০৯. কলিকাতা খাইবার পাস-২

কলিকাতা খাইবার পাস-২

‘কলিকাতা খাইবার পাস’—আমার এই প্রতিবেদনটি পড়ে পাঠকদের অনেকেই আমার কাছে অভিযোগ করেছিলেন—“এ তো আপনার ভয়ংকর একচোখোমি মশাই। গোটা লেখায় আপনি নর্থের খাবারকে প্রশংসায় প্রশংসায় একেবারে ভরিয়ে দিলেন অথচ সাউথের ধারপাশও মারালেন না। দক্ষিণ কলকাতা কি এতটাই এলেবেলে? নাকি সেখানে কোনও খাবারের দোকানই নেই। সেইসব পাঠকদের অভিযোগ কাম ভর্ৎসনার কথা মাথায় রেখেই ফের একবার কলম ধরা। তবে দক্ষিণে পা বাড়ানোর আগে আমাকে একবার ফিরতেই হবে উত্তরে। প্রায়শ্চিত্তের জন্য। প্রায়শ্চিত্তই বলব কারণ আগের প্রতিবেদনে উত্তরের কিংবদন্তী কয়েকটি খাদ্য বিপণির কথা উল্লেখ করতে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। ফলত সেই প্রায়শ্চিত্তের টানেই উত্তরে ফেরা। হে দক্ষিণী পাঠকবৃন্দ, কুপিত হবেন না। একটা ছোট্ট ঢুঁ মেরেই ফিরে আসব। দেরি করব না মোটে। কথা দিচ্ছি।

লালবাজার থেকে চিৎপুর রোড অধুনা রবীন্দ্র সরণি ধরে উত্তরমুখো এগোলে নতুন বাজারে গায়ে লাগা দুটো মিষ্টির দোকান। নলিনচন্দ্র দাস আর মাখনলাল দাস। প্রথমে নলিনচন্দ্রকে দিয়েই শুরু করি। সারাজীবন তো নকুড়ের মনোহরার কথাই শুনে এসছেন। বলি নলিনের মনোহরা চেখে দেখেছেন কখনও? ওপরে চিনি অথবা নলেন গুড়ের ফুরফুরে পলকা বর্ম। হালকা কামড় বসালেই মুখের মধ্যে ভেঙে চৌচির। ভেতরে মিহি ঝুরঝুরে পেটাছানার পুর। এককথায় স্বর্গীয়! নকুড় না নলিন? পেলে না মারাদোনার মতো একটা চিরন্তন তর্কে পড়ে যাবেন নিজের মধ্যেই। তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। নলিনের একমাত্র পরিচয় তার মিষ্টি। বিজ্ঞাপনে মুখ ঢেকে যাওয়া এই গ্লোবালাইজড সময়েও নিজেদের জন্য একটি লাইনও খরচ করবার প্রয়োজন নেই শতক পেরোনো এই প্রতিষ্ঠানটির।

নলিনের পাশেই মাখনলাল দাস। আরেক মিষ্টান্ন মহীরুহ। সুইট উইজার্ড! পুরনো ঘরানার কাঠের শোকেস। কাঠের আঁচের উনুনে বানানো হচ্ছে মিষ্টি। খোলা ভিয়েন। ক্রেতার চোখের সামনেই। নকুড় বা নলিনের মতো এদেরও কোনও লুকোছাপা, রাখঢাক নেই। এদের বিশেষত্ব হল ক্রেতার চাহিদা বা পছন্দ অনুযায়ী টাটকা মিষ্টি বানিয়ে হাতে হাতে তুলে দেওয়া। কীরকম খেতে? সেটা যে না চেখেছে তাকে বেকার বুঝিয়ে কোনও লাভ নেই। পুরীর সমুদ্র, মাউন্ট এভারেস্ট বা অ্যামাজোন রেইন ফরেস্টের মতো গিয়ে দেখতে থুড়ি চাখতে হবে। তবেই মালুম হবে ব্যাপারটা। তবে বেশি রাত করে না যাওয়াই ভাল। এই দুটো দোকানেই বেশিরভাগ পদ সন্ধের পরে নিঃশেষ হয়ে যায় প্রায়ই। বিলম্বে হতাশ হতে হবে। তাই শুভস্য শীঘ্রম!

নলিন-মাখন পালা শেষ করে সামান্য এগিয়ে কোম্পানি বাগানের (রবীন্দ্রকানন) মুখ থেকে অটো ধরে হেদোর মোড়। এক স্টপেজ হেঁটে হাতিবাগান বাজার। বাজারের গায়েই গদার কচুরি। নামটিই যথেষ্ট। অধিক পরিচিতি নিষ্প্রয়োজন। হিংয়ের কচুরি। সঙ্গে আলুকুমড়োর ঘ্যাঁট। হালকা পাঁচফোড়নের গন্ধটা মনের (নাকি জিভের) মণিকোঠায় গেড়ে বসে যাবে আজীবন। হলফ করে বলতে পারি। গদার গদাঘাতে আক্রান্ত হবার পর কালক্ষেপ না করে সোজা বাগবাজার বাটার মোড়। এতটুকু তো পথ। হেঁটেই মেরে দিন। হজমে সাহায্য হবে। বাটার ঠিক উলটোফুট থেকে বাগবাজার স্ট্রিট ধরে হেঁটে সেই গিরিশ মঞ্চ অবধি রাস্তার দু’ধারে সব মিলিয়ে কমপক্ষে গোটা দশ বারো তেলেভাজার দোকান। জিভে জল আনা স্বাদেগন্ধে এরা সবাই যাকে সেই হিন্দিতে বলে—‘এক সে বঢ় কর এক’। কারও নাম আলাদা করে বলা যাবে না। আলুর চপ, মোচার চপ, ফুলুরি, কাশ্মীরি চপ, বেগুনি, ক্যাপসিকামের চপ, ধোঁকা, ছান্তাবড়া, পলতাবড়া, ভেজিটেবল চপ, ন্যাজ উঁচিয়ে থাকা চিংড়ির চপ, লঙ্কাবড়া, ডালবড়া… কতরকম তেলেভাজা যে ভাজা হয় এসব দোকানে তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিবেদকের পরামর্শ একটু বিকেলের দিকে যান। পারলে বসন্তকালে। প্রায় সবক’টা দোকানেই মুড়ি পাওয়া যায়। বেশি নেবেন না। জনপ্রতি মাত্র দু’ টাকা। আর তেলেভাজা? একজন হলে গোটা চারেক। দোকা থাকলে আটটা। কোনটা নেবেন অথবা খাবেন? রাইট অফ চয়েস সম্পূর্ণভাবে আপনার। মুড়ি, তেলেভাজা আলাদা আলাদা ঠোঙায় নেবেন। ওপরে সামান্য বিটনুন আর গোটা মশলার ছিটে, ঝালে আপত্তি না থাকলে সঙ্গে একটা কাঁচা লঙ্কা। কিনেই হড়বড় করে খেতে শুরু করবেন না। প্রতিবেদকের গাইডলাইন মেনে চলুন। দু’-দশ কদম এগিয়েই সামনে গঙ্গার ঘাট। দুলকি চালে গিয়ে বসুন ঘাটলার সিঁড়িতে। ফুরফুরে গঙ্গার হাওয়া। সিঁড়িতে ধাক্কা মারা ছোট ছোট ঢেউয়ের ছলাত্ছল। মাঝ গঙ্গায় দুলতে থাকা মেছো নৌকো। পাশে রেললাইন ধরে ভোঁ বাজিয়ে চলে যাওয়া চক্ররেল। অন্ধকার নেমে আসা ঘাটে সন্ধ্যারতি… মুখে ফেলে দেওয়া একমুঠো মুড়ি। কামড় বসানো ধোঁয়া ওঠা পাইপিং হট তেলেভাজায়… পুরনো গঙ্গা আবার নতুন করে আবিষ্কৃত হবে ঘোর লেগে যাওয়া চোখে। গ্যারান্টি।

দক্ষিণপন্থী পাঠকরা নিশ্চয়ই রেগেখেপে কাঁই হয়ে গেছেন এতক্ষণে। একটু আসছি বলে সেই যে নর্থের দিকে গেল লোকটা, ফেরবার নামটি নেই। তাই আর একটুও দেরি না করে বাস বা ট্যাক্সি যা হোক একটা কিছু ধরে সোজা এসে পৌঁছনো যাক ধর্মতলার মোড়ে। একদম মোড়ের মাথায় কে সি দাস। মনে আছে ‘খাইবার পাস’ প্রথম পর্বের প্রতিবেদনটা শুরু করেছিলাম এখান থেকেই। তাই এখান থেকেই শুরু হোক দ্বিতীয় পর্বের খাদ্য পরিযায়। কে সি দাসের গা ঘেঁষে সিধুকানু ডহর ধরে খানিকটা এগিয়েই হাতের ডানদিকে ডেকার্স লেন। চিত্তদার দোকান। বাটার টোস্ট আর ঘুগনি। ওপরে পিঁয়াজকুচি আর বিটনুনের হালকা ছিটে। না খুব পাতলা, না খুব ঘন। একদম ঠিকঠাক। স্বাদে ফাটাফাটি। এর পাশাপাশি এদের স্টু। তিন রকম চিকেন-মাটন-ভেজিটেবল। সঙ্গে আলু-পেঁপে-গাজরের টুকরো। ফ্রেশ ক্রিম, মাখন আর কারি পাউডারের মিশেলে সে এক রূপকথা কুইজিন। সঙ্গে চা। শেষপাতে। দুধ-লিকার-ফ্লেভার, একদম সঠিক পরিমাণে। যেদিনই যান না কেন সেই একই রকম স্বাদগন্ধ। প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকবার কীভাবে এই একইরকম মান ধরে রাখা যায় সেটা আজও বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা এল-ডোরাডোর মতোই এক অপার রহস্য আমার কাছে।

চিত্তদার দোকানকে পিছনে ফেলে আবার ফিরে আসা যাক ধর্মতলার মোড়ে। জওহরলাল নেহরু রোড ধরে মেট্রো আর হোয়াইটওয়ে লেডল বিল্ডিং টপকেই এস এন ব্যানার্জি রোডের মোড়ে অনাদি কেবিন। কলকাতার আর এক কুইজিন ল্যান্ডমার্ক। বিখ্যাত মোগলাই পরোটার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা এ দোকানেই। নামে মোগলাই হলেও মোগলাই রান্নার সঙ্গে সাতকুলেও কোনও সম্পর্ক নেই। মোলায়েম খাস্তা পরোটার মধ্যে দেশি হাঁসের ডিম আর মশলায় জারানো মাংসের কিমার পুর। সঙ্গে আলুর তরকারি আর ঝিরিঝিরি করে কাটা পেঁয়াজ-বিট-গাজরের স্যালাড। ওপরে সামান্য গোলমরিচের গুঁড়ো ছিটিয়ে নিন। কাঁটাচামচে কেটে স্যস মাখিয়ে এক টুকরো মুখে পুরুন। মুহূর্তে গোটা ব্যাপারটা জমে ক্ষীর একেবারে। তবে একটু বেশি গুরুপাক। একবারে একজনের পক্ষে একটার বেশি ট্রাই না করাই উচিত। প্রয়োজনে বাড়ি ফিরে রাতের মিলটা অফ করে দিলেও দিতে পারেন।

অনাদি থেকে বেরিয়ে এস এন ব্যানার্জি ধরে একটু এগোতেই রিগ্যাল সিনেমা। দেয়ালে ‘চামেলি কি জওয়ানি’ বা ‘হওয়াসি আত্‌মা’ টাইপের সিনেমার রগরগে পোস্টার। হলের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সস্তার দেহপসারিনি। মুখে সস্তা প্রসাধন। জ্যালজ্যালে চকমকি শাড়ি। ওসবে নজর না দিয়ে চোখ ঘোরান উলটোফুটে। জোড়া কচুরির দোকান। সামনের কাচের শোকেসে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি। ওপরে বড় স্টেইনলেস স্টিলের পাত্রে গুলাবজামুন। তবে এদের আসল প্রসিদ্ধি বিখ্যাত হিংয়ের কচুরির জন্য। ফুলকো পেটের মাঝখানটা আঙুলে টিপে সামান্য ফাটিয়ে দিলেই নিভু নিভু ভলক্যানোর মতো বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার ভাপ। হিং, বিউলির ডাল আর ভাজা মৌরির মাতমাত গন্ধ। নাকে ঢুকলেই এক মাসের খিদে একেবারে পেয়ে যাবে। তবে সেরা আকর্ষণটি অবশ্য আলুর তরকারির পাশে দেওয়া একটুখানি কাঁচালঙ্কার আচার। অকল্পনীয় স্বাদ! কিন্তু কী কী মশলা মেশানো হয় আচারে, হাজার চেষ্টা করেও সেটা ধরা যাবে না কিছুতেই। জিজ্ঞেস করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না, কারণ সেটাই এদের কারবারের টপ সিক্রেট। অনেকটা চেরোনোবিল বা ম্যানহাটান নিউক্লিয়ার প্রোজেক্টের মতো। এই অধম প্রতিবেদকের অর্ধাঙ্গিনী, যিনি কিনা অন্যের রেসিপি হাতিয়ে নেবার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই পূর্বেকার সমস্ত ক্রাইম ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন, সেই তিনিও বহুবার চেষ্টা করেও এই সিক্রেট ফর্মুলাটি এদের কাছ থেকে হস্তগত করতে পারেননি। অবশেষে ‘উনিশটি বার ম্যাট্রিকে সে…’ মনোভাবাপন্ন হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এ হতাশা রাখার জায়গা কোথায়?

কচুরি পর্ব তো মিটল। কাউন্টারে বিল মিটিয়ে মৌরি চিবুতে চিবুতে ফুটপাতে নামুন। এলিট সিনেমা আর নিউ মার্কেট থানাটা পেরিয়ে সামান্য এগোলেই জানবাজারের মোড়টা যেখানে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের দিকে বাঁক নিয়েছে, সুপুরিপট্টি, সার সার মুদিখানা আর পাখির খাবারের দোকানের গা ঘেঁষে রানি রাসমণির বাড়ির ঠিক পিছনদিকে ছোট একফালি দরজার ওপর সাইনবোর্ডে লেখা—‘সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম।’ নাম পড়ে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। নেহাতই ভাতের হোটেল। গলিতে ঢুকে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতেই সে এক এলাহি কাণ্ড। বিরাট এক যজ্ঞিবাড়ি যেন। সামনে টাঙানো লম্বা বোর্ডে চকের টুকরোয় লেখা— ‘আজকের মেনু’। অন্তত তিরিশ বত্রিশটা পদের নাম পরপর সাজানো। দু’পাশে তিন তিনখানা ঘর। সার সার লম্বা টেবিল আর চেয়ার অথবা বেঞ্চি। মাথার ওপর ঘুরন্ত ডিসি ফ্যান। প্রচুর মানুষ বসে খাচ্ছেন। ঢুকেই জায়গা পাওয়ার আশা না করাই ভাল। হয়তো একটু অপেক্ষা করতে হতে পারে। জায়গা খালি হওয়ামাত্র পরিবেশকরাই ডেকে আদর করে বসিয়ে দেবেন আপনাকে। ঝকঝকে পরিষ্কার থালার ওপর বেছানো কলাপাতা (চার্জ এক্সট্রা)। পাশে লেবুর টুকরো, এক চিমটে নুন। চারাপোনা, কাটাপোনা, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, পাবদা, পমফ্রেট, পারসে, তোপসে, ইলিশ (সিজনে), খাসির মাংস (রেয়াজি এবং কচি) সহ নিরামিষের একাধিক সুপারলেটিভ পদের অসামান্য আয়োজন এখানে। অ্যালার্জি না থাকলে আপনি অর্ডার করুন গলদার মালাইকারি, কাতলার কালিয়া, ভাপা ইলিশ, সঙ্গে সোনামুগের ডাল, সুতোর মতো ঝুরিঝুরি আলুভাজা আর মুড়িঘণ্ট। শেষপাতে আদা আর জিরের ফোড়ন দেওয়া অলৌকিক টম্যাটোর চাটনি। গরমকাল হলে টম্যাটোর বদলে লম্বা ফালি করে কাটা কাটা কাঁচা আম। অলৌকিকত্ব আর এক অন্য মাত্রা পাবে। এক কথায় এদের প্রতিটি পদই যাকে ইংরেজিতে বলে— ‘এক্সক্লুসিভ, মাউথ ওয়াটারিং অ্যান্ড হেভেনলি!’ এসি নেই, গদি আঁটা চেয়ার টেবিল নেই। নেই ফিউশন বা এক্সপেরিমেন্টের লোকদেখানো কায়দাবাজি। সো-কলড কাম অ্যান্ড কুল অ্যাম্বিয়েন্সের প্রশ্নই ওঠে না। আর দাম? অবিশ্বাস্য রকম সস্তা! তবু স্রেফ জাদুমাখা রান্নার গুণেই ইদানীং ব্যাঙের ছাতার মতো শহরে গজিয়ে ওঠা সবকটা ‘বেঙ্গলি কুইজিন’-এর হোটেল রেস্তোরাঁকে গুনে গুনে দশ গোল দেবে সিদ্ধেশ্বরী। গরমকালে যদি যান তা হলে আপনার শেষপাতে পৌঁছে যাবে আম। পরিপাটি করে তিনফালি মেরে কাটা। পাকা ল্যাংড়া কিংবা হিমসাগর। বর্ষার গোড়ায় ফজলি। অবশ্যই আপনি যদি চান। খাওয়া শেষে উঠে হাতমুখ ধুয়ে ঘুরতেই সিঁড়ির গোড়ায় দুটো টেবিল। নাকের ডগায় চশমা, দুই ক্যাশিয়ারবাবু, বসে রয়েছেন গম্ভীরমুখে। টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র এসে হাজির পরিবেশনকারী। ব্রাহ্মী, হিব্রু, ল্যাটিন বা টোটো ভাষার চেয়েও দুর্বোধ্য কোনও ভাষায় ঝড়ের গতিতে বলে চলেছেন কিছু। ক্যাশিয়ারবাবু কিন্তু ঠিক বুঝে নিচ্ছেন আর খসখস করে লিখে চলেছেন ছোট ছোট কাগজে। কাস্টমার ঠিক যা যা খেয়েছেন হুবহু লিখে নিয়ে বিল ধরিয়ে দিচ্ছেন হাতে হাতে। জাদুবাস্তব এক দৃশ্যের অবতারণা চোখের সামনে। মোবাইলে তুলে নিয়ে ইউটিউব বা হোয়াটসআপে ছড়িয়ে দিন। ভাইরাল হয়ে যাবে বাজি রেখে বলতে পারি।

এবার সিদ্ধেশ্বরীর চরণ ছেড়ে ফের একবার ফিরে আসা যাক জওহরলাল নেহরু রোডের মোড়ে। হাতের বাঁদিকে দুটো বাড়ি পরেই বড় রাস্তার ওপর ঐতিহাসিক র‍্যালি সিং অ্যান্ড কোং। সংক্ষেপে ‘র‍্যালিজ’, ‘র‍্যালিজ’ মানেই এক ঝটকায় এক টুকরো ছেলেবেলা। অনেকখানি মধুর স্মৃতি। বাবার হাত ধরে মেট্রোয় সকাল সাড়ে ন’টার শো। জনি ওয়েসমুলারের ‘টারজান দ্য এপম্যান’, জুলি এন্ড্রুজের ‘মেরি পপিন্স’, ওয়াল্ট ডিজনির ‘ম্যাজিক বয়’…। শো ভাঙার পর অবশ্য গন্তব্য র‍্যালিজ। শরবত সম্রাট। রোজ, পাইন অ্যাপল, অরেঞ্জ, ম্যাঙ্গো কতরকম শরবত যে পাওয়া যায় শতাব্দীপ্রাচীন এই সুধারস বিপণিতে। সেই ছেলেবেলা থেকে আজও আমার পছন্দ রোজ। গোলাপের গন্ধ আপনার পছন্দ না হলে অর্ডার করুন অরেঞ্জ, পাইনাপল, যা হোক একটা কিছু। ওপরে ভাসমান বরফের ছোট ছোট চৌকো টুকরো। ছোট্ট একটা চুমুক। ঠোঁট হয়ে গলা বেয়ে নেমে যাওয়া সুগন্ধী তরল-রাশি। কলকাতার একচল্লিশ ডিগ্রি গরমেও গোটা শরীর জুড়ে মুসৌরি, কালিম্পং, দার্জিলিং। বাকিটা অবর্ণনীয়! কথাপ্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভাল, দোকান ছাড়াও ওদের শরবতের সবক’টা কনসেনট্রেট সিরাপও বিক্রি করে থাকে র‍্যালিজ। কিনে নিয়ে গিয়ে বরফঠান্ডা জলে বোতলের গায়ে লেখা পরিমাণমতো মিশিয়ে খেতে পারলেই শরবতের ম্যাজিক বাড়িতেও। শরবত ছাড়াও আরও একটি ব্যাপারে বিখ্যাত এরা। সেটা এদের চাট। আলু-পাপড়ি চাট, রাজকচুরি চাট, দহিবড়া চাট, মিক্সড চাট… গোটা একটা চাট সাম্রাজ্য যেন। সঙ্গে কুলচা-নান বা ছোলে-ভাটুরে। অতঃপর সেই অবধারিত প্রশ্ন। খেতে কীরকম? আর কত তুলনা টানব মশাই? উপমার ভাণ্ডার তো বাড়ন্ত প্রায়। অতএব নিজেই না হয় গিয়ে দেখে চেখে নেবেন একদিন। মাঝখানে সমগ্র র‍্যালিজপ্রেমীদের শোকসাগরে নিমজ্জিত করে বেশ কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছিল এই শতাব্দীপ্রাচীন সুধাবিপণি। আশার কথা আপামর প্রেমিকদের বিরহ ভেঙে সুকুমার রায়ের সেই পাগলা দাশুর মতোই ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’। আমাদের এ শহরে। স্থান-কাল-পাত্র অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই আর একটুও দেরি নয়। শুরু হয়ে যাক ‘অপারেশন র‍্যালিজ!’

এইবার। দক্ষিণীদের চূড়ান্ত বিরক্তি আর অধীর আগ্রহের অবসান ঘটিয়ে সত্যিসত্যিই পা রাখা খোদ দক্ষিণে। ভবানীপুর জগুবাজারের গা ঘেঁষা গলিটা ধরে হাত পঞ্চাশেক এগিয়ে খালসা স্কুলের ঠিক উলটোফুটে বলরাম মল্লিক অ্যান্ড রাধারমণ মল্লিক। সন্দেশ উইজার্ড! এদের অজস্র ধরনের সন্দেশ আর মিষ্টি নিয়ে কিছু বলার নেই মানে বলার থাকতে পারে না। এতটাই দেবভোগ্য। তবে আমার ফোকাস অন্য ধরনের দুটো ডেলিকেসির দিকে। এদের আমদই আর আতার পায়েস। জমাট লালচে দইয়ের ক্যামুফ্লেজে লুকিয়ে থাকা ঘন পাকা আমের রস। বাকিটা আর জাস্ট ভাবা যাচ্ছে না। আমদইয়ের সুযোগ্য দোসর আতার পায়েস। ক্ষীরজমাট দুধের মধ্যে চোবানো তুলতুলে নরম আতার শাঁস। একবারটি জিভে ছোঁয়ালেই নন্টে ফন্টের সেই কেল্টুদার ভাষায় বলে উঠতেই হবে—‘উলস!’

মিষ্টি ছাড়াও আর একটি কারণে অনন্য এই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। বছরে একবার দোকানপত্তর গুটিয়ে হপ্তাখানেকের জন্য তল্পিতল্পা বেঁধে সমস্ত কর্মচারীদের নিয়ে বেড়াতে যান দোকান মালিকরা। জানি না এই প্রথা আজও তাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন কিনা। না হলে ব্যাপারটা সত্যিই দুঃখজনক।

জগুবাজারের পরের বাসস্টপ। আশুতোষ মুখার্জি রোডের ওপর পূর্ণ সিনেমা। মাল্টিপ্লেক্সের দাপটে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন। ভাঙা জংধরা কোলাপসিপল গেট। ফাঁক দিয়ে উঁকি মারলে অন্ধকার হল। ধুলোভর্তি মেঝে। ছেঁড়া কালচে পর্দা। ঘুণ লেগে পচে যাওয়া কাঠের দর্শকাসন। প্রজেক্টর হোলে পুরু মাকড়সার জাল। এখানেই মেজমামার হাত ধরে ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’, ‘বর্ন ফ্রি…’ জায়গায় জায়গায় ইটের দাঁত বেরিয়ে পড়া দেয়াল ফুঁড়ে মাথা তুলেছে বট-অশত্থের চারা। জরাজীর্ণ অবস্থা। কোথায় গেলেন কর্মচারীরা? ভাবলেই বুকের মধ্যে কীরকম একটা করতে থাকে। অদূরেই বনফুল। পুরনো কলকাতার রেস্তোরাঁ কালচারের অন্যতম প্রতিনিধি। বনফুল মানেই অদৃশ্য কোনও টাইম মেশিনে চড়ে পিছিয়ে যাওয়া অনেকটা সময়। বনফুল মানে উত্তমকুমারের প্রিয় ব্রেস্ট কাটলেট। বনফুল মানেই পাশে রূপচাঁদ মুখার্জি লেন। মামাবাড়ির পুরনো পাড়া। দিদিমার আমূল কৌটোর ব্যাঙ্ক খুঁচিয়ে বের করে আনা পাঁচ নয়া, দশ নয়া, সিকি… এক ছুটে রাস্তায়। তারপর বনফুল। স্বপ্নের ব্রেস্ট কাটলেট! আর এখন। করুণ অবস্থা। পুরনো রঙ চটে যাওয়া টেবিল চেয়ার। ধুলোপড়া টিউব লাইট। অযত্ন আর অসচ্ছলতার ছাপ চারদিকে। সময়ের কাছে হেরে গিয়ে সস্তার রোল আর চাউমিন বেচে টিকে আছে টিমটিম করে। বড় মন খারাপ করা সময়। এক ঢোঁকে দুঃখটাকে গিলে ফেলে চলুন আরেকটু সামনে এগোনো যাক। বিজলী সিনেমার উলটোফুটে শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। সংক্ষেপে শ্রীহরি। ঘিয়ে ভাজা লুচি, হিংয়ের কচুরি, সঙ্গে ছোলার মিষ্টি ডাল আর আলুকুমড়োর তরকারি। এই দুই পদের জন্য নাম কলকাতাজোড়া। আর অবশ্যই ল্যাংচা। বিঘতখানেক লম্বা। লালচে বাদামি খোসার নীচে মধুর মোলায়েম ছানার আবাসভূমি। সারা গায়ে ভুরভুরে ঘিয়ের গন্ধ। চুপচুপে রসের আধার। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পরবর্তী রসনার ঠিকানা সন্ধানে বেরোনোর আগে ধ্যানস্থ হয়ে দোকানের বেঞ্চিতেই বসে থাকুন দু’-চার মিনিট। তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করুন অসম্ভব এই ভালোলাগাটুকুকে।

‘আপনজন’। আপামর চপ কাটলেট প্রিয় বাঙালির জন্য একটা দোকানের নাম, এর চেয়ে উপযুক্ত আর কিছুই হতে পারে না। কালীঘাট ট্রামডিপোর উলটোদিকে যে রাস্তাটা সোজা কালীঘাট মন্দিরের দিকে চলে গেছে সেটা ধরে সামান্য এগুলেই হাতের বাঁদিকে সদানন্দ রোড। দ্বিধা না করে ঢুকে পড়ুন। মিনিট তিনেকের রাস্তা। বাঁ ফুটে আপনজন। চপ কাটলেটের স্বর্গদ্বার! দুটো মানুষ পাশাপাশি দাঁড়াতে পারে না এতটাই সরু এক ফালি দোকান। ফুটে দাঁড়িয়ে অথবা টুলে বসে খেতে হবে ফিশ ফ্রাই থেকে শুরু করে ডিমের ডেভিল, ফিশ ওরলে হয়ে চিকেন কাটলেট… আজকের ভাষায়—‘মাইন্ডব্লোইং’! মনে আছে প্রথম পর্বে কলেজ স্ট্রিটে দিলখুশা কেবিনের বিখ্যাত কবিরাজি কাটলেটের মান পড়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিলাম। আপনজনে এলে আপনার সে আক্ষেপ মিটে যাবে। ওপরে ফুরফুরে ডিমের পরত। মধ্যে চাপ চাপ মাংস অথবা মাছের পুর। পিঁয়াজ-আদা-রসুনকুচি আর ঝিরঝিরে কাটা ধনেপাতার অ্যারোমা… লিখতে গিয়ে কলম থেমে যাচ্ছে। বিশ্বাস করুন। ফিশ, চিকেন অথবা মাটন কবিরাজী-আর একমুহূর্তও দেরি না করে অর্ডার করে ফেলুন এর মধ্যে যে-কোনও একটা। সস বা কাসুন্দিতে (কাসুন্দিই বেটার) চুবিয়ে পরপর দু’-তিনটে কামড়। দিলখুশার পুরনো সেই স্বাদ হুবহু পুনরুদ্ধার হবে, জোর দিয়ে বলতে পারি।

হালফিলে আপনজন তাদের আরেকটি শাখা খুলেছে ওই একই রাস্তার ওপর, তপন থিয়েটারের উলটোদিকে। ভিড় এড়াতে সেখানেও যেতে পারেন। খাবারের স্বাদ এবং মান একইরকম থাকবে এটা নিশ্চিত।

এই রে! কথায় কথায় ‘ক্যাফে’-র কথাটাই তো ভুলে মেরে দিয়েছি একেবারে। প্রতিবেদকের এই সামান্য অপরাধটুকু ক্ষমাঘেন্না করে দিয়ে পিছিয়েই না হয় গেলেন একটু। হাজরা মোড়ে যতীন দাস পার্কের উলটোদিকে ‘ক্যাফে’। মেট্রো স্টেশনের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকা ভেজ চপ, ফিশ কাটলেটের ‘গেরিলা জোন’। সঙ্গে একটু কড়া লিকারের দুধ-চা। আগে না হোক রসাস্বাদন করে বেরিয়ে আসার পর সাত খুন মাফ হয়ে যাবে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।

অতঃপর আমাদের ডেস্টিনেশন হোক তরুণ নিকেতন। রাসবিহারী মোড় থেকে গড়িয়াহাটের দিকে ঘুরে গিয়ে পুরো একটা স্টপেজও যেতে হবে না। হাতের বাঁদিকে পুরনো ভাতের হোটেল। প্রিমিয়াম আইটেম তেল-চিতল, চিতল মুইঠ্যা, কাতলার ঝোল আর জিরে ফোড়নের সামান্য পাতলা মুসুরির ডাল। চাইলে এবং থাকলে পেয়ে যাওয়া যেতে পারে সুগন্ধি কাগজি লেবুর ছোট একটা টুকরো (অন্যথায় পাতিলেবুতেই কাজ চালাতে হবে)। সঙ্গে ঝুরো ঝুরো আলুভাজা নইলে থকথকে পোস্তয় ডুবুডুবু আলুপোস্ত। ওপরে ছড়িয়ে যাওয়া কাঁচা সরষের তেলের হালকা ভাপ… নাঃ, বাকিটা আর বলা যাচ্ছে না। জিভ জুড়ে স্যালাইভার নিঃসরণ বলাকওয়া বন্ধ করে দিচ্ছে। অতএব নিজ জিহ্বায় পরীক্ষা প্রার্থনীয়। তবে একটা কথা এখানে জোর দিয়ে বলাই যেতে পারে যে সিদ্ধেশ্বরী, ইয়ং বেঙ্গল (খিদিরপুরের মোড়ে আরেক অসামান্য পাইস হোটেল) আর তরুণ নিকেতনের হাত ধরে অন্তত এই একটা ব্যাপারে উত্তরকে অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছে মধ্য আর দক্ষিণ কলকাতা। আজ থেকে দশক তিনেক আগেও উত্তর কলকাতায় এরকম বেশ কয়েকটা পাইস হোটেল ছিল শোভাবাজার, গড়পার আর শেয়ালদা অঞ্চলে। যার মধ্যে অন্যতম শ্রীমানি বাজারে চণ্ডীর হোটেল বা শেয়ালদা স্টেশনের গায়ে হোটেল ব্যারন। ইদানীং এদের মধ্যে অনেকগুলিই উঠে গিয়েছে আর বাকিগুলোর মান এতটাই পড়ে গিয়েছে যে তাদের নিয়ে আর কিছু লেখার কোনও মানেই হয় না।

তরুণ নিকেতনের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে লেক মার্কেট। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম আদি বাজার। ইদানীং তার মাথার ওপর ধাঁ করে ঝাঁ চকচকে একটা মল চাপিয়ে দেওয়ার ফলে হাতিমি বা বকচ্ছপের মতো একটা বিটকেল কদর্য চেহারা নিয়েছে। কী আর করা। অগত্যা গতস্য শোচনা নাস্তি বলে ঢুকে পড়া যাক লেক মার্কেটের গায়ে লাগা রাস্তাটায়। জনক রোড। নামে রোড হলেও চওড়া একটা গলি ছাড়া আর কিছুই নয়। গলি ধরে হাত বিশেক এগিয়েই ডানফুটে রাধুবাবুর (মতান্তরে রাদুবাবু) দোকান। আপনজনের মতো না হলেও আকারে বেশ ছোটই। তবে সুবিধে একটাই। উলটোদিকের ফুটপাতটা বেশ চওড়া। দোকানের এক কোণে দাঁড়ান চুপটি করে। মনোযোগ সহকারে চোখ বুলিয়ে নিন দোকানের একপাশে টাঙানো মেনুবোর্ডে। হরেকরকম চপ কাটলেট আই ফ্রাইয়ের নাম লেখা রয়েছে। ফের একবার প্রতিবেদকের অ্যাডভাইস মানলে অর্ডার করুন চিকেন কাটলেট আর ঠিকঠাক লিকার-ফ্লেভারের চা। এদের বৈশিষ্ট্য। হাতে পাওয়া-মাত্র নিয়ে সেঁটে যান ওপারের ফুটপাতে। চা-টা অবশ্য পরেও অর্ডার করতে পারেন, কারণ প্রথম কাটলেটটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মনের মধ্যে প্রচণ্ড টানাপোড়েন শুরু হবে। দ্বিতীয়টা অর্ডার করবেন কি না। এতটাই অমোঘ এই কাটলেটের আকর্ষণ। সঙ্গে কাসুন্দিটা চেয়ে নিতে ভুলবেন না যেন। কলকাতার সব ক’টা চপ কাটলেটের দোকানের মধ্যে রাধুবাবুর কাসুন্দিটাই সেরা। কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা বলছি। বিশ্বাস করলে ঠকবেন না।

লেক মার্কেটের পরের স্টপেজ দেশপ্রিয় পার্ক। তাই বাসে-ট্রামে না চড়াই ভাল। পার্কের ঠিক উলটোদিকে সুতৃপ্তি। চোখে পড়ামাত্র বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস! বেশ কিছুদিন হল বন্ধ হয়ে গেছে। সুতৃপ্তি মানেই শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চাটুজ্জে, ঋত্বিক ঘটকদের ধুন্ধুমার আড্ডা… চা আর ফিশফ্রাই। ডিমের ব্যাটারে মাখামাখি, ওপরে ব্রেডক্রাম্বের মিহি মুচমুচে আস্তরণ। মাছখানে শুয়ে থাকা পিওর ভেটকির পুর। ধনেপাতা, জায়ফল, জয়িত্রি আর আদা-রসুন-পেঁয়াজ কুচির সেই নিওলিথ সুবাস… সব চলে গেল! চেখে দেখতে পারলেন না। তবু হেরে যাওয়া ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করুন এক মিনিট। বাঙালি হিসেবে লজ্জিত হন। আত্মগ্লানিতে ফালাফালা করুন নিজেকে। যে শহরে ভুজিয়াওয়ালা, ফিউশন ফুড সংস্কৃতি দাপিয়ে বেড়ায় আর সুতৃপ্তি বন্ধ হয়ে যায়। এ লজ্জা রাখার জায়গা কোথায়? দেশপ্রিয় পার্কের অদূরে গড়িয়াহাট অঞ্চলে এবং ধর্মতলায় সুতৃপ্তির মতোই আরও তিনটি রেস্তোরাঁ আছে অথবা ছিল। কাফে-ডি-মনিকো, স্যাঙ্গুভ্যালি এবং সাউথ পোল। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভদের আড্ডা, বাটার টোস্ট, ভেজিটেবল চপ আর চায়ের জন্য বিখ্যাত। ছিল বলছি কারণ এখনও আছে না কি জেট স্পিড সময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পাততাড়ি গুটিয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখা হয়নি অনেকদিন। আপনারা চেষ্টা করলেও করতে পারেন।

গড়িয়াহাট এলাকায় দুটি মিষ্টির দোকানের কথাও এই প্রতিবেদনে না বললে বোধহয় অন্যায় হবে। ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের কাছে যাদব চন্দ্র দাস আর হিন্দুস্থান রোডের মোড়ে মহাপ্রভু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। যাদবের কড়াপাক আর মহাপ্রভুর আইসক্রিম সন্দেশ। বহুদিন হল ঢুঁ মারা হয়নি ওদিকটায়। তবে স্বাদ আজও জিভে লেগে রয়েছে।

ইদানীং গড়িয়াহাট, যাদবপুর, টালিগঞ্জ, গড়িয়া আর বেহালা অঞ্চলে বেশ কয়েকটা নতুন নামীদামি মিষ্টির দোকান হয়েছে। সুখ্যাতিও হচ্ছে প্রচুর। কারও নাম আলাদা করে করতে চাই না। তবে এদের প্রায় প্রত্যেকের মিষ্টিই চেখে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। অনবদ্য বা দুর্দান্ত কিছু মনে হয়নি। কিন্তু একটি দোকানের নাম এক্ষেত্রে উল্লেখ করতেই হবে। স্রেফ তাদের দইয়ের জন্য। বেহালা ট্রামডিপোর উলটোদিকে ব্রাহ্মসমাজ রোডের মোড়ে পান্না সুইটস্। বহু নামীদামি দোকানের দই বাড়িতে এনে ফ্রিজে রেখে দেখেছি। দু’-তিন দিন বাদে কেটে নেওয়া জায়গাগুলোয় জল ছেড়ে যায়। স্বাদও যায় ফিকে হয়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম পান্না। এনে ফ্রিজে রেখে দিন। দু’-তিন দিন বাদেও জল কাটবে না এতটুকু। আর স্বাদেও অটুট। পান্নার দইয়ের বিশেষত্ব এখানেই।

দইয়ের কথা যখন উঠলই তখন ফের একবার মধ্য আর উত্তর কলকাতায় ফিরতেই হবে। কিছু করার নেই। মিঠাই। মধ্য আর দক্ষিণ কলকাতার একদম সীমান্ত ঘেঁষা এই মিষ্টান্ন বিপণি। পার্ক সার্কাস ট্রামডিপোর পরবর্তী স্টপেজ বেকবাগান মোড়ে। পাঁচ দশকের এই সুইট শপ আর তাদের তাক লাগিয়ে দেওয়া দই। যদিও একটু বেশি মিষ্টি তবুও স্বাদে গন্ধে অনন্য। দই ছাড়াও আরও অনেকরকম মিষ্টান্ন পদ বানিয়ে থাকেন এঁরা। তবে সিঙাড়া আর খাস্তা কচুরির কথাটা আলাদা করে বলতেই হবে। খাঁটি তেলে ভাজা, চুড়মুড়ে। সিঙাড়ার ভেতর আলুর পুরটা বোধহয় কলকাতার সেরা। এ রকমটা আর কোথাও খাইনি। বিশেষ করে শীতকালে পুরের মধ্যে ফুলকপি আর ভাজা চিনেবাদামের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় স্বাদটা যে সর্বোচ্চতায় ওঠে সেটা বলাই বাহুল্য। অতঃপর আসি মিহিদানার কথায়। আধভেজা রসে টইটুম্বুর তারামণ্ডল যেন। গায়ে জড়ানো খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের মসলিন। বর্ধমান, বর্ধমান তো অনেক করলেন। একদিন মিঠাইয়ের মিহিদানা টেস্ট করে দেখুন। কোনও অংশে খাটো পড়বে না, বাজি রেখে বলতে পারি।

শেয়ালদায় সত্যনারায়ণ সুইটস আর এদের দই। বহু বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে ফিরছে এদের কথা। অধিকাংশ বিখ্যাত মিষ্টির দোকানেই দইয়ের রঙটা লালচে ধরনের। ব্যতিক্রম সত্যনারায়ণ। এদের বৈশিষ্ট্য সাদা চিনিপাতা দই। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পাওয়া যেত কলকাতার দোকানে দোকানে। সেই ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে সত্যনারায়ণ। গাদাগুচ্ছের কিড়কিড়ে মিষ্টি নয়। বরং একটা অম্লমধুর ভাব। প্রিয় পাঠক, একবার হিমসাগরের সঙ্গে ল্যাংড়ার স্বাদের পার্থক্যটা কল্পনা করুন মনে মনে। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে জলের মতো। টকমিষ্টি সাদা দই। জানি না আর কেউ এই বৈশিষ্ট্যটি বাঁচিয়ে রেখেছেন কি না আজও এ শহরে। জানতে পারলে অবশ্যই জানাবেন দয়া করে।

ফড়িয়াপুকুরে সেন মহাশয়ের গা ঘেঁষে অমৃত সুইটস। নলিন বা মাখনলালের মতো এর কথাও উল্লেখ করতে ভুলেই গিয়েছিলাম প্রথম পর্বে। নতুন করে এদের সম্পর্কে কিছু বলার নেই। শ্রবণ এবং জিহ্বার বিবাদভঞ্জন করতে একদিন পৌঁছে যান ফড়িয়াপুকুর। একটু বিকেল-বিকেলই যান। কারণ সন্ধের পর বেশিরভাগ সময়ই দোকানের একপাশে ছোট শেলেট ঝোলানো থাকে। তাতে চক দিয়ে লেখা— ‘দধি নাই।’ খাঁটি উত্কৃষ্ট দই আর অমৃত, দুটো নাম সমার্থক। অমৃতর দই অমৃতই। অন্য কোনও তুলনা বাতুলতা মাত্র।

এবার যে দোকানটির কথা বলে এই প্রতিবেদন পর্বে দাঁড়ি টানব তার সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সীমানাতেও দাঁড়িটা পড়ে যাবে অবশ্যম্ভাবীভাবেই। কারণ উলটোফুটে বহমান পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে। আর গঙ্গা টপকালেই হাওড়া। হ্যারিসন অধুনা মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে সোজা এগিয়ে বড়বাজারের মোড়ে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। কলকাতায় একমাত্র নবকৃষ্ণ গুঁই আর গাঙ্গুরাম ছাড়া আর কোথাও এত ভাল রাধাবল্লভি পাওয়া যায় বলে আমার অন্তত জানা নেই। আপাদমস্তক খাঁটি ঘিয়ে ভাজা। দু’ আঙুলের চাপে তবকের চেয়েও পাতলা ওপরের আস্তরণটা ছিঁড়লেই কলাইয়ের ডাল আর ভাজা জিরে মৌরির মন পাগল করা সুবাস। মিষ্টি ছোলার ডাল (মাঝে মাঝে জিভে এসে আটকে যাওয়া ফুলোফুলো কিশমিশ) অথবা নিরামিষ আলুর তরকারি। দুটোর সঙ্গেই সমান যায়। তবে প্রতিবেদকের মতে ফটো-ফিনিশে ছোলার ডাল সামান্য হলেও এগিয়ে থাকবে। রাধাবল্লভির পাশাপাশি নিতেই হবে আট প্যাঁচের অমৃতি। আদরের নাম অমিত্তি (আহা!)। পাকা সোনার রং পিছলে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। ওপরটা খাস্তা কুড়কুড়ে। ভেতরটা রসে টইটুম্বুর। শেষপাতে কাঁচা হলুদ রঙা কেশরভোগ। বলি রাজভোগ বা কমলাভোগ তো অনেক খেয়েছেন। একবার দেশবন্ধুর কেশরভোগটা খেয়ে দেখুন। তারপর এসে বলবেন।

আর কী? অনেক তো হল। এরপর আর এগোলে তো গঙ্গায় থুড়ি হাওড়ায় গিয়ে পড়তে হবে। শিবপুর, রামরাজাতলা… হাওড়ার পর হুগলি। রিষড়া, চন্দননগর, জনাই… বাঙালি মিষ্টির আদি জন্মভূমি… আর এক রূপকথার শুরু। সময় সুযোগ হলে শোনানো যাবে আরেকদিন। আজ এই পর্যন্তই।

সংযোজন: এই দেখুন! এত লেখার ভিড়ে গড়পারে সুকিয়া স্ট্রিটের গায়ে শ্রীমানি বাজারের ভেতর এ ডি কেবিনের নামটাই করতে ভুলে গেছি বেমালুম। কলকাতা রেস্তোরাঁ সংস্কৃতির আরেক উজ্জ্বল নাম। ততোধিক উজ্জ্বল এদের ফাউল কাটলেট আর মাটন স্টু। যারা খাননি, চেখে দেখার সুযোগ আর নেই! মাত্র বছর দুয়েক আগে এই অমৃত পদ বিপণি বন্ধ করে দিয়েছেন বৃদ্ধ কর্ণধার। পরবর্তী প্রজন্ম ব্যাবসা চালাতে রাজি না হওয়ায়। ভাবা যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *