৫. পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

পলাশি বিপ্লবের অনিবার্যতা

পলাশি বিপ্লব কেন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল সে-সম্বন্ধে ঐতিহাসিকরা এ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান এই সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল—মুসলমান শাসনের নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দুরা মুসলমান নবাবের শাসনের অবসান কামনা করছিল। আবার অনেকের বক্তব্য, পলাশি আসলে হিন্দু-জৈন সওদাগর ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং মহাজন শ্রেণীর দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে এদের স্বার্থ এমনই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল যে, সিরাজদৌল্লা ইউরোপীয়দের, বিশেষ করে ইংরেজদের, বাংলা থেকে তাড়িয়ে দেবে, এটা এরা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। আরেক দল ঐতিহাসিক বলছেন, একদিকে ‘বাংলার অভ্যন্তরীণ’ সংকট অন্যদিকে নবাব যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর গণ্যমান্য অমাত্যদের বিরূপ করে তুলেছিলেন যার জন্য নবাবকে গদিচ্যুত করতে তারা ইংরেজদের সাহায্য চেয়েছিল—দুটো ব্যাপারই ইংরেজদের পলাশির ষড়যন্ত্রে/বিপ্লবে টেনে এনেছিল। কিন্তু আমরা এখানে দেখাব যে উপরোক্ত বক্তব্যগুলির কোনওটাই গ্রহণযোগ্য নয়। ইংরেজদের বাংলাবিজয়ের পেছনে সবচেয়ে জোরালো যে-উদ্দেশ্য কাজ করেছে, তা হল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষা, যেটা ঠিক প্রাক্-পলাশি সময়ে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল।

দ্বিধাবিভক্ত সমাজ

প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলার সমাজ সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ বক্তব্যের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল। তিনি বলেছেন, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলার সমাজ হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। মুসলমান শাসনের নিপীড়নে নির্যাতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমান নবাবের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য কোনও ত্রাণকর্তার প্রত্যাশায় অধীর হয়ে পড়েছিল এবং ইংরেজদের জানিয়েছিল সাদর অভ্যর্থনা। হিল সাহেব তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে দু’জন সমসাময়িক ইউরোপীয়র—জাঁ ল’ এবং কর্নেল স্কটের (Scott)— লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। জাঁ ল’ বলেছেন: ‘হিন্দু রাজারা [জমিদাররা] মুসলমান শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত। প্রখ্যাত ব্যাঙ্কার জগৎশেঠরা, যাদের সঙ্গে এদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, না থাকলে সিরাজদৌল্লা যে বিপ্লবে বিতাড়িত হন, তারপরে তারা হিন্দু রাজত্ব কায়েম করত।’ অন্যজন, কর্নেল স্কট তাঁর বন্ধু মি. নোবলকে লিখেছেন: ‘হিন্দু রাজারা এবং রাজ্যের হিন্দুরা মুসলমান শাসনের নিপীড়নে ক্ষুব্ধ। তারা গোপনে এর পরিবর্তন চাইছিল এবং এই অত্যাচারী শাসনের অবসানের সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।’ এ-সব বক্তব্যের ওপর নির্ভর করে হিলের সিদ্ধান্ত: ‘মুসলমান শাসকের বিরুদ্ধে হিন্দুদের অসন্তোষ ছিল। তা থেকে অব্যাহতির আশায় তারা গোপনে সম্ভাব্য মুক্তিদাতার অপেক্ষা করছিল।’

হিলকে অনুসরণ করে পরবর্তীকালে আরেকজন ঐতিহাসিক অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ তুলে ধরায় যত্নবান। তিনি লিখছেন: ‘ইংরেজদের ধারণা ছিল, হিন্দুরা মুসলিম নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য শুধু প্রস্তুতই ছিল না, তারা মুসলমান শাসনের অবসান ঘটাতে ইংরেজদের সাহায্য নিতেও আগ্রহী ছিল।’ সুতরাং দেখা যাচ্ছে উক্ত দু’জন ঐতিহাসিকেরই বক্তব্য, প্রাক্-পলাশি বাংলায় সমাজ ছিল দ্বিধাবিভক্ত। হিন্দুরা মুসলিম শাসনকে ঘৃণার চোখে দেখত এবং তার হাত থেকে অব্যাহতি চাইছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি বাংলায় হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক সম্পর্ক বিশ্লেষণ করে সমাজের কোনও দ্বিধাবিভক্ত চেহারা (যার ফলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণ করা যায়) চোখে পড়ে কি না তা দেখার আগে সমাজের এই দ্বিধাবিভক্ত রূপচিত্রণের পেছনে ইউরোপীয়দের বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য কাজ করেছে কি না তা বিচার করে দেখা উচিত।

বস্তুতপক্ষে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে অনেক ইউরোপীয়ই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখছিল এবং এ জয় অনায়াসলভ্য বলে মনে করত। তাদের লেখা থেকেই তাদের এ মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যায়। সুতরাং বাংলা বিজয় যেখানে মুখ্য উদ্দেশ্য, তখন সে অবাধ বিজয়ের যাথার্থ্য প্রমাণে যদি তারা বাংলার দ্বিধাবিভক্ত সমাজের চেহারা খুঁজে বার করতে চায়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাঁ ল’ বা স্কটের মন্তব্য উদ্দেশ্য প্রণোদিতই মনে হয় এবং সে-কারণেই এগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই। তা ছাড়া এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, পলাশি শুধু হিন্দুত্বের দ্বারা সংগঠিত বিপ্লব নয়—এটি মূলত ইংরেজদের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের ফল, যাতে তারা শাসকশ্রেণীর একটি শক্তিশালী অংশকে সামিল করতে পেরেছিল। এর মধ্যে হিন্দু যেমন ছিল, তেমনি মুসলমানও। এখানে স্মর্তব্য, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় আরও দুটি বিপ্লব হয়েছিল—১৭২৭ এবং ১৭৩৯-৪০ সালে, যখন শাসকশ্রেণীর দুই সম্প্রদায়েরই অভিজাতবর্গ নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থানুযায়ী ও অভিপ্রায় অনুসারে নবাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অংশগ্রহণ করেছিল, সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে নয়। সুতরাং ওই দুটি বিপ্লবের সময়ে যদি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও প্রশ্ন না উঠে থাকে, তা হলে ১৭৫৬-৫৭ সালেও সে-প্রশ্নের অবতারণা অবান্তর।

এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে, আলিবর্দি তথা সিরাজদ্দৌল্লার সময় অধিকাংশ উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদার হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিক মহলে প্রাক্-পলাশি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপ অবাধ স্বীকৃতি পেয়েছে। লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস রেকর্ডসে (ব্রিটিশ লাইব্রেরি) ওরম সংগ্রহ (Orme Collection) ও হল্যান্ডের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) ঠিক প্রাক্-পলাশি বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের দুটি তালিকা আমরা পেয়েছি। প্রথমটিতে (রবার্ট ওরমের তালিকা) দেখা যাচ্ছে আলিবর্দির সময় (১৭৫৪-তে) দেওয়ান, ‘তান-দেওয়ান’, ‘সাব-দেওয়ান’, বক্সি প্রভৃতি সাতটি গুরুত্বপূর্ণ পদের মধ্যে ছয়টিই হিন্দুরা অলংকৃত করছে—একমাত্র মুসলিম বক্সি ছিল মীরজাফর। আবার ১৯ জন জমিদার ও রাজার মধ্যে ১৮ জনই হিন্দু। বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান ইয়ান কারসেবুমের (Jan Kerseboom) তালিকাতেও (১৭৫৫ সালের) নায়েব দেওয়ান উমিদ রায়ের নেতৃত্বে হিন্দুদেরই একচ্ছত্র প্রাধান্য।১০ ১৭৫৪-৫৫ সালের এই যে চিত্র, নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সময় তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, মুসলমান রাজত্বে হিন্দুরা মুসলমানদের চাইতেও বেশি সুবিধেজনক অবস্থায় ছিল। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি রাজ্যের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রে হিন্দু প্রাধান্য এত বেশি ছিল যে রবার্ট ওরম মন্তব্য করেছেন:১১

তাঁর [আলিবর্দির] রাজত্বকালে হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল অপরিসীম। শাসনযন্ত্রের প্রতিটি বিভাগেই এটা লক্ষ করা যায়। তারা এত যত্ন ও দক্ষতার সঙ্গে সব বিভাগের কাজকর্ম পরিচালনা করত যে তাদের অজান্তে বা তাদের হাত দিয়ে ছাড়া কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজই হত না।

সিরাজদ্দৌল্লার সময় সর্বক্ষেত্রে এই হিন্দু প্রাধান্য আরও বেড়ে যায়। তরুণ নবাবের সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন মোহনলাল। প্রকৃতপক্ষে সিরাজের ওপর মোহনলালের প্রভাবই ছিল সর্বাধিক। ইউসুফ আলির তারিখ-ই-বাংগালা-ই-মহবৎজঙ্গী-র ভাষায় মোহনলাল ছিলেন নবাবের সবচেয়ে বড় ভরসা (firm pillar)। মোহনলালের মতো ‘বিধর্মী’কে এত বেশি প্রাধান্য দেবার জন্য তিনি সিরাজের ওপর বিরক্ত ছিলেন।১২ ওরমও লিখেছেন: ‘মোহনলাল সিরাজের মন্ত্রী না হলেও সব মন্ত্রী মিলে যে ক্ষমতার অধিকারী, তার চেয়েও মোহনলালের প্রভাব অনেক বেশি।১৩ সুতরাং এসব তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রাক্-পলাশির বাঙালি সমাজ হিন্দু-মুসলমান এ-সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল, এ-কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

বাংলার সমাজ যদি সত্যিই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ত, তা হলে সমসাময়িক বাংলা সাহিত্য ও ফারসি ইতিহাসে তার প্রতিফলন অবশ্যই দেখা যেত। কিন্তু সেরকম কোনও নির্দিষ্ট ইঙ্গিত তৎকালীন সাহিত্য বা ইতিহাসে দেখা যায় না। সমাজের উঁচুতলায় কিছুটা টানাপোড়েন নিশ্চয়ই থাকতে পারে, জমিদার ও শাসকশ্রেণীর মধ্যে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলতেই পারে। কিন্তু সেগুলি হিন্দু-মুসলমান এই বিভেদমূলক চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, তার মূল শ্রেণীগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের সংঘাত। বাংলায় হিন্দু, মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের বিশেষ করে সাধারণ মানুষ বহুদিন ধরে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগে লেখা কবি ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যে আছে, হিন্দু সওদাগর লক্ষ্মীন্দরকে সর্পদেবতা মনসার হাত থেকে বাঁচাতে লোহার খাঁচায় বন্ধ করে রাখা হয়েছিল, তাতে মা মনসাকে দূরে রাখার জন্য অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে একটি কোরাণও রাখা ছিল।১৪ আবার প্রায় এই সময় রচিত বেহুলাসুন্দর কাব্যে দেখা যায়, এক হিন্দু সওদাগরের পুত্রলাভের কামনায় ব্রাহ্মণরা কোরাণের সাহায্য নিচ্ছে এবং সওদাগরকে আল্লার নাম করতে বলছে। উক্ত কাব্যেই আছে, ব্রাহ্মণরা কোরাণ দেখে সওদাগরের বাণিজ্যযাত্রার শুভদিন নির্ণয় করছে। সওদাগরও ব্রাহ্মণদের নির্দেশ অনুযায়ী আল্লার নাম নিতে নিতে বাণিজ্যযাত্রা করছে, যেন এ নির্দেশ বেদশাস্ত্রেই লেখা আছে।১৫

সাধারণ মানুষের মধ্যে এই দুই ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ের যে প্রক্রিয়া অনেকদিন ধরে চলছিল, অষ্টাদশ শতকেও তা বজায় ছিল। সমাজের উঁচুতলাতেও দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চোখে পড়ে। নবাব শহমৎ জঙ্গ (নওয়াজিস মহম্মদ খান) শওকত জঙ্গের (যিনি তখন পাটনা থেকে এসেছিলেন) সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মতিঝিলে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেন। সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) সম্পাদন করেই তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে তাঁর প্রাসাদে হোলি উৎসবে মেতে ওঠেন।১৬ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এ সময় মুসলমানরা হিন্দু মন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে ‘সিন্নি’ দিচ্ছে—এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম আর সংস্কৃতির সমন্বয় প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র জন্ম—যে ‘দেবতা’ দুই সম্প্রদায়ের মানুষেরই পূজ্য। কবি ভারতচন্দ্রের সত্যপীর কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।১৭ অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে রচিত শ্যামসুন্দর গাজির পুঁথি-তে আছে যে এক হিন্দু দেবী স্বপ্নে গাজির সামনে আবির্ভূত হন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী পরের দিন সকালে গাজি ব্রাহ্মণদের সহায়তায় সব হিন্দু আচার মেনে দেবীর পূজা করেন। হিন্দুরা সামাজিক, এমনকী ধর্মীয় ব্যাপারেও, মুসলমানদের মতামত গ্রহণ করত এবং তাদের সহায়তা কামনা করত।১৮ ১৭৩২ সালের একটি বাংলা দলিলে, যাতে গোঁড়া বৈষ্ণব ধর্মের ওপর সহজিয়া ধর্মের বিজয় প্রতিফলিত হয়, দেখা যাচ্ছে, হিন্দুদের সঙ্গে কয়েকজন মুসলমানও তাতে সই করেছে।১৯ এডওয়ার্ড সি. ডিমক (Edward C. Dimmock, Jr) একটি সুচিন্তিত প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে, মধ্যযুগের (পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত) বাংলা সাহিত্য পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষে’র পরিচয় পাওয়া দুষ্কর।২০ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহিষ্ণুতা ও বোঝাপড়ার চমৎকার নিদর্শন অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের কবি ফৈজুল্লার সত্যপীর কবিতা—যেখানে ‘যে রাম, সেই রহিম’ এমন অভিব্যক্তি সোচ্চার।২১ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্য থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাঙালি সমাজের দ্বিধাবিভক্ত রূপের কোনও পরিচয় মেলে না।

ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদ?

আমরা আগেই বলেছি এবং যা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক সম্বন্ধে উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, জাঁ ল’ ও কর্নেল স্কট বর্ণিত বাংলার সমাজের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দ্বিধাবিভক্ত রূপ তাঁদের কষ্টকল্পনা, এবং তা ইউরোপীয়দের বাংলা বিজয়ের একটা অজুহাত মাত্র। ১৭৫৭-র আগেই যে ইংরেজদের বাংলা সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট না হলেও অস্পষ্ট পরিকল্পনা ছিল, তা সহজেই দেখানো যেতে পারে। ইংরেজ কোম্পানির পরিচালক সমিতি এ বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না বললেও কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্যরা মাঝেমধ্যেই বাংলা বিজয়ের বাসনা সদর্পে ঘোষণা করত। অবশ্য তখনও পর্যন্ত পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদের চিন্তা হয়তো মাথায় ছিল না। তবে ভারতবর্ষের একটি ভূখণ্ডে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন একটা প্রচেষ্টা ছিল। এর বাহ্যিক উদ্দেশ্য ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করা। ইংরেজ বাণিজ্য বলতে শুধু কোম্পানির বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যও তার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যেই ছিল কর্মচারীদের সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ও আগ্রহ। তারা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দেশে আসত একটি মাত্র উদ্দেশ্য নিয়ে—ব্যক্তিগত বাণিজ্যের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হয়ে কিছুদিন পর দেশে ফিরে সুখে-স্বচ্ছন্দে জীবন কাটানো। আর নতুন দেশে তারা ছিল ইংল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা থেকে বহুদূরে—যেখানে জাহাজে করে চিঠিপত্র/নির্দেশনামা আসতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। ফলে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার স্বার্থে এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কিছুটা জাতীয় স্বার্থের খাতিরে কোম্পানির কর্মচারীদের নিজদায়িত্বে (লন্ডনের অনুমতির অপেক্ষা না করে) সিদ্ধান্ত গ্রহণের এক মানসিকতার জন্ম হয়, যাকে স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ (sub- imperialism) বলে অভিহিত করা যায়। কোম্পানির সাংগঠনিক যে কাঠামো তাতে এ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ ‘সাম্রাজ্যর মধ্যে সাম্রাজ্যের মতো আরেকটি স্তর হিসেবে গড়ে উঠেছিল।২২

ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব ও বিকাশের উৎস সম্ভবত কোম্পানির সুরাট কুঠির প্রধান ও পরে বোম্বাই-এর গভর্নরূ্ (১৬৬৯) জেরাল্ড অঙ্গিয়ারের শান্তিপূর্ণ বাণিজ্য (peaceful trade) থেকে ‘সশস্ত্র বাণিজ্যে’ (armed trade) পরিবর্তন করার আহ্বান। তিনি ইংরেজ বাণিজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলিষ্ঠ ও আক্রমণাত্মক নীতি প্রয়োগের সুপারিশ করেন। লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে তিনি ১৬৭৭ সালে লেখেন, ন্যায়সঙ্গতভাবে এবং প্রয়োজন অনুসারে কোম্পানির এখন “যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল’’ নীতি প্রয়োগ করতে হবে। এখন এদেশে বাণিজ্য করতে গেলে অস্ত্রহাতেই তা করতে হবে।২৩ অঙ্গিয়ারের বক্তব্য কোম্পানির মনে ধরল। স্যার জোসাইয়া চাইল্ডের (Sir Josiah Child) নেতৃত্বে কোম্পানি ভারতবর্ষে ‘আগ্রাসী নীতি’ (for-ward policy) অনুসরণ করা স্থির করল।২৪ এদিকে বাংলা থেকে কোম্পানির এজেন্ট রবার্ট হেজেজ (Robert Hedges) ও সুরাট থেকে সেখানকার কোম্পানির কর্ণধার স্যার জন চাইল্ড (Sir John Child) কয়েক বছর ধরে ইংরেজ বাণিজ্যকে সুরক্ষিত করার জন্য কোম্পানিকে প্ররোচিত করছিলেন।২৫

বস্তুতপক্ষে ১৬৮০-র দশকে মুঘলদের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির সশস্ত্র সংঘর্ষের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় একটি সুসংহত উপনিবেশ (fortified settlement) স্থাপন করা। ১৬৮৭ সালে লন্ডন থেকে পরিচালক সমিতি মাদ্রাজে যে নির্দেশ পাঠায় তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:২৬

That which we promise ourselves in a most especial manner from our new President and Council is that they will establish such a politie of Civil and Military power, and create and secure such a large revenue to maintain both at that place; as may be the foundation of a large, well-grounded, sure English dominion in India for all time to come.

ভারতবর্ষে সুরক্ষিত, স্থায়ী ও বৃহৎ ইংরেজ ‘ডোমিনিয়ন’ স্থাপনের এই যে স্বপ্ন, যা তখন সম্পূর্ণ অবাস্তব ছিল, তাই-ই সত্তর বছরের মধ্যে কিন্তু বাস্তবে পরিণত হয়েছিল। মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে ইংরেজরা পর্যুদস্ত হয় বটে এবং ফলে বাংলায় বা অন্যত্র সুসংহত ইংরেজ ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠাও সম্ভব হয়নি। কিন্তু সুরক্ষিত উপনিবেশের চিন্তা ইংরেজদের মানসিকতায় বরাবরের মতো ঢুকে গিয়েছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে আকস্মিক এক ঘটনার জের হিসেবে তা সম্ভবও হয়ে গেল।।

সুতরাং বলা যেতে পারে, ১৭৫০-এর দশকের প্রথমদিকে ইউরোপীয় কোম্পানির কর্মচারী ও অন্যান্য বণিক অভিযাত্রীরা (merchant adventurers) প্রকাশ্যেই ঐশ্বর্যশালী বাংলা বিজয়ের সম্ভাব্যতা নিয়ে যে-সব জল্পনা-কল্পনা করছিল, তা মোটেই কাকতালীয় নয়। এ-সব ইউরোপীয়দের মধ্যে অনেকেই মনে করত যে বাংলা বিজয় খুব সহজসাধ্য হবে। তাই তারা সবাই বাংলা বিজয়ের স্বপ্ন দেখত। তখনকার নথিপত্রেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ডুপ্লে (Dupleix), ১৭৩০-এর দশকে যিনি বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান ছিলেন, কর্নেল বসিকে (Bussy) লিখছেন (১৫ জুন ১৭৫১): ‘আমি বাংলা থেকে খবর পেলাম যে বাংলার নবাব আমাদের কাছ থেকে কোনও কারণ বা যুক্তি ছাড়াই টাকা আদায় করছেন। এ-ব্যাপারে মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে এমন নির্দেশ বার করা কি সম্ভব, নবাব যেন আমাদের বিরক্ত না করেন? তা যদি সম্ভব না হয়, তা হলে আমাদের বাধ্য হয়ে তাকে তাড়াতে হবে।২৭ এর ক’দিন পরেই তিনি আবার জানাচ্ছেন (১৬ জুলাই ১৭৫১): ‘ঐ ভদ্রলোকের [নবাব আলিবর্দি খান] দম্ভকে চূর্ণ করা খুবই সহজ। ওঁর সৈন্যবাহিনী একেবারেই অপদার্থ, যা আপনি অন্যত্র দেখেছেন।….একটু সতর্কতার সঙ্গে এগুলে আমরা সহজেই হুগলি দখল করে নিতে পারব।২৮ আবার কিছুদিন পরে (১১ সেপ্টেম্বর ১৭৫১) তাঁর শেষ মতামত জানিয়ে লিখছেন: ‘নবাবের অত্যাচারের জন্য সবাই তাকে ঘৃণা করে। বর্তমানে নবাব সরকারের নিপীড়নে দেশের যা অবস্থা তাতে এই দেশ জয় করা আপনার মতো শক্তিমানের পক্ষে সহজেই সম্ভব।২৯ অনুরূপভাবে, ইংরেজ ভাড়াটে সৈন্য কর্নেল মিল (Colonel Mill) লিখেছেন: ‘স্পেনীয়রা যেভাবে উলঙ্গ রেড ইন্ডিয়ানদের অতি সহজেই পরাস্ত করেছিল, তেমনি এদেশ জয় করাও অত্যন্ত সহজ হবে। পনেরোশো থেকে দু’হাজার সৈন্যসহ তিনটে জাহাজ পাঠালেই একাজ সম্পন্ন করা যাবে।৩০

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম মাদ্রাজে ক্লাইভকে লিখেছিলেন (১৭৫২): “বাংলা থেকে এ বুড়ো কুকুরটিকে [নবাব আলিবর্দি] তাড়াতে পারলে একটা উত্তম কাজ করা হবে। ভাল করে চিন্তা না করে আমি এ-কথা বলছি না। ব্যাপারটা নিয়ে কোম্পানির বিশেষ চিন্তাভাবনা করা উচিত। তা না হলে বাংলায় বাণিজ্য করা কোম্পানির পক্ষে মোটেই লাভজনক হবে না।’৩১ বস্তুতপক্ষে কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার কর্নেল স্কট পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে বাংলা বিজয়ের এক বিশদ পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাতে এই ‘গৌরবজনক ঘটনায়’ কোম্পানি কী পরিমাণ লাভবান হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা ছিল। স্কট এটাও জোর দিয়ে বলেছিলেন: ‘বাংলা জয় করতে পারলে ইংরেজ জাতির প্রভুত লাভ হবে’ এবং এ রাজ্যজয়ের ফলে ‘শুধু যে আমাদের সুনাম ও খ্যাতি পুনরুদ্ধার হবে তা নয়…এতে আমাদের বিপুল জাতীয় ঋণ শোধ করাও সম্ভব হবে।৩২ সুতরাং দেখা যাচ্ছে বাংলা বিজয় সম্বন্ধে ইংরেজদের একটা প্রচ্ছন্ন, যদিও তখনও পর্যন্ত তা খুব স্পষ্ট হয়তো নয়, এবং কিছুটা অপরিণত পরিকল্পনা ছিল। তাই পলাশির আগে তাদের বাংলা বিজয়ের কোনও ইচ্ছা বা মতলব ছিল না, আকস্মিকভাবে তারা এতে জড়িয়ে পড়ে এবং বাংলার অভ্যন্তরীণ সংকটই তাদের বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ করে—এ-সব বক্তব্য মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্য ও ‘কোলাবোরেশন থিসিস’

ইদানীং কালে বলা হচ্ছে, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত যে হিন্দু-জৈন মহাজন-ব্যাঙ্কিং ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব হচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে পলাশি বিপ্লবের ব্যাখ্যা করা সমুচিত। হিল সাহেব অবশ্য অনেকদিন আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে এদের সঙ্গে উপরোক্ত শ্রেণীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।৩৩ পরবর্তীকালে ব্রিজেন গুপ্ত বলছেন, বাংলার সঙ্গে ইউরোপীয় সমুদ্রবাণিজ্যের ফলে ‘হিন্দু ব্যবসায়ী শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির স্বার্থের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিশেষ শ্রেণীই বাংলায় ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় প্রধান সহায়কের (catalytic agent) কাজ করেছিল’।৩৪ আবার অতি সম্প্রতি পিটার মার্শাল, ক্রিস বেইলি, প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ইউরোপীয় রাণিজ্যের ফলে ইউরোপীয়দের সঙ্গে বাংলার হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গগাষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ওপর জোর দিচ্ছেন—বলছেন, তার ফলে উভয়ের স্বার্থ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সে-কারণেই হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলায়।৩৫ অর্থাৎ সেই ‘কোলাবোরেশন থিসিসের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য, ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে বাংলায় হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের, বিশেষ করে ইংরেজদের, স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল এবং সেজন্যই এরা ইংরেজদের সঙ্গে পলাশির ষড়যন্ত্রে সামিল হয়। বিশদভাবে বলতে গেলে এ বক্তব্য মোটামুটি এরকম: অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ইউরোপীয় বাণিজ্যেরই বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, ইউরোপীয়রাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি বাণিজ্য করছিল এবং ফলে তারাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি ধনসম্পদ (রুপো, টাকাকড়ি) আমদানি করছিল। আর এই বাণিজ্যের ফলে হিন্দু-জৈন ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বেশ লাভবান হতে থাকে এবং এই কারণেই তাদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এমনকী ক্রিস বেইলি এ-কথাও বলছেন যে বাংলায় ব্যবসায়ী ও জমিদারদের স্বার্থ ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে এমন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছিল যে কলকাতা থেকে ইংরেজদের তাড়ানোর ব্যাপারটা তারা সহ্য করতে পারছিল না এবং সেইজন্যই পলাশির ঘটনা ঘটল।৩৬

বেইলি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে ১৭৭০-এর দশকের শেষদিকে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ফরাসি অধিকৃত অঞ্চলের গভর্নর ল’ দ্য লরিস্টনের (Law de Lauriston) মন্তব্য উদ্ধৃত করছেন: ‘প্রাক্-পলাশি সময়টাতে বাংলার হিন্দু ও জৈন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছিল’।৩৭ এখানে এটাও স্মর্তব্য, এ কোলাবোরেশন থিসিসে অন্য একটি মাত্রার সংযোজন হয়েছে এখন। সেটা হচ্ছে, ভারতীয়রাই পলাশির ষড়যন্ত্রের উদ্যোগ নিয়েছিল, তাদের পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য তারাই ইংরেজদের সাহায্য চেয়ে তাদের ডেকে আনে, তারাই এগিয়ে গিয়ে ইংরেজদের সাহায্য চেয়েছিল। এ-বক্তব্য সঠিক হলে পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের ভূমিকা নিতান্ত গৌণ হয়ে যায়, এ-ব্যাপারে তাদের দায়িদায়িত্বও অনেক কমে যায়।

উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য মনে হলেও এগুলির ঐতিহাসিক যাথার্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন থেকে যায়। এ বক্তব্যগুলিতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে, যার সত্যতা সম্বন্ধে অধুনাতম গবেষণা গভীর সন্দেহ প্রকাশ করছে। প্রথম, পলাশির প্রাক্‌কালে বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যেরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অবশ্য কে. এন. চৌধুরী (K.N. Chaudhuri), ওম প্রকাশ (Om Prakash) প্রমুখের গবেষণা থেকে এ-ধারণা হওয়াই স্বাভাবিক।৩৮ কিন্তু এ-সব ঐতিহাসিকের বক্তব্যে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করে শিরীন মুসভি (Shireen Moosvi) একটি প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে প্রকৃত ঘটনা আসলে খুব সম্ভবত অন্যরকম। একমাত্র ইউরোপীয়রাই সোনা-রুপো এনে বাংলায় ব্যবসা-বাণিজ্য করছে এবং তারাই সবচেয়ে বেশি পরিমাণ সোনা-রুপো আনছে, তা নাও হতে পারে।৩৯ আমরাও সম্প্রতি ইউরোপের বিভিন্ন মহাফেজখানা থেকে বর্ণনামূলক ও পরিসংখ্যানগত বহু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছি যে অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও অর্থাৎ প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় এশীয় ব্যবসায়ীদের মোট রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ সমস্ত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মোট রফতানির চাইতে অনেক বেশি। ফলে, যেহেতু সব ব্যবসায়ীদেরই—সে ইউরোপীয়ই হোক বা এশীয়ই হোক—বাংলায় রুপো বা নগদ টাকাকড়ি নিয়ে এসে বাংলা থেকে রফতানি পণ্য সংগ্রহ করতে হত। তাই প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়রাই-ইউরোপীয়রা নয়—বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত।৪০

বাংলা থেকে প্রধান দুটি পণ্যের (বস্ত্র ও রেশম) রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের চেয়ে এশীয়রাই যে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়েছিল তা পরিসংখ্যান দিয়ে প্রমাণ করা যায়। আমাদের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, যা আমরা আগেও বলেছি, বাংলা থেকে এসময় এশীয় বণিকদের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক মোট গড়মূল্য যেখানে ৯০ থেকে ১০০ লক্ষ টাকার মতো, সেখানে ইউরোপীয়দের বস্ত্র রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি নয়।৪১ রেশম রফতানির ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি শক্ত ভূমিতে দাড়িয়ে বলতে পারি (কারণ এখানে আমাদের পরিসংখ্যান একেবারেই অনুমানভিত্তিক নয়) যে, প্রাক্-পলাশি যুগে এশীয়দের বার্ষিক রফতানির গড়মূল্য ৪৮ লক্ষ টাকা আর ইউরোপীয়দের ১০ লক্ষ টাকারও কম।৪২ তা হলে বস্ত্র ও রেশম রফতানির বার্ষিক গড় মূল্য ধরে এশীয়দের রফতানির মূল্য যেখানে দাঁড়াচ্ছে ১৪০ থেকে ১৫০ লক্ষ টাকা, সেখানে ইউরোপীয়দের ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। যার অর্থ, যেহেতু রুপো এনে বা নগদ টাকা দিয়ে সবাইকে বাংলায় এ-সব পণ্য কিনতে হত, সেজন্য অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় সবচেয়ে বেশি রুপো, নগদ টাকা আমদানি করত এশীয়রা— ইউরোপীয়রা নয়। ফলে ইউরোপীয়রাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো আমদানি করত, এ-বক্তব্য অসার হয়ে পড়ছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে পলাশি ষড়যন্ত্র/বিপ্লবের যোগসূত্রটিও।

দ্বিতীয় যে জিনিসটি স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে তা হল প্রাক্-পলাশি বাংলায়-ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং জমিদার ও সামরিক অভিজাতদের স্বার্থের সঙ্গে ইউরোপীয় স্বার্থ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। উক্ত বক্তব্যে ধরে নেওয়া হয়েছে, প্রাক্‌-পলাশি বাংলায় উপরোক্ত শ্রেণীগুলির আয় ও মুনাফার মোটা অংশই আসত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির, বিশেষ করে ইংরেজদের, সঙ্গে তাদের বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে। ইউরোপীয় বাণিজ্যকে যদি ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী ও জমিদারদের আয়বৃদ্ধির (এবং সেজন্য তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির) প্রধান উৎস বলে প্রমাণ করা যায়, তবেই শুধু বলা যেতে পারে যে, ইউরোপীয়দের ভাগ্যের সঙ্গে বাংলার উপরোক্ত বিভিন্ন শ্রেণীর ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি, প্রাক্-পলাশি যুগেও বাংলার বাণিজ্যিক অর্থনীতিতে ইউরোপীয় বাণিজ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ও মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং এই ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী বাংলায় ইউরোপীয় বা ইংরেজদের বাণিজ্যকে অবলম্বন করেই প্রতিপত্তিশালী হচ্ছে, একথা বলা যায় না। এই শ্রেণীর সম্পদপুঞ্জীভবনের (এবং তা থেকে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি) প্রধান উৎসগুলি বিশ্লেষণ করলেই আমাদের বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রলাশি বিপ্লবের এদেশীয় প্রধান তিন হোতার—তিন বণিকরাজা (merchant princes)—জগৎশেঠ, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের মোট আয়/মুনাফার উৎস ইউরোপীয় বা ইংরেজদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমে কি না সেটা দেখলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। ১৭৫৭ সালে লিউক স্ক্র্যাফটন (Luke Scrafton) মুর্শিদাবাদ থেকে জগৎশেঠদের বার্ষিক আয়ের নিম্নোক্ত হিসেব দিয়েছেন:৪৩

সারণি ২

জগৎশেঠদের আনুমানিক বার্ষিক আয়, ১৭৫৭

রাজস্বের দুই তৃতীয়াংশের ওপর শতকরা ১০ ভাগ১০,৬০,০০০ টাকা
জমিদারদের কাছ থেকে শতকরা ১২ টাকা হারে সুদ১৩,৫০,০০০ টাকা
৫০ লক্ষ টাকার মুদ্রা নতুন করে তৈরি করা বাবদ, শতকরা ৭ টাকা হারে৩,৫০,০০০ টাকা
৪০ লক্ষ টাকার ওপর শতকরা ৩৭.৫ টাকা হিসেবে সুদ বাবদ১৫,০০,০০০ টাকা
বাট্টা ও মুদ্রা বিনিময়ের সুদ বাবদ ৭-৮ লক্ষ টাকা৭,০০,০০০ টাকা
মোট পরিমাণ:৪৯,৬০,০০০ টাকা

ওপরের সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে, জগৎশেঠদের বাৎসরিক মোট আয় প্রায় ৫০ লক্ষ টাকার মধ্যে টাঁকশাল থেকে আয় (যেটা জগৎশেঠদের একচেটিয়া অধিকার ছিল) ও বাট্টা এবং বাণিজ্যিক ঋণের সুদ থেকে মোট আয় খুব বেশি করে ধরলেও ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টাকার বেশি ছিল না। তাই আমরা একটু আগে যা বলেছি তারপর এটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই যে টাঁকশাল বা বাট্টা ইত্যাদি থেকে যা আয়, তার সবটাই ইউরোপীয় বাণিজ্যের ফলে রুপো বা টাকাকড়ি আমদানির জন্যই সম্ভব হচ্ছে। কারণ আমরা দেখেছি, এশীয় বণিকরা ইউরোপীয়দের চাইতেও অনেক বেশি রুপো ও টাকাকড়ি আমদানি করত। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জগৎশেঠদের বার্ষিক মোট আয়ের বেশির ভাগই ইউরোপীয় বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। তেমনি উমিচাঁদ ও খোদা ওয়াজিদের সঙ্গে ইউরোপীয় ও ইংরেজদের বাণিজ্যিক লেনদেন ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের আয়ের মূল উৎস ছিল সোরা, লবণ, প্রভৃতির একচেটিয়া ব্যবসা। উমিচাঁদ আফিং ও শস্যের একচেটিয়া ব্যবসায়েরও চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। খোজা ওয়াজিদের নিজস্ব বেশ কয়েকটি বাণিজ্যতরী ছিল। সেগুলি হুগলি বন্দর থেকে সুরাট, লোহিতসাগর ও পারস্য উপসাগরে বাণিজ্য করত। এ-সব তথ্য জানার পরে কিন্তু বাংলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ব্যাঙ্কিং শ্রেণীর স্বার্থ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভাগ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, এ-কথা মেনে নেওয়া কঠিন।৪৪

বাংলার অভ্যন্তরীণ ‘সংকট’?

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, মধ্য-অষ্টাদশ শতকে বাংলায় যে সংকট দেখা দেয় তার ফলেই ইংরেজরা বাংলা জয় করতে এগিয়ে আসে। আগে এ সংকট’কে রাজনৈতিক সংকট হিসেবে দেখা হত কিন্তু ইদানীং বলা হচ্ছে, এটা ‘অর্থনৈতিক সংকট’ও বটে। রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয় যে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাণিজ্যিক-ব্যাঙ্কিং শ্রেণী, জমিদার ও সামরিক অভিজাতবর্গের সঙ্গে নবাবের যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নিজামতকে স্থায়িত্ব দিয়েছিল, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর তা ভেঙে পড়ে। অর্থনৈতিক সংকটের লক্ষণ হিসেবে নির্দেশ করা হচ্ছে—অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি, শিল্প-বাণিজ্যের অধোগতি, ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণীর আর্থিক দুর্গতি, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম এবং ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণে ঘাটতি, ইত্যাদি। এ-সবগুলিকে ১৭৪০-এর দশকে যে ক্রমাগত মারাঠা আক্রমণ হয়েছিল তার ফলশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে।৪৫

ঐতিহাসিকদের মধ্যে ইদানীং প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজের যে সংঘর্ষ বাধে তার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় নিজামতের সঙ্গে ব্যবসায়ী/মহাজন শ্রেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে নতুন শ্রেণীবদ্ধতা গড়ে উঠেছিল তা সিরাজের সময় একেবারে ভেঙে পড়ে এবং সেজন্যই এ বিরোধ ও সংঘর্ষের সূত্রপাত। এ-বক্তব্যে বলা হচ্ছে, সিরাজ তাঁর ব্যবহারে ওই সব শ্রেণীর লোকজনদের তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলেন। এর সমর্থনে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকরা প্রায় সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসগ্রন্থ ও বাছাই করা সমসাময়িক কিছু ইউরোপীয়-ইংরেজ পর্যবেক্ষকদের মন্তব্য পেশ করছেন। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, ফারসি গ্রন্থগুলির বেশিরভাগই এ-সব লেখকদের ইংরেজ ‘প্রভু’র নির্দেশে বা পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত এবং স্বভাবতই এতে ‘মনিবদের’ খুশি করার প্রবণতা থাকবে। আবার ইউরোপীয়-ইংরেজদের লেখা বাজারের ‘গসিপে’ ভরতি। তাই তাদের তথ্য সঠিক বা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু এ-সব তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই উপরোক্ত ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর বাংলায় “নতুন শ্রেণী জোটবদ্ধতায়” ছেদ পড়ে এবং তার ফলেই বাংলায় রাজনৈতিক ‘সংকট’ দেখা দেয়।৪৬ এই সংকট থেকে বাংলাকে উদ্ধার করার জন্যই ইংরেজরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও প্রায় অন্যমনস্কভাবে বাংলা জয় করে। এরকম ব্যাখ্যা গ্রাহ্য হলে, পলাশির ষড়যন্ত্রে ইংরেজদের প্রকৃত যে ভূমিকা তা নিতান্তই গৌণ হয়ে যায় এবং সিরাজদ্দৌল্লাই ‘ভিলেন’ হয়ে পড়েন। অবশ্য এরকম বক্তব্য একেবারে নতুন কিছু নয়। এগুলি হিলের পুরনো বক্তব্যেরই নতুন কলেবরে পরিবেশন।

এটা ঠিকই যে মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের ফলে বাংলায় এক নতুন আঞ্চলিক গোষ্ঠীর (new regional group) উদ্ভব হয়। এই নতুন শক্তিজোটের (power block) অংশীদার—সামরিক অভিজাতবর্গ, জমিদার ও ব্যাঙ্কিং-বাণিজ্যিক শ্ৰেণী। কিন্তু এই শক্তিজোটকে একটি মজবুত ও সংঘবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা বা একে একটি বিশিষ্ট শক্তিসঙ্ঘ হিসেবে গণ্য করা মোটেই ঠিক হবে না। আমরা আগেও বলেছি, এটি ছিল স্বার্থান্বেষী কিছু ব্যক্তির একটি জোট, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল—কোনও বিশেষ শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জোট নয়। এসময় বাংলার ক্ষমতাবিন্যাসে একটি পিরামিডসদৃশ কাঠামো তৈরি হয়েছিল—যার শীর্ষে ছিলেন নবাব, আর তলদেশে শাসকগোষ্ঠীর সদস্যরা যাদের ক্ষমতার একমাত্র উৎস ছিলেন নবাব। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে নিজামতের দিক থেকে উক্ত ব্যক্তিসমষ্টিকে (যা শ্রেণী নির্ভর নয়) ক্ষমতার অংশীদার করে নেয়ার কোনও সচেতন প্রচেষ্টা ছিল না। বাংলায় যে বড় বড় জমিদার বা বড় বড় ব্যাঙ্কার ও ব্যবসায়ীর উদ্ভব তা নবাবদের এই উদ্দেশ্যে অনুসৃত কোনও নীতির ফল নয়—এটা মুর্শিদকুলির সংস্কারের পরোক্ষ ফল। এবং আমরা যা আগেও বলেছি, নবাবের সঙ্গে ব্যবসায়ী শ্ৰেণী, ভূস্বামী ও সামরিক অভিজাত বর্গের যে জোটবন্ধন তা সম্পূর্ণ ব্যক্তিকেন্দ্রিক, একেবারেই শ্রেণীভিত্তিক নয়। ফলে এর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল না। এ সমঝোতা যে নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ— জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে এরা নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠে। আবার এই সমঝোতার ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বরূপটি স্পষ্ট হয়ে উঠছে হাজি আহমেদ ও আলিবর্দির ক্ষেত্রে। এঁরা কেউই প্রথমে জমিদার বা মনসবদার শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না—ভাগ্যান্বেষী এই দুই ভাই শুধুমাত্র নবাব সুজাউদ্দিনের ব্যক্তিগত বন্ধু হিসেবেই উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।৪৭

আবার এই শক্তিজোট একেবারে অখণ্ড এবং নিচ্ছিদ্র কোনও সংগঠন নয়। বারে বারে এর মধ্যে ফাটল দেখা গেছে। সরফরাজ নবাব হয়ে তাঁর পিতার আমলের কর্মচারীদের পদোন্নতি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হাজি আহমেদ, দেওয়ান আলমচাঁদ ও জগৎশেঠ—এই ত্রয়ীর বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে দরবারের অমাত্যদের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। উক্ত ত্রয়ীর—যারা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল, কোনও শ্রেণীগত স্বার্থরক্ষা যাদের উদ্দেশ্য ছিল না—ষড়যন্ত্রের ফলেই ১৭৩৯-৪০-এর বিপ্লব সংগঠিত হল, সরফরাজকে হঠিয়ে আলিবর্দি মসনদ দখল করলেন।৪৮ সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের ব্যক্তিগত স্বার্থপ্রণোদিত চক্রান্তে (কোনও শ্রেণীগত স্বার্থে নয়) এই বিপ্লব, নতুন শ্রেণীগত সমঝোতার সম্মিলিত প্রয়াসে নয়। গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজ নিহত হন ঠিকই কিন্তু এ যুদ্ধে সরফরাজের পক্ষে প্রভাবশালী মনসবদার ও জমিদারদের একটি গোষ্ঠী, ঘাউস খান, মীর শরফউদ্দিন, মীর মহম্মদ বকীর খান, বিজয় সিং, রাজা গন্ধরাব সিং প্রমুখের নেতৃত্বে সরফরাজের পক্ষে যুদ্ধ করে। এদেরই অন্য একটি গোষ্ঠী আলিবর্দির দলে যোগ দেয়। এ-ঘটনা থেকেই স্পষ্ট, মনসবদার-জমিদার গোষ্ঠীর যে জোটবদ্ধতা, তা ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য বিচারবিবেচনার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, এটা শ্ৰেণীগত সমঝোতা নয়।৪৯ সুতরাং সিরাজদ্দৌল্লা আসার পর নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা ভেঙে পড়েছিল এবং তাতে বাংলায় রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়, যার ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়—এ বক্তব্য খুব সমীচীন বলে মনে হয় না।

তা ছাড়া এটাও বলা হচ্ছে, মারাঠা আক্রমণের ফলে এবং সওদাগর/ব্যাঙ্কার গোষ্ঠীর ওপর অর্থ আদায়ের জন্য নবাব আলিবর্দি যে নিগ্রহ শুরু করেন তার জন্য তারা আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়ে এবং তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই শোচনীয় হয়ে পড়ে। সেজন্য ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানি রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য মধ্যস্বত্বভোগী (merchant middlemen) সওদাগর/ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করা বন্ধ করে সোজাসুজি কোম্পানির বেতনভুক গোমস্তার মাধ্যমে তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে।৫০ এ-বক্তব্যও কিন্তু মেনে নেওয়া কঠিন। আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৫১ যে, ডাচ কোম্পানি শুধুমাত্র একটি জায়গায় বা আড়ং-এ (শান্তিপুর) তিন বছরের জন্য (১৭৪৭ থেকে ১৭৪৯) এরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল কারণ সেখানে কয়েকজন ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে গেছিল বলে তাদের কাছে খবর ছিল। কিন্তু উল্লেখযোগ্য, তিন বছর পরেই, ১৭৫০ সাল থেকে কোম্পানি আবার আগের মতো মধ্যস্বত্বভোগী দাদনি বণিকদের মাধ্যমে পণ্য সংগ্রহ শুরু করে। আমরা অন্যত্র এটাও বিশদভাবে দেখিয়েছি৫২ যে ইংরেজ কোম্পানি ১৭৫৩ সালে দাদনি ব্যবস্থা তুলে দিয়ে গোমস্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল বাংলায় বণিকসম্প্রদায়ের আর্থিক দুরবস্থার জন্য নয়। এ পরিবর্তনের আসল উদ্দেশ্য ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য যে সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, তার নিরসনের জন্য। দাদনি বণিকদের কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না কারণ এরা নিজেরাই বড় বড় ব্যবসায়ী ও সওদাগর। কোম্পানির পণ্যসরবরাহ ছাড়াও এদের নিজস্ব প্রভূত ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল। ফলে এদের ওপর দাপট খাটিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধে করা যাচ্ছিল না। অন্যদিকে গোমস্তারা যেহেতু কোম্পানির বেতনভুক কর্মচারী, তাদের দিয়ে কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যবৃদ্ধি অনেক সহজ ও সুবিধেজনক। এজন্যই কোম্পানির কর্মচারীরা দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন করে। তার সঙ্গে দাদনি বণিকদের আর্থিক দুর্গতির কোনও সম্পর্কই ছিল না।

মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার শিল্পবাণিজ্য যে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা তার যে দীর্ঘস্থায়ী কোনও প্রভাব এতে পড়েনি, তার প্রমাণ মধ্য অষ্টাদশ শতকেও বাংলা থেকে ইউরোপীয় এবং এশীয় বণিকদের বিপুল রফতানির পরিমাণ। ১৭৪০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজ রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে সর্বাধিক। তবে এটা ঠিক যে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ইংরেজদের রফতানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইউরোপীয়দের সামগ্রিক রফতানির পরিমাণ কিন্তু এ সময় কিছুমাত্র কমেনি। ইংরেজদের রফতানিতে যে ঘাটতি তা পূরণ হয়ে যায় ডাচদের রফতানি বৃদ্ধিতে। তা ছাড়া, ইংরেজদের বাণিজ্যহ্রাসের কারণ বাংলার আর্থিক সংকট নয়। এর জন্য দায়ী তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যা আর গোমস্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে পণ্যসংগ্রহের নতুন পদ্ধতি। আবার এ সময় বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ বেশ উল্লেখযোগ্য। সুতরাং ইউরোপীয়দের এবং এশীয় ব্যবসায়ীদের রফতানির মোট মূল্য যোগ করলে যা দাঁড়ায় তাতে প্রাক্-পলাশি যুগে শিল্প বাণিজ্যের অবক্ষয় হয়েছিল এটা বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ তা হলে বাংলা থেকে এত বিপুল পরিমাণ রফতানি কিছুতেই সম্ভব হত না।৫৩

অনেক ঐতিহাসিকই মনে করেন এবং দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় মূল্যস্তর বেশ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং জিনিসপত্রের দাম, বিশেষ করে বস্ত্র, রেশম এবং চালের দাম, অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছিল।৫৪ এই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল ১৭২০ থেকে, বিশেষ করে ১৭৪০ থেকে ১৭৬০ পর্যন্ত। কিন্তু আমরা বিস্তৃত পরিসংখ্যান দিয়ে অন্যএ৫৫ দেখিয়েছি যে কাপড়, সিল্ক এবং চালের দাম তেমন কিছু বাড়েনি, যাতে এ মূল্যবৃদ্ধিকে ‘লক্ষণীয় ও ক্রমাগত’ (‘marked and sustained’) বৃদ্ধি বলা যায়। আসলে পূর্বোক্ত ঐতিহাসিকদের মধ্যে কেউ কেউ৫৬ পরিসংখ্যান ও অর্থনীতির বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে এ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তে এলেও, তাঁদের বিশ্লেষণে বেশ কিছু ত্রুটি থেকে গেছে, যার জন্য তাঁদের বক্তব্যে এ মূল্যবৃদ্ধি স্বতঃসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। যেমন বস্ত্র বা কাঁচা রেশমের মূল্য নির্ধারণ ও যাচাই করার সময় তাঁরা কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস (যার ওপর বস্তু বা রেশমের সঠিক মূল্য নির্ভর করে) সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন। এর ফলে তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে, ভুলের মাত্রাও (margin of error) গ্রহণযোগ্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

প্রথমে বস্ত্র বা কাপড়ের কথা ধরা যাক। কাপড়ের মধ্যে নানারকম বৈচিত্র্য এবং বিভিন্ন মান দেখা যেত—যেমন মসলিন, মিহি সুতীবস্ত্র, মোটা ও সস্তা কাপড়, রেশম বস্ত্র, সুতী ও রেশম মিশ্রিত কাপড়, ইত্যাদি। আবার প্রত্যেক প্রকার (catagory) কাপড়ের মধ্যে (যেমন মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) নানা রকম প্রকারভেদ (types) ছিল যেমন মসলিনের মধ্যে খাসা, মলমল, ইত্যাদি)। আবার প্রত্যেক রকমের কাপড়ের (যেমন খাসা) দাম নির্ভর করত কয়েকটি জিনিসের ওপর যেমন, কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ (size), উৎকর্ষ (quality) এবং কোন আড়ং বা জায়গায় এগুলি তৈরি— এ-সবের ওপর। রেশম বা সিল্কের ক্ষেত্রেও রকমভেদের ওপর মূল্য নির্ভর করত। যেমন কোন ধরনের সিল্ক (‘গুজরাট’, ‘কুমারখালি’, ‘কাশিমবাজার’ ইত্যাদি), তার উৎকর্ষ (fineness) এবং বছরের কোন সময় তা উৎপন্ন (bund ‘বুন্দ’, যেমন নভেম্বর বৃন্দ, জুলাই বুন্দ, ইত্যাদি) এ-সবের ওপরই সিল্কের সঠিক দাম নির্ভর করত। তাই কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করার সময় এ-সব জিনিস সতর্কতার সঙ্গে বিচার না করে যদি শুধু মোট ক্রয়মূল্যকে মোট রফতানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে কাপড় বা সিল্কের ক্রয়মূল্য হিসেব করা হয়, তাতে বিরাট ত্রুটি থেকে যায় এবং ফলে এরকম ক্ষেত্রে ওইসব পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্য দেখা গেলে তা নির্দ্বিধায় গ্রহণ করা সমীচীন হবে না। তাই উপরোক্ত ঐতিহাসিকরা যে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথা বলছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয় কারণ তাঁদের হিসেবে অনেক গলদ থেকে গেছে।

সঠিকভাবে কাপড়ের মূল্য নির্ণয় করতে গেলে এবং তাতে লক্ষণীয় হ্রাস বা বৃদ্ধি হচ্ছে কি না তা নির্ধারণ করতে হলে খুব সতর্কতার সঙ্গে কোনও বিশেষ রকমের কাপড়ের (মসলিন বা মিহি সুতী কাপড়) মোট পরিমাণ, এ-সব কাপড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ, কোন আড়ং-এ তৈরি হয়েছে এবং কাপড়ের উৎকর্ষ quality-মিহি, মোটা) ইত্যাদি যাচাই করে দেখা দরকার এবং তারপর কত দামে কোন রকমের কত কাপড় কেনা হয়েছে তা থেকেই একমাত্র মূল্যস্তরের সঠিক হদিস পাওয়া সম্ভব। যেমন, খাসার (এক প্রকারের মসলিন) দাম বার করতে গেলে কত পরিমাণ খাসা কত দামে কেনা হয়েছে শুধু এ থেকে খাসার সঠিক মূল্য বার করলে ভুল হতে বাধ্য। আমাদের জানতে হবে এ খাসা সাধারণ না মিহি, না অতি মিহি (মানে খাসার উৎকর্ষ—quality), এই খাসা ৪০ কোঃ৫৭ × ৩ কোঃ, না ৪০ কোঃ × ২১/২, কোঃ, বা ৪০ কোঃ × ২ কোঃ (মানে সঠিক মাপ বা সাইজ), এ খাসা কোথায় তৈরি—জগন্নাথপুরে না কাগমারিতে না ওরুয়াতে (মানে কোন আড়ং-এ) ইত্যাদি। যেহেতু এ—সবের ওপরেই খাসার দাম নির্ভর করছে, তাই এইসবগুলি সতর্কভাবে বিচার করে দাম বার করলে তবেই খাসার সঠিক দাম পাওয়া যাবে।

কিন্তু এ ধরনের বিস্তৃত তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির রফতানির তালিকায় শুধু মোট খাসার পরিমাণ এবং তার মোট মূল্যই দেওয়া আছে—তাদের প্রকারভেদ, উৎকর্য, সাইজ বা আড়ং-এর নাম ইত্যাদি কিছুই নেই। আবার কোম্পানি যে পরিমাণ কাপড় রফতানি করছে এবং তার জন্য যে মোট মূল্য দিচ্ছে তা থেকে যদি প্রত্যেকটি কাপড়ের দাম বার করা হয়, তাতে বিরাট গলদ থেকে যাবে। কারণ কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের এবং বিভিন্ন দামের কাপড় রফতানি করত। যেমন মসলিন, মিহি সুতী কাপড়, মোটা সস্তা সুতী কাপড়, ইত্যাদি। এই সবগুলি একসঙ্গে যোগ করে মোট কাপড়ের পরিমাণ বার করতে গেলে মুড়ি মুড়কির মধ্যে তফাতটা গুলিয়ে যায়। তা ছাড়া এতে কোম্পানি যে ধরনের কাপড় রফতানি করছে এবং তাতে বছর বছর যে তারতম্য হচ্ছে তাও ধরা পড়ে না। ফলে কাপড়ের দামের হিসেবে প্রচুর ভুলভ্রান্তি হতে বাধ্য। ইংরেজ কোম্পানির বস্ত্র রফতানি থেকে তাই ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়ভাবে যে মূল্যবৃদ্ধি ঐতিহাসিকরা দেখাবার চেষ্টা করেছেন তার প্রধান একটি ত্রুটি হচ্ছে যে কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে বেশি করে সস্তা, মোটা সুতী কাপড় রফতানি করেছে, দামি মসলিন কম। আবার ১৭৪০-এর দশকে বস্ত্র রফতানির প্যাটার্নে পরিবর্তন হয়—কোম্পানি সস্তা, মোটা কাপড় পাঠাচ্ছে কম, দামি মসলিন বেশি। পঞ্চাশের দশকেও তাই।৫৮ এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হিসেবের মধ্যে না নেওয়াতেই কাপড়ের একক মূল্যে (unit price) ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি দেখা যায়, যা কিন্তু আদৌ সত্য নয়।

কাপড়ের দাম বাড়ছে বা কমছে কিনা তার হদিস পাওয়া যায় একমাত্র কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের পণ্য সরবরাহের জন্য প্রতিবছর যে চুক্তি হত, তা থেকে। কাপড়ের দাম সম্বন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলি—যেমন কাপড়ের প্রকারভেদ, সাইজ, উৎকর্ষ বা মান ও আড়ং-এর বিস্তৃত বিবরণ ও প্রত্যেক কাপড়ের আনুমানিক মূল্য ইত্যাদি এ চুক্তিগুলিতেই শুধু পাওয়া যায়। কোম্পানিগুলি দাম নিয়ে অনেক বাকবিতণ্ডার পর দাদনি বণিকদের সঙ্গে যথাসময়ে কাপড় সরবরাহের জন্য এই চুক্তিগুলি করত। ডাচ ও ইংরেজ কোম্পানিগুলির সঙ্গে দাদনি বণিকদের এই চুক্তিগুলো বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি,৫৯ প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় কাপড়ের দাম এমন কিছুই বাড়েনি যাকে ‘ক্রমবর্ধমান ও লক্ষণীয়’ মূল্যবৃদ্ধি বলা যেতে পারে। বরং এটা দেখা গেছে যে উক্ত সময় অর্থাৎ ১৭৫১-৫৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মসলিনের দাম—বিশেষ করে খাসা এবং মলমল, যেগুলো ইউরোপীয় কোম্পানিরা প্রচুর পরিমাণে রফতানি করত—১৭৩২ থেকে ১৭38-এর (মানে মারাঠা আক্রমণের পূর্বেকার) দামের তুলনায় কিছুটা কমেই গেছে। মসলিনের মধ্যে শুধু নাদোনায় তৈরি খাসার (এটা সস্তা দামের মসলিন) দাম কিছুটা বেড়েছিল। তবে সস্তা, মোটা কিছু কাপড়ের দাম প্রাক্-পলাশি যুগে কিছুটা বেড়েছিল সন্দেহ নেই—এগুলি প্রধানত বর্ধমান এবং বাঁকুড়া অঞ্চলে তৈরি হত এবং এই অঞ্চলগুলিই মারাঠা আক্রমণে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে প্রাক্-পলাশি যুগে কাপড়ের দাম অস্বাভাবিক কিছু বাড়েনি। তেমনিভাবে কাঁচা রেশম বা সিল্ক ও চালের দাম বিশ্লেষণ করে আমরা অন্যত্র দেখিয়েছি৬০ যে এক্ষেত্রেও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিশেষ নিদর্শন পাওয়া যায় না। সুতরাং এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে পলাশি-পূর্ব সময়ে অর্থনৈতিক কোনও ‘সংকট’ ছিল না এবং তাই এ সংকটের ফলে ইংরেজরা বাংলা বিজয় করতে উদ্বুদ্ধ হয়, এ-বক্তব্য অসার হয়ে যায়।

কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য (private trade)

বস্তুতপক্ষে ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই ইংরেজদের বাংলা বিজয় অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, বাংলার অভ্যন্তরীণ কোনও সংকটের জন্য নয়। ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় যে উদ্দেশ্য বা শক্তি কাজ করছিল তা হল কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার প্রয়াস। কর্মচারীদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসার রমরমা দেখা গেছে ১৭২০-এর দশকের শেষদিক থেকে ১৭৩০-এর দশকের শেষাশেষি পর্যন্ত। কিন্তু তারপর বিশেষ করে ১৭৪০-এর দশকের শেষ দিক থেকে ১৭৫০-এর দশকের প্রথম দিক অবধি এই ব্যবসা-বাণিজ্য তীব্র সংকটের সম্মুখীন হয়। এ সময় একদিকে ফরাসি কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসা হঠাৎ অনেকটা বেড়ে যায় এবং এদের সঙ্গে খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে হুগলির আর্মানি বণিকরা হাত মেলায়। এই ফরাসি-আর্মানি জোটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইংরেজরা পেরে উঠছিল না এবং তার ফলে তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসা প্রচণ্ড মার খেতে শুরু করে।৬১ তাই কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের পুনরুদ্ধার ও পূর্বতন আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন এবং নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অপসারণ। সিরাজ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন যে, ইংরেজদের অবৈধ ব্যক্তিগত ব্যবসা ও দস্তকের অপব্যবহার মোটেই বরদাস্ত করা হবে না। তাই কোম্পানির কর্মচারীদের স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদের (sub-imperialism) শিকার হতে হল ফরাসিদের এবং সিরাজদ্দৌল্লাকে।

তবে এখানে মনে রাখা দরকার, লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি রাজ্যজয়ের কোনও সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অবশ্য পাঠায়নি। ব্যবসার মুনাফাই যেহেতু তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল, তাই তারা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে রাজ্যজয়ে অতটা আগ্রহান্বিত ছিল না, পাছে এতে কোম্পানির খরচ বেড়ে যায় এবং মুনাফার ঘাটতি পড়ে। তাদের প্রকৃত মনোভাব ছিল—রাজ্যজয় যদি ব্যয়বহুল না হয়, যদি সস্তায় বা বিনাব্যয়ে তা সম্ভব হয়, তাতে কিন্তু তাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই, বরং তারা এরকম সম্ভাবনাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত ছিল। কোম্পানির কর্মচারীরা পরিচালক সমিতির এরকম মনোভাব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল। তাই কোম্পানির স্থানীয় আর্থিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অর্থাৎ স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ প্রয়োগ করে প্রধানত তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থে বাংলা জয় করে। লন্ডনে বাংলা জয়ের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি খুবই উৎফুল্ল হয়। এতে ভবিষ্যতে কোম্পানির কী প্রচুর পরিমাণ লাভ হবে তা ভেবে পরিচালক সমিতি অত্যন্ত পুলকিত হয়ে ওঠে। বাংলায় তাদের কর্মচারীদের উচ্ছ্বসিত সাধুবাদ জানানো হয় লন্ডন থেকে।

আসলে একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই রাজ্যবিজয় সম্বন্ধে কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে একটি স্পষ্ট মতলব ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা লক্ষ করা যায় এবং তা তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থেই। সপ্তদশ শতকের শেষে কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপনের পরে কলকাতা ধীরে ধীরে আন্তঃএশীয় সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় এবং এ-বাণিজ্যের প্রায় সম্পূর্ণটাই ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত, ব্যবসা-বাণিজ্য। ১৭২০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৭৩০-এর দশক পর্যন্ত কলকাতা থেকে ইংরেজদের এই ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্যের ছিল স্বর্ণযুগ। কিন্তু ১৭৪০-এর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ১৭৫০-এর প্রথমার্ধে তা চরম সংকটের মধ্যে পড়ে। এর প্রধান কারণ, তুলনামূলকভাবে ফরাসিদের ব্যক্তিগত ব্যবসার অভাবনীয় অগ্রগতি হওয়ায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসাবাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৭৩০-এর দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। কিন্তু ১৭৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে গভর্নর ডুপ্লের নেতৃত্বে তা বাড়তে থাকে এবং চল্লিশের দশকে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফরাসিদের সঙ্গে যোগ দেয় হুগলিতে অবস্থিত খোজা ওয়াজিদের নেতৃত্বে আর্মানি বণিকরা। এদের সম্মিলিত প্রয়াসে ইংরেজদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। ডাচ কোম্পানির নথিপত্রে এ সময় বাংলার বন্দরগুলিতে বিভিন্ন কোম্পানির ইউরোপীয়দের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের এবং এশীয় বণিকদের বাণিজ্যতরীগুলির আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।৬২

শুধু তাই নয়, ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেও, বিশেষ করে ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্রে, চল্লিশের দশকের শেষদিকে ও পঞ্চাশের দশকের প্রথমদিকে ইংরেজদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের দ্রুত অবনতিতে ইংরেজদের দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার পরিচয় স্পষ্ট। রবার্ট ওরমের ১৭৫১ সালের চিঠিতে দেখা যায় কলকাতায় ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ওপর দেয় শুল্কের (consulage) পরিমাণ ভীষণভাবে কমে গেছে।৬৩ কলকাতার তৎকালীন এক বাসিন্দা, ক্যাপ্টেন ফেনউইক (Captain Fenwick) ১৭৫২ সালে লিখছেন: ‘ফরাসিরা এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের শীর্ষতম পর্যায়ে পৌঁছেছে।’ এ-সবের পরিসংখ্যানগত সাক্ষ্য মেলে ডাচ কোম্পানির রেকর্ডসে জাহাজের তালিকায়। ১৭৫৪ সালে যে-সব ইংরেজ জাহাজ কলকাতায় এসেছিল তার মোট সংখ্যা কুড়ি। এর মধ্যে বারোটি কোম্পানির নিজস্ব জাহাজ আর মাত্র আটটি ছিল কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজ। সেক্ষেত্রে ওই বছরই ফরাসি জাহাজ এসেছে সাতাশটি—তার মধ্যে বাইশটিই ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল, বাকি পাঁচটি জাহাজ মাত্র কোম্পানির বাণিজ্যে নিযুক্ত। আবার টানেজের (tonnage) হিসেবে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭৫১ সালে ইংরেজ জাহাজের মোট টানেজ ছিল ৭৪২০ টন, তার মধ্যে ৫০২০ টন ছিল ব্যক্তিগত ব্যবসার। আর ১৭৫৪-তে ফরাসি জাহাজের টানেজের পরিমাণ ছিল ১০,৪৫০ টন—এর মধ্যে ব্যক্তিগত ব্যবসায়ে নিযুক্ত জাহাজের টানেজের পরিমাণ ৭৪৫০ টন।৬৪ এই পরিসংখ্যানগত তথ্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্ধে ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের যে প্রভূত শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তার ফলে ইংরেজদের ব্যক্তিগত ব্যবসার যথেষ্ট ক্ষতি হয়।

তাই কোম্পানির কর্মচারীদের সংকটাপন্ন ব্যক্তিগত বাণিজ্য-স্বার্থকে পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ফরাসিদের বিতাড়ন ও রাজ্যজয়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়োজন ঘটেছিল। তাতে শুধু যে আন্তঃএশীয় ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যবসার সংকট দূর করা সম্ভব হত তা নয়—উৎপাদন ক্ষেত্র থেকে সরবরাহ, বাজার-হাট, সওদাগর ব্যবসায়ী, তাঁতি ও অন্যান্য কারিগরদের ওপর সার্বিক নিয়ন্ত্রণও নিশ্চিতভাবে বৃদ্ধি পাবে। এ-কথা যে শুধু পশ্চাৎ-সমীক্ষাতে (hind sight) ধরা পড়ছে তা নয়। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা ও কাজকর্মের মধ্যে তা প্রকাশ পেয়েছে। কর্নেল স্কটের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা, ফ্রাঙ্কল্যান্ড ও ম্যানিংহামের ক্লাইভকে লেখা চিঠি (১৭৫৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যাতে ইংরেজ বাণিজ্যের বিশেষ করে ব্যক্তিগত বাণিজ্যের ক্রমাবনতির কথা করুণভাবে প্রকাশ পেয়েছে), কোম্পানির বেচাকেনায় দাদনি থেকে গোমস্তা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, নবাবের প্রতি ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের ও গভর্নর ড্রেকের অনমনীয় ও মারমুখখা মনোভাব—এ-সবই ইংরেজদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের যে অভিপ্রায় তারই নির্দেশক। কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির বৈঠকে মীরজাফরের সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলী কী হবে তা আলোচনার সময় রিচার্ড বেচার জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধের ব্যবস্থা চুক্তির শর্তাবলীতে রাখতেই হবে কারণ ‘তারাই পুরো ব্যপারটা [নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে হঠিয়ে মীরজাফরকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা] চালু করেছিল।’৬৫ এ-সব থেকে ইংরেজদের অভিপ্রায় সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

ফরাসি যোগসূত্র

ফরাসিদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, ইংরেজদের আরেকটি দুর্ভাবনার বিষয় ছিল সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের আঁতাতের সম্ভাবনা। যদি এরকম সমঝোতা গড়ে ওঠে, তা হলে ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনা হয়তো সুদূরপরাহত থেকে যেত। সেজন্য বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন ইংরেজদের পক্ষে অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে ফোর্ট সেন্ট জর্জ (মাদ্রাজ) থেকে ক্লাইভ ও ওয়াটসনকে বাংলার নবাবকে হঠিয়ে অন্য কাউকে বসাবার প্রচেষ্টা করার জন্য নির্দেশ দেওয়ার পরেই আবার নির্দেশ দেওয়া হল, সম্ভব হলে চন্দননগর থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন করার ব্যবস্থা করতে।৬৬ এদিকে ইউরোপে সপ্তদশ বর্ষব্যাপী যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ইংরেজদের হাতে সুযোগও এসে গেল। ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের সঙ্গে সাধারণভাবে নিরপেক্ষ থাকার (simple neutrality) চুক্তি করার প্রস্তাব দেয় কিন্তু ইংরেজরা তা নাকচ রে দেয়। তখন জাঁ লঁ’ ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ফরাসিদের সমঝোতা করার প্রয়োজনীয়তার কথা বাংলায় ফরাসি প্রধান রেনল্টকে (Renault) জানান।৬৭ কিন্তু এরকম কোনও সমঝোতা হওয়ার আগেই পণ্ডিচেরি থেকে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনও জোট গঠন করতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

ইতিমধ্যে ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পরে এবং সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজদের মধ্যে যে দ্রুততার সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি সম্পাদিত হয়, তাতে ইংরেজদের ধারণা জন্মায় যে নবাবের অনুমতি নিয়ে চন্দননগর দখল করে ফরাসিদের তাড়াতাড়ি বাংলা থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া যাবে। তাই ওয়াটস ও উমিচাঁদের ওপর এ কাজে সিরাজের অনুমতি আদায় করার ভার দেওয়া হয়। সিরাজ কিন্তু তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তিনি যে তাঁর এই নীতিতে স্থিরসংকল্প তা তাঁর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ থেকে সুস্পষ্ট। তা ছাড়া বিবদমান দুই পক্ষের মধ্যে একপক্ষ যদি অন্য পক্ষকে আক্রমণ করে, সেক্ষেত্রে আক্রান্ত পক্ষের সঙ্গে যোগ দিয়ে আক্রমণকারীকে শায়েস্তা করার জন্যও সিরাজ প্রস্তুত ছিলেন। এই কারণেই তিনি হুগলির ফৌজদার নন্দকুমারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। আর যদি ফরাসিরা প্রথমে ইংরেজদের আক্রমণ করে তা হলে ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যেন সাহায্য করা হয়।৬৮ তাই সিরাজ যখন শুনলেন যে ফরাসি নৌবহর নিয়ে মঁসিয়ে ব্যুসি বাংলার দিকে আসছেন, তখন উক্ত নীতি অনুসরণ করেই সিরাজ উমিচাঁদ মারফত ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন প্রয়োজনে ফরাসিদের অনুপ্রবেশে বাধা দিতে।৬৯

ইংরেজরা অবশ্য নন্দকুমার যাতে ফরাসিদের সাহায্যে এগিয়ে না আসে তার জন্য ঘুষ দিয়ে তাকে নিরস্ত করে।৭০ আলিনগরের চুক্তির (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) পর থেকেই ইংরেজরা বাংলা থেকে ফরাসিদের তাড়াবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কিন্তু কতগুলো কারণে তা খুব তাড়াতাড়ি করা সম্ভব হচ্ছিল না। প্রথমত তারা নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য বোম্বাই থেকে আরও সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র আসার অপেক্ষায় ছিল কিন্তু তা আসতে দেরি হচ্ছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল যে ওই অতিরিক্ত সাহায্যে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করা বিপজ্জনক হতে পারে কারণ এর ফলে নবাবের সঙ্গেও বিরোধ বাধতে পারে। বাংলায় তখন তাদের যা শক্তিসামর্থ্য তাতে নবাব এবং ফরাসিদের যৌথশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানানো নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক হবে। দ্বিতীয়ত, নবাবের সুস্পষ্ট অনুমতি ছাড়া চন্দননগর আক্রমণ করতে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। এ অবস্থায় ক্লাইভ ৪ মার্চ অবধি কোনও স্থির সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না।৭১

কিন্তু ইংরেজদের নসিব ভাল—পরের দু’দিনের মধ্যে তাদের পক্ষে অনুকূল দুটো ব্যাপার ঘটে গেল। প্রথমটি, কাম্বারল্যান্ড জাহাজে করে বোম্বাই থেকে সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র এসে পৌঁছে গেল। দ্বিতীয়টি, সিরাজদ্দৌল্লা একটি চিঠিতে ক্লাইভকে জানালেন, আহমদ শা আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে তিনি পাটনা অভিমুখে রওনা হবেন এবং ক্লাইভকে অনুরোধ করলেন ইংরেজ সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি যদি নবাবকে সাহায্য করেন, তা হলে নবাব ইংরেজদের মাসে এক লক্ষ করে টাকা দেবেন।৭২ ক্লাইভ সঙ্গে সঙ্গে সব দ্বিধা কাটিয়ে এবং ‘ইংরেজরা ষড়যন্ত্র করতে অভ্যস্ত’৭৩ এ-জনশ্রুতির বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে ৮ মার্চ চন্দননগর অভিমুখে যাত্রা করলেন। ফরাসিরা শঙ্কিত হয়ে যখন ইংরেজদের চন্দননগরের দিকে রওনা হওয়ার উদ্দেশ্য জানতে চাইল, তখন ক্লাইভ সম্পূর্ণ মিথ্যাভাষণ করে তাদের জানালেন (৯ মার্চ ১৭৫৭):৭৪

আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে আপনাদের কুঠি আক্রমণ করার কোনও অভিপ্রায় আমার নেই। যদি মত পরিবর্তন করি তা হলে তা আপনাদের জানাতে আমার ভুল হবে না।

এ সময় সিরাজদ্দৌল্লা খুবই অসুবিধেজনক অবস্থায় পড়েছিলেন। একদিকে সম্ভাব্য আফগান আক্রমণের আশঙ্কা, অন্যদিকে তাঁর রাজ্যে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধতে পারে বলে দুশ্চিন্তা। এরকম জটিল অবস্থায় পড়ে তিনি ওয়াটসনকে একটি চিঠি লেখেন যার আসল উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে ফরাসিদের সঙ্গে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে রাজি করানো। কিন্তু ওয়াটস চালাকি করে নবাবের ওয়াকিয়ানবিশকে (পত্ৰলেখক) প্রচুর উৎকোচ দিয়ে চিঠির বয়ান এমন করে করালেন যার অর্থ দাঁড়াল যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করতে ইংরেজদের অনুমতি দিচ্ছেন।৭৫ সমসাময়িক কেউ কেউ মনে করেন যে এই চিঠি নবাবের অনুমতি না নিয়ে ফরাসিদের আক্রমণ করতে ওয়াটসনের যে দ্বিধা ছিল তা দূর করে।৭৬ কিন্তু স্ক্র্যাফটন পরিষ্কার জানাচ্ছেন: ‘যদিও এ-চিঠিতে মনে হতে পারে যে নবাব ফরাসিদের আক্রমণ করার অনুমতি দিয়েছেন, আসলে এর উদ্দেশ্য মোটেই তা ছিল না।’৭৭ ওয়াটসন কিন্তু নবাবের অনুমতির জন্য বিশেষ তোয়াক্কা করেছিলেন বলে মনে হয় না কারণ নবাবের উক্ত চিঠি আসার আগেই চন্দননগর অভিমুখে যাত্রারত ক্লাইভের সৈন্যবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য তিনি তার নৌবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।৭৮

খুব সম্ভবত অত তাড়াতাড়ি বা অত সহজে চন্দননগরের পতন হত না যদি না একজন বিক্ষুব্ধ ফরাসি সৈনিক বিশ্বাসঘাতকতা করে ইংরেজদের চন্দননগর কেল্লার গুপ্তপথ দেখিয়ে না দিত এবং যদি না হতবুদ্ধি নবাব ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে অত দোনামনা না করতেন। ক্লাইভ ১৩ মার্চ চন্দননগরের প্রধান রেনল্টকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তিনি তা করতে অস্বীকার করলে সেই রাত্রেই ইংরেজরা চন্দননগর আক্রমণ করল।৭৯ খবর পেয়ে সিরাজ তাঁর পূর্বতন নীতি অনুযায়ী নন্দকুমারকে নির্দেশ দিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে। কিন্তু ইংরেজদের কাছ থেকে আবার প্রচুর উৎকোচ পেয়ে নন্দকুমার নবাবের নির্দেশ পালনে অনীহা প্রকাশ করলেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে, ফরাসিরা যেহেতু ইংরেজদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হবে, সেজন্য তিনি চান না যে নবাবের বিজয়ী সৈন্যবাহিনী ফরাসিদের পরাজয়ের গ্লানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।’৮০

তা সত্ত্বেও তখনই সব শেষ হয়ে যায়নি। জাঁ ল’ ইংরেজদের আক্রমণের খবর পেলেন ১৪ মার্চ। এর পরের ঘটনাবলী তাঁর স্মৃতিকথায় সুস্পষ্টভাবে বিধৃত, যেখানে এসময় ফরাসিদের সাহায্য করা নিয়ে সিরাজের মানসিক অনিশ্চয়তা ও দোদুল্যমান মনোভাব সুস্পষ্ট।৮১ তার জন্য অবশ্য কিয়দংশে দায়ী দরবারের তৎকালীন অবস্থা। মনে হয় সিরাজ ততদিনে মোটামুটি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে দরবারে তাঁর বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র দানা বাঁধছে এবং তাতে তিনি বেশ কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিদের সাহায্য করতে গিয়ে অন্য কোনও ঝামেলায় পড়ার ভয়ে তিনি মনস্থির করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছিলেন। তবু শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা কাটিয়ে (তাতে অবশ্য অনেক সময় নষ্ট হল এবং শেষপর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেল) তিনি তাঁর দুই দক্ষ সেনাপতি—রায় দুর্লভরাম ও মীর মর্দানকে— ফরাসিদের সাহায্যার্থে চন্দননগর যাত্রার জন্য নির্দেশ দিলেন। দুই সেনাপতি চন্দননগরের পথে হুগলি পৌছুলেন ২২ মার্চ। তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং প্রায় সব শেষ। ২৩ মার্চ রেনল্ট আত্মসমর্পণ করে ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করলেন। এই চুক্তি অনুযায়ী সব ধনসম্পদ ও জিনিসপত্র ইংরেজদের হাতে প্রায় তুলে দিয়ে ফরাসিরা চন্দননগর ছাড়তে বাধ্য হল।৮২ ফরাসিদের পতন সম্বন্ধে স্ক্র্যাফ্‌টনের যে বক্তব্য তা অনেকাংশে সত্য—ফরাসিদের পতনের অন্যতম কারণ ‘Nabob float-ed between his fears and his wishes’—নবাবের ভীতি—আবদালির সম্ভাব্য আক্রমণ ও দরবারের ষড়যন্ত্রের চিন্তা নিয়ে, আর তাঁর প্রত্যাশা—ফরাসিদের সাহায্য করা। সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বসির আগমন এবং ইংরেজদের পর্যদস্ত করা— একদিকে এই ভয় এবং অন্যদিকে তাঁর কামনা—এ দুয়ের মধ্যে নবাবের দোদুল্যমান অবস্থার জন্যই ফরাসিরা বাংলা থেকে বিতাড়িত হল।৮৩

সুতরাং এ-কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, ইউরোপে ইঙ্গ-ফরাসি যুদ্ধ শুরু হওয়ার জন্যই ইংরেজদের পক্ষে চন্দননগর অধিকার অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল বলে এতদিন যে ধারণা ছিল তা সঠিক নয়, ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের স্বার্থরক্ষার্থেই বাংলা থেকে ফরাসিদের বিতাড়ন জরুরি হয়ে পড়েছিল। তা ছাড়া ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পরিকল্পনাতে ফরাসিরা প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারত। তাই ফরাসিদের তাড়াতে পারলে নবাব ও ফরাসিদের মধ্যে জোটবন্ধনের কোনও সুযোগ আর থাকবে না—ফরাসিরা চলে গেলে নবাবও বিচ্ছিন্ন এবং একাকী হয়ে পড়বেন। তা ছাড়া, দরবারে ফরাসিদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন গোষ্ঠীও দুর্বল হয়ে পড়বে, ফলে নবাবের সমর্থনে যে গোষ্ঠী তাও কমজোরী হয়ে যাবে। খোজা ওয়াজিদের শেষমুহুর্তে ভোল পাল্টে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মেলানোতেই তার প্রমাণ। ওয়াজিদ প্রথম থেকে ফরাসিদের সমর্থক ছিলেন এবং সে পরিমাণে তিনি ইংরেজদের প্রতি বিরূপ ছিলেন। তিনি বরাবরই নবাব সিরাজদ্দৌল্লার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু একেবারে শেষমুহুর্তে, ফরাসিদের পতনের পর নবাবের অবস্থা দেখে তিনি পলাশির যড়যন্ত্রে যোগ দেন। এভাবে ফরাসিদের বিতাড়নের পর ইংরেজদের বাংলা বিজয়ের পথ সুপ্রশস্ত হল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. Hill, Bengal, I, p. xxiii, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 41.

২. C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50: P. J. Marshall, Bengal, p. 67; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32; Hill, I, p. xxii.

৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 75-76, 80; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 12. 14-15.

৪. Hill, Bengal, vol. I, Introduction.

৫. S. C. Hill, Three Frenchmen in Bengal, p. 120.

৬. Hill, Bengal, I, p. xxiii.

৭. ঐ, lii.

৮. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p.41.

৯. Orme Mss., India, VI, ff. 1500-2. ওরমের তালিকায় প্রত্যেকের নাম ও তাদের পদমর্যাদার উল্লেখ আছে।

১০. Jan Kerseboom’s ‘Memorie’, 14 Feb, 1755, VOC 2849, ff. 125-26. বাংলায় ওলন্দাজ কোম্পানির প্রধান বা ডাইরেক্টররা বাংলা ছাড়ার আগে তাঁদের উত্তরসূরিদের জন্য বিস্তৃত রিপোর্ট লিখে রেখে যেতেন। এতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশদ বিবরণ তো থাকতই, সঙ্গে থাকত শিল্প-বাণিজ্যের খবরাখবর, সওদাগর-মহাজন-বণিকদের যাবতীয় বৃত্তান্ত, বিভিন্ন শিল্পের সংগঠন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে তাদের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি, দেশবিদেশের জাহাজের আনাগোনার মাধ্যমে সমুদ্র বাণিজ্যের নানা খবর, এমনকী বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর (যেমন আর্মানিদের) বাংলার বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা, ইত্যাদি বহুরকমের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। বলতে গেলে ঐতিহাসিকদের পক্ষে এই ‘মেমোরি’ (Memorie) গুলি এক বিশাল রত্নভাণ্ডার।

১১. Robert Orme, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 52-53.

১২. Yusuf Ali, Tarikh-i-Bangala-i-Mahabatjangi, pp. 130, 132. বস্তুত বেশির ভাগ প্রায়-সমসাময়িক ফারসি ইতিহাসের লেখকই ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ করেননি।

১৩. Orme, Military Transanctions, vol. II, Sec. I, pp. 127-28

১৪. D. C. Sen, History of Bengali Language and Literature, pp. 288, 793.

১৫. ঐ, পৃ. ৩১৯, ৭৯৩.

১৬. Karam Ali, Muzaffarnamah, text, ff. 86a-86b, 123b; J. N. Sarkar, Bengal Nawabs, pp. 49,72.

১৭. D. C. Sen, Bengali Language, pp. 396-97,793; ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা।

১৮. S. R. Mitra, Types of Early Bengali Prose, pp. 135-38; সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা, ১৭, ১৩০৮ বাংলা সাল, পৃ. ৮-১০।

১৯. ঐ।

২০. Edward C. Dimmock, Jr. “Hinduism and Islam in Medieval Bengal”, in Rachel van M. Baumer, (ed.), Aspects of Bengali History and Society, p. 2.

২১. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।

২২. Sub-Imperialism বা স্বায়ত্ত-সাম্রাজ্যবাদ কথাটি এ প্রসঙ্গে প্রথম ব্যবহার করেন J. D. Nichol, তাঁর কেমব্রিজ থিসিসে, ‘The British in India, 1740-63, A Study of Imperial Expansion into Bengal’, ১৯৭৬ (অপ্রকাশিত)। তারপর P. J. Marshall-ও এটি ব্যবহার করেন তার Bengal—the British Bridgehead গ্রন্থে, ১৯৮৭।

২৩. O.C., no. 4258, 22 Jan. 1677, vol. 37, f. ৪.

২৪. D. B., vol. 90, para 25, f. 58, 15 Jan. 1681.

২৫. Diary of William Hedges, vol. I, pp. 133-34.

২৬. D. B., vol. 91, para 25, f. 37, 14 Jan. 1686; vol. 91, f. 466, 12 Dec. 1687. আমিই জোর দিয়েছি।

২৭. কর্নেল বসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, Brijen K. Gupta, Sirajuddiullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।

২৮. ব্যুসিকে লেখা ডুপ্লের চিঠি, পৃ. ৩৬।

২৯. ঐ।

৩০. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 36-এ উদ্ধৃত।

৩১. ক্লাইভকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ২৫ আগস্ট ১৭৫২, Orme Mss., 0.v. 19, ff. 1-2.

৩২. One Mss., India, ff. 1487-91; Orme Mss.. 0.v. 12, ff. 140-43.

৩৩. Hill, Bengal, vol. I, p. xxiii,

৩৪. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 32.

৩৫. C. A. Bayly, Indian Society, p.50.

৩৬. ঐ।

৩৭. ১৯৮৬ সালে প্যারিসের Centre d’etudes de l’Inde et de l’Asie du Sud-এ বেইলির প্রদত্ত বক্তৃতা।

৩৮. K.N. Chaudhuri, Trading World; Om Prakash, Dutch Company; P. J. Marshall, Bengal; C. A. Bayly, Indian Society.

৩৯. Shireen Moosvi, “The Silver Influx, Money Supply, Prices and Revenue Extraction in Mughal India, JESHO, vol. XXX, 1988, pp. 92-94.

৪০. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ২০২-১১, ২৪৯-৫৯-তে এর বিশদ ব্যাখ্যা ও বিবরণ পাওয়া যাবে।

৪১. ঐ, পৃ. ২০২-১১।

৪২. ঐ, পৃ. ২৪৯-৫৯।

৪৩. ক্লাইভকে লেখা লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের চিঠি, ১৭ ডিসেম্বর ১৭৫৭, One Mss., India, XVIII, f. 5043.

৪৪. বিশদ বিবরণের জন্য অষ্টম অধ্যায় দ্রষ্টব্য। তা ছাড়া আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১১৭-২৩; আমার প্রবন্ধ ‘Khwaja Wajid in Bengal Trade and Politics.’ IHR, vol. XVI, nos. 1-2, pp. 137-48.

৪৫. এখানে আমার যে বক্তব্য ও যে-সব তথ্য পেশ করা হয়েছে, তা মূলত আমার প্রবন্ধ “Was there a ‘Crisis’ in mid-Eighteenth Century Bengal’ থেকে নেওয়া। এ প্রবন্ধটি পাঠ করেছিলাম ১৯৯৪ সালের অক্টোবরে, “Workshop on the Eighteenth Century”, University of Virginia, Charlottesville-এ। আমার বই From Prosperity to Decline থেকেও এখানে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

৪৬. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67-68; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, pp. 7, 12, 14.

৪৭. রিয়াজ, পৃ. ২৯৪-৯৫।

৪৮. ঐ, পৃ. ৩২০।

৪৯. ঐ, পৃ. ৩১১, ৩১৪-১৫, ৩১৯-২০।

৫০. P. J. Marshall, Bengal, p. 73; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 310-12.

৫১. আমার বই, From Prosperity to Decline, পৃ. ১০২-১০৫।

৫২. ঐ, পৃ. ১০২-১০৮।

৫৩. এ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়, ‘ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়’ দ্রষ্টব্য।

৫৪. যেমন K. K. Datta, Bengal Suba, pp. 463-69; Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 33; K. N. Chaudhuri, Trading World, pp. 99-108; P. J. Marshall, East Indian Fortunes, p. 35; Bengal, pp. 73, 142-43, 163-64, 170.

৫৫. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ২৭৮-৩০৫।

৫৬. যেমন K. N.Chaudhuri, Trading World.

৫৭. কোঃ হচ্ছে কোবিদ, যে একক দিয়ে তখন কাপড় মাপা হত। এ কোবিদ সাধারণত ১৮ ইঞ্চি হিসেবে ধরা হত।

৫৮. আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ১৯২, সারণি ৭.৭; পৃ, ২১৩, ফিগার ৭.৪।

৫৯. ঐ, পৃঃ ২৭৯-৯৩

৬০. ঐ, পৃঃ ২৯৩-৯৯

৬১. ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্রে বাংলায় জাহাজ আনাগোনার যে তালিকা পাওয়া যায়, তা থেকে এটা সুস্পষ্ট।

৬২. VOC2469, ff. 10078; 2489, ff. 291-9lvo, 293; 2504, ff. 1065-66; 2518, f. 15; 2556, ff. 2575-76; তা ছাড়া আমার বই From Prosperity to Decline, পৃ. ৩১৫, সারণি, ১১.১।

৬৩. BPC, Range 1, vol. 15, f. 327, 7 Oct. 1742; Orme Mss, OV. 12. f. 83; Eur G 37, Box. 21, 1st Sept, 1753; Ome Mss, India, VI, f. livo. মিঃ রবিন্সকে লেখা রবার্ট ওরমের চিঠি, ১০ মে ১৭৫১, One Mss.ov. 12, f. 83.

৬৪. ক্যাপ্টেন ফেনউইকের চিঠি, ১৭৫২, Ome Mss, India, VI, f. lllvo; ক্লাইভকে লেখা ম্যানিংহাম (Manningham) ও ফ্র্যাঙ্কল্যান্ডের (Frankland) চিঠি, ১ সেপ্টেম্বর, ১৭৫৩, Eur. G. 37,Box 21.পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলি ওলন্দাজ কোম্পানির নথিপত্র থেকে উদ্ধার করে তারপর টানেজের হিসেব বার করা হয়েছে।

৬৫. Bengal letters Recd., vol 24, f. 236, 20 May 1757.

৬৬. Select Committee, Fort St. George to Select Committee, Fort William, 14 Nov. 1756, Hill, vol. I, p. 302.

৬৭. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 103-13; Law’s Memoir, Hill, vol. III, p. 179.

৬৮. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 104-05.

৬৯. ঐ৷

৭০. বিশদ বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaallah, pp. 103-13।

৭১. ঐ, পৃ. ১০৮-১১০

৭২. Ome, Military Transactions, vol. II, Sec. I, pp. 142-43; ক্লাইভকে লেখা সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি, ৪ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. III, পৃ, ২৭০-৭১।

৭৩. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 113.

৭৪. চন্দননগরের ফরাসি কাউন্সিলকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ৯ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. II, p. 277.

৭৫. Watts’ Memoir, p. 42; Hill, Vol. III, p. 191, note; Scrafton, Reflections, pp. 70 74.

৭৬. যেমন ওয়াটস ও ইভস (Ives)। বিস্তারিত বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, পৃ. ১১১।

৭৭. Scrafton, Reflections p. 75.

৭৮. ওয়াটসনকে লেখা ক্লাইভের চিঠি, ১১ মার্চ ১৭৫৭, Hill, vol. II, p. 280.

৭৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 108-113.

৮০. Scrafton, Reflections, p. 70.

৮১. Law’s Memoir, Hill, vol. III.

৮২. বিশদ বিবরণের জন্য, Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah. Pp.112-13.

৮৩. Scrafton, Reflections, p. 76.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *