প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৫.৫ মেরিয়াস আর কসেত্তে’র বিবাহ উৎসব

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

১৮৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে আবহাওয়াটা ছিল মোটামুটি ভালো। রাত্রিতে অন্ধকার থাকলেও আকাশটা ছিল পরিষ্কার। এই রাত্রিতেই মেরিয়াস আর কসেত্তে’র বিবাহ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সারাদিন মাঝে মাঝে একপশলা করে বৃষ্টি হলেও পরক্ষণেই পরিষ্কার হয়ে যেত আকাশটা।

বিয়ের দিনকতক আগে ছোটখাটো এক পথদুর্ঘটনায় জাঁ ভলজাঁ’র ডান হাতের বুড়ো আঙুলে চোট লাগে। আঘাতটা খুব বেশি না হলেও ডান হাতটা তার গলার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখতে হয়। তার হয়ে তার অনুমতি নিয়ে বিয়ের কাগজপত্রে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ স্বাক্ষর করেন। বিয়ের কথাটা যেদিন স্থির হয় সেদিন যে টাকাটা ভলজাঁ মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কাছে রাখতে দিয়েছিল, বিয়ের আগের দিন সে টাকাটা সে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের সামনে মেরিয়াসের হাতে তুলে দেয়।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ইচ্ছানুসারে বিয়ের উৎসবটা হবে মার্দিগ্রাস’ ধরনের। তখনকার দিনে ফ্রান্সে অভিজাত সমাজে এই ধরনের বিবাহোৎসবই অনুষ্ঠিত হত।

অনেকগুলো গাড়িসহ বিয়ের শোভাযাত্রা র‍্যু দে কালভেরির বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেন্ট পল চার্চের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। প্রথম গাড়িতে ছিল কসেত্তে, ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ, মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আর জাঁ ভলজাঁ। দ্বিতীয় গাড়িতে ছিল মেরিয়াস। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বহু আত্মীয়-কুটুম্ব নিমন্ত্রিত হয়। তাদের নিয়ে অনেক গাড়ি শোভাযাত্রায় যোগদান করে। দেখা গেল গাড়ির লাইন ম্যাদলেন থেকে বাস্তিল পর্যন্ত চলে গেছে। কতকগুলি ভোলা গাড়িতে মুখোশধারী ছেলেমেয়েরা নানা অঙ্গভঙ্গিসহকারে নাচছিল। কুৎসিত নাচের মধ্য দিয়ে সমাজের অনেক দুর্নীতিকে দেখাচ্ছিল তারা। কুৎসিত হলেও তা দেখে রাস্তার দু পাশে ভিড় করে থাকা দর্শকরা হাসাহাসি করছিল। শোভাযাত্রা চলাকালে একসময় থেনার্দিয়েরের ছোট মেয়ে আজেলমা শীতে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তার ধার থেকে একজন যুবককে প্রথম গাড়িতে বসে থাকা ভলজাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ওই ভদ্রলোককে চেন?

যুবকটি বলল, না, তুমি চেন?

আজেলমা বলল, কোথায় দেখেছি মনে হচ্ছে। মনে হয় ওই মেয়ের বাবা। শোভাযাত্রা কোথায় যায় এবং কোন বাড়িতে ফিরে আসে তা অনুসরণ করে দেখ।

যুবক বলল, তাতে লাভ কী?

পরে কাজে লাগতে পারে। ওরা ধনী লোক।

তুমি দেখ না কেন!

আমি রাস্তায় বার হলেই পুলিশ ধরবে।

আমাকেও ধরবে।

সব মানুষের স্বপ্ন কখনও সফল হয় না। মানুষের স্বপ্নপূরণের ব্যাপার নিয়ে স্বর্গে হয়তো দেবদূতদের মধ্যে ভোট হয়। সেই ভোটে কসেত্তে আর মেরিয়াস জয়লাভ করে। তাদের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হয়।

বিয়ের আনুষ্ঠানিক সব কাজকর্ম সেন্ট পল চার্চে ঠিকমতো সম্পন্ন হল। কসেত্তেকে জমকালো পোশাক পরিয়ে তুসাঁ সাজিয়ে দিয়েছিল। এবার থেকে কসেত্তের খাস ঝি হিসেবে তুসাঁ তার কাছেই থাকবে। ভলজাঁ ঠিক করে দিয়েছে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার বাড়িতে ভলজাঁর জন্য একটা ঘর নির্দিষ্ট করে রেখে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর সে সেখানেই থাকবে এবং এতে সে রাজি হয়েছে।

তুসাঁ আর নিকোলেত্তে দু জনে মিলে সাজিয়েছে কসেত্তেকে। দুধের মতো ঝকঝকে সাদা পোশাক, গলায় মুক্তোর হার, মাথায় কমলালেবু রঙের মুকুট। তাকে দেবীর মতো মনে হচ্ছিল। মেরিয়াসের পরনে ছিল কালো পোশাক। তার মাথার সুন্দর চুলগুলোতে সুবাস মাখানো হয়েছিল। কপালে দু-একটা ক্ষতের দাগ তখনও দেখা যাচ্ছিল।

চার্চের অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলে মেরিয়াস আর কসেত্তে একটি গাড়িতে সামনের সিটে পাশাপাশি বসল। তাদের পেছনের সিটে বসলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আর জাঁ ভলজাঁ। কসেত্তে এক সময় মেরিয়াসের কাঁধের উপর ঝুঁকে বলল, আজ থেকে তোমার নাম আমার নাম এক হয়ে গেল। আমি হব মাদাম তুমি।

অতীতে তারা একসময় দারুণ দুঃখকষ্ট পেয়েছে বলে আজকের সুখটাকে অনেক বড় অনেক মধুর বলে মনে হল তাদের। কসেত্তে আরও চুপি চুপি বলল, আমরা কিন্তু র‍্যু প্লামেতের বাগানে একবার যাব।

র‍্যু কালভেরির বাড়িতে ফিরে এল তারা। বাড়ির সদর দরজার কাছে অনেক ভিখারি ও গরিবদুঃখী জড়ো হয়েছে। তাদের সবাইকে ভিক্ষা দেওয়া হচ্ছিল।

বর-কনে বাড়ির ভেতরে ঢুকলে নিমন্ত্রিত অতিথিরা বসার ঘরে বসল। ভোজসভার ঘরে তখন খাবার দেওয়া হচ্ছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আত্মীয় হিসেবে ক্যাপ্টেন থিওদুলও ছিল। সে কিন্তু কসেত্তেকে দেখে চিনতে পারেনি। অনেক মেয়েকে সে ভালোবাসায় কোনও বিশেষ মেয়ের প্রতি কোনও আসক্তি দানা বাঁধে না তার মনে এবং বিশেষ কোনও মেয়ের কথা মনেও রাখে না সে।

জাঁ ভলজাঁ ঘরের এক কোণে একটি টেবিলের ধারে বসে ছিল। কসেত্তে এ সময় তার কাছে গিয়ে বলল, বাবা তুমি খুশি তো?

হ্যাঁ মা, খুব খুশি।

তবে হাসছ না কেন?

এই তো হাসছি।

এরপরই বাস্ক অতিথিদের ডাকল। বলল, খাবার ঘরে আসুন।

ভোজসভায় কসেত্তে’র চেয়ারের দু পাশে দুটি আর্মচেয়ার রাখা হয়েছে। তার একটি মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের জন্য আর একটি জাঁ ভলজাঁর জন্য। কিন্তু মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত ঘরের মধ্যে কোথাও নেই। বাস্ককে জিজ্ঞাসা করা হল, সে কিছু জানে কি না।

বাস্ক বলল, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত তার হাতে যন্ত্রণা হচ্ছে বলে কোথায় চলে গেছেন। বলে গেছেন আগামীকাল সকালে আসবেন।

ব্যাপারটাকে সহজভাবে নিলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। তিনি বললেন, যন্ত্রণা হওয়ার জন্য ভোজসভা থেকে সরে গিয়ে ভালোই করেছেন মঁসিয়ে ফশেলেভেস্ত। অতিথিরাও সহজভাবে নিল ব্যাপারটাকে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের খালি চেয়ারটায় যদিও মেরিয়াসের মাসির বসার অধিকার, তথাপি মেরিয়াস তাতে বসবে। কারণ তার মাসি এসব পছন্দ করে না।

মেরিয়াস সে চেয়ারটাতে বসাতে সবাই খুশি হল। বিশেষ করে ভলজাঁর অনুপস্থিতিতে কসেত্তে’র মনটা খারাপ হয়ে যায়, মেরিয়াস তার কাছাকাছি বসাতে সে খুশি হল। মেরিয়াস কাছে থাকলে এমনকি ঈশ্বরের অনুপস্থিতিকেও সহ্য করবে সে এবং তার দুঃখের কিছু থাকবে না।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ উঠে দাঁড়িয়ে একটা মদের গ্লাস হাতে করে বর-বধূর স্বাস্থ্যপান করলেন। তিনি বর-বধূকে উদ্দেশ করে বলতে লাগলেন, তোমরা সুখী হও। এ বিষয়ে দার্শনিকদের কথা শুনবে না। তাঁরা বলেন, আনন্দ উৎসবের ব্যাপারে মধ্যপন্থী হবে, সংযতভাবে আনন্দ করবে। কিন্তু আমি বলি আনন্দে মত্ত হয়ে উঠবে। দার্শনিকেরা নিপাত যাক! তাদের বাজে কথায় কান দেবে না। আমরা কি ভালোর জন্য, মঙ্গলের জন্য খুশি হই নাকি সুখের জন্যই ভালো হই? জীবন এই সব ধাঁধার মতো প্রশ্নে ভরা। আমরা তার উত্তর জানি না। আমরা শুধু অন্ধ উপাসকের মতো সুখরূপ সূর্যের সাধনা করে যাব। প্রেমই হল এই সুখের সূর্য আর প্রেম মানেই নারী। নারী ছাড়া ভালোবাসার কোনও অর্থ হয় না। প্রেম-ভালোবাসার ক্ষেত্রে নারীই সর্বশক্তিময়ী। আজ মেরিয়াসের মতো বিপ্লবী যুবক কসেত্তে’র কাছে দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ এবং আনন্দের সঙ্গে দাসত্বকে মেনে নিয়েছে। তোমরা রোবোসপিয়াসের কথা বলতে পার, কিন্তু আসলে নারীই শাসন করে। রাজশক্তির বলে যদি কোনও জিনিস থাকে তো আসলে নারীই হল সে শক্তি। ঈভ ছাড়া আদমের অর্থ হয় না, কারণ ঈভের দ্বারাই আদম চালিত হয়। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অনেক বিপ্লব হয়েছে, কিন্তু নারীদের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে, একটি সুবাসিত রুমালের বিরুদ্ধে কখনও বিপ্লব হয়েছে? বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে পৃথিবীতে অনেক কিছুর আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু ভালোবাসাবাসির ব্যাপার থেকে পরিত্রাণের কোনও পথ আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পেরেছে মানুষ? কোনও পথ নেই। নারীকে ভালোবেসেই যেতে হবে। প্রেমময় চুম্বন ও আলিঙ্গনের ঐন্দ্রজালিক বৃত্তবলয় থেকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারবে না কখনও। আমি তো পারলে আবার সেই বৃত্তের মধ্যেই ঢুকব। তোমরা সবাই আকাশে শুকতারাকে উঠতে দেখলেই আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠ। এই শুক্রগ্রহ হল প্রেমের প্রতীক। তেমনি কোনও সময় আমরা যতই আমাদের ক্রোধাবেগের প্রচণ্ডতায় ফেটে পড়ি না কেন সুন্দরী নারী একবার আমাদের সামনে এলেই নতজানু হয়ে পড়ি। প্রেম হচ্ছে এমনই এক বৃদ্ধশিশু যার বয়স হল দু হাজার বছর। এই প্রেমের সুতো দিয়েই চিরকাল ধরে এক মধুর ইন্দ্রজাল রচনা করে আসছে মানুষের যৌবন। সৃষ্টির আদিকাল থেকে পৃথিবীর সব নরনারী এই প্রেমের এক অঘোষিত চুক্তিতে আবদ্ধ। শয়তান পৃথিবীর যত ক্ষতি করেছে প্রেম তার থেকে অনেক মঙ্গল সাধনা করেছে। এই প্রেম চিরপুরাতন হয়েও চিরনতুন। সুতরাং ভালোবেসে যাও, প্রেমের সদ্ব্যবহার কর। কসেত্তে হবে মেরিয়াসের সূর্য, যাকে প্রদক্ষিণ করে যাবে তার জীবন আর মেরিয়াস হবে কসেত্তে’র পৃথিবী। ভালোবাসাবাসি বাপারটাই হল সূর্য ও পৃথিবীর খেলা। সে খেলায় একজন একজনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হবে, একজন একজনকে প্রদক্ষিণ করে যাবেই। প্রেমই হবে স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম। আপন আপন স্ত্রীকে ভালোবেসে যাওয়াই হল ঈশ্বরোপাসনার শ্রেষ্ঠ উপায়। সুন্দরী এবং সুখী স্ত্রীই হল স্বামীর কাছে সবচেয়ে আনন্দের বস্তু। প্রেম ছাড়া বসন্তের দাম কোথায়? সুন্দরী নারী আছে বলেই ফুল, পাখি, আলো, হাওয়া প্রভৃতি পৃথিবীর সব সুন্দর জিনিস এত অর্থময়।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ হলে নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড় শুরু হল। কিন্তু হঠাৎ বরবধূ ঘর থেকে চলে যাওয়ায় সব আনন্দোৎসব স্তব্ধ হয়ে গেল।

বর-বধূ একটি রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করল। একটি রুদ্ধদ্বার ঘরের মধ্যে যখন প্রেমিক-প্রেমিকার দুটি দেহ দুটি আত্মা বিগলিত হয়ে মিলে মিশে এক হয়ে গেল তখন হয়তো বাইরের রাত্রির অন্ধকার কিছুটা কেঁপে উঠল। এক পবিত্র প্রেমে উৎসর্গীকৃত দুটি মুখ যখন পরস্পরের কাছে সরে এসে এক নিবিড় চুম্বনে আবদ্ধ হয়ে সৃষ্টিযজ্ঞে মেতে ওঠে তখন তাদের সেই অমৃতনিষ্যন্দী চুম্বনের অশ্রুত ধ্বনিতে আকাশের তারারা কেঁপে উঠবে না তা কি হয়? প্রেমের এই সুখ ছাড়া জীবনের আর সব কিছুই দুঃখময়, ছায়াময় ও অশ্রুসজল।

.

২.

কিন্তু জাঁ ভলজাঁ কোথায় গেল?

কসেত্তে’র অনুরোধে একটুখানি হাসার পর ভলক্স উঠে পাশের ঘরে চলে যায়। আট মাস আগে সে এই ঘরেই প্রথম মেরিয়াসকে অচেতন অবস্থায় দিয়ে যায়। সে ঘরে তখন বাস্ক ভোজসভার জন্য ফুলের তোড়া তৈরি করছিল। তার চলে যাবার কথা সে বাস্ককে বলে ঘরে থেকে বেরিয়ে যায়।

বাইরে গিয়ে ভোজসভার ঘরের জানালার তলায় একবার দাঁড়াল সে। ভোজসভার ঘরে তখন বেহালা বাজছিল। অতিথিরা হাসিঠাট্টা ও হৈ-হল্লোড় করছিল। সকলের গলা ছাপিয়ে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কথা শোনা যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে কসেত্তে’র দু-একটা কথা শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ তা শোনার পর কালভেরির বাড়ি ছেড়ে র‍্যু হোমি আর্মের বাড়িতে চলে যায় ভলজাঁ।

র‍্যু সেন্ট লুই ও ব্যাক্স মাতোর পথটা দূর হলেও এই পথেই সে কসেত্তেকে নিয়ে আসা-যাওয়া করত, তাই সেই পথেই গেল সে। তার বাসায় গিয়ে প্রথমে বাতি জ্বালিয়ে উপরতলার ঘরে চলে গেল। সব ঘর খালি। তুসাঁ নেই। তুর্সা ও কসেত্তে’র বিছানাগুলো গোটানো আছে। সব আলমারিগুলো খালি। সেগুলো খোলা ছিল। ভলজাঁ সেগুলো বন্ধ করে দিল। ঘরগুলোতে শুধু কিছু আসবাবপত্র আছে আর আছে শূন্য দেয়ালগুলো। ফাঁকা ঘরগুলো একবার ঘুরে-ফিরে দেখে অবশেষে সে তার নিজের ঘরে এসে জ্বলন্ত বাতিটা তার টেবিলের উপর রাখল। তার যে ডান হাতটা বাঁধা অবস্থায় ঝোলানো ছিল সে হাতের বাঁধনটা খুলে দিয়ে হাতটা মুক্ত করে দিল। দেখল হাতে কোনও ব্যথা নেই।

সে এবার তার বিছানায় গিয়ে বসল। হঠাৎ তার কসেত্তে’র সেই কালো বাক্সটার উপর চোখ পড়ল। এই বাক্সটা কসেত্তে সব সময় নিজের বিছানার কাছে রাখত। কনভেন্ট থেকে র‍্যু প্লমেতের বাড়িতে, তার পর সেখান থেকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে। কসেত্তে’র বিছানার কাছে একটা টুলের উপর রাখা ছিল বাক্সটা।

বাক্সটা খুলে কসেত্তে’র অতীতের পুরনো পোশাকগুলো বার করল। এ পোশাকগুলো হচ্ছে সেই কালো পোশাক যে পোশাক সে তার জন্য কিনে মঁতফারমেলে থেনার্দিয়েরদের হোটেলে নিয়ে যায়। কারণ সে তখন ভেবেছিল শোকসূচক এই কালো পোশাক কসেত্তে পরলে তার মা’র মৃত আত্মা খুশি হবে। সেদিন ছিল ডিসেম্বরের এক ঠাণ্ডা রাত্রি। একে একে সেদিনের সব কথা মনে পড়ল তার। সে রাতে মঁতফারমেল বনের মধ্য দিয়ে তারা দু জনের নিঃশব্দে পথ হেঁটেছিল। পাতাঝরা গাছগুলোর মধ্যে দিয়ে অন্ধকারে যখন তারা গাঁয়ের দিকে এগিয়ে আসছিল তখন বনে কোনও পাখি ছিল না, আকাশে কোনও তারার আলো ছিল না।

কসেত্তে’র সেই ছেলেবেলার পোশাকগুলো তার বিছানার উপর ছড়িয়ে রাখল। কসেত্তে তখন এই পোশাক পরে সেই বড় পুতুলটা হাতে নিয়ে হোটেল থেকে চলে গিয়েছিল তার সঙ্গে। সেদিন কসেত্তে তার কাছে ছিল বলে কত আনন্দে ছিল। কোনও দুঃখ বলে মনে হয়নি তার।

কসেত্তে’র একটা জামার মধ্যে মুখটা খুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ভলজাঁ। তখন যদি সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাইরে কোনও লোক ভলজাঁ’র ঘরের সামনে এসে দাঁড়াত তা হলে সে তাকে এইভাবে শিশুর মতো কাঁদতে দেখতে পেত।

ভলজাঁ’র মনের মধ্যে আবার সেই ভয়ঙ্কর সগ্রাম শুরু হল। দেবদূতের সঙ্গে জ্যাকবের সগ্রাম মাত্র একদিন স্থায়ী হয়। কিন্তু আপন বিবেকের সঙ্গে ভলজাঁ’র সংগ্রামের অন্ত নেই। কখনও তার জীবনের পথে চলতে চলতে পা পিছলে গেছে, কখনও বা পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। তার বিবেক কত দৃঢ়তার সঙ্গে কতবার সংগ্রাম করেছে তার সঙ্গে। কত নির্মম সত্যের উপলব্ধি এক-একটা ভারী বোঝার মতো তার বুকের উপর এসে চাপিয়ে দিয়েছে। কতবার সে বিশপের দেওয়া বাতিটার সামনে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, তার বিদ্রোহী আত্মা সহজ-সরল কর্তব্যজ্ঞানের চাপে নিষ্পেষিত হতে হতে কতবার বেদনায় আর্তনাদ করেছে। আত্ম-আরোপিত আঘাতে কতবার হৃদয়ে রক্ত ঝরেছে তার, যার কথা সে ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। এই নীরব অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অদৃশ্য সংগ্রামের সব দুঃখ ঝেড়ে ফেলে আবার শান্তিতে এগিয়ে গেছে সে তার জীবনের পথে।

কিন্তু আজ রাত্রিতে ভুল’র মনে হল তার অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে। আজ এক বিরাট প্রশ্ন দেখা দিল তার মনে। সে বুঝল মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য আগে থেকে ঠিক করলেও সে লক্ষ্যে সে সোজা সরাসরি পৌঁছতে পারে না; অনেক বাধাবিপত্তি আসার ফলে ঘুরে ঘুরে তাকে যেতে হয় সে পথে। সে লক্ষ করেছে, যখনি তার জীবনে কোনও সংকট উপস্থিত হয়েছে তখনি তার সামনে দুটো পথ বিস্তৃত হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা পথ তাকে আলোকিত করেছে আর একটা পথ তাকে ভীত করে তুলেছে।

এবার প্রশ্নটা হল এই যে, সে কি কসেত্তে আর মেরিয়াসের নববিবাহিত জীবনের সঙ্গে তার জীবনকে মিলিয়ে নিয়ে তাদের সুখে সুখী হবে? কসেত্তে আজ অন্য একজনের স্ত্রী হলেও তাকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করে। ভলজাঁ ভাবল, সে কি তার অতীতজীবনের কোনও কথা না বলে আইনের অশুভ ছায়াটাকে দূরে সরিয়ে রেখে সেই শ্রদ্ধা লাভ করে যাবে? সে ভাবল মানুষের আত্মার পরিবর্তন হয়, ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না কেন? তার নিষ্করুণ নিয়তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সব দিকগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। যদি সে কসেত্তে’র কাছাকাছি থেকে তার জীবনে জড়িয়ে থাকে তা হলে সে নিরাপদ, কিন্তু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তা হলে আবার তাকে এক শূন্য গহ্বরে গিয়ে পড়তে হবে।

এ প্রশ্নের সমাধান আপাতত করতে না পারলেও অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদার পর কিছুটা স্বস্তি পেল সে। কিছুটা শান্ত হয়ে উঠল সে। তার মনে হল, মানুষের বিবেক যেন এক এক সময় এক অতল অন্তহীন খাদের মতো মানুষের সব কিছুকে গ্রাস করতে আসে। সে খাদের মধ্যে বিবেকের দংশনে মানুষকে তার সারাজীবনের শ্রম, স্বাধীনতা, সুখ, শান্তি–সব কিছু এমনকি তার অন্তরটাকে ফেলে দিতে হয়। বস্তুজগতে সব বস্তুর মধ্যে গতি থাকলেও সে গতি নানারকমের বাইরের শক্তি ও বাধার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বস্তুর গতি যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তা হলে আত্মার গতি নিয়ন্ত্রিত হবে না কেন? কোনও গতিই যখন চিরন্তন নয়, তখন কোনও বিশেষ নীতির প্রতি আত্মার গতি বা আসক্তিই-বা চিরন্তন হবে কেন? কসেত্তে’র বিয়ে আর শ্যাম্প ম্যাথিউ’র ব্যাপারটা–এই দুটো ঘটনার মধ্যে পার্থক্য কী? জেলে যাওয়া আর নরকের প্রান্তভাগে যাওয়া এই দুই-এর মধ্যেই-বা পার্থক্য কী?

ভলজাঁ ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত ও আগের থেকে শান্ত হয়ে ঠিক করল আজ তাকে দুটো পথের মধ্যে একটাকে বেছে নিতেই হবে। আজ তাকে হয় সুখী নবদম্পতির ওপর তার অতীত ঘৃণ্য কয়েদিজীবনের সব তথ্যপুঞ্জের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে তাদের অনাবিল সুখের মাঝে দুঃখের ছায়া নিয়ে আসতে হবে অথবা তার আত্মাকে হারাতে হবে। হয় কসেত্তেকে তাগ করতে হবে অথবা নিজের আত্মাকে ত্যাগ করতে হবে।

সারারাত ধরে এইভাবে বিছানার উপর ঝুঁকে মুখ গুঁজে হাত দুটো টান করে ছড়িয়ে ভেবে যেতে লাগল সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে ক্রুশ থেকে নামানো হয়েছে। কিন্তু বাইরে তাকে মড়ার মতো মনে হলেও তার মাথার মধ্যে তখন চলছিল চিন্তার এক অবিরাম অবিচ্ছিন্ন আলোড়ন।

অবশেষে ভোরের দিকে এক সময় উঠে বসে কসেত্তে’র পোশাকগুলো তার ঠোঁটের উপর চেপে ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *