০১. প্রথম অধ্যায় – ভূমিকা

প্রথম অধ্যায় – ভূমিকা

এ বছর, ২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদ তিনশ’ বছরে পদার্পণ করল। ১৭০৪ সালে মুর্শিদকুলি খান মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তন করেন। সে অনুযায়ী এ বছরই মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছর। এ উপলক্ষেই এই গ্রন্থের অবতারণা। সাধারণভাবে একটি শহর বা নগরের কোনও প্রতিষ্ঠাতা থাকে না, স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই শহর বা নগরের উৎপত্তি হয়। এর ব্যতিক্রম হাতে গোনা যায়। যেমন সেন্ট পিটারের প্রতিষ্ঠিত রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ শহর। মুর্শিদাবাদও এই ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়ে। এতদিন আমরা জানতাম, জোব চার্ণকই কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা এবং ১৬৯০-র ২৪ আগস্ট তিনিই এই শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। তাই বহুদিন ধরে এই দিনটি কলকাতার জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছিল। ১৯৯০ সালে বেশ সাড়ম্বরে কলকাতার তিনশ’ বছর পূর্তি উৎসবও হয়ে গেল। কিন্তু অতি সম্প্রতি মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট দ্বারা নিযুক্ত পাঁচজন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক সহমত হয়ে অভিমত প্রকাশ করেছেন যে, জোব চার্ণককে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা বলা যায় না, ২৪ আগস্টও কলকাতার জন্মদিন নয়। তবে মুর্শিদাবাদ প্রসঙ্গে এ ধরনের প্রশ্ন ওঠার কোনও অবকাশ নেই কারণ মুর্শিদকুলি খান যে ১৭০৪ সালে মুর্শিদাবাদ শহরের পত্তন করেন সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রামাণিক তথ্য পাওয়া যায়।

মুর্শিদাবাদ ও এই অঞ্চল নিয়ে অনেক বইই লেখা হয়েছে। তবে তার মধ্যে বেশ কিছু ভাল বই প্রায় একশ’ বছর বা তারও আগে লেখা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: নিখিলনাথ রায় মুর্শিদাবাদ কাহিনী (১৮৯৭), মুর্শিদাবাদের ইতিহাস (১৯০২), জগৎশেঠ (১৯০৫); J. H. T. Walsh, A History of Murshidabad District (1902); P. C. Majumdar, The Musnud of Murshidabad (1905); A. C. Campbell, Glimpses of Bengal (1907) ইত্যাদি। গত কয়েক দশকেও মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে: B. N. Banerjee, Begams of Bengal; K. K. Datta, Alivardi and His Times; Abdul Karim, Murshid Quli and His Times; J. H. Little, The House of Jagat Seths; K. M. Mohsin, A Bengal District in Transition: Murshidabad; প্রতিভারঞ্জন মৈত্র, মুর্শিদাবাদের ইতিহাস, মুর্শিদাবাদ চর্চা; সোমেন্দ্র চন্দ্র নন্দী, বন্দর কাশিমবাজার, The Life and Times of Kanto Babu ইত্যাদি। তা ছাড়াও Philip Calkins, গৌতম ভদ্র প্রমুখ মুর্শিদাবাদ নিয়ে সুচিন্তিত কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। কিন্তু এ সবগুলিতেই মুর্শিদাবাদের শুধু খণ্ড খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদের একটি সামগ্রিক চিত্র কোথাও ঠিক নেই।

তাই মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছর উপলক্ষে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসের প্রতি, বিশেষ করে স্বাধীন নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ শহরের প্রসঙ্গে, নতুন করে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন আছে। গত প্রায় চার দশক ধরে সমুদ্র বাণিজ্যের ইতিহাস, ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলায় ব্যবসা-বাণিজের গতিপ্রকৃতি, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে বাংলার ইতিহাস ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভসে, বিশেষ করে লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরি (British Library, India Office Records) এবং হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভস (Algemeen Rijksarchief), যেসব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছি তার ভিত্তিতে মুর্শিদাবাদের সার্বিক ইতিহাস রচনা করার তাগিদ অনুভব করেছি। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এই গ্রন্থের অবতারণা। আর মুর্শিদাবাদের তিনশ’ বছরে পদার্পণই এই গ্রন্থ রচনার সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আশা করি তা মনে রাখলে এই গ্রন্থ রচনার ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক বলে বিবেচিত হবে। এখানে নবাবি আমল বলতে আমাদের আলোচনা স্বাধীন নবাবি আমলেই সীমাবদ্ধ রেখেছি। অর্থাৎ মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা এবং পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত, মোটামুটি ১৭০৪ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল। তারপরেও মুর্শিদাবাদের নবাবরা ছিলেন বটে তবে মীরজাফর থেকে আরম্ভ করে সবাই ইংরেজদের ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া মুর্শিদাবাদের যা কিছু গৌরব এবং শ্রীবৃদ্ধি, সবটাই স্বাধীন নবাবি আমলে। তারপর ইংরেজ কোম্পানি ও তাদের কর্মচারীদের দৌরাত্ম্যে আস্তে আস্তে মুর্শিদাবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে, কলকাতাই সব কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠে। পলাশির পর থেকেই মুর্শিদাবাদের এই অবনমনের সূত্রপাত। তাই এই বইতে শুধু মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগের কথাই তুলে ধরা হয়েছে।

মোট দশটি অধ্যায়ে আমার বক্তব্যগুলি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। প্রথমেই ‘ভূমিকা’-তে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আভাস দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের পত্তনের ইতিবৃত্ত। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে এবং কেন মুর্শিদকুলি খান ঢাকা থেকে দেওয়ানি কার্যালয় মখসুদাবাদে নিয়ে আসেন এবং তাঁর নিজের নাম অনুযায়ী নতুন নামকরণ করেন মুর্শিদাবাদ। বিভিন্ন তথ্যের সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে ১৭০৪ সালেই যে মুর্শিদাবাদের পত্তন তাও এখানে প্রতিষ্ঠিত। পরের অধ্যায়ে মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত বিভিন্ন নবাবরা কীভাবে মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন তার সম্যক বিশ্লেষণ। বস্তুতপক্ষে, নবাবি আমলই মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। বহু তথ্যের সমাবেশে এখানে তাই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছি। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে মুর্শিদাবাদের ইতিহাসে বণিকরাজাদের (merchant princes) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার তিন বণিকরাজা— জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ— মুর্শিদাবাদে নবাবি দরবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। নবাবদের সঙ্গে এঁদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। নবাবদের আনুকূল্যেই এঁরা বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতির প্রায় সবটাই কুক্ষিগত করে নেন। শুধু তাই নয়, বাংলা তথা মুর্শিদাবাদের রাজনীতিতেও এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদের উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে এঁদের অবদান অনস্বীকার্য।

পঞ্চম অধ্যায়ে পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের বিস্তারিত ব্যাখ্যা। পলাশি বাদ দিয়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করা যায় না। বিশেষ করে এতদিন পর্যন্ত পলাশির যে ব্যাখ্যা ঐতিহাসিকরা দিয়ে এসেছেন— কেন এই ষড়যন্ত্র, কে বা কারা এর মূল নায়ক, এতে ইংরেজদের ভূমিকা কী, ইত্যাদি— তা সত্যি যুক্তিগ্রাহ্য কিনা তা নতুন করে বিচার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ এর মধ্যে অনেক নতুন তথ্য, বিবরণগত শুধু নয় পরিসংখ্যানগতও বটে, আমরা ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে আবিষ্কার করতে পেরেছি যার ভিত্তিতে এতদিনের বক্তব্যগুলি অসার বলে প্রমাণ করা যায়। সংক্ষেপে এ বক্তব্যগুলি হল— পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের পেছনে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না, তাদের বাংলা বিজয় নেহাতই ‘আকস্মিক ঘটনা’, প্রায় ‘অনিচ্ছাকৃত’। বাংলার ‘অভ্যন্তরীণ সংকটই’ ইংরেজদের বাংলায় ডেকে আনে, পলাশি ‘ভারতীয়দেরই ষড়যন্ত্র’, ইত্যাদি। এখানে আমরা এই সব বক্তব্যগুলি খণ্ডন করে দেখিয়েছি যে পলাশি চক্রান্তের মূল নায়ক ইংরেজরাই। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও মদত ছাড়া পলাশি সম্ভব হত না। তারাই একদিকে নানা প্রলোভন ও প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়ে, অন্যদিকে প্রায় কাকুতিমিনতি করে নবাবের দরবারের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠীকে তাদের ‘বিপ্লবে’র পরিকল্পনায় সামিল করিয়েছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্ন, ইংরেজদের পক্ষে বঙ্গবিজয় এত অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল কেন এবং যে প্রশ্নের কোনও উত্তর এতদিন কেউ দিতে পারেননি, আমরা তা এখানে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ১৭৩০-র দশক থেকে ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা চলছিল। এরা এই ব্যক্তিগত ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার আশায় সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে এদেশে আসত। কিন্তু ১৭৪০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৫০-র দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত বাণিজ্য প্রচণ্ড মার খায়। তার কারণ ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলি থেকে দেশীয় বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্যের সঙ্গে ইংরেজদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইংরেজ কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও তাকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই পলাশির ষড়যন্ত্র।

ষষ্ঠ অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের বেগমদের বৃত্তান্ত। এঁদের চারিত্রিক বৈপরীত্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কেউ কেউ স্বামীর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছেন শুধু নয়, স্বামীর অনুপস্থিতিতে রাজকার্যও পরিচালনা করেছেন। স্বামীর বিপদের সময় তাঁর পাশে থেকে তাঁকে সাহস ও উৎসাহ দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও উচ্চাকাঙক্ষা চরিতার্থ করার জন্য যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা করেননি। জিন্নতউন্নেসা, শরফুন্নেসা, ঘসেটি বেগম, আমিনা বেগম, লুৎফুন্নেসা, মুন্নি বেগম প্রমুখের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করে তাই এখানে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায়ে মুর্শিদাবাদের শিল্পবাণিজ্যের বিশ্লেষণ। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল বাংলায় কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে ভারতবর্ষ ও এশিয়া ছাড়াও ইউরোপে এই দুটি পণ্যের বিরাট চাহিদা ছিল। ফলে নবাবি আমলে এই দুটি পণ্যের উৎপাদন এবং বাণিজ্যের দ্রুত অগ্রগতি হয়। এশীয়/ভারতীয় বণিক এবং ইউরোপীয়রা বাংলা থেকে প্রচুর পরিমাণে এই পণ্য দুটি রফতানি করত। এতদিন ঐতিহাসিকদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে এই রফতানি বাণিজ্যে মুখ্য ভূমিকা ছিল ইউরোপীয়দের, তারাই এই দুটি পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি করত। কিন্তু আমরা বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে এখানে দেখিয়েছি যে এতে এশীয়/ভারতীয়দের ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এই দুটি পণ্য রফতানি করত, ইউরোপীয়রা নয়। বস্তুতপক্ষে, কাঁচা রেশমের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এশীয়/ভারতীয়দের রফতানির পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানি মিলে যে মোট রফতানি তার চার থেকে পাঁচগুণ বেশি।

মুর্শিদাবাদের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির আলোচনা অষ্টম অধ্যায়ে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও নানা কাজকর্ম উপলক্ষে বহু জাতি, বর্ণ ও ধর্মের লোকরা এসে মুর্শিদাবাদে বসবাস করত। তারপর পরস্পরের পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান হত স্বাভাবিকভাবেই। ফলে মুর্শিদাবাদে একটি ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের অর্থনীতিও বেশ উন্নত ছিল। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দিল্লি-আগ্রা থেকে আগত মনসবদার ও অভিজাতবর্গ বাংলা থেকে যে ধন নিষ্ক্রমণ করত, মুর্শিদকুলির আমল থেকে তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বাংলার ধনসম্পদ বাংলাতে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদেই, সঞ্চিত হত। ১৭৪০-র দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত নবাবরা দিল্লিতে নিয়মিত রাজস্ব পাঠাতেন। তা সত্ত্বেও এঁদের কোষাগারে যে পরিমাণ ধনরত্ন সঞ্চিত হয়েছিল তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। মারাঠা আক্রমণে এ সময় বাংলার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল বলে যে বক্তব্য তা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা মোটামুটি বেশ ভালই ছিল বলে ফারসি ঐতিহাসিকরা মন্তব্য করেছেন। জৈন কবি নিহাল সিংহও এটা সমর্থন করেছেন।

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য—হিন্দু ও মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কোনওভাবেই ব্যাহত হয়নি। সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কোনও ঘটনা এসময় ঘটেনি। বরং এই দুই ধর্ম-সংস্কৃতির যে সমন্বয় প্রক্রিয়া তা ওই সময়েই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। এ মিলন প্রক্রিয়া থেকেই ‘সত্যপীরের’ মতো নতুন ‘দেবতা’র উদ্ভব, যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। এ সময় হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে বা মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাবরা মহা আড়ম্বরে হোলি, দেওয়ালি প্রভৃতি হিন্দু উৎসব পালন করতেন, তাতে কোনও প্রশ্ন কখনও ওঠেনি। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ও এই দুই ধর্মসংস্কৃতির মিলন প্রক্রিয়ার প্রতিফলন একদিকে মুসলমান কবি ফৈজুল্লা ও অন্যদিকে হিন্দু কবি ভারতচন্দ্রের ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তিতে।

নবম অধ্যায়ে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্যের বর্ণনা। বাংলার স্থাপত্য শিল্পের ইতিহাসে মুর্শিদাবাদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। নবাবদের আমলে মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য এক নতুন মাত্রা পায়। মুঘল শৈলীর সঙ্গে বাংলার স্থানীয় শৈলীর সংমিশ্রণ হয় মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজদ্দৌল্লা পর্যন্ত সব নবাবেরই প্রাসাদ, ইমারত, মসজিদ, সমাধিভবন, ইত্যাদি নির্মাণ করা প্রায় ‘হবি’তে পরিণত হয়েছিল। একদিকে নবাবদের এই মানসিকতা, অন্যদিকে তাঁদের হাতে অফুরন্ত ধনরত্ন থাকায় মুর্শিদাবাদে একের পর এক নতুন নতুন প্রাসাদ, মসজিদ, উদ্যানবাটিকা প্রভৃতি নির্মিত হয়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুর্শিদকুলির কাটরা মসজিদ ও খোশবাগের সমাধিক্ষেত্র, সুজাউদ্দিনের ফৰ্হাবাগ, নওয়াজিস মহম্মদের মোতিঝিল প্রাসাদ, সিরাজদ্দৌল্লার হিরাঝিল বা মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ, ইমামবারা ও মদিনা, মুন্নি বেগমের চৌক মসজিদ ইত্যাদি। পরিতাপের বিষয়, এগুলির মধ্যে বেশিরভাগই এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। শেষ অধ্যায়ে উপসংহার— এই গ্রন্থের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণের সংক্ষিপ্তসার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *