০৫. নার্গিস

০৫. নার্গিস

বেশ কিছুদিন আগে নবাব ছাতারি তনয়া মিসেস তসনিম সেলিম আমাকে একখানা চিঠি লিখেছিলেন:

তা কেমন লাগল আপনার বোনের স্বামীকে? আপনার সেখান থেকে ফিরে এসে কিন্তু আমাকে বড্ড জ্বালিয়ে মারছে। মানে, আপনার নাম করে আমাকে বিরক্ত করছে। তার ধারণা ছিল, আমার অদেখা ভাইটি তাকে ঠিকমতো যত্ন-আত্তি করবে না এবং ফিরে এসে আমাকে লজ্জা দিতে পারবে। আর এখন ফিরে এসে শুধু উত্যক্ত করে বলছে, জলদি বোম্বে চলে যাও, মান্টো বড়ো আজব লোক। এবং এমন করে বলে, মনে হয় মান্টো তারই ভাই, আমার কিছু নয়।

আমি তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলাম, বুঝেশুনে কথা বোলো কিন্তু। যাক, ফিরে এসে আপনার সম্পর্কে সে খুশি-খুশি ভাব ব্যক্ত করছে। আমার ভাই নির্বাচনটা বৃথা যায়নি।

সে আপনার সাক্ষাতের কথা সবিস্তারে বলেছে সত্য, কিন্তু নার্গিসের আলোচনাটা একেবারে চেপে গেছে। আমার ভাইসাহেব তার আগেভাগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তার মুখের বিবরণটা সবশেষে শুনলাম। তিনি সেখানকার আদ্যোপান্ত সব খবর বললেন। এমনকি নাখশাব এবং আপনার মধ্যেকার যুদ্ধের খবরটাও বড় রসিয়ে বললেন। জিদ্দন বাইয়ের সেখানে যাওয়ার ব্যাপারটায় ভাইসাহেব সত্যি দুঃখিত। আসলে এতে রসদ যুগিয়েছিল শামসাদ ভাই (সেও আপনার সাথে দেখা করেছে) তার ইচ্ছা ছিল, পেলে আপনাকে নিয়েই যাবেন। ওর সম্পর্কে তো আপনি জানেন, লীলা চিটনিসের প্রতিই সে একটু অনুরাগী। এত বাজে রুচি তো আর নয়।

সেলিম যখন এসেছিলেন আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম। তার সঙ্গে এই আমার প্রথম সাক্ষাৎ। যেহেতু তাসনিমের মতে তিনি আমার ভগ্নিপতি, এজন্য যথাসম্ভব খাতির তোয়াজ করতে হয়েছে। ফিল্ম লাইনের লোকদের কাছে ‘চিয়ার স্যুটিং’ নামের উপঢৌকন ছবি থাকে। আমি তাদেরকে তাও দেখিয়ে দিলাম। সম্ভবত ছবিটার নাম ছিল ফুল। পরিচালক ছিল আসু’ অর্থাৎ কে আসিফ।

সেলিম এবং তার সাথিদের সবদিক দিয়ে খুশি করে দেয়া উচিত। কিন্তু তাদের ভাবগতিক দেখে মনে হল বোম্বেতে তারা রীতিমতো প্রোগ্রাম বানিয়েছেন। কথা প্রসঙ্গে সেলিম আমাকে বললেন, নার্গিস আজকাল কোথায় থাকছে?

কেন, তার মা-র কাছে।

আমি একটু রসিকতা করে বললাম, কিন্তু আমার রসোক্তিটা মাঠে মারা গেল মনে হল। মেহমানদের মধ্য থেকে একজন নবাবি ঠাটে বলল, জিদ্দন বাইয়ের কাছে?

জি হাঁ।

সেলিম বললেন, তার সাথে দেখা করা কি সম্ভব? আসলে আমার এ বন্ধুটি তাকে দেখার জন্যে খুব উদগ্রীব। আপনি কি তাকে চেনেন?

হাঁ, সামান্য।

একজন পেছন থেকে অনেকটা কৈফিয়তের সুরে বললেন, কেন?

কারণ আমরা একত্র হয়ে কোনো ছবিতে কাজ করিনি এখনও।

সেলিম একথা শুনে বললেন, রাখুন ওসব কথা। আমরা আপনাকে বেশি বিরক্ত করতে চাই না। থাক তাহলে।

কিন্তু আমার নিজেরই নার্গিসের কাছে যাবার দরকার ছিল। ক’বারই যাওয়ার মনস্থ করেছি। কিন্তু একাকী যেতে ভালো লাগছিল না। যাকে তাকে নিয়ে গেলে নার্গিসকে হাঁ করে গিলতে থাকে শুধু। এদেরকে নিয়ে যাওয়া যায়। সাদাসিধা লোক এবং শুধু একটু চোখের তৃপ্তির জন্যেই নার্গিসকে দেখবার অভিপ্রায়। দেশে ফিরে প্রজা এবং বন্ধুবান্ধবদের কাছে গর্ব করে ফিল্ম স্টার নার্গিসের গল্প বলতে পারবে। আমি সেলিমকে বললাম, না। বিরক্তির কী আছে? চলুন নিয়ে যাচ্ছি। সম্ভবত দেখা করা যাবে।

আমি নার্গিসের কাছে কেন যেতে চাইছিলাম এটা একটা প্রশ্ন বটে! বোম্বেতে কত ফিল্ম অ্যাকট্রেস রয়েছে। সবার কাছেই আমার যাওয়াআসা ছিল কিন্তু নার্গিসের কাছে বিশেষভাবে প্রোগ্রাম করে কেন যেতে চাইছিলাম সেকথা বলার আগের একটা কাহিনি বলে নেওয়া দরকার।

আমি তখন ফিল্মিস্থানে কাজ করি। সকাল আটটায় বেরিয়ে রাত আটটায় ফিরি। একদিন ঘটনাক্রমে একটু সকাল সকালই চলে এলাম। তখন বেলা দুপুর। ঘরে ঢুকতেই আবহাওয়াটা কেমন থমথমে মনে হল। কে যেন তানপুরায় তান তুলে নিজেই তাতে বিভোর হয়ে গুম মেরে বসেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমার সেই শ্যালিকা চুলে বিলি দিচ্ছে। ঠোঁট নেড়ে ফিশফাস কী বলাবলি করছে বোঝা গেল না। একটা সন্ত্রস্ত ভাব তাদের। অকারণে বারবার ওড়না ঠিক করছে।

আমি সোফাতে বসে গেলাম। দুজন ফিশফাস করে একসঙ্গে এসে আমাকে সালাম করল, ভাইজান সালাম।

অ–আলাইকুম সালাম, কী ব্যাপার?

আমি অনুমান করলাম, সবাই মিলে সিনেমায় যাবার উদ্যোগ করছে হয়তো। আমার প্রশ্ন শুনে দুজনই একসঙ্গে খিলখিল করে হেসে উঠল।

এরপর আবার ভাবলাম, কোনো বান্ধবীকে নিমন্ত্রণ করেছে। সে এখন হয়তো আসছে। কিন্তু মাঝখানে অসময়ে আমি এসে লণ্ডভণ্ড করে দিলাম।

এরপর তিন বোনে মিলে অন্য কামরায় কী ফিশফাস করছিল। মাঝে-মাঝে চাপা হাসির গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিল। অতঃপর একসময় বড়ো বোনটি অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী বোনদের শাসানোর ভঙ্গিতে মূলত আমাকে শোনাবার জন্যেই বলতে লাগল, তা আমি বলতে যাব কেন? তোমরা নিজেরা গিয়েই তো বলতে পার। সা’দত সাহেব, আজকে সকাল সকাল এসে পড়লেন যে?’

আমি জানালাম স্টুডিয়োতে কাজ ছিল না, তাই চলে এলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ওরা (শালীরত্নদ্বয়) কী বলতে চাইছে?

ওরা বলতে চাইছে আজ নার্গিস আসছে আমাদের বাসায়।

তা আসুক না ক্ষতি কী? ও তো বরাবরই আমাদের বাসায় আসে।

আমি মনে করেছিলাম, আমাদের প্রতিবেশী নার্গিসের কথা, যার মা এক মুসলমানকে বিয়ে করেছে। কিন্তু সাফিয়া বলল, কী যে বলল, নার্গিস কবে এল আমাদের বাসায়।

কেন, ও বাসার নার্গিস…

না, সে নয়। ফিল্ম অ্যাকট্রেস নার্গিস।

আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সে কী করতে আসছে এখানে?

সাফিয়া আমাকে সব কাহিনি শোনাল। ঘরে টেলিফোন রয়েছে। অবসর সময়ে তিন বোনই তার সদ্ব্যবহার করে থাকে। যেদিন ফোন করার মতো আর কোনো বান্ধবী না থাকে, কোনো ফিল্মস্টারের নম্বর তালাশ করে ডায়াল করে। যোগাযোগ হয়ে গেলে এলোপাথাড়ি কথা বলতে থাকে তার সঙ্গে। আমরা আপনার খুব গুণগ্রাহী। আজকেই দিল্লি থেকে এসেছি। অনেক কষ্টে আপনার নম্বরটা পেয়েছি। আপনাকে দেখার জন্যে মনটা বড় উচাটন করছে। কিন্তু বেপর্দা হতে পারি না বলে আপনার বাড়িতে আসতে পারছি না। যেমন আপনার রূপ তেমনই আপনার অভিনয়। কোকিলের মতো মধুময় আপনার গলার স্বর (অথচ সে স্বর হয়তো আমির বাইর বা শামশাদের)।

চিত্রতারকাদের ফোন নম্বর ডাইরেক্টরিতে সচরাচর খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা ইচ্ছা করেই নম্বর ছাপতে দেয় না। কারণ, ভক্তরা সারাক্ষণ বিরক্ত করতে থাকে। কিন্তু এরা (তিন বোন) আমার বন্ধু আগা খাল কাশ্মীরির কাছ থেকে বহু চিত্রতারকার ফোন নম্বর জোগাড় করে নিয়েছে, যাদের নম্বর ডাইরেক্টরিতে ছিল না।

সে সব নম্বরের দৌলতে এরা এ যাবৎ বহু চিত্রতারকার সঙ্গে অদৃশ্য সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলেছে। ফোন করতে করতে যেদিন নার্গিসের সন্ধান পেয়ে গেল, বেশ জমে উঠল তার সঙ্গে। নার্গিসের কথাবার্তা বেশ ভালো লাগল তাদের। রোজ টেলিফোনে তাদের আড্ডা চলত। আমার শালিরত্নের একজন বলত, আমার বাড়ি আফ্রিকাতে। সে আবার স্বর বদল করে বলত, আমার বাড়ি লখনউতে। দ্বিতীয়জন বলত, আমরা রাওয়ালপিণ্ডিতে থাকি। বোম্বেতে এসেছি শুধু আপনাকে একনজর দেখার জন্যে। তৃতীয় জন (আমার স্ত্রী) কখনও গুজরাটি ভাষায় কথা বলত, কখনও নিজেকে পারসি মেয়ে বলে পরিচয় দিত।

পরিচয় গোপন করে এভাবে রোজ টেলিফোনে আড্ডা শোনা নার্গিসের বড়ো খারাপ লাগত। সে বিরক্ত হয়ে তাদের আসল পরিচয়টা জানার জন্যে বকাঝকা করে বলত ‘কেন তোমরা মিছিমিছি নিজেদের পরিচয়টা লুকাচ্ছ? রোজ এসব আর ভালো লাগে না, ভালো মানুষের মতো পরিচয়টা দিয়ে ফেল বলছি।’

নিঃসন্দেহে নার্গিস তাদের দ্বারা বেশ প্রভাবিত হয়ে পড়েছিল। তাঁর কাছে রোজ অসংখ্য ভক্তের টেলিফোন আসত। কিন্তু বিশেষ করে এ তিনজনকে কেন জানি তার ভালো লাগত। এ জন্য সে তাদের পরিচয়টা জেনে ঘনিষ্ঠ হবার জন্যে কিছুটা ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল। তাদের হাজার কাজ থাকলেও রিসিভারটা লুফে নিত। এবং সময়জ্ঞান ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে যেত।

এভাবে অদৃশ্য আলাপ আর নার্গিসের ভালো লাগছিল না। একদিন নার্গিস নিজেই সেধে তাদেরকে দেখার জন্যে তাদের বাড়ি যাবার আগ্রহ জানাল এবং টেলিফোনে দিন তারিখ ঠিক করে ফেলল। সাফিয়া তাকে বাড়ির ঠিকানা এবং লোকেশান পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল। এরপরও যদি বাড়ি খুঁজে পেতে কষ্ট হয়, বাইখোলার পুলের কাছাকাছি। এসে কোনো হোটেল থেকে ফোন করলেই সবাই পৌঁছে যাবে সেখানে, একথাও সাফিয়া জানিয়ে দিল।

বাইখোলার পুলের কাছ থেকে যখন ফোন এল আমি তখন সবেমাত্র ঘরে পা রেখেছি। নার্গিস জানাল, সে নাকি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। সুতরাং পুলের কাছের এক স্টোর থেকে সে ফোন করেছে।

নার্গিসকে এগিয়ে আনার জন্যে তিন বোনেই পাঁয়তারা দিচ্ছিল। কিন্তু মাঝখানে আমি আসাতেই ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেল। শালিরা ভেবেছিল আমি এতে সায় দেব না। কারণ অন্যায় কিছুই হচ্ছে না। তদুপরি শালিদের ব্যাপারে বোনাইদের রাগ করাতো বাতুলতা। কথায় বলে, যে ঘরে শালি নেই সে ঘরের আধখানাই অন্ধকার। আর আমার তো মাশাল্লা দুই শালি। পুরো বাড়িটাই তাদের আওতায়। তাদের অভিপ্রায় অনুযায়ী অবশেষে আমিই যখন গা নাড়া দিয়ে নার্গিসকে আনতে রওনা দিলাম, ভেতর কামরা থেকে হাততালি শুনতে পেলাম।

পৌঁছে দেখি বাইখোলার পথের ওপর জিদ্দন বাইয়ের ইয়া বড়ো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি সালাম দিলাম। তিনি সশব্দে সালামের জবাব দিলেন। বরাবর যেমন দিয়ে থাকেন।

কী খবর মান্টো, কেমন আছ?

খোদার ইচ্ছায় কোনো রকম, আপনি এখানে?

না, তেমন নয়। পেছনের সিটে বসা নার্গিসকে একনজর দেখে নিয়ে বললেন, বেবি তার বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা করবে। কিন্তু বাড়িটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

বলেন কী? চলুন আমার সাথে আমি খুঁজে দিচ্ছি।

একথা শুনে নার্গিস বাইরে মুখ বাড়িয়ে বলল, আপনি কি তাদের বাড়ি চেনেন?

আমি মুচকি হেসে বললাম, নিজের বাড়িকে আবার চিনতে হয় নাকি।

জিদ্দন বাই মুখের পান পাশব্দল করে কপালে চোখ তুলে বললেন, তুমি কি গল্প করছ আমাদের সাথে?

আমি দরজা খুলে জিদ্দন বাইর কাছে বসে পড়লাম।

গল্প করব কেন? সত্যি বলছি, অবশ্য আদৌ এর কিছুই জানতাম না আমি। আমার স্ত্রী আর তার দু-বোনরত্নের এসব কাণ্ডকারখানা।

এরপর আমি সংক্ষেপে সকল ঘটনা বললাম। নার্গিস বড়ো মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। জিদ্দন বাই বিরক্ত হয়ে বললেন, লা হাওলা অলা কুয়াতা… কি ধারার মেয়ে এরা বলো

দেখি। প্রথম দিনেই তো বলে দিতে পারত আমরা মান্টোর বাড়ি থেকে বলছি। হায় আল্লা, সহজেই বেবিকে পাঠিয়ে দিতাম, আর এত টানা-হিচড়া হত না। এত ঝকমারিও কি মানুষ পোয়াতে পারে? রোজ টেলিফোন আসত আর বেবি দৌড়ে গিয়ে কথা জুড়ে দিত। আমি এত জিজ্ঞেস করতাম, দিনরাত এত কাদের সঙ্গে কথা বলিস? বলত নাম বলে না তবে খুব ভালো মেয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ বলল যে, তাদের বাড়িতে যেতে হবে। ঠিকানা বলে দিয়েছে। আমি বললাম, পাগল হয়েছিস, কেউ ঠিকানা বললেই কি সেখানে রওয়ানা দিতে হবে? আমি হাজার মানা করলাম। তবু মেয়েকে কি মানানো যায়? শেষে আমাকেই নিয়ে আসতে হল। আমি মাঝখানে বললাম, কী দরকার ছিল আপনার এত কষ্ট করার। ঠিকইতো ও একাই আসতে পারত। খামকা আমি বেচারী চলতে পারি না, আমাকে নিয়ে টানাটানি। তুমি তো আর আমাদের পর নও।

জিদ্দন বাই গল্প উপন্যাস পড়তে ভালোবাসতেন। আমার লেখার বেশ কদর করতেন এবং মনোযোগ দিয়ে পড়তেন। আমার সে সময়কার একটা গল্প ‘সাকীত’-এ ছাপা হয়েছিল। সম্ভবত গল্পটির নাম ‘তরক্কী ইয়াপ্তা কবরেস্থান’। তিনি গল্পটি পড়ে বেশ মুগ্ধ হন।

তুমি এমন গল্প লিখতে পারো তা তো আগে জানতাম না। এমন টিপ্পনিও কাটতে জানো তুমি। তোমার গল্প পড়ে সেদিন আমার যা অবস্থা হয়েছিল, বেবি দেখেছে।

আমার বাড়ি খুব কাছেই ছিল, দুমিনিটের মধ্যে এসে পৌঁছোলাম–ওপরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ওরা আমাদের দেখছিল। শালিদ্বয়ের তো খুশিতে ফেটে পড়ার জো আর কী। ওপরে পৌঁছোতেই বহুদিনের চেনা পরিচিতের মতো নার্গিস শালি দুজনকে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেল। আমি সাফিয়া এবং জিদ্দন বাই বৈঠকখানায় বসে পড়লাম।

আমরা নানা কথাবার্তায় বেশ সময় কাটাতে লাগলাম। শেষের দিকে সাফিয়া হঠাৎ মেহমানদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল এবং কিছু নাস্তাপানির বন্দোবস্ত করতে চলে গেল।

সাফিয়া চলে গেলে, আমি এবং জিদ্দন বাই চিত্রশিল্পের উন্নতি অবনতি সম্পর্কে প্রাণখোলা আলাপ জুড়ে দিলাম। জিদ্দন বাইর মতো পানখেকো মহিলা আমি কম দেখেছি। পানের ঘটি-বাটি তার সঙ্গেই থাকত, পানের সরঞ্জাম সামনে মেলে রেখেছিল। সুযোগ পেয়ে আমিও কয়েক খিলি খেলাম।

বেশ অনেককাল পরে নার্গিসের দেখা পেলাম। কোনো প্রেস শো বা বিশেষ প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে যখন সে তার মায়ের আঁচল ধরে হলে আসত তখন বড়োজোর তার বয়েস ছিল দশ-এগারো বছর। টানা একজোড়া চোখ, লম্বা মতো মুখ এবং শুকনো হাত পা ইত্যাদি মিলিয়ে তাকে হঠাৎ দেখলে মনে হত, সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছে বা ঘুমোচ্ছ। কিন্তু আজ সে যৌবনের ষোলোকলায় পূর্ণ চিত্রতারকা নার্গিস। ছোটোবেলার সেই লিকলিকে দেহ আর নেই এখন। তবে চোখগুলো তার আগের মতোই রোগারোগা স্বপ্নমাখা। এদিক দিয়ে বিচার করলে নার্গিস’ নামটা তার বেশ প্রযোজ্য।

নার্গিস বিনয়ী এবং লাজন ছিল। তবে একটা মুদ্রাদোষ ছিল তার, সারাক্ষণ নাক মুছত, মনে হত সর্দি তার লেগেই আছে (বরসাত ছবিতে এ মুদ্রাদোষটাকে অভিনয় হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে)। চেহারা দেখে হঠাৎ তাকে গোবেচারি মনে হলেও তার ভিতরে যে সত্যিকার প্রতিভা রয়েছে এটা ধরা পড়ত। যখন সে চোখ টেনে ঠোঁটের কোণে মৃদু-হাসি মেখে কথা বলত, মনে হত অভিনয় করছে। এই স্বভাবটাই যেন তাকে সার্থক অভিনয় করতে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

নার্গিস সম্পর্কে যে কথাটা আমি বিশেষভাবে অনুভব করছিলাম তা হল তার দৃঢ় আত্মবিশ্বাস ছিল যে, একদিন সে অনেক উঁচুদরের চিত্রাভিনেত্রী হবেই। নামকরা অভিনেত্রী হবার জন্যে তার মধ্যে কোনো রকম তাড়াহুড়ো ছিল না। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সময়ের স্বাভাবিক সুযোগ পরম্পরাকে সদ্ব্যবহার করে চলেছিল সে।

ওরা তিনজন অপর কামরাতে বেশ জমিয়ে বসেছে ততক্ষণে। কিন্তু তাদের সে আলোচনায় চিত্রশিল্পের কোনো কথাই ছিল না। সেলুলয়েডের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ দূরে সরে, তার স্কুলজীবন এবং জীবনের কিশোর স্বপ্নগুলো নিয়ে আলোচনায় ডুবে গিয়ে নার্গিস ভুলেই গিয়েছিল যে, সে একজন নামকরা চিত্রতারকা। আর তার বান্ধবীরাও ভুলে গেল যে, তারা একজন চিত্রতারকার সঙ্গে গালগল্পে মেতেছে।

আমার স্ত্রী নার্গিসের চেয়ে বয়েসে বড়ো ছিল। নার্গিস সম্পর্কে তার যে একটা জড়তা ছিল, নার্গিসকে দেখার পর তা আস্তে আস্তে কেটে যেতে লাগল। পর্দায় যখন সে নার্গিসকে দেখত এক ডাকসাইটে সবজান্তা মেয়ের মতো মনে হত তার। দিব্যি গাট্টাগোট্টা জোয়ানদের সঙ্গে মাখামাখি করছে, হাসছে, কাঁদছে। কিন্তু সামনাসামনি দেখার পর তাদের সম্পর্কটা বোনের সম্পর্কে এসে দাঁড়াল। সাফিয়া বড়ো বোনের মতো তাকে শাসিয়ে বলত ঠান্ডা পানি এবং টক ঝাল খেয়ো না যেন। বেশি ছবিতে কাজ করার দরকার নেই। শরীর ঠিক থাকলে সব ঠিক।

আমি, সাফিয়া এবং জিদ্দন বাই গালগল্পে বেশ মেতে উঠেছিলাম এমন সময় সা’দত আপা কোত্থেকে এসে উপস্থিত হলেন। নামের দিকে আমার সঙ্গে মিল রয়েছে। সা’দত আপা এক চমকপ্রদ চরিত্র। তার স্বভাবসিদ্ধ এমন একটা ভঙ্গি রয়েছে যে, তার চলা বলার দিকে মনোযোগ না দিয়ে কারও উপায় নেই। সবার মনোযোগটা এমনভাবে আচ্ছন্ন করে কথা বলতে বলতে এসে ঢুকলেন যে, জিদ্দন বাইর সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেবার অবসর হল না। প্রায় আড়াই মণ ওজনের বিরাট বপুটা সোফাতে এলিয়ে দিয়েই বললেন, সুফুজান, তোমার ভাইজানকে এত করে বললাম যে, পুরোনো গাড়ি নিয়ো না, কিন্তু কার কথা কে শোনে। দুকদম না চলতেই হাঁফাতে শুরু করেছে। একপাও আর অগ্রসর হচ্ছে না। এখন শুধু বসে বসে হ্যাঁন্ডেল মারছে। আমি বললাম, দরকার নেই, আমি সুফুজানের বাসায় গিয়ে বসি, তুমি যেভাবে পারো কোনোমতে বাসায় চলে যাও।

জিদ্দন বাই সম্ভবত কোন খাজা-গজাদের কথা বলছিলেন। খুব নাকি বিলাসপ্রিয় ছিলেন তিনি। সা’দত আপা আসাতে মাঝখানে কথাটা কেটে গেল। আবার যখন কথা শুরু হল, সাদত আপাও তাতে অংশগ্রহণ করলেন। কাঠিরাদার এবং তার আশপাশের প্রায় সব নবাবদের হাঁড়ির খবর জানা ছিল তার। কারণ, মাংরুলের নবাব পরিবারে তার বিয়ে হয়েছে।

জিদ্দন বাই তার পেশার কল্যাণে দেশের ওপরতলার প্রায় সব মহারথীকেই জানতেন। কথায় কথায় এক গণিকার কথা উঠল। অনেক নবাব বাদশার মাথামুণ্ড খেয়েছে নাকি সে। সা’দত আপা বলে উঠলেন, খোদা এমন মাগীদের খপ্পরে যেন কাউকে না ফেলে। একবার যার সাথে এগুলোর সংযোগ ঘটে পুরুষদের দিন দুনিয়া সব নস্যাৎ হয়ে যায়। সফুজান, তোমাকে কী বলব, পুরুষদের যদি এ রোগে ধরে বসে কেউ বাঁচাতে পারে না তাকে। এর মতো বড়ো রোগ আর নাই। ধনদৌলত টাকাপয়সা, স্বাস্থ্য

এভাবে তিনি বলেই যাচ্ছিলেন। আমরা চেষ্টা করছিলাম কীভাবে তাকে নিরস্ত করা যায়। জিদ্দন বাই কিন্তু তার হাঁ-তে-হাঁ মিলাচ্ছিলেন। আমরা শুনতে শুনতে হাঁফিয়ে উঠেছি। আমরা যতই তাকে নিরস্ত করার মতলব আঁটছিলাম ততই তিনি মুখর হয়ে উঠছেন। বলতে বলতে জোশ এসে গেল তার। এবার রীতিমতো গালি ছুঁড়তে শুরু করলেন। গালির ফাঁকে পলকের জন্যে, একবার জিদ্দন বাইর দিকে তাকালেন। জিদ্দন বাইর চোখমুখ সাদা হয়ে গেল এবং থরথর করে তার গা কাঁপছিল। সা’দত আপা তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে নিজের রাণে এক থাপ্পড় মেরে জিদ্দন বাইর চোখে চোখ রেখে বললেন, আপনি? আপনি জিদ্দন বাই তো, জিদ্দন বাই না আপনার নাম?

জিদ্দন বাই বড়ো নরম হয়ে মাথা নেড়ে জানালেন, হ্যাঁ।

‘তা’লে আপনিই কম কিসে? আপনিও তো পয়লা নম্বরের গণিকা, না সফুজান?

সফুজান একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আমি জিদ্দন বাইর দিকে তাকিয়ে একটু উপশমের হাসি হাসলাম। আমার হাসিটা যে খুব প্রাণখোলা ছিল তা বলতে পারব না। কিন্তু জিদ্দন বাই এমন করে হাসলেন যেন কিছুই হয়নি। তারপর অবলীলাক্রমে তিনি সেই আলোচ্য গণিকার বাদবাকি অংশটা সবিস্তারে বললেন।

জিদ্দন বাই যতই জমাতে চেষ্টা করছিলেন তেমন আর জমল না। সা’দত আপা নিজের ভুল সম্পর্কে একটু সচেতন হলেন আর আমরাও শ্রোতা হিসেবে যে কথায় সংক্রমিত হবার তার প্রভাবটা মন থেকে দূর করার জন্যে আইঢাই করছিলাম। এমন সময় এরা এসে পড়ল সেখানে। ওরা এসে পড়াতে আবার গুমোটটা কেটে যেতে লাগল।

একথা সেকথার পর নার্গিসকে গান গাইবার ফরমাশ করা হল। জিদ্দন বাই বললেন, অবশ্য ওকে গান শেখাইনি। কারণ এতে মোহনবাবুর মত ছিল না। অবশ্য এক-আধটু যে না গাইতে পারবে এমনও নয়। তারপর মেয়েকে সম্বোধন করে বললেন, শোনাও বেবি, যেমন পারো তেমনই শোনাও।

নার্গিস গাইতে শুরু করল। স্বরে তেমন দরদ নেই। অত্যন্ত নিম্নমানের সুরে গাইতে লাগল সে। মাশাল্লা, আমার ছোটো শালিও এর চেয়ে ভালো গাইতে পারে। করা কী, ফরমাশ যখন করা হয়েছে, শ্রবণশক্তির ওপর কিছুক্ষণ অত্যাচার গ্রহণ করতে হল। গান শেষ হলে সবাই মিলে প্রশংসা করল। আমি আর সা’দত আপা কিছুই বললাম না। এরপর জিদ্দন বাই চলে যাবার জন্যে উঠলেন। ওরা (নার্গিস ও শালিরা) বিদায়ী গলাগলি করল। কিছুক্ষণ ফিশফাস হল। আবার যেন আসে, এসব বলে কয়ে মেহমানদের বিদায় দিল।

অভিনেত্রী নার্গিসের সঙ্গে এ-ই আমার প্রথম সাক্ষাৎ।

এরপর আরও ক-বার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। ওরা ফোনে ডাকত আর নার্গিস একা গাড়ি নিয়ে এসে পড়ত। এভাবে মেলামেশা করাতে ওদের মধ্যে বেশ অন্তরঙ্গতা গড়ে উঠল। ওদের কাছে নার্গিসের অভিনেত্রী সত্তা লোপ পেয়ে গেল। নার্গিস চলে গেলে তিন বোনে মিলে বলাবলি করত, সত্যি নার্গিসের মতো ভালো মেয়ে আর হয় না। মোটেই অ্যাকট্রেস বলে মনে হয় না তাকে।

ইতিমধ্যে তিন বোনে মিলে একদিন নার্গিসের নতুন একটা ছবি দেখল। স্বভাবতই নার্গিস তাতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছে। নায়কের সঙ্গে তার প্রেমালাপ এবং বিচ্ছেদের আবেগ ইত্যাদি দেখে সাফিয়া বলল, হায় আল্লা, ছবির মধ্যে নার্গিস এমন করল, মনে হল সত্যি সত্যি সে লোকটার প্রেমে পড়েছে। অথচ কাল আমাদের জিজ্ঞেস করছিল টফি’ কেমন করে বানাতে হয়।

নার্গিসের অভিনয় সম্পর্কে আমার ধারণা অন্যরকম। অভিনয়ের মধ্যে প্রেমদ্বন্দ্ব খুঁজতে যেয়ে হাঁফান আর স্কুলের স্পোর্টস্-এ দৌড় দিয়ে হাঁফানো ঠিক এক বস্তু নয়। তার অভিনয়ে প্রেমদ্বন্দ্বটা কোন ধরনের হয় নার্গিস তা নিজেও উপলব্ধি করতে পারত না। তার অভিনয়ে গভীর হৃদয়াবেগ প্রকাশ পেত না। অবশ্য আমি তার প্রথম দিককার ছবিগুলোর কথা বলছিলাম।

পরবর্তীকালে তার অভিনয়ে বয়েস এবং অভিজ্ঞতার রং লেগেছে। এবং পাকাপোক্ত অভিনয় করতে শিখেছে। এখন স্কুলে দৌড়োনোর ক্লান্তি এবং প্রেমের ক্লান্তির মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে নার্গিস ভালোভাবেই সচেতন। মনস্তত্ত্বের গভীর জটাজালে তারে আনাগোনা ছিল।

সে অত্যন্ত ধীরে মন্থর গতিতে তার অভিনয়ের সোপানগুলো অতিক্রম করেছে। যদি সে রাতারাতি একটা কিছু হয়ে বসত, তাহলে শিল্পজীবী দর্শকদের কাছে নার্গিসের যেমন অপমৃত্যু হত, তেমনি ছোটোবেলা থেকেই যদি সে ইচড়েপাকা হয়ে খোলা বাজারে তার দেহের মাপজোখ প্রদর্শন করে বেড়াত, সেটাও আমাদের দুঃখের কারণ হত।

নার্গিস এমন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, যে ঘরের মেয়ের পক্ষে অভিনেত্রীর পেশা গ্রহণ না করে অন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না। জিদ্দন বাইয়ের বয়েস পেরিয়ে গেছে। দুই ছেলে আছে তার, কিন্তু তার সব মনোযোগ নার্গিসের প্রতি। নার্গিসের চেহারা সুরত তেমন আকর্ষণীয় ছিল না। গলার স্বরও তেমন হৃদয়গ্রাহী নয় কিন্তু জিদ্দন বাই জানতেন, অন্তরে যদি শিল্পরস থাকে তাহলে কৃত্তিম আভরণেও তাকে হৃদয়গ্রাহী করা যাবে। এই ভেবে নার্গিসকে অভিনেত্রী করে তোলার জন্য তাঁর সফল প্রচেষ্টা ব্যয় করেছেন।

বাড়িতে জিদ্দন বাই, তার মা, মোহনবাবু আর নার্গিস ছিল। ছেলে দুটোর ভরণপোষণের ভারও জিদ্দন বাইয়ের ওপর ছিল। মোহনবাবু এক নবাবজাদা ছিলেন, জিদ্দন বাইয়ের রূপ এবং গলায় সুর শুনে মজে গিয়েছিলেন। অর্থ, বৈভব, স্বাস্থ্য সম্পদ সবই ছিল তার সবই তিনি জিদ্দন বাইয়ের প্রেমানলে ঢেলে দিলেন। শেষকালে যথাসর্বস্ব হারিয়ে জিদ্দন বাইয়ের করুণার পাত্র হয়ে দিন গুজরান করছিলেন। সেকালে জিদ্দন বাইয়ের বড়ো নামডাক ছিল। বড়ো বড়ো নবাব বাদশা তার গান শুনে ‘এনাম’ এর বৃষ্টি বইয়ে দিতেন। তারপর মহফিল শেষে যখন তিনি ঘরে ফিরে আসতেন মোহনবাবুকেই তিনি সত্যিকারভাবে প্রেমাবেগে সিঞ্চিত করতেন। কারণ, একমাত্র মোহনকেই তিনি ভালোবাসতেন। মোহনই ছিল তার সব।

আজীবন মোহনবাবু জিদ্দন বাইয়ের কাছেই ছিলেন। মোহনবাবুকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন জিদ্দন বাই। কারণ তার জানা ছিল, সব রকম সম্পদকে তিনি পদদলিত করে তার কাছে এসে আত্মাহুতি দিয়েছেন। তারপরও তিনি আরও ভালোবাসতেন তাঁকে এজন্যে যে, তিনি তার সন্তানের জনক।

যাক, যা বলছিলাম। নার্গিসকে অভিনেত্রী হতেই হত এবং অবশেষে হলও তাই। তার সুউচ্চ খ্যাতিসৌধ নির্মাণের পেছনে যে রহস্য রয়েছে, আমি মনে করি, তা হচ্ছে তার আন্তরিক শিল্পসাধনা এবং গভীর আত্মবিশ্বাস।

আমার শালিদের সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে নার্গিসের একটা সংকোচবোধ লক্ষ করতাম আমি। নার্গিস মনে করত, ওরা না জানি কেমন আবহাওয়ায় মানুষ হয়েছে। নার্গিস সে পরিবেশ হয়তো পায়নি। রোজ দেখতাম গলায় গলায় খাতির, কিন্তু নার্গিস কোনোদিন ওদেরকে নিজের বাড়িতে নেবার কথা উচ্চারণ করত না। মনে করত ওরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে না। শুধু শুধু লজ্জা পেতে হবে। সেদিন আমি বাড়ি ছিলাম। নার্গিস কথায় কথায় বলেই ফেলল, আমাদের বাড়ী যাবে? চলল না একবার।

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটা কথা শুনে তিনবোনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ভাবখানা হল, বললেই হল আর কি আমরা কি আর নার্গিসদের বাড়ি যেতে পারি? সাফিয়া যেহেতু আমার ভাবধারা সম্পর্কে ওয়াকেফহাল ছিল, এজন্যে নার্গিসের নিমন্ত্রণকে অমর্যাদা করল না এবং একদিন আমাকে না বলে কয়েই নার্গিসের বাড়ি চলে গেল।

নার্গিস গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। বোম্বের বনেদি পাড়ায় নার্গিসদের ‘মেরিন ড্রাইভ’ ফ্ল্যাটের সাজগোজ দেখে ওরা অনেকটা হকচকিয়ে গেল। তাদের জন্যে বিশেষভাবে নানা কিছুর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। মোহনবাবু আর যুবক ছেলে দুজনকে সাময়িকভাবে ঘরে আসতে বারণ করে দেওয়া হল। কারণ নার্গিসের সইরা এসেছে। পুরুষ চাকরদেরকে অন্দরে আসতে বারণ করে দেওয়া হল। স্বয়ং জিদ্দন বাইও ক্ষণিকের জন্যে মেহমানদের পাশে বসে তারপর একসময় কেটে পড়লেন। নার্গিস যেন নিরঙ্কুশভাবে সইদের সান্নিধ্য পায় সে দিকে খেয়াল।

নার্গিস তাদেরকে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছে। তাদের যত্নআত্তির ব্যাপারে পান থেকে চুন খসার উপায়টুকু পর্যন্ত ছিল না। কাছেই পিয়ার্সনের বিখ্যাত মিল্কসেক–এর দোকান ছিল। নার্গিস নিজেই গাড়ি করে গিয়ে জগ ভরে ‘মিল্কসেক’ নিয়ে এল। চাকরদের দিয়ে আনাতে পারত। কিন্তু তা না করে নিজেই গেল।

নার্গিস তাদের যত্নআত্তি করতে গিয়ে এত বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে সুদৃশ্য এক গ্লাস হাত থেকে ফেলে চুরমার করে দিল। ওরা আফশোস করলে নার্গিস বলল, তাতে কিছু হবে না। বিবি (তার মা) রাগ করলে ডেকে তাকে বুঝিয়ে নেবে।

মোহনবাবু নার্গিসকে খুব ভালোবাসতেন। সেও ড্যাডির জন্যে একরকম বলতে গেলে পাগল ছিল।

‘মিল্কসেক’ পান করানোর পর নার্গিস তার অ্যালবাম খুলে বসল। বিভিন্ন স্টাইলের ছবিতে ভরা অ্যালবামটি। ওরা কখনও ছবির দিকে, কখনও নার্গিসের দিকে এমনই করে ছবি দেখা শেষ করলে। সাফিয়া বলল, হায় নার্গিস, ছবির নার্গিসগুলো এমন দেখাচ্ছে। কেন?’ শুনে নার্গিস শুধু মুচকি হাসল, সাফিয়া আমাকে জানাল, বাড়িতে নার্গিস নেহাতই এক গোবেচারি মেয়ে। ছবির ঠাটঠমক, কথাবার্তা এবং হইহুল্লোড় জাতীয় কোনো কিছুরই তার ঘরোয়া পরিবেশে নেই। সাদা কথায় বলতে গেলে নার্গিস নেহাতই এক ঘরোয়া মেয়ে।

এটা নিশ্চিতভাবে সত্য যে, নার্গিস খ্যাতির শীর্ষে উঠেছে। ভাগ্য-বিধাতা তার ভাগ্যের সব কিছু লেখাজোখা শেষ করে কাজগুলো যেন তার হাওলা করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও নার্গিসকে হৃষ্ট মনে হত না। যেন একটা বিষাদজাল অহোরাত্র সে বুনে। চলেছে। হয়তো বা তার অবচেতন মনে একটা ধারণা এসে জেঁকে বসত যে, এভাবে কৃত্রিম প্রেমের খেলা খেলতে খেলতে একদিন সে এমন নিঃসীম শূন্যতায় এসে থমকে যাবে, যেখানে আসল বলতে আর কিছু নেই। শুধু মরীচিকা আর মরীচিকা। তেষ্টায় প্রাণটা আনচান করবে কিন্তু এক ফোঁটা পানি পাওয়া যাবে না। ওপরের মেঘমালা একবিন্দু জল তখন বর্ষণ করবে না। কারণ, মেঘ জানে নার্গিসের তেষ্টাটা কৃত্রিম। ভাবতে গিয়ে নার্গিস হয়তো এক সময় ভেবে বসেছে, তার সত্যিকার তেষ্টাটাও কৃত্রিম নয়তো আবার?

বেশ অনেককাল পর নার্গিসকে আবার পর্দাতে দেখলাম। কেমন যেন নিষ্প্রাণ অভিনয়। আগের সেই প্রাণবন্ত অভিনয় তার কোথায় গেল? আমার মতে এর জবাব একমাত্র সেই ভালো দিতে পারবে।

তিনজন আমাকে না জানিয়ে গিয়েছিল বলে বেশি সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি চলে এল। ফিরে এসে নার্গিস সম্পর্কে ওদের যে আলোচনাটা সবচেয়ে মুখ্য হয়ে দাঁড়াল, তা হল, নার্গিসের বিয়ে। শালি রত্নদ্বয়ের বারবার জানতে ইচ্ছা করছিল, কবে কখন কার সঙ্গে নার্গিসের বিয়ে হচ্ছে। ওদের বোন, যার বিয়ে বছর পাঁচেক আগেই হয়ে গেছে, নার্গিস সম্পর্কে তার সমস্যা হল, নার্গিসের বিয়ে হল, আবার মা কেমন করে হবে সে?

চুপি চুপি নার্গিসের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা প্রথম ক-দিন চাপা দিয়ে রাখল। তারপর একদিন বলে দিল। আমি কৃত্রিম রাগ দেখালাম। ওরা ভেবেছে, সত্যি সত্যি আমি রাগ করেছি। ক্ষমা চেয়ে বলল, সত্যি আমরা অন্যায় করেছি। খবরটা কাউকে বলবেন না কিন্তু।

একজন অ্যাকট্রেসের বাড়িতে দলবেঁধে যাওয়াটা বিরাট একটা অপরাধ হয়ে গেল যেন। আমার জানামতো আমাকে ছাড়া আর কাউকে কোনোদিন খবরটা জানায়নি ওরা। এমনকি ওদের মাকেও না। যদিও ওদের মা (আমার শাশুড়ি) তেমন সংকীর্ণমনা ছিলেন না।

আজ এত বছর পরও আমি একথার হদিস খুঁজে পেলাম না যে, একজন অ্যাকট্রেসের বাড়ি যাওয়াতে এমন কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল? অভিনয়বৃত্তি এতই কি ঘৃণ্য কাজ? কেন, আমাদের পূতপবিত্র খানদানি মানুষদের মধ্যে কি এমন কোনো মহাজনরা নেই, যাদের সারাটা জীবন ধোঁকা এবং অপকর্মে অতিবাহিত হয়েছে? নার্গিস অভিনয় জীবন বেছে নিয়েছে পেশা হিসেবে এবং এটা সে ঢোল বাজিয়েই করেছে। যারা লুকিয়ে অপকর্ম করছে তাদের তুলনায় মন্দ করছে কি?

এ লেখার প্রথম দিকে যে চিঠির কথা বলেছিলাম এবার ফিরে আসা যাক সে কথায়।

আমার নিজেরও যেহেতু, নার্গিসকে একবার দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল, এজন্যে মি. সেলিমদের সঙ্গে ‘মেরিন ড্রাইভ’ রওনা হয়ে গেলাম। উচিত ছিল, আগেভাগেই জিদ্দন বাইকে ফোন করে জানিয়ে দেয়া যে কজন মেহমান আসছে, নার্গিস যেন এ ব্যাপারে সচেতন থাকে। কিন্তু এসব লৌকিকতা আমার ধাতে সয় না। সুতরাং না বলেকয়েই গিয়ে উপস্থিত হলাম।

জিদ্দন বাই বারান্দায় বসে কুটুর কুটুর করে সুপারি কাটছিলেন, আমাকে দেখেই বললেন,

আরে মান্টো যে, এসো বাবা এসো৷ আরে ও বেবি, তোমার সইরা এসেছে।

আমি বললাম, সইরা নয় অন্য কজন লোক এসেছে। তাদের আবছা একটা পরিচয় দিতে গিয়ে যখন বললাম নবাব ছাতারির জামাইবাবুও এসেছেন। জিদ্দন বাইয়ের চেহারা কেমন যেন একটু ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বললেন, ঠিক আছে, তাদেরকে ভেতরে নিয়ে এসো।

ইতিমধ্যে নার্গিস এসে দাঁড়াল সেখানে। তিনি নার্গিসকে বললেন, তুমি ভেতরে যাও বেবি, মান্টোর কজন বন্ধু এসেছে।

জিদ্দন বাই সবাইকে এমনভাবে গ্রহণ করলেন, যেন আমরা বাড়ি দেখতে এসেছি। আমার সঙ্গে যে সহজ ভাবটুকু ছিল সেটুকুও উবে গেল। আমরা সবাই যেন নতুন মানুষ। ‘তুমি’ রেখে আপনি করে কথা বলতে শুরু করলেন। ‘আসুন বসুন, বলুন, আপনার জন্যে কী করতে পারি’ ধরনের কথা শুনে আমার বড্ড খারাপ লাগছিল।

আমি যখন নানা কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বন্ধুদের আসল উদ্দেশ্যের কথা পাড়লাম, বললেন, বেবির সাথে দেখা করতে চাইছে? কিন্তু আজ কদিন থেকে ওর শরীরটা যেন কেমন হয়ে গেছে। উপর্যুপরি স্যুটিং করতে বেচারীর নাকে দম এসে গেছে। কত করে বলছি শরীরটার দিকে একটু দ্যাখো। মেহবুবও বলছিল শরীর খারাপ করে লাভ নেই। দরকার হয় কদিন স্যুটিং বন্ধ করে রাখি। তবু তুমি আরাম করে নাও। কিন্তু কে কার। কথা শোনে? স্যুটিং-এর পাগলা নেশায় পেয়ে বসেছে ওকে। আজ আমি জোর করে শুইয়ে রেখেছি-সর্দিতে মাথা ভারী হয়ে আছে।

একথা শুনে বন্ধুদের সব আশায় জল পড়ল। জিদ্দন বাই এদিক সেদিকের নানা কথা বলে তাদেরকে বিদায় করে দিতে চাচ্ছিল। আমি বিলক্ষণ জানি নার্গিসের কোনো অসুখবিসুখ নেই। আমি জিদ্দন বাইকে প্রায় নাছোড়বান্দা হয়ে ধরে বললাম, দেখুন, বেবির স্বাস্থ্য খারাপ এটা ঠিক, কিন্তু এরা অনেক দূর থেকে এসেছে। অল্প সময়ের জন্যেও যদি —

জিদ্দন বাই ভেতরের দিকে মুখ করে তিন-চারবার ডাকাডাকি করার পর অবশেষে নার্গিস বেরিয়ে এল। সবাই দাঁড়িয়ে নার্গিসকে সালাম করল। আমি শুধু বসেছিলাম। নার্গিসের আসা বসা, সালামের জবাব দেওয়া–সবকিছু যেন অভিনয় মনে হল। সে যেন ক্যামেরার সামনে সংলাপ আওড়াচ্ছে।

আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হলাম।

জি হ্যাঁ, আজকেই এসেছি।

কালপরশু নাগাদ চলে যাব।

খোদার ইচ্ছায় এখন আর আপনার নাগাল পায় কে? আপনি এখন খ্যাতির চূড়ায়।

আমি আপনার সব ছবির প্রথম শো দেখেছি।

আপনার এ ছবিটা আমার অ্যালবামে রাখব।

এসব কথার জবাব নার্গিস এমন ভঙ্গিতে দিল, যেন এক নবাবজাদি এসে বসেছেন। ইতিমধ্যে মোহনবাবু কোত্থেকে এসে চুপচাপ বসে গেলেন আমাদের পাশে। তিনি কিছুই বললেন না, শুধু ঘুরে ঘুরে আমাদের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করছিলেন।

সবচেয়ে বেশি কথা বলেছেন জিদ্দন বাই। তার সব প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু হল ভারত ভূখণ্ডের যত নবাব বাদশা আছেন তাদের নাড়িনক্ষত্রের খবর জানা আছে তাঁর।

নার্গিস আগাগোড়া অভিনয়সুলভ আলাপই করল। এজন্যে আমার কাছে এবং আমার সাথিদের কাছে নার্গিসের সাক্ষাৎকারটা একেবারে রসকসহীন হয়ে রইল। আমি আশ্চর্য হলাম, আমার শালিদের সঙ্গে যে কিশোরী নার্গিস কথা বলত, বোকা আলাপ করত, সে নার্গিস কোথায় গেল।

এরপর সেলিমার আমাকে না জানিয়েই আর একবার নার্গিসের বাড়ি গিয়েছিল। কিন্তু সে সাক্ষাৎকারও মাঠে মারা গেছে কি না জানি না।

নাখসাবের সঙ্গে আমার কী যুদ্ধ হয়েছে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা। তবে যথাসম্ভব আমাদের সঙ্গে তখন নাখসাবও সেখানে উপস্থিত ছিল। কারণ জিদ্দন বাই কবিতা (প্রেমের) শুনতে ভালোবাসতেন। বোম্বের প্রায় কবিরাই তাঁর বাড়িতে আসা-যাওয়া করত। হতে পারে সে মজলিসে নাখসাবের সঙ্গে কবিতা নিয়ে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল।

আমি যখন অশোকের সঙ্গে থাকতাম, তখন একবার নার্গিসকে এক চমকপ্রদরূপে দেখেছিলাম। জিদ্দন বাই নিজে একটা ছবি করতে যাচ্ছিলেন। তাঁর ইচ্ছা সে ছবিতে নায়ক হিসেবে অশোক কাজ করুক। অশোক জিদ্দন বাইয়ের বাড়ি যাবে। কিন্তু ওর যা বরাবরের অভ্যাস কোথাও একা যেতে চাইত না। বাধ্য হয়ে আমাকে সঙ্গে যেতে হবে।

দেদার কথাবার্তা চলছে। পয়সাকড়ির ব্যাপার থেকে শুরু করে তোষামোদ পর্ব পর্যন্ত নানা ধরনের কথা চলছে। জিদ্দন বাই কথা বলতে বলতে কখনও চপলা, কখনও রাশভারী মহিলা, কখনও প্রযোজক পরিচালক। কখনও নার্গিসের মা বনে বসেন, তখন শুধু মেয়ের গুণকীর্তন করাই তার আসল কথা হয়ে দাঁড়ায়। মোহনবাবু চুপচাপ বসে থাকতেন। হুঁ হাঁ ছাড়া আর কোনো কথা বলতেন না তিনি।

ছবি তৈরি করতে যে টাকা খরচ হবে বা হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে হিসাবকিতাব শুরু হল। নার্গিস হঠাৎই কথা থেকে ফাঁক বের করে প্রসঙ্গহীনভাবে অশোককে আক্রমণ করে বসল, দ্যাখো অশোক, জানি নায়ক হিসেবে তোমার বেশ নামডাক। সবাই তোমাকে চেনে। কিন্তু তাই বলে আমরাও একেবারে ফেলনা নই। আমি তোমার চেয়ে অভিনয় কোনো অংশে কম জানি না।

বুদ্ধিমান অশোক কোনোমতে সে কথা এড়িয়ে কাজের কথায় যোগ দিল। কিছুক্ষণ পর নার্গিস আবারও কথার ফাঁক বের করে শুরু করল,

তুমি মনে করো অনেক মেয়ে তোমার জন্যে পাগল। এখন আমার জন্যেও বহু লোক প্রাণ দিতে প্রস্তুত। বিশ্বাস না হয়, লোকদের জিজ্ঞেস করো।

জিদ্দন বাই এমতাবস্থায় অনেকটা আপস মীমাংসার মতো করে বললেন, দ্যাখো অশোক, তোমার জন্যে আর আমার বেবির জন্যে সবাই পাগল। এজন্যে আমি চাই তোমরা দুজন একসাথে এই ছবিতে কাজ করো। তাহলে দু-হাতে আমরা পয়সা কামাতে পারব।

জিদ্দন বাই যখন দেখল, কথাগুলো তেমন গায়ে মাখানো গেল না। অশোক যেমন গম্ভীর ছিল তেমনই রয়েছে, আমাকে উদ্দেশ্য করে শুরু করলেন, সত্যি মান্টো, অশোক এত বড়ো অ্যাক্টর হয়েছে অথচ কত কম কথা বলে দ্যাখো। চোখে লাজলজ্জা বলে একটা জিনিস আছে। খোদা বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখুন ওকে। অশোকের যাতে অসুবিধা না হয় এজন্যে আমি ওর উপযোগী করে বিশেষভাবে সংলাপ লিখিয়েছি। শুনবে নাকি সংলাপগুলো?

আমি মনে মনে বললাম, সে সংলাপ নাইবা শুনলাম। আপনাদের সংলাপই তার চে ঢের মজাদার।

কথায় কথায় সুরাইয়ার কথা এসে গেল। কিন্তু জিদ্দন বাইয়ের যেন হঠাৎ নাকে গন্ধ লেগে গেল। সুরাইয়ার চৌদ্দ পুরুষকে উদ্ধার করতে শুরু করলেন তিনি। ওর না গলা ভালো, না কোথাও ওস্তাদের কাছে গান শিখেছে। মুখের না আছে শ্ৰী। দাঁতগুলো পর্যন্ত আঁকাবাঁকা–আরও কত কী? এরপর সুরাইয়াদের বাসায় গেলে আবার জিদ্দন বাই এবং নার্গিস সম্পর্কেও বেশ কিছু শুনে আসা যায়। সুরাইয়ার নানিও (আসলে তার মা) জিদ্দন বাইয়ের চেয়ে কোনো অংশে কম যায় না। বলেন, নার্গিস? ওর আবার একটা চেহারা? মেয়েদের মুখের শ্রী আল্লা দুশমনের এমন না করুক।

—–

৮। জিদ্দন বাই। প্রখ্যাত গায়িকা। পাশাপাশি হিন্দি ও উর্দু ছবির পরিচালক, অভিনেত্রী। নার্গিসের মা। জহরলাল নেহরুর সঙ্গে বন্ধুত্ব। ১৯০৮-এ জন্ম। ছবি করেছেন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবি- তিন ভাষাতেই দখল ছিল। 

সম্প্রতি (৩.৫.৮১) নার্গিস বোম্বেতে ক্যানসার রোগে পরলোকগমন করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে তিনি আমেরিকাতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি স্বামী সুনীল দত্ত, দুটি কিশোর ছেলে ও অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন–অনুবাদক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *