॥ ত্রিশ ॥
অণিমার সান্নিধ্য কোনওদিনই খারাপ লাগেনি সোমেনের। ওকে ভয় পাওয়ারও কিছু ছিল না। খুব ঠান্ডা মাথার মেয়ে অণিমা। সব সময়ে মুখখানা সিরিয়াস করে বিচ্ছুর মতো ইয়ারকি দেয়।
কিন্তু এ অণিমা যেন সে নয়।
অণিমা ফিরে তাকাল। আবছা অন্ধকারে ওর মুখচোখ দেখা যায় না। কিন্তু শ্বাসের শব্দ আসে। অণিমা খুব নার্ভাস আজ! যেন বা শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, এমনভাবে নাক টানল। বলল—বললে না?
সোমেনের গলার স্বর অন্যরকম হয়ে গেল। সে প্রায় ধরা গলায় বলে—কোন কথাটা? অণিমা জানালার দিকে পিছন ফিরে জানালার গ্রিল-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দুটো তুলে পিছনে মুড়ে জানালার গ্রিল ধরে আছে। ভঙ্গিটা শিথিল, কেমন যেন। বলল সেই কথাটা। যেদিন চাঁদ উঠবে, ফুল ফুটবে, লোডশেডিং থাকবে, সেদিন আমরা দুজন দূরে কোথাও গিয়ে
—ও। বলে হাসল সোমেন। প্রাণহীন হাসি।
— কথাটা কিন্তু কোনওদিনই বলোনি।
—আজ কি বলব অণিমা?
—বলো। কেন, শুনে কী হবে?
—শুনতে ইচ্ছে করছে। কেউ তো কোনওদিন বলেনি।
—যাঃ। তোমাকে অনেকে বলেছে।
অণিমা একটু হাসল, বলল—বললেই বা। তুমি তো বললানি।
—ভয় পেতাম অণিমা। যা মেয়ে তুমি, শুনেই হেসে উঠবে হয়তো।
—নইলে সিরিয়াসলি বলতে?
সোমেন উত্তর দিল না।
একটা ফোঁপানির মতো কাঁপা শ্বাস ফেলে অণিমা বলে—আমি খুব ইয়ারকি করি, না?
আর তৎক্ষণাৎ ঘটনাটা ঘটল বজ্রপাতের মতো। সোমেন জানত না, এতটা হবে।
ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়েছিল সোমেন, প্রতিরোধহীন। জানালার চৌকো আলোর পরদায় ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল অণিমা। হঠাৎ অণিমার ছায়া খসে পড়ল। নিঃশব্দ, নরম পায়ে অণিমা ছুটে এসে হঠাৎ দুটো জোরালো হাতে সোমেনের দু-কাঁধ খামচে ধরল আশ্লেষে, টেনে আনল নিজের দিকে। অন্ধকারে একটু বুঝি সময় লাগল অণিমার। সোমেনের ঠোঁট দু-খানা খুঁজতে। তারপরই সোমেন দু-খানা তুলোর চেয়েও নরম, উত্তপ্ত, আঠালো ঠোঁটের স্বাদ পেল নিজের ঠোঁটে।
বিশ্বাস হয় না। তবু ঘটনাটা ঘটছে। এমন নয় যে, সোমেন কাউকে কখনও চুমু খায়নি। কিন্তু অণিমা এত অন্যরকম। কী করে হয়! ভেবে কাঠের মতো হয়ে গেল সোমেন। শরীরে থরথরানি, কিন্তু আড়ষ্ট, ভীত। কী গভীর ঝড়ের মতো শ্বাস ফেলল অণিমা তার মুখে। সেই শ্বাসের বাতাস এত গরম যেন চামড়া পুড়ে যায় সোমেনের। অণিমার শরীরের ভিতরে বুঝি জ্বর? ভয়ংকর এক জ্বর! দুই হাতে সোমেন অণিমাকে ধরতে যাচ্ছিল বুঝি। অণিমা তখন সরে গেল আচমকা।
জানালায় ঠিক আগের মতো হয়ে দাঁড়াল। সোমেনের দিকে পিঠ। আস্তে করে বলল—এটা কিন্তু ইয়ারকি নয়।
অণিমার গলাটা ধরা-ধরা। প্রবল শ্বাস। হাঁফাচ্ছে। সোমেন হাতের পিঠে ঠেটি মুছে নেয়। কিছু বলার নেই। জীবনে এরকম কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যার কোনও অর্থ হয় না। আর কি কোনওদিন সোমেন ইয়ারকি করতে পারবে অণিমাকে নিয়ে? কেমন যেন মন খারাপ হয়ে গেল সোমেনের। বলল—তুমি পাগল আছ, মাইরি!
অন্ধকারেই অণিমা একবার ফিরে তাকাল তারদিকে। একবার নাক টানল। তারপর খুব সহজ হয়ে একবার বলল—ও ঘরে যাও সোমেন। গাব্বু আজ পড়বে না।
করিডোরটা পার হয়ে সামনের ঘরে আসবার পথটুকুতে সোমেন তার শরীরে অণিমার গন্ধ পাচ্ছিল। অণিমার গায়ে কোনও দামি সুগন্ধী ছিল, মুখে ছিল রূপটান। এসব অণিমা বড় একটা মাখে না। আজ কেন মেখেছিল কে বলবে? সবচেয়ে বেশি সজাগ হয়ে আছে সোমেনের ঠোঁটে অণিমার মুখের স্বাদ। সেই সঙ্গে একটা অনিচ্ছুক, কিন্তু তীব্র কামবোধ। শরীর তো মনের বশ নয়। সোমেনের বুকের মধ্যে একটা ধুকধুকুনি উঠেছে, চোখেমুখে রক্তোচ্ছাস। বাইরের ঘরের আলো আর অনেক চোখের চাউনির মধ্যে এসে দাঁড়াতেই তার বড্ড লজ্জা হতে লাগল।
ঘরের মাঝখানে ম্যাক্স দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা চোথা কাগজ। চোখ দুটোয় নীল আগুন। ওই আগুনের রহস্য আজও ভেদ হয়নি সোমেনের কাছে। ওই নিরীহ রোগা সাহেব লোকটার চোখ ওরকম জ্বলে কেন? কাগজ হাতে ম্যাক্স দাঁড়িয়ে চারধারটা ওই আগুনে-চোখে দেখে নিচ্ছিল।
ঘরের কোণে একটা প্রকাণ্ড গোল টেবিলের ওপর বসেছিল অপালা। ঝুটো হারের লকেটটা মুখে পুরে চুষছে। সোমেনকে বড় বড় চোখের দৃষ্টিতে প্রায় ছ্যাঁদা করে দিল। ঝামরে বলল—কোথায় গিয়েছিলি?
পূর্বা সোফায় অনিল রায়ের পাশে বসে আছে। মুখ ফিরিয়ে বলল—ও তো প্রাইভেট টিউটর এ বাড়ির, জানিস না?
সে কথার কোনও উত্তর দিল না অপালা। বড় স্থির চোখের চাউনিতে তাকিয়ে থেকে বলল—এখানে এসে চুপ করে বোস। ম্যাক্স একটা কবিতা পড়বে।
অনিল রায় হাত তুলে বললেন—চুপ। হাশ্ সায়লেন্স।
গোলটেবিলের ওপর অপালার পাশে উঠে বসে সোমেন। ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করে ম্যাক্স কবিতা লেখে? জানতাম না তো।
অপালা মাথা নেড়ে বলে—লেখে। আরও কত কী করে!
বাঙালির চেয়ে কয়েক পরদা গম্ভীর বাজ ডাকার মতো গুরগুরে গলায় ম্যাক্স কবিতা পড়তে শুরু করে। কবিতার নাম—গ্র্যান্ড রেস্টুরেন্ট। ইংরেজি কবিতাটার অর্থ এরকম—আমি একদিন গ্র্যান্ড রেস্টুরেন্টে যাই। তখন সকালবেলা। রেস্টুরেন্টে লোকজন ছিল না। কী চমৎকার সেই দোকানঘর! দেয়ালে দেয়ালে সুরেলা রং। কাচের তৈরি সব জানালা দরজা। মেঝেতে পুরু কার্পেট। একধারে নাচের জায়গা। টেবিল-চেয়ারগুলি কী চমৎকার। সেই সকালেও ব্যান্ড বাজছে রেস্টুরেন্টে। সেই সুর শুনে মনে হয়, পৃথিবীর সব দুঃখ বুঝি ঘুচে গেছে। আমি সেখানে বসে রইলাম অনেকক্ষণ, মনটা বড় ভাল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর আমার একবার ল্যাভেটারিতে যাওয়ার দরকার হলে আমি বেয়ারাকে ডেকে বললাম—তোমাদের ল্যাভেটারি কোনদিকে? লোকটা খুব বিনীতভাবে আমাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিল ল্যাভেটারিটা, দূর থেকে। আমি ল্যাভেটারির দরজা খুলে ঢুকেই কিন্তু শিউরে উঠলাম। এ কী নরক চারদিকে! মেঝের ওপর পড়ে আছে শেষ রাতের মাতালের বমি, বেসিনের গায়ে ফাটা আর ময়লার দাগ। মেঝেয় জল জমে আছে। আয়নাটা নোংরা। তেমন নোংরা ওদের কমোড। আমি দৌড়ে ফিরে এলাম, সোজা গিয়ে ম্যানেজারের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম—কেন তোমার সামনের দোকানটা এত ঝকমকে? আর কেনই বা তোমার ল্যাভেটারি এত নোংরা? কেন তোমার ল্যাভেটারিটাও নয় তোমার রেস্টুরেতে মতোই পরিষ্কার? আমি এই কথা চিৎকার করে যত বলি, লোকটা তত অসহায়ের মতো বলে—আমি কী করব, তামার কী করার আছে?
কয়েকজন ক্ষীণ হাততালি দিল। বোঝা গেল যে, কেউ কিছু বোঝেনি।
অপালা সোমেনের কানে কানে বলে—কী সব পড়ল রে? বাথরুমটা নোংরা বলে অত রাগ কেন?
সোমেন খানিকটা স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে বলল—ওটা আসলে বাথরুম নয়।
—তবে কী?
—সভ্যতার অভ্যন্তর। সভ্যতার বাইরের দিকটাই চকচকে, ভিতরটায় নোংরা জমে যাচ্ছে।
অপালা চোখ বড় বড় করে বলে—বাঃ, তুই তো বেশ কবিতা বুঝিস।
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—আমি বেশি বুঝি না, তবে তোরা কিছু কম বুঝিস।
—আমরাও কিছু কম বুঝি না। বলে অপালা বড় বড় চোখে একবার সোমেনের দিকে দেখে নিয়ে মুখটা ফিরিয়ে বলে—মেয়েদের কাছে তোর এখনও ঢের শেখার আছে।
কবিতার মাঝখানে কখন যেন অণিমা ঘরে এসেছে। একটু ঘুরল এদিক-ওদিক। ম্যাক্স যে মোড়ায় বসে আছে তারই পাশে মেঝের ওপর বসল দীনদরিদ্রের মতো। মুখখানা এখনও বুঝি একটু লাল। আর কিছুটা অন্যমনস্ক। সোমেনের চোখে চোখ পড়ল একবার। একটু ক্ষীণ হাসল। চোখ সরিয়ে নিল আস্তে আস্তে। কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যেই ওর কি কিছু পরিবর্তন ঘটে গেল? লজ্জা করছিল সোমেনের।
চায়ের আর বিস্কুটের ট্রে নিয়ে চাকর এল ঘরে। সবাই চা নিচ্ছে, ঘরের মাঝখানে একটু হুড়োহুড়ি। কেবল সোমেন চা নিতে উঠল না, অণিমাও নয়। সোমেন ভাবে—আমরা অন্যরকম হয়ে গেলাম। এরকমই কি হওয়া উচিত ছিল? এটা কি স্বাভাবিক! ভাবতে গেলে অস্বাভাবিক কিছু নয়। বয়সের ছেলেমেয়ে, হলে দোষ কী? কিন্তু মনটা কখনও প্রস্তুত ছিল না তো সোমেনের! প্রেম নিয়ে কত ঠাট্টা করেছে তারা। বিপজ্জনক সব ঠাট্টা। মনে কিছু থাকলে কি ওরকম ঠাট্টা করা যায়!
চায়ের পর রিহার্সাল শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু হুল্লোড়ে তা আর হল না। এখন নিছক আড্ডা চলবে। সোমেনের কিছুক্ষণ একা হয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। সকলের অন্যমনস্কতায় সে টুপ করে উঠে পড়ল একসময়। দরজার কাছ বরাবর গিয়ে একবার চোর-চোখে ফিরে তাকাল। দেখল আর কেউ নয়, কিন্তু অণিমা ঠিক অপলক চোখে চেয়ে আছে।
সোমেন মুখটা ফিরিয়ে নিল। বারান্দা পার হয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই অণিমার ডাক শুনতে পেল—শোনো।
সোমেন দাঁড়ায়—কী?
—গাব্বুকে এরপর পড়াবে তো?
সোমেন যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলে—পড়াব না কেন?
অণিমা একটু হেসে বলল—ভয় ছিল, তুমি—তোমার খুব রাগ হয়নি তো!
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—না তো! তবে কেমন অন্যরকম লাগল অণিমা।
—বোকা, অন্যরকম আবার কী! তুমি ভারী উলটোপালটা মনের ছেলে।
—এতকাল টের পাইনি তো কিছু।
—সে তোমার বোঝার দোষ। কিছু ভুল হয়নি সোমেন। আমি তোমাকে জানাতে চাইছিলাম। হয়তো কাজটা নির্লজ্জ হয়েছে।
সোমেন মুখ তুলে অণিমাকে দেখল। বেশ সুন্দরীই অণিমা। বয়স সোমেনেরই মতো। তাদের ভালবাসা হতে কিছু আটকায় না। তবু কেন যে সোমেনের মনটা দোমড়ানো কাগজের মতো হয়ে আছে! তাতে অনেক ভাঁজ, অনেক আলো অন্ধকারের ইকড়ি-মিকড়ি। কোথায় যেন আটকাচ্ছে।
—চলি। সোমেন বলল।
অণিমা বুঝি কিছু আকুলতাভরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে আসতে বলে—শোনো, আর একটা কথা।
—কী?
—তোমার কোনও ভয় নেই। আমি ভূতের মতো তোমার ঘাড়ে ভর করব না।
—বুঝলাম না আণিমা।
— বলছি। আজ যা করেছি তা একটা স্মৃতিচিহ্নের মতো রইল।
সোমেন অবাক হয়ে বলে—তার মানে?
অণিমা হাসল। আকাশে জ্যোৎস্না রয়েছে। সেই জ্যোৎস্নায় বড় ম্লান দেখাল হাসিটি। বলল—আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। বৈশাখে। কাউকে এখনও জানাইনি। তোমাকে জানালাম প্রথম।
সোমেনের শরীরে একটা বিদ্যুৎ স্পর্শ করল হঠাৎ। বাতুলের মতো চেয়ে থেকে সে বলে—কী বলছ অণিমা?
—সত্যি সোমেন। গাড়ি-বাড়িঅলা এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে।
সোমেনের বুকটা হঠাৎ বায়ুশূন্য হয়ে যায়। দম নিতে কষ্ট হয় তার। বড় আশ্চর্য ব্যাপার। একটু আগে অণিমা যখন চুমু খেয়েছিল তখন থেকে এই সময়টুকুর মধ্যে তার মনে মনে একটা প্রত্যাশা তেরি হয়েছিল। তার ভিতরে যেন সর্বদাই বাস করে অন্য এক সোমেনের যার সঙ্গে এই সোমেনের ইচ্ছের মিল নেই। সেই অন্য সোমেন বুঝি এই ক্ষণেক সময়টুকুতেই অণিমাকে নিজের বলে চিহ্নিত করে রেখে দিয়েছিল। ভিতরের সেই সোমেনটাই এখন মার খেয়ে মুষড়ে ওঠে।
—তা হলে আজকের ব্যাপারটা কেন করলে অণিমা?
অণিমা ঘন গভীর শ্বাস ফেলে একটা। বলে—তোমাকে জানিয়ে দিলাম যে, জীবনে আমি কত অসুখী হব। ওরকম না করলে তুমি বুঝতে না সোমেন। এখন বুঝবে। মনে রাখবে।
হঠাৎ সোমেন তার ভুবনজয়ী হাসিটা হাসে। বলে—ধ্যাৎ। তুমি ভারি ইমোশনাল, এমন তো ছিলে না?
অণিমাও হাসে। হঠাৎ ডান হাতখানা বাড়িয়ে পাকা জুয়াড়ির মতো গলায় বলে—কুইটস।
সোমেন হাতটা ধরে। বলে—শোধবোধ।
অণিমা হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে—এসো সোমেন। গাব্বুকে পড়িও। লজ্জার কিছু নেই। সোমেন মাথা নাড়ল।
নির্জন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোমেন ভাবে—অণিমার হাতটা কেন অত ঠান্ডা?
সোমেন বড় অস্থির বোধ করে। অনেক দূর রাস্তা আপনমনে হাঁটতে থাকে। মাথাটা গরম হয়। একবার নিজের থেকেই হেসে উঠল সে। একবার মাথা নেড়ে বলল—আহা রে। এবং প্রথম বুঝতে পারল, অণিমার বিয়ে হয়ে গেলে তার মন খুব খারাপ লাগবে। বড্ড একা লাগবে তার।
কয়েক দিন ধরে মনটা খারাপ রইল সোমেনের। একটি মুহূর্তের ঘটনাটুকুকে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা গেল না। বার বার ম্লান জ্যোৎস্নায় অণিমার প্রেত হাসিটুকু মনে পড়ে। বুকটা বায়ুশূন্য হয়ে যায়।
কয়েকদিন গাব্বুকে পড়াতে গেল না সোমেন। খুব আড্ডা দিয়ে বেড়াল এদিক-ওদিক। কিন্তু মনের মধ্যে কেবলই বুকচাপা দম আটকানো কষ্ট হয়। এই বয়সের মধ্যে সোমেন কখনও এমন গভীর কষ্ট ভোগ করেনি। বার বার ভাবে, একটা সিদ্ধান্তে আসতে চেষ্টা করে। কিন্তু কিছু হয় না। কষ্টটা থেকে যায়। ঘুমের মধ্যেও ছটফট করে সোমেন। যখন জেগে থাকে তখন বড় আনমনা হয়ে থাকে। অণিমা সবই স্পষ্ট করে বলেছে তাকে। তবু সসামেনের বড় ঝাপসা লাগে। মাঝে মাঝে তার পাগলামি করতে ইচ্ছে করে।
আবার একদিন গাব্বুকে পড়াতে গেল সোমেন। যতক্ষণ পড়াল ততক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে রইল, বারবার ফিরে তাকাল দরজার দিকে। অণিমার দেখা পাওয়া গেল না। গাব্বুকে অণিমার কথা জিজ্ঞেস করতে তার ভয় হচ্ছিল, যদি গাব্বু কিছু টের পেয়ে যায়!
দু-চারদিন পড়ানোর পর একদিন ধৈর্য হারিয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল সোমেন—তোমার দিদিভাই কোথায়?
মোটাসোটা ফরসা আর খুব স্মার্ট ছেলে গাব্বু। চোখে কথা খেলাতে পারে। মিচকি হেসে বলে—আপনি জানেন না! দিল্লি গেছে পিসির বাড়ি বেড়াতে।
সোমেনের আর কিছু বলার থাকে না। সে কেবল ক্ৰমে একজন দুঃখী যুবকের রূপ ধরতে থাকে। একটা চুমু কি ভীষণ ট্র্যাজিক হতে পারে!
এই দুঃখের দিনে আচমকা একটা ঘটনা ঘটে গেল একদিন।
॥ একত্রিশ ॥
আজকাল কেমন বিকেলবেলার মতো বিষয় হয়ে থাকে সোমেনের মন। মনের মধ্যে যেন এক বাসাবদল চলছে। নিজের ঠাঁই ছেড়ে মন চলল কোথায়! চৈত্রের বুক-শুকনো করা গরম বাতাস বয় এখন। সারা গায়ে ধুলো মেখে পিঙ্গল হয়ে থাকে কলকাতা। গাছপালাহীন শানবাঁধানো শহরের আবহে জ্বোরো রুগির গায়ের তাপ৷ দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল আসছে। ঋতুর এই পরিবর্তন তেমন লক্ষ করে না সোমেন। অন্যমনস্কতাই তার সঙ্গী আজকাল। একটি চুম্বনে তাকে বিদীর্ণ করে দিয়ে গেছে অণিমা।
মাঝে মাঝে শীত করার মতো শিউরে ওঠে গা। মাঝে মাঝে তাকে চাবুক মারে স্মৃতি। মনে পড়ে সেই পাগল চুমু-খাওয়া। কোনও মানে হয় না। এও কি অণিমার কোনও ইয়ারকি। এক-একবার ইয়ারকি বলে মনে হয়। তখন বুকে একরকমের কষ্ট টের পায়। যখন ভাবে, ইয়ারকি নয়, তখন একরকমের রহস্যের ঘন গন্ধ ভরে ওঠে বুক।
মানুষের ভিতরে এক অনন্ত জগৎ রয়েছে। নিজের ভিতরে ডুবুরির মতো নেমে যেতে সারলে দেখা যায়, এক ক্ষ্যাপা সেখানে আজব শহর-বন্দর তৈরি করে রেখেছে। অকল্পনীয় সব রঙের বুরুশ ঘষে চারদিক রঙিন করে রেখেছে সে। সেখানে অদ্ভুত সব মানুষের আনাগোনা—যাদের আর কোনওদিন পাওয়া যাবে না। সেখানে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। নাটকের মতো, বায়োস্কোপের মতো। একটা চুমু-খাওয়া তেমন কিছু আণবিক বিস্ফোরণ নয়, তবু বজ্রপাতের মতো মাঝে মাঝে গর্জে ওঠে সেই চুম্বনের স্মৃতি। মাথার মধ্যে ঝলসে ওঠে নীল ফসফরাস। অণিমা কি তাকে ভালবাসত? নাকি ইয়ারকি করে গেল? তার চব্বিশ পূর্ণ হওয়ার জন্মদিনে ও কীরকম উপহার অণিমার, ক্ষতচিহ্নের মতো চিরস্থায়ী? মনের সেই অলীক ক্ষ্যাপা জগতে অণিমার উষ্ণ শ্বস কুসুমগন্ধের মতো ছড়িয়ে থাকে। নাড়া-খাওয়া গাছের মতো কেঁপে ওঠে সোমেন। শীত করে ওঠে গায়ে কাঁটা দিয়ে এই চৈত্রেও।
অণিমাকে ভালবাসার কথা কখনও তেমন ভাবেনি সোমেন ইদানীং। এখন নাগালের বাইরে গিয়েই কি শতগুণে ফিরে এল অণিমা।
গাব্বুকে পড়াতে যায় ঠিকই। মাস—মাইনে হাত পেতে নেয়, অবিকল টিউটরের মতো। অণিমা থাকলে এই হীনমন্যতাটুকু আসত না। মাসে একশো টাকা না পেলেও চলে যাচ্ছিল একদিন। এখন ওই একশো টাকার একটা বাজেট তৈরি হয়ে গেছে মাসে। মায়ের একপো দুধের দাম, নিজের সিগারেট-দেশলাই, লন্ড্রি কিংবা রেস্টুরেন্ট, কিছু পত্র-পত্রিকা। এই দুর্দিনে একশো টাকার টিউশনি ভাবাই যায় না। স্কুল-কলেজ ছেড়ে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করা হয়েছে। কৃষিবিপ্লবের জন্য গ্রামীণ ভারতে ডাক দেওয়া হচ্ছে ছেলেদের। কলকাতার ছেলেরাও দেয়ালে দেয়ালে সেইসব কথা লিখল ঠিকই, কিন্তু স্কুল-কলেজ ছাড়ল না। পরীক্ষাটাকেই আরও সহজ করে নিল তারা। আগুন বোমা, গুলি আর ছুরি ঝলসে ওঠে চারদিকে। স্কুল-কলেজে ছাত্ররা বই খুলে পরীক্ষায় বসে। এ অবস্থায় প্রাইভেট পড়বে কে, কোন দুঃখে! পাস করা অনেক সহজ হয়ে গেছে এখন। অণিমার দেওয়া টিউশনিটা তাই বড় দুর্লভ বলে মনে হয়।
অন্যমনস্কতার মধ্যেই সেদিন গাব্বুকে পড়িয়ে ফিরছিল সোমেন। এই সব ভাল পাড়ার ভিতরে আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। খুব নির্জন। গাছপালার ছায়ায় ঘনায়মান রহস্য। একলা হাঁটতে একটু ভয় করে। কখন নিরালা ফুঁড়ে প্রেতের মতো কয়েকজন এসে ঘিরে ধরবে চারদিক থেকে, ওরা চলে গেলে পড়ে থাকবে সোমেনের লাশ। চারদিক দেখে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে সোমেন আবার মনের মধ্যে ডুবে হাঁটছিল। মনের মধ্যে এক ক্ষ্যাপার তৈরি জগৎ। দুঃখের বা পিপাসার কোনও রং নেই। কিন্তু মনের মধ্যে সেইসব অলীক রঙের আভা ঠিকই ধরা পড়ে। কত কথা ভাবে সোমেন! বুড়োমানুষদের এরকম হয়, আর কিছুই ঘটবে না, তাই তারা অতীতের স্মৃতি নিয়ে থাকে। সোমেনেরও সেই দশা আজকাল। যেন বা, যা ঘটার ঘটে গেছে জীবনে। এখন আছে শুধু তার স্মৃতি। সোমেন আজকাল বড় ভাবে।
সামনেই রাস্তার আলোর স্তম্ভ। তার নীচে গাছের ঘন এবড়ো-খেবড়ো ছেঁড়া ছায়া। সেই ছায়ায় একটা মস্ত লম্বা গাড়ি এসে ধীর হয়ে থামল। পিছনের দরজা খুলে কে যেন নামছে। লক্ষ করার মতোই দামি বিদেশি গাড়ি, অঢেল কালো টাকায় কেনা। সোমেন অবহেলাভরে একবার মুখ তুলে দেখল। গাড়ির পিছনে দামি জড়োয়া গয়নার মতো লাল আলোর অলংকার একবার উজ্জ্বল হয়ে নিল।
আধো অন্ধকারে সোমেন পেরিয়ে যাচ্ছিল গাড়িটা। যে মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমেছে সে ঝুঁকে গাড়ির সিট থেকে তার ব্যাগ কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হতেই সোমেনের মুখোমুখি দেখা। এত আবছায়ায় চিনবার কথা নয়। তবু বলল—আরে! আপনি!
রিখিয়া! সচেতন হয়ে সোমেন চেয়ে দেখল, এই তো রিখিয়াদের বাড়ি। সে অন্য মনস্কতায় পেরিয়ে যাচ্ছিল। কোনও ভুল নেই। রাস্তার আলো পড়েছে রিখিয়াদের ঘের-দেয়ালের গায়ে। তাতে আলকাতরা দিয়ে লেখা—প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। এই কথাটা রিখিয়াদের দেয়ালে সে তো দেখছে।
চুমকি বসানো কী একরকম শাড়ি পরেছে রিখিয়া, অন্ধকারেও চমকাচ্ছিল।
ভারি অপ্রস্তুত লাগছিল সোমেনের। সে কদিন দাড়ি কামায়নি। পরনে যদিও সেই বড়দির দেওয়া দামি প্যান্ট, আর বউদির দেওয়া শার্ট, তবু দুটোই চৈত্রের ধুলোয় বড় ময়লা হয়ে গেছে। বুকটায় পাখি ঝাপটাল। গলার স্বর হয়ে গেল অন্যরকম। বলল—যাচ্ছিলাম।
এটা কোনও জবাব হল না। রিখিয়া অন্যরকম বুঝল। বলল—কোথায় যাচ্ছিলেন? আমাদের বাড়ি?
যদি সোমেন ‘হ্যাঁ’ বলে এখন তবে হয়তো ভাববে—হ্যাংলা সেধে সেধে বাড়ি আসে। আর যদি ‘না’ বলে, তবে হয়তো ভাববে—ইস্, আমাদের জন্য একটুও ভাবে না তো!
সুসময়ে তো আসতই সোমেন। কিন্তু সুসময় তো আসে না।
সোমেন উত্তর না দিয়ে হাসল। তার সেই বিখ্যাত ভুবনজয়ী হাসিটি। দাড়ির জন্য চিন্তিত ছিল সোমেন। কিন্তু এও জানে, অল্প দাড়ি থাকলে তাকে যুবা বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো দেখায়।
রিখিয়ার কথা বলার সময়ে একটু মাথা নাড়ার রোগ আছে। তাতে ওকে খারাপ লাগে না। এখন মাথা নাড়ল, কানের ঝুটা ঝুমকো ঝিকিয়ে ওঠে। বলে—যাচ্ছিলেন না আর কিছু। আপনি প্রায় সময়েই তো এদিক দিয়ে হেঁটে যান। আসেন না।
—তুমি দেখেছ?
—না দেখলে বললাম কী করে?
—ডাকোনি তো!
—আমি ডাকব কেন? যার আসবার আসবে।
এমন অভিমানের গলায় বলল! ছেলেমানুষ। নইলে অমনভাবে বলে? বুকের মধ্যে তোলপাড় করে ওঠে যে!
সোমেন কবজির ঘড়ি দেখে বলল—সাড়ে সাতটা বাজে। আর একদিন আসব।
—মায়ের খুব অসুখ।
—কী হয়েছে?
রিখিয়া কিন্তু হাসল। বলল—খুব কিছু নয়। মার তো নানারকম। এখন শ্বাসকষ্ট হয়। আর চোখে নাকি ভাল দেখছে না। ডাক্তার বলেছে, রেটিন্যাল হেমারেজ। সব্বাইকে দেখার জন্য পাগল। আপনার মাকে নিয়ে আসার কথা ছিল না? প্রায় সময়েই ননীবালার চুলের গল্প শুনি।
সোমেনের গলার স্বর তীব্র শ্বাসবায়ুর প্রভাবে কেঁপে গেল। বলল—আর একদিন—
রিখিয়া মাথা নাড়ে, বলে—তা কেন? এই তো দু-পা। মা এখনও ঘুমোয়নি।
সোমেনের চোখে পড়ল আবার সেই লেখাটা। কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড। দারোয়ান গেটটা খুলে দিল। গাড়িটা আলো জ্বেলে বাঁক নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে গ্যারেজে। একটা কুকুর ডেকে উঠল দোতলায়। সোমেন সিগারেটটা ফেলে দিয়ে বলল—চলো৷ শৈলীমাসির কথা আমিও খুব ভাবি।
শান-বাঁধানো বাগানের একটুখানি রাস্তায় আগে হেঁটে যেতে যেতে রিখিয়া বলল—আহা! ভেবে ভেবে ঘুম হয় না বেচারির!
শৈলীমাসির ঘরে তেমনি কোমল অন্ধকার। সবুজ ঘেরাটোপে ঢাকা বাতিদান। ওষুধের গন্ধ, অডিকোলনের গন্ধ। খুব মৃদু শব্দ করে চলেছে এয়ারকুলার। সামান্য ঠান্ডা ঘর। নাইলনের সাদা মশারি ফেলা। বিছানার পাশে আজ একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। সিলিন্ডারের পাশে একটু মোটা মতো, লম্বা লোক গম্ভীরভাবে চেয়ারে বসে আছে।
ঘরে ঢুকে তাকে ডেকে রিখিয়া বলে—বাপি, এই হচ্ছে ননীমাসির ছেলে।
ভদ্রলোক একবার সোমেনের দিকে চাইলেন। চেনার কথা নয়। তার ওপর উনি উদ্বিগ্ন। বললেন—রাখু, উনি কিন্তু ট্র্যাংকুইলাইজারটা খেলেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।
সোমেন প্রণাম করবার জন্য উপুড় হয়ে ভদ্রলোকের পা খুঁজে পাচ্ছিল না মেঝের অন্ধকারে। একটা পা পেল, অন্যটা না পেয়ে চেয়ারের পায়ার হাত ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকাল। উনি গ্রাহ্য করলেন না। স্ত্রীর জন্য বোধ হয় খুবই উদ্বিগ্ন। একবার তাকিয়ে বললেন—কে বললি?
রিখিয়া বোধ হয় বাপকে তেমন আমল দেয় না। আদুরে মেয়েরা এরকমই হয়। হঠাৎ একটা ঝাঁঝের গলায় বলল—বললাম তো। ননীমাসির ছেলে। চুলঅলা ননীবালার গল্প শোনোনি!
—ও। বলে উনি খুব গম্ভীর হয়ে রইলেন। তারপর হঠাৎ সোমেনের দিকে চেয়ে নালিশ করার মতো বললেন—অক্সিজেন নেওয়াটা ওর এক বাতিক। নাকে নল নিয়ে নিয়ে ঘায়ের মতো হয়ে গেছে—
সোমেন কী বলবে। চুপ করে রইল। যখন প্রণাম করছিল তখন ভদ্রলোক পা দুটো এগিয়ে দেননি। সেই রাগটা সোমেনকে খানিকটা উত্তপ্ত রেখেছে।
উনি রিখিয়াকে বললেন—রাতের খাওয়াটা আজ ঠিক খেয়েছেন। অন্য দিনের মতো গোলমাল করেননি।
রিখিয়া তার বাবার দিকে চেয়ে মাথা নাড়ল কেবল। বলল—এখানে বসে অত কথা বোলো না। ডিস্টার্ব হয়।
উনি কিন্তু বসে রইলেন। কেমন একটু ঘোর-লাগা ভাব। পরনে একটা গোলাপি। পায়জামা, একই রঙের টিলা কোটের মতো জামা গায়ে। দেখে মনে হয় না যে লোকটার রুচি বা বুদ্ধি-সুদ্ধি আছে। অথচ কত টাকা করেছে। সোমেনের ভারী হিংসে হয়। বোধবুদ্ধিহীন এরকম কত মানুষ লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিচ্ছে বাতাস থেকে। ভদ্রলোকের কোনও ব্যক্তিত্বও নেই। মেয়ে তার সঙ্গে কেমন ঝাঁঝিয়ে কথা বলে! হয়তো বা ভদ্রলোক কিছুটা স্ত্রৈণও। অন্ধ কুকুরের মতো বসে আছে বশংবদ। মনে মনে নিজের বাবার সঙ্গে তুলনা করে দেখে সোমেন। বাবাকে অনেক মহৎ মানুষ বলে মনে হয়। সৎ, চরিত্রবান, শুভ্র মানুষ। মায়ের দেওয়া ছোট্ট চিরকুটটা যখন ব্যগ্রভাবে খুঁজে দেখছিলেন সেদিন তখনই সোমেন টের পেয়েছিল, মায়ের প্রতি বাবার মমতা এখনও কী গভীর। তবু ব্রজগোপালের চরিত্রে একটুও স্ত্রৈণতা নেই। অসফল মানুষ, তবু সোজা গনগনে মানুষ। শরীর শক্ত হাড়গোড় আছে।
সামান্য অ্যালকোহলের একঝলক গন্ধ আজও পেল সোমেন। অন্ধ কুকুরটা টলতে টলতে এল ঘরে। মুখ তুলে চাইল রিখিয়ার দিকে। না, চাইবে কী করে! ও তো দেখে না। কেবল শ্রবণ উৎকর্ণ করে বাতাস শু^কছে। রিখিয়ার বাবা হাত বাড়ালেন কুকুরটার দিকে। মৃদু গলায় বললেন—আয়!
কুকুরটা মাথা নামিয়ে লুটিয়ে পড়ল পায়ের কাছে। চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সামনের দুটো পা নুলোর মতো বুকের ওপর জড়ো করে, পিঁছনের পা দুটো ছড়িয়ে অদ্ভুত আদরখেকো ভঙ্গিতে পড়ে আছে। রিখিয়ার বাবা চটিসুদ্ধ পা তুলে ওর গলার কাছটা রগড়াতে রগড়াতে বললেন—আজও খুব রিন্টুর কথা বলছিলেন। সে আসছে না কেন। দোষটা যেন আমার। সে যদি তার মা-বাবার কথা না ভাবে—
বলে উনি চাইলেন রিখিয়ার দিকে। রিখিয়া বুঝি চোখ দিয়ে একটু শাসন করল। বাইরের লোকের সামনে ঘরের কথা বলা ঠিক নয়। উনি তাই কথাটা শেষ করলেন না।
রিখিয়া সোমেনের দিকে চেয়ে বলল—মা তো ঘুমিয়েছে। আপনি এ ঘরে এসে বসুন।
কুকুরের ওপরে আদুরে পা রেখে ভদ্রলোক বসে থাকলেন অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাশে। ফিরে ও দেখলেন না, সোমেন আর রিখিয়া কোথায় গেল। কিন্তু এই প্রথম সোমেনের কষ্ট হল লোকটার জন্য। মনে হল, সংসার থেকে লোকটা খুব বেশি কিছু পায়নি। ছেলে বিলেতে, স্ত্রী শয্যাশায়ী, মেয়ে আমল দেয় না। টাকা ছাড়া ওই লোকটার আছে কি? টাকা আর একা। আর বোধ হয় আদর করার জন্য একটা অন্ধ কুকুর।
রিখিয়ার বসবার ঘরে উজ্জ্বল আলো। টক টক করছে লাল উলের মস্ত পা-পোশ। উজ্জ্বল আলোয় এসেই সোমেনের লজ্জা করছিল। বলল—আমি আজ যাই—
—ও মা! কেন?
—রাত হয়ে গেছে।
—ইস্। কী লক্ষ্মী ছেলে! রাত আটটায় রোজ বাড়ি ফেরা হয় বুঝি!
—তা নয়। তোমাদেরও অসুবিধে।
—সেটা আমরা বুঝব। বসুন।
আসলে সোমেনের কেমন একরকম হচ্ছে। এ মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে, আজ বাদে কাল যে কোনও দিন। প্রথমদিন যেমন একরকমের ভালবাসা বোধ করেছিল, আজ তেমনি একটা হতাশা মাখানো হিংসে হচ্ছে কেবল। মন বলছে—কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
আজও একই জায়গায় পড়ে আছে অবহেলাভরে সেই পেনট্যাক্স ক্যামেরা। আজ শুধু লেনসের ওপর ঠুলি পরানো।
রিখিয়া হঠাৎ বলে—বাবা একটু ওইরকম।
সোমেন অবাক হয়ে বলে—কীরকম?
—সন্ধের পর বলে—কথাটা শেষ করল না রিখিয়া! আবার বলল—দাদার জন্যই।
মুখোমুখি বসল রিখিয়া। চুমকির শাড়ি আলো পেয়ে এখন আগুন হয়ে ঝলসাচ্ছে। মুখে আজ কিছু প্রসাধন। খোঁপাটা দোকানে বাঁধা, দেখলেই বোঝা যায়। চওড়া ব্যান্ডে বাঁধা বড় ঘড়ি বাঁ হাতে। হাতের তেলোয় একটু বুঝি মেহেদির রং। কী জীবন্ত চোখ। সোমেন চোখ সরিয়ে নেয়। মেয়েদের চোখের দিকে সে এখনও তেমন করে চাইতে শেখেনি।
—যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ ওই কুকুরটাকে নিয়ে থাকে।
সোমেন বুঝতে না পেরে বলে—কে? বলেই বুঝতে পারে, রিখিয়া তার বাবার কথা বলছে। মুখটা কিছু ভারাক্রান্ত রিখিয়ার।
সোমেন টপ করে বলে—তুমি কী নিয়ে থাকো সারাদিন? ক্যামেরা?
রিখিয়া বিষণ্ণতা থেকে নিজেকে তুলে আনে। একটু হেসে বলে—হ্যাঁ। খুব ছবি তুলি।
—পারো?
—ও মা! পারব না কেন?
—ও সব ক্যামেরায় তো অনেক গ্যাজেট থাকে।
—খুব সোজা। বলে রিখিয়া লাফিয়ে উঠে বলে—দাঁড়ান, আপনার একটা তুলে রাখি। ফ্ল্যাশটা চার্জ করতে দিয়েছি প্লাগে। আনছি।
রিখিয়া চলে যেতে ফাঁকা ঘরে এতক্ষণে যেন একটু হাঁফ ছাড়ে সোমেন। বুকটা কাঁফছিল ভীষণ। শ্বাস টানতেই একটা সুগন্ধ পেল। রিখিয়া ফেলে গেছে তার গায়ের ঘ্রাণ। এই গন্ধটুকু কি চিরকাল থেকে যাবে সোমেনের জীবনে, যেমন থেকে যাবে অণিমার সেই চুম্বনের স্মৃতি?
॥ বত্রিশ ॥
একা ঘরে সোমেন বসে আছে। এ ঘরে এয়ারকুলার নেই, মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। বাতাসে শিস টানার শব্দ। ওই শব্দটুকু ছাড়া সারা বাড়িটা নিস্তব্ধতায় ডুবে আছে। কেবল ঘুরে যাচ্ছে পাখা। অক্লান্ত যান্ত্রিক।
শৈলীমাসির ঘরের দরজাটা আটকানো। দরজা খোলা থাকলে ঠান্ডাভাব বেরিয়ে যাবে বলে দরজায় যন্ত্র লাগানো আছে। আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। ওই ঠান্ডা ঘরে শুয়ে আছে শৈলীমাসি, পাশে বশংবদ স্বামী। এই সময়টায় লোকটা একটু নেশা করে নিশ্চয়ই, মুখে কেমন ভ্যাবলা ভাব, রিখিয়ার বাবা বা শৈলীমাসির স্বামী বলে মোটেই মনে হয় না। এদের চেয়ে অনেক ভোঁতা চেহারা। লোকটার কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সোমেন। এত টাকার ওপরে বসে আছে, তবু কেমন লক্ষ্মীছাড়া চেহারা। শোকাতাপা, সংসারে যেন কেউ নেই। অভিমানী কী! তার বাবা ব্রজোগোপালও অভিমানী।
বন্ধ দরজাটায় নখের আঁচড় আর কুঁই কুঁই একটা শব্দ আসছে। পাল্লাটা খুব হালকা নয়। সোমেন তাকিয়ে থাকে। দরজাটা দুলছে অল্প। নখে আঁচড়াচ্ছে কুকুরটা। দরজাটা ঠেল আসবার চেষ্টা করছে। দরজাটা খুলে কুকুরটাকে আসতে দেবে কিনা ভাবছিল সোমেন। তার দরকার হল না। কয়েকবার ধাক্কা দিয়ে দরজাটার দুলুনি বাড়িয়ে পাল্লার একটু ফাঁক দিয়ে ঘষটে কুকুরটা এ ঘরে এল। একটু ধীর গতি, সাবধানী। ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে। কান দুটো খাড়া হয়ে আছে, ঘ্রাণ সজাগ, মুখ ওপর দিকে তুলে কিছু বুঝবার চেষ্টা করছে। কী যেন টের পেয়েছে! চেনা ঘরে অচেনা মানুষের গন্ধ। সোমেন একটু ভয় খায়। কামড়াবে না তো! অন্ধ মানুষেরা বড় ভাল লোক হয়। আজ পর্যন্ত কোনও অন্ধ মানুষকে খারাপ লোক হতে দেখেনি সোমেন। যত অন্ধকে সে দেখেছে তারা সবাই ভদ্র, বিনয়ী, নরম ও সহনশীল মানুষ। চোখ থাকলে তারা কে কীরকম হত, বলা শক্ত। কিন্তু অন্ধ হলে মানুষের মধ্যে ওই গুণগুলো জন্ম নেয় বোধ হয়। এই অন্ধ কুকুরটার মধ্যে সেই নিয়ম অনুসারেই হয়তো হিংস্রতা নেই।
জীবনে আর কোনও অন্ধ কুকুর দেখেনি সোমেন। দুটি চোখে গভীর ক্ষতচিহ্ন। চোখে জল গড়িয়ে পড়বার দাগ। যখন ছোট ছিল তখন কোনও নিষ্ঠুর ছেলে ওর চোখ দুটো গেলে দিয়েছে বোধ হয়। তাই হবে, নইলে কুকুর কখনও অন্ধ হয় না তো!
সোমেন সাবধানে ডাকে—আ—তু—
বনগাঁর ক্যাম্পে তারা কিছুকাল ছিল। বাবা তখনও চাকরি পাননি। সে সময়ে সংসারে নির্মম অভাব ছিল, কিন্তু ছেলেবেলাটা এমন যে কিছুই গায়ে লাগে না। নতুন পৃথিবীর শব্দ গন্ধ বর্ণ সব দুঃখ ভুলিয়ে রাখে। কষ্টে ভাত জুটত তখন। তবু সেই ভাতের শেষ গ্রাসটা কখনও খায়নি সোমেন। মুঠ করে নিয়ে দৌড়ে ঘাটলার দিকে যেতে যেতে হাঁক পাড়ত —আ—তু—। কোথাও কিছু নেই, সেই ডাকের জাদুতে ঠিক আঁদাড়-পাঁদাড় ভেঙে কচুবন মাড়িয়ে ভাঙা বেড়ার ফোকর দিয়ে দুটো দিশি কুকুর ছুটে আসত। খাড়া কান, ল্যাজ নড়ছে, চোখে নিবিড় লোভ।
এ কুকুরটা তেমন নয়। লোভ নেই। কিন্তু ডাক শুনে ল্যাজ নাড়ল প্রবলভাবে। এক-পা দু-পা করে কাছে আসতে থাকে। আসে ঠিক, ভুল দিকে যায় না। মাটি শুঁকে শুঁকে এসে মুখ তোলে কোলের কাছে। খুব আদরখেকো কুকুর। তেজ-টেজ নেই। সোমেন ওর মাথায় হাত রাখতেই ‘কুঁ কুঁ’ একটা শব্দ গলায় তুলে আদুরে ভাবে ভেজা নাকটা সোমেনের হাতে ঘষে দেয়, পায়ের কাছে বসে মুখটা তুলে রাখে ওপরে। সোমেন আর একবার মাথায় হাত দিতেই কুকুরটা চিত হয়ে শুয়ে পিছনের ঠ্যাং ছড়িয়ে দেয়, সামনের পা দুটো বুকের ওপর নুলো করে রেখে ঘাড় কাত করে শরীর ছেড়ে দেয়। এই হল ওর আদর খাওয়ার ভঙ্গি। সবই ঠিক আছে, কেবল চোখ দুটো নেই। তবু সবই বুঝি টের পায়। সোমেন নিচু হয়ে ওর গলার কোমল কম্বলে আঙুল দিয়ে খানিক আদর করল, তারপর বলল—যাঃ।
কুকুরটা গেল না। পায়ের ওপরে মাথা ঘষছে। বিরক্তি। সোমেন উঠে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসে। কুকুরটা টের পায় ঠিক। গন্ধে গন্ধে কাছে আসে ফের। আদুরে শব্দ করে ভিখিরির মতো মুখ তুলে থাকে। সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—জানিস না তো, আমি এ বাড়ির কেউ নই, হতে পারতাম—
আচমকা কথা ফাঁকা ঘরে বলে ফেলেই চারদিকে চায় সোমেন। কেউ নেই। সোমেন কুকুরটার কাছ থেকে সরে বসে। ফের কাছে আসে কুকুরটা। জ্বালাতন।
বাইরের দিকে একটা ঝুলবারান্দা, অন্ধকার মতো। সোমেন সেখানে এসে দাঁড়ায়। হাতের নাগালে একটা নিবিড় আমগাছ। বৌলে ছেয়ে আছে। মাতলা গন্ধ। গাছ থেকে আধোঘুমে পাখিপক্ষীর ডানার শব্দ আসে। বাতাস বয়ে যাচ্ছে সাপের মতো হিলহিল করে। তার পায়ে নাক ঠেকিয়ে প্রণাম করে কুকুরটা ঊর্ধ্বমুখে প্রত্যাশায় লেজ নাড়ে।
সোমেন শ্বাস ছাড়ে। বলে—পেয়ে বসলি যে!
অন্ধদের নিয়ে তোলা একটা ডকুমেন্টারি ছবিতে সে দেখেছিল, অন্ধ মানুষকে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে চলেছে পোষা কুকুর। ট্রাফিকের আলো দেখে থামছে, গাড়িঘোড়ার ব্যস্ত রাস্তা পার করে দিচ্ছে সাবধানে। আর এ কুকুরটা নিজেই অন্ধ।
হঠাৎ সোমেন নিচু হয়ে ওর গলার বকলশটা ধরল। তারপর চোখ বুজে থেকে ঠোঁট টিপে হেসে বলল—দেখি কেমন পারিস! চল।
কুকুরটা কী বুঝল কে জানে! কিন্তু হঠাৎ শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠল। লেজ নাড়ছে, প্রবল কুঁই কুঁই শব্দ করছে। কিন্তু আস্তে আস্তে টেনে নিতে লাগল সোমেনকে। সোমেন চোখ খুলল না, কুঁজো হয়ে কুকুরটার টানে টানে হাঁটতে লাগল। যে ঘরে সোমেন বসেছিল সে ঘরে নয়, করিডোর দিয়ে অন্য কোনও ঘরে নিয়ে যাচ্ছে তাকে। কোথায়! রিখিয়ার ঘরে?
অচেনা বাড়ি। খেলাটা বিপজ্জনক। তবু চোখ খোলে না সোমেন। দেখা যাক না!
—ও কী! বলে চেঁচিয়ে উঠল রিখিয়া। আর সেই মুহূর্তেই ঝলসে উঠল ফ্ল্যাশগান-এর আলো।
চমকে সোমেন চোখ খোলে। রিখিয়ার ঘরের দরজায় সে দাঁড়িয়ে। অপ্রস্তুত অবস্থা। ভিতরে রিখিয়া, ঘরের ঠিক মাঝখানে। অবাক চোখ, হাতে ক্যামেরা।
সোমেন বলে—কুকুরটার কাছে ট্রেনিং নিচ্ছিলাম।
রিখিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলে—কেন? ড্যাবা ড্যাবা দুটো চোখ তো রয়েছে।
—এমনি।
—এমনি না। মাথায় ছিট। যা চমকে গিয়েছিলাম না! বলে রিখিয়া হাসে। স্নিগ্ধ এক রকমের রাগহীন হাসি। বলে—কম্পোজিশনটা কিন্তু দারুণ হয়েছিল। প্রিন্ট করি, দেখবেন।
—ছবি তুললে?
—হুঁ। দাঁড়ান, আর একটা তুলি।
—এ ঘরে?
—হুঁ। বলে অন্যমনস্ক রিখিয়া তার ক্যামেরায় মুখ নিচু করে কী সব কলকব্জা নাড়াচাড়া করে।
তখন সোমেন মনে মনে বলে—তোমার শোওয়ার ঘরে আমার ছবি উঠবে? তা কি ভাল হয় রিখিয়া? ছবি তো দলিল হয়ে থাকবে। চিরকালের জন্য। সে ভাল নয়। আমি তো আসিনি তোমার ঘরে, কুকুরটা নিয়ে এসেছে। কেন, কে জানে!
ক্যামেরা ঠিক করতে করতে রিখিয়া বলে—বোকা লোকেরা ক্যামেরা দেখলেই কেমন ক্যাবলা হয়ে যায়। অমন চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন দরজায়? ওই বুককেশটার উপর হাতের ভর রেখে দাঁড়ান। পিছনে পরদা, পাশে ফুলদানি, ফ্রেমটা দারুণ হবে।
সম্পূর্ণ ক্যামেরামগ্ন চোখে চেয়ে রিখিয়া কপালের ওপর থেকে চুলের ঘুরলি সরিয়ে ভিউফাইন্ডারে চোখ রাখে।
—আমার ছবি দিয়ে কি হবে? সোমেন তখন বলে। মনে মনে বলে—আমার ছবি রাখবে কেন? আমি কে?
—কী আবার হবে! ছবি ভেজে খাব। রিখিয়া ঝাঁঝ দিয়ে বলে। আদুরে মেয়েদের এরকম রাগী স্বভাব হয় বটে। পরক্ষণেই রিখিয়া হেসে ফেলে বলে—আমি ভীষণ ছবি তুলি, সব জিনিসের। দাঁড়ান না!
ছেলেমানুষি একরকমের অভিমান বুকে মেঘলা ঘনিয়ে তুলল সোমেনের। সে মাথা! নেড়ে বলে—না। ছবি নয়।
—কেন?
—আমার ছবি ভাল ওঠে না।
—আচ্ছা দেখবেন, আমি কীরকম ভাল তুলে দিই!
সোমেন মাথা নাড়ল। আমি কি শুধু ক্যামেরার চোখ দিয়ে দেখবার! আমি কি কেবলই ছবি! শুধু পটে লিখা। আর কিছু নই! রিখিয়া! সোমেন মুখ ফিরিয়ে নিল।
সেই মুখ-ফেরানো অভিমানী মুখের ভঙ্গিমা দেখে রিখিয়ার ক্যামেরাটা আর একবার চমকায়। একটু হাসে রিখিয়া। বলে—রাগী বোকা মুখ তুলে রাখলাম।
সোমেন রাগে মুখ ফিরিয়ে বলে—তুমি বড় পাকা মেয়ে।
রিখিয়া রাগে না। ক্যামেরাটা তার বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অবশ্য ক্যামেরাটা চোট পায় না। ফোম রবারের গদির বিছানায় নিঃশব্দে লাফিয়ে উঠে কাত হয়ে থাকে। মস্ত একটা নিথর চোখ চেয়ে থাকে সোমেনের দিকে।
রিখিয়া মৃদু হেসে বলে—পাকাই তো। সবাই বলে।
সোমেন কী করবে বুঝতে পারে না।
রিখিয়া তখন বলে—বসুন। চা আসছে।
—এ ঘরে?
রিখিয়া অবাক হয়ে বলে—বারবার এ-ঘরে এ-ঘরে করছেন কেন? এ ঘরটা আমার, অন্য কারও নয়। বসুন। বিছানাতেই বসুন।
এটা রিখিয়ার শোওয়ার ঘর। এ কথাটা কিছুতেই ভুলতে পারে না সোমেন।
—শোওয়ার ঘরে কেউ বাইরের উটকো লোককে বসতে বলে! আপনজন হলে অন্য কথা। সোমেন মুখ ফেরানো অবস্থাতেই বলে। বুকে অকারণ অভিমান।
রিখিয়া অধৈর্যের গলায় বলে—বাব্বাঃ, আমার অত শুচিবাই নেই।
—থাকা ভাল। সোমেন জ্যাঠামশাইয়ের মতো মাতব্বরী গলায় বলে—বিয়ে হচ্ছে, এখন বালিকাবুদ্ধি থাকা ভাল নয়।
—কার বিয়ে হচ্ছে? বলে রিখিয়া ভ্ৰূ কোঁচকায়।
করিডোর দিয়ে বসার ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে সোমেন। তার পায়ের শব্দ শুনে আসে কুকুরটা, পিছনে রিখিয়া।
সোমেন মুখ না ফিরিয়ে বলে—সব শুনেছি।
—কী? রিখিয়ার প্রশ্ন আসে।
—বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা।
—ও! বলে রিখিয়া চুপ করে যায়।
সোমেন ফিরে তাকিয়ে বলে—খুব ভাল খবর।
রিখিয়ার মুখটা ছুটে পড়ছে। কিছু রাগে, কিছু বুঝি অপমানে।
বসবার ঘরে এসে বলল—বসুন। চা আসছে। ক্যামেরাটা কুড়িয়ে এনেছে। রাগ দেখানোর জন্যই শব্দ করে বুককেসের ওপর রাখল।
মুখোমুখি বসল। গলায় হারের লকেটটা তুলে দুই ঠোঁট চেপে ধরল। অন্যমনস্ক।
কিছু বলার নেই। সোমেন ভাবল, বিয়ের কথা শুনে খুশি হয়নি রিখিয়া। কথাটা ঘোরানোর জন্য সোমেন বলে—আমার ছবি সত্যিই ভাল ওঠে না, বুঝলে রিখিয়া!
—ওঠে না-ই তো।
রাগের কথা। সোমেন হাসল। কিছু বলার নেই, তাই বলল—ভাল ক্যামেরায় ছবি তোলা খুব শক্ত। তুমি তোলো কী করে?
এক চটকায় উত্তর দিল না। অন্যমনস্ক মুখটা আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে এল। আচমকা একটু হাসল সে। বোঝা গেল, ক্যামেরা ওর ভীষণ প্রিয়। বলল—ডেভেলপ আর প্রিন্ট করা আরও শক্ত। আমি সব নিজে করি। আমাদের ডার্করুম আছে।
শোওয়ার ঘরে গিয়ে কখন যেন চুমকি বসানো শাড়িটা ছেড়ে একটা গাঢ় কালচে লাল শাড়ি পরেছে সে৷ শাড়ি পালটানোর সময়ে ভাগ্যিস গিয়ে হাজির হয়নি সোমেন। ব্যাপারটা ভাবতেই লজ্জা করছিল তার। লাল শাড়িটাতেও কেমন মানিয়েছে! একদম বালিকা বয়স, অহংকারে ডগোমগো মুখ, হাঁসের মতো গলা উঁচু করে বসে আছে কিশোরী-দেমাকে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, বুকের ভিতরে মায়া জন্মায়।
সোমেন অবাক হওয়ার ভান করে বলে—তাই নাকি! এইটুকু বয়সে!
রিখিয়া লকেটটা দাঁতে চেপে রেখেছিল। ছেড়ে দিয়ে বলল—বয়স কী কম! লকেটটা গড়িয়ে পড়ল ওর বুকের ওপর, ঢাকা দুটি কোমল স্তনের মাঝখানে।
সোমেন চোখ তুলে নেয়। বলে—এরকম আর কী কী জানো তুমি? গাড়ি চালাতে?
—ওমা! সোজা। অবশ্য লাইসেন্স নেই। ময়দানে গিয়ে চালাই। স্কুটারও পারি। বলে হাসল।
সোমেন সিগারেট ধরাল। কত কী জানো তুমি! আমি কিচ্ছু পারি না। ভারী লজ্জার কথা। তুমি এত জানো কেন? প্রিসিসন ক্যামেরায় অঙ্ক কষে ছবি তোলো, বড় গাড়ি চালাও, স্কুটার জানো। বড় পাকা মেয়ে। দূর, তোমার সঙ্গে আমাকে মানাত না।
—কে বলেছে শুনি! রিখিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।
সোমেন চমকে ওঠে। মনে মনে বলা কথা সব শুনতে পেল নাকি ও?
—কে কী বলেছে? বোকার মতো জিজ্ঞেস করে সোমেন।
—ওই কথাটা! রিখিয়া নিজের হাতের পাতার দিকে চেয়ে বলে।
সোমেন একটু হাসে। বলে—বিয়ের কথা তো?
—তাই তো বলছিলেন।
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—বাজে লোক বলেনি। শৈলীমাসি।
রিখিয়া কথা বলল না।
ফরসা কাপড়পরা চাকর ট্রে রেখে যায়। অনেক খাবার। ভারী ভাল চায়ের গন্ধ। খেতে ইচ্ছে করছিল না সোমেনের। তার ভিতর অনেক রকম ভাবনা চিন্তার চোরাস্রোত। ক্ষিদে মরে গেছে।
সোমেন চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে বলে—তোমার বিয়ের দিন এসে খাবার খাব। আজ নয়।
রিখিয়া একরকম ধমক-চোখে তাকায়। পরমুহূর্তে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।
হঠাৎ কি একটা আশা আকাঙক্ষা মায়া ভালবাসা অন্ধের মতো নড়ে ওঠে সোমেনের মধ্যে। আবহাওয়ার বার্তায় যেমন বলে, বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, ঝড় উঠবে।
সোমেনের চা চলকে যায়, একটুখানি, নামিয়ে রাখে কাপ।
বলে—আচ্ছা খাচ্ছি।
॥ তেত্রিশ ॥
কেমন এক অভিমানী মুখ নিয়ে বসেছিল রিখিয়া। পায়ের কাছে কুকুর, আর বুক-কেসের ওপর সেই ঝকঝকে আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরা, কখন আবার কুড়িয়ে এনে রেখেছে। দৃশ্যটা ছবি হয়ে আছে। ওই অভিমানী ভঙ্গিতে এক ভিন্ন রকমের সৌন্দর্য ছিল। যেন ওই নতমুখ তুলে জলভারে আক্রান্ত তীব্র চোখে সোমেনকে দায়ী করে বলবে—কে বলল অন্য কোথাও আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! তা কি হয়! তুমি বলো!
তা অবশ্য বলেনি রিখিয়া। কেন বলবে? সোমেনের ছেলেমানুষি মন কত কী ভেবে নেয়। এমনকী সোমেন বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি ওই অভিমানী সুন্দর ভঙ্গির দিকে। মেয়েদের দিকে সোজাসুজি তাকাতে তার ভয় করে। সেই অবশ্যম্ভাবী ভিটামিনের অভাব তার মধ্যে আজও। রাস্তায়-ঘাটে অনেক পুরুষকে দেখেছে সোমেন, যারা মেয়েছেলে দেখলেই আত্মহারা হয়ে যায়। চোখের পলক না ফেলে, চারদিককে ভুলে গিয়ে হাঁ করে দেখে। দেখতে দেখতে আত্মজ্ঞান, চক্ষুলজ্জা, লোকভয় লুপ্ত হয়। তখন চিমটি কাটলেও টের পাবে না, অপমান করলেও গায়ে মাখবে না। মেয়েটা কী ভাবছে তাও ভেবে দেখে না। সোমেনের বন্ধু হেমন্তর সেবার চোখ খারাপ হল, তো অ্যাট্রোফিন চোখে দিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে যাওয়ার সময়ে সোমেনকে সঙ্গে নিয়েছিল, পাছে আবছাচোখে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু দুর্ঘটনা একটা ছোট রকমের ঘটল ডাক্তারের চেম্বারেই। একটি অবাঙালি বিবাহিতা সুন্দরী তেজি মহিলা বসেছিলেন সেখানে। হেমন্তর কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেল। অ্যাট্রোফিন দেওয়া চোখে এমন ডেলা পাকিয়ে চেয়ে রইল যে মহিলার ভারী অস্বস্তি। বাঙালি মেয়েরা সাধারণত এমন অবস্থায় ভ্রূ কোঁচকায়, বিরক্তির ভাব করে। কিন্তু সরাসরি কিছু করে না। কিন্তু এ মহিলার ধাত অন্যরকম। কিছুক্ষণ হেমন্তর তাকানোটা লক্ষ্য করে হঠাৎ উঠে তেড়ে এল—আপনি ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? লজ্জা নেই, বেশরম? ঘর ভরতি লোকের সামনে কী যে বে-ইজ্জতী তা বলার নয়, হেমন্ত অবশ্য খুব বিনয়ের সঙ্গে বলল—আমার চোখে অ্যাট্রোফিন, কিছু দেখছি না। এ কথা শুনে দু-চারজন হাসতে থাকে, মহিলাও একটু থমকে যান। সেই ফাঁকে দুঃসাহসী হেমন্ত গলা একটু নিচু করে জোরাল শ্বাসধ্বনির শব্দে বলল—আপনি ভীষণ সুন্দর।
এ সবই হচ্ছে ভিটামিনের কাজ। মেয়েদের দিকে তাকানো, চালাক, চতুর কথাবার্তা, সংকোচহীন মেলামেশা। সেখানে সোমেনের কিছু খাঁকতি আছে। নইলে কিশোরী রিখিয়ার দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা যেত, প্রশ্ন করা যেত—তোমার বিয়ে কি সত্যিই ঠিক হয়ে নেই?
সে প্রশ্ন করা হল না। রহস্য রয়ে গেল। বিয়ের কথায় কেন রেগে গিয়েছিল রিখিয়া? কেন ওই অভিমান? হয়তো তা টের পেয়েছিল অন্ধ কুকুরটা, দু-পায়ে কোলের ওপর শরীর তুলে মুখটা বাড়িয়ে শুনছিল রিখিয়ার কম্পিত শ্বাসের শব্দ। অস্পষ্ট সান্ত্বনার আওয়াজ করেছিল। অবোলা জীব, হয়তো বলতে চেয়েছিল—দুঃখ কোরো না রিখিয়ার মনের মতো বর আসবে। বুক-কেসের ওপর থেকে করুণ একটি চোখ মেলে ক্যামেরাটা দেখেছিল রিখিয়াকে। বলেছিল—কেঁদো না রিখিয়া, সব ছবি আমার তোলা রয়েছে। কোথায় পালাবে তোমার প্রেমিক। তাকে বন্দি করে এনে দেব তোমার কাছে।
তাই আবার অন্ধ কুকুরটার কথা মনে পড়ে সোমেনের। মনে পড়ে, আসাহি পেন্ট্যাক্স ক্যামেরার একটিমাত্র চোখ। সে ঘরে আর একটু বসে থাকতে পারত সোমেন, হাতে কোনও কাজ ছিল না, রিখিয়াদের বাড়ির কেউ কিছু মনে করত না, তেমন রাতও হয়ে যায়নি। তবু সোমেনের মনে হতে লাগল, সে বড় বেশিক্ষণ আছে এদের বাড়িতে। দৃষ্টিকটু হচ্ছে কিশোরী রিখিয়ার সঙ্গে এতক্ষণ বসে থাকা। এবার তার চলে যাওয়া উচিত। সে এমনও ভাবল— এরা বড়লোক, এদের বাড়িতে থাকা ভাল নয় বেশিক্ষণ।
শুকনো সন্দেশ জল দিয়ে গিলে ফেলে সোমেন, সন্দেশের তেমন কোনও স্বাদ পায় না সে। দামি চায়ে চুমুক দিয়ে তার মনে হল, ভারী বিস্বাদ। খাবার খাওয়ার শাস্তিটুকু ভোগ করে সে খুব ব্যস্ততার ভাব দেখিয়ে উঠে গেল। যেন খুব তাড়া আছে এমনভাবে বলে—চলি।
রিখিয়া নতমুখে চেয়ে একখানা আদরের হাত রেখেছে কুকুরটার মাথায়। অন্য হাতে মাথার একগুচ্ছি চুল টেনে এনে আঙুলে ঘুরলি পাকাচ্ছে। ভঙ্গিতে একটা আভিজাত্য ফুটে আছে। একটু অহংকারও। সোমেনের গলা শুনে চোখ তুলল।
সেই তাকানোতে কী ছিল কে জানে! কিন্তু সোমেন কত কী ভেবে নিল। ভাবল, বুঝি রিখিয়ার চোখে বিতৃষ্ণা, বিরক্তি। রিখিয়া তাকে বুঝি পছন্দ করে না।
রিখিয়া তার কিশোরীসুলভ উঁচু স্বরে বলল—সবাই জেনে গেছে, না?
—কী?
—বিয়ের কথা?
—জানবে না কেন? ভাল খবর।
রিখিয়া আবার মাথা নত করে রইল। আর সোমেনের মনে হল, রিখিয়ার ভঙ্গিতে অবহেলা। উপেক্ষা। একটু দূরের মানুষ হয়ে যাওয়া।
সোমেন আবার বলল—চলি।
রিখিয়া মাথা নেড়ে বলে—আচ্ছা।
বলল না আবার আসবেন। একটু হতাশ হল সোমেন। ওটুকু অন্তত না বললে সোমেন। আসে কী করে! যদি রিখিয়া ডাকত, তবে আসত কোনওদিন। না ডাকলে কি বড়লোকদের বাড়িতে আসা যায় ঘন ঘন?
ব্যস্ততার ভান করে নেমে এল সোমেন। আলোছায়াময় রাস্তায় পা দিয়ে দেখে, গ্রীষ্মের বিকেলে কলকাতার সুন্দর হাওয়াটি বয়ে যাচ্ছে। কী নিবিড় ঝিরঝির স্রোতস্বিনীর মতো শব্দ উঠেছে গাছে গাছে। অবিরল বয়ে চলেছে সেই ঘুমপাড়ানি শব্দ। দূর থেকে রিখিয়ার কুকুরটা একবার ডাকল। পিয়ানোর মতো হর্নের শব্দ করে বিশাল এক গাড়ি সোমেনকে সতর্ক করে দিয়ে পাশ ঘেঁষে চলে যায়। চলন্ত গাড়ি থেকে রেডিয়োর গানের শব্দ এল। গাড়ির আলোয় দেয়ালের লিখনটি স্পষ্ট হল একবার। তারপর মিলিয়ে গেল। প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
রাস্তায় এসে সে মেনের যেন আর সময় কাটে না। রাস্তা ফুরোয় না। রিখিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলে যেন আর কোথায় যাওয়ার থাকে না।
বহুদিন বাদে অণিমাকে আবার দেখল সোমেন, নাটকের দিন, মুক্ত অঙ্গনে। অবশ্য দূর থেকে দেখা। একটা দৃশ্যে অল্পক্ষণের জন্য মঞ্চে এল অণিমা। বয়স্কা প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় তার অল্পক্ষণের অভিনয়। এই দৃশ্যে বিভ্রম সৃষ্টি করার জন্য মঞ্চে খুব মৃদু আলো। ঘোর সবুজ সেই ম্লান আলোয় অণিমাকে চেনাই যাচ্ছিল না। শুধু দেখা গেল সে এক সাদা-খোলের শাড়ি পরেছে আর ডানদিকের মাথার চুলে একগুছি পাকা চুল। যে লোকটা চাঁদ গিলে ফেলেছিল তার কাছে কৈফিয়ত চাইছেন প্রধানমন্ত্রী, বিধিভঙ্গের দায়ে দায়ী করছেন।
মঞ্চে সেই আবছায়া মূর্তির দিকে চেয়ে নিথর হয়ে থাকে সোমেন। বুকের মধ্যে একটা কেমন কষ্ট হয়। প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চে আবির্ভাবমাত্র দর্শকরা হাততালি দিচ্ছিল। যদিও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং নন, তাঁর ভূমিকায় অন্যজন। তবু জনগণ খুশি, এটা বোঝা গেল। সোমেন প্রধানমন্ত্রীকে দেখছিল না। দেখছিল অণিমাকে।
পাশে বসে ম্যাক্স দাঁত দিয়ে নখ খুঁটছিল। হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বলে— সোমেন, কোনও দেশেই প্রধানমন্ত্রীরা এত ইম্পর্ট্যান্ট নন।
সোমেন ঘাড়টা নাড়ল কেবল।
ম্যাক্স ভারী হতাশ গলায় মৃদুস্বরে স্বগতোক্তির মতো বলে—নিউজপেপার খুলেই হেডিং দেখি, প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এই কথা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী এরকম উপদেশ দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন বা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রেডিয়ো খুলেই নিউজ-এ শুনি, কি প্রাইমমিনিস্টার হ্যাজ স্টেটেড দ্যাট…। তোমরা এত প্রধানমন্ত্রীর ভক্ত কেন?
সোমেন কী উত্তর দেবে? একবার আবছায়ায় ম্যাক্সের মুখটা দেখল। মুখে একটু কৌতুক। সোমেন বলল—আমরা ওইরকম।
ম্যাক্স মাথা নেড়ে বলল—আইডোল্যাট্রি! আমি তোমাদের দুর্গাপুজো, কালীপুজো, গণেশপুজো সব দেখেছি। কিন্তু তোমাদের গ্রেটেস্ট গড হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী। অল অ্যালং তোমরা তোমাদের সব প্রধানমন্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি পুজো করে এসেছ। বাচ্চারা যেমন মা-বাবা ছাড়া কিছু বোঝে না, তোমরা সেরকম প্রধানমন্ত্রী বোঝো। হোয়াই?
পিছন থেকে কে যেন বলল—আস্তে।
ম্যাক্স চুপ করে আবার নখ খুঁটতে থাকে দাঁতে। তার মুখে ভ্রূকুটি চোখে নীলচে ফসফরাস জ্বলছে।
সোমেনের ডানপাশে কয়েকজন অচেনা লোক, তার ওপাশে পূর্বা বসেছিল আর দুটি মেয়ের সঙ্গে। সারাক্ষণ নিচু স্বরে বক বক করছিল আর হাসছিল। ওদের আশপাশের লোক বিরক্ত। নাটকের মাঝামাঝি হঠাৎ উঠে এসে সোমেনের পাশের লোকটাকে কী বলল। লোকটা উঠে গেল পূর্বার জায়গায়। পূর্বা সোমেনের পাশে বসেই হাসতে থাকে—বুঝতে পারছিস?
সোমেন মুখটায় বিরক্তভাব করে বলে—জ্বালাতে এলি।
—আহা, আমি বুঝি সব সময়ে জ্বালাই।
—জ্বালাস না? সেবার লাইটহাউস থেকে তোর জন্য উঠে আসতে হয়েছিল মাঝপথে, মনে নেই?
—আহা। সে তো ড্রাকুলার ছবি দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলাম বলে!
—ব্যাপারটা একই। হয় ভয় পাবি, নয়তো হাসবি, নাহলে কেবল বক বক করবি। চুপ করে থাকতে পারিস না কেন?
—পেট ফুলে ওঠে যে! দু-তিনঘণ্টা চুপ করে থাকা সোজা কথা?
পিছন থেকে কে আবার বলে—আস্তে। একটু আস্তে হোক।
সোমেন পুর্বার দিকে চেয়ে বলে—ওই শোন।
পূর্বা মুখে রুমাল চাপা দিয়ে হাসতে থাকে। সোমেন চাপা স্বরে বলে—পেট ফুলে উঠলে অ্যান্টাসিড খাস।
পূর্বা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মঞ্চের একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে আলো। আলোতে নায়িকার ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছে অপালা। অন্ধকারে আবছা দেখা যাচ্ছে মিহির বোসকে, সে নায়ক। নায়িকা দায়ী করছে নায়ককে, পৃথিবী থেকে সবচেয়ে সুন্দর জিনিস জ্যোৎস্নাকে হরণ করার জন্য। বলছে, সে নাকি আত্মহত্যা করবে। কারণ জ্যোৎস্নার অভাবে তার ভিতরকার ভালবাসা মরে যাচ্ছে।
পূর্বা হঠাৎ চাপা স্বরে বলল—পিছনের লোকটা কী বলছিল রে? আস্তে, একটু আস্তে হোক। কী হওয়ার কথা বলছিল?
—জিজ্ঞেস করে আসব?
—ধ্যুৎ। তুই বুঝি জানিস না?
অন্ধকারেই সোমেন পূর্বার দিকে একটু তাকায়। বলে—খুব পেকেছ খুকি!
মঞ্চে হঠাৎ মাকবেথ নাটকের একটা সংলাপের অনুকরণে হাহাকার করে ওঠে অপালার তীব্র গলা—তুমি চাঁদকে হত্যা করেছ, তাই তুমি কোনওদিন কারও ভালবাসা পাবে না।
অন্ধকারে মঞ্চের অন্য ধারে মিহির বোস একথা শুনে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে—ভালবাসা! ভালবাসা নিয়ে কী হবে। আমার গলায় মহামূল্য চাঁদ। কে ভালবাসা চায়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী-সমস্যা ম্যাক্সের এখনও মেটেনি। সে আবার তার নীল ফসফরাস জ্বালা চোখে চেয়ে বলল—অল অফ ইউ আর ইটিং আউট অফ পি-এম’স হ্যান্ড, ইজনট ইট? ভারতে যদি পি এম না থাকে কোনওদিন, তা হলে তোমাদের কী হবে সোমেন?
ডান কানে ঝুঁকে পূর্বা তখন বলল—পেকেছিই তো। বড়দের দেখে ছোটরা শেখে। তোমাদের সব ব্যাপার-স্যাপার জানি মশাই।
গুল। পূর্বা কিছু জানে না। জানলে কেঁদে ভাসাত। তবু একটু চমকে ওঠে সোমেন, মঞ্চে নায়িকার ভালবাসার সংকট, বাঁ পাশে ম্যাক্সের প্রধানমন্ত্রী ধাঁধাঁ থেকে সরে এসে সে পূর্বার দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে—কী জানিস?
পূর্বা ঠ্যাং নাচিয়ে নিরুদ্বেগ মুখে বলে—এভরিথিং।
সোমেনের বিশ্বাস হয় না। অণিমা যেদিন তাকে চুমু খায় সেদিন ঘরটা অন্ধকার ছিল এবং কেউ তাদের অনুসরণ করেনি। তবু বুকটা কেঁপে ওঠে। দরজাটা বন্ধ করেনি অণিমা, সে কি ইচ্ছে করে?
সোমেন প্রসঙ্গটা পাশে সরিয়ে হঠাৎ বলল—আমরা বুঝি তোর চেয়ে বয়সে বড়! আর তোমার বুঝি এখনও দাঁত ওঠেনি!
পূর্বার ঠ্যাং নাচানো বন্ধ হয়, চোখ ফিরিয়ে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—কে, বলেছে আমি ছোট?
—এই যে বললি বড়দের দেখে ছোটরা শেখে! তুই কি ছোট?
পূর্বা সঙ্গে সঙ্গে কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে—কখন বললাম! এ মা! যাঃ!
—বলেছিস।
একটা হাত কাঁধে এসে পড়ে পিছন থেকে, একটা স্বর বলে—দাদা, কাইন্ডলি একটু আস্তে।
একটা চিনেবাদামের খোলা ভাঙার শব্দ হয়, কাছেই। আর তখনই হঠাৎ অপালা মঞ্চ থেকে চেঁচিয়ে বলে—হায় চাঁদ! হায় প্রেম!
মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে টানাটানি করে কারা পরবর্তী দৃশ্যের দৃশ্যপট সাজাচ্ছে।
পূর্বা হঠাৎ মনে-পড়ায় ব্যগ্র কণ্ঠে বলে—বলেছি তো, কিন্তু সে তুই আমাকে খুকি বলেছিস বলে।
—ও। সোমেন উদাস গলায় বলে।
—রাগ করলি? পূর্বা অন্ধকারেই চেয়ে থাকে তার দিকে।
—না।
—করেছিস। মাইরি, রাগ করিস না। জানিস তো, কেউ আমার ওপর রাগ করলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।
—করিনি।
তৃতীয় দৃশ্যের মাঝ বরাবর সোমেন বেরিয়ে এল।
গ্রিনরুমের গলিতে ঢুকেই চমকে ওঠে সোমেন। অণিমা দাঁড়িয়ে আছে। চুলে এখনও সাদা মেক-আপ লেগে আছে। সাদা খোলের শাড়িটাও পরনে। দিল্লির জলহাওয়ায় শরীরে একটা ঢল এসেছে। এত শ্ৰী ওর আগে কখনও দেখেনি সোমেন। রং-ও বোধ হয় ফরসা হয়েছে, মেক-আপের জন্য ভাল বোঝা যাচ্ছে না।
চোখে চোখ পড়তেই মুখটা কেমন অপরাধী লজ্জায় মাখা হয়ে গেল অণিমার। চোখটা নামিয়ে নিয়ে আবার তুলল। ভারী চশমার ভিতরে ওর চোখ বরাবরই ছোট দেখাত। সে-চোখ দুটির দিকে অনেকবার অলস মন নিয়ে তাকিয়ে দেখেছে সোমেন। আজকের দেখার মধ্যে একটু অনুসন্ধিৎসা ছিল। ছিল রহস্যমোচন।
ভারী মিষ্টি একটা লাজুক হাসি হাসল অণিমা। অণিমার সর্বাঙ্গে আর কোথাও এতটুকু ইয়ারকির ভাব নেই। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল—চলে যাচ্ছ?
সোমেন থমকে বলল—তুমিও যাবে নাকি!
অণিমা তার চোখে চোখ না রেখে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল—কী করে যাই! এই দৃশ্যেও পাট রয়েছে। শেষটা দেখে যাবে না?
সোমেন একটু হেসে বলে—তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছি। গাব্বুর টার্মিনাল, একবার যাব বলেছিলাম। আর বেশি দেরি করলে রাত হয়ে যাবে।
—ও! ভারী নরম বিস্ময় প্রকাশ করে অণিমা।
—কবে ফিরেছ?
—এই তো কদিন।
—খুব বেড়ালে?
—উঁ! বলে একটু চুপ করে থাকে অণিমা, তারপর আস্তে দু-দিকে মাথা নেড়ে বলে—না। বেড়াইনি খুব একটা। ভাল লাগত না। ঘরে বসে থাকতাম। রেকর্ড শুনতাম।
—তবে গেলে কেন?
অণিমা তেমনি সুন্দর হেসে মৃদু গলায় বলল—বিয়ের আগে শরীর সারাতে।
সোমেন সিগারেট ধরিয়ে বলে—তোমার শরীর সেরেছে অণিমা।
অণিমা লজ্জা পেল। মুখ নামিয়ে নিল।
তারপর বলল—কিন্তু তুমি রোগা হয়ে গেছ সোমেন। কেন?
—কী জানি! সোমেন উত্তর দিল।
ভিতর থেকে কে এসে ডাকল—অণিমা!—যাচ্ছি। অণিমা তাকে বলল। তারপর সোমেনের দিকে চেয়ে বলল—যাই সোমেন।
—আচ্ছা। বলে হাসে সোমেন—দেখা হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী!
অণিমা মৃদু হাসল। কী লাজুক, সুন্দর হাসি। সেই ইয়ারবাজ মেয়েটার চিহ্ন আর নেই ওর কোথাও।
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সিগারেটটা শেষ করল সোমেন। হাঁটতে হাঁটতে আজও যেন আবার সোমেনের রাস্তা ফুরোয় না। সময় কাটে না।
একটা লাইন আজকাল প্রায়ই অকারণে মনে পড়ে সোমেনের। প্রতিশোধ, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, কমরেড, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো, গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
রিখিয়াদের দেয়ালে কে এই লাইনটা লিখেছিল কে জানে! যে লিখেছিল সে কি বেঁচে আছে! না কি মুক্তি সংগ্রামের হাওয়ায় ছেঁড়া পোস্টারের কাগজের মতো উড়ে গেছে দুনিয়া ছেড়ে! ওই স্লোগান এখন কেউ আর লক্ষও করে না দেয়ালটায়। কিন্তু লাইনটা বড় আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকে সোমেনের মধ্যে। অকারণে মনে পড়ে। চারদিকে গতিময়, ক্ষিপ্র কলকাতা বয়ে যায়। কর্মহীন সোমেনের অলসভাবে চলতে-ফিরতে হঠাৎ ওই লাইনটা মনে পড়ে যায়।
জীবনের সুখী সুন্দর দিনগুলি বুঝি শেষ হয়ে এল!
॥ চৌত্রিশ ॥
ব্যাঙ্কের লকারের জন্য বহুদিন আগে দরখাস্ত করে রেখেছিল রণেন। তিন-চারটে ব্যাঙ্কে। আজ ব্রাবোর্ন রোডের একটা ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানল, বীণা লাহিড়ির নামে একটা লকার পাওয়া যাবে সামনের মাসে। লকার নিয়ে আজকাল বড় কাড়াকাড়ি। সকলেরই কিছু না কিছু লুকনো টাকা, সোনাদানা বা গয়নাগাটি আছে।
আজ শনিবার। অফিসে কাজ ছিল না। একটা ইনস্পেকশন রিপোর্ট দিয়ে আসবার সময়ে বুড়ো রামসদয় ঘোষকে খবরটা দিল। ফাঁকা অফিস। সবাই চলে গেছে। কেবল ঘোষ বসে বসে একটা আন-অফিসিয়াল অঙ্ক কষছিল। মুখ তুলে বলল—ছেলেটা কাল রাতে টেস্টপেপার থেকে অঙ্কটা কষতে গিয়ে পারেনি। তাই আমি অফিসে নিয়ে এসেছি। কেউ পারল না সবাইকে দেখিয়েছি। আমি সারাদিন ধরে বার দশেক করলাম।
ঘোষকে প্রায়ই এরকম আফিসে বসে অঙ্ক কষতে দেখেছে রণেন। ওটা ঘোষের নেশা। রণেন হেসে বলে—তাই বলুন। আমি ভাবছিলাম অফিসের কাজকর্ম।
—নাঃ। অফিস আবার কী! এ বছরই রিটায়ারমেন্ট, ডিসেম্বরে। ত্রিশ বছর ঢের কাজ করেছি। এবার ছোট ছেলেটাকে দাঁড় করাতে পারলে নিজের কাজ হবে।
টেরিলিনের জামাকাপড় পরলে বড় ঘাম হয়। এ গরমে সবচেয়ে আরামের হল ধুতি পাঞ্জাবি, নয়তো সুতির জামাকাপড়। বীণা সে সব পাট চুকিয়ে দিয়েছে। টেরিলিনের জন্যই পাখার তলায় বসেও রণেন ঘামে। একটা পাতলা ফাইল তুলে হাওয়া খেতে খেতে বলল—লকারটা পেয়ে গেছি।
—লকার? ব্যাঙ্কের নাকি? বলে অন্যমনস্ক ঘোষ মাথা নাড়ে—সে তো বড়লোকি ব্যাপার।
মনে মনে রণেন বলে—তাই তো, সেটা বুঝতে দেরি হয় কেন রে শালা? মুখে বলল—না না। আজকাল যা চুরি-ছিনতাই গেরস্থরাও লকার রাখে। সেফ।
—সেফ আবার কী! একটা চাবি তো ম্যানেজারের কাছে থাকে শুনেছি।
—তা থাকে। তাও সেফ।
মাথা নেড়ে ঘোষ বলে—ধরুন, লকারে গিয়ে যদি একদিন দেখেন যে, টাকাপয়সা সোনাদানা সব হাওয়া, তখন কী হবে? ব্যাঙ্ক ক্ষতিপূরণ দেবে?
—না, তেমন নিয়ম নেই।
—তবে! সে আবার কী! চাবি যখন ওদের কাছে থাকে তখন একটা ডুপ্লিকেট করে রাখলে আটকাচ্ছে কে! চাবি-দাওয়া যখন চলবে না তখন সিকিউরিটি কী থাকল! তার ওপর পুলিশ এসে জোর করে খেলে আজকাল, সেও ফ্যাসাদ।
রণেন একটু দ্বিধায় পড়ে।
ঘোষ অঙ্কটা কষতে কষতে না তাকিয়েই বলে—সবচেয়ে ভাল হল লোহার সিন্দুক। লকার কি বউমার নামে নিলেন নাকি?
—হুঁ।
—ভাল। স্ত্রী কৈবল্যদায়িনী। এ যুগটা বউদেরই যুগ। সবাই বউয়ের নামে সব করে। আমার বউটা বেঁচে থাকলে আমিও তার নামে কিছু না কিছু করতাম।
রণেন অবাক হয়ে বলে—কিছু করেননি?
—কী করব? তিলজলায় খানিকটা জমি কিনেছিলাম বউয়ের তাগিদে, যেদিন ভিত পুজো সেদিনই সুট করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল। অলক্ষণ দেখে জমি বেচে দিই, আর কিছু করিনি।
—রিটায়ারমেন্টের পর?
—ছেলেরা আছে। তবে বল-ভরসা কেউ নয়। বড় দুজন বিয়ে শাদি করে বউ চিনেছে। ভরসা ছোটটা, তা এও বড় হয়ে হাতে হারিকেন ধরিয়ে দেবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকাটা তাই মুঠো করে বসে থাকব, সেই টাকার জোরে যা সেবাযত্ন পাই পাব। বুড় বয়েস বউ না থাকলে ভারী মুশকিল। জোর খাটানো, রাগ দেখানোর মানুষ থাকে না। অথচ কেরানি-টেরানির তো এই বুড়ো বয়সটাই খিটকেল মেজাজের বয়স। তখন মনের মধ্যে নতুন রাগ অভিমানের দাঁত গজায়, কিন্তু বউ না থাকলে কামড়ানোর কিছু থাকে না। ভারী মুশকিল।
লকার পাওয়ার যে আনন্দটা ছিল তা যেন হঠাৎ নিবে গেল রণেনের। মানুষের মুশকিল, নানুষ মরণশীল। দূর ভবিষ্যতের একটা অচেনা, অজানা, একাকীত্বের ছবি ভেবে কেন যে শিউরে উঠল রণেন। হঠাৎ মনে হল, লকার-টকার এ-সব মিথ্যে প্রয়োজন। সিকিউরিটি কোথাও নেই।
উঠতে যাচ্ছিল, ঘোষ অঙ্কটা কষতে কষতেই বলল—বউয়ের নামে সর্বস্ব উচ্ছুগ্যু করবেন, তাতে মাগিদের বড় তেল হয়। এদিক-ওদিক নিজের নামেও কিছু রাখবেন।
—নিজের নামে? কিন্তু ইনকাম ট্যাক্স…
ঘোষ মুখ না তুলেই বলে—ইনকাম ট্যাক্স, অ্যান্টি করাপশ্যান, আর বউ, এ তিনের মধ্যে বউ সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। পুরুষমানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।
রণেনের ঘেমো শরীরে গরম ছুঁড়ে একটা শীত এসে লাগে। কথাটা মনের মতো। সে বলল—আমার বউ…
ঘোষ কথাটা শেষ করতে দিল না, তেমনি ছোট ছেলের আঁক কষতে কষতে বলল—ও জানি। সব্বার বউয়ের গল্পই একরকম। নারীরাই এখন লড়ছে ভাল৷ পুরুষসিংহের বড় অভাব।
রণেন উঠতে উঠতে বলে—কিন্তু লকারের ব্যাপারে একটা ভাবনায় ফেলে দিলেন ঘোষদা। এখন মনে হচ্ছে, লকার তেমন সেফ নয়।
ঘোষ হাসল। এই বয়সেও ভাল চেহারা, লম্বা—ফরসা। একহারা। চোখেমুখে ভাল বংশ এবং বুদ্ধির ছাপ আছে। সেই সঙ্গে একটু ক্লান্তিও। লাল ঠোঁট চিরে একটু হাসল, বলল— মানুষকে ভয় দেখানোটা আমার হবি, যেমন হচ্ছে ছেলের অঙ্ক কষা। ওসব কিছু নয়। সবাই রাখছে, আপনিও রাখবেন। বউয়ের নামে যে এককাঁড়ি নিন্দেমন্দ করলাম সেও কি সব সত্যি? ভড়কে দেওয়ার জন্য বলি। এই যে অফিস ছুটির পর বসে অঙ্ক কষছি, বউ থাকলে পারতাম? বুড়োগুড়ো, কালো-কুচ্ছিৎ যাইহোক, বউ বেঁচে থাকলে ঠিকই সংসারের দিকে, বাসার দিকে একটা টান থাকত। ওই টানটুকুর জন্যই সংসারী, নইলে সব ব্যাটা সন্ন্যাসী।
ঘোষ আবার কিছুক্ষণ নীরবে অঙ্ক কষে। বিরক্তিকর। রণেন বুকের বোতাম খুলে গেঞ্জি ফাঁক করে ভিতরে হাওয়া ঢোকানোর চেষ্টা করে। বড্ড গরম।
ঘোষ বলে—কিন্তু মেয়েছেলেদের উলটো। বউ মরলে পুরুষে যেমন একাবোকা হয়ে যায় আমার মতো, মেয়েদের তা হয় না। বুক চাপড়ে কাঁদেটাঁদে প্রথমটায় ঠিকই, তারপর আবার হামলে সংসার করে, ছেলেপুলে, নাতি-নাতনি টানে। ভুলে-টুলে যায় তাড়াতাড়ি।
—আজ উঠি।
—বাজে বকছি, না? টাকা-পয়সা কেমন করেছেন?
—দূর! কই? বলে রণেন লাজুক হাসে।
ঘোষ একপলক তাকিয়ে দেখে নেয়। মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলে—খবরটবর সব পাই। করুন না দোষের কিছু তো নয়। লোকের হাতে আজকাল অঢেল টাকা। বাজারে কোনও জিনিস পড়ে থাকে না, তা সে যত দামই হোক। দোকান-পসারও কত বেড়ে গেছে দেখেছেন? কত বাহারি শোকেস? লুকনো টাকা ধরার ফাঁদ। তবু কেন যে লোকে দেশের দুরবস্থার কথা বলে! ওপর ওপর কিছু ফালতু লোক না খেয়ে মরছে, কিন্তু মোটের ওপর মানুষ সুখেই আছে। নাকি! বলে ফের অঙ্কটা একটু করেই বলে ওঠে—ওই যাঃ!
—কী হল?
ঘোষ খুব হতাশার সুরে বলে—অঙ্কটা মিলে গেল।
—ভালই তো।
ঘোষ খুব বিমর্ষভাবে মাথা নেড়ে বলে—হুঁ।
তার ভ্রূ কোঁচকানো মুখ দেখে পরিষ্কার বোঝা যায় যে ঘোষ খুশি হয়নি। অঙ্কর সঙ্গে আর কিছুক্ষণ লড়ালড়ির ইচ্ছে ছিল বোধ হয়। টেবিলের টানা খুলে একটা ছেঁড়া-খোঁড়া পুরনো টেস্ট পেপার বের করে পাতা উলটে আবার অঙ্ক খোঁজে ঘোষ।
রণেন বলে—আপনি তো এখন অঙ্ক কষবেন। আমি উঠি।
—আরে কেবল উঠি-উঠি করছেন কেন? বসুন না। ঘোষ বলে।
—একটু খোলা হাওয়ায় যাই, এখানে বড় গরম। বলে রণেন মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটার দিকে চেয়ে বলে—আজকাল যে কেন ফ্যানগুলোর হাওয়া হয় না?
—ফ্যানের দোষ নেই, ওটা টাকার গরম। বলে ঘোষ হাসল।
ঠাট্টা বিদ্রূপ করলেও এই ঘোষ লোকটাই বরাবর রণেনকে বুদ্ধিটুদ্ধি দেয়। ভারী ঠান্ডা মাথা। রিটায়ারমেন্টের কাছাকাছি এসে এখন একটু নিস্পৃহ হয়ে গেছে। মনের মতো একটা অঙ্ক বুঝি খুঁজে পেল ঘোষ। কাগজে সেটা টুকতে টুকতে বলল—জমি জায়গা করেছেন?
রণেন বিমর্ষভাবে বলে—এখনও নয়। তবে টালিগঞ্জে খানিকটা জমি মায়ের নামে।
ঘোষ সবিস্ময়ে চোখ তুলে বলে—মায়ের নামে! আপনি তো দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ! আজকাল কেউ মায়ের নামে জমি করে?
রণেন বাধা দিয়ে বলে—না না। বাবা টাকা দিচ্ছেন।
—বাবা বেঁচে আছেন এখনও? বলে লাল ঠোঁট চিরে এরকম গা-জ্বালানো হাসি হেসে ঘোষ বলে—ভারী অন্যায়।
ঘোষ ব্রজগোপালকে চেনে। এক ডিপার্টমেন্টে কিছুকাল একসঙ্গে কাজ করেছে। ব্রজগোপালকে যারা চেনে তাদের সামনে রণেন একটু অস্বস্তি বোধ করে।
ঘোষ অঙ্কের দিকে চেয়েই বলে—উনি টাকা পেলেন কোথায়?
—পলিসির টাকা।
ঘোষ একটা নিশ্চিন্ত হওয়ার শ্বাস ছেড়ে বলে—তাই বলুন। হঠাৎ ব্রজগোপালদার টাকার কথা শুনে চমকে গিয়েছিলাম। ওরকম মানুষের তো বাড়তি টাকা থাকার কথা নয়। সারাজীবন অন্যের ফাইফরমাস খাটতেন, এটা-ওটা কিনে এনে দিতেন কলিগদের, কিন্তু কখনও কারও টাকা নিজের বা অন্য কারও টাকার সঙ্গে মেশাতেন না, সব আলাদা রাখতেন। বলতেন মেশালে সূক্ষ্মভাবে গো-বিটউইন হয়। মনে নাকি একটা দ্বন্দ্বীবৃত্তি আসে। বলে ঘোষ নিঃশ্বাস ফেলে হাসল—এ টোটাল মিসফিট। তবু ওরকম দু-চারজন লোক বেঁচে আছেন বলেই এখনও চন্দ্রসূর্য ওঠে।
রণেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। একটু অস্বস্তি হতে থাকে। একটা ঘুমন্ত আবেগ হঠাৎ বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে জেগে উঠতে চায়। যার বাবা সৎ সে কত ভাগ্যবান। ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সে উঠে দাঁড়ায়।
—চললেন? ঘোষ জিজ্ঞেস করে।
—চলি। আপনি যাবেন না?
ঘোষ উদাসভাবে বলে—কোথায় যাব? বসে বসে অঙ্কটা কষি। একটু বাদে দারোয়ানরা বন্ধ করতে আসবে, তখন উঠে পড়ব।
ঘোষ আবার অঙ্কের মধ্যে ডুবে যায়।
বড় ঘরটা পার হয়ে দরজার কাছ বরাবর এসে একটু তাকিয়ে দেখে রণেন। সারি সারি খালি টেবিল। ফাঁকা ঘরে একা ঘোষ বসে আছে এতটুকুন হয়ে। অঙ্ক কষছে। হঠাৎ ভিতরটায় একটু চমকা ভয় জেগে ওঠে। মনে পড়ে বুড়োবয়েস, একাকীত্ব। মনে পড়ে মৃত্যু। মাথাটা একটা টাল খায়। ভারী ব্যাগটা একহাতে ধরে রেখেই কষ্টে একটা সিগারেট জ্বালে রণেন। ঘোষের সামনে খায় না, বাবার কলিগ ছিল। সিগারেটের ধোঁয়া ভিতরে যেতেই একটু অন্যরকম লাগে।
ছটা বাজে। বাইরে এখনও বেশ রোদ। বাইরে এসে বুক ভরে শ্বাস নেয় রণেন, কিন্তু তবু একটা শ্বাসরোধকারী কী যেন কাজ করছে ভিতরে! ভয়? নিরাপত্তার অভাব? মৃত্যু?
মনটা ভারী খারাপ লাগতে থাকে। শরীরটাকে কয়েকবার ঝাঁকি দেয় রণেন, হাতের ব্যাগটা দোলায়। মনটাকে হালকা করে দেওয়ার জন্য মুখ ছুঁচলো করে শিস্ দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। উৎকট শ্বাসবায়ুর শব্দ বের হয়। লম্বা লম্বা সব বাড়ির ছায়ায় হাঁটে। ধুলোটে গরম হাওয়া দিচ্ছে, নাকে ধুলোর গন্ধ। উদ্ভিদহীন, শান বাঁধানো কলকাতা নির্মম তাপ বিকীরণ করছে। একটা পাম্পসেটের দোকানের শো-কেসের সামনে দাঁড়াল রণেন। কাচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখল। গায়ে কলকা ছাপ, টেরিকটনের বুশ শার্ট, পরনে চেক প্যান্ট, পায়ে দামি জুতো। তবু চেহারাটা লোকাল ট্রেনের ফেরিঅলার মতো কেন যে লাগে!
মনটা খারাপ। মনটা বড্ড খারাপ। কেবলই মনে পড়ে, মলিন অফিস ঘরে ছুটির পর নিরালায় বসে ঘোষ আঁক কষছে। একটা সময় আসে যখন আয়ুটাকে ফালতু সময় বলে মনে হয়। না? আর আসে একাকীত্ব! মৃত্যু!
অনেকে আছে, মন খারাপ থাকলে একা থাকতে ভালবাসে। নিরালায় ছাদে-টাদে গিয়ে চুপচাপ থাকে। রণেন সেরকম নয়। তার উলটো। মন খারাপ থাকলে তার খুব ইচ্ছে করে কোনও আপনার জনের কাছে গিয়ে বসে, আদর খায়, ভরভর করে অনেক কথা বলে।
সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে এল রণেন। মা নেই। গত তিন মাসে মা এই নিয়ে বারচারেক শীলার বাড়িতে গিয়ে থাকছে। এই সময়টায় সোমেন থাকে না। বড় ছেলেমেয়ে দুজন বাইরের ঘরে ছোকরা মাস্টারের কাছে পড়ছে। নতুন রাখা হয়েছে টিউটরটিকে, ফালতু পঞ্চাশ টাকা চলে যাচ্ছে মাসে মাসে। সোমেনই পড়াতে পারে, পড়ায় না। সংসারের সবাই বড় উদাসীন রণেনের প্রতি, এমন মনে হয়।
টুবাই সন্ধেয় ঘুমোয়। শোওয়ার ঘরে মশারি ফেলা। রণেন ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালতেই নাইলেক্সের মশারির ভিতর থেকে বীণা ঘুম চোখে আলো লাগাতে চোখ পিট পিট করে বলে—আঃ নেবাও না। ছেলেটা এইমাত্র ঘুমিয়েছে, উঠে পড়বে।
ভারী অপমান বোধ করে রণেন। বড় সহজেই বীণা আজকাল তাকে ধমকায়। মনটা ভাল নেই বলে অভিমানটা যেন আরও গাঢ় হয়ে মেঘলা করে দিল মনটা। রণেন সবুজ রঙের ঘুম-আলোটা জ্বেলে বড় আলো নিবিয়ে দিল। লুঙ্গি পরতে পরতেই অভিমানটা খসে গেল খানিক। ডাকল—বীণা।
—উঁ।
—শুয়ে কেন? বেরিয়ে এস।
—চা চাই নাকি!
—সে পরে হবে। এখন তোমাকে চাই।
—হঠাৎ এত প্রেম?
এটাও অপমান। রণেন ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে একটা সিগারেট ধরাল। এই কায়দায় অশোককুমার সিগারেট ধরাত একসময়ে। বিছানায় বীণার শাড়ির আর গয়নার শব্দ উঠল। বসে খোঁপাটা বেঁধে নিল। অনেকখানি আঁচল বিছানায় রেখে বেরিয়ে এল, তারপর শ্লথ হাতে অফুরান আচলটা টেনে আনতে থাকল বিছানা থেকে।
রণেন বাইরের ঘরের দিককার দরজাটা বন্ধ করে দিল উঠে।
বীণা বলল—ও কী! বাইরের লোক রয়েছে, কী ভাববে?
কাম নয়, একটা তীব্র সঙ্গলিপ্সায় আকুল রণেন দু-হাতে জাপটে ধরল বীণাকে, প্রথম প্রেমিকের মতো কাঁপা গলায় পুরনো বউকে ডাকল—বীণা!
—ইস্! কী যে করো না! বীণা রোগাটে হলেও গায়ে জোর কম নয়। দু-হাতে ঝটাপটি করে ছাড়িয়ে নিল।
—তোমাকে আমার ভীষণ দরকার। রণেন হাঁফসানো গলায় বলে।
—রাতে হবে। বীণা নিস্পৃহ গলায় বলে।
—সে সব নয়। এমনি এসো, কাছাকাছি জড়াজড়ি করে বসে থাকি। কথা বলি।
বিরক্ত হয়ে বীণা বলে—কিছু খেয়েছ নাকি!
বলে কাছে এসে মুখটুখ শুঁকে বলে—না তো! তবে হল কী?
আকুল দু-হাতে আবার ভালুকের মতো তাকে চেপে ধরে রণেন—শোনো। আমার কোনও কথা তুমি আজকাল শুনতে চাও না। বড় সংসারী হয়ে গেছ বীণা। আজ একটু বোসো।
বীণা বলে—ধ্যেৎ। বলে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। বলে—দরজাটা খুলে দাও। খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে। ছেলেটা কি না জানি ভাবছে! তুমি একটা কী বলো তো!
বীণা দরজাটা খুলে দেয়। বাইরের ঘরের স্টিক লাইটের আলো পরদার ফাঁক দিয়ে ঘরে এসে পড়ল। বীণা গেল রান্নাঘরে। আয়নার সামনে বসে রইল রণেন। অ্যাশট্রের ওপর রেখে দেওয়া সিগারেটটার কথা ভুলে গিয়ে নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। অন্য সিগারেটটা ধূপ কাঠির মতো জ্বলতে থাকল একা-একা।
ঘোর সবুজ আলোয় ঘরটা কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে এখন। প্রাচীন অরণ্যের অন্ধকারে একটা ধ্বংসস্তূপ। পাখার হাওয়ায় মশারি কাঁপছে। ঢেউ দিচ্ছে। আয়নায় তার আবছা প্রতিবিম্ব। কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগে সব কিছু। কেমন যেন রোজকার মতো নয়। বুকটা ফাঁকা। গায়ে ঘাম। সিগারেটের ধোঁয়ার কর্কশ গন্ধ। রণেনের মাথার ভিতরটা ক্রমে পাগল-পাগল হয়ে যাচ্ছে।
তাড়াতাড়ি উঠে বড় আলোটা জ্বালল রণেন। জানালার কাছে দৌড়ে গিয়ে বাইরের বাতাস টানল। অস্থিরতা। তার নিজের মানুষ যেন কেউ নেই পৃথিবীতে। এমন কেন লাগছে। উজ্জ্বল আলোয় নিজের হোঁৎকা শরীরের প্রতিবিম্বের দিকে আয়নায় চেয়ে থাকে রণেন। তীব্র একটা ঘেন্না হয় লোকটাকে।
একটা সেফটিপিন পড়ে আছে টেবিলের ওপর। কিছু না ভেবে সেটা তুলে নিল রণেন। এবং দাঁতে দাঁত ঘষে আচমকা খোলা সেফটিপিনটা বসিয়ে দিল বাঁ হাতের কবজির ওপর। ক্যাঁচ করে ঢুকে গেল সেটা। প্রথম একটা তীক্ষ্ণ ব্যথা, তারপর হাতটার একটা অবশ ভাব। গাঁথা সেফটিপিনটা তুলল না রণেন। একটু পরে দুই বিন্দু রক্ত উপচে এল। চেয়ে রইল সে, একা ফাঁকা অফিসঘরে ঘোষ বসে আঁক কষছে, ছুটির পর কিছু করার নেই…কোথাও যাওয়ার নেই! মানুষ এরকম অবস্থা সহ্য করে কী করে? মাথাটা ঘুলিয়ে ওঠে আবার। মৃত্যু! একা! কেউ নেই।
॥ পঁয়ত্রিশ ॥
চুপ করে জেগে শুয়েছিল রণেন। পাশে বউ বীণা। ওপাশে বাচ্চারা। পাঁচ বাই সাত খাটে জায়গা হয় না বলে দেয়ালের দিকে একটা বেঞ্চ খাটের সঙ্গে জোড়া হয়েছে। বেঞ্চটার পায়ায় দোষ আছে। বাচ্চাদের কে একজন ঘুমের মধ্যে দাঁত কিড়মিড় করছে। কৃমি। পাশ ফিরতেই বেঞ্চটায় মচাং শব্দ হল। রাস্তায় ঘেয়ো কুকুররা ঝগড়া করছে। সোমেনের ঘরে পুরনো পাখার একটা খটাং খটাং শব্দ হয়। এ সব রণেন একা শোনে। বিশ্বসংসার ঘুমোয়।
রণেনের ঘুম এমনিতে ভালই। স্বপ্ন খুব কম দেখে। নেশারুর মতো ঘুম তার। আজ মনটা বড় খারাপ। সে একবার ঘুমন্ত বীণার গায়ে হাত রাখল। এই মেয়েমানুষটা তার। নিজস্ব। ঘাঁটাঘাঁটি খুব কম হয়নি, তবু কি সবটা চেনা হয়েছে! প্রতিদিন শ্বাসে শ্বাস মিলে যায়, উভয়ের মিলেমিশে তৈরি করা ওই সব সন্তান, তবু দু-জনের মাঝখানে সমুদ্রের ব্যবধান।
ঘুমন্ত বীণার শরীরের সর্বত্র তৃষিতের মতো হাত রাখে রণেন। ঘুমের মধ্যেই বিরক্তির শব্দ করে বীণা হাত সরিয়ে দেয়। একবার অস্ফুট স্বরে বলে—বড় গরম, উঃ!
অপ্রতিভ রণেন বলে—ঘুমোলে?
উত্তর পায় না। বাঁ-হাতের কবজির কাছটায় বড় যন্ত্রণা। ফুলে আছে, টাটাচ্ছে। একটু ডেটল বা কিছু লাগালে হত। পিনটা বের করার পর রক্ত পড়েছে অনেকটা। পেকে ফুলেটুলে ওঠে যদি! আঙুলগুলো কয়েকবার মুঠো করে রণেন। কবজি ঘোরায়, ব্যথা।
বীণা ঘুমন্ত অবস্থায় একবার পাশ ফেরে। তার একটা হাত এসে বুকের ওপর দিয়ে জড়িয়ে ধরে, একটা পা উঠে আসে তলপেটের ওপর। এই ঘুমন্ত আলিঙ্গনটা এখন বড় অস্বস্তিকর। রণেন চায়, এখন তার সঙ্গে কেউ জেগে থাকে। জেগে থেকে আদরে, ভালবাসায় তাকে ঘুম পাড়াক।
বাঁ-হাতির কবজির ওপরেই বীণার শরীরের ভার। হাতটা অবশ হয়ে আসছে। সরার জায়গা নেই। বীণা জেটির দড়ির মতো বেঁধে রেখেছে। ঘরে সবজে রঙের ঘুম-আলোটা জ্বালা আছে। সেই আলোয় একবার বীণার মুখটা দেখে রণেন। শরীর জুড়োলেই কি মেয়েমানুষের প্রয়োজন ফুরোয় পুরুষের কাছে! আর কি চাওয়ার আছে মেয়েমানুষের কাছে? বেশ দেখতে বীণা। মেয়েমানুষের যা যা থাকা দরকার সবই আছে। তবু যেন বেশি কিছু নেই।
রণেন একবার দুঃসাহসে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল—এই।
বীণা বলে—উঃ!
—সরে শোও।
বীণা পাশ ফিরে সরে যায়।
চারদিক থেকে রাতের শব্দ আসে। খাপছাড়া, হঠাৎ শব্দ সব। ইঁদুরের দৌড়-পায়ের আওয়াজ, ইঞ্জিনের ভোঁ, একটা ডাইনামোর আওয়াজ, কাশি, রাস্তায় পায়ের শব্দ, রিকশার ঘণ্টি, রাতচড়া মোটর চলে যাচ্ছে, বহুদূরে কোথায় লাউডস্পিকারে গান হচ্ছে। ঘুম হবে না।
রণেন উঠে মশারি থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের ঘরে এসে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয় সাবধানে। আলো জ্বেলে রেডিয়োগ্রামের খোপে নিবিষ্ট হয়ে খুঁজতে থাকে একটা রেকর্ড। গতবারে খামখেয়ালে কিনেছিল, আছে কিনা কে জানে!
আছে। রবিঠাকুরের নিজের গলায় গাওয়া গানের রেকর্ডটা চাপিয়ে দিয়ে আস্তে ছেড়ে দিল রেডিয়ো। একটু খোনাসুরে, রিক্ত বার্ধক্যের গলায় বৃদ্ধ কবির গান হতে থাকে—অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ…
দুর্বল গলা, সুরের ওপর স্থায়ী হতে পারছে না, দম ফুরিয়ে যাচ্ছে। স্বাসবায়ুর শব্দ আসছে। তবু হাহাকার ভরা কেমন মরুভূমি ফুটে উঠছে চোখের সামনে। উদ্ভিদহীন এক রুক্ষ ধূসর পৃথিবীর ওপর হাঁটু গেড়ে বসেছে বয়সের ভারে ন্যুব্জ, শোকে তাপে জর্জরিত অপমানিত, অসহায় মানুষ। তার পোশাক ধুলোয় লুটোচ্ছে। ক্ষীণদৃষ্টি সে-মানুষ অস্পষ্ট আকাশের দিকে চেয়ে দুহাত তুলে বলছে—অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে…
রেকর্ডটা আবার ফিরিয়ে দেয় রণেন। চোখের জল মুছে নেয়। মানুষ যা ছিল তাই আছে। অন্ধ ও মৃত। আকাশের দিকে নিরন্তর বাড়ানো আছে তার দুই হাত। রবিঠাকুর গাও। রবীন্দ্রনাথ গাইতে থাকেন, কাঁপা কাঁপা, বুড়োটে গলায়, অশ্রুহীন শুষ্ক ক্রন্দনের মতো—অন্ধজনে দেহ আলো…
আর সেই শব্দে মুচড়ে ওঠে বুক। ঝলকে ঝলকে নিঙড়ানো বুক থেকে উঠে আসে চোখের জল। টাগরা ব্যথা করে, কান্নার দলা ঠেলে ধরে টনসিলকে। বয়স ভুলে, সংসার ভুলে, হঠাৎ সব ছদ্মবেশ ঝেড়ে ফেলে ধুলোয় লুটনো শিশুর মতো অসহায়ভাবে ‘মা’ বলে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। কেন কাঁদবে তা তো জানে না রণেন। কেন কাঁদবে? কোনও কারণ নেই। কিংবা হয়তো খুবই তুচ্ছ সেই কারণ। কেবল কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে।
কয়েকবার রেকর্ডটা শুনল রণেন। আরও খারাপ হয়ে গেল। রাস্তায় কুকুরেরা ডাকছে। তাতে যেন আরও নির্জন লাগে কলকাতাকে। আরও ভয়াবহ। বৃশ্চিক রাশির শেষ জীবনটা নাকি ভাল কাটে না। কোষ্ঠীতে রণেনের রাশি বৃশ্চিক নয়, কিন্তু ইংরেজি একটা বইতে সে পড়েছিল, সায়ন মতে জন্মতারিখ অনুযায়ী তার রাশি বৃশ্চিক। শেষ জীবনে সে হয় পাগল হয়ে যাবে, অপঘাতে মারা যাবে। শেষ জীবনের এখনও অনেক দেরি। তবু কেন যে মনে পড়ে!
রাতে ভাল ঘুম হল না, রবিবার সকালটা বাজার করে এসে রণেন তার চার জোড়া জুতোর কালি লাগাল। বাথরুম ঘষল। গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার, টেরিলিন কাচল কয়েকটা। বাচ্চাদের সবকটাকে ধরে ধরে সাবান ঘষে স্নান করাল। কাজকর্মের মধ্যে মন-খারাপটাকে যদি ডুবিয়ে মারা যায়।
পাগল হয়ে যাব না তো! এই কথাটা সারাদিন ধরে মাঝে মাঝে মনে হয়। মরে যাব একদিন! ভেবে চমকে ওঠে সে। স্নানের ঘরে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে রণেন। উৎকট শিস দেওয়ার চেষ্টা করে। গান গায়—অন্ধজনে দেহ আলো…সুরটা লাগে না। মেঠো সুরহীন। গলায় রামপ্রসাদী গানের মতো হয়ে যায় রবীন্দ্রসংগীত।
স্নান করতে করতেই জলের শব্দের মধ্যেই শুনল, কে যেন এসেছে। বাইরের লোকই হবে। কড়া নাড়ার শব্দ। সোমেন ফিরল বোধ হয় আড়া সেরে। না, সোমেন নয়। সোমেন হলে চেঁচাত। বীণা উঁচু বিরক্তির গলায় জিজ্ঞেস করল—কে? না জিজ্ঞেস করে বীণা দরজা খোলে না। দিনকাল ভাল নয়। ছোট ছেলেটাকে বোধ হয় খাওয়াতে বসেছে। ছুটির দিনে আত্মীয়স্বজনরা আসে। বাদুড়বাগানের সম্বন্ধী, কিংবা গড়িয়ার পিসি। তাদেরই কেউ হবে। ছিটকিনি খোলার শব্দ পেল রণেন। নীরস গলায় বীণা আগন্তুককে বলল—ঘরে এসে বসুন। তারপর বাথরুমের দরজার কাছে এসে বলল—শুনছ, বাবা এসেছেন।
বাবা! বাবার কথা ভারী ভুল হয়ে যায় আজকাল। মনেই থাকে না যে বাবা আছেন। কাল একবার মনে হয়েছিল, ঘোষের কথায়। তাড়াতাড়ি জল ঢেলে স্নানটা সম্পূর্ণ করে রণেন। বুকের ভিতরে একটা আকুলি-বিকুলি। মনটা কেবলই বায়নাদার বাচ্চার মতো আপনজনের গন্ধ খুঁজছে। কোথায় আছে মায়ের কোল, বাপের গন্ধ, বউয়ের শরীর। কেউ যেন নেই। বাবা এসেছে শুনে বুকটা তাই কেমন করে উঠল।
গামছা-পরা অবস্থায় বেরিয়েই খানিকক্ষণ বাবার দিকে চেয়ে দেখল রণেন। গায়ে হাফ-হাতা সাদা ফতুয়া, একটু উঁচুতে তোলা ধুতি। শরীরটা বেশ রোগা। বেতের চেয়ারে বসে ধুতির খুঁটে মুখটা মুছছেন। রুমাল রাখেন না। চেয়ারের পাশে মেঝের ওপর রাখা সেই ক্যাম্বিসের ব্যাগ।
মুখ মুছে তাকালেন একটু। কথা বললেন না।
রণেন বলল—এই রোদে বেরিয়েছেন?
ব্রজগোপাল হাসলেন একটু। বললেন—আর সব কোথায়?
রণেন বুঝল, মার কথা বলছেন। বলল—মা তো শীলার কাছেই আছেন। ওর বাচ্চা হবে, কাছে থাকেন।
—ও। আর সোমেন?
—বেরিয়েছে। বসুন, এই সময়ে আসে।
বীণা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করল—চা খাবেন তো!
ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—বরং একটু জল দিয়ো। হাতের কাজ সেরে নিয়ে।
রণেনের কান-মুখ গরম হয়ে ওঠে। রাগে, লজ্জায়। অতিথি তো নয়, বাবা। ভরদুপুরে তাঁকে কেউ চায়ের কথা বলে। বলা উচিত—ভাত খেয়ে যাবেন। কিংবা বলারও দরকার। নেই। ভাত বেড়ে ডাকতে হয়।
লুঙ্গি পরে, চুল আঁচড়ে এসে বসে রণেন। বাবার কাছাকাছি বসতেই যেন একটা শস্য, ফুল আর যজ্ঞমাটির গন্ধ পাওয়া গেল। বীণা পাখাটা খুলে দিয়ে যেতে ভুলে গেছে, রণেন পাখা খুলল। বলল—অনেকদিন বাদে এলেন। শরীরটরীর ভাল তো!
—শরীর ভাল। তবে ওদিককার খবর ভাল না।
—কেন, কী হয়েছে?
ব্রজগোপাল স্পষ্ট কিছু বললে না। কেবল বললেন—কী আর হবে! বহেরুর বয়স হচ্ছে। আমারও। বুড়োরা এবার পা বাড়িয়ে রয়েছি। এই বেলা সব বুঝে না নিলে…
সেই পুরনো কথা। রণেন চুপ করে থাকে।
বীণা হাত ধুয়ে এক গ্লাস জল রেখে যায় টেবিলের ওপর। ব্রজগোপাল জলটার দিকে চেয়ে থাকেন। বলেন—সে যাকগে। আমার অ্যাকাউন্টে এল আই সি’র চেকটা ক্যাশ হয়ে এসেছে নাকি?
—সে তো কবে!
—তা হলে টাকাটা দিয়ে যাই। সেজন্যেই এসেছি। তোমাদেরও জমিটার ব্যাপারে দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ক্যাম্বিসের ব্যাগ থেকে খুঁজে খুঁজে হাঁতড়ে দোমড়ানো চেক বইটা বের করলেন বাবা। বুকপকেট থেকে ট্রেনের ফেরিঅলার কাছ থেকে কেনা সস্তা কলম বের করে বললেন—উনি দশ হাজার চেয়েছিলেন, না কি পলিসির পুরো টাকাটাই, তুমি জানো?
রণেন বিপদে পড়ে মাথা নেড়ে বলল—না।
—কার নামে লিখলে ভাল হয়?
—মার তো অ্যাকাউন্ট নেই।
—নেই? বলে একটু দ্বিধায় পড়লেন ব্রজগোপাল।
—আমার আছে।
—তোমার নামে লিখব? বলে ব্রজগোপাল রণেনের দিকে তাকালেন। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন সংশয় ভরা। যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।
ভারী অভিমান হল রণেনের। চুপ করে রইল।
ব্রজগোপাল কলম রেখে জলটা খেলেন। কোঁচার খুঁটে মুখ মুছে বললেন—তোমার তো ইনকাম ট্যাক্সের ঝামেলা আছে। বরং তোমার মায়ের নামে একটা অ্যাকাউন্ট খুলে নাও। বলে একটু চুপ থেকে বললেন—তোমার মাকেই টাকাটা দেওয়ার কথা আমার। তোমার নামে লিখলে কথা রাখা হল না। কাজের সুবিধে হলেও সেটা উচিত হবে না।
—তবে মার নামেই লিখুন।
ব্রজগোপাল তাই লিখলেন। সাবধানে চেকটা ক্রস করে অ্যাকাউন্ট পেয়ি করে দিলেন। রণেন দেখল, ব্রজগোপাল পলিসির পুরো টাকাটাই লিখে দিয়েছেন।
চেকটা হাতে দিয়ে বললেন—তোমার মায়ের হাতে দিতে পারলেই ভাল হত।
রণেন বলল—শীলার বাড়ি তো দূর নয়। খাওয়া-দাওয়া করে নিন, তারপর, একটা ট্যাক্সি করে চলে গেলেই হবে।
ব্রজগোপাল ভারী লাজুক একটু হেসে বলেন—ওখানে যাওয়ার কী দরকার? তুমি ওঁর নামে ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিয়ো।
ব্রজগোপালের কাজ ফুরিয়েছে, এক্ষুনি বুঝি চলে যাবেন। ফলে রাতের সেই কান্নার দলাটা আজও ঠেলা দিয়ে উঠল রণেনের টনসিলের কাছে। বাবা চলে গেলেই বড় একা লাগবে। রণেন তাই তাড়াতাড়ি বলল—চলুন না। শীলা অজিতদেরও বহুদিন দেখেননি।
ব্রজগোপাল কী ভেবে চেয়ারে ঠেসান দিয়ে বললেন—তা হলে তুমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। আমি বসছি।
—আপনি খাবেন না?
—আমি! ব্রজগোপাল ভারী অবাক হয়ে বললেন। মাথা নেড়ে বলেন—আমি তো স্বপাক খাই। নিরামিষ। খেয়েই এসেছি।
বীণা ভিতরের ঘরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। তাকে ঘিরে ছানাপোনা। সবাই অবাক হয়ে ব্রজগোপালকে দেখছে। বীণা বলল—কিছুই খাবেন না?
সংকোচের সঙ্গে ব্রজগোপাল বললেন—খাওয়ার দরকার নেই। ওই ডানদিকেরটি বুঝি সুপ্রসন্ন? না, কি যেন ওর নাম রেখেছ?
বীণা লজ্জা পেয়ে বলে—মনোজিৎ, ছেলেকে একটু ঠেলা দিয়ে বলে—যাও, দাদুর কাছে যাও।
—এস দাদা। বলে হাত বাড়ান ব্রজগোপাল। তাঁর দুই গর্তে ঢাকা চোখে কী একটা অন্তর্নিহিত পিপাসা ঝিকিয়ে ওঠে। আপনজন! রক্তের মানুষ! উত্তরাধিকার!
ভয়ে ভয়ে বুবাই এক-পা দু-পা করে এগিয়ে আসতে থাকে। এই বুড়ো মানুষটা তার দাদু, সে জানে। কিন্তু পবিচয়হীনতার দূরত্বটুকু পার হতে সময় লাগে তার।
ব্রজগোপাল নিচু হয়ে ক্যাম্বিসের ব্যাগ তোলপাড় করে কাগজে মোড়া এক ডেলা আমসত্ত বের করে আনেন, একটা ঠোঙায় কিছু শুকনো কুল, আমসি, প্লাস্টিকের ঠোঙায় কিছু ক্ষোয়া ক্ষীর। নাতির হাতে দিয়ে বলেন—সবাই খেয়ো।
নাতির পিঠে একবার হাত রাখলেন। কোলে নিলেন না। অভ্যাস ভাল নয়। ফিরে গিয়ে মনটা আবার গর্ত খুঁড়বে। পিঠে হাতটা রেখে বললেন—যাও, মায়ের কাছে যাও।
খেয়ে নিতে একটুও সময় নষ্ট করল না রণেন। ঘরের মধ্যে তার হাঁপ ধরে আসছে। একটা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এসে বলল—চলুন।
চেকটা টেবিলের ওপর পড়েছিল। ব্রজগোপাল সেটা সযত্নে ভাঁজ করে ভিতরের পকেটে রাখলেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন—তোমাদের জমিটাও ওইখানেই?
—হ্যাঁ, জমিটাও দেখা হয়ে যাবে আপনার। রণেন বলে।
—আমি দেখে কী করব! তোমরা থাকবে, তোমাদের পছন্দ হলেই হল।
রণেন উত্তর দিল না।
বেরোবার মুখে দরজার কাছ বরাবর একটু দাঁড়ালেন ব্রজগোপাল। ইতস্তত করে বললেন—সোমেন এল না এখনও? রোজ এরকম বেলা করে নাকি!
বীণা হেসে বলে—কিছু ঠিক নেই।
—ভাল কথা নয়। অনিয়ম করে এ বয়সে শরীর ভাঙলে খুব বিপদ। চাকরিবাকরি কিছু হয়নি?
—না। বীণা উত্তর দেয়।
ট্যাক্সিতে বসে রণেন বলে—বাবা।
ব্ৰজগাপাল অন্যমনস্ক ছিলেন। উত্তর দিলেন না। কিন্তু হঠাৎ মুখটা ফিরিয়ে বললেন—ট্যাক্সিতে চড়ে পয়সা নষ্ট করো কেন? এ বয়সে আয়েশি হলে শরীর বসে যায়, মনটাও আলসে হয়।
—বাসে-ট্রামে চড়া যায় না। বড় ভিড়।
—তোমরাই ভিড় বাড়াচ্ছ। ভিড় তো তোমাদেরই। বলে আবার মুখটা বাইরের দিকে ফিরিয়ে বলেন—কলকাতায় যারা থাকে তারা ক্রমে মানুষকে ঘেন্না করতে শেখে। এ বড় পাপ।
রণেন আবার ডাকল—বাবা।
—উঁ! বলে ব্রজগোপাল মুখ ফেরালেন।
রণেনের তখন বড় লজ্জা করল। কী বলবে? বাবাকে তার কিছু বলার নেই। মুখে পান ছিল। গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল—বাড়িটা যদি হয় তো আমাদের কাছেই এসে থাকুন।
ব্রজগোপালের ভিতর যে অভিমানী কঠিন মানুষটির বাস সেই মানুষটিই যেন ঈষৎ উষ্মভরে জবাব দেন—কেন?
ঠিকই তো। কেনো? বাবা কেনো থাকবেন তাদের সঙ্গে!
ব্রজগোপাল আরও কিছুক্ষণ আলগা চোখে বাইরের দিকে কলকাতার অপসৃয়মান বাড়িঘর দেখলেন। গাড়ি আনোয়ার শা রোড ধরে শীলাদের বাড়ির গলির কাছাকাছি এসে পড়ল। ট্যাক্সি থামলে ব্রজগোপাল হঠাৎ চমকে উঠে বললেন—এসে গেলাম নাকি!
—হুঁ। রণেন নেমে ভাড়া দিতে দিতে বলে। এবং টের পায়, বাবা এখনও মায়ের সাহচর্যে আসতে কত লাজুক ও অপ্রতিভ হয়ে যান। বাবা ও মার মধ্যে তবে কি ভালবাসা আছে আজও?
॥ ছত্রিশ ॥
অজিত দরজা খুলে ভারী অবাক হয়। শ্বশুরমশাইকে তার বাড়িতে সে একদম প্রত্যাশা করেনি। তারওপর দুপুরের কাঁচা ঘুম থেকে উঠে এসেছে, ভারী থতমত খেয়ে গেল। এ সময়টায়, বিশেষত ছুটির দুপুরে সবাই ঘুমোয়।
ব্রজগোপালের মুখে-চোখে একটু অপ্রসন্নতার ছাপ। বললেন—আছে সবাই?
—আসুন। বলে দরজার পাল্লা হাট করে দিয়ে বলে অজিত—ঘুমোচ্ছে। ডাকছি।
ব্রজগোপাল ঘরে এসে বসলেন। চারদিকে চেয়ে-টেয়ে বললেন—ভালই।
অজিত সেন্টার টেবিল থেকে সন্তর্পণে তার সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার সরিয়ে নিচ্ছিল। ব্রজগোপাল সেটা নিশ্চয়ই চোখে দেখলেন। অজিত তাঁকে অন্যমনস্ক করার জন্য বলল—কী ভাল? বাড়ি?
ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বললেন—ঘরদোর তো বেশ বড় বড় দেখছি। কখানা?
—দুটো বেডরুম আছে দুদিকে। একটা প্যাসেজ, আর যা যা সব থাকে। বলে হাই তুলল।
রণেন একটু দূরে বসেছে। এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বলল—ওরা দোতলা করে নীচের তলাটা ভাড়া দেবে।
ব্রজগোপাল উদাস গলায় বলেন—লাভ কী?
—বাড়ির কষ্টটা খানিকটা উঠে আসে।
—ভাড়াটেদের সঙ্গে থাকা সঙ্গত নয়। ব্রজগোপাল তেমনি নিশ্চিত স্বরে বলেন—বাড়ির বড় মায়া। পরমানুষ দেয়ালে পেরেক ঠুকলেও বুকে লাগে।
—আমিও ভাবছিলাম, বাড়িটা যদি হয় তো তিনতলার ভিত গেঁথে করব। একতলাটা ভাড়াটে, দোতলা আর তিনতলায় আমরা।
ব্রজগোপাল একবার ছেলের মুখ নিরীক্ষণ করলেন। তারপর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন—তোমরাই থাকবে, তোমাদের যা ইচ্ছে।
অজিত ভিতরের ঘরে এসে দেখে শীলা এক কাত হয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছ। এ সময়টায় চেহারা রুক্ষ হয়ে যায়, মুখে মেচেতার মতো দাগ পড়ে। চোখ বসা, কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। কিছু পেটে রাখতে পারে না, সব উলটে বের করে দেয়। তা হোক। তবু পেটের বাচ্চাটিকে ধরে রাখতে পেরেছে। নষ্ট হয়নি শেষ পর্যন্ত। ঘুমন্ত শীলাকে ডাকতে বড় মায়া হয়। পাশেই শাশুড়ি ঠাকরুন গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমের মধ্যেও মাথায় ঘোমটা।
অজিত গলাখাঁকারি দিল। শাশুড়িকে মা বা শ্বশুরকে বাবা বলে ডাকার অভ্যাসটা তার এখনও হয়নি? শীলা সেজন্য রাগ করে। বলে—তোমার মা-বাবাকে আমি মা বাবা ডাকতে পারি, আর তুমি আমার মা-বাবাকে পারো না? অজিত অবশ্য ঝগড়া করে না, কিন্তু ডাকেও না।
অজিত গলাখাঁকারি দিতেই অবশ্য ননীবালা মুখখানা সন্তর্পণে তুলে বললেন—কে এসেছে? বাইরের ঘরে আওয়াজ পাচ্ছি।
অজিত ইতস্তত করে বলে—উনি।
ননীবালাকে আর বলতে হল না। বুঝলেন। যেন উনি বলতে বিশ্বসংসারে একজনই আছে। শীলাকে একটু ঠেলা দিয়ে বললেন—ওঠ্।
শীলা আদুরে ঘুম-গলায় বলে—উঁ।
—উনি এসেছেন। উঠতে হয়। তোর বাড়িতে প্রথম এলেন।
ঘুম থেকে উঠলেই একটা সিগারেটের তেষ্টা পায়। অজিত তাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট টেনে নিতে থাকে দ্রুতবেগে। পরশুদিন একটু বৃষ্টি হয়েছিল। সামান্য বৃষ্টিতেই সামনের রাস্তার ধুলো ধুয়ে পাঁজর বেরিয়ে পড়েছে। খাটালের জমানো গোবরের টাল থেকে পচাটে গন্ধ আসে। ওপরে ধুলোটে আকাশ। ফরসা রোদ। শুকনো গরম হাওয়া দিচ্ছে। বহু ওপরে আকাশের গায়ে দাগের মতো বড় পাখি চিল বা শকুন উড়ছে। ভারী নিরালা দুপুর। আকাশে চড়ানো ডানামেলা পাখি, রোদ, বিস্তার দেখে অজিতের মনটাও নিরালা হয়ে যায়। আত্মীয়স্বজন আজকাল তার ভাল লাগে না। আগেও লাগত না। মা বাবা ভবানীপুরের সংসার ছেড়ে এসে আরও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে সে। বাড়িতে আত্মীয় এলে তার অকারণ উৎপাত মনে হয়। কথা বলতে হবে, সামনে গিয়ে বসে থাকতে হবে, সিগারেট লুকোতে হবে। কিংবা আবার ভদ্রতা রক্ষার জন্য কখনও-সখনও যেতে হবে তাদের বাড়িতেও। ভাবতেই ক্লান্তি লাগে। নিজের মতো নিরালা জীবন পাওয়াটাই সবচেয়ে প্রিয় ছিল তার কাছে।
তাড়াতাড়ি জোরে টান দেওয়ায় সিগারেটটা তেতে গেছে, ধোঁয়া আসছে না। সেটা ফেলে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে চোখেমুখে জল দিল সে। যতক্ষণ সময় কাটানো যায়। জলের ঝাপটা চোখেমুখে দিতে গিয়ে এক কোষ জল নাকে ঢুকে দম আটকে দিল। অস্বস্তি। জলের গন্ধে কী যেন একরকম লাগে। বুকচাপা নিঃসঙ্গতা। অজিত জানে, পৃথিবীতে তার কেউ নেই। একদম কেউ না। ছিল লক্ষ্মণ। তাকে একা করার জন্যই ভগবান বুঝি তাকে দূরে নিয়ে গেলেন। অবশ্য ভগবান মানে না অজিত, ভাগ্যও না। তবু ওইরকম মাঝে মাঝে মনে হয়। কার অদৃশ্য হাত তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধুটিকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তাকে একাকীত্বে রেখে দেখার জন্যই বুঝি!
বাথরুমের দরজাটা ভেজানো ছিল। সেটা ধাক্কা দিয়ে অধৈর্য হাতে খুলে শীলা ঢুকল। বলল—ইস্, বাথরুমে এত দেরি কেন, মেয়েদের মতো? বাইরে যাও।
ধীরেসুস্থে অজিত তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে—তাড়া কীসের?
—ভীষণ পেয়েছে। তুমি যাও তো, বাবা বসে আছেন। মেয়ে-জামাইয়ের বাড়িতে প্রথম এলেন, জামাইয়ের পাত্তা নেই। শীলার গলায় যথেষ্ট রাগ।
ডাক্তারের মত নিয়ে শীলা আজকাল ইস্কুলে যায়। রিকশায় করে। একবার বাইরের স্বাদ পেলে মেয়েরা আর ঘরবন্দি থাকতে চায় না। হাঁপিয়ে ওঠে। কদিন আগে সন্ধেবেলা বাসায় ফিরে অজিত একটু অবাক হয়ে দেখে, বাইরের ঘরে একটা অপরিচিত ছেলে বসে আছে। ভারী সুন্দর চেহারা, আর ভীষণ স্মার্ট। শীলা পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম সুভদ্র। বলল—শোভনাদির লিভ ভ্যাকেন্সিতে চাকরি করছিল আমাদের স্কুলে। শোভনাদি ফিরে এসে জয়েন করেছেন, বেচারির চাকরি গেছে। এখন তোমার কাছে এসেছে, যদি তুমি ওকে এ আই সি’র একটা এজেন্সি পাইয়ে দাও।
একটু অবাক হয়েছিল অজিত। এল আই সি’র এজেন্সি পাওয়া কোনও শক্ত ব্যাপার নয়। ধরা করার দরকার হয় না। তা হলে তার কাছে আসা কেন। সে-রহস্যের ভেদ হল না বটে কিন্তু ছেলেটাকে বেশ ভাল লেগে গেল। এ ছেলেটা খুব সুন্দর বটে কিন্তু নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন নয়। গালে দাড়ি আছে, লালচে রকম গোঁফ আছে একটু। পোশাক-আশাকে সাধারণ। চমৎকার কথা বলে। ভীষণ হাসায়। টকটকে ফরসা রং, লম্বা এবং গোরাটে চেহারার মধ্যে আবার একটু বাচ্চাদের মতো লাজুকতাও আছে।
যতক্ষণ সুভদ্র ছিল ততক্ষণ শীলার চেহারাই অন্য রকম। চোখেমুখে একটা উত্তেজিত চকচকে ভাব। ঠোঁটে হাসি, মুখে অনর্গল কথা। বারোটা মিষ্টি সব যত্ন করে সাজিয়ে দিল। লম্বা সোফাটায় সুভদ্র বসেছিল, অন্য ধারে বসল শীলা। নিঃসংকোচে। কোনও হাসির কথা উঠলে ঝুঁকে সুভদ্রকে ঠেলা দিয়ে বলছিল—এই সুভদ্র, বলুন না সেই নক্সালাইটরা ইস্কুলে বোমা ফেললে অচলাদি আর দীপ্তিদি কেমন করে পায়খানায় ঢুকে গিয়েছিলেন, আর ঢুকেই দেখেন সেখানে পণ্ডিতমশাই…হি…হি….
রাত ন’টা পর্যন্ত সুভদ্র ছিল। ততক্ষণ শীলাকে মনে হচ্ছিল একটি কুমারী মেয়ে। শরীরে কোনও অস্বস্তি নেই। কোনও সম্পর্ক নেই অজিতের সঙ্গে।
সুভদ্র চলে গেলে এ বাড়ির ভূতটা নেমে এল। তখন শাশুড়ি ঠাকরুন ছিলেন না। শুধু অজিত আর শীলা থাকলে এ বাড়িতে ভূত নামে। সে ভূতটার নাম গাম্ভীর্য। কথার শব্দ নেই, হাসির শব্দ নেই, ফাঁকা নিঃসঙ্গতা শুধু। শীলার শরীর তখন খারাপ লাগতে লাগল বলে গিয়ে শুয়ে রইল ঘর অন্ধকার করে। পাশের ঘরে অজিত নতুন কেনা একটা ফাঁকা কাচের টিউব থেকে অন্তহীন রুমাল বের করতে থাকল। দর্শকহীন ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাজিকের প্যাটার মুখস্ত বলে যেতে যেতে একটা জাম্বো কার্ডের খেলা দেখাতে লাগল নিজেকে। ম্যাজিক মানেই হাত, চোখ, মুখ, ভঙ্গি আর কথার কৌশল। জীবন মানেও কি তাই নয়? কিন্তু সেইসব কৌশল অজিতের জানা নেই। তাই বাড়িতে ভূত নামে। অনেকক্ষণ ম্যাজিক করে ক্লান্ত অজিত সিগারেট ধরিয়ে একা বাইরের ঘরে এসে বসে থাকল। ঘরে আলো জ্বালেনি, পাশের ঘর থেকে আবছা আলো আসছে। বসে থেকে থেকে সে টের পেল, এ বাড়ির ভূতটা সে নিজেই। ভূত মানে, যে ছিল, এবং এখন আর নেই। অজিত তো তাই। সে ছিল, সে এখন আর নেই, নইলে ওই যে সুন্দর চেহারার ছেলেটা, সুভদ্র, ওর কারণে একটু হিংসে হতে পারত তার। একটু সন্দেহ। কিন্তু কিছু হচ্ছে না। বরং অজিত ভাবছিল, শীলা আর কাউকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে বড় ভাল হয়। সে নিজে আর একটু আলগা হতে পারে, আর একটু একা। একা হওয়া কী ভীষণ ভাল। আহা, শীলা ওই ছেলেটার সঙ্গে হালকা একটু প্রেম করুক না। ক্ষতি কী?
জীবন মানেও একরকম কৌশল। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে তারা দুজনেই ভারী নিস্তেজ, পরস্পর সম্পর্কে কৌতুহলহীন। তাই মাঝে মাঝে নিজেকে একটু উসকে নেয় অজিত, শীলাকেও উসকে নেয়। এইভাবে অনুভব করার চেষ্টা করে যে, তারা সম্পর্কিত, তারা আছে।
বাথরুমের বাইরে যাওয়ার জন্য শীলা তাড়া দিচ্ছিল, অজিত র্যাকে তোয়ালেটা রেখে বেসিনের ওপর ছোট আয়নার দিকে চেয়ে আঙুলে চুল পাট করতে করতে বলল—লজ্জা কী, বসে পড়ো না। আমি দেখছি না।
—সে খালি বাড়িতে। এখন দেয়ালা কোরো না। বাইকে যাও তো শীগগির। কেউ এসে পড়লে…ছি ছি…
অজিত গম্ভীরভাবে বলল—শোনো, একটা কথা।
—পরে হবে। উঃ। বাবা বসে আছেন, দাদা মা…তুমি একটা কী বলো তো!
—কী?
—এখন যাও না।
—আমার কানে কয়েকটা উড়ো কথা এসেছে শীলা।
—পরে শুনব।
—না, এখনই। সুভদ্রর সম্পর্কে…
শীলা হঠাৎ যেন থমকে গেল। গলার স্বরটা হয়ে গেল অন্যরকম। বলল—কী কথা? কী শুনছ?
—তোমার সঙ্গে সুভদ্রর রিলেশনটা…
—কীরকম?
—লোকে বলে।
—কে লোক?
—আছে। তুমি চিনবে না।
বাথরুমের ঝুঁঝকো আলোয় শীলা কেমন ছাইরঙা হয়ে গেল। অবাক বড় চোখ, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে আছে, ক্ষতচিহ্নের মতো।
—তারা কী বলেছে? শীলা নরম গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে।
শীলার চেহারা দেখে অজিত ভয় পেয়ে গেল। ঠাট্টার এমন প্রতিক্রিয়া হবে, এতটা পালটে যাবে শীলা তা সে ভাবেনি। হাত বাড়িয়ে বলল—কী হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি!
—তুমি ও কথা বললে? শীলার গলায় মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কাঁদবে।
—কিছু না। কেউ কিছু বলেনি। বলল অজিত। কিন্তু গলায় কোনও আন্তরিকতা ফোটাতে পারল না। মাঝে মাঝে মানুষের বড় ভুল হয়ে যায়। গলা খাঁকারি দিয়ে অজিত বলে—ঠাট্টা করছিলাম। আমি যাচ্ছি।
ম্লান মনে বেরিয়ে এল অজিত। হঠাৎ বুঝতে পারল, সে যে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে তী শীলাকে কোনওদিন বিশ্বাস করানো কঠিন হবে। কিন্তু ঠাট্টাটা কী? অজিতের মনেও কি কিছু ছিল না!
সম্পূর্ণ আনমনা অজিত বাইরের ঘরে এসে দেখল তার শ্বশুর ব্রজগোপাল লাহিড়ি তার শাশুড়ি ননীবালা লাহিড়ির হাতে মোটা টাকার চেক তুলে দিচ্ছেন। দৃশ্যটা অনেকটা খবরের কাগজের ছবির মতো, কোনও সংস্থার পক্ষ থেকে কেউ যখন বন্যাত্ৰাণ বা ওইরকম কিছুর জন্য রাজ্যপাল বা প্রধানমন্ত্রীর হাতে চেক তুলে দেয়, স্রেফ পাবলিসিটির জন্য। বিজ্ঞাপন দেওয়ার চেয়ে সংবাদে নাম তোলা অনেক বড় বিজ্ঞাপন। আজকাল সবাই সংবাদ হতে চায়। পারিবারিক ক্ষেত্রে ব্রজগোপালও এখন সংবাদ। শেষ পর্যন্ত টাকা তিনি দেবেন এমন বিশ্বাস অনেকেরই ছিল না। কিন্তু এই মুহুর্তে চেকটা দেওয়ার সময়ে তাঁর ভাবমূর্তিটা বেশ বড়সড় হয়ে উঠল। ননীবালা বাঁ-হাতে চোখ মুছে ধরা গলায় বললেন—রণোর নামে দিলেই তো পারতে!
ব্রজগোপাল রক্তাভ লাজুক মুখে বললেন—তোমাকেই দেওয়ার কথা ছিল।
শ্বশুরকে বহুকাল বাদে একটু মন দিয়ে দেখল অজিত। ক্ষ্যাপাটে, বাতিকগ্রস্ত বুড়ো। তবু মুখের ওই রক্তাভাব যে লাজুকভাব, যে চাপা অস্থিরতা তার মধ্যে একটা গভীর মমতাময় হৃদয়ের চিহ্ন আছে। বুড়ো মানুষরা চিঠির শেষে পাঠ লেখে ইতি নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী অমুক। সেটা কথার কথা। কিন্তু এই লোকটার শরীরের মধ্যে যেন সেই কথাটা গোপনে ভোগবতীর মতো বয়ে যাচ্ছে—নিত্য শুভাকাঙ্ক্ষী।
ননীবালার চোখে বুঝি জল এল আবার। প্রায় রুদ্ধ গলায় বললেন—বাড়িটা যদি হয় তাহলে…
বলে একরকম প্রত্যাশায় তাকালেন স্বামীর দিকে। ঘোমটাটা আর একটু টেনে মুখখানা প্রায় ঢেকে বললেন—রণো বলছিল, বাড়ি করলে বাবার জন্য একটা আলাদা ঘর করব।
কথাটায় ইঙ্গিত ছিল। নিরুদ্দিষ্টের প্রতি আহ্বান।
ব্রজগোপাল একটু চেয়ে রইলেন ননীবালার দিকে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন—কতকাতায় আর না। তোমরা থাকো। গোবিন্দপুর ছেড়ে আসা হবে না। তা হলে সব দেখবে কে?
ননীবালা উত্তর দিলেন না। রণেন চুপ করে বসে আছে। কিংবা ঠিক চুপ করেও নেই। তার ঠোঁট নড়ছে নিঃশব্দে। আপনমনে কথা বলছে নাকি?
অজিত সকলের কাছ থেকে দূরে। ঘরের কোণে একটা গদি আঁটা শান্তিনিকেতনি মোড়ায় বসে রইল। ব্রজগোপালের দিকে চোখ। এ লোকটাকে তার বড় হিংসে হয়। সব থেকেও কেমন একা, আলগা। হৃদয়হীন বলে মনে হয়। মনে হয়, বুঝি সন্ন্যাসী।
সে যাইহোক, লোকটা সংসারকে লাথি মারতে পেরেছে। বুকের পাটা আছে এ বয়সেও।
উৎকর্ণ হয়ে বসেছিল অজিত। বাথরুমে শীলা অনেকক্ষণ সময় নিচ্ছে। বড় ভয় হয়। পাঁচ মাসের পেট নিয়ে, যদি পড়েটড়ে যায়। ঠাট্টাটা করা ঠিক হয়নি।
আবার অজিত ভাবে, ঠাট্টা! ঠাট্টাই কী! আর কিছু নয়? উৎকর্ণ হয়ে থাকে। এ বাড়ির নিঃসঙ্গতার ভূতটা কখন যে কার ঘাড়ে ভর করে কী অনর্থ ঘটায়! সেই নিঃসঙ্গতা ভাগিয়ে দেওয়ার জন্য একজন আসছে। উগ্র আগ্রহে অপেক্ষা করছে অজিত। শীলা, পড়েটড়ে যেয়ে না, সাবধান! মন খারাপ কোরো না, ওটা একটা ভূতুড়ে ইয়ারকি।
ব্রজগোপাল চেক-দান অনুষ্ঠানের ভাবগম্ভীরতা থেকে হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে চারদিকে চেয়ে বললেন—শীলুকে দেখছি না!
ননীবালা ডাকলেন—অ শীলা।
—বাথরুমে। জবাব দিল অজিত।
—ও। ব্রজগোপাল খানিক চুপ করে থেকে বললেন—শীলুর বাড়িতে এলাম, অথচ ওর জন্য হাতে করে কিছু আনিনি।
—কী আনবে! ননীবালা বলেন।
— বাচ্চাদের কাছে আসতে বাপের কিছু হাতে করে আনতে হয়। ব্রজগোপাল বলেন।
—ওরা কি বাচ্চা! ত্রিশের কাছে বয়স হল। বলেন ননীবালা। একটু হাসলেনও বুঝি।
বড় হয়েছে! বলে ভ্রূকুটি করেন ব্রজগোপাল। যেন বা তাঁর বাচ্চারা যে বড় হয়েছে এটা তাঁর বিশ্বাস হয় না। তিনি জানেন, ওরা এখনও ভুলে ভরা, বায়নাদার, অবুঝ শিশু তাঁর। বড় হয়নি, একদম বড় হয়নি।
বাচ্চা ঝিটা বাইরে থেকে মিষ্টি নিয়ে ঘরে এল। রান্নাঘর থেকে চায়ের জলের শিস শোনা যাচ্ছে। শীলার এবার বাথরুম থেকে বেরনো উচিত।
ব্রজগোপাল জামার ভিতরের পকেট থেকে দশটা টাকা বের করে অজিতের দিকে চেয়ে বললেন—তোমরা মিষ্টি খেয়ো।
অজিত হাসল, বলল—না, না। সে কী!
রণেন দৃশ্যটা দেখে হাসল। ননীবালাও হেসে বললেন—ওরা কি আর সেই ছোটটি আছে যে বাপ মিষ্টি খেতে টাকা দেবে!
ব্রজগোপাল নিপাট গম্ভীর চোখে চেয়ে বললেন—নাও।
হাতটা বাড়িয়ে রইলেন। অজিত বাচ্চা ছেলের মতো লাজুক ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল। কিছু বলার নেই।
—উঠি। ব্রজগোপাল বলেন।
—বসুন! চা হচ্ছে। অজিত বলল।
—পরমানুষের মতো কেবল উঠি-উঠি ভাব কেন? শীলা আসুক। ননীবালা এই বলে মুখের পানের ছিবড়ে ফেলে এলেন জানালা দিয়ে।
অজিত উৎকর্ণ হয়ে আছে। শীলার কোনও শব্দ নেই। বড় দেরি করছে শীলা। এত দেরি হওয়ার কথা নয়।
॥ সাঁইত্রিশ ॥
ব্রজগোপাল আর ননীবালা কথা বলছেন। সেই ফাঁকে নিঃশব্দে উঠে গেল অজিত। নিঃশব্দ পায়ে বাথরুমের দরজার কাছে চলে এল। ভিতরে কলের জল বয়ে যাওয়ার শব্দ। খুব মৃদু দুটো টোকা দিল অজিত। সাড়া নেই। আর একটু জোরে টোকা দিতেই আটকানো কপাটের পাল্লা নরমভাবে একটু খুলে গেল। ভিতরে অন্ধকার। অজিত কাছেপিঠে কেউ নেই দেখে ঢুকে গেল ভিতরে।
শীলা বেসিনের ওপর উপুড় হয়ে আছে। বাড়ানো হাতে দেয়ালে ভর। হিক্কার মতো শব্দ করছে। গলায় আঙুল দিয়ে একঝলক বমি করল। পিছন থেকে অজিত পিঠে হাত রাখে। অন্য হাতে মাথাটা ধরে শীলার। বমির সময় কেউ মাথা চেপে ধরে রাখলে কষ্ট কম হয়।
কিন্তু বমি আর এল না। শীল জলের ছাঁটে চোখ মুখ ভিজিয়ে নিতে থাকে। অজিত মৃদু গলায় বলে—শ্বশুরমশাই বসে আছেন। তাড়াতাড়ি করো।
জলে ভেজা মুখটা ফেরাল শীলা। তীব্র, সজল, বড় বড় চোখ। একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে—আমি যাব না।
অজিত বুঝল, রেগেছে খুব। বলে—বিশ্রী দেখাচ্ছে কিন্তু। চলো। ওঁরা অপেক্ষা করছেন।
একটু ক্লান্তির স্বরে শীলা বলে—তুমি যাও।
অজিত বলে—যাচ্ছি। দেরি কোরো না, প্লিজ।
বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল, ঠিক এ সময়ে শীলা নাটুকে ভঙ্গিতে হাতটা বাড়াল। বলল—ওগো!
অনেকটা আর্তস্বরের মতো ডাক। অজিত একটা শ্বাস ছাড়ল মাত্র। এটা দেয়াল। নইলে ও এমন কিছু অসুস্থ নয় যে, হেঁটে ঘরে যেতে পারবে না। এ অবস্থায় বমি কে না করে! গত চার মাস ধরে শীলাও করছে।
অজিত একটু কুণ্ঠিতভাবে বলে—কী?
—ধরো। পারছি না। শীলা হাত বাড়িয়ে চেয়ে আছে। অভিমান ঘনিয়ে আসছে চোখে।
অজিত বিরক্তি চেপে বলে—বাইরের ঘরে শ্বশুরমশাই। দেখতে পাবেন।
শীলা সেটা শুনল না। জীবনের শেষতম প্রশ্নের মতো গভীর গলায় বলে—ধরবে না?
আর একটা অসহায় শ্বাস ছেড়ে অজিত হাত বাড়িয়ে শীলার কোমর ধরল। শীলার ভেজা হাত বেষ্টন করে তার কাঁধ, খুবই ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি। এইভাবেই তারা বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে। পুরো নাটক। শীলা হঠাৎ মুখটা তুলে কাঁধে মুখ ঘষে কান্নায় ধরা গলায় বলে—তুমি কী নিষ্ঠুর!
সব স্ত্রীই স্বামীকে এই কথা বলে। কারণে, অকারণে। তবু শীলার এই কথাটা যত আলগাভাবে বলা ততটা মিথ্যে নয়। অজিত তো জানে, সে কত নিস্পৃহ! কত উদাস! এ বোধ হয় অর্থনীতির ক্রমহ্রাসমান উপযোগ বিধি! ডিমিনিশিং ইঊটিলিটি। না কি, তারা কেবলমাত্র যৌন অংশীদার? নাকি পারস্পরিক নিরাপত্তার জন্য একটা প্রাইভেট লিমিটেড? বিবাহ শব্দটির মধ্যে একটি বহ্ ধাতু আছে। তার মানে কি বহন করা? বহন করাই যদি হয়, তবে সে বড় কষ্টের। বহন কেন করবে? একদিন অফিস যাওয়ার আগে থেকে উঠে পোশাক পরছিল অজিত। হঠাৎ মাথার মধ্যে চিড়বিড়িয়ে উঠল একটা রগ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মাথায়। সেরিব্রাল থ্রম্বসিস এভাবেই হঠাৎ হয়, জানা ছিল। সেই স্মৃতিই বোধ হয় আচমকা এসেছিল মাথায়। দু-হাতে মাথা চেপে ধরে ‘এ কী। এ কী’ বলে বসে পড়েছিল অজিত। শীলার সায়া-ব্লাউজ পরা হয়ে গেছে, শাড়িটা ফেরত দিয়েছিল মাত্র, অজিতের কাণ্ড দেখে শাড়িটা দু-হাতে খামচে খুলে পক্ষিণীর মতো জাপটে ধরল তাকে, দু-হাতে মাথা বুকে নিয়ে ‘ঠাকুর! ঠাকুর! এ কী সর্বনাশ’। বলে চেঁচিয়ে উঠল। বলে চেঁচিয়ে উঠল। সেও জানে এইভাবে আজকাল আচমকা থ্রম্বসিস হয়, মানুষ চলে যায় বিনা নোটিশে। কিছুক্ষণ বসে থেকে সামলে নিল অজিত। কিছু না। তবু শীলা অফিস যেতে দিল না, নিজেও গেল না স্কুলে। সারা দিন আগলে বসে পাহারা দিল অজিতকে। কয়েক দিন চোখে চোখে রাখল। বিবর্ণতার মধ্যে সে ছিল উজ্জ্বল কয়েকটা দিন। প্রেমে পূর্ণ, নির্ভরতায় গদগদ। তবু অজিত ভাবে, কেন ওই পক্ষিণীর মতো ছুটে আসা, কেন আগলে ধরা! সে কি ভালবাসা! নাকি নিরাপত্তার জন্য? সে কি নান্দনিক! না কি অর্থনৈতিক। তবে কি দুটোই? ভেবে পায় না অজিত। শুধু বোঝে, মৃত্যুই মানুষকে কখনও কখনও মূল্যবান করে তোলে, নিতান্ত অপদার্থও হয়ে ওঠে নয়নের মণি। মৃত্যু নামে এক ভাবাবেগহীন, অবশ্যম্ভাবী শীতল ঘটনা মানুষের সব সময়ে মনে থাকে না, যখন মনে পড়ে, যখন মৃত্যুর কাছাকাছি এসে যায় কেউ, তখনই জাতিস্মরের মতো তার ভালবাসার কথা মনে আসে, বিরহ মনে পড়ে। জীবন বুঝি মৃত্যুর বিরুদ্ধে এক নিরন্তর লড়াই। নানাভাবে ভেবেছে অজিত। সিগারেট পুড়েছে কত! কোনও সিদ্ধান্তে আসেনি আজও।
বাইরের ঘরের পরদাটা উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। স্পষ্ট ব্রজগোপালকে দেখা যাচ্ছে। উনিও চেয়ে আছেন হয়তো। দেখছেন। তবু শীলাকে ওইরকম ঘনিষ্ঠভাবে ধরে বিছানা পর্যন্ত নিয়ে আসে অজিত। বহন করা যাকে বলে।
শীলা বিছানায় বসে। সময়োচিত কয়েকটা ব্যথা বেদনার শব্দ করে। মেয়েরা বোঝে না পুরুষ কখন তাদের সম্পর্কে বিরক্ত বোধ করে। যেমন এখন। অজিত জানে শীলার কিছু হয়নি। তবু বড় বড় চোখে চেয়ে খাস টানছে শীলা, মুখে যথোচিত বেদনার ভাব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করছে। সুভদ্রর প্রসঙ্গটার ওপর ওইভাবেই সে কি জয়ী হতে চায়? বড় বোকা। ও জানেও না সুভদ্রর প্রতি কোনও হিংসা বিন্দুমাত্র বোধ করে না অজিত। বরং মাঝে মাঝে ভাবে, ওইরকম করে যদি সময়টা ভালই কাটে শীলার, কাটুক। তবু কথাটা বেরিয়ে গেছে অজিতের মুখ থেকে। এখন তার প্রায়শ্চিত্ত।
—এখন কেমন? অজিত খুব আন্তরিকতা ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করে গলায়।
শীলা বোধ হয় বুঝতে পারে। যতই চেষ্টা করুক অজিত। আন্তরিকতা বোধ হয় ফোটে না। অজিতের ভাঙা, মেদহীন মুখে কয়েকটা অবশ্যম্ভাবী রাগ, বিরক্তি, হতাশার রেখা আছে, যা ফুটে ওঠে। সে লুকোতে পারে না। শীলা বোধ হয় সেটা টের পায়। অভিমানে মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে—ভাল। তুমি যাও।
অজিত এসে আবার বাইরের ঘরে মোড়ায় বসে। একটু অন্যমনস্কভাবে শ্বশুরের দিকে তাকায়। একটা সিরাগেট খেতে বড় ইচ্ছে করছে। পায়জামার পকেটে একবার বে-খেয়ালে সিগারেটের প্যাকেটটার জন্য হাত ভরেছিল। মনে পড়ল শ্বশুর বসে আছে সামনে।
অবশ্য ব্রজগোপাল অজিতকে লক্ষ করছিলেন না। ওদিকের চেয়ারে রণেন এতক্ষণ নিঃশব্দে কথা বলছিল। ঠোঁট নড়ছে, হাতের আঙুল নাড়ছে। একটা মূক অভিনয় যেন। ব্রজগোপাল অবাক হয়ে সেদিকে চেয়েছিলেন। রণেন খেয়াল করেনি। হঠাৎ ব্রজগোপালের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল। খুব বিনীতভাবে বসে রইল, মাথা নামিয়ে দু-হাত কোলের ওপর জড়ো করে।
পুরো ব্যাপারটা নজরে এল অজিতের। ও কি করছিল রণেন? অদ্ভুত তো মাঝে মাঝে রাস্তায়-ঘাটে অজিত দেখেছে বটে একটু খ্যাপাটে ধরনের এক-আধজন লোক এ রকম একা-একা কথা বলতে বলতে যায়। হয়তো পাগল নয়, কিন্তু ওরকমই। রণেনের সেরকম কিছু হয় নাকি আজকাল!
ব্রজগোপাল থমথমে মুখটা ফিরিয়ে অজিতকে বলেন—শীলুটা! কী করছে? শরীর খারাপ নাকি?
একটু চমকে অজিত বলে না—। এই আসছে।
ব্রজগোপাল একটু গলা পরিষ্কার করলেন। বললেন—তোমার এ বাড়ি কদিনের?
বিনীতভাবে অজিত বলে—কয়েক বছর হয়ে গেল। আপনি তো দেখেননি?
—না। বলে একটু চুপ করে থাকেন ব্রজগোপাল, বলেন—আসতে ইচ্ছে হলেও কী আসা সোজা! কলকাতার রাস্তাঘাট আজকাল একটুও চিনতে পারি না। নতুন নতুন বাড়ি উঠে সব অচেনা হয়ে যাচ্ছে। এত ভিড়ে ঠিক দিশেও পাই না।
কলকাতার ওপর ব্রজগোপালের একটা জাতক্রোধ আছে, অজিত তা জানে। তাই একটু উদাস গলায় বলল—পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ছে, কলকাতায় তো বাড়বেই।
ব্রজগোপাল উত্তরটা আশা করেননি। একবার তাকালেন। মাথা নাড়লেন। বললেন—সবাই তাই বলে। জনসংখ্যা। আজকাল জন-টাকে কেউ পাত্তা দেয় না, সংখ্যাটা নিয়ে মাথা ঘামায়। মানুষকে কেবল সমষ্টিগত করে দেখা ভাল না।
অজিত এককালে বিস্তর পলিটক্সি করেছে। পথ-সভা, বিতর্ক, দাবি আদায়ের বৈঠক। তর্কের গন্ধ পেলে আজও চনমন হয়ে ওঠে। এই ছবির বিশ্বাসের মানুষটাকে যদিও কিছু বোঝানো যাবে না, তবু একটু ধাক্কা দেওয়ার জন্য সে বলে—সমষ্টিই তো আমাদের কাছে সব। সমষ্টিই শক্তির উৎস। তাকে নিয়ে তাই মাথা ঘামানোর দরকার। প্রতি জনকে নিয়ে মাথা ঘামানো সম্ভব নয়।
ব্রজগোপাল বুঝদারের মতো মাথা নাড়লেন। তারপর আস্তে করে বললেন—কোনও মানুষই নিজেকে ভিড়ের একজন বলে ভাবতে ভালবাসে না বাপু। এ হচ্ছে মিথ্যা কথা। বুকের মধ্যে সব মানুষই টের পায়, সে একজন আলাদা মানুষ, সবার মতো নয়। তিনশো কোটি মানুষের মধ্যে আমি একজনা বেনম্বরি মানুষ, গোবিন্দপুরের হেলে চাষাটাও এমন ভাবতে ভালবাসে না। বাসে, বলো?
—না বাসলেও কথাটা তো সত্যি!
—সত্যি কিনা কে জানে। তবে আজকাল যাকে রাষ্ট্র বলো, সেই রাষ্ট্র তোমাকে আমাকে মানুষের সমুদ্রে সত্তাহীন একফোঁটা জল যেমন, তেমন মনে করে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে মানুষ পিণ্ডাকার একটা সমষ্টিসত্তা। কোথায় কোন মানুষ মরল, কোন মানুষ বেঁচে রইল, কে ঠ্যাং ভেঙে পড়ে থাকল, কে পাগল হয়ে গেল তাতে তার কিছু যায় আসে না। রাষ্ট্র তা টেরও পায় না, পৃথিবীর ভারও তাতে কমেও না বাড়েও না। মানুষ যখন এটা টের পেতে শুরু করে, তখনই তার মধ্যে হতাশা, ক্লান্তি আর নানারকম বিকৃতি আসতে থাকে। দু-চারজন যারা বড়টড় হয়, তাদের কথা ছেড়ে দাও। যারা গোলা মানুষ, অল্পবুদ্ধি, বা যারা তেমন বড়টড় হতে পারেনি, তারা নিজেদের নিয়ে পড়ে যায় বড় মুশকিলে। এই বিপুল রাষ্ট্রে তাদের স্থান কোথায়, কাজ কী, কেন তাকে পৃথিবীর দরকার, এ সব বুঝতে না পেরে সে ক্রমে নিজেকে ফালতু লোক বলে ভাবতে শুরু করে। কটা লোক ভাবতে সাহস পায় যে, তাকে ছাড়া পৃথিবী চলবে না? শহরে, গাঁয়েগঞ্জে, জনে জনে জিজ্ঞেস করে দেখো তো বাপু, এ রাষ্ট্রের তারা কে, পৃথিবীর তারা কে, এটা টের পায় কিনা?
ব্রজগোপাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান বুঝি। চোখটায় একটা ঘোর লাগা ভাব, মাথা নেড়ে বলেন—বেঁচে থাকার একটা জৈব তাগিদ আছে। মরতে কেউ চায় না। কেবল সেই তাগিদে যে যার মতো পৃথিবীর সঙ্গে সেঁটে আছে প্রাণপণে। নইলে সবাই জানে সে মরলে বা পড়লে পৃথিবীর কাঁচাকলা। এই কথা সার বুঝে গেছে বলেই আজ আর কেউ রাষ্ট্র বলো, দুনিয়া বলো, জনগণ বলো, কারও কাছে কোনও দায় আছে বলে মনে করে না। বুঝে গেছে, সার হচ্ছে নিজের দায়িত্বে বেঁচে থাকা। সে কেন, কোন দুঃখে রাষ্ট্র-ফাষ্ট্র, দুনিয়া-টুনিয়া, ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাবে! সে তো জনগণ, জনসংখ্যা, ভিড়ের একজন।
অজিত শ্বশুরের দিকে চেয়ে থাকে। একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টি। বলে—কোনও মানুষই তো বিচ্ছিন্ন নয়। আলাদা ব্যষ্টি হয়ে যেমন, তেমনি আবার সে সমষ্টিরও একজন। কোনওটাই মিথ্যে নয়।
—মিথ্যে হওয়া উচিতও নয়। ঠিকই তো। মানুষ যেমন আলাদা আবার তারা গোষ্ঠীবদ্ধও। কে না স্বীকার করবে? কিন্তু এখনকার রীতিই হচ্ছে আগে সমষ্টিকে দেখা, ব্যক্তির কথা তারপরে। আগে সংখ্যা, তারপর জন। কিন্তু আবার তোমার বিজ্ঞানই বলছে, পৃথিবীর কোনও দুটো জিনিসই হুবহু একরকমের নয়। পৃথিবীর প্রতিটি বালুকণা, প্রতি গাছ, প্রতি ফল, প্রতিটিই আলাদা রকমের। সে হিসেবে পৃথিবীতে ঠিক একরকমের জিনিস একাধিক নেই। তাই কারও সঙ্গে কাউকে যোগ করে এক-এ এক-এ দুই করাই যায় না। কারণ প্রতিটি একই আলাদা এক। তার কোনও দ্বিতীয় নেই। এটা আগে সবাই তোমরা বোঝো তার সমষ্টির কথা ভেব। জনগণ বা জনসখ্যা এ কথাগুলো অস্পষ্ট। প্রতিটি মানুষকে আগে বুঝতে দাও যে সে সমাজ সংসারের অপরিহার্য একজন। তাকে না হলে চলে না। নইলে মানুষ কেবলমাত্র সংখ্যাতত্ত্ব হয়ে যাবে, মানুষের ভিড় দেখে মানুষেরই ক্লান্তি আসবে। ভবিষ্যৎ বচনেরও দরকার নেই, এসে গেছে।
এই সব তত্ত্বকথা শুনেই বোধ হয় ননীবালা উঠে পড়লেন। বললেন—যাই দেখি গে।
ব্রজগোপাল নড়েচড়ে বললেন—আমিও উঠে পড়ি।
ননীবালা মাথা নেড়ে বললেন—উঠবে কী! বোসো। আসছি।
ননীবালা চলে গেলেন। রন্নাঘরের দিকেই বোধ হয়। সেদিক থেকে তাঁর গলা পাওয়া গেল, বাচ্চা ঝিটাকে বকছেন—তুই খাবার বেড়ে নিয়ে যাচ্ছিস কিরে! সবাইকে কী আর ঝি-চাকরে খাবার দিতে আছে! এ কী যে সে লোক। রাখ, আমি নিয়ে যাচ্ছি।
অজিত চুরি করে একটু হাসল। শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া অনেক হাজার টাকার চেক আঁচলে বেঁধে শাশুড়ি ঠাকুরুনের ভালবাসাটাসা সম্মানবোধ সব মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। বিয়ের সম্পর্কটা কি তবে অর্থনৈতিক। ভালবাসার জান কি টাকা আর নিরাপত্তার ভিতরে বীজাকারে নিহিত রয়েছে! সংসার থেকে প্রায় বহিষ্কৃত ব্রজগোপালের তো এত সম্মান প্রাপ্য নয়! সংসারের কারও ব্রজগোপালের প্রতি কোনও দরদ আছে বলে অজিত জানে না। সবাই বলে, এ লোক হচ্ছে একগুঁয়ে জেদি মানুষ, কারও সঙ্গে বনে না। কথাটা ঠিক। তবু অজিত মনে মনে এ-লোকটাকে হিংসে করে। এ লোককে দিনে দশবার বউয়ের অকারণ রাগ অভিমান ভাঙাতে হয় না, এ লোক বিবাহের বহন করার কষ্টকর কাজ থেকে কৌশলে নিজেকে সরিয়ে নিতে পেরেছে। এ সব তো বটেই। তার ওপর অজিত দেখেছে, এ লোকটার ভিতরে এখনও ভালবাসা মরে যায়নি। নইলে কেউ বয়স্ক জামাইয়ের হাতে মিষ্টি খাওয়ার টাকা দিতে পারে। অজিত হলে পারত না।
একটা চমৎকার মিঠে কমলা রঙের শাড়ি সদ্য পরে ঘর আলো করে শীলা ঘরে এল। চুলটুল আঁচড়ে এসেছে। চোখে এখনও কান্নার ফোলাভাব। কপালে সিঁথিতে সিঁদূর দগদগে। মুখে একটু পাইডারের ছোঁয়া। এ সবই মুখের ভাব, কান্নার চিহ্ন ঢাকার ছদ্মবেশ। কোনও কথা না বলে প্রণাম করল বাপকে। ব্রজগোপাল মাথায় হাত রাখলেন। একটু বেশিক্ষণ রাখলেন যেন। চোখটা বুজলেন। ইষ্ট স্মরণ করলেন বোধ হয়।
শীলা বাপের পাশ ঘেঁষে বসল। আঁচলটা কুড়িয়ে নিয়ে মুখে চাপা দিল একটু বলল—কেমন আছ বাবা?
ব্রজগোপাল উদাস স্বরে বললেন—আছি। আমাদের আর বিশেষ কী। তোরা কেমন?
শীলা মাথা নেড়ে বলে—ভাল।
ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ছেড়ে বলেন—সংসারের কাজটাজ সব করিস নিজের হাতে?
শীলা হাসল একটু। বিবাহিতা বয়স্ক মেয়ের উপযুক্ত প্রশ্ন নয়; তবু বলল—করি।
—করিস! বলে ব্রজগোপাল হালেন—কখন করিস? তুই তো চাকরি করছিস, শুনেছি।
—দুটোই করি।
—চাকরি করিস কেন? অজিতের আয়ে তোদের চলে না? ওর তো রোজগার ভালই।
—আজকাল সব মেয়েই করে।
—তাই করিস? নিজের ইচ্ছেয় নয়? প্রয়োজনও নেই?
শীলা একটু অপ্রস্তুত হয়। অনেকদিন পর বাপের সঙ্গে দেখা, তাই বোধ হয় মানুষটাকে ঠিক বুঝতে পারে না। একপলক বাবাকে দেখে নিয়ে বলে—টাকার দরকার তো আছেই। সময় কাটে না। লেখাপড়া শিখেছি, সেটাও তো কাজে লাগানো উচিত।
—ও। বলে ব্রজগোপাল বুড়োটে মুখে দুষ্টুমির হাসি হাসেন। যেন তাঁর এ-মেয়েটা নাবালিকা এবং তিনি তার সঙ্গে খুনসুটি করছেন। বলেন—মেয়েরা যেন এত টাকার ফিকির খোঁজে রে? পুরুষ যদি খাওয়াতে পরাতে না পারে তখন না হয় কিছু করলি। এমনি খামোকা চাকরি করবি কেন? এককাঁড়ি টাকার মধ্যে কি সুখ? বেশি বহির্মুখী হলে মেয়েদের মধ্যে ব্যাটাছেলের ভাব এসে যায়। সংসারেও বিরক্তি আসে। স্বামীর সঙ্গে পাল্লা টানে। ও ভাল নয়।
শীলা মাথা নিচু করে চুপ করে আছে। তর্ক করে লাভ কী!
ব্রজগোপাল তেমনি দুষ্টুমির হাসি হাসেন। আচমকা বলেন—ট্রামে বাসে পুরুষের বগলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে রোজ যাতায়াত। সেও বিশ্রী। পুরুষেরাও তো ভাল নয়। কত লোকের মনে কত বিকৃতি আছে। তারচেয়ে বরং হামলে সংসার করবি। নিজের হাতে রেঁধেবেড়ে দিবি। স্বামীর সেবা নিজের হাতে করলে ভালবাসা আসে। এ তো আর অংশীদারি কারবার নয় যে, যে-যার ভাগের টাকা ঢেলে সংসার চালালি।
ব্রজগোপাল ডান হাতে মেয়ের দীর্ঘ এলো চুলে একটু হাত বুলিয়ে দিলেন। বললেন—বাচ্চাকাচ্চা যখন হবে তখন দেখবি। মা-বাপ ছাড়া বাড়িতে কেমন অনাথ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ননীবালা খাবারের প্লেট আর চা হাতে এলেন।
ব্রজগোপাল একটু তাকালেন মাত্র সেদিকে। মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন—ও নিয়ে যাও।
—মেয়ের বাড়িতে এসেছ, একটু মুখে দিতে হয়।
—যখন-তখন খাই না আজকাল। অভ্যেসও নেই। ওদের সব দাও।
বলে ছেলের দিকে তাকালেন। অজিত লক্ষ করে, রণেনের ঠোঁট আবার নড়ছে। আঙুলে বাতাসের একটু শূন্য আঁকল রণেন। কাকে যেন উদ্দেশ করে নিঃশব্দে কী বলে যাচ্ছে।
॥ আটত্রিশ ॥
এই ছেলেটার বরাবরই বড় ঘাম হয়। ধুতি পাঞ্জাবি পরা, মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে, তবু গলা বগল ভিজে গেছে। ননীবালা উঠে ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে বলেন—তুই অত ঘামিস কেন?
রণেন দু-হাতে মাথা চেপে বসেছিল। মুখ তুলে কেমন একরকম ভাবে তাকায়। পাঁজর কাঁপিয়ে একটা শ্বাস ছাড়ে। হঠাৎ চোখের ডিম উলটে শিবনেত্র হয়ে বলে—মা! মাগো!
গর্ভধারিণীকে নয়, যেন জগজ্জননীকে ডাকছে। ডাকটা বেখাপ্পা শোনাল। এ ছেলেটা ননীবালার তেমন সুখী নয়। বউটা তেমন হয়নি, বড্ড খোঁড়ে। ছেলেটা বউয়ের তাল রাখতে পারে না। বোধ হয় ঝগড়াটগড়া হয়েছে আবার। এখন তো বাসায় ননীবালা নেই, রক্তারক্তি হলে চেঁচাবে কে, আটকাবে কে! ননীবালার বুকটা তাই কেঁপে ওঠে। কী করার আছে! বুড়ো হলে মানুষের আর সংসারে বিশেষ কিছু করার থাকে না। এখন তো আর কোলের সেই ন্যাংলা রণো নয়, এখন পুরোদস্তুর স্বামী-বাপ সংসারের ভিত। এই ছেলেকে ননীবালা আগলে রাখেন কী করে! তবু মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ছায়া ফেলে। বড়বেশি দিন মেয়ের বাড়িতে থাকা হল। এবার একবার ওদিককার সংসারে একবার গা ফেলবেন।
বলেন—কবে নিয়ে যাবি আমাকে?
রণেন চোখ বুজে ছিল। বলল—যবে খুশি।
—আজই চল। বুবাই-টুবাই ঠাকুমা ছাড়া কেমন করে সব? মা তো জো পেয়ে খুব ঠ্যাঙায়। ঠ্যাঙাড়ে বাড়ির মেয়ে।
থাবারটাবার সব পড়ে আছে। কেউই ছোঁয়নি এখনও। শীলা বলল—বাবা, খাও।
ব্রজগোপাল প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন—তোরা খা। এ বয়সে যখন-তখন খাওয়া বড় অপয়া। যত কম খাই, তত ভাল থাকি।
—একটু শরবত দিই বাবা?
ব্রজগোপাল একটু ঘাড় নাড়লেন। মুখে দুশ্চিন্তার চিহ্ন। বললেন—সেটা বরং সহজে গলা দিয়ে নামবে। নিজের হাতে করে আনিস যদি।
—আনছি। বলে শীলা উঠে গেল।
ব্রজগোপাল চারদিকে একবার তাকালেন। কিন্তু কিছুই দেখলেন না। দৃষ্টিটা এসে স্থির হল ননীবালার চোখে। ননীবালাও চেয়ে আছেন। একদৃষ্টে। তাঁদের ভালবাসা ছিল। সে-আমল এখনকার মতো নয়। সারা দিন কেউ কারও দেখা পেতেন না। রাতে দেখা হত, কিন্তু কথা হত ফিসফিসিয়ে, যেন গহীন রাতের চোরেও না শুনতে পায়। এই যে এখন যেমন, মা-বাপের সামনে মেয়ে আর জামাই বসে থাকে, কিংবা ছেলে আর ছেলের বউ, এরকমটা ভাবা যেত না। নিজের বাবার সঙ্গে কখনও বসে কথা বলেননি ব্রজগোপাল, সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকতেন। ননীবালার সঙ্গে যৌবন বয়সে বেড়াতে বেরিয়েছেন জোড়ে, এমন মনে পড়ে না। বউ ছিল শুধু রাতটুকুর জন্য, বেহানেই সে হয়ে যেত সংসারের একজন, স্বামীর কেউ নয়। তুব ভালবাসা তো কিছু কম ছিল না। আর এখন স্বামী-স্ত্রী বড় বেশি পায় পরস্পরকে। এদের বিরহ কম। এদের বিবাহের পুরোহিত হচ্ছে কামস্পৃহা। মনে মনে তাই বড় তাড়াতাড়ি দূরের হয়ে যায়। কাছে কাছে থেকেও। কামটুকু ফুরোলেই আর থাকে কী! অবশ্য ব্রজগোপাল আর প্রমাণ করতে পারেন না যে, তাঁর এবং ননীবালার মধ্যে ভালবাসা ছিল। প্রমাণের দরকারই বা কী? মনে মনে তিনি তো জানেন, তাঁর হৃদয় ননীবালার নিরন্তর মঙ্গল প্রার্থনা করে। স্থির জানেন, পরজন্মেও তাঁর বউ হবে এই ননীবালাই। ছাড়ান কাটান নেই, এই এক সম্পর্ক। এসব কি প্রমাণ করা যায়।
ননীবালার চোখে চোখে আটকে গেল। ননীবালাই সামলালেন আগে। ঘোমটা ডান কানের পাশে দিয়ে একটু টেনে দিয়ে বলেন— বুকের ব্যথাটা কি আর হয়?
—না।
শরীর-টরীর খারাপ হলেও তো খবরবার্তা কেউ দেয় না যে গিয়ে পড়ব।
ব্রজগোপাল মুখটা ফিরিয়ে নেন। বলেন—ব্যস্ত হওয়ার মতো ব্যাপার কী! মেঘু ডাক্তার আমলকী আর মধু খেতে বলেছিল। সেই খেয়ে এখন ভালই আছি।
—রাতে বোবায়-টোবায় ধরলে কে ডেকে দেয়! বুড়ো বয়সে একা শোওয়া ভাল নয়, রাতটা ভয়ের।
ব্রজোগোপাল তাচ্ছিল্যের ভাব করে বলেন—শোয় একজন। উটকো লোক, পেল্লায় ঘুম তার। আর বোবায় ধরবে কাকে, ঘুমই নেই।
ননীবালা বলেন—মাটির ভিত্-এর ঘর। এই গ্রীষ্মকালটায় সাপখোপ সব ঘরেদোরে চলে আসে। বহেরু যেন ঘরের গর্তটৰ্ত সব বুজিয়ে দেয়।
ব্রজগোপাল উত্তর করলেন না। তবু ননীবালার এই উদ্বেগটুকু বহুকাল বাদে তাঁর বেশ লাগছিল। এটা টাকায় কেনা জিনিস নয়, স্বার্থত্যাগ মানুষকে কখনও-সখনও একটু বা মহৎ করে। ব্রজগোপালের মূর্তিটা বোধ হয় ননীবালার বুকের মধ্যে ঘষা-মাজা খেয়ে একটু স্পষ্ট হল।
কিন্তু মেয়েমানুষের দোষ হল, সে বেশিক্ষণ আলগা ভালবাসার কথা বলতে পারে না। তার মধ্যে হঠাৎ বিষয় সম্পর্কিত কিংবা সংসারের আর পাঁচটা কথা এনে ফেলে। বেসুর বাজতে থাকে।
যেমন ননীবালা এসব কথার পর হঠাৎ বলেন—এবারও বহেরু ধানের দাম কম দিল।
ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বললেন—বহেরুর হাতে তো সব নয়। ছেলেরাই এখন সব করছে।
—কেন, বহেরুর কী হয়েছে?
ব্রজগোপাল হাসলেন। বললেন—কী আর হবে। বুড়ো হয়েছে। সে যতদিন দেখত ততদিন বুঝেসুঝে দিত। ছেলেরা দেবে কেন? তারা বর্গা ভাল জানে। যা দেবে, তাই নিতে হবে।
—তুমি তো আছো, তুমি দেখতে পারো।
ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—ছড়ানো জমি, অত কি একটা মানুষ দেখতে পারে! তার ওপর মাঝেমধ্যে তো মানুষের মন বিষয় থেকে উঠে যায়। আমার ওসব আর ভাল লাগে না। নিজের হাতে গাছপালা যে এখনও করি সে ফুলপাকুড় খাব কী টাকা হবে বলে নয়। গাছ জন্মায়, ফল দেয়, ফুল ফোটে, সেটা চোখে দেখার একটা মায়া আছে, তাই।
ননীবালা রাগ করেন না, তবু অনুযোগের সুরে বলেন—সেটা কি কোনও কাজের কথা! ছেলেরা যেতে পারে না বলে তুমি রাগ করো। কিন্তু তারা কি তোমার মতো বিষয়বুদ্ধি রাখে! তুমি না দেখলে তো হবে না।
ব্রজগোপাল একটু চুপ করে থেকে বলেন—তারা না গেল, তা বলে আমাকে যক্ষবুড়ো হয়ে থাকতে হবে কেন? তোমার তো মোটে পাঁচ কী ছ-বিঘে, আমার তারচেয়ে ঢের বেশি। যা ফসল হয় তার পাঁচ ভাগের এক ভাগ রাখি, বাকি, চার ভাগ খয়রাতিতে যায়।
—সে কেন?
—ওটা আমার একটা ব্রত।
—দেবত্র করলে নাকি?
—ওরকমই।
ভারী উদ্বিগ্ন হয়ে ননীবালা প্রশ্ন করেন—সে কেন?
ব্রজগোপাল ননীবালার উদ্বেগটা টের পেয়ে হেসে মাথা নেড়ে বললেন—ভয়ের কিছু না। ঠাকুর দেবতার নামে লিখে দিইনি, আমার নামেই আছে, আমার ওয়ারিশ যারা তারাই পাবে। কিন্তু পেলেও আমার ব্রতটা যেন তারা না ভাঙে। ফসলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ নেবে, বাকি থেকে যা আয় হবে তা দিয়ে সম্পত্তি বাড়াবে। আর মানুষকে দেবেথোবে, অনাহারীকে খাওয়াবে, গরিব গুর্বোদের দেখবে, কাঙাল ফকিরকে সাহায্য করবে।
—সে তো ভূতভোজন হল। তবে ওরা খাবে কী?
ওদের খেতে বারণ নেই। খেয়েপরেও অনেকের খানিকটা থাকে। দেয় না।
—সে যাদের অনেক আছে তারা দিকগে। আমাদের তো জমিদারি নেই। বছরে সামান্য কটা টাকা। সেও ভূতভোজনে গেলে জমি লোকে করে কেন?
—নিজের জন্যেই করে। জমি, সম্পত্তি, চাকরি সবই নিজের জন্য। সে একশোবার। আবার গরিব গুর্বো, শিয়াল কুকুর, কাক শালিখকেও ভাত দেয়, সেও নিজের স্বার্থেই দেয়। জগৎসংসারে থাকতে হলে প্রতিকূলভাবে না থেকে অনুকূলভাবেই থাকা ভাল। আমি তৃপ্ত হই, আমার চারদিক তৃপ্ত হোক।
—ওসব ভাল কথার দিন কি আর আছে! শখের গয়না বেচে জমি কিনেছিলে, আমারটা খয়রাতি হতে দেব কেন?
ব্রজগোপাল ননীবালার দিকে একটু চেয়ে থাকেন। সামান্য বুঝি অভিমান ভরে বলেন— তোমার দুঃখ কী! সংসারে আটকা আছো, বুঝতে পারো না মানুষজন কীভাবে বেঁচে আছে। চারদিকে মানুষজন যত উপোসী থাকবে, যত অতৃপ্ত অশান্ত হবে তত তোমার সংসারে তাদের হাত এসে পড়বে। ছেলেদের ভালই যদি চাও তো তারা যে সমাজ সংসারে আছে তার আগে ভাল করো। শুধু আলাদা করে রণেন সোমেনের ভাল চাইলেই কি ভাল হয়?
ননীবালা ধৈর্য রাখতে পারেন না। আঁচলে বাঁধা চেকটার কথা ভুলে গিয়েই বুঝি তেড়ে ওঠেন—ওসব আমি বুঝি না। ব্ৰতট্রত ওরা মানতে পারবে না। পুরো ফসলের হিসেব যদি না পাই তো জমি বেচে দেব।
অজিত এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। একটু বিষণ্ণ, একটু অনুতপ্ত, শীলার জন্যই। এখন হঠাৎ বলল—উনি বোধ হয় ওইভাবে একটা ব্যালান্স অফ ইকনমির চেষ্টা করছেন।
ননীবালা জামাইয়ের দিকে একটু ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন। জামাইটা বড় ট্যাটন। লঘুজন-গুরুজন মানে না, পট পট কথা বলে। একটু আগে বুড়ো শ্বশুরের মুখে মুখে জবাব করছিল। বললেন—কী বললে?
অজিত হেসে বলে—গরিবকে দিয়েথুয়ে খুশি রাখলে বড়লোকদের এরকম সুবিধেই হয়। ধর্মও হয়, শোষণের সুবিধে হয়।
ননীবালা কথাটা বুঝলেন না। মানলেনও না। গম্ভীরভাবে বললেন—বড়লোকরা যা খুশি করুক। আমরা করতে যাব কেন?
শীলা চমৎকার কাচের গ্লাসে ঠান্ডা শরবত এনে রাখলে টেবিলে। মুখখানা একটু ভার, একটু নত। বাপের কাছে বসে মুখ তুলে মাকে বলল—চুপ করো তো মা। বাবার জমি যা খুশি করুক, তোমার কী!
—আহা, বড় বাপসোহাগী হলেন! ননীবালা এই ঢঙে কথা বলে রাগের মাঝখানেও হেসে ফেললেন একটু। পরমুহূর্তে গম্ভীর হয়ে বললেন—ওঁর জমি মানে ছেলেদেরও। ছেলেরা তো আকাশ থেকে পড়েনি, ওঁরই জন। পর নয়।
ব্রজগোপাল মলিন একটু হাসলেন। বললেন—ছেলেরা বাপের পর হবে কেন, তারা শ্রাদ্ধের অধিকারী।
কথাটার মধ্যে একটু ব্যঙ্গ ছিল, আর বুঝি নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা। ননীবালা দমলেন না, বললেন—শ্রাদ্ধের কথা ওঠে কেন? বেঁচে থাকতে কি অধিকার থাকে না নাকি?
মাথাটা দু-হাতে কঠিনভাবে চেপে ধরে বসেছিল রণেন। হঠাৎ উত্তেজিত মুখ তুলে বলে—মা!
এবার জগজ্জননীকে নয়, নিজের নাকেই বলা। বরাবর এ ছেলেটা বাপের পক্ষ হয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। শেষমেষ বাপের উপরেও বিরক্তি এসেছিল। তবু বুঝি এখনও কিছু পক্ষপাত রয়ে গেছে। ননীবালা ঝাঁকি দিয়ে বললেন—কী, বলবি কী? বাপের সম্পত্তিতে তোর দরকার নেই এই তো! তোর না থাকে, সোমেনের আছে। আমি ছাড়ব না।
ব্রজগোপাল খানিকটা হতভম্বের মতো চেয়ে থাকলেন। শীলা শরবতের গ্লাসটা তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলে—বাবা খেয়ে নাও তো। ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে এনেছি, আবার গরম হয়ে যাবে।
ব্রজগোপাল গ্লাসটা ধরলেন না। ননীবালার দিকে চেয়ে বললেন—বরাবর দেখে আসছি তুমি সংসারের দুটো পক্ষ তৈরি করে নিয়েছ। আমি একদিকে, ছেলেরা আর তুমি অন্যদিকে।
শীলা মাকে একটু চোখ টিপে বলে—মা, তুমি একটু রান্নাঘরে যাও তো। ঝি মেয়েটাকে দুধ জাল দিতে বলে এসেছি, ও গ্যাসের উনুন নেবাতে পারে না। যাও।
ননীবালা নড়লেন না। এর একটা বিহিত করতে হবে বলে বসে রইলেন। বললেন—ওঁর কথাটা শুনিছিস। আমি দুপক্ষকে পর করেছি। ঝগড়া লাগিয়েছি।
—তা নয়। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন—তা নয়। দু’পক্ষকে বুঝতে দিলে না। তাদের সম্পর্কে কী। কথাটা বোঝানো শক্ত। তর্ক করে বোঝানো যাবে না। তবু তোমাকে একটা জিনিস বুঝতে বলি, আমিও ছেলেদের ভাল চাই।
—ভাল চাইলে আর দেবত্র করে দেবে কেন?
অজিত আবার আস্তে করে বলে—ব্যালান্স অফ ইকনমি।
ঠাট্টা! ব্রজগোপাল জামাইয়ের দিকে তাকালেন। তারপর নিজের ক্যাম্বিসের ব্যাগটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন—না বাবা, ব্যালান্স অফ ইকনমি আমি বুঝি না। আমি বড় স্বার্থপর। সার বুঝি, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে সেইজন্যই ভয় খাই। আমার সন্তানের দুধ ভাত একদিন নিরন্ন, বর্বর মানুষ যদি কেড়ে নেয়! তাই এই ত্যক্তেন ভূঞ্জীথাঃ। তবে একজন অ্যাকচুয়ারির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। বিজ্ঞ লোক। সে ওই ব্ৰতর কথা শুনে বলেছিল—এ ভারী আশ্চর্য জিনিস, ব্রজদা, ঘরে ঘরে সবাই এমন করলে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের দুর্দিন, অভাব কষ্ট সব লোপাট হয়ে যাবে। আমি তো অত বুঝি না। বুড়ো বামুন যেমন বলে গেছে তেমন করি। আমার বুঝটা বড় সাদামাটা।
কেউ কোনও কথা বলার আগেই ব্রজগোপাল উঠে দাঁড়ালেন। ভারী ক্লান্ত দেখাছিল। শীলা উদ্বিগ্ন মুখে বলে—শরবতটা খেলে না বাবা!
ব্রজগোপাল সে কথায় কান না দিয়ে বললেন—ভূতভোজনের কথা বলছ, ভয় বোধ হয় হ্যাঙালি ক্যাঙালিরা এসে রোজ ভাগাড়ের শকুনের মতো পড়বে। কিন্তু এ কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থা নয়, দরিদ্র নারায়ণ সেবাও নয়। বসিয়ে খাওয়ালে মানুষের গতরে মরচে পড়ে যায়, আর নড়ে না। এ কে না জানে! অযোগ্য অপাত্রে দান, দাতা গ্রহীতা দুই-ই ম্লান। কিন্তু সেবাবুদ্ধি থাকলে মানুষের ঠিক অভাবের জায়গায় হাত বাড়ানো যায়। কত বড়মানুষেরও কত অভাব আছে। আমি যেমন বলছি তেমন করলে নিজের মধ্যেও সেবাবুদ্ধি জাগে, পাঁচজনেও দেখে শেখে। তা এসব কথা তো তোমাদের কাছে অবান্তর।
ননীবালা কী বলতে যাচ্ছিলেন, রণেন আবার বলল—মা!
ননীবালা ছেলের দিকে চেয়ে সামলে গেলেন। রণেনের মুখ লাল। চোখ দুটো বড় ঘোলাটে লাগল। ননীবালা একটা দীর্ঘশ্বাস, ফেললেন। ব্রজগোপালের দিকে চেয়ে বললেন—উঠলে নাকি?
—উঠি। অনেক দূর যেতে হবে।
ননীবালা বাধা দিলেন না। বললেন—দুর্গা, দুর্গা। জোড়হাত কপালে ঠেকিয়ে শীলার দিকে চেয়ে বলেন—আজ আমি একবার ও-বাড়ি যাব। ছাদ থেকে আমার জামাকাপড়গুলো আনতে বল তো!
রণেন রয়ে গেল, মাকে নিয়ে বাসায় ফিরবে। ব্রজগোপাল একাই বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় পা দিয়ে হঠাৎ টের পেলেন, তিনি বড় বেশি একা। ভয়ংকর একা। বুকের ভিতরটা যেন এক চৈত্রের ফুটি-ফাটা মাঠ, সেখানে এক ন্যাড়া গাছে বসে দাঁড়কাক ডাকছে—খা, খা।
উত্তজনা বীজমন্ত্রের খেই হারিয়ে গিয়েছিল। ছেঁড়া সুতোটা মনের মধ্যে কাটা ঘুড়ির সুতোর মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। বীজনাম অতিদ্রুত স্পন্দিত হতে থাকল শরীরে, রক্তে, হৃৎস্পন্দনে। নির্ঝরের মতো। অবগাহন হতে থাকে। তবু মনটা ভাল না। ছেলেটা ভাল নেই, মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে একটা কেমনতর ভাব! আর ননীবালা! এখনও এই আয়ুর সাঁঝবেলায় দু-হাতে ছেলেদের স্বার্থ আগলাচ্ছে। ব্রজগোপাল তাই এই মস্ত জগৎসংসারে বড় একা।
নির্জন পাড়াটা পার হয়ে বড় রাস্তায় লোকজনের মাঝখানে চলে এলেন ব্রজগোপাল। তখনও মনটা ওইরকম খাঁ-খাঁ করছে। আপন মনে বলেন—দূর বেটা, তুই যে নেংটে নেই নেংটে। একা আবার কী? একটা শ্বাস ছেড়ে ব্রজগোপাল বাস-স্টপে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। চারদিকে ফুলিয়ে ওঠা কলকাতার ভিড়, ট্রামে-বাসে লাদাই ভিড়, ধুলোটে আকাশ। তারই মাঝখানে হঠাৎ যেন বহুদূরের এক চিত্র ভেসে ওঠে। যজ্ঞস্থলীতে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছে। যজ্ঞধূমের গন্ধ ভেসে আসে। কী পবিত্র পৃথিবী! কী পরিষ্কার এর বাতাস! ব্রজগোপাল তাঁর পরিবারের কথা ভুলে গেলেন। বুড়ো বামুনের মুখটা ভেসে ভেসে ওঠে নাসামূলের আজ্ঞাচক্রে।
ননীবালা যখন ঢাকুরিয়ার বাড়িতে পা দিলেন তখন সন্ধে হয়ে গেছে। নাতি-নাতনিরা মাস্টারের কাছে পড়ছিল, ঠাকুমাকে দেখে দৌড়ে এসে সাপটে ধরল। ঠাকুমা, ঠাকুমা ডাকে অস্থির। বাচ্চাকাচ্চা না থাকলে আর বাড়ি কী! শালির বাড়িতে এ ক’দিন যেন হানাবাড়িতে কেটেছে। হাঁফ ধরে গিয়েছিল।
ছোট নাতিকে ট্যাঁকে গুঁজে নিজের ঘরের তক্তপোশে এসে বসলেন। ভারী একটা নিশ্চিন্তভাব। বীণা একবার উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করে গেল—চা খাবেন তো! হচ্ছে।
—দিয়ো, বললেন ননীবালা। নাতিটা ধামসাচ্ছে। বললেন—বড় ডাকাত হয়েছিস দাদা।
চারদিকে চেয়ে দেখলেন। সোমেনের টেবিলে ছাইদানিটা উপচে পড়ছে পোড়া সিগারেট, দেশলাই কাঠি আর ছাইতে। বিছানার চাদর নোংরার হদ্দ। মশারিটা আগে খুলে ভাঁজ করে রাখা হয়, এখন চালি করে রাখা, তাতে ময়লা হয়েছে। বিছানায় ছাড়া জামাকাপড় পড়ে আছে।
এসব সারতে থাকেন ননীবালা, আর আপনমনে বক বক করেন। পরোক্ষে বউকেই শোনান।
ঘরদোর সেরে পরনের কাপড়টা পালটে নিলেন। ভাঁজ করে তুলে রাখতে যাবেন এমন সময়ে আঁচলের গেরোটা চোখে পড়ল। সাবধানে পেট আঁচলে বেঁধে এনেছেন। সেই চেকটা খুলে শত ভাঁজের দাগ ধরা চেকটা আলোয় দেখলেন একটু। চোখে জল এল। অনেকগুলো টাকা। এত টাকা ও-মানুষ জন্মে কখনও দেননি ননীবালাকে। এতকাল গরিবেরই ঘর করেছেন ননীবালা, টাকার মুখ বড় একটা দেখেননি। লোকটা যে শেষ পর্যন্ত দেবে এমন বিশ্বাস ছিল না। তবু দিল তো!
ননীবালা চেক হাতে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। চোখে জল। বুকে বৃষ্টিপাত। নাতিটা অন্যধারে বসে চিড়ের মোয়া খায় টুক-টুক করে। ননীবালার মনটা উদাস হয়ে যায়। লোকটা অনেক টাকা এককথায় দিয়ে দিল। বিষয় সম্পত্তিও সব দেবত্র না কী যেন মাথামুণ্ডু করছে। হল কী মানুষটার! চিরকালই ঘর-জ্বলানি, পর-ভুলানি ছিল বটে, কিন্তু এখনকার রকমসকম বুঝি কিছু আলাদা। সংসারের ওপর থেকে মায়া তুলে নিচ্ছে না তো! দুম করে একদিন ননীবালাকে রেখে চলে যাবে না তো! বুকটা কেঁপে ওঠে। গভীর শ্বাস পড়ে।
ও-ঘরে বীণার খর গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। কী যেন হল। একটু কান পাতলেন ননীবালা। কিছু বুঝতে পারলেন না।
বীণা এসে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলে—মা, একবার ও-ঘরে আসুন।
—কী হল?
—আপনার ছেলে কেমন করছে।
বীণার মুখটা থমথমে। ননীবালা উঠলেন, বললেন—ওকে সবাই বড় জ্বালায়।
শোওয়ার ঘরে রণেন বসে আছে চেয়ারে। কপালে একটা জায়গায় থেঁতলে যাওয়ার ক্ষতচিহ্ন, রক্ত।
ননীবালা গিয়ে ছেলেকে ধরলেন—কী হল?
বীণা বাইরের ঘরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলে—ওঁকে আমি বলেছিলাম হাতমুখ ধুয়ে এসে চা খাও। উনি গেলেন না। তারপর আমি রান্নাঘর থেকে ঘুরে এসে দেখি। ড্রেসিং টেবিলের কোনায় মাথা ঠুকছেন।
—কে কী? ননীবালা রণেনের দু-কাঁধ ধরে মুখ নিচু করে বড় ছেলের মুখ দেখলেন ঠিক যেমন করে মা শিশু-ছেলের মুখ দেখে—কী হয়েছে তোর, ও রণো! মাথা খুঁড়ছিলি কেন?
রণেন তার তীব্র ঘোলাটে চোখ তুলে একবার অদ্ভুতভাবে তাকাল। গভীর শ্বাসের মতো শব্দ করে বলল—মা!
॥ উনচল্লিশ ॥
মানুষ কত অসুখী! এরা জানেই না কী করে জীবনযাপন করতে হয়। ব্রজগোপালের মন বড় কু-ডাক ডাকে। সবাইকে ছেড়ে আলগা আছেন তবু সমস্ত মনপ্রাণটা ওদের দিকে চেয়ে। বসে থাকে। ঠাকুর ওদের সুখে রাখো।
হাওড়ায় এসে ট্রেন ধরলেন ব্রজগোপাল। অফিস-ভাঙা-ভিড়। আজকাল বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে পা-দুটো রসস্থ হয়। ওপরে ঝোলানো হাতল ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল, তাই হাতটাও ভেরে আসে। ক্যাম্বিসের ব্যাগটা ধরে রাখতে কষ্ট হয়। চারধারে মানুষের শরীরের ভাপ, গরম, ঘাম, দুর্গন্ধ। মাথার ওপর পাখা নেই। হাওয়ার জন্য দরজার হাতলে বিপজ্জনকভাবে মানুষ ঝুলছে। বদ্ধ, চাপা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থেকে ব্রজগোপালের মাথাটা দুবার চক্কর খেল। মাথাঘোরার রোগটা তাঁর যৌবন বয়স থেকেই। তালুতে তিল তিল চেপে ঠান্ডা জলে মাথা ধুলে একটু আরাম লাগে। দাঁড়িয়ে ব্রজগোপাল বারবার বীজমন্ত্র জপ করার চেষ্টা করেন। বারবার সুতো ছিঁড়ে যায়। কাটা ঘুড়ির মতো বনটা ভেসে বেড়াচ্ছে। একবার রণেনের মুখটা মনে পড়ে, একবার ননীবালার, মেয়ে-জামাই, ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি সকলের কথাই ভাবেন। বীজমন্ত্র ধরে রাখতে পারেন না। শরীরটা আজ বড় বেগোছ। এই দমচাপা অবস্থায় কারা ভিতরের দিকে ফুটবলের ব্যাপার নিয়ে চেঁচামেচি করছে। সেই গোলমালটা অসহ্য লাগে, আর সিগারেটের ধোঁয়া।
পরপর কয়েকটা স্টেশন পার হতেই ভিড় পাতলা হয়ে গেল। উত্তরপাড়া পার হয়ে বসার জায়গা পেলেন ব্রজগোপাল। ব্যাগটা কোলের ওপর রেখে বসলেন। হালকা জিনিসপত্র কখনও ব্যাঙ্কের ওপর রাখেন না তিনি। যদি চুরি যায়! চুরি যাওয়া ভাল নয়। যার চুরি যায় তার চরিত্রের মধ্যে কোথাও ঢিলেমি আছে, অসংলগ্নতা আছে। যত সামান্য জিনিসও হোক, ব্রজগোপাল সদাসতর্ক থেকে পাহারা দেন!
একটা মোটামতো পশ্চিমা লোক সরে বসে ব্রজগোপালকে জায়গা করে দিয়েছিল, লোকটার গায়ে খয়েরি রঙের এরটা পাঞ্জাবি, পরনে পরিষ্কার ধুতি, মাথায় একটু টিকি আছে, হাতে ভোলা একটা ছোট বই। খুব মন দিয়ে বইটা পড়ছে। ব্রজগোপাল একটু উঁকি দিয়ে দেখেন, বইটার পাতা জুড়ে দেবনাগরী অক্ষরে কেবল একটা কথাই ছাপা আছে, সীতারাম, সীতারাম, সীতারাম। প্রথমটায় কিছু বুঝতে পারলেন না তিনি। পশ্চিমা লোকটা পাতা ওলটাল। আবার দেখেন, ওই একই কথা লেখা সারা পাতায়, সীতারাম, সীতারাম, সীতারাম। বুঝলেন, সারা বই জুড়ে ওই একটি কথাই আছে। গল্প না, প্রবন্ধ না, ধর্মকথা না।
ব্রজগোপাল একটু ঝুঁকে বললেন—এটা কীসের বই ভাই?
লোকটা মুখ তুলে একটু হাসল। পাকানো মোচের নীচে বেশ ঝকঝকে হাসি। মাঝবয়সি মানুষ। দেখে মনে হয় কোথাও বেশ ভাল বেতনের দায়োরান-টারোয়ানের চাকরি করে বলল—রামসীতার নাম আছে বুড়াবাবা, আর কুছু নাই।
—সে তো মনে মনে জপ করলেও হয়।
—এ ভি জপ আছে। পড়তে পড়তে জপ হয়ে যায়।
তাই তো! ব্রজগোপাল ভারী মুগ্ধ হয়ে যান। এই হচ্ছে এৎফাঁকি বুদ্ধি। দুনিয়ার টানাপোড়েন, গণ্ডগোলে অস্থির মন যখন জপ করে রাখতে পারে না তখন এইভাবে নিজেকে জপে বদ্ধ করা যায় বটে। লোকটার ওপর ভারী শ্রদ্ধা হয় ব্রজগোপালের। কেমন নিবিষ্ট মনে নিজেকে রামসীতার নামের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে! লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে তাঁর। কিন্তু ইষ্টনাম জপে বাধা হবে বলে বলেন না। কিন্তু মানুষের মধ্যে আন্তরিক ভক্তিভাব দেখলে তাঁর চোখে জল আসে।
গ্রীষ্মকালে হাওড়া স্টেশনে বেশ সস্তায় নাগপুর না কানপুর কোথাকার যেন কমলালেবু বিক্রি হয়। কদমার মতো ছোট ছোট লেবু, ভারী মিষ্টি। বোঁটার কাছে কিছু পচা-পচা ভাব থাকে, সেটুকু চেঁছে ফেলে বেশ খাওয়া যায়। হাওড়া স্টেশনে গাড়ি ছাড়বার আগে এক বুড়ো মানুষকে লেবু কিনতে দেখেছিলেন। সঙ্গে পোঁটলা-পুঁটলি আছে, বৃদ্ধা স্ত্রীও আছেন সঙ্গে। এই ভিড়ে ‘আমি বুড়ো মানুষ বাবা, সঙ্গে মেয়েছেলে আছে বাবা’ এইসব বলতে বলতে ঠেলেঠুলে গাড়িতে উঠে পড়তেও দেখেছিলেন। এখন ভিড় পাতলা হওয়াতে দেখা গেল, সেই বুড়ো মানুষটি বেশ গুছিয়ে বসেছেন উলটোদিকের দূরের জানালার ধারে। জানালার ধারের জায়গা দখল করা এই গরমকালে বেশ মুশকিল। কিন্তু ঘোড়েল গোছের লোকটা দিব্যি জায়গাটা বন্দোবস্ত করেছেন। এও এৎফাঁকি বুদ্ধি। বুড়োর উলটোদিকে কয়েকটা চ্যাংড়া ছেলে বসেছে, ইয়ারবাজ। তাদের সঙ্গে জমিয়ে তুলেছেন বেশ। পাশে আধ-ঘোমটায় গিন্নি মানুষটির মুখ বেশ প্রসন্ন। দেখলেই বোঝা যায়, এরা বেশ সুখী লোক। বিষয় সম্পত্তি আছে, ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত, তেমন কোনও দুশ্চিন্তা নেই। চপাচপ লেবু খাচ্ছেন, মুখে হাসি।
চ্যাংড়াদের একজন বলে—জায়গাটা যে ছেড়ে দিলাম দাদু, তার বদলে কী দেবেন?
—কী দেব বাবা, বুড়ো মানুষ আমরা, পরের ভরসায় রাস্তায় বেরোই। তোমরা জায়গা ছাড়বে না তো কে ছাড়বে! ইয়ং ম্যান সব, স্পিরিটেড।
—ওসব গ্যাস ছাড়ুন। বর্ধমানে কিন্তু মিহিদানা খাওয়াতে হবে।
—আর মিহিদানা! সে বস্তু কী আর আছে। এখন কেবল বেসম আর চিনির রস। ও আমরা খাই না। আবার লেবু মুখে দিয়ে কোয়ার ফ্যাঁকড়া মুখ থেকে টেনে বের করতে করতে বলেন—তোমাদের বয়সে বুড়ো মানুষ আর মেয়েছেলে দেখলেই আমরা জায়গা ছেড়ে দিতুম।
—আমরাও তো দিলাম। আর একজন চ্যাংড়া বলে—আরও কিছু করতে হবে নাকি বলুন না। আর খুব পরোপকারী। বয়সের নাতনি-টাতনি থাকলে বলুন, দায় উদ্ধার করে দেব।
লোকটা খুব ঘোড়েল। একটুও ঘাবড়ায় না। হাতের আধখানা লেবু গিন্নির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে—ধরো! গিন্নি মুখটা ফিরিয়ে নেন, হাতের একটা ঝাপটা দিয়ে সরিয়ে দেন হাত। বুড়ো লেবুটা ফিরিয়ে নিয়ে বলে—না ভাই, নাতনি-টাতনি নেই। দুই ছেলে। ছোটটির জন্যই, মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কলকাতায়।
একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে—পছন্দ হল?
—না বাবা। বড্ড রোগা। মুখখানা আছে একরকম, কিন্তু হাওয়ায় হেলেপড়া চেহারা। ও আমার পছন্দ নয়।
—তা ওখানে খ্যাঁটটা কেমন হল দাদু?
বুড়ো হাসে। মাথা নেড়ে বলে—খাইয়েছে ভাল। এই দুর্দিনে বেশ বড় বড় রাজভোগ পায়েস, ফলটল।
—বছরে কবার মেয়ে দেখেন দাদু? দু-তিনবার করে হলে তো বেশ ভালই ম্যানেজ হয়, কী বলেন? আচ্ছা ম্যানেজার বাবা!
অন্য একটা চ্যাংড়া বলে—বুড়ো ভাম।
বুড়ো সবই শোনে। একটু হাসিমুখে লেবু খায়, আর বলে—তা ছেলের বিয়ে দিতে হলে মেয়ে তো দেখতেই হবে।
—হুঁ! ওদের চোখকে বিশ্বাস কী? বয়সের ছেলে, কটা চামড়া কী ভাসা ভাসা চোখ, কী একটু পাতলা হাসি দেখে মাথা ঘুরে যাবে। আমাদের চোখ অন্যরকম।
—দুরকম চোখ দাদু? ছুঁচে সুতো পরাতে পারেন?
বুড়ো হঠাৎ সোজা হয়ে বসে বলে—চোখ দুখানা এখনও আছে, বুঝলে! ঘরে লক্ষ্মীনারায়ণের সেবা হয়। রোজ সকালে নিজের হাতে মালা গেঁথে পরাই। লক্ষ্মীনারায়ণকে বলে রেখেছি, যেদিন চোখের দোষ হবে সেদিন থেকেই মালা বন্ধ।
বলে ঘোড়েল মানুষটা মাথা নেড়ে হেসে বলে—বুঝলে তো! চোখে আজ তাই পষ্ট দেখি। লক্ষ্মীনারায়ণের প্রাণে ভয় আছে না, মালা বন্ধ হয়ে যাবে যে!
ব্রজগোপাল মুখটা ফিরিয়ে নেন। পশ্চিমা লোকটা সীতারামের নাম পড়ে যাচ্ছে নীরবে। জপ করছে। অন্তরের গভীরতম প্রার্থনা সংসার থেকে সুতো বেয়ে চলে যাচ্ছে কী তাঁর কাছে! ব্রজগোপাল চোখ বুজে একটা গভীর শ্বাস ফেলেন। রণেনের কথা কেন যে এতবার মনে হচ্ছে! ভাবতে ভাবতে একটু শিউরে ওঠেন বুঝি! ছেলেটা শীলার বাসায় বসে একা-একা কথা বলছিল। সংসারে বোধ হয় ন্যাজে-গোবরে হচ্ছে একটু অল্প বুদ্ধির ছেলেটা। ছেলেবেলায় টাইফয়েডের পর মাথার দোষ হয়েছিল। মাথাটা কমজোরি। তেমন ভাবনা-চিন্তার চাপ পড়লে কী হয় না হয়। সংসারের আত্মীয়রা বড় স্বার্থপর, মন বুঝে, অবস্থা বুঝে চলে না। রণেনের মনে ব্যথা দিয়ে কারও কিছু করা উচিত নয়। কিন্তু সে কি ওর বউ বোঝে! না কি ননীবালাই বোঝেন? না কি বাচ্চাকাচ্চা বা ভাই-ই বোঝে! সংসার এত মন বুঝে চললে তো স্বর্গ হয়ে যেত। রণেনের জন্য ব্রজগোপালের মনটা তাই ভাল লাগে না। ওকে বোধ হয় সবাই অতিষ্ঠ করে, অপমান করে। কিছুকাল আগে একবার দৌড়ে গিয়েছিল গোবিন্দপুরে। স্টেশনে দেখা হতে বলেছিল—সংসারে যত অশান্তি। আজকেও একবার ট্যাক্সিতে হঠাৎ ‘বাবা’ বলে ডেকেছিল, কিন্তু কিছু বলেনি। কিছু যেন বলার ছিল। লজ্জায় পারেনি।
ব্রজগোপাল চোখ বুজে চাপ ধরা বুকের ভারটা আর একটা দীর্ঘশ্বাসে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। মনের মধ্যে বলে রাখলেন—সব ভাল রেখো। ওদের সুখে রেখো।
সংসারে ওই যে লেবু খাচ্ছে ঘোড়েল লোকটা, মান অপমান জ্ঞান কিছু কম, লোভী ওই সব মানুষেরা একরকম সুখেই আছে। ঠাকুরদেবতার সঙ্গে পর্যন্ত চুক্তি করে কাজ করে। ব্রজগোপাল আবার একটা শ্বাস ছাড়লেন। পাশের লোকটা আপনমনে সীতারামের নাম পড়ে যাচ্ছে। ওটা বুঝি বুড়ো বামুনেরই ইঙ্গিত। ব্রজগোপাল ছিঁড়ে-যাওয়া জপের সুতোটা আবার চেপে ধরলেন। জপ চলতে থাকল।
স্টেশনে যখন নামলেন তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। এদিকে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মের মোরম ভেজা। বাতাসে ভেজা মাটির আঁশটে গন্ধ। গাছপালার হাওয়া-বাতাসের পাগল শব্দ। আকাশে হালকা মেঘ রেলগাড়ির মতো চলে যাচ্ছে, অন্ধকারেও বোঝা যায়। প্ল্যাটফর্মে নেমে দাঁড়াতেই ওই বাতাস, ওই গাছ-মাটির গন্ধ, পৃথিবী-জোড়া অন্ধকার ব্রজগোপালের মন থেকে ধুলোবালি ঝরিয়ে দিল। মনখারাপটা ভুল পড়ল একটু।
প্ল্যাটফর্মের গাছতলায় কাঠের বেঞ্চ-এ একজন লোক গা মাথা একটা গামছায় ঢেকে বসে আছে। বেঞ্চের নীচে, পায়ের কাছে হারিকেন। আলোটা বাতাসে দাপাচ্ছে। নিববে। লোকটার পাশে রাখা একটা ছাতা, খোলেনি, প্রকাণ্ড অন্ধকার চেহারাটা দেখেই চিনতে পারেন ব্রজগোপাল।
একটু এগিয়ে গিয়ে বলেন—বহেরু।
লোকটা নড়েচড়ে উঠে বসে, বলে—আলেন?
—হুঁ।
—ভয় লাগতে ছিল, ভাবলাম বুঝি আজ আর আলেন না। ঠাকরোন আর ছানা-পোনারা সব ভাল?
—হুঁ, তুই কখন থেকে বসে আছিস?
—অনেকক্ষণ। তখন বেলা ছিল।
বহেরু উঠে দাঁড়ায়। বলে—আজকাল আপনি না থাকলি ভাল লাগে না।
ব্রজগোপাল চুপ করে থাকেন। একটু কষ্ট হয়। বহেরুটা এবার বুড়ো হল এই সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সে। বলেন—তা তুই কেন বসে আছিস দুপুর থেকে, আমার তো রাতেই ফেরার কথা, তখন না হয় কালীপদ বা কোকা আসতে পারত!
—তাদের বড় গরজ! বামুনকর্তার মহিমা তারা কী বুঝবে!
—তা না হয় আমি একাই যেতাম। অভ্যেস তো আছে। দুপুর-দুপুর এসে বসে আছিস, বাদলায় ভিজেছিস নাকি!
স্টেশনের বেড়া পার হয়ে রাস্তায় পড়ে বহেরু ডান ধার বাঁ ধার তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলে—না। স্টেশনের ঘরে গিয়ে বসলাম তখন। বাদলা তেমন হয়ওনি। ছিটে-ফোঁটা। হারিকেনটা তুলে একবার দেখল বহেরু। আগুনটা দাপাচ্ছে। বলল—এটা নিবে গেলেই চিত্তির।
—টর্চ তো ছিল।
—সে কোন বাবু নিয়ে বেরিয়েছে কী হারিয়ে এসেছে কে তার খোঁজ রাখে। রাবণের গুষ্টি। বলে বহেরু খুব বিরক্তির গলায় বলে—বেরুনোর সময়ে খুঁজে পেলাম না। আপনারও তো একটা ছিল।
ব্রজগোপাল থেমে ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতড়ে ছোট্ট টর্চবাতি বের করে দেখেন বোতাম টিপতে একটা অত্যন্ত মলিন লাল আলো ধীরে জ্বলে উঠল। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—এটারও ব্যাটারি ফুরিয়েছে। আজ আনব বলে ঠিক করেছিলাম, তাড়াহুড়োয় ভুলে গেলাম।
—নলিনীর দোকানে পাওয়া যায়।
—দূর! ও ব্যাটা চোর। তিন আনার জিনিস আট আনা হাঁকে। কলকাতায় কিছু সস্তা হয়। গায়ে গায়ে সব দোকান গজিয়েছে, রেষারেষি করে বিক্রি করে। তাই সস্তা।
বহেরু বুঝদারের মতো মাথা নাড়ল। বলল—ভারী শহর। বহুকাল যাই না। বহেরু একটু থেমে গিয়ে ব্রজগোপালের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে—আপনি একটু আগু হোন। আলো পেছনে থাকলিই ভাল।
ব্রজগোপাল এগোন। বহেরু পিছনে বোধ হয় ফস করে বিড়ি ধরাল। অলোতে সামনে ছায়াটা লম্বা হয়ে দিগন্তের অন্ধকারে মিশে গেছে। ব্রজগোপাল ঠাহর করে হাঁটেন। বহেরু বলে—সেই দুপুর থেকে বসে বসে মাছি মশা তাড়াচ্ছি। কত ট্রেন গেল।
ব্রজগোপাল শুধু বিরক্তিসূচকভাবে বললেন—হুঁ।
—বাসায় বসে দিন কাটে না।
—তোর তো কত কাজ। ব্রজগোপাল বলেন।
একঝলক বিড়ির গন্ধ আসে পিছনে থেকে। বহেরু নিরাসক্ত গলায় বলে—করতে গেলে কাজ ফুরোয় না, সে ঠিক। কিন্তু এখন মনে করি, আর কাজ কী কাজে! কাজ করে মেলা কাজি হয়েছি। সংসার বেশি দেখতে গেলে কাজিয়া লেগে যায়। ছেলেগুলো সব হারামি, জানেন তো।
ব্রজগোপাল একটু ভেবেচিন্তে বলেন—তোরই রক্তের ধাত তো। পাজি তুই কি কিছু কম ছিলি?
বহেরু একটু হাসল। বলল—বুড়োও তো হলাম।
—বুড়ো মনে করলেই বুড়ো। মনে যদি বয়স না ধরিস তো বুড়ো আবার কী! বুড়োটে ভাবটাই ভাল না।
বহেরু একটু চুপ করে থাকে। বলে—এক পাঞ্জাবি জ্যোতিষকে ধরে এনেছিলাম পরশুদিন। বললাম থাকার জায়গা দেবো, ভাতকাপড়ের ব্যবস্থা করব, থাকো। রাজি হল না। তা সে হাতটাত দেখে বলল, আমার কপাল নাকি খুব ভাল। তীর্থে মরব।
ব্রজগোপাল মরার কথা সহ্য করতে পারেন না। একটু এঁটেল মতো পিছল জায়গা পার। হচ্ছিলেন সাবধানে। একটু ঝাঁকি মেরে বললেন—তীর্তে মরলে কি আর দুটো করে হাত পা গজাবে নাকি! যত ইল্লুতে কথা! বেঁচে থেকে কী কী করতে পারবি তাই ভাব।
—আর কী করব! আপনি কথা কবেন, পায়ের কাছে বসে শুনব। পাপ তাপ কেটে যাবে। কত কুকর্ম করেছি।
—কর্মের পাপ কর্ম দিয়ে কাটাতে হয়। তত্ত্ব শুনলে কাটে না।
—আপনার কেবল ওই কথা। কাজ তো অনেক হল।
—তবে কি তোর পছন্দমতো কথা বলতে হবে নাকি! কাজকে তোর এত ভয় কীসের?
বহেরু একটু চুপ করে থাকে। বিড়ির ধোঁয়া বুকে চেপে রাখতে গিয়ে দু-দমক কাশি আসে। বলে কাজকে ভয় নেই। ছেলেগুলো বড় ব্যাদড়া। সামলাতে পারি না। এই সেদিনও রক্তের দলা ছিল সব, এখন ডাকাত হয়ে উঠেছে।
—হলই বা। বিশ্বসংসারের কাজ বলতে কী কেবল নিজেব সংসারের কলকাঠি নাড়া? অন্য কিছু নেই?
—কিছুতেই মন লাগে না। মেধু ডাক্তারের ভূত নয়নতারাকে ভর করে রাতবিরেতে কত কথা বলে?
—কী বলে? ব্রজগোপাল ধমক দিয়ে বলেন।
পুরনো একটা সাঁকো পার হয়ে ব্রজগোপাল বড় রাস্তা ছেড়ে আল ধরার জন্য নেমে পড়লেন। বহেরু রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে পড়ল, লণ্ঠনটা উঁচু করে ধরে বলল—দুর্যোগে ফুলতলার রাস্তা দিয়ে যাবেন নাকি!
—ভারী তো দুর্যোগ! ক’ফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে, সেইজন্য আধ মাইল ঘুরপথে যাব নাকি!
বহেরু ইতস্তত করে বলে—রাস্তাটা ভাল নয়। রাম রাম।
ব্রজগোপালের মায়া হল। বহেরুর কোনওকালে ভয়ডর বলে বস্তু ছিল না। এখন কেমন কোলঘেঁষা ছেলের মতো ভয় পায়। ব্রজগোপাল নীচে থেকে রাস্তার ওপর ওর বিশাল ছায়াটা দেখলেন। হারিকেনের খুব নিবন্ত আলোয় চোখমুখ অসুরের মতো দেখায়। এখন লোকে ওকে দেখলে ভয় খেয়ে যাবে। কিন্তু আদতে বহেরু ডাকাতের নিজের প্রাণেই এখন নানা ভয়ভীতির বাসা। ব্রজগোপাল বললেন—ভয়টা কীসের? বলে আবার রাস্তায় উঠে এলেন, যেখানে জেদি কুকুরের মতো পা জড়িয়ে আছে বহেরু। এখন ওকে টেনেও নেওয়া যাবে না।
আবার আগে আগে হাঁটেন ব্রজগোপাল, পিছনে বহেরু। বহেরু পিছনে গলা খাঁকারি দেয়। বলে—ঘরে বসেই সব শুনতে পাই। রাতবিরেতে নয়নতারা কাঁদে। ঘুমোয় না মেয়েটা। কেবল বোনাসুরে বলে-রক্ত বৃষ্টি হবে, মাটির তলায় বসে যাবে গ্রামগঞ্জ। আর আমার নাম ধরে ডেকে বলে—তুই মরবি শেয়াল কুকুরের মতো, ধাঙড়ে পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে ফেলে দিয়ে আসবে ভাগাড়ে। গতিমুক্তি হবে না, অন্ধকারে হাতড়ে মরবি চিরকাল, জন্ম হবে না। এই সব বলে।
ছাতাটা একটু মাটিতে ঠুকল বহেরু। গলাখাঁকারি দিল। আলোটা তুলে কল ঘুরিয়ে তেজি-কমী করল। ব্রজগোপাল ফিরে তাকালেন একটু। মুখের কাছে আলোটা তুলেছে তাই মুখটা দেখতে পেলেন। আর কিছু নয়, কেবল মুখে একটা আলগা বুড়োটে ছাপ পড়েছে। ব্রজগোপাল একটু চিন্তিতভাবে হাঁটেন। অনেকক্ষণ বাদে হঠাৎ একটু ফুর্তির সুরে বলেন— দূর ব্যাটা! দলমাদল কামান দাগায়ে দে, সব ভয়ভীতি খসে পড়বে।
বহেরু পিছন থেকে তাড়াতাড়ি দু-কদম এগিয়ে আসে—কী বলেন কর্তা?
—কী কী! জয়গুরু জগন্নাথ। তুই ছিলি কাজের কাজি, এখন হয়েছিস ভাবন কাজি। এত ভাবিস ক্যান? চাষাভুষো মানুষকে কি ভাবনাচিন্তা সয়? মনের মুখে নাড়া জ্বেলে দে। দুনিয়া কি তোর? এত ভাবনা কেন?
তত্ত্বকথার গন্ধ পেয়ে বহেরু কান খাড়া করে। ব্রজগোপালের ঘাড়ে শ্বাস ফেলে পিছু পিছু হাঁটে গৃহপালিতের মতো। বলে—ঠাকুর থাকবেন তত আমার কাছে? ছাড়ে যাবেন না তো!
দূর ব্যাটা।
বহেরু একটা শ্বাস ফেলে। বিড়বিড় করে বলে—ঠাকুর, থাকেন। থাকেন।
Leave a Reply