৫.
আসিফ সাহেবের কনস্ট্রাকসান ফার্ম তেজগাঁয়ে। আমজাদ ছয় মাস হল এখানে ডাইরেক্টর পদে জয়েন করেছে। জয়েন করার কয়েকদিনের মধ্যে বাড়ি, গাড়ি, ফোন ও মোবাইল পেয়েছে। ফার্মের লস হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করে তিনজন স্টাফকে ছাটাই করে নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছে এবং ম্যানেজারের উপর সবকিছুর দায়িত্ব দিলেও নিজেও লক্ষ্য রেখেছে। ফলে এই ছয় মাসের মধ্যে লস কভার করে প্রফিটের মুখ দেখিয়েছে। তাই আসিফ সাহেব তার বেতন ডবল করে দিয়েছেন। তিনি কয়েকবার তাকে বাসায় যাওয়ার কথা বলেছেন। আমজাদ বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে যাই নি। কিন্তু রুমালী ও আনানকে নিয়ে অনেক চিন্তা করে। একদিকে সাহেবের ইচ্ছা, অপরদিকে তার ইচ্ছা … আনান যদি তাকে পছন্দ করে এবং তার মনের মতো আনানের মন হয়, তা হলে রুমালীকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারবে না। বড়কে পছন্দ হয় নি–ছোটকে হয়েছে, কথাটা সাহেবকে বলা কি ঠিক হবে? এসব চিন্তা করে করে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে এতদিন যাই নি। তবু রুমালীর সঙ্গে আলাপ করা উচিত ভেবে আজ সাহেবকে ফোন করে জানাল, পাঁচটার সময় বাসায় আসবে।
আসিফ সাহেব আনন্দিতস্বরে বললেন, ওয়েলকাম মাই সান। আমি বাসায়। থাকব।
আপনি রুমালীর সঙ্গে আমার ব্যাপারে কোনো আলাপ করেছেন?
না। ভাবছি, আজ তুমি আসার আগে করব।
না, তা করবেন না। আমি আলাপ করার পর করবেন।
বেশ, তাই করব!
আপনি সাড়ে পাঁচটা বা ছ’টার আগে বাসায় ফিরবেন না।
কেন বলতো?
আপনি বাসায় ফেরার আগে আমি রুমালীর সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
আসিফ সাহেব হেসে উঠে বললেন, ওকে মাই সান। তারপর লাইন কেটে দিয়ে রুমালীকে মোবাইলে ফোন করলেন।
বাসায় ডিজিটাল ফোন আছে তিনটে। দুবোনের রুমে দু’টো আর আসিফ সাহেবের রুমে একটা। তিনজনের তিনটে মোবাইলও আছে।
রুমালী ফোন ধরতে আসিফ সাহেব বললেন, একটা ইয়াং গেস্ট পাঁচটার সময় বাসায় আসবে। তারা দু’বোন ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করবে।
উনি কে বাবা?
দেখলেই চিনতে পারবি।
ওনার পরিচয় বলছ না কেন?
জিদ করিস না মা, বললাম না, দেখলেই চিনতে পারবি?
তুমি কখন আসবে?
ছ’টার দিকে।
কেন? পাঁচটা সময়েই তো তোমার আসা উচিত।
আজ একটা জরুরী মিটিং আছে। শেষ হতে ছটা বেজে যেতে পারে। আমি তার আগে আসার চেষ্টা করব। তারপর রুমালী কিছু বলার আগে লাইন কেটে দিলেন।
রুমালী বাবার ফোন করার কথা আনানকে বলে জিজ্ঞেস করল, কে হতে পারে বলতে পারিস?
আনান বাবার কাছ থেকে অনেক আগে জেনেছে, আমজাদকে বাবা তেজগাঁ কনস্ট্রাকসান ফার্মের ডাইরেক্টার করেছে। জানার পর থেকে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য মন খুব অস্থির হয়ে উঠলেও লজ্জায় করে নি। এখন রুমালীর কথা। শুনে ভাবল, সে নয় তো আবার ভাবল, সে হলে বাবা আমাদেরকে তার ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতে বলল কেন?
কি রে, কী ভাবছিস? কে হতে পারে বল না?
আমি কি করে বলব? কে হেতে পারে চিন্তা করছিলাম।
যেকোনো গেষ্টকে বাবা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আজ ব্যতিক্রম হল। ব্যাপারটা মাথায় ঢুকছে না।
মাথায় ঢোকাবার দরকার নেই, এলেই তো জানা যাবে।
আমজাদ ঠিক পাঁচটার সময় সাহেবের বাসার গেটে এসে গাড়ি থামাতে যাবে এমন সময় গেট আপনা থেকে খুলে গেল। অবাক হলেও গাড়ি ভিতরে নিয়ে একেবারে গাড়ি বারান্দায় এসে থামাল।
নামার আগেই একজন লোক এসে গেট খুলে দিয়ে বলল, আমার সঙ্গে আসুন।
আমজাদ গাড়ি থেকে নেমে বেশ অবাক হয়ে বলল, আমার পরিচয় না জেনেই ভিতরে যেতে চাচ্ছেন?
আপনার পরিচয় না জানলেও সাহেবের নির্দেশ পালন করছি। লোকটা তাকে একটা বেশ বড় ড্রাইংরুমে বসেত বলে চলে গেল। ড্রইংরুমের পরিবেশ দেখে আমজাদের মনে হল, সাহেবের স্ত্রীর বাড়ির ড্রাইংরুম এটার চেয়ে অনেক উন্নত।
দু’বোন পাঁচটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে সেজেগুজে দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে গেষ্টের অপেক্ষায় ছিল। আমজাদ গাড়িতে এসেছে বলে তারা চিনতে পারল না।
রুমালী ঘড়ি দেখে বলল, উনি এসে গেছেন, চল যাই।
আমজাদ দেয়ালে টাঙানো দুটো বাঘের লড়াইয়ের অয়েল পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়েছিল। ওদের আগমন টের পেল না।
ওরা দরজার পর্দা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমজাদ পিছন ফিরে অয়েল পেন্টিং-এর দিকে তাকিয়ে ছিল। তাই চিনতে পারল না। রুমালী দরজায় আঙ্গুলের উল্টো পিঠ দিয়ে টকটক শব্দ করে এগিয়ে এল।
আমজাদ ঘুরে তাদেরকে দেখে সালাম দিল।
আনান চিনতে পেরে খুব আনন্দিত হয়ে সালামের উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল। তখন তার মনে আনন্দের লহরী বইতে শুরু করেছে।
রুমালী চিনতে পেরে খুব রেগে গেলেও সংযত কণ্ঠে বলল, আপনি এখানে এসেছেন কেন? বাবার কাছে এসে থাকলে সন্ধ্যের পর অথবা কাল সকালে আসুন। এখন উনি বাসায় নেই।
রুমালীর কথা শেষ হতে আমজাদ সোফায় বসে তাদেরকে বসতে বলে বলল, আমি ওনার কাছে আসি নি, এসেছি আপনাদের কাছে।
রুমালী রাগ সহ্য করতে পারল না। বেশ উঁচু গলায় বলল, হোয়াট?
আনান তার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চস্বরে বলল, তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? যা বলার ভালোমুখে বল।
রুমালী ঝাড়ি মেলে বলল, তুই চুপ কর। তারপর আমজাদের দিকে তাকিয়ে একটু স্বর নামিয়ে বলল, বসে আছেন কেন? এ সময়ে একজন গেস্ট আসার কথা আছে। আপনি চলে যান।
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, যদি বলি আমিই সেই গেস্ট?
ইম্পসিবল, ইউ গেট আউট এ্যাট দ্য মোমেন্ট।
মুখে হাসি ধরে রেখে আমজাদ বলল, যদি না যাই?
দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব।
আনান রুমালীর একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, এই আপা, কি যা-তা বলছিস? যশোহর যাওয়ার পথে উনি আমাদের কতবড় উপকার করেছিলেন মনে নেই।
কথাটা আনান আস্তে বললেও আমজাদ শুনতে পেয়েছে। বলল, সেদিন শুধু আপনাদের জন্য কাজটা করি নি, সব গাড়ির যাত্রীদের জন্য করেছিলাম। তারপর রুমালীকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি স্বনামধন্য কোটিপতি আসিফ সাহেবের কন্যা, ভার্সিটিতেও পড়ছেন, মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হয় জানেন না। জেনে খুব দুঃখ হচ্ছে। যাক গে, আমি কিছু মনে করি নি। আপনাদের বাবা পাঁচটার সময় আসতে বলেছিলেন। আরো বলেছিলেন, আসতে একটু দেরি হলে আমার মেয়েদের সঙ্গে আলাপ করে সময় কাটাবেন।
কথাটা শুনে রুমালী বাবার উপর খুব রেগে গেল। ভাবল, এরকম একটা যাচ্ছেতাই ছেলেকে আসতে ও তাকে ভালোভাবে ট্রিটমেন্ট করতে বলল কি করে
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আনান বলল, এই আপা, ওনার ট্রিটমেন্ট করবি না?
এরকম একটা ফালতু ছেলের ট্রিটমেন্ট করতে আমার বয়ে গেছে। তোর ইচ্ছা হলে কর, আমি চললাম বলে রুমালী সেখান থেকে চলে গেল।
আনান এগিয়ে এসে আমজাদের পাশের সোফায় বসে বলল, আপা একটু ঐ রকমই, কিছু মনে করবেন না। আমি ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। কেমন আছেন। বলুন।
আল্লাহ্ ভালো রেখেছেন বলে আসতে পেরেছি।
আপনি কেমন আছেন? ভালো।
অফিসের কাজ কর্ম কেমন লাগছে?
ভালো। অফিসের খবরও রাখেন দেখছি?
কেন রেখেছি বলতে পারেন?
পারি।
বলুনতো দেখি?
ফালতু ছেলেতো, হয়তো ফালতু কথা বলে ফেলব। তাই সাহস পাচ্ছি না।
আমিতো আপনাকে ফালতু ছেলে বলি নি, বলেছে আপা। আসলে কথাটা আপনি বলতে পারবেন না। তাই এইসব বলছেন।
কথাটা শুনে আপনার আপার মতো আপনিও রেগে যাবেন।
কথা দিচ্ছি রাগব না, এবার বলুন।
আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। তাই আমার খবর রাখেন।
কথাটা শুনে আনান লজ্জারাঙা হয়ে মুখ নিচু করে চুপ করে রইল।
এমন সময় আয়া ট্রে টেবিলে বিভিন্ন আইটেমের নাস্তা ও পানীয় নিয়ে ঢুকে ছোট আপা বলে ডাকল।
আনান মুখ তুলে তাকিয়ে তাকে চলে যেতে বলল। আয়া চলে যাওয়ার পর ট্রে টেবিল ঠেলে আমজাদের সামনে নিয়ে এসে বলল, কি কি খেতে ভালো লাগে বলুন, আমি রেডি করে দিই।
এ সময়ে যা খেতে আপনার ভালো লাগে, আমারও তাই ভালো লাগে।
আনান হেসে ফেলে বলল, আমার ভালো লাগার কথা আপনি জানলেন কি করে? আমি কখন কি খাই আপনিতো কোনোদিন দেখেন নি?
দেখিনি বলেই তো আজ দেখতে চাই। আমার রুচির সঙ্গে আপনার রুচির মিল আছে কি না।
ঠিক আছে বলে আনান দু’পীস স্লাইস রুটিতে জেলী মাখিয়ে একটা প্লেটে রাখল। আর দুটো বড় সাগর কলা ছাড়িয়ে অন্য প্লেটে রেখে বলল, নিন, শুরু করুন।
আমি একা খাব না কী?
আমি নিচ্ছি, আপনি শুরু করুন তো।
রুটি কলা খাওয়ার পর তিনটে সিদ্ধ ডিম ছাড়িয়ে দুটো আমজাদকে দিল আর নিজে একটা নিল। তারপর ফ্লাক্স থেকে গরম দুধ দুটো গ্লাসে ঢালল।
দুধ খাওয়ার পর আনান বলল, পাশ করেছি কি না বলুন।
শুধু পাশ নয়, শতকরা একশ নাম্বার পেয়ে পাশ করেছেন?
যদি বলি আমার মন রাখার জন্য বললেন?
তা বলতে পারেন। তবে জেনে রাখুন, আমি মিথ্যা ও প্রবঞ্চনাকে ঘৃণা করি। কারণ, মুসলমান কখনও মিথ্যুক ও প্রবঞ্চক হতে পারে না।
শুনে খুশী হলাম। আপনার পকেটে মোবাইল দেখছি, আপনার নাম ও নাম্বারটা বলুন।
আমজাদ নাম ও নাম্বার বললে আনান নিজের মোবাইলে বুকে সেফ করে নিল।
আমজাদ মৃদু হেসে বলল, এবার আপনারটা বলুন। আনান নাম ও নাম্বার বলে জিজ্ঞেস করল, ফোন করলে বিরক্ত হবেন না
আপনার কি মনে হয়?
খুশী হবেন।
তা হলে জিজ্ঞেস করলেন কেন?
টেস্ট করলাম।
ফলাফল তিতা না মিষ্টি
আনান হেসে ফেলে বলল, মিষ্টি।
এবার আমি যদি একই প্রশ্ন করি?
করুন, ফলাফল একই হবে।
তা হলে ফাইন্যাল ফলাফল, আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসি তাই না?
আনান লজ্জামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, তাই।
এমন সময় গাড়ির শব্দ পেয়ে আনান বলল, বাবা এসে গেছেন।
আসিফ সাহেব রুমে ঢুকে আনানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কিরে মা, তুই একা কেন? রুমালী কোথায়?
আপাও ছিল, কিছুক্ষণ আগে চলে গেছে।
যা, তাকে ডেকে নিয়ে আয়।
আমজাদ বলল, তার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, ডাকবার আর দরকার নেই। অনেকক্ষণ এসেছি, এবার আসি।
আরো কিছুক্ষণ থাক না, আলাপ করা যাক।
মাফ করবেন, মায়ের শরীর ভালো না। অফিসে বেরোবার সময় বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব বলে এসেছি।
তোমার মায়ের কি হয়েছে।
তেমন গুরুতর কিছু না, কয়েকদিন থেকে সারা শরীর ব্যথা করছে। সেকথা ডাক্তারকে বলে ওষুধ এনেছিলাম, কাজ হয় নি।
তা হলে আর দেরি করব না, যাও।
আমজাদ সালাম বিনিময় করে চলে গেল।
আসিফ সাহেব আনানকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করেছিস?
করেছি।
কেমন বুঝলি?
সাধারণ ঘরের অসাধারণ ছেলে।
আসিফ সাহেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বললেন, তুই ঠিক বলেছিস। কেন ওকে আসতে বলেছিলাম জানিস?
তুমি আসতে না আসতেই উনি চলে গেলেন। তাই কথাটা আমিই জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।
ওকে আমি রুমালীর জন্য চয়েস করেছি। তাই তোদর সঙ্গে আলাপ করার জন্য আসতে বলেছিলাম। ওকে রুমালীর নিশ্চয় ভালো লেগেছে।
বাবার কথা শুনে আনানের মুখ শুকিয়ে গেল। কিছু বলতে না পেরে চুপ করে রইল।
জানিস মা, এ যুগে ওর মতো ছেলে পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। আল্লাহ রাজি থাকলে খুব শিঘ্রী ওদের বিয়ে দেব। রুমালীর ভাগ্য খুব ভালো, তাই না? অবশ্য তোর জন্যেও ঐ রকম একটা ছেলে পছন্দ করে রেখেছি। তারপর চঞ্চল ও বাকপটু মেয়েকে চুপ করে থাকতে দেখে বললেন, কিরে মা, হঠাৎ তোর মন খারাপ হয়ে গেল কেন? আমজাদ সাধারণ ঘরের ছেলে বলে?
