০৭. হানিফ আজাদ ও জিন্নাহ্ সাহেব

০৭. হানিফ আজাদ ও জিন্নাহ্ সাহেব

এটা সাঁইত্রিশ সালের ঘটনা। মুসলিম লিগের বেশ তোড়জোড় চলছে তখন। আমি (হানিফ) নিজেও তখন যৌবনের প্রান্তসীমায়। এ বয়সে সবসময়ই একটা কিছু করতে চাইত মন। গায়ে জোর ছিল, স্বাস্থ্য ভালো ছিল, মনের মধ্যে সবসময়ই একটা অদম্য ইচ্ছে তোলপাড় করত। আগামীতে যে কোনো একটা কাজে লেগে যাব। যদি কোনো কাজ না পাই তাহলে কাজ তৈরি করে নেব এবং সে কাজকে উপলক্ষ্য করেই চলতে থাকব সামনের দিকে। যৌবনের এ বয়সটা এমনই একটা সময় যখন একটা কিছু করতে মন চায়। কিছু একটা করা মানে, আমি বলতে চাইছিলাম, কোনো একটা মহৎ কাজ করা। কোনো মহৎ কাজ সম্পন্ন না হোক, তাতে ক্ষতি নেই, সে নামে একটা অনাসৃষ্টিই হোক না, ক্ষতি কী, তবু একটা কিছু হোক।

এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার অবতারণা করে আমি সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাই যখন মির্জা গালিব যুবক ছিলেন। জানি না তিনি যৌবনে কোনো রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। কিন্তু এই অধম মুসলিম লিগের একজন নগণ্য খাদেম ছিল। গাজী-আবাদে আমার মতো এ ধরনের বেশ কজন যুবকের একটা দল ছিল। এই দলের আমি অন্যতম সদস্য ছিলাম। নিজের আত্মপ্রচার এজন্যে শুরু করছি যে, সে সময় এটা ছাড়া আমাদের করণীয় কিছুই ছিল না, এটাই ছিল ধ্যানজ্ঞান।

এটা তখনকার কথা, যখন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ দিল্লি আসেন এবং মুসলমানরা তাকে নিয়ে বিরাট মিছিল বের করে। স্বভাবতই এই মিছিলকে সাফল্যমণ্ডিত করার পেছনে গাজী-আবাদের যুবকদেরও অবদান কম ছিল না। আমাদের দলের নেতা ছিলেন আনোয়ার কোরাইশী। বেশ সুদর্শন যুবক, বর্তমানে যিনি শায়েরে পাকিস্তান’ নামে বেশি খ্যাত। আমাদের যুবকদের কণ্ঠে যে গান শোনা যেত তা ছিল তারই রচিত জাতীয় সঙ্গীতের পঙক্তিমালা। সুর-তাল রক্ষা করে আমরা গাইতাম কি না তা জানি না, তবে এতটুকু মনে আছে, সুর-তালের নিয়ন্ত্রণে কারও কণ্ঠই ছিল না, কোনোরকমে গানটি গেয়ে ফেলতে পারলেই আমরা উদ্ধার হয়েছি বলে ভাবতাম।

সেই ঐতিহাসিক মিছিল দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসজিদ থেকে শুরু হয়েছিল। মুখরোচক স্লোগান তুলে চঁদনীচক, লালকুয়া, হাওজে কাজী এবং চাঁদরি বাজার ইত্যাদি হয়ে মুসলিম লিগের অফিসে এসে শেষ হয়। এই মিছিলেই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহক ‘কায়েদে আজম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ছটি ঘোড়াবিশিষ্ট একটি শকটে তাকে বসানো হয়েছিল। এই মিছিলে মুসলিম লিগের গণ্যমান্য সকল ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। মোটর, মোটর সাইকেল, বাইসাইকেল এবং উট শোভিত এই মিছিল সত্যিই দেখার মতো হয়েছিল। শৃঙ্খলাপ্রিয় কায়েদে আজমের ঠিক মনেরই যেন প্রতিফলন ছিল এই মিছিলটি।

আমি মিছিল চলাকালে একাধিকবার তাকে দেখেছিলাম। তাকে দেখে আমার মানসিক প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল তা মনে নেই। তবে এখন ভাবি এবং একটা নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আন্তরিকতার কোনো অতিরঞ্জন নেই, ভাবাবেগটাই প্রধান সেখানে। সে সময় কেউ যদি আমাকে যে-কোনো একজনকে দেখিয়ে বলত ইনি হচ্ছেন ‘কায়েদে আজম’ তখন তার প্রতিই আমার ভক্তি এবং শ্রদ্ধা উথলে উঠত। কিন্তু মিছিলের মাঝে আমি যখন তাকে বার কয়েক দেখলাম, অলক্ষে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ছি, কায়েদে আজম তাহলে এত দুর্বল এবং শীর্ণকায়?

গালিব বলেছিলেন:

ওহ আয়ে ঘরমে হামারে
খোদা কি কুদরত হায়,
কভি হাম উনকো,
কভি আপনে ঘরকো দেখতে হ্যাঁয়।

তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। এটা তার মেহেরবানী এবং আল্লার অনুগ্রহ ছিল। খোদার কসম, আমি যখনই তাঁকে দেখতাম, তার কৃশ এবং দুর্বল দেহের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হত। একবার তার দিকে তাকাতাম আর একবার নিজের নাদুস-নুদুস। দেহটার দিকে। ভাবতাম, আমার দেহটা যদি তার হয়ে যেত। কিন্তু এ সবই মনে মনে ভাবতাম, অবশ্য তার এই কৃশ দেহটা যেন নিরাপদে এবং বেঁচেবর্তে থাকে সে জন্য দোয়াও করতাম। তখন শত্রুদের প্রতি তাঁর আঘাত নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলত দেদার।

পরিস্থিতি নিরন্তর বদলাতে থাকে। জানি না পরিবর্তনের অপর নামই পরিস্থিতি কি না। যা হোক, পরিস্থিতি এমন হল, মগজের মধ্যে যে শিল্প-সাহিত্যের পোকা ঢুকেছিল, তা কিলবিল করে উঠতে লাগল। মেজাজটা উড়ু উড় হয়ে উঠল, কোনোমতে, বোম্বেতে গিয়ে ভাগ্য-পরীক্ষায় নেমে পড়ব, এই ছিল একান্ত মনোবাসনা। ছোটোবেলা থেকে নাটকের দিকে বেজায় ঝোঁক ছিল। ভাবলাম, সেখানে গিয়ে এ লাইনেও নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা করা যাবে। দেখুন, কোথায় দেশসেবা আর কোথায় সাহিত্য, অভিনয় ও নাটকের চচা- সত্যি, মানুষও এক আজব ধরনের পরস্পরবিরোধী সত্তা!

বোম্বে পৌঁছোলাম। সেকালে ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানি(৯) সর্বশীর্ষে। এখানে কোনোরকম সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবুও কোনোমতে এখানে একটু সুযোগ করে নিলাম। দৈনিক আট আনা পারিশ্রমিকের ভিত্তিতে এক্সট্রা হিসাবে কাজ করতে লাগলাম। স্বপ্ন দেখতাম, এমন একদিন হয়তো সামনে রয়েছে, যেদিন একজন প্রখ্যাত চিত্রতারকার গৌরব আমি অর্জন করব।

খোদার অনুগ্রহে কথা বলার শক্তি ছিল খুব। কথা শুনতে সুমধুর না হলেও তেমন অশ্রাব্য ছিল না, মাতৃভাষা ছিল উর্দু। ইম্পেরিয়াল কোম্পানির প্রায় সকল তারকাই উর্দুর ব্যাপারে ছিল আনাড়ি। ফলে, দিল্লির বদলে বোম্বেতেই তারা আমার সহযোগিতা গ্রহণ করল। প্রায় সব তারকাই আমাকে দিয়ে উর্দুতে তাদের রাশিফল লিখিয়ে নিল এবং আমাকেই আবার তা পড়ে শোনাতে হল। উর্দুতে কোনো চিঠিপত্র এলেও আমার ডাক পড়ত। পড়ে শোনাতে হত, অর্থ বলতে হত এবং পত্রের উত্তরও লিখে দিতে হত। কিন্তু এসব চিঠি পড়ে আর মুন্সিগিরি করে তেমন কোনো সুবিধা হল না, এক্সট্রা ছিলাম এক্সট্রাই রয়ে গেলাম।

এ সময় ইম্পেরিয়াল কোম্পানির মালিক শেঠ আর্দেশির ইরানির বিশেষ ড্রাইভার বুধনের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল। বন্ধুত্বের বিনিময়ে সে আমাকে অবসর সময়ে গাড়ি ড্রাইভিং-এর কাজ শিখিয়ে দিল। ড্রাইভিং শেখার সময়টা ছিল খুবই সংক্ষিপ্ত। বুধনের সবসময় ভয়ে বুক দুরুদুরু করত, পাছে না আবার শেঠ এই ব্যাপারটা টের পেয়ে যায়। এজন্য অত্যন্ত মনোযোগ থাকা সত্ত্বেও আমি পুরোপুরি এই বিদ্যাটা আয়ত্ত করতে পারলাম না। আয়ত্ত করা তো দূরের কথা, শুধু সোজা সড়কে লোকজন যখন থাকে না তখন শেঠের বুইকটা বেশ চালাতে পারি। তা ছাড়া অন্য কোনো কারিগরি জ্ঞান আয়ত্ত করতে পারিনি।

অভিনয় করার নেশাটা একেবারে জেঁকে বসেছিল। এটা ছিল মগজে, আর মনের গভীরে ছিল মুসলিম লিগ এবং তার কর্ণধার মোহাম্মদ আলি জিন্না। ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে, ব্রিচ কেনেডিতে, ডান্ডি বাজারে, সঙ্গে কংগ্রেসপন্থীদের ব্যবহার সম্পর্কে আলাপ-সালাপ হত। ইম্পেরিয়ালে সবাই জানত যে, আমি মুসলিম লিগ করি এবং কায়েদে আজমের অন্ধ ভক্ত। কিন্তু সে সময়টা ছিল অন্যরকম। তখন কোনো হিন্দু কারও মুখে কায়েদে আজমের নাম শুনলে তেড়ে উঠে তাকে মারতে আসত না। পাকিস্তানের দাবি তখনও পুরোপুরি সাধারণ্যে প্রকাশ পায়নি। আমার মুখে যখন তারা কায়েদে আজমের প্রশংসা শুনত, মনে করত লোকটি বেশ নামকরা চিত্রতারকা এবং আমি তার গোঁড়া ভক্ত।

একদিন আমরা বসে গল্প করছিলাম, এমন সময় সেকালের সেরা নায়ক ডি, বালিমুরিয়া এক কপি ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল—এই নাও তোমার জিন্নাহ সাহেব।’

আমি ভেবেছিলাম জিন্নাহ সাহেবের কোনো ছবি ছাপা হয়েছে। উলটেপালটে কোনো ছবি না দেখে বললাম, কই, জিন্নাহ সাহেবের ছবি কোথায়?

বালিমুরিয়া তার পাতলা গোঁফ নেড়ে মুচকি হেসে বলল, ছবি নয়, তার বিজ্ঞাপন।

— ‘বিজ্ঞাপন? কীসের বিজ্ঞাপন?’

বালিমুরিয়া হাত দিয়ে একটা কলাম দেখিয়ে বলল, এই দ্যাখো, জিন্নাহ সাহেবের একজন মোটর মেকানিক চাই। তার গ্যারেজের সব কাজ যেন সামলাতে পারে।

চট করে আমি খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ ছানাবড়া করে কায়েদে আজমের বিজ্ঞাপনটা দেখলাম। আচ্ছা এই ব্যাপার তা তো জানি না।

এমন একটা ভাব দেখালাম যে, এক নিমেষে সবটা পড়ে ফেলেছি। আসলে বালিমুরিয়া যেমন উর্দু জানত আমার ইংরেজি জানার দৌড়ও তেমন ছিল।

আমার গাড়ি ড্রাইভ করার অভিজ্ঞতা কতটুকু ছিল তা আগেই বলেছি। তার ওপর মেকানিজম তো আদৌ জানতাম না। সেল চাপ দিলে কেন স্টার্ট হয়, কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে আমি বলব, এটা তো মোটর গাড়ির স্বভাব। যদি বলে অনেক সময় সেল চাপলেও তো স্টার্ট হয় না তখন বলব, এটাও গাড়ির স্বভাব।

এতৎসত্ত্বেও কী ঝোঁকে আমি জিন্নাহ সাহেবের ঠিকানা টুকে নিলাম। আসলে আমার চাকরি-বাকরির কোনো মতলব ছিল না। শুধু কায়েদে আজমকে স্বচক্ষে নিকট থেকে দেখার জন্যেই মাউন্ট প্লেজেন্ট রোড রওনা হয়ে গেলাম। মালাবার হিলে তার সুদৃশ্য ভবন। বাইরে পাঠান দারোয়ান পাহারায় ছিল। কয়েক থানের তৈরি সালোয়ার এবং মাথায় রেশমি কাপড়ের পাগড়িতে তাকে বেশ দেখাচ্ছিল।

আগেভাগে আরও কজন প্রার্থী এসে জমা হয়েছে ততক্ষণে। তাদের কাছে গাদা গাদা ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং নানা প্রশংসাপত্র রয়েছে। কিন্তু আমার কাছে কিছুই ছিল না। বুক দুরুদুরু করছিল। এমন সময় হঠাৎ কায়েদে আজমের আবির্ভাব হলে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। আমিও এক পাশে গুটিশুটি মেরে রইলাম। সঙ্গে তার বোনও এসেছেন। তিনিও ভাইয়ের মতনই হালকা পাতলা। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আমি তার অনেক ছবি দেখেছি।

জিন্নাহ সাহেব তার এক চোখে মনোকল লাগিয়ে এক এক করে সবাইকে দেখে চললেন। দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার কাছে এসে কড়া স্বরে বললেন,

–ইউ।

আমি থতোমতো খেয়ে চারদিকে তাকালাম। ভাবলাম, আমার পাশের জনকে নির্দেশ করছেন। আমি কনুই দিয়ে তাকে গুঁতো দিলাম। সে সরাসরি কায়েদে আজমকে জিজ্ঞেস করল, স্যার আমি?

কায়েদে আজম আমার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, নো, টুমি।

আমি?

ইয়েস।

আমি একটা তেতো ঢোক গিলোম। মনে হল গোটা চারেক কুইনিন টেবলেট আমার গলা দিয়ে একসঙ্গে পার হয়ে গেল। তারপর চোখ থেকে মনোকল নামিয়ে বললেন অল রাইট। চকিতে সুদর্শন সেক্রেটারিকে ডেকে কানে কানে কি বললেন, তারপর বোনের সঙ্গে অন্দরে চলে গেলেন।

আমি চলে যাচ্ছিলাম, এমন সময় সেক্রেটারি মতলুব সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, সাহেব কালকে সকাল দশটায় তোমাকে হাজির হতে বলেছেন।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না আমাকে অযথা কেন ডাকা হচ্ছে, এ চাকরির জন্যে আমি তো মোটেই উপযুক্ত নই।

পরদিন সকাল দশটায় হাজির হলাম। সেক্রেটারি জানালেন, সাহেব আমাকে পছন্দ করেছেন। আমি ঝটপট গ্যারেজের দায়িত্বটা যেন নিয়ে নিই।

আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, আমি ঠাট্টা করেই ইন্টারভিউতে এসেছিলাম। আমাকে গ্যারেজের প্রধান বানিয়ে সব চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হল। গ্যারেজে বিভিন্ন মডেলের চারটি গাড়ি ছিল। আমি শুধু শেঠ ইরানির বুইকটা যা একটু চালাতে পারতাম। তাও বরাবর সোজা রাস্তায়। মালাবার হিল অবধি রাস্তায় বেশ কটি বাঁকই পড়ে। এই বিপদসংকুল রাস্তা দিয়ে এমন একজনকে ড্রাইভ করে নিয়ে যেতে হবে যার সঙ্গে অসংখ্য মুসলমানের ভাগ্য জড়িত।

আমি একবার ভাবলাম সব কিছু রেখে সোজা টিকিট কেটে দিল্লি চলে যাই। আবার ভাবলাম, বরং জিন্নাহ সাহেবকে আসল ব্যাপারটা বলে ক্ষমা চেয়ে কেটে পড়ি। কিন্তু মান্টো ভাই বিশ্বাস করুন, সারা মাসেও আমি সে সুযোগ পেলাম না।

কেন পেলে না? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হানিফ আজাদ বলল, আগে সব কিছু শুনেই নিন না।

পরদিন আমার ওপর গাড়ি বের করার হুকুম হল। ভাবলাম, সাহেব যখনই আমার সামনে আসবেন চাবির গোছাটা তার হাতে দিয়ে পা ধরে বসে পড়ব। কিন্তু তা পারলাম না। তাঁর সঙ্গে আবার ফাতেমা জিন্না সব সময় ছায়ার মতন থাকেন। মেয়েদের সামনে কারও পা ধরা মান্টো ভাই বলুন তো খুব লজ্জার কথা না?

আমি বললাম, তারপর কী হল?

আজাদ বলল, তারপর গাড়ি স্টার্ট করতেই হল। নতুন পেকার্ড গাড়ি। খোদা ভরসা করে রওনা দিলাম। মালাবার হিলের নীচে যেখানে লালবাতি চেনেন তো?

হ্যাঁ।

সেখানে এসে বেসামাল হয়ে পড়লাম। ওস্তাদ বলেছিল, বেলাইনে পড়লেই ব্রেক কষবে। খুব জোরসে ব্রেক কষলাম। কায়েদে আজমের হাতের সিগারেট পড়ে গেল। মিস জিন্না সিট থেকে দুহাত লাফিয়ে উঠলেন। আমাকে গালিগালাজ করলেন। কায়েদে আজম সিগারেট তুলে ইংরেজিতে কি যেন বললেন, ভাবে বুঝলাম, ফিরে যাবার কথা বলছেন। বাড়ি ফিরে নতুন গাড়ি এবং নতুন ড্রাইভার তলব করলেন। তারপর যেখানে যাবার সেখানে চলে গেলেন।

এই ঘটনার পর ছমাস পর্যন্ত আমার আর ডাক পড়েনি।

মতলুব সাহেব প্রায় বিকেলে জানিয়ে দিতেন কবে কোন গাড়ির জন্যে কাকে মোতায়েন থাকতে হবে। কিন্তু আমি যখন মাঝেমাঝে নিজের কথা পাড়তাম, তিনি এড়িয়ে যেতেন। পরে জানলাম, আমার জন্যে সাহেবের পক্ষ থেকে কোনো আদেশ থাকত না। আর গায়ে পড়ে সাহেবকে কোনো কথা জিজ্ঞেস করাও যেত না। সেটা মস্তবড়ো অপরাধ হত। আমি বুঝতে পারলাম না গ্যারেজের প্রধান বানানো সত্ত্বেও কী। কারণে আমাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে।

হয়তো কায়েদে আজম তোমার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। আমি বললাম।

কায়েদে আজমের ভুল? অসম্ভব। তিনি ভুলেও কোনো সময় ভুল করতেন না। তার বিলক্ষণ জানা ছিল, আমি ছমাস ধরে তার গ্যারেজে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করছি।

চকিতে আমি ৩৭-৩৮ বছরের শক্ত সুঠাম স্বাস্থ্যবান পুরুষ আজাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, সত্যি তো এমন লোক যদি ছ-মাস বসে বসে খায় তাহলে তো রাজার গোলাও মানবে না। হ্যাঁ, আপনাদের পরিচিত চরিত্রাভিনেতা আজাদের কথাই বলছি। বিভাগোত্তর কালে সে বোম্বে চিত্রজগতের সঙ্গে জড়িত ছিল। বর্তমানে লাহোর চিত্রজগতে এসে জমিয়ে বসেছে।

প্রথমদিকে এক বন্ধু আজাদকে দেখিয়ে বলেছিল, এ গাট্টাগোট্টা কালোমতো জোয়ান লোকটা এককালে কায়েদে আজমের গাড়ি চালাত।

কায়েদে আজমের গাড়ি চালাত? আমি একটু বিস্মিত হই এবং তার প্রতি বিশেষ মনোযোগী হয়ে পড়ি। তারপর কীভাবে আমাদের খাতির জমে সেকথা আর মনে নেই। এর পর যখনই তার সঙ্গে আমার দেখা হত আমি কায়েদে আজমের কথাই বেশি বেশি জিজ্ঞেস করতাম তাকে।

কথায় কথায় আমি একদিন কায়েদে আজমের চরিত্রের এক বিশেষ দিক সম্পর্কে জানতে পাই। সব ব্যাপারেই তিনি নাকি হালকা পাতলা জিনিস পছন্দ করতেন না। মোটা পরিপুষ্ট এবং শক্তসমর্থ বস্তু তার বড়ো প্রিয় ছিল। কবি ইকবাল যেমন লম্বা চওড়া জিনিস পছন্দ করতেন এটাও অনেকটা তদ্রপ। এ কারণেই চাকর-নোকর, ড্রাইভার

আর্দালি যাকেই তিনি নিয়োগ করতেন, সুদর্শন এবং স্বাস্থ্যবান নিয়োগ করতেন।

কায়েদে আজমের সেক্রেটারি মতলুব সাহেব অপরূপ সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান লোক ছিলেন। পাঠান দারোয়ানের প্রতি হুকুম ছিল সে যেন সব সময় তার জাতীয় পোশাক পরিধান করে থাকে। আজাদ যদিও পাঞ্জাবি ছিল না তবু তার প্রতি পাগড়ি পরবার হুকুম ছিল। আজাদ পাগড়ি পরে কায়েদের আজমের সামনে এলে কোনো কোনো সময় তাকে এনাম দেওয়া হত।

কায়েদে আজমের খাবার পরিমাণ এত কম ছিল যে, তা দেখে তোক বিস্মিত না হয়ে পারত না। আমরা আশ্চর্য হতাম যে, এত কম খেয়ে লোকটি বেঁচে আছে কী করে? রোজ চার-পাঁচটা মুরগি জবাই হত। কিন্তু কায়েদে আজমের জন্যে নেহাত ছোটো একটুকরো মাংস পরিবেশন করা হত। রোজ বাজার থেকে অনেক ফলমূল আসত। কিন্তু তার সবই ড্রাইভাররা খেয়ে ফেলত।

কায়েদে আজমের রোজকার অভ্যাস ছিল তিনি রোজ রাতের খাবার শেষে আমাকে তলব করতেন এবং খাবার তালিকা দেখে দু-একটায় দাগ দিয়ে দিতেন। তারপর একশো টাকার একখানা নোট আমার দিকে এগিয়ে দিতেন। আমি বুঝে নিতাম এ টাকা পরদিনের বাজার খরচ।

‘একশো টাকাই?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। হ্যাঁ, পুরো একশো টাকাই। রোজ একশো টাকা বাজার খরচ দিতেন অথচ কায়েদে আজম কোনোদিন হিসাব চাইতেন না। বাজার করে যে টাকা বাঁচত আমরা সবাই ভাগাভাগি করে নিতাম। প্রায় দিন ত্রিশ-চল্লিশ এমনকি সত্তর টাকা পর্যন্ত বেঁচে যেত। কিন্তু এ ব্যাপারে, তিনি কোনদিনই মাথা ঘামাতেন না। অবশ্য মিস জিন্না সময় সময় আমাদের ওপর বেশ চটে যেতেন। বলতেন, আমরা সবাই চোর। এক আনার জিনিসকে এক টাকা বলি। প্রায়ই কায়েদে আজম এমন মুহূর্তগুলোতে এসে বলতেন ইট অলরাইট, ইট ইজ অলরাইট।

একবার কিন্তু কায়েদে আজমের ‘অলরাইট’-এ কাজ হল না। মিস জিন্না দুজন বাবুর্চিকে বের করে দিলেন। কায়েদে আজমের জন্যে সব সময় দুজন বাবুর্চি থাকত। একজন ইংলিশ খানা পাকাত, অপর জন দেশি। দেশি খানা পাকানোর জন্যে যাকে রাখা হয়েছিল সে প্রায় পুরো মাস বসেই থাকত।

বাবুর্চিদের বিদায় করে দেবার পর কায়েদে আজম দিন কয়েক তাজ হোটেলে গিয়ে খেলেন। এসময় আমরা বেশ মজা করতাম। রোজ নতুন বাবুর্চির তালাশে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে পড়তাম। ফিরে এসে বলতাম বাবুর্চি পাওয়া যায়নি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে পুরোনো বাবুর্চিদেরকেই আবার ডেকে পাঠানো হল।

কায়েদে আজম নিজে কম খেয়েও অপরকে বেশি খাইয়ে খুশি হতেন। এজন্যে তিনি রোজ শ-টাকার নোট দিয়ে হিসাব চাইতেন না।

কায়েদে আজম একদিন সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে বের হলেন। আমি পেকার্ড গাড়ি আস্তে আস্তে চালাচ্ছিলাম। আবহাওয়া বেশ চমৎকার ছিল। ভাবে বুঝলাম কায়েদে আজমের মেজাজ খুব ভালো। আমি সুযোগ বুঝে ইদের বখশিশের কথা পাড়লাম। কায়েদে আজম হেসে উঠে বললেন, তুমি দেখছি, একেবারে, পাকাপোক্ত মুসলমান হয়ে গেছ। মাঝেমধ্যে একটু হিন্দুও হও।

এর চারদিন আগে কায়েদে আজম আমাকে মুসলমান বানিয়ে দিলেন অর্থাৎ এনাম হিসাবে দুশো টাকা দিয়েছিলেন। তাই মাঝেমধ্যে একটু হিন্দু হবারও উপদেশ দিলেন।

আজাদের এসব কথা শুনে আমি ভাবলাম, আজাদের ওপর এসব কথার কোনো প্রভাব পড়েনি।

কায়েদে আজম সম্পর্কে একটা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে যে, তার ঘরোয়া জীবন অত্যন্ত প্রচ্ছন্ন। কিন্তু আমি যতটুকু দেখেছি তাতে মনে হয়, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে পারিবারিক জীবন অবিচ্ছেদ্য ছিল। পারিবারিক জীবনের আলাদা কোনো স্বাতন্ত্র ছিল না তাঁর। স্ত্রী ছিল, অনেক আগেই তার সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে। এক মেয়ে ছিল, সে কায়েদে আজমের মতের বিরুদ্ধে এক পারসিক যুবককে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে। এ বিয়েতে কায়েমে আজম যারপরনাই মর্মাহত হয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন যেমনই। হোক এক মুসলমান যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে হোক। ওদিকে মেয়ে বলে বেড়াতে লাগল, পিতাজি যখন এক বিধর্মী মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করতে পেরেছেন আমি কেন পারব না?

বলা বাহুল্য, এটা হয়তো অনেকেই জানে না যে, কায়েদে আজম বোম্বের এক পার্সি সম্প্রদায়ে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়েতে পার্সিরা তার ওপর বড়ো খ্যাপা ছিল এবং নানাভাবে প্রতিশোধ নেবার চেষ্টায় ছিল। অনেকের মতে, পার্সিরাই চক্রান্ত করে তার মেয়েকে তাদের সম্প্রদায়ে গ্রহণ করে কায়েদে আজমের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। আমি এ ব্যাপারে আজাদকে জিজ্ঞেস করায় সে বলল, অতশত জানিনে ভাই– তবে এতটুকু বলতে পারি ও বিয়েতে কায়েদে আজম যারপরনাই ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। পনেরো দিন ধরে কারও সঙ্গে মেলামেশা করেননি। নিজের কামরায় অসংখ্য সিগারেট ফুঁকেছেন এবং এত পায়চারি করেছেন যার পরিমাণ কয়েক মাইল হবে।

কায়েদে আজমের এটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিল, চিন্তা এবং দ্বন্দ্বময় মুহূর্তে তিনি রুমের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াতেন। অনেক গভীর রাতেও তার ঘর থেকে পায়চারি করার আওয়াজ শোনা যেত। এক বিশেষ ছন্দবদ্ধ তালে তার জুতো ঠকঠক করত। তার জুতোর আওয়াজ শুনেই বোঝা যেত তার মানসিক অবস্থা কেমন।

অনবরত পনেরো দিন এই অন্তর্দ্বন্দ্বের পর কায়েদে আজম অনেকটা সুস্থ স্বাভাবিক হলেন। পনেরো দিন পর আমরা যখন তাকে দেখলাম, মনে হল, ব্যথাটা সামলে নিয়েছেন। তবে একেবারে ভুলে গেছেন বলে মনে হল না।

আমি আজাদের কথায় বাধা দিয়ে বললাম, একেবারে যে ভুলে যায়নি তা তুমি কী করে বুঝবে?

আজাদ একটু হেসে বলল, কি যে বলো মান্টো ভাই, ড্রাইভারদের কাছে কারও কথা লুকিয়ে থাকতে পারে? তিনি এ ঘটনার পর মাঝেমধ্যে আমাদের বড়ো সিন্দুকটা খুলবার হুকুম করতেন। সিন্দুকটাতে তার স্ত্রী আর সেই অবাধ্য মেয়ের বহু কাপড়-চোপড় রাখা ছিল। একেবারে ছোটো বয়সের কাপড় পর্যন্ত ছিল এতে। সেগুলি যখন বের করা হত, তিনি চোখ বড় বড় করে সেগুলো দেখতেন এবং গভীর বিষণ্ণ হয়ে যেতেন। অতঃপর এক সময় মনোকল নামিয়ে ‘ইট ইজ অলরাইট’ বলে চোখ মুছতে মুছতে অন্য দিকে চলে যেতেন।

কায়েদে আজমের তিন বোন ছিল। ফাতেমা জিন্না রহমত জিন্না এবং অন্য আর একজনের নাম আমার জানা ছিল না। তিনি ডুংরি এলাকায় থাকতেন। রহমত জিন্না থাকতেন চৌপাটির চিনাই মটর ওয়ার্কস-এর কাছাকাছি। তার স্বামী স্বল্প বেতনে কোনো অফিসে কাজ করতেন। সাহেব প্রতি মাসে আমাকে একটা বন্ধ খাম দিয়ে তাদের বাসায় পাঠাতেন। তাতে কারেন্সি নোট থাকত। এছাড়া কখনও এক আধবার পার্সেলে কাপড় চোপড়ও পাঠাতেন। তা ছাড়া ফাতেমা জিন্নাকে নিয়ে তিনি রহমত জিন্নার বাসায় মাঝে মধ্যে যেতেনও। এ ছাড়া যে বোনটি ডুংরিতে থাকতেন তিনিও বিবাহিতা ছিলেন। তাদের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। কারও সাহায্য করতে হত না।

কায়েদে আজমের একটি মাত্র ভাই ছিল। কায়েদে আজম নিয়মিত তাকে সাহায্য করতেন। কিন্তু কায়েদে আজমের বাড়িতে আসার অনুমতি ছিল না তার।

আমি কায়েদে আজমের সেই ভাইকে একবার বোম্বেতে এক বারে রাম পান করতে দেখেছি। চেহারা সুরত কায়েদে আজমেরই মতো। আমি একজনকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন যে, ইনি কায়েদে আজমের ভাই। তার নাম ছিল আহমদ আলি। আমি তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। যখন তার টেবিলে বিল দেওয়া হল, তিনি পকেট থেকে এমনই গড়িমসি করে পয়সা বের করলেন, মনে হল পয়সাটা একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই তিনি দিতে যাচ্ছেন। পয়সা দেবার সময় বারবার পয়সার দিকে তাকালেন। তা ছাড়া তার পোশাক-আশাক এবং গতিবিধি দেখে মনে হল তিনি তৃতীয় শ্রেণির বারে যেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজকে ভুলবশত এই অভিজাত হোটেলে ঢুকে পড়েছেন।

এরপর বোম্বেতে এক ভরা মজলিশে তাকে দেখেছিলাম। কায়েদে আজম ওজস্বী ভাষায় সে মজলিশে বক্তৃতা দিচ্ছেন আর তার ভাই আহমদ আলি দূরে দাঁড়িয়ে চোখে মনোকল লাগিয়ে ভাইয়ের বক্তৃতা শুনছিলেন।

ইনডোর গেমের মধ্যে কায়েদে আজম শুধু বিলিয়ার্ড পছন্দ করতেন। যখন তার খেলবার ইচ্ছা হত বিলিয়ার্ডের কামরা খুলবার হুকুম করতেন। বিলিয়ার্ড রুমে শুধু আমারই যাবার অনুমতি ছিল। কারণ এ খেলায় আমার একটু-আধটু শখ ছিল। খেলার শুরুতে তার সামনে এক ডজন বল দেওয়া হত। তা থেকে তিনি পছন্দ করে একটা তুলে নিতেন। মিস জিন্না এক পাশে বসে থাকতেন। বল মারার আগে তিনি চারদিক থেকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বল মারার পজিশন দেখে নিতেন। তারপর সিগারেট টানতে টানতে একসময় বল মারতেন। বলটা যদি তার ইচ্ছা মতো গন্তব্যে পৌঁছত, তিনি বিজয়ীর ভঙ্গি তে মিস জিন্নার দিকে তাকাতেন।

বিলিয়ার্ডের বলকে কায়েদে আজম যেমন চারদিক থেকে দেখতেন, রাজনৈতিক চালের বেলায়ও তিনি অনুরূপ ইতস্তত করতেন। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত একটা সমস্যার পুরোপুরি স্বরূপ তার কাছে উদ্ঘাটিত না হত, তিনি সে সম্পর্কে কোন মতামত দিতেন না।

কায়েদে আজম যার-তার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেন না, বাজে কথা শুনতে তার অস্বস্তি লাগত। তার খাস কামরায় মাত্র একটা সোফা থাকত। পাশে ছোটো ‘টিপয়’-এ ছাই ফেলার অ্যাশট্রে ছিল। সোফার সামনে দুটো শোকেস ছিল। তাতে কোরান শরিফ রাখা থাকত। এক কামরাতে তাঁর ব্যক্তিগত কাগজপত্র থাকত। সেক্রেটারি বা যে কেউ এ কামরায় আসত তাকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হত। কোনো চিঠির জবাব দেবার প্রয়োজন হলে মতলুব হোসেন বা স্টেনোকে ডাকতেন এবং জবাবে কী লিখতে হবে মুখে মুখে বলে দিতেন। বলার সময় প্রত্যেক শব্দ স্পষ্ট এবং জোরে জোরে বলতেন।

কায়েদে আজমের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন মরহুম বাহাদুর ইয়ার জং। একমাত্র বাহাদুরের সঙ্গেই তিনি একান্ত ভাবে প্রাণ খুলে কথা বলতেন। দুজনের মধ্যেকার ভাব দেখলে মনে হত তারা ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু। বাহাদুর ইয়ার জং ছাড়াও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যেমন রাজা মাহমুদ আবাদ, আই আই চুন্দ্রি গড়, মাওলানা জাহেদ হোসেন, লিয়াকত আলি খান, নবাব ইসমাইল এবং আলী ইমাম প্রমুখও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তাঁরাও প্রায়ই কায়েদে আজমের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু বাহাদুর ইয়ারের সঙ্গে তার যেরকম অন্তরঙ্গতা ছিল এমন আর কারও সঙ্গে ছিল না।

লিয়াকত আলি খানের সঙ্গে তাঁর কীরকম সম্পর্ক ছিল একথা জানতে চাইলে আজাদ বলল, লিয়াকত আলী খান কায়েদে আজমের সামনে একজন ভক্ত শিষ্যের মতো হয়ে কথা বলতেন। প্রথমে এসেই আমার কাছে জিজ্ঞেস করে নিতেন, কায়েদে আজমের মুড সম্পর্কে। মুড খারাপ হলে ফিরে যেতেন। কায়েদে আজম চাকর-বাকরদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতেন। কারও দেহের নোংরাপনা যেমন পছন্দ করতেন না, তেমনই মনের নোংরামিকেও দু-চোখে দেখতে পারতেন না। মতলুব হোসেনকে সব দিক দিয়ে তিনি ভালোবাসতেন। কিন্তু যখন তিনি জানতে পারলেন যে, সে একজন স্বেচ্ছাসেবী মেয়ের প্রণয়াসক্ত হয়েছে তখন তাকে বিদায় করে দিলেন।

আমি মাঝেমধ্যে রাত করে বাড়ি ফিরতাম। কায়েদে আজম কীভাবে টের পেয়ে গেলেন। আমাকে ডেকে বললেন, তোমার ক্যারেকটার খারাপ করছ–তোমার এখন বিয়ে হয়ে যাওয়া দরকার।

এর চার মাস পর কায়েদে আজমই চেষ্টা করে আমার বিয়ে করিয়ে দিলেন। একমাত্র কায়েদে আজমের সুবাদেই আমি ভালো পরিবারে বিয়ে করতে পেরেছি। আর না হয় আমি জাতে শেখ রংশ ছিলাম।

আমি আজমকে বললাম, তুমি কখনও কায়েদে আজমের মুখে ‘আই অ্যাম সরি’ শুনতে পেয়েছ?

আজাদ বলল, না, কায়েদে আজমের মুখে এ ধরনের কোনো কথা কোনো দিন শুনিনি।

তখন কায়েদে আজম আর ইহজগতে নেই। কিন্তু তার সুযোগ্য ড্রাইভার তারই তৈরি পাকিস্তানে বুক ভরা কায়েদে আজমের স্মৃতি নিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াত। পাঞ্জাব আর্ট পিকচার্স-এর দ্বারে পানের দোকানের টুলে বসে বসে সে কায়েদে আজমের কথা ভাবত। আমি তাকে কায়েদে আজমের জীবনের নানা কথা জিজ্ঞেস করতাম। সেসব কথা বলতে বলতে সে ভাবালু হয়ে উঠত। চোখে জল ভরে আসত। বলত, আমার সাহেবের সাথে আমিও যদি মরে যেতে পারতাম। আমি তার ওপেন পেকার্ড গাড়ি মন্থর গতিতে চালিয়ে নিয়ে তাঁকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতাম। তাঁর হালকা নরম দেহ আমি ছাড়া কে বহন করে নিয়ে যেত পারত। কিন্তু আমি শুনতে পেলাম, তার প্লেন ল্যান্ড করার পর সেখানে যে অ্যাম্বুলেন্সটি এসেছিল তার ইঞ্জিন খারাপ ছিল। একটু চলার পর সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখন কায়েদে আজমের মেজাজ কেমন খারাপ হয়েছিল, একমাত্র আমি ছাড়া আর কে বুঝতে পারত সে কথা, মান্টো ভাই।

—–
৯। ম্যাজেস্টিক ও রয়্যাল আর্ট ফিল্ম ভেঙে ১৯২৬ সালে তৈরি হয় ইম্পেরিয়াল ফিল্ম কোম্পানি। ইম্পেরিয়াল স্টুডিয়োতে প্রথম রাতে কৃত্রিম আলোয় শুটিং শুরু হয়। ভারতের প্রথম সবাক পূর্ণাঙ্গ ছবি ‘আলম-আরা’ তৈরি হয় ইম্পেরিয়ালেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *