০৭. সত্যবতী

সত্যবতী

জন্ম ও পরাশর সম্মিলন

সর্বদা ধর্মপরায়ণ, বেদপাঠে নিরত, পবিত্র অথচ মৃগয়াশীল, পুরুবংশীয় স্বভাবসুন্দর, ইন্দ্রের সখা উপরিচর বসু চেদিরাজ্যের রাজা ছিলেন। অস্ত্র ত্যাগ করে তপোবনে উপরিচর বসু দীর্ঘকাল তপস্যায় নিরত হলে দেবগণ চিন্তিত হলেন যে, তিনি ইন্দ্রত্বপদের জন্য তপস্যা করছেন। তখন দেবতারা তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “আপনার জন্যই পৃথিবীতে ধর্ম হ্রাস পাচ্ছে না। আপনি সর্বদা উদ্‌যোগী, সতর্ক ও ধার্মিক হয়ে ভূলোকে থেকে ধর্ম রক্ষা করুন। আপনি পরিণামে পুণ্যলোভজনক চিরস্থায়ী ব্রহ্মলোক দেখতে পাবেন।

দেবরূপী ইন্দ্র আরও বললেন, ‘নরনাথ! আপনি ভূতলে আছেন, আমি স্বর্গে। তথাপি আপনি আমার প্রিয়সখা হয়েছেন। তাই শস্যাদি ও ধনরত্নে পরিপূর্ণ, ধর্মানুষ্ঠানের জন্য বিখ্যাত, পশুদের পক্ষে হিতকর— আপনি এই চেদিদেশেই বাস করুন। এ দেশের মানুষ সত্য ভাষণে রত ও সর্বদা আনন্দিত। পুত্র পিতার সঙ্গে সদ্‌ভাবে বাস করে। কৃষক গোরুগুলিকে ভারবহনে নিযুক্ত করে না। দুর্বল গোরুগুলিকে সবল করে। এই চেদিদেশে সকল বর্ণই আপন ধর্ম পালন করে। আপনি চেদিদেশে রাজত্ব করুন।

আমি আপনার উদ্দেশ্যে একটি দিব্য বিমান দান করে রেখেছি। তা স্ফটিকনির্মিত, দেবভোগ্য। আকাশগামী ও বিশাল, তা আপনার কাছে উপস্থিত হবে। আপনি মর্ত্যলোকের মধ্যে প্রধান। সুতরাং সেই মহাবিমানে চড়ে মূর্তিমান দেবতার মতো সর্বত্র আকাশে বিচরণ করবেন। আর ‘বৈজয়ন্তী’ নামে আপনাকে একছড়া পদ্মের মালা প্রদান করছি, এর পদ্মগুলি কখনও বিকৃত হবে না এবং এই মালা যুদ্ধে আপনাকে অক্ষত অবস্থায় রক্ষা করবে। এই মালা ‘ইন্দ্ৰমালা’ নামে জগতে খ্যাত হবে এবং এই মালাই আপনার চিহ্ন হবে। এ ছাড়াও শিষ্টলোকের পরিরক্ষক বংশযষ্টি প্রদান করছি।

ইন্দ্র দেবগণের সঙ্গে চলে গেলে, অত্যন্ত আনন্দিত সেই উপরিচর বসু ইন্দ্রের উপহারগুলি নিয়ে আপন রাজ্যে প্রবেশ করলেন এবং অত্যন্ত উৎকৃষ্ট বেদি নির্মাণ করে সেই বংশযষ্টি বেদিমধ্যে প্রোথিত করে দেশবাসীর সঙ্গে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষে মহাসমারোহে তাঁর পূজা করলেন। সেই দিন থেকে এই ইন্দ্রযষ্টি পূজা চেদিরাজ্যে প্রচলিত হল এবং তা প্রতি বৎসর পালিত হতে থাকল।

উপরিচর বসুর পাঁচটি মহাবলবান ও প্রভাবশালী পুত্র ছিল। জ্যেষ্ঠ বৃহদ্রথ মগধদেশের বীরদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র ‘প্রত্যগ্রহ,’ তৃতীয়ের নাম কুশাম্ব, কুশাম্বের আর এক নাম ছিল মণিবাহন। চতুর্থের নাম ‘মাবেল্ল’ এবং পঞ্চমের নাম যদু। যদু সর্বত্র অপরাজিত ক্ষত্রিয় ছিলেন।

উপরিচর রাজার রাজ্যের কাছ দিয়ে ‘শুক্তিমতী’ নদী প্রবাহিত ছিল। কোলাহল নামের এক পর্বত কামের আবেগে শুক্তিমতীকে আবদ্ধ করে। রাজা সে কথা শুনে কোলাহল পর্বতকে এক কঠিন পদাঘাত করেন। সেই পাদপ্রহারে শুক্তিমতী নদীর গর্ভজাত কোলাহল পর্বতের এক পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। শুক্তিমতী কন্যাটিকে রাজার মহিষী ও পুত্রটিকে সেনাপতি হবার জন্য দান করে। পর্বতের সেই কন্যার নাম ছিল গিরিকা।

গিরিকা ছিল তুলনাহীনা রূপবতী নারী, অনবদ্যাঙ্গী। কোনও এক সময়ে বসুপত্নী গিরিকা ঋতুস্নান করে পবিত্র হয়ে পুত্র উৎপাদনের জন্য রাজাকে রমণের সময় জানালেন। দৈববশত সেই দিনই রাজার পিতৃপুরুষগণ এসে সন্তুষ্ট চিত্তে রাজাকে বললেন, ‘তুমি আজ বনে মৃগবধ করো।” পিতৃগণের আদেশে রাজা গিরিকাকে ছেড়ে মৃগয়া করতে চলে গেলেন; কিন্তু মনে কামের আবেগ থাকল। দ্বিতীয় লক্ষ্মীর ন্যায় সুন্দরী গিরিকাকে ভাবতে ভাবতেই মৃগয়া করতে লাগলেন।

মৃগয়া করতে করতে রাজা কুবের উদ্যানের ন্যায় মনোহর একটি বন দেখতে পেলেন। সে বনে অশোক, চম্পক, আম্র, তিনিশ, পুন্নাগ, কর্ণিকার, বকুল, পারুল, কাঁঠাল, নারকেল চন্দন ও অর্জুন প্রভৃতি বহুতর মনোহর পবিত্র ও সুস্বাদু ফলযুক্ত বৃক্ষ ছিল। একে বসন্তকাল, তাতে আবার কোকিলগণ আকুল রবে চিৎকার করছিল। মত্ত ভ্রমরকুল গুনগুন করে চারপাশে গুঞ্জন করছিল। কামসন্তপ্ত চিত্তে ইতস্তত ভ্রমণ করতে করতে রাজা এক অশোক বৃক্ষ দেখতে পেলেন। তার শাখার আগাগুলি ফুলে ছেয়ে গিয়েছিল। পল্লবে শোভা পাচ্ছিল এবং বহুতর পুষ্পগুচ্ছে আবৃত ছিল। রাজা উপরিচর সেই অশোক গাছের ছায়ায় সুখে উপবেশন করে মধু ও পুষ্পের সৌরভবাহী বাতাস সেবন করতে লাগলেন; সেই বায়ু সেবনে তার উত্তেজনা জন্মাল। তিনি মনে মনে স্ত্রী সম্ভোগসুখ অনুভব করতে লাগলেন; তাতেই তাঁর সেই গভীর বনমধ্যে শুক্রপাত হল।

‘আমার শুক্র নিষ্ফল না হয়’ এই ভেবে রাজা পতনের সময়ে সেই শুক্র কোনও বৃক্ষপত্রে ধারণ করলেন। রাজা অঙ্গুলীয় দিয়ে সেই শুক্র সংহত করলেন এবং অশোকের রক্তপল্লবদ্বারা সেই পত্রটিকে একটি ছোট্ট পুটকের আকারে বন্ধন করলেন।

রাজা ধর্মের সূক্ষ্ম তত্ত্ব জানতেন এবং নিজের বীর্য; যে অব্যর্থ তাও জানতেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন— আমার এই শুক্র নিস্ফল না হয় এবং মহিষীর ঋতুও ব্যর্থ না হয়ে যায়। এই ভেবে রাজশ্রেষ্ঠ বসু বার বার কর্তব্য বিষয়ে পর্যালোচনা করে এবং মহিষীর গর্ভধারণের এই সময় তা ভেবে, সেই শুক্রকে অভিমন্ত্রিত করে নিকটবর্তী এক দ্রুতগামী শ্যেনপক্ষীকে গিয়ে বললেন, “হে সৌম্যমূর্তি শ্যেন, আমার সন্তোষের জন্য তুমি আমার শুক্র আমার স্ত্রী গিরিকার কাছে নিয়ে যাও। আজ তার ঋতুস্নান হয়েছে।

তখন সেই বেগবান শ্যেন পাখি সেই শুক্র নিয়ে, দ্রুত আকাশে ছুটে চলল। অন্য আর একটি শ্যেন পাখি প্রথম শ্যেন পাখির নখের মধ্যে ধরে থাকা সেই ছোট্ট পুটকটিকে মাংসখণ্ড মনে করে প্রথম শ্যেন পাখিটিকে আক্রমণ করল। তারপর তারা দুই শ্যেন পাখিই আকাশে চঞ্চুযুদ্ধ আরম্ভ করল। তারা যুদ্ধ করতে থাকলে; সেই শুক্র যমুনার জলে পড়ে গেল। তখন অদ্রিকা নামের কোনও প্রধান অপ্সরা কোনও ব্রাহ্মণের শাপে মৎস্য হয়ে জলে বাস করছিল। মৎস্যরূপিণী সেই অদ্রিকা বেগে এসে শ্যেনপক্ষীর চরণ থেকে পতিত রাজার সেই শুক্র মুখ দ্বারা গ্রহণ করল। তারপর দশম মাস উপস্থিত হলে, কোনও একদিন সে ধীবরদের জালে ধরা পড়ল। ধীবরেরা তাকে পেটের থেকে কাটলে তার পেটের ভিতর থেকে একটি স্ত্রী ও একটি পুরুষ বার হল। তারপর ধীবরেরা গিয়ে সেই আশ্চর্য বৃত্তান্ত রাজাকে জানাল। বলল, “মহারাজ, মৎস্যীর পেট থেকে এই দুটি মানুষ জন্মেছে।” রাজা উপরিচর সে মানব সন্তান দুটিকে গ্রহণ করলেন। এই পুরুষটিই পরে মৎস্য নামে ধার্মিক ও সত্যপ্রতিজ্ঞ বিরাট রাজা রূপে বিখ্যাত হয়েছিলেন। সেই অপ্সরাও তৎক্ষণাৎ শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেলেন। রাজা এই কন্যা সন্তানটি “তোমার হোক” বলে রাজা সেই কন্যাটিকে ধীবরের হাতে সমর্পণ করলেন।

সেই কন্যাটির রূপ, উৎসাহ ও সমস্ত গুণ ছিল এবং বাস্তবিক নাম ছিল সত্যবতী। আর মৎস্যঘাতীদের আশ্রয়ে থাকায় অনেকে তাকে কিছু কাল মৎস্যগন্ধা বা গন্ধকালী বলেও ডাকত। সে পরমাসুন্দরী ছিল; তাকে দেখে সিদ্ধ মুনিগণেরও লোভ জন্মাত। কোনও সময়ে সেই কন্যাটি পিতার আনুকূল্য করার জন্য যমুনার জলে পিতারই নৌকা বাইছিল। এই সময়ে তীর্থযাত্রায় বহির্গত পরাশর মুনি তাকে দেখতে পেলেন। দেখেই তিনি কামার্ত হয়ে পড়লেন—

দৃষ্ট্বৈব স চ তাং ধীমাংশ্চকমে চারুহাসিনীম্।

দিব্যাং তাং বাসবীং কন্যাং রম্ভোরুং মুনিপুঙ্গবঃ ।। আদি : ৫৮ :৮৫।

—দেখেই তিনি (পরাশর মুনি) কামার্ত হয়ে পড়লেন; কেন-না তখন সে সুন্দর হাসছিল, তার স্বর্গীয় রূপ প্রকাশ পাচ্ছিল এবং উরু দুটি কদলী স্তম্ভের ন্যায় শোভা পাচ্ছিল।

তখন পরাশর তাকে চিনতে পেরে, সমস্ত বৃত্তান্ত স্মরণ করে বললেন, “সুন্দরী, যে নৌকা বেয়ে থাকে, সে নাবিক কোথায় গিয়েছে বলো।” মৎস্যগন্ধা বললেন, “ব্রাহ্মণ ধীবররাজের কোনও পুত্রসন্তান নেই; আমিই তাঁর একমাত্র কন্যা। তাই সহস্রলোক আরোহণ করলেও তাঁর সন্তোষের জন্য আমি এই নৌকা বেয়ে থাকি।” পরাশর বললেন, “কল্যাণী! বসুনন্দিনী! তুমি ভাল কাজ করছ। যা-ই হোক তুমি বিলম্ব করছ কেন, নৌকা বাইতে থাকো। আজ আমার অনুগ্রহ পেয়ে এই নদী— সহস্র ভাগের একভাগ হয়ে যাবে এবং আমিই আজ শেষ আরোহী হব; সুতরাং সত্বর আমাকে পারে নিয়ে যাও।”

‘তাই হোক’ এই কথা বলে মৎস্যগন্ধা নৌকা বাইতে লাগলেন। এদিকে পরাশর সতৃষ্ণ কামার্ত দৃষ্টিতে তাকে দেখতে থাকলেন; মৎস্যাগন্ধা পরাশরের দৃষ্টির তৃষ্ণা বুঝতে পেরে বললেন, “আমি ধীবররাজের কন্যা; লোকে আমাকে মৎস্যাগন্ধা বলে ডাকে। আমার বাস্তবিক পিতামাতা নেই বলে আমি শোকসন্তপ্ত; এ অবস্থায় আপনি আমার জন্মের বিষয় কীভাবে জানলেন, বলুন।” পরাশর বললেন, “আমি তোমাকে দেখামাত্র তোমাকে দিব্যজ্ঞানে চিনতে পেরেছি। বসুনন্দিনী! তোমার প্রণয় লাভ করার জন্য আমি যা বলছি, তা শোনো। বর্হিষদ বলে বিখ্যাত সোমপায়ী কতগুলি পিতৃলোক আছেন; তুমি তাঁদের মানসকন্যা ছিলে; তখন তোমার নাম ছিল ‘অচ্ছোদা’। তোমার থেকেই সেই অলৌকিক অচ্ছোদ সরোবর জন্মেছিল। তুমি কোনও সময়েই সেই পিতৃগণকে দেখোনি। তুমি পিতৃগণের মন থেকে জন্মেছিলে, অথচ তাদের আপন পিতা বলে জানতে না। তাই তুমি সেই পিতৃগণকে পরিত্যাগ করে অন্য লোককে পিতা বলে স্বীকার করেছিলে; সে লোকটির নাম ছিল বসু। তিনি স্বর্গীয় মনুর পুত্র ছিলেন এবং তৎকালে তিনি আকাশে অদ্রিকা নামক অপ্সরার সঙ্গে বাস করছিলেন। তুমি নিজের ইচ্ছা অনুসারে রূপধারণ করতে পারতে; কিন্তু অন্য লোককে পিতা বলে প্রার্থনা করেছিলে, সেই অপরাধেই যোগভ্রষ্ট হয়ে পড়ছিলে। তুমি পতনের সময়ে কাছেই তিনটি বিমান দেখেছিলে এবং তার ভিতরে অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতি সেই আপন পিতৃগণকেও দেখেছিল। অঙ্গগুলি যেন সেই পিতৃপুরুষগণকে অপর অঙ্গের ভিতর রেখে দিয়েছিল এবং তাঁরা এত ক্ষুদ্র ছিলেন যে তাঁদের দেখা যাচ্ছিল না। এদিকে তুমি অধোমুখ হয়ে পড়তে থেকে হা পিতঃ! বলে তাঁদের ডাকছিলে। তখন তাঁরা তোমাকে বলেছিলেন ‘ভয় নেই’; তাতেই তুমি আকাশেই থেকে গিয়েছিলে। তারপর তুমি কাতর পিতৃপুরুষগণকে প্রসন্ন করেছিলে। তোমার পিতৃগণ তোমাকে বলেছিলেন যে, শুভ্রহাসিনী! তুমি নিজের দোষে অণিমাদি ঐশ্বর্যশূন্য হয়ে পড়ছ। এ জগতে দেবতারা যে শরীর দ্বারা ধর্ম বা অধর্ম করেন সেই শরীর দ্বারাই তার ফলভোগ করেন। কিন্তু মনুষ্যেরা অন্য শরীর দ্বারা ধর্মাধর্মের ফল ভোগ করেন, এই বিধাতার নিয়ম। আর দেবতার কর্মফল সদ্যই হয় এবং মনুষ্যের কর্মফল জন্মান্তরে হয়ে থাকে। অতএব পুত্রী, তুমি দেবতা বলে, আপন কর্মফলে সদ্যই পতিত হচ্ছ। তোমার দোষ এই যে তুমি পিতৃপুরুষ চিনতে না-পেরে আপনাকে আপনি বসুর কন্যা বলে স্বীকারও করেছ। তুমি উপরিচর রাজার ঔরসে মৎস্যীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবে। এদিকে সে অদ্রিকা প্রয়াগে গঙ্গাযমুনা সঙ্গমস্থানে মৎস্যরূপে জন্মেছে। তুমি পরাশরের ঔরসে একটি পুত্র প্রসব করবে; সে পুত্রটি পরে ব্রহ্মর্ষি হয়ে এক বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করবে। আর, তুমি শান্তনুরাজার ঔরসে মহাবীর চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুটি পুত্রকেও প্রসব করবে। তুমি এই তিনটি উৎকৃষ্ট পুত্র প্রসব করে পুনরায় আপন পিতৃলোকে চলে যাবে। আপন পিতা পরিত্যাগ করে অন্য পিতা গ্রহণ করাতেই তুমি কুৎসিত জন্মগ্রহণ করবে। তুমি উপরিচর রাজার কন্যা রূপে অদ্রিকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করবে। সে জন্মটা আজ থেকে আটশো দ্বাপরযুগে মৎস্যযোনিতে হবে।

সেই পূর্বকালে পিতৃলোকেরা তোমাকে একথা বলেছিলেন। তাই তুমি এখন সত্যবতী হয়ে জন্মেছ। অদ্রিকা অপ্সরাও ব্রাহ্মণের অভিসম্পাতে মৎস্যী হয়ে, তোমাকে প্রসব করে স্বর্গে চলে গিয়েছে। সেই তুমি উপরিচর রাজার ঔরসে সেই মৎস্যীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছ। অতএব বসুকন্যে, তোমার মঙ্গল হোক; আমি তোমার কাছ থেকে একটি বংশরক্ষক পুত্র প্রার্থনা করি; সুতরাং কল্যাণী, তুমি আমার সঙ্গে সঙ্গম করো” পরাশর একথা বললেন।

পূর্বজন্ম স্মরণ হওয়ায় বিস্ময়ে মৎস্যগন্ধার সর্ব অঙ্গে রোমাঞ্চ দেখা দিল। তখন সে বলল, “ভগবন! অপর পারে ঋষিরা রয়েছেন। তাঁরা দেখতে থাকলে আমাদের সঙ্গম হবে কীভাবে?” মৎস্যগন্ধা এ কথা বললে, তপোপ্রভাবশালী পরাশর ঘন কুয়াশা সৃষ্টি করলেন; স্থানটি ঘন অন্ধকারে পূর্ণ হল। মহর্ষির সে আশ্চর্য ক্ষমতায় মৎস্যগন্ধা লজ্জিত ও বিস্মিত হয়ে পড়ল। সত্যবতী বলল, “ভগবন! আমি কুমারী বিশেষত সর্বদাই পিতার অধীনে চলি। আর আপনার সঙ্গে সংসর্গ করলে আমার কন্যাত্ব দূষিত হয়ে পড়বে। কুমারী অবস্থায় দূষিত হয়ে আমি গৃহে ফিরব কেমন করে বাঁচতেও তো পারব না। মহর্ষি এই সমস্ত বিবেচনা করে যা কর্তব্য হয় করুন।” মৎস্যগন্ধা একথা বললে, পরাশর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বললেন, “তুমি আমার প্রিয়কার্য করেও কন্যাই থাকবে। হে অনুরাগিণী! হে ভয়শীলে! তোমার যে বর ইচ্ছা করো, তাই গ্রহণ করো। আমার অনুগ্রহ পূর্বে কখনও নিস্ফল হয়নি।” পরাশর এই কথা বললে, মৎস্যগন্ধা আপন গাত্রের উত্তম গন্ধ বর প্রার্থনা করল।

প্রভাবশালী মহর্ষি পরাশর মৎস্যগন্ধার অভিলষিত বর তাকে দিলেন। তদনন্তর স্ত্রীজাতির স্বভাব ও সৌন্দর্যাদি গুণশালিনী সত্যবতী অদ্ভুতকর্মা পরাশরের সঙ্গে সংসর্গ করল। সেই পরাশরের বরে তার ‘গন্ধবতী’ নামটি জগতে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। লোকসকল এক যোজন দূর থেকে সত্যবতীর শরীরের আঘ্রাণ-সৌরভ লাভ করত। তাই তার যোজনগন্ধা নাম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল।

এইভাবে সত্যবতী উৎকৃষ্ট বর লাভ করে আনন্দিত হয়ে পরাশরের সংসর্গে সদ্যই গর্ভধারণ করলেন এবং প্রসব করলেন। পরাশরের পুত্র যমুনাদ্বীপেই বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠলেন এবং মাতার অনুমতি নিয়ে তপস্যাতেই মনোনিবেশ করলেন। তখন তিনি বললেন, “মা, কার্য উপস্থিত হলে, আপনি আমাকে স্মরণ করা মাত্র আমি আপনার কাছে এসে উপস্থিত হব।” এইভাবে পরাশর থেকে সত্যবতীর গর্ভে দ্বৈপায়ন জন্মেছিলেন। সেই পুত্রটির জন্ম দ্বীপে স্থাপিত হয়েছিল বলে, তার নাম হয়েছিল দ্বৈপায়ন। তিনি কোনওক্রমে মহাজ্ঞানী হয়ে প্রত্যেক যুগে ধর্মের এক এক পাদ হ্রাস পাচ্ছে দেখে এবং লোকের আয়ু ও শক্তি কমে যাচ্ছে ইত্যাদি যুগের অবস্থা দেখে, বেদ ও ব্রাহ্মণদের প্রতি অনুগ্রহ করার ইচ্ছায় এক বেদকে চার ভাগে বিভক্ত করেন; তাতেই তাঁর নাম হয় ‘ব্যাস’। গাত্রবর্ণ কালো হওয়ায় নাম হল কৃষ্ণ।

প্রভাবশালী বরদাতা মুনিশ্রেষ্ঠ দ্বৈপায়ন সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল আর নিজ পুত্র শুক এবং বৈশম্পায়নকে সাম, ঋক যজু ও অথর্ব এই চারটি বেদ এবং পঞ্চম বেদ মহাভারত অধ্যয়ন করান; পরে তাঁরাই মহাভারতের মূল সংহিতাগুলি পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশ করেন।

সত্যবতীর বিবাহ।

গঙ্গা বিচ্ছেদের পর ছত্রিশ বছর কেটে গেছে। শান্তনু গঙ্গাবক্ষে বিচরণ করতে করতে পুত্র দেবব্রতকে দেখলেন। শান্তনুর আকুল প্রার্থনায় গঙ্গা দেবব্রতকে এনে শান্তনুর হস্তে সমর্পণ করলেন। শান্তনু পুত্র দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন। আনন্দে আরও চার বছর কেটে গেল।

তারপর কোনও একদিন শান্তনু রাজা যমুনানদীর তীরবর্তী বনে গিয়ে অনির্বচনীয় একপ্রকার উৎকৃষ্ট গন্ধ অনুভব করলেন। সেই গন্ধের উৎপত্তিস্থান কোথায় তা অন্বেষণ করতে থেকে তিনি সকল দিকে বিচরণ করতে লাগলেন। তখন দেবতার ন্যায় সুন্দরী একটি কন্যাকে দেখতে পেলেন। তিনি সেই দীর্ঘনয়না কন্যাটিকে দেখে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি কার কন্যা? তোমার নাম কী? এখানে তুমি কী করছ?” সেই কন্যাটি বলল, “আমি কৈবর্তের কন্যা; আমার পিতা মহাত্মা দাসরাজার আদেশে আমি ধর্মের জন্য নৌকা বাইছি; আপনার মঙ্গল হোক।” শান্তনু সেই দাসকন্যাটিকে কোনও দেবীর ন্যায় রূপ, লাবণ্য ও সৌরভযুক্ত দেখেই তার সঙ্গে সম্ভোগের ইচ্ছা করলেন। তিনি দাসরাজের কাছে গিয়ে কন্যাটিকে প্রার্থনা করলেন। সে দাসরাজও শান্তনুকে বললেন, “মহারাজ, কন্যা যখন জন্মেছে, তখন অবশ্যই তাকে বরের হাতে দান করতে হবে; কিন্তু আমার মনে একটি ইচ্ছা আছে, আগে আপনি তা শ্রবণ করুন।

শান্তনু বললেন, “দাসরাজ তোমার ইচ্ছা শুনেই আমি তা পূর্ণ করতে প্রবৃত্ত হব। দানের যোগ্য হলে, তা তোমাকে দেব। আর দানের যোগ্য না হলে কিছুতেই তা দিতে পারব না।” দাসরাজা বললেন, “এই কন্যার গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে আপনার পর সেই রাজা হবে, এইভাবে তাকেই যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করতে হবে; কিন্তু অন্য কাউকেই ভাবী রাজা বলে অভিষিক্ত করতে পারবেন না।”

শান্তনু তীব্র কামানলে দগ্ধ হতে থেকেও, দেবব্রতকে স্মরণ করে, ধীবরকে সে বর দিতে ইচ্ছা করলেন না। কিন্তু তিনি কামবেদনায় মূৰ্ছিতপ্রায় হয়ে, সেই দাসকন্যাকেই চিন্তা করতে করতে হস্তিনাপুরে ফিরলেন। অপ্রাপ্তিজনিত শোকে শান্তনু আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। এমন সময়ে একদিন পুত্র দেবব্রত এসে তাকে বললেন, “পিতৃদেব, সকল দিকেই আপনার মঙ্গল দেখছি এবং সকল রাজাই আপনার বশবর্তী রয়েছেন। তবে আপনি কোন দুঃখে সর্বদা শোকগ্রস্ত আছেন। মহারাজ আপনি ধ্যানীর মতো থেকে আমাকে কোনও কথাই বলেন না এবং অশ্বারোহণ করে বাইরেও যান না। আপনার শরীর কান্তিহীন, পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে গেছে। আপনার রোগ কী আমি জানতে ইচ্ছা করি, কেন-না তা জানলে আমি তার প্রতিকার করতে পারব।”

দেবব্রত এই কথা বললে, শান্তনু প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘বৎস, তুমি যে আমাকে ধ্যান-তৎপর বলছ, তা ঠিকই; তবে তার কারণ শোনো— আমাদের এই বিশাল বংশে তুমিই একমাত্র সন্তান। অথচ তুমি সর্বদাই পুরুষকার অবলম্বন করে থাকো এবং সর্বদাই অস্ত্র ব্যবহার করো। এদিকে মানুষও স্থায়ী নয়। এইসব ভেবে আমি শোকার্ত হয়ে পড়েছি। কেন-না, কোনও প্রকারে তোমার বিপদ ঘটলে, আমাদের বংশ আর থাকবে না। এই কারণে তুমি একশো পুত্র থেকেও আমার কাছে প্রিয় এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এইজন্যই আমি সন্তানবৃদ্ধির জন্য অনর্থক পুনরায় দারপরিগ্রহ করতে ইচ্ছা করি না; কিন্তু তোমার মঙ্গল হোক, এই কেবল কামনা করি। তবে বেদবাদীরা বলে থাকেন যে, এক পুত্র থাকা আর নিঃসন্তান হওয়া— এই উভয়েই প্রায় সমান। আর অগ্নিহোত্র করা, বেদাধ্যয়ন করা এবং অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যা বিস্তার করা— এ সমস্তও এক সন্তান থাকার ফলে ষোলোভাগের একভাগ ফলও লাভ করতে পারে না। বৎস, একথা সকল প্রাণীর ক্ষেত্রেই সত্য। গাঙ্গেয়, সন্তান যে সর্বকল্যাণকর এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তুমি বীর, সর্বদা যুদ্ধ করতে সমর্থ এবং সর্বদা অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। সুতরাং যুদ্ধ ব্যতীত অন্য কোনও কারণে তোমার মৃত্যু ঘটবে না। সুতরাং বৎস, আমি এই সংশয়াপন্ন হয়েছি যে, তোমার অভাবে আমাদের বংশের কী অবস্থা হবে। তোমার নিকট আমার সমস্ত দুঃখের কারণ বললাম।”

অত্যন্ত বুদ্ধিমান দেবব্রত শান্তনুর সেই দুঃখের কারণ সমস্ত বুঝতে পেরে সেই বিষয় চিন্তা করতে করতে পিতার হিতৈষী বৃদ্ধ মন্ত্রীর কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেই বৃদ্ধ মন্ত্রী দেবব্রতের কাছে বললেন, “দাসকন্যা সত্যবতীকে দেখে মহারাজের অভিলাষ জন্মেছে।” দেবব্রত বৃদ্ধ ক্ষত্রিয়গণের সঙ্গে মিলিত হয়ে তখনই দাসরাজের কাছে গিয়ে, পিতার জন্য নিজেই সত্যবতীকে প্রার্থনা করলেন।

তখন দাসরাজ আদরের সঙ্গে দেবব্রতকে আপন সভায় নিয়ে গেলেন এবং যথাবিধানে তাঁর পূজা করে বললেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, আপনি মহারাজ শান্তনুর পুত্র, বিশেষত আপনি এখন অস্ত্রধারিশ্রেষ্ঠ হয়েছেন। সুতরাং আপনিই মহারাজের উপযুক্ত অবলম্বন আছেন; সুতরাং আপনাকে আমি আর কী বলব। এই রকম শ্লাঘ্য ও অভীষ্ট বৈবাহিক সম্পর্ক স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না।

এই সন্তানটি মহাকুল সম্ভূত রাজা উপরিচরের। যিনি কৌলীন্য প্রভৃতি গুণে আপনাদেরই সমকক্ষ এবং যাঁর ঔরসে উৎকৃষ্ট নারী এই সত্যবতী জন্মেছেন, বৎস, সেই উপরিচর রাজা বহুবার আমার নিকট আপনার পিতার বর্ণনা করে বলেছেন যে, ধার্মিক রাজা সেই শান্তনুই সত্যবতীকে বিবাহ করার যোগ্য। তারপর দেবর্ষিশ্রেষ্ঠ অসিতও সত্যবতীর বিশেষপ্রার্থী। তথাপি তাকেও আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। কিন্তু রাজকুমার, কন্যার পিতা বলে আমি আপনাকে কিছু বলব। এই বিবাহের একমাত্র দোষ দেখা যাচ্ছে প্রবল শত্রু দেখা দেবে। কারণ আপনি শত্রু হয়ে যার প্রতি ক্রুদ্ধ হবেন, সে গন্ধর্বই হোক আর অসুরই হোক, কখনও সুখে জীবনযাপন করতে পারবে না। সত্যবতীর বিবাহ দেওয়া না দেওয়ার ক্ষেত্রে এই একটিমাত্র প্রতিবন্ধকতা। আপনার মঙ্গল হোক।”

দাসরাজ এই কথা বললে গাঙ্গেয় সঙ্গী ক্ষত্রিয়দের শুনিয়ে আপন পিতার জন্য প্রত্যুত্তরে বললেন, “হে সত্যবাদীশ্রেষ্ঠ দাসরাজ, আপনি আমার এই সত্য প্রতিজ্ঞা শুনুন। অতীতে কোনও লোক একথা বলতে সমর্থ হননি। বর্তমানে অথবা ভবিষ্যতেও হবেন না। আপনি যেমন বললেন, আমি তাই করব, আপনার ইচ্ছা অনুসারে সত্যবতীর গর্ভে যে পুত্র জন্মাবে, সেই আমাদের রাজা হবে।”

গাঙ্গেয় এই কথা বললে, সত্যবতীপুত্রের রাজ্যের জন্য দাসরাজ দুষ্কর কার্য করার উদ্দেশ্যে পুনরায় গাঙ্গেয় বললেন, “হে ধার্মিক, আপনি অসাধারণ প্রভাবশালী শান্তনু রাজার উপযুক্ত অবলম্বন তো আছেনই; এখন এই সত্যবতীরও প্রভু হলেন; সুতরাং এখন আপনি এঁকে দান করতে সমর্থ। কিন্তু হে সৌম্যমূর্তি, আপনি আমার এই অবশ্য বক্তব্য কথাটি শুনুন। কন্যাপক্ষের স্বভাব অনুসারে আমি এই কথা বলব। হে সত্যধর্মপরায়ণ, আপনি সত্যবতীর জন্য রাজগণের মধ্যে যে প্রতিজ্ঞা করেছেন, তা আপনার পক্ষেই সম্ভব। আপনার এ প্রতিজ্ঞা কখনও মিথ্যা হবে না। সে বিষয়ে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই; কিন্তু আপনার যে পুত্র হবে, তার বিষয়েই আমাদের গুরুতর সন্দেহ।”

সত্যধর্মপরায়ণ গাঙ্গেয় দাসরাজের সেই অভিপ্রায় বুঝে, পিতার প্রিয় কাজ করবার ইচ্ছায় তখন আবার প্রতিজ্ঞা করলেন। গাঙ্গেয় বললেন— “দাসরাজ, সমস্ত শ্রোতা ক্ষত্রিয়দের মধ্যে পিতার জন্য আমি যা বলছি, আপনি আমার সেই বাক্য শ্রবণ করুন। আমি পূর্বেই সমস্ত রাজ্য পরিত্যাগ করেছি। এখন পুত্র না-হওয়ার জন্যও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করছি। আজ থেকে আমার ব্রহ্মচর্য ব্রত হবে; তাতে আমার পুত্র না হলেও, স্বর্গলোকে অক্ষয় বাস হবে।” গাঙ্গেয়ের এই কথা শুনে রোমাঞ্চিত শরীর দাসরাজ বললেন, “অবশ্যই আমি সত্যবতীকে দান করব।” তারপর অপ্সরাগণ দেবগণ ও পিতৃগণ আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। তারপর ভীষ্ম গিয়ে পিতার জন্য সেই যশস্বিনী সত্যবতীকে বললেন, “মা, আপনি রথে উঠুন। চলুন আমরা নিজগৃহে যাই।” ভীষ্ম সত্যবতীকে এই কথা বলে রথে তুলে হস্তিনাপুরে গিয়ে শান্তনুর কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন।

রাজারা সম্মিলিতভাবে এবং পৃথকভাবে ভীষ্মের সেই দুর্জয় কার্যের প্রশংসা করে বললেন, “ইনি ভীষ্মই বটে।”

শান্তনু রাজা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে মহাত্মা ভীষ্মকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিলেন। “বৎস, তুমি যতকাল জীবিত থাকতে ইচ্ছা করবে তার মধ্যে তোমার মৃত্যু হবে না। তোমার অনুমতি পেয়েই মৃত্যু তোমার কাছে আসবে।”

সত্যবতী উপরিচর রাজার কন্যা, কিন্তু দাসরাজ তাকে কেবল বর্ধিত করেছেন একথা জানতে পেরে ভীষ্ম আপন পিতা শান্তনুর সঙ্গে যথাবিধানে সেই সত্যবতীর বিবাহ করিয়েছেন এবং বিবাহ নিষ্পন্ন হলে, শান্তনু রাজা সেই সুন্দরী সত্যবতীকে আপন ভবনে প্রবেশ করালেন।

রাজা শান্তনু সত্যবতীর গর্ভে প্রথমে চিত্রাঙ্গদ এবং পরে বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম দেন। এই দুই পুত্রই যথাক্রমে বুদ্ধিমান, তেজস্বী ও মহাবীর মহাধনুর্ধর হয়েছিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ বিচিত্রবীর্য যৌবনে পদার্পণ করার পূর্বেই শান্তনু রাজা লোকান্তরে গমন করেন।

শান্তনু স্বর্গারোহণ করলে ভীষ্ম সত্যবতীর মতানুসারে চিত্রাঙ্গদকে রাজপদে স্থাপন করেন। চিত্রাঙ্গদ আপন বাহুবলে পৃথিবীর সমস্ত রাজাকে পরাস্ত করেছিলেন এবং কোনও মানুষকেই তিনি বীরত্বে নিজের তুল্য বলে মনে করতেন না। চিত্রাঙ্গদ বলগর্বে গর্বিত ছিলেন। তিনি দেবগণ অসুরগণ ও মনুষ্যগণের নিন্দা করতেন। তখন বলবান গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। গন্ধর্বরাজ চিত্রাঙ্গদ বললেন, “রাজপুত্র, আপনার ও আমার একই নাম। অতএব আমার সঙ্গে যুদ্ধ করুন, না হয় আপনার নাম পরিবর্তন করুন।”

তখন তারা দুজনে গর্জন করতে করতে হিরণ্মতী নদীর তীরে এসে ভয়ংকর যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। সেই তুমুল যুদ্ধে অধিক কূটকৌশলী গন্ধর্বরাজ মহাবীর কুরুরাজ চিত্রাঙ্গদকে বধ করলেন। চিত্রাঙ্গদ নিহত হলে, শান্তনুনন্দন ভীষ্ম বিচিত্রবীর্য দ্বারা তাঁর প্রেতকার্যগুলি করালেন। তারপর ভীষ্ম সেই কিশোরবয়স্ক বিচিত্রবীর্যকে কুরুরাজ্যে অভিষিক্ত করে, উপদেশ দান করে বিচিত্রবীর্যের রক্ষণাবেক্ষণ করতে লাগলেন ও বিচিত্রবীর্যের নামে রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন।

বিচিত্রবীর্য যৌবনে পদার্পণ করলে ভীষ্ম তাঁকে উপযুক্ত দেখে তাঁর বিবাহের জন্য ব্যবস্থা করলেন। তিনি শুনলেন যে কাশীরাজের অপ্সরার ন্যায় সুন্দরী তিন রাজকন্যার স্বয়ংবর সভা হবে। সত্যবতীর অনুমতিক্রমে ভীষ্ম এক রথে সেই সভায় উপস্থিত হলেন। কন্যারা সভায় উপস্থিত হয়ে ভীষ্মকে বৃদ্ধ ও একাকী দেখে তাকে ত্যাগ করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলেন। কন্যাদের অলোকসামান্য রূপ দেখে ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের জন্য ভীষ্মের সেই কন্যাদের পছন্দ হল। উপস্থিত রাজারা ভীষ্মকে দেখে ও তাঁর ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করে পরস্পর হাসাহাসি করতে লাগলেন। তখন প্রভাবশালী ভীষ্ম সেই কন্যা তিনটিকে রথে তুলে বীরতেজে দীপ্তি পেতে থেকে, জলদগম্ভীর স্বরে রাজাদের বলতে লাগলেন, “রাজগণ, গুণবান বরকে আহ্বান করে এনে, কন্যাকে শক্তি অনুসারে অলংকৃত করে এবং ক্ষমতা অনুযায়ী যৌতুক দিয়ে অনেকে সেই কন্যা দান করেন। কেউ কেউ নির্দিষ্ট ধন নিয়ে কন্যা দান করেন ও অন্য দল বলপূর্বক কন্যা হরণ করেন। কেউ কেউ কন্যাকে সম্মত করিয়ে বিবাহ করেন; অন্য কেউ কেউ অসতর্ক অবস্থায় কন্যাকে রমণ করে সেই কন্যা লাভ করেন, অন্য লোকেরা যজ্ঞে প্রবৃত্ত কন্যা গ্রহণ করেন।

তোমরা দুজনে দাম্পত্য ধর্ম আচরণ করো এই বলে কন্যাদান করে সেই আর্যবিধান অনুসরণ কেউ কেউ ভার্যা লাভ করেন। পণ্ডিতবর্ণিত সেই বিবাহকেই অষ্টম বিবাহ বলে জানবে। কিন্তু ক্ষত্রিয়েরা স্বয়ংবরের প্রশংসা করেন এবং তাই করে থাকেন। কেন-না ধর্মবাদীরা বলে থাকেন, ‘বিপক্ষদিগকে পরাজিত করে যে বিবাহ, সেই ভার্যাই ক্ষত্রিয়দের পক্ষে প্রশস্ত।’

অতএব হে রাজগণ, আমি বলপূর্বক এই কন্যা ক’টিকে এখান থেকে হরণ করে নিয়ে যেতে ইচ্ছা করি, আপনারা শক্তি অনুসারে জয় বা পরাজয়ের জন্য বিশেষ চেষ্টা করুন। রাজগণ, আমি যুদ্ধের জন্য কৃতনিশ্চয় হয়ে রইলাম।” ভীষ্ম অন্য রাজাকে এবং কাশীরাজকে এই কথা বলে, নিজেই কন্যা ক’টিকে রথে তুলে নিয়ে দ্রুত প্রস্থান করতে লাগলেন।

ক্রুদ্ধ সকল রাজাই অলংকার ত্যাগ করে বর্ম পরিধান করে, অসহনীয় ক্রোধে আরক্ত হয়ে ভীষ্মকে আক্রমণ করলেন। ভীষ্ম অতি সামান্য সময়ের মধ্যে রাজগণকে পরাজিত করে হস্তিনার দিকে চলতে লাগলেন। কেবলমাত্র শাল্বরাজ, যিনি পূর্ব থেকে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যার অনুরাগী ছিলেন, তিনি কিছুক্ষণ যথাসাধ্য যুদ্ধ করেও পরাজিত হলেন, আপন রাজধানীর দিকে পালাতে আরম্ভ করলেন। অক্ষত ভীষ্ম কন্যার ন্যায় অথবা পুত্রবধূর ন্যায় কাশীরাজ কন্যা তিনটিকে বিচিত্রবীর্যের জন্য রাজধানীতে নিয়ে এলেন।

বিবাহের আয়োজন শুরু হয়েছে, এমন সময়ে কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা সলজ্জভাবে ভীষ্মের কাছে জানাল যে, সে শাল্বরাজার বাগদত্তা এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ-সম্পর্কে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শুনে ভীষ্ম মাতা সত্যবতী ও মন্ত্রীবর্গের সঙ্গে আলোচনা করে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের সঙ্গে অম্বাকে শাল্বরাজার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

অম্বিকা ও অম্বালিকাকে মহাসমারোহে বিচিত্রবীর্যের হাতে সমর্পণ করলেন ভীষ্ম। রূপ ও যৌবনগর্বিতা ধর্মাত্মা বিচিত্রবীর্য অম্বিকা ও অম্বালিকার পাণিগ্রহণ করে অত্যন্ত কামাসক্ত হয়ে পড়লেন। অম্বিকা ও অম্বালিকার শরীরের কান্তি বৃহতীপুষ্পের ন্যায় শ্যামবর্ণ, কেশকলাপ কুঞ্চিত ও নীলবর্ণ, নখসমূহ কিঞ্চিদুন্নত ও রক্তবর্ণ এবং নিতম্বযুগল ও স্তনযুগল স্থূল ছিল; আর তাঁরা লোকের সম্মান-গৌরব বুঝতেন, শুভলক্ষণ যুক্ত ছিলেন এবং বংশের মঙ্গল সূচনা করতেন। এহেন অম্বিকা ও অম্বালিকা বিচিত্রবীর্যকে আপনাদের অনুরূপ পতি লাভ করেছেন মনে করে, যথানিয়মে তার শুশ্রূষা করতে লাগলেন।

এদিকে অশ্বিনীকুমারের মতো রূপবান এবং দেবতার তুল্য পরাক্রমশালী বিচিত্রবীর্যও সকল রমণীর চিত্ত উদ্বেলিত করতে লাগলেন। সাত বৎসর যাবৎ বিচিত্রবীর্য অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে অতিমাত্রায় অধিক পরিমাণে বিহার করে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হলেন। সম্মিলিত বিশ্বস্ত সকল চিকিৎসকের বিশেষ প্রতিকার চেষ্টা সত্ত্বেও বিচিত্রবীর্য যমালয়ে গমন করলেন।

ভীষ্মকে সত্যবতীর সন্তান জন্মদানের অনুরোধ

মৃত পুত্রের প্রেতকার্য সম্পন্ন করে, পতিশোকে উদ্বিগ্না পুত্রবধূদের সান্ত্বনা দিয়ে সত্যবতী ভীষ্মের কাছে গিয়ে বললেন, “ভীষ্ম, ধার্মিক ও যশস্বী শান্তনু রাজার পিণ্ড, যশ ও বংশ এখন তোমার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হল। পুণ্যকর্ম করলে স্বর্গলাভ যেমন নিশ্চিত এবং সত্যপরায়ণ হলে আয়ু যেমন নিশ্চিত, তেমন তোমাতেও ধর্ম নিশ্চিত।

“হে ধর্মজ্ঞ, তুমি সংক্ষিপ্তভাবে এবং বিস্তৃতভাবে সমস্ত ধর্মই জানো এবং নানাবিধ বেদ ও বেদাঙ্গ জানো। তোমাতে ধর্মের স্থিতি, কৌলিক আচার এবং বিপৎকালে শুক্র ও বৃহস্পতির ন্যায় কর্তব্যজ্ঞান— এ সমস্তই আছে। অতএব হে ধার্মিক শ্রেষ্ঠ, তোমার উপর বিশেষ ভরসা করে আমি তোমাকে কোনও কার্যে নিযুক্ত করব। তুমি শুনে সেই কাৰ্যসম্পাদন করো। আমার পুত্র তোমার ভ্রাতা ছিল, সে অত্যন্ত বলবান এবং তোমার বিশেষ প্রিয়ও ছিল। অথচ সেই পুরুষশ্রেষ্ঠ বাল্যবয়সেই অপুত্রক অবস্থায় স্বর্গে গিয়েছে। তোমার সেই ভ্রাতার এই দুটি মহিষী। এরা একে কাশীরাজের কন্যা, শুভ লক্ষণান্বিতা এবং রূপ-যৌবন সম্পন্না; তাতে আবার পুত্রকামনাও করছে। অতএব তুমি আমাদের বংশরক্ষার জন্য আমারই আদেশে এদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করো এবং তা করে ধর্ম উপার্জন করো। অথবা নিজেই রাজ্যে অভিষিক্ত হও, ভরতবংশকে শাসন করো এবং ধর্মানুসারে দারপরিগ্রহ করো; কিন্তু পিতৃপুরুষদের নরকে নিমগ্ন কোরো না।”

সত্যবতীর সমস্ত বক্তব্য শুনে ভীষ্ম বললেন, “মা, আপনি শ্রেষ্ঠ ধর্মের কথাই বলেছেন, এ-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পুত্র-উৎপাদন বিষয়ে আমার প্রতিজ্ঞা আপনি অবগত আছেন। বিবাহের পণ-সম্পর্কিত সকল ঘটনাও আপনার জানা আছে। আমি আবার আপনার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি। আমি ত্রিভুবন ত্যাগ করতে পারি, কিংবা দেবগণের রাজত্বও পরিত্যাগ করতে পারি, অথবা এ দুটির থেকে বেশি যদি কিছু থাকে তাও পরিত্যাগ করতে পারি কিন্তু কোনও প্রকারেই সত্য ত্যাগ করতে পারি না। পৃথিবী গন্ধ ত্যাগ করতে পারে, জল আপন রস ত্যাগ করতে পারে, তেজ নিজের রূপ ত্যাগ করতে পারে এবং বায়ু স্পর্শগুণ ত্যাগ করতে পারেন। সূর্য আলোক ত্যাগ করতে পারেন, অগ্নি উষ্ণতা ত্যাগ করতে পারেন, আকাশ শব্দ ত্যাগ করতে পারে এবং চন্দ্র শীতরশ্মিতা ত্যাগ করতে পারেন। ইন্দ্র পরাক্রম ত্যাগ করতে পারেন, ধর্মরাজও ধর্ম ত্যাগ করতে পারেন কিন্তু আমি কোনও প্রকারেই সত্য ত্যাগ করতে প্রবৃত্ত হতে পারি না।”

তখন সত্যবতী বললেন, “সত্যপরাক্রম ভীষ্ম, তুমি যে দৃঢ়ভাবে সত্যে অবস্থান করো, আমি তা জানি। আপন ক্ষমতার বলেই তুমি ত্রিভুবন সৃষ্টি করতে পারো। ভীষ্ম, আমি তোমার সত্য প্রতিজ্ঞা জানি এবং আমার জন্য তুমি যে শপথ গ্রহণ করেছিলে, তাও জানি। কিন্তু আপৎকাল বিবেচনা করে এই বিশাল ভার বহন করো। যাতে তোমার বংশ এবং ধর্ম নষ্ট না হয়, বন্ধুগণ সন্তুষ্ট থাকে, তেমন কাজ করো।”

পুত্রার্থিনী সত্যবতী বারবার এই কথা বলতে লাগলেন। তখন ভীষ্ম আবার বললেন, “রাজ্ঞী, আপনি ধর্ম পর্যালোচনা করুন, আমাদের সকলকেই নষ্ট করবেন না। ক্ষত্রিয়ের ধর্মভ্রষ্ট হওয়া ধর্মশাস্ত্রে প্রশস্ত নয়। রাজ্ঞী, যাতে শান্তনুর বংশ জগতে অক্ষয় হয়, ক্ষত্রিয়ের পক্ষে চিরপ্রচলিত সেই ধর্ম আপনার কাছে আমি বলব। আপনি তা শুনে, আপৎকাল বিবেচনা করে, পুরোহিতদের সঙ্গে আলোচনা করে সেই ধর্ম স্বীকার করুন।”

ভীষ্ম বললেন, ‘পুরাকালে জমদগ্নিনন্দন রাম পিতৃবধ সহ্য করতে না-পেরে কুঠার দ্বারা কার্তবীর্যার্জুন রাজাকে বধ করেছিলেন। তিনি কার্তবীর্যার্জুনের সহস্র বাহু ছেদন করে সেই রক্ত দ্বারা পিতৃতর্পণ করে, লোকের পক্ষে অতিদুষ্কর ধর্ম অর্জন করেছিলেন। পুনরায় তিনি ধনুর্ধারণ করে রথারূঢ় হয়ে পৃথিবী জয় করতে থেকে একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেন। সেই মহাত্মা পৃথিবী ক্ষত্রিয়শূন্য করলে পর ক্ষত্রিয়দের ভার্যারা বেদপারদর্শী ব্রাহ্মণগণের সঙ্গে মিলিত হয়ে সন্তান উৎপাদন করেন। কেন-না, বেদে নির্ণয় করা আছে যে ক্ষেত্রজ পুত্র—পরিণেতার পুত্রই হয়। আর সেই ক্ষত্রিয় রমণীরা ধর্মপালন করতেই সেই ব্রাহ্মণদের কাছে গিয়েছিলেন; বিশেষত, ক্ষত্রিয়দের ক্ষেত্রজ সন্তান-উৎপাদন লোকাচারও দেখা যায়। তখন থেকেই আবার ক্ষত্রিয়জাতির উৎপন্ন হয়েছিল। এ-বিষয়ে একটি প্রাচীন ইতিহাস আছে।

পূর্বকালে ঋষিশ্রেষ্ঠ উতথ্যের মমতা নাম্নী প্রিয়তমা ভার্যা ছিলেন। একদিন উতথ্যের ভ্রাতা, দেবগণের পুরোহিত বৃহস্পতি সেই পরম রূপবতী মমতার নিকট উপস্থিত হন। মমতা তাঁকে বলেন, “আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দ্বারাই আমি গর্ভবতী হয়েছি। অতএব আপনি বিরত হোন। আমার উদরে উতথ্যের পুত্র আছে এবং সে এইখানে থেকে ষড়ঙ্গ বেদ অধ্যয়ন করেছে। আপনিও অব্যর্থরেতা। আমার উদরে দুটি সন্তান ধারণের ক্ষমতা নেই। অতএব আপনি বিরত হোন।

মমতা এই কথা বললেও বৃহস্পতি নিবৃত্ত হলেন না। তিনি মমতাকে ধারণ করলেন। তখন গর্ভস্থ বালক বৃহস্পতিকে বলল, “পিতৃব্য, আপনি কামব্যবহারে প্রবৃত্ত হবেন না। এখানে দু’জনের স্থান হবে না।” কিন্তু বৃহস্পতি তখন চূড়ান্ত কামাসক্ত। তখন মমতার গর্ভস্থিত সেই শিশু আপন চরণযুগল দিয়ে বৃহস্পতির বীর্য প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ করে রাখল। বৃহস্পতির বীর্য জরায়ুতে প্রবেশ না করে ভূমিতে পতিত হল। ক্রোধে বৃহস্পতি গর্ভস্থ শিশুকে শাপ দিলেন, “এমন সুন্দর সময়ে তোর এই ব্যবহারের জন্য তুই দীর্ঘকালের জন্য অন্ধ হবি।” যশস্বী বৃহস্পতির অভিশাপ অনুসারে সেই উতথ্যপুত্রের নাম হয়েছিল— দীর্ঘতমা। তপস্যার প্রভাবে তিনি বৃহস্পতির তুল্যই হয়েছিলেন।

দীর্ঘতমা বেদজ্ঞ, পণ্ডিত ও অতিশয় বিদ্বান ছিলেন। কালক্রমে তিনি প্রদ্বেষী নাম্নী সুন্দরী, যুবতী এক ব্রাহ্মণকন্যাকে পত্নীরূপে লাভ করেছিলেন। প্রদ্বেষীর গর্ভে গৌতম প্রভৃতি পুত্রগণের জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘতমা মুনি সুরভিনন্দনের কাছে সমস্ত গোধর্ম শিক্ষা করে, তারই প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সেই গোধর্ম প্রচার করতে প্রবৃত্ত হন। আশ্রমবাসী সকল মহর্ষিই দীর্ঘতমাকে মিথ্যাচারসম্পন্ন দেখে, ক্রুদ্ধ ও বিদ্বেষসম্পন্ন হয়ে, পরস্পর আলোচনা করলেন যে, দীর্ঘতমা শিষ্টাচার পরিত্যাগ করেছেন। অতএব তিনি আর আশ্রমে থাকার উপযুক্ত নন। তাঁরা এই আলোচনা করে দীর্ঘতমাকে ত্যাগ করলেন।

পূর্বেই পুত্রলাভ করায় এবং দীর্ঘতমা গোধর্ম প্রচারে প্রবৃত্ত হওয়ায় পত্নী প্রদ্বেষী স্বামী দীর্ঘতমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতে লাগলেন। দীর্ঘতমা কারণ অনুসন্ধান করায় প্রদ্বেষী বললেন, “স্বামী স্ত্রীকে ভরণ করেন বলেই তাঁকে ভর্তা বলে। পালন করেন বলে পতি বলে। কিন্তু আমিই এ যাবৎকাল পুত্রগণের সঙ্গে আপনার ভরণ করে এসেছি। এবং তাতে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছি। সুতরাং আর আমি আপনার ভরণ করতে পারব না।”

দীর্ঘতমা বললেন, “আজ থেকে আমি জগতে স্ত্রীলোক বিষয়ে নিয়ম প্রতিষ্ঠা করছি— পুরুষ যাবজ্জীবন স্ত্রীলোকের একমাত্র পরম অবলম্বন হবে। পতি মরে গেলে কিংবা জীবিত থাকলে, স্ত্রী অন্য পুরুষ অবলম্বন করতে পারবে না। স্ত্রী অন্য পুরুষ সংসর্গ করলে পতিত হবে। আজ থেকে অন্য পুরুষ সংসর্গ করলে বিধবাদের পাপ হবে এবং পতির সর্বপ্রকার ধন থাকলেও তা ভোগ করা বিধবাদের পক্ষে নিষ্ফল হবে। তারপরও ভোগ করতে চাইলে, তাদের নিন্দা হবে এবং বন্ধুজন তাদের ত্যাগ করতে চাইবে।

দীর্ঘতমার এই কথা শুনে ব্রাহ্মণী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে পুত্রদের আদেশ করলেন, “একে গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দাও।” পুত্রেরা মাতার আদেশ শুনে দীর্ঘতমাকে নিয়ে গিয়ে গঙ্গায় একটি ভেলায় ভাসিয়ে দিল। ঠিক সেই সময়ে বলি নামে এক ধার্মিক রাজা স্নান করার সময় ভেলায় আগত দীর্ঘতমা মুনিকে দেখতে পেলেন। বলিরাজা সেই দীর্ঘতমাকে ধরলেন এবং পরিচয় নিয়ে পুত্রোৎপাদনের জন্য তাঁকে বরণ করলেন। বলি বললেন, “মহাশয় বংশবিস্তারের জন্য আমার ভার্যাদের গর্ভে আপনি ধর্মার্থনিপুণ কতগুলি পুত্র উৎপাদন করুন।” দীর্ঘতমা স্বীকার করে বললেন, “তাই হবে।” তারপর রাজা আপন ভার্যা সুদেষ্ণাকে দীর্ঘতমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মহিষী সুদেষ্ণা দীর্ঘতমাকে অন্ধ ও বৃদ্ধ জানতে পেরে নিজে তাঁর কাছে না গিয়ে আপন দাসীকে সেই বৃদ্ধের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দীর্ঘতমা ঋষি সেই শূদ্রার গর্ভে কাক্ষীবান প্রভৃতি এগারোটি পুত্র উৎপাদন করলেন। বেদপাঠরত পুত্রদের দেখে বলিরাজা বললেন, “এগুলি আমার পুত্র।”

দীর্ঘতমা বললেন, “না, এরা আমার পুত্র। কারণ এগুলি আমার দ্বারা শূদ্রার গর্ভজাত সন্তান। মহারাজ, আপনার মহিষী মূঢ়া সুদেষ্ণা আমাকে অন্ধ ও বৃদ্ধ জেনে নিজের ধাত্রীতনয়া কোনও শূদ্রাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিল।” তখন বলিরাজা দীর্ঘতমা ঋষিকে প্রসন্ন করে সেই সুদেষ্ণাকে দীর্ঘতমার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখন দীর্ঘতমা সুদেষ্ণার অঙ্গ স্পর্শ করে বললেন, “দেবী, আপনার সূর্যের তুল্য তেজস্বী পাঁচটি পুত্র জন্মাবে। তাদের নাম হবে— অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও শুম্ভ্র।” তাদের অধিকৃত দেশগুলি তাদের জগতে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। এইভাবে অসংখ্য ক্ষত্রিয় পৃথিবীতে জন্মেছিল।”

ভীষ্ম সত্যবতীকে বললেন, “মা, আপনিও ধনদানের অঙ্গীকার করে কোনও ব্রাহ্মণকে আহ্বান করুন। তিনি বিচিত্রবীর্যের ভার্যাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করবেন।

সত্যবতীর পরাশর মিলন-কথা ভীষ্মকে জ্ঞাপন

ভীষ্মের সমস্ত বক্তব্য শোনার পর ন্যায়পরায়ণা সত্যবতী সকুণ্ঠ লজ্জার সঙ্গে ভীষ্মকে বললেন, “ভীষ্ম তুমি যা বললে তা সত্য। তোমার প্রতি আমার বিশ্বাস আছে বলে আমাদের বংশবৃদ্ধির জন্য কোনও কথা তোমাকে বলব। সেদিনের বিপৎকালের ঘটনা তোমাকে না বলে পারছি না। তুমি শ্রবণ করো। পরে ইতিকর্তব্য নির্ধারণ করো। তুমিই এখন আমাদের বংশের ধর্মরক্ষক, তুমিই সত্যরক্ষক, তুমিই একমাত্র অবলম্বন।

প্রথম যৌবন বয়সে পিতা অন্য কর্মে ব্যস্ত থাকলে আমি নৌকা পারাপার করতাম। একদিন ধার্মিক শ্রেষ্ঠ ও বুদ্ধিমান মহর্ষি পরাশর যমুনানদী পার হবেন বলে এসে সেই নৌকায় বসলেন। আমি যমুনা পার করার জন্য তাঁকে নিয়ে নৌকা বেয়ে চললাম। তখন সেই মুনিশ্রেষ্ঠ কামার্ত হয়ে আমার কাছে এসে আমার বংশ ও পরিচয় দিয়ে এবং ‘তুমি ধীবরের কন্যা নও’— এই কথা বলে প্রলোভন পূর্বক আমাকে অনেক মধুর বাক্য বললেন।

আমি তখন তাঁর শাপের ভয়ও করছিলাম এবং পিতার ভয়ও করছিলাম। এই সময়ে তিনি দুর্লভ বর দেবেন বলে আমাকে প্রলুব্ধ করে ফেললেন। সুতরাং আমি আর তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। তিনি তখন জগৎ অন্ধকারে আবৃত করে আপন তেজে আমাকে অভিভূত ও বশীভূত করে ফেললেন। আগে আমার গায়ে ঘৃণিত মৎস্যের গুরুতর গন্ধ ছিল। কিন্তু মুনিই সেই গন্ধ দূর করে আমার শরীরে এই মনোহর গন্ধ জন্মিয়ে ছিলেন। তারপর তিনি আমাকে বললেন, “তুমি এই দ্বীপেই আমার উৎপাদিত গর্ভ প্রসব করে পুনরায় কন্যাই হবে।”

কন্যাবস্থায় পরাশর মুনি থেকে উৎপন্ন সেই পুত্রটি প্রথমে দ্বৈপায়ন নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিল। ক্রমে সে মহাযোগী ও মহর্ষি হয়েছে। মাহাত্ম্যশালী সেই দ্বৈপায়ন ঋষি তপোবলে চারটি বেদকে বিভক্ত করে জগতে ‘ব্যাস’ নাম লাভ করেছেন এবং কৃষ্ণবর্ণ বলে কৃষ্ণ নাম ধারণ করেছেন। আমি ও তুমি দুইজনে নিযুক্ত করলে, নিশ্চয়ই সেই অসাধারণ তেজা বেদব্যাস ভ্ৰাতৃভার্যাদের গর্ভে মঙ্গলজনক সন্তান উৎপাদন করবেন। সত্যবাদী, শান্তিপরায়ণ ও তপস্যার প্রভাবে পাপ-বিহীন সেই মহাত্মা উৎপন্ন হয়ে তখনই পিতার সঙ্গে সে স্থান থেকে চলে গিয়েছিলেন। তিনি যাবার সময়ে আমাকে বলে গিয়েছিলেন যে, কর্তব্য উপস্থিত হলে আপনি আমাকে স্মরণ করবেন। অতএব ভীষ্ম যদি তুমি ইচ্ছা করো, তবে আমি সেই ব্যাসকে স্মরণ করি। ভীষ্ম তুমি অনুমতি করলে নিশ্চয় সেই মহাতপস্বী বেদব্যাস বিচিত্রবীর্ষের ভার্যাদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন।”

সেই মহর্ষির নাম উচ্চারণ করলে ভীষ্ম কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, “যে লোক কার্য করার পূর্বে ধর্ম, অর্থ ও কাম— এই তিনটিরই পর্যালোচনা করে এবং যে লোক অর্থ এবং অর্থের ফল, ধর্ম ও ধর্মের ফল এবং ‘কাম ও কামের ফল পর্যালোচনা করে কার্যে প্রবৃত্ত হয়, সেই লোকই বুদ্ধিমান। অতএব মা, আপনি আমাদের বংশের হিতকর, মঙ্গলজনক, অথচ ন্যায়সংগত এই যে কথা বললেন, তা আমার অত্যন্ত অভিপ্রেত।” ভীষ্মের এই অঙ্গীকার শুনে সত্যবতী ব্যাসদেবকে স্মরণ করেন।

মাতা সত্যবতী স্মরণ করেছেন জানামাত্র বেদব্যাস বেদ পাঠ করতে করতে সকলের অজ্ঞাত অবস্থায় ক্ষণকালমধ্যে সেখানে আবির্ভূত হলেন। বহুকাল পরে পুত্রকে দেখে মাতা সত্যবতী স্বাগত প্রশ্ন দ্বারা তাঁকে সম্মান জানিয়ে, বাহুযুগল দ্বারা তাঁকে আলিঙ্গন করে, স্তন্যদুগ্ধে তাঁকে অভিষিক্ত করে আনন্দাশ্রু মোচন করতে লাগলেন। মহর্ষি বেদব্যাসও আপন কমণ্ডলুস্থিত তীর্থবারি দিয়ে স্নেহকাতরা মাতা সত্যবতীকে অভিষিক্ত করে অভিবাদনপূর্বক বললেন, “হে ধর্মতত্ত্বজ্ঞে, আপনি যা কিছু অভিপ্রায় করেছেন, আমি তাই করতে এসেছি।” রাজপুরোহিত যথাবিধানে ব্যাসদেবের পূজা করলেন। ব্যাস সেই পূজা গ্রহণ করলেন।

ব্যাসদেব আসনে উপবেশন করেছেন দেখে, মাতা সত্যবতী তাঁর স্থায়ী মঙ্গলের বিষয় জিজ্ঞাসা করে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হে কবি, পুত্র সকল মাতা ও পিতার সহকারী হয়ে জন্মগ্রহণ করে। সুতরাং পিতাও যেমন পুত্রদের স্বামী, মাতাও তেমনই স্বামিনী। হে ব্রহ্মর্ষি, মহর্ষি পরাশর শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী তোমাকে আমার গর্ভে উৎপাদন করেছেন। সুতরাং তুমি যেমন আমার জ্যেষ্ঠপুত্র। বিচিত্রবীর্যও তেমনই আমার কনিষ্ঠপুত্র ছিল। এক পিতার বলে ভীষ্ম যেমন বিচিত্রবীর্যের ভ্রাতা, এক মাতা বলে তুমিও তেমনই বিচিত্রবীর্যের ভ্রাতা। কিন্তু যথার্থ বিক্রমী শান্তনুনন্দন ভীষ্ম সত্যপ্রতিজ্ঞা বজায় রাখার জন্য সন্তান উৎপাদনও করবেন না, রাজ্যশাসনও করবেন না। ভ্রাতা বিচিত্রবীর্যের কল্যাণে, ভীষ্মের অনুরোধে এবং আমার আদেশে তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার রূপযৌবনবতী দুটি ভার্যার গর্ভে পুত্র উৎপাদন করো।”

বেদব্যাস বললেন, “মা সত্যবতী, আপনি ধর্মানুরাগিণী। আমি আপনার অভীষ্ট সম্পাদন করব। মিত্র ও বরুণ দেবতার তুল্য দুই পুত্র আমি উৎপাদন করব। তবে রানি দুজনকে আমার নির্দেশ অনুযায়ী এক বৎসর ব্রত উদযাপন করতে হবে। তবে তারা শুদ্ধ হয়ে আমার কাছে আসতে পারবেন।” সত্যবতী বললেন, “বৎস, রানিরা যাতে সদ্য গর্ভধারণ করেন, তুমি তাই করো। অরাজক দেশে বৃষ্টি হয় না, দেবতারাও প্রসন্ন হন না। আমরাই বা কীভাবে অরাজক দেশ রক্ষা করব। অতএব তুমি শীঘ্র রানিদের গর্ভ উৎপাদন করো। ভীষ্ম সেই সন্তানদের বর্ধিত করবেন।”

বেদব্যাস বললেন, ‘মা, যদি আমাকে সত্বর অকালে পুত্র উৎপাদন করতে হয় তবে রানিরা যেন আমার বিকৃত রূপ সহ্য করেন। অম্বিকাদেবী যদি আমার শরীরের গন্ধ, রূপ, বেশ এবং এই বিকৃত দেহ সহ্য করতে পারেন, তবে আজই তিনি উৎকৃষ্ট গর্ভধারণ করবেন।” এই বলে ব্যাস অন্তর্হিত হলেন।

তখন সত্যবতী নির্জনে পুত্রবধূর কাছে গিয়ে তাঁকে এই হিতকর ও ধর্মযুক্ত কথা বললেন, “তোমাকে ধর্মসংগত কিছু কথা বলব। আমার অদৃষ্টের দোষে ভরতবংশের উচ্ছেদের উপক্রম হয়েছে। ভীষ্ম আমাকে ভরতবংশ বৃদ্ধির উপযুক্ত পরামর্শ দিয়েছেন। সেই পরামর্শ অনুযায়ী তোমাকে কাজ করতে হবে। তাতেই বিনষ্ট ভরতবংশ আবার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। তুমি ইন্দ্রের তুল্য সন্তান প্রসব করো।”

সত্যবতী ব্রহ্মচারিণী অম্বিকাকে ধর্মের পথ দেখিয়ে, অনুনয় সহকারে কোনও প্রকারে সম্মত করিয়ে দেবতা, মুনি, ব্রাহ্মণ ও অতিথিদের ভোজন করালেন।

তারপর সত্যবতী, যথাসময়ে ঋতুস্নাতা পুত্রবধূ অম্বিকাকে শয়নগৃহে প্রবেশ করাতে করাতে মৃদুস্বরে এই কথা বললেন, “অম্বিকা, তোমার একটি দেবর আছে, সে আজ তোমার জন্য এই গৃহে প্রবেশ করবে।” অতএব তুমি সাবধানে তার জন্য প্রতীক্ষা করো। সে রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরের সময়ে আসবে। অম্বিকা শাশুড়ির কথা শুনে, মনোহর শয্যায় শয়ন করে, দেবর ভীষ্মকে এবং দেবরস্থানীয় অন্যান্য কুরুবংশীয় প্রধান পুরুষকে চিন্তা করতে থাকলেন।

যথাসময়ে অম্বিকার জন্য প্রথম নিযুক্ত সত্যবাদী বেদব্যাস এসে সেই গৃহে প্রবেশ করলেন, তখন সে গৃহে বহুতর দীপ জ্বলছিল। বেদব্যাসের জটা ও শ্মশ্রুযুগল পিঙ্গলবর্ণ এবং উজ্জ্বল চোখ দুটি দেখে অম্বিকা ভয়ে নয়নদ্বয় মুদ্রিত করে ফেললেন। মাতা সত্যবতীর প্রিয় কার্য করার জন্য সেই অবস্থায় বেদব্যাস অম্বিকার সঙ্গে রমণে প্রবৃত্ত হলেন। কিন্তু অম্বিকা ভয়ে সমগ্র রমণ সময়ে একবারও চোখ খুললেন না। তারপর বেদব্যাস ঘরের বাইরে এলে, মাতা সত্যবতী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বৎস, এর গর্ভে গুণবান রাজপুত্র হবে তো?”

ত্রিকালজ্ঞ বেদব্যাস মাতার প্রশ্ন শুনে দৈবপ্রেরিত হয়ে বললেন, “মা, এই বালকটি দশ হাজার হস্তীর তুল্য বলবান, বিদ্বান রাজর্ষি শ্রেষ্ঠ, অত্যন্ত ভাগ্যবান, অত্যন্ত উৎসাহী এবং বিশেষ বুদ্ধিমান হবে। কালে বালকটির একশো পুত্র হবে। কিন্তু মাতার দোষে এ বালকটি জন্মান্ধই হবে।”

বেদব্যাসের সেই কথা শুনে মাতা সত্যবতী পুত্র বেদব্যাসকে বললেন, “তপোধন, অন্ধ লোক কুরুবংশের উপযুক্ত রাজা হবে না। অতএব ভরতবংশের রক্ষা এবং পিতৃবংশের বৃদ্ধি করতে পারবে এমন আর-একটি কুরুবংশের রাজার জন্ম দাও।” তাই হবে বলে বেদব্যাস চলে গেলেন। ওদিকে অম্বিকাদেবী যথাসময়ে একটি অন্ধ পুত্র প্রসব করলেন।

তারপর সত্যবতীদেবী পুত্রবধূ অম্বালিকাকে পূর্বের ন্যায় সমস্ত বলে সম্মত করিয়ে পুনরায় বেদব্যাসকে আহ্বান করলেন। বেদব্যাস, পূর্বের মতো বিকৃত রূপ নিয়ে এসে অম্বালিকাকে ধারণ করলেন। অম্বালিকাও তাঁর পিঙ্গল দাঁড়ি, জটা ও নয়নযুগল দেখে ভয়ে পাণ্ডবর্ণ হয়ে গেলেন। তখন বেদব্যাস তাঁকে বললেন, “সুন্দরী আমার বিকৃত মূর্তি দেখে তুমি যখন ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলে, তখন তোমার এই পুত্র ‘পাণ্ডুবর্ণই’ হবে এবং তার নামও হবে ‘পাণ্ডু’।” মাতা সত্যবতী প্রশ্ন করায় বেদব্যাস অম্বালিকাকে বলা কথাই মায়ের কাছে আবার বললেন। আরও বললেন, “এই বালক যথাকালে অত্যন্ত বিক্রমশালী ও জগদ্বিখ্যাত হবে। কিন্তু মাতার দোষে পাণ্ডুবর্ণ হবে। সেই বালকের আবার মহাধনুর্ধর পাঁচটি পুত্র হবে।”

বেদব্যাস এই কথা মাতাকে বলে চলে যাবার উপক্রম করলেন, তখন সত্যবতী তাঁর কাছে আরও একটি পুত্র প্রার্থনা করলেন। তাই হবে বলে ব্যাস চলে গেলেন। তারপর অম্বালিকাদেবী যথাসময়ে পাণ্ডুবর্ণ এবং সমস্ত রাজলক্ষণযুক্ত একটি পুত্র প্রসব করলেন; সে বালক আপন কান্তিতে যেন জ্বলছিল।

তারপর আবার ঋতুকালে সত্যবতী জ্যেষ্ঠ বধূ অম্বিকাকে ব্যাসদেবের জন্য নিযুক্ত করলেন। কিন্তু দেবকন্যাতুল্যা অম্বিকা বেদব্যাসের বিকট আকৃতি ও শরীরের বিকৃত গন্ধ স্মরণ করে শাশুড়ির আদেশ পালন করলেন না। অপ্সরার ন্যায় আপন সুন্দরী দাসীটিকে আপন অলংকারে সজ্জিত করে বেদব্যাসের কাছে পাঠিয়ে দিলেন।

বেদব্যাস উপস্থিত হলে, সেই দাসী তাঁর প্রত্যুদ্‌গমন করে, তাঁর অনুমতি নিয়ে রমণগৃহে প্রবেশ করে তাঁকে যথেষ্ট আদর ও পরিচর্যা করলেন। বেদব্যাস অতি প্রসন্ন হয়ে মৌখিক অনুরাগ জানিয়ে, সেই রমণীর অঙ্গস্পর্শ ও কামভোগে সন্তুষ্ট হলেন। সহবাস সম্পূর্ণ করে পরিতৃপ্ত বেদব্যাস ওঠার সময়ে সেই রমণীকে বললেন, “তুমি আমার বরে আজ থেকে আর কারও দাসী থাকবে না। হে শুভলক্ষণে, কোনও শ্রেষ্ঠ পুরুষ এই গৰ্ভরূপে তোমার উদরে এসেছেন। ইনি ধার্মিক এবং জগতে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান রূপে পরিচিত হবেন।” বেদব্যাসের এই পুত্রই “বিদুর” রূপে বিখ্যাত হন এবং মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর ভ্রাতা বলে পরিচিত ছিলেন। মহাত্মা মাণ্ডব্য মুনির অভিসম্পাতে স্বয়ং ধর্ম এসে, রাজনীতিজ্ঞ এবং কামক্রোধ শূন্য হয়ে বিদুররূপে জন্মেছিলেন।

বেদব্যাসও অম্বিকার প্রতারণা এবং শূদ্রার গর্ভে নিজের পুত্রোৎপত্তি ইত্যাদি সমস্ত বৃত্তান্ত সত্যবতীকে জানালেন।

বস্তুত এইখানেই রাজরানি সত্যবতীর কাহিনি শেষ। এরপর তাকে আর একবার মাত্র দেখতে পাই। পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত্যুর পর কুন্তী যখন আপন পঞ্চপুত্রকে নিয়ে হস্তিনাপুরে এলেন, কৌরব সন্তানেরা তাঁদের খুব ভালভাবে গ্রহণ করলেন না। নানা দুর্লক্ষণ দেখা দিতে লাগল। তখন বেদব্যাস এসে সত্যবতীকে বললেন, “মা, সুখের দিন অপগত হয়েছে। আর আপনার এখানে থাকার দরকার নেই। তপোবনে গিয়ে ঈশ্বরচিন্তায় বাকি দিনগুলি অতিবাহিত করুন।” পুত্রের উপদেশ মাতার গ্রহণীয় মনে হল। তিনি অম্বিকা ও অম্বালিকাকে সেই প্রস্তাব জানালেন। তাঁরাও রাজি হলেন। তপোবনেই সত্যবতী, অম্বিকা, অম্বালিকার মৃত্যু ঘটল।

সত্যবতী—সাধারণ আলোচনা

সত্যবতী রাজকন্যা। ধীবরের গৃহে লালিতা। কিন্তু গাত্রগন্ধ ছাড়া তিনি ধীবরের গৃহের কোনও কিছুই গ্রহণ করেননি। দাসরাজের অনুপস্থিতিকালে তিনি নৌকা নিয়ে নদী পারাপার করেছেন সত্য। কিন্তু তা তাঁর স্বভাবের অঙ্গ হয়নি। আত্মপরিচয় পেয়ে তিনি পরাশরের কাছে প্রথম চেয়েছেন গাত্রগন্ধ দূরীকরণ। পরাশরের সঙ্গে প্রথমেই তিনি মিলনে রাজি হননি। তাঁর কন্যাভাব দূষিত হওয়ার ভয় পেয়েছেন। তিনি কুমারী নারীর বৈশিষ্ট্য জানতেন। কিন্তু পরাশর যখন আশীর্বাদ দিলেন, তাঁর সঙ্গে মিলনের পরও সত্যবতী কুমারী থাকবেন, তখন তিনি সঙ্গমে রাজি হন। আপন সন্তানের বিদ্যা, বুদ্ধি, ক্ষমতার সংবাদ তিনি রাখতেন।

তাঁর জন্য ভীষ্মের জীবন যে স্বাভাবিক প্রবাহ পেল না, তা তিনি জানতেন। সেজন্য আত্মগ্লানিও তাঁর ছিল। বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর তিনি চেয়েছিলেন অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে ভীষ্ম রমণী উপভোগের সুখ অনুভব করুন ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। কিন্তু ভীষ্মের প্রত্যাখ্যানের পর তিনি স্বাভাবিকভাবেই বাইরের কোনও ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে চাননি।

যথার্থ রাজকন্যার সলজ্জ কুণ্ঠায় তিনি ভীষ্মকে জানান তাঁর কুমারী জীবনে মহর্ষি পরাশরের আগমন এবং “তুমি ধীবরের কন্যা নও” এই বক্তব্য জানিয়ে, তাঁকে গন্ধবতী করে তাঁর সম্মতির পর তাঁকে রমণ করে ব্যাসদেবকে সদ্য প্রসব করান। পরাশর আশীর্বাদ করে যান এই মিলনের পরেও সত্যবতী কুমারী থাকবেন।

ব্যাসদেব মাতার আদেশ অনুসারে অম্বিকা অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন। এরা বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ পুত্র। অর্থাৎ এখান থেকেই সত্যবতীর বংশধারাও শুরু হল। শূদ্রা-দাসীর গর্ভে জন্ম নিলেন ধার্মিকশ্রেষ্ঠ বিদুর। মহাভারতের মঞ্চ প্রস্তুত হল। কামার্ত শান্তনুর ভীষ্মকে আশীর্বাদ আমাদের বিস্ময় জন্মায়। কিন্তু তখনই মনে পড়ে শান্তনু পূর্বজন্মে রাজতপস্বীশ্রেষ্ঠ ‘মহাভিষ’-ই অভিশপ্ত শান্তনু। তখন তাঁর বরদানের ক্ষমত্তা স্বীকার করতে আমরা বাধ্য হই।।

অম্বা-কাহিনি ভীষ্ম উদ্যোগ পর্বে দুর্যোধনকে বলেছিলেন। সে-কাহিনি তাই পরে আছে।

গোধর্ম— নীলকণ্ঠের টীকা— “দিবা বা রাত্রৌ বা, প্রকাশমপ্রকাশং বা, যস্যাদং কস্যচিৎ স্ত্রীয়াং রমণম্‌।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *