‌ঘাটন

[আঠারো দিনের যুদ্ধে কৌরববাহিনী সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হল। তাঁদের পক্ষে জীবিত রইলেন কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্মা। পাণ্ডব সেনাবাহিনী ধ্বংস হলেও তাঁদের প্রধান বীরেরা জীবিতই ছিলেন। কিন্তু সুপ্তিমগ্ন ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রকে নির্দয়ভাবে হত্যা করলেন অশ্বত্থামা। পাণ্ডবপক্ষে সাতজন মাত্র রথী—কৃষ্ণ, সাত্যকি ও পঞ্চপাণ্ডব অবশিষ্ট রইলেন। এই হল দ্বাপরযুগ সমাপ্তির সূচনা। কৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর দ্বাপর যুগ শেষ হবে। ইতিমধ্যে ক্ষত্রিয় পুরুষের অভাবে ক্ষত্রিয়-নারীরা ব্রাহ্মণ পুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান ধারণ করতে আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণের অন্তর্ধানের পর আর কোনও বাছবিচার রইল না। ক্ষত্রিয় রমণী—ব্রাহ্মণী বৈশ্য-শূদ্র নির্বিশেষে মিলিত হতে লাগলেন। ব্রাহ্মণের যজনযাজন পঠনপাঠন দান প্রতিগ্ৰহ বন্ধ হল। কলিযুগের সূচনা হল।]।

যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের দাহকার্য সম্পাদন করে, ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রবর্তী করে যুধিষ্ঠির গঙ্গার অভিমুখে গমন করলেন। যুধিষ্ঠির প্রভৃতি ধর্মজ্ঞ লোক শুভজনিকা, পবিত্রজলযুক্তা, আহ্লাদকারিণী, নির্মলা, বিশালা ও তীরদেশে বিশাল বনসমন্বিতা গঙ্গানদীতে এসে অলংকার উত্তরীয় বস্ত্র, উষ্ণীষ খুলে ফেলে পিতৃগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, জ্ঞাতিগণ, অন্যান্য। সজ্জনগণ ও সুহৃদগণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন এবং কৌরব স্ত্রীগণ অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রোদন করতে থেকে পতিদের উদ্দেশে তর্পণ করলেন। বীরপত্নীরা বীরগণের তর্পণ করতে থাকলে গঙ্গার জলে নামবার পথগুলিও প্রশস্ত হল এবং গঙ্গানদী যেন আরও বিস্তৃত হয়ে গেল। সেই সময়ে মহাসমুদ্রের তীরের মতো সেই গঙ্গাতীরটি আনন্দশূন্য এবং উৎসবরহিত হয়েও বীরপত্নীগণে ব্যাপ্ত হয়ে যাওয়ায় শোভা পেতে লাগল। তখন কুন্তীদেবী সহসা শোকে আকুল হয়ে রোদন করতে থেকে বাষ্পগদগদ বাক্যে পুত্রদের বললেন, “মহাধনুর্ধর রথসমূহ রক্ষকগণেরও রক্ষক ও বীর লক্ষণ লক্ষিত সেই যে বীরকে অর্জুন বধ করেছেন পাণ্ডবগণ, তোমরা যাঁকে সূতপুত্র ও রাধার গর্ভজাত বলে মনে করতে; যে প্রভাবশালী বীর সৈন্যমধ্যে সূর্যের মতো দীপ্তি পেতেন; যিনি পূর্বে অনুচরগণের সঙ্গে তোমাদের সকলের সঙ্গে প্রতিযুদ্ধ করতেন; যিনি দুর্যোধনের সমস্ত সৈন্য আকর্ষণ করতে থেকে প্রকাশ পেতেন; পৃথিবীর মধ্যে কোনও ব্যক্তি বলে যার সমান নেই এবং যে বীর পৃথিবীতে সর্বদাই প্রাণদ্বারাও যশ বরণ করে নিতেন; যুদ্ধে অপলায়ী, অনায়াসে কার্যকারী ও সত্যপ্রতিজ্ঞ তোমাদের ভ্রাতা সেই কর্ণের উদ্দেশেও তোমরা তর্পণ করো। কারণ, তিনি সূর্য থেকে আমার গর্ভে কুণ্ডল ও কবচধারী এবং সূর্যের তুল্য তেজস্বী হয়ে জন্মেছিলেন; সুতরাং তিনি তোমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন।” তখন পাণ্ডবেরা সকলে মাতা কুন্তীদেবীর সেই অপ্রিয় বাক্য শুনে কর্ণের উদ্দেশে শোক করতে লাগলেন এবং শোকে আরও গুরুতর পীড়িত হতে থাকলেন।

তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ ও বীর কুন্তীনন্দন যুধিষ্ঠির সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে মাতাকে বললেন, “অর্জুন ছাড়া কোনও ব্যক্তি যাঁর বাণের আঘাত সহ্য করে যুদ্ধে অবস্থান করতে পারতেন না, দেবতা থেকে উৎপন্ন সেই কর্ণ পূর্বে কী প্রকারে আপনার পুত্র হয়েছিলেন এবং সেই বীর কী প্রকারেই বা কুণ্ডল ও কবচধারী এবং সূর্যের মতো তেজস্বী অবস্থাতেই জন্মেছিলেন? দেবী! যাঁর বাহুর প্রতাপে আমরা সর্বপ্রকার তাপিত হতাম, বস্ত্রদ্বারা অগ্নির ন্যায় কেন আপনি তাকে ঢেকে রেখেছিলেন? আমরা যেমন অর্জুনের বাহুবলের উপাসনা করেছি, তেমনি ধার্তরাষ্ট্রেরা যাঁর বাহুবলের উপাসনা করতেন। কর্ণ ভিন্ন অন্য কোনওই বলিশ্রেষ্ঠ রথী-রথারোহী সমস্ত রাজার সৈন্য গ্রহণ করতে সমর্থ হতেন না।

“সর্বশস্ত্রধারীশ্রেষ্ঠ সেই কর্ণ আমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা ছিলেন? আপনি প্রথমে সেই অদ্ভুতবিক্রমশালী মহাপুরুষকে কীভাবে প্রসব করেছিলেন? হায়! আপনি এই বিষয় গোপন করায় আমরা নিহত হয়েছি। কর্ণের মৃত্যুতে বন্ধুদের সঙ্গে আমরা সকলেই শোকে পীড়িত হচ্ছি। অভিমন্যুর বিনাশ, দ্রৌপদীর পুত্রগণের বধ পাঞ্চালগণের সংহার এবং কৌরবদের বিধ্বংসে আমরা সকলেই অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করছি। কর্ণের মৃত্যু সে সব থেকে শতগুণ অধিক, এই দুঃখ আমাকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছে। হায়! কর্ণের জন্য শোক করতে থেকে আমি অগ্নিতে স্থাপিত লোকের মতো গুরুতর দগ্ধ হচ্ছি। আজ কর্ণ জীবিত থাকলে এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হতে পারলে, এই জগতে আমাদের কোনও বস্তুই অপ্রাপ্য হত না। এমনকী, স্বর্গের রাজত্বপদে থাকতে পারতাম এবং কুরুবংশের ধ্বংসকারী এই ভয়ংকর যুদ্ধও হত না।”

এইভাবে বহুতর বিলাপ করে প্রভাবশালী রাজা যুধিষ্ঠির উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে করতে কর্ণের উদ্দেশে তর্পণ করলেন। সেই তর্পণকার্যের সময়ে সকল দিকে যে সকল স্ত্রীলোক ছিলেন, তারা সকলেই উচ্চৈঃস্বরে রোদন করতে লাগল। তখন কুরুরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃসৌহার্দ্যবশত কর্ণের পরিচ্ছদগুলির সঙ্গে তাঁর স্ত্রীগণকে সেই স্থানে আনিয়ে নিলেন। পরে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির কর্ণের ভার্যাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, কর্ণের উদ্দেশে তর্পণ করে, শোকবিহ্বল চিত্তে গঙ্গা থেকে তীরে উঠলেন।

কর্ণবধ যুধিষ্ঠিরের মধ্যে তীব্র মনস্তাপ সৃষ্টি করেছিল। কর্ণের স্মৃতিজড়িত সেই গঙ্গাতীরেই তিনি অশৌচকাল অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত করেন। এই সময়ে পর্যায়ক্রমে রাজর্ষি মহর্ষি ও দেবর্ষিগণ সাক্ষাৎ ও কুশল কামনায় তার কাছে আসেন। একদিন দেবর্ষি নারদ তাঁকে দেখা দিলেন। যুধিষ্ঠির তার সমগ্র জীবন সৌজন্য ও গুরুজনদের মর্যাদা দান বিষয়ে বিখ্যাত ছিলেন। কর্ণবধ জনিত আক্ষেপ তাঁর চিরসঞ্চিত শ্রদ্ধাবোধকেও অতিক্রম করে গেল। তিনি দেবর্ষি নারদের কাছে মাতা কুন্তীর কর্ণ বিষয়ে সত্যগোপনের অভিযোগ তুললেন এবং কেন কর্ণ অভিশপ্ত হয়েছিলেন জানতে চাইলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে কর্ণ কর্তৃক দ্রোণাচার্যের ব্রহ্মাস্ত্র দানে অস্বীকৃতি, কর্ণের পরশুরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ, গুরুর-নিদ্রাকালে ‘অলর্ক’ নামের কৃমির কর্ণকে দংশন এবং পরিণতিতে পরশুরাম কর্তৃক কর্ণকে অভিসম্পাত, অনবধানতাবশত কর্মের ব্রাহ্মণের হোমধেনু হত্যা এবং ব্রাহ্মণ কর্তৃক অভিসম্পাত লাভ— তারও পূর্বে অর্জনের মঙ্গল করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক কর্ণের কবচকুণ্ডল হরণের বৃত্তান্ত জানান। নারদের মুখে এই সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বীর হলেও তৎকালে যুধিষ্ঠিরের চিত্ত শোকে কাতর ও পীড়িত হচ্ছিল এবং তাঁর নয়নযুগল থেকে অশ্রুজল পড়ছিল; আর তিনি অধোবদন হয়ে সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করছিলেন।

কর্ণবধ যুধিষ্ঠিরের মধ্যে তীব্র মনস্তাপ সৃষ্টি করেছিল। কর্ণের স্মৃতিজড়িত সেই গঙ্গাতীরেই তিনি অশৌচকাল অতিবাহিত করার সিদ্ধান্ত করেন। এই সময়ে পর্যায়ক্রমে রাজর্ষি মহর্ষি ও দেবর্ষিগণ সাক্ষাৎ ও কুশল কামনায় তার কাছে আসেন। একদিন দেবর্ষি নারদ তাঁকে দেখা দিলেন। যুধিষ্ঠির তার সমগ্র জীবন সৌজন্য ও গুরুজনদের মর্যাদা দান বিষয়ে বিখ্যাত ছিলেন। কর্ণবধ জনিত আক্ষেপ তাঁর চিরসঞ্চিত শ্রদ্ধাবোধকেও অতিক্রম করে গেল। তিনি দেবর্ষি নারদের কাছে মাতা কুন্তীর কর্ণ বিষয়ে সত্যগোপনের অভিযোগ তুললেন এবং কেন কর্ণ অভিশপ্ত হয়েছিলেন জানতে চাইলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে কর্ণ কর্তৃক দ্রোণাচার্যের ব্রহ্মাস্ত্র দানে অস্বীকৃতি, কর্ণের পরশুরামের শিষ্যত্ব গ্রহণ, গুরুর-নিদ্রাকালে ‘অলর্ক’ নামের কৃমির কর্ণকে দংশন এবং পরিণতিতে পরশুরাম কর্তৃক কর্ণকে অভিসম্পাত, অনবধানতাবশত কর্মের ব্রাহ্মণের হোমধেনু হত্যা এবং ব্রাহ্মণ কর্তৃক অভিসম্পাত লাভ— তারও পূর্বে অর্জনের মঙ্গল করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক কর্ণের কবচকুণ্ডল হরণের বৃত্তান্ত জানান। নারদের মুখে এই সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে বীর হলেও তৎকালে যুধিষ্ঠিরের চিত্ত শোকে কাতর ও পীড়িত হচ্ছিল এবং তাঁর নয়নযুগল থেকে অশ্রুজল পড়ছিল; আর তিনি অধোবদন হয়ে সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করছিলেন।

সেই সময়ে শোকাকুলা ও দুঃখিতচিত্তা মধুরভাষিণী কুন্তী যুধিষ্ঠিরের প্রতি উপযুক্ত বাক্য বললেন, “মহাবাহু! মহাপ্রাজ্ঞ! যুধিষ্ঠির! তুমি কর্ণের জন্য শোক করতে পারো না, শোক পরিত্যাগ করো, আমার কথা শোনো! তোমাদের পিতা সূর্যদেবের অনুরোধে পূর্বে আমি কর্ণের কাছে এরূপ প্রার্থনা করেছিলাম যে, কর্ণ, তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে ভ্রাতৃসৌহার্দ্য দেখাও, তারপর একদিন কর্ণ স্বপ্নে দেখেছিলেন যে, সূর্য যেন আমার সম্মুখেই কর্ণের কাছে এসে আত্মীয়ের হিত ও সমৃদ্ধিকামী বন্ধুর মতো কর্ণকে বলেছিলেন, ‘কর্ণ, তুমি তোমার ভ্রাতাদের সঙ্গে ভ্রাতৃসৌহার্দ করো।’ কিন্তু আমি বা সূর্যদেব স্নেহরূপ হেতু দেখিয়েও কর্ণকে শান্ত করতে পারিনি। তারপর কর্ণ কালপ্রযুক্ত হয়ে শত্রুতা উদ্ধারে নিরত হলেন এবং তোমাদের প্রতিকূল কার্য করতে লাগলেন; তখন আমিও তাকে উপেক্ষা করলাম।”

কুন্তী এই কথা বললে, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের নয়নযুগল অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল এবং শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ল; তখন তিনি এই কথা বললেন, “মা! আপনি এই বিষয় গোপন করেছেন বলে আমার গুরুতর দুঃখপীড়া উৎপাদন করেছেন এবং মহাতেজা ও দুঃখিতচিত্ত যুধিষ্ঠির সমগ্র জগতের স্ত্রীলোকগণের প্রতি এই অভিসম্পাত করলেন যে, ‘আজ থেকে স্ত্রীলোকেরা গোপনীয় বিষয় গোপন রাখতে পারবে না, নিজেরাই প্রকাশ করবে।”

পরিক্ষিতের জন্ম—কুন্তীর কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ জয়ের পর শোকাতুর যুধিষ্ঠির দেবর্ষি মহর্ষিদের অনুরোধ সত্ত্বেও রাজ্যভার নিতে সম্মত হচ্ছিলেন না। মাতার আদেশ, ভ্রাতাদের অনুরোধ, স্বয়ং কৃষ্ণের নির্দেশও তাঁর অশান্ত হৃদয়কে শান্ত করতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ তাঁকে নিয়ে গেলেন দক্ষিণায়নের অপেক্ষায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত কৌরবশ্রেষ্ঠ ভীষ্মের কাছে। সেইখানে যুধিষ্ঠির পেলেন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একক শিক্ষা। ক্ষত্রিয়ের, সাধারণ মানুষের সকল জ্ঞাতব্য বিষয়ে যুধিষ্ঠিরের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন ভীষ্ম।

ভীষ্মের মৃত্যুর পর যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের সিংহাসনে আরোহণ করলেন। পুরোহিত, সুহৃদবর্গের পরামর্শে তিনি অশ্বমেধযজ্ঞের আয়োজন করলেন। রক্ষক অর্জুন যথাসময়ে যজ্ঞীয় অশ্বকে হস্তিনাপুরে ফিরিয়ে আনলেন। অশ্বমেধ যজ্ঞের সময় হয়েছে জেনে অগ্রবর্তী বলরামকে নিয়ে বৃষ্ণিবংশীয় শ্রেষ্ঠ পুরুষদের সঙ্গে কৃষ্ণ-রুক্মিণী হস্তিনাপুর উপস্থিত হলেন। এই সময়ে কুন্তীর প্রপৌত্র পরিক্ষিতের জন্ম হল। অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে আহত ছিলেন বলে সেই রাজা পরিক্ষিৎ সেই সময়ে নিশ্চেষ্ট একটি শবস্বরূপ হওয়ায় একই কালে বন্ধুবর্গের আনন্দ ও শোকবর্ধক হয়েছিলেন। আনন্দিত লোকসমূহের সিংহনাদধ্বনি সকল দিকে গিয়ে পুনরায় বিরত হল। তখন কৃষ্ণ অত্যন্ত ত্বরান্বিত ও দুঃখিতচিত্ত হয়ে সাত্যকির সঙ্গে তখনই অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন।

তারপর তিনি দেখলেন, তাঁর পিসিমা কুন্তী “কৃষ্ণ! শীঘ্র এসো, শীঘ্র এসো” এই কথা বার বার বলতে বলতে ছুটে আসছেন এবং যশস্বিনী দ্রৌপদী ও সুভদ্রা আর বন্ধুবর্গের স্ত্রীগণ সকরুণ আর্তনাদ করতে করতে কুন্তীর পিছনে আসছেন। তখন কুন্তীভোজনন্দিনী কুন্তী কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে বাষ্পগদগদ বাক্যে কৃষ্ণকে বললেন, “মহাবাহু কৃষ্ণ! দেবকীদেবী তোমাদ্বারাই সুসন্তান হয়েছেন এবং তুমি আমাদের গতি ও প্রতিষ্ঠা; আর তোমারই অধীন এই বংশ। প্রভু যদুপ্রবর কৃষ্ণ! এই যে তোমার ভাগিনেয় অভিমন্যুর পুত্র, অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে মৃত অবস্থায় জন্মেছে, তুমি একে সঞ্জীবিত করো। প্রভু যদুনন্দন! তুমি সেই ঐষীকাস্ত্র নিক্ষেপের সময়ে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলে যে, ‘এই গর্ভস্থ বালক মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করলে আমি একে সঞ্জীবিত করব।’ বৎস পুরুষশ্রেষ্ঠ! এই সেই বালক মৃত অবস্থায় জন্মেছে, তুমি একে দেখো। দুর্ধর্ষ মাধব! উত্তরা, সুভদ্রা, আমি, যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব আমাদের সকলকে তুমি রক্ষা করো। কৃষ্ণ! আমার ও পাণ্ডবগণের জনার্দন! তোমার মঙ্গল হোক! তোমার প্রিয় ও সদৃশ আকৃতি মতো অভিমন্যুরও তুমি আজ প্রিয়কার্য করো।

“শত্রুদমন কৃষ্ণ! উত্তরা অভিমন্যুর পূর্বে বলা বাক্য বারবার বলেন। তোমাকে অভিমন্যু যে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কৃষ্ণ, অভিমন্যু উত্তরাকে বলেছিলেন যে, ‘ভদ্রে, তোমার পুত্র আমার মাতুলালয়ে গমন করবে। এবং সে বৃষ্ণিগৃহে ও অন্ধক গৃহে গিয়ে ধনুর্বেদ, বিচিত্র অস্ত্র এবং প্রধান নীতিশিক্ষা লাভ করবে। বৎস! দুর্ধর্ষ ও বিপক্ষ বীরহন্তা অভিমন্যু প্রণয়বশত এই কথা বলেছিল। তা অবশ্যই সত্য হবে, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অতএব মধুসূদন, এখন আমরা প্রণত হয়ে তোমার কাছে সেই সকল বিষয় প্রার্থনা করছি। তুমি এই বংশের হিতের জন্য, এর জীবনদানরূপ উত্তম কল্যাণসাধন করো।”

বিশালনয়না কুন্তী কৃষ্ণকে এই কথা বলে বাহুযুগল উত্তোলিত করে দুঃখার্ত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন ও অন্যান্য কৌরবমহিলাও ভূতলে পড়ে গেলেন। তখন কৃষ্ণ ভূতল পতিতা কুন্তীকে ধারণ করলেন ও তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। ইতিপূর্বে অভিমন্যুর মৃত্যু হলে উত্তরা প্রাণত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন কুন্তী তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘গর্ভস্থ শিশুটিকে রক্ষা করো, কারণ কেশব কথা দিয়েছেন, “এই শিশু মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করলে তিনি তাঁকে সঞ্জীবিত করবেন।’ কৃষ্ণ তাঁর বাক্য স্মরণ করে একাগ্রমনে সেই মৃত শিশুর দেহে জীবন সঞ্চারের ব্যবস্থা করলেন। ধীরে ধীরে শিশুটি অঙ্গ সঞ্চালন করতে আরম্ভ করল। সমগ্র কৌরবকুলে আনন্দলহরি উচ্ছ্বসিত হল। কুরুবংশ পরিক্ষীণ অবস্থায় শিশুটির জন্ম হল বলে কৃষ্ণ তাঁর নাম রাখলেন ‘পরিক্ষিৎ’।

রাজামাতা কুন্তী

রাজমাতা কুন্তীর জীবনের শেষ অঙ্ক উপস্থিত হল। শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে বিধবা কুন্তী যেদিন তাঁর স্বামীর সন্তানদের নিয়ে হস্তিনাপুর উপস্থিত হন, সেদিন থেকে তাঁর অন্তরে ন্যায়ধর্ম অনুসারে একটি প্রত্যাশাই গড়ে উঠেছিল। ন্যায়ত, ধর্মত এই রাজ্য তাঁর স্বামীর! স্বামীর মৃত্যুর পর রাজধর্ম অনুসারে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের স্বাভাবিক রাজা। কিন্তু রাজত্ব যুধিষ্ঠির পেলেন না, উপরন্তু তাঁকে এবং অন্য ভ্রাতাদের হত্যা করার একটার পর একটা চক্রান্ত চলতে লাগল। তাঁদের কুরু-জঙ্গল প্রান্তে খাণ্ডববনের অত্যন্ত অনুর্বর রুক্ষ অঞ্চলে রাজ্য গড়ে তুলে বাস করতে পাঠানো হল। সেখানেই তাঁরা গড়ে তুললেন অপূর্ব এক প্রাসাদ—ময়দানবের সহায়তায় অসাধারণ এক সভাকক্ষ নির্মিত হল। কিন্তু সেখানেও তাঁরা দীর্ঘকাল বাস করতে পারলেন না। দূতক্রীড়ার নাম করে প্রথমবার তাঁদের ধর্মপত্নীকে করা হল অকথ্য লাঞ্ছনা, আর দ্বিতীয়বার তাদের নিজহস্তে গড়ে তোলা রাজ্য কেড়ে নেওয়া হল। বনবাস অজ্ঞাতবাসে চলে যেতে বাধ্য হলেন তাঁরা। শর্ত পূরণ করেও তাঁরা নিজরাজ্য ফিরে পেলেন না। ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী’—দুর্যোধনের এই আস্ফালনের ফলে আত্মীয়-জ্ঞাতিদের বিরুদ্ধে সমগ্র ভারতব্যাপী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হলেন কুন্তীপুত্রেরা। সেই যুদ্ধে জয়ী হলেন কুন্তীপুত্রেরা। হস্তিনাপুরে প্রথমবার আসার ছাপ্পান্ন বছর পর পিতৃরাজ্যে অধিকার পেলেন কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির। কুন্তী রাজমাতার স্বীকৃতি লাভ করলেন।

তবু এক অনির্বাণ দাহে তাঁর অন্তর পুড়ে যাচ্ছিল। কুমারী জীবনে সূর্যদেবের সঙ্গমে যে শিশুর জন্ম দিয়েছিলেন তিনি, প্রথমবার যাঁকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দ্রোণাচার্যের অস্ত্রশিক্ষার রঙ্গমঞ্চে, যে শিশুকে স্তন্যপান করাতেও পারেননি তিনি, সেই শিশুকে প্রায় পঁচাত্তর বৎসর পর ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিলেন তিনি। সফল হননি, প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। সেই শিশু প্রতিপক্ষের সেনাপতি হয়ে সহোদর ভ্রাতার হস্তে নিহত হয়েছেন। কুন্তী তাঁর পরিচয় উন্মুক্ত করে অন্ত্যেষ্টিকার্য করিয়েছেন। কিন্তু মাতৃহৃদয়ের দাহ তাতে নির্বাপিত হয়নি। কত কিছু দেওয়ার ছিল তাঁকে, কত অকথিত বক্তব্য বলার ছিল। তাই কুন্তী অন্তর্দহনে জ্বলছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

যুধিষ্ঠিরের রাজত্বের পঞ্চদশ বৎসর অতিক্রান্ত হল। ধৃতরাষ্ট্র যে শ্রদ্ধা ও সম্মান যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে পেয়েছেন, দুর্যোধনের জীবিতকালে তিনি আপন পুত্রদের কাছ থেকেই কখনও সে শ্রদ্ধা সম্মান পাননি। একমাত্র ভীমসেন তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে কিছু কিছু অপ্রিয় মন্তব্য করতেন। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের শিষ্ট ব্যবহার ও শ্রদ্ধা তাঁকে আশ্বস্ত করত। শেষ পর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন, বনবাস যাত্রা করবেন। যাত্রার পূর্বে ধৃতরাষ্ট্র দান করতে চাইলেন ব্রাহ্মণ ও হিতার্থীদের। যুধিষ্ঠির নিজের ভাগের অর্থ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছা পূর্ণ করলেন। নির্দিষ্ট দিনে ধৃতরাষ্ট্র যাত্রা করলেন। মাতা কুন্তীদেবী ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে বনে গমন করছেন দেখে যুধিষ্ঠির তাঁকে বললেন, “মা! আমি রাজার অনুসরণ করছি, আপনি ফিরুন। রাজ্ঞী, আপনি বধূগণের সঙ্গে নগরে ফিরে যান, মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র তপস্যায় কৃতনিশ্চয় হয়েছেন, তাই ইনি বনে গমন করুন।” যুধিষ্ঠির এ-কথা বললে পরেও অশ্রুপূর্ণানয়না কুন্তী গান্ধারীকে ধরে এগিয়ে চলতেই লাগলেন। চলতে চলতেই কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “মহারাজ, তুমি কখনও সহদেবের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ কোরো না। কারণ, রাজা, সহদেব সর্বদাই তোমার ও আমার প্রতি অনুরক্ত আছে! আর তুমি সর্বদাই যুদ্ধে অপলায়ী কর্ণকে স্মরণ কোরো। কারণ, আমি তখন দুর্বুদ্ধিবশতই সেই বীরকে পরিত্যাগ করেছিলাম। পুত্র, আমার গর্ভে সূর্য থেকে উৎপন্ন কর্ণকে আজ দেখতে না পাওয়ায় যে আমার হৃদয় শতধা বিদীর্ণ হচ্ছে না, মূঢ়া আমার সেই হৃদয় নিশ্চয়ই লোহা দিয়ে নির্মিত। শত্রুদমন, গর্ভজাত প্রথম পুত্র মৃত, এই অবস্থায় বনগমন ছাড়া আমি আর কী করতে পারি। আমার জীবনের সব থেকে বড় দোষ যে, আমি গর্ভ থেকে উৎপন্ন বলে কর্ণকে ঘোষণা করিনি। অতএব মহাবাহু অরিন্দম, তুমি সর্বদাই ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কর্ণের জন্য উত্তম দান কোরো। শত্রুদমন, তুমি সর্বদাই দ্রৌপদীর প্রীতিকর কার্যে ব্যাপৃত থাকবে। আর কুরুকুলশ্রেষ্ঠ, তুমি সর্বদাই ভীম, অর্জুন ও নকুলকে সৌহার্দ্যে রাখবে। কারণ রাজা, এখন বংশের ভার তোমার উপর পড়েছে। কিন্তু আমি ‘শ্বশ্রু ও শ্বশুরের’ তুল্য গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের চরণশুশ্রূষা করতে থেকে, তপস্বিনী ও মললিপ্তা পঙ্কলিপ্তা হয়ে গান্ধারীর সঙ্গে তপোবনে বাস করব।”

কুন্তী একথা বললে, ধর্মাত্মা ও স্বাধীনচিত্ত বুদ্ধিমান যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের সঙ্গে বিষণ্ণ হলেন এবং কিছুকাল চিন্তা করে বললেন, “দেবী, আপনি এটা কী আরম্ভ করেছেন, আপনি একথা বলতেই পারেন না, আমি আপনাকে তপোবনে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারি না, আপনি আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন। প্রিয়দর্শনে! পূর্বে আমরা নগর থেকে নির্গত হবার উপক্রম করলে, আপনি বিদুলার বাক্যদ্বারা উৎসাহিত করে আমাদের ত্যাগ করতে পারেননি। আমি আপনার এবং নরশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের উপদেশ শুনে রাজাগণকে বিনাশ করে এই রাজ্য লাভ করেছি। আমি আপনার কাছে যে বুদ্ধি পেয়েছিলাম, আজ সেই বুদ্ধি কোথায় গেল? আপনি এখন ক্ষত্রিয়ধর্ম ত্যাগ করে তপোবনে যেতে পারেন না। যশস্বিনী! আপনি আমাদের ও রাজ্য পরিত্যাগ করে পুত্রবধূবিহীনা হয়ে দুর্গম বনমধ্যে কী প্রকারে বাস করবেন? অতএব আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।”

কুন্তী পুত্রের এই অশ্রুযুক্ত বাক্য শুনে অশ্রুপূর্ণা নয়ন হয়ে গমন করতেই লাগলেন। তখন ভীম তাঁকে বললেন, “জননী কুন্তী! পুত্রনির্জিত এই রাজ্য যখন আপনাকে ভোগ করতেই হবে এবং রাজধর্ম পালন করতে হবে, তখন আপনার এ রকম বুদ্ধি হল কেন? পূর্বে আপনি আমাদের দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস করালেন কেন এবং এখনই বা কী জন্য পরিত্যাগ করে বনে যেতে ইচ্ছা করছেন? কী জন্যই বা আপনি বালক অবস্থায় আমাদের ও দুঃখশোকার্ত নকুল ও সহদেবকে শতশৃঙ্গ পর্বতের বন থেকে হস্তিনায় নিয়ে এসেছিলেন? মা! আপনি প্রসন্ন হোন, এখন বনে যাবেন না। বল দ্বারা অর্জিত যুধিষ্ঠিরস্থিত সম্পদ ভোগ করুন।” ভীম একথা বললেও তাপসী ভাবাপন্ন কুন্তী বনবাসে কৃতনিশ্চয় থেকে পুত্রদের নানাবিধ বিলাপের মধ্যে, তাঁদের বাক্য পালন না করে অগ্রসর হতে থাকলেন। বিষণ্ণবদনা দ্রৌপদী, সুভদ্রা রোদন করতে করতে তার পিছনে পিছনে যেতে লাগলেন। কুন্তীও যেতে যেতে বারবার পিছনে পুত্রদের মুখ দেখছিলেন। কুন্তী সেই অবস্থায় ভীমসেনকে বললেন, “পাণ্ডুনন্দন মহাবাহু ভীম, তুমি যা বললে, তা সত্য। তোমরা রাজ্য থেকে নির্বাসিত হওয়ায় অবসন্ন হয়েছিলে, সেই জন্য আমি তোমাদের যুদ্ধ করতে বলেছিলাম। জ্ঞাতিরা দূতক্রীড়ায় তোমাদের রাজ্য অপহরণ করেছিল, তোমরা সুখ থেকে বিচ্যুত হয়েছিলে, সেই জন্য আমি উপদেশ দিয়ে তোমাদের উদ্ধার করেছি। পাণ্ডব শ্রেষ্ঠগণ, কী করে পাণ্ডুর বংশ লোপ না পায় এবং কীভাবেই বা তোমার যশ নষ্ট না হয়, এই জন্যই আমি তোমাদের উদ্ধার করেছি। তোমরা সকলেই ইন্দ্রের তুল্য এবং দেবগণের তুল্য পরাক্রমশালী হয়েও পরের সুখ দেখে জীবন কাটাও, তা চাইনি বলেই আমি তোমাদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছি। যুধিষ্ঠির, তুমি ধার্মিকশ্রেষ্ঠ এবং ইন্দ্রের তুল্য রাজা হয়েও পুনরায় বনে গিয়ে যাতে দুঃখভোগ না করো, এই জন্যই আমি তোমাকে উদ্ধার করেছি। দশ হাজার হস্তীর তুল্য বলশালী এবং বিখ্যাত বিক্রম ও পুরুষকার সম্পন্ন এই ভীম কষ্ট ভোগ না করে, এর জন্যই আমি তোমাদের উদ্ধার করেছি। ভীমসেনের কনিষ্ঠ, ইন্দ্রের তুল্য পরাক্রমশালী এই অর্জুন যাতে অবসন্ন না হয়, তাই আমি তাকে উদ্ধার করেছি। গুরুজনের অধীন এই নকুল ও সহদেব ক্ষুধায় কোনও প্রকারে কষ্ট না পায়, সেই জন্যই তোমাদের উপদেশ দিয়ে উদ্ধার করেছি।

“মহাভাগা, শ্যামবর্ণা ও আয়তলোচনা এই দ্রৌপদী একবার সভায় কষ্ট পেয়েছেন, আবার সেরূপ কষ্ট না পান, এই জন্যই আমি তোমাদের যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছি। ভীম! যখন দুঃশাসন মূর্খতাবশত তোমাদের সাক্ষাতেই, কদলীবৃক্ষের মতো কম্পমানা, রজস্বলা, সুলক্ষণা ও দ্যুতপরাজিত এই দ্রৌপদীকে দাসীর ন্যায় আকর্ষণ করছিল, তখনই আমি বুঝেছিলাম যে, এই বংশ নষ্ট হয়েছে। তখন আমার শ্বশুর ভীষ্ম প্রভৃতি কৌরবগণ অবসন্ন হয়ে থেকেছিলেন, আর দ্রৌপদী দৈবকে রক্ষকরূপে ইচ্ছা করে কুররী-পক্ষিণীর ন্যায় বিলাপ করছিলেন।

কেশপক্ষে পরামৃষ্ঠা পাপেন হতবুদ্ধিনা।

যথা দুঃশাসনেনৈষা তদা মুহ্যাম্যহং নৃপাঃ ॥ আশ্রমবাসিক : ১৯ : ১৩ ॥

“রাজগণ যখন পাপিষ্ঠ ও হতবুদ্ধি দুঃশাসন, দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করেছিল, তখন আমি মুর্ছিত হয়ে পড়েছিলাম।

“পুত্রগণ, তখন আমি তোমাদের তেজ বৃদ্ধি করবার জন্যই বিদুলার বাক্যদ্বারা তোমাদের উৎসাহিত করেছিলাম। এটা তোমরা মনে রেখো। পুত্রগণ, আমার পুত্রগণ জীবিত থাকতেও পাণ্ডুর রাজবংশ যাতে নষ্ট না হয়, সেই জন্যই আমি তোমাদের যুদ্ধের উপদেশ দিয়ে উদ্ধার করেছিলাম। বংশনাশক লোকের পুত্রগণ বা পৌত্রগণ পুণ্যপ্রাপ্য লোক লাভ করে না। পুত্রগণ, আমি পূর্বে ভর্তার বিশাল রাজ্য ভোগ করেছি। প্রচুর দান করেছি এবং যজ্ঞে যথাবিধানে সোমরস পান করেছি। আমি বিদুলার সেই সকল বাক্য দ্বারা নিজের ভোগের জন্য কৃষ্ণকে প্রেরণ করিনি; কিন্তু পৃথিবী রক্ষার জন্যই তা করেছিলাম। রাজা! পুত্রগণ! আমি পুত্রদ্বারা বিজিত রাজ্যভোগের কামনা করি না; কিন্তু তপস্যাজনিত পবিত্র পতিলোককে কামনা করি। যুধিষ্ঠির, আমি বনবাসী, শ্বশ্রুতুল্য গান্ধারী ও শ্বশুরতুল্য ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা করে তপস্যাদ্বারা শরীর শুষ্ক করব। অতএব কৌরবশ্রেষ্ঠ, তুমি ভীমসেন প্রভৃতির সঙ্গে নিবৃত্ত হও, তোমার বুদ্ধি ধর্মে অভিনিবিষ্ট থাকুক এবং তোমার মন প্রশস্ত হোক।” পাণ্ডবেরা কুন্তীর বাক্য শুনে লজ্জিত হয়ে দ্রৌপদীর সঙ্গে নিবৃত্ত হলেন।

কুন্তীর বনগমন

ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতির বন গমনের পর এক বৎসর কাল অতিক্রান্ত হল। কুন্তীর বিরহে পাণ্ডবগণ কাতর হয়ে কালযাপন করতে লাগলেন, কোনও বিষয়ে তাঁরা মন দিতে পারলেন না! কয়েকদিন পরে তাঁরা স্থির করলেন যে বনে গিয়ে সকলকে দেখে আসবেন, দ্রৌপদীও অন্য পুরস্ত্রীদের সঙ্গে গমনের জন্য উৎসুক হলেন। পাণ্ডবগণ সেই আশ্রমে উপস্থিত হলেন। ইতিমধ্যে দেবর্ষি নারদের মুখে পাণ্ডবগণ জেনেছেন যে, ধৃতরাষ্টের আয়ু আর তিন বৎসর মাত্র। কাজেই পাণ্ডবেরা অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাণ্ডবগণ ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রমে প্রবেশের পর একমাস কালের ব্যবধানে ব্যাসদেব সেই আশ্রমে প্রবেশ করলেন। ব্যাসদেব উপস্থিত হবার পূর্বেই বিদুর কৌশিতকী অবলম্বন করে যুধিষ্ঠিরের দেহে প্রবেশ করেছিলেন।

ব্যাসদেব এসে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “রাজেন্দ্র, তোমার কী কামনা বলো, তপস্যার প্রভাবে আমি তা পূর্ণ করব।” গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্র বললেন, যার দুর্নীতির ফলে পাণ্ডবগণ নির্যাতিত ও বহু নরপতি বিনাশিত হয়েছেন সেই হতভাগ্য দুর্যোধনের জন্য তাঁদের হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। তাঁরা একবার দুর্যোধনকে দেখতে চাইলেন। তারপর বেদব্যাস কুন্তীকে বললেন, “মহাভাগে, তোমার মনে যা রয়েছে, তুমি যে কার্য বলবার ইচ্ছা করেছ, তা বলো।” কুন্তী মস্তকদ্বারা শ্বশুরকে প্রণাম করে বললেন, “ভগবন, আপনি আমার শ্বশুর; সুতরাং দেবতারও দেবতা। আমার সেই দেবাদিদেব আপনি আমার সত্যবাক্য শুনুন। একদা দুর্বাসা নামে তপস্বী ও কোপনস্বভাব এক ব্রাহ্মণ ভিক্ষা করার জন্য আমার পিতার কাছে এসেছিলেন। আমি পরিচর্যা করে তাঁকে সন্তুষ্ট করেছিলাম। আমার পবিত্রতা, কোনও অপরাধ না করা এবং শুদ্ধচিত্তের গুণে গুরুতর কোপ সম্ভাবনার স্থলেও তিনি আমার প্রতি কুপিত হননি। কৃতকার্য ও সন্তুষ্ট সেই মহর্ষি প্রস্থান কালে আমাকে বরদান করে বলেছিলেন— ভদ্রে শুভাননে। তুমি ধর্মের জননী হবে এবং তুমি যে সকল দেবতাকে আহ্বান করবে, তারা তোমার বশবর্তী হবেন। এই কথা বলে তিনি অন্তর্হিত হলেন, আমি বিস্তয়াপন্ন হলেও সেই মন্ত্রের স্মৃতি আমার কখনও নষ্ট হয়নি। তারপর আমি একদিন দুর্বাসার সেই বাক্য স্মরণ করে উদয়মান সূর্যকে দেখতে থেকে বালিকাচাপল্যে তাতে দোষ হবে না বুঝে অট্টালিকার মধ্যে কিছুকাল দাঁড়িয়েছিলাম। তখন সূর্যদেব আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।

“তখন তিনি নিজের দেহটিকে আকাশে ও ভূতলে স্থিতরূপে দুইভাগে বিভক্ত করে আকাশস্থিত রূপ দ্বারা জগৎ সন্তপ্ত করতে লাগলেন এবং ভূতলস্থিত রূপদ্বারা আমার কাছে এলেন। তখন আমি কাঁপতে লাগলাম। এই সময়ে তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি আমার কাছ থেকে বর গ্রহণ করো।’ তখন আমি মস্তক দ্বারা তাঁকে প্রণাম করে বললাম, ‘আপনি চলে যান।’ তিনি বললেন, ‘আমাকে আহ্বান করা নিষ্ফল হতে পারে না। তুমি নিষ্ফল করলে যিনি তোমাকে বর দিয়েছেন সেই ব্রাহ্মণকে ও তোমাকে দগ্ধ করব।’ তখন আমি সূর্যের শাপ থেকে সেই অনপকারী দুর্বাসাকে রক্ষা করার ইচ্ছা করে বললাম, ‘দেব! আপনার তুল্য একটি পুত্র হোক।’ তখন সূর্য আমাকে মুগ্ধ করে এবং তেজে আমাতে প্রবেশ করে বললেন, ‘ভদ্রে! তোমার একটি পুত্র হবে।” এই কথা বলে তিনি আকাশে চলে গেলেন।

“তারপর আমি পিতার মনোভাবের অনুসরণ করে গৃহমধ্যে গুপ্তভাবে উৎপন্ন বালকপুত্র কর্ণকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম। ব্রাহ্মণ, নিশ্চয়ই সেই সূর্যদেবের অনুগ্রহে এবং দুর্বাসা আমাকে যে বলেছিলেন, সেই অনুসারে আমি পুনরায় কন্যাই হলাম। ব্রহ্মর্ষি, আমি মূঢ়া কিনা, তাই জেনেও সেই পুত্রটিকে উপেক্ষা করেছিলাম, সেই উপেক্ষাই আমাকে দগ্ধ করছে, তা আপনার ভাল ভাবে জানা আছে। ভগবান, আমার এই কার্য দুষ্টই হোক বা অদৃষ্টই হোক, তা আমি প্রকাশ করলাম। সে যাই হোক, আমি কর্ণকে দেখতে চাই, আপনি আমার সেই শোক দূর করুন। নিষ্পাপ মুনিশ্রেষ্ঠ, এই রাজার মনে যা আছে, তা আপনি জানেন; অতএব সেই অভীষ্ট বিষয় আজই লাভ করুন।”

কুন্তীর কথা শুনে বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ বললেন, ‘বৎসে! তুমি আমাকে যা বললে, সে সমস্তই ভাল এবং সে সমস্তই হবে। বৎসে এ-ব্যাপারে তোমার কোনও দোষ হয়নি। কারণ, তুমি পুনরায় কন্যাত্ব প্রাপ্ত হয়েছ। আবার দেবগণ ও সত্যসংকল্প বলে সূর্য তোমার দেহে প্রবেশ করেছেন মাত্র। দেবতাদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা সংকল্প, বাক্য, দৃষ্টি, স্পর্শ ও সঙ্গম— এই পাঁচ প্রকারেই স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে পারেন। কুন্তী, তুমি মনুষ্যধর্মে আছ বলে তোমার মোহজনিত দোষ হয়নি, তোমার মনের সন্তাপ দূর হোক! সমস্ত খাদ্যবস্তুই বলবানদের পথ্য, সকল কার্যই বলবানদের পবিত্র, সমস্ত আচরণই প্রবলদের ধর্ম, এবং সমস্ত বস্তুই শক্তিশালীদের স্বকীয়। তোমরা সকলে গঙ্গাতীরে গমন করো। যাঁরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত হয়েছেন, তুমি তোমার নিহত পুত্র, পৌত্রদের সেই গঙ্গাতীরে দেখতে পাবে।”

ব্যাস এই কথা বললে সমাগত জনগণ সিংহনাদ করে গঙ্গার অভিমুখে যাত্রা করলেন। ধৃতরাষ্ট্র, পঞ্চপাণ্ডব, অমাত্যগণ, নারীগণ, ঋষি ও গন্ধর্বগণ, অনুচরবর্গ সকলেই গঙ্গাতীরে এসে অধীরভাবে রাত্রির প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত হলে তাঁরা পবিত্রভাবে একাগ্রমনে , গঙ্গাতীরে উপবেশন করলেন। অনন্তর মহাতেজা ব্যাসদেব ভাগীরথীর পুণ্যজলে অবগাহন করে মৃত কৌরব ও পাণ্ডবযোদ্ধা ও নরপতিগণকে আহ্বান করলেন। তখন জলমধ্যে কুরুপাণ্ডব সেনার তুমুল নিনাদ উঠল। ভীষ্ম, দ্রোণ, পুত্রসহ বিরাট ও দ্রুপদ, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, ঘটোৎকচ, কর্ণ, দুর্যোধন দুঃশাসন প্রভৃতি, শকুনি, জরাসন্ধ পুত্র সহদেব, ভগদত্ত, ভূরিশ্রবা, শল্য, বৃষসেণ, দুর্যোধনপুত্র লক্ষ্মণ সানুজ ধৃষ্টকেতু, বাহ্লিক, সোমদত্ত, চেকিতান প্রভৃতি বীরগণ দিব্য দেহধারণ করে গঙ্গাগর্ভ সসৈন্যে উখিত হলেন। জীবদ্দশায় যাঁর যে প্রকার বেশ ধ্বজা ও বাহন ছিল এখনও সেই প্রকার দেখা গেল। অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ স্তবগান করতে লাগলেন। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে দিব্যচক্ষু দান করলেন। সকলে রোমাঞ্চিত হয়ে চিত্রপটে অঙ্কিতের ন্যায় এই আশ্চর্য উৎসব দেখতে লাগলেন।

কুরু ও পাণ্ডব পক্ষের বীরগণ ক্রোধ ও দ্বেষ ত্যাগ করে নিস্পাপ হয়ে একত্রে সমাগত হলেন। পুত্র পিতামাতার সঙ্গে, ভার্যা পতির সঙ্গে, ভ্রাতা ভ্রাতার সঙ্গে এবং মিত্র মিত্রের সঙ্গে সহর্ষে মিলিত হলেন। পাণ্ডবগণ কর্ণ অভিমন্যু ও দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্রর সঙ্গে মিলিত হলেন। মুনিবর ব্যাসের প্রসাদে সকলে আত্মীয় ও বন্ধুর সঙ্গে মিলিত হয়ে সেই রাত্রিতে স্বর্গবাসের সুখ অনুভব করলেন। তাঁদের শোক ভয় দুঃখ অযশ কিছুই রইল না। তাঁরা নিজ নিজ পত্নীর সঙ্গে এক রাত্রি সুখে যাপন করলেন। রাত্রি প্রভাত হলে ব্যাসদেব সেই মৃতোত্থিত যোদ্ধাগণকে প্রস্থানের অনুমতি দিলেন। ক্ষণমধ্যে রথ ও ধ্বজসহ গঙ্গাগর্ভে প্রবেশ করে নিজ নিজ লোকে ফিরে গেলেন। পতিহীনা ক্ষত্রিয় নারীগণকে ব্যাস বললেন, যাঁরা পতিলোকে যেতে চান তাঁরা শীঘ্র জাহ্নবীর জলে অবগাহন করুন। তখন সাধ্বী বরাঙ্গনাগণ ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে জলে প্রবেশ করলেন এবং দেহত্যাগ করে পতির সঙ্গে মিলিত হলেন।

যিনি এই প্রিয়-সমাগম বিষয় শোনেন তিনি ইহলোক ও পরলোকে প্রিয় বিষয় লাভ করেন। যিনি অপরকে শোনান তিনি ইহলোকে যশ ও পরলোকে শুভগতি লাভ করেন। যে বেদজ্ঞ সাধু মানব শুচিভাবে শ্রদ্ধাসহকারে এই আশ্চর্য পর্ব শোনেন তিনি পরমগতি প্রাপ্ত হন।

কুন্তীর মৃত্যু

ব্যাসদেব চলে যাওয়ার কিছুকাল পরে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠির ও পাণ্ডবদের হস্তিনায় ফিরে যেতে বললেন। যুধিষ্ঠির কুন্তীর কাছে গিয়ে তাঁকে পুত্রদের সঙ্গে হস্তিনায় যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন। কিন্তু কুন্তী সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে যুধিষ্ঠিরকে নিজের রাজ্যে ফিরে যেতে বললেন।

যুধিষ্ঠির ফিরে যাবার দু’বছর পরে দেবর্ষি নারদ বহু তীর্থ ও গঙ্গাদর্শন করে হস্তিনাপুরে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। যুধিষ্ঠির অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে তাঁর কাছে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর কুশল প্রশ্ন করলেন। নারদ জানালেন, “তোমরা সেই তপোবন থেকে চলে এলে, তোমার জ্যেষ্ঠতাত জ্ঞানী রাজা ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্র থেকে গঙ্গাদ্বারে গিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি মহাতপা হলে, অন্যরা সকলে তাঁর সম্মান করতে লাগলেন। এইভাবে তিনি অস্থিচর্মসারমাত্র হয়ে ছ’ মাস যাবৎ থাকলেন। সেই সময়ে গান্ধারী জলমাত্র পান করে, কুন্তী একমাস যাবৎ উপবাসিনী থেকে এবং তৃতীয় দিন রাত্রিতে ভোজন করে জীবনধারণ করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র সেই বনে কখনও দৃষ্টিগোচর থাকতেন, কখনও বা স্থানান্তরে যাওয়ায় অদৃশ্য হতেন, এই অবস্থায় তাঁর যাজকেরা যথাবিধানে অগ্নিতে হোম করতেন। সেই সময়ে ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে বাস হত না। তিনি বনেই থাকতেন এবং কুন্তী, গান্ধারী ও সঞ্জয়—এঁরাও তাঁর অনুসরণ করতেন। সঞ্জয় সমতল অসমতল ভূমিতে ধৃতরাষ্ট্রকে নিয়ে যেতেন, আর অনিন্দিতা কুন্তী গান্ধারীর চোখ ছিলেন।

তারপর কোনও এক সময়ে জ্ঞানী ও রাজশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র গঙ্গাস্নান করে আশ্রমাভিমুখ হয়ে গঙ্গার তীর দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন বায়ুও উঠল, বিশাল দাবাগ্নি জন্মাল এবং সেই দাবাগ্নি সকল দিক ব্যাপ্ত করে সেই সমগ্র বনটি দগ্ধ করতে লাগল। ক্রমে হরিণগণ ও সর্পগণ সকল দিকে দগ্ধ হতে লাগল। শূকরগণ জলাশয় অবলম্বন করতে থাকল এবং সেই বন জ্বলে উঠল। তাঁদের গুরুতর বিপদ উপস্থিত হল। তখন অনাহারে ধৃতরাষ্ট্রের দৈহিক শক্তি ও দ্রুত গমনের শক্তি অত্যন্ত কমে গিয়েছিল বলে তিনি দ্রুত সরে যেতে অসমর্থ হলেন এবং যুধিষ্ঠিরের মাতা দু’জনও (কুন্তী ও গান্ধারী) অত্যন্ত কৃশ দেহ বলে দ্রুত অপসারণ করতে পারেননি। অগ্নি কাছে এসেছে জেনে বিজয়ীশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র সূতপুত্র সঞ্জয়কে বললেন, “সঞ্জয়, যে স্থানে অগ্নি তোমাকে কখনও দগ্ধ করবে না, তুমি সেই স্থানে সরে যাও। আমরা এই স্থানে থেকেই পরমগতি লাভ করব।” তখন বাগ্মীশ্রেষ্ঠ সঞ্জয় অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “রাজা! এই বৃথাগ্নি দ্বারা আপনার মৃত্যু কারও অভিপ্রেত নয়। অথচ এই দাবাগ্নি থেকে আমাদের মুক্তির বিষয়ে কোনও উপায়ও দেখছি না; এখন কী করা উচিত আপনি বলুন।” সঞ্জয় এই কথা বললে, ধৃতরাষ্ট্র পুনরায় বললেন, “আমরা নিজেরা গৃহ থেকে বার হয়ে এসেছি বলে আমাদের এই মৃত্যু অনভিপ্রেত নয়। কারণ, জল, অগ্নি, বায়ু—এগুলি অথবা নিজেই প্রাণ আকর্ষণ— তপস্বীগণের মৃত্যুর পক্ষে প্রশস্ত। অতএব সঞ্জয়, তুমি চলে যাও, বিলম্ব কোরো না।” সঞ্জয়কে এই কথা বলে তখনই ধৃতরাষ্ট্র ইষ্টদেবতার উপর মন স্থাপন করে পূর্বমুখ হয়ে গান্ধারী ও কুন্তীর সঙ্গে উপবেশন করলেন। বুদ্ধিমান সঞ্জয় সেইরূপে ধৃতরাষ্ট্রকে দেখে প্রদক্ষিণ করলেন এবং তাঁকে বললেন, “রাজা! আপনি ইষ্টদেবতার সঙ্গে আত্মসংযোগ করুন।” বেদব্যাসের পুত্র ও জ্ঞানী ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের সেই বাক্য রক্ষা করলেন অর্থাৎ তখনই তিনি ইন্দ্রিয়সমূহকে নিরুদ্ধ করে ধ্যানস্থ হওয়ায় কাষ্ঠের ন্যায় নিশ্চল হলেন। এই সময়ে মহাভাগা গান্ধারী ও যুধিষ্ঠির জননী কুন্তী দাবাগ্নিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। সঞ্জয় সেই তিনজনের অনুমতি নিয়ে হিমালয় পর্বতে চলে গেলেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “এইভাবে অগ্নিগ্রস্ত অবস্থায় কুন্তীর মৃত্যু ঘটেছে।” নারদ তাঁদের প্রায় দগ্ধ শরীরগুলি দেখেছিলেন। তারপরে তপস্বীরা সেই তপোবনে গমন করলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রের দাবানলে দাহ ও মৃত্যু শুনেও তাঁরা শোক করেননি। নারদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজা ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও তোমার জননী কুন্তী—এইভাবে অগ্নিসংযোগ পেয়ে স্বর্গে গিয়েছেন, সুতরাং তাঁদের জন্য তোমাদের শোক করা উচিত নয়।”

অন্তঃপুরে বিশাল আর্তনাদ উত্থিত হল। যুধিষ্ঠির ধৈর্যগুণে অশ্রুজল নিরুদ্ধ করে বলতে লাগলেন, “আমাদের মতো বন্ধু থাকতেও ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর এইভাবে মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। উন্নতিশীল, অতিবিশাল, উজ্জ্বল পুত্ৰৈশ্বর্য পরিত্যাগের পর বনবাসগতা কুন্তীর জন্য আমি শোক করি। আমরা জীবিত আছি অথচ আমাদের মাতা মৃত— অতএব আমাদের রাজ্য, বল, বিক্রম ও ক্ষত্রিয়ধর্মে ধিক। অগ্নিকে অর্জুন খাণ্ডবদাহকালে অনর্থক সন্তুষ্ট করেছিলেন। সেই অগ্নিই অর্জুন-জননীকে গ্রাস করে কৃতঘ্ন হয়েছেন। অগ্নিকে ধিক। অর্জুনের নিকটে সত্যপ্রতিজ্ঞাও ধিক।” যুধিষ্ঠিরের সেই বিলাপ শুনে পাণ্ডবেরা সকলেই দুঃখার্ত হয়ে প্রলয়কালে প্রাণীগণের ন্যায় রোদন করতে লাগলেন। তাঁদের সেই রোদন ধ্বনি অট্টালিকার সীমা সংলগ্ন আকাশস্থল ও ভূতল ব্যাপ্ত করল।

কুন্তী—সাধারণ আলোচনা

কুন্তী চরিত্রের আলোচনায় আমরা শিরোনাম দিয়েছিলাম—‘নিঃসঙ্গ-মনস্বিনী কুন্তী’। কুন্তী সম্পর্কে এমন সার্থক শিরোনাম সম্ভবত আর হয় না। জন্মের পর থেকেই কুন্তী নিঃসঙ্গ। মায়ের সঙ্গে কুন্তীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার আগেই পিতা শূরসেন তাঁকে রাজা কুন্তীভোজকে প্রদান করলেন। জন্মদাতা পিতা শূরসেনের সঙ্গেও স্বাভাবিক পিতা-পুত্রীর সম্পর্ক তাঁর হল না।

কুন্তীভোজের গৃহে গিয়েও কুন্তী নাম ছাড়া অন্য কিছুই পেলেন না। কুন্তীভোজের রানি কেউ নিশ্চয়ই ছিলেন। কিন্তু তিনি মাতৃত্বের বন্ধনে কুন্তীকে আবদ্ধ করতে পারলেন না। অপরিসীম বুদ্ধিমতী কুন্তী অন্তঃপুরের অঘোষিত সম্রাজ্ঞী হয়ে গেলেন। কিন্ত শাসন নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই। রাজপরিবারে জন্ম ও রাজপরিবারে দত্তা হিসাবে কুন্তী ক্ষমতার অধিকারিণী যতটা হলেন, ততই তাঁর দায়িত্ববোধ, কর্তব্যপালন অভ্যাস গড়ে উঠছিল। দাস-দাসীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, অতিথিসেবা ইত্যাদি কুন্তীর দৈনন্দিন কার্যের মধ্যেই স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ল। কুন্তী এলিয়ে পড়া মেয়ে ছিলেন না। দুরূহ কর্তব্য অনায়াসে সম্পাদন ক্ষমতা তাঁর ছিল কিন্তু তিনি স্বেচ্ছাচারিণীও হলেন না। যাঁর পিতৃত্ব স্বীকার করেছেন, তাঁর যে-মর্যাদা প্রাপ্য ছিল, কুন্তীভোজকে সে-মর্যাদা তিনি দিয়েছিলেন।

কুন্তীভোজ আড়ালে থাকলেও কুন্তীর এই সমস্ত গুণ তাঁর চোখ এড়ায়নি। তাই দুর্বাসার আগমনে অতি সম্মানিত অথচ কোপনস্বভাব এই ঋষির আতিথ্যের সেবার ভার তিনি কুন্তীর উপর অসংকোচে ছেড়ে দিলেন। অনায়াস দক্ষতায় কুন্তী সেই দায়িত্ব পালন করছিলেন। দুর্বাসাকে বুঝে নিতে তাঁর সময় লাগেনি। এরপর তিনি নিশ্ছিদ্র সেবায় দুর্বাসাকে অতি প্রসন্ন ও সন্তুষ্ট করে তুললেন। প্রসন্ন দুর্বাসা প্রস্থানকালে তাঁকে দিয়ে গেলেন ‘দেব-অভিকর্ষণ’ মন্ত্র। ধ্যানযোগে দুর্বাসা জেনেছিলেন যে মানুষের ঔরসে কুন্তীর সন্তান হবে না। তাই এক অলৌকিক বরদান। কৌতুক ছলে এই মন্ত্রের শক্তি পরীক্ষা করতে গিয়ে কুন্তী কুমারী জীবনের এক নিদারুণ সংকটের মধ্যে পড়লেন। সূর্যদেবের সঙ্গে মিলনের ফলে কুন্তী গর্ভবতী হলেন। জন্ম হল তাঁর কানীন পুত্র কর্ণের। মহাভারত পাঠে জানা যায় সন্তানের জনক সুর্যদেব এবং কুন্তীর পিতা কুন্তীভোজের সম্মতি ও অনুমতি নিয়ে কুন্তী সদ্যোজাত কবচকুণ্ডলধারী সেই সন্তানকে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিলেন।

স্বয়ংবরসভায় কুন্তী পাণ্ডুকে বরণ করেছিলেন। কিন্তু স্বামী-সোহাগিনি হওয়া তাঁর কপালে ছিল না। ভারতবিখ্যাত বীর হওয়া সত্ত্বেও দৈবনিবন্ধনে পাণ্ড প্রজনন শক্তি হারালেন। না জেনে তিনি মৈথুনরত কিমিন্দম মুনিকে বধ করলেন। মুমূর্ষ কিমিন্দম মুনি অভিসম্পাত দিলেন—“পাণ্ডুও মৈথুনরত অবস্থায় মৃত্যুপ্রাপ্ত হবেন।” দুঃখার্ত পাণ্ডু প্রব্রজ্যা নিলেন ও তপস্বী হলেন। দুই ভার্যাই সেই অবস্থা মেনে নিলেন। কুন্তী অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন যে পাণ্ডু তাঁকে কোনও অবস্থায় নির্জনে পেয়ে কামাবিষ্ট না হয়ে পড়েন। কিন্তু মাদ্রী তা পারলেন না। সূক্ষ্মবসন পরিহিতা মাদ্রীর দেহসৌষ্ঠবে পাণ্ডু নির্জন বনমধ্যে কামবেগে তাঁকে সবলে আক্রমণ করলেন এবং সঙ্গমে প্রবৃত্ত হলেন। পাণ্ডুর মৃত্যু হল।

মৃত্যুর পূর্বে পাণ্ডু যখন পিতৃঋণ শোধ না হওয়া বিষয়ে অত্যন্ত আক্ষেপ করছিলেন তখন কুন্তী তাঁকে দুর্বাসার বরদান বিষয়ে জানালেন। পাণ্ডু অত্যন্ত আনন্দিত হলেন এবং তাঁর অনুমতিতে কুন্তী ধর্মের ঔরসে যুধিষ্ঠির, বায়ুর ঔরসে ভীমসেন এবং ইন্দ্রের ঔরসে অর্জুনের জন্ম দিলেন। পাণ্ডুর আদেশে কুন্তী একবারের জন্য মাদ্রীকে সেই মন্ত্র দান করলেন, মাদ্রী অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের ঔরসে নকুল ও সহদেবের জন্ম দিলেন।

পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর থেকেই কুন্তী নিঃসঙ্গ। এই নিঃসঙ্গতা তিনি পূর্ণ করেছিলেন বাৎসল্য দিয়ে। আপন পুত্র এবং মাদ্রীর পুত্রের মধ্যে কোনও ভেদ তিনি করেননি। বস্তুত সর্বকনিষ্ঠ সন্তান সহদেবের উপর কুন্তীর স্নেহ ছিল সব থেকে বেশি। চিরবঞ্চিত কানীন পুত্র সম্পর্কে অপরাধবোধ এবং মমতাও ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রবল। কর্ণের মৃত্যুর পর হাহাকার করে তিনি যুধিষ্ঠির ও অন্য পুত্রদের কাছে কর্ণের যথার্থ পরিচয় দিয়েছিলেন। আশ্রমবাসিক পর্বে তিনি বেদব্যাসের কাছে মৃত কর্ণকে একবার দেখতে চেয়েছিলেন। একথা ঠিকই যে দুর্যোধনের অসৎ সংসর্গে কর্ণের ক্রম অধঃপতন কুন্তীকে অত্যন্ত ব্যথিত করছিল। কিন্তু কেবলমাত্র অন্য পুত্রদের বাঁচাতে তিনি কর্ণের কাছে গিয়েছিলেন এ-ধারণাও ঠিক নয়। কুন্তী কর্ণকে ফিরিয়ে আনতেই গিয়েছিলেন। আপন গর্ভের দুই সন্তান, কর্ণ ও অর্জুনের মধ্যে সংগ্রাম কুন্তী আটকাতেই চেয়েছিলেন। কর্ণ সম্মত হলে কুন্তী আপন পুত্রদের কাছে সুনিশ্চিত কর্ণের যথার্থ পরিচয় দিতেন। কিন্তু কর্ণ সম্মত হলেন না।

কুন্তী কৃষ্ণকে কর্ণের যথার্থ পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই সত্য জানতে পেরেই কৃষ্ণও কর্ণকে ভ্রাতাদের সঙ্গে মিলিত হতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কর্ণ তাতেও সম্মতি দেননি। কৃষ্ণকে জানিয়েছিলেন, আপন পরিচয় তিনি অবগত আছেন কিন্তু দুর্যোধনের বন্ধুত্বের ঋণ তাঁকে শোধ করতেই হবে। অনুরোধ করেছিলেন কর্ণের জীবিতকালে কৃষ্ণ যেন কিছুতেই কর্ণের পরিচয় যুধিষ্ঠিরকে না জানান। এই কারণেই কর্ণার্জুনের যুদ্ধের সময় কর্ণের রথের চাকা মেদিনী গ্রাস করলে কৃষ্ণ তাঁকে তেরোটি অধর্মাচরণের উল্লেখ করলেও বলেননি যে, “তুমি তোমার মাকে জতুগৃহে দাহ করতে চেষ্টা করেছিলে”, কারণ কৃষ্ণ জানতেন যে পরিচয় জ্ঞাত হলে যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’ অর্জুন কখনই কর্ণকে বধ করবেন না।

আপন পুত্রদের শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে জননী কুন্তীর সম্যক ধারণা ছিল। একচক্রাপুরীতে ব্রাহ্মণের ঘরে যে বকরাক্ষসের খাদ্য প্রেরণের পালা এল, যাতে একজন মানুষকেও খাদ্য হিসাবে বকরাক্ষসের কাছে পাঠাতে হবে, কুন্তী ক্ষণমাত্র দ্বিধা না করেই ভীমসেনকে সেই খাদ্য নিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির এই নিয়ে অনুযোগ করলে কুন্তী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে ভীমের শক্তি সম্পর্কে আপন প্রত্যয় জানিয়েছিলেন। কুন্তীর মনস্বিতার পরিচয় পাওয়া যায় ভীম-হিড়িম্বার প্রণয়-পরিণয়ের স্বীকৃতি দানে। রাক্ষসী বলে হিড়িম্বার প্রণয় এবং কামকে তিনি অশ্রদ্ধা করেননি। নারীর কামনার দুরন্ত প্রকৃতি তিনি জানতেন। তাই ভীম ও হিড়িম্বার বিবাহ তিনি অনুমোদন করেছিলেন। ঘটোৎকচের জন্মের পর, তার অমানবিক রূপ দেখেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি। তাঁকে বরণ করেছিলেন আনন্দে। পরিচয় দিয়েছিলেন, “জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব সন্তান” রূপে। এই স্বীকৃতি ঘটোৎকচ আমৃত্যু স্মরণ করেছেন, তাই ইরাবান-অভিমন্যুর মৃত্যুর পর ঘটোৎকচ ক্ষিপ্ত সংহারমূর্তি ধারণ করেছিলেন।

দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর অসম্মান কুন্তীকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। বিশ্বসাহিত্যে কুন্তীই প্রথম নারী, যিনি নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মানের পূর্ণ দাবি করেছিলেন। নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রথম নেত্রী তিনি। কৌরবসভায় যে অসম্মান দ্রৌপদী পেয়েছিলেন, শাস্তির দাবি ছিল তাঁর। তাই উদ্‌যোগপর্বে কৃষ্ণের দৌত্য ব্যর্থ হলে তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে কৃষ্ণ মারফত বিদুলা উপাখ্যান জানিয়েছিলেন। দুঃশাসন যে তাঁর অনুরোধ অগ্রাহ্য করে দ্রৌপদীকে রজস্বলা অবস্থায় রাজসভায় নিয়ে গিয়েছিল, তার শাস্তি দাবি করেছিলেন কুন্তী।

বিদুরের নির্দেশে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর তেরো বছর বনবাস অজ্ঞাতবাসের সময় কুন্তী বিদুরের গৃহেই বাস করছিলেন। এই সময়ে গান্ধারীর একবারের জন্যও কুন্তীর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করার ঘটনা আমাদের বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এমনকী দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর চুড়ান্ত লাঞ্ছনার ক্ষেত্রেও গান্ধারী প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তা নিবারণের চেষ্টা করেননি। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা গান্ধারী অবচেতন মনে সমর্থন করেছিলেন। বিবাহের পর দ্রৌপদী প্রথম প্রণাম করতে এলে গান্ধারীর মনে পড়েছিল, এই নারীর জন্যই তাঁর শত পুত্রের মৃত্যু ঘটবে। স্ত্রীপর্বে কৌরব বিধবাদের হাহাকার দেখতে দেখতে গান্ধারী কৃষ্ণকে অভিসম্পাত দিয়েছিলেন যে, তাঁর উপস্থিতিতেই যদুবংশ ধ্বংস হবে। কৃষ্ণ ভূলুণ্ঠিতা গান্ধারীকে তুলে ধরতে ধরতে প্রায় রূঢ় কণ্ঠেই বলেছিলেন, “আপনার দোষেই এই পরিণতি ঘটেছে। আপনি পুত্রদের সমস্ত অন্যায় সমর্থন করে গিয়েছেন, তাদের নিবৃত্ত করার কোনও চেষ্টা করেননি।” মুনিঋষিগণ এইসব কারণেই গান্ধারীকে প্রাতঃস্মরণীয়া পঞ্চকন্যার অন্তর্গত করেননি।

কুন্তী পুত্রদের যুদ্ধজয়ী দেখলেন, রাজচক্রবর্তী যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধযজ্ঞ দেখলেন। পরিচিত হলেন পুত্রবধূ চিত্রাঙ্গদা ও উলূপীর সঙ্গে, পৌত্র বভ্রুবাহনকে আদর করে যথাযথ মর্যাদায় ভূষিত করলেন। সন্তানসম্ভবা উত্তরার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এসব ছাপিয়েও কুন্তীর দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হল গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। পুত্রহারা গান্ধারীকে শুশ্রূষা করেন কুন্তী, কিন্তু বলতে পারেন না যে পুত্র তিনিও হারিয়েছেন। বিজয়ী পুত্রদের দেখলেই তাঁর মনে পড়ে বঞ্চিত মৃত পুত্র কর্ণকে। উত্তরার গর্ভে মৃত পুত্রের জন্ম হলে কুন্তী শেষবারের মতো হাহাকার করেন কৃষ্ণের কাছে। স্বামী-পাণ্ডুর বংশধরকে বাঁচিয়ে দেবার জন্য।

কিন্তু ভিতরে ভিতরে কুন্তী বিলাস-বৈভব, রাজ্যসিংহাসন, বীরত্ব, সাফল্য সব কিছুতেই অনাসক্ত হয়ে উঠছিলেন। তাই যুধিষ্ঠিরের রাজত্বের পনেরো বছর পর ধৃতরাষ্ট্র যখন বনবাস গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেন, কুন্তীও তাঁদের সঙ্গী হলেন। পুত্রদের শত অনুরোধ তাঁকে ফেরাতে পারল না। “তোমরা ক্ষত্রিয়ের পুত্র, অন্যায় করে তোমাদের রাজ্য কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তাই আমি তোমাদের যুদ্ধে উদ্দীপ্ত করেছি। কিন্তু আজ আমার কাজ শ্বশুর-শাশুড়ি তুল্য দুই অন্ধ মানুষের কাছে। সুতরাং আমাকে যেতেই হবে।”

এই কাজ মনস্বিনী কুন্তীরই সাজে। তিনি জানতেন যে, ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারী তাঁর পুত্রদের প্রতি সুবিচার করেননি। তবুও অবহেলা ভরে তাঁদের নিঃসঙ্গ ছেড়ে দিতে পারেন না কুন্তী। তিনি একই সঙ্গে গান্ধারীর দৃষ্টির কাজ করলেন। পুত্রেরা রাজমর্যাদা পেয়েছে, মাতার কাজ শেষ হয়েছে। তিনি এখন কুলবধূ হিসাবে ধৃতরাষ্ট্রের তপস্যার ব্রতে ব্রতী। যাজ্ঞিকেরা প্রতিদিন হোম করছে। সেই হোমের অগ্নি একদিন দাবানলরূপে ছড়িয়ে পড়ল। তপস্যায় ক্ষীণা, কৃশা কুন্তী সরতেও পারলেন না। অগ্নিতেই তাঁর দেহ দগ্ধ ও ভস্মীভূত হল। খাণ্ডবদাহনে পুত্র অর্জুন যে অগ্নিকে তৃপ্ত ও সুস্থ করেছিলেন, সেই অগ্নিই স্বাভাবিক নিয়মে কুন্তীকে গ্রাস করল। সমাপ্তি ঘটল—মনস্বিনী কুন্তীর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *