৪. সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

সিরাজদ্দৌল্লা ও ইংরেজ কোম্পানির সংঘাত

বহুদিন ধরে ঐতিহাসিকরা বলার চেষ্টা করছেন যে ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার যে-সংঘর্ষ (১৭৫৬-৫৭) বাধে, তার জন্য মূলত দায়ী নবাব সিরাজদ্দৌল্লাই। এই মতের সবচেয়ে বড় প্রবক্তা এস. সি. হিল (S. C. Hill, 1905), যদিও এই বক্তব্যই বেশ চাতুর্যের সঙ্গে এবং খুব সূক্ষ্মভাবে (সোজাসুজি নয়) অধুনাতম গ্রন্থেও পরিবেশিত হয়েছে। উক্ত সংঘর্ষের কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে হিল বলছেন, সিরাজদ্দৌল্লার ‘আত্মম্ভরিতা’ (vanity) এবং ‘অর্থলিপ্সাই’ (avarice) এ সংঘর্ষের মুখ্য কারণ। ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের যে কতগুলি নির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ ছিল, হিল সাহেব সেগুলিকে ‘ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য’ নবাবের ‘মিথ্যা ওজর’ বলে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। নবাব হওয়ার আগে হয়তো সিরাজদ্দৌল্লা কিছুটা দাম্ভিক ছিলেন কিন্তু নবাব হওয়ার পরে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর আচরণে বা সম্পর্কে এমন কোনও ঘটনা বা তথ্য দেখানো মুশকিল যাতে প্রমাণিত হয় যে সিরাজের দাম্ভিকতাই ইংরেজের সঙ্গে তাঁর বিরোধের অন্যতম কারণ। আর খোদ ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকেই সহজে দেখানো যায় যে সিরাজের অর্থলিপ্সা যদি থেকেও থাকে, তা কিন্তু কোনওভাবেই এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী নয়। অন্যদিকে আমাদের কাছে এমন তথ্যপ্রমাণ আছে যা থেকে দেখানো যাবে যে, যদি কোনও একটি কারণকে এ-সংঘর্ষের জন্য দায়ী করা যায় তবে তা হল কলকাতায় ইংরেজ কোম্পানির গভর্নর রজার ড্রেকের (Roger Drake) কঠিন ও অনমনীয় মনোভাব। হিল কিন্তু এ-সংঘর্ষে ড্রেকের ভূমিকা সম্বন্ধে আশ্চর্যরকমের (সুবিধেজনকও বটে) নীরব!

অধুনা ঐতিহাসিকদের মধ্যে যদিও পিটার মার্শাল বলছেন যে, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে ‘মিটমাট করার জন্য কোনও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়নি’ তবু তিনি এবং অন্যান্যরা এখনও প্রচ্ছন্নভাবে এ-সংঘর্ষের জন্য সিরাজদ্দৌল্লাকেই বেশি করে দায়ী করেছেন।

ইদানীং ঐতিহাসিকরা বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে বিরোধের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছেন যে, অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে বাংলায় নবাবের সঙ্গে সামরিক অভিজাতশ্রেণী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও জমিদারদের মধ্যে যে নতুন শ্রেণীগত জোটবদ্ধতা (new class alliance) তৈরি হয়েছিল এবং যা মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি খান পর্যন্ত বাংলায় নবাবি শাসনের মূল ভিত্তি, সিরাজদ্দৌল্লার সময় তা ভেঙে পড়ে। তার ফলেই তরুণ নবাবের সময় বাংলার রাজনৈতিক জীবনে ‘সংকট’ ঘনীভূত হয়। আর সেই সুযোগেই ইংরেজরা বাংলায় নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে সমর্থ হয়। এটা ঠিকই, ১৭৫৬-৫৭ সালে বাংলায় যে ‘সংকটে’র কথা বলা হয় তা সম্যক উপলব্ধি করতে গেলে, বাংলার নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে যে-সম্পর্ক তা ভাল করে বুঝতে হবে। এ-সম্পর্ক আবার অনেকটা নির্ভর করত একদিকে বাংলায় ইংরেজ কোম্পানির নিজস্ব অর্থাৎ কোম্পানির তরফে যে-সব ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যদিকে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যবসার সমৃদ্ধি বা অবনতির ওপর। কিন্তু যে-সব বিশেষ ঘটনা বা নির্দিষ্ট বিষয়কে কেন্দ্র করে নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষের উৎপত্তি, সেগুলি ভাল করে বিশ্লেষণ করা দরকার, যাতে এ-সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।

কাশিমবাজারের ফরাসি কুঠির অধ্যক্ষ জাঁ ল’ লিখেছেন যে নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর আগে থেকেই ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার বিরূপ মনোভাব ছিল। কিন্তু এ বক্তব্য মোটেই সঠিক নয়। এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা যখন নবাব হলেন, তখনও ইংরেজদের প্রতি তাঁর কোনও বিরূপতা ছিল না, কোনও শত্রুতামূলক মনোভাবও নয়। সাধারণভাবে ইউরোপীয়দের প্রতি, ইংরেজসমেত, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল আলিবর্দির মতোই। দু’জনেরই এদের প্রতি মনোভাব দক্ষিণ ভারত এবং কর্ণাটকের ঘটনার প্রেক্ষিতেই আবর্তিত হত। দক্ষিণ ভারতে যা ঘটছিল, সেখানে কীভাবে ইংরেজ ও ফরাসিরা রাজনীতির দাবাখেলায় মেতে উঠেছিল এবং কীভাবে স্থানীয় শাসকদের তাদের হাতের পুতুল করে তুলছিল, সে সম্বন্ধে আলিবর্দি সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন। তাঁর ভয় ছিল, ইউরোপীয়রা বাংলায়ও সে-খেলায় মেতে উঠতে পারে। তাই তারা যাতে বাংলায় তার পুনরাবৃত্তি করতে না পারে তার জন্য তিনি সচেষ্ট ও বদ্ধপরিকর ছিলেন। জাঁ ল’ বলছেন, আলিবর্দি ইংরেজ ও ফরাসিদের সমান সন্দেহের চোখে দেখতেন। তবে বৃদ্ধ নবাব বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলায় ফরাসিদের তুলনায় ইংরেজদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক বেশি ছিল— সুতরাং ফরাসিদের চেয়ে তারাই বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। সিরাজদ্দৌল্লার উপলব্ধিও ছিল তাই। এটা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের পাণ্ডুলিপি থেকে সুস্পষ্ট: ‘নতুন নবাব তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত বোধ করছিলেন এবং তা হ্রাস করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। এদের মধ্যে যেহেতু ইংরেজরাই বেশি শক্তিশালী, তাই তিনি ন্যায্যভাবে [just policy] প্রথমে তাদের দমন করতে অগ্রসর হলেন।’

হলওয়েল (Holwell) অবশ্য লিখেছেন যে আলিবর্দি অনেকদিন ধরে ইউরোপীয়দের অস্ত্রসম্ভার ও দুর্গ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করছিলেন এবং মৃত্যুশয্যায় সিরাজকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ইংরেজদের প্রথম শায়েস্তা করতে এবং তাদের কোনও দুর্গ বা সৈন্যসামন্ত রাখতে না দিতে। কিন্তু হলওয়েলের দেওয়া তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। কলকাতার ‘অন্ধকূপ হত্যার’ যে-কাহিনী তার জনক তিনিই। তাঁর সত্যবাদিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে অনেক ইংরেজ কর্মচারীই সন্দিহান ছিল। নিজের বক্তব্যকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করতে বা তথ্যকে বিকৃত করতে তিনি বেশ অভ্যস্ত ছিলেন। অন্য ইংরেজ কর্মচারীদের লেখা থেকে প্রমাণ করা যায় যে আলিবর্দির মৃত্যুশয্যায় সিরাজের প্রতি নির্দেশ একেবারেই আজগুবি গল্প। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস, যিনি মুর্শিদাবাদ দরবারের হাঁড়ির খবরও রাখতেন, জানিয়েছেন যে তিনি বা ওই কুঠির কেউ, এমনকী স্থানীয় লোকজনরাও মৃত্যুশয্যায় আলিবর্দির সিরাজের প্রতি নির্দেশের কথা শোনেননি। ওই কুঠির দ্বিতীয় প্রধান ম্যাথু কোলেট (Mathew Collet) হলওয়েলের বক্তব্যকে ‘একেবারেই আজগুবি গল্প’ (spacious fable) আখ্যা দিয়েছেন।১০ এখানে স্মর্তব্য, এঁরা দুজনেই কাশিমবাজারে ছিলেন বলে পাশে মুর্শিদাবাদ দরবারে রোজ যা ঘটত, তার সবকিছুরই খবর রাখতেন। তাঁরা কিছু জানতেন না অথচ হলওয়েল কলকাতায় বসে কী করে সব জানলেন? ইংরেজ কোম্পানির আরেকজন কর্মচারী, রিচার্ড বেচার (Richard Becher) লিখেছেন: ‘ইংরেজরা এমন অনেক কাজ করেছে যার জন্য স্বাভাবিকভাবেই সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের ওপর রেগে গেছিলেন। তাদের প্রতি বিরূপ হওয়ার জন্য আলিবর্দির শেষ উপদেশের কোনও প্রয়োজনই ছিল না।১১

আগেই বলা হয়েছে প্রথমদিকে সিরাজ ইংরেজদের প্রতি একেবারেই শত্রুভাবাপন্ন ছিলেন না। সিরাজ মসনদে বসার অনেক আগেই আলিবর্দি ইংরেজদের দেওয়া এক পরোয়ানায় জানিয়েছিলেন যে, সিরাজদ্দৌল্লা সবসময় আলিবর্দির সমক্ষে ইংরেজদের প্রশংসা করতেন এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য শুভকামনা করতেন।১২ ১৭৫২ সালের মে মাসে আলিবর্দি সিরাজদ্দৌল্লাকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করেন আর ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই হুগলির ফৌজদার ও আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদের পরামর্শে ইংরেজরা সিরাজের সঙ্গে দেখা করেন। ফোর্ট উইলিয়ামের নথিপত্র থেকে জানা যায়, সিরাজ ‘ইংরেজদের প্রতি ডাচ বা ফরাসিদের চেয়েও বেশি সৌজন্য দেখান এবং যথেষ্ট হৃদ্যতামূলক আচরণ করেন।’১৩ নবীন যুবরাজের সহৃদয় ব্যবহারের খবর পেয়ে কোম্পানির পরিচালক সমিতি লন্ডন থেকে ফোর্ট উইলিয়ামে লিখে পাঠায় (২৩ জানুয়ারি ১৭৫৪) যে ‘তারা যেন ইংরেজদের প্রতি সিরাজদ্দৌল্লার এই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবের সুযোগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে সম্পর্কের আরও উন্নতি করে।’১৪ আবার আরেকটি চিঠিতে পরিচালক সমিতি জানাচ্ছে (২৪ নভেম্বর, ১৭৫৪), সিরাজ অন্য ইউরোপীয়দের চেয়ে ইংরেজদের প্রতি অনেক বেশি প্রসন্ন বলে মনে হচ্ছে এবং এটাকে যেন কাজে লাগানো হয়।১৫

সাধারণভাবে একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে সিরাজ নবাব হওয়ার পর তখনকার রীতি অনুযায়ী ইংরেজরা তাঁকে কোনও নজরানা বা উপঢৌকন দেয়নি বলে তিনি ইংরেজদের ওপর অসন্তুষ্ট হন। কিন্তু এটা বোধহয় ঠিক নয়। ইংরেজরা একটি চিঠি লিখে সিরাজকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন এবং নতুন নবাবের কাছ থেকে অনুগ্রহ ও নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিলেন। এ চিঠি বেশ সাদরেই গৃহীত হয়েছিল। তরুণ নবাব দরবারে ইংরেজদের ‘ভকিল’ (vakil) বা প্রতিনিধিকে জানিয়ে দেন যে তিনি ইংরেজদের প্রতি তাঁর মাতামহ আলিবর্দির চেয়েও বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবেন।১৬ আসলে ইউরোপীয়দের প্রতি আলিবর্দির নীতি ছিল ‘ঋজু অথচ অন্যায্য নয়’ (rigid rather than unjust)। যাতে তাঁর প্রবল আপত্তি ছিল তা হল, ইউরোপীয়রা নবাবের অধীন নয়—স্বাধীন, নবাবের তারা তোয়াক্কা করে না এমন মনোভাব। জাঁ ল’ জানাচ্ছেন, ‘আলিবর্দি কিন্তু ভালভাবেই জানতেন ঠিক কখন এবং কীভাবে এদের সমঝে দেওয়া প্রয়োজন যে তিনিই বাংলার হর্তাকর্তা। তিনি চেয়েছিলেন যে ইউরোপীয়রা কেউই বাংলায় দুর্গ তৈরি করে নিজেদের সুসংহত না করে।’১৭ তিনি দরবারে এ-সব কোম্পানির প্রতিনিধিদের বলতেন—‘তোমরা সওদাগর, তোমাদের দুর্গ তৈরি করার প্রয়োজনটা কী? আমার রাজ্যে তোমাদের এমন কোনও শত্রু নেই যাকে তোমরা ভয় করতে পার।’ তিনি আরও বলছেন, ‘আলিবর্দি যদি আর কিছুদিন সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকতেন, তা হলে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইউরোপীয়দের যথাযথ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এত বৃদ্ধ ও এমন অসুস্থ ছিলেন যে তাঁর উত্তরসূরিকেই সেই কাজ করতে এগিয়ে আসতে হল।’১৮ সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম থেকেই ইউরোপীয় এবং ইংরেজদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্নই ছিলেন। জাঁ ল’ লিখেছেন, সিরাজ ফরাসিদের প্রতি বেশ সন্তুষ্টই ছিলেন। তারাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে রায়দুর্লভ ও মোহনলালের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলত।১৯

কিন্তু সিরাজদ্দৌল্লার নবাব হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, নবাব ও ইংরেজদের মধ্যে, দু’পক্ষের স্বার্থের মধ্যে সংঘাতের ফলে, বিরোধ অপরিহার্য হয়ে উঠল। আসলে আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে সিরাজ ইংরেজদের কিছু কাজকর্মের প্রতিবাদ করেছিলেন কারণ এগুলির মাধ্যমে নবাবের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রতি অবজ্ঞা দেখানো হচ্ছিল। ইউরোপে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কায় এবং আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদে মসনদ নিয়ে বিরোধ অবধারিত ভেবে ইংরেজ ও ফরাসিরা উভয়েই প্রায় প্রকাশ্যে তাদের দুর্গগুলি সংস্কার ও সংহত করার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু একদিকে আলিবর্দি অত্যন্ত অসুস্থ এবং অন্যদিকে দিল্লি থেকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী বাংলার বকেয়া রাজস্ব আদায় করতে অভিযান করবে এমন আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় সিরাজ আপাতত ইংরেজ ও ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াটা মুলতুবি রাখতে বাধ্য হলেন।২০

সিরাজদ্দৌল্লার ইংরেজদের প্রতি বিরূপ হওয়ার আরও গভীর কারণ ছিল। তিনি আশঙ্কা করেন যে ইংরেজরা তাঁর সিংহাসন প্রাপ্তির বিরোধিতা করতে পারে। তিনি যখন ১৭৫৬-এর এপ্রিলে নবাব হলেন তখন তাঁর সন্দেহ হয় যে ইংরেজরা মসনদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের মদত দিচ্ছে। এ-সন্দেহ কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। বস্তুত ইংরেজরা প্রথম থেকে প্রায় ধরেই নিয়েছিল, সিরাজের পক্ষে নবাব হওয়া প্রায় অসম্ভব। বাংলায় ফরাসি কোম্পানির প্রধান রেনল্ট বা জা ল’র লেখা থেকে এবং অন্যান্য বেশ কিছু ইউরোপীয় তথ্য থেকেও জানা যায় যে ইংরেজরা সিরাজের বিরুদ্ধে একটা মতলব ভাঁজছিল এবং সিরাজের বিরুদ্ধ-গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। রেনল্ট স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ‘ঘসেটি বেগমের দলকে মসনদ দখলের দৌড়ে কেউ আটকাতে পারবে না এবং সিরাজদ্দৌল্লার পতন অনিবার্য, এই স্থির বিশ্বাসে ইংরেজরা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে [সিরাজের বিরুদ্ধে] চক্রান্ত শুরু করেন।’২১ জাঁ ল’-ও লিখছেন যে অন্য অনেকের মতো ইংরেজরাও ভেবেছিল, ‘সিরাজদ্দৌল্লা কখনও নবাব হতে পারবেন না, এবং তাই তারা কোনও কাজে তাঁর দ্বারস্থ হত না। শুধু তাই নয়, তারা তাঁর সঙ্গে কোনওরকম যোগাযোগই রাখত না।’ এ-সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:২২

it was in the effervescence of these troubles that the English gave Siraj-uddaula reason for complaint against them. Always led away by the idea that he would not have sufficient influence to get himself recognised as subahdar they carried on a correspondence with the Begum (Ghaseti)…. It is even said that they had an understanding with the Nawab of Purnea (Shaukat Jung).

ইংরেজরা যে সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছিল তা অন্য একটি ফরাসি সূত্র থেকেও জানা যায়। তাতে বলা হয়েছে যে, লেখকের বিশ্বাস, ইংরেজরা ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গের সঙ্গে সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্তে যোগ দেয়।২৩ এখানে উল্লেখ্য, শওকত জঙ্গও ঘসেটি বেগমের মতো মসনদের দাবিদার হিসেবে সিরাজের প্রতিপক্ষ ছিলেন। হলওয়েল নিশ্চিত ছিলেন যে সিরাজের বিরুদ্ধে ঘসেটি বেগমের জেতার সম্ভাবনা খুবই উজ্জ্বল।২৪ এমনকী ইংরেজ গভর্নর ড্রেকও যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন যে সিরাজদ্দৌল্লা ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধে সফল হতে এবং আদৌ নবাব হতে পারবেন কি না।২৫ সিয়র-উল-মুতাখারিনে-র লেখক ও শওকত জঙ্গের পরামর্শদাতা গোলাম হোসেন খান সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সঙ্গে সমঝোতা করার জন্য শওকত জঙ্গকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন।২৬ কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচার লিখেছেন যে ইংরেজরা সিরাজদ্দৌল্লাকে তাদের ওপর রেগে যাওয়ার যথেষ্ট ইন্ধন জুগিয়েছিল।২৭

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার নির্দিষ্ট অভিযোগগুলি যথার্থ কি না তা বিচার করার আগে তাঁর আত্মম্ভরিতা ও অর্থলিপ্সা, যা সিরাজ-ইংরেজ সংঘর্ষের মূল কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, তার দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক। সিরাজ যদি সত্যিই দাম্ভিক হতেন এবং তাঁর দাম্ভিকতাই যদি বিরোধের অন্যতম কারণ হয়ে থাকে, তা হলে তাঁর দুই প্রবল শত্রু ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গকে পরাভূত করার পরই তিনি ইংরেজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। মসনদে বসার ক’দিন পরে তিনি রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে অর্পণ করার অনুরোধ জানিয়ে কলকাতায় চিঠি দেন। কৃষ্ণদাস ৫৩ লক্ষ টাকা মূল্যের ধনসম্পদ নিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন। খুব সম্ভবত তাঁর পিতা রাজবল্লভ ইংরেজদের যোগসাজশে ওই ধনসম্পদ সমেত তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমের বিশ্বস্ত অনুচর—তাঁর মৃত স্বামী নওয়াজিস মহম্মদ ঢাকার নবাব থাকার সময় রাজবল্লভ প্রথমে একজন সহকারী ছিলেন, পরে তিনি ঢাকার রাজস্ববিভাগের দায়িত্ব পান। তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি তহবিল আত্মসাৎ করার অভিযোগ উঠেছিল এবং যখন এ-সব হিসেবপত্র পরীক্ষার কাজ চলছিল, তখন রাজবল্লভ ইংরেজদের কাছে তাঁর পুত্র কৃষ্ণদাস ও পরিবারের জন্য কলকাতায় আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কৃষ্ণদাস কলকাতা পৌঁছোন ১৩ মার্চ ১৭৫৬—আলিবর্দির মৃত্যুর প্রায় মাসখানেক আগে।২৮

কয়েক সপ্তাহ পরে, সিরাজদ্দৌল্লা নবাব হওয়ার পর ইংরেজদের লিখে পাঠান, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লাকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করার জন্য যেন নতুন করে কিছু করা না হয় এবং ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে যে প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) সম্প্রতি বানিয়েছে তা যেন ভেঙে ফেলা হয়। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক সিরাজের চিঠিকে শুধু উপেক্ষাই করেননি, পত্রবাহক মেদিনীপুরের ফৌজদার রাজারামের ভাই নারায়ণ সিংকে ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশকারী ও গুপ্তচর অপবাদ দিয়ে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন।২৯ অথচ তখনকার কলকাতার সবচেয়ে ধনী ও সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী উমিচাঁদই নারায়ণ সিংকে পরিচয়পত্র দিয়ে ড্রেকের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লার দ্বিতীয় চিঠির উত্তরে ড্রেক যা লিখেছিলেন তাতে ইউরোপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধ যদি ভারতবর্যে বিস্তার লাভ করে, সেক্ষেত্রে ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা নবাবের সাধ্যে কুলোবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল।৩০ এ-চিঠি পেয়ে সিরাজের সন্দেহ আরও ঘনীভূত হল যে ইউরোপীয়রা, বিশেষ করে ইংরেজরা, দক্ষিণ ভারতে মাত্র কয়েক বছর আগে যেভাবে নিজেদের রাজনৈতিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেছিল, বাংলায় তারা তার পুনরাবৃত্তি করতে পারে। নারায়ণ সিং-এর কলকাতা থেকে বহিষ্কারের খবর পেয়ে ওয়াটস শঙ্কিত হয়ে লিখেছেন: ‘যে মুহূর্তে আমি নারায়ণ সিং-এর ব্যাপারটি জানতে পারলাম, তখনই আমি নবাবের উচ্চপদাধিকারী এই কর্মচারীকে এভাবে অপমান করার ফল কী হতে পারে তা ভেবে আতঙ্কিত হলাম কারণ তরুণ নবাবকে ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের প্রাচুর্যে কিঞ্চিৎ বেসামাল মনে হয় এবং তাঁর প্রত্যাশা তাঁর আদেশ লোকে বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে।’৩১ জাঁ ল’-ও জানাচ্ছেন যে ‘ইংরেজরা নবাবের দূতকে অপমান করেছে এবং নবাবের চিঠির উত্তরে বেশ চড়া (offensive) জবাব দিয়েছে।’৩২ হুগলির ডাচ কুঠির কুঠিয়ালরাও লিখেছেন যে নবাবের মতো শক্তিশালী বিপক্ষকে ‘এমনভাবে সোজাসুজি অগ্রাহ্য করে [ইংরেজরা] হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছে।’৩৩

বস্তুতপক্ষে পুর্ণিয়া রওনা হওয়ার (১৬ মে ১৭৫৬) আগে সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের মতো ফরাসিদেরও আলিবর্দির শেষ অসুস্থতার সুযোগে তাদের কেল্লার সংস্কার ও সংহত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল, সেগুলি ভেঙে ফেলতে বলেন। ফরাসিরা জাঁ ল’-র পরামর্শে, ইংরেজদের মতো ঔদ্ধত্য না দেখিয়ে, নবাবের পত্রবাহককে বেশ সৌজন্য দেখায় এবং তাকে দিয়ে রিপোর্ট করায় যে ফরাসিরা বেআইনি কিছু করেনি। নবাব ২০ মে নাগাদ রাজমহলে এ-খবর পেয়ে বেশ সন্তুষ্ট হন।৩৪ এদিকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল বুঝতে পারে নারায়ণ সিংকে কলকাতা থেকে ওভাবে বহিষ্কার করার ফলে নবাবের সঙ্গে সম্পর্কে বেশ তিক্ততার সৃষ্টি হতে পারে। তাই কাশিমবাজারে ওয়াটসকে নির্দেশ দেওয়া হল, তা যেন না হয় তার জন্য আগে থেকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে। ওয়াটস তড়িঘড়ি দরবারে নবাবের ঘনিষ্ঠ লোকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন।৩৫ কিন্তু আমরা আগেই বলেছি, ড্রেকের চিঠিতে সম্ভাব্য ফরাসি আক্রমণের বিরুদ্ধে নবাব ইংরেজদের রক্ষা করতে পারবেন কি না তা নিয়ে নবাবের ক্ষমতার ওপর কটাক্ষপূর্ণ ইঙ্গিত ছিল এবং মনে হয় সিরাজ তাতে খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। আবার এমন একটা সময় এ-সব ঘটনা ঘটল যখন সিরাজদ্দৌল্লা তাঁর এক প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী, ঘসেটি বেগমকে, কাবু করে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী শওকত জঙ্গের সঙ্গে মোকাবিলা করতে যাচ্ছিলেন। ফলে, অন্য সময় এ-সব ঘটলে সিরাজের ওপর যা প্রতিক্রিয়া হত, সে-সব এ সময় ঘটায় তার প্রতিক্রিয়া অনেক বেশি জোরালো হয়ে দেখা দিল।৩৬

এর পরের যে ঘটনাবলী তার সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সিরাজদ্দৌল্লা এতসব সত্ত্বেও দম্ভসূচক বা হঠকারিতার কোনও কাজ করেননি। তিনি তাঁর দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অমাত্যদের ডেকে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধে পরামর্শ চাইলেন। মুজাফ্‌রনামা-র লেখক করম আলির তথ্য অনুযায়ী, সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন, জয়নাল আবেদিন, মীর্জা হাবিব বেগ, মীর হাসাউল্লা প্রমুখের নেতৃত্বে একদল পরামর্শ দিল, ইংরেজদের না ঘাঁটাতে, তারা ‘আগুনের শিখার মতো’ (‘flames of fire’), অন্যদিকে খোজা ওয়াজিদ, রায়দুর্লভ, মীরজাফর প্রমুখের নেতৃত্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী গোষ্ঠী পরামর্শ দিল, ইংরেজদের প্রতি ‘দৃঢ় কূটনীতির সঙ্গে প্রয়োজনে অস্ত্রধারণের নীতি’ (‘a policy of firmness and diplomacy combined with a show of force’) অবলম্বন করতে।৩৭ সেই (দ্বিতীয়) পরামর্শ অনুযায়ী সিরাজদ্দৌল্লা প্রখ্যাত আর্মানি বণিক খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করলেন। ওয়াজিদের নিযুক্তি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ মিটিয়ে নেবার জন্য তরুণ নবাবের সদিচ্ছারই প্রমাণ। এই দৌত্যের কাজে ওয়াজিদই যোগ্যতম ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নেই, কারণ এই আর্মানি বণিক তখন বাংলার অগ্রণী ব্যবসায়ীদের অন্যতম এবং ইংরেজ সমেত ইউরোপীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল। ইংরেজ গভর্নর ড্রেক তাঁর সঙ্গে অপমানসূচক ব্যবহার করেন এবং তাঁকে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেন। উইলিয়াম ওয়াটসের লেখা থেকে জানা যায়, ওয়াজিদ চার বার কলকাতায় ইংরেজদের সঙ্গে দেখা করে নবাবের সঙ্গে একটা মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ইংরেজরা তাঁকে এই বলে শাসিয়েছিল যে এরকম প্রস্তাব নিয়ে ওয়াজিদ যেন আর কলকাতায় আসার চেষ্টা না করেন।৩৮ এমনকী বাংলায় প্রুশীয় (Prussian) কোম্পানির প্রধান জন ইয়াং (John Young) নবাব ও বাংলার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ইংরেজদের প্রতি ক্ষোভের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন:৩৯

[ইংরেজদের সঙ্গে] মিটমাটের জন্য যখন ফখর-উৎ-তুজ্জার [ওয়াজিদ] গেছলেন বা তাঁকে পাঠানো হয়েছিল—কোনটা আমি ঠিক জানি না, কতবার তাও না—তখন আপনারা [ইংরেজরা] নাকি কোনও কথায় কর্ণপাত করতে বা কোনও কিছু মেনে নিতে একেবারে অনিচ্ছুক ছিলেন। উপরন্তু আপনারা নাকি তাঁকে এ-কাজে আবার না আসার জন্য শাসিয়েছিলেন।

খোজা ওয়াজিদ যখন নিষ্ফল দৌত্যে ব্যস্ত, সিরাজদ্দৌল্লা তখন দুর্লভরাম ও হাকিম বেগকে কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি অবরোধ করার জন্য নির্দেশ দিয়ে শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে অভিযান করার জন্য পুর্ণিয়া অভিমুখে রওনা হন।৪০ কিন্তু রাজমহল পৌঁছে ইংরেজদের উদ্ধত আচরণের, ড্রেকের চিঠির এবং নারায়ণ সিং-এর প্রতি দুর্ব্যবহারের খবর পেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎগতিতে কাশিমবাজারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন। ইতিমধ্যে, ২৪ মে তিনশোর মতো নবাবের সৈন্য কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির সামনে উপস্থিত হয়। সিরাজদ্দৌল্লা কাশিমবাজার পৌঁছলেন ৩ জুন, তখন তাঁর সৈন্যসংখ্যা ৩০,০০০।৪১ ৪ জুন কাশিমবাজারের ইংরেজকুঠি বিনা প্রতিরোধে নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করে। কুঠির প্রধান উইলিয়াম ওয়াটস সিরাজের নির্দেশে এক চুক্তির শর্তাবলীতে স্বাক্ষর করলেন। এই শর্তগুলি হল: (১) নবাবের কোনও অপরাধী প্রজাকে কলকাতায় আশ্রয় দেওয়া চলবে না (২) ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানে যে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু (draw bridge) তৈরি করেছে, তা ভেঙে দিতে হবে (৩) এশীয়/ভারতীয় বণিকদের কাছে ইংরেজরা দস্তক বিক্রি করতে পারবে না।৪২ এ থেকে পরিষ্কার, শর্তগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের নির্দিষ্ট অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে রচিত—অভিযোগগুলি আমরা পরে খতিয়ে দেখব। কাশিমবাজারের পতনের পর সিরাজদ্দৌল্লা ৫ জুন কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। তাঁর নির্দেশে কাশিমবাজার কুঠির ওয়াটস এবং কোলেটও নবাবের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কলকাতা চললেন। সিরাজ কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া আর কিছুতে হাত দেননি বা বাজেয়াপ্ত করেননি—কোনও লুঠতরাজ বা হত্যাকাণ্ড হয়নি। কোনও নিষ্ঠুরতাও নয়।৪৩

এ পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার সম্পর্কে তাঁর কোনও দাম্ভিকতা বা ঔদ্ধত্যের পরিচয় পাওয়া যায় না। কলকাতা আক্রমণ করার আগে (১৬ জুন) সিরাজ আপস-মীমাংসার জন্য ইংরেজদের অনেক সময় দিয়েছিলেন, প্রথমে অস্ত্রধারণ না করে শুধু কূটনীতি ও দৌত্যের মাধ্যমে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিটমাটের চেষ্টা করেছিলেন। তা যখন ব্যর্থ হল, তখনই তিনি একদিকে দৌত্য এবং অন্যদিকে অস্ত্রধারণ করলেন। কাশিমবাজার কুঠি অবরোধ করার পেছনে বোধহয় সিরাজের উদ্দেশ্য ছিল, ওখানে ইংরেজদের নিরস্ত্র করে ওই কুঠির প্রধান ওয়াটসের মাধ্যমে কলকাতায় ইংরেজদের ওপর নবাবের সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করা। ওয়াটসের সঙ্গে চুক্তির যে শর্তাবলী, সেগুলি ইংরেজদের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগের ওপর ভিত্তি করা এবং মোটেই অযৌক্তিক কিছু নয়। তা ছাড়া এরকম ক্ষেত্রে ইউরোপীয় কোম্পানির কুঠি অবরোধ করা নতুন কিছু নয়, সিরাজের আগের নবাবরাও তা করেছেন। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ সম্বন্ধে রিচার্ড বেচারের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ:৪৪

That he [Siraj] must have been greatly incensed somehow or other is certain; he had proceeded as far as Rajamahall against the Purnea Nabob, who he must have looked on as a competitor for his sub- adarry, and yet he waived his resentment against him and marched back directly to attack the English. This does not appear like a pre-meditated design but rather a sudden gust of passion. What prevented you gentlemen [the Governor and the Fort William Council] from using proper means to mollify him while on his march I do not know….

হুগলির ডাচ কুঠিয়ালরাও জানাচ্ছে যে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের দুর্গকে দুর্ভেদ্য করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল, সেগুলি ভেঙে দেবার জন্য নবাবের নির্দেশে তারা কর্ণপাত করেনি। এভাবে তাঁকে অগ্রাহ্য করার জন্যই নবাব কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠি দখল করেন।৪৫

সিরাজদ্দৌল্লার ‘অর্থলিপ্সার’ কোনও প্রমাণ কিন্তু সমসাময়িক নথিপত্রে পাওয়া দুষ্কর, যদিও শুধু হিল সাহেব নন, এমনকী অধুনাও কোনও কোনও ঐতিহাসিক সোজাসুজি বা প্রচ্ছন্নভাবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।৪৬ এখানে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, সিরাজ যদি অর্থলোলুপ হতেন, তা হলে কাশিমবাজার কুঠির পতনের পর ইংরেজদের ওখানকার সব ধনসম্পত্তি তিনি অনায়াসে আত্মসাৎ করতে পারতেন। তিনি কিন্তু কিছুতে হাত দেননি, শুধু ইংরেজদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। তিনি তাদের কাছ থেকে কোনও অর্থও দাবি করেননি। তার চেয়েও বড় কথা, ওয়াটস যে-সব শর্তাবলীতে সই করেছিলেন, তাতেও অর্থের কোনও কথা ছিল না, যদিও এ রকম ক্ষেত্রে অর্থের দাবি করাটা প্রচলিত রীতি ছিল এবং বাংলার পূর্বেকার নবাবরা তা করেছিলেন। সিরাজদ্দৌল্লা যে ইংরেজদের সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর তথাকথিত ‘অর্থলিপ্সা’ যে তাতে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি, তা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি থেকে স্পষ্ট: ‘নবাব যে একটা আপস-মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন তার প্রমাণ তিনি কাশিমবাজারে যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম ছাড়া কোম্পানির অন্য কোনও জিনিসে হাত পর্যন্ত দেননি।’৪৭ পরে অবশ্য কলকাতা আসার পথে নবাবের দেওয়ান ও সেনাপতি দুর্লভরাম ওয়াটস ও কোলেটের কাছে অর্থের দাবি করেন—নবাব নন—তাও খুব একটা জোর দিয়ে নয়, অনেকটা তাদের যাচাই করার জন্য, অর্থের বিনিময়ে ইংরেজরা নবাবের কলকাতা অভিযান বন্ধ করতে রাজি কি না দেখতে হয়তো।৪৮ ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের অনেকে অবশ্য ভেবেছিল কিছু টাকাপয়সা দিয়ে নবাবের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করা যেত কিন্তু ইংরেজদের প্রতি সিরাজদৌল্লার অসন্তোষ এত তীব্র হয়ে উঠেছিল যে শুধু অর্থ দিয়ে তা দূর করা সম্ভব ছিল না বলেই মনে হয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, কলকাতা দখল করার পর মুর্শিদাবাদ ফেরার পথে তিনি ডাচদের কাছ থেকে সাড়ে চার লক্ষ টাকা ও ফরাসিদের থেকে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা নজরানা হিসেবে নিয়েছিলেন।৪৯ কলকাতার ইংরেজ কোষাগারে নবাব মাত্র চল্লিশ হাজার টাকার মতো পেয়েছিলেন। এখানে স্মর্তব্য, বাংলার সব নবাবই কোনও যুদ্ধজয়ের পর বা ওরকম উপলক্ষে বিদেশি বণিক ও দেশীয় সওদাগরদের কাছ থেকে প্রথাগত নজরানা আদায় করতেন—নজরানার পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে বেশিও হত। তবু বেছে বেছে অর্থলিপ্সার অপবাদ সিরাজের ঘাড়ে চাপানো কেন?

সিরাজদ্দৌল্লার কলকাতা আক্রমণের সময় ইংরেজ কোম্পানির যে ক্ষয়ক্ষতি হয় (আনুমানিক বারো লক্ষ টাকার মত৫০) তা মূলত সংঘর্ষের সময় অগ্নিকাণ্ডের জন্যই। লুঠতরাজ অবশ্য হয়েছিল সন্দেহ নেই। ইংরেজ কোম্পানির সরকারি ঐতিহাসিক রবার্ট ওরমের (Robert Orme) মতে তার জন্য দায়ী ছিলেন রাজা মানিকচাঁদ, সিরাজ নন। পরে সিরাজ তাঁকে এজন্য কারাদণ্ড দেন এবং দশ লক্ষ টাকা জরিমানা দিয়ে তিনি শেষে মুক্তি পান।৫১ সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অর্থলোলুপতার অভিযোগ যে কত অসার এবং তা যে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধের জন্য একেবারেই দায়ী নয় তা এক অজ্ঞাতনামা ইংরেজের লেখা [লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত] পাণ্ডুলিপি থেকে স্পষ্ট। ওই লেখক বলছেন: ‘বাংলার সুবাদার [সিরাজদ্দৌল্লা] যা চেয়েছিলেন তা মোটেই অর্থ নয়—অর্থের ব্যাপারটা ছিল নিতান্তই গৌণ। তিনি আসলে চেয়েছিলেন, ইউরোপীয়রা নিজেদের সুসংহত করার জন্য দুর্গগুলিকে যেভাবে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল, তার সম্পূর্ণ অবসান।৫২ এমনকী যে হলওয়েল সিরাজের প্রতি মোটেই সদয় ছিলেন না, তাঁর ব্যাপারও প্রমাণ করে যে, সিরাজ মোটেই অর্থগৃধ্নু ছিলেন না। কলকাতার পতনের পর যখন হলওয়েলকে বন্দি হিসেবে নবাবের কাছে উপস্থিত করা হল, তখন তিনি নবাবকে জানান যে, যুদ্ধের ফলে তাঁর ব্যক্তিগত অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও নবাবকে ভাল পরিমাণ অর্থ দিয়েই তিনি তাঁর মুক্তি কিনতে চান। সিরাজ এর উত্তর দিয়েছিলেন: ‘হলওয়েলের টাকা থাকলে তাঁর নিজের কাছেই থাক। তাঁর অনেক যন্ত্রণাভোগ হয়েছে, তাঁকে মুক্তি দেওয়া হোক।’৫৩ এ থেকে একটা জিনিস সুস্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা অর্থলোলুপ ছিলেন না এবং অন্তত কিছুটা মানবিকতাবোধও তাঁর মধ্যে ছিল। বেশির ভাগ ঐতিহাসিক তাঁকে যতটা ‘অমানুষ’ ভাবেন, ততটা ‘অমানুষ’ হয়তো তিনি ছিলেন না।

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:

ন্যায়সঙ্গত না শুধু মিথ্যা ওজর?

ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার তিনটে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল এবং আমাদের কাছে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে স্পষ্ট যে এগুলি খুবই ন্যায়সঙ্গত। এগুলিকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য ‘শুধু মিথ্যা ওজর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তিনটে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কেন্দ্র করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ:

(১) ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লার সংস্কার ও এটাকে দুর্ভেদ্য এবং সুসংহত করার প্রচেষ্টা।

(২) দস্তকের বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

(৩) নবাবের অপরাধী প্রজাদের কলকাতায় আশ্রয়দান।

খোজা ওয়াজিদকে ইংরেজদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার দৌত্যে নিযুক্ত করার পর সিরাজদ্দৌল্লা তাঁকে একটা চিঠিতে ইংরেজদের প্রসঙ্গে তাঁর নিজের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন:৫৪

তিনটে মুখ্য কারণে আমি আমার রাজ্য থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চাই। প্রথমত, দেশের কোনও আইনকানুন না মেনে তারা বাদশাহি মুলুকে [বাংলায়] গড়খাই কেটে জোরদার কেল্লা বানিয়েছে। দ্বিতীয়ত, তারা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করেছে, এমন সব লোককে দস্তক দিয়েছে যারা কোনওমতেই তা পেতে পারে না এবং তাতে বাদশাহের [রাজ্যের] রাজস্বের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। তৃতীয়ত, নবাবকে অগ্রাহ্য করে নবাবের অপরাধী প্রজাদের নবাবের বিচারের হাত থেকে তাদের রেহাই দিতে কলকাতায় আশ্রয় দিচ্ছে।

কেল্লার সংস্কার ও দুর্ভেদ্যীকরণ

উপরোক্ত অভিযোগগুলিকে কেন্দ্র করেই যেহেতু ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ, সেজন্য এগুলি আদৌ ভিত্তিহীন কি না তা খুব সতর্কতার সঙ্গে বিচার করা দরকার। তখনকার সব সরকারি নথিপত্র থেকে স্পষ্ট, সব ইউরোপীয় কোম্পানিই এ সময় তাদের কেল্লাগুলিকে সুসংহত ও দুর্ভেদ্য করে তোলার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। সপ্তদশ শতকের শেষদিকে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণার জমিদার শোভা সিং-এর বিদ্রোহের সময় বাংলার সুবাদার ইউরোপীয় কোম্পানিগুলিকে তাদের কেল্লা সুসংহত করার যে ঢালাও অনুমতি দেন, তার সুযোগ নিয়ে তারা তাদের কেল্লাগুলিকে দুর্ভেদ্য করে তুলছিল।৫৫ আবার, ১৭৪০-এর দশকে মারাঠা আক্রমণের সময় ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামে পেরিনের উদ্যানের দিকটাতে দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও অপসারণীয় সেতু তৈরি করে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের চারিদিকে গড়খাই খনন করে। এর পরেও লন্ডন থেকে কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় নির্দেশ পাঠায় (১৬ জানুয়ারি, ১৭৫২), ‘নবাবের অনুমতি নিয়ে বা অন্য কোনও উপায়ে’ ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা আরও শক্তিশালী করে তুলতে।৫৬ এর আগেও অবশ্য তারা কলকাতাকে জানিয়েছিল (১৭ জুন ১৭৪৮) যে বাংলার নবাব যদি কেল্লা সুরক্ষিত করার অনুমতি দিতে না চান তবে যেন তাঁকে সাবধান করে দেওয়া হয় যে, এর ফল দেশের এবং দেশের রাজস্বের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হবে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও যেন জানিয়ে দেওয়া হয় যে, ইংল্যান্ডের রাজা কোম্পানির হিতাকাঙক্ষী। ফলে কোম্পানি যা করবে, তিনি তা সমর্থন করবেন।৫৭ এমনকী ১৭৫৪ সালেও কোম্পানির পরিচালক সমিতি কলকাতায় লিখছে, নবাবকে বোঝাতে যে, ইংরেজদের কেল্লা সুসংহত করার মূল উদ্দেশ্য অন্য ইউরোপীয়দের হাত থেকে কোম্পানির অর্থসম্পত্তি রক্ষা করা এবং বাংলায় শান্তি বজায় রাখা।৫৮ এ থেকে স্পষ্ট, ফরাসিদের হাত থেকে ইংরেজদের রক্ষা করতে নবাবের সাধ্যে কুলোবে কি না সে-বিষয়ে ইংরেজরা যথেষ্ট সন্দিহান ছিল এবং এটা সিরাজদ্দৌল্লার শ্লাঘায় আঘাত করেছিল।

প্রকৃতপক্ষে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করার জন্য বেশ সচেষ্ট ছিল। ১৭৫৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ড্রেক ও ম্যানিংহাম (Manningham) কলকাতা থেকে লন্ডনে যে চিঠি লেখেন তা থেকে এটা পরিষ্কার:৫৯

কর্নেল স্কটের [Colonel Scott] মৃত্যুতে [কলকাতার কেল্লাকে দুর্ভেদ্য করার] তাঁর যে পরিকল্পনা (দেশীয় [নবাবের] আক্রমণ থেকে আমাদের বসতিকে রক্ষা করার জন্য) তা যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাতে যে পরিমাণ খরচ হবে তা করতে আমরা দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কিন্তু আপনারা তা অনুমোদন করার ফলে এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তা করার চেষ্টা করব। তবে আবহাওয়া কেমন থাকে তার ওপর কাজের অগ্রগতি কিছুটা নির্ভর করবে। এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, নবাবি সরকারের মনোভাব যদিও বেশ কঠিন, এখনও পর্যন্ত আমাদের কাজে বাধা দিতে তারা কোনও চেষ্টা করেনি।

বলা বাহুল্য, লন্ডনের পরিচালক সমিতি কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করার জন্য স্কটের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিল।

এদিকে ড্রেক ও ম্যানিংহাম ওয়াটসের অভিমত চাইলেন, কর্নেল স্কটের পরিকল্পনা রূপায়ণ করতে নবাবের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি না এবং না-নিলে কোনও ঝামেলা হতে পারে কি না তা জানতে। তার উত্তরে ওয়াটস জানালেন: ‘কলকাতার কেল্লা সুরক্ষিত করার ব্যাপারে আগে থেকে নবাবের অনুমতি চাওয়া একেবারেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। কারণ নবাব যদি অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন, তা হলে আমাদের পুরো পরিকল্পনাই বাতিল করতে হবে। নয়তো নবাবকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে আমাদের এগোতে হবে।’৬০ বাংলার নবাবের কর্তৃত্বকে ইংরেজরা এ সময় কী রকম তাচ্ছিল্য এবং অবজ্ঞা করতে শুরু করে, ওয়াটসের এই বিধি তার নিদর্শন। ওয়াটস আরও লিখেছেন: ‘নবাব আলিবর্দির হয়তো চোখেই পড়বে না যে আমরা কলকাতার কেল্লা সুদৃঢ় করে তুলছি। সুতরাং নবাবের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। কাজটা তাড়াতাড়ি শুরু করে দেওয়াই উচিত।’৬১ গভর্নর ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের অনুমতির তোয়াক্কা না করেই কলকাতার কেল্লা আরও দুর্ভেদ্য ও শক্তিশালী করে তোলার কাজ শুরু করে দিল।

অধুনা কোনও কোনও ঐতিহাসিকের বক্তব্য, ইংরেজরা ফরাসিদের আক্রমণের ভয়েই কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬২ কিন্তু লন্ডনের পরিচালক সমিতিকে লেখা ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলের চিঠি এ-বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করে। কাউন্সিল লন্ডনে পরিষ্কার লেখে যে, ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লা শক্তিশালী করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের’ (অবশ্যই নবাব) বিরুদ্ধে কাজে লাগাবার জন্য।৬৩ এর আগেই আমরা দেখেছি, ড্রেক এবং ম্যানিংহামও লন্ডনে লিখেছিলেন যে দুর্গকে দুর্ভেদ্য করা হচ্ছে ‘দেশীয় শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করতে।’ এ-সব তথ্য থেকে সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে ইংরেজরা বাংলার নবাবের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করে এবং তাঁর অনুমতি না নিয়েই ফোর্ট উইলিয়ামের কেল্লা দুর্ভেদ্য করে তুলছিল মূলত বাংলার নবাবের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। দক্ষিণ ভারতে ইংরেজ ও ফরাসিদের কাণ্ডকারখানা দেখে এবং বাংলার মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা মনে রেখে সিরাজদ্দৌল্লা স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজদের এ-প্রচেষ্টায় আশঙ্কিত হয়েছিলেন। এ-বিষয়ে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ:৬৪

নবাব সুবাদার তাঁর রাজ্যে ইউরোপীয়দের স্বাধীন ক্ষমতা দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। এদের মধ্যে ইংরেজরা সবচেয়ে শক্তিশালী বলে তারাই তাঁর ন্যায়সঙ্গত নীতির [just policy] প্রধান লক্ষ্য হয়ে পড়ে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ইংরেজরা যদি জাফর খানের [মুর্শিদকুলি খান] সময় তারা যে-ভাবে বাংলায় ব্যবসাবাণিজ্য করত সে অবস্থায় ফিরে না যায়, তা হলে তিনি তাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে ছাড়বেন। এটা স্পষ্ট যে সিরাজদৌল্লার প্রধান ও আসল উদ্দেশ্য ছিল [কলকাতার] কেল্লা ও যুদ্ধসরঞ্জাম ধ্বংস করা।

এখানে বলা প্রয়োজন যে, ইংরেজদের প্রতি কোনও বিরূপ বা শত্রুতামূলক মনোভাবের জন্য তাদের দুর্গ শক্তিশালী করাতে নবাব আপত্তি জানাননি। সিরাজদ্দৌল্লা সব ইউরোপীয়দেরই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। জাঁ ল’-র লেখা থেকে জানা যায় যে, নবাব একই সময় ইংরেজ এবং ফরাসি দু’পক্ষকেই আলিবর্দির রাজত্বের শেষ দিক থেকে তাদের দুর্গগুলি সুরক্ষিত করার জন্য যে-সব নির্মাণকার্য করেছিল সব ভেঙে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি ল’-কে চিঠি লিখে জানান যে, তিনি দুর্গের সংস্কারে আপত্তি করছেন না, করছেন নতুন নির্মাণকার্যে। ফরাসিরা বিনীতভাবে নবাবকে জানায় যে তারা দুর্গে নতুন কিছু করেনি—ফলে ব্যাপারটা সহজেই মিটে গেছল।৬৫ কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি, ইংরেজদের মনোভাব ছিল আক্রমণাত্মক ও অবজ্ঞাপূর্ণ। এমনকী হিল সাহেবও স্বীকার করেছেন, ইংরেজরা তাদের দুর্গ সুরক্ষিত করার প্রশ্নে তাদের ‘অধিকারের সীমা অতিক্রম’ করেছিল এবং নবাবের ‘অনুমতি না নিয়েই’ বে-আইনিভাবে কলকাতার কেল্লা সুসংহত করেছিল।৬৬ সুতরাং দেখা যাচ্ছে এ-ব্যাপারে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ সম্পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত, এটাকে ইংরেজদের আক্রমণ করার জন্য তাঁর মিথ্যা ওজর বলে নস্যাৎ করা যায় না।

দস্তকের অপব্যবহার

দস্তকের অপব্যবহার সম্বন্ধেও সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ মোটেই ভিত্তিহীন নয়। ইংরেজ কোম্পানির নথিপত্রেই অসংখ্য প্রমাণ আছে যে কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহার করছিল। এই দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্রের সাহায্যে কোম্পানির কর্মচারীরা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের (private trade) ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিত না, এমনকী তারা এ-দস্তক এশীয় বণিকদের কাছে বিক্রি করত। ফলে এশীয় বণিকরাও ওই দস্তক দেখিয়ে তাদের পণ্যের জন্যও কোনও শুল্ক দিত না এবং তাতে রাজ্যের যথেষ্ট আর্থিক ক্ষতি হত। কারণ এতে করে বাণিজ্য শুল্ক বাবদ ন্যায্যপ্রাপ্য রাজস্ব থেকে রাজ্য বঞ্চিত হত। কোম্পানির কর্মচারীরা অবশ্য দাবি করত যে, ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়র যে ফরমান বা আদেশপত্র ইংরেজ কোম্পানিকে দিয়েছিলেন তা শুধু কোম্পানির আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য নয়, কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকেও শুল্কমুক্ত করে দিয়েছিল। এই দাবি কিন্তু একেবারেই অযৌক্তিক এবং অসঙ্গত। যে-উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষিতে ওই ফরমান দেওয়া হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে অনেকদিন আগেই আমরা দেখিয়েছি যে, ১৭১৭-এর ফরমান শুধু কোম্পানির আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকেই শুল্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল, কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যকে নয়।৬৭

ফলে মুর্শিদকুলির সময় থেকেই এ নিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের সঙ্গে বাংলার শাসকদের প্রায়ই বিবাদ-বিসংবাদ লেগে থাকত। কখনও কখনও ওই বিবাদের সুযোগ নিয়ে বাংলার নবাবের আদেশে কোম্পানির বেচাকেনা একদম বন্ধ করে দেওয়া হত। বিরোধ যখন চরমে উঠত তখন বেগতিক দেখে কোম্পানি নবাব ও তাঁর অমাত্যদের মোটা নজরানা দিয়ে মীমাংসা করে নিত। কখনও বা ইংরেজরা পালটা ব্যবস্থা হিসেবে হুগলি নদীতে এশীয়দের বাণিজ্যতরী আটকে দিত। আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখেছেন: ‘কোম্পানির দস্তকের অপব্যবহার নবাবের হাতে ন্যায্য হাতিয়ার তুলে দিয়েছিল যাতে নবাব ইচ্ছে করলে কোম্পানির বেচাকেনা বন্ধ করে দিতে পারতেন।’ ওই লেখক আরও বলেছেন: ‘দস্তকের যথেচ্ছ অপব্যবহারের ফলে কোম্পানির কাছ থেকে নবাব মোটা টাকা আদায় করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এভাবে টাকা আদায় করাটা নবাবের পক্ষে বেশি বাড়াবাড়ি বলে গণ্য করা যায় না।’৬৮ দস্তকের অন্যায় অপব্যবহারের প্রশ্ন আগের নবাবরাও তুলেছিলেন, সিরাজদ্দৌল্লা প্রথম নন। তবে তিনি এই অবৈধ ও বে-আইনি ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। তাই হয়তো কোম্পানির কর্মচারীরা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল যে এটার মাধ্যমে তাদের রাতারাতি বড়লোক হওয়ার সবচেয়ে সহজ ও লোভনীয় উপায়টি এবার বন্ধ হয়ে যাবে।

কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহারকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে আমাদের অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক লিখছেন ‘কী লজ্জাকর বেশ্যাবৃত্তিই না চলছে দস্তক নিয়ে।’ তিনি আরও জানাচ্ছেন, দরবারের গুপ্তচরেরা ‘দস্তক নিয়ে এই বেশ্যাবৃত্তির’ খবর রোজ দরবারে পৌঁছে দিত।৬৯ এখানে মনে রাখা দরকার, সিরাজদ্দৌল্লা কিন্তু একেবারে মৌলিক প্রশ্ন যেটা, সেটা তখনও তোলেননি। কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের ভাঁওতা দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ব্যাপারে যে শুল্ক ফাঁকি দিত সেটা জেনেও সিরাজদ্দৌল্লা সে-অবৈধ অধিকারকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তিনি প্রধানত কোম্পানির কর্মচারীরা মোটা টাকার বিনিময়ে দস্তকের মাধ্যমে এশীয় ব্যবসায়ীদের যে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিত তাতেই বিশেষ আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং এভাবে নবাব সরকারের যে রাজস্ব হানি হচ্ছিল তা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের পাণ্ডুলিপির অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখক জানাচ্ছেন: ৭০

সিরাজদ্দৌল্লা ঘোষণা করেছিলেন, তাঁর কাছে যে সমস্ত রসিদ আছে তা থেকে তিনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, ইংরেজরা ফারুখশিয়রের ফরমান পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে কোম্পানির দস্তকের মাধ্যমে শুল্ক মুক্ত করে দিয়ে বাংলার নবাবকে তাঁর ন্যায্যপ্রাপ্ত দেড় কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করেছে।

বাংলায় প্রশীয় কোম্পানির অধিকর্তা জন ইয়াং ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব এবং দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অসন্তোষ ও ক্ষোভের কারণ জানাতে গিয়ে গভর্নর ড্রেককে লিখেছিলেন: ‘এদেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যকে শুল্কমুক্ত করার জন্য আপনাদের দস্তকের যে যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়মিত বেশ্যাবৃত্তির পর্যায়ে পড়ে। এতে নবাবের যথেষ্ট রাজস্ব হানি হচ্ছে এবং এটা তাঁর সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলেই তিনি আপনাদের প্রতি বিরূপ হয়েছেন।’৭১ এমনকী হিল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে:৭২

ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য যে-সব সুযোগ সুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তার অপব্যবহার সম্বন্ধে এটা স্বীকার করতে হবে যে ইংরেজরা দস্তক বা বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অনুমতিপত্র যেভাবে ব্যবহার করেছে, তা ফরমানে কখনওই বলা হয়নি। এই ফরমান শুধু কোম্পানিকেই শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার সুবিধে দিয়েছিল কিন্তু ইংরেজরা এই দস্তক দিয়ে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য শুধু নয়, দেশীয় ব্যবসায়ীদের বাণিজ্যও শুল্কমুক্ত করে দিত।

ওপরের তথ্যপ্রমাণ ও বিশ্লেষণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, দস্তক নিয়ে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগ যথার্থ, একে মিথ্যা অজুহাত বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নবাবের অপরাধী প্রজাদের আশ্রয়দান

নবাবের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে নবাবেরই প্রজাদের, যারা অপরাধী হিসেবে নবাবের বিচারসাপেক্ষ, কলকাতায় আশ্রয় দিয়ে নবাবকে অগ্রাহ্য করার প্রকৃষ্ট নমুনা কৃষ্ণদাসের ঘটনা। নবাব আলিবর্দিও এরকম অবৈধ ও বেআইনি আশ্রয়দানের জন্য কয়েকবার জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।৭৩ আমরা আগেই দেখিয়েছি, আমাদের হাতে যে-সব তথ্যপ্রমাণ আছে তা থেকে যথেষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দানের পেছনে ইংরেজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল এবং মসনদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজ ন্যায়সঙ্গতভাবেই কৃষ্ণদাসকে তাঁর হাতে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছিলেন। আমরা আগেই দেখেছি কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভের বিরুদ্ধে ঢাকায় সরকারি তহবিল তছরুপের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে-সব হিসেবপত্র যখন পরীক্ষা করা হচ্ছিল, রাজবল্লভ তখন ওয়াটসকে অনুরোধ জানান কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় দেবার জন্য। কাশিমবাজার থেকে ওয়াটসই গভর্নর ড্রেকের কাছে কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয়দানের সুপারিশ করেছিলেন। ওয়াটসের ধারণা ছিল, ঘসেটি বেগমের দল, যার অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন কৃষ্ণদাসের পিতা রাজবল্লভ, মসনদ দখলের লড়াইয়ে নিশ্চিত সাফল্যলাভ করবে। ওয়াটস লেখেন যে রাজবল্লভকে ইংরেজদের কাজে লাগে এবং ভবিষ্যতে আরও বেশি লাগতে পারে।৭৪ কিন্তু আলিবর্দির মৃত্যুর ঠিক আগে ওয়াটস বুঝতে পারেন যে সিরাজের উত্তরাধিকার সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নেই। তখন তিনি ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে জানিয়ে দিলেন যে কৃষ্ণদাসকে এ-অবস্থায় কলকাতায় রাখা মোটেই সমীচীন হবে না।৭৫ ড্রেক কিন্তু তাতে কর্ণপাতও করলেন না, যদিও কাউন্সিলের দুই সদস্য হলওয়েল ও ম্যানিংহাম অভিমত দিয়েছিলেন যে, এ-অবস্থায় কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় রাখা ঠিক নয়। কারণ তা হলে নতুন নবাব সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক বিঘ্নিত হতে পারে।৭৬ অবশ্য হলওয়েল যথারীতি কদিন পরেই মত পালটে ছিলেন কেননা তখন বাজারে গুজব যে, ঘসেটি বেগমের দল হয়তো জিততেও পারে। তাই হলওয়েল লিখেছেন: ‘কৃষ্ণদাসকে এ সময় কলকাতা থেকে বার করে দেওয়া কোম্পানির স্বার্থের দিক থেকে ক্ষতিকারক হতে পারে।’৭৭ যা হোক, এটা সুস্পষ্ট যে কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দিয়ে ইংরেজরা শুধু নবাবের কর্তৃত্বকেই অমান্য ও অবজ্ঞা করেনি, সিরাজের যে-বিরোধী দল তার সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছিল। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, নবাবের অপরাধী প্রজাদের অন্যায়ভাবে কলকাতায় আশ্রয়দানের জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার যে-অভিযোগ, তা খুবই ন্যায়সঙ্গত।

তা হলে দেখা যাচ্ছে যে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার অভিযোগগুলি খুবই সঙ্গত। একটিও তাদের আক্রমণ করার জন্য নবাবের মিথ্যা ওজর নয়। এ সময় বাংলায় উপস্থিত একজন ইংরেজ নাবিক, ডেভিড রেনি (David Rannie), জানাচ্ছেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাবের তিনটে অভিযোগই ‘অত্যন্ত খাঁটি’ (strictly true)।৭৮ এমনকী হিলও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে নবাবের ‘মিথ্যা ওজরগুলোর’ মধ্যে ‘কিছুটা সত্য’ ছিল।৭৯ তবে সিরাজদ্দৌল্লার ঘাড়ে দোষ চাপাবার জন্য তিনি সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘যেখানে ইংরেজদের মতো রাজ্যের পক্ষে হিতকারী জাতির সঙ্গে তাঁর মাতামহ নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন, সেখানে সিরাজদ্দৌল্লার মূর্খামি হয়েছিল যে তিনি তাদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করেছিলেন।’৮০

সিরাজদ্দৌল্লা যা করেছিলেন তাকে কোনওভাবেই মূর্খামির দ্যোতক বলা যায় না। বাদশাহি ফরমানে ইংরেজদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছিল, তা সিরাজ কখনওই বাতিল করতে চাননি৷ ইংরেজরাই বরং ফরমানের শর্তাবলীর অপব্যবহার করছিল। সিরাজ শুধু চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা ফরমানের শর্তাবলী মেনে ব্যবসা-বাণিজ্য করে। তা ছাড়া এটাও ঠিক নয় যে আলিবর্দি ইংরেজদের প্রতি নরম মনোভাব দেখিয়েছিলেন। ইংরেজদের আক্রমণ করা বা তাদের কুঠি দখল করা তাঁর কখনও প্রয়োজন হয়নি কারণ তারা তার আগেই তাঁর মতো শক্তিশালী নবাবের কথা বা নির্দেশ মাথা পেতে নিত, অগ্রাহ্য করতে সাহস করত না। সিরাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম দাঁড়িয়ে যায়— ইংরেজরা তখন দরবারের রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েছে, এমনকী সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে মদত দিতেও শুরু করেছে, যা আলিবর্দির সময় করতে তারা সাহস করত না।

সিরাজদ্দৌল্লার অভিপ্রায়: গভর্নর ড্রেকের মনোভাব

সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে অভিযোগ—বাংলা থেকে তিনি ইংরেজদের তাড়াতে চেয়েছিলেন। হিল হয়তো এটাকেই সিরাজের মূর্খামির চূড়ান্ত ভেবেছেন। এ-ধারণা ঐতিহাসিক মহলে এতদিন ধরে চলে এসেছে এবং এতই স্বতঃসিদ্ধ বলে গৃহীত যে অধুনা প্রকাশিত গ্রন্থেও বলা হচ্ছে যে, সিরাজদ্দৌল্লা ‘বাংলা থেকে ইংরেজদের বহিষ্কার করতে চেয়েছিলেন।’৮১ কিন্তু তখনকার তথ্যপ্রমাণ থেকে এ-অভিযোগ ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করা অসুবিধে হবে না। খোজা ওয়াজিদকে লেখা চিঠিতে (২৮ মে ১৭৫৬) সিরাজ ইংরেজদের সম্বন্ধে তাঁর অভিপ্রায় পরিষ্কার করে জানিয়েছিলেন:৮২

ইংরেজরা আমার রাজ্যে থাকতে চাইলে তাদের দুর্গগুলি ভেঙে ফেলতে হবে, পরিখা ভরাট করে দিতে হবে এবং জাফর খানের (মুর্শিদকুলি খান] আমলে যে-শর্তে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে সেই শর্তেই তাদের এখন তা করতে হবে। তা না হলে আমার রাজ্য থেকে তাদের বহিষ্কার করা হবে। তারা যেন মনে রাখে আমিই এ রাজ্যের নবাব। ইংরেজরা যাতে পূর্বোক্ত শর্তগুলি মেনে চলে, সে ব্যবস্থা করতে আমি বদ্ধপরিকর।

এর ক’দিন পরে ওয়াজিদকে লেখা দ্বিতীয় চিঠিতে (১ জুন, ১৭৫৬) সিরাজ আরও জানাচ্ছেন: ‘ইংরেজরা যদি তাদের উপরোক্ত আচরণগুলি সংশোধন করবে বলে কথা দেয়, তা হলে আমি তাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দেব এবং তাদের আমার রাজ্যে থাকতে দেব।’৮৩ এ চিঠিগুলি থেকে এটা স্পষ্ট যে সিরাজদ্দৌল্লা আসলে চেয়েছিলেন, ইংরেজরা যাতে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য কাজকর্ম ১৭১৭ সালের ফরমানের শর্তগুলি মেনে করে এবং ওই ফরমানে তাদের যে সুযোগসুবিধে দেওয়া হয়েছে তার যেন যথেচ্ছ অপব্যবহার তারা না করে। তিনি যে ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাননি সেটা ফোর্ট সেন্ট জর্জের (Fort St. George—মাদ্রাজ) গভর্নর পিগটকে (Pigot) লেখা তাঁর চিঠিতে সুস্পষ্ট: ‘সুবা বাংলায় ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়া বা এখান থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়া মোটেই আমার অভিপ্রায় নয়।’৮৪ অজ্ঞাতনামা ইংরেজ লেখকও বলছেন: ‘ইংরেজরা যদি জাফর খানের আমলে যে-শর্তে বাণিজ্য করত সে-শর্তেই যদি আবার তা করতে রাজি না হয়, তা হলে সিরাজদ্দৌল্লা বাংলায় তাদের ক্ষমতা হ্রাস করতে এবং বাংলা থেকে তাদের বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন।’৮৫ তবে এটা ঠিকই অল্প বয়সের ক্ষমতার দম্ভে ও অভিজ্ঞতার অভাবে তিনি বাংলা থেকে ইংরেজদের তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। এটা অবশ্য মনে হয় নেহাতই ইংরেজদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য যাতে তারা তাঁর সঙ্গে মিটমাট করে নেয়।

নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের যে-সংঘর্ষ এবং নবাবের কলকাতা আক্রমণের আগের যে-ঘটনাবলী তা বিশ্লেষণ করে এ সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ইংরেজদের, বিশেষ করে গভর্নর ড্রেকের, কঠোর ও অনমনীয় মনোভাব এ-সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। কোম্পানির কর্মচারীদের লেখা থেকেই আমাদের বক্তব্যের প্রচুর সমর্থন পাওয়া যাবে। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধার তিন দিন আগে পর্যন্ত সিরাজদ্দৌল্লা কূটনৈতিক দৌত্যের মাধ্যমে একটা আপস-মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। নারায়ণ সিং ও খোজা ওয়াজিদের দৌত্য নিষ্ফল হল মূলত ড্রেকের ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের জন্য। লন্ডনের পরিচালক সমিতি, মাদ্রাজের ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিল ও ফলতাতে ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে ওয়াটস ও কোলেট বার বার জোর দিয়েছেন যে, ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল নবাবের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও আগ্রহই দেখায়নি।৮৬ কাশিমবাজার থেকে কলকাতা অভিযানের পথে ওয়াটস ও কোলেট এক গোপন পত্রে দুর্লভরামের সঙ্গে মিটমাটের আলোচনার বিবরণ দিয়ে ড্রেককে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়াটস লিখেছেন: ‘ড্রেক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিল তাতে কোনও সাড়াই দেয়নি,নবাবের সঙ্গে কোনও মীমাংসায় যেতে তারা [ড্রেক ও কাউন্সিল] একেবারেই নারাজ।’৮৭ জাঁ ল’-র অবশ্য বিশ্বাস যে, ইংরেজরা ভেবেছিল একটু শক্ত ও কঠোর মনোভাব দেখালে নবাব ভয় পেয়ে মুর্শিদাবাদ পালিয়ে যাবেন।৮৮ এটাও হয়তো সম্ভব যে ড্রেক ভেবেছিলেন নবাবের অভিযোগগুলি ইংরেজদের বাংলা থেকে বিতাড়নের এবং তাদের ধনসম্পত্তি দখল করার জন্য নবাবের মিথ্যে অজুহাত। তাই হয়তো ড্রেক সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে নবাবকে কাবু করতে চেয়েছিলেন।

ওয়াটস, কোলেট ও বেটসন (Batson) আবার ৩১ মে ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লিখলেন নবাবকে ‘আপসের সুরে’ একটা চিঠি দিতে।৮৯ ড্রেক সেটাও অগ্রাহ্য করলেন। এদিকে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদের কলকাতার এজেন্ট শিববাবুর আপসচেষ্টা ড্রেকের আগ্রহের অভাবে ব্যর্থ হল। কাশিমবাজার কুঠির অবরোধ ও ইংরেজদের শর্তাধীন আত্মসমর্পণে ড্রেক খুবই ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। শিববাবুকে ড্রেক নাকি বলেছিলেন—সিরাজ যত তাড়াতাড়ি কলকাতা আসে ততই ভাল, তা হলে ড্রেক সিরাজের জায়গায় অন্য কাউকে নবাব করতে পারবেন।৯০ শিববাবু দ্বিতীয়বারের (১০ জুন) প্রচেষ্টায় ড্রেককে দিয়ে সিরাজদ্দৌল্লাকে একটি চিঠি লেখাতে সক্ষম হলেন কিন্তু সে-চিঠিতে যদি সমঝোতার কোনও সুর থেকেও থাকে, তা ড্রেকই ওই একই দিনে থানা ও সুখসাগরে নবাবের দুটি ফৌজি ফাঁড়ি আক্রমণ করার আদেশ দিয়ে বানচাল করলেন।৯১ নবাবের সঙ্গে একটা চুড়ান্ত বোঝাপড়ায় ড্রেক যে দৃঢ়সংকল্প তা ওয়াটস ও কোলেটের (তাঁরা তখনও নবাবের ফৌজের সঙ্গে কলকাতার পথে) চিঠির (১২ জুন) তিনি যে উত্তর দিচ্ছেন তা থেকে সুস্পষ্ট: ‘কাশিমবাজারে কোম্পানির যে-অবমাননা হয়েছে, তারপরে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে কোনও সমঝোতায় আসতে একেবারে নারাজ।’৯২ দু’পক্ষের মধ্যে আপস-মীমাংসার শেষ চেষ্টা করেছিলেন ফরাসি কোম্পানির প্রাক্তন কর্মচারী ও তখন নবাবের গোলন্দাজ বাহিনীর অধিনায়ক মার্কুইস দ্য সাঁ জাঁক (Marquis de St. Jacques) ১৩ জুন (নবাবের অজ্ঞাতে নিশ্চয়ই নয়, তার মানে নবাব তখনও পর্যন্ত একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় আগ্রহী ছিলেন)। এর উত্তরে ড্রেক সাঁ জাঁককে জানিয়েছিলেন, তিনি যেন নবাবকে ছেড়ে ইংরেজদের দিকে চলে আসেন।৯৩ সুতরাং ওপরের আলোচনা থেকে এ সিদ্ধান্ত করা ভুল হবে না যে, গভর্নর ড্রেকের মারমুখো ও অনমনীয় মনোভাব ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের ১৬ জুনের সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এ-প্রসঙ্গে কোম্পানির কর্মচারী রিচার্ড বেচারের মন্তব্য বিশেষ প্রণিধানযোগ্য:৯৪

এ কথা কি কখনও কল্পনা করা যায় যে, কোনও রাজার [দোষী] প্রজাকে একদল বিদেশি বণিক আশ্রয় দেবে?…কিংবা তাঁর দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে রাজা সেই অপমান নির্বিবাদে মেনে নেবেন?…দূতকে (অপমান করে] তাড়িয়ে দেওয়াটা সারা পৃথিবীতেই রাজার অপমান বলে গণ্য হয়…

ডাচ কোম্পানির নথিপত্র থেকেও এটা স্পষ্ট যে, সিরাজদ্দৌল্লার সঙ্গে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজরাই বহুলাংশে দায়ী। ১৭৫৬ সালের জুন মাসের ঘটনাবলী নিয়ে জুলাই মাসে হুগলির ডাচ কুঠি থেকে এশিয়াতে তাদের প্রধান কার্যালয় ব্যাটাভিয়াতে জানানো হয় যে, ইংরেজরাই এ সংঘর্ষের জন্য মূলত দায়ী।৯৫ তা ছাড়া ড্রেক যখন সিরাজদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ডাচদের সাহায্য করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তখন বাংলায় ডাচ কোম্পানির প্রধান বিসডম (Bisdom) তা করতে অক্ষমতা জানিয়ে লেখেন যে, ইংরেজরা যখন এ-ঘটনার জন্য নিজেরাই দায়ী, তখন নবাবের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা ডাচদের পক্ষে সম্ভব নয়।৯৬

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. S.C. Hill, Bengal in 1756-57, vol. I. Introduction. p. liii.

২. P. J. Marshall, Bengal, pp. 67, 75-77, 80, 91-92; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, IHR, pp. 7,8,11,12 মার্শাল এখন (Bengal, p.77) তাঁর আগের বক্তব্য থেকে কিছুটা সরে এসেছে। আগে তিনি বলেছিলেন, ‘ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কে ধস নামে যখন সিরাজদ্দৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করলেন।’ (East Indian Fortunes,, Oxford, 1976)। বেইলি এবং রজতকান্ত রায় এখনও বলছেন, ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজদ্দৌল্লার বিরোধ আরও ‘ঘনীভূত হল যখন সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের বাংলা থেকে তাড়িয়ে তাদের ধনসম্পত্তি দখল করতে চাইলেন, Bayly, Indian Society, p. 47. Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 12; পলাশীর ষড়যন্ত্র, পৃ. ৩২।

৩. P. J. Marshall, Bengal, pp. 56, 63; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 6.

৪. Law’s Memoir, Hill, III, p. 163.

৫. Hill, I, p. XXXI; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.

৬. Hill, I, p. lii; Law’s Memoir, Hill, III, p. 161.

৭. Mss. Eur. D. 283,f. 26.

৮. লন্ডনে কোম্পানির পরিচালক সমিতিকে (Court of Directors) লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 15-16.

৯. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা উইলিয়াম ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭; Beng. Letters Recd, vol. 23, f. 386.

১০. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ম্যাথিউ কোলেটের চিঠি, ২২ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 129.

১১. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, 11. p. 162.

১২. Annex to Consults., 27 Nov. 1752, BPC, vol. 25, f. 30la.

১৩. BPC, Range 1, vol. 25, f. 251, 18 Sept. 1752.

১8. Quoted in K. K. Datta, Sirajuddaullah, p. 5.

১৫. ঐ।

১৬. Evidence of John Cooke, Orme Mss., India IV, ff. 804-5; Hill, III, p. 290.

১৭. Hill, I, pp. XXX-XXXI: Law’s Memoir, Hill, III, pp. 160-62.

১৮. ঐ, পৃ. ১৬০-১৬২।

১৯. ঐ, পৃ. ১৬৩।

২০. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 41.

২১. ডুপ্লেকে লেখা রেনল্টের চিঠি, চন্দননগর, ২৬ আগস্ট ১৭৫৬, Hill, I, p. 207.

২২. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 162-64.

২৩. Hill, III, p. 219.

২৪. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 349.

২৫. Drake’s Narrative,, 19 July 1756, Hill, I, pp. 122-23.

২৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ২০৫।

২৭. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 460.

২৮. সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি কলকাতায় পৌঁছয় ১৫ এপ্রিল ১৭৫৬, Drake’s Narrative, Hill, I, p. 125. ঢাকায় থাকাকালীন রাজবল্লভ দুই কোটি টাকার ওপর আত্মসাৎ করেছিলেন, W. W. Hunter, Statistical Account of Bengal, vol.V, p. 123. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ড্রেকের চিঠি, ১৭-২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 136-39. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ১০ আগস্ট ১৭৫৭, Hill, III, p. 348; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা উইলিয়াম ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, ff. 377-78; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ঢাকার ইংরেজ কুঠির চিঠি, ১৮ জুলাই ১৭৫৬; C. & B. Abstracts, vol. 6, f. 118; Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 239.

২৯. অন্যদিকে রিচার্ড বেচার লিখেছেন যে ‘কী কারণে’ নারায়ণ সিংকে ছদ্মবেশে কলকাতা ঢুকতে হল, তা তাঁর কিছুতে বোধগম্য হচ্ছে না। তাই তাঁর ‘দৃঢ় বিশ্বাস যে নারায়ণ সিং মোটেই ছদ্মবেশে কলকাতা ঢোকেননি।’ ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 159.

৩০. Drake’s Narrative, 19 July 1756, Hill, I, pp. 124-26; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 8-9; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, চন্দননগর, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, pp. 100-101; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol.23, f. 378.

৩১. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 379; Hill, III, p. 332.

৩২. Law’s Memoir, Hill, III, p. 165.

৩৩. হুগলির ডাচ কাউন্সিলের গোপন আলোচনা [Secret Consultations], হুগলি, ২৮ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 37.

৩8. Law’s Memoir, Hill, III, p. 165; vol. I, pp. xlviii-xlix.

৩৫. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৬, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 379, Hill, I, p. xlix-l; করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ: ৬৩; কে. কে. দত্ত, সিরাজদ্দৌল্লা, পৃ: ১৬।

৩৬. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 52.

৩৭. করম আলি, মুজাফ্‌ফরনামা, পৃ. ৬৩-৬৪। এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল সিয়রে-র লেখক গোলাম হোসেন খানের সিরাজের প্রতি বিরূপ মনোভাব। তিনি এক জায়গায় বলছেন, সিরাজ ‘কারও সঙ্গে আলোচনা করতে বা কারও পরামর্শ নিতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিলেন না’ এবং ‘কারও সঙ্গে পরামর্শ না করেই শুধুমাত্র নিজের অভিপ্রায় অনুযায়ী এই অনভিপ্রেত ও অশুভ অভিযানে [কাশিমবাজার ও কলকাতা আক্রমণ] লিপ্ত হয়ে পড়েন।’ কিন্তু পরে গোলাম হোসেন নিজের উক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলেছেন—তিনি লিখেছেন: ‘সিরাজ যাদের সঙ্গে [এ ব্যাপারে] পরামর্শ করেছিলেন, তারা সিরাজের অপছন্দ হতে পারে এমন কোনও পরামর্শ দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।’ সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৮-৮৯।

৩৮. ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা, চন্দননগর, ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, চন্দননগর, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104.

৩৯. Hill, I, pp. 62-63.

৪০. Hill, II, pp. 142-43.

৪১. কোম্পানিদের জব্দ করতে বা তাদের বেচাল দেখলে বাংলার নবাবরা অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে কোম্পানির কুঠি বা বাণিজ্য অবরোধ করে তাদের সোজা পথে আনার চেষ্টা করতেন।

৪২. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ফ্রান্সিস সাইকসের [Francis sykes] চিঠি, কাশিমবাজার, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10.

৪৩. জাঁ ল’-র তথ্য [Law’s Memoir, Hill, III, 166] অবলম্বন করে হিল জানাচ্ছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি পেছনে বাঁধা অবস্থায় তাঁকে বন্দি হিসেবে সিরাজের সামনে উপস্থিত করা হয় (Hill, I, p. lix)| অন্যদিকে উইলিয়াম টুক লিখছেন যে ওয়াটসের হাত দুটি একটা রুমাল দিয়ে মোড়া হয়েছিল, শুধুমাত্র ওয়াটসের বশ্যতা স্বীকার বোঝাবার জন্য (Tooke’s Narrative, Hill, I, p. 252)৷ এটা যদিও বলা হয় যে ওয়াটস এবং কোলেট দু’জনকেই বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তাঁরা কেউ কিন্তু এই অভিযোগ করেননি যে তাঁদের হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছিল (ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 46; কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, Hill, I, p. 10)। এখানে উল্লেখযোগ্য যে সাইকস ও কোলেট, যাঁরা দুজনেই তখন কাশিমবাজারে ছিলেন, ৪ জুন ১৭৫৬-তে লিখছেন যে নবাব কলকাতা রওনা হওয়ার সময় তাঁর সঙ্গে ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনকে সঙ্গে নিয়ে যান, কিন্তু বন্দি করে নিয়ে যান, এমন কথা লেখেননি (ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোলেটের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 9; সাইকসের চিঠি, ৪ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 10)। একটা বেশ চালু গল্প হচ্ছে যে ওয়াটস সিরাজের পা জড়িয়ে ধরে ‘আমি তোমার গোলাম’, ‘আমি তোমার গোলাম’ বলে কান্নাকাটি করেছিলেন। সেটা নেহাতই বাজারে গল্প, যার কোনও ভিত্তি নেই। এমনকী হিল পর্যন্ত এটা বিশ্বাস করেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনও কোনও কোনও ঐতিহাসিক এ গল্পের পুনরাবৃত্তি করার লোভ সামলাতে পারেন না। যেমন রজতকান্ত রায়, পলাশী, পৃ. ২৬, ২৯; ‘Colonial Penetration’, p. 10.

৪৪. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, p. 161. জোরটা আমি দিয়েছি।

৪৫. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলি ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, ৫ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 53.

৪৬. Rajat Kanta Ray, পলাশী,, পৃ. ১৫৬; C. A. Bayly, Indian Society, pp. 49-50; P, J. Marshall, Bengal, p. 76.

৪৭. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I. p. 103; কোর্টকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336.

৪৮. Hill, I, pp. 58, 60, 103, 118; III, p. 336.

৪৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 80.

৫০. ঐ, পৃ. ৮১-৮২।

৫১. Robert Orme, Military Transactions, II, p. 147.

৫২. Mss. Eur. D. 283, f. 27.

৫৩. Holwell’s Narrative, Hill, III, p. 152.

৫৪. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজদ্দৌল্লার চিঠি, ১ জুন ১৭৫৬, Hill, III, p. 152.

৫৫. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 39-40.

৫৬. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসের চিঠি, DB, vol. 3, 16 Jan. 1752.

৫৭. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, ১৭ জুন ১৭৪৮, DB, vol. 2.

৫৮. ফোর্ট উইলিয়ামকে লেখা কোর্টের চিঠি, DB, vol. 4, 29 Nov. 1754; FWIHC, vol. 1, p. 68.

৫৯. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা ড্রেক ও ম্যানিংহামের চিঠি, ৩ সেপ্টেম্বর ১৭৫৫; FWIHC, vol. 1, p. 882.

৬০. ড্রেক ও ম্যানিংহামকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, ১৫ আগস্ট ১৭৫৫, Annex to Drake and Manningham’s Letter to Court, 3 Sept. 1755, Bengal Letters Recd. vol. 23, ff. 4-5; FWIHC, vol. 1, pp. 883-85.

৬১. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755.

৬২. C. A. Bayly, Indian Society, p. 50; Rajat Kanta Ray, ‘Colonial Penetration’, p. 9.

৬৩. ড্রেক ও ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটসের চিঠি, BPC, vol. 28, 15 Aug. 1755; C. R. Wilson, Old Fort William, vol. II, p. 31.

৬৪. Mss. Eur. D. 283, f. 26. প্রায় একই রকম বক্তব্য কোর্টকে লেখা হলওয়েলের চিঠিতে, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 18.

৬৫. Law’s Memoir, Hill, III, pp. 164-65.

৬৬. Hill, I, pp. liv-ly.

৬৭. ফরমানের বিশদ বিবরণের জন্য, S. Bhattacharyya, The East India Company, pp. 28-29.

৬৮. Mss. Eur. D. 283, ff. 15,25.

৬৯. ঐ, পৃ. ১৫।

৭০. ঐ, পৃ. ২৫।

৭১. Hill, I, p. 63.

৭২. Hill, I, p. lv.

৭৩. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, pp. 38-39.

৭৪. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, pp. 4-5; রিচার্ড বেচার, লিউক স্ক্র্যাফ্‌টনের কোর্টকে চিঠি, ১৮ জুলাই ১৭৫৬, Beng. Letters Rec., vol. 23, f. 239; C & B Abstrs., vol. 6, f. 118; কোর্টকে ওয়াটসের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 378.

৭৫. Hill, III, pp. 332-33; II. Pp. 4-5.

৭৬. কোর্ট অফ ডাইরেক্টরসকে লেখা হলওয়েলের চিঠি, ৩০ নভেম্বর ১৭৫৬, Hill, II, p. 5.

৭৭. ঐ।

৭৮. Causes of Loss of Calcutta, David Rannie, Aug. 1756, Hill, III, p. 384.

৭৯. Hill, I, p. lv.

৮০. ঐ।

৮১. C. A. Bayly, Indian Society, p. 46; Rajat Kanta Ray, পলাশী, পৃ. ৩২।

৮২. খোজা ওয়াজিদকে লেখা সিরাজের চিঠি, ২৮ মে ১৭৫৬, Hill, I, p. 3.

৮৩. ঐ, পৃ. ৪।

৮৪. মাদ্রাজের গভর্নর পিগটকে লেখা সিরাজের চিঠি, ৩০ জুন ১৭৫৬, Hill, I, p. 196.

৮৫. Mss. Eur. D. 283, f. 26.

৮৬. ওয়াটস ও কোলেটের লেখা কোর্টকে বিভিন্ন সময়ের চিঠি, ৩০ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, III, p. 336; ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill I, pp. 103-04. ফোর্ট সেন্ট জর্জ কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ২ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p.47; ৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 58; ফলতায় কাউন্সিলকে লেখা চিঠি, ৮ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 60.

৮৭. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 103.

৮৮. Law’s Memoir, Hill, III, p. 169.

৮৯. ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা ওয়াটস, কোলেট ও বেটসনের চিঠি, ৩১ মে ১৭৫৬, Hill, I, p.4.

৯০. Beng. Letters Recd., vol. 23, ff. 239-40.

৯১. কোর্টকে লেখা ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৭ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, pp. 116-17.

৯২. কোর্টকে ওয়াটস ও কোলেটের চিঠি, ১৬ জুলাই ১৭৫৬, Hill, I, p. 104; Drake’s Narrative, Hill, I, pp. 140-42.

৯৩. Hill, I, pp. 142-43.

৯৪. ড্রেককে লেখা রিচার্ড বেচারের চিঠি, কলকাতা, ২২ মার্চ ১৭৫৭, Beng. Letters Recd., vol. 23, f. 460; ফোর্ট উইলিয়াম কাউন্সিলকে লেখা বেচারের চিঠি, ২৫ জানুয়ারি ১৭৫৭, Hill, II, pp. 158-60.

৯৫. ব্যাটাভিয়াতে লেখা হুগলির ডাচ কাউন্সিলের চিঠি, Hill, I, p. 54.

৯৬. ড্রেককে লেখা বিসডমের চিঠি, ১৪ জুন ১৭৫৬, VOC, 2781, ff. 16vo, 27vo, 243vo.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *