সেকালে পদবী ছিল না

সেকালে পদবী ছিল না

বাঙালী বৈচিত্র্যবিলাসী জাতি, সুতরাং তার নামের শেষে যুক্ত পদবীটিতেও বৈচিত্র্যের শেষ নেই। পদবীর অফুরন্ত ভাণ্ডার ইংরেজদেরও। অর্থহীন বা হাস্যকর পদবী তাদের নামগুলিকেও বিশেষত্ব দেয়। ফক্স কিংবা উলফ পরিচয় নিয়েও তারা নির্বিবাদে জন-সমাজে বিচরণ করে বেড়ায়, নিতান্তই হাস্যকর শোনালে বড়জোর শব্দটির বানানে কিঞ্চিৎ তারতম্য ঘটিয়ে নেয়। উদাহরণ: ভার্জিনিয়া উলফ। টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স নামক চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক ফক্স। কিন্তু বাংলা ভাষায় এ ধরনের নাম দেখলে অনেক নায়ক-নায়িকাই হয়তো তাঁর ধূর্ততায় আতঙ্কিত হয়ে শত হস্ত দূরে থাকতেন। অবশ্য পদবীর ক্ষেত্রে আমরাও জীবজন্তুর নামকে অপাঙক্তেয় রাখিনি। বাঙ্গালীর বাগ পদবী বাঘের বানানান্তর নয়, হলেও আপত্তি ছিল না। সিংহ বা নাগ তো দিব্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত। পাঞ্জাব-রাজস্থানের মরু অঞ্চল থেকে মধ্য ভারতের উপজাতি এলাকা হয়ে পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চল অবধি সিংহ সর্বত্রই দৃশ্যমান, যদিও গির অরণ্যের পশুরাজ প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। ইরানের রাজাও যখন অবশিষ্ট রইলেন না, তাসের রাজাই সামন্ততন্ত্রের একমাত্র স্মারকপত্র, তখন অনুমান করা যায় সিংহও অবশেষে আমাদের পদবীর অরণ্যে স্মৃতিচিহ্ন রেখে পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হবে। কিন্তু শব্দগত অর্থের জন্য নয়, পদবীর কৌলীন্য গড়ে ওঠে অতি পরিচিতির ফলে, কিংবা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ হলে। অথবা কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তি একটি পদবীকে মর্যাদা এনে দিতে পারেন। বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক বা ভারতখ্যাত দেশপ্রেমিকরা সাহা, পাল, চাকি, বল, শাসমল পদবগুলিকে কি কৌলীন্য এনে দেননি! পদবীর ক্ষেত্রে সংস্কৃত ভাষার দাপট সবচেয়ে বেশি, স্কুলপাঠ্য সংস্কৃত ভাষাকে আমরা যতই না ভয় পেয়ে থাকি। তাই সিংহ বা নাগ পদবীর রাজ্যে কুলীন, কিন্তু ঘুঘু, ঘোড়া, বোয়াল, বাঁদুড়ি পদবী সমাজে উপরতলার আসন পায়নি।

লেখার ভাষায় বা মুখের ভাষায় আমরা প্রচুর অস্ট্রিক বা দেশজ শব্দ ব্যবহার করি। মূল সংস্কৃত থেকে অপভ্রংশ ঘটিয়ে দুমড়ে মুচড়ে কত শব্দকেই তো আমরা বাংলা শব্দ বানিয়ে নিয়েছি, অথচ বাঙালীর পদবী দেখলেই অবাক হই কেন? সেগুলিও তো দেশজ শব্দ বা, সংস্কৃতেরই অপভ্রংশ। আবার যেগুলিকে সংস্কৃত বলে ভাবি, তারও অনেকগুলি আঞ্চলিক ভাষা থেকে গৃহীত। জনৈক ভাষাতাত্ত্বিকের মতে সিংহ শব্দটি ভোট-চীনী শব্দ থেকে এসে সংস্কৃতে রুপান্তরিত হয়েছে। আফরিকান কোন কোন ভাষায় সিংহের প্রতিশব্দ সিম্বা। কিন্তু আফরিকান সিম্বা কোন সুদূর অতীতে ভারতীয় সিংহ হয়ে গিয়েছিল এবং সংস্কৃত ভাষা তাকে সাদরে গ্রহণ করে সিংহাসনে বসিয়েছিল এমন অনুমান নাকি যুক্তিযুক্ত নয়, কারণ ভাষাতাত্ত্বিকের মতে সোয়াশ-দেড়শ বছর আগে ভারতীয় গুজরাতিদের কাছ থেকে কেনিয়াবাসীরা সিংহ শব্দ-টিকে গুজরাতি উচ্চারণ মারফৎ পায় এবং তা থেকেই সিম্বা শব্দের উৎপত্তি। সিংহ পদবীর প্রতি মধ্যযুগীয় ক্ষত্রিয় রাজাদের আকর্ষণ সর্বজ্ঞাত, কিন্তু বিদেশীদের সিংহপ্রীতিও কম নয়। লিও টলস্টয়রা তাকে নাম হিসেবেই ব্যবহার করেছেন। লিও থেকেই লায়ন।

জীবজন্তুর নাম থেকে পদবী সৃষ্টি হওয়ার কথায় মনে পড়ে মৌর্য সম্রাট অশোককে। ট্রাইবাল বংশোদ্ভূত এই দেবানাম পিয়দসী অশোককে বলা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বলতেও অবশ্য মৌর্য পদবী বোঝায় না। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন সম্রাট অশোক বা তাঁর গোষ্ঠীর লোকেরা নিজেদের ময়ূরজ বা ময়ূরজাত মনে করতেন অর্থাৎ ময়ূর ছিল তাঁদের টোটেম। মতান্তরে সম্রাট অশোক নাকি ময়ূরের মাংস খেতেন। সে-কারণেও মৌর্য নামকরণ হতে পারে। শিলালেখে প্রতি সম্রাট অশোকের নির্দেশ : ‘উৎসবেও প্রাণহানি বা বলিদান নিষিদ্ধ হ’ল। আমার রন্ধনাগারে আগে হাজার হাজার পশুবলি হ’ত, পরে মাত্র দুটি ময়ূর ও একটি হরিণ বলি হ’ত; এখন তাও নিষিদ্ধ হ’ল।’ মৌর্য বংশ এবং এই ময়ূর বলিদানের মধ্যে সম্ভবত কোন যোগাযোগ ছিল। এখনো ভারতের কোন কোন অঞ্চলে মৌর্য পদবীর দেখা মেলে, তবে তাদের সঙ্গে সম্রাট অশোকের কোন আত্মীয়তা প্রমাণ করা কঠিন। চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত ছিলেন না, ওটি আদৌ পদবী নয়, এবং কোন কিছু, গুপ্ত রাখার তাঁর প্রয়োজন ছিল বলেও মনে হয় না।

মেগাস্থিনিস মৌর্য সাম্রাজ্যের যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন তা থেকে জানা যায় সেকালে চতুর্বর্ণের পরিবর্তে বৃত্তিই শ্রেণী নির্ণয় করতো। তিনি সাতটি শ্রেণী বা জাতির কথা উল্লেখ করেছেন : শিক্ষক কৃষক পশুপালক কারুশিল্পী বণিক সৈনিক রাজকর্মচারী। এগুলি অনুদিত শব্দ এবং সে-কারণেই প্রচলিত জাতিনাম কি ছিল জানা যায় না।

মনুস্মৃতি পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্ত অধ্যায়ে যতই সংকরত্ব নির্ণয় করার চেষ্টা করে থাকুক, তা যে ভিত্তিহীন তার প্রমাণ ব্রাহ্মণ পিতা ও নাগ মাতার সন্তান ছিলেন আস্তিক। আবার জন্মেজয়ের প্রধান পুরোহিত সোমশ্রবাও সংকর। অথচ তাঁরা আর্য এবং ব্রাহ্মণই রয়ে গেলেন। অর্থাৎ অরণ্যচারী নাগ উপজাতির কন্যাকে বিবাহ করলেও সন্তানের ব্রাহ্মণত্ব থেকে পতন ঘটতো না। কোশাম্বি বলছেন; the pioneer brahmin rarely had any women folk with him of l:is own caste.

নাগরা যে সর্পবৎ রূপ পরিগ্রহণ করতে পারতো তার অর্থ সম্ভবত এই যে মোঙ্গলিয় ড্রাগন নাচের মত মুখোশ পরে তারা কোন উৎসবে বা ধর্মানুষ্ঠানে যোগ দিত। নাগ ছিল তাদের টোটেম, কিন্তু তারা অবশ্যই খুব উন্নত এবং প্রভাবশালী ছিল। মহাভারতে তাদের বিস্তৃত বংশ পরিচয় ও পরবর্তীকালে কৃষ্ণ শিব বিষ্ণুর উপাসকদের দ্বারা এই টোটেমকে স্বীকৃতি দানের মধ্যেই তার প্রমাণ মেলে। বৌদ্ধধর্মেও তার প্রাধান্য ছিল। রাজগৃহের মনিয়ার মঠ দ্রষ্টব্য। দেবতাদের মাথার উপর মুকুট বা ছত্রের মত সাপের ফণা শোভা পেত বলেই নাগ শব্দের ব্যঞ্জনা বদলে যায়। সিংহ শব্দের মত নাগ শব্দের অর্থ হয় রাজা বা শ্রেষ্ঠ। ধনী বণিকদেরও রাজা বলা হ’ত। সেকালীন নাগদের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের নাগা বা উত্তর ভারতের নাগা সন্ন্যাসীদের কোন যোগসূত্র নেই। নাগা সন্ন্যাসীর ‘নাগা’ আধুনিক শব্দ, নাঙ্গা শব্দের অপভ্রংশ। অর্থাৎ দিগম্বর। অনেকের মতে নাগা সম্প্রদায় থেকে এই ‘নাগা এসেছে, কিন্তু শব্দার্থ পাওয়া যায় না। নাগাল্যান্ডের ‘নাগা’ বোধহয় ভিন্ন ভাষা।

“Naga also means ‘noble in character’ according to Buddhist tradition. Inscriptions show that as late as the 11th Century A. D., it was an honour for Kings to claim Naga descent.”

নাগ পদবী কিন্তু এসেছে নামের শেষাংশ থেকে, ঐ টোটেমের সঙ্গে তাঁদের কোন সম্পর্ক নেই।

টোটেমকে অনার্য বা বর্বরোচিত মনে করা আমাদের আর্য আত্মম্ভরিতা থেকে সৃষ্ট। কিন্তু আর্যরাও টোটেম-মুক্ত ছিল না। জীবজন্তু বৃক্ষলতা, ফলমূল, বিবিধ খাদ্যও গোষ্ঠীবিশেষের কাছে টোটেম। আবার এগুলি একদিক থেকে প্রকৃতির অঙ্গ। প্রকৃতি বলতে শুধু, মিত্র বরুণ বা সূর্য চন্দ্র বোঝায় না, আবার সোমলতা বা অশ্বীদ্বয় এক অর্থে টোটেম। নাগ মূলতঃ টোটেম, কিন্তু পদবীর উদ্ভব তা থেকে নয়, রাজা বা শ্রেষ্ঠ অর্থে। যাই হোক, টোটেমের স্মৃতি কোন না কোনভাবে সর্বদেশেই রয়ে গেছে। রোমের বনেদী নাম পোর্সিয়া, এসিনিয়া ইত্যাদি। মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে পোর্সিয়া আমাদের যতই মুগ্ধ করুক, তার বুদ্ধিমত্তায় (শাইলককে এ পাউণ্ড অব ফ্লেশ রক্তপাত না ঘটিয়ে গ্রহণ করতে বলে) ঐ পোর্সিয়া নামের আদি কিন্তু এখানেই। আর হায়! পোর্সিয়া মানে শূকর, এসিনিয়া মানে গাধা।

পদবীর খোঁজে বেদ, পুরাণ, জাতক এবং কথাসরিতের পাতা ওল্টালেও তার হদিস মেলে না। সেখানে শুধুই নাম, কোন পদবী নেই। উপনিষদে কোন কোন নামের দুটি অংশ আছে। যেমন উদ্দালক আরুণি, প্রাচীন-শাল ঔপমন্যব। আরুণি অর্থ অরুণের পুত্র, ঔপমন্যব—উপমন্যুর পুত্র। অর্থাৎ এগুলি পিতার নাম, যা দক্ষিণ ভারতে আজও প্রচলিত। মাতা জবালার পুত্র অর্থে সত্যকাম জাবলি। অর্থাৎ পুরাণকালে মাতৃ-পরিচয়ও স্বীকৃত হত। মাতার সুত্রে পাওয়া এই জাবাল গোত্রপরিচয়ও কোন পদবী নয়।

মহাভারতে দুর্যোধন দুঃশাসন বা যুধিষ্ঠির অর্জুনাদি কৌরব ও পাণ্ডব পরিচয়ে পিতৃপরিচয়ই প্রকাশ করেছে, বংশ পরিচায়ক পদবী ধারণ করেনি। পদবীর সন্ধানে পরবর্তীকালের ইতিহাস খুঁজে বিষ্ণুশর্মা বা কৃষ্ণস্বামী জাতীয় নাম পাই। এই শর্মা ও স্বামী কিভাবে পদবীতে রুপান্তরিত হয়েছে তা অজ্ঞাত। এই স্বামীর বৈষ্ণব রূপান্তর গোস্বামী, এবং স্বামীর অপভ্রংশ থেকেই সাঁই পদবী। সুকুমার সেনের মতেও সাঁই এসেছে স্বামী থেকে। যেমন গোস্বামী থেকে গোসাঁই। সাঁইবাবাও এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয়। গোসাঁই পূর্ববঙ্গের আরো পূবে গিয়ে হয়েছেন গোহাঁই ও বড়গোহাঁই। গৌড়ীয় বৈষ্ণবযুগে ব্রাহ্মণও দাস হতেন, অব্রাহ্মণও হতেন গোসাঁই। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব হ্রাস পাওয়ার পর বর্ণাশ্রম যখন ফিরে আসে তখন অব্রাহ্মণ গোঁসাইরা আর ঐ পরিচয়কে বড় একটা পদবীত্ব দেননি। কিন্তু বহু, ব্রাহ্মণ দাস পদবী রক্ষা করে এসেছেন।

বিষ্ণুশর্মা বা কৃষ্ণস্বামী জাতীয় নামের শেষাংশ থেকেই শর্মা ও স্বামীর উৎপত্তি কিনা গবেষণাসাপেক্ষ। তবে চন্দ্ৰবর্মা জাতীয় নাম থেকে বর্মা ও বর্মন ক্ষত্রিয় পদবী, যার উত্তর ভারতীয় বর্তমান রূপ ভার্মা। জাতক চরিত্রের নামগুলির শেষাংশ থেকে পাওয়া যায় দত্ত, সেন, সোম, শূর প্রভৃতি। প্রাচীন ইতিহাস থেকে পাই গুপ্ত। ওঁরা অধিকাংশই কিন্তু বণিক ছিলেন। উপরন্তু বাংলার বাইরে দত্ত ও গুপ্ত ছাড়া অন্য-গুলির প্রচলন নেই। সুতরাং বাঙালীর পদবী ঐ সব ব্যক্তিদের বংশ পরিচয় ঘোষণা করে না। সেন উগ্রসেনের বা বল্লালসেনের বংশধর নন। বল্লালসেন ছিলেন ব্ৰহ্মক্ষত্রিয়, চন্দ্রগুপ্ত বৈদ্য ছিলেন না। তেমনই কল্পনা করা দুরূহ যে ঋগ্বেদের মিত্র দেবতা বা ঋষি বিশ্বামিত্রের শুধু মাত্র বাঙালীর প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। এমন কি বণিক বুদ্ধমিত্রের কাছ থেকেও আমরা যদি মিত্র পদবীটি পেতাম তা হলে বণিকদের মধ্যেই এই পদবীটি পাওয়া যেত। টডের রাজস্থান ইতিহাসে গোহো নামের উল্লেখ আছে, যিনি গুহায় প্রতিপালিত হয়েছিলেন। আমাদের গুহ নিশ্চয় গুহাবাসের স্মৃতি ধরে রাখেননি। রামায়ণের গুহক চণ্ডাল কোন কোন অনুবাদকের হাতে গুহ হয়েছেন, কিন্তু বর্তমানের গুহদের সঙ্গে রামায়ণের গুহকের কোন সম্পর্ক নেই। ভারতের অন্যত্র প্রাপ্ত বৌদ্ধ-যুগের কিছু কিছু মুদ্রা ও শিলালেখেও কিছু নাম পাওয়া যায়, যার শেষাংশ একমাত্র বাঙালীর পদবীর সঙ্গে অভিন্ন। সুদূর সৌরাষ্ট্রে পাওয়া মুদ্রাগুলি থেকে জেমস প্রিন্সেপ ব্রাহ্মী হরফের পাঠোদ্ধার করতে গিয়ে যে নামগুলি পেয়েছিলেন, তার মধ্যে আছে বিজয়মিত (বিজয়মিত্র) রুদ্র-সহ বিশ্বসহ অত্ৰিদাম বীরদাম ইত্যাদি। এই সহ বা তার পরবর্তী সংশোধিত পাঠ সহী থেকেই কি সাহা পদবী? দাম পদবীর বর্তমান অপভ্রংশ দাঁ। জাতকের দত্ত-সেন-সোম যেমন বণিকদের নাম, তেমনই সহ বা দাম রাজাদের নাম। সম্ভবত ক্ষত্রিয়। সুতরাং বাঙালী এই পদবীগুলি ঐ প্রাচীনকালে আহরণ করেনি। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে দামদক্‌, অস্ট্রিক শব্দের দক্‌, অর্থ জল, এবং তা থেকে উদক সংস্কৃত শব্দের সৃষ্টি। প্রাচীনকালে রাঢ় বাংলায় দামরাজ্য পাওয়া যায়, তার রাজাদের নামান্ত দাম। এঁরা বোধহয় ক্ষত্রিয় ছিলেন। তাম্রলিপ্ত বন্দরের আদি নাম দামলিপ্ত।

বণিকদের মধ্যে এই পদবীর কয়েকটি যদিও পাওয়া যায়, তথাপি প্রশ্ন থাকে ভারতের অন্যত্র এই পদবীগুলি বণিকদের মধ্যে আদৌ নেই কেন! সে বিষয়ে অনুসন্ধান ও বিচারবিশ্লেষণ আপাতত মুলতুবি থাক।

এক সময়ে ভারতবর্ষ থেকে ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রায় সম্পূর্ণ লোপ পায়। বৌদ্ধ ও জৈনধর্মই সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করে। বুদ্ধের নির্বাণোত্তর প্রায় এক হাজার বছর ছিল বৌদ্ধ সংস্কৃতির স্বর্ণযুগ। এ-সময় অধিকাংশ ব্রাহ্মণও বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। অন্তত অধিকাংশই বৌদ্ধ সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশে পরে বৌদ্ধ-জৈন ধর্ম লুপ্ত হলেও সম্ভবত তার অন্তঃসলিলা প্রভাবের ফলে পুরাতন যুগের নাম-করণের প্রথা অপরিবর্তিত থেকে যায়। পুত্রপৌত্রাদিক্ৰমে নামের অন্তিম অংশ একই রাখার প্রবণতা শুধু, সেকালেই নয়, একালেও ছিল। নাথ-প্রসাদ-প্রসন্ন-কুমার-চন্দ্ৰ শব্দগুলি এখনও বাঙালীর নামের মধ্যমাংশ। পদবীবর্জিত উদয়শঙ্কর নামের শেষাংশ যেভাবে বিশেষত্ব অর্জন করেছে, মধ্যযুগেও সেই ভাবেই কোন গৌরবান্বিত পূর্বপুরুষের নামের শেষাংশকে পুরুষানুক্রমে ধরে রাখার চেষ্টা থেকে অধিকাংশ পদবীর সৃষ্টি। অতি প্রাচীনত্বের মধ্যে তাদের উৎস সন্ধান করা অর্থহীন। একটি মত হ’ল গুপ্তবংশের প্রথম ব্যক্তির নামান্ত গুপ্ত। তাঁর পুত্র ঘটোৎকচ, তাঁর পুত্র চন্দ্রগুপ্ত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর উত্তরাধিকারীরা গুপ্তান্ত নাম নিতে শুরু করেন। আবার বহু, পরে অষ্টম শতাব্দীতে দয়িত-বিষ্ণুর পুত্র ব্যপট, তার পুত্র গোপাল সম্রাট হওয়ার ফলে উত্তরাধিকারীরা পাল নামান্ত গ্রহণ করে। পাল কায়স্থাদি বহু, জাতিরই পদবী। ব্রাহ্মণদের মধ্যেও নামান্ত পদবীর প্রচলন ছিল। গুপ্তযুগের কালে বাংলাদেশে নামান্ত ব্যবহারে কোন বর্ণভেদ ছিল না বা খুবই কম ক্ষেত্রে ছিল। ক্ষিতিমোহন সেন একালের বহু পদবীকে বলেছেন জৈন প্রভাব থেকে উদ্ভূত। বাঙালীর নামের মধ্যাংশে যে ‘চন্দ্র’ ‘নাথ’ প্রভৃতি দেখা যায়, তাঁর মতে সেই রীতি জৈন প্রভাবের ফল। অন্ত্যনাম থেকে গড়ে ওঠা পদবীর মধ্যে যেগুলির নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙালীর ইতিহাসে’ উল্লেখ আছে, সেগুলি হল: দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দী, বর্মন, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, দাম (দাঁ), ভূতি, বিষ্ণু, যশ, শিব, রুদ্র। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রায় সমস্ত সংস্কৃত শব্দের পদবীই নামের অন্তিমাংশ থেকে গড়ে উঠেছে।

অষ্টম শতাব্দীতেও এই পদবীগুলি কোন জাতিবিশেষের সম্পত্তি ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই নামের দুটি অংশ যুক্তভাবে লেখার পরিবর্তে বিচ্ছিন্নভাবে লেখা রীতি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে এই অন্তিমাংশ গুরত্ব পেতে শুরু করে এবং পরিবার বা বংশের পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়। আধুনিক-কালেও দেখা গেছে শিবনাথ ঘোষ বা কালিকাপ্রসাদ সেন ইংরেজদের ত্রি-মাত্রিক নামের অনুসরণে (জর্জ বানার্ড শ বা জি বি এস) নিজেদেরও এস এন ঘোষ বা কে পি সেন বানিয়ে তোলেন। এবং সেজনই শিবনাথ হয়ে যান শিব নাথ এবং কালিকাপ্রসাদ হন কালিকা প্রসাদ। অর্থাৎ -নাথ -চন্দ্র -প্রসাদ -প্রসন্ন -কুমার ইত্যাদি মধ্যমাংশ ইংরেজদের নামের প্রভাবে বিযুক্তভাবে লেখা শুরু হয়েছিল। কিন্তু ভাষাচেতনার ফলে তা পুনরায় যুক্তভাবে লেখা প্রবর্তিত হয়েছে, যদিও মধ্যমাংশ লুপ্ত করে দেওয়ার দিকেই অতি-আধনিক ঝোঁক।

যাই হোক্‌, ঘোষ মিত্র দেব দত্ত চন্দ্ৰ যশ রুদ্র দাস ইত্যাদি বহু শব্দ প্রাচীনকালে উত্তর ভারতীয় নামের শেষাংশে পাওয়া গেলেও বাংলা দেশে এগুলির প্রচলন ঐ জাতীয় নামকরণের রীতি থেকে। ঐ ঐতিহাসিক পুরুষদের বংশগত উত্তরাধিকার থেকে নয়। বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্ব- ঘোষের মতই বাঙালীর মধ্যযুগীয় নাম ঈশ্বরঘোষ। তিনি অশ্বঘোষের বংশোদ্ভূত নন। এক হাজার বছর আগেও অতীশ দীপঙ্করের সমকালে বৌদ্ধদের মধ্যে -মিত্র, -ঘোষ, -গুহ নামান্ত বাঙালী পাওয়া যাচ্ছে। এঁদের জাতি জানা যায় না। কারণ এঁরা ছিলেন বৌদ্ধ।

উপরের পদবীগুলি বিভিন্ন বর্ণহিন্দু, জাতির মধ্যেই দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের কোন পদবী থেকেই তার জাতি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া সম্ভব নয়।

ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ‘চিন্ময় বঙ্গ’ গ্রন্থে লিখেছেন যে বসু, মিত্র, দত্ত, দেব, চন্দ্র, সেন, নন্দী, ধর, ভদ্র, শূর প্রভৃতিতে জৈন সংস্রবের পরিচয় পাওয়া যায়।

দেশজ শব্দের পদবীগুলি কিন্তু গড়ে উঠেছে নানা ভাবে এবং নানা কারণে।

পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে বাঙালী ব্রাহ্মণদের আদি পদবীগুলি ছিল দেশজ শব্দ। অনেকের ধারণা, এগুলি মূলত দেশজ শব্দ, কেউ কেউ মনে করেন এগুলি সংস্কৃত গ্রাম-নামের অপভ্রংশ। কিন্তু ভারতীয় ব্রাহ্মণের আদি পদবীর অন্যতম শর্মা পদবীও সেকালে বাঙালী ব্রাহ্মণরা ব্যবহার করতেন। বর্ণপরিচয়ের পৃষ্ঠায় ঈশ্বরচন্দ্র শর্মণঃ সইটি বাঙালী মাত্রেরই পরিচিত। কিন্তু শর্মা বা শর্মণঃ পদবী অধুনা খুব কম ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের নামের শোভা বর্ধন করে। যদিও আচারে অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ- পত্রে এটিকে এখনো দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ পুরোনো পদবী পরিত্যক্ত হয়ে নতুন পদবী গৃহীত হয়েছে। সে আলোচনার আগে বরং উত্তর ভারতের দিকে একবার তাকানো যাক।

উত্তর ভারতে ব্রাহ্মণদের আদি পদবীর সন্ধানে গেলে দেখা যাবে শর্মা ও স্বামী অনেকক্ষেত্রেই বিদায় নিয়ে শিক্ষাগত উপাধি তার স্থান করে নিয়েছে। অর্থাৎ একালে নামের শেষে বি-এ এম-এ লেখার মত তাঁরা বেদপাঠের বিজ্ঞাপন দিতেন। পণ্ডিত, দ্বিবেদী, ত্রিবেদী, চতুর্বেদী ও শাস্ত্রী উপাধিগুলি ছিল ডিগ্রি ডিপ্লোমার সমতুল্য। আরেকটি উপাধি উপাধ্যায়। সম্ভবত ছোটখাটো টোলের শিক্ষক ছিলেন পণ্ডিত, উচ্চ- শিক্ষায় যাঁরা অধ্যাপনা করতেন তাঁরা ছিলেন উপাধ্যায়। একটি বেদ যিনি পাঠ করেছেন তিনি ছিলেন পণ্ডিত, দুটি বেদপাঠে দ্বিবেদী, তিনটি বেদপাঠে ত্রিবেদী, চারটি বেদপাঠে চতুর্বেদী। কিন্তু বংশ- পরম্পরায় এগুলি যে পদবী হয়ে গেল তার অর্থ কিন্তু এমন নয় যে পুরুষানুক্রমে তাঁরা সকলেই বেদবিশারদ ছিলেন। পূর্বপুরুষের কোন একজনের পান্ডিত্যকে পদবীতে ধারণ করলেও পরবর্তীকালে তার বংশ- ধরেরা যে একেবারে অশিক্ষিত হতে পারে তার প্রচুর দৃষ্টান্ত বাংলা দেশের গ্রামে গঞ্জেও পাওয়া যাবে। অন্যদিকে, পন্ডিত বা দ্বিবেদী পদবী হয়ে যাওয়ার পর সেই বংশের সন্তান হয়তো চারখানি বেদেই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু পদবীটির দ্বিবেদী থেকে চতুর্বেদীতে রূপান্তর ঘটেছিল কিনা তা জানা সম্ভব নয়। তবে আর্যাবর্ত থেকে ক্রমশ এই পদবীগুলি যতই ব্রাত্য পূর্ব ভারতে অগ্রসর হয়েছে ততই তা অপভ্রংশ হয়ে দেশজ রুপ নিয়েছে। বিহারে তাই পন্ডিত হয়ে গেলেন পান্ডে, দ্বিবেদী দুবে, ত্রিবেদী হলেন তেওয়ারী, চতুর্বেদী হলেন চৌবে। আর উপাধ্যায় হলেন ওঝা বা ঝা। এই ওঝা আমাদের বাংলা দেশেও পদবী হিসেবে প্রচলিত ছিল। রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার নামেই তার প্রমাণ। এই ওঝা সম্ভবত সংক্ষিপ্ত হয়ে ঝা। উত্তর ভারতে শাস্ত্রী কিন্তু কায়স্থেরও পদবী।

সংস্কৃত শব্দ অপভ্রংশিত হয়ে একেবারে দেশজ রূপ গ্রহণের এই দৃষ্টান্ত যখন চোখের সামনে রয়েছে তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে বাঙালীর বহু বিচিত্র পদবী কৌতুককর মনে হলেও তার আদি সংস্কৃত রূপ হয়তো কোন গৌরবের কথাই উল্লেখ করে। তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবনতি দেখে আমরা হয়তো দেশজ শব্দ- টিকেই স্বাভাবিক মনে করছি। স্মরণীয়, বাংলা সাহিত্যে এককালে দুবে চৌবে জমিদারবাড়ির দারোয়ানের পদ অলঙ্কৃত করতো, বাস্তব জীবনেও।

বাংলাদেশে শুদ্ধ সংস্কৃত শব্দ অনতিবিলম্বে অপভ্রংশিত হয়, দেশজ উচ্চারণই বিকৃতির কারণ। ফলে, সঙ্গে সঙ্গে তার মূল্যহ্রাস ঘটে। আমাদের জাতিগুলির নাম ও পদবীগুলিও এভাবেই দেশজ চেহারা নিয়েছে। ব্রাহ্মণ শব্দটিই চলতি ভাষায় হয়ে গেছে বামুন। শরৎচন্দ্রও লিখেছেন ‘বামুনের মেয়ে’। এই বামুন শব্দকে ব্রাহ্মণে উত্তীর্ণ করার মতই পদবীরও পদোন্নতি করা হয়েছে। সুতরাং চলতি জাতিনাম বা দেশজ পদবীকে সংস্কৃত মূল শব্দে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে উপহাস করবো কোন যুক্তিতে? কিন্তু প্রশ্ন জাগে ব্রাহ্মণদের পদবী অপভ্রংশিত হল, অথচ দাস, ঘোষ, নাগ, দত্ত, বসু, মিত্র শব্দগুলি দেশজ রুপ নেয়নি কেন? সংস্কৃত শিক্ষায় তো ব্রাহ্মণদের পূর্ণ অধিকার ছিল। অতএব তাদের পদবীই অবিকৃত থাকার কথা। তা হ’লে বুঝতে হবে, বেদে অধিকার না থাকলেও অন্যান্য জাতির অর্থবান উন্নত অংশ সংস্কৃত শিখতেন বা সংস্কৃতজাত বাংলাভাষায় শিক্ষিত ছিলেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মণদের আর্থিক পতন ঘটে, শিক্ষা লুপ্ত হয়, ফলে দেশজ ভাষার মধ্যেই তারা আশ্রয় গ্রহণ করে।

কোন কোন পদবীর শব্দার্থকেই গুরুত্ব দিয়ে কৌতুক সৃষ্টি করা অযৌক্তিক। একটি পদবী ‘মিশ্র’। সাহিত্যের কল্যাণে বিহারে যাকে আমরা মিশিরজীর চেহারায় দেখতে অভ্যস্ত। এই মিশিরের সঙ্গে মিশরের কোন কৌটুম্বিক সম্পর্কও নেই, মিশ্র শব্দ থেকেও তার উৎস সন্ধান করা হঠকারিতা। সুতরাং অন্যান্য জাতির পদবীর ক্ষেত্রেই বা সরলার্থ গ্রহণ কর হয় কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *