প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.১৩ সেন্ট মেরি গির্জার ঘড়ি

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

১.

তবু কিছু ঘটল না। সেন্ট মেরি গির্জার ঘড়িতে রাত্রি দশটা বাজল। এঁজোলরাস আর কমবেফারে বড় ব্যারিকেডটার পাশের পথটার উপর বসে পড়ল। ওরা কোনও কথা বলছিল না, শুধু কান খাড়া করে দূরাগত এক সমবেত পদধ্বনি শোনার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে ছিল।

হঠাৎ অদূরে একটি ছেলের আনন্দোচ্ছল কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা। এঁজোলরাস বলল, গাভ্ৰাশে।

গাভ্রোশে মনের আনন্দে গান করতে করতে ওদের এদিকেই আসছিল।

এঁজোলরাস ও কমবেফারে করমর্দন করল।

গাভ্রোশে ব্যারিকেডের উপর থেকে এদিকে লাফ দিয়ে পড়ল। এসেই সে বলল, ওরা আসছে। আমার বন্দুকটা কোথায়? সেই বড় বন্দুকটা আমার চাই।

সে জেভার্তের বন্দুকটার কথা বলছিল।

বিপ্লবী জনতার প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হল। মোট তেতাল্লিশজন বিপ্লবী বন্দুক হাতে প্রতিরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। ফুলি দু জন বন্দুকধারী লোক নিয়ে হোটেলের দোতলার ঘরের জানালার ধারে দাঁড়িয়ে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। এদিকে ব্যারিকেডের কাছে এঁজোলরাস ও তার বন্ধুরা বাকি লোকদের নেতৃত্ব দান করতে লাগল। তারাও সকলে নতজানু হয়ে গুলিভরা বন্দুক নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। গাভ্রোশেও একটা বন্দুক হাতে তাদের সঙ্গে প্রথম সারিতে বসে রইল।

কিছুক্ষণ পরে ওরা একসঙ্গে অসংখ্য সৈনিকের পদধ্বনি শুনতে পেল। কিন্তু তখনও কোনও লোককে দেখতে পাচ্ছিল না ওরা। অগ্রসরমান সেনাবাহিনীর মুখে কোনও কথা ছিল না। শুধু পথের পাথরের উপর তাদের ভারী বুটের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। জ্বলন্ত মশালের আলোর আভায় তাদের চকচকে ব্যারেল আর বেয়নেটগুলোকে দেখা যাচ্ছিল অস্পষ্টভাবে।

সহসা সব পদধ্বনি থেমে গেল। এক ভয়ঙ্কর নীরবতায় জমাট বেঁধে উঠল যেন সব কিছু। এমন সময় ওদিককার অন্ধকারের ভেতর থেকে এক অদৃশ্য মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কে ওখানে?

এদিক থেকে ওরা বুঝতে পারল ওদিকে সৈনিকরা বন্দুকে গুলি ভরছে।

এঁজোলরাস এদিকে গম্ভীর ও উঁচু গলায় বলল, ফরাসি বিপ্লব।

ওদিকে সেই কণ্ঠস্বর তখন গুলি করার হুকুম দিল জোর গলায়।

সহসা এক তীব্র আলোর ছটায় সামনেকার বাড়িগুলোর দেয়াল চুল্লির মুখের মতো ঝলসে উঠল। একসঙ্গে অনেকগুলো বন্দুকের গুলি সামনের বাড়িগুলোর গাঁয়ে লেগে প্রতিহত হয়ে বিপ্লবীদের উপর পড়ায় তাদের কিছু লোক আহত হল। ব্যারিকেডের উপর থেকে লাল পতাকাটা পড়ে গেল ওদের পায়ের কাছে। ওরা বুঝতে পারল এক বিশাল সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করতে এসেছে।

কুরফেরাক বলল, বন্ধুগণ, এখন তোমরা গুলি খরচ করবে না। ওদের আবার গুলি করতে দাও।

এঁজোলরাস বলল, এখন এই পতাকাটা আবার ওখানে তুলে দিতে হবে।

ওরা শুনতে পেল ওধারে সৈনিকরা আবার গুলি ভরছে তাদের বন্দুকে। এঁজোলরাস আবার বলল, কার সাহস আছে? ব্যারিকেডের উপর পতাকাটা কে আবার তুলে দিতে আসবে?

তার নিজেরই ভয় হচ্ছিল তার নিজের এই আদেশ শুনে। শেষে সে আবার বলল, এমন কোনও স্বেচ্ছাসেবী নেই?

.

২.

কোরিনথে ব্যারিকেড তৈরি হওয়ার সময় থেকে পিয়ের মেবুফে’র দিকে তারা কেউ নজর দেয়নি। মেবুফ তাদের দল ত্যাগ না করলেও তার কথা একরকম ভুলে গিয়েছিল তারা। মেবুফ কিন্তু সব সময় তাদের সঙ্গেই ছিল। তারা যখন সবই ব্যারিকেড তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিল মেবুফ তখন হোটেলের নিচের তলায় এক জায়গায় একা একা বসে কী ভাবছিল। কুরফেরাক ও আরও কয়েকজন তাকে আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ফিরে যেতে বলে। কিন্তু মেবুফ কোনও উত্তর দেয়নি সে কথার। শুধু তার ঠোঁট দুটো একটু কেঁপেছে। সে শুধু শূন্য নীরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে তাদের দিকে। তার চারদিকে কী ঘটছে না ঘটছে সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না তার।

সেনাবাহিনী ব্যারিকেড লক্ষ্য করে গুলি করার পরে যখন দ্বিতীয় দফায় আরও কিছু বিপ্লবী লড়াইয়ে যোগদান করে, তখন মেবুফে’র ঘরে মাত্র তিনজন লোক অবশিষ্ট ছিল। তারা হল বন্দি জেভাৰ্ত, মুক্ত তরবারি হাতে একজন বিপ্লবী প্রহরী আর মেবুফ। গুলির শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার পর এঁজোলরাস যখন পতাকা উত্তোলনের জন্য আহ্বান করে সকলকে তখন তার কাছে এগিয়ে যায় মেবুফ।

বিপ্লবী জনতার মধ্যে একজন বলে উঠল, উনি জনগণের প্রতিনিধি, রাজার মৃত্যুর জন্য ভোট দিয়েছিলেন।

সে কথায় কান না দিয়ে মেবুফ এঁজোলরাসের হাত থেকে পতাকাটা নিয়ে পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ব্যারিকেডের উপর উঠে গেল। অশীতিপর বয়সের চাপে তার মাথাটা নড়তে থাকলেও তার প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল দৃঢ়। বিপ্লবীরা নিচে থেকে শ্রদ্ধায় তাদের টুপি খুলে ফেলল মাথা থেকে। মাথায় সাদা চুল শীর্ণ ম্লান মুখ, বিস্ময়াবিষ্ট ও বিস্ফারিত মুখগহ্বর, কুঞ্চিত ললাট, লোলচর্ম অশক্ত হাতে উত্তোলিত লাল পতাকা–সব মিলিয়ে আশ্চর্য মহিমা দান করেছিল মঁসিয়ে মেবুফে’র চেহারাটাকে। মশালের কম্পিত আলোয় অনেক বড় দেখাচ্ছিল তার চেহারাটাকে। মনে হচ্ছিল ১৭৯৩ সালের বিপ্লবের প্রেতাত্মা সন্ত্রাসের পতাকা হাতে সমাধিগহ্বর থেকে উঠে এসেছে। মৃত্যুর থেকে মহীয়ান ও বলবান এক শক্তিরূপে সে রাস্তার ওপাশের অদৃশ্য বারোশো সৈনিকের গুলির সামনে বুক পেতে ব্যারিকেডের উপর দাঁড়িয়ে উপহাস করছে স্বয়ং মৃত্যুকে। অন্ধকার ব্যারিকেডটা মঁসিয়ে মেবুফে’র উপস্থিতিতে অলৌকিক এক অতিপ্রাকৃত মর্যাদা ও মহত্ত্ব লাভ করল।

মঁসিয়ে মেবুফ এবার পতাকাটা দোলাতে দোলাতে চিৎকার করে বলে উঠল, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক। সৌভ্রাতৃত্ব সাম্য –মৃত্যু।

রাস্তার ওপার থেকে পুলিশ কমিশনারের গলা শোনা গেল, চলে যাও।

মঁসিয়ে মেবুফ উন্মাদের মতো পতাকাটা নাড়তে নাড়তে আবার বলল, প্রজাতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক!

এদিকে ওদিকের সেনাবাহিনী আবার এক ঝাঁক গুলি করল। গুলিগুলো সব ব্যারিকেড়ে এসে লাগল। মঁসিয়ে মেবুফে’র হাত থেকে পতাকাটা পড়ে গেল। তার পা দুটো কাঁপছিল। চিৎ হয়ে পড়ে গেল সে। তার দেহে গুলিবিদ্ধ ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।

নিজেদের নিরাপত্তার কথা সব ভুলে গিয়ে বিপ্লবীরা এগিয়ে গিয়ে মেবুফে’র মৃতদেহটা দেখতে লাগল। শ্রদ্ধার সঙ্গে ভয় মিশে ছিল তাদের দৃষ্টিতে।

এঁজোলরাস বলল, সত্যিই এক বীরপুরুষ যিনি রাজার বিরুদ্ধে একদিন নির্ভীকভাবে যুদ্ধ করেন।

কুরফেরাক বলল, আমি ভদ্রলোককে চিনতাম। এর নাম ছিল মেবুফ। সরল শান্ত প্রকৃতির ও সাদাসিধে মানুষ।

এঁজোলরাস বলল, সরল ও সাদাসিধে হলেও তাঁর অন্তরটা ছিল ব্রুটাসের মতো শক্ত।

এরপর এঁজোলরাস বিপ্লবীদের উদ্দেশে বলতে লাগল, বন্ধুগণ, আজ বৃদ্ধ মঁসিয়ে মেবুফ যে দৃষ্টান্ত করে গেলেন তা আমাদের মতো যুবকদের অনুসরণ করে যেতে হবে। যেখানে আমরা ইতস্তত করছিলাম, ভয়ে পিছিয়ে এসেছিলাম, তিনি সেখানে এগিয়ে যান। অকুণ্ঠ ও নির্ভীকভাবে। এইভাবে বয়স ও বার্ধক্যের ভারে অবনত এক বৃদ্ধ ভয়ে কম্পিত যুবকদের শিক্ষা দিয়ে গেল। আজ তিনি দেশের সামনে এক মহান আদর্শ স্থাপন করে গেলেন। সুদীর্ঘ এক জীবন যাপনের পর উনি বরণ করলেন এক গৌরবময় মৃত্যু। এখন এই মৃতদেহটিকে পিতৃজ্ঞানে রক্ষা করা উচিত আমাদের। এই মৃতদেহের উপস্থিতি অজেয় করে তুলঁবে আমাদের এই ঘাঁটিটাকে।

জনতার মধ্য থেকে উত্থিত এক কলগুঞ্জন সমর্থন করল এঁজোলরাসের কথাগুলোকে।

এঁজোলরাস নত হয়ে মেবুফে’র মৃতদেহ একটু তুলে তার কপালটা চুম্বন করল। তার পর তার কোটটা খুলে দিল যাতে তার ক্ষতস্থান সবাই দেখতে পায়। এঁজোলরাস শেষে বলল, এটাই হবে আমাদের পতাকা।

.

৩.

মাদাম হুশেলুপের একটা কালো শাল ছিল। সেই শালটা এনে মেবুফে’র মৃতদেহটাকে ঢেকে দেওয়া হল। ছ টা বন্দুক দিয়ে একটা স্ট্রেচার বানিয়ে তার উপর মৃতদেহটা চাপিয়ে ওরা হোটেলের একতলায় একটা ঘরের টেবিলের উপর শ্রদ্ধার সঙ্গে নামিয়ে রাখল।

জেভার্তের পাশ দিয়ে যখন মৃতদেহটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন এঁজোলরাস তাকে বলল, তোমারও সময় হয়ে এসেছে।

শোকাহত সবাই যেন নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়েছিল।

এমন সময় গাভ্রোশের জোর চিৎকারে তাদের হুঁশ হয়।

গাভ্রোশে একা যখন পাহারা দিচ্ছিল তখন সে দেখে একদল সৈনিক চুপিসারে নিঃশব্দ পদক্ষেপে ব্যারিকেডের দিকে এগিয়ে আসছে। তাই সে চিৎকার করে ওঠে।

নগররক্ষী সেনাবাহিনীর লোকেরা ব্যারিকেডের ফাঁক দিয়ে ঝাঁক বেঁধে এগিয়ে আসছিল। এ এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক অবস্থায় বন্যার জল যেন বাঁধের কানায় কানায় উঠে পড়েছিল। আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই বাঁধ ছাপিয়ে উঠত যেন সে জল। বিপ্লবীদের ঘাঁটি দখল করে নিত সেনাবাহিনী।

বাহোরেল এগিয়ে গিয়ে কাছ থেকে একটা সৈনিককে গুলি করে মারল। তখন আর একটা সৈনিক তার বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে বাহোরেলকে মারল। আর এক সৈনিকের আঘাতে কুরফেরাক পড়ে গিয়ে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে লাগল। সেনাবাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে উঁচু মাথার একটা লোক বেয়নেট দিয়ে গাভ্রোশেকে আক্রমণ করতে গাভ্রোশে জেভার্তের সেই বড় বন্দুকটা উঁচিয়ে ধরল। কিন্তু ঘোড়া টিপলেও গুলি বার হল না, জেভার্ত গুলি ভরেনি তার বন্দুকে। সৈনিকটা তখন হাসতে হাসতে বেয়নেট দিয়ে গাভ্রোশের দেহে খোঁচা মারতে গেল। কিন্তু বন্দুকটা তার হাত থেকে পড়ে যেতেই তার থেকে একটা গুলি বার হয়ে সৈনিকটার কপালটাকে বিদ্ধ করল এবং তার থেকে আর একটা গুলি বার হয়ে যে সৈনিকটা কুরফেরাককে আক্রমণ করেছিল তার বুকে লাগায় সে লুটিয়ে পড়ল।

এমন সময় মেরিয়াস এসে বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে ঢুকল।

.

৪.

র‍্যু মঁদেতুরের মোড়ের মাথা থেকে মেরিয়াস যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সব দেখছিল। তখনও পর্যন্ত সে দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠতে পারেনি। তখনও তার বুকের ভেতরটা কাঁপছিল। কিন্তু এক অনিশ্চয় শূন্যতার রহস্যময় আঘাত সহ্য করতে পারছিল না সে। তার ওপর মঁসিয়ে মেবুফ ও বাহোরেলের মৃত্যু, গাভ্রোশের ওপর আক্রমণ, কুরফেরাকের সাহায্য প্রার্থনা, পর পর ঘটে যাওয়া এই সব মর্মান্তিক ঘটনাগুলোর আঘাতে তার মনের সব কুণ্ঠা নিঃশেষে দূরীভূত হয়ে গেল। দু হাতে দুটো পিস্তল নিয়ে এসে একটা পিস্তলের গুলি দিয়ে গাভ্রোশের আক্রমণকারীকে আর একটা পিস্তলের গুলি দিয়ে কুরফেরাকের আক্রমণকারীকে হত্যা করে তাদের উদ্ধার করল মেরিয়াস। পিস্তল দুটো খালি হয়ে পড়ল এবং আর গুলি নেই দেখে সে দুটো ফেলে দিল সে।

গোলমালের মধ্যে একদল সৈনিক ব্যারিকেডের উপর উঠে একটা দিক দখল করে নিল। তবে ব্যারিকেড থেকে নেমে বিপ্লবীদের অন্ধকার ঘটিটাতে ঢুকতে পারছিল না তারা। মেরিয়াস যখন নিরস্ত্র অবস্থায় হোটেলের নিচের তলায় বারুদের খোঁজে ঢুকতে যাচ্ছিল তখন একটা সৈনিক তাকে লক্ষ্য করে বন্দুক তুলে ধরে। কিন্তু একজন বিপ্লবী শ্রমিক তীরবেগে তার কাছে গিয়ে সৈনিকের বন্দুকধরা হাতটা বন্দুকের বাঁটটা দিয়ে মেরে সরিয়ে দিয়ে তাকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়। শ্রমিকটির হাতে গুলি লাগায় সে পড়ে যায়। কিন্তু মেরিয়াস বেঁচে যায়।

মেরিয়াস কিন্তু এ সবের কিছুই দেখেনি বা বুঝতে পারেনি। কারণ হোটেলে ঢোকার মুখটা ছিল অন্ধকারে ঢাকা এবং তার মনটা ছিল অন্য চিন্তায় মগ্ন। এক চরম বিপদের মুখে বিহ্বলতার একটা কুয়াশা ঘিরে থাকায় সে পেছন ফিরে তাকায়নি।

বিপ্লবীরা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লেও ভীত বা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েনি একেবারে। এঁজোলরাস তাদের বলল, মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করো। এলোমেলোভাবে গুলি ছুঁড়ো না।

বিপ্লবীদের বেশির ভাগ যোদ্ধা হোটেলের উপরতলায় গিয়ে জানালার ধারে শত্রুসৈন্যদের দিকে লক্ষ্য রেখে দাঁড়িয়ে ছিল। তবে এঁজোলরাস, কুরফেরাক, কমবেফারে আর জাঁ প্রভেয়ার হোটেলের বাইরে বাড়িটার গা ঘেঁষে সেনাদলের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে ছিল।

সেনাদলের এক অফিসার হঠাৎ একটা তরবারি তুলে ধরে বিপ্লবীদের উদ্দেশে বলল, অস্ত্র ত্যাগ করো।

এঁজোলরাস বলল, গুলি করো।

আবার দু পক্ষে গুলি বিনিময় হল। ধোঁয়ায় ভরে গেল চারদিক। এদিকে মেরিয়াস হোটেলের নিচের তলায় ঘর থেকে বারুদের একটা থলে নিয়ে ধোঁয়ায় গাঁ ঢাকা দিয়ে ব্যারিকেড়ের গাঁয়ে পাথরের একটা সিঁড়িতে যেখানে একটা মশাল জ্বলছিল সেখানে গিয়ে বারুদের থলেটা রাখল। তার পর সৈন্যদের লক্ষ্য করে চিৎকার করে বলল, ব্যারিকেড থেকে সরে যাও, তা না হলে ব্যারিকেড উড়িয়ে দেব বারুদের আগুনে।

সৈন্যরা বলল, তুমিও তার সঙ্গে উড়ে যাবে।

মেরিয়াস নত হয়ে মশালটা নামিয়ে বারুদে আগুন লাগাতে গেল মনে হল। তা দেখে সব সৈনিক ব্যারিকেড থেকে রাস্তার ওপারে চলে গেল।

.

৫.

মেরিয়াসকে এতক্ষণ তার বন্ধুদের কেউ দেখতে পায়নি। মেরিয়াসও কাউকে লক্ষ করেনি। তাকে এবার দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বন্ধুরা ছুটে এসে তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। কুরফেরাক গলাটা জড়িয়ে ধরল, তুমি তা হলে সত্যিই এসেছ?

কমবেফারে বলল, স্বাগত হে বন্ধু!

ল্যাগলে ওরফে বোসেত বলল, যথাসময়েই এসেছ।

কুরফেরাক বলল, তুমি সে সময় না এলে আমি মারা যেতাম।

গাভ্রোশে বলল, আমিও মারা যেতাম।

মেরিয়াস বলল, আমাদের নেতা কোথায়?

এঁজোলরাস বলল, এখন তুমিই আমাদের নেতা।

আজ সারাদিন ধরে মেরিয়াসের মাথার ভেতর যেন আগুন জ্বলেছে। এখন তার মনে হল একটা প্রবল ঘূর্ণিঝড় কোথা থেকে এসে তাকে তার জীবন থেকে বহু দূরে উড়িয়ে নিয়ে এসেছে। প্রজাতন্ত্রের জন্য মঁসিয়ে মেবুফে’র মৃত্যুবরণ এবং হঠাৎ তার বিপ্লবী নেতায় পরিণত হওয়ার ব্যাপার দুটো এমনভাবে ঘটে গেল যে সেসব সত্য কি না তা সে বুঝতেই পারছিল না। তার নিজের জীবনেরই ঘটনাগুলোকে এক দুর্বোধ্য নাটকের অলীক ঘটনাজাল বলে মনে হচ্ছিল।

ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মনটা বিব্রত ছিল বলে এতক্ষণ ঘরের এককোণে বাধা থাকা জেভার্তকে দেখতে পায়নি মেরিয়াস। জেভার্ত এতক্ষণ নির্বিকারভাবে উভয়পক্ষের যুদ্ধ এক শহীদসুলভ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দেখছিল।

আক্রমণকারী সৈনিকরা আর এগোয়নি। রাস্তার ওপার থেকে তাদের কথাবার্তার শব্দ কানে আসছিল। হয়তো নতুন আদেশনামার জন্য অপেক্ষা করছিল অথবা আরও সেনাদলের আসার অপেক্ষায় ছিল। তারা হয়তো বুঝেছিল বিপ্লবীদের এ ঘাঁটি দখল করা খুব একটা সহজ কাজ নয়।

মঁসিয়ে মেবুফে’র মৃতদেহটা নিচের তলার ঘরের একটা টেবিলের উপর শায়িত ছিল। হোটেলের বিছানা থেকে সব তোষক এনে ঘরের মেঝেয় পাতা হয়ে ছিল। তার উপর আহতদের শুইয়ে রাখা হয়েছে এবং মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা আহতদের চিকিৎসা করছিল।

হঠাৎ দেখা গেল জাঁ প্রুভেয়ার নেই। আহত বা মৃতদের মাঝেও তাকে পাওয়া গেল। না। তখন কমবেফারে এঁজোলরাসকে বলল, ওরা বোধ হয় প্রভেয়ারকে বন্দি করে নিয়ে গেছে। ঠিক আছে, ওরা আমাদের বন্ধুকে নিয়ে গেছে, ওদের তেমনি এজেন্ট জেভাৰ্তও আমাদের হাতে আছে। তুমি কি জেভার্তকে একান্তই মৃত্যুদণ্ড দিতে চাও?

এঁজোলরাস বলল, তার বিনিময়ে জাঁ প্রুভেয়ারকে পেলে তা দিতে চাই না।

কমবেফারে বলল, তা হলে একটা সাদা রুমাল উড়িয়ে ওদের এই বন্দি বিনিময়ের প্রস্তাবটা দেব?

এঁজোলরাস তাকে চুপ করতে বলল ইশারায়। সহসা গুলি বিনিময়ের শব্দ শোনা গেল। এক বীরত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক! প্রজাতন্ত্রের ভবিষ্যৎ দীর্ঘজীবী হোক!

সে কণ্ঠস্বর জাঁ ভেয়ারের।

কমবেফারে বলল, ওরা প্রুভেয়ারকে গুলি করেছে।

এঁজোলরাস জেভার্তের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, তোমার বন্ধুরা তোমাকেও হত্যা করল।

.

৬.

যুদ্ধের এক আশ্চর্য রীতি এই যে আক্রমণকারীরা শুধু ব্যারিকেডের সামনেটাই আক্রমণ করে। তার পেছনে গিয়ে শত্রুপক্ষের ঘাঁটিটাকে আক্রণ করতে চায় না। কারণ তারা গলিপথে ঢুকতে চায় না এবং তার ওপর তারা গুপ্ত প্রতি-আক্রমণের ভয় করে।

র‍্যু মঁদেতুরের গলির মোড়ে যে ছোট ব্যারিকেডটা তৈরি করা হয়ে ছিল সেটারও দিকে কেউ এতক্ষণ নজর দেয়নি। সেখানে শুধু একটা ছোট মশাল জ্বলছিল। বিপ্লবী যোদ্ধাদের দৃষ্টি ছিল বড় ব্যারিকেডের ওপর।

মেরিয়াস এবার সেই ছোট ব্যারিকেডটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল। তার পর সে। যখন সেই ব্যারিকেড থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় অন্ধকার থেকে কে তার নাম ধরে ডাকল, মঁসিয়ে মেরিয়াস।

কণ্ঠস্বরটা চিনতে ভুল হল না মেরিয়াসের। সে বেশ বুঝতে পারল মাত্র দু তিন ঘন্টা আগে এই কণ্ঠস্বরই র‍্যু প্লামেতের গেট থেকে তাকে ডেকেছিল। তবে এখন সে কণ্ঠস্বরটাকে অনেক ক্ষীণ মনে হল।

কাউকে দেখতে না পেয়ে চলে যাচ্ছিল মেরিয়াস। তখন আবার সেই কণ্ঠস্বর তাকে ডাকল।

এবার মেরিয়াস একটা বাতির অস্পষ্ট আলোয় দেখল রক্তমাখা আলখাল্লা আর পায়জামা পরা কমবয়সী কে একটা লোক খালি পায়ে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে তার দিকে। সাদা ফ্যাকাশে মুখটা মেরিয়াসের দিকে তুলে সে লোকটি বলল, আমাকে। চিনতে পারছেন?

না।

আমি এপোনিনে।

মেরিয়াস ঝুঁকে ভালো করে দেখল, পুরুষের পোশাকপরা এপোনিনেই তার সঙ্গে কথা বলছে।

এখানে কী জন্য এসেছ তুমি? কী করছ? আমি এখন মরতে চলেছি।

এপোনিনের কথাগুলো এমনভাবে ধ্বনিত হল তার কণ্ঠে, যা শুনে ভয় পেয়ে গেল মেরিয়াস। সে ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগল, তুমি আহত, আমি তোমাকে হোটেলে বয়ে নিয়ে যাব। ওরা তোমার ক্ষততে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেবে।

মেরিয়াস হাত বাড়িয়ে এপোনিনেকে তুলে ধরতে যেতে সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল।

মেরিয়াস ব্যস্ত হয়ে বলল, তোমার লাগছে? একটু লেগেছে।

এই বলে এপোনিনে তার একটা হাত তুলে দেখাল হাতের চাটুতে একটা ফুটো। মেরিয়াস বলল, কী হয়েছে?

একটা গুলি ঢুকে বেরিয়ে গেছে। তোমার মনে নেই একটা সৈনিক বন্দুক উঁচিয়ে তোমাকে গুলি করতে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, আর একটা হাত তার হাতটা সরিয়ে দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দেয়।

সে হাত আমার।

মেরিয়াস কেঁপে উঠল। বলল, কী পাগলামি! আমি তোমাকে বিছানায় শুইয়ে দেব, ও হাতটা বেঁধে দেবে। শুধু হাতটা ক্ষত হলে মানুষ মরে না।

এপোনিনে বলল, শুধু হাতে নয়, গুলিটা আমার পিঠেও লাগে। পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে এসে হাতে লাগে। আমাকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং তুমি আমার খুব কাছে এসে বস।

মেরিয়াস তাই করল। এপোনিনে তার মাথাটা মেরিয়াসের হাঁটুর উপর রাখল। তার পর তার মুখের দিকে না তাকিয়েই বলতে লাগল, আহ্, কত সুখ কত শান্তি! আর আমি কোনও যন্ত্রণা অনুভব করছি না। এবার সে মেরিয়াসের মুখপানে তাকিয়ে বলতে লাগল, তুমি জান তুমি যখন র‍্যু প্লমেতের বাগানে গিয়েছিলে তখন আমি রেগে গিয়েছিলাম। অথচ আমিই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাই সেখানে। কিন্তু আমার জানা উচিত ছিল। তোমার মতো এক যুবক—

কথাটা বলতে বলতে কী যেন ভাবতে লাগল সে আর একফালি ক্ষীণ সকরুণ হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। তার পর আবার সে বলতে লাগল, তুমি আমাকে কুৎসিত ভাব। কিন্তু তোমারও মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। কারণ এখান থেকে জীবন্ত কেউ বেরিয়ে যেতে পারবে না। আর আমিই তোমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসি। কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখ। কিন্তু আমিও এখানে চলে আসি, কারণ তোমার আগেই আমি মরতে চেয়েছিলাম। সেদিনটার কথা তোমার মনে আছে, যেদিন আমি প্রথম তোমার ঘরে ঢুকে তোমার আয়নায় আমি মুখ দেখি। আমি যখন লার্কের মাঠে তোমার সঙ্গে দেখা করি সেই সময়টার কথা মনে পড়ে? দিনটা ছিল কত উজ্জ্বল আর উষ্ণ, একটুও ঠাণ্ডা ছিল না। মাঠে কত পাখি গান করছিল। পথে তুমি আমায় পাঁচ ফ্রাঁ দিতে এসেছিলে। কিন্তু আমি নিইনি, বলেছিলাম, তোমার টাকা আমি চাই না। তুমি কি সেটা কুড়িয়ে নিয়েছিলে? আজ আমি কত সুখী! আমরা সবাই মরতে বসেছি।

আচ্ছন্নের মতো প্রলাপ বকছিল এপোনিনে। তার ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে তার বুকের ক্ষতটা দেখা যাচ্ছিল। সে হাত দিয়ে বুকের ক্ষতটা চেপে ধরল। তার থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছিল। সেই ক্ষতটার পানে তাকাতেই মেরিয়াসের বড় ব্যথা লাগল।

এপোনিনে বলল, আবার সেই যন্ত্রণাটা উঠছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না।

এমন সময় গাভ্রোশের গলা শোনা গেল। সে বন্দুকে গুলি ভরতে ভরতে গান করছিল।

সে গান শুনে এপোনিনে বলল, ও আমার ভাই। ও যেন আমাকে না দেখে, ও তা হলে আমায় বকবে।

মেরিয়াস আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল, তোমার ভাই! কী বলছ?

সহসা তার বাবা থেনার্দিয়েরদের প্রতি যে কর্তব্যভার তার ওপর দিয়ে যায় সে কথা মনে পড়ে গেল মেরিয়াসের। সে বলল, যে ছেলেটা গান করছে তার কথা বলছ?

হ্যাঁ, ও আমার ভাই।

মেরিয়াস উঠে ডাকতে যাচ্ছিল তাকে। কিন্তু এপোনিনে বলল, না, যেও না, আর বেশিক্ষণ আমি বেঁচে থাকব না।

একটু খাড়া হয়ে বসার চেষ্টা করল এপোনিনে। তার হেঁচকি উঠছিল। তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। সে মুখ তুলে বলল, আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে পারব না। আমার পকেটে একটা চিঠি আছে। চিঠিটা আমাকে ডাকে ফেলে দিতে বলেছিল, কিন্তু আমি দিতে চাইনি। কিন্তু এখন সেটা না দিলে পরে যখন স্বর্গে আমাদের দেখা হবে তখন আমার ওপর রেগে যাবে তুমি। আমরা তো সবাই এক জায়গাতেই যাচ্ছি। আবার আমাদের দেখা হবে।

অনেক কষ্ট করে চিঠিটা মেরিয়াসের হাতে তুলে দিল এপোনিনে। বলল, এই নাও।

মেরিয়াস চিঠিটা নিতেই স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ল এপোনিনে। তার পর বলল, এখন তোমাকে একটা কথা দিতে হবে।

মেরিয়াস বলল, দিচ্ছি। বল কী করতে হবে?

এপোনিনে বলল, আমার মৃত্যুর পর আমার কপালে একটা চুম্বন করবে। আমি তা বুঝতে পারব।

এই বলে সে তার মাথাটা আবার মেরিয়াসের কোলের উপর রাখল। সে চোখ দুটো বন্ধ করল। মেরিয়াসের মনে হল তার আত্মা দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। কিন্তু এপোনিনে আবার চোখ খুলল। মেরিয়াস দেখল সে চোখে মৃত্যুর এক গভীর ছায়া ঘন হয়ে উঠেছে। এপোনিনে ক্ষীণ কণ্ঠে টেনে টেনে বলল, তুমি হয়তো জান, আমি তোমাকে কিছুটা ভালোবেসেছিলাম।

এপোনিনের কণ্ঠস্বরটা এমন মধুর শোনাল যে তার মনে হল সে কণ্ঠ এ জগতের নয়, অন্য এক জগৎ থেকে ভেসে এসেছে। এপোনিনে একটুখানি হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করল তার মুখে কিন্তু তার আগেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেল।

.

৭.

মেরিয়াস তার প্রতিশ্রুতি রাখল। হিমশীতল ঘাসে ভিজে এপোনিনের ফ্যাকাশে কপালটার উপর চুম্বন করল মেরিয়াস। তার পর তার দেহটা মাটির উপর নামিয়ে রাখল।

এপোনিনের চোখ দুটো চিরতরে মুদ্রিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই চিঠিটা খোলার জন্য দারুণ কৌতূহল জাগল মেরিয়াসের। তবু সে ভাবল এপোনিনের মৃতদেহটার পাশে বসে এ চিঠি পড়া উচিত হবে না। তাই হোটেলের নিচের তলায় একটা ঘরে গিয়ে বাতির আলোয় চিঠিটা খুলল সে। খামে ভরা চিঠিটা পড়ার জন্য খামটা খুলে ফেলল। তার উপর মেয়েমানুষের হাতে তার ঠিকানা লেখা ছিল। চিঠিটাতে অল্প দু-চারটে কথা লেখা ছিল।

প্রিয়তম,

আমার বাবা আজ রাতেই এ বাসা ছড়ে চলে যাবার জন্য জেদ ধরেছেন। আমরা এখন র‍্যু দ্য লা হোমি আর্মেতে চলে যাচ্ছি। এক সপ্তা পরেই ইংল্যান্ড রওনা হচ্ছি।– কসেত্তে। ৪ জুন।

আসলে যে ব্যাপারটা ঘটেছিল তা হল এই, সব কিছুর জন্য এপোনিনেই দায়ী। ৩ জুন তারিখে সন্ধ্যাবেলায় এপোনিনের মনে দুটো কাজের পরিকল্পনা ছিল। একটা কাজ হল তার বাবা ও তার সহকর্মীরা র‍্যু প্লামেতের বাড়ি লুট করার মতলব করেছিল তা ব্যর্থ করা আর একটা কাজ ছিল মেরিয়াসকে কসেত্তে’র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা। এপোনিনে তাই একজন যুবকের সঙ্গে পোশাক বিনিময় করে নিজে পুরুষের পোশাক পরে আর যুবকটি মেয়েদের পোশাক পরে মজা পায়। ম্যাম্প দ্য শার্সে ভলজাঁ যখন একা একা বসে ভাবছিল তখন সে ভলজাঁকে একটা বেনামি চিঠি দিয়ে র‍্যু প্লামোতের বাড়ি ছাড়ার জন্য সতর্ক করে দেয়। ভলজাঁ সেদিন তাই বাড়ি ফিরেই কসেত্তেকে বলে, তুসাঁকে নিয়ে তারা সেই দিনই র‍্যু দ্য লা হোমির বাড়িতে চলে যাবে এবং পরের সপ্তাহে তারা ইংল্যান্ড চলে যাবে।

কসেত্তে তখন তাড়াতাড়ি মেরিয়াসকে একটা চিঠিতে জানিয়ে ভাবতে থাকে কিভাবে চিঠিটা সে ডাকে পাঠাবে। কোথায় ফেলবে। এমন সময় সে বাগানের গেটের সামনে এক যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে তখন তাকে ডেকে চিঠিটা তাকে ফেলতে দেয়। চিঠিটা কসেত্তে ডাকে না ফেলে নিজের কাছে দু দিন রেখে দেয়। ৫ জুন সে মেরিয়াসের খোঁজে কুরফেরাকের বাসায় যায়। মেরিয়াসকে একবার চোখে দেখাই ছিল তার উদ্দেশ্য। তার পর কুরফেরাক যখন বলে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে ব্যারিকেড তৈরি করতে গেছে তখন এপোনিনে লুকিয়ে গিয়ে দেখে আসে কোথায় তারা ব্যারিকেড তৈরি করছে। পরে সে র‍্যু প্লামেতে চলে যায়, কারণ সে জানত সন্ধের সময় সেদিন মেরিয়াস সেখানে কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করতে যাবে। সে তখন অন্ধকারে মেরিয়াসকে ব্যারিকেডে তার বন্ধুদের কাছে যাবার জন্য বলে। পরে সে নিজে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে চলে যায়। এইভাবে অতৃপ্ত প্রেমজনিত এক প্রবল ঈর্ষার বশে নিজেকে এবং তার প্রেমিককে একই সঙ্গে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় সে। ভাবে যে প্রেমিককে সে লাভ করতে পারবে না জীবনে তাকে যেন আর কেউ লাভ করতে না পারে।

কসেত্তে’র চিঠিটা পড়ার পর মেরিয়াস সেটাকে চুম্বন করল। কসেত্তে এখনও তাকে ভলোবাসে, ভাবল, তাকে তা হলে বাঁচতে হবে কসেত্তে’র জন্য। কিন্তু সে এখন ইংল্যান্ড চলে যাচ্ছে এবং তার মাতামহ এ বিয়েতে মত দেননি। আবার হতাশার গভীরে ডুবে গেল সে। সে ভাবল মৃত্যু ছাড়া আর কোনও গতি নেই। কিন্তু তার আগে দুটো কাজ তাকে করতে হবে। সে তার পকেট থেকে নোটবইটা বার করে তার থেকে একটা পাতা নিয়ে কসেত্তেকে একটা চিঠি লিখল। তাতে লিখল, আমাদের বিয়ে সম্ভব নয়। আমার মাতামহের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এ বিয়েতে মত দেননি। আমার টাকা নেই। আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমরা ছিলে না। তোমার কাছে যে শপথ আমি করেছিলাম সে শপথের কথা হয়তো তোমার মনে আছে। আমি মরব। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি যখন এ চিঠি পড়বে তখন আমার আত্মা তোমার কাছেই থাকবে এবং তোমার পানে তাকিয়ে হাসবে।

খাম না থাকায় চিঠিটা লেখার পর সেটা ভাঁজ করে তার উপর কসেত্তে’র নতুন ঠিকানাটা লিখল। তার পর আর একটা কাগজে লিখল, আমার নাম মেরিয়াস পঁতমার্সি। আমার মৃত্যুর পর আমার মৃতদেহ আমার মাতামহ মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কাছে র‍্যু দে ফিলে দু কালভেরিতে নিয়ে যাওয়া হবে।

এরপর সে গাভ্রোশেকে ডাকল। বলল, একটা কাজ তুমি আমার করবে?

গাভ্রোশে বলল, তুমি যা বলবে। তুমি না হলে তো আমি মরেই যেতাম।

এই চিঠিটা দেখছ। এই চিঠিটা এই ঠিকানায় দিয়ে আসতে হবে। এখনি যেতে হবে তোমায়।

গাভ্রোশে মাথা চুলকোঁতে লাগল। মেরিয়াস বলল, চিঠিটা দিতে হবে ম্যাদময়জেল কসেত্তেকে, তার বাবার নাম মঁসিয়ে ফশেলেভেন্ত। তাদের বাড়ি ৭ নম্বর র‍্যু দ্য লা হোমি আর্মেতে।

গাভ্রোশে বলল, তা তো বুঝলাম। কিন্তু আমি চলে গেলে ওরা ব্যারিকেড দখল করে নেবে।

কিন্তু রাত্রিতে ওরা আর আক্রমণ করবে না। সকাল না হওয়া পর্যন্ত ব্যারিকেডের পতনের কোনও সম্ভাবনা নেই।

কিন্তু চিঠিটা তো আমি সকালে দিয়ে আসতে পারি।

অনেক দেরি হয়ে যাবে। তা ছাড়া সকালে রাস্তায় রাস্তায় পাহারা বেড়ে যাবে। তখন যেতেই পারবে না।

মাথা চুলকোঁতে চুলকোঁতে কুণ্ঠিত অবস্থায় আবার কিছুটা ভাবল গাভ্রোশে। তার পর সে চিঠিটা নিল।

চিঠিটা নিয়ে গাভ্রোশে ভাবল, জায়গাটা দূরে নয়, এখন দুপুররাত। এখনো সময় আছে। চিঠিটা একসময় নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েই চলে আসবে। কিন্তু কথাটা বললে মেরিয়াস আপত্তি করবে ভেবে তাকে বলল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *