০৭. শিল্পবাণিজ্য

সপ্তম অধ্যায় – শিল্পবাণিজ্য

এই গ্রন্থে আমাদের আলোচ্য বিষয় মূলত নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহরের ইতিহাস হলেও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের শিল্প বাণিজ্যের কথা স্বভাবতই এসে পড়ে কারণ নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের যে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি দেখা গেছে তার একটি প্রধান কারণ মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের শিল্পবাণিজ্যে বিরাট অগ্রগতি— যা এর আগে বা পরে কখনও দেখা যায়নি। এই শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বড় বড় সব ব্যবসায়ী, সওদাগর, মহাজন, প্রভৃতি মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারেই তাদের আস্তানা করেছিল এবং সেখান থেকেই তারা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করত। এসব ব্যবসায়ী, সওদাগরদের মধ্যে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের লোক তো ছিলই, এমনকী ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিও এখানে তাদের কুঠি তৈরি করেছিল। এরা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের প্রধান দু’টি শিল্পবাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিল— এ দু’টি হল, কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র।

কাঁচা রেশম(Raw Silk)

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বিভিন্ন এশীয়/ভারতীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও ইউরোপীয় কোম্পানিরা বাংলা থেকে যে-সব পণ্য রফতানি করত, তার অন্যতম প্রধান ছিল কাঁচা রেশম। পণ্য রফতানির মোট যে মূল্য, সেদিক থেকে বস্ত্র রফতানির পরেই রেশমের স্থান। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বহু দিন ধরেই বাংলা থেকে রেশম রফতানি করছিল, ইউরোপীয়রা এ ব্যবসা শুরু করে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। তার আগে ইংরেজ ও ডাচরা পারস্যদেশ ও চিন থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করত। কিন্তু যখন তারা দেখল যে বাংলা থেকে রেশম রফতানি করতে পারলে অনেক লাভজনক হবে, তখন তারা এদিকে নজর দিল। ইংরেজ কোম্পানি ১৬৫৮ সালে কাশিমবাজারে কুঠি স্থাপন করে বাংলা থেকে ইউরোপে রেশম রফতানি করার ওপর জোর দিল। ১৬৭০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ইংরেজদের রেশম বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে এবং মাঝেমধ্যে কিছুটা ওঠানামা করলেও এ বাণিজ্য ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এই দশকেই সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছয়। তার পরের দুই দশকে— ১৭৪০ ও ১৭৫০— অবশ্য তাতে ভাঁটা পড়ে যায়। ডাচ কোম্পানিও সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে রেশম রফতানি শুরু করে। তবে ইংরেজদের সঙ্গে তফাত, ডাচরা বাংলার রেশম শুধু ইউরোপে নয়, জাপানেও তারা তা রফতানি করত। বস্তুতপক্ষে জাপানে রেশম রফতানি তাদের আন্তঃএশীয় বাণিজ্যের একটি প্রধান অঙ্গ ছিল। ১৬৭০-র দশক পর্যন্ত ডাচরা হল্যান্ডে বেশির ভাগ পারস্যদেশের রেশমই রফতানি করত, আর বাংলা ও চিনদেশের রেশম প্রধানত জাপানে। কিন্তু ওই শতকের শেষ দুই দশকে এই প্যাটার্ন সম্পূর্ণ পালটে যায়। একদিকে জাপানের বাণিজ্যে এ সময় ভাটা পড়ে এবং অন্যদিকে বাংলার রেশম চিন বা পারস্যদেশের রেশমের চাইতে একটু নিম্নমানের হলেও, অনেক সস্তা তাই তারা এখন শুধু বাংলার রেশম হল্যান্ডে রফতানি করতে শুরু করল।

ইউরোপের রেশমশিল্পে সাধারণত ইতালির রেশমই ব্যবহার করা হত। কিন্তু ওই রেশমের মূল্য ছিল অত্যধিক। কিন্তু যখন দেখা গেল যে বাংলার রেশম ইতালির রেশমের বদলে ইউরোপের রেশমশিল্পে সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে এবং তাতে খরচ অনেক কম পড়বে, তখন ইউরোপে বাংলার রেশমের চাহিদা বেশ বেড়ে গেল এবং কোম্পানিগুলিও বাংলা থেকে রেশম রফতানি করে প্রচুর মুনাফা করতে লাগল। দু’-একটি উদাহরণ থেকে এই লাভের পরিমাণ আন্দাজ করা যেতে পারে। ১৬৫৩-৫৪ সালে ডাচরা বাংলা থেকে রেশম রফতানি করে শতকরা প্রায় দু’শো শতাংশ লাভ করে। ইংরেজ কোম্পানির ক্ষেত্রেও লাভের পরিমাণ ছিল ওরকমই। ১৬৯৫-৯৬ সালে মার্থা নামের জাহাজ বাংলা থেকে যে রেশম ইংল্যান্ডে রফতানি করে, তাতে কোম্পানির মোট মুনাফা হয় শতকরা আড়াইশো ভাগ। তবে এই লাভের পরিমাণ সব সময় এক রকম হত না, কখনও বেশি, কখনও কম হত। সে জন্য অন্যান্য দেশের রেশমের তুলনায় কিছুটা নিম্নমানের হলেও, বাংলার রেশমের ইউরোপে বেশ চাহিদা ছিল। এ প্রসঙ্গে ফরাসি পর্যটক বার্ণিয়ে’র মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে:

The (Bengal) silks are not certainly so fine as those of Persia, Syria, Sayd and Barut, but they are of a much lower price; and I know from indisputable authority that, if they were well selected and wrought with care, they might be manufactured into most beautiful stuffs.

এখানে বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, শুধু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি নয়, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সওদাগর ব্যবসায়ীরা বাংলার রেশমের উৎপাদন কেন্দ্র ও বাজারগুলিতে ভিড় জমাত। বস্তুত কোম্পানিগুলি ভারতবর্ষে আসার অনেক আগে থেকেই এসব ব্যবসায়ীরা বাংলা থেকে স্থলপথে ভারতবর্ষের ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে রেশম রফতানি করত। এদের মধ্যে গুজরাটিরাই ছিল সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গোষ্ঠী। তা ছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে ছিল মধ্য এশিয়া, মুলতান, লাহোর, আগ্রা, বেনারস, হায়দরাবাদ, গোরখপুর প্রভৃতি অঞ্চলের সওদাগর গোষ্ঠী। এরা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণ রেশম রফতানি করেছে, পলাশির আগে পর্যন্ত বাংলার রেশমের বাজারে এদেরই অনেক বেশি প্রাধান্য ছিল, ইউরোপীয়দের নয়। পলাশির পরে চিত্রটা সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে এশীয়/ভারতীয় বণিকরা বাংলার রেশমের বাজার থেকে প্রায় উৎখাত হয়ে যায়। তাদের রেশম রফতানির পরিমাণও প্রায় তলানিতে এসে ঠেকে।

রেশমের উৎপাদন ও রেশমশিল্পের সংগঠন

এ বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে বাংলায় রেশম উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল। ১৬৭৬ সালে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির অধ্যক্ষ স্ট্রেনশ্যাম মাস্টার (Streynsham Master) লিখেছেন যে ওই অঞ্চলের প্রায় পুরোটাতেই তুঁত গাছের চাষ হত। এই তুঁতের পাতাই রেশম পোকার প্রধান খাদ্য। তুঁত গাছের চাষই ছিল তখন মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের সবচেয়ে পরিচিত চিত্র। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক জীবনে রেশমের উৎপাদন ও বাণিজ্য যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বোঝা যায় এখানকার একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্যে— ‘তুঁতের চাষ নিজের পুত্রসন্তানের চাইতেও অনেক বেশি সম্পদ ও সুখের আকর’। বলা বাহুল্য, রেশম উৎপাদন, রেশমশিল্পের সংগঠন ও বাণিজ্য এ অঞ্চলের বহু মানুষেরই রুজি রোজগারের উপায় করে দিয়েছিল। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন যে অন্য কিছু কিছু অঞ্চলেও, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের রংপুরে, নদীয়ার কুমারখালি ইত্যাদি জায়গায় রেশমের উৎপাদন হত। তবে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলই ছিল রেশমের সর্বপ্রধান উৎপাদন কেন্দ্র। শুধু তাই নয়, গুণগত মানের দিক থেকেও ওই অঞ্চলের রেশমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট।

রেশমের মোট বার্ষিক উৎপাদন সম্বন্ধে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া দুষ্কর। ফরাসি পর্যটক টাভার্নিয়ে জানিয়েছেন যে ১৬৬০ ও ১৬৭০-এর দশকে বাংলার রেশম উৎপাদনের মোট পরিমাণ ছিল ২২,০০০ গাঁট, প্রত্যেক গাঁটরিতে ১০০ পাউন্ড করে রেশম। এ পরিসংখ্যান নিয়ে অবশ্য ইদানীং সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ টাভার্নিয়ে বলছেন, এ সময় ডাচরা বাংলা থেকে বছরে ৬০০০-৭০০০ গাঁটরি রেশম রফতানি করত। তা ঠিক নয়। আসলে তারা বছরে এর চেয়ে অনেক কম পরিমাণ রেশম রফতানি করেছে। ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে এটা সুস্পষ্ট। কিন্তু আমরা যদি বাংলা থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রেশম রফতানির হিসেব দেখি, তা হলে টাভার্নিয়ের দেওয়া বাংলায় রেশম উৎপাদনের পরিমাণে কিছুটা অত্যুক্তি থাকলেও তা সম্পূর্ণ অবাস্তব নয়। ১৭৫১ সালে যখন মারাঠা আক্রমণে বাংলার রেশমশিল্পের উৎপাদন বেশ কিছুটা ব্যাহত হয়, তখনও এশীয়/ভারতীয় বণিকদের বাংলা থেকে রেশম রফতানির পরিমাণ ছিল ২৪,০০০ মণের মতো।১০ সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে মধ্য-অষ্টাদশ শতকেও বাংলায়, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে, বিপুল পরিমাণ রেশমের উৎপাদন হত।

রেশম শিল্পকে দু’ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—কাঁচা রেশমের উৎপাদনের জন্য তুঁতের চাষ এবং তারপর রেশম তৈরির প্রণালী। তাই এ শিল্প আংশিক কৃষিভিত্তিক, আংশিকভাবে পারিবারিক কুটিরশিল্প। কৃষকরা অন্যান্য শস্যের সঙ্গে তুঁতের চাষও করত। এই তুঁতগাছের গাছের পাতা খাইয়ে চাষির বাড়িতে গুটিপোকার লালনপালন করা হত। সাধারণত চাষিবাড়ির পুরুষরা মাঠে তুঁতগাছের চাষ করত আর বাড়ির মেয়েরা রেশম গুটিপোকার লালনপালন করত। এ গুটিপোকার লালনপালনের জন্য আলাদা ও বিশেষ রকমের ঘর তৈরি করতে হত। এরকম ঘরের দৈর্ঘ্য হত ২৪ ফুট, প্রস্থ ১০ ফুট, উচ্চতা ৯ ফুট, এবং তাতে ৩ ফুট উঁচু একটি মাচা থাকত। মাটির মোটা দেয়াল করতে হত আর দেয়ালের ওপরের দিকে দুটো জানলা, খড়ের পুরু ছাদ। ওরকম ঘরে ২০০ কাহন বা মোট ২,৫৬,০০০ গুটিপোকা গোবর দিয়ে ভাল করে লেপা ডালাতে করে মাচার ওপরে রাখা যেত। পোকামাকড় যাতে ডালায় আসতে না পারে তার জন্য মাটির রেকাবিতে জল দিয়ে তাঁর ওপর বাঁশের খুঁটির ওপর মাচাটা রাখা হত। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে দরকার হত সুতো কাটার জন্য মাদুর, ছুরি, তুঁতের পাতা নিয়ে আসার জন্য ঝুড়ি, গুটিপোকা রোদে দেওয়ার জন্য কয়েকটি চটের ব্যাগ আর মাটির রেকাবিগুলি মাঝেমাঝেই জলভরতি করে রাখার জন্য কয়েকটি কলসি। এই সবগুলি জিনিস করতে উনবিংশ শতকের প্রথমদিকে খরচ পড়ত ৫০ থেকে ৬০ টাকার মতো।১১ মধ্য অষ্টাদশ শতকে মনে হয় আরও কম খরচে সবটাই হয়ে যেত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে রেশম উৎপাদন সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে, তাঁর আগে নয়। তবে অষ্টাদশ শতকের ক্ষেত্রেও এসব তথ্য প্রযোজ্য কারণ তাঁর মধ্যে উৎপাদন পদ্ধতিতে বিশেষ হেরফের হয়নি। উৎপাদনের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে গুটিগুলিকে দিনে দু’বার তুতের পাতা খেতে দিতে হত এবং পরের দু’পর্যায়ে ৬ বা ৮ ঘণ্টা অন্তর এটা করতে হত। গুটিপোকা থেকে যখন রেশমের সুতো কাটার সময় হত তখন ‘they turn from a greenish-cream to a mellow light orange colour… with a transparent streak down the back, passing, as it is observed, the emission from tail to head, which forms the silk’.১২ তারপর গুটি পোকাগুলিকে মাদুরে রেখে রোদে ও হাওয়ায় দেওয়া হয় আর রাত্রে ঢাকা দিয়ে রাখা হত। গুটিপোকাগুলি প্রায় ৫৬ ঘণ্টা ধরে রেশমের সুতো বার করতে থাকত। চার পাঁচদিন পর পোকাগুলি তাঁর থেকে কাটিম দিয়ে সুতো বার করার জন্য উপযোগী হত। তখন গৃহস্থ চাষি সেগুলিকে পাইকার বা অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিত কিংবা নিজের বাড়িতে পোকাগুলি সেদ্ধ করে রেশমের সুতো তৈরি করত।১৩

রেশমসুতোর কাটনিরা গুটিপোকা থেকে যে সুতো তৈরি করত তার নাম পাটানি (pattaney) বা পাটনি (putney)। এতে মিহি এবং মোটা দু’রকমের সুতোই মেশানো থাকত। সুতো কাটার ব্যাপারে মেয়েরাই অগ্রবর্তী ভূমিকা নিত এবং এ ব্যাপারে তাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। ১৭৫০-র দশকে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেছেন যে:১৪

The women wind off raw silk from the pod of the worm. A single pod of raw silk is divided into twenty different degrecs of fineness, and so exquisite is the feeling of these women, that whilst thread is running through their fingers so swiftly that their eyes can be of no assistance, they will break it off exactly as the assortments change, at once from the first to the twentieth, from nineteenth to the second.

১৮০৭ সাল নাগাদ বুকাননও (Buchanan) রেশমের সুতো কাটার ব্যাপারে মেয়েদের দক্ষতা ও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন।১৫

রেশমের বাজার

অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে, বাংলার রেশমের বাজারে ক্রেতাদের মধ্যে প্রচণ্ড রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলত। এর কারণ, শুধু ভারতবর্ষ নয়, এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে ব্যবসায়ীরা রেশম কিনতে বাংলায়, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আসত। তা ছাড়াও ক্রেতাদের মধ্যে ছিল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, ভারতীয়/এশীয় ব্যবসায়ীরাই বাংলার রেশমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত, ইউরোপীয়রা নয়। আবার দেশীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে গুজরাটিরাই ছিল সবচেয়ে বড় ক্রেতা। উৎকৃষ্ট মানের রেশম হলে দামের তোয়াক্কা না করেই তারা সেই রেশম কিনে নিত। বাংলার রেশমের বাজারে তাদের এমনই প্রভাব এবং প্রতিপত্তি ছিল যে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের সর্বোৎকৃষ্ট এবং সবচেয়ে দামি যে রেশম তাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘গুজরাটি সিল্ক’।১৬ উত্তর ভারতের অর্থনীতির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের সিল্কের বাজার। এটা ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারী জন কেনের (John Kenn) লেখা থেকে স্পষ্ট। ১৬৬১ সালে তিনি জানাচ্ছেন:১৭

According as this silk sells in Agra, so the price of silk in Kasimbazar riseth and falleth. The exchange of money from Kasimbazar to Patna and Agra riseth and falleth as the said silk findeth a vent in Patna and Agra.

মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের কাঁচা রেশমের বাজারে এশীয়/ভারতীয় ব্যবসায়ীদের এমনই দাপট ছিল যে অনেকটা তাদের কেনাকাটার ওপরেই বাজারে দাম ওঠানামা করত, ইউরোপীয়রা এ বাজারে প্রায় নীরব দর্শক হয়েই থাকত। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৭৩৩ সালে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি জানায় যে কাঁচা রেশমের দাম নির্ভর করছে বাজারের এশীয়/ভারতীয়দের চাহিদা অনুযায়ী, এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা তাদের ক্ষমতায় কুলোবে না। এটা সম্পূর্ণ তাদের আয়ত্তের বাইরে।১৮ এর এগারো বছর পরেও (১৭৪৪) অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। কোম্পানির কাশিমবাজার কাউন্সিল কলকাতায় লিখছে যে কাঁচা রেশমের দাম অনেক বেড়ে গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ অসহায় কারণ কাঁচা রেশমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা তাদের ক্ষমতার বাইরে।১৯ অবশ্য এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে বাজারে কাঁচা রেশমের দাম এশীয়/ভারতীয় সওদাগরদের চাহিদা ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণে ওঠানামা করত। যেমন প্রাকৃতিক কারণ। বেশি বৃষ্টিতে বা খরার জন্য রেশমের উৎপাদন অনেকটা ব্যাহত হত এবং তাতে বাজারে কাঁচা রেশমের দামও বেড়ে যেত। তা ছাড়া মারাঠা আক্রমণের জন্যও (১৭৪২-৫১) রেশম উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোম্পানির নথিপত্রে তাঁর প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়। তবে ঐতিহাসিকরা মারাঠা আক্রমণের নেতিবাচক ফলাফলের ওপর বড় বেশি জোর দিয়েছেন বলে মনে হয়।২০ যদিও এটা অস্বীকার করা যায় না যে মারাঠা আক্রমণ রেশমের উৎপাদনে কিছুটা বিঘ্ন ঘটিয়েছিল, কিন্তু বাংলা থেকে এ সময়কার রেশম রফতানির পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে যে মারাঠা আক্রমণে রেশমশিল্প বা বাণিজ্যে খুব বেশি একটা প্রভাব পড়েনি। তাঁর সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে প্রায় দশ বছর ধরে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও ১৭৫১ সালে এশীয় বণিকরা বাংলা থেকে ২৪,০০০ মণের মতো কাঁচা রেশম রফতানি করেছে।২১ মারাঠা আক্রমণের ফলে যদি রেশমশিল্প ও বাণিজ্য বিপর্যস্ত হয়ে থাকত, তা হলে এত বিশাল পরিমাণ কাঁচা রেশম রফতানি করা কোনওমতেই সম্ভব হত না।

এশীয়/ভারতীয় বণিকরা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে তাদের প্রয়োজনমতো রফতানির জন্য কাঁচা রেশম কিনত। মাঝে মাঝে অবশ্য তারা স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বা পাইকারদের মাধ্যমেও রেশম সংগ্রহ করত। বলা বাহুল্য, এইসব বণিকদের অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে নিজেদের আস্তানা করেছিল। কিন্তু ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি প্রধানত কাঁচা রেশম সংগ্রহের জন্য ওই অঞ্চলে নিজেদের কুঠি স্থাপন করলেও, ভাষাগত অসুবিধের জন্য তারা উৎপাদকদের কাছ থেকে বা বাজার থেকে সরাসরি রেশম কিনতে পারত না। তার জন্য স্থানীয় রেশম ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করতে হত। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে অবশ্য এরকম সওদাগরের কোনও অভাব ছিল না। এদের মধ্যে স্থানীয় বাঙালি ব্যবসায়ী যেমন ছিল, তেমনি ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সওদাগর ব্যবসায়ী। এরা মূলত রেশম ও রেশমিবস্ত্র ব্যবসায়েই লিপ্ত ছিল।

১৭৫৩ সালে ইংরেজ কোম্পানি কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য যে ৪২ জন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁর মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১২ জন ছিল বাংলার বাইরের— প্রধানত গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং উত্তর ভারতের লোক। আবার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ থেকে শুরু করে তেলি পর্যন্ত সব জাতের মানুষ ছিল।২২

কোম্পানিগুলি সাধারণত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে রেশম সরবরাহের জন্য দাদনি বণিকদের সঙ্গে চুক্তি করে নিত কারণ এ সময়েই সবচেয়ে ভাল পাটনি বাজারে আসত। অনেক দর কষাকষির পর রেশমের দাম ও কত পরিমাণ রেশম সরবরাহ করতে হবে তা ঠিক হত। কোম্পানি তখন বণিকদের মোট দামের শতকরা ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ টাকা অগ্রিম বা দাদন বাবদ দিত। এ টাকার জন্য কোম্পানি বণিকদের কাছ থেকে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে চেষ্টা সফল হত না। কারণ মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের বণিকরা বেশ জোটবদ্ধই ছিল। তাদের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে তারা প্রায়শই কোম্পানির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারত এবং কোম্পানির নির্দেশ অগ্রাহ্য করতে সমর্থ হত। এটা আমরা আগের একটি অধ্যায়ে বিশদভাবে দেখিয়েছি।২৩

তবে চুক্তির সময় কীরকম দামে বণিকরা রেশম সরবরাহ করবে তা ঠিক হয়ে গেলেও মাঝে মধ্যে তারা দাম নিয়ে কোম্পানির সঙ্গে বাক্‌বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ত। সমসাময়িক নথিপত্র থেকে একটি ঘটনার উল্লেখ করলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ১৭৪৫ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি ইংরেজ কোম্পানির দাদনি বণিকেরা একটি নির্দিষ্ট হারে রেশম সরবরাহ করবে বলে চুক্তি করে। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে তারা কোম্পানিকে জানিয়ে দেয় যে রেশমের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের পক্ষে পূর্বনির্ধারিত দামে রেশম সরবরাহ করা কোনও মতেই সম্ভব হবে না, রেশমের দাম বাড়াতেই হবে। কাশিমবাজার কাউন্সিল বণিকগোষ্ঠীর (‘assembly of merchants’) সঙ্গে বৈঠক করে তাদের বাগে আনার বিফল চেষ্টা করল। বৈঠকের পর কাউন্সিল যা লিখেছে তা থেকে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের রেশম বাণিজ্য সম্বন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। কাউন্সিল বলছে:২৪

We told them (merchants) the price being already agreed, it was not in our power to alter it, and if they would not undertake the invest-ment we must look out for other merchants that would, to which they replied we might do as we pleased, but they were sure no merchants could contract cheaper than themselves, who had been bred up in silk business from their childhood, but they could not give us their labour without some profit of which they saw no prospect at the price we kept.

এ থেকে স্পষ্ট যে কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদের বণিকগোষ্ঠীর একটি বিশেষত্ব ছিল যে তারা সাধারণত কোনও একটি নির্দিষ্ট পণ্য সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞ (specialist) ব্যবসায়ী, ছোটবেলা থেকে তারা এ পণ্যের কাজ কারবারেই অভিজ্ঞতা অর্জন করে এ পণ্যের ব্যবসা-বাণিজ্যেই লিপ্ত হত। এ অঞ্চলের বণিকরা সাধারণত রেশম এবং রেশমিবস্ত্রের ব্যবসাতেই নিযুক্ত থাকত। এদের মধ্যে অনেকে শুধু রেশমের ব্যবসা করত, আবার অনেকে শুধু রেশমিবস্ত্রের। কেউ কেউ অবশ্য দু’টো পণ্যের বাণিজ্যই করত। এদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য, এরা মোটামুটি ভাল মুনাফা না হলে কাউকে পণ্য সরবরাহ করতে আগ্রহী হত না এবং এদের পঞ্চায়েত বেশ শক্তিশালী ছিল।

ইংরেজ কোম্পানি মুর্শিদাবাদ কাশিমবাজার থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভর করত কাশিমবাজারের কাটমা পরিবারের ওপর। অষ্টাদশ শতকের তিরিশের দশকে এ পরিবারের কয়েকজনই কোম্পানির ‘প্রধান বণিক’ (chief merchant) হিসেবে কাজ করেছে। এদেরই একজন বলাই বা বলরাম কাটমা, কোম্পানির ‘প্রধান বণিক’ নিযুক্ত হয় ১৭৩৭ সালে। ১৭৪০-এ যখন কোনও একটি কারণে নবাব তাঁকে বন্দি করে রাখেন, তখন কোম্পানি চোখে অন্ধকার দেখে কারণ ‘if some of that family [Katma] will not assit us on this occasion, we find it on several Tryalls impossible to get any of our other merchants to agree for more silk or piece-goods.’২৫

কোম্পানিগুলি বাংলা থেকে ইউরোপে যে কাঁচা রেশম পাঠাত, অনেক সময় সে রেশম ইউরোপের তাতে ব্যবহার করা মুশকিল হত। কারণ এগুলো গোটানো বা কুণ্ডলী করা থাকত না। এসব অসুবিধে দূর করার জন্য কোম্পানিগুলি, বিশেষ করে ডাচরা, কাশিমবাজারে কারখানা (karkhana) স্থাপন করে এ কাজের জন্য উপযুক্ত কারিগর নিযুক্ত করত। বাংলার শিল্প জগতে একদিক থেকে এটি একটি অভিনব সংযোজন। এর আগে কোনও ব্যক্তিগত বা বেসরকারি মালিকানার প্রতিষ্ঠানে এরকম নতুনত্ব দেখা যায়নি। অবশ্য মুঘল যুগের কারখানার কথা আমরা জানি। তবে এসব কারখানা মূলত বাদশাহি প্রতিষ্ঠান। এখানে বাদশাহ ও আমির ওমরাহদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই শুধু তৈরি হত, সাধারণ মানুষের বা বাজারের জন্য নয়। নবাবি আমলে ঢাকায় এরকম কারখানা ছিল, যেখানে সবচেয়ে বিলাসবহুল, উৎকৃষ্ট ও দামি মসলিন তৈরি হত।২৬ সে যাই হোক, ডাচ কোম্পানিই প্রথম ইউরোপের তাঁতগুলোর উপযুক্ত করে রেশমিসুতো কাটাবার ও ভাল করে গুটিয়ে রফতানি করার জন্য ১৬৫৩ সালে কাশিমবাজারে একটি কারখানা স্থাপন করে। তার জন্য কোম্পানি একটি চালা (shed) তৈরি করে, যাতে ৩,০০০ কারিগর কাজ করতে পারত। এদের পুরো কাজে লাগালে বছরে ১,৫০০ গাঁটরি উৎকৃষ্ট মানের রেশম তৈরি করা যেত। কিন্তু কোম্পানি তা সব সময় করে উঠতে পারত না। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ইউরোপে রেশমের চাহিদা আরও বেড়ে যাওয়ায় ডাচ কোম্পানি ১৭১৫ সালে চালাটি আরও বাড়ায় যাতে ৪,০০০ কারিগর একসঙ্গে কাজ করতে পারে।২৭ ইংরেজ কোম্পানিও এরকম কারখানা তৈরি করে কিন্তু সেখানে ৩০০-র বেশি লোক একসঙ্গে কাজ করতে পারত না, তাই কাশিমবাজার কাউন্সিল ১৭৫৫ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখে কারখানাটি বড় করা দরকার, তাই চালাটা আরও বাড়াতে হবে এবং তাঁর জন্য অর্থ মঞ্জুর করতে। ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে রাজি না হওয়ায় কারখানার সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়নি।২৮

রেশমিবস্ত্র

কাঁচা রেশম ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ সিল্কের কাপড় তৈরি হত এবং তাঁর অধিকাংশই ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে শুধু নয়, ইউরোপেও রফতানি হত। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার যেহেতু বাংলায় রেশম উৎপাদনের সবেচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল, সেজন্য স্বাভাবিক ভাবেই উৎকৃষ্ট সিল্পের কাপড়ও এখানেই তৈরি হত। সঙ্গে সঙ্গে সিল্ক-সুতি মেশানো কাপড়ও। এই দু’রকম কাপড়েরই প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল। ঐতিহাসিকরা বলেন:

The neighbourhood of Murshidabad is the chief seat of manufacture of wove silk: taffeta, both plain and flowered, and many other sorts of inland commerce and for exportation, are made there abundantly, than at any other places where silk is wove.

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সিল্ক কাপড়ের কাজ-কারবার যারা করত, তারা ওতেই বিশেষজ্ঞ ব্যবসায়ী। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত এরকম কাপড় কেনাবেচা করত না। কোম্পানির নথিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৭৪৪ সালে কাশিমবাজার থেকে যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করার প্রয়োজন হয়, তা করতে হলে এখানকার কুঠিয়ালরা জানায়, মুর্শিদাবাদ-সৈয়দাবাদে যে সব অভিজ্ঞ ও বড় বড় ব্যবসায়ী এই পণ্যই শুধু সরবরাহ করে, তাদের সাহায্য একান্ত দরকার। এদের মধ্যে আছে গোঁসাইরাম, রাম সিং, রামনাথ ইচ্ছানাথের মতো ধনী ও এ পণ্যে অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী। তারাই প্রধানত সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের সিল্কের কাপড় সরবরাহ করতে পারে। অন্যান্য ব্যবসায়ীরা সাধারণত এই পণ্যে কাজ-কারবার করতে চায়না। কোম্পানি গোঁসাইরাম প্রমুখ ব্যবসায়ীর সঙ্গে রেশমিবস্ত্র সরবরাহের জন্য চুক্তি করতে চায় কিন্তু ওই সব ব্যবসায়ীরা অগ্রিমের জন্য জামিন দিতে অস্বীকার করে। তারা বলে যে এতে বাজারে তাদের সুনাম নষ্ট হবে। কাশিমবাজার কাউন্সিল কলকাতায় লেখে যে এরা খুবই ধনী এবং সিল্কের কাপড়ে বিশেষ ব্যবসায়ী। সিল্কের কাপড় সরবরাহ করার জন্য ওদের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি না করলে এরা হাতছাড়া হয়ে যাবে, ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি এদের লুফে নেবে। ফলে ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে ইংল্যান্ড থেকে যে পরিমাণ রেশমিবস্ত্র পাঠানোর জন্য নির্দেশ এসেছে, তা কার্যকর করা সম্ভব হবে না। অবশেষে কোম্পানি জামিন ছাড়াই ওই সব রেশমিবস্ত্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়।৩০

সিল্ক কাপড়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ছিল ‘টাফেটার’ (tafettas বা taffaties) আর এটা প্রধানত কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলেই বেশি তৈরি হত। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি ইউরোপে যে রেশমিবস্ত্র রফতানি করত, তার একটা বড় অংশই টাফেটা। ডাচরা আবার এটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও জাপানে রফতানি করত। শুধু ইউরোপীয়রা নয়, এশীয় বণিকরাও মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে বেশ ভাল পরিমাণ ‘টাফেটা’ রফতানি করত। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে বাংলা থেকে ইউরোপীয়রা নয়, এশীয় বণিকরাই সবচেয়ে বেশি রেশমিবস্ত্র রফতানি করত, যার মধ্যে টাফেটা অন্যতম। নীচে প্রদত্ত সারণি থেকে এটা পরিষ্কার।

সারণি ৭.১

এশীয় বণিক ও ইউরোপীয়দের রেশমিবস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড়

১৭৫০/৫১-১৭৫৪/৫৫

 এশীয়রা ইউরোপীয় কোম্পানি
বছর(সংখ্যা)ডাচরাইংরেজরামোট ইউরোপীয়
  (সংখ্যা)(সংখ্যা)(সংখ্যা)
     
১৭৫০/৫১১২৪,৬৭৫১২,৮৯০১২,৭৬০২৫,৬৫০
১৭৫১/৫২৯২,৪৭৫৩৯,৬২৮২০,০৪১৫৯,৬৬৯
১৭৫২/৫৩৮৯,৯৭৮২৭,৭৭৭৩২,৬১৫৬০,৩৯২
১৭৫৩/৫৪৭৮,৯৭৮২৯,০২৯২৪,৬৬৩৫৩,৬৯২
১৭৫৪/৫৫৭৫,০৬২৪০,৮৮৩৩৪,১৬০৭৫,০৪৩
মোট সংখ্যা৪৫৭,১৬৮১৫০,২০৭১২৪,২৩৯২৭৪,৪৪৬
বার্ষিক গড়৯১,৪৩৪৩০,০৪১২৪,৮৪৮৫৪,৮৮৯

[সূত্র: এশীয় বণিকদের রফতানি, BPC, vol. 44, Consult. 19 June 1769; ডাচ রফতানি হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানা (Algemeen Rijksarchief) থেকে সংগৃহীত তথ্য থেকে হিসেব করে বার করা হয়েছে; ইংরেজ কোম্পানির রফতানি K. N. Chaudhuri-র বই (Trading World) থেকে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে।]

এই পরিসংখ্যানে অবশ্য ফরাসিদের রফতানির পরিমাণ ধরা হয়নি কারণ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া দুষ্কর। তবে P.J. Marshall এর বক্তব্য অনুসরণ করে, যে ফরাসিদের রফতানির পরিমাণ ডাচ বা ইংরেজদের রফতানির অর্ধেক হওয়ারই সম্ভাবনা,৩১ আমরা অনুমান করতে পারি যে, ডাচ ও ইংরেজদের রফতানির বার্ষিক গড় যখন যথাক্রমে ৩০,০৪১ ও ২৪,৮৪৮ তখন ফরাসিদের বার্ষিক গড় রফতানি ১২,০০০ থেকে ১৫,০০০-এর বেশি হতে পারে না। তা যদি হয়, তা হলে ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রেশম রফতানির মোট বার্ষিক গড় ৬৭,০০০ থেকে ৭০,০০০-এর বেশি হতে পারে না (ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে ডাচ ও ইংরেজদের রফতানির বার্ষিক গড় ৫৪,৮৮৯)। অথচ ওপরের সারণি থেকে আমরা দেখছি যে এশীয় বণিকদের রেশমিবস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড় ৯১,৪৩৪। সুতরাং কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে রেশমিবস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশীয় বণিকরাই অনেক বেশি এগিয়ে ছিল।৩২

কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে কাঁচা রেশম উৎপাদন ও এই শিল্পের সঙ্গে অনেক কৃষক/কারিগর যেমন যুক্ত ছিল, তেমন রেশমিবস্ত্র তৈরি করার জন্যও অনেক তাঁতি ও কারিগরের প্রয়োজন ছিল। সমসাময়িক নথিপত্র থেকে জানা যে এ অঞ্চলে এমন তাঁতি ও কারিগরের কোনও অভাব ছিল না। এদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা কিন্তু সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে বাজারে যখন সিল্কের কাপড়ের প্রচুর চাহিদা ছিল, কাঁচা মালেরও খুব একটা অভাব যখন চোখে পড়ে না, তখন আন্দাজ করা যেতে পারে যে এদের অবস্থাও খুব একটা খারাপ ছিল না। তাঁতিরা সাধারণত তিনটে রঙের ‘টাফেটা’ বুনত— পাকা সবুজ, হালকা সবুজ ও নীল। এই তিন রকম কাপড় বুনতে কোন খাতে কত খরচ হত, তাঁতি কত পেত এবং বিশেষ করে পুরো খরচের শতকরা কত তাঁতির লাভ থাকত সে সম্বন্ধে একটি তালিকা আমি পেয়েছি। পরের পাতায় সেটি উদ্ধৃত করা হল।

আমরা আগেই বলেছি বাংলা থেকে যে বিপুল পরিমাণ কাঁচা রেশম রফতানি হত, তাঁর অধিকাংশই কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চল থেকে, এবং ইউরোপীয় কোম্পানি তথা ভারতীয়/এশীয় বণিকরা সবাই এতে লিপ্ত ছিল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ রেশম রফতানিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কাদের— ইউরোপীয়দের না ভারতীয়/এশীয় বণিকদের? এতদিন ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়দেরই মুখ্য ভূমিকা— তারাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করত। তা যদি হয়, তা হলে কাঁচা রেশমের রফতানিতেও তারা ছিল অগ্রগণ্য, কারণ বাংলা থেকে যে দু’টি প্রধান রফতানি পণ্য (মোট মূল্য এবং পরিমাণগতভাবে), তা হল বস্ত্র ও কাঁচা রেশম। সুতরাং ওপরের বক্তব্য অনুযায়ী কাঁচা রেশমের রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দেরই প্রধান ভূমিকা। অন্তত কে, এন, চৌধুরী (১৯৭৮), ওম প্রকাশ (১৯৮৫, ১৯৯৮), পিটার মার্শাল (১৯৭৮, ১৯৮৭), ক্রিস বেইলি (১৯৮৭) প্রমুখের গবেষণা গ্রন্থ থেকে এ ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।৩৩

তবে প্রশ্ন, এ ধারণা কি সঠিক? আমরা অস্বীকার করছি না যে বাংলার সমুদ্র বাণিজ্যে ইউরোপীয়রা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু তা বলে একথা বলা যায় না যে বাংলার সামগ্রিক বহির্বাণিজ্যে তারা এশীয় বণিকদের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল কারণ এতে সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে স্থলপথে বহির্বাণিজ্যের ব্যাপারটাও থাকছে। অনেকদিন ধরেই বাংলা থেকে স্থলপথে বহিবাণিজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিকদের মধ্যে একটি বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে (বিশেষ করে নীলস স্টিনসগার্ড (Niels Steensgaard), অশীন দাশগুপ্ত প্রমুখের লেখায়),৩৪ মুঘল, পারসিক ও অটোমান (Ottoman) এই তিনটি বিশাল সাম্রাজ্যের পতনের পর এবং তাঁর ফলে সুরাটের মতো আন্তর্জাতিক ও গুরুত্বপূর্ণ বন্দরের পতন হওয়ায় স্থলপথে বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায়। এরকম চিন্তাধারার অন্যতম কারণ, ভারতবর্ষ/বাংলা থেকে স্থলপথে বাণিজ্য সম্বন্ধে কোনও তথ্য পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর, যেখানে ইউরোপীয় বাণিজ্য সম্বন্ধে বেশ সহজেই পরিসংখ্যানগত তথ্য ইউরোপের মহাফেজখানাগুলি থেকে সংগ্রহ করা যায়। অবশ্য এর সঙ্গে ও-সব ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইউরোপ কেন্দিক (Eurocentric) মানসিকতাও হয়তো কিছুটা কাজ করেছে।

সারণি ৭.২
কাশিমবাজারে টাফেটা তৈরীর খরচ, ১৭৫৬
 [টাকা, আনা, পাই]
 
TaffetaCost of SilkWinding CostTwisting CostPatash
& Straw agent
Blue & otherOther DyesTying Broken ThreadsWeavingTotal CostWeaver’s Profit in Percentage of Total Cost
Pucca Green6.100.4.60.4.00.2.00.10.63.12.60.1.01.4.013.0.69.6
Pale Greem6.100.4.60.4.00.2.00.10.63.11.00.1.01.4.09.15.012.5
Blue6.100.4.60.4.00.2.00.10.6 0.1.01.4.09.4.013.5
[সূত্র: Fact. Records, Kasimbazar, vol 12, 15 Jan. 1756; BPC, vol. 28,f. 386. 22 Jan. 1756]

আমরা কিন্তু এখন বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাতে পারছি যে কাঁচা রেশম রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়রা ইউরোপীয়দের চাইতে, বলতে গেলে, বেশ কয়েক যোজনই এগিয়ে ছিল। এজন্য প্রথমে দেখা যাক, বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি মধ্য-অষ্টাদশ শতক নাগাদ বাংলা থেকে কী পরিমাণ রেশম রফতানি করত। ইংরেজ কোম্পানির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে ১৭৪৫-৪৬ থেকে ১৭৪৯-৫০, এই পাঁচ বছরে তাদের রেশম রফতানির বার্ষিক গড় ১,২০০ মণ আর পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৭৫০-৫১ থেকে ১৭৫৪-৫৫ পর্যন্ত বার্ষিক গড় ১,১৪৬ মণ। আর ডাচ কোম্পানির ক্ষেত্রে ১৭৪০-৪১ থেকে ১৭৪৪-৪৫-এ পাঁচ বছরে বার্ষিক গড় ছিল ৮৯৭ মণ আর ১৭৫০-৫১ থেকে ১৭৫৪-৫৫ পর্যন্ত তা ছিল ৯৬৯ মণ।৩৫ ফরাসিদের রফতানি সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি তবে পিটার মার্শালের অভিমত অনুসারে তাদের রফতানির পরিমাণ ইংরেজ ও ডাচদের রফতানির অর্ধেক মতো হবে (যদিও তা আরও কম হওয়ার সম্ভাবনা) ধরে নিলে, তার বার্ষিক গড় পরিমাণ হবে ৫০০ মণের মতো। অর্থাৎ ইংরেজ, ডাচ ও ফরাসিদের সম্মিলিত রফতানির বার্ষিক গড় পরিমাণ দাঁড়ায় (ইংরেজদের ১,৫০০ মণ, ডাচদের ১,০০০ মণ, ফরাসিদের ৫০০ মণ ধরে) খুব বেশি হলে ৩,৫০০ মণ।৩৬ তা যদি হয়, এ সময় এশীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ কতটা ছিল তা দেখতে হবে।

আমার সৌভাগ্য যে আমি কাশিমবাজার থেকে ১৭৪৯-১৭৬৭, এই দীর্ঘ উনিশ বছরের এশীয় বণিকদের রেশম রফতানির সম্পূর্ণ পরিসংখ্যান উদ্ধার করতে পেরেছি। এই তালিকাটি ১৭৬৯ সালে কাশিমবাজারের ‘কমার্শিয়াল রেসিডেন্ট’ অলডারসে (W. Aldersey) মুর্শিদাবাদের বাদশাহি শুল্কবিভাগের (seir customs house) রসিদপত্র থেকে তৈরি করেছিলেন।৩৭ যেহেতু এশীয় বণিকদের রেশম রফতানির জন্য মুর্শিদাবাদের শুল্কবিভাগে শুল্ক জমা দিতে হত, সেজন্য এই তালিকায় এশীয় বণিকরা কী পরিমাণ রেশম রফতানি করছে, তার পরিমাণ, মূল্য এবং কত শুল্ক দিচ্ছে সবই আছে। এতে স্পষ্ট করে বলা আছে যে এই তালিকায় শুধু এশীয় বণিকদের রফতানিই ধরা হয়েছে, অন্য কারও নয়। আমরা এখানে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত এশীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ ও তার মূল্য তুলে ধরেছি। তারপর কয়েকবছরের যে হিসেব তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই কারণ তখন রফতানির পরিমাণ অনেক কমে গেছে।

সারণি ৭.৩

কাশিমবাজার থেকে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাঁচা রেশম রফতানি, ১৭৪৯-৫৮ মোট পরিমাণ ও মূল্য

বছরপরিমাণ(মণ)মূল্য (টাকা)
১৭৪৯২০,০৩৭৫৬,১০,৪২৩
১৭৫০১৯,৫৭১৫৪,৭৯,৭৮৬
১৭৫১২৩,৭৪০৬৬,৪৭,০৯৫
১৭৫২১৭,৬১৫৪৯,৩২,২২১
১৭৫৩১৮,০৫৩৫০,৫৪,৮৪০
১৭৫৪১৫,২৪৯৪২,৬৯,৫৯৪
১৭৫৫১২,২৬৯৩৪,৩৫,৩১০
১৭৫৬৭,৬৩৫২১,৩৭,৭৬২
১৭৫৭২১,৩৪৭৫৯,৭৭,০৪৫
১৭৫৮১৮,১৯২৫০,৯৩,৬৩৪

এই তালিকার তলায় সংকলক অলভারসে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন:

The above account indicates only the Trade on which Duties were really paid to the pachotra daroga [Royal Customs House] but besides this there was formerly carried on a very considerable trade in these articles by Juggutseats House and others who had interests with the Nizamat for these goods to pass Duty free…. The above is the trade of Natives only on which duties have been paid.

[সূত্র: Bengal Public Consultations, Range 1, vol. 44, 19 June 1769]

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে যে ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৮, এ দশ বছরে এশীয়/ভারতীয় বণিকরা মোট ১,৭৩,৭০৮ মণ কাঁচা রেশম রফতানি করেছে অর্থাৎ এসময় তাদের রফতানির বার্ষিক গড় ছিল ১৭,৩৭১ মণ। আর ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মোট রফতানির বার্ষিক গড় ৩,৫০০ মণের বেশি নয়। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সিল্ক রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চাইতে এশীয়/ভারতীয় বণিকদের রফতানির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল— অন্ততপক্ষে চার পাঁচগুণ বেশি। আর তাই যদি হয়, তা হলে এশীয়/ভারতীয় বণিকরাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো/টাকাপয়সা আমদানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। কারণ বাংলায় পণ্য কিনতে গেলে সব ব্যবসায়ী-সওদাগরকেই নগদ টাকা বা সোনা-রুপো নিয়ে আসতে হত। বাংলায় তা ছাড়া অন্য কোনও জিনিসের চাহিদা ছিল না। মধ্য অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বারবার একথা বলেছেন। এরকম এক কর্মচারী, উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts), লিখেছেন যে বাংলার পণ্য কেনার জন্য অসংখ্য ব্যবসায়ী বাংলায় আসত, ‘with little else than money or bills [of exchange]’৩৭ এবং সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন যে ‘the inland importation into Bengal always far exceeded the whole importation by sea from Europe and the gulfs of Arabia and Persia.’৩৮ আরেকজন কর্মচারী যিনি পরে বাংলার গভর্নরও হয়েছিলেন, হ্যারি ভেরেলষ্ট (Harry Verelst) বলেছেন যে ‘the whole amount of the trade of the Provinces [of Bengal] was a clear gain to them by an exchange of their produce for bullion’ এবং ‘there flowed every year an increase of specie equal to the Amount of the export of the Country’.৩৯ অন্য আরেক কর্মচারী, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন (Luke Scrafton), জানিয়েছেন যে এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য সওদাগর ‘used to resort to Bengal with little else than ready money or bills to purchase the produce of the Provinces’.৪০

বাংলা থেকে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল থেকে, কাঁচা রেশম রফতানির ক্ষেত্রে ভারতীয়/এশীয় বণিকদের যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য ছিল সেটা সমসাময়িক বহু তথ্য থেকে সুপ্রতিষ্ঠিত। সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি কাশিমবাজারের এক গুজরাটি সিল্ক ব্যবসায়ীর গোমস্তা ছিলেন এবং তিনি নিজেও তিরিশ বছর ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৭৫০-র দশকের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে মুর্শিদাবাদে তখন দশ জন সওদাগর ছিল যারা বছরে ১৩,০০০ থেকে ২০,০০০ মণ পর্যন্ত সিল্ক রফতানি করত।৪১ বাংলায় ডাচ কোম্পানির অধ্যক্ষ লুই টেইলেফারট (Louis Taillefert) ১৭৬৩ সালে লিখেছেন যে অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিক থেকে লাহোর ও মুলতান অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের গোমস্তারা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার থেকে সিন্ধ কেনার পরিমাণ অনেক বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে।৪২ তা ছাড়া উইলিয়াম বোল্টস, হ্যারি ভেরেলস্ট, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন প্রমুখ জোর দিয়ে বলেছেন যে ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীদের অসংখ্য ‘ক্যারাভ্যান’ (caravan) বাংলায় পণ্য, বিশেষ করে বস্ত্র ও রেশম, কেনার জন্য নিত্য আসা যাওয়া করত। কিন্তু উত্তর পলাশি পর্বে এ চিত্র সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে ভারতীয়/এশীয় বণিকরা পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং ধীরে ধীরে তাদের স্থলপথের বাণিজ্যে ভাঁটা পড়তে থাকে এবং ক্রমশ তা প্রায় বিলীন হয়ে যায়।

রেশম শিল্পের পাশাপাশি আরও কিছু ছোটখাটো শিল্পের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছিল নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হাতির দাঁতের কারুশিল্প (ivory carving)। এই শিল্পের উৎপত্তি নবাবি আমলে। তার আগে এর অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায় না। এর উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি গল্প বহুল প্রচলিত। মুর্শিদাবাদের এক নবাব একটি কান-খুঁচুনি (ear-pick) তৈরি করতে বলেন এবং সে অনুযায়ী ঘাসের তৈরি একটি কান-খুঁচুনি বানানো হলে সেটা তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি। কারণ একমাত্র হাতির দাঁতের তৈরি জিনিসই নবাবের মর্যাদার উপযোগী। তখন এ কাজের জন্য দিল্লি থেকে এক ওস্তাদ কারিগরকে আনা হল। তিনি যখন এ কাজ করছিলেন তখন এক হিন্দু ভাস্কর বা খোদাইকার দেয়ালের একটি ফুটো দিয়ে জিনিসটা কীভাবে করা হচ্ছে সেটা দেখে নেয় এবং কীভাবে এটা করতে হয় সে কৌশল শিখে ফেলে। এই ভাস্কর তার ছেলে তুলসীকে কৌশলটি শিখিয়ে দেয়। তুলসী খাটেম্বের (Khatember) এ কাজে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠে এবং নবাব তাকে পনেরো টাকা মাস মাইনেতে দরবারে নিযুক্ত করেন। নবাব ও দরবারের জন্য তুলসী হাতির দাঁতের নানারকম জিনিসপত্র তৈরি করত। অষ্টাদশ শতকে মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম ভারতবর্ষের অন্য যে কোনও অঞ্চলের চাইতে অনেক বেশি সুনাম অর্জন করেছিল। দিল্লি, বেনারস প্রভৃতি অঞ্চলে মুর্শিদাবাদের এই শিল্পের অনুকরণে জিনিসপত্র তৈরি হত।৪৩

হাতির দাঁতের কারুশিল্পে প্রধানত জীবজন্তুর মূর্তি— হাতি, ঘোড়া, উট, ইত্যাদি; নৌকা, পালকি, গোরুর গাড়ি, হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি, বিয়ের মিছিল, শিকারের চিত্র, চিরুনি, লাঠি, খেলনা, ছুরির বাঁট, কলমদান, দোয়াতদান, আয়নার ‘ফ্রেম’ (কাঠামো), এসব ছিল উল্লেখযোগ্য। মীরজাফরের বেগম বিধবা মুন্নি বেগম ওয়ারেন হেস্টিংসের স্ত্রীকে হাতির দাঁতের তৈরি একটা চেয়ার ও ছোট টেবিল উপহার দিয়েছিলেন। এ দু’টি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মূল্যবান বস্তু হয়ে উঠেছিল। মুর্শিদাবাদ থেকে হাতির দাঁতের কারুশিল্প ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে এবং বিদেশেও রফতানি হত। দেশের ভেতরে এই শিল্পের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাবরা, তাঁদের অমাত্য ও অন্যান্য অভিজাতবর্গ এবং ধনী শ্রেষ্ঠীরা। নবাব এবং দরবারের রমরমা যখন অস্তমিত, তখন কিছুদিন কাশিমবাজার-মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারীরা এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে। কিন্তু রেশম শিল্প ও বাণিজ্যের অবনতির ফলে কোম্পানিগুলির এজেন্টরা ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়ায় হাতির দাঁতের কারুশিল্পেও দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। হাতির দাঁতের কারুশিল্পের জন্য হাতির দাঁত আসত শ্রীহট্ট ও চট্টগ্রাম থেকে, যেখানে তখন হাতি শিকার করা হত। তা ছাড়া বোম্বাই থেকে কলকাতা হয়ে আফ্রিকার হাতির দাঁতও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আসত।৪৪

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. Glamann, Dutch-Asiatic Trade, pp. 112-113; K.N. Chaudhuri, Trading World, pp. 343-47; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 178-80; Om Prakash, Dutch Company, pp. 208-09.

২. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, p. 179.

৩. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 119-200.

৪. Glamann, Dutch-Asiatic Trade, p. 122; Om Prakash, Dutch Company, pp. 187, 196, 199; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, p. 181.

৫. Bernier, Travels, p. 439.

৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 220-21.

৭. Streynsham Master, The Diaries of…, vol. 2. p. 28.

৮. H.R. Ghosal, Economic Transition, p. 57, f.n. 126-এ উদ্ধৃত।

৯. Tavernier, Travels, vol. II, p. 2; K. N. Chaudhuri, Trading World, p. 354; Om Prakash, Dutch Company, p. 57.

১০. BPC, Range 1, vol. 44, Annex. to Consult., 19 June 1769,

১১. J. Geoghegan, Silk in India, pp. 15-16; D. H. W. Speed, ‘Notes on the Culture of Silk in Bengal’, in Transactions of Agricultural and Horticultural Society of India, vol. III. 1837, pp. 14-15. ১২৮০ টি গুটিপোকায় এক কাহন (kahan) বা ১৬ পণ। গোবর দিয়ে লেপে নিলে ডালাগুলি অনেক বেশি টিঁকত এবং গোবরের গন্ধে পোকামাকড়ও কম আসত।

১২. D. H. W. Speed, ‘Notes on the Culture of Silk’, pp. 22-23.

১৩. J. Geoghegan, Silk in India, pp. 6-7, 15-16.

১৪. Robert Orme, Historical Fragments, p. 412.

১৫. F. Buchanan, Bhagalpur, p. 613.

১৬. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 225.

১৭. B. M. Addl. Mss. 34,123; Wilson, Early Annals, vol. 1. p. 376.

১৮. C & B. Abstr., vol. 3, f. 337, para. 36, 26 Dec. 1733.

১৯. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 6, Consult. 23 Jan. 1744.

২০. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 299-303.

২১. BPC, Range 1, vol. 44, Annex. to Consult., 19 June 1769.

২২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 241, f.n. 82.

২৩. এ বইয়ের তৃতীয় অধ্যায়।

২৪. Fact. Records, Kasimbazar, vol. 7, Consults., 19 Jan., 28 Feb. 1745.

২৫. Ibid, vol. 6, Consults., 10 March 1742; S. Chaudhury From Prosperity to Decline, p. 239.

২৬. John Taylor, ‘Dhaka Cloth Production’, Home Misc., 456F; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 145-46.

২৭. Om Prakash, European Commercial Enterprise, p. 174; Dutch Company, p. 217.

২৮. Factory Records, Kasimbazar, vol. 12, Consults, 7 Aug. 27 Aug. 1755.

২৯. Colebrook and Lambert, Remarks on Husbandry, p. 170.

৩০. BPC, Range 1, vol. 17, f. 66, 23 April 1744; Factory Records, Kasimbazar, vol. 6, 19 April 1744.

৩১. P. J. Marshall, Bengal, p. 66.

৩২. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 208-210.

৩৩. K. N. Chaudhuri, Trading World; Om Prakash, Dutch Company: European Commercial Enterprise; P. J. Marshall, East Indian Fortunes; Bengal; C. A. Bayly, Indian Society.

৩৪. Niels Steensgaard, Asian Trade Revolution; Ashin Das Gupta, Indian Merchants and the Decline of Surat.

৩৫. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, Table 8.2 and Table 8.3, pp. 251-52.

৩৬. Ibid, pp. 251-253; f. n. 114, p. 253.

৩৭. BPC, Range 1, vol. 44, Consults., 19 June 1769.

৩৮. William Bolts, Considerations, p. 200.

৩৯. Harry Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC, Range 1, vol. 24, f. 324.

৪০. Luke Scrafton, Reflections, p. 20.

৪১. Proceedings of the Board of Trade, 13 March 1791, quoted in N. K. Sinha, Economic History of Bengal, vol. 1, pp. 111-12.

৪২. Taillefert’s ‘Memorie’, HR. 246, f. 141, 17 Nov. 1763.

৪৩. O’Malley, Murshidabad District Gazetteer, p. 140; K. M. Mohsin, A Bengal District in Transition, pp. 74-75.

৪৪. Ibid., pp. 75-76.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *