প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৩.৮ গ্রীষ্ম ও শরৎ কেটে গিয়ে বসন্ত এল

অষ্টম পরিচ্ছেদ

১.

দেখতে দেখতে গ্রীষ্ম ও শরৎ কেটে গিয়ে বসন্ত এল। কিন্তু মঁসিয়ে লেবলাঁ বা তার মেয়ে কেউ একটি দিনের জন্যও লুক্সেমবুর্গ বাগানে এল না। মেরিয়াসের মনে তখন শুধু একটা চিন্তাই ছিল। কখন এবং কী করে মেয়েটির সুন্দর মুখখানা আবার দেখতে পাবে। সে বহু জায়গায় খোঁজ করে, তার খোঁজে অনেক অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কোথাও খোঁজ পায়নি তাদের। ভাগ্যের সঙ্গে সগ্রাম করার মতো সাহস তার ছিল না, নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মতো যৌবনসুলভ শক্তিও ছিল না তার। তার মন শুধু আকাশকুসুম কল্পনা করাতেই নিরত ছিল সব সময়। হতাশমগ্ন পথকুকুরের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল। তার জীবন হয়ে উঠল অর্থহীন। যে কোনও কাজ তার কাছে হয়ে উঠল বিতৃষ্ণাজনক, পথ হাঁটা হয়ে উঠল বিরক্তিকর। বিস্তৃত উদার দিগন্তসমন্বিত যে বিরাট প্রকৃতিজগৎ একদিন আলো ও অর্থে পরিপূর্ণ ছিল তার কাছে, আজ তা সব অর্থ হারিয়ে শূন্য হয়ে উঠল। জগৎ ও জীবনের সব কিছু থেকে যেন সব অর্থ উবে গেছে।

তবু সে ভাবত। নির্জন চিন্তায় মগ্ন হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। কারণ না ভেবে পারত না। কিন্তু চিন্তা-ভাবনায় আর কোনও আনন্দ পেত না সে। কোনও চিন্তা বা পরিকল্পনা তার মনে এলেই শুধু তার মনে হত, কী হবে তাতে।

নিজেকে নিজে প্রায়ই ভর্ৎসনা করত। মেয়েটিকে চোখে দেখেই যখন আনন্দ পেত তখন কেন তাকে অনুসরণ করতে গেল? মেয়েটিও যখন তার দিকে তাকিয়েছিল তখন সেইটাই কি যথেষ্ট ছিল না? তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে-ও তাকে ভালোবাসে, আবার কী চায় সে? সে ভুল করেছে, নিজেকে সে হাস্যাস্পদ করে তুলেছে। আজকের এ দুঃখ তারই সৃষ্ট। কুরফেরাককে সে কিছু না বললেও কুরফেরাক তার এই ব্যাপারটা কিছু জানতে পেরেছে অনুমানের মাধ্যমে। কারণ এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে তার। প্রথমে কুরফেরাক এজন্য অভিনন্দন জানায় তাকে। তার প্রেমে পড়ার ব্যাপারে সে অবশ্য কিছুটা আশ্চর্য হয়ে যায়। পরে তার দুঃখ দেখে সে দমে যায়। সে বলে, তুমিও তো আমাদের মতো মানুষ। চল, আমরা একবার শমিয়ের দিয়ে বেড়িয়ে আসি।

একবার কোনও এক শরতের উজ্জ্বল দিন দেখে সে বাল দ্য স্কিও দিয়ে কুরফেরাক, বোসেত আর গ্রান্তেয়ারের সঙ্গে বেড়াতে যায়। তার প্রবল আশা ছিল সে হয়তো সেখানে দেখতে পাবে মেয়েটিকে। গ্রান্তেয়ার একবার তার বন্ধুদের কাছে বলেছিল, ওখানে অনেক হারানো মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যায়।

সেখানে গিয়ে মেরিয়াস তার বন্ধুদের ছেড়ে দিয়ে পথের গাড়িঘোড়া আর মানুষের ভিড় এড়িয়ে গাছপালায় ঘেরা এক নির্জন জায়গায় চলে যায়। এইভাবে তার তপ্ত আবেগকে শীতল করতে চায় সে।

এরপর থেকে সে শুধু নির্জন জায়গা বেছে নিয়ে নিজের দুঃখের কথাটাই ভাবতে লাগল। খাঁচাবন্দি নেকড়ের মতো দুঃখের প্রাচীরঘেরা একটা ঘরের মধ্যে যেন নিবিড় যন্ত্রণার আঘাতে মুচড়ে উঠতে লাগল। তবে মাঝে মাঝে সে তার আকাঙ্ক্ষিত প্রেমাস্পদের খোঁজ করে বেড়াতে লাগল।

একদিন একটি ঘটনায় চমকে উঠল সে। বুলভার্দ দু লুক্সেমবুর্গ অঞ্চলে একদিন সে শ্রমিকের পোশাকপরা একটা প্রৌঢ় লোককে দেখতে পেল। তার টুপির তলায় মাথায় পাকা চুলগুলো বেরিয়েছিল। লোকটি ধীর পায়ে পথ হাঁটছিল। হয়তো সে কোনও বেদনার্ত চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিল। মেরিয়াসের মনে হল লোকটি মঁসিয়ে লেবলাঁ। সেই চুল আর চেহারা ঠিকই আছে। শুধু মুখখানা আরও বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকের পোশাক পরে আছে কেন? এটা কি ছদ্মবেশ? মেরিয়াস আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল। কিন্তু সে বুঝল এখন তাকে বিস্ময়ের সব ঘোর কাটিয়ে সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ভদ্রলোকের পিছু পিছু গিয়ে সে কোথায় থাকে তা দেখতে হবে। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে সে দেখল মঁসিয়ে। লেবলাঁ একটা পাশের গলিপথ দিয়ে চলে গেছে। কোনদিকে গেছে তা বুঝতে পারল না। সে। এই ঘটনার কথাটা কয়েকদিন তার মনটাকে আচ্ছন্ন করে ছিল। তার পর সে চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলল মন থেকে। ভাবল সে হয়তো ভুল দেখেছে।

.

২.

মেরিয়াস তখনও গর্বে অঞ্চলের সেই বাড়িটাতেই ছিল। বাড়ির অন্যান্য ভাড়াটের সম্বন্ধে তার কোনও খেয়াল বা হুঁশ ছিল না। সেই সময় গোটা বাড়িটার মধ্যে সে আর জনদ্ৰেত্তে ছাড়া আর কোনও ভাড়াটে ছিল না। জনদ্ৰেত্তে ছিল সেই দুস্থ পরিবারের কর্তা যে পরিবারে ছিল বাবা-মা আর দুটি মেয়ে, কিছুদিন আগে সে যে পরিবারকে বাড়িভাড়া মেটানোর জন্য তিরিশ ফ্রাঁ দিয়ে সাহায্য করেছিল এবং যে পরিবারের লোকদের সঙ্গে সে কোনওদিন কথা বলেনি। বাড়ির অন্য ভাড়াটেরা ভাড়া না দিতে পারার জন্য বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র উঠে গেছে।

তখন ছিল শীতকাল। ফেব্রুয়ারির একটি দিন। সেদিন সকাল থেকে সূর্য লুকোচুরি খেলছিল আকাশে। সূর্যের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছিল এরপর কয়েক সপ্তা ধরে আবহাওয়া খুব ঠাণ্ডা থাকবে। সেদিন ছিল প্রাচীন ক্যান্ডলমাস উৎসবের দিন।

সন্ধে হতেই বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ল মেরিয়াস। আর কোনও কাজ না থাকায় সন্ধে হলেই হোটেলে রাতের খাওয়াটা সারতে যায় সে। যাবার সময় মাদাম বুগনল ঘর ঝাঁট দিতে দিতে তাকে বলল, আজকালকার দিনে একটা জিনিসই সস্তা পাওয়া যায়। সেটা হল মানুষের শ্রম আর দুঃখকষ্ট। এটা তুমি বিনা পয়সাতেই পেতে পার।

মেরিয়াস ধীর পায়ে ব্যারিয়ের অঞ্চলে অবস্থিত র‍্যু সেন্ট জাক হোটেলের পথে এগিয়ে যাচ্ছিল। বিষণ্ণ চিন্তার ভারে মাথাটা নত ছিল তার। হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে দুটি মেয়ে তাড়াহুড়ো করে এসে তাকে দেখতে না পেয়ে ছুটে এসে তার উপর পড়ল। তার গায়ে ধাক্কা লাগল। মনে হল কিছু একটার ভয়ে মেয়ে দুটি এস্ত হয়ে ছুটে আসছিল। তাদের পোশাক-আশাক বড় মলিন ছিল। তাদের মধ্যে একটি লম্বা রোগা এবং আর একটি মেয়ে তার থেকে ছোট। তাদের দিকে তাকিয়ে মেরিয়াস দেখল, তাদের মুখগুলো। ম্লান, চুলগুলো আলুথালু, জামাগুলো ছেঁড়া এবং বোতাম খোলা, পায়ে জুতো নেই। তাদের কথাবার্তার কিছু শুনতে পেল সে।

বড় মেয়েটি বলছিল, ওরা আমাদের খুব কাছে এসে পড়েছিল। আর একটু হলেই ধরে ফেলত।

ছোট মেয়েটি বলল, আমি তো দেখতেই পাইনি এবং মোটেই ছুটিনি।

তাদের কথা থেকে মেরিয়াস বুঝল পুলিশ তাদের ধরতে এসেছিল এবং তারা কোনওক্রমে পালিয়ে এসেছে।

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে মেয়ে দুটির চলে যাওয়ার পথপানে তাকিয়ে রইল। তার পর সেখান থেকে তার পথে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই একটা কাগজের মোড়ক পথের উপর দেখতে পেয়ে সেটা তুলে নিল। তার মনে হল তার মধ্যে কাগজ আছে।

দুটি মেয়ের মধ্যে একজনের হাত থেকে পড়ে গেছে কাগজটা। মেরিয়াস তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের ডাকতে ডাকতে ছুটে গেল। কিন্তু তারা শুনতে পেল না। তখন সে কাগজের মোড়কটা তার পকেটে ভরে রাখল। কিছুদূর গিয়ে সে দেখল একটি শিশুর মৃতদেহভরা একটি কফিন তিনটি চেয়ারের উপর পথের ধারে নামানো রয়েছে। পাশে একটা বাতি জ্বলছে। এ দৃশ্য দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার মেয়ে দুটির কথা মনে পড়ল।

সে ভাবল, হায় দুঃখী মায়েরা! যে মায়েরা নিজের মৃত সন্তানকে এভাবে ফেলে রেখে চলে যায় তারা কত দুঃখী! তারা কী ভয়ঙ্কর জীবনই-না যাপন করে।

এরপর সে এইসব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এবং এই ঘটনার কথা আর না ভেবে নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল আবার। সে ভাবতে লাগল তার ছয় মাস ধরে চলতে থাকা প্রেমের ব্যাপারটার কথা। যে লুক্সেমবুর্গ বাগানে কত সূর্যালোকিত দিনে গাছের তলায় প্রেমের কত আনন্দোজ্জ্বল অনুভূতি সে উপভোগ করেছে তার কথা সে ভাবতে লাগল।

সে ভাবতে লাগল কত দুঃখময় হয়ে উঠেছে তার জীবন। আমি একদিন যুবতী মেয়েদের দেবদূত ভেবে ছুটে গিয়েছি। একদিন তাদের দেবদূত বলে ভাবতাম। কিন্তু আজ দেখছি তারা আসলে অন্ধকারের জীব।

.

৩.

সেদিন রাত্রিতে বাসায় ফিরে পোশাক ছাড়তে গেলে তার জামার পকেটে সেই কাগজের মোড়কটাতে হাত পড়ল। মেয়েটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। এবার ভাবল এই কাগজের মধ্যেই হয়তো মেয়েটির ঠিকানা লেখা আছে। এ কাগজ যদি তাদের না হয় তা হলে এর যে মালিক নিশ্চয় তার ঠিকানা আছে।

মোড়কটা আঁটা ছিল না বলে সে খুলে ফেলল সেটা। দেখল তার মধ্যে চারটে চিঠি রয়েছে এবং তাতে প্রাপকের ঠিকানা রয়েছে। চিঠিগুলোর থেকে কড়া সস্তা তামাকের গন্ধ আসছিল।

প্রথম চিঠিটা মাদাম লা মার্কুই প্রশেরেকে লেখা। তার ঠিকানাটা হল শাস্ত্রে দে দেপুতের পেছন দিকে। চিঠিগুলোর মধ্যে সে যাদের খুঁজছে তাদের কোনও হদিশ পাওয়া যেতে পারে এই আশায় প্রথম চিঠিটা পড়তে লাগল সে।

মাদাম লা মার্কুই,

মমতা এবং করুণার বন্ধন হচ্ছে এমনই এক বন্ধন, যা মানুষের সমাজকে বেঁধে রেখেছে। আমার অনুরোধ, আপনি আপনার মমতাসুন্দর খ্রিস্টীয় চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একবার এক হতভাগ্য স্পেনিয়ার্ডকে দেখুন, সে এক বৈধ আদর্শের প্রতি তার নিবিড় আসক্তি আর অনুরাগের খাতিরে দেহের বহু রক্তপাত করেছে এবং বহু অর্থ ব্যয় করে আজ নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ নেই। যে আপনার মহান আত্মা এমনই এক হতভাগ্য সৈনিকের অসহায় অসুখী জীবনকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসবে, যার যথেষ্ট শিক্ষাদীক্ষা আছে এবং যে দেশের স্বার্থে অনেক আঘাত সহ্য করে সম্মান অর্জন করেছে। মাদাম লা মার্কুই তাঁর দেশবাসীর জন্য যে মানবতা ও সহানুভূতি অনুভব করেন এবং যার কথা সুবিদিত সারা দেশে, তার ওপর এই সৈনিকের প্রভূত আস্থা আছে। তার একান্ত আশা তার এই আবেদন ব্যর্থ হবে না এবং মাদামের প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত তাঁর স্মৃতি চিরদিন পোষণ করে যাবে তার অন্তরে।

আপনার প্রতি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি নিজে এ পত্রে স্বাক্ষর করলাম।

ডন আলভার্তেজ,

স্পেনীয় অশ্বারোহী বাহিনীর জনৈক ক্যাপ্টেন, দেশের স্বার্থে যে রাজতন্ত্রী শরণার্থী হিসেবে বর্তমানে ফ্রান্সে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, কিন্তু অর্থাভাবে সে আর বেশি অগ্রসর হতে পারছে না।

স্বাক্ষরের তলায় কোনও ঠিকানা নেই।

এবার দ্বিতীয় চিঠিখানি পড়তে লাগল মেরিয়াস। দ্বিতীয় চিঠিখানি মাদাম লা কোঁতেসি দ্য আঁতভানেতকে লেখা। প্রাপকের ঠিকানা হল ৯, র‍্যু কাসেত্তে।

মাদাম লা কোঁতেসি,

আমি ছয়টি সন্তানের জননী। আমার শেষ সন্তানটির বয়স হল মাত্র আট মাস। সে এখন অসুস্থ। পাঁচ মাস আগে আমার স্বামী আমাকে ত্যাগ করে চলে যায়। বর্তমানে আমি ভয়ঙ্কর দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছি, হাতে একটি পয়সাও নেই। মাদাম লা কোঁতেসির বদান্যতার নিকট আমি কাতর আবেদন জানাচ্ছি।

প্রথম দুটি চিঠির মতো তৃতীয়টিও এক ভিক্ষাপত্র।

তৃতীয় চিঠিখানি মঁসিয়ে পাবুরগতকে লেখা। তার ঠিকানা র‍্যু সেন্ট ভেনিস। তাতে লেখা আছে–

আমি এমনই একজন সাহিত্যিকের পক্ষ থেকে আপনার নিকট এই আবেদনপত্র পাঠাচ্ছি যিনি থিয়েটার শোয়াতে একটি নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য উপস্থাপিত করেছেন। এই নাটকটি ঐতিহাসিক এবং এর ঘটনাস্থল হচ্ছে সম্রাটের শাসনাধীন অভার্নে। আমার মতে নাটকটির আঙ্গিক হচ্ছে বাস্তবানুগ এবং এর মধ্যে বস্তু আছে। নাটকের চারটি জায়গায় গান আছে। হাস্যরস, নাটকীয়তা এবং বিস্ময় বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে মিশে আছে। পটভূমিকা ও আঙ্গিকের মধ্যে রোমান্টিকতার সুবাস আছে। কয়েকটি দৃশ্যে বিস্ময়ের চমক সৃষ্টি করে নাটকটি পরিণতির দিকে এগিয়ে গেছে।

যেসব কামনা-বাসনা আপনাদের এই শতকের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে সেই কামনাকে পরিতৃপ্ত করাই হল আমার প্রধান উদ্দেশ্য। সমাজের যেসব রীতিনীতি যখন-তখন বদলায় সেই সতত পরিবর্তনশীল রীতিনীতিকে তুলে ধরতে চেয়েছি আমি। কিন্তু আমার নাটকে এইসব গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও আমার ভয় হয় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ঈর্ষা ও লোভের জন্য আমার নাটকটি প্রত্যাখ্যাত হতে পারে। নবাগতদের সঙ্গে তারা কেমন ব্যবহার করে, তাদের কিভাবে দেখে তা আমার জানা আছে।

শিল্পকর্মের প্রতি আপনার অনুরাগের কথা জেনে আমি আমার মেয়েকে আপনার নিকট পাঠালাম। সে আমাদের দুরবস্থার কথা সব জানাবে। এই শীতে খাদ্য এবং তাপ নেই আমাদের। আমার প্রার্থনা আপনি আমাকে আমার এই নাটকটি আপনাকে উৎসর্গ করার অনুমতি দান করবেন। আমার অন্য নাটকগুলো আপনার প্রতি শ্রদ্ধাবশত আপনার জন্যই রচনা করব। এর দ্বারা বোঝা যাবে আমি আপনার সাহায্যের কতখানি প্রত্যাশা করি এবং আমার লেখার সঙ্গে আপনার নামটিকেও অলঙ্কৃত করে রাখতে চাই। আপনি যদি আমাকে কিছু সাহায্য করেন তা হলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত আমি আপনার জন্য একটি প্রশস্তিমূলক কবিতা রচনা করব। কবিতাটি নাটকের প্রথমেই সংযোজিত হবে এবং সেটি মঞ্চে আবৃত্তি হবে।

পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে
সাহিত্যিক জেনফ্লট

পুনশ্চ:–অন্তত চল্লিশ ব্যু দয়া করে দেবেন।

আমি নিজে যেতে না পারার জন্য ক্ষমা করবেন। উপযুক্ত পোশাক না থাকার জন্য আমি যেতে না পেরে আমার মেয়েকে পাঠালাম।

চতুর্থ চিঠিখানি এক পরোপকারী ব্যক্তিকে লেখা।

পরোপকারী মহানুভব মহাশয়,

আপনি যদি অনুগ্রহপূর্বক আমার মেয়ের সঙ্গে আসেন তা হলে এক বিপর্যস্ত জীবনের চিত্র দেখতে পাবেন স্বচক্ষে। আমি আমার পরিচয়পত্র আপনাকে দেখাব। আমি জানি এই চিঠিখানি আপনার উদার আত্মাকে পরোপকারে অনুপ্রাণিত করবে। কারণ দার্শনিক প্রকৃতির মানুষরা সহজেই প্রবল আবেগে বিচলিত হন।

আপনি হয়তো এই বিষয়ে একমত হবেন যে নির্মম প্রয়োজনের খাতিরে মানুষকে দুঃখের সঙ্গে কোনও সদাশয় ব্যক্তির দয়ার প্রত্যাশী হতে হয়। আমাদের চরমতম দুরবস্থার কালে অপরের সাহায্য প্রত্যাশা না করে নির্দ্বিধায় অনাহারে মরতে পারি না। নিয়তি কারও প্রতি নিষ্ঠুর এবং কারও প্রতি সদয়–এইটাই দুনিয়ার নিয়ম।

আমি আপনার আগমন অথবা দানের প্রতীক্ষায় আছি। আপনি যদি দয়া করে আপনার প্রতি নিবেদিত আমার গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করেন তা হলে বিশেষ বাধিত হব।

আপনার একান্ত বিনয়াবত ও অনুগত ভৃত্য
পি ফাবান্ত, নাট্যশিল্পী

চারটি চিঠি পড়ার পর মেরিয়াস দেখল সে যা খুঁজছিল তা পেল না। এই চিঠিগুলোর কোনওটিতে পত্রপ্রেরকদের ঠিকানা নেই। তবু বিভিন্ন দিক দিয়ে চিঠিগুলো আগ্রহজনক এবং কৌতূহলদ্দীপক। যদিও চারটি চিঠি পৃথক চারজন লোকের জবানিতে লেখা তবু হাতের লেখা এবং একই হলদে মোটা কাগজে লেখা। চারটে চিঠি হতেই তামাকের গন্ধ আসছিল। যদিও বিভিন্ন চিঠিতে বিভিন্ন লেখার ভঙ্গিমা ব্যবহৃত হয়েছে তথাপি সব চিঠিতে একই ধরনের বানান ভুল দেখা যায়। সব দেখে মনে হয় চিঠিগুলো একই লোকের লেখা।

মেরিয়াস দেখল, এইসব চিঠির রহস্যটা তুচ্ছ এবং এ নিয়ে মাথা ঘামানো বৃথা সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। তার মন-মেজাজ এমনই বিষাদগ্রস্ত হয়ে ছিল যে প্যারিসের কোনও এক পথে কুড়িয়ে পাওয়া এই রসিকতায় যেন মন ভুলল না। গতকাল সন্ধ্যায় পথে যে মেয়ে দুটি ব্যস্ত হয়ে তার কাছে এসে পড়ে এই চিঠিগুলো যে তাদের তার কোনও প্রমাণ নেই। আসলে এই চিঠিগুলোর কোনও মূল্য বা তাৎপর্যই নেই। সে তাই চিঠিগুলো সেই মোড়কের মধ্যে ভরে রেখে ঘরের কোণে ফেলে রেখে বিছানায় শুতে চলে গেল।

পরদিন সকাল সাতটার সময় যখন সে পোশাক পরে প্রাতরাশ খেতে খেতে তার কাজের কথা ভাবছিল তখন হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে কে টোকা দিল। দরজায় খিল ছিল না। ঘরে কোনও দামি জিনিস বা বেশি টাকাকড়ি নেই বলে সে ঘরে খিল না দিয়েই শুত। এজন্য মাদাম বুগনল একবার প্রতিবাদ করে এবং তার পর তার এক জোড়া নতুন জুতো চুরি যায়।

দ্বিতীয়বার তার দরজায় টোকা পড়ল। মেরিয়াস ভাবল, মাদাম বুগনল ডাকছে। তাকে। সে তাই ঘরের ভেতর থেকে বলল, ভেতরে এস।

বাইরে থেকে এক নারীকণ্ঠ বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে।

মেরিয়াস বুঝল এ কণ্ঠস্বর মাদাম কুগনলের নয়। এ কণ্ঠস্বর যেন কোনও ব্রঙ্কাইটিসের রোগীর।

সে চোখ তুলে দেখল একটি মেয়ে তাকে ডাকছে।

.

৪.

এক তরুণী দরজার উপর এসে দাঁড়িয়েছিল। দরজার উল্টোদিকের জানালা দিয়ে আসা একঝলক আলো এসে পড়েছিল তার মুখের উপর। তার চেহারাটা খুব রোগা। একটা শেমিজ আর স্কার্ট ছাড়া তার গায়ে আর কিছু ছিল না। সে শীতে কাঁপছিল। তার কোমরে একটা দড়ি বাঁধা ছিল; আর একটা দড়িতে তার মাথার চুলগুলো বাঁধা ছিল। শেমিজের ফাঁক দিয়ে তার কাঁধের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। তার হাত দুটো আলোর ছটায় লালচে দেখাচ্ছিল। তার মুখে কয়েকটা দাঁত ছিল না। চোখ দুটো কোটরাগত আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বয়সে সে একজন বালিকা হলেও তার চোখ দুটো ছিল বয়স্ক মহিলার মতো। পনেরো আর পঞ্চাশ বছরের সব পার্থক্য যেন লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে। তার শীর্ণ চেহারাটা যে একবার দেখবে সে-ই কেঁপে উঠবে।

মেরিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল মেয়েটি যেন স্বপ্নে দেখা অন্ধকারের এক প্রেতমূর্তি। মেয়েটি সম্বন্ধে সবচেয়ে মর্মান্তিক এই যে তাকে এমন কুৎসিত দেখালেও সে কুৎসিত হয়ে জন্মায়নি। শৈশবে সে হয়তো সুন্দরী ছিল। কিন্তু বর্তমানে নিঃসীম দারিদ্র্য আর দুরবস্থার ক্রমাগত আঘাতে তার চেহারাটা এখন অকালবৃদ্ধ ও কুৎসিত হয়ে উঠেছে। তার মোলো বছরের মুখখানায় অবশিষ্ট সৌন্দর্যের একটা ছাপ তখনও ফুটে ছিল যেন কোনও শীতের সকালে মেঘের আড়ালে এক বিরল সূর্যরশ্মি উঁকি মারে।

মুখখানা চেনা চেনা মনে হল মেরিয়াসের। আগে যেন কোথায় দেখেছে তাকে।

মেরিয়াস বলল, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি ম্যাদময়জেল?

মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আপনার জন্য একটা চিঠি আছে মঁসিয়ে।

তা হলে মেয়েটি তার নাম জানে। কিন্তু তা হলে কী করে তার নাম জানল?

কোনও আহ্বানের অপেক্ষা না করেই মেয়েটি ঘরে ঢুকে পড়ল। তার ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে হাঁটুটা দেখা যাচ্ছিল। শীতে কাঁপছিল সে।

তার হাত থেকে চিঠিটা নিল মেরিয়াস। তাতে লেখা ছিল,

আমার সদয় সহৃদয় প্রতিবেশী, পরম শ্রদ্ধেয় যুবক!

আজ থেকে ছয় মাস আগে আপনি আমার বাকি বাড়িভাড়া দয়া করে মিটিয়ে দিয়ে আমার যে উপকার করেছিলেন সে কথা আমি শুনেছি। এর জন্য আমি আপনাকে আশীর্বাদ করছি। আমার বড় মেয়ের মুখ থেকে শুনবেন আজ দুদিন আমাদের খাওয়া হয়নি। আমার রুগণ স্ত্রীকে নিয়ে আমরা চারজন। মানবতার প্রতি বিশ্বাস করে আমি যদি কোনও ভুল না করে থাকি তা হলে ধরে নেব আপনার উদার অন্তঃকরণ অবশ্যই আমাদের এই দুরবস্থার দ্বারা বিচলিত হবে এবং আপনি অবশ্যই আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবেন।

আপনার মানবতাবোধে আমার বিশ্বাস জানিয়ে এইখানেই চিঠি শেষ করছি আমি।

আপনার একান্ত বিশ্বস্ত
জনদ্ৰেত্তে

পুনশ্চ: আমার কন্যা আপনার সেবাদানে সতত প্রস্তুত মঁসিয়ে।

যে সমস্যার দ্বারা বিব্রত হয়ে পড়েছিল মেরিয়াস এই ঘটনা সেই সমস্যার ওপর আলোকপাত করল। এখন সবকিছু পরিষ্কার হয়ে উঠল তার কাছে। এই চিঠিখানি অন্য চিঠিগুলোর উৎস–সেই এক হাতের লেখা, এক আবেদন, এক কাগজ, এক তামাকের গন্ধ। মোট পাঁচখানি চিঠি একই লোকের লেখা। যে চারটি লোকের জবানিতে চারখানি চিঠি লেখা হয়েছিল সেই চারটি লোকই হল জনদ্ৰেত্তে।

আমরা আগেই বলেছি মেরিয়াস তার বাসার আশপাশের অন্য ভাড়াটেদের প্রতি কোনওদিন কোনও মনোযোগ দেয়নি। তার চিন্তা সব সময় অন্যত্র কেন্দ্রীভূত ছিল। যদিও সে বারান্দায় জনদ্ৰেত্তের পরিবারের মেয়েদের এর আগে দেখেছে তথাপি সে তাদের কখনও ভালো করে দেখেনি। ফলে গত সন্ধ্যায় তাদের রাস্তায় দেখে চিনতে পারেনি। আজও যখন একটি মেয়ে তার ঘরে এসে চিঠিটি দিল তখনও সে তাকে চিনতে পারল না।

এখন সে সবকিছু বুঝতে পারল। সে বুঝল জনদ্ৰেত্তের কাজই হল ধনী লোকদের ঠিকানা জোগাড় করে চিঠি লিখে তার মেয়েদের তাদের কাছে পাঠানো। জীবনের সঙ্গে জুয়াখেলায় সে তার মেয়েদের এইভাবে ব্যবহার করত। গতকাল সন্ধ্যায় তার মেয়ে দুটি চিঠিগুলো নিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সমাজের মধ্যে এই দুটি দুস্থ মেয়ে গত সন্ধ্যায় সব স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত হয়ে নারীসুলভ সব শালীনতা ও দায়িত্ববোধ হারিয়ে দুটি দানবীতে পরিণত হয় যাদের বালিকা বা পূর্ণবয়স্কা মহিলা, ভালো বা মন্দ, নির্দোষ বা দুষ্ট প্রকৃতির কোনওটাই বলা যায় না। তাদের আত্মাগুলো ফুলের মতো ফুটে উঠে একদিনের মধ্যেই পথের উপর ম্লান হয়ে ঝরে পড়ে।

ইতোমধ্যে মেরিয়াস যখন মেয়েটিকে এক বেদনার্ত বিস্ময়ের সঙ্গে দেখছিল, মেয়েটি তখন এক উদ্ধত প্রেতের মতো তার দীনহীন অবস্থার কথা সম্পূর্ণ বিস্তৃত হয়ে ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখছিল। চেয়ারগুলো সরিয়ে মেরিয়াসের পোশাকগুলো আঙুল দিয়ে টিপে, ড্রয়ারের উপর রাখা প্রসাধদ্রব্যগুলোয় চোখ বুলিয়ে কী সব দেখছিল। সে একসময় বলল, আমি দেখছি, আপনার একটা আয়না রয়েছে।

বাজে গলায় সে বাজারের চলতি গানের দু একটা লাইন গুনগুন করে গাইছিল। যেন সে সব ঘরখানার মধ্যে একা আছে। তার গলা মিষ্টি না হওয়ার জন্য সে গান ভয়ঙ্কর শোনাচ্ছিল। কিন্তু তার এই নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যের অন্তরালে একটা গোপন লজ্জা আর অস্বস্তি লুকিয়ে ছিল। তাছাড়া ঔদ্ধত্য একদিক দিয়ে লজ্জার বিকৃত অভিপ্রকাশমাত্র। মেয়েটি যখন হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা-লাগা ভগ্নপক্ষ এক পাখির মতো সমস্ত ঘরখানা জুড়ে সকরুণভাবে উড়ে বেড়াচ্ছিল তখন তাকে দেখতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল মেরিয়াসের। পরিবেশ যদি ভিন্ন হত এবং তার যদি শিক্ষাদীক্ষা কিছু থাকত তা হলে তার সহজ সরল আনন্দোচ্ছলতা সত্যিই বড় মধুর এবং মনোহর হয়ে উঠত।

মেরিয়াস যখন বসে বসে এইসব ভাবছিল আর মেয়েটিকে দেখছিল সে তখন তার কাছে সরে এসে বলল, বই!

তার মেঘাচ্ছন্ন ম্লান চোখে যেন একটা আলোর তরঙ্গ খেলে গেল। সে কিছুটা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করল, আমি পড়তে জানি।

টেবিলের উপর থেকে একটা বই তুলে নিয়ে সে সহজভাবে পড়তে লাগল, ‘ওয়াটারলু’র রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে অবস্থিত শ্যাতো দ্য হুগোমঁত বাহিনীর পাঁচটি দল নিয়ে শত্রুঘাটি আক্রমণ ও দখল করার জন্য জেনারেল বদিনকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

হঠাৎ পড়া থামিয়ে সে বলে উঠল, ওয়াটারলু! আমি জানি, এটা এক যুদ্ধের নাম। আমার বাবা সৈন্যদলে কাজ করতেন এবং ওই যুদ্ধে ছিলেন। আমরা হচ্ছি আসল বোনাপার্টপন্থী। ওয়াটারলুতে ফরাসিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

এবার সে বইটা নামিয়ে কলমটা তুলে নিয়ে বলল, আমি লিখতেও জানি। আপনি দেখবেন?

মেরিয়াস কিছু বলার আগেই সে লিখল, বাইরে তাকিয়ে দেখ, তোমার চারদিকে পুলিশবাহিনী রয়েছে।

এরপর কলমটা হাত থেকে নামিয়ে রেখে বলল, কোনও বানান ভুল নেই। আপনি দেখতে পারেন। আমি আর আমার বোন কিছুদিন স্কুলে পড়াশুনো করেছি। এখনকার মতো আমরা ছিলাম না।

হঠাৎ সে থেমে গিয়ে মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে জোরে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, নরক। তার সে কণ্ঠে তীব্র বেদনার ঊর্ধ্বে এক তীব্র হতাশা ফুলে ফুলে উঠছিল।

মেয়েটি আবার বলতে লাগল, আপনি থিয়েটারে যান মঁসিয়ে মেরিয়াস? আমি যাই। আমার এক ছোট ভাই আছে। তার সঙ্গে দু একজন অভিনেতার আলাপ পরিচয় আছে। সে আমাকে টিকিট এনে দেয়। আমার গ্যালারিতে বসতে মোটেই ভালো লাগে না। সেখানে লোকের বড় ভিড়। তাদের গা থেকে দুর্গন্ধ বার হয়।

মেরিয়াসের দিকে লজ্জামদির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, জানেন মঁসিয়ে মেরিয়াস, আপনি খুব সুন্দর।

কথাটা বলে সে হাসতে লাগল আর মেরিয়াস লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। সে মেরিয়াসের আরও কাছে সরে এসে তার কাঁধের উপর একটা হাত দিয়ে বলল, আপনি কখনও আমার দিকে তাকান না। কিন্তু আমি আপনাকে সিঁড়িতে উঠতে প্রায়ই দেখি। অস্টারলিস অঞ্চলে পিয়ের মেবুফ নামে এক বৃদ্ধের সঙ্গে আপনাকে বেড়াতে দেখেছি। আপনার চুলটা অবিন্যস্ত ও অপরিচ্ছন্ন থাকলে আপনাকে ভালো দেখায়, এটা হয়তো আপনি জানেন!

সে তার গলার স্বরটাকে যথাসম্ভব নরম করার চেষ্টা করলেও তার সব দাঁত না থাকার জন্য সব কথা শোনা যাচ্ছিল না।

এতক্ষণে কথা বলল মেরিয়াস। সে স্বাভাবিক নীরস গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, আমার কাছে তোমার একটা জিনিস আছে ম্যাদময়জেল। তুমি বললে সেটা দিতে পারি।

চারটে চিঠিওয়ালা সেই মোড়কটা মেয়েটির হাতে দিয়ে দিল মেরিয়াস। মেয়েটি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল, এটা আমরা কত খুঁজে বেড়িয়েছি।

মোড়কটা খুলতে খুলতে মেয়েটি বলতে লাগল, হা ভগবান, আমি আর আমার বোন এটা কত খুঁজেছি। আপনি তা হলে এটা বুলভার্দে পেয়েছেন। আমরা যখন ছুটছিলাম তখন আমার বোনের হাত থেকে এটা পড়ে যায়। বাড়িতে গিয়ে দেখি এটা নেই। আমরা মার খাবার ভয়ে বলেছি চিঠিগুলো আমরা দিয়ে দিয়েছি। এখন দেখছি চিঠিগুলো আপনার কাছে রয়েছে। আপনি কী করে জানলেন এগুলো আমাদের চিঠি? অবশ্য হাতের লেখা দেখে। গতকাল সন্ধ্যায় তা হলে আপনার সঙ্গেই আমাদের ধাক্কা লাগে। আমার বোনকে বলেছিলাম, একজন ভদ্রলোক না? আমার বোন বলল, আমারও তাই মনে হয়।

এবার মেয়েটি চিঠিগুলোর থেকে এক পরোপকারী ভদ্রলোককে লেখা চিঠিখানি বার করে বলল, এটি বৃদ্ধকে লেখা যিনি নিয়মিত সমবেত প্রার্থনায় যোগদান করতে যান। এখন সময় হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে তাকে ধরতে হবে। হয়তো তিনি আমাকে যা দেবেন তাতে আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে। তার মানে কী আপনি জানেন? গতকাল ও আগের দিন আমাদের কিছুই খাওয়া হয়নি। গতকালকার প্রাতরাশ এবং দুপুরের খাওয়া সব হয়ে যাবে। তার মানে তিন দিনের মধ্যে আজ প্রথম খাব।

মেয়েটির এই কথায় হুঁশ হল মেরিয়াসের। সে বুঝল মেয়েটি কেন এসেছে তার কাছে। মেয়েটি যখন সমানে কথা বলে যেতে লাগল মেরিয়াস তখন তার পকেটটা হাতড়াতে লাগল।

মেয়েটি বলে যেতে লাগল, এক একদিন রাত্রিতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে আর আমি ফিরি না। গত বছর শীতকালে এ বাড়িতে আসার আগে আমরা একটা পুলের তলায় থাকতাম। শীতে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে থাকতাম। শীতে আমার বোন কাঁদতে থাকত। ঠাণ্ডা জল কত ভয়ঙ্কর। তাই নয় কি? এক একবার ভাবি, জলে ডুবে মরব। কিন্তু ঠাণ্ডা জলের ভয়ে তা পারি না। যখন আমি রাত্রিকালে বুলভার্দ অঞ্চল দিয়ে হেঁটে যাই তখন দু পাশের গাছগুলো সঁচলো বর্শার মতো আমার দিকে যেন তাকিয়ে থাকে। দু পাশের বাড়িগুলোকে নোতার দ্যাম গির্জার মতো উঁচু দেখায়। তখন আকাশের তারাগুলো কুয়াশায় ধূমায়িত পথের আলোর মতো মিটমিট করে। এক একসময় মনে হয় লোকে যেন আমার উপর পাথর ছুঁড়ছে। মনে হয় একটা ঘোড়া যেন আমায় তাড়া করছে। আমি তখন ভয়ে ছুটে পালাতে থাকি। তখন সবকিছু ঘুরতে থাকে আমার চারদিকে। খাবার কিছু না থাকলে সব কিছু বড় অদ্ভুত লাগে।

এই বলে মেরিয়াসের দিকে তাকাল সে। মেরিয়াস ততক্ষণে পকেট হাতড়ে পাঁচ ফ্রাঁ ষোলো স্যু পেল। তখন তার কাছে এই টাকাটা ছিল। সে বুঝল আজকের খাওয়া তার এতেই হয়ে যাবে। কাল যা হয় হবে। সে তার থেকে মাত্র ষোলো স্যু রেখে দিয়ে মেয়েটিকে পাঁচ ঐ দিয়ে দিল।

টাকাটা নিয়ে মেয়েটি বলল, অবশেষে সূর্যের আলো দেখা দিয়েছে। এতেই আমাদের দু দিনের খাওয়া হয়ে যাবে। আপনি সত্যিই মহান। এতেই দু দিনের মতো সবকিছু কেনা হয়ে যাবে।

তার শেমিজটা ঠিক করে নিয়ে মেরিয়াসকে হাত নেড়ে গভীরভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে সে চলে যাবার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে গেল। যাবার পথে ড্রয়ারের উপর একটুকরো বাসি। রুটি দেখতে পেয়ে সে সেটা তুলে নিয়ে খেতে লাগল। এটা শক্ত হলেও চিবুনো যাবে।

এই বলে সে চলে গেল।

.

৫.

মেরিয়াস পাঁচ বছর ধরে অর্থাভাবে দারুণ কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটিকে দেখার আগে আসল দারিদ্র কাকে বলে তা সে জানতে পারেনি। শুধু মানুষের কষ্ট দেখলেই হবে না, নারীদের দুঃখকষ্ট সে স্বচক্ষে দেখল।

মানুষ যখন তীব্র প্রয়োজন আর অভাবের শেষ প্রান্তে চলে যায়, যখন তারা সব দিক দিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে তখন কাজ আর বেতন, খাদ্য আর তাপ, সাহস ও শুভেচ্ছা এইসব কিছুর কোনও অর্থ থাকে না তাদের কাছে। তখন তাদের কাছে দিনের আলো ছায়াচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। সব সময় একটা অন্ধকার গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে তাদের অন্তরকে। সেই অন্ধকারের মাঝে তারা সব বোধ হারিয়ে ফেলে। তখন তারা নারী ও শিশুদের জোর করে অপমানের পথে ঠেলে দেয়। তখন তারা মরিয়া হয়ে যে কোনও পাপ ও অপরাধের আশ্রয় গ্রহণ করে।

স্বাস্থ্য, যৌবন, সম্মান, সতীত্ব, অন্তরের সততা, কুমারীত্ব প্রভৃতি যেসব গুণ আত্মার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে সেসব গুণকে তারা অস্তিত্ব রক্ষার এক কৃষ্ণকুটিল সংগ্রামে নিয়োজিত করে। যে কোনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে তারা। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, সব সম্পর্ক, সব পাপ-পুণ্য ধাতুর সঙ্গে মেশানো খাদের মতো মিলে মিশে এক হয়ে যায়। তারা তখন সকলে মিলে জড়োসড়ো হয়ে এক জায়গায় থাকে, একে অন্যের পানে ম্লান সকরুণ দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের দেহগুলো কত স্নান কত হিমশীতল হয়ে ওঠে! সেইসব হতভাগ্যদের দেখে মনে হয় তারা যেন পৃথিবী ও সূর্য থেকে বহু দূরের এক গ্রহান্তরের জীব।

মেরিয়াসের মনে হল যে মেয়েটি তার কাছে একটু আগে এসেছিল সে যেন অন্ধকার জগতের এক দূত। সেই ভয়ঙ্কর জগতের একটা দিক উদ্ঘাটিত করে গেল তার কাছে। এতদিন সে প্রেমের ব্যাপারে নিজেকে জড়িয়ে রেখে তার প্রতিবেশীদের পানে একবারও তাকায়নি। এজন্য তিরস্কার করতে লাগল নিজেকে। এর আগে সে তাদের বাড়িভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে ঠিক, কিন্তু সেটা এমন কিছু নয়, আবেগের বশে সে এটা করে ফেলেছে যান্ত্রিকভাবে, এটা যে কেউ করতে পারবে। তাদের জন্য তার আরও কিছু ভালো করা উচিত ছিল। তার পাশের ঘরেই তারা থাকে, মাঝখানে শুধু একটা ক্ষীণ আবরণ। সেই আবরণের অন্তরালে কয়েকটি অসহায় আত্মা সমগ্র জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকারে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করে চলেছে, তাদের সে সংগ্রামের কিছু কিছু শব্দ সে শুনেছে। তবু তাদের দিকে কোনও মনোযোগ দেয়নি। প্রতিদিন দেয়ালের ওপার থেকে তাদের যাওয়া-আসার পদশব্দ শুনেছে, তাদের কথাবার্তার আওয়াজ তার কানে এসেছে, কিন্তু সে কথা শুনতে চায়নি। তাদের কথাবার্তার সঙ্গে একটা চাপা আর্তনাদ প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু সে তাতে কান দেয়নি। এইসব মানুষগুলো তারই ধর্মভ্রাতা, তারা যখন এক নিবিড় যন্ত্রণায় অসহায়ভাবে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছিল, তার সব চিন্তা তখন প্রেমের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। তার মনে হল সে তাদের দুঃখ আর দুর্ভাগ্যকে কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও। তার পরিবর্তে এখানে অন্য কোনও সহৃদয় প্রতিবেশী থাকলে সে তার স্বাভাবিক পরোপকার প্রবৃত্তির বশে আত্মচিন্তায় মগ্ন না হয়ে তাদের দুঃখকষ্টের দিকে নজর দিত এবং তাদের দুরবস্থার লক্ষণ দেখে এতদিনে হয়তো তার একটা প্রতিকার করে ফেলত। অবশ্য তাদের দেখে অসৎ এবং দুর্নীতিপরায়ণ মনে হয়, কিন্তু যারা পতনের শেষ সীমায় নেমে যায় তাদের কাছে নীতি-দুর্নীতির কোনো অর্থ থাকে কি? দুর্ভাগ্য আর দুর্নীতি এক হয়ে মিশে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র জগতে পরিণত হয়। যারা সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে নেমে গেছে, যারা পথের মানুষ তারা হয়তো এদের থেকে কম দুঃখী। এর জন্য দায়ী কে?

এইসব কথা যখন ভাবছিল মেরিয়াস, যখন নিজেকে এইভাবে বোঝাচ্ছিল তখন যে দেয়ালটা জনদেত্তের ঘর থেকে তার ঘরটাকে পৃথক করে রেখেছিল সেই দেয়ালের দিকে তাকাল, যেন সে তার সহানুভূতিশীল দৃষ্টির উত্তাপ আর নিবিড়তা দিয়ে তাদের দুঃখে সান্তনা দেবার চেষ্টা করতে লাগল। ক’টা খুঁটির সঙ্গে ইট দিয়ে গাঁথা দেয়ালটা পাতলা এবং ওপাশের সব গতিবিধি বোঝা যায় এবং সব কথাবার্তা স্পষ্ট শোনা যায়। মেরিয়াস স্বপ্নালু প্রকৃতির মানুষ বলেই এতদিন সে তা শোনেনি।

সহসা মেরিয়াস দাঁড়িয়ে দেখল মাঝখানের দেয়ালটার উপর দিকে ছাদের কাছে তিনকোনা একটা ফুটো রয়েছে। সেখানটায় চুন-বালি খসে গেছে। ড্রয়ারের উপরে উঠে দাঁড়ালেই সেই ফুটো দিয়ে ওপাশের ঘরটার সব কিছু দেখা যাবে। কৌতূহল যেন করুণারই অংশবিশেষ। কারও দুঃখের প্রতিকার করতে হলে সে দুঃখ নিজের চোখে দেখা উচিত। ফুটোটা যেন জুডাসের জানালা। মেরিয়াস মনে মনে বলল, ওরা কী ধরনের লোক এবং কী ধরনের দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, তা দেখি একবার।

সে ড্রয়ারের উপর দাঁড়িয়ে ফুটোর কাছে চোখ রেখে ওপাশের ঘরটার দিকে তাকাল।

.

৬.

অরণ্যে যেমন হিংস্র প্রাণীদের কতকগুলি গোপন জায়গা বা গুহা থাকে, নগরের তেমনি কিছু হিংস্র প্রকৃতির লোকদের থাকার জন্য কতকগুলি গোপন আস্তানা থাকে। অরণ্যের গুহাগুলো মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে, কিন্তু নগরের ওই সব আস্তানাগুলো যত সব নোংরা পরিবেশে অবস্থিত এবং দেখতে সেগুলো খুবই কুৎসিত। শহরের নোংরা বস্তির থেকে অরণ্যগুহা অনেক ভালো।

মেরিয়াস তখন ওই বস্তিরই কথা ভাবছিল।

মেরিয়াস ছিল অবস্থার দিক থেকে গরিব এবং তার ঘরখানাও ভালো পরিবেশের মধ্যে ছিল না। কিন্তু তার দারিদ্র্যের মধ্যে যেমন একটা উদারতা আর সততা ছিল, তেমনি তার ঘরখানার পরিবেশ-প্রতিবেশ নোংরা হলেও সে ঘরখানা মোটের উপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকত।

মেরিয়াস জনদ্ৰেত্তে’র যে বাসা-ঘরটার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে ঘরটা ছিল নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, দুর্গন্ধময় এবং সব সময় গোলমালের শব্দে ভরা। সে ঘরে আসবাব বলতে ছিল একটা অশক্ত নড়বড়ে চেয়ার আর একটা টেবিল, কয়েকটা ফাটা ডিশ, দরজার উল্টো দিকে দুটো বিছানা। একটা মাত্র ছোট জানালার কাঁচের অস্বচ্ছ সার্সি দিয়ে যে আলো আসে তা এত অস্পষ্ট যে সে আলোয় কোনও মানুষের মুখটাকে ভূতের মতো দেখায়। চুনবালিখসা দেয়ালগুলো আহত ও ক্ষতবিক্ষত মানুষের মুখের মতো দেখাচ্ছে। ক্ষত জায়গাগুলো স্যাঁতস্যাঁত করছে। তার ওপর আবার কয়লা দিয়ে কে কতকগুলি অশ্লীল ছবি এঁকেছে। দেয়ালগুলো কুষ্ঠরোগীর মতো ক্ষতবিক্ষত দেখাচ্ছিল।

মেরিয়াসের ঘরের মেঝেটায় টালিগুলোর রঙ চটে গিয়েছিল। কিন্তু জনদ্ৰেত্তেদের ঘরটার কোনও টালিই ছিল না। উপরে টালি বা সিমেন্টের প্রলেপ না থাকায় মেঝেটায় এবড়ো-খেবড়ো ইটের কুচো দেখা যাচ্ছিল আর পায়ের ধুলোয় কালো হয়ে গিয়েছিল সেটা। ঘরখানায় কোনওদিন ঝাট দেওয়া হয় না। তার ওপর এখানে-সেখানে ছেঁড়া অব্যবহৃত কিছু পোশাক পড়ে ছিল। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালার একটা জায়গা ছিল এবং তার জন্য বছরে চল্লিশ ট্র্য বাড়তি দিতে হত। চুল্লিটাতে অল্প একটু আগুনে কিছু কাঠ দেওয়া ছিল এবং তার থেকে ধোঁয়া বার হচ্ছিল। চুল্লিটার আশেপাশে একটা স্টোভ, একটা ঝোল রান্নার প্যান, কিছু কাঠ, একটা পাখির খাঁচা আর কিছু ছাই ছিল।

ঘরখানার আকার বড় হওয়ার জন্য আরও খারাপ লাগছিল। তার অন্ধকার কোণগুলোতে বড় বড় মাকড়সা আর আরশোলা বাসা বেঁধেছিল। আগুনের চুল্লিটার দু পাশে দুটো বিছানা পাতা ছিল। মেরিয়াস দেখতে পেল একদিকের দেয়ালে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা রঙিন ছবি ছিল। তার তলায় ‘স্বপ্ন’ এই কথাটা লেখা ছিল। ছবিটাকে একটি ঘুমন্ত নারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যার কোলে একটি শিশু ঘুমোচ্ছে। তাদের মাথার উপরে একটা ঈগল তার ঠোঁটে করে একটা মুকুট নিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই নারীটি তার ছেলের মাথা থেকে মুকুটটা সরিয়ে দিচ্ছিল। ছবিটার পটভূমিতে নেপোলিয়নের এক উজ্জ্বল মূর্তি শোভা পাচ্ছিল। নেপোলিয়নের তলায় মেরিঙ্গো, অস্টারলিৎস, আয়েনা, ওয়াগ্রাম আর এলট এই কথাগুলো লেখা ছিল।

টেবিলের পাশের চেয়ারটাতে প্রায় ষাট বছরের একটি লোক বসেছিল। তার চেহারাটা ছিল বেঁটেখাটো আর রোগা। তার চোখ-মুখের ওপর অশান্ত ও এক বিষাক্ত চাতুর্যের ভাব ফুটে উঠেছিল। লাভেতারের মতো কোনও শরীরতত্ত্ববিদ তার চেহারাটা দেখলে দেখত এক শকুনি আর এক অ্যাটর্নির মিশ্রণ ঘটেছে তার মধ্যে। আইনগত ছলনার দিক থেকে তার শকুনির মতো শিকারি পাখিকেও হার মানাবার ক্ষমতা আছে। তবে তার পরনে ছিল কাদামাখা একটা পায়জামা আর গায়ে ছিল একটা মেয়েদের শেমিজ। তার মুখে ছিল লম্বা পাকা দাড়ি। তার পায়ের ছেঁড়া জুতোর ফাঁক দিয়ে বুড়ো আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছিল। টেবিলের উপর তার সামনে কিছু কাগজ, একটা কলম আর কালি ছিল। সে তখন পাইপ খাচ্ছিল (খাবার না জুটলেও তামাক ঠিক জোটে) এবং কী লিখছিল। নিশ্চয় সে ধরনের কোনও আবেদনপত্র। টেবিলের উপর একটা লাইব্রেরির বই নামানো ছিল। বইটা কোনও জনপ্রিয় উপন্যাস। দুক্রে দুমিউলের লেখা।

লোকটি লিখতে লিখতে আপন মনে কথা বলে যাচ্ছিল। সে বলছিল, সাম্য! তুমি মরে গেলেও সাম্য বলে কোনও বস্তুর দেখা পাবে না। যাদের টাকা আছে তারাই সব সময় সমাজের উপরতলায় থাকে। গরিবদের কবর দেখতে যেতে হলে হাঁটুভোর কাদা ভেঙে যেতে হবে। আমার মনে হয় আমি সবাইকে খেয়ে ফেলি।

একজন মহিলা আগুনের কাছে খালি পায়ে ঘোরাঘুরি করছিল। তার বয়স চল্লিশ বা একশোও হতে পারে। তার গায়েও একটা শেমিজ আর ছেঁড়া তালি লাগানো স্কার্ট ছিল, তার চেহারাটা তার স্বামীর তুলঁনায় খুব লম্বা ছিল। সে তার লম্বা লম্বা আঙুলওয়ালা ময়লা হাত দিয়ে তার মাথার লাল চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছিল। তার পাশে মেঝের উপর টেবিলের উপর রাখা বইটার মতো একটা বই খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল।

একটা বিছানায় একটা শীর্ণ মেয়ে পা মেলে বসে ছিল। যে মেয়েটি মেরিয়াসের ঘরে এসেছিল ওই শিশুটি হয়তো তারই ছোট বোন। তাকে প্রথমে দেখেই দশ-বারো বছরের মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার বয়স খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে পনেরো’র কম হবে না। ওই মেয়েটিও গতকাল সন্ধ্যায় পথে তার দিদির সঙ্গে ছিল এবং সে বলেছিল, আমি মোটেই ছুটতে পারিনি। সে এমনই এক মেয়ে যে দারিদ্র্য আর অভাবের মধ্যে লালিত হতে হতে দেহের দিক থেকে অপরিণত এবং অপুষ্ট থেকে গেলেও মনের দিক থেকে পরিণত হয়ে ওঠে তাড়াতাড়ি। তারা বাল্য, কৈশোর বা যৌবনের মধ্যে কোনও পার্থক্যই বুঝতে পারে না। তাদের পনেরো বারো বছরের মতো দেখায়। ষোলো বছর বয়সে তাদের কুড়ি বছরের বলে মনে হয়। জীবনটাকে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলার জন্য তারা যেন উড়ে চলেছে।

মেরিয়াস ঘরটার মধ্যে এমন কোনও বস্তু দেখতে পেল না যার থেকে তারা কোনও কোনও কাজ করছে। শুধু কতকগুলি ধাতববস্তু পড়ে রয়েছে মেঝের উপর। হতাশা থেকে যে অকর্মণ্যতা আর এক ধরনের ঔদাসীন্য ও নিস্পৃহতার উদ্ভব হয় এবং যা কালক্রমে মৃত্যুযন্ত্রণায় পরিণত হয় সেই মৃত্যুযন্ত্রণা বিরাজ করছিল যেন সারা ঘরখানায়। মেরিয়াসের মনে হল ঘরখানা কবরখানার থেকেও ভয়ঙ্কর, কারণ সে ঘরে যেন একই সঙ্গে কয়েকটি জীবন এবং জীবন্ত মৃত্যু বাস করছে অর্থাৎ সেখানে জীবন্ত অবস্থায় বাস করছে কয়েকটি মানুষ। ঘরখানা কোনও সমাধিস্তম্ভ না হলেও সেটা যেন জীবনের প্রান্তঃসীমা এবং মৃত্যুপুরীর প্রবেশপথ। ধনীরা যেমন তাদের প্রাসাদের প্রবেশপথে অনেক ঐশ্বর্যের উপকরণ সাজিয়ে রাখে, তেমনি মৃত্যু এখানে তার অনেক বিভীষিকা ছড়িয়ে রেখেছে।

লোকটি তখন চুপ করে ছিল। মহিলাটি একটিও কথা বলেনি। মেয়েরাও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে ছিল। সমস্ত ঘরখানা স্তব্ধ হয়ে ছিল। সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কাগজের উপর লেখার শব্দ ক্ষীণভাবে ঝাঁকিয়ে উঠছিল। হঠাৎ লোকটি লিখতে লিখতেই বলে উঠল, নোংরা, নোংরা, সবকিছু নোংরা।

মহিলাটি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

সে বলল, বিচলিত হয়ো না প্রিয়তম। তোমার জবানিতেই এই চিঠিগুলো লিখতে হবে।

তীব্র শীতে যেমন শীতার্ত মানুষরা একসঙ্গে জড়োসড়ো হয়ে থাকে তেমনি নিবিড় দারিদ্রের মধ্যেও তারা পরস্পরে জড়াজড়ি করে থাকে। কিন্তু দেহগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করে খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের অন্তরগুলো দূরে চলে যায়। দেখে মনে হয় এই মহিলাটি একদিন তার অন্তরের সব ভালোবাসা উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে তার স্বামীর ওপর। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের এই দুরবস্থা আর ঘৃণ্য পরিবেশের মধ্যে তার প্রেমের সব আগুন নিভে গেছে এবং শুধু ছাই পড়ে আছে তার জায়গায়। তবু সাধারণত যা হয়ে থাকে পুরনো প্রেমের বহিরঙ্গের আকাশটা তখনও অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছিল। তাই সে তার স্বামীকে প্রিয়তম বলে সম্বোধন করল। কিন্তু কথাটা শুধু তার মুখের কথা, অন্তর থেকে উৎসারিত নয়।

লোকটি অর্থাৎ জনদ্ৰেত্তে লিখে চলল।

.

৭.

ভারাক্রান্ত হৃদয়ে টেবিল থেকে নেমে আসছিল মেরিয়াস। হঠাৎ একটা শব্দে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। দেখল হঠাৎ ঘরের দরজা ঠেলে ব্যস্ত হয়ে জনদ্ৰেত্তের বড় মেয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকেই তার পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, উনি আসছেন।

তার বাবা-মা দু জনেই তার মুখপানে তাকিয়ে বলে উঠল, কে আসছেন?

মেয়েটি বলল, ওই সেই বৃদ্ধ পরোপকারী ভদ্রলোক যিনি সেন্ট জ্যাক গির্জায় প্রার্থনা করতে যান।

উনি কি সত্যিই আসছেন?

উনি আমার পিছু পিছু আসছেন।

তুই ঠিক বলছিস?

হ্যাঁ অবশ্যই ঠিক বলছি। উনি একটা গাড়িতে করে আসছেন।

জনদ্ৰেত্তে উঠে দাঁড়াল। বলল, উনি যদি গাড়িতে করে আসেন তা হলে তুমি কী করে তার আগেই এসে পড়লে? ওঁকে ঠিকভাবে ঠিকানাটা দেওয়া হয়েছে তো? বলে দিয়েছ তত বারান্দার শেষ প্রান্তে শেষের ঘরটা? উনি যেন ভুল না করেন। তুমি কি ওঁকে চার্চেই পেয়ে গিয়েছিলে? আমার চিঠিটা উনি পড়েছিলেন? উনি কী বললেন?

আমি ওঁকে চার্চের সেই নির্দিষ্ট জায়গাতে পাই। আমি তাকে তোমার চিঠিটা দিই এবং তিনি চিঠিটা পড়ে বললেন, তুমি কোথায় থাক বাছা?’ আমি বললাম, আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যাব মঁসিয়ে। উনি তখন বললেন, তাঁর মেয়ে কিছু কেনাকাটা করবে। তাকে আমাদের ঠিকানাটা দিলে তিনি একটা গাড়ি ভাড়া করে যথাসময়ে আসবেন। আমি ঠিকানাটা বললে তিনি কিছুটা বিস্মিত হলেন, তার পর বললেন, তিনি ঠিক আসবেন। আমি দেখলাম তিনি আর তাঁর মেয়ে চার্চ থেকে বেরিয়ে একটা গাড়িতে উঠলেন। আমি তাকে বলেছি বারান্দার শেষ প্রান্তের ঘরটা।

তার মানে এই নয় যে তিনি আসছেন।

আমি তাঁদের গাড়িটাকে র‍্যু দু পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরে দেখেছি। দেখেই আমি ছুটতে শুরু করেছি।

কী করে তুমি জানলে সেই গাড়িটা তাঁদেরই?

আমি তাঁদের গাড়ির নম্বরটা দেখে নিয়েছিলাম। নম্বরটা হল ৪৪০।

ভালো, তুমি দেখছি বুদ্ধিমতী মেয়ে।

মেয়েটি তার বাবার দিকে উদ্ধতভাবে তাকিয়ে তার পা-টা একবার দেখে নিয়ে বলল, আমি বুদ্ধিমতী হতে পারি, কিন্তু এই ছেঁড়া নোংরা জুতোটা পরে আর কোথাও যাব না। প্রতিটি পদক্ষেপে ছেঁড়া জুতোটা থেকে শব্দ হয়। এ জুতো পরার থেকে আমি খালি পায়ে যাব।

তার বাবা গলার স্বরটা নরম করে বলল। আমি তোমাকে এর জন্য কোনও দোষ দিচ্ছি না বাছা। কিন্তু জুতো পরে না গেলে চার্চে ঢুকতে দেবে না। গরিবদেরও জুতো পরতে হবেই। খালি পায়ে কেউ ঈশ্বরদর্শনে যেতে পারে না। কিন্তু উনি যে আসছেন এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?

উনি আমার পেছনেই আসছেন।

জনদেত্তে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার সারা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে বলল, কি আমার স্ত্রী, শুনতে পাচ্ছ? পরোপকারী ভদ্রলোক আসছেন। আগুন নিবিয়ে দাও।

তার স্ত্রী তার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল। এক পা-ও নড়ল না। জনদ্ৰেত্তে তাক থেকে জল নিয়ে চুল্লির জ্বলন্ত আগুনে জল ঢেলে দিল। তার পর তার বড় মেয়েকে বলল, ওই চেয়ারটাকে ছিঁড়ে ফেল।

তার মেয়েটি কথাটা বুঝতে পারল না। সে তখন নিজেই আলগা সিটটার উপর লাথি মেরে সেটা ভেঙে দিল।

এরপর সে তার বড় মেয়েকে বলল, বাইরে কি খুব ঠাণ্ডা?

খুব ঠাণ্ডা, বরফ পড়ছে।

এরপর জনদ্ৰেত্তে তার ছোট মেয়েকে বলল, একটু নড়াচড়া করো কুঁড়ে মেয়ে কোথাকার! তুমি কিছু করতে পার না? জানালার কাছে গিয়ে একটা কাঁচের সার্সি ভেঙে ফেল।

মেয়েটি বিছানায় বসে ছিল। সে শীতে কাঁপতে কাঁপতে জানালার ধারে গেল। বলল, জানালার কাঁচ ভাঙব?

আমি কী বললাম শুনতে পেলে না?

মেয়েটি বিছানার উপর উঠে দাঁড়াল। এক সন্ত্রস্ত আনুগত্যে সে তার হাতের একটা ঘুষি মেরে একটা কাঁচ ভেঙে দিল। কাঁচটা মেঝের উপর পড়ে গেল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, ভালো। এই বলে সে যুদ্ধক্ষেত্র পরিদর্শন করারত এক সেনাপতির মতো সমস্ত ঘরখানা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তার স্ত্রী এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। সে এবার বলল, এ সব কী হচ্ছে প্রিয়তম?

তার যেন কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, যাও, বিছানায় শুয়ে পড়গে।

তার এই হুকুমের ভঙ্গিমা আর কণ্ঠস্বর শুনে প্রতিবাদ করার সাহস পেল না তার স্ত্রী। সে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এমন সময় কে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, কে কাঁদছে?

ছোট মেয়েটি তার মার কাছে বিছানার এক কোণে শুয়ে তার রক্তাক্ত হাতটা দেখাল। সে কাঁদছিল।

তার মা তার বাবাকে বলল, এই দেখ, ও জানালার কাঁচ ভাঙতে গিয়ে হাতটা কেটে ফেলেছে।

তার বাবা বলল, ভালো। আমি আগেই ভেবেছিলাম ওর হাত কাটবে।

ভালো–তার মানে?

জনদ্ৰেত্তে বলল, চুপ কর। আমি সাংবাদিকদের স্বাধীনতা উচ্ছেদ করেছি।

এই বলে যে শেমিজটা সে পরে ছিল তার থেকে কিছুটা ছিঁড়ে তাই দিয়ে মেয়েটির কাটা হাতটা বেঁধে দিল। তার পর বলল, খুব ভালো হল, আমার জামাটাও ছেঁড়া রইল।

কাঁচভাঙা সার্সিটা দিয়ে বাইরের হিমেল বাতাস আর একরাশ কুয়াশা এসে ঘরে ঢুকল। ওরা তার ভেতর দিয়ে দেখতে পেল বাইরে তখন বরফ পড়ছে।

ক্যান্ডলমাস উৎসবের আগে যে দারুণ ঠাণ্ডা পড়ে সেই ঠাণ্ডা এখন তাদের ঘরখানায় এসে তার বুক চেপে বসল। জনদ্ৰেত্তে ঘরখানার চারদিকে তাকিয়ে দেখল প্রস্তুতির ব্যাপারে কোনও কিছু বাদ গেছে কি না। এবার সে কিছু শুকনো ছাই নিয়ে ভিজে কাঠগুলোর উপর ছড়িয়ে দিল। এরপর সে নিবে যাওয়া চুল্লির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এবার আমরা সেই পরোপকারী ভদ্রলোকের জন্য প্রস্তুত।

.

৮.

বড় মেয়েটি তার একটা হাত তার বাবার দিকে বাড়িয়ে বলল, দেখ আমার গা-টা কীরকম হিম হয়ে গেছে।

তার বাবা বলল, যত সব বাজে কথা। আমার গা-টা আরও হিম।

তার স্ত্রী তখন বলল, সব দিক দিয়ে সবার থেকে তোমার অবস্থাটা খারাপ।

জনদ্ৰেত্তে ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর।

এই বলে এমনভাবে সে তাকাল যাতে তার স্ত্রী একেবারে চুপ করে গেল।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। বড় মেয়েটি তার পোশাক থেকে ধুলো-কাদাগুলো ঝাড়তে লাগল। ছোট মেয়েটি কেঁদে যেতে লাগল। তার মা তার মাথাটা ধরে তাকে চুম্বন করে বলল, কেঁদো না বাছা, তোমার বাবা রাগ করবে।

কিন্তু তার বাবা বলল, না, মোটেই রাগব না আমি। যত পার কেঁদে যাও।

এরপর সে তার বড় মেয়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, সব ঠিক আছে। কিন্তু মনে কর যদি উনি না আসেন। এখনও উনি এলেন না। অথচ আমি ঘরের আগুন নিবিয়ে। দিয়েছি, জানালার কাঁচ ভেঙেছি, চেয়ার ফুটো করেছি, আমার জামা ছিঁড়েছি।

মা বলল, তাছাড়া তোমার মেয়ের হাত কেটেছে।

জনদ্ৰেত্তে বলে যেতে লাগল, ঘরটা বরফ ঘরের মতো ঠাণ্ডা। উনি যদি একেবারেই আসেন। আমরা অপেক্ষা করে থাকলে তার কিছু যায়-আসে না। তিনি কিছু মনে করেন না, ভাবেন, ওরা অপেক্ষা করারই যোগ্য। হে ঈশ্বর, আমি ওদের কত ঘৃণা করি। ওই সব ধনী, তথাকথিত দানশীল ধনী যারা প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করে আর গির্জায় প্রার্থনা করতে যায়। তাদের গলাটা টিপে যদি মারতে পারতাম। তারা মনে মনে ভাবে তারা আমাদের প্রভু, সর্বময় কর্তা, তারা আমাদের দুঃখে সহানুভূতি দেখাতে এসে কিছু ছাড়া পোশাক আর কিছু খাবারের টুকরো দিয়ে যায়। কিন্তু কোথা থেকে কী করে ধনী হয় তারা? যত সব চোরের দল। চোর না হলে তারা ধনী হতে পারত না। আমার ইচ্ছা হয় আমি সমাজের সব কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে সেই ভস্মস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে থাকি। বোধ হয় একদিন সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে এবং সমাজের সব মানুষ সমান হয়ে যাবে।… কিন্তু তোমার পরোপকারী ভদ্রলোক কী করছেন? উনি কি আসছেন? বোধ হয় বৃদ্ধ অকর্মণ্য লোকটা আমাদের ঠিকানাটাই ভুলে গেছে।

এমন সময় দরজায় মৃদু করাঘাত শোনা গেল। জনদ্ৰেত্তে ছুটে খুলতে গেল দরজাটা। সে যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিল। সে বিনয়ের সঙ্গে বলল, হে আমার প্রিয় মহাশয়, আমার মহান উপকারী, দয়া করে আসুন।

একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং একজন সুন্দরী তরুণী দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। মেরিয়াস সেই ফুটো দিয়ে তা দেখতে দেখতে বিস্মিত হয়ে গেল। সে বিস্ময় বর্ণনাতীত।

সেই তরুণীই তার সেই প্রেমাস্পদ। যে জীবনে একবার ভালোবেসেছে সে প্রেমাস্পদ এই কথাটার কত বড় শক্তি তা জানে। যে উজ্জ্বল কুয়াশা সেই মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সে কুয়াশার ভেতর দিয়ে মেয়েটির চেহারাটাকে স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছিল না তার যে চোখ, তার কপাল আর তার সুন্দর মুখ তার জীবনকে ছয় মাস ধরে আলোকিত করে সহসা তাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না সে। আজ এই ঘৃণ্য পরিবেশে আবার সে আবির্ভূত হয়েছে।

মেরিয়াসের সারা শরীর কাঁপতে লাগল। তার হৃৎপিণ্ডটা এত জোরে স্পন্দিত হতে লাগল যে তার চোখের দৃষ্টি ব্যাহত এবং তার চোখে জল আসার উপক্রম হল। এতদিন ধরে যাকে খুঁজে চলেছিল তাকে আবার সে দেখতে পেল। তার মনে হল তার হারানো আত্মাকে আবার সে খুঁজে পেয়েছে।

তার মুখখানাকে শুধু ম্লান দেখাচ্ছিল। এ ছাড়া তার চেহারাটা ঠিক ছিল। তার মাথায় ছিল নীলচে রঙের মখমলের একটা ওড়না। তার গায়ে ছিল কালো সাটিনের পোশাক যার নিচে তার হাঁটু দুটো দেখা যাচ্ছিল। এবারও তার একমাত্র সঙ্গী ছিল মঁসিয়ে লেবলাঁ। সে ঘরের ভেতর ঢুকে টেবিলের উপর একটা বড় প্যাকেট নামিয়ে রাখল।

জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী মেয়েটির ওড়না, পোশাক আর সুন্দর মুখপানে অপলক দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

.

৯.

বাইরে থেকে আগত কোনও আগন্তুকের কাছে ঘরখানা বেশি অন্ধকার দেখায়। মনে হয় তারা যেন কোনও গুহায় প্রবেশ করেছে। যারা বাইরে থেকে ঘরের মধ্যে অনিশ্চয়তার সঙ্গে পা রেখে তারা তাদের চারপাশের ঘরখানার মধ্যে কোথায় কী আছে, তা দেখতে পায় না। অথচ ঘরের বাসিন্দারা তাদের স্পষ্ট দেখতে পায়, কারণ চোখের দৃষ্টি এ অন্ধকারে অভ্যস্ত।

মঁসিয়ে লেবলাঁ তার স্বভাবসুলভ বিষণ্ণ ও করুণাভরা দৃষ্টিতে জনদ্ৰেত্তে’র পানে তাকিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি এই প্যাকেটটার মধ্যে কিছু গরম মোজা, কম্বল আর এই ধরনের কিছু শীতবস্ত্র পাবেন।

জনদ্ৰেত্তে নত হয়ে বলল, হে উদারহৃদয় মহান, আপনার দয়া আমাকে অভিভূত করে দিচ্ছে।

কিন্তু আগন্তুকরা যখন ঘরের পরিবেশটাকে খুঁটিয়ে দেখায় ব্যস্ত ছিল জনদ্ৰেত্তে তখন আড়ালে তার বড় মেয়েকে বলল, আমি তোমাকে কী বলেছিলাম? শুধু এক পুঁটলি পোশাক, কোনও টাকা-পয়সা নেই। ওরা সবাই এক ধরনের। যাই হোক, যে চিঠিটি তুমি ওঁকে দিয়েছিলে তাতে কোনও নামের স্বাক্ষর ছিল?

ফাবান্ত।

তা হলে নাট্যাভিনেতা।

কথাটা সে ঠিক সময়েই জিজ্ঞাসা করেছিল তার মেয়েকে। কারণ ঠিক এই সময়েই মঁসিয়ে লেবলাঁ তার দিকে ঘুরে বলল, আপনি সত্যিই করুণার পাত্র মঁসিয়ে–

এই বলে সে থামল।

জনদ্ৰেত্তে তার অসম্পূর্ণ কথাটা বলে দিল–ফাবান্ত।

হ্যাঁ, মঁসিয়ে ফাবান্ত।

একজন অভিনেতা মঁসিয়ে, যে একদিন বেশ কিছু সাফল্য অর্জন করেছিল।

জনদ্ৰেত্তে যখন দেখল নিজেকে আগন্তুকের সামনে প্রতিষ্ঠিত করার সময় এসেছে তখন সে একই সঙ্গে একজন সফল অভিনেতা আর পথের ভিখারির ভাব নিয়ে কথা বলতে লাগল। সে বলল, স্বয়ং ভালমার শিষ্য মঁসিয়ে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছিল আমার ওপর। কিন্তু আজ আমি দুর্ভাগ্যের দ্বারা প্রপীড়িত। আজ আমার খাদ্য নেই, ঘরে তাপ নেই। আমার হতভাগ্য সন্তানরা শীতে কাঁপছে। ঘরে একটা চেয়ারও নেই। জানালার কাঁচ ভাঙা। আমার স্ত্রী শয্যাগত।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আহা বেচারি মহিলা।

জনদ্ৰেত্তে বলল, আর আমার ছোট মেয়ে আহত।

ছোট মেয়েটি আগন্তুকদের দেখে এতদূর অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে তার কান্না থেমে গিয়েছিল।

জনদ্ৰেত্তে চাপা গলায় বলল, কী, দেখাতে পারছ না?

এই বলে সে তার হাতের ক্ষতটার উপর চাপ দিতেই সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল এবং তাতে মেরিয়াস একদিন যার নাম দিয়েছিল আরসুলা সেই মেয়েটি আবেগের সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, আহা বেচারি।

জনদ্ৰেত্তে বলল, আপনি স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছেন তার হাত থেকে রক্ত বার হচ্ছে। ও যে কারখানায় ঘন্টায় ছয় স্যু বেতনে কাজ করে সেখানে এক অ্যাকসিডেন্টে ওর হাতটা কেটে যায়। হয়তো ওর হাতটা বাদ দিতে হবে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, তাই নাকি?

হাতটা কেটে বাদ দিতে হবে এই কথাটা সত্যি ভেবে ছোট মেয়েটি আরও জোরে কাঁদতে লাগল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, আমার তাই মনে হয়।

মঁসিয়ে লেবলাঁর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে জনদ্ৰেত্তে কী দেখছিল। সে যেন কিছু একটা স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। আগন্তুকেরা যখন তার ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল তখন সেই সুযোগে জনদ্ৰেত্তে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে চুপি চুপি বলল, লোকটিকে ভালো করে দেখ তো।

এবার সে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ঘুরে তার দুঃখের কাহিনী আবার শোনাতে লাগল। সে বলল, দেখুন মঁসিয়ে, এই দারুণ শীতে আমার একমাত্র পোশাক হল আমার স্ত্রীর এই শেমিজটা। একটা কোটের অভাবে আমি বাইরে যেতে পারি না। একটা কোট থাকলে আমি একবার ম্যাদময়জেল মার্সের কাছে যেতাম। সে আমার পুরনো বন্ধু। সে কি এখনও র‍্যু দ্য লা দে দ্যাম অঞ্চলে বাস করছে? আমরা একসঙ্গে অভিনয় করেছিলাম এবং তার সাফল্যে আমার অবদান ছিল। সেলিমেনে আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। মঁসিয়ে এলমিরা তার বেনিসারিসসকে ঠিক সাহায্য করবে। কিন্তু আমার এখন পরার কিছু নেই, ঘরে একটা স্যুও নেই। আমার স্ত্রী রুগ্ণ এবং আমার মেয়ে আহত। তবু একটা পয়সা নেই। আমার স্ত্রী স্নায়ুদৌর্বল্যে ভুগছে। তার এবং মেয়ের এখন চিকিৎসা দরকার। কিন্তু কে ডাক্তার এবং ওষুধের টাকার দেবে? আজ আমি একটা পেনির জন্য নতজানু হতে পারি। জানেন মঁসিয়ে, আমি আমার মেয়েদের ধর্ম এবং নীতিশিক্ষা দিয়েছি বলে তাদের মঞ্চে পাঠাইনি। তারা খুব কড়া শাসনের মধ্যে মানুষ হয়েছে। কতবার আমি তাদের নীতি এবং গুণাবলি সম্বন্ধে কত বুঝিয়েছি। আপনি তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। মানুষের সঙ্গে কিভাবে ভদ্র ব্যবহার করতে হয় তা তারা জানে। তারা সেইসব হতভাগ্যদের মতো নয় যারা অভাবের তাড়নায় বাড়ি ছেড়ে পথে বেরিয়ে যায়। ফাবান্ত পরিবারে এমন একজনকেও পাবেন না। তারা সদগুণ, সততা, ধর্ম, ঈশ্বরবিশ্বাস কাকে বলে তা শিখেছে। কিন্তু কাল আমাদের কী ঘটবে, তা জানি না স্যার। কাল ৪ ফেব্রুয়ারি, বাড়িওয়ালা আমাদের আর থাকতে দেবে না। আজ সন্ধের মধ্যে যদি আমরা সব ভাড়া মিটিয়ে না দিই তা হলে আমাদের উঠে যেতে হবে। তা হলে আমার রুগ্‌ণ স্ত্রী ও মেয়েদের হাত ধরে পথে বেরিয়ে যেতে হবে আমাকে। বরফ আর বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার মতো কোনও আশ্রয়ই থাকবে না আমাদের। এই হল আমাদের অবস্থা মঁসিয়ে। আমার বাড়িভাড়া বাকি আছে চার কোয়ার্টারের অর্থাৎ পুরো এক বছরের। তার মানে মোট ষাট ফ্রাঁ।

কথাটা একেবারে মিথ্যা। প্রথমত তার এক বছরের বাড়িভাড়া হল মোট চল্লিশ ফ্রাঁ, ষাট ফ্রাঁ নয়। তাছাড়া মাস ছয় আগে মেরিয়াস দু কোয়ার্টারের ভাড়া মিটিয়ে দিয়েছে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ তার পকেট হাতড়ে পাঁচ ফ্ৰাঁ বার করে টেবিলের উপর রাখল। তা দেখে জনদ্ৰেত্তে তার বড় মেয়ের কানে কানে বলল। দেখলে বুড়োর কাণ্ডটা? পাঁচ ফ্রাঁতে কী হবে? চেয়ার আর কাঁচের দামও হবে না।

মঁসিয়ে লেবলাঁ তখন তার বাদামি রঙের ওভারকোটটা খুলে চেয়ারের পিঠের উপর ঝুলিয়ে রেখে দিল। তার পর বলল, শুনুন মঁসিয়ে ফাবান্ত, আমার কাছে এখন আর টাকা নেই, যা ছিল দিলাম। তবে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি, সন্ধের সময় আবার আসব। আপনার তো আজকের সন্ধের মধ্যে ভাড়া দিতে হবে।

সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল জনদ্ৰেত্তে’র মুখখানা। সে বলল, হ্যাঁ মঁসিয়ে। আপনি ঠিক বলেছেন। আমাকে বাড়িওয়ালার বাড়িতে গিয়ে দেখা করতে হবে আটটার সময়।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, ঠিক আছে, আমি দুটোর সময় এসে আপনাকে ষাট ফ্রাঁ দিয়ে যাব।

জনদ্ৰেত্তে বলল, সত্যিই আপনি মহান স্যার।

এরপর সে তার স্ত্রীকে আড়ালে চুপি চুপি বলল, লোকটাকে দেখছ?

মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার তার মেয়ের হাত ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, তা হলে সন্ধের আগে আমাদের আর দেখা হবে না।

জনদ্ৰেত্তে বলল, সন্ধে ছটা।

যা ঠিক ছটায়।

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই বড় মেয়েটি তাদের পেছনে পেছনে গিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি আপনার ওভারকোটটা ভুলে রেখে যাচ্ছেন।

জনদ্ৰেত্তে তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে একবার তাকাল। মঁসিয়ে লেবলাঁ হাসিমুখে বলল, আমি ভুলে যাইনি; আমি ওটা ইচ্ছা করেই রেখে এসেছি।

জনদ্ৰেত্তে বলল, হে আমার রক্ষাকর্তা, আমার চোখে জল আসছে। দয়া করে আপনার গাড়ি পর্যন্ত আমাকে সঙ্গে যাবার অনুমতি দিন।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, তা হলে আপনি কোটটা পরুন। বড় ঠাণ্ডা।

জনদ্ৰেত্তেকে আর বলতে হল না। সে সঙ্গে সঙ্গে কোটটা পরে নিল। সে আগন্তুকদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

.

১০.

মেরিয়াস একটু আগে ঘরখানায় যা যা ঘটেছে তা সব দেখেছে। কিন্তু আবার একদিক দিয়ে কিছুই দেখেনি। মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করার পরমুহূর্ত থেকে তার চোখ মেয়েটির ওপর সর্বক্ষণ নিবদ্ধ ছিল। তার পর যতক্ষণ সে ঘরের মধ্যে ছিল ততক্ষণ এক গভীর আনন্দের আবেগ তার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে ছিল। তার সমস্ত সত্তা, সমস্ত মনোযোগ একটি মাত্র বিষয়ের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। সে যেন একটি মেয়েকে দেখছিল না, সাটিন পোশাকে আবৃত এক আলোর প্রতিমূর্তিকে দেখছিল। যদি কোনও দেবদূত এসে সেই ঘরে ঢুকত তা হলে সে এর থেকে বেশি বিস্ময়ে অভিভূত হত না।

মেয়েটি যখন কাপড়ের প্যাকেটটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখে তখন তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করে, সে যখন রুগ্‌ণ মা ও আহত মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে তখন তার প্রতিটি কথা শোনে পরম আগ্রহের সঙ্গে। এর থেকে সে তার মুখচোখ ও প্রতিটি গতিভঙ্গি লক্ষ করেছে, কিন্তু কথা খুব কম শুনেছে। শুধু লুক্সেমবুর্গ বাগানে একদিন তাকে তার বাবার সঙ্গে কিছু কথা বলতে শুনেছে। তার কথা শোনা এবং তার কথার সুর অন্তরে বহন করার জন্য সারাজীবন সে অতিবাহিত করতে পারত। কিন্তু জনদ্ৰেত্তের হইচই ও গোলমাল করার জন্য তার কোনও কথা শুনতে পায়নি। সে শুধু তার ক্ষুধিত চোখের দৃষ্টি দিয়ে তার চেহারাটা গ্রাস করেছে, কিন্তু বুঝতে পারেনি তার মতো সুন্দরী মেয়ে অবর্ণনীয়ভাবে নোংরা পরিবেশ আর মানুষের মধ্যে কী করে এল।

মেয়েটি ঘর থেকে চলে যাবার পর তার খেয়াল হল তাদের পিছু পিছু গিয়ে তারা কোথায় থাকে, তা দেখে আসা উচিত। তা না হলে এতদিন পর আশ্চর্যভাবে অকস্মাৎ দেখতে পেয়েও আবার তাকে হারাতে হবে। টেবিল থেকে তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে নেমে সে তার মাথায় টুপিটা চাপিয়ে নিল। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে গিয়ে ইতস্তত করতে লাগল। সে ভাবল তারা এখনও গাড়িতে চাপেনি এবং বাঁচাল জনদ্ৰেত্তে এখনও হয়তো কথা বলছে তাদের সঙ্গে। মঁসিয়ে লেবলাঁ যদি তাকে দেখে ফেলে তা হলে সে হয়তো ভয় পেয়ে যাবে এবং তাকে কৌশলে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করবে।

তা হলে কী করবে সে? সে কি অপেক্ষা করবে কিছুক্ষণ? কিন্তু তা যদি করে তা হলে দেরি হয়ে গেলে এবং তাদের গাড়িটা ছেড়ে দিলে তারা কোথায় যাবে, তা আর দেখতে পাবে না। সুতরাং তাকে তারা দেখে ফেললেও তাকে যেতেই হবে। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল মেরিয়াস।

বারান্দাটা এবং সিঁড়িগুলো ফাঁকা। তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে সে বুলভার্দে গিয়ে দেখল একটি গাড়ি পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে প্যারিসের পথে এগিয়ে চলেছে। সে গাড়িটাকে লক্ষ্য করে ছুটতে লাগল। দেখল গাড়িটা মুফেতার্দের ঢালু পথটা বেয়ে নেমে যাচ্ছে। দেখল গাড়িটা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আর ধরা সম্ভব নয়। পায়ে হেঁটে বা ছুটে গিয়ে তার নাগাল পাওয়া যাবে না। তাই অবিলম্বে একটা গাড়ি ভাড়া করে গাড়িটার অনুসরণ করা উচিত। তাছাড়া গাড়িটাকে লক্ষ্য করে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলে গাড়ির আরোহীদের সন্দেহ হতে পারে। এমন সময় একটা খালি ঘোড়ার গাড়িকে আসতে দেখে মেরিয়াস সেটা ভাড়া করার জন্য গাড়োয়ানকে ডাকল। তার ময়লা ও কিছুটা ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক দেখে গাড়োয়ান আগাম ভাড়া চাইল।

ভাড়া কত?

চল্লিশ স্যু।

কিন্তু মেরিয়াসের কাছে তখন মাত্র ছিল মোলো স্যু। সে তাই বলল, তুমি আমাকে ফিরিয়ে আনার পর তোমার ভাড়া দেব।

গাড়িচালক জোরে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।

মেরিয়াস বিষণ্ণ দৃষ্টিতে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাত্র চল্লিশ স্যু’র অভাবে সে তার প্রেমাস্পদকে এবং তার জীবনের সুখ হারাতে বসেছে এবং তার ফলে সে আবার অন্ধকারে ডুবে যাবে। ক্ষণিকের জন্য একবার এক চকিত আলো দেখার পর আবার সে অন্ধ হয়ে উঠল। এই ভেবে সে অনুশোচনা করতে লাগল যে সে বোকার মতো পাঁচ ফ্রাঁ সেই দুস্থ মেয়েটিকে দিয়েছে। সেই পাঁচ ফ্রাঁ তাকে না দিলে এই হতাশা, লক্ষ্যহীনতা এবং নিঃসঙ্গতা হতে উদ্ধার করতে পারত নিজেকে। তা না হয়ে তার সৌভাগ্যের হারানো সুতোটা আবার ছিঁড়ে গেল। আবার সেই হতাশার অন্ধকারটা বুকচেপে বসল তার। সে নিবিড় হতাশার সঙ্গে বাসায় ফিরে গেল।

একথা ভেবে সে কিছুটা আশ্বস্ত হতে পারত যে মঁসিয়ে লেবলাঁ কথা দিয়ে গেছে। সন্ধ্যার সময় সে আবার আসবে এবং তখন সে সাফল্যের সঙ্গে তাদের অনুসরণ করতে পারবে। কিন্তু সে এমনই বিষাদে মগ্ন হয়ে ছিল যে সে কথা তার মনেই এল না।

বাসাবাড়িতে ঢোকার মুখে সে দেখল জনদ্ৰেত্তে মঁসিয়ে লেবলাঁর দেওয়া কোটটা পরে বাইরে একজন নামকরা অপরাধীর সঙ্গে কথা বলছে। জনদ্ৰেত্তে এমনই একজন লোকের সাথে কথা বলছিল যার চোখ-মুখ দেখলে এবং যার কথা শুনলেই সন্দেহ জাগে, সে লোক সারাদিন ঘুমিয়ে রাতের বেলায় যতসব অপকর্ম করে বেড়ায়। তাদের দু জনের এই নির্জন আলাপ এবং কথাবার্তা সমাজের আইনশৃঙ্খলার অভিভাবকের পক্ষে বিশেষ আগ্রহের বস্তু। কিন্তু মেরিয়াস তা লক্ষ করেও করল না।

বিষণ্ণ চিন্তায় মেরিয়াসের মনটা আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও একটা কথা সে বেশ বুঝল জনদ্ৰেত্তে কথা বলছে পানশাদ ওরফে ব্রিগেনেলের মতো একজন কুখ্যাত লোকের সঙ্গে, যাকে একদিন কুরুফেরাক তাকে দেখিয়ে দেয় এবং সে একজন বিপজ্জনক রাতপাখি হিসেবে চিহ্নিত। তার নাম আগেই আমরা উল্লেখ করেছি এবং সে এর পরে কতকগুলি অপরাধে জড়িয়ে আদালতের বিচারাধীন আসামি হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করবে। বর্তমানে সে একজন অন্ধকার জগতের নায়ক এবং অপরাধীরা তাদের আড্ডায় ফিসফিস করে তার কথা প্রায়ই বলে। এমনকি লা কোর্স নামক জেলখানাতেও তার নাম কয়েদিদের মধ্যে আলোচিত হয়। ১৮৪৩ সালে যে তিরিশজন কয়েদি জেলখানার এক প্রস্রাবাগারের পাইপ বেয়ে আশ্চর্যভাবে পালিয়ে যায় তার মধ্যে পানশাদও ছিল। অবশ্য ১৮৩২ সাল থেকে তার ওপর নজর রাখতে থাকে পুলিশ। কিন্তু সে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেনি।

.

১১.

সিঁড়িতে ওঠার সময় মেরিয়াস দেখল তার পিছু পিছু জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ে আসছে। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায় নাসিকা কুঞ্চিত হয়ে উঠল তার। কারণ তাকে সে পাঁচ ফ্রাঁ আগেই দিয়ে দিয়েছে এবং তার জন্য তাকে কষ্ট পেতে হচ্ছে। এখন আর পাঁচ ফ্রাঁ ফিরে চাওয়ার কোনও অর্থ হয় না। কারণ তাদের গাড়িটা এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তাছাড়া এখন চাইলে সে তা ফিরিয়ে দিতেও পারবে না। মঁসিয়ে লেবলাঁদের ঠিকানাটা চেয়েও কোনও লাভ নেই। কারণ মেয়েটি তা জানে না। চিঠিটা দেওয়া হয়েছিল চার্চের ঠিকানায়। মেরিয়াস তার ঘরের মধ্যে ঢুকে তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

কিন্তু বন্ধ হল না দরজাটা। ঘুরে দাঁড়িয়ে মেরিয়াস দেখল একটা হাত দরজার একটা কপাট ধরে কে সেটা খুলে রেখেছে। দেখল, জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সে কড়াভাবে বলল, তুমি? আবার কী চাও তুমি।

মেয়েটি উত্তর দিল না এ কথার। সে মেরিয়াসকে লক্ষ্য করে কী ভাবতে লাগল। সে ঘরের ভেতর ঢোকেনি। বারান্দার আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে।

মেরিয়াস বলল, কী, কথার উত্তর দিতে পারছ না? কী চাও তুমি আমার কাছ থেকে?

মেয়েটি সকরুণ দৃষ্টিতে নীরবে তাকিয়ে রইল মেরিয়াসের দিকে। তার চোখে বিষাদের কালো ছায়ার মধ্যে একটা ক্ষীণ আলোও ছিল। সে বলল, মঁসিয়ে মেরিয়াস,

আপনাকে বিচলিত দেখাচ্ছে। কী হয়েছে আপনার?

মেরিয়াস বলল, আমার?

হ্যাঁ।

আমার কিছুই হয়নি।

না, কিছু নিশ্চয় হয়েছে।

আমাকে একা থাকতে দাও।

এই বলে দরজাটা আবার বন্ধ করতে গেল মেরিয়াস। কিন্তু দরজার একটা কপাট ধরে মেয়েটি তবু দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বলল, আপনি ভুল করছেন। আপনি ধনী নন। কিন্তু আজ সকালে আপনি যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। এখন সদয় ব্যবহার করুন। আপনি আমাকে আমাদের খাওয়ার জন্য টাকা দিয়েছেন। এখন আপনার সমস্যাটা কী তা বলুন। আমি দেখছি আপনি কোনও কারণে দুঃখী এবং আমি সেটা চাই না। আমি কি আপনার জন্য কিছুই করতে পারি না? আপনি শুধু আপনার দুঃখের কথাটা বলুন। আমি আপনার গোপন কথা জানতে চাই না, আমাকে আপনার সব কথা বলতে হবে না। তবে আমি আপনার কোনও না কোনও কাজে লাগতে পারি। আমি আমার বাবাকে সাহায্য করে থাকি, সুতরাং আপনাকেও সাহায্য করতে পারব। কারও হাতে চিঠি দেওয়া, কারও বাড়ি যাওয়া, কারও ঠিকানা জোগাড় করা এবং কারও অনুসরণ করা–এইগুলোই হল আমার কাজ। এখন আপনি বলুন আপনি কী চান? দরকার হলে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে পারি। আপনি শুধু বলুন কী আপনার দরকার।

মেরিয়াস এবার সরে গেল মেয়েটির কাছে। নিমজ্জমান ব্যক্তি একটা খড়কুটোকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার জন্য। সে বলল, ঠিক আছে, একটা কথা শোন–

সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল মেয়েটির চোখ দুটো। সে মাঝপথে মেরিয়াসকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আপনি খুব সুন্দরভাবে কথা বলছেন। এটাই ভালো।

তুমি যে ভদ্রলোক আর তার মেয়েকে তোমাদের বাড়িতে এনেছিলে তাদের ঠিকানাটা জান?

না।

ঠিকানাটা জোগাড় করে দিতে পার?

মেয়েটি চোখ থেকে আলোটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই মুছে গেল।

আপনি শুধু এইটাই চান?

হ্যাঁ।

আপনি তাদের চেনেন?

না।

মেয়েটি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে এবং কিছুটা তিক্তভাবে বলল, তার মানে আপনি মেয়েটিকে চেনেন না আর তার সঙ্গে পরিচিত হতে চান।

মেরিয়াস বলল, তুমি তার ঠিকানাটা জোগাড় করে দিতে পার?

সুন্দরী মেয়েটির ঠিকানা জোগাড় করে দেব।

তার কণ্ঠে দ্বেষের ভাব দেখে রেগে গেল মেরিয়াস। সে বলল, তার ঠিকানা সেটা বড় কথা নয়। ঠিকানাটা বাপ এবং মেয়ের দু জনেরই। তাদের ঠিকানা।

মেয়েটি কড়াভাবে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কী দেবে তুমি?

তুমি যা চাইবে তাই দেব।

যা চাইব?

হ্যাঁ।

তা হলে আমি জোগাড় করে দেব।

এই বলেই সে দরজা বন্ধ দিয়ে চলে গেল।

মেরিয়াস একটা চেয়ারে বসে দু হাতের মধ্যে মাথাটা রেখে ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ আগে যা সব ঘটে গেছে অর্থাৎ মেয়েটির আকস্মিক আবির্ভাব, জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়ের প্রতিশ্রুতি তাকে ভাবিয়ে তুলঁল। তবে এই প্রতিশ্রুতির মাঝে সে একটা আশার আলো দেখতে পেল।

এমন সময় হঠাৎ পাশের ঘরে জনদ্ৰেত্তে’র কর্কশ কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠল সে।

জনদেত্তে বলছে, আমি তোমাকে বলছি তাকে আমি ঠিক চিনতে পেরেছি।

মেরিয়াস ভাবল মঁসিয়ে লেবলাঁ ছাড়া আর কার কথা বলবে সে। তার এই ক্রুদ্ধ কর্কশ কথা বলার ভঙ্গির মধ্যেই কি পিতা-কন্যার কোনও রহস্য লুকিয়ে আছে আর কিছু না ভেবে সে লাফ দিয়ে আবার সেই টেবিলটার উপর উঠে সেই ফুটো দিয়ে ওদের মধ্যে তার দৃষ্টি চালিয়ে দিল।

.

১২.

মেরিয়াস দেখল, ঘরখানার মধ্যে যেখানে যা ছিল সেখানে সব ঠিকই আছে। শুধু জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী আর দুই মেয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিয়ে যাওয়া গরম মোজাগুলো ছিল। কম্বল দুটো বিছানায় নামানো আছে।

বাইরে থেকে জনদ্ৰেত্তে এসে ঠাণ্ডা লাগার জন্য হাঁপাচ্ছিল। মেয়ে দুটি আগুনের ধারে বসে ছিল। বড় মেয়ে ছোট মেয়ের হাতের ক্ষত জায়গাটা বেঁধে যাচ্ছিল। তাদের মা একটা বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে ছিল। সে বিস্ময়ের সঙ্গে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে ছিল। তার স্বামী তখন চোখে এক অস্বাভাবিক আলো নিয়ে ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। তার কথা শুনে তার স্ত্রী হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

তার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করল, সত্যি বলছ? এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত।

অবশ্যই আমি নিশ্চিত। আট বছর হয়ে গেল। তবু আমি তাকে একনজরেই চিনতে পেরেছি। তুমি কী বলছ, তুমি তাকে চিনতে পারনি?

না।

কিন্তু আমি তো তোমাকে বললাম লোকটাকে ভালো করে দেখ। তার চেহারা, তার মুখ আট বছরের মধ্যে মোটেই বদলায়নি। এক ধরনের লোক আছে যাদের বয়স বেড়েছে বলে মনেই হয় না। কিভাবে যে ওরা দেহটাকে ঠিক রাখে তা আমি বুঝতে পারি না। ওর গলার কণ্ঠস্বরটা পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে ওর পোশাকটা এখন ভালো, এই যা। কিন্তু ঈশ্বরের নামে বলছি, ওকে আমি হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে গেছি।

এরপর সে তার মেয়েদের বলল, তোমরা এখন বেরিয়ে যাও। তুমি তাকে চিনতে পারলে না দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি।

মেয়ে দুটি নীরবে উঠে পড়ল। তাদের মা মৃদু অনুযোগের সুরে বলল, ওর কাটা হাত নিয়ে বেরিয়ে যাবে?

জনদ্ৰেত্তে বলল, ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভালো থাকবে। যাও, চলে যাও।

জনদ্ৰেত্তে এমনই লোক যার কথার কোনও প্রতিবাদ করা চলে না। মেয়েরা তার কথা পালন করল। তারা ঘরের দরজার কাছে যেতেই জনদ্ৰেত্তে বলল, তোমরা দু জনেই ঠিক পাঁচটার সময় চলে আসবে। দরকার আছে।

মেরিয়াসের আগ্রহ বেড়ে গেল।

মেয়েরা চলে গেলে জনদ্ৰেত্তে আবার পায়চারি করে বেড়াতে লাগল ঘরের মধ্যে। হঠাৎ থেমে তার শেমিজটা তার কোমরের কাছে পায়জামার মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, আর একটা কথা বলব তোমায়। ওই মেয়েটা…

তার স্ত্রী বলল, মেয়েটা? কী ব্যাপার?

কাদের সম্বন্ধে তারা কথা বলছে এ কথা বুঝতে আর বাকি রইল না মেরিয়াসের। এক উত্তপ্ত প্রত্যাশায় তার সমস্ত সত্তা কানের মধ্যে এসে কেন্দ্রীভূত হল। কিন্তু জনদ্ৰেত্তে এবার তার স্ত্রীর কানের কাছে মুখটা এনে চুপি চুপি কী বলতে লাগল। শেষে সে বলল, ও হচ্ছে সেই মেয়েটা।

স্ত্রী বলল, সেই মেয়েটা!

হ্যাঁ, সেই মেয়েটা।

এবার তার স্ত্রীর মধ্যে একই সঙ্গে বিস্ময়, ঘৃণা আর ক্রোধ ফুটে উঠল ভয়ঙ্করভাবে। তার স্বামী তার কানে কানে বলল তাতে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখা গেল তার মধ্যে। উদাসীন থেকে সে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল।

সে বলল, অসম্ভব! আমাদের মেয়েরা খালি পায়ে এবং তাদের গায়ে কোনও পোশাক নেই। অথচ ওই মেয়েটার গায়ে দুশো ফ্রা’র পোশাক এবং ওকে এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো দেখাচ্ছে। তোমার কথা ঠিক নয়। একটা কথা, সেই মেয়েটা তো দেখতে কুৎসিত ছিল, কিন্তু এই মেয়েটা তো দেখতে মোটেই খারাপ নয়। এ কখনও সেই মেয়ে নয়।

আমি বলছি সে-ই। পরে দেখবে তুমি।

জনদ্ৰেত্তে’র এই দৃঢ় আশ্বাসে তার স্ত্রী আরও হতবুদ্ধি হয়ে উঠল। সে বিহ্বলভাবে ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চওড়া মুখখানা বিকৃত হয়ে উঠল। মেরিয়াসের মনে হল সে তার স্বামীর থেকে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। একটা শূকরী যেন বাঘিনীর মূর্তি ধারণ করেছে।

সে বলতে লাগল, সেই মেয়েটা। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো পোশাক পরে এসে আমার মেয়েদের সঙ্গে করুণার সঙ্গে কথা বলছে। আমার মনে হচ্ছে ওর পেটের উপর পা দিয়ে দাঁড়াই।

বিছানা থেকে উঠে সে স্তব্ধভাবে বসে রইল। মাথার চুলগুলো আলুথালু হয়ে উঠেছে তার, নাসারন্ধ্র দুটি কাঁপছে। মুখটা অর্ধবিস্ফারিত। তার হাত দুটো ঘুষি পাকিয়ে উঠল। এই অবস্থায় সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।

কিন্তু তার স্বামী তার এই অবস্থার দিকে না তাকিয়ে ঘরটার মধ্যে আবার নীরবে পায়চারি করতে শুরু করে দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে বলল, আর একটা কথা শুনবে?

কী কথা?

সে নিচু গলায় বলল, এতে আমাদের সৌভাগ্য বৃদ্ধি হবে।

তার স্ত্রী তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যাতে মনে হল সে ভাবছে তার স্বামীর বোধশক্তিরহিত হয়ে পড়েছে।

তার স্বামী বলে যেতে লাগল, আমি অনেক বাজে কাজে ঘুরে বেড়িয়েছি। ক্ষুধায় খাদ্য চেয়ে উপবাস এবং অনশন পেয়েছি। শীতের তাপ চেয়ে শীতে জমে গিয়েছি। এইভাবে পথের কুকুরের মতো ঘুরে বেড়ানো আর আমার ভালো লাগে না। ঈশ্বরের এক নিষ্ঠুর পরিহাস আর আমি পছন্দ করি না। আমি এখন যথেষ্ট খাদ্য ও পানীয় চাই। নিশ্চিন্তে ঘুমোতে চাই। আমি চাই অনায়াসলব্ধ সচ্ছলতা। এবার আমার পালা। মরার আগে আমিও লক্ষপতির মতো জীবনকে উপভোগ করতে চাই।

সে আবার পায়চারি করতে করতে বলল, আমি এবং আরও কয়েকজন।

তার স্ত্রী বলল, কী বলতে চাইছ তুমি?

কী বলতে চাইছি? বলছি, কী বলতে চাইছি—

তার স্ত্রী বলল, চুপ কর। আস্তে বল। তেমন কিছু হলে বাইরের কেউ যেন না শোনে। বাইরের কে? পাশের ঘরের লোকটা? আমি কিছুক্ষণ আগে তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি। কাজেই সে শুনছে এই ভেবো না। আমি বলছি আমি তাকে বেরিয়ে যেতে দেখেছি।

জনদ্ৰেত্তে গলার স্বরটা নিচু করলেও তার কথা শুনতে অসুবিধা হচ্ছিল না মেরিয়াসের। তবে তার সব কথা শুনতে পাওয়ার আর একটা কারণ হল তুষারপাত। বাইরে তুষারপাতের জন্য রাস্তার যানবাহনের কোনও শব্দ আসছিল না ঘরে।

জনদ্ৰেত্তে বলতে লাগল, শোন। ওই পরোপকারী ভদ্রলোককে আমি পেয়ে গেছি। সে আমার থলের ভেতর ভরা আছে ধরে নিতে পার। আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। সে ছটার সময় আসছে ষাট ফ্রাঁ নিয়ে। সব ঠিক হয়ে আছে। আমি তাকে বাড়ি ভাড়ার কথা কেমন বানিয়ে বলেছি। সে ছটার সময় যখন আসবে, পাশের ঘরের প্রতিবেশী তখন বাইরে খেতে যাবে হোটেলে এবং এগারোটার আগে আসবে না। বুড়ি বুগনল ঘর পরিষ্কারের কাজে যাবে। এখানে জনপ্রাণীও থাকবে না। মেয়েরা বাইরে পাহারা দেবে। তুমি সাহায্য করবে। সুতরাং সে ফাঁদে পড়বেই।

কিন্তু মনে কর–সে যদি না আসে।

জনদ্ৰেত্তে বলল, আমরা জানি তখন কী করতে হবে।

মেরিয়াস আজ প্রথম হাসতে দেখল জনদ্ৰেত্তেকে। তার নিষ্ঠুর হিমশীতল হাসির শব্দে বুকটা কেঁপে উঠল তার। জনদ্ৰেত্তে আলমারি খুলে একটা টুপি বার করে পরল মাথায়। তার পর সে বলল, আমাকে এখন বাইরে যেতে হবে। আরও লোক আছে, তাদের সঙ্গে। কথা বলতে হবে। এ এক বড় খেলা। আমি শিগগির ফিরে আসব। তুমি বাড়িতে থাক।

কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কী ভেবে নিয়ে জনদ্ৰেত্তে আবার বলল, সে আমাকে চিনতে পারেনি এটা ভাগ্যের কথা। সে আমায় চিনতে পারলে আর আসত না। আমার এই দাড়িটাই আমায় বাঁচিয়ে দিয়েছে।

সে আবার হাসতে লাগল। সে জানালার ধারে গিয়ে দেখল বাইরে বরফ পড়ছে।

তা দেখে বলল, কী বাজে আবহাওয়া।

এই বলে গরম কোটটা পরল। বলল, কোটটা বড় হচ্ছে। লোকটা কোটটা রেখে যাওয়ায় খুব ভালো হয়েছে। তা না হলে বেরোতে পারতাম না। তা হলে সব সুযোগ হারাতে হত। এক একসময় ঘটনার যোগাযোগটা ভালোই হয়।

টুপিটা মুখের সামনের দিকে ঠেলে বেরিয়ে পড়ল জনদ্ৰেত্তে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে দরজা ঠেলে আবার সে ঘরে ঢুকল। সে বলল, একটা কথা বলছি। তোমার কয়লার আগুনটা জ্বেলে রাখতে হবে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দেওয়া পাঁচ ফ্রাঁ পকেট থেকে বার করে জনদ্ৰেত্তে তার স্ত্রীর হাতে দিল।

তার স্ত্রী বলল, কয়লার আগুন?

হ্যাঁ।

কত কয়লা চাই।

দু কিলো মতো।

তা হলে তিরিশ স্যু লাগবে। বাকি পয়সাতে আমি রাতের খাবার ব্যবস্থা করব।

মোটেই না।

কেন নয়?

এর থেকে আর কোনও খরচ করলে চলবে না। আমাকে একটা জিনিস কিনতে হবে।

কী জিনিস?

কিছু একটা–এখানে কোনও কামারশাল আছে?

র‍্যু মুফেতার্দে আছে।

হ্যাঁ, জায়গাটা আমি জানি।

তোমার জিনিসটার দাম কত হবে?

দু-তিন ফ্রাঁ।

তা হলে তো রাতের খাওয়া তাতে হবে না।

হয় না-খেয়ে থাকতে হবে। কারণ এর থেকে দরকারি একটা কিছুর কথা ভাবতে হচ্ছে আমায়।

ঠিক আছে প্রিয়তম।

দরজাটা পেছন থেকে বন্ধ করে এবার চলে গেলে জনদ্ৰেত্তে। মেরিয়াস সিঁড়িতে তার দ্রুত পদশব্দ শুনতে পেল।

সেন্ট মেদার্দ গির্জার ঘড়িতে বেলা একটা বাজল।

.

১৩.

দিবাস্বপ্নে প্রায়ই মত্ত হয়ে থাকলেও মেরিয়াস সময়মতো দৃঢ়তার সঙ্গে কোনও কাজে নেমে পড়তে পারত। সে নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করার ফলে অলস হয়ে ওঠে এবং করুণা ও সহানুভূতি এই গুণ দুটি তার মধ্যে গড়ে ওঠে। পরোপকার প্রবৃত্তির সঙ্গে তার মধ্যে বিচারকের এক কঠোরতা ছিল। সে যেমন এক ব্যাঙের উপর দয়া দেখাত, তেমনি বিষাক্ত সাপকে পা দিয়ে মাড়িয়ে দিতে পারত। সে যে ঘরের দিকে ফুটো দিয়ে তাকিয়ে ছিল সেটা সত্যিই এক বিষাক্ত সাপের গর্ত, রাক্ষসদের গুহা। সেখানে যেন কোনও মানুষ থাকে না।

নিজের মনে মেরিয়াস বলল, এই বদমাশ দুবৃত্তগুলোকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।

কিন্তু তাদের যে সব কথা সে শুনতে পেয়েছে সে কথায় কোনও রহস্য উদঘাটিত হয়নি। তাতে শুধু রহস্যটা ঘোরালো হয়েছে আরও। সে লুক্সেমবুর্গের বাগানে দেখা সেই মেয়েটি আর তার পিতার সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারেনি। শুধু এইটুকু জেনেছে যে জনদ্ৰেত্তে তাদের চেনে। তাদের কথাবার্তা থেকে আর একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে। সেটা হচ্ছে এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁদের জন্য একটা ফাঁদ পাতা হচ্ছে। এটা সত্যিই ভয়ের কারণ। জনদ্ৰেত্তের সব কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে মাকড়সার জালের মতো এই চক্রান্তজাল ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে।

সে দেখল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী ঘরের কাজ করছে। সে খুব সাবধানে কোনও শব্দ না করে টেবিল থেকে নেমে পড়ল। জনদ্ৰেত্তে যে ফাঁদ পেতেছে তার জন্য তার মনে ভয় হলেও সেই সঙ্গে একটা খুশির আলোও উঁকি মারছিল সেই ভয়ের অন্ধকারে। সে তার প্রিয়তমার জন্য কিছু করবে, তাদের কোনও উপকারে লাগবে এই ভেবে আনন্দ জাগছিল তার মধ্যে।

কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব? সে তো তাদের বাসার ঠিকানা জানে না যে আগে থেকে সতর্ক করে দেবে তাদের। তারা এখানে এসেই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে গেছে। অবশ্য ছটার সময় পথে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের সাবধান করে দিতে পারে। কিন্তু জনদেত্তে আর তার দলের লোকরা নিশ্চয় বাড়ির বাইরে পথে আগে হতেই দাঁড়িয়ে থাকবে। তখন রাস্তা ফাঁকা থাকবে এবং তাতে তাকে দেখে চিনতে পারবে। তা হলে তারা হয়তো তাকে তাড়িয়ে দেবে সেখান থেকে অথবা তুলে নিয়ে যাবে।

তখন বেলা একটা বাজে। আর পাঁচ ঘণ্টা সময় হাতে আছে। তার মধ্যে কিছু না কিছু করতে হবে। একটা মাত্র উপায় আছে। সে তার ভালো পোশাকটা পরে মাথায় টুপি চাপিয়ে আর গলায় চাদর জড়িয়ে বাড়ি থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ল।

সে বুলভার্দ অঞ্চলটা তাড়াতাড়ি পার হয়ে পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের কাছে চলে গেল। এ রাস্তাটা নিচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল দু ধারে। পাঁচিলটা ডিঙিয়ে পার হওয়া যায়। পাঁচিলটার ওধারে কিছু পতিত জমি আছে। মেরিয়াস পাঁচিলটার ধার দিয়ে যাচ্ছিল। সহসা কয়েকজন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে। তখন বরফ পড়ছিল। বরফ পড়ার ফলে পথ চলতে কষ্ট হচ্ছিল তার। তার ওপর চিন্তায় মাথাটা ভারী হয়ে ছিল তার; মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেও সে চারদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। উজ্জ্বল। দিনের আলোয় সে কাউকে দেখতে না পেয়ে সে পথের ধারের পাঁচিলের ওপাশটা একবার দেখল।

দেখল দু জন লোক ওধারে পাঁচিলটার গায়ে ঠেস দিয়ে বসে কথা বলছে। তাদের কাউকে চেনে না সে। তাদের মধ্যে একজনের মুখে দাড়ি আর মাথায় টুপি ছিল এবং তার পরনে ছিল একটা আলখাল্লা। অন্যজনের পোশাকটা ছিল ছেঁড়াখোঁড়া আর তার একমাথা লম্বা লম্বা চুল ছিল। তার মাথায় টুপি ছিল না বলে তার মাথার চুলে বরফের কণাগুলো চকচক করছিল। পাঁচিলের উপর ঝুঁকে তাদের কথা শুনতে লাগল মেরিয়াস।

লম্বা চুলওয়ালা লোকটা বলল, পেত্ৰন মিনেত্তে যখন একসঙ্গে আছে তখন তা কিছুতেই ব্যর্থ হবে না।

দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, তুমি তাই মনে কর?

হ্যাঁ, নিশ্চয়, পাঁচশো ফ্ৰাঁ করে প্রত্যেকেই পাবে। আর তাতে খারাপ কিছু যদি হয় তো পাঁচ বছরের জেল।

মাথায় গ্রিক টুপি পরা লোকটা টুপির নিচে মাথাটা চুলকে বলল, এ টাকা হাতছাড়া করা উচিত হবে না।

চুলওয়ালা লোকটা বলল, কাজটা ঠিক হবে। তবে মাস্টার হোয়াটসিটকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে।

ওরা গতকাল থিয়েটারে দেখা এক নাটক নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে মেরিয়াস চলে গেল সেখান থেকে।

মেরিয়াসের মনে হল যে কথাগুলো সে তাদের মুখ থেকে শুনল, জনদেত্তের চক্রান্তের সঙ্গে তার নিশ্চয় একটা সম্পর্ক আছে। লোক দুটো তুষারপাতের মধ্যে

সন্দেহজনকভাবে বসে এ বিষয়েই নিশ্চয় আলোচনা করছিল।

মেরিয়াস ফবুর্গ সেন্ট মার্সের পথে এগিয়ে গিয়ে প্রথমেই যে দোকানটা পেল সেখানে সে জিজ্ঞাসা করল, এ অঞ্চলে সবচেয়ে কাছে যে থানা আছে তার ঠিকানাটা কী?

দোকানদার বলল, তার ঠিকানা হচ্ছে ১৪ নম্বর র‍্যু দা পঁয়য়।

থানার দিকে যেতে যেতে মেরিয়াস ভাবল আজ রাতে তার খাওয়া হবে না। তাই সে একটা রুটির দোকান থেকে একটা পাউরুটি নিয়ে সেটা খেয়ে আবার পথ চলতে লাগল।

সে আরও ভাবল; ভাগ্যের বিধান ফলবেই। সে যদি জনদ্ৰেত্তে’র বড় মেয়েকে পাঁচ ফ্রাঁ না দিত এবং সেটা যদি তার কাছে থাকত তা হলে গাড়িভাড়া করে মঁসিয়ে লেবলাঁকে অনুসরণ করত তার ঠিকানা দেখার জন্য। তা হলে সে জনদ্ৰেত্তে’র চক্রান্তের কথা কিছুই। জানতে পারত না। তা হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ আর তার মেয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হত।

.

১৪.

থানায় পৌঁছে মেরিয়াস একতলায় অফিসে গিয়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

একজন কেরানি বলল, তিনি এখন নেই। একজন ইনসপেকটর কাজ করছেন তাঁর জায়গায়। আপনার কি বিশেষ দরকার আছে?

হ্যাঁ।

কেরানি তাকে একটা ঘর দেখিয়ে দিল। মেরিয়াস সেই ঘরে গিয়ে দেখল, একজন লম্বা লোক একটা বড় কোট পরে দাঁড়িয়েছিল একটা বড় স্টোভের ধারে। তার মুখটা চওড়া, পাতলা ঠোঁট, ধূসর রঙের ঘন গালপাট্টা ছিল দু গালে। তার চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ আর সন্ধানী। তবে জনদ্ৰেত্তে’র থেকে তাকে কম হিংস্র আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল।

ইন্সপেক্টর কোনও ভণিতা না করে বলল, কী চান আপনি?

আপনিই কি পুলিশ কমিশনার?

তিনি বাইরে গেছেন। আমি তার জায়গায় আছি।

বিশেষ গোপনীয় ব্যাপার।

বলুন আমাকে।

ব্যাপারটা জরুরিও বটে।

তাড়াতাড়ি বলুন।

তার হিমশীতল কঠোরতা একই সঙ্গে মানুষকে হতবুদ্ধি করে দেয় এবং আশ্বস্ত করে। সে মেরিয়াসের মনে ভীতি আর আস্থার সঞ্চার করছিল।

মেরিয়াস সব কথা খুলে বলল। বলার আগে প্রথমেই বলল তার নাম মেরিয়াস পঁতমার্সি, একজন উকিল। সে বলল, একজন ভদ্রলোককে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভুভদ্রলোক তার শুধু মুখচেনা। সে এই চক্রান্তের ব্যাপারটা সব শুনেছে, কারণ চক্রান্তকারী লোকটি তার পাশের ঘরে থাকে। চক্রান্তকারী শয়তানটার নাম হল জনদ্ৰেত্তে। এ ব্যাপারে তার কিছু সহকারী আছে। এই সব সহকারীদের মধ্যে পানশাদ নামে একটা লোক আছে যে প্রিস্তানিয়ের ও বিগ্রেনেল নামেও পরিচিত। জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী। ও তার দুই মেয়েও এর সঙ্গে জড়িত আছে। সে পরোপকারী ভদ্রলোকের নাম জানে না। বলে আগে হতে তাঁকে সাবধান করে দিতে পারেনি। ঘটনাটা ঘটবে সন্ধে ছটার সময়। জায়গাটা বুলভার্দ অঞ্চলের ৫০-৫২ নম্বর বাড়িটা।

বাড়িটার কথা শুনে ইন্সপেক্টর মেরিয়াসের পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ওদের ঘরটা বারান্দার শেষ প্রান্তে?

মেরিয়াস আশ্চর্য হয়ে বলল, হ্যাঁ, আপনি বাড়িটা জানেন?

ইন্সপেক্টর কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবার পর বলল, মনে হয় জানি। মনে হচ্ছে পেট্রন মিনিত্তে এ ব্যাপারে জড়িত আছে।

কথাটায় চৈতন্য হল মেরিয়াসের। সে বলল, এই নামটা কিছুক্ষণ আগে আমি শুনেছি।

এই বলে সে পথে আসতে আসতে দুটো লোকের মুখ থেকে যা যা শুনেছিল তা সব বলল।

ইন্সপেক্টর বলল, চুলওয়ালা লোকটার নাম হয়তো ব্রুজঁ আর দাড়িওয়ালা লোকটা হল ডেনি লিয়ার্দ বা দিউ মিলিয়ার্দ। আপনি শুধু এই দু জনকে দেখেছেন? আর কাউকে দেখেননি?

মেরিয়াস বলল, না।

ইন্সপেক্টর বলল, ওদের সাধারণত দিনের বেলায় দেখা যায় না। আমি বাড়িটা চিনি। কিছুক্ষণ আপন মনে বিড় বিড় করে কী বলার পর ইন্সপেক্টর বলল, একটা কথা বলব, কিছু মনে করবেন না তো?

মেরিয়াস বলল, না, কী কথা?

মেরিয়াসকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে ইন্সপেক্টর বলল, আপনি একজন সাহসী এবং সৎ লোকের মতো কথা বলছেন। সাহসীরা অপরাধীদের ভয় পায় না আর সৎ লোকেরা শাসন কর্তৃপক্ষকে ভয় পায় না।

মেরিয়াস সঙ্গে সঙ্গে বলল, ঠিক আছে। আপনি কী বলতে চান?

ইন্সপেক্টর বলল, ওই বাড়িতে যারা থাকে তাদের বাড়ি ঢোকার সদরদরজার চাবি একটা করে থাকে। আপনার কাছে সেই চাবিকাঠি আছে?

মেরিয়াস বলল, হ্যাঁ আছে।

তা হলে আমাকে সেটা দিন।

মেরিয়াস পকেট থেকে চাবিকাঠিটা বার করে সেটা দিয়ে বলল, আমার কথা যদি শোনেন তা হলে সেখানে একা যাবেন না।

ইন্সপেক্টর এমনভাবে মেরিয়াসের দিকে তাকাল যাতে সে বোঝাতে চাইল কোনও গ্রাম্য স্কুলমাস্টারের পক্ষে ভলতেয়ারের মতো লোককে কর্তব্য সম্বন্ধে বক্তৃতা দিয়ে বোঝাতে যাওয়া যেমন অবাস্তব ও হাস্যাস্পদ ব্যাপার তেমনি তার মতো একজন অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারকে তার নিরাপত্তা সম্বন্ধে উপদেশ দিতে যাওয়াও অবান্তর ও এক হাস্যাস্পদ ব্যাপার। এবার সে তার বড় কোটটার পকেট থেকে দুটো পিস্তল বার করে বলল, এই দুটো রেখে দিন। এর মধ্যে দুটো করে গুলি ভরা আছে। এখন বাড়ি গিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে থাকুন যাতে ওরা বুঝতে পারে আপনি বাইরে আছেন। সেই ফুটোটা দিয়ে ওদের ঘরটার ভেতর লক্ষ রাখবেন, তারা এলে ওরা যা করে করবে। ওদের করতে দেবেন। যখন দেখবেন বাড়াবাড়ি হচ্ছে, ঘটনা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন পিস্তল থেকে একটা গুলি করবেন। তার পর আমি হস্তক্ষেপ করব। সব ভার নেব। ছাদের দিকে অথবা ঘরের যে কোনও জায়গায় গুলি করবেন। তবে দেখবেন তাড়াহুড়ো করে কিছু করবেন না। ওদের কিছু একটা করা চাই। কারণ সাক্ষ্যপ্রমাণের দরকার। আপনি একজন উকিল। আমি কী বলতে চাইছি তা আপনি জানেন।

মেরিয়াস পিস্তল দুটো নিয়ে তার জামার পাশপকেটে রাখল।

ইনসপেকটার বলল, পকেট থেকে দেখা যাচ্ছে। আপনি ও দুটো কোমরে গুঁজে রাখুন।

মেরিয়াসকে যা বলা হলো তাই করল।

ইন্সপেক্টর বলল, আর সময় নষ্ট করলে চলবে না। এখন সময় কত? আড়াইটা। ওরা কখন আসবে, সাতটায় না?

না, ছটায়।

ঠিক আছে, আমি বেশকিছুটা সময় পেলাম। তবে আমি যা বললাম ভুলবেন না। একটা গুলি পিস্তল থেকে করবেন।

মেরিয়াস ঘর থেকে চলে যাবার উদ্যোগ করে বলল, আমি তা করব।

ইন্সপেক্টর বলল, আর একটা কথা। তার আগে যদি আমাকে প্রয়োজন বোঝেন তা হলে আপনি চলে আসবেন অথবা কাউকে পাঠাবেন। আমার নাম জেভার্ত।

.

১৫.

বেলা তিনটের সময় কুরফেরাক র‍্যু মুফের্দ অঞ্চলে বোসেতের সঙ্গে বেড়াচ্ছিল। তখন বরফ পড়ছিল। বোসেত বলছিল, তুষারকণা দেখে মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য সাদা সাদা প্রজাপতি ঝাঁকে ঝাঁকে এসে আমাদের হেঁকে ধরছে।

হঠাৎ রাস্তায় মেরিয়াসকে ব্যারিয়েরের পথে লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে যেতে দেখে কথা থামিয়ে দিল কুরফেরাক। বলল, মেরিয়াসকে দেখছি। এখন ওর সঙ্গে কথা বলা

ঠিক হবে না।

বোসেত বলল, কেন বলা উচিত হবে না?

দেখছ না, ও খুব ব্যস্ত?

কিন্তু ও কী করছে?

ওর চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে ও কারও অনুসরণ করছে।

দেখে তা তো মনে হচ্ছে না। কিন্তু কাকে ও অনুসরণ করছে?

হয়তো কোনও মেয়েকে দেখে ওর ভালো লেগেছে।

কিন্তু কোনও মেয়েকে তো কোথাও দেখছি না।

কুরফেরাক মেরিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, ও একটা লোককে অনুসরণ করছে।

ওরা দেখল যে লোকটাকে অনুসরণ করছিল মেরিয়াস সে মাথায় টুপি পরে মেরিয়াসের আগে আগে তার মাত্র কুড়ি পা দূরে যাচ্ছিল। ওরা শুধু লোকটার পেছনটা দেখতে পাচ্ছিল। তবে ওরা বেশ বুঝতে পারছিল লোকটার মুখে দাড়ি আছে। লোকটা একটা নতুন ওভারকোট আর একটা ছেঁড়াখোঁড়া কাদা-লাগা পায়জামা পরেছিল।

বোসেত হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে বলল, লোকটা কে?

কুরফেরাক বলল, নিশ্চয় কোনও কবি। একমাত্র কবিরাই ভবঘুরের মতো ছেঁড়া ময়লা পায়জামা আর লর্ডদের মতো ওভারকোট পরে।

বোসত বলল, চল, ওদের পিছু নেওয়া যাক।

কুরফেরাক বলল, কী বোসেত, তুমি কি পাগল হয়েছ? একটা লোক একটা লোককে অনুসরণ করছে, তুমি আবার তার অনুসরণ করতে চাও?

ওরা দু জনে অন্য পথ ধরে চলে গেল।

মেরিয়াস জনদ্ৰেত্তেকে মুফেতার্দে দেখতে পায়। সে কোথায় যায় বা কী করে তা দেখার। জন্য সে তার পিছু নিল। তার কেউ পিছু নিয়েছে একথা মোটেই বুঝতে পারেনি জনদ্ৰেত্তে। সে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে যাচ্ছিল। সে প্রথমে র‍্যু গ্রেসিউজে গিয়ে একটা বাড়িতে মিনিট পনেরো কাটাল। তার পর সে র‍্যু মুফেতার্দের একটা কামারশাল হতে কাঠের বাটওয়ালা একটা লোহার বাটালি নিয়ে বেরিয়ে এল। তার পর র‍্যু দ্য পেতিত ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। মেরিয়াস দেখল রাস্তাটা ফাঁকা এবং এমত অবস্থায় তাকে অনুসরণ করা ঠিক হবে না। মেরিয়াস দূর থেকে তাকে লক্ষ করতে লাগল। দেখল, জনদ্ৰেত্তে রাস্তার ধারের সেই পাঁচিলটা পার হয়ে সেই পতিত জায়গাটায় চলে গেল।

মেরিয়াস ঠিক করল জনদ্ৰেত্তে বাসায় ফেরার আগেই সে ফিরে যাবে। সেইটাই ঠিক হবে। তাছাড়া মাদাম বুগনল কাজ করতে বেরিয়ে গেল সদরদরজায় চাবি দিয়ে যাবে। তার কাছে যে বাড়তি চাবি ছিল তা সেই ইন্সপেক্টরকে দিয়ে দিয়েছে।

তখন অন্ধকার হয়ে আসছিল। আকাশে চাঁদ উঠছিল ধীরে ধীরে। সালপেত্রিয়ের চারদিকে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পা চালিয়ে বাসার দিকে ফিরে যেতে লাগল মেরিয়াস। পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে পা টিপে টিপে সিঁড়ি বেয়ে উঠে বারান্দার দেয়ালে পিঠ দিয়ে নিঃশব্দে তার ঘরটায় চলে গেল। সদরদরজাটা তখনও খোলা ছিল বলে বাড়িটাতে সহজেই ঢুকতে পারল। বারান্দার ধারের ঘরগুলোয় তখন কোনও ভাড়াটে ছিল না বলে মাদাম বুগনল খুলে রাখত। মেরিয়াস একটা ভোলা ঘরে চকিতে দৃষ্টি ফেলে দেখল চারজন লোক স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তাদের মাথাগুলো অল্প অল্প দেখা যাচ্ছিল। সে এর থেকে বেশি আর কিছু দেখতে চাইল না। তাকেও কেউ দেখতে পেল না। এইভাবে অদৃশ্য অবস্থায় সে তার ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঠিক সময়েই এসে পড়েছে সে। কারণ সে ঢোকার পরমুহূর্তেই মাদাম বুগনল সদরদরজায় চাবি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

.

১৬.

মেরিয়াস বিছানার উপর বসে পড়ল। তখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। আর মাত্র আধ ঘণ্টা সময় আছে। তার দেহের শিরায় শিরায় রক্তচলাচলের গতিবেগ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সে যেন তার রক্তস্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল সন্ধ্যার ঘনায়মান ছায়ান্ধকারে অপরাধীরা যেন সমবেত হচ্ছে। অন্য দিকে অন্যায়ের হাতে ন্যায়ের নির্জিত হবার সময় এগিয়ে আসছে। সে ঠিক ভয় পায়নি। তবে একটু পরে কী ঘটবে তা ভাবতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠছিল তার। আজ সারাদিন ধরে যা যা ঘটে গেছে তা সব একটা দুঃস্বপ্নের কতকগুলি অস্পষ্ট ছায়াদৃশ্য বলে মনে হচ্ছিল। শুধু তার কোমরে গুঁজে রাখা পিস্তল দুটোয় হাত পড়তেই বাস্তবসচেতন হয়ে উঠল সে।

তখন তুষারপাত একরকম বন্ধ হয়ে গেছে। কুয়াশা ভেদ করে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে। চারদিকে পড়ে থাকা সাদা তুষারের উপর চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে যে এক শুভ্র-উজ্জ্বল আভার দৃষ্টি হয় সেই আভার একটা অংশ মেরিয়াসের ঘরে এসে পড়েছিল। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরে একটা আলো জ্বলছিল। মেরিয়াস দেয়ালের উপর দিকের সেই ফুটোটা দিয়ে দেখল নিস্তব্ধ ঘরখানার মধ্যে রক্তচক্ষুর মতো লাল আগুনের একটা ক্ষীণ শিখা দেখা যাচ্ছিল। এটা কোনও বাতির আলো নয়। এক জ্বলন্ত আগুন। ঘরখানা এতদূর নিস্তব্ধ যে আগুনটা না থাকলে সেটাকে আস্ত সমাধিগহ্বর বলে মনে হত।

পায়ের জুতো খুলে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে ছিল মেরিয়াস। এমন সময় সদরদরজাটা খোলার শব্দ হল এবং তার পর জনদ্ৰেত্তে তার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল। ঠিক সেই সময় বারান্দার ধারে একটা ঘরে যে চারজন লোককে অন্ধকারে সন্দেহজনকভাবে অপেক্ষা করতে দেখেছিল মেরিয়াস, তারা এসে দেখা করল জনদ্ৰেত্তের সঙ্গে। নেকড়ের বাচ্চাগুলো যেন নেকড়েমাতা আসার সঙ্গে সঙ্গে সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠেছে।

ঘরে ঢুকেই জনদ্ৰেত্তে বলল, আমি এসে গেছি।

মেয়েরা বলল, শুভসন্ধ্যা বাবা।

তার স্ত্রী বলল, এস।

জনদ্ৰেত্তে বলল, সব ভালোভাবেই হয়ে গেছে। কিন্তু আমার পা দুটো শীতে জমে গেছে। আমি দেখছি তোমরা পোশাক পরেছ। ভালো।

মেয়েরা বলল, আমরা বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত।

আমি যা যা বলেছি তোমরা তা যেন ভুলবে না। ঠিক ঠিক সব করবে তো?

কিছু ভাববে না।

জনদ্ৰেত্তে এবার একটা ভারী জিনিস তার হাত থেকে টেবিলের উপর নামিয়ে রাখল। যে বাটালিটা সে কামারশাল থেকে কিনে এনেছিল সেইটা বোধ হয়।

সে তার স্ত্রীকে বলল, খাবার কিছু আছে?

তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, তিনটে বড় আলু ছিল, সিদ্ধ করে রেখেছি।

ভালো করছে। আগামীকাল আমি তোমাদের খুব ভালো করে অনেক কিছু খাওয়াব। কাল তোমরা রাজরাজড়াদের মতো খাবে।

এরপর গলার স্বরটা অনেক নামিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, আগুনে ওটা ফেলে দাও। এবার এখন ফাঁদ তৈরি, বিড়ালরা অপেক্ষা করছে। ইঁদুর এসে ফাঁদে পড়লেই হল।

মেরিয়াস শুনতে পেল, কী একটা লোহার জিনিস কয়লার আগুনে ফেলে দেওয়া হল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, দরজার কজায় তেল দিয়েছিলে যাতে শব্দ না হয়?

তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ।

এখন কটা বাজে?

ছ’টা বাজতে চলেছে। সেন্ট মেদার্দে সাড়ে পাঁচটার ঘণ্টা পড়ে গেছে।

জনদ্ৰেত্তে বলল, এবার মেয়েরা পাহারা দিতে চলে যাবে। শোন তোমরা, মাদাম বুগনল চলে গেছে?

তার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ গেছে।

তোমরা জান পাশের ভদ্রলোক নেই?

উনি তো আজ সারাদিনই ছিলেন না। এখন আবার রাতের খাওয়ার সময়।

তোমরা ঠিক জান তো?

হ্যাঁ ঠিক।

ঠিক আছে। তবু একবার দেখে নেওয়ায় ক্ষতি কী?–এই নাও বাতিটা নিয়ে যাও।

মেরিয়াস সঙ্গে সঙ্গে টেবিল থেকে নেমে তার খাটের তলায় ঢুকে পড়ল গুঁড়ি মেরে। সে দেখল বড় মেয়েটি দরজা খুলে বাতি হাতে ঘুরে ঢুকল। সে ঘরের চারদিকে তাকিয়ে বিছানার দিকে সরে এল। মেরিয়াস ভয় পেয়ে গেল। আসলে সে আসছিল বিছানার উপর দেয়ালে টাঙানো একটা বড় আয়নায় মুখটা দেখতে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে নিজের মুখটা দেখতে লাগল। এমন সময় পাশের ঘর থেকে দুটো ধাতুর মধ্যে ঠোকাঠুকির শব্দ কানে এল।

মেয়েটি এক হাতে চুলটা আঁচড়াতে আঁচড়াতে মোটা গলায় গান গাইতে লাগল। গানের বাণীটি ছিল এই রকম : আমাদের প্রেম খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেছে। আমাদের সুখও সব এখন বিগত। মাত্র একটা সপ্তার জন্য পেয়েছিলাম আমার প্রেমিককে। কিন্তু প্রকৃত প্রেম চিরকালের। তা বেঁচে থাকে চিরকাল।

মেরিয়াস খাটের তলায় কাঁপতে লাগল ভয়ে। তার নিশ্বাসের শব্দ হয়তো শুনতে পাচ্ছে মেয়েটা।

মেয়েটা এবার জানালার ধারে গিয়ে আপন মনে বলল, মনে হচ্ছে সমস্ত প্যারিস শহরটা যেন একটা সাদা জামা পরেছে।

আবার সে আয়নার সামনে ফিরে এসে দাঁড়াল। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল নিজেকে। তার বাবা হেঁকে বলল, কী করছিলি?

মেয়েটি বলল, আমি ঘরটার সব জায়গা খুঁজে দেখছি। ঘরে কেউ নেই।

এই বলে সে তার মাথার চুলটা ঠিক করতে লাগল।

তা হলে চলে এস। নষ্ট করার মতো সময় নেই।

ঠিক আছে, আমি আসছি।

সে আবার গানটা গাইতে লাগল। তুমি আমাকে ফেলে তোমার গৌরবের পথে চলে গেছ। কিন্তু আমার অন্তর তুমি যেখানেই যাবে অনুসরণ করবে তোমাকে ছায়ার মতন।

এরপর শেষবারের মতো একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে চলে গেল মেয়েটি। মেরিয়াস শুনতে পেল দুই বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। তাদের বাবার গলা শোনা গেল, মনে রাখবে একজন থাকবে ব্যাঙ্কিয়েরের দিকে, আর একজন থাকবে ব্যারিয়েরের দিকে। বাড়ির সদরদজার ওপর থেকে চোখ সরাবে না কখনও। কোনও কিছু দেখলে দু জনে এসে খবর দেবে আমাকে।

বড় মেয়েটি বলল, খালি পায়ে বরফের উপর দাঁড়িয়ে পাহারা দেওয়া খুব ভালো কাজ।

জনদ্ৰেত্তে বলল, কাল তোমরা খুব ভালো জুতো পাবে।

এবার তারা দু জনেই বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

মেরিয়াস দেখল, এখন গোটা বাড়িটার মধ্যে জনদ্ৰেত্তে, তার স্ত্রীর আর সেই অচেনা লোকগুলো ছাড়া আর কেউ নেই।

.

১৭.

সময় বুঝে মেরিয়াস আবার টেবিলের উপর উঠে গিয়ে ফুটোটার মধ্য দিয়ে দেখতে লাগল। ঘরখানার মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। এখন একটা বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলোয় মেরিয়াস দেখল জ্বলন্ত চুল্লির উপর একটা লোহার কড়াই-এর উপর একরাশ জ্বলন্ত কয়লা চাপানো আছে। কড়াইটাও গরমে লাল হয়ে উঠেছে। জ্বলন্ত কয়লাগুলোর উপর আগুনের একটা নীলচে শিখা দেখা যাচ্ছিল। কম্পিত শিখাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সেটা যেন নাচছে। সেই আগুনের আভায় দেখা গেল কাছেই জনদ্ৰেত্তে’র কিনে আনা সেই বাটালিটা পড়ে আছে। ঘরটার এককোণে একগাদা লোহার টুকরো আর বেশ কিছু দড়ি পড়ে আছে। বাইরে থেকে ওদের ঘরটাকে যেন নরকের দ্বারের পরিবর্তে কামারশালের মতো মনে হচ্ছিল। জনদ্ৰেত্তে তেমনি একজন কামারের বদলে একটা দানব বলে মনে হচ্ছিল।

তপ্ত কড়াই-এর আগুনটার এত জোর ছিল যে তার আঁচে অদূরবর্তী বাতির মোমগুলো গলে গলে পড়ছিল চুল্লির আগুনে। ধোয়াটা অবশ্য চিমনি দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। জানালাগুলোর কাঁচের সার্সির দিয়ে চাঁদের আলোর ছটা দেখে মেরিয়াসের কবি-মনে এই ভাব জাগল যে, স্বর্গ থেকে যেন এক আলোর ছটা এসে মর্ত্যের এক কুৎসিত পরিবেশের সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে গেছে। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরটা যে কোনও অপরাধমূলক কাজকর্মের পক্ষে খুবই প্রশস্ত ছিল। প্রথমত বাড়িটা ছিল প্যারিসের শহরতলির এক নির্জন পরিবেশে। বাড়িটা বুলভার্দে অবস্থিত হলেও তার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না। বাড়িটার এক দিকে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ দেখা যায়। তাছাড়া বাড়িটাও নির্জন এবং পরিত্যক্তপ্রায়। দুটো ছাড়া সব ঘরই খালি।

ভাঙা চেয়ারটায় বসে পাইপ খেতে লাগল জনদ্ৰেত্তে। তার সঙ্গে তার স্ত্রী নিচু গলায় কথা বলছিল। পরিহাসরসিক কুরফেরাক এ দৃশ্য দেখলে জোর হেসে উঠত। রাজা দশম চার্লস-এর অভিষেকের সময় তাঁর প্রহরীরা যে কালো টুপি পরেছিল সেই ধরনের একটা কালো টুপি ছিল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রীর মাথায়। তার গায়ে ছিল একটা পশমি স্কার্ট আর একটা শাল। তার পায়ে পুরুষদের একজোড়া জুতো যে জুতোর বিরুদ্ধে আজই সকালে তার মেয়ে অভিযোগ করে। তার এই বেশভূষা তার স্বামীর সমর্থন লাভ করেছে এবং তার মতে তার স্ত্রীকে এই বেশভূষায় সম্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে। জনদ্ৰেত্তে নিজে তখনও মঁসিয়ে লেবলাঁর দেওয়া সেই ওভারকোটটা পরে ছিল। তার ময়লা কাদা লাগা পায়জামাটার সঙ্গে কোটটার কোনও সংগতি ছিল না। তার পোশাকের এই গরমিলটাকেই কুরফেরাক কবিসুলভ এক বৈপরীত্য বলে অভিহিত করেছিল।

সহসা গলার স্বরটা উঁচু করে জনদ্ৰেত্তে বলে উঠল, একটা কথা হঠাৎ মনে পড়ল আমার। এই সময় সে ঠিক এসে পড়বে। লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে সদরদরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করো। গাড়িটা কাছে এলেই দরজাটা খুলে দেবে। তার পর তাদের সিঁড়িতে আলো দেখিয়ে উপরে নিয়ে আসবে। এসেই আবার নিচে গিয়ে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গাড়িটাকে ছেড়ে দেবে।

তার স্ত্রী বলল, কিন্তু টাকার কী হবে।

জনদ্ৰেত্তে তার পকেট থেকে পাঁচ ফ্রাঁ বার করে তার স্ত্রীর হাতে দিল।

তার স্ত্রী বলল, কোথায় পেলে টাকাটা?

জনদ্ৰেত্তে গম্ভীরভাবে উত্তর করল, আজ সকালে পাশের ঘরের ভদ্রলোকের কাছ থেকে। আর একটা কথা। আমাদের দুটো চেয়ার চাই।

তার স্ত্রী শান্ত কণ্ঠে বলল, পাশের ঘর থেকে নিয়ে আসব?

জনদ্ৰেত্তে বলল, বাতিটা নিয়ে যাও।

তার স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বলে গেল, বাতি চাই না। চাঁদের আলো আছে।

ভয়ের একটা হিমশীতল শিহরণ খেলে গেল মেরিয়াসের প্রতিটি রক্তশিরায়।

মেরিয়াস দেখল এখন টেবিল থেকে নেমে খাটের তলায় গিয়ে লুকোন কোনওমতেই সম্ভব নয়।

সে তাই শক্ত কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মেরিয়াস দেখল তার ঘরের দরজা ঠেলে একটা হাত অন্ধকারে হাতড়ে চেয়ারের খোঁজ করছে। জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী ঘরের মধ্যে চারদিকে তাকালেও দেয়ালের কাছটায় অন্ধকার জমে থাকায় সে দেখতে পেল না মেরিয়াসকে।

চেয়ার দুটো নিয়ে বেরিয়ে গেল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী। সে বেরিয়ে যেতেই দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রী বলল, এই নাও চেয়ার।

তার স্বামী বলল, এই নাও লণ্ঠন। লণ্ঠন নিয়ে চলে যাও এখনি।

জনদ্ৰেত্তে চেয়ার দুটো টেবিলের দু ধারে রাখল। বাটালিটা আগুনে একবার পুড়িয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার সামনে একটা পুরনো পর্দা টাঙিয়ে দিল, যাতে সেটা চোখে না পড়ে। এরপর দড়িটার উপর ঝুঁকে কী দেখল সে। দড়িটা জনদ্ৰেত্তে তুলঁতেই মেরিয়াস দেখল ওটা শুধু দড়ি নয়, দড়ির একটা মই। তাতে কাঠের আংটা আর দু’দিকে দুটো লোহার হুক লাগানো আছে। এই দড়ির মইটা বা টুকরো লোহার কোনও যন্ত্রপাতি আজ সকালে ঘরের মধ্যে ছিল না। মেরিয়াস বাইরে গেলে সে এগুলো কিনে আনে দোকান থেকে। এইসব যন্ত্রপাতি দিয়ে ঘরের দরজা ও তালা ভাঙা যায়। কোনও কিছু কাটার জন্য চোরেরা এইসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে।

কড়াই-এর কয়লার আগুনটা আর দেখতে না পাওয়ায় শুধু বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে রইল ঘরটা। বিভিন্ন বস্তুর ছায়া জমে ছিল এখানে-সেখানে। ছায়াকালো এক ভয়ঙ্কর প্রশান্তি আর কুটিল নীরবতা বিরাজ করছিল ঘরখানায়।

জনদ্ৰেত্তে কী ভাবছিল। তার মুখের পাইপটা নিবে গিয়েছিল। বাতির স্বল্প মৃদু আলোয় তার মুখের কুটিল রেখাগুলো দেখা যাচ্ছিল না। তার ভ্রু দুটো ওঠানামা করছিল। তার হাত দুটো বারবার মুষ্টিবদ্ধ হচ্ছিল আর খুলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে নিজের অন্তরের সঙ্গে লড়াই করছিল। সেই নিঃশব্দ নিবিড় অন্তর্দ্বন্দ্ব আর স্বগতোক্তির মধ্যে হঠাৎ একসময় টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা ছুরি বার করে তার ধারটা পরীক্ষা করে আবার সেটা রেখে দিল জনদ্ৰেত্তে।

মেরিয়াস একটা পিস্তল বার করে তার ডান হাতে নিল। সেটা খুলে দেখল তার মধ্যে টোটা ভরা আছে কি না। বন্ধ করতে একটা শব্দ হতেই জনদ্ৰেত্তে চমকে উঠল। বলে উঠল, কে?

মেরিয়াস শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় স্তব্ধ হয়ে রইল।

তার পর নিজের মনেই জনদ্ৰেত্তে বলল, ও কিছু না, আমারই মনের ভুল। মেরিয়াস পিস্তলটা তার হাতে ধরে রাখল।

.

১৮.

দূরে সেন্ট মেদার্দ গির্জার ঘড়িতে ছটা বাজল। জানালার কাঁচগুলো যেন ঈষৎ কেঁপে উঠল। ছটা ঘণ্টাই গুনতে লাগল জনদ্ৰেত্তে। শেষ ঘণ্টাটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সে বাতিটা নিবিয়ে দিল। তার পর সারা ঘরময় পায়চারি করতে লাগল শান্তভাবে। সে আপন মনে বলতে লাগল, এখনও সে এল না।

এই বলে সে চেয়ারে বসতে যেতে না যেতেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল।

জনদ্ৰেত্তে দেখল, তার স্ত্রী ঘরের সামনে বারান্দায় রয়েছে। সে কাকে বলল, দয়া করে ভেতরে আসুন মঁসিয়ে।

জনদেত্তে তাড়াতাড়ি উঠে বলল, হে মহান পরোপকারী, ঘরের ভেতরে আসুন।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল মঁসিয়ে লেবলাঁ। তার প্রশান্ত গাম্ভীর্য এক স্বতন্ত্র মহিমা দান করেছিল তার চেহারাটাকে। সে ঘরে ঢুকেই টেবিলের উপরে চারটে লুই রাখল। তার পর বলল, এইটা আপনার বাড়িভাড়া আর কেনাকাটার জন্য রাখুন। আর কী দরকার তা পরে দেখা যাবে।

জনদ্ৰেত্তে বলল, হে উদারহৃদয় মহান, ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন। এই বলে সে তার স্ত্রীকে ইশারায় গাড়িভাড়া মেটাতে পাঠিয়ে দিল।

তার স্ত্রী চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। ইতোমধ্যে জনদ্ৰেত্তে মঁসিয়ে লেবলাঁকে একটা চেয়ারে বসিয়ে টেবিলের ধারে অন্য একটা চেয়ারে বসল।

বরফের মতো ঠাণ্ডা রাত্রি। পথে-ঘাটে পড়া তুষারকণার উপর চাঁদের আলো পড়ে চকচক করছিল। রাস্তার আলোগুলো মিটমিট করে জ্বলছিল। তার মাঝে এলমগাছে ঘেরা বুলভার্দ অঞ্চলের নির্জন পথটা বিস্তৃত হয়ে ছিল। গর্বোর আশপাশে প্রায় এক মাইলের মধ্যে কোনও জনমানব ছিল না। জনদ্ৰেত্তে’র ঘরের মধ্যে তখন একটা বাতি জ্বলছিল। একই টেবিলের দুধারে দুটো চেয়ারে দু জন লোক বসেছিল। একজনকে প্রশান্ত আর একজনকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল এবং একজন মহিলা ক্ষুধিত নেকড়ের মতো তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। আর এ ঘরে মেরিয়াস একা পিস্তল হাতে সেই টেবিলটার উপর দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধভাবে এক দুর্ঘটনার অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে ছিল।

মেরিয়াসের মনে তখন ভয়ের পরিবর্তে ছিল শুধু অপরিসীম ঘৃণা। পিস্তলের বাটে হাত দিয়ে সে নিজেকে আশ্বস্ত করে আপন মনে বলল, পশুটা কোনও অঘটন ঘটাতে চাইলে আমি তাকে থামাতে পারি। সে ভাবল, পুলিশ নিশ্চয় কোথাও আড়ালে লুকিয়ে আছে। পিস্তলের গুলির একটা আওয়াজ পেলেই ছুটে আসবে। তাছাড়া তার আশা হচ্ছিল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র সঙ্গে জনদ্ৰেত্তে’র সংঘর্ষ বাধলে সে হয়তো অনেক রহস্যময় কথা জানতে পারবে। যে রহস্যের কথা সে এতদিন জানতে পারেনি, এই ঘটনা হয়তো তার ওপর আলোকপাত করবে।

.

১৯.

মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার ঘরের দুটো শূন্য বিছানার দিকে তাকিয়ে বলল, আহত মেয়েটি কেমন আছে?

মুখে এক বিষণ কৃতজ্ঞতার হাসি ফুটিয়ে জনদেত্তে বলল, ভালো। এখনও যন্ত্রণা হচ্ছে। তার দিদি তাকে হাসপাতালে ক্ষতটা খোবার জন্য নিয়ে গেছে। এখনি ফিরে আসবে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, মাদাম ফাবান্ত সেরে উঠেছেন দেখছি।

সে দেখল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী দরজার কাছে পাহারা দেবার ভঙ্গিতে ভালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

জনদ্ৰেত্তে বলল, সে এখনও দারুণ অসুস্থ। কিন্তু কী করা যাবে বলুন। তার মনের জোর খুব বেশি। সে যেন এক নারী নয় যেন একটা ষড়।

এ কথায় তার স্ত্রী অনুযোগের সুরে বলল, তুমি সব সময় আমার প্রশংসা কর মঁসিয়ে জনদ্ৰেত্তে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, জনদ্ৰেত্তে? আমি তো জানতাম আপনার নাম ফাবান্ত।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল জনদ্ৰেত্তে, দুটোই আমার নাম। মঞ্চে যখন অভিনয় করতাম তখন আমার নাম ছিল জনদ্ৰেত্তে।

তার স্ত্রীর দিকে কড়াভাবে তাকাল জনদ্ৰেত্তে। মঁসিয়ে লেবলাঁ তা দেখতে পেল না।

জনদ্ৰেত্তে অন্য একটা বিষয়ের অবতারণা করে বলতে লাগল, আমরা স্বামী-স্ত্রী দু জনে কত সুখে জীবন যাপন করেছি একদিন। কিন্তু আমাদের ভাগ্য বড় খারাপ স্যার। আমাদের কাজ করার ইচ্ছা আছে, কাজ নেই। আমি জানি না দেশের সরকার কী করছে। জ্যাকবিনদের আমি কোনও ক্ষতি করতে না চাইলেও আমি নিজে কিন্তু গণতন্ত্রবাদীদের মতো জ্যাকবিন নই। আমি এখন বাধ্য হয়ে আমাদের মেয়েদের প্যাকিং-এর ব্যবসা শেখাতে চাই। আমাদের আগে যে অবস্থা ছিল তার তুলঁনায় এটা এক হীন ব্যবসা, কিন্তু যাই হোক, সভাবে জীবন যাপন করতে হবে। তো। আগেকার সৌভাগ্য আর সমৃদ্ধি তো আর নেই আমাদের। আমি ছবি আঁকার কাজ খুব ভালোবাসি। কিন্তু সে কাজ আমায় ছেড়ে দিতে হবে, কারণ খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে তো।

জনদ্ৰেত্তে যখন শান্তভাবে এইসব অসংলগ্ন কথাগুলো বলে চলেছিল মেরিয়াস তখন দেখল ঘরের মধ্যে এমন একজন এসে ঢুকল এর আগে সে ছিল না ঘরের মধ্যে। লোকটা এমন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকল যে দরজায় কোনও শব্দ হল না। তার গায়ে কোনও জামা ছিল না। গাঁয়ে ছিল শুধু একা ছেঁড়া ওয়েস্টকোট আর পায়ে দড়ি বাঁধা একজোড়া চটি। তার অনাবৃত হাতে উল্কি ছিল এবং তার মুখটা ছিল কালিমাখা। সে একটা বিছানায় জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রীর পেছনে বসল।

এক সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ সেদিকে তাকিয়ে লোকটাকে দেখে চমকে উঠল। জনদ্ৰেত্তে তা লক্ষ করল। সে বলল, আপনি বোধ হয় আপনার ওভারকোটটা দেখছেন। এটা আপনি ওবেলায় রেখে গিয়েছিলেন আমার জন্য। কোটটা সত্যিই চমৎকার। তাই নয় কি?

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, ওই লোকটি কে?

জনদ্ৰেত্তে বলল, ও? ও হচ্ছে আমার প্রতিবেশী, ওর দিকে নজর দেবার দরকার নেই।

ব্যাপারটাকে সত্যিই সহজভাবে নিল মঁসিয়ে লেবলাঁ। কারণ ফবুর্গ সেন্ট মার্সো অঞ্চলে ওষুধের কারখানায় যেসব শ্রমিক কাজ করে তাদের মুখগুলো এমনি দেখায়।

নিজেকে সামলে নিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আপনি কী বলেছিলেন মঁসিয়ে ফাবান্ত?

জনদ্ৰেত্তে বলল, আমি বলেছিলাম, আমার একটা ছবি বিক্রি করার আছে।

দরজার কাছে একটা মৃদু শব্দ হল। আর একজন লোক বাইরে থেকে ঘরে ঢুকে সেই বিছানায় বসল। প্রথম লোকটার মতো তার হাত দুটোও অনাবৃত ছিল এবং তার মুখেও কালি ছিল। সে নিঃশব্দে প্রবেশ করলেও মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দৃষ্টি তার ওপর পড়ল।

জনদ্ৰেত্তে বলল, চিন্তার কোনও কারণ নেই। ওরা এই বাড়িতেই থাকে। আমার ছবিটা দামি। আপনি যদি অনুমতি দেন সেটা দেখাই আপনাকে।

সে উঠে গিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে একটা ছবি তুলে আনল। বাতির আলোয় দেখা গেল সেটা সত্যিই একটা বড় ছবি। মেরিয়াস ছবিটাকে ভালো করে দেখতে পেল না। কারণ জনদ্ৰেত্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মেরিয়াস দেখল একটা প্ল্যাকার্ডের মতো পিচবোর্ডের উপর রঙ দিয়ে আঁকা একটা ছবি।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, এটা কিসের ছবি?

জনদ্ৰেত্তে বলল, ছবিটা দারুণ এবং খুব দামি। ছবিটাকে আমি এবং আমার মেয়েরা খুব ভালোবাসি। কিন্তু অবস্থার বিপাকে এটা বিক্রি করতে হবে আমায়।

মঁসিয়ে লেবলাঁ একটা অস্বস্তি বোধ করায় ছবিটা দেখতে দেখতে ঘরের চারপাশে তাকাতে লাগল। দেখল তখন ঘরে চারজন বাইরের লোক এসে ঢুকেছে। তিনজন বিছানায় বসেছে আর একজন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবারই হাতগুলো অনাবৃত ছিল এবং মুখগুলো কালিমাখা ছিল। সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। বিছানার উপর যারা বসে ছিল তাদের একজন চোখ বন্ধ করে অর্ধশায়িত অবস্থায় ছিল। তাকে মনে হচ্ছিল সে ঘুমোচ্ছে। তার মাথার চুলগুলো একেবারে সাদা ছিল। অন্য দু জন বয়সে যুবক। তাদের পায়ে জুতো বা চটি ছিল না।

মঁসিয়ে লেবলাঁ তাদের দেখছে দেখে জনদ্ৰেত্তে বলল, ওরা সবাই আমার বন্ধু এবং প্রতিবেশী। ওরা সবাই কারখানার ফার্নেসে কাজ করে বলে ওদের মুখগুলো ময়লা এবং কালিমাখা। ওদের কথা ভাববেন না স্যার। আমার ছবিটা আপনি কিনুন। আমার দুরবস্থায় করুণা করুন। আমি আপনাকে সস্তায় দেব। এর কত দাম হতে পারে? আপনার কী ধারণা?

মঁসিয়ে লেবলাঁ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জনদ্ৰেত্তে’র পানে তাকিয়ে বলল, ছবিটা একটা হোটেলের সামনে রাখা ছিল। এর দাম হবে তিন ফ্রাঁ।

জনদ্ৰেত্তে নরম গলায় শান্তভাবে বলল, আপনার কাছে টাকার ব্যাগটা আছে? আমি এটার জন্য চাই এক হাজার ক্রাউন।

মঁসিয়ে লেবলাঁ এবার সতর্ক হয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখল জনদ্ৰেত্তে তার বাঁ দিকে আর তার স্ত্রী আর চারজন লোক দরজার কাছে তার ডানদিকে আছে। জনদ্ৰেত্তে তখন এমন সকরুণভাবে কথা বলে যাচ্ছিল যে মঁসিয়ে লেবলাঁ ভাবল এক দুর্ভাগ্যপীড়িত একজন মানুষ খুবই বিব্রত হয়ে পড়েছে; তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনও মিল নেই।

জনদ্ৰেত্তে বলে যেতে লাগল, আপনি যদি ছবিটা না কেনেন তা হলে আমাকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে মরতে হবে। আমি আমার মেয়েদের প্যাকিং-এর ব্যবসা করতে বলেছিলাম। কিন্তু তার জন্য একটা টেবিল ও অনেক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। ঘরটা পরিষ্কার রাখতে হবে। অনেক খেটে চার ঘণ্টা কাজ করে মাত্র চার স্যু পাওয়া যাবে। তাতে কখনও চলে?

কথা বলার সময় মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে তাকাচ্ছিল না জনদ্ৰেত্তে। কিন্তু মঁসিয়ে লেবলাঁ’র দৃষ্টি তার ওপর বরাবর নিবদ্ধ ছিল। জনদ্ৰেত্তে শুধু বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছিল। মেরিয়াস তখন তাদের দু জনকেই দেখছিল। মঁসিয়ে লেবলাঁ শুধু তখন একটা কথাই ভাবছিল, লোকটা কি পাগল হয়ে গেছে! জনদেত্তে তখন একটা কথাই বারবার বলে যাচ্ছিল, নদীতে ডুবে মরা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই। একদিন আমি মরতে গিয়েছিলাম…

সহসা তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলে উঠল। তার চেহারাটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। সে মঁসিয়ে লেবলাঁর সামনে এসে বলল, ও সব কথা এখন থাক। আপনি আমাকে চিনতে পারছেন?

.

২০.

ঘরের দরজাটা হঠাৎ খুলে গেল। বাইরে থেকে আরও তিনজন লোক এসে ঢুকল। তাদের পরনে ছিল কালো আলখাল্লা আর মুখে কাগজের মুখোশ। প্রথম লোকটার হাতে ছিল একটা ধারালো দা। দ্বিতীয় লোকটার হাতে ছিল একটা কুড়ুল আর তৃতীয় লোকটার হাতে ছিল একটা বড় চাবি।

জনদ্ৰেত্তে হয়তো এদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে লোকগুলোকে বলল, সব ঠিক আছে?

একটা রোগা মতো লোক বলল, হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।

কিন্তু মঁতপার্নেসি কোথায়?

সে আপনার বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে।

গাড়ি প্রস্তুত?

হ্যাঁ।

দুটো ভালো ঘোড়া?

হ্যাঁ, খুব ভালো।

জনদ্ৰেত্তে বলল, ঠিক আছে।

মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখখানা ম্লান হয়ে গেল। ভীত হওয়ার থেকে সে বিস্মিত হল বেশি। সে শুধু লোকগুলোকে দেখতে লাগল। সামনে টেবিলটাকে সে একটা বাধা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইল। ভয়ের কোনও চিহ্ন দেখা গেল না। যে কত ভালো ব্যবহার করছিল সে হঠাৎ একজন বলিষ্ঠ ব্যায়ামবিদের মতো ভয়ঙ্করভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠল। সে তার চেয়ারের পেছনটা শক্ত হাতে ধরে ছিল। বিপদের মুখে তার সাহস বেড়ে যেত। সদাশয়তার মতো তার সহিষ্ণুতাও ছিল অসাধারণ। তা দেখে তার প্রেমাস্পদের পিতা হিসেবে মঁসিয়ে লেবলাঁ’র জন্য গর্ববোধ করতে লাগল মেরিয়াস।

যে তিনজন লোক কারখানার ফার্নেসে কাজ করে বলে পরিচয় দিয়েছিল জনদ্ৰেত্তে, তারা ঘরের কোণে যেখানে কতকগুলি লোহার যন্ত্রপাতি ছিল সেখানে গিয়ে সেখান থেকে হাতুড়ি প্রভৃতি লোহার কতকগুলি অস্ত্র তুলে এনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল। বিছানায় যে বড় লোকটা ঘুমোচ্ছিল তার পাশে বসেছিল জনদ্ৰেত্তে’র স্ত্রী।

মেরিয়াস ভাবল এবার তার পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার সময় এসে গেছে। এবার পুলিশকে আসার জন্য সঙ্কেত জানাতে হবে। এদিকে জনদ্ৰেত্তে একটা লোকের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ফিরে এক নিষ্ঠুর হাসি হেসে বলল, আমাকে চিনতে পারছেন না?

না।

জনদ্ৰেত্তে তার কাছে আরও এগিয়ে গিয়ে হিংস্র জন্তুর মতো মুখটা বাড়িয়ে বলল, আমার নাম মঁসিয়ে ফাবান্ত বা জনদ্ৰেত্তে নয়, আমি হচ্ছি মঁতফারমেলের হোটেলমালিক থেনার্দিয়ের। শুনতে পাচ্ছেন? এবার আমাকে চিনতে পারছেন না?

মৃদু কম্পনের একটা ছোট্ট ঢেউ খেলে গেল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখে। কিন্তু সে শান্তভাবে নরম সুরে বলল, না, চিনতে পারছি না।

কেউ যদি সেই মুহূর্তে মেরিয়াসের মুখপানে তাকাত তা হলে সে দেখতে পেত ভয়ে অভিভূত হয়ে উঠেছে সে মুখ। থেনার্দিয়েরের নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহটা এমনভাবে কেঁপে ওঠে যে পার্টিশানের দেয়াল ধরে না ফেললে পড়ে যেত সে। তার মনে হল কে যেন একটা তীক্ষ্ণ তরবারি ঢুকিয়ে দিয়েছে তার বুকের ভেতর। তার যে হাত পিস্তলটা ধরে গুলি করার জন্য উদ্যত হয়ে উঠেছিল সে হাতটা আপনা থেকে ঢলে পড়ল। আর একটু হলে পিস্তলটা পড়ে যেত মেঝের উপর। জনদ্ৰেত্তে তার আসল পরিচয়টা দিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁকে কাঁপাতে পারেনি, কিন্তু মেরিয়াসের অন্তরটাকে দীর্ণ বিদীর্ণ করে দিয়েছে। আমরা জানি এ পরিচয়ের মানে কী। মঁসিয়ে লেবলাঁ হয়তো এ নামের সঙ্গে পরিচিত না থাকতে পারে, কিন্তু মেরিয়াস এ নামের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। তার বাবার কথাগুলো অন্তরে আজও গাঁথা আছে তার। তার বাবার একটা চিঠিতে লেখা ছিল, ‘থেনার্দিয়ের নামে একটি লোক আমাকে বাঁচিয়েছিল। আমার পুত্র কোনওদিন যদি তার দেখা পায় তা হলে সে তাকে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।’ মেরিয়াসের কাছে এ কথা যেন এক ধর্মীয় আইন এবং আদেশ। মঁতফারমেলের হোটেলমালিক যে থেনার্দিয়েরকে সে কত খুঁজছে, যে থেনার্দিয়ের তার পিতার রক্ষাকর্তা, সে আসলে একজন দস্যু, নরঘাতক এবং এই মুহূর্তে এক জঘন্য অপরাধ করতে চলেছে। অদৃষ্টের পরিহাস এর থেকে নির্মম কখনও হতে পারে না। চার বছর ধরে মেরিয়াস তার ওপর চাপিয়ে চাপিয়ে ঋণের বোঝা থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য যাকে কত খুঁজে আসছে আজ তাকেই হয়তো জেলে বা ফাঁসির মঞ্চে পাঠাতে হবে। আজ তার পিতার রক্ষাকর্তাকে তাকেই শাস্তি দিতে হবে। কিন্তু তা না করে সে কী করে থাকবে? কী করে সে নীরবে ও নিষ্ক্রিয়ভাবে এই জঘন্য অপরাধ ও অপকর্ম নিজের চোখে দেখবে, কী করে এ কাজ ঘটতে দেবে সে? কী করে একই সঙ্গে অপরাধী এবং যার ওপর অপরাধ করা হচ্ছে তাদের দু জনকে রক্ষা করবে? এই ধরনের দুষ্ট প্রকৃতির লোকের কাছে কোনও ঋণ থাকলে সে ঋণ কি সংগত বলে বিবেচিত হতে পারে? কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারল না মেরিয়াস। তার সর্বাঙ্গ শুধু কাঁপতে লাগল। এখন তারই ওপর নির্ভর করছে সব কিছু। যদি সে এখন পিস্তল থেকে গুলি করে তা হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ বেঁচে যাবে, কিন্তু থেনার্দিয়ের ধ্বংস হবে। আর তা না হলে মঁসিয়ে লেবলাঁ মারা যাবে আর থেনার্দিয়ের পালিয়ে যাবে। কিন্তু মেরিয়াসকে কিছু একটা করতেই হবে। দু জনের একজনকে বাঁচাতেই হবে। সে কি তার পিতার শেষ ইচ্ছা পূরণ করে তার শপথ পালন করে এই অপকর্ম ঘটতে দেবে, নাকি পিতার আত্মার প্রতি প্রদত্ত শপথ ভঙ্গ করে মঁসিয়ে লেবলাঁকে বাঁচাবে? তার মনে হল দুটো কণ্ঠস্বর তার কানে এসে বাজছে–একটি কণ্ঠস্বর হল তার প্রেমাস্পদ সেই মেয়েটির যে তার পিতাকে বাঁচাবার জন্য কাতর মিনতি জানাচ্ছে তাকে আর একটি কণ্ঠস্বর হল তার পিতার যে থেনার্দিয়েরকে বাঁচাতে বলছে। তার মনে হল সে যেন ক্রমশই তার চেতনা ও সমস্ত বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছে এবং তার হাঁটু দুটোর জোর কমে আসছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। তার চোখের সামনে যে নাটক অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে, অবিলম্বে তার গতি রোধ না করলে আর কোনও উপায় থাকবে না। মনে হল যেন এক প্রবল ঘূর্ণিবায়ু তাকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে এখনি মূৰ্ছিত হয়ে পড়বে।

এদিকে থেনার্দিয়ের পাগলের মতো ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে বাতিটা তাকের উপর জোরে নামিয়ে রেখে মঁসিয়ে লেবলাঁ’র কাছে এসে বলতে লাগল, অবশেষে আমি তা হলে তোমাকে পেয়ে গেছি। আমি তোমাকে ঠিক চিনেছি, কিন্তু তুমি আমাকে চিনতে পারনি। তুমিই কি একদিন খ্রিস্টোৎসবের সময় মঁতফারমেলে আমার হোটেলে এসে ফাঁতিনের মেয়েটাকে নিয়ে যাওনি? তোমার গাঁয়ে তখন কি একটা হলুদ রঙের কোট আর হাতে জামাকাপড়ের পুঁটলি ছিল না? মনে হচ্ছে ওঁর যেন দান করার একটা বাতিক আছে, উনি সবাইকে জামাকাপড় বিলিয়ে বেড়ান। উদারহৃদয় লক্ষপতি, তুমি তা হলে আমাকে চিনতে পারলে না? তোমাকে এবার মজা দেখাচ্ছি। তুমি মনে করেছ হাসপাতালের কিছু পুরনো পোশাক আর একটা ওভারকোট দিয়ে পার হয়ে যাবে!

থেনার্দিয়ের একটু থামল। তার মনে হল সে যেন তার ক্রোধের সব আবেগটুকু নিঃশেষে ঢেলে দিয়েছে। তার পর সে হঠাৎ টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে বলল, উনি যেন কিছু জানেন না। ওঁর মুখে যেন মাখন গলে না!

এরপর মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মুখটা ঘুরিয়ে বলতে লাগল, একদিন তুমি আমাকে হারিয়ে দিয়ে চলে যাও। তুমিই আমার সব দুঃখ-বিপর্যয়ের কারণ। মাত্র পনেরোশো ফ্রাঁ দিয়ে মেয়েটাকে নিয়ে যাও তুমি। সে আমার কাছে থাকলে আমি অনেক টাকা পেতাম এবং তাতে আমার জীবনটা ভালোভাবেই কেটে যেত। তার অনেক ধনী আত্মীয় ছিল। তার থেকে অনেক টাকা আমি পেয়েও ছিলাম। আমার হোটেল ভালো চলত না। যত সব বাজে খরিদ্দার মদ খেতে আসত প্রায় বিনা পয়সায়। দেনায় পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সে থাকলে তার টাকায় আমি সব দেনা মিটিয়ে ফেলতাম একে একে। আমি কারবারের পুঁজিটাকেও খেয়ে ফেলতে বাধ্য হই। তুমি সেদিন আমাকে বনে খুব বোকা বানিয়েও যাও। বনে কোনও লোক ছিল না। তুমি আমার থেকে বেশি শক্তিশালী ছিলে। এবার আমার পালা। আমি তোমাকে বোকা বানাব। আমি বলেছিলাম আগামীকাল ৪ ফেব্রুয়ারি, বাড়িভাড়া মেটাতে হবে। কবে কোন তারিখ সেটাও তোমার জ্ঞান নেই। আর মাত্র ষাট ফ্রাঁ উনি ভিক্ষে দিতে এসেছেন। পুরো একশো ফ্ৰাও আনেননি। আজ এখন আমার বলতে ইচ্ছা করছে, সকালে তোমার পা চেটেছিলাম, রাত্রে তোমার হৃৎপিণ্ড কাটব।

শ্বাস নেবার জন্য থামল থেনার্দিয়ের। সে হাঁপাচ্ছিল। তার বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল। এক হীন জয়ের পৈশাচিক আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে হয়ে উঠল তার চোখ দুটো। তাতে তার কাপুরুষোচিত দুষ্ট প্রকৃতিটা ফুটে উঠল। এইভাবে সে যেন তার জয়ের বস্তুকে জয় করতে চায়। বামন হয়ে সে দৈত্যের বুকে পা দিয়ে দাঁড়াতে চায়। একটা শেয়াল যেন রুগ্‌ণ ষাড়ের পাজরে কামড় দিতে চায়।

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আমি বুঝতে পারছি না তোমরা কী বলছ। তোমরা ভুল করছ। আমি একজন সামান্য গরিব লোক, লক্ষপতি তো দূরের কথা। আমি তোমাদের চিনি না। তোমরা হয়তো অন্য কারও সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছ।

থেনার্দিয়ের গর্জন করে উঠল, তুমি সেই এক কথা বলছে। তুমি স্মরণ করতে পারছ না? আমি কে সে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই।

মঁসিয়ে লেবলাঁ শান্তভাবে বলল, না, মোটেই না। তবে, তোমার প্রকৃতিটা আমি বুঝতে পেরেছি। বুঝেছি কী ধরনের মানুষ তুমি। তুমি একটি কাপুরুষ।

এই অবস্থায় সে যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় কথাগুলো বলল তা সত্যিই প্রশংসনীয়।

‘কাপুরুষ’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে থেনার্দিয়ের-পত্নী লাফিয়ে উঠল। থেনার্দিয়ের একটা চেয়ার ধরে গর্জন করে বলল, তুমি যেখানে আছে সেখানেই থাক।

এরপর সে মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ফিরে বলতে লাগল, কাপুরুষ, তাই না? তোমরা ধনীরা আমাদের মতো গরিবদের এই কথাই বলবে। আমি ব্যবসায় ব্যর্থ হয়েছি, লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার পকেটে পয়সা নেই–আমি কাপুরুষই বটে। তোমরা দামি জুতো আর আর্কবিশপদের মতো দামি কোট পর। তোমরা ভালো বাড়িতে থাক যে বাড়িতে দারোয়ান থাকে। তোমরা খবরের কাগজে আবহাওয়ার সংবাদ পড়ে দামি থার্মোমিটারে তাপমাত্রা দেখ। আর আমরা নিজেরাই থার্মোমিটার। আমাদের কোনও থার্মোমিটারের দরকার হয় না। ঠাণ্ডায় আমাদের দেহের রক্ত হিম হয়ে যায়। এবং আমরা তখন বলি, ঈশ্বর নেই। আমার তোমরা আমাদের এই শুয়োরের খোয়াড়ে এসে আমাদের কাপুরুষ বল। কিন্তু আমরা যা-ই হই না কেন, তোমাদের চিবিয়ে খাব, তোমাদের গায়ের মাংস খাব। তবে শুনে রাখ পালকের পোশাকপরা লক্ষপতি, আমিও একদিন সভাবে ব্যবসা করতাম, আমি ছিলাম এক লাইসেন্সধারী হোটেল মালিক। আমার ভোট দেবার অধিকার ছিল, আমি ছিলাম এক সম্ভ্রান্ত নাগরিক।

এবার সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লোকগুলোকে লক্ষ করে বলল, উনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমি একজন পকেটমার।

থেনার্দিয়ের আবার মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে ঘুরে বলল, শুনে রাখ পরোপকারী বন্ধু, আমি যে-সে নই, চোরও নই। আমি ফ্রান্সের এক ভূতপূর্ব সৈনিক। আমার একটা মেডেল পাওয়া উচিত ছিল। আমি ওয়াটারলুতে যুদ্ধ করি এবং আমি একজন সেনাপতিকে বাঁচাই যিনি ছিলেন একজন কাউন্ট উপাধিধারী। তিনি তার নাম বলেছিলেন, কিন্তু আমি তা শুনতে পাইনি। তাঁর নাম আর ঠিকানাটা জানলে আমার উপকার হত। যে ছবিটা আমি দেখিয়েছি সেটা ডেভিডের আঁকা। শিল্পী আমাকে তাতে অমর করে রেখেছে। আমাকে যুদ্ধরত অবস্থায় দেখানো হয়েছে। আমি সেই জেনারেলকে পিঠে করে গোলাগুলির মধ্য দিয়ে নিরাপদ জায়গায় বয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম। এই হল আমার কাহিনী। অবশ্য সে জেনারেল আমার কোনও উপকার করেননি। তিনিও আপনাদের মতো। যাই হোক, আমার হাতে প্রমাণ আছে। আমি হচ্ছি ওয়াটারলু যুদ্ধের একজন নির্ভীক সৈনিক। যাই হোক, এখন আমি আমার পরিচয় দিলাম। এবার কাজের কথায় আসা যাক। আমার এখন টাকা চাই।

মেরিয়াস তার আবেগানুভূতিকে সংযত করার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে। সে আবার কান পেতে পাশের ঘরের সব কথাবার্তা শুনতে লাগল। সে বুঝতে পারল এই লোকই হচ্ছে তার বাবার চিঠিতে উল্লিখিত থেনার্দিয়ের। এই থেনার্দিয়ের আবার তার বাবার অকৃতজ্ঞতার জন্য অভিযোগ করল। থেনার্দিয়েরের প্রতিটি আবেগে উচ্ছ্বাসে, তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে, তার জ্বলন্ত চোখের উত্তাপে, দুঃখকষ্টের সঙ্গে সঙ্গে তার পাপপ্রবৃত্তির নির্লজ্জ অভিব্যক্তিতে একই সঙ্গে এক ধ্বংসাত্মক জীবন আর তার সঙ্গে সঙ্গে এক মর্মস্পশী সত্যের আবেদন ছিল।

থেনার্দিয়ের যে ছবিটা দেখিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁকে কিনতে বলে, আসলে সে ছবিটা তার নিজেরই আঁকা। ছবিটা সে মঁতফারমেলের হোটেলের সামনে টাঙিয়ে রাখত। থেনার্দিয়ের তখন ছবিটার সামনে না থাকায় মেরিয়াস এবার ছবিটাকে ভালো করে দেখতে পেল। সে দেখল ছবিতে সত্যিই যুদ্ধক্ষেত্রের একটা দৃশ্য চিত্রিত হয়েছে। সে দৃশ্যে একজন বীর সার্জেন্ট একজন অফিসারকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ছবিটাতে তার বাবা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। মেরিয়াসের মনে হল, সহসা অনাবৃত উন্মুক্তদ্বার এক সমাধিগহ্বর থেকে তার পিতার পুনরথিত প্রেতমূর্তি উঠে এসেছে। সে যেন ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্রের কামানের গর্জন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। মনে হল মোটা হাতে স্থূলভাবে আঁকা তার পিতার রক্তাক্ত দেহটা সহসা জীবন্ত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

থেনার্দিয়ের তখন হাঁফ ছেড়ে কড়াভাবে মঁসিয়ে লেবলাঁকে বলল, আমরা আমাদের কাজ করার আগে তোমার কিছু বলার আছে?

মঁসিয়ে লেবলাঁ কোনও কথা বলল না।

তখন দরজার সামনে কুড়ুল হাতে একটা লোক মোটা গলায় বলল, যদি কোনও কাটাকাটি করার কাজ থাকে তো আমি আছি।

থেনার্দিয়ের বলল, তুমি তোমার মুখোশটা খুলে রেখেছ কেন?

মঁসিয়ে লেবলাঁ এতক্ষণ থেনার্দিয়েরের প্রতিটি গতিভঙ্গি লক্ষ করে যাচ্ছিল। সে দেখল দলে মোট নয়জন লোক রয়েছে। থেনার্দিয়ের তার দিকে পেছন ফিরে দরজার কাছে দাঁড়ানো লোকগুলোর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। এই সুযোগে মঁসিয়ে লেবলাঁ তার সামনের টেবিল আর চেয়ারটা উল্টে দিয়ে এক মুহূর্তে জানালার ধারে চলে গেল। পালাবার জন্য জানালা দিয়ে উঁকি মেরে নিচে তাকাতে লাগল। কিন্তু দু জন লোক তাদের শক্ত হাত দিয়ে ধরে ফেলল তাকে। তাদের মধ্যে তিনজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল মঁসিয়ে লেবলাঁ’র উপর। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তার মাথার চুলগুলোকে ধরে ফেলল।

হইচই শুনে বারান্দায় অপেক্ষমাণ লোকগুলো ছুটে এল। যে বুড়ো লোকটা বিছানায় ঘুমোচ্ছিল সে একটা হাতুড়ি নিয়ে উঠে পড়ল। পানশাদ বা বিগ্রেনেল নামে লোকটা তার হাতের দা-টাকে ঘোরাতে লাগল।

মেরিয়াস আর সহ্য করতে পারল না। সে মনে মনে বলল, আমাকে ক্ষমা কর পিতা, তোমার কথা আমি রাখতে পারব না।

এই বলে সে পিস্তলের ঘোড়ায় হাত দিল। এমন সময় থেনার্দিয়ের বলল, ওকে কোনওরূপ আঘাত করো না।

বন্দির অবস্থা দেখে থেনার্দিয়েরের রাগের পরিবর্তে ধৈর্য বেড়ে গেল। তার মধ্যে যেন দুটো মানুষ ছিল একটা পশু আর একটা চতুর মানুষ। তার শিকার বা বন্দি মানুষটাকে বেকায়দায় ফেলে তাকে করায়ত্ত করার ব্যাপারে তার পাশবিক প্রবৃত্তিটা কাজ করছিল। কিন্তু যখন দেখল বন্দি লোকটা ঘুষি মেরে দু তিনজনকে ঘায়েল করে ফেলে দিল তখন তার মধ্যে চতুর মানুষটা প্রাধান্য লাভ করল। সে আবার বলল, ওকে আঘাত করো না।

কেউ বন্দিকে আঘাত না করায় মেরিয়াস গুলি করতে গিয়েও করল না। সে দেখতে লাগল এরপর কী হয়। সে ভাবল হয়তো শেষ মুহূর্তে কিছু একটা ঘটবে যার ফলে তার প্রেমাস্পদের পিতার প্রাণনাশ হবে না, আর তার পিতার রক্ষাকর্তাকেও মারতে হবে না।

এদিকে মঁসিয়ে লেবলাঁ সেই বুড়ো লোকটাকে একটা ঘুষি মেরে ফেলে দিল এবং আও দু জনকে ফেলে দিল। কিন্তু বাকি চারজন লোক তার হাত আর ঘাড়টা ধরে রইল। অর্ধ বিজেতা আর অর্ধ বিজিত অবস্থায় মঁসিয়ে লেবলাঁ একদল শিকারি কুকুর-পরিবৃত এক বনশুয়োরের মতো বসে রইল এক জায়গায়।

লোকগুলো বন্দিকে ধরে জানালার ধারে একটা বিছানায় বসাল। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তখনও মঁসিয়ে লেবলাঁ’র মাথার চুলগুলো ধরে ছিল।

থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে বলল, তুমি ছেড়ে দাও, তোমার শাল ছিঁড়ে যাবে।

স্বামীর কথায় বন্দির মাথাটা ছেড়ে দিল থেনার্দিয়ের-পত্নী।

থেনার্দিয়ের বলল, ওর পকেটগুলো খুঁজে দেখ কী আছে।

লোকগুলো বন্দির সব পকেট খুঁজে মাত্র ছ ফ্রাঁ আর রুমাল পেল। থেনার্দিয়ের বলল, টাকার কোনও প্যাকেট নেই?

একজন লোক বলল, হাতঘড়িও নেই।

মুখোশপরা লোকটা বলল, লোকটা চতুর এবং পুরনো পাপী।

থেনার্দিয়ের সেই দড়ির মইটা দিয়ে তার লোকদের বলল, ওকে ভালো করে বেঁধে রাখ। খাটের পায়ার সঙ্গে ওর পা দুটোকে বেঁধে দাও।

যে বুড়ো লোকটা মঁসিয়ে লেবলাঁ’র ঘুষি খেয়ে মড়ার মতো পড়েছিল তার দিকে তাকিয়ে থেনার্দিয়ের বলল, বুনায়েল কি মরে গেছে?

বিগ্রেনেল বলল, না, মদ খেয়ে ও মাতাল হয়ে আছে।

থেনার্দিয়ের বলল, ওকে সরিয়ে দাও।

কয়েকজন লোক বুনায়েলকে ধরাধরি করে ঘরের এককোণে লোহার যন্ত্রপাতিগুলোর গাদায় শুইয়ে দিল। এরপর থেনার্দিয়ের বলল, শোন বাবেত, এত লোক এনেছ কেন? এত লোক তো আমাদের দরকার নেই।

বাবেত বলল, কী করব, ওরা ছাড়ল না, জোর করে এল।

এদিকে হাসপাতালের বিছানার মতো চারটে কাঠের খুঁটিওয়ালা যে বিছানাটায় মঁসিয়ে লেবলাঁকে বসানো হয়েছিল, থেনার্দিয়ের সেই বিছানাটার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে অন্য লোকদের বলল, তোমরা একটু সরে যাও। আমি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

পথনার্দিয়েরের এই আকস্মিক ভাবান্তর দেখে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেল মেরিয়াস। একটু আগে তার যে মুখখানায় প্রচণ্ড রাগে ফেনা ভাসছিল সে মুখে এখন এক শান্ত হাসি ফুটে উঠেছে। তার এই আশ্চর্য ভাবান্তর দেখে মেরিয়াসের মনে হল একটা বাঘ যেন হঠাৎ অ্যাটর্নি হয়ে গেছে।

শান্ত কণ্ঠে বলল থেনার্দিয়ের, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পালাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাতে আপনার পা ভেঙে যেত। যাই হোক, এখন শান্তভাবে আমরা কিছু আলোচনা করতে পারি। তবে একটা কথা, তার আগে না বলে পারছি না। এত সব মারামারি আর গোলমালের মধ্যে আপনি একবারও চিৎকার করেননি।

কথাটা অস্বীকার করা যায় না। খুব বিচলিত হয়ে পড়লেও মেরিয়াস এটা লক্ষ করেছে। গোলমালের সময় মঁসিয়ে লেবলাঁ যে সব কথা বলেছে তা যথা সম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলেছে। এমনকি সে যখন লোকগুলোর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করে তখনও মুখে একটা কথাও বলেনি।

থেনার্দিয়ের বলল, আপনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে পারতেন। তা যদি করতেন আমরা তা হলে বিস্মিত হতাম না। আমরা আপনার গলা টিপে ধরিনি। কারণ আমরা জানি এ জায়গাটা এমনই যে এখানকার কোনও শব্দ বাইরে যায় না। এখান থেকে কেউ বোমা ছুঁড়লে বা গুলি করলে পুলিশরা ভাববে ওসব মাতালদের কাণ্ড। তবে কেন আপনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করেননি তার কারণ আমি জানি। কারণ আপনি জোরে চিৎকার করলে হয়তো পুলিশ আসত আর পুলিশ মানেই আইন। সেই আইনকে আপনি ভয় পান ঠিক আমরা যেমন আইন আর পুলিশকে ভয় পাই। এটা আমি অনেক আগে থেকে সন্দেহ করেছিলাম যে আপনার জীবনে গোপনীয় একটা ব্যাপার আছে। আমাদেরও ঠিক সেই অবস্থা। সুতরাং আলোচনার মাধ্যমে একটা বোঝাপড়ায় আসা যাক।

এইভাবে কথা বলার সময় মঁসিয়ে লেবলাঁর পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল থেনার্দিয়ের। তার ভাষা এবং শয়তানসুলভ নৈপুণ্য, কথা বলার সুচতুর ভঙ্গিমা, তার উদ্ধত অথচ অবদমিত আত্মাভিমান–তখন যদি কেউ দেখত তা হলে ভাবত থেনার্দিয়ের সত্যিই একজন যাজক হতে পারত।

থেনার্দিয়েরের কথাগুলো মঁসিয়ে লেবলাঁ সম্বন্ধে রহস্যটা ঘন করে তুলঁল আরও মেরিয়াসের মনে। সাধারণত এই অবস্থায় মানুষ যা করে তা না করে বাদি যা করল তা সত্যিই অদ্ভুত। আবার থেনার্দিয়ের তার এই এই অদ্ভুত আচরণ সম্বন্ধে যে মন্তব্য করল এক বিজ্ঞ কূটনীতিকের মতো, সে মন্তব্য মঁসিয়ে লেবলাঁ সম্বন্ধে এক রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠল। কিন্তু সে যাই হোক, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় এক দল খুনির দ্বারা পরিবৃত হয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ যে এক নিষ্ক্রিয় ঔদাসীন্যের সঙ্গে যেভাবে থেনার্দিয়েরের প্রচণ্ড ক্রোধাবেগের অভিব্যক্তি এবং শান্তশীতল বিষোদ্গার নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে, তা তার মুখমণ্ডলকে এক বিষণ্ণ মহিমায় মণ্ডিত করে তুলেছে। এর থেকে বেশ বোঝা যায় তার আত্মা ভয় বা আতঙ্ক কাকে বলে তা জানে না। এক বিপজ্জনক পরিস্থিতিজনিত সব বিস্ময়কে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে। পরিস্থিতি যত সংকটজনকই হোক না কেন, বিপদ যতই আসন্ন বা অপরিহার্য হোক না কেন, এক নির্ভীক নিরাসক্তির সঙ্গে তার সম্মুখীন হতে পারে সে।

সহসা উঠে পড়ল থেনার্দিয়ের। চুল্লির উপর জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটাকে আড়াল করে যে পর্দাটা টাঙানো ছিল সেটা সরিয়ে দিতে সেই কড়াইয়ের উপর যে লোহার বাটালিটা বসানো ছিল সেটা চোখে পড়ল। তার পর সে মঁসিয়ে লেবলাঁর সামনের চেয়ারটাতে আবার বসল। সে বলল, এবার আমরা একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারি। আমি যে রেগে গিয়েছিলাম সেটা ঠিক হয়নি। আমার মাথা ঠিক ছিল না এবং আমি অনেক বাজে কথা বলেছি। যেমন আমি বলেছিলাম, যেহেতু আপনি লক্ষপতি সেইহেতু আমি অনেক টাকা চাই আপনার কাছ থেকে। কিন্তু সেটা কখনও যুক্তিসঙ্গত কথা নয়। আপনি যত ধনীই হন না কেন, আপনারও খরচ আছে। আপনাকে নিঃস্ব করা উদ্দেশ্য নয় আমার। আমি রক্তচোষা নই। আমি সেই ধরনের লোক নই যারা কোনও মানুষকে হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়ে এমন দাবি করে বসে, যা অযৌক্তিক ও হাস্যাস্পদ। আমি দু দিকই বজায় রেখে চলতে চাই। আমি শুধু আপনার কাছ থেকে দু লক্ষ ফ্রাঁ চাই।

মঁসিয়ে লেবলাঁ কোনও উত্তর দিল না। থেনার্দিয়ের বলে চলল, আমি আপনার প্রকৃত অবস্থার কথা জানি না। তবে জানি টাকা-পয়সার প্রতি আপনার কোনও মায়া নেই এবং আপনি গরিব-দুঃখীদের দান করার মতো অনেক ভালো কাজ করে থাকেন। সুতরাং আপনি এক দুস্থ পরিবারের পিতাকে দু লক্ষ ফ্ৰাঁ অবশ্যই দান করতে পারেন। আপনি একজন যুক্তিবাদী লোক এবং আপনি দেখতে পাচ্ছেন এ ব্যাপারে কয়েকজন ভদ্রলোককে সাহায্যকারী হিসেবে আনতে হয়েছে। এঁরা এ বিষয়ে সকলেই একমত হবেন যে আমি যা চাইছি সেটা মোটেই বেশি নয়।

তাতে কোনওরকমের মোটা ভাত মোটা কাপড়সহ আমার বাকি জীবনটা কেটে যাবে। আমি শুধু চাই দু লক্ষ ফ্রাঁ। আমি কথা দিচ্ছি, এই টাকা ছাড়া আর আমি কখনও কিছুই চাইব না আপনার কাছ থেকে, আপনার আর ভয়ের কিছু থাকবে না। আপনি হয়তো বলতে পারেন, এখন আপনার কাছে অত টাকা নেই। আমিও অত বোকা নই যে তা আশা করব। এখন আমি শুধু বলছি, আপনি আমার কথামতো একটা চিঠি লিখুন।

এখানে থামল থেনার্দিয়ের। কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার দিকে একবার চাইল। তার পর বলল, আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনি লিখতে না জানার ভান করবেন না।

সে অদ্ভুত এক অর্থপূর্ণ হাসি হেসে টেবিলটা মঁসিয়ে লেবলাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে কাগজ-কলম বার করার জন্য ড্রয়ার খুলতেই তার মধ্যে একটা বড় ছুরি দেখা গেল। থেনার্দিয়ের একটা কাগজ মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাতে দিয়ে বলল, লিখুন।

বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ এই প্রথম কথা বলল, আমার হাত বাঁধা থাকলে কী করে লিখব।

থেনার্দিয়ের বলল, তা বটে। মাপ করবেন।

সে বিগ্রেনেলকে বলল, ওঁর হাতের বাঁধন খুলে দাও।

মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাত দুটো মুক্ত হতে একটা কলম কালিতে ডুবিয়ে তার হাতে দিল থেনার্দিয়ের।

থেনার্দিয়ের বলল, শুনুন মঁসিয়ে, আপনি এখন সম্পূর্ণ আমাদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। যদিও কোনও মানুষ আমাদের কবল থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে না তথাপি আপনাকে দিয়ে এক অপ্রিয় কাজ করিয়ে নিতে দুঃখ হচ্ছে আমার। আমি আপনার নাম-ঠিকানা জানি না। কিন্তু আমি আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আপনি যে চিঠি লিখবেন সে চিঠি যে নিয়ে যাবে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত আপনাকে বেঁধে রাখা হবে। এবার আমি যা বলছি লিখুন।

মঁসিয়ে লেবলাঁ কলমটা ধরল। পেনার্দিয়ের বলল, লিখুন, আমার প্রিয় কন্যা তুমি পত্রপাঠ এখানে চলে আসবে।

তার পরই চিঠির কথা বন্ধ করে বলল, আপনি কি ওকে ‘মেয়ে’ না ‘লার্ক’ বলে সম্বোধন করেন?

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না।

থেনার্দিয়ের বলল, ও কিছু মনে করবেন না। ঠিক আছে লিখুন,… তুমি এখনি চলে আসবে। তোমাকে আমার খুবই প্রয়োজন। পত্রবাহক তোমাকে এখানে নিয়ে আসবে। তোমার ভয়ের কিছু নেই।

এরপর হঠাৎ সে মতের পরিবর্তন করল। বলল, না, শেষের লাইনটা কেটে দিন। এতে তার মনে সন্দেহ জাগতে পারে। এবার সই করুন। আপনার নাম কী?

মঁসিয়ে লেবলাঁ বলল, কার নামে চিঠিটা দেওয়া হবে?

আপনার মেয়েকে। আমি তো আগেই বলেছি।

মঁসিয়ে লেবলাঁ মেয়ের কোনও নাম চিঠির উপর লিখল না।

থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে সই করুন। আপনার নাম কী যেন?

আর্বেন ফেবার।

থেনার্দিয়ের বিড়ালসুলভ চাতুর্যের সঙ্গে তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া রুমালটা বার করে দেখল তাতে ইউ, এফ নামের এই অক্ষর দুটো সেলাই করা আছে।

সেটা দেখে থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে। ইউ, এফ–মানে আর্বেন ফেবার। ঠিক আছে। সই করুন, ইউ. এফ।

বন্দি তাই করল।

থেনার্দিয়ের বলল, এবার চিঠিটা আমাকে দিন। আমি মুড়ে দেব।

চিঠিটা মুড়ে সে বলল, ঠিক আছে, খুব ভালো। এবার চিঠির উপরে লিখুন, ম্যাদময়জেল ফেবার। এবার আপনার ঠিকানাটা লিখুন। আশা করি আপনি আপনার নাম ভুল বলেননি, ঠিকানাটাও ভুল বলবেন না। আপনার বাসা নিশ্চয় খুব একটা দূরে হবে না। কারণ সেন্ট জ্যাক চার্চে আপনারা প্রার্থনা করতে যান। তবে রাস্তার নামটা আমি জানি না।

বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ কিছুক্ষণ ভেবে চিঠিটার উপরে লিখল, ম্যাদময়জেল ফেবার অফ আর্বেন ফেবার, ১৭ র‍্যু সেন্ট ডোমিনিক দ্য এলফার।

এবার চিঠিটা মঁসিয়ে লেবলাঁ’র হাত থেকে কেড়ে নিল থেনার্দিয়ের এক উত্তপ্ত উত্তেজনার সঙ্গে। তার পর তার স্ত্রীকে বলল, এই নাও চিঠি। তোমাকে কী করতে হবে তা জান। নিচে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখনি চলে যাও এবং যত তাড়াতাড়ি পার ফিরে আসবে।

এবার কুডুলহাতে লোকটাকে সে বলল, তুমি তোমার মুখোশটাকে খুলে রেখেছ। তুমি গাড়িতে ওর সঙ্গে যাও। তুমি জান, গাড়িটা কোথায় আছে।

তার স্ত্রী আর লোকটা ঘর থেকে তখনি বেরিয়ে গেল। থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে আবার ডেকে বলল, চিঠিটা যেন হারিয়ে না বা হাতছাড়া করো না কিছুতেই। মনে রাখবে এই চিঠিটার দাম ছয় লক্ষ ফ্রাঁ।

তার স্ত্রী বলল, ঠিক আছে। ভাবনার কোনও কারণ নেই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরে বাড়ির নিচে গাড়ি ছাড়ার শব্দ পেল তারা। থেনার্দিয়ের বলল, খুব ভালো। ওরা সময় নষ্ট না করে রওনা হয়ে গেছে। তার মানে পৌনে এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসবে। সে এবার আগুনের কাছে বসে পা দুটো সেঁকতে লাগল। বলল, আমার পা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে! বন্দি আর থেনার্দিয়েরকে ধরে মোট পাঁচজন লোক ছিল ঘরের মধ্যে। যে লোকগুলো ছিল তাদের মুখগুলো কালিমাখা ছিল বলে তাদের দেখে কয়লাখনির শ্রমিক বা রাক্ষস বলে মনে হচ্ছিল। তাদের দেখে মনে হচ্ছিল অপরাধটাই তাদের পেশা। তাই এই পরিস্থিতিতে নির্বিকারভাবে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে বসে ছিল। বিরাট গোলমালের পর একেবারে শান্ত হয়ে পড়েছিল ঘরখানা। শুধু ঘুমন্ত মাতাল লোকটার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। বাতির কম্পিত আলোয় ঘরের লোকগুলোর ছায়া পড়েছিল দেয়ালে।

কিন্তু ঘরখানার আপাতস্তষ্ক আবহাওয়াটা মেরিয়াসের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছিল। থেনার্দিয়েরের কথাবার্তা মঁসিয়ে লেবলাঁ ও তার মেয়ে সম্বন্ধে রহস্যটার সমাধান করার পরিবর্তে আরও নিবিড় করে তুলেছিল সেটাকে। তবে একটা জিনিস বুঝতে পারল রুমালে সেলাই করা ইউ. এফ অক্ষর দুটোর অর্থ হল আরসুলা নয়, আর্বেন ফেবার।

এই ভয়ঙ্কর কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে মেরিয়াস সেখানে যেমনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। সেইখানে তেমনিভাবেই দাঁড়িয়ে রইল। সে নড়তে নড়তে বা কোনও কিছু ভাবতে পর্যন্ত পারছিল না। যে ঘটনা কিছু আগে সে ঘটতে দেখেছে সে ঘটনা যেন তার সর্বাঙ্গ অসাড় করে দিয়েছে। এরপর আবার কী হয় তা সে দেখতে চায়। সে এখন কী করবে তা সে স্থির করতে পারছিল না।

সে ভাবল মেয়েটি আসলে কে, সে তার সেই আকাক্ষিত প্রেমিকা কি না তা একটু পরেই সে এলে দেখা যাবে। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তাকে নিয়ে আসবে। সে যদি এসে বিপদে পড়ে তা হলে আমি আমার জীবন দিয়েও তাকে রক্ষা করব। কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না বা কোনও বাধা আমি মানব না।

আধঘণ্টা কেটে গেল। থেনার্দিয়ের তার কুটিল চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল। বন্দি চুপচাপ বসে ছিল। হঠাৎ থেনার্দিয়ের বন্দিকে বলতে লাগল, আমার স্ত্রী ফিরে আসবে এখনি। আমাদের একটু শুধু অপেক্ষা করতে হবে। আমার মনে হয় লার্কই আপনার মেয়ে। আপনার মেয়ে আপনারই থাকবে। আমার স্ত্রী তাকে আপনার চিঠিটা দেবে। আমি তাকে বলে দিয়েছি আপনার মেয়েকে যেন ভালোভাবে পোশাক পরার সময় দেয়। তা হলে সে কোনও সন্দেহ করবে না এবং সে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঠিক আসবে। তাকে অন্য গাড়িতে তুলে দিয়ে ওরা এসে আমাকে খবর দেবে। আপনার মেয়ের কোনও ক্ষতি করা হবে না। তাকে এখানে আনার পর এক নিরাপদ জায়গায় রেখে দেওয়া হবে এবং আপনি আমাদের দু লক্ষ ফ্রাঁ দিয়ে দিলেই তাকে আপনার হাতে তুলে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি যদি আমাকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করেন তা হলে সেটা খারাপ হবে আপনার মেয়ের পক্ষে। বুঝতে পারলেন?

বন্দি কোনও কথা বলল না। থেনার্দিয়ের আবার বলল, তা হলে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ব্যাপারটা খুবই সহজ-সরল। আপনি কিছু না করলে খারাপ বা কারও কোনও ক্ষতিই হবে না।

থেনার্দিয়ের একটু থেমে আবার বলল, আমার স্ত্রী এসে যেমনি খবর দেবে লার্ক আসছে, অমনি আপনার সব বাঁধন খুলে দেওয়া হবে এবং আপনি ওই বিছানায় ঘুমোতে পারবেন। সুতরাং দেখছেন, আমাদের কোনও কুমতলব নেই।

মেরিয়াসের মনটা এতদূর খারাপ হয়ে গেল যে তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। মেয়েটিকে তা হলে এখানে আনা বা রাখা হবে না, অন্য কোনও অজানা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। এখন সে বুঝতে পারল সব। এখন কি সে তা হলে পিস্তলের গুলি করে পুলিশের হাতে এইসব শয়তানদের ধরিয়ে দেবে? কিন্তু তা হলে যে লোকটা মেয়েটিকে আনতে যাবে সে মুক্ত রয়ে যাবে এবং সে মেয়েটির ক্ষতি করতে পারে। পেনার্দিয়ের সেই কথাই বলছে। এখন তার পিতার আদেশ নয়, তার প্রেমাস্পদের চিন্তাই তার ডান হাতটা যেন ধরে রাখল, তাকে গুলি করতে দিল না।

সময় কেটে যেতে লাগল। প্রতিটি মুহূর্তে তার সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠতে লাগল। সে মরিয়া হয়ে এই সংকট থেকে মুক্তির কোনও সম্ভাবনা বা আশার আলো দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু তা না পাওয়ায় তার অন্তরের আলোড়ন বেড়ে যেতে লাগল। ঘরখানার সমাধিভূমিসুলভ নীরবতার মাঝে তার অন্তরের এই আলোড়ন বিপরীতক্রমে প্রকট হয়ে উঠছিল তার কাছে।

সহসা ঘরের দরজাটা খুলে গেল। থেনার্দিয়ের বলল, এসে গেছে।

পরমুহূর্তেই থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তার জানুর উপর হাত চাপড়ে চিৎকার করে বলে উঠল, ভুল ঠিকানা। তার সঙ্গের লোকটা হাতের কুডুলটা তুলঁল।

থেনার্দিয়ের আশ্চর্য হয়ে বলল, ভুল ঠিকানা!

হ্যাঁ, ১৭ র‍্যু সেন্ট ডোমিনিকে মঁসিয়ে আর্বেন ফেবার বলে কেউ থাকে না। বাড়িটা বড় এবং অনেক লোক আছে। তারা ও নামে কাউকে চেনে না। বাড়ির দারোয়ান ও তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা হল। বুড়োটা তোমাকে বোকা বানিয়েছে মঁসিয়ে থেনার্দিয়ের। তুমি খুব ভালো লোক কি না। আমি হলে ওর মুখটা ছিঁড়েখুঁড়ে দিতাম। ওর মেয়ের আসল ঠিকানা না দেওয়া পর্যন্ত ওকে আগুনের হেঁকা দিতাম। কী করে টাকা বের করতে হয় আমি জানি। কিন্তু তোমরা তো আমার বুদ্ধি নেবে না।

মেরিয়াস হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মেয়েটির নাম লার্ক বা আরসুলা যা-ই হোক, সে তা হলে নিরাপদে আছে।

তার স্ত্রী যখন রাগে চেঁচামেচি করে বেড়াচ্ছিল থেনার্দিয়ের তখন টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল। সে তার ডান পা-টা নাড়তে নাড়তে জ্বলন্ত কয়লাভরা কড়াইটার পানে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর সে বন্দির দিকে তাকিয়ে ভয়ঙ্করভাবে বলল, ভুল ঠিকানা। এতে তোমার কী লাভ হবে?

বন্দি বলল, সময় পাব।

এই বলে সে হাতের বাঁধনগুলো সরিয়ে দিল। সে বাঁধনগুলো আগে থেকে কাটা ছিল। তখন শুধু তার একটা পা বাঁধা ছিল বিছানার খাটের সঙ্গে।

হঠাৎ বন্দি বিছানা থেকে এক লাফে কড়াইটা থেকে উত্তপ্ত লাল বাটালিটার কাঠের বাট ধরে তাদের সামনে ভয়ঙ্করভাবে দাঁড়াল। থেনার্দিয়েরের স্ত্রী ও অন্য লোকেরা স্তম্ভিত হয়ে গেল।

মঁসিয়ে লেবলাঁর পকেটে ছোট একটা করাত ছিল। জেলের কয়েদিরা পালাবার জন্য এই ধরনের করাত কাছে রাখে। পরে পুলিশ ঘরটার মধ্যে এটা পড়ে থাকতে দেখতে পায়। সেই করাত দিয়ে সে তার হাতের বাঁধন কেটে দেয়। কিন্তু পায়ের বাঁধনটা কাটতে পারেনি সে।

বিগ্রেনেল বিস্ময়ের ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর থেনার্দিয়েরকে বলল, চিন্তার কারণ নেই। ওর একটা পা এখনও বাধা আছে।

বন্দি এবার ওদের বলতে লাগল, তোমরা বোকা। আমার জীবন খুব একটা মূল্যবান নয়। আমাকে কিছু লেখানো বা বলানোর চেষ্টা করে লাভ হবে না। আমি কিছু লিখব না বা বলব না। এই দেখ –এই বলে তপ্ত লাল বাটালির ধারালো দিকটা তার বাঁ হাতের উপর এক জায়গায় বসিয়ে দিল। তাতে হাতের কিছুটা চামড়া পুড়ে গেল। মেরিয়াস তা দেখে ভয়ে অভিভূত হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে যারা ছিল সেই দুবৃত্তগুলোও শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তা দেখতে লাগল। কিন্তু বন্দির মুখের শান্ত ভাবের কোনও পরিবর্তন হল না। কোনও ঘৃণা বা বেদনার চিহ্ন ফুটে উঠল না। মহান চরিত্রের লোকদের মধ্যে দেহগত যন্ত্রণা তাদের আত্মাকে উন্নত করে।

সে বলল, যত সব বোকা কোথাকার, আমাকে ভয় করার কিছু নেই। দেখলে, আমি তোমাদের ভয় করি না। সে এবার বাটালিটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তার পর বলল, এবার তোমরা আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পার।

থেনার্দিয়ের তার লোকদের বলল, ওকে ধরে ফেল।

দুটো লোক সঙ্গে সঙ্গে বন্দির দুটো কাঁধ ধরে ফেলল। মুখোশপরা লোকটা তার। সামনে ঘুষি পাকিয়ে এমনভাবে দাঁড়াল যাতে দরকার বুঝলে ঘুষি মেরে তার মুখটা ভেঙে দিতে পারবে।

মেরিয়াস দেখল ঘরের মধ্যে সকলে চুপি চুপি নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করছে।

একজন বলল, একটা কাজ করতে হবে—

ওরা গলাটা কেটে দাও।

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীর সঙ্গে কী পরামর্শ করতে লাগল। তার পর ধীর পায়ে টেবিলের ধারে গিয়ে ড্রয়ার থেকে সেই বড় ছুরিটা বার করল।

মেরিয়াসের হাতটা পিস্তলের বাঁটের উপর ছিল। তার উভয়সংকট চরমে উঠল। এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে তার দ্বিধাবিভক্ত বিবেকের দুটি কণ্ঠস্বর তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করছিল তার মধ্যে। একটি কণ্ঠস্বর তাকে তার পিতার ইচ্ছা পূরণ করতে বলছিল আর একটি কণ্ঠস্বর বন্দিকে বাঁচাতে বলছিল। দুটি পরস্পরবিরুদ্ধ নীতির দ্বন্দ্বে তার অন্তর। ক্ষতবিক্ষত ও বেদনায় অভিভূত হয়ে উঠছিল। তার কেবলি মনে হচ্ছিল শেষ মুহূর্তে এমন কিছু একটা ঘটবে যাতে বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে মিলন ঘটবে। কিন্তু আর অপেক্ষা করার মতো সময় নেই। কিছু একটা করতে হবে। থেনার্দিয়ের ছুরি হাতে বন্দির সামনে কয়েক পা দূরে ইতস্তত করছিল।

হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে ছিল মেরিয়াস। হঠাৎ তার ঘরের মধ্যে একবার চোখ ফেরাতেই চাঁদের আলোয় তার টেবিলের উপর একটা কাগজ সে দেখতে পেল। এই কাগজের উপর আজ সকালে থেনার্দিয়েরের বড় মেয়েটি একটা কথা লিখেছিল, বাইরে দেখ, পুলিশ এসে গেছে।

মুহূর্তমধ্যে সব সমস্যার সমাধান খুঁজে পেল মেরিয়াস। তাকে এখন কী করতে হবে তা সে বুঝে নিল। সে এমন একটা কিছু করবে যাতে একই সঙ্গে হত্যার বলি আর হত্যাকারীকে বাঁচানো যাবে। মেরিয়াস কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে একটা ছোট ঢেলা দিয়ে মুড়িয়ে পার্টিশানের ফাঁক দিয়ে এমনভাবে পাশের ঘরে ফেলে দিল যাতে সেটা ঘরের মাঝখানে মেঝের উপর পড়ল।

ঠিক সময়েই কাগজটা ফেলেছিল মেরিয়াস। থেনার্দিয়ের তখন তার সব উৎকণ্ঠা ঝেড়ে ফেলে ছুরি হাতে বন্দির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় তার স্ত্রী তাকে বলল, কী একটা জিনিস পড়ল।

থেনার্দিয়ের বলল, কী বলছ তুমি?

তার স্ত্রী কাগজটা কুড়িয়ে তার স্বামীর হাতে দিল।

থেনার্দিয়ের বলল, কী করে এল এটা?

জানালা দিয়ে নিশ্চয়।

বিগ্রেনেল বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমি দেখেছি।

থেনার্দিয়ের তাড়াতাড়ি কাগজটা খুলে পড়ে ফেলল বাতির আলোয়। পড়ার পর সে বলল, এটা এপোনিনের হাতের লেখা। হা ভগবান!

সে স্ত্রীকে ডেকে কাগজটা পড়ে শোনাতে লাগল। তার পর বলল, জানালায় মইটা লাগাও। ইঁদুরটাকে ফাঁদে ফেলে রেখে আমাদের এখনি পালাতে হবে।

তার স্ত্রী বলল, ওর গলা না কেটেই?

সময় নেই।

বিগ্রেনেল বলল, কিন্তু কী করে পালাব আমরা?

থেনার্দিয়ের বলল, এপোনিনে যা লিখেছে তাতে বোঝা যায় বাড়ির পাশে জানালার নিচে কোনও পাহারা নেই।

মুখোশপরা লোকটা তার হাত দিয়ে তিনবার তালি দিল। এর দ্বারা সব লোককে সতর্ক করে দিল। যারা তখন বন্দিকে ধরে ছিল তারা তাকে ছেড়ে দিল। একজন দড়ির মইটা খুলে জানালায় লাগিয়ে দিল। থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে ডেকে আগে মইয়ে উঠতে যেতেই বিগ্রেনেল তার জামার কলারটা ধরল। বলল, এত তাড়াতাড়ি আগে গেলে হবে না। আমরা আগে যাব।

অন্য সব লোকরা বলল, আমরা আগে যাব।

থেনার্দিয়ের তাদের বলল, কেন ছেলেমানুষি করে বৃথা সময় নষ্ট করছ?

তখন একজন বলল, তা হলে কে আগে যাবে তার জন্য লটারির ব্যবস্থা করা হোক।

থেনার্দিয়ের আবার বলল, পুলিশ দূরে নেই। আইন আমাদের তাড়া করছে। আর তোমরা লটারি করে সময় নষ্ট করবে?

এমন সময় দরজার কাছে এক গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, তোমরা দেখছি আমার টুপিটা ধার করতে চাও।

সবাই সচকিত হয়ে দেখল, জেভার্ত দাঁড়িয়ে আছে। সে তার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে হাসছিল।

.

২১.

রাত্রি নামার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ইন্টপেক্টর জেতার্ত তার লোকজন নিয়ে বাড়িটার সামনের দিকে গাছের আড়ালে লুকিয়ে সংকেতের অপেক্ষা করতে থাকে। পেনার্দিয়েরের দুই মেয়েকে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের ধরতে গিয়ে দেখে বড় মেয়েটা পালিয়ে গেছে। তাই সে ছোট মেয়ে আজেলমাকে ধরে। সে বাড়ির সামনে কয়েকবার ঘোড়ার গাড়ি যাতায়াত করতে দেখে। বাড়িতে যেসব লোক ঢোকে তাদের সে চিনত। তাতে তার সন্দেহ হয়। তার পর গুলির কোনও আওয়াজ না পেয়ে মেরিয়াস তাকে সদরদরজার যে চাবিকাঠি দিয়েছিল তাই দিয়ে দরজা খুলে সে অবশেষে বাড়িতে ঢুকে পড়ে।

পুলিশ দেখেই সাতজন ভয়ঙ্কর চেহারার লোক তাদের ফেলে দেওয়া অস্ত্রগুলো আপন আপন হাতে তুলে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়। তাদের হাতে কুডুল-দা প্রভৃতি অস্ত্র ছিল। থেনার্দিয়ের তার ছুরিটা ঘোরাতে থাকে। তার স্ত্রী একটা পাথর কুড়িয়ে নেয়।

জেতার্ত আবার টুপিটা মাথায় দিয়ে ঘরের মধ্যে দু-পা এগিয়ে এসে শান্ত কণ্ঠে বলল, ব্যাপারটা বোঝ। তোমরা জানালা দিয়ে পালাতে পারবে না। বরং দরজা দিয়ে পালানোটা কম কষ্টকর হবে। তবে তোমরা সংখ্যায় সাতজন আর আমরা সংখ্যায় আছি পনেরো জন। সুতরাং বুদ্ধি-বিবেচনা করে কাজ করাই ভালো।

বিগ্রেনেল তার পিস্তলটা বার করে থেনার্দিয়ের হাতে দিয়ে চুপি চুপি বলল, আমি জেভাৰ্তকে গুলি করতে পারি না। তুমি পারো তো করো।

থেনার্দিয়ের বলল, আমি করব।

জেতার্ত তখন থেনার্দিয়েরের কাছ থেকে মাত্র তিন পা দূরে ছিল। সে জেতার্তকে লক্ষ্য করে পিস্তলটা তুলে ধরল।

জেভার্ত বলল, কোনও লাভ হবে না। ওতে গুলি নেই।

থেনার্দিয়ের পিস্তলের ঘোড়া টিপল, কিন্তু গুলি বার হল না।

জেভার্ত বলল, আমি তো আগেই বলেছিলাম।

বিগ্রেনেল তার হাতের দা-টা ফেলে দিয়ে জেভার্তকে বলল, তুমি হচ্ছ শয়তানের রাজা। আমি আত্মসমর্পণ করলাম। তবে আমাকে জেলে রাখার সময় তামাক খাবার অনুমতি দিতে হবে।

জেভার্ত বলল, ঠিক আছে। তোমার দেখছি বুদ্ধি আছে। আর বাকি সবাই? বাকি সবাই ঘাড় নেড়ে আত্মসমর্পণ করতে চাইল।

এমন সময় সশস্ত্র পুলিশবাহিনী ঘরে ঢুকল। জেতার্ত তাদের হুকুম দিল, ওদের হাতে হাতকড়া লাগাও।

এদিকে থেনার্দিয়েরের স্ত্রী তখন জানালার ধারে একটা বড় পাথর হাতে দাঁড়িয়ে পুলিশদের বলল, কই এস দেখি।

থেনার্দিয়ের তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক দানবী একটা পাথর ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে।

পুলিশরা দরজার কাছে সরে গেল পাথরের ভয়ে। তাদের ভয় দেখে থেনার্দিয়েরের স্ত্রী বলল, কাপুরুষ শূকরী কোথাকার!

জেভাৰ্ত কিন্তু নির্ভয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়ের-পত্নী তখন তার দিকে তাকিয়ে বলল, এক পা-ও এগোবে না। তা হলে তোমার মাথাটা গুঁড়ো করে দেব।

জেভার্ত বলল, একজন যোদ্ধা যেন। তুমি পুরুষের মতো ব্যবহার করছ। কিন্তু আমার আছে নারীদের থাবা আর নখ।

এই বলে সে এগিয়ে যেতে লাগল। থেনার্দিয়ের-পত্নী পাথরটা ছুঁড়ে দিল। জেভাৰ্ত কায়দা করে পাশ কাটিয়ে গেল। পাথরটা তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। সেটা। সামনের দেয়ালে লাগায় কিছু চুন-বালি খসে গেল। তখন থেনার্দিয়ের-পত্নী কান্নায় ভেঙে পড়ল, আমার মেয়েরা।

জেভার্ত বলল, তাদের আগেই ধরেছি।

এই বলে সে একটা হাত থেনার্দিয়েরের মাথায় আর একটা হাত তার স্ত্রীর কাঁধের উপর দিয়ে তার লোকদের বলল, হাতকড়া লাগাও।

পুলিশরা সবার হাতে হাতকড়া লাগাবার পর ঘুমন্ত মাতাল লোকটাকে তুলঁল। সে বলল, কে জনদ্ৰেত্তে? সব ঠিক হয়ে গেছে।

জেভার্ত বলল, হ্যাঁ, সব কাজ হয়ে গেছে। হাতকড়া লাগানো লোকগুলোর মধ্যে তিনজনের মুখে মুখোশ ছিল আর তিনজনের মুখে চুনকালি মাখা ছিল। তাদের ভূতের মতো দেখাচ্ছিল।

জেভার্ত বলল, সবাই মুখোশ খুলে ফেল।

তারা সবাই মুখোশ খুলে ফেললে জেভার্ত তাদের অভ্যর্থনা জানাল। বলল, সান্ধ্য নমস্কার বিগ্রেনেল, ব্রুজোঁ, দিউ মিলিয়ার্দ। গুয়েলমার, বাবেত, আর ক্লাসেকাস, তোমাদেরও নমস্কার জানাই। মুখোশ পরায় তোমাদের চমৎকার দেখাচ্ছিল।

এবার বন্দির দিকে তাকিয়ে জেভার্ত বলল, ভদ্রলোকের বাঁধন খুলে দাও। কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া কেউ যেন বাইরে না যায়।

বন্দি এতক্ষণ সব কিছু দেখে যাচ্ছিল নীরবে। একটা কথাও বলেনি।

এবার জেভার্ট টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসে তার রিপোর্ট লিখতে লাগল। লেখার পর সে বলল, এবার ভদ্রলোককে আমার কাছে আসতে বল।

পুলিশরা এবার ভদ্রলোকের খোঁজ করতে লাগল। জেভার্ত বলল, কোথায় সে?

কিন্তু ঘরের মধ্যে কোথাও তাকে দেখা গেল না।

বন্দি মঁসিয়ে লেবলাঁ বা আর্বেন ফেবার চলে গেছে। দরজার কাছে পাহারা ছিল। কিন্তু খোলা জানালার কাছে কোনও পাহারা ছিল না। মঁসিয়ে লেবার পায়ের বাধন খুলে দিলে সে ভিড়ের মধ্যে পুলিশদের কর্মব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে জানালার কাছটা অন্ধকার থাকায় সেই দিকে পালিয়ে যায়। দড়ির মইটা জানালায় তখনও লাগানো ছিল। একজন পুলিশ জানালার ধারে গিয়ে উঁকি মেরে দেখল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। জেভার্ত বলল, লোকটা দেখছি সব থেকে পাকা শয়তান।

.

২২.

এই ঘটনার পরের দিন সন্ধের সময় একটি ছেলে পন্ত দ্য অস্টারলিৎস থেকে গর্বোর ব্যারাকবাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। মাদাম বুগনল সদরদরজার সামনে বসে ছিল। ছেলেটা তার কাছে এসে বলল, আমি ভেবেছিলাম একটা বড় কুকুর।

কুকুর বলায় বুড়ি বুগনল রেগে গিয়ে বলল, একটা খুদে রাক্ষস। আমি দাঁড়িয়ে থাকলে তোর বুকে পা দিতাম।

ছেলেটা বলল, আমি তা হলে ঠিকই ভেবেছি।

ছেলেটা এবার বাড়ির সদরদরজাটা বন্ধ দেখে দরজায় লাথি মারতে লাগল। মাদাম বুগনল ব্যস্ত হয়ে বলল, এ কি করছিস রে ছোঁড়া? ভালো দরজাটা ভাঙবি নাকি?

এতক্ষণে রাস্তার আলোয় ছেলেটার মুখটা দেখতে পেয়ে বুগলন বলল, ও তুই? পাজি ছোঁড়া কোথাকার!

ছেলেটা বলল, তুমি বুড়ি? নমস্কার মাদাম বুগ–আমি বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। মাদাম বুগনল বলল, বাড়িতে কেউ নেই।

ছেলেটা বলল, আমার বাবা কোথায়?

জেলে।

আমার মা কোথায়?

সেন্ট লাজারেতে।

আমার দিদিরা?

ম্যাদেলোনেত্তেতে আছে।

ছেলেটা তখন শিস দিয়ে বলল, ঠিক আছে।

এই বলে সে গান করতে করতে এলমগাছে ঘেরা রাস্তা দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *