১০. সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল

১০. সম্পাদক বাবুরাও প্যাটেল

সম্ভবত আটত্রিশ সালে বাবুরাও প্যাটেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। আমি তখন ‘সাপ্তাহিক মুসাওয়ার’ সম্পাদনা করতাম। সর্বমোট বেতন পেতাম চল্লিশ টাকা। ‘মুসাওয়ার’-এর মালিক নজির লুধিয়ানভির ইচ্ছা আমার আরও কিছু বেশি উপার্জন হোক, এজন্যে তিনি আমাকে বাবুরাও প্যাটেলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

বাবুরাও প্যাটেলের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বর্ণনা দেবার পূর্বে ফিল্ম ইন্ডিয়া কীভাবে ভারতের আনাচে-কানাচে প্রসিদ্ধি অর্জন করল সে সম্পর্কে কিছু বলে নিই। আপনারা বেশ জানেন, এমন এক কাল ছিল যখন পুনার ‘প্রভাত ফিল্ম কোম্পানি’র নামে ছিল জয়জয়কার। ‘অমৃতমন্থন’ ও ‘অমর জাবতী’ নামক দু-খানি অমর ছবি নির্মাণ করে সারা ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এ সংস্থা শেষাবধি একটা বিরাট প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে প্রভাত নগরে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রভাত নগরের প্রতিটি কর্মীর মনে ছিল অপরিসীম কর্মপ্রেরণা ও উদ্যোগ। শান্তারাম, সৈয়দ ফতেলাল, ধাইবর– সবাই প্রভাত নগরের অমিত তেজীয়ান প্রতিভাধর শিল্পী হিসেবে পরিচিত।

ঠিক এমন দিনে প্রভাত নগর তিনটি সন্তানের জন্ম দিল :

১। ফেমাস পিকচার্স–প্রভাত নগরের ছবির একমাত্র পরিবেশক। এর মালিক ছিলেন বাবুরাও প্যাটেল।

২। বিজ্ঞাপন কোম্পানি বি পি সামন্ত অ্যান্ড কোম্পানি–প্রভাতের সকল ছবির প্রচারণা কার্যে নিয়োজিত ছিল।

৩। নিউজেক প্রিন্টিং প্রেস– প্রভাতের সকল পোস্টার-পত্র ইত্যাদি ছাপার কাজে নিয়োজিত ছিল।

ফিল্ম ইন্ডিয়া এই নিউজেক প্রিন্টিং-এর সন্তান। প্রেসের মালিক পার্কার, বাবু প্যাটেলের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। পড়ালেখা মামুলি জানতেন। দুজন মিলে পরিকল্পনা নিলেন ফিল্ম ইন্ডিয়া বের করার। প্রেস তো রয়েছেই। বি.পি. সামন্ত কোম্পানির মাধ্যমে প্রভাত কোম্পানির ছবির বিজ্ঞাপন ছাড়াও অন্যান্য ছবির বিজ্ঞাপনও সহজে পাওয়া যাবে। মোট কথা, সকল উপাদান হাতের কাছেই। বাবুরাও খুবই পরিশ্রমী ছিলেন, রসবোধও ছিল প্রচুর। তিনি স্বপ্ন দেখার লোক ছিলেন না। সঠিক জায়গায় আঘাত হেনে কাজ হাসিল করার লোক ছিলেন তিনি। অতএব ফিল্ম ইন্ডিয়ার প্রথম সংখ্যা ছাপা হবার পর ভারতীয় চিত্র-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হল।

বাবুরাও-এর লেখায় পাণ্ডিত্য ছিল, রস ছিল এবং বখাটে ছোকরাদের মনের মতো করে টিপ্পনী কাটতেও পারতেন বেশ। তাঁর লেখনীতে চুলচেরা সমালোচনা এবং প্রচ্ছন্ন আঘাত হানারও ক্ষমতা ছিল প্রচুর। মোট কথা, আমি তার লেখায় যা দেখেছি, ভারতের আর কোনো ইংরেজি লিখিয়ে সাংবাদিকদের কলমে তা দেখিনি।

বাবুরাও-এর লেখায় যে দিকটি সবাইকে চমৎকৃত এবং মুগ্ধ করেছে তা হল তার ধারালো অথবা প্রচ্ছন্ন টিপ্পনী। টিপ্পনীর জগতে তিনি এমন সব আঙ্গিক ও কৌশল আবিষ্কার করেছেন যে সম্পর্কে ভারতীয় পাঠকরা সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল। বাবুরাও-এর লেখা পাঠকদের মাঝে চাটনির স্বাদ পরিবেশন করত।

বাবুরাও বড়ো জাঁকজমকপ্রিয় লোক ছিলেন। এপলো স্ট্রিটের মোবারক বিল্ডিং-এর এক প্রশস্ত কামরায় তিনি ফিল্ম ইন্ডিয়ার অফিস স্থাপন করেন। এবং তাকে খুব আকর্ষণীয় করে সাজিয়েছিলেন।

এই সুসজ্জিত অফিস-কামরাতেই বাবুরাও-এর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তখন ফিল্ম ইন্ডিয়ার সবেমাত্র সাত-আট সংখ্যা বেরিয়েছে। মুসাওয়ারের দফতরে আমি তার প্রত্যেকটি কপি দেখেছি এবং চমৎকৃত হয়েছি।

আমার ধারণা ছিল, এমন ঝরঝরে ইংরেজি লিখিয়ে অবিশ্যি পাতলা ছিপছিপে ধরনের লোক হবেন। কিন্তু আমি যখন তাকে এক জাহাজের টেবিলে ইয়াবড়া চেয়ারে বসে থাকতে দেখলাম, আমি নিরাশ হলাম। তার চেহারার কোনো অভিব্যক্তিই, কোনো হাবভাবই তার ধারালো লেখার সঙ্গে সুসামঞ্জস নয়। চোখ দুটো ছোটো ছোটো। চওড়া কপাল, মোটা নাক, মোটা এবড়ো থেবড়ো ঠোঁট আর বিটকেলে দাঁত। তবে কপালটা ছিল চওড়া।

তিনি যখন আমার সঙ্গে হাত মেলাবার জন্যে দাঁড়ালেন, দেখলাম তিনি আমার চেয়ে লম্বা– খুবই লম্বা। দশাসই দেহ আবেষ্টনী, কিন্তু করমর্দনের বাঁধনটা খুবই ঢিলা মনে হল। এরপর তিনি যখন আমার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলতে শুরু করলেন, আমি আরও নিরাশ হলাম। গোঁয়ার লম্পটদের মতো স্বর– কথায় কথায় বোম্বের অসভ্য সম্প্রদায়ের মতো ‘শালা বাঞ্চোত’ বলে গালাগাল দেন।

আমি মনে করলাম উর্দুটা ভালোভাবে তার রপ্ত নেই বলেই এমনটা হচ্ছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি যখন টেলিফোনে অন্য একজনের সঙ্গে ইংরেজিতেই কথা বললেন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল এ লোকটি কোনোদিনই ফিল্ম ইন্ডিয়ার সেই ধারালো ও জোরালো সম্পাদকীয় লিখতে পারেন না, ইংরেজিতেও তিনি প্রতি ফুলস্টপের পর একবার করে শালা বললেন।

আমি মনে মনে বললাম, এই শালা যদি বাবুরাও প্যাটেল হয়ে থাকে তাহলে আমি শালা সাদাত হাসান মান্টো।

কথাবার্তা অল্প কিছুক্ষণ হল। নজির লুধিয়ানভি আমার খুব প্রশংসা করলেন। এরপর বাবুরাও বললেন, হা হা আমি জানি। এই শালা আবেদ গুল প্রতি সপ্তাহে আমাকে মুসাওয়ার পড়ে শোনায়। এরপর তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, এই শালার মান্টোটা আবার কী?

আমি তাকে মান্টো অর্থ বুঝিয়ে দিলাম।

আসল ব্যাপার ছিল প্রভাতের একটি ছবির যে কাহিনি বাবুরাও লিখেছিলেন আমি তার উর্দু তর্জমা করব। আমি তার সেই কাহিনিটা নিয়ে ঝটপট অল্পদিনের মধ্যে অনুবাদ করে লুধিয়ানভির মাধ্যমে তার কাছে পাঠিয়ে দিলাম। তিনি বেশ পছন্দ করলেন আমার অনুবাদ।

এরপর অনেকদিন তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। আমি অফিস থেকে খুবই কম বের হতাম। ফিল্ম কোম্পানিতে চাকরি নেয়ার জন্যে দ্বারে দ্বারে ধনা দেওয়া আমার নীতিবিরুদ্ধ ছিল।

শান্তারাম যাতে করে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন এ জন্যে বাবুরাও তাকে রাজি করালেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন ভঙ্গিতে এই ফিল্ম কোম্পানির প্রচারণা করা যাবে। শান্তারাম যদিও পড়ালেখা জানতেন না, কিন্তু জাতে ছিলেন শিল্পী। বাবুরাও এর কথায় সহজেই মেনে গেলেন। এবং অল্পদিনের মধ্যেই ‘প্রভাত’ বের হল। বাবুরাও সত্যিই অত্যন্ত আকর্ষণীয় করে শান্তারামের ফিল্ম কোম্পানির পাবলিসিটি করালেন।

নজির লুধিয়ানভি খুবই সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বাবুরাও-এর কাছে গিয়ে পৌঁছলেন এবং তাকে রাজি করালেন যাতে করে প্রভাতের বিভিন্ন প্রবন্ধাবলি। ‘মুসাওয়ার’-এ ছাপানো যায়।

আমি এখানে একটা কথা বলে নিতে চাই, বাবুরাও নিজে জীবনে বহু দুঃখ-কষ্ট করেছেন। এজন্যে অভাবী মানুষের প্রতি সব সময়েই তিনি সদয় ছিলেন। তিনি জানতেন লুধিয়ানভির অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। এজন্যে তিনি যা কিছু ইংরেজিতে লিখেছেন তা উর্দুতে ভাষান্তরিত হতে পারবে না। কিন্তু নজির লুধিয়ানভি যখন আমার নাম নিলেন, তিনি কিছুটা আশ্বস্ত হলেন।

কসম করে বলছি, ইংরেজিতে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। বাবুরাও যা কিছু লিখেছেন, তা যে আমার বোধগম্যের বাইরে এমনও নয়। তবে হুবহু অনুবাদ কিছুটা কষ্টসাধ্য বই কি। বাবুরাও-এর প্রকাশভঙ্গির একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। শব্দ চয়নের মধ্যে অভিনবত্ব ছিল। লেখায় ব্রিটেন এবং আমেরিকান উভয় প্রবাদাবলির অনুসরণ ছিল। কোনো শব্দ তিনি এমন খেলোভাবে প্রয়োগ করেছেন যে, তার পরিভাষা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বহু চিন্তাভাবনার পর সিদ্ধান্ত নিলাম, লেখা সামনে রেখে যা কিছু বুঝে আসে তারই ভাব রক্ষা করে অনুবাদ করে যাব। শেষ পর্যন্ত করলামও তাই।

যখন এ অনুবাদ ছাপা হল নজির লুধিয়ানভি সেগুলো নিয়ে বাবুরাও-এর কাছে গেল। আমিও তার সঙ্গে ছিলাম। তিনি আমাকে দেখেই বলে উঠলেন,

শালা তুমিও বাবুরাও হবার চেষ্টা করছ দেখছি।

আমি তাকে আগাগোড়া সবকিছু ধীরেসুস্থে বুঝিয়ে বললাম।

আমি যেভাবে অনুবাদ করেছি এভাবে ছাড়া আপনার লেখা ভাষান্তর করার আর কোনো উপায় নেই। অতএব আমি যা করেছি, ঠিকই করেছি।

ডানহাতের শেষ আঙুলে সিগারেট চেপে ধরে ঠায় গেঁয়ো গোঁয়ারদের মতো লম্বা করে কেশে নিয়ে বলতে লাগলেন, শালা আমি আবেগুলের কাছে সব শুনেছি, শুনে বেশ মজা পেলাম। আমি তাকে বললাম (গালি) ও তো বলছিল তুই নাকি উর্দুর মস্ত বড়ো রাইটার।

এ ধারা স্বীকৃতি শুনে আমি মনে মনে কষ্ট পেলাম। এরপর ঠিক হল আমি নিয়মিত এভাবে অনুবাদ করব। কিন্তু মাত্র দু-সপ্তাহ পরই প্রভাত কোম্পানির এই মাসিক বন্ধ হয়ে গেল, কেননা দু-সংখ্যাতেই কোম্পানির বিস্তর পয়সা নেমে গেছে।

যাক আমি বেশি বিস্তারিত বর্ণনায় যেতে চাই না। কেননা ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে হবে তাহলে। আসলে আমার উদ্দেশ্য হল বাবুরাও প্যাটেল সম্পর্কে আমার মতামত ব্যক্ত করা।

এমন কতকগুলো ঘটনা হল, যার দরুন নজিরের সঙ্গে আমার… না না সেগুলো পরে বলব জী হাঁ, যা বলছিলাম, আমি বিয়ে করা মনস্থ করলাম। এ সময় আমি ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে আশি টাকা বেতনে একটা চাকরি নিলাম। এখানে এক বছর চাকরি করলাম। কিন্তু বেতন পেয়েছিলাম মাত্র আট মাসের। চার মাসের বেতন না পেতেই কোম্পানি লালবাতি জ্বালিয়ে দিল।

এখান থেকে আমি সরোজ ফিল্ম কোম্পানিতে চলে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনে হল আমি কোম্পানিতে ঢুকবার পূর্বেই কোম্পানি পাততাড়ি গুটাতে শুরু করেছে। কিন্তু সহজে দমবার পাত্র ছিলাম না। এই কোম্পানির শেঠজি কোম্পানি উঠে যাবার পর সেই চারদেয়ালির মাঝেই অন্য একটি ছোটোখাটো কোম্পানির পত্তন করলেন। আমি এখানে একশো টাকার চাকরি নিলাম। একটা চমৎকার কাহিনি লিখলাম। এর তিন চতুর্থাংশ চিত্রায়িতও হল। ইতিমধ্যে আমার বিয়েও হয়ে গেল। এখন কনে তুলে আনবার পালা। এজন্যে আমার যথেষ্ট টাকার প্রয়োজন ছিল। একটা মামুলি বাসা ভাড়া নিয়ে তাতে বউকে তুলতে হবে। কিন্তু যখন টাকা চাইলাম শেঠ নানুভাই সোজা হাত উলটে দিলেন এবং বললেন, আমার অবস্থা কাহিল। তার অবস্থা কতটুকু খারাপ ছিল সেটা আমি জানতাম। কিন্তু আমার অবস্থাটা চিন্তা করে দেখুন। আমি শেঠকে সবকিছু খুলে বললাম। কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়াই তার মনে পড়ল না। বিগড়ে গেলাম। পরিস্থিতি কিছু হাতাহাতির পর্যায়ে উপনীত হলে শেঠ আমাকে দফতর থেকে বের করে দিলেন। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম কোম্পানির দ্বারে বসে অনশন ধর্মঘট করব। এখান থেকে এক পাও নড়ব না।

আমার এই অবস্থার খবর কীভাবে যেন বাবুরাও-এর কান অবধি পৌঁছল। তিনি প্রথমে নানুভাই দেশাইকে টেলিফোনে এক চোট নিলেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না দেখে তিনি নিজেই নানুভাইয়ের অফিসে এলেন। বারোশো টাকা পাওনা ছিল। বাবোশোর স্থলে আটশো টাকায় তিনি মীমাংসা করে দিলেন। আমি মনে মনে বললাম, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। আমার জাতকুল রক্ষা হল।

আমার ইজ্জতটা কোনোমতে বেঁচে গেল। হ্যাঁ আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমি যখন ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে কাজ করতাম তখন সেখানে নেহাতই ভদ্র স্বভাবের এক চিত্রাভিনেত্রীর সঙ্গে আমি পরিচয় লাভ করি, তার নাম পদ্মদেবী। আমার প্রথম ছবি ‘কিষণ কন্যা’তে তাকেই নায়িকা বানিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তার সঙ্গে সত্যিকারভাবে দৈহিক সম্পর্ক ছিল বাবুরাও প্যাটেলের। বাবুরাও সবসময় তার প্রতি কড়া নজর রাখতেন।

এটাও এখানে বলে নেওয়া ভালো যে, বাবুরাও-এর এ সময় দুজন স্ত্রী ছিলেন। দুই স্ত্রীর একজনকে আমি দেখেছিলাম, তিনি ছিলেন ডাক্তারনি।

সে যাই হোক এর মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটে গেল যে, আমার অক্লান্ত সেবা এবং পরিশ্রমকে অস্বীকার করে তিনি আমার সঙ্গে অসহযোগিতা প্রদর্শন করলেন। আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। অবশ্য এজন্যে আমার কোনো দুঃখ ছিল না। তার কাছ থেকে কীই। বা পেতাম– তা ছাড়া আমার বাড়িভাড়া পঁচিশ টাকা– তাও চুকিয়ে দিত সে। এ সময় থেকে আমি রেডিয়োতে লিখতে শুরু করলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি এখন আর একা ছিলাম না। এ জন্যে ভাবলাম, বাবুরাও-এর সঙ্গে দেখা করা দরকার। আরে দাঁড়ান, আমি হঠাৎ করে এগিয়ে এলাম, মাঝখানে আরও অনেক কথা রয়ে গেছে…।

অত্যন্ত আজব পরিস্থিতির মধ্যে আমার বিয়েটা হয়েছিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে বলতে হয়, বাড়িতে আমার মা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। চিত্রশিল্পের লোকজনরা আসা-যাওয়া করত। তাদের মেহমানদারি কে করত? মার দ্বারা কি এসব সম্ভব ছিল?

বাবুরাও জানতে পারলেন মান্টো খুবই অসুবিধার মধ্যে আছে। তিনি পদ্মাদেবীকে পাঠিয়ে বললেন, যাও মান্টোর মাকে গিয়ে একটু সাহায্য করে। আমার বেশ মনে আছে। পদ্মদেবী বিয়ের সময় আমার স্ত্রীকে গহনাপত্র ইত্যাদি দিয়েছিলেন।

বলুন, এবার চলি। জী হাঁ, আমি বাবুরাও-এর কাছে যেয়ে পৌঁছলাম। কেননা তিনি কারওয়া’ নামে একটি উর্দু পত্রিকাও বের করতেন। ইচ্ছা ছিল আবেদ গুলরেজ-এর একটা উপায় হয়ে যাক। আবেদগুল ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু কবি গুলের মেজাজটা ছিল অন্য ধরনের। খবরের কাগজের কাজ ছেড়ে দিয়ে সে সংলাপ, গীত ও চিত্র নির্মাণের ধান্দায় নেমে পড়েছিল।

আমি বাবুরাওকে নজিরের লিখিত বরখাস্তনামা দেখালাম। সেটা দেখে বাবুরাও মুহূর্তের জন্যে প্রমাদ গুণলেন। তারপর অত্যন্ত ভারী একটা গালি ঝেড়ে বললেন, তাহলে এই ব্যাপার? তাহলে শালা তুই আমার এখানে কেন চলে আসতে চাস না? আমার ‘কারওয়া’ আছে। দুই কথা বলবে এমন শালা কে আছে?

আমি জানালাম, আপনি যদি বলেন তাহলে আমি রাজি আছি।

বাবুরাও জোরে ডাকলেন ‘রিটা।

দরজা খুলে সটান দেহবল্লরীসম্পন্না জনৈকা ক্রিশ্চান মেয়ে প্রবেশ করল। বাবুরাও তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলেন এবং বললেন, কাছে এসো।

মেয়েটি আসনের কাছে ঘেঁষে বসল। বাবুরাও আবার বললেন, মুখটা এদিকে করো।

মেয়েটি তার হুকুম তামিল করল। বাবুরাও এরপর তার নিতম্বে এমন একটা চপেটাঘাত করলেন, মনে হল, সেখানকার মাংস একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। তারপর বললেন, যাও কাগজ পেনসিল নিয়ে এসো।

মেয়েটির নাম ছিল রিটা কারলাইল। সেক্রেটারি, স্টেনো ও প্রেমিকা–সবকিছুই ছিল সে বাবুরাও-এর। সে শর্ট হ্যান্ড-এর খাতা আর পেনসিল নিয়ে হাজির হল। বাবুরাও আমার নামে নিয়োগপত্র লিখতে শুরু করলেন। লিখতে গিয়ে বেতনের কাছে পৌঁছতেই বাবুরাও বললেন, ‘মান্টো কত হলে চলবে?’ তারপর নিজেই বললেন। একশো পঞ্চাশ হলে ঠিক হবে তো?

আমি বললাম, না।

বাবুরাও অনেকটা অনুনয়ের সুরে বললেন, দ্যাখো মান্টো, এর বেশি দেওয়া যায় না।

আমি বললাম, আমি দেড়শো টাকার বেশি চাই না। আমি বরং কম চাচ্ছি। আমি মাত্র ৬০ টাকা নেব, এর বেশিও নয় কমও নয়।

বাবুরাও মনে করেছেন, আমি তার সঙ্গে ঠাট্টা করছি। কিন্তু আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম, আমি ষাট টাকাই নেব। তিনি আমাকে বললেন, তুমি দেখছি আস্ত গাধা। আমি বললাম, গাধা বলুন আর যা-ই বলুন, আমি ষাট টাকার বেশি চাই না। এবং এজন্যে চাই না যাতে স্বাধীনভাবে আসতে যেতে পারি, কোনো রকম টাইমটেবিল আমি মানব না, যখন ইচ্ছা আসব যখন ইচ্ছা যাব। কিন্তু পত্রিকা ঠিকমতোই বের হবে।

কথাবার্তা পাকাপাকি হয়ে গেল।

আমি বাবুরাও-এর অফিসে সম্ভবত ছ-সাত মাস কাজ করেছিলাম। এ সময়ে আমি তার আজব ব্যক্তিত্বের বহু খুঁটিনাটি জানতে পেরেছি।

রিটাকে তিনি খুবই ভালোবাসতেন। তার মতে রিটার মতো সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয় কেউ নেই। অন্যান্য ক্রিশ্চান মেয়েদের মতো রিটার দিব্যি চলে যাচ্ছিল তাদের নিয়মমাফিক। কিন্তু বাবুরাও-এর কারণে রিটার দামটা বেড়ে গেল।

আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত, রিটা যদি এক-আধটু উর্দু বলতে পারত তাহলে, বাবুরাও তাকে অল্প কদিনেই খ্যাতির শীর্ষে তুলে দিতেন।

পদ্মাদেবীকে কেউ জানত না। কিন্তু যখন বাবুরাও-এর সংস্পর্শে এল, বাবুরাও তাকে কালার কুইন’ বানিয়ে দিলেন। ফিল্ম ইন্ডিয়ার প্রত্যেক সংখ্যায় তার ডজন ডজন ছবি থাকত। ছবির নীচে বাবুরাও চমৎকার ক্যাপশন দিতেন।

বাবুরাও সম্পূর্ণভাবে স্বয়ম্ভু। নিজেকে বানিয়ে নিয়েছেন। যৌবনেই বাবার সঙ্গে তার অ-বনিবনা হয়ে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাবুরাও-এর কাছে যখনই বুড়ো প্যাটেলের কথা শুনতাম, বলতেন, ও শালা একটা আস্ত হারামি।

জানি না এ দুজনের মধ্যে আসলে হারামি কে ছিলেন। বুড়ো প্যাটেল যদি সত্যিই হারামি থেকে থাকেন, তাহলে এই বাবুরাও হারামিপনায় তার চেয়ে কয়েক পা অগ্রসর ছিলেন।

বাবুরাও-এর কলমের ক্ষুরধার তেজ তার মানসিকতারই ফসল। এবং এই মানসিকতার কারণ রয়েছে। তিনি সুলতান মাহমুদ হয়ে মন্দিরের মূর্তিগুলোকে খণ্ড বিখণ্ড করতে চাইতেন। কেননা ছোটোবেলায় তার বাবা তার স্বাভাবিক মননশীলতাকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছেন। বাবা তাঁকে জোর করে বিয়ে করিয়েছিলেন তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিয়ে নিজে করছেন নিজের ইচ্ছায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি ধোঁকা খেয়ে নিজের ওপর নিজে চটে গেছেন এবং প্রত্যেকের ওপর সে চটার বিকার প্রতিফলিত হয়েছে।

বাবুরাও-এর সামনে কোনো লোক একটু ওপরে বসবে এটা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তবে যে লোক ভূলণ্ঠিত হয়ে পড়ত তাকে টেনে তুলবার জন্যে কয়েক ক্রোশ পায়ে হেঁটে আসতেন, তাকে ওপরে তুলবার জন্যে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। তবে লোকটি তার চেষ্টায় ওপরে উঠে গেলে বাবুরাও পুনরায় তাকে নীচে নামাবার জন্যে উঠে পড়ে লাগতেন।

বাবুরাও সম্পূর্ণ স্ববিরোধী পুরুষ ছিলেন।

এমন এককাল ছিল যখন তিনি শান্তারামকে মনে করতেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ডাইরেক্টর। কিন্তু পরে এমন সময়ও এল, শান্তারামের ছবি, এমনকি স্বয়ং শান্তারামের ব্যক্তিগত ক্রিয়াকর্মেও কালি ঢালতে শুরু করেন তিনি। কারদারকে তিনি দু চোক্ষে দেখতে পারতেন না। কিন্তু কিছুকাল পর বাবুরাও তাকে আবার পছন্দ করতে লাগলেন। দেশ ভাগাভাগির পর আরেকবার তিনি কারদারের বিরোধিতা করতে শুরু করলেন এবং তার স্টুডিও এবং বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন, কিন্তু কারদারের কপাল ভালো, কোনোমতে বেঁচে গেলেন।

মাঝখানে একবার এমন সময় এল যখন তিনি একেবারে খোলাখুলি ঘোষণা করলেন যে, একমাত্র মিয়াঁ ভাইরাই (মুসলমান) ছবি তৈরি করতে জানেন। মুসলমান চিত্র পরিচালকদের মধ্যে যে শিল্পগুণ ও সৃষ্টিধর্মী প্রবণতা আছে হিন্দুদের মধ্যে তার লেশমাত্রও নেই। এমন এক সময় ছিল যখন তিনি পৃথ্বীরাজকে মানুষ বলেও গণ্য করতেন না। আবার এমন সময়ও আমরা দেখেছি, যখন কিশোর শাহুর মতো শিল্পী আর হয় না।

সময় সময় বাবুরাও-এর ওপর ভাবাবেগের প্রবাহ চলত। মনস্তত্ত্বের দিক থেকে তার মানসিক অবস্থা মোটেই সুস্থ ছিল না। একটা ভবঘুরে প্রাণাবেগ অহরহ তার ধমনীর মধ্যে চলাফেরা করে। এই অন্ধ ভাবাবেগে কখনও তিনি নিজেই নিজেকে নানাভাবে আঘাত করে বসতেন। তিনি এমন একজন শিল্পমনা পুরুষ, যিনি ভাবাবেগের তেপান্তরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন।

আমি যদ্দিন ‘কারাভাঁ’তে ছিলাম, ফিল্ম ইন্ডিয়াতে আমার পাণ্ডিত্য ও যোগ্যতার বেশ ঢাকঢোল পেটানো হত। কিন্তু সেখান থেকে সম্পর্কচ্যুত হতেই এই মান্টোটা আবার কে এই ধরনের মন্তব্যের সম্মুখীন হলাম আমি। কিন্তু এর কিছুদিন পর যখন আমার ছবি ‘আট দিন’ মুক্তি পেল, ফিল্ম ইন্ডিয়া মাথার টুপি অবনত করে আমাকে অভিনন্দন জানাল। বলা হল, মান্টো এদেশের একজন অনন্যসাধারণ প্রতিভাধর কাহিনিকার।

বাবুরাও যখন প্রভাত ফিল্ম কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তখন শান্তা আপ্তে (১২) ভারতের একজন প্রথম শ্রেণির নায়িকা হিসাবে আখ্যায়িত হন। কিন্তু সেখান থেকে সম্পর্কচ্যুত হবার পর শান্তা আপ্তের মতো বদসুরত নায়িকা আর হয় না বলে বেড়াতে লাগলেন। শান্তা আপ্তেকে নিয়ে তিনি ফিল্ম ইন্ডিয়াতে বহু বিষোঙ্গর করেন। কিন্তু শান্তা আপ্তে ছিল জাত মারাঠার মেয়ে। একবার অতর্কিতে বাবুরাও-এর অফিসে ঢুকে পড়ল এবং হান্টার দিয়ে লাগিয়ে দিল কয়েক ঘা।

একটা প্রবাদ আছে, উটের দেহের কোনো অঙ্গই নাকি সোজা নয়। এ ব্যাপারে উটের পরেই বাবুরাও প্যাটেলের স্থান। বেশ কিছুকাল আগে বোম্বের ইংরেজি সাংবাদিক জগতের জনক মি. বি. জি. হানিম্যান একবার ‘বোম্বে সেন্টিনাল’ পত্রিকায় বাবুরাও সম্পর্কে দু-চারটে নিযাস মন্তব্য করেছিলেন। বাবুরাও বেকায়দায় পড়ে গেলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে দিলেন। আশি বছরের ঝানু হানিম্যান তা শুনে খুব হাসলেন এবং এক বন্ধুর মারফতে একজনকে বলে পাঠালেন যে, তুমি যদি চাও আমি তোমার সঙ্গে লড়ব, তাহলে আমি প্রস্তুত, আর যদি তুমি ভালো চাও তাহলে। অনতিবিলম্বে আমাকে হাজার দুয়েক টাকা পাঠিয়ে দাও। তাহলে আমি চুপচাপ থাকব।

বাবুরাও আর একবার খেপে গেলেন। কিন্তু বৃদ্ধ হানিম্যানের অতীত কার্যকলাপ যখন শান্ত মনে চিন্তা করলেন তখন বাধ্য হয়ে তাঁর নামে দু-হাজার টাকা নজরানা পাঠালেন।

বাবুরাও ছিলেন বোকার হদ্দ। এত বড়ো বোকা আর হয় না। তার মনে মানব হিতৈষণার পুরোপুরি আবেগ বিদ্যমান ছিল না। আমার বেশ মনে আছে, একবার তিনি একটা মানবতাবিরোধী কাজে হইচই করে আকাশ-পাতাল একত্রিত করেছিলেন।

তখন সবে বোম্বের বড়ো বড়ো বাড়িতে লিফট বসানো হয়েছে। যে বাড়িতে লিফট আছে তাতে সিঁড়িও আছে। কিন্তু বেচারি ডাক-হরকরাদের জন্যে এই লিফট ব্যবহার করার অডার ছিল না। কোনো বাড়ির পাঁচতলার একটা চিঠির জন্যে পুরো বাড়ির সিঁড়ি ভেঙে পাঁচতলায় উঠতে হত। বাবুরাও এই নির্মমতার বিরুদ্ধে খুব লাগলেন। এবং বহু বাদ-প্রতিবাদের পর শেষাবধি এই নিষেধাজ্ঞা বাতিল করিয়ে ছাড়েন।

পাক-ভারতীয় চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নের জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বিদেশি চলচ্চিত্রকাররা যারা পাক-ভারতীয় চলচ্চিত্র নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন তাঁদের তিনি দাঁতভাঙা জবাব দেন। তিনি ইউরোপ পরিভ্রমণ করেন এবং ব্রিটেনের চলচ্চিত্রকারদের বোকামিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন।

বাবুরাও-এর সন্তান-সন্ততি অনেক। ডজন খানেক না হলেও ডজনের কাছাকাছি। একদিন বাবুরাও-এর সঙ্গে তার বাড়িতে গেলাম। বাবুরাও সব বাচ্চাকে ‘কিউ’ দিয়ে দাঁড়াবার জন্যে অর্ডার দিলেন। বাবুরাও এসব সন্তানদের একজন স্নেহময় পিতা, কিন্তু….।

যাক কিন্তু। কেন-না এ কিন্তুর পরই বাবুরাও-এর আরম্ভ।

মাহমুদ গজনভীর মতো মূর্তি ধ্বংস করার যেটুকু প্রবণতা তার মধ্যে ছিল এবারে তা নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করল।

ইতিমধ্যে জওহরলাল নেহরুর জনপ্রিয়তা ও খ্যাতির ওপর খেপে গিয়ে একবার তিনি তাঁকে গান্ধিজির পথের কাঁটা এবং জনগণের মাথাব্যথার কারণ বলে মন্তব্য করেছিলেন। পরবর্তীকালে তা পাকিস্তানবিরোধী সংবাদে রূপান্তরিত হয়। কেন-না এতদিনে পাকিস্তান হয়ে গেছে। বিশ্বের মানচিত্রে পাকিস্তান নিজের জন্যে একটা আলাদা। স্থান করে নিয়েছে। এবং পাকিস্তানের অবস্থিতিটা এখন তার সম্পূর্ণ মত-বিরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘ফিল্ম ইন্ডিয়া’র নাম শুনেই মনে হয় এতে চলচ্চিত্র সম্পর্কিত ব্যাপার থাকবে। অবশ্য থাকতও তাই। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখা গেল তাতে রাজনীতি ঢুকে পড়েছে। শেষকালে এমনও দেখা গেল চলচ্চিত্র, রাজনীতি এবং যৌনশাস্ত্র ইত্যাদি এ পত্রিকায় একটি বৈশিষ্ট্য স্থাপন করে বসেছে। এগুলো পড়লে বাবুরাও-এর চেহারাই ভেসে উঠত, তাতে পাকিস্তান সমাচার, মোরারজি দেশাই এবং মেয়েদের ঋতুস্রাব ইত্যাদির আলাপ আলোচনাও বাদ যেত না।

রাজনীতিতে পা দিয়ে বাবুরাও এটাকেও রিটা, সুশীলা বা পদ্ম মনে করেছিলেন। মনে করেছিলেন দু-হাতে এদেরকে দিয়ে ডুগডুগি বাজাবেন আর নিজে তামাশা দেখবেন। অথচ তিনি নিজেই জানতেন চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে ব্যর্থ হয়েছেন এবং এক্ষেত্রেও তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও একটা হইচই ও কাদা ছোঁড়াছুড়ি ছিল তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।

আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে আমি বলব পাকিস্তান, হিন্দুস্থান কোনোটাই বাবুরাও-এর মাথাব্যথার কারণ ছিল না। আসলে তিনি সব রকম ভাড়ামির দুশমন ছিলেন। তিনি ওমর পার্কের কাছে বেশ পয়সা খরচ করে যে বাংলা নিয়েছেন তা নিয়ে বেশ সুখী ছিলেন। প্রাইভেট সেক্রেটারি সুশীলা রানিকে নিয়েও তিনি সুখী ছিলেন। সুশীলাকে আকাশে তুলবার জন্যে দু-বছর যাবৎ ফিল্ম ইন্ডিয়াকে নিয়োজিত করেছিলেন। সুশীলাকে তিনি একটা ছবিতেও পেশ করেছিলেন। পাছে আবার অন্য লোক সুশীলাকে স্পর্শ করবে এজন্যে তিনি নিজেই সে ছবিটি পরিচালনা করেন। কিন্তু সবই বিফল।

বাবুরাও-এর দুনিয়াতে কোন কিছুর পরোয়া ছিল না। তার কাছে রানি ছিল রেসের ঘোড়া। জমজমাট দফতর ছিল। তার পেটে রয়েছে গ্যাস্ট্রিক। কিন্তু তার ট্রেজারিতে যে পরিমাণ অর্থ রয়েছে তা দিয়ে স্বচ্ছন্দে আমেরিকা গিয়ে তার চিকিৎসা করাতে পারেন। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তার একটা মস্ত বড়ো দুঃখ রয়েছে মনে।

তার সে দুঃখটা কী জানেন? দুঃখটা হল মুসলমানরা এত বেইমান কেন? আমি কসম করে বলছি, তার বহু মুসলমান বন্ধু তাঁর সঙ্গে বহু রকম বেইমানি করেছে। হিন্দুরাও যে বেইমানি না করেছে এমন নয়। তবে তিনি মুসলমান বন্ধুদেরকেই বেশি ভালোবাসতেন। মুসলমানদের কথাবার্তা, চালচলন, চেহারা তার বেশ পছন্দ ছিল। তিনি মুসলমানদের খাবার সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন।

মতবাদের দিক থেকে বাবুরাও বেশ উদারমনা ছিলেন। তার এক মেয়ে প্রেসের এক মুসলমান কর্মচারীকে ভালোবেসে ফেলে। কর্মচারীটি প্রায় নিরক্ষর ছিল। অথচ বাবুরাও তনয়া ছিল শিক্ষিতা। কিন্তু প্রেম শিক্ষা-অশিক্ষা চায় না। একদিন তারা দুজনে পালিয়ে গেল।

বাবুরাও দুজনকে পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। বাবুরাও প্রথমত মেয়েকে খুব বকলেন। কিন্তু পরে যখন দেখলেন মেয়ে ছেলেটিকে খুবই ভালোবাসে তখন তাদের বিয়ে করিয়ে দিলেন।

কিছুদিন পর বাবুরাও-এর সঙ্গে আমার দেখা হলে তিনি অশ্রুসজল চোখে বললেন, তোমরা মুসলমান শালারা কী ধরনের? একজন আমার কাছ থেকে মেয়ে নিয়ে আমার কাছ থেকে আবার খোরপোষও চায়।

এরপরই বাবুরাও মুসলমানদের ওপর খেপে গেলেন। কিন্তু এটা কোন ধরনের বোকামি, একজন কিংবা দুজনের প্রতিশোধ তিনি পুরো জাতির ওপর থেকে তুলতে শুরু করলেন। বাবুরাও ছিলেন একজন শিল্পী। হিংসা এবং জিঘাংসা তাকেও একজন সাধারণ মানুষ বানিয়েছিল। ফিল্ম ইন্ডিয়ার প্রতি লাইনে তা বিম্বিত করেছেন তিনি।

খোদার কসম করে বলছি, এ সময় ফি ইন্ডিয়ার ক-টি সংখ্যা দেখে আমার প্রাণভরে ঘৃণা হল। শিল্পী ও সাংবাদিক বাবুরাও যেন বহু আগেই মারা গেছেন এমন মনে হল।

——-
১২। শান্তা আপ্তে। মারাঠি গায়িকা ও নায়িকা। প্লেব্যাক আসার আগে ছবিতে নিজের গলায় গান গাইতেন। বাংলার কাননদেবীর মতো। জন্ম ১৯১৬। মৃত্যু ১৯৬৪।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *