০৬. সুমন কলকাতা

সুমন কলকাতা

সালটা উনিশশো তিরানব্বই। ছোট বোন সবে কলেজে পড়ানোর চাকরিটা পেয়েছে। পোস্টিং মেদিনীপুরে। উইক এন্ডে বাড়ি ফেরে। এমনিতে প্রতি সোমবার ভোরের ট্রেনে কাজের জায়গায় ফিরে গেলেও সেবার কোনও একটা জরুরি কাজে আটকে পড়ায় সকালে আর ফেরা হয়নি। ফলে যে করে হোক সন্ধ্যার ট্রেন ধরে কর্মস্থলে ফিরে পরদিন জয়েন করাটা অত্যন্ত জরুরি। সেদিন সন্ধে থেকেই আকাশের মুখ গোমড়ানো। মাঝে মাঝেই হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। এই দুর্যোগে ওকে একা ছাড়ার ভরসা না পেয়ে ট্রেনে তুলে দিতে হাওড়ায় যাওয়া। তুলে দিয়ে ফেরার পথে বৃষ্টিটা আরও ঝাঁপিয়ে কাঁপিয়ে নামল। সঙ্গে প্রবল দমকা হাওয়া। এর মধ্যেই কোনও মতে বাড়ি ফেরার বাসটা পেয়ে গেলেও হঠাৎ মাঝপথে ধর্মতলায় নেমে পড়লাম। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই কাজের জায়গায়… চেনাজানা মহলে… বন্ধুদের আড্ডায় টুকরো টুকরো সংলাপ, কিছু মন্তব্য এবং প্রশ্ন…-র গান শুনেছিস?… একদম অন্যধরনের… অনুষ্ঠান দেখেছিস?… টিকিটই পাওয়া যায় না! এই ধরনের কথাবার্তা এবং তার ফলে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠা কৌতূহল… সব মিলিয়ে একটা বেদম বেহাল অবস্থা আমাকে কীরকম একটা ঘোর-লাগা, ভূতগ্রস্থ অবস্থায় ওই প্রবল বর্ষণের রাতে মাঝপথে নামিয়ে দিল। মেট্রো সিনেমার ঠিক পাশেই ব্যাপক পরিচিত মিউজিক ক্যাসেটের দোকানটিতে কাকভেজা বললেও কম বলা হয় এমন অবস্থায় গিয়ে ঢুকে পড়লাম। সাধারণ অবস্থায় ওই দোকানটিতে খদ্দেরের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা থাকে না। কিন্তু সেদিন একেবারে ফাঁকা। বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাড়ি ফেরার চিন্তায় উদ্বিগ্ন কাউন্টার সেলসম্যানরা আমাকে দেখে কিছুটা চমকেই গেলেন। আমি সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, সুমনের গানের ক্যাসেট আছে? তখনও ক্যাসেটের টাইটেল জানি না। ওদের মধ্যে একজন বিনা বাক্যব্যয়ে আমার হাতে ক্যাসেটটি এনে দিলেন। অন্ধকারের মাঝখানে আবছা মায়াবী নীল আলোয় গিটার হাতে শ্মশ্রুগুম্ফশোভিত মুখ। ক্যাসেটের নাম ‘তোমাকে চাই’। তখনও মোবাইল যুগ শুরু হয়নি। ফলে ওই অবস্থায় বেশ দেরিতে বাড়ি ফিরে মাতৃদেবী ও অর্ধাঙ্গিনীর চোখা চোখা বাক-মিসাইলের ঝাঁকের মধ্যে দিয়ে কোনওমতে বাথরুমে গিয়ে-বেরিয়ে এসে এবং নিজেকে ডিফেন্ড করার ন্যূনতম প্রচেষ্টা না করে মিউজিক সিস্টেমের মধ্যে ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে যখন প্লে-বাটনে আঙুলটা চাপলাম তখন উভয় প্রতিপক্ষই খানিকটা হতভম্ব এবং বাকরুদ্ধ। এরপর কী ঘটল এটা এককথায় বলতে গেলে আমাকে তারাপদ রায়ের কাছে একটি লাইন ধার করতেই হচ্ছে— ওই বর্ষণমুখর কালো রাতেও ‘নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক!’ হালকা তরঙ্গের মতো সিন্থেসাইজারের সুর। মেঘমন্দ্র ব্যারিটোন ভয়েস। আর গানের কথা— আমার মতো পাতি মধ্যবিত্তর গান শোনার অভিজ্ঞতার অ্যাকোয়ারিয়ামটা যেন কোন সাংঘাতিক কালাপাহাড়ের আঘাতে নিমেষে ভেঙে চুরমার। এ যেন মহাসমুদ্রে গিয়ে পড়া। কিছুই মিলছে না আবার যেন খুব কাছের। যখন শুনছি— ‘চৌরাস্তার মোড়ে-পার্কে দোকানে/শহরে-গঞ্জে-গ্রামে-এখানে ওখানে/স্টেশন-টার্মিনাস-মাঠে-বন্দরে/অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে/বালিশ-তোষক-কাঁথা-পুরনো চাদরে/ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে’— আমার ভীষণ পরিচিত এই শহরটা কখনও না পড়া একটা বইয়ের মতো পাতায় পাতায় খুলে যাচ্ছিল চোখের সামনে। মনে হচ্ছিল এ তো আমারই কথা, কী ভয়ংকর রকম চেনা অথচ কখনও শুনতে পাইনি অথবা বলতে পারিনি। অন্য কেউও শোনাতে অথবা বলতে পারেননি। সেই রাতে দুটো ঘটনা ঘটেছিল— এক) তুচ্ছ কারণে স্ত্রীর সঙ্গে বেশ কয়েকদিন ধরে চলা ঝগড়ার কিঞ্চিৎ প্রেমময় সমাপ্তি। দুই) ওই একটাই গান বারবার বাজিয়ে চলেছিলাম যতক্ষণ না পাশের ঘর থেকে মা তার পেটেন্ট পূর্ববঙ্গীয় টানে মৃদু ধমক দেন— ‘অরে, এইবার বন্ধ কর। ক্যাসেটটা তো খারাপ হইয়া যাইব’— ‘তোমাকে চাই’ বন্ধ হয়নি। রাতের ঘড়ি তখন দুটোর কাঁটা ছাড়িয়েছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার— ওই একটা গানই বারবার বাজিয়ে শুনছিলাম কারণ পরেরগুলি শুনে ওঠার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছিলাম না। কী জানি যদি এইরকম ভাল না হয়। যদি মোহভঙ্গ ঘটে। কারণ একটি অথবা দুটি মহৎ সৃষ্টির পর মান পড়ে গেছে এমন উদাহরণ অন্তত সাহিত্যে অথবা চলচ্চিত্রে কম নেই। যাইহোক এক-আধদিনের জড়তা-ভয় কাটিয়ে সেই বিশাল সাংগীতিক মহাসমুদ্রে ডিঙি নামিয়েছিলাম। অনেকটা সেই হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’-র নায়কের মতো। আর জালে উঠে এল একের পর এক— ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’, ‘দশ ফুট বাই দশ ফুট’, ‘কখনও সময় আসে’, ‘গড়িয়াহাটার মোড়’-এর মতো অতিকায় সব প্রাগৈতিহাসিক মাছ। ততদিনে বাইশ গজের পিচে দাঁড়িয়ে ভিভ রিচার্ডসের অনায়াস ভঙ্গিতে রাজকীয় ছয় মারার মতো শ্রোতাদের গ্যালারিতে এসে পড়ছে ‘বসে আঁকো’, ‘ইচ্ছে হল’-র মতো জাদুমাখানো বল। শুরু হচ্ছে আরও নতুন আরও সাম্প্রতিক কিছুর জন্য প্রতীক্ষা।

ক্যাসেটে গান শোনার পাশাপাশি লাফ দিয়ে দিয়ে বাড়তে লাগল অনুষ্ঠান দেখার প্রবল আকাঙ্ক্ষা। যার কাছে কোথায় লাগে সের্গেই বুবকা। অবশেষে সুযোগ এল। কানোরিয়ার সংগ্রামী শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে শিল্পীর একক অনুষ্ঠান। নজরুল মঞ্চে। প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা এইরকম— অন্তত আমার কাছে। চিড়িয়াখানার পিছনদিকের অন্ধকার ঘরটা থেকে কখনও কোনও বাঘকে হঠাৎ সামনের বড় জাল লাগানো খাঁচায় বেরিয়ে আসতে দেখেছেন? অথবা পুরী স্টেশন থেকে রিকশায় চড়ে স্বর্গদ্বারে বাঁক নেওয়ার মুখে প্রথম শোনা এবং দেখা বিশাল সমুদ্রের ঢেউ ভাঙার ধড়াম শব্দ! আমার প্রথম অভিজ্ঞতা হুবহু সেইরকম। দ্রুতপায়ে মঞ্চে প্রবেশ। কী-বোর্ডের সুইচটা অন করে দিয়ে দৃপ্ত পদচারণা। পরিধানে ব্লু-ডেনিম। হাতে অনায়াস গিটার। কণ্ঠে ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’। মুহূর্তে স্টেজ হাতের মুঠোয়! নির্বাক-মুগ্ধ-সম্মোহিত দর্শক। অনুষ্ঠান তো নয়। যেন এক আন্তর্জাতিক-মহাজাগতিক প্যাকেজ। গান চলছে। সেই সঙ্গে মেসমারাইজিং কথা। যেন এক অদ্ভুত ফাঁসে চেপে ধরছেন। আবার হালকা করে দিচ্ছেন। গানে কথায় উঠে আসছেন— সুকুমার রায়— প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়— আর্নেস্তো চে গেভারা— আখতারউজ্জামান ইলিয়াস— আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ— ফ্রানত্জ বেকেনবাওয়ার— আমির খান— শ্যামল মিত্র— পীট সিগার— নোয়াম চাম্স্কি। উচ্চারিত হচ্ছে অপার প্রকৃতি প্রেম— প্যারিসের ছাত্র সংগ্রাম অথবা আণবিক বোমার বিরুদ্ধে জেহাদ। গান-কথা চলছে ঘুরছে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে। প্রতিটি স্তরেই অনায়াস বিচরণ করছেন শিল্পী। ঘরে বসে নাক নেড়ে নেড়ে অনেক ‘সো-কলড্ সুশীল’ অনেক কথাই বলতে পারেন কিন্তু মনে মনে একথা স্বীকার করতে বাধ্য যে এরকম ম্যাজিক-রিয়্যালিজম তাঁরা কস্মিনকালেও প্রত্যক্ষ করেননি। অন্তত মঞ্চে তো নয়ই। এ যেন জন লেননের Nowhere land। যেন এক অতিপ্রাকৃতিক ক্যালাইডোস্কোপ। শত সহস্র রঙিন নকশা প্রতি মুহূর্তে ভাঙছে, জুড়ছে, আবার পুনর্গঠিত হচ্ছে। এ যেন— ‘তার অন্ত নাই গো নাই।’ আসলে যে কথা বলছিলাম— শিল্পী মঞ্চে গাইছেন, বলছেন। শুধু গাইছেন বা বলছেনই না সেগুলো বিশ্বাস করছেন। আর বিশ্বাস করছেন বলেই দেখতে পাচ্ছি মানুষটা ছুটে যাচ্ছেন— দাঁড়াচ্ছেন কানোরিয়ার সংগ্রামী শ্রমিকদের পাশে, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন জমি দখলের বিরুদ্ধে রাজারহাট-সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে। গানের দুনিয়ায় তিনিই প্রথম যিনি তাঁর কথায় বাংলা গানের সঙ্গে শুয়েছেন। এই তীব্র প্রেমই সম্ভবত (সম্ভবত শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারণেই যে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই) জন্ম দিয়েছে বিপুল সাংগীতিক জ্ঞানের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে বলে যেতে পারেন— রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরী, গোপাল উড়ে থেকে সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, বড়ে গোলাম থেকে অজয় চক্রবর্তী, পীট সিগার থেকে স্টিভি ওয়ান্ডার— বলে যেতে পারেন এঁদের গান এবং আরও বহুবিধ সংগীতের ধারা প্রসঙ্গে। একটা প্রশ্ন রাখাই যেতে পারে যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের এতবড় জীবন্ত আর্কাইভ আমার এই পোড়া দেশে আর দেখা গেছে কি? অন্তত আমার চোখে তো পড়েনি। এরপর যদি তাঁর নিজের গানের কথাই ধরি তা হলে এত বিপুল বৈচিত্র্যও তো আর কোথাও চোখে পড়েনি যেখানে প্রেম-প্রকৃতি-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সমকাল-সমাজ সচেতনতা— রাজনীতি-ব্যঙ্গ-শ্লেষ-ক্রোধ-আশাবাদ এমনকী আমার পাশের বাড়ি-চিলছাদও মিলে মিশে একাকার। আবার অনায়াস দক্ষতায় তিনি নিজেই আলাদা করে দিতে পারেন একেকটি গানকে। নির্মাণ হয় ‘সন্ধে হলো’ বা ‘মোমবাতিটা কোথায় গেল’-র মতো নিখাদ অসাধারণ প্রেমের গান। ‘চাঁদের কাস্তে’ ‘বিভূতিভূষণে’ জড়াজড়ি করে আটকে থাকে প্রকৃতি। ‘হাল ছেড়ো না’ ‘কখনও সময় আসে’ জন্ম দেয় এক চিরন্তন আশাবাদের যেখানে ‘গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইনস’ আর ‘ফুলমণি’ হয়ে ওঠে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক। আর উপরোক্ত সমস্ত বিশেষণগুলিই যেন কোন ম্যাজিক টাচে এক হয়ে মিলেমিশে যায় ‘তোমাকে চাই’ বা ‘জাতিস্মরে’।

শুধু কি গান, কুড়ি বছরের সুমন-যুগে আমরা জন্ম হতে দেখলাম এক নতুন ঘরানার— যা প্রথা ভাঙার, যা নিয়মানুবর্তিতার। আগে বাংলা গানের অনুষ্ঠান বলতেই আমরা বুঝতাম কোঁচানো ধুতি পাঞ্জাবি পরে গায়কের মঞ্চে প্রবেশ, বহুক্ষণ ধরে তবলার ঠুকঠাক, হারমোনিয়ামের প্যাঁ-পোঁ, অতঃপর গায়কের নীরস গম্ভীর বদনে একের পর এক গান গেয়ে চলা। এবার আমরা কী দেখলাম? সুমন স্টেজে ঢোকা মাত্রই নমস্কার অথবা আদাব এবং তত্ক্ষণাৎ অনুষ্ঠান শুরু। গান দিয়েই যে শুরু হবে তার কোনও মানে নেই। কখনও কথা, কখনও গান। আগে আমরা এ দৃশ্য প্রায়শই দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম, গায়ক গান গেয়ে চলেছেন আর সামনের সিটে— ‘মণি মাসির ছেলের বিয়েতে মেয়ের বাড়ি থেকে গলার সেটটা কীরকম দিয়েছে’ অথবা ‘রিলায়েন্সের বাজার দরটা কি এ মাসে চড়বে?’ এ জাতীয় আলোচনা অনর্গল চলেছে। সুমনই প্রথম, যিনি বোঝালেন, শুধু বোঝালেন-ই না বিশ্বাস করতে শেখালেন গানকে শ্রদ্ধা করতে হবে। দিতে হবে তার প্রাপ্য মর্যাদা। দর্শকরাও শিখলেন অনুষ্ঠান চলাকালীন অপ্রয়োজনীয় কথা বলার অভ্যাসকে বর্জন করতে। একই সঙ্গে গায়কের সঙ্গেও তাদের একটা যোগাযোগ গড়ে উঠল। কথার পৃষ্ঠে কথা, সরল যুক্তিপূর্ণ মন্তব্যের ধারা গড়ে উঠল। উভয় তরফেই। শুরু হল গানের সঙ্গে কোরাসে গলা মেলানো, অদ্ভুতভাবে সাপোর্ট দিয়ে ধরতাইটা বেঁধে দিলেন ওই একা একটা মানুষ মঞ্চে দাঁড়িয়েই। যা অভিনব আন্তরিক সর্বোপরি সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয়বহনকারী। বন্ধ হল বিপন্ন বিড়ম্বিত সব ঘোষক আয়োজকদের ঘোষণা— ‘আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন, শিল্পী এখনও এসে না পৌঁছনোয় অনুষ্ঠান শুরুতে একটু দেরি হচ্ছে’। সুমনের অনুষ্ঠান সাড়ে ছ’টা মানে সাড়ে ছ’টা। এক ইঞ্চি নড়চড় নেই। এই অসাধারণ নিয়মানুবর্তিতার নাম সুমন। এটা আস্তে আস্তে শ্রোতাদের মধ্যেও চারিয়ে গেল। তৈরি হল একটা আদ্যন্ত সিরিয়াস এবং কমিটেড দর্শকমণ্ডলী। যাদের মধ্যে, খুব সমস্যায় না পড়লে কেউ সুমনের অনুষ্ঠানে দেরিতে প্রেক্ষাগৃহে ঢোকেন না। আর একটা বিষয় এখানে উল্লেখ না করলে অত্যন্ত ভুল হবে— তা হল নাগরিক কবিয়ালের অসামান্য রসবোধ। যারা তাঁর অনুষ্ঠান নিয়মিতভাবে দেখেন অথবা ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত উভয়েরই মানুষটির এই গুণটির সঙ্গে সবিশেষ পরিচয় আছে।

সুমন এলেন। বাংলা গানের মরা গাঙে জোয়ার এল। ইতিহাস সৃষ্টি হল— এসব এখন বহুচর্চিত, বহুব্যবহৃত বিশেষণ। অনেকেই বলে থাকেন। টিভি-র অ্যাঙ্কর থেকে বোদ্ধা। যেটা প্রায় কখনওই চর্চিত হয় না গানটা তিনি কতটা ভালবেসে গান। কতটা শারীরিকভাবে। তিন ঘণ্টা, গিটার, সিন্থেসাইজার, অর্গ্যান হারমোনিকা বাজিয়ে পাথর ভাঙা মজদুরের মতো পরিশ্রম করে। একা হাতে এবং সম্পূর্ণ একা। এ উপমহাদেশে তো বটেই সারা বিশ্বে এর নজির ক’টা আছে? একটা মানুষ গান এবং কী উদ্দেশ্যে গান করছেন সে ব্যাপারে এতটা কমিটেড হতে পারেন?

হ্যাঁ সুমন পারেন। আর পারেন বলেই কানোরিয়া থেকে অর্চনা গুহনিয়োগীর মামলা— জীবনে নিজের করা অনুষ্ঠানের একটা বৃহদংশই বিনা পারিশ্রমিকে করেছেন। ক’জন বলেন একথা? যাঁর অনুষ্ঠানের ইঞ্চি দুয়েক সাইজের একটা বিজ্ঞাপন খবরের কাগজে ভিতরের পাতায় বেরুলে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ হয়ে যায় নিমেষে, এখনও— তাঁকেই দেখেছি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় মেট্রো চ্যানেলের সামনে ঘ্যাড়ঘেড়ে আওয়াজের মাইকে কোনওরকম যন্ত্রানুষঙ্গ ছাড়াই খালি গলায় গান গাইছেন। রাস্তায় অথবা ভাড়ার ম্যাটাডোরের ওপর দাঁড়িয়ে। সেই সুমনের ‘তোমাকে চাই’-এর বয়স হল মাত্র কুড়ি। এটা আর যে কেউ বিশ্বাস করুন আমি অন্তত করি না। আসলে এ গান তো ছিলই। আমাদের মধ্যে। বহু বহু যুগ ধরে। ছিল আমাদের শহর কলকাতায় পাড়ায়-প্রেমে-প্রতিবাদে। ছিল স্যাঁতস্যাঁতে গলির নোনাধরা দেওয়ালে। বাজারের ব্যাগে। গলির মোড়ে হাবুর রোল সেন্টারে। এলাকার এজমালি পাহারাদার ভুলির একগাদা ছানাপোনাকে দুধ খাওয়ানোর পরম আনন্দে। ছিল রোজ রোজ হারতে হারতে অন্তত একদিন জেতার নাছোড় মানসিকতায়। ছিল গুপ্তযুগের কোনও প্রাচীন ঢিপি অথবা অতিকায় টিরেনোসোরাস-রেক্সের ফসিলের মতো মাটি চাপা পড়া আমাদের মনের অন্দরে। আমরা তাকে আবিষ্কার করতে পারিনি। পারেননি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ-রৌপ্যযুগের সেইসব প্রত্নতাত্ত্বিক খলিফারাও। সুমন পেরেছেন। তাই তিনি মায়েস্ত্রো, অনন্য, ইতিহাস। সব শেষে জয় কবির ভাষায় বলি— “আগুন ছেলেমেয়ে আমাদের/আকাশ আমাদের দখলে/যে যার বঁধুয়াকে ডেকে নাও/সুমনে দেখা করো সকলে।” দেখা করো কলকাতা।

* সুমনের গানের কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল আলতামিরা পত্রিকায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *