৩. ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়

ইউরোপীয় কোম্পানি ও এশীয় বণিক সম্প্রদায়

পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লবের প্রেক্ষিত সম্যক অনুধাবন করতে হলে প্রাক্-পলাশি বাংলার শিল্পবাণিজ্য, বিশেষ করে বহির্বাণিজ্যের বিস্তারিত বিশ্লেষণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি বাংলায় এশীয় বণিকদের এ সময় কী ভূমিকা তাও জানা দরকার। প্রথমটি সম্বন্ধে আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকলেও, দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এতদিন অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল, যে-কারণে ঐতিহাসিক মহলে প্রচলিত ধারণা ছিল যে, ওই সময় বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এশীয় বণিকদের ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ। কিন্তু এখন আমাদের হাতে এমন তথ্যপ্রমাণ এসেছে যা দিয়ে উক্ত বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করা অনেকটা সহজসাধ্য হবে।

প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলায় ইউরোপীয়দের উপস্থিতি এবং তাদের বাণিজ্য বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে বেশ বড় রকমের পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলে ইংরেজদের পক্ষে বাংলা বিজয় অনেক সহজসাধ্য হয়ে যায়। তাই ‘বণিকের মানদণ্ড’ কী ভাবে ‘রাজদণ্ডরূপে’ দেখা দিল তা সম্যক উপলব্ধি করতে হলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতির হিসেবনিকেশ করা প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে এ সময় বাংলায় এশীয় বণিকদের ভূমিকা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তাও বিচার করে দেখা দরকার। এভাবে প্রাক্-পলাশি যুগের বাণিজ্যের জগতে বাংলার বাণিজ্যের ভূমিকা নির্ণয় করা সম্ভব হবে।

এটা মোটামুটিভাবে এখন সবার জানা যে পঞ্চদশ শতকের শেষে ভাস্কো ডা গামা (Vasco da Gama) উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) হয়ে ইউরোপ থেকে এশিয়া/ভারতবর্ষে আসার সোজা সমুদ্রপথ আবিষ্কার করার ফলে ইউরোপ ও ভারতবর্ষের মধ্যে সোজাসুজি সমুদ্রবাণিজ্য সম্ভব হল। বলা বাহুল্য, এ-বিষয়ে পর্তুগিজরাই পথ প্রদর্শক এবং তারাই প্রথম এশিয়া/ভারতবর্ষ থেকে সোজা ইউরোপে মশলাপাতি রফতানি করতে শুরু করে। যোড়শ শতক ও সপ্তদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত এশিয়া থেকে ইউরোপে মশলাপাতি রফতানির বাণিজ্যে পতুর্গিজদেরই ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। ইউরোপে মশলার যে বিরাট বাজার এবং পতুর্গিজরা এশিয়া থেকে মশলা রফতানি করে যে বিপুল পরিমাণ মুনাফা করছিল তাতে প্রলুব্ধ হয়ে ইংরেজ ও ওলন্দাজরা (Dutch) এশিয়াতে বাণিজ্য করার জন্য কোম্পানির প্রতিষ্ঠা করে। এইভাবে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন হয় ১৬০০ সালে, ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১৬০২ সালে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুটি কোম্পানি এশীয় বাণিজ্যে পর্তুগিজদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় এবং ক্রমে ক্রমে পতুর্গিজ বাণিজ্য তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময় ইংরেজ ও ডাচরা বাংলায় কুঠি স্থাপন করে বাণিজ্য শুরু করে— ইংরেজরা হুগলিতে, ডাচরা চুঁচুড়াতে। হুগলি ছিল ষোড়শ শতকের শেষদিক থেকে অষ্টাদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলার সবচেয়ে বড় বন্দর। ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন হয় পরে। এই কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে ১৬৮০-এর দশকে। অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির মধ্যে অস্টেন্ড এবং ডেনিস কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য শুরু করে অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে কিন্তু তাদের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল খুবই নগণ্য।

একেবারে প্রথম দিকে ইংরেজ ও ডাচ কোম্পানির মূল লক্ষ্য ছিল এশিয়া থেকে মশলাপাতি সোজা ইউরোপে রফতানি করা। এই মশলাপাতির প্রধান উৎস ছিল পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের তথাকথিত মশলাদ্বীপগুলি (Spice Islands)—আজকের ইন্দোনেশিয়ার জাভা, সুমাত্রা, বোর্নিও প্রভৃতি অঞ্চল ও মালাক্কা ইত্যাদি। কোম্পানিগুলি ইউরোপ থেকে সোনা-রুপো, বিশেষ করে রুপো, নিয়ে ওই অঞ্চলে মশলা কিনতে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ভাস্কো ডা গামার আগে আমেরিকা আবিষ্কৃত হয় এবং সেখানে, বিশেষ করে, দক্ষিণ আমেরিকায় প্রচুর রুপোর খনি পাওয়া যায়। সে-সব খনি থেকে ইউরোপে তখন প্রচুর রুপো আসতে থাকে। সে রুপো নিয়ে এসে এশিয়াতে বাণিজ্য করতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির খুব সুবিধে হয়ে গেল। কোম্পানিগুলি মশলাদ্বীপে গিয়ে দেখল সেখানে সোনা-রুপোর চাহিদা তেমন নেই, সবচেয়ে বেশি চাহিদা ভারতীয় মোটা ও সস্তা কাপড়ের। ফলে তারা নজর দিল ভারতের দিকে, সোনা-রুপো দিয়ে ভারত থেকে সস্তা কাপড় কিনে সেগুলো মশলাদ্বীপে নিয়ে গিয়ে তার বিনিময়ে মশলা সংগ্রহ করার জন্য। ভারতে তাদের প্রথম নজরে এল করমণ্ডল বা মাদ্রাজ উপকূল—যেখানে সস্তা ও মোটা কাপড় যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে করমণ্ডলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ভিক্ষ ও নিরন্তর যুদ্ধবিগ্রহের ফলে সেখানে বাণিজ্য করা শুধু অসুবিধাজনক ও বিপজ্জনক হয়ে পড়ল না, অনিশ্চিতও হয়ে দাঁড়াল, কাপড়চোপড়ের দামও অনেক বেড়ে গেল। তাই করমণ্ডলের বাণিজ্য ছাড়তে তারা বাধ্য হল।

তখন কোম্পানিগুলি বাংলার দিকে নজর দিল। তারা আবিষ্কার করল, বাংলার সঙ্গে বাণিজ্য করার অনেক সুবিধে। বাংলায় অপর্যাপ্ত সস্তা ও মোটা কাপড় সংগ্রহ করা সম্ভব। এ-সব কাপড় অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক সস্তাই শুধু নয়, এগুলির মান অন্যান্য জায়গার কাপড়ের তুলনায় অনেক উৎকৃষ্টও। দ্বিতীয়ত, বাংলা কাঁচা রেশমের অফুরন্ত ভাণ্ডার। এই রেশম যেমন উন্নত মানের, তেমনি দামেও অনেক সস্তা। ইউরোপে এই রেশমের চাহিদা হবে প্রচুর, কারণ পারস্য বা চিনদেশের রেশমের তুলনায় এর দাম অনেক কম, মানও বেশ উন্নত। এতদিন পারস্য ও চিনদেশের রেশমই ইউরোপের চাহিদা মেটাত, সে-জায়গায় বাংলার রেশম খুবই ভাল বিকল্প হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলার সোরার প্রচুর চাহিদা হবে ইউরোপে কারণ সেখানে তখন গৃহযুদ্ধ ও এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। সোরা গোলাবারুদ তৈরি করার সবচেয়ে বড় উপাদান। বাংলার সোরা যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট তা শুধু নয়, দামেও বেশ সস্তা। তা ছাড়া, জাহাজের তলদেশে লোহার পরিবর্তে সোরা রেখে জাহাজকে সমুদ্রবাহী করা যাবে, কারণ তলদেশে ভারী পদার্থ রেখেই সমুদ্রে জাহাজের ভারসাম্য রক্ষা করতে হত। লোহা দিয়ে সে-কাজ করলে সেটা একেবারেই লাভজনক হত না, অথচ তার পরিবর্তে সোরা দিয়ে এ-কাজ করলে, সেই সোরা ইউরোপে বিক্রি করে বেশ ভাল মুনাফাই করা যাবে। তাই সব দিক থেকে ইউরোপে সোরা রফতানি খুব লাভজনক। এ-সব কারণে কোম্পানিগুলি বাংলায় বাণিজ্য করতে আগ্রহী হল এবং বিপুল উৎসাহে বাণিজ্য শুরু করে দিল।

তবে ১৬৭০-এর আগে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য তেমন উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ৭০-এর দশকে হঠাৎ ইউরোপে বাংলার কাঁচা রেশমের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়, যার ফলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৬৮০-এর দশকে যখন ইউরোপে এবং ইংল্যান্ডে বাংলার কাপড়ের চাহিদা হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে যায়, তখন থেকেই আসলে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। ইউরোপে বাংলার কাপড়ের হঠাৎ যে বিরাট চাহিদা দেখা যায় তার অন্যতম কারণ ওইসব দেশের মানুষের মধ্যে রুচির এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর আগে ইউরোপ বা ইংল্যান্ডে বাংলা তথা ভারতের সস্তা ও মিহি কাপড় পরার চল বিশেষ ছিল না। এ-সব কাপড় গরিব ও খুব সাধারণ লোকদের পরিধেয় ছিল, যারা দামি লিনেন বা ওখানকার অন্য ভাল কাপড় কিনতে পারত না। ভারতীয়/বাংলার কাপড় সস্তা বলে শবদেহের আচ্ছাদন হিসেবেই বিশেষ করে ব্যবহার করা হত। কিন্তু ৮০-র দশকে হঠাৎ বাংলা তথা ভারতীয় কাপড় ব্যবহার করা সমগ্র ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু অভিজাত লর্ড বা লেডিরা নয়—ঠাকুর, চাকর, ঝি, সবাই ভারতীয়/বাংলার কাপড় না পরলে ইজ্জত থাকছে না বলে ভাবতে শুরু করল। ফলে ইউরোগে ও ইংল্যান্ডে ভারতীয়, বিশেষ করে, বাংলার কাপড়ের চাহিদা অস্বাভাবিক বেড়ে গেল এবং কোম্পানিগুলিও তাই প্রচুর পরিমাণে বাংলার কাপড় ইউরোপ ও ইংল্যান্ডে রফতানি করতে শুরু করল। এইভাবে ১৬৮০-এর দশক থেকে বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত তা বজায় থাকে। এশিয়ার মধ্যে বাংলাই কোম্পানিগুলির বাণিজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা থেকে এই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অবশ্য মুখ্য অংশ নেয় ডাচ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ফরাসি কোম্পানি ১৭৩০-এর দশকে ডুপ্লের (Dupleix) অধীনে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। অন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির ভূমিকা তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। পলাশি বিপ্লবের পরে অবশ্য চিত্রটা সম্পূর্ণ পালটে যায়। ইংরেজরা বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে এনে ধীরে ধীরে অন্যান্য ইউরোপীয় এবং এশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের বাংলার বাণিজ্যজগৎ থেকে হঠিয়ে দেয় এবং সবটাই নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলে।

অবশ্য সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও অষ্টাদশ শতকের প্রথম দুই দশক পর্যন্ত বাংলা থেকে ডাচ বাণিজ্য ইংরেজ বাণিজ্যের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল। অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে ইংরেজ বাণিজ্যে অগ্রগতি হতে থাকে। ১৭৩০-এর দশকের প্রথম থেকে ওই বাণিজ্য অনেক বেড়ে যায় এবং ১৭৪০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছরে তা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছয়। কিন্তু ১৭৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে তাতে ভাটা পড়ে, বাণিজ্যের পরিমাণ কিছুটা কমে যায় তবে এই হ্রাসের পরিমাণ খুব বেশি নয়। ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ পর্যন্ত বাংলা থেকে ইংরেজ কোম্পানির রফতানি বাণিজ্যের বার্ষিক মোট গড়মূল্য ৩৫ লক্ষ টাকার মতো। ১৭৫০-এর দশকের প্রথমার্ধে ইংরেজদের বাণিজ্যে যে পরিমাণ ঘাটতি দেখা যায়, ওই সময় ডাচদের বাণিজ্যে প্রায় সমপরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। ফলে বাংলা থেকে ইউরোপীয়দের রফতানি বাণিজ্যের মোট পরিমাণে আগের তুলনায় বিশেষ তারতম্য কিছু হয়নি। ১৭৫০-এর দশকের প্রথম পাঁচ বছর ডাচদের ইউরোপে রফতানি বাণিজ্যের বার্ষিক মূল্যের গড় দাঁড়ায় ২৩ লক্ষ টাকার মতো আর ইউরোপ ও এশিয়ার অন্যত্র তাদের রফতানি মিলে বার্ষিক গড়মূল্য ছিল ৩০ লক্ষ টাকার মতো। নীচের সারণি (সারণি ১) থেকে ১৭৩০ থেকে ১৭৫৫ সালের প্রত্যেক দশকের প্রথম পাঁচ বছরের ইংরেজ ও ডাচ বাণিজ্যের তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে।

সারণি ১

১৭৩০-১৭৫৫ সালের প্রত্যেক দশকের প্রথম পাঁচ বছরে ইংরেজ ও ডাচ বাণিজ্যের

মোট পরিমাণ ও তার বার্ষিক গড় মূল্য

(টাকায়)

বছরইংরেজ বাণিজ্যডাচ বাণিজ্য 
 ইউরোপ ও এশিয়ার রফতানি গড়মূল্যইউরোপে রফতানির বার্ষিক গড়মূল্যইউরোপ ও এশিয়ায় রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য
১৭৩০/৩১—১৭৩৪/৩৫—৩৩,৮৮,৩০২১৩,৪৬,৯৭৩২৩,২৬,৩৭৮
১৭৪০/৪১—১৭৪৪/৪৫—৩৮,৪২,৮৫৬১৫,৯৩,৭০৫২৩,১৭,১৮০
১৭৫০/৫১—১৭৫৪/৫৫—৩২,৫৩,১৯০২২,৭৮,২০৪২৯,৮৬,৭৩৬

[সূত্রনির্দেশ: ডাচ কোম্পানির রফতানির পরিসংখ্যান হল্যান্ডের ‘হেগ’ শহরের রাজকীয় মহাফেজখানায় (Algemeen Rijksarchief) রক্ষিত ডাচ কোম্পানির রেকর্ডস থেকে সংগৃহীত এবং সেগুলির ওপর নির্ভর করে রফতানির পরিমাণ হিসেব করা হয়েছে। ইংরেজ কোম্পানির রফতানির পরিসংখ্যান কে. এন. চৌধুরীর ‘ট্রেইডিং ওয়ার্লড’ থেকে, এক বছর করে পেছিয়ে, নেওয়া হয়েছে। বিনিময়ের হার ৮ টাকায় এক ব্রিটিশ পাউন্ড, ১.৫ ডাচ গিল্ডারে ১ টাকা]

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এতদিন ঐতিহাসিক মহলে বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়দেরই ছিল মুখ্য ভূমিকা—তারাই বাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য রফতানি করত। কিন্তু ইদানীং আমরা সন্দেহাতীতভাবে দেখাতে পেরেছি যে এমনকী অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেও বাংলা থেকে এশীয়দের রফতানি বাণিজ্য ইউরোপীয়দের চেয়েও অনেক বেশি ছিল। বস্ত্র রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়দের রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য মোটামুটি ৯০ থেকে ১০০ লক্ষ টাকার মতো আর সেক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের মোট রফতানির পরিমাণ গড়ে বার্ষিক ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ টাকার বেশি নয়। কাঁচা রেশমের রফতানির ক্ষেত্রে এশীয়দের ভূমিকা আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ—ইউরোপীয়দের চেয়ে তারা এক্ষেত্রে অনেক বেশি এগিয়ে ছিল। ১৭৪৯ থেকে ১৭৫৩ এই পাঁচ বছর বাংলা থেকে এশীয়দের রেশম রফতানির গড় মূল্যের পরিমাণ ৫৫ লক্ষ টাকা, আর ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৮ পর্যন্ত (যখন নানা কারণে বাণিজ্য কিছুটা ব্যাহত হয়েছে) তার পরিমাণ ৪১ লক্ষ টাকা। অন্যদিকে ওই সময় (১৭৫০ থেকে ১৭৫৫) ইউরোপীয়দের মোট রেশম রফতানির বার্ষিক গড়মূল্য ১০ লক্ষ টাকারও কম। অর্থাৎ প্রাক্-পলাশি আমলে বাংলা থেকে এশীয়দের রেশম রফতানির পরিমাণ ইউরোপীয়দের সম্মিলিত রেশম রফতানির চেয়ে ৪ থেকে ৫ গুণ বেশি ছিল।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য বিষয়, সব ব্যবসায়ীদেরই তখন—সে ইউরোপীয়ই হোক বা এশীয়ই হোক—বাংলা থেকে রফতানি পণ্য সংগ্রহের জন্য বাইরে থেকে নগদ টাকা বা সোনা-রুপো নিয়ে আসতে হত। বাংলায় সোনার চাহিদা তেমন ছিল না—রুপোরই ছিল একমাত্র চাহিদা। এর মুখ্য কারণ বাজারে রৌপ্য মুদ্রারই শুধু প্রচলন ছিল। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি অবশ্য কিছু কিছু গরম ও মোটা কাপড়, কিছু ধাতব জিনিসপত্র যেমন দস্তা, লোহা, টিন, এ-সব নিয়ে আসত বাংলায় বিক্রি করার জন্য। কিন্তু তাদের পরিমাণ ও মোট মূল্য ছিল নিতান্ত সীমিত। ডাচ কোম্পানি বাংলায় যা আমদানি করত, তার শতকরা ৮৭.৫ ভাগই ছিল সোনা-রুপো বা নগদ টাকা। ইংরেজদের ক্ষেত্রে তার পরিমাণ শতকরা প্রায় ৯০ থেকে ৯৪ ভাগ। এর প্রধান কারণ বাংলা ছিল স্বনির্ভর, বাইরে থেকে মূল্যবান বিশেষ কিছু আমদানির প্রয়োজন তার ছিল না। ফলে বাংলায় বিদেশি পণ্যের বাজার ছিল অত্যন্ত সীমিত। ইউরোপে উৎপন্ন বা তৈরি কোনও পণ্যের চাহিদা বাংলায় তেমন ছিল না, ইউরোপও কোনও জিনিস বাংলায় এনে সস্তা দামে দিতে পারত না কারণ সেখানে উৎপাদনের খরচ ছিল অনেক বেশি।

কিন্তু পলাশির পরে ইউরোপ ও ইংল্যান্ড থেকে রুপো ও নগদ টাকাপয়সা আসা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে ইংরেজ কোম্পানি মাছের তেলে মাছ ভাজা শুরু করল। কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা বাংলায় বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে লাগল—বাংলার রাজস্ব, নানা উপঢৌকন, উপহার ও ঘুষ ইত্যাদির মাধ্যমে।১০ আর এই অর্থ দিয়েই ইংল্যান্ডে রফতানির জন্য বাংলায় পণ্যসংগ্রহ করতে শুরু করল। ইংল্যান্ড ও ইউরোপ থেকে আর সোনা-রুপো আনার কোনও প্রয়োজনই হল না। ফলে, এতদিন ধরে বাংলার উৎপন্ন পণ্যের বিনিময়ে বাংলায় যে অজস্র সম্পদ, সোনা-রুপো আসত, তা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। উত্তর-পলাশি যুগে ডাচ ও অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির বাংলা থেকে রফতানি বাণিজ্য অনেক কমে গেল—ইংরেজরা তাদের ও এশীয় ব্যবসায়ীদের কোণঠাসা করে রাখল। যেটুকু ইউরোপীয় বাণিজ্য তাও চলছিল, তার জন্য ইউরোপ থেকে রুপো আনার প্রয়োজন হল না। ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলায় নানাভাবে অর্জিত অর্থ দিয়েই তার জন্য কেনাকাটা চলল। আর এই কর্মচারীরা ইউরোপীয়দের তাদের দেওয়া অর্থ ইউরোপে ‘বিল অফ এক্সচেঞ্জে’ বা হুন্ডির মাধ্যমে সংগ্রহ করত এবং এভাবে এখানে বেআইনিভাবে অর্জিত অর্থ ইউরোপ/ইংল্যান্ডে পাচার করতে থাকল। এখানে স্মর্তব্য, যা আমরা আগেও বলেছি, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বাংলার রফতানি বাণিজ্যে ইউরোপীয়রা মুখ্য ভূমিকায় ছিল না—এশীয়দের রফতানি তাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। ফলে ইউরোপীয়রাই বাংলায় সবচেয়ে বেশি সোনা-রুপো বা নগদ টাকা আমদানি করেনি, করেছে এশীয়রা। কিন্তু পলাশির পরে ইংরেজদের দৌরাত্ম্যে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্য ভীষণ কমে যায়। ফলে বাংলায় তাদের আমদানি করা রুপো আর টাকাপয়সার জোয়ারেও ভাঁটা পড়ে, যার নিট ফল প্রাক্-পলাশি যুগে বাংলায় ধনসম্পদ আসার যে জোয়ার চলছিল, তা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল।১১

এশীয় বণিকরা যে বাংলায় ইউরোপীয়দের চেয়েও অনেক বেশি সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসত, তা মধ্য অষ্টাদশ শতকে বাংলায় ছিলেন এমন কয়েকজন ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীর বয়ান থেকে স্পষ্ট জানা যায়। এঁদের মধ্যে একজন উইলিয়াম বোল্টস (William Bolts)। তিনি লিখেছেন, ভারত ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনেক সওদাগর বাংলায় ব্যবসা করতে আসত এবং তারা বাংলায় পণ্য কেনার জন্য ‘শুধু টাকাপয়সা, সোনা-রুপো বা হুন্ডি’ নিয়ে আসত। তাঁর আরও গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য, ‘বাংলায় এশীয় বণিকদের মাধ্যমে যে-পরিমাণ সোনা-রুপো ও টাকাপয়সা আসত, তা ইউরোপ থেকে বা পারস্য ও আরব উপসাগরের সমুদ্রপথে আসা সোনা-রুপো ও নগদ টাকার চেয়ে অনেক বেশি ছিল।১২ আরেকজন ইংরেজ কর্মচারী হ্যারি ভেরেলস্ট (Harry Verelst) জানাচ্ছেন, ‘বাংলার পণ্যের বিনিময়ে বাংলায় আসত সোনা-রুপো এবং এভাবে যত বেশি পণ্য বাংলা থেকে রফতানি হত, তত পরিমাণ ধনসম্পদই প্রত্যেক বছর বাংলায় আসত।১৩ অন্য এক কর্মচারী লিউক স্ক্র্যাফ্‌টন বলছেন, ‘এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিকরা শুধু নগদ টাকাকড়ি ও সোনা-রুপো দিয়ে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনতে আসত।’১৪ এ-সব বৃত্তান্ত থেকে এটা স্পষ্ট যে মধ্য অষ্টাদশ শতকেও এশীয় বণিকরা বাংলায় সোনা-রুপো ও টাকাকড়ি আমদানিতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল, ইউরোপীয়রা নয়। এবং সবাইকেই বাংলা থেকে রফতানি পণ্য কেনার জন্য বাইরে থেকে সোনা-রুপো ও নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত।১৫

.

সূত্রনির্দেশ ও টীকা

১. বাংলায় ইউরোপীয় বাণিজ্যের বিস্তৃত বিবরণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 27-46.

২. হুগলি বন্দরের উত্থান ও আধিপত্য, S. Chaudhury, ‘The Rise and Decline of Hughli’, Bengal Past & Present, Jan-June, 1967, pp. 33-67.

৩. বিস্তারিত বিবরণের জন্য S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 28.

৪. S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization in Bengal, pp. 196-97.

৫. Kristof Glamann, Dutch Asiatic Trade, p. 144.

৬. যেমন, Om Prakash, The Dutch East India Company and the Economy of Bengal; P. J. Marshall, Bengal: the British Bridgehead; K. N. Chaudhuri, The Trading World of Asia and the English East India Company. ইত্যাদি।

৭. যে-সব তথ্যের ভিত্তিতে এ পরিসংখ্যান, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণের জন্য, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 202-13, 249-58.

৮. ঐ।

৯. Om Prakash, Dutch East India Company; S. Chaudhury, From Prosperity to Decline.

১০. এই বইয়ের দশম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

১১. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline,, pp. 30-31.

১২. William Bolts, Considerations on Indian Affairs, p. 200.

১৩. Harry Verelst to Court of Directors, 2 April 1769, BPC, Vol. 24. f. 324.

১৪. Luke Scrafton, Reflections, p. 20.

১৫. আমার একটি প্রবন্ধের ‘European Companies and Bengal’s Textile Industry in the Eighteenth Century: The Pitfalls of Applying Quantitative Techniques’, Modern Asian Studies, 27, 2 (May 1993, 321-40), বক্তব্যের উত্তরে ওম প্রকাশ বলছেন ‘On Estimating the Employment Implications of European Trade for Eighteenth Century Bengal Textile Industry—A Reply, (Modern Asian Studies) পূর্বোক্ত সংখ্যা, পৃ. ৪১-৪৬) এশীয় বণিকরা অন্যান্য অঞ্চল থেকে, বিশেষ করে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও সিংহল থেকে, বাংলায় নানারকম পণ্য নিয়ে আসত এবং সেগুলি বিক্রি করে বাংলায় রফতানি পণ্য কিনত। তাই তাদের বাইরে থেকে সোনা-রুপো বা নগদ টাকাপয়সা নিয়ে আসার তেমন প্রয়োজন হত না। এ-বক্তব্য কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। এশীয় বণিকরা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বিশেষ করে ৮০ ও ৯০’-এর দশকে, ওই সব অঞ্চল থেকে কিছু কিছু পণ্য বাংলায় নিয়ে আসত সন্দেহ নেই কিন্তু তার পরিমাণ ও মোট মূল্য বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের যে বিপুল পরিমাণ রফতানি তার তুলনায় নিতান্তই নগণ্য ছিল। দ্বিতীয়ত, অষ্টদশ শতকের প্রথমার্ধে এশীয় বণিকদের সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণ অনেক কমে যায় কারণ বাংলা থেকে সমুদ্রবাণিজ্য এখন দিক পরিবর্তন করে পূর্বমুখী থেকে পশ্চিমমুখী হয়ে যায় এবং এই নতুন দিকের বাণিজ্যে এশীয়রা ইংরেজদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে কোনও সক্রিয় অংশ নিতে পারেনি। তা ছাড়া এই নতুন সমুদ্রবাণিজ্যের পরিমাণও তেমন উল্লেখযোগ্য ছিল না। এ-প্রসঙ্গে এটা মনে রাখা দরকার যে বাংলা থেকে এশীয় বণিকদের রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগই হত স্থলপথে এবং বাংলা থেকে এই স্থলবাণিজ্যের পণ্য ক্রয় করতে তাদের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সোনা-রুপো এবং নগদ টাকাকড়ি নিয়ে আসতে হত। এ-কথা ইউরোপীয় পর্যটক থেকে বাংলায় কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন। ডাচ কোম্পানি এশিয়ার মধ্যে তাদের বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির সঙ্গে কিছু কিছু বাণিজ্য করত ঠিকই এবং সে-সব জায়গা থেকে বাংলায় পণ্য নিয়ে আসত। সেগুলি বিক্রি করে এবং এই আন্তঃএশীয় বাণিজ্যের মুনাফা দিয়ে বাংলার রফতানি পণ্য কিনত। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতের এই বাণিজ্য অনেকটা কমে যায় ফলে তারাও আগে বাংলায় যে পরিমাণ পণ্য ওই সব অঞ্চল থেকে আনত, তা নিতান্তই নগণ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং ওই বাণিজ্যের মুনাফাও একেবারে কমে যায়। এ-সব দিক থেকে বিচার করলে ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে অসার হয়ে পড়ে। তা সত্ত্বেও আশ্চর্য যে, কোনও কোনও ঐতিহাসিক ওমপ্রকাশের বক্তব্যকে বেদবাক্য ধরে নিয়ে এবং তাঁর দেওয়া তথ্যগুলির বিচার বিবেচনা না করে আমার বক্তব্যের সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি (যেমন, লক্ষ্মী সুব্রাহ্‌মানিয়াম, Review, Indian Economic and Social History Review, July, 1997; রজতকান্ত রায়, গ্রন্থলোক, দেশ পত্রিকা, ১২ জুলাই ১৯৯৭। রজত রায়ের উত্তরে আমার বক্তব্য, দেশ পত্রিকা, নভেম্বর ১৯৯৭।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *