০৮. আগা হাশর

০৮. আগা হাশর

সন তারিখ মনে নেই। মনে থাকে না বলেই লেখার সময় যত বিতিকিচ্ছিরি লাগে। আমার বয়েসটা কত তাও মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে বহু চেষ্টা চরিত্রের পর এনট্রেন্সটা পাশ করে দু-দুবার এফ এ ফেল করার পর পড়াশোনার ওপর মনটা একেবারে উঠে গিয়েছিল। আজমল সিং কাটাবার ফজলু কুমারের দোকানের ওপরে একটা আড্ডা জমে উঠেছিল, সেখানে দিনরাত জুয়া চলত। ফ্লাস চলত। প্রথম দিকে এ আজব খেলাটা আমার মোটেই বোধগম্য হচ্ছিল না। কিন্তু যখন শিখে নিলাম তখন একেবারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। রাতের বেলা শোবার টাইম পেতাম না বললেই চলে। যেটুকু পেতাম স্বপ্নের মধ্যেও হরতন রুহিতনের ধান্ধা করতাম।

প্রায় বছর খানেক পর জুয়া থেকেও আস্তে আস্তে মনটা উঠে যাচ্ছিল। কিন্তু অন্য একটা কিছু তো করতে হবে?

জুয়ার আড্ডায় ইব্রাহিম (সে অমৃতসর মিউনিসিপ্যালিটি টাঙা সমিতির দারোগা ছিল) কথায় কথায় একদিন আগা হাশর-এর কথা তুলল। সে জানাল, আগা হাশর নাকি অমৃতসরে আসছেন। এ কথা শুনেই আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে গেল। স্কুলে কতিপয় ছেলে ছোকরাকে নিয়ে একবার একটা ড্রামাটিক ক্লাব খুলে আগা হাশর-এর একটা নাটক মঞ্চস্থ করার আয়োজন করেছিলাম। একদিন বাবা কেমন করে টের পেয়ে গেলেন এবং অতর্কিতে এসে আমাদের হারমোনিয়াম, তবলা ইত্যাদি ভেঙেচুরে লন্ডভন্ড করে দিলেন। বলতে গেলে মাত্র বিশ দিন পরই এ ক্লাব ভেঙে যায়।

ইব্রাহিম দারোগা যখন আগা হাশর-এর কথা পাড়ল আগা হাশরের সেই নাটকের একটা বিরাট সংলাপ আমার তখনও মুখস্থ ছিল। এতএব আগা হাশরের কথা পাড়তেই আমার মনে একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। জেনে খুশি হলাম যে, আগা হাশর অমৃতসরে আসছেন।

আগা হাশর-এর কোনো নাটকই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কারণ, সেকালে রাতের বেলা ঘর থেকে বের হবার অনুমতি ছিল না। তার নাটক আমি পড়েও দেখিনি। কেন-না, মিস্ট্রেস অব কোর্ট অব লন্ডন-এর তীর্থরাম ফিরোজ পুরীর অনূদিত ইংরেজি গোয়েন্দা সিরিজ পড়ার বেজায় শখ ছিল আমার। তারপরই কেন জানি আমি আগা হাশরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লাম।

জানতে পারলাম আগা হাশর মস্তবড়ড়া মানুষ। কাশ্মীরি মুসলমান। আমিও কাশ্মীরি। তারপর শুনলাম আমাদের গলিতেই নাকি তাঁর আদি নিবাস। আমাদের গলিতেই নাকি তার ছোটোবেলা কেটেছে ইত্যাদি।

ইব্রাহিমের কাছ থেকে যা কিছু শুনলাম, ইতিপূর্বেও আমি তা বহুবার শুনেছি। আগা হাশরের মতো কড়া নোক নাকি আর হয় না। দিন-রাত মদ নিয়ে পড়ে থাকেন এবং যতসব অকাজ কুকাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন। যখন তার মুখ থেকে গালির তুড়ি ছুটতে থাকে তখন মনে হয় এর মতো গালিবাজ আর কেউ নেই। বড়ো বড়ো লোক পর্যন্ত তার গাল থেকে রেহাই পায়নি। কোম্পানির অমুক শেঠরা যখন তার কাছ থেকে নাটকের ফরমাশ করল তাদেরকে এমন গালি দিলেন তিনি একেবারে বাপ-দাদার নাম ভুলিয়ে দিলেন। বাপের জন্মে তারা আর আগা হাশরের মুখোমুখি হয়নি।

একবার রিহার্সাল হচ্ছিল। গরমের দরুন নায়িকা বারবার কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছিল। আগা সাহেব চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন:

আবরু না সেনওয়ারা করো
কাট জায়েগী অংলী
নাদান হো তলওয়ার সে
খেলা নেহি করতে।

একবার এক নায়িকার মুখ দিয়ে ‘ফাস্ত’ শব্দ উচ্চারণ হচ্ছিল না। আগা হাশরের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। তিনি এমন এক ধমক দিলেন যে, পর মুহূর্তে নায়িকা সঠিকভাবে শব্দটি উচ্চারণ করে নিল।

একবার আগা হাশরের কানে একটা খবর এসে পৌঁছোল যে, কতিপয় দুষ্ট প্রকৃতির লোক প্রপাগান্ডা করে বেড়াচ্ছে যে, হিন্দিতে যে ড্রামা আগা হাশরের নামে চলছে আসলে তা নাকি আগা হাশরের রচনা নয়। আগা হাশর হিন্দি জানেন না। আগা হাশর রেগেমেগে নাটক শুরু হবার অনেক পূর্বেই এসে হাজির হলেন এবং মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন, শুনলাম কারা নাকি রটনা করেছে এ নাটক ভাড়া করে হিন্দি পণ্ডিতদের দিয়ে লিখিয়ে এনেছি। আমি সত্যিকার হিন্দি জানি কি না আপনারা পরীক্ষা নিতে চান? আসুন আমি শুদ্ধ হিন্দিতে আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, বলেই তিনি খাসা হিন্দিতে ঘণ্টা দুয়েক বক্তৃতা দিলেন। আগাগোড়া একবর্ণও উর্দু বা ফারসি শব্দ মেশানো হয়নি এতে।

আরও শুনেছি, আগা সাহেব যে নায়িকার দিকে দৃকপাত করতেন তখনই তাকে আগা হাশরের আহ্বানে গোপন কামরায় চলে যেতে হত।

আগা সাহেব মুন্সিদেরকে (সেক্রেটারি) হুকুম দিতেন, হ্যাঁ- তৈয়ার হয়ে যাও।

বলেই তিনি একই সঙ্গে যুগপৎ কমেডি এবং ট্র্যাজেডি রচনায় লেগে যেতেন। বলাবাহুল্য তখন তিনি মদমত্ত থাকতেন।

আগা সাহেব কোনোদিন কোনো মেয়েকে ভালোবাসেননি। কিন্তু ইব্রাহিম দারোগা আমাকে জানাল একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আগা হাশর নাকি অমৃতসরের বিখ্যাত গণিকা মোখতার-এর প্রেমে নিমজ্জিত। ‘আওরত কা পেয়ার’ ছবিতে যে মোখতার নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিল।

মোখতারকে আমি জানতাম। হল বাজারের আনোয়ার পেইন্টার-এর দোকানে বসে থেকে প্রায় প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে নিত্য-নতুন সাজে অন্যান্য গণিকাদের সঙ্গে তাকে খালি পায়ে দরগার দিকে যেতে দেখতাম।

আগা হাশর দেখতে কেমন ছিলেন আমি তা জানতাম না, তবে খবরের কাগজে দু একবার তাঁর ছবি পেয়েছি। কিন্তু তা দেখে তার আসল ছবি কল্পনা করা অসম্ভব। বয়েস সম্পর্কে শুধু এতটুকু জানতাম, তিনি বেশ বুড়িয়ে গেছেন। এই শেষ বয়সে মোখতারের সঙ্গে তার কেমন করে প্রেম হল আমরা তা নিয়ে ফজলুর দোতলার জুয়ার আড্ডায় আলোচনা করতে গিয়ে বেশ একদিন রীতিমতো বিস্মিত হলাম। আমার বেশ মনে আছে ফজলুকুমার গাঁট থেকে পয়সা বের করতে করতে একটা নিতান্ত দার্শনিক ভঙ্গিতে বলেছিল, বৃদ্ধ বয়েসের প্রেমের জ্বালা বড়ো কড়া হয়রে ভাই।

কবে কোন সময় হঠাৎ কী প্রসঙ্গে আগা হাশরের আলোচনা উঠেছিল তা মনে নেই। তবে হররোজ আগা হাশরকে নিয়ে আলোচনা করা আমাদের একটা বাতিক হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মধ্যে ইব্রাহিম দারোগাই আগাসাহেব সম্পর্কে বিশেষভাবে জানত। একদিন কথায় কথায় সে বলে ফেলল, গত রাতে আমরা মোখতারের ওখানে ছিলাম। আগা সাহেব হাত-পা ছড়িয়ে বসেছিলেন। আমরা বহু অনুনয় বিনয় করে বললাম আপনার ‘রুস্তম সোহরাব’ নাটকের কাহিনি যদি দয়া করে আমাদের শোনান। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। আমরা নিরাশ হলাম। আমাদের একজন এ ব্যাপারে মোখতারের সাহায্য প্রার্থনা করল। মুহূর্তে মোখতার আগাসাহেবের কাছে ঘেঁষে বসল এবং বলল, আগা সাহেব আমার হুকুম–রোস্তম সোহরাবের কাহিনি শোনাতে হবে আপনাকে।

বাধ্য হয়ে আগাসাহেব একটু মুচকি হাসলেন এবং গুরুগম্ভীর কণ্ঠে রুস্তম সোহরাবের ডায়ালগ বলতে লাগলেন পর্যায়ক্রমে। মনে হচ্ছিল একটি দ্রুতগামী নদী খরতর বেগে বয়ে চলেছে। ওরে বাবা তার কণ্ঠের সে কী গর্জন!

একদিন ইব্রাহিম জানাল, আগাসাহেব নাকি মদ ছেড়ে দিয়েছেন। যারা আগা হাশরকে জানতেন তাঁদের পক্ষে এটা সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য। ইব্রাহিম জানাল, এই অল্প কদিন হল তিনি মদ ছেড়েছেন। মোখতারের প্রেমে পড়েই তাঁকে মদ ছাড়তে হয়েছে। ছিঃ! এ আবার কেমন প্রেম–আবার তাও মদ ছেড়ে দিতে হচ্ছে। আমাদের মন্তব্য শেষ হতে না হতেই ফজলুকুমার একগাদা নোটে তাঁর টাকা ভরে নিতে নিতে বলল, হায় ভাই বুড়াকালের প্রেমের মতো প্রেম আর হয় না।

এ সময় বারিসাহেব এবং হাজি লকলক-এর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। দৈনিক মাসাওয়াত সম্পাদনার ব্যাপারে সম্প্রতি তারা অমৃতসরে এসেছেন। সিরাজ হোটেলে দুজনে চা পান করতে আসতেন। সাহিত্য এবং রাজনীতি নিয়ে দেদার আলোচনা হত। বারিসাহেবকে আমার বেশ পছন্দ হল। হোটেলের মালিক জিজু ইতিমধ্যে আবার আখতার শিরানিকেও আমন্ত্রণ জানালেন। দিনরাত পানীয়ের ছড়াছড়ি চলতে লাগল। শিল্প সাহিত্যের প্রতি আমিও একটু ঝুঁকে পড়লাম। যে সময়গুলো আমার জুয়ায় আচ্ছায় কাটত এখন তা ‘মাসাওয়াত’-এর সম্পাদকীয় অফিসে কাটে। বারি সাহেব কখনো কখনো দু-একটা খবর অনুবাদ করার জন্যে এগিয়ে দিতেন কাঁচা হাতে কোনোমতে তা অনুবাদ করে দিতাম। কিছুদিন পর পত্রিকাতে একটা সিনেমা বিভাগ খুলে আমি তা পরিচালনা করতে লাগলাম। বন্ধুরা বলত, কিছুই হয় না। বারিসাহেব বলতেন ওসব শুনতে যেও না চুপচাপ লিখে যাও। মৌলিক রচনা লিখতে চেষ্টা করো।

কিন্তু মৌলিক লেখা আমার হাতে আসছিল না। একজন ফারসি লেখকের ‘লাস্ট ডেজ অব কনডেন্ড’ আমার আলমারিতে পড়েছিল। একদিন বারিসাহেব সেটা তুলে নিয়ে গেলেন। পরদিন যখন দুপুর নাগাদ অফিসে গেলাম কাতিবরা জানাল যে, বারিসাহেব সেই সাত-সকাল থেকে উচ্চস্বরে কী একটা বই পড়ছেন। কিছুক্ষণ পরপরই বাইরে আসেন এবং এক ঘটি ঠান্ডা পানি মাথায় ঢেলে আবার ভেতরে গিয়ে পড়তে বসে যান। আমি গিয়ে দেখলাম দরজা বন্ধ। কড়া নাড়ালাম। তখনও তিনি উচ্চস্বরে ইংরেজি পড়ছেন। দরজা খুলে গেল। বারিসাহেব জামা-পায়জামা ছাড়াই বেরিয়ে এলেন, হাতে ভিক্টর হুগোর বই। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে খাসা ইংরেজিতে বললেন, ইট ইজ এ ভেরি হট বুক। তারপর আমাকে পরামর্শ দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি বইটার অনুবাদ করে ফেল।

আমি বইটি পড়লাম। রচনাধারা অত্যন্ত সাবলীল। কিন্তু ভাষা বড়ো শক্ত। চোখের সামনে অক্ষরগুলো কিলবিল করে উঠল। আঙিনায় খাঁটিয়া বিছিয়ে নিয়ে হুঁকোর নল টানতে টানতে বোনকে অনুবাদ শেখাবার ছলে তাকে দিয়ে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতেও কোনো কিছু হল না, অবশেষে আমি কঠোর পণ নিয়ে একটা অভিধান ঘেঁটে ঘেঁটে এক পক্ষকালের মধ্যে অনুবাদ করে ফেললাম। বারি সাহেব খুব বাহবা দিলেন। নিজে একটু আধটু সংশোধন করে দিয়ে উর্দু বুকস্টলের কাছে পাণ্ডুলিপিটা ত্রিশ টাকায় বিক্রি করে দিলেন। ইউসুফ হাসান অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেটা ছেপে বাজারে ছাড়লেন। ব্যস, আমি একজন লেখক হয়ে গেলাম।

‘মাসাওয়াত’ বন্ধ হয়ে গেল। বারিসাহেব অন্য এক পত্রিকায় কাজ নিয়ে লাহোর চলে গেলেন। জিজুর হোটেলের সেই জমজমাট আড্ডা ভেঙে গেল। এতদিনে আমার লেখায় হাত এসে গেছে। কিন্তু বন্ধুদের কাছে এর কোনো দাম ছিল না বলে লেখাজোখা অবশেষে ছেড়ে দিলাম। আবার ফজলুকুমারের আড্ডায় গিয়ে হাজির হলাম। আবার জুয়া চলল। কিন্তু আগের মতো সেই মন আর নেশা ছিল না।

একদিন দারোগা ইব্রাহিম ফ্লাস খেলতে গিয়ে বলল, এবার কিন্তু আগা হাশর এসে মোখতারের কুঠিতে উঠেছেন।

আমি তাকে বললাম, আমাকে একদিন নিয়ে চলো সেখানে।

ইব্রাহিম নিয়ে যাবে বলে কথা দিল। কিন্তু আজ যাব কাল যাব করে আর গেল না। অবশেষে আমি একদিন চেপে ধরলাম। পরে সে জানাল–আগা হাশর তো লাহোর চলে গেছেন।

হরি সিং বলে আমার এক বন্ধু ছিল। আল্লা তাকে বাঁচিয়ে রাখুন। পাঁচ-পাঁচটা বাড়ি বিক্রি করে পুরো ইউরোপ ঘুরে এসেছে একবার। ষষ্ঠ বাড়িটিও বিক্রি করে বসে বসে খাবার জোগাড়ে ছিল। ফ্রান্সে মাত্র ছমাস ছিল সে। কিন্তু ফরাসিতে কথা বলতে তার একটুও অসুবিধা হয় না। দেখতে খুবই হালকা পাতলা লিকলিকে। কিন্তু জবান ছিল বড়ো ক্ষুরধার। চোখ দুটো ছিল কোটরাগত।

একদিন আমি তার কাছে আগা হাশরের কথা পাড়লাম। সে বলল, তো তুমি কি তার সাথে দেখা করতে চাও?

আমি বললাম, আলবত। আমি দু-চোখে একবার তাকে দেখতে চাই।

সে বলল, ওমা, তা আর কী এমন কঠিন কাজ? অমৃতসরে এসে তিনি পণ্ডিত মোহসিন-এর ওখানে উঠেছেন–আমার সাথে প্রায় প্রত্যেক দিনই কথাবার্তা হয়।

আমি একেবারে অধীর হয়ে উঠলাম এবং তাকে ধরে বললাম, তাহলে কালকেই আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো।

পরদিন হরি সিং আমাকে হাশর কাশ্মীরির কাছে নিয়ে উপস্থিত হল। পণ্ডিত মোহসিনের নাম শুনেই মনে হল কাশ্মীরের লোক। তার আসল নামটা হয়তো অন্য কিছু। এটা ছিল তার উপনাম। বিভিন্ন মোশায়েরায় সেকেলে কাব্যকর্মের কিছু নমুনা পেশ করতেন। ঘনিয়া কাটরার অমৃত সিনেমার সঙ্গে তার কাজকারবার ছিল।

আগাসাহেবের সঙ্গে পণ্ডিতজির বন্ধুত্ব কাব্যচর্চার মাধ্যমেই হয়েছিল। এমনও হতে পারে অমৃত সিনেমার সামনে মোখতারের কুটির সেই সুবাদেও হতে পারে। কারণ। যা-ই থাকুক বর্তমানে আগা সাহেব পণ্ডিতজির ওখানেই উঠেছিলেন। দুজনের কথাবার্তা শুনে মনে হল দুজনের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।

পণ্ডিত মোহসিনের দফতর ঘনিয়া কাটরার কাছাকাছি পশমের বাজারের একটু আগে তরিতরকারির দোকানের পাশে একটা বিরাট দেউড়ির ওপারে। হরি সিং আগে আগে চলছিল। দেউড়ির সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে আমার বুক দুরুদুরু করছিল।

বাইরে আঙিনায় চেয়ার পেতে কিছু লোক বসে ছিল। এককোণে পণ্ডিতজি গড়গড়া টানছিলেন। প্রথমেই একজন বিরাট দশাসই বিচিত্র পোশাক-আশাকে সজ্জিত মানুষের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়ে গেল। গাঢ় লাল চমকদার সার্টিনের গলাবন্ধ, মোটা কলারের সাদা কামিজ, কোমরে গাঢ় নীল রঙের বন্ধনী আর বড়ো জবাফুলের মতো দুটো চোখ। আমি ভেবেছিলাম এখানকার কোনো পিরসাহেব হবেন হয়তো। কিন্তু একটু পরেই দেখলাম সবাই তাকে আগাসাহেব বলে সম্বোধন করছে। আমি একটা হোঁচট খেলাম।

হরি সিং এগিয়ে গিয়ে এই আজব লোকটির সঙ্গে করমর্দন করল এবং আমাকে দেখিয়ে বলল, আমার বন্ধু সাদত হাসান মান্টো, আপনার সাথে পরিচয় করতে চায়।

আগা সাহেব তার চোখ দুটো বিস্ফারিত করে একটু মুচকি হেসে বললেন, লর্ড মিল্টোর সাথে তোমার কী সম্পর্ক?

আমার মুখে কোনো উত্তর জোগাল না। কিন্তু হরি সিং বলল, মিন্টো নয়, ওর নাম মান্টো। জাতে কাশ্মীরি।

আগাসাহেব একথা শুনে একটু ‘হুঁহ’ শব্দ করে পণ্ডিতজির সঙ্গে কাশ্মীরিদের বংশগৌরব নিয়ে আলোচনায় মত্ত হলেন। আমি কাছেই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লাম। আগাসাহেবের আলোচনায় মোটেই মন ছিল না পণ্ডিতজির। কারণ, মাঝখানে ফাঁক পেলেই তিনি বারবার বলতে শুরু করেন, আগাসাহেব ওসব রেখে দিন, দুটো রিল কৌতুক নাটক লিখতে কবে নাগাদ আপনি হাত দিচ্ছেন সেইটে বলুন।

আগাসাহেবেরও কৌতুক নাটকের আলোচনায় তেমন মন ছিল না। কারণ, তিনি তো কাশ্মীরিদের বংশগৌরবের আলোচনায় মত্ত। আসলে ওই আলোচনায়ও তার মন ছিল না, মাঝে-মাঝে কী যেন ভাবছিলেন তিনি এবং চাকর ছোকরাকে উদ্দেশ্য করে বার কয়েক গালি দিলেন। চাকর ছোকরাটা এখনও কেন আসছে না।

আগা যখন থামলেন পণ্ডিতজি বললেন, আগা সাহেব, এসময় আপনার মুড ভালো আছে। আমি কাগজকলম আনিয়ে নিচ্ছি। আপনি সেই কমেডিটা লিখে ফেলুন।

আগা হাশর মুহূর্তে চোখ পাকিয়ে বলে উঠলেন, আরে চুপ করো। আগা হাশরের মুড সব সময়ই ঠিক থাকে।

পণ্ডিতজি চুপসে গেলেন। এবং নিজের গড়গড়ার নল টেনে নিলেন। চোখে সরষে ফুল দেখছিলাম যেন। কোনদিক থেকে যেন একটা সুবাস আসছিল। চেয়ে দেখলাম আগা সাহেবের দুকানে আতর মাখানো তুলা রয়েছে। মনে হল মাথার চুলেও আতর রয়েছে।

হঠাৎ বাইরের দিকে শোরগোল শোনা গেল। কে একজন এসে আগাসাহেবকে বলল, আগাসাহেব বাইরে মহরমের মিছিল আসছে। আসুন, দেখুন।

আগাসাহেব বললেন, রাখো ওসব বকবাজি। বলেই তিনি কারবালা-কাহিনি সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় অবতীর্ণ হলেন। আলোচনা করতে গিয়ে এমন সব তথ্য আবিষ্কার করে ফেললেন যে, শুনে সবাই হতবাক। তিনি নাটকীয় কায়দায় বললেন, ফোরাতের মুখ ছিল বন্ধ। ফোরাতে আদৌ পানিই ছিল না। আগা হাশর কোনো কথা…।

এখানে আসতেই একজন লোক মহফিল ছেড়ে উঠে গেল। সম্ভবত লোকটি শিয়া। আগাসাহেবের আলোচনার মোড় ঘুরে গেল।

পণ্ডিতজি ফাঁক পেয়ে গেলেন। আবার বলে ফেললেন–একটা কমেডি আপনাকে যে ভাবে হোক লিখতেই হবে।

আগাসাহেব এবারে একটা মোটা গালি দিয়ে বললেন–এখানে হচ্ছে ট্র্যাজেডির কথা আর তুমি কিনা নিয়ে এসেছ কমেডি।

একথা বলেই আবারও তিনি কারবালার বিষাদ গাথার সুক্ষ্ম আলোচনায় নিমগ্ন হলেন। বেশ অনেকক্ষণ বকবক করার পর হঠাৎ তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে গিয়ে চাকর ছোকরাকে গালি দিতে শুরু করলেন এবং বললেন- হতভাগা এখনও কোথায় বসে মরছে।

কিছুক্ষণ পর এদিক-সেদিকের কথাবার্তার পর কে একজন মাওলানা আবুল কালাম আজাদের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কথা পাড়ল, আগা সাহেব বলে উঠলেন, ও–মহিউদ্দিনের কথা বলছ? আমরা দুজনেই তো খ্রিস্টান মিশনারিদের প্রচারণার মুণ্ডপাত করেছি। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বক্তৃতা দিয়ে যেতাম–কী ছিল সে দিনগুলো।

একথা বলেই তিনি অতীতের সেই মধুময় দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থনে হারিয়ে গেলেন। অতীত দিনের কথা ভাবতে গিয়ে তার চোখদুটো বুজে এল। অনেকক্ষণ পর যখন চোখ খুললেন, মনে হল বহু বছরের নেশা থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন তিনি।

আগাসাহেব আবার বললেন, তখনকার দিনগুলোই ছিল অন্য রকমের। আজাদের কাদা ছোঁড়াছুড়ির অভ্যেস ছিল আর আমার ছিল অত্যন্ত সন্তর্পণে প্যাঁচ কষার। যেখানে হাত দিয়েছি সেখানেই শত্রুরা কুপোকাত হয়েছে। একবার আজাদ (মাওলানা আজাদ) বিশ্রীভাবে চিৎপটাং হয়ে পড়ল। চারজন খ্রিস্টান মিশনারির সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছিল। যথাসময়ে আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমাকে দেখে আজাদের দেহে প্রাণ ফিরে এল। সে ত্বরিত পরিস্থিতিটা আমার হাতে ন্যস্ত করল। আমি দু-তিনটা প্যাঁচ কষে তাদেরকে ধরাশায়ী করে ফেললাম। এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আমার আয়ত্তাধীনে। কিন্তু ওদিকে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মসজিদে বেজায় গরম। দম বন্ধ করে আসছিল। আমি আজাদকে বললাম, বোতলটা কোথায়? আজাদ বলল, এই তো আমার পকেটে। আমি বললাম, দোহাই–একটুও দেরি না করে চলো। আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বেশি দূরে গেলাম না। মসজিদের গোসলখানাতে ঢুকেই গলাধঃকরণ শুরু করলাম।

এমন সময় আগাসাহেবের চাকর এসে উপস্থিত হল। আগাসাহেব তার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় তাকে কিছুক্ষণ গালি দিলেন এবং দেরি হবার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। বুঝা গেল, গালি শোনা তার নিত্যকার অভ্যাস। এত গালি তার গায়েই যেন লাগল না। স্বচ্ছন্দে সে কাগজে মোড়ানো একটা পুঁটলি তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল, দেখুন, আপনার জন্যে কী নিয়ে এসেছি। আপনি খুশি না হয়ে পারবেন না।

আগাসাহেব পুটলি খুললেন। তাতে রং-বেরঙের চারটি শেলোয়ার রয়েছে। আগা সাহেব খুশি হবার বদলে রক্তচক্ষু পাকিয়ে গর্জন করে বললেন, বেশ করেছ বাঞ্চোত–এমন আজগুবি কাপড় তো এই শহরের আজেবাজে মানুষেও পরে না।

একথা বলেই তিনি সেগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে দিলেন। এরপর আরও কিছুক্ষণ গালাগাল দিয়ে পকেট থেকে দু-তিন হাজার টাকার একটা বান্ডিল বের করে বললেন।

যা পান নিয়ে আয়।

পণ্ডিতজি গড়গড়া একদিকে সরিয়ে রেখে বললেন, রাখুন আগা সাহেব, আমিই আনাচ্ছি পান।

আগাসাহেব নোটের বান্ডিলটা পকেটে পুরতে পুরতে বললেন, যা, তোর কাছে ভাংতি আছে। তা থেকে নিয়ে আয়।

চাকর যেতে উদ্যত হলেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, শোন–ও এখনও কেন এল না সে খবরও নিয়ে আসবি কিন্তু।

চাকর চলে গেল। কিছুক্ষণ পর সিঁড়ির কাছে কাঁকনের টুংটাং শোনা গেল। ঘরময় ভুরভুর সুগন্ধী ছড়িয়ে গেল। আগাসাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। মোখতার পায়ে পায়ে কামরায় ঢুকে পড়ল। তার বিন্দুমাত্র সৌন্দর্য বলতে কিছু ছিল না। পরনে দামি পরিচ্ছদ। আগাসাহেব এবং উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে সালাম আদাব জানিয়ে ভেতরের খাস কামরায় চলে গেল। আগাসাহেবের দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করে সে কামরা অবধি গেল।

ইতিমধ্যে পান এসে গেল। খবরের কাগজে মোড়ানো এক বান্ডিল পান। চাকর ভেতরে চলে যাচ্ছিল। আগাসাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কাগজ ফেলে দিসনে। যত্ন করে রেখে দে।

আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এ টুকরো কাগজটুকু দিয়ে কী করবেন আগাসাহেব?

আগাসাহেব বললেন, তা জানো না? এটা পড়ব। ছাপানো কোনো কাগজই আমি পড়ে ছাড়ি না। জীবনে আমি যত টুকরো কাগজ পেয়েছি সবই পড়েছি। একথা বলেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ক্ষমা করবেন, ভেতরে এক প্রেমিকা আমার জন্যে অপেক্ষা করছে।

পণ্ডিতজি আবার গড়াগড়া তুলে টানতে লাগলেন আর আমি এবং হরি সিং কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে এলাম।

আমি ক-দিন ধরে এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করতে লাগলাম। আগাসাহেব আজব চরিত্রের লোক। হাজার বাহু বিস্তত তাঁর ব্যক্তিত্ব। আমি ইতিমধ্যে তার কটি নাটক পড়ে ফেললাম। ভাষায় অজস্র ভুল। বাজে কাগজে ছাপানো। নাটকের দৃশ্যগুলোতে অত্যন্ত জমকালো সংলাপ। মিলনান্তক দৃশ্য গোঁজামিলে পরিপূর্ণ। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, তার সব নাটকই গণিকাদের নিয়ে। জীবনের শেষ মুহূর্তে মদ ছেড়ে তিনি এক গণিকার প্রেমে নিমজ্জিত হয়েছেন। পণ্ডিত মহসিনের সঙ্গে একবার দেখা হয়েছিল। তিনি বললেন, ওসব প্রেমট্রেম সম্পর্কে আমার জানা নাই। তবে মদ ছেড়ে তিনি ভুল করেছেন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মারা পড়বেন।

আমি এখন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করেছি। মাস কয়েক পর লোকমুখে শুনতে পেলাম, আগা হাশর ‘রুস্তম সোহরাব’ নাম দিয়ে ছবি করছেন। এ ব্যাপারে পানির মতো টাকাপয়সা ছিটানো হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এ ছবির নায়িকা মোখতার।

অমৃতসর থেকে লাহোর মাত্র এক ঘণ্টার পথ। আগাসাহেবের সঙ্গে আবার দেখা করার জন্য মন আঁকুপাঁকু করছিল। কিন্তু আজ কাল করে আর লাহোর যাওয়া হয়ে উঠল না।

অনেকদিন পর বারিসাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি লাহারে গেলাম। তারপর নানা কার্যকারণে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে, আগাসাহেবের কথা ভুলেই বসেছিলাম। একদিন সন্ধ্যার দিকে ভাবলাম, উর্দু বুকস্টলের দিকে যাওয়া যাক। আমি ও বারিসাহেব আরব হোটেল থেকে চা পান করে সেদিকে রওয়ানা দিলাম। উর্দু বুকস্টলে পৌঁছে দেখি আগা হাশর– একটা টেবিলের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছেন। আমি বারিসাহেবকে ইশারা করে বললাম, ইনিই হলেন আগা হাশর। বারিসাহেব চোখ ছানাবড়া করে তার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বললেন, ওমা, এই নাকি আগা হাশর?

আগাসাহেবের পোশাক-আশাক আগের মতোই। বসে-বসে একটা বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছিলেন। কাছে পৌঁছেই আমার বুক দুরুদুরু করে উঠল। আগাসাহেবের হাতে আমারই অনূদিত ‘ছারগুজান্তে আশির’ বইটি।

দোকানি ইউসুব আমার সঙ্গে আগাসাহেবের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনিই হলেন মান্টো। ইনি এটা অনুবাদ করেছেন।

আগাসাহেব ভারী চোখ দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাকে দেখলেন। আমি মনে করেছিলাম, তিনি হয়তো আমাকে চিনে নেবেন। কিন্তু তিনি আমাকে দেখে নিয়ে বইখানা আবার ওলটাতে শুরু করলেন। এবং বললেন, ভিক্টর হুগো লোকটি কেমন লিখতেন?

বারিসাহেব বললেন, ফরাসি সাহিত্যে ভিক্টর হুগোর স্থান খুব উঁচুতে।

আগাসাহেব পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, নাট্যকার ছিলেন নাকি?

জী, নাট্যকার।

আগাসাহেব বললেন, তার মানে?

বারিসাহেব বললেন, আসলে তিনি ফরাসি সাহিত্যের একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। নাটক-উপন্যাসও লিখেছেন। বিপদগ্রস্ত’ নামের একখানি উপন্যাস তার এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, লোকেরা তাঁর কবিপ্রতিভার কথা ভুলে যায়। পরে একজন ঔপন্যাসিক হিসেবেই তিনি পরিগণিত হন।

আগাসাহেব এসব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। শেষে তিনি দোকান থেকে আমার আমার বইটিও কিনবেন বলে জানালেন। তা শুনে আমি খুব খুশি হলাম।

বারিসাহেব কথা বলতে বলতে ভেতরে শোরুমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং তার অনুরোধক্রমে বেশ ক-খানা বই কিনলেন। কথায় কথায় বারিসাহেব বললেন, আগা সাহেব, আপনি কেন পাক-ভারতের নাটকের ইতিহাস লিখছেন না, লিখলে কিন্তু একখানা। মূল্যবান বই হয়।

আগাসাহেব বললেন, এমন একখানা বই আগা হাশরই লিখতে পারে।

লেখার ইচ্ছাও ছিল। কিন্তু হতভাগা আজকাল কবরে পা দিয়ে বসেছে, তার দ্বারে এসে মৃত্যু করাঘাত হানছে। আমি কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আগাসাহেব, সেসব নাটক আজকাল বাজারে চলছে…।

আমি কথা শেষ না করতেই তিনি বললেন, তওবা তওবা … লাহাওলা অলা–হারামজাদারা এখান থেকে ওখান থেকে নিয়ে আগা হাশরের নামে ছাপিয়ে দিয়ে পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। আগা হাশর এসব আজে বাজে……

বলেই তিনি এসব বইয়ের প্রকাশকদেরকে বেশ কষে গালি দিলেন একচোট। আমি বললাম, আপনি ওদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন না কেন?

–তিনি বললেন, কী করবো এসব চুনোপুটি মেরে।

কথাটা সত্যি বলেছেন। আমি চুপসে গেলাম।

আগা হাশর শোরুমের বাইরে এসে ইউসুবের কাছে বিল চাইলেন এবং বাজিকরের ভঙ্গিতে পকেট থেকে দশ ও পাঁচ টাকার নোটে তিন হাজার টাকা বের করলেন। তখন এক ধরনের নূতন নোট বেরিয়েছে। আগেকার নোটের চেয়ে এগুলো অনেক ছোটো এবং দেখতে সুন্দর ছিল।

আগা হাশর বললেন, চেক ক্যাশ করাবার জন্যে যখন ব্যাঙ্কে গেলাম, ক্লার্ক বলল, সময় শেষ হয়ে গেছে। আমি বললাম, আগা হাশরের জন্যে এখনও ঢের সময় আছে। আমার নাম শুনতেই ক্লার্ক দৌড়ে ম্যানেজারের কামরায় গেল। আর ম্যানেজার আমাকে সসম্মানে ডেকে পাঠাল, আর নতুন নোটগুলো আমাকে দিয়ে বলল, আপনার তো আর কোনো খেদমত করতে পারব না। এই নতুন ধরনের নোটগুলো আজকেই এসেছে। আপনাকেই প্রথম এইগুলো দিলাম।

বারিসাহেব সেখান থেকে একটা নোট নিয়ে নেড়েচেড়ে বললেন, আকারে বেশ ছোটো–একেবারে আমাদের সরকারের মতো।

কথাটা শুনে আগাসাহেব বারিসাহেবের পিঠ চাপড়ে ধন্যবাদ দিলেন এবং বললেন, তোমার একথা আমি যে-কোনো নাটকে ঢুকিয়ে দেব।

বারিসাহেব বেশ খুশি হলেন। ইতিমধ্যে সেদিনের সেই চাকরটি এসে উপস্থিত হল। এবারে তার হাতে গোটা চারেক কান্দাহারের আনারস। আগাসাহেব সেগুলো নাকের কাছে নিয়ে ভ্র কুঞ্চিত করে বললেন, এমন আজেবাজে আনারস কোনো ভদ্রলোকে খায়?

চাকর বলল, তাহলে ফিরিয়ে দিয়ে আসব?

আগাসাহেব বললেন, কুত্তা, দরকার নেই বরং–তুই খেয়ে নিস। বলেই তিনি একটা ভারী গালি ছুড়লেন তার দিকে।

আগাসাহেব যেতে উদ্যত হতেই আমি অটোগ্রাফ বুক এগিয়ে দিয়ে তার স্বাক্ষর নিলাম। আগাসাহেব কাঁপা কাঁপা হাতে স্বাক্ষর দিতে দিতে বললেন, বহুকাল পরে মাত্র এই কটা অক্ষর লিখলাম।

আমি অমৃতসরে ফিরে এলাম, কিছুদিন পর লাহোর থেকে খবর এল সামান্য অসুখে ভুগে আগা হাশর ইন্তেকাল করেছেন। তার জানাজায় অল্প কজন লোক উপস্থিত হয়েছিল।

ফজলুকুমারের জুয়ার আড্ডায় যখন আগা হাশরের মৃত্যুর খবর নিয়ে আলোচনা উঠল, ফজলুকুমার তার স্বভাবসিদ্ধ কায়দায় পয়সা কুড়িয়ে ট্যাকে ভরতে ভরতে একজন পাকাপোক্ত দার্শনিকের মতো আমতা আমতা করে বলল, হায়, বুড়াকালের প্রেমের মতো প্রেম আর হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *