প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

২.৩ মঁতফারমেল শহরটা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মঁতফারমেল শহরটা লিভরি আর শশালেসের মাঝখানে অবস্থিত। জায়গাটা হল উর্ক নদী আর মার্নের মাঝখানে উঁচু মালভূমিটার দক্ষিণ দিকের ঢালটার উপরে। একালে মঁতফারমেল শহরটার অনেক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে আগের থেকে। অনেক বড় বাড়ি গড়ে উঠেছে সেখানে আর রাস্তাঘাটেরও অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সেকালে এ শহর ছিল একটা গণ্ডগাঁয়ের মতো। সেকালে ঘরবাড়ির সংখ্যা ছিল খুবই কম। গাঁয়ের ভেতরটা ছিল যেমন শান্ত তেমনি ফাঁকা ফাঁকা। পরে এই শান্ত সুন্দর গাটায় লিনেন ব্যবসায়ী আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা ভিড় জমাতে থাকে। গাঁটা খুবই শান্ত এবং সুন্দর। একমাত্র সমস্যা ছিল জলের। কারণ গাটা ছিল এক উঁচু মালভূমির উপরে অবস্থিত।

জল আনতে হত অনেক দূর থেকে। গায়ের যেদিকটা দিয়ে গ্যাগনির পথটা চলে গেছে সেই দিকের বাসিন্দারা গ্রামপ্রান্তের এক বনের ভেতর যেসব জলাশয় ছিল সেখান থেকে জল আনত। গাঁয়ের যে প্রান্ত দিয়ে শেলেনের রাস্তাটা চলে গেছে সেই প্রান্তের লোকেরা শেলেন রোডের ধারে পাহাড়ের ঢালের নিচু দিয়ে বয়ে যাওয়া একটা ঝরনা থেকে জল আনত।

সুতরাং গাঁয়ের সাধারণ অধিবাসীদের জলের জন্য দারুণ কষ্ট পেতে হত। গায়ের মধ্যে। যারা ছিল অভিজাত শ্রেণির লোক আর থেনার্দিয়েরদের মতো হোটেল মালিক তারা কিছু টাকা খরচ করে জল বয়ে আনাত। জলবাহকও এইভাবে জল বয়ে দিয়ে প্রায় আট স্যু করে রোজগার করত। শীতকালে বেলা পাঁচটা পর্যন্ত আর গ্রীষ্মকালে সন্ধে সাতটা পর্যন্ত জল বয়ে। আনার কাজ করত। এরপর কারো কোনও দরকার পড়লে আর এক বিন্দুও জল কিনতে পাওয়া যেত না। তখন কারও জলের দরকার পড়লে তাকে নিজেরও আনতে যেতে হত। এই জল আনার ব্যাপারটাই ছোট মেয়ে কসেত্তের কাছে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মতো ছিল। ফাঁতিনের মেয়ে কসেরে পাঠকদের কাছে আগে থেকেই পরিচিত। পাঠকদের হয়তো মনে থাকতে পারে দুটো কারণে থেনার্দিয়েররা তাকে ছাড়তে চাইত না। তার একটা কারণ ছিল তার মার কাছে থেকে বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে টাকা আদায় করা এবং আর একটা কারণ ছিল তাকে দিয়ে ঘর-সংসারের কাজ করিয়ে নেওয়া। তাকে দিয়ে গাধার মতো খাঁটিয়ে নেওয়ার জন্য তার মা টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেও তাকে ছেড়ে দেয়নি তারা। এক অবৈতনিক ভৃত্য হিসেবে থেনার্দিয়েরদের বাড়িতে এক বিশেষ প্রয়োজন ছিল তার। তাকেই জল আনতে পাঠাত থেনার্দিয়েররা। পাছে সন্ধের পর তাকে জল আনতে পাঠায় এজন্য কসেত্তে দিনের বেলাতেই বেশি করে জল বয়ে আনত। সন্ধের পর জল যাতে ফুরিয়ে না যায় এজন্য তার আগেই ব্যবস্থা করে রাখত। সন্ধের পর জল আনতে যেতে বড় ভয় করত তার।

১৮২৩ সালে মঁতফারমেলে খ্রিস্টোৎসবটা বেশ জাঁকজমকের সঙ্গেই সম্পন্ন হয়। সেবার প্রথম শীত পড়ার সময় বরফ পড়েনি। এই খ্রিস্টোৎসব উপলক্ষে সেবার প্যারিস থেকে এক ভবঘুরে নাট্যদল এসে মেয়রের অনুমতি নিয়ে মঁতফারমেলের মধ্যে থেনার্দিয়েরদের হোটেলটার কাছাকাছি এক জায়গায় পথের ধারে ডেরা পাতে। মেয়রের অনুমতি পেয়ে কতকগুলি ফেরিওয়ালাও দোকান পাতে সেখানে। ফলে জায়গাটা জমজমাট হয়ে ওঠে মানুষের ভিড়ে। থেনার্দিয়েরদের হোটেলেও খরিদ্দারের বেশ ভিড় হতে থাকে।

এই সময় সেই জায়গায় একদল লোক কোথা থেকে জীবজন্তুর খেলা দেখাতে আসে। তারা কোথা থেকে আসে তা কেউ জানে না। তাদের সঙ্গে যেসব জীবজন্তু ছিল তাদের মধ্যে ব্রাজিলের একটা লাল রঙের শকুনি ছিল। শকুনিটাকে দেখতে ভয়ঙ্কর রকমের ছিল। ১৮৪৫ সালের আগে মিউজিয়ামে এই ধরনের কোনও শকুনিকে রাখা হয়নি। নেপোলিয়নের অনেক নামকরা অফিসার শকুনিটাকে দেখতে আসে। দলের লোকেরা বলত, ঈশ্বর যেন তাদের সুবিধার জন্য শকুনির ডানাগুলোকে লাল করেছেন।

সেদিন খ্রিস্টোৎসব উপলক্ষে একদল লোক থেনার্দিয়েরদের হোটেলের একটা বড় ঘরে বসে মদ পান করছিল। লোকগুলো ছিল মালবাহী গাড়ির চালক। চার-পাঁচটা বাতির আলোয় ঘরটা আলোকিত ছিল। লোকগুলো মদ পান করতে করতে গোলমাল করছিল। থেনার্দিয়ের মদ পান করতে করতে তার খরিদ্দারদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছিল আর মাদাম থেনার্দিয়ের আগুনের ধারে হাত সেঁকছিল।

রাজনীতির বিষয়টা স্পেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ। তবে যুদ্ধ ছাড়াও আর একটা বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করছিল। এ বিষয়টা গাঁয়ের সবাই তখন আলোচনা করত।

ওরা বলাবলি করছিল, এবার নানতারে আর সুরেসনের চারপাশের অঞ্চলে খুব ভালো আঙুর হয়েছে। আঙুরগুলো পাকা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। বসন্তকাল শুরু হতেই কাঁচা আঙুরগুলো পেড়ে গাঁজাতে দিতে হবে। তা হলে বেশ ভালো হালকা মদ হবে তার থেকে। আমাদের এখানকার মদের থেকে হালকা।

ময়দালের একজন শ্রমিক বলছিল, ময়দার বস্তার মধ্যে যদি বাজে ময়দা থাকে তা হলে আমরা কী করব বলো তো? যেমন গম হবে তেমনিই তো ময়দা হবে। বিশেষ করে ব্রেতো’র গমগুলো খুব খারাপ। গমের সঙ্গে হাড়, এক ধরনের হলুদ ফুলওয়ালা চারাগাছ, শন, খেঁকশেয়ালের লেজ প্রভৃতি যত সব বাজে জিনিস মেশানো থাকে আর সেগুলো মেশিনে পেশাই হয়ে গুড়ো হয়ে যায়। ময়দা নিয়ে লোকে নানারকম অভিযোগ করে। কিন্তু কী করব বল?

জানালার ধারে বসে একজন দিনমজুর আর একজন চাষি দিনমজুরি নিয়ে আলোচনা করছিল। আগামী বসন্তকালে ফসল কাটার সময় মজুরি কী হবে, তাই নিয়ে কথা বলছিল তারা। শ্রমিকটা চাষিকে বলছিল, তোমার ঘাস কাটা শক্ত মঁসিয়ে, কারণ ও ঘাস এত নরম যে কাস্তে দিয়ে কাটতেই চায় না।

এইভাবে হোটেলের খাবারঘরে নানা লোক যখন নানা রকমের আলোচনা করছিল তখন কসেত্তে রান্নাঘরের টেবিলের তলায় উনোনের পাশে একটা কাঠের উপর বসে ছিল। একটা কম্বলে গা-টা জড়ানো ছিল তার। পায়ে ছিল কাঠের জুতো। কিন্তু কোনও মোজা ছিল না। সে থেনার্দিয়েরদের ছেলেমেয়েদের জন্য পশম দিয়ে মোজা বুনছিল। পাশের ঘরে দুটো বাচ্চা মেয়ের হাসি আর কথাবার্তার শব্দ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। এই মেয়ে দুটি হল এপোনিনে আর অ্যাজেলমা। দেয়ালের উপর গাথা একটা পেরেক থেকে চামড়ার একটা ফিতে ঝুলছিল। মাঝে মাঝে ঘরের বাইরে কোনখান থেকে একটা শিশুর কান্নার শব্দ আসছিল। এই শিশুটি থেনার্দিয়েরদের শেষ সন্তান তিন বছর বয়স। সে খুব দুষ্টুমি করায় তার মা তাকে বাইরে ছেড়ে দিয়েছিল।

তাই সে কাঁদছিল। তার কান্না আর চিৎকারের শব্দ যখন হোটেলের খাবারঘরে খুব বেশি করে আসতে লাগল তখন থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে বলল, তোমার ছেলে চেঁচাচ্ছে, দেখ কী চায়।

কিন্তু তার স্ত্রী মাদাম থেনার্দিয়ের কথাটার কোনও গুরুত্ব না দিয়ে নিতান্ত সহজভাবে বলল, ছেলেটা বাজে।

মা না ধরায় ছেলেটা গোটা বাড়িময় কেঁদে বেড়াচ্ছিল।

.

২.

এ পর্যন্ত থেনার্দিয়ের দম্পতির যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তা তাদের একটি রেখাচিত্র মাত্র। এবার আমরা তার আরও কাছে যাব খুব ঘনিষ্ঠভাবে।

বর্তমানে হোটেলমালিক থেনার্দিয়েরের বয়স ছিল পঞ্চাশ আর মাদাম থেনার্দিয়েরের বয়স ছিল চল্লিশ। মেয়েদের চল্লিশ বছর বয়স পঞ্চাশের সমান। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর বয়স প্রায় এক ছিল বলা যায়। পাঠকদের হয়তো স্মরণ থাকতে পারে মাদাম থেনার্দিয়েরের চেহারার একটা বর্ণনা আগেই দেওয়া হয়েছে। তারা চেহারাটা ছিল লম্বা, মাথায় ছিল ভালো চুলের রাশি, মুখখানা লাল, মাংসল দেহ, চওড়া কাঁধ, স্বাস্থ্যটা খুবই সুগঠিত। আবার সে ছিল তেমনি কর্মঠ। তাকে প্রায়ই খাটতে দেখে মনে হত সে যেন কোনও রূপকথার রাক্ষসীদের কথা মনে পড়িয়ে দেয় যারা তাদের মাথার চুল থেকে ঝোলানো। দু পাশে থান ইটগুলো নিয়ে মাটির উপর দিয়ে মার্চ করে যেত। সে সংসারের যাবতীয় কাজ করত–বিছানা পাতা, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় কাঁচা, রান্না করা–সব করত সে একা। সে-ই ছিল হোটেলের প্রাণ। সে ছিল এক আস্ত শয়তান আর কসেত্তে ছিল একমাত্র সহকারিণী। ঠিক যেন কোনও হাতির সেবাকার্যে নিযুক্ত এক নেংটি ইঁদুর। তার গলার স্বর শুনে শুধু জানালার কাঁচের সারসি আর ঘরের আসবাবপত্রগুলো কাপত না, হোটেলে যারা খেতে আসত সেই সব খরিদ্দারেরাও কাঁপত ভয়ে। তার মুখখানা ছিল ব্রণতে ভর্তি এবং তার মুখে সামান্য একটু দাড়ি ছিল। তাকে দেখে মনে হত যেন বাজারের এক মালবাহী কুলি নারীর বেশ ধারণ করে আছে। সে জোর গলায় বড়াই করে বলত সে একটা ঘুষি মেরে একা নারকেল ফাটিয়ে দিতে পারে। সে পুলিশের মতো কথাবার্তা বলত, গারোয়ানের মতো মদ খেত এবং কসেত্তের সঙ্গে একজন জেলারের মতো ব্যবহার করত। একটা দাঁত মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে থাকত।

থেনার্দিয়ের সব সময় হাসত এবং সব খরিদ্দারের সঙ্গে দ্র ব্যবহার করত। এমনকি যে ভিখারিকে সে বাড়ি থেকে কিছু না দিয়ে তাড়িয়ে দিত তাকেও মিষ্টি কথা বলত। বেজি আর উচ্চশিক্ষিত বুদ্ধিমান লোকের মতো তার দৃষ্টি ছিল তীক্ষ্ণ। আব্বে দেলাইনের ছবিতে ঠিক যেমনটি দেখা যায়। সে তার খরিদ্দারদের সঙ্গে মদ খেতে ভালোবাসত। কিন্তু তাকে মদ খাইয়ে মাতাল করে তুলঁতে পারত না কখনও। সে একটা বড় পাইপে চুরুট খেত এবং একটা কালো জ্যাকেটের উপর ঢোলা আলখাল্লা পরত। সে উচ্চশিক্ষার ভান করত এবং বলত সে বস্তুবাদী দর্শনের সমর্থক। তার যুক্তির সমর্থনে সে ভলতেয়ার, রেনল, পার্নে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সেন্ট অগাস্টাইনের নাম করত। সে বলত তার একটা নিজস্ব মতবাদ আছে। এছাড়া সে ছিল কুটিল প্রকৃতির, এক সাধু শয়তান। এই ধরনের লোকের অবশ্য অভাব নেই। সে একদিন সেনাবিভাগে কাজ করেছিল বলে দাবি করত। সে বলত ওয়াটারলু যুদ্ধে সে একজন সার্জেন্ট হিসেবে শত্রুপক্ষের এক দুর্ধর্ষ সেনাদলের সঙ্গে একা লড়াই করে এবং ভয়ঙ্করভাবে আহত এক সেনাপতিকে সে রক্ষা করে। এজন্য তার হোটেলটাকে স্থানীয় লোকেরা ওয়াটারলু’র সার্জেন্টের হোটেল বলে। সে ছিল একই সঙ্গে উদারনীতিবাদী, রক্ষণশীল এবং বোনাপার্টবাদী। যেসব উদারনীতিবাদী ও বোনাপার্টাদী টেকসাসের উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেয় সেখানে সে কিছু দান করে। গায়ের লোকেরা বলত পৌরোহিত্য কাজের জন্যও সে পড়াশুনো করে।

কিন্তু আমাদের বিশ্বাস সে হল্যান্ডে হোটেল চালাবার জন্য প্রশিক্ষণ লাভ করে। আসলে সে ছিল বিভিন্ন জাতির রক্তগত সংমিশ্রণে উদ্ভূত এক অদ্ভুত বর্ণসংকর। সে ছিল ক্ল্যাভার্সে ক্লেমিশ, প্যারিসে ফরাসি, ব্রাসেলস্-এ বেলজিয়ান। যখন যেখানে যেমন দরকার সেই ধরনের পোশাক পরত সে। আমরা জানি ওয়াটারলুতে কী ঘটেছিল। আমরা জানি সে যুদ্ধে তার ভূমিকা সম্বন্ধে আগে কিছু বাড়িয়ে বলেছে সে। জোয়ার-ভাটার বিপরীতমুখী তরঙ্গাভিঘাতে দোলায়মান কুণ্ঠাহীন দ্বিধাহীন এক জীবন। সব সময় নিজের প্রধান স্বার্থপূরণের লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে ভেসে চলেছে। এইভাবে সে সাঁতার কেটে চলে। ১৮১৫ সালের জুন মাসে যুদ্ধকালে দারুণ গোলমালের সময় শিবিরে শিবিরে ঘুরে বেড়ায়। তার কিছুটা বিবরণ আমরা আগেই দিয়েছি। আমরা জানি সে একটা চাকা দেওয়া ঘোড়ার গাড়িতে করে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। এক জায়গায় একটা জিনিস চুরি করে অন্য জায়গায় তা বিক্রি করেছে, সব সময় বিজেতা পক্ষের দলে ভেড়ার চেষ্টা করেছে। ওয়াটারলু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে কিছু স্বার্থ ও সুখ-সুবিধা ত্যাগ করে আবার সে মঁতফারমেলে এসে তার হোটেল ব্যবসায় মন। দিয়েছে। তার মানে যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলোর থেকে যেসব হাতঘড়ি, টাকা-পয়সা, সোনার আংটি প্রভৃতি সে চুরি করে তাতে সে খুব একটা বেশি লাভ করতে পারেনি। সে বেশি দূর এগোতে পারেনি।

প্রার্থনাসভায় যাবার সময় থেনার্দিয়েরের গতিভঙ্গির মধ্যে এক নীরস গাম্ভীর্য ও কঠোরতার ভাব ছিল। সে খুব মোলায়েমভাবে কথা বলতে পারত এবং একজন গণ্যমান্য পণ্ডিত লোকের খ্যাতি পেতে চাইত। কিন্তু গাঁয়ের স্কুলমাস্টার লক্ষ করেছিল তার হোটেলের বাসিন্দাদের যেসব বিল দিত সেসব বিলে তার হাতের লেখাটা ভালো হলেও তাতে বানান ভুল থাকত। সে ছিল ধূর্ত, চোর, কুঁড়ে এবং কুটিল। নারীভৃত্যদের প্রতি সে মোটেই উদাসীন ছিল না অর্থাৎ তাদের প্রতি তার একটা জান্তর লালসা এবং আগ্রহ ছিল আর সেই কারণেই তার স্ত্রী হোটেলে কোনও নারীভৃত্য রাখত না। মাদাম থেনার্দিয়ের ছিল এক ঈর্ষাপরায়ণ দানবী। তার হলদেমুখো, বেঁটে-খাটো স্বামীটার প্রতি তার আসক্তির অন্ত ছিল না। এর ওপর থেনার্দিয়ের ছিল সদাসতর্ক, সংযতমনা, আত্মস্থ এক ঠাণ্ডামাথা জুয়োচোর, যার গোটা মনটা ছিল ভাঁড়ামিতে গড়া।

তার মানে এই নয় যে সে কখনও কোনও অবস্থাতেই রাগত না। বরং মাঝে মাঝে সে তার স্ত্রীর মতোই রেগে যেত। অবশ্য তার রাগটা খুব কমই হত। সে তখন এক গোড়া মনুষ্যবিদ্বেষীর মতো সমগ্রভাবে মানবজাতির প্রতি ঘৃণার গরল উদ্গার করত। সে এমনই এক লোক ছিল যে তার নিজের দুর্ভাগ্যের বা হতাশার জন্য কে বা বাইরের কোনও না কোনও ঘটনাকে দায়ী করত। তার মুখ থেকে তখন ফেনা ভাঙত। চোখ দুটো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। তখন যারা তার সেই কোপের কবলে পড়ত তাদের দুর্ভাগ্য বলতে হবে।

এছাড়া থেনার্দিয়েরের পর্যবেক্ষণশক্তি ছিল খুব উচ্চ ধরনের। অবস্থা অনুসারে সে কখনও নীরব, নিরুচ্চার অথবা কখনও-বা বাঁচালের মতো সোচ্চার হয়ে উঠত। কাঁচের। মধ্য দিয়ে দূর দিগন্তে তাকিয়ে থাকা নাবিকদের মতো তার দৃষ্টি ছিল শক্তিসম্পন্ন। একথায় এক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ।

হোটেলে কোনও নতুন লোক এলে মাদাম থেনার্দিয়েরকেই হোটেলের আসল মালিক মনে করত। কিন্তু সেটা তার ভুল। আসলে মাদাম থেনার্দিয়ের কী ছিল না। থেনার্দিয়েরই ছিল একই সঙ্গে হোটেলের কর্তা এবং কত্রী। মাদাম থেনার্দিয়ের খাটত ঠিক, সব পরিকল্পনা তার স্বামী করত। সব কিছু নিয়ন্ত্রণ বা পরিচালনা করত সে। থেনার্দিয়েরের সামান্য একটা মুখের কথায় বা একটা অঙ্গুলি হেলনে সাক্ষাৎ দানবীর মতো এই মহিলাটি কেঁচো হয়ে যেত। অকুণ্ঠভাবে তার স্বামীর আদেশ মেনে চলত। কোনও কিছু না ভেবেই মাদাম থেনার্দিয়ের তার স্বামীকে তার থেকে সব দিক দিয়ে বড় বলে মেনে নিত। নীতিগত কোনও বিষয়ে তার স্বামীর মতের বিরুদ্ধে যেত না। প্রকাশ্যে কোনও বিষয়ে স্বামীর কোনও কথা বা কাজের প্রতিবাদ করত না। যদিও তাদের দু জনের মিলনে বিশেষ কোনও সুফল ফলেনি, তবু স্বামীর প্রতি আত্মসমর্পণের ব্যাপারে এক তুরীয় ও বিরল মনের পরিচয় দেয় মাদাম থেনার্দিয়ের। স্বৈরাচারী স্বামীর সামান্য অঙ্গুলি হেলনের সঙ্গে সঙ্গে মেদবহুল সেই অচল অটল পাহাড় টলতে শুরু করে। যে বৈশ্বিক নিয়মের বশে আত্মার দ্বারা বস্তুজগৎ অনুশাসিত হয় মাদাম থেনার্দিয়েরের জীবনে সেই নিয়মেরই প্রকাশ ঘটে। অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণের মধ্যে যেমন এক শান্ত সৌন্দর্য আছে তেমনি তার মধ্যে কতকগুলি কুৎসিত রূপও আছে। তবে একথা ঠিক যে থেনার্দিয়েরের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যার জন্য সে তার স্ত্রীর ওপর আধিপত্য করতে পারত। এক-এক সময় তার মনে হত তার স্বামী এক প্রদীপের আলো, আবার এক-এক সময় তাকে শাঁখের করাত বলে মনে হত।

মাদাম থেনার্দিয়ের নামে এই ভয়ঙ্কর মহিলাটি তার ছেলেমেয়েদের ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসত না। একমাত্র স্বামী ছাড়া জগতে আর কাউকে ভয় করত না। তবে তার মাতৃস্নেহ শুধু তার মেয়েদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে স্নেহ তার পুত্রসন্তানের প্রতি প্রসারিত ছিল না। থেনার্দিয়েরের স্নেহ-ভালোবাসা বলে কোনও কিছু ছিল না। জীবনে কী করে ধনী হওয়া যায়, এটাই ছিল তার একমাত্র চিন্তা। অর্থের প্রতিই ছিল তার একমাত্র আগ্রহ।

কিন্তু এই অর্থোপার্জনের ব্যাপারে ব্যর্থ হয় সে। তার প্রভূত প্রতিভার উপযুক্ত কোনও কর্মসংস্থানের সুযোগ কোনও দিন আসেনি তার জীবনে। মঁতফারমেলের এই হোটেল ব্যবসায় সে নিজেকে ক্ষয় করে চলেছিল তিলে তিলে। সুইজারল্যান্ড অথবা পিরেনিজে থাকলে সে অনেক সম্পদ অর্জন করতে পারত। তবে হোটেলমালিককে কোথায় কখন ব্যবসার খাতিরে থাকতে হয়, তা তো বলা যায় না। ১৮২৩ সালে বেশ কিছু ঋণ ছিল থেনার্দিয়েরের এবং যে সব ঋণ অবিলম্বে পরিশোধ করা দরকার এমন ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫০০ ফ্রাঁ এবং এ জন্য সে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল।

থেনার্দিয়ের সবকিছু বুঝত এবং তার আতিথেয়তা ছিল। এছাড়া সে ভালো মাছ ধরতে পারত এবং লক্ষ্যভেদেও তার দক্ষতা ছিল। তার শান্তশীতল হাসিটা কিন্তু বড় কুটিল ছিল।

হোটেল চালানো সম্বন্ধে তার যে নীতি ছিল তা সে নিজেই প্রয়োগ করতে পারত না। তবু সে তার স্ত্রীর সুবিধার জন্য তাকে এ বিষয়ে উপদেশ দিত। সে একবার চাপা গলায় প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে তার স্ত্রীকে বলেছিল, হোটেলমালিকের কাজ হল সব নবাগতকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানানো, তাদের খাদ্য, আলো, জল, তাপ, বিছানার চাদর, নারীভৃত্য এবং সব রকমের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। তাদের জন্য চেয়ার-টেবিল, আর্মচেয়ার, তোষক, আয়না প্রভৃতির ব্যবস্থা করা। এমনকি তাদের কুকুরের খাওয়ার জন্য ভালো ব্যবস্থা করা।

তাদের দাম্পত্যসম্পর্কটা কিন্তু মোটেই মধুর ছিল না। সে সম্পর্ক ছিল চাতুর্য আর রাগারাগিতে ভরা। থেনার্দিয়ের শুধু টাকার হিসাব করত, লাভের অঙ্ক কষত, নানারকম ফন্দি আঁটত আর কলা-কৌশল উদ্ভাবন করত। মাদাম থেনার্দিয়ের কিন্তু পাওনাদারদের তাগাদা সম্বন্ধে কোনও কিছু ভাবত না। অতীত বা ভবিষ্যতের পানে তাকাত না। সে শুধু একান্তভাবে বর্তমানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত।

তাদের দুজনের মাঝখানে ছিল কসেত্তে। দু দিক থেকেই চাপ পেত সে। তার একদিকে ছিল এক জাঁতাকল আর একদিকে ছিল সাঁড়াশি। বেশির ভাগ আঘাত আর পীড়নটা আসত মাদাম থেনার্দিয়েরের কাছ থেকে। পোশাক-আশাকের দিক থেকে কষ্ট দিত থেনার্দিয়ের নিজে। তার জন্যই তাকে খালি পায়ে চলতে হত। সে সব সময় উপর-নিচে করত, ঘর মোছা, ঘর ঝাঁট দেওয়া, পালিশ করা, ভারী বোঝা বহন করা প্রভৃতি অনেক কাজ তাকে নিদারুণ পরিশ্রম সহকারে করতে হত। কর্তা বা গিন্নি কারও কাছ থেকেই সে কোনও দয়ামায়া পেত না। সারা হোটেল ছিল যেন এক বিরাট ফাঁদ। সে ফাঁদের মধ্যে যে দাসত্বের জীবন সে যাপন করত সে জীবন ছিল নির্মম পীড়ন আর যন্ত্রণায় ভরা। এক বিরাট মাকড়সার বিষাক্ত জালের মধ্যে অসহায় এক মাছির মতো ছটফট করত সে।

মুখে কোনও কথা বলত না মেয়েটা। কিন্তু মুখে কোনও কথা না বললেও তার শিশু মনের মধ্যে মানুষের জগৎ সম্বন্ধে কী চিন্তার উদয় হত, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দিত তা কে জানে?

.

৩.

চারজন নতুন পথিক এল হোটেলে। তার জন্য দুশ্চিন্তার শেষ নেই কসেত্তে’র মনে। তার বয়স মাত্র আট হলেও তার জীবনটা ছিল এমনই দুঃখকষ্টের যে সে যেন এক বৃদ্ধার চোখ দিয়ে জগক্টাকে দেখত। একবার মাদাম থেনার্দিয়েরের একটা ঘুষিতে তার মুখে দাগ হয়ে যায়। তাতে মাদাম থেনার্দিয়েরই বলে, দেখ দেখ, ওর মুখটা কেমন দেখাচ্ছে।

টেবিলের তলায় বসে সে ভাবছিল। ভাবছিল অন্ধকার রাত্রি। অথচ হোটেলে আসা নতুন লোকদের জন্য জল চাই। তাদের খাবারঘরে জলের যে সব জগ আর কলসি আছে সেগুলো ভরতে হবে। অবশ্য এটাও ঠিক যে হোটেলে যারা আসে তারা বেশি জল খায় না। জলের বদলে মদের পিপাসাই তাদের বেশি। তবু ভয়ে কাঁপতে লাগল কসেত্তে। মাদাম থেনার্দিয়ের স্টোভের উপর চাপানো রান্নার একটা পাত্র তুলে কী দেখল। তার পর একপাত্র জল আনতে গেল। গিয়ে দেখল জল নেই। সে বলল, জল ফুরিয়ে গেছে।

কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। কসেত্তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বসে রইল।

থেনার্দিয়ের আধগ্লাস জল দেখে বলল, ভাবনার কিছু নেই, এতেই হবে। কসেত্তে তার কাজ করতে গেল। কিন্তু তার বুকের ভেতরটা লাফাচ্ছিল। কখন সকাল হবে তার জন্য মুহূর্ত গণনা করতে লাগল সে। মাঝে মাঝে হোটেলের এক একজন বাসিন্দা জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলতে লাগল, রাস্তাটা পিচের মতো অন্ধকার। লণ্ঠন না নিয়ে কোনও বিড়াল ছাড়া কেউ বাইরে যেতে পারবে না।

একজন ফেরিওয়ালা তার একটা ঘোড়া নিয়ে সে রাতে হোটেলে এসে উঠেছিল। সে তার ঘর থেকে বাইরে এসে রাগের সঙ্গে বলল, আমার ঘোড়াকে জল দেওয়া হয়নি।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, নিশ্চয় হয়েছে।

ফেরিওয়ালা লোকটা বলল, আমি বলছি হয়নি মাদাম।

টেবিলের তলা থেকে কসেত্তে বেরিয়ে এসে বলল, আমি নিজে এক বালতি জল তাকে খাইয়েছি।

কথাটা সত্যি নয়, কসেত্তে মিথ্যা কথা বলছিল।

ফেরিওয়ালা বলল, হাঁটুর বয়সি মেয়েটা বড় মানুষের মতো মিথ্যা কথা বলছে। আমি বলছি, তাকে জল খাওয়ানো হয়নি।

কসেত্তে অশ্রুতপ্রায় নিচু গলায় বলল, যাই হোক, তাকে জল দেওয়া হয়েছে।

ফেরিওয়ালা বলল, ঠিক আছে, ঘোড়াকে জল দেওয়া তো আর একটা বিরাট ব্যাপার নয়। এখন জল এনে দাও না কেন?

কসেত্তে আবার টেবিলের তলায় ঢুকে গেল।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, তা অবশ্য ঠিক। ঘোড়াকে জল দেওয়া না হলে অবশ্যই। তা এখন দিতে হবে। মেয়েটা গেল কোথায়?

টেবিলের তলায় উঁকি মেরে দেখে মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, বেরিয়ে আয়।

কসেত্তে আবার বেরিয়ে এল।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, মিস অপদার্থ, এবার জল এনে ঘোড়াটাকে দাও।

ক্ষীণ স্বরে কসেত্তে বলল, মাদাম, জল তো নেই।

তার উত্তরে মাদাম থেনার্দিয়ের রাস্তার দিকে সদর দরজাটা খুলে বলল, তা হলে জল নিয়ে এস।

অগত্য কসেত্তে রান্নাঘর হতে একট খালি বালতি বার করে নিয়ে এল। বালতিটা তার থেকে বড়। তার ভেতর তার বসা চলে। মাদাম থেনার্দিয়ের একটা কাঠের হাতা নিয়ে রান্নায় মন দিল। রান্নার কাজ করতে করতে বলল, ঝরনায় প্রচুর জল আছে। এতে আর কষ্ট কী আছে। এটা তো আগেই করে রাখতে পারতে।

মাদাম থেনার্দিয়ের একটা ড্রয়ার থেকে পনেরো স্যু’র একটা মুদ্রা বার করে এনে কসেক্তের হাতে দিয়ে বলল, এই নাও মিস ব্যাড়, এটা রেখে দাও। এটা দিয়ে রুটির দোকান থেকে একটা বড় পাউরুটি কিনে আনবে।

কসেত্তে মুদ্রাটা হাত পেতে নিয়ে তার জামার পকেটের ভেতর রেখে দিল। তার পর বালতিটা নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ধরে ভাবতে লাগল।

মাদাম থেনার্দিয়ের চিৎকার করে উঠল, চলে যাও।

কসেত্তে বেরিয়ে গেল। সদর দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হল।

.

৪.

মেলা উপলক্ষে পথের ধারে খোলা জায়গায় যে দোকানগুলো পাতা হয়েছিল সেগুলো চার্চ থেকে শুরু করে থেনার্দিয়েরের হোটেল পর্যন্ত চলে এসেছিল। মধ্যরাত্রিতে চার্চে উপাসনা করতে যাবার সময় গায়ের লোকেরা যাতে সবকিছু দেখতে পায় তার জন্য। দোকানগুলোতে উজ্জ্বল আলো জ্বেলে রাখা হয়েছিল। মঁতফারমেলের স্কুলমাস্টার তখন হোটেলে বসে ছিল। সে দোকানগুলোর দিকে তাকিয়ে তখন বলেছিল ‘অসংখ্য কাগজের লণ্ঠনগুলো চমৎকার দেখাচ্ছে। কিন্তু আকাশে কোনও তারা ছিল না।

হোটেলের উল্টো দিকে যে দোকানটা ছিল তাতে চকচকে কাঁচ আর অনেক ধাতুর জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছিল। দোকানটার সামনে দু-ফুট উঁচু পুতুল সাজানো ছিল। পুতুলটার পরনে ছিল গোলাপি রঙের ক্রেপের জামা, মাথায় সত্যিকারের কালো চুল আর এলোমেলো চোখ। পুতুলটা সারাদিন দোকানের সামনে ওইভাবে সাজানো ছিল। সারাদিন অসংখ্য শিশুর লুব্ধ দৃষ্টির শরে বিদ্ধ হয়েছে পুতুলটা। কিন্তু মঁতফারমেলের গাঁয়ের কোনও শিশুর মায়ের পুতুলটা কেনার মতো পয়সা জোটেনি। এপোনিনে আর অ্যাজেলমা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে পুতুলটার পানে সারাদিন কতবার তাকিয়ে থেকেছে। কসেত্তেও মাঝে মাঝে দেখেছে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে কসেত্তে একবার সেই দোকানটার সামনে দিয়ে যাবার লোভ সামলাতে পারল না। ধীর পায়ে দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখতে লাগল। তার মনে হল দোকানটা যেন সামান্য একটা দোকান নয়, সুসজ্জিত এক প্রাসাদ এবং পুতুলটা যেন সামান্য একটা পুতুল নয়, যেন জীবন্ত এক মেয়ে। পুতুলটাকে এত কাছে থেকে এর আগে দেখেনি সে। দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল এক অফুরন্ত সুখ-সম্পদ আর ঐশ্বর্যের আলোকবন্যা অপরিসীম দুঃখকষ্ট আর অবজ্ঞার অন্ধকারভরা তার ছোট্ট জগৎটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কোথায় যেন। কসেত্তে এবার তার থেকে পুতুলটার আসল দূরত্ব বা ব্যবধানটা কতখানি তা বোঝার চেষ্টা করেছিল। সে বেশ বুঝতে পারল, রানি বা রাজকন্যা না হলে কেউ কখনও এত সুন্দর একটা জিনিসকে কিনতে পারে না। ঘরে রাখতে পারে না। পুতুলের পোশাক, চুল আর চোখ দেখে সে ভাবল পুতুলটা কত সুখী! দোকান থেকে একটা পা-ও নাড়াতে পারছিল না সে। সে সরে যেতে পারছিল না। যতই সে দেখছিল ততই সে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে গোটা দোকানটা স্বর্গ মনে হচ্ছিল, বড় পুতুলটা আর তার পেছনে আরও যে সব পুতুল ছিল সেগুলো যেন এক একটা দেবদূত আর দোকানের মধ্যে ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে থাকা দোকানমালিক স্বর্গের পরম পিতা।

সে এতখানি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে জল আনতে যাবার কথাটা সে ভুলেই গিয়েছিল। সহসা এক কর্কশ কণ্ঠস্বরে চমক ভাঙল তার।

মাদাম থেনার্দিয়ের একবার হোটেল থেকে রাস্তার পানে তাকাতেই কসেত্তেকে দেখতে পেয়ে চিৎকার করে ওঠে, হতভাগী পাজি বদমাশ কোথাকার, এখনও যাসনি? ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস? দাঁড়া, যাচ্ছি, গিয়ে মজা দেখাচ্ছি।

বালতিটা হাতে নিয়ে ছুটতে লাগল কসেত্তে।

.

৫.

থেনার্দিয়েরদের হোটেলটা ছিল গাঁয়ের এক প্রান্তে চার্চের কাছাকাছি। কসেত্তেকে তাই শেলেসের দিকে বনভূমির ভেতর যে ঝরনা ছিল সেখানে যেতে হবে জল আনতে। চার্চের কাছাকাছি দোকানগুলোর আলোয় কিছুটা পথ আলোকিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কিছু পরেই সে আলো আর দেখতে পেল না। সে অন্ধকারে পড়ে গেল। সে বালতিটা দিয়ে ঝনঝন শব্দ করে তার স্নায়ুবিক ভয়টাকে কাটাবার চেষ্টা করল। যতক্ষণ পথের দু ধারে দু-একটা বাড়ি ছিল এবং সেই সব বাড়ি থেকে দু একটা বাতির আলোর ছটা বেরিয়ে আসছিল ততক্ষণ বেশ সাহসের সঙ্গে পথ চলতে লাগল কসেত্তে। পথে তখন কোনও লোকচলাচল ছিল না। একজন মহিলা এক জায়গায় তাকে বলল, মেয়েটা এ সময় যাচ্ছে কোথায়? ভূত নাকি? তার পর তাকে চিনতে পারল। কিন্তু যখন পথের ধারে আর একটা বাড়ি ও দেখা গেল না, একটা আলোর ছটাও কোথাও থেকে বেরিয়ে এল

তখন আপনা থেকেই থেমে গেল কসেত্তে’র পা দুটো। তার চলার গতি কমতে কমতে একেবারে থেমে গেল। দোকানের আলোগুলো ছেড়ে অন্ধকারে আসতে তার কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু শহরের বাড়িগুলো ছাড়িয়ে মাঠে গিয়ে পড়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে উঠল তার পক্ষে। বালতিটা নামিয়ে রেখে সে ভীতসন্ত্রস্ত ছেলেমেয়েদের মতো মাথা চুলকাতে লাগল। শহর ছাড়িয়ে সে অন্ধকারঘেরা মাঠের মধ্যে এসে পড়েছে। সেই অন্ধকারে মাঠে শুধু জীবজন্তু নয়, প্রেতাত্মাও থাকতে পারে। সে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে জীবজন্তুর ডাক শুনতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন ভূত-প্রেতগুলোর আকার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। সে আবার বালতিটা তুলে নিল। ভয়ের আঘাতে মনে মনে শক্ত হয়ে উঠল সে। সে ভাবল ঠিক আছে, আমি গিয়ে বলব ঝরনায় আর জল নেই। আমি ফিরে যাব।

এই ভেবে ফিরে যাবার জন্য গাঁয়ের দিকে পা বাড়াল। কিন্তু কিছুটা যাওয়ার পর আবার থেমে দাঁড়াল। আবার মাথা চুলকাতে লাগল। এবার সে বাড়ির গিন্নির কথা ভাবতে লাগল। সে যেন স্পষ্ট দেখতে পেল বিশালবপু সেই ভয়ঙ্কর মহিলার চোখ থেকে আগুন ঝরছে। তার চারদিকে হতাশভাবে একবার তাকাল সে। কিন্তু কী করবে? তার সামনে এক ভয়ঙ্কর মূর্তি আর তার পেছনে জমাট অন্ধকার আর বনভূমি। দুটোর মধ্যে মাদাম থেনার্দিয়ের সত্যিকারের বেশি ভয়ের বস্তু।

আবার সে ঝরনায় যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। এবার সে চোখ বন্ধ করে ঊধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল, কোনও শব্দ শুনল না। মাঝে মাঝে শুধু নিশ্বাস নেবার জন্য থামতে লাগল এবং আবার ছুটতে লাগল। অবশেষে সে বনের মধ্যে এসে পড়ল।

তার চারদিকের গাছগুলোর পাতা নড়ার সমবেত শব্দে দারুণ ভয় হচ্ছিল তার। তার চোখে জল এসে গিয়েছিল। সে যেমন ভালো করে কিছু দেখতে পারছিল না তেমনি সে কিছু ভাবতেও পারছিল না। তার মতো ছোট্ট একটি প্রাণীর ওপর চারদিক থেকে রাত্রির অনন্ত অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছিল।

বনের প্রান্ত থেকে ঝরনা কয়েক মিনিটের পথ। কসেত্তে সে পথ চেনে, কারণ দিনের বেলায় সে পথে যাওয়া-আসা করে। সুতরাং অভ্যাসবশে সে ঠিক পথেই চলতে লাগল। ভয়ে ডাইনে-বায়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে চলতে চলতে অবশেষে সে ঝরনার ধারে এসে পড়ল। সে ভাবছিল কোনও দিকে তাকালেই ভৌতিক কিছু না কিছু দেখতে পাবে।

ঝরনা মানে দু ফুট গভীর এক স্রোতোধারা, স্রোতের বেগে মাটি আর পাথরের মধ্যে পথ করে বয়ে চলেছে। তার দু পাশে শ্যাওলা আর আগাছা গজিয়ে উঠেছে। তার দু পাশের গাঁয়ে অনেক পাথরখণ্ড জমে আছে। ঝরনাটা কোনও শব্দ না করে শান্তভাবে বয়ে চলেছিল।

একবারও না থেমে অন্ধকারে কসেত্তে ছোট ওকগাছটার খোঁজ করতে লাগল। গাছটা ঝরনার ধার ঘেঁষে গজিয়ে উঠেছে। দিনের বেলায় কসেত্তে যখন বালতি করে ঝরনার উপর ঝুঁকে জল ভরে তখন হাত বাড়িয়ে ওকগাছের একটা ডাল ধরে থাকে। এবারও সে গাছটার ডাল ধরে জল ভরে বালতিটা ঘাসের উপর নামিয়ে রাখল। স্নায়ুবিক উদ্বেগের জন্য গায়ে যেন তার দ্বিগুণ শক্তি এসে গিয়েছিল। কিন্তু কোনও দিকে তার খেয়াল না থাকায় তার জামার পকেট থেকে পনেরো স্যু’র মুদ্রাটা পড়ে গেল জলের মধ্যে।

জল তোলার পর কসেত্তে দেখল সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অনেক চেষ্টা করে বালতিতে জল ভরতে গিয়ে তার হাত-পা যেন অবশ হয়ে যায়। সে এমনি ফিরে যেতে পারলে খুশি হত। কিন্তু তখন তার পথচলার শক্তি ছিল না। তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে। সে তাই ঘাসের উপর বসে পড়ল।

চোখ দুটো বন্ধ করে আবার সে চোখ খুলল, কেন তা সে জানে না। মনে হল কে যেন বাধ্য করছে তাকে চোখ খুলতে। আকাশটা ধোঁয়ার মতো কালো মেঘে ভরা ছিল। মনে হল অন্ধকার রাত্রি যেন কালো মেঘের মুখোশ পরে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

আনমনে আকাশটার পানে তাকাতে দেখল দিগন্তে একটা নক্ষত্র রয়েছে। কিন্তু সে জানত না ওটা বৃহস্পতি গ্রহ। দিগন্তে ঘন কুয়াশার মাঝে কিসের একটা লাল আভা দেখা যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কার যেন বিশাল এক রক্তাক্ত ক্ষত।

বনভূমির উপর দিয়ে ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বইছিল। গাছের কোনও পাতা নড়ছিল। কোথাও কোনও আলো দেখা যাচ্ছিল না। গ্রীষ্মকালে নৈশ বনভূমির অন্ধকারের মাঝে জোনাকির উড়ন্ত আলোর কিছু খেলা দেখা যায়। কিন্তু এখন সে আলোর কোনও খেলা দেখতে পাওয়া গেল না কোথাও। কসেত্তে’র মাথার উপর বড় বড় গাছের ডালগুলো এক অতিপ্রাকৃত ভয়াবহতায় বিরাট জন্তুর মতো হাত বাড়িয়ে যেন শিকার ধরার চেষ্টা করছে। বনভূমির লম্বা লম্বা ঘাসগুলো বাতাসে মাছের মতো কিলবিল করছিল। অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গাগুলোতে আকারহীন ঝোঁপগুলো অন্ধকারে তালগোল পাকিয়ে চাপ বেঁধে ছিল। শুকনো খড় বা তৃণখণ্ডগুলো বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তারা যেন কার ভয়ে। উড়ে পালাচ্ছে। শৈত্য আর বিষাদ যেন ব্যাপ্ত হয়েছিল চারদিকে।

অন্ধকার সব সময় চাপ সৃষ্টি করে মানুষের আত্মার ওপর। মানুষ তাই আলো চায়। দিনের আলো থেকে মানুষ বিচ্ছিন্ন হলেই তার অন্তরাত্মাটা সংকুচিত হয়ে পড়ে কেমন যেন। মানুষের চোখ যখন অন্ধকার দেখে তখন অন্তর ভয় দেখে। এইজন্য গ্রহণের সময়, নিশীথ রাত্রিতে, বজ্র-বিদ্যুতের সময় সবচেয়ে শক্তিশালী মানুষের অন্তরেও শঙ্কা জাগে। রাত্রিকালে কোনও বনভূমির উপর দিয়ে একা যেতে গিয়ে কোনও মানুষ ভয়ে না কেঁপে পারে না। শুধু ছায়া আর গাছ এই দুটো জিনিসের মধ্যেই রাত্রির রহস্যকুটিল বাস্তবতা প্রকটিত হয়ে ওঠে আমাদের সামনে। অকল্পনীয় অনেক ছায়ামূর্তি অশরীরী অথচ দৃশ্যমান অবস্থায় আমাদের হাতের কাছে এসে পড়ে যেন। ঘুমন্ত ফুলের স্বপ্নের মতো সেই সব অবয়বহীন ছায়ামূর্তিগুলো বাতাসে ভাসতে থাকে। আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে সেগুলো এসে পড়লেও আমরা ধরতে পারি না তাদের। দূরে তাকালেই মনে হয় যত সব বন্যপ্রাণী বা ভৌতিক মূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে নিশ্বাস আমরা নিই, সে নিশ্বাস এক অন্ধকার শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পেছনে তাকাতে ইচ্ছা হয়, অথচ তাকালেই ভয় হয়। শূন্যগর্ভ রাত্রির সমাধিগহ্বর সুলভ মৃত্যুশীতল নীরবতার অনন্ত অবকাশে অনেক অদৃশ্য মূর্তির উপস্থিতির আভাস পাওয়া যায়। নগ্ন বৃক্ষকাণ্ড, ঝুলন্ত শাখাপ্রশাখা, লম্বা লম্বা কম্পিত ঘাস–এই সবকিছুই ভয়াবহ হয়ে ওঠে রাত্রিকালে এবং এগুলোর সামনে আত্মরক্ষার পথ খুঁজে না পেয়ে অসহায়বোধ করি আমরা। কোনও মানুষই রাত্রিকালে বনের মধ্যে নির্ভীক, অকম্পিত ও অবিচলিত অবস্থায় যাবার মতো সাহস খুঁজে পায় না। এ ক্ষেত্রে কোনও মানুষই কোনও কাজ করতে পারে না। যেন তার গোটা আত্মাটাই অন্ধকারে মিশে গেছে, একক হয়ে গেছে। কোনও শিশুর কাছে এই সব প্রাকৃত বস্তু অতিপ্রাকৃতের রূপ ধরে অনির্বচনীয়ভাবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। রাত্রিকালে অন্ধকার বনে শিশুদের আত্মারা এক ভয়ার্ত বেদনার বৃক্ষশাখাগুলোকে ধরে যেন ঝুলতে থাকে।

কী ঘটছে, কোথায় কী আছে তা জানতে পারল না কসেত্তে। প্রকৃতিজগতের বিশালতার মধ্যে সে যেন হারিয়ে গেল। ভয়ের থেকে বেশি ভয়ঙ্কর এক চেতনা আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। সে কাঁপতে লাগল। সেই মুহূর্তে যে ভয়ে তার গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায় তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তার কেবলি মনে হতে লাগল কাল হয়তো এই সময়ে আবার তাকে আসতে হবে এখানে।

মনের এই অবস্থাটা কাটাবার জন্য সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে এক, দুই করে দশ পর্যন্ত জোরে গুনতে লাগল। এইভাবে সে তার বর্তমান বাস্তব অবস্থাটার প্রতি সচেতন হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল যে হাত দুটো জলভরা বালতিটা ধরে আছে সে হাত দুটো ঠাণ্ডায় হিম হয়ে গেছে। সে উঠে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। এবার স্বাভাবিক এক ভয়ের তাড়নায় সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন ও মাঠ পার হয়ে শহরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। বালতিটা নিয়ে যেতে কষ্ট হলেও তার মালিকপত্নীর ভয়ে সেটাকে সে ছেড়ে যেতে পারবে না। সে তাই জলভরা বালতিটা দু হাত দিয়ে তুলে নিয়ে যাবার জন্য পা বাড়াল।

কিন্তু বালতিটা এত ভারী যে সে কয়েক পা গিয়েই দাঁড়াল। হাঁটতে পারছিল না। বালতিটা নামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাঁপ ছেড়ে আবার বালতি নিয়ে যেতে লাগল। বালতির ভারে সে কুঁজো হয়ে পথ হাঁটছিল। এবার সে অনেকটা গেল। বালতির ঠাণ্ডা হাতলটা তার হাতটাকে যেন কামড় দিচ্ছিল। কিন্তু একটানা সে বেশিদূর যেতে পারছিল না। মাঝে মাঝে থামতে হচ্ছিল তাকে। আর বালতিটা নামাতে হচ্ছিল। যতবার বালতিটা নামাচ্ছিল কিছুটা করে জল পড়ে যাচ্ছিল। কোনও এক শীতের রাতে লোকচক্ষুর অন্তরালে আট বছরের একটি শীতার্ত মেয়ের জীবনে এই সব ঘটেছিল। একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া এ ঘটনার আর কোনও সাক্ষী ছিল না। আর একজন সাক্ষী হয়তো ছিল–সে হল তার মা’র আত্মা। সংসারে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা হয়তো মৃতদেরও জাগিয়ে তোলে কবর থেকে।

সে হাঁপাচ্ছিল। চাপা গলায় ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে। মাদাম থেনার্দিয়েরকে সে এতখানি ভয় করত যে তার কাছ থেকে সে তখন অনেক দূরে থাকলেও জোরে কাঁদতে পারছিল না।

কোনওখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াচ্ছিল না এবং যাওয়ায় জন্য যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করছিল। তবু তার চলার গতিটা বাড়াতে পারছিল না। সে হিসাব করে দেখল এইভাবে সে যেতে থাকলে মাদাম থেনার্দিয়ের তাকে বাড়ি গেলেই মারবে। এই দুশ্চিন্তাটা রাত্রির অন্ধকার আর নির্জনতাজনিত মনঃকষ্টকে আরও বাড়িয়ে দিল। তার সব শক্তি যেন ফুরিয়ে এসেছিল। আর সে ভারী বালতিটাকে বইতে পারছিল না। তবু সে তখনও বনটা পার হয়ে মাঠে পড়তে পারেনি। তার অতিপরিচিত একটা বাদামগাছের তলায় এসে আবার থামল সে। কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলতে শুরু করল। কিন্তু হতাশা আর দুঃসহ কষ্টের তীব্রতায় আপন মনে সে চিৎকার করে বলতে লাগল, হে ঈশ্বর, দয়া করে আমাকে সাহায্য কর।

সহসা সে দেখল কোথা হতে একটা লম্বা হাত এসে বালতিটা তুলে নিল। কসেত্তে অন্ধকারের মধ্যেই দেখতে পেল তার পাশে এক জীবন্ত মানুষের মূর্তি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা তার পিছু পিছু নিঃশব্দে পদসঞ্চারে আসছিল এতক্ষণ। সে তা দেখতে পায়নি বা তার কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। এবার সে তার পাশ থেকে কোনও কথা না বলে বালতিটা তুলে নিল।

অবস্থা যত ভয়ঙ্করই হোক, অনেক সময় একজন মানুষের প্রবৃত্তি অন্য কোনও মানুষের শুভেচ্ছার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না। কসেত্তে বয়সে ছোট হলেও অচেনা মানুষটিকে ভয় করল না তখন কিছুমাত্র।

.

৬.

১৮২৩ সালের সেই খ্রিস্টোৎসবের দিন প্যারিসের বুলভার্দ দ্য হেপিতাল নামে এক নির্জন এলাকায় কিছুক্ষণ ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল একটা লোক। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে একটা থাকার জায়গা খুঁজছে এবং ফবুর্গ সেন্ট মার্কোর প্রান্তভাগে ছোটখাটো একটা কুঁড়ে মতো ঘর চায়। পরে আমরা দেখতে পাব সে ওই অঞ্চলে একটা ঘর ভাড়া করে।

তার পোশাক-আশাক আর চেহারাটা দেখে মনে হচ্ছিল লোকটা এক সম্ভ্রান্ত ভিখারি। চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে রুচিশীল পরিচ্ছন্নতাবোধের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ছিল তার মধ্যে। অভাব আর আত্মমর্যাদাবোধের এই মিশ্রণের জন্য এই ধরনের ভিখারিদের প্রতি মানুষের দ্বিগুণ শ্রদ্ধা জাগে। তার মাথায় ছিল একটা পুরনো লম্বা টুপি, মোটা হলদে সুতোয় বোনা একটা লম্বা কোট, যার পকেটগুলো ছিল চারকোনা বর্গক্ষেত্রের মতো এবং সে কোটটার দু-এক জায়গায় ছেঁড়া ছিল। তার পায়ে ছিল কালো পশমের মোেজা আর বিশ্রী ধরনের এক জুতো। বহিরাগত বাস্তুত্যাগী এই লোকটি হয়তো একদিন এক স্কুলমাস্টার ছিল এবং ভালো বংশের লোক। তার মাথার সাদা চুল, রেখাঙ্কিত কপাল, ম্লান বিস্ফারিত ঠোঁট, বার্ধক্যপীড়িত অবসন্ন মুখমণ্ডল থেকে বোঝা যায় তার বয়স ষাটের উপর। কিন্তু তার ধীর অথচ দৃঢ় পদক্ষেপ এবং চলার ভঙ্গিমা দেখে মনে হয় তার বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে না। তার কপালের রেখাগুলোকে কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখলে লোকটাকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা হবে। তার উপরকার ঠোঁটটার মধ্যে এমন একটা অদ্ভুত ভাঁজ ছিল যা দেখে মনে হবে সে একই সঙ্গে কঠোর এবং নম্র প্রকৃতির। তার দৃষ্টির মধ্যে ছিল এক শান্ত বিষাদ। তার বাঁ হাতে ছিল কাপড়ে-বাঁধা একটা পুঁটলি আর ডান হাতে ছিল গাছের ডাল কেটে বানানো একটা লাঠি। লাঠিটার গাঁটগুলো ঘষে-মেজে পালিশ করা হয়েছে। তার মাথায় লাল মোম দিয়ে তৈরি গোলমতো একটা হাতল করা হয়েছিল। লাঠিটাতে ভয়ের কিছু নেই, সেটাকে বেড়াবার ছড়িও বলা যেতে পারে।

বিশেষ করে শীতকালে ওই এলাকার পথ দিয়ে বেশি লোক চলাচল করে না। লোকটিও মানুষদের এড়িয়ে যেতে চাইছিল যদিও তার এই মনোভাবটা সে প্রকাশ করতে চাইছিল না।

সেকালে রাজা অষ্টাদশ লুই রোজ ওই পথ দিয়ে গাড়িতে করে একবার করে বেড়াতে যেতেন। ও অঞ্চলটা তার প্রিয় জায়গা ছিল। রোজ বেলা ঠিক দুটোর সময় বুলভার্দ দ্য হোপিতাল এলাকার পথে রাজার গাড়িটাকে তাঁর অনুচরবৃন্দসহ দেখা যেত। গাড়িটা নিয়মিত ঠিক বাধা সময়ের মধ্যে যেত বলে স্থানীয় লোকেরা গাড়িটা দেখেই বলে দিত দুটো বাজে; রাজা তুলিয়েরে ফিরে যাচ্ছেন।

অনেকে রাজাকে দেখার জন্য রাস্তার ধারে ছুটে যেত। অনেকে আবার রাস্তার ধারে সারবন্দিভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। মোট কথা, রাজার যাওয়া-আসায় স্থানীয় জনগণ বেশ আগ্রহ দেখাত। রাজা দুর্বল এবং নিজে হাঁটতে পারতেন না বলে গাড়িটাকে জোরে চালাতে বলতেন। হাঁটতে পারতেন না বলেই হয়তো ছুটতে চাইতেন। এ যেন চলৎশক্তিহীন পঙ্গুর বিদ্যুৎগতিতে চলার শখ। আকস্মিক কোনও গোলমালের সম্মুখীন হবার জন্য রাজার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে অনুচর ও প্রহরীরা উন্মুক্ত তরবারি হাতে নিয়ে থাকত। বিরাট গাড়িটার দ্রুতগতি চাকাগুলো পাথরে উপর ঘর্ষণ করতে করতে ছুটে যেত। এত জোরে যেত যে রাজার মুখটা শুধু একবার কোনওরকমে দেখা যেত। গাড়িটার ডান দিকের কোণে সাদা শাটিনের আসনের উপর বসে থাকা রাজার বড় গম্ভীর মুখখানা শুধু দেখা যেত। তাঁর চোখের দৃষ্টিটা ছিল গর্বিত ও তীক্ষ্ণ। তার বুর্জোয়া ফ্ৰককোটের উপর দুটো বড় পালক ছিল আর ছিল সোনালি পরশ। সেন্ট লুই-এর ক্রস, লিজিয়ন দ্য অনার হলি স্পিরিটের রুপোর মেডেল, এবং তার মোটা পেটটার উপর নীলরঙের একট চওড়া স্কার্ফ জড়ানো ছিল। প্যারিস শহরের বাইরে গেলেই তিনি তার সাদা পালকওয়ালা টুপিটা মাথা থেকে খুলে হাঁটুর উপর রেখে দিতেন। আবার শহরে ঢোকার সময় সেটা মাথায় পরতেন। এক হিমশীতল ঔদাসীন্যের সঙ্গে জনগণের পানে তাকাতেন তিনি এবং জনগণও অনুরূপ ঔদাসীন্য দেখিয়ে তার প্রতিদান দিত। একদিন সেন্ট মার্কো দিয়ে রাজা যখন গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন তখন দর্শকদের মধ্যে একজন মন্তব্য করে, তা হলে ওই মোটা লোকটাই হচ্ছে দেশের সরকার।

এ অঞ্চলের লোকদের কাছে রাজার এই সমালোচনার ব্যাপারটা এক সহজ সাধারণ দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু হলুদ কোটপরা লোকটি এ অঞ্চলের বাসিন্দা নয় বলে সে এ সবের কিছুই জানত না। যখন বেলা দুটোর সময় সালপেত্রিয়ের ঘুরে বুলভার্দ অঞ্চলে এসে পড়ল রাজার গাড়িটা তখন জমকালো পোশাকপরা রাজার প্রহরীদের দেখে লোকটি চমকে উঠল এবং কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়ল। ফুটপাথের উপর তখন সে ছাড়া আর কেউ ছিল না। সে তাড়াতাড়ি একটা বাড়ির দরজার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিল। কিন্তু রাজার গাড়ির মধ্যে থেকে প্রহরীদের প্রধান তাকে দেখে ফেলল এবং বলল, ওই কুৎসিত ভবঘুরেটা কে দেখ তো। সে কর্তব্যরত একজন পুলিশ অফিসারকে তার অনুসরণ করতে বলল। কিন্তু ভবঘুরে লোকটি পাশের একটা গলির মধ্যে ঢুকে পড়ায় পুলিশ অফিসার দেখতে পেল না তাকে। তখন গোধূলির ছায়া ঘন হয়ে উঠছিল।

ভবঘুরে লোকটি পেছন ফিরে যখন দেখল তাকে আর কেউ অনুসরণ করছে না তখন সে আবার তার চলার পথে ফিরে এল। তখন ফ্রাঁসোয়া চারটে বাজে এবং তখনি প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছিল। পোর্তে সেন্ট থিয়েটারে একটা নাটক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। থিয়েটারের বাইরে আলোকিত বিজ্ঞাপন দেখে সে একবার থমকে দাঁড়াল। তার পর একটা গলিপথ ধরে একটা হোটেলে চলে গেল। সেখান থেকে সাড়ে চারটের সময় একটা গাড়ি ছাড়বে। যাত্রীরা তখন গাড়িতে উঠছিল।

ভবঘুরে গারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল, একটা আসন খালি আছে?

গারোয়ান বলল, আমার পাশেই একটা আসন আছে।

আমি ওটা নেব।

তা হলে উঠে পড়।

কিন্তু ভবঘুরের পোশাক-আশাক দেখে সে ভাড়াটা আগেই চাইল। সে বলল, তুমি কি সোজা ল্যাগনে যাবে।

ভবঘুরে বলল, হ্যাঁ।

এই বলে সে পুরো ভাড়াটা মিটিয়ে দিল।

অবশেষে গাড়িটা ছেড়ে দিল। গারোয়ান ভবঘুরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভবঘুরে হা’, ‘না’, ছাড়া আর কিছুই বলছিল না। গারোয়ান ঘোড়া চালানোর কাজে মন দিল।

গাড়িটার স্তনে এবং নেলি সুর মার্নের মধ্য দিয়ে সন্ধে ছ’টার সময় শেলেসে পৌঁছল। এইখানে গাড়ি থামিয়ে ঘোড়াগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হল। একটা হোটেলের সামনে গাড়িটা দাঁড়াল।

ভবঘুরে বলল, আমি এইখানে নেমে যাব।

এই বলে সে তার পুঁটলি আর লাঠিটা হাতে করে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে হোটেলে উঠল না।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করার পর গাড়িটা আবার চলতে লাগল। কিন্তু ভবঘুরে আর এল না। তাকে বড় রাস্তার কোথাও দেখা গেল না। গারোয়ান গাড়ির যাত্রীদের বলল, লোকটাকে আমি চিনি না। ও এ অঞ্চলের লোক নয়। লোকটাকে দেখে মনে হয় একটা পয়সাও নেই, কিন্তু ওর কাছে টাকা আছে এবং ভাড়াটা আগেই দিয়ে দিল এককথায়। ল্যাগনের ভাড়া দেয়, কিন্তু শেলেসেই নেমে পড়ে। অন্ধকার রাত, সব বাড়ির দরজা বন্ধ, অথচ ও হোটেলেও ওঠেনি। লোকটা কোথায় গেল কে জানে?

লোকটা একটা অন্ধকার রাস্তা দিয়ে শহরের চার্চের কাছে গিয়ে মঁতফারমেলে যাবার জন্য একটা পথ ধরল। মনে হল সে এখানকার পথঘাট চেনে। সে খুব দ্রুত পথ হাঁটছিল। কার পায়ের শব্দ শুনে সে পেছন ফিরে তাকাল। খালের মধ্যে বসে পড়ল। তার পর পায়ের শব্দটা মিলিয়ে গেলে সে আবার বেরিয়ে এল। তার ভয়ের অবশ্য কিছু ছিল না, কারণ ডিসেম্বরের শীতের রাতের মেঘ আর আকাশ মাথায় করে কোনও লোক পথে বার হয় না কখনও। এইখান থেকেই পাহাড়ের ঢালটা শুরু। কিন্তু ভবঘুরে পথিক মঁতফারমেলের পথে না গিয়ে মাঠ পার হয়ে বনের মধ্যে গিয়ে ঢুকল।

বনের মধ্যে গিয়ে সে তার চলার গতিটা কমিয়ে দিল। মনে হল গাছপালার মধ্য দিয়ে সে একটা চেনা পথ খুঁজছে। এবার মনে হল সে যেন পথটা হারিয়ে ফেলেছে। অবশেষে কিছুটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর সে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ল। সেখানে কতকগুলি সাদা পাথর জড়ো করা ছিল। সেখানে অন্ধকারে সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ধরে কী ভাবল। কয়েক হাত দূরে একটা বড় গাছ ছিল। গাছটা লতায় জড়ানো ছিল। সে ঝুঁকে পড়ে সেই লতার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে কী গুনতে লাগল। কাছেই একটা বাদামগাছ ছিল। সেই বাদামগাছ আর পাথরখণ্ডগুলোর মাঝখানের মাটিটা সম্প্রতি খোঁড়া হয়েছে কি না, তা দেখতে লাগল। তার পর সে বনের মধ্যে চলে গেল।

এই লোকটির সঙ্গে বনের প্রান্তে দেখা হয়ে যায় কসেত্তে’র।

বনের মধ্যে দিয়ে মঁতফারমেলের পথে যেতে যেতে সে দেখে তার সামনে অদূরে একটি ছায়ামূর্তি একটা ভারী বোঝার সঙ্গে যেন লড়াই করছে। বোঝাটা বইতে তার কষ্ট হচ্ছিল বলে সে বারবার নামাচ্ছিল সেটা। কাছে গিয়ে সে দেখল ছায়ামূর্তি একটি ছোট মেয়ে। তার হাতে একটা বড় জলভরা বালতি ছিল। লোকটি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নীরবে সেই বালতিটা নিজের হাতে তুলে নিল।

.

৭.

কসেত্তে কোনও ভয় পেল না।

লোকটি চাপা অথচ গম্ভীর গলায় বলল, শোন মেয়ে, এত ভারী জিনিসটা বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তোমার পক্ষে।

কসেত্তে বলল, হ্যাঁ, মঁসিয়ে।

আমাকে দাও, আমি নিয়ে যাচ্ছি।

কসেত্তে তাই করল, তারা দু জনে পাশাপাশি পথ চলতে লাগল।

লোকটি বলল, সত্যিই এটা খুবই ভারী। তোমার বয়স কত?

আমার বয়স আট মঁসিয়ে।

কতদূর থেকে এটা বয়ে নিয়ে আসছ?

ঝরনা থেকে এখন পর্যন্ত।

কত দূর যেতে হবে তোমাকে?

এখান থেকে পনেরো মিনিটের পথ।

লোকটি কিছুক্ষণ কী ভাবার পর বলল, তোমার মা নেই?

কসেত্তে বলল, আমি জানি না। অন্য সব ছেলেমেয়ের মা আছে, আমার মা নেই। হয়তো কখনও ছিল না।

লোকটি হঠাৎ থেমে গেল। বালতিটা নামিয়ে রেখে সে কসেত্তে’র কাঁধের উপর হাত রেখে তার চেহারাটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করল। তার শীর্ণ ম্লান মুখখানার কিছুটা দেখতে পেল।

অবশেষে সে বলল, তোমার নাম কী?

কসেত্তে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ঙ্করভাবে চমকে উঠল লোকটি। কিছুক্ষণ কসেত্তে’র মুখপানে তাকিয়ে রইল। তার পর তার কাঁধ থেকে হাত দুটো সরিয়ে নিয়ে বালতিটা তুলে নিয়ে পথ হাঁটতে লাগল আবার।

যেতে যেতে সে বলল, কোথায় থাক তুমি?

মঁতফারমেলে। তুমি জায়গাটা চেন কি?

আমরা কি সেখানেই যাচ্ছি?

হ্যাঁ মঁসিয়ে।

কিছুক্ষণ দু জনেই চুপ করে রইল। পরে লোকটি বলল, কিন্তু এত রাতে কে তোমাকে জল আনতে পাঠিয়েছে?

মাদাম থেনার্দিয়ের।

কাঁপা কাঁপা গলায় লোকটি বলল, সে কী করে?

সে আমার মালিকপত্নী। সে একটা হোটেল চালায়।

হোটেল? আমি তো আজ রাতে সেখানেই থাকব। আমাকে পথটা দেখিয়ে দেবে? কসেত্তে বলল, আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি।

লোকটি বালতিটা নিয়ে বেশ তাড়াতাড়ি পথ হাঁটছিল। কিন্তু হাতে বোঝা না থাকায় কসেত্তে তার সঙ্গে সমানে হেঁটে চলেছিল। তার আর ক্লান্তিবোধ হচ্ছিল না। মাঝে মাঝে এক আশ্চর্য বিশ্বাস আর আশ্বাসের সঙ্গে লোকটির মুখপানে তাকাচ্ছিল। কেউ তাকে কখনও ঈশ্বরের কথা বলেনি, তাকে কখনও প্রার্থনা করতে শেখায়নি। কিন্তু সেই মুহূর্তে এক অদ্ভুত আশা আর সুখের অনুভূতি তাকে ঈশ্বরের কথা ভাবিয়ে তুলঁল।

মিনিটকতক পরে লোকটি বলল, মাদাম থেনার্দিয়েরের কোনও চাকর নেই?

না মঁসিয়ে।

তুমি তা হলে একাই সব কাজ করো?

হ্যাঁ। তবে তার দুটো মেয়ে আছে।

কী নাম তাদের? কত বড়?

তাদের নাম এপোনিনে আর অ্যাজেলমা। তারা দু জনেই ছোট।

তারা কী করে?

তাদের অনেক পুতুল আর পয়সা রাখার বাক্স আছে। তারা অনেক কিছু কিনতে পারে এবং ইচ্ছামতো খেলা করতে পারে।

সারাদিন?

হ্যাঁ।

আর তুমি কী করো?

আমি কাজ করি।

সারাদিন?

হ্যাঁ, সারাদিন।

জলভরা চোখ তুলে কসেত্তে তাকাল লোকটির পানে। কিন্তু অন্ধকারে সে জল দেখা গেল না।

কসেত্তে আবার বলল, হ্যাঁ, মঁসিয়ে। তবে সব কাজ শেষ করে তারা বললে অল্প কিছুক্ষণ আমি খেলা করি।

কী খেলা করো তুমি?

যা হোক কিছু। আমার কোনও খেলনা নেই। এপোনিনে আর অ্যাজেলমা তাদের পুতুল নিয়ে আমার সঙ্গে খেলে না। আমি একাই খেলি। আমার একটা ছোট ভোঁতা ছুরি আছে।

কিন্তু সেটা দিয়ে কিছু কাটা যায় না।

হ্যাঁ যায়। লেটুসপাতা আর মাছিদের মাথা।

এবার ওরা গাঁয়ের মধ্যে এসে পড়ল। কসেত্তে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটি চুপ করে ছিল। কিন্তু চার্চের কাছে আলো ঝলমল সারবন্দি দোকানগুলো দেখে বলল, এখানে কি কোনও খেলা হচ্ছে?

না, খ্রিস্টের জন্মদিনের জন্য উৎসব চলছে।

হোটেলের কাছটায় এসে কসেত্তে লোকটির গাঁয়ে হাত দিয়ে বলল, দয়া করে শোন মঁসিয়ে।

লোকটি বলল, আমরা তো এসে গেছি।

হ্যাঁ। এবার বালতিটা দয়া করে দাও আমার হাতে।

কিন্তু কেন?

কেউ বালতিটা বয়ে এনেছে দেখলে ওরা আমাকে মারবে।

লোকটি বালতিটা কসেত্তে’র হাতে দিয়ে দিল। এরপর ওরা দু জনেই হোটেলের মধ্যে ঢুকল।

.

৮.

হোটেলের দরজার সামনে আসার সময় রাস্তার ওপারে সেই দোকানটায় সাজানো বড় পুতুলটাকে একবার দেখতে ভোলেনি কসেত্তে। কিন্তু তার পনেরো স্যু’র কথাটা ভুলে গিয়েছিল। সেটা কখন পড়ে গেছে সে বিষয়ে কোনও খেয়াল নেই তার। রুটির দোকান থেকে পাউরুটি কেনাও হয়নি।

দরজার কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল। মাদাম থেনার্দিয়ের একটা বাতি হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। কসেত্তেকে দেখেই সে বলল, তা হলে এতক্ষণে তুমি এলে অপদার্থ কোথাকার? কোথায় ছিলে এতক্ষণ?

ভয়ে কাঁপছিল কসেত্তে। সে বলল, মাদাম, এই ভদ্রলোক থাকবে এখানে। একটা ঘর চায়।

হোটেলমালিকদের মতো স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মাদাম থেনার্দিয়ের অতিথির পানে তাকিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। সে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল অতিথিকে। পরে বলল, এই ভদ্রলোক?

লোকটি তার মাথার টুপিতে একটা হাত রেখে বলল, হ্যাঁ মাদাম।

সঙ্গতিসম্পন্ন পথিকরা সাধারণত এত ভদ্র ও মোলায়েম হয় না। লোকটি ভাবভঙ্গি আর পোশাক-আশাক ও পুঁটলি দেখার সঙ্গে সঙ্গে মাদাম থেনার্দিয়েরের মুখ থেকে সব হাসি মিলিয়ে গেল। সে নীরসভাবে পথিককে বলল, ভেতরে আসুন।

লোকটি ভেতরে গেলে মাদাম থেনার্দিয়ের আবার তাকে খুঁটিয়ে দেখল। তার কোট, টুপি, তার পুঁটলি প্রভৃতি দেখে সে তার স্বামীর পানে তাকাল। তাকে খরিদ্দার হিসেবে নেওয়া যাবে কি না, তার জন্য জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে তাকাল। থেনার্দিয়ের তখন হোটেলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছিল, সে-ও নবাগত পথিককে ভালো করে দেখে ঠোঁট কামড়ে বলল, না, নেওয়া চলবে না।

মাদাম থেনার্দিয়ের তখন বলল, আমি দুঃখিত। হোটেলের সব ঘর ভর্তি।

লোকটি বলল, যেখানে তোক আমাকে একটু থাকতে জায়গা দিতে পারেন? আমি তার জন্য একটা ঘরের যা ভাড়া তা দেব।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, একটা ঘরের ভাড়া চল্লিশ স্যু।

ঠিক আছে, চল্লিশ সু-ই দেব।

মাদাম থেনার্দিয়ের তখন বলল, আচ্ছা, দেখি কী করতে পারি।

একজন খরিদ্দার বলল, একটা ঘরের ভাড়া তো কুড়ি স্যু।

মাদাম থেনার্দিয়ের চাপা গলায় বলল, ওই ধরনের লোকের জন্য চল্লিশ।

থেনার্দিয়ের বলল, হ্যাঁ ঠিক তাই। বাজে লোক রেখে হোটেলের কোনও লাভ হয় না।

লোকটি ততক্ষণে একটা বেঞ্চের উপর তার পুঁটলি আর লাঠিটা রেখে টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসল।

কসেত্তে তাড়াতাড়ি এক বোতল মদ আর একটা গ্লাস এনে তার সামনে রাখল। হোটলের যে খরিদ্দার তার ঘোড়ার জন্য জল চেয়েছিল সে তার ঘোড়ার কাছে গেল। কসেত্তে সেই টেবিলের তলায় গিয়ে উল বুনতে লাগল। লোকটি মদপান করার পর আগ্রহ সহকারে কসেত্তে কী করে না-করে দেখতে লাগল।

কসেত্তে খুব সাদাসিধে পোশাক পরে সব সময় বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকে। সে যদি সুখে-শান্তিতে থাকত তা হলে তাকে সুন্দরী দেখাত। তার চেহারাটা এত রোগা এবং ম্লান যে তার বয়স আট হলেও ছ’-এর বেশি মনে হয় না। তার বড় বড় চোখ দুটো ক্রমাগত জল ফেলে ফেলে সব উজ্জ্বলতা হারিয়ে কালো হয়ে গেছে। ক্রমাগত দুঃখকষ্ট ভোগ করে করে তার ঠোঁট দুটো কোনও দুরারোগ্য রোগে ভুগতে থাকা মানুষের মতো শুকনো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারা রোগা-রোগা হাত দুটোতে কালি পড়ে গেছে। সে সব সময় শীতে কাঁপতে থাকা হাঁটু দুটো জড়ো করে থাকত। আর পোশাক বলতে কতকগুলি সুতির ছেঁড়া জামা ছিল, তাতে কোনও পশম ছিল না। তার ছেঁড়া জামার ফাঁকে ফাঁকে তার গায়ের কিছু কিছু অংশ দেখা যায় এবং কিছু ক্ষতচিহ্নও দেখা যায়। তার পাগুলো খসখসে আর নীল। তাতে কোনও মোজা বা জুতো নেই। তার ঘাড়ের কাছটা কাঁপা কাঁপা ভাব, তার সদাসংকুচিত চেহারা, তার কুণ্ঠিত কথাবার্তা, তার নীরবতা ও তার প্রতিটি গতিভঙ্গিতে একটা ভয়ের আবেগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এক দারুণ ভয় কসেত্তে’র দেহমন দুটোকেই যেন গ্রাস করেছিল। সে যেন ভালো করে হাঁপ ছাড়তে পারত না, ভালো করে নিশ্বাস নিতে পারত না। তার চোখের কোণে কোণে ভয়ের ছায়া মূর্ত হয়ে উঠেছিল। তার মুখখানা দেখে তাকে বোকা-বোকা দেখাত। তাকে কেউ কখনও প্রার্থনা করতে শেখায়নি। সে কখনও কোনও চার্চে দেয়নি। চার্চে যাবার কথা বললে মাদাম থেনার্দিয়ের বলত, সময় কোথায়?

হলুদ কোট পরা নবাগত লোকটি কসেত্তেকে খুঁটিয়ে দেখছিল। এমন সময় মাদাম থেনার্দিয়ের চেঁচিয়ে বলল, এতক্ষণে মনে পড়েছে, পাউরুটি কোথায়?

গিন্নির গলার আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যথারীতি টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে এল কসেত্তে। সে পাউরুটির কথাটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু শাস্তির ভয়ে সব ছেলেমেয়েই যেমন মিথ্যা কথা বলে তেমনি কসেত্তেও মিথ্যা কথা বলল। সে বলল, রুটির দোকান বন্ধ ছিল মাদাম।

কসেত্তে বলল, আমি তাকে ডেকেছিলাম। কিন্তু দোকান খুলল না।

ঠিক আছে, কাল আমি দেখব তাকে জিজ্ঞাসা করে তোমার কথা সত্যি কি না। সত্যি হলে মজা দেখবে। যাই হোক, পনেরো স্যু’র মুদ্রাটা আমাকে দাও।

কসেত্তে তার জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখল মুদ্রাটা নেই। পয়সাটা কোথায় গেল সে বিষয়ে তার কোনও খেয়াল ছিল না। সে কোনও কথা না বলে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মাদাম থেনার্দিয়ের আবার বলল, কী, কথা কানে যাচ্ছে না? আমি দাঁড়িয়ে আছি।

কসেত্তে আবার একবার তার পকেট হাতড়াল। কিন্তু সেটা পেল না।

মাদাম থেনার্দিয়ের এবার গর্জন করে উঠল, তুই-ই হারিয়েছিস অথবা চুরি করেছিস।

এই বলে দেয়ালে ঝোলানো বেতটা নেবার জন্য এগিয়ে গেল সে।

কসেত্তে তা দেখে ক্ষমা প্রার্থনা করল। বলল, দয়া করুন মাদাম। দয়া করুন।

যখন এই সব চলছিল তখন হলুদ কোটধারী লোকটি তার পকেট হাতড়ে দেখছিল, আনমনে কী দেখতে লাগল। হোটেলের অন্য বাসিন্দারা মদ খেয়ে তাস খেলছিল আবার কেউ কেউ গল্পগুজব করছিল। তারা এ সব কিছু দেখছিল না।

কসেত্তে ঘরের কোণে লুকোবার চেষ্টা করছে। পকেটের ভেতর হাত দুটো ঢুকিয়ে তা বাঁচাবার চেষ্টা করছিল। বেতটা হাতে নিয়ে মাদাম থেনার্দিয়ের হাত তুলঁল কসেত্তেকে মারার জন্য।

নবাগত লোকটি বলল, মাপ করবেন মাদাম, কিছুক্ষণ আগে আমি দেখলাম ঘরের মেঝের উপর একটা মুদ্রা গড়িয়ে পড়ল। মনে হয় মেয়েটির পকেট থেকেই এটা পড়েছে। দেখি, সেটা খুঁজে দিচ্ছি।

এই বলে সে নত হয়ে খোঁজার ভান করে একটা মুদ্রা মাদাম থেনার্দিয়েরের হাতে দিল।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, হ্যাঁ, এইটাই।

অথচ আসলে সেটা নয়, কারণ সেটা কুড়ি স্যু’র মুদ্রা। হারানো মুদ্রাটা ছিল পনেরো স্যু’র। মুদ্রাটা পকেটে ভরে রেখে মাদাম থেনার্দিয়ের কসেত্তে’র পানে একবার তাকিয়ে বলল, আর যেন কখনও এমন না হয়।

কসেত্তে তার বড় বড় চোখ দুটো তুলে অচেনা লোকটির পানে তাকাল। তার সে চোখের দৃষ্টিতে এক সরল নির্দোষ বিস্ময়ের সঙ্গে এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের একটা ভাব ছিল।

মাদাম থেনার্দিয়ের এবার নবাগতকে বলল, আপনাকে কি রাতের খাবার দেওয়া হবে? লোকটি চিন্তায় মগ্ন হয়ে ছিল বলে কথাটার উত্তর দিল না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগল মাদাম থেনার্দিয়ের, কে এই শয়তান লোকটা? রাতের খাবার কেনার মতোও কি পয়সা নেই? ও এত গরিব? সে কি ঘরভাড়া দিতে পারবে? তবু ভালো যে পয়সাটা ঘরের মেঝের উপর দেখতে পেয়েও চুরি করেনি।

এমন সময় ঘরের দরজা খুলে এপোনিনে আর অ্যাজেলমা এসে ঘরে ঢুকল।

মেয়ে দুটি দেখতে বেশ সুন্দর। তাদের মধ্যে শহুরে ভাবটাই বেশি। একজনের চুল বাদামি আর চকচকে, আর একজনের চুলগুলো কালো আর পিঠের উপর। ছড়ানো। দু জনকেই বেশ গোলগাল আর প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল। তারা দু জনেই বেশ গরম আর ঝকঝকে পরিষ্কার পোশাক পরেছিল। তাদের চোখের চাউনি, মুখের ভাব, তাদের চঞ্চলতা, গোলমাল সবকিছুর মধ্যে এক সবুজ আনন্দ ঝরে পড়ছিল। তাদের দেখে তাদের মা এক কপট তিরস্কার আর প্রভূত আদরের সুরে বলল, এবার তা হলে এলে!

মাদাম থেনার্দিয়ের তার মেয়েদের কোলের উপর বসিয়ে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, বলল, কী নোংরা তোরা!

মেয়েরা মা’র কোল থেকে নেমে ছুটে ঘরের কোণে গিয়ে একটা পুতুল নিয়ে খেলা করতে লাগল। পুতুলটাতে তাদের দু জনেরই সমান ভাগ ছিল। টেবিলের তলা থেকে কসেত্তেও পুতুলটার পানে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এপোনিনে আর অ্যাজেলমা কসেত্তে’র পানে কোনও নজর দিল না। তার প্রতি তাদের কোনও আগ্রহ নেই। তাদের কাছে ও একটা কুকুর ছাড়া আর কিছুই নয়। একদিকে কসেত্তে আর একদিকে এপোনিনে ও অ্যাজেলমা এই তিনটি মেয়ে মানবসমাজের দুটি দিকের যেন মূর্ত প্রতীক, সমাজের নিদারুণ নিষ্করণ অবহেলা, অবজ্ঞা আর ঔদাসীন্য যেন স্তূপীকৃত হয়ে উঠেছে কসেত্তের ওপর। দুই বোনে যে পুতুলটি নিয়ে খেলা করছিল সেটি পুরনো। তবু কসেত্তে’র কাছে সেটা এক আশ্চর্যের বস্তু, কারণ তার নিজের কোনও পুতুল ছিল না।

হঠাৎ কসেত্তে’র ওপর মাদাম থেনার্দিয়েরের চোখ পড়ল। সে দেখল কসেত্তে চুপচাপ বসে তার মেয়েদের খেলা দেখছে। সে বলে উঠল, তোমার কাজে মন দাও। তোমাকে বেত না মারলে কি তুমি কাজ করবে না?

চেয়ার ছেড়ে না উঠেই নবাগত বলল, ওর ওপর খুব বেশি কঠোর হবেন না মাদাম। কিছুক্ষণের জন্য ওকে খেলতে দিন।

হোটেলের যেসব সংগতিপসম্পন্ন বাসিন্দারা মাংসের প্লেট আর বোতলের পর বোতল মদ খেয়ে যায় তাদের মধ্যে কেউ একথা বললে মাদাম থেনার্দিয়ের তা শুনত। নিঃস্ব গরিবদের মতো এই ধরনের কোট আর টুপিপরা একটা লোকের মুখ থেকে বলা এ কথাটা সহ্য করতে পারল না সে।

মাদাম থেনার্দিয়ের তার কড়াভাবে প্রত্যুত্তর করল, মেয়েটি খায়। খায় যখন, তখন তাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। তাকে তো বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারি না।

শান্ত কণ্ঠে নবাগত আবার প্রশ্ন করল, আসলে কী সে বুনছে?

তার গলার স্বর এবং কথা বলার ভঙ্গিমাটা তার ভিক্ষুকসুলভ বেশভূষার সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, মোজা। আমার মেয়েদের জন্য মোজা বুনছে ও। তাদের মোজা নেই। শিগগির এটা তৈরি না হলে ওদের খালি পায়ে চলতে হবে।

নবাগত কসেত্তে’র অনাবৃত লাল পা দুটোর পানে তাকাল। সে বলল, মোজা বোনার কাজ শেষ হতে কতদিন লাগবে?

মেয়েটা কুঁড়ে বলে তিন-চার দিন লাগবে।

মোজাগুলো বোনা শেষ হলে তার দাম কত হবে?

মাদাম থেনার্দিয়ের লোকটির পানে বিরক্তির সঙ্গে তাকিয়ে বলল, অন্তত তিরিশ স্যু।

পাঁচ ফ্রাঁ নিয়ে মোজাগুলো আমায় বিক্রি করবেন?

হোটেলের এক বাসিন্দা কথাটা শুনে লাফিয়ে উঠল। আশ্চর্য হয়ে বলল, পাঁচ ফ্রা! একজোড়া মোজার দাম পাঁচ ফ্রাঁ!

থেনার্দিয়ের নিজেও এবার এদিকে নজর দিল। সে বলল, মঁসিয়ে হয়তো ঠাট্টা করে বললেন পাঁচ ফ্রাঁ দিয়ে মোজাগুলো কিনবেন।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, তা হলে নগদ টাকা দিন।

নবাগত তার পকেট থেকে পাঁচ ফ্ৰাঁ বার করে টেবিলের উপর রেখে বলল, আমি ওগুলো কিনবই। এই নিন টাকা।

এবার সে কসেত্তে’র পানে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন আমার কাজ করছ মেয়ে। আমি বলছি এখন তুমি যাও, খেলগে এবং বিশ্রাম নাওগে।

হোটেলের সেই বাসিন্দা ব্যাপারটা দেখে এতদূর আশ্চর্য হয়ে পড়েছিল যে উঠে এসে পাঁচ ফ্রা’র মুদ্রাটা আসল কি না নেড়ে-চেড়ে দেখতে লাগল। পরে বলল, হ্যাঁ, এটা আসল। এরপর থেনার্দিয়ের উঠে এসে মুদ্রাটা পকেটে ভরে নিল। মাদাম থেনার্দিয়ের হতবাক হয়ে ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে দাঁড়িয়ে রইল। কসেতে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, মাদাম, আমি তা হলে খেলা করতে যেতে পারি?

মাদাম থেনার্দিয়ের গর্জন করে উঠল, হ্যাঁ, ঈশ্বরের নামে বলছি, খেলা করতে পার।

কসেত্তে বলল, ধন্যবাদ মাদাম।

কিন্তু আসলে সে ধন্যবাদ দিতে চাইছিল সেই নবাগত লোকটিকে যার দয়ার অন্ত নেই। তার সমস্ত অন্তর তার প্রতি কৃতজ্ঞতার আবেগে ফেটে পড়ছিল।

থেনার্দিয়ের তার চেয়ারে গিয়ে বসল। মাদাম থেনার্দিয়ের তার কানে কানে বলল, লোকটা কে?

থেনার্দিয়ের জোর গলায় বলল, আমি অনেক লক্ষপতিকে চিনি যারা ওই ধরনের ছেঁড়া কোট পরে থাকে।

কসেত্তে উলোনার কাজটা বন্ধ করলেও সেই জায়গাটা ছাড়েনি। তার কাছে যে একটা বাক্স ছিল সেটা খুলে কিছু টুকরো কাপড় আর সিসের ছোট্ট ছুরিটা বার করল।

এপোনিনে আর অ্যাজেলমা তখন তাদের খেলা নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিল যে তারা ঘরের মধ্যে কী হচ্ছিল তা মোটেই দেখেনি। বড় বোন এপোনিনে তখন পুতুলটাকে পোশাক পরিয়ে সাজাচ্ছিল এবং তার বোনকে কী সব বোঝাচ্ছিল। শিশুদের কণ্ঠস্বর ও ভাষার মধ্যে প্রজাপতির রঙিন পাখনার সৌন্দর্যের মতো এমন এক পলায়মান সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য থাকে যা আমাদের মুগ্ধ করে, কিন্তু তাকে আমরা ধরতে পারি না।

এপোনিনে বলছিল, এটা অন্য সব পুতুলের মতো নয়, কারণ এটা হাঁটতে পারে এবং তখন কাঁচ ক্যাচ শব্দ হয়। ওটাকে আমি সাজাচ্ছি। এর একটা মোচ আর একটা লেজ করে দেব। তুই তখন তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বলবি, হা ভগবান! আমি তখন বলব, এটা আমার মেয়ে মাদাম এবং এইভাবেই এর জন্ম হয়। আজকালকার সব মেয়েই এই রকম।

অ্যাজেলমা বিস্ময়ে অবাক হয়ে শুনছিল।

এতক্ষণ ধরে যারা মদ খাচ্ছিল তারা এবার গান গাইতে শুরু করল।

থেনার্দিয়ের চিৎকার ও হাততালি দিয়ে তাদের উৎসাহ দিতে লাগল।

পাখিরা খড়কুটো বা কোনও জিনিস পেলেই যেমন বাসা তৈরি করতে শুরু করে তেমনি শিশুরা পুতুল হাতে পেলেই নানাভাবে খেলা করতে থাকে। এপোনিনে আর অ্যাজেলমা যখন তাদের পুতুলটাকে সাজাতে লাগল কসেত্তে তখন তার সেই সিসের ছুরিটাকে সাজাতে লাগল। তার পর শুইয়ে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে লাগল।

শিশু-মেয়েদের কাছে পুতুল যেন অত্যাবশ্যক একটা বস্তু। এ বস্তুর প্রতি তাদের যেন একটা সহজাত আসক্তি আছে। পুতুলের প্রতি তাদের স্নেহ ও ভালোবাসার শেষ নেই। তাকে সাজানো, খাওয়ানো, তাকে উপদেশ দেওয়া, তিরস্কার করা, বিছানায় শোয়ানো, গান গেয়ে ঘুম পাড়ানো প্রভৃতি সব কিছু পরম নিষ্ঠার সঙ্গে করে তারা পুতুলটা যেন এক জীবন্ত শিশু। তাদের সমস্ত ভবিষ্যৎ যেন এর মধ্যে ছোট আকারে বিরাজ করে। এইভাবে শিশুরা পুতুলদের লালন-পালন করতে করতে শৈশব থেকে বাল্যে পদার্পণ করে, বালিকা থেকে পরে নারীত্ব লাভ করে। নারীত্ব লাভ করার পর তারা স্ত্রী হয় এবং তাদের প্রথম সন্তান যেন তাদের শেষ পুতুলের অধিকারী। কোনও ছোট মেয়ে পুতুল থেকে বঞ্চিত হলে সন্তানহীনা নারীর মতো এক অস্বাভাবিক ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে। তাই কসেত্তে পুতুল না পেয়ে একটা ছুরিকে পুতুলের মতো করে সাজায়।

মাদাম থেনার্দিয়ের এবার হলুদ কোটপরা নবাগতের দিকে মন দিল। সে তার কাছে ফিরে গেল। সে ভাবল তার স্বামীর কথাই হয়তো ঠিক। হয়তো লোকটা ধনী হতেও পারে। ধনীদের অদ্ভুত অনেক খেয়াল থাকে।

সে নরম সুরে বলল, দেখুন মঁসিয়ে–

এই সম্মানজনক সম্বোধনে নবাগত আশ্চর্য হয়ে মুখ তুলে তাকাল। এর আগে সে তাকে এভাবে মঁসিয়ে বলে সম্বোধন করেনি।

টেবিলের উপর কনুই দুটো রেখে বসল মাদাম থেনার্দিয়ের। সে বলল, দেখুন মঁসিয়ে, আপনার উদারতা দেখে মেয়েটাকে একবার খেতে দিতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে তো কাজ করতে হবে। কারণ তার কেউ নেই।

নবাগত বলল, ও আপনার মেয়ে নয়?

না না, একেবারে নিঃস্ব, আমরা দয়া করে রেখেছি ওকে এবং রেখে ভুল করেছি। আপনি ওর মাথার আকারটা একবার দেখুন। ওরা চেহারাটাও বাড়ছে না। আমরা ওর জন্য অনেক কিছু করি। কিন্তু আমার তো আর ধনী নই। আমরা ওর মাকে চিঠি লিখি, কিন্তু ছয় মাস ধরে কোনও উত্তর পাইনি। মনে হয়, ওর মা মারা গেছে।

নবাগত বলল, হয়তো তাই। এই বলে সে ভাবতে লাগল। মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, ওর মা থাকলেও অবশ্য কোনও লাভ ছিল না। সে তার মেয়েকে পরিত্যাগ করে।

কসেত্তে’র চোখের দৃষ্টি তার মালিকপত্নীর ওপর নিবদ্ধ ছিল। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে এই হিসেবে সতর্ক করে দেয় মাদাম থেনার্দিয়ের আর নবাগতের মধ্যে যে সব কথাবার্তা হচ্ছে সে-ই তার বিষয়বস্তু। যাই হোক, কসেত্তে’র উদ্বেগের অবসান হল যখন মাদাম থেনার্দিয়ের নবাগতকে কিছু খাওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল।

সে নবাগতকে বলল, আপনি কী খাবেন মঁসিয়ে?

নবাগত বলল, রুটি আর মাখন।

মাদাম থেনার্দিয়ের তা শুনে ভাবল, লোকটা তা হলে সত্যিই গরিব।

যারা গান গাইছিল তারা মাঝখানে কিছুক্ষণ থামার পর আবার নতুন উদ্যমে গান শুরু করল। তাদের গানের বিষয়বস্তু ছিল কুমারী মেরি আর শিশু যিশু। মাদাম থেনার্দিয়ের নবাগতকে রুটি আর মাখন এনে দিয়ে গান শুনতে গেল। সে-ও তাদের হাসি আর হৈ-হুল্লোড়ে যোগদান করল। কসেত্তে তার নকল পুতুলটাকে নিয়ে আগুনের দিকে তাকিয়ে আমার মা মরে গেছে, এই কথাটা বারবার গানের সুরে গাইছিল।

সহসা তার গানটা থেমে গেল। থেনার্দিয়েরদের মেয়েরা তাদের পুতুলটাকে মেঝের উপর ফেলে রেখে বিড়ালছানা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাত্র দু-এক গজ দূরে পড়ে আছে পুতুলটা। তার নকল পুতুলটা নামিয়ে রেখে ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগল সে। দেখল মাদাম থেনার্দিয়ের নিচু গলায় তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলছে। হোটেলের বাসিন্দারা মদপান করছে আর গান গাইছে। এপোনিনে ও অ্যাজেলমা দু জনেই বিড়ালছানা নিয়ে খেলা করছে। কেউ তাকে দেখছে না। চারদিকে একবার সতর্ক দৃষ্টি ছড়িয়ে সে হাতে-পায়ে হেঁটে এসে পুতুলটাকে তুলে নিয়েই টেবিলের তলায় সেইখানে ঢুকে পড়ল। কিন্তু আগুনের দিকে পেছন ফিরে এমনভাবে বসে রইল সে যাতে পুতুলটা তার হাতে থাকলেও তা দেখা যায় না। সত্যিকারের একটা পুতুল পাওয়া তার কাছে ভাগ্যের কথা এবং আনন্দে আত্মহারা হবার কথা। একমাত্র নবাগত এ ব্যাপারে কিছুটা দেখেছিল।

কিন্তু কসেত্তে’র সে আনন্দ স্থায়ী হল না বেশিক্ষণ। তার সতর্কতা সত্ত্বেও সে বুঝতে পারেনি, পুতুলের একটা পা এমনভাবে বেরিয়ে আছে যাতে সেটা পেছন থেকে দেখা যায়। জ্বলন্ত আগুনের ছটায় অ্যাজেলমা পুতুলের গোলাপি পা-টা প্রথমে দেখতে পায়। সে তার দিদিকে দেখাল এবং তখন দুই বোনে এক ক্ষুব্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে পেছন থেকে কসেত্তেকে দেখতে লাগল, ভাবল কসেত্তে’র এত বড় সাহস হল যে সে তাদের পুতুলে হাত দেয়!

এপোনিনে বিড়ালছানাটা ধরেই তার মাকে ডেকে নিয়ে এল।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কী হয়েছে?

এপোনিনে হাত বাড়িয়ে কসেত্তেকে দেখিয়ে বলল, দেখ দেখ।

পুতুল পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল যেন।

মাদাম থেনার্দিয়েরের মুখখানা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। আহত অভিমান তার ক্রোধের আবেগকে শতগুণে বাড়িয়ে দিল। সব ছাড়িয়ে গেছে কসেত্তে। সে তার মালিকের মেয়েদের পুতুলে হাত দিয়েছে! এতদূর স্পর্ধা তার! রাশিয়ার সম্রাট জারের পত্নী কোনও গরিব কৃষককে তার রাজকুমারের নীল কোমরবন্ধনীতে সজ্জিত দেখলেও হয়তো এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত না।

প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে কড়া গলায় মাদাম থেনার্দিয়ের ডাকল কসেত্তেকে, কসেত্তে!

কসেত্তে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পেছন ফিরল। তার মনে হল তার পায়ের তলার সব মাটি কাঁপছে।

মাদাম থেনার্দিয়ের আবার জোর গলায় ডাকল, কসেত্তে!

কসেত্তে এবার তার হাত থেকে পুতুলটা নামিয়ে রেখে তার হাত দুটো জড়ো করে মোচড়াতে লাগল। তার পর সে এমন একটা কাজ করল, আজ সারাদিনের এত সব প্রতিকূল ঘটনার নির্মমতা যা তাকে করাতে পারেনি। অন্ধকার বনের মধ্যে ঝরনা থেকে জল আনতে যাওয়া, ভারী বালতি বওয়ার কষ্ট, পয়সা হারানো, বেত মারার উপক্রম, মাদাম থেনার্দিয়েরের মুখ থেকে তার মার মৃত্যুসংবাদ শোনা প্রভৃতি কোনও ঘটনাই তাকে কাঁদাতে পারেনি। কিন্তু এবার জোরে কেঁদে উঠল কসেত্তে।

নবাগত খেতে খেতে উঠে দাঁড়াল। সে মাদাম থেনার্দিয়েরকে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

পুতুলটার দিকে হাত বাড়িয়ে মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, দেখতে পাচ্ছেন না?

নবাগত বলল, আমি বুঝতে পারছি না।

ওই মেয়েটা বেয়াদবি করে আমার মেয়েদের পুতুল নিয়েছে।

নবাগত সহজভাবে বলল, তাতে কী হয়েছে? পুতুলটা নিয়ে সে-ই বা কেন খেলবে না?

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, সে তার নোংব্রা হাত দিয়ে পুতুলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

নবাগত হঠাৎ রাস্তার দিকে দরজাটা খুলে বেরিয়ে গেল। তার আকস্মিক অন্তর্ধানের সুযোগ নিয়ে কসেত্তেকে একটা লাথি মারল মাদাম থেনার্দিয়ের। তাতে আরও জোরে কাঁদতে লাগল কসেত্তে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এল নবাগত। তার হাতে ছিল সেই সুন্দর বড় পুতুলটা যেটা সারাদিন ধরে গায়ের সব ছেলেমেয়ে পাবার জন্য লোভ করেছে। লুব্ধ দৃষ্টিতে বারবার তাকিয়ে থেকেছে সেটার দিকে।

পুতুলটা কসেত্তের সামনে রেখে নবাগত বলল, এই নাও, এটা তোমার।

হোটেলে এসে ওঠার পর থেকে জানালা দিয়ে রাস্তার ওপারের আলো ঝলমল দোকানগুলো, পানে মাঝে মাঝে তাকিয়েছে সে। আসার পথেও দেখেছে দোকানগুলো।

অন্ধকারাচ্ছন্ন দু চোখের দৃষ্টির সামনে হঠাৎ একঝলক সূর্যরশ্মি এসে পড়লে মানুষ যেমন অভিভূত হয়ে যায় তেমনি পুতুলটার পানে একবার তাকিয়েই অভিভূত হয়ে পড়ল কসেত্তে। এই পুতুলটা তোমার এই অবিশ্বাস্য কথাগুলো শুনে সে একবার নবাগতের পানে আর একবার পুতুলটার পানে তাকায়। তার পরই সে আবার টেবিলের তলায় চলে যায়। সেখানে গিয়ে ভয়ে স্থির ও জড়োসড়ো হয়ে থাকে।

মাদাম থেনার্দিয়ের, এপোনিনে আর অ্যাজেলমা মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। যারা গান গাইছিল আর হৈ-হুল্লোড় করছিল তারাও থেমে গেল। এক গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল সারা বাড়িটার মধ্যে।

বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল মাদাম থেনার্দিয়ের। আবার ধারণা আর অনুমানের খেলা চলতে লাগল তার মনে। লোকটা গরিব না ক্রোড়পতি? অথবা দুই-এরই মিশ্রণে গড়া এক অপরাধী আসামি?

কোনও প্রবল আবেগ মানুষকে হঠাৎ আচ্ছন্ন করে বসলে যেমন তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে এক আর্ত নিবিড়তা তেমনি তার স্বামী থেনার্দিয়েরের মুখে-চোখে তাই ফুটে উঠেছিল। একবার পুতুল আর একবার নবাগত পথিকের পানে তাকিয়ে তার আসল পরিচয়টা অনুমান করার চেষ্টা করল, যেমন কোনও গুপ্তধনখ্যাত জায়গায় গিয়ে মানুষ গুপ্তধনের সন্ধান করতে থাকে।

কিন্তু তার দ্বিধাভাবটা স্থায়ী হল না বেশিক্ষণ। সে তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে চুপি চুপি বলল, ওই পুতুলটার দাম অন্তত তিরিশ ফ্রাঁ। বোকার মতো কাজ করো না, লোকটার কাছে যাও।

সুলতা আর নির্দোষিতা যে এক বস্তু নয়, তা বুঝতে পারল না থেনার্দিয়ের। এ দুটোর মধ্যে কোনও পার্থক্য সে বুঝতে পারত না।

নরম সুরে মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, আচ্ছা কসেত্তে, তুমি তোমার পুতুলটা নেবে না?

তার আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এল কসেত্তে।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, ভদ্রলোক তোমাকে একটা পুতুল দিয়েছেন। এটা তোমার। এটা নিয়ে তুমি খেলা করবে।

সেই ইন্দ্রজালিক পুতুলটার দিকে ভয়ের সঙ্গে তাকাল কসেত্তে। তার মুখখানা তখনও ভিজে ছিল কান্নার জলে। কিন্তু তার চোখ দুটো সকালবেলার মেঘমুক্ত আকাশের মতো এক নতুন আলোর আভায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল। যে আনন্দের অনুভূতিতে সে মাতোয়ারা হয়ে উঠল। কেউ যদি হঠাৎ স্বর্গ থেকে নেমে এসে তাকে বলত, “হে শিশু, তুমি ফ্রান্সের রানি’ তা হলেও এই আনন্দ থেকে বেশি আনন্দ সে পেত না। তথাপি সে ভয়ে পুতুলটাকে স্পর্শ করতে পারল না পাছে তার থেকে অকস্মাৎ বজ্রপাত হয়, কারণ। সে তার মালিকপত্নীর রাগের কথা জানত। পুতুলটার প্রতি তার আসক্তি এমনই প্রবল ছিল যে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি কি সত্যি সত্যিই এটা নিতে পারি?

একই সঙ্গে বেদনা আর আনন্দের আবেগ আর কোনও কথার ওপর এমনভাবে ঝরে পড়েনি কখনও।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, নিশ্চয়, এটা তোমার। ভদ্রলোক তোমায় দিয়েছেন।

কসেত্তে আবার বলল, এটা কি সত্যি মঁসিয়ে? পুতুলটা আমার?

নবাগতের চোখে জল এসে গিয়েছিল। তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে তাই কথা বলতে পারছিল না। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল এবং পুতুলটা কসেত্তে’র হাতের মধ্যে দিল।

কসেত্তে হাতটা পুতুল থেকে সরিয়ে নিল যেন পুতুলটার স্পর্শে তার হাত পুড়ে গেছে।

অবশেষে সে মেঝের দিকে তাকিয়ে পুতুলটা নিয়ে বলল, আমি এর নাম দেব ক্যাথারিন।

সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মেয়েটির ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকের পটভূমিকায় পুতুলটার গোলাপি চকচকে রঙটা বেমানান লাগছিল।

কসেত্তে বলল, পুতুলটাকে চেয়ারের উপর বসাতে পারি মাদাম?

এপোনিনে আর অ্যাজেলমা ঈর্ষান্বিতভাবে তাকিয়ে রইল পুতুলটার পানে। কসেত্তে পুতুলটাকে আরেকটা চেয়ারের উপর বসিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

নবাগত বলল, পুতুলটা নিয়ে খেলা করো কসেত্তে।

আমি তো খেলা করছি।

সেই সময় মাদাম থেনার্দিয়ের সারা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র নবাগত ছাড়া আর কাউকে এত বেশি ঘৃণা করত না। নবাগত যেন অন্য এক জগৎ থেকে হঠাৎ কসেত্তে’র জীবনে নেমে এসেছে। মাদাম থেনার্দিয়ের যদিও সব কাজে তার স্বামীর কথামতো চলার চেষ্টা করে অথবা তার ভান করে তথাপি এই মুহূর্তে নবাগতের প্রতি তার নবজাগ্রত ঘৃণার অনুভূতিটাকে দমন করতে পারল না। সে তাড়াতাড়ি তার মেয়েদের বিছানায় শুতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে নবাগতের কাছে গিয়ে কসেত্তেকে শুতে পাঠাবার অনুমতি চাইল। মাতৃসুলভ আগ্রহের সঙ্গে বলল, সারাদিন মেয়েটা কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কসেত্তে পুতুলটা হাতে নিয়ে চলে গেল।

মাদাম থেনার্দিয়ের তার স্বামী যেখানে বসে ছিল সেইখানে গিয়ে কথার বন্যা ছুটিয়ে তার অবদমিত আবেগকে মুক্ত করল। কথাগুলো চাপা গলায় বলতে হচ্ছিল বলে সেগুলো আরও তীক্ষ্ণ ও আরও বিষাক্ত হয়ে উঠল।

সে বলল, ওই বুড়ো পাগলটা কোথায় থেকে এসে সব ওলটপালট করে দিল, মেয়েটাকে অনবরত খেলা করতে বলছে, তাকে চল্লিশ ফ্রাঁ দিয়ে একটা পুতুল কিনে দিল। অথচ আমরা চল্লিশ স্যু দিয়েও ও পুতুল কিনতাম না। এরপর সে মেয়েটাকে ‘মহারানি’ বলে ডাকবে। লোকটা কি পাগল?

থেনার্দিয়ের বলল, মেয়েটাকে খেলতে দেখে সে যদি মজা পায় তো পাক না। তুমি যেমন ওকে কাজ করিয়ে আনন্দ পাও, ও তেমনি মেয়েটাকে খেলতে দেখে আনন্দ পায়। খরিদ্দার যদি আমাদের হোটেলখরচ মিটিয়ে দেয় তা হলে যা খুশি সে করতে পারে। সে পরোপকারী বা অপদার্থ যা-ই হোক না কেন তাতে তোমার কী আসে-যায়? তার নিশ্চয় অনেক টাকা আছে।

নবাগত আবার টেবিলের উপর কনুই রেখে ভাবতে শুরু করল। যারা গান করছিল তারা গান থামিয়ে দিয়ে বসে ছিল। তারা সবাই ভয়মেশানো শ্রদ্ধার সঙ্গে নবাগতকে দেখছিল। যে মানুষটা এমন গরিবের মতো পোশাক পরে আছে, সে কী করে একটা ছোট মেয়ের পেছনে একটা স্বর্ণমুদ্রা খরচ করে? এ সত্যিই দেখার মতো জিনিস।

কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। দুপুররাতের সমবেত প্রার্থনা শেষ হয়ে গেল। হৈ-হুল্লোড় থামিয়ে সবাই শুতে চলে গেল। তখন ঘর একেবারে ফাঁকা। আগুনটা জ্বলতে জ্বলতে স্তিমিত হয়ে এসেছে। নবাগত কিন্তু যেখানে বসে ছিল সেখানেই একা বসে রইল। কসেত্তে চলে যাওয়ার পর সে একটা কথাও বলেনি।

থেনার্দিয়েররা পাশের ঘর থেকে দেখতে পেল নবাগতকে। তারা বলাবলি করতে লাগল, ও কি এইভাবেই রাত কাটাবে?

কিন্তু রাত দুটো বাজতেই মাদাম থেনাদিয়েরের ঘুম এসে পড়ল। সে আর বসে থাকতে পারল না। বলল, তোমার যা খুশি করতে পার।

থেনার্দিয়ের টেবিলের এক কোণে বসে একটা খবরের কাগজ পড়তে লাগল। গোটা কাগজটা তার পড়া হয়ে গেল, কিন্তু নবাগত তবু একটুও নড়ল না। যেমন বসে ছিল তেমনিই বসে বসে ভাবতে লাগল।

থেনার্দিয়ের কেশে, চেয়ারটার সরিয়ে কিছু শব্দ করে নবাগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। সে ভাবল, লোকটা কি বসে বসেই ঘুমোচ্ছে?

কিন্তু লোকটা সত্যি সত্যিই ঘুমোচ্ছিল না। কিন্তু কিছুতেই সে উঠছিল না বা কোনও দিকে তাকাচ্ছিল না। অবশেষে থেনার্দিয়ের তার মাথা থেকে টুপিটা খুলে নবাগতের কাছে গিয়ে সাহস করে বলল, মঁসিয়ে, বিশ্রাম করতে যাবেন না?

কথাটা সাবধানে কায়দা করে বলল থেনার্দিয়ের। শুতে যাওয়ার থেকে বিশ্রাম করতে যাওয়ার কথাটা আরও শোভন ও সম্মানজনক। এ কথার গুণে আগামীকাল অনেক বেশি টাকার বিল করা যাবে। সাধারণ একটা শোবার ঘরের ভাড়া হল কুড়ি স্যু, কিন্তু একটা বিশ্রামাগারের ভাড়া হল কুড়ি।

নবাগত বলল, অবশ্যই। আপনি ঠিকই বলছেন। আপনাদের আস্তাবলটা কোথায়?

থেনার্দিয়ের মৃদু হেসে বলল, মঁসিয়ে চাইলে আমিই আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।

নবাগত তার লাঠি আর পুঁটলিটা তুলে নিল। বাতি হাতে থেনার্দিয়ের নবাগতকে দোতলার একট ঘরে নিয়ে গেল। মেহগনি কাঠের আসবাব আর লাল পর্দা দেওয়া ঘরটা এক অপ্রত্যাশিত ঐশ্বর্যে ভরা।

নবাগত বলল, এ কী?

থেনার্দিয়ের বলল, এটা আমাদের বিয়ের বাসরঘর। আমি আর আমার স্ত্রী এখন অন্য ঘরে শুই। বছরে মাত্র তিন-চারবার এই ঘরটা ভোলা এবং ব্যবহার করা হয়।

নবাগত বলল, আস্তাবল হলেই আমার চলে যেত।

থেনার্দিয়ের যেন শুনেও শুনল না। সে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে আলমারির উপর রেখে দিল। উনোনে আগুন জ্বলছিল। একটা বড় কাঁচের জারের মধ্যে মেয়েদের মাথায় পরার একটা পোশাক ছিল। একটা রুপোর তার দিয়ে সেটা বাঁধা ছিল।

নবাগত বলল, ওটা কী?

থেনার্দিয়ের বলল, এটা আমার স্ত্রীর বিয়ের বনেট।

আসলে কিন্তু সেটা বিয়ের বনেট নয়। ওটা পুরনো, এক জায়গা থেকে কেনা। থেনার্দিয়ের মিথ্যা কথা বলছিল। শুধু তার স্ত্রীকে খাতির করত এই কথা বলে।

হঠাৎ নবাগত মুখ ঘুরিয়ে দেখল সে ঘরের মধ্যে একা। থেনার্দিয়ের কখন একসময় ঘর থেকে নিঃশব্দে চলে গেছে তাকে ‘শুভরাত্রি না জানিয়েই। কারণ সে জানে পরদিন যার নামে মোটা বিল করে টাকা আদায় করবে তার সঙ্গে বেশি বন্ধুত্ব করা ভালো নয়।

থেনার্দিয়ের তার শোবার ঘরে গিয়ে দেখল তার স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু ঘুমোয়নি তখনও।

মাদাম থেনার্দিয়ের তাকে ঘুরে ঢুকতে দেখে বলল, আমি ভাবছি কসেত্তেকে কাল ছেড়ে দেব।

থেনার্দিয়ের বলল, তুমি সব ব্যাপারেই তাড়াহুড়ো করতে চাও।

আর কেউ কোনও কথা বলল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।

নবাগত তার ছড়ি আর পুঁটলিটা এক জায়গায় রেখে একটা আর্ম চেয়ারে বসে ভাবতে লাগল। সে একসময় পায়ের জুতো জোড়াটা খুলল। তার পর বাতিটা নিবিয়ে দিল। সে দরজাটা খুলে কসেত্তে যে ঘরে শুয়ে আছে সেই ঘরে যাবার পথটা খুঁজতে লাগল। সে বারান্দা দিয়ে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। এমন সময় একটা ঘরে শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে সেই শব্দ অনুসরণ করে সে সিঁড়ির তলায় দেখল তিন কোনা দরজাহীন ঘরের মতো একটা জায়গায় কতকগুলি ভাঙা ঝুড়ি, বাক্স, ধুলো আর মাকড়সার জালের মধ্যে একটা ছেঁড়া তোষক পাতা রয়েছে মেঝের উপর আর কসেত্তে তার উপর শুয়ে ঘুমোচ্ছে।

নবাগত অদূরে দাঁড়িয়ে তা দেখতে লাগল।

কসেত্তে শীতের ভয়ে জামা-প্যান্ট পরেই ঘুমোচ্ছে। পুতুলটা তার হাতেই ধরা আছে। মাঝে মাঝে সে একটা করে জোর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিল যেন এখনি জেগে উঠবে। কিন্তু সে ঘুমের ঘোরেই পুতুলটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরছিল। একটা কাঠের জুতো তার পায়ে ছিল আর একটা জুতো তোষকের পাশে পড়ে ছিল। কসেত্তে যেখানে ঘুমোচ্ছিল তার কাছেই একটা ঘর ছিল। অন্ধকারে ঘরটা দেখা যাচ্ছিল না। নবাগত সেই ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখতে লাগল। সে দেখল ঘরটার একপ্রান্তে সাদা ধবধবে চাদর পাতা দুটো বিছানায় এপোনিনে আর অ্যাজেলমা ঘুমোচ্ছিল। তাদের বিছানার পাশে একটা দোলনায় একটি শিশুপুত্র ঘুমোচ্ছিল। নবাগত বুঝতে পারছিল সারা সন্ধে ধরে এই ছেলেটির কান্না তারা শুনে এসেছে।

নবাগত বুঝল এই ঘরটার পাশেই একটা ঘর আছে এবং সেখানে থেনার্দিয়ের দম্পতি ঘুমোচ্ছে। হঠাৎ দেখল থেনাদিয়েরের মেয়েরা যে ঘরে ঘুমোচ্ছিল সেই ঘরে আগুন জ্বালার জায়গাটার কাছে একটা করে জুতো পড়ে আছে। নবাগত বুঝতে পারল এটাই। হল রীতি। ছেলেমেয়েরা আগুনের চুল্লির কাছে একপাটি করে জুতো রেখে যায়। তা হলে সকালে উঠে তারা দেখবে সেই জুতোর মধ্যে এক সদাশয় পরী কখন এসে একটা করে উপহার দিয়ে গেছে। নবাগত দেখল, পরীর পক্ষ থেকে তাদের মা-ই সেই জুতো দুটোর মধ্যে একটা করে দশ স্যু’র মুদ্রা রেখে দিয়ে গেছে।

নবাগত এবার চলে যাচ্ছিল সেখান থেকে। কিন্তু যেতে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পেল সেই জুতোর পাটি দুটোর থেকে কিছু দূরে একপাটি কাঠের কুৎসিত জুতো পড়ে রয়েছে। কিন্তু কোনও মুদ্রার উপহার নেই তার মধ্যে। মা’র রূপ ধরে কোনও সদাশয় পরী কোনও উপহার দিয়ে যায়নি তাতে।

নবাগত তার পকেট থেকে একটি স্বর্ণমুদ্রা বার করে সেই জুতোটার মধ্যে ফেলে দিল। তার পর সে তার নিজের ঘরে চলে গেল।

.

৯.

পরদিন সকাল হবার দু ঘণ্টা আগেই বড় বসার ঘরটাতে টেবিলের ধারে বসে থেনার্দিয়ের কলম হাতে নবাগতের জন্য হোটেলখরচের বিল তৈরি করতে লাগল। সকালের আলো তখন ফুটে না ওঠায় বাতি জ্বেলে কাজ করছিল সে। তার স্ত্রী তার পাশে তার ঘাড়ের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে তা দেখছিল। কেউ কোনও কথা বলছিল না। তাদের একজন খুঁটিয়ে হিসাব করে যাচ্ছিল একমনে আর একজন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির শক্তি কতখানি হতে পারে এবং কিভাবে তার প্রকাশ ঘটতে পারে তা এক ভীতিবিহ্বল শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখতে যাচ্ছিল। সিঁড়িতে কিসের শব্দ হচ্ছিল। তারা বুঝল কসেত্তে উঠে সিঁড়ি ঝাট দিচ্ছে।

পনেরো মিনিট ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে বিলটা তৈরি করে ফেলল থেনার্দিয়ের। বিলটা হল এই রকম : রাতের খাওয়া ৩ ফ্রাঁ, ঘরভাড়া ১০ ফ্রাঁ, বাতিখরচ ৫ ফ্রাঁ, আগুন ৪ ফ্রাঁ, ভূত্যখরচ ১ ফ্রাঁ–সব মিলিয়ে মোট ২৩ ফ্রাঁ। ভৃত্যখরচের জায়গায় বানানটা ভুল করল।

মাদাম থেনার্দিয়ের ভয়ে ভয়ে বলে উঠল, তেইশ ফ্রাঁ!

বড় বড় শিল্পীদের মতো নিজের কাজে নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারল না থেনার্দিয়ের।

বলল, বাহ্, এ তো কিছুই হল না।

তার মেয়েদের সামনে লোকটা একট দামি পুতুল কিনে দিয়েছে এজন্য নবাগতের ওপর রাগ ছিল মাদাম থেনার্দিয়েরের। তাই সে কথা মনে করে বলল, ঠিক করেছ প্রিয়তম। ঠিক হয়েছে। তবে বিলটা বেশ হয়েছে। এত টাকা দেবে কি?

একটুখানি হেসে তার স্বামী বলল, হ্যাঁ, দেবে।

তার হাসিটার মধ্যে এক পরিপূর্ণ আশ্বাস আর একটা প্রভুত্বের ভাব ছিল। তার স্ত্রী আর এ নিয়ে কোনও কথা বলল না। সে ঘর পরিষ্কার করার কাজে মন দিল। থেনার্দিয়ের ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে করতে একসময় বলল, আমি পনেরো শো ফ্ৰাঁ পাই।

এই বলে সে আগুনের কাছে বসে ভাবতে লাগল।

তার স্ত্রী বলল, পুতুলটার কথা ভাবলেই আমার মাথাটা খরাপ হয়ে যায়। তুমি নিশ্চয়। ভোলনি, আমি আজ কসেত্তেকে বার করে দিচ্ছি। আর একটা মিনিটও তাকে আমি সহ্য করতে পারব না।

থেনার্দিয়ের তার পাইপটা ধরাচ্ছিল। পাইপ থেকে ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে সে বলল, বিলটা তাকে দিয়ে দেবে।

এই বলে সে বেরিয়ে গেল।

ঘর থেকে বেরোতে না বেরোতেই নবাগত এসে ঘরে ঢুকল। তার হাতে সেই লাঠি আর পুঁটলিটা ছিল। থেনার্দিয়ের আবার ফিরে এল। মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন! আপনি কি এখনি চলে যাবেন?

কথা বলার সময় বিলটা তার হাতে মোচড়ানো অবস্থায় ধরা ছিল। তার মুখের ওপর একটা নিবিড় কুণ্ঠা ফুটে উঠেছিল। যে লোকটাকে বেশভূষা এতখানি গরিব দেখায় তাকে কী করে সে এত টাকার বিল দেবে তা খুঁজে পাচ্ছিল না।

নবাগত আনমনে বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, মিতফারমেলে মঁসিয়ের কোনও কাজ নেই?

নবাগত বলল, না আমি এমনি এদিকে দিয়ে যাচ্ছিলাম এক জায়গায়। আমার কত হয়েছে মাদাম?

কোনও কথা না বলে তার হাতে বিলটা ধরিয়ে দিল মাদাম থেনার্দিয়ের। নবাগত একবার সেটা দেখল। কিন্তু কিছু বলল না। তার মনটা অন্য চিন্তায় নিবিষ্ট ছিল।

কিছু পরে নবাগত বলল, মঁতফারমেলে আপনাদের কারবার কেমন চলছে মাদাম?

বিলটা দেখে নবাগত রাগে ফেটে পড়ল না বা তার মধ্যে কোনও বিরূপ বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া হল না দেখে সে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল। সে উৎসাহিত হয়ে বলল, খুব ভালো।

তার পর একটু ভেবে করুণ সুরে বলল, দিনকাল বড় খারাপ যাচ্ছে মঁসিয়ে। আজকাল খরিদ্দার খুব কম আসে। গরিব দেশ। আপনার মতো কিছু ধনী খরিদ্দার মাঝে মাঝে না এলে আমরা চালাতেই পারতাম না। কত খরচ আমাদের। তার ওপর মেয়েটার ব্যয়ভার। আপনি জানেন না ওর পেছনে কত খরচ?

নবাগত বলল, কোন মেয়েটার কথা বলছেন?

কেন, যাকে আপনি গতকাল রাতে দেখছেন, কসেত্তে। বকাটে চাষিগুলো আবার একে লার্ক পাখি বলে। আমরা কারও কাছে কোনও দান চাইতে পারি না বা দিতে পারি না। আজকাল আমাদের রোজগার খুব কম হয়। তার ওপর দেনা শোধ দিতে হয়। এমন। সরকার হয়েছে, আমাদের লাইসেন্স, কর ইত্যাদির ব্যাপারে কত টাকা চলে যায়। তার ওপর আমাদের নিজেদের ছেলেমেয়ে আছে। তাদের দেখতে হয়। পরের মেয়ে মানুষ করার মতো ক্ষমতা আমাদের নেই।

কিছুটা ইতস্তত করার পর কাঁপা কাঁপা কুণ্ঠিত গলায় বলল, মনে করুন আমি মেয়েটাকে আপনাদের কাছ থেকে যদি নিয়ে যাই?

কে–কসেত্তেকে?

হ্যাঁ।

মাদাম থেনার্দিয়েরের লাল ম্লান মুখখানা সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, হ্যাঁ মঁসিয়ে, ওকে নিয়ে যান। আপনি ওকে নিয়ে যান। ওর ভার নিন। কুমারীমাতা মেরি আপনার মঙ্গল করবেন। স্বর্গের সাধুরা আপনাকে আশীর্বাদ করবেন।

ঠিক আছে, আমি ওকে নিয়ে যাব।

সত্যিই কি আপনি ওকে নিয়ে যাবেন?

হ্যাঁ।

এখনি?

নিশ্চয়। তাকে এখানে নিয়ে আসুন।

মাদাম থেনার্দিয়ের ডাক দিল, কসেত্তে!

নবাগত বলল, ইতোমধ্যে আমি আপনাদের টাকাটা দিয়ে দিই। কত হয়েছে বললেন?

এবার সে বিলটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা চমকে উঠে বলল, তেইশ!

এই বলে সে মাদাম থেনার্দিয়েরের পানে তাকাল। তার দৃষ্টির মধ্যে কিছুটা বিস্ময়ের একটা প্রশ্ন মেশানো ছিল।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, হ্যাঁ, মঁসিয়ে, তেইশ ফ্রাঁ।

নবাগত টেবিলের উপর পাঁচ ফ্রাঁ করে পাঁচটা মুদ্রা রাখল। তার পর বলল, ঠিক আছে। মেয়েটাকে নিয়ে আসুন।

এমন সময় থেনার্দিয়ের এসে ঘরে ঢুকে বলল, মঁসিয়ের কাছে আমরা ছাব্বিশ স্যু পাব।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কেন?

থেনার্দিয়ের বলল, কুড়ি স্যু ঘরের জন্য আর ছয় স্যু রাতের খাওয়ার জন্য। আর কসেত্তের ব্যাপারে মঁসিয়ের সঙ্গে কথা বলছি। তুমি একটু বাইরে যাও তো।

মাদাম থেনার্দিয়ের ব্যাপারটা এক মুহূর্তে বুঝে নিল। যখন প্রধান অভিনেতা মঞ্চের উপর এসে হাজির হয়েছে তখন সে নিজে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। এসব ব্যাপার এক লহমায় বোঝার মতো তার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল।

থেনার্দিয়ের এবার নবাগতকে বসতে বলে নিজে দাঁড়িয়ে রইল। এবার তার মুখের ওপর এক কৃত্রিম সরলতা আর একটা শান্ত ভাব ছিল।

থেনার্দিয়ের বলল, মঁসিয়ে, আমি মেয়েটাকে ভালোবাসি।

কোন মেয়ে?

থেনার্দিয়ের বলল, আসক্তি জিনিসটা সত্যিই আশ্চর্যের। এখানে টাকার কথাটা বড় নয়। আমি টাকা চাই না, আমি মেয়েটাকে রেখে দিতে চাই।

কোন মেয়ের কথা বলছেন আপনি?

কেন, আমাদের কসেত্তে’র কথা। আপনি মেয়েটাকে নিয়ে যেতে চাইছেন না? ভদ্রলোকের মতো আমরা খোলাখুলি আলোচনা করতে চাই। আমি তাকে যেতে দিতে পারি না। সে চলে গেলে তার অভাবটা আমায় খুব বেশি অনুভব করতে হবে। আমি তাকে ছোট থেকে দেখে আসছি। একথা সত্যি যে তার জন্য খরচ হয় এবং তার দোষত্রুটিও আছে। এটাও ঠিক যে আমরা ধনী নই এবং একবার তার অসুখের জন্য আমাকে চার শো ফ্রাঁ খরচ করতে হয়। কিন্তু এই সব কিছুই আমরা ঈশ্বরের সেবা এবং পবিত্র কর্তব্য হিসেবে করে যাই। তার বাবা-মা কেউ নেই। আমি শৈশব থেকে। লালন-পালন করছি তাকে। তাকে খাওয়াবার মতো সামর্থ্য আমার আছে। তাকে ছাড়া আমার চলবে না। স্নেহ কী বিষয় বস্তু তা জানেন না। আমি নির্বোধ, আমার কোনও যুক্তিবোধ নেই। তাই বোকার মতো তাকে ভালোবেসে যাই আর আমার স্ত্রীও তাকে ভালোবেসে যদিও সে মাঝে মাঝে দোষ করলে কিছু শক্ত কথা বলে। তিরস্কার করে। ও আমাদের নিজের সন্তানের মতোই হয়ে গেছে। আমি চাই ও আমাদের বাড়িতে খেলে ও ছোটাছুটি করে বেড়াক।

নবাগত নীরবে তার মুখপানে তাকিয়ে রইল।

থেনার্দিয়ের আবার বলতে শুরু করল, মাপ করবেন মঁসিয়ে। কেউ কখনও কোনও পথিকের হাতে তার ছেলেকে তুলে দেয় না। আমি কি ঠিক বলছি না? অবশ্য যদিও আপনি পথিক হলেও ধনী এবং সৎ বলেই মনে হচ্ছে। আমি তার ভালোর জন্যই এ কথা বললাম। আমি আশা করি আপনি তা বুঝতে পারবেন। মনে করুন, আমি তাকে যেতে দিলাম তার প্রতি আমার সব অনুভূতিকে দমন করে। কিন্তু তাই বলে তাকে চিরদিনের মতো চোখের আড়াল করতে পারি না। আমার জানা উচিত সে কোথায় থাকবে, যাতে আমি মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসতে পারি, যাতে সে-ও বুঝতে পারে তার পালকপিতা তার ওপর লক্ষ রাখে। আমি আপনার নাম-ধাম কিছুই জানি না। আপনি যদি তাকে নিয়ে যান তা হলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগবে আমার মনে, কসেত্তে কোথায় গেল? কী ঘটল তার জীবনে? আপনার পাসপোর্ট বা বাসস্থান সম্বন্ধে অন্তত একটুকরো কাগজ দেখান।

নবাগত থেনার্দিয়েরের ওপর থেকে তার তীক্ষ্ণ মর্মভেদী দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে দৃঢ়স্বরে বলল, মঁসিয়ে থেনার্দিয়ের, প্যারিস থেকে পাঁচ-দশ মাইলের মধ্যে কোথাও গেলে কখনও পাসপোর্টের দরকার হয় না। আমি যদি কসেত্তেকে নিয়ে যাই তা হলে ব্যাপারটার এইখানেই নিষ্পত্তি ঘটবে চিরদিনের জন্য। আমার নাম বা বাসস্থানের কথা কিছুই বলা হবে না আপনাকে। আমার ইচ্ছা সে আর কখনও চোখ জুড়বে না আপনার সঙ্গে। তার এই বর্তমান জীবনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাই আমি। বলুন আপনি রাজি আছেন?

দানবরা যেমন উচ্চস্তরের দেবতার উপস্থিতির কথা কোনও না কোনও লক্ষণ দ্বারা বুঝতে পারে থেনার্দিয়ের তেমনি বুঝতে পারল প্রভূত নৈতিক শক্তিসম্পন্ন এক ব্যক্তির সঙ্গে এবার তাকে লড়াই করতে হবে। এটুকু বোঝার মতো অন্তদৃষ্টি তার ছিল। গতকাল সন্ধে থেকে রাত পর্যন্ত সে হৈ-হুল্লোড় ও গান-বাজনায় মত্ত থাকলেও সে বারবার তার তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে নবাগতকে বারবার নিরীক্ষণ করেছে। এক নীতিগত কর্তব্যবোধ ও কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই এ কাজ করেছে সে। ফলে হলুদ কোটপরা নবাগতের কোনও অঙ্গভঙ্গি বা কথাবার্তাই দৃষ্টি এড়ায়নি তার। কসেত্তে’র প্রতি নবাগত কোনও আগ্রহ বা মমতা দেখাবার আগে সে এটা অনুমান করেছিল। সে বারবার কসেত্তে’র ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখেছে তাকে। কসেত্তে’র প্রতি তার এই আগ্রহের কারণ কী? তার কাছে থলেভরা টাকা থাকা সত্ত্বেও সে কেন এমন দীনহীনের মতো পোশাক পরে থাকে? সারারাত ভেবেও এই সব বিভ্রান্তিকর বিরক্তিকর প্রশ্নের কোনও সংগত উত্তর খুঁজে পায়নি থেনার্দিয়ের। লোকটা কখনই কসেত্তে’র পিতা হতে পারে না। তবে কি সে তার পিতামহ? কিন্তু তা হলে কেন সে দাবি জানাচ্ছে না কসেত্তে’র ওপর? তবে কে সে? থেনার্দিয়েরের মাথাটা খারাপ হয়ে যেতে লাগল। সে অনেক কিছু অনুমান করল, কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। তবু যখন সে বুঝল নবাগতের জীবনে কিছু একটা গোপন। ব্যাপার আছে, যা সে গোপন রাখতে চায় তখন সে তার নিজের দিকটাকে জোরালো ভাবল। আবার যখন দেখল নবাগত কোনওক্রমেই তার রহস্যকে উদ্ঘাটিত করতে চায় না, বরং চাপ দেওয়া সত্ত্বেও সে রহস্যের আবরণটা আরও জোর করে জড়িয়ে নিতে চায়। তখন সে হতাশ না হয়ে পারল না। সে তখন ঠিক করল এইভাবে পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি না করে তার আসল কথাটা খোলাখুলিভাবে সোজাসুজি বলা উচিত। অভিজ্ঞ সেনানায়কের মতো একনজরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে থেনার্দিয়েরের।

সে বলল, মঁসিয়ে, আমি পনেরোশো ফ্রাঁ চাই।

নবাগত সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতরের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা চামড়ার প্যাকেট থেকে পাঁচশো ফ্রা’র তিনটে ব্যাংকনোট বার করে টেবিলের উপর রাখল। তার পর বলল, নিয়ে আসুন কসেত্তেকে।

এদিকে কসেত্তে সেদিন সকালে জেগে উঠেই তার সেই একপাটি কাঠের কদাকার জুতোটার মধ্যে একটা স্বর্ণমুদ্রা পেল। মুদ্রাটা কুড়ি ফ্রা’র। মুদ্রাটা রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর বেরিয়েছে। যদিও এ মুদ্রা সে কখনও দেখেনি এর আগে এবং কত দাম তা সে জানে না, তবুও সে এটা পেয়ে খুশি হয়ে সে তার জামার পকেটে রাখল। কোথা হতে সে মুদ্রাটা এসেছে, এটাও বুঝতে পারল সে। আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও হচ্ছিল তার। আনন্দের থেকে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল বেশি। এই সব অকাতর দান, এত সুন্দর সুন্দর উপহার দেখে সে সত্যিই ভীত হয়ে পড়েছিল। এই দামি পুতুল আর এই স্বর্ণমুদ্রার মতো ঐশ্বর্যের জৌলুসভরা জিনিস দেখে ভয়ে কাঁপতে থাকে সে। তবে অবশ্য এই সব জিনিস যে তাকে দিয়েছে সেই নবাগতকে দেখে কিন্তু তার ভয় করে না, বরং এক পরম আশ্বাস খুঁজে পায় তার জীবনে। গতকাল সন্ধে থেকে এক পরম বিস্ময়ের সঙ্গে সর্বক্ষণ এই অচেনা-অজানা লোকটির কথা ভেবেছে। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে তাকে দেখেছে। লোকটিকে দেখে গরিব, বৃদ্ধ ও বিষণ্ণ মনে হলেও সে ধনী এবং দয়ালু। গত সন্ধ্যায় সেই অন্ধকার বনভুমিতে লোকটির সঙ্গে দেখার পর থেকে কসেত্তে’র গোটা জীবনটার মধ্যেই যেন এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বনের পক্ষীশাবকদের মতো সে তার মায়ের ডানার তলায় কোনওদিন কোনও নিশ্চিন্ত আশ্রয় পায়নি। তখন থেকে সে তার জীবনের কথা মনে করতে পারছে সেই পাঁচ বছর থেকে আজ পর্যন্ত সে শুধু ভয়ে কেঁপে এসেছে। সহায়-সম্বলহীন একটি নিঃসঙ্গ আত্মা ক্রমাগত বয়ে যাওয়া চরম দুর্ভাগ্যের হিমশীতল এক প্রচণ্ড ঝড়ের সামনে সম্পূর্ণ অনাবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে নীরব নিরুচ্চার এক বেদনায় কাঁপতে থেকেছে। এখন মনে হল তার, তার সে আত্মা আর অনাবৃত নেই। সে আর নিঃসঙ্গ বা অসহায় নয়। এখন আর সে তার মালিকপত্নীর ভয়ে ভীত নয় আগের মতো। এখন একজন তার পাশে আছে। প্রতিরক্ষাগত এক উত্তপ্ত আশ্বাসে তার অসহায় নিঃসঙ্গতার যত সব হিমশীতল বেদনা কোথায় উবে গেছে।

এই সব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে তার সকালের কাজে যথারীতি মন দেয় কসেত্তে। সে প্রথমে সিঁড়িগুলোতে ঝাঁট দিতে থাকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে সে কাজ ফেলে, কাজের কথা ভুলে থমকে দাঁড়িয়ে তার পকেটের ভেতর চকচকে স্বর্ণমুদ্রাটাকে দেখতে থাকে।

এমন সময় মাদাম থেনার্দিয়ের এসে শান্ত কণ্ঠে তাকে বলে, তোমাকে এখনি আসতে হবে।

কসেত্তে নিচের তলায় নেমে এলে নবাগত তার পুঁটলি খুলে আট বছরের এক মেয়ের উপযুক্ত দামি পশমি পোশাক, মোজা আর জুতো বার করে দিল। তার সঙ্গে একটা শালও আছে। সব পোশাকের রঙগুলো কালো।

নবাগত বলল, এইগুলো সব তোমার। যত তাড়াতাড়ি পার, পরে নাও।

সেই মঁতফারমেলে সকাল হতেই বাড়ির সদর দরজা খুলতে শহরের অনেকইে দেখল দীনহীনের মতো পোশাকপরা একটি লোকের সঙ্গে একটি ছোট মেয়ে দামি পোশাক পরে একটা বড় পুতুল হাতে র‍্যু দ্য প্যারিসের পথে হেঁটে চলেছে। ওরা যাচ্ছে লিভরি’র পথে। লোকটি কে তা শহরের কেউ চিনতে পারল না। ভালো পোশাক পরে থাকায় কসেত্তেকেও চিনতে পারল না তারা।

কোথায় কার সঙ্গে যাচ্ছে তা কসেত্তে নিজেও জানত না। সে শুধু জানত চিরদিনের মতো থেনার্দিয়েরদের বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছে সে। কেউ তাকে বিদায় দেয়নি সে বাড়ি থেকে, সে-ও বিদায় জানায়নি কাউকে। সে যেমন এতদিন ধরে এক তীব্র ঘৃণা পেয়ে এসেছে তাদের কাছ থেকে তেমনি তাদের প্রতিও এক তীব্র ঘৃণা নিয়েই সে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এতদিন সে তার কোনও সহজাত অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারেনি।

গম্ভীরভাবে পথ হেঁটে চলেছিল কসেত্তে। মাঝে মাঝে বিস্ফারিত চোখের দৃষ্টি দিয়ে তাকাচ্ছিল মুক্তনীল আকাশের পানে। জীবনে আজ প্রথম মুক্তির আনন্দ অনুভব করল সে। তার ওপর স্বর্ণমুদ্রা আর পুতুল। স্বর্ণমুদ্রাকে তার নতুন অ্যাপ্রনের পকেটে রেখেছিল আর মাঝে মাঝে উঁকি মেরে দেখছিল। এক একবার সে নিঃশব্দে পথ চলতে থাকা তার পাশের লোকটিকেও দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল সে যেন ঈশ্বরের অনেক কাছে চলে এসেছে।

.

১০.

মাদাম থেনার্দিয়ের তার অভ্যাসমতো বড় কিছু প্রাপ্তির আশায় স্বামীকে নবাগতের কাছে ছেড়ে দিয়ে অন্যত্র চলে গেল। নবাগত কসেত্তেকে নিয়ে হোটেল ছেড়ে চলে যাবার মিনিট পনেরো পর থেনার্দিয়ের তার স্ত্রীকে ডেকে পনেরো শো ফ্রাঁ দেখাল।

কিন্তু মাদাম থেনার্দিয়ের তাতে রুষ্ট হয়ে বলল, শুধু এই পেলে?

গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে স্বামীকে বরাবর সমর্থন করে আসছে মাদাম থেনার্দিয়ের। একমাত্র এই ব্যাপারেই জীবনে আজ প্রথম প্রতিবাদ করল সে তার স্বামীর কাজের।

কথাটার আঘাতে হুঁশ হল তার স্বামীর।

থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক বলেছ, আমিই বোকা। আমার টুপিটা কোথায়?

এই বলে সে নোটগুলো পকেটে ভরে রেখে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। কিন্তু সে বা দিকে না গিয়ে ডান দিকের পথ ধরল। তার পর যখন পথে একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল একটা ভবঘুরের মতো লোক একটা মেয়েকে সঙ্গে করে উল্টো দিকে গেছে তখন সে ঘুরে আবার ঠিক পথ ধরল। সে লিভরি’র পথে জোরে ছুটতে লাগল।

পথে ভাবতে লাগল থেনার্দিয়ের, হলুদ কোটপরা লোকটা নিশ্চয় লক্ষপতি আর আমি বোকা। প্রথমে সে কুড়ি স্যু দেয় তার পর পাঁচ ফ্রাঁ। তার পর পঁচিশ আর তার পর পনেরো শো ফ্রাঁ। এত সব দেয় প্রতিবাদের একটা গুঞ্জনও না তুলে। তাকে জোর করে চেপে ধরলে সে নিশ্চয় পনেরো হাজার ফ্ৰাঁ দিত। যাই হোক, আমি তাকে ধরে ফেলব।

তাছাড়া তার সেই পুঁটলিটাতে মেয়েটার সব পোশাক আগে হতেই নিয়ে এসেছিল। এটা সত্যিই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ও কী করে কসেত্তেকে চিনল, তার জন্য পোশাকই-বা আনল কী করে? ধনীদের রহস্য কে জানে? তাদের কাছ থেকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় কিভাবে করতে হয়, তা জানতে হয়। তাই সে বারবার ভাবতে লাগল, আমি বোকা।

মঁতফারমেল গা-টাকে পেছনে ফেলে লিভরি যাবার পথের মোড়ে এলেই দেখা যায় সামনে এক বিরাট প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে পথটা চলে গেছে। থেনার্দিয়ের ভাবল, এইখানে সে লোকটার দেখা পাবে। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে সে কিছুই দেখতে পেল না। এইখানে আর একজনকে জিজ্ঞাসা করতে হল। কিছুটা সময় নষ্ট হল। একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, তারা গ্যাগনির দিকে একটা বনের মধ্য দিয়ে গেছে।

এ অঞ্চলের সব পথঘাট চেনা ছিল থেনার্দিয়েরের। সে তাড়াতাড়ি সেইদিকে চলে গেল। মেয়েটা নিশ্চয় বেশি জোরে হাঁটতে পারবে না।

হঠাৎ থেমে কপালে একটা হাত দিয়ে কী দেখতে লাগল থেনার্দিয়ের। সে নিজের মনে মনে বলল, আমার বন্দুকটা আনা উচিত ছিল।

উপর থেকে দেখলে মনে হবে থেনার্দিয়ের একজন সৎ ব্যবসায়ী। একজন শান্ত নিরীহ নাগরিক। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে স্বার্থপূরণের উপযুক্ত সুযোগ পেলে সে এক পুরো শয়তান হয়ে উঠতে পারে। সে ব্যবসায়ী হলেও আসলে সে একটা রাক্ষস।

কিছুক্ষণ ভেবে সে ঠিক করল তাদের সন্ধানে এখন কালবিলম্ব না করে এগিয়ে যাবে। এখন ফিরে গিয়ে বন্দুক আনতে গেলে তারা তার নাগালের বাইরে চলে যাবে। শিকারের গন্ধে উন্মত্ত খেকশিয়ালের মতো সে ছুটতে লাগল। অবশেষে বড় প্রান্তরটা পার হয়ে একটা পাহাড়ের ধারে একটা বনের প্রান্তে একটা টুপি দেখতে পেল। থেনার্দিয়েরের মনে হল এরা এক জায়গায় বসে আছে। মেয়েটার পুতুলের মাথাটা দেখা যাচ্ছে।

সে ঠিকই ভেবেছিল। কসেত্তে’র বিশ্রামের জন্য লোকটা কিছুক্ষণ বসেছিল সেখানে।

থেনার্দিয়ের তাদের সামনে গিয়ে সরাসরি বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে, আমি আপনার পনেরো শো ফ্রাঁ ফিরিয়ে দিচ্ছি।

এই বলে সে তিনটে ব্যাংকনোট দেবার জন্য তুলে ধরল।

নবাগত তার মুখপানে তাকিয়ে বলল, এর মানে?

থেনার্দিয়ের গম্ভীরভাবে বলল, এর মানে মঁসিয়ে আমি কসেত্তেকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

কসেত্তে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে লোকটিকে জড়িয়ে ধরল।

নবাগত থেনার্দিয়েরের মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শান্ত কণ্ঠে বলল, আপনি কসেত্তেকে নিয়ে যাবেন?

থেনার্দিয়ের বলল, হ্যাঁ মঁসিয়ে। আমি অনেক ভেবেছি। তাকে আপনার হাতে তুলে দেবার আমার কোনও অধিকার নেই। আমার একটা সম্মান আছে। মেয়েটা আমার নয়, ওর মা আমার কাছে ওকে রেখে গেছে। সুতরাং তার মায়ের হাতেই আমাকে তুলে দিতে হবে তাকে। আপনি হয়তো বলবেন তার মা-বাবা মারা গেছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে সে লোক তার মায়ের সই করা কোনও চিঠি দেখাবে তারই হাতে তুলে দিতে হবে মেয়েটাকে। এই চিঠি খুবই আবশ্যক।

নবাগত তার পকেট থেকে আবার সেই চামড়ার প্যাকেটটা বার করল। তাতে অনেক ব্যাংকনোট ছিল।

থেনার্দিয়ের ভাবল লোকটা তাকে আবার টাকার ঘুষ দিতে আসছে। এই সময় তার বন্দুকটা থাকলে ভালো হত।

নবাগত প্যাকেটটা বার করার আগে তার চারদিকে একবার তাকাল। জায়গাটা একেবারে নির্জন। কেউ কোথাও নেই। প্যাকেটটা খুলে নোটের পরিবর্তে সে একটা কাগজ বার করল। কাগজটা ভাঁজ করে সে থেনার্দিয়েরের হাতে তুলে দিল।

নবাগত বলল, আপনি এটা চেয়ে ঠিকই করেছেন। দয়া করে পড়ে দেখুন। থেনার্দিয়ের দেখল একটা ছোট্ট চিঠি। সে পড়তে লাগল,

মন্ত্রিউল-সুর-মের
২৫ মার্চ, ১৮২৩ সাল।

মঁসিয়ে থেনার্দিয়ের,

আপনি পত্রবাহকের হাতে কসেত্তেকে দিয়ে দেবেন। আপনার পাওনা টাকা সব শোধ করে দেবেন উনি। আমার শ্রদ্ধা গ্রহণ করবেন।

ফাঁতিনে

নবাগত বলল, আপনি স্বাক্ষরটা বুঝতে পারছেন?

থেনার্দিয়ের বুঝতে পারল, হাতের লেখাটা যে ফাঁতিনের সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কোনও উত্তর খুঁজে পেল না থেনার্দিয়ের। দু দিক থেকে রাগ হতে লাগল। নবাগতের কাছ থেকে আর কোনও টাকা পাওয়ার কোনও অবকাশ বা উপায় রইল না। তার ওপর তাকে হার মানতে হল।

নবাগত বলল, আপনি চিঠিটা প্রমাণ হিসেবে রেখে দিতে পারেন।

থেনার্দিয়ের একবার শেষ চেষ্টা করে বলল, সইটা ভালোভাবেই জাল করা হয়েছে। তবু যাই হোক, আপনি যখন চিঠিটা এনেছেন আপনার কথাই মেনে নিচ্ছি। তবে লেখা আছে আমার সব পাওনা মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু সে তো অনেক টাকা হবে।

নবাগত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, মঁসিয়ে থেনার্দিয়ের, কসেত্তে’র মা গত জানুয়ারি মাসে বলেছিল তার কাছ থেকে আপনি একশো কুড়ি ফ্র পাবেন। ফেব্রুয়ারি মাসে আপনি পাঁচশো ফ্রা’র এক বিল পাঠান। আপনি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে তিন শো ফ্রাঁ আর মার্চের শেষে তিনশো ফ্ৰাঁ পান। তার পর ন’ মাস কেটে গেছে। মাসে পনেরো ফ্রাঁ করে দেবার কথা হয়েছে। তা হলে এই ন’মাসের জন্য আপনার পাওনা হয় এক শো পঁয়ত্রিশ ফ্রাঁ। আপনাকে প্রথমেই এক শো ফ্ৰাঁ অগ্রিম দেওয়া হয়েছিল। তা হলে আপনি সব বাদ দিয়ে মাত্র পঁয়ত্রিশ ফ্র পাবেন। অথচ আপনাকে আমি পনেরো শো ফ্রাঁ দিয়েছি।

থেনার্দিয়েরের মনে হল সে ফাঁদেপড়া এক নেকড়ে। সে ভাবতে লাগল, কে এই শয়তান?

থেনার্দিয়ের তখন সব ভদ্রতা ঝেড়ে ফেলে বলল, হে নাম-না-জানা ভদ্ৰ মহাশয় আপনাকে আরও এক হাজার ফ্রাঁ দিতে হবে। তা না হলে আমি কসেত্তেকে নিয়ে যাব।

নবাগত শান্ত কণ্ঠে ডাক দিল, এস কসেত্তে।

সে বাঁ হাত দিয়ে কসেত্তেকে তুলে ধরে ডানহাত দিয়ে তার ছড়িটা তুলে নিল মাটি থেকে। যেনার্দিয়ের ভাবল ছড়িটা লাঠির মতো, মাথায় গোল হাতল আছে। তার উপর। জায়গাটা নির্জন। আর কোনও কথা না বলে নবাগত কসেত্তে’র হাত ধরে বনের মধ্যে ঢুকে গেল। থেনার্দিয়ের সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল বজ্রাহতের মতো। সে নবাগতের চওড়া কাঁধ আর হাতের মুঠোগুলোর সঙ্গে তার নিজের রোগা রোগা চেহারাটার তুলঁনা করে ভয় পেয়ে গেল। সে নিজের মনে বলতে লাগল, আমি কী বোকা, সঙ্গে বন্দুকটা শিকার করতে যাচ্ছি বলে আনতে পারতাম।

তবু সে আশা ছাড়ল না। সে ভাবল, ওরা কোথায় কোন দিকে যাচ্ছে তা অন্তত দেখব।

এই ভেবে সে ওদের অনুসরণ করতে লাগল। এই বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে লাগল সে ফাঁতিনের সই করা একটা চিঠি হাতে পেয়েছে। তাতে অবশ্য তার কোনও লাভ হবে না। কিন্তু পনেরো শো ফ্ৰাঁ সে পেয়েছে।

নবাগত কসেত্তেকে সঙ্গে নিয়ে লিভরির দিকে এগিয়ে চলেছিল। এক বিষণ্ণ চিন্তায় মাথাটা নত করে পথ হাঁটছিল সে। শীতের মরশুমে সব গাছের পাতা ঝরে যাওয়ায় বনের ফাঁকে ফাঁকে তাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। এরপর লোকটা কসেত্তেকে নিয়ে কতকগুলি গাছের জটলার আড়ালে চলে গেল। থেনার্দিয়ের আর তাদের দেখতে পেল না। একটা আস্ত শয়তান’ এই বলে সে তাদের ধরার জন্য ছুটতে লাগল।

বনটা সেখানে ঘন থাকায় উভয় পক্ষে পথ চলায় অসুবিধা হচ্ছিল। থেনার্দিয়ের যথাসম্ভব গাছের আড়ালে অনুসরণ করলেও নবাগত একসময় পেছন ফিরে তাকে দেখতে পেল। সে মাথা নেড়ে আবার পথ চলতে লাগল। থেনার্দিয়ের তবু অনুসরণ করতে থাকায় নবাগত আবার পেছন ফিরেই তাকে দেখতে পেল। কিন্তু এবার সে থেনার্দিয়েরের পানে এমন ভয়ঙ্করভাবে তাকাল যে থেনার্দিয়ের বুঝল আর অনুসরণ করা। উচিত নয় তার পক্ষে। তাই সে ঘুরে বাড়ির পথে রওনা হল।

.

১১.

সমুদ্রে পড়ে গিয়ে জাঁ ভলজাঁ’র মৃত্যু হয়নি। আমরা জানি সে যখন জাহাজ থেকে সমুদ্রের জলে পড়ে যায় অথবা নিজে থেকেই ঝাঁপ দেয় তখন তার পায়ে শিকল ছিল না। সে জলের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কেটে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজের পাশে একটা নৌকোয় গিয়ে ওঠে এবং রাত্রি না হওয়া পর্যন্ত সেই নৌকোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে। অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠার পর সে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে ক্যাপ ব্রান থেকে কিছু দূরে কূলের উপর একটা জায়গায় ওঠে। তার কাছে টাকা থাকায় তাই দিয়ে জামা-প্যান্ট কিনে নেয়। তার পর সে বানাগিয়েরের কাছে একটা মদের দোকানে গিয়ে ওঠে। সেই দোকানে পলাতক কয়েদিদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করা হত। এরপর জাঁ ভুলা অন্যান্য পলাতক কয়েদিদের মতো অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে পথ চলতে থাকে এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। সে প্রথমে বোসেতের। কাছে লে পার্দো নামে এক জায়গায় আশ্রয় পায়। সেখানে থেকে হতেস আল্পস-এর অন্তর্গত ব্রিয়া নামে একটা গাঁয়ে যায়। এইভাবে ছুঁচোর মতো লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে-সেখানে বেড়াত। পরে সে পিরেনিজের অন্তর্গত একটা গাঁয়ে এবং তার কাছাকাছি পেরিগো নামে আর একটা গাঁয়ে যায়। সেখানে থেকে কালক্রমে প্যারিস এবং পরে প্যারিস থেকে যায় মঁতফারমেলে।

প্যারিসে গিয়ে সে প্রথমে একটা ঘর ভাড়া করে এবং তার পর আট বছরের মেয়ের জন্য শোকসূচক কালো পোশাক কেনে। পরে পুলিশ জানতে পারে মন্ত্রিউল সুর-মেরের পুলিশ-হাজত থেকে পালাবার পর ভলজাঁ একবার তফারমেল ও তার পাশাপাশি এলাকায় যায়। কিন্তু জেলের কয়েদি হিসেবে কাজ করতে করতে একটা। লোককে বাঁচাবার পর সমুদ্রের জলে যখন সে পড়ে যায় তখন সবাই ভাবে সে মারা গেছে। পুলিশের এখনও ধারণা সে আর জীবিত নেই। ভলজাঁ নিজেও খবরের কাগজে প্রকাশিত তার মৃত্যুর খবরটা দেখে আশ্বস্ত হয়। তার মনে হয় সে সত্যিই মারা গেছে।

মঁতফারমেল থেকে কসেত্তেকে উদ্ধার করার পর ভলজাঁ তাকে প্যারিসে নিয়ে যায়। সন্ধ্যার পর প্যারিসে পৌঁছবার পর একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে এসপ্লানেদ দ্য অবজারভেটারির কাছে গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে কসেত্তে’র হাত ধরে নির্জন গলিপথ দিয়ে বুলভার্দ দ্য হপিতালে গিয়ে ওঠে।

একটা দিনের মধ্যে কসেত্তে’র জীবনে কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে যায়। পথে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও গাড়িতে আসে তারা। পথের ধারে যেসব দোকান পায় তার থেকে রুটি আর মাখন কিনে বনের মধ্যে বসে দু জনে খায়। পথ হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে কসেত্তে। তবু সে তার ক্লান্তির কথা বলেনি। এক সময় ভলজাঁ তার ক্লান্তির কথা বুঝতে পেরে তাকে পিঠের উপর চাপিয়ে পথ হাঁটতে থাকে। কসেত্তে হাতের পুতুলটা ধরে তার ঘাড়ে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *