০৬. বেগম বৃত্তান্ত

ষষ্ঠ অধ্যায় – বেগম বৃত্তান্ত

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে নবাব-বেগমদের কথা স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিত্বসম্পন্না, বুদ্ধিমতী, বিজ্ঞ মহিলা—তাঁদের স্বামীদের প্রয়োজনমতো রাজকার্য থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংকটের সময় যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার কেউ কেউ ছিলেন কুটিল, কুচক্রী ও স্বার্থান্বেষী। শুধু তাই নয়, কারও কারও ব্যক্তিগত চরিত্রও খুব একটা নিষ্কলঙ্ক ছিল না। নিজেদের অভীষ্ট সিদ্ধ করার জন্য এঁরা অনেকটা নীচে নামতেও দ্বিধা করতেন না। তাই বলা যায় যে মুর্শিদাবাদ বেগমদের মধ্যে একদিকে খুব উঁচু আদর্শের মহিলাকে যেমন দেখা যায়, তেমনি সাক্ষাৎ মেলে একেবারে বিপরীত চরিত্রের নারীর। এখানে আমরা এই দুই বিপরীত মেরুর কয়েকজন বেগমদের বৃত্তান্ত আলোচনা করব।

জিন্নতউন্নেসা

জিন্নতউন্নেসা ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর একমাত্র কন্যা এবং পরবর্তী নবাব সুজাউদ্দিনের পত্নী। সিয়রের লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেনের ভাষ্য অনুযায়ী তাঁর আরেকটি নাম ছিল, নাফিসা। কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতিনে নাফিসাকে সরফরাজের ভগিনী বলেই বলা হয়েছে। সমসাময়িক সব ফারসি ইতিহাস থেকেই জানা যায় যে মুর্শিদকুলির অন্য কোনও স্ত্রী বা রক্ষিতা ছিল না। বাংলার পরবর্তী কিছু নবাবের মতো তাঁর কোনও হারেমও ছিল না। মুর্শিদকুলি তাঁর একমাত্র পত্নীর প্রতিই বিশ্বস্ত ছিলেন। সে যাই হোক, তিনি যখন দাক্ষিণাত্যে ছোট রাজকর্মচারী ছিলেন, তখনই তিনি তাঁর কন্যার সঙ্গে সুজাউদ্দিনের বিবাহ দেন। সুজা তাঁর শ্বশুরবাড়িতে পরিবারের সদস্য হিসেবে বাস করতে আরম্ভ করেন। এর কিছুদিন পরে মুর্শিদকুলি বাংলার দেওয়ান ও পরে বাংলার সুবাদার পদেও অধিষ্ঠিত হলেন। তখন তিনি জামাতা সুজাউদ্দিনকে উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর বা ছোট নবাব হিসেবে নিযুক্ত করেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই শ্বশুর-জামাতার সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করল। দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে সুজাউদ্দিন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে উড়িষ্যা চলে গেলেন।

শাসক হিসেবে সুজাউদ্দিন জনপ্রিয় ছিলেন, বেশ দয়ালু এবং উদার স্বভাবেরও। কিন্তু নারীর প্রতি ছিল তাঁর অসম্ভব দুর্বলতা, নারী সম্ভোগে তাঁর আসক্তি ছিল প্রবল। জিন্নতউন্নেসা ধর্মভীরু ও উদারচেতা ছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তেজস্বীও। তাই স্বামীর এমন চরিত্রস্খলন তিনি মেনে নিতে পারেননি। তা ছাড়া তাঁর পিতার প্রতি স্বামীর বিরূপ মনোভাবও তিনি সহ্য করতে পারেননি। তাই স্বামী সুজাউদ্দিনকে ছেড়ে তিনি পুত্র সরফরাজকে নিয়ে পিতার কাছে মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। সেখানে তিনি ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে জীবন কাটাতে থাকেন।

মুর্শিদকুলির কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। জামাতা সুজাউদ্দিনের ওপর তিনি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে বুঝতে পেরে তিনি তাঁর দৌহিত্র, কন্যা জিন্নতউন্নেসার পুত্র, সরফরাজকে মসনদে তাঁর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করবেন স্থির করে দিল্লির বাদশাহের কাছ থেকে অনুমোদন আনার চেষ্টা করলেন। এদিকে সুজাউদ্দিন এখবর পেয়ে তাঁর পরামর্শদাতা দুই ভ্রাতা হাজি আহমেদ ও আলিবর্দি খানের সঙ্গে আলোচনা করে দিল্লিতে বাদশাহের কাছে দূত পাঠালেন বাংলার দেওয়ানি ও নিজামতে তাকে অধিষ্ঠিত হওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। তারপর যেই তিনি খবর পেলেন যে মুর্শিদকুলি মৃত্যুশয্যায়, তখনই তিনি আলিবর্দি খান ও সৈন্যসামন্তদের নিয়ে কটক থেকে মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা করেন। পথিমধ্যেই তিনি মুর্শিদকুলির মৃত্যু সংবাদ পান এবং মুর্শিদাবাদ পৌঁছবার আগেই বাদশাহের অনুমতিও এসে যায়। মুর্শিদাবাদ এসে তিনি সোজা মুর্শিদকুলির প্রাসাদ চেহেল সুতুনে ওঠেন এবং নিজেকে বাংলার নবাব হিসেবে ঘোষণা করেন।

এ খবর পেয়ে সরফরাজ তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু তাঁর মা জিন্নতউন্নেসা ও দিদিমা, মুর্শিদকুলির বেগম নাসিরা, দু’জনেই সরফরাজকে তা থেকে বিরত করার চেষ্টা করলেন। সরফরাজ এ দু’জনেরই নয়নের মণি ছিলেন। তাঁরা তাঁকে বললেন:

Your father is old; after him, the subadari as well as the country with its treasure would devolve on you. To fight against one’s own father is cause of loss in this world and in the next as well as ignominy. It is meet that till the lifetime of your father, you should remain con-tented with the Diwani of Bengal.

সরফরাজ যেহেতু কোনওদিনই এঁদের মতামত অগ্রাহ্য করেননি এবং সবসময় এঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়েছেন, তাই তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে এঁদের কথা মেনে নিলেন এবং সুজাউদ্দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেন। তিনি তাঁর পিতাকে বাংলার নবাব হিসেবে মেনে নিলেন। এ ঘটনা থেকে মুর্শিদ-বেগম নাসিরা বানু ও সরফরাজের মা, সুজাউদ্দিনের বেগম, জিন্নতউন্নেসার বিচক্ষণতা ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়।

এরপর সুজাউদ্দিন জিন্নতউন্নেসার কাছে গিয়ে তাঁর পূর্বকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করেন এবং বেগমের ক্ষমা ভিক্ষা করেন। বেগম জিন্নতউন্নেসা তাঁকে ক্ষমা করে দেন। নবাব হয়ে সুজাউদ্দিন সরফরাজ বা তাঁর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র টাকি খানকে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করতে চাইলেন। কিন্তু জিন্নতউন্নেসা তাঁর একমাত্র পুত্রকে কাছ ছাড়া করতে রাজি হলেন না। আবার টাকি খানকেও ওই পদে নিযুক্ত করতে তিনি আপত্তি জানালেন। বাধ্য হয়ে সুজাউদ্দিন বেগমের ইচ্ছা মেনে নিলেন। এ থেকে বোঝা যায় সুজাউদ্দিনের ওপর জিন্নতউন্নেসার কতটা প্রভাব ছিল।

যা হোক শেষ পর্যন্ত, মনে হয় অনেকটা জিন্নতউন্নেসার ইচ্ছেতেই, আলিবর্দি খানকে বিহারের ডেপুটি গভর্নর করে পাঠানো হবে স্থির হল। বেগম মনে করতেন তিনিই মুর্শিদকুলির মৃত্যুর পর তাঁর প্রতিষ্ঠিত নিজামতের প্রকৃত উত্তরাধিকারী এবং সুজাউদ্দিন তাঁর অধীনেই রাজ্যশাসন করার অধিকার পেয়েছেন। তাই তিনিই প্রথমে আলিবর্দিকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁকে খেলাত দিয়ে বিহারের ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করলেন। তাঁর পর সুজাউদ্দিন আলিবর্দিকে খেলাত প্রদান করে বিহারের ছোট নবাব বলে ঘোষণা করলেন। এ ঘটনা থেকেও স্পষ্ট, জিন্নতউন্নেসা কতটা বিজ্ঞা, বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্না ছিলেন, এবং তিনি রাজ্যশাসনেও কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।

এর পরের ঘটনাবলী জিন্নতউন্নেসার পক্ষে খুবই নিদারুণ হয়েছিল। আলিবর্দি সুজাউদ্দিনের সময়কার শক্তিশালী ত্রয়ীর (triumverate)—হাজি আহমেদ, আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ, যাঁরা সুজাউদ্দিনের বকলমে বাংলা শাসন করতেন—সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সুজাউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর বেগম জিন্নতউন্নেসার পুত্র নবাব সরফরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। গিরিয়ার যুদ্ধে (১৭৪০) সরফরাজ আলিবর্দির বাহিনীর মুখোমুখি হন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতেই তিনি প্রাণ বিসর্জন দেন। এভাবে একমাত্র পুত্রের মৃত্যু জিন্নতউন্নেসার কাছে কতটা মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক হয়েছিল তা সহজেই অনুমান করা যেতে পারে।

যুদ্ধ জেতার দু’দিন পরে আলিবর্দি মুর্শিদাবাদ শহরে পদার্পণ করলেন এবং মসনদে বসার আগেই জিন্নতউন্নেসার কাছে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বেগমকে তিনি জানালেন যে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দেবেন এবং যথাসাধ্য তাঁর আজ্ঞা বহন করে চলবেন। জিন্নতউন্নেসা পুত্রশোকে এতই কাতর ছিলেন যে তিনি উত্তরে আলিবর্দিকে কোনও কথাই বললেন না। নবাব হয়ে আলিবর্দি তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যার স্বামী নওয়াজিস মহম্মদকে ঢাকার ছোট নবাব পদে নিযুক্ত করেন। নওয়াজিস জিন্নতউন্নেসাকে তাঁর প্রাসাদ ছেড়ে ঢাকায় তাঁর কাছে তাঁর পালিতা মা হিসেবে এসে থাকতে রাজি করালেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাঁর ঘরসংসারের সব দায়িত্বও জিন্নতউন্নেসার হাতে দিয়েছিলেন এবং এ ব্যাপারে তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। বেগম নওয়াজিসকে জিজ্ঞেস না করে বা তাঁর অনুমতি না নিয়েও নিজের পছন্দমতো সব কাজ করার অধিকারও পেলেন। তবে নিজের সম্মান ও আভিজাত্য বজায় রেখে তিনি সবসময় পর্দার অন্তরাল থেকেই নওয়াজিসের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন।

বেগম জিন্নতউন্নেসার উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায় আরও একটি ঘটনা থেকে। তিনি সরফরাজের এক রক্ষিতার গর্ভজাত পুত্র আগা বা আকা বাবাকে দত্তক নেন। সরফরাজ যেদিন গিরিয়ার যুদ্ধে নিহত হন, সেদিনই আগা বাবার জন্ম হয়। হয়তো এজন্যই শোকাতুরা বেগমের আগার প্রতি করুণার উদ্রেক হয় এবং তিনি তাঁকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। আগা বেগমের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন, বেগমের বার্ধক্যে একমাত্র সান্ত্বনা। আগার সঙ্গে তিনি নওয়াজিস মহম্মদের ভাই সৈয়দ আহমেদের এক কন্যার বিবাহ দিতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। সৈয়দ আহমেদ প্রথমে এ প্রস্তাবে রাজি হননি কিন্তু শেষ পর্যন্ত নওয়াজিস মহম্মদ ও তাঁর স্ত্রী ঘসেটি বেগমের পীড়াপীড়িতে রাজি হলেন, কিন্তু নবাব পরিবারের নানা দুর্ঘটনার জন্য এই বিবাহ সম্পন্ন হয়নি বলেই মনে হয়।

ঘসেটি ও নওয়াজিস দু’জনেই জিন্নতউন্নেসাকে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। মুর্শিদকুলির খাসতালুক ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি তিনি একাই ভোগ করেছেন। নওয়াজিস মহম্মদ বা আলিবর্দি কখনও তাতে হাত দেননি। শুধু তাই নয়, আলিবর্দি এবং নওয়াজিস তাকে এতই সমীহ এবং সম্মান করতেন যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁর সামনে তারা নতজানু হয়ে অভিবাদন জানাতেন এবং তিনি বলার পরই শুধু তারা তাঁর সামনে আসন গ্রহণ করতেন।১০

জিন্নতউন্নেসা কতদিন জীবিত ছিলেন, কবে তাঁর মৃত্যু হয়, সে সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। তবে মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের আধ মাইলের মতো উত্তরে আজিমনগরে তিনি যে মসজিদ নির্মাণ করেন, তাঁর ধ্বংসাবশেষ অনেক দিন দেখা গেছে। কথিত আছে, এ ধ্বংসাবশেষের পাশেই তাঁর মৃত্যুর পর তাকে সমাধিস্থ করা হয়।১১

দুরদানা বেগম

মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারের মহিলাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন যে ব্যক্তিত্বসম্পন্না, সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ দুরদানা বেগম। তিনি ছিলেন নবাব সরফরাজ খানের সহোদরা এবং উড়িষ্যার ছোট নবাব (ডেপুটি গভর্নর) দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের পত্নী। কথিত আছে যে উড়িষ্যাতে তাঁর স্বামীর চাইতেও তাঁর সম্মান ও মর্যাদা ছিল অনেক বেশি। আলিবর্দি খান সরফরাজ খানকে গিরিয়ার যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদে বসার পর সরফরাজের ভগ্নীপতি উড়িষ্যার ছোট নবাব দ্বিতীয় মুর্শিদকুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। আলিবর্দির বিশাল সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো কোনওরকমের সহায়সম্বল তাঁর ছিল না। সে রকম মনোবলও নয়। তাই তিনি আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে একেবারে ভরসা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু তাঁর পত্নী দুরদানা বেগম তাকে আলিবর্দির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন কারণ তিনি এভাবে তাঁর সহোদর সরফরাজের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। তাতে বিশেষ কোনও ফল না হওয়ায় এবং যুদ্ধ করতে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলির প্রচণ্ড অনীহা দেখে দুরদানা বেগম শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বামীকে এই বলে ভয় দেখালেন যে আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে না গেলে তিনি তাকে পরিত্যাগ করবেন। তাঁর সব বিষয়সম্পত্তি ও উড়িষ্যার ছোট নবাবের পদ সব কিছু তাঁর জামাই মীরজা বকীর খানকে দিয়ে দেবেন। এতেই কাজ হল এবং মুর্শিদকুলি আলিবর্দির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বালেশ্বরের এই যুদ্ধে তিনি আলিবর্দির কাছে পরাজিত হন। এরপর মুর্শিদকুলি ও দুরদানা বেগম দাক্ষিণাত্যে নিজাম-উল-মুলক আসফ ঝা’র দরবারে আশ্রয় নেন।১২

শরফুন্নেসা

মুর্শিদাবাদের রাজনীতি ও শাসন প্রক্রিয়ায় বেগমদের কারও কারও প্রভাব যে বেশ মঙ্গলদায়ক ও ইতিবাচক হয়েছিল তা আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসার উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়। তিনি যে শুধু অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রেও তাঁর স্বামীর পাশে থেকেছেন তা নয়, আলিবর্দি যখন মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকতেন, রাজধানী থেকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে তিনি তখন রাজকার্য পরিচালনা করতেন। আলিবর্দি যখন বালেশ্বরে দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, তখন শরফুন্নেসাও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। আবার তিনি যখন ভাস্কর পণ্ডিতের নেতৃত্বে মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধ করতে বর্ধমানের কাছে মারাঠাদের সম্মুখীন হন, তখন বেগম শরফুন্নেসা স্বামীর সহযোগী হন।১৩ ওই যুদ্ধে মারাঠারা লণ্ডা নামের যে হাতির পিঠে বসে বেগম যুদ্ধ করছিলেন, সেটাকে ঘিরে ফেলে এবং তাকে প্রায় ধরে ফেলে। ভাগ্যক্রমে নবাবের সেনাপতি ওমর খানের পুত্র মুসাহিব খানের অসীম বীরত্বে শরফুন্নেসা মারাঠাদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে বেঁচে যান।১৪

অনেক সময় দেখা গেছে যে শরফুন্নেসা তাঁর স্বামী নবাব আলিবর্দিকে তাঁর বিপদ ও দুশ্চিন্তার সময় সাহস, ভরসা ও বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শ দিয়েছেন। এমন একটি পরিস্থিতির কথা সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন লিখে গেছেন। একদিন তিনি যখন বেগমের অন্দরমহলে বসেছিলেন, তখন উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নবাব এসে হাজির হন। আলিবর্দির মুখ দেখেই শরফুন্নেসা বুঝতে পারেন যে নবাব বেশ চিন্তাগ্রস্ত। স্বামীর কাছে কী হয়েছে তা তিনি জানতে চান। তাঁর অনুরোধে আলিবর্দি জানান যে তাঁর আফগান সেনাপতিদের, বিশেষ করে শামসের খানের, মতিগতি সুবিধের নয়, তিনি হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করে মারাঠাদের সঙ্গে যোগ দিতে পারেন। এ ভাবনায় আলিবর্দি খুবই উদ্বিগ্ন। শরফুন্নেসা তক্ষুনি দু’জন বিশ্বস্ত অনুচরকে মারাঠা বাহিনীর প্রধান রঘুজি ভোঁসলের কাছে পাঠালেন এই বার্তা নিয়ে যে তাঁরা বেগমের কাছ থেকে আসছেন এবং একটা মিটমাট করে মারাঠারা যেন বাংলা ছেড়ে চলে যান। রঘুজির খুব আপত্তি ছিল না। কিন্তু মীর হাবিব তা হতে দিলেন না। মীর হাবিবের প্ররোচনায় তিনি মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন কিন্তু কাটোয়ার যুদ্ধে তিনি আলিবর্দির হাতে পরাজিত হন।১৫

রাজকার্যের ব্যাপারে শরফুন্নেসা অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে আলিবর্দিকে সাহায্য করতেন। মারাঠাদের পরাস্ত করার পর তিনি মারাঠাদের সঙ্গে যোগসাজসের অভিযোগে তাঁর আফগান সেনাপতিদের বরখাস্ত করেন। তারা আলিবর্দির জামাতা ও বিহারের ছোট নবাব জৈনুদ্দিন আহমেদকে হত্যা করে এবং আলিবর্দির কন্যা ও জৈনুদ্দিনের পত্নী, আমিনা বেগমকে বন্দি করে রেখে প্রতিশোধ নিল। কিন্তু আলিবর্দি যুদ্ধ করে আফগানদের পরাস্ত করেন ও কন্যা আমিনাকে তাদের হাত থেকে মুক্ত করে আনেন। বিহার শাসন করার জন্য তিনি তাঁর দাদা হাজি আহমেদের পুত্র ও তাঁর মধ্যম জামাতা সৈয়দ আহমেদকে ছোট নবাব করে পাটনা পাঠালেন। এই ব্যবস্থা বেগম শরফুন্নেসার একেবারে মনঃপূত হল না। তিনি বুঝতে পারেন যে বিহার সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওখান দিয়েই বাইরের শত্রু ও আক্রমণকারীরা বাংলায় ঢুকতে পারে। তাই বিহারের শাসনকর্তার গুরুত্বপূর্ণ পদে সৈয়দ আহমেদ একেবারে অনুপযুক্ত। আলিবর্দিকে তিনি বিষয়টার গুরুত্ব বুঝিয়ে বললেন। তিনি জানতেন নবাব তাঁর কথার ও মতামতের যথেষ্ট দাম দেন। তবু সৈয়দ আহমেদকে বিহারের ছোট নবাবের পদ থেকে হঠাবার জন্য তিনি আরেকটি মোক্ষম অস্ত্র প্রয়োগ করলেন। আলিবর্দির, এবং অবশ্য তাঁর বেগমেরও, ইচ্ছে যে সিরাজউদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করবেন। বেগম সিরাজের মাথায় ঢোকালেন যে সৈয়দ আহমেদ বিহারের ছোট নবাব থাকলে সিরাজের পক্ষে আলিবর্দির পর মসনদে বসা সম্ভব হবে না। সিরাজ আলিবর্দির কাছে বায়না ধরলেন, সৈয়দ আহমেদকে বিহার থেকে সরাতে হবে। বৃদ্ধ আলিবর্দি প্রিয় নাতির কথা কোনওদিন ফেলতে পারেননি। এবারও পারলেন না। সৈয়দ আহমেদকে সরিয়ে সিরাজকেই বিহারের ডেপুটি গভর্নর করা হল।১৬ এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়, বেগম শরফুন্নেসা কতটা বিজ্ঞ, বুদ্ধিমতী ও কৌশলী ছিলেন।

মুর্শিদকুলির মতো আলিবর্দিও একমাত্র পত্নীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। তাঁর অন্য কোনও পত্নী বা রক্ষিতা ছিল না। বেগম শরফুন্নেসা ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণা ও সচ্চরিত্রা। তাঁর নৈতিক মূল্যবোধও ছিল প্রখর। তাই তিনি তাঁর কন্যাদের, ঘসেটি ও আমিনা বেগমের, চারিত্রিক স্খলন কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেননি। ঘসেটি তাঁর স্বামী ঢাকার ছোট নবাব নওয়াজিস মহম্মদের অধস্তন কর্মচারী ও প্রিয়পাত্র হোসেন কুলি খানের সঙ্গে অবৈধ প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বদান্যতায় হোসেন কুলি বেশ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন এবং তাঁর অনেক কুকর্মও ঢাকা পড়ে যায়।১৭ কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হোসেন কুলি ঘসেটির বোন, জৈনুদ্দিন আহমদের স্ত্রী ও সিরাজদ্দৌল্লার মা, আমিনা বেগমের প্রেমে পড়েন। এ সব ঘটনায় শরফুন্নেসা খুবই অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি তাঁর দুই কন্যাকে সুপথে আনার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তিনি সফল হতে পারলেন না। তখন তিনি স্থির করলেন সব নষ্টের গোড়া হোসেন কুলি খানকে একেবারে সরিয়ে দিতে হবে। এজন্য তিনি আলিবর্দির কাছে দরবার করেন। এর উত্তরে আলিবর্দি জানালেন যে যেহেতু হোসেন কুলি নওয়াজিস মহম্মদের কর্মচারী ও তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ, তাঁর অনুমোদন ছাড়া এ কাজ করা ঠিক হবে না। বেগম শুরফুন্নেসা নওয়াজিসের অনুমতি আদায় করলেন এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে এ কাজের ভার দিলেন। সিরাজ লোক দিয়ে সেটা সম্পন্ন করেন বলে কথিত আছে।১৮

শরফুন্নেসা অত্যন্ত দয়ালু ছিলেন। হলওয়েল জানাচ্ছেন যে সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা দখল করার পর হলওয়েল ও অন্য কয়েকজন ইংরেজকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। শরফুন্নেসার অনুরোধে সিরাজ হলওয়েল ও অন্যান্যদের মুক্তি দেন।১৯ সে যাই হোক, হলওয়েল শরফুন্নেসার গুণমুগ্ধ ছিলেন বলে তাঁর প্রশংসা করতে ভোলেননি :২০

a woman whose wisdom, magnanimity, benevolence and every ami-able quality, reflected high honour on her sex and station. She much influenced the Usurper’s [Alivardi’s] councils, and was ever consult-ed by him in every material movement in the state, except when san-guinary and treacherous measures were judged necessary, which he knew she would oppose as she ever condemned them when perpe-trated, however successful.

শরফুন্নেসার শেষ জীবন কেটেছিল দুঃখদুর্দশা ও যন্ত্রণার মধ্যে। পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর মীরজাফর মসনদ দখল করলে তাঁর পুত্র মীরণ শরফুন্নেসা, তাঁর দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগম এবং সিরাজপত্নী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে বন্দি করে ঢাকা পাঠিয়ে দেন। ঘসেটি ও আমিনাকে সলিল সমাধি দেওয়া হয়। বাকিরা কোনওরকমে এই মর্মান্তিক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন এবং শেষ পর্যন্ত ক্লাইভের হস্তক্ষেপে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতে পারলেন। কিন্তু তাদের যে মাসোহারার ব্যবস্থা হল, তাতে জীবন নির্বাহ করা খুব কঠিন হয়ে ওঠে। ১৭৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরফুন্নেসাকে ইংরেজ গভর্নরের কাছে তাঁর ভাতা বৃদ্ধির জন্য আর্জি পাঠাতে দেখা যায়।২১ বাংলার দোর্দণ্ডপ্রতাপ নবাব আলিবর্দি খানের বেগমের কী নিদারুণ পরিণতি!

ঘসেটি—মোতিঝিলের বেগম

ঘসেটি বেগম নবাব আলিবর্দির জ্যেষ্ঠা কন্যা। প্রথমে তাঁর নাম ছিল মেহেরুন্নিসা। পরে তিনি ঘসেটি বলেই পরিচিত হন। তবে অনেকেই তাঁকে ছোট বেগম হিসেবেই জানত কারণ তাঁর স্বামী নওয়াজিস মহম্মদ ছিলেন ঢাকার ছোট নবাব। মুর্শিদাবাদের জনমানসে তাঁর পরিচয় ছিল মোতিঝিলের বেগম বলে কারণ তাঁর স্বামীর তৈরি মুর্শিদাবাদের অদূরে মোতিঝিল প্রাসাদেই তিনি বসবাস করতেন।২২ আলিবর্দি ঘসেটির বিবাহ দেন তাঁর দাদা হাজি আহমেদের জ্যেষ্ঠ পুত্র নওয়াজিস মহম্মদের সঙ্গে। বাংলার মসনদ দখল করার পর তিনি নওয়াজিসকে ঢাকার ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত করেন। নওয়াজিস প্রথম যৌবনে তাঁর উচ্ছৃঙ্খলতা, নিষ্ঠুরতা ও বদচরিত্রের জন্য কুখ্যাত ছিলেন কিন্তু পরে তাঁর চরিত্রে বিরাট পরিবর্তন আসে। শাসক হিসেবে তিনি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সুখ্যাতি অর্জন করেন।২৩ তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিকের মতে ভগ্নস্বাস্থ্য ও নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার অভাবের জন্য তিনি ঢাকার শাসনভার তুলে দিয়েছিলেন পত্নী ঘসেটি বেগম ও তাঁর প্রিয়পাত্র হোসেন কুলি খানের ওপর।২৪

ঘসেটি বেগম ও নওয়াজিস মহম্মদের কোনও সন্তান ছিল না। তাই তাঁরা সিরাজদ্দৌল্লার ছোট ভাই এক্রামুদ্দৌল্লাকে দত্তক নিলেন। এক্ৰাম নওয়াজিসের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন এবং তাঁর জীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস। এদিকে আলিবর্দি খান ১৭৫২ সালে তাঁর দুই জামাতা ও ভ্রাতুষ্পুত্র, নওয়াজিস মহম্মদ ও পূর্ণিয়ার নবাব সৈয়দ আহমেদকে বাদ দিয়ে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন।২৫ এতে মনে হয় নওয়াজিস খুবই ক্ষুব্ধ হন এবং তখন থেকে তিনি তাঁর বেগম ঘসেটিকে নিয়ে প্রধানত মুর্শিদাবাদে তাঁর মোতিঝিলের প্রাসাদে বাস করতে থাকেন। এর কিছুদিন পরেই ১৭৫৪ সালে তাঁর দত্তক পুত্র ও প্রাণাধিক প্রিয় এক্রামুদ্দৌল্লা বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নওয়াজিস এ নিদারুণ শোক সহ্য করতে পারলেন না। ১৭৫৫ সালের ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। মোতিঝিলের প্রাসাদে এক্রামুদ্দৌল্লার পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।২৬

নওয়াজিসের মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগম ঢাকার শাসনব্যবস্থা পুরোপুরি হোসেন কুলির হাতেই দিয়ে দেন। আমরা আগেই বলেছি, ঘসেটির সঙ্গে হোসেন কুলির অবৈধ সম্পর্ক ছিল এবং কথিত আছে যে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা কৌশল করে সিরাজদ্দৌলাকে দিয়ে হোসেন কুলিকে হত্যা করান। এরপর ঢাকার শাসনভার চলে যায় নওয়াজিস পত্নী ঘসেটির আরেক প্রিয়পাত্র ও ঘনিষ্ঠ রাজবল্লভের হাতে। নওয়াজিস অত্যন্ত ধনী ছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর বেগম ঘসেটিই সবকিছুর মালিক হন। ঘসেটি প্রথম থেকেই সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ ছিলেন। প্রথমত তাঁর আশঙ্কা ছিল সিরাজ নবাব হয়েই তাঁর সব ধনসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবেন। তা ছাড়া তিনি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে নিজের জন্য মসনদ দখল করতে চেয়েছিলেন। আলিবর্দি তাঁর জীবিতাবস্থায় দু’জনের মধ্যে আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সফল হতে পারেননি। বৃদ্ধ নবাব ৮০ বছর বয়সে ১৭৫৬ সালের ৯/১০ এপ্রিল মারা যান। খোশবাগে তাকে সমাধিস্থ করা হয়।২৭

নবাব আলিবর্দির মৃত্যুর পর সিরাজদ্দৌল্লা ১০ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন। প্রথমেই তিনি মসনদের জন্য তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঘসেটি বেগমের সঙ্গে মোকাবিলা করতে চাইলেন। স্বামী নওয়াজিসের দৌলতে ঘসেটি প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন। তা ছাড়া হোসেন কুলির মৃত্যুর পর ঢাকার শাসনভার যাঁর হাতে ছিল, সেই রাজবল্লভও ঘসেটি বেগমের দলভুক্ত হয়ে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে বেশ শক্তিশালী চক্র গড়ে তোলেন। এদিকে সিরাজও সন্দেহ করেছিলেন যে ঘসেটি ও রাজবল্লভ ইংরেজদেরও তাদের দলে সামিল করার চেষ্টা করছিলেন। এ সন্দেহ একেবারে অমূলক নয়।২৮ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রেকর্ড থেকে এর সত্যতা প্রমাণ করা যায়। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির অধ্যক্ষ রেনল্ট (Renault) লিখেছেন যে, ইংরেজদের ধারণা হয়েছিল যে ঘসেটি বেগমের দলকে কেউ রুখতে পারবে না, ঘসেটিই মসনদ দখল করবেন। সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য। তাই তারা বেগমের সঙ্গে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে যোগ দেয়।২৯ আবার কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির প্রধান জাঁ ল’ও বলেছেন যে ইংরেজরা ভেবেছিল সিরাজদ্দৌল্লা কখনওই নবাব হতে পারবেন না। এ অভিমত অন্য একটি ফরাসি তথ্যেও পাওয়া যায়।৩০ ইংরেজদের মধ্যে অনেকের লেখা থেকেও এটা স্পষ্ট। হলওয়েলের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের সাফল্য সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নেই। এমনকী কলকাতার গভর্নর রজার ড্রেকেরও (Roger Drake) ধারণা ছিল ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে সিরাজের সফল হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই।৩১

এই পরিপ্রেক্ষিতে ঘসেটি বেগমকে শায়েস্তা করা ছাড়া সিরাজদ্দৌল্লার কোনও গত্যন্তর ছিল না। সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ অবশ্য বলেছেন যে ঘসেটি বেগমের ধনসম্পদ হস্তগত করাই ছিল সিরাজের প্রধান উদ্দেশ্য। এটা মনে হয় সর্বাংশে সত্য নয়। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে সিরাজ ভাবতেই পারেন যে ঘসেটি বেগমের হাতে যে প্রভূত অর্থ আছে, তা তিনি সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে নানাভাবে কাজে লাগাতে পারেন। সেজন্য তাঁর কাছ থেকে ওই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা অত্যন্ত জরুরি। ঘসেটি বেগম যে তাঁর ঐশ্বর্য ছড়িয়ে নানা শ্রেণীর লোককে তাঁর দলে টানছিলেন তা ফারসি ইতিহাসেও আছে।

তবে নবাব সিরাজদ্দৌল্লা ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে প্রথমে কোনও জোরজবরদস্তি করেননি। তিনি আপস-মীমাংসার চেষ্টাই করেছিলেন। এজন্য তিনি আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা ও বণিকরাজা জগৎশেঠকে ঘসেটি বেগমের কাছে পাঠান যাতে বেগম মোতিঝিলের প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। ঘসেটি বেগমের সঙ্গে সমঝোতা করতে সিরাজ যে এই কুটনৈতিক চালের আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারিখ-ই-বংগালা-ই মহবৎজঙ্গীর লেখক ইউসুফ আলিও তাঁর তারিফ না করে পারেননি। উক্ত লেখক এই মর্মে লিখেছেন যে, বহুলোক যারা আগে বেগমকে সমর্থন করত, তারা সিরাজের আপসমূলক নীতি ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মেটাবার প্রচেষ্টায় সন্তুষ্ট হয়ে বেগমের দল ছেড়ে সিরাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে।৩২ এদিকে হোসেন কুলির মৃত্যুর পর ঘসেটি বেগমের আরেক প্রণয়ী, মীরজা নজর আলি, মোতিঝিলের রক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। কোনও কোনও ফারসি ঐতিহাসিকের মতে সিরাজদ্দৌল্লা মোতিঝিল আক্রমণ করেন। নজর আলি পালিয়ে যান এবং সিরাজ বেগমকে বন্দি করে তাঁর সমস্ত ধনসম্পদ তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে নিয়ে আসেন। মুজাফ্‌ফরনামার লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী এই সম্পদের মধ্যে হিরে, জহরত ছাড়াই নগদ চার কোটি টাকা, চল্লিশ লক্ষ মোহর এবং এক কোটি টাকা মূল্যের সোনা, রুপোর বাসন ছিল।৩৩ এটা অত্যুক্তি বলেই মনে হয়।

ঘসেটি বেগমের জীবন করুণ পরিণতির মধ্যেই শেষ হয়। আমরা আগেই দেখেছি, পলাশি যুদ্ধের পরে মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা, তাঁর দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগম, সিরাজ-পত্নী লুৎফুন্নেসা ও তাঁর শিশুকন্যাকে বন্দি করা হয় এবং কিছুদিন পরে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, আগস্ট ১৭৫৮-তে। মীরণ এঁদের সবাইকে মসনদের দাবিদার ভেবে তাঁর শত্রু মনে করতেন। তিনি ঢাকার ডেপুটি গভর্নর যশরত খানকে এঁদের সবাইকে মেরে ফেলতে নির্দেশ পাঠান। যশরত তাতে রাজি না হওয়ায় মীরণ এ কাজ সম্পন্ন করতে তাঁর এক অনুচরকে পাঠান। সে অনুচরের কাছ থেকে ব্যাপারটা জানতে পেরে ঘসেটি বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েন। কথিত আছে যে, এসময় আমিনা ও ঘসেটি বেগম এই বলে সান্ত্বনা পাওয়ার চেষ্টা করেন যে তাঁরা নিজেরাই অনেক পাপ করেছেন, তাই মর্মান্তিক মৃত্যুই তাদের প্রাপ্য। তবে তাঁরা ভাগ্যবান যে এভাবে মৃত্যু হলে তাঁদের পাপের ভার মীরণের ওপর পড়বে। তাদের দু’জনকে একটি নৌকো করে ঢাকার অদূরে বুড়িগঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেই নৌকো মাঝনদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে দুই বোন ঘসেটি ও আমিনা বেগমের সলিল সমাধি হয়। জনশ্রুতি আছে যে দুই বোন মীরণকে এই বলে অভিশাপ দেন যে বজ্রাঘাতে যেন তাঁর মৃত্যু হয়। তাই নাকি হয়েছিল, যদিও এর সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ আছে।৩৪

আমিনা বেগম

আমিনা বেগম নবাব আলিবর্দির কনিষ্ঠা কন্যা ও সিরাজদ্দৌল্লার জননী। তাঁর বিয়ে হয় আলিবর্দির ভ্রাতুষ্পুত্র জৈনুদ্দিন আহমেদ খানের সঙ্গে। পরে আলিবর্দি জৈনুদ্দিনকে বিহারের ডেপুটি গভর্নর করে পাঠান। আমিনাও তাঁর সঙ্গে পাটনা যান। কিন্তু আমিনা বেগমের কপালে খুব বেশিদিন সুখভোগ করা ছিল না। বিহারের বিদ্রোহী আফগানরা আলিবর্দির ওপর প্রতিশোধ নিতে জৈনুদ্দিন ও তাঁর বৃদ্ধ পিতাকে হত্যা করে। আমিনা কোনওরকমে বেঁচে যান। আফগানরা তাঁকে বন্দি করে রাখে। শোনা যায় যে আফগানরা বেআব্রু করে খোলা গাড়িতে আমিনাকে পাটনায় প্রদক্ষিণ করায় এবং এতে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত অত্যন্ত ব্যথা পায়। পরে আলিবর্দি পাটনা অভিযান করে আফগানদের শায়েস্তা করেন এবং আমিনাকে উদ্ধার করতে সমর্থ হন। এরপর আমিনা বেগম মুর্শিদাবাদে এসে আশ্রয় নেন।৩৫ সেখানে তিনি দিদি ঘসেটি বেগমের মতো অবৈধ প্রণয়ে লিপ্ত হয়ে পড়েন। সেটা ভেবেই হয়তো সিয়রের অনুবাদক নোটা মানুস (Nota Manus) ওরফে হাজি মুস্তাফা মন্তব্য করেন যে ‘She [Amina] became famous in Murshidabad by her amours and gallantry’.৩৬ দিদির প্রণয়ী হোসেন কুলির সঙ্গে তাঁর অবৈধ সম্পর্ক হয় এবং আমরা দেখেছি বেগম শরফুন্নেসার উদ্যোগে কীভাবে হোসেন কুলিকে হত্যা করা হয়। এই ত্রিকোণ প্রেম মুর্শিদাবাদের জনমানসে যে কতটা প্রভাব ফেলেছিল তা সিয়রের লেখক ও আলিবর্দির আত্মীয় গোলাম হোসেনের লেখা থেকে স্পষ্ট।৩৭

In the zenith of the conqueror’s (Alivardi’s) power, such infamies and lewdness came to be practised by some females and other persons of his family, as cannot be mentioned with decency, but effectually dishonoured his family for ever. All his daughters as well as his beloved Siraj-ud-daulla, lapsed into such a flagitious conduct, and they were guilty of such a variety of shameful excesses, as would have disgraced totally any person whatever, still more, persons of their elevated rank and sublime station.

এখানে অবশ্য বলা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা সম্বন্ধে গোলাম হোসেনের যে বক্তব্য তা আমরা পুরোপুরি মেনে নিতে পারি না—এটা অনেকটাই উদ্দেশ্য প্রণোদিত, যা আমরা অন্যত্র বিশদ তথ্যপ্রমাণ দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করেছি।৩৮

আমিনা সম্বন্ধে অবশ্য বলা যায় যে তিনি নাকি উদার এবং কোমল বৃত্তিসম্পন্ন মহিলা ছিলেন। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করার পর সিরাজ যখন উইলিয়াম ওয়াটস ও তাঁর স্ত্রী পরিবারকে তাঁর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা যেতে বাধ্য করেন এবং পরে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান, তখন নাকি আমিনা বেগমের অনুনয়ে সিরাজদ্দৌল্লা তাদের মুক্তি দেন। এটা বোধ হয় সঠিক নয়, কারণ সিরাজ ওয়াটসের পরিবারকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যান এমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য কিন্তু পাওয়া যায় না। বরঞ্চ দেখা যায় যে, কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজ ইংরেজ কুঠির অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ছাড়া কিছুতে হাত দেননি। ইংরেজ মহিলা, শিশুদের এমনকী ওয়াটস সমেত কোনও কর্মচারীকে বন্দিও করেননি। শুধু ওয়াটস ও বেটসনকে তাঁর সঙ্গে কলকাতা অভিমুখে যাত্রার সঙ্গী করে নেন, খুব সম্ভবত সিরাজের সঙ্গে আপস-মীমাংসা করে নেওয়ার জন্য কলকাতার গভর্নর ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য।৩৯

আমিনা বেগমের জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ মুহূর্ত দেখা দেয় পলাশির যুদ্ধের ক’দিন পরে। পলাশির যুদ্ধে পরাজিত নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে নতুন নবাব মীরজাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে হত্যা করা হয়। তারপর সিরাজের ছিন্নভিন্ন দেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে মুর্শিদাবাদ শহরে ঘোরানো হয়। মৃতদেহ নিয়ে হাতিটি আমিনার প্রাসাদের কাছে এসে পৌঁছয়। আমিনা খবর পেয়ে তখন বেআব্রু অবস্থায় পাগলের মতো বেরিয়ে আসেন এবং প্রিয়পুত্রের মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করতে থাকেন। এই হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে মুর্শিদাবাদের মানুষ অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এমন অবস্থা দেখে মীরজাফরের ভাগ্নে ও নানা বদ অভ্যেস ও বদকাজে তাঁর সহযোগী খাদিম হোসেন খান তাঁর ভৃত্যদের আমিনা বেগম ও অন্য মহিলাদের জোর করে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে নির্দেশ দেন। এরপর যখন সিরাজের মৃতদেহ মুর্শিদাবাদের বাজারে এনে ফেলে দেওয়া হল, এবং কেউ মৃতদেহকে স্নান করিয়ে সমাধিস্থ করতে এগিয়ে এল না, তখন নবাব পরিবারের কাছে ঋণী এক বৃদ্ধ, মীর্জা জয়নাল আবেদিন বাকাওয়াল, সিরাজের মৃতদেহকে স্নান করিয়ে শবাধারে রেখে খোশবাগে আলিবর্দির সমাধির পাশে সমাধিস্থ করেন।৪০ এরপর আমিনার জীবনে যে দুঃসময় নেমে আসে এবং তাঁর যে মর্মান্তিক মৃত্যু হয় তা আমরা আগেই বলেছি।

লুৎফুন্নেসা—সিরাজ-বেগম

লুৎফুন্নেসার নামে বাঙালির হৃদয়তন্ত্রীতে এখনও বিষাদের সুর বেজে ওঠে। সত্য-মিথ্যা কল্পনা মিশে লুৎফুন্নেসা এখনও বাঙালির জনমানসে প্রেম, ভালবাসা, ত্যাগ, তিতিক্ষার মূর্ত প্রতীক। আর বলা বাহুল্য, মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের সঙ্গে লুৎফুন্নেসার নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তাঁর শৈশবের পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কথিত আছে যে তিনি জন্মসূত্রে হিন্দু ছিলেন। নাম ছিল রাজ কনওয়ার। তিনি সিরাজ-জননীর ক্রীতদাসী ছিলেন এবং সিরাজের তাঁকে খুব পছন্দ হওয়ায় তিনি তাকে সিরাজের হাতে তুলে দেন। সিরাজ তাঁর রূপ ও গুণে এতই মুগ্ধ হন যে তিনি তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে হারেমে রাখেন এবং তাঁর নতুন নামকরণ করেন লুৎফুন্নেসা। তাদের একটি কন্যা সন্তানও জন্মায়।৪১ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৭৪৬ সালে আলিবর্দি তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে মহম্মদ ইরাজ খানের কন্যা উমদাতুন্নেসা ওরফে বানু বেগমের খুব ধুমধাম করে বিবাহ দেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাঁর ভক্তি, ভালবাসা, সেবাযত্ন ও গভীর অনুরাগে তাঁর স্বামীকে এমনই আপন করে নিলেন যে সিরাজ তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী বানু বেগমের চেয়েও লুৎফুন্নেসার ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন এবং কার্যত তাকেই প্রধান বেগমের মর্যাদা দেন।

লুৎফুন্নেসাও অবশ্য এই মর্যাদার যথাযোগ্য সম্মান রেখেছিলেন। মুর্শিদাবাদের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় এক শতাব্দীরও আগে লুৎফুন্নেসা সম্বন্ধে যা লিখেছিলেন তা যদিও খুবই ভাবাবেগপূর্ণ, তবুও অনেকাংশে সত্য।৪২

লুৎফ উন্নেসা মানবী হয়েও দেবী। তাঁর এই পবিত্র দেবভাবে হতভাগ্য সিরাজ নিজের অপদগ্ধ জীবনে কিছুটা শান্তি লাভ করতে পেরেছিলেন। লুৎফ উন্নেসা ছায়ার মতো সিরাজের সঙ্গ দিতেন। কি বিপদে, কি সম্পদে, লুৎফ উন্নেসা কখনও সিরাজকে পরিত্যাগ করেননি। যখন সিরাজ বাঙ্গালা, বিহার, উড়িষ্যার যুবরাজ হয়ে আমোদ তরঙ্গে গা ঢেলে দিতেন, তখনও লুৎফু উন্নেসা তাঁর সহচরী। আবার যখন রাজ্যভ্রষ্ট হয়ে তেজোহীন—আভাহীন—কক্ষচ্যুত গ্রহের মতো পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, তখনও লুৎফ উন্নেসা তাঁরই অনুবর্তিনী। যখন… [পলাশি যুদ্ধের পর] তাঁর আকুল আহ্বানে ও মর্মভেদী অনুনয়ে কেউই তাঁর অনুসরণ করতে ইচ্ছে করেনি, কেবল লুৎফ উন্নেসা নিজের জীবনকে অকিঞ্চিৎকর মনে করে শত বিপদ মাথায় নিয়ে সিরাজের পেছনে পেছনে চলেছেন। স্বামীর দেহত্যাগের পরও তাঁর জীবন তাঁরই পরকালের কল্যাণের উদ্দেশ্যে সমর্পিত হয়।

অবশ্য অনেকে বলেন যে লুৎফুন্নেসার প্রতি সিরাজের ভালবাসা এবং আনুগত্যের আরও একটি কারণ ছিল। সিরাজ ফৈজি ফরজান নামে দিল্লির এক অপূর্ব সুন্দরী নর্তকীর মোহে পড়েন এবং তাকে এনে তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে তোলেন। কিছুদিন পর ফৈজি সিরাজের ভগ্নীপতি সৈয়দ মহম্মদ খানের শারীরিক সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাঁর প্রেমে পড়েন এবং লুকিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেন। এটা টের পেয়ে সিরাজ ফৈজিকে প্রাসাদের একটি ঘরে বন্দি করে চারদিক থেকে ঘরটি বন্ধ করে দেন। তাতে ফৈজির নির্মম মৃত্যু হয়।৪৩ ফৈজির বিশ্বাসঘাতকতায় সিরাজ খুবই আঘাত পান এবং ফলে লুৎফুন্নেসার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সিরাজদ্দৌল্লা যখন মুর্শিদাবাদে পালিয়ে আসেন। তখন তাঁর এত বড় বিপদে তাঁর পাশে দাঁড়াবার জন্য বিশেষ কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকী তাঁর শ্বশুর ইরাজ খানও সাহায্যের হাত বাড়াননি। বাধ্য হয়ে সিরাজ ২৫ জুন রাত্রির অন্ধকারে মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করলেন—সঙ্গে লুৎফুন্নেসা, তিন বছরের শিশুকন্যা ও দু’একজন দাসদাসী। সিরাজদ্দৌল্লা নাকি লুৎফুন্নেসাকে এ অবস্থায় তাঁর সঙ্গে যেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু লুৎফুন্নেসা তাতে কর্ণপাতও করেননি—এ দুর্দিনে তিনি স্বামীকে একা একা যেতে দিতে কিছুতেই রাজি হননি। তিনদিন তিনরাত অনাহারে পথ চলার পর রাজমহলের কাছে নৌকো থেকে নেমে সিরাজ দানশাহ নামে এক ফকিরের কাছে খাবার চাইতে গেলেন। সিরাজকে চিনতে পেরে দানাশাহ তাঁকে মীরজাফরের জামাই মীরকাশিমের হাতে তুলে দেন। এরপর তাকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে মীরজাফরের পুত্র মীরণের গুপ্তঘাতক মহম্মদি বেগ সিরাজকে হত্যা করেন। এসব ঘটনা মোটামুটিভাবে সবার জানা। তাই বিস্তারিত বিবরণের প্রয়োজন নেই।৪৪

স্বামীর মৃত্যুর পর লুৎফুন্নেসার জীবন নিদারুণ দুঃখদুর্দশা ও দারিদ্রের মধ্যে কাটে। নতুন নবাব মীরজাফর ও তাঁর পুত্র মীরণ লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা উম্মত জহুরাকে আলিবর্দির বেগম শরফুন্নেসা, দুই কন্যা ঘসেটি ও আমিনা বেগমের সঙ্গে ১৭৫৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় নির্বাসিত করেন। সেখানে কীভাবে মীরণের নির্দেশে ঘসেটি ও আমিনা বেগমকে নৌকো থেকে নদীগর্ভে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় তা আগেই বলা হয়েছে। শরফুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা প্রাণে বেঁচে গেলেও বন্দি অবস্থায় তাদের দুঃখদুর্দশার সীমা ছিল না। তাঁদের জন্য যে সামান্য মাসোহারার ব্যবস্থা ছিল তাও তারা নিয়মিত পেতেন না। পরে মহম্মদ রেজা খান যখন ঢাকার শাসক হয়ে আসেন তখন তাঁদের নিয়মিত মাসোহারা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। আর ভাগ্যের এমনই পরিহাস, যে ক্লাইভ তাঁর স্বামীর ভাগ্য বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ, তাঁরই কৃপায় ঢাকায় সাত বছর বন্দিজীবন যাপন করার পর লুৎফুন্নেসাদের মুর্শিদাবাদে ফেরত পাঠানো হয়।৪৫

মুর্শিদাবাদে আসার পর শরফুন্নেসা, লুৎফুন্নেসা ও তাঁর কন্যা কোম্পানি সরকারের কাছে তাঁদের জীবিকার জন্য মাসোহারার ব্যবস্থা করতে আবেদন করেন। আবেদনপত্রে তিনজনেরই স্বাক্ষর ছিল।৪৬ লুৎফুন্নেসাকে খোশবাগে আলিবর্দি ও সিরাজদ্দৌল্লার সমাধির তত্ত্বাবধান করার ভার দেওয়া হয়। এজন্য তিনি মাসে ৩০৫ টাকা করে পেতেন। তা ছাড়া মাসে ১০০ টাকা করে তিনি মাসোহারা পেতেন। কিছুদিন পর তাঁর একমাত্র কন্যা উম্মত জহুরার স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি খুবই শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ১৭৭৪ সালে উম্মত জহুরার মৃত্যু হয়। জহুরার চারটি অল্প বয়স্কা কন্যা ছিল—শরফুন্নেসা, আসমতুন্নেসা, সাকিনা, আমাতুলমাদি। কোম্পানি এঁদের ভরণপোষণের জন্য মাসে ৫০০ টাকা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করে।৪৭ কিন্তু তারা যখন বড় হয়ে উঠল, তখন ওই টাকায় তাদের খরচপত্র চালানো লুৎফুন্নেসার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। তাই তিনি ১৭৮৭ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসকে তাঁর অবস্থার কথা জানিয়ে এবং তাঁদের মাসোহারা বাড়াবার অনুরোধ জানিয়ে একটি চিঠি দেন। তাতে তিনি এটা জানান যে জহুরার দুটি মেয়ের তিনি বিয়ে দিয়েছেন, এতে তাঁর প্রচুর খরচ হয়েছে। আরও দুটি মেয়ের বিয়ে দিতে হবে, যা ব্যয় সাপেক্ষ এসব যেন বিবেচনা করা হয়।৪৮ কিন্তু কর্নওয়ালিসের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। লুৎফুন্নেসা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লার সমাধির দেখাশোনা করেছেন এবং রোজই সমাধিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ দিয়েছেন। ১৭৯৫ সালের নভেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয়।

সিরাজদ্দৌল্লার মৃত্যুর পর অনেকেই লুৎফুন্নেসাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি কারও প্রস্তাবে রাজি হননি। মুজাফ্‌ফরনামার লেখক করম আলি লিখেছেন যে এরকম এক ব্যক্তি লুৎফুন্নেসাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে লুৎফুন্নেসা উত্তর দিয়েছিলেন যে ‘আমি হাতির পিঠে চড়তে অভ্যস্ত ছিলাম, এখন গদর্ভের পিঠে চড়ব কী করে’?৪৯ এটা থেকে লুৎফুন্নেসার চরিত্রের দৃঢ়তা ও তেজস্বিতার প্রমাণ পাওয়া যায়।

মুন্নি বেগম

যদিও এ গ্রন্থে স্বাধীন নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিবৃত্ত আমাদের আলোচ্য বিষয়, তাই মীরজাফর বা তাঁর বেগম মুন্নি আমাদের আওতায় ঠিক পড়ে না। তবু মুর্শিদাবাদের বেগম বৃত্তান্ত আলোচনা করতে গিয়ে মুন্নি বেগমকে বাদ দিলে তাতে কিছুটা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। কারণ মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে মুন্নি বেগমের জীবনই বোধ হয় সবচেয়ে বর্ণময় ও রোমাঞ্চকর। মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি চতুর, কৌশলী, বুদ্ধিমতী, স্বার্থান্বেষী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্না ছিলেন। তাই তিনি মীরজাফরের বিবাহিতা স্ত্রী না হয়েও তাঁর বিবাহিতা স্ত্রী শা’ খানমকে ম্লান করে দিয়ে মীরজাফরের প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন।৫০

মুন্নি বেগমের জীবন অনেকটাই সরদানার প্রখ্যাত রানী সমরুর মতো। গরিবের ঘরে জন্ম, দারিদ্রের মধ্যে শিশুকাল আর পরবর্তী জীবনে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের চূড়ায়— যেন রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছেন। সিকান্দ্রার কাছে বলকুণ্ডা নামের এক অখ্যাত গ্রামের এক গরিব বিধবার সন্তান তিনি। দারিদ্রের জন্য বিধবা মা ছোটবেলাতেই তাঁকে একজন আমিরের বিশু নামে এক ক্রীতদাসীর কাছে বিক্রি করে দেন। বিশু পাঁচ বছর দিল্লিতে ছিলেন এবং সেখানে মুন্নিকে নাচগানে তালিম দেন। কিছুদিনের মধ্যে মুন্নির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আনুমানিক ১৭৪৬ সালের আগস্ট মাসে নওয়াজিস মহম্মদ খান তাঁর দত্তকপুত্র এক্রামুদ্দৌল্লার বিয়ে উপলক্ষে মুন্নিসহ বিশুর নর্তকীর দলকে দশ হাজার টাকা দিয়ে মুজরো করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। এরপর মুন্নি ও বিশুর দল ওখানেই থেকে যায় এবং আমির ওমরাহদের মনোরঞ্জন করতে থাকে। মীরজাফর মাসে পাঁচশো টাকা দিয়ে দলটিকে নিজের দরবারের জন্য নিয়োগ করলেন। কিন্তু নিজে মুন্নির রূপ ও গানে এতই মোহিত হয়ে পড়লেন যে তাঁকে নিজের হারেমে নিয়ে এলেন। আর মুন্নি সুকৌশলে মীরজাফরকে বশীভূত করে তাঁর প্রধানা বেগম হয়ে ওঠেন, যার ফলে মীরজাফর পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয়ের পর তাঁর মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ থেকে যে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ আত্মসাৎ করেছিলেন, তাঁর পুরোটারই অধিকারী হতে পেরেছিলেন।

১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মীরজাফরের মৃত্যু হয়। তাঁর স্ত্রী বব্বু বেগমের মুবারকউদ্দৌল্লা নামে এক পুত্র ও মুন্নি বেগমের দুই পুত্র ছিল—নজমউদ্দৌল্লা ও সইফউদ্দৌল্লা। মুন্নি বেগম কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের প্রচুর পরিমাণ ঘুষ দিয়ে নিজের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে মসনদে বসবার ব্যবস্থা করলেন। কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিল মীরজাফর পুত্র মীরণের একমাত্র বৈধ পুত্রের নবাব হওয়ার ন্যায্য দাবি নস্যাৎ করে মুন্নি বেগমের ১৫ বছরের পুত্র নজমউদ্দৌল্লাকে নবাব করে দিল। কিন্তু নজমউদ্দৌল্লা জ্বর হয়ে ১৭৬৬ সালের ৮ মে মারা যান। এরপর তাঁর ছোটভাই নবাব হলেন। ১৭৭০ সালের মার্চ মাসে তারও অকাল মৃত্যু হয়। ফলে বন্ধু বেগমের ১২ বছরের পুত্র মুবারকউদ্দৌল্লা মসনদে বসেন। বলা বাহুল্য, তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই পুত্র নবাব থাকাকালীন মুন্নি বেগমের হাতেই ছিল সব ক্ষমতা, তিনিই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। বব্বু বেগম একেবারে অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হলেন।

কিন্তু মুবারকউদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর মুন্নি বেগমের ক্ষমতার অবসান হল। ক্ষমতায় থাকাকালীন মুন্নি বেগম নায়েব দেওয়ান ও ডেপুটি গভর্নর মহম্মদ রেজা খানকে বেশ অবজ্ঞা করেই চলতেন। এখন সুযোগ বুঝে রেজা খান তাঁর প্রতিশোধ নিলেন। কিছুটা তাঁরই প্ররোচনায় গভর্নর কার্টিয়ার আদেশ দিলেন যে এখন যেহেতু মুবারকউদ্দৌল্লাই নবাব, তাঁর মা বব্বু বেগমের হাতেই মুন্নি বেগমকে সব ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে— তাঁকে এখন বব্বু বেগমকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলে মানতে হবে। কিন্তু তাতে মুন্নি বেগম বিশেষ হতাশ হননি কারণ সুচতুর এই মহিলা জানতেন, একদিন না একদিন সুযোগ আসবেই, ধৈর্য ধরে শুধু অপেক্ষা করতে হবে। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন এসময়ের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন :

…whose [Munni Begam’s] extent of understanding nothing can be compared to, but the immense stock which is known to be possessed of in jewels and money, thought proper to take no notice of such an alteration; and although deeply wounded by such underhand deal ings, she thought it beneath her dignity to descend to an explanation; and she passed the whole over with a disdainful silence.

কিছুদিনের মধ্যেই কোম্পানির কর্মচারীদের রদবদল হল। ১৭৭২ সালের এপ্রিল মাসে কার্টিয়ারের জায়গায় গভর্নর হিসেবে যোগ দিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি কলকাতায় এসে লন্ডনের নির্দেশমতো নিজামতের তহবিল আত্মসাৎ ও তছরুপ করার অভিযোগে রেজা খানকে বন্দি করলেন। আর ওদিকে নবাবের নিজের মা বব্বু বেগমের হাত থেকে নিজামতের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা আবার মুন্নি বেগমকে দেওয়া হল। মুন্নি বেগমের বয়স তখন ৫০। তাঁর সাম্মানিক ধার্য হল বছরে ১,৪০,০০০ টাকা আর তাঁর সাহায্যকারী মহারাজ নন্দকুমারের পুত্র রাজা গুরুদাসের বেতন বছরে ১,০০,০০০ টাকা। শোনা যায় যে মুন্নি বেগম হেস্টিংসকে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে এ কাজ করিয়েছিলেন। এর মধ্যে হয়তো কিছুটা সত্য আছে কিন্তু এর পেছনে হেস্টিংসের অন্য মতলবও ছিল। লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতির সিক্রেট কমিটিকে তাঁর লেখা একটা চিঠিতে সেটা পরিষ্কার :

The Begam as a woman, is incapable of passing the bounds assigned her; her ambition cannot aspire in higher dignity. She has no children to provide for, or mislead her fidelity; her actual authority rests on the Nawab’s life, and therefore cannot endanger it. It must cease with his minority, when she must depend absolutely on the Company for sup-port against her ward and pupil, who will then become her master. Of course her interest must lead her to concur with all the designs of the Company and to solicit their patronage.

কিন্তু মুন্নি বেগমের এই সৌভাগ্য বেশি দিন স্থায়ী হল না। দু’বছর পরে ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল পদে নিযুক্ত হলেন বটে কিন্তু যে নতুন কাউন্সিল হল, তাতে তিনজন সদস্যই হেস্টিংস-বিরোধী। তারা মুন্নি বেগমকে অপসারণ করে আবার বব্বু বেগমকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। এতে হেস্টিংস খুবই মর্মাহত হন। মুন্নি অবশ্য বরাবরই হেস্টিংসের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর বিপদে আপদে সবসময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন। হেস্টিংসও অবশ্য তাঁর প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকী ১৭৮৩ সালে ভারতবর্ষ ছাড়ার আগে তিনি লন্ডনের পরিচালক সমিতির কাছে মুন্নি বেগমের প্রশংসা করে এবং বৃদ্ধ বয়সে তিনি যেন একটু আরামে থাকতে পারেন তাঁর জন্য ওঁর ভাতা যেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সে অনুরোধ জানান। মুন্নি বেগমের একটি আর্জিও এ চিঠির সঙ্গে পাঠানো হয়। তাতে অবশ্য খুব একটা ফল হয়নি—মুন্নি বেগমের মাসিক ভাতা ঠিক হল ১২,০০০ টাকা। সেটা এবং নিজের সঞ্চিত ধনভাণ্ডার দিয়ে সত্যিকারের বেগম ও রানির মতোই তিনি মুর্শিদাবাদে জীবন কাটাতে লাগলেন। তাঁকে কেউ ভালবাসত না কিন্তু নবাব থেকে সবাই তাঁকে ভয় করত।

মুন্নি বেগম আনুমানিক ৯৭ বছর বয়সে ১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তির মোট মূল্য ছিল ১৫ লক্ষ টাকার ওপর। জাফরাগঞ্জে মীরজাফরের পারিবারিক সমাধিক্ষেত্রে তাঁকেও সমাধিস্থ করা হয়। মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের দক্ষিণপূর্বে চক মসজিদ মুন্নি বেগম তৈরি করিয়েছিলেন। এটাই মুর্শিদাবাদের বৃহত্তম মসজিদ। নবাব সুজাউদ্দিনের প্রাসাদ চেহেল সুতুনের ধ্বংসাবশেষের ওপর এটি তৈরি হয় ১৭৬৭ সালে। মুন্নি বেগমকে কোম্পানির জননী আখ্যা দেওয়া হয়। তাঁর স্বামী নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর তিনি যখন শোকে মুহ্যমান তখন লর্ড ক্লাইভ নাকি তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দেন যে, ‘আমি মৃত নবাবকে বাঁচিয়ে তুলতে পারব না কিন্তু আপনাকে আন্তরিকভাবে জানাচ্ছি যে আমি এবং এখানকার আমার ইংরেজ সহকর্মীরা আমাদের আপনার সন্তান বলেই মনে করি, আপনাকে আমরা আমাদের জননী বলে জানি।’ বস্তুতপক্ষে ক্লাইভ এবং হেস্টিংস দুজনেই মুন্নি বেগমকে বেশ সম্ভ্রমের চোখে দেখতেন এবং তাঁর প্রতি যথেষ্ট সদয় ছিলেন। সত্যি বলতে গেলে মুন্নি বেগমের জীবনের মতো বারবার এমন উত্থানপতন, এমন বৈচিত্র্যে ভরা বর্ণময় জীবন মুর্শিদাবাদের বেগমদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাই আজও তাঁর স্মৃতি অমলিন।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪৫; রিয়াজ-উস-সলাতিন, পৃ. ৩২২।

২. Abdul Karim, Murshid Quli, p. 59

৩. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 2-3. ফারসি ইতিহাস সিয়র বা রিয়াজ-উস-সলাতিনে আগে থেকে বাদশাহের অনুমোদন নেওয়ার উল্লেখ কিছুই নেই। আসলে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে দিল্লির বাদশাহ শুধু নামেমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন কিন্তু কার্যত তাঁর কোনও ক্ষমতাই ছিল না। ফলে বাংলার নবাবরা দিল্লিতে যিনিই মসনদে বসতেন, তাঁকেই রাজস্ব পাঠাতেন। দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠালেই বাদশাহ সন্তুষ্ট থাকতেন, তাঁদের আর ঘাঁটাতেন না।

৪. রিয়াজ-উস-সলাতিন, পৃ. ২৮৮. রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন সলিম অবশ্য বলছেন যে সরফরাজকে নিবৃত্ত করেন তাঁর মাতামহী মুর্শিদপত্নী নাসিরা বানু বেগম, রিয়াজ, পৃ. ২৮৮। স্যার যদুনাথ সরকারের বক্তব্যও মোটামুটি তাই, History of Bengal, vol. 2, p.423. অন্যদিকে ব্রজেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি লিখেছেন যে জিন্নতউন্নেসাই সরফরাজকে তাঁর পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন, B. N. Banerjee, Beganas of Bengal, p. 2. অবশ্য তারিখ-ই বংগালার লেখক সলিমুল্লা জানাচ্ছেন, এ ব্যাপারে নাসিরা বানু ও জিন্নতউন্নেসা দু’জনেই সরফরাজকে নিবৃত্ত করেন, তারিখ-ই-বংগালা, পৃ. ৭২।

৫. ইউসুফ আলি, তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী, পৃ. ৮-৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 3-4; সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮২।

৬. রিয়াজ, পৃ. ৩১০-৩২১, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ২০-২৩; J. N. Sarkar, History of Bengal, vol. II, pp. 440-42; K. K. Datta, Alivardi and His Times, p. 248.

৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৪০; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 5.

৮. B.N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 6

৯. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬; J, N. Sarkar, Bengal Nawabs, Pp. 50, 147-48; 152-53.

১০. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৫৬।

১১. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 6.

১২. সিয়র, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৩৪৮-৫০, ৩৫৩-৫৫; রিয়াজ, পৃ. ৩২৭-২৮, ৩৩০।

১৩. রিয়াজ, পৃ. ৩২৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 8.

১৪. রিয়াজ, ৩৩৮-৩৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 7; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৭৯-৮০।

১৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১-১৪।

১৬. ঐ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬৫-৬৬।

১৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪২২।

১৮. B, N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 11; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, পৃ. ৮৪-৮৫।

১৯. Holwell to William Davis, 28 Feb. 1757, Hill, 111, pp. 151-52.

২০. Holwell, Interesting Historical Events, pt. I, Chap. II, pp. 170-71.

২১. B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 12.

২২. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০৯; J. N. Sarkar History of Bengal, vol II, p. 469; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 14.

২৩. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 34 35.

২৪. J. N. Sarkar, History of Bengal, vol. II, p. 470.

২৫. K. K. Datta, Sirajuddaullah, pp. 1-2.

২৬. মুজাফ্‌ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 56-57; আওয়াল-ই-মহবৎজঙ্গী, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 152-53; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 446; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৭।

২৭. রিয়াজ, পৃ. ৩৬২; মুজাফ্‌ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p.58; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০৯-১১; J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p.447.

২৮. S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 41-42.

২৯. ডুপ্লেকে রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 207.

৩০. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64; Hill, III, p. 219.

৩১. কোর্ট অফ্‌ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 349; Drake’s Narrative, 19 July 1756, Hill, I, pp. 122-23.

৩২. রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩; তারিখ-ই-বংগালা-ই-মজবৎজঙ্গী, পৃ. ১১৮।

৩৩. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬১-৬২; রিয়াজ, পৃ. ৩৬৩; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৫-৮৬, Hill, II, P. 2; III, pp. 217-18.

৩৪. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮১, ৩৬৮-৭০; রিয়াজ, ৩৮৯; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 21-23.

৩৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৪৩-৪৪, ৫৬।

৩৬. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৮২ পাদটীকা; ২য় খণ্ড, পৃ. ১২৪ পাদটীকা।

৩৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১২১।

৩৮. সুশীল চৌধুরী, পলাশির অজানা কাহিনী, পৃ. ১৯-২৩।

৩৯. Hyde, Parochial Annals of Bengal, p. 158 quoted in B.N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 25; Hill, I, p. lx; 176; S. Chaudhury, Prelude to Empire, pp. 46-47, fn. 46, p. 47,

৪০. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৭-৭৮; রিয়াজ, পৃ. ৩৭৬; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ, ২৪২-৪৩, J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 496.

৪১. Letter of the Board of Revenue to the Court of Directors, 29 Dec. 1794. Para 40, quoted in B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 31, fn; সিয়রেও তাঁকে ক্রীতদাসী বলে বর্ণনা করা হয়েছে, সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ১৮২; বেভারিজ অবশ্য বলেছেন যে লুৎফুন্নেসা মোহনলালের সহোদরা ছিলেন কিন্তু এটা বোধ হয় ঠিক নয়, Beveridge, ‘Old Places in Murshidabad’, Calcutta Review, 1892.

৪২. নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১১৩।

৪৩. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ. ৬১৪-১৫ এবং পাদটীকা; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১১৫-১৮। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ফৈজির ঘটনাটা কিন্তু রিয়াজ-উস-সলাতিন, মুজাফ্‌ফরনামা বা তারিখ-ই-বংগালা-ই-মহবৎজঙ্গীতে পাওয়া যায় না।

৪৪. রিয়াজ, পৃ. ৩৭৪-৭৬; মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৭-৭৮; সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪০-৪২; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২২-২৩; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 32-34.

৪৫. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৮১; B. N. Banerjee, Begams of Bengal, p. 35; নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২৪।

৪৬. Calender of Persian Correspondence, vol. 1, p. 452, Letter no. 2761, 10 Dec. 1756, quoted in B.N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 35-36.

৪৭. B. N. Banerjee, Begamas of Bengal, p. 36: নিখিলনাথ রায়, মুর্শিদাবাদ কাহিনী, পৃ. ১২২-২৩।

৪৮. Original Receipts, 1787, no. 176, quoted in B. N. Banerjee, Begams of Bengal, pp. 36-37.

৪৯. মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৭৮।

৫০. এর পরের অংশটি মূলত B. N. Banerjee, Begams of Bengal এবং সিয়র অবলম্বনে লেখা। তাই সূত্রনির্দেশ ও টীকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *