০৪. হামুরাবির সংবিধান

হামুরাবির সংবিধানকে বলা যায় পৃথিবীর প্রথম সংবিধান।

খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭৬ সালের কথা। ব্যাবিলন তখন প্‌থিবীর সবচেয়ে জমজমাট সাম্রাজ্য। ইরাক, ইরান আর সিরিয়া মিলে এর বিস্ত্‌তি। ব্যাবিলনের সবচেয়ে বিখ্যাত সম্রাট ছিলেন হামুরাবি। না, ইনি আকবরের মত দীর্ঘ সময় রাজত্ব করছেন বলে বিখ্যাত নন। কিংবা আলেকজান্ডারের মত অর্ধেক প্‌থিবী জয় করার জন্যও বিখ্যাত নন।

তার খ্যাতির পেছনে লুকিয়ে আছে একটা কোড যে কোড তার নাম বহন করে চলেছে। এই কোডে সেকালের সমস্ত আইন কানুন লেখা আছে। এই আইন এতোই প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে এর পরের যুগের শাসকেরাও এটা ফলো করে গেছে বহুদিন। কী এমন আইন যা মানুষ যুগ যুগ ধরে মানুষ অন্ধের মত অনুসরণ করে গেছে?

সংবিধানের ভেতরে একটু চোখ বুলানো যাক। তাহলেই রহস্যটা ক্লিয়ার হবে।

সংবিধানের শুরু হয়েছে স্রষ্টার নাম নিয়ে। আনু, ইনলিল আর মারডুক—সেকালের তিন দেবতা। বলা হচ্ছে—দেবতারা হামুরাবিকে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্য ধরাধামে পাঠিয়েছেন। এটা শাসকদের একটা কমন ফিচার। শাসকেরা যেই আইনই প্রণয়ন অরে, সেটাকে হায়ার অথরিটির’ নাম দিয়ে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করে। সেই হায়ার অথরিটি হতে পারে কোন ঈশ্বর বা শ্রদ্ধেয় কোন পূর্বপুরুষ। কিছু আইন এমনঃ

-এক লোক যদি আরেক লোকের চোখ উপড়ে ফেলে আর দুইজনই যদি অভিজাত হয়, তবে অপরাধীরও চোখ উপড়ে ফেলা হবে।

(চোখের বদলে চোখ—এই ব্যাপারটা এসেছে সম্ভবত হিব্রু ল থেকে। ইহুদীরা বিশ্বাস করতো, তারা খোদার ‘চজেন পিপল’। প্রতিটা ইসরায়েলীকেই খোদা পরম যত্নে তৈরি করছেন। কাজেই এক ইহুদী যদি আরেক ইহুদীর চোখ উপড়ে ফেলে, সেটা যতোটা না ঐ মানুষটার বিরুদ্ধে অন্যায়, তার চেয়ে অনেক বেশি খোদার বিরুদ্ধে অন্যায়। ফিলোসফিটা এমন—খোদা এতো কষ্ট করে এমন একটা জিনিস তৈরি করেছেন, তুমি কোন ছার যে তা নষ্ট করবা?)

-এক অভিজাত যদি এক সাধারণ মানুষের চোখ উপড়ে ফেলে, তবে তার ৬০ ভরি রৌপ্য জরিমানা দিলেই চলবে।

-এক অভিজাত যদি এক দাসের চোখ উপড়ে ফেলে, তবে সেই দাসকে যেই দামে কেনা হইসে, তার অর্ধেক জরিমানা হিসেবে দিলেই চলবে।

-এক অভিজাত পুরুষ যদি এক অভিজাত নারীকে গর্ভবতী করে ফেলে আর কোন কারণে সন্তানটি যদি মারা যায়, সেটা গর্ভাবস্থায় হোক কিংবা প্রসবের সময়, তবে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে দশ ভরি রৌপ্য দিলেই চলবে। আর যদি কোন কারণে মহিলাটি মারা যায় তবে শাস্তি হিসেবে সেই লোকের কন্যাসন্তানটিকে হত্যা করা হবে।

-একই ঘটনা যদি এক অভিজাত পুরুষ এক সাধারণ নারীর সাথে ঘটায়, তবে জরিমানা হিসেবে দিতে হিবে আগের অর্ধেক। মানে পাঁচ ভরি রৌপ্য। আর সেই মহিলা যদি মারা যায়, তবে আরো তিরিশ ভরি রৌপ্য দিলেই মাফ। অভিজাত বীরপুঙ্গবের কন্যাসন্তানটি এ যাত্রায় বেঁচে গেল।

-ঠিক এই ঘটনাই এক দাসীর সাথে ঘটলে অভিজাত পুরুষটিকে দিতে হবে যথাক্রমে দুই ভরি আর বিশ ভরি রৌপ্য।*

একটা অদ্ভূত নিয়ম খেয়াল করসেন নিশ্চয়ই। হামুরাবির সংবিধান অনুযায়ী পুত্র-কন্যা হচ্ছে বাপ-মা’র সম্পত্তি। অভিজাত বাবা পাপ করলে তার দায় ভোগ করতে হবে তার নিরপরাধ কন্যাটিকে। নারীদের জন্য প্‌থিবীটা সবসময়ই কঠিন ছিল। অন্তত লিখিত ইতিহাস যতোদিনের, ততোদিন তো বটেই।

কঠিন ছিল সাধারণ মানুষের জন্যও। স্পষ্টতই, সেকালে অভিজাত মানুষের জন্য এক রকম আইন ছিল, আর সাধারণ মানুষের জন্য এক। সকল মানুষ যে সমান—এই ধারণা আসেই নি তখনো।

এই ধারণার প্রয়োগ আমরা দেখি আরো বহু বছর পর ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সংবিধানে। ইংল্যান্ডের রাজার শাসনে অতিষ্ঠ একদল ভদ্রলোক নিজেদের জন্য এক রকম আইন তৈরি করে। সেখানে দ্‌প্তকণ্ঠে ঘোষনা করা হয়—সকল মানুষ সমান। যদিও মানুষ বলতে তারা অঘোষিতাভেব ‘শাদা মানুষ’-কেই বোঝাচ্ছিল। কালো মানুষেরা তখনো সিলেবাসের বাইরে ছিল। সকল মানুষ সমান—এই বোধটা আসতে আরো দুশো বছর লেগে যায়। দরকার হয়ে অনেক রক্তের। কালো মানুষের রক্তের।

কিন্তু আসলেই কি সব মানুষ সমান? আমরা কি বায়োলজিক্যালী সমান? উহুঁ। অর্থনৈতিকভাবে সবাই একই শ্রেণীতে পড়ি? তাও না। তবে কিভাবে মানুষ সমান হয়? আইন করে সকাল মানুষকে সমান ঘোষণা করারই বা দরকার কী? এর পেছনে কি কারো স্বার্থ আছে? আইনের জন্মই বা কেন?

মনে রাখতে হবে, আইনের জন্ম কিন্তু অভিজাতদের হাতে। সাধারণ মানুষ তৈরি করে প্রথা, আর অভিজাতেরা আইন। গল্প যেমন মিথ তৈরি করে, আইনও দিনে দিনে একটা মিথ তৈরি করে। প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা—এই আইনের কথা মনে আছে? এর ঠুনকোতা আমাদের আরবান কালচারে অনেক অনেক গল্প তৈরি করেছিল। নিউয়র্কে একটা মেয়ে চাইলেই প্রকাশ্যে টপলেস হতে পারবে। কিন্তু আইনত সেই টপলেস ছবি কোথাও কমার্শিয়ালী ব্যবহার করতে পারবে না। নিউয়র্কের জনসমাজেও হয়তো এই আইন নিয়ে নানা চটুল গল্প চালু আছে।

গল্প যেই কাজটা করে, আইনও ধীরে ধীরে সেই কাজটাই করে। একটা ইমাজিনড রিয়েলিটির জন্ম দেয়। জন্ম দেয় একটা অর্ডারের। সাধারণ মানুষের উপর ছড়ি ঘুরাবার জন্য এই অর্ডারটা দরকার অভিজাতদের।আইন ছাড়াও কিন্তু আমরা বেশ চলতে পারতাম। সেটা খুব ক্ষুদ্র গণ্ডিতে। ১০০ কি ১৫০ মানুষের দলে। আরো বড় ফেইজে যখন কো-অপারেশনের প্রয়োজন হয়, তখনই দরকার হয় আইন। আইনের দণ্ডটা যদিও অভিজাতদের হাতে, একটা বড়সড় সমাজকে ফাংশনাল রাখতে আইনের আসলেই কোন বিকল্প নেই।

একটা দেশ বা জাতি কতোটুকু সভ্য—তার প্রমাণ হয়, তার পাবলিক টয়লেট দেখে আর সে তার অভিজাতদের অন্যায়ের বিচার কতোটুকু করতে পারে—সেই মেট্রিক দিয়ে। আমাদের দেশে যেমন শুধু সংবিধানেই লেখা সবার জন্য একই আইন। বাস্তবে, অভিজাতদের জন্য এক আইন, আর সাধারণের জন্য আরেক। এদেশে একজন আইজি’র ছেলে যেমন বড় হতে হতে জেনে যায়, সে যে কারো উপর গাড়ি উঠিয়ে দিতে পারবে। ফুতপাতে ঘুমন্ত মানুষকে মেরে ফেললেও কেউ কিছু বলবে না। এই নলেজ কিন্তু সে সংবিধান পড়ে পায়নি, আশপাশটা দেখে পেয়েছে। আগেকার দিনে এই নলেজটাই অনেক খোলাখুলি সংবিধানে বলা থাকতো। সেদিক দিয়ে বিচার করলে, ব্যাবিলনের মানুষকে ভাল-মন্দ জাজ করা আপনার বিবেচনা, কিন্তু তারা যে অনেক সৎ ছিল—সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

ব্যাবিলনের সংবিধানের সবটাই যে খারাপ ছিল—তা নয়। সমাজের প্রতি যেন ইনডিভিজুয়ালের দায়িত্ববোধ তৈরি হয়—তার জন্য বেশ কড়া কিছু নিয়ম-কানুন ছিল সেই বিধানে। ধরা যাক, এক ইঞ্জিনিয়ার আপনার বাড়ি তৈরি করে দিল। কিছুদিন পর সেই বাড়ি ধ্বসে গিয়ে সবাই মারা গেল। আইনমতে, সেই ইঞ্জিনিয়ারের তখন ফাঁসি হবে। আজকের পারস্পকেটিভে এটা লঘু পাপে গুরুদণ্ড হলেও সেকালের দ্‌ষ্টিতে এটা ছিল ভয়ানক অপরাধ। আপনি যখন কারো জন্য কিছু নির্মাণ করছেন, তখন সেই বাড়িতে অবস্থানকালীন তার জানের জিম্মাদারিও আপনি নিচ্ছে। সেই জান বিগত হওয়া মানে আপনারও আর বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

কেবল সমাজের প্রতি ইনডিভিজুয়ালের নয়, ইনডিভিজুয়ালের প্রতি সমাজেরও একটা দায়িত্ব আছে। একটা আইন ছিল এমন—কোন একটা পাড়ায় কোন বহিরাগত এসে ছিনতাইয়ের শিকার হলে পাড়ার সবাই মিলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে। এটা হল পাড়ায় ছিনতাইকারী পোষার শাস্তি।

কোন বিধানই পারফেক্ট নয়। হামুরাবিরটাও না। তবু সেই সমাজে বিধান আর বিধানের বাইরের জীবনটায় দূরত্ব অনেক কম ছিল। সভ্যতার চাকা ঘুরতে ঘুরতে সেই দূরত্ব কেবল বেড়েই চলেছে। বেড়েই চলেছে।

আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত স্বপ্নগুলোও আসলে ‘ইমাজিনড অর্ডার’-ই ঠিক করে দেয়।

পপুলার কালচার আমাদের বলে—Follow your heart. হ্‌দয়ের দাবি শোনো। এখন এই হ্‌দয়ের দাবি তো শূন্য থেকে ভেসে ওঠা কোন চাহিদা নয়। হাজার বছরের সভ্যতায় এই দাবিগুলো তৈরি হয়েছে। ঊনিশ শতকের রোমান্টিসিজম আর বিশ শতকের কনজ্যুমারিজম সেই পালে আরো হাওয়া লাগিয়েছে। আমরা নিজেদের যতোই বিদ্রোহী, বিপ্লবী বা হাওয়া বিরোধী দাবি করি না কেন, দিন শেষে আমরা সেই হাওয়ার সাথেই চলি।

আপনার হয়তো ছুটিছাটায় খুব বেড়ানোর শখ। এই শখ কিন্তু আমাদের পূর্বপুরুষদের ছিল না। এক আলফা শিম্পাঞ্জী গায়ের জোর খাটিয়ে আরেক দল শিম্পাঞ্জীর বাসায় দাওয়াত খেতে যেতো না। আমাদের মিশরীয় দাদুরা অবসরে কক্সবাজার না গিয়ে বানাতেন পিরামিড। আর মমি। এই কক্সবাজার যাওয়ার কালচারটা শুরু করে মূলত রোমানরা। রোমান সাম্রাজ্যের শেষ দিকে অভিজাতরা তাদের সামার কাটানোর জন্য বেছে নিত মিশরকে। রোমানদের সেই কালচারই আজকের বিরাট পর্যটন শিল্পে রূপ নিয়েছে।

রোমান্টিসিজম আমাদের বলে, জীবনটাকে যতো পারো, উপভোগ করে নাও। যতো বেশি পারো, অভিজ্ঞতা অর্জন করে নাও। আমাদের তাই সব রকমের বই পড়ে দেখতে হবে, সব রকমের মুভি চেখে দেখতে হবে, সব রকমের খাবারের স্বাদ নিতে হবে, সব রকম রিলেশনশিপের মজা নিতে হবে, আর যতো যতো দর্শনীয় স্থান আছে—সবগুলো দেখে মরতে হবে।

কেন ভাই? কেন আমাকে সব কিছুই করতে হবে? গিভ মি এ্যা ব্রেক।

কিন্তু রোমান্টিসিজম আপনাকে ব্রেক দিলেও কনজ্যুমারিজম আপনাকে ব্রেক দিবে না। সে সারাক্ষণ আপনার চোখের সামনে এই সবের বিজ্ঞাপন নিয়ে হাজির হতে থাকবে। Ten things you must do before you get 30, ten places you must visit before you die, ten girls/boys you must date before you marry—এই সবই হচ্ছে পুঁজিবাদের টোপ। পত্রিকা ম্যাগাজিনের গণ্ডি ছাড়িয়ে সেই টোপ চলে এসেছে আপনার মুঠোফোনে। দিনরাত এগুলো দেখে আপনিও এক সময় নিজের বাকেট লিস্ট টৈরি করা শুরু করেন। কনজ্যুমারিজম আপনাকে যেই ছাঁচের মানুষ বানাতে চাচ্ছে, আপনি নিজের অজান্তে সেই ছাঁচের মানুষে পরিণত হচ্ছেন। যদিও মনে মনে ভাবছেন—আমার হ্‌দয় আমাকে এটা বলছে। সত্যটা হচ্ছে এই যে, হ্‌দয় আপনাকে বলছে না। বলছে পুঁজিবাদ। আমি আপনি তাতে সাড়া দিচ্ছি কেবল।

কনজ্যুমারিজমের কাজই হচ্ছে প্রোডাক্ট বিরক্রি করা। আর অভিজ্ঞতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রোডাক্ট। আপনার কানের কাছে এসে দিনরাত বিড়বিড় করা হবে—নায়াগ্রা ফলস না দেখলে আপনার জীবন ব্‌থা। কিংবা “প্‌থিবীতে দুই রকমের মানুষ আছে–এক, যারা নায়াগ্রা ফলস দেখসে। আর এক, যারা তা দেখেনি।” আপনি নিশ্চয়ই দুই নম্বর দলে পড়ে থাকতে চাইবেন না। প্রিয় মানুষদের কম সময় দিয়ে হলেও আপনি এক্সট্রা খেটে সেই অভিজ্ঞতাটা কিনতে চাইবেন।

আপনি হয়তো এই মধ্যবিত্তের দলে পড়েন না। আপনি পড়েন বিত্তবানদের দলে। আপনার সাথে আপনার বউয়ের রিলেশনশিপ ক্রাইসিস চলছে। তো এই ক্রাইসিস মেটানোর জন্য আপনি তাকে লন্ডন বা প্যারিস নিয়ে গেলেন। অথচ রাত করে বাড়িতে না ফিরে বউকে সময় দিলেই হয়তো এই ক্রাইসিস মেটানো যেত। কিন্তু পুঁজিবাদের চাকা তো তাইলে বন্ধ হয়ে যাবে। পুঁজিবাদ চাইবে, আপনাদের মধ্যে বারংবার ঝগড়া হোক। আর আপনারা বেশি বেশি করে হিল্লিদিল্লি করুন।

ওয়েল, এই কাজটাই ফারাওরা করতো তাদের বউয়ের জন্য তার মন পছন্দ সমাধি বানিয়ে। বউ নিয়ে তারা ব্যাবিলন ঘুরতে যেতো না। মোগল সম্রাটেরা করতেন তাজমহল বানিয়ে। আমাদের তাজমহল বানানোর সামর্থ্য নেই। কাজেই, আমরা বেশি বেশি করে এক্সপেরিয়েন্স নেবার চেষ্টা করি। এই এক্সপেরিয়েন্সগুলোই আমাদের তাজমহল। সমস্ত সভ্যতাই এভাবে তাজমহল বানিয়ে গেছে। তাজমহলের রূপটা কেবল বদলেছে যুগে যুগে।

হ্‌দয়ের দাবি নয়, সময়ের দাবীই তাই আমরা শুনে চলেছি বারবার। সাজেকের ইতিহাস হয়তো আপনার জানা। কীভাবে সেখানকার মানুষদের উচ্ছেদ করে সাজেক বানানো হয়েছে—আপনি তার খুঁটিনাটি জানেন। কাজেই, সাজেকে যেতে আপনার মন ঠিক সায় দেয় না। এদিকে বন্ধুবান্ধবের তোলা ছবি দেখে আপনার ঘুম পাড়ানো ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে। আর এটা তো জানা কথাই যে, সোশ্যাল মিডিয়া হচ্ছে কনজ্যুমারিজমের সবচেয়ে বড় চারণক্ষেত্র। আপনি গাড়ি, বাড়ি, ডিএসএলার—যাই কিনেন না কেনো, আপনাকে একটা ম্য্যণ্ডাটরি ছবি দিতেই হবে। মানুষ একটা কিছু অর্জন করে যতোটা না সুখ পায়, তার চেয়ে অনেক বেশি সুখ পায় অন্যের মধ্যে হাহাকার তৈরি করে। দিন শেষে আপনিও তাই ব্যাকপ্যাক নিয়ে সাজেকের উদ্দেশে রওনা দেন। জিত হয় কনজ্যুমারিজমের।

নিজের কথাই বলি। শাদা ইউরোপীয়রা এককালে আমেরিকার আদি অধিবাসীদের মোটামুটি নিশ্চিহ্ন করে তাদের ইমাজিনড অর্ডার তৈরি করেছে এখানে। আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সেখানটিতেই হয়তো কোন আদিবাসী ফ্যামিলির সুখী, সুন্দর সংসার ছিল। তাদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা জ্ঞানচর্চা করে চলেছি। এই জ্ঞানটুকু থাকার পরও আমরা কিন্তু এখানে আসি। এসে অন্যদের উপদেশ দিই, ফলো ইয়োর হার্ট। যদিও আমরাও সময়ের দাবিতেই এখানে এসেছি।

সবাই যে কনজ্যুমারিজমের দাস—তা অবশ্যই নয়। এক আধজন পাগল সব জায়গাতেই থাকে, যারা কিনা হ্‌দয়ের দাবি শোনে। এদের মধ্য থেকেই কেউ নিউটন হয়, আর কেউ হয় কৈলাশ সত্যার্থী।

গল্পের মিশরীয় ভার্সনটা এরকম।

দেবতা থট একবার এক নতুন জিনিস আবিষ্কার করলেন। এর নাম লিখিত ভাষা। এই নিয়ে তিনি সম্রাট থামুসের কাছে হাজির হলেন। ভাবলেন, এই নতুন টেকনোলজি দেখে রাজা বেজায় খুশি হবেন। কিন্তু না! রাজা বেজার হলেন। বললেন, এই টেকনোলজি লইয়া আমরা কী করিব? এর ফলে তো মানুষ আর কিছু মনে রাখতে চাইবে না। সব পুঁথিগত বিদ্যায় পণ্ডিত হবে। আস্তে আস্তে তার স্ম্‌তিশক্তি লোপ পাবে।

থামুসের ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরি না হলেও আংশিক সত্যি হয়েছে বলা যায়। তাতে কী? টেকনোলজি এমন একটা জিনিস যাকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারে না। কোন রাজা-মহারাজাও না। মানুষ নিজ প্রয়োজনেই তাকে আপন করে নেয়। থটের লিখিত ভাষাও তাই মানুষ যাকে সভ্যতা বলে, অতি দ্রুত সেই সভ্যতার কেন্দ্রে জায়গা করে নিল।

দেবতাদের গল্প পুরাণের পাতাতেই থাক। আমরা পুরাণ ছেড়ে বাস্তবে আসি।

কবি বলেছেন, Necessity is the mother of invention. ইরাকের দক্ষিণাঞ্চলে মানুষ যতো বাড়ছিলো, তাদের ফসলের ম্যানেজমেন্ট করাও ততো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। কে কতোটুকু ফসল ফলাচ্ছে, কার কাছ থেকে কতোটুকু খাজনা নিতে হবে—বেচারা গ্রামপ্রধান তার ছোট্ট মগজ দিয়ে এই ব্যাপারগুলোর আর ট্র্যাক রাখতে পারছিলো না। যদিও পপুলার সায়েন্স আমাদের বলে, Your brain is bigger than you think.আমাদের মগজ আসলে ডাটা এ্যানালাইজ করার জন্য ভালো মাল। ডাটা স্টোর করার জন্য নেহাৎ-ই ভুষি মাল।

গ্রামপ্রধানের এই দুর্দিনে এগিয়ে এলেন কিছু সুমেরীয় জিনিয়াস। কোথা থেকে কীভাবে ঠিক জানা যায় না, তবে লিখিত ভাষার উদ্ভাবনের মধ্য দিয়ে তারা এই সমস্যার আপাত সমাধান দিলেন। সেটা আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের কথা।

সুমেরীয়রা দু’রকম চিহ্ন ব্যবহার করতো। একটা ছিল সংখ্যাভিত্তিক চিহ্ন।
১, ১০, ৬০, ৬০০, ৩৬০০, ৩৬০০০—এই বিশেষ সংখ্যাগুলোর জন্য তাদের আলাদা আলাদা চিহ্ন ছিল। সংখ্যাগুলো কি চেনা চেনা লাগছে? লাগারই কথা। আজ আমরা যে সময় গণনা করি—তা তো এই ৬ ভিত্তিক সংখ্যার বদৌলতেই। এমনকি আমাদের দিনও হয় ২৪ ঘণ্টায়। সেও ৬ দ্বারা বিভাজ্য। আর এক ধরনের চিহ্ন দিয়ে বোঝাতো মানুষ, পশুপাখি—এইসব।

মানুষ, পশুপাখি, ঘরবাড়ির ছবি দিয়ে ওরা যে ভাষা কাঠামো তৈয়ার করেছিল—একে বলে পিকটোগ্রাম। আমাদের আজকের বর্ণমালার বিবর্তন খেয়াল করলে দেখবেন, প্রায় প্রতিটা বর্ণই এসেছে কোন না কোন ছবি থেকে। ছবি মা, বর্ণ তার দুষ্টু সন্তান।

A এর বিবর্তনটা লক্ষ করুন। শুরুতে A দেখতে ছিল ষাঁড়ের মাথার মত। আস্তে আস্তে সেটা বিবর্তিত হতে হতে আজকের A তে এসে ঠেকেছে। (ছবি-১)। একুইভাবে B এসেছে কুঁড়েঘর থেকে (ছবি-২)। C উটের কুঁজের বিবর্তিত রূপ। আর O চোখের সংক্ষিপ্ত ভার্সন।

বর্ণগুলো না হয় বুঝলাম ছবি থেকে এসেছে। বর্ণগুলোর উচ্চারণ কোথ থেকে এসেছে? এসেছে শব্দ থেকে। বাবা আদামকে খোদা দায়িত্ব দিয়েছিলেন সকল পশুপাখির নাম দেবার। উনি তাদের কী নাম দিয়েছিলেন আমি জানি না। তবে ফিনিশীয়রা কী নাম দিয়েছিল—সেটা জানা যায়। ফিনিশীয়রা ষাঁড়কে বলতো aleph. সেই আলেফ থেকেই গ্রীক আলফা বা আরবী আলিফের জন্ম। যা কিনা আজকের A. ঘরকে ওরা বলতো beth. গ্রীক বেটা’র সাথে কোন মিল পাচ্ছেন কি? কিংবা আরবি বা আর ইংরেজি b এর সাথে? বেথেলহেমের নাম তো সবাই শুনেছেন। প্রভু যীশুর জন্মস্থান। bêth আর lehem—এই দুটি শব্দের মিলনে মেথেলহেমের জন্ম। Bêth মানে তো এখন বুঝতেই পারছেন ঘর। আর lehem মানে রুটি। বেথেলহেম হল সেই শহর বা ঘর যেখানে রুটি বানানো হত।

সুমেরিয়ান বর্ণমালাকে অবশ্য পূর্ণাঙ্গ বর্ণমালা বলা যায় না। এতে অল্প কিছু কাজই হত। মূলত অফিশিয়াল কাজ সব। আমাদের জন্য রেখে যাওয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রথম মেসেজও অফিশিয়াল। মেসেজটা এরকমঃ “২৯০৮৬ মণ বার্লি, ৩৭ মাস, কুশিম।” এর অর্থ সম্ভবত এরকমঃ বিগত ৩৭ মাসে ২৯০৮৬ মণ বার্লি সংরহ করা হইসে। সাক্ষরে, কুশিম।

ইতিহাসের প্রথম টেক্সটে কোন কবিতা নাই, কোন ফিলোসফি নাই, এমনকি কোন রাজ-রাজড়ার যুদ্ধজয়ের গল্পও নাই। আছে কাঠখোট্টা হিসাব নিকাশ।

আমাদের প্রথম চিন্তা তাই কোন মহৎ চিন্তা নয়। ধর্মীয়, সামাজিক,আধ্যাত্নিক কোন উঁচু স্তরের চিন্তা নয়। আমাদের প্রথম চিন্তা চাল, ডাল তেল আর নুনের চিন্তা। পেটের চিন্তা, পিঠের চিন্তা।

উঁচু স্তরের চিন্তা যে একদমই ছিল না–তা নয়। হোমার কোন রকম লিখিত ভাষার সাহায্য ছাড়াই মহাকাব্য রচনা করে গেছেন। মানুষের মুখে মুখে সেই কবিতা ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু আপনি যখন খাজনা আদায় করতে যাবেন, তখন মুখের ভাষায় কাজ হবে না। কে কতোটুকু খাজনা দিয়েছে, তা লিখে রাখতে হবে। কবিতা আর খাজনা দুটো পরস্পরবিরোধী ব্যাপার হলেও এই দিয়ে মিলেই জন্ম দিয়েছে আমাদের পূর্ণাঙ্গ ভাষার।

এই সময়ের আরেকটা স্ক্রিপ্ট আমরা হাতে পাই। এতে অল্প কিছু শব্দ বার বার লিখা আছে। ‘৪০ মণ ধান’, ‘৪০ মণ ধান’, ‘৪০ মণ ধান’—এরকম কিছু একটা হবে। সম্ভবত কোণ নাদান বালকের হোমওয়ার্ক-এর খাতা এটি। সেকালে পড়াশোনা করে ছেলে আমলা হবে—এই চিন্তা থেকেই অভিজাতেরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিত। পড়াশোনা করে কেউ হোমার বা মধুসূদন হবে—এই চিন্তা তারা মাথাতেও আনতো না।

এর কারণও ছিল। লেখালেখি ছিল খুবই কষ্টসাধ্য কাজ। আজকের মত কীবোর্ডে টাইপ করে বা কাগজে ঘষঘষ করেই কিছু একটা লেখা যেত না। লিখতে হত মাটির ট্যাবে। আজকের ট্যাবে লেখা যতোটা সোজা, মাটির ট্যাবে লেখাটা ছিল ততোটাই কঠিন। কেউ আর তাই কষ্ট করে মাটির ট্যাবে গল্প-উপন্যাস লিখতে যেত না। স্রেফ এবং স্রেফ হিসাবপত্তর করার জন্যই ঐ খাটনিটুকু খাটতো।

ইনকারা এক বিশেষ রকমের ভাষা ব্যবহার করতো। ওরা কিছু দড়ি পাশাপাশি সাজাতো। সেই দড়িগুলো দিয়ে নানা রকমের গিট্টু বাঁধতো। গিট্টুগুলোকে আবার নানা রঙে রাঙাতো। দড়ি, গিট্টু আর রঙের পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে ওরা ওদের দৈনন্দিন যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগকরে নিত। গোটা ব্যাপারটা এখনো গবেষণার বিষয়। (ছবি ৩ ও ৪)

স্প্যানিশরা যখন প্রথম দক্ষিণ আমেরিকায় আসে, তখনো এই কিপোর চল ছিল। দেখা গেল, কিপোর মাধ্যেম হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে স্থানীয়দের সাহায্য নিতে হচ্ছে। স্থানীয়রা স্প্যানিশদের কিপো অজ্ঞতার সুযোগে নানা রকম ঠক-জোচ্চোরি করছে। আস্তে আস্তে স্প্যানিশরা যখন গোটা মহাদেশ দখল করে নিল, তখন এই ভাষা বাতিল করে নিজেদের ল্যাটিন স্ক্রিপ্ট চালু করলো। কিপো চলে গেলো ইতিহাসের খরচের খাতায়। কিপোর অর্থ উদ্ধার করার মত আর একটা লোকও এক সময় জীবিত রইলো না।

খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭৬ সালের এক সকাল।

রাম আর শামের মধ্যে জমি নিয়ে বিবাদ লাগলো। রাম বলে, এই জমি সে শামের কাছ থেকে তিরিশ বছর আগে কিনছে। শাম সেটা বেমালুম অস্বীকার করলো। শামের ভাষ্য— সে এই জমি রামকে তিরিশ বছরের জন্য ইজারা দিসিলো। ইজারার মেয়াদ শেষ। কাজেই, এই জমি এখন আবার তার।

ঝগড়া মেটানোর জন্য তারা রাজ্যের তহশিল অফিসে গেলো। সেখানকার কর্মচারীরা তাদের এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ঘুরাইতে লাগলো।

শেষমেশ এক কর্মচারীর খোঁজ পাওয়া গেলো, যে তাদের এই দলিলের সন্ধান জানে। সেও তাদের খালি চা খাওয়ায়, মিষ্টি-মধুর গল্প করে আর পরের দিন আসতে বলে।

একদিন তাদের ভাগ্যের চাকা খুললো। সেই কর্মচারী যে বিশেষ ভল্টে সব দলিল রাখা হয়েছে, সেই ভল্ট খুলে দেখালো—হাজার হাজার মাটির ট্যাবলেটে ভল্ট ভর্তি। এই খড়ের গাদায় সুঁচ খুঁজবে কে? ধরে নিলাম, খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও পেলো। এখন এটাই যে গত তিরিশ বছরে করা লাস্ট ডকুমেন্ট, এর মধ্যে যে জমির আর হাত বদল হয়নি, এর গ্যারান্টি দেবে কে?

এই সমস্যা সমাধান করার জন্য দরকার হল ডাটা ক্যাটালগ করার। ঠিকমত ক্যাটালগ করে রাখলে দলিল খুঁজতে গিয়ে আর এই হুজ্জত করতে হত না। আর এই ক্যাটালগ করতে গিয়েই জন্ম নিল একটি বিশেষ পেশার। ব্রিটিশ আমলে আমরা যাদের কেরানী বলতাম। আজকাল বলি এক্সিকিউটিভ।

ক্যাটালগ করে রাখার একটাই সুবিধা—যখন যার ফাইল দরকার হবে, সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। এতে কিছুটা সময় সেভ হচ্ছে বটে। কিন্তু তার চেয়ে বহুগুণ সময় নষ্ট হচ্ছে একই ফাইল দশ টেবিলে ক্রস চেক হয়ে যেতে যেতে। অবশ্য ব্যুরোক্রেসির মূল মটোই হচ্ছে এ্যাকিউরেসি, এফিশিয়েন্সি নয়। সেটা প্রাচীনকালের আমলাতন্ত্রই হোক আর একালের।

মিশরের ব্যুরোক্রেসির দিকে একটু তাকাই। মিশরে সাধারণ মানুষ কোন জমির মালিক ছিল না। জমির মালিক ছিল ফারাওরা। কে কোন জমিচাষ করবে, কতোটুকু ফসল নিজে রাখবে আর কতোটুকু ফারাওর দুয়ারে পাঠাবে—সব নিয়ন্ত্রণ করতো এই ফারাওরা। অবশ্যই নিজেরা এই কাজ করে হাত ময়লা করতো না। এই কাজ করতো এক শক্তিশালী ব্যুরোক্রেসি দিয়ে।

এই ব্যুরোক্রেসি ছিল অনেকটা আজকের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মত। প্রফিট আর প্রফিটই ছিল এদের জীবনের মূল লক্ষ। একটা গাছ কাটতেও সেসময় যথাযথ কর্ত্‌পক্ষের পারমিট লাগতো। পারমিট লাগতো এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে মুভ করতেও। ঠিক এরকম একটা ব্যবস্থা ছিল জারের সময় রাশিয়াতেও। সরকারের পারমিশন ছাড়া কেউ এক ফার্ম থেকে আরেক ফার্মে যেতে পারতো না। এই ধরনের অধিবাসীদের একটা নামও আছে। এদের বলা হয় Serf. Less than subject, more than slave. দাসের চেয়ে উঁচু, মানুষের চেয়ে নিচু। (আজকেও যে সাধারণ মানুষ serf দের চেয়ে খুব ভালো অবস্থায় আছে—তা বলা যায় না:P)

ব্যুরোক্রেসির আরেকটা বদনাম হচ্ছে এরা মানুষের খাটনির উপর যত্রতত্র ট্যাক্স বসিয়ে নিজেদের রুটি রোজগার করে। মিশরীয় ব্যুরোক্রসি ছিল এক্ষেত্রে সেরা। অন্তত প্রাচীন যুগে। ধরা যাক, এক লোক এ্যালকোহল উৎপাদন করবে। এর জন্য তাকে পয়সাকড়ি দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হবে। এই ট্রেড লাইসেন্স ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিচিত হলেও সেকালে ছিল একেবারেই অনন্য। কেবল মিশরীয়রাই এই গোপন রহস্যের কথা জানতো। রোমানরাও না, ফিনিশীয়রাও না।

তারপর তাকে সরকারী কোন কোম্পানি থেকে বার্লি কিনতে হত। সেই বার্লির উপর এক দফা ট্যাক্স বসবে। উৎপাদন করার পর তাকে বিক্রিও করতে হবে সরকারী কোন কোম্পানির কাছে। সেইখানে আরেক দফা সেলস ট্যাক্স। সরকার সেটা সীল টীল দিয়ে আবার হয়তো সেই লোকের কাছেই বিক্রি করবে। এবার কেনার সময় তাকে আরেক দফা ট্যাক্স দিতে হবে। অনেকটা বাংলাদেশের গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির মত। আমাদের ট্যাক্স দিয়ে কাঁচামাল কিনতে হয়। সেইটা দিয়ে আমরা জামাকাপড় বানাই। সেটা বাইরে চালান করি সীল লাগানোর জন্য। থাইল্যান্ড থেকে সেটা সীল সমেত আমাদের রেক্স বা কেলভিন ক্লেইনে জায়গা করে নেয়। আমরা সেটাই আবার বেশি দামে কিনে নিই।

ব্যুরোক্রেসির সবটুকুই যে খারাপ—তা নয়। ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দেয় যে, যেখানেই ব্যুরোক্রেসির বিকাশ হয়েছে, সেইখানেই গণিতের বিকাশ হয়েছে। সেটা চাইনিজ ব্যুরোক্রেসি হোক কিংবা মিশরে। যতো বড় সাম্রাজ্য, ততো বেশি ডাটা। আর এই ডাটা সংরক্ষণ করার জন্য গণিতবিদদেরও সারাক্ষণ দৌড়ের উপর থাকতে হয়েছে। নিত্য নতুন গণনা পদ্ধতি আবিষ্কার করে সাম্রাজ্যের চাহিদা মেটাতে হয়েছে।

আজ যারা সমাজের এলিট, তারা সবাই এই গণিতের ভাষাতেই কথা বলেন। বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, ইকোনমিস্ট থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদেরা পর্যন্ত। মানুষের সুখ আজ মাপা হয় জিডিপি দিয়ে। আপনি সৎ কিনা মাপা হয় আপনার ক্রেডিট স্কোর দিয়ে। আপনি প্রেমিক হিসেবে সফল কিনা–মাপা হয় আপনারা কয়টা বসন্ত একসাথে পার করেছেন, সেই সংখ্যা দিয়ে।

গণতন্ত্র হোক আর একনায়কই হোক—ব্যুরোক্রেসি না হলে কারোরই চলে না। দিন শেষে আমরা এই কচ্ছপকে গালি দিই, অভিশাপ দিই—যাই করি, যতো নতুন সমাজের স্বপ্নই দেখি না কেনো—সেই প্রতিটা নতুন সমাজেই কোন না কোন ফর্মেটে এই ব্যুরোক্রেসি থাকবেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *