প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.১২ সব দুঃখের অবসান

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

১.

সেদিন সন্ধ্যার সময় লা শাঁব্রেরির ব্যারিকেডের কাজে যোগদান করার জন্য মেরিয়াসকে যখন ডাকা হয় তখন তার মনে হয় নিয়তি যেন তাকে ডাকছে। আশাহত বেদনায় ও নিবিড় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে সে যে মৃত্যুকে কামনা করেছে সেই মৃত্যুবরণের এটাই হল প্রকৃষ্ট উপায়। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার সব দুঃখের অবসান ঘটাতে চেয়েছিল সে।

ঘর থেকে বেরিয়ে সে হাঁটতে লাগল। তার হাতে আগেই জের্তের দেওয়া পিস্তলটা ছিল। সে র‍্যু প্লামেত থেকে বুলেভার্দ ও শ্যাম্প এলিসি হয়ে র‍্যু দ্য রিভোলিতে চলে গেল। সেখানে দেখল দোকানপাত খোলা আছে। অনেকে দোকানে জিনিস কিনছে।

কিন্তু দেলোর্মে দিয়ে র‍্যু সেন্ট অনোরেত্তে এসে মেরিয়াস দেখল সেখানে দোকানপাট সব বন্ধ। কিন্তু সব বাড়িতে আলো জ্বলছিল। ফুটপাথ দিয়ে লোক যাতায়াত করছিল। বাড়িগুলোর আধখোলা দরজায় লোকেরা জটলা করছে। কিন্তু আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মেরিয়াস দেখল সব বাড়ির দরজা-জানালা বন্ধ। পথে লোকজন নেই। কোনও বাড়িতে আলো জ্বলছে না। দেখল অন্ধকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে একদল করে জনতার ভিড়। কিন্তু কোনও মানুষের মুখে কথা নেই। মাঝে মাঝে চাপা গলায় তারা কী সব বলাবলি করছিল। জনতার মধ্যে অনেকের গায়ে কালো কোট আর গোল টুপি ছিল। অনেকের গায়ে ছিল শ্রমিকদের আলখাল্লা। পথের উপর এক জায়গায় দেখল বন্দুক গাদা করা রয়েছে। পথে আলো জ্বলছে, কিন্তু কোনও লোকচলাচল নেই। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখল, জনতার ভিড় আর নেই। তার কিছু দূরে ওদিকে সেনাবাহিনী পথ দখল করে আছে। মাঝখানে অন্ধকার। মেরিয়াস তবু থামল না। যে আহ্বান এসেছে তার কাছে সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে যেতেই হবে।

কিছুদূর গিয়ে সে একটা ব্যারিকেড দেখতে পেল। পাশ কাটিয়ে আরও কিছুটা গিয়ে সে র‍্যু ব্যালেতে এসে পৌঁছল। র‍্যু ব্যালে থেকে একটা রাস্তা সেন্ট ডেনিসের দিকে চলে গেছে।

লে হ্যালে অঞ্চলের বিভিন্ন গলিপথে তখন বিপ্লবীরা ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। যে অন্ধকার সব বিদ্রোহ ও গণ-অভ্যুত্থানের অদৃশ্য অভিভাবক, যে অন্ধকারের আবরণে বিদ্রোহীরা তাদের সংখ্যাগত অপূর্ণতাটাকে ঢেকে রাখে, সে অন্ধকার যেন প্রহরীর মতো সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে বিদ্রোহী ঘাঁটিগুলোকে রক্ষা করে চলছিল। কোনও বাড়ির জানালায়। কোনও আলো দেখা যাচ্ছিল না। কোনও জানালায় আলো দেখা গেলেই গুলি করা হচ্ছিল। ভয়ে, শোকে, বিস্ময়ে বাড়ির মধ্যে স্তব্ধ হয়ে ছিল বাসিন্দারা। অন্ধকারের মাঝে মাঝে ব্যারিকেডগুলো থেকে একটা করে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছিল। সেন্ট মেরি ও তুর সেন্ট জ্যাকে দুটো ব্যারিকেড ছিল। অবরুদ্ধ এলাকার বাড়িগুলো অন্ধকারে সব স্তব্ধ হয়ে ছিল। সরকার ও বিদ্রোহী জনতা–উভয়পক্ষই অনমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে জিততে চায়।

প্রকৃতিও যেন বিপ্লবীদের সপক্ষে সহানুভূতি প্রকাশ করছিল। আকাশে কোনও তারা ছিল না। ঘন কালো মেঘ মৃতবৎ রাস্তাগুলোকে সমাধিগহ্বরের ছাদের মতো ব্যাপ্ত করে ছিল। মাঝে মাঝে নীরব নির্জন রাস্তাগুলো থেকে বিক্ষুব্ধ জনতার যে ধ্বনি শোনা যাচ্ছিল সেই ধ্বনির মধ্যে একই সঙ্গে হিংস্র জন্তুর গর্জন আর দেবতার কণ্ঠস্বর যেন মিশ্রিত হয়ে ছিল। সে ধ্বনি একই সঙ্গে দুর্বলচিত্তদের মনে ভয় আর আত্মসচেতন ব্যক্তিদের মনে এক ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী হিসেবে কাজ করছিল।

.

২.

লে হ্যালেতে পৌঁছে মেরিয়াস দেখল অন্যান্য রাস্তার থেকে এ অঞ্চলটা আরও শান্ত, আরও স্তব্ধ। সেখান থেকে অদূরে লা শাঁব্রেরি’র মাথায় একটা জ্বলন্ত মশালের আলো দেখে সেদিকে এগিয়ে যেতে লাগল সে। মার্শে-অ-পয়রি আর র‍্যু দে প্রেশিউর পার হয়ে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলে বিদ্রোহী প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে অবশেষে নেতুরের গলিপথে ছোট ব্যারিকেডটার কাছে এসে পড়ল মেরিয়াস। দেখল গলিপথের ওধারে হোটেলটার কাছে আর একটা বড় ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে। ব্যারিকেডের মাথা থেকে মোমবাতির মশালের ক্ষীণ আলোর একটা আভা ছড়িয়ে পড়েছিল গলিপথে। একটা বাড়ির আড়ালে এক জায়গায় একটা পাথরের উপর বসে বসে ভাবতে লাগল সে। তার থেকে মাত্র কুড়ি গজ দূরে বিদ্রোহীদের ঘাটি। সেখানে বিদ্রোহীরা নিজেদের মধ্যে কী আলোচনা করছিল।

মেরিয়াস প্রথমে তার বাবা কর্নেল পঁতমার্সি’র কথা ভাবতে লাগল। তার বাবা যে কর্নেল পঁতমার্সি নেপোলিয়নের অধীনে ফ্রান্সের সীমান্ত ও গৌরব রক্ষার জন্য এশিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে যায় একদিন, সে একদিন জেনোয়া, আলেকজেন্দ্রিয়া, মাদ্রিদ, ভিয়েনা, মিলান, টুরিন, মস্কো প্রভৃতি ইউরোপের কত যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বসহকারে যুদ্ধ করে বেড়ায়, যে সারাজীবন ধরে সামরিক আদেশ পালন করে আর নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলে অকালে চুল পাকিয়ে ফেলে, সেই কর্নেল পঁতমার্সির রক্ত তার দেহের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। আজ এবার তার পালা। আজ তাকে তার বাবার মতোই এই অটল সংকল্পে দৃঢ়চিত্ত হয়ে কামানের গোলার সামনে বুক পেতে দিতে হবে নির্ভীকভাবে।

এ ছাড়া আর কী-ই বা করবে সে? বেঁচে থেকে কী লাভ? কসেত্তে ছাড়া জীবনে বেঁচে থাকা অসম্ভব তার পক্ষে। একথা সে জেনেও তাকে না বলে, তার ঠিকানা জানা সত্ত্বেও তাকে কিছু না জানিয়ে কোথায় চলে গেছে। তার মানে তার মৃত্যুতে তার সমর্থন আছে।

তাছাড়া সে যখন এতদূর এসে পড়েছে তখন আর ফিরবে না সে। যেসব বন্ধুর কাছে। সে এতদিন বাস করেছে, যারা এই বিপদের দিনে তাকে চায়, তাদের ফেলে চলে যাওয়া মোটেই শোভা পায় না তার পক্ষে। বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা ঝেড়ে ফেলে দেশের ডাকে সাড়া না দিয়ে কাপুরুষের মতো সে যদি পিছু হটে যায় তা হলে তার বাবার আত্মা বোধ হয় তার সেই পবিত্র তরবারিটা দিয়েই আঘাত করবে তাকে। দেশসেবার এক মহান কর্তব্য হিসেবে আজ যদি এ বিপ্লবে যোগ দেয় তা হলে কি সেটা কর্নেল পঁতমার্সি’র পুত্র হিসেবে অপমানজনক কাজ হবে তার পক্ষে?

মাথা নিচু করে সোজা হয়ে বসে ভেবে যেতে লাগল মেরিয়াস, অনেকে হয়তো বলতে পারে গৃহযুদ্ধ।

গৃহযুদ্ধ মানে কী? প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধের কি কোনও বিশেষণ থাকতে পারে, যেমন বৈদেশিক যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি যুদ্ধে ন্যায়-অন্যায়টাই হল বড় কথা। যে যুদ্ধ মানুষের অধিকারকে পদদলিত করে, অগ্রগতিতে বাধা দেয়, যুক্তি, সভ্যতা, ন্যায় ও সত্যকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করে সেই যুদ্ধই অন্যায় যুদ্ধ। অপরপক্ষে যে যুদ্ধ ন্যায় ও সত্যকে রক্ষা করে, মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় সেই যুদ্ধই ন্যায়যুদ্ধ। যতদিন পর্যন্ত সারা বিশ্বে মানবজাতির মধ্যে পরিপূর্ণ ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হবে ততদিন এ যুদ্ধ চলবেই। ঐশ্বরিক অধিকারবোধে প্রমত্ত রাজতন্ত্র অত্যাচারী হয়ে উঠলে তা বৈদেশিক শত্রুর মতো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কোনও বৈদেশিক আক্রমণ যেমন দেশের ভৌগোলিক সীমানাকে লঙ্ঘন করে তার জাতীয় স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে তেমনি স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী রাজা দেশের নাগরিকদের নৈতিক সীমানা লঙ্ঘন করে তার ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করে। তাই বৈদেশিক আক্রমণকারীদের মতো স্বৈরাচারী রাজাকেও লড়াই করে বিতাড়িত করতে হয়। এমন এক একটা সময় আসে যখন কোনও প্রতিবাদ, কোনও যুক্তি বা চিন্তাশক্তি অত্যাচারের-অবিচারের প্রবল স্রোতের সামনে দাঁড়াতে পারে না, খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। তখন চাই বলপ্রয়োগ আর সংগ্রাম। যে জনগণ রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের প্রমত্ততা ও সিজারীয় গৌরবের কুটিল ঐশ্বর্যের বিশাল ছায়ার দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে সেদিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে, দেশের কিছু বীর যোদ্ধা ও সগ্রামী নেতা এই ছায়ার করালগ্রাস থেকে উদ্ধার করে সামাজিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন দেশে, জনগণের হাতে তুলে দেন তাদের হারানো স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের অধিকার। অত্যাচারী নিপাত যাক। কিন্তু অত্যাচারী কে? লুই ফিলিপ কি অত্যাচারী? ইতিহাস তো রাজা লুই ফিলিপ আর রাজা ষোড়শ লুই দু জনকেই ভালো রাজা বলে আখ্যাত করেছে। কিন্তু ইতিহাস যা-ই বলুক, মানুষ হিসেবে যতই ভালো বা নিহরষ্কারী হোক লুই ফিলিপ, জনগণকে প্রতিশ্রুত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তিনি দিয়েছেন এক অমার্জনীয় স্বৈরাচারিতার পরিচয়। সত্য কখনও অংশীভূত বা খণ্ডিত হতে পারে না। কোনও রাজা বা মানুষের একদিক ভালো আর একদিক খারাপ হলে তাকে কখনও ভালো বলা যায় না। যে ভালো, সব দিকেই ভালো হবে। যে রাজশক্তি মানবজাতির ঐক্য, বিশ্বশান্তি ও সর্বত্র আইনের অনুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় হয়ে ওঠে, আজকের বিপ্লব সেই রাজশক্তির উচ্ছেদ চায়। অস্টারলিৎসের যুদ্ধ জয় করা গৌরবজনক কাজ ঠিক, কিন্তু বাস্তিল দুর্গ দখল করা আরও বড় কাজ।

হতাশার শেষ প্রান্তে এসে যুক্তিপারম্পর্যের এক অবিছিন্ন সুতো দিয়ে এমনি করে এক চিন্তার জাল রচনা করে যেতে লাগল মেরিয়াস।

এইসব কিছু ভাবতে ভাবতে ব্যারিকেডের ওদিকটায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করল সে। বিদ্রোহী নেতাদের চাপা কথাবার্তা থেকে তার মনে হল তাদের নীরবতা অস্বাভাবিক, এ নীরবতা এক ভয়ঙ্কর প্রত্যাশার শেষ স্তরের সূচক ছাড়া আর কিছুই নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *