০৭. না-মানুষী কলকাতা

না-মানুষী কলকাতা

বসন্ত এসে গেছে

কলকাতায় কি বসন্ত আর আসে? নমো নমো করে কোনওমতে লক্ষ্মীপুজোর পুরুতের যজমান বাড়িতে হাজিরা দেওয়ার মতো কয়েকদিনের জন্য ঢুঁ মেরেই উধাও শীত। তারপরই কাঠফাটা গরম নয়তো প্যাচপ্যাচে বর্ষা। গত কয়েক বছর ধরে শহরের আবহাওয়ার হাল হকিকত অনেকটা এই রকম। মাঝখানে সন্ধেবেলা ফুরফুরে মিঠে হাওয়া বয়ে যাওয়া বসন্তকালটাই বিলকুল বেপাত্তা কলকাতা থেকে। তবে বসন্ত না এলেও হলুদ বসন্ত কিন্তু আসে। পার্ক সার্কাসের ঘিঞ্জি সংখ্যালঘু মহল্লা। ইট কাঠ পাথরের জঙ্গল। গাছ গাছালি নিশ্চিহ্ন প্রায়। তবু হলুদ বসন্ত আসে। আমার পুরনো ফ্ল্যাটের সামনে ছোট্ট একফালি বাগানে। বিশেষ করে শীতকালে। হলুদ বসন্ত মানে হলুদ বসন্ত পাখি (ব্ল্যাক হেডেড ওরিঅল/ গোল্ডেন ওরিঅল)। বাংলায় বসন্ত বউরি, বেনেবউ নামেও ডাকা হয়। উজ্জ্বল হলুদ শরীরে কালো ডানা আর মাথা। থেকে থেকে ‘চিয়াক চিয়াক’ জাতীয় ডাক ছাড়ে। মাঝে মাঝে— ‘পি ও ও’ ধরনের সুরেলা শিস। বহুবার চেষ্টা করেছি ক্যামেরাবন্দি করার। পারিনি। চোখাচোখি হওয়ামাত্র পালিয়েছে। লক্ষ করে দেখেছি বাগানের সামনে শিমুল গাছটার মধু খুব প্রিয় পাখিটার। ফুলের একেবারে গোড়ায় বসে মাথা ঝুঁকিয়ে খাওয়ার সে কী তরিবত। ইদানীং বুড়ো হয়েছে গাছটা। ক্রমশ হেলে পড়ছে একদিকে, শীতের শেষে আর তুলো ওড়ে না তেমন। ভয় লাগে কোনওদিন যদি পড়ে যায়… আর আসবে তো হলুদ বসন্ত? বাড়ির সামনে এই একফালি বাগানে?

শুধু কি হলুদ বসন্ত? আরও কত রকমের পাখি যে আসে বাগানটায়। তার মধ্যে অন্যতম খঞ্জন (লার্জ পাইড ওয়াগটেইল)। এই এতটুকু ইঞ্চিতিনেক লম্বা চেহারা। কালচে ধূসর গায়ের রং। পেটের কাছটা দুধসাদা। শরীরের চেয়ে বড় লেজ। সবসময় খাড়া আকাশের দিকে। মাঝে মাঝেই দেখি নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছাদে। ইতি-উতি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে কী সব। মানুষ দেখে তেমন একটা ভয়টয় পায় বলে মনে হয় না। তবে খুব কাছে গেলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে বাগানে শিউলি গাছটার ডালে বসে। খঞ্জন ছাড়াও মাঝেমধ্যেই কলকে ফুলের গাছটায় এসে বসে মৌটুসি (পার্পল সানবার্ড)। আকারে চড়াইয়ের চেয়েও ছোট। মধুকুয়া বা মধুচুয়া নামেও ডাকা হয় বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চলে। চোখ ঝলসে দেওয়া ময়ূরকণ্ঠী নীল রং। হেলিকপ্টারের প্রপেলারের চেয়েও বিদ্যুত্গতিতে ডানা নাড়িয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে উড়ন্ত অবস্থায় কলকে ফুলের মধু খায় বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে। অবিকল দক্ষিণ আমেরিকান জ্ঞাতিভাই হামিংবার্ডের কায়দায়। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

এদেরই আরেক জ্ঞাতিগুষ্টির দেখা পেয়েছিলাম বাগানে। বছর কয়েক আগে। মাঝে মাঝেই বাগানে গাছগাছালির আড়াল থেকে তীক্ষ্ন ‘চিক চিক’ শব্দ শুনতে পেতাম। প্রথমে ভাবতাম বোধ হয় কাঠবেড়ালী (কমন ইন্ডিয়ান চিমপাক)। তারাও দু’-চারজন রয়েছেন যে বাগানে। রোঁয়া ফোলানো লেজ আর পিঠে তিনটে কালো ডোরা। সর্বদা ব্যস্ত ঘোরাফেরা। ভাতের দানা থেকে ছোলাভাজা, সবই রয়েছে খাদ্যতালিকায়। ওদের ডাকও অনেকটা ওই একইরকম। ক’দিন কান খাড়া রেখে ভাল করে শোনার পর মনে হল তীক্ষ্ন হলেও কাঠবেড়ালীর তুলনায় স্বরটা অনেক মৃদু এবং মিহি। ভাল করে নজর চালাতেই রহস্যের পরদা ফাঁস। চড়াই এমনকী মৌটুসির চেয়েও সাইজে ছোট একরত্তি একজোড়া পাখি। লালচে মেটে গায়ের রং। ফুড়ুক ফুড়ুক নেচে বেড়াচ্ছে ডালপালার আড়ালে। টুনটুনি। ইংরেজিতে ‘টেলার বার্ড’ ‘দর্জি পাখি’ নামে অমর হয়ে আছে রুইয়ার্ড কিপলিঙের লেখায়, উপেন্দ্রকিশোরের বইয়ে। সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। গাছের আঁশ, পাতার টুকরো ইত্যাদি ঠোঁট দিয়ে সেলাই করে অসাধারণ ঘর বানায়। খাদ্যতালিকায় রয়েছে ছোটখাটো পোকামাকড় আর ফুলের মধু। ঘর বানাতে দেখিনি কখনও তবে মধু আর পোকামাকড় খেতে দেখেছি হামেশাই। মৌটুসির মতোই প্রচণ্ড ভীরু, লাজুক এবং সতর্ক। কাছাকাছি উপস্থিতির আঁচটুকু পেলেই ফুড়ুৎ একনিমেষে। হলুদ বসন্ত, খঞ্জন, মৌটুসি, টুনটুনি ছাড়াও আসে শা-বুলবুলি (রেড ভেন্টেড বুলবুল)। পালিশ কালো নতুন জুতোর মতো পালকের রং। পেটের কাছটা টকটকে লাল। চারপাশে সাদা বর্ডার। টুনটুনির মতো এরাও থাকে জোড়ায়। পুরুষ পাখির মাথায় তেকোনা ঝুঁটি। চালের দানা, ভাঙা বিস্কুট বেশ তরিবত করে খেলেও মূল খাদ্য পোকামাকড়। স্বভাব চঞ্চল। মানুষকে তেমন একটা ভয় পায় না, মাঝে মাঝে তো উড়ে এসে জানলায় বসে পড়ে। সামনে মুড়ি বা ভাঙা বিস্কুট ছড়িয়ে দিলে প্রাথমিক সন্দেহের বশে উড়ে পালালেও পরমুহূর্তেই এসে খুঁটে খেয়ে যায়। ছোট থেকে পোষ মানালে খুব ভাল পোষ মানে। উত্তর কলকাতার গড়পাড়ে আমার জন্ম। ছেলেবেলায় দেখতাম অনেকেই একে পোষ মানিয়ে আঙুলে বসিয়ে ঘুরে বেড়াত। শুনেছি একসময় পুরনো কলকাতার বনেদি বাড়িগুলোতে বুলবুলির লড়াই হত। সেসব দেখার সৌভাগ্য হয়নি তবে কৈলাস বোস স্ট্রিটে কালোয়ার পট্টির ছোট মাঠে বুলবুলির লড়াইয়ের আসর বসত। বন্ধুবান্ধব মিলে দল বেঁধে দেখতে যেতাম। লড়াইয়ের কুশীলব সবসময় নর অর্থাৎ পুরুষ বুলবুলি। লড়াইয়ের আগে পাখিটিকে উত্তেজিত করার জন্য খাওয়ানো হত মাংসের কিমা আর ব্র্যান্ডি মেশানো ছাতুর মণ্ড। কালোয়ার মানে লোহার ব্যবসায়ীদের অনেকেরই প্রচণ্ড শখ ছিল এই খেলায়। প্রাইজ মানি ছাড়াও বিজেতা পেতেন সুদৃশ্য ট্রফি। ব্যবসায়ীদের অনেকের গদির সামনেই রাজকীয় ভঙ্গিমায় দাঁড়ে বসে রয়েছে শা-বুলবুল, আমহার্স্ট স্ট্রিট, কৈলাস বোস স্ট্রিট, চালতাবাগান, এ সব অঞ্চল ধরে হেঁটে গেলে এটি বড় পরিচিত দৃশ্য ছিল সেসময়। পাখিগুলোকে বাগানে ওড়াউড়ি করতে দেখলে আজও সেই ছেলেবেলায় ফিরে যাই মাঝে মাঝেই।

আজ থেকে বছর দশেক আগেও দেখেছি ওদের। ভর দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝেই এসে ঢুলুঢুলু চোখে গম্ভীর দার্শনিকের মতো মুখ করে বসে থাকত ভেন্টিলেটরের গর্তে। লক্ষ্মী-প্যাঁচা। ইংরেজিতে মিল্কি আউল। দুধসাদা গায়ের রং। মুখটা হালকা বাদামি। থ্যাবড়া বাঁকানো ঠোঁট। দেখলে মনে হয় সব সময় ঢুলছে নয়তো ঘুমোচ্ছে। মোটেই তা নয়। আসলে চোখের আকারটাই অন্যরকম। সরু আর চেরা ধরনের। ফলে ওরকমটা মনে হয়। এসে বসতে দেখলেই দুনিয়ার কাকের দল উড়ে এসে কা কা শব্দে পাড়া মাথায় তুলে ব্যতিব্যস্ত করত পাখিটাকে। শোনামাত্র একতলার ফ্ল্যাটের জেঠিমা প্রচণ্ড চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করতেন— “ভাগা, ভাগা, কাউয়াগুলিরে ঢ্যালা মাইরা ভাগা… লক্ষ্মী উইড়্যা যাইব।” নামে লক্ষ্মী হলেও কাজে যে মোটেই লক্ষ্মী নয় সেটা টের পেয়েছিলাম গরমকালের এক রাতে। জানলার ধারে শুতাম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল একদিন। জানলার ধারে এসে দাঁড়ালাম। এখনও মনে আছে রাতটা ছিল পূর্ণিমা। চোখ গেল নীচে বাগানে। একটা ধেড়ে ইঁদুর। ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছে বাগানে, বোধহয় খাবারের সন্ধানে। হঠাৎই সামনে শিমুল গাছটার ডাল থেকে কী যেন একটা উড়ল ইঁদুরটাকে তাক করে। শরীরের দু’পাশে সমান্তরালভাবে ছড়িয়ে দেওয়া দুধসাদা এক জোড়া ডানা। ঝকঝক করছে পূর্ণিমা চাঁদের আলোয়। উড়ে এল না বলে যেন ভেসে এল বলা ভাল। দক্ষ পেশাদার গ্লাইডারের মতো। মুহূর্তের মধ্যে বিশাল দুই ছড়ানো ডানা আর শরীরের তলায় ঢেকে গেল ইঁদুরটা। ‘ক্রিচ!’— একটা আর্ত চিৎকার। সামান্য ঝটাপটি। ঘাড় ধরে দুয়েকটা মোচড় আর ঝাঁকুনি। ঠোঁটের ডগায় শিকার নিয়ে ফের শিমুলগাছের মগডালে গিয়ে বসল লক্ষ্মীপ্যাঁচা। বোধহয় আশি সালের কথা। মোবাইল ফোন তখনও দূর গ্রহের কোনও প্রাণী। হাতের কাছে ক্যামেরাও নেই, তাই ধরে রাখতে পারিনি দৃশ্যটা। সে আফশোস যায়নি আজও।

অনেকদিন হল লক্ষ্মীপ্যাঁচারা আর এসে বসে না ফ্ল্যাটের ভেন্টিলেটারে। তবে বেহালায় মামাবাড়িতে শুনেছি এখনও তেনাদের দেখা পাওয়া যায় কালেভদ্রে। শুনলেই একটা চরম স্বস্তি অনুভব করি মনে মনে— ‘যাক! সবকিছুই তা হলে’ ‘হারানো প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশের’ তালিকায় চলে যায়নি এখনও। আশার কথা এইটুকুই।

তবে সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে বাড়ির সামনে এই বাগানেই। সকালবেলা। দশটা সাড়ে দশটা মতো হবে। বাজার সেরে ফিরছি। বাগানের সামনে ছোটখাটো একটা জটলা। আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে রয়েছেন উদ্বিগ্ন মুখে। সামনে উপুড় করে রাখা বড় একটা বেতের ঝুড়ি। ঝুড়ির ওপর চাপা দেওয়া একটা আধলা ইট। আমাকে দেখেই উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলেন— “দ্যাখো তো কী একটা পাখি, গায়ে কালো ছিট ছিট মতো… উড়ে এসে পড়েছে বাগানে। মনে হয় ঠিক মতো উড়তে পারছে না। কী করব বুঝতে না পেরে ঝুড়ি চাপা দিয়ে রেখে দিয়েছি। অর্ধাঙ্গিনীর হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে ঝুঁকে পড়লাম ঝুড়ির সামনে। বেতের ফাঁক দিয়ে চোখ চালালাম। আধো অন্ধকার ভেতরটা। আবছা দেখা যাচ্ছে ধূসর পালকে ঢাকা একটা কিছু, সারা গায়ে ছিট ছিট দাগ। কাছাকাছি কারও উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র ‘ফ্যাঁস্ স্!’ ভয়ংকর বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ গর্জন ভেতর থেকে। সতর্ক হয়ে গেলাম মুহূর্তে। ঝুড়ির মধ্যে যিনি রয়েছেন, আর যাই হোক খালি হাতে তেনাকে ধরতে গেলে যে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা সেটা বুঝে ফেলতে সময় লাগল না একটুও। ঝুড়ির সামনে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম এন্টালিতে বার্ড লাভার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য রাজুদাকে। একাধিক ডানা ভাঙা চিলকে শুশ্রূষা করে ফের ছেড়ে দিয়েছে মুক্ত আকাশে। বাড়ি থেকে পালানো কাকাতুয়াকে (পোষ মানা ও কথা বলার জন্য বিখ্যাত হলেও ক্রুদ্ধ অবস্থায় প্রচণ্ড ধারালো ঠোঁটের আঘাতে ফালা ফালা করে দেওয়ার কুখ্যাতিও রয়েছে সমপরিমাণে) ফের পাকড়াও করে খাঁচায় ঢোকাতে দেখেছি নিজের চোখে। অতএব একমাত্র ভরসা রাজুদা। ফোন পেয়ে হাজির আধঘণ্টার মধ্যে। এসেই চেয়ে নিল একটা বড় মোটা কাপড়। অতঃপর হাতে কাপড় পেঁচিয়ে ঝুড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কী দুঃসাহসিক দক্ষতায় প্রাণীটার ঘাড় চেপে ধরে পুরনো পাখির খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল, ভাবলে হাড় হিম হয়ে যায় আজও। কারণ খাঁচায় ঢোকানো মাত্র পালক ফুলিয়ে লড়াকু যোদ্ধার কায়দায় ফ্যাঁস করে উঠেছিল প্রাণীটা। একটা প্যাঁচা। কিন্তু সাধারণ লক্ষ্মীপ্যাঁচার মতো দেখতে নয় মোটেই। ধূসর গায়ে কালো ছিট ছিট। বাঁকানো হাঁসুয়ার মতো ধারালো ঠোঁট। ফুটখানেকের মতো উচ্চতা। লড়াকু মোরগের চেয়েও মোটা দুটো পায়ে ছুরির মতো ধারালো আর বাঁকানো চারটে করে নখ। বড় মার্বেল গুলির মতো হলুদ একজোড়া চোখ। আড়াআড়ি সরু আর চেরা দু’চোখের মণি। রক্ত জল করে দেওয়া দৃষ্টি। (প্রিয় পাঠক, সত্যজিৎ রায়ের এক ডজন গল্পে ‘বৃহচঞ্চু’র সেই প্রাগৈতিহাসিক অ্যান্ডাল গ্যালার্নিস পাখির চোখ দুটোর কথা স্মরণ করুন। ধারণাটা পরিষ্কার হবে)। কোণঠাসা গুলবাঘের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে খাঁচার এককোণে। মাঝে মাঝেই একশো আশি ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে সামনে পিছনে, পাক্কা মার্শাল আর্ট যোদ্ধার কায়দায়, কোনওদিক থেকে কোনও আক্রমণ নেমে আসছে কি না, কী লড়াকু, হিংস্র আর রাজকীয় দাঁড়াবার ভঙ্গি। ধরবার সময় হিসেবের একচুল এদিক ওদিক হলে রাজুদাকে যে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হত সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাজুদা, যেন কিছুই হয়নি এরকম একটা নিস্পৃহ মুখে খাঁচার ভেতরে চোখ চালিয়ে বলল— “বাঁদিকের ডানায় একটু চোট লেগেছে। তাই মাটিতে পড়ে গেছে… তেমন কিছু নয়। সামান্য চুন-হলুদ আর মাংসের কিমার সঙ্গে মিশিয়ে দু’-তিনটে পেইনকিলার… তা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা নেই। চিন্তা তো নেই কিন্তু আপাতত কী গতি হবে এই ক্ষণিকের অতিথির। একমাত্র সমাধান সল্টলেকে বন্যপ্রাণী দপ্তর। কিন্তু তাদের ফোন নম্বর তো হাতের কাছে নেই। হঠাৎই মনে পড়ল ক’দিন আগে ওদের একটা হোর্ডিং চোখে পড়েছিল গুরুসদয় দত্ত রোডের মোড়ে। রাজুদারই স্কুটারে চেপে দেখে আসা হল হোর্ডিংয়ের তলায় লেখা ফোন নম্বর দুটো। ফোন করা হল দপ্তরের অফিসে। এবং কিমাশ্চর্যম! সরকারি কাজকর্মের ধীরগতি এবং গয়ংগচ্ছ মনোভাবের প্রবাদপ্রতিম সমস্ত ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে মিনিট চল্লিশের মধ্যে বাড়ির দরজায় হাজির বন্যপ্রাণী দপ্তরের গাড়ি। তিন-চারজন কর্মী। ওদের মধ্যে একজন মহিলা। হাতে পুরু মজবুত অ্যাসবেসটাসের গ্লাভস। ছোট খাঁচাটার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বের করে এনে নিজেদের বড় খাঁচায় ঢুকিয়ে দিলেন পাখিটাকে। জানালেন চিকিত্সার পর সুস্থ করে ফের ছেড়ে দেওয়া হবে প্রকৃতিতে। কথাবার্তার মাঝখানে গিয়ে বুক সেল্ফ থেকে নামিয়ে এনেছিলাম ড. সেলিম আলির ‘কমন বার্ডস’ আর অজয় হোমের ‘বাংলার সাধারণ পাখি’ বই দুটো। বই বলছে পাখিটার নাম ‘খুরলে প্যাঁচা’ বা ‘কুটরে প্যাঁচা’ (বার্ন আউল/স্পটেড আউলেট)। ঘন ঝোপঝাড় আর গাছের কোটরে থাকে। নিশাচর শিকারি পাখি। সম্পূর্ণ মাংসাশী। ব্যাঙ, ইঁদুর, গিরগিটি, পোকামাকড়, পাখির বাচ্চা এমনকী ছোটখাটো সাপও রয়েছে খাদ্যতালিকায়। অতঃপর অতিথি বিদায়ের পালা, গাড়িতে ওঠার আগে ওই একই কায়দায় পুরো ঘাড়টা ঘুরিয়ে তাকিয়েছিল পিছনে। শ্যেনদৃষ্টিটা চোখে লেগে রয়েছে আজও।

এফ-সিক্সটিন

কলকাতার পুরনো পাড়া বিশেষ করে উত্তরে অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য এটা। পুরনো বাড়ির ছাদে বাঁশের খুঁটিতে মাথা উঁচিয়ে থাকা পায়রার ব্যোম (বসবার জায়গা) আর ছোট ছোট খোপওয়ালা কাঠের বাক্স। বিকেলবেলা, নীল আকাশে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে শয়ে শয়ে পায়রা। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন পায়রাদের মালিক। পুরনো কলকাতার ভাষায় ‘লক্কাবাজ’, ‘পায়রাবাজ’ বা ‘কবুতরবাজ’। হাতের মুঠোয় লম্বা বাঁশের লাঠি। লাঠির ডগায় বাঁধা কাপড়ের লাঠিটা জোরে জোরে নাড়াচ্ছেন এদিক থেকে ওদিক। ‘হ্যা ট্যা ট্যা’ চিৎকার করছেন, তীক্ষ্ন শিস ঠোঁটে। উত্সাহ পেয়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে যাচ্ছে পায়রার ঝাঁক, হঠাৎই ছন্দপতন! ছাদে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল একটি পায়রা। নরম বুকটা ধারালো নখের আঘাতে ফালাফালি নয়তো কণ্ঠনালি চিরে গেছে তীক্ষ্ন ঠোঁটের আঘাতে। দেখামাত্র পারাবত পালকের তীব্র অভিসম্পাত মিশ্রিত হাহাকার— “নির্ঘাৎ শালা শিকরে মেরেছে! ওর…” বাকিটা অশ্রাব্য গালাগাল। যার উদ্দেশে এই পিতৃমাতৃকুল উদ্ধারকারী গালিবর্ষণ, সে আসলে একটি ছোট পাখি। আকারে পায়রারই সমান। কিন্তু পৃথিবীর সবক’টি শিকারি প্রজাতির পাখির মধ্যে সাহস ও ক্ষিপ্রতায় অন্যতম— শিকরে বাজ! কমন এশিয়ান ফ্যালকন। পিঠের রং নীলচে ধূসর। পেটের কাছে সাদার ওপর বাদামি ডোরা আর বাদামি লেজের ওপর ছিট ছিট দাগ। বাসস্থান মূলত গ্রামাঞ্চলে গাছপালা ভরতি নির্জন জায়গা হলেও লোকালয়ে হানা দেয় প্রায়ই। আক্রমণ বা শিকারের মূল লক্ষ্য পায়রা। উপরোক্ত যে দৃশ্যটির কথা এখানে বর্ণনা করলাম সেই পায়রার মালিক অত্যন্ত ভাগ্যবান, তিনি তবু তাঁর মৃত পোষ্যটিকে চোখের দেখাটুকু দেখতে পেয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবার কপালে সে সুযোগটুকুও জোটে না। নিরীহ পায়রাটিকে আকাশেই হত্যা করে নখের ডগায় গেঁথে উড়িয়ে নিয়ে চলে যায় শিকরে বাজ। তারপর কোনও নির্জন গাছের ডালে বসে ধারালো ঠোঁটের সাহায্যে ছিঁড়ে খায়। গ্রামাঞ্চলে পায়রা ছাড়াও মুরগির বাচ্চা এদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য। পাখি ছাড়াও খাদ্যতালিকায় রয়েছে ইঁদুর, গিরগিটি, সাপ, ব্যাঙ, গঙ্গাফড়িং বা পঙ্গপালের মতো বড় পোকামাকড়। এদেরই একজনের শিকার ধরার অনবদ্য কৌশল দেখেছিলাম আজ থেকে বেশ কয়েকবছর আগে। সালটা ঠিক মনে নেই। বাইপাসের ধারে জলাভূমি ও কৃষিজমি বুজিয়ে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক নগরায়ণ। গড়িয়ার কাছে হাইল্যান্ড পার্কের আকাশ ঝাড়ু দেওয়া বহুতলগুলো সম্পূর্ণ হয়নি তখনও কিন্তু কাঠামোটা দাঁড়িয়ে গেছে। মনে আছে বহুতলের আশেপাশে বেশ কিছু গরিবগুরবো ঝুপড়িবাসী মানুষজনের বসবাস ছিল, তখনও হয়তো বা তাদেরই কারও একটা মুরগি তার গোটা পাঁচেক ছানাপোনা নিয়ে চরে বেড়াচ্ছিল দুটো বহুতলের মাঝখানে এবড়ো খেবড়ো জমিতে। এটা ওটা খুঁটে খাচ্ছিল এদিক ওদিক। এর মধ্যে একটা ছানা দলছুট হয়ে মায়ের থেকে পিছিয়ে পড়েছিল কয়েক পা। ঠিক এই সময় বহুতলের ছাদ থেকে একটা কিছু ঝাঁপ দিল আকাশে। এফ সিক্সটিন বম্বার প্লেনের মতো গোৎ খেয়ে তিরবেগে নেমে আসতে লাগল দুটো হাইরাইজের মাঝখান দিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলাম চিল। পরমুহূর্তেই ভুল ভাঙল। চিলের চেয়ে আকারে অনেক ছোট, প্রায় একটা পায়রার সমান। শিকরে বাজ! ডানা জোড়াকে শরীরের সঙ্গে প্রায় মুড়ে ফেলে কী অনায়াস দক্ষতায় অতটা উঁচু থেকে সোজা নেমে আসছিল পাখিটা। হুবহু F-১৬ বোমারু বিমানের কায়দায়। পলক ফেলার আগেই ছানাটাকে নখের ডগায় উঠিয়ে একই কায়দায় পাক মেরে ফিরে গেল ঠিক যেভাবে নেমে এসেছিল। যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল আজ সেখানে আকাশ ফুঁড়ে মাথা তুলেছে বিশাল সব হাইরাইজ, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স… শিকরে বাজরাও পরিস্থিতির সামনে হার মেনে পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। এখনও মাঝেমধ্যে দুয়েকটাকে উড়তে দেখা যায় বাইপাসের ধারে যেখানে আজও খানিকটা সবুজ টিকে আছে। তবে চিনতে হলে চাই বন্যপ্রাণ সম্পর্কে অপরিসীম আগ্রহ আর অবশ্যই খানিকটা পর্যবেক্ষণ শক্তি। তবু আর কতদিন শহরের বুকে মুক্ত পরিবেশে দেখা যাবে পাখিটাকে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ শুধু প্রকৃতিপ্রেমিক এবং ঈষৎ খ্যাপাটে মানুষজন ছাড়াও আরও একদলের আনাগোনা রয়েছে ওইসব অঞ্চলে। আঠা-সুতোর ফাঁদে ফাঁসিয়ে ধরে এনে বাজারের থলেয় ভরে বিক্রি করা হয় গ্যালিফ স্ট্রিট, গড়িয়া আর বানতলার পাখির হাটে। বন্যপ্রাণ দপ্তর থেকে মাঝে মাঝে রুটিন রেইড হয়। তবে ওই অবধিই। কাজের কাজ কিছু হয় না। এরকম চলতে থাকলে শহরের আকাশ থেকে এই দুর্দান্ত সুন্দর শিকারি পাখিটার হারিয়ে যাওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

ওৎ পেতে ওই আছি বসে…

দৃশ্যটা চোখে পড়েছিল বছর পনেরো আগে। ইডেন গার্ডেনের মাঝখানে পাকা রাস্তাটা ধরে চলেছি হাইকোর্টের দিকে। হঠাৎই চোখ আটকে গেল হাতের বাঁদিকে প্যাগোডার সামনে পুকুরটার ওপর ঝুঁকে পড়া একটা গাছের ডালে। একটা মাছরাঙা (লেসার ব্লু কিং ফিশার), পালকে উজ্জ্বল ভেলভেট নীল আর লাল রঙের অপূর্ব মিশেল। পার্পল রঙা লম্বা ঠোঁট। আকারে ল্যাজসুদ্ধ বড়জোর ইঞ্চিছয়েক। পাথরের মতো স্থির, বসে রয়েছে গাছটার সরু ডালে। দৃষ্টি নিবদ্ধ পুকুরের জলে। চোখে পড়া মাত্র দাঁড়িয়ে পড়লাম কী ঘটে দেখতে। এভাবে কাটল মিনিট পাঁচেক। হঠাৎই গাছের নীচে পুকুরের জলে ছোট্ট দুয়েকটা বুড়বুড়ি। চোখের পলক পড়ার আগে সেটাকে তাক করে বিদ্যুত্গতিতে জলে ঝাঁপ দিল মাছরাঙা। বৃত্তাকারে একটা ছোট আলোড়ন সৃষ্টি হল জলে। সেকেন্ড পাঁচেকের মধ্যে জল ফুঁড়ে উঠে এল পাখিটা। ডানা ঝটপটিয়ে ফের গিয়ে বসল গাছের ডালে। লম্বা ঠোঁটের আগায় ছটফট করছে এই এতটুকু একটা ল্যাটা মাছের বাচ্চা। মাটিতে পা জমিয়ে দেবার মতো দৃশ্য। ব্যস! ওই শুরু। প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণের আকর্ষণে এরপর থেকে বারবার ফিরে গেছি ইডেন গার্ডেনে। একবারও আমাকে নিরাশ করেনি দেড় শতক পেরিয়ে যাওয়া এই স্বর্গোদ্যান। পরবর্তীতে এই বাগানেই একাধিক বার দেখা পেয়েছি মাছরাঙার আরেক জাতভাইয়ের। স্পটেড বা পাইড কিংফিশার। সাধারণ মাছরাঙার চেয়ে আকারে অনেকটা বড়। পায়রার চেয়ে সামান্য ছোট। সারা গায়ে সাদার ওপর অজস্র ছিটছিট দাগ। এদেরও শিকার করে মাছ খেতে দেখেছি ইডেনের পুকুরে। শিকার ধরবার কায়দাটাও হুবহু সাধারণ মাছরাঙার মতো।

মাছরাঙা ছাড়াও পুকুরের জলে রয়েছে অজস্র ঢোঁড়া সাপ (চেকারড কিলব্যাক স্নেক)। গায়ে কাঁচা হলুদ রঙের ওপর কালো কালো ডোরা। অসম্ভব সুন্দর দেখতে, নির্বিষ এই প্রাণীটির উপস্থিতি গোটা পুকুর জুড়ে। ডাঙায় প্রায় ওঠে না বললেই চলে। আবার জলের গভীরেও যায় না তেমন একটা। ছোটখাটো মাছ বা ব্যাঙ ধরবার জন্য পাড়ের কাছাকাছি ঘোরাফেরা করে বেশিরভাগ সময়। পাড়ের ধারে দাঁড়ালে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে না। একটু বাদেই দেখা মিলবে এদের। নিঃশব্দে জল কেটে কেটে কী রাজকীয় ভঙ্গিমায় বিচরণ করছে। অকারণে বিরক্ত না করলে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণেও কোনও বিপদ নেই। প্রয়োজন শুধু সামান্য ধৈর্য আর সহমর্মিতার। আগে গ্র্যান্ড হোটেলের উলটোদিকে মনোহরদাস তরাগ সহ কলকাতার বহু পুকুরেই দেখা মিলত। আজকাল আর দেখা যায় না তেমন একটা। ব্যাপক হারে পুকুর বোজানো আর সিমেন্টে বাঁধিয়ে ফেলা পাড় প্রায় অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিয়েছে এই অসামান্য সুন্দর এবং নিরীহ সরীসৃপটিকে শহরের বুক থেকে।

বাগানের দেয়ালটা যেখানে গিয়ে স্টেডিয়ামের গায়ে ধাক্কা খেয়েছে, ঘন ঝোপঝাড় আর আগাছার জঙ্গলে ঘেরা টুকরো টুকরো ঘাসজমিতে প্রায়ই দেখেছি বেজি-মা (কমন ইন্ডিয়ান মংগুজ), তার একগাদা ছানাপোনাকে নিয়ে ঘুরঘুর করছে এদিক ওদিক, চোখে সদা সতর্ক দৃষ্টি। খুদে খুদে ছানাগুলো। একরত্তি তুলোর বলের মতো। মায়ের পেছন পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে বাধ্য ছাত্রের মতো। শিখে নিচ্ছে বেয়াড়া রকম নির্দয় এ শহরে টিকে থাকার কলাকৌশল। আর বেশিদিন পারবে কি? ভরসা হয় না তেমন একটা। কারণ বাগানের রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ওই তালগাছগুলো ছিল শকুনদের আস্তানা। ছিল মানে আজ আর নেই। শকুন (বেঙ্গল ভালচার)। একদা এ শহরে বিনেমাইনের মুদ্দোফরাস। পচামড়া পশুর শবদেহ, আবর্জনা খেয়ে পরিষ্কার রাখত কল্লোলিনী তিলোত্তমাকে। ইডেনের তালগাছ ছাড়াও কুৎসিত দর্শন অথচ অসম্ভব নিরীহ এই পাখিটির দেখা মিলত ধাপার মাঠে, শহরের এখানে ওখানে আবর্জনার স্তূপে। মৃত গবাদি পশুর শরীরে মৃত্যুর পরও মিশে থাকা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যকৃৎ অকেজো হয়ে বছর পনেরো হল চলে গেছে বেবাক খরচার খাতায়। এখনও মনে আছে বিশাল দুই ডানা মেলে গ্লাইডারের ভঙ্গিমায় শহরের আকাশে রাজকীয় সেই ভেসে বেড়ানো। এখন চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখতে হয়, নয়তো ডুয়ার্সের সংরক্ষণ কেন্দ্রে। এর চেয়ে মর্মান্তিক এবং দুর্ভাগ্যজনক কিছু হতে পারে কি?

বাগানের সীমানা ছেড়ে ফের প্যাগোডার দিকটায় পিছিয়ে এলে চোখে পড়বে বিশাল বিশাল সব মেহগনি, পাকুড়, অশত্থ গাছগুলোর গুঁড়ির গায়ে একাধিক ছোট বড় গর্ত। ওগুলো আসলে টিয়াপাখির (রোজ রিঙ্গড প্যারাকিট) বাসা। কলাগাছের পুরনো পাতার মতো গাঢ় সবুজ গায়ের রঙ। গলায় লাল-গোলাপি গোল রিঙের গায়ে কালো বর্ডার। টুকটুকে লাল ঠোঁট, নিশ্চিত দেখা পাওয়ার সময় শীতের শেষ। ডিম পাড়ার মরশুমে। একেকটা গর্তে একজোড়া করে থাকে। বাসার দখল নিয়ে প্রচণ্ড মারামারিও হতে দেখেছি নিজেদের মধ্যে। আগে কলকাতার আকাশে, বিশেষত সন্ধের মুখে ‘টি টি’ আওয়াজ তুলে উড়ে যেতে দেখা যেত ঝাঁকে ঝাঁকে। দিনে দিনে কমে আসছে সংখ্যাটা। উঁচু উঁচু বহুতলের বাধা, কেটে ফেলা গাছের পর গাছ আর চোরাশিকারির আঠা সুতোর ফাঁদ… ধরা পড়ে সোজা চালান রথের মেলা আর গালিফ স্ট্রিটের পাখির হাটে, অতঃপর ঠিকানা গেরস্ত বাড়ির দেড়-দু ফুটের গোল খাঁচা। একটু একটু করে হারিয়ে ফেলা ডানা মেলে আকাশে ওড়ার শক্তি। করুণ, দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থা। খাঁচার বাইরে প্রিপারেটরি স্কুলে পড়া বাচ্চার পাশে গর্বিত মা। “সি হানি, দিস ইজ পি ফর প্যারট…।”

মনে আছে আজ থেকে প্রায় বছর বিশেক আগে ইডেনে নৈশালোকে কোনও একটি আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে মাঠে ঢুকে পড়েছিল একটি অদ্ভুত দর্শন প্রাণী। মুখটা ছুঁচোলো। অনেকটা শেয়ালের মতো। ধূসর পাটকিলে গায়ের রং। অথচ পাগুলো ছোট ছোট। গুলির মতো গোল গোল চোখ। রোঁয়াফোলানো মোটা লেজের গায়ে কালো কালো ডোরা। ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠের মধ্যে। মাঠভর্তি দর্শক, খেলোয়াড় আর ফ্লাডলাইটের উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে খানিকটা বিভ্রান্তও বুঝিবা। আম্পায়ার, কর্মকর্তা, খেলোয়াড়, মায় হাজার আশি দর্শক, তারাও সবাই ধন্ধে পড়ে গিয়েছিলেন কিছুটা। তবে এই হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবটা স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। মিনিট পাঁচেক ইতিউতি ঘোরাঘুরি করে ময়দান থেকে বিদায় নিয়েছিল অবাঞ্ছিত আগন্তুক। স্বস্তির হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন মাঠসুদ্ধ সবাই। পরদিন খবরের কাগজ আর টিভিতে এ নিয়ে বেশ খানিকটা হৈ চৈ-ও হয়েছিল মনে আছে। রহস্যভেদ করেছিলেন প্রাণী বিজ্ঞানীরা। ময়দানে অনুপ্রবেশকারী আগন্তুকের নাম-ভাম। ইংরেজিতে কমন পাম সিভেট। বাংলার অনেক অঞ্চলে একে সরেল বা গন্ধগোকুল নামেও ডাকা হয়। আমেরিকান রেকুনের জ্ঞাতিভাই, ফলমূল থেকে শুরু করে মাছ, পাখি, ব্যাঙ, গিরগিটি, ছোটখাটো সাপ এমনকী রান্না করা খাবার অরুচি নেই কিছুতেই। গ্রামাঞ্চল তো বটেই, পূর্বতন শহরতলি, অধুনা শহরের আওতায় এসে পড়া কসবা, যাদবপুর, টালিগঞ্জ সহ একাধিক অঞ্চলে মাঝেমধ্যেই হানা দেয় গৃহস্থের রান্নাঘরে, পাখি আর মুরগির খাঁচায়। বাড়ির আশেপাশে এলে গা থেকে পাকা মহুয়া বা আতপ চালের গন্ধ পাওয়া যায়। ধূর্ত, জাতশিকারি নিশাচর এই প্রাণীটি এমনিতে নিরীহ এবং লাজুক হলেও বিপদে পড়লে কিন্তু ভয়ংকর হিংস্র। সরু করাতের মতো দুপাটি দাঁত আর ক্ষুরের চেয়েও ধারালো নখ। বেশি সাহস দেখাতে গেলে সাংঘাতিক রকম আহত হবার সম্ভাবনা। যথেচ্ছ নগরায়ণ দিনে দিনে শহরের বুক থেকে অবলুপ্তির পথে ঠেলে দিচ্ছে ভয়ংকর সুন্দর, ছোটখাটো এই শিকারি প্রাণীটিকে। বছর পাঁচ ছয়েক আগে এদেরই একজনকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল খোলা পরিবেশে। ইডেন গার্ডেন আর বিধানসভার মাঝখানে রাস্তার ওপরে। তবে জীবিত নয়, মৃত অবস্থায়। কোনও কারণে রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে বেচারা। ওরকম একটা প্রাণী, কী অপূর্বদর্শন! দ্রুততম স্তন্যপায়ীদের মধ্যে অন্যতম। হেরে গেল যান্ত্রিক গতির কাছে। মর্মান্তিক! বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব হয়নি দৃশ্যটা। দ্রুত পা চালিয়ে চলে এসেছিলাম সামনে থেকে।

ছিল রুমাল…

প্রথম দেখেছিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাঝখানে বাঁধানো পুকুরটায়। প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল সাপ বোধহয়। ঠিক যেন ফণা উঁচিয়ে রয়েছে জলের মধ্যে থেকে। হঠাৎই গোৎ খেয়ে জলের মধ্যে ডুব মারল প্রাণীটা। ভেসে উঠল মিনিট দুয়েক বাদে, ঠোঁটে গাঁথা একটা ছোট মাছ। ছটফট করছে ঠোঁটের আগায়। এরকম বার তিনেক চলার পরই চরম বিস্ময়! অনেকটা সেই সুকুমার রায়ের হযবরল-র ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল-এর মতো। আপাতদৃষ্টিতে যাকে সাপ ভেবেছিলাম সে-ই হঠাৎ পাখি হয়ে জল থেকে উড়ে গিয়ে বসল পুকুরের পাড়ে একটা গাছের ডালে। রোদ পোয়াতে লাগল দু ডানা মেলে। আগ্রহ বাড়ল। সন্তর্পণে পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম গাছের নীচে। একটা পাখি। কুচকুচে কালো পালিশ করা পালকের রং। ঈষৎ বাঁকা আর ছুঁচোলো ঠোঁট। বড়জোর একটা দাঁড়কাকের সাইজের হবে। ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো বাঁকানো গলাটা অনেকটা ফণাতোলা সাপের মতো। বোধহয় গাছের তলায় আমার উপস্থিতি টের পেয়ে একটু বাদেই উড়ে গেল পাখিটা। বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমেই গেলাম বুক সেল্ফের কাছে। কালবিলম্ব না করে শরণাপন্ন হলাম তাবৎ যত পক্ষীকুলের সিধুজ্যাঠা ড. সেলিম আলি আর অজয় হোম মহাশয়ের। দুজনেই বলছেন পাখিটার নাম পানকৌড়ি। ইংরেজিতে লেসার কমোর‍্যান্ট। বিহার উত্তরপ্রদেশে পানকৌয়া নামেও ডাকা হয়। এরপর থেকে যতবার গেছি ততবারই এদের দেখা পেয়েছি ভিক্টোরিয়ার পুকুরে। নিরাশ হতে হয়নি একটিবারের জন্যও।

পানকৌড়ি ছাড়াও ভিক্টোরিয়ার বাগানে আমার আকর্ষণের আরেকটি মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাদুড় (কমন ইন্ডিয়ান ফক্সব্যাট)। কমলা আর ধূসর বাদামি গায়ের রং। ছুঁচোলো মুখটা অনেকটা খ্যাঁকশেয়ালের মতো। শয়ে শয়ে ঝুলে থাকত বড় বড় গাছের ডালে। আদ্যম্ত নিশাচর। সন্ধে নামলেই ঝাঁক বেঁধে বেরিয়ে পড়ত ফলমূল, খাবারের সন্ধানে। পরবর্তীতে যাযাবর শ্রেণীর একধরনের মানুষের খাদ্য হিসেবে পালে পালে শিকার হয়ে পুরনো বাসা ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে আলিপুর চিড়িয়াখানার বড় বড় গাছগুলোকে। পয়সা খরচ করে টিকিট কাটতে হবে না। তাজ বেঙ্গলের উল্টোদিকে আদি গঙ্গার ব্রিজটার ওপরে দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন যে-কোনওদিন। শয়ে শয়ে ঝুলে রয়েছে গাছের ডালে। পড়ন্ত বিকেলে বাসা ছেড়ে ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া খাদ্যান্বেষণে। রোজ সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য। সারারাত উড়ে উড়ে ফলপাকুড়, পোকামাকড় খেয়ে কাল ভোর ভোর আবার ফিরে আসবে এই ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে…এখনও টিকে থাকা একটুকরো বাসায়। ভাবলেই মনে মনে অদ্ভুত আনন্দ আর স্বস্তির নিশ্বাস পড়ে একটা।

নীরব উচ্ছেদ

বছর দুয়েক আগে, রবিবারের দুপুর। ঈষৎ ভালমন্দ খেয়ে চোখ বুলোচ্ছি গল্পের বইয়ে। এমন সময় আদ্যন্ত প্রকৃতিপ্রেমী, অনুজপ্রতিম বন্ধু বিমলের ফোন। “তাড়াতাড়ি এসো বাপিদা! পাড়ায় সাপ ধরা পড়েছে” কথার মাঝখানে যান্ত্রিক গোলযোগে কেটে গেল লাইনটা। আর দেরি না করে জামাটা গলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাস ধরব বলে।

এন্টালি তালতলা অঞ্চলের পুরনো পাড়ায় বিমলদের বাড়ি। গিয়ে দেখি ওদের বাসা থেকে সামান্য দুরে একটা ছোটখাটো জটলা। বিমল আমাকে দেখামাত্র বেরিয়ে এল ভিড়ের মধ্যে থেকে। উত্তেজিত চোখমুখের চেহারা। ওর কাছেই শুনলাম ঘটনাটা। এলাকার একটা পুরনো বনেদি বাড়ি ভাঙা হচ্ছিল কদিন ধরেই। ফ্ল্যাট উঠবে। আজ সকালে ভাঙতে এসে প্রোমোটারের মিস্ত্রি-মজুররা ইটের পাঁজার আড়ালে সাপটাকে দেখতে পায়। ওরা তো তখনই মেরে ফেলতে যাচ্ছিল। নেহাতই ভাগ্যক্রমে বিমলের চোখে পড়ে যাওয়ায় সেরকম কিছু ঘটেনি। শুনতে শুনতেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম সামনে। পাশে ভাতের হোটেল থেকে চেয়ে আনা একটা গামলা উপুড় করে তার মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে প্রাণীটাকে। গামলার ওপর চাপানো বড়সড় একটা থানইট। বসে পড়ে ছোট্ট একটা টোকা দিলাম গামলার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে ভয়ংকর ক্রুদ্ধ ফোঁসফোঁসানি। গর্জন আর চেহারার বর্ণনা শুনে যা মনে হচ্ছিল সেটা আর ভাঙলাম না বিমলের কাছে। মুখে প্রশ্ন করলাম বনদপ্তরে খবর দিয়েছিস?” “প্রায় আধঘণ্টা হতে চলল…।” জবাব দিল উদ্বিগ্ন বিমল। অতঃপর অপেক্ষার পালা। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মিনিট কুড়ির মধ্যে বাড়ির সামনে হাজির দপ্তরের গাড়ি। নিজের বাড়িতে প্যাঁচা উদ্ধারের অভিজ্ঞতা থেকে ওদের কাজের ধরন সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা ছিল। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই সামনের ভিড়টাকে হালকা করে দিতে বললেন পাড়ার ছেলেদের। প্রত্যেকের হাতে মোটা ধাতব দস্তানা। একজনের হাতে দুমুখো সাপধরা লাঠি। এগিয়ে গিয়ে ইট তুলে গামলাটা সরাতেই বুঝতে পারলাম আমার ধারণাটা একদম সঠিক। ফুট চারেকের মতো লম্বা। উজ্জ্বল হালকা বাদামি রঙের ওপর কালচে বাদামি রঙের মতো ছোপ সারা গা জুড়ে। গোখরো, কেউটে বা দাঁড়াশের তুলনায় মোটা, ভারীসারি চেহারা। চওড়া, থ্যাবড়াটে মাথা। চন্দ্রবোড়া। ইংরেজিতে রাসেল ভাইপার। ঝোপজঙ্গল, খড়ের গাদা ছাড়াও পুরনো বাড়ির ইটের ফাঁকফোকরে অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে জায়গাতেও থাকতে পছন্দ করে। পাড়ার লোক বিশেষ করে বাড়ির বাসিন্দাদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অ্যাতোদিন ধরে রয়েছেন এবাড়িতে অথচ কাউকে কামড়ানোর কথা শোনা যায়নি কোনওদিন। অতএব এ নিশ্চয়ই বাস্তুসাপ। কথাবার্তা শুনে হাসছিলাম মনে মনে। আসলে ওসব কিছু নয়। সাপ এমনিতেই ঠান্ডা রক্তের নিরীহ প্রাণী। আগে থেকে মানুষের পায়ের আওয়াজ বা উপস্থিতি টের পেলে পত্রপাঠ সরে পড়ে সেখান থেকে। নেহাতই আক্রান্ত বোধ করলে বা গায়ে পা না পড়ে গেলে সাধারণত কামড়ায় না কাউকে। আর সেটাও সেই ভয়ের কারণেই। বনদপ্তরের কর্মীরা মোটা ঝোলায় ভরে সাপটাকে নিয়ে যাবার সময় একটাই প্রশ্ন জাগছিল মনে। একজন তো রক্ষা পেল। উচ্ছেদ হলেও পুনর্বাসনের একটা ব্যবস্থা-ট্যাবস্থা হবে আশা করি। কিন্তু ওর আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগুষ্টি —তারা কি কেউ এখনও থেকে গেল ভাঙা বাড়িটার ইটের পাঁজায়? তাদের ভবিষ্যৎ কী? উচ্ছেদ তো হতে হবেই। কিন্তু হওয়ার পর যাবেটা কোথায়? আরেকটা পুরনো বাড়িতে? সেরকম আস্তানাই বা আর ক’টা টিকে রয়েছে শহরে? প্রায় সবই তো হাইরাইজের গর্ভে। যদি বা কোনওমতে এক-আধটাকে খুঁজে পাওয়া যায় আদৌ সেখানে গিয়ে পৌঁছোনো যাবে কি? পাকা রাস্তা, নিয়নের চোখ ধাঁধানো আলো, ধেয়ে আসা নির্দয় গাড়ির টায়ার, সভ্য এবং হিংস্র চোখের শ্যেন নজর আর শরীর লক্ষ্য করে নেমে আসা নির্মম উদ্যত লাঠি…এতসব এড়িয়ে বুকে হেঁটে আদৌ পৌঁছনো যাবে কি কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়? উত্তর অজানা।

জলে হাঁটা

শুনেছি হঠযোগী সিদ্ধপুরুষরা নাকি জলের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারেন। সচক্ষে দেখার ‘সৌভাগ্য’ হয়নি। বাস্তবে আদৌ সম্ভব কি? পরীক্ষা করে দেখার সুযোগও পাইনি কোনওদিন। মানুষ কেন কোনও প্রাণীই যে জলের ওপর দিয়ে হাঁটতে পারে না এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য। আর এই জানাটাই চরম বিভ্রান্তিতে ফেলে দিয়েছিল একবার। পার্ক সার্কাস কানেক্টর ধরে যাচ্ছি। হঠাৎই চোখ গেল সায়েন্স সিটির গায়ে বিশাল ঝিলটার পাড়ে। একটা পাখি। মুরগি আর বকের মাঝামাঝি চেহারা। আকারে বড়জোর একটা দেশি মুরগির মতো। চোখধাঁধানো উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী গায়ের রং। লাল টুকটুকে ঠোঁট। লম্বা লম্বা বকের মতো ঠ্যাঙ ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছে জলের ওপর। অবাক বিস্ময়টা কাটিয়ে একটু কাছে যেতেই ভুল ভাঙল। আসলে জল নয়, জলের ওপর ভেসে থাকা বনকলমি আর কচুরিপানার ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে পাখিটা। অথচ গাছগুলো একটুও ডুবে যাচ্ছে না। এতটাই নিঃশব্দ আর হালকা পদচারণা। পরে জেনেছিলাম পাখিটার নাম জলপিপি। ইংরেজিতে পার্পল মুরহেন। এ ছাড়াও কামপাখি, জলমুরগি, ডাহুক ইত্যাদি একাধিক নামেও পরিচিত বাংলার গ্রামাঞ্চলে। পরবর্তীতে এদের আরও দুই জ্ঞাতিভাইয়ের দেখা পেয়েছিলাম বাইপাসের ধারে ভেড়িগুলোয় আর সেই ইডেনের পুকুরে। ধূসর আর সাদা রঙের হোয়াইট ব্রেস্টেড ওয়াটার হেন। দ্বিতীয়টি ব্রোনজ উইঙ্গড জাকানা। উজ্জ্বল কালো মাথা, গলা আর বুক। পিঠ আর ডানার রং সবুজাভ ব্রোঞ্জের মতো। লালচে বাদামি লেজ। সব মিলিয়ে সে এক রাজকীয় রঙের সমাহার। ইডেনের পুকুর আর বাইপাসের ভেড়ি ছাড়াও পরে আরও বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ হয়েছে বন্ধু গৌতম কুমার দে-র নিউ গড়িয়ার বাড়ির পাশের ডোবায়। জলে হাঁটার মতো ডুব সাঁতার বা ভেসে বেড়ানোতেও সমান দক্ষ কিন্তু ওড়ার ব্যাপারে ততটা নয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া উড়তেও চায় না তেমন একটা। খাদ্য বলতে জলজ ঘাসপাতা আর ছোটখাটো পোকামাকড়। বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে এখনও নিয়মিত উড়ে আসছে কল্লোলিনী তিলোত্তমায়। এখানেও বিপদ তো সেই একটাই। পুকুর ক্রমাগত কমে আসছে শহরে। ফলে আর কতদিন দেখতে পাওয়া যাবে রূপসী (নাকি রূপবান?) জলপিপিদের তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশটা কিন্তু থেকেই গেল।

উত্তরসূরি

বছর কয়েক আগে সল্টলেক থেকে ফিরছিলাম এক বন্ধুর গাড়িতে চড়ে ইস্টার্ন বাইপাস ধরে। মাঝরাস্তায় হঠাৎই বিগড়াল গাড়িটা। দাঁড়িয়ে পড়ল চিংড়িহাটা থেকে সামান্য দূরে বিশাল পুকুরটার পাড়ে। ড্রাইভার নেমে বনেট তুলে খুটখাট কীসব পরীক্ষা করতে শুরু করল। পাশে দাঁড়ানো উদ্বিগ্ন বন্ধু। যেহেতু যন্ত্রপাতি সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান নেই তাই পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম জলাশয়ের ধারে। আর ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। দূর থেকে ভেসে আসা হোর্ডিংয়ের হালকা আলোয় একটা প্রাণী। আকারে সাধারণ বেড়ালের প্রায় তিনগুণ। ধূসর গায়ে লম্বাটে গোল গোল ছোপ। পুকুরপাড়ে ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল জলের ধারে। পাথরের মতো নিশ্চল, স্থির হয়ে ওত পেতে বসে রইল কিছুক্ষণ। মিনিট দুয়েক এভাবে কাটল। হঠাৎই বিদ্যুত্গতিতে জলে থাবা মারল একটা। মুহূর্তের মধ্যে একটা মাছ, থাবার ঝটকায় ছিটকে এসে পড়ল পুকুরপাড়ে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে তরিবত করে মাছটাকে খেল প্রাণীটা। তারপর ধীরে সুস্থে উঠে ফের মিলিয়ে গেল ঝোপঝাড়ের আড়ালে। আগে যেহেতু চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েকবার দেখেছি তাই আলো আঁধারিতেও চিনতে অসুবিধে হয়নি। মেছো বিড়াল, ইংরেজিতে ফিশিং ক্যাট। বাঘঢাঁশ, বাঘঢাশা বা বাঘেলা নামেও পরিচিত। বন্দি অবস্থায় দেখে থাকলেও মুক্ত প্রকৃতিতে শিকার করতে দেখার দুর্লভ অভিজ্ঞতা এই প্রথম (সেটাই একমাত্র এবং শেষ) আর সেই ঘোরেই বুঁদ হয়ে রয়েছি। এমন সময় গোঁ গোঁ যান্ত্রিক আওয়াজ। সচল হয়েছে গাড়ি। ফিরতে ফিরতে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘দশ লক্ষ বছর আগে’ উপন্যাসটির কথা। প্রবাসী জেনেটিক বিজ্ঞানী পরিতোষ কুণ্ডুর স্কটিশ সহধর্মিণী এলসা টিচবোর্ন (নিজেও বিজ্ঞানী)। কলকাতায় সংহতি কলোনির স্বামীর বাড়িতে এসে মাঝরাতে বাড়ির পাশে প্রায় মজে যাওয়া পুকুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছিল এমনই একটি বাঘঢাশাকে। এ এমনই এক প্রাণী যা শেয়াল, খটাশ, বাঘরোল বা বনবেড়ালের মতোই মুছে গ্যাছে শহর আর শহরতলির মানচিত্র থেকে। এলসার মনে হয়েছিল এ যেন সেই কোটি কোটি বছর আগে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া ডাইনোসরের কোনও উত্তরসূরি, আজও টিকে রয়েছে সংহতি কলোনির পুকুরপাড়ে… হু হু করে গাড়ি ছুটছে। গাড়ির মধ্যে আমি। এলসার ভাবনা রথের সহযাত্রী। পটভূমি—সংহতি কলোনির পুকুরের জায়গায় বাইপাসের জলাভূমি। তফাত শুধু এটুকুই।

উলট পুরাণ

ঠিক তাই। একদিকে যেমন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে পেরে শহর থেকে একে একে অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে সেখানকার না-মানুষি বাসিন্দারা, আর ঠিক তখনই এর একদম উলটোটাও ঘটে চলেছে প্রকৃতিতে। জঙ্গলে পর্যাপ্ত খাবার নেই তাই জঙ্গল ছেড়ে লোকালয় চলে আসছে বন্যপ্রাণীরা। সুন্দরবনের বাঘ থেকে ডুয়ার্সের লেপার্ড হয়ে দলমার হাতি—কেউই এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের শহরেও কিন্তু এরকমটা ঘটে চলেছে মাঝে মধ্যেই। রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে অথবা বাড়ির পাশেই আপনাদেরও অনেকের নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে দৃশ্যটা। বাড়ির ছাদ, টালির চাল, জানালার আলসে, জনবহুল বাজার এলাকা…সর্বত্র এদের অবাধ উপস্থিতি। রাস্তা ধরে বাজার ভরতি থলে হাতে চলেছেন অসতর্ক সহনাগরিক। হঠাৎই একটা আওয়াজ—হুপ! সরু সরু নখর আঙুলের হ্যাঁচকা টানে বাজারের ব্যাগ ছিটকে মাটিতে। ছিনতাই হয়ে গেল কলাটা মুলোটা। ফলের ডালা সাজিয়ে বসে আছেন দোকানি। খদ্দেরের সঙ্গে কথাবার্তায় মজে সামান্য ঘাড় ঘুরিয়েছেন এদিক ওদিক। টুকরি থেকে উধাও পুরুষ্টু আপেল। কে এই দুর্দমনীয় ছিনতাইবাজ? আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। হনুমান (কমন ইন্ডিয়ান লেঙ্গুর)। মাঝে মাঝেই দেখা যায় একা অথবা গুষ্টিসুদ্ধ আন্ডাবাচ্চা নিয়ে বসে আছে বাড়ির ছাদে, গাছের মগডালে অথবা খোলা রাস্তায়। গম্ভীর কালো মুখ, ইয়া লম্বা লেজ। মুখে একটা দার্শনিক ভাবভঙ্গি সবসময়। খাবার দাবার যা টুকটাক ছিনতাই করছে সেটা নেহাৎই পেটের জ্বালায়। কারণটা তো সেই একই। জঙ্গলে খাবার নেই। তার ওপর ব্যাপকভাবে চলছে বৃক্ষনিধন। কী করবে বেচারারা? কথায় বলে ‘পাপি পেট কা সওয়াল’। তাই বাধ্য হয়ে প্রকৃতির জঙ্গল ছেড়ে কংক্রিটের জঙ্গলে। ভয় নেই, ওরা আপনার টাকাকড়ি, গয়নাগাঁটি, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিছু চুরি করবে না। এটিএম অ্যাকাউন্ট হ্যাক করারও মতলব নেই বিন্দুমাত্র। শুধু সামান্য খাবারদাবার। পেটি ক্রাইম কেস। তা ছাড়া আমাদেরই তো পূর্বপুরুষ। খেতে না পেলে আর যাবেটা কোথায়? শুধু এটুকু ভেবে এই সামান্য অপরাধ ক্ষমা করে দেয়া যায় না কি?

খাদের কিনারে

বাবুঘাট, প্রিন্সেপ ঘাট, শোভাবাজার, বাগবাজার…কলকাতার যে-কোনও গঙ্গার ঘাটে দাঁড়ালেই হরবখত চোখে পড়ত দৃশ্যটা। পিঠে কুঁজমতো, সরু পাখনাওয়ালা কালোমতো কী একটা, ঘাই মেরেই গোৎ খেয়ে ফের ডুবে গেল জলে। ফেরি স্টিমারের নিত্যযাত্রীরা প্রায়ই দেখতে পেতেন খুব কাছ থেকে। অনেকদিন হল প্রায় অবলুপ্ত হয়ে গেছে কলকাতায় গঙ্গার বুক থেকে। শুশুক। সাধু বাংলায় শিশুমার। ইংরেজি নাম পরপয়েজ বা গ্যাঞ্জেটিক ডলফিন, সামুদ্রিক ডলফিনের মিঠেজলতুতো জ্ঞাতিভাই। ‘প্রায় অবলুপ্ত’ বাক্যটা ব্যবহার করলাম অত্যন্ত সচেতনভাবেই। কারণ প্রখ্যাত প্রাণী বিশেষজ্ঞ শ্রীঅজয় হোম মহাশয় উনিশশো চুরাশি সালে তাঁর প্রকাশিত বই ‘বিচিত্র জীবজন্তু’-তে শুশুক সম্পর্কে লিখেছিলেন— ‘এককালে কোলকাতার হুগলী নদীতেও দেখা যেতো, এখন আর চোখে পড়ে না গঙ্গার জল অতিরিক্ত দূষিত হবার ফলে’। অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জানাই কথাটা বহুলাংশে সঠিক হলেও সর্বাংশে নয়। দু হাজার চোদ্দো সাল, হাওড়া থেকে ফেরিলঞ্চে ফিরছি বাবুঘাটে। প্রায় মাঝগঙ্গায় এসে পড়েছে নৌকা। দাঁড়িয়ে রয়েছি ডেকের ধারে। হঠাৎই মাত্র হাত বিশেক দূরে জলে আলোড়ন তুলে ডিগবাজি খেয়ে ডুবে গেল একটা শুশুক! চোখের পলক ফেলার আগেই ঘটে গেল পুরো ঘটনাটা। দক্ষ পেশাদার ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার নই। তাই লেন্সবন্দি করে রাখতে পারিনি দৃশ্যটা। তবে প্রচণ্ড উল্লসিত হয়েছিলাম মনে মনে। এটা ভেবে যে যাক! এখনও তা হলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। তবে সেই উল্লাস মিলিয়ে যেতেও লাগেনি বেশিক্ষণ। কারণ ওই যে একটু আগেই লিখেছিলাম—‘কথাটা বহুলাংশে সঠিক।’ আগে আধঘণ্টা গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালেই অন্তত দু’-তিনবার শুশুকের দেখা পাওয়া যেত। আর এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকী পুরো একটা দিন অপেক্ষা করলেও অনেকসময় দেখা মেলে না। কলকারখানার বর্জ্য, মানুষের ফেলা আবর্জনা, থার্মাল পাওয়ার স্টেশনগুলোর টারবাইন জেনারেটর থেকে উৎপন্ন হওয়া উষ্ণ জল….এসবের অবশ্যম্ভাবী ফল গঙ্গাদূষণ অবলুপ্তির কিনারায় ঠেলে দিয়েছে বিশ্ব বন্যপ্রাণ সংস্থা থেকে ‘মোস্ট এনডেজারড স্পেসিস’-এর তকমা পাওয়া সম্পূর্ণভাবে মত্স্যভোজী নিরীহ এই প্রাণীটিকে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা কিছু ভাবছেন কি?

ওই যে আকাশের গায়…

…দূরের বলাকা ভেসে যায়। পঞ্চাশ-ষাটের দশকের কালজয়ী গান। বলাকা মানে যে বক সে কথা তো সবাই জানেন। সন্ধের আকাশে আজও দেখা যায় ঝাঁক বেঁধে উড়ে যেতে। কত কবিতা আর গানের উপজীব্য হয়ে চিরকাল বেঁচে রয়েছে এই পাখিটি আর তাদের উড়ে বা ভেসে যাওয়া। যাকে নিয়ে এত কবির কল্পনা, এত গান বাঁধা তাকে আপনারা অনেকেই দেখেছেন মাটিতে চরে বেড়াতে। গো-বক বা গাই বগলা, ইংরেজিতে ক্যাটেল ইগ্রেট। দুধবরণ পালকের রং আর লম্বা হলুদ ঠোঁট। আকারে মুরগির সমান। শহরের বিস্তীর্ণ ঘাসজমি, যার মধ্যে অন্যতম কলকাতা ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম আর টলি ক্লাবের গল্ফ কোর্সে একা, জোড়ায় জোড়ায় অথবা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড় খুঁটে খায়। লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘুরে বেড়ায় গরুমোষের পিছু পিছু। উদ্দেশ্য সেই একই। গবাদি পশুর ক্ষুরের চাপে উঠে আসা মাটি থেকে কেঁচো, ছোটখাটো কীটপতঙ্গ ধরে খাওয়া। আগে গরুমোষের খাটাল-সংলগ্ন কাদাজমিতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত প্রচুর পরিমাণে। ইদানীং কলকাতা থেকে খাটাল উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের সংখ্যাও দ্রুতহারে কমতে শুরু করেছে শহর থেকে। পরবর্তীতে দেখেছি ময়দানে ঘোড়ার পিছুপিছু ঘুরে বেড়াতে। পরিস্থিতির প্রয়োজনে খুব দ্রুত পালটে নিয়েছে নিজেকে। সারাদিন খুঁটে খেয়ে উড়ে যাওয়া সন্ধের মুখে কোনও বড় জলাশয় (মূলত রবীন্দ্র সরোবর) বা ময়দানের কোনও ঝাঁকড়া গাছে যেখানে কাক বা অন্য শিকারি পাখির উত্পাত তুলনামূলকভাবে কম। এদেরই আরেক জাতভাই আকারে সামান্য ছোট তবে গো-বকের মতো পতঙ্গভোজী নয় মোটেই। ফিকে হলুদ বা বাদামি গায়ে লম্বা লম্বা ছিট। কোঁচ বক (পন্ড হেরন)। ধান পাখি নামেও ডাকা হয় গ্রামবাংলায়। পুকুরের ধারে ঘাড় গুঁজে বসে থাকে চুপটি করে। পাথরের মতো নিশ্চল। খুব ছোটখাটো মাছ নাগালের মধ্যে এলেই বিদ্যুত্গতিতে গেঁথে তোলে লম্বা সরু ঠোঁটের আগায়। মাছ ছাড়াও খাদ্যতালিকায় রয়েছে কেঁচো, ব্যাঙ ইত্যাদি। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয় মাথা ও মূল শরীরের মধ্যে গলা নামক বস্তুটির কোনও অস্তিত্বই বোধহয় নেই। কিন্তু শিকার ধরা বা উড়ে যাওয়ার সময় বোঝা যায় ঈষৎ বাঁকা, অনেকটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো গলাটা বেশ লম্বা। এমনিতে সাদামাটা চেহারা। তবে প্রজননের সময় রূপ একেবারে ভুবনভোলানো। তখন পুরুষদের সারা পিঠ জুড়ে তামাটে লাল চুলের মতো লম্বা লম্বা পালক গজায় আর মাথা থেকে ঘাড় অবধি ঢেকে যায় দীর্ঘ দুধসাদা ঝুঁটিতে। আগে কলকাতা সহ শহরতলির সবকটা জলাশয়ে আকচার দেখা যেত। ইদানীং নগর সৌন্দর্যায়নের নামে পুকুর বাঁধানোর ধুম লেগে গেছে শহর ও শহরতলি জুড়ে। ফলে পাড়ে দাঁড়ানোর জমিটুকুও হারাচ্ছে কোঁচবক, শুধু কি ওরাই? সৌন্দর্যায়নের ঠেলায় পড়ে দ্রুত অবলুপ্তির পথে চলে যাচ্ছে শামুক, ঝিনুক, গেঁড়িগুগলি, কেঁচো, ব্যাঙ আর ঝাঁঝি পানা সহ একাধিক জলজ গাছগাছালি। পুকুরের ধারে মাটির পাড়কে ঘিরেই যাদের প্রজনন, বেড়ে ওঠা আর বিচরণক্ষেত্র। অন্যদিকে কংক্রিটে বাঁধানো পুকুর দ্রুততার সঙ্গে স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে পরিণত হচ্ছে দূষিত কালো জলের বদ্ধ জলাশয়ে। মরে ভেসে উঠছে মাছ। কদিন আগেই বাঘাযতীনে এরকমই একটা পুকুরের ধারে মরে ভেসে থাকতে দেখলাম কেজি তিনেক ওজনের গোটা দুয়েক কাতলাকে। পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কুকুর বেড়াল টানাহ্যাঁচড়া করছে। পল্লীবাসী নির্বিকার, নীরব প্রশাসন চুপ! সৌন্দর্যায়ন চলছে।

দিনকাল ভাল নয় নৈর্ঋৎ

‘জোড়া শালিখ দেখলে দিন ভাল যায়।’—এহেন প্রবাদ বাক্যটি শুনে আসছি সেই ছেলেবেলা থেকে। শালিখ অথবা শালিক। ইংরেজি নাম স্টারনিডি। উজ্জ্বল আর কালচে বাদামি গায়ের রং। হলুদ কালো চোখ। অসামান্য সুন্দর দেখতে এই পাখিটি। একসময় ঝাঁকে ঝাঁকে অথবা জোড়ায় জোড়ায় নেচে বেড়াত শহর জুড়ে। বাসা বাঁধত গেরস্থবাড়ির ঘুলঘুলি অথবা কড়িকাঠে। শালিখ দেখলে কারও দিন ভাল যায় কিনা জানা নেই তবে শালিখের দিনকাল যে ইদানীং মোটেই ভাল যাচ্ছে না সেটা বোঝা যায় শহরে উপস্থিতির হার দেখলে। ‘ড্রপ আউট’ হতে প্রায় বেপাত্তা একেবারে। ঝাঁকে বা জোড়ায় তো দূরের কথা, কালেভদ্রে এক-আধটার দেখা পাওয়া গেলেও দিন ভাল গেল বলতে হবে। উধাও হবার কারণটাও প্রায় সেই একই। অবাধ, অসুস্থ এবং অসামঞ্জস্যপূর্ণ নগরায়ণ। এখনও মোটামুটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দেখা যায় কলকাতা ময়দান, ফোর্ট উইলিয়াম, ভিক্টোরিয়ার বাগান, টালিগঞ্জ গল্ফ কোর্স আর শহরতলি অঞ্চলে যেখানে এখনও কিছুটা সবুজ টিকে রয়েছে।

আয় রে পাখি লেজঝোলা…

বাংলাভাষার নার্সারি রাইমস। মা-ঠাকুমার অবাধ্য ছেলেপুলেকে ভুলিয়েভালিয়ে খাওয়ানো বা ঘুম পাড়ানোর কলাকৌশল। সে সব পাট চুকেবুকে গেছে অনেকদিন। কবিতার সেই লেজঝোলা পাখিটা, ছিপছিপে চেহারা, কুচকুচে কালো গায়ের রং, ছটফটে আর প্রচণ্ড ঝগড়ুটে। শরীরের চেয়েও বড় চেরা লেজটা কাস্তের মতো দুদিকে বাঁকানো। আজ্ঞে হ্যাঁ, ফিঙের কথাই বলছি। সাহেবি নাম ব্ল্যাক ড্রংগো। আগে হাওড়া বা শেয়ালদা লাইনে লিলুয়া বা উলটোডাঙ্গা ছাড়ালেই দেখা যেত টেলিগ্রাফের তারে লম্বা লেজ ঝুলিয়ে কেতা নিয়ে বসে আছে। এখন নিদেনপক্ষে বৈদ্যবাটি বা ব্যারাকপুর না ছাড়ালে দেখা মেলে না। তবে ক’দিন আগে শহরেই দেখতে পেলাম কয়েকজনকে। সল্টলেক স্টেডিয়ামের চার নং গেটের উলটোদিকে। বসে আছে এ এম আর আই হসপিটালের সামনে ল্যাম্পপোস্টের তার আর গাছগুলোর ডালে। সন্ধের মুখে জ্বলে ওঠা ভেপার ল্যাম্পের আলোয় পোকামাকড় ধরে খাচ্ছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা এলাকা বাঁধা। একটু বেচাল, এক ইঞ্চি অনধিকার প্রবেশ… অমনি কর্কশ ‘ক্রি ই ই চ্’ শব্দে পালক ফুলিয়ে তেড়ে যাচ্ছে একে অন্যকে। দেখে ভাল লাগল—যাক! ঝগড়াঝাটি করেও এখনও তো টিকে আছে এ শহরে। এটাই কম প্রাপ্তি নাকি।

স্টেডিয়ামের ওপারেই বেলেঘাটা সুভাষ সরোবর। শীতের সময় গেলে দেখতে পাবেন জলাশয়ের মাঝখানে গোল দ্বীপের মতো জঙ্গুলে জমিটায় পানকৌড়ি আর বকেদের পাশে গাছের ডালে ভাঙা কাঠকুটো দিয়ে থালার আকারে বাসা বেঁধেছে শামুকখোল সারস (ওপেন বিলড স্টর্ক)। আকারে অন্যান্য প্রজাতির বড় সারসের সমান। ধূসর সাদা গায়ের রং। ডানার শেষপ্রান্তে কালো রঙের শেড। মাছ, ব্যাঙ, ঢোঁড়া সাপ, গেঁড়িগুগলি… অরুচি নেই কিছুতেই। প্রায় সর্বভুক বলা চলে। লম্বা মজবুত ঠোঁটে শামুকের খোলা ভেঙে খাওয়ার দক্ষতার জন্যেই বোধ হয় শামুকখোর বা শামুকখোল নামটির উৎপত্তি। আগে রবীন্দ্র সরোবরের দ্বীপটিতেও দেখতে পাওয়া যেত। ইদানীং আর দেখা মেলে না তেমন একটা। বর্তমানে সুভাষ সরোবর ছাড়া শহরে মুক্ত প্রকৃতিতে দেখতে পাওয়ার একমাত্র ঠিকানা আলিপুর চিড়িয়াখানার ঝিল।

স্বর্গোদ্যান

গার্ডেনরিচে বি এন আর অধুনা সাউথ ইস্টার্ন রেলওয়ের সদর দপ্তর। অফিসের চারপাশ ঘিরে বিশাল খোলা মাঠ আর বাগান। অফিস চত্বরের পিছনেই বহমান গঙ্গা। পাড় ভর্তি গাছগাছালি। এককথায় সবুজের সমারোহ। আমার নিজের ভাষায় স্বর্গোদ্যান। প্রকৃতি আর বন্যপ্রাণকে এত কাছাকাছি আর এত ভালভাবে দেখার জায়গা এই শহরে আর কোথাও নেই। অন্তত এই অধম প্রতিবেদকের ধারণা তাই। কত রকমের পাখি যে দেখেছি এখানে। টুনটুনি, বক, পানকৌড়ি, টিয়া, ছাতারে, কাঠঠোকরা, বুলবুলি, কোকিল… এসব তো আছেই, এ ছাড়াও এমন দুটি পাখি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল এখানে যা মুক্ত প্রকৃতিতে আর কোথাও দেখতে পাইনি, অন্তত এই শহরবৃত্তে। ময়দান, লেক, চিড়িয়াখানা, ফোর্ট উইলিয়াম আর টলিগঞ্জ গল্‌ফ ক্লাবের কথা মাথায় রেখেই একথা বলছি। এবার প্রথম পাখিটিকে দর্শনের অভিজ্ঞতা বলি। হাসপাতালের পিছনে গঙ্গার পাড় ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল একটা পাখি। আকারে দাঁড়কাকের চেয়েও বড়। লেজটা শরীরের চেয়েও লম্বা। পালিশ কালো গায়ের রং। উজ্জ্বল বাদামি ডানাজোড়া, ঘুরে ঘুরে কী সব খুঁটে খাচ্ছে গাছের ছায়ায়। আমাকে দেখেও তেমন একটা ভয় পেল বলে মনে হল না। খুব কাছে এগিয়ে যেতে ‘কুব্’ জাতীয় একটা শব্দ করে উড়ে গিয়ে বসল গাছের ডালে। বাড়িতে ফিরে বইপত্তর ঘেঁটে পাখিটার নাম জেনেছিলাম। কুকো। কুকা বা কুবোপাখি নামেও ডাকা হয় বাংলার অনেক অঞ্চলে।

দ্বিতীয় পাখিটিকেও দেখেছিলাম মাটিতেই তবে গাছের ছায়ায় নয়। খোলা ঘাসজমিতে। রেল হাসপাতাল লাগোয়া ফুটবল গ্রাউন্ডের ঘাসজমিতে ঘুরে ঘুরে পোকামাকড় খুঁজছে একমনে। প্রথমে মনে হয়েছিল কাঠঠোকরা বুঝি। একটু বাদেই ভুল ভাঙল। কাঠঠোকরারা এতক্ষণ জমিতে থাকে না। চেহারাটা চোখে পড়ার মতো। গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল খয়েরি। কাঠঠোকরার চেয়েও সরু ছুঁচলো ঠোঁট। ডানার ওপর ত্রিভুজাকৃতি সাদা-কালো নকশা। লম্বা বাঁকানো ঝুঁটির ওপর গোটা পাঁচেক কালো ফুটকি। এককথায় অপূর্ব। আকারে কাঠঠোকরার চেয়ে সামান্য বড় আর স্বভাবে বেশ ভিতু। কাছাকাছি কেউ নজর রাখছে টের পেতেই উড়ে গেল ফুড়ুৎ করে। এর পরিচয় জানতেও শরণাপন্ন হতে হয়েছিল ড. সালিম আলির ‘কমন বার্ডস’-এর। মোহনচূড়া। ইংরেজিতে উপুপা।এখনও বহুল পরিমাণে দেখা যায় বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে সুন্দরবন ঘেঁষা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায়।

উপরোক্ত দুটি পাখিকেই পরবর্তীতে গ্রামের দিকে বেশ কয়েকবার দেখার সুযোগ ঘটলেও শহরবৃত্তে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা ওই একবারই। সেই বি এন আর-এর বাগানে। এখানেই দেখেছি ধূসর ছিট ছিট আর পাকা পাতিলেবু রঙা ডানাওয়ালা দু’ধরনের প্রজাপতি। পুজোর আগে থেকে শুরু করে পুরো শীতকালটা জুড়ে উড়ে বেড়াত গোটা কলকাতায়। বহুদিন হল ‘নিরুদ্দেশ’ শহর থেকে। ‘হারানো-প্রাপ্তি’-টা ঘটতে পারে একমাত্র এই বি এন আর-এর বাগানে এলে।

বন্যপ্রাণ নিয়ে টুকটাক শহুরে অভিজ্ঞতার মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনার সাক্ষীও এই বাগান। একটা মাদি হনুমান। কোত্থেকে যেন পোয়াতি অবস্থায় এসে ডেরা গেড়েছিল এই রেলের বাগানে। কিছুদিন বাদে একটা মৃত বাচ্চা প্রসব করে। বেশ কয়েকদিন বসে ছিল মরা বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাসপাতালের সামনে। এরপর হঠাৎই একদিন উধাও বাগান থেকে। দু’-চারদিন বাদে ফিরে এসেছিল খালি হাতে। ফাঁকা হয়ে যাওয়া কোলে তুলে নিয়েছিল মা-মরা দুটো কুকুরছানাকে। সারাদিন কত না যত্নআত্তি। সরু লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে পোকা বেছে দেওয়া, পেশেন্টপার্টিদের ছুড়ে দেওয়া ভাঙা বিস্কুট, কেক-পাউরুটির টুকরো, আগে ছানাদের মুখে দিয়ে তারপর দু-চার টুকরো দাঁতে কাটত। কিন্তু সমস্যা একটাই। সামান্য বিপদের আঁচ পেলেই ছানা কোলে সোজা মগডালে। অনভ্যস্ত পরিবেশে ছানাদের প্রচণ্ড বিরক্তি প্রকাশ, কুঁইকুঁই, কেঁউকেঁউ… অমনি লম্বা লম্বা হাতে ঠাস ঠাস চড় গালে বা পিঠে। এই অসম, বিধর্মী অপত্য স্নেহের পরিণাম শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল দেখার জন্য ফিরে যাওয়া হয়নি রেলের বাগানে।

ফিরবে না আর কোনওদিন

‘ওরে ভোঁদড় ফিরে চা/খোকার নাচন দেখে যা।’ বাংলার আরেক ছেলেভোলানো ছড়া। খোকার নাচন দেখে ভোঁদড় আদৌ ফিরে চায় কি না জানা নেই, তবে ভোঁদড় ত্রিসীমানায় রয়েছে জানতে পারলে লালবাড়ির বুড়ি জেঠিমা যে ধেই ধেই করে নাচতেন সেটা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি বহুবার। বেহালা সরশুনায় মামাবাড়ির পাশে লালবাড়ি। বনেদি এদেশীয় পরিবার। বিশাল পুরনো বাড়িটা লাল ইটের বলেই এলাকায় পরিচিত ছিল লালবাড়ি নামে। বাড়ির গায়েই ঘাটবাঁধানো পুকুর। দুপুরবেলা শুয়ে আছি। হঠাৎই ‘ঝপ্পাৎ’ শব্দ পুকুরের জলে। সঙ্গে সঙ্গে লালবাড়ির বড় বউ, বুড়ি জেঠিমার তীব্র চিলচিৎকার—“ওরে বিজে! পুকুরে উদ পড়েচে! শিগ্গির শিগ্গির যা…” শোনামাত্র বিজয়দা, বুড়ি জেঠিমার বড় ছেলে। শক্তসমর্থ চেহারা। খালি গা। মালকোঁচা মারা গামছা। নাকের নীচে ক্লার্ক গেবলের মতো সরু গোঁফ… তেড়ে ছুটে যেতেন পুকুরপাড়ে। হাতের মুঠোয় ধরা একটা খেটো বাঁশের লাঠি। দমাদম পিটতে শুরু করতেন পুকুরের জলে আর আশপাশের ঝোপঝাড়ে। সঙ্গে প্রবল হেঁড়ে গলার গর্জন—“অ্যাই শালা উদের বাচ্চা!…” বাকিটা অশ্রাব্য। আমরাও গোলমাল শুনে ছুটে যেতাম পুকুরপাড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা প্রাণী। না কুকুর, না বেড়াল, না শেয়াল… সাইজে হাত দেড়েক। লম্বাটে গোলপানা কালো তেল পিছলোনো চেহারা। চ্যাপটা মোটা লেজ। হাঁসের পায়ের মতো চ্যাপটা বেঁটে বেঁটে পা। থ্যাবড়া মুখ। নাকের দু’ধারে খাড়া খাড়া ঝাঁটা গোঁফ। মুখে কামড়ে ধরা একটা ল্যাটা, চারাপোনা বা এদেশে সদ্য উপনিবেশ স্থাপনকারী ত্যালপিয়া। বিদ্যুত্গতিতে জল ছেড়ে উঠে মিলিয়ে যেত ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে। আসলে ওটা ভোঁদড় (কমন ইন্ডিয়ান অটার)। উদ, উদবিড়াল, বা উদবিলাই নামে পরিচিত সারা বাংলা জুড়ে। ‘পানি কা কুত্তা’ নামেও ডাকা হয় হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যগুলোয়।

আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগেকার কথা। লালবাড়ির সেই বড় পুকুরটা মজে এখন এতটুকু একটা ডোবা। আর ভোঁদড়? লালবাড়ির পুকুর তো বটেই, ক্রমাগত পিছু হঠতে হঠতে মিলিয়েই গেছে গোটা গ্রাম বাংলা থেকে। চলে গেছে বিশ্ব বন্যপ্রাণ সংস্থার ‘চরম বিপদাপন্ন প্রজাতি’-র তালিকায়। সুন্দরবন আর ডুয়ার্সের জঙ্গলঘেরা নদীগুলোয় এখনও নাকি দেখা যায় মাঝেমধ্যে। সেও শুনেছি কালেভদ্রে। এখন দেখতে পাওয়ার একমাত্র ঠিকানা আলিপুর চিড়িয়াখানা। সিমেন্ট বাঁধানো জলাধার। নোংরা জল। জলে পড়ে থাকা দু’-চারটে পচাফাটা মাছ। একধারে উঁচু বেদিমতন জায়গাটায় চুপ করে বসে রয়েছে বিষণ্ণ বিমর্ষ মুখে। নিঃসঙ্গ একা! যদি মনের কোনও অবচেতন কোণে এখনও এতটুকু প্রকৃতিপ্রেম অবশিষ্ট থাকে, যদি একটিবারের জন্যও মনে হয় যে এই পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়, অন্যদেরও সেখানে বাস করার অধিকার আছে, তা হলে এই বিমর্ষ একাকীত্ব, ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা আপনাকেও ছুঁয়ে যাবে, যাবেই। যেতে বাধ্য।

ডাইনোসরের নাতিপুতি…

গড়িয়াহাট থেকে রুবিমোড়ের দিকে যাবার যে রাস্তাটায় এখন সারি সারি হাইরাইজ, ফ্ল্যাট, মল আর রেস্তোরাঁর ছড়াছড়ি, আজ থেকে বছর পঁয়তিরিশ—ছত্রিশ আগেও জায়গাটা ছিল ধানিজমি আর অজ পাড়াগাঁ। মনে আছে আটাত্তর সালে ভয়াবহ বন্যার কিছুদিন পরে বন্ধু বাপ্পার সাইকেলের কেরিয়ারে সওয়ার হয়ে ঘুরতে গেছিলাম ওদিকটায়। এখন যেখানটায় গীতাঞ্জলি স্টেডিয়াম, চারপাশ তখনও জলে থই থই, হঠাৎই চোখে পড়ল ধানখেতের পাশে আলের ধারে মাটিতে কী একটা শুয়ে রয়েছে। প্রথমে মনে হয়েছিল মরা গাছের ডাল বুঝি। একটু এগোতেই ভুল ভাঙল। কালো খড়খড়ে গা। ধারালো নখওয়ালা চার পা। বিশাল লম্বা লেজ। দৈর্ঘ্যে নিদেনপক্ষে ফুট পাঁচেক। কুমির না কি? তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় চমকে উঠে (আসলে ভয় পেয়ে) ধড়মড় করে দৌড়ে পিছিয়ে এসেছিলাম বেশ খানিকটা। আমাদের পায়ের শব্দে সচকিত হয়ে আল ছেড়ে খেতের জলে লাফ দিল প্রাণীটা। তিরবেগে সাঁতার কেটে মিলিয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। বেশ খানিকটা আতঙ্ক আর কলকাতার বুকে কুমির আবিষ্কারের উত্তেজনায় দুই বন্ধু যখন থরথর করে কাঁপছি তখন সাইকেল আরোহী এক বৃদ্ধ চাচা, থুতনিতে একটুখানি সাদা দাড়ি, মালকোঁচা মেরে পড়া লুঙ্গি, এগিয়ে এলেন সামনে। আমাদের আতঙ্কের কারণটা শুনে তো হেসেই কুটিপাটি— “আরে ধুৎ খোকাবাবু… কুমুর (কুমির) টুমুর কিছু নয় কো। ও ব্যাটা গোঁয়ারগেল। সাপ, মাছ ধরে খায়।” প্যাডেলে চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলেন চাচা, চলে যাওয়া মাত্র আমার হাত চেপে ধরল বাপ্পা। —“খবরদার ওসব গোঁয়ারগেল-ফেল নয়। পাড়ায় ফিরে বলতে হবে কুমিরই দেখেছি, বুঝেছিস?”

সে যাই হোক গোঁয়ারগেল নিয়ে আগ্রহটা কিন্তু থেকেই গেল। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার দেখেছি ওই বাইপাস এলাকাতেই, চিড়িয়াখানায় সাপের ঘরে কাচাধারে আর দীপক মিত্রের বাদুর সর্পোদ্যানে। তাঁর কাছেই প্রথম জেনেছিলাম প্রাণীটার নাম। ওয়াটার মনিটর লিজার্ড। সাদা বাংলায় গোসাপ। গোঁয়ারগেল, গুঁইসাপ বা গুইসাপ নামেও পরিচিত। মূলত জলচর সরীসৃপ তবে ডাঙাতেও সমান দ্রুতগামী। দক্ষ মাছশিকারি, প্রয়োজনে বড় বড় সাপ মেরে খেতেও দ্বিধা করে না। এমনিতে নিরীহ কিন্তু বিপদে পড়লে আক্রমণ করতে পিছপা হয় না এতটুকু। মজবুত, ধারালো লেজ আর করাতের মতো দাঁত— এই দুয়ের আঘাতই মারাত্মক। সময়মতো চিকিত্সা না করলে বিষাক্ত সংক্রমণ হতে পারে। বহুদিন হল নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। বছরখানেক আগে দেখেছিলাম বারুইপুর স্টেশনের গায়ে লম্বা পুকুরটায়। একটা নয়, দুটো। বিশাল লম্বা লেজটা নাড়িয়ে প্রপেলারের মতো জল কেটে কেটে সাঁতার কাটছে জোড় বেঁধে। রাজকীয় ভঙ্গিমায়। তবে বারুইপুরও তো এখন প্রায় কলকাতা। চারদিকে ধড়াদ্ধড় গজিয়ে ওঠা ফেলাটবাড়ি, দোকানপাট… হয়তো যে-কোনও দিন ঢুকে পড়বে কলকাতার পিনকোডে। তখন এসব পুকুরটুকুর থাকবে তো? কোথায় সাঁতার কাটবে এইসব ডাইনোসোরাসের নাতিপুতিরা?

মিনিমাগনার মুদ্দোফরাশ

‘একদম হাড়গিলের মতো দেখতে।’ কোনও শীর্ণকায় কাঠখোট্টা চেহারার কারও উদ্দেশে আমরা প্রায়ই ব্যবহার করি উপমাটা। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই জানি না কার সঙ্গে তুলনা করে এই উপমাটা দেওয়া হয়। হাড়গিলে। অ্যাডজুট্যান্ট স্টর্ক। মদনটাক নামেও ডাকা হয় গ্রাম বাংলায়। সারস প্রজাতির পাখিদের মধ্যে আকারে বৃহত্তম গোষ্ঠীদের অন্যতম। কদাকার দর্শন আক্ষরিক অর্থেই। ধূসর সাদা গায়ের রং। মাথা থেকে নিয়ে গলার শেষপ্রান্ত অবধি পালকের লেশমাত্র নেই। গলার নীচে বিশাল গলকম্বল। মৃত পশুর শবদেহ ভক্ষণ করে সাফসুতরো রাখত পুরনো কলকাতাকে। বিশাল লম্বা লম্বা ঠ্যাং ফেলে ঘুরে বেড়াত শহরময় আবর্জনার স্তূপে। এ ব্যাপারে এদের খ্যাতি এতই সুবিদিত ছিল যে তত্কালীন মিউনিসিপাল কর্পোরেশন তাদের লোগোয় এদের ছবি ব্যবহার করত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ সহ পুরনো কলকাতা-সংক্রান্ত একাধিক বইয়ে পাখিটির উল্লেখ রয়েছে। শকুনের মতোই হাড়গিলেও অবলুপ্ত হয়ে গেছে শহরের বুক থেকে। শকুনের অনেক আগেই। সেই বিশের দশকে। কলকাতার আরেক বিনে মাইনের মুদ্দোফরাশ।

নগর পুড়িলে কি…

বছর পঞ্চাশ আগে চিড়িয়াখানার চেহারাটা মনে আছে? শীতকালের দুপুর। চিড়িয়াখানার বিশাল ঝিল। এক ইঞ্চি জল দেখা যাচ্ছে না। পরিযায়ী পাখির ভিড়ে থিকথিক করছে জলাশয়। গ্রেটার হুইসলিং টিল, লেসার হুইসলিং টিল, স্পটবিল হাঁসের দল, মানস সরোবর, সাইবেরিয়া… হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে উড়ে এসেছে শহরে। সুদূর শীতের রাজ্য থেকে। কিচমিচ কলরবে মুখরিত চারপাশ। শীত দুপুরের মিঠে রোদে গা ভাসিয়ে ম্যাগনোলিয়া আর জলি চ্যাপ আইসক্রিম খেতে খেতে ঝিলের ঝোলানো ব্যালকনিতে বসে বসে পাখি দেখা। ওফ! সে এক রূপকথা ছেলেবেলা। মোটামুটি আশির দশকের গোড়া থেকেই এই অলৌকিক দৃশ্যপটের পর্দায় চিড় ধরতে শুরু করে একটু একটু করে। আকাশ ফুঁড়ে ওঠা কুৎসিত দাম্ভিক বহুতল আর চোরাশিকারির লঙ্গর সুতোর বড়শি-ফাঁদে পড়ে ক্রমাগত পথ হারাতে থাকে পরিযায়ী পাখিরা। আর আজ? খাঁ খাঁ চিড়িয়াখানার পুকুর। ইতিউতি কয়েকটা গো-বক, পানকৌড়ি, কোঁচবক আর শামুকখোল… বিলুপ্ত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও রয়ে গেছে চিড়িয়াখানার ঝিলে। কী বুঝছেন পাঠক? একবারও মনে হচ্ছে না আমি বা আপনি, আমরাই এর জন্য দায়ী? কারণ আমরা তো প্রতিবাদ করিনি কখনও। চিৎকার করে উঠিনি একটিবারের জন্যও— “যা হচ্ছে, অন্যায় হচ্ছে!” তার বদলে আরও, আরও বেশি করে লুকিয়ে পড়ছি সাড়ে সাতশো, হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট, ই এম আইয়ে কেনা গাড়ি আর স্মার্টফোনের স্ক্রিনের আড়ালে। কিন্তু এভাবে কি বাঁচা যাবে? সার্ধশতবর্ষ অতিক্রান্ত মহীরুহ এক জ্ঞানবৃদ্ধ সেই কবে লিখেছিলেন— ‘নগর পুড়িলে কি দেবালয় বাঁচে?’ চিন্তা নেই, এরকম চলতে থাকলে আমরা বাঁচব না, গাছপালা, নদনদী, খালবিল-পুকুর, পাহাড় ঝরনা, কীটপতঙ্গ পশুপাখি… আমাদের অনেক, অনেক আগে থেকে পৃথিবী নামক এই অনন্য আর অসামান্য গ্রহটার বাসিন্দা ওরা। তাই ওরা না থাকলে আমরাও থাকব না— এই সহজ সরল সত্যটা উপলব্ধি করা দরকার সবার আগে। বুঝতে পারলে ভাল। আর না পারলে?—‘শেষের সে দিন (কিন্তু সত্যিই) ভয়ংকর!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *