প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.০৩ গত শতাব্দীর মধ্যভাগে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

১.

গত শতাব্দীর মধ্যভাগের কাছাকাছি হাইকোর্টের এক বিচারপতি ও পার্লামেন্টের সদস্য ফবুর্গ সেন্ট জার্মেন অঞ্চলের রুট প্লামেতে একটা বাড়ি করেছিলেন। বাড়িটা দোতলা। নিচের তলায় ছিল দুটো বসার ঘর আর একটা রান্নাঘর। তার উপরে ছাদ। বাড়িটার সামনের দিকে ছিল লোহার গেটওয়ালা একটা বাগান, তার সামনে বড় রাস্তা। বাড়ির পেছনে ছিল একটা উঠোন আর তার একপাশে দুটো ঘর ছিল কটেজ ধরনের। প্রয়োজনমতো শিশুসহ কোনও ধাত্রীর থাকার জন্য হয়তো তৈরি হয়েছিল ঘর দুটো। এই ঘর দুটোর পেছন দিকে একটা গোপন দরজা ছিল যার মধ্য দিয়ে একটা গলিপথে গিয়ে পড়া যেত।

যে বিচারপতি ম্যাজিস্ট্রেট এই বাড়িটা চেনেন তিনি ছাড়া এই গোপন দরজাটার কথা আর কেউ জানত না। বাড়ির পেছন দিকের অঞ্চলটার নাম র‍্যু দ্য বেবিলন। বর্তমানে কিন্তু এই বাড়িটা তার এমন এক মালিকের অধীনে আসে যিনি নিজে থাকেন না এ বাড়িতে এবং ১৮২৯ সালের অক্টোবর মাসে একজন ভদ্রলোক এই গোটা বাড়িটা ভাড়া নেয়। কিন্তু বাড়িতে লোক বলতে ছিল ভদ্রলোক নিজে, একটি তরুণী মেয়ে আর ঘর-সংসারের কাজকর্ম করার জন্য এক বৃদ্ধা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাড়ির এই নতুন ভাড়াটে সম্বন্ধে এ অঞ্চলে কোনও আলোচনা হয়নি, কারণ এ অঞ্চলে লোকবসতি মোটেই ঘন নয়।

একরকম অজানিতভাবে এই বাড়িটি মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের নামে যে ভদ্রলোক ভাড়া নেয় সে ভদ্রলোক হল আসলে জাঁ ভলজাঁ। তার সঙ্গের তরুণীটি হল কসেত্তে। তাদের কাজকর্ম করার জন্য যে বৃদ্ধা ছিল তার নাম ছিল তুসা। সে একটা কারখানায় কাজ করত আগে। কিন্তু বার্ধক্যবশত কারখানার কাজ করতে পারত না বলে জাঁ ভলজাঁ তাকে আশ্রয় দিয়েছে তার বাড়িতে।

কিন্তু জাঁ ভলজাঁ পেতিত পিকপাসের কনভেন্ট ছাড়ল কেন?

তার উত্তর হল এই যে, কিছুই ঘটেনি।

আমরা যতদূর জানি জাঁ ভলজাঁ কনভেন্টে খুব সুখেই ছিল। এত সুখে ছিল যে তার বিবেক বিব্রতবোধ করত। কসেত্তেকে রোজ দেখার সঙ্গে সঙ্গে পিতৃসুলভ দায়িত্ববোধ বেড়ে যেত। সে তার আত্মিক উন্নতির কথা ভাবত। সে ভাবত পৃথিবীর কোনও লোক কসেত্তেকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারবে না। তার কেবলি মনে হত কসেত্তে ভবিষ্যতে একজন সন্ন্যাসিনী হবে। কনভেন্টের পরিবেশ ধীরে ধীরে তাকে সন্ন্যাসিনী জীবনের দিকে নিয়ে যাবে এবং এই কনভেন্টই একদিন তাদের দুজনেরই এক নিজস্ব জগতে পরিণত হয়ে উঠবে। কালক্রমে সে নিজে বুড়ো হয়ে উঠবে এবং কসেত্তে এক পূর্ণবয়স্কা নারীতে পরিণত হবে। তাদের মধ্যে আর কোনওদিন কোনও বিচ্ছেদ ঘটবে না। কিন্তু সে নিজেকে প্রায়ই প্রশ্ন করত, এই সুখ এই মিলনের আনন্দ সে নিজে বৃদ্ধ হয়ে কেন এক শিশুর আত্মত্যাগের বিনিময়ে লাভ করতে চলেছে। তার মনে হত সে যেন এই সুখ চুরি করছে এবং সংসার ও তার ভোগসুখের জগৎ ত্যাগ করার আগে সেই জগৎ সম্বন্ধে তার একটা জ্ঞান থাকা উচিত। তার কোনও মতামত না নিয়ে তাকে জীবনের সব ভোগ-সুখ থেকে চিরতরে বঞ্চিত করলে সে ভবিষ্যতে তাকে ঘৃণা করবে। এই চিন্তাই তাকে সবচেয়ে ভাবিয়ে তুলঁল। ক্রমে কনভেন্ট জীবন অসহ্য হয়ে উঠল তার কাছে। সে কনভেন্ট ছেড়ে যাবার সংকল্প করল।

এই সংকল্পের কথাটা সে ভালো করে ভেবে দেখতে লাগল। অনেক ভেবে সে ঠিক করল সে এখান থেকে চলে যাবেই। এখন আর কোনও বিশেষ বাধা নেই। পাঁচ বছর ধরে কনভেন্টের এই চার দেয়ালের মধ্যে সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করার ফলে সমস্ত আশঙ্কার কারণ এখন অপসৃত হয়ে গেছে। এখন তার বয়স আরও বেড়ে গেছে; তার চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। এখন কে তাকে চিনতে পারবে? তাছাড়া বিপদের যেটুকু ঝুঁকি আছে তা তার নিজস্ব। সে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত বলে সেই দণ্ড পরিহার করার জন্য কসেত্তে’র মতো নির্দোষ নিরীহ মেয়েকে সারাজীবন কনভেন্টের কারাগারে সন্ন্যাসিনী হিসেবে আটক করে রাখার কোনও অধিকার নেই তার। বিপদের ঝুঁকির থেকে কর্তব্য তার কাছে অনেক বড়। তাছাড়া সুবিবেচনা সহকারে সতর্কতা অবলম্বনের পথে তো তার কোনও বাধা নেই। কসেত্তে’র শিক্ষা এখন প্রায় সমাপ্ত। সে তাই কনভেন্ট ছেড়ে চলে যাবার একটা সুযোগ খুঁজতে লাগল এবং সে সুযোগ অল্প দিনের মধ্যে এসেও গেল। ফশেলেভেন্ত একদিন মারা গেল।

জাঁ ভলজাঁ একদিন কনভেন্টের প্রধানার সঙ্গে দেখা করল। প্রধানাকে বলল, তার ভাই মারা গেছে। তার ভাই তার জন্য কিছু সম্পত্তি রেখে গেছে যাতে কোনও কাজ না করেই তদের চলে যাবে। তাই তারা কনভেন্ট ছেড়ে চলে যাবে। তবে যেহেতু কসেত্তে মাইনে না দিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে সন্ন্যাসিনী হিসেবে শপথ নেয়নি সে জন্য কনভেন্টকে পাঁচ হাজার ফ্ৰাঁ দান করে যাবে। এ বিষয়ে তাকে যেন অনুমতি দেওয়া হয়।

এইভাবে কনভেন্ট ছেড়ে কসেত্তেকে নিয়ে চলে যায় জাঁ ভলজাঁ। র‍্যু প্লামেতে একটা বাড়ি ভাড়া করে সে।

এ ছাড়া প্যারিস শহরের মধ্যে দু জায়গায় দুটো ঘর ভাড়া করে রেখেছিল। হঠাৎ যদি দরকার হয় বা এ বাড়ি ছেড়ে দিতে হয় তা হলে সেখানে গিয়ে উঠতে পারবে।

নতুন বাসায় আসার পর থেকে বাড়ি থেকে খুব একটা বার হত না ভলজাঁ। বাইরে বার হলেই একটা গভীর আশঙ্কা বুক চেপে বসত তার। পাছে সব সময় একটানা বাড়িতে থাকলে কারও মনে কোনও সন্দেহ জাগে এজন্য সে মাদাম তুসাঁকে বাড়িতে রেখে কসেত্তেকে নিয়ে মাঝে মঝে প্যারিসের বাসায় গিয়ে দিনকতক কাটিয়ে আসত। র‍্যু প্লমেতের বাড়িতে এসে সে তার নতুন নাম দেয় আলতিমে ফশেলেভেন্ত। তবে বাড়িটা শহর থেকে দূরে এক নির্জন অঞ্চলে ছিল বলে তাতে ভয় কম ছিল।

.

২.

উপরতলার বড় শোবার ঘরটাতে কসেত্তে’র থাকার ব্যবস্থা হল। এই বাড়ির প্রথম মালিক সেই বিচারপতির আমল থেকে শৌখিন পর্দা ঝোলানো ছিল ঘরটায়। তার মধ্যে ছিল বড় বড় আর্মচেয়ার। ভলজাঁ কসেত্তে’র শোবার জন্য একটা দামি খাট কিনে আনে। সোনার জলে বাঁধানো বইগুলো রাখার জন্য একটা আলমারি কিনে আনে। এছাড়া কিনে আনে একটা লেখাপড়া করার টেবিল, আর আয়নাসহ একটা দামি ড্রেসিং টেবিল। শীতকালে কসেত্তে’র শোবার ঘরটাকে উপর থেকে নিচে পর্যন্ত ভালোভাবে গরম রাখার ব্যবস্থা ছিল।

জাঁ ভলজাঁ বাড়িটার উপরতলায় বা নিচের তলায় থাকত না। সে থাকত উঠোনের একপ্রান্তে সেই কটেজ ধরনের ঘর দুটোর একটাতে। তার ঘরে ছিল তোষকপাতা সাদাসিধে একটা বিছানা, একটা কাঠের টেবিল, দুটো চেয়ার, দেয়ালে একটা কাঠের তাক। আর কিছু বই। কিন্তু ঘরখানায় আগুন জ্বালাবার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সে অবশ্য কসেত্তের সঙ্গে যেত। এ বাড়িতে আসার পর তুসাঁ যখন কাজে নিযুক্ত হয় তখন ভলজাঁ তাকে বলে দিয়েছিল, কসেত্তেই হল এ বাড়ির কর্তী।

তুস তখন আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি মঁসিয়ে?

ভলজাঁ বলেছিল, আমি তার বাবা।

কসেত্তেই সংসার চালাত। কনভেন্টে থাকার সময় এ সম্বন্ধে তার একটা জ্ঞান হয়। তার হাতেই সংসারের হিসাবপত্র সব থাকত। মোটামুটি সচ্ছলভাবেই খরচপত্র করা হত। ভলজাঁ কসেত্তেকে নিয়ে বিকালের দিকে রোজ লুক্সেমবুর্গের বাগান দিয়ে বেড়াতে যেত। প্রতি রবিবার সকালে সে সেন্ট জ্যাক দু হন্ট পাস চার্চে প্রার্থনাসভায় যোগদান করতে যেত। ভিখারিদের সে উদারভাবে পয়সা দিত। এ জন্য ভিখারিরা তাকে চিনত এবং এইজন্যই থেনার্দিয়ের তার মেয়েকে তার কাছে সাহায্যভিক্ষা করতে পাঠিয়েছিল। থেনার্দিয়ের তাকে সেন্ট চার্চের পরোপকারী ভদ্রলোক বলে সম্বোধন করেছিল।

কোনও অতিথি আসত না জাঁ ভলজাঁ’র এই নতুন বাসায়। তুস বাজার করত। ভলজাঁ নিজে বাইরের কল থেকে জল নিয়ে আসত। ভলজাঁ যে ঘরে থাকত তার পাশের ঘরের এক জায়গায় জ্বালানি কাঠ আর মদ রাখা হত। পোর্তে দ্য বেবিলনের দিকে খিড়কিদরজার পাশে বাইরে একটি চিঠির বাক্স ছিল। কিন্তু তাতে কোনও চিঠি আসত না। শুধু মিউনিসিপ্যালিটির ট্যাক্সের বিল আর নোটিশ আসত। জাঁ ভলজাঁ যখন পেতিত পিকপাসের কনভেন্টে থাকত তখন ১৮৩১ সালের লোকগণনায় তাকে আলতিমে ফশেলেভেন্ত নামে গার্দে ন্যাশনাল অর্থাৎ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর সদস্য করা হয়। এজন্য বছরে তিন-চারবার সামরিক পোশাক পরে সে তার ডিউটি দিতে যেত। এটাই ছিল তার বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র যোগসূত্র। তার বয়স হয়েছিল তখন ষাট। অথচ তাকে দেখে পঞ্চাশের বেশি মনে হত না। নিয়মিত ট্যাক্স দিয়ে এবং গার্দে ন্যাশনালের সদস্য হয়ে এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক হিসেবে গণ্য হতে চেয়েছিল ভলজাঁ।

কসেত্তেকে নিয়ে সে যখন বিকালে বেড়াতে যেত তখন সে একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসারের পোশাক পরত। কিন্তু সন্ধের পর সে একা কোথাও গেলে সে একজন সাধারণ শ্রমিকের পোশাক আর মুখঢাকা একটা টুপি পরত। হয়তো সতর্কতা হিসেবেই এ পোশাক পরত সে। তার এই সব আচরণের দিকে কোনও নজর দিত না কসেত্তে। তুসাঁ সব ব্যাপারেই তাকে শ্রদ্ধা করত। এঁসা একদিন মাংস কিনতে গেলে এক কসাই তাকে বলেছিল, তোমার মালিক একজন অদ্ভুত খরিদ্দার। তুসাঁ তখন বলেছিল, উনি একজন সাধু পুরুষ।

র‍্যু বেবিলনের দিকের দরজাটায় তালাচাবি দেওয়া থাকত সব সময়। ভলজাঁ বাড়ির সামনের দিকের বাগানটা ব্যবহার করত না বা গাছপালার কোনও যত্ন করত না। এ বিষয়ে সে হয়তো ভুল করেছিল। সে হয়তো কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করার জন্যই বাগানটা ব্যবহার করত না।

.

৩.

প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অযত্নে পড়ে আছে বাগানটা। কোনও মালী না থাকায় বাগানটা প্রকৃতির খেয়াল-খুশিমতো বেড়ে উঠেছে। মাটিতে গজিয়ে ওঠা ঘাস আর আগাছাগুলো বড় হয়ে উঠেছে অত্যধিক। গাছের ডালপালাগুলো লম্বা হয়ে বেড়ে গেছে। দুটো পাথরের স্তম্ভের মাঝখানে লোহার গ্রিলওয়ালা একটা গেট ছিল। বাগানটার এককোণে একটা পাথরের বেঞ্চ আর দুটো মর্মরমূর্তি ছিল। বাগানের মধ্যে কোনও ফাঁকা জায়গা বা পথ ছিল না। সর্বত্র ঘাস আর আগাছায় ঢেকে গিয়েছিল। লতায় জড়ানো ছিল গাছের সব গুঁড়িগুলো। বাগানটাকে দেখে তখন আর বাগান বলে মনে হত না, মনে হত যেন একটা জঙ্গল। জনবহুল শহরের কোনও খিড়কি বস্তিতে ঘেঁষাঘেঁষিভাবে বাস করে থাকা মানুষদের মতো অসংখ্য গাছ আর আগাছা ঘনসংবদ্ধ হয়ে বাস করত সেখানে। অথচ সেটা ছিল কোনও গির্জার ভেতরটার ঘন অন্ধকার সমাধিভূমির মতোই নির্জন নীরব।

তবু প্রতিবার বসন্তকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে লোহার গেট আর পাথরের প্রাচীরঘেরা সেই অযত্নবর্ধিত বাগানটার মধ্যে চলত ফুল ফোঁটাবার আর নতুন পাতা গজাবার এক নীরব খেলা। প্রতিটি গাছপালার শিরায় শিরায় বয়ে যেত যেন এক নতুন রক্তের স্রোত। এক মহাজাগতিক ভালোবাসায় স্পন্দিত কোনও জীবন্ত প্রাণীর মতোই তারা উদীয়মান সূর্যের তরুণ তাজা রশ্মিগুলোকে বরণ করে নিত প্রতিটি প্রভাতে। দুপুরবেলায় এক ঝাঁক প্রজাপতি উড়ে এসে ছায়াভরা বাগানের গাছগুলোর উপর বসত এবং তাতে এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হত। পাখির গান ছাড়া কত সব অদৃশ্য পোকামাকড়ের একটানা ডাক ছিন্নভিন্ন করে দিত বনভূমির নিস্তব্ধতাকে। সন্ধ্যা হলেই একরাশ কুয়াশা আচ্ছন্ন করে রাখত সমস্ত বাগানটাকে এক স্বর্গীয় বিষাদের মতো। অসংখ্য ফোঁটা ফুলের গন্ধের মাদকতায় আমোদিত হয়ে থাকত বাগানটা। সারাদিন ধরে গাছপালা আর পাখিদের অবিচ্ছিন্ন অন্তরঙ্গতা মুখর করে তুলঁত সমস্ত বনভূমিটাকে। সারাদিন পাখিদের নিরন্তর ডানা ঝাঁপটানিতে পুলকের শিহরণ জাগত গাছের পাতাগুলোর সবুজ গায়ে। রাত্রি হলেই সেই গাছপাতার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ত পাখিগুলো।

শীতকাল গাছগুলোর পাতা ঝরে যাওয়ায় শুকনো কঙ্কালসার গাছগুলোর মধ্য দিয়ে বাগানসংলগ্ন বাড়িটাকে রাস্তা থেকে দেখতে পাওয়া যেত। অন্য সময়ে ঘন লতাপাতায় ভরা গাছগুলো আড়াল করে রাখত বাড়িটাকে। শীতকালে ঝরা পাতাগুলোর উপর তুষারকণা জমে থাকত। তবে বছরের সব ঋতুতেই এক নিঃসঙ্গ বিষাদ প্রকৃতির এক অবাধ জনহীন স্বাধীনতা মূর্ত হয়ে থাকত যেন সমস্ত বাগানটায়।

অথচ এই নির্জন জায়গাটা খাস প্যারিস শহর থেকে খুব একটা দূরে নয়। এই নির্জন বাড়ি আর এই পরিত্যক্ত বাগানটার অদূরেই আছে র‍্যু দ্য ভারেনে অঞ্চলের বড় বড় অট্টালিকা, ইনভালিদের বিরাট গম্বুজ, চেম্বার অফ ডেপুটিজ-এর কার্যালয়, র‍্যু দ্য বুর্গনে ও র‍্যু দ্য ডোমিনিকের রাজপথে কত রং-বেরঙের যানবাহনের যাতায়াত। তার মালিকের মৃত্যুর পর চল্লিশ বছর ধরে পরিত্যক্ত থাকার পর র‍্যু প্লামেতের বাড়িটাতে আজ আবার ভাড়াটে এসেছে। কিন্তু বাগানটা তেমনিই পরিত্যক্ত ও অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। কত আগাছা ও কাঁটাগাছ মাটির ভেতর থেকে গজিয়ে উঠেছে, কত পোকা-মাকড় বাসা বেঁধেছে তার মাটি ও গাছপালায়।

গণিতের বিজ্ঞান মেঘেদের ক্ষেত্রেও খাটে। মেঘেদের গতিভঙ্গি গণিতজ্ঞ বিজ্ঞানীরাও স্বীকার করবেন। নক্ষত্রের আলোয় গোলাপ লালিত হয়। কোনও চিন্তাশীল ব্যক্তিই একথা অস্বীকার করবেন না যে ফুলের বর্ণ-গন্ধ নক্ষত্রগুলোর কাছে মূল্যহীন। অণু-পরমাণুদের কথা কে আগে হতে বলতে পারে? ক্ষুদ্র ও বৃহত্তের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পরিমাপ কে ঠিকমতো ধরতে পারে? বিশ্বসৃষ্টির ধ্বংসলীলা ও প্রতিটি বস্তুর গভীরের কার্যকারণের যে খেলা চলছে তার কথাই বা সঠিকভাবে কে বলতে পারে? সবকিছুই প্রয়োজনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়; প্রয়োজনের মাপকাঠিতে যা কিছু বড় তা ছোট হয়ে যায় এবং যা কিছু ছোট তা বড় হয়ে যায়। সজীব প্রাণিকুল ও নির্জীব জড়বস্তুর মধ্যে এক রহস্যময় সম্পর্ক আছে। সুদূর সৌরমণ্ডল থেকে শুরু করে গরিবদের নোংরা বস্তি পর্যন্ত অন্তহীন অফুরন্ত পরিবেশের মধ্যে কোনও কিছুর প্রতি ঘৃণার কোনও অবকাশ নেই। প্রতিটি বস্তুরই কোনও না কোনও প্রয়োজন আছে। আলো কখনও পৃথিবীর কোনও সুবাস বায়ুমণ্ডলের ঊর্ধ্বতন স্তরে তুলে ধরতে পারে না; একমাত্র অন্ধকারই তা পারে। আবার অন্ধকারই নক্ষত্রমণ্ডলের সুবাস ঘুমন্ত ফুলেদের উপর ছড়িয়ে দেয়। প্রতিটি উড়ন্ত পাখিই তার নখে অনন্তের কিছু ভগ্নাংশ নিয়ে আসে। সামান্য কোনও কীটপতঙ্গই হোক বা সক্রেটিসই হোক, প্রতিটি জীবের জন্মের এক তাৎপর্য আছে। যেখানে দূরক্ষণের কাজ শেষ হচ্ছে সেখানেই শুরু হচ্ছে অণুবীক্ষণের কাজ। কার দৃষ্টিশক্তি বেশি কে তা জানে? মনের জগৎ ও জড়বস্তুর মধ্যে সেই একই সম্পর্ক আছে, সে সম্পর্ক যতই দুর্বোধ্য হোক না কেন। প্রকৃতিজগতের প্রতিটি পদার্থ আর মানুষের যত সব নীতি এক হয়ে মিশে আছে। তাদের মিলন পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে কাজ করে। সব ঘটনাই এক নিয়ম আর নীতিকে লুকিয়ে রাখে তার মধ্যে। প্রতিনিয়ত যে এক মহাজাগতিক রূপান্তরের রহস্যময় তরঙ্গলীলা চলেছে তাতে কত জীবন যাওয়া-আসা করছে। তাতে প্রতিটি বস্তুরই মূল্য সূচিত হচ্ছে। এমনকি প্রতিটি ঘুমন্ত ব্যক্তির স্বপ্নেরও একটা করে বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই মহাজাগতিক রূপান্তরের অবিরাম খেলায় কোথাও এক জীবনের বীজ উপ্ত হচ্ছে, আবার কোথাও-বা একটি জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কোথাও আলো রূপান্তরিত হচ্ছে শক্তিতে, আবার কোথাও বা চিন্তার সব শক্তি পরিণত হচ্ছে জড়বস্তুতে। একমাত্র আত্মা ছাড়া সব বস্তুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে। সব বস্তুই ধ্বংস হবার পরে শুধু তার আত্মা অবশিষ্ট থাকে। সব বস্তুই অবশেষে ঈশ্বরের এক একটি উদ্দেশ্য সাধন করে ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। পৃথিবীর আবর্তন থেকে এক পতঙ্গের উড়ে চলা পর্যন্ত সবকিছুই এক অনন্ত বিশ্বসৃষ্টি প্রতিক্রিয়া এক গোপন অংশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

.

৪.

বাগানটা আর সেই আগের মতো নেই। কিন্তু তা না থাকলেও এখনও সেখানে আছে গাছের শীতল ছায়া, বনভূমির শান্ত সবুজ নীরবতা। আছে গাছপালার মর্মরধ্বনি আর পাখির গান। দেখে মনে হয় পাখিডাকা সেই ছায়ামেদুর বনস্থলীর মাঝে যেন কোনও প্রতীক্ষমানা অন্তর প্রেমে আকুল হয়ে এক নিবিড় আস্থা, আশা, সরলতা আর এক শীতল কামনার সবুজ আস্তরণ বিছিয়ে কার পথ চেয়ে বসে আছে।

কসেত্তে যখন কনভেন্ট ছেড়ে চলে আসে তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ’র কিছু বেশি। সে তখন ছিল এক কিশোরী। তার চেহারাটা ঠিক কুৎসিত না হলেও খুব রোগা ছিল, প্রায় অস্থিচর্মসার। সে ছিল একাধারে লাজুক আর দুঃসাহসী।

তার শিক্ষা তখন সমাপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তার মানে ধর্ম ও ভক্তিতত্ত্বে উপযুক্ত শিক্ষালাভ করে সে। এ ছাড়া যে যে বিষয়ে শিক্ষালাভ করে সে তা হল ইতিহাস, ভূগোল, ব্যাকরণ, ফ্রান্সের রাজবংশ ও রাজনীতি, সঙ্গীত, চিত্রকলা আর গার্হস্থ্যবিজ্ঞান। কিন্তু বাস্তবজগতের অনেক কিছুই তার দেখা হয়নি তখনও। কোনও তরুণীর মনকে খুব ধীরে শিক্ষা দিতে হয়। তাকে যেমন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে নেই, তেমনি জ্ঞানের তীব্র আলোয় হঠাৎ ঝলকানি দিয়ে চোখগুলো ধাঁধিয়ে দিতে নেই। তাদের কঠোর বাস্তবের মুখোমুখি না করিয়ে বাস্তবের প্রতিফলনের মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হয়। তাদের এমন শিক্ষা দিতে হয় যে শিক্ষা একই সঙ্গে তাদের যৌবনের ভয়াবহ দিকগুলোকে সরিয়ে দেয় তাদের কাছ থেকে এবং পতনের হাত হতে রক্ষা করে।

এই শিক্ষা দেবার জন্য চাই মায়ের মন, যার মধ্যে থাকবে যৌবনসুলভ মনোভাবের সঙ্গে মাতৃসুলভ অভিজ্ঞতা। এর কোনও বিকল্প নেই। তাই একজন তরুণী যুবতীর মন গঠনে মায়ের স্থান কেউ নিতে পারে না।

কসেত্তে’র মা ছিল না, শুধু কনভেন্টের কয়েকজন সন্ন্যাসিনী মাদার ছিল। জাঁ ভলজাঁর অন্তরে তার প্রতি যথেষ্ট স্নেহ-ভালোবাসা থাকলেও সে ছিল এক বয়োপ্রবীণ পুরুষ, যার তরুণীর মন সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান ছিল না।

এই শিক্ষার ব্যাপারে কতখানি জ্ঞান, কতখানি কৌশলের দরকার হয়? কোনও তরুণীর মনে প্রেমাবেগ জাগিয়ে এবং সেই আবেগকে পরিপক্ক করে তুলঁতে কনভেন্টের মতো আর কোনও কিছুতে পারে না। এই কনভেন্ট তার মনকে অজানার চিন্তার দিকে নিয়ে যায়। তখন তার অন্তর বাইরে থাকার পথ না পেয়ে বাইরে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে না পেরে সঙ্কুচিত হয়ে সে আত্মমুখী হয়ে ওঠে, নিজের মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হয়। তখন সে তার অবাধ কল্পনার বশবর্তী হয়ে অনেক প্রেমের কাহিনী গোপনে আপন মনে রচনা করে, অনেক দুঃসাহসী অভিযানের পরিকল্পনা করে।

কনভেন্ট ছেড়ে কসেত্তে যখন র‍্যু প্লমেতের বাড়িতে এসে উঠল তখন সে সবচেয়ে খুশি হল। অথচ সে বুঝতে পারল না এই বাড়িটাই তার পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক। এখানেও কনভেন্টের মতো ছিল সেই একই নির্জনতা, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল স্বাধীনতা। এখানেও ছিল প্রাচীরঘেরা এক বাগান–গাছ, ফুল ও পাখির গানে ভরা। এখানেও ছিল কনভেন্টের মতো অন্তর্মুখী মনের মাঝে উদ্ধত দিবাস্বপ্নের ভিড়। কিন্তু এখান থেকে কল্পিত প্রেমকাহিনীর জীবন্ত যুবকনায়কদের দেখা যেত। এখানেও ছিল একটা লোহার গেট, কিন্তু সে গেট দিয়ে রাস্তার সব কিছু দেখা যেত।

তবু কসেত্তে যখন এখানে প্রথম আসে, তখন তার তরুণী মন ছিল সত্যি সত্যিই অনভিজ্ঞ। জাঁ ভলজাঁ তাকে এই বাগানটা উপহার দিয়ে বলে, এটা তোমার, এটা নিয়ে তোমার যা খুশি করতে পার। বাগানটা দেখে প্রচুর আনন্দ পায় কসেত্তে। সে প্রথমে বাগানের নিচের আগাছাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। পাথরখণ্ডগুলোকে তুলে ফেলে দেয়। সে ভাবল বাচ্চা ছেলেরা খেলা করতে এলে অসুবিধা হবে, ঘাসের উপর যে সব। পোকামাকড় বা কীটপতঙ্গ থাকে, পাথরগুলোতে তাদেরও অসুবিধা হবে।

সমস্ত অন্তর দিয়ে তার বাবা জাঁ ভলজাঁকে ভালোবাসত সে। তার ভালোবাসা, ভক্তি আরও মধুর, আরও মনোরম করে তুলঁত ভলজাঁকে। মঁসিয়ে ম্যাদলেন যেমন বাড়িতে প্রচর পড়াশুনো করত তেমনি জাঁ ভলজাঁও অনেক বই পড়ত। তাই সে খুব ভালো কথা বলতে পারত। তার কথার মধ্যে জ্ঞানের ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ এক বিনম্র বাগ্মিতা ফেটে পড়ত। সে ছিল একই সঙ্গে কড়া এবং শান্ত, তার একটা সহজাত দয়া ও মমতাবোধ ছিল। সে তার দুটো ভাবই বজায় রেখে চলত। সে যখন লুক্সেমবুর্গ বাগানে কসেত্তেকে নিয়ে বেড়াতে যেত তখন তার প্রচুর পড়াশুনো আর অতীত দিনের দুঃখ-কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে যে কোনও কথা তার মনে আসত সে কথা কসেত্তেকে বলত অকুণ্ঠভাবে। তার সব কথা শুনত কসেত্তে।

জাঁ ভলজাঁকে ভক্তি ও শ্রদ্ধা করত কসেত্তে। তাকে খুঁজত সব সময়। যতক্ষণ তার কাছে থাকত কসেত্তে ততক্ষণ সে খুব আনন্দ পেত। ভলজাঁ মূল বাড়িতে বা বাগানে বড় একটা যেত না বলে কসেত্তে ভলজাঁ’র কটেজ ধরনের ঘরটাতে গিয়ে বসে থাকত। বাগান ও তার সাজানো সুন্দর ঘরখানার থেকে ভলজাঁর কাছে থাকতে বেশি ভালোবাসত সে। ভলজাঁ তখন মাঝে মাঝে হাসিমুখে বলত, এবার তুমি যাও, আমাকে শান্তিতে একা থাকতে দাও।

ভক্ত মেয়ের মতো তার বাবাকে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলত কসেত্তে, বাবা, এ ঘরে বড় ঠাণ্ডা। মেঝেতে একটা কার্পেট আর একটা স্টোভ রাখ না কেন?

ভলজাঁ উত্তর দিত, কত লোক শীতে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের মাথা গোঁজার মতো একটা ঘরও নেই।

তা হলে আমার ঘরে আগুন জ্বলে কেন? স্বাচ্ছন্দ্যের সব উপকরণই আমার আছে।

তুমি মেয়েছেলে এবং তোমার বয়স কম।

বাজে কথা। তুমি কি বলতে চাও পুরুষরাই যত কষ্ট পাবে?

কিছু লোক।

বাবা, তুমি কি কালো রুটিটা খাও?

তার কিছু কারণ আছে বাছা।

তা হলে আমিও খাব তাই।

কসেত্তে’র জন্য তাই ভলজাঁ আর সেই কালো রুটি না খেয়ে সাদা পাউরুটি খেল। শৈশবের কিছু স্মৃতি তখনও জেগে ছিল কসেত্তে’র মনে। কনভেন্টে থাকাকালে সে দিনরাত মাদারদের নির্দেশে প্রার্থনা করত। দুঃস্বপ্নে দেখা অবাঞ্ছিত মানুষদের মতো থেনার্দিয়েরদের কথা তার মনে পড়ত। তার মনে আছে এক সন্ধেবেলায় প্যারিস থেকে দূরে একটা বনে ঝরনায় জল আনতে গিয়েছিল। ভলজাঁ তাকে তার সেই আশঙ্কাগ্রস্ত জীবন থেকে উদ্ধার করে। রাত্রিতে সে এই সব কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ত। যেহেতু ভলজাঁকে সে তার বাবা বলে ভাবতে পারত না, সে ভাবত ভলজাঁই তার মা, তার মায়ের আত্মাটা ভজ’র মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠেছে। মহত্ত্ব কী জিনিস সে বিষয়ে তখনও তার কোনও জ্ঞান হয়নি। মাঝে মাঝে সে তার হাতের উপর মাথা রেখে যখন ভাবত এবং চোখ থেকে এক বিন্দু জল গড়িয়ে ঝরে পড়ত তখন তার মনে হত, ভলজাঁ নামে এই লোকটিই হয়তো তার মা।

মাঝে মাঝে ভলজাঁ’র কাছ থেকে সে তার মার নাম জানতে চাইত। জিজ্ঞাসা করার সময় তার মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে চোখে জল আসত। কিন্তু ভলজাঁ কোনও উত্তর দিত না। ফাঁতিনের নামটা গোপন করে রাখত ভলজাঁ।

কসেত্তে যখন শিশু ছিল তখন ভলজাঁ প্রায়ই তার মায়ের কথা বলত। কিন্তু এখন বড় হওয়ায় তার মা’র নাম উল্লেখ করত না কখনও। কেমন যেন একটা ধর্মীয় ভয় আচ্ছন্ন করে রাখত তাকে। তাছাড়া সে হয়তো ভাবত, তাদের দুজনের মাঝে মৃত ফাঁতিনেকে এনে দাঁড় করালে তার প্রতি কসেত্তে’র ভালোবাসা খণ্ডিত হয়ে যাবে। কিন্তু ফাঁতিনের স্মৃতিটাকে সে যতই ছায়াচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করত ততই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত সে স্মৃতি। যে লজ্জার বোঝাটা জীবিত ফাঁতিনের জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে সে, মৃত ফাঁতিনের ওপর সে লজ্জার বোঝাটা যেন আবার ভয়ঙ্করভাবে চেপে বসে তার ওপর।

একদিন কসেত্তে ভলজাঁকে বলল, বাবা, গতকাল আমি আমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। তার দুটো ডানা ছিল।

এ কথায় খুশি হল ভলজাঁ। ভলজাঁ যখন তাকে নিয়ে তার হাত ধরে বেড়াতে বেরোত তখন তার প্রতি কসেত্তের শ্রদ্ধা-ভালোবাসার ছোটখাটো অনেক পরিচয় পেয়ে ভলজাঁর মনে হত এমন নির্দোষ নিষ্পাপ সরল হৃদয়ের এক মেয়ের ভালোবাসা তার জীবনে এক পরম সম্পদ। জীবনে সে যত কষ্ট পেয়েছে আজকের এই সরল অনাবিল সুখের তুলঁনায় তা কিছুই নয়।

.

৫.

একদিন কসেত্তে আয়নার দিকে তাকিয়ে আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, বাহ্! তার হঠাৎ মনে হল সে যেন সুন্দরী এবং এই চিন্তাটা তাকে বিচলিত করে তুলঁল। এই মুহূর্তের আগে সে কখনও আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখেনি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধলেও সে দেখেনি নিজেকে। কনভেন্টে সবাই তার চেহারাটাকে বলত সাদাসিধে অর্থাৎ সে সুন্দরী নয় এবং এটাকেই সহজভাবে মেনে নিয়েছিল সে। একমাত্র জাঁ ভলজাঁ বলত, এ কথা সত্য নয়। তা সত্ত্বেও সে নিজেকে অসুন্দরী সাদাসিধে চেহারার বলেই ভাবত। কিন্তু আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখার পর তার মনে হল ভলজাঁ’র কথাই সত্যি। এ কথা ভেবে সে এত বিচলিত হয়ে পড়ল যে সে রাতে একেবারে ঘুমোতে পারল না। পরদিন আয়নায় আবার সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল। এবার দেখে কিন্তু নিজেকে মোটেই সুন্দরী বলে মনে হল না। আসলে গতরাতে তার ঘুম না হওয়ায় তার মুখখানা ম্লান দেখাচ্ছিল এবং তার চোখের কোণে কোণে কালি পড়েছিল। তা দেখে দুঃখিত হল সে। সে ভাবল, সে যদি সুন্দরী হত! কনভেন্টের কোনও কোনও সুন্দরী মেয়ের মতো তার চোখমুখ আর পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করত!

এরপর থেকে সে আয়নার সামনে কোনওদিন দাঁড়াত না। আয়নায় নিজের চেহারাটা কোনওদিন দেখত না। এমনকি চুল বাধার সময় আয়নার দিকে পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে চুল বাধত।

এরপর থেকে সন্ধের সময় সূচিশিল্পের কাজ করত অথবা ভলজাঁ’র ঘরে গিয়ে বসে থাকত বা কোনও না কোনও কাজ করত। ভলজাঁ তখন আপন মনে বই পড়ত। একদিন সে হঠাৎ দেখল ভলজাঁ বই পড়তে পড়তে তার পানে বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এর অর্থ বুঝতে পারল না। আর একদিন বাইরে বেড়াতে যাবার সময় শুনতে পেল তাদের পেছনে কোনও একজন পুরুষ বলছে, মেয়েটি সুন্দরী, কিন্তু বাজে পোশাক পরে আছে। কিন্তু এর মানে সে বুঝতে পারল না। কারণ সে ভাবল সে দেখতে খারাপ, কিন্তু ভাল পোশাক পরে আছে। সুতরাং ও নিশ্চয় আমার কথা বলেনি।

আর একদিন তাদের বাড়ির সংলগ্ন বাগানে যখন বেড়াচ্ছিল তখন হঠাৎ তুসাঁ তার বাবাকে এক সময় বলল, মঁসিয়ে লক্ষ করেছেন, ম্যাদময়জেলের চেহারাটা কেমন সুন্দর হয়ে উঠছে? এর উত্তরে তার বাবা কী বলেছিল তা সে শুনতে পায়নি। কিন্তু তুস’র কথাটা বিচলিত করত তাকে। সে তার শোবার ঘরে ছুটে গিয়ে তিন মাস পর আবার আয়নায় খুঁটিয়ে দেখল নিজেকে। দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। সে যা দেখল তাতে আনন্দিত হয়ে উঠল সে।

দেখল, সে সত্যিই সুন্দরী। আর সে তুসার কথা বা আয়নার সাক্ষ্যকে সন্দেহ করতে পারে না। তার সারা দেহ কানায় কানায় ভরে উঠেছে যৌবনের লাবণ্যে, তার গায়ের চামড়া আগের থেকে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে, তার চোখ দুটো হয়ে উঠেছে আরও নীল আর চুলগুলো আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। সে আবার সিঁড়ি বেয়ে বাগানে ছুটে গেল। রানির মতো সৌন্দর্যগর্বে গরবিনী হয়ে উঠল সে। তার মনে হল তুসাঁ ঠিকই বলেছে, রাস্তার সেই অচেনা পুরুষকণ্ঠও তারই উদ্দেশ্যে সেকথা বলেছে। বাগানের সব কিছুই সহসা সুন্দর হয়ে উঠল তার কাছে। অননুভূতপূর্ব এক আনন্দের আবেগে উল্লাসে সে দেখতে লাগল, গাছের শাখাপ্রশাখার ফাঁক দিয়ে সোনালি সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত বাগানময়, গাছের শাখে শাখে সুগন্ধি ফুল ফুটে আছে কত, পাখিরা গান করছে।

এক অব্যক্ত নিবিড় অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল জাঁ ভলজাঁ। কিছুদিন ধরে সে আনন্দের সঙ্গে কসেত্তে’র দেহ-সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতা লক্ষ করে আসছিল। এই সৌন্দর্যের আলোর মধ্যে অনেকে এক নতুন প্রভাতের উজ্জ্বলতা দেখলেও এই আলোর মধ্যে এক কুলক্ষণের অশুভ আভাস দেখতে পেল ভলজাঁ। বেশ কিছুদিন ধরেই সুন্দরী দেখাচ্ছে কসেত্তেকে। কিন্তু সে সৌন্দর্যের প্রতি সে সচেতন ছিল না মোটেই। আজ এই সৌন্দর্যের আলোই তার স্বার্থপর চোখে ভয়ের বস্তু হয়ে উঠল। এর মধ্যে সে এমন এক পরিবর্তনের আভাস পেল, যে পরিবর্তন অশুভ হয়ে উঠতে পারে তাদের জীবনে। অনেক কষ্ট ভোগ করেছে। যদিও লোহার হাতকড়া হাতে পরে ও পায়ে লোহার বেড়ি নিয়ে কারাযন্ত্রণা ভোগ করেছে, আইনের অনুশাসন আজও তাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে এবং তাকে পেলেই আবার কারাগারে নিয়ে যাবে তবু তার কোনও রাগ বা কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। সে মানবজাতি, সমাজ বা ঈশ্বরের কাছ থেকে একমাত্র কসেত্তে’র ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না।

সে শুধু একটা জিনিসই চায়। ঈশ্বর যেন তাকে কসেত্তের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেন। এই ভালোবাসাই তার জীবনের সব আঘাত, সব ক্ষত সারিয়ে তুলঁতে পারে। ঈশ্বর যদি আজ তাকে স্বর্গ দিতে চান তা হলে সে বলবে, আমার তাতে লোকসান হবে। নারীদের সৌন্দর্য সম্বন্ধে তার কোনও জ্ঞান ছিল না। নারীদের দিকে সে কখনও ভালো করে তাকাতও না। তবে সে সহজাত অন্তদৃষ্টির সাহায্যে একটা কথা বুঝতে পেরেছিল, নারীদের সৌন্দর্য বড় ভয়ঙ্কর। আজ সে তার চেহারার অসৌন্দর্য ও বয়সের ব্যবধান অতিক্রম করে লক্ষ করতে লাগল কসেত্তে’র চেহারাটা কিভাবে যৌবনে সমৃদ্ধ ও সুন্দর হয়ে উঠেছে। সে আপন মনে বলে উঠল, কত সৌন্দর্য! কিন্তু আমার কী হবে?

এইখানেই মা’র সঙ্গে ভলজাঁর পিতৃত্বের তফাত। মেয়ের দেহে যৌবনের যে লাবণ্য দেখে মা কত আনন্দে উল্লসিত হয়ে ওঠে তা দেখে এক অপরিসীম উদ্বেগ ও অন্তর্বেদনায় আকুল ও আত্মহারা হয়ে উঠল।

পরিবর্তনের প্রথম লক্ষণগুলো একে একে ফুটে উঠতে লাগল কসেত্তে’র মধ্যে।

যেদিন তার দেহসৌন্দর্যকে প্রথম আবিষ্কার করে কসেত্তে এবং তার প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে সন্দেহাতীতভাবে সেদিন থেকে সে চেহারার দিকে বেশি নজর দিতে থাকে। লোকের মুখে তার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে তার মনে যে দুটি বীজাণুর সৃষ্টি হয় সে দুটি বীজাণু হল–এক ছলনাময় অভিনয় আর প্রেম।

তার দেহ-সৌন্দর্যের প্রতি নিঃসন্দেহ হয়ে ওঠার পর থেকে নারীসুলভ প্রকৃতিটা পুষ্পিত হয়ে উঠতে লাগল তার মধ্যে। তার আগের পোশাক ছেড়ে নতুন এক সাজ-পোশাক কিনল। তার বাবা তাকে কোনওদিন কোনও কিছু দিতে চায়নি। কসেত্তে এবার অনেক পছন্দ করে তার টুপি, গাউন, ক্লোক, দস্তানা, চটি কিনল এবং প্রতিটি পোশাকের রং পরস্পরের সঙ্গে মিলিয়ে কিনল। মাসখানেকের মধ্যেই কসেত্তে হয়ে উঠল প্যারিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুন্দরী, সুসজ্জিতা ও শৌখিন যুবতী, যার পোশাকের পারিপাট্য এবং দেহসৌন্দর্যের আবেদন মোহপ্রসারী, গভীর এবং বিপজ্জনক। তার এবার ইচ্ছা করল সে রাস্তার লোকটার কাছে গিয়ে তার পোশাক দেখিয়ে তাকে বলে, দেখ দেখি এবার একবার আমাকে কেমন দেখাচ্ছে।

কসেত্তে’র এই পরিবর্তন দেখে চিন্তিত হয়ে পড়ল ভলজাঁ। তার কেবলি মনে হতে লাগল, কসেত্তে যদি এবার পাখা মেলে উড়তে শুরু করে তা হলে তাকে বুকে হেঁটে চলতে হবে অথবা বড়জোর পায়ে হেঁটে চলবে।

তবে এই পোশাকপরা অবস্থার কোনও মহিলা যদি তাকে দেখত তা হলে এক নজরেই বুঝতে পারত, তার মা নেই। পোশাকপরার ব্যাপারে সে এমন দু-একটা ভুল করে বসত যা তার মা থাকলে ঠিক ধরিয়ে দিত।

যেদিন তার নতুন পোশাক পরে প্রথম বাইরে বার হল কসেত্তে, সেদিন পথে তার বাবার হাত ধরে যেতে যেতে একসময় জিজ্ঞাসা করল, এ পোশাক পরলে আমাকে তোমার চোখে ভালো দেখায় তো?

ভলজাঁ বলল, চমৎকার।

সেদিন বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে ভলজাঁ কসেত্তেকে বলল, তুমি কি তোমার আগের পোশাকটা আর কখনও পরবে না?

কসেত্তে তার আলমারি খুলে কনভেন্টের পোশাকটা বার করে বলল, এটা পুরনো হয়ে গেছে বাবা। এটা আর আমি কখনই পরব না। এটা পরলে আমাকে কাকতাড়ানো ডামির মতো মনে হবে।

ভলজাঁ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

যে কসেত্তে আগে বাড়িতেই বেশি থাকতে চাইত সেই কসেত্তে আজকাল প্রায়ই বাইরে বেড়াতে যেতে চাইত। কোনও সুন্দরী সুসজ্জিত নারী তার পোশাক ও সৌন্দর্য আর পাঁচজনকে দেখাতে চাইবেই। ভলজাঁ আরও লক্ষ করল কসেত্তে আজকাল আর তার কটেজে যেতে চায় না। সে যখন একা একা তার কটেজে কুকুরের মতো বসে থাকত কসেত্তে তখন একা একা বাগানে পায়চারি করে বেড়াত।

তার এই রূপলাবণ্যের প্রতি যতই সচেতন হয়ে উঠতে লাগল কসেত্তে, তার সৌন্দর্যের প্রতি তার সেই আগেকার উদাসীন ভাবটা ততই হারিয়ে ফেলতে লাগল সে। যে নির্দোষ সরলতা যে কোনও সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয়, যে অকৃত্রিম উজ্জ্বলতা সে সৌন্দর্যকে এক স্বর্গীয় সুষমা দান করে, কসেত্তে তা হারিয়ে ফেলতে লাগল ক্রমে ক্রমে। তবু তার নব যৌবনের এক বিপুল আনন্দ তার সব দোষ-ক্রটি সত্ত্বেও মনোহারিণী করে তুলঁল তাকে।

এই সময় একদিন তাকে লুক্সেমবুর্গের বাগানে দেখে ফেলল মেরিয়াস।

.

৬.

মেরিয়াসের মতো কসেত্তেও একা একা নির্জনে বসে ভাবত। নির্মম নিয়তি রহস্যজনকভাবে ধীরে ধীরে এই দুটি জীবনকে পরস্পরের কাছে আনছিল, যেমন বজ্রমেঘ আর বিদ্যুৎ এক অন্তর্নিহিত প্রেমাবেগের তাড়নায় এক ঝলকে মিলিত হয় পরস্পরের সঙ্গে।

প্রথম দর্শনে প্রেম সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। সে সব কাহিনীকে আমরা তেমন গুরুত্ব না দিলেও দৃষ্টিবিনিময়ের মধ্য দিয়েই সব প্রেম সঞ্চার হয়। দুটি দৃষ্টির মাধ্যমে প্রেমের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সঞ্চারিত হয় পরস্পরের অন্তরে তার থেকেই সৃষ্ট তড়িতাবেগে দুটি অন্তর অভিভূত হয়।

কসেত্তে’র যে দৃষ্টির আঘাতে মেরিয়াস অভিভূত হয় সে দৃষ্টির শক্তি সম্বন্ধে কসেত্তে সচেতন।

মেরিয়াসকে সে আগেই দেখেছে। কিন্তু সব মেয়েদের মতো না দেখার ভান করেছে। তাকে দেখতে সুদর্শন মনে হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে মেরিয়াসের তেমন সুন্দরী মনে হয়নি। মেরিয়াস তাকে ভালো করে দেখেনি বলে মেরিয়াসের প্রতি কোনও বিশেষ আগ্রহ জাগেনি তার মনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে লক্ষ করেছে তার চোখ, চুল সুন্দর, তার দাঁতগুলো সাদা ঝকঝকে। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ করেছে তার কণ্ঠস্বর মনোরম। তার পোশাকটা অবশ্য তেমন ভালো ছিল না। কিন্তু সেটা যদি কেউ সহজ বলে মেনে নেয় তা হলে সে দেখবে তার গতিভঙ্গির মধ্যে একটা সুষমা আছে। তার সমস্ত চেহারাটার মধ্যে একটা শান্ত সরলতা আর আত্মমর্যাদাবোধ আছে। কসেত্তে লক্ষ করেছে তাকে দেখতে গরিব মনে হলেও সে সৎ }

যেদিন প্রথম তাদের দৃষ্টিবিনিময় হয় কসেত্তে তার দৃষ্টির অর্থ কিছু বুঝতে পারেনি। তখন ভলজাঁ যে র‍্যু দ্য লোয়েস্তের বাড়িতে দু সপ্তা ধরে বাস করছিল সেই বাড়িতে সে চিন্তান্বিতভাবে ফিরে যায়। পরদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠে আবার যখন সেই অদ্ভুত যুবকটির কথা মনে করল তখন সে বুঝতে পারল অনেকদিন ধরে মেরিয়াস তার প্রতি ঔদাসীন্য দেখালেও সেদিন তাকে দেখেছে। যদিও তার এই আকস্মিক পরিবর্তনটাকে সে ভালোভাবে নিতে পারেনি। সে বরং তার অন্তরের মধ্যে এক প্রতিরোধের প্রাচীর তুলে এক শিশুসুলভ আনন্দের সঙ্গে তার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইল। সে জানে সে সুন্দরী এবং তার দেহ-সৌন্দর্যই তার কাছে এখন পরম অস্ত্র। নারীরা তাদের সৌন্দর্য নিয়ে খেলা করে, শিশুরা যেমন ছুরি নিয়ে খেলা করতে করতে অনেক সময় হাত কেটে ফেলে।

মেরিয়াসের দ্বিধা ও বিহ্বলতার কথা আমাদের মনে আছে। সে তার বেঞ্চ থেকে উঠে তাদের কাছে যায়নি এবং তার এই নিষ্ক্রিয়তাই উত্তেজিত করে তোলে কসেত্তেকে। সে তখন তার কাছে যাবার জন্য তার বাবাকে বলে, বাবা, চল একবার ওদিকে ঘুরে আসি। একঘেয়েমিটা কাটানো যাবে। মেরিয়াস তার কাছে না আসায় সে নিজেই তার কাছে যায়। এই অবস্থায় নারীরা মহম্মদের পর্বতগমনের মতো পুরুষের কাছে এগিয়ে যায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হলেও এই রকমই হয়। প্রেমের টানে নর-নারী যখন কাছ আসে তখন একে অন্যের গুণ প্রাপ্ত হয়। পুরুষদের মধ্যে দেখা দেয় নারীসুলভ লজ্জা আর নারীদের মধ্যে দেখা দেয় পুরুষালি সাহসিকতা।

সেদিন কসেত্তে’র দৃষ্টির শরাঘাতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে মেরিয়াস, কিন্তু মেরিয়াসের দৃষ্টিশর কসেত্তে’র সমস্ত অন্তরটাকে কাঁপিয়ে তোলে। মেরিয়াস সেদিন বিজয়গর্বে বাসায় ফিরে যায়, কিন্তু কসেত্তে’র মনটা অশান্ত হয়ে ওঠে। তবে সেদিন থেকেই দু জনে পরস্পরকে ভালোবাসতে থাকে।

প্রথম প্রেমের আবিষ্কার বিহ্বলবিমূঢ় করে তোলে কসেত্তেকে, এক গভীর বিষাদের কালো ছায়া নিয়ে আসে তার অন্তরে। তার মনে হয় তার সমগ্র আত্মা কালো হয়ে গেছে। সে আত্মাকে যেন আর চিনতে পারবে না সে। সব কুমারী মেয়ের আত্মা যেন বরফের মতো হিমশীতল। সে আত্মা একমাত্র সূর্যসন্নিভ প্রেমের উত্তাপে গলে যায়।

কসেত্তে জানত না প্রেম কী বস্তু। প্রেমের পার্থিব অর্থ বা তাৎপর্য কোনও জ্ঞান ছিল না তার। কনভেন্টে যে গান প্রার্থনার স্তোত্র হিসেবে গাওয়া হত তাতে প্রেম কথাটা পাল্টে তার জায়গায় অন্য শব্দ বসিয়ে দেওয়া হত। ফলে এখন সে কী অনুভব করছে তা সে প্রকাশ করতে পারছে না। এ যেন কোনও রোগের নাম না জেনে সেই রোগে ভোগা।

ভালোবাসার ব্যাপার না জেনেই গভীর ভালোবাসার মধ্যে ডুবে যায় সে। কিন্তু সে জানত না এই ভালোবাসার ফল ভালো না খারাপ, এটা নিষিদ্ধ না সমাজসম্মত বা নীতিসম্মত। সে শুধু ভালোবেসে যাচ্ছিল। কেউ যদি তাকে বলত, তুমি ভালো করে ঘুমোও না, ভালো করে খাও না। তোমার অন্তর অনুক্ষণ স্পন্দিত হচ্ছে। কালো পোশাকপরা কোনও লোক দেখলেই তোমার মুখখানা মলিন হয়ে যায়। এগুলো কিন্তু খুব খারাপ, সে তা হলে উত্তর দিত, যে কাজ আমি না করে পারি না, যে কাজের ব্যাপারে আমি অসহায় সে কাজে যদি কোনও দোষ থাকে তো আমি কী করতে পারি?

কসেত্তে নিজের মতো করে ভালোবেসেছিল। তার ভালোবাসা ছিল ঈশ্বরপ্রেমের মতো। তার প্রেম ছিল যেন জীবনের উপাসনা। তার ভালোবাসা মানে এক অজানা অচেনা ব্যক্তিকে দেবতার আসনে বসিয়ে দূর থেকে তার ধ্যান করা, নির্জনে নীরবে শুধু তার কথা ভাবা। কল্পিত প্রেমের বহু আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে রক্তমাংসের মানুষের মতো সাজানো, কিন্তু সে বস্তু দূরস্থিত, যার কোনও দাবি নেই, যে কিছুই চায় না তার কাছ থেকে। তার মনের মধ্যে প্রেম সম্বন্ধে তখনও এক ঘন কুয়াশাজাল জমে থাকায় সে প্রেমের বস্তু যদি তখন তার খুব কাছে এসে দাঁড়াত তা হলে সে ভয় পেয়ে যেত। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে তখনও এক অলস ভীতি আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তাকে। যে কনভেন্টে সে দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিল, যার রীতিনীতিতে সে ডুবে ছিল বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে সেই কনভেন্টের আত্মাটা তার মন থেকে যতই উবে যাচ্ছিল ততই বাইরের জগৎটা কাঁপছিল তার চারদিকে। সেই কম্পমান দোলায়িত জগতের মাঝে একটা অবলম্বন চাইছিল সে, যে অবলম্বন সুন্দর, মনোহর, অথচ যাকে পাওয়া সম্ভব নয়। মেরিয়াস ছিল সেই অবলম্বন। তাই সে মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিল।

মেরিয়াসকে সেদিন বেড়াতে দেখে এক অনিবচনীয় আনন্দ লাভ করেছিল। তার মনে হয়েছিল তার মনের কথাটাকে সে তার নীরব দৃষ্টি আর ঈষৎ হাসির স্বল্প আলোর মাধ্যমে প্রকাশ করতে পেরেছে। সে তাই আনন্দের আবেগে ভলজাঁকে বলেছিল, লুক্সেমবুর্গ বাগানটা কী সুন্দর!

এইভাবে তারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আপন আপন অন্ধকার জগতের মধ্যে বাস করছিল। তারা তখনও কথা বলেনি পরস্পরের সঙ্গে। তারা শুধু দেখেছিল পরস্পরকে। আকাশের অনন্ত শূন্যতার দ্বারা পরিবৃত দুটি নক্ষত্রের মতো বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অবস্থান করছিল।

এইভাবে কসেত্তে পরিণত হয় পূর্ণ যুবতীতে। সে তার সৌন্দর্যের প্রতি সচেতন ছিল, কিন্তু তার প্রেম সম্বন্ধে তার কোনও সচেতনতা ছিল না।

.

৭.

কে যেন অস্পষ্টভাবে জাঁ ভলজাঁকে ভেতর থেকে সতর্ক করে দেয়, মেরিয়াস ধীর অথচ নিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। ভলজাঁ তাদের দৃষ্টিবিনিময়ের ব্যাপারটার কিছু না দেখলেও এক অগ্রপ্রসারী ছায়ার অশুভ বিস্তার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠেছিল সে। এক অমোঘ ঐশ্বরিক বিধানের তাড়নায় আপনা থেকেই সতর্ক হয়ে ওঠে সে। তার পিতৃসুলভ প্রভুত্বটাকে সে যেন যথাসম্ভব লুকিয়ে রাখে। ভলজাঁ শুধু মেরিয়াসকে একবার চকিতে দেখেছে।

মেরিয়াসের আচরণটা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না তখন। সে তার মনের আসল ভাবটা লুকোঁতে যাওয়ার ফলে তাকে খারাপ দেখাচ্ছিল এবং তার সাহসিকতার মধ্যেও একটা দুর্বলতা ছিল। সে আগের মতো তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে না গিয়ে কিছু দূরে একটা বেঞ্চের উপর বসে বই নাড়ার ভান করছিল। কিন্তু কার জন্য সে ভান করছিল? আগে আগে মেরিয়াস ছেঁড়া পোশাক পরে আসত; কিন্তু সেদিন এসেছিল সবচেয়ে ভালো পোশাক পরে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে তার মাথার চুলে ক্রিম দিয়ে এসেছে। তার চোখ-মুখের ভাবটা ছিল অদ্ভুত। সে হাতে দস্তানা পরেছিল। মোটের ওপর যুবকটির প্রতি বিতৃষ্ণা জাগে জাঁ ভলজাঁ’র মনে।

এদিকে কসেত্তে কোনও কিছু প্রকাশ করেনি। কী ঘটছে সে চোখে তার কোনও জ্ঞান না থাকলেও একটা জিনিস সে বুঝেছিল, কিছু একটা ঘটেছে। তবে সেটা গোপন রাখতে হবে। কিন্তু পোশাক ও সাজসজ্জার প্রতি তার আকস্মিক আগ্রহ, মেরিয়াসের মতো কসেত্তে’র এক নির্দিষ্ট সময়ে বাগানে আসা এবং মেরিয়াসের পোশাকের উন্নতি ঘটনার এই সব যোগাযোগ ভলজাঁ’র মনটাকে ভাবিয়ে তুলঁল। হয়তো এটা পূর্বকল্পিত নয়, কয়েকটি ঘটনার আকস্মিক মিল শুধু, তবু এ মিলের মধ্যে একটা কুলক্ষণের আভাস পেল ভল। দীর্ঘদিন ধরে সে এই অচেনা যুবকটির সম্বন্ধে কোনও কথাই বলেনি, আর সে সংযত করে রাখতে পারল না নিজেকে। একদিন যে জিভ যেমন কোনও যন্ত্রণাদায়ক দাঁতকে তুলে ফেলতে চায় তেমনি ভলজাঁ কথাটা বলে ফেলল, ওই যুবকটিকে বড় বাজে মনে হচ্ছে।

এক বছর আগে কসেত্তে’র বয়স যখন আরও কম ছিল তখন হয়তো সে তার বাবার কথার উত্তরে বলতে পারত, কিন্তু আমার তাকে দেখে ভালোই মনে হয়। আবার কয়েক বছর পরে মেরিয়াসের ভালোবাসাটা তার অন্তর থেকে ছিন্নমূল হয়ে পড়লে সে হয়তো বলত, শুধু বাজে নয়, একবার চোখে চেয়ে দেখারও যোগ্য নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার মনের যা অবস্থা ছিল তাতে সে শুধু বলল, তুমি কোন যুবকের কথা বলছ, যে ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা এমনভাবে বলল যেন সে এর আগে তাকে দেখেনি। তার মুখ থেকে এ কথা শুনে ভলজাঁ ভাবল সে তা হলে যুবকটিকে লক্ষই করেনি, সে-ই তাকে খুঁচিয়ে দেখিয়ে দিল।

এইভাবে বার্ধক্যের সরলতা আর যৌবনের চাতুর্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে লাগল। এ দ্বন্দ্ব বাধার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ যৌবনের এক উন্মত্ত দ্বন্দ্ব। মনে হয় মেয়েরা কোনও ফাঁদে পড়ে না, যুবকরাই সব রকমের ফাঁদে পড়ে। মেরিয়াসের বিরুদ্ধে এক গোপন অভিযান শুরু করল, কিন্তু যৌবনসুলভ প্রেমাবেগের আবেশে তা বুঝতে পারল না। ভলজাঁ কত ফাঁদ পাতল তাকে ধরার জন্য। সে তাদের বাগানে যাওয়ার সময় পাল্টে দিল, বসার বেঞ্চ পরিবর্তন করল, বাগানে একা আসতে লাগল, তার রুমালটা ইচ্ছা করে একদিন ফেলে গেল।

এদিকে কসেত্তে তার আপন ঔদাসীন্য আর অটল প্রশান্তির এক দুর্ভেদ্য দুর্গ রচনা করে তার মধ্যে বসে রইল। ভলজাঁ তখন ভাবল যার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে যুবকটি সে নিজেই জানে না সে প্রেমের কথা।

তবু ভয় পেয়ে গেল ভলজাঁ। কসেত্তে যে কোনও মুহূর্তেই সত্যি সত্যিই প্রেমে পড়ে যেতে পারে। ঔদাসীন্য দিয়েই এ সব কাজ শুরু হয়। তাছাড়া কসেত্তে’র একদিনের একটা কথা থেকেও ভলজাঁ ভয় পেয়ে যায়। একদিন বাগানে বেড়াতে গিয়ে এক ঘণ্টা বসার পর যাবার জন্য ভলজাঁ উঠে পড়তেই কসেত্তে বলে ফেলল, এত তাড়াতাড়ি

তবু লুক্সেমবুর্গ বাগানে যাওয়া বন্ধ করল না জাঁ ভলজাঁ। হঠাৎ কিছু একটা করে কসেত্তে’র মনে কোনও সন্দেহ জাগাতে চাইল না। কিন্তু যখনি দেখেছে সে মেরিয়াস কসেত্তে’র পানে তাকাচ্ছে তখনি ভয়ঙ্করভাবে সে মেরিয়াসের পানে তাকিয়েছে। এতদিন তার মনে কারও প্রতি কোনও ঈর্ষা ছিল না, কিন্তু আজ তার অন্তরের গভীরে এক প্রচণ্ড রোষের সঙ্গে এক বন্য বর্বর ঈর্ষা জাগল। কোনও শয়তানের প্ররোচনায় ওই নারকীয় যুবকটি জাঁ ভলজাঁ’র একমাত্র সুখের বস্তুকে তার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যাবার জন্য তার জীবনকে ভেঙে দিতে আসছে?

ভলজাঁ ভাবল, ও প্রেম করতে আসছে। প্রেম? আর আমি? আমার মতো সব দিক থেকে সবচেয়ে হতভাগ্য এক লোক সবচেয়ে বঞ্চিত হতে চলেছি। ষাট বছর ধরে চরম দুঃখকষ্ট ভোগ করে, আত্মীয়-স্বজনহীন অবস্থায় পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে, পাথরে, কাঁটায়, প্রাচীরে চোরের মতো কত রক্তপাত করে যখন আমি আমার আকাক্ষিত বস্তুকে পেয়ে একটু শান্তি আর আশ্রয় পেলাম তখন আমার কাছ থেকে সেই সুখের বস্তুকে কেড়ে নিতে আসছে একজন। কসেত্তেকে হারাতে হবে আমায়, আর কসেত্তেকে হারানো মানেই আমার সারাজীবন মাটি হয়ে যাওয়া। আমাকে সব কিছু হারাতে হবে, কারণ একটা লম্পট ছোকরা লুক্সেমবুর্গ বাগানে অলসভাবে ঘুরতে আসে।

এই সব ভাবতে গিয়ে তার চোখে এক কুটিল আলোর উজ্জ্বলতার ঢেউ খেলে যায়। একটা মানুষ যেন একটা মানুষের পানে তাকিয়ে নেই, যেন এক প্রহরী কুকুর একটা চোরের পানে তাকিয়ে আছে।

এর পরে কী হয়েছিল তা আমরা জানি। কসেত্তে’র পিছু পিছু সে র‍্যু দ্য লোয়েস্তের বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল। সে বাড়ির দারোয়ানের কাছে ভলজাঁর নাম জিজ্ঞাসা করে। দারোয়ান আবার ভলজাঁকে বলে, একজন যুবক আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছিল মঁসিয়ে। এরপর জাঁ ভলজাঁ এমন কড়া দৃষ্টিতে মেরিয়াসের পানে তাকায় যে সে দৃষ্টির অর্থ সে বুঝতে পেরেছিল। তার পর সে র‍্যু দ্য লোয়েন্তের বাড়ি ছেড়ে র‍্যু প্লমেতের বাড়িতে চলে আসে। প্রতিজ্ঞা করে এ বাড়ি আর লুক্সেমবুর্গ বাগানে আর জীবনে কখনও আসবে না সে। তারা র‍্যু প্লমেতে ফিরে গেল।

কোনও অভিযোগ করল না কসেত্তে। কোনও কথা বলল না সে, কোনও প্রশ্ন করল না, এর কারণ পর্যন্ত জানতে চাইল না। তার তখন একমাত্র ভয় ছিল যে সে ধরা পড়ে যাবে এবং সে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করছে। মেয়েদের এই সব অন্তর্দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে জাঁ ভলজাঁ’র কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না। এইজন্যই সে কসেত্তে’র নীরবতার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি। সে শুধু বুঝত কসেত্তে’র মনে শান্তি নেই এবং এতে আরও বিচলিত হয়ে পড়ত। এটা যেন একটি অনভিজ্ঞতার সঙ্গে আর একটি অনভিজ্ঞতার মিলন।

একদিন জাঁ ভলজাঁ তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি লুক্সেমবুর্গ বাগানে যাবে?

কসেত্তে’র গালদুটো রাঙা হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ।

তারা লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল দু জনে। কিন্তু মেরিয়াসকে দেখতে পেল না। তিন মাস ধরে সে বাগানে আসেনি। পরদিন ভলজাঁ আবার কসেত্তেকে জিজ্ঞাসা করল, আজ যাবে বাগানে?

কসেত্তে বলল, না।

কসেত্তের বিষাদ আর নম্রতা দেখে ভয় পেয়ে গেল ভলজাঁ। কসেক্তের অন্তরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তার সে কিছুই বুঝতে পারল না। তার তরুণ অন্তঃকরণটা হঠাৎ এমন দুর্বোধ্য ও রহস্যময় হয়ে উঠল কেন? কী পরিবর্তন ঘটছে তার অন্তরে? এক একদিন সারা রাত ভলজাঁ বিছানায় বসে বসে ভাবত কসেত্তে কী চাইছে, কী সব চিন্তা করছে। এই সময় কনভেন্টের কথা মনে পড়ে গেল ভলজাঁ’র। সে ভাবত, যে কনভেন্টে অবহেলিত সব ফুলের গন্ধ, কারারুদ্ধ কুমারীদের সব উচ্চাভিলাষ স্বৰ্গাভিমুখে ধাবিত হয়, সে কনভেন্টে সে থেকে গেলে আজ কসেত্তে’র এ অবস্থা হত না। যে স্বর্গ থেকে সে স্বেচ্ছায় কসেত্তেকে নিয়ে চলে এসেছে নির্বুদ্ধিতাবশত সেখানে ফিরে যাবার আর কোনও পথ নেই। নিজের হাতে নিজেকে বলি দিয়েছে সে। সে শুধু বারবার এই অনুশোচনা করতে লাগল, আমি কী সর্বনাশ করেছি।

কিন্তু এ সব কথা সে কসেত্তেকে কিছুই বলেনি। কোনও রাগ বা নির্দয়তা দেখায়নি তার প্রতি। কসেত্তে’র মুখে অবশ্য আগের মতোই হাসি লেগে থাকত।

এদিকে মেরিয়াসকে দেখতে না পেয়ে দুঃখবেদনা বেড়ে যাচ্ছিল তার। ভলজাঁ যখন লুক্সেমবুর্গ বাগানে যাওয়া বন্ধ করে দিল তখন সে ভেবেছিল লুক্সেমবুর্গ বাগানে যাওয়ার প্রতি সে কোনও বিশেষ আগ্রহ না দেখালে তার বাবা আবার তাকে নিয়ে যাবে সেখানে। কিন্তু সপ্তার পর সপ্তা এবং মাসের পর মাস এইভাবে কেটে গেলেও যখন তার বাবা আর সেদিকে যাওয়ার নাম করল না তখন সে হতাশ হয়ে পড়ল। অবশেষে সে একদিন সেখানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে ভলজাঁ তাকে নিয়ে গেল লুক্সেমবুর্গ বাগানে। কিন্তু মেরিয়াসকে দেখা গেল না সেখানে। কসেত্তে’র মনে হল তার জীবনে আসতে না আসতেই মেরিয়াস চিরদিনের মতো চলে গেছে সে জীবন থেকে। আর কোনও কিছু করার নেই। তাকে দেখতে পাবার আর কোনও আশা নেই। যে দুঃখের বোঝাভারে অন্তরটা ভারী হয়ে উঠেছিল তার বোঝাটা বেড়ে যেতে লাগল। দিনে দিনে চারদিকের বাস্তব অবস্থার কথা একেবারে ভুলে গেল সে। শীত, গ্রীষ্ম, রোদ, বৃষ্টি সব একাকার হয়ে গেল তার মনে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতি কোনও আগ্রহই রইল না তার।

অবশেষে একদিন ভলজাঁ জিজ্ঞাসা করল কসেত্তেকে, তুমি কেমন আছ?

তার মুখখানা বিষাদে ম্লান ও বিবর্ণ হয়ে থাকা সত্ত্বেও সে বলল, ভালোই আছি বাবা। কিন্তু তুমি কেমন আছ?

ভলজাঁ বলল, আমার শরীর তো ভালোই আছে।

এইভাবে দুটি প্রাণ যারা একদিন একসঙ্গে কত সুখে বাস করে এসেছে, একে অন্যকে সুখী করে এসেছে, আজ তারা একে অন্যের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াল। অথচ কেউ কাউকে এ কথাটা জানাল না বা কোনও অভিযোগ করল না।

.

৮.

তবে দু জনের মধ্যে জাঁ ভলজাঁ’র দুঃখটাই বেশি। শত দুঃখের মাঝেও যৌবন এক সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পারে। কিন্তু ভলজাঁ তা পারেনি। এই কথা ভেবে সে প্রায়ই দুঃখে অভিভূত হয়ে যেতে লাগল যে কসেত্তে তার জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই কসেত্তে’র সেই পলাতক মনটাকে ঘুরিয়ে আনার জন্য মরিয়া হয়ে যেন লড়াই করে যেতে লাগল সে। একদিন রাজপথে প্যারিসের এক সেনাপতিকে উজ্জ্বল সামরিক পোশাক পরে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দেখে তার হঠাৎ মনে হল সে-ও এক জমকালো পোশাক পরে একটা ঘোড়া কিনে তার উপর চড়ে তাক লাগিয়ে দেবে কসেত্তেকে। তুলিয়েরের প্রাসাদের পাশ দিয়ে সেখানকার বাগানে বেড়াতে যাবে সে। কসেত্তের মনটাকে এইভাবে সে ভুলিয়ে রেখে দিলে সে মন আর কোনও যুবকের দিকে ধাবিত হবে না। দুঃখের ক্রমাগত আঘাতে মনটা যেন শিশুর মতো অবুঝ হয়ে ওঠে তার।

পরে অবশ্য এক অপ্রত্যাশিত আঘাতে এই ধরনের শিশুসুলভ পরিকল্পনা বাতিল করে দেয় সে। র‍্যু প্লামেতের বাড়িতে আসার পর তারা রোজ ভোরবেলায় সূর্যোদয় দেখার জন্য বিশেষ এক জায়গায় যেত। যে সব যুবক-যুবতী জীবন শুরু করছে এবং যে সব বৃদ্ধ জীবনের শেষ প্রান্তসীমায় এসে পড়েছে তারা সবাই এই সূর্যোদয় দেখে প্রচুর আনন্দ পেত মনে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো ঝরে পড়া পাখিডাকা নির্জন পথ দিয়ে হেঁটে যেতে খুব ভালো লাগত তাদের। কবে কোন পথ দিয়ে যাবে সে কথা দু জনে আলোচনা করে আগের দিন ঠিক করে রাখত তারা। ভোর হতে না হতেই দু জনেই উঠে পড়ত।

যে সব পরিত্যক্ত জায়গা দিয়ে বড় একটা লোকজন যায় না সেই দিকে যাবার প্রতি একটা বিশেষ আগ্রহ ছিল ভলজাঁ’র মনে। প্যারিসে ব্যারিয়ের অঞ্চলে যে সব পতিত জমিগুলো কাঁটাগাছে ভরা ছিল সেই সব জমিওয়ালা ফাঁকা মাঠটা প্রিয় ছিল ভলজাঁর। জায়গাটা কসেত্তেও পছন্দ করত। জায়গাটা নির্জন বলে ভালো লাগত ভলজাঁ’র আর এখানে এলে অবাধ মুক্তি পাবে বলে ভালো লাগত কসেত্তে’র। কসেত্তে সে জায়গায় বেড়াতে গিয়েই ভলজাঁ’র হাঁটুর উপর তার টুপিটা রেখে বুনো ফুল তুলঁতে যেত। সে প্রজাপতির পাখা মেলে উড়ে যাওয়া দেখত, কিন্তু তাদের ধরতে যেত না। করুণা আর মমতা এই দুয়েরই বশবর্তী হয়ে সে ধরতে চাইত না তাদের।

তাদের দু জনেরই জীবনে দুঃখময় বোঝা নেমে আসা সত্ত্বেও তারা সকালে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যাসটা ত্যাগ করেনি। তারা রোজ ভোর হলেই বেরিয়ে পড়ত বাড়ি থেকে। সেদিন ছিল ১৮৩১ সালের অক্টোবর মাসের এক স্নিগ্ধ সকাল। ওরা হাঁটতে হাঁটতে চলেছিল ব্যারিয়ের দু মেনের দিকে। তখনও ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি ভালো করে। ঝাপসা আকাশের গভীরে দু চারটে তারা তখনও ছিল। পুব দিকটা ফর্সা হয়ে আসছিল। লার্ক পাখি ডাকছিল কোথায়। অপস্রিয়মাণ অন্ধকার দিগন্তের মাথার উপরে ধ্রুবতারাটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। চারদিক নির্জন নিস্তব্ধ! শুধু দু একজন শ্রমিককে কারখানার পথে। ব্যস্তভাবে যেতে দেখা যাচ্ছিল।

যেতে যেতে একটা কাঠের কারখানার কাছে পথের ধারে একটা কাঠের উপর বসে ছিল ভলজাঁ। তার পিঠটা ছিল উদীয়মান সূর্যের দিকে। সেদিন তার চিন্তার জটিল জালে মনের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটোও এমনভাবে আটকে পড়ে যে সূর্যোদয় দেখার কোনও আগ্রহ ছিল না তার। সে ভাবছিল যদি তাদের দু জনের মাঝখানে কোনও অঘটন না ঘটে তা হলে তাদের এই সুখ অব্যাহত থাকবে। যে সুখের পশরা দিয়ে তার জীবনকে ভরে দিয়েছে কসেত্তে সে সুখের পশরা যেন না ফুরোয় কোনও দিন। ভলজাঁ যখন এই সব অলস দিবাস্বপ্নজাল রচনা করে চলেছিল আপন মনে, কসেত্তে তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেখছিল দিগন্তজোড়া ধূসর মেঘগুলো কিভাবে গোলাপি হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে।

সহসা চিৎকার করে উঠল কসেত্তে, বাবা, কারা আসছে মনে হচ্ছে।

চোখ তুলে তাকাল ভলক্স। ব্যারিয়ের দু মেনের দিকে যে বড় রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, কিছুদূরে আর একটা রাস্তা সেই বড় রাস্তাটাকে খণ্ডিত করে বুলভার্দের দিকে চলে গেছে। সেই চৌরাস্তার কাছ থেকে গোলমালের এক শব্দ আসছিল। পরে দেখা গেল। ঘোড়ায় টানা একটা পুরনো আমলের গাড়ি ঝাপসা অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চৌরাস্তা থেকে এগিয়ে আসছে ধীরগতিতে। কয়েকজন মানুষের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে চাবুক মারার। শব্দ কানে আসছিল।

ক্রমে ওরা দেখল একটার পর একটা মোট সাতটা ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে আসছে এই দিকে। মনে হল গাড়িগুলোতে মানুষ আছে এবং কোনও কোনও মানুষের হাতে অস্ত্র আছে।

ঘোড়ায় টানা মালগাড়িতে ছিল চব্বিশজন কয়েদি। তাদের ঘাড়ের উপর ছিল লোহার জোয়াল আর পায়ে বেড়ি। প্রতিটি গাড়িতে দুটি করে সারিতে কয়েদিরা বসেছিল। গাড়ির দু দিকের মুখের কাছে দু জন করে সশস্ত্র সৈনিক পাহারা দিচ্ছিল। গাড়িগুলোর আগে আগে একদল অশ্বারোহী পুলিশ যাচ্ছিল, তাদের হাতে ছিল মুক্ত তরবারি। গাড়িগুলো রাস্তার মাঝখান দিয়ে যাচ্ছিল।

এই শোভাযাত্রা দেখার জন্য পথের দু ধারে দর্শকদের ভিড় জমে গিয়েছিল। একদল বাচ্চা ছেলে চিৎকার করছিল। চাবুক হাতে একজন সেনাপতি হাঁকডাক করে বন্দিদের ওপর খবরদারি করছিল। প্রহরী সৈনিকরা মাঝে মাঝে তাদের হাতের লাঠি দিয়ে বন্দিদের মারছিল। তাদের পিঠের উপর সশব্দে লাঠির ঘাগুলো বসিয়ে দিচ্ছিল।

আকাশটাকে দেখে মনে হচ্ছিল কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ ভেঙে সূর্য দেখা দিল। সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বন্দি কয়েদিদের মাঝে একজন নিগ্রো ক্রীতদাস ছিল। শৃঙ্খলিত থাকার অভ্যাস ছিল তার। তাছাড়া অন্য কয়েদিরাও সব অত্যাচার নীরবে সহ্য করে যাচ্ছিল।

এই সব দেখে ভলজাঁ’র অতীতের কথা মনে পড়ল। একদিন সে-ও এমনি করে বন্দি কয়েদি হিসেবে পশুর মতো একস্থান থেকে অন্যস্থানে গিয়েছে। তাকেও এই সব অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এই সব স্বচক্ষে দেখে মনটা তার বিষণ্ণ হয়ে উঠল। সে ভয় পেয়ে গেল। ছুটে পালাতে ইচ্ছা করছিল তার। কিন্তু সেখান থেকে উঠতে পারল না সে।

কসেত্তেও এ দৃশ্য দেখে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল অন্য কারণে। সে হতবুদ্ধি ও বিমূঢ় হয়ে রুদ্ধশ্বাসে এই সব দেখে যাচ্ছিল। সে একসময় বলল, এই সব লোক কারা বাবা?

ভলজাঁ বলল, ওরা কঠোর শ্রমে দণ্ডিত কয়েদি।

কোথায় যাচ্ছে ওরা?

জাহাজে কাজ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওদের।

এমন সময় লাঠির ঘা আর বেতের চাবুক চরমে উঠল। খাঁচাবন্দি নেকড়ের মতো বন্দিরা বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এই বন্দিদের বিশেতার থেকে লে মাসের পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু ফঁতেনব্লোতে রাজার বাসভবন থাকায় এ দৃশ্য পাছে রাজার চোখে পড়ে তাই সেদিকে না গিয়ে তিন-চারদিনের ঘুরপথে ওদের এইভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।

গভীর বিষাদে মগ্ন হয়ে কসেত্তেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে এল ভলজাঁ। পথে সে বন্দিদের কথা ভাবতে ভাবতে এমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল যে কসেন্তের কোনও প্রশ্নেরই সে জবাব দিতে পারল না। রাত্রিতে কসেত্তে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুতে যাবার সময় বলে গেল, পথে কোনও মানুষের উপর ওই ধরনের অত্যাচার দেখলে এবার আমি ভয়ে মরে যাব।

পরদিন প্যারিসে সেন নদীর ধারে সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজের এক সরকারি উৎসব ছিল। সন্ধের দিকে অনেক বাজি পোড়ানো ও আলোকসজ্জা হবে। বিকালের দিকে ভলজাঁ সেখানে উৎসব দেখার জন্য কসেত্তেকে নিয়ে গেল। এই উৎসব দেখলে গতকালকার অপ্রিয় অবাঞ্ছিত অভিজ্ঞতার কথাটা হয়তো ভুলে যেতে পারবে সে। ভলজাঁ জাতীয় রক্ষীবাহিনীর পোশাক পরে গেল সেখানে।

কয়েকদিন পরে সেদিন সকালবেলায় বাগানবাড়িতে ওরা দু জনেই উজ্জ্বল রোদে বসেছিল। ভলজাঁ সাধারণত বাগানে বসে না। কসেত্তেও সাধারণত ঘরের মধ্যে একা বসে বসে ভাবতে থাকে। কিন্তু আজ ওরা এই উজ্জ্বল সকালে বাগানের এই গাছপালা আর ফুলের রাজ্যে এসে বসেছিল। কসেত্তে হালকা রঙের একটা পোশাক পরে ছিল। নক্ষত্রদের ঘিরে থাকা কুয়াশার মতো পোশাকটা জড়িয়ে ছিল তার গায়ে। গতরাতে তার ভালো ঘুম হওয়ায় তার গালগুলোকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। সে একটা ডেইজি ফুল নিয়ে খেলা করছিল। তার বাবা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই খেলা দেখছিল। কসেত্তে’র এই আনন্দময় উপস্থিতিতে তার সব দুঃখের কথা ভুলে গিয়েছিল ভলজাঁ। তাদের মাথার উপর একটা পাখি ডাকছিল। আকাশে হালকা সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল।

ফুল নিয়ে খেলা করতে করতে হাঁসের মতো ঘাড়টা ঘুরিয়ে বলে উঠল কসেত্তে, বাবা, ওদের কোথায় কোন জাহাজে কাজ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *