প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৫.১ প্যারিসে বিপ্লব ও পথযুদ্ধ

পঞ্চম খণ্ড প্রথম পরিচ্ছেদ

১.

প্যারিসে অনেকবার অনেক বিপ্লব ও পথযুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু সে বিপ্লব ও পথযুদ্ধের ইতিহাসে ১৮৪৮ সালের বিপ্লব ও পথযুদ্ধ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। সেই পথযুদ্ধটিতে পথে পথে বিপ্লবীদের দ্বারা যে সব ব্যারিকেড ও ঘাঁটি রচিত হয় তার মধ্যে ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনে আর ফবুর্গ দ্য তেম্পলের দুটি ঘাটি মনে রাখার মতো।

তার মধ্যে আবার ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনে ব্যারিকেড ছিল অপেক্ষাকৃত অনেক বড়। তার উচ্চতা ছিল তিনতলার মতো আর তার দৈর্ঘ্য ছিল সাতশো ফুট। ফবুর্গে যে তিনটি বড় রাস্তা এসে মিলিত হয় সেই তেমাথার মুখের সমস্ত জায়গা জুড়ে এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সে ব্যারিকেড। তিনটি ছ তলা বাড়ি ভেঙে তার যত কিছু লোহার গ্রিল, কাঁচ, কাঠ, কড়ি, বরগা, আসবাবপত্র সব ব্যবহার করা হয়েছিল এই ব্যারিকেড রচনার জন্য। প্যারিস শহরের বিভিন্ন পথের মোড়ে আরও উনিশটা ব্যারিকেড গড়ে তোলা হয়। কিন্তু সেগুলো ছিল ছোট এর থেকে। ফবুর্গ সেন্ট আঁতোনের ব্যারিকেড দেখার সঙ্গে সঙ্গে ভয় জাগত যে কোনও দর্শকের মনে। স্বর্গের অলিম্পাস পর্বতের মতো সেই ব্যারিকেডটা দেখে মনে হত কামানের গোলা পর্যন্ত সেটা ভেদ করতে পারবে না।

একটা বিরাট আকারের লাল পতাকা উড়ছিল ব্যারিকেডটার উপর। এই ব্যারিকেড রক্ষার জন্য বিপ্লবীদের যখন সরকারি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হত তখন বহু মৃতদেহ সেই ব্যারিকেডের উপর পড়ে থাকত। তার আশপাশে একদল বিপ্লবী জনতা বন্দুক, লাঠি, তরবারি, ছোরা প্রভৃতি অস্ত্র নিয়ে প্রতিরক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকত। বিদ্রোহী জনতার বিক্ষুব্ধ ধ্বনিতে মুখরিত সেই বিশাল ব্যারিকেডের উপর বিপ্লবের আত্মা যেন এক রক্তাক্ত ছায়া বিস্তার করেছিল। কিন্তু এ বিপ্লব কিসের জন্য? এ বিপ্লব ছিল জনগণের সার্বভৌমত্ব, অবাধ গণভোট, প্রজাতন্ত্র ও কতকগুলি অধিকার লাভের যুদ্ধ।

সেন্ট আঁতোনের ব্যারিকেড থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে শ্যাতো দ্য ইউর কাছে রচিত হয় ফবুর্গ দু তেম্পল-এর ব্যারিকেড। এ ব্যারিকেড ছিল দোতলা সমান উঁচু এক বিশাল প্রাচীরের মতো। দেখে মনে হত বড় বড় পাথরগুলো পর পর সাজিয়ে সিমেন্ট দিয়েই রোমের প্রাচীরের মতো গড়ে তোলা হয়েছে এই ব্যারিকেড। তার দিকে যে কেউ তাকালেই তাকে ভাবতে হত। কেউ যদি সে রাস্তায় একবার অসাবধানে গিয়ে পড়ত তা হলে আর রক্ষা ছিল না তার। তাকে আহত অথবা নিহত হয়ে ফিরে আসতে হত। সে ব্যারিকেডের সামনে ও দু পাশে অনেক মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে ছিল।

সরকারি সেনাদলের একজন বীর সাহসী কর্নেল মতিনার্দ ওই ব্যারিকেড দেখে একই সঙ্গে ভয়ে কাঁপতে থাকে এবং তার প্রশংসায় ফেটে পড়ে। সে বলে, কী চমৎকারভাবে এটা তৈরি হয়েছে! একটা পাথরও লাইন থেকে সরে যায়নি। মাটি দিয়েও এটা ওই ভাবে তৈরি করা হত।

সে যখন এই কথাগুলো বলছিল তখন বিপ্লবী পক্ষের কাছ থেকে একটা বন্দুকের গুলি এসে তার বুকটাকে বিদ্ধ করে এবং সে পড়ে যায়। বিপ্লবীরা বলতে থাকে, ওরা কাপুরুষ, আনাচ-কানাচে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে ওরা। সাহস থাকে তো সামনে এসে যুদ্ধ করুক।

ফবুর্গ দু তেম্পল-এর ব্যারিকেডে মাত্র আশিজন বিপ্লবী তিন দিন ধরে সরকার পক্ষের দশ হাজার সৈনিকের সঙ্গে লড়াই করে টিকিয়ে রেখেছিল সেটাকে। চতুর্থ দিনে সেনাদলের লোকেরা আশপাশের বাড়িগুলো ভেঙে তার মধ্যে ঢুকে তার ছাদ থেকে বাড়ির জানালাগুলোর ধার থেকে যুদ্ধ চালিয়ে এই ব্যারিকেড ও বিপ্লবীদের ঘাঁটি দখল করে। কিন্তু একজন বিপ্লবীও পালায়নি বা পালাবার চেষ্টা করেনি। এই বিপ্লবীদলের

সেন্ট আঁতোনে আর তেম্পল-এর ব্যারিকেড দুটো আসলে দুটো যুবকের দ্বারা তৈরি হয়। তারা হল কুর্নেত আর বার্থেলমি। দু জনেই ছিল সাহসী আর দায়িত্বশীল। কুর্নেত ছিল বয়সে বড়। চওড়া কাঁধ, মোটা পেশিওয়ালা বলিষ্ঠ চেহারা। আগে সে ছিল নৌবাহিনীর এক অফিসার। তার কণ্ঠে যেন ছিল সামুদ্রিক ঝড়ের গর্জন। সে যখন যুদ্ধ করত মনে হত সে যেন সমুদ্র থেকে আসার সময় এক ঘূর্ণিঝড়ের প্রচণ্ডতা নিয়ে এসেছে এই যুদ্ধক্ষেত্রে।

কুর্নেত যেমন ছিল সেন্ট আঁতোনের লোক–বার্থেলমি তেমনি তেম্পল-এর অধিবাসী। বয়সে বার্থেলমি ছিল তরুণ যুবক। তার চেহারাটা ছিল রোগা রোগা। সরু মুখখানা সব সময় এক সকরুণ বিষাদে ভরা থাকত। একবার এক পুলিশ অফিসারের হাতে সে মার খায়। তার পর থেকে তার ওপর প্রতিশোধ নেবার সুযোগ খুঁজতে থাকে। সুযোগ পেয়ে সেই পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে ধরা পড়ে। জেল খেটে বেরিয়ে আসার পর বিপ্লবে যখন যোগ দেয় তখন তার বয়স সতেরো-আঠারো। ফবুর্গ তেল-এর বারিকেডটা তারই হাতে গড়া, সেন্ট আঁতনের ব্যারিকেডটা যেমন কুর্নেতের হাতে গড়া।

সেনাবাহিনীর কাছে দু জনে হেরে গিয়ে সোজা লন্ডনে পালিয়ে যায় ওরা। সেখানে প্রেমের ব্যাপারে ডুয়েল লড়তে গিয়ে বার্থেলমি কুর্নেতকে হত্যা করে। বিচারে তার লন্ডনেই ফাঁসি হয়। নির্মম দারিদ্র্য আর নৈতিক অন্ধকারে গড়া লৌহকঠিন এক যুবক ফরাসি দেশের এক কারাগারে যে জীবন শুরু করে, অবশেষে ইংল্যান্ডে এক বধ্যভূমিতে সে জীবনের অবসান হয়।

.

২.

১৮৩২ সালের জুন বিপ্লব আর ১৮৪৮ সালের জুন বিপ্লবের মধ্যে ছিলো ষোল বছরের ব্যবধান। কিন্তু ১৮৪৮ সালের বিপ্লবীরা ছিল আরও অনেক অভিজ্ঞ এবং কুশলী। লা শাঁব্রেরি’র ব্যারিকেডটা ফবুর্গের ব্যারিকেড দুটোর তুলঁনায় জ্বণ পরিমাণ হলেও তাকে কেন্দ্র করে যে বৈপ্লবিক কর্মতৎপরতা গড়ে উঠেছিল তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেকের।

সেদিন রাত্রিতে এপেনিনের মৃত্যুর পর মেরিয়াস আর কাজে মন দিতে পারেনি। তখন এঁজোলরাসকেই আবার নেতৃত্ব দিতে হয়। বড় ব্যারিকেডটাকে আরও দশ ফুট উঁচু করা হল। সামনের দিকে আরও অনেক জিনিসপত্র দিয়ে সেটাকে আরও শক্তিশালী করা হল। মদেতুরের ব্যারিকেডটার আশপাশে রক্ত ছড়ানো ছিল। জাতীয় রক্ষীবাহিনীর চারজন লোক নিহত হয় যুদ্ধে। এঁজোলরাস তাদের পোশাকগুলো খুলে নিয়ে নিল। এঁজোলরাস সকলকে দু ঘণ্টা করে ঘুমিয়ে নিতে বলল। তবু অনেকে কাজ করতে লাগল। ফুলি হোটেলটার সামনে ‘জনগণ দীর্ঘজীবী হোক এই কথাগুলো পেরেক দিয়ে খোদাই করতে লাগল। হোটেলের তিনজন মেয়ে অন্ধকারে হোটেল ছেড়ে পাশের একটা বাড়িতে চলে যায়। বিদ্রোহীরা তাদের ব্যাপারে অনেকটা স্বস্তি অনুভব করে। পাঁচজন লোক বিশেষভাবে আহত হয়, তাদের মধ্যে দু জন জাতীয় রক্ষীবাহিনীর লোক।

হোটেলের নিচের তলার ঘরে ছিল শুধু মেবুফে’র মৃতদেহ আর জেভাৰ্ত। এঁজোলরাস বলল, এ ঘরটা হল মৃত্যুপুরী, মৃতদেহ রাখার জায়গা।

ব্যারিকেডের সামনের দিকে যে ভাঙা বাসটা ছিল তার উপর পতাকাটার পাশে মঁসিয়ে মেবুফে’র রক্তমাখা জামাটা ঝুলিয়ে রাখে ওরা। হোটেলে রুটি-মাংস বা কোনও খাবার ছিল না। মোলো ঘণ্টার মধ্যে পঞ্চাশজন বিপ্লবী হোটেলের সব খাবার খেয়ে ফেলে। ফলে তাদের ক্ষুধা সহ্য করতে হচ্ছিল। সেন্ট মেরি ব্যারিকেডের নেতা জাঁ তার লোকেরা খেতে চাইলে বলে এখন রাত তিনটে বাজে, চারটের সময় আমরা সবাই মারা যাব, এখন আর খেয়ে কী হবে?

হোটেলের একটা ঘরে এঁজোলরাস পনেরো বোতল মদ পেল। কিন্তু সে মদ কাউকে খেতে দিল না।

কমবেফারে বলল, এ বোতলগুলো হয়তো পিয়ের হুশেলুপের রাখা।

বোসেত বলল, প্রান্তেয়ার এখন ঘুমোচ্ছে তাই, তা না হলে ওগুলো পাহারা দেবার কাজ বাড়ত আমাদের।

এঁজোলরাস মদের বোতলগুলো যে টেবিলে মঁসিয়ে মেবুফে’র মৃতদেহ ছিল সেই টেবিলের নিচে রেখে দিল। বলল, এগুলো যেন কেউ না ছোঁয়।

রাত দুটোর সময় উপস্থিত সব বিপ্লবীর নাম ডাকা হল। দেখা গেল মোট সাঁইত্রিশজন লোক আছে। তখন ভোর হয়ে আসছিল। জ্বলন্ত মশালটাকে নিভিয়ে দেওয়া হল। কুরফেরাক ফুলিকে বলল, ভালো হল। মশালের আলোটা হাওয়ায় কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল ওটা যেন কাপুরুষের অন্তর।

জলি একটা বিড়াল দেখে দর্শনের কথা বলতে লাগল। সে বলল, ইঁদুরের পর বিড়াল সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। এর থেকে সৃষ্টিব্যবস্থার উন্নতির প্রমাণ পাওয়া যায়।

কমবেফারে একজন ছাত্রের সঙ্গে জাঁ প্রুভেয়ার, বাহোরেল, মেবুফ আর কিউবাকের মৃতদেহগুলোর সত্ত্বারের কথা আলোচনা করছিল। প্রথমে জাঁ প্রভেয়ারের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে করতে ওরা সিজারের মৃত্যু আর ব্রুটাসের বিষয়ের ওপর এসে পড়ল।

কমবেফারে বলল, প্রতিভাবান পুরুষরা একে অন্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে একে অন্যকে আক্রমণ করে। সিজারকে হত্যা করে ব্রুটাস ন্যায়সংগত কাজই করেছিল। সিসারার এ কথার মধ্যে যুক্তি আছে। সিজার সিনেটরকে মান্য করতেন না, তিনি স্বৈরাচারী রাজার মতো চলতেন। হত্যা করার সময় তার দেহে তেইশটা ক্ষত হয়। সেগুলোর থেকে যিশুর দেহের ক্ষত আমাকে বেদনা দেয় বেশি। কারণ সিজারকে মেরেছিল গণমান্য সিনেটররা, কিন্তু যিশুকে মারে যত সব হীন প্রকৃতির বাজে লোক। তবু বলতে হয় আমরা আমাদের ক্রোধের তীব্রতার মাঝে ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করি। হয়নাস হোমারকে আক্রমণ করেন। মেডিয়াস ভার্জিলকে আক্রমণ করেন, ভিসে মনিয়ারকে আর পোপ শেকসপিয়ারকে আক্রমণ করেন।

.

৩.

এঁজোলরাস চারদিকে ঘুরে একবার সব দেখে নিল। রাত্রির যুদ্ধের সাফল্যের মত্ততায় তারা ভুলে গিয়েছিল সকালে আবার আক্রমণ শুরু করবে সেনাবাহিনী। তাছাড়া বিপ্লবীদের আশা ছিল পরের দিন সন্ধের আগেই তাদের চূড়ান্ত জয় অনিবার্য। তারা আগামী দিনটাকে তিনভাগে ভাগ করে ধরে নিয়েছিল। এই তিনভাগে এমন তিনটে ঘটনা ঘটবে সুনিশ্চিত করে তুলঁবে তাদের জয়কে। তারা ভেবেছিল আগামীকাল সকাল ছ টায় সরকারি সেনাদলের একটা অংশ তাদের দলে এসে যোগদান করবে। তাদের ধারণা সেনাদলের অনেকে তাদের বিপ্লবের আদর্শ বুঝতে পেরেছে অথবা ভয় পেয়ে গেছে। তার ওপর দুপুরবেলায় প্যারিসের সমস্ত জনগণ বিপ্লবে যোগদান করবে। এখনও যারা বিপ্লবের কাজে এগিয়ে আসেনি তারা সবাই এসে লড়াই করবে। সুতরাং দিনের শেষে তারা একান্তভাবে জয়লাভ করবে।

কিন্তু এঁজোলরাস ব্যারিকেডগুলোর চারদিকে ঘুরে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে ফিরে এসে বলল অন্য কথা। সে বলল, সরকার সব সেনাবাহিনী তলব করেছে। একটা বাহিনীকে আমাদের দমন করবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। তার ওপর আছে জাতীয় রক্ষীবাহিনী। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আমরা আক্রান্ত হব। শহরের জনগণ গতকাল বেশ উৎসাহ দেখিয়েছিল; কিন্তু আজ তাদের কোনও উৎসাহ নেই। ফবুর্গের কোনও লোকই এগিয়ে আসছে না। আমাদের আর কোনও আশা নেই।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সকলের কলগুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে গেল। ভয়ের ছায়া নেমে এল সকলের চোখে-মুখে। কিন্তু বিপ্লবীদের মধ্যে একজন অচেনা লোক যাকে শ্রমিক বলে মনে হচ্ছিল, বলে উঠল, ঠিক আছে নাগরিকগণ, ভয়ের কিছু নেই, আমরা ব্যারিকেড়টা আরও কুড়ি ফুট উঁচু করব। আমরা দেশকে দেখিয়ে দেব জনগণ প্রজাতন্ত্রীদের ত্যাগ করলেও প্রজাতন্ত্রীরা তাদের ত্যাগ করেনি।

অনেকে আনন্দধ্বনি করে কথাগুলোকে সমর্থন করল।

.

৪.

সেই অচেনা লোকটা যখন বলল, তাদের সব মৃতদেহগুলো ব্যারিকেডটার মাথায় স্থূপাকার করে দেবে সেটা আরও, তখন উপস্থিত সকলেই খুশি হল সে কথায়। সকলেই এক বাক্যে বলল, আমরা সকলেই এখানে থাকব। শেষ পর্যন্ত থেকে মৃত্যুবরণ করব।

এঁজোলরাস বলল, সকলের থাকার কী দরকার?

হ্যাঁ, সকলেই থাকব।

এঁজোলরাস বলল, আমাদের অবস্থা এখানে ভালো। তিরিশজনই এ ব্যারিকেড রক্ষা করার পক্ষে যথেষ্ট। ছত্রিশজনের প্রাণ দেবার কী দরকার?

তার উত্তরে ওরা বলল, কারণ কেউ এখানটা ছেড়ে যেতে চায় না।

এঁজোলরাস একটু রাগের সঙ্গে ঝাঝালো সুরে বলল, হে নাগরিকবৃন্দ, আমাদের প্রজাতন্ত্রে কাজের লোক কম। বীরদের অবশ্য প্রাণদানের প্রতি ঝোঁক থাকে। তবু কিছু লোকের কর্তব্য এখান থেকে চলে যাওয়া।

এঁজোলরাস ছিল বিপ্লবীদের সর্বজনবন্দিত নেতা। তার প্রভুত্বের প্রতি আস্থা ছিল সকলের। তথাপি উপস্থিত সকলের মধ্যে এক বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদের কলগুঞ্জন উঠল। তাদের একজন বলল, তাছাড়া শক্রসেনারা আমাদের ঘিরে ফেলেছে চারদিক থেকে। এখান থেকে বেরোনোও মুশকিল।

এঁজোলরাস বলল, হ্যালের সব দিকে পাহারা নেই। মঁদেতুরে’র গলিপথটা ফাঁকা আছে। তোমরা মার্সে দে ইনোসেন্ত দিয়ে র‍্যু দে গ্রেশেউরে গিয়ে পড়তে পার।

একজন বলল, আমরা সেখানে গেলে আমাদের পোশাক দেখে তারা জানতে চাইবে কোথা থেকে আমরা আসছি, তখন তারা গুলি করবে।

এঁজোলরাস তখন কমবেফারের কাঁধে হাত রেখে কী বলতে ওরা হোটেলের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কিছু পরেই জাতীয় রক্ষীবাহিনীর বন্দি চারজনের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া চারটে পোশাক হাতে বেরিয়ে এল। কমবেফারের হাতে তাদের শিরস্ত্রাণগুলো ছিল। সেগুলো তাদের সামনে ফেলে দিয়ে এঁজোলরাস বলল, এগুলো পরে চারজন অন্তত বেরিয়ে যেতে পারবে।

তবু কারও মধ্যে চলে যাওয়ার কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। তখন কমবেফারে তাদের বলতে লাগল, কথা হচ্ছে তোমাদের ছেলে-পরিবার নিয়ে। এঁজোলরাস বলল, সে একটি বাড়ির জানালায় একজন বয়স্ক মহিলাকে সারারাত জেগে থাকতে দেখেছে। সে তার ছেলে ফিরে না আসায় উদ্বেগে ছটফট করেছে সারারাত। তোমাদের যাদের ঘরে মা, বোন বা স্ত্রী ও শিশুসন্তান আছে, যারা শ্রমের কাজ করে সংসার প্রতিপালন করো তাদের অবিলম্বে চলে যাওয়া উচিত। বিপ্লব কখনও কারও সংসারের ক্ষতি করতে বলে না। তোমাদের হাতে বন্দুক আছে, তোমরা লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত থাকতে পার। মরবার জন্য উদ্যত হতে পার। কিন্তু কাল তোমরা থাকবে না, তখন তোমাদের ওপর নির্ভরশীল নারী ও শিশুদের কী হবে ভেবে, দেখেছ? তারা তোমাদের অবর্তমানে পথের ভিখারি হবে। পুরুষমানুষ অভাবে ভিক্ষা করতে পারে, কিন্তু নারীদের দেহদান করতে হয়। বেশ্যাগিরি করতে হয়। যাদের বাড়িতে ছেলে-পরিবার আছে তাদের চলে গিয়ে বাকি যারা থাকবে তাদের কাজ করতে দেওয়া উচিত। তাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা সহকারে সব কিছু ভেবে দেখা উচিত। ভেবে দেখা উচিত, সমাজে মেয়েদের সুযোগ দিই না, তাদের স্বাধীনভাবে সব কিছু ভাবতে শেখাই না, তাদের স্বাবলম্বী হতে দিই না, রাজনীতিতে যোগদান করতে দিই না। এই সব নারী তাদের স্বামীদের অকালমৃত্যুতে কী করে দিন চালাবে? আমি যখন হাসপাতালে এক সহকারী ডাক্তার হিসেবে কাজ করতাম তখন একটি শিশু ভর্তি হয় সেখানে। তার বাবা অকালে মারা যায়। মা ছিল খুব গরিব, সহায়-সম্বলহীনা। অভাবে উনুন জ্বলত না। শিশুটি খাবার না পেয়ে ছাই আর মাটি খেত। কাদা ঘাটত খাদ্যের আশায়। তার হাত-পা শীর্ণ হয়ে যায়, পেটটা ফুলে যায়। হাসপাতালে তার পেটে মাটি আর দাঁতে ছাই পাওয়া যায়। শিশুটি মারা যায়। যাদের পরিবার আছে, সন্তান আছে, তাদের এই শিশুটির কথা নিজের মতো করে ভাবা উচিত। আমি তোমাদের সম্বন্ধে কিছু বলছি কি? কিছু না। আমি জানি তোমরা সাহসী, বীরপুরুষ, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আত্মবলি দেবার জন্য তোমাদের অন্তর উন্মুখ। সকলেই আত্মত্যাগের গৌরব লাভ করতে চাও। সেটা খুবই ভালো কথা। কিন্তু তোমরা একা নও। সংসারে আর যারা আছে তাদের জন্যও ভাবতে হবে তোমাদের। যে সব পরিত্যক্ত ও পিতৃমাতৃহীন অনাথ শিশু আছে দেশে, পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় তাদের মধ্যে শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ মারা যায়। যারা সংসারের কথা ভাবে না তারা আত্মকেন্দ্রিক।

কমবেফারের কথা শুনে সবাই মাথা নত করে চুপ করে রইল।

মেরিয়াস এতক্ষণ কোনও কাজ না করে ভাবছিল বসে বসে। ওদের কথাবার্তা সব শুনছিল। আশার সুউচ্চ শিখর থেকে হতাশার গভীরে ডুবে যায় সে। সে তার শেষ পরিণতির এক চরম মুহূর্তের জন্য আচ্ছন্নের মতো অপেক্ষা করছিল। হতাশার এক গভীর আবেশে আচ্ছন্ন থাকায় তার সামনে যে সব ঘটনা ঘটে যাচ্ছিল তার খুঁটিনাটিগুলো সে গ্রাহ্য না করলেও মোটামুটি আসল বাপারটা সে বুঝতে পেরেছিল। সে নিজে একান্তভাবে মৃত্যু কামনা করলেও কয়েকটি জীবনকে যাতে বাঁচাতে পারে তার জন্য দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠল সে।

মেরিয়াস হঠাৎ বলে উঠল, এঁজোলরাস আর কমবেফারে ঠিক বলেছে। অহেতুক অনাবশ্যক প্রাণবলি চলবে না এ বিষয়ে আমিও একমত। আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। তোমাদের মধ্যে যাদের বাড়িতে মা, স্ত্রী ও শিশুসন্তান আছে তাদের চলে যেতে হবে। বিবাহিত যেসব লোকের সংসার চালাতে হয় তারা চলে যাও।

মেরিয়াসের কথাটির গুরুত্ব আরও বেশি, কারণ এঁজোলরাস নেতা হলেও সে বড় রকমের একটা বিপদ থেকে সকলকে রক্ষা করে। সে তাদের রক্ষাকর্তা।

এঁজোলরাস বলল, হ্যাঁ, এটা আমাদের আদেশ।

মেরিয়াস বলল, আবার আমি তোমাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।

অবশেষে কমবেফারের দীর্ঘ বক্তৃতা, এঁজোলরাসের আদেশ, মেরিয়াসের আবেদন সব মিলিয়ে বিপ্লবীদের মনে প্রভাব বিস্তার করল। তারা একে অন্যকে বলতে লাগল, হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। তুমি তো বিয়ে করেছ, তোমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আছে।’… তোমার দুটি বোন আছে। … তোমার মা আছে।

কুরফেরাক বলল, তাড়াতাড়ি কর। এরপর খুব দেরি হয়ে যাবে।

এঁজোলরাস বলল, নাগরিকবৃন্দ, তোমরা প্রজাতন্ত্রের লোক, কাদের যেতে হবে তা নিজেদের মধ্যে ঠিক করে নাও।

তার কথামতো কয়েক মিনিটের মধ্যেই ওরা ঠিক করে ফেলল, পাঁচজন লোককে যেতে হবে দল থেকে।

মেরিয়াস বলল, পাঁচজন লোক, কিন্তু চারজনের পোশাক আছে বেরিয়ে যাবার।

তখন সেই পাঁচজন বলল, তা হলে একজনকে থেকে যেতে হবে।

কুরফেরাক বলল, তাড়াতাড়ি কর।

একজন মেরিয়াসকে বলল, তুমি ঠিক করে দাও কে থাকবে আমাদের মধ্যে।

মেরিয়াস একবার নির্বাচিত পাঁচজন লোক আর চারটে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পোশাকের দিকে তাকাল। সে যখন ভাবল মৃত্যুর জন্য একজন লোককে নির্বাচিত করতে হবে তখন তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল।

এমন সময় উপর থেকে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর একটা পোশাক পড়ে গেল। মনে হল যেন আকাশ থেকে পোশাকটা পড়েছে।

মেরিয়াস মুখ ঘুরিয়ে দেখল মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত। সে আন্ডারপ্যান্ট পরে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পোশাকটাই খুলে দিয়েছে।

কিছুক্ষণ আগে জাঁ ভলজাঁ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পোশাক পরে বন্দুক হাতে মঁদেতুরে’র গলিপথ দিয়ে বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে। সে কী জন্য এখানে আসে তা বলা শক্ত। সে খবর পেয়ে ব্যারিকেড দেখার জন্য কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে এখানে। আসে, নাকি বিপ্লবের প্রতি তার কোনও সহজাত প্রবৃত্তি বা প্রবণতার বশে এখানে আসে, তা কেউ জানে না। গলিপথের মোড়ে বিপ্লবীদের যে পাহারাদার ছিল সে ভলজাঁকে আটকায়নি, কারণ সে ভেবেছে অচেনা আগন্তুক জাতীয় রক্ষীবাহিনীর লোক হলেও সে একা, এবং সে হয়তো বিপ্লবীদের দলে যোগদান করবে, আর যদি যোগদান না করে তা হলে সে বন্দি হবে, একা কখনও লড়াই করতে পারবে না।

ভলজাঁ যখন প্রথম এসে ঘাঁটিতে ঢুকে পড়ে তখন কেউ তাকে দেখেনি, কারণ তখন সকলের দৃষ্টি ছিল যে পাঁচজন লোক ঘাটি ছেড়ে চলে যাবার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। তাদের ওপর নিবদ্ধ। ভলজাঁ তাদের সব কথাবার্তা শুনে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। তার পর সে তার পোশাকটা খুলে দেয়।

বোসেত বলল, কে এই লোকটি?

কমবেফারে বলল, যেই হোক, আমাদের একজনের জীবনকে রক্ষা করতে চায়।

মেরিয়াস গম্ভীরভাবে বলল, আমি ওকে চিনি।

এঁজোলরাস জাঁ ভলজাঁ’র দিকে তাকিয়ে বলল, এটাই যথেষ্ট। আর কোনও কথা নেই।

এরপর সে ভলকে বলল, নাগরিক, তুমি স্বাগত আমাদের মাঝে। তুমি হয়তো জান, আমাদের মৃত্যুকাল আসন্ন।

ভলজাঁ নীরবে পাঁচজনের মধ্যে যার পোশাক ছিল না তাকে তার পোশাকটা পরিয়ে। দিল নিজের হাতে।

.

৫.

তাদের ঘাঁটির বিপন্ন অবস্থাটা এঁজোলরাসের বিষাদকরুণ মুখের ওপর স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছিল। এঁজোলরাস ছিল বিপ্লবের পূর্ণ প্রতীক। তবু কতকগুলি অপূর্ণতা ছিল তার মধ্যে। প্রথম দিকের এবিসি সোসাইটি আর কমবেফারের চিন্তার দ্বারা বেশি প্রভাবিত ছিল সে। পরে সে সংকীর্ণ গোঁড়ামি থেকে মুক্ত হয়ে উন্নততর সমাজবিপ্লবের মহান আদর্শকে চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ক্রমে তার জাতীয় প্রজাতন্ত্রকে প্রসারিত করে মানবজাতির প্রজাতন্ত্রে পরিণত করার কথা ভাবতে থাকে সে। হিংসা বলপ্রয়োগের দিক থেকে ১৮৭২ সালের ফরাসি বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটাবার ব্যাপারে সে অটল। ব্যারিকেডের একটা সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে ফাঁসিকাষ্ঠের আসামির মতো মৃত্যুভয়ের বাতাসে কাঁপছিল সে তবু তার চোখে ছিল এক অন্ধ আগুনের ধূমায়িত আভা। তার মাথার সুন্দর চুলগুলো পেছনের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, নক্ষত্রমণ্ডলের রথের উপর আরূঢ় কোনও দেবদূত অথবা কেশরওয়ালা কোনও সিংহ।

এঁজোলরাস বলতে লাগল, হে নাগরিকবৃন্দ! তোমরা একবার ভবিষ্যতের কথা ভেবে দেখেছ? যে ভবিষ্যতে সব শহরের পথগুলো হবে উজ্জ্বলভাবে আলোকিত, দু ধারে থাকবে বড় বড় বাড়ি, সব মানুষ হবে উন্নতমনা, পৃথিবীর সব জাতিগুলো পরস্পরে মিলেমিশে বাস করবে, সমস্ত চিন্তাশীল ব্যক্তিরা স্বাধীনতাকে চিন্তা করবে, সব ধর্মের লোক আইনের চোখে পরিগণিত হবে সমানভাবে, স্বর্গই হবে একমাত্র ধর্ম। ঈশ্বর হবেন সে ধর্মের পুরোহিত আর মানুষের বিবেক হবে সে ধর্মোপাসনার বেদি। সকল রকমের ঘৃণার অবসান ঘটবে, কোনওরকমের শ্রেণিবৈষম্য বা দ্বন্দ্ব থাকবে না, সকল মানুষ কাজ পাবে, সকল মানুষ পাবে ন্যায়বিচার আর শান্তি, শ্রমিক আর ছাত্ররা ভাই-এর মতো মিলেমিশে বাস করবে। সব কাজের জন্য থাকবে শান্তি আর পুরস্কারের সমান ব্যবস্থা। যুদ্ধ আর রক্তপাত চিরদিনের মতো বন্ধ হবে। প্রকৃতিজগৎকে বশীভূত করাই হবে প্রথম কাজ, দ্বিতীয় কাজ হবে আদর্শের পরিপূরক। ইতোমধ্যেই মানুষ যে কৃতিত্ব অর্জন করেছে তা একবার ভেবে দেখ। আদিম মানুষ হায়েড্রা, ড্রাগন, গ্রিফিন, বাঘ প্রভৃতি হিংস্র জন্তুর ভয় করত। আর মানুষ বুদ্ধির ফাঁদ পেতে তাদের কবল থেকে মুক্ত করেছে নিজেদের। তারা বাষ্পন, ইঞ্জিন এবং বেলুন আবিষ্কার করেছে। আজ মানুষ সমস্ত জীবজগতের প্রভু হয়েছে। আজ আমাদের লক্ষ্য কী? সত্যের আলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত ন্যায়বিচারসমৃদ্ধ এক সরকার। সে সত্যের আলোর সঙ্গে দিনের আলোর সার্থক সাযুজ্য থাকবে। আমরা চাই পৃথিবীর সব জাতির মিলন আর মানবজাতির মহান ঐক্য। একমাত্র বুদ্ধির পার্লামেন্টের দ্বারা শাসিত হবে সমগ্র জগৎ। হে নাগরিকবৃন্দ, সাহস অবলম্বন কর, এগিয়ে যাও। একদিন গ্রিকরা যা শুরু করেছিল আজ ফ্রান্স তা সম্পন্ন করবে। হে আমার বন্ধু ফুলি শোন; তুমি হচ্ছ এক বলিষ্ঠ শ্রমিক, জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি। তুমি ঠিকভাবে ভবিষ্যৎকে দেখতে পার, ঠিকমতো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পার। তোমার চিন্তাধারা স্বচ্ছ। তোমার পিতামাতা নেই। সমগ্র মানবজাতিই তোমার মাতা আর ন্যায়বিচারই তোমার পিতা। তোমাকে এইখানেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। তার মানে তুমি এক গৌরবময় জয় লাভ করবে। হে নাগরিকবৃন্দ, আজ যা-ই ঘটুক না কেন, পরাজয়ের মধ্যেও তোমরা লাভ করবে জয়ের গৌরব। আমরা বিপ্লবকে সার্থক করে তুলঁবই। এক বিরাট অগ্নিকাণ্ড যেমন সমগ্র শহরকে আলোকিত করে তোলে, তেমনি বিপ্লবের আগুন সমগ্র মানবজাতিকে করে তুলঁবে আলোকিত। কিন্তু আমরা কী ধরনের বিপ্লব চাই? আমি আগেই বলেছি সে বিপ্লব হল সত্যের বিপ্লব। আমরা চাই নিজের ওপর নিজের সার্বভৌমত্বের প্রতিষ্ঠা। কোনও দেশের প্রতিটি মানুষ যখন এইভাবে আত্মসংযমের মাধমে এই সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে তখনি তাকে আমরা বলি রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের সব মানুষ আপন আপন সার্বভৌমত্বের কিছু কিছু ত্যাগ করে আইনের অনুশাসনকে সম্ভব করে তুলঁবে। আইনের অনুশাসন প্রতিটি মানুষের অধিকারকে রক্ষা করে চলবে। সকল মানুষের সমান স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব ত্যাগকেই বলা হয় সাম্য। সকল মানুষ যখন সকল মানুষের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করে চলে তখন তাকে বলে সৌভ্রাতৃত্ব। সে আধারে সকল সার্বভৌমত্ব পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হয় সেই আধারকেই বলে সমাজ। সকল সার্বভৌমত্বের এই শান্তিপূর্ণ মিলনই হল সামাজিক বন্ধন বা সামাজিক চুক্তি যার মাধ্যমে সকল মানুষ পরস্পরের কাছে আসে, মিলিত হয়। সাম্য মানে এই নয় যে সব গাছের মাথাগুলো এক মাপে বেড়ে উঠবে, সব ঘাস, আগাছা আর বনস্পতি পাশাপাশি অবস্থান করবে। নাগরিক অর্থে সাম্য মানে হল সকল প্রতিভার সমান বিকাশ। রাজনৈতিক অর্থে সাম্য হল সকলের ভোটের মূল্য সমান। ধর্মীয় অর্থের সাম্য হল সকলের সমান অধিকার ভোগ। সাম্য প্রথমে সকল মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক অবাধ শিক্ষার ব্যবস্থা করবে। শিক্ষার আলো থেকেই সব কিছুর জন্ম হয়। আমাদের উনবিংশ শতাব্দী মহান ঠিক, কিন্তু বিংশ শতাব্দী হবে সব দিক দিয়ে সুখী। আজকের সব ভয় হবে দূরীভূত–যুদ্ধ এবং দিগ্বিজয়ের অভিলাষ, বিভিন্ন জাতির মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম, বিভিন্ন রাজবংশের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপনের কূটনীতি, অত্যাচারী, স্বৈরাচারী রাজাদের উত্তরাধিকার, অনন্তত্বের অরণ্যে মাথা খুঁড়তে থাকা ভেড়াদের মতো বিভিন্ন ধর্মের দ্বন্দ্ব-সংঘাত–এই সব কিছুর অবসান ঘটবে। মানুষকে আর দুর্ভিক্ষ বা শোষণকে ভয় করতে হবে না, অভাবের তাড়নায় কোনও মেয়েকে বেশ্যাগিরি করতে হবে না, কাজের অভাবে কোনও বেকারকে নিরাশ্রয় হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে না, কোনও মানুষকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হবে না, বা হিংসাজনিত উগ্র সংগ্রামের শিকার হতে হবে না। সব মানুষ সুখে জীবনযাপন করবে। সূর্যের চারদিকে যেমন সব গ্রহেরা ঘোরে তেমনি সত্যকে কেন্দ্র করে অবর্তিত হবে সব আত্মা। সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আর আমাদের মৃত্যুরূপ মূল্য দান করতে হবে না যে ভবিষ্যতে মানবজাতি হবে বন্ধন হতে মুক্ত, সব দিক উন্নত এবং সুখী। একথা আমরা আজ এই মুহূর্ত এই ব্যারিকেড থেকে ঘোষণা করছি। ভাইসব, এ ব্যারিকেড সামান্য পাথর দিয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে গড়া এক বস্তু নয়, যারা চিন্তা করে আর দুঃখভোগ করে তাদের মিলনস্থল হল এই ব্যারিকেড। দুঃখভোগ আর আদর্শ–এই দুই উপাদানে গড়া হল এই ব্যারিকেড। দিন রাত্রিকে আলিঙ্গন করে বলে, আমি মরে যাব, কিন্তু আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নবজন্ম লাভ করবে তুমি। তেমনি আজ এখানে হতাশার দ্বারা আলিঙ্গিত হয়ে জন্মলাভ করবে এক নতুন আশা। দুঃখ আনে মৃত্যু, কিন্তু আদর্শ বা চিন্তাধারা নিয়ে আসে অমরত্ব। সব দুঃখবেদনা ও অমরত্ব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে আমাদের মৃত্যুর মধ্যে। ভাইসব, ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল আলোয় অভিম্নত হয়ে মৃত্যুবরণ করব আমরা। এক নতুন প্রভাতের আলোয় পরিপ্লাবিত হয়ে উঠবে আমাদের সমাধিভূমি।

এঁজোলরাস এবার চুপ করল। তবু তার ঠোঁট দুটি কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল কণ্ঠটি তার নীরব হয়ে গেলেও সে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলছে। শ্রোতারা তার কথা আরও শুনতে চাইছিল। শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে উঠল তাদের মাথা। এক চাপা প্রশংসার কলগুঞ্জনে ফেটে পড়ল সবাই তারা।

.

৬.

এবার মেরিয়াসের মনের অবস্থার কথা কিছু বলতে হবে। বাস্তব জগতে তখনও মনটা ফিরে আসেনি তার। মৃত্যুচিন্তার একটা আবেশে তখনও আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সে। মৃত্যুর দুটো কালো ডানার বিশাল ছায়ান্ধকারে তখনও ঘোরাফেরা করছিল সে যেন।

এই মানসিক অবস্থার মধ্যেই সে ভাবতে লাগল, মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত কেন এবং কিভাবে এল এখানে। এ প্রশ্নের কোনও যুক্তি সে খুঁজে না পেলেও সে ভাবল তারই মতো সে-ও হয়তো মরতে এসেছে। তবে কসেত্তে’র জন্য চিন্তা হচ্ছিল তার।

মেরিয়াস যখন প্রথম জাঁ ভলজাঁকে দেখে এবং বলে সে তাকে চেনে তখন সে কোনও কথা বলেনি ভলজাঁ’র সঙ্গে। তার সঙ্গে কোনও কথা বলার প্রবৃত্তি মেরিয়াসেরও ছিল না।

বিপ্লবীদের দল থেকে নির্বাচিত পাঁচজন লোক মঁদেতুরে’র গলিপথ দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় তারা উপস্থিত সকলকে আলিঙ্গন করল। তাদের চোখে জল এসেছিল।

এঁজোলরাস এবার বন্দি জেভার্তের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু চাও তুমি?

জেভার্ত বলল, কখন তোমরা আমায় হত্যা করছ?

তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। এখন আমাদের গুলি দরকার।

তা হলে আমাকে একটু পানীয় দাও।

জেভার্তের হাত-পা বাঁধা থাকায় এক গ্লাস জল এনে তার মুখের কাছে ধরল এঁজোলরাস।

জেভার্তের জল খাওয়া হয়ে গেলে সে বলল, আর কিছু চাও?

জেভার্ত বলল, আমার বড় অস্বস্তি হচ্ছে। আমার জন্য একটু শোবার ব্যবস্থা করে দাও। কোনও একটা টেবিল হলেই চলবে।

এঁজোলরাসের আদেশে একটা টেবিলে জেভার্তের শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল কয়েকজন লোক। বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে টেবিলে শুইয়ে তার দেহটাকে টেবিলের সঙ্গে বেঁধে রাখল।

জেভার্ত শোয়ার পর দেখল দরজার সামনে একটি লোক দাঁড়িয়ে লক্ষ করেছে তাকে। লোকটি এগিয়ে এলে সে তাকে চিনতে পারল। দেখল জাঁ ভলজাঁ।

ভলজাঁ শান্ত কণ্ঠে বলল, তা হলে আমরা দু জনেই এখানে এসে পড়েছি?

.

৭.

তখন ভোর হয়ে এসেছে। তবু কেউ তখনও জাগেনি। আশপাশের বাড়িগুলোর কোনও জানালা কেউ তখনও খোলেনি। লা শাঁব্রেরি আর র‍্যু ডেনিস থেকে সেনাবাহিনী চলে যাওয়ার পর রাস্তাটা একেবারে খালি হয়ে যায়। ভোরের আলোয় রাস্তাটা ফাঁকা দেখাচ্ছিল। কিছু দেখা না গেলেও কিছুদূরে পাথরের রাস্তার উপর লোহার চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ওরা বুঝল অস্ত্রবাহিনী আগে আসছে তাদের আক্রমণ করতে। শাঁব্রেরি ও মদেতুরে’র ব্যারিকেড দুটোকে আগের থেকে আরও দুর্ভেদ্য করে তোলা হল। যাওয়া-আসার পথগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় ব্যারিকেডগুলো দুর্গম হয়ে উঠল। কমবেফারে বলল, এটা শুধু দুর্গম দুর্গ নয়, ইঁদুরের ফাঁদ হয়ে উঠল।

তিরিশটা পাথর দিয়ে হোটেলের মুখটা বন্ধ করে দিল বোসেত। অস্ত্রবাহিনীর চাকার শব্দ পেয়ে এঁজোলরাস সকলকে বন্দুক হাতে এক একটি জায়গায় দাঁড় করিয়ে বা বসিয়ে দিল। তাদের সকলকে মদ বিতরণ করল। বিপ্লবীরা অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে শত্রুসেনাদের চিন্তার মধ্যে সমস্ত প্রাণমনকে কেন্দ্রীভূত করল। এঁজোলাস একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে রইল। গম্ভীর হতাশা থেকে অনেক সময় জয়ের উদ্ভব হয়। সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে অনেক সময় মানুষ জাহাজডুবির হাত থেকে বাঁচে।

ওদের সকলের দৃষ্টি রাস্তার ওপর নিবদ্ধ ছিল। সেন্ট লিউ-এর দিক থেকে অস্ত্রবাহিনীর ট্যাঙ্কগুলো এগিয়ে আসছিল। গাড়িগুলোর সঙ্গে লোহার শিকল বাঁধা থাকায় শিকলের শব্দ আসছিল।

অস্ত্রবাহিনীর গাড়িগুলো দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এঁজোলরাস গুলি করার হুকুম দিল। অস্ত্রবাহিনীর সেনাদের লক্ষ্য করে ওরা একসঙ্গে অনেকগুলো গুলি করল। সেনারা কাজ থামিয়ে দিলেও তাদের কেউ হতাহত হল না গুলিতে। কুরফেরাক আর বোসেত বলল, খুব ভালো হয়েছে।’ এই বলে তারা উৎসাহ দিতে লাগল সকলকে।

এঁজোলরাস তার লোকদের আবার গুলি ভরতে বলল। কামানের গোলার আঘাতে কিভাবে ব্যারিকেডটা টিকবে সেই কথা ভাবতে লাগল ওরা।

এমন সময় কোথায় থেকে গাভ্রোশে এসে বলল, আমি ফিরে এসেছি।

সেনাবাহিনীর লোকেরা যখন ব্যারিকেডটাকে লক্ষ্য করে কামান থেকে গোলা বর্ষণ করল ঠিক তখনি গাভ্রোশে এসে হাজির হল। সে গুলিতে ব্যারিকেডের সামনের দিকে ভাঙা বাস আর ঠেলাগাড়ির অংশগুলো এদিক-সেদিক হয়ে গেলেও তা কারও গাঁয়ে লাগেনি। বিপ্লবীরা তা দেখে হাসতে লাগল।

.

৮.

গাভ্রোশেকে ঘিরে সকলে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল। কিন্তু সে কারও কোনও প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই মেরিয়াস তাকে সরিয়ে নিয়ে গেল নির্জনে।

মেরিয়াস তাকে কড়াভাবে বলল, তুমি আমার চিঠিটা দিয়েছ তো?

গাভ্রোশে মিথ্যা করে বলল, ম্যাদময়জেল তখন ঘুমোচ্ছিল। বাড়ির দারোয়ানের হাতে তাই চিঠিটা দিয়ে এসেছি।

মেরিয়াসের সন্দেহ হল চিঠিটা হয়তো ভলজাঁ’র হাতে পড়েছে। সে তাই ভলজাঁকে দেখিয়ে গাভ্রোশকে বলল, তুমি এঁকে চেন?

গাভ্রোশে বলল, না।

সে তাকে রাত্রিতে দেখায় ঠিক তাকে চিনতে পারল না।

মেরিয়াস ভাবল ভলজাঁ হয়তো প্রজাতন্ত্রী, তাই এই বিপ্লবীদের দলে এসে যোগদান করেছে।

গাভ্রোশে এবার তার বন্দুকটা চাইল। কুরফেরাক তার বন্দুকটা তার হাতে দিয়ে দিল। গাভ্রোশে বলল, চারদিকে থেকে সৈন্যরা তাদের ঘিরে ফেলেছে। কোনও রাস্তা বাদ নেই।

কামানের গোলায় কোনও কাজ না হওয়ায় সেনাবাহিনী আর গুলি করেনি। তারা তখন পাথর দিয়ে রাস্তার উপর একটা পাঁচিল তৈরি করার কাজে ব্যস্ত ছিল। যেসব বিপ্লবী গাভ্রোশেকে দেখার জন্য আপন আপন জায়গা থেকে চলে এসেছিল, এঁজোলরাস তাদের ফিরে যাবার হুকুম দিল। কিন্তু তারা আপন আপন জায়গায় ফিরে যেতে না যেতে শত্রুসৈন্যরা আবার গুলিবর্ষণ করল। তাতে এ পক্ষের দু জন লোক নিহত আর তিনজন আহত হল। এঁজোলরাস বলল, এ ভুল যেন আমাদের আর না হয়।

ওরা দেখল সেনাবাহিনীর এক যুবক সার্জেন্ট তাদের লক্ষ্য করে তার বন্দুক তুলেছে। এদিকে এঁজোলরাসও তাকে লক্ষ্য করে তার বন্দুক তুলঁল। কমবেফারে বলল, দেখ দেখ, সার্জেন্টটা বয়সে যুবক, পঁচিশের বেশি বয়স হবে না। কী সুন্দর দেখতে! ওর হয়তো প্রেমিকা আছে, বাড়িতে বাবা-মা আছে।

এঁজোলরাস তাকে লক্ষ্য করে গুলি করতেই সে পড়ে গেল। তার পিঠ থেকে রক্ত ঝরতে লাগল। সৈন্যরা তার মৃতদেহটাকে সরিয়ে নিয়ে গেল।

এদিকে ব্যারিকেডের মধ্যে বিপ্লবীরা আলোচনা করতে লাগল, এভাবে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইফেলের গুলির সামনে ওরা বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। তাছাড়া দুর্ভেদ্য। ব্যারিকেডটার মধ্যে একটা বড় ফুটো হয়েছে, সেটা বন্ধ করা দরকার।

এঁজোলরাস বলল, একটা মোটা তোষক এনে ওটা বন্ধ করে দাও।

কমবেফারে বলল, আর একটা তোষকও নেই। আহতরা সব তোষকে শুয়ে আছে।

ওরা সবাই দেখল পাশের একটা ছয়তলা বাড়ির একটা বড় ভোলা জানালায় একটা মোটা তোষক পর্দার মতো করে বাইরের দিকে ঝোলানো রয়েছে। উপর দিকের দুটো কোণের সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝোলানো ছিল সেটা।

ভলজাঁ এতক্ষণ ঘরের এক কোণে তার বন্দুকটা নিয়ে বসে ছিল চুপ করে। এতক্ষণ কোনও কাজে অংশগ্রহণ করেনি সে। ওদের সব কথা শোনার পর ভলক্স উঠে এসে ওদের বলল, আমাকে কেউ একটা দোনলা বন্দুক দিতে পার?

এঁজোলরাস তার বন্দুকটা ভলজাঁ’র হাতে দিয়ে দিল। ভলজাঁ দু বার দুটো গুলি করে যে দড়ি দুটোতে তোষকটা ঝোলানো ছিল সেই দুটো কেটে দিল আর সঙ্গে সঙ্গে ঝোলানো তোষকটা নিচেতে পড়ে গেল।

ওরা সবাই হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল ভলজাঁকে। সবাই বলে উঠল, তোষক পাওয়া গেছে।

কমবেফারে বলল, পাওয়া তো গেছে, তোষকটা তুলে আনবে কে?

তোষকটা পড়ে ছিল দু পক্ষের মাঝখানে খালি জায়গাটাতে। সে জায়গাটাতে এ ধার থেকে কেউ গেলেই ও ধারের সেনাবাহিনীর লোকেরা গুলি করতে পারে। সেনাবাহিনীর লোকেরা তখন তাদের সার্জেন্টের মৃত্যুর পর বিপ্লবীদের লক্ষ্য করে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়েছিল। ভলজাঁ তখন কাউকে কিছু না বলে ব্যারিকেডের পাশ দিয়ে গুলিবর্ষণের ভয়কে তুচ্ছ করে তোষকটা পিঠের উপর তুলে নিয়ে এদিকে চলে এল। তোষকটা আনা হলে সেটা দিয়ে ব্যারিকেডের ফুটোটা বন্ধ করে দেওয়া হল।

এঁজোলরাস এবার ভলজাঁকে বলল, নাগরিক, আমাদের প্রজাতন্ত্র তোমায় ধন্যবাদ জানাচ্ছে।

বোসেত হাসতে হাসতে বলল, সামান্য একটা তোষক দিয়ে কামানের গোলাকে আটকানো হচ্ছে।

.

৯.

লা শাভেরি’র ঘাঁটিতে যখন এই সব কাণ্ড চলছিল ঠিক সেই সময় কসেত্তে জেগে ওঠে। প্যারিসে যে সব কাণ্ড চলছে তার কিছুই জানে না সে। গত রাতে সে যখন বিছানায় শুতে যায় তখন তুসাঁ তাকে বলেছিল, শহরে গোলমাল হচ্ছে। তার পর আর কিছু জানে না সে। গতরাতে তার ঘুম ভালোই হয়েছে। শেষরাতের দিকে মেরিয়াসকে স্বপ্নে দেখে সে। স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমটা ভেঙে যায় তার। দেখে সকাল হয়ে গেছে।

ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর কোনও দুঃখকে আমল দিল না কসেত্তে। ভলজাঁ’র মতো তার আত্মাও শক্ত হয়ে উঠেছে আঘাতে আঘাতে। এক নতুন আশায় সঞ্জীবিত হয়ে সে আত্মা সব দুঃখ-দুর্ভাগ্যের আঘাতকে প্রতিহত করতে শিখেছে যেন।

আজ তিন দিন হল মেরিয়াসকে দেখেনি সে। সে ভাবল এতক্ষণ সে নিশ্চয় সে চিঠি পেয়েছে এবং তাদের ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সে নিশ্চয় আজ সন্ধের সময় এসে পড়বে। ঈশ্বরের বিধানে তিনটি দিন সে দেখতে পায়নি মেরিয়াসকে। মেরিয়াসকে ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকা অসম্ভব তার পক্ষে। তবু সে এই তিনটি দিনের বিরহব্যথা সহ্য করেছে নীরবে। আজ সে ব্যথার অবসান ঘটবে। আজ নিশ্চয় মেরিয়াস এসে তাকে সুসংবাদ দান করবে। যৌবনের দুর্মর প্রাণশক্তি এইভাবে ভাগ্যের সব নিষ্ঠুর পরিহাসকে ও বিপদের ভয়াবহতাকে হেলাভরে অস্বীকার করে এক কৃত্রিম সুখে মত্ত হয়ে থাকে।

মেরিয়াসের সঙ্গে তার যেদিন শেষ দেখা হয় সেদিন চুপ করে কী ভাবছিল এবং সে কেন তার কাছে এতদিন আসতে পারবে না তার কারণ হিসেবে সে তাকে কী বলেছিল তা সে মনে করতে পারল না। তার স্মৃতির স্বল্পতার জন্য বিরক্তিবোধ করল কসেত্তে। মেরিয়াসের কথা ভুলে যাওয়ার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে হল তার।

বিছানা থেকে উঠে একই সঙ্গে আর ভুলের জন্য প্রার্থনা আর প্রসাধনের কাজ দুটো সারল। কোনও কুমারী মেয়ের শোবার ঘর হল মুদ্রিত শতদলের কোরাভ্যন্তরভাগের মতো যার মধ্যে বিরাজ করে ছায়াচ্ছন্ন শুভ্রতায় ভরা এক স্বতঃশুদ্ধ গোপনতা। সূর্যের উত্তাপে তার পাপড়িগুলো উজ্জীবিত না-হওয়া পর্যন্ত সে অভ্যন্তরভাগ কেউ দেখতে পায় না। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গর সমস্ত লাবণ্য এক লজ্জার আবরণের মধ্যে ঢেকে রাখে সে।

উদীয়মান সন্ধ্যাতারার মতো সদ্য নিদ্রোখিতা কোনও কুমারীর দিকে শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে হবে পুরুষকে। কুমারী মেয়ে হচ্ছে স্বপ্নের বস্তু, তাকে জাগ্রত অবস্থায় খোলা চোখে দেখতে নেই। কোনও পুরুষ যদি তার নির্লজ্জ দৃষ্টিশর দিয়ে তার অস্পৃশনীয় অবগুণ্ঠনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে তার দেহের লাবণ্যলতাকে বিদ্ধ করতে চায় তা হলে তা অধর্মাচরণের শামিল হবে। প্রাচ্যদেশীয় এক রূপকথায় বলে, ঈশ্বর যখন প্রথম গোলাপ সৃষ্টি করেন তখন তা শুদ্ধ ছিল, কিন্তু তার ওপর একদিন প্রথম পুরুষ আদমের দৃষ্টি পড়ায় সঙ্গে সঙ্গে তা লজ্জায় গোলাপি হয়ে ওঠে।

কসেত্তে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে পোশাক পরে ও চুল বেঁধে তার জানালাটা খুলল। কিন্তু বাড়ির পেছনদিকে উঁচু পাঁচিল থাকায় রাস্তার একটুখানি অংশ দেখতে পেল। উঁচু পাঁচিলের ওধারে ফোঁটা ফুলের বাগান থাকায় তাতে রাস্তাটা ঢাকা পড়ে গেছে। সে ভাবল, মেরিয়াস ওই পথে এলে সে দেখতে পাবে না। তাই তার জীবনে আজ প্রথম ফুলগুলোকে সবচেয়ে কুৎসিত মনে হল তার। তাই সে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আকাশের পানে তাকাল। মেরিয়াস হয়তো আকাশপথে নেমে আসবে তার কাছে এই ধরনের অবান্তর কথা মনে হল তার। কিছু না বুঝলেও বাতাসে যেন এক অজানা বিপদের আভাস পেল। এক আশাহত দুঃখ ও বেদনায় চোখে জল এল তার।

সমস্ত বাড়িটার মধ্যে এক গ্রাম্য নীরবতা বিরাজ করছিল। বাড়িটার মধ্যে অনেক ঘর থাকলেও কোন ঘরের দরজা-জানালা খোলা হয়নি। তুস তখনও ওঠেনি। এমনকি দারোয়ানের ঘরের দরজাও বন্ধ। কসেত্তে ভাবল, তার বাবা হয়তো তার ঘরে ঘুমুচ্ছে তখনও। দূর থেকে কিসের ভারী শব্দ আসছিল। কিন্তু সে শব্দ কামানের গোলা, না বন্দুকের গুলির শব্দ সে বুঝতে পারেনি। সে বুঝতে পারল না কেন সব বাড়ির লোকেরা জানালাগুলো একবার খুলেই আবার বন্ধ করে দিচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।

কসেত্তে’র ঘরের জানালার নিচে কার্নিশে একটা পাখির বাসা ছিল। সে বাসাতে পক্ষীমাতা ডানা মেলে ধরে ছিল তার শাবকদের উপর। পিতা ঘুরে ঘুরে কোথা থেকে খাবার জোগাড় করে এনে দিচ্ছিল। এই পাখির বাসাটা কসেত্তের কুমারী মনের ওপর এক গভীর প্রভাব বিস্তার করল। মেরিয়াসের কথাটা মনে পড়ে গেল তার। মা-বাবা ও সন্তানদের দ্বারা পরিপূর্ণ এক সুখী বাসার ছবি ভেসে উঠল তার মনের মধ্যে।

.

১০.

আক্রমণকারী সেনাবাহিনী বন্দুক আর স্টেনগান থেকে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ কোনও ক্ষতি হয়নি। শুধু হোটেলের দোতলার জানালাগুলো ভেঙে গিয়েছিল। সেই সব জানালার ধারে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা সরে গিয়েছিল। বিপ্লবীদের ঘাঁটি বা ব্যারিকেড আক্রমণ করার এটাই হল রীতি। আক্রমণকারীরা সমানে গুলি চালিয়ে বিপ্লবীদের কাছ থেকে গুলির প্রতিদান চায়, কারণ তারা জানে বিপ্লবের গুলির পরিমাণ কম। তারা যদি নির্বোধের মতো বেশি গুলি খরচ করে তা হলে তা ফুরিয়ে গেলে তারা পালাতে থাকে আর তখনই ঘাঁটি দখল করে আক্রমণকারী সেনাদল। এঁজোলরাস এই ফাঁদে ধরা দেয়নি। সে যখন-তখন গুলি চালিয়ে শত্রুপক্ষের গুলির প্রত্যুত্তর দেয়নি। যতবার সৈন্যরা গুলি ছুঁড়ছিল ততবার গাভ্রোশে তার জিবটা বার করে গালের উপর বুলিয়ে ভেংচাচ্ছিল। আর কুরফেরাক তাদের বিদ্রূপ করছিল।

যোদ্ধাদের মধ্যে কৌতূহল খুবই স্বাভাবিক। সেনাবাহিনীর লোকেরা যখন দেখল বিপ্লবীরা কোনও গুলির প্রত্যুত্তর না দিয়ে চুপ করে আছে তখন তাদের ঘাঁটিতে কী ঘটেছে, ভয়ঙ্কর কোনও প্রতি-আক্রমণের জন্য নীরবে গোপনে প্রস্তুত হচ্ছে কি না, তা দেখার কৌতূহল হল তাদের। এই দেখার জন্য সেনাদলের অফিসাররা একজন সৈনিককে কাছাকাছি একটা বাড়ির পাইপ বেয়ে উপরে ওঠার হুকুম দেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিপ্লবীরা দেখল লোহার শিরস্ত্রাণপরা এক সৈনিক তাদের দিকে পেছন ফিরে একটা বাড়ির গায়ের পাইপ বেয়ে উপরে উঠছে।

তখন কোনও কথা না বলে তার বন্দুকটা দিয়ে একটা গুলি করল ভলজাঁ। গুলিটা সৈনিকের শিরস্ত্রাণটায় লাগতেই সেটা নিচে পড়ে গেল।

তখন সেনাদলের এক অফিসার সেই পাইপটা বেয়ে উপরে উঠতে থাকলে ভলজাঁ আবার গুলি করল। এবার তারও শিরস্ত্রাণটা সেইভাবে গুলি লেগে পড়ে গেল।

বোসেত ভলজাঁকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি ওদের হত্যা না করে শিরস্ত্রাণ দুটো ফেলে দিলে কেন?

ভলজাঁ তার কোনও উত্তর দিল না।

বোসেত কুরফেরাককে কথাটা বলতে কুরফেরাক বলল, দয়া করে ওদের মারেনি।

সেনাবাহিনীর অবিরাম গুলিবর্ষণ দেখে এঁজোলরাস বিরক্ত হয়ে বলল, ওরা বোকা, অকারণে ওরা আমাদের গুলি খরচ করাতে চাইছে।

এঁজোলরাস যেন জন্মবিপ্লবী নেতা। সে জানত বিদ্রোহী আর বিদ্রোহ দমনকারী সেনাবাহিনী এক নয়। এটা অসম যুদ্ধ। এ যেন একশো জনের বিরুদ্ধে একজনের যুদ্ধ। বিপ্লবীদের একটা গুলি খরচ হলে বা একটা যোদ্ধা মারা গেলে তা পূরণ করতে পারে না। তাদের লোক বা অস্ত্রশস্ত্র সীমিত। কিন্তু সরকারি সৈন্যবাহিনীতে অনেক সৈন্য, তাদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র আছে এবং অস্ত্রশস্ত্র তৈরির কারখানা আছে। তবে যদি সমগ্র দেশ বিপ্লবে ফেটে পড়ে, যদি প্রতিটি শহরের ইট-কাঠ-পাথর জেগে ওঠে তবেই সরকারি সেনাদলকে হারিয়ে তারা মাথা তুলে উঠে জয়লাভ করতে পারে।

.

১১.

বিপ্লবীদের ব্যারিকেডের মধ্যে একসঙ্গে অনেকগুলো জিনিস কাজ করে। সেখানে আছে বীরত্ব, আছে যৌবন, আত্মসম্মান, উৎসাহ, আদর্শ, আত্মপ্রত্যয়, আর আছে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব। এক একসময় তারা এক নতুন আশার উত্তাপে উজ্জ্বলতায় সজীব হয়ে ওঠে পরক্ষণেই আবার হিমশীতল হতাশায় নির্জীব ও নিস্তেজ হয়ে যায়।

হঠাৎ এঁজোলরাস চিৎকার করে বলে উঠল, ওই শোন, আমার মনে হচ্ছে সমগ্র প্যারিস শহর জেগে উঠেছে।

কথাটা ঠিক। ৬ জুন ঘণ্টাখানেক বা ঘণ্টা দুই-এর জন্য শহরের লোকরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। র‍্যু দু পঁয়তিয়ের ও র‍্যু দে গ্রেভিনিয়েরে দুটো ব্যারিকেড় গড়ে ওঠে। পোর্তে সেন্ট মার্তিনে এক যুবক একা এক অশ্বারোহী দলের সেনাপতিকে সামনে থেকে গুলি করে হত্যা করে। পরে অবশ্য তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করা হয়। র‍্যু সেন্ট ডেনিসে একজন নারী একটা ঘরের জানালা থেকে জাতীয় রক্ষীবাহিনীর একজন লোককে গুলি করে। র‍্যু দ্য লা কসোনেরিতে চৌদ্দ বছরের একটি ছেলের পকেটে অনেক কার্তুজ পাওয়া যায়। র‍্যু বার্তিন নগরীতে জেনারেল কাভেগনাকের নেতৃত্বে এক সেনাদল আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয়। র‍্যু প্ল্যানশে মিত্রেতে সরকারি সেনাবাহিনীর উপর বাড়ির ছাদ থেকে যত সব লোহা ও কাঠের জিনিসপত্র ফেলা হয়।

এই সব কথা এঁজোলরাস না জানলেও কান খাড়া করে চারদিকে গোলমালের শব্দ পায়। সব ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী পাল্টা আক্রমণের দ্বারা বিদ্রোহীদের দমন করে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই উত্তেজিত জনতার সব বিদ্রোহ, সব বিক্ষোভের আগুন নিবে যায়। ক্ষণিকের জন্য যে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে সে বিদ্যুৎ থেকে বজ্রপাত হয় না।

সূর্য উঠল আকাশে। শাঁব্রেরি’র ঘাঁটিতে বিপ্লবীদের একজন বলল, আমাদের দারুণ ক্ষিদে পেয়েছে। আমাদের কি না খেয়ে মরতে হবে?

নীরবে ঘাড় নাড়ল এঁজোলরাস।

কুরফেরাক তখনও সেনাবাহিনীর লোকেরা গুলিবর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিদ্রূপ করে যাচ্ছিল সমানে। বোসেত একসময় এঁজোলরাসের অপরিসীম ধৈর্য দেখে বলল, আমি সত্যিই প্রশংসা করি এঁজোলরাসের। বিপদে কত শান্ত এবং ধীর, অথচ সে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করে। তার কোনও প্রেমিকা নেই। আমাদের প্রত্যেকের প্রেমিকা আছে। আমরা তাদের কাছ থেকে উৎসাহ পাই। একজন প্রেমিক বাঘ-সিংহের মতো হিংস্রভাবে যুদ্ধ করতে পারে। কিন্তু সে নিজের মন থেকেই সব উৎসাহ-উদ্দীপনা পায় না। সে কখনও বরফের মতো ঠাণ্ডা, কখনও আগুনের মতো গরম।

এঁজোলরাস অন্য মনে একসময় বলে উঠল, ‘প্যাত্রিয়া’। কথাটা সে অনুচ্চস্বরে বলায় কেউ শুনতে পেল না।

সেনাবাহিনী এবার দ্বিতীয় একটা কামান এনে গোলাবর্ষণের জন্য তৈরি হল। এঁজোলরাস বিরক্ত হয়ে বলল, এদের এই বাঁদরামি বন্ধ করতে হবে। ওদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়।

এতক্ষণ ধরে নীরব হয়ে থাকা ব্যারিকেড থেকে একঝাঁক গুলি বেরিয়ে গেল। তাতে সেনাবাহিনীর কয়েকজন গোলন্দাজ সামনে উপুড় হয়ে পড়ে গেল।

বোসেত বলে উঠল, চমৎকার। এ এক বিরাট সাফল্য।

এঁজোলরাস বলল, আর একবার এ সাফল্য লাভ করতে গেলেই আমাদের সব কার্তুজ ফুরিয়ে যাবে।

কথাগুলো মনে হয় গাভ্রোশের কানে গিয়েছিল।

কুরফেরাক হঠাৎ দেখল গাভ্রোশে হোটেল থেকে একটা ঝুড়ি বার করে গুঁড়ি মেরে রাস্তায় চলে গেল ব্যারিকেডের পাশ দিয়ে। যে সব নিহত সৈনিকের মৃতদেহগুলো রাস্তায় পড়েছিল সে তাদের থেকে কার্তুজের বাক্সগুলো বার করে ঝুড়িতে ভরতে লাগল। দু পক্ষের গুলিবর্ষণের ফলে রাস্তায় তখন চাপ চাপ ধোয়া ছিল। সেই ধোঁয়ায় তাকে দেখা যাচ্ছিল না।

কুরফেরাক চিৎকার করে বলল, কী করছিস গাভ্রোশে?

আমি আমার ঝুড়ি ভর্তি করছি।

ওরা গুলি ছুঁড়ছে যে।

তাতে কী হয়েছে?

চলে আয় তাড়াতাড়ি।

ঠিক সময়ে যাব।

কুয়াশায় এতক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়নি গাভ্রোশেকে। কুয়াশাটা পাতলা হয়ে যেতেই তাকে দেখতে পেয়ে ওধার থেকে সৈনিকরা গুলি করতে লাগল তাকে লক্ষ্য করে। প্রথম গুলিতে তার কার্তুজভরা ঝুড়িটা উল্টে গেল। গাভ্রোশে আবার কার্তুজগুলো কুড়িয়ে ভর্তি করে ফেলল তার ঝুড়িটা। গাভ্রোশে একটা গান ধরল নির্বিকারভাবে। পর পর আরও দুটো গুলিতে উল্টে গেল গাভ্রোশের ঝুড়িটা। গাভ্রোশে গান করতে করতে কুড়োতে লাগল। মাঝে মাঝে সৈনিকদের চোখের সামনে সে নাচতে লাগল। সৈনিকরাও হাসতে লাগল। এক একটা গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে এক একটা নতুন গান শুরু করল সে। চড়ুই পাখির মতো লাফাতে লাগল, চতুর্থ গুলিটা তার দেহের পাশ দিয়ে চলে গেল। একটুর জন্য বেঁচে গেল সে। ব্যারিকেডের সবাই ভয়ে কাঁপতে লাগল। গাভ্রোশে কিন্তু নির্বিকার। সামান্য একটা রাস্তার ছেলে মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগল যেন। কিন্তু অবশেষে একটা গুলি তার গায়ে লাগতেই সে টলতে লাগল। তার গা থেকে রক্ত ঝরতে লাগল, সে খাড়া হয়ে বসে রইল। তবু সে গান গাইতে লাগল। কিন্তু তার গান শেষ না হতেই আবার একটা গুলি তাকে ধরাশায়ী করে দিল। সে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। এবার তার প্রাণপাখি বেরিয়ে গেল দেহ থেকে।

.

১২.

লুক্সেমবুর্গ বাগানে তখন দুটি ছেলে হাত ধরাধরি করে বেড়াচ্ছিল। একজনের বয়স সাত আর একজনের বয়স প্রায় পাঁচ। বৃষ্টিতে তাদের সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছিল। বড় ছেলেটি ছোট ছেলেটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। ছোট ছেলেটি বলল, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।

বড় ছেলেটি বাঁ হাত দিয়ে ছোট ছেলেটিকে ধরে ছিল আর তার ডান হাতে একটা ছুরি ছিল। রাত্রিতে এ বাগানে সেনাবাহিনীর একটা দল ছাউনি করে ছিল। সকাল হতেই তারা তাদের কাজে চলে গেছে। বাগানে রাস্তার ভবঘুরে ছেলেদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। তবু তারা গতকাল সন্ধের সময় যখন বাগানের গেট বন্ধ করা হয় তখন দারোয়ানের দৃষ্টি এড়িয়ে কোনওরকমে ঢুকে পড়েছে।

এই দুটি ছেলেকেই একদিন গাভ্রোশে রাত্রিতে তার বাসায় আশ্রয় দেয়। এরা। দু জনেই থেনার্দিয়েরের সন্তান যাদের তারা লা ম্যাগননের হাতে তুলে দেয়। লা ম্যাগনন বাড়িছাড়া হলে তারাও বৃন্তচ্যুত পাতার মতোই ছিটকে পড়ে। নিরাশ্রয় হয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকে। একদিন যাদের পরনে ভালো পোশাক থাকত আজ তাদের পরনের সব পোশাক ছেঁড়া ও ময়লা হয়ে গিয়েছে। পুলিশ একবার ধরে তাদের পরিত্যক্ত সন্তান হিসেবে চিহ্নিত করে।

তখন গোলমালের সময় বলেই বাগানে সকলের অলক্ষে ঢুকে রাত কাটাতে পায় তারা। কারণ বাগানের দারোয়ানদের চিন্তা বাইরের হাঙ্গামার দিকে থাকায় বাগানের ভেতর কী হচ্ছে না-হচ্ছে সেদিকে তাদের খেয়াল ছিল না।

গত রাত্রিতে বৃষ্টি হয়েছিল। বসন্তের বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। দিনের বেলায় বৃষ্টির পরক্ষণেই রোদ ওঠে। আকাশটা আরও নীল দেখায়, গাছপালা আরও সবুজ হয়ে ওঠে। উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ আর নিচে সবুজ গাছপালা। বসন্তের প্রকৃতি উপরে-নিচে দু রঙের জামা পরে। সেদিন ৬ জুন তারিখে বেলা এগারোটার সময় লুক্সেমবুর্গ বাগানের সবুজ গাছপালাগুলো যেন মধ্যাহ্নসূর্যের সঙ্গে এক নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ ছিল। বাদামগাছে বুলবুল আর কাঠঠোকরা পাখি ডাকছিল। এক অমিত প্রাণচঞ্চলতা প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য ঝরে পড়েছিল আলোছায়াভরা নগ্নসবুজ গাছপালার মধ্যে।

বাগানের ভেতর যে একটা পুকুর ছিল তাতে হাঁস চরে বেড়াচ্ছিল। ছেলে দুটি পুকুরের ধারে গিয়ে হাঁসের ঘরটায় বসল। মাঝে মাঝে লে হ্যালে থেকে গোলাগুলির শব্দ আসছিল। সেদিকে কোনও মনোযোগ দিল না ওরা।

এমন সময় মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক তার শিশুপুত্রকে নিয়ে বেড়াতে এল বাগানে। তারা পুকুরের ধারে একটা বেঞ্চের উপর বসল। ছেলেটির হাতে একটা মিষ্টি পাউরুটি ছিল। ছেলেটিকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল তার পেট ভর্তি ছিল, ক্ষিদে ছিল না মোটেই।

এবার ভদ্রলোকের হাঁসের ঘরে বসে থাকা ছেলে দুটির ওপর নজর পড়ল। সেই সময় দূর থেকে গুলিবর্ষণের শব্দ এল। ছেলেটি তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করল, ও কিসের শব্দ?

তার বাবা বলল, অরাজকতা চলছে চারদিকে। বাগানের মধ্যেও অরাজকতা ঢুকে পড়েছে।

ছেলেটি বলল, আমার ক্ষিদে নেই।

তার বাবা বলল, একটা কেক খেতে ক্ষিদের দরকার হয় না।

আমার এটা ভালো লাগছে না, এটা বাসি।

তা হলে ওই হাসদের দিয়ে দাও।

ছেলেটি দিতে চাইছিল না। তার বাবা তখন বলল, উদার হও, না খেতে পারলে খাবার জিনিস জন্তু-জানোয়ারদের দিয়ে দিতে হয়।

অবশেষে পাঁউরুটিটা জলের উপর ফেলে দিল ছেলেটি। তার বাবা হাততালি দিয়ে হাঁসগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল।

এবার আরও জোর গুলি আর চেঁচামেচির শব্দ কানে এল ওদের। তার ওপর আকাশে মেঘ করে এল।

ভদ্রলোক তার ছেলেকে বলল, মনে হচ্ছে সেনাবাহিনী তুলিয়ের আক্রমণ করেছে। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তার ওপর মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে। তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।

ওরা চলে যেতেই ছেলে দুটি হাঁসের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তাদের দৃষ্টি ছিল জলের উপর ভাসতে থাকা পাউরুটিটার ওপর। হাঁসগুলো তখন পাউরুটিটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ধরতে পারেনি তখনও। বড় ছেলেটি তার ছড়িটা দিয়ে হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পাউরুটিটাকে তুলে নিয়ে এল জল থেকে। তার পর সেটাকে দু ভাগ করে বড় অংশটা তার ছোট ভাইকে দিল।

.

১৩.

গাভ্রোশে মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরিয়াস কমবেফারের সঙ্গে ব্যারিকেড থেকে ছুটে রাস্তায় চলে গেল। মেরিয়াস গাভ্রোশের মৃতদেহটাকে নিজের কাঁধের উপর তুলে নিল আর কমবেফারে কার্তুজরা ঝুড়িটা তুলে নিল। দু জনে এক মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এল তাদের ঘাঁটির মধ্যে। আসার সময় মেরিয়াসের মাথার খুলিতে অল্প একটু গুলি লাগায় রক্ত ঝরছিল তার মাথা থেকে। এই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে সে যেন থেনার্দিয়েদের প্রতি তার ঋণ শোধ করছিল।

কুরফেরাক মেরিয়াসের মাথাটা ব্যান্ডেজ করে দিল। কমবেফারে গাভ্রোশের মৃতদেহটাকে টেবিলের উপর মেবুফে’র মৃতদেহের পাশে রেখে দিল। তার পর কমবেফারে ঝুড়ি থেকে কার্তুজগুলো নিয়ে পনেরো রাউন্ড করে গুলি সকলকে ভাগ করে দিল। কিন্তু ভলজাঁকে তার ভাগ দিতে গেলে সে নিল না। সে এঁজোলরাসকে বলল, উনি আমাদের দলে এসে যোগ দিলেও বোধ হয় যুদ্ধ করতে চান না।

এঁজোলরাস বলল, তা হলেও দরকারের সময় সাহায্য করেন।

ব্যারিকেডের উপর ক্রমাগত গোলাগুলি বর্ষণ চলতে থাকলেও প্রতিরক্ষাকারী বিপ্লবীরা তাতে বিচলিত হল না কিছুমাত্র। অবস্থা যতই সংকটজনক হয়ে উঠতে লাগল, সংকটটা যতই বিপদে পরিণত হয়ে উঠতে লাগল, বিপ্লবীদের মনোবল ততই বেড়ে উঠতে লাগল, ততই তাদের বীরত্ব উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল। কুরফেরাক আহতদের ক্ষত জায়গাগুলোতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছিল। বোসেত আর ফুলি গাভ্রোশের ঝুড়ি থেকে বারুদের পাউডার নিয়ে আরও কার্তুজ তৈরি করছিল। জাঁ ভলজাঁ তার পেছনের দিকের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে নীরবে কী ভাবছিল। কয়েকজন বিপ্লবী একটা ড্রয়ারের মধ্যে কিছু রুটি পেয়ে গ্রোগ্রাসে তাই খাচ্ছিল। কুগুদ থেকে আসা কয়েকজন যুবক গল্প করছিল নিজেদের মধ্যে।

গৃহযুদ্ধের সময় বিপ্লবীদের ঘাঁটিগুলোতে এই রকম অবস্থাই দেখা যায়। তার ভেতরটা যখন শান্ত থাকে, যখন অজানা ও অনিশ্চয়তার একটা কুয়াশা ঘিরে থাকে তখন সহসা এক প্রচণ্ড বিক্ষোভের আগুনে ফেটে পড়ে সেটা।

ঘড়িতে ঢং ঢং শব্দে বেলা দুটো বাজতেই চমকে উঠল লা শাঁব্রেরি’র ঘাঁটির বিপ্লবীরা। এঁজোলরাস উঠে দাঁড়িয়ে হুকুম দিল, আরও পাথর এনে একতলার মেঝেটা ভরে দাও। তোমাদের অর্ধেক বন্দুক হাতে পাহারা দাও আর বাকি তোক পাথর বয়ে আন। এক মিনিট সময়ও নষ্ট করলে চলবে না।

এদিকে রাস্তার ওপারে সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে কুড়ুল হাতে একদল লোক এল। ব্যারিকেড ভাঙার জন্য ওদের দরকার হবে।

এঁজোলরাসের আদেশ অবিলম্বে পালিত হল। সেনাবাহিনী দুটো কামান ঠিক করে রেখেছে ব্যারিকেডটাকে উড়িয়ে দেবার জন্য। তারা এবার জোর আক্রমণ চালাতে চায়। এঁজোলরাস এবার মৃতদেহ-রাখা টেবিলটার তলা থেকে মদের বোতলগুলো বার করে সবাইকে ভাগ করে দিল।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আক্রমণের দেরি হচ্ছিল বলে এঁজোলরাস সব কিছু গুছিয়ে নেবার সময় পেল। সব ঠিক হয়ে গেলে এঁজোলরাস মেরিয়াসকে বলল, আমরা দু জন নেতা। তুমি বাইরে থেকে সব কিছু লক্ষ রাখবে, হুকুম দেবে আর আমি ভেতর থেকে হুকুম দেব।

মেরিয়াস ব্যারিকেডের উপর একটা জায়গা তার পর্যবেক্ষণ স্থান হিসেবে বেছে নিল। এঁজোলরাস হোটেলের যে রান্নাঘরে আহতদের রাখা হয়েছিল তার দরজাটা বাইরে থেকে পেরেক এঁটে বন্ধ করে দিল যাতে গোলগুলির কোনও টুকরো তার মধ্যে ঢুকতে না পারে। ফুলি তার আদেশগুলো ঘর থেকে জোর দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল।

এঁজোলরাস আবার আদেশ দিল, সিঁড়িগুলো ভেঙে দেবার জন্য কুড়ুল ঠিক করে রাখ হাতের কাছে, সৈনিকরা যাতে উপরতলায় সহজে উঠে যেতে না পারে।

সে আবার বলল, আমরা মোট কতজন আছি?

ছাব্বিশ জন। কতগুলো বন্দুক আছে?

চৌত্রিশটা।

তা হলে আটটা বাড়তি আছে। ওগুলোতে গুলি ভরে হাতের কাছে রেখে দাও। কুড়িজন বাইরে ব্যারিকেড রক্ষার কাজে থাকবে আর ছয়জন দোতলার ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে গুলি চালনার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে।

এইভাবে সবকিছু বুঝিয়ে দেবার পর এঁজোলরাস জেভাতের দিকে মুখ ফেরাল। বলল, আমি তোমার কথা ভুলিনি। সবশেষে যে লোক এই ঘর ছেড়ে যাবে সে তোমাকে গুলি করবে। এই টেবিলে একটা পিস্তল রইল।

একজন বলল, এখনি ওকে হত্যা করা হোক না কেন।

এঁজোলরাস বলল, না। মদেতুরে’র ছোট ব্যারিকেডটার উপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে ওকে।

জেভার্ত নীরবে নির্বিকারভাবে শুনে গেল সবকিছু।

ভলজাঁ ছিল ব্যারিকেডে প্রতিরক্ষাকারীদের দলে। সে এঁজোলরাসের কাছে এগিয়ে এসে বলল, তুমিই এখানকার বিপ্লবীদের নেতা?

হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ আগে তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলে।

আমি ধন্যবাদ দিয়েছিলাম প্রজাতন্ত্রের পক্ষ থেকে। মেরিয়াস আর তুমি দু জনে ব্যারিকেড রক্ষা করেছিলে।

আমি কোনও পুরস্কারের যোগ্য বলে মনে কর? নিশ্চয়।

তা হলে আমি একটা পুরস্কার চাই।

কী সে পুরস্কার?

জেভার্তের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি এই লোকটার মাথাটা গুলি করে উড়িয়ে দিতে চাই।

জেভার্ত ভলজাঁ’র দিকে তাকিয়ে বলল, খুব ভালো কথা।

এঁজোলরাস তার দোনলা বন্দুকটায় গুলি ভরছিল। সে বলল, এ বিষয়ে কারও আপত্তি আছে?

কেউ কোনও কথা বলল না। এঁজোলরাস তখন ভলজাঁকে বলল, ঠিক আছে, এই গুপ্তচরটা তা হলে তোমার হাতেই পড়ল।

ভলজাঁ জেভার্তের পাশে টেবিলের একধারে বসে পিস্তলটা হাতে নিল। ঠিক সেই মুহূর্তে মেরিয়াস বাইরে থেকে চিৎকার করে উঠল, প্রস্তুত হও।

এঁজোলরাস উপর থেকে হুকুম দিল, ব্যারিকেডের লোকরা সবাই বাইরে চলে যাও।

জেভাৰ্ত ভলজাঁকে বলল, তোমাদের অবস্থা আমার থেকে একটুও ভালো নয়।

সকলেই ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

সকলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও ভলজাঁ বেরিয়ে গেল না। সে জেভার্তের কাছেই বসেই রইল। যে দড়িটা দিয়ে জেভাৰ্ট টেবিলের সঙ্গে বাঁধা ছিল সেটা খুলে দিয়ে তাকে উঠে দাঁড়াতে বলল ভলজাঁ। জেভার্ত একটুখানি ক্ষীণ হাসি হেসে উঠে দাঁড়াল। ভলজাঁ এবার তার কোটের কোমরে যে বেল্ট ছিল তা ধরে তাকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে মদেতুরে’র ছোট ব্যারিকেডটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, একমাত্র মেরিয়াস ছাড়া কেউ দেখতে পেল না তাদের। কারণ সকলেই তখন পেছন দিয়ে ব্যারিকেড় রক্ষার কাজে ব্যস্ত ছিল।

ব্যারিকেডটার উপর উঠে ভলজাঁরা দেখল অদূরে কতকগুলি মৃতদেহ স্তূপাকার করা আছে। তার মধ্যে এপানিনের মৃতদেহটাও ছিল। সেটা দেখে জেভার্ত বলল, মনে হচ্ছে আমি চিনি মেয়েটিকে।

ভলজাঁ তখন বলল, তুমি আমাকেও চেন।

জেভার্ত বলল, প্রতিশোধ নাও।

ভলজাঁ পকেট থেকে একটা ছুরি বার করে সেটা খুলল।

জেভার্ত বলল, ছুরি দিয়ে মারবে? ভালো। সেটাই তোমার পক্ষে সহজ হবে।

জেভার্তের ঘাড়ে আলগাভাবে যে ফাঁসের দড়িটা পরানো ছিল সেটা তার ছুরি দিয়ে কেটে দিল। তার পর বলল, এবার তুমি চলে যাও।

জেভা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। তার প্রভূত আত্মসংযম সত্ত্বেও সে বিস্ময় প্রকাশ করে পারল না। সে ভলজাঁ’র মুখপানে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।

ভলজাঁ বলল, এখান থেকে আমি জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে পারব না। তবে যদি পারি তো দেখা হবে। আমার ঠিকানাটা জেনে রাখ। আমি ফশেলেভেন্তু নাম ধারণ করে ৭ র‍্যু দ্য হোমি আমেতে থাকি।

জেভার্তের ঠোঁটের কোণটা একটু কুঁচকে উঠল। ভলজাঁ বলল, দেরি কর না, চলে যাও।

ভাবতে ভাবতে বাজারের পথে এগিয়ে চলল জেভার্ত। ভলজাঁ সেই দিকে তাকিয়ে রইল। যেতে যেতে হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে। আমি চাই তুমি আমাকে হত্যা কর।

ভলজাঁ বলল, চলে যাও শিগগির।

জেভার্ত তার দৃষ্টিপথের সীমা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলে পিস্তল থেকে একটা ফাঁকা আওয়াজ করল ভলজাঁ। জায়গাটা একটি বাড়ির আড়ালে ছিল বলে বিপ্লবীরা দেখতে পেল না। গুলি করার পর ভলজাঁ ফিরে এসে বলল, সব শেষ।

ব্যারিকেড রক্ষার ব্যাপারে মেরিয়াসের মনটা ব্যস্ত এবং চঞ্চল থাকলেও গুলির শব্দে তার হুঁশ হল। হঠাৎ তার মনে হল যে লোকটাকে ভলজাঁ একটু আগে মারল গুলি করে সেইটি হয়তো সেই পুলিশ ইনসপেক্টার জেভার্ত যে একদিন তাকে দুটো পিস্তল দিয়েছিল। সে এঁজোলরাসকে জিজ্ঞাসা করতে এঁজোলরাসও বলল, ওরই নাম জেতার্ত।

কিছুটা আগে একথা জানলে তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করত মেরিয়াস। কিন্তু এখন আর সময় নেই। ভলজাঁ এসে বলেছে, সব শেষ হয়েছে।

.

১৪.

একই সঙ্গে আকাশে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা, দু পাশে সারবন্দি বাড়িগুলোর ভয়ঙ্কর নীরবতা, রাস্তার উপর পদাতিক ও অশ্বারোহী বাহিনীর আনাগোনা, গোলাগুলির মুহূর্মুহূ শব্দ, চারদিকে উডডীয়মান ধোঁয়ার কুণ্ডলী–সব মিলিয়ে সেদিনের সেই সময়টাকে এক চরম মুহূর্তে পরিণত করে তুলেছিল।

গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাস্তার দু পাশের বড় বড় সারবন্দি বাড়িগুলোর দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ থাকায় সেগুলো দুর্গের মতো দেখাচ্ছিল।

সেকালে দু ধরনের বিপ্লব দেখা যেত। রাষ্ট্রপতি খুব বাড়াবাড়ি করছে এবং সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ প্রতিকারের অতীত দেখে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে বিপ্লবে যোগদান করত, যে বিপ্লবে সব শ্রেণির লোকদের সমর্থন থাকত, যে বিপ্লবকালে প্রতিটি বড় বাড়ি স্বেচ্ছায় এক একটি দুর্গে পরিণত হত সে বিপ্লব অবশ্যই সফল হত। কিন্তু যে বিপ্লব শুধু বিশেষ এক শ্রেণির লোকদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হত, যাতে দেশের বেশির ভাগ লোকের সমর্থন থাকত না সে বিপ্লবের জয়লাভের কোনও আশা থাকত না, সে বিপ্লবকালে শহরের সব পথঘাটগুলোকে জনহীন মরুভূমি বলে মনে হত, তখন রাস্তায় শুধু সেনাবাহিনী টহল দিয়ে বেড়াত আর দু পাশের বাড়িগুলো থাকায় বিপ্লবীদের পালাবার কোনও পথ থাকত না।

জনগণের এগিয়ে চলার এক বিশেষ গতিমাত্রা আছে। তারা যে গতিতে চলতে চায় তার থেকে বেশি দ্রুত গতিতে তাদের চালাতে চেষ্টা করা বৃথা। কোনও দেশের সব মানুষকে, একটা গোটা জাতিকে কখনও জোর করে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় না। বিপ্লবীরা তা চাইলে জনগণ তাদের পরিত্যাগ করে, তাদের মহামারীর মতো এড়িয়ে চলে। রুদ্ধদ্বার বাড়িগুলো এক ভয়ঙ্কর গাম্ভীর্যে জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, একটা বাড়িও দরজা খুলে একজন বিপ্লবীকেও আশ্রয় দিয়ে বাঁচায় না। যে ভয়ের অজুহাতে বাড়ির মধ্যে আবদ্ধ রাখে বেশির ভাগ লোক তারা কিন্তু সে ভয়কে প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত করে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? কেউ বিপ্লবের রূপ ধারণ করে, যুক্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরিবর্তে অনেকে অস্ত্র ধারণ করে, মিনার্ভাকে প্যালাসে পরিণত করে। যে জনগণের উন্নতির জন্য বিপ্লবীরা এত কিছু করে সেই জনগণই তাদের প্রতি উদাসীন ও অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে কেন, তা কেউ জানে না।

প্রগতি হল সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতি। এই প্রগতি যে সব সময় শান্তিপূর্ণ হবে–এমন কোনও কথা নেই। নদীর পথ যেমন সব সময় সহজ-সরল ও মসৃণ হয় না, অনেক সময় তাকে পাহাড় ভেঙে পাথরের বাধা ঠেলে চলতে হয় তেমনি মানবজাতির অগ্রগতির পথেও অনেক সময় আসে অনেক বাধাবিপত্তি। এই সব বাধাবিপত্তি দূর করার নামই হল বিপ্লব বা অন্তযুদ্ধ। যতদিন পর্যন্ত না বিশ্বশান্তি ও মানবজাতির মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে ততদিন মানবজাতির অগ্রগতির বিরাম হবে না আর বিপ্লবেরও শেষ হবে না।

এই প্রগতির জন্যই একটি আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু বীর প্রগতির পায়ে প্রাণবলি দেয়। আসলে ১৮৪৮ সালের এই জুন বিপ্লবে ফ্রান্সের বিপ্লবীরা রাজা লুই ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। আসলে রাজার বিরুদ্ধে তাদের বিশেষ কোনও অভিযোগ ছিল না। রাজা লুই ফিলিপ যে মানুষ হিসেবে ভালো–একথা তারা মুখে স্বীকার করত। তাদের আসল। উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্স থেকে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ। তাদের বিশ্বাস ছিল ফ্রান্স থেকে রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ হলেই সারা পৃথিবী থেকে স্বৈরাচারী শক্তির অবসান ঘটবে।

ফ্রান্সের জনগণের মনের একটা নিজস্ব ঐশ্বর্য আছে। সে ঐশ্বর্য হল এই যে তারা পেটে খাওয়াটাকেই বড় করে দেখে না। তারা এক পরম শিল্পীর মতো শুধু সমগ্র ইউরোপের নয়, সমগ্র মানবসভ্যতাকে এক আদর্শ রূপ দান করতে চায়। ইউরোপীয় সভ্যতার যে মশাল একদিন গ্রিস জ্বালে, যে মশাল পরে গ্রিস ইতালিকে দেয়, সেই মশালই ইতালি আবার ফ্রান্সের হাতে তুলে দেয়। ফ্রান্স একাধারে গ্রিস আর রোমের দুটো শ্রেষ্ঠ গুণ লাভ করতে চায়। সে এথেন্সের সৌন্দর্য আর রোমের শক্তি ও ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে চায়। তাছাড়া সে উদার। সে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য বারবার বিলিয়ে দিতে চায় নিজেকে। সে রাত্রিতে সবার শেষে ঘুমোয় এবং সকালে সবার আগে জাগে। ফ্রান্স একাধারে কবি এবং বিজ্ঞানী হতেও চায়। সে কবির মহান কল্পনাকে বিজ্ঞানের সাহায্য ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এক একটি সামাজিক আদর্শ ও সৌন্দর্যকে রূপায়িত করে তুলঁতে চায়। মানবসভ্যতার আদর্শ রূপকার হিসেবে ফ্রান্সের জনগণ একাধিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে মিথ্যা থেকে সত্য, অন্ধকার থেকে আলো, অন্যায় থেকে ন্যায়ে, নরক থেকে স্বর্গে, অন্ধ ক্ষুধা থেকে মুক্তি আর নীতির রাজ্যে নিজেদের উত্তরণ। ঘটাতে চায় তারা। তাদের এই যাত্রাপথের প্রথম স্তরে বস্তুর প্রাধান্য থাকলেও শেষ স্তরে তাদের একমাত্র লক্ষ্য হল আত্মা।

জনগণ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে প্রগতিকে রূপায়িত করে তোলার জন্য অনেক সময় এক অলীক অপরীক্ষিত আদর্শকে আঁকড়ে ধরে। বিপ্লবীরা ব্যর্থ হলে আমরা তাদের অভিযুক্ত করি। বর্তমান সমাজব্যবস্থাতে অস্তিত্বকে বিপন্ন করে দেশের সর্বত্র সন্ত্রাস ছড়িয়ে মানুষের দুঃখকষ্টকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে আমরা তিরস্কার করি তাদের।

তার উত্তরে তারা বলে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে যে কোনও সমস্যার প্রতিকার ভালো–একথা জেনেও আমরা সমাজের মঙ্গলের জন্যই এই সব করি। সমাজের উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য এক মহান আদর্শের খাতিরেই আমরা আত্মত্যাগ করি।

.

১৫.

সহসা জয়ঢাক বেজে উঠল।

ঝড়ের বেগে শুরু হল আক্রমণ। রাত্রিকালে যে আক্রমণ চলেছিল চুপিসারে গোপনে, এখন উজ্জ্বল দিবালোকে সে আক্রমণ শুরু হল প্রকাশ্যে। প্রথমে ব্যারিকেড়টাকে লক্ষ্য করে কামান দাগা হতে লাগল। আর সেই সঙ্গে পদাতিক বাহিনী সরাসরি এগিয়ে যেতে লাগল ঘাঁটি আক্রমণের জন্য। বিপ্লবীরাও জোর গুলি চালাতে লাগল। সেনাবাহিনীর সঙ্গে এবার জাতীয় রক্ষীবাহিনীর অনেক লোকও ছিল। উভয় পক্ষেই বীরত্ব হয়ে উঠল এক হিংস্র বর্বরতা।

এঁজোলরাস ছিল ব্যারিকেডের একপ্রান্তে আর মেরিয়াস ছিল ব্যারিকেডের বাইরের দিকের আর এক প্রান্তে। তার মাথাটা খালি ছিল। তার দেহের নিচের অংশ অর্থাৎ

কোমর পর্যন্ত ব্যারিকেডের আড়ালে থাকলেও উপরের অংশটা দেখা যাচ্ছিল।

কুরফেরাকের মাথাটা খালি দেখে বোসেত বলল, তোমার টুপি কোথায়?

কুরফেরাক বলল, একটা গুলি এসে আমার টুপিটা খুলে নিয়ে গেছে।

আক্রমণ চলল অব্যাহত গতিতে। ব্যারিকেড নয়, যেন অবরুদ্ধ এক ট্রয়নগরী। কয়েকজন ক্লান্ত, অবসন্ন ও অভুক্ত বিপ্লবী যারা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে খায়নি বা ঘুমোয়নি তারা এক বিরাট ও দুর্ধর্ষ সেনাদলের সঙ্গে লড়াই করে যেতে লাগল সমানে। আক্রমণের চাপ এবং প্রবলতা ক্রমশই বেড়ে যেতে লাগল। বিপ্লবীদের গুলি ফুরিয়ে আসতে লাগল।

বিপ্লবীদের ক্রমে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা সৈনিকদের সঙ্গে ছোরা, তরবারি আর বেয়নেট দিয়ে হাতাহাতি জনে জনে যুদ্ধ করতে লাগল। সে যুদ্ধে বোসেত, জলি, ফুলি, কুরফেরাক মারা গেল। কমবেফারেও বেয়নেটের তিনটে খোঁচায় মারা গেল। নেতাদের মধ্যে বেঁচে রইল শুধু মেরিয়াস আর এঁজোলরাস।

আঘাতে আঘাতে মেরিয়াসের মাথা আর মুখটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছিল। তার মাথা ও মুখ থেকে রক্ত ঝরছিল ক্রমাগত। একমাত্র এঁজোলরাসের সারা দেহের মধ্যে কোনও আঘাত লাগেনি বা কোনও ক্ষত দেখা যায়নি, তার এক হাতে ছিল একটা তরবারি, আর অন্য হাতে ছিল গুলিহীন দোনলা একটা বন্দুক।

মেরিয়াস আর এঁজোলরাস ছাড়া আর মাত্র সাত-আটজন বিপ্লবী জীবিত ছিল। এবার তারা সবাই পিছু হটতে লাগল। এতক্ষণ ধরে প্রাণের আশা ত্যাগ করে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করার পর যখন তারা দেখল তাদের ঘাঁটি রক্ষার আর কোনও উপায় নেই, যখন মৃত্যু এবার অবধারিত তখন আত্মত্যাগের প্রবণতার জায়গায় আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠল।

অবশিষ্ট বিপ্লবীদের নিয়ে হোটেলের মধ্যে ঢুকে পড়ল এঁজোলরাস। তারা ডবল খিল এঁটে সিঁড়িগুলো ভেঙে উপরতলায় উঠে গেল। ক্রমাগত গোলাগুলির আঘাতে হোটেলের উপরতলার দেয়ালগুলো ও ছাদের কয়েক জায়গা ধসে যায়। প্রচুর ক্ষতি হয় বাড়িটার।

কিন্তু আহত মেরিয়াস বাইরে পড়ে ছিল। আর একজন বাইরে ছিল। সে হল জাঁ ভলজাঁ।

একটা গুলি লেগে কাঁধের হাড় বেরিয়ে যায় মেরিয়াসের। সে পড়ে যায়। সে চেতনা হারিয়ে ফেলেছিল। তার মনে হল কে একজন ধরেছে তাকে। কসেত্তে’র কথা মনে পড়ল তার। সে অস্ফুটস্বরে বলল, আমি বন্দি হলাম। আমাকে ওরা গুলি করে মারবে।

হোটেলের দোতলায় আশ্রয় নেওয়া লোকদের মধ্যে মেরিয়াসকে দেখতে না পেয়ে চিন্তিত হল এঁজোলরাস। কিন্তু তখন আর কোনও উপায় নেই। দরজায় খিল দেওয়া হয়ে গেছে। সেই রুদ্ধ দরজার উপর সৈনিকরা জোর ধাক্কা দিচ্ছে ঘরে ঢোকার জন্য। এঁজোলরাস বলল, “আমরা মরব, কিন্তু আমাদের জীবন উপযুক্ত মূল্য দিয়ে কিনতে হবে ওদের।’ এই কথা বলে সে মেবুফে’র ঝুলতে থাকা হাতটা চুম্বন করল।

দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে সৈনিকরা দেখল নিচেরকার ঘরে টেবিলের উপর একটা চাদর ঢাকা দুটো মৃতদেহ রয়েছে আর কয়েকজন আহত লোক আর্তনাদ করছে। অবশিষ্ট জীবিত বিপ্লবীরা উপরতলায় আশ্রয় নিয়েছে। এঁজোলরাসের আদেশ পেয়ে বিপ্লবীরা একসঙ্গে গুলি ছুঁড়ল অনেকগুলো। এই ছিল তাদের শেষ গুলি। আর কোনও কার্তুজ নেই তাদের। এরপর মদের খালি বোতলগুলো উপর থেকে ছুঁড়তে লাগল তারা। উপরে ওঠার সময় তারা ঘোরানো সিঁড়িটা ভেঙে দিয়ে যাওয়ার জন্য সৈনিকরা উঠতে পারছিল না।

কুড়িজন আক্রমণকারী সৈনিক সিঁড়ির যে অবশিষ্ট অংশটা ঝুলছিল সেটা দিয়ে ও দেয়াল বেয়ে কোনওরকমে উপরতলায় উঠে দেখল একমাত্র এঁজোলরাস ঘরের এক কোণে একটা বিলিয়ার্ড টেবিলের ওধারে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সবাই মারা গেছে। তার গুলিহীন বন্দুকের বাঁট দিয়ে সৈনিকদের মাথায় মারতে মারতে সেটা ভেঙে যায়। সেই বাটভাঙা বন্দুকছাড়া আর কোনও অস্ত্র ছিল না তার হাতে।

একজন সৈনিক তাদের অফিসারকে বলল, ওই হচ্ছে নেতা। ও আমাদের অস্ত্রবাহিনীর লোকদের মেরেছে।

ওকে আমরা এখনি এখানে গুলি করে মারতে পারি।

এঁজোলরাস এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাঙা বন্দুকটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার বুকটা এগিয়ে দিয়ে বলল, গুলি কর।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ ধরনের সাহসিকতার উচ্ছ্বাস দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল সৈনিকরা। এঁজোলরাস যখন তার হাত দুটো জড়ো করে ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হল তখন সৈনিকদের সব গোলমাল স্তব্ধ হয়ে গেল।

ফোঁটা ফুলের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল এঁজোলরাসের মুখখানাকে। এত ক্লান্তি, এত কষ্ট ও সংগ্রাম সত্ত্বেও সে মুখসৌন্দর্য বিকৃত হয়নি এতটুকু। তার লম্বা কালো চুলগুলো ছড়িয়ে ছিল মাথার চারদিকে। এক উদ্ধত গর্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছিল যেন সে মুখের সৌন্দর্যকে।

একজন সৈনিক তাকে গুলি করার জন্য তার বন্দুক তুলে বলল, আমার মনে হচ্ছে যেন একটা ফোঁটা ফুলকে গুলি করছি আমি।

একজন সার্জেন্ট বলল, গুলি কর।

কিন্তু তাদের অফিসার বলল, থাম।

অফিসার এঁজোলরাসকে বলল, তোমার চোখের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করে দেব?

না।

আচ্ছা তুমিই কি আমাদের অস্ত্রবাহিনীর সার্জেন্টকে গুলি করে হত্যা কর?

হ্যাঁ।

এমন সময় গ্রান্তেয়ারের ঘুম ভাঙল। যে ঘুম এত চিৎকার, এত গোলাগুলির শব্দ ও এত যুদ্ধতেও ভাঙেনি সে ঘুম সব গোলমাল নিঃশেষে থেমে যাবার পর ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে গ্রান্তেয়ারের মনে হল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। চারদিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝতে পারল না সে। অবশেষে সব কিছু দেখে এবং এঁজোলরাস ও সৈনিকদের পানে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চিৎকার করে ধ্বনি দিতে লাগল, প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক। আমি প্রজাতন্ত্রেরই একজন।

গ্রান্তেয়ার একবার উঠে দাঁড়াল। যে যুদ্ধে সে একবারও যোগদান করেনি, যার কথা সে একবারও ভাবেনি, সে যুদ্ধের আগুন তার মাতাল চোখের মধ্যে হঠাৎ জ্বলে উঠল যেন। সে ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে দর্পিত পদক্ষেপে হেঁটে গিয়ে এঁজোলরাসের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বন্দুকধারী সৈনিকদের লক্ষ্য করে বলল, এক ঢিলে দুটো পাখিই মারতে পার তোমরা।

এই বলে সে হাসিমুখে এঁজোলরাসের পানে তাকিয়ে বলল, কিছু মনে কর না।

এঁজোলরাস হাসিমুখে তার একটা হাত ধরল।

কিন্তু তাদের দু জনের মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে না যেতেই একসঙ্গে অনেকগুলো বন্দুক গর্জন করে উঠল। এঁজোলরাসের গা-টাকে আটটা গুলি বিদ্ধ করে দেয়ালের সঙ্গে তার দেহটাকে সেঁটে দিল। গ্রান্তেয়ার মুখ থুবড়ে পড়ে গেল।

সৈনিকরা তখন বিপ্লবীদের মৃতদেহগুলো জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। তাদের মধ্যে কিছু আহত আর্তনাদ করছিল।

.

১৬.

মেরিয়াস তখন সত্যিই বন্দি হয়েছিল। তবে শত্রুসেনাদের হাতে নয়, জাঁ ভলজাঁ’র হাতে।

কাঁধে গুলি লাগার পর সে যখন পড়ে যাচ্ছিল তখন ভলজাঁ’র হাতই তাকে ধরে ফেলে। ভলজাঁ এতক্ষণ যুদ্ধে একবারও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেনি। একটা শত্রুসৈনিককেও গুলি করে মারেনি সে। সে শুধু সর্বক্ষণ আহতদের সেবা-শুশ্রূষা করেছে, তাদের ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছে।

সে যখন দেখে মেরিয়াস পড়ে যাচ্ছে, তখন সে ছুটে গিয়ে শিকার ধরার মতো ধরে ফেলে তাকে। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল সে যেন মেরিয়াসের দিকে তাকাচ্ছে না একবারও। কিন্তু আগে সে সর্বক্ষণ লক্ষ করছিল মেরিয়াসকে তার সব কাজের ফাঁকে ফাঁকে।

কুড়িজন আক্রমণকারী সৈনিক যখন হোটেলে ঢোকার জন্য দরজায় ঘা দিচ্ছিল এবং দরজায় লাথি মেরে দরজা ভাঙার চেষ্টায় দারুণভাবে ব্যস্ত ছিল, ভলজাঁ তখন আহত মেরিয়াসকে কাঁধের উপর চাপিয়ে নিয়ে হোটেলটার পেছন দিকের দেয়ালের আড়ালে চলে যায়। সৈনিকরা তখন পেছন ফিরে একবারও তাকায়নি বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল তার পক্ষে।

ভলজাঁ আহত অচেতন মেরিয়াসকে কাঁধ থেকে নামিয়ে মাটির উপর রাখল। কিন্তু বুঝল বেশিক্ষণ সেখানে তাদের থাকা চলবে না। সৈনিকরা এখন হোটেলের ভেতর দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েছে। ভেতরে তুমুল লড়াই-এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ওরা বেরিয়ে এসে এদিকে চলে এলেই তাদের দুজনেরই প্রাণ যাবে।

কিন্তু কোন দিকে কোথায় যাবে ভলজাঁ? এখন সব পথেই সেনাবাহিনী টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পথের মোড়ে সেনাদল ঘাঁটি করে আছে। হোটেলের উল্টো দিকে বড় বাড়িটার পানে একবার তাকাল সে। দেখল বাড়িটার দরজা-জানালা সব বন্ধ। মনে হল সেটা যেন সমাধিস্তম্ভ, ভেতরে কোনও জীবিত মানুষ নেই। বিপ্লবীরা পরাজয়ের পর হোটেলের ভেতর আশ্রয় নেবার আগে বারবার এ বাড়ির দরজায় ঘা দেয়। কিন্তু সে বাড়ির দরজা খোলেনি কেউ। সে বাড়িতে একবার আশ্রয় পেলে তারা প্রাণে বেঁচে যেত। বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে পারত তারা।

এমন সময় মাটির দিকে তাকাতেই একটা জিনিস নজরে পড়ল তার। সে দেখল কতকগুলি পাথরখণ্ডের মাঝখানে লোহার রড়ওয়ালা দু ফুট চওড়া একটা ঢাকনা রয়েছে। ঢাকনার তলায় একটা সুড়ঙ্গপথ আছে। ঢাকনা তুলে ফেললে একটা লোক তার মধ্যে ঢুকতে পারবে। ভলজাঁ ক্ষিপ্র হাতে ঢাকনাটা সরিয়ে মেরিয়াসকে কাঁধে নিয়ে তার মধ্যে নেমে পড়ল। দেখল তলায় টালিপাতা একটা মেঝে রয়েছে। ভেতরে অন্ধকার সুড়ঙ্গপথটা লম্বা এবং এঁকেবেঁকে কোথায় চলে গেছে। ভলজাঁ’র মনে পড়ল অতীতে সে একদিন এমনি করে কসেত্তেকে নিয়ে রাস্তা থেকে পাঁচিল ডিঙিয়ে কনভেন্টের বাগানের মধ্যে পড়ে। সে তখনও বাইরে থেকে আসা সৈনিকদের হোটেল দখল করার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিল। ভলজাঁ নালার ভেতরে নেমেই ঢাকনাটা আবার চাপিয়ে দিয়েছিল তার মুখের উপর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *