০৫. পেডোফাইল কলকাতা

পেডোফাইল কলকাতা

সময়টা উনিশশো তিরানব্বই কি চুরানব্বই। বম্বে হেডকোয়ার্টার থেকে কলকাতার অফিসে এসেছিল প্রজেক্টটা। একদিন সকালে অফিসে ঢুকতেই সোস্যাল রিসার্চ ডিভিশনের ব্রাঞ্চ চিফ ড. অর্না শীল, ডেকে পাঠালেন ওনার ঘরে। “পেডোফাইল সম্পর্কে কিছু জানো?” পেডোফাইল? জীবনে প্রথমবার শুনলাম শব্দটা। অগত্যা ঘাড় নেড়ে জানাতেই হল অজ্ঞতার কথা। “বসো” সামনে চেয়ারটার দিকে ইশারা করলেন অর্নাদি। অতঃপর সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলেন ব্যাপারটা।

পেডোফাইল মানে বিকৃতকাম এক ধরনের মানুষ, যারা শিশুদের তাদের বিকৃত যৌনলালসার শিকার বানায়। এদের অধিকাংশই এদেশে ঘুরতে আসা বিদেশি এবং স্বভাবতই ধনী। ভারতে এদের মূল বিচরণক্ষেত্র গোয়া। সেখানে রীতিমতো একটা অপরাধচক্র গরিবগুর্বো ঘরের বাচ্চাদের অভিভাবকদের পয়সার টোপ ফেলে, ফুসলেফাসলে, প্রয়োজনে জোর খাটিয়ে তুলে এনে চালান করে দেয় স্থানীয় হোটেল, রিসর্ট আর ফার্ম হাউসগুলোয়। এর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়েছে গোয়ার শৈশব। একটা আন্তর্জাতিক শিশুকল্যাণ সংস্থা সমগ্র গোয়া জুড়ে কাজ করছে এর বিরুদ্ধে। তারাই আমাদের সংস্থাকে বরাত দিয়েছে চারটে মেট্রো শহর সমেত হায়দ্রাবাদ আর বেঙ্গালুরুতে এ বিষয়ে একটা সমীক্ষা চালানোর জন্য। মনে রাখতে হবে যে সময়ের কথা বলছি তখনও পরিচালক মধুর ভাণ্ডারকরের ‘পেজ থ্রি’ (পেডোফাইল চক্রের কার্যকলাপ বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছিল সিনেমাটিতে) মার্কেটে রিলিজ করতে অন্তত বছর পনেরো বাকি। গুগুল সার্চ তো কোন দূরের গ্রহ। অর্নাদির দেওয়া এতটুকু তথ্যের ভিত্তিতে কতদূর এগোনো সম্ভব? কিন্তু কিছু করার নেই। নামী ফান্ডিং এজেন্সির প্রজেক্ট কনসাইনমেন্ট। রিপোর্ট তো পাঠাতেই হবে। কাজটা হাতে নিয়েই টার্গেট এরিয়া হিসেবে প্রথমেই বেছে নিলাম ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, রিপন স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, মার্ক্যুইস স্ট্রিট… এইসব অঞ্চলকে। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সদর স্ট্রিট এলাকা। কলকাতা জাদুঘরের গা ঘেঁষে সোজা গিয়ে মিশেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। ছোট, বড়, মাঝারি… প্রচুর হোটেলের ছড়াছড়ি গোটা এলাকা জুড়ে। শয়ে শয়ে বিদেশির আনাগোনা নিত্যরোজ। কিছুক্ষণ ওই এলাকায় ঘোরাঘুরি করলেই চোখে পড়তে বাধ্য দৃশ্যটা। ফুটপাথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দরিদ্র শ্রেণির মহিলা। পেশা ভিক্ষাবৃত্তি। প্রত্যেকের কোলে কাঁখে একটা দুটো করে বাচ্চা। কিন্তু স্বদেশি মানুষজনের কাছে ভিক্ষে চাইতে তেমন একটা উত্সাহী নয় কেউই। সেই আপাতনিস্পৃহ ভাবটাই মুহূর্তে কেটে যাচ্ছে বিদেশি-বিদেশিনীদের দেখামাত্র। বিগলিত হেসে এগিয়ে যাচ্ছে। বিদেশিদের কোলে তুলে দিচ্ছে বাচ্চাদের। আশেপাশে দাঁড়ানো খুদেগুলোও ছুটে গিয়ে হাতজামার খুঁট ধরে ঝুলে পড়ছে সাহেব মেমসাহেবদের। ওরাও কোলে তুলে নিচ্ছেন, খুনসুটিতে মাতছেন বাচ্চাদের সঙ্গে। দামি এস এল আর ক্যামেরায় ছবি তুলছেন ঘনঘন। প্রথম দু-তিনদিন স্রেফ নজর করেছিলাম ব্যাপারটা। লক্ষ করেছিলাম ভিখারিনিদের প্রায় সবাই খানিকটা ভাঙাচোরা ইংরেজি জানেন যেরকম— ‘হাই’, ‘হ্যালো’, ‘গুড মর্নিং’, ‘হাউ (আর বাদ) ইউ?’ ‘ভেরি পুওর’, ‘টু মেনি চিলড্রেন’, ‘হাংরি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। বাকিটা বোঝানো হচ্ছে হাত-পা নেড়ে, শরীরী ভাষায়। আরেকটা ব্যাপারও গুরুত্বপূর্ণভাবে লক্ষণীয়, বলার কায়দা বা অ্যাকসেন্টটা অবিকল বিদেশিদের মতো। হয়তো দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার ফল। দিনকয়েক অনুসরণ করার পর একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করলাম। ঘনিষ্ঠতা বলতে বাচ্চাগুলোকে টুকটাক লজেন্স-টফি কিনে দেয়া, মায়েদের সঙ্গে এটা সেটা গল্পগাছা করা… এইসব আর কী। যারা এতে একটু আধটু খুশি হচ্ছিল অর্থাৎ সোশ্যাল রিসার্চের ভাষায় ‘পজিটিভ রেসপন্স’ জানান দিচ্ছিল, তাদের মধ্যে দু’জনকে টার্গেট বা ‘কী রেসপনডেন্ট’ (মুখ্য উত্তরদাতা) হিসেবে বেছে নেয়া হল। অতঃপর শিপ্রার পালা।

শিপ্রা বিশ্বাস। অফিসে আমার দীর্ঘদিনের সহকর্মী। অসমসাহসিনী এবং বুদ্ধিমতী। আরও দুয়েকদিনের চেষ্টায় টুকটাক কথাবার্তা চালাতে চালাতে বিশ্বাস অর্জন করে ফেলল উত্তরদাতাদের। কথাবার্তার ফাঁকে উঠে আসা টুকরো টুকরো তথ্যগুলোকে একত্রিত করে সাজানোর পর যা উঠে এসেছিল সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক এবং চিন্তায় ফেলে দেবার মতো। যেসব বিদেশিরা এখানে আসেন, বাচ্চাদের কোলে তুলে আদর করেন, দামি দামি চকলেট আর বিস্কুটের প্যাকেট উপহার দেন, মায়েদের হাতে গুঁজে দেন বিশ-পঞ্চাশ-একশো টাকার নোট, তাদের অধিকাংশের উদ্দেশ্য দরিদ্র দেশের গরিবগুর্বো মানুষ আর পথশিশুদের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছি ভেবে সন্তুষ্টি লাভ করা হলেও সবার উদ্দেশ্য কিন্তু অতটা সহজ সরল নয়। ওইসব অঞ্চলের বেশকিছু হোটেলে মোটা অর্থের বিনিময়ে রমরমিয়ে চলে পেডোফাইল চক্র, হোটেল মালিক ম্যানেজার কর্মচারী এবং ওই অঞ্চলের অপরাধ জগতের কুশীলবদের সহায়তায়। কিছুদিন সমীক্ষা চলার পর কোনও কারণ না দর্শিয়ে হঠাৎই মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায় প্রজেক্টটা।

কেন?— সেটা আজও অপরিসীম দুর্জ্ঞেয় রহস্য এই অধম প্রতিবেদকের কাছে। পরবর্তীতে বিষয়টা নিয়ে কলকাতায় আর কখনও কোনওরকম কাজ হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। ফলে এই বিষবৃক্ষের চারা এতদিনে মহীরুহে পরিণত হয়েছে কিনা জানা নেই সেটাও। সবচেয়ে মর্মান্তিক যেটা, শিপ্রা যার উপস্থিত বুদ্ধি আর দুঃসাহস ছাড়া এ কাজটা করা সম্ভব হত না কোনওমতেই, মারাত্মক বোন-ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চলে গেছে মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে। তাই সম্ভবত একমাত্র আমিই বেঁচে আছি আজও এ শহরে, এক ভয়ংকর এবং একই সঙ্গে হাড় হিম করে দেওয়া ঘটনাক্রমের সাক্ষী হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *