৬. ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

ষড়যন্ত্রের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ

ঐতিহাসিকদের মধ্যে, এমনকী সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থেও, পলাশি চক্রান্তে ইংরেজদের ভূমিকা সম্পর্কে আশ্চর্যরকম ঐকমত্য দেখা যায়। এঁদের বক্তব্য, পলাশি সম্বন্ধে ইংরেজদের কোনও ‘পূর্ব-পরিকল্পনা’ ছিল না; এই চক্রান্তের উদ্ভব বা ক্রমবিকাশে ইংরেজদের কোনও ভূমিকা নেই; মুর্শিদাবাদ ‘দরবারের অন্তর্দ্বন্দ্বই ইংরেজদের অনিবার্যভাবে বাংলার রাজনীতিতে টেনে এনেছিল।’ কিন্তু পলাশির প্রাক্‌কালে যে-সব ঘটনাবলী এবং আমাদের কাছে যে-সব নতুন তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে স্পষ্টত দেখা যাবে, ইংরেজরাই পলাশির মূল ষড়যন্ত্রকারী। সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার ব্যাপারে তারাই সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছিল এবং তারাই স্থানীয় চক্রান্তকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, পলাশি যুদ্ধের আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে যাতে প্রধান প্রধান দেশীয় চক্রান্তকারীরা শেষপর্যন্ত ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকে। আমাদের এ-বক্তব্যকে দেশীয় ষড়যন্ত্রকারীদের দোষস্খলনের প্রচেষ্টা হিসেবে ধরে নেওয়া ভুল হবে। মুর্শিদাবাদ দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌল্লার প্রতি বিরূপ হয়ে একটা চক্রান্ত করছিল, এটা আমরা অস্বীকার করছি না। কিন্তু যে-বক্তব্যে আমরা জোর দিচ্ছি তা হল, ইংরেজদের নেতৃত্বেই পলাশি চক্রান্ত পূর্ণ অবয়ব পেয়েছিল এবং খুব সম্ভবত, ইংরেজদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া এ ষড়যন্ত্র পূর্ণ রূপ নিয়ে নবাবের পতন ঘটাতে পারত না। মসিয়ে জাঁ ল’ পরিষ্কার জানাচ্ছেন ইংরেজরা কীভাবে দরবারের অভিজাতবর্গের একটি গোষ্ঠীর নবাবের প্রতি বিরূপতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এবং বুদ্ধিমানের মতো ঠিক ঠিক জায়গায় টাকা ছড়িয়ে দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাত করেছিল।

তবে এটা স্বীকার করতে হবে যে আমাদের কাছে যে তথ্যপ্রমাণ আছে, তা অনেক সময় কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। ষড়যন্ত্রের উন্মেষে কে কখন কাকে প্রথম যোগাযোগ করে তা নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন দাবি এবং প্রতিদাবি আছে। আবার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একই ব্যক্তির বয়ানে স্ববিরোধিতা দেখা যায়। অন্য দিকে, এ-সব ক্ষেত্রে সচরাচর হয়ে থাকে, অনেকে আবার ষড়যন্ত্রের খেলায় নিজের ভূমিকা বড় করে দেখাবার জন্য অন্যদের ভূমিকাকে গৌণ করে দেখাবার প্রচেষ্টায় সচেষ্ট। কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও খুব সতর্কতার সঙ্গে তথ্যপ্রমাণগুলির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে ষড়যন্ত্রের কীভাবে উন্মেষ হচ্ছে এবং তা কীভাবে দানা বাঁধছে এবং কীভাবে তার বিকাশ হচ্ছে, পলাশি বিপ্লব ত্বরান্বিত করতে কে বা কারা সবচেয়ে বেশি অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং শেষপর্যন্ত বিপ্লব সংঘটিত করে কীভাবে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানো হল—তার একটি মোটামুটি সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।

বাংলায় তথা ভারতবর্ষে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়টা ছিল যুদ্ধবিগ্রহ, অন্তহীন সুযোগ ও দুর্নীতি এবং নিরন্তর পরিবর্তনের যুগ। ওয়াটস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘নবাবের দরবারের অন্তর্কলহ দিন দিন বাড়ছে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া অন্য কিছুতে আগ্রহী নয়—পুরো দরবারই দুর্নীতিগ্রস্ত।’ লিউক স্ক্র্যাফ্‌টুন আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা করে জানাচ্ছেন: ‘আমার মনে হয় টলেমি (Ptolemy) যখন ফারসালিয়া (Pharsalia) যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মিশরে রাজত্ব শুরু করেন, তখন তাঁর দরবারের যা অবস্থা ছিল তার সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের তুলনা করা যেতে পারে, অর্থাৎ দরবারের উঁচুতলা থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সবাই যথেচ্ছ ভ্ৰষ্টাচারে লিপ্ত এবং সবাই বিশ্বাসঘাতক। সুতরাং এ ক্ষেত্রে রোমান সম্রাট সিজার যা করেছিলেন, ক্লাইভের উচিত তাই করা অর্থাৎ রাজ্যটি জয় করে নেওয়া। পুরনো নবাবকে হঠিয়ে নতুন কাউকে নবাব করা যাতে রাজ্যের প্রজারা সুখে থাকতে পারে।’

কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার, তখনকার দিনে ভারতীয়দের মতো ইউরোপীয়রাও (ইংরেজরাও বটে) সমান দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। তারা তৎকালীন অবস্থার ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছিল এবং কোনওরকম ন্যায়নীতি বা বিবেকদংশনের তোয়াক্কা না করে দরবারের অমাত্যদের নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। জাঁ ল’ লিখেছেন যে ইংরেজদের বৃত্তান্ত পড়লে প্রত্যয় জন্মাতে পারে যে ফরাসিরা নানা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে নবাবের দরবারের অমাত্যদের তাদের দলে টেনে নিয়েছে। কিন্তু সত্য ঘটনা হল, ল’ সাফাই গাইছেন, ইংরেজরাই ভ্ৰষ্টাচারের মাধ্যমে পুরো দরবারকেই হাত করে নেয়। তিনি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার করেছেন যে, ইংরেজদের মতো ফরাসিরাও দুর্নীতির সাহায্যে দুর্নীতি রোধ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উৎকোচের মাধ্যমে অমাত্যদের দলে টানার প্রতিযোগিতায় ইংরেজরা ফরাসিদের চাইতে অনেক এগিয়ে ছিল। এই ব্যর্থতার অনেকখানি অবশ্য তাঁর এবং সে জন্যই সাফাই গাইবার সরে বলছেন, ‘ইংরেজরা অবশ্য বরাবর আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অর্থসামর্থ্য নিয়োগ করতে পেরেছিল।’

বস্তুতপক্ষে ইংরেজদের হুগলি আক্রমণের (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকে জাঁ ল’-র মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কার (১৬ এপ্রিল ১৭৫৭) পর্যন্ত দরবারের অভিজাতবর্গকে নিজ নিজ দলে টানার জন্য ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। জাঁ ল’ এবং ওয়াটস দু’জনেই অকপটে স্বীকার করেছেন যে তারা উৎকোচ দিয়ে দরবারের অমাত্যদের বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন, যদিও উভয়েই এর জন্য দোহাই দিয়েছেন, দরবারের ভ্ৰষ্টাচারকে, যেখানে উৎকোচ ছাড়া কিছুই হয় না। ল’র তুলনায় ওয়াটসের হাতে টাকাকড়ি ছিল অনেক বেশি এবং তা দিয়ে শুধু দরবারের গণ্যমান্যদেরই ইংরেজরা দলে টানেনি, এমনকী মুৎসুদ্দিদেরও হাত করেছিল। এ-কাজে ওয়াটসের প্রধান সহায়ক ছিলেন উমিচাঁদ। ওয়াটস ১১ এপ্রিল একটি চিঠিতে ক্লাইভকে লিখছেন: ‘নবাবের অমাত্যদের মধ্যে প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কারণ তাদের আমরা (টাকাকড়ি দিয়ে) সন্তুষ্ট করতে পারিনি। উমিচাঁদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকের পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে কিছু খরচাপাতি করে হলেও ওইসব ব্যক্তিদের আমাদের দলে টানা একান্তভাবে উচিত।’ ফলে যেখানে জাঁ ল’ সিরাজদ্দৌল্লার দরবারের খবরাখবরের জন্য শুধুমাত্র গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করতেন, সেখানে ওয়াটস ও উমিচাঁদের যৌথপ্রচেষ্টায় ইংরেজরা নবাবের প্রভাবশালী অমাত্যদের হাত করতে পেরেছিল। এদের মধ্যে অন্যতম প্রধান হুগলির ফৌজদার নন্দকুমার—চন্দননগর আক্রমণের সময় যাঁর সহযোগিতা ইংরেজদের পক্ষে খুবই কার্যকর হয়েছিল। ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিদের অর্থভাণ্ডারের দৈন্যের জন্য ল’-কে দরবারের চুনোপুঁটিদের হাত করে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল এবং তারাই শেষপর্যন্ত ফরাসিদের ডুবিয়েছিল।

সে যাই হোক, মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষ এবং দুর্নীতি থাকা সত্ত্বেও ক্লাইভ এবং ওয়াটসন যখন মাদ্রাজ থেকে সৈন্যসম্ভার নিয়ে কলকাতায় পৌঁছোন, তখনও কিন্তু যড়যন্ত্রের কোনও আভাস পাওয়া যায় না। আসলে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) কাউন্সিল ক্লাইভ ও ওয়াটসনের নেতৃত্বে অভিযাত্রী সৈন্যদলকে বাংলায় পাঠাবার সময় যে নির্দেশ দিয়েছিল (১৩ অক্টোবর ১৭৫৬) তার মধ্যেই পলাশি চক্রান্তের বীজ নিহিত ছিল। এই নির্দেশের মধ্যেই অভিযানের উদ্দেশ্য বর্ণিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শুধু কলকাতা পুনরুদ্ধার এবং যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায়,’ অভিযাত্রীদলের উদ্দিষ্ট হবে না, ‘বাংলার নবাবের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ বা নবাব হওয়ার মতো উচ্চাভিলাষী কোনও শক্তি বা গোষ্ঠীর সঙ্গে যেন তারা গোপন আঁতাত করার চেষ্টা করে।’ উপরোক্ত নির্দেশের শেষদিকের অংশটুকুর তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। বলা বাহুল্য, এতেই ষড়যন্ত্রের সদর দরজা উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। মাদ্রাজ থেকে রওনা হওয়ার আগেই ক্লাইভ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লা ‘দুর্বল শাসক’ এবং ‘তাঁর দরবারের বেশির ভাগ লোকই তাঁর প্রতি বিরূপ’ দরবারের মধ্যে এই যে অসন্তোষ তা দিয়েই, ক্লাইভের ভাষায়, ‘ইংরেজরা রাজনীতির দাবাখেলায় বাজিমাৎ করেছিল’ এবং এভাবেই তারা ষড়যন্ত্র পাকা করে পলাশিতে সিরাজদ্দৌল্লার পতন ঘটিয়েছিল।

ক্লাইভ বাংলা অভিযান সম্বন্ধে যখন তাঁর পিতাকে লিখছেন, ‘এ-অভিযান সার্থক হলে আমি বিরাট কিছু করতে পারব,’১০ তখন তিনি নিশ্চয়ই কল্পলোকে বাস করছিলেন না। তিনি এবং ওরম (Ome) কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের বিশদ পরিকল্পনার কথা জানতেন—এই পাণ্ডুলিপিটি মাদ্রাজেই ছিল। ১৭৪৯-৫০ সালে ক্লাইভ যখন কলকাতায় এসেছিলেন, তখন বাংলার অগাধ ঐশ্বর্য তাঁর মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, আর্কটের যুদ্ধের পর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসার এক সহযোগী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে, বাংলায় যদি যুদ্ধ লাগে, তা হলে ক্লাইভ রাতারাতি খুব বড়লোক হয়ে যাবেন।১১ এ-সবের পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাজের উপকূল অঞ্চলের পরিস্থিতির জন্য বাংলা থেকে কোম্পানি তাঁকে সরিয়ে নিতে পারে বলে ক্লাইভের যে উদ্বেগ, তা সহজেই বোধগম্য।

নবাবের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা অসন্তোষ ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত পরিমণ্ডল তৈরি করতে পারে হয়তো কিন্ত ষড়যন্ত্র দানা বাঁধার পক্ষে এবং তা সফল করতে আরও পর্যাপ্ত কারণের প্রয়োজন ছিল। সে জন্যই দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করার দরকার ছিল। অংশত সেটা আবিষ্কার করার জন্যই ইংরেজরা হুগলি আক্রমণ করে (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭)। ফোর্ট উইলিয়ামের চিঠি থেকে (৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭) তা সুস্পষ্ট:১২

নবাবের সৈন্যদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করা এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর লোকজনকে আমাদের দলে যোগদানে উৎসাহিত করার জন্য হুগলি আক্রমণ এবং দখল করা এতটা জরুরি হয়ে পড়েছিল।…এতে আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে।

১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে যখন ইংরেজরা চন্দননগর অবরোধ নিয়ে ব্যস্ত, তখনও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের সিলেক্ট কমিটি কাশিমবাজারে উইলিয়াম ওয়াটসকে নির্দেশ দিচ্ছে, ‘জগৎশেঠ পরিবার আমাদের পক্ষ যাতে সমর্থন করে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা’ চালিয়ে যেতে।১৩

পলাশি বিপ্লবে ইংরেজদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে (এবং কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে এ বিপ্লবে ফরাসিদের এবং তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ও হতাশা ঢাকতে গিয়ে) জাঁ ল’ মন্তব্য করেছেন যে সবাই নবাবের পরিবর্তন চাইছিল এবং অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে ওটা শীঘ্রই হবে। তাঁর নিজের ধারণা ছিল, তিন-চারশো ইউরোপীয় সৈন্য এবং অল্প সংখ্যক তেলেঙ্গা সৈন্য এ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে। যদি ফরাসিরা এরকম একটি বাহিনীর সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার শত্রুদের হাত মিলিয়ে দিতে পারত, তা হলে ফরাসিরাই বাংলার মসনদে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে বসাতে পারত। অবশ্য সে ব্যক্তি পুরোপুরি তাদের পছন্দের লোক নাও হতে পারত। সে ব্যক্তিকে অবশ্যই জগৎশেঠ, মুসলিম অভিজাতশ্রেণী ও হিন্দু রাজন্যবর্গের পছন্দসই হতে হত।১৪ কিন্তু ফরাসিরা কী ঘটতে যাচ্ছে সে সম্বন্ধে বিশেষ ওয়াকিবহাল ছিল না— ঘটনাক্রমও যতটা ইংরেজদের অনুকূলে ছিল, ফরাসিদের পক্ষে ততটা নয়।

শওকত জঙ্গের পরাজয়ের পর এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে ইংরেজরাই একমাত্র শক্তি যারা বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম। কিন্তু জাঁ ল’ বলছেন, এর জন্য ইংরেজদের প্রয়োজন ছিল মর্শিদাবাদের দরবারে নবাবের বিরুদ্ধে একটি দল তৈরি করা যার মাধ্যমে এ-বিপ্লব সম্ভব হতে পারে। ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। কারণ জগৎশেঠরা ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ইংরেজদের ততটা ঘনিষ্ঠতা ছিল না। জগৎশেঠরাই ইংরেজদের সাহায্য করতে পারত এবং কিছুটা সময় দিলে তাঁরাই দরবারে সিরাজ-বিরোধী একটি দল তৈরি করতে পারত এবং শেষপর্যন্ত, এমনকী ইউরোপীয়দের সাহায্য ছাড়াই, সিরাজদ্দৌল্লাকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে পারত। কিন্তু তার জন্য বেশ কিছুটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করা ইংরেজদের পোষাত না। এ ছাড়া হিন্দু বলে জগৎশেঠদের বেশ কিছুটা শঙ্কা এবং ভয়ও ছিল যাতে তারা নিজেরা বিপদের মুখে না পড়ে। তাদের উৎসাহ ও উস্‌কে দিতে ইংরেজদের দিক থেকে প্রয়োজন ছিল নবাবের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক কিছু একটা করা। কিন্তু তারা তা করেনি। সিরাজদ্দৌল্লাকে পুরোপুরি নিজের দলে টানতে ব্যর্থ হয়ে জাঁ ল’ এমন অবধি বলছেন যে ‘আমি শুধু দেখতে চাই ইংরেজরা সিরাজদ্দৌলাকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ছেড়েছে।’১৫

পলাশি ষড়যন্ত্রের উদ্ভব সম্বন্ধে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে ১৭৫৭-এর এপ্রিলের প্রথমদিক পর্যন্ত এ চক্রান্ত একেবারেই দানা বাঁধেনি। জাঁ ল’ অবশ্য বলছেন যে ১৭৫৬-এর সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শওকত জঙ্গকে শায়েস্তা করার জন্য সিরাজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদ থেকে পুর্ণিয়া অভিমুখে যাত্রা করার আগেই সিরাজের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র হয়েছিল। মীরজাফরসহ অভিজাত সামরিক গোষ্ঠীর কয়েকজন এতে জড়িত ছিলেন। এঁরা ঠিক করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে শওকত জঙ্গের যুদ্ধে সৈন্যবাহিনীর একাংশ নিষ্ক্রিয় থাকবে। কিন্তু ল’ জানাচ্ছেন (এবং আশ্চর্য, বেশ কিছুটা হতাশার সুরে) বিহারের নায়েব সুবা রাজা রামনারায়ণ তাতে যোগ না দেওয়াতে পুরো জিনিসটাই ভেস্তে যায়।১৬ ফারসি ইতিহাস সিয়র থেকেও জানা যায় যে এরকম একটা ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছিল—মীরজাফর শওকত জঙ্গকে নাকি একটি চিঠির মাধ্যমে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং তাঁর কাছ থেকে মসনদ ছিনিয়ে নিতে উসকানি দিয়েছিলেন। উক্ত লেখক এটাও জানাচ্ছেন যে, মীরজাফর এবং অন্য কয়েকজন সৈন্যাধ্যক্ষ শওকত জঙ্গকে সিরাজের বিরুদ্ধে তাঁদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হিসেবে গণ্য করছিলেন।১৭ কিন্তু ষড়যন্ত্র কোনও বাস্তবরূপ নেওয়ার আগেই ভেস্তে যায়। অবশ্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে নবাবের বিরুদ্ধে এরকম চক্রান্ত বেশ কয়েকবারই হয়েছিল। কিন্তু তার অধিকাংশই দানা বাঁধার আগেই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুতরাং মীরজাফর পলাশির আগে শওকত জঙ্গের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার চেষ্টা করলেও তার খুব একটা গুরুত্ব নেই।

তবে পলাশির প্রাক্‌কালে মুর্শিদাবাদ দরবারে অসন্তোষের চাপা আগুনের অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না। ইংরেজরা এই অসন্তোষের পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র পাকা করে। ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের খবর বাংলায় পৌঁছুতেই ইংরেজদের আশঙ্কা হল, ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাত হবার সম্ভাবনা প্রবল। তার ফলে তারা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবরূপ দিতে মরিয়া হয়ে উঠল। জাঁ ল’ লিখছেন, সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠানোটা ইংরেজদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছিল (had become an absolute necessity) এবং সেই কারণেই তার আগে ফরাসিদের বিতাড়ন করাটা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে চন্দননগর দখল করার পর বিপ্লব অনেক সহজসাধ্য হয়ে যাবে। অবশ্য ল’ এটাও বলেছেন যে, ফরাসিদের না তাড়িয়েও ইংরেজরা নবাবের শত্রুদের সঙ্গে যোগসাজস করে বিপ্লব সংঘটিত করতে পারত কারণ এই শত্রু দলে ছিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অনেক প্রভাবশালী ও গণ্যমান্য ব্যক্তি।১৮

অবশ্য আমরা আগেই বলেছি জাঁ ল’-র দেওয়া তথ্য সবসময় নির্ভরযোগ্য বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক দরবারের অভিজাতবর্গের মধ্যে বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি (সবাই নয়, ল’ যা বলছেন) বিপ্লব সংঘটিত করতে আগ্রহী ছিল এবং এরা সম্ভবত ইংরেজদের সঙ্গে তলায় তলায় যোগসাজশও করছিল। কিন্তু এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত কেউই প্রকাশ্যে বিপ্লবের বা ষড়যন্ত্রের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি, সবাই বেড়ার ধারে অপেক্ষা করে ছিল। আর ইংরেজরা তাদের প্রকাশ্যভাবে ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে পীড়াপীড়ি করছিল। পরে তথ্যপ্রমাণ দিয়ে আমরা তা দেখাব। ক্লাইভকে লেখা ১১ এপ্রিলের চিঠিতে ওয়াটস পরিষ্কার জানাচ্ছেন যে নবাবের অমাত্যদের অধিকাংশ ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং তারা ফরাসিদের শক্তির জয়গান করছে।১৯ আর স্ত্র্যাফ্‌টন ওয়ালসকে (Walsh) ৯ এপ্রিল লিখছেন, ফরাসিরা নবাবের ঘনিষ্ঠ কিছু লোককে ঘুষ দিয়ে হাত করেছে, ফলে তারা ইংরেজদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ফরাসিদের বর্তমান অর্থাভাবের জন্য তাদের ধরে রাখতে পারছে না। এই সুযোগে ইংরেজরা কিছু খরচাপাতি করে এদের দলে টানতে সক্ষম হচ্ছে।২০ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদ দরবারে পরস্পরবিরোধী দুটি গোষ্ঠী বিরাজ করলেও এবং দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নবাবের প্রতি অসন্তোষ থাকলেও, তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্র বিশেষ দানা বাঁধেনি।

ইংরেজরা যে দরবারের বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর সাহায্য নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদল ঘটাতে শুধু আগ্রহী নয়, ব্যস্ত হয়েও পড়েছিল তা ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর জন ওয়ালসকে লেখা স্ক্র্যাফ্‌টনের ৯ এপ্রিলের চিঠিতে সুস্পষ্ট। স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন:২১

ঈশ্বরের দোহাই, একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে….ঘটনা স্রোত যদি অন্যদিকে যায় [বিরোধের দিকে?] সেটা ভেবে এখন থেকে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। মি. ওয়াটসকে এ-ব্যাপারে একটু ইঙ্গিত ও কিঞ্চিৎ উৎসাহ দিলেই তিনি একটি দল তৈরি করতে লেগে যাবেন যেটা বিপদের সময় আমাদের কাজে লাগবে। কোম্পানির অনুগত একজন নবাবকে [বাংলার মসনদে] বসাতে পারলে ব্যাপারটা কোম্পানির পক্ষে কী গৌরবজনকই না হবে!…আর পরে [ভবিষ্যতে] আমাদের পক্ষে মারাত্মক কিছু ঘটে যেতে পারে এ আশঙ্কায় এখন থেকে আমাদের তৈরি থাকতে হবে এবং সে জন্য এমন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার যাতে আমার প্রিয় পুরনো পরিকল্পনাটি (my old favourite scheme) সফল হতে পারে।

আসলে এ সময়ে বা তার কাছাকাছি সময়ে ইংরেজরা উমিচাঁদের সহায়তায় পলাশির ষড়যন্ত্রের কিছুটা বাস্তবরূপ দিতে সক্ষম হয়। উমিচাঁদের বুদ্ধিমত্তা ও বিবেচনাশক্তির ওপর ওয়াটসের তখন অগাধ আস্থা ছিল এবং তাঁর বদ্ধমূল ধারণা ছিল উমিঁচাদ এ ব্যাপারে ইংরেজদের যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। ওয়াটস ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে লেখেন: ‘উমিঁচাদ এবং আমি একটি বিষয় নিয়ে অনেকবার আলোচনা করেছি। বিষয়টি আপনার কাছে কীভাবে ব্যক্ত করব বুঝতে পারছি না। স্ক্র্যাফ্‌টনকে বিষয়টি সম্বন্ধে খুলে বলেছি এবং তাঁর কাছ থেকে জানলাম যে আমি আর উমিচাঁদ যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তাতে আপনার এবং মেজরের [ওয়াটসন] অনুমোদনের অভাব হবে না।২২ বলা বাহুল্য, এখানে পলাশি বিপ্লবের পরিকল্পনার কথাই বিধৃত হয়েছে।

পলাশির ষড়যন্ত্র যে কিছুটা দানা বাঁধছে তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যায় ওয়ালসকে লেখা স্ত্র্যাফ্‌টনের ১৮ এপ্রিলের চিঠিতে। এতে আছে যে স্ক্র্যাফ্‌টন উমিঁচাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলে উমিচাঁদ তাঁকে বলেন যে, নবাব যদি কোনওভাবে আলিনগরের চুক্তি (৯ জানুয়ারি ১৭৫৭) ভঙ্গ করেন, তা হলে ইংরেজদের উচিত নবাবকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফ খানকে মসনদে বসানো। উমিচাঁদ নাকি এটাও জানান যে, ইয়ার লতিফ একজন যোগ্য ব্যক্তি, সচ্চরিত্র এবং জগৎশেঠদের সমর্থনপুষ্ট।২৩ এর দিন দুয়েক পরে আবার স্ক্র্যাফ্টন ওয়ালসকে জানান যে, নবাব ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন, দরবার থেকে তাদের ‘ভকিল’কে বার করে দিয়েছেন এবং মীরজাফরকে পলাশি অভিমুখে যাত্রা করার আদেশ দিয়েছেন। এরপর স্ক্র্যাফ্‌টন যা লিখেছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।২৪

ঈশ্বরের দোহাই, নবাবকে আমাদের এখনকার মতো শান্ত করা দরকার [কারণ] এখনও সব ব্যবস্থা পাকা হয়নি [things are not yet ripe]। উমিচাঁদ জগৎশেঠদের কাছে গেছেন। জগৎশেঠ কেন আগেই উমিচাঁদকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তা আমি জানি। কারণটা হল, আমরা যেন ইয়ার লতিফকে নবাব করি, তাঁর এই ইচ্ছের কথা উমিচাঁদকে জানাবার জন্য….আমাদের ধীরেসুস্থে এগুতে হবে যাতে আমাদের সাফল্য সুনিশ্চিত হয় [Let us strike slow and steady that we may strike sure]।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্রের এখনও অঙ্কুরাবস্থা—বিপ্লবের পরিকল্পনা এখনও পুরোপুরি বাস্তবরূপ নেয়নি। কিন্তু এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা হুমকি দিলেন যে ফরাসিদের মুর্শিদাবাদ থেকে বিতাড়নের পরেও যদি ইংরেজরা সৈন্য প্রত্যাহার করে না নিয়ে যায়, তা হলে আলিনগরের চুক্তি বানচাল বলে গণ্য হবে। এতে ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন সিদ্ধান্তে এলেন যে, বিপ্লব অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তাঁরা ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন ও তার জন্য দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিজেদের দলে টেনে আনতে বেশি করে সচেষ্ট হন।২৫ তবে ২৩ এপ্রিলের আগে পলাশির ষড়যন্ত্র কোনও চূড়ান্ত রূপ নেয়নি। কারণ সেদিনই ওয়াটস ক্লাইভকে লিখেছেন: ‘যদিও আমি বুঝতে পারছি আমাদের প্রতি অনুগত একজনকে মসনদে বসানো কতটা জরুরি হয়ে পড়েছে (কারণ এই নবাব সিরাজদ্দৌল্লা কখনওই তা হবেন না), তবুও আমার মনে হয় আমাদের পক্ষে অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। তাই যতক্ষণ না পর্যন্ত ফরাসিরা অনেকটা দূরে চলে যাচ্ছে, পাঠানরা [আফগানরা] অনেকটা এগিয়ে আসছে এবং আমি ও উমিচাঁদ যে পরিকল্পনা করছি তা পাকাপোক্ত হচ্ছে, ততদিন নবাবকে শান্ত রাখা দরকার এবং এমন ভাব করা উচিত যেন আমরা যুদ্ধের কথা চিন্তাই করছি না।’ ওয়াটস আরও জানান যে, তাঁর ইচ্ছানুসারে [by his desire] উমিচাঁদ ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করেছেন। লতিফ তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে নবাব ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধ শুরু করলে তিনি তাঁর সৈন্যদল নিয়ে ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দেবেন, যদি অবশ্য তাঁকে নবাব করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।২৬

বস্তুতপক্ষে এই প্রথম সঠিক ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে ষড়যন্ত্র বাস্তবরূপ নিতে চলেছে। এবং এটাও পরিষ্কার যে তা হচ্ছে প্রধানত ইংরেজদের উদ্যোগেই। তবু ছবিটা কিন্তু এখনও খুব স্পষ্ট নয়। সোজা ক্লাইভকে লেখা একটি চিঠিতে (এতদিন স্ক্র্যাফ্টন ক্লাইভের বিশ্বস্ত অনুচর ওয়ালসকেই লিখতেন, সোজা ক্লাইভকে নয়—এই প্রথম এবং যেহেতু ওটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তাই সোজা ক্লাইভকে লেখা) স্ক্র্যাফ্‌টন ২৪ এপ্রিল জানাচ্ছেন—উমিচাঁদের মাথায় একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা ঘুরছে। তাঁর অনুমান, এটা হচ্ছে জগৎশেঠদের যোগসাজশে ইয়ার লতিফকে নবাব করা। কিন্তু যেহেতু উমিচাঁদ কৃতিত্বটা পুরোপুরি নিজেই নিতে চান, সে জন্য স্ক্র্যাফ্‌টনকে কিছু ভেঙে বলেননি—তাই স্ক্র্যাফ্‌টন ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন তিনি যেন উমিচাঁদকে নির্দেশ দেন পুরো ব্যাপারটা স্ক্র্যাফ্‌টনকে জানাবার জন্য।২৭ মনে হয়, উমিচাঁদ জগৎশেঠকে প্রস্তাব দেন যে তিনি যেন সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে সাহায্য করেন। সম্ভবত শেঠরা সিরাজকে হঠিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন, যদিও তাঁর জায়গায় কাকে বসানো হবে সে সম্বন্ধে কোনও স্থির সিদ্ধান্ত তখন কবুল করেননি।

ঠিক এ সময় মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন মীরজাফর। ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিলের চিঠিতে লিখছেন যে দু’দিন আগে মীরজাফর খোজা পেট্রুসকে (Khwaja Petruse) ডেকে পাঠান এবং তাঁকে বলেন ওয়াটসকে জানাতে যে ওয়াটস যদি রাজি থাকেন, তা হলে মীরজাফর, রহিম খান, রায়দুর্লভ, বাহাদুর আলি খান এবং অন্যান্যরা সিরাজকে হঠাবার জন্য ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলাতে প্রস্তুত এবং সবার অনুমোদন সাপেক্ষে অন্য কাউকে নবাব করা যেতে পারে। ওয়াটস আরও জানান: ‘আপনি যদি এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন, তা হলে আমি আগে যে পরিকল্পনার কথা লিখেছিলাম তার চেয়ে অনেক সহজে এই পরিকল্পনা সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে টাকাকড়ি, জমিজমা বা চুক্তির শর্তাবলী কী হবে আমাকে জানান।’২৮ ওই একই দিনে এদিকে ক্লাইভ ওয়াটসনকে লিখছেন, তাঁরা খবর পেয়েছেন যে দরবারের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি, যার মধ্যে জগৎশেঠ, মীরজাফর প্রভৃতি আছেন, একজোট হয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করতে চান। লতিফ একজন ধনী, প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য।২৯

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, ক্লাইভ ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে ওরকম লম্বা সার্টিফিকেট দিলেও, তিনি নিজে ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে একেবারে কিছুই জানতেন না। শুধু তাই নয়, তাঁর সম্বন্ধে ক্লাইভের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাই এর ঠিক দুদিন পরে (২৮ এপ্রিল) ক্লাইভ ওয়াটসকে লিখছেন: ‘লতি[ফ] কেমন লোক আপনি ভাল করে খোঁজ নিন। উনি কি মুসলমান? ওঁকে মসনদে বসাবার যে পরিকল্পনা, আফগানরা এলে তা ভেস্তে যাবে না তো? লতির সঙ্গে আফগানদের যোগাযোগ আছে?’৩০

এদিকে ওইদিনই একটি চিঠিতে ওয়াটস ক্লাইভের কাছে অনুনয় জানান, মীরজাফরের প্রস্তাব সম্বন্ধে তাঁর মতামত সত্বর জানাতে যাতে ওয়াটস মীরজাফরের সঙ্গে তাড়াতাড়ি চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। তিনি ক্লাইভকে আরও অনুরোধ করেন, নবাবের বিরুদ্ধে আরও কয়েকটা দিন যেন কিছু করা না হয়। ওই ক’দিনের মধ্যে তিনি সব ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করে ফেলতে পারবেন বলে আশা করছিলেন। তাই তিনি ক্লাইভকে এই বলেও আশ্বস্ত করলেন যে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তিটা হয়ে গেলে খুব ভাল হবে কারণ, তাতে করে ইংরেজরা দরবারের সবচেয়ে প্রভাবশালী একজনকে নিজেদের দলে পেয়ে যাবে।৩১

ইতিমধ্যে ২৩ এপ্রিল ফোর্ট উইলিয়ামের সিলেক্ট কমিটিতে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে অন্য কাউকে নবাব করার প্রস্তাব সরকারিভাবে গৃহীত হয়। আবার ওই একই দিনে ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটিকে অনুরোধ করলেন, স্ক্র্যাফ্‌টন যাতে মুর্শিদাবাদে থাকতে পারে তার অনুমতি দেবার জন্য কারণ ক্লাইভ ওখানে ‘স্ক্র্যাফ্‌টনের ওপর কিছু জরুরি কাজের ভার দিতে চান।’৩২ এ-কাজটা যে দরবারের ‘বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাজিয়ে দেখা’ সেটা আন্দাজ করে সিলেক্ট কমিটি ক্লাইভের অনুরোধে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। কমিটি ২৮ এপ্রিল প্রস্তাব নিল: ‘কর্নেল ক্লাইভ যেন নবাবের প্রতি দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মনোভাব এবং এই নবাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসাবার পরিকল্পনায় তাদের প্রতিক্রিয়া জানার জন্য উপযুক্ত লোক নিয়োগ করেন।৩৩ সে অনুযায়ী ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন ইংরেজদের ‘পরিকল্পনায়’ দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমর্থন আদায়ের কাজে উঠে পড়ে লেগে গেলেন। সিরাজকে হঠাবার ইংরেজ পরিকল্পনা এপ্রিল মাসের শেষাশেষি মোটামুটি চূড়ান্ত হয়ে যায়। ২৬ এপ্রিল ক্লাইভ ওয়াটসনকে লেখেন: ‘খুব শিগগিরই বড় একটা বিপ্লব ঘটবে।’ আর ৩০ এপ্রিল তিনি মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে লিখলেন যে দরবারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জগৎশেঠ ও খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের সুখবর তিনি আশা করতে পারেন।৩৪

অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ভারতীয় ষড়যন্ত্রীরাই তাদের পরিকল্পিত বিপ্লবে ইংরেজদের সাহায্য ও সহায়তা লাভের আশায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু আমাদের হাতে যে তথ্যপ্রমাণ আছে তার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে ইংরেজরাই প্রথমে দরবারের অভিজাতবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাদের পলাশি ষড়যন্ত্রে সামিল করার চেষ্টা করে। জঁ ল’ যাঁকে ইংরেজদের ‘এজেন্ট’ বলছেন,৩৫ সেই উমিচাঁদের সাহায্যেই ইংরেজরা ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং আস্তে আস্তে দরবারের বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হাত করে নেয়। রবার্ট ওরম লিখেছেন, ওয়াটস ও স্ক্র্যাফ্‌টন মিলে উমিচাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁকে দরবারের হালহকিকৎ জানার কাজে লাগান।৩৬ উমিচাঁদ বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের কাছে যাতায়াত শুরু করেন। খুব সম্ভবত তারই ফলস্বরূপ ইয়ার লতিফ ২৩ এপ্রিল ওয়াটসের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করার বাসনা ব্যক্ত করেন। ওয়াটস উমিচাঁদকে পাঠান ওই উচ্চাভিলাষী সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে। ইয়ার লতিফ উমিচাঁদের কাছে নবাব হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং বলেন যে জগৎশেঠরা তাঁকে সমর্থন করবেন। ওরম জানাচ্ছেন যে এর আগেই ওয়াটস স্ক্র্যাফ্‌টনকে তাঁর এবং উমিচাঁদের ‘পরিকল্পনার’ কথা জানিয়েছিলেন—নবাব আলিনগরের চুক্তির অন্যথা করলে তাঁকে সরিয়ে অন্য কাউকে মসনদে বসানো যেতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে ওই পদের জন্য ইয়ার লতিফই যোগ্য ব্যক্তি।৩৭ আবার এদিকে ২০ এপ্রিল স্ক্র্যাফ্‌টন লিখছেন যে উমিচাঁদ জগৎশেঠের কাছে গেছেন, সম্ভবত তাঁকে জানাতে যে সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে ইয়ার লতিফকে নবাব করার পরিকল্পনা হচ্ছে। ওইদিন রাত্রেই ইয়ার লতিফের সঙ্গে স্ক্র্যাফ্‌টনের দেখা করার কথা ছিল কিন্তু দরবারে ঝামেলার জন্য তা সম্ভব হয়নি।৩৮ ইংরেজরা যদি পলাশির ষড়যন্ত্রে নিস্পৃহ থাকত এবং তাতে যদি তারা কোনও সক্রিয় ভূমিকা না নিয়ে থাকে, তা হলে স্ক্র্যাফ্‌টন ইয়ার লতিফের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন কেন?

সে যাই হোক, ইয়ার লতিফকে নবাব করার প্রস্তাব ওয়াটস লুফে নেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তা ক্লাইভের গোচরে আনেন। ক্লাইভও তাতে সম্মতি জানান, যদিও ইয়ার লতিফ সম্বন্ধে তাঁর বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা ছিল না। এ থেকে স্পষ্ট যে, ইংরেজরা বিপ্লব ঘটানোর জন্য অতি উৎসাহে হাতের কাছে যাকে পাওয়া যায় তাকেই নবাব করতে চেয়েছিল। সে কেমন ব্যক্তি, ভাল না মন্দ, তা নিয়ে তারা কিছুমাত্র মাথা ঘামায়নি। এমনি সময় রঙ্গমঞ্চে হাজির হলেন মীরজাফর, যদিও ওয়াটস ক্লাইভকে ২৬ এপ্রিল লেখেন যে, কলকাতার আর্মানি বণিক খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর তাঁর প্রস্তাব ওয়াটসকে জানান। পরে তিনি তাঁর পিতাকে অবশ্য লেখেন যে তিনি নিজেই মীরজাফরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাবরেন এবং মীরজাফর সাগ্রহে ‘আমার প্রস্তাব’ গ্রহণ করেন।৩৯ খোজা পেট্রুসও লিখেছেন যে ওয়াটসই একটি প্রস্তাব নিয়ে তাঁকে মীরজাফরের কাছে পাঠিয়েছিলেন এবং তিনি মীরজাফরকে ওয়াটসের প্রস্তাবে রাজি করান।৪০ এর পরেই ইংরেজরা ইয়ার লতিফকে নবাব করার পূর্ব পরিকল্পনা বাতিল করে মীরজাফরকে মসনদে বসাবার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কারণ, ওয়াটসের ভাষায়, ‘নবাব করার পক্ষে মীরজাফরই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। তিনি ইয়ার লতিফের চাইতে অনেক বেশি যোগ্য, তাঁর সুনাম এবং প্রভাবও অনেক বেশি।৪১

খুব সম্ভবত ইংরেজরা বুঝতে পেরেছিল যে ইয়ার লতিফের নাম দিয়ে তারা তাদের পরিকল্পনায় সফল হতে পারবে না। তাই তাঁর জায়গায় মীরজাফরকে বেছে নেয় যেহেতু মীরজাফর যে শুধু সবচেয়ে প্রভাবশালী সৈন্যাধ্যক্ষ তা নয়, তিনি জগৎশেঠদেরও খুব ঘনিষ্ঠ। ওরম-এর বক্তব্য এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ: ‘মীরজাফর নবাবের ওপর ক্ষুব্ধ এ খবর শুনে ক্লাইভ ওয়াটসকে নির্দেশ দেন মীরজাফরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে।’৪২ সম্ভবত মীরজাফর প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি এবং অন্য সৈন্যাধ্যক্ষরা সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠাতে ইংরেজদের সাহায্য করতে প্রস্তুত।৪৩ সিলেক্ট কমিটির জবানিতেও জানা যায় যে খোজা পেট্রুসের মাধ্যমে মীরজাফর ইংরেজদের জানায় যে দরবারের বিশিষ্ট অমাত্যদের মধ্যে অনেকে সিরাজের পরিবর্তে অন্য কাউকে মসনদে বসাতে প্রস্তুত যদি ইংরেজরা তাদের মদত দেয়।৪৪ অর্থাৎ ইংরেজদের কার্যকর ভূমিকা ছাড়া পলাশির ষড়যন্ত্র খুব সম্ভবত পূর্ণরূপ নিতে পারত না। ক্লাইভ ও সিলেক্ট কমিটি সঙ্গে সঙ্গে ওয়াটসকে মীরজাফরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব পরিকল্পনা পাকা করে ফেলতে দায়িত্ব দেয়। তা থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইংরেজরা পলাশি বিপ্লব ঘটাতে অত্যন্ত উদগ্রীব হয়ে পড়েছিল।

কিন্তু ষড়যন্ত্রের তখনও অঙ্কুরাবস্থা এবং মীরজাফরের ওপর ইংরেজরা পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলনা। মীরজাফরও তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে পুরোপুরি সামিল হননি। তাই ক্লাইভ ২ মে ওয়াটসকে লিখছেন: ‘মীরজাফরকে যেন আশ্বস্ত করা হয় যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ইংরেজরা নবাবকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবং ক্লাইভ নিজে তাঁর একজন সৈন্যও জীবিত থাকতে মীরজাফরকে পরিত্যাগ করবেন না।’৪৫ এদিকে সিলেক্ট কমিটিও অস্থির হয়ে পড়েছিল এবং ১৭ মে স্ক্র্যাফ্‌টনকে নির্দেশ দেয় মীরজাফরের সঙ্গে একটি গোপন বৈঠক করে ‘আমাদের পরিকল্পনাকে কীভাবে রূপায়িত করা যায় তার একটা ছক তৈরি করতে, আমাদের দাবিগুলো যে এমন কিছু বেশি নয় তা তাঁকে ভাল করে বোঝাতে…এবং আমাদের কথার যে নড়চড় হয় না ও তাঁকে নবাব করতে যে আমরা বদ্ধপরিকর সে সম্বন্ধে তাঁকে নিশ্চিন্ত করতে।’৪৬ এটা থেকেই স্পষ্ট যে ইংরেজরা কী পরিমাণ প্রলোভন এবং আশ্বাস দিয়ে মীরজাফরকে দলে টানার চেষ্টা করেছে। ক্লাইভের অস্থিরতাও বিন্দুমাত্র কম ছিল না। তাই ১২ মে তিনি ওয়াটসকে লিখছেন মীরজাফরকে জানাতে যে ‘তিনি যদি সিরাজকে হঠাতে সাহস করে স্থিরসংকল্প হন তা হলে ক্লাইভ শেষ পর্যন্ত তাঁর পাশে থাকবেন।’৪৭ পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লিখছেন যে বর্ষা এগিয়ে আসছে এবং তা শুরু হয়ে গেলে বিপ্লব ঘটাবার এ-সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হয়ে যাবে।৪৮ অর্থাৎ বিপ্লবের পরিকল্পনা যাতে তাড়াতাড়ি রূপায়িত করা যায় তার জন্য ক্লাইভের ছটফটানি।

এদিকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে কতগুলি অসুবিধে দেখা দিল। উমিচাঁদ একদিকে নবাবের ধনসম্পদের এক চতুর্থাংশ ও কোষাগারের শতকরা পাঁচ শতাংশ দাবি করে বসলেন। তা ছাড়া মীরজাফরের কাছ থেকে যা আদায় করা যাবে তার এক চতুর্থাংশ রায়দুর্লভের জন্য চেয়ে বসলেন, যাতে রায়দুর্লভকেও দলে টানা যায়। ওয়াটস কিন্তু এ-সবে আপত্তি জানালেন কারণ তাঁর তখন ধারণা হল যে উমিচাঁদ এত সব পাওয়ার মোটেই যোগ্য নন.৪৯ অথচ ক্লাইভ নিজেই ৫ মে ওয়াটসকে লিখেছিলেন যে কলকাতায় গণ্ডগোলের সময় উমিচাঁদের যে ক্ষতি হয়েছিল, চুক্তির একটি বিশেষ শর্তে তা পূরণ করে দেওয়া উচিত।৫০ এটা আশ্চর্যের বিষয় যে ওয়াটস, স্ক্র্যাফ্‌টন, ক্লাইভ সমেত যে ইংরেজ ষড়যন্ত্রকারীরা উমিচাঁদকে কাজে লাগিয়ে এবং মূলত যাঁর সাহায্যে তাঁরা পলাশি চক্রান্তের পরিপূর্ণ রূপ দিতে পেরেছিলেন এবং যাঁর সম্বন্ধে তাঁরা আগে ‘কোম্পানির স্বার্থে অক্লান্ত কর্মী’ বা ‘ইংরেজদের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রশংসার অপেক্ষা রাখে না’ এমন সব মন্তব্য করেছেন, এখন হঠাৎ তাঁরাই তাঁকে প্রতারণা করা স্থির করলেন।৫১

ওয়াটসকে যদি বিশ্বাস করা যায়, তা হলে মনে হয় জগৎশেঠদের ইশারায় মীরজাফরেরও উমিচাঁদের ওপর কোনও আস্থা ছিল না, তাই মীরজাফরও চাননি যে উমিচাঁদ কোনওভাবেই চুক্তির সঙ্গে জড়িত থাকুক।৫২ এ-সব কারণে সিলেক্ট কমিটি ১৭ মে প্রস্তাব নিল উমিচাঁদের জন্য লাভজনক শর্ত মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি থেকে একেবারেই বাদ দিয়ে দিতে হবে কারণ তাঁর ব্যবহারের জন্য কোনও পুরস্কার তো নয়ই, তাঁর প্রাপ্য হওয়া উচিত অসম্মান ও অন্য শাস্তি। উমিচাঁদকে কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, যেহেতু উমিচাঁদের দাবিগুলো অত্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত এবং যেহেতু তাঁকে পরিকল্পিত বিপ্লবে আর কোনও কাজে লাগবে না, তাই তাঁকে নবাবের কোষাগারের বা ধনসম্পদের বিন্দুমাত্র অংশ দেওয়ার কথা চুক্তিতে থাকবে না। কিন্তু উমিচাঁদ যাতে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস করে না দেয় তার জন্য তাঁকে খুশি রাখতে হবে এবং সে জন্য দুটো চুক্তি করা হবে—একটি নকল, লাল কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কথা লেখা থাকবে, অন্যটি আসল, সাদা কাগজে, যাতে উমিচাঁদের প্রাপ্যের কোনও উল্লেখই থাকবে না।৫৩ ওয়াটস ক্লাইভকে পরামর্শ দিলেন যে, ক্লাইভ নিজে যা চেয়েছিলেন সেভাবে উমিচাঁদকে ফাঁকি দিতে হবে, নতুবা এমন ভাব দেখাতে হবে যে তাঁরা বিপ্লবের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দিয়েছেন এবং উমিচাঁদের কাছ থেকে সবকিছু গোপন রাখতে হবে। তা ছাড়াও তিনি ক্লাইভকে সতর্ক করে দিলেন যাতে এই সংকটময় অবস্থায় আর কোনও নতুন পরিকল্পনা করা না হয় কারণ কোথাও সামান্য ভুলত্রুটি হলেই ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে।’৫৪

মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তি করার ব্যাপারে আরেকটি অসুবিধে ছিল, মুর্শিদাবাদে রায়দুর্লভের অনুপস্থিতি। ওয়াটসের মতে রায়দুর্লভ মীরজাফরের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর সঙ্গে পরামর্শ না করে মীরজাফর কখনওই এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।৫৫ কিন্তু রায়দুর্লভ যখন মুর্শিদাবাদে ফিরলেন এবং চুক্তির শর্তাবলীর কথা জানলেন, তখন তিনি প্রবল আপত্তি জানালেন কারণ চুক্তির দাবি মেটানোর মতো এত অর্থ নবাবের ভাণ্ডারে নেই।৫৬ ওয়াটসের ধারণা, এ আপত্তি রায়দুর্লভ ও উমিচাঁদের যোগসাজশেরই ফল। কারণ এর ক’দিন আগেই উমিচাঁদ পলাশিতে রায়দুর্লভের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।৫৭ ইতিমধ্যে চুক্তি সম্পাদনের জন্য অপেক্ষা করে করে ওয়াটসও অধৈর্য হয়ে যান এবং মীরজাফরের নির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাঁর এও সন্দেহ হয় যে, মীরজাফর রায়দুর্লভের হাতের পুতুলমাত্র এবং নবাবের সেনাপতিদের মধ্যে অনেকে তাঁর সঙ্গে আছে বলে মীরজাফর দাবি করলেও তা হয়তো মোটেই ঠিক নয়। ওয়াটস এও লিখছেন যে মীরজাফর এবং তাঁর সঙ্গীরা যুদ্ধের সময় নিরপেক্ষ থাকবে, এর বেশি সাহায্য তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তাই অত্যন্ত হতাশ এবং বিরক্ত হয়ে তিনি ৩ জুন লিখছেন, ‘এ সব অস্থিরচিত্ত, মিথ্যাচারী, মেরুদণ্ডহীন বদ লোকের ওপর নির্ভর না করে আমরা নিজেরাই সবকিছু করলে পারতাম।’৫৮

এদিকে উমিচাঁদকে ঠকানোর পরিকল্পনায় ক্লাইভও সম্মতি দিলেন। উমিচাঁদ সম্বন্ধে তাঁর আগের ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে তিনি ১৯ মে ওয়াটসকে লিখলেন— ‘উমিচাঁদ এ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভিলেন এবং তাঁর রক্তেই তা আছে।’ তবে সেই সঙ্গে ওয়াটসকে পরামর্শ দিলেন:৫৯

Flatter Omichand greatly, tell him the Admiral [Watson], Committee and Self are infinitely obliged to him for the pains he has taken to aggrandise the Company’s affairs, and that his name will be greater in England than ever it was in India.

রায়দুর্লভ মুর্শিদাবাদে ফিরলেন ২ জুন। নবাবের সম্পদের শতকরা পাঁচ ভাগ তাঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চুক্তিতে তাঁর আপত্তি দূর করা হল। মীরজাফর ৫ জুন চুক্তিতে সই করে, তাতে সিলমোহর লাগিয়ে ওয়াটসকে দিলেন এবং ১১ জুন তা কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে পৌঁছে গেল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নকল (লাল) চুক্তিতে কীভাবে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনকে দিয়ে সই করানো যায়। এতে সই করতে এবং তাতে তাঁর সিলমোহর দিতে ওয়াটসন অস্বীকার করলেন। কিন্তু ক্লাইভের আদেশে লাশিংটন (Lushington) ওয়াটসনের সই জাল করে চুক্তিতে সই করলেন।৬০ এই জাল চুক্তি উমিচাঁদকে দেখিয়ে আপাতত তাঁর সন্দেহ দূর করা হল। তা সত্ত্বেও এদিকে ক্লাইভের অস্থিরতা বাড়তে থাকল—তাঁর চিঠিপত্র থেকে এটা স্পষ্ট। বিপ্লবের রূপায়ণে দেরি হচ্ছে দেখে তিনি ৫ জুন ওয়াটসকে তাঁর উদ্বেগের কথা জানিয়ে লিখছেন যে ‘ব্যাপারটা নিয়ে লোকে কানাঘুষো শুরু করছে, তাড়াতাড়ি একটা কিছু না করতে পারলে পরে আর কিছু করা যাবে না কারণ বৃষ্টি আসার আগেই যা কিছু করতে হবে।’ ওইদিনই লেখা আরেকটি চিঠিতে তিনি ওয়াটসকে জানান যে এরকম ‘ভিতু, বদমায়েশ’ লোকদের সঙ্গে কোনও রকম পরিকল্পনা করাই উচিত হয়নি। পরের দিনই তিনি আবার ওয়াটসকে লেখেন:৬১

আপনি বলছেন চুক্তি হয়ে গেছে এবং তা আমাকে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু আমার সঙ্গে কে বা কারা, কখন কীভাবে কোথায় যোগ দেবে এবং আদৌ দেবে কিনা—তা কিছুই বুঝতে পারছি না। এ-সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর না পেলে, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এক পাও নড়ছি না।

ওয়াটসের দিক থেকেও উদ্বেগ ও অস্থিরতা বিন্দুমাত্র কম ছিল না। ৬ জুনের একটি চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে অনুরোধ করছেন, তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে, কারণ মুঘল সম্রাটের উজির এবং তাঁর পুত্র খুব শীঘ্রই বাংলা অভিযান করতে পারেন এমন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তা হলে কিন্তু ‘আমাদের পুরো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে।’ ওয়াটসের ভয়ের আরও কারণ, ব্যাপারটা নিয়ে কলকাতায় প্রকাশ্যে আলোচনা হচ্ছিল এবং কয়েকদিনের মধ্যে তা মুর্শিদাবাদের লোকেরাও জেনে যাবে। আর তা হলে ইংরেজদের সর্বনাশ হবে।৬২ যা হোক, ৯ জুনের চিঠিতে তিনি ক্লাইভকে জানান যে সব প্রস্তুতি শেষ এবং ১২ জুন তিনি মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার আগে খুব তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করতে আবার ক্লাইভকে অনুরোধ জানান।৬৩

এর পরেই ইংরেজরা বিপ্লব ঘটাবার প্রচেষ্টায় পুরোপুরি ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি বানচাল করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানোয় সিরাজদ্দৌল্লার কাছে ইংরেজদের আসল অভিসন্ধি পরিষ্কার হয়ে গেল। তিনি ক্লাইভকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, তাঁর নির্দেশ ও সম্মতি ছাড়া এই ঘটনা ঘটতে পারত না এবং এ থেকে ইংরেজদের ছলনামূলক আচরণ (‘deceitful design’) ও আলিনগরের চুক্তিভঙ্গের অভিসন্ধি জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে।৬৪ আসলে পলাশি অভিমুখে অভিযানের জন্য ইংরেজদের একটা অজুহাতের দরকার হয়ে পড়েছিল। সিরাজদ্দৌল্লা, আলিনগরের চুক্তির শর্তগুলি মানেননি এবং ফরাসি নৌসেনাপতি বুসির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন—এ-সব কারণে ক্লাইভ পলাশি অভিমুখে যাত্রা করবেন বলে সিরাজকে জানিয়ে দেন।৬৫ এখানে বলা প্রয়োজন যে সিরাজদ্দৌল্লা আলিনগরের সন্ধির শর্তাবলী পালন করেননি বলে যে অভিযোগ তা একেবারেই ভিত্তিহীন। ক্লাইভ এবং ওয়াটসনকে লেখা কয়েকটি চিঠিতেই সিরাজ পরিষ্কার জানিয়েছেন যে তিনি বরাবরই সন্ধির শর্তাবলী মেনে চলেছেন এবং কখনওই তা থেকে বিচ্যুত হননি। সন্ধিভঙ্গের জন্য তাঁর বিন্দুমাত্র দায়িত্ব নেই।৬৬

বস্তুতপক্ষে ইংরেজরা মাঝেমধ্যেই স্বীকার করেছে যে সিরাজদ্দৌল্লা সন্ধির প্রায় সব শর্তাবলীই পূরণ করেছেন। সিলেক্ট কমিটি (৩০ মার্চ) ও মাদ্রাজের গর্ভনর পিগটকে (৩০ এপ্রিল) লেখা চিঠিতে ক্লাইভ নিজেই এটা স্বীকার করেছেন।৬৭ এমনকী ওয়াটসও ১১ এপ্রিল ক্লাইভকে জানান যে সিরাজ সন্ধির শর্তাবলী পালন করছেন, যদিও ইংরেজরা যতটা তাড়াতাড়ি চাইছিল ততটা তাড়াতাড়ি হয়তো নয়।৬৮ অবশ্য মাঝে মাঝেই ইংরেজরা অভিযোগ করেছে যে সিরাজ সন্ধির কিছু শর্ত পালন করতে গড়িমসি করছেন। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, স্ক্র্যাফ্‌টনের লেখা থেকে যা পরিষ্কার বোঝা যায়, যে ইংরেজরা তাদের দাবিগুলো সিরাজকে কখনও সঠিকভাবে জানায়নি এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে বেড়েই যাচ্ছিল।৬৯ নবাবের বিরুদ্ধে ক্লাইভের আরও অভিযোগ যে তিনি ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন যদিও এটা ঠিক হয়েছিল যে ‘আপনার শত্রু আমাদের শত্রু এবং আমাদের শত্রু আপনার শত্রু, হিসেবে গণ্য করা হবে। ক্লাইভকে লেখা ওয়াটসের চিঠিতে (২৬ এপ্রিল) সমগ্র পরিস্থিতিটা পরিষ্কার করে বলা আছে:৭০

…he [the nawab] is complying with his contracts, grants us parwannahs and whatever we ask within the compass of his Agreement. Our attack- ing the French I take it has nothing to do with our articles of Peace nei- ther is he bound thereby to deliver them up. He writes to you that your enemies are his and his yours, but this is only a private letter and not mentioned in the Agreement; on the contrary it says we shall not make war in Bengal while he continues firm to his Agreement.

তবে এটা ঠিকই যে সিরাজদ্দৌল্লা ফরাসিদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন এবং তাদের কখনওই পুরোপুরি পরিত্যাগ করেননি। ইংরেজদের পীড়াপীড়িতে, তাঁর নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, জাঁ ল’-কে মুর্শিদাবাদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেও তিনি ল’-র সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, এমনকী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ব্যুসির সাহায্য ও মদত নেওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন। আসলে একদিকে তাঁর নিজের দরবারের অমাত্যদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে ও অন্য দিকে ইংরেজদের জঙ্গি মূর্তি দেখে সিরাজদ্দৌল্লা এমন এক ‘মিত্রের’ প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন বিপদের সময় যার সাহায্য পাওয়া যাবে। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে দেখা যাবে যে সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনে যেতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন, কখনওই এ-ব্যাপারে পুরোপুরি মনস্থির করতে পারেননি। তিনি যদি এ বিষয়ে স্থিরসংকল্প হতে পারতেন এবং ইংরেজদের প্রকৃত অভিসন্ধি বোঝার মতো দূরদৃষ্টি যদি তাঁর থাকত, তা হলে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন করা তেমন কঠিন হত না। এমন সম্ভাবনার কথা ইংরেজরা আন্দাজ করেছিল এবং তা নিয়ে বেশ শঙ্কিতই ছিল। এক ফরাসি পর্যবেক্ষক সঙ্গতভাবেই বলেছেন, নবাবের দোনামনা ভাবের জন্যই এ মৈত্রীবন্ধন সম্ভব হয়নি। ফলে ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধনের সম্ভাবনা বিলীন হয়ে গেল।৭১ মীরজাফরের সঙ্গে ৫ জুন ইংরেজদের চুক্তি, ১২ জুন মুর্শিদাবাদ থেকে ওয়াটসের পালানো, ১৩ জুন ক্লাইভের পলাশি অভিমুখে যাত্রা—এ-সব মিলিয়ে বলা যায় যে, এভাবেই পলাশির ষড়যন্ত্র পূর্ণরূপ পেল এবং এতে পলাশি বিপ্লবের পটভূমি তৈরি হয়ে গেল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. P. J. Marshall, Bengal, p. 91; C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray. ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 11, 12; পলাশী, পৃ. ১২,১৬।

২. দৃষ্টান্তস্বরূপ, Scrafton, Reflections, and Watts, Memoirs.

৩. Watts’ Memoirs, p.74; ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.

৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 189.

৫. ক্লাইভকে ওয়াটসের চিঠি, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

৬. ঐ; Hil, I, clxxvii.

৭. Orme Mss., vol. 170, f. 99, Records of Fort St. George, Diary and Consultation Books, Military Department, 1756, p. 330; Hill, I, pp. 239-40.

৮. Clive to Select Committee, Fort St. George, 2 July 1757, Hill, II, p. 442.

৯. Hill, II, p.440.

১০. তাঁর পিতাকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৫ অক্টোবর ১৭৫৬, Hill, I, p. 227.

১১. Powis Collection, Box 20, John Brown to Clive, 27 Feb. 1752, quoted in Mark Bence-Jones, Clive of India, p. 92.

১২. সিক্রেট কমিটিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি, ৩১ জানুয়ারি ১৭৫৭, Bengal Letters Received, vol. 23, f. 405.

১৩. ওয়াটসকে সিলেক্ট কমিটি, ১৪ মার্চ ১৭৫৭, Ome Mss., Inida, V,f. 1275; Orme Mss., O.V. 170,f. 397.

১৪. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 173-74.

১৫. ঐ, পৃ. ১৭৫-৭৭।

১৬. ঐ, পৃ. ১৭৪।

১৭. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৯৬।

১৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 185.

১৯. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 322.

২০. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, III, p. 342.

২১. ঐ, Hill, III, p. 343. জোরটা আমার দেওয়া।

২২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

২৩. ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

২৪. ওয়ালসকে স্ক্র্যাটফ্‌ন, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 349-50.

২৫. ওয়াটসকে নবাবের চিঠি, সম্ভবত ১৬ এপ্রিলের পর যখন জাঁ ল’ মুর্শিদাবাদ ছেড়ে চলে যান, Hill, II, p. 335.

২৬. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 353-54.

২৭. ক্লাইভকে স্ক্র্যাটন, ২৪ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 357-58.

২৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 363.

২৯. ওয়াটসনকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 362,

৩০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

৩১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 366.

৩২. Select Committee Consultations, 23 April 1757; Orme Mss., India V, f. 1212; O.V. 170, f. 222.

৩৩. ক্লাইভকে সিলেক্ট কমিটি, ২৯ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368; Select Committee Consultations, 28 April 1757; Orme Mss., O.V. India, f. 1214.

৩৪. ওয়াটসনকে ক্লাইভ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II. p. 362; পিগটকে ক্লাইভ, ৩০ এপ্রিল, ১৭৫৭, Hill, II, pp. 368-69.

৩৫. Law’s Memoir, Hill, III, PP. 353-54.

৩৬. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৩৭. ওয়ালসকে সস্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 342-43.

৩৮. ঐ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 349.

৩৯. তাঁর পিতাকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৩ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, II, p. 468.

৪০. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা খোজা পেট্রুসের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 366,

৪১. Watts’ Memoirs, p. 82.

৪২. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, p. 148.

৪৩. Hill, I, p. clxxxiii.

৪৪. সিক্রেট কমিটিকে লেখা সিলেক্ট কমিটির চিঠি, ১৪ জুলাই ১৭৫৭, Hill, II, p. 446.

৪৫. ক্লাইভ ওয়াটসকে, ২মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 373,

৪৬. Ome Mss., India V, f. 1228; O.V. 170, f. 265.

৪৭. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১২ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 379.

৪৮. ঐ, ১৩ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৪৯. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৫০. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 377; ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 380.

৫১. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ মার্চ ১৭৫, Hill, II, p.294; ওয়ালসকে স্ক্র্যাফ্‌টন, ১৮ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 343.

৫২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১৪ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 382.

৫৩. Select Committee Proceedings, 17 May 1757, Hill, II, p. 383.

৫৪. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৩ মে ১৭৫৭ , Hill, II, p. 393.

৫৫. ঐ, ৩১ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 396.

৫৬. ঐ, ৮ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 401.

৫৭. ঐ।

৫৮. ঐ, ৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 397.

৫৯. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ১৯ মে ১৭৫৭, Hill, II, pp. 388-89.

৬০. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ১৮ মে ১৭৫৭, Hill, II, p. 387; পার্লামেন্টারি কমিটির সামনে ওয়ালসের সাক্ষ্য, Hill, III, p. 318; জন কুকের [John Cooke] সাক্ষ্য, Hill, II, p. 320.

৬১. ওয়াটসকে ক্লাইভ, ৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 398-99; ৬ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 399.

৬২. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৬ জুন, ৭ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 400.

৬৩. ক্লাইভকে ওয়াটস, ৯, ১১ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p. 403. যদিও ওয়াটস তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন যে ১১ জুন মুর্শিদাবাদ ছেড়েছিলেন, আসলে তারিখটি কিন্তু ১২ জুন, Watts’ Memoirs, p. 107; Hill, II, pp. 400-04; 410-11.

৬৪. ক্লাইভকে সিরাজদ্দৌল্লা, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.411; ওয়াটসনকে সিরাজ, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, P. 410.

৬৫. সিরাজদ্দৌল্লাকে ক্লাইভ, ২০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 355; ক্লাইভকে সিরাজ, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 359, 360-6l; ২৭ মে ১৭৫৭, Hill, I, p. 394; ক্লাইভকে শেখ আমিরুল্লা, ১২ জুন ১৭৫৭, Hill, I, p. 405; ওয়াটসনকে সিরাজ, ১৩ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp. 409.10; ক্লাইভকে সিরাজ, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, p.411.

৬৬. ওয়াটসন ও ক্লাইভকে লেখা সিরাজের চিঠি, ১৩, ১৫ জুন ১৭৫৭, Hill, II, pp.410-11

৬৭. সিলেক্ট কমিটিকে ক্লাইভ, ৩০ মে ১৭৫৭, Hill, I, p. 308; পিগটকে ক্লাইভ, ৩০ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 368.

৬৮. ক্লাইভকে ওয়াটস, ১১ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, p. 323.

৬৯. Hill, I, p. clxxxii; Hill, III, pp.342-46.

৭০. ক্লাইভকে ওয়াটস, ২৬ এপ্রিল ১৭৫৭, Hill, II, pp. 362-63.

৭১. Account of what happened in Bengal by a French Doctor, 17 Oct. 1756 to 22 Jan, 1758, Hill, III, p. 257.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *