১০. রাক্ষসী জরা

রাক্ষসী জরা

মগধ দেশে তিন অক্ষৌহিণী সৈন্যের নেতা এবং সমরগর্বিত ‘বৃহদ্রথ’ নামের এক রাজা ছিলেন। তিনি রূপবান, বলবান, সম্পত্তিশালী, অসাধারণ বিক্রমী সর্বদাই যজ্ঞদীক্ষায় চিহ্নে এবং দ্বিতীয় ইন্দ্রের ন্যায় বিদ্যমান ছিলেন। সূর্যের কিরণে এই পৃথিবী যেমন ব্যাপ্ত আছে, তেমনই তাঁর সৎকুলোচিত গুণে এই সমগ্র পৃথিবী ব্যাপ্ত ছিল। সেই মহাবীর বৃহদ্রথ কাশীরাজের পরমাসুন্দরী দুই কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। একদিন নির্জনে বৃহদ্রথ সুন্দরী দুই ভার্যার নিকট শপথ করলেন, “আমি তোমাদের দু’জনার সঙ্গে অপক্ষপাত সমান ব্যবহার করব।” দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হলেও রাজা বৃহদ্রথের কোনও বংশরক্ষক পুত্র জন্মগ্রহণ করল না। রাজা যাগযজ্ঞ, নিষ্ঠা, হোম, মাঙ্গলিক কার্য করলেন—কিন্তু পুত্র জন্মাল না।

একদিন রাজা শুনতে পেলেন যে গৌতমবংশীয় কাক্ষীবানের পুত্র উদারচেতা চণ্ডকৌশিক মুনি তপস্যায় পরিশ্রান্ত হয়ে এক বৃক্ষমূলে অবস্থান করছেন। রাজা দুই ভার্যার সঙ্গে গিয়ে অনেক সেবায় তাঁকে সন্তুষ্ট করলেন। তখন চণ্ডকৌশিক মুনি বললেন, “মহারাজ আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনি বর গ্রহণ করুন।”

তখন বৃহদ্রথ রাজা দুই ভার্যার সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রণাম করে, পুত্রমুখ না দেখার সুগভীর নৈরাশ্যে বাষ্প গদগদ কণ্ঠে মুনিকে বললেন, “ভগবান আমি রাজ্য পরিত্যাগ করে তপোবনে চলেছি। আমি মন্দভাগ্য, আমার বরে প্রয়োজন কী?” এই কথা শুনে বিচলিত চণ্ডকৌশিক মুনি সেই আমগাছের ছায়াতে উপবেশন করলেন এবং ধ্যানস্থ হলেন।

মুনি উপবেশন করলে, একটি আম্রফল বায়ুসঞ্চারিত বা শুকদষ্ট না হয়েই তাঁর কোলের উপর পড়ল। মুনি সেই অতুলনীয় ফলটি গ্রহণ করে, মনে মনে মন্ত্রপাঠ করে পুত্রলাভের জন্য তা রাজাকে দিলেন। মুনির এই কথা শুনে রাজা তাঁর চরণে প্রণাম করে আপন গৃহে প্রত্যাগমন করলেন এবং পত্নীদের ঋতুকাল উপস্থিত হয়েছে জেনে একটি আম্রফল দুই পত্নীকে প্রদান করলেন এবং রাজরানিরা মুনিবাক্য অবশ্য সত্য হবে এই ভেবে, একটি ফলকেই দুইভাগে ভাগ করে দুজনেই ভক্ষণ করলেন। ফল ভক্ষণ করার ফলে রাজরানিদের দুজনেরই গর্ভ হল। রাজা তাদের গর্ভবতী দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তারপর দশম মাস উপস্থিত হলে তাঁরা যথানিয়মেই দুটি শরীরখণ্ড প্রসব করলেন।

তখন সেই ভগিনীরা অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন যে, তাঁদের প্রতি প্রসূতখণ্ডে এক একটি চোখ, এক একটি হাত ও এক একখানি চরণ ছিল এবং উদরের অর্ধ, মুখের অর্ধ এবং শরীরের অবোভাগের অর্ধ ছিল। সেই অবস্থা দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ও দুঃখিত রানিরা কাঁপতে কাঁপতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেই সজীব শরীর খণ্ড দু’খানিকে পরিত্যাগ করলেন।

এদিকে রক্তমাংসভোজী ‘জরা’ নামে এক রাক্ষসী চতুষ্পথনিক্ষিপ্ত সেই গর্ভখণ্ড দু’খানি গ্রহণ করল। তারপর সেই রাক্ষসী বিধাতার প্রভাবে প্রণোদিত হয়ে সেই খণ্ড দু’খানিকে সুদৃশ্য করবার ইচ্ছায় সংযোজিত করল। সেই খণ্ড দু’খানিকে সংযোজিত করা মাত্র তা শরীর ধারণ করে একটি বীরশিশু রূপে পরিণত হল। রাক্ষসী বিস্ময়ে বিস্ফারিত নেত্রে দেখল যে, সে নিজে এই শিশুকে বহন করতে পারছে না। এদিকে সেই শিশুটি রক্তবর্ণ ডান হাতখানি মুঠো করে, তা মুখে পুরে অতিদর্পিত জলপূর্ণ মেঘের গর্জনে রোদন করে উঠল। সেই প্রচণ্ড গর্জন শুনে অন্তঃপুরের লোকেরা এবং দুই রানি রাজার সঙ্গে পথে নেমে এল। জরা রাক্ষসী সেই দুগ্ধপূর্ণস্তনী রাজমহিষী দু’জন ও পুত্রার্থী বিষণ্ণ রাজাকে দেখে ভাবল, “ধার্মিক, মহাত্মা, পুত্রার্থী রাজার রাজ্যে বাস করে আমি তাঁর এই শিশুপুত্রকে বধ করতে পারি না।”

তখন সেই রাক্ষসী মানুষীর রূপ ধারণ করে, মেঘশ্রেণি যেমন সূর্যকে ধারণ করে, তেমনই অতি কষ্টে শিশুটিকে ধারণ করে রাজাকে বলল, “মহারাজ, আমি এই পুত্রটিকে আপনাকে দিলাম।আপনি গ্রহণ করুন। একটি ব্রাহ্মণের বরে আপনার দুই পত্নীর গর্ভে শিশুটি জন্মেছিল, পরে ধাত্রীরা তাকে পরিত্যাগ করেছিল। কিন্তু আমি রক্ষা করেছি।” কাশীরাজকন্যারা তৎক্ষণাৎ সেই শিশুপুত্রকে ক্রোড়ে নিয়ে স্তন্যদুগ্ধ দ্বারা স্নান করাতে লাগলেন। রাজা এই ঘটনা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে স্বর্ণবর্ণা মনুষ্যরূপিণী সেই রাক্ষসীকে বললেন, “হে পদ্মকোষবর্ণা কল্যাণী, আমার পুত্রদায়িনী তুমি কে? নিঃসংকোচে আমাকে বলো। আমার মনে হয়, তুমি দেবতা।” রাক্ষসী বলল, “মহারাজ, আমি জরানাম্নী কামরূপিণী রাক্ষসী। আমি আপনার ঘরে পূজিত হয়ে সুখে বাস করেছি, আপনার মঙ্গল হোক। গৃহদেবী নামে রাক্ষসী প্রত্যেকের গৃহে সর্বদা বাস করে; পূর্বকালে ব্রহ্মা তাদের দিব্যরূপবতী করে সষ্টি করে দানবদের বিনাশ করার জন্য মনুষ্যগৃহে স্থাপন করেছেন। যে লোক ভক্তির সঙ্গে যুবতী ও পুত্রদের নিয়ে গৃহদেবীকে দেওয়ালে এঁকে রাখে তাদের উন্নতি হয়, না হলে অবনতি ঘটে। মহারাজ আমি বহু পুত্ৰবেষ্টিত অবস্থায় আপনার ঘরের দেওয়ালে চিত্রিত অবস্থায় বহুদিন সম্মানিত হয়েছি। গন্ধ, পুষ্প, ধূপ, খাদ্য এবং পেয় দ্বারা বিশেষভাবে পূজিত হয়েছি। তাই সর্বদাই আমি আপনার উপকার করার চিন্তা করে যাচ্ছি। আমি আপনার এই পুত্ৰশরীরের খণ্ড দুটি দৈববশত দেখেছিলাম। তারপর তা সংযোজিত করামাত্র আপনার ভাগ্যবশত এই শিশু জন্মেছে। আমি নিমিত্তমাত্র। আমি সুমেরু পর্বত পর্যন্ত খেয়ে ফেলতে পারি। আপনার পূজায় সন্তুষ্ট, তাই আপনার পুত্রকে খাইনি।”

জরা রাক্ষসী এই বলে অন্তর্হিত হল। রাক্ষসী জরা চরিত্রে অপূর্ব মাতৃ-মমতার পরিচয় দিয়েছেন ব্যাসদেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *