প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

২.৫ এরপর যেসব ঘটনা সংযোজিত হবে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এই কাহিনীতে এরপর যেসব ঘটনা সংযোজিত হবে সেই সব ঘটনার সঙ্গে পাঠকরা যাতে সহজে পরিচিত হতে পারেন তার জন্য আগে থেকে কিছু বলে রাখা প্রয়োজন। এই বইয়ের রচয়িতা কিছুকালের জন্য প্যারিস থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলেন। তার এই অনুপস্থিতিকালে প্যারিস শহরের এক পরিবর্তন ঘটে। এখন এমন এক শহরের উদ্ভব ঘটেছে যে শহর তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। যে প্যারিস শহরকে সে জন্মাবধি ভালোবেসে এসেছে, যে প্যারিস ছিল তার আধ্যাত্মিক আবাসভূমি, যার স্মৃতি আজও জেগে আছে তার অন্তরে। ভাঙচুর আর পুনর্গঠনের সময় সে প্যারিস অদৃশ্য হয়ে যায়। অতীতের বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং গ্রন্থকার যে প্যারিস শহরের কথা বলতেন সে প্যারিস হল অতীতের সেই শহর, যার অস্তিত্ব এখন আর নেই। তিনি যেসব রাস্তা বা বাতির উল্লেখ করবেন বর্তমানে তার খোঁজ করলে হয়তো পাওয়া যাবে na। অথচ গ্রন্থকারের ধারণা পুরনো শহরটার সব কিছু হয়তো বদলে যায়নি একেবারে। আমরা যখন আমাদের জন্মভূমি ও স্বদেশ ছেড়ে দূরে চলে যাই তখন তার প্রতি আমাদের ভালোবাসার টানটা বুঝতে পারি। তখন মনে হয় সেখানকার পথঘাট, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছুর মধ্যে আমাদের অন্তরের একটা অংশ ফেলে রেখে এসেছি। আমাদের অনুপস্থিতিকালে আমাদের অন্তরের স্পর্শে সেই সমগ্র জন্মভূমি যেন মায়াময় এক অপরূপ বস্তু হয়ে ওঠে। আমরা যখন আবার দূর প্রবাস থেকে সেই জন্মভূমিতে ফিরে আসি তখন আমাদের আগের দেখা সেই জন্মভূমির অবিকৃত রূপকে দেখতে চাই। সেই গাছপালা, ঘরবাড়ি, পথঘাট যেখানে যা কিছু দেখে গিয়েছিলাম সেখানেই সব কিছু দেখতে চাই।

পাঠকদের কাছে অতীতের সেই প্যারিস শহরকে বর্তমানে চালিয়ে দেবার অনুমতি চেয়ে আবার কাহিনী শুরু করছেন তিনি।

জাঁ ভলজাঁ বাজার এলাকাটা ছেড়ে দিয়ে গলিপথ ধরে প্রায়ই পেছন ফিরে তাকাতে তাকাতে শিকারির তাড়া খাওয়া হরিণের মতো জোর পায়ে হাঁটতে লাগল কসেত্তেকে নিয়ে। সে প্রায়ই দিক পরিবর্তন করে এক পথ থেকে ভিন্ন পথ ধরতে লাগল।

সেদিন ছিল পূর্ণিমারাত্রিচাঁদটা তখনও দিগন্তেই ছিল। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছিল রাস্তার উপর। ভলজাঁ রাস্তার কোল ঘেঁষে ছায়ায় গা-ঢাকা দিয়ে আলোর দিকে চোখ রেখে পথ হাঁটছিল। নির্জন রাস্তাটায় বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সে অন্তত বুঝতে পারল কেউ তাদের অনুসরণ করছে না।

কসেত্তে কোনও প্রশ্ন না করেই ভলজাঁর পাশে পাশে পথ হাঁটতে লাগল। ক্রমাগত ছয় বছর ধরে সে যে কষ্ট জীবনে পেয়েছে তাতে এক নীরব সহনশীলতা আপনা থেকে শিখে ফেলেছে। তাছাড়া এই কদিনের মধ্যেই ভলজাঁ’র কতকগুলি বাতিকের ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। অপ্রত্যাশিত কোনও ঘটনাই আর বিস্মিত করতে পারে না তাকে। ভলজাঁ’র কাছে থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করে সে।

কসেত্তের মতো ভলজাঁ নিজেও জানত না সে কোথায় যাচ্ছে। ভলজাঁর ওপর কসেত্তের যেমন অকুণ্ঠ বিশ্বাস ছিল, ঈশ্বরের ওপর ভলজাঁ’র তেমনি ছিল অকুণ্ঠ অবিচল বিশ্বাস। তার মনে হল এক অদৃশ্য বৃহত্তর শক্তি তার হাত ধরে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে কী করবে বা কোথায় যাবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা বা নির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা ছিল না। সে যে জেতার্তকে ঠিক দেখেছে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারল

সে। আর সে যদি জেতার্তকে দেখেও থাকে তা হলে তার মানে এই নয় যে জেতার্ত তাকে জাঁ ভলজাঁ বলে চিনতে পেরেছে। কারণ সে এমনভাবে ছদ্মবেশ ধারণ করে আছে যাতে তাকে ভলজাঁ বলে কেউ চিনতে না পারে। সবাই জানে ভুলা মারা গেছে। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেসব ঘটনা ঘটে গেছে সেসব ঘটনাকে অস্বীকার করতে পারে না সে। তবে সে মনে মনে সংকল্প করল গর্বোর সেই বাড়িটাতে আর ফিরে যাবে না কখনও। আপন গুহা থেকে বিতাড়িত এক জন্তুর মতো এক অস্থায়ী অথচ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে।

অনেক পথ ঘুরে ঘুরে র‍্যু মুফের্দ অঞ্চলে এসে দেখল সমস্ত অঞ্চলটা এরই মধ্যে মধ্যযুগীয় এক গ্রামের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন সান্ধ্য আইন জারি আছে গোটা এলাকাটায়। র‍্যু সেনসিয়ের, র‍্যু কোপো, সেন্ট ভিক্টর, র‍্যু দু পুইত, লার্মিতে প্রভৃতি নামে কতকগুলি রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে কতকগুলি হোটেল দেখতে পেল ভলজাঁ। কিন্তু হোটেল পছন্দ হল না তার। কারণ তাকে যে কেউ অনুসরণ করছে না। এবং সে অনুসরণকারীদের নাগালের বাইরে চলে এসেছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারল na তখনও।

সেন্ট এতিয়েনে চার্চে এগারোটা বাজল। রাস্তার অন্ধকার দিকটায় র‍্যু পস্তয় নামে একটা পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ভলজাঁ একবার পেছন ফিরে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখল ফাঁড়ির সামনে লণ্ঠন জ্বালিয়ে তিনটে পুলিশ বসে আছে। তাদের দলের নেতার সন্দেহ হওয়ায় সে কসেত্তেকে নিয়ে র‍্যু পন্তয় ছেড়ে অন্য পথ ধরল।

র‍্যু দে পোস্তের কাছে এসে একটা বড় ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল ভলজাঁ। গোটা জায়গাটা জুড়ে চাঁদের আলো ঝরে পড়ছিল। ভলজাঁ কাছাকাছি একটা বাড়ির সদর দরজার আড়ালে লুকিয়ে লক্ষ করতে লাগল তাকে কেউ অনুসরণ করছে কি না। সে ভাবল, এতক্ষণ ছায়ায় ভালো করে লক্ষ করতে পারেনি। এবার কেউ যদি সত্যিই তাদের পিছু পিছু আসে তা হলে তাকে ওই ফাঁকা জায়গাটা পার হয়ে আসতে হবে আর তা হলে চাঁদের আলোয় তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে।

ভলজাঁ যা ভেবেছিল ঠিক তাই হল। মিনিট তিনেকের মধ্যেই চারজন লোক সেই চাঁদের আলোঝরা ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তারা চারজনই ছিল পুলিশ। লম্বা চেহারা, গায়ের রঙ বাদামি, মাথায় গোল টুপি আর হাতে লাঠি। ফাঁকা জায়গাটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে তারা বুঝতে পারছিল না কোনদিকে যাবে। তাদের মধ্যে একজন ভলজাঁ যেদিকে এসেছিল সেই দিকে আসছিল। কিন্তু অন্যরা উল্টো দিকের পথ ধরল। তখন সে ভলজাঁর দিকে আসছিল। সে মুখটা ঘোরাতেই চাঁদের আলোটা তার মুখের উপর পড়ল। ভজ দেখল লোকটা জেতার্ত।

.

২.

এতক্ষণে অস্বস্তিকর যে অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিটি মুহূর্ত যাপন করছিল ভলজাঁ তা অন্তত দূর হল। তার অনুসরণকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় এবং দেরি করে ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ভলজাঁ লাভবান হয়। সেই অবকাশে ভলজাঁ দরজার সেই আশ্ৰয়টা ছেড়ে র‍্যু দে পোস্তের দিয়ে জাদিল দে প্ল্যান্তের দিকে চলে গেল। কসেত্তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ভলজাঁ তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পথ চলতে লাগল। রাস্তায় কোনও লোক ছিল না। চাঁদের আলো থাকায় রাস্তার লাইটপোস্টের আলো জ্বালা হয়নি।

ভলজাঁ তার চলার গতি বাড়িয়ে দিয়ে ফতেন সেন্ট ভিক্টর পার হয়ে জার্দিল দে প্ল্যান্তের চারদিকে ঘুরে অবশেষে নদীর ধারের বাঁধের উপর এসে উঠল। বাঁধের উপর কোনও লোক না থাকায় সে এবার হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এবার সে সেখানে দাঁড়িয়ে নিজের বর্তমান অবস্থাটা খতিয়ে দেখতে লাগল।

বাঁধটা ধরে কিছুদূর গিয়ে নদীর সেতুটা পেল। সেতুটা পার হতে হয় পয়সা দিয়ে। একজন আদায়কারী সামনে বসে ছিল। ভলজাঁ তার কাছে গিয়ে একটা স্যু দিল। কিন্তু লোকটা বলল, দুটো স্যু লাগবে। তোমার সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। সে হাঁটতে পারে, তাই তোমাকে দু জনের ভাড়া দিতে হবে।

ভজ তাই দিয়ে হাঁটতে লাগল। একটা মালবোঝাই গাড়ি ধীর গতিতে পুলের উপর দিয়ে আসছিল, ভলজাঁ সেই গাড়িটার পাশে পাশে আড়ালে পথ চলতে লাগল। অর্ধেকটা যাওয়ার পর কসেত্তে বলল, সে এবার হেঁটে যেতে পারবে।

সেতুর উপর দিয়ে নদীটা পার হয়ে ওপারে গিয়ে ডানদিকে কতকগুলি কাঠের গুদাম দেখতে পেল ভলজাঁ। সেইদিকে যাবার ঠিক করল সে। একটা ফাঁকা জায়গা পার হয়ে তবে সেখানে যেতে হবে। কোনও দ্বিধা না করেই সে সেটা পার হয়ে কাঠগোলার কাছে গিয়ে হাজির হল। পাশাপাশি অনেকগুলো গোলার মাঝে মাঝে এক-একটা সরু অন্ধকার গলি আছে। এমনি একটা গলির ভেতর ঢোকার আগে ভলজাঁ একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে লাগল তাদের পিছু পিছু কেউ আসছে কি না।

ভলজাঁ ভালো করে দেখল সেতুটার ওপারে জার্দিল দে প্ল্যান্তের কাছে সেই চারটে ছায়ামূর্তি ধীর গতিতে আসছে। তবে ভলজাঁ দেখল এখনও আশা আছে। ওরা তাকে সেতু পার হতে দেখেনি, এখনও এখানে আসতে ওদের দেরি আছে। সে ভাবল নীরব নির্জন ছায়ান্ধকার গলিপথ তার পক্ষে অনেক নিরাপদ, এই ভেবে একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

.

৩.

গলির ভেতরে ভেতরে তিনশো গজ যাবার পর ভলজাঁ দু দিকে দুটো পথ দেখতে পেল তার সামনে। কোনও দ্বিধা না করেই ডানদিকের পথটা ধরল সে। কারণ সে দেখল বা দিকের পথটা সোজা শহরের মাঝখানে চলে গেছে। কিন্তু ডান দিকের পথটা গেছে গ্রামাঞ্চলের পথে।

কসেত্তে’র জন্য সে তাড়াতাড়ি যেতে পারছিল না। কসেত্তে হাঁটতে পারছিল না বলে তাকে আবার তুলে নিল পিঠের উপর। কসেত্তে তার কাঁধের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। গলিপথে তাড়াতাড়ি যেতে যেতে প্রায়ই পেছন ফিরে তাকাচ্ছিল ভলজাঁ।

প্রথমে দু-তিনবার তাকিয়েও পেছনে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু পরে একবার তাকাতেই সে দেখল কারা যেন ছায়ার মধ্যে কথা বলতে বলতে আসছে। ভলজাঁ তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে যেতে লাগল। ভাবল আবার সে একটা দোমাথা রাস্তার সামনে। গিয়ে পড়বে এবং একটা পথ ধরে তার অনুসরণকারীদের ধোকা দেবে।

এইভাবে গলিপথটা পার হয়ে সামনে একটা বিরাট প্রাচীর দেখতে পেল। দেখল গলিপথটার সেখানেই শেষ এবং আবার দু দিকে দুটো রাস্তা চলে গেছে। আবার তাকে ঠিক করতে হবে সে বাঁ অথবা ডান কোনদিকে যাবে।

এবারও ডানদিকের পথ ধরল ভলজাঁ। সেটাও একটা গলিপথ। পথটার দু ধারে কতকগুলি বড় বড় পাকা বাড়ি রয়েছে। সেগুলো বসতবাড়ি নয়। দোকান অথবা মাল রাখার গুদাম। সেই গলিপথটাও একটা বড় সাদা প্রাচীরের সামনে এসে শেষ হয়ে গেছে। এখানেও আবার দু দিকে দুটো পথ চলে গেছে।

ভলজাঁ দেখল বাঁ দিকে একটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। জায়গাটা পার হলেই একটা বড় রাস্তা পাওয়া যাবে। সে ঠিক করল বাঁ দিকের পথটায় যাবে সে।

কিন্তু বাঁ দিকে যাবার জন্য ঘুরতেই ভজ দেখল গলিপথটা যেখানে বড় রাস্তায় গিয়ে মিশেছে তার মুখে একটা লোক স্তব্ধ প্রতিমূর্তির মতো ছায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হল তারই পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে সে।

প্যারিসের যে অংশে ভলজাঁ তখন উপনীত হয়েছিল সে অংশ ফবুর্গ সেন্ট আঁতয়নে আর লা রেনির মধ্যে আবদ্ধ ছিল। বর্তমানে সে জায়গাটা একেবারে বদলে গেছে। সে জায়গার এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেকের মতে সেটা দেখতে খারাপ হয়েছে, আবার অনেকের মতে জায়গাটা উন্নত হয়েছে আগের থেকে। এখন সেখানে অনেক বাজার, কাঠগোলা, বড় বড় বাড়ির পরিবর্তে বড় বড় রাস্তা, থিয়েটার হল, রেলস্টেশন আর কারখানা গড়ে উঠেছে।

অর্ধশতাব্দী আগে প্যারিসের এই অঞ্চলটাকে বলা হত লে পেতিত পিপাস। পুরনো প্যারিসের পোর্তে সেন্ট জ্যাক, পোর্তে প্যারিস, ব্যভিয়ের দে সার্জেন্ট, লা গ্যালিওত, লা পেতিত প্রোলোতানে প্রভৃতি নামগুলো আজও চলে আসছে।

তখন লে পেতিত পিকপাস অঞ্চলের চেহারাটা ছিল কোনও স্প্যানিশ শহরের মতো হতশ্রী। তার রাস্তাঘাটগুলো ছিল খারাপ, এবড়ো-খেবড়ো, বাড়িগুলো ছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। দু-তিনটে বড় চওড়া রাস্তা ছাড়া চারদিকে ছিল শুধু বড় বড় প্রাচীর আর একটা করে ফাঁকা জায়গা। এমনি একটা বড় প্রাচীরের গাঁয়ে কতকগুলি বাগান আর একতলা বাড়ি, কাঠগোলা আর দোকান গড়ে উঠেছিল।

আজ হতে প্রায় তিরিশ বছর আগে পেতিত পিকপাস নামে অঞ্চলটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আজ তার কোনও চিহ্নই নেই। এ যুগের কোনও মানচিত্রে তার কোনও উল্লেখ নেই। শেষ ১৭৭২ সালের প্রকাশিত এক সরকারি মানচিত্রে লে পেতিত পিকপাসের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সেদিন রাত্রিতে এই লে পেতিত পিকপাস অঞ্চলেই এসে পড়ে ভলজাঁ।

র‍্যু দ্রয়েত মুর আর র‍্যু পিকপাসের মাঝখানে এক কোণে একটি অন্ধকার মূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিছিয়ে গেল ভলজাঁ। যে লোকটার মূর্তি সে দেখতে পেয়েছে সে লোকটা নিশ্চয় তার ওপর নজর রাখতে এসেছে।

এখন সে কী করবে? কিছুক্ষণ আগে পেছন ফিরে দেখেছে তিন-চারজন লোক তার পিছু পিছু আসছে অর্থাৎ তাকে অনুসরণ করছে তারা। তার মানে পেছন দিকে পালাবার পথ তার বন্ধ। মনে হয় জেতার্ত তার দলবল নিয়ে সেখানে পাহারায় আছে। তাকে ধরার জন্য তৈরি হয়ে আছে। আর জেভাৰ্তই হয়তো একজনকে সামনের দিকে পথটা রুদ্ধ করে দেবার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। এই সব অনুমান নিশ্চয়তার রূপ ধরে দমকা বাতাসের আঘাতে ঝরে পড়া ধুলোর মতো তার মনের ওপর ঝরে পড়তে লাগল।

জাঁ ভলজাঁ র‍্যু পিকপাসের দিকটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল। ফুটপাতের উপর অন্ধকারে যে প্রহরী মূর্তিটা দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে পালাতে গেলে তার হাতে ধরা পড়তে হবে। আবার পেছন দিকে পালাতে গেলে জেভার্তের হাতে ধরা পড়তে হবে। ভলজাঁর মনে হল এমন একটা জালের মধ্যে সে ধরা পড়েছে, যে জালটা ক্রমশই শক্ত হয়ে উঠছে। এক নিবিড় হতাশায় আকাশের পানে মুখ তুলে তাকাল ভলজাঁ।

.

৪.

ব্যাপারটা অর্থাৎ ভলজাঁ’র তখনকার অবস্থাটা ঠিকমতো বুঝতে হলে র‍্যু দ্ৰয়েত মুর-এর আসল ছবিটা দেখা দরকার। র‍্যু পোলেনসো’র দিক থেকে গলিপথটাতে ঢুকে একটা মোড় ফিরলেই র‍্যু দ্ৰয়েত মুরে গিয়ে পড়তে হবে। র‍্যু দ্ৰয়েত মুর জায়গাটা ডানদিকে কতকগুলি যত সব বিশ্রী রকমের বাড়ি দিয়ে ঘেরা আর তার বাঁ দিকে আছে এমন একটা বিরাট বড় বাড়ি যার র‍্যু পিকপাসের দিকে মাথাটা ক্রমশই উঁচু হয়ে উঠছিল, কিন্তু র‍্যু পোলোনসোর দিকে তার মাথাটা খুবই নিচু ছিল। বাড়ি বলতে শুধু দু দিকে দুটো বড় দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে আর তার ভেতরকার ঘরগুলো ভেঙে গেছে।

ভজ তার এই বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে পড়ে ভাবতে লাগল সে একবার যদি জোড়া বাড়িটির মধ্যে গিয়ে পৌঁছতে পারে তা হলে সে নিরাপদ। তা হলে আর কোনও ভয় নেই তার। বাড়িটার আপাতত নির্জনতা আর নীরবতার একটা আকর্ষণ ছিল তার কাছে। ভজ দেখল বাড়িটার প্রতিটি ঘরের জানালার নিচে একটা করে পাইপ আছে। সেইসব পাইপ একটা বড় পাইপে গিয়ে মিশেছে। ভলজাঁ ভাবল পাইপ বেয়ে কসেত্তেকে নিয়েই সে বাড়িটার উপরে উঠে যাবে। পাইপগুলো একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত যুক্ত আছে। তবে জানালাগুলো সব বন্ধ। তাছাড়া বাড়িটার সামনের দিকটা চাঁদের আলোয় ভাসতে থাকায় সেখানে আশ্রয় নিতে গেলেই তাকে দেখতে পাওয়া যাবে। তাছাড়া পাইপগুলো বহুকালের পুরনো হওয়ায় পচে গেছে। তিনতলা বাড়িটার উপরে কসেত্তেকে পিঠে নিয়ে পাইপ বেয়ে ওঠা সম্ভবও নয়।

সে আশা ত্যাগ করে ছায়ান্ধকার জায়গাটায় এসে দাঁড়াল ভলজাঁ। ভাবল এখানে দাঁড়ালে অন্তত তাকে দেখা যাবে না এবং দরজাটা খোলার চেষ্টা করবে। লাইমগাছের শাখাগুলোকে অবলম্বন করে আইভি লতাগুলো দেয়ালে উঠে গেছে। মনে হল দরজা আর দেয়ালের ওপারে একটা বাগান আছে। সে বাগানে একবার গিয়ে পড়তে পারলে বাকি রাতটা তারা লুকিয়ে থাকতে পারবে।

সময় কেটে যাচ্ছে। যা কিছু করতে হবে তাড়াতাড়ি করতে হবে। সে সদর দরজাটা চাপ দিয়ে খোলার চেষ্টা করল। মনে হল দরজার কাঠটা পুরনো আর পচা। যে লোহা দিয়ে কাঠগুলো আটকানো আছে তাতে মরচে পড়েছে। কিন্তু সে পরীক্ষা করে দেখল আসলে সেটা দরজাই নয়। তাতে কোনও কপাট নেই। লোহার পাত আর কাঠ দিয়ে সেটা ঢাকা। তার ওপারে দেয়াল। সে দরজা কোনওমতেই ভোলা যাবে না।

.

৫.

এমন সময় দূর থেকে কতকগুলি লোকের পথচলার শব্দ আসতে লাগল। সে সেই ছায়ান্ধকার থেকে দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখল সাত-আটজন সৈনিক দুই সারিতে বিভক্ত হয়ে মার্চ করে তার দিকেই আসছে। তাদের বন্দুকের বেয়নেটগুলো চকচক করছিল।

সে আরও দেখল সেই সৈনিকদলের সামনে জেভার্তের লম্বা মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে ধীরগতিতে সতর্কতার সঙ্গে পথ হাঁটছিল। সে মাঝে মাঝে থেমে পথের দু ধারের প্রতিটি অলিগলি এবং বাড়ির দরজাগুলো খুঁটিয়ে দেখে কার খোঁজ করছিল। সে বুঝতে পারল জেভাৰ্ত তার দু জন পুলিশ নিয়ে তার সন্ধান করার সময় প্রহরারত এক সৈনিকদল দেখতে পেয়ে তার কাজে লাগায়। তারা একযোগে মার্চ করে তার দিকে আসছিল।

তাদের চলার গতি দেখে ভলজাঁ বুঝতে পারল সে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে তাদের এসে পৌঁছতে এখনও পনেরো মিনিট সময় লাগবে। এই নিয়ে তৃতীয়বার সে এক বিরাট শূন্য খাদে পড়তে চলেছে। আবার তাকে সেই দুর্বিষহ কারাজীবনে প্রবেশ করতে হবে। যে বিরাট শূন্য খাদটা তার জীবনকে গ্রাস করার জন্য মুখ ব্যাদান করে তার প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে, সেই খাদ আর তার মাঝখানে মাত্র পনেরো মিনিটের ব্যবধান। সেই খাদের করাল গ্রাসে পড়ে যাওয়া মানেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে নরকের অন্ধকারে প্রবেশ করা। কিন্তু এবার সে কারাজীবন আগের থেকে আরও ভয়ঙ্কর। কারণ এবার কারাজীবনে প্রবেশ করার মানেই চিরদিনের মতো কসেত্তেকে হারানো আর তার মানেই এক জীবন্ত মৃত্যু।

এই মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা মাত্রই উপায় আছে।

জাঁ ভলজাঁ’র জীবনে দুটো প্রবৃত্তি কাজ করে যেত সব সময়। ক্ষেত্রবিশেষে দরকার মতো এই দুটো প্রবৃত্তির একটাকে কার্যে রূপায়িত করার জন্য কাজ করার এক বিশেষ ক্ষমতা ছিল তার। সে যেমন সাধু হবার এক উচ্চাভিলাষের তাড়নায় অনেক বড় কাজ করতে পারত তেমনি একজন পাকা স্বভাবসিদ্ধ অপরাধীর মতো অনেক হীন কাজও করতে পারত।

পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে এর আগে সে তুলঁ জেল থেকে বার বার পালাবার সময় কয়েকটা কৌশল আয়ত্ত করে। এই সব কৌশলের একটা হল বাইরের কোনও কৃত্রিম সাহায্য ছাড়াই শুধু হাতের পেশির শক্তি ও কলাকৌশল অবলম্বন করে এবং পিঠ, কাঁধ আর হাঁটু প্রয়োগ করে যে কোনও উঁচু খাড়া দেয়াল বা প্রাচীরের উপর অবলীলাক্রমে উঠে যাওয়া। কোনও পাইপ ধরে বা শুধু পায়ের বুড়ো আঙুল বা হাতের আঙুলে ভর করে সে ছয়তলা কোনও দেয়াল বা প্রাচীরের উপর উঠে যেতে পারত। এই কৌশল অবলম্বন করেই ব্যাটলমোত নামে এক দণ্ডিত অপরাধী প্যারিসের আদালত-প্রাঙ্গণের এক উঁচু পাঁচিল পার হয়ে পালিয়ে গিয়ে খ্যাতি লাভ করে।

কিন্তু একমাত্র সমস্যা হল কসেত্তেকে নিয়ে। তাকে সে ছাড়তে পারে না। কিন্তু কসেত্তেকে ওই দেয়ালের উপর বয়ে নিয়ে যাওয়াও এক অসম্ভব ব্যাপার। সে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে এই দেয়ালের উপর উঠে যেতে পারে। কিন্তু তার পিঠে বা কাঁধে কোনও বোঝা থাকলে সে কেন্দ্রচ্যুত হয়ে পড়ে যাবে।

তার একটা দড়ি দরকার। কিন্তু র‍্যু পোলোনমো’র এই জনমানবহীন জায়গায় দুপুর রাতে দড়ি কোথায় পাওয়া যাবে? জাঁ ভলজাঁ’র হাতে যদি একটা রাজ্য থাকত তা হলে সামান্য একটা দড়ির জন্য সেই গোটা রাজ্যটা দিয়ে দিতে পারত।

অবস্থার প্রবল চাপে মানুষের বুদ্ধি বাড়ে। তখন যে কোনও বস্তু দিয়ে প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা করে সে। সেকালে প্যারিসের রাস্তায় গ্যাসলাইটগুলো একটা মোটা দড়ি দিয়ে ঝোলানো থাকত। গ্যাসের আলোটা থাকত একটা লোহার বাক্সের মধ্যে। আর মোটা দড়িটা একটা ধাতব হাতলের সঙ্গে বাঁধা থাকত।

ভলজাঁ মরিয়া হয়ে ক্ষিপ্র গতিতে তার ছুরি দিয়ে সেই মোটা দড়িটা কেটে নিয়ে কসেত্তেকে বেঁধে ফেলল। দড়িটা বেশ লম্বা ছিল।

আমরা আগেই বলেছি সে রাতে পূর্ণ চাঁদের আলো থাকায় রাস্তায় কোনও আলো জ্বালানো হয়নি। ছায়ান্ধকারভরা নির্জন নৈশ পরিবেশ, পলাতক ভলজাঁর বিভিন্ন আচরণ বিব্রত করে তোলে কসেত্তেকে। অন্য কোনও শিশু হলে এই অবস্থায় কেঁদে ফেলত সে। কিন্তু কসেতে বিব্রত ও বিপন্নবোধ করলেই শুধু ভলজাঁর কোটের আঁচলটা টানত।

এবার জের্তের সেনাদলের মার্চ করে এগিয়ে আসার শব্দটা আরও জোর হয়ে উঠল।

সে শব্দ শুনে কসেত্তে বলল, আমার ভয় করছে। কে আসছে বাবা?

ভলজাঁ বলল, চুপ। মাদাম থেনার্দিয়ের আসছে।

ভয়ে কাঁপতে লাগল কসেত্তে। ভলজাঁ বিব্রত হয়ে বলতে লাগল, কথা বল না। আমার ওপর সবকিছু ছেড়ে দাও। তুমি কথা বললেই মাদাম থেনার্দিয়ের শুনতে পাবে। সে তোমাকে নিয়ে যেতে আসছে।

এরপর ভলজাঁ আর দেরি করল না। কারণ সে বুঝল জেভাৰ্ত তার দলবল নিয়ে এখনি এসে পড়বে। সে তার দড়ির একটা প্রান্ত কসেত্তে’র বগলের তলা দিয়ে বেঁধে দেয়ালের উপর উঠে গেল। তার জুতো-মোজাটা ওপারে ছুঁড়ে দিল। কসেত্তে নিচে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগল। সে তখন মাদাম থেনার্দিয়েরের কথা ভাবতে লাগল।

ভলজাঁ তাকে চুপি চুপি ডাক দিল, কসেত্তে, দেয়ালে পিঠ দিয়ে চুপ করে দাঁড়াও। কোনও শব্দ করো না। ভয় করো না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কসেত্তেকে টেনে পাঁচিলের উপর তুলে নিল ভলজাঁ। কসেত্তে কিছু বুঝতেই পারল না। কসেত্তে পাঁচিলের মাথায় দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাকে পিঠের উপর চাপিয়ে নিল ভলজাঁ। সে দেখল পাঁচিলের সঙ্গে লাগোয়া একটা ছাদ রয়েছে। ছাদটা নিচু হয়ে ওদিকে নেমে গেছে। সেখান থেকে বাগানের মাটিটা অনেক কাছে। লাইমগাছের ডালগুলো ছাদের উপর এসে পড়েছে।

ভলজাঁ ছাদে গিয়ে সেখান থেকে গাছের ডাল ধরে মাটিতে নেমে পড়ল। এমন সময় জেভার্তের গলা শুনতে পেল। জেভাৰ্ত তার লোকদের হুকুম করছে, এই জায়গাটা খোঁজ কর। আমি জোর গলায় বলতে পারি ও এখানেই লুকিয়ে আছে।

সৈনিক ও পুলিশরা ভলজাঁ আগে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেই ফাঁকা জায়গাটা তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল।

বাগানের মাটিতে নেমে ভয় বা সাহস যে কোনও কারণেই হোক কসেত্তে একটা কথাও বলল না, বা কোনও শব্দ করল না।

.

৬.

ভলজাঁ দেখল এ এক অদ্ভুত বাগান। মনে হল এ বাগানে কোনও মানুষ আসে না। এখানে-সেখানে কিছু পপলার গাছের জটলা। কোণে কোণে কাটাগাছগুলো লম্বা হয়ে উঠছে। বাগানের মাঝখানে একটুখানি ফাঁকা জায়গা আছে। মাঝে মাঝে এক একটা পথ আছে। কিন্তু পথগুলো ঘাসে ঢেকে গেছে। দু-একটা পাথরের বেঞ্চ আছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার না করার জন্য শ্যাওলায় ভরে গেছে।

ভলজাঁ দেখল যে বাড়ির ছাদ থেকে সে বাগানে নেমেছে সে বাড়িতে অনেকগুলো ঘর রয়েছে। কিন্তু কোনও ঘরে মানুষ নেই। ছায়া-ছায়া অন্ধকার বাড়িটার সামনে একটা পাথরের প্রতিমূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু মূর্তিটার মুখটা একেবারে ভেঙে বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। গোটা বাড়িটা একেবারে ভাঙা এবং বসবাসের অযোগ্য। ভাঙা বাড়িটা অনেকখানি লম্বা র‍্যু দ্ৰয়েত মুর থেকে পোতিত র‍্যু পিকপাস পর্যন্ত বিস্তৃত। বাড়িটার সামনেই বাগান। বাড়িটার অবস্থা রাস্তার দিক থেকে ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িটা দোতলা। কিন্তু দুটো তলার সব ঘরের জানালাগুলোই বন্ধ ছিল।

বাগানটার শেষ প্রান্তটা অন্ধকার আর কুয়াশায় ঢাকা থাকায় তা দেখতে পাচ্ছিল না ভলজাঁ। বাগানটার চারদিকেই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার মনে হল বাগানটা যেখানে শেষ হয়েছে তার পাঁচিলঘেরা সীমানার ওপারে আবাদি জমি আছে। দু একটা বাড়ির নিচু ছাদ দেখা যাচ্ছিল।

এর থেকে নির্জন এবং পরিত্যক্ত জায়গা আর হতে পারে না। শীতের রাতে এ জনহীন পরিত্যক্ত বাগানটায় কেউ আসতে পারে না এটা ভলজাঁ বেশ বুঝল। কিন্তু তার মনে হল শুধু রাত্রিবেলায় নয়, দিনের বেলাতেও এদিকে কোনও মানুষ আসে না।

বাড়িটার একদিকে মাল রাখার চালাঘর ছিল। ভলজাঁ প্রথমে ওধার থেকে ফেলে দেওয়া জুতো ও মোজাজোড়াটা খুঁজে বার করে কসেত্তেকে নিয়ে সেই চালাঘরটায় গেল। কোনও পলাতকের মতো কখনই কোনও জায়গাকে একেবারে নিরাপদ বোধ করে না। এত নির্জন এবং পরিত্যক্ত জায়গাটাতে এসেও মাদাম থেনার্দিয়েরের ভয়ে বুকটা কাঁপছিল কসেত্তে’র। সে তখন লুকোঁতে চাইছিল।

রাস্তার দিকে অর্থাৎ বাড়িটার পেছনে পাঁচিলের ওপার থেকে তখন জেভার্তের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তার লোকজন এখনও পাথরের পাঁচিলের গাঁয়ে বেয়নেট ঠুকে ঠুকে কার খোঁজ করে চলেছিল। জেভার্ত তখনও ভলজাঁকে না পেয়ে চিৎকার করছিল। তার সব কথা বোঝা যাচ্ছিল না এধার থেকে।

ক্রমে সময় যত কেটে যেতে লাগল তত অনুসন্ধানকারী দলের কথাবার্তার শব্দ স্তিমিত হয়ে আসছিল। ভয়ে ভলজাঁ তখনও নিশ্বাস পর্যন্ত ফেলেনি। শ্বাসরুদ্ধভাবে সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কসেত্তে’র মুখের উপর একটা হাত দিয়ে রেখেছিল। রাস্তার দিকে পাঁচিলটার ওধারে যখন সৈনিকদের ভারী পায়ের শব্দ আর চেঁচামেচির জোর শব্দ হচ্ছিল তখন এপারে নির্জন বাগানটা অদ্ভুতভাবে শান্ত ও নিস্তব্ধ হয়ে ছিল।

হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে সেই সুগভীর নৈশ নির্জন প্রশান্তির মাঝে এক সুন্দর স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর ককিয়ে উঠল। নিশীথ রাতের নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে সেই কণ্ঠস্বর রহস্যময় মনে হচ্ছিল ভলজাঁর। তার মনে হল সেই নির্জন পরিত্যক্ত অন্ধকার বাড়িটার মধ্যে কারা যেন সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনা করছে। কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা গেল একজন কুমারী মেয়ে আর শিশু প্রার্থনার গান করছে। মনে হচ্ছিল এ স্বর যাদের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হচ্ছে তারা এই মর্তের মানুষ নয়। কোনও মৃতপ্রায় ব্যক্তির কর্ণকুহরে কোনও নবজাত শিশুর কণ্ঠস্বর প্রবেশ করলে তার যেমন মনে হয় সেই সমবেত প্রার্থনার কণ্ঠস্বর শুনে ভলজাঁর তাই মনে হচ্ছিল।

প্রার্থনার গানের শব্দটা আসছিল বাগানের ধারের ঘরগুলোর একটা থেকে। ভলজাঁ’র মনে হচ্ছিল দানবের গর্জন দূরে মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যেন দেবদূতদের সমবেত কণ্ঠস্বর এক স্বর্গীয় সুষমায় নৈশ নিস্তব্ধ বাতাসে ভেসে উঠতে শুরু করেছে।

কসেত্তে আর জাঁ ভলজাঁ দু জনেই হঠাৎ নতজানু হল। তারা কোথায় আছে এবং প্রার্থনা কারা করছে তার কিছু না জানতে পারলেও তারা সহজাত প্রবৃত্তির তাড়নায় একটা জিনিস বুঝতে পারল যে তাদের নতজানু হওয়া উচিত। তার মনে হল এই সমবেত প্রার্থনার গান নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িটার প্রশান্তিকে ক্ষন্ন করেনি কিছুমাত্র। বরং তার মনে হল এ গান কোনও মানুষ গাইছে না, এক অতিপ্রাকৃত কণ্ঠনিঃসৃত এই গান যেন শূন্য নির্জন বাড়িটার মধ্যে ঐন্দ্রজালিকভাবে গীত হচ্ছে।

যতক্ষণ পর্যন্ত এই প্রার্থনার গান চলতে লাগল ততক্ষণ ভলজাঁ’র মনটা একেবারে শূন্য হয়ে রইল। কোনও কিছুই ভাবতে পারল না সে। কোনও দিকে তাকিয়ে কোনও কিছু দেখতে পারল না। সে কেবল তার চোখের সামনে অনন্ত প্রসারিত এক নীল আকাশ দেখতে লাগল আর তার সমগ্র অন্তরাত্মা পাখা মেলে সেই গোটা আকাশটাকে এক নীরব নিবিড় স্বাচ্ছন্দ্যে পরিক্রমা করে বেড়াতে লাগল। যখন সে প্রার্থনার গান শেষ হয়ে গেল, তখন ভলজাঁ বুঝতে পারল না এ গান কতক্ষণ চলেছে। গান যতক্ষণ চলেছে ততক্ষণ সময় সম্বন্ধে তার কোনও খেয়াল ছিল না, পার্থিব কোনও বিষয়েই তার কোনও চেতনা ছিল না।

এবার সব চুপচাপ। ওদিকের রাস্তায় অথবা এদিকে বাগানবাড়িতে কোথাও বিন্দুমাত্র শব্দ নেই। কোনও ভয় বা আশ্বাসের আভাস নেই কোথাও। শুধু নিশীথ রাতের অলস বাতাসের আঘাতে কম্পিত ও মৃদু শিহরিত ঘাসগুলো থেকে এক বিষণ্ণ শব্দের ঢেউ বয়ে আসছিল।

.

৭.

একটা দমকা বাতাস থেকে ভলজাঁ বুঝতে পারল রাত্রি তখন একটা থেকে দুটোর মধ্যে হবে। কসেত্তে চুপ করে ছিল। সে ভলজাঁর কাঁধের উপর মাথা রেখে বসেছিল বলে ভলজাঁ ভেবেছিল সে ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু তার মুখপানে তাকিয়ে দেখল তার চোখ দুটো খোলা রয়েছে। সে ভয়ে চোখ দুটো বিস্ফারিত রেখে তাকিয়ে আছে। তার অবস্থা দেখে ভলজাঁর দুঃখ হল।

ভলজাঁ বলল, তুমি ঘুমোওনি?

কসেত্তে বলল, আমার শীত লাগছে।

কিছুক্ষণ পর সে আবার বলল, এখনও সে আছে?

কে?

মাদাম থেনার্দিয়ের।

ভলজাঁ কসেত্তেকে চুপ করে থাকার জন্য মাদাম থেনার্দিয়েরের নাম করেছিল, সে কথাটা ভুলে গিয়েছিল, সে বলল, সে চলে গেছে। আর তোমার ভয়ের কিছু নেই।

কসেত্তে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল, যেন একটা বড় বোঝা তার বুক থেকে নেমে গেছে।

যে চালাঘরটার মেঝের উপর তারা বসেছিল সেটা স্যাঁতসেঁতে ছিল। চালাঘরটার চারদিকে কোনও দেয়াল ছিল না। ভলজাঁ তার কোটটা খুলে কসেত্তে’র গাঁয়ে জড়িয়ে দিল। বলল, এটা ভালো হল তো?

কসেত্তে বলল, হ্যাঁ বাবা।

শুয়ে পড়। আমি এখনি ফিরে আসছি।

চালাঘরটা ছেড়ে ভলজাঁ বাগানবাড়ির বাইরের দিকটা খুঁজে দেখতে লাগল এর থেকে কোনও ভালো আশ্রয়ের আশায়। সে বাড়িটার নিচের তলায় প্রতিটা ঘরের সামনে গিয়ে দেখল সব ঘরের দরজাই বন্ধ। নিচের তলার সব ঘরের জানালাগুলো বন্ধ। ঘুরতে ঘুরতে সে দেখল আর একটা দিকের কতকগুলি ঘরের সারিবদ্ধ জানালাগুলোর একটা হতে একটা ক্ষীণ আলোর রশ্মি বেরিয়ে আসছে। সে তখন পা টিপে টিপে এগিয়ে গিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে তাকাল। সেই আধখোলা জানালাটা দিয়ে সে দেখল ঘরটা বড়, তার মেঝেটা পাথরের। প্রশস্ত ঘরখানার মধ্যে অনেকগুলো স্তম্ভ রয়েছে। ঘরের এককোণে একটা আলো জ্বলছে। আলোটা ক্ষীণ বলে ঘরের মধ্যে জমে থাকা ছায়াগুলোকে অপসারিত করতে পারছিল না। ঘরটা একেবারে নির্জন; কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে দেখল ঘরের মেঝের উপর একজন মানুষ শুয়ে রয়েছে; তার গোটা গা-মুখে একটা কাপড় ঢাকা। মনে হল লোকটা উপুড় হয়ে হাত দুটো ছড়িয়ে মড়ার মতো শুয়ে আছে। মনে হল তার ঘাড়ে একটা দড়ি জড়ানো আছে। মৃদু আলোকিত ঘরখানার ছায়া-ছায়া অন্ধকার দৃশ্যটাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল।

জাঁ ভলজাঁ পরে বলেছিল, জীবনে অনেক ভয়ের বস্তু সে দেখলেও গায়ের রক্ত হিম করে দেওয়া এমন রহস্যময় ও ভয়াবহ বস্তু সে কখনও দেখেনি। লোকটা মৃত বলে একটা ভয়ের ব্যাপার ঠিক, কিন্তু জীবিত থাকলে সেটা আরও ভয়ের ব্যাপার।

সাহস করে ভলজাঁ জানালার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জানালার গরাদের উপর মুখ রেখে দেখতে লাগল শায়িত লোকটার মধ্যে জীবনের কোনও লক্ষণ আছে কি না। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেও সেই শায়িত মূর্তির মধ্যে কোনও জীবনের লক্ষণ দেখতে পেল না। একবারও নড়াচড়া করল না মূর্তিটা। এক অনির্বচনীয় ভয়ের আবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল ভুলজা’র মনটা এবং সে পেছন ফিরে ছুটতে শুরু করে দিল। যেখানে সে কসেত্তেকে রেখে এসেছিল সেই চালাঘরটার দিকে ছুটতে ছুটতে মাঝে মাঝে পেছন ফিরে দেখতে লাগল জীবিত বা মৃত সেই রহস্যময়ভাবে শায়িত লোকটা হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে আসছে কি না। সে যখন এইভাবে ছুটতে ছুটতে চালাটায় পৌঁছল তখন সে হাঁপাচ্ছিল। তার গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল। তার হাঁটু দুটো অবশ হয়ে আসছিল।

এখন সে কোথায়? কে কল্পনা করতে পারে প্যারিস শহরের মধ্যে এই ধরনের এক সমাধিভূমি থাকতে পারে! এক নৈশ রহস্যে মণ্ডিত এ কোন স্থান যেখানে দেবদূতদের আলোকিত কণ্ঠস্বর শুনে কেউ এগিয়ে গেলে এমন এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে যে দৃশ্যের। মধ্যে স্বর্গীয় দ্যুতির মহিমার সঙ্গে সঙ্গে পাশাপাশি প্রকটিত হয়ে উঠেছে সমাধিগহ্বরের এক মৃত্যুনিবিড় নরকান্ধকার। অথচ এটা কোনও স্বপ্ন নয়। রাস্তার ধারে একটা আস্ত বাড়ি। সে হাত দিয়ে বাড়িটার পাথরগুলো স্পর্শ করে দেখতে লাগল। নিশীথ রাতের এই শৈত্যনিবিড় স্তব্ধতা, আশ্রয়হীন অসহায়তা, মনের নিরন্তর উদ্বেগ অসুস্থ করে তুলেছিল তার দেহটাকে। সে জ্বর-জ্বর অনুভব করছিল। সে কসেত্তে’র উপর ঝুঁকে পড়ে দেখল কসেত্তে ঘুমিয়ে পড়েছে।

.

৮.

একটা পাথরের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে কসেত্তে। ভলজাঁ তার পানে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে শান্ত হয়ে ভাবতে লাগল।

সে এখন স্পষ্ট বুঝতে পারল কসেত্তেই তার জীবনের একমাত্র কেন্দ্রীয় সত্য, যাকে ঘিরে সে আবর্তিত করে চলেছে নিজেকে। সে যতক্ষণ তার কাছে থাকবে ততক্ষণ একমাত্র কসেত্তে’র প্রয়োজন ছাড়া তার নিজের কোনও প্রয়োজন নেই। এখন যদি সে কোনও কিছুকে ভয় করে তা হলে কসেত্তে’র জন্যই করবে। এমনকি এই দারুণ শীতে তার গায়ের কোটটা কসেত্তেকে খুলে দিলেও সে কোনও শীত অনুভব করছিল না।

সে বসে বসে ভাবতে লাগল। ক্রমে আবার একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল কানে। সে স্পষ্ট শুনতে পেল বাগানের ভেতর থেকে নৈশ মাঠে চরে বেড়ানো ভেড়ার গলায় বাঁধা ঘণ্টার ধ্বনির মতো এক ঘণ্টাধ্বনি শান্ত হিমেল বাতাসে ভেসে আসছিল। সেই ধ্বনি শুনে মুখ ফিরিয়ে লক্ষ করে দেখল ভলজাঁ বাগানের ভেতর একটা ছায়ামূর্তি কী করছে। সে আরও ভালো করে দেখল মানুষের মতো একটা মূর্তি বাগানের মাঝখানে তরমুজের ক্ষেতের উপর ঝুঁকে বীজ ছড়াচ্ছে।

জাঁ ভলজাঁ পিছিয়ে এল। ক্রমাগত তাড়া খেয়ে খেয়ে ধরা পড়ার ভয়ে এমনই বিব্রত হয়ে পড়েছিল যে সব মানুষকেই সে তার শত্রু আর সন্দেহজনক ভাবছিল। সব তাড়া খাওয়া পলাতক ব্যক্তিরাই তাই করে। তারা দিনের আলোকে ভয়ের চোখে দেখে, কারণ সবাই তাদের দেখে ফেলবে। হঠাৎ ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় রাতের অন্ধকারকেও তারা ভয় করে। বাগানবাড়ির নির্জনতায় সে ভয়ে শিউরে উঠেছিল ঠিক, কিন্তু সেই নৈশ নির্জন বাগানের মধ্যে একটা লোক দেখে সে ভয়ে কাঁপতে লাগল।

এবার সে কাল্পনিক ভয় থেকে বাস্তব ভয়ের সম্মুখীন হল। সে ভাবল, জেভার্ত তার সহকারীদের নিয়ে এই এলাকাতেই আছে এখনও। ওপারের বড় রাস্তায় সে হয়তো একদল লোককে পাহারায় রেখে গেছে। বাগানের ওই লোকটা তাকে দেখে চিৎকার করে উঠলে সেই প্রহরী ছুটে আসবে। সে তাই ঘুমন্ত কসেত্তেকে কাঁধের উপর তুলে নিয়ে চালাঘরটার এক প্রান্তে যেখানে একরাশ পুরনো ভাঙা আসবাব জড়ো করা ছিল তার আড়ালে গিয়ে লুকোল। সে তবু সেখানে থেকে তরমুজক্ষেতের সেই লোকটার দিকে নজর রাখল।

সে দেখল লোকটা যতবার নড়াচড়া করছে ততবারই ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে। সে যখন থেমে থাকছে ঘণ্টাটাও স্তব্ধ হয়ে থাকছে। মনে হয় তার দেহের কোনও না কোনও অঙ্গের সঙ্গে একটা ঘন্টা বাধা আছে। কিন্তু এর মানে কী? যে ঘণ্টা কোনও গরু বা পশুর গলায় বাঁধা থাকে, তা মানুষের দেহে কেন?

ভলজাঁ যখন এই সব কথা ভাবছিল তখন হঠাৎ কসেত্তে’র একটা হাত তার গায়ে লাগল। সে দেখল হাতটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।

সে নিচু গলায় বলে উঠল, হা ভগবান!

সে নিচু গলায় এবার কসেত্তেকে ডাকতে লাগল, কসেত্তে, কসেত্তে!

কিন্তু চোখ খুলল না কসেত্তে। সে জাগল না।

ভলজাঁ এবার কসেত্তে’র ঘুমন্ত দেহটাকে জোরে নাড়া দিতে লাগল। তবু সে জাগল না।

তবে কি সে মারা গেছে?

সহসা এই কথা ভেবে সে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তার আপাদমস্তক কাঁপতে লাগল।

কত সব অশুভ চিন্তার ঢেউ বয়ে যেতে লাগল তার মনের মধ্যে। অনেক সময় কতকগুলি ভয় একসঙ্গে এক প্রচণ্ড সেনাদলের মতো আমাদের মস্তিষ্ককে আঘাত করতে থাকে ক্রমাগত। যে ভয়ের সঙ্গে আমাদের কোনও প্রিয়জন জড়িয়ে থাকে সে ভয়ের তখন সীমা-পরিসীমা থাকে না। সে ভেবে দেখল শীতের রাত্রিতে ভোলা বাতাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়াটা অনেক সময় মারাত্মক হয়ে ওঠে।

তার পায়ের কাছে কসেত্তে’র অচেতন দেহটা স্তব্ধ হয়ে পড়ে ছিল। সে তার উপর ঝুঁকে তার বুকের স্পন্দন অনুভব করার চেষ্টা করল। কিন্তু তার সে হৃৎস্পন্দন এতটা ক্ষীণ যে, মনে হল যে কোনও মুহূর্তে সে স্পন্দন থেমে যেতে পারে একেবারে।

কী করে সে কসেত্তের এই হিমশীতল দেহটাকে গরম করে তুলঁবে? কী করে তার হারানো চেতনাকে ফিরিয়ে আনবে? এ ছাড়া আর কোনও চিন্তা ছিল না তার মনে।

সে তখন মরিয়া হয়ে চালা থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগল। যা-ই ঘটুক মিনিট পনেরোর মধ্যে কসেত্তেকে কোনও এক গরম জায়গায় একটা বিছানার মধ্যে শোয়াতে হবে।

.

৯.

ভলজাঁ সোজা তরমুজক্ষেতে কাজ করতে থাকা লোকটার কাছে চলে গেল। কোটের পকেট থেকে কতকগুলি মুদ্রা বার করে হাতে ধরল সে। লোকটা নত হয়ে কী করছিল বলে ভলজাঁকে দেখতে পায়নি সে।

ভলজাঁ তার কাছে গিয়ে কোনও ভূমিকা না করে সরাসরি বলল, একশো!

লোকটা চমকে উঠে তার পানে তাকাল মুখ তুলে।

ভলজাঁ আবার বলল, যদি তুমি রাত্রির মতো আমাকে একটু আশ্রয় দিতে পার তা হলে তোমাকে একশো ফ্রাঁ দেব।

চাঁদের আলো তার সমস্ত মুখখানার উপর ছড়িয়ে পড়েছিল।

লোকটা আশ্চর্য হয়ে বলল, পিয়ের ম্যাদলেন আপনি!

সেই গভীর রাত্রিতে সেই নির্জন বাগানবাড়িতে একজন অপরিচিত লোকের কণ্ঠে তার নাম উচ্চারিত হতে শুনে চমকে উঠল ভলজাঁ চরম বিস্ময়ে। এটা সে কোনওমতেই আশা করতে পারেনি। যে তার নাম ধরে ডেকেছিল সে লোকটি একটু কুঁজো আর খোঁড়া ছিল। সে মাঠে কাজ করা চাষিদের পোশাক পরে ছিল। চামড়ার নরম আবরণী দিয়ে তার বাঁ পায়ের হাঁটুটা ঢাকা ছিল। তাতে একটা ঘন্টা বাধা ছিল। তার মুখের উপর একটা গাছের ছায়া পড়ায় মুখটা ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না।

লোকটা তার মাথা থেকে টুপি খুলে বলে যেতে লাগল, ঈশ্বরের নামে বলছি, আপনি এখানে কী করে এলেন? কী করে আপনি এ বাগানে ঢুকলেন? মনে হল আপনি যেন আকাশ থেকে এখানে পড়েছেন। কিন্তু আপনি কী পোশাক পরে আছেন? আপনার মাথার টুপি নেই, গলায় নেকটাই নেই, ওভারকোট নেই। আমি আপনাকে অতি কষ্টে চিনতে পেরেছি। কিন্তু এসবের মানে কী? আপনি কী করে এলেন এখানে? আজকাল কি

ভালো লোকরা সব পাগল হয়ে গেছে।

কিন্তু তার এইসব কথার মধ্যে ভয়ের কিছু ছিল না। এক নিরীহ নির্দোষ গ্রাম্য চাষির মতো কথাগুলো সে সরলভাবে বলে ফেলল।

জাঁ ভলজাঁ বলল, তুমি কে? এটা কোন জায়গা?

লোকটা বলল, এই হল ধনীদের ব্যাপার। আপনিই তো আমাকে এই জায়গায় কাজে লাগান। আর আপনি বলছেন আপনি আমাকে চেনেন না।

না, আমি তোমায় চিনতে পারছি না, তুমি আমাকে কিভাবে চিনতে পারলে তা-ও বুঝতে পারছি না।

লোকটা বলল, আপনিই তো আমাকে বাঁচিয়ে ছিলেন।

এবার লোকটার মুখের উপর চাঁদের আলো পড়ায় ভলজাঁ তাকে চিনতে পারল।

লোকটা হল ফশেলেভেন্ত, যে একদিন গাড়ির তলায় চাপা পড়ে।

ভলজাঁ বলল, হ্যাঁ, এবার আমি তোমায় চিনতে পেরেছি।

তাই আমি ভেবেছিলাম।

কিন্তু এত রাত্রিতে এখানে তুমি কী করছ?

আমি তরমুজের উপর চাপা বা ঢাকনা দিচ্ছি।

তার হাতে তখনও খড়ের তৈরি মাদুরের মতো একটা জিনিস ছিল এবং সেটা একটু আগে তরমুজের উপর চাপিয়ে দিচ্ছিল সে। ভলজাঁ যখন তাকে প্রথম দেখে তখন সে এই কাজই করছিল।

ফশেলেভেন্ত হাসতে হাসতে বলল, আমি ভাবলাম জ্যোৎস্না রাত, একটু পরেই বরফ পড়বে। তাই তরমুজগুলোর গাঁয়ে জামা পরিয়ে দিই। আমার জায়গায় আপনি থাকলে আপনিও তাই করতেন।

লোকটা তাকে ম্যাদলেন নামে চিনে ফেলেছে। ভলজাঁ তাই সাবধানে কথা বলতে লাগল। সে তাকে প্রশ্ন করল, তোমার হাঁটুতে ঘন্টা বাধা কেন?

ফশেলেভেন্ত বলল, ও, এই ঘন্টাটা? এটা লোকদের সাবধান করে দেবার জন্য।

কিন্তু লোকদের কেন সাবধান করে দিতে হবে?

বৃদ্ধ ফশেলেভেন্তের মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে বলল, জানেন না? এখানে শুধু মেয়েরা ছাড়া কোনও পুরুষ থাকে না। এখানে আমিই একমাত্র পুরুষ। তাই ঘণ্টার শব্দ শুনে আমার উপস্থিতির কথা জানতে পারবে তারা। তা হলে আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে তারা।

কিন্তু এটা কোন জায়গা?

আপনার তো তা জানা উচিত।

আমি বলছি, আমি জানি না।

কিন্তু আপনিই তো এই বাগানের মালীর কাজ দিয়ে আমাকে পাঠিয়েছিলেন এখানে।

এখনও আমি বুঝতে পারছি না ব্যাপারটা। তুমি আমাকে সব খুলে বল।

কেন, এইটাই তো পেতিত পিকপাসের কনভেন্ট।

এবার মনে পড়ল ভলজাঁর। দৈবযোগে ঈশ্বরের বিধানেই সে সেন্ট আঁতোনে’র সেই কনভেন্টে এসে পড়ে যেখানে সে ফশেলেভেন্ত গাড়িচাপা পড়ে খোঁড়া হয়ে যাবার পর তাকে বাগানের মালীর কাজ দিয়ে পাঠায়। সে আজ থেকে দু বছর আগের কথা। ভলজাঁ আপন মনে কথাটার পুনরাবৃত্তি করতে লাগল, পেতিত পিকপাসের কনভেন্ট।

ফশেলেভেন্ত এবার বলল, সব তো শুনলেন। এবার বলুন তো মঁসিয়ে ম্যাদলেন, কিভাবে আপনি এলেন এখানে। আপনি একজন সাধু ব্যক্তি হলেও তো পুরুষ মানুষ।

এখানে কোনও পুরুষকে ঢুকতে দেওয়া হয় না কখনও।

কিন্তু তুমি তো রয়েছ।

আমিই এখানে একমাত্র পুরুষ আছি।

ভলজাঁ বলল, যাই হোক, এখানে আমাকে আসতে হল।

ফশেলেভেন্ত বলল, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন।

ভলজাঁ তার খুব কাছে গিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, পিয়ের ফশেলেভেন্ত, আমি একদিন তোমার জীবন রক্ষা করেছিলাম।

সে কথা তো আমি আপনাকে একটু আগেই মনে করিয়ে দিয়েছি।

ঠিক আছে, এখন তুমিও আমার জন্য কিছু করতে পার।

হঠাৎ ফশেলেভেন্ত ভলজাঁ’র হাত দুটো ধরে টেনে নিয়ে আবেগে এমনভাবে বিচলিত হয়ে উঠল সে যে কোনও কথা বলতে পারল না। তার পর সে আবেগের সঙ্গে বলে ওঠে, যদি আমি এখন আপনার জন্য কিছু করে আপনার ঋণ কিছুটা শোধ করতে পারি তা হলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেব আমি। এখন দরকার হলে আপনার জীবন আমি রক্ষা করব। আমি আপনার দাস। আপনি যা বলবেন তাই করব আমি।

তার মুখটা যেন সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মুখ থেকে যেন একটা জ্যোতি বার হচ্ছিল। সে বলল, এখন আমাকে কী করতে বলছেন?

আমি বলছি কি, তোমার থাকার ঘর আছে এখানে?

এই কনভেন্টের যে দিকটা ভেঙে গেছে সেই ভগ্ন্যুপের কাছে আমার একটা বাসা আছে। তাতে তিনখানা ঘর আছে। সেদিকে কেউ যায় না।

সত্যিই, সে বাসাটা এমন জায়গায় আছে যে ভলজাঁ আগে দেখতে পায়নি তা।

ভলজাঁ বলল, আমার দুটো কথা তোমায় রাখতে হবে। প্রথমত, তুমি আমার সম্বন্ধে যা জান কাউকে তা বলবে না। আর দ্বিতীয়ত, আমার সম্বন্ধে এর থেকে বেশি কিছু জানতে চাইবে না।

ফশেলেভেন্ত বলল, ঠিক আছে, আপনি যা বলছেন তাই হবে। আপনার মতো ঈশ্বরবিশ্বাসী ও ভক্তিমান মানুষ কখনও কোনও অন্যায় বা অপমানজনক কোনও কাজ করতে পারেন না। আপনিই আমাকে এ কাজে নিযুক্ত করেন। আপনার আদেশ মেনে চলাই আমার কর্তব্য। আপনি কী করেন না-করেন তা দেখা আমার কাজ নয়।

ধন্যবাদ, এখন আমার সঙ্গে এস। একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে আসতে হবে।

আর কোনও কথা না বলে অনুগত কুকুরের মতো ভলজাঁকে অনুসরণ করতে লাগল ফশেলেভেন্ত।

ফশেলেভেস্ত বলল, একটা শিশু আছে নাকি?

আধ ঘণ্টার মধ্যেই কসেত্তেকে মালীর বাসায় নিয়ে গিয়ে আগুন জ্বালা এক গরম ঘরের মধ্যে একটি বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। ভলজাঁ তার কোট আর টুপিটা পরল। ফশেলেভেন্ত তার হাঁটুর উপর থেকে সেই চামড়ার আবরণী আর ঘণ্টাটা খুলে রাখল।

এরপর তারা দু জনে এক টেবিলে পাশাপাশি বসল। টেবিলের উপর মাখন, রুটি, এক বোতল মদ আর দুটো গ্লাস রাখল ফশেলেভেন্ত। তার পর ভলজাঁ’র একটা হাঁটুতে হাত রেখে সে বলল, পিয়ের ম্যাদলেন, আমাকে তা হলে আপনি চিনতেই পারলেন না। আপনি যাদের জীবন বাঁচান পরে তাদের ভুলে যান। কিন্তু তারা আপনাকে ভোলে না। আপনি কিন্তু এদিক দিয়ে অকৃতজ্ঞ পিয়ের ম্যাদলেন।

.

১০.

যেসব ঘটনা আমরা ঘটতে দেখলাম সেসব ঘটনা নিতান্ত স্বাভাবিকভাবেই ঘটে যায়।

জাঁ ভলজাঁ যেদিন দ্বিতীয়বার জের্তের হাতে গ্রেপ্তার হয় এবং যেদিন সন্ধ্যাবেলায় মঁতফারমেলের জেল হাজত থেকে পালিয়ে যায় সেদিন সেখানকার পুলিশমহল ভেবেছিল সে প্যারিসে পালিয়ে যাবে। প্যারিস শহর এমনই এক বিরাট ঘূর্ণাবর্ত যেখানে যে কোনও ব্যক্তিই বিশাল জনারণ্যে সহজেই হারিয়ে যেতে পারে, যেখানে বিশাল সমুদ্রে ভাসমান ভগ্ন জাহাজের মতো যে কোনও মানুষ সহজেই ডুবে যেতে পারে। সব পলাতক আসামি একথা ভালোভাবেই জানে যে প্যারিসের জনবহুল পথে-ঘাটে যেভাবে কোনও লোক গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারে তেমনটি কোনও গভীর অরণ্যে থাকা যায় না। পুলিশমহলও একথা ভালোভাবেই জানে বলে যে কোনও পলাতক আসামির জন্য প্যারিস শহরকে তারা তন্ন তন্ন করে খোঁজে। ভলজাঁকে ধরার জন্য প্যারিসে পুলিশের পক্ষ থেকে অনুসন্ধানকার্য চালানো হয়, তাতে সাহায্য করার জন্য জেভার্তকে ডেকে পাঠানো হয় এবং জেভাৰ্তও তাতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে জেভার্তের উদ্যম এবং তৎপরতা পুলিশ বিভাগের সেক্রেটারি মঁসিয়ে শ্যাপুলেতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। জেভার্তের কাজকর্ম দেখে তার প্রতি আগে হতেই আগ্রহান্বিত হন শ্যাপুলেত এবং তাই তিনি জেভার্তকে মন্ত্রিউল-সুর-মের থেকে বদলি করে প্যারিসে নিয়ে আসেন। তার ওপর যে কাজের ভার দেওয়া হয় সেই কার্য সম্পাদনের জেতার্তও বিশেষ সম্মানজনক দক্ষতার পরিচয় দান করে।

১৮২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কোনও একদিন একটা খবরের কাগজে জাঁ ভলজাঁ’র নাম না দেখা পর্যন্ত তার কথা একবারও মনে করেনি জেভাৰ্ত। নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ত না জেভাৰ্ত। কিন্তু একজন গোঁড়া রাজতন্ত্রী হিসেবে সে বেয়নে যুবরাজের আগমন সম্বন্ধে তার কৌতূহল ছিল বলে সে একদিন খবরের কাগজটা পড়তে থাকে। যুবরাজের আসার ব্যাপারটার পর গোটা কাগজটার ওপর চোখ বুলাতে বুলোতে হঠাৎ কাগজের একটা পাতার তলার দিকে একটা খবর তার চোখে পড়ে। তাতে কয়েদি জাঁ ভলজাঁ’র মৃত্যুর সংবাদ ছিল। ঘটনার বিবরণটা এমন নিখুঁত ছিল যে তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। ফলে সে ভাবল এতে ভালোই হল। ক্রমে সে ভলজাঁর ব্যাপারটাকে মন থেকে মুছে ফেলে একেবারে।

প্যারিসে বদলি হয়ে আসার পর জেতার্ত পুলিশ বিভাগের আসা একটা অভিযোগের বিবরণ থেকে জানতে পারে মঁতফারমেলের একটা হোটেল থেকে একটি শিশুকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এই অপহরণকার্য রহস্যময়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়। শিশুটি একটি মেয়েছেলে এবং তার বয়স সাত অথবা আট। তার মা এক হোটেল মালিকের ওপর তার সব ভার দিয়ে যায়। মেয়েটির নাম কসেত্তে এবং তার মা’র নাম ফাঁতিনে যে কোনও এক হাসপাতালে মারা যায়। পুলিশের কাছে এ বিষয়ে যে অভিযোগ পাওয়া যায় তাতে ঘটনার পূর্ণ বিবরণ পাওয়া না গেলেও সে অভিযোগ জেতার্তকে ভাবিয়ে তোলে।

ফাঁতিনেকে ভোলেনি জেভাৰ্ত। আর সে একথাও ভোলেনি যে ভলজাঁকে গ্রেপ্তার করার সময় সে তিন দিনের সময় চেয়েছিল, যাতে সে মঁতফারমেলে গিয়ে ফাঁতিনের মেয়েকে নিয়ে আসতে পারে। এ কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়েছিল জেতার্ত। তার একথাও মনে পড়ে গেল যে মঁতফারমেলের গাড়িতে চাপার সময়েই ভলজাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাছাড়া এর আগের দিনও সে মঁতফারমেল অঞ্চলে একবার গিয়েছিল যদিও সে গাঁয়ের মধ্যে তাকে দেখা যায়নি। মঁতফারমেল কেন গিয়েছিল ভলজাঁ একথা অন্য কেউ না জানলেও জেভার্তের সে কারণ বুঝতে বাকি নেই। সে সেখানে গিয়েছিল ফাঁতিনের সন্তানের জন্য এবং সেই সন্তানকে একজন বিদেশি অপরিচিত ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে যায়। তবে ভলজাঁই সেই ব্যক্তি। কিন্তু ভলজাঁ মারা গেছে বলে খবর বেরিয়েছে। যাই হোক, এ বিষয়ে কাউকে কোনও কথা না বলে একদিন মঁতফারমেল যাবার গাড়ি ধরে জেভার্ত।

ঘটনাটা জানার জন্য সেখানে যায় জেভাৰ্ত। সেখানে গিয়ে দেখে ঘটনাটা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। তাতে আরও জট পাকিয়ে গেছে।

কসেত্তেকে নিয়ে যাবার পর প্রথম প্রথম হতাশ হয়ে পড়ে থেনার্দিয়েরেরা এবং সেই হতাশার আঘাতে কথাটা বলে বেড়াতে থাকে সারা গায়ে। কসেত্তে’র অপহরণ নিয়ে গাঁয়ের নানা লোকে নানা কথা বলতে থাকে। এ বিষয়ে বিভিন্ন কাহিনী প্রচারিত হতে থাকে। পুলিশ রিপোর্টের মধ্যে তাই অসংলগ্নতা দেখা দেয়। দুঃখ আর হতাশার প্রথম আঘাতের ব্যথাটা কাটলে পর থেনার্দিয়ের তার সাবধানি বুদ্ধির সাহায্যে একটা কথা বুঝতে পারে। এ বিষয়ে অভিযোগ করে সরকারি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা উচিত হবে না। সে যদি বিধিমতো এই অপহরণ সম্বন্ধে অভিযোগ করে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে তা হলে তার ও তার নানারকমের সন্দেহজনক কাজ-কারবারের ওপর আইনের ঈগল দৃষ্টি পড়বে। পেঁচা কখনও কোনও বাতির আলোয় নিজেকে দেখা দিতে চায় না। সে যে পনেরোশো ফ্রাঁ নিয়েছে সে কথা কী করে চাপা দেবে সে? সে তাড়াতাড়ি সুর পাল্টে ফেলে এই সব ভেবে। তার স্ত্রীর কণ্ঠরোধ করে দেয় এবং গাঁয়ের কোনও লোক চুরির কথাটা তুলঁলেই চরম বিস্ময় প্রকাশ করতে থাকে যেন মেয়েটা আসলে অপহৃত হয়নি। আসল কথা অকস্মাৎ কসেত্তেকে তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে সে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কসেত্তে’র প্রতি স্নেহবশত সে চেয়েছিল কসেত্তেকে কিছুদিন পরে তার কাছ থেকে নিয়ে যাবে। সে ভাবতে পারেনি এত তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে যাবে কেউ। জেভার্ত যখন মঁতফারমেলে তদন্ত করতে এসেছিল তখন থেনার্দিয়ের বলেছিল, যে ভদ্রলোক কসেত্তেকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছিল সে তার পিতামহ। থোর্দিয়ের এইভাবে জাঁ ভলজাঁকে কসেত্তে’র পিতামহ হিসেবে চালিয়ে খুশি হয়।

তবু জেভাৰ্ত এ কাহিনীর সত্যতা নির্ণয়ের জন্য কয়েকটা প্রশ্ন করে। কসেত্তে’র এই পিতামহ লোকটা কে? তার নামই বা কী? থেনার্দিয়ের সরলভাবে উত্তর করে, সে একজন ধনী জমিদার। সে বলে, আমার মনে হয় লোকটার নাম মঁসিয়ে গিলম ল্যাম্বার্ত।

ল্যাম্বাৰ্ত নামটা সম্মানজনক। জেভার্ত প্যারিসে চলে যায়। সে আপন মনে বলে, ভলজাঁ মারা গেছে। আমি একটা গাধা।

জেভার্ত ব্যাপারটা ভুলে যেতে বসেছিল। তার পর ১৮২৪ সালের মার্চ মাসে একটা ঘটনার কথা জানতে পারে। প্যারিসের মফস্বল অঞ্চলে সেন্ট মেদার্দে একজন বাস করে। সে নিজে ভিখারি হয়েও ভিক্ষা দেয়। লোকটা তার ব্যক্তিগত আয়ের উপর স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করে এবং একটা ছোট মেয়ে তার কাছে থাকে। মেয়েটা শুধু জানে সে মঁতফারমেল থেকে এসেছে। এছাড়া তার বর্তমান অবস্থার কথা সে কিছুই জানে না। জেভার্ত তখন কান খাড়া করে তৎপর হয়ে ওঠে।

একজন প্রবীণ ভিখারি যে আগে অপরাধীদের সম্বন্ধে পুলিশকে খবরাখবর দিত সে জেভাৰ্তকে সেন্ট মেদর্দের বসবাসকারী লোকটা সম্বন্ধে আরও কিছু খবর দেয়। সে জেভার্তকে বলে, লোকটা অদ্ভুত ধরনের। সে একমাত্র গরিবদের সঙ্গে ছাড়া কারও সঙ্গে কোনও কথা বলে না। সে সব সময় একটি হলুদ রঙের কোট পরে যার দাম লক্ষ লক্ষ টাকা কারণ তাতে অনেক ব্যাংকনোট সেলাই করা আছে।… এ সব কথা শুনে জেভার্তের কৌতূহল বেড়ে যায়। সেই লোকটাকে একবার নিজের চোখে দেখার জন্য সে সেই ভিখারির বহিরঙ্গের পোশাকগুলো ধার নিয়ে তাই পরে রোজ সন্ধেবেলায় সেন্ট মেদার্দ অঞ্চলে পথের ধারে এক জায়গায় বসে প্রার্থনার স্তোত্র আওড়াত। আর চোখ দুটো খুলে তাকিয়ে থাকত লোকটা পথ চেয়ে।

সেই সন্দেহভাজন ব্যক্তি সন্ধের সময় নিয়মিত আসত এবং ছদ্মবেশী ভিখারিকে পয়সা দিত। সে ভিখারিবেশী জেভার্তের দিকে তাকালে জেভাৰ্তও তার দিকে তাকাত ভিখারিবেশী জেভাৰ্ততে চিনতে পেয়ে ভলজাঁ যে বিস্ময়ের চমক অনুভব করে, জেভার্তও ভলজাঁকে চিনতে পেরে অনুরূপ চমক অনুভব করে। সেই সঙ্গে জেভার্ত বুঝতে পারে অন্ধকারে তার ভুল হতে পারে। সরকারি খবরে জানা যায় ভলজাঁ মারা গেছে। এ বিষয়ে সন্দেহের প্রচুর অবকাশ আছে। জেভাৰ্তও দ্বিধাবশত এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে তার ওপর হাত দেয়নি।

লোকটাকে অনুসরণ করে জেভার্ত একদিন তার বাসায় যায়। গার্বোর সেই। বাড়িটাতে গিয়ে বাড়িওয়ালি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে। মেয়েটা বলে, লোকটার হলুদ ওভারকোটটায় লক্ষ লক্ষ টাকা আছে সেলাই করা। সে নিজে একদিন এক হাজার ফ্রা’র একটা নোট ভাঙিয়ে আনে। একথা শুনে সেদিন সন্ধ্যার সময় জেভাৰ্তও সেই বাড়িটার মধ্যে একটা ঘর ভাড়া করে। সে ভলজাঁ’র ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শোনার জন্য কান পেতে থাকে। কিন্তু ভুল বারান্দায় তার ঘরের সামনে বাতির আলো দেখে চুপ করে থাকে। ফলে জেভার্তের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।

পরের দিন ভলজাঁ পালিয়ে যায় বাড়ি ছেড়ে। বেরোবার সময় ভুলজা’র হাত থেকে পাঁচ ফ্রা’র একটা মুদ্রা পড়ে যায়। তার শব্দ শুনে বাড়িওয়ালি বুঝতে পারে ভলজাঁ চলে যাবে। সে জেতার্তকে সাবধান করে দেয়। ভলজাঁ তখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে জেভার্ত দু জন লোক নিয়ে বুলভার্দের রাস্তায় গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে।

জেভাৰ্ত পুলিশ বিভাগের বড় কর্তাদের কাছে এ বিষয়ে পূর্ণ ক্ষমতা চেয়ে আবেদন করে কিন্তু কাকে সে গ্রেপ্তার করতে চায় তা সে জানায়নি। তিনটে কারণে সে একথা জানায়নি। প্রথম কারণ হল, হঠাৎ কিছু করে বসলে ভলজাঁ সাবধান হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত সরকারি নথিপত্রে ভয়ঙ্করজনকভাবে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত উল্লিখিত এক জেল-পলাতক কয়েদিকে ধরতে পারাটা তার মতো এক অফিসারের পক্ষে এক বিরাট গৌরব এবং প্যারিসের পুলিশ বিভাগ এটা জানতে পারলে এই কৃতিত্ব ও গৌরব যাতে সে লাভ করতে

পারে হিংসাবশত তার জন্য তারা চেষ্টা করবে। সুতরাং কাজটা ভাবনা-চিন্তা করে স্থির করতে হবে। তৃতীয়ত জেভার্তের মনের মধ্যে একটা শিল্পীসুলভ ভাব ছিল বলে এক নারকীয় আকস্মিকতার প্রতি একটা মোহ ছিল তার। এত বড় কাজের কথা আগে থেকে ঘোষণা করে ফেললে সে কাজ সম্পাদনের মধ্যে কোনও জয়ের গৌরব থাকবে না পরিশেষে। কাজটা তাই সে অকস্মাৎ করে ফেলে তাক লাগিয়ে দিতে চেয়েছিল সকলকে।

জেভার্ত তাই ভলজাঁকে সেদিন সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি বৃক্ষান্তরালে ও পরে মাঠে ছায়ার মতো অনুসরণ করে চলেছিল। এমনকি ভলজাঁ যখন তাকে দেখতে পায়নি, যখন সে নিজেকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবেছিল তখনও তার ওপর কড়া নজর রেখেছিল জেভাৰ্ত।

তবু সে কেন তাকে গ্রেপ্তার করেনি এত কাছে এসেও? তার শুধু একটাই কারণ–তার মনে তখনও সন্দেহ ছিল। সে তখনও নিশ্চিত হতে পারেনি।

একথা আমাদের মনে রাখতে হবে, এ বিষয়ে তখনকার দিনে প্যারিসের পুলিশমহল সাংবাদিকদের জ্বালায় বড় বিব্রত বোধ করছিল। ভালো করে নিশ্চিত না হয়ে উপযুক্ত প্রমাণাদি সংগ্রহ না করেই পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে বসলে খবরের কাগজে পুলিশের নামে নিন্দাবাদ প্রকাশিত হত। পুলিশকে ধিক্কার জানাত সাংবাদিকরা। ফলে পার্লামেন্টে কথাটা উঠত এবং সদস্যদের কাছ থেকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত মন্ত্রীদের। পুলিশ বিভাগ তখন স্বাভাবিকভাবেই বিব্রত হয়ে উঠত এবং এক অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ত। কোনও নির্দোষ লোকের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করাটা এক গুরুতর অন্যায়। কোনও পুলিশ এই ধরনের বড় রকমের এক ভুল করে বসলে তার চাকরি থেকে সে বরখাস্ত হত।

এই ধরনের এক সংবাদ সেকালে একদিন প্রায় কুড়িটা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সংবাদটা এই: গতকাল প্রবীণ পকূকেশ এক পিতামহ, এক বাড়ির মালিক, করদাতা এবং সমাজের একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি তাঁর আট বছরের পৌত্রীকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলে তাকে পুলিশ এক পলাতক কয়েদি হিসেবে গ্রেপ্তার করে পুলিশের সদর দপ্তরে নিয়ে যায়।

এই সব সংবাদ পুলিশের পক্ষে সত্যিই অপমানজনক।

তাছাড়া আমরা জানি জেভার্তের একটা নীতি আছে। সে পুলিশ হলেও তার বিবেক বলে একটা জিনিস আছে। তার মনে তখনও সন্দেহ ছিল। ভলজাঁ যখন তার সামনে দিয়ে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায় সে তখন তার শুধু পিঠটা দেখতে পায়। তাছাড়া তখন তার মুখ দেখেও চেনার উপায় ছিল না। সে নতুন করে এক ঘোরতর বিপদে পড়ায় কসেত্তের জন্য উদ্বেগ তার দারুণ বেড়ে যায়, সে পাগলের মতো যেখানে-সেখানে আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকে। এই সব উদ্বেগ, অশান্তি আর চরম দুরবস্থা হঠাৎ যেন। তার বয়সটা বাড়িয়ে দেয়, তার চোখ-মুখ বিবর্ণ ও বিকৃত হয়ে ওঠে এমনভাবে যে তাকে তখন তার মুখ ও চেহারা দেখে চিনতে পারাটা কোনও ধুরন্ধর পুলিশের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। তাছাড়া তখন তার পোশাকটা অদ্ভুত ধরনের ছিল। দেখে মনে হত যেন কোনও প্রবীণ স্কুলমাস্টার। তার ওপর থেনার্দিয়ের জেতার্তকে বলেছিল যে কসেত্তেকে তার কাছ থেকে নিয়ে গেছে সে তার পিতামহ; আবার সরকারি সূত্রে জানা যায় সে মারা গেছে। এই সব কিছু মিলে জেভার্তের মনের মধ্যে অনিশ্চয়তার ভাবটা বাড়িয়ে দেয়।

জেভার্ত একবার ভাবে সে সরাসরি লোকটার কাছে গিয়ে তার পরিচয় সম্বন্ধে কাগজপত্র চাইবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে লোকটা যদি ভুল না হয়, আবার কোনও নির্দোষ ভদ্রলোকও না হয়, যদি সে প্যারিসের এক দাগি অপরাধী বা ডাকাতদলের সর্দার হয় তা হলে তাকে ঘিরে, যে গোপন চক্ৰজাল বিস্তৃত হয়েছে সে জাল ছিন্ন করতে হলে অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হবে তাকে। তাকে অনেক তদন্ত ও অনেক ঘোরাঘুরি করতে হবে এবং তাকে গ্রেপ্তার করতে গিয়ে আসল ভলজাঁকে ধরতে পারার চরম গৌরব অর্জন করার ব্যাপারটা সোনার ডিমের লোভে হাঁসের পেট কাটার মতো হাস্যাস্পদ ও অবান্তর হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং অপেক্ষা করায় ক্ষতি কী? জেভার্তের দৃঢ় বিশ্বাস ভলজাঁ কিছুতেই তার জাল থেকে পালাবে না।

জেতার্ত তাই ভলজাঁকে র‍্যু পন্তয়ের একটা হোটেল পর্যন্ত অনুসরণ করে চলল। হোটল থেকে যে আলো বেরিয়ে আসছিল তাতে সে ভলজাঁকে স্পষ্ট দেখতে পেল। সে বুঝতে পারল সে-ই হচ্ছে ভলজাঁ। কোনও মা তার হারানো সন্তানকে ফিরে পেলে অথবা কোনও বাঘ তার হারানো শিকারকে ফিরে পেলে যেমন হয় তখন জেভার্তের মনেও এই ধরনের এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগছিল। কিন্তু সেই সঙ্গে তার ভয়ও লাগছিল। সে যখন বুঝতে পারল পলাতক লোকটা জাঁ ভলজাঁ এবং তাকে ধরার জন্য তার হাতে মাত্র দু জন পুলিশ আছে তখন সে রুপন্তয়ের পুলিশ ফাঁড়িতে সাহায্য চাইল। আমরা কাঁটাওয়ালা ছড়ি ধরার সময় কাটার ভয় করি।

পুলিশের সাহায্য নিতে কিছুটা দেরি হল জেভার্তের। রোলার চৌরাস্তার কাছে তার লোকদের সঙ্গে কিছুটা কথা বলতেও দেরি হল। ফলে পলাতক আসামি তার চোখের আড়ালে চলে গেল। জেভার্ত বুঝতে পারল নদীর পুলটা পার হয়ে অনুসরণকারীদের চোখে ধুলো দিয়ে সে পালিয়ে যাবে। তাই সে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে শিকারি কুকুরের মতো শিকারের সন্ধানে দ্রুতবেগে এগিয়ে গেল পুলটার মুখের কাছে। যে লোকটা পুল পার হবার পয়সা আদায় করে তার সঙ্গে কথা বলে জানল ভলজাঁ এই পুল পার হয়েই পালিয়েছে। পয়সা আদায়কারী লোকটা বলল, আট বছরের মেয়ের সঙ্গে একটা লোককে দেখেছি। আমি তার কাছ থেকে দুই স্যু চেয়েছিলাম।

জেভাৰ্ত ঠিক সময়েই পুলটার মুখে এসে চাঁদের আলোয় দেখতে পেল কসেত্তেকে নিয়ে ভজ পুলটা পার হয়ে যাচ্ছে। সে দেখল ভলজাঁ কুল-দ্য-সাক জেনরতের দিকে যাচ্ছে। তার মনে হল সে যাবে র‍্যু দ্রয়েত মুরের দিকে। সেখান থেকে বেরোবার একমাত্র পথ হল পেতিত কু্য পিপাস। সেই পথে যাতে সে পালাতে না পারে তার জন্য একটা লোককে পেতিত পিকপাসের সামনে পাঠিয়ে দিল জেতার্ত। তার পর সে তার দল নিয়ে আর্সেনালের পেছন দিকে এগিয়ে গেল। তার মনে হল এটা যেন এক ধরনের শিকার। একটা বন্য শূকরকে ধরতে হলে একদিকে যেমন শিকারির বুদ্ধি আর চাতুর্য দরকার তেমনি দরকার একদল শিকারি কুকুরের। এইভাবে সব ব্যবস্থা করে সে দেখল ডান দিকে বাঁ দিকে ভলজাঁ’র পালাবার সব পথ বন্ধ করে দিয়ে তাকে ফাঁদে ফেলা হল চমৎকারভাবে। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে এক টিপ নস্যি নিল জেভার্ত।

এইভাবে ভলজাঁ’র মুক্তির শেষ আশা ও সম্ভাবনাটুকু নিঃশেষে মুছে দিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এক পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করতে লাগল সে। মাকড়সার জালের মধ্যে মাছি পড়লে সে মাছির ব্যর্থ সংগ্রাম দেখে মাকড়সা যে আনন্দ পায়, খাবার মধ্যে কোনও উঁদুর পড়ে বাঁচার জন্য আঁকপাক করতে থাকলে বিড়াল যেমন তা দেখে যে আনন্দ পায় তেমনি ভলজাঁ’র কল্পিত সগ্রামের ব্যর্থতার কথা মনে ভেবে আনন্দ পেতে লাগল জেভাৰ্ত। সে যে কুটিল জাল বিস্তার করেছে সে জাল ইচ্ছামতো গুটিয়ে নিতে পারে সে। ভলজাঁ যত বেপরোয়া বা বিপজ্জনকই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে সমবেত প্রতিকূল শক্তির প্রতিরোধ করতে কোনওমতেই পারবে না সে।

সুতরাং বাঁ দিকে ডান দিকে পথের ধারে সব জায়গা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে এগিয়ে যেতে লাগল জেভার্ত। এইভাবে দেখতে দেখতে সে যখন তার পাতা জালের মাঝখানে গিয়ে হাজির হল তখন দেখল মাছি পালিয়ে গেছে। যেখানে ভলজাঁ’র থাকার কথা সে জায়গা শূন্য। যে লোককে পাহারায় নিযুক্ত করেছিল সে দেখতে পায়নি ভলজাঁকে।

জেভার্তের ক্রোধের প্রচণ্ডতা সহজেই অনুমেয়। কখনও কখনও এমনিই হয়। অনেক সময় চারদিকে শিকারি কুকুরের দল ঘিরে থাকলেও তার মধ্যে থেকে একটা হরিণ ঐন্দ্রজালিকভাবে পালিয়ে যায়। তখন মনে হয় হরিণ নয়, যেন এক সুদক্ষ জাদুকর। জেভার্তেরও এ ক্ষেত্রে তাই মনে হচ্ছিল। তাই বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল।

একথা অনস্বীকার্য যে নেপোলিয়ন রুশ অভিযানে ভুল করেছিলেন, আলেকজান্ডার ভুল করেছিলেন ভারত অভিযানে, সিজার ভুল করেছিলেন আফ্রিকা অভিযানে, সাইরাস স্কাইথিয়ায়, ভলজাঁ’র বিরুদ্ধে অভিযানে জেভার্তও ভুল করেছিল। ভলজাঁকে চিনতে তার দেরি হয়েছিল, তাকে এক নজরে দেখেই তাকে চিনতে পারা উচিত ছিল–এটাই ছিল তার প্রথম ভুল। তার পরেও যে ভুল করেছিল গার্বোর বাড়িতে যে তাকে চিনতে পেরেও সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করেনি। আবার রুপন্তয়ে যে তাকে নিশ্চিতরূপে চিনতে পেরেও গ্রেপ্তার করেনি; রোলার চৌরাস্তার মাথায় চাঁদের আলোয় তাকে দেখতে পেয়েও তাকে গ্রেপ্তার করেনি সে। ভাবনা-চিন্তা করে কোনও কিছু করা বিজ্ঞজনোচিত কাজ, কিন্তু কোনও নেকড়ে বা পলাতক কয়েদির মতো সদাসতর্ক কোনও জীবকে ধরার সময় শিকারি বা পুলিশ অনেক বেশি তৎপর হয়ে ওঠে। সে নিজেকে বেশি শক্তিশালী ভেবেছিল। সিংহকে ইঁদুর ভেবে খেলা করতে গিয়েছিল তার সঙ্গে। আবার নিজের শক্তিকে অহেতুক কম ভেবে পুলিশের সাহায্য চাইতে গিয়ে অমূল্য সময় নষ্ট করাটাও অন্যায় হয় তার। একজন কূট প্রকৃতির সুদক্ষ ডিটেকটিভ হয়েও এই সব ভুল করে বসে সে। একজন অভিজ্ঞ শিকারি কুকুর হয়েও ভুল করে বসে শিকার ধরতে গিয়ে।

কিন্তু ভুল কে করে না আমাদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিরক্ষাগত কৌশলের মধ্যেও অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। যে কোনও বড় ভুল হচ্ছে মোটা দড়ির মতো। সরু সরু অনেক সুতোর সমন্বয়ে যেমন এক-একটা মোটা দড়ি গড়ে ওঠে, তেমনি ছোটখাটো ভুলের সমন্বয়েই গড়ে ওঠে এক-একটা বড় রকমের ভুল। পূর্বে মার্সিয়া আর পশ্চিমে ভ্যালেন্তিলিয়ার মাঝখানে অহেতুক ইতস্তত করে ভুল করেছিলেন হ্যাঁনিবল, কাপুয়াতে অকারণে দেরি করেছিলেন। দাঁতন আর্সি-সুর-আবেতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।

ভুল করলেও জেতার্ত যখন দেখল ভলজাঁ পালিয়ে গেছে তখন সে মাথা গরম করল না বা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল না। সে বুঝল তার শিকার হাতছাড়া হয়ে গেলেও বেশি দূর যেতে পারেনি। সে তাই আশেপাশে কয়েকটি জায়গায় পাহারায় নিযুক্ত করে রাখল কয়েকজনকে। পাহারাদারেরা লুকিয়ে ওত পেতে রইল। হঠাৎ একসময় জেভার্ত দেখল রাস্তার লাইটপোস্টের মধ্যে একটা বড় দড়ি নেই। এটা এক মূল্যবান হদিশ হলেও জেভাৰ্ত ভাবল ভলজাঁ জেলরতের দিকে গেছে। সে তাই সেখানে খুঁজতে গেল। ওদিকের পথটা বাগানের একটা পাঁচিলের গাঁয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে। বাগানটার ওপারে আছে কিছু আবাদযোগ্য জমি। সে ভাবল ভলজাঁ এই পথেই গেছে। যদি সে সে-পথে যেত তা হলে তার আর অব্যাহতি ছিল না। জেভার্ত বাগানটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল ঠিক যেন খড়ের গাদায় একটা সূচ হারিয়ে গেছে।

সকাল হলে সে দু জন যোগ্য লোককে পাহারায় নিযুক্ত করে নিজে মুরগির দ্বারা বোকা বানানো এক ঘেঁকশেয়ালের মতো লজ্জাভরা মুখ নিয়ে পুলিশের সদর দপ্তরে গিয়ে পৌঁছল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *