1 of 2

ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম – ১০

১০. ॥ দশম অধ্যায় ।

আমরা এগিয়ে চলেছি তো চলেইছি। এ-চলার শেষ যে কোথায় কে জানে? তবু স্রোতের টানে আমাদের যে না চলে উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে তো আমাদের ইচ্ছাশক্তির কোনো দামই নেই।

পথ চলতে চলতে আমরা এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হলাম যা আমার জীবনে খুবই উল্লেখযোগ্য বলে মনে করি। কারণ, সে ঘটনাটা প্রথমে আমাকে এক অনির্বচনীয় আনন্দের জোয়ারে ভাসিয়ে দিল আর তার পরেই আমার মনকে অন্তহীণ আনন্দে ভরিয়ে দিল।

আমরা সকালের দিকে ডেকে শুয়ে সময় কাটাচ্ছি। আমি হঠাৎ পাশ ফিরতেই অগাস্টাসের দিকে নজর গেল। আমি সচকিত হয়ে ব্যাপারটাকে অনুসন্ধিৎসু নজরে নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করলাম। না, দেখার ভুল অবশ্যই নয়। আমি দেখলাম, অগাস্টাসের মুখটা চকের মতো, মরা মানুষের মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আর ঠোঁট দুটো অনবরত তির তির করে কাঁপছে।

তার মুখের দিকে চোখ পড়তেই আমার বুকের ভেতরে ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেল অস্বাভাবিক ভয় পেয়ে ক্ষীণ ও কাঁপা কাঁপা গলায় তার নাম ধরে বার কয়েক ডাকলাম। কিন্তু তার দিকে থেকে কোনো সাড়াই পেলাম না।

অগাস্টাসের কাছে গিয়ে, তার মুখের ওপর ঝুঁকে আর ভালো করে লক্ষ্য করার পর ধরেই নিলাম, সে হঠাৎ কোনো মারাত্মক ঝামেলার শিকার হয়েছে। তার চোখ দুটোর দিকে অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আমার পিছন দিককার একটা কিছুর দিকে সে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রয়েছে। অকস্মাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তাকানো মাত্র আমার শরীর ও মন এমন এক অবর্ণনীয় রোমাঞ্চে ভরপুর হয়ে গেল, সে আনন্দানুভূতি জাগল তা কোনোদিন মুহূর্তের জন্যও মন থেকে মুছে যাবে না। কি? কি দেখলাম, তাই না? আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, বড় বড় একটা পালতোলা জাহাজ আমাদের দিকে দ্রুত ছুটে আসছে। আমাদের থেকে সেটার ব্যবধান মাত্র মাইল দুই।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো অতর্কিতে লাফিয়ে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ডান হাতটা সেটার দিকে উঁচু করে নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমার সঙ্গে সঙ্গে ডার্ক পিটার্সও তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সে উন্মাদের মতো ডেকময় লাফালাফি নাচানাচি জুড়ে দিল।

আমাদের দুজনের কার মধ্যে যে আনন্দের সঞ্চার বেশি তা বলা খুব মুশকিল। আর মাত্রাতিরিক্ত আনন্দ সহ্য করতে না পেরে পার্কার বিলাপ পেড়ে কাঁদতেই শুরু করল, শিশুর মতো হাপুস নয়নে অনবরত কেঁদেই চলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজটা আমাদের মোটামুটি কাছাকাছি চলে এলো। এবার সেটাকে আরও ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। বুঝলাম, জাহাজটা খুবই বড়। হল্যান্ডে নির্মিত। আর চারিদিক কালো রঙের প্রলেপ দেওয়া।

ভালোভাবে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ওই জাহাজটারও খুবই ক্ষতি হয়েছে।

বাতাস ক্রমে পড়তে পড়তে খুবই পড়ে গেল। পালে খুব বেশি বাতাস না লাগায় জাহাজটা এখন ধীরগতিতে চলতে শুরু করেছে।

জাহাজটার গতি মন্থর হয়ে পড়ায় আমরা যারপরনাই উল্কণ্ঠায় ভুগতে লাগলাম। অনন্যোপায় হয়ে সাধ্যমত গলা চড়িয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দিলাম।

জাহাজটা আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমাতে কমাতে যখন সিকি মাইলের মধ্যে চলে এসেছে, তখন তিনজন নাবিককে আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। তাদের দুজন গলুইয়ের ওপর জড়ো করা পালের উপর বসে, আর তৃতীয়জন আমাদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে। লোকটা কৃষ্ণকায়, দীর্ঘাকৃতি আর অমিত শক্তিধর বলেই মনে হল।

একটু পরেই জাহাজটা আরও কাছে এগিয়ে এলে দেখলাম, কৃষ্ণকায় দীর্ঘাকৃতি লোকটার মুখে হাসির ছোপ সুস্পষ্ট।

আমাদের বাঞ্ছিত জাহাজটা ক্রমে কাছে আমাদের আরও কাছে এগিয়ে এলো। এবার অতর্কিতে সে লোকটার মাথার লাল ফানেলের টুপিটা হাওয়ায় উড়ে সমুদ্রের পানিতে পড়ে গেল। এদিকে তার সামান্যতম খেয়ালও নেই। সে আগের মতো হেসে হেসে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল। বাস্তবিকই বিচিত্র কাণ্ড বটে।

জাহাজটা এগোতে এগোতে যত কাছে এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের বুকের ভেতরের উথালি-পাথালি ভাবটা ততই বাড়তে লাগল।

ঠিক তখনই আমাদের একান্ত বাঞ্ছিত জাহাজটা থেকে কেমন যেন একটা উকট গন্ধ বাতাস বাহিত হয়ে আমাদের নাকে আসতে লাগল। এর তুল্য দুর্গন্ধ পৃথিবীতে অন্য কোনো কিছু থেকে নির্গত হয় বা হয়েছে বলে, জানা নেই। হয়তো বা একমাত্র নরকেই এমন শ্বাসরোধকারী উৎকট গন্ধ পাওয়া যায়–আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।

আমি মুক্ত বাতাসে দম বন্ধ হয়ে আসার পরিস্থিতিটাকে সামাল দেবার চেষ্টা চালিয়ে যেতে যেতে আমার দুই সহযাত্রীর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। দেখলাম, তাদের মুখ চকের চেয়ে বেশি ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

তখন সে পরিস্থিতি তাতে কোনো চিন্তা করা বা প্রশ্ন করার মতো এতটুকুও ফুরসৎ নেই। জাহাজটা ধরতে গেলে হাতের নাগালের মধ্যে, প্রায় পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে চলে এসেছে।

ব্যাপার দেখে মনে হল, আমাদের জাহাজ থেকে নামবার পথটার গায়েই আমাদের বাঞ্ছিত জাহাজটাকে দাঁড় করানো হবে। আমরা যেন নৌকার সাহায্য ছাড়াই এটা থেকে সে জাহাজটায় চলে যেতে পারি।

জাহাজটা খুবই ধীরগতিতে এগোতে এগোতে আমাদের বিশ ফুটের মধ্যে চলে এলো। এবার সম্পূর্ণ ডেকটাকে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হল।

আমি আচমকা নাকে হাত দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে দিলাম। আর প্রায় অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলাম–‘কী বীভৎস! কী নরকীয় দৃশ্য রে বাবা!

মুহূর্তের মধ্যে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠল তা কোনোদিনই আমার মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। একেবারেই অভাবনীয় অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা হচ্ছে, ডেকের ওপরে পাশাপাশি গা-ঘেষাঘেষি করে পড়ে আছে পঁচিশ ত্রিশটা নারী-পুরুষের পচা গলা লাশ। আর সেই সঙ্গে উৎকট গন্ধ যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে।

নারকীয় দৃশ্যটা চোখে পড়তেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বেশিক্ষণ চোখের সামনে যে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। তবু এটুকু সময়ের মধ্যেই আমি দেখতে পেলাম ওই লাশ কয়টা ছাড়া জীবিত কোনো মানুষই নেই।

সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তখনও খুশিতে এমনই মশগুল যে, ওই প্রাণহীন পচা গলা মানুষগুলোর কাছেই চিৎকার করে সাহায্য ভিক্ষা করেই চললাম। বল্গাহীন খুশি আর হতাশায় আমাদের কাণ্ডজ্ঞান যে অনেক আগেই লোপ পেয়েছে। ফলে মরা মানুষের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা চলে সে বোধটুকু যে আমরা হারিয়ে বসেছি। মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটলে মানুষের পক্ষে যা করা সম্ভব আমরাও ঠিক সেরকম কাজেই মেতে গেলাম।

আমরা ভীত-সন্ত্রস্ত কণ্ঠে প্রথম চিৎকার করে সাহায্য ভিক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে নবাগত জাহাজটার মাস্তুলের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে কোনো একটা অস্পষ্ট সাড়া ভেসে এলো। সে আওয়াজটার সঙ্গে মানুষের কণ্ঠস্বরের অবিকল মিল খুঁজে পেলাম।

উৎকর্ণ হয়ে কণ্ঠস্বরটা আবিষ্কার করতে চেষ্টা করলাম। আর তা করলামও। দীর্ঘকৃতি শক্তিধর সে লোকটা তখন জাহাজের রেলিং ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে রয়েছে। কিন্তু তার মুখটা দেখতে পেলাম না। কারণ, সে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রয়েছে।

অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য করে দেখলাম, তার হাত দুটো রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া আর শক্ত দড়ি দিয়ে পা দুটো মাস্তুলের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে বেঁধে দেওয়া। আর তার পিঠের দিকের জামার ভেঁড়া অংশটার ওপরে একটা গণ্ড ছিল বসে ঠোঁটটাকে ভেতরে চালান করে দিয়ে পচা গলা মাংস ঠুকরে ঠুকরে পরম তৃপ্তিতে খেয়ে চলেছে। রক্তের ছোপ লেগে তার পালকগুলো লাল হয়ে গেছে।

ঢেউয়ের চাপে জাহাজটা একটু ঘুরে গেলে দৃশ্যটাকে আর ভালোভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। পাখিটা এবার খুবই কষ্ট করে লোকটার দেহের ভেতর থেকে রক্তে জবজবে মাথাটাকে বের করে আনল। তারপর বার দু-তিনেক এদিক-ওদিক তাকাল। কি ভাবল, কি বুঝল, কে জানে। এবার সেটা হঠাৎ উড়ে এসে আমাদের ডেকের ওপর বার বার চক্কর মারতে লাগল।– পাখিটার ঠোঁটে কুণ্ডলী পাকানো লিভারের মতো কি যেন একটা বস্তুকে ঝুলতে দেখা গেল।

আমি অপলক চোখে উকণ্ঠার সঙ্গে ব্যাপারটার ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখে চললাম। একেবারেই হঠাৎ একটা অভাবনীয় ব্যাপার ঘটে গেল। কুণ্ডলি পাকানো রক্তমাখা মাংসপিণ্ডটা আচমকা পাখিটার ঠোঁট থেকে খসে দুম্ করে পার্কারের পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পড়ল।

পরম পিতা আমাকে মার্জনা করুন। হঠাৎ-ই একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল, তবে সে আকস্মিক চিন্তাটার কথা এখনই ফাঁস করার ইচ্ছা আমার আদৌ নেই, করবও না।

তবে আমার একান্ত আগ্রহ সেই রক্তমাখা মাংসের গর্তটার দিকে গুটি গুটি এগিয়ে গিয়ে আরও ভালো করে ব্যাপারটা দেখি,নিঃসন্দেহ হই।

না, আমার সে ইচ্ছাটাকে আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব হলো না। পরমুহূর্তেই বুঝি আমার চৈতন্য, স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধি মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।

যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত একটা লাফ দিয়ে ভয়ঙ্কর সে বস্তুটার কাছে চলে গেলাম। দুরু দুরু বুকে কাঁপা কাঁপা হাত দুটো দিয়ে সেটাকে এক হ্যাঁচকা টানে তুলে নিলাম। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে সেটাকে উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রে ছুঁড়ে মারলাম। চোখের পলকে সেটা আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

এই ভয়ঙ্কর বস্তুটা যে পচাগলা দেহ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেটা দড়ির ঝুলন্ত অবস্থায় থাকার অন্য মাংস-খেকো পাখিটার ঠোঁটের টানাটানিতে সেটা অনায়াসেই বার বার দোল খেয়ে চলেছে। আর সেটাকে এ অবস্থায় দেখে তাকে জীবিত বলেই আমাদের মনে হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে পাখিটা তার মাংস খুবলে খুবলে খেয়ে হালকা করে দিয়েছে। আর এরই ফলে এখন সেটা উলটে গেছে। এবার তার মুখটা পুরোপুরি আমাদের দিকে ঘুরে গেল। ফলে মুখের সবটুকুই আমরা দেখতে পেলাম। এক নজর দেখেই আমি চমকে উঠলাম। কোনো মুখ যে এমন কদর্য হতে পারে আমি স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবিনি। না, কেবলমাত্র কদর্য বললে ঠিক বলা হবে না–ভয়ংকর বীভৎস।

আমি দুরুদুরু বুকে তার দিকে তাকালাম। তার চোখের কোটর দুটো শূন্য–মণি দুটো উধাও, মুখের চারদিকের মাংস হাফিস হয়ে গেছে। ফলে দাঁতের পাটি দুটো। বেরিয়ে পড়েছে।

তবে, তবে একটু আগে এ-হাসি দেখেই আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আবেগে উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম? এ মুখ, এ হাসি দেখেই কি-না, এ প্রসঙ্গ এখন চাপা থাক।

আমাদের অবাক করে দিয়ে নবাগত জাহাজটা তিল তিল করে সরে যেতে লাগল। আমাদের হাসি-আনন্দ আর মুক্তির আশা ভরসাটুকুও ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল।

ক্ষণিকের জন্য দেখা দেওয়া, বুকে মুক্তির আনন্দ সঞ্চার করে, শেষমেশ আমাদের হতাশার সাগরে ভাসিয়ে ধীরে ধীরে সরে পড়ার কারণটা জানার জন্য আমি সে মুহূর্ত থেকেই ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি।

জাহাজটার প্রসঙ্গে বলতে শুরু করেই আমি সেটার গঠন প্রকৃতি আর আকৃতির দেখে বাণিজ্য জাহাজ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। ওলন্দাজ বনিকদের জাহাজ ভেবে নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম।

সেই মুহূর্তে ব্যাপারটা আমার মাথায়ই আসেনি, প্রকৃতপক্ষে জাহাজটা কোন দেশের নইলে তার গায়ের লেখা দেখে এটা অনায়াসেই জেনে নেওয়া যেত। আসলে তখন আমার মধ্যে উত্তেজনা এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, অন্য কোনো দিকে নজর দেওয়ার মতো মানসিকতা আমার ছিল না।

আর ডেকের ওপরে পাশাপাশি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে পড়ে থাকা নারী-পুরুষের পচা গলা দেহগুলো দেখে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ওগুলো পচে গলে যায়নি, পীতজ্বরের শিকার হয়ে তারা ধুকছে, সংজ্ঞা হারিয়ে মরার মতো পড়ে রয়েছে। আর তাই যদি সত্য হয় তবে তো আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উঁকি দিয়ে ওঠা প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে।

তবে এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে, একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যু এসে বেচারাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, মহামারী যত মারাত্মকই হোক না কেন কখনই এমন আকস্মিকভাবে হানা দিয়েছে বলে শোনা যায়নি, হয়ওনি কোনোদিন।

চিন্তা ভাবনা করে এটাই মনে করা যেতে পারে, যুক্তিগ্রাহ্যও বটে সে, সমুদ্রযাত্রাকালে কোনো উপায়ে খাদ্যবস্তুতে বিষ প্রয়োগ করা হয় বা আপনা থাকতেই তা বিষাক্ত হয়ে যায়, আর এ যদি নাও হয় তবে কোনো না-জানা বিষাক্ত মাছ, কোনো সামুদ্রিক পাখি বা সামুদ্রিক প্রাণী সে বিষ বহন কওে নিয়ে আসে।

কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই যেখানে ভয়ানক এক রহস্যের প্রলেপে আবৃত এবং চিরকালই তা রহস্যাবৃতই রয়ে যাবে। সেখানে এরকম কোনো সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে বসা নিছকই বৃথা কালক্ষয়। অর্থাৎ সে রহস্য কোনোদিনই ভেদ করার তিলমাত্র সম্ভাবনা নেই তা নিয়ে অর্থহীন ভাবনা চিন্তা করা বুদ্ধিমানের কাজও নয়।

.

১১. ॥ একাদশ অধ্যায় ।

আমরা অপলক চোখে, হতাশায় বুক বেঁধে রহস্যের আধার জাহাজটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আর আকাশ পাতাল ভেবে চললাম। আমাদের হতাশা আর হাহাকারের মধ্যে সেটা ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল।

আমাদের ছেড়ে-যাওয়া দূরগামী জাহাজটার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকেই আমি সারাটা দিন কাটিয়ে দিলাম। আর দিনভর যুক্তিগ্রাহ্য ও অযৌক্তিক হাজারো চিন্তা ভাবনা আমার মাথায় একের পর এক চক্কর মারতে লাগল।

কোনো কাজই করতে পারলাম না, আসলে কিছু করার মতো মানসিকতাই আমার ছিল না।

তারপরই পুরনো সেই কষ্ট, ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্টটা নতুন করে চাঙা হয়ে উঠল।

সমুদ্রের বুকে ক্রমে রাতের অন্ধকার নেমে এলো। অজানা সমুদ্র–সবকিছু অন্ধকার কালো ঘোমটার আড়ালে চলে গেল। আমাদের সামনে অবস্থান করছে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার–অন্ধকার যক্ষপূরী। আর আমরা সে অন্ধকারের মধ্যে বুক না মানা ক্ষুধা-তৃষ্ণার জ্বালায় নির্মমভাবে জ্বলেপুড়ে খাক হতে লাগলাম।

আমরা যতই হাই ফাঁই করি না কেন ভোরের আলো ফোঁটার আগে কিছুই যে আমাদের করার নেই।

রাত ক্রমে ক্রমে গম্ভীর হতে লাগল। আমরা সবাই একটু ঘুমিয় নেবার চেষ্টা করলাম।

ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর নিরবচ্ছিন্ন হতাশা আর হাহাকারে অবসাদগ্রস্ত আমার দেহটা কখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল তা আমি বুঝতেই পারিনি।

সহযাত্রী বন্ধুরা ডাকাডাকি ও ঠেলাধাক্কা দিয়ে শেষমেশ আমার ঘুম ভাঙাল। চোখ খুলে দেখি, প্রকৃতির বুকে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে।

বাতাসের তীব্রতা মোটেই নেই, ঢেউও কমতে কমতে একেবারেই শান্ত-স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সমুদ্রবাহিত ঝিরঝিরে বাতাস খুবই মনোরম বোধ হচ্ছে। সবই আছে, কিন্তু কিছুই নেই। খাদ্য-পানীয় নেই, নেই বলতে কিছুই নেই। যাকে বলে সম্পূর্ণ নিঃস্বর-রিক্ত। থাকার মধ্যে আছে কেবল বুকভরা হতাশা আর হাহাকার।

বহু খোঁজাখুঁজি করে একটা বোতল পাওয়া গেল। তাতেই আমরা আনন্দে নাচানাচি জুড়ে দিলাম। সবার বরাতে একটা করে চুমুক জুটল। এটুকু দিয়ে গলাটা ভেজাতে পেরে আমরা যে কী আনন্দ লাভ করলাম, তা কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু সে আনন্দ আর কতক্ষণ স্থায়ী হল? এ যে মরুভূমিতে এক বিন্দু বৃষ্টির সামিল।

আমাদের চোখের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর ছবি জ্বল জ্বল করছে। আমাদের মৃত্যু যে অনিবার্য তা আমরা অনেক আগেই বুঝে গেছি। এখন কেবল সে বিশেষ মুহূর্তটির জন্য অসহায়ভাবে প্রতীক্ষা করা। এ ছাড়া গত্যন্তরও কিছু নেই।

ক্ষুধায় জ্বালা বড় জ্বালা। এই জ্বালা যে কী ভয়ঙ্কর একমাত্র ভুক্তভোগী ছাড়া তা উপলব্ধি সম্ভব নয়। যে করেই হোক। এ জ্বালা মেটাবার একটা ফন্দি ফিকির বের করতেই হবে।

জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে ছুরিটা বের করে একটা চামড়ার টুকরো কেটে চিবাতে লাগলাম। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও একটা টুকরোও উদরস্থ করতে পারলাম না। তার স্বাদ আর গন্ধ দুই উকট। বাধ্য হয়ে বিতৃষ্ণার সঙ্গে ফেলে দিতেই হল।

মাঝ রাত। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় অস্থিরভাবে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলাম। হঠাৎ আমার সহযাত্রী বন্ধুদের চিৎকার চাচামেচিতে আমার তন্দ্রা টুটে গেল। সচকিত হয়ে উঠে বসে পড়লাম। দেখি, তারা কাতার স্বরে হাহাকার করছে। তাদের সর্বাঙ্গ অনবরত অভাবনীয়ভাবে কেঁপে চলেছে। তারপরই শুরু হলো বুক চাপড়ে কাদা। মরা কান্নাও বোধহয় এমন মর্মভেদী হয় না।

ছ-ছটা দিন হয়ে গেল, সেই এক বোতল মদ ছাড়া কারো পেটে একটা দানাও পড়েনি। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি, আর কয়টা দিন যদি এভাবে কাটে আরও কিছু সময় চলে তবে কারো প্রাণরক্ষার আশা তিলমাত্রও নেই।

আমার বন্ধু অগাস্টাস আর ডার্ক পিটার্সের অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। তারা উভয়েই শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেছে। তাদের দিকে চোখ পড়লেই বুকের ভেতরে হ্যাঁৎ করে ওঠে। সত্যি কথা বলতে কি তারা যে আমার পরিচিত, দিনের পর দিন একই সঙ্গে কাটাচ্ছি ভাবতেও উৎসাহ পাচ্ছি না। তাদের চোখ-মুখের গড়নই বদলে গেছে।

অগাস্টাস ক্ষিধের জ্বালার সঙ্গে কিছুতেই বোঝাপড়া করতে না পেরে শেষমেষ চামড়ার টুকরো চিবিয়ে গেলার জন্য কয়েকবার মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে ব্যর্থ হল।

তাদের খারাপ অবস্থা দেখে আমি পরামর্শ দিলাম, চামড়ার টুকরো চিবিয়ে চিবিয়ে থ্যাতো করে কষটা খেলে কিছুটা অন্তত স্বস্তি পাওয়া যাবে।

আমার পরামর্শটাকে তারা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে না দিলেও সেই মতো কাজ করতে পারল না। আসলে তারা এতই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, চামড়া চিবোনোর মতো জোরটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।

আবার! আবার আর একটা জাহাজের পাল আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ল। বার কয়েক এদিক-ওদিক কাৎ হয়ে অনুসন্ধিৎসু নজরে দেখে নিয়ে নিঃসন্দেহ হল, জাহাজই বটে।

আমাদের সবার মধ্যে আবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণা দেখা দিল।

কিন্তু হায়! আমাদের চোখের সামনে দিয়েই আমাদের নতুন আশার উৎস জাহাজটার মুখ হঠাৎ অন্যদিকে ঘুরে গেল। ক্রমে দূরে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

অপলক চোখে দীর্ঘ সময় একই দিকে তাকিয়ে থেকে পার্কার হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে এমন চোখ করে আমার দিকে তাকাল যে, আতঙ্কে আমার বুকটা কেঁপে উঠল।

সে মুখ কোলার আগেই চোখের ভাষায় আমাকে বুঝিয়ে দিল সে কি বলতে চাইছে।

পার্কার সংক্ষেপে প্রস্তাব করল–‘শোন, আমাদের বাঁচার একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে।

আমি অত্যুগ্র প্রকাশ করে বললাম–‘বাঁচার উপায়? কী সে উপায়?

‘উপায় একটাই, অন্য সবার জীবন রক্ষা করতে আমাদের মধ্যে একজনকে প্রাণ দিতেই হবে।

আমি আর টু-শব্দটিও করতে পারলাম না। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ এঁকে আমি দিগন্ত রেখার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে স্থবিরের মতো দাঁড়িয়েই রইলাম।

.

১২. ॥ দ্বাদশ অধ্যায় ॥

সত্যি কথা বলতে কি, সর্বশেষ ভয়ঙ্কর বিপদজনক পথটার কথা দিন কয়েক আগে আমার মনেও জেগেছিল। আর আমি একান্ত গোপনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি, যে কোনো উপায়ে যে কোনো পথে এবং যে কোনো মুহূর্তেই মৃত্যু এসে সামনে দাঁড়াক না কেন তাকে হাসিমুখে বুক পেতে নেব। তবুও এ-পথ অবলম্বন করব না। কিছুতেই না।

বুঝলাম, পার্কারের ভয়ঙ্কর প্রস্তাবটা এখনও সে অগাস্টাস এবং ডার্ক পিটার্সের কাছে পাড়েনি।

সুযোগ বুঝে আমি পার্কারকে টানতে টানতে একান্তে নিয়ে গেলাম। তাকে বহু বোঝালাম। বহুভাবে মিনতি জানালাম, চরম এ-বিকল্প পথটার কথা সে যেন মন থেকে ধুয়ে মুছে সাফ সুতরো করে ফেলে। ভুলেও যেন সে অন্য দুজনের কাছে কথাটা না। পাড়ে, কিছুতেই না।

পার্কার পায়ের বুড়ো আঙুল জাহাজের পাটাতনে ঘষতে ঘষতে নীরবে আমার সব কথা শুনল।

এক সময় আমি নীরব হওয়ামাত্র সে মুখ খুলল–‘দেখ, তুমি যা-কিছু বললে সবই আমি জানি, আর যুক্তিসঙ্গতও বটে। কিন্তু এরকম ভয়ঙ্কর একটা বিকল্প পথ মানুষ কখন আঁকড়ে ধরতে উৎসাহি হয়, বল তো?’

আমি তার কথার কি জবাব দেব হঠাৎ করে গুছিয়ে উঠতে না পেরে মুখে কলুপ এঁটে দাঁড়িয়ে রইলাম।

সে এবার বলল–এমন ভয়ঙ্কর একটা বিকল্প পথ মানুষ একেবারে চরম মুহূর্তেই আঁকড়ে ধরতে উৎসাহি হয়, ঠিক কিনা? এ কথা তো মিথ্যে নয়, সব কষ্ট যতদিন সম্ভব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি।

‘সবই বুঝলাম। কিন্তু—’

এর মধ্যে আর কোনো কিন্তু নয় বন্ধু, মাত্র একজনের জীবনদানের মাধ্যমে যদি বাকি কয়জনের প্রাণরক্ষা পায় তবে সবার মৃত্যু ঘটতে দেওয়া কখনই সঙ্গত নয়। এ নিয়ে তুমি মিছে পথ আগলে দাঁড়িয়ও না বন্ধু।

আমার পক্ষে তার প্রস্তাব এত সহজে মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব হলো না।

সে তবুও আমাকে বহুভাবে ব্যাপারটা বোঝাতে চেষ্টা করলে আমি উপায়ান্তর না দেখে তাকে জানালাম, সে যদি কিছুতেই তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে যেতে না চায় তবে সে অন্তত আর একটা দিন অপেক্ষা করে দেখুক। ইতিমধ্যে কোনো জাহাজ আমাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসে কিনা।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই পার্কার ব্যাপারটা সম্বন্ধে একেবারে চরম মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে, আর চরমতম হতাশায় জর্জরিত হয়ে তবেই সে এ-পথ অবলম্বন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আর জীবনরক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই আরও একটা দিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করলে খুব দেরি হয়ে যাবে। আর যা-ই হোক তার নিজের বেলায় তো অবশ্যই।

আমি যখন নিশ্চিত হলাম, তাকে কোনোভাবেই নিজের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো যাবে না তখন নিতান্ত নিরূপায় হয়েই অন্য পথ অবলম্বন না করে পারলাম না।

আমি পার্কারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠেই তাকে বললাম, বললাম বললে ভুল হবে সরাসরি ভয় দেখালাম। তাকে বললাম–শুনুন, এ মুহূর্তে আপনার চেয়ে, এমনকি আমার বন্ধু অগাস্টাস বা মি. ডার্ক পিটার্সের চেয়ে আমার শরীর অনেক, অনেক বেশি সবল। অতএব প্রয়োজনে আমি কিন্তু আমার শারীরিক শক্তি সামর্থ্যের সাহায্য নিতে বাধ্য হব।

পার্কার টু-শব্দটিও না করে লক্ষী ছেলের মতো আমার দিকে নীরবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

ওষুধে কাজ হতে চলেছে অনুমান করে আমি আরও গলা চড়িয়ে দিয়ে বললাম– ‘আমার সাফ কথা শুনে নাও, তুমি যদি এ রক্তলোলুপ মাংসাশী পরিকল্পনার প্রস্তাবটা ভুলেও অন্য দুজনের কাছে পাড় তবে কিন্তু তোমাকে বলপূর্বক সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিতে এতটুকুও দ্বিধা করব না মনে রেখো।

আমার মুখের কথা শেষ হতে না হতেই পার্কার চোখের পলকে পকেট থেকে ছুরিটা বের করে নিল, অন্য হাতে আমার গলাটা চেপে ধরে ছুরির ফলাটা আমার পেটে গেঁথে দেবার জন্য বার কয়েক ব্যর্থ চেষ্টা চালাল।

আমিও হাত-পা গুটিয়ে নিশ্চেষ্ট হয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম না। বরং রেগে আগুন হয়ে গিয়ে তাকে টেনে হিঁচড়ে একেবারে জাহাজের রেলিংয়ের কাছে নিয়ে হাজির করলাম। এমন ভাব দেখালাম, তাকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হব। ঠিক সেই মুহূর্তেই ডার্ক পিটার্স হঠাৎ ছুটে এসে আমাকে ক্ষান্ত করল। তাকে জোর বাঁচান বাঁচিয়ে দিল। আমি দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসতে লাগলাম।

ডার্ক পিটার্স ব্যাপারটা দেখে তো রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। আমার কাছে এর কারণ জানতে চাইল।

আমি মুখ খোলার আগেই পার্কার পুরো ব্যাপারটা তার কাছে খোলাখুলিভাবে ব্যক্ত করল।

ডার্ক পিটার্স সবকিছু শুনে তখনকার মতো গুম হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম, ব্যাপারটা তার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে চলেছে।

কিন্তু পার্কারের বক্তব্যের পরিণাম যে এতখানি ভয়ঙ্কর রূপ নেবে তা আমি ঘুণাক্ষরেও অনুমাণ করতে পারিনি। আমি ধরেই নিলাম, ডার্ক পিটার্স আর অগাস্টাসও এমন একটা ধারণার কথা মনে মনে ভাবছে। এতদিন প্রকাশ করতে পারেনি।

এবার ডার্ক পিটার্স আর অগাস্টাসও পার্কারের পক্ষ অবলম্বন করল। তারপর তাদের মতলবটাকে বাস্তবায়িত করার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল।

আমি ভেবে দেখলাম, আমার পথ সঠিক নয়, বোকামিই করছি। তারা সংখ্যায় তিনজন, আর আমি একদম একা। তাদের তিনজনের মতে বিরুদ্ধাচারণ করতে যাওয়ার অর্থ চরম বোকামি করা। এতে আমার নিজের সর্বনাশের আশঙ্কা যথেষ্টই রয়েছে।

শেষপর্যন্ত নিতান্তই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের কাছে বক্তব্য রাখতে বাধ্য হলাম। আমি বললাম–‘শোন, তোমাদের প্রস্তাবে আমি সম্মতি দিচ্ছি, তবে আরও একটা ঘণ্টা অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ রাখছি।

তারা তিনজনই চোখে জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে নীরবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।

আমি এবার বললাম–‘অনুরোধটা করছি এজন্য যে, একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক, কুয়াশার আস্তরণটা সরে গেলে ইতিমধ্যে কোনো জাহাজ নজরে পড়ে কিনা।

হতাশার জ্বরে যারা ভুগছে তাদের কি এত সহজে পরিকল্পনাচ্যুত করা সম্ভব! শেষপর্যন্ত বহুভাবে বুঝিয়ে, অনুরোধ উপরোধ করে তবে আমার কথাটা বাস্তবায়িত করতে পারলাম।

আমাদের কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই কুয়াশার গাঢ় আস্তরণটা ক্রমে সরে যেতে যেতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। সমুদ্র-আকাশ স্বচ্ছ হয়ে উঠল।

অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে বার বার এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলাম। কিন্তু দারুণভাবে হতাশ হতে হল। কোনো জাহাজের চিহ্নও চোখে পড়ল না।

তাই উপায়ান্তর না দেখে আমার ভাগ্য পরীক্ষার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগলাম।

ঠিক তার পরই যে মর্মভেদী দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল, পরবর্তীকালে ঘটা কোনো ঘটনাই আমার স্মৃতি থেকে ধুয়ে মুছে নিতে পারবে না। আর যতদিন ধরে প্রাণের অস্তিত্ব থাকবে ততদিন সে ভয়ঙ্কর মর্মভেদি দৃশ্যের স্মৃতি আমার প্রতি মুহূর্তকে বিষময় করে রাখবে। এ কারণেই আমার কাহিনীর সে অংশটুকু যত সংক্ষেপে, যত শীঘ্র পারা যায় সেরে ফেলতে চাচ্ছি।

লটারির চিন্তা করা হল। আর তা করা হবে খড়টানার পদ্ধতিতে। বিভিন্ন মাপের চারটে খড়ের টুকরো একজন হাতের মুঠোয় ধরে রাখবে। যে সবচেয়ে ছোট টুকরোটা টেনে বের করবে সেই মৃত্যুবরণ করার অধিকার পাবে। আর এতে প্রত্যেকেই বেঁচে থাকার একটা সুযোগ পেতে পারবে।

আলোচনার মাধ্যমে এও সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, খড়ের টুকরোগুলো আমিই মুঠো করে ধরে রাখব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, জাহাজে খড় কোথায় মিলবে? পাতিপাতি করে খুঁজে কোথাও খড় মিলল না। শেষপর্যন্ত কয়েকটা ছোট ছোট কাঠের টুকরো জোগাড় করা গেল।

আমি কাঠের টুকরোগুলোকে নিয়ে জাহাজের এক কোণে চলে গেলাম। আর অন্য কোণে, আমার দিকে পিছন ফিরে আমার সহযাত্রী বন্ধুরা দাঁড়াল।

ডার্ক পিটার্সের পালা এলো সবার আগে। সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি মুঠো করে ধরে থাকা কাঠের টুকরোসমেত হাতটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে-ও নির্দিধায় ও নির্ভয়ে তা থেকে একটা টুকরো টেনে নিল। দেখা গেল, সে সবচেয়ে ছোট টুকরোটা টানেনি, ব্যস, সে প্রাণে বেঁচে গেল।

এবার এগিয়ে এলো অগাস্টাস। তার মুখেও ভয়ের চিহ্ন লক্ষিত হলো না। সে-ও সবচেয়ে ছোট টুকরোটা না টানায় বেঁচে গেল। এবারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়ে যাবে, আমার প্রাণরক্ষা হবে, নাকি প্রাণ দিতে হবে।

এবার ভাগ্য নির্ধারিত হবে পিটার্স আর আমার। ব্যস, তৎক্ষণাৎ আমার মধ্যে ক্রোধোন্মত্ত বাঘের হিংস্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। হতভাগা পার্কারের প্রতি আমার নির্মম-নিষ্ঠুর বিদ্বেষ যেন চড়চড় করে একেবারে তুঙ্গে উঠে গেল। তবে সে আর কতক্ষণ? ক্ষণিকের অনুভূতি মাত্র।

আমি এবার দুরুদুরু বুকে, ভীত-সন্ত্রস্ত মুখে আর চোখ দুটো বন্ধ করে অবশিষ্ট কাঠের টুকরো দুটো দিয়ে হাতটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম।

পার্কার মুহূর্তের জন্য আমার মুখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়েনিল। তারপর স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে রইল পুরো পাঁচটা মিনিট। এ সময়টুকুর মধ্যে আমি একটা বারের জন্যও তার মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাইনি, আসলে তাকাতে পারিনি।

পাঁচ মিনিট ধরে ভেবে চিন্তে শেষমেষ পার্কার আমার হাত থেকে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুততার সঙ্গে একটা কাঠের টুকরো টেনেনিল।

ব্যস, লটারি খেলা শেষ হল, মিটে গেল ভাগ্যের পরীক্ষা।

আমি তখনও সম্পূর্ণ অন্ধকারে, আমার পাল্লা মৃত্যুর পথে, নাকি বিরুদ্ধে ঝুঁকেছে।

কেবলমাত্র আমারই নয়, কারো মুখে টু-শব্দটিও নেই।

আমার ভেতর থেকে নিজের হাতের দিকে তাকাবার মতো শক্তি নিঃশেষে উবে গেছে।

আমার চোখ দুটো আগের মতো বুজেই রইল। শেষপর্যন্ত ডার্ক পিটার্স দুম্ করে আমার হাতটা চেপে ধরতে আমি চোখ মেলে তাকালাম।

পার্কারের ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখের দিকে চোখ পড়তেই আমি বুঝে নিলাম, আমি বেঁচে গেছি, আর তার বরাতে নেমে এসেছে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু।

না, আর এক মুহূর্তও আমার পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হলো না। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল। পর মুহূর্তেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম।

আমি সংজ্ঞা ফিরে পেতেই আমার চোখের সামনে সে বেচারার এক বিয়োগান্ত নাটক অনুষ্ঠিত হলো যার প্ররোচনায় সেই প্রধান চরিত্র। সে-ও বাধা না দিয়ে স্থবিরের মতো নিশ্চল-নিথরভাবে দাঁড়িয়েই রইল।

পিটার্স পিছন দিক থেকে আচমকা ছুরির ফলাটা তার পিঠে গিঁথে দিল। ব্যস, মুহূর্তে তার রক্তাপ্লুত দেহটা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। বারকয়েক হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করেই সে নিশ্চল হয়ে গেল। ব্যস, পিটার্সের আত্মা দেহ–খাঁচা ছেড়ে গেল।

এবার যা ঘটল তা ভাষায় বর্ণনা করাঅন্য কারো পক্ষে সম্ভব হলেও অন্তত আমার পক্ষে তো কিছুতেই সম্ভব নয়।

কেবলমাত্র এটুকু বললেই হয়তো যথেষ্ট যে, আমরা সদ্য মৃতের রক্তে আমাদের শুকিয়ে-ওঠা কলজেটাকে ভিজিয়ে, দীর্ঘ দিনের পিপাসাকে মিটিয়ে নিলাম। তারপর সবার সম্মতি নিয়ে তার কাঠের মতো শুকনো হাত-পা, মাথা আর নাড়িভুড়িগুলো সমুদ্রে ফেলে দিলাম। তারপর তার মাংস দিয়ে পেটের জ্বালা নেভাতে মেতে গেলাম। আর তার মাংস খেয়ে আমরা মাসের ১৭, ১৮, ১৯ আর ২০-চারটি স্মরণীয় দিন দিব্যি চালিয়ে দিলাম।

১৯ তারিখ। সে দিন পনেরো ২০ মিনিটের জন্য রীতিমত প্রবল বর্ষণ হয়ে গেল। আমরা বুদ্ধি করে একটা কেনেস্তারা টিনে বৃষ্টির পানি ধরে রাখলাম। অনুমানে বুঝলাম আধ গ্যালনের বেশি পানি ধরা সম্ভব হয়নি।

আধ গ্যালন। হ্যাঁ আধ গ্যালন পানি জমা করতে পাড়ার ফলেই আমার শরীর ও মনের বল অনেকাংশে বেড়ে গেল। কম কথা, অন্তত দিন-কয়েকের জন্য তো নিশ্চিন্ত।

টিনের পানি একুশ তারিখেই একেবারে তলে গিয়ে দাঁড়াল।

মাসের ২০ তারিখ। আমরা পরস্পরের মুখোমুখি বসে আমাদের মর্মান্তিক পরিস্থিতি কথাবার্তা বলতে লাগলাম। কথার ফাঁকে আচমকা একটা কথা আমার মনের কোণে উঁকি দেওয়ায় নতুন অর একটা আশা উঁকি দিল। বড় মাস্তুলটা কেটে সমুদ্রের ফেলে দেওয়ার পর পিটার্স কুড়ালটা আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। তখন সে বার বার সতর্ক করে দিয়েছিল, এমন এক জায়গায় রেখে দিতে যাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে চলে না যায়। এখন কথার ফাঁকে হঠাৎ আমার মাথায় মতলবটা খেলল, পানি তলিয়ে যাওয়া গুদামটার ওপরের ডেকের ছাউনি কোনোরকমে কুড়ুল দিয়ে বিচ্ছিন্ন করতে পারলে ভাগ্য খুললে খুলতেও পারে। তাতে খাবার দাবার পেয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র অসম্ভব নয়।

আমার মতলবটা সহযাত্রী বন্ধুদের কাছে বলতেই তারা সবাই সম্মতি দিল। ব্যস। আর কিছুমাত্র দেরি না করে আমরা কুড়ুলটা নিয়ে কাজে মেতে গেলাম।

ডার্ক পিটার্স আর আমি পালা করে কাঠের গায়ে অনবরত কুড়ুলের ঘা মারতে লাগলাম। বন্ধু অগাস্টাসের হাত ক্ষত থাকার জন্য তাকে কাজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হল। এদিকে আমাদের শক্তি-সার্মথ্যের তো দীর্ঘদিন ধরে তিল তিল করে খোয়া গেছে–শরীর খুবই দুর্বল।

কুড়ুল দিয়ে ঘা কয়েক মারার পরই আমরা ধরে নিলাম, কাঠ লোহার মতো শক্ত। কুড়ুলের ঘা মেরে মেরে একজনের ঢোকার মতো গর্ত তৈরি করতে দুজনের প্রচুর সময় লেগে যাবে। তা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু মোটেই উৎসাহ হারালাম না।

চাঁদের জ্যোৎস্নায় কুড়ুল চালিয়ে ২৩ তারিখের ভোরের আলো ফোঁটার আগে কেটে ফোঁকড় তৈরি করার কাজ সেরে ফেললাম।

ডার্ক পিটার্স স্বেচ্ছায় পানিভর্তি গুদামটার ভেতরে নেমে গেল।

একটু পরেই ডার্ক পিটার্স পানিভর্তি একটা বড়সড় টিন নিয়ে ওপরে উঠে এলো।

আমরা তিনজনই বুভুক্ষ জলপাইয়ের টিনটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সেগুলো গোগ্রাসে সাবাড় করে দিলাম।

আর দেরি নয়, ডার্ক পিটার্সকে আমরা আবার গুদামের ভেতরে নামিয়ে দিলাম। একটু পরেই সে একেবারেই অভাবনীয় এক কাণ্ড করে ফিরে এলো। সে তুলে আনল, কিছু শূকরের মাংস আর এক বোতল মদ। একেবারে বেশি খেতে ভরসা পেলাম না। সবাই এক ঢোক করে মদ খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলাম। আর এদিকে হাড়ের গায়ে লেগে থাকা দুপাউন্ডের মতো মাংস খাবার যোগ্য নয় দেখে আমরা ফেলে দিলাম। অবশিষ্ট ভালো মাংসটা তিনটি ভাগ করে তিনজনে নিলাম।

ক্ষিধের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে অগাস্টাস আর ডার্ক পিটার্স তখনই তাদের ভাগের মাংসটুকু গপাগপ উদরস্থ করে ফেলল। সামান্য একটু খেয়ে বাকি মাংসটুকু আমি ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম।

দীর্ঘ কঠোর পরিশ্রমের জন্য আমাদের শরীর আর চলছে না, রীতিমত টলছে। বাধ্য হয়ে শরীরটাকে একটু চাঙা করে নেবার জন্য আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম। আর তা নিতান্ত অপরিহার্যও ছিল।

আমার ঘুম ভাঙল দুপুরের দিকে। ঘুমের মাধ্যমে আমাদের শরীর ও মন কিছুটা অন্তত চাঙা তো হয়েছেই। আমরা নতুন উদ্যমে আবার খাবার জোগাড় করতে মেতে গেলাম।

সূর্য পাটে বসা পর্যন্ত ডার্ক পিটার্স আর আমি পালা করে ডুব দিয়ে দিয়ে সব মিলিয়ে তুলে আনলাম, শূকরের মাংসের বড়সড় একটা খণ্ড, চার টিন জলপাই ও প্রায় তিন গ্যালন ভালো মদ, আর যা সবচেয়ে খুশির ব্যাপার–গ্যালিপাগো জাতের ছোট একটা কচ্ছপ।

ক্যাপ্টেন বার্ণাডই গ্রামপাস বন্দর থেকে রওনা দেবার আগে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে সবে ফিরে-আসা জাহাজ ‘মেরিপিটস’ থেকে কচ্ছপটাকে সংগ্রহ করে জিইয়ে রেখেছিলেন।

এ অভিযানের বিবরণ দিতে গিয়ে ভবিষ্যতে এরকম কচ্ছপের কথা বার বার এসে পড়বে। গালিপাগাসে দ্বীপপুঞ্জে এ জাতের কচ্ছপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এর দৈহিক গড়ন বাস্তবিকই বিচিত্র। আর কাজকর্মের কথা বিবেচনা করে একে হাতি কচ্ছপ নামে সম্বোধন হয়। আর এরা পনেরো শত পাউন্ড ওজন বিশিষ্ট গ্যালিপাগো কচ্ছপ দেখেছি। এরা অনেকটা মরুভূমির উটের মতো। স্বভাবও উটের মতোই বটে। গলার কাছে একটা করে থলে থাকে যাতে প্রচুর পরিমাণে পানি ধরে রাখতে পারে। আমরা সে কচ্ছপটাকে গুদাম থেকে বের করে আনলাম। তার ওজন পয়ষট্টি থেকে সত্তর পাউন্ডের মতো হবে, খুব বেশি বড় নয়। আর এটা মেয়ে-কচ্ছপ। পেটে প্রচুর চর্বি জমে গেছে।

আমাদের চরম বিপদের সময় এরকম একটা কচ্ছপ হাতে পাওয়া তো অমূল্য সম্পদ হাতে পাওয়ারই সামিল। এক কোয়ার্টের বেশি পানিও তুলে আনি।

আমরা তিনজনই একসঙ্গে নতজানু হয়ে পরম পিতাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম। তাঁর কৃপা ছাড়া যে এমন অপ্রত্যাশিতভাবে একান্ত অপরিহার্য সম্পদ কিছুতেই হাতে পাওয়া যেত না।

.

১৩. ॥ ত্রয়োদশ অধ্যায় ।

চব্বিশে জুলাই। সকাল থেকেই আমরা অবিশ্বাস্য রকমের প্রফুল্লতা ও সতেজতা অনুভব করতে লাগলাম। ফলে আমাদের কাজের উৎসাহও অনেক গুণ বেড়ে গেল।

পনিভর্তি গুদামঘর থেকে আরও কিছু খাবার দাবার তুলে আনার জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। ঠিক তখনই বজ্রপাতসহ মুষলধারে কিছুক্ষণ বৃষ্টি হয়ে গেল।

আমরা আগের দিনের মতোই টিনটায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার চেষ্টা করতে যাব ঠিক তখনই আচমকা উত্তর দিক থেকে দমকা বাতাস বইতে শুরু করল।

বাতাসের বেগ ক্রমেই বেড়ে চলল। ফলে জাহাজটা মোচার খোলার মতো এমন মারাত্মক দোল খেতে লাগল যে, আমাদের দাঁড়িয়ে থাকাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তাই বৃষ্টির পানি ধরে রাখার পরিকল্পনাটা বাতিল করতেই হল।

দুপুর হতেই বাতাস অধিকতর তীব্র বেগে প্রবাহিত হতে লাগল। রাতের অন্ধকার নামা পর্যন্ত বাতাসের বেগ একই রকম রইল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমে ভয়ঙ্কর ঝড়ের রূপ ধারণ করল। ঝড়ের সে কী গর্জন। কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড় হল।

চব্বিশ তারিখে রাত কেটে কোনোরকমে পঁচিশ তারিখে ভোর হল।

সকালের দিকে ঝড়ের বেগ কিছুটা কমল। আগের রাতে সমুদ্রের পানি যে পরিমাণ ফুলে ফেঁপে উঠেছিল তা একটু একটু করে কমে অনেক নিচে নেমে গেছে। উন্মত্ত সমুদ্রের ঢেউ এখন আর আগের মতো মাথার ওপর তীব্র আক্রোশে আছড়ে পড়ছে না।

ভাগ্যের ব্যাপারই বলতে হয়–এত সতর্কতার সঙ্গে রাখা সত্ত্বেও সবটুকু শূকরের মাংস আর দুটিন পানি জমে থাকা মেঝের ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কয়েকটা মাত্র জলপাই আর পানিমেশানো মদ সহযোগে রাজা-বাদশার মতো মৌজ করে সকালের আহার সারলাম।

সমুদ্র কিছুটা শান্ত হলেও তার উদ্দামতা একেবারে শেষ হয়ে স্বাভাবিকতা ফিওে আসেনি–থেকে থেকে উত্তাল উদ্দাম হয়ে পড়ছে।

দুপুর হল। সূর্য ঠিক মাথার ওপর উঠে গেল। অনুমান করতে পারছি, উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাতাসের বেগে আমরা বিষুবরেখার কাছাকাছি কোনো স্থানে হাজির হয়েছি।

সবে সন্ধ্যার অন্ধকার একটু একটু করে নেমে আসতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই লক্ষ করলাম, অতিকায় একটা হাঙর লোলুপ দৃষ্টি নিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ভয়ে আমাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাবার উপক্রম হল। ব্যস, তাদের পরিশ্রমই সার হল।

জুলাইয়ের ছাব্বিশ তারিখ। গুদামঘরে নেমে হণ্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করেও খাদ্যবস্তু কিছুই সংগ্রহ করে আনতে পারলাম না। আবার হতাশার মেঘ আমাদের ঘিরে ধরল।

সাতাশে জুলাইয়ের ভোর হল। অবস্থার কিছুমাত্রও পরিবর্তন হলো না। আমরা থেকে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলাম। বিকেলের দিকে সূর্যের তেজ প্রচণ্ড হয়ে উঠল। আমরা সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে ভেজা পোশাক-আশাক শুকিয়ে নিলাম। সমুদ্রে স্নান সেরেও স্বস্তি কম পেলাম না।

পরিস্থিতি অনুকূল হয়ে ওঠায় কচ্ছপটা, পানির পাত্র, জলপাইয়ের টিন প্রভৃতি বাধা বাঁধি করে রাখলাম। বলা তো যায় না কখন আবার বিধি বাম হয়ে যায়। দিনভর সমুদ্র শান্তই রইল, এতটুকু উন্মাদনাও প্রকাশ পায়নি।

উনত্রিশে জুলাই। আবহাওয়া এতটুকু পরিবর্তন হলো না। এদিকে এক সর্বনাশা কাণ্ড ঘটতে চলেছে। লক্ষ্য করলাম, আগাস্টাস-এর হাতের ক্ষতটা পচতে শুরু করেছে। সে তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় এলিয়ে পড়ে রইল। থেকে থেকে কেবল তার তৃষ্ণার কথা বলছে। কিন্তু ব্যথা বেদনার তীব্রতার কথা মোটেই বলছে না। তার রোগমুক্তির ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। আমাদের সাধ্যের মধ্যে যা রয়েছে, তার জন্য বরাদ্দ পানির পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিলাম। সত্যি কথা বলতে কি, এতে আমাদের ত্যাগ স্বীকার তো করতেই হল। সেদিনটা ছিল ত্রিশে জুলাই। আবহাওয়া গুমোট। অস্বাভাবিক গরম। আর বাতাসও নেই। মনটা হঠাৎ আনন্দে নেচে উঠল। অতিকায় একটা হাঙরকে আমাদের চারিদিকে লোলুপ দৃষ্টি মেলে ঘুর ঘুর করতে দেখলাম। সারাটা সকাল নরমাংস লোভি জন্তুটা আমাদের কাছাকাছি ছোঁক ছোঁক করল। আমরাও কম লোভের পরিচয় দেইনি। পাল বাঁধার কাছির ফাস তৈরি করে হতচ্ছাড়াটাকে ধরার জন্য বহুভাবে চেষ্টা চালাতে লাগলাম। কিন্তু শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিতেই হল।

আমার বন্ধুবর অগাস্টাসের অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে হতে সে এখন একেবারেনির্জীব হয়ে পড়েছে। একে ক্ষতের যন্ত্রণা, তার ওপর পুষ্টির নিতান্তই অভাব তো রয়েছেই।

সব শেষে সে কয়টা জলপাই টিনের তলায় পড়েছিল আজ সন্ধ্যায় সেগুলো খেয়ে সাবাড় করে দিলাম। আর পানি? দুর্গন্ধ ছাড়ছে। মদ না মিশিয়ে সে পানি গলা দিয়ে নামানোই সম্ভব নয়।

আমরা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। সকালে কচ্ছপটাকে কেটে তার মাংস দিয়ে কাটাতে হয়েছে। জাহাজের খোলের পরিস্থিতিটাই আমাদের এ নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার কারণ।

ভোরের আলো ফুটে ওঠার একটু পরেই আমরা কচ্ছপটাকে জবাই করার কাজে মেতে গেলাম। কাজ মিটিয়ে ফেলতে দেরি হলো না। কচ্ছপটাকে ছোট, কুড়িয়ে কাড়িয়ে যে মাংসটুকু উদ্ধার করার হলো তার ওজন খুব বেশি হলেও পাউন্ড দশেক হবে। মাংসের একটা অংশ পৃথক করে টুকরো টুকরো করে কেটে নিলাম। উদ্দেশ্য ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করে রাখা। তাই সেগুলোকে জলপাইয়ের টিন আর মদের বোতলে ভরে রাখলাম। এভাবে তিন পাউণ্ডের মতো কচ্ছপের মাংস ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হল।

আমরা আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, অবশিষ্ট মাংসটুকু খেয়ে সাবাড় না করা অবধি সঞ্চিত মাংসে ভুলেও হাত দেওয়া চলবে না। এও সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, প্রতিদিন আমরা চার আউন্স মাংস খাব। এভাবে চালালে সম্পূর্ণ মাংসে আমরা তের দিন চালিয়ে নিতে পারব।

সন্ধ্যার কিছু আগে বজ্রবিদ্যুৎসহ বৃষ্টি শুরু হল। অল্পেতেই বৃষ্টি থেমে গেল। বহু চেষ্টা করে আধ পাইট বৃষ্টির পানি ধরতে পারলাম। পাত্রের সবটুকু পানিই অগাস্টাসের জন্য বরাদ্দ করা হল। এছাড়া উপায়ও কিছু নেই। কারণ, তার অবস্থা শেষ ধাপে পৌঁছে গেছে। বৃষ্টি নামার পরও তার অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না।

অগাস্টাসের আহত হাতটার দিকে তাকালে কেবল সে মনটা বিষিয়ে ওঠে তাই নয়, আচমকা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কবজি থেকে একেবারে কাঁধ পর্যন্ত কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। আলকাতরার প্রলেপ দিলেও বুঝি কোনোকিছু এতখানি কালো দেখায় না। পা দুটোতে হাত বুলিয়ে মনে হলো বরফও বুঝি এর চেয়ে কম ঠাণ্ডা।

অগাস্টাসের অবস্থা দেখে আমার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। যে কোনো মুহূর্তে তার দেহ থেকে আত্মাটা বেরিয়ে যেতে পারে।

অগাস্টাস শুকিয়ে একেবারে পোড়া কাঠ হয়ে গেছে। আমাকে নিয়ে ন্যান্টাকেট থেকে যাত্রা করার সময় এক শ সাতাশ পাউন্ড ছিল তার দৈহিক ওজন। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে খুব বেশি হলেও পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ পাউন্ড।

তার চোখের মণি দুটো কোটরের অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। সে দুটোর উপস্থিতিই বোঝা যায় না। মুদু কি এ-ই? যে খাদ্যবস্তু চিবোনোর ক্ষমতাটুকুও তার মধ্য থেকে লোপ পেয়েছে। এমনকি পানি পর্যন্ত গলা দিয়ে নামতেও যেন প্রাণটা বেরিয়ে যাবার উপক্রম হয়। উ। তার কষ্ট চোখের সামনে দেখলেও চোখ দুটো জলে ভরে ওঠে।

জুলাই মাস গিয়ে অগাস্টের পয়লা তারিখ এলো। আবহাওয়া আগের মতোই শান্ত স্বাভাবিক। রোদের তাপ অস্বাভাবিক। তৃষ্ণার ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে। বোতলের পানি পুরোপুরি দূষিত হয়ে গেছে। পোকা জন্মেছে। পোকাগুলোকে ছুটোছুটি করতে দেখা যাচ্ছে। তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ওই পানির সঙ্গেই মদ মিশিয়ে বার বার গলাটাকে ভিজিয়ে নিতে লাগলাম। কিন্তু তৃষ্ণা তো মিটছে না।

বুকের জ্বালা নেভাতে সমুদ্রে খুব করে স্নান করলাম। কিছুটা স্বস্তি পেলাম বটে। হাঙরের ভয়ে বুক কাঁপে, বেশি সময় ধরে স্নান করতেও ভরসা হলো না।

এদিকে আমি ক্রমেই নিঃসন্দেহ হয়ে পড়তে লাগলাম, অগাস্টাসকে বাঁচানো সম্ভব নয়। মৃত্যু শিয়রে ঠায় দাঁড়িয়ে।

ঘণ্টা কয়েক অসাড়ভাবে পড়ে থাকার পর অগাস্টাস বারোটার কাছাকাছি শেষ বারের মতো নিশ্বাস ফেলল। ব্যস, খতম। বন্ধু অগাস্টাসের মৃত্যুতে আমরা যারপরনাই মর্মাহত হলাম। দিনভর বিষণ্ণমনে মৃতদেহটা আগলে বসে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসর পর পাষাণে বুক বেঁধে অগাস্টাসের মৃতদেহটা সমুদ্রে ফেলে দিলাম। অন্ধকারে, ঢেউয়ের মুখে পড়ে সেটা কোথায় যে তলিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। আমার ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

আগস্টের দুই তারিখ। আবহাওয়ার কোনো পরিবর্তনই হলো না। বাতাস ও সমুদ্র আগের মতোই শান্ত। আর ভ্যাপসা গরম তো আছেই।

আমি পূর্বদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ মন আর ক্লান্ত অবসন্ন প্রায় শরীরে ভোরটাকে দেখতে লাগলাম। অসহ্য বোতলের পানি একেবারেই পানের উপযুক্ত নয়। তৃষ্ণায় শেষপর্যন্ত সাগরের পানির সঙ্গে মদ মিশিয়ে গিলতে আরম্ভ করলাম। একবারের বেশি পারলাম না। ঠেলে বমি বেরিয়ে আসতে চাইল। উপায়ন্তর না দেখে সে চেষ্টাও ছেড়ে দিতেই হল।

গত রাতে বন্ধু অগাস্টাসের মৃতদেহটা সমুদ্রে ফেলে দেবার পর উৎপাত নতুন রূপ নিয়ে দেখা দিল। হাঙরের ছোঁকছোঁকানি বেড়ে গেল। আসলে নরমাংসের লোভেই তারা এমন উৎপাত জুড়ে দিয়েছে। তার এমন লোলুপদৃষ্টিতে আমাদের দিকে বার বার তাকাতে লাগল যে, নাগালের মধ্যে পেলেই যেন ছিঁড়ে ফেঁড়ে খেয়ে নেবে।

হায় ঈশ্বর! একী মহা ফাঁপরেই না পড়া গেল। এক দিকে বুকফাটা তৃষ্ণার যন্ত্রণা আর অন্যদিকে ক্ষুধার্ত হাঙরের নিরবচ্ছিন্ন ছোঁক ছোঁকানি। রাতভর বিন্দ্ৰিই কাটাতে হল। কেউ-ই আতঙ্কে চোখের পাতা একত্র করতে পারলাম না।

৩ আগস্ট। আমাদেও নিরবচ্ছিন্ন দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান ঘটার কিছুমাত্র সম্ভাবনাই দেখলাম না।

এদিকে জাহাজটার পরিস্থিতিও খুবই খারাপ। এটা একদিকে এত বেশি কাৎ হয়ে পড়েছে যে, যে কোনো মুহূর্তে ভয়ঙ্কর অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া ডেকের ওপর দাঁড়ানো পর্যন্ত যাচ্ছে না। আর ঘুমের তো দফারফা।

অগাস্টের চার তারিখের সকাল হল। ভোরের আলো ফোঁটার আগেই বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল জাহাজটা একটু একটু করে সমুদ্রের বুকে তলিয়ে যাচ্ছে। উলটাতে শুরু করেছে। জাহাজটাকে–নিজেদের বাঁচাবার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম। সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টা করে দেখলাম। গোড়ার দিকে ধীরে ধীরে তারপর শেষ-মেষ একেবারে দুম্ করে জাহাজটা অবিশ্বাস্যভাবে উলটে গেল। মুহূর্তের মধ্যে আমরাও আছাড় খেয়ে সমুদ্রে পড়ে খাবি খেতে লাগলাম। কারণ প্রকাণ্ড জাহাজটার খোলের তলায় চাপা পড়ে আমার তখন কয়েক বাও পানির নীচে অবস্থান করছি।

আমি তখন পিতৃদত্ত জীবনটার আশা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতীক্ষায় রয়েছি।

আমি কিন্তু সে খারাপ অবস্থায় হাবুডুবু খাবার সময় ভুলেও ভাবতে পারিনি আকাশচুম্বী এক ঢেউয়ের ধাক্কায় আমাদের জাহাজটা আবার হঠাৎ করে সোজা হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু সত্যি তা-ই ঘটে গেল। আমাকে একেবারে অবাক করে দিয়ে জাহাজ আবার সত্যি সত্যি স্বাভাবিকতা ফিরে পেল।

আমি কিন্তু তাতে ২০ গজ দূরে ছিটকে গেছি। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুকে পড়ে খাবি খাচ্ছি। পিটার্সকে চোখে পড়ছে না।

সমুদ্রে পড়ে হাবুডুবু খেতে খেতে হঠাৎ একটা তেলের পিপে ভাসতে দেখলাম। আমার সঙ্গে সেটার ব্যবধান ফুট-কয়েকের বেশি নয়। আর জাহাজের হাজারো খুটিনাটি জিনিস সমুদ্রে এখানে-ওখানে ভেসে বেড়াচ্ছে।

সেই অসহায় অবস্থায় আমার সবচেয়ে বড় ভয় হাঙরের পেটে গিয়ে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে না হয়। একটু আগেও তো যমদূতদের ধারে কাছেই ছোঁক ছোঁক করতে দেখেছি। তারা যাতে কাছে ঘেঁষতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে, প্রচুর পরিমাণে পানি ছিটিয়ে ঢেউয়ের তালে তালে এগোতে লাগলাম।

আমার ভাগ্যের জোর আছে বটে। নিতান্ত ভাগ্যের জোরেই কোনোরকমে জাহাজটার কাছে পৌঁছতে পারলাম। কিন্তু সে মুহূর্তে ক্লান্তিতে হাত-পা এমন অবশ হয়ে পড়েছিল যে পিটার্সের সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া আমার পক্ষে জাহাজে ওঠা কিছুতেই সম্ভব হত না। সে জাহাজের খোলের ওপর উঠে একটা কাছি ঝুলিয়ে দেয়, আমি সেটা ধরে ঝুলতে ঝুলতে জাহাজে উঠে যাই।

কোনোরকমে এখনকার মতো ভয়ানক বিপরীত অবস্থা থেকে অব্যাহতি পেলাম। এবার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, নিশ্চিত নিরম্বু উপবাস। ডেকে যৎসামান্য খাবার দাবার যা-কিছু ছিল সবই জাহাজ উলটে যাওয়ায় ঢেউয়ের ঝাঁপটায় সাগরের পানিতে স্থান নিয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে খাবার-দাবার মেলার কোনো সম্ভাবনাই দেখছি না। হতাশা আর হাহাকার বুকে নিয়ে আমার দুজনই অবোধ শিশুর মতো বিলাপ পেড়ে কাঁদতে লাগলাম। জানি, কান্নাকাটি করা নিরর্থক, তবু মন মানবে কেন?

যাবতীয় মন্দেরই একটা ভালো দিক হয়তো থাকে। এক্ষেত্রেও তা অবশ্যই লক্ষিত হল। আমরা কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের মতো হাঁটাহাঁটি করতে করতে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেললাম এক ধরনের সামুদ্রিক গেঁড়ি জাহাজটার তলা থেকে খোল পর্যন্ত দু-তিন ফুট জায়গা জুড়ে সেঁটে রয়েছে।

গেঁড়ি খাদ্য হিসেবে উপাদেয়, আর পুষ্টিগুণও যথেষ্টই বর্তমান।

হিসাব করে দেখলাম অপ্রত্যাশিতভাবে সে খাদ্যবস্তু আমাদের হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে, তা দিয়ে আমরা অনায়াসেই অন্তত এক মাস তো কাটিয়ে দিতে পারবই।

অভাবনীয় উপায়ে আমাদের খাবারের সমস্যা মিটলেও পানীয় জলের সমস্যা আরও তীব্রতর রূপ নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হল।

ডার্ক পিটার্স রাতে কোনোরকমে চোখ বুজতে পারলেও আমি কিন্তু তীব্র পানিতৃষ্ণার কষ্টের জন্য দুচোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারলাম না। এভাবে বিদ্রি রাত কাটালাম। সে কী দূর্বিষহ যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার তা একমাত্র ভুক্তভোগি ছাড়া অন্য কারো পক্ষে উপলব্ধি করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

পাঁচই আগস্টের সকাল। হালকা বাতাসের চাপে আমরা সামুদ্রিক শ্যাওলার দামের ভেতর দিয়ে ধীর মন্থর গতিতে অগ্রসর হতে লাগলাম।

নিছকই ভাগ্যের জোরে আমরা শ্যাওলা দামের ভেতর থেকে এগারোটা ইয়া বড় বড় কাঁকড়া ধরে ফেললাম। সেগুলো দিয়ে আমরা দুজনে মৌজ করে আহার সারলাম। আশ্চর্য ব্যাপার সেগুলো উদরস্থ করার পর সেঁড়ি খাওয়ার মতো অত তীব্র পানিকষ্টে ভুগলাম না।

আর একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম, সামুদ্রিক শ্যাওলার পুরু আস্তরণ চারদিক ছেয়ে থাকায় হাঙরের ছোঁক ছোঁকানি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সাহসে ভর করে দীর্ঘ সময় সমুদ্রের পানিতে স্নান করে শরীর ও মন তৃপ্তি করে নিলাম। মাংসলোলুপ হাঙরগুলো যখন বেপাত্তা হয়ে গেছে তখন প্রাণনাশের সম্ভাবনা নেই। তাই নির্ভয়ে সমুদ্রস্নান সারা সম্ভব হল। পরম তৃপ্তি পাওয়ায় গভীর ঘুমের মধ্যে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলাম।

আগস্ট মাসের ১০ তারিখ, সকাল। চোখে সূর্যের আলো পড়ায় সকাল সকালই আমাদের ঘুম চটে গেল। সকালে আকাশ নির্মেঘই ছিল। কিন্তু দুপুর হতে না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। জাহাজে পানির ড্রাম বা টিন না থাকায় আফসোসে নিজের চুল নিজেরই ছিঁড়তে ইচ্ছে করছিল।

উপায়ান্তর না দেখে শেষমেষ গায়ের জামা খুলে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে তা নিঙড়ে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া জিভ, গলা আর ফুসফুস ভিজিয়ে নিলাম। উফ! কী যে তৃপ্তি, কী যে অনির্বচনীয় শান্তি, তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব নয়। সত্যি কথা বলতে কি, দিনটা ভালোই কাটল।

আগস্টের ১৭ তারিখ। ভোরের আলো ভালোভাবে ফোঁটার আগে আমরা দুজনের একই সঙ্গে একটা পাল হঠাৎ নজরে পড়ল। অনুসন্ধিৎসু নজরে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম, সেটা আমাদের দিকে এগোচ্ছে।

অপ্রত্যাশিত, একেবারে অকল্পনীয় ব্যাপারটায় আমাদের মন-প্রাণ আনন্দে নাচানাচি করতে লাগল। আমরা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য যা-কিছু করা সম্ভব সাধ্যমত সবই করলাম। হাত নেড়ে, গায়ে জামা খুলে তাদের দিকে বার বার নাড়াতে লাগলাম। শেষপর্যন্ত গলা চড়িয়ে চিৎকার জুড়ে দিলাম।

তখন আমাদের আর সেই দূরের জাহাজটার মধ্যে ব্যবধান মাইল পনের তো হবেই।

হাত ও জামা নাড়ানাড়ি আর গলাফাটা ডাকাডাকির মধ্য দিয়ে ঘন্টা খানেক কেটে গেল।

ইতিমধ্যে জাহাজটা আরও কাছে এগিয়ে আসায় জাহাজটাকে ভালোভাবে দেখা সম্ভব হল। তার বড় পালটার গায়ে কালো বল আঁকা, দেখলাম। আর এও অনুমান করতে পারলাম, বাণিজ্য জাহাজ নয়, যাত্রী-জাহাজ। যাত্রী বোঝাই।

নবাগত জাহাজটা আরও সামান্য এগিয়ে এলে লক্ষ্য করলাম, ডেকের ওপরে সবাই উত্তেজিতভাবে হাঁটাহাঁটি করছে।

মুহূর্তের মধ্যে ওই জাহাজটার গায়ে একটা বড়সড় বৃটিশ পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হল। আর সেটা সোজা আমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল।

তারপর মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা দুজন–ডার্ক পিটার্স আর আমি নবাগত বৃটিশ জাহাজটার কেবিনে আশ্রয় পেলাম। জাহাজটার নাম ‘জেন গাই’। লিভারপুল থেকে এসেছে। তবে যাত্রী-জাহাজ নয়। আগে ভুল অনুমানই করেছিলাম। সীলমাছ শিকার আর বাণিজ্যিক যাত্রা চলেছে। ক্যাপ্টেন গাই একে প্রশান্ত মহাসাগর আর দক্ষিণ সাগর অঞ্চলে নিয়ে চলেছেন। আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় নতজানু হয়ে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ না জা নিয়ে পারলাম না।

.

১৪. ॥ চতুর্দশ অধ্যায় ॥

‘জেন গাই’ জাহাজটার আয়তন বাস্তবিকই সুবিশাল। বহু পাল বিশিষ্ট। আর তার গঠন প্রকৃতিও চোখে লাগার মতোই বটে। ১৮০ টন মাল বহন করার ক্ষমতা রাখে। কেবল এই নয় চলে দ্রুতগতিতে। অস্বীকার করব না, ইতিপূর্বে আমি কোনোদিনই এমন দ্রুতগামিসম্পন্ন জাহাজ দ্বিতীয় আর একটি দেখিনি।

খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, জাহাজে পঁয়ত্রিশজন নাবিক কাজে নিযুক্ত। আর আছেন ক্যাপ্টেন ও মেট। একটা ব্যাপার আমার নজর এড়ালো না। বাণিজ্য-জাহাজের বিপদ তো যে কোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। সে রকম সম্ভাব্য বিপদ আপদের কবলে পড়লে নিষ্কৃতি পাওয়ার মতো অস্ত্রপাতিতে জাহাজটা সুসজ্জিত নয়। অর্থাৎ আত্মরক্ষার ব্যবস্থাদি তো খুবই সাধারণ।

সামান্য পরিচয়ের মাধ্যমেই বুঝতে পারলাম, ক্যাপ্টেন গাই যথার্থই একজন সজ্জন। দক্ষিণ অঞ্চলে সমুদ্রযাত্রায় তার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। জীবনের একটা বড় অংশ তিনি এ-কাজেই নিজেকে লিপ্ত রেখেছেন। তবে একটা কথা খুবই সত্য যে, সে গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়ে তিনি জাহাজ ভাসিয়েছেন সে কাজে তার চরিত্রে অত্যাবশ্যক কর্মদক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় উৎসাহ উদ্দীপনার কিছু আছেই।

ক্যাপ্টেন যে জাহাজটা নিয়ে যাত্রা করেছেন তিনি সেটার মালিকানার একজন অংশীদার। আর যে কোনো রকম বাণিজ্য সম্পদ নিয়ে দক্ষিণ অঞ্চলের সমুদ্রের বুকে হরদম যাতায়াত করার হিম্মৎ তিনি রাখেন। তাই তো তিনি হরেকরকম দ্রব্যসামগ্রিতে জাহাজটা বোঝাই করে নিয়েছেন।

দশই জুলাই জেন গাই জাহাজটা লিভারপুল বন্দর ছেড়ে এসেছে। পঁচিশে জুলাই কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করেছে। আর উনত্রিশ তারিখে ভার্ড দ্বীপপুঞ্জেও হাজির হয়েছে। সেখান থেকে নুন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রি জাহাজে তুলেছে।

ভাউস অন্তরীপ থেকে গাই নোঙর তুলেছে তেসরা আগস্ট। সেখান থেকে যাত্রা করে দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল ধরে ব্রাজিলের দিকে ঘুরে গেছে, সেখান থেকেই বিষুবরেখাকে অতিক্রম করার লক্ষ্য নিয়ে।

ইউরোপ থেকে উত্তমাশা অন্তরীপগামী জাহাজগুলো সাধারণত সে পথেই যাতায়াত করে। অথবা পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জেও যেতেও সেই পথই ব্যবহার করে।

ক্যাপ্টেন গাই কেন যে কেরগুলেন্স ল্যাণ্ড-এ প্রথম যাত্রাবিরতির ইচ্ছা অন্তরে পোষণ করতেন তা আমার জানা নেই।

ক্যাপ্টেন গাই যেদিন আমাদের অসহায় অবস্থা থেকে রক্ষা করার সুমহান উদ্দেশ্য আমাদের তুলে নিয়েছিলেন, সেদিন সেন্ট রোখ অন্তরীপে, পশ্চিমে ৩১° ডিগ্রি দ্রাঘিমায় জাহাজটা অবস্থান করছিল। অর্থাৎ তখন আমরা অন্তত ৩৫ ডিগ্রি উত্তর থেকে দক্ষিণে ভেসে চলে এসেছিলাম। ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও সম্পূর্ণ সত্য।

আমাদের জেন গাই জাহাজে তুলে নিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকেই যে কেবল রক্ষা করেছিল তা-ই নয়, সহানুভূতিপূর্ণ আচরণও করতে লাগলেন।

আমরা আশ্রয় লাভের পর এক পক্ষকালের মধ্যেই ডার্ক পিটার্স আর আমি পুরোপুরি সুস্থ স্বাভাবিকতা ফিরে পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে কু-গ্রহের খপ্পরে পড়ে আমরা যে অন্তহীন দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছি আজ সেসব কথা ভাবলে নিতান্তই দুঃস্বপ্ন বলে মনে হতে লাগল। তা যেন আমাদের জীবনে বাস্তবে ঘটেনি।

পর পর কয়েকটা সপ্তাহ কেটে গেল। ইতিমধ্যে বলার মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

ষোলই সেপ্টেম্বর। জাহাজটা উত্তমাশা অন্তরীপের কাছাকাছি সমুদ্রে হাজির হল। এই প্রথম সেটা প্রলয়ংকর একটা ঝড়ের কবলে পড়ল।

তীব্র ঝড় ঝাঁপটার মধ্যে দিয়ে আমাদের সারাটা রাত কাটল। জাহাজটা এই ডোবে কি সেই ডোবে।

পূর্ব-আকাশে রক্তিম ছোপ ফুটে উঠল। ভোরের দিকে ঝড়ের তাণ্ডব কেটে গিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠল।

ক্যাপ্টেন গাই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে আমাকে বললেন ‘আমাদের ভাগ্যের জোর আছে বটে। ঝড়টা অল্পের ওপর দিয়েই আমাদের রেহাই দিয়ে গেল। এ অঞ্চলের ঝড় অধিকাংশ সময়েই খুবই প্রলয়ংকর হয়ে থাকে।

সেটা ছিল ১৩ অক্টোবর। আমরা দূর থেকে প্রিন্স অ্যাডয়ার্ড দ্বীপটা দেখলাম। ৩৭° ৪৬, পূর্ব দ্রাঘিমা ৪৫° ৪৩ দক্ষিণ দ্রাঘিমায় সেটা অবস্থিত। অর্থাৎ ষোলই অক্টোবর আরও দুদিন একনাগাড়ে চলার পর জেনগাই ক্রোজেট দ্বীপ ছাড়িয়ে গেল।

১৮ তারিখে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের বুকে অবস্থিত ফেরগুলেন দ্বীপে আমরা হাজির হলাম। আর সেখানেই আমরা ক্রিস্টমাস বন্দরে জাহাজ নোঙর করলাম।

ফেরগুলেন দ্বীপটা উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে পূর্ব দক্ষিণে প্রায় ৮০০ লীগ দূরে অবস্থান করছে।

১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে এ দ্বীপটা আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কর্তা ফরাসি নাবিক ডি ফেরগুলে। তিনি ধারণা করেছিল, এ-দ্বীপটা সুবিশাল দক্ষিণ মহাদেশের একটা অংশ।

দ্বীপটা আবিষ্কারের খবরটা ব্যারণ ডি কারগুলেম নিজের দেশে পাঠিয়ে দিলে সেখানে তো রীতিমত হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়।

ব্যাপারটার দিকে সরকারের নজর পড়ল। সরকার এর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্তনিল। শেষপর্যন্তনিলও।

সরকার পক্ষ থেকে নাবিক ব্যারণ ডি কারগুলেমকে দ্বীপটাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করে বিশদভাবে বিবরণ পেশ করার জন্য নিযুক্ত করল।

ব্যাস, এ কাজ করতে গিয়ে ভুলটা নজওে পড়ে গেল। পরবর্তীকালে, সতেরশ সাতাত্তর খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন কুক সে দ্বীপটায় জাহাজ নোঙর করেন। তিনি দ্বীপটাকে ঘুরেফিরে দেখে এর নামকরণ করলেন ‘নির্জন দ্বীপ’। আর সেটা পাহাড়ে ঘেরা ও সবুজে ঢাকা। পাহাড়গুলোর শিখর দেশ সর্বদা বরফাবৃত থাকলেও তারা কিন্তু খুব উঁচু নয়। তিনি এও বুঝতে পারলেন, সেখানকার বহু দ্বীপের মধ্যে সুযোগ সুবিধার দিক থেকে ক্রিস্টমাস দ্বীপই সেরা। আর অন্য দ্বীপগুলোর কোনো-না-কোনো সমস্যা আছেই।

আমাদের জাহাজ জেন গাই ক্রিস্টমাস বন্দরে নোঙর করা মাত্র প্রধান মেট জাহাজ থেকে নৌকা সমুদ্রের বুকে নামিয়ে দিলেন। সেটা নিয়ে তিনি সীল মাছের সন্ধানে যাত্রা করলেন। আর ক্যাপ্টেন ও তার এক যুবক আত্মীয় জাহাজেই রয়ে গেলেন। শুনলাম, দ্বীপের ভেতরে তাদের কি যেন একটা কাজ রয়েছে।

এক সময় আমি দেখলাম, ক্যাপ্টেন মুখ আঁটা একটা চিঠি বোতলের মধ্যে ভরে তার ছিপিটা এঁটে দিলেন। তারপর সেটাকে হাতে নিয়ে তিনি সেখানকার উচ্চতম পাহাড়টার দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর উদ্দেশ্য–আমার জানা নেই, জানার চেষ্টা করার প্রয়োজন বোধ করেনি।

ডার্ক পিটার্স আর আমি করার মতো কোনো কাজ না থাকায় সীল মাছের সন্ধানে। উপকূল ধরে এগোতে লাগলাম।

প্রায় তিন মাস ধরে চেষ্টা চালিয়ে আমরা মাত্র তিনশো পঞ্চাশটা সীল মাছ শিকার করে তাদের চামড়া জাহাজে আনতে পারলাম।

এগারো দিন বাদে আমরা জাহাজে ফিরে এলাম। ক্যাপ্টেন গাই আর তার ভাইপো জাহাজেই রয়েছে দেখলাম। আমরা আবার তাদের সঙ্গে মিলিত হলাম। তাদের মুখে গল্প শুনে আমরা জানতে পারলাম সারা দ্বীপটা ঘুরে তারা নিঃসন্দেহ। হয়েছেন, স্থানটা জনমানবশূন্য।

ফেরগুলেম দ্বীপে আর থাকার দরকার নেই মনে করায় আমরা অহেতুক সেখানে জাহাজটাকে আর দাঁড় করিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ না করায় সেখান থেকে আমরা নোঙর তুললাম।

জেনগাই বন্দর ছেড়ে গভীর সাগরের দিকে এগিয়ে চলল।