১০. বছরের পর বছর চলে গেছে

বছরের পর বছর চলে গেছে। মানুষের চোখের সামনে ব্যাপারটা ঘটেছে। বোকা মানুষ সেটা খেয়াল করে নাই।

একটা কেটলিতে পানি গরম করতে দিয়ে ডেকে দিন। যে মুহূর্তে পানি ফুটে বলক দিবে, সেই মুহূর্তে ধক করে ঢাকনাটা উপরে একটা লাফ দিয়ে উঠবে। পানি বাষ্প হয়ে ঢাকনাটাকে ধাক্কা দিচ্ছে বলেই এটা হচ্ছে। পানির তাপ এখানে ঢাকনার গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। দুনিয়াজুড়ে লাখ লাখ মানুষ এই ঘটনার সাক্ষী হচ্ছিল প্রতিদিন। অথচ কেউ এর ভেতরে যে বিপুল সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে, সেটা কেউই ধরতে পারে নাই।

প্রথম ইঙ্গিতটা আসে গানপাউডার দিয়ে। নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি চায়নার এর আবির্ভাব। সেই সময় গানপাউডার ব্যবহার হত আগুনের গোলা বানাতে। কিন্তু সেই গোলার পিছনে যে ঠিকঠাক তাপ দিলে সেই গোলাই বহুদূর যাবে, এই ভাবনা তখনো মাথায় আসে নাই। যখন মাথায় আসছে, ততোদিনে আরো ৬০০ বছর পেরিয়ে গেছে। বন্দুকের মূলনীতি আবিষ্কারের অনেক কাছাকাছি এসেও তাই চাইনিজরা এই এ্যাচিভমেন্ট আনলক করতে পারে নাই। আনলক করসে ইউরোপীয়ানরা।

তাও আরো তিনশো বছর পর। তাপশক্তি যে গতিশক্তিতে রূপান্তর হয়—এইটা তারা বুঝছে স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করে। যদিও স্টীম ইঞ্জিনের আঁতুরঘর কোন রেলওয়ে শপ বা মেশিন শপে নয়। এর জন্ম নোংরা, ছোটলোক কয়লা খনিতে।

ব্রিটেনে তখন জনসংখ্যা বাড়ছে। আর বেশি জনসংখ্যা মানে এনার্জি কনসামশনও বেশি। নতুন মানুষ মানে নতুন নতুন বাড়িঘর তৈরি করতে হবে তাদের জন্য। সেকালে সব কাঠের বাড়িঘর তৈরি হত। রিয়েল এস্টেটের চাহিদা মেটাতে বনকে বন বন উজাড় করা হল। ফলে জ্বালানি কাঠের অভাব দেখা দিল। সেই অভাব পূরণ করতে এগিয়ে এল কয়লা। কয়লা পুড়িয়ে রান্নার চল হল।

সমস্যা হল কয়লা উত্তোলনে। অনেক কয়লাখনিতে একটু নিচের দিকের স্তরে পানি জমে থাকে। ঐ স্তর থেকে আর কয়লা কালেক্ট করা যায় না। তো এই সমস্যার সমাধান কী?

সমাধান নিয়ে এল স্টীম ইঞ্জিন।

কয়লা পুড়ায়া যে তাপটা তৈরি হয়, সেই তাপ দিয়ে পানি গরম করা হয়। পানি ফুটে বাষ্প হয়। সেই বাষ্প একটা পিস্টনকে ধাক্কা দেয়। পিস্টন লড়ে। এখন পিস্টন নড়লে পিস্টনের সাথে যাকেই বেঁধে দেয়া হবে, সেও নড়বে। ব্যাং! ঘরে বসেই আপনি তৈরি করে ফেললেন একখানা আস্ত স্টীম ইঞ্জিন।

কয়লা খনিগুলোতে এই পিস্টনটা একটা পাম্পের সাথে লাগানো থাকতো। এই পাম্প খনির গভীরের পানি বাইরে বের করে দিত। শুরুর দিকের পাম্পগুলো ছিল খুবই ইনএফিশিয়েন্ট। বস্তা বস্তা কয়লা পুড়াইলে হয়তো সামান্য পরিমাণ পানি বের হইতো। যেহেতু কয়লাখনির পাশে কয়লার কোন অভাব ছিল না—এটা কোন বড় ইস্যু হয়ে দেখা দিল না।

আস্তে আস্তে ইঞ্জিনের এফিশিয়েন্সি বাড়লো। কয়লা খনি থেকে তুলে একে স্থান দেয়া হল টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে। চোখের পলকে গোটা টেক্সটাইল শিল্পে একটা বিপ্লব ঘটে গেলো। কাপড়ের দাম হু হু করে পড়ে গেলো।

সেই সাথে পড়ে গেলো আমাদের উপমহাদেশের তাঁত শিল্প। মিথ আছে, ব্রিটিশরা নাকি আমাদের সেরা তাঁত শিল্পীদের আঙুল কেটে দিত। যাতে তারা মসলিন আর যতো মিহি কাপড় বুনতে না পারে। এটা যতোটা না ঐতিহাসিক সত্য, তার চেয়ে অনেক বেশি সিম্বলিক সত্য। টেক্সটাইলের আগ্রাসনের সাথে আমাদের কুটির শিল্প তাল মেলাতে পারছিল না। বাজার অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মেই আমরা হেরে যাচ্ছিলাম। হেরে যাচ্ছিলো আমাদের তাঁত শিল্পীরা। এই হেরে যাওয়াটা লিটার‍্যালী আঙুল কাটার চেয়ে কোন অংশে কম কষ্টের না।

স্টীম ইঞ্জিন মাটির নিচ থেকে উপরে উঠে আসায় টেকনোলজিক্যাল ব্যারিয়ারের সাথে সাথে একটা সাইকোলজিক্যাল ব্যারিয়ারও আমরা কাটিয়ে উঠলাম। কয়লা পুড়ায়া যদি তাঁত চালানো যায়, তবে অন্য জিনিস নয় কেনো? ধরেন, গাড়িঘোড়া।

১৮২৫ সালে এক চতুর ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার স্টীম ইঞ্জিনের সাথে ট্রেনের কতগুলা বগি জুড়ে দিলেন। কাকতালীয়ভাবে, সেই বগিগুলোও কয়লাই নিয়ে যাচ্ছিল। তখন মানুষের মাথায়া আসলো— আরে, স্টীম দিয়ে যদি কয়লা আনা-নেয়া করা যায়, তবে মানুষ নয় কেন? আমরা মানুষেরা তো আর বানের জলে ভেসে আসি নাই।

আমাদেরও আছে অধিকার। স্টীম ইঞ্জিন চালিত যানে চলার।

১৮৩০ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর আসলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দুনিয়ার প্রথম কমার্শিয়াল রেলওয়ে সেদিন চালু হইলো। লিভারপুল থেকে ম্যানচেস্টার। কয়েক বছরের মধ্যে রেলওয়ে ট্র্যাক গোটা ব্রিটেনকে ছেয়ে ফেললো।

যদি ভেবে থাকেন, ব্রিটিশরা তাদের চাতুর্য দিয়েই অর্ধেক দুনিয়া জয় করেছিল, তাহলে ভুল করবেন। ব্রিটিশরা সেকালে ছিল টেকনোলজিক্যালী সবচেয়ে এগিয়ে। শিল্প বিপ্লব বলতে গেলে এই জাতির হাত ধরেই হয়েছে। আর প্‌থিবীর ইতিহাস আমাদের বলে, যে জাতি টেকনোলজিতে এগিয়ে থাকবে, তারাই অন্যদের উপর রাজত্ব করবে। খুব সোজাসাপটা হিসাব। এর মধ্যে কোন আইডিওলজিকাল ব্যাপার-সেপার নেই।

স্টীম ইঞ্জিনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনোজগতে একটা বড় পরিবর্তন আসলো। দীর্ঘদিন তার বিশ্বাস ছিল, দুনিয়ায় এনার্জি খুবই সীমিত। আর আমরা মানুষেরা সেই এনার্জি সব শেষ করে ফেলতেসি। প্রথমবারের মত তার মধ্যে কনফিডেন্স এলো, যে চাইলেই তো আমরা এক এনার্জিকে আরেক এনার্জিতে কনভার্ট করতে পারতেসি।

কাজেই, এনার্জি সোর্স শেষ হয়ে যাইতেসে—এই ভেবে ভয়ের কিছু নাই। ভয়ের ব্যাপার হবে তখন, যখন এনার্জিকে কনভার্ট করার নিত্যনতুন উপায় আমরা আর বের করতে পারবো না।

মোটরগাড়ি আবিষ্কারের আগে লন্ডনের রাস্তা ঘোড়ার লাদিতে কয়েক ইঞ্চি ঢাকা ছিল। ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, এরকম চলতে থাকলে মানুষ লন্ডন ছেড়ে পালাবে। মানুষ কিন্তু তাপশক্তিকে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করে সেই সমস্যার সমাধান করে ফেলসে। আইনস্টাইন E=mc^2 আবিষ্কার করে দম ফেলার টাইম পান নাই। চল্লিশ বছরের মধ্যেই আমরা পারমাণবিক বোমা বানায়ে ফেলসি। দুনিয়ার জায়গায় জায়গায় নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বসায়ে ফেলসি।

তারপরও মানুষের মধ্যে এই ভয় যায় নাই যে, আমরা আমদের সব এনার্জি শেষ করে ফেলতেসি। জীবাশ্ম জ্বালানির ভাণ্ডার খতম হয়ে যাচ্ছে। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানি কিন্তু আমাদের এনার্জির খুব গুরুত্বপূর্ণ সোর্স না। সবচেয়ে বেশি এনার্জি স্টোর হয়ে আছে সূর্যে। সূর্য থেকে প্রতি বছর ৩,৭৬৬,৮০০ এক্সাজুল পরিমাণ শক্তি পৌঁছায় আমদের প্‌থিবীতে। দুনিয়ার সব মানুষ আর ইন্ডাস্ট্রি মিলে বছরে আমাদের লাগে মাত্র ৫০০ এক্সাজুল। এক্সাজুল যে কতো বড় ইউনিট তা বোঝানোর জন্য বলি—১ এর পর ১৮টা শূন্য বসান। তাইলে ১ এক্সা হয়।

বোঝাই যাইতেসে, সূর্যদেব আমাদের দুহাত ভরে যা দেন, তার কিছুই আমরা ঠিকমত নিতে পারতেসি না। নিতে পারলে উনি দেড় ঘণ্টায় আমাদের যা পাঠান, তা দিয়েই আমাদের বাৎসরিক এনার্জির দুশ্চিন্তা শেষ হয়ে যেত। লোডশেডিং-এর জন্যও সরকারকে আর গালি দেয়া লাগতো না।

এতো মাত্র একটা সোর্সের কথা বললাম। চোখ মেলে তাকালে বোঝা যাবে—আমাদের চারপাশে এনার্জির ছড়াছড়ি। পরমাণুর মধ্যে শক্তি। গ্র্যাভিটির মধ্যে শক্তি। শক্তি নাই কোথায়? শুধু দরকার এই শক্তিগুলাকে ক্যাপচার করার নতুন নতুন তরিকা।

১৭৫০ সালেও ইউরোপ আর এশিয়া একই কাতারে ছিল। ১৭৫০-১৮৫০, এই একশো বছরে পাওয়ারটা পুরোপুরি ইউরোপে শিফট করে।

প্‌থিবীতে কার রাজ চলছে, তা বোঝার একটা প্যারামিটার হতে পারে মোট উৎপাদন যন্ত্রে কার কন্ট্রিনিউশন কেমন। যার উৎপাদন যতো বেশি, ক্ষমতার ভারকেন্দ্রও তার দিকেই ততো হেলে থাকবে। ১৭৭৫ সালেও প্‌থিবীর মোট উৎপাদনের ৮০ ভাগ হত এশিয়ায়। দুই শতাব্দীর মধ্যে পাশার দান ঘুরে যায়। ১৯৫০ সালে এসে দেখা যায়, প্‌থিবীর মোট উৎপাদনের অর্ধেকের বেশি করছে ইউরোপ আর তাদের কাজিন নব্য আমেরিকানরা মিলে।

যে ইউরোপকে কেউ এককালে পাত্তাই দিত না, তাদের মধ্যে হঠাৎ কী এমন হল যে তারা নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ জয় করা শুরু করলো? নিজেদের বিজয় নিশান দিকে দিকে ওড়াতে লাগলো? চাইনিজ বা অটোম্যানরা কেন এই কাজটা করতে পারলো না? ইউরোপীয়দের চেয়ে তাদের ইতিহাস তো বরং সম্‌দ্ধ ছিল। ছিল স্ট্রং শাসন ব্যবস্থা।

ইউরোপীয়রা না হয় স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কার করলো। অটোম্যানরা তো সেটা কিনে নিজেদের দেশে চালু করতে পারতো। কিংবা চাইনিজরা কপি করে নিজেদের ভূখণ্ডে ছাড়তে পারতো। সেকালে তো পেটেন্ট নিয়েও এতো কড়াকড়ি ছিল না। প্রাচ্যের লোকজন এর কোনটাই করলো না।

প্রাচ্যের লোকজনের যে টাকাকড়ির অভাব ছিল—তা না। ছিল মাইন্ডসেটের অভাব। উদারতার অভাব। ফলে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার লোকটা যা আবিষ্কার করসে, ফ্রান্সের লোকজন, জার্মানির লোকজন সেটা খুব দ্রুতই আপন করে নিতে পারসে। কিন্তু ইস্তানবুল বা সাংহাইর লোকজন পারে নাই।

পশ্চিমকে আমরা রাজত্ব করতে দেখসি ১৭৫০ থেকে। আমরা আসলে দেখসি ফলাফলটা। ‘কারণ’-টা কিন্তু আরো আগে থেকেই শুরু হইসে। এই সময়কালটা হল ১৫০০ থেকে ১৭৫০ পর্যন্ত।

১৭৫০ এর যে আপাত সাম্য আমরা দেখছি এশিয়া আর ইউরোপের মধ্যে, সেটা আসলে একটা ধোঁকা। ধোঁকাটা কীরকম বলি।

ধরা যাক, দুইজন ইঞ্জিনিয়ার। প্রত্যেকেই উঁচু লম্বা একটা বিল্ডিং বানাবে। একজন ইট ব্যবহার করতেসে। আরেকজন স্টীল আর কংক্রীট। শুরু কয়কে তলা দুজন ঠিকঠাকই বানাবে। এ্যাপারেন্ট কোন পার্থক্য চোখে পড়বে না। একটা থ্রেশোল্ড ক্রস করে ফেললে (ধরা যাক আট তলা), ইটের বাড়িটা আর লোড নিতে পারবে না। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। স্টীলের দালানটা ওদিকে আকাশ ছুঁচ্ছে।

ইউরোপের দালানটা হচ্ছে স্টীলের দালান। আর প্রাচ্যের বাড়িঘর ছিল ইট-কাঠ-সুড়কির। নতুন যুগের লোড সে নিতে পারে নাই।

ইউরোপ কীভাবে এই ভারটা নিতে পারলো? কারণ তার ভিত্তিটা সে মজবুত করে নিসে আগের আড়াইশো বছরে। বিজ্ঞান আর পুঁজিবাদ হলো ইউরোপের সেই স্টীল আর কংক্রীট।

ইউরোপীয়রাই সবার আগে সায়েন্টিফিক ওয়েতে চিন্তাভাবনা শুরু করে। সায়েন্টিফিক আর পুঁজিবাদী ধারায়। পুঁজির মালিকেরা এখন আর তাদের রবরবা ধরে রাখার জন্য খালি আর্মি পালতে শুরু করলো না, সেই সাথে বিজ্ঞানীদের খোরাকিও দিতে লাগলো। বিজ্ঞানীরাও আগের মত আর বিজ্ঞানের জন্য বিজ্ঞান করতে লাগলেন না। তারা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে, পুঁজিবাদীদের প্রয়োজনে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিলেন।

বিজ্ঞান আর সাম্রাজ্যবাদের এই যে মিলন—এটাই ইউরোপীয়দের অন্যদের চেয়ে দুশো বছর এগিয়ে দিল।

আমাদের অনেকেরই বিজ্ঞান পছন্দ, বিজ্ঞানের ফল পছন্দ, কিন্তু পুঁজিবাদ পছন্দ না। অথচ পুঁজিবাদের সাথে বিজ্ঞানের এই বোঝাপড়া না হলে কিন্তু বিজ্ঞান এতো দ্রুত আর এতোদূর আগাতো না। গানপাউডারের যুগেই বসে থাকতে হত আমাদের।

ইউরোপীয়দের জিনে এমন কিছু আছে, যা তাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই এই রেসে এগিয়ে দিয়েছে—এমন ধারণা তাই আর হালে পানি পায় না। ইউরোপীয়রা জ্ঞান-বিজ্ঞানের উসাইন বোল্ট না। চায়না বা ইসলামের ইতিহাস ঘাঁটলেও নিউটনের মত স্কলার পাওয়া যাবে। নিউটনের মত প্রলিফিক হয়তো না, কিন্তু তার সমান মেধাসম্পন্ন লোক ঠিকই পাওয়া যাবে। নিউটন তবে নিউটন হলেন কেন? নিউটনের জন্ম ইংল্যান্ডে না হয়ে কায়রো বা বেইজিং এ হল না কেন?

কারণ, নিউটন হবার জন্য যে এনভাইরনমেন্ট দরকার, নিউটন সেটা পুরোপুরিই পেয়েছিলেন। ক্যামব্রিজ তাকে সেভাবে কিছু না শেখালেও পরিবেশটা ঠিকই দিয়েছে। একটা বাচ্চা যতো মেধা নিয়েই জন্মাক না কেনো, উগান্ডা বা উজবেকিস্তানে কোন নিউটনের জন্ম হবে না। রূঢ় হলেও এটাই সত্য। বিজ্ঞান তো কতগুলো ভাবনার সমষ্টি না। ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য আপনার যে ইকুইপমেন্ট লাগবে, ফান্ডিং লাগবে–ওটা দিবে কে? আফ্রিকা থেকে সাহিত্যে নোবেল আসে, বিজ্ঞানে আসে না কেন?

আর এটাই ইউরোপীয়ান সাম্রাজ্যবাদের সাথে অন্য সাম্রাজ্যগুলোর একটা বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। আগেকার সাম্রাজ্যগুলো কেবল মাটির দখল নিত। মানচিত্রে নিজেদেরে কলার উঁচিয়ে হাজির করতো। ইউরোপীয় সাম্রাজ্যই প্রথম সাম্রাজ্য, যে মাটির দখলের সাথে সাথে ঐ এলাকার জ্ঞানরাজ্যের দখলও বুঝে নেয়।

যে কোন ইউরোপীয় অভিযানে তাই আর্মির সাথে সাথে একদল ডাক্তার থাকতো। থাকো বোটানিস্ট, জুওলজিস্ট, এ্যাস্ট্রোনোমার, জিওলজিস্ট। এদের কাজ ছিল আধিক্‌ত অঞ্চলের সব কিছু, লিটার‍্যালী সব কিছু নিয়ে গবেষণা করা। জ্ঞানরাজ্যে নিজেদের হেজিমনি প্রতিষ্ঠা করা। ইউরোপীয়রা, এটা বুঝেছিল, মাটির রাজ্য আসলে রাজ্য না। জাস্ট দিখাওয়া। আসল রাজ্য হচ্ছে জ্ঞানরাজ্য। এইখানে একবার নিজেদের হেজিমি প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মাটির রাজ্য এমনিই তাদের হাতে থাকবে।

ক্যাপ্টেন কুক যেটা করেছিলেন। সে সময় জাহাজ যাত্রায় স্কার্ভির খুব প্রাদুর্ভাব দেখা দিত। প্রতি যাত্রাতেই অর্ধেকের বেশি লোক এই রোগে ভুগে মারা পড়তো। এক ডাক্তার এক্সপেরিমেন্ট করে দেখলেন, যেসব লোককে সাইট্রাস ফল খেতে দেয়া হচ্ছে, তারা খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ঠছে। আজ আমরা জানি, সাইট্রাস ফলে ভিটামিন সি আছে যা স্কার্ভি প্রতিরোধ করে। সেসময় তো মানুষ এতো কিছু জানতো না। তারা মেইনলি শুকনা খাবার দাবার, বিস্কিট-টিস্কিট—এসব নিয়েই সমুদ্র যাত্রায় বেরিয়ে পড়তো।

ডাক্তারের এই এক্সপেরিমেন্টকে তেমন একটা কেউ পাত্তা দিল না। একজন মাত্র দিলেন। তিনি ক্যাপ্টেন জেমস কুক। তিনি বুঝলেন, নাবিকেরা ঠিকমত পুষ্টি উপাদান পাচ্ছে না। তাই তাদের এই দুর্দশা। তিনি জাহাজ বোঝাই ফলমূল আর সবজি নিয়ে রওনা দিলেন এইবার। ফলাফল হাতেনাতে পেলেন। একটা লোকও স্কার্ভিতে মারা পড়লো না এবার।

বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদে অতি দ্রুত ইংরেজরা গোটা সমুদ্রপথে রাজত্ব কায়েম করলো। অর্ধেক প্‌থিবীর রাজা হবার জন্য যতোটুকু ধন্যবাদ ইংরেজ আর্মি আর তার টেকনোলজি পাবে, ঠিক ততোটুকু ধন্যবাদই প্রাপ্য সেই অখ্যাত ডাক্তার আর ক্যাপ্টেন কুকের।

এখানেই শেষ নয়। নেপোলিয়ন যখন মিশর আক্রমণ করেন, তখন উনি সাথে করে ১৬৫ জন স্কলার নিয়ে যান। এদের কাজ ছিল মিশরের ইতিহাস, ধর্ম, কালচার—সব কিছু নিয়ে গবেষণা করা। এদের হাত ধরেই জ্ঞানের একটা নতুন শাখার জন্ম হয়। যার নাম Egyptology.

১৮৩১ সালে ব্রিটিশ নেভী গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে যাত্রা করে। দ্বীপগুলো ছিল যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য স্ট্রাটেজিক্যালী ইম্পর্ট্যান্ট। জাহাজের ক্যাপটেন নিজেও ছিলেন একজন শখের বিজ্ঞানি। উনি দলে একজন ভূতাত্ত্বিককে নেবার সিদ্ধান্ত নেন। জিওলজির প্রফেসররা একের পর এক তাকে ‘টাইম নাই’ জানিয়ে দেন। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে তিনি সদ্য ক্যামব্রিজ পাশ করা এক ছাত্রকে এই জবের অফার দেন। ছাত্রটিও খুশিমনে এই অফার লুফেও নেয়। ক্যাপ্টেন ওখানে গিয়ে মিলিটারী ম্যাপ তৈরি করেন। আর ক্যাম্ব্রিজের স্টুডেন্টটি নিয়ে আসে রাশি রাশি ডাটা। যা কিনা একদিন আমাদের মনোজগতে বিরাট আঘাত হানবে।

তরুণ সেই গ্র্যাজুয়েটের নাম চার্লস ডারউইন। আর তার প্‌থিবী কাঁপানো তত্ত্বের নাম ‘থিওরি অফ ইভোল্যুশন’।

মানচিত্র আঁকার অভ্যাস আমাদের অনেক আগে থেকেই ছিল। সমস্যা হল, ঐ মানচিত্রগুলো ছিল অসম্পূর্ণ। আমরা, আফ্রো-এশিয়ার লোকজন তখন আমেরিকা সম্পর্কে জানতাম না। আমেরিকার আদি অধিবাসীরাও আমাদের সম্পর্কে জানতো না। কাজেই, আফ্রো-এশিয়ার মানচিত্র এঁকেই আমরা একে গোটা প্‌থিবীর মানচিত্র বলে চালিয়ে দিতাম।

আমাদের এই আইডিলোজিতে প্রথম আঘাতটা হানে ইউরোপীয়রা। তারা মানচিত্রের স্থানে স্থানে ফাঁকা রেখে একে আঁকতে শুরু করে। ইউরোপীয়ানদের চিন্তাধারায় যে বড়সড় পরিবর্তন আসছে, এটা তার প্রথম লক্ষণ। এশিয়ানরা যেখানে ‘সব জেনে বসে আছি ভাব’ নিয়ে লিটার‍্যালী বসে ছিল, সেখানে নিজেদের অজ্ঞানতাকে ওরা খোলা বাজারে স্বীকার করা শুরু করে। আর সেই অজানা ভূমির খোঁজে পাল তুলে বেরিয়ে পড়ে।

কলম্বাস নিজেও অবশ্য প্‌থিবীর পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রে ঈমানধারীদের একজন ছিলেন। উনি হিসেব কষে দেখেছিলেন, স্পেন থেকে সোজা পশ্চিমে যাত্রা করলে ৭ হাজার কিলোমিটার পর তিনি জাপান পৌঁছে যাবেন। তার এই হিসাব ঠিক মিললো না। ৭ হাজার নয়, ২০ হাজার কিলোমিটার যাত্রার পর তার জাহাজের এক নাবিক অদূরে স্থলভাগের চিহ্ন দেখে “মাটি, মাটি” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। এই স্থলভাগকেই আজ আমরা বাহামা বলে জানি।

স্পেন আর জাপানের মাঝখানে আর কিছু যে থাকতে পারে—কলম্বাস এতে বিশ্বাস করতেন না। তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, তিনি এশিয়ার পূর্ব প্রান্তের কোন দ্বীপে এসে পৌঁছেছেন। তিনি এই নতুন মানুষদের নাম দিলেন ইন্ডিয়ান। তিনি যে একটা সম্পূর্ণ নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেলেছেন—এই ব্যাপারটা তিনি নিতেই পারলেন না। কাজেকর্মে আধুনিক আর সাহসী হলেও মনে আর মননে কলম্বাস ছিলে পুরোপুরি মধ্যযুগের মানুষ। বাইবেলের উপর তার ছিল গভীর আস্থা। একটা বিরাট মহাদেশ থাকবে আর তার কথা বাইবেলে থাকবে না—এমনটা হতে পারে না। এই বিরাট ভুল নিয়েই তিনি সারা জীবন কাটিয়ে দেন।

এদিক থেকে প্রথম আধুনিক মানুষ ছিলেন আমেরিগো ভেসপুচি। কলম্বাসের কয়েক বছর পর ইতালির এই ভদ্রলোক আমেরিকায় সমুদ্রাত্রা করনে। সময়টা ছিল ১৪৯৯-১৫০৪। এই সময়ের মধ্যে তিনি দুটো বইও লিখে ফেলেন। এখানেই তিনি প্রথম দাবি করেন, কলম্বাস যেখানে আসছিলেন, ওটা আসলে এশিয়ার পূর্ব উপকূলের কোন দ্বীপ না। ওটা নতুন একটা মহাদেশের অংশ। যে মহাদেশ সম্পর্কে আমরা এখনো জানি না।

তার কথাবার্তায় কনভিন্সড হয়ে মার্টিন ওয়ালসেমুলার নামে সেকালের এক বিখ্যাত মানচিত্র নির্মাতা এই নতুন মহাদেশকে মানচিত্রে ঢুকিয়ে দেন। এখন এই নতুন মহাদেশের তো একটা নাম দিতে হবে। ওয়ালসেমুলারের ধারণা ছিল, আমেরিগো-ই এই নয়া মহাদেশের আবিষ্কারক। আমেরিগোর নাম অনুসারে তিনি এর নাম দেন আমেরিকা। তার এই ম্যাপখানা ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আর প্‌থিবীর বুকে আমেরিকা নামখানি-ই খোদাই হয়ে যায়।

কলম্বাসের নামে আমেরিকায় বেশ কিছু শহরের নাম আছে। দক্ষিণ আমেরিকায় একটা দেশের নামও আছে। কিন্তু ঐ গোঁয়ার্তুমিটা না করলে হয়তো আজ প্‌থিবীর দু দুটো মহাদেশের নাম আমেরিকা না হয় কলম্বিয়া হত। ইতিহাসের অল্প কয়টা ‘পোয়েটিক জাস্টিস’ এর মধ্যে এটা একটা। কলম্বাস তার অজ্ঞানতাকে স্বীকার করতে চাননি। আর আমেরিগো ভেসপুচির এই স্বীকারটুকু করার সাহস ছিল বলে নতুন পৃথিবীর নাম তার নামেই হল।

সায়েন্টিফিক রেভোল্যুশন এগজ্যাক্টলি কবে শুরু হয়, তার যদি কোন ল্যান্ডমার্ক চিহিত করতে হয়, তবে ইউরোপীয়ানদের এই আমেরিকা আবিষ্কার-ই সেই ল্যান্ডমার্ক। এর মধ্য দিয়ে মানচিত্র নির্মাতারাই কেবল মানচিত্রের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করা শুরু করলেন না, তাদের সাথে এগিয়ে এলেন জ্ঞানের সব শাখার লোকেরা। উদ্ভিদ ও প্রাণিবিদ, পদার্থ ও রসায়নবিদ, তাত্ত্বিক ও ধার্মিক—সবাই। সবাই পাগলের মত যার যার ফিল্ডের ফাঁকা জায়গাগুলো ভরাট করা শুরু করলেন।

ইউরোপীয় ছাড়া আর এক দলের সামান্য সম্ভাবনা ছিল নতুন প্‌থিবীর মালিক হবার। তারা হল চাইনিজ। কলম্বাসের যাত্রার বেশ আগে ১৪৩৩ সালে মিং রাজারা এক বিরাট লটবহর পাঠান ভারত মহাদেশ এক্সপ্লোর করতে। ৩০০ জাহাজ ওয়ালা সেই বহর শ্রীলংকা, ভারত, পারস্য উপসাগর ঘুরে আফ্রিকার পূর্বভাগে ছুঁয়ে যায়।

কলম্বাসের সাথে এই অভিযানের পার্থক্য ছিল—এরা একদম নতুন, অপরিচিত কোন ভূমির সন্ধান পায়নি। যে দেশগুলো ছুঁয়ে গেছে, তাদেরকেও কলোনাইজ করার চেষ্টা করেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই দুঃসাহসী অভিযান ব্যাপারগুলো কেন যেন চাইনিজ কালচারের সাথে খুব যায় না। তাদের ট্রাডিশনাল কালচারে গতির চেয়ে স্থিতিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ্যাদ্ভেঞ্চার নয়, স্ট্যাবিলিটি তাদের মূল মোক্ষ। বেইজিং এ তাই ক্ষমতার পালাবদলের পর এইসব অভিযানে ফান্ডিং-ও গুটিয়ে আনা হয়। চাইনিজদের নতুন প্‌থিবী জয়ের স্বপ্নও সেইখানেই থমকে যায়।

ইউরোপীয়ানদের এই পাগলামির আমরা অনেক সময় ক্রেডিট দিতে চাই না। ইউরোপীয় কলোনিয়ালিজমের আমরা সমালোচনা করতেই পারি, সেই সাথে ওদের সাহসের প্রশংসাও করতে হবে। সেকালের প[রস্পেক্টিভে এটা কিন্তু ছিল চূড়ান্ত মাত্রার দুঃসাহসিক যাত্রা। আজ আমাদের জন্য অন্য কোন গ্রহে বসতি স্থাপন করা যতোটা কঠিন, ইউরোপীয়দের অভিযানগুলোও ঠিক ততোটাই কঠিন আর অনিশ্চিত ছিল।

সেসময় যে মানুষ অন্য দেশ দখল করতে যাত্রা করতো না, তা না। কিন্তু সেটা ছিল নিজেদের আশেপাশের চল্লিশ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খুব দূরে কোথাও যাত্রা করে সাম্রাজ্য স্থাপনের কথা এট লিস্ট কেউ ভাবতো না। তাও অজানা আর দীর্ঘ সমুদ্রপথে। আলেকজান্ডার বহুদূর থেকে এসে ভারবর্ষে আক্রমণ করসেন। কিন্তু এখানে সাম্রাজ্য স্থাপন করেননি। বা থেকে যাননি। থেকে গেছে মোগলরা। যারা এক অর্থে আমাদের প্রতিবেশীই ছিল।

আর একটা উদাহরণ দিই। রোমানরা এত্রুরিয়া জয় করসে ৩০০-৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এত্রুরিয়া রক্ষা করার জন্য তারা জয় করসে পো ভ্যালী (২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে)। পো ভ্যালী সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য জয় করসে জয় করসে প্রোভেন্স (১২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), প্রোভেস্নকে রক্ষা করার জন্য গল (আ জকের ফ্রান্স, ৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে) আর গলকে রক্ষা করার জনন্য ব্রিটেনের দখল বুজে নিসে ৫০ খ্রিস্টাব্দে। লন্ডন থেকে রোমে যাইতে তাদের ৪০০ বছর লেগে গেছে। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমানরা ভুলেও লন্ডন জয়ের স্বপ্ন দেখতো না। ইউরোপীয়রা সেটাই দেখসে। আগের সমস্ত ধ্যান-ধারণা ভেঙে সম্পূর্ণ অজানার ইদ্দেশ্যে যাত্রা করসে। আর সফলও হইসে।

আজ যে আমরা সবাই এক প্‌থিবীর বাসিন্দা, এক ধরণী মাতার সন্তান—এই বোধটা কিন্তু ইউরোপীয়দের এই অভিযানগুলোই আমাদের মধ্যে তৈরি করসে। এর মাশুলও আমাদের দিতে হয়েছে। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে মহাদেশ ইউরোপীয়দের নামে লিখে দিয়ে।

শেষটা করি মন্টেজুমার গল্প দিয়ে।

মন্টেজুমা ছিলেন আজটেকদের সম্রাট। আজটেকদের শেষ সম্রাট।

শেষ সম্রাট বলেই এই গল্পে আরো একটা চরিত্র চলে আসবে। ইনি গল্পের ভিলেন। শক্তিশালী এই ভিলেনের নাম কর্টেজ।

গল্পের পটভূমি ১৫০০ সাল, আজকের আমেরিকা। আজটেকরা তখন এই আমেরিকায় সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যটির মালিক।

১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন তার সোনার তরী নিয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে এসে হাজির হন, তখন থেকেই সেখানকার আদি বাসিন্দাদের কলোনাইজ করা শুরু করেন। ঐ কলোনীগুলো ছিল পৃথিবীর বুকে এ এক টুকরো দোযখ। বাসিন্দাদের সেখানে খনি আর খেতখামারে দাস হিসেবে খাটানো হত। অমানবিক অত্যাচার আর ইউরোপীয়দের আনা জীবাণুর কবলে পড়ে অতি অল্প সময়েই তারা পটাপট ইহধামের মায়া ত্যাগ করতে লাগলো।

গোটা ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জ বলতে গেলে জনশূন্য হয়ে গেলো। এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তখন আফ্রিকা থেকে দাস আমদানির কালচার শুরু হল। আজ আমরা যে ক্যারিবীয়দের দেখি, তার বড় অংশটাই এই আফ্রিকানদের বংশধর। সহী ক্যারিবীয়ানদের দেখা পাওয়া আজ দুষ্কর।

আজটেকদের দরজার ঐপাশেই ঘটনাগুলো ঘটছিল। যদিও আজটেকরা এর কিছুই জানতো না। ১৫১৯ সালে তাই কর্টেজের নেতৃত্বে স্প্যানিশরা যখন আজটেকদের দরজায় কড়া নাড়ে, তখন বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না। আজ যদি পৃথিবীর বুকে এলিয়েন নেমে আসে, তখন আমরা যেমন অবাক হব, আজটেকরাও ইউরোপীয়দের দেখে ঠিক ততোটাই অবাক হয়েছিল।

তাদের সাম্রাজ্যের বাইরেও যে আনুষের অস্তিত্ব আছে—এটা ছিল তাদের ধারণার বাইরে। ইউরোপীয়রা কি মানুষ না অন্য কিছু—এটাই তারা ডিসাইড করে উঠতে পারছিল না। মানুষ হলে এরকম ধবল শাদা হবে কেন? গা থেকে এরকম গন্ধই বা বেরোবে কেন? (এইখানে বলে রাখি, ইউরোপীয়রা কিন্তু দিনের পর দিন গোসল না করে থাকতে পারতো)

চেহারা সুরত যাই হোক, ইউরোপীয়দের সাথের জিনিসপত্র দেখে তারা মুগ্ধ না হয়ে পারলো না। এতো বড় বড় জাহাজ তারা বাপের জন্মে দেখেনি। ঘোড়ার মত দ্রুতগামী প্রাণীর সাথেও তাদের পরিচয় সেই প্রথম। সবচেয়ে অবাক করা বিষয়, ইউরোপীয়দের হাতের লাঠি থেকে আগুনের হলকা বেরোয়। কেবল দেবতারাই এরকম লাঠির মালিক হয়ে থাকেন।

(পাঠকের জন্য ছোট্ট কুইজ। বলতে হবে, এই লাঠিটি আসলে কী?:p)

নাহ! এরা দেবতা না হয়ে যায় না। হয় দেবতা নয়তো শয়তান।

এখন এরা মানুষ না দেবতা না শয়তান—এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক করতে করতেই সময় চলে যেতে লাগলো। এরা যে সাম্রাজ্যের পটেনশিয়াল শত্রু, এদের বিরুদ্ধে যে এখনই সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার—এটা তাদের মাথায় এলো না। সাড়ে ৫শ’ মানুষের একটা দল এই বিশাল সাম্রাজ্যের আর কী-ইবা ক্ষতি করবে—এই ভেবে তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমাতে লাগলো।

কর্টেজ এর সুবিধাটাই নিলেন। জাহাজরূপী স্পেসশিপ থেকে অবতরণ করে তিনি স্থানীয়দের উদ্দেশ্যে বললেন, স্পেনের রাজা তাকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন সম্রাট মন্টেজুমার কাছে। মন্টেজুমার সাথে দেখা করতে চায় সে।

ডাহা মিথ্যা কথা। স্পেনের রাজা কস্মিনকালেও মন্টেজুমার নাম শোনেননি। কর্টেজ নিজেই এসব তথ্য যোগাড় করেছে স্থানীয় আজটেক বিরোধী মহলের কাছ থেকে।

এরা তাকে আজটেকদের রাজধানী পর্যন্ত এগিয়ে দিল। কর্টেজ বিনা বাধায় রাজধানীতে প্রবেশ করলেন।

মন্টেজুমার সাথে কথাবার্তা হচ্ছে, এমন সময় কর্টেজ তার সৈন্যদের একটা সিগনাল দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্প্যানিশরা সম্রাট মন্টেজুমার বডিগার্ডদের কচুকাটা করলো। সম্রাট আর সম্রাট রইলেন না। পরিণত হলেন সম্মানিত বন্দীতে।

সুঁচ হয়ে ঢোকা আর ফাল হয়ে বেরোনো বোধয় একেই বলে। কর্টেজ তবু স্বস্তি পেল না। সম্রাটকে তো বন্দী করলো। কিন্তু তার চারপাশে যে লক্ষ লক্ষ এ্যাজটেক রয়েছে—এদের কী করবে সে? সবাইকে তো আর একবারে ফেলা সম্ভব না এই ৫০০ সৈন্য দিয়ে। কারো কাছে যে সাহায্য চাইবে—সেটাও সম্ভব না। সবচেয়ে কাছের স্প্যানিশ বেসটা রয়েছে এখান থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূরে। কিউবায়।

কর্টেজ করলো কি—সে মন্টেজুমাকে প্রাসাদে বন্দী রেখে দিল। কিন্তু এমন একটা ভাব করলো যেন এখনো মন্টেজুমাই দেশ চালাচ্ছেন। সে জাস্ট বিদেশী গেস্ট। আজটেকদের সমস্যা ছিল—তাদের শাসন ব্যবস্থা ছিল অত্যধিক সেন্ট্রালাইজড। সম্রাটের আদেশই ছিল এখানে শেষ কথা। আর এখন সম্রাটের আদেশ মানে তো দস্যু কর্টেজের আদেশ। আজটেক এলিট সেই আদেশই নতমস্তকে পালন করছিল।

কয়েক মাস এইভাবে চললো. এর মধ্যে চতুর কর্টেজ চারদিকে তার দলবল পাঠিয়ে গোটা সাম্রাজ্য সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পেয়ে গেলো। স্থানীয় ভাষা, কালচার—সব কিছু সম্পর্কে।

আজটেক এলিটরা যখন শেষমেশ বিদ্রোহ করলো, তখন তারা বিশেষ সুবিধা করে উঠতে আরলো না। কর্টেজ তখন সাম্রাজ্যের ফাঁকফোকরগুলো খুব ভালোমত ইস্তেমাল করা শিখে গেছে। আজটেক শাসকদের বিরুদ্ধে একদল লোক তো খ্যাপা ছিলই। তাদেরকে সে নিজ হাতের মুঠোয় নিয়ে এল।

এই স্থানীয়রা ভেবেছিল, আজটেকদের উৎখাত করে তারা ক্ষমতায় বসে যাবে। স্প্যানিশদের আসল চরিত্র তাদের জানা ছিল না, জানা ছিল না অতি সম্প্রতি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে তাদের কীর্তিকলাপের কথা। এই অল্প ক’টা স্প্যানিশ যে এক সময় তাদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিবে—এ ছিল তাদের দুঃস্বপ্নের বাইরে।

এর মধ্যে কর্টেজ কিন্তু ইয়াহিয়া খান স্টাইলে আশপাশ থেকে যথেষ্ট সৈন্য এনে মজুদ করে রেখেছে। স্থানীয়রা যখন বুঝলো, কী হচ্ছে—ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

মন্টেজুমার গল্প এখানেই শেষ। পরিশিষ্ট হল, ১০০ বছরের মধ্যেই স্থানীয় জনসংখ্যার ৯০ ভাগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। ক্যারিবীয়রা যে কারণে মরেছিল, এরাও ঠিক সেই কারণেই মরলো। এক অত্যাচারে। আর বেশিরভাগ মারা পড়লো ইউরোপীয় জীবাণুর বিরুদ্ধে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায়। আজ যে জীবাণু অস্ত্র কনশাসলি তৈরি হচ্ছে, সেকালে সেই জীবাণু অস্ত্রই আনকনশাসলি একটা জাতিকে প্‌থিবীর বুক থেকে মুছে দিয়েছিল।

হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। দশ বছর পর একই ঘটনা ঘটেলো ইনকাদের সাথে।

জ্ঞান বা জ্ঞানের আগ্রহকে যে গ্লোরিফাই করা হয়—তা তো আর এমনি এমনি না। ইউরোপীয়দের যে জ্ঞান ত্‌ষ্ণাটা ছিল, অজানাকে জানার যে আগ্রহ ছিল, তার ভগ্নাংশও যদি আজটেক বা ইনকাদের থাকতো, তবে আজ হয়তো তারা ইতিহাসের পাতায় না থেকে মর্ত্যের পৃথিবীতেই থাকতো। ক্যারিবীয়দের দুর্দশার কথা জানলে হয়তো আজটেকরা আরো প্রিপেয়ার্ড থাকতো। কিংবা আজটেকদের কথা জানলে ইনকারা। কিন্তু ঐ যে, নিজেদের সীমানাকেই পৃথিবীর সীমানা ভাবা—এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাদের সর্বনাশ করলো।

‘নলেজ ইজ পাওয়ার’, বা আজকের ভাষায় ‘ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার’—তাই কোন তত্ত্বকথা নয়। ইতিহাস নিজেই এর বড় প্রমাণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *