যাও পাখি – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
.
“রা-স্বা”
শ্রীতুলসী সেনগুপ্ত
শ্ৰীমতী কৃষ্ণা সেনগুপ্ত
করকমলেষু
.
“রা-স্বা”
গ্রন্থকারের নিবেদন
এই গ্রন্থের প্রথম উদ্ধৃতিটি আমার পরমারাধ্য গুরুদেব পরমপ্রেমময় শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের। কাহিনীর আখ্যান ও সংলাপ অংশে তাঁর আরও অনেক বাণী ব্যবহৃত হয়েছে।
আমার শ্রদ্ধেয় ইষ্টভ্রাতা পরলোকগত হিরন্ময় মুন্সীর “ইসলাম দীপ্তি” গ্রন্থ থেকে প্রচুর সাহায্য গ্রহণ করেছি।
‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করার সময়ে বহুল অংশে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত হয়েছে।
.
“তুমি ঠিক ঠিক জেনো যে তুমি
তোমার, তোমার নিজ পরিবারের,
দশের এবং দেশের বর্তমান ও
ভবিষ্যতের জন্য দায়ী।”
.
॥ এক ॥
সোমেন জানে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন।
ব্যাপারটা সে টের পেল শনিবার সকালে, বৈঁচী স্টেশন থেকে আড়াই মাইল উত্তরে গোবিন্দপুর গাঁয়ে বহেরুর কিচেন গার্ডেনে বসে। কিচেন গার্ডেন বললে অবশ্য কিছুই বলা হয় না। বহেরু তার বিশাল পরিবারের সবজিটা এই ক্ষেতে ফলিয়ে নেয়। আড়েদিঘে ক্ষেতটা চার-পাঁচ বিঘে হেসেখেলে হবে। বহেরু আদ্যিকালের চাষা নয়, কেমিক্যাল সার, ইনসেকটিসাইডসের সব বৃত্তান্ত জানে। জানে ব্যাঙ্কের সুদের হার, রাইটার্স বিল্ডিংস বা বি-ডি-ও অফিসে গিয়ে মুখচোরা জোড়হাত চাষার মতো ঈশ্বর ভরসায় বসে থাকে না চোটেপাটে কথা বলে কাজ আদায় করে আসে। বহেরু যে উন্নতি করেছে তা তার এই সবজিক্ষেতের উন্নত সতেজ সবুজ রং সংকেতে জানিয়ে দিচ্ছে। একটু দূরেই চলছে পাঁচ-ঘোড়ার পাম্পসেট। ডিজেলের গন্ধ আর ফটফট শব্দ। বছরে বার-দুই সে ভাড়া করে ট্যাক্টর। বহেরুর পরিবারের নামে বা বেনামে কত জমি আছে তার হিসেব সোমেন জানে না। আন্দাজ করে দেড় দুশো বিঘে হবে। অনেক আগে যখন এখানে আসত সোমেন তখন অত বাড়বাড়ন্ত দেখেনি। মাঠের ধান উঠে গেছে। পড়ে আছে ন্যাড়া মাথায় সদ্য গজানো চুলের মতো কাঁটা কাঁটা ধানের গোড়া। তবু সেই ক্ষেত সারা সকাল ধরে দেখিয়েছে তাকে বহেরু। দু-চার জায়গায় আগুনের চিহ্ন পড়ে আছে মাটিতে। এ জায়গায় আখের চাষ হয়। বহেরু মোটা সুতির একটা ভাগলপুরী চাদর গায়ে, পরনে ধুতি আর পায়ে বাটা কোম্পানির মজবুত একজোড়া খাকি রঙের হকিবুট পরে ঘুরে ঘুরে তাকে খানিকটা জমিজিরেত দেখাল। একবার দাঁড়িয়ে পড়ে সখেদে একটা ঢেলা বুটের ডগায় উলটে দিয়ে বলল—মাটির কি আর নিজের দুধ আছে।
—কি বল বহেরু? সোমেন জিজ্ঞেস করল।
—মাটির নিজের রস হল মায়ের বুকের দুধের মতো। কেমিক্যাল সার হচ্ছে গুঁড়ো দুধ, সেই নকল দুধ মায়ের বুকে ভরে দেওয়া। ছেলেবেলা যেমন স্বাদ পেতেন সবজিতে, এখন আর পান?
সোমেন মুশকিলে পড়ে যায়। শাকসবজির স্বাদ নিয়ে সে মাথা ঘামায় না, পাতে দিলে সে মটর শাকের সঙ্গে খেসারির শাকের তফাত বুঝতে পারে না। চুপ করে রইল।
—এ মাটি হচ্ছে এখন ওষুধের জোরে বেঁচে থাকা রুগি। নিজের জোর বল নেই। ওষুধ পড়লে বছর-বিয়োনী বাঁজা বনে যাবে।
খালধার পর্যন্ত যেতে যেতে রোদ চড়ে গেল। বহেরু ভাগলপুরী চাদরখানা খুলে ফেলল গা থেকে। গায়ে একটা ফতুয়া। সত্তরের কাছাকাছি বয়েস কে বলবে? হাতে বুকে ঢিলে চামড়ার তলা থেকে ডিম-ডিম পেশি পিছলোচ্ছে। গর্দানখানা ভাল খাঁড়া দিয়েও এক কোপে নামানো যাবে না, এত নিরেট। চুলে পাক ধরেছে কিন্তু চোখ দুখানা এখনও রোদে ঝিকোয়। বিশাল লম্বা বহেরু। চাদরখানা খুলে মাটির বাঁধের ওপর যখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল তখনই অস্পষ্টভাবে সোমেন ভিটামিনের কার্যকারিতা বুঝতে পেরেছিল। ঢালুতে দাঁড়িয়ে সোমেন দেখে বাঁধের ওপরে শীতের ফিরোজা আকাশের গায়ে বিশাল স্তম্ভের মতো উঠে গেছে বহেরুর শরীর। এখানে রোদে বাতাসেও ভিটামিন ভেসে বেড়ায় নাকি? সেই সঙ্গে ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিনও? কতকাল ধরে বহেরু প্রায় একরকমের আছে। নিমের দাঁতনে মাজা স্টেনলেস স্টিলের মতো শক্ত দাঁত দেখিয়ে হেসে বহেরু হাত তুলে খালধারে একটা অনির্দিষ্ট এলাকা দেখিয়ে বলল—এই হচ্ছে আপনাদের জমি, একলপ্তে পাঁচ বিঘে। পোটাক উজিয়ে গেলে আরও এক বিঘে আছে আপনাদের, সে কিন্তু অনাবাদি, মরা জমি। ঠাকরুনকে বলবেন, সে জমিতে চাষ দিতে এখনও দু-তিন বর্ষা লাগবে।
গতকাল তাড়াতাড়ি কিট ব্যাগ গুছিয়ে দুপুরের বর্ধমান লোকাল ধরেছে সোমেন। তাড়াহুড়োয় ভুলভ্রান্তি হয়। আজ সকালে দেখে টুথব্রাশ আনেনি। বহেরুর ছেলে শক্ত দেখে নিমডাল কেটে দিয়েছিল, সকালে সেটা আধঘণ্টা চিবিয়ে মাড়ি ছড়ে গেছে, মুখে বিদঘুটে স্বাদ। বহেরুর সত্তর বছরের পুরনো আসল দাঁতগুলোর দিকে চেয়ে সোমেন মুগ্ধ হয়ে গেল। ক্লোরোফিলের কাজ।
কাল রাতে তার সম্মানে বহেরু মুরগি মেরেছিল। এরা ব্রাহ্মণের পাতে নিজেদের হাতের রান্না দেয় না। সোমেনকে নিজে বেঁধে নিতে হয়েছে। খুব তেল-ঘি-রসুন-পেঁয়াজ-লংকা দিয়েছিল বটে, কিন্তু তেমন কষায়নি বলে মাংসটা জমেনি তেমন। খিদের মুখে একপেট সেই ঝোলভাত খেয়েছে। এগারো ঘণ্টা পর আজ সকালে সেই মাংসের একটা ঢেকুর উঠল। সোমেন হাতের পাতায় চোখের রোদ আড়াল করে ধু-ধু মাঠ ময়দান দেখে।
ফেরার পথে সোমেন জিজ্ঞেস করল—বাবা এখানে এসে করে কী?
বহেরু সামনে হাঁটছে। লাঠিয়াল চেহারা। কাঁধে চাদর ফেলা। উত্তরে বাতাস দিচ্ছে টেনে। রোদ ফুঁড়ে বাতাসের কামড় বসে যাচ্ছে শরীরে। বহেরুর ভ্রূক্ষেপ নেই। লং ক্লথের ফতুয়ার আড়ালে চওড়া কাঁধ। অহংকারী চেহারা। খুলনা জেলার গাঁয়ে সে ছিল কখনও কামলা, কখনও ডাকাত, কখনও দাঙ্গাবাজ, আবার কিছু কিছু ভাগের চাষও করত, শীতের নদীতে মাছ ধরতে যেত, আবার সোমেনদের দেশের বাড়িতে ঘরামি বা মুনিশও খেটে গেছে। দেশ ভাগাভাগির সময়ে সে একটা সুযোগ নেয়। যশোর আর খুলনার রাস্তায় ঘরছাড়া মানুষদের ওপর হামলা করে সে কিছু কাঁচা পয়সার মুখ দেখে। শোনা যায়, নিজের দলের গোটা চারেক লোককে কেটে সে ভাগীদার কমিয়ে ফেলে। গোবিন্দপুরে এসে এক মুসলমান চাষির সঙ্গে দেশের জমি বদলাবার অছিলায় তাকে উচ্ছেদ করে জমির দখল নেয়। তারপর এই উন্নতি। সেই উন্নতিটাই কঠিন এবং সহজ শরীরের অহংকারে ফুটে উঠেছে এখন।
মুখটা না ফিরিয়েই জবাব দিল বহেরু—কী আর করবেন! বুড়ো মানুষ। এমনভাবে ‘বুড়োমানুষ’ কথাটা বলল যেন বা সে নিজে তেমন বুড়োমানুষ নয়। একটু ভেবেচিন্তে সাবধানে বলে—সারাদিন পুঁথুপত্রই নাড়াচাড়া করেন, খুড়োমশাইয়ের কাছে সাঁঝ সকাল খোলের বোল তোলেন, কচি-কাঁচাগুলোকে লেখাপড়াও করান একটু-আধটু, রোগেভোগে ওষুধপত্র দেন। মাঝে মাঝে বাই চাপলে এধার-ওধার চলে যান। যেমন এখন গেছেন।
—কোথায় গেছে কিছু বলে যায়নি?
বহেরু মাথা নাড়ল—কথাবার্তা তো বলেন না বেশি। বলাকওয়ার ধার ধারেন না। আমরা ভাবলাম বুঝি কলকাতাতেই গেলেন, ঠাকরুন আর ছানাপোনাকে দেখা দিয়ে আসবেন। গেছেন তো মোটে চারদিন।
—না বহেরু, একমাস হয় আমরা কোনও খবরবার্তা পাইনি!
বহেরু দুশ্চিন্তাহীন গলায় বলে—আছেন কোথাও। উদাসী মানুষ। যেদিন মন হবে ফিরে আসবেনখন। ভাববেন না।
বহেরুর কথাটায় একটু তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। বাবার প্রতি নয়, তার প্রতি বা তাদের প্রতি। যেন বা বাবা কোথায় আছে তা জেনেও বলার চাড় নেই বহেরুর। বহেরু কি বুঝে গেছে যে বাবার খোঁজে সোমেনদের আর সত্যিই দরকার নেই? খোঁজখবর করাটা বাহুল্য মাত্র?
মাঠটা পার হয়ে এল তারা। বড় রাস্তাটা অন্তত পঁচিশ ত্রিশ বছরের পুরনো, পাথরকুচির রাস্তা। কোনওকালে বোধ হয় মেরামত হয়নি, গোরুর গাড়ির চাকায় আর গত বর্ষার জলে চষা জমির মতো এবড়ো-খেবড়ো হয়ে আছে, তারই পাশে একা দাঁড়িয়ে আছে বহেরুর খামারবাড়ি। আশেপাশে আর গাঁ-ঘর নেই। গোবিন্দপুরের বসত আরও কিছু উত্তরে। বহেরুর খামারবাড়িতে আটচালা, চারচালা, দোচালা মিশিয়ে দশ-বারোখানা ঘর। আর আছে গোশালা, ঘানিঘর, ঢেঁকিঘর, কাঠের মাচানের ওপর জাল দেওয়া একটা হাঁস-মুরগির পোলট্রিও। প্রায় স্বয়ম্ভর ব্যবস্থা। জামাকাপড় আর শৌখিন জিনিসপত্র ছাড়া বহেরুদের প্রায় কিছুই কিনতে হয় না।
বাড়ির হাতায় পা দিয়ে বহেরু হাত তুলে উত্তর দিকটা দেখিয়ে বলল—ওই গোবিন্দপুরের লোকগুলো খচ্চর। আমি এখানে নিজের মতো একখানা গাঁ করব। বহেরু গাঁ।
চোখ দুটো আবার রোদে ঝিকলো। ঠাট্টার কথা নয়, বহেরু হয়তো বা পারে। সে ভাগচাষি বা বরগাদার নয়। সে নিজস্ব জোতের মালিক, পয়সায় সোমেনদের কেনাবেচা করার মতো ধনী। তবু যে সে সোমেনদের জমি চষে দেয়, ফসলের দাম দেয়, সে তার দয়া। একসময়ে সে সোমেনদের বাপ-দাদুর নুন খেয়েছে। বাড়ির চাকরবাকরের মতো ছিল। দান উলটে গেছে এখন। সোমেনের বাবা বোধ হয় এখন বহেরুরই একজন কর্মচারী মাত্র, বাচ্চাদের পড়ায়, তার অর্থ প্রাইভেট টিউটর, হিসেবনিকেশও বোধ হয় কিছু করে দেয়। তার মানে, বাবা এখন বহেরুর ম্যানেজার কিংবা নায়েব। এ পর্যন্ত যখন বহেরু পেরেছে, নিজের নামে একখানা গাঁয়ের প্রতিষ্ঠা করতেও পারবে। জ্ঞাতিগুষ্টি মিলিয়ে বহেরুর পরিবারেই প্রায় এক গাঁ লোকজন।
উঠোন থেকে খোলের শব্দ আসছে। কাল সন্ধেবেলাও শুনেছিল খোলের শব্দ, আবার খুব ভোরে। বহেরুর নব্বই বছর বয়সি জ্ঞাতি খুড়ো দিগম্বরের ওই এক শখ। এ বাড়িতে বোধ হয় ওই লোকটিই স্বার্থশূন্য এক বাতিক নিয়ে আছে। ক্ষেতখামার, বিষয়-আশয় বোঝে না। বোঝে কেবল খোলের শব্দ। তাতেই মাতাল হয়ে আছে। ভোররাতে সোমেন ঘুম ভেঙে প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে কানে বালিশ চাপা দিয়ে শব্দটা আটকাবার চেষ্টা করল কিছুক্ষণ। কিন্তু দূরাগত মেঘের গুরু গুরু ধ্বনির মতো শব্দটা খুব সহজেই তার বুকে ঘা মারতে থাকে। চারদিকের নিস্তব্ধতার মধ্যে ওই শব্দটা যেন ওই নিস্তব্ধতারই একটা স্পষ্ট রূপ। বাজনার কিছুই জানে না সোমেন। কিন্তু ক্রমে ওই শব্দ তাকে কিছুক্ষণের জন্য অন্য সব শব্দের প্রতি বধির করে দিল। না-টানা সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে ঝুলে থাকে। সে অনুভব করে তার হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক ডুবডাব শব্দ আস্তে আস্তে বদলে যায়। বহেরুর বুড়ো খুড়োর আঙুলের টোকায় টোকায় নাচে তার আনন্দিত হৃৎপিণ্ড।
সকালে উঠেই সে তাই প্রথমে বুড়ো লোকটাকে খুঁজে বের করে।
—বড় ভাল বাজান তো আপনি!
ঘোলাটে ছোট ছোট দুই চোখ, বেঁটেখাটো চেহারা এ বয়সেও মজবুত, আঙুলগুলোর ডগায় কড়া, ঝুপ্পুস এক নোংরা তুলোর কম্বল মুড়ি দিয়ে রোদে বসেছিল মহানিম গাছটার তলায়। হাতে কাঁসার গ্লাসে চা। সোমেনের কথা শুনে কেঁপে ওঠে বুড়ো, হাতের চা চলকে যায়। বলে—আমি?
আপনিই তো বাজালেন।
বুড়ো থরথরিয়ে কেঁপে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। হাত বাড়িয়ে সোমেনের হাত দুটো সাপটে ধরে ককিয়ে ওঠে—আমি না বাবু, আমি না। গুরু বাজাইছে। মাঝেমইধ্যে গুরু ভর করে শরীলে…
কথার টান শুনে বোঝা যায় দিগম্বর ঢাকা বা ওদিককার পুব দেশের লোক। যশোর বা খুলনার নয়। তবু কেন যে তাকে জ্ঞাতি বা খুড়ো বলে চালাচ্ছে বহেরু তা কে জানে! সোমেন শুনেছে, বহেরু নানা জায়গার সব গুণী, কিম্ভূত বা অস্বাভাবিক লোক এনে তার নিজের কাছে রাখে। এটাই ওর বাতিক। কী পরিষ্কার টনটনে আওয়াজে ওই খোল বাজছে এখন। কী একটা কথা ফুটি-ফুটি হয়ে উঠছে। ঠিক বোঝা যায় না। আবার বোঝাও যায়। বহেরুর বিশাল সংসারের নানা বিষয়কর্মের শব্দ উঠছে। কুয়োয় বালতি ফেলার শব্দ, পাম্পসেটের আওয়াজ, শিশুদের চিৎকার, বাসনের শব্দ। কিন্তু সব শব্দের ওপরে খোলের আওয়াজ বধির করে দিচ্ছে পৃথিবীকে।
হলুদ কুঞ্জলতায় ছেয়ে আছে কাঁটাঝোপের বেড়া। সোনা রঙে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। তার পাশে বহেরু দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে শোনে একটু। তারপর হঠাৎ ফিরে বলে—খুলোমশাইয়ের খোল কি বলছে বুঝছেন?
সোমেন অবাক হয়ে বলে—না তো! কী?
—ভাল করে শুনুন।
সোমেন শোনে। বলছে বটে, কিন্তু ঠিক বোঝা যায় না।
বহেরুর বিযয়ী চোখ দুটো হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তাতে একটা বৈরাগ্যও এসে যায় বুঝি। মাথা নেড়ে বলে—ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া…
হাসে বহেরু।
কিন্তু সোমেন আবাক হয়ে শোনে। সত্যিই পরিষ্কার ভাষাটা বুঝতে পারে সে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…
আবার পালটে যায় বোল। বহেরু হাঁটতে হাঁটতে বলে—এখন বলছে চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন…. পরমুহূর্তেই আবার পালটে যায় বোল। বাঙ্ময় খোলে বহেরুর খুড়ো আর একটা কী কথা বলে যেতে থাকে।
বহেরু হাঁটতে হাঁটতে ধুঁধুল লতায় অন্ধকার শুঁড়িপথ ধরে বলে—এবার বলছে মাখিজুখি, মাখিজুখি, মাখিজুখি…
দু-তিনটে সনের শব্দ ওঠে। খোল বোল পালটাচ্ছে।
বহেরু শ্বাস ছেড়ে বলে, শুনুন, বলছে—দে দই, দে দই, দে দই…
সোমেন দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর হাঁটে আবার। খোল ততক্ষণে ফিরে ধরেছে প্রথম বোল৷ ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া…
একটু হতাশায় ম্লান হাসি হেসে বহেরু মাথা নেড়ে বলে—সারাদিনই শুনবেন ওই আওয়াজ। যান আপনি বিশ্রাম করেন।
মটরশাকের ক্ষেতে সাদা ফুল প্রজাপতির মতো আলগোছে ফুটে আছে। বহেরু যখন ক্ষেতটা পার হচ্ছে, তখন গাছগুলি শুঁড় বাড়িয়ে তাকে স্পর্শ করতে চাইছে, এই দৃশ্যটা দাঁড়িয়ে দেখল সোমেন।
বিশ্রাম করার কিছু ছিল না। বহেরু বয়স্ক লোক, তার ওপর দেশের মানুষ। সিগারেটটা এতক্ষণ ইচ্ছে করেই খায়নি সে। একটা সিগারেট খাবে বলে ঘরে ঢুকল। বাবার ঘর। এই ঘরটায় রাত কাটিয়েছে সোমেন। বড় কষ্ট গেছে।
সরগাছের বেড়ার ওপর মাটি লেপা, ওপরে টিনের চাল। সারা রাত ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাস ঢুকেছে, আর শব্দ উঠেছে টিনের চালে। একধারে বাঁশের মাচানে বিছানা। গদির বদলে চটের ভিতরে খড় ভরে গদি বানানো হয়েছে, তার ওপর শতরঞ্জি আর পাতলা তোশকের বিছানা। গায়ে দেওয়ার জন্য একটা মোটা কাঁথা। একটা শক্ত বালিশ।
একটা হলদি কাঠের সেলফে কিছু কাচের জার, শিশি, বোতল। কৃষি বিজ্ঞানের কয়েকটা বই। একটা ছোট টেবিল, লোহার চেয়ার। দুটো ঝাঁপের জানালা খুলে আলো হাওয়ার রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। তবু ঘরটা আবছা। দীর্ঘ বৃষ্টির দিনে যেমন ঘরের আসবাবে, বিছানায় একটা সোঁদা গন্ধ জমে ওঠে, এ ঘরে তেমনই এক গন্ধ। মাটির মেঝেয় ইঁদুরের গর্ত, বাঁশের খুঁটির নীচে ঘুণপোকায় কাটা বাঁশের গুঁড়ো। উইয়ের লাইন গেছে কাঠের তক্তার পাটাতন পর্যন্ত। বাবার বউল-ওলা খড়ম জোড়া আর একটা পিতলের গাড়ু মাচানের নীচে। তার পাশে বড় একটা টিনের, আর একটা চামড়ার স্যুটকেশ। দুটোই বিবর্ণ। মশারিটা চালি করে রেখে গেছে কে, ঘরটা ঝাঁটপাটও দিয়েছে, কিন্তু কিছুমাত্র উজ্জ্বলতা ফোটেনি। এই ঘরে তার বাবা থাকে। দিনের পর দিন। এবং প্রায় অকারণে। ভাবতে, বহুকাল বাদে বাবার জন্য একটু করুণা বোধ করে সোমেন।
চেয়ারটায় বসতেই টিনের চেয়ারের কনকনে ঠান্ডা শরীরের নানা জায়গায় ছ্যাঁকা দেয়। তবু বসে থাকে সোমেন। একটা সিগারেট ধরায়।
গত এক মাসে বাবাকে দুটো চিঠি দেওয়া হয়েছে। একটারও জবাব পায়নি। বাবা চিঠি দেবে না, এ তাদের জানাই ছিল। কিছু লোক থাকে যারা ঘর-জ্বালানি কিন্তু পর-ভুলানি। নিম্পর লোকেরা নাম শুনলে কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে বলে সাক্ষাৎ দেবতা। অমন পরোপকারী মানুষ হয় না। কিন্তু ঘরের লোক জানে, ওরকম খেয়ালি, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর মানুষ আর নেই। এরকমই একজন ঘরজ্বালানি লোক হচ্ছে বাবা, যাকে বাড়ির লোক বাদে আর সবাই সম্মান করে। পরোপকারী? হবেও বা। বাবার খুব বেশি রহস্য জানা নেই সোমেনের। সে মার কাছে শুনেছে, ভরা যৌবনে স্ত্রীকে রাতে-বিরেতে পাড়াপড়শির ভরসায় ফেলে রেখে বাবা যাত্রা-থিয়েটারে যেত। যাত্রা-থিয়েটারে পার্টও করত না, দেখতেও যেত না। যেত, স্টেজ বাঁধতে যাত্রাদলের সুখসুবিধের ব্যবস্থা করতে। ফুটবল খেলতে না জানলেও গাঁয়ের ম্যাচ-এ বাবা ছিল প্রধান জোগাড়ে মানুষ। গ্রাম দেশে প্রথা আছে, গোলপোস্টের পিছনে একজন কোনও নিষ্কর্মাকে গোলজাজ হিসেবে বসিয়ে দেওয়ার। বাবার কোনও যোগ্যতা ছিল না বলে ‘গোলজাজ’ হত বরাবর। এরকম কোনওখানে কিছু একটা হচ্ছে জানলেই সেখানে ছুটে যেত মহা ব্যস্ততায়, দরকার থাক না থাক, সামান্য যে কোনও দায়িত্ব নিয়ে সাংঘাতিক ডাক হাঁক পাড়ত। পাড়াপড়শিদের ফাইফরমাশ খাটত বিনা দ্বিধায়। আশপাশের বিশ গাঁয়ের লোকের কাছে ব্রজগোপাল ছিল অপরিহার্য লোক। ব্রিজ খেলার কারও পার্টনার না জুটলে ব্রজগোপাল তিনক্রোশ বর্ষার গেঁয়ো রাস্তা ঠেঙিয়ে যেত। খেলতে পারত না তেমন, ভুলভাল ডাক দিত। পার্টনার রাগারাগি করলে অমায়িক হাসত। সবাই জানে, এমন নিরীহ লোক হয় না। কিন্তু বাড়িতে সে লোকের অন্য চেহারা। পুরুষ সিংহ যাকে বলে। সোমেনরা মার কাছে শুনেছে, বারোটা রাতে দেড়সের মাংস আর তিনজন উটকো অতিথি জুটিয়ে এনে মাকে দিয়ে সেই রাতেই রাঁধিয়ে ভোর রাতে খেয়ে বিছানায় গেছে। তিথি-না-মানা অতিথির জ্বালায় মা অতিষ্ঠ, বাড়ির লোকজন জ্বালাতন। সারা যৌবন বয়সটা বাবাকে রোজগার করতে কেউ দেখেনি। দাদুর জমিজিরেত আর সেরেস্তার চাকরির আয়ে সংসার চলত। নেশাভাঙ ছিল না বটে, কিন্তু বাড়ির জিনিসপত্র, এমনকী নিজের বিয়ের শাল, আংটি, ঘড়ি পরকে বিলিয়ে দিতে বাধেনি।
সোমেনরা জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছে বাবা বাড়ি ফিরলেই মার সঙ্গে ঝগড়া লাগে। প্রথম প্রথম সে ঝগড়ার মধ্যে মান-অভিমান ছিল। মানভঞ্জনও তারা লুকিয়ে দেখে হেসে কুটিপাটি হয়েছে। বাবা মার পায়ে মাথা কুটেছে, আর মা খুশিয়ালি মুখে ভয়-পাওয়া-ভাব ফুটিয়ে বলছে, পায়ে হাত দিয়ে আমায় পাপের তলায় ফেলছ, আমি যে কুষ্ঠ হয়ে মরব! কিন্তু ক্রমে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখেছে ঝগড়ার রকম পালটাচ্ছে। তখন দাদু বেঁচে নেই, দেশ ভাগ হয়েছে। অপদার্থ বাবা কোনওখানে জমি দখল করতে পারল না। ভাড়াটে বাড়িতে সংসার পেতেছে। তবু ধাত পালটায়নি। দু-তিনরকমের চাকরি করেছে বাবা সে সময়ে। প্রথমে ভলান্টিয়ার, তারপর রেশনের দোকান, কাপড়ের ব্যাবসা। কোনওটাই সুবিধে হয়নি। তবে প্রচুর লোকের সঙ্গে পরিচয় থাকার সূত্রে, সবশেষে বেশি বয়সে একটা সরকারি কেরানিগিরি জুটিয়ে নেয়। কিন্তু বার-ছুট নেশা ছিল সমান। সোমেন মনে করতে পারে, তারা শিশু বয়সে দেখেছে দিনের পর দিন বাবা বাড়ি নেই। বনগাঁ থেকে কৃষ্ণনগর পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বাবা যেত উদ্বাস্তুদের তদারক করতে কিংবা কোনও মচ্ছবের ব্যবস্থায়, সংকীর্তনের দলে। কোনওটাই কাজের কাজ নয়। বাড়িতে মা আর চারটি শিশু-সন্তান একা। তখন মা আর বাবার ঝগড়ায় মান-অভিমান মরে যেতে লাগল। এল গালাগালি। মা বলত শয়তান, বেইমান, বাবা বলত নিমকহারাম, ছোটলোক। তখন বাবা বাড়িতে না এলেই তারা ভাল থাকে। পরস্পরের প্রতি আক্রোশ দেখে তাদের মনে হত, মা-বাবার এবার মারামারি লাগবে। মারামারি লাগত না। কিন্তু বাবা আরও বারমুখে হয়ে যেতে লাগল। পাঁচজনে বলত, ব্রজগোপালের মতো সচ্চরিত্র লোক হয় না, অমন নিরীহ আর মহৎ দেখা যায় না। সোমেনরাও সেটা অবিশ্বাস করত না। বাইরে লোকটা তাই ছিল। নেশাভাঙ বা মেয়েমানুষের দোষ নেই, ঝগড়া কাজিয়া মেটায়, পাঁচজনের দায়ে-দফায় গিয়ে পড়ে। অমায়িক, মিষ্টভাষী, অক্রোধী। তাকে ভালবাসে না এমন লোক নেই। মা ছিল একটিমাত্র মানুষ যার সংস্পর্শে এলেই বাবার চেহারা যেত পালটে। এবং ভাইস ভার্সা।
বড় হয়ে তারা ভাই-বোনেরা বাবা-মায়ের স্থায়ী ঝগড়াটা মিটিয়ে দেবার অনেক চেষ্টা করেছে। বাবা কিংবা মা আলাদাভাবে কেউই লোক খারাপ ছিল না। দাদা একবার মা-বাবাকে টাকা-পয়সা দিয়ে বুড়ো বয়সে লেট হানিমুন করতে পাঠালে পুরীতে। বিশ্বাস ছিল, সমুদ্রের বিশাল বিস্তারের সামনে, আর তীর্থের গুণে যদি দুজনের মধ্যে একটা টান জন্মায়। কিন্তু মা বাবা খড়্গপুর পার হতে পারেনি। সেখান থেকে ফিরতি ট্রেনে দুই আলাদা কামরায় চড়ে দুজনে ফিরে এল। বাসায় ফিরল আলাদা ট্যাক্সিতে। কথা বন্ধ।
বাবা রিটায়ার করার পর অবস্থা উঠল চরমে। তখন বাবা কিছু বেশি সময় বাসায় থাকত। তখন ঝগড়াটা দাঁড়াল, মা বাবাকে বলত, তুমি মরো, বাবা মাকে বলত—আমি মরলে বুঝবে, দুনিয়াটা হাতের মোয়া নয়। লজ্জার কথা এই, ততদিনে দাদার বউ এসেছে, তাদের ছেলেপুলে হয়েছে। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা, জামাইরা আসাযাওয়া করে। তখন মা-বাবা দুজনেই ছেলেমেয়েদের নিজের নিজের দিকে সাক্ষী মানতে শুরু করেছে। বুড়ো বয়সের স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় সবচেয়ে বড় দরকার হয় সাবালক ছেলেমেয়েদের সমর্থন। মার পাল্লাই ছিল ভারী। বাবা অভিমানে বাড়ি ছাড়ল। বাবার বাড়ি ছাড়াটা তখন নিতান্তই প্রয়োজন।
একথা সত্যি যে, একমাত্র দাদা ছাড়া বাবার প্রতি তাদের আর কোনও ভাইবোনেরই তেমন টান নেই। ছেলেবেলা থেকেই তারা মাকে জানে। বাবার সঙ্গ তারা কদাচিৎ পেয়েছে। কাজেই, বাবা বাড়ি ছাড়ায় কেউ তেমন দুঃখ পায়নি। দাদাও না।
বাবা লোকটা বাউণ্ডুলে হলেও তার একটা খুব বড় শখ ছিল। জমি। দেশ গাঁয়ের লোকের জমির টান থাকেই। বাবার কিছু বেশি ছিল। মার গায়ের কিছু গয়না বেচে বহেরুর হাতে দিয়েছিল সেই দেশ ভাগাভাগির কিছু পরেই। বহেরু মার নামে ছ’বিঘে চাষের জমি কিনেছিল। আর নিজের খামারবাড়ির পাশে একটু বাস্তুজমিও। সেই জমিটা তারের বেড়ায় ঘেরা হয়ে পড়ে আছে। রিটায়ারমেন্টের সময়ে বাবা প্রায়ই ছেলেমেয়েদের এবং মাকেও বলত গোবিন্দপুরে বাড়ি করে সকলে মিলে থাকার কথা। কিন্তু ততদিনে তার ছেলেরা কলকাতার জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছে। কেউ এল না। বাবা গৃহত্যাগ করে এল একা। মাঝে মাঝে যায়। দু’মাসে ছ’মাসে একবার। চিঠিপত্র দেয় মাঝে মাঝে। দাদা কয়েকবার দেখা করে গেছে। কেউ এলে বাবা অভিমান করে রাগ করে বলে—কেন এসেছ? আমি বেশ আছি।
সোমেন জানে, সংসারের প্রতি, পরিবারের প্রতি বাবার কোনও টান আর নেই। তারাও বাবার কথা ভাবে না বড় একটা। আর পাঁচজন নিষ্পর লোকের মতো বাবাও একজন। কোনও টান ভালবাসা, দেখার ইচ্ছে কখনও বোধ করেনি সোমেন। গত পাঁচ-ছ বছরের মধ্যে সে বাবাকে দেখেছে এক-আধবার। বুড়ো মতো, টান-টান চেহারার একজন গ্রাম্য লোক, ঢোলহাতা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরা, সদর থেকে বউদি বা দাদার ছেলেমেয়ে, কিংবা ঝি-চাকরের কাছে বাড়ির লোকের কুশল জিজ্ঞাসা করে চলে যাচ্ছে। ঘরে ঢুকত না, বাড়ির জলটলও খেত না। কিন্তু ফিরে আসবার সময় সিঁড়ি ভাঙত আস্তে আস্তে। দু-একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাত। জোরে গলা খাঁকারি দিত। এ দৃশ্য সোমেন নিজেই দেখেছে। কিন্তু কাচালে বুড়োর সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি।
বলতে কী, বাবার চেহারাটা ভুলেও গেছে সোমেন। দেখা হলে হয়তো চট করে চিনতেই পারবে না। সোমেনের জামার বুকপকেটে বাবাকে লেখা মার একটা ছোট্ট চিরকুট আছে। তাতে লেখা—তোমার কাছে কোনওদিন কিছু চাইনি। আমাকেও কিছু দিলে না তুমি। তোমার ইন্সিওরেন্সের পলিসিটা পেকেছে। আমার ইচ্ছা, ওই দশ হাজার টাকায় এখানে একটু জমি কিনি, আমাকে না দাও, রণেনকে অন্তত দাও। ভাড়া বাড়িতে আর থাকতে ইচ্ছা করে না। ইতি প্রণতা ননী।
বোধ হয় বাবাকে লেখা মার এই প্রথম চিঠি। শেষ বয়সে। খোলা চিঠি, পড়তে কোনও বাধা নেই। আদর ভালবাসার কোনও কথা না থাক, তবু কেমন চমকে উঠতে হয় ‘প্রণতা ননী’ কথাটা দেখে। ‘প্রণতা’ কথাটাকে বড় আন্তরিক বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় সোমেনের। এই চিরকুটটা বাবার হাতে দিতে সোমেনের বড় লজ্জা করবে। আবার একটু ভালও লাগবে। ভাল লাগবে ওই ‘প্রণতা’ টুকুর জন্য। লজ্জা করবে টাকার প্রসঙ্গ আছে বলে। বাবা প্রভিডেন্ড ফান্ডের এক পয়সাও কাউকে দেয়নি। ইন্সিওরেন্সের টাকাটা কি দেবে? দাদাও আপত্তি করেছিল। কিন্তু মা শুনল না। বলল—আমাকে যখন নমিনি’ করেছে তখন ও টাকা আমাদেরই প্রাপ্য, কোনওদিন তো কিছু দেয়নি। প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকাটা বহেরুই পাবে শেষ পর্যন্ত, তোরা বাপেরটা কিচ্ছু পাবি না। বাপের সবকিছু থেকে বঞ্চিত হবে কেন? ও পাগলের কাছ থেকে টাকা নিলেই মঙ্গল। নইলে পাঁচ ভূতে লুটে খাবে।
তাই মার চিঠি নিয়ে আসা সোমেনের।
টেবিলের ওপর কাগজপত্র পড়ে আছে, একটা স্বর্ণসিন্দুর খাওয়ার খল-নুড়ি, একটা দশবাতির ল্যাম্প, কিছু চিঠিপত্র, একটা সস্তা টাইমপিস টক টক বিকট শব্দ করে চলছে। চিঠিপত্রগুলো একটু ঘেঁটে দেখল সোমেন। কলকাতার কয়েকটা নার্সারির চিঠির সঙ্গে তাদের দেওয়া চিঠিও আছে। আর আছে আজেবাজে ক্যাটালগ, ক্যাশমেমো, কয়েকটা একসারসাইজ বুকের পৃষ্ঠায় সাঁটা কিছু গাছের পাতা, পাশে নামগোত্র লেখা। পুরনো মোটা একটা বাঁধানো খাতা। তার পাতা খুলে দেখল, প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা—ডায়েরি। তার পরের পৃষ্ঠায় লেখা—পতিত জমিটায় ভেষজ লাগাইব। তার পরের পৃষ্ঠাগুলিতে পর পর কুলেখাড়া, ঘৃতকুমারী, কালমেঘ ও পুরাতন চালকুমড়ার গুণাগুণ। একটা পৃষ্ঠায় লেখা—‘বুড়োনিমের শিকড় হইতে ন্যাবার ওষুধ হইতে পারে, ফকির সাহেব বলেছেন। তার পরেই লেখা—‘তাণ্ডবস্তোত্র জপ করিলে অ্যাজমা সারে।’ অন্য এক পৃষ্ঠায়—‘ইজরায়েলের এক জ্যোতিষী বলিয়াছেন অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী শাসন করিবে কিছু শুভ্রবসন পরিহিত, দণ্ডধারী যোগীপুরুষ।’
এরকম কথা সর্বত্র। বোঝা যায়, বাবা কৃষি, ডাক্তারি, জ্যোতিষী, অকাল্ট ইত্যাদি সব কিছুরই চর্চা করে। ছেলেমানুষি ডায়েরির কোনও একটা পৃষ্ঠায় চিঠিটা গুঁজে রাখবে বলে শেষদিকের পাতা ওলটাতেই সোমেন দেখে একটা প্রায় সাদা পৃষ্ঠা। ঠিক তার মাঝখানে গোটা অক্ষরে লেখা—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
খাতাটা বন্ধ করে চুপ করে ভাবে একটু। ঘরভরতি একটি আবছায়ার চৌখুপি। সোঁদা গন্ধ। হঠাৎ ওই গন্ধ আর ওই অন্ধকারটা সোমেনকে চেপে ধরতে থাকে। দমফোট লাগে তার।
বাইরের রোদে এসে সে বুকভরে শ্বাস নেয়। কী সবুজ, কী ধারাল রং প্রকৃতির। কী নিস্তব্ধতা। দিগম্বরের খোলের আওয়াজ এখন আর নেই। দূরে পাম্পসেটটা অবিরল চলেছে।
এইখানে মানুষেরা বেশ আছে। মটর শাকের ক্ষেত পার হতে হতে এই বোধ লাভ করে সোমেন। বড় বড় শুঁটি ঝুলে আছে। একটা-দুটো তুলে দানা বের করে মুখে দেয় সে। মিষ্টি। ভুরভুরে বেলেমাটির একটা ক্ষেত তছনছ হয়ে আছে। আলু ছিল বোধ হয়, উঠে গেছে। মাচানের পর মাচান চলেছে, ধুঁদুল, সিম, বিন! যেন বা কেউ শালিমারের সবুজ এনামেল রঙে গাঢ় পোঁচ দিয়ে গেছে চারধারে। হাতের মুঠোয় ধরা যায় না, বিশাল বড় গাঁদা ফুল জঙ্গলের মতো একটা জায়গাকে গাঢ় হলুদ করে রেখেছে।
মহানিমের তলায় বসে আছে দিগম্বর। গাছের গুঁড়িতে ঠেস। মাথা বুকের দিকে ঝুলে পড়েছে। ঘুম। পাশে বশংবদ খোল। রঙিন সুতোর জাল দিয়ে খোলের গায়ে জামা পরানো হয়েছে। লাল-সাদা পুঁতির গয়না খোলের গায়ে। কয়েকটা গাঁদা ফুল গোঁজা আছে। দিগম্বরের নত মুখ থেকে সুতোর মতো লালা ঝুলে আছে।
শীতের মিঠে রোদ পড়ে আছে গায়ে। ঘুম থেকে উঠে আবার বাজাবে। ঘুঘু তাড়া ঘুঘু তাড়া, ঘুঘু তাড়া।
আমের বোল এসে গেছে। পোকামাকড় ঝেঁপে ধরেছে গাছটাকে। ঝনঝন শব্দ বাজছে। একটা দোচালার নীচে একপাল বাচ্চা বসেছে বইখাতা শেলেট নিয়ে। বুড়োমতো একজন পড়াচ্ছে। পোড়োরা তাকে ছোট ছোট বেলের মতো মাথা ঘুরিয়ে দেখল। সোমেন জায়গাটা পার হয়ে আসে। কুলগাছের তলায় দুটো সাঁওতাল মেয়ে বসে আছে। জায়গাটায় ম ম করছে পাকা কুলের গন্ধ। একটা মেয়ে মুখ থেকে একটা সাদা বিচি ফুড়ুক করে ছুঁড়ে দিল, আর একটা কুল মুখে পুরল। বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষের মেজো মেয়েটাকে কাল রাতে একঝলক দেখেছিল। তখন গায়ে ছিল একটা খদ্দরের চাদর। গোলপানা মুখ, শ্যামলা রং, বেশ লম্বা, এছাড়া বেশি কিছু বোঝা যায়নি। সৌন্দর্য ছিল তার চোখে। বিশাল চোখ, মণিদুটো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত অনেক সময় নিয়ে ঢলে পড়ে। দশবাতির আলোয় চোখ থেকে এক কণা আগুন ঠিকরে এসেছিল সোমেনের হৃৎপিণ্ডে। সেই মেয়েটিকে এই সকালের রোদে আবার দেখা গেল। গায়ে চাদর নেই। সতেজ লাউডগার মতো লম্বাটে শরীর। একটা ঝুড়ি বয়ে এনে উপুড় করে দিল সাঁওতাল মেয়েদুটোর একটার কোঁচড়ে।
সোমেন দেখল, মরা ইঁদুর।
মেয়েদের একজন সন্দিহান চোখ তুলে বলে—বিষ দিয়ে মারোনি তো দিদি?
মেয়েটি কপালের চুলের গুছি সরিয়ে অবহেলা আর অহংকারভরে বলল—বিষ দিয়ে মারব কেন? আছড়ে আছড়ে মেরেছি।
এই কথা বলে সে চোখ তুলে সোমেনকে লক্ষ করে। কিন্তু তেমন ভ্রূক্ষেপ করে না। বহেরুর খামারবাড়িতে সর্বত্র ভিটামিনের কাজ দেখতে পায় সোমেন। লাউডগার মতো ওই মেয়েটির অস্তিত্বের ভিটামিনও কিছু কম নয়। এ যে বহেরুর মেয়ে তা একনজরেই বোঝা যায়। চোখা নাক, দুরন্ত ঠোঁট, আর চোখ দুটোতে নিষ্ঠুরতা। জ্যান্ত ইঁদুর হাতে ধরে আছড়ে মারা ওর পক্ষে তেমন শক্ত নয়।
সাঁওতাল মেয়েদুটো উঠে দাঁড়িয়েছিল। লম্বাজনের পেট-কেঁচড়ে ইঁদুরের স্তূপ। সোমেন কয়েকপা গিয়ে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল—খাবে?
অবাক চোখে অচেনা লোকের দিয়ে চায় মেয়েটি। ঘাড় নাড়ল। খাবে।
—কীভাবে খাও? পুড়িয়ে?
সাঁওতাল বলতে যেমন সুঠাম শরীর বোঝায় এ মেয়েটির তা নয়। একটু ঢিলে শরীর, বহু সন্তান ধারণের চিহ্ন, বয়সের মেচেতা, আর ধুলোময়লা-বসা ম্লানভাব। প্রশ্ন শুনে দুধ-সাদা দাঁত দেখিয়ে হাসে। বলে—আগে পুড়িয়ে নিই, তারপর কেটেকুটে রাঁধি, যেমন সবাই রাঁধে।
দাঁড়াল না। বহেরুর বাগান এখানে শেষ, ঢালু একটা পায়ে-হাঁটা-পথ মাঠে নেমে গেছে। সেইদিকে নেমে গেল দুজন। সোমেন মুখ ফিরিয়ে বহেরুর মেয়েকে দেখল। দাঁড়িয়ে আছে এখনও। ব্লাউজের হাতা ফেটে হাতের স্বাস্থ্য ফুটে আছে, ডগবগে শরীরে আঁট করে শাড়ি জড়িয়েছে বলে ধারাল শরীর ছোবল তুলে আছে। পিছনে একটি কামিনী ঝোপের চালচিত্র, পায়ের কাছে কলাবতী ফুলের গাছ।
॥ দুই ॥
বহেরুর চার-পাঁচটা মেয়ের সব কজনারই বিয়ে হয়ে গেছে। তার মধ্যে দুজন স্বামীর ঘর করে, একজনের বর ঘরজামাই, আর দুটো মেয়েকে তাদের স্বামী নেয় না। এ সবই সোমেন জানে। এ মেয়েটা ফেরতদের একজন, বিন্দু। বহেরুর কাছ থেকে ধানের দাম বুঝে নিতে কয়েকবার এসেছে সোমেন। তখন এইসব মেয়েরা ছোট ছিল। ধুলোময়লা মাখা গেঁয়ো গরিব চেহারা। ভিটামিনের প্রভাবে লকলকিয়ে উঠেছে। সিঁথিতে সিঁদুর আছে এখনও। বাকি সিঁদুর, অস্পষ্ট।
মেয়েটা সোমেনকে দেখে একটু ইতস্তত করে। সর্দি হয়েছে বোধ হয়, বাঁ হাতে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা কালোজিরের পুঁটুলি। সেটা তুলে বারকয় শুঁকল। অন্যদিকে চেয়ে বলে— আপনার চা হচ্ছে। ঘরে দিয়ে আসব?
—চা?
—খাবেন না? আপনার জন্যই হচ্ছে।
—দিতে পারো।
—অতদূর নিয়ে যেতে ঠান্ডা মেরে যাবে। আমাদের ঘরে আসুন না, বসবেন।
সোমেন মাথা নাড়ে। একা ঘরে মন টেকে না। এদের ঘরে দু-দণ্ড বসা যেতে পারে। আগেও এসেছে সোমেন, গন্ধ বিশ্বেসের কাছে কত গল্প শুনেছে বসে। বহুকাল আর আসা নেই বলে একটু নতুন নতুন লাগে। বহেরুর তখন এত জ্ঞাতিগুষ্টি ছিল না। একা-বোকা হেলে-চাষা গোছের ছিল তখন। এখন তার উন্নতির সংবাদ ছড়িয়ে গেছে চারধারে। নিষ্কর্মা, ভবঘুরে আত্মীয়রা এসে জুটেছে। সংসার বেড়ে গেছে অনেক। বহেরুও বোধ হয় তাই চায়। ভবিষ্যতের বহেরু গাঁয়ে থাকবে তারই রক্তের মানুষ সব।
পুরো চত্বরটাই বহেরুর বসত, তবু তার মধ্যেও ঘের-বেড়া দিয়ে আলাদা আলাদা বাড়ির মতো বন্দোবস্ত। কামিনী ঝোপটা ডান হাতে ফেলে ধান-সেদ্ধ-করার গন্ধে ভরা একখানা উঠোনে চলে আসে সোমেন, মেয়েটির পিছু পিছু। জিজ্ঞেস করে—গন্ধ বিশ্বেস নেই?
মেয়েটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, চোখ ছোট করে বলে—থাকে। তবে পাগলমানুষ।
—কোথায় সে? তার কাছে কত গল্প শুনেছি!
মেয়েটা হাসে—এখনও গল্প বলে। সব আগডুম বাগডুম গল্প। ওই বসে আছে।
হাত তুলে বড় উঠোনের একটা প্রান্ত দেখিয়ে দিল।
কটকটে রোদে সাদা মাটির উঠোনটা ঝলসাচ্ছে। চাটাই পাতা, ধান শুকোচ্ছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। তারই একপ্রান্তে বসে আছে বুড়ো-সুড়ো এক মানুষ। বহেরু গাঁয়ে মানুষের আয়ুর যেন শেষ নেই। গন্ধ বিশ্বেস মরে গেছে বুঝি। যখন দাদা বা বাবার সঙ্গে এক-আধদিনের জন্য আসত সোমেন তখন সে হাফপ্যান্ট পরে, গন্ধ বিশ্বেস তখনই ছিল বুড়ো। এক সময়ে ডাকাবুকো শিকারি ছিল, সাহেবদের সঙ্গে বনে-জঙ্গলে ঘুরেছে কম নয়। গারো পাহাড়, সিলেট, চাটগাঁ—কত জায়গায় ঘুরে ঘুরে ব্যাবসা করেছে। সে সব জায়গার গল্প করত সোমেনের কাছে। উসকে দেওয়ার দরকার হত না, নিজে থেকেই বলত। কবেকার কথা সব। সোমেনের মনে হত, বুঝি বা ইতিহাসের পাতা থেকে খসে পড়েছে গন্ধ। এখনও সেই লোকটা বসে কাক শালিক তাড়িয়ে ধান বাঁচাচ্ছে। হাতে একটা তলতা বাঁশের লগি। আশপাশে গোটা চোদ্দো-পনেরো সাদা সাদা বেড়াল তুলোর পুঁটলির মতো পড়ে রোদ পোয়াচ্ছে। তিন-চারটে দিশি কুকুরও রয়েছে বেড়ালদের গা ঘেঁষে বসে। পাশে একটা শূন্য কলাই-করা বাটি। মুড়ি খেয়েছিল বোধ হয়।
নাম গন্ধ, পদবি বিশ্বাস। কিন্তু সবাই বরাবর ডেকে এসেছে ‘গন্ধ বিশ্বেস’ বলে, যেন বা নামটা ওর পদবিরই অঙ্গ। শোনা যায়, বুড়ো বয়সে একটা ছুঁড়িকে বিয়ে করে এনেছিল! সে গন্ধর সঙ্গে থাকতে চাইত না। কারণ, গন্ধর বিছানায় বিড়ালের মুত, কুকুরের লোম, বালিশে নাল শুকিয়ে দুর্গন্ধ। কিন্তু বউয়ের মনস্তুষ্টির জন্য কিছু ছাড়ান-কাটান দেবে, এমন মানুষ গন্ধ নয়। বউ তাই এক রাতে সরাসরি গিয়ে দেওর বহেরুর দরজায় ধাক্কা দিল—শুতে দাও দিকিনি বাপু। না ঘুমিয়ে গতর কালি হয়ে গেল। সেই থেকে সে হয়ে গেল বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ।
ঝগড়া-কাজিয়া তেমন কিছু হয়নি। বেড়াল-অন্ত প্রাণ গন্ধ, কুকুর তার ভারী আদরের। বউ তাদের বেশি কিছু নয়। বিয়ে করলেই আবার একটা বউ হয়। কিন্তু গন্ধ বখেরায় যায়নি। একই সংসারে একটু আলাদা হয়ে থেকে গেছে। সেই বউ-ই এখনও ভাত বেড়ে দেয়, বাতের ব্যথায় রসুন-তেল গরম করে দেয়, বকাঝকাও করে। ওদিকে বহেরুর সন্তান ধারণ করে। কিন্তু সিঁদুর পরে গন্ধর নামে।
এরকম যে একটা গোলমেলে সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে গন্ধ, তাকে দেখলে মনে হয় না। বৈরাগীর মতো বসে আছে। মুখময় বিজবিজে দাড়ি। ছানি কাটা হয়নি, দু-চোখে স্পষ্ট মুসুরির ডালের মতো ছানি দুটো দেখা যায়। শীতে কাহিল হয়ে একটা কাঁথা জড়িয়ে বসে, গায়ে বহু পুরনো মিলিটারি পুলওভার, নিম্নাঙ্গে ময়লা ধুতি। ধুতিতে ঢাকা আছে ফুটবলের সাইজের হাইড্রোসিল। চলাফেরায় ভারী কষ্ট তার। এই নিয়ে কত হাসাহাসি করেছে সোমেন।
সামনে সামনে বসতেই বেড়ালগুলো মিটমিটে চোখে একটু চেয়েই চোখের ফসফরাস ঢেকে ফেলল। কুকুরগুলো একটু গর-র শব্দ করে শুয়ে-শুয়েই লেজ নাড়ে।
—গন্ধ, চিনতে পারো?
গন্ধ স্থবিরতা থেকে একটু জাগে। রোদ থেকে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে বলে—কিছু দেখি না।
—আমি সোমেন, ব্ৰজকর্তার ছেলে।
—বড়জন?
—না। ছোট।
হাসে গন্ধ। বুঝদারের হাসি। হাত তুলে একটা মাপ দেখিয়ে বলে—এইটুকুন ছিলেন। আসেন না তো! বাপের জন্য প্রাণ টানে না?
—কলকাতা ছেড়ে আসা হয় না।
একটা শ্বাস ছাড়ে গন্ধ, বলে—সবাই তাই কয়।
—কী কয়?
—কলকাতা ছেড়ে আসা যায় না। সিগারেট নাই?
—আছে। খাবে?
—খাই।
হাত বাড়ায় গন্ধ। সোমেন সিগারেট দেয়। দন্তহীন মুখে সিগারেট বসিয়ে বড় আগ্রহে টানে গন্ধ। কাশে।
—কাশছ তো, খেয়ো না। সোমেন বলে।
হাঁপির টান তুলে কাশে গন্ধ, চোখে জল এসে যায়। হাতের উলটো পিঠে চোখের জল মুছে বলে—যত কষ্ট তত আরাম। এ কাশি আরামের। কতকাল খাই না কেউ দেয় না।
সিগারেটের গোড়া লালায় ভিজে গেছে। থুঃ করে জিভ থেকে তামাকের আঁশ ছিটিয়ে গন্ধ চোখ বুজে টানে। ঝপাস করে ধানের ওপর নেমে আসে কাক। গন্ধ হাত তুলে তাড়ায়—হেঃ ই।
—কেমন আছ গন্ধ?
—ভালই। বহেরু কষ্ট দেয় না।
—চোখটা কাটাও না কেন?
—দেখার কিছু নাই। কাটায়ে হবেটা কী? হাতায়ে হাতায়ে সব বুঝতে পারি। বেলাও ঠাহর পাই ধুয়া ধুয়া। খামোখা কাটায়ে হবেটা কী? খরচ।
—বিনা পয়সায়ও কাটে। সোমেন বলে—ক্যাম্প করে কাটে।
—ঝাঞ্ঝাট।
সিগারেটে প্রাণভরে টান মারে গন্ধ। কাশে। বড় আরাম পায়। সামলে নিয়ে বলে—বহেরুর খুব বাড়বাড়ন্ত দেখলেন সব?
—হুঁ।
—হাতের গুণ। গাছ ওরে ভালবাসে। আমারে ভালবাসে কুত্তা বিড়াল।
বহেরুর মেয়ে বিন্দু পেয়ালা-পিরিচে চা নিয়ে আসে। পিরিচে চা চলকে পড়েছিল, সেটুকু ঢেলে ফেলে দিয়ে পেয়ালা বসিয়ে যত্নে চা দিল। দুটো বিস্কুট।
শব্দে ঠাহর পেয়ে গন্ধ চেয়ে বলে, বিন্দু নাকি? কী দিলি ব্রজকর্তার ছেলেরে? চা?
—কেন? তুমি খাবা?
—খাই।
—দেব।
—ব্রজকর্তার ছেলেরে একটু রস খাওয়াবি না?
—ও রস তো শীতে হিম হয়ে আছে, খেলে ঠান্ডা লাগবে না!
—একটু আমারে দে।
—দেবো।
বলে বিন্দু চলে যায়। আর আসে না।
সোমেনের চা যখন শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, তখন গন্ধ বলে, তলানি থাকলে একটু দিবেন।
—এঁটো খাবে?
—সব খাই।
সংকোচের সঙ্গে কাপটা একটু চা সুদ্ধ এগিয়ে দেয় সোমেন। বড় শীত। গন্ধ কাপটা গালে চেপে ধরে তাপটা নেয়। আস্তে আস্তে টুকে টুকে খায়। বলে—বহেরু কষ্ট দেয় না। এরা দেয়। মাগিগুলি বজ্জাত। সব মাগি বজ্জাত। দেবে বলে কিছু দেয় না। উপোস থাকি।
বলে নিবিষ্ট মনে চা খায় গন্ধ। অল্প একটু তলানি, টপ করে ফুরিয়ে যায়। গন্ধ আঙুল দিয়ে কাপের তলার তলানির চিনি খোঁজে। গাঁ ঘরের চা, চিনি একটু বেশিই দেয় ওরা। সবটা গলে না। গন্ধ আঙুলের ডগায় ভেজা চিনি তুলে এনে আঙুল চোষে। একটা বেড়াল নির্দ্বিধায় তার কোলে উঠে আসে, কাপটা শোঁকে। মুখ থেকে আঙুলটা বের করে বেড়ালের মুখে ধরে গন্ধ। বেড়ালটা দু-একবার চাটন দেয়। তারপর নির্জীব হয়ে কোলেই বসে ঘুমোয়।
—ব্রজকর্তার খোঁজে আলেন নাকি?
—হ্যাঁ। কিন্তু বাবা তো নেই।
গন্ধ চুপ করে থাকে একটু। মাঝে মাঝে মাথাটা বোধ হয় ঝিম মেরে যায়। ধানের ওপর শালিখের হুড়াহুড়ি শুনে হাত বাড়িয়ে লগিটা নেয়। বলে—হেঃ ই।
তারপর বলে—আসে যাবেন যে-কোনও দিন। ব্ৰজকর্তার পায়ের নীচে সুপারি, আছেন ক’দিন?
—আজই চলে যাব। বাড়িতে ভাববে।
—বহেরুর কাণ্ডকারখানা দেখে যাবেন না? কত জমি জোত, ধান-পান, বিশ-তিরিশ মুনিশ খাটে। বহুত পয়সা বহেরুর।
—জানি।
গন্ধ হাত বাড়িয়ে বলে—দেন একটা।
—কী?
গন্ধ হাসে, চোখ ছোট করে বলে—সাদা কাঠি।
সোমেন বুঝতে পেরে একটা সিগারেট দেয়।
গন্ধ সিগারেটটা নাকের কাছে নিয়ে কাঁচা সিগারেটের গন্ধ নেয়। হাত বাড়িয়ে বলে—দেশলাইটা রেখে যান, পরে খাব।
সোমেন দেশলাই দিয়ে দেয়। খালি কাপটা নিয়ে বেড়ালের খেলা শুরু হয়ে গেছে। শক্ত ঝুনো উঠোনে টঙাস করে কাপটা ঢলে পড়ে। গন্ধ মুখ তুলে বলে—ব্রজকর্তারে বুঝয়ে-সুঝায়ে নিয়ে যান বাড়ি। বুড়ো বয়সে কখন কী হয়।
সোমেন চুপ করে থাকে। মনে পড়ে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
গন্ধ নিচু গলায় বলে—এখানে সব শালা পাজি। বহেরু ভাল। কষ্ট দিতে চায় না। কিন্তু মাগিগুলো—এগারো হাতে কাছা নাই যার—ওই গুলান খচ্চর।
—কত গল্প শোনাতে গন্ধ, সব ভুলে গেছ?
—গল্প?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, পরস্তাব।
গন্ধ ফোকলা মুখে হাসে হঠাৎ।
—মনে থাকে না কিছু।
মানুষের বুড়ো বয়সের কথা ভেবে ভারী একটু দুঃখ হয় সোমেনের। তার বাপ দাদা গন্ধ বিশ্বেসের কাঁধে চড়েছে। সেই আমান মানুষটা কেমন লাতন হয়ে বসে গেছে এখন।
—যাই গন্ধ। বলে সোমেন ওঠে।
পুবের মাঠ রবিশস্যের চাষ পড়ে গেছে। সেই চৈতি ফসলের জমি চৌরস করছে বহেরুর লোকজন। দিগম্বরের খোলের শব্দ ওঠে হঠাৎ। পৃথিবীকে আনন্দিত করে বয়ে যেতে থাকে শব্দ। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায় রোদের চিকরি-মিকরি। বুনো গন্ধ, মাটির সুবাস।
বেলায় বিন্দু এল তার রান্নার জোগাড় নিয়ে। ঘরের পাশেই বাবার ছোট্ট পাকশাল। কাঠের জ্বালে রান্না হয়। স্তূপ করে কাটা আছে কাঠ, পাঁকাঠি। কাঠের জ্বালে অনভ্যস্ত রান্না রাঁধতে কাল তার চোখ জ্বলে ফুলে গিয়েছিল। বিন্দুকে বলল—আজ তুমিই বেঁধে দিয়ে যাও। আমার ইচ্ছে করছে না।
বিন্দু চোখ বড় করে বলে—আমি রাঁধব? কাকা তা হলে কেটে ফেলবে।
—কাকা? কাকা আবার কে?
বিন্দু মাথাটি নামিয়ে প্যাঁকাটির আগুনে কাঠের জাল তুলতে তুলতে বলে—কে আবার! বহেরু বিশ্বেস।
ভারী অবাক হয় সোমেন। বহেরু ওর কাকা হয় কী করে? সবাই জানে, বিন্দুর মা বহেরুর দ্বিতীয় পক্ষ। বিন্দুও কি জানে না যে ওই বুড়ো, অক্ষম গন্ধ বিশ্বেসের বিকৃত অঙ্গ থেকে ও জন্মায়নি?
বিন্দু মুখ তুলে বলে—চাল ধুয়ে দিয়েছি, তরকারি মাছ সব কোটা আছে, মশলা বেটে দিয়েছি, আমি সব দেখিয়ে দেব, বেঁধেবেড়ে নিন।
—কলকাতায় হোটেলে রেস্টুরেন্টে আমরা বারো জাতের ছোঁয়া খাই।
—সে কলকাতায়। এখানে নয়।
অগত্যা উঠতে হয় সোমেনকে।
গনগনিয়ে আঁচ ওঠে। বড় তাপ, ধোঁয়া। বিন্দু এটা-ওটা এগিয়ে দেয়, উপদেশ দেয়, হাসেও। এত কাছাকাছি এমন ডগবগে মেয়ে থাকলে কোন পুরুষের না শরীর আনচান করে! সোমেনের কিন্তু—আশ্চর্যের বিষয়—করল না। বরং সে কেমন নিবু নিবু বোধ করে মেয়েটার সামনে। কেন যে! সে কি ওই প্রচণ্ড শরীর, প্রচুর ভিটামিন, প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ক্লোরোফিলে ভরা অতিরিক্ত উগ্রতার জন্য? হতে পারে। অত যৌবন সোমেনের সহ্য হয় না। ওই উগ্র শরীরের সঙ্গে টোক্কর দেওয়ার মতো ভিটামিন তার নেই। মেয়েটা কিন্তু টোক্কর দিতেই চায়। ছলবল করে কাছে আসে, যেন বা ছুঁয়ে দেবে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ফুলকপিটা আরও সাঁতলান, নইলে স্বাদ হবে না। তার শ্বাস সোমেনের ঘাড়ে লাগে। সোমের সরে বসে, মেয়েটা অমনি জিভ কেটে বলে—ছুঁয়ে দিচ্ছিলাম আর কী! তারপর হাসে। সোমেন নপুংসকের মতো ভীত বোধ করে মেয়েটির কাছে। বহেরুকে ও কাকা ডাকে কেন তা কিছুতেই ভেবে পায় না। গা-টা একটু ঘিন ঘিন করে তার।
নিজের ভিতরে ভিটামিনের বা প্রোটিনের, বা ওইরকম একটা কিছুর অভাব সে চিরকাল বোধ করে এসেছে। বহেরুর খামারবাড়িতে এই যৌবন বয়সে সেটা তার কাছে আর একটু স্পষ্ট হয়।
সোমেন একটু আলগোছে, সতর্কভাবে জিজ্ঞেস করে—শ্বশুরবাড়ি কতদূর?
মেয়েটার মুখভাব পালটায় না, হাসিখুশি ভাবটা বজায় রেখেই বলে—কাছেই। বর্ধমান।
—যাও-টাও না?
—না।
—কেন?
—বনে না।
সোমেনের আর কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না।
মেয়েটা নিজে থেকেই আবার বলে—আমারই দোষ কিন্তু। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ননদ দেওর কেউ খারাপ না।
—তবে?
—যে-মানুষটাকে নয়ে শ্বশুরবাড়ি সেই লোকটাকেই আমার পছন্দ নয়। এমনি মানুষটা মন্দ না, দেহতত্ত্বটত্ত্ব গেয়ে বেড়ায়, এক বোষ্টমের কাছে নাম নিয়েছে। নিরীহ মানুষ। তবে তার কোনও সাধ আহ্লাদ নেই। মেড়া। সে আমার পা চাটত, এমন বাধুক ছিল।
—তবে?
—সেই জন্যই তো বনে না। আমি লাঠেল মানুষ পছন্দ করি।
সাদা দাঁতে চূড়ান্ত একটা অর্থপূর্ণ হাসি হাসল। সোমেন ভিতরে ভিতরে আরও মিইয়ে যায়।
—সে কীরকম? সোমেন জিজ্ঞেস করে।
—ধামসানো আদর সোহাগ যেমন করবে, তেমনি আবার দরকার মতো চুলের মুঠ ধরবে।
বাঁ হাতের কালোজিরের পুঁটলিটা নাকের কাছে ধরে শ্বাস টানে বিন্দু। চোখে চোখ রাখে। সোমেন চোখটা সরিয়ে নেয়। মেয়েটা পুরুষচাটা। বুকের ভিতরটা গুর গুর করে ওঠে সোমেনের, অস্বস্তি লাগে। একবার ভেবেছিল, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল ফিরে যাবে কলকাতায়। বাবার সঙ্গে যদি দেখাটা হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েটাকে তার ভাল লাগছে না। রাতবিরেতে এসে যদি ঠেলে তোলে! কিছু বিচিত্র নয়। বহেরুর মেয়ে, নিজের পছন্দমতো জিনিস দখল পেতেই শিখে থাকবে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে সোমেন, আজ রাতেই ফিরবে। আটটার কিছু পরে বোধ হয় একটা শনিবারের স্পেশাল ট্রেন যায় হাওড়ায়। বিকেল পর্যন্ত বাবার জন্য দেখে ওই ট্রেনটা ধরতে সুবিধে।
ভিটামিনের অভাব তাকে কতটা ভিতু করেছে তা ভাবতে ভাবতে নেয়েখেয়ে দুপুরে ঘুমলো সোমেন।
বিকেলে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিল, পোষা বেজি কাঁধে বহেরু এল সে সময়ে। বলল—চলে যাবেন?
—হ্যাঁ।
—একটা কথা বলি।
—কী?
—ব্রজকর্তা এখানে থাকে থাক। অযত্ন হবে না। এখানে বামুন মানুষ নেই। ব্রজকর্তাকে তাই ছাড়তে চাই না। আরামেই আছে। সোমেন উত্তর দিল না। উত্তর জানা নেই।
একগোছা টাকা হাতে ধরিয়ে দিল বহেরু। বলল—কোমরে আন্ডারপ্যান্টে গুঁজে নেবেন। ঠাকরুনকে বলবেন এবার ধানের দর ভাল। আপনি না এলে মানি-অর্ডার করে দিতাম। আজ কী কাল।
তিন-চাররকমের ডাল, কিছু আনাজপত্র, এক বোতল ঘানির তেল—এই সব গুছিয়ে দিয়ে যায় বিন্দু। বহেরুর লোক স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বড় একটা চটের থলিতে ভরে দিয়েছে। বেশ ভারী, তবু বোধ হয় বওয়া যায়। হাত তুলে থলির ওজনটা পরখ করছিল সোমেন, বিন্দু হেসে আঁচল চাপা দেয় মুখে। মেয়েটার সাহস বেড়েছে। বলল—খুব মরদ।
সোমেন বোকা বনে যায় একটু। মনে পাপ। ইচ্ছে হল, থেকে গেলেও হত আজ রাতে। সে এখনও তেমন করে মেয়েমানুষের গা ঘেঁয়নি।
পরক্ষণেই ভাবে, সে ধরেই নিচ্ছে কেন যে বিন্দু তার সঙ্গে আজ রাতেই একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে চায়?
চা খেয়ে সে গেল বিন্দুর সঙ্গে ময়ুরের ঘর দেখতে। বহেরুর বড় শখ, একটা চিড়িয়াখানা করে তার বহেরু গাঁয়ে। আপাতত গোটাকয় পাখি, একটা ময়ূর, দুটো হনুমান নিয়ে ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। পরে আরও হবে। উত্তরের সবজিক্ষেতের শেষে বহেরুর সেই সাধের চিড়িয়াখানা। জালে ঘেরা ঘর, উপরে অ্যাসবেস্টাসের ছাউনি। কিছু দেখার নেই। ময়ূর ঝিমোচ্ছে, হনুমান দুটো বিরক্ত। বিচিত্র কয়েকটা পাখি ঠোঁটে নখে নিরর্থক জাল কাটার চেষ্টা করছে। দু’মিনিটেই দেখা হয়ে যায়।
বিন্দু চিড়িয়াখানার পিছনে একটা মখমলের মতো ঘাসজমি দেখিয়ে বলল—মন খারাপ হলে আমি এইখানে এসে বসে থাকি। ভারী নিরিবিলি জায়গা। কেউ টেরই পায় না।
জায়গাটায় দু-চার পা হাঁটে দুজনে। সোমেন ভাবে, প্রেমের মূলেও আছে ভিটামিন। এই ডগবগে মেয়েটার কাছে এখন ইচ্ছে করলেই প্রেম নিবেদন করা যায়। মেয়েটাও মুখিয়ে আছে। অবশ্য এখানে প্রেম বলতে শরীর ছাড়া কী! মেয়েটাও কথার প্রেম বুঝবার মতো মানুষ নয়। কিন্তু ভিটামিনের অভাবে সোমেন শরীরে জ্বর বোধ করে, ভয় পায়, নিজেকে অভিশাপ দেয়।
হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বিন্দুর মুখের দিকে চায়। মাথার চুলে অ্যামিনো অ্যাসিডের কাজ। ঘন গহীন চুলে সূক্ষ্ম সিঁথি। মেটে সিঁদুরটুকু ঠিক আছে। গায়ে খদ্দরের হলুদ চাদর, পায়ে হাওয়াই। মুখের গোলভাবটুকুর মধ্যে বেড়ালের কমনীয়তা, এবং বেড়ালেরই হিংস্রতা ফুটে আছে। খর চোখ। সোমেন বলতে যাচ্ছিল—ধরো বিন্দু, যদি আজকের দিনটা থেকেই যাই!
বিন্দু দূরের দিকে অকারণ তাকায় মাঝে মাঝে। এখনও তাকিয়ে ছিল। সোমেন কিছু বলার আগেই তার দিকে চেয়ে বিন্দু বলল—ব্রজকর্তা আসছে।
—কই? ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করে সোমেন। টালিগঞ্জের জমিটা তাদের দরকার। বড্ড দরকার।
—ওই যে, মাঠের মাঝ দিয়ে আসছে।
॥ তিন ॥
বিন্দুবৎ একটা মানুষ বহেরুর চৈতালি ফসলের ক্ষেত ধরে আসছে। কাছে এলে তার মন্থরগতি এবং ক্লান্তি বোঝা যায়। কালচে জমি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তাতে রঙিন আলো, একটু কুয়াশার ভাপ জমে ঝুলে আছে মাথার ওপরে। একটা বিস্তৃতি পিছনে ফেলে আসছে বলেই লোকটাকে ছোট দেখায়। গায়ে র্যাপার, ধুতি, হাতে একটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ। গেঁয়ো হাটুরে মানুষ একটা। বাবা বলে মনে করতে কষ্ট হয়।
সোমেন বলল—তোমার চোখ সাংঘাতিক! এতদূর থেকে চিনলে কী করে?
—চিনব না কেন! নিজেদের লোক। ওঁর চলন-বলন সবই চেনা।
সোমেনের ভিতরে একটা ছ্যাঁকা লাগে। নিজেদের লোক। তবু, ঠিক কথাই, বাবা আর তাদের লোক তো নয়।
একটু সময় নিয়ে মাঠ পার হয়ে আসেন ব্রজগোপাল। খামারে ঢোকার রাস্তা কিছু উত্তরে। সেই দিকে আড়ালে পড়ে যান।
বিন্দু মুখ ফিরিয়ে বলে—যাই, খবর দিই গে।
বিন্দু চলে যাওয়ার পরও ঘাসজমিটায় কিছুক্ষণ একা একা সিগারেট টানে সোমেন। বাবা জামাকাপড় বদলে স্থিতু হোক, তারপর দেখা করবে। আসলে, তার একটু লজ্জাও করছে। গত কয়েক বছর তারা চিঠিপত্র ছাড়া বাবার খবর নিতে কেউ আগ্রহ বোধ করেনি। বাবাই বরং কয়েকবার গেছে। এতকাল পরে সোমেন এসেছে বটে, কিন্তু সেও খবর নিতে নয়, স্বার্থসিদ্ধি করতে। টালিগঞ্জের জমির প্লটটার সমস্যা দেখা না দিলে সে কোনওদিনই এখানে আর আসত না বোধ হয়।
সিগারেট শেষ করে আস্তে ধীরে ঘরে আসতে আসতে শীতের বেলা ফুরিয়ে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, ব্রজগোপাল মেঝেয় উবু হয়ে বসে ল্যাম্প জ্বালাচ্ছেন।
শব্দ পেয়ে ঘাড়টা ঘোরালেন। জ্বলন্ত ল্যাম্পটা রাখলেন টেবিলের উপর। বললেন—এস।
বাবার চেহারাটা বোধ হয় আগের মতোই আছে। মুখে চোখে একটা মেদহীন রুক্ষ ভাব। গালে কয়েকদিনের দাড়ি। গায়ের চামড়া রোদে পোড়া, তাম্রাভ। শীতটা চেপে পড়েছে বলে এর মধ্যেই মাথা কান ঢেকে একটা খয়েরি কম্ফার্টার জড়িয়ে নিয়েছেন। সোমেনের চেয়ে বাবা লম্বায় কিছু খাটো। সোমেন একটা প্রণাম করল।
—শরীর-টরীর ভাল? জিজ্ঞেস করে সোমেন। লজ্জা করে।
—আছে একরকম—প্রেসারটা একটু উৎপাত করে। বাড়ির সবাই কেমন আছে?
—আছে ভালই।
যেন বা দুই পরিচিত লোকের কথাবার্তা। মাঝখানে একটু দূরত্ব কাঁটা ঝোপের বেড়ার মতো।
—আজই চলে যাবে?
সোমেন মুখ নামিয়ে বলে—আজই। নইলে সবাই ভাববে।
—থাকতে বলছি না। যাওয়ার হলে যাবে। বলে বাবা খানিকটা বিহ্বল চোখে সোমেনের দিকে চেয়ে থাকেন। সব পুরুষেরই বোধ হয় একটা পুত্ৰক্ষুধা থাকে। বাবার চোখে এখন সেই রকমই একটা জলুস। পরক্ষণেই নিবে গেল চোখ, বললেন—কিছু দরকারে এসেছিলে?
—মা একটা চিঠি দিয়েছে ওই ডায়েরিতে গোঁজা আছে।
বাবা একটু তটস্থ হন। হাতড়ে চিঠিটা খোঁজেন। খুবই ব্যগ্র ভাব। সোমেন এগিয়ে গিয়ে চিঠিটা ডায়েরির পাতা থেকে বের করে দেয়।
গলা খাঁকারি দিতে দিতে বাবা চিঠিটা নিবিষ্টমনে পড়েন। ছোট্ট চিঠি, তবু অনেকক্ষণ সময় লাগে। সোমেনের বুকে একটু চাপ কষ্ট হয়। চিঠিটাতে ব্যগ্রভাবে বাবা যা খুঁজছেন তা কি পাবেন? বিষয়ী কথা ছাড়া ওতে কিছু নেই। না, আছে, ‘প্রণতা ননী’—এই কথাটুকু আছে। ওইটুকু বাবা লক্ষ্য করবেন কি?
চিঠিটা হাতে নিয়ে বাবা টিনের চেয়ারে বসলেন। মুখের রেখার কোনও পরিবর্তন হল না তেমন। মুখ তুলে বললেন—কলকাতায় বাড়ি করতে চাও?
—মার খুব ইচ্ছে।
দুহাতের পাতায় মুখখানা ঘষে নিলেন বাবা।
—বাড়ি করার জমি তো এখানেই কেনা আছে।
—এ জায়গা তো দূরে। কলকাতাতেই চাকরি-বাকরি সব।
—চাকরি তো চিরকাল করবে না, কিন্তু বসতবাড়ি চিরকাল থাকে। বংশপরম্পরায় ভোগ করে লোক। চাকরির শেষে যখন নিরিবিলি হবে তখন বিশ্রাম নিতে বাড়িতে আসবে।
সোমেন চুপ করে থাকে।
বাবা আস্তে করে বললেন—বাড়ি তো কেবল ইট কাঠ নয়। মনের শান্তি, দেহের বিশ্রাম—এসব নিয়ে বাড়ি। কলকাতায় কি সেসব হবে?
সোমেন এ কথারও উত্তর খুঁজে পায় না।
—কোথায় জমি দেখেছ?
—টালিগঞ্জে।
—কতটা?
—দেড় দুই কাঠা হবে। আমি ঠিক জানি না। বড় জামাইবাবুর এক বন্ধুর জমি। সেই বন্ধু কানাডায় সেটল করেছে। সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছে জমিটা।
—সস্তা মানে কত?
—হাজার দশেক হবে বোধ হয়।
—কীরকম জমি?
—কর্নার প্লট। দক্ষিণ-পূর্ব খোলা। বড় জামাইবাবুর বাড়ির পাশেই।
বাবা বড় চোখ করে বললেন—অজিতের বাড়ির পাশে? সেখানে কেন বাড়ি করবে তোমরা? আত্মীয়দের কাছাকাছি থাকা ভাল না, বিশেষ করে মেয়ের শ্বশুরবাড়ির পাশে তো নয়ই। এ বুদ্ধি কার, তোমার মায়ের?
—আপনার অমত থাকলে অবশ্য—সোমেন কথাটা শেষ করে না।
বাবা তার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। কথাটা সোমেন শেষ করল না দেখে বললেন—আমার মতামতের কি কোনও দাম তোমার মা দেবেন? তিনি যদি মনে করে থাকেন তবে আমার অমত থাকলেও ওই জমি কিনবেনই। তবু অমতটা জানিয়ে রাখা ভাল বলে রাখলাম।
—এত সস্তায় আর কোথাও পাওয়া যাবে না। বড় জামাইবাবুই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।
বাবা চিন্তিত মুখে বললেন—আমি টাকা না দিলেও ও জমি তোমরা কিনবেই। ধার-কর্জ করা হলেও, এ আমি জানি। কিন্তু তা হলে এখানকার জমিটার কী হবে?
—এটাও থাকুক।
—তাই থাকে! পৃথিবীতে যত মানুষ বাড়ছে তত জমি নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ছে। দখল যার, জমি তার। বহেরু যতদিন আছে ততদিন চিন্তা নেই, সে আমাদের বাধ্যের লোক। কিন্তু চিরকাল তো সে থাকবে না। তার জ্ঞাতিগুষ্টি অনেক, ছেলেপুলেরা সাবালক। তোমরা দখল না নিলে তারা ক্রমে সব এনক্রোচ করে নেবে। তখন? আমি যক্ষীর মতো আগলে আছি জমিটা, তোমাদের জন্যই। দেখেছ জমিটা ভাল করে? পশ্চিম দিকে সবটা আমাদের। প্রায় দুই বিঘে।
—দেখেছি?
—পছন্দ নয়?
—ভালই তো। কিন্তু বড় দূরের জায়গা।
বাবা মাথা নাড়লেন। বুঝলেন। একটা শ্বাস ফেললেন জোরে।
তারপর আস্তে আস্তে বললেন—কলকাতাতেও পাটিশানের পরে খানিকটা জমি ধরে রেখেছিলাম। জবর দখল। হাতে-পায়ে ধরে দেশের লোক নীলকান্ত সেখানে থাকতে চায়। দিয়েছিলাম থাকতে, সময়মতো জমি পেলে সে উঠে যাবে—এরকম কথা ছিল। কিন্তু যাদবপুরের ওই এলাকার জমি পাওয়া ভাগ্যের কথা। নীলকান্ত আর ছাড়ল না সেটা। আমি মামলা মকদ্দমা করিনি। কলকাতায় আমার কোনও লোভ নেই। জানি তো, ও শহরটা শিগ্গিরই শেষ হয়ে আসছে।
একটু বিস্মিত হয়ে সোমেন বলে—কেন?
—ও শহর শেষ হবেই। অত বাড়িঘর নিয়ে হয় একদিন ডুবে যাবে মাটির মধ্যে, নয়তো মহামারী লাগবে, না হয় ভূমিকম্প। একটা কিছু হবেই। যার বুদ্ধি আছে সে ওখানে থাকে কখনও?
সোমেন মুখ লুকিয়ে হাসে একটু। এতক্ষণ বেশ ছিলেন বাবা, এইবার ভিতরকার চাপা পাগলামিটা ঠেলা দিয়ে উঠছে।
—তুমি বিশ্বাস করো না?
—কী?
—কলকাতায় একটা অপঘাত যে হবেই? আমি যতদিন ছিলাম ততদিন আমার ওই একটা টেনশন ছিল। এত লোক, এত বাড়ি-ঘর, এত অশান্তি আর পাপ—এ ঠিক সইবে না। মানুষের নিঃশ্বাসে বাতাস বিষাক্ত। ডিফর্মড, ইমমর্যাল একটা জায়গা। ওখানে চিরকাল বাস করার কথা ভাবতেই আমার ভয় করত। নিশুতরাতে ঘুম ভেঙে গেলে শুনতাম, মাটির নীচে থেকে যেন একটা গুড় গুড় শব্দ উঠে আসছে।
—কীসের শব্দ?
—কী করে বলব? মনে হত। পাতালের জল বুঝি ক্ষয় করে দিচ্ছে শহরের ভিত। যেন ভোগবতী বয়ে যাচ্ছে।
সোমেন চুপ করে থাকে।
বাবা মুখ নিচু করে আত্মগত চিন্তায় ডুবে থাকেন একটুক্ষণ। তারপর মুখ তুলে বলেন—মোটে দেড় দুই কাঠা জমি?
—হ্যাঁ।
—ইচ্ছে করলে একটু শাকপাতা কি দুটো কলাগাছও লাগাতে পারবে না! বাক্সের মতো সব ঘর হবে, গাদাগাদি করে থাকবে, সেটাই পছন্দ তা হলে?
—মায়ের ইচ্ছে, বাড়িওয়ালারা বড্ড ঝামেলা করছে।
—কেন?
—ছেলেরা বিয়েটিয়ে করেছে, ওদের ঘর দরকার। বার বার তাগাদা দেয়, নতুন বাসাও পাওয়া যায় না সুবিধে মতো। মা বলে, কষ্ট করে একটু নিজেদের ব্যবস্থা করে নেওয়া যায়, জমিটা যখন সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে—
—টাকা না দিলেও তো তোমরা জমিটা কিনবেই?
সোমেন উত্তর দেয় না। বাবা উৎসুক চোখে চেয়ে থাকেন।
তারপর বললেন—সময় থাকতে যদি ও জায়গা ছেড়ে পালিয়ে আসতে পারতে তবে ভাল হত। একদিন দেখবে কলকাতায় দিন-দুপুরে শেয়াল ডাকছে, মড়ার মাথা পড়ে আছে এখানে-সেখানে, জনমনুষ্য কেউ থাকবে না। একটু ভেবে দেখ।
—আপনি মাকে যা লেখার লিখে দিন।
—এসব কথা চিঠিতে লেখার নয়, তোমার মাকে মুখের সামনে কিছু বলাও মুশকিল। ওঁর সবসময়ে একটাই ভাব ‘এই পেয়েছি ঝগড়ার গোড়া, আর যাব না বালি-ওতরপাড়া।’
—তবে আমি মাকে গিয়ে কী বলব?
এই প্রথম বাবা একটু হাসলেন। বললেন—তোমরা তবু কিছুতেই এদিকে চলে আসবে না?
—আমার কোনও মত নেই।
—তোমরা বড় হয়েছ, মত নেই কেন? এই বয়সে নিজস্ব মতামত তৈরি না হলে আর কবে হবে? তোমাদের যদি এদিকে থাকার মত হয় তবে তোমার মায়েরও হবে। মেয়েরা স্বামীর বিরুদ্ধে যত শক্ত হয়েই দাঁড়াক না কেন, ছেলের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায় না। ওখানে মেয়েরা বড় কাবু।
সোমেন কথাটার সত্যতা বুঝতে পারে। জীবন থেকেই মানুষ কিছু সহজ দার্শনিকতা লাভ করে। বাবার কথাটা মিথ্যে নয়। সে একটু স্মিত হাসল।
বাবা একটু শ্বাস ফেলে বললেন—বুঝেছি। রণেনই চায় কলকাতায় বাড়ি হোক। তোমারও হয়তো তাই ইচ্ছে। বলে বাবা আবার একটু হেসে মাথা নেড়ে বললেন—তোমাদের চেহারায় কলকাতার ছাপ বড় স্পষ্ট। তোমরা আর দেশ গাঁয়ে থাকতে পারবে না। আমার ইচ্ছে করে তোমাদের জন্য কলকাতা থেকে দূরে একটা নকল কলকাতা তৈরি করে দিই। তা হলেও হয়তো বাঁচাতে পারতুম তোমাদের।
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন—ক’টার গাড়িতে যাবে?
—যেটা পাই। রাত আটটার গাড়িটা—
পরে ঘড়ি দেখে বললেন—রাত আটটার পর শনিবার গাড়ি খুব ফাঁকা যায়। দিনকাল ভাল নয়, অত রাতের গাড়িতে যাবে কেন? যেতে হলে একটু আর্লি যাও। ভাল হয়, আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে গেলে।
—দেরি হলে মা ভাববে। আমার আজই ফেরার কথা।
বাবা চিন্তিতভাবে বললেন—সাড়ে পাঁচটা বাজে, এখন রওনা হলেও রাত আটটার আগে গাড়ি পাবে না।
—কিছু হবে না। ঠিক চলে যাব।
বাবা আবার হাসলেন। গাড়ু-গামছা নিয়ে বৌলওলা খড়মের শব্দ তুলে দরজার কাছে যেতে যেতে বললেন—তোমাদের জন্য আমিও কিছু কম চিন্তা করি না, বুঝলে?
বাবা খড়মের শব্দ তুলে বাইরে বেরিয়ে যান। কুয়োতলার দিকেই যান বুঝি। অদূরে জলের শব্দ হয়। দশবাতির ল্যাম্প-এর নীচে খাতাটা পড়ে আছে, তারই একটা পৃষ্ঠায় লেখা আছে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কথাটা ভুলতে পারছে না সোমেন। বার বারই মনে পড়ে। কেমন যেন অস্থির লাগে।
বাবা ঘরে নেই, সেই ফাঁকে বিন্দু এল। নিঃশব্দে। খানিকটা চুপি চুপি ভাব ছিল আসায়। একটু আগে যেমন পোশাক ছিল, তেমন আর নেই। একটু সেজেছে বুঝি। দশবাতির আলোয় ভাল বোঝা যায় না, তবু মনে হয়, চোখে কাজল টেনেছে, কপালে সবুজ টিপ, গায়ে একটা রঙিন উলের স্টোল। একটু অবাক হয় সোমেন, স্টোলটা দেখে। তারপর ভাবে, বহেরু তো আর সত্যিই সাধারণ চাষা নয়, তার মেয়ের ফ্যাশন করতে বাধা কী?
গলা নিচু করে বিন্দু বলে—জিনিসপত্র গুছিয়ে দেব?
—গোছানোর কিছু নেই।
—আজ থাকবেন না?
—না
—ব্রজকর্তার সঙ্গে সব কথা হয়ে গেল?
সোমেন একটু হাসে, ম্লান হাসি।
বিন্দু গলাটা বিষণ্ণ করে বলে—ব্রজকর্তা একা একা পড়ে থাকে। আগে রণেনবাবু আসত, আজকাল কেউ আসে না।
সোমেন নীরবে শুনে যায়। কথা বলে না।
—খেয়ে যাবেন না?
—কী খাব?
—ভাত।
—না, দেরি হয়ে যাবে।
—মাঝে মাঝে আসবেন।
সোমেন চোখ তোলে। বিন্দু চেয়ে আছে। চোখে পিপাসা।
সোমেন বলে—কেন?
ব্ৰজকর্তাকে দেখতে। আবার কেন? বলে হাসে।
সোমেন চোখ নামিয়ে নয়। বুকটার মধ্যে কী একটা মাতামাতি করে।
বিন্দু দু-পা এগিয়ে এসে বলে—ব্ৰজকর্তার খুব অসুখ করেছিল। সোমেন চমকে উঠে বলে—কী অসুখ?
—বুকের। হার্টের।
—কেউ জানায়নি তো!
—বাবা ভয়ে জানায়নি, যদি আপনারা ব্রজকর্তাকে নিয়ে যান এখান থেকে। বাবা ওঁকে ছাড়তে চায় না।
—অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিল?
—হয়েছিল। বৈঁচীর হাসপাতাল, তারপর বর্ধমানেও নিয়ে যেতে হয়েছিল ডাক্তার দেখাতে।
—সসামেন চুপ করে থাকে।
—মাঝে মাঝে আসবেন। আপনাদের জন্য ভেবে ভেবে বুড়োমানুষের বুক ঝাঁঝরা।
একটা শ্বাস ফেলে সোমেন বলে—আচ্ছা, আসব।
—আসবেন কিন্তু।
—রিকশা পাওয়া যাবে না বিন্দু? আমি এবার রওনা হই।
—রিকশা আনতে লোক চলে গেছে গোবিন্দপুর। এসে যাবে যখন-তখন।
খড়মের শব্দটা বাইরে শুনেই বিন্দু পালিয়ে গেল।
বাবা ঘরে আসেন। নিঃশব্দে জামাকাপড় ছাড়েন৷ কোণের দড়িতে আলগা হলদে রঙের শুদ্ধবস্ত্র আছে, সেটা পরে নিয়ে খুঁটটা গায়ে জড়ান। খালি গা, ধপধপ করছে পৈতেখানা।
—কিছু খেয়েছ-টেয়েছ?
—খেয়েছি।
—কোনও অসুবিধে হয়নি তো?
—না। বহেরু খুব যত্ন করেছে।
—বিছানাপত্র ভাল নয়, রাতে কষ্ট হয়েছিল নিশ্চয়ই?
—তেমন কিছু না। আপনার কি অসুখ হয়েছিল?
—অসুখ?
—শুনলাম হাসপাতাল পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। আমাদের জানাননি কেন?
বাবা গম্ভীর মুখে বলেন—তোমাদের জানাব কেন? কলকাতায় ভাল আছ, এত দূরে টেনে এনে কষ্ট দেওয়া।
—কষ্ট কীসের?
—কষ্টই তো! অভিমান করে বাবা বলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন—বেশ আছি, অসুখ-টসুখ কিছু নেই। এরা আত্মীয়ের চেয়ে বেশি দেখাশোনা করে। তা ছাড়া, আমিও খাড়া আছি এখনও, বসে যাইনি।
—আমি বরং মাঝে মাঝে আসব।
—কী দরকার! বলে বাবা একটা তিক্ত উত্তর দিতে গিয়েও থেমে যান। বোধ হয় সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত তাঁর ছোট ছেলেটির মুখের সুকুমার ডৌলটুকু দশবাতির আলোয় হঠাৎ তাঁর বড় ভাল লাগে। যখন সংসার ছেড়ে এসেছিলেন তখন ছেলেটা পালটে গেছে। সেই পরিবর্তনটুকু বোধ হয় তাঁর ভাল লাগে। পুত্ৰক্ষুধা টের পান বক্ষ জুড়ে। গলাটা হঠাৎ নরম হয়ে আসে। বলেন—এস। ইচ্ছে হলে এস।
সোমেন এই অভিমান দেখে স্মিত হাসে।
বাবা জিজ্ঞেস করেন—চাকরিবাকরি করছ?
—না। এখনও পাইনি। চেষ্টা করছি। ব্যাঙ্ক অব বরোদায় একটা হতে পারে।
—ভাল।
সোমেন একটু ইতস্তত করে। তাকে কেউ কথাটা বলতে বলেনি। তবু তার বলতে ইচ্ছে করে।
—বাবা, কিছুদিনের জন্য চলুন আমাদের কাছে।
বাবা একটু অবাক হন—তোমাদের কাছে?
—হ্যাঁ।
বাবা একটু হাসেন। বলেন—বরং তুমি চাকরিবাকরি পেয়ে আলাদা বাসা-টাসা করলে ডেকো। যাব।
—আপনি যে আমাদের কাছে থাকেন না সেটা বড় খারাপ দেখায়।
—থাকলে আরও খারাপ দেখাবে। বাসায় কাক-শালিক বসতে পারবে না অশান্তির চোটে। সব দিক ভেবেই আমি চলে এসেছি। যখন আমি আসি তখন তুমি নাবালক ছিলে, তাই তোমার কথা ওঠে না। কিন্তু রণেন আমাকে আটকাতে পারত। সে আটকায়নি।
বাবা গলা খাঁকারি দেন। মুখে চোখে রক্তোচ্ছাস এসে যায় বুঝি! বাবা গলাটা প্রাণপণে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলেন—সায়ংকালটা পার হয়ে যাচ্ছে। আমি একটু জপে বসি। তোমার সময় হলে চলে যেও।
সোমেন ঘাড় নাড়ল। উঠে প্রণাম করে নিল।
বিছানায় কম্বলের আসন পেতে বাবা গায়ের খুঁটটায় মাথা মুখ ঢেকে শিরদাঁড়া সোজা করে বসেন। সোমেন চেয়ে থাকে। কঠোর হওয়ার কত চেষ্টা করে লোকটা। পারে না। ঢাকা শরীরটা একটু একটু কাঁপে। শীতে, না নিরুদ্ধ ক্রন্দনে?
সেই প্রথম যৌবনকালের অভিমান আর ভাঙেনি। অভিমানে অভিমানে নষ্ট হয়ে গেছে ভালবাসা। কেউ কাউকে বইতে পারে না, সইতে পারে না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই অভিমানই হয়েছে আরও কঠিন। যত দিন গেছে তত তা আরও কঠিন হয়েছে। বুকের গভীরে চৈত্রের কুয়োর তলানি জলের মতো কিছু ভালবাসা এখনও পড়ে আছে হয়তো। কিন্তু ওই দুস্তর অভিমান পার হয়ে সেইটুকু স্পর্শ করবে কে? ননীবালা না, রণেন না, সোমেন না। ওই অভিমানটুকুই ব্রজগোপালের অস্তিত্ব বোধ হয়। তার সঙ্গে নিরন্তর চলে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এই কঠিন পাথরের অভিমান ভাঙবার জন্য কেউ আসুক, সবাই আসুক।
মৃত্যু ছাড়া ব্রজগোপালের এই বৃথা অভিমান থেকে মুক্তি নেই। এই কথা ভেবে রিকশায় বসে উত্তুরে বাতাসে কেঁপে ওঠে সোমেন। পাশে-বসা মুনিশ লোকটা একটা বিড়ি ধরায়।
রাতের ট্রেনটা এল। ইলেকট্রিক ট্রেন নয়। কয়লার ইঞ্জিন, কাঠের বগি। আগাপাশতলা গাড়িটা ফাঁকা। দু-একটা কামরায় দু-চারজন আছে। বেশির ভাগ কামরাই জনশূন্য। বাছাবাছির সময় নেই বলে সামনের কামরাতেই মুনিশ লোকটা ব্যাগট্যাগ সুদু তুলে দেয় সোমেনকে।
সোমেন গাড়ি ছাড়লে টের পায় তার কামরাটায় সে একদম একা।
॥ চার ॥
ফাঁকা গাড়ির কামরায় সোমেনের একা বড় ভয়-ভয় করে। কোমরে আন্ডারওয়্যারের দড়ির খোপে কয়েকশো টাকা রয়েছে, বহেরুর দেওয়া। দাদা বিয়েতে নতুন ঘড়ি পেয়ে তার পুরনো ঘড়িটা দিয়ে দিয়েছে সোমেনকে। পুরনো হলেও ভাল ঘড়ি, টিসো। সেই ঘড়িটা সোমেনের কবজিতে বাঁধা। বউদির বড্ড ভুলো মন, স্নানের সময়ে সাবান মাখতে অসুবিধে হয় বলে আংটি খুলে রাখে। তারপর প্রায়দিনই ভুলে ফেলে আসে বাথরুমে। কতবার বাড়ির লোক পেয়ে ফেরত দিয়েছে। সোমেন কয়েকবার আংটি লুকিয়ে রেখে সিনেমার বা সিগারেটের পয়সা আদায় করেছে। অবশেষে বউদি জ্বালাতন হয়ে একদিন বলে—ও আংটি হাতে রাখা মানে হাতি পোষার খরচ। রোজ হারাবে আর রোজ তোমার কাছ থেকে বন্ধকি জিনিস ছাড়াতে হবে। তার চেয়ে ওটা তুমিই আঙুলে পরে থাকে। তাই পরে সোমেন। বউদির মধ্যের আঙুলের আংটি তার কড়ে আঙুলে হয়।
ঘড়ি আংটি দুটোই খুলে পকেটে রাখল সোমেন। দরজা দুটোর লক লাগাতে গিয়ে দেখল, ছিটকিনি ভাঙা। গোটা দুই টিমটিমে আলো জ্বলছে, মাঝে মাঝে উসকে উঠছে আলো, আবার নিবু-নিবু হয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা, রহস্যময়, ভৌতিক কামরা। শনিবার রাতের ট্রেন ফাঁকা যায়, বাবা বলেছিলেন। কিন্তু এতটা ফাঁকা, সোমেন ভাবতে পারেনি। আশপাশের কামরাতেও লোক নেই, সোমেন বৈঁচী স্টেশনে গাড়িতে উঠবার সময়ে লক্ষ করেছে, লোক থাকলেও অবশ্য লাভ ছিল না। ডাকাতি ভরাভরতি কামরাতেও হয়। সে সাবধানে কোমরে হাত দিয়ে ফোলা জায়গাটা দেখল। বহেরুর দেওয়া টাকা, একবার ভাবল, পরের স্টেশনে নেমে কামরা পালটে নেবে। কিন্তু বৈঁচীগ্রাম স্টেশনে গাড়ি থামলে দরজা খুলে নামতে গিয়েও সে দমে যায়। এমন ফাঁকা, শূন্য হাহাকার স্টেশন সে কদাচিৎ দেখেছে। দীর্ঘ প্ল্যাটফর্মে জনমানুষের চিহ্নও নেই, শুধু শীতের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। অনেক দূরে স্টেশন-ঘরটা ঝিম মেরে আছে আধো অন্ধকারে। কুয়াশায় আবছা। খোলা মাঠে জমে আছে অন্ধকার, ঘুমন্ত, নির্জীব। সোমেন নামবার সময়ও পেল না। ট্রেন ছেড়ে দিল। প্ল্যাটফর্মটা পার হওয়ার সময় সে কেবল একজন বুড়ো কুলিগোছের লোককে দেখল রেলের কম্বুলে কোট গায়ে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একা একটা মানুষ, পিছনে প্ল্যাটফর্মের বিশাল নির্জনতা। সোমেন তৃষিতের মতো লোকাকে দেখল। মানুষ যে মানুষের মত আপন তা ওই একা লোকটাকে দেখে সোমেন বুঝতে পারে হঠাৎ।
একটু কাঁপা বুক আর দুশ্চিন্তা নিয়ে সে দরজা থেকে ফিরে এসে বেঞ্চে বসে। কামরা বদলেও লাভ যখন নেই, লোকভরতি কামরাতেও যখন ডাকাতি হয়, আর তাকে যখন এই ট্রেনে ফিরতেই হবে তখন আর কী করার আছে?
পুরনো আমলের গাড়ি। বয়সের জীর্ণতা দেখা যাচ্ছে চারধারে। রঙের ওপর বিবর্ণ রং দিয়ে কামরাটার ব্রিটিশ আমলের জরার চিহ্ন ঢাকা পড়েনি। চলার সময়ে একটা ক্লান্তির ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ তুলছে। অ্যালার্মের শেকল দুলে দুলে টংটঙাস শব্দ তোলে। বাতি নিবু-নিবু হয়ে আসে, আবার জ্বলে। পরের স্টেশনও পার হয়ে গেল গাড়ি। লোকজনের কোনও শব্দ হল না। ফাঁকা ট্রেন একটা বাঁশি দিয়ে আবার ছাড়ল।
সোমেন বসে থাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে, পরের স্টেশনে যেন দু-চারজন লোক ওঠে কামরায়। এত ফাঁকা সে সহ্য করতে পারে না। ভিড়ের কামরা কত বিরক্তিকর, ফাঁকা কামরাও কী অসহ্য! মানুষ যে কোন অবস্থায় সুখী হয়!
চিনেবাদাম, কমলার খোসা পড়ে আছে। দোমড়ানো ঠোঙা, সিগারেট আর বিড়ির টুকরো, দেশলাইয়ের বাক্স ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ মেঝেটা দেখলে হঠাৎ ভয় করে। কত মানুষ ছিল, তারা কেউ নেই। এ কথাটা হঠাৎ চমকে ওঠে বুকের মধ্যে। কলকাতার ভিড়-ভাট্টায়-গা-ঘেঁষা মানুষকে মানুষ কত অপছন্দ করে! আবার কখনও এরকম নির্জনতায় মানুষের বুকে মানুষের জন্যই পিপাসা জেগে ওঠে। সোমেন একটা সিগারেট ধরায়। জানালার ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে বাতাস আসে, ছিটকিনিহীন দরজা বাতাসের দমকায় দড়াম করে খুলে আবার ধীরে ধীরে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। ভূতুড়ে বাতিগুলো জ্বলে আর নেবে। একটা কালভার্ট বাঁয়ার শব্দের মতো শব্দ তুলে পার হয় গাড়ি। সোমেনের বড্ড শীত করতে থাকে। দাঁতে দাঁতে শব্দ হয়। কোটের কলারটা সে তুলে দেয়, জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য সে সুন্দর কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করে। আর ট্রেনটা অবিরল ‘দিনকাল ভাল নয়, দিনকাল ভাল নয়’, শব্দ তুলে ছুটতে থাকে।
চোখ বুজে এখন একটা বাক্য ভাবছিল সোমেন—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কখন, কোন একাকীত্ব বা সহায়তার সময়ে বাবা ওই কথাটা তাঁর ডায়েরির পাতায় লিখে রেখেছিলেন কে জানে। সোমেনের আর কিছু মনে পড়ে না, কেবল ওই বাক্য মনে পড়ে। বাবার জন্য একটু কষ্ট হয়। তাঁর অভিমান যে কত কঠিন হয়ে গেছে তা বাবাও জানেন না। আয়ুর সময় আর বেশি দিন নয়, ততদিন উদ্গ্রীব অপেক্ষা করবে বাবা। কেমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে মার চিরকুটটুকু পড়ছিল বাবা। হায়, তার মধ্যে বেশি কিছু ছিল না, ছিল ‘প্রণতা ননী’। কিন্তু ওই প্রণামটুকু বাবা কি নিয়েছে? নেবে কী করে? চিঠির মধ্যে বড় স্বার্থপর কথা ছিল যে! দশ হাজার টাকা নিজের ছেলেদের বাড়ি করবার জন্য চেয়ে নেওয়া, প্রণামটুকু তার মধ্যেই হারিয়ে গেছে। ওটা শব্দমাত্র, আর কিছু নয়। সোমেন জানে।
সোমেনের বড় ইচ্ছে করে, বাবাকে আবার ফিরিয়ে আনতে। তা হয় না যদিও। ফিরে এলে আবার কাক-শালিক তাড়ানো ঝগড়া হবে। সে ভারী অশান্তি। বাবা বলেছিলেন, সোমেনের আলাদা বাসা হলে আসবেন। আলাদা বাসার কথা সোমেন কল্পনা করতে পারে না। মা আর দাদাকে ছেড়ে আলাদা বাসা করে থাকবে—তা কি হয়?
বাবার কথা ভাবতে ভাবতে তার কলকাতার কথা মনে হয়। কলকাতার ওপর বাবার ভারী রাগ। কলকাতা সম্বন্ধে বাবার মতামত শুনলে হাসি পায় ঠিকই। কিন্তু সোমেনের মাঝে মাঝে মনে হয়, কলকাতার যেন আর কিছু হওয়ার নেই। তার বুকে যতটুকু জায়গা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষজন আর ইমারত ঠেসে দিচ্ছে চারপাশ থেকে। এ ভার সে আর বইতে পারছে না। রাস্তায় রাস্তায় আজকাল হোর্ডিং লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়—কলকাতা একদিন কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে। কিংবা—ক্যালকাটা ইজ ফর এভার, কিপ ক্যালকাটা ক্লিন…ইত্যাদি। পাশে আঁকা রক্তবর্ণ গোলাপের ছবি। কিন্তু তার মনে হয়, কলকাতার যতটুকু হওয়ার তা হয়ে গেছে। এখন কেবল অপটিমাম প্রেসারে টান টান টেনশনের ওপর রয়েছে কলকাতা। চারধারে কী একটা যেন ছিঁড়বে, ভাঙবে, তখন হুড়মুড় করে নগরপতনের ভয়াবহ শব্দ উঠবে। কলকাতার প্রতিটি লোকই বোধ হয় কোনও না কোনও বিহ্বল মুহূর্তে এই কথা ভাবে। কী সেটা তা বোঝা যায় না, অনুভব করা যায়।
আবার একটা নির্জন স্টেশন এল, চলে গেল। শীতের বাতাসে গা-শিরশির করা বাঁশি দিয়ে গাড়িটা নড়ে ওঠে। বুড়ো শরীরের জীর্ণতার শব্দ তুলে চলে। সোমেন সুন্দর কিছু ভাবতে চেষ্টা করে। সুন্দর কিছু মনে পড়ে না। এক হতে পারে বাড়ি গিয়ে সে দেখবে ব্যাঙ্ক অব বরোদার চিঠিটা এসেছে। পরীক্ষা ভাল দিয়েছিল, প্যানেলের উঁচুর দিকেই তার নাম থাকার কথা। চিঠিটা যদি আসে!
ভাবতেই কেমন একটা আনন্দের ধড়ফড়ানি ওঠে বুকে, আর সেই সঙ্গে রিখিয়ার মুখ মনে পড়বেই, পাভলভের থিয়োরিতে কুকুরের ঘটনার মতো, কন্ডিশন রিফ্লেকস। কিন্তু ভেবে দেখলে তার চাকরির সঙ্গে রিখিয়াকে কিছুতেই এক সুতোতে বাঁধা যায় না। এ এক রকমের স্বপ্ন দেখা সোমেনের, তেইশ বছর বয়সে এখনকার ছেলেরা আর এরকম স্বপ্ন দেখে না। সোমেন বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে রিখিয়াদের বাড়িটা প্রায় সময়েই মনশ্চক্ষে দেখে। একদম হালফিল কায়দার বাড়ি, যার ডিজাইনটায় অনেকগুলো অসমান কিউবিক প্রকোষ্ঠ। দোতলার বারান্দায় অ্যালুমিনিয়ামের রেলিং। সবুজ খানিকটা জমির ওপর বাড়িটা বিদেশের গন্ধ মেখে দাঁড়িয়ে। ঘরে ঘরে অদ্ভুত সব গন্ধ।
মাকে বলেছিল—তুমি সঙ্গে চলো। মা রাজি হয়নি। বলেছিল, আমার বড় লজ্জা করে। তুই একা যা। সোমেন তবু চাপাচাপি করেছিল—তোমার ছেলেবেলার সই, তার কাছে লজ্জা কী? মা বিষণ্ণ মুখে বলেছে—সংসারের কী অবস্থা, দেখিস তো? মনের এসব অশান্তি নিয়ে কোথাও যেতে ইচ্ছেই করে না। ছেলেবেলার সই, তোর বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে বলব কী? কোন কথায় কোন কথা উঠে পড়ে, আমি আবার সাজিয়ে বানিয়ে দুটো মিথ্যে কথা বললে তাল রাখতে পারি না। সব গোলমাল হয়ে যায়, তার ওপর এ চেহারা শৈলী কি আর চিনবে, দেখে আঁতকে উঠবে হয়তো। কী যে এক ঢল চুল ছিল আমার, রংটাও ছিল ফুটফুটে। চেহারা দেখেই সংসারের অশান্তি বুঝে ফেলবে। তুই একা যা। আমার খুব বন্ধ ছিল শৈলী। তোকে আদর-টাদর করবে। সংসারের কথা যদি জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে তো রেখেঢেকে বলিস।
সেই যাওয়া, পকেটে একটা চিঠি ছিল মায়ের দেওয়া, তাতে লেখা—শৈলী, এই আমার ছোট ছেলে, সোমেন, তোর কাছে পাঠালুম। ওর যাতে একটা চাকরি- বাকরি হয় দেখিস…. ।
দোতলার ঘরে মার সেই শৈলী শুয়ে আছে। পিয়ানোর রিডের মতো চমৎকার সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ঘরটিতে ঢুকে দৃশ্যটা দেখে থমকে গিয়েছিল সোমেন। পড়ন্ত বেলার আলো থেকে বাঁচানোর জন্য শ্যাওলা রঙের শেড টানা ছিল জানালায়, একটা মস্ত নিচু ইংলিশ খাটের উপর উনি শুয়ে, বুক পর্যন্ত টানা একটা পাতলা লেপ। চেহারাটা রোগজীর্ণ, সাদা, রোগা। উঠে বসতে বসতে বললেন—কোন ননী, বগুড়ার ননী? তুমি তার ছেলে? ওমা!
ঘরটায় তেমন কিছু ছিল না। শেড থেকে একটা সবজে আভা ছড়িয়ে আছে আলোর মতোই। পরিষ্কার সাদা শ্বেতপাথরের মতো মেঝে। শিয়রের কাছে একটা ট্রলি, তাতে ওষুধের শিশি, কাটগ্লাসের জগে স্বচ্ছ জল, ভাঁজ করা ন্যাপকিন। একধারে একটা সাদা রেফ্রিজারেটার, ছোট্ট। একটা ড্রেসিং টেবিল। বালিশের পাশে কয়েকটা বই, একটা মহার্ঘ চশমা। একটা বই খোলা এবং উপুড় করা।
—বোসো বাবা। তোমরা কলকাতায় থাকো? কোথায়? বলে উনি ঝুঁকে বসলেন, কোলের ওপর হাত। ঢাকুরিয়া শুনে চোখ বড় বড় করে বললেন, এত কাছে! তবু ননী একদিনও এল না? সেই খুলনায় থাকতে চিঠি দিত মাঝে মাঝে। কতকাল তাকে দেখি না। খুব বুড়ো হয়ে যায়নি তো ননী? আমি যেমন হয়ে গেছি?
সোমেন অস্বস্তির হাসি হেসেছিল। মা-ও বুড়ো হয়ে গেছে ঠিকই। বয়স তো আছেই, আর আছে সংসারের কত তাপ, ব্যথা বেদনা। সেসব কে বোঝে?
অত বড়লোক, তবু শৈলীমাসির কোনও দেমাক দেখেনি সোমেন, বরং বললেন—কতকাল ধরে রোগে পড়ে আছি। সারে না। বড় মানুষজন দেখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এই রোগা-ভোগার কাছে কে এসে বসে থাকবে! ননী এলে কত খুশি হতাম, তবু ননীর বদলে তুমি তো এসেছ! তোমার মুখখানা ননীর মতো, মাতৃমুখী ছেলেরা সুখী হয়।
এ সময়ে রিখিয়া এল। বোধ হয় ইস্কুলের উঁচু বা কলেজের নিচুর দিকে পড়ে। কিশোরী, চঞ্চল, সদ্য শাড়ি ধরেছে। ইস্কুল বা কলেজ থেকে ফিরল বোধ হয়, মুখখানায় রোদ-লাগা লালচে আভা। এলো চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে ঘরে এল, মায়ের বিছানার কাছে এসে অন্যমনে উঠে-আসা আলগা চুল আঙুলে জড়িয়ে চোখের সামনে তুলে ধরে বলে—ইস, রোজ কতটা করে চুল উঠে যাচ্ছে?
শৈলীমাসির মুখখানার রেখাগুলি নরম হয়ে গেল, বললেন—এই আমার একটামাত্র মেয়ে রিখিয়া। আমি ডাকি রিখি, ওর বাপ ডাকে রাখু। তোমার ভাল নাম কি বললে, সোমেন্দ্রনাথ?
সোমেন মাথা নাড়ে।
শৈলীমাসি হেসে বলেন—পুরনো আমলের নাম। আজকাল আর নামের মাঝখানে নাথ-টাথ কেউ লেখে না। সোজা নাম-টাম লেখে। এখন দেখি ডাকনামের মতো সব ছোট ছোট নামের রেওয়াজ। সেদিন এক বারোয়ারি পুজোর স্যুভেনির দিয়ে গেল, মেম্বারদের নামের মধ্যে দেখি কত মিন্টু ঘোষ, পন্টু রায়, বাবলু সান্যাল—বলতে বলতে মুখ তুলে মেয়ের দিকে চেয়ে বলেন—তাই না রিখি?
রিখিয়া উত্তর না দিয়ে মুখ টিপে অর্থপূর্ণ হাসে। হাসতেই থাকে। বোঝা যায় নামের ব্যাপারটা নিয়ে এ বাড়িতে একটা রসিকতা চালু আছে।
রিখিয়া বলল—রিখিয়া নামটা বিচ্ছিরি।
শৈলীমাসি হাসেন, সোমেন বলেন—রিখিয়ার বড় মামার ছিল বিদঘুটে পেটের ব্যামো, কত ডাক্তার-বদ্যি করেও সারে না, সেবার গেল সাঁওতাল পরগনার রিখিয়াতে হাওয়া বদলাতে। সেখানে সারল, ফিরে এসে দেখে ভাগনি হয়েছে, তাই নাম রাখল রিখিয়া, বলল—শৈলী, তোর মেয়ের যা নাম রাখলাম দেখিস, রোগবালাই সব রুখে দিলাম।
বলে সস্নেহে মেয়ের দিকে কয়েক পলক চেয়ে থেকে মুখ সরিয়ে একটা শ্বাস ফেলে বলেন—বলতে নেই, শরীর নিয়ে রিখি আমাকে একটুও জ্বালায়নি, আমি তো কবে থেকে রোগ-বালাই নিয়ে পড়ে আছি, রিখি শিশুবেলায় যদি ভুগত তো ওকে দেখত কে? বড্ড লক্ষ্মী ছিল রিখিয়া সেই বয়স থেকেই। রিখি, সোমেনকে কিছু খেতে দিবি না? ফ্রিজিডেয়ারে সন্দেশ আছে, দে। এ ঘরে নয়, পাশের ঘরে নিয়ে যাস। রুগির ঘরে খেতে নেই।
সোমেন কয়েক পলকের বেশি রিখিয়াকে তখন দেখেনি। খুব সুন্দরী নয়, তবু হালকা পলকা শরীরে একটা তেলতেলে লাবণ্য পিছলে যাচ্ছে। শ্যামলা রং, মুখখানায় সংসারের টানাপোড়েনের ছাপ পড়েনি বলে ভারী কমনীয়। একটু দুষ্টু ভাব আছে, আছে বেশি হাসার রোগ। একটু জেদ-এর ভাবও নেই কি! তবু সব মিলিয়ে রিখিয়া বড় জীবন্ত।
শৈলীমাসি বলেন—রিখি আমার চুলের গোছ ধরে বলে—মা, তোমার এখনও কত চুল। আমি তখন ননীর কথা ভাবি। ইস্কুলে ননীর নাম ছিল চুলঅলা ননীবালা, দিদিমণিরা পর্যন্ত ওর খোঁপা খুলে চুলের গোছ দেখত। আমরা কত হিংসে করতাম। দড়িদড়া দিয়ে কতবার চুল কত লম্বা তা মেপে দেখেছি, ভারী লক্ষ্মী ছিল ননী, আমরা যতবার ওর চুল মাপতাম ততবার চুপটি করে দাঁড়াত, হাসত, কখনও আপত্তি করত না। দাঁড়াও, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই। রিখি, আমার অ্যালবামটা দে তো—
অ্যালবাম এলে শৈলীমাসি সোমেনকে কাছে ডাকলেন। একটা পাতায় গ্রুপ ছবি। হলদে হয়ে গেছে প্রায়। তিন সারি মেয়ে। দাঁড়িয়ে এক সারি, চেয়ারে বসে এক সারি, মাটিতে এক সারি। কারও হাতে এমব্রয়ডারির ফ্রেম—সেলাই করছে, কারও বা হাতে কুরুশকাঠি, চেয়ারে বসা দুজন মেয়ের সামনে সেলাই মেশিন। প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন মেয়ে ছবিতে রয়েছে।
শৈলীমাসি বলেন—ইস্কুলে হাতের কাজের ক্লাসে তোলা ছবি। এর মধ্যে ননী কে বলো তো?
সোমেন মুখ টিপে হাসল। বাঁ ধারে সেলাই মেশিনের পিছনে মা বসে আছে। রোগা, খুব এক ঢাল চুল, নতমুখে, বড় হাতার ব্লাউজ, শাড়ির আঁচল ব্লাউজের কাঁধে পিন করা। এক নজরেই চেনা যায়। তবু বড় অবাক লাগে। তাদের বাড়িতে মার ওই বয়সের কোনও ছবি নেই। কিশোরী মাকে কখনও দেখেনি সোমেন। দেখে অবাক মানে। এই ছিল আমার মা?
শৈলীমাসি মুখের দিকে চেয়েছিল সকৌতুকে। সোমেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে—এই তো আমার মা।
—ও বাবা! নিজের মাকে চিনতে দেখি একটুও ভুল হয়নি! এখন বলো তো, আমি কোন জন?
ভারী মুশকিলে পড়ে যায় সোমেন। মুহূর্তেই ত্রিশজন মেয়ের ছবি একাকার হয়ে যেতে থাকে। শৈলীমাসির মুখটা কিছুতেই খুঁজে পায় না। তখন টের পায় তার কাঁধে সুগন্ধী এলোচুলের একটা গুছি এসে স্পর্শ করেছে। পরিষ্কার শরীরের সতেজ স্বাস ফেলে রিখিয়া ঝুঁকে পড়ে কাঁধের ওপর দিয়ে, আঙুল বাড়িয়ে বলে—এই তো আমার মা।
সোমেন দেখে, শৈলীমাসিই তো! নীচের সারিতে এমব্রয়ডারির কাঠের ফ্রেম হাতে বসে। ঢলঢলে শরীর, আহ্লাদী মুখ।
শৈলীমাসি বুক পর্যন্ত লেপটা টেনে আবার আধশোয়া হয়ে বলেন—চিনবে কী করে? তখন তো এমন হইনি। তুই ওকে খাবার দিলি না রিখি? দে, ভুলে যাবি পরে। কতদিন পর ননীর খবর পেলাম। বড় দেখতে ইচ্ছে করে। কে কে আছে তোমাদের সংসারে, বলো তো সব, শুনি। ক’ভাই-বোন তোমরা?
সোমেন সতর্ক হয়ে যায়। বাবাকে নিয়েই তাদের যত ভয়। সংসারের কথা একটুআধটু বলল সোমেন। তার দাদা রণেন্দ্রনাথ ফুড ইনস্পেকটর, দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, সে ছোট, বাবা রিটায়ার করে জমিজমা দেখছেন।
শৈলীমাসি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—ননীকে আসতে বোলো। খুব ভাল লাগবে। আমার ছেলেটা কতকাল ধরে বিলেতে পড়ে আছে। আসে না। আসবেও না লিখেছে। ওখানেই বিয়ে করবে। মেয়েটাই সম্বল। কিন্তু মেয়ে তো নিজের না, পরের ঘরে যাবে। আমার মাত্র দুটি। ননীকে বোলো যা দেখে গেলে।
—বলব।
—রিখি, ওকে খাবার দে। তুমি ওর সঙ্গে যাও সোমেন, যাওয়ার সময় আমাকে বলে যেও। আমি একটু ঘুমোই।
শৈলীমাসি পাশ ফিরে শুলে সোমেন রিখিয়ার পিছু নিয়ে পাশের ঘরটায় আসে। বসার ঘর। গভীর সব গদিওলা সোফা, একধারে বুক-কেস কালো কাঠের। চার রঙের চারটে দেয়ালে তেলতেলে পালিশ। বুক-কেসের ওপর একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা হেলাফেলায় পড়ে আছে।
কোথা থেকে এই সুন্দর বড়লোকি ঘরের কোন কোনা থেকে একটা কুকুর উঠে এল। দিশি কুকুর। তার হাঁটাটুকুর মধ্যে যেন আত্মবিশ্বাস নেই। এই ঘরে একটা দিশি হলদে কুকুর দেখবে। এমনটা আশা করেনি সোমেন। সে এসে রিখিয়ার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে মুখটা তোলে। রিখিয়া ঝুঁকে একটু আদর করে ওকে। মুখ ফিরিয়ে সোমেনকে বলে—বসুন।
সোমেন খুব অবাক হয়ে কুকুরটাকে দেখছিল। প্রথমে লক্ষ করেনি। এখন দেখল, কুকুরটা অন্ধ। সোমেন এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি।
সন্দেশ আনতে রিখিয়ার অনেক সময় লাগল। কুকুরটাকে আদর করল অনেকক্ষণ। তারপর প্লেট ভরতি ঠান্ডা সাদা সন্দেশ সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বলল—আমার ভাল নামটাও বিচ্ছিরি।
—কী সেটা?
—অপরাজিতা। কিন্তু ওই নামে কেউ ডাকে না।
—রিখিয়া বেশ নাম।
—ছাই, জায়গার নামে মানুষের নাম বুঝি ভাল?
—আমার নামও ভাল নয়। আমার ছোড়দির নাম বুড়ি…
এইভাবে কথা শুরু হয়েছিল। ঠান্ডা, হিম সন্দেশের ডেলা সোমেনের গলা দিয়ে নামছিল না। মেজের ওপর কার্পেট নেই, সোফার সামনে মস্ত মস্ত লাল নীল উলের নরম পাপোশ। পা রাখলে ডুবে যায়। তারই একটাতে রিখিয়ার পায়ের কাছে অন্ধ কুকুরটা শুয়ে আছে।
—কুকুরটা চোখে দেখে না?
—না। অন্ধ।
—কী করে হল?
—জানি না তো, আমরা ওকে এরকমই পেয়েছিলাম। তখন গড়পারের বাড়িতে থাকতাম আমরা। বেশ গরিব ছিলাম। সে সময়ে এটা কোথা থেকে এসে জুটল। রয়ে গেল। এখন বুড়ো হয়ে গেছে।
—ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে?
—একটু একটু অভ্যাস আছে, তবে প্রায়ই এখানে-ওখানে ধাক্কা খায়।
‘তুমি’ না ‘আপনি’ কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না সোমেন। অন্ধ কুকুরটা থেকে চোখ তুলে সে আবার বুক-কেসের ওপর আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরাটা দেখে। কী চকচকে, ঝকঝকে ক্যামেরাটা। মস্ত লেন্স। নিষ্প্রাণ একটি চোখ মেলে চেয়ে আছে সোমেনের দিকে। ঠিক যেন পাহারা দিচ্ছে। বার বার ওই অন্ধ কুকুর থেকে ক্যামেরার একটিমাত্র নিষ্প্রাণ চোখ পর্যন্ত দেখছিল সোমেন। সন্দেশের ডেলাটা গলা দিয়ে নামতে চাইছে না। জল খেতে গিয়ে বিষম খেল। ওই হেলাফেলায় পড়ে থাকা দামি ক্যামেরা তার সঙ্গে দিশি কুকুরটা কেমন যেন বেমানান। ঘরের মধ্যে ওই দুটি জিনিসই সবচেয়ে বেশি লক্ষ করছিল সোমেন।
রিখিয়াকেও কি লক্ষ করেনি? করেছে। তবে তার তেমন কোনও দুর্বলতা নেই মেয়েদের সম্পর্কে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে কত মেয়ের সঙ্গে তার তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল, আড্ডা দিয়েছে লন-এ বা রেস্টুরেন্টে, ফাঁকা ক্লাসঘরেও। তাই বুক কাঁপছিল না সোমেনের। কিন্তু সেই অপরাহ্নকালে বসবার ঘরে রিখিয়াকে দেখতে তার ভাল লেগেছিল বড়। লাল কার্পেটের ওপর পা রেখে রিখিয়া বসে। একটু ঝুঁকে কুকুরটাকে আদর করছে। বড় মহার্ঘ মনে হয়েছিল তাকে। পাহারা দিচ্ছে অন্ধ কুকুর, ক্যামেরার চোখ। একটু ভয় ভয় করেছিল সোমেনের।
রিখিয়া বলে—আপনি এম-এ পরীক্ষা দেননি?
—না।
—কেন?
—কী হবে পড়ে! চাকরি করা বরং ভাল।
—চাকরি? বলে সকৌতুকে রিখিয়া চেয়ে থাকে। ভাবখানা—ইস, এইটুকু ছেলের আবার চাকরি।
পকেটের চিঠিটা পকেটেই রয়ে গেল সোমেনের। দেওয়া হল না শৈলীমাসিকে। মুখে সে পরিচয় দিয়েছিল—আমি ননীবালার ছেলে, আপনার সই ননীবালা। ব্যস ওইটুকুর জোরেই ওরা গ্রহণ করেছিল তাকে। প্রমাণপত্র চায়নি। চিঠিটা হাতে দিতে বড় লজ্জা করেছিল সোমেনের।
যখন শৈলীমাসির কাছে বিদায় নিয়ে আসে তখনও বুকপকেটের চিঠিটার কথা মনে হয়েছিল। শৈলীমাসি বলেন—আবার এসো। ননীকে আসতে বোলো। আমি তো কোথাও যেতে পারি না।
—আসব মাসিমা। বলেছিল সোমেন।
চমৎকার সিঁড়িটা বেয়ে নেমে আসার সময়ে হঠাৎ শুনল রিখিয়ার স্বর—আবার আসবেন।
মুখ তুলে দেখে, রিখিয়া রেলিং ধরে ঝুঁকে দোতলা থেকে চেয়ে আছে। তার চলে যাওয়া দেখছে।
সোমেন ঘাড় নাড়ল। আসবে। মনে মনে বলল—তোমার কাছেও আসব রিখিয়া। একা তোমার কাছেই। এ তো স্পষ্টই বোঝা যায় যে একদিন সুসময়ে তোমার সঙ্গেই আমার ভালবাসা হবে!
সেই অন্ধ কুকুর, সেই আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা বড় মনে পড়ে সোমেনের। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চাকরির কথা মনে হলে রিখিয়ার কথা কেন যে মনে পড়বেই!
গাড়িটা চলেছে তো চলেছেই। একটু ঢিমে গতি, নড়বড় করা শরীরের শব্দ। পাঁচটা স্টেশন গেল। কেউ উঠল না, নামল না। সোমেনের কোমরে গোঁজা টাকা, পকেটে আংটি, ঘড়ি, দিনকাল ভাল নয়, দিনকাল ভাল নয়, বলতে বলতে ট্রেনটা ছুটছে।
একটু ঢুলুনি এসেছিল বুঝি। বেঞ্চের ওপর পা তুলে, ছারপোকার কামড় খেতে খেতে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই ফাঁকে ট্রেনটা থেমেছিল কোথাও।
হঠাৎ আবার চলতেই ঝাঁকুনিতে জেগে যায় সোমেন। এবং চমকে দেখতে পায়, সামনে চারটে ছেলে দাঁড়িয়ে। চারজোড়া চোখ তার মুখের ওপর স্থির।
॥ পাঁচ ॥
যে চারজন সোমেনকে দেখছিল তাদের একজনের নাম মেকো।
চারজনের একজন মেকোকে বলে—মেকো, প্যাসেঞ্জার।
—আই বে। মেকোর উত্তর।
—ও ধারটায় বসি চল, হেভি খাওয়া হয়ে গেছে। বাবুর বাবাটা মাইরি এত খচরা কে জানত।
অন্য একজন বলে—মেকো, মনে দুখ লিস না। তোর কপালটা খারাপ।
মেকো লম্বা, কালো, পরনে নোংরা প্যান্ট, গায়ে একটা মেয়েদের খদ্দরের নকশাদার চাদর। মুখটা সরু, ভাঙা। সোমেনকে একবার স্থির, ক্রূর দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল—না গান্ডু, দুখ কীসের? তোমরা তো চুপকি মেরে ঢুকে খেয়ে এলে, আমার বেলায় হারামি বাবুর বাবা ঠিক আটকে দিল!
চারজন কামরার অন্য দিকে গিয়ে বসে। সোমেনের বয়সিই হবে। জামা প্যান্ট ময়লা, ফরসা কিংবা কালো, লম্বা কিংবা বেঁটে চারজনকে কিন্তু গড়পড়তা একই রকম দেখায়। মেকো এক ঠোঙা চিনাবাদাম বের করে বেঞ্চে নিজের পাশে রেখে বলে—বাবু বলেছিল বাটে ওর বাপটা হারামি আছে।
একজন বলে—বহুত হারামি। বাবু আমাকেও বুধবারে বলেছিল, ওর বোনের বিয়েতে আসতে পারলে একটা সিনেমা দেখাবে। আমি তো যেখানে বিয়েবাড়ি দেখি ঠিক ঢুকে যাই, আর এ তো বন্ধুর বোনের বিয়ে! বাবু তখনই বলল—শুয়োরের বাচ্চা, আমার বাপকে তো চেনো না। বলেছে আমার কোনও বন্ধু ঢুকলে ঘাড় ধরে বের করে দেবে। আমিও বললাম, ঠিক আছে দেখে নেব।
—তোকে কী বলল?
—কী বলবে! প্যান্ডেলের গেট আটকে দাঁড়িয়েছিল উটকো লোক যদি ঢুকে যায় তো আটকাবে! আমাকে কেবল জিজ্ঞেস করল—তুমি কোত্থেকে আসছ? বুদ্ধি করে বলে দিলাম, ছেলের তরফের। সন্দেহ করেছিল বটে, কিন্তু আটকায়নি৷
মেকো বেঁটে একজনকে জিজ্ঞেস করে, তোর তো শালা নেমন্তন্নই ছিল।
যাকে জিজ্ঞেস করা সেই হাই তুলে বলে—নেমন্তন্ন মানে! পুরো ফ্যামিলি কার্ড। আমাকেও আটকে ছিল, বাবার নাম বলতেই ছেড়ে দিল। প্রেজেন্টেশনের প্যাকেট-ফ্যাকেট হাতে না থাকলে সন্দেহ করবেই। তুইও আবার মেজাজ নিলি।
মেকো ঠ্যাংটা ছড়িয়ে বলল—দূর বে গাভু, মেজাজ নেব না তো কি ওর ইয়ে ধুয়ে জল খাব? খপ করে হাতটা চেপে ধরল যে! বলল—তোমাকে তো চেনা-চেনা লাগছে, তুমি বাবুর বন্ধু না? তখন আমি ভাঁট নিয়ে বললাম—হ্যাঁ বন্ধু তো কী হয়েছে! তখন বলে—কে নেমন্তন্ন করেছে তোমাকে? আমি তখন গরম খেয়ে বললাম—নেমন্তন্ন আপনি করেননি, বাবু করেছে। হারামিটা তখন বলে—বাবু তার কোনও বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেনি, করলে তার হাড় গুঁড়ো করে দেব। দেখি নেমন্তন্নের কার্ড! সে একটা ফ্যাসাদ মাইরি। আরও গরম খেতে যাচ্ছিলাম, লোকজন জুটিয়ে ঠিক একটা ভণ্ডুল করতাম, সে সময়ে বাবু এসে দূর থেকে চোখ টিপে সরে পড়তে বলল। নইলে—
চতুর্থজন সিগারেট ধরাল। বলল—আমাকে কিছু জিজ্ঞেসই করেনি। বাইরে একটু দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যুট করে ঢুকে গেলাম এক সময়ে।
মেকো বলে—বাবুকে ঝাড়ব একদিন। এত বিয়েবাড়ি ‘রেড’ করলাম, সন্দেহ করলেও ভদ্রলোকেরা বেশি কিছু বলে না, কিন্তু এরকম খচাই পার্টি কখনও দেখিনি।
মেকো দ্রুত চিনেবাদামের খোসা ভাঙে। তিনজন তার দিকে চেয়ে হাসে। মেকো হাসে না।
চতুর্থজন বলে—মেজাজটা না নিলে ঠিক ছেড়ে দিত তোকে।
মেকো তাকে একটা লাথি মারল! আচমকা। বলল—বেশ করেছি মেজাজ নিয়েছি।
লাথি খেয়ে চতুর্থজন বলে—তাতে লাভ কী হল? ভরপেট হাওয়া।
তিনজন হাসে।
দ্বিতীয়জন বলে—আসল কথাটা কী জানিস মেকো, তোর ড্রেসটা আজ সব মাটি করেছে। বিয়েবাড়ি ভদ্রলোকের জায়গা। আমাদের রাস্তা-ঘাটে দেখে তো বাবুর বাবা, ছোটোলোকের মতো দেখতে। তুই যদি একটু মেক-আপ নিয়ে যেতিস—
—খচাস না কেলো। ছোট ভাইটাকে বললাম পুলওভারটা রেখে যাস, এক জায়গায় যাব, বিকেলে দেখি সেটা নেই। মেজাজটা সেই থেকে বিলা হয়ে আছে।
তৃতীয়জন হঠাৎ বলে—মেকো, তোকে একটা জিনিস দিতে পারি।
—কী? নিস্পৃহ মেকো জিজ্ঞেস করে।
তৃতীয়জন তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা ডেলা বের করে আনে।
—কী রে? মেকো চোখ ছোট করে জিজ্ঞেস করে।
—ফ্রাই। হাতছিপ্পু করে একটা সরিয়েছিলাম।
—কার জন্য?
কার জন্য আবার! এমনি।
মেকো জোর হেসে ওঠে—সুধাকে দিতিস? আলু!
সবাই খ্যা-খ্যা করে হাসতে থাকে।
মেকো আর তার সঙ্গীদের পুরো গল্পটা শোনা হল না। ব্যান্ডেলে ওরা নেমে গেল। সোমেন পকেটে হাত দিয়ে দেখল তার ঘড়ি আংটি, কোমরে টাকা। কিছু বিশ্বাস নেই। এখনও অনেকটা পথ।
হাওড়ায় যখন গাড়ি ঢুকল তখন স্টেশন ফাঁকা। রেল পুলিশ স্টেশনের চত্বর থেকে ভবঘুরেদের সরিয়ে দিচ্ছে, তবু এমন ভাল শোওয়ার জায়গা পেয়ে কিছু লোক এধার-ওধার পড়ে আছে চাদরমুড়ি দিয়ে শবদেহের মতো। শীতের রাত দশটার পরই ঝিমিয়ে গেছে শহর। কয়েকজন মাত্র তোক নিয়ে স্টিমারের মতো প্রকাণ্ড পাঁচ নম্বর বাসটা ছেড়ে যাচ্ছিল, সোমেন দৌড়ে গিয়ে ধরল। হাওড়ার পোল পেরিয়ে শহর ভেদ করে যেতে যেতে কিছুতেই যেন বিশ্বাস হয় না, একটু আগেই সে বহেরুর খামারবাড়িতে ছিল।
রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরে এল সোমেন। সবাই তার অপেক্ষায় জেগে বসে আছে। কেউ খায়নি।
খেতে বসলে পর মা জিজ্ঞেস করে—কী বলল রে? দেবে?
—কী জানি। স্পষ্ট কথা বলল না।
মা শ্বাস ফেলে বলে—দেবে না। আমি জানতাম।
দাদা বিরক্ত মুখ তুলে বলে—জানতে যদি তবে আগ বাড়িয়ে চেয়ে পাঠালে কেন? আমি তো বারণই করেছিলাম।
—বুড়ো হয়েছে, এখন যদি মতিগতি পালটে থাকে—সেই আশায়।
দাদা ভাত মাখতে মাখতে বলে—যে লোকটার কোনওকালে মন বলে বস্তু ছিল না তার কাছ থেকে কিছু আশা করা বৃথা। তুমি কোন আক্কেলে যে চিঠিটাতে আমার নাম করে চাইলে! তোমার কি ধারণা, আমার নাম করে চাইলে বাবা গলে যাবে!
—তোকে তো ভালবাসত খুব। সংসারে একমাত্র তোর দিকেই টান ছিল।
—ওসব বাইরের টান, মায়া। সত্যিকারের ভালবাসা নয়…।
বলতে বলতে দাদা লাল হয়ে ওঠে রাগে, অপমানে।
মা দুঃখ করে বলে—অজিত বলছিল জমিটা আর ধরে রাখা যাবে না, ভাল ভাল দর দিচ্ছে লোক। ওর বন্ধুও দাদাকে দিয়ে গত সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে।
—বেচে দিক গে। দাদা প্রচণ্ড রাগের গলায় বলে।
মা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে। দাদার রাগকে এ বাড়ির সবাই ভয় পায়। দীর্ঘকাল হয় দাদার রোজগারে সংসার চলছে। সাঁইত্রিশ বছর বয়সে দাদা সংসারের পরিপূর্ণ অভিভাবক।
মা হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে—তুই একটু দেখ না!
দাদা অবাক চোখ তুলে বলে—কী দেখব?
—একবার যা, তোর মুখ দেখলে যদি মায়া হয়।
দাদা স্থির দৃষ্টিতে মার মুখের দিকে চাইল। মাও তক্ষুনি কথাটার ভুল বুঝতে পারে। চোখ সরিয়ে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটে বলে—না হলে দেখ যেমন করে পারিস, ধারধোর করেও যদি রাখা যায়। আমার একখানা গয়না থাকলেও আজ খুলে দিলাম। কিন্তু ওই রাক্ষস তো সবই খেয়েছে।
দাদা কোনও উত্তর দেয় না, খাওয়ার শেষে উঠে যায়।
সোমেন আর মা এক ঘরে দুটো চৌকিতে শোয়। মশারি ফেলা হয়ে গেছে, সোমেন শোওয়ার আগে সিগারেট খাচ্ছিল। মার সামনেই খায়। মা তার মশারির মধ্যে বসে মশা খুঁজল কিছুক্ষণ। চুলের জট ছাড়াল বসে। তারপর এক সময়ে বলল—কেমন সব দেখে এলি?
—কীসের কথা বলছ? বাবার কথা?
—হুঁ।
—ভালই তো।
—বহেরু মোটে চারশো টাকা পাঠাল, ধানের দর কি এবার কম?
—বলল তো দর ভালই। যা দিল নিয়ে এলাম।
—তুই তো ওরকমই, বাপের মতো ন্যালাক্ষ্যাপা। হিসেব বুঝে আসতে হয়। বহেরু কি সোজা লোক! তোর বাপের প্রভিডেন্ট ফান্ডের আর হাতের-পাতের যা ছিল তা দিয়ে নাকি জমি-টমি কিনিয়েছে। শেষে সব ও নিজেই ভোগ করবে।
সোমেন একটু বিরক্ত হয়ে বলে—লোকটাকেই যখন ছেড়ে দিয়েছ তখন তার টাকার হিসেব দিয়ে কী হবে!
মা চুপ করে যায়। কিন্তু বেশিক্ষণ নিজেকে সামলাতে পারে না, বলে—আমার দুঃখ তোরা তার কিছু পেলি না। দশভূতে লুটে খাচ্ছে।
—খাক গে। আমার ওসব দরকার নেই।
—ঠিক ঠিক কী বললে বল তো?
—একবার তো বললাম।
—আবার বল। খতিয়ে দেখি, কথার মধ্যে কোনও ফাঁক রেখেছে কিনা।
—কলকাতায় আমরা বাড়ি করি তা চান না। গোবিন্দপুরে গেলে বাড়ি করার টাকা দেবে।
—চাকরি-বাকরি ছেড়ে যাবে কী করে!
—সেটা কে বোঝাবে!
—তুই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আসতে পারলি না?
সোমেন নীরব উত্তেজনায় আর একটা সিগারেট ধরাল।
—কিরে? মা জিজ্ঞেস করে আবার।
—বাবার বয়স কত মা?
—কেন?
—বলো না!
—সে হিসেব কি জানি? সে আমলে বয়স-টয়স নিয়ে তো কেউ হিসেব বড় একটা করত না। মনে হয় পঁয়ষট্টি হবে। আমারই তো বোধ হয় ষাট-টাট। কী জানি, ঠিক জানি না।
—এই বয়সে একটা লোক অতদূরে একা পড়ে আছে। সে কেমন আছে তা একবারও জিজ্ঞেস করলে না?
—মা একটু অবাক হয়ে বলে—জিজ্ঞেস করলাম তো! তুই তো বললি ভালই। কেন, কিছু হয়েছে নাকি?
বলতে বলতে মা উদ্বেগে মশারি তুলে বেরিয়ে আসে। মার চুল এখনও সব শেষ হয়ে যায়নি। এলো চুলের ঢলটি এখনও পিছনে কালো প্রপাতের মতো ঝরে পড়ছে। সেই কালোর মধ্যে রোগা সাদা মুখখানা, তাতে বিস্ফারিত চোখ দেখে সোমেনের মায়া হয়।
মাথা নেড়ে বলল—কিছু হয়নি।
—তবে ওসব কী বলছিস। ভাঁড়াস না। ঠিক করে বল।
সোমেন হাসতে চেষ্টা করে। ঠিক ফোটে না হাসিটা। তার মনের মধ্যে একটা কথা বিঁধে আছে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে। কোন অসতর্ক মুহূর্তে নাকি মৃত্যুচিন্তায় নিজের ওই আর্তস্বর ডায়েরিতে লিখে রেখেছে বাবা!
মা চেয়ে আছে।
সোমেন বলে—ভেব না, ভালই আছে। টাকার কথাটা বেশি বলতে আমার লজ্জা করেছিল। গত পাঁচবছর আমরা কেউ বাবার খোঁজ নিতে যাইনি।
মার মুখে যেন জল শুকিয়ে যায়। শুকনো মুখে টাকরায় জিভ লাগার শব্দ হয় একটা। মা বলে—গেলে কি খুশি হত নাকি। রণেন যখন যেত-টেত তখন তো উলটে রাগ করেছে! রণেনের অপমান হয় না! ছেলে এখন বড় হয়েছে, ছেলেমেয়ের বাবা তার সঙ্গে কথা বলতে বাপকেও সাবধান হতে হয়। সে লোকটা কী তেমন বাপ। চিরকাল…
মা হাপরহাটি খুলে বলতে যাচ্ছিল। সোমেন বাধা দিয়ে বলে—থাকগে। ওসব শুনে শুনে তো মুখস্থ হয়ে গেছে।
মা রাগ করে বলে—আজ হঠাৎ তার দিকে টানছিস কেন? সে তোর জন্য কী করেছে?
কিছু করেননি। সোমেন তা জানে। কেবল দশবাতির আলোয় মুখ তুলে বাবা একবার তাঁর কনিষ্ঠ ছেলেটির সুকুমার মুখশ্রী বড় ক্ষ্ধাভরে দেখেছিলেন। কী পিপাসা ছিল সেই চোখে!
সোমেন হঠাৎ হালকা গলায় বলে—তোমরা মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এবার একটা ফয়সালা করে নাও না।
—কীসের ফয়সালা?
—তুমি কি শুভদৃষ্টির সময়ে টেরছা করে চেয়েছিলে বাবার দিকে?
অন্য সময়ে মা হালকাভাবেই নেয় এসব কথা। এখন উদাস গলায় বলে—কে কাকে টেরছা চোখে চেয়েছে তা সেই জানে।
মা একটু চুপ করে ভাবে। তারপর বলে—আমি তো সবই করেছি। ঘরদোর আগলে, ছেলেমেয়ে মানুষ করে, কোনওটাতেই তো ফাঁক রাখিনি। এখনও আমিই আছি সংসারে। কিন্তু তাকে বাউন্ডুলে হতে হয়েছে। কর্মফল কার ফলল? সে যদি ভালমানুষই হবে, তবে কেন এই সংসারের ঘরে পা দিতে সাহস পায় না? কেন ছেলেরা মেয়েরা জামাইরা তাকে বিষচক্ষে দেখে?
সোমেন মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলে—তোমার বড় গুমোর হয়েছে ননীবালা!
—গুমোর! কীসের গুমোর রে পাজি ছেলে?
—ছেলেমেয়েরা তোমাকে ভালবাসে, বাপকে বাসে না, তার গুমোর।
—গুমোর থাকলে আছে। মায়েদের তো ওই একটাই অহংকারের জায়গা। তাকে ভাল বলার জন্য বাইরের লোক আছে, আমাকে তো বাইরের লোকে জানে না, তোরা জানিস। আমিও তোদের জানি। সে বলুক তো বুকে হাত দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য কী করেছে!
সোমেন সিগারেটটা পিষে নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে গিয়ে বলে—বাদ দাও। রাত বারোটা বাজে।
মা তবু গুনগুন করতে থাকে—একদিনে তুই এমন কী চিনে এলি লোকটাকে! আমরা সারাজীবন জ্বলেপুড়ে গেলাম—
—আঃ। আলোটা নেবাও তো।
মা আলো নিবিয়ে দেয়, অন্ধকারেও কথা বলে—আমার বাচ্চারা জন্ম থেকে মাকে জানে, বাপ ছিল অতিথিসজ্জনের মতো। আজও তাই আছে। স্বার্থপর বারমুখো, পাগল একটা।
সোমেন ধমকায়, বকবক করো না তো। অনেক ধকল গেছে—
মা চুপ করে যায়। গলা এক পরদা নামিয়ে গুনগুন স্বরে বলে, আরজন্মে আর মেয়ে হয়ে জন্মাব ভেবেছিস? মেয়েজন্ম এবারই ঘুচিয়ে গেলাম। আর না। কী পাপ, কী পাপ!
ব্যাঙ্ক অফ বরোদা একদম মৌনীবাবা হয়ে আছে। চিঠিপত্র কিছু আসছে না। দিন যায়, সোমেন ভাবে চাকরিটা বোধ হয় হল না। ওদের অফিসে গিয়ে খোঁজ নিতে ভয়-ভয় করে। ইদানীং যে কয়েকটা পরীক্ষা বা ইন্টারভিউ দিয়েছিল তার মধ্যে ব্যাঙ্ক অফ বরোদাই ছিল হট ফেবারিট। যদি না হয় তবে কী যে হবে।
অণিমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটির লন-এ অনেক বসেছে সোমেন। মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী। অনেক মেয়ের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও, অণিমার সঙ্গে আলাদা বসতে ভাল লাগত। চোখা চেহারা, ভারী চশমা চোখে। দাঁত চমৎকার। মুখটা একটু ভাঙা আর লম্বা বটে, কিন্তু ফরসা রঙে, আর প্রচুর পড়াশুনো করার ফলে একরকমের গাম্ভীর্য এসে গিয়েছিল বলে ওর চেহারাটা ভালই লাগে সকলের। সোমেনের ভাল লাগা কিছু বেশি ছিল। অণিমাও তাকে পছন্দ করেছে বরাবর।
সেবার বউদির সঙ্গে মার ঝগড়াটা খুব চরমে উঠেছিল। বরাবরই ছিল ঝগড়া। মার একটা বিচ্ছিরি স্বভাব আছে, সংসার থেকে জিনিস সরানো। তেমন কোনও কাজে লাগে না, তবু মা একটু চিনি কী আটা, নিজস্ব একটু বাসনপত্র, ছেঁড়া ন্যাকড়াই হল কখনও, যা পাবে সব সরিয়ে লুকিয়ে রাখে। তার ওপর আড়াই ঘরের ফ্ল্যাট বাড়ির যে ঘরখানায় মা আর সোমেন থাকে, সেটা প্রায় সময়েই তালাবন্ধ করে রাখে মা। এই স্বার্থপরতা বউদি প্রথম থেকেই সহ্য করতে পারত না। প্রায় সময়েই বলত—ছেলেমেয়েগুলো জায়গা-বাসা পায় না, এমনিতেই জায়গা কম, তার ওপর আবার একখানা ঘর তালাবন্ধ। মা আবার সে কথার জবাব দিত—আমি বাপু নিজের হাতে ঘর পরিষ্কার করি, ছেলেপুলে নোংরা করলে, তোমরা তো সব পটের বিবি, মুখ ফিরিয়ে থাকবে। সারাদিন খেটেখুটে রাতে একটু পরিষ্কার বিছানা পাব না, তা হবে না।
এইভাবেই ক্রমে ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে দুই যুযুৎসব তৈরি হচ্ছিল। কারণটা কিছুই না, তবু ওই ঘরখানার অধিকারবোধ নিয়ে দুপক্ষের লড়াই। এই ঝগড়ায় বরাবর দাদা এসে মিটমাট করেছে, সোমেন বাড়ি ফিরে মাকে ধমকেছে। আবার পরদিন সব ঠিকও হয়ে গেছে।
কিন্তু সেবার ঝগড়াটা এতই চরমে উঠল যে, মা একটা বাটি ছুঁড়ে মেরেছিল বউদিকে। বউদির বদলে সেটা তার কোলের বাচ্চার হাঁটুতে লাগে। বউদি বাচ্চা ফেলে তেড়ে এসেছিল মাকে মারতে। ঝি আটকায়।
দাদা সেই প্রথম ঝগড়ার মিটমাট করার চেষ্টা করল না। অফিস থেকে ফিরে আসার পর বউদি পাশের ঘরে দাদার কাছে চেঁচিয়ে কেঁদে মার নামে নালিশ করল। অনেক রাত পর্যন্ত অশান্তি। অন্য ঘরে মা তখন ভয় পেয়ে কাঁদছে। সোমেন মাকে ধমকায়নি পর্যন্ত সেদিন। চুপ করে নিজের বিছানায় শুয়েছিল। সেই রাতে বউদি বা মার কারও ওপর তেমন নয়, কিন্তু দাদার ওপর কেমন একটু অবিশ্বাস এসেছিল তার। ছেলেবেলা থেকে যেমন সে দেখে এসেছে, মা-অন্ত প্রাণ দাদাকে, সেই দাদা যেন বা আর নেই। দাদার বিয়ের আগে পর্যন্ত তারা কত সুখী ছিল, এই কথা আলাদা থাকবে। সে রাতে সে মার পক্ষই যে সমর্থন করেছিল তা নয়। সে কেবল ভেবেছিল সংসারটার শান্তি বাঁচাতে ননীবালাকে আলাদা করা দরকার। দাদার রোজগারে যখন সংসার চলে তখন বউদির প্রাপ্য সম্মান তাকে দিতেই হবে। মা পুত্ৰঅন্ধ, অধিকারবোধ প্রবল, মা জানে রণেন তারই আছে সবটুকু।
কাউকে কিছু না জানিয়ে সে ইউনিভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে পড়াশুনো আস্তে আস্তে ছেড়ে দেয়। পড়াশুনোর ক্ষতি হয় বলে দাদা তাকে টিউশনি করতে দেয়নি কখনও। ক্রমে সে টিউশনিও খুঁজতে থাকে।
সে সময়ে অণিমার সঙ্গে দেখা একদিন। চাকরির অ্যাপ্লিকেশনের জন্য ক্যারেকটার সার্টিফিকেট আনতে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে, দেখে অণিমা একা জলের ধারে ঘাসে বসে আছে রোদ্দুরে। কোলে খোলা বই। ওকে একা দেখে একটু কষ্ট হল সোমেনের। পাশে তার থাকার কথা এ-সময়ে। কত কথা হত তাদের। চুপ করে থাকাটাও একরকমের পূর্ণই ছিল। সেটা ভালবাসা নয়, বোধ হয় বন্ধুত্বই হবে।
তাকে দেখে চমকাল না অণিমা। আন্তরিক মুখখানা তুলে বলল—ভাবছিলাম, তোমার খোঁজ নিতে যাব। অসুখ-বিসুখ করেছিল?
—না। পড়া ছেড়ে দিচ্ছি।
অনিমা মৃদু হেসে বলে—ছেড়ে দেওয়াই উচিত। একে কি পড়াশুনো বলে!
—আমি ছাড়ছি পেটের ধান্ধায়।
—তাই নাকি? চাকরি পেয়েছ?
—কোথায় চাকরি! টিউশনিই পাচ্ছি না সুবিধা মতো।
অণিমা আন্তরিক উদ্বেগের সঙ্গে বলে—তোমার খুব দরকার টিউশনির?
—খুব।
—এতদিন কী করে চালাচ্ছিলে?
—দাদা দিত। দিত কেন, এখনও দেয়। আমার নিতে ইচ্ছে করে না। এম-এ পাশের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, খামোখা খরচা। ছমাস মাইনে দিইনি।
অণিমা অকপটে জিজ্ঞেস করল—তোমার কেউ বার্ডেন নেই তো?
—না, কেন?
—ভাবছিলাম, একশো টাকার একটা টিউশনি হলে তোমার চলে কি না।
—তোমার হাতে আছে?
—আছে। যদি প্রেস্টিজে না লাগে করতে পারো।
—প্রেস্টিজের কী ব্যাপার টিউশনিতে?
—আমার ভাইকে পড়াবে?
অণিমার ভাইকে কেন পড়াতে পারবে না, তার কোনও যুক্তিসিদ্ধ কারণ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অণিমা তো বন্ধু, একই ক্লাসে পড়ে। ওর ভাইকে পড়ালে বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সাম্যভাবটা নষ্ট হয়ে যাবে—শুধু এইটুকু খারাপ লেগেছিল সোমেনের। কিন্তু অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে হেসে সে বলল—পড়াব না কেন?
অণিমা নিশ্চিন্ত হয়ে বলে—তাহলে কাল থেকেই যেয়ো। ভাইটা সেন্ট লরেন্স-এ পড়ে। ক্লাস সিক্স। ইংরেজিতে বড্ড কাঁচা, ক্লাস ফলো করতে পারে না। স্কুল থেকে চিঠি দিয়েছে, পরের পরীক্ষায় ইংরেজিতে ভাল ফল না করলে নীচের ক্লাসে নামিয়ে দেবে। আমরা তাই একজন ভাল টিউটর খুঁজছি।
—আমি রাজি।
সেই থেকে সোমেন পড়ায় অণিমার ভাইকে। কিন্তু আশ্চর্য, এক’মাসের মধ্যে একদিনও ওদের বাড়িতে অণিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বোধ হয় লজ্জায় অণিমাই সামনে আসে না। সোমেনকে ওরা মাইনে দিয়ে রেখেছে, এটা বোধ হয় অণিমার কাছে সাধারণ ব্যাপার নয়। সোমেনও খোঁজ করে না। যতদিন টিউশনি না করত ততদিন সহজে দেখা হত বরং। এখন অণিমার বাড়িতে রোজ আসে বলে অণিমা রবিঠাকুরের সেই সোনার হরিণ হয়ে গেল বুঝি! পালিয়ে বেড়ায়, দৃষ্টি এড়ায়।
কিন্তু টিউশনি করে কিছু লাভ হয়নি। মাকে নিয়ে আলাদা বাসা করার সাময়িক চিন্তা সে ছেড়েও দিয়েছে। সংসারের সবটাই তো কেবল কুরুক্ষেত্র নয়, সেখানে আছে একটা অদৃশ্য নিউক্লিয়াস, অণু-পরমাণু সব মানুষ কেন্দ্রাভিগ আকর্ষণে একটা টানক্ষেত্র তৈরি করে নেয়। তাই সংসারের প্রতিদিনকার ভাঙচুরগুলো অলক্ষ্যে এক সারাইকর এসে কিছু কিছু মেরামত করে দিয়ে যায়, ঠুকে ঠুকে যেন বা বাসনপত্রের টোল-পড়া জায়গা তুলে দিয়ে যায়, জোড়া দেয় ফাটা-ভাঙা বাসন। সবটা মেরামত হয় না অবশ্য। নিখুঁতভাবে জোড়া লাগে না। তবুও অদৃশ্য নিউক্লিয়াস টানক্ষেত্রের ধর্ম রক্ষা করে চলে। তাই আবার মা আর বউদি ভাগাভাগি করে সংসারের কাজ করে এখনও। এ ছেলে রাখে তো ও রান্না করে। সোমেন তাই আর আলাদা বাসা করার কথা ভাবে না। কেবল বাবার কথা ভাবলেই সংসারের টানক্ষেত্রটার দুর্বলতা ধরা পড়ে। বাবা যে সত্যিই টানক্ষেত্রটা ছেড়ে গেছে তাও মনে হয় না আবার। সেই কথাটা বিধে থাকে সোমেনের মনে—ভগবান, উহারা যেন সুখে থাকে।
টিউশনিটা তাই আর ভাল লাগে না সোমেনের। খামোখা। চাকরিটা পেলে বরং হয়। টিউশনিটা ছাড়লে অণিমাও সহজভাবে কথা বলতে পারে আবার। বড্ড আবেগপ্রবণ মেয়ে। আবার মাসের প্রথমে একশোটা টাকা পাওয়ার অভ্যাসই বা কেমন করে ছাড়ে সোমেন?
সন্ধ্যাবেলা সোমেন গাব্বুকে পড়িয়ে বেরোচ্ছে, হঠাৎ দেখে, অন্যমনে মাথা নিচু করে অণিমা অন্য দরজা দিয়ে বাসা থেকে বেরোচ্ছে। তেমনই আছে অণিমা। ভারী চশমার আড়ালে চোখ, পরনে ছাপা শাড়ি, গায়ে স্টোল, হাতে ব্যাগ, পায়ে চপ্পল। মুখে কোনও প্রসাধন কখনও মাখে না, চুল রুক্ষ।
—এই যে বস, কী খবর?
অণিমা চমকাল না। অণিমা কখনও চমকায় না। অণিমা কখনও চমকাবে না। আচমকা বোমা পড়লেও না। ওর ওই স্বভাব। গম্ভীর মুখখানা তুলে চমৎকার মুখে হাসল—কী খবর! ছাত্র কীরকম পড়ছে?
—ভালই। টার্মের ইনক্রিমেন্ট দেবে নাকি?
—ইনক্রিমেন্ট? ভারি অপ্রতিভ গলায় বলে অণিমা।
তেমনি ঠাট্টার স্বরে সোমেন বলে—ইনক্রিমেন্ট না দিলে ঘেরাও করব।
—একা কি কাউকে ঘেরাও করা যায়?
চোখ নাচিয়ে সোমেন বলে—যায় না?
—কীভাবে শুনি?
সোমেন শব্দহীন হাসি হেসে বলে—যায়। একজনের দুটো হাতে একদিন ঠিকই ঘেরাও হবে তুমি। জানো না?
অণিমা মাথা নেড়ে বলে—না তো! কে সে?
—ধরো, যদি বলি….
॥ ছয় ॥
অণিমা মুখ তুলে হাসে। হাসিটা দুষ্টুমিতে ভরা। অণিমা বলল—থাক, বোলো না।
—বলব না? সোমেন বিস্ময়ের ভান করে—তা হলে কথাটা কি টের পেয়ে গেছ?
—না তো! তবে শুনতে চাইছি না।
সোমেন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—গরিব হওয়ার ওই একটা দোষ। বড়লোকের মেয়েরা পাত্তা দিতে চায় না।
—অ্যাই! তোমাকে আমি পাত্তা দিইনি?
—দিয়েছ? তা হলে শোনোই না কথাটা। ধরো, যদি বলি—
—আঃ। চুপ করো।
—চুপ করব? যদি তোমাদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে আজ আমার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয় তা হলে কিন্তু কথাটা না বলাই থেকে যাবে। সারাজীবন তুমি ভাববে, সোমেন কী একটা বলতে চেয়েছিল—
বিরক্তিতে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আবার হেসে ফেলে অণিমা। বলে—গরিবের ছেলের অনেক দোষ। তার মধ্যে মৃত্যু নিয়ে রোমান্টিসিজম একটা।
অণিমাদের বাগানে চমৎকার ফুল ফুটেছে। বারান্দার ফ্লুরোসেন্ট আলোতে অজস্র ভৌতিক ফুল দেখা যাচ্ছে। আসল রং বোঝা যায় না রাতে, কেমন আলোর তৈরি ফুল সব আধো-অন্ধকার বাগানে নিস্তব্ধ হয়ে ফুটে আছে। সোমেন চলে যাবে বলে বারান্দার দুধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। বলল—চলি। বলা হল না কিন্তু।
—না হোক। শোনো, কোথায় যাচ্ছ?
—গড়িয়াহাটা।
—হাতে কোনও কাজ নেই তো!
—কী কাজ থাকবে? সারাদিন নৈকষ্যি বেকার। গড়িয়াহাটায় বুকস্টলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু লিটল ম্যাগাজিন দেখব, তারপর বাসায় ফিরব।
অণিমার বাইরে যাবার সাজ। সোমেনের পিছু পিছু নেমে আসতে আসতে বলল—একটা জায়গায় আমার সঙ্গে যাবে?
সোমেন দাঁড়ায়। হেসে বলে—যেতে পারি, যদি কথাটা শোনো—
অণিমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে—কথাটা আর একদিন বললে হয় না! যেদিন বেশ চাঁদটাঁদ উঠবে, ফুল-টুল ফুটবে, দূরে কোথাও যাব আমরা। সেদিন বোলো বাপু!
—সময় কিন্তু বয়ে যাচ্ছে।
—যাকগে। এখন আমাকে পৌঁছে দাও। একা একা ট্যাক্সি চড়তে ভয় করে।
—তাই বলো! নইলে কি আর আমাকে সঙ্গে নিতে!
অণিমা কথা বলে না। ভ্রূকুটি করে।
প্রশস্ত পথটি ধরে ওরা বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের দিকে আস্তে আস্তে হাঁটে। সোমেন সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বলে—অত রাতে কোথায় যাচ্ছ একা?
অণিমা বলে—একা তো যাচ্ছি না।
—আমাকে না পেলে তো যেতে।
অণিমা হেসে বলে—তাই যদি যাব তবে গাব্বুর পড়ার ঘরের পাশের ঘরটায় বসে ঘণ্টাখানেক মশা তাড়ালাম কেন? বুঝলে মশাই, ঠিক তক্কে তক্কে ছিলাম কখন তোমার পড়ানো শেষ হবে।
সোমেন বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে—তাই বুঝি! তবে কী কথাটা তুমিই বলতে চাও অণিমা। তাই অপেক্ষা করেছিলে ট্যাক্সিতে যেতে যেতে বলবে? নাকি কোথাও দুরের কোনও মাঠে পৌঁছে গিয়ে বলবে।
অণিমা ভয় পাওয়ার ভান করে বলে—না, না, আজ নয়। আজ অন্য জায়গায় যাচ্ছি।
সোমেন ম্লান মুখে হাঁটতে হাঁটতে বলে—কলকাতার কত লোকের কত জায়গা আছে যাওয়ার!
—তোমার নেই বুঝি?
সোমেন মাথা নাড়ে। আস্তে আস্তে আপন মনে বলে—ধরো, পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে নাচ-গান হুল্লোড় হয়, বড় রেস্টুরেন্টে হয় বিউটি কন্টেস্ট, কেনেল ক্লাবে ডগ শশা, সাউথ ক্লাবে টেনিস, গোপন আড্ডায় নেশাভাঙ। সব জায়গায় যেতে ইচ্ছে করে। একটা শ্বাস ফেলে বলে—এমন গঙ্গার ঘাটেও যাই না, জাহাজ দেখলে মন খারাপ হয়ে যায়। কোনওদিন বিদেশে যাব না, এই সত্যি কথাটা বড্ড মনে পড়ে।
—আচ্ছা ছিঁচকাঁদুনে ছেলে রে বাবা! আর কী কী ইচ্ছে করে তোমার, একটা লিস্ট করে দিও তো! খেয়াল রাখব।
—এই তো ইচ্ছে করছে একটা কথা বলি। ধরো, যদি বলি….
দু’হাতে কান চাপা দিয়ে অণিমা হেসে ওঠে—ওটা থাক।
—থাকবে?
—বললেই তো ফুরিয়ে গেল। থাক না।
—সময় চলে যাচ্ছে।
—যাকগে। তুমি ট্যাক্সি ধরো তো। এই রাস্তায় ট্যাক্সি বড় কম।
সন্ধে সাতটাও বাজেনি। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড এর মধ্যেই জনহীন, পরিত্যক্ত। হুড়হুড় করে কেবল কয়েকটা গাড়ি ওয়াশ-এর ছবির মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
সোমেন রাস্তার দু’ধার দেখে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে বলে—প্রাইভেট টিউটর হওয়ার কি গেরো রে বাবা।
—কী হল?
—চাকরি বজায় রাখতে কত ওভার-টাইম খাটতে হচ্ছে।
—ইস! কী যে অসহ্য হয়ে যাচ্ছ না দিনকে দিন!
—সেই জন্যই তো বলছিলাম, আরও অসহ্য হয়ে ওঠার আগেই কথাটা বলে ফেলার একটা চান্স দাও। এমন ফাঁকা রাস্তা, নিঝুম শীতের রাত, লোড শেডিং থাকলে চাঁদও দেখা যেত ঠিক। ধরো, যদি বলি…
—ওই যে ট্যাক্সি সোমেন। ধরো, দৌড়ে যাও…
সোমেন দৌড়োল, এবং চটির একটা স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ট্যাক্সিটা ধরতে পারল। অবশ্য আর কেউ ট্যাক্সি ধরার জন্য ওত পেতে ছিল না। যতদূর দেখা যায় রাস্তাটা অতিশয় নির্জন।
ট্যাক্সিতে সোমেন একটা সিগারেট ধরাল। হাঁফাচ্ছিল একটু। দুঃখিত স্বরে বলে—সব মুচি ঘরে আসে, সব চটি ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন—
—কী বলে রে পাগলা? অণিমার হাসি চলকায়।
—রাস্তায় এত রাতে মুচি নেই একটাও। তোমার ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে চটিটা ছিঁড়েছে মাইরি।
অণিমা শ্বাস ফলে বলে—কী যে কাণ্ড করো না!
—তুমি দৌড়োতে বললে যে! না দৌড়োলে যদি চাকরিটা খাও?
—ইচ্ছে করেই তো বললাম, নইলে তুমি বোকার মতো কথাটা বলে ফেলতে যে!
সোমেন সবিস্ময়ে বলে—কোন কথাটা?
—যেটা বলতে চাইছিলে!
—কী বলতে চাইছিলাম বলো তো!
—ওই যে! ধরো, যদি বলি—
সোমেন বিরসমুখে বলে—থাকগে। বোলো না।
—বলব না?
—অন্য দিন বোলো। সোমেন সিগারেটে টান দিয়ে বলে—যেদিন ফুলটুল ফুটবে, চাঁদ-টাঁদ উঠবে, লোড শেডিং থাকবে, দূরে কোথাও গিয়ে—
দুজনেই হেসে গড়ায়। পাঞ্জাবি ট্যাক্সিওয়ালা ঘাড় না ঘুরিয়েই একটা অস্ফুট শব্দে রাস্তা জানতে চায়। অণিমা হাসি না থামিয়েই বলে—সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ।
অণিমা তার খোঁপা ঠিকঠাক করল, গা ঢাকা দিল, গাড়ির কাচটা তুলে দিল ভাল করে। বলল—শোন, কথাটা একজন বলে ফেলেছে।
—কোন কথা? সোমেন উদাসভাবে জিজ্ঞেস করে।
—সেই কথাটা।
—ও। সোমেন তেমনি নিরাসক্ত। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড পেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোড ধরে ছুটছে গাড়ি। ডাইনে মোড় নিল একটা। কী চমৎকার সব মস্ত মস্ত ফ্ল্যাটবাড়ি, নিঝুম, অ্যারিস্টোক্র্যাট আর নরম সব আলোর রঙে রঙিন। মুগ্ধ হয়ে দেখে সোমেন।
—সত্যি বলছি। অণিমা বলল।
—কে বলেছে কথাটা।
—ম্যাক্স।
সোমেন একটু অবাক হয়ে বলে—কে বললে?
—ম্যাক্স।
—সে কে?
—একজন অস্ট্রেলিয়ান সাহেব।
—তাকে কোথায় পেলে?
—পেয়ে গেলাম। একটা সেমিনারে আলাপ। সেখান থেকেই পিছু নেয় কলকাতার গলিঘুঁজি দেখবে, বাঙাল রান্না খাবে, সেতার আর তবলা শিখবে। কিছুতেই ছাড়ে না। তাই তার গাইড হয়ে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিন ঘুরলাম, নেমন্তন্ন করে খাওয়ালাম, গানের ইস্কুলে নিয়ে গেলাম। সেই থেকে কী যে হয়ে গেল ওর!
সোমেন চোখ মিট মিট করে ট্যাক্সির মধ্যেকার অন্ধকারে আবছা অণিমার মুখের দিকে চায়—বলেছে?
—তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। তিন-চারদিন আগে ওর সঙ্গে তারাপীঠ গিয়েছিলাম। মস্ত শ্মশান সেখানে, গাঁজার আড্ডা। ম্যাক্স গাঁজা খেতে গেল, আমি শ্যামলের সঙ্গে এধার-ওধার ঘুরে দেখছিলাম। ম্যাক্স ঘণ্টাখানেক গাঁজা-টাঁজা টেনে এসে সোজা আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল—
কথাটা শেষ না করে ট্যাক্সির ভিতরকার অন্ধকারে অণিমা ভারী রহস্যময়ী হয়ে বসে থাকে।
সোমেন বিরসমুখে বলে—তারাপীঠ জায়গাটাই খারাপ। আর কখনও যেও না—
অণিমা মুখ ফিরিয়ে নিবিষ্টমনে বাইরের দিকে চেয়ে ছিল। স্তিমিত গলায় বলল—কলকাতায় কত সুন্দর সুন্দর বাড়ি অণিমা। আমাদের যদি একটা বাড়ি হয়, আর ব্যাঙ্ক অফ বরোদার চাকরিটা তা হলে একদিন চলো তোমার সঙ্গে তারাপীঠে যাই।
—ওমা! কেন?
—তারাপীঠে না গেলে তুমি শুনবে না কথাটা!
—কোন কথা?
—সেই যে। ধরো, যদি বলি—
—বোলো না, বোলো না—
বলতে বলতে অণিমা হাসতে থাকে। সোমেন তেমনি স্তিমিত গলায় বলে—কতদিন ধরে বলতে চেষ্টা করছি। একবার তারাপীঠে না গেলে—
চিনে রেস্টুরেন্টটার দিনকাল শেষ হয়ে গেছে। তবু বহুকালের পুরনো নিয়মমাফিক আজও একজন আধবুড়ো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ব্যাঞ্জো বা ওই জাতীয় কোনও একটা তারের যন্ত্র বাজায় মিনমিন করে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দ্রুতগামী অটোমোবিলের শব্দে কিছু শোনা যায় না। লোকটা তবু প্রাণপণে বাজায়।
বাঁ ধারে শেষ কেবিনটায় ঢুকে সোমেন অবাক হয়। ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর যাদের কোনওদিনই আর দেখবে না বলে ভেবেছিল তাদের কয়েকজন বসে আছে। একধারে অপালা আর পূর্বা। অন্যধারে অধ্যাপক অনিল রায়, শ্যামল আর একজন নীলচোখো, সোনালি চুলো, গোঁফদাড়িওলা অল্প বয়সি সাহেব। তার পরনে খদ্দরের গেরুয়া পাঞ্জাবি, তার ওপর কালো জহর কোট। সাহেব কী বলছিল, অপালা আর পূর্বা তার ইংরেজি কিছুমাত্র না বুঝে হেসে কুটিপাটি।
মুখ তুলেই পূর্বা লাফিয়ে ওঠে—সোমেন! কী রোগা হয়ে গেছিস! রোজ তোর কথা ভাবি। মাইরি!
—আমিও। সোমেন নিরুত্তাপ গলায় বলে।
অপালা বড় বড় চোখ করে চেয়েই হেসে ফেলে—সোমেন, তুই বেশ মোটা-সোটা হয়েছিস তো!
—তুইও।
ওরা সরে বসে জায়গা করে দেয়। অণিমা আর সোমেন বসে। বসেই টের পায়, উলটোদিকে তিন-তিনটে আধো মাতাল চেয়ে আছে।
অধ্যাপক অনিল রায় বলেন—আগন্তুকটি কে অণিমা?
—সোমেন স্যার।
—আমারও তাই মনে হচ্ছিল। মুখটা চেনা-চেনা।
শ্যামল সাহেবের কাঁধের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে সোজা হয়ে বলে—সোমেন, তোর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। রিগার্ডিং—
বলে ভুলে যায়। হাতটা অসহায়ের মতো উলটে দিয়ে বলে—যাকগে।
সাহেব প্রোটোকলের তোয়াক্কা না করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে—ম্যাক্স।
সোমেন হাতখানা ধরে নিয়ে বলে—সোমেন।
হাতটা নরম, একটু ঘেমো। আটলান্টিক নীল চোখ দুটোয় কিছু ভিতু ভাব, খরগোশের মতো, হাসিটি লাজুক। পেটরোগা বাঙালির মতোই চেহারা, কেবল রং-টা ফরসা। সোমেন হাতটা ছেড়ে দিল এবং সাবধানে নিজের হাতের চেটো প্যান্টে মুছে ফেলল।
পূর্বা ফিসফিস করে বলে—যা ভয় করছিল, তখন থেকে তিনটে মাতাল নিয়ে বসে আছি। তোরা কেন দেরি করলি?
সোমেন টের পায় তার পাঁজরে কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে অণিমা কী একটা ইঙ্গিত করল। পরমুহূর্তেই অণিমা গলা নামিয়ে পূর্বাকে বলে—দেরি হবে না! বিকেলের মধ্যেই সাক্ষী সাবুদ জোগাড় করে রেজিস্ট্রারের কাছে যেতেই তো বেলা হয়ে গেল। সইটই করে এই দুজনে আসছি।
পূর্বা ভীষণ অবাক হলে বলে—কী বলছিস যা তা!
—মাইরি।
—সোমেনকে?
—আর কাকে?
—কী বলছে রে? বলে অপালা তার লাইমজুসের গেলাস সরিয়ে রেখে রেখে মুখ এগিয়ে আনে।
পূর্বা অসহায়ের মতো বলে—ওরা রেজিষ্ট্রি করে এল, জানিস! কি বদমাশ বলত?
—কে? কারা? ভারী অবাক হয় অপালা।
—অণিমা আর সোমেন।
—মাইরি? অপালার বড় চোখ বিশালতর হয়।
পূর্বা কাঁদোকাঁদো মুখে বলে—এ মা! শেষ পর্যন্ত সোমেনকে?
অণিমা ভারী চশমায় বেশ গম্ভীর মন-খারাপ গলায় বলে—সেই কবে থেকে জ্বালাচ্ছে। বিয়ে করো, বিয়ে করো, ধৈর্য থাকে? আজ তাই ঝামেলা মিটিয়ে দিলাম।
অপালা বড় বড় চোখ করে, নিশ্বাস চেপে শুনেটুনে হঠাৎ বলে—গুল!! ওদের দেখে মোটেই বোঝা যাচ্ছে না বিয়ে করেছে।
এই নাটকটায় নিজের ভূমিকা বুঝতে একটু সময় নিয়েছিল সোমেন। এবার হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে মুখ নিচু করে অপালার দিকে চেয়ে বলে—তোমার বুঝে কাজ নেই সোনা। তুমি তো পুতুল! পুতুলের সব বুঝতে নেই।
—মারব এক থাপ্পড়।
অনিল রায় হঠাৎ ওপাশ থেকে বললেন—কী হয়েছে মেয়েরা? রাগারাগি কীসের?
পূর্বা তেমনি কাঁদো-কাঁদো গলায় বলে—দেখুন স্যার, ওরা দুজন বিয়ে করে এল।
—কারা?
—সোমেন আর অণিমা।
—অ্যাঁ! আমি যেন অন্যরকম শুনেছিলাম! দাঁড়াও, দাঁড়াও, খুব মাতাল হয়ে গেলাম নাকি!
অপালা গলা তুলে বলে—মোটেই বিয়ে করেনি স্যার। সোমেনকে দেখুন, তিনদিন দাড়ি কামায়নি, চোর-চোর চেহারা, ময়লা জামাকাপড়, ও মোটেই বিয়ে করেনি অণিমাকে।
অনিল রায় হাত তুলে অপালাকে থামান, গম্ভীর গলায় বলেন—ইজ ইট ফ্যাক্ট অণিমা? তোমার মুখ থেকে শুনি।
অণিমা ভীষণ লাজুক মুখভাব করে সোমেনের দিকে তাকায়—লক্ষ্মীটি, স্যারকে বলে দাও না।
সোমেন তার খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকে মাথাটাথা নিচু করে বলে—তুমিই বলো।
একদিন পূর্বার সঙ্গে উজ্জ্বলায় ম্যাটিনিতে সিনেমা দেখে ফিরছিল সোমেন। কালীঘাট স্টপে ভিড়ের পাঁচ নম্বরে উঠতে গিয়ে সোমেন উঠল, পূর্ব উঠতে পারেনি। পূর্বার হাতব্যাগের ভিতরে ছোট্ট পয়সা রাখার ব্যাগে পাঁচটা টাকা ছিল, বাসের পাদানিতে সাফ হাতের কেউ সেটা তুলে নিয়েছিল। বাস ছেড়ে দিলে ভিতর থেকে সোমেন শুনেছিল, পূর্বা সর্বনাশের গলায় চেঁচাচ্ছে—সোমেন! সোমেন! ব্যাপারটা কিছুই না, পরের বাসে পূর্বা আসতে পারত, পয়সা না থাকলেও অসুবিধে ছিল না, কন্ডাকটরকে বললেই হত। কিন্তু পূর্বা ঘাবড়ে-টাবড়ে, দুঃখে কান্নাকাটি শুরু করে, বাসস্টপে কয়েকজন লোকও জুটে গিয়েছিল ওর চারপাশে। সোমেন রাসবিহারী বাসস্টপে নেমে ফিরে এসে পূর্বাকে ঘিরে ভিড়, ঘুনধুন করে কঁদছে পূর্বা, বলছে—আমার বন্ধু চলে গেছে, কী যে হবে! এমা! আমার টাকাও নেই, তুলে নিয়েছে। কী বিচ্ছিরি। বুড়ো একটা লোক ওকে একটা টাকা অফার করতেই পূর্বা ঝেঁঝে ওঠে—আমি কারও কাছে টাকা নেব না। তারপরেই আবার ঠোঁট কাঁপিয়ে চোখভরা জল রুমালে মুছে দিশাহারাভাবে বলতে থাকে—কী যে সব বিচ্ছিরি কাণ্ড না! যা তা! সোমেন যখন ভিড় ঠেলে গিয়ে ওর হাতটা ধরল তখন পূর্বার মুখে-চোখে সে কী আনন্দের রক্তিমাভা, যেন বাচ্চা মেয়ে মেলার ভিড়ে বাবাকে হারিয়ে ফেলেছিল, এইমাত্র ফিরে পেল।
এই হচ্ছে পূর্বা। যেখানে দুশ্চিন্তার কিছু নেই, সেখানেও ওর দুশ্চিন্তা। যেখানে কাঁদবার মতো কিছু ঘটেনি সেখানেও ও কেঁদে ফেলে। আড়চোখে সোমেন দেখে পূর্বার মুখ লাল, ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতা ফেলছে ঘনঘন এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে। সোমেন ভারী ভয় পেয়ে যায়। পূর্বা ঘনঘন শ্বাস ফেলে বলে—স্যার, বন্ধুকে কেউ বিয়ে করে? সেটা ট্রেচারি নয়। বলেই সোমেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—লজ্জা করে না। কী বিচ্ছিরি সব কাণ্ড করিস না!
সোমেন অবাক হয়ে বলে—কেন, আমি পাত্র খারাপ?
পূর্বা তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বলে—সে কথা বলছি নাকি! কিন্তু অণিমা তোকে বর বলে ভাববে কী করে! তুই-ই বা কী করে ভাববি যে—ইস ভাবতেই গা কেমন করে!
অনিল রায় ভারী অবাক হয়ে পূর্বার কাণ্ডকারখানা দেখে বলেন—বন্ধুকে বিয়ে করতে নেই? কেন বলো তো!
—সোমেনকে কখনও স্বামী বলে ভাবতে পারবে অণিমা?
—কেন পারবে না?
—আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার। স্বামী মানে তো বড় বড় মানুষ, যাকে শ্রদ্ধাভক্তি করতে হয়। সোমেনটা তো সমবয়সি, কেবল ইয়ারকি করে বেড়ায়, ও স্বামী হবে কী করে?
অনিল রায় তাঁর ছাত্রজীবনে মস্ত আধুনিক মানুষ ছিলেন। শোনা যায় প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ে রংদার চকরা-বকরা জামা, ষাঁড় ক্ষ্যাপানো উৎকট রঙের প্যান্ট পরতেন, হিপ পকেটে থাকত মাউথ-অর্গান, করিডোরে মাউথ-অর্গান বাজিয়ে বিলেতি নাচ নাচতেন। অধ্যাপকরা চটে গিয়েছিলেন। তবু বি-এ আর এম-এ-তে ফাস্ট হতে আটকায়নি। আমেরিকায় ডক্টরেট করেন। এখনও এই উত্তর চল্লিশে প্রায় একই রকম আছেন অনিল রায়। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এখনও লনে বসে আড্ডা দেন। সিগারেট বিলোন। গায়ে কাউবয় রঙিন শার্ট, বড় জুলপি, ফাঁপানো চুল, নিম্নাঙ্গে নিশ্চিত বেলবটমও আছে, টেবিলে পা ঢাকা রয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে না। একটা শ্বাস ফেলে বললেন—আমাদের আমলে ক্লাসমেটকে বিয়ে করাটাই ফ্যাশন ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমিও ইনভলভড ছিলাম। তোমাদের আমলটা কি খুব বেশি পালটে গেছে?
—না স্যার, মোটেই পালটায়নি। সোমেন হেসে ওঠে—পালটালে আমি আর অণিমা কেমন করে করলাম?
—করেছিস? অপালা হাত বাড়িয়ে বলে—দেখি সার্টিফিকেট।
—ওর হাতব্যাগে আছে। উদাস গলায় বলে সোমেন। তারপর সিগারেটের ধোঁয়ার আড়ালে আত্মগোপন করার চেষ্টা করে। আর তক্ষুনি দেখতে পায়, ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে উলটোদিকে একজোড়া নীল ফসফরাস জ্বলছে। ম্যাক্স। এতক্ষণ ম্যাক্সকে হিসেবের মধ্যেই ধরেনি সোমেন। ও কি সত্যিই প্রোপোজ করেছিল অণিমাকে! করে থাকলে অণিমার এ কী রকম ব্যবহার। লাজুক, ভিতু, পেটরোগা চেহারার কোনও সাহেব এর আগে দেখেনি সোমেন। ম্যাক্সকে দেখে তাই কষ্ট হয়। ওর মুখে, কপালে রগ দেখা্ যাচ্ছে! শুষ্ক নেশার চিহ্ন। গাল বসা, চুল রুখু। শুধু চোখ দুখানার নীল আগুন জ্বলছে। কিছু বুঝতে পারছে, কিন্তু আন্দাজ করছে। কেবিন ঘরটা হালকা কথায় খিলখিল করছে, বাতাসে ইয়ারকি, তবু সে সব ছাপিয়ে একটা টানাপোড়েনও কি নেই!
—অপালা অণিমার হাতব্যাগ কেড়ে নিয়ে হাঁটকে দেখে বলে—না স্যার, নেই।
অনিল রায় লম্বা চুলে আঙুল চালিয়ে উত্তেজিতভাবে বলেন—ইয়ারকি! ইয়ারকি! মাই গড, তোমরা মোটেই বিয়ে করোনি! এমন ইয়ারকি তোমরা কোথা থেকে শিখলে?
পূর্বা হঠাৎ ভীষণ হাসতে থাকে। সোমেনের দিকে চায়। ভারী আদুরে স্বরে বলে—তুই যা পাজি না সোমেন! এমন চমকে দিয়েছিলি!
অণিমা অসহায় মুখ করে বলে—ছিল স্যার, বোধ হয় ট্যাক্সিতে পড়ে-ফড়ে গেছে, ভাড়া দেওয়ার সময়—
—ফের? অপালা ধমক দেয়।
—অণিমা, তুই আমার জায়গায় বোস, সোমেনের সঙ্গে আমার কথা আছে। এই বলে পূর্বা জায়গা বদল করে নেয়।
বেয়ারা বিয়ারের জগ রেখে গিয়েছিল। সোমেন ফেনাটা ফুঁ দিয়ে চুমুক দিতে যাচ্ছে, পূর্বা কানের কাছে মুখ এনে বলল—বেশি খাস না সোমেন, পায়ে পড়ি।
—কেন?
—আমি তোর সঙ্গে ফিরব যে। গড়িয়ার দিকে যাওয়ার আর কেউ নেই। মাতালের সঙ্গে ফেরার চেয়ে একা ফেরা ভাল। খাস না।
—আচ্ছা। তোর কাছে টাকা আছে?
—গোটা চারেক। কেন?
—ট্যাক্সি নিস। চটিটা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটতে পারছি না।
—গড়িয়া পর্যন্ত ট্যাক্সি! কত উঠবে জানিস? তা দিয়ে একজোড়া নতুন চটি হয়।
অপালা চাপা ধমক দিয়ে বলে—তোর সঙ্গে ফিরবে কেন? আজ বিয়ের দিন, সোমেন ওর বউয়ের সঙ্গে ফিরবে।
চিলি-চিকেন আর এক চামচ ফ্রায়েড রাইস মুখে তুলেছিল সোমেন। একটু বিষম খেল। বউ কথাটা তার ভিতরে হঠাৎ বিদ্যুতের মতো খেলে যায় অলক্ষ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহী পেনট্যাক্স ক্যামেরার নিষ্প্রাণ চোখ। গর্র শব্দ করে জেগে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর। হঠাৎ এতক্ষণ বাদে একটা নিরুদ্ধ লজ্জায় সোমেনের মুখ লাল হয়ে যায়।
॥ সাত ॥
বিকেলের দিকে হাওড়ায় এসে নামলেন ব্রজগোপাল। ক্যাম্বিসের ব্যাগে কিছু তরিতরকারি, একটু খেজুর গুড়, আমসও্ব, কিছু গাছ-গাছড়া, ফকির সাহেবের দেওয়া বাতের ওষুধ। স্টেশনের চত্বরে নেমে ভারি বিশ্রী লাগছে তাঁর। কলকাতার বুকচাপা ভিড়, গরমি ভাব, গাড়িঘোড়া, যতবার আসেন ততবারই আরও বেশি খারাপ লাগে। খেই পান না, দিশাহারা লাগে। এই বিপজ্জনক শহরে এখনও কিছু নির্বোধ বাস করছে, প্রতিদিন কিছু নির্বোধ আসছে বাস করতে। মানুষের নিয়তিই টেনে আনছে তাদের। তাঁর ছেলেরা এই শহরে বাড়ি করবে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন ব্রজগোপাল। সংসারে অনেকদিন হয় তিনি বাতিল মানুষ। তাঁর কথা বা মতামতের কোনও মূল্য আর ওদের কাছে পাওয়া যাবে না। তবু ছেলেদের মুখের কাছে বিষের বাটি ধরতেই তিনি এসেছেন। বাড়ির জন্য দশ হাজার টাকা দিয়ে দেবেন। একেবারে পর হয়ে যাওয়ার ক্ষণকাল আগে, মৃত্যুর আগমুহূর্তেও যেন ওরা অন্তত একবার তাঁর দিকে আকর্ষণ বোধ করে। পুত্র-ক্ষুধা বড় মারাত্মক। সন্তানের বড় মায়া।
বাসে একটা জানালার ধারের সিট পেয়েছিলেন ব্রজগোপাল। খর চোখে চেয়ে কলকাতার দৃশ্যাবলি দেখতে থাকেন। বড়বাজার, ব্রাবোর্ন রোড, ডালহৌসি হয়ে ময়দান। এইটুকু রাস্তা জুড়ে বাণিজ্য আর বাণিজ্য। মানুষের লোভ-লালসার শেষ নেই। ময়দান থেকে বাকি রাস্তাটা চোখ বুজে কেবল ভাবেন আর ভাবেন। স্ত্রী আজ কেমন ব্যবহার করবে কে জানে? বোধ হয় ভাল ব্যবহার কিছু আশা করা যায় না। তবে টাকার খাতির সর্বত্র। হয়তো বসিয়ে চা জলখাবার খাওয়াতেও পারে। ভেবে একটু হাসেন ব্রজগোপাল। কিশোর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের। নৌকোয় সে বহু দূরের রাস্তা। কত রোমাঞ্চ কত কল্পনা। আজও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। সেই কিশোর বয়স ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যদি পান ব্রজগোপাল, যদি এখনও কিশোর ব্রজগোপালকে কেউ জিজ্ঞেস করে, পৃথিবীর এত মেয়ের মধ্যে কাকে বউ করতে চাও, তবে ব্রজগোপাল এখনও অম্লানবদনে বলবেন—ননীবালা। ননীবালার প্রতি তাঁর ভালবাসার এখনও যেন শেষ নেই। মুখখানার দিকে এখন আর ভাল করে তাকানো হয় না বটে, কিন্তু তাকালে এখনও সেই কিশোরকালের প্রণয়ের চিহ্নগুলি দেখতে পান যেন। আধো-ঢাকা কপাল, পিছনে অন্ধকারের মতো চুলের রাশি, থুঁতনির খাঁজে ঘামের মুক্তাবিন্দু। স্ত্রী শব্দটাই কী মারাত্মক! এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অভ্যাস, আশ্রয়, বিশ্রাম, শান্তি। ব্রজগোপাল তা পাননি। তবু এখনও যদি তাঁকে কেউ প্রেমভিক্ষা করতে পাঠায়, তিনি এসে দাঁড়াবেন ননীবালার দরজায়। কেন দাঁড়াবেন তা কেউ জানে না। সংস্কার।
রাস্তা ফুরিয়ে যায়। শীতের বেলাশেষে যোধপুর পার্কের পিছনে সূর্যাস্ত ঘটছে। ঢাকুরিয়ার প্রকাণ্ড জলাভূমিটায় কত কচুরিপানা, ঠিক মাঠের মতো দেখাচ্ছে। যোধপুরের ফাঁকা জমিগুলো ভরতি হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বাড়ি আর বাড়ি। পায়ের নীচে ভারবাহী কলকাতার নিঃশব্দ আর্তনাদ শোনেন ব্রজগোপাল। ওই জলাভূমিটাও ক্রমে গ্রাস করে নেবে মানুষের সর্বগ্রাসী বসত।
ঢাকুরিয়ার বাড়ির দোতলায় কুণ্ঠিত পায়ে উঠে এসে কড়া নাড়েন তিনি। খুবই সংকোচের সঙ্গে। যেন বা বেড়াতে এসেছেন, কর্তা বাড়ি নেই শুনলে ফিরে যাবেন। এ বাসার তিনি আর কেউ নন। যত রাতই হোক আজই তাঁকে ফিরে যেতে হবে।
রণেনের বউ দরজা খোলে। ভারি খর ঝগড়াটে চেহারা, তবু সুন্দরী। হাঁটু ধরে একটা ছেলে বায়না করছে। নাতি। সন্ধ্যা হয়েছে, তবু এখনও আলো জ্বালানো হয়নি বলে জায়গাটা অন্ধকার। রণেনের বউ দরজা খুলে বলে—কে?
ব্রজগোপাল গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন—আমি ব্রজগোপাল।
বউটি ঘোমটা টানার প্রয়োজন বোধ করে না। বলে—ও।
সুইচ টিপে আলো জ্বালে।
ব্রজগোপাল ঘরে যাবেন কিনা স্থির করতে না পেরে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলেন—রণেন বাড়ি নেই?
—না, এখনও ফেরেননি।
—আর কে আছে?
—মা আছেন। আপনি ঘরে আসুন।
—থাক, এইখান থেকেই বরং কথা বলে চলে যাই।
বউটি গলায় যথেষ্ট ধার তুলে বলে—আপনি রোজ রোজ দরজায় দাঁড়িয়ে কথা বলে যান, পাঁচজন তাতে কী ভাবে! ঘরে আসুন।
ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ভিতরে সরে যায় বীণা। ব্রজগোপাল নিজের হৃৎস্পন্দন আকস্মাৎ টের পেতে থাকেন। বহুকাল বাদে ওদের ঘরদোরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। ওরা কেমন যে আছে!
সামনের ঘরটা ঠিক ঘর নয়। একটুখানি প্যাসেজ। কলঘর রান্নাঘর আর শোওয়ার ঘরের দরজা চারদিকে। মাঝখানে বেতের চেয়ার আর টেবিল পেতে বসার ব্যবস্থা। তারই একধারে খাওয়া-দাওয়া হয়। বউটি ঘরের বাতি জ্বালল। আগে ষাট পাওয়ারের বালব জ্বলত, এখন ফ্লরেসেন্ট বাতি। ঘরদোরের চেহারাও আগের মতো নেই। বেতের চেয়ারগুলো রং করা হয়েছে, তাতে ডানলোপিলোর কুশন পাতা। একটা ঝকঝকে নতুন সোফা-কাম-বেড। একধারে একটা মস্ত বড় রেডিয়োগ্রাম, তার ওপর ফুলদানি। দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে কেষ্টনগরের পুতুল, বাঁকুড়ার ঘোড়া, রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়ে একটা গ্যাস সিলিন্ডার দেখা যাচ্ছে। নিজের অবস্থাকে প্রাণপণে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে এরা।
রণেন ঘুষটুষ খায় না তো এখন! ফুড ইনস্পেকটরের ঘুষের ক্ষেত্র অঢেল। ইচ্ছে করলেই রণেন অবস্থা ফিরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু আকণ্ঠ সৎ মানুষ ব্রজগোপালের রক্তের ধাত খানিকটা আছে বলে রণেন এই সেদিনও ঘুষটুষ খেত না। এখন কি খায়? অবস্থার ফেরে পড়ে, বউ আর মায়ের গঞ্জনায়? বড় অস্বস্তি বোধ করেন ব্রজগোপাল। যদি ঘুষ না খাস তবে কেন নিজের অবস্থার চেয়ে ভাল থাকার চেষ্টা করিস? না কি পাঁচজনকে দেখাতে চাস যে তোরা ঠিক মধ্যবিত্ত নোস।
বীণা ভিতরের ঘর থেকে ঘুরে এসে বলল—বসুন, মা আসছেন।
ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বীণার কোলের ছেলেটির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন—কী নাম রেখেছ ওর?
—কৌশিক। ডাকনাম টুবাই।
—দু-বছর বয়স হল, না?
—দু-বছর তিন মাস।
—মুখখানা রণোর মতোই।
বউটি ছেলেকে আদর করে ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে বলে—ছোনা একটা।
লজ্জায় ব্রজগোপাল মুখ ফিরিয়ে নেন। মা বাবা শ্বশুর-শাশুড়ির সামনে নিজের ছেলেকে আদর করা বড় লজ্জার ব্যাপার ছিল একসময়ে। এরা কিছু জানে না, মানেও না।
ব্রজগোপাল হঠাৎ প্রশ্ন করেন—রণেনের কি প্রোমোশন হয়েছে?
—না। হওয়ার কথা চলছে, কিন্তু কীসব যেন গণ্ডগোল।
—এসব কবে হল?
—কীসের কথা বলছেন?
—এই যে সব জিনিসপত্র?
—কিস্তিবন্দিতে?
—বোধ হয়। আমি ঠিক জানি না।
ব্রজগোপাল হাসলেন। জানো না, তা কি হয়? সোফা-কাম-বেড, রেডিয়োগ্রাম কিংবা গ্যাসের উনুন কেনার মানুষ রণেন তো নয়। সে ঢিলাঢালা মানুষ, শখ-শৌখিনতার ধার ধারে না। এসব মানুষ কেনে স্ত্রীবুদ্ধিতে, স্ত্রীরই তাগিদে। মেয়েছেলের মতো এমন বিপজ্জনক প্রাণী আর নেই। সাধুকে চোর, সরলকে কুটিল বানানোর হাত তাদের খুব সাফ। সম্ভবত, রণো এখন ঘুষ খাচ্ছে। সংসারটাও বড়, হয়তো সামলাতে পারে না।
—বসুন, চা করে আনি। বীণা বলে।
ব্রজগোপাল হাত তুলে বলেন—না, চা আমি খাই না।
—ওমা! আগে তো খুব খেতেন।
—ছেড়ে দিয়েছি।
—খাবারটাবার কিছু দিই?
অভিমান, পুরনো অভিমানটাই বুকে ফেনিয়ে ওঠে আবার। ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বললেন—না। মনে ভাবলেন, এরা জিজ্ঞেস করে কেন? জিজ্ঞেস করলে কেউ কি বলে, খাব?
ব্রজগোপাল বললেন—বরং তোমার শাশুড়িকে ডেকে দাও। ফিরে যাওয়ার গাড়ি আটটায়। দেরি হলে ওরা ভাববে।
বীণা অবাক হয়ে বলে—কারা?
—যাদের আশ্রয়ে আছি। আত্মীয়ের অধিক।
কথাটা বলার দরকার ছিল না। তবু বললেন ব্রজগোপাল। বীণা খারাপ বাবহার কিছু করছে না, কিন্তু একধরনের ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রাখছে যা তিনি ঠিক সহ্য করতে পারেন না। বোঝাই যাচ্ছে, ননীবালারও এখানে সুখে থাকার কথা নয়।
বীণা মুখটা গম্ভীর করে থাকল।
ব্রজগোপাল সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভুলটা ধরতে পারেন। কিন্তু কথাটা ফেরাবেন কী করে! তাই তাড়াতাড়ি নাতির দিকে হাত বাড়িয়ে বলেন—এস দাদা।
বীণা ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বলে—দাদুর কাছে যাও।
ছেলেটি দু-পা এগিয়ে আসে। একদম কাছে আসে না। ব্রজগোপাল তবু হাত দুটো বাড়িয়েই থাকেন। বলেন—খুব দুষ্ট হয়েছে?
—খুব। সেইজন্যই তো স্কুলে দিয়ে দিলাম।
খুব অবাক হয়ে ব্রজগোপাল বলেন—স্কুলে দিলে! দু-বছর মাত্র বয়স বললে না?
বীণা হেসে বলে—দু-বছর তিন মাস। আজকাল ওর বয়সে সবাই স্কুলে যায়।
—বলো কী! আমরা প্রথম স্কুলে যাই সাত আট বছর বয়সে, তাও খুব কান্নাকাটি করতাম।
—এখনকার ছেলেরা তো স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির।
—কীরকম ইস্কুল?
—নার্সারি। ইংলিশ মিডিয়াম।
—ও। সে তো অনেক পয়সা লাগে।
—কুড়ি টাকা মাইনে, বাস পঁচিশ, তার ওপর আজ এটা কাল সেটা লেগেই আছে। মাসে পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা।
ব্রজগোপাল মনে মনে ভারী বিরক্ত হন। কিন্তু মুখে নির্বিকার ভাবটা বজায় রেখে বলেন—বড়জনকেও কি ইংলিশ মিডিয়ামে দিয়েছ? মেয়েটাকেও?
—হ্যাঁ একই স্কুলে।
—তা হলে সংসারের দেড়শো টাকা মাসে বেরিয়ে যাচ্ছে!
—হ্যাঁ । একটু কষ্ট করছি, ছেলেমেয়েগুলো যদি মানুষ হয়।
ব্রজগোপাল দীর্ঘশ্বাস চাপলেন। রণোর যা বেতন তাতে এত বড় সংসার চালিয়ে কষ্ট করেও বাড়তি দেড়শো টাকা বাচ্চাদের জন্য খরচ করা সম্ভব নয়। তবে কি রণো উপরি নিচ্ছে আজকাল? বুকের মধ্যে ভারী একটা কষ্ট হতে থাকে তাঁর। এ সংসারে কেউই ব্রজগোপালকে অনুসরণ করল না। তিনি সৎ ছিলেন, এবং সৎ-অসতের ব্যাপারে তাঁর কোনও দ্বন্দ্ব ছিল না। ছেলের ভিতরে অন্তত সেইটুকু থাকলে তার অহংকার থাকত।
তিনি প্রসঙ্গ পালটে বললেন—বড়জন কোথায়?
—কে, বুবাই? সে খেলতে গেছে।
—পড়াশুনোয় কেমন হয়েছে?
—ভাল, ফার্স্ট হয়। মাস্টারমশাইরা আন্টিরা মনোজিৎ বলতে অস্থির।
—মনোজিৎ? ভারী অবাক হলেন ব্রজগোপাল। বড় নাতির নাম তিনিই রেখেছিলেন সুপ্রসন্ন। তিনি যখন চলে যান তখনও এ নামই বহাল ছিল। সদ্য লিখতে শিখেছিল নাতিটি, একসারসাইজ বুক আর বইয়ের ওপরে কাঁচা হাতে অতি কষ্টে লিখত সুপ্রসন্ন লাহিড়ি। ব্রজগোপাল নিস্তেজ গলায় বলেন—নামটা কি বদলানো হয়েছে?
বীণা একটু লজ্জা পায়, বলে—সেকেলে নাম বলে পালটে রাখা হয়েছে। ওর বন্ধুদের সব আধুনিক নাম, ও তাই ভাল নামের জন্য বায়না করত।
—ও। একটু চুপ করে থেকে বলেন—মনোজিৎ বেশ নাম। ভাল। মেয়েটারও কি নতুন নাম রেখেছ?
—না, ওর সেই পুরনো নামই আছে। তবে ডাকনাম অনেক। কেউ ডাকে শানু, কেউ বেলকুঁড়ি, কেউ বুড়ি।
ভিতরের ঘরে ননীবালা পরনের নোংরা শাড়িটা ছেড়ে ধীরে আস্তে একটা ভাল শাড়ি পরলেন। জরির ধাক্কা দেওয়া লাল পাড়। বেখেয়ালেই পরছিলেন। পরার পর মনে হল লাল পেড়ে শাড়ি বড় পছন্দ ছিল মানুষটার।
শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চিরুনিটা হাতে নিলেন। সিঁথিতে সিঁদুরের ঘা। আজকাল সব সিঁদুরেই ভেজাল। বাসি বিয়ের দিন সকালে বাসি বিছানায় ব্রজগোপাল যে সিঁদুরের স্তূপ ঢেলে দিয়েছিলেন সিঁথি ভরে, তার কিছু আজও অবশিষ্ট আছে, গোপন কৌটোয় যত্নে তুলে রেখেছেন ননীবালা। ওই সিঁদুর একটু একটু করে কৃপণের মতো অন্য সিঁদুরের সঙ্গে মিশিয়ে আজও পরেন তিনি। নিয়ম। এখনকার সিঁদুর সে আমলের মতো নয়, সিঁথি চুলকে ঘা হয়ে যায়, তাই সচরাচর খুব সামান্য একটু সিঁদুর ছোয়ান আজকাল। কী ভেবে আজ ডগডগে করে সিঁদুর পরলেন। চুলের জট পছন্দ করতেন না ব্রজগোপাল। মাথার তেলের দাম বড্ড বেড়ে গেছে, ননীবালার একরাশি চুলে তেল দিতে সিকি শিশি তেল শেষ হয়ে যায়। রণেনের মুখ চেয়ে আজকাল তালুতে একটু তেল চেপে ননীবালা স্নান সারেন। তাই তেলহীন চুলে আঠা আর জট। চিরুনি চালাতে গিয়ে একটা শ্বাস ফেললেন। এই বিপুল চুলের রাশি তাঁর বোঝার মতো লাগে।
সাজগোজ কি একটু বেশি হয়ে গেল? বীণা বোধ হয় শাশুড়ির এই প্রসাধন দেখে মুচকি হাসবে। মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। সব লক্ষ করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। শ্বশুরবাড়িতেই তিনি শিখেছিলেন যে স্বামী শ্বশুর ভাসুরের সামনে যেতে হলে পরিচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। অবশ্য ব্রজগোপালের ব্যবহারে সেসব শিক্ষা তিনি ভুলেও গিয়েছিলেন। আজ সেই পুরনো নিয়মটা রক্ষা করার জন্য তাঁর আগ্রহ হয়। তিন-চারবছর তিনি স্বামীর মুখশ্রী দেখেননি, তার আগেও বছর দুই এক আধপলক দেখেছেন। আজ তাঁকে ওই লোকটার সামনে যেতে হবে, মেজাজ ঠিক রাখতে হবে, মিষ্টি কথায় বোঝাতে হবে, টালিগঞ্জের জমিটা কেনা তাদের একান্ত দরকার। ছেলেদের ব্রজগোপাল তো কিছুই দিলেন না, এটুকু অন্তত ছেলেদের জন্য ভিক্ষা করে নিতেই হবে তাঁকে। শরীর পরিচ্ছন্ন থাকলে মনটাও শান্ত রাখা যাবে। ব্রজগোপালেরও হয়তো তাঁকে দেখামাত্র খ্যাঁক করে উঠতে ইচ্ছে করবে না।
সাজগোজ করতে বেশ একটু বেশি সময় নিলেন ননীবালা। তাঁর হাত-পা যেন বশে নেই। প্রেসারটা বোধহয় ইদানীং বেড়েছে, বুকে ধপ ধপ হাতীর পা পড়ছে। মাথায় ঘোমটা সযত্নে টেনে ননীবালা ধীরপায়ে বাইরের ঘরের পরদা সরিয়ে চৌকাঠে দাঁড়ালেন। বাইরের মানুষের মতোই বসে আছেন ব্রজগোপাল। খয়েরি চাদর গায়ে, আধময়লা ধুতি, পায়ে ক্যাম্বিসের জুতো, ধুলায় ধূসর চেহারা। ননীবালার দিকে চেয়েই মুখটা ফিরিয়ে নিলেন।
ননীবালা আজকাল বীণাকে কোনও কাজের কথা বলতে ভয় পান। সংসার খরচের টাকা আজকাল বীণার কাছেই থাকে। খরচ নিয়ে খিটিমিটি বাঁধত বলে ব্যবস্থাটা ননীবালাই করেছেন। সংসারের কর্তৃত্বও সেই সঙ্গেই চলে গেছে। বীণা এখন ওপরওয়ালা। সচরাচর ননীবালা তাকে কাজের কথা বলেন না। কিন্তু এখন অনুচ্চ কর্তৃত্বের সুরে বললেন—বউমা, চায়ের জল চাপাও। ও-বেলার রুটি করা আছে, একটু ঘিয়ে ভেজে দাও।
বীণা বাধ্য মেয়ের মতো ওঠে। দেখে ননীবালা খুশি হল। ব্রজগোপাল এদের সংসারে ননীবালার অবস্থাটা যেন টের না পান।
বীণা কাছে এসে বলে—উনি কিছু খাবেন না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
ননীবালা সুর নামিয়ে বলেন—ওসব কি জিজ্ঞেস করতে হয়! সামনে ধরে দেবে। এস-জন বোসো-জন তো নয়। যাও।
বীণা চলে গেলে নাতি কোলে ননীবালা সোফা-কাম-বেডের একধারটায় বসেন। বলেন—ওদিককার খবর-টবর সব ভাল?
—ওই একরকম। ব্রজগোপাল অন্যদিকে চেয়ে বলেন।
ননীবালা বেশি কথাটথা জানেন না, দ্বিতীয় কথাতেই সরাসরি প্রশ্ন করলেন—কী ঠিক করলে?
—জমিটা কিনবেই তুমি?
ননীবালা শ্বাস ফেলে বললেন—আমি জমি দিয়ে কী করব? জমি তো আমার জন্য চাইছি না। ওদের জন্য। আমি আর কֹ’দিন?
—ওই হল।
—খুব সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। অজিতের বন্ধুর জমি, সেই সব ব্যবস্থা করে দেবে। তাকে ওকালতনামা দেওয়া আছে।
—শুনেছি। কিন্তু কথা তো তা নয়। রণো ওরা সব এখানকার বাসিন্দা হয়ে গেলে গোবিন্দপুরে থাকবে কে?
—যেই থাকুক, ওরা থাকবে না। গ্রামে-গঞ্জে থাকার ধাত তো ওদের নয়।
ব্রজগোপাল উত্তর দেন না।
ননীবালা শান্ত গলায় বলেন—আমার ওপর রাগ আছে তো থাক। ছেলেরা তো কোনও দোষ করেনি বাপের কাছে! রণোর একার ওপর এত বড় সংসার, দশ-বিশ হাজার এক ডাকে বের করে দেবার ক্ষমতা নেই। তুমি একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ।
ব্রজগোপাল আস্তে করে বললেন—সচ্ছলতার মধ্যেই তোমরা আছ, দেখতে পাচ্ছি। নতুন নতুন সব জিনিসপত্র কেনা হচ্ছে, নিজের অবস্থাকে ডিঙিয়ে পাঁচজনের কাছে সচ্ছলতা দেখানো।
—ওমা! গরিবের সংসারেও দিনে দিনে টুকটাক করে কত জিনিস জমে যায় দেখতে দেখতে। গত পাঁচ-সাত বছর ধরে কত কষ্টে এইসব করেছে একে একে। তাও তো তেমন শৌখিন জিনিস না, সংসারের যা লাগে তাই। ছেলেদের সংসারের শ্রী দেখতে ইচ্ছে করে না?
ব্রজগোপাল ভ্রূকুটি করে বললেন—কিন্তু এত টাকা আসছে কোত্থেকে! রণোর যা মাইনে তাতে তো এসব হওয়ার কথা নয়। টাকার দাম কমছে বই বাড়ছে না। ঘুষটুষ খাচ্ছে নাকি!
—সেরকম ছেলে নয়। তবে কেউ হয়তো খাতির-টাতির করে সস্তায় কোনও জিনিস ধরে দেয়। সে তো আর দোষের নয়!
উদাস গলায় ব্রজগোপাল বলেন—তাই হবে। আমার সেসব না জানলেও চলবে।
ননীবালা মাথা ঠান্ডা রেখে বলেন—একটা বয়সের পর ছেলেদের হাঁড়ির খবর নেওয়া ঠিক নয়। ওরা বড় হয়েছে, দায়িত্ব নিয়েছে, ওদের ভালমন্দ ওদের বুঝতে দাও।
—আমি তো সব কিছু থেকেই দূরে আছি, তবে আর আমাকে সাবধান করা কেন! ঘুষটুষ যদি নেয় তো নিক, আমার কী! শুধু সমাজের একজন মানুষ হিসেবে অন্য এক মানুষকে বিচার করছি।
ননীবালা চঞ্চল হয়ে বলেন—রণো হয়তো এক্ষুনি চলে আসবে। এ সব কথা তার কাছে তুলো না।
ব্রজগোপাল ভ্রূ কুঁচকে সরাসরি স্ত্রীর দিকে তাকান। অল্প কঠিন স্বরে বলেন—ছেলের প্রতি তোমার এত টান, তবু তাকে অত ভয় কেন? তাকে যদি শাসন করা দরকার হয় তবে তা করাই উচিত।
—না না, তার দরকার নেই। রণো ওসব কিছু করে না।
—ভাল, জেনে গেলাম।
—রণোকে কী বলব জমিটার কথা?
—কিনুক।
—কিনবে?
—হ্যাঁ তো বলছি।
—ভাল মনে বলছ, না মনে রাগ রেখে?
—তাতে কী দরকার! টাকাটা আমি দেব। কর্তব্য হিসেবে।
—রণো বড় অভিমানী ছেলে, এরকম কথা শুনলে টাকা নেবে না।
ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—তবে কীরকম কথাবার্তা বলতে হবে?
—বিরক্ত হয়ো না। ছেলের মুখ চেয়ে খুশি মনে দাও। অনাদর অশ্রদ্ধার দান যে নেয় সে খুশি হয়ে নেয় না।
ব্রজগোপাল চুপ করে থাকেন। চোখে একটু উদাস ভাব। হঠাৎ বলেন—রণো খুব সৎ ছিল। ফুড ইনস্পেকটরের চাকরিতে অনেক উপরি। সে সব লোভে কখনও পা দেয়নি।
—তোমার অত সন্দেহের কী? ঘরে দুটো বাড়তি জিনিস দেখেই কি লোকটাকে বিচার করা যায়?
—যায়। আমার বড় দুশ্চিন্তা হয়।
—দুশ্চিন্তা কীসের?
—যারা ঘুষ নেয় তারা কখনও প্রকৃত শ্রদ্ধা পায় না, কেবল খাতির পায়।
—শ্রদ্ধা ধুয়ে জল খাবে! মা, ভাই, সংসার পালছে পুষছে, সে বড় কম কথা নাকি! আজকাল ক’টা ছেলে এই বয়সে এত দায়িত্ব ঘাড় পেতে নেয়? যার দায়িত্ব নেওয়ার কথা সেই নিল না কোনওদিন। রণোকে কেন অশ্রদ্ধা করবে লোকে?
ব্রজগোপাল ননীবালার দিকে তাকালেন। মধ্য যৌবনে স্ত্রীর প্রতি যে হিংস্র রাগ তাঁর দেখা যেত এখনও সেরকমই এক রাগে বুড়ো বয়সের দীপ্তিহীন চোখও একটু ঝলসে ওঠে। অথচ একথাও ঠিক, স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও প্রতি কখনও এমন তীব্র রাগ তিনি অনুভব করেননি। তার অর্থ কি এই যে, স্ত্রীর প্রতিই তিনি সবচেয়ে বেশি অধিকার সচেতন?
বীণা বুদ্ধিমতী। রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু ওপাশে কান পেতে আছে হয়তো। তাই ননীবালা ব্রজগোপালের চোখ দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। যদি লোকটা তেড়েফুঁড়ে কিছু বলে তো বউমার কাছে অপমান। বললেন—ভয় পেয়ো না। রণো তেমন কিছু করেনি। শত হলেও তোমারই ছেলে তো!
—আমার ছেলেই শুধু নয়। তোমার ধাতও তো কিছু তার মধ্যে আছে। তা ছাড়া আছে পারিপার্শ্বিকের প্রভাব, চারদিকের লোভ আর আকর্ষণ। মানুষ খুব মরিয়া না হলে এমন অবস্থায় সৎ থাকতে পারে না।
ননীবালা স্বামীকে চটাতে চাইলেন না। উত্তরে বলতে পারতেন—সৎ হয়ে কী ঘচু হবে। তা না বলে বললেন—তুমি হাতমুখ ধুয়ে নাও। খেয়ে বিশ্রাম করো।
—ওসব দরকার নেই। রণোকে বোলো টাকা আমি দেব। এল-আই-সিতে গিয়ে যেন ও একটু খোঁজখবর করে। দরকার মতো আমাকে খবর দিলেই আমি এসে সইটই করে টাকা তুলে দিয়ে যাব।
—সব ব্যবস্থা অজিতই করছে। বসবে না?
না। আটটার কাছাকাছি সময়ে গাড়ি আছে। তাড়াতাড়ি না উঠলে গাড়িটা ধরতে পারব না।
—একটু বোসো, জলখাবারটুকু খেয়ে যাও, তা করতে হয়তো রণো এসে পড়বে।
ব্রজগোপাল খাওয়ার জন্য ব্যস্ত নন। কিন্তু এই সংসারের মাঝখানে আর একটু বসে বিশ্রাম নিতে তাঁর বড় সাধ হচ্ছিল। দূর এক একাকী নির্জন ঘরে ফিরে যেতেই তো হবে! বললেন—সোমেন বাড়িতে নেই?
—না। এ সময়ে কি ডাঁশা ছেলেরা ঘরে থাকে?
ব্রজগোপাল সেটা জানেন। ছোট ছেলেটি যখন বয়ঃসন্ধিতে পা দিয়েছে তখন তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। চেহারায় ভাঙচুর হয়ে ছেলেটি এখন অন্যরকম হয়ে গেছে। তীক্ষ্ণ, বুদ্ধিমান এবং সুশ্রী মুখখানা আর একবার দেখবার জন্য তার বড় সাধ হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলেন—কখন ফেরে?
—তার কিছু ঠিক নেই।
—কী করেটরে আজকাল? স্বভাবটভাব কেমন?
ননীবালা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন—কাজকর্ম না থাকলে কী আর ভাল থাকে। এম. এ. পরীক্ষাটা দিল না, ব্যাঙ্কে একটা চাকরি পাওয়ার কথা হচ্ছিল তো তারও চিঠি এসেছে, চাকরি এখন হবে না।
জলখাবারের প্লেট আর চা নিয়ে বীণা আসে। ঘরে ঢোকার আগে গলা খাঁকারি দেয়। ব্রজগোপাল জলখাবারের প্লেটটা ছুঁলেন মাত্র, চায়ে গোটা দুই চুমুক দিলেন। তারপর অন্যমনস্কভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—চলি।
কিছু বলার নেই ননীবালার। কেবল বললেন—শরীরটরীর কেমন?
—ভাল, বেশ ভাল।
—আর একটু বসলেই রণো এসে পড়ত।
—দেখা করার জন্য তাড়া কী? হবে এখন।
—দুর্গা দুর্গা। ননীবালা বলেন।
ব্রজগোপাল দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে প্রশ্ন করলেন—বাড়িটা কার নামে হবে?
—রণোর ইচ্ছে আমার নামে হোক। আমি বলি দুই ছেলের নামে হলেই ভাল। তুমি কী বলো?
—আমি কী বলব? যেটা তোমাদের খুশি।
রাস্তায় এসে ব্রজগোপাল ইতস্তত তাকালেন। আরও শ্রীহীন, নোংরা ধুললাটে হয়ে গেছে কলকাতা। রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপ জমে আছে। স্টেশন রোডে এই শীতেও কোথা থেকে জল জমে কাদা হয়ে আছে এখনও। ঘর-ছাড়া ছেলেরা জটলা করছে। যতদূর সতর্ক চোখে সম্ভব দেখলেন ব্রজগোপাল, সোমেনকে দেখা যায় কিনা কোথাও। নেই, থাকার কথাও নয়।
কলকাতায় বেড়েছে কেবল দোকান। এত দোকান, কেনে কে, তা ব্রজগোপাল ভেবে পান না। তবু ঠিকই সওদা বেচাকেনা চলে। মানুষকে লোভী করে তুলবার কত আয়োজন চারদিকে।
একটা ট্যাক্সি উলটোদিক থেকে এসে তাঁকে পেরিয়ে গেল। থামল। ব্রজগোপাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, বাসার সামনেই থেমেছে। একটু দাঁড়ালেন। রণো না? রণোই। ঘাড় নিচু করে নেমে এল, হাতে বোধ হয় একটা দুধের কৌটো, দু-একটা প্যাকেট গোছের, একটা ফোলিও ব্যাগ। চশমা নিয়েছে আজকাল। বেশ মোটা হয়ে গেছে। সোয়েটারের ওপর দিয়ে পেটটা বেশ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গালটাল পুরন্ত। চিনতে তবু অসুবিধে হয় না, ছেলে তো। মোটা হয়ে যাওয়ায় এই বয়সেই বেশ বয়স্ক দেখায়।
কয়েকটা মুহূর্ত তিনি দাঁড়ালেন, ট্যাক্সিতে চড়ার অবস্থা রণোর নয়। তবু কী করে ট্যাক্সি চড়ে ও? দিব্যি নির্লিপ্ত মুখে ভাড়া গুনে দিয়ে খুচরো ফেরত নিচ্ছে। ট্যাক্সির মিটার টুংটাং করে ঘুরে গেল। বোঝা যায় হামেশা ট্যাক্সিতে চড়ার অভ্যাস আছে। নামা থেকে ভাড়া দেওয়া অবধি ঘটনাটুকুর মধ্যে একটা অভ্যস্ত অবহেলার ভাব।
রণো বাড়িতে ঢুকে গেলে ব্রজগোপালের খেয়াল হয়, ছেলে এক্ষুনি শুনবে যে বাবা এসেছিল, এইমাত্র বেরিয়ে গেছে। ফলে হয়তো বাপের সঙ্গে দেখা করতে তড়িঘড়ি নেমে আসবে। ভেবে ব্রজগোপাল দ্রুত হাঁটতে থাকেন। তাঁর অভ্যাসের পক্ষে খুবই দ্রুত। জোরে হাঁটা তাঁর বারণ।
বড় রাস্তা পর্যন্ত এসেই ব্রজগোপাল বুঝতে পারেন, কাজটা ঠিক হয়নি। বুকে প্রাণপাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে। শ্বাসবায়ু উকট রকমের কমে আসছে। এ সময়টায় তাঁর আজকাল হাঁপির টান ওঠে। দু-চার কদম হেঁটে ব্রজগোপাল ব্রিজের পিলারের কাছে উবু হয়ে বসে পড়েন। ভগবান! এ যাত্রা সামলাতে দাও। এক বিশাল সমুদ্র যেন ক্লান্ত সাঁতারুকে বড় নয়-ছয় করে। ব্রজগোপাল বসে নিবিষ্টমনে শ্বাস টানতে চেষ্টা করেন। একবার এ সময়ে সোমেনটার মুখখানা যদি দেখে যেতে পারতেন। ওই ছেলেটির প্রতি বড় মায়া। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে আছে ছেলেটা! এ বয়সে কবে কখন প্রাণপাখি ছেড়ে যায় দেহের খাঁচা। আয় সোমেন আয়।
॥ আট ॥
কলকাতার ময়দানে প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছেন। রেডিয়োতে রিলে হচ্ছে।
সন্ধেবেলা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতার সুরে বার বার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, আরও ত্যাগ, আরও কষ্ট স্বীকার, আরও ধৈর্যের জন্য জনগণকে প্রস্তুত হতে হবে। ভারতের চতুর্দিকে কয়েকটি দেশ মিত্রভাবাপন্ন নয়। যে কোনও সময়ে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। বন্ধুগণ, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধে যদি আমাদের নামানো হয় তবে আমরা আদর্শের জন্য, অস্তিত্বের জন্য, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে চূর্ণ করার জন্য…
অজিত রেডিয়োটা বন্ধ করে দেয়। রেডিয়োর পাশে পোষা বেড়ালের মতো বেতের গোল চেয়ারে পা গা ঢাকা দিয়ে বসে আছে শীলা। তার মুখশ্রী চমৎকার, রং একটু চাপা, ইদানীং সুখের কিছু মেদ জমছে গায়ে। তুঁতে রঙের উল দিয়ে একটা সোয়েটার বুনছিল, একটা ঘর গুনতে ভুল হয়েছে, মাথা নিচু করে দেখছিল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে। রেডিয়োটা বন্ধ হয়ে যেতেই চমকে উঠে বলে—এই যাঃ, কী হল?
—বন্ধ করে দিলাম। তুমি তো শুনছ না। অজিত শান্ত গলায় বলে।
শুনছি না কে বলল? তুমি বন্ধ করে দিলে তাই বলে! প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা! ভারি বিস্ময়ভরে বলে শীলা।
—তোমার কি ধারণা, প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বরে ঘরদোর পবিত্র হবে? কেউ যখন শুনছি না তখন খামোখা ব্যাটারি নষ্ট করে লাভ কী! আজকাল ব্যাটারির লনজিভিটি অনেক কমে গেছে, যদি যুদ্ধ হয় তো নেকস্ট বাজেটে দামও বাড়বে।
—ভারী বিশ্রী স্বভাব তোমার। ভাল কথা সহ্যই করতে পারো না। কত লোক আজকের মিটিং অ্যাটেন্ড করছে জানো?
—খামোখা করছে। ফেরার সময়ে অধিকাংশ লোকই ট্রামে বাসে উঠতে পারবে না। লম্বা রাস্তা হেঁটে মরবে সবাই, আর তা করতেই ভাল ভাল কথা যা শুনছে সব ভুলে যাবে।
—ইউনিয়ন করতে করতে তোমার মনটাই হয়ে গেছে বাঁকা। যেহেতু পি-এম বলছে সেইজন্যই তার সব খারাপ। শুনছিলাম বেশ, দাও আবার রেডিয়োটা।
—থাক। তার চেয়ে এস একটু প্রেমট্রেম করা যাক। যুদ্ধফুদ্ধ লাগলে কবে যে কী হবে! মরেটরে যাওয়ার আগে—
—আহা, সারাদিনে যেটুকু সময় দেখা হয় সেটুকু সময়ও তো আমার দিকে তাকাও না। এখন প্রধানমন্ত্রীর ইমপর্ট্যান্ট বক্তৃতার সময়ে প্রেম উথলে উঠল। দাও না রেডিয়োটা, একটা ঘর পড়ে গেছে, তুলতে পারছি না। দাও না গো—
অজিত রেডিয়োটা আস্তে করে ছেড়ে দেয়। রেডিয়োর টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর রনসন গ্যাস লাইটারটা তুলে নিয়ে বারান্দায় আসে।
টালিগঞ্জের এ পাড়াটাকে খাটালের পাড়াও বলা যায়। বারান্দায় দাঁড়ালেই গোচোনা, শুকনো গোবর তার গরুর গায়ের গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় নাকে। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। ঝিম এক সন্ধ্যা নেমে আসছে মাঠে ময়দানে। তাল্প কুয়াশা, ভৌতিক আলো জ্বলছে অন্ধকারে। কুয়াশার ভিতরে পাখির ডিমের মতো। এখনও এ-দিকটায় ফাঁকা জমি দেখা যায়। অবশ্য ক্রমেই ফাঁকা জায়গা ভরে যাচ্ছে, নিত্য নতুন ভিত পত্তন হয়, বাঁশের ভারা ওঠে, তার সঙ্গে উঠতে থাকে ইটের গাথনি। লোহার গ্রিল শীতে চনচনে হয়ে আছে। গ্রিলের সঙ্গেই প্রায় গাল ঠেকিয়ে দাঁড়ায় অজিত। ঘরের ভিতর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে, চারদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার স্বর আসছে। সব বাড়িতে রেডিয়ো খোলা। কর্তা গিন্নি, চাকর-বাকর, খাটালওয়ালা সবাই শুনছে, নির্বাচকমণ্ডলী, জনগণ।
কাঁচা রাস্তাটা বাঁ ধারে কিছুদূরে গিয়ে বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখেই একটা বাতিস্তম্ভ। হলুদ আলো নতমুখ হয়ে দাঁড়িয়ে। ওই জমিটা লক্ষ্মণের। গতকালও একটা এয়ারোগ্রাম এসেছে লক্ষ্মণের। কানাডা থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রী বেড়াতে বেরিয়েছে স্টেটসে। বড় শীত, খুব ফূর্তি। লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। ইমিগ্রান্ট ভিসা পেয়ে গেছে। ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার লক্ষ্মণ কোনও দিনই খাটাল-ভরা এই এলাকায় বাড়ি করতে আসবে না। তার জমিটা বায়না করেছে রণেন। দু-একবছরের মধ্যেই ওখানে এক কি দেড়তলা দীন একটি বাড়ি উঠবে। শীলার খুব আনন্দ, বাপের বাড়ি উঠে আসছে কাছে।
রনসন গ্যাসলাইটারটার আগুন কেমন লেলিহান হয়ে লাফিয়ে ওঠে! চাকা ঘুরিয়ে দিলেই আবার কমে যায়। গ্যাসের সিলিন্ডার শেষ হয়ে এসেছে। লক্ষ্মণ আবার পাঠাবে, লিখেছে। কিন্তু লক্ষ্মণ আর ফিরবে না। বন্ধুর জন্য শখ করে কাছাকাছি জমি কিনেছিল। যখনই কিনেছিল তখনই বোধ হয় লক্ষ্মণ জানত যে সে সুখের পাখি হয়ে উড়ে গেছে। ফিরবে না। তবু অজিতকে খুশি করতেই কিনেছিল বোধ হয়। মেরেকেটে পৌনে দু-কাঠা জমি হবে। বেশি দামও নয়। লক্ষ্মণের কিছু যায় আসে না যদি অজিত খুব কম দামেও জমিটা ছেড়ে দেয়। লক্ষ্মণ বহু টাকা মাইনে পায়। কানাডায় বাড়িও করেছে। খাটালে ভরা, বন্ধুহীন এলাকায় অজিত পড়ে আছে একা। একাই। অজিত বড় একা।
ঘর থেকে প্রধানমন্ত্রীর গলার ওপরে গলা তুলে শীলা ডাকে—শুনছো, ঠান্ডা লাগিও না। বারান্দায় এখন কী? ঘরে এস।
অজিত উত্তর দিল না। কিং সাইজ ডানহিল সিগারেটের সুন্দর গন্ধটি ফুসফুস ভরে টেনে নিল। পাঁচ প্যাকেট পাঠিয়েছিল লক্ষ্মণ। আর মাত্র আড়াই প্যাকেট আছে। কৃপণের মতো খায় অজিত। একটুও ধোঁয়া নষ্ট করতে ইচ্ছে করে না। ফুরোলে আবার পাঠাবে। কত কী পাঠায় লক্ষ্মণ! কিন্তু সে নিজে ফিরবে না। দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলো কুয়াশার একটা ধাঁধার মতো জ্বলছে। মাকড়সার জালের মতো সেই ভৌতিক আলোয় লক্ষ্মণের শূন্য জমিটা দেখা যায়। শীতে কিছু ছেলে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলে, বর্ষায় আগাছা জন্মায়। কোনওদিন লক্ষ্মণ ফিরবে, বাড়ি-টাড়ি করবে, এই আশায় এতকাল জমিটা ধরে রেখেছিল অজিত। শীলার তাগাদায়, শাশুড়িই আর রণেনের আগ্রহে ছেড়ে দিতে হল। ধরে রেখেও লাভ ছিল না অবিশ্যি। পৃথিবী ঠিক এক পুকুরের মতো, মাছের মতো মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে কোথায় কোথায়। বৃথা ছিপ ফেলে বসে থাকা, কোন দূরে হারিয়ে যাওয়া মাছটিকে ধরে আনবে কাছে, এমন সাধ্য কী!
লক্ষ্মণের পায়ে থাকত একটা বর্ণহীন ধুলোটে চপ্পল, একটু খাটো ধুতি, গায়ে একটা ফুলহাতা শার্ট—যার হাতে বোতাম খসে যাওয়ার পর হাতীর কানের মতো লটপট করত। শীত-গ্রীষ্মে ওই ছিল তার মার্কামারা পোশাক। কখনও কারও সঙ্গে ঝগড়া করত না লক্ষ্মণ, তর্কাতর্কিতে যেত না, কাউকে কখনও অবহেলা করেনি। বিশাল এক যৌথ পরিবারে মানুষ, মা-বাবা বর্জিত কাকা-জ্যাঠার সংসারে তার অনাদর ছিল না হয়তো। কিন্তু সে পরিবারের আদর জানাবার সাধ্যই ছিল কম। কাকা পলিটিকস করত—তৎকালীন সি পি আইয়ের নিয়তকর্মী। জ্যাঠা দোকান দিয়েছিল। বাসায় পড়ার ঘর ছিল না। বইপত্র ছিল না, শোওয়ার জায়গারও কিছু ঠিক ছিল না। লক্ষ্মণের বাসায় গিয়ে দৃশ্যটা নিজের চোখে দেখেছে অজিত। লক্ষ্মণের তাই বেশি আপন ছিল ঘরের বাইরের জগৎ। সকলেই ভালবাসত লক্ষ্মণকে। সেবার প্রথম আই এস সি ক্লাসে বিজ্ঞান পড়তে গিয়ে অজিত বস্তুবিশ্বের অণুময় অস্তিত্বের বিষয়ে জানতে গিয়ে ভারী অবাক হয়। বিজ্ঞান, ত্রিকোণমিতি বা অঙ্কের বই খুলে বসে সে এক অবাক বিস্ময়ভরা তত্ত্বজ্ঞানের মুখোমুখি হত। বিশ্বের সব কিছুর অস্তিত্বের স্বরূপ বিশ্লেষণ জানতে গিয়ে তার বহুকালের পুরনো সব ধারণা ভেঙে যাচ্ছিল। বহু ছেলেই আই এস সি পড়ে, তাদের কারও এসব মনেই হয় না। কিন্তু অজিতের ভিতরে চাপা বিষাদরোগ বীজাণুর মতো ওত পেতে ছিল। বিজ্ঞান পড়তে গিয়েই সেই বীজাণুর আক্রমণ টের পায়। সারাদিন বসে ভাবত—এই যে আমি, আমি কতগুলি অণুর সমষ্টি মাত্র? একদিন ঠাট্টা করে কেমিস্ট্রির অধ্যাপক ক্লাসে বললেন—মানুষকে পুড়িয়ে ফেললে খানিকটা কার্বন পড়ে থাকে, খানিকটা জল হয়ে উড়ে যায়। আমাদের এত আদরের শরীরের ওই হচ্ছে পরিণতি। জল আর কার্বন নিয়ে খুবই ভাবতে শুরু করেছিল অজিত। খেতে পারত না, রাতে ঘুমও কমে যেতে থাকে। মাথা-ভরা ওলট-পালট বিজ্ঞানের তত্ত্বজ্ঞান। বস্তুবিশ্বের গঠন, অঙ্কের কাল্পনিক সংখ্যা এবং অসীম চিহ্নের ব্যবহার তাকে মনে মনে ভয়ংকর উত্তেজিত এবং বিষাদগ্রস্ত করে তুলত। ইনফিনিটি শব্দটা নিয়ে ভাবতে বসে সে কেবলই অসীমতার ধারণা করতে গিয়ে মাথা চেপে ধরত ভয়ে। পাগল হয়ে যাব না তো! অবস্থা কাউকে বলাও যায় না। একা সওয়াও যায় না। সব ছেলেরা যখন রসায়নের ক্লাসে বস্তুত মলিকিউলার ভ্যালেন্সি বুঝছে তখন অজিত নিউক্লিয়াস আর তার চারধারে ঘূর্ণমান পরমাণুকণার ধারণা করতে গিয়ে ভারী অন্যমনস্ক হয়ে যেত। বুঝতে পারত অন্যান্য ছেলেদের মতো সে স্বাভাবিক নয়। সে একা, সে আলাদা। তার মতো চিন্তা বা দুশ্চিন্তা অন্য কারও নেই। ঠিক সেই সময়ে একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে লক্ষ্মণকে সঙ্গী পায়। সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ থেকে ওয়েলেসলি হয়ে হেঁটে কালীঘাট ফিরবে লক্ষ্মণ। কারণ তার পয়সা নেই। অজিত বলল—চলো তোমার ট্রামভাড়া আমি দেব। লক্ষ্মণ রাজি হল তবু বলল—পরে উঠব, ময়দান পর্যন্ত হাঁটি চলো। এ সময়ে ফাঁকা জায়গায় হাঁটতে বেশ লাগে। সেই থেকে বন্ধুত্ব। সারা রাস্তা কত কথা বলে গেল লক্ষ্মণ। অজিত ভাল শ্রোতা পেয়ে মনোহরদাস তড়াগের কাছে ঘাসে মুখোমুখি বসে তার বিজ্ঞান-বিষয়ক বিপদের কথা ব্যক্ত করলে লক্ষ্মণ তার হাত চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল—মাইরি, আমারও ওরকম হয়। ‘আকাশের কথা’ নামে একটা বই পড়ে আমার মাথা গোলমাল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। মনে হচ্ছে সেই কথাটাই ঠিক, মানুষ হচ্ছে জন্মান্ধ, তাকে একটা অন্ধকার ঘরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে একটা কালো বেড়ালকে খুঁজে বের করতে হবে। আমার কাকা একবার বলেছিলেন—সৃষ্টির আদি রহস্য জানাবার চেষ্টা করা মূঢ়তা। যদি তা কউ করতে যায় তবে সেই অন্ধকার ঘরে ঢোকার আগে সে যেন তার বোধবুদ্ধি রেখে যায়, নইলে পাগল হয়ে যাবে। তার মতো আর একজনও আছে যে কিনা বিজ্ঞানের তত্ত্বজ্ঞান নিয়ে মাথা ঘামায়—এই কথা জেনে কী রোমহর্ষময় আনন্দ হয়েছিল অজিতের। আজও গায়ে কাঁটা দেয়।
মজ্জাগত বিষাদরোগ যদিও কোনওদিনই ছাড়েনি অজিতকে, তবু ওই বন্ধুত্ব তার মনে একটা, হাওয়া-বাতাসের জানালা খুলে দিল। বড় অকপট, বন্ধুবৎসল ছেলে লক্ষ্মণ। মন-খারপ হলেই অজিত চলে যেত তার কাছে। লক্ষ্মণ তার চিরাচরিত পোশাকে বেরিয়ে আসত। রাস্তায় হাঁটত দুজনে, কয়েক পয়সার চিনেবাদাম কিনে নিত। পার্ক বা লেকের ধারে বসত গিয়ে। সেই বয়সের তুলনায় কিছু বেশি পড়াশুনো ছিল লক্ষ্মণের। বিবেকানন্দের বই ইংরেজিতে পড়েছে, নাড়াচাড়া করেছে কিছু রাজনীতির বই, সবচেয়ে বেশি ছিল তার পত্রিকা পড়ার অভ্যাস—পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে, কীভাবে ঘটছে, কেন—সে সব ছিল তার নখদর্পণে। তার কাছে খুব একটা মানসিক আশ্রয় পেয়েছিল অজিত। ওই ভাবেই তারা বড় হয়। আই এসসি থেকে বি এসসি। তারপরও লক্ষ্মণ পড়ল এম টেক। অনার্স ছিল না বলে অজিত লেখাপড়া ছাড়ে। বরাতজোরে এক ছোট্ট জীবনবিমা কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যায়। লক্ষ্মণ এম টেক-এ ভাল রেজাল্ট করে কিছুদিন চাকরি করল এখানে-সেখানে, একটা প্রফেসারিও করল কিছুদিন। বলত—অজিত, এখানে বড় কূপমণ্ডুকের জীবন। পাসপোর্ট করছি, দেখি কী হয়। পাসপোর্ট করেও রিনিউ করাতে হল লক্ষ্মণকে। প্যাসেজ মানির সংকুলান হত না। ভিসা পচে যেত। অজিতের ছোট্ট কোম্পানি রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে মাইনে-টাইনে বাড়তে লাগল। কাজ কমল। বউ এল ঘরে। এবং বউয়ের সঙ্গে মা বাবার বনিবনার অভাব ঘটাতে অজিত ভবানীপুরের বাসা ছেড়ে আলাদা হয়ে উঠে এল টালিগঞ্জের কাছে। একটু বেশি বয়সেই লক্ষ্মণ গেল কানাডায়। বড় একা হয়ে গেল অজিত। ঘরে বউ, তবু একা। মেয়েরা যে পুরুষের গভীরতার বন্ধু নয় সে সত্য অজিতের চেয়ে বেশি কে জানে! আজ যদি আবার সেই বিষাদরোগ ফিরে আসে তবে অজিত জানে, নিঃসঙ্গতার কাছে ছাড়া ঘরে তার কেউ নেই যাকে বলবে তত্ত্বকথা। কত প্রেমের গল্প লেখা হয়, একটা মেয়েকে নিয়ে কত টানাপোড়েন, কত দ্বন্দ্ব, কত আশা-নিরাশা, ব্যর্থতা ও মিলন, হায়, নারী প্রেম তবু জীবনের কতটুকু মাত্র জুড়ে আছে। মেয়েদের সাধ্য কী স্পর্শ করে ধীমান পুরুষের গভীর নিঃসঙ্গতা! মেয়েমানুষের প্রতি প্রেম তাই ফুরিয়ে যায়, জুড়িয়ে যায়। কিন্তু দূরের লক্ষ্মণের জন্য অজিতের পিপাসা ঠিক জেগে থাকে। বন্ধুর মতো বন্ধু পেলে পৃথিবীর কত বিষণ্ণতার অর্থ হয়ে যায় আনন্দ!
অজিতের ছেলেপুলে হল না। সরকার খেপে খেপে মাইনে বাড়িয়ে গেল। আগে ইউনিয়ন করত, শীলা বকে বকে ছাড়াল ইউনিয়ন। বছরখানেক আগে প্রোমোশন পেয়ে সেকশন ইনচার্জ হয়ে গেল অজিত। শীলাও একটা গার্লস স্কুলে চাকরি করছে। দুজনের রোজগার। ফলে হাতে টাকা জমে গেল কিছু। লক্ষ্মণকে লিখল কাছাকাছি দুটো প্লটে জমি আছে, লক্ষ্মণের জন্য একটা কিনবে নাকি? দুই বন্ধুতে পাশাপাশি থাকবে সারাজীবন। তত্ত্বজ্ঞানী সহৃদয় বন্ধু আর কে আছে! চিঠি পেয়েই লক্ষ্মণ টাকা পাঠিয়েছিল জমি কিনবার জন্য।
ল্যাম্পপোস্টের মাকড়সার জালের মতো ভৌতিক আলোটি লক্ষ্মণের জমির ওপর ময়লা জলের মতো পড়ে আছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টের আশে-পাশে কাঁটাঝোপ। বর্ষাকালে পাগলা চেঁকি, ভাঁট আর আগাছায় ছেয়ে যায়। লক্ষ্মণ জার্মান এক মহিলাকে বিয়ে করেছে, পেয়েছে ইমিগ্রান্ট ভিসা, জমিটা বেচে দিতে লিখেছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিষণ্ণ-গম্ভীর কণ্ঠস্বর ক্রমে উঁচুগ্রামে উঠছে। সেতারের ঝালার মতো। এবার থামবে। ঘোষক বলবে—এতক্ষণ তিনতালে প্রথমে বিলম্বিত এবং পরে দ্রুত রাগ শোনালেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী…ইত্যাদি। অজিতের বিদেশি সিগারেট শেষ হয়ে আসে। ফিল্টারটায় আগুন ধরেছে, পোড়া একটা গন্ধ পাওয়া যায়। সেটা ফেলে দিয়ে আর একটা ধরায় অজিত। রনসন গ্যাসলাইটারটার চাকা ঘুরিয়ে হঠাৎ প্রায় আধফুট উঁচু একটা শিখা তৈরি করে। নিবিয়ে দেয়। লক্ষ্মণ কোনওদিনই ফিরবে না।
শীতের নির্জন রাস্তা দিয়ে কুয়াশায় ডুবন্ত একটা ছায়ার মতো মানুষ আসছে। সামনে এসে চিন্তামগ্ন মুখটা তুলল। অন্ধকার বারান্দায় সম্ভবত সিগারেটের আগুন দেখে জিজ্ঞেস করে—অজিত নাকি?
আরে রণেন!
—খবর আছে।
—কী?
—ভিতরে এস বলছি।
অজিত মন্থর পায়ে ভিতরে আসে। ঘর ভরতি প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর। শীলা বোনা অংশটুকু তুলে আলোয় ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নকশাটা দেখছে। অজিত দরজা খুলে এক বিপর্যস্ত রণেনকে দেখতে পায়। আজকাল রণেন একটু মোটাসোটা হয়েছে। ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়ায় এবং টাক পড়ছে বলে একটু বয়স্ক দেখায়। তবু আজকাল আগের তুলনায় অনেক বেশি রংদার, বাহারি পোশাক পরে সে। আজও পরনে নেভি ব্লু রঙের একটা স্যুট, গলায় টাই, কোটের তলায় দুধসাদা জামা। চুল বিন্যস্ত, দাড়িও কামানো। তবু বিপর্যয়ের চিহ্ন ফুটে আছে তার মুখে-চোখে। হা-ক্লান্ত এবং হতাশা মাখানো মুখ।
শীলা মুখ তুলেই হাতের বোনাটা রেখে দিল। বলল—কী রে দাদা?
সেই মুহূর্তেই প্রধানমন্ত্রী বলে উঠলেন—জয় হিন্দ। এবং জনতা তার প্রতিধ্বনি করল। শীলা নিজেই রেডিয়োটা বন্ধ করে দেয় এবার। উৎকণ্ঠায় রণেনের দিকে চেয়ে থাকে।
রণেন চেয়ারে বসে একটু এলিয়ে হাতের ফোলিও ব্যাগটা মেঝেয় রেখে হাতের চেটোয় মুখটা ঘষে নেয়। বলে—একটু চা কর তো।
—করছি। কী হয়েছে?
—গ্রহের ফের। বলে রণেন অজিতের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে—এল আই সি-তে চেকটায় খোঁজ নিয়েছিলে?
অজিত তার বিদেশি সিগারেটটার ফিল্টার পুড়িয়ে ফেলেছে আবার। সেটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে বলে—নিয়েছি। কাল-পরশুই ইস্যু হওয়ার কথা।
—কিন্তু বাবা আসতে পারছেন না। বহেরু লিখেছে বাবার শরীর ভাল নেই। কলকাতা থেকে ফিরে গিয়েই অসুস্থ। বাবাকে ছাড়া চেক তো ওরা আর কাউকে দেবে না!
—না
—ব্যাপারটা এত দূর ম্যাচিওর করেও ঝুলে গেল!
অজিত ভ্রূ কুঁচকে বলে—শ্বশুরমশাইয়ের কী হয়েছে?
—জানি না। বহেরু ভেঙে তো কিছু লেখেনি। লিখেছে, বুকে ব্যথা। তা থেকে কিছু আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এদিকে আমি সিমেন্টের পারমিট বের করেছি। লোহালক্কড়ও পেয়ে যাচ্ছি সস্তায়। টাকা অ্যাডভান্স করা হয়েছে। এত দূর এগিয়ে আবার বসে থাকতে হবে। চেক-এর ভ্যালিডিটি কতদিন থাকে? তিন মাস?
—ওরকমই।
শীলার মুখটা ম্লান হয়ে গিয়েছিল। বলল—তুই একবার গিয়ে দেখে আয় না!
রণেন একটু চড়া গলায় বলে—যাব বললেই যাওয়া যায়! তোর বউদির বোধ হয় একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেল।
—কী?
—কনসিভ করেছিল। তিন মাস। কাল থেকে ব্লিডিং —
—ইস! কী করে হল? পড়েটড়ে যায়নি তো!
—না। কিছু বলেনি সেরকম। আজ নার্সিং হোমে ভরতি করে দিতে হল। এক সঙ্গে এত ঝামেলা যে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। জলের মতো কিছু টাকা বেরিয়ে যাবে।
কেউ কথা বলল না। রণেনই আবার বলে—অজিত, জমিটার ব্যাপারে তুমি কি আর সময় দিতে পারো না?
অজিত উত্তর দেয় না। হাতের রনসন লাইটারটার দিকে চেয়ে থাকে। শীলা উৎকণ্ঠিত মুখ তুলে স্বামীকে দেখে।
—পারো না? রণেন আবার প্রশ্ন করে।
অজিত ভ্রূ কুঁচকে বিপরীত দেয়ালে কাঠের চৌখুপিতে রাখা হরেক পুতুলগুলো দেখে। প্রধানমন্ত্রী চুপ করেছেন। দূর থেকে সম্ভবত পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কণ্ঠস্বর আসতে থাকে। অজিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—মুশকিল হল, লক্ষ্মণের এক পিসেমশাই প্লটটার ব্যাপারে জানেন। লক্ষ্মণও লিখেছিল যেন তার পিসেমশাইকে প্লটটা আমি বিক্রি করে দিই। উনি আট হাজার টাকা অফার দিয়েছিলেন। আমি লক্ষ্মণকে লিখি যে জমি অলরেডি বায়না হয়ে গেছে, কয়েক দিনের মধ্যেই রেজিষ্ট্রি হয়ে যাবে। এদিকে সেই পিসেমশাই এখনও খোঁজখবর রাখছেন যদি বাই চান্স পার্টি পিছিয়ে যায়, তবে উনিই কিনবেন। ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখা খুবই দৃষ্টিকটু হবে। লক্ষ্মণ কোনও প্রশ্ন তুলবে না, কিন্তু মনে মনে অবাক হবে। তার খুবই ইচ্ছে ছিল পিসেমশাইকে প্লটটা বিক্রি করি।
শীলা ভ্রূ কুঁচকে বলে—তোমার তো খুব বন্ধু সে। তাকে একটু বুঝিয়ে লিখে দাও না।
—বোঝাবার কী আছে! সে তো তাগাদা দেয়নি। তাগাদা যা আমারই। তা ছাড়া ওই পিসেমশাই ভদ্রলোক রিটায়ার করে সামান্য কিছু টাকা পেয়েছেন। কলকাতায় ওই টাকায় জমি পাওয়া যে কী মুশকিল, তাই ভদ্রলোক খুব আশায় আশায় এসেছিলেন লক্ষ্মণের জমিটার জন্য। তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছি জমি বিক্রি হয়ে গেছে বলে। লক্ষ্মণকে আমি এখন কী লিখব?
—একটু সময় চাও।
অজিত অদ্ভুত চোখে শীলাকে দেখে। বলে—চাইব কেন? সে তো আমায় সময় বেঁধে দেয়নি। জমি বিক্রির টাকারও তার দরকার নেই। টাকাটা তার অ্যাকাউন্টে কলকাতার এক ব্যাঙ্কে জমা পড়বে। প্রবলেম তো সেখানে নয়।
—তা হলে আর প্রবলেম কী? তুমি চুপচাপ থাকো জমির ব্যাপারে। বাবা সুস্থ না হয়ে এলে তো রেজিস্ট্রি হবে না।
রণেন ম্লানমুখে বলে—শোনো অজিত, বাবা বুড়ো হয়েছেন, তাঁর অসুখকে বিশ্বাস নেই, গুরুতর কিছু হলে—বলে একটু চুপ করে থাকে রণেন। শীলা তার মুখের দিকে চেয়ে আছে, অজিতও। রণেন চোখটা নামায়, বলে—কাজেই তাঁর ভরসায় থাকাটা এবং তোমাকেও অসুবিধেয় ফেলাটা ঠিক নয়। আমি অন্য একটা ব্যাপার ভাবছি।
—বলো। অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে।
—ধরো যদি টাকাটা আমিই জোগাড় করে দিই তা হলে কেমন হয়?
অজিত একটু বিস্মিত হয়ে বলে—তুমি দেবে? তা হলে এতদিন ওল্ডম্যানের ভরসায় ছিলে কেন?
—সেটা মার আইডিয়া। মার ধারণা বাবার টাকা বারোভূতে লুটে খাবে, তাই বাবার কিছু টাকা ছেলেদের জন্য আদায় করে দিতে চেয়েছিল মা। সেটা যখন আপাতত হচ্ছে না তখন জমিটা কেন হাতছাড়া হয়! বীণার সঙ্গে আমি পরামর্শ করেছি, সে তার কিছু গয়না দেবে, আমিও প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে লোন নিচ্ছি, আরও কিছু জোগাড় করেছি। সব মিলিয়ে জমির দামটা হয়ে যাবে।
শীলা তার বড় বড় চোখ পরিপূর্ণ মেলে রণেনকে দেখছিল। হঠাৎ বলল—জমিটা তা হলে কার নামে কেনা হবে?
রণেন তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেয়। বলে—সেটা এখনও ঠিক করিনি! তবে, মার ইচ্ছে, আমার নামে হোক।
—তোর কী মত?
রণেন একটু ইতস্তত করে বলে—বীণার গয়নার অংশটাই বড়। মেজর টাকাটা ও-ই দিচ্ছে যখন, প্লটটা তখন ওর নামেই কেনা হোক। নইলে ওর বাপের বাড়ির লোকেদের চোখে ব্যাপারটা ভাল দেখাবে না।
শীলা একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে যায়।
রণেন মুখ তোলে।
—অজিত!
—বলো।
—আমি দিন-সাতেকের মধ্যেই পেমেন্ট করব।
—ভাল৷
—তা হলে উঠি!
—বোসো। শীলা তোমার চা করতে গেল।
রণেন বসে। কিন্তু তার মুখচোখে একটা রক্তাভা ফুটে থাকে। সে যে স্বস্তি বোধ করছে না, তা বোঝা যায়। অজিত চেয়ে থাকে। একসময়ে রণেনও তার বন্ধু ছিল, বেশি বয়সের বন্ধু। সেই সূত্রেই ওর বোনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অজিতের। কিন্তু লক্ষ্মণ যেমন বন্ধু তেমন বন্ধু রণেন নয়। এখন ওর দিকে চেয়ে একটু মায়া হয় অজিতের।
রাতে শুয়ে শীলা বলল—শুনছ?
—কী?
—বউদির নামে জমিটা দিও না। আমি অনেক ভাবলাম সারা সন্ধ্যা।
—কী ভাবলে?
—দাদা নানা ছুতোয় ইচ্ছে করেই বউদির নামে প্লটটা কিনছে।
—কিনুক না!
—তুমি কিছু বোঝে না। বউদির নামে বাড়ি হলে সেখানে সোমেন বা মার দাবি-দাওয়া থাকে না। আমরাও সেখানে বাপের বাড়ি বলে মাথা উঁচু করে যেতে পারব না। তুমি ওকে বেচো না।
অজিত সামান্য উম্মার সঙ্গে বলে—সেটা রণেন থাকতে-থাকতেই বলতে পারতে। ওকে কথা দিয়ে দিলাম, তা ছাড়া ও বউয়ের গয়নাটয়নাও বেচেছে বলল।
—ছাই। বউদি গয়না বেচতে দেওয়ার লোক কিনা! তা ছাড়া সবাই জানে দাদা দ’হাতে পয়সা রোজগার করছে। বিয়ের পর থেকেই ও যথেষ্ট পালটে গেছে। তোল্লা ঘুষ খায়। দশ-বিশ হাজার টাকার জন্য ওকে বউদির গয়না বেচতে হবে না। যদি বেচে তো সে লোক দেখানোর জন্য।
অজিত অন্ধকারে একটু হাসল। বলল—আমার কাছে সবাই সমান। পিসেমশাই কিনুক, কী রণেনের বউ কিনুক, কী শাশুড়িই কিনুক—আমার কিছু যায় আসে না।
শীলা ঝংকার দিয়ে বলে—কিন্তু আমার যায় আসে। তুমি দাদাকে বেচতে পারবে না।
—তা হলে কী করব?
—আমি কিনব। শীলা বলে।
—তুমি? তুমি কিনে কী করবে?
—ফেলে রাখব। যেদিন বাবা টাকা দিতে পারবেন সেদিন ছেড়ে দেব।
—তা হয় না।
—কেন?
—বড্ড দৃষ্টিকটু দেখায়। লক্ষ্মণ কী ভাববে? তা ছাড়া রণেন আর তার বউও চটে যাবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দেবে।
শীলা চুপ করে থাকে। ভাবে। বলে—তাহলে লক্ষ্মণবাবুর পিসেমশাইকেই বিক্রি করে দাও।
একটু স্তব্ধ থেকে অজিত বলে—রণেন কি তোমার শত্রু? সে কিনলেও জমিটা তোমার বাপের বাড়ির হাতেই থাকল।
শীলা একটু শ্বাস ফেলে বলে—পুরুষমানুষ তুমি, তোমাদের মন একরকম। মেয়েদের মনই কেবল কু-ডাক ডাকে।
—রণেনকে অত অবিশ্বাস কেন? সংসারটা তো এতকাল সে-ই টানছে। টানবেও। ছেলে হিসেবে রণেন তার সব কর্তব্যই করেছে। তোমার বাবা যখন টাকা তুলতে আসতে পারছেন না, অনিশ্চিত অবস্থায় জমিটা হাতছাড়া না করে রণেন যদি কেনেই তো তাতে দোষ কী! বউয়ের নামে কিনলেও দোষ নেই। নিজের বাড়ি বলে সে যে মা-ভাইকে বের করে দেবে, এমন তো মনে হয় না।
শীলা চুপ করে থাকে। কিছু বলার মতো যুক্তি খুঁজে পায় না বোধ হয়। এক সময়ে বলে—বাবার যে কেন এসময়ে অসুখ করল! চলো না একদিন বাবাকে দেখে আসি।
—তোমার বাবা আমাকে পছন্দ করেন না, জানোই তো!
—কাকেই বা করেন! বাবার ভালবাসা আমরাই পাইনি, যা একটু দাদা পেয়েছে। মার জীবনটা যে কীভাবে কাটল!
অনেকক্ষণ স্তব্ধ থাকে শীলা। তারপর অজিত টের পায়, শীলা ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
ভীষণ অসহায় বোধ করে অজিত। কান্নাকাটি তার সহ্য হয় না। উঠে একহাতে শীলাকে নিজের দিকে পাশ ফেরাবার চেষ্টা করতে করতে বলে—আচ্ছা বোকা তো! কাঁদো কেন? না হয় যাব শ্বশুরমশাইকে দেখতে, রণেনকেও না হয় প্লটটা না বেচলাম।
শীলা তবু কাঁদে। সাধাসাধি করে করে ক্লান্ত হয়ে গেল অজিত। ঘুমও হবে না। অগত্যা উঠে একটা ডানহিল ধরায়।
সেই শব্দে শীলা হঠাৎ ফোঁপানি বন্ধ করে বলে—তুমি চলে গেলে কেন? ভিতরে এস।
—যাচ্ছি। সিগারেটটা খেয়ে নিই।
—না। সিগারেট নেবাও।
—আঃ, একটু অপেক্ষা করো না।
—না, এক্ষুনি ভিতরে এস।
অজিত শ্বাস ফেলে বলে—কখন যে কী মনে হয় তোমার! একখানা হাত টেনে নেয় বুকের ওপর। অজিত আন্দাজে বালিশের তোয়ালে তুলে শীলার চোখ-মুখ মুছে দেয়। বলে—কেন কাঁদলে? বাবার জন্য, নাকি রণেন জমি বউয়ের নামে কিনছে বলে?
—ওসব কারণ নয়।
—তবে?
শীলা চুপ করে থেকে বলে—আমি একটা জিনিস টের পাই আজকাল।
—কী?
—তুমি আমাকে ভালবাস না।
॥ নয় ॥
খুব ভোরেই ঘুম ভাঙল রণেনের। বিছানা আজ ফাঁকা। শুধু বড় ছেলেটা একধারে কেৎরে লেপের তলায় শুয়ে আছে। মেয়ে আর ছোট ছেলে তাদের ঠাকুমার কোল কাড়াকাড়ি করে শুয়েছে, ওঘরে। বড় ছেলেটার মাথায় একটোকা চুল, মস্ত মাথাটা জেগে আছে লেপের ওপরে, মুখ নাক ঢাকা। বীণা আজ পাঁচদিন নার্সিং হোমে।
বুবাইয়ের মুখ থেকে লেপটা সাবধানে সরিয়ে দিল রণেন। ভারী হালকা আর ফুরফুরে আছে মনটা। সকাল থেকেই যে গাম্ভীর্য তাকে চেপে ধরে সেটা কদিন হল একদম নেই। বীণা নার্সিং হোমে যাবার পর থেকেই নেই। অন্যদিন লেপ ছেড়ে উঠতে কষ্ট হয়। আজ হল না। শিস দেওয়া তার আসে না। ছেলেবেলা থেকে অনেক চেষ্টা করে দেখেছে, ঠোঁট ছুঁচোল করে নানা কায়দায় বাতাস ছেড়েছে, বড় জোর একটা কুঁই কুঁই আওয়াজ তুলতে পারে। তবু মন খুশি থাকলে রণেন আড়ালে শিস দেয়। অর্থাৎ ওই আওয়াজটা বের করে। আওয়াজটা একটানা হয় না, বাতাসটা বেরিয়ে যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে একটু কুঁই শব্দ তুলে তার মান রেখে যায় মাত্র।
এক কাকভোরে রণেন উঠে গায়ে হাতঅলা একটা উলিকটের গেঞ্জি পরল, লুঙ্গিটা ঝেড়ে পরতে পরতে ড্রেসিং-টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। নিজেকে দেখে তার খুব বেশি পছন্দ হল না। পেটটা বেশ বেড়ে গেছে, গলায় চর্বির গোটাকয়েক থাক। গাল দুটোও কি বেশ ভারী নয়? ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে দেখল সে। হাত ভাঁজ করে বাইসেপ টিপে দেখল গেঞ্জির ওপর দিয়েই।
না, তেমন শক্ত হয় না আজকাল। অর্থাৎ অপরিহার্য মেদ জমছেই। লোকে বলে তার ব্যক্তিত্ব নেই। ব্যাপারটা সে ঠিক বোঝে না। চিরকালই সে কিছু ঢিলা-ঢালা রশি-আলগা মানুষ, একটু আয়েশি; টিপটপ থাকা তার আসে না। অনেক মানুষ যেমন কল-টেপা পুতুলের মতো ঘুম থেকে উঠে চট-জলদি হাতে নিখুঁত দাড়ি কামিয়ে, দাঁত মেজে, স্নান সেরে, এক্সিকিউটিভ-টি সেজে, ব্রেক-ফাস্ট টেবিলে গিয়ে বসে—তার সেরকম হবেও না কোনওদিন। ফুড-ইনস্পেকটরের বেলা এগারোটার পরে বেরোলেও ক্ষতি নেই, অঢেল আউটডোরে ঘোরা আছে তারপর। কিন্তু বীণা সেরকম পছন্দ করে না। বীণা যে কী চায়!
কিন্তু বীণা আপাতত নার্সিং হোমে। পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেল। তা যাক। রণেন সেটা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। আপাতত সে ব্যক্তিত্ব কথাটা নিয়ে ভাবছিল। তার ব্যক্তিত্ব নেই এটা একটা চাউর ব্যাপার। আয়নায় সে তার ব্যক্তিত্বটা একটু খুঁটিয়ে দেখছিল। প্রথমে সে ছোট চোখে চাইল, তারপর বিস্ফারিত চোখে একবার মুখটা তোল্লা গভীর করল, একবার ছটাকী একটু হাসির বিজলি খেলিয়ে দেখল। বাঁধার এবং ডানধার থেকে দেখে অতঃপর সে ছোট হাত-আয়নাটা বড় আয়নার মুখে মুখে ফেলে নিজের সঠিক চেহারাটা লক্ষ করে। আয়নার উলটো ছায়া পড়ে আর একটা আয়নায় সেই উলটো ছায়াটাকে উলটে নিয়ে নিজের প্রকৃত চেহারাটা দেখা যায়। কিন্তু দেখেটেখে খুব একটা প্রভাবিত হয় না সে। কিংবদন্তীর খানিকটা সত্যিই। চর্বিওলা তুম্বো গাল দুটো আর ছোট চোখে কি ব্যক্তিত্ব ফোটানো যায়! কিন্তু চার্চিলের ছিল, বিবেকানন্দের ছিল। দুনিয়ার বিস্তর মোটাসোটা মানুষের এখনও ব্যক্তিত্ব আছে। কিন্তু সে যখন রোগা ছিল তখনও ছিল না, সে যখন মোটা হয়েছে তখনও নেই।
নেই, কিন্তু তাতে ধৈর্য হারায় না সে। নিরিবিলিতে একা একখানা আয়না হাতের কাছে পেলে সে নিজের দিকে চেয়ে বিস্তর খোঁজে। এবং নিজেকে বিরল ধমকধামকও দেয়। কিন্তু লোকের সামনে সে গম্ভীর মানুষ, কথা কম, ভারী দায়িত্বশীল কাজের মানুষ।
সোমেন বা মা কেউ এখনও ওঠেনি। শিস দেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টাটা চালাতে চালাতে সে দাঁতটাঁত মেজে নিল, ইসবগুলের ভুষি খানিকটা জলে নেড়ে খেল। মোজা এবং একজোড়া ন্যাকড়ার জুতো পরে বেরিয়ে পড়ল। রোজই সে খানিক সকালে বেড়ায় আজকাল। বীণা তার মেদ কমানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।
দরজা ভেজিয়ে শিস দেওয়ার চেষ্টার অবিরল শ্বাসবায়ুর উদ্ভট শব্দটা করতে করতে সে নিচতলার সদর খুলে রাস্তায় পড়ল। ধারেকাছে পার্ক নেই। হাঁটতে হাঁটতে চলে এল যোধপুর পার্কে। ঝিলের ধারে অনেকটা ফাঁকা জমি পড়ে আছে। শোনা যাচ্ছে, একদিন এখানে পার্ক হবে। ফাঁকা জায়গায় পড়েই দ্রুতপায়ে চক্কর দিতে থাকে সে। লক্ষ করে, সে আজ বড্ড সকালেই চলে এসেছে। কাছেপিঠে কেউ নেই। শুধু দূরে দু-চারজন খাটালওলা লোটা হাতে ফাঁকা ঝিলপাড়ে যাচ্ছে প্রাকৃতিক কাজে। সে দ্রুত চারদিক দেখে নিয়ে লুঙ্গিটা কেচে নিয়ে ফটাস করে মালকোঁচার মতো এঁটে নিল। প্রকাণ্ড উরুত দুটো বেরিয়ে পড়েছে, উঁচু হয়ে আছে দাবনা। একটু লজ্জার ভাব ঝেড়ে ফেলে পাঁই পাঁই দৌড়োতে লাগল সে। মেদটা ঝরাতেই হবে। শরীর বা মনে একটা গভীর পরিবর্তন দরকার। রণেনের ঠিক রণেন হয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। হঠাৎ নিজের সব ভেঙেচুরে ফেলে হয়ে যেতে ইচ্ছে করে স্লিম ফিগারের একজন এক্সিকিউটিভ, কিংবা পারসোনালিটিঅলা ডাইরেকটর, কিংবা হেভি ফাঁটের একজন ডিপার্টমেন্টাল সেক্রেটারি। যাহোক কিছু একটা। শুধু ফুড ইনস্পেকটর রণেন লাহিড়ি বাদে।
দু-চক্কর ঘুরতেই জিব বেরিয়ে গেল। শুকনো টাকরায় লেগে জিবটা টকাস শব্দ করে। দু-চারজন বুড়োসুড়ো মানুষ রাস্তায় হাঁটছে, চেয়ে দেখছে তাকে, রণেন দাঁড়িয়ে লুঙ্গি নামায় প্রচণ্ড হাঁফাতে হাঁফাতে বুকে হাত চেপে হৃৎপিণ্ডকে সামাল দেয়—র’ বাবা র’!
যতদূর সম্ভব গম্ভীর হয়ে বাসায় ঢুকল সে। বাচ্চাগুলো এখনও ওঠেনি। মা নার্সিং হোমে বলে ঠাকুমার প্রশ্রয় পায় বড্ড বেশি। বীণা থাকলে ঠিক এই শীতভোরে তুলে দিত, ঠকঠকিয়ে শীতে কাঁপতে কাঁপতে দাঁতটাঁত মেজে সেগুলো পড়তে বসত এতক্ষণে। দেখে ভারী কষ্ট হয় রণেনের। ক’দিন ঘুমিয়ে নিক। বাচ্চাবেলায় শীতভভারের লেপঘুম যে কী আরামের! আহা, ঘুমোক।
সোমেন রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে হাই তুলছে। চা ওর প্রাণ। মা আঁচলে চেপে চায়ের কেটলি নামাল গ্যাস-উনুন থেকে। রণেন সাধারণত নিজের ঘরে বসে চা খায়, একা। রান্নাঘরের দরজায় বসে চা-খাওয়া যে কী মৌজের তা বীণার রাজত্বে সে টেরই পায় না। সংসারের কর্তা সকলের সঙ্গে মেঝেয় বসে হুইহাট চা খাবে, কী গল্প করবে—তাতে ওজন কমে যায়। আজকাল বীণা নেই। সোমেনের পাশেই মেঝের ওপর থপাস করে বসে সে। আরামের একটা শব্দ তোলে—ওঃ ও! মাজাটায় একটা খচাং টের পায়। বুড়ো হাড়ে দৌড়টা ঠিক হজম হয়নি। সোমেন তটস্থ হয়ে সরে জায়গা দেয়। মা কলকা ছাপের খদ্দরের চাদরের মোড়ক থেকে মাথা বের করে তাকে দেখে। সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বহীন একগাল হাসে রণেন। বলে—মেরে দিলাম একটা দৌড়।
সোমেন হাঁ করে তাকায়। মা বলে—কী বলছিস? কাকে মারলি?
রণেন ভারী আমুদে গলায় বলে—যোধপুর পার্কে বেড়াতে যাই তো রোজ, আজ দেখলাম ফাঁকা, কেউ নেই। লুঙ্গিটা কেঁচে নিয়ে মারলাম দৌড়। মাজাটা গেছে। ওঃ।
—ইস! ওসব দৌড়ঝাপ কি তোর সয়! মা দুঃখের গলায় বলে—তোর হচ্ছে আদুরে ধাত।
—ওই আদর দিয়ে দিয়েই তো খেয়েছ। এই বয়সে পোয়াতির মতো ভুঁড়ি, নাড়ুগোপাল নাড়ূগোপাল চেহারা! চা দাও তো।
মা একটা শ্বাস ফেলে বলে—আদর আর দিতে পারি কই? বউয়ের হাতে দিয়েছি, সে যা দিয়ে যা করে। আমাদের কি আর আদর দেওয়ার ক্ষমতা আছে।
কী কথার কী উত্তর! তবু গায়ে মাখে না রণেন। প্রায় চোদ্দো বছরের ছোট ভাইটার দিকে চায়। তারই ভাই, তবু চেহারায় প্রায় বিপরীত। লম্বা, রোগাটে, চোখা বুদ্ধিমানের চেহারা। অল্প বয়স, দাড়িকাড়িও ঠিকমতো কামায় না, নইলে ঠিকই বোঝা যায় যে ব্যক্তিত্বের চেহারা।
রণেন হঠাৎ বলে—বসে না থেকে আই এ এসটা দিয়ে দে না!
সোমেন অবাক হয়ে বলে—আই এ এস! আমি?
রণেন মাথা নাড়ে। বলে—আজকাল যেন কোথায় ট্রেনিং দেয়?
—ইউনিভার্সিটিতে।
—ভরতি হয়ে যা। আমি টাকা দেব। নিশ্চিত গলায় বলে রণেন।
সোমেন সামান্য হাসে, বলে—টাকাফাকার জন্য নয়। আমার ইচ্ছে করে না।
—কেন, ইচ্ছে করে না কেন?
—ওসব আমার হবে না। খামোখা চেষ্টা।
—দ্যাখ না। লেগে যেতে পারে। বলে খুব ভরসার হাসি হাসে রণেন। বহুকাল এমন সহজভাবে কথাবার্তা হয়নি তিনজনে। বীণা নার্সিং হোমে যাওয়ার পর থেকে হচ্ছে। ভাইয়ের দিকে একটু চেয়ে থাকে রণেন। ওই রকম তেইশ চব্বিশ বছর বয়সে তারও কি সোমেনের মতো চেহারা ছিল? অবিকল না হলেও ওরকমই অনেকটা ছিল সে। বহেরুর খামারবাড়িতে সে যেতটেত তখন। নয়নতারার সঙ্গে তখন তার একটা সম্পর্ক ছিল।
মনে পড়তেই ফুড়ুক ফুড়ুক একটু হেসে ফেলল সে, আপনমনেই। ব্যক্তিত্বের অভাব। হাসিটা চাপা উচিত ছিল। গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে বলল—বহেরুর ওখানে কাকে কাকে দেখলি?
সোমেন বলে—কাকে দেখব? হাজারটা লোক, কাউকে আলাদা করে দেখার উপায় কী? তবে গন্ধ বিশ্বেস, দিগম্বর…
বিরক্ত হয়ে রণেন বলে—ওরা নয়।
—তবে?
—বহেরুর ছেলেপুলেদের কাকে দেখলি?
—চারটে ছেলের সঙ্গে আলাপ হল, আরও সব আছে। একটা মেয়েকে দেখলাম—বিন্দু, ডিভোর্সড।
—ডিভোর্সড আবার কী! ওরা ওইরকম, ছেড়ে চলে আসে, আবার বিয়েফিয়েও করে। আইনটাইন মানে না। আমি যখন যেতাম তখন নয়নতারা নামে একজন ছিল, সেও ওইরকম—
সোমেন মাথা নেড়ে বলে হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে একজন। আলাপ হয়নি। দূর থেকে আমাকে খুব দেখছিল।
রণেন আপনমনে হাসে। বহুকাল আগের কয়েকটা দিন মনে পড়ে। নয়নতারা খুব জমিয়েছিল তার সঙ্গে। বেশি কিছু নয় অবশ্য। এই একটু জড়িয়ে-উড়িয়ে ধরা। দু-চারটে চুমু, আনাড়ির কাজ সব। তবু ভোলা যায় না। সে সবের জন্য সে তার পৈতেয় পাওয়া একটা আংটি খুলে দিয়ে এসেছিল নয়নতারাকে। বাড়ি এসে একটা ছিনতাইয়ের গল্প বলেছিল। মা অনেকদিন আংটিটার কথা দুঃখ করে বলেছে। আংটিটা তার নামের দুটো আদ্য অক্ষর মিনা করা ছিল—আর এল। আংটিটা কি আজও আছে নয়নতারার আঙুলে, বা বাক্সে? ভারী বিহ্বল লাগছিল ভাবতে।
সুখের স্বপ্নটা ভেঙে হঠাৎ চমকে ওঠে রণেন। ভারী ভয়-ভয় করে হঠাৎ। আংটিটা কি এখনও রেখেছে নয়নতারা? সর্বনাশ ওই আংটি দিয়ে যে এখনও অনেক কিছু প্রমাণ করা যায়। রণেন মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলতে থাকে—অবশ্য, বেশি কিছু নয়, বেশি কিছু নয়। সবই আনাড়ির কাজ, ছেলেমানুষি…ইত্যাদি।
চায়ের সুঘ্রাণ এবং তাদের তিনজনের এই কাছাকাছি বসে থাকা—বেশ ভাল লাগছিল রণেনের। বলল—সোমেন, কাল তুই বরং নার্সিং হোমে যাস, বউদিকে দেখে আসিস। আমি বরং কাল একবার বাবাকে দেখতে যাই।
সোমেন বলল—তোমার যাওয়ার কী দরকার? আমিই বরং—
—না, না। কাল রবিবার আছে। আমিই যাব’খন। অনেককাল যাই না। বাবাকে দেখে আসি, বহেরুটাও গড়বড় করছে
মা বলে—বউমাকে আর কদিন রাখবি ওখানে?
—আছে থাক না। রণেন অন্যমনস্কভাবে বলে—বেশ তো আছে। বলেই নিজের ভুল বুঝতে পেরে কথা উলটে বলে—ডাক্তার ঠিক এখনই ছাড়তে চাইছে না।
মা একটু অনুযোগ করে—ততাদের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। হুট বলতে ডাক্তার। হুট বলতে নার্সিং হোম। মেয়েরাও কেমনধারা হয়ে গেল, সজ্ঞান অবস্থায় একটা পরপুরুষ ডাক্তার মেয়েদের শরীরে হাত দেবে এ কেমন কথা! পেটে বাচ্চা এলে দশবার চেক-আপ, লজ্জা হায়া কোথায় যে গেল। তুই নিয়ে আয় তো, কিছু হবে না।
সোমেন এসব শুনে উঠে পড়ে। রণেন হাসে। বলে—ডাক্তারই ছাড়তে চাইছে না যে!
—কেন? স্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, অপারেশনও যখন দরকার নেই, তখন আর গুচ্ছের টাকা গুনবি কেন?
—অপারেশন! বলে একটু চোখ বড় করে চায় রণেন। বলে—একটা মাইনর অপারেশন দরকার ছিল বটে।
—তা না হয় সেটাই করিয়ে আন।
—পাগল হয়েছ? ওখানকার ডাক্তার হচ্ছে সাহা। এমনিতে ডাক্তার ভালই। কিন্তু দিনরাত কেবল খাওয়ার গল্প। অমন ইলিশ-ভক্ত তোক দুটো নেই। আমাকে প্রায়ই বলে—পদ্মার ইলিশ! ও আর উনুনে চড়াতে হয় না, একটু তেল-সরষেবাটা মেখে বগলে চেপে রাখুন, বগলের ভাপেই সেদ্ধ হয়ে যাবে—এত নরম সুখী মাছ! বলতে বলতে বুঝলে মা, ডাক্তারের চোখ দুখানা স্রেফ কবির চোখ হয়ে গেল। উদাস, অন্যমনস্ক। হাত থেকে স্টেথেসকোপের চাকতিটা পড়ে গেল ঠকাস করে, চশমা খুলে বুঝি চোখের জলও মুছল। সেই থেকে অপারেশনের নামে আমি ভয় পাই। রুগির শরীরে ছুরি বসিয়ে যদি লোকটার হঠাৎ ইলিশের কথা মনে পড়ে, যদি ওরকম অন্যমনস্ক আর উদাস হয়ে যায়, তা হলে তোমার বউমার কী হবে!
সোমেন যেতে যেতেও শেষটুকু শুনে হেসে ফেলে। মা স্মিতমুখ ফিরিয়ে নেয়।
বেলায় অফিস বেরনোর সময়ে রণেনের মাজার ব্যথাটা যেমন খচাং করল একবার জুতোর ফিতে বাঁধার সময়ে, তেমনি তার মনেও একটা খচাং খিঁচ ধরল হঠাৎ। সে যে বউয়ের নামে জমিটা কিনতে চেয়েছে এটা মা জানে না তো! নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য সে বেরোবার মুখে জিজ্ঞেস করল—ওরা কেউ এসেছিল নাকি মা?
—কারা?
—শীলা, কিংবা অজিত।
মা বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে—আসবে কী! সেখানেও আদেখলাপনার চূড়ান্ত।
—কেন?
—মেয়ের নাকি পেটে বাচ্চা এসেছে। ডাক্তার বলেছে পাঁচ মাস পর্যন্ত নড়াচড়া বারণ। জামাই ডানলোপিলোর কুশন কিনে তিনরাত মেয়েকে শুয়ে থাকার কড়া আইন করেছে। পাশের বাড়িতে ফোন করে জামাই জানিয়ে দিয়েছে, মেয়ে এখন আসবে না।
—ওঃ। বলে রণেন নিশ্চিন্তমনে বেরোয়। পাঁচ মাসের জন্য নিশ্চিন্ত।
কিন্তু বাসরাস্তার দিকে হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ মনে পড়ে—নিশ্চিন্ত! দূর বোকা! নিশ্চিন্ত কীসের? শীলা না এলে মাও তো যেতে পারে ওদের বাড়িতে!
সমস্যাটা ভেবে সে একটু থমকায়। তারপরই আবার দার্শনিক হয়ে যায়। জানবেই তো, একদিন তো জানবেই!
যেমন সুন্দরভাবে দিনটা শুরু হয়েছিল সেভাবে শেষ হল না।
কলকাতায় আজকাল ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিং হোম গজিয়ে উঠেছে। দোকানঘরের ওপরে, কারখানার পাশে, অফিসবাড়িতে সর্বত্রই নার্সিং হোম। ভাল ব্যাবসা। বীণাকে যে নার্সিং হোমে ভরতি করেছে রণেন সেটাও একটা এরকমই জায়গা। মধ্য কলকাতার জরাজীর্ণ বাড়িতে ঝকঝকে সাইনবোর্ড লাগানো। নীচের তলায় সামনের দিকে কাপড়ের দোকান, পিছনের দিকে এক আমুদে অবাঙালি পরিবারের বাস; দোতলায় নার্সিং হোম, তিনতলায় বোধ হয় কোনও পাইকারের গুদাম। নীচের তলায় সবসময়েই হয় রেডিয়ো, নয়তো স্টিরিও কিংবা পিয়ানো অ্যাকোর্ডিয়ান রেওয়াজের শব্দ হচ্ছে। ওপরতলায় কুলীদের মালপত্র সরানোর শব্দ। সামনের রাস্তাতেও কোনও নৈঃশব্দ্য নেই। ট্রাম এইখানে বাঁক নেয় বলে প্রচণ্ড ক্যাঁচকোচ শব্দ তোলে। লরির হর্ন শোনা যায়। শীতের শুকনো বাতাসে পোড়া ডিজেল, ধুলো আর আবর্জনার গন্ধ আসে অবিরল। তবু নার্সিং হোম।
রক্ত বন্ধ হয়েছে। বীণাকে একটু ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, তবু সামলে উঠেছে অনেকটা। রণেনকে দেখে একটু কর্কশ স্বরে বলল—টুবাইকে আজও আনলে না?
রণেনের মেজাজ ভাল নেই। ভিতরে নানারকমের অস্থিরতা। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে বলল—কেমন করে আনব? আমি সোজা অফিস থেকে আসছি।
—অফিস থেকে আসছি, অফিস থেকে আসছি—রোজ এক কথা। বীণা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
—ট্রামবাসের অবস্থা তো জানোই। বাসায় ফিরে টুবাইকে নিয়ে আসতে আসতে ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে যেত।
বীণা ঝেঁঝে ওঠে—ভিজিটিং আওয়ার্স না হাতি! সারাদিন রাজ্যের লোক আসছে যাচ্ছে! পরশু এক ছুঁড়ি ভরতি হয়েছে, তার কাছে সারাদিনই দু-তিনটি ছোঁড়া আসছে, ফুল, ক্যাডবেরি, সিনেমার কাগজ দিয়ে যাচ্ছে, গুজগুজ ফুসফুস করছে—তারা আসছে কী করে? আর তোমার অফিসটাই বা কোন জেলখানা? সারাদিন তো টো-টো করে বেড়ানোই তোমার চাকরি! একটু আগে বেরিয়ে টুবাইকে নিয়ে আসতে পারলে না?
এরকম ভাষাতেই বীণা আজকাল কথা বলে। রণেন চুপ করে থাকে। আসলে রাগটা তার সোমেন আর মার ওপর গিয়ে পড়ে। পরশু থেকেই সোমেনকে বলছে বুবাই, টুবাই আর শানুকে নিয়ে একবার নার্সিং হোমে তাদের মাকে দেখিয়ে যেতে। ট্যাক্সি ভাড়াও কবুল করা ছিল। সোমেন, তেমন উৎসাহ দেখায়নি। মাও আপত্তি করেছে—মোটে তো তিনদিন হল গেছে, এর মধ্যে ছেলেমেয়েদের জন্য হেদিয়ে পড়ার কী! ওদের তো মায়ের জন্য কিছু আটকাচ্ছে না!
তা ঠিক। বীণাকে ছাড়াও ছেলেমেয়েদের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। মা যক্ষীবুড়ির মতো সংসারের সব কিছু আগলে রেখেছে।
রণেন চুপ করে ছিল। বীণা মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করে—ডাক্তার কী বলল?
—আরও কয়েকদিন এখানে রাখতে বলছে।
—আরও কয়েকদিন রাখতে বলার মানে জানো? টাকা মারার ধান্ধা। আমি থাকব না। তুমি ট্যাক্সি ডাকো, আমি আজই চলে যাব।
—ডাক্তারের অমতে কি যাওয়া ঠিক হবে?
—হবে। আমি ভাল আছি। ছেলেমেয়ে না দেখে আমি থাকতে পারি না। এখানকার অখাদ্য খাবারও মুখে দিতে পারি না, দু’দিন প্রায় উপোস যাচ্ছে। তুমি ট্যাক্সি ডাকো।
—ব্লিডিংটা মোটে কালই বন্ধ হয়েছে, দুটো দিন থেকে যাও।
—না। বলে বীণা মাথা নাড়ল। তারপর অভিমানভরে বলল—আমার তো এমন কেউ আপনজন নেই যে বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার দিয়ে যাবে রোজ। এখানে সকলের বাড়ি থেকে ভাত আসে, আমাকেই কেবল এদের হাতের অখাদ্য রান্না খেতে হচ্ছে।
রণেন একটা শ্বাস ফেলে বলে—পরশু নিয়ে যাব। কথা দিচ্ছি।
বীণা অবাক হয়ে বলে—পরশু? মাথা খারাপ! এই নরকে আর এক রাতও নয়। তুমি আমাকে এখানে রেখে কী করে নিশ্চিন্ত আছো? সুস্থ মানুষ এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি আজই চলে যাব।
রণেন মলিন মুখে ওঠে।
ইলিশের কবি ডাক্তার সাহা গাঁইগুঁই করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেড়েও দিল।
ট্যাক্সিতে ওঠার পর, বীণার যেটুকু অসুস্থতা ছিল সেটুকুও ঝরে গেল। দিব্যি এলিয়ে বসে বাইরের দিকে চেয়ে রইল একটুক্ষণ, মুখ না ঘুরিয়েই বলল—অজিতবাবুর সঙ্গে কথা বলেছ?
—বলেছি।
—কী বলছে?
—কী আবার! ও তো রাজিই।
—শীলা কী বলল?
—কী বলবে?
—জমিটা আমার নামে কিনতে চাও শুনে কিছু বলল না?
—না। তবে আমি কাল একবার বাবার কাছে যাব।
বীণা মুখ চকিতে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করে—কেন?
—বাবার শরীর খারাপ, একবার দেখে আসি।
—ও। বলে মুখ ফিরিয়ে নিল বীণা। তারপর একটু চুপ করে থেকে গলা আর একটু মৃদু, এবং আর একটু কঠিন করে বলল—শীলার কথায় হঠাৎ হুট করে বাবার কাছে যাওয়ার কথা বললে কেন?
রণেন এত সাংসারিক বুদ্ধি রাখে না। তর্কও তেমন আসে না তার। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল—বাবা যদি কলকাতায় আসতে পারেন তবে জমিটা বাবার টাকাতেই কেনা হবে, মার নামে।
—তাই বাবাকে দেখতে যাচ্ছ?
—হ্যাঁ।
বীণা তার চোখে চোখ রেখে তেমনি কঠিন গলায় বলে—সেজন্যই আমাকে আরও দু-দিন নার্সিং হোমে ফেলে রাখতে চেয়েছিলে, যাতে আমি জানতে না পারি যে তুমি বাবার কাছে গেছ?
কথাটা ঠিক। বীণার বুদ্ধির প্রশংসাই করতে হয়। তবু রণেন একটু রেগে গেল। বলল—কেন, তোমাকে ভয় করে চলি নাকি! বাবার কাছে যাওয়াটা কি দোষের কিছু?
—তা বলিনি।
—তবে?
—যা খুশি করো, কিন্তু আমার কাছে লুকচ্ছ কেন?
রণেন উত্তেজিত হয়। মুখে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু চঞ্চল হাতে একটা সিগারেট ধরায়। বীণা চেয়ে আছে মুখের দিকে, জবাব চাইছে।
রণেন গলা ঝেড়ে বলে—লুকোইনি। জমিটা মার নামে কেনা হবে বলে ঠিক হয়েছিল, এখন হঠাৎ তোমার নামে কেনা হলে খারাপ দেখায়।
—খারাপ লাগবে কেন? বাবা কলকাতায় আসতে পারছেন না, অজিতবাবুও জমি বিক্রির জন্য সময় দিচ্ছেন না। সেক্ষেত্রে জমিটা আমি তোমার টাকা দিয়ে কিনে নিতে বলেছি। তাতে দোষের কী? আর তোমার টাকা দিয়ে যদি কেনা হয় তবে মার নামে কেনা হবে কেন? যদি আমার নামে নাও কেনো, তুমি নিজের নামে কিনবে।
—তাতে মা খুশি হবে না। মা চেয়েছিল, আমাদের দুই ভাইয়ের নামে কেনা হোক, আমি বলেছিলাম, মার নামে কেনা হোক।
—সে হত যদি শ্বশুরমশাই টাকা দিতেন। তিনি যদি না দেন তবে অমন সস্তার সুন্দর জমি তো হাতছাড়া করা যায় না!
—মার ইচ্ছে দুই ভাইয়ের অংশীদারি থাক।
বীণা অত্যন্ত বিদ্যুৎগর্ভ একটু হেসে বলে—তার মানে মা তোমাকে বিশ্বাস করেন না। তাঁর ধারণা, সোমেনকে তুমি আলাদা করে দেবে।
রণেন সেটা জানে। তাই উত্তর দেয় না।
বীণা বলল—একটা কথা বলি। যদি শ্বশুরমশাই শেষ পর্যন্ত টাকা দেন আর জমিটা যদি মা কিংবা তোমাদের দুই ভাইয়ের নামেই কেনা হয়, তা হলেই বা বাড়ি করার টাকা দিচ্ছে কে? ওই দশ হাজারে জমির দাম দিয়ে যা থাকবে তাতে তো ভিতটাও গাঁথা হবে না। যেমন-তেমন বাড়ি করতেও ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার ধাক্কা। জমি যদি মায়ের নামে হয়। বাড়িও তাঁর নামেই হবে, ভাগীদার তোমরা দুই ভাই। বাড়ির টাকার অর্ধেক তা হলে হয় মার দেওয়া উচিত, নইলে দেওয়া উচিত সোমেনের। তারা কি দেবে?
—কোত্থেকে দেবে?
—তা হলে তোমাকেই দিতে হয়। তুমি যদি বাড়ি তৈরির পুরো খরচ দাও তা হলেও পুরোটা কোনওদিন ভোগ করতে পারবে না। অর্ধেক দাবি সোমেনের। তা হলে ওই ভাগের জমিতে তুমি বাড়ি করার খরচ দেবে কেন?
রণেন যুক্তিটা বোঝে। কিন্তু মানতে চায় না। তার মাথায়, বোধ বুদ্ধিতে কেবলই একটা কথা খেলা করে যে, এই যুক্তিতে একটা মস্ত বড় অন্যায় রয়ে গেছে। কিন্তু সেটা ঠিক ধরতে পারে না রণেন। কিছু বলতেও পারে না। কিন্তু ছটফট করে। বীণা আর কয়েকদিন নার্সিং হোমে থাকলে সে ঠিকই অন্যায়টা বুঝতে পারত।
বাড়িতে ঢুকবার আগে রণেন তার কষ্টকর গাম্ভীর্যের মুখোশটা মুখে এঁটে দিল আবার।
Leave a Reply