আনানের মনে তখন চিন্তার ঝড় বইছে। সামলে নিয়ে ঢোক গিলে কোনোরকমে বলল, এক্ষুনি বললাম না, উনি সাধারণ ঘরের অসাধারণ ছেলে? আমার মাথাটা খুব ধরেছে, তারপর যাই বলে নিজের রুমে চলে গেল।
হঠাৎ ছোট মেয়ের পরিবর্তন দেখে আসিফ সাহেবের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। ভাবলেন, তা হলে আমাজাদকে কি ওর পছন্দ? চিন্তিত মুখে দোতালায় রুমালীর রুমের দরজার কাছে এসে নাম ধরে ডাকলেন।
গাড়ির শব্দ পেয়ে রুমালী বুঝেছে বাবা এসেছে। তার উপর আগেই রেগেছিল, আসার পর আরো রেগেছে। বাবার গলা পেয়ে সংযত কণ্ঠে বলল, ভেতরে এস বাবা।
আসিফ সাহেব ডুকে বললেন, গেস্টের কাছে আনানকে দেখলাম, তুই চলে এলি কেন?
তুমি তো জান, আমি যার তার সঙ্গে আলাপ করি না। তবু তুমি একটা সাধারণ ছেলেকে গেস্ট হিসাবে পাঠাবে ভাবতেই পারি নি।
ও সাধারণ ঘরের ছেলে হলেও অসাধারণ। তাই ওকে তোর জন্য সিলেক্ট করে বাড়ি, গাড়িসহ তেজগাঁও কনট্রাকসান ফার্মের দায়িত্ব দিয়েছি। মনে হচ্ছে, ওকে দেখে চিনতে পেরেই আলাপ না করে চলে এসেছিস। আলাপ করলে বুঝতে পারতিস ছেলেটা কত জিনিয়াস।
যতই জিনিয়াস হোক, ওকে পছন্দ করা তো দূরের কথা, দেখতেই ইচ্ছা করে না। তারপর কুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, আমি কি তোমার কাছে এতই ভারি বোঝা হয়ে গেছি, এক্ষুনি বিয়ে দিতে চাচ্ছ?
ছেলেমেয়েরা মা বাবার কাছে কখনো ভারি বোঝা হয় না। শুধু তোর না, আনানের জন্যেও ছেলে সিলেক্ট করে রেখেছি। বিলেতে ব্যারিষ্টারী পড়তে গেছে। শিঘ্রী ফিরবে। ফেরার পর আনানের বিয়ে দেব। তাই ওদের আগে তোর বিয়ে দিতে চাই। কেন তোদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে যাচ্ছি জানিস, আমার ঐশ্বর্যের দিকে বন্ধুরা হায়েনার দৃষ্টি ফেলেছে। তাদের অনেকে তোদেরকে পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দিতে শুরু করছে। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, সেসব ছেলে শিক্ষিত হলেও চরিত্রবান নয়। তোদের কোনো ভাই নেই। ভবিষ্যতে তোরাই আমার ঐশ্বর্যের মালিক হবি। তোদের স্বামীরা যদি চরিত্রবান না হয়, তা হলে এত ঐশ্বর্য অসৎ। পথে উড়িয়ে দেবে। তোরা আপত্তি করলে তাদের সঙ্গে মনোমালিন্য হবে, এমন কি তোদের উপর অত্যাচার করবে। এইসব চিন্তা করে করে চরিত্রবান ছেলের খোঁজে ছিলাম। ভাগ্যচক্রে আমজাদকে পেয়ে তার সবকিছু খোঁজ-খবর নিয়ে জেনিছি, ওর মতো চরিত্রবান ছেলে আর হয় না। তাই তাকে তোর জন্য সিলেক্ট করে তেজগাঁ অফিসের ডাইরেক্টর পদে নিয়োগ করেছি। তুই আমাকে ভুল বুঝিসনি মা। উপযুক্ত পাত্রে তোমাদের বিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই।
কিন্তু বাবা, আমি যে এখন বিয়ের কথা ভাবতেই পারছি না। তা ছাড়া আমজাদকে আমার একদম পছন্দ নয়। তাকে স্বামী হিসাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারব না।
তুই যদি তোর বন্ধুদের মধ্যে কাউকে পছন্দ করিস, তা হলে বল, তার সঙ্গেই বিয়ে দেব।
বন্ধু অনেক আছে, কিন্তু তাদের কাউকে বিয়ে করব, সেরকম কখনো ভাবি নি।
ঠিক আছে, আমজাদকে যখন তোর পছন্দ নয় তখন আর জোর করব না। বন্ধুদের মধ্যে যাকে তোর পছন্দ হবে তার সবকিছু পরীক্ষা করে আমাকে জানাবি। আমি তার মা বাবার সঙ্গে আলাপ করব।
রুমালী আনন্দিত হয়ে বাবার দুটো হাত ধরে চুমো খেয়ে বলল, তোমার মতো বাবা পেয়ে আমি ধন্য। একটা কথা বলব, রাগ করবে না বল?
তোদের দুজনের উপর কখনো রাগ করেছি।
রুমালী হেসে ফেলে বলল, তা অবশ্য কর নি। বলছিলাম কি, আমজাদকে তোমার যখন খুব পছন্দ তখন তার সঙ্গে আনানের বিয়ে দিতে পার।
কথাটা তুই ভালো বললেও তা একেবারেই সম্ভব নয়। কারণটাতো তোকে একটু আগে বললাম।
ছেলেটা কি তোমার আত্মীয়?
না, তবে এমন এক বন্ধুর ছেলে, যে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছে। আর তার টাকাতেই আমি ব্যবসা শুরু করে আজ এতবড় ব্যবসায়ী হয়েছি। তার কথা আর জিজ্ঞেস করিস নি মা। তারপর চোখ মুছতে মুছতে সেখান থেকে বেরিয়ে ছোট মেয়ের রুমের দিকে গেলেন।
আনান বাবার পিছন পিছন উপরে এসে নিজের রুমে গিয়েছিল। যদিও ইচ্ছা হয়েছিল, বাবা আপাকে কি বলে না বলে শোনার জন্য; তবু ইচ্ছাটা দমন করে রেখেছিল। অনেকক্ষণ হয়ে গেলেও যখন আপার রুম থেকে বাবাকে বেরোতে দেখল না তখন কৌতূহল বোধ করে পা পা করে এসে ভিতরে না ডুকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল। রুমালী যখন আমজাদের সঙ্গে আনানের বিয়ে দেয়ার কথা বলার পর আসিফ সাহেব বললেন, কথাটা মন্দ বলিস নি তখন আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন নেই মনে করে ফিরে এল। তারপর খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে আমজাদকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনছিল।
আসিফ সাহেব ঢুকে বললেন, কিরে মা, মাথার যন্ত্রণা কমেছে?
আনান উঠে বসে বলল, একটু কমেছে।
আসিফ সাহেব একটা চেয়ারে বসে জিজ্ঞেস করলেন, রুমালী আমজাদের সঙ্গে আলাপ করেছিল?
আপা ওনাকে দেখেই খুব রেগে উঠে চলে যেতে বলে। উনি না যেতে সেখান থেকে চলে আসে। আমি বাধা দিলে আমার উপরও রাগ দেখিয়েছে।
কেন যে রুমালী আমজাদকে পছন্দ করল না বুঝতে পারছি না। আচ্ছা, ও কাউকে ভালবাসে কিনা জানিস?
সেরকম কেউ থাকলে জানতে পারতাম। আমার মনে হয় উনি গরিব ঘরের ছেলে জেনে পছন্দ করতে পারে নি।
আমারও তাই মনে হচ্ছে বলে আসিফ সাহেব নিজের রুমে চলে গেলেন।
আপা ও বাবার আলাপ শোনার পর থেকে আনানের মন আনন্দে মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাই পড়তে বসেও এতটুকু মন বসাতে পারল না। কেবলই আমজাদকে ফোন করতে ইচ্ছা করছে। ভাবল, রাত দশটার পর করবে। এখন বাসায় নাও পাওয়া যেতে পারে।
আসিফ সাহেব রাত দশটার সময় দু’মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খান। আজ খাওয়ার সময় লক্ষ্য করলেন, আনান সামান্য খেয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছে, বললেন, কিরে মা, খাচ্ছিস না কেন?
আর খেতে ইচ্ছা করছে না বাবা। তোমরা খাও বলে বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে রুমে চলে এল। ফোনে আমাজাদের সঙ্গে কিভাবে আলাপ করবে প্রায় আধ ঘন্টা চিন্তা করল। তারপর ফোন করল।
আমজাদ মায়ের সঙ্গে খেয়ে উঠে সবেমাত্র রুমে এসেছে। রিং হতে শুনে ভাবল, সাহেব হয়তো তার সঙ্গে রুমালীর দুর্ব্যবহারের কথা জেনে ফোন করেছেন। রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, আমজাদ বলছি।
আনান সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আমি আনান। খুশী হয়েছেন? হান্ড্রেড পার্সেন্ট খুশী হয়েছি। কি করছিলেন?
সন্ধ্যের পর থেকে আপনার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। সবেমাত্র খেয়ে এসে মনে হল, এক্ষুনি ফোন আসবে। এখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি। এবার আপনার কথা বলুন।
প্রথমে আপনারটা বলুন। পরে আমারটা বলব।
আপনার বাবা আমাকে চাকরি দিয়ে রুমালীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। আমি রাজি না হয়ে বললাম, আমার মনের মতো যে মেয়ের মন, তাকে ছাড়া বিয়ে করব না। উনি বললেন, রুমালী খুব ভালো মেয়ে তার সঙ্গে আলাপ করে দেখ, তার মন তোমার মনের মতো হতে পারে। তাই আজ গিয়েছিলাম।
রেজাল্ট বলুন।
রেজাল্ট আগেই জানতাম। তবু আপনার বাবার কথা রাখার জন্য গিয়েছিলাম।
কি জানতেন বলবেন তোর।
আজ বিকেলে যা ঘটল তাতে বুঝতে পারেন নি?
পেরেছি।
তবুও জিজ্ঞেস করলেন কেন?
আনান তার কথার উত্তর না দিয়ে বলল, একজন পুরুষের মনের মতো মন, সারা পৃথিবীতে তেমন কোনো মেয়ে কি আছে?
আছে। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম।
তা হলে তখন আমাকে ভালবাসেন বললেন কেন?
আপনি ঐ খুব কম সংখ্যার দলের।
আমার মন যে আপনার মনের মতো, জানলেন কী করে?
আল্লাহ্ জানিয়েছেন।
প্রমাণ করতে পারবেন?
ইনশাআল্লাহ্ পারব।
কই, করুন তো দেখি।
কাল দুটোর সময় ফার্মগেটে তাইপিং রেস্টুরেন্টের গেটে থাকব, আপনি আসবেন। প্রমাণ মুখে নয় বাস্তবে দেখাব।
ঠিক আছে, আসব।
একটু ভুল বললেন।
ভুল বললাম মানে?
বলবেন ইনশাআল্লাহ্ আসব।
আনান কথাটা রিপীট করে বলল, এবার হয়েছে।
শুধু হয়েছে না, আপনার মন যে আমার মনের মতো তা আপনিই প্রমাণও করে দিলেন।
সত্যি বাবা আপনাকে ঠিকই চিনেছেন।
আপনি চেনেন নি?
চিনেছি বলেই তো আপনার মধ্যে বিলীন হতে ইচ্ছা করছে।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, আমারও কিন্তু তাই ইচ্ছা করছে। এতেই প্রমাণ হয়ে গেল, আমাদের দুজনের দেহ ভিন্ন হলেও মন এক।
আমাকে পছন্দ হওয়ার কথা আপনি কি বাবাকে বলবেন?
আমার কিছু বলা লাগবে না, আপনার বাবাই আমাকে বলবেন।
বাবা তো আপাকে বিয়ে করার কথা আপনাকে বলেছিলেন, এখন আমার কথা বলতে হয়তো দ্বিধাবোধ করবেন। তাই আপনারই বলা উচিত।
আপনি অবশ্য ঠিক কথা বলেছেন। তবে আপাতত বলা উচিত হবে না। প্রয়োজনে পরে বলব। এবার রাখুন, মা এখনো ঘুমান নি। বাথরুমে যাওয়ার সময় এত রাতে কারো সঙ্গে কথা বলছি শুনলে অনেক রকম প্রশ্ন করবেন।
ঠিক আছে, আর একটা কথা বলে রাখছি, আপনার মাকে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। কাল ফার্মগেট না গিয়ে আপনার বাসায় যেতে চাই। সাড়ে চারটের সময় আপনার অফিসের সামনে থাকব।
শুনে খুশী হলাম। এতক্ষণ এই কথা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।
ফার্মগেটের কথা না বলে বাসায় আসার কথা বললে আমিও আপনার মতো খুশী হতাম।
কোনো ব্যাপারেই জীবনে কারো কাছে হারি নি। আজ আপনি হারিয়ে দিলেন।
বুঝলাম না।
আপনি বাসায় আসার কথা বলেন কিনা জানার জন্য ফার্মগেটের কথা বলেছি। আপনি বলে হারিয়ে দিলেন আর তৃতীয়বারের মতো প্রমাণ করে দিলেন, দু’জনের মন একই।
আর একটা কথা বলতে চাই।
আমজাদ হেসে উঠে বলল, এটাই কিন্তু শেষ।
আনানও হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে।
বলুন তা হলে।
কাল বাসায় গেলে মা যখন আমার পরিচয় জানতে চাইবেন তখন কি বলবেন?
সে কথা ভেবে রেখেছি।
বলুন না শুনি।
যখন বলব তখন শুনবেন।
এখন বললে কী হয়?
এখন বললে আপনি লজ্জা পাবেন। কাল হয়তো বাসায় আসার প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করবেন।
আপনার কথাই ঠিক, এখনই লজ্জা পাচ্ছি। কাল বাসায় যাব কি করে ভাবছি
মাকে আপনার পরিচয় কি বলব বুঝতে পেরেছেন তা হলে?
আপনার কথাতেই বলি, “আমাদের দেহ দু’টো হলেও মন এক।”
তা হলে তুমি করে না বলে আপনি করে বলছ কেন?
এক্ষুনি আমিও কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম, তার আগেই তুমি বলে ফেললে।
গুড, ভেরি গুড। তোমাকে জানাচ্ছি অসংখ্য ধন্যবাদ। আর সেই মহান রাব্বল আল আমিনের দরবারে জানাচ্ছি হাজার হাজার শুকরিয়া যিনি আমার মনের মতো মন দিয়ে তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। এবার আমি একটা কথা বলি।
আনান হেসে উঠে বলল, এখন মা শুনতে পাবেন না?
শুনতে পেলেও কথাটা বলা খুব দরকার।
তা হলে বল।
মা খুব ধার্মিক মহিলা। আসার সময় ধর্মীয় পোশাক পরে আসবে।
তুমি না বললেও তাই করতাম।
কি করে জানলে আমার মা ধার্মিক মহিলা।
তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমার মন বলছে, তুমি ধার্মিক। মা ধার্মিক না হলে ছেলে ধার্মিক হয় না। তাই যখন তোমার বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম তখনই মন বলল, ধর্মীয় পোশাক পরে যেতে।
তোমার মন বুঝল কি করে আমি ধার্মিক
মাত্র দু’বার তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। সে সময় তুমি আমার শরীরের কোনো অংশের দিকে না তাকিয়ে শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেছ। তাতেই আমার মন বুঝেছে তুমি ধার্মিক।
আমজাদ মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, এবার রাখ, ইনশাআল্লাহু কাল দেখা হবে।
ঠিক আছে বলে আনান সালাম বিনিময় করে লাইন কেটে দিল।
.
সালমা খাতুন প্রতিদিন রাতে খাওয়ার পর দুটো পান খান। তারপর দাঁত খেলাল করে বাথরুমের কাজ সেরে অযু করে এসে কিছুক্ষণ কুরআন তেলাওয়াত ও হাদিস পড়েন। বিয়ের আগে তিনি দাদির কাছে শুনেছিলেন, রাতে ঘুমাবার সময় এইসব করে ঘুমালে সারা রাত জেগে ইবাদত করার মতো সওয়াব পাওয়া যায়। সেই থেকে এই আমল করে আসছেন।
আজ খাওয়ার পর পান খাওয়ার সময় ফোন বাজতে শুনেছেন। প্রতিদিনের মতো কুরআন হাদিস পড়ে দরজা বন্ধ করতে এসে তখনও ছেলেকে ফোনে কথা বলতে শুনে তার রুমে যখন এলেন তখন তাকে রিসিভার ক্যাডেলে রাখতে দেখলেন।
মাকে দেখে আমজাদ বলল, বস, তোমার সঙ্গে কথা আছে। তুমি না এলে আমি এক্ষুনি তোমার কাছে যেতাম।
সালমা খাতুন বসে বললেন, এতক্ষণ ধরে ফোনে কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
সাহেবের ছোট মেয়ের সঙ্গে। সাহেবের ছেলেমেয়ে কয়টা?
ছেলে নেই, শুধু দুটো মেয়ে।
তাদের বিয়ে হয়ে গেছে?
না।
সাহেবের ছোট মেয়ের সঙ্গে এতক্ষণ কি কথা হল?
সেসব অনেক কথা, তোমার শোনার দরকার নেই। জান মা, চাকরি পাওয়ার সময় তোমার কাছে একটা কথা গোপন করেছিলাম, এখন বলতে চাই।
কথাটা তখন গোপন করে এখন বলতে চাচ্ছিস কেন?
তখন না বলে যে ভুল করেছি, সেই ভুলের সংশোধন করতে চাই।
বল কি কথা গোপন করেছিলি?
সাহেব ঐ দিন ওনার বড় মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
বিয়ে করার জন্য সাহেব এখন বুঝি চাপ দিচ্ছেন?
না মা, তুমি যা ভাবছ তা নয়। তোমার ছেলের মন এত ছোট নয় যে, চাকরি পাওয়ার জন্য বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেব।
তা হলে সাহেবকে তখন কি বলেছিলি?
রাজি না হয়ে বলেছিলাম, “যে মেয়ের মন আমার মনের মতো হবে তাকেই বিয়ে করব। নচেৎ সারাজীবন বিয়েই করব না।”
এই কথা শোনার পরও সাহেব তোকে চাকরি দিলেন?
তিনি আমাকে ছেলে হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তাই চাকরি দিয়েছেন। শুধু বলেছিলেন, “আমার বড় মেয়ের সঙ্গে অন্ততঃ একবার আলাপ কর, তা হলে হয়তো তোমার আশা পূরণ হতে পারে।” এতদিন অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত ছিলাম। আজ একটু অবসর পেয়ে সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম ওনার বড় মেয়ের সঙ্গে আলাপ করার জন্য।
আলাপ হয়েছে।
বলছি শোন, মেয়েটা ভীষণ সুন্দরী, কিন্তু খুব উগ্র ও রাগি। গরিবদের মোটেই দেখতে পারে না। আমি গরিব ঘরের ছেলে জেনে রেগে গিয়ে যা তা বলে অপমান করে আমার কাছ থেকে চলে গেল। অবশ্য তার ছোট বোনটা খুব ভালো। বড় বোন চলে যাওয়ার পর তার হয়ে ক্ষমা চেয়ে আমার সঙ্গে অনেক্ষণ আলাপ করল।
এখন সে ফোন করেছিল কেন?
কাল তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলার জন্য ফোন করেছিল।
তুই আমাকে খুব বোকা মেয়ে মনে করিস, তাই না?
তুমি হঠাৎ এরকম কথা বলছ কেন?
বলব নাতো কি? শুধু আমাকে দেখতে আসার কথা বলার জন্য কেউ ফোনে এক ঘন্টা কথা বলে? আসল কথাটা বলছিস না কেন? আমার তো মনে হচ্ছে, তোরা দুজন দুজনকে ভালবেসে ফেলেছিস। তাই আমাকে দেখতে আসতে চায়।
আমজাদ ধরা পড়ে খুব লজ্জা পেল। কোনো কথা বলতে না পেরে মুখ নিচু করে রইল।
কিরে, কিছু বলছিস না কেন? ছেলেমেয়েদের মনের কথা মায়েরা বুঝতে পারে। বড়টাকে যে তোর পছন্দ হয় নি, সাহেবকে জানিয়েছিস?
আমাকে জানাতে হবে না, সেই মেয়েই এতক্ষণে জানিয়ে দিয়েছে।
আর ছোট মেয়ের ব্যাপারটা?
সেটা ছোট মেয়েই জানাবে।
অত বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করে তুই কি সুখী হবি? না আমি হব?
তক্বদীরে যা আছে তার কম বেশি থেকে তো বঞ্চিত হব না। তবে এতটুকু বলতে পারি, ওকে যতটুকু জেনেছি ইনশাআল্লাহ্ তুমি আমি কেউ অসুখী হব না।
কাল কখন আসবে?
পাঁচটার সময়।
তোর সঙ্গে আসবে?
তাই তো বলল।
ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড় রাত হয়েছে বলে সালমা খাতুন চলে গেলেন।
.
পরের দিন আনান একটা ক্লাস গ্যাপ দিয়ে বাসায় এল। তারপর ড্রেস চেঞ্চ করে সিল্কের সাদা সালওয়ার কামিজ পরে সাদা জর্জটের ওড়ানা গায়ে মাথায় দিয়ে গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে বলল, তেজগাঁ অফিসে চল। অফিসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে ফিরে যেতে বলে ঘড়ি দেখল, সারে চারটে।
আমজাদ চারটে পঁচিশে অফিস থেকে বেরিয়ে নিচে এসে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল। আনানকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, আজ তোমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে জান?
হ্যাঁ জানি। নিশ্চয় মনে হচ্ছে, বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতায় অংশ নিলে ফাস্ট হব।
সুবাহান আল্লাহ্ বলে আমজাদ বলল, সত্যিই আমার তাই মনে হয়েছ। তারপর তাকে নিয়ে গাড়িতে উঠল।
আনানকে নিয়ে আমজাদ যখন বাসয় পৌঁছাল তখন সালমা খাতুন আসরের নামায পড়ে তসবীহ পড়তে পড়তে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
গাড়ি থেকে নেমে আমজাদ বলল, আমি মাকে মুখে সালাম দেব। তুমি মুখে সালাম দিয়ে পায় হাতে ছুঁয়ে কদমবুসিও করবে।
আনান বলল, ওসব তোমাকে বলতে হবে না। তুমি না বললেও করতাম।
বাসায় ঢুকে আমজাদ মাকে সালাম দিল।
আনান সালাম দিয়ে কদমবুসি করল।
সালমা খাতুন আনানকে দেখে খুব অবাক হলেন। ভাবলেন, কোনো মেয়ে কি এত সুন্দরী হয়? সালামের উত্তর দিয়ে তাকে জড়িয়ে প্রথমে কপালে ও পরে দু’গালে চুমো খেয়ে দোয়া করলেন, “আল্লাহ তোমাকে দুনিয়াতে ও আখেরাতে চিরসুখী করুক।”
আমজাদ মাকে বলল, তুমি বোধ হয় আসরের নামায পড়ে নিয়েছ। আমি পড়ে নিই ততক্ষণ ওর সঙ্গে আলাপ কর।
ছেলে চলে যাওয়ার পর সালমা খাতুন আনানকে জিজ্ঞেস করলেন তোমার নাম কি মা?
আফরা আনান। ডাক নাম আনান।
বাহ! খুব সুন্দর নাম তো? নামের মতই তুমি দেখতে। নামের অর্থ জান?
আনান লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল, জি, সাদা মেঘ।
তোমার বড় বোনের নাম কি?
আফরা রুমালী। ডাকনাম রুমালী।
এই নামও খুব সুন্দর। এটারও নিশ্চয় অর্থ জান?
জি, সাদা কবুতর।
তোমাদের দু’বোনের নাম যিনি রেখেছেন, তিনি খুব জ্ঞানী। তুমি নামায পড়
জি, না। আপনার ছেলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নামায পড়ার নিয়ম কানুন শিখছি।
আনান মুখ নিচু করে কথা বলছিল। সালমাখাতুন তার চিবুক ধরে তুলে বললেন, শহরের ধনী ঘরের শিক্ষিত মেয়েদের লজ্জা নেই বলে জানি। তোমাকে ব্যতিক্রম দেখে খুশী হয়েছি। আমাদের কাছে তোমাদের সবার কথা শুনেছি। এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? দু’চারটে কথা বলছি মন দিয়ে শোন, বিত্ত বৈভব না। থাকলে মানুষ যেমন সুখ শান্তি পায় না, তেমনি বিত্ত বৈভব আবার মানুষের দুঃখের ও অশান্তির কারণও হয়। তাই বিত্ত বৈভবে থাকার সময় ও অভাবের সময় কি করা উচিত তা প্রতিটি মানুষের জানা একান্ত কর্তব্য। সেসব জানতে হলে প্রত্যেক নর-নারীকে স্কুল কলেজে পড়ার সাথে সাথে কুরআন হাদিস পড়তে হবে। কারণ সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বল আল আমিন ইহজগতে ও পরজগতের সুখ শান্তির পথ কুরআনপাকে ও হযরত মুহাম্মদ (দঃ) হাদিসে বাতলে দিয়েছেন। আজকাল মানুষ সেসব জানছে না ও মানছে না বলে সারা দুনিয়াতে এত অশান্তি। তুমি শিক্ষিত মেয়ে। আশা করি, আমার কথা বুঝতে পেরেছ এবং তা পালন করার চেষ্টা করবে। তারপর বললেন, নামায পড়ে আমজাদ এক্ষুনি এসে পড়বে। আমি তোমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করি। পাশের রুমটা আমজাদের। তুমি ওখানে গিয়ে বস।
আমজাদ নামায পড়ে এসে দেখল, আনান চেয়ারে বসে টেবিলের উপর রাখা একটা হাদিসের বই নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছে। বলল, এতক্ষণ মায়ের বকবকানি শুনে নিশ্চয় বিরক্তি হয়েছ?
বিরক্ত হব কেন? উনি তো অনেক ভালো ভালো উপদেশ দিলেন। শুনে বরং খুশী হয়েছি।
তোমার কথা শুনে আমিও খুশী হলাম। জান, সেই ছোটবেলা থেকে এখন পর্যন্ত সময় সুযোগ পেলেই মা আমাকে উপদেশ দেন।
আমার কি মনে হচ্ছে জান? ওনার উপদেশের কারণেই তুমি ধার্মিক ও চরিত্রবান হয়েছ। উনি প্রকৃত আদর্শবতী মা। প্রতিটি ঘরে এরকম মা থাকা দরকার।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক কথা বলেছ। তাইতো মনিষিরা বেলেছেন, আদর্শবতী মা না হলে আদর্শবান ছেলেমেয়ে হয় না।
নাস্তা খাওয়ার পর আমজাদ আনানকে বলল, চল, তোমাকে পৌঁছে দিই। বিদায় নেয়ার আগে সালমা খাতুন আনানকে বললেন, আবার আসবে তো মা?
জি আসব বলে আনান ওনার সঙ্গে সালাম বিনিময় করে আমজাদের সঙ্গে বেরিয়ে এল।
.
Leave a Reply