প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.১৪ অন্তরে যে দারুণ বিপ্লব চলছিল

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

১.

জাঁ ভলজাঁর অন্তরে তখন যে দারুণ বিপ্লব চলছিল তার তুলঁনায় প্যারিস শহরের গণবিপ্লব কিছু নয়। তার ভবিষ্যৎ এবং তার বিবেক দুটোই ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এক গভীর সন্ত্রাসের রাজত্ব চলতে থাকে তার অন্তরে। তার মনে হচ্ছিল হতাশার এক অতলান্তিক খাদের উপরে আলো আর অন্ধকারের দুটো দেবদূত এক ভয়ঙ্কর লড়াইয়ে মত্ত হয়ে উঠেছে।

৫ জুন রাত্রিতে যখন ভলজাঁ র‍্যু প্লামেতের বাড়ি ছেড়ে হঠাৎ চলে আসে তখন কসেত্তে প্রতিবাদ করেছিল। জীবনে হয়তো এই প্রথম তার বাবার কাছে প্রতিবাদ জানায় সে। কিন্তু সে প্রতিবাদ টেকেনি। কারণ বেনামি চিঠিটা পেয়ে ভলজাঁ ভয়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ে। সে ভাবতে থাকে হয়তো বা পুলিশ তার ঠিকানা জেনে ফেলেছে এবং তাকে ধরার চেষ্টা করছে। ভলজাঁ তাই পোশাক-আশাক ও দু-একটি জিনিসপত্র ছাড়া বেশি কিছু আনেনি, কারণ তা হলে মালবাহকের দরকার হত এবং মালবাহকরা তাদের ঠিকানা বদলের সাক্ষী হত। তাই একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে তাড়াহুড়ো করে র‍্যু বেবিলনের পথ দিয়ে চলে আসে এখানে।

লা হোমি আর্মে জায়গাটার পরিবেশটা ছিল অনেক শান্ত এবং নির্জন। আসল শহর থেকে দূরে একটা সরু গলির দু ধারে পুরনো আমলের কতকগুলি বাড়ি; কারও সঙ্গে কারও কোনও সম্পর্ক নেই। ওদের বাসটা ছিল তিনতলায়। মোট তিনখানা ঘর। সবচেয়ে ছোট ঘরটার গাঁয়ে ছিল রান্নাঘর। ছোট ঘরটাতে তুসাঁ থাকবে। পাশাপাশি দুটো ঘরের একটাতে থাকবে ভলজাঁ আর একটাতে কসেত্তে। বাড়িটার পেছন দিকে একটা ফাঁকা উঠোন ছিল।

সেদিন রাত্রিতে ওরা বাসায় পৌঁছনোর পর নীরবে শুতে চলে গেল। এ বাসায় আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেকখানি আশ্বস্ত ও শান্ত হয়ে উঠল ভলজাঁ’র মনটা। তার ভয়ের অনেকটা কেটে গেল। রাত্রিতে ভালো ঘুম হল তার।

পরদিন সকালে কসেত্তে তার ঘরে একাই প্রাতরাশ খেল। তুসাঁকে বলল, তার মাথা ধরেছে। ভলজাঁ যখন তার ঘরে প্রাতরাশ খাচ্ছিল তখন তুসাঁ একসময় বলল, শহরে দারুণ গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু সে কথায় বিশেষ কান দিল না ভলজাঁ। তার মনটা আগের থেকে অনেক শান্ত আর স্বচ্ছ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সে কসেত্তে’র কথাটা ভাবতে লাগল। তার মাথা ধরার ব্যাপারটা এমন কিছু ভাববার কথা নয়। ওটা-দু-এক দিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে। সে ভাবছিল তার ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু ব্যাপারটা তার কাছে খুব সহজ বলে মনে হল না। কসেত্তে সারাজীবন তার কাছেই থাকবে, তাদের এই সুখের দ্বৈত জীবনে বিচ্ছেদের কোনও অবকাশ নেই। তাছাড়া সে এই ভেবে নিশ্চিন্ত হল যে সে র‍্যু প্লমেতের বাড়ি ছেড়ে বিনা বাধায় এখানে আসতে পেরেছে, কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এটাই যথেষ্ট তার কাছে। তবে ফান্সের অবস্থা এখন ভালো নয়, লন্ডনে গিয়ে মাসকতক কাটিয়ে আসবে। কসেত্তে তার কাছে থাকলে পৃথিবীর যে কোনও দেশে যে কোনও দূরতম জায়গায় সে স্বচ্ছন্দে যেতে বা থাকতে পারবে।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াতে লাগল ভলজাঁ। সহসা আয়নায় কসেত্তে’র নোটবইটা প্রতিফলিত দেখল সে। বইটার একটা পাতা খোলা ছিল। তাতে কসেত্তে’র নিজের হাতে মেরিয়াসকে লেখা সেই ছোট্ট চিঠির প্রতিলিপিটা ছিল। তাতে লেখা আছে, প্রিয়তম, বাবা জেদ ধরেছেন আজই আমাদের এ বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে। আজই রাত্রে আমরা যাচ্ছি র‍্যু দ্য লা হোমি আর্মের বাড়িতে। এক সপ্তার মধ্যেই আমরা ইংল্যান্ড চলে যাব। কসেত্তে। ৪ জুন।

স্তম্ভিত হয়ে গেল ভলজাঁ।

কসেত্তে এখানে আসার পর নোটবইটা আয়নার কাছ থেকে তুলে রাখতে ভুলে গেছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে মন চায়নি ভলজাঁ’র। পরে যখন এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল সে তখন কাঁপতে কাঁপতে পাশে আর্মচেয়ারটায় বসে পড়ল। বুকের ভেতরটা জ্বলতে লাগল তার। সে ভাবল আর কোনও উপায় নেই, জগতের সব আলো, সব আশা চিরদিনের মতো মিলিয়ে গেল নিশ্চিহ্নভাবে। তার বিক্ষুব্ধ আত্মা সেই হতাশার নিবিড় নিরস্ত্র অন্ধকারে নিষ্ফল আক্রোশে গর্জন করতে লাগল। সে বেশ বুঝতে পারল কসেত্তে নিশ্চয় তার প্রেমিককে লিখেছে।

জীবনে এর আগে বহু দুঃখ ভোগ করেছে ভলজাঁ। এমন কোনও চূড়ান্ত দুর্ভাগ্যের প্রান্তসীমা নেই যেখানে বাধ্য হয়ে পা দিতে হয়নি তাকে, সমাজের এমন কোনও অবজ্ঞা, অপমান ও লাঞ্ছনা নেই, যা তাকে সহ্য করতে হয়নি। একে একে জীবনের সব স্বাধীনতা, সব সুখ, সব সম্মান বিসর্জন দিয়ে এক নীরব আত্মসমর্পণের সঙ্গে সব কিছু মেনে নিয়ে ধীরে ধীরে এক চরম আত্মনিগ্রহ ও ত্যাগের পথে ঠেলে দিয়েছে নিজেকে শহীদের মতো। দুর্ভাগ্য ও প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করে তার বিবেক তার অন্তরাত্মাটাকে এক সুরক্ষিত দুর্গে পরিণত করে অপরাজেয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন কেউ তাকে দেখলে বুঝতে পারবে তার সেই অন্তরাত্মার দুর্গটা ধসে যেতে বসেছে। তার অপ্রতিহত বিবেক এক প্রতিহত বেদনার বিহ্বলতায় ভেঙে পড়েছে।

ভলজাঁ এখন বুঝল দুর্ভাগ্যের শত পীড়নের যন্ত্রণা থেকে আজকের এ পীড়নের যন্ত্রণা সবচেয়ে ভয়াবহ, সবচেয়ে মারাত্মক। জীবনের সবচেয়ে প্রিয়বস্তুকে হারানো সবচেয়ে বড় ক্ষতি। একথা ঠিক যে তার মতো এক নিঃস্ব বয়োপ্রবীণ মানুষ কসেত্তেকে কন্যার মতো ভালোবাসে। কিন্তু তার আপন অন্তরের সীমাহীন শূন্যতা তার সেই পিতৃসুলভ ভালোবাসাকে এক সর্বাত্মক সর্বগ্রাসী ভালোবাসায় পরিণত করে। কসেত্তে একাধারে তার কাছে হয়ে ওঠে তার কন্যা, মাতা এবং ভগিনী। যেহেতু তার স্ত্রী বা কোনও প্রণয়িনী ছিল না, তার মনের অগোচরেই এক অন্ধ বিশুদ্ধতায় সব ভালোবাসার আবেগ মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

কসেত্তে’র সঙ্গে ভলজাঁ’র সম্পর্কটা যদি আমরা বিশ্লেষণ করি তা হলে দেখব বয়সের অনতিক্রম্য ব্যবধানে আত্মিক মিলনও সম্ভব ছিল না। তবু ভাগ্যের অমোঘ বিধান এই দুটি জীবনকে পরস্পরের কাছে এনে দেয়। কসেত্তে’র প্রতি পিতৃসুলভ ভালোবাসা সত্ত্বেও একাধারে সে তার কাছে হয়ে ওঠে তার পিতা, মাতা, তার ভ্রাতা এবং স্বামী। সে হয়ে ওঠে এমনই এক আশ্চর্য পিতা যার মধ্যে ছিল মায়ের স্নেহ এবং বিশ্বস্ত প্রেমিকের সর্বাত্মক ভালোবাসা। কসেত্তে এইভাবে হয়ে ওঠে তার জীবনের একমাত্র আলো, একমাত্র আশ্রয়স্থল, তার পরিবার, দেশ, সমাজ এবং স্বর্গ।

ভলজাঁ তাই যখন দেখল তার সেই জীবনের একমাত্র আলো তার চোখের সামনে নিবে যাচ্ছে চিরতরে, তার একমাত্র আশ্রয়স্থল অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, স্বর্গীয় সুখ উবে যাচ্ছে, কসেত্তে জল বা কুয়াশার মতো তার আঙুলের ভেতর দিয়ে গলে যাচ্ছে, যখন দেখল অন্য একজন কসেত্তে’র অন্তরকে অধিকার করে ফেলেছে, তখন সে ভাবল কসেত্তে নিশ্চয় তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তখন তার বেদনা দুঃসহ হয়ে উঠল। তখন তার অন্তরের সুগভীর শূন্যতা থেকে এক বৈপ্লবিক ঝঞ্ঝা এসে তার অস্তিত্বের ভিত্তিভূমিটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে ওলটপালট করে দিল তার জীবনের সব কিছু। মানুষ সহ্যের সব সীমা যখন পার হয়ে যায় তখন তার জীবনের প্রতিষ্ঠিত অন্তবৃত্তি, বুদ্ধি ও বোধি সব অন্তর্হিত হয়ে যায় একে একে।

ভলজাঁ’র অন্তরের মধ্যে যখন এই ধরনের এক তুমুল আলোড়ন চলছিল তখন বাইরেটা কিন্তু অদ্ভুতভাবে শান্ত ছিল। কিন্তু মানুষের যে প্রশান্তি প্রাণহীন প্রতিমূর্তির এক হিমশীতল স্তব্ধতায় জমাট বেঁধে থাকে, সে প্রশান্তি সত্যিই বড় ভয়ঙ্কর। ভলজাঁ তার ভাগ্যবিড়ম্বিত এই অবস্থার কথা ভাবতে ভাবতে দেখল এক বিরাট খাড়াই পাহাড়ের নিচে এক গভীর অতলান্তিক খাদের অন্ধকার। কিন্তু এখন আর সে সেই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নেই, কে যেন তার অজানিতে অকস্মাৎ সে খাদের অন্ধকার গভীরে ফেলে দিয়েছে তাকে। তার মনে হল বাইরে পৃথিবীর আকাশে তখন সূর্য কিরণ দিতে থাকলেও তার জীবনের আলো নিবে গেছে।

মেরিয়াসের নামটা সে না জানলেও মুহূর্তমধ্যে লুক্সেমবুর্গ বাগানে দেখা তার চেহারাটা ভেসে উঠল তার মনের পটে। নারীলোলুপ সেই যুবক, অলস নির্বোধ এক অপদার্থ প্রেমিক এবং প্রতারক যে পিতার সাক্ষাতে তার কন্যার পানে প্রেমের দৃষ্টিতে তাকাতে কুণ্ঠাবোধ করে না।

যখন সে বুঝল এই যুবকটাই তাদের সব বিপত্তির মূলে তখন তার যে বিষাক্ত ঘৃণাটা তার সারা অন্তরজোড়া অখণ্ড প্রেমবোধের তাড়নায় অবলুপ্ত হয়ে যায় সেই ঘৃণার অবাঞ্ছিত প্রেতটা আবার যেন উঠে আসে কোথা থেকে।

দুঃখ থেকেই আসে দুর্বলতা, কমে যায় বাঁচার আকাঙ্ক্ষা। মানুষের যৌবনকালে দুঃখ ও হতাশা বিপজ্জনক হলেও বার্ধক্যের মতো তত ক্ষতিকর নয়। যৌবনে যত দুঃখ যত হতাশার আঘাতই আসুক না কেন, তখন দেহের রক্ত থাকে উত্তপ্ত, প্রাণশক্তি থাকে অক্ষত, তখন এক কৃষ্ণাভ সৌন্দর্যে দীপ্ত কেশরাশির দ্বারা মণ্ডিত তার উদ্ধত মাথাটি জ্বলন্ত মশালের মতো জীবনের অমিত তেজে জ্বলতে থাকে, তখন তার মনে হয় এক বিরাট বিশ্ব বিস্তৃত হয়ে আছে তার সামনে। আছে কত প্রেম কত সৌন্দর্য, কত আশা আর হাসি গানের উজ্জ্বলতা। কিন্তু বার্ধক্যে জীবনসায়াহ্নে এসে মানুষ যখন আকাশে মুখ তুলে নক্ষত্রালোকের মধ্যে আসন্ন মৃত্যুর হাতছানি দেখতে পায়, যখন তার প্রাণশক্তি স্তিমিত হয়ে আসে, যখন সে তার চারদিকে কোনও আশা, কোনও আলো দেখতে পায় না, তখন কী নিয়ে বাঁচবে সে?

ভলজাঁ বসে বসে এইসব ভাবছিল তার ঘরে। তখন হঠাৎ সা ঢুকল সে ঘরে। তাকে দেখে ভলজাঁ বলল, তুমি যে বলছিলে কোথায় গোলমাল হচ্ছে, সেটা কোথায়?

তুঁসা বলল, সেন্ট মেরির কাছে।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভলজাঁ ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে গিয়ে বাড়ির নিচে রাস্তার ধারে একটা পাথরের উপর খালি মাথায় কান খাড়া করে কী শোনার অপেক্ষায় বসে রইল।

.

২.

কিন্তু কতক্ষণ সেভাবে বসেছিল সে? তার চিন্তার অবিরাম অবিচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার কি কোনও ছেদ পড়েনি? সে কি একেবারে ভেঙে পড়েছিল অথবা তার অন্তরের মধ্যে আবার নতুন করে সোজা হয়ে দাঁড়াবার কোনও শক্ত ভিত্তিভূমি খুঁজে পেয়েছিল?

তখন রাস্তাটা ছিল একেবারে জনশূন্য। যে দু-একজন পথচারী এস্ত পায়ে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল তারা যদি ভলজাঁ’র দিকে তাকিয়ে একবার দেখত তা হলে তাদের মনে হত ভলজাঁ কোনও জীবিত মানুষ নয়, মানুষের এক মর্মরমূর্তি। স্থির হয়ে সেই পাথরের উপর বসে ছিল ভলজাঁ। হঠাৎ একঝাঁক গুলির শব্দ পেয়ে চমকে উঠল সে। হয়তো র‍্যু শাঁড্রেরি’র ব্যারিকেডটাকে আক্রমণ করল সেনাদল।

হঠাৎ কার পদশব্দে মুখ তুলে তাকাল ভলজাঁ। রাস্তার আলোয় সে দেখল একটি প্রাণচঞ্চল ছেলে চারদিকের বাড়িগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে একটা বাড়ির নম্বর খোঁজ করছে। নম্বরটা না পেয়ে সে আপন মনে বলে উঠল, এবার রাস্তার বাতিগুলো ভাঙি। ছেলেটা ছিল গাভ্রোশে।

কোনওদিকে নজর দেবার মতো মনের অবস্থা তখন ভলজাঁর ছিল না। কিন্তু ছেলেটির উদ্ধত ও প্রাণঞ্চল ভাব দেখে তার প্রতি দুর্বার বেগে আকৃষ্ট হল সে। সে বলল, কী চাইছ হে ছোকরা?

গাভ্রোশে বলল, কী চাইছি? আমি ক্ষুধার্ত! তুমি ছোকরা।

ভলজাঁ তার পকেটে হাত দিয়ে দেখল পাঁচ ফ্রাঁ আছে। গাভ্রোশে একটা পাথর কুড়িয়ে লাইটপোস্টের বাতি লক্ষ্য করে ছুঁড়ল। তার শব্দে পাশের বাড়ির লোকগুলো জেগে উঠে বলে উঠল, এ যে দেখছি ‘৯৩ সালের সেই বিপ্লব আবার শুরু হল।

গাভ্রোশে বলল, এ রাস্তায় দেখছি এখনও সব আলোগুলো জ্বলছে। এটা কিন্তু ঠিক নয়। এখানে কোনও শৃঙ্খলা নেই। আমি ওই বাতিগুলো সব ভেঙে দেব।

ভলজাঁ এবার উঠে গাভ্রোশের দিকে এগিয়ে গেল। আপন মনে বলল, “আহা বেচারা, ছেলেটা আধপেটা খেয়ে আছে।

এই বলে সে পাঁচ ফ্রা’র মুদ্রাটা গাভ্রোশের হাতে দিয়ে দিল।

গাভ্রোশে আশ্চর্য হয়ে মুদ্রাটা নিল। এ মুদ্রা সে কোনওদিন হাতে পায়নি জীবনে। সে খুশি হল প্রথমে, কিন্তু পরক্ষণেই সে বলল, ধন্যবাদ মালিক, কিন্তু এতে আমি ভুলব। না, আমি বাতিগুলো ভাঙবই। ও টাকায় আমার দরকার নেই।

ভলজাঁ বলল, তোমার মা আছে?

তোমার থেকে আমার বেশি মা আছে।

তা হলে এটা রেখে দাও, তাকে দেবে।

এ কথায় বিগলিত হল গাভ্রোশের অন্তরটা। তাছাড়া লোকটার মাথায় টুপি না থাকায় সে আরও নরম হল। সে বলল, তা হলে তুমি এটা নিতে বলছ? কিন্তু এটা দিয়ে তুমি কিন্তু আমার বাতিভাঙা বন্ধ করতে পারবে না।

যত খুশি বাতি ভাঙতে পার তুমি।

গাভ্রোশে মুদ্রাটা পকেটে রেখে বলল, ঠিক বলেছ, আচ্ছা, তুমি এই রাস্তাতেই থাক?

হ্যাঁ, কেন?

আচ্ছা সাত নম্বর বাড়িটা আমায় দেখিয়ে দিতে পার?

কিন্তু ও বাড়িটা কেন তুমি খুঁজছ?

গাভ্রোশে হাত দিয়ে মাথার চুল ধরে ইতস্তত করতে লাগল।

কী মনে হতে ভলজাঁ বলল, তুমি কি একটা চিঠি এনেছ? আমি চিঠিটার জন্যই অপেক্ষা করছি।

গাভ্রোশে বলল, তুমি? তুমি তো মেয়েমানুষ নও। চিঠিটা লেখা হয়েছে ম্যাদময়জেল কসেত্তেকে।

ভলজাঁ বলল, আমি তাকে দিয়ে দেব। তার জন্যই আমি এখানে আছি। আমাকে দিতে পার।

মনে রেখো, আমি ব্যারিকেড থেকে আসছি। অস্থায়ী সরকারের পক্ষ থেকে এক গোপনীয় সংবাদ বহন করে এনেছি।

হ্যাঁ, আমাকে দিয়ে দাও চিঠিটা।

কিন্তু ভেব না, এটা সামান্য একটা চিঠিমাত্র। এটি একটি মেয়েকে লেখা। আমরা বিপ্লবী হলেও মেয়েদের শ্রদ্ধা করি। যারা মেয়েদের হাঁস, নেকড়ের মতো তাড়া করে বেড়ায় আমরা তাদের মতো নই। তোমাকে দেখে অবশ্য ভদ্রলোক বলেই মনে হচ্ছে।

চিঠিটা দিয়ে দাও।

গাভ্রোশে ভলজাঁ’র হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, ম্যাদময়জেল কসেত্তেকে তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবে চিঠিটা।

ভলজাঁ বলল, একটা কথা, আমি কি এর উত্তর সেন্ট মেরিতে পৌঁছে দিতে পারি?

না, আমি আসছি শীভ্রারির ব্যারিকেড থেকে। শুভরাত্রি নাগরিক।

অন্ধকারের মধ্যে তীরবেগে ছুটতে ছুটতে অদৃশ্য হয়ে গেল গাভ্রোশে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আর একটা রাস্তার বাতি ভাঙার শব্দে চমকে উঠল আশপাশের বাড়িগুলোর বাসিন্দারা।

.

৩.

মেরিয়াসের লেখা চিঠিটা নিয়ে তার নিজের ঘরে চলে গেল ভলজাঁ। দেখল পাশের ঘরে কসেত্তে ও তুস ঘুমোচ্ছে। তার হাত দুটো কাঁপছিল। কম্পিত হাতে বাতি জ্বালিয়ে টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল সে। তার পর খুলে ফেলল চিঠিটা।

যখন আমাদের অন্তর এক প্রবল আবেগে বিচলিত থাকে তখন কোনও চিঠি পড়তে গিয়ে সবটা পড়ার ধৈর্য থাকে না আমাদের। তখন চিঠিটার প্রথম কিছুটা পড়েই আমাদের দৃষ্টি লাফ দিয়ে চলে যায় শেষাংশে। ভলজাঁ’র তাই হল। চিঠিখানার শেষের একটা লাইন দৃষ্টি আকর্ষণ করল তার। সেই লাইনটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অপ্রত্যাশিত এক আনন্দের আবেগে আত্মহারা হয়ে উঠল ভলজাঁ। লাইনটা হল, আমি মরব… যখন তুমি এ চিঠি পড়বে তখন আমার অশরীরী আত্মা তোমার কাছে চলে যাবে।

যে ব্যক্তি তার জীবনের সব সুখকে বিঘ্নিত করে তুলেছিল, যাকে সে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করত, তাকে সরাবার জন্য কিছুই করতে হল না ভলজাঁকে। সে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতে চলেছে। এর থেকে সুখসংবাদ আর কী হতে পারে? তবে যতদূর তার মনে হয় তার মৃত্যু এখনও ঘটেনি। কারণ সেনাবাহিনী ব্যারিকেডটা ঠিকভাবে আক্রমণ করবে আগামীকাল সকালে। সেটা কোনও কথা নয়। সে যখন বিপ্লবে যোগ দিয়েছে তখন আজ হোক কাল হোক মরতে তাকে হবেই। এতক্ষণে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ মনে হল ভলজাঁ’র, কসেত্তেকে পুরোপুরিভাবে পাবার পথে আর কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী বা অন্তরায় থাকবে না। তবে এই চিঠিটা তাকে গোপনে রেখে দিতে হবে। কসেত্তে যেন এ ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। কী সুখের কথা!

নিজেকে এভাবে আশ্বস্ত করলেও কিসের একটা বিষাদ আবার বুক চেপে বসল তার। হঠাৎ সে নিচের তলায় গিয়ে দারোয়ানকে জাগাল। তার পর জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পোশাক পরে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে সেই রাতেই বেরিয়ে পড়ল ভলজাঁ। লে হ্যালের দিকে এগিয়ে চলল সে।

.

৪.

এদিকে বাতি ভাঙতে ভাঙতে ভিয়েলে হদ্রিয়েত্তে অঞ্চলে এসে পড়ল গাভ্রোশে। তার পর একটা গান গাইতে শুরু করে দিল। সে নাচতে নাচতে গান করছিল। হাওয়ায় উড়তে থাকা ছেঁড়া কাপড়ের মতো তার মুখের ওপর নানারকম বিকৃত ভাব খেলে যাচ্ছিল।

হঠাৎ রাস্তার ধারে কী একটা জিনিস দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়াল গাভ্রোশে। সে দেখল, রাস্তার ধারে একটা ঠেলাগাড়ি নামানো রয়েছে আর একটা চাষি লোক গাড়িটার উপর পা তুলে দিয়ে ঘুমোচ্ছ। গাভ্রোশে ভাবল ওই ঠেলাগাড়িটা ব্যারিকেডের কাজে লাগবে। এই ভেবে সে লোকটার পা দুটো আস্তে করে ধরে সরিয়ে গাড়িটা সরিয়ে আনল। তার পর পকেট থেকে কাগজ-পেনসিল বার করে তাতে লিখল, ফরাসি প্রজাতন্ত্র। একটি ঠেলাগাড়ি অধিগ্রহণ করা হল। (স্বাক্ষর) গাভ্রোশে।

এই রসিদটা ঘুমন্ত চাষিটার পকেটে ঢুকিয়ে রেখে গাড়িটা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলে গেল গাভ্রোশে। ইম্প্রিমিয়ের রয়ালে এক সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। সেখানে জাতীয় রক্ষীবাহিনীও ছিল। গাভ্রোশে তা খেয়াল করেনি। তাই সে একের পর এক করে রাস্তায় বাতি ভেঙেছে, তার পর গান গেয়েছে; এইভাবে এ অঞ্চলের সব বাসিন্দাদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। প্রহরারত সৈনিকরা অনেকক্ষণ থেকে এই সব কিছু লক্ষ করে তার জন্য ওত পেতে বসে ছিল।

আনমনে গাড়িটা ঘর্ঘর শব্দে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে পাহারাদার সৈনিকদের সামনে এসে পড়ল গাভ্রোশে। কোনও অবস্থাতেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে না গাভ্রোশে। সে সৈনিকদের সরাসরি বলল, এ যে দেখছি স্বয়ং কর্তৃপক্ষ! ভালো তো?

সার্জেন্ট বলল, কোথায় যাচ্ছ পাজি বদমাশ কোথাকার?

গাল্লোশে বলল, নাগরিক, আমি তো তোমাদের বুর্জোয়া বলিনি, কেন আমাকে গালাগালি করছ?

কোথায় যাচ্ছ ভাঁড় কোথাকার?

মঁসিয়ে, গতকাল তোমার যে বুদ্ধি মাথায় ছিল সে বুদ্ধি আজ গেল কোথায়?

আমি জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

তুমি বেশ ভদ্রভাবেই কথা বলছ। টাকার দরকার থাকলে মাথার চুলটা বিক্রি করতে পার।

কোথায় যাচ্ছ? কোন কাজে যাচ্ছ পাজি কোথাকার?

তোমার কথাটা বড় কুৎসিত। মদ খাবার আগে মুখটা ধুয়ে ফেলবে।

কোথায় যাচ্ছ তা বলবে কি বলবে না?

হে আমার শ্রদ্ধেয় সেনাপতি, আমার প্রভু, আমার স্ত্রীর প্রসবযন্ত্রণা ওঠার জন্য ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি।

সার্জেন্ট তার অধীনস্থ সৈনিকদের হুকুম দিল, গুলি চালাও।

সার্জেন্ট উপর দিকে বন্দুক তুলে একটা ফাঁকা আওয়াজ করতেই অন্য সৈনিকরাও ব্যস্ত হয়ে গুলি করতে লাগল। তখন গাভ্রোশে ঠেলাগাড়িটা ফেলে কৌশলে পালিয়ে গেল। তীরবেগে অন্ধকারে ছুটে বহু দূরে গিয়ে একটা জায়গায় একটা পাথরের উপর বসে পড়ল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাভ্রোশের হুঁশ হল, সে তাদের ব্যারিকেডের ঘাঁটি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। এখনি তাকে ফিরে যেতে হবে। তাই সে আবার একটা গান ধরে গাইতে গাইতে ছুটতে লাগল।

এদিকে প্রহরারত সৈনিকরা ঠেলাগাড়িটা দখল করে তার মালিকের খোঁজ করে ধরে তাকে। পরে সেই চাষির বিচার হয় সামরিক আদালতে এবং বিপ্লবীদের সাহায্যকারী হিসেবে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।

গাভ্রোশের সেই অভিযানটা ইম্প্রিমিয়ের রয়ালে সামরিক ঘাঁটির উপর নৈশ আক্রমণ হিসেবে আজও সে অঞ্চলের লোকের মুখে মুখে ফেরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *