২.
বেল টিপতে ইসমাঈল দরজা খুলল।
ইসমাঈল আমজাদের মামাত ভাই। দু’তিন বছরের ছোট। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিলেও পাশ করে নি। সেজন্য মামা তাকে জুতোপেটা করেছিলেন। তারপর পড়াশোনা ভালো লাগে নি বলে আর পড়ে নি। দরজা খুলে আমজাদকে দেখে চোখ বড় বড় করে অবাক কণ্ঠে বলল, তুমি? তারপর বড় গলায় বলল, ফুপু, দেখবে এস কে এসেছে।
আমজাদের মনে হল প্রথমে মা আসবে, তারপর মামা মামি। মামা এসেই রাগের সঙ্গে বলবেন, যে ছেলে ঢাকায় গিয়ে মায়ের খবর রাখে না, সেরকম ভাগ্নার সঙ্গে তিনি আর সম্পর্ক রাখতে চান না।
মায়ের আগে মামা এলেন। আরে আমজাদ যে, এস এস। কোনো খবর না দিয়ে এলে যে? অবশ্য নিজের বাড়িতে খবর দেয়ার দরকার কী। খালি হাত দেখছি, জিনিস পত্র কিছু নিয়ে আস নি?
মামা তাকে তুই তোকারি করে বলে। আজ তুমি করে বলছে শুনে আমজাদ বেশ অবাক হল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে বলল, হঠাৎ আসতে হল। আজ রাতের বাসে চলে যাব।
পাগল ছেলের কথা শোনো। বললেই হল আজ রাতেই চলে যাব? কি এমন। রাজ কাজ কর ঢাকায়?
আমি চাকরি করি মামা।
পরীক্ষার পর মামা চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, যা কিছু টাকা পয়সা তার বাবা রেখে মারা গিয়েছিল, তার পড়াশোনার পেছনে সব খরচ হয়ে গেছে। তার মা আর টাকা পয়সা পাঠাতে পারবে না। সে যেন রুজী-রোজগারের চেষ্টা করে।
তাই এখন ভাগ্নাকে বললেন, পরীক্ষার পর যখন এলে না তখন রাগের মাথায় কি না কি চিঠিতে লিখেছিলাম, আর তুমি কিনা সম্পর্ক ত্যাগ করে চাকরিতে লেগে গেলে? অবশ্য চাকরি করছ ভালো কথা। তাই বলে এতদিন পরে এসেই চলে যাবে তা হচ্ছে না। অন্তত দু’চার দিন থাক, তারপর না হয় যাবে। আচ্ছা, তুমি কি রকম ছেলে? আমাদের কথা না হয় বাদই দিলাম, বুবুর কথা চিন্তা করতো। তুমি তার একমাত্র সন্তান। তোমার মুখের দিকে চেয়ে, তোমার ভালো মন্দ চিন্তা করে আর বিয়ে করল না। তোমাকে ধার্মিক করে মানুষ করল। আর তুমি কি না তার মনে কষ্ট দিচ্ছ। এটাই কি ধার্মিক ছেলের পরিচয়?
নিজের কানকে আমজাদ বিশ্বাস করতে পারল না। আগের মামা আর এখনকার মামা কি এক? বয়স হলে মানুষ নাকি বদলে যায় শুনেছি। এত বেশি বদলায়?
পাশের রুমে মামির গলা শোনা গেল, কে এসেছে গো? মামা কিছু বলার আগে কাছে এসে বললেন, ওমা আমজাদ, তুইএ ঘরে কেন? ভিতরে আয়।
এ ঘরটা ড্রইংরুম। আগে এখানেই আমজাদ ও ইসমাঈল দুটো আলাদা চেয়ার টেবিলে পড়ত। আর একটা চৌকিতে ঘুমাত। আজ এখানে সোফাসেট ও অন্যান্য আসবাবপত্র দেখে আমজাদ খুব অবাক হয়ে ভাবল, এতসব হল কি করে?
এমন সময় মাকে ঢুকতে দেখে সালাম দিয়ে এগিয়ে এসে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছ মা?
সালমা খাতুন সালামের উত্তর দিয়ে দোয়া করে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, আল্লাহ্ যেমন রেখেছেন তেমনি আছি। মামা-মামিকে কদমবুসি করেছিস?
পেছন থেকে মামি বলে উঠলেন, বাড়ির সবার বড়কে আগে কদমবুসি করতে হয়।
সালমা খাতুন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোকে তো আমি সেরকম শিক্ষা দিয়ে মানুষ করি নি।
মামা-মামিকে কদমবুসি করার পর সবাই ভিতরের রুমে এল।
বসার পর আমজাদ মাকে বলল, অনেকদিন তোমার চিঠি পাই নি।
সালমা খাতুন বললেন, চিঠি দিয়ে ঠিকানা জানিয়েছিস? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুই যেন নিয়মিত আমাকে চিঠি দিস।
মামি বললেন, বুবু, এখন ওসব কথা থাক। আমজাদ মুখ হাত ধুয়ে চা নাস্তা খাক। তারপর যা বলার বলবেন। আমজাদ তুই ঐ রুমে যা। ওটা ইসমাঈলের রুম। রুমের সঙ্গে বাথরুম আছে। হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি নাস্তা নিয়ে আসি।
ইসমাঈল আগেই বাইরে চলে গেছে। মামি চলে যাওয়ার পর মামাও চলে গেলেন।
সালমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, তোর জিনিসপত্র নিয়ে আসিস নি?
না। সঙ্গে কিছু নিয়ে আসি নি।
ও, তা হলে আজই ফিরে যাবি?
হ্যাঁ।
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ঠিক আছে বলে সালমা খাতুন চলে গেলেন।
আমজাদ ইসমাঈলের রুমে ঢুকে চেয়ারে বসল। আসবাবপত্র দেখে আরো অবাক হল। নতুন খাটে জাজিম ও তোষকের উপর দামি চাদর, চব্বিশ ইঞ্চি রঙিন টিভি। তারপাশে সিডি ও রয়েছে। আর আলনায় দামি প্যান্ট শার্ট হ্যাঁঙ্গারে ঝুলছে।
এমন সময় ইসমাঈল রুমে এসে বলল, সঙ্গে যখন কিছুই আন নি তখন আমরটাই পর বলে আলনা থেকে একটা লুঙ্গি এগিয়ে দিল। আমজাদ প্যান্ট ছেড়ে লুংগি পরে বাথরুমে ঢুকল। বাথরুমও উন্নত। আয়না ফিট করা, কত রকমের দামি শ্যাম্পু ও সাবান। ভাবল, ইসমাইল তা হলে ভালোই রোজগার করছে। সাবান মেখে গোসল করে বেরিয়ে দেখল, মামি টেবিলের উপর নাস্তা রেখে গেছেন। খেতে বসে ইসমাঈলকে বলল, তুইও খা।
আমি একটু আগে খেয়েছি, তুমি খাও। তারপর পকেট থেকে গোন্ডলীফের প্যাকেট বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, এতদিন ঢাকায় রয়েছ, নিশ্চয় স্মোক কর?
না, এ রকম বাজে নেশা আমি করি নি।
ও, তুমিতো আবার হুজুর মানুষ।
তুই কি করছিস?
ব্যবসা।
ব্যবসা? টাকা পেলি কোথায়?
ইসমাঈল তার কথার উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে রিং তৈরী করে ধোয়া ছাড়তে লাগল।
ইসমাঈল আগে বাড়ির বাইরে লুকিয়ে সিগারেট খেত। এখন তাকে ঘরে সিগারেট খেতে দেখে অবিশ্বাস্য মনে হল। আমজাদ বলল, টাকা কোথায় পেলি বললি না যে?
ব্যবসা দু’রকমের হয়। কোনো প্রডাকশনে অথবা ডিস্ট্রিবিউশনে নামলে অনেক টাকার ক্যাপিটাল লাগে। আর টাকা ছাড়াও ব্যবসা করা যায়, যদি একটা গ্যাং তৈরি করা যায়।
গ্যাং তৈরি করে ব্যবসা, সে আবার কি ব্যবসা?
এইধর, এখানকার মাল অন্য জায়গায় আবার অন্য জায়গার মাল এখানে। যাকে বলে আমদানি রপ্তানী।
তোর কথা ঠিক বুঝলাম না।
বোঝার দরকার নেই। তা ছাড়া তোমার মাথায় ঢুকবেও না।
কী রকম আয় হয়?
এত কথা জানতে চাচ্ছ কেন? কোনো মাসে দশ, কোনো মাসে বিশ আবার বাজার খারাপ থাকলে কিছুই হয় না।
তোর মতো মামা মামিকেও যেন অন্য রকম দেখলাম। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।
রূপোর ঝনঝনানী। মানে টাকা হলে সবাই পাল্টে যায়। আমি এখন বেরোব। কথা বলতে বলতে ড্রেস চেঞ্জ করেছে। তুমি রাতে থাকলে দেখা হবে বলে ইসমাঈল বেরিয়ে গেল।
একটু পরে সালমা খাতুন চা নিয়ে এসে ছেলের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই কি চাকরি করছিস?
একটা প্রেসে সামান্য বেতনের চাকির করছি।
থাকিস কোথায়?
একজনের অফিসে রাতে থাকি?
ঘর ভাড়া করে আমাকে নিয়ে যাওয়া কি তোর পক্ষে সম্ভব হবে?
কেন? এখানে কি তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে?
তুই কি কিছুই বুঝতে পারিস নি? ইসমাঈল অসৎ পথে টাকা রোজগার করছে। তোর মামা মামি ছেলেকে বাধা দেয় নি। বরং ঐ অসৎ রোজগারের টাকা পেয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত। এখানে এক দণ্ড থাকতে ইচ্ছা করছে না। তোর বাবা যা রেখে গিয়েছিল, সব তোর পেছনে খরচ করে এত লেখাপড়া করালাম। এখন তোর কাছ থেকে কি কিছুই আশা করতি পারি না?
নিশ্চয় পার মা। খুব চেষ্টা করছি। প্রেসে চাকরি করে যে টাকা পাই তাতে কোনো রকমে আমার চলে। তাই মেস ভাড়া নিতে না পেরে রাতে একজনের অফিসে থাকি। এ মাসে একটা ভালো বেতনের টিউসনি পেয়েছি। সামনের মাসে টিউসনির টাকা পেলে একরুম ভাড়া নিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে পারব ইনশাআল্লাহ্।
তা হঠাৎ এলি কেন?
চিঠি নিতে।
কী চিঠি?
কেন? আমার নামে কোনো চিঠি আসে নি?
তো। আমজাদ অবাক হয়ে বলল, সে কী? ঢাকা থেকে রিডাইরেক্ট করা কোনো চিঠি আসে নি?
না। এলে নিশ্চয় তোর মামা মামি আমাকে জানাত।
তা কী করে হয়? আগে আমি যে হোষ্টেলে থাকতাম, সেখানকার লোক বলল, চিঠিটা এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। জান মা, আমিও আমার এক বন্ধু একটা ভালো চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। বন্ধুটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে আমারও অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ওখান থেকেই এসেছে।
এমন সময় আমজাদের মামি সাজেদা বেগম এসে বললেন, মা-বেটায় কি এত কথা হচ্ছে?
সালমা খাতুন ছেলের চিঠির কথা বললেন।
সাজেদা বেগম বললেন, আমরা তো কোনো চিঠি পাই নি।
আমজাদ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি নিশ্চিত চিঠি এসেছে।
সাজেদা বেগম রুষ্টস্বরে বললেন, তোর কি মনে হচ্ছে, মিথ্যে কথা বলছি? তারপর স্বামীকে আসতে দেখে বললেন, তোমার ভাগ্নার কথা শোনো।
জহির উদ্দিন বললেন ভাগ্নের চাকরি হয়েছে বুঝি?
চাকরি না ছাই? ওর কি একটা চিঠি নাকি এখানে এসেছে। সেটা নিতে এসেছে। আমি তো জানি আসে নি, তুমি পেয়েছ?
জহির উদ্দিন মাথা নেড়ে বললেন, না, পাই নি?
আমজাদ মুখ নিচু করে চিন্তা করতে লাগল, চিঠিটা গেল কোথায়? মহিমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার এসেছে শুনে তারও নিশ্চয় এসেছে মনে করে মনের মধ্যে যে আশা ও আনন্দ হয়েছিল, তা নিভে গেল।
জহির উদ্দিন জিজ্ঞেস করলেন, কি চিঠি আসার কথা ছিল?
চাকরির।
তাই নাকী? তা তুমি পোষ্ট অফিসে খোঁজ নিতে পার বলে জহির উদ্দিন সেখান থেকে চলে গেলেন।
সাজেদা বেগম বললেন, অনেক সময় পোষ্ট অফিসেই গোলমাল হয়। সেখানে খোঁজ করতে পার।
সালমা খাতুন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তাই না হয় একবার পোষ্ট অফিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আয়।
আমজাদ যখন পোষ্ট অফিসে গেল তখন দুপুর বারোটা। কোনো পিয়নকে পাওয়া গেল না। সবাই চিঠি বিলি করতে বেরিয়ে গেছে, বিকেলে ফিরবে। এতক্ষণ অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না ভেবে ফিরে এল।
সালমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, কিরে কোনো খোঁজ পেলি?
না পিয়নরা কেউ নেই, বিকেলে আবার যাব।
বিকেলে যাওয়ার পথে পিওন সাগিরের সঙ্গে দেখা । সাগিরের বয়স চল্লিশের উপর এই এলাকায় প্রায় সবাইকে চেনে। সালাম বিনিময় করে আমজাদ জিজ্ঞেস করল, আমার নামে বড় খামে কেননা চিঠি আসে নি?
সাগির চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, কই, নাতো? এলে নিশ্চয় । তোমার মামার কাছে ডেলিভারী দিতাম।
কিন্তু বিশ্বাস করুন ঢাকা থেকে মামার ঠিকানায় পাঠান হয়েছিল।
কতদিন আসে বলুন তো?
কয়েকদিন আগে।
ঠিক আছে, আসুন আমার সঙ্গে। পোষ্ট অফিসে পৌঁছে আমজাদকে একটা টুল দেখিয়ে বলল, বসুন। তারপর অনেক খোঁজাখুজি করে ফিরে এসে বলল, না। পাওয়া গেল না। আমজাদের মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ফেরার সময় চিন্তা করল, আজ রাতেই ফিরে যাবে।
ছেলেকে মন খারাপ করে ফিরতে দেখে সালমা খাতুন বললেন, মনে হচ্ছে চিঠি পাস নি? মন খারাপ করছিস কেন? সবর করে আল্লাহর কাছে মনের বাসনা জানা। তিনি কুলমাখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর ইশারাতেই সবকিছু চলছে। যা কিছু চাওয়ার তার কাছে কায়মনোবাক্যে চাইবি। তিনি অসীম দয়ালু। কোনো বান্দা কায়মনোবাক্যে কিছু চাইলে না দিয়ে থাকতে পারেন না। কখনো কোনো ব্যাপারেই তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হবি না। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি আজই চলে যাবি?
হা মা। মনে করেছিলাম, চাকরিটা পেলে টিউসনিটা করব না। তা যখন হল না তখন টিউসনিটা করতেই হবে। আজ থেকে পড়াতে যাওয়ার কথা। কাল ঢাকায় পৌচ্ছে পড়াতে যাব। আজ যদি থেকে যাই, তা হলে দু’দিন কামাই হবে। পড়াতে যাওয়ার কথা বলে যদি প্রথমেই দু’দিন না যাই, তা হলে ছাত্র ও তার মা বাবা কি মনে করবে?
তা হলে তোকে আর থাকার কথা বলব না। তোর কাছে আমার একটাই দাবি, তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস এখান থেকে আমাকে নিয়ে যাবি।
তুমি দোয়া কর মা, আল্লাহ্ যেন তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। জান মা, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে তিনশটাকা ধার নিয়ে এসেছি। ভেবেছি মামার কাছে শপাঁচেক টাকা চাইব।
না, চাইবি না। ইসমাঈল চোরা কারবার করে। ঐ টাকা তোকে নিতে দেব না। আমি তোর যাওয়ার গাড়ি ভাড়া দেব।
পরের দিন সকালে বাস থেকে নেমে আমজাদ সোজা মধুবাগে ছাত্রীকে পড়াতে এল।
বিথী জিজ্ঞেস করল, কাল এলেন না কেন?
বিশেষ কাজে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
আপনাদের গ্রামের বাড়ি কোথায়?
সাতক্ষীরা।
ওমা, সেতো অনেক দূর। একদিনের মধ্যে গেলেন এলেন কী করে?
পরশু রাতের গাড়িতে গেছি, কাল রাতের গাড়িতে ফিরে এসেছি। এখন ওসব কথা রেখে বই খাতা বের কর।
বিথী বই খাতা বের করে বলল, আমরা তো মনে করেছি, আপনার কোনো অসুখ বিসুখ হয়েছে।
আমজাদ তার কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, গণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতিঃ এর মধ্যে কোনটা তোমার কাছে কঠিন লাগে?
গণিত।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পড়াবার পর চলে যাওয়ার জন্য যখন আমজাদ উঠে দাঁড়াল তখন স্বাতি এসে বললেন, আসুন আমার সঙ্গে। তারপর ডাইনিংরুমে নিয়ে এসে বাথরুমের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, যান, হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
আমজাদ টেবিলের উপর প্লেটে পরোটা, ডিম ও সবজি ভাজা দেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
কি হল? আমার কথা শুনতে পান নি?
আমজাদের তখন মায়ের কথা মনে পড়ল, খাবার নিয়ে এসে বলবে, যা, হাত মুখ ধুয়ে এগুলো খেয়ে ফেল।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে স্বাতি বললেন, এসব আমি তেলে ভেজিছি। শুনুন, রজত বলেছে, আপনি প্রতিদিন এখানে নাস্তা খেয়ে যাবেন।
আমজাদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে স্বাতি বললেন, আপনার কোনো অজুহাত শুনব বা। গণি ভাই আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন। দ্বিধা বা লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। না খেলে বরং আমরা কষ্ট পাব।
অগত্যা আমজাদ হাতমুখ ধুয়ে এসে খেতে শুরু করল।
আপনি খান আমি চা নিয়ে আসি বলে স্বাতি চলে গেলেন।
আমজাদের প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছিল লজ্জা পেলেও চারটে পরোটা ও ডিম সজি সব খেয়ে ফেলল। বেসিনে হাত মুখ ধুয়ে এসে তিন গ্লাস পানি খেল।
স্বাতি দুকাপ লেবু চা নিয়ে এসে একটা আমজাদের হাতে দিয়ে একটা চেয়ারে বসলেন। তারপর নিজের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, কাল আপনার জন্য নাস্তা তৈরী করেছিলাম, এলেন না কেন?
বিথীকে যে কথা আমজাদ বলেছিল, তার মাকেও তাই বলল।
গণি ভাই কাল রাতে এসেছিলেন। বললেন, আপনি অফিসে যান নি। বেশ চিন্তিত দেখলাম। ওনাকে জানিয়ে গেলেন না কেন?
হঠাৎ যেতে হয়েছিল, তাই জানিয়ে যেতে পারি নি। রজতদা বাসায় নেই?
ও কাল ঢাকার বাইরে গেছে।
এবার আসি বলে আমজাদ খালি চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বিদায় নিয়ে চলে এল।
রাস্তায় এসে খুব ক্লান্তি বোধ করল। ভাবল, টানা তিন চার ঘণ্টা ঘুমাতে পারলে খুব ভালো হত। কিন্তু ঘুমাবে কোথায়?
কাওরান বাজার থেকে অত সকালে পড়াতে আসা খুব অসুবিধে। তাই ছাত্রীর বাসার কাছাকাছি মেসে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।
আসার সময় সালমা খাতুন ছেলের হাতে এক হাজার টাকা দিয়েছিলেন। সে কথা মনে পড়াতে ভাবল, মধুবাগে আপাতত একটা মেসে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। দু’তিন মাস পরে না হয় একরুমের ফ্যামিলী বাসা ভাড়া নিয়ে মাকে নিয়ে আসা যাবে। এই ভেবে মধুবাগ গিয়ে মেসে সীট খুঁজতে লাগল। ভাগ্যক্রমে একটা মেসে সীট পেয়েও গেল। মাসে পাঁচশ টাকা ভাড়া আর বুয়া রান্না করে দিলে পঁচাত্তর টাকা। মায়ের দেয়া টাকা থেকে পাঁচশ টাকা মেস ভাড়া আর বাকি টাকা থেকে তিনশ টাকা ফারযানার ধারশোধ করবে ভেবে মেসের একমাসের অগ্রিম ভাড়া পাঁচশ দিয়ে সীট বুক করে বলল, কাল সকাল সাতটায় আসবে।
বিকেলে অফিসে এসে গণি ভাইকে ফোন করল।
গণি ভাই বললেন, কী খবর আমজাদ? কাল কোথায় ছিলে?
আমজাদ গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলল।
একটা ফোন করে যাওয়া উচিত ছিল।
যাওয়ার কোন ঠিক ছিল না, হঠাৎ গিয়েছিলাম। তখন আর ফোন করার সময় ছিল না।
তোমার বাড়ির খবর সব ভালো?
হ্যাঁ ভালো। গণি ভাই, অত দূর থেকে এসে সকালে টিউশনী করতে খুব অসুবিধে। তাই মধুবাগ মেসে সিট নিয়েছি।
ভালই করেছ। এবার রাখছি বলে গণি ভাই ফোন ছেড়ে দিলেন।
পরেরদিন টিউশনী পড়িয়ে আমজাদ মহিমের বাসায় খোঁজ নিয়ে জানল, আজ সকালের ট্রেনে রাজশাহী চলে গেছে। কমলাপুর থেকে রাজশাহীর ট্রেন ছাড়ে আটটা চল্লিশে। ঘড়ি দেখল দশটা। এখন আর স্টেশনে গিয়ে কাজ হবে না। ফারহানাও তার সাথে গেল কিনা জানার জন্য তাদের বাসায় যাওয়ার মনস্থ করেও গেল না। কারণ তাদের বাসা চেনে না।
Leave a Reply