প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৫.৭ পরদিন সন্ধে হতেই

সপ্তম পরিচ্ছেদ

১.

পরদিন সন্ধে হতেই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বাড়িতে এসে দরজার কড়া নাড়তে লাগল জাঁ ভলজাঁ। বাঙ্ক দরজা খুলে দিল। তাকে বলে রাখা হয়েছিল, ভলজাঁ এ সময় আসবে। বাস্ক বলল, মঁসিয়ে, লে ব্যারন আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন আপনি উপরকার ঘরে যাবেন, না নিচের তলার ঘরেই বসবেন।

ভলজাঁ বলল, আমি নিচের তলার ঘরেই বসব।

বাস্ক যথাযযাগ্য সম্মান দেখিয়ে নিচের তলার একটি ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল ভলজাঁকে। সে ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপনি বসুন, আমি মাদামকে খবর দিতে যাচ্ছি।

ঘরটার মধ্যে দুটো আর্মচেয়ার পাতা ছিল। আগুন জ্বলছিল। ঘরটা স্যাঁতসেঁতে। আলো-বাতাস কম।

ভলজাঁ খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। সে দিনকতক ধরে কিছু খায়নি বা ঘুমোয়নি। সে একটা আর্মচেয়ারে বসে পড়ল। বাস্ক একটি বাতি হাতে নিয়ে ফিরে এসে জ্বলন্ত বাতিটা ঘরে রেখে দিয়ে চলে গেল ঘর থেকে।

ভলজাঁ মুখটা নামিয়ে বসেছিল। সে কোনওদিকে তাকায়নি। কিন্তু সে হঠাৎ কসেত্তে’র নিঃশব্দ উপস্থিতি অনুভব করল ঘরের মধ্যে। মুখ তুলে দেখল, কসেত্তে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়ে আছে নীরবে। তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। কিন্তু ভলজাঁ তার দেহের সৌন্দর্য নয়, তার আত্মার অবস্থাটা দেখতে চাইছিল।

কসেত্তেই প্রথমে কথা বলল, বাবা, আমি জানি তুমি অদ্ভুত ধরনের লোক, কিন্তু এটা আমি আশা করতে পারিনি তোমার কাছ থেকে। মেরিয়াস আমাকে বলেছিল, তোমার অনুরোধেই এখানে আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ভলজাঁ বলল, একথা সত্যি।

আমিও তাই ভেবেছিলাম। এটা নিয়ে কিন্তু বেশ একটা ব্যাপার হবে। সে যাই হোক, এখন আপাতত আমাকে একটা চুম্বন কর।

এই বলে সে একটা গাল বাড়িয়ে দিল ভলজাঁ’র দিকে। কিন্তু ভলজাঁ নড়ল না। তার পা দুটো যেন মেঝের উপর গাঁথা আছে।

কসেত্তে বলল, এটা কিন্তু বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কী দোষ আমি করেছি। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বললে আমি তার প্রায়শ্চিত্ত করব। আজ তুমি আমাদের সঙ্গে

খেয়ে যাবে।

আমার খাওয়া হয়ে গেছে।

আমার বিশ্বাস হয় না। আমি মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদকে বলে তাকে দিয়ে তোমায় বকুনি খাওয়াব। বাবাদের জব্দ করতে হলে দাদুদের দরকার। চল তুমি উপরে আমার ঘরে।

তা অসম্ভব।

কসেত্তে হতাশ হয়ে বলল, কিন্তু কেন? কেন তুমি দেখা করার জন্য সবচেয়ে এই নোংরা ঘরটা বেছে নিয়েছ?

প্রথমে কসেত্তেকে তুই ও তুমি বলে সম্বোধন করার পর মাদাম আপনি’ বলে সম্বোধন করতে লাগল ভলজাঁ। বলল, মাদাম জানেন আমি এক অদ্ভুত লোক। এটা আমার অদ্ভুত খেয়াল।

কসেত্তে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, বাহ্ বেশ বেশ। মাদাম আর আপনি এটাও তোমার খেয়াল। কিন্তু এর মানে কী?

ভলজাঁ শুধু নীরবে হৃদয়বিদারক এক সকরুণ হাসি হাসল। তার পর বলল, তুমি মাদাম হতে চেয়েছিলে এবং তা এখন হয়েছ।

কিন্তু সেটা তোমার কাছে নয় বাবা।

তুমি আর আমাকে বাবা বলে ডাকবে না।

কী?

তুমি আমাকে এবার হতে মঁসিয়ে আঁ বা ইচ্ছা করলে শুধু জাঁ বলে ডাকবে।

তুমি বলতে চাও তুমি আর আমার বাবা নও? এরপর তুমি বলবে, আমি আর কসেত্তে নই। এসবের মানে কী? কী হয়েছে? তুমি আমাদের কাছে থাকবে না, আমার ঘরেও আসবে না। এটা তো একটা বিপ্লব। কিন্তু কী দোষ আমি করেছি। নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে।

কিছুই হয়নি।

তা হলে?

যা হওয়া উচিত তাই হচ্ছে।

তুমি তোমার নামটা বদলে দিয়েছ কেন? তোমার নামও পাল্টে গেছে। তুমি যদি এখন মাদাম পঁতমার্সি হও তাহলে আমিও মঁসিয়ে আঁ হতে পারি।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না। এসব ধাঁধার মতো মনে হচ্ছে। আমি মেরিয়াসকে জিজ্ঞাসা করব, ওই নামে তোমায় ডাকব কি না। তুমি আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছ। সব ওলটপালট করে দিচ্ছ। মানুষের খেয়াল থাকা ভালো, কিন্তু সেই খেয়াল দিয়ে অপরের মনে আঘাত দেওয়া উচিত নয়। তুমি একজন দয়ালু প্রকৃতির লোক হয়ে এমন নিষ্ঠুর হওয়া উচিত নয়।

ভলজাঁ কোনও উত্তর দিল না। কসেত্তে ভলজাঁ’র দুটি হাত নিয়ে তার গলার উপর রাখল। বলল, আমার ওপর দয়া করে আমাদের সঙ্গে থাক, আমাদের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া কর। আমার বাবা হও আগের মতো।

ভলজাঁ তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এখন তুমি স্বামী পেয়েছ, আর বাবার কোনও প্রয়োজন নেই তোমার।

কসেত্তে রাগের সঙ্গে বলল, বাবার কোনও প্রয়োজন নেই? এ কী কথা! এ কথার কোনও মানে হয়?

ভলজাঁ বলল, আজ যদি তুসাঁ থাকত তা হলে সে বুঝত আমি খেয়ালি লোক। আমি একা থাকতে ভালোবাসি।

কিন্তু এ ঘরটা ঠাণ্ডা। এখানে ভালো করে বসা বা দেখা যায় না। তোমাকে মঁসিয়ে আঁ বা আপনি বলা আমার মোটেই ভালো লাগে না।

কসেত্তে এবার কৃত্রিম গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলতে লাগল, তুমি আমাকে কিন্তু ভীষণ রাগিয়ে দিচ্ছ। আমি তোমার জন্য এ বাড়িতে চমৎকার একটা ঘরের ব্যবস্থা করলাম, কিন্তু সেখানে তুমি থাকবে না। আমাদের সঙ্গে খাবার ব্যবস্থা করলাম, কিন্তু তুমি খাবে না। আমার বাবা মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত হওয়ার পরিবর্তে তুমি হলে মঁসিয়ে জাঁ এবং মাকড়সার জাল আর বোতলে ভর্তি এই নোংরা ঘরটা বেছে নিলে দেখা করার জন্য। র‍্যু হোমির সেই ঘৃণ্য বাসাতেই তুমি থাকছু। আমার বিরুদ্ধে কী তোমার বলা আছে? তবে তুমি কি আমার সুখে সুখী নও? আমার সুখ দেখে তোমার কি জ্বালা ধরছে, রাগ হচ্ছে?

ভলজাঁ’র মনে হল কসেত্তে যেন ঘামাচি মারতে গিয়ে তার অন্তরটাকে উপড়ে ফেলেছে। ঘা দিয়ে। সে আপন মনে বলল, তার সুখই ছিল আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

এরপর সে বলল, কসেত্তে, তুই এখন সুখী এবং আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে। কসেত্তে আনন্দের আবেগে তার দু হাত দিয়ে ভলজাঁ’র ঘাড়টাকে জড়িয়ে ধরল। তুমি আমাকে তুই বলেছ। কী মজা!

ভলজাঁ এবার কসেত্তে’র হাত দুটো আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়ে মাথায় টুপিটা তুলে নিয়ে বলল, আমি যাচ্ছি মাদাম। আপনাকেও এখন অন্যত্র যেতে হবে। দরজার কাছে। গিয়ে বলল, আমি আপনাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছি। তার জন্য ক্ষমা করবেন। আপনার স্বামীর কাছে কথা দিচ্ছি এরকম ভুল আর হবে না।

এই বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ভলজাঁ। বিস্ময়ে হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কসেত্তে।

.

২.

পরদিন সন্ধের সময়ে সেই একই সময়ে কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করতে এল ভলজাঁ। আজ আর তার অদ্ভুত খেয়াল-খুশি সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন করল না কসেত্তে। সে ভলজাঁকে বাবা বা মঁসিয়ে আঁ–দুটোর কোনওটা বলেই সম্বোধন করল না। ভলজাঁ তাকে মাদাম আর আপনি বলাতেও কোনও আপত্তি তুলঁল না।

গতকাল ভলজাঁর ব্যাপারটা সে মেরিয়াসের কাছে তোলায় মেরিয়াস তাকে সবকিছু মেনে নিতে বলেছে এবং কসেত্তেও হয়তো তাই তার স্বামীর অনুরোধে প্রেমের খাতিরে সবকিছু সহজভাবে মেনে নিয়েছে।

তবে যে ঘরে তারা দেখা করত সেই ঘরখানার চেহারা কিছুটা পাল্টেছে। বাস্ক খালি বোতলগুলো সরিয়েছে আর নিকোলেত্তে মাকড়সার জালগুলো পরিষ্কার করেছে। ভলজাঁ এর পর থেকে রোজ সন্ধ্যাতে আসতে লাগল। তবে সে যখন আসত তখন মেরিয়াস কাজের অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে যেত। কোনওদিন ওই সময় বাড়িতে থাকত না। আইনের কাজে ব্যস্ত থাকত।

ভলজাঁ’র এই সব খেয়াল-খুশির ব্যাপারগুলোকে বাড়ির আর সকলেও সহজভাবে মেনে নেয়। মঁসিয়ে গিলেনমার্দও ধীরে ধীরে ভুলে যান মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তুকে। তিনি তার সম্বন্ধে বলতে থাকেন, লোকটা একবারে খাঁটি গেঁয়ো মানুষের মতো, কোনওরকম ছল-চাতুরি নেই। মার্কুই দ্য কানাপলস্-এর খেয়ালও এর থেকে বাজে ছিল। তিনি এক বিরাট প্রাসাদ কিনে নিজে চিলেকোঠার ছাদের ঘরটায় থাকতেন। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ ধর্মকর্ম নিয়ে থাকত বেশি।

কিন্তু আসল কথা কেউ জানত না। এই ঘটনার আসল পটভূমিকা কী, তা কেউ কিছু জানতে পারেনি। বাতাসে বেগ না থাকলেও জলে এত ঢেউ আসছে কোথা থেকে, তা কেউ বুঝতে পারত না বা তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাত না।

এইভাবে কয়েক সপ্তাহ চলতে লাগল। ভলজাঁ’র এই নতুন জীবনযাত্রা প্রণালী ও আচরণবিধির সঙ্গে দিনে দিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল কসেত্তে। তাছাড়া এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর সময় নেই তার। বাড়ির গৃহিণী হিসেবে দায়দায়িত্ব বেড়েছে তার। তার ওপর সে মেরিয়াসের সঙ্গে একা থাকতে চায় এবং তার সঙ্গে সে বেড়াতে যেতে চায়। একসঙ্গে দু জনে বেড়াতে গিয়ে দু জনেই আনন্দ পায় প্রচুর।

কসেত্তে’র শুধু একটা বিষয়েই বিরক্তিবোধ হয়, তুস এখানে আসার পর থেকে নিকোলেত্তের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছে না। যখন কোনওমতেই তাদের বনিবনাও হল না তখন তুই একদিন চলে গেল এ বাড়ি ছেড়ে।

একদিন কসেত্তে ভলজাঁকে বলল, তুমি আমার বাবা নও, কাকা নও, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত নও, তবে তুমি সত্যি সত্যি কে?

ভলজাঁ বলল, আমি হচ্ছি জাঁ।

কসেতে হেসে বলল, মঁসিয়ে জাঁ।

তা হলে তো আরও ভালো।

.

৩.

কসেত্তেকে রোজ একবার করে দেখতে যায় ভলজাঁ–এইটাই তার পক্ষে যথেষ্ট। এই দেখাটাই তার জীবনের একমাত্র সম্বল। সে কসেত্তের দিকে তাকিয়ে নীরবে বসে থাকবে, কখনও অতীতজীবনের ও ছেলেবেলাকার গল্প করবে, কনভেন্টের বন্ধুদের কথা বলবে–এতেই খুশি সে। আর কিছু চায় না।

এপ্রিল মাসের একদিন বিকালবেলায় মেরিয়াস কসেত্তেকে র‍্যু প্লামেতের সেই বাগানটাতে বেড়াতে নিয়ে গেল, যেখানে তাদের প্রথম আলাপ হয়। যেহেতু জাঁ ভলজাঁ সেটাকে লিজ হিসেবে নিয়েছিল সেইহেতু সেটা কসেত্তের সম্পত্তিতেই পরিণত হয়েছিল।

সেখানে গিয়ে আর সব কথা ভুলে গেল। সন্ধে হয়ে গেলেও বাড়ি ফিরল না। ভলজাঁ কসেন্তের সঙ্গে দেখা করতে এসে অনেকক্ষণ বসে থাকার পর হতাশ হয়ে চলে গেল।

পরদিন সন্ধ্যায় এসে ভলজাঁ ওদের র‍্যু প্লামেতের বাগানে বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে কসেত্তেকে জিজ্ঞাসা করল, ওখানে কিসে করে গেলে?

পায়ে হেঁটে।

এলে কী করে?

গাড়িতে।

ভলজাঁ কদিন ধরে কতকগুলি বিষয়ে মেরিয়াসের কার্পণ্য আর অত্যধিক মিতব্যয়িতার পরিচয় পেয়ে বিচলিত হয়ে ওঠে মনে মনে। সে কসেত্তেকে জিজ্ঞাসা করল, তোমরা একটা গাড়ি কেন না কেন? তাতে হয়তো তোমাদের পাঁচশো া করে বাড়তি খরচ হবে। কিন্তু এ টাকাটা তোমরা সহজেই খরচ করতে পার।

কসেত্তে বলল, আমি জানি না।

ভলজাঁ বলল, তার পর তুসাঁ চলে গেছে, তার পরিবর্তে অন্য কোনও মেয়েলোক রাখা হয়নি কেন?

নিকোলেত্তেই যথেষ্ট।

কিন্তু তোমার নিজের জন্য একজন দাসী দরকার।

আমার মেরিয়াস আছে।

তোমাদের দু জনের একটা নিজস্ব আলাদা বাড়িরও দরকার। তাতে তোমাদের নিজস্ব দাসদাসী থাকবে, গাড়ি থাকবে, থিয়েটারে বা অপেরাতে তোমাদের জন্য বক্সের ব্যবস্থা থাকবে। যে সম্পদ মানুষের সুখকে বাড়িয়ে দেয় সে সম্পদ তোমাদের থাকা সত্ত্বেও তার সুযোগ নিচ্ছ না কেন?

কসেত্তে কোনও উত্তর দিল না।

আজকাল সন্ধের সময় কসেত্তেকে দেখতে এসে ভলজাঁ তাড়াতাড়ি চলে যেত না। আজকাল সে অনেকক্ষণ ধরে থাকতে লাগল। দিনে দিনে তার থাকার সময় বেড়ে যেতে লাগল। বেশিক্ষণ কাটাবার জন্য সে কসেত্তে’র কাছে মেরিয়াসের প্রশংসা করে কসেত্তেকে খুশি করার চেষ্টা করত।

এক-একদিন রাত এত বেড়ে যেত যে বাস্ক এসে কসেত্তেকে বলতে বাধ্য হত, মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে বলেছেন যে খাবার দেওয়া হয়েছে।

এই সব দিনে ভলজাঁ বাড়ি ফেরার সময় ভাবত, বেশি রাত করার জন্য মেরিয়াস হয়তো রাগ করবে তার ওপর।

একদিন সবচেয়ে বেশি রাত হল।

পরদিন ভলজাঁ এসেই দেখল ঘরে আগুন জ্বালানো নেই। কসেত্তে এসে বলল, আগুন থাকলে ঠাণ্ডায় বসা যায়? বাস্ক আগুন জ্বালায়নি কেন?

ভলজাঁ বলল, এখন এপ্রিল মাস। আমার মতে আগুনের দরকার নেই।

এটাও তোমার একটা খেয়াল।

অথচ ভলজাঁ জানত কেন সে ঘরে আগুন জ্বালানো হয়নি।

পরের দিন ভলজাঁ এসে দেখল ঘরের মধ্যে আর্মচেয়ার দুটো যেখানে থাকত সেখানে নেই, ঘরের এককোণে জড়ো করা আছে।

কসেত্তে এসে চেঁচামেচি করতে ভলজাঁ নিজে চেয়ার দুটো যথাস্থানে নিয়ে এল। তবে সেদিন আগুন জ্বালা ছিল ঘরে।

যাবার জন্য ভলজাঁ উঠে দাঁড়ালে কসেত্তে বলল, আজ আমার স্বামী আমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলল। বলল, আমাদের দু জনের মোট বার্ষিক আয় মাত্র তিরিশ হাজার লিভার। তাতেই চালাতে পারবে তো? একথা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে আমি বললাম, একথা বলছ কেন? সে তখন বলল, আমি এমনি জানতে চাইছিলাম, পারবে কি না।

সে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কোনও কথা খুঁজে পেল না ভলজাঁ। সে রাতে ভলজাঁর মনটা এমন চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল যে সে তার বাসায় না গিয়ে ভুল করে অন্য এক বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। কয়েকটা সিঁড়ি ওঠার পর তার হুঁশ হল। ভলজাঁ’র মনে হল যে ছয় লক্ষ ফ্রাঁ সে যৌতুক হিসেবে তাদের দিয়েছে তার উৎস সম্বন্ধে সন্দেহ জেগেছে মেরিয়াসের মনে। সে হয়তো ভেবেছে টাকাটা আসলে ভলজাঁর এবং সে কোনও অসদুপায়ে সগ্রহ করেছে। তাই সে সে-টাকায় হাত না দিয়ে কষ্ট করে সংসার চালাতে চায় কসেত্তেকে নিয়ে।

পরদিন সন্ধ্যায় কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করতে গেলে তার সন্দেহটা আরও জোরালো হল। সে দেখল তাদের বসার ঘরে আর্মচেয়ার দুটো নেই। সেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

কসেত্তে এসে চেঁচামেচি করতে লাগল। বলল, এর মানে কী?

ভলজাঁ বলল, আমি বাস্ককে তা নিয়ে যেতে বলেছি। হয়তো তার দরকার আছে অন্য ঘরে সেগুলো রাখার।

কিন্তু কেন?

হয়তো বাইরে থেকে কোনও অতিথি আসবে।

না, কোনও অতিথি আসার তো কথা নেই। কিন্তু কী করে বসব আমরা?

ভলজাঁ বলল, আমরা দু মিনিট দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি।

কসেত্তে বলল, তুমি চেয়ার দুটো বাস্ককে নিয়ে যেতে বলেছ, একদিন আগুন জ্বালাতে বারণ করেছিলে। সত্যিই তুমি অদ্ভুত লোক।

ভলজাঁ বলল, বিদায়।

এক গভীর দুঃখ আর হতাশা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে বাড়ি থেকে। আসলে কী ঘটেছে তার বুঝতে কিছু বাকি রইল না তার।

পরের দিন সন্ধ্যায় ভলজাঁ আর এল না কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করতে। তার আসার সময় একেবারে পার হয়ে গেলে তার কথাটা মনে করে তুলঁতে যাচ্ছিল। কিন্তু এমন সময়ে মেরিয়াস এসে তাকে চুম্বন করতে সে সব ভুলে গেল।

পরের দিন সন্ধ্যাতে এল না ভলজাঁ।

তার পরদিন সকালে কসেত্তে নিকোলেত্তেকে ভলজাঁ’র শরীর খারাপ হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য তার র‍্যু হোমির বাসায় পাঠাল। নিকোলেত্তে ফিরে এসে জানাল, মঁসিয়ে জা’র শরীর ভালোই আছে। তবে তিনি বাইরে কোথায় যাবেন বলে কয়েকদিন আসতে পারবেন না। বাইরে থেকে ফিরে এসে তিনি দেখা করবেন মাদামের সঙ্গে।

.

৪.

ভলজাঁ কিন্তু কোথাও যায়নি। সে তার বাসাতেই ছিল। পরদিন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠতেই লে হোমি’র বাসা ছেড়ে সে বিষণ্ণভাবে পথ হাঁটতে হাঁটতে সেন্ট লুই-এর দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। সেন্ট লুই থেকে র‍্যু কালভেরির মেরিয়াসদের বাড়িটা দূর থেকে দেখতে লাগল। বাড়িটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তরে একটা সুখের অনুভূতি জাগছিল। তার ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। যেন সে কোনও অদৃশ্য মানুষের সঙ্গে অশ্রুত ধ্বনিতে নীরব ভাষায় কথা বলছে। খুব ধীর পায়ে সে এগিয়ে যাচ্ছিল বাড়িটার দিকে। বাড়িটার কাছে এসে এমন বিষাদগ্রস্ত হয়ে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকাতে লাগল সেদিকে যেন মনে হবে এক নিষিদ্ধ স্বর্গরাজ্যে এসে পৌঁছলেও সেখানে সে ঢুকতে পারবে না। এই সময় তার চোখে যে জল এসেছিল তার ফোঁটাটা বড় হতে হতে তার গাল বেয়ে ঝরে পড়ল এবং তা ঠোঁটের উপর আসায় তার তিক্ততাটা আস্বাদ করতে পারল।

এক পাথরের মূর্তির মতো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে এল সে। যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথেই সে বাসায় ফিরে গেল শূন্য মনে।

এর পর থেকে রোজ একবার করে সে সন্ধ্যার সময় বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু ক্রমেই সে তার সান্ধ্যভ্রমণের পরিধিটা কমিয়ে আনতে লাগল। দ্বিতীয় দিন সে সেন্ট লুই থেকে র‍্যু কালভেরির বাড়িটা দেখেই ফিরে এল, তার কাছে আর গেল না। তার পরদিন সে সেন্ট লুই পর্যন্ত গেল না। র‍্যু পেভি থেকেই ফিরে এল। তার পরদিন সে ফিরে এল র‍্যু হয় পেভিলন থেকে। তার পরদিন র‍্যু দে লা মতো থেকেই ফিরে এল। দম ফুরিয়ে আসা ঘড়ির দোলকের মতো তার গতি ক্রমশই স্তিমিত হয়ে আসছিল। তার চোখে আর কোনও আশার আলো ছিল না, চোখে আর জলও আসত না।

আবহাওয়া মেঘলা থাকলে বা বৃষ্টি পড়লে সঙ্গে একটা ছাতা নিত সে। কিন্তু সে ছাতা সে খুলত না। তা হাতেই থাকত।

আশপাশের বাড়িগুলোর মেয়েরা তাকে দেখে বলাবলি করত, লোকটি বড় সাদাসিধে। কিন্তু বাচ্চা ছেলেরা তাকে আধপাগলা ভেবে হাসাহাসি করত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *