১২. কবি আখতার শিরানী

১২. কবি আখতার শিরানী

আল্লা জানে এরই মধ্যে কত বছর গত হয়ে গেছে। স্মৃতিশক্তি এত দুর্বল যে, সন এবং তারিখ মনে থাকে না। অমৃতসরে গাজি আবদুর রহমান সাহেব দৈনিক মাসাওয়াত’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। এর সম্পাদনার জন্য বারিসাহেব (আলিগড়) এবং আবুল আলা চিশতী আস্ সাহাফীকে (হাজি লকলক খ্যাত) ডেকে পাঠানো হল। এ সময়ে আমার ভবঘুরে জীবন চরম পর্যায়ে। দিনভর সারা শহর চষে বেড়াতাম। মনমেজাজ বিগড়ে থাকত। এ সময় আমি টের পাইনি, তবে পরে বুঝতে পেরেছি। আমার মস্তিষ্কটা সারাক্ষণ নিজের পথ খুঁজে পাবার জন্যে মাথা কুটে মরত। জিজের হোটেলে (সিরাজ) প্রায় প্রতিদিনই আড্ডা বসত গালগল্পের। বালা, আনোয়ার পেইন্টার, আশেক ফটোগ্রাফার, ফকির হোসেন এবং আরও এক ব্যক্তি যার নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না, রীতিমতো এই আড্ডায় শামিল হত। সব রকম বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হত। বালা বেশ বলতে পারত ভালো। মনমেজাজটাও ছিল তার রোমান্টিক। যেদিন সে অনুপস্থিত থাকত আসর মোটেই জমত না আমাদের। ভালো কবিতা রচনা। করতে পারত। তার কবিতার এক চরণ আমার এখনও বেশ মনে আছে:

আশ্‌ক্‌ মুজগাঁ পে হায়
আটকছা গ্যায়া,
নোক ছি চুভ্‌ গেয়ি হ্যায়
ছালে মে।

জিজে থেকে শুরু করে আনোয়ার পেইন্টার পর্যন্ত সংগীত এবং কাব্যচচার ব্যাপারে কম যেত না। আর ভদ্রলোকের নাম ভুলে গিয়েছিলাম তার নাম হচ্ছে ক্যাপ্টেন ওয়াহিদ। নীল একজোড়া চোখ। শক্ত সুঠাম লম্বা চওড়া একজন দশাসই লোক। তার প্রিয় হবি ছিল শ্বেতাঙ্গদের ঠ্যাঙানো। তিনি বেশ কজন ইংরেজকে পিটিয়েছেন। বেশ চোস্ত ইংরেজি বলতে পারেন। অভিজ্ঞ তবলচিদের মতো তবলা বাজাতে পারেন।

এ সময় জিজের হোটেলে আখতার শিরানী নামক একজন কবি সম্পর্কে বেশ আলাপ-সালাপ হত। প্রায় প্রতিটি সভাসমিতিতে তার কবিতা এবং গজল গাওয়া হত। জিজে প্রায়শ ম্যায় আপনে ই মে ছব কুছ তাবাহ কর লোঙ্গা (সম্ভবত এ বচন হুবহু এ রকম নয়) গুনগুন করে গাইত। অর্থাৎ আমার প্রেমের জন্যে সব কিছু বিলিয়ে দেব। এ ধরনের একটা প্রেমাবেগ তখন সকলের মনেই সঞ্চারিত ছিল। দয়িতাকে উদ্দেশ্য করে এ ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ তখন বেশ মনঃপূত ছিল সকলের জন্য। জিজে আখতার শিরানীর নামে একেবারে পাগল ছিল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে পয়সা উশুল করছে আর গাইছে, আয় ইশক কাহি লে চল মুঝে। অথবা মোসাফিরদের কামরা দেখিয়ে দিচ্ছে আর গাইছে; কেয়া বিগাড় জায়েগা রাহ যাও এহি রাত কি রাত।

আশেক ফটোগ্রাফারের কণ্ঠস্বর যদিও কিছুটা পাতলা ধরনের ছিল তবু তার কণ্ঠে ‘ইশক কাঁহি লে চল’ অপূর্ব শোনাত। আমি যখনই তার মুখে এ গান শুনতাম ভাবাবেগে। আপ্লুত হয়ে উঠতাম। তখনকার দিনগুলোতে যেহেতু মনটা ছিল উদাস ও নানা অনিশ্চয়তায় ভারাক্রান্ত, তাই এসব গান আমাকে দূরে বহু দূরে স্বপ্নলোকে নিয়ে যেত। হারিয়ে যেতাম আবেগের অথই পাথারে।

এতকাল চলে গেছে কিন্তু তখনকার সে সময়ের মানসিক প্রতিক্রিয়া এখনও যেন আমি অনুভব করি। তখনকার দিনগুলোর ভাবনাচিন্তাই ছিল অন্যরকম। জিজের হোটেলের প্রায়ান্ধকার অথচ শীতল প্রকোষ্ঠে বসে আমি চিন্তা করতাম, আমি একটা দোলায়মান নৌকোতে বসে আছি। নৌকোর চারিদিকে পরিরা আমাকে নাগর দোলা দিচ্ছে। সময়টা ছিল রাতের বেলা তাই পরিদের চাক্ষুষ দেখিনি, দেখেছি শুধু ছায়ার মিছিল। ওদিকে সমুদ্রের তাণ্ডব শান্ত হয়ে এসেছে। নৌকোগুলো হালছাড়া ভেসে যাচ্ছে ধীরে ধীরে যেন অজানার উদ্দেশে। এই পাপের পৃথিবী পেছনে রয়ে গেছে, আর আমরা চলেছি কলরবপূর্ণ এই পৃথিবীকে পেছনে রেখে হাজার হাজার মাইল সামনের দিকে।

জিজের হোটেলে কিছুদিন পর বারিসাহেব এবং চিশতী সাহেবেরও আনাগোনা শুরু হল। দুজনেই এসে খাবার খেতেন অথবা চা পান করে চলে যেতেন। কিন্তু জিজে যখন জানতে পারল এরা দুজন খবরের কাগজের লোক তখন গায়ে পড়ে পরিচয় করে একটা সম্পর্ক তৈরি করে নিল।

বারিসাহেব আখতার শিরানীর কাব্যকর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে এই কবিকে জানতেন না। চিশতী সাহেব বেশ কিছুকাল বাগদাদ এবং মিশর ইত্যাদি জায়গা পরিভ্রমণ করে সবে নতুন এসেছেন। এ জন্যে এখানকার কবি সাহিত্যিকদের সম্পর্কে তিনি তেমন খোঁজখবর রাখতেন না। কিন্তু তিনি জিজের কাছে আখতার শিরানীর কবিতার উদ্ধৃতি শুনে বেশ মুগ্ধ হন।

এ সময় আমিও বারিসাহেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি। তার সহজ সরলতা এবং সাহিত্যিকসুলভ রসিকতা আমার বেশ লাগত। মানসিক দিক থেকে প্রভাবান্বিত করে ক্রমান্বয়ে আমাকে সাংবাদিকতার দিকে আকৃষ্ট করেন তিনি। সাহিত্যসাধনার ব্যাপারেও তিনি আমাকে পথ প্রদর্শন করেন। প্রথম দিকে আমি তীর্থরাম ফিরোজপুরির উপন্যাস পাঠ করি। অতঃপর বারিসাহেবের নির্দেশক্রমে আমি অস্কার ওয়াইলড ও ভিক্টর হুগোর লেখা পাঠ করি। হুগোর লেখা আমার বেশ পছন্দ হত। পরে আমি উপলব্ধি করলাম এই ফরাসি লেখকের ধাঁচটি বারিসাহেবের লেখায় ছায়াপাত করেছে।

যেহেতু আমি ততদিনে সাহিত্য সম্পর্কে বেশ অনেক কিছু রপ্ত করেছি এজন্যে আমি আখতার শিরানীর লেখাকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করি। তার কাব্য বেশ ঝরঝরে এবং হালকা রোমান্টিক ধাঁচের ছিল। আর আমার বেশ মনে হচ্ছে, আখতার শিরানী নিছক কলেজ ছাত্রদের কবি ছিলেন। এরা হচ্ছে এক বিশেষ বয়সের তরুণ, যাদের মন-মগজে শুধু রোমান্টিকতা কিলবিল করে। আমিও এই জগতে পা রাখতে সচেষ্ট হলাম। এক বন্ধু জানাল আখতার শিরানী এদিকে এসেছেন এবং সিরাজ হোটেলে উঠেছেন। তখনই রওনা দিয়ে সেখানে পৌঁছলাম। কিন্তু পৌঁছে দেখি তিনি নেই, জিজেকে নিয়ে কোথায় যেন বেরিয়ে পড়েছেন। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম কিন্তু তারা দুজন আর এল না।

সন্ধ্যার দিকে পৌঁছলে সিন্ধি বাবুর্চি এসে জানাল, সবাইকে নিয়ে ওপরে আসর জমিয়ে বসেছেন। দুরুদুরু বুকে ওপরের দিকে রওনা হলাম। বেশ সাজগোজ করে চারপেয়ের ওপর বিছানা পাতা হয়েছে। চারদিকে কিছু চেয়ারও ছিল। আমার চেনাজানা দশ-বারোজন লোক, একটি মুখ অচেনা আর তা হল শিরানীর মুখ। বেশ দশাসই দেহসৌষ্ঠব, চওড়া কপাল, মোটা নাক, মোটা ঠোঁট, গাঢ় শ্যামলা রং, ঘাড় অবধি চুল, চোখদুটো বড়ো বড়ো এবং আকর্ষণীয়, তবে কিছুটা উদাসীনতা ছেয়েছিল তাতে। সাদাসিধে বাজারি উর্দুতে সবার সঙ্গে কথা বলছিলেন।

আমি পৌঁছুতেই বালে আমাকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গেই আমাকে স্বাগত জানালেন এবং বসতে বললেন। আমি চারপেয়ের একেবারে কাছের চেয়ারটিতে বসে পড়লাম। আখতার সাহেব জিজের উদ্দেশ্যে বললেন, আজিজ (আমার দিকে চেয়ে), এর জন্যে গ্লাসের বন্দোবস্ত করো।

গ্লাস আসার পর আখতার সাহেব নিজেই আমার জন্যে এক পেগ তৈরি করে দিলেন। আমি তা ধন্যবাদ জানিয়ে গ্রহণ করলাম। কে যেন আখতার সাহেবকে ধরে বসল তার কবিতা শোনার জন্যে। তিনি বললেন, না ভাই, আজ আমি কিছুই শোনাব না, বরং শুনব। তারপর জিজের দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে বললেন, আজিজ শোনাও তো,

রসিলি আংখিরাউছে
নিন্দ্‌ বরসাতে হুয়ে আনা।

এই চরণ বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস টানলেন অলক্ষে। মনে হল অতীতের কোনো স্মৃতি হঠাৎ মনে পড়ে গেছে। জিজের কোনো সাধ্য ছিল না– এই আদেশ লঙঘন করে। গলাটা একবার সাফ করে নিয়ে আখতার সাহেবের একটা বিখ্যাত গজল গাইতে শুরু করল। সুর লয় সবই ঠিক ছিল, তবে গলাটা একটু ফ্যাকাশে। তবুও বেশ জমে উঠল। ওদিকে আখতার সাহেব পান করছিলেন এবং ঝিমুচ্ছিলেন।

দ্বিতীয় দিন দুপুরের দিকে আমি সিরাজ হোটেলে আখতার সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। তিনি কোথাও নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে গিয়েছেন। এ সময় বোরখা পরিহিতা জনৈকা মহিলা টাঙা গাড়িতে চড়ে এলেন। তিনি একজন ভৃত্যকে আখতার সাহেবের খোঁজ জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু বোরখাধারিণী নাম না বলেই চলে গেলেন।

আখতার সাহেব আসার পর আমি সেই মহিলার কথা বললাম। তিনি খুবই কবিসুলভ চাহনি নিক্ষেপ করে আমার সব কথা শুনলেন।

ফলে এই মহিলা এক রহস্য হয়ে বিরাজ করতে লাগল আমার মনে। রাতের খাবারের পূর্বে যখন একপালা আসর বসল, জিজে পুনরায় সেই বোরখা পরিহিতা মহিলার কথা বলল, হজরত, কে এই ভদ্রমহিলা যিনি আজ দুপুরের দিকে পদার্পণ করেছিলেন?

আখতার সাহেব মুচকি হাসলেন এবং কৌশলে জবাব এড়িয়ে গেলেন। এবারে বালে বলল, সালমা সাহেবা এসেছিলেন বুঝি?

আখতার সাহেব হেসে উঠে তার গালে একটা চড় মারলেন এবং শুধু বললেন, দুষ্টু কোথাকার। ব্যাপারটি আরও রহস্যময় হয়ে উঠল, যা অদ্যাবধি রহস্য হয়ে রইল। জানি না এই বোরখা পরিহিতা ভদ্রমহিলা কে ছিলেন। তবে তখন আরও এতটুকু জানতে পেরেছিলাম, আখতার সাহেবের চলে যাবার পরও এই অদৃশ্যময়ী মহিলা একবার এসে আখতার সাহেবের কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

পালাক্রমে সবাই আখতার সাহেবকে নিমন্ত্রণ করত এবং তা সিরাজ হোটেলেই সম্পন্ন হত। নিমন্ত্রণের পদ্ধতি ছিল এই রকম, রাতদিন যত বোতল মদ শেষ করা হত, নিমন্ত্রণকারীকে তার দাম চুকিয়ে দিতে হত। আমিও এই পদ্ধতি অনুসরণ করলাম এবং এক সন্ধ্যায় দুই বোতল হুইস্কি নিয়ে হাজির হলাম। বোতলের কাগজটা তুলে ফেললাম। তা দেখে আখতার সাহেব বললেন,

এটা তুমি কী করলে? দেশি মদই তত ভালো ছিল, এক বোতলের বদলে না হয় দু বোতলই লাগত এই তো।

আমি বললাম,

শেষ হলে আরও আসবে।

সেটা শেষ হলে? আখতার সাহেব মুচকি হেসে বললেন।

আমি বললাম,

দরকার হলে আরও আসবে।

তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বেঁচেবর্তে থাকো বেটা।

দু-বোতলই শেষ হল। আমার মনে হল আখতার সাহেব যেন খুব একটা জুত পাচ্ছেন না। তাই আমি বেয়ারাকে দিয়ে অমৃতসর ডিস্টিলারির এক বোতল আনালাম। তাতে আখতার সাহেবের যেটুকু তৃষা বাকি ছিল মিটিয়ে নিলেন।

যেহেতু এই মহফিল নিছক সাহিত্য বিষয়ক ছিল না, আখতার সাহেবের ভক্তদের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছিল, এজন্যে শুধু তারই কবিতা পাঠ হত, গজল গাওয়া হত। কাব্য সাহিত্য সম্পর্কে অন্য কোনো শিক্ষণীয় কিছু আলাপ হত না। তবে আখতার সাহেবের আলাপ আলোচনা থেকে আমি আঁচ করে নিয়েছিলাম, এ ব্যাপারে তার জানাশোনা অত্যন্ত গভীর।

এর কিছুকাল পর আমি আখতার সাহেবকে আমাদের বাসায় দাওয়াত করেছিলাম। তবে তা ছিল শুধু চায়ের দাওয়াত। কিন্তু আখতার সাহেবের চা পানে কোনো আসক্তি ছিল না। তবু আমার অনুরোধক্রমে তিনি বাধ্য হয়ে এক পেয়ালা চা পান করলেন।

এসব মহফিলে বারিসাহেব খুব কমই আসতেন। তবে চিশতী সাহেবের পানাভ্যাস আখতার সাহেবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল। তিনি এই মহফিলে আসতেন এবং স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনাতেন তবে তা ছিল খুবই রসকষহীন।

আখতার সাহেব প্রায় দশদিন অমৃতসরে অবস্থান করেছিলেন। এ সময় তিনি জিজের পীড়াপীড়িতে ‘সিরাজ হোটেল’ সম্পর্কে একটি কবিতা লেখেন। জিজে এই কবিতাটি বারিসাহেবের সহযোগিতায় বড়ো কাগজে সুন্দরভাবে ‘খোশখত’ করে লিখিয়ে আয়নাতে বাঁধাই করে হোটেলের শোভা বর্ধনের জন্যে টাঙিয়ে রাখে। জিজে খুব খুশি হয়েছিল, কেননা কবিতায় তার নামোল্লেখ করা হয়েছিল।

আখতার সাহেব চলে যাওয়ার পর জিজের হোটেলের জৌলুস কমে গেল যেন।

বারিসাহেবও মাস তিনেক অমৃতসরে ছিলেন। এসময় তিনি আমাকে দিয়ে ভিক্টর হুগোর একটি বই ‘ছেরগুজাস্তে আসির’ নাম দিয়ে অনুবাদ করালেন। কিন্তু এটা যখন প্রেস থেকে ছেপে বাজারে এল, তখন তিনি লাহোরে চলে গেছেন। ছাপানো বইটা দেখে আমি বেশ উৎসাহ বোধ করি এবং এ ধরনের আরও কিছু অনুবাদ করার ইচ্ছা পোষণ করলাম। অতএব, আমি অস্কার ওয়াইল্ড-এর ‘ভিরা’ অনুবাদে হাত দিই। অনুবাদ শেষ করে আমি বারিসাহেবকে সংশোধন করার জন্যে দিলাম। কিন্তু তিনি কাটছাঁট তেমন করতেন না। অনেক জায়গায় ভাষার ভুল থেকে যেত, কিন্তু সে সম্পর্কে তাকে কিছু বলাও একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার ছিল। শেষ পর্যন্ত আমি ঠিক করলাম পাণ্ডুলিপিখানি

আখতার সাহেবকে দেখাব।

আরব হোটেলে যাতায়াত করতাম বলে মুজাফফর হোসেন শামিম সাহেবের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল।

আমি পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কথা পাড়তেই তিনি আমাকে তক্ষুনি আখতার সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন। ছোটোমতো নোংরা একটা কামরা। চারপেয়েতে একটা আয়েশি বালিশে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। সালাম বিনিময় হল। আমাকে চিনতে আখতার সাহেবের তেমন কোনো কষ্ট হয়নি। সিরাজ হোটেলের ইয়ার দোস্তদের কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি যতটুকু জানতাম তা বললাম।

শামিম সাহেব এবং আখতার সাহেবের কথাবার্তার মধ্যে বেশ লৌকিকতা পরিলক্ষিত হল। কিন্তু আমাকে কে একজন বলেছিল, এরা দুজন এককালে ‘হরিহর আত্মা’ বলে পরিচিত ছিল। শামিম সাহেব আমার উদ্দেশ্যটা ব্যক্ত করলেন। তিনি স্বচ্ছন্দে রাজি হয়ে বললেন, আমি আজ রাতেই পুরো পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখব।

আখতার সাহেব বুকের সঙ্গে একটা বালিশ রেখে সেটা দিয়ে চাপ দিচ্ছিলেন। কেন-না, কিছুক্ষণ পর পর সেখানে ব্যথা উঠত। এসময় তার যকৃত প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সন্ধ্যায় আসব বলে শামিম সাহেবকে নিয়ে আরব হোটেলে চলে এলাম। তিনি আমাকে ইঙ্গিতে বললেন, যদি তুমি আখতার সাহেবকে দিয়ে তাড়াতাড়ি কাজটা করিয়ে নিতে চাও তাহলে সেই বস্তু নিয়ে যেও কিন্তু।

সন্ধ্যায় আমি যখন আখতার সাহেবের কাছে পৌঁছলাম, আমার বগলে সেই বস্তু ছিল। আমি ভয়ে ভয়ে বোতলটি বের করে তার সামনে রেখে বললাম, এখানে এসব চলে কি না আমি ঠিক জানি না। ক্ষমা করবেন যদি কোনো বেয়াদবি করে থাকি।

আখর সাহেবের চোখেমুখে এক আলোর দ্যুতি খেলে গেল যেন। মনে হল সকাল থেকে এই বস্তু তার গলায় এক ফোঁটাও পড়েনি। মুচকি হেসে সস্নেহে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, মদ্যপান কেন বেয়াদবি হয়ে যাবে?

একথা বলে আমার হাত থেকে বোতলটা নিলেন, হাতের বালিশটা নীচে রেখে দিয়ে বোতলটা ঝাঁকাতে লাগলেন যাতে করে কর্কটা বেরিয়ে আসে।

কথায় কথায় এবং পান করতে করতে রাত অনেক হয়ে এল। ততক্ষণে আখতার সাহেবের খাবার এল। খাবার যেভাবে এল তাতে মনে হল সংসারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এরপর সত্যি-সত্যি জানতে পারলাম তার পিতা হাফেজ মাহমুদ শিরানী সাহেব (মরহুম) তার পানাভ্যাসের দরুন খুবই অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু শেষাবধি তার সঙ্গে আর না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছেন।

রাত অনেক হয়ে এলে আমি আখতার সাহেবকে পাণ্ডুলিপির কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি পাণ্ডুলিপিতে হাত দিলেন এবং পাতায় পাতায় সংশোধন করে যেতে লাগলেন। কয়েক পাতা সংশোধন করার পর তিনি অস্কার ওয়াইল্ড-এর বিচিত্র জীবন। সম্পর্কে কথা তুললেন। সম্ভবত তিনি অন্য কারও কাছে এসব কথা শুনেছেন। অস্কার ওয়াইল্ড এবং লর্ড আলফ্রেড ডগলাস-এর প্রেমজীবন সম্পর্কে রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলেন। ওয়াইল্ড কীভাবে গ্রেফাতর হলেন তাও বললেন। সহসা তার আলোচনার মোড় ঘুরে গেল লর্ড বায়রনের দিকে। এই কবির সব কিছুই তার পসন্দ। তার অসংখ্য প্রেমাভিনয় আখতার সাহেবের মতে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল। পরে আমি জানতে পেরেছি, আখতার সাহেব লর্ড বায়রনের উদ্দেশ্যে বেশ কিছু গজল এবং কবিতাও লিখেছেন।

লর্ড বায়রন একটি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হৃদয়হীন বেপরোয়া ধরনের লোক ছিলেন। তা ছাড়া বৈষয়িক দিক থেকে তিনি একজন নবাব ছিলেন। অপরিসীম ধনরত্নের অধিকারী ছিলেন। আখতার সাহেব ছিলেন অভাবী, দয়ালু এবং বন্ধুবৎসল। বায়রন উৎকৃষ্ট মদ খেতেন আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আর আখতার সাহেব অনেক চেষ্টা চরিত্র করে চোলাই মদ সংগ্রহ করেন। বায়রনের দেশ ও কাব্য-পরিবেশ ছিল একরকম আর আখতার সাহেবের অন্যরকম। আখতার হাজার চেষ্টা করেও কোনোদিন লর্ড বায়রন হতে পারবেন না। কিন্তু তার পরও তিনি তার মানসিক প্রশান্তির জন্যে দুজন প্রেমিকার অস্তিত্বের সৃষ্টি করে নিয়েছেন। এরা দুজন হলেন সালমা এবং আজরা।

সালমা সম্পর্কে অনেক কাহিনি প্রচলিত। কারোর মতে সত্যিকার ভাবে সালমার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তবে আখতারের কবিতায় যে সালমার সাক্ষাৎ মেলে তা নিছক কবিতার অস্তিত্বেই সীমাবদ্ধ। কবিতায় যে সালমাকে উপস্থাপিত করা হয় তার রূপগুণের বর্ণনা অপরিসীম। সত্যিই সালমা যদি বাস্তবের কোনো রক্ত-মাংসের মেয়ে হত, তার সঙ্গে আখতার এতখানি চুটিয়ে প্রেম করতে পারত না। সালমা তার কল্পলোকের দেবী বলেই এতখানি অবারিত প্রেমাভিনয় করা সম্ভব হয়েছে।

লর্ড বায়রনের কথা শুনতে শুনতে আমার ঘুম এসে গেল। সেখানেই শুয়ে পড়লাম। সকালে চোখ খুলে দেখি আখতার সাহেব শান্ত মনে পাণ্ডুলিপি দেখে চলেছেন। পাশের বোতলে সামান্য কিছু ছিল। তা ঢেলে নিয়ে শেষ চুমুক দিলেন এবং আমার পাণ্ডুলিপি দেখাও শেষ হয়ে এল। দেখা শেষে পাণ্ডুলিপি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, অনুবাদ বেশ পছন্দ হয়েছে, স্থানে স্থানে ভাষাগত ভুল ছিল, আমি তা সংশোধন করে দিয়েছি।

আমি ভাবে গদগদ হয়ে তাকে ধন্যবাদ জানালাম এবং অমৃতসর রওনা হয়ে গেলাম। এরপর যখনই আমি লাহোরে যেতাম আখতার সাহেবের আতিথ্য গ্রহণ করতাম। একবার। গিয়ে দেখি আখতার সাহেবের মাথায় ব্যান্ডেজ। জিজ্ঞেস করার পর বললেন, আমার তো কোনো কিছু মনে নেই। তবে লোকেরা বলছিল গতরাতে আমি টাঙা ঘোড়ায় চড়ার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম এবং তাতেই এ অবস্থা হয়েছে।

আখতার সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এই স্পষ্টভাষণ আমার বেশ ভালো লাগত। তিনি কোনো কোনো সময় একেবারে শিশুসুলভ ব্যবহার করতেন। চালচলনে, আচার ব্যবহারে একেবারে শিশু বনে যেতেন এবং শিশু-জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতেন।

এর কিছুকাল পর আমি বোম্বে চলে গেলাম। কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠেনি বলে চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়নি। তবে তিনি যখন ‘রোমান’ পত্রিকা প্রকাশ করেন আমি ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লিখলাম। তখন আমি বেশ ভালো গল্প লিখিয়ে হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেছি। অনুবাদ কর্ম ছেড়ে এসেছি লাহোর এবং অমৃতসরেই। মৌলিক গল্প লিখিয়ে হিসাবে তখন মোটামুটি একটা স্বীকৃতি হয়ে গেছে আমার। একবার ‘রোমান’-এ প্রকাশিত আহমদ নদিম কাসেমির একটা গল্প আমার খুব ভালো লেগেছিল। বোম্বের ‘মোসাওয়ার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে আমি ‘রোমান’-এর এই গল্পের ভূয়সী প্রশংসা করি। তা ছাড়া আখতার সাহেবকে লিখিত আলাদা এক পত্রেও গল্পের খুব প্রশংসা করলাম। এর কিছুদিন পরই আহমদ নদিম কাসেমির পক্ষ থেকে এক দীর্ঘ চিঠি এল অজস্র ধন্যবাদ ও অফুরন্ত ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে। এরপর আমাদের মাঝে নিয়মিত চিঠিপত্র আদানপ্রদান হত।

কিছুকাল চলার পর ‘রোমান’ বন্ধ হয়ে গেল। আখতার শিরানীর সঙ্গে আমার তখন থেকেই আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। এর মধ্যে বেশ কয়েক বছর গত হল। রাজনৈতিক আকাশে নানা পটপরিবর্তন হল। এমনকি দেশের ভৌগোলিক পরিবর্তন হল। ভাগ-বাটোয়ার পূর্বলগ্নে দেশময় যে হই-হুঁল্লোড় ও অরাজকতা সৃষ্টি হল সে সম্পর্কে আপনারা সকলেই সুবিদিত। এ সময় হঠাৎ কাগজে খবর ছাপা হল যে, আখতার সাহেব টুংক থেকে পাকিস্তান আসছিলেন, পথিমধ্যে দুষ্কৃতকারীরা তাকে হত্যা করে। আমি ইসমত ও শাহেদ লতিফ তা শুনে মর্মাহত হই এবং তার সম্পর্কে নানা স্মৃতিচারণা করি।

বেশ কটি পত্রিকাতেই তাঁর মৃত্যুর খবর ফলাও করে ছাপা হয়। তার পুরোনো কবিতা ও তাঁর কাব্যকর্ম সম্পর্কে নিবন্ধ ছাপা হল। কিন্তু কিছুদিন পর পালটা খবর ছাপা হল, তিনি বেঁচে আছেন এবং দিব্যি লাহোরে বসবাস করছেন। একথা শুনে বোম্বের সাহিত্য জগতে একটা স্বস্তি ফিরে এল।

দেশ ভাগাভাগির পাঁচ মাস পর আমি লাহোরে চলে এলাম। কেন-না, সকল আত্মীয় পরিজন এখানে এসে জমা হয়েছেন। চারিদিকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ এবং অস্থিরতা বিরাজমান। আখতার সাহেবের সঙ্গে দেখা করব এমন একটা চিন্তা করার মানসিকতাও ছিল না। দীর্ঘকাল পর ইকবাল দিবসে আমি তাকে একবারের মতো দেখেছিলাম। দুঃখ, দারিদ্র্য ও নানা সমস্যায় জর্জরিত মনে হয়েছিল তাঁকে।

রাতে অধিবেশনের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল আখতার সাহেবের। ইউনিভার্সিটি হলে লোকে লোকারণ্য। এই অধিবেশনে অংশগ্রহণের জন্য হিন্দুস্থান থেকে সর্দার জাফরি ও কায়ফি আজমি প্রমুখ এসেছেন। অধিবেশনের সময় হয়ে এসেছে, কিন্তু সভাপতির কোনো খবর নেই। আমি সাহির লুধিয়ানভিকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আখতার সাহেব হলের বাইরে দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে মদ্যপান করছেন। তার অবস্থা কোনো মতেই সভাপতিত্ব করার মতো ছিল না। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা, সভাপতিত্ব তিনি করবেনই।

আমি বাইরে গিয়ে দেখি তিনি সত্যিই দেওয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে পান করছেন। জাহির কাশ্মীরি বোতল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। গ্লাসে শেষ চুমুকটি দিয়ে জাহিরকে বললেন, চলো, সময় হয়ে গেছে। কিন্তু ভেতর থেকে কবিতা আবৃত্তির আওয়াজ আসছিল। কথা বলতে তার কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল। বললেন, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, আমি তা বেশ শুনতে পাচ্ছি। বলেই তিনি জহির কাশ্মীরিকে ধাক্কা দিয়ে চলতে শুরু করলেন। এ সময় আমি তার সামনে এগিয়ে গেলাম। প্রথমত তিনি আমাকে চিনতে পারেননি। নেশায় ক্রমশ তিনি বুঁদ হয়ে যাচ্ছিলেন। আমি তার গা নাড়া দিয়ে বললাম, আমি মান্টো। এবারে তিনি আমাকে চিনলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং একের পর এক প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন। জহির আমার কানে কানে বলল, আমরা তাকে হলে ঢুকতে দেব না। কিন্তু তাঁকে আটকানো আমাদের সাধ্যের বাইরে ছিল। আমরা তাকে কিছুই বললাম না। এরই মধ্যে তিনি হলের দিকে রওয়ানা দিলেন। তাকে কোনোক্রমেই আটকানো যাচ্ছিল না। তিনি মঞ্চে প্রায় উঠেই যাচ্ছিলেন, এমন সময় আমি গিয়ে তাকে আগলে দাঁড়ালাম। কিন্তু তিনি আমাকে এড়িয়ে পায়ে পায়ে সভাপতির আসনে গিয়ে বসে পড়লেন। অনুষ্ঠানের লোকজনরা বেশ ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠল। কী করবে কিছু স্থির করতে পারছিল না। তার অবস্থা একেবারে যাচ্ছেতাই। কিছুক্ষণ তিনি আসনে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। কিন্তু যখন দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে গিয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন তখন অবস্থা বড়ো সঙ্গিন হয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। বড়ো টলটলায়মান অবস্থা। বারবার পরনের পাতলুন ঠিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন। তিনি মাইকে কী যেন বলছিলেন! তার কিছুই বুঝা যাচ্ছিল না।

গ্যালারি থেকে কে একজন বলে উঠল, ‘এ তো দেখছি বদ্ধ মাতাল। তাকে বের করে দাও’ লতেই হয় হইচই পড়ে গেল। একজন চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে রোষভরে চিৎকার করে বলল, পাকিস্তানের পাক মাটিতে এসবই চলবে নাকি? অন্য একজন চিৎকার করে বলল, হলে মেয়েছেলে রয়েছে কিন্তু।

ওদিকে আখতার শিরানীর কোন খেয়াল-খবর ছিল না, তিনি বলেই যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না। তার কণ্ঠস্বরও শোরগোলের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। পরিস্থিতি যখন চরমে পৌঁছল বন্ধুবান্ধব কজন মিলে বলপূর্বক তাকে হলের বাইরে নিয়ে গেল। এদিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য শোরশ কাশ্মীরি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং তার ওজস্বী বক্তৃতায় সারা হল মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল। আমি পারভেজ ফিল্মস্ প্রোডাকশনের জন্যে একটি চিত্ৰকাহিনি লেখার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। একদিন আহমদ নদিম কাসেমি এসে বলল, শুনলাম, আখতার সাহেব দু-তিন দিন থেকে মেয়ো হাসপাতালে ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় আছেন। এই দুর্দিনে আমরা কি তাঁর কোনো উপকারে আসতে পারি না?

আমরা একটা উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা করছিলাম। মাসুদ পারভেজ একটা বুদ্ধি বাতলে দিলেন। তাঁর দু-তিনটা গজল বা কবিতা ‘পারভেজ প্রোডাকশন’-এর জন্য নেওয়া হোক এবং বিনিময়ে তাকে শ-পাঁচেক টাকা দেওয়া হোক। প্রস্তাব মন্দ নয়, আমরা তখনই গাড়িতে উঠলাম এবং মেয়ো হাসপাতালের দিকে চললাম।

হাসপাতালের রোগীদের দেখার জন্যে আলাদা সময় নির্ধারিত ছিল। এজন্যে আমরা ওয়ার্ডে যাবার অনুমতি পেলাম না। কর্তব্যরত ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে যখন বললাম, আমরা আখতার শিরানির সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ তিনি আফশোস করে বললেন, কোনো লাভ নেই। হাসপাতালে ভর্তি হবার পর থেকে তিনি বেহুঁশ অবস্থায় আছেন।

একথা শুনে আমরা তাকে দেখার জন্যে আরও ব্যাকুল হয়ে উঠলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে ডাক্তার সাহেব আমাদের নিয়ে চললেন।

যেয়ে দেখি আমাদের রোমান্টিক কবি, সালমা এবং আজরার প্রেমিক নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছেন। চারিদিকের কাপড় বেশবাস ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, অস্বাভাবিকভাবে তার শ্বাস চলাচল করছিল। আমরা তার অবস্থা দেখে সত্যি ঘাবড়ে গেলাম।

আমরা ডাক্তার সাহেবকে বললাম, আমরা কি তার কোনো উপকারে আসতে পারি?

ডাক্তার জবাবে বললেন,

আমরা নিজেরাই তো প্রাণপণে চেষ্টা করছি তাকে বাঁচিয়ে তুলতে কিন্তু তার অবস্থা খুবই জটিল। যকৃৎ এবং ফুসফুস প্রায় নিষ্ক্রিয়। পেটের তন্ত্রীগুলো পর্যন্ত নিস্পন্দ। তবে হার্টটা এখনও ভালো আছে, এইটুকুই একটু ভরসা।

তারপরও আমরা যখন জানালাম এ অবস্থায় তার কোনো-না-কোনো কাজে সাহায্য করতে চাই, তখন ডাক্তার সাহেব বললেন, আচ্ছা, এক কাজ করুন, আমি একটা ওষুধের নাম করছি। যদি পারেন সংগ্রহ করে দিন। পাকিস্তানে পাবেন না, সম্ভবত হিন্দুস্থানে পাবেন।

ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে ওষুধের নাম লিখে নিলাম এবং আমি ফয়েজ সাহেবের কাছে পৌঁছে সব কিছু খুলে বললাম। তিনি তখনই অমৃতসরে টেলিফোন করে তার পত্রিকার এজেন্টকে বললেন, যে ভাবেই হোক ওষুধটি সংগ্রহ করে যেন পাঠায়। কিন্তু আফশোস, ওষুধ পাওয়া গেল না। পারভেজ সাহেব দিল্লিতে টেলিফোন করলেন, কিন্তু সেখানেও পাওয়া গেল না। ততদিনে আখতার সাহেব বেঁহুশ অবস্থাতেই তার কাব্যপ্রিয়া সালমা এবং আজরার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *