1 of 2

ন্যারেটিভ আর্থার গর্ডন পাম – ০৫

০৫. ॥ পঞ্চম অধ্যায় ॥

কালো গাট্টাগোট্টা পাচকটা অগাস্টাসকে সতর্ক করে দিয়ে চলে যাবার পর তার মনটা খুব দুর্বল হয়ে পড়ল। আর এটা তো হবারই কথা। প্রথমবার ভাগ্যের জোরে তার প্রাণ রক্ষা পেলেও দ্বিতীয়বার বন্দি হবার পর আর বাঁচার আশা মন থেকে নিঃশেষে মুছে গেল।

ফলে বাধ্য হয়েই মনস্থির করে ফেলল, এবার যে বা যারাই নিচে, তার কাছাকাছি আসবে তাকেই সে কেঁদে কেটে আমার অসহায় অবস্থার কথা বলবে। অন্ধকার খাঁচাটির ভেতরে থেকে একটু একটু নির্মম-নিষ্ঠুর মৃত্যুর শিকার হওয়ার চেয়ে আর কিছু না হোক বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রাণে বেঁচে থাকার মতো একটা না বোঝাপড়ায় তো আমি আসতেই পারব। এতে আমার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার হাত পায়ের বেড়ি। নইলে যে করেই হোক উপায় একটা যে করতেই পারত এতে তিলমাত্র সন্দেহই নেই।

গোড়ার দিকে তার ধারণা হয়, লোহার বেড়ি খোলার চেষ্টা নিতান্তই পাগলের। খেয়াল। কিন্তু বার কয়েক মোচড়া মুচড়ি আর টানাটানি করার পর সে বুঝল, হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেবার মতো ব্যাপার মোটেই নয়। যদিও ব্যাপারটা খুবই কষ্টসাধ্য তবুও জোর কদমে চেষ্টা চালিয়ে হাতটা চাপাচাপি করে হাত কড়াটার ভেতর দিয়ে কোনোরকমে গলিয়ে নেওয়া সম্ভব হতেও পারে। অতএব কাজটা নিছকই অবাস্তব কল্পনা নয়।

অগাস্টাস এবার নিজের ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাতে শুরু করল।

অগাস্টাস দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কোনোরকমে ডান হাতটাকে হাতকড়াটা থেকে হাত বের করে ফেলল। এবার টানাটানি করে পায়ের বাঁধনটাকেও আলগা করেনিল।

হাত-পায়ের বাধন মুক্ত করতে না করতেই হঠাৎ কার যেন কণ্ঠস্বর কানে এলো। ব্যস, মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে সে আবার ঝটপট হাতকড়াটা হাতে পরেনিল। আর দড়ি দিয়ে পা দুটোকেও বেঁধেনিল।

ডার্ক পিটার্স নিচে নেমে বাঘা নামধারী কুকুরটা তার সঙ্গেই রয়েছে।

বাঘার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক তা বন্ধু অগাস্টাসের তো আর অজানা নয়। এ জন্যই তো আমাকে অন্ধকার খুপরিটার মধ্যে আটকে রেখে সে সোজা আমাদের বাড়ি চলে যায়। বাঘাকে নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাহাজে ফিরে আসে। বাঘাকে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে রাখে।

ডার্ক পিটার্স বাঘাকে দেখতে পায়। সে তাড়াতাড়ি বাঘাকে নিয়ে আমার বন্ধুর কাছে পৌঁছে দিল।

পিটার্স বিদায় নিলে বন্ধু অগাস্টাস ব্যস্ততার সঙ্গে হাতের বেড়ি ও পায়ের বাঁধন খুলে ফেলে পকেট থেকে ছুরিটা বের করে তার তীক্ষ্ণতা পরীক্ষা করেনিল।

এবার সাধ্যমত নিঃশব্দে পাটাতনটা কাটতে মেতে গেল। সেটার নিচেই যে আমার অন্ধকার খাঁচাটা এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ।

দিনভর আর কেউ আমার কুঠুরিতে ঢুকল না। অগাস্টাসও সারাদিন সরারাত এক নাগাড়ে কাজে লেগে থেকে পাটাতনের কাঠ কেটে আমার কাছে পৌঁছাবার কাজে মেতে রইল। কোনোক্রমে একটা ফাঁক বের করে ফেলল। এবার সেটা দিয়ে নিজেকে গলিয়ে দিয়ে নিচে নেমে এলো।

এখানে বলে রাখা দরকার, বিদ্রোহীরা ঘটনাগুলো ঘটাবার পর থেকে জাহাজের গলুইয়ের এদিকটায় রাতে কেউই ঘুমায় না। ক্যাপ্টেন বানার্ডের জন্য সঞ্চিত খাদ্য ও পানীয়ের সদ্ব্যবহার করে তারই কেবিনের ভেতরে ও বাইরে দরজার কাছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রাত কাটায়।

অতএব এটা অগাস্টাস আর আমার পক্ষে হিতকরই হলো তা যদি না হত তবে এতগুলো লোকের নজর এড়িয়ে অগাস্টাসের পক্ষে কিছুতেই আমার কাছে আসা সম্ভব হত না।

যা-ই হোক, দড়ি, লোহালক্কড় ও অন্যান্য ভাঙাচারো যন্ত্রপাতির খাঁচা কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে ডিঙিয়ে বন্ধু অগাস্টাস আমার কাছে হাজির হতে পারল।

আমার অন্ধকার কুঠুরিটার দরজায় পৌঁছেই সে বুঝতে পারল, আমার প্রিয় বাঘা তাকে অনুসরণ করে এখানে পৌঁছে গেছে।

এদিকে ভোরের আলো ফুটতে চলেছে। চারদিক ফর্সা হবার আগেই তাকে এখান থেকে কেটে পড়তে হবে। চলে যেতে হবে তার নির্দিষ্ট জায়গায়। অতএব সে সিদ্ধান্ত নিয়েনিল কুঠুরি দরজাটা সামান্য ফাঁক করে আমার পরিস্থিতি সম্বন্ধে একটু আধটু ধারণা করে নিয়েই এখান থেকে দ্রুত চম্পট দেবে। আবার সুযোগ বুঝে রাতে আমার কাছে আসবে।

অগাস্টাস ব্যস্ত হাতে আমার কুঠরির দরজাটা সামান্য ফাঁক করতেই বাঘার ছোঁক ছেকানি বেড়ে গেলে। সে দরজার ফাঁক দিয়ে নাকটা গলিয়ে দিয়ে বার কয়েক খুঁকেই অস্থির হয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে প্রায় অবোধ্য কুৎ কুৎ আওয়াজ করতে লাগল। শুধু কি এই? সে উন্মাদের মতো দরজাটার গায়ে নখ দিয়ে আঁচড়াতে শুরু করল।

অগাস্টাসের মাথায় হঠাৎ একটা মতলব খেলে গেল। সে যদি বাঘার গায়ে কোনো চিঠি লিখে আমার কাছে পাঠায় তবে তা অনায়াসেই আমার হাতে পৌঁছতে পারে। অনেক ভেবে চিন্তে সে এ মতলবটাকেই আঁকড়ে ধরল। আর এতে সুবিধা হবে এ মুহূর্তে আমার সঙ্গে তার দেখা করার ঝুঁকি না নিলেও কাজ মিটে যাবে। এবার অগাস্টাসের সামনে নতুনতর একটা সমস্যা দেখা দিল। আমাকে চিঠি লিখতে হলে তো কাগজ-কলম দরকার। কোথায় মিলবে এসব অত্যাবশ্যক সামগ্রি? একটা সরু কাঠি দিয়ে না হয় কলমের কাজ মিটিয়ে নেওয়া হবে। জ্যাকেটের পকেট হাতড়ে একটা পুরনো চিঠি মিলে গেল। তার বিপরীত দিকটা ফাঁকা, লেখা যাবে, এবারের সমস্যা কালির ব্যবস্থা করা। এ সমস্যাটারও সমাধান করে ফেলল। ছুরি সুতীক্ষ্ণ ফলাটা দিয়ে বাঁ হাতের কিছুটা জায়গা চিড়ে ফেলল। রক্ত বেরিয়ে এলো।

চিঠি লেখার সমস্যা আর রইল না। আবছা অন্ধকারেই অগাস্টাস কোনোরকমে চিঠিটা লিখে ফেলল। সে এবার সাধ্যমত সংক্ষেপে জাহাজের পরিস্থিতিটার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমাকে লিখল– ‘অতি সম্প্রতি জাহাজে একটা ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ ঘটে গেল। বিদ্রোহীরা জাহাজের ক্যাপ্টেনকে উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছে। অনতিকালের মধ্যেই তোমার জন্য কিছু খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা হতে পারে। খবরদার, তুমি নিজে থেকে কিছু করার চেষ্টা কোরো না। সব শেষে বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে লেখা হয়েছে–‘রক্তের অক্ষরে চিঠিটা লিখলাম, কাছাকাছি কোথাও তোমার ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকার ওপর তোমার বেঁচে থাকা নির্ভর করছে মনে রেখো।’

চিঠিটা নিয়ে বাঘা সোজা আমার কাছে চলে এলো। আর অগাস্টাস নিজে চলে গেল নিজের বার্থে। নিজের বার্থে ঢুকেই সে আগের মতোই পায়ে দড়ি বেঁধে আর হাতে হাতকড়া পরে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করে শুয়ে পড়ল।

মিনিট খানেকের মধ্যেই ডার্ক পিটার্স মদের ঘোরে টলতে টলতে তার কাছে। হাজির হল। মদের ঝেকে সে তখন খুব মৌজে রয়েছে। সে আমার বন্ধু অগাস্টাসরে জন্য গোটা কয়েক সিদ্ধ আলু আর এক পাত্র পানি নিয়ে এসেছে।

সে হাতের পানির পাত্র আর আলু সিদ্ধর থলেটাকে মেঝের ওপর রেখে দিয়ে একটা বাক্সের ওপর আয়েশ করে বসে নিজে থেকেই জাহাজের পরিস্থিতি এবং প্রথম। মেটের ব্যাপার স্যাপার সম্বন্ধে অনেক কথাই বলল।

ডাক পিটার্সের মতিগতির আকস্মিক আমূল পরিবর্তন দেখে আমার বন্ধুটি রীতিমত ভড়কে গেল। ব্যাপারটা তো অবশ্যই অভাবনীয়।

শুধু কি এ-ই? পরদিন আমার বন্ধুর জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে তখনকার মতো বিদায় নিল।

কালো গাট্টগোট্টানিগ্রো পাচকটা দিনের বেলায় দুজন হারপুননিক্ষেপকারীকে সঙ্গে করে আমার কাছে এলো। তিনজনই নেশায় একেবারে কুঁদ হয়ে রয়েছে। পা দুটো রীতিমতো টলছে। এমনকি কথা পর্যন্ত জড়িয়ে আসছে।

তাদের কথাবার্তা থেকে আমি যেটুকু হৃদয়ঙ্গম করতে পারলাম তা হচ্ছে, জাহাজের কর্মীরা পরিষ্কার দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। তাদের একটা দলের মাতব্বরনিগ্রো পাচক আর অন্য দলটাকে পরিচালনা করছেন প্রথম মেট।

প্রথম মেটের একান্ত ইচ্ছা, যে কোনো একটা জাহাজ দখল করে জলদস্যুদের মতো লুঠপাটে মেতে উঠবে, আরনিগ্রো পাচক ও তার দলের সবার একান্ত ইচ্ছা, তারা

যে কাজের জন্য যাত্রা করেছে অর্থাৎ দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে পৌঁছে তিমি শিকারেই। নিজেদের লিপ্ত করবে। আর তা যদি সম্ভব না-ই হয় তবে জায়গামত গিয়ে পরিস্থিতি

অনুযায়ী অন্য কোনো কাজে হাত দেবে। পিটার্স বহুবার এসব অঞ্চল দিয়ে যাতায়াত করেছে। তাই তার মুখে বহু রোমাঞ্চকর আনন্দ ফুর্তির অভিযানের কথা শুনে সবাই আনন্দে আপ্লুত হয়ে তার খাতায়ই নাম লিখিয়েছে।

নিগ্রো পাচক ও তার সহগামী নাবিক দুজন দীর্ঘসময় ধরে প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বহু কথা নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বকবক করার পর এক সময় ধীরে ধীরে সেখান থেকে সরে পড়ল।

ক্রমে সারাটা দিন পেরিয়ে গেল। আমার বন্ধুর ঘরে বা তার দরজার ধারেকাছেও কেউই আসেনি।

অগাস্টাস সারাদিন, রাতে পর্যন্ত হতাশা-হাহাকারের মধ্যে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিল।

রাতের অন্ধকার নেমে আসার বেশ কিছুক্ষণ পরে সে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দু পকেট ভর্তি করে সিদ্ধ আলু আর পানির পাত্রটা নিয়ে তৈরি হয়ে পড়ল। আলোর ব্যবস্থা যা হোক কিছু করতেই হবে। কিন্তু উপায়? অদূরে একটা চর্বির বাতি দেখতে পেয়ে সে যেন হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। জ্যাকেটের পকেটে তো একটা ফসফরাসের দেশলাই আছেই, চিন্তা কি?

অগাস্টাস এবার চর্বির বাতিটাকে খুবই ক্ষীণ আলো দানের মতো পলতে বের করে দেশলাই দিয়ে সেটাকে ধরিয়ে যাত্রা করার জন্য তৈরি করেনিল।

আমার অন্ধকার খুপরিটার কাছে অগাস্টাস গুটিগুটি হাজির হল। সাধ্যমত গলা নামিয়ে সে আমার নাম ধরে বার-কয়েক ডাকাডাকি করল। তার কণ্ঠস্বর আমার কানে ঠিকই পৌঁছাল। কিন্তু সে মুহূর্তে শারীরিক ও মানসিক উভয় জড়তার জন্য শতচেষ্টা করেও তার ডাকের উত্তর কিছুতেই আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হলো না।

ব্যাপারটা তাকে যারপরনাই পীড়িত ও মর্মাহত করল। সে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হল–নির্ঘাৎ আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে গেছে। ক্ষিদে তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে আমি তিলে তিলে মৃত্যুর শিকার হয়েছি। অসহায় শিশুর মতো সে চাপাস্বরে কাঁদতে লাগল।

সে যখন আমার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিয়ে আমার শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ার জোগাড় হয় ঠিক তখনই আমার বাঁকানো ছুরিটার ‘বিশ্রি আওয়াজটা তার কানে গেল।

ছুরির ফলার আওয়াজটা কানে যেতেই বন্ধু অগাস্টাস অতর্কিতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা এবং তার উৎসস্থলটা সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার চেষ্টা করল। সে নিঃসন্দেহ হল, অদ্ভুত আওয়াজটা আমরা কুঠরিটা থেকেই বেরোচ্ছে।

অগাস্টাস এবার মাত্রাতিরিক্ত উচ্ছ্বাস ও আবেগের জন্য বিপদের কথা ভুলে গিয়ে আমার নাম ধরে গলা ছেড়ে ডাকতে লাগল।

আমার জড়তা ইতিমধ্যে অনেকখানি কেটে গেছে। আমি তার কথার জবাব দিয়ে তার নাম ধরে ডাকতে শুরু করলাম।

আমার মৃত্যু হয়নি, ইহলোকেই আছি বুঝতে পেরে অফুরন্ত উৎসাহ এবং আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করে যাবতীয় বাধা এক নিশ্বাসে দূর করে আমার কুঠরিটায় ঢুকে এলো। সে যখন আমার মুখোমুখি দাঁড়াল তখন সে রীতিমত ফোঁস ফোঁস শব্দ করে হাঁফাচ্ছে।

.

০৬. ॥ ষষ্ঠ অধ্যায় ॥

অগাস্টাস আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। মিনিট খানেক বিশ্রাম নেওয়ার পর সে কিছুটা প্রকৃতিস্থ হল।

অগাস্টাস স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে আমার সঙ্গে পরিস্থিতিটার মোকাবিলা করার জন্য আলোচনায় লিপ্ত হল। দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা উভয়েই স্থির করলাম, যে করেই হোক এ নরককুন্ড, অন্ধকার কুঠরিটা থেকে বেরোতেই হবে। এভাবে নরকযন্ত্রণা ভোগ করা আর সম্ভব নয়। আর এও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এখান থেকে বেরিয়ে আমি কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে থাকব।

আমাকে লুকিয়ে রেখে অগাস্টাস পালিয়ে যাবার পথ খুঁজে বের করার ধান্দায় থাকবে। সে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করে পালাবার ফিকির একটা করতে পারবেই।

আর এও আলোচনা হল, আমাদের পালাবার পথ বের করা সম্ভব হলেও সমস্যা দেখা দেবে আমার প্রিয় কুকুর টাইগারকে নিয়ে। তার কি ব্যবস্থা করা হবে। অন্ধকার কুঠরিটার মধ্যে তাকে নির্মমভাবে ফেলে রেখে নিজেরা হাসিমুখে বাঁচব এ তো কিছুতেই সম্ভব নয়। আবার তাকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া তো সামান্য ব্যাপার?

তবে উপায়? টাইগারের ব্যবস্থা কী করব? ঘাড় ঘুরিয়ে আমি বাঘার দিকে তাকালাম। দেখলাম, সে পা চারটি ছড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। নেশাখোরের মতো তার অবস্থা। তবে প্রাণে বেঁচে রয়েছে, সন্দেহ নেই।

যা করার যত শীঘ্র সম্ভব সেরে ফেলতে হবে। হাতে সময় খুবই কম। অগাস্টাস আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই ঘুমন্ত বাঘাকে পাজাকোলে করে দড়িদড়া আর লোহালক্করের স্তূপের ওপর দিয়ে সন্তর্পণে হাঁটতে লাগল। কেউ টের পেলে কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

অগাস্টাস বলেই কাজটা সম্ভব হচ্ছে। টাইগারকে কোলে নিয়ে দুর্বল শরীরে মালপত্রের পাহাড় ডিঙিয়ে নির্বিঘ্নে পথ পাড়ি দেওয়া কিছুতেই সম্ভব হত না।

বার কয়েক হোঁচট খেয়ে অগাস্টাসকে নীরবে অনুসরণ করে করে কোনোরকমে তার থাকার জায়গাটির ঠিক নিচে পৌঁছে যেতে পারলাম।

অগাস্টাস আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল–শোন, সামনের ওই অন্ধকার গর্তটার মধ্যে তোমাকে গুটিসুটি মেরে বসে থাকতে হবে, টু-শব্দটাও করা চলবে না, মনে থাকবে তো

আমি নীরবে ঘাড় কাৎ করে তার নির্দেশ পালন করার সম্মতি দিলাম।

এবার তার নিজের হাতে কাঠ কেটে কেটে তৈরি করা গর্তটার দিকে অঙুলি নির্দেশ করে বলল–আর শোন, সময়মত তোমার প্রয়োজনীয় খাবারদাবার ও পানীয় ওই গর্তটা দিয়ে নিয়মিত আমি যোগান দেব, ভেব না–

আমি ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললাম–‘আমার আর ভাববার কি থাকতে পারে। আর আমি যখন ভেবে কিছুই করতে পারব না তখন মিছে নিজেকে কষ্ট দিয়ে লাভও তো কিছু নেই বন্ধু।

‘হ্যাঁ, তোমার যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা আমার ওপর সঁপে দিয়ে নীরবে শুভক্ষণের প্রতীক্ষায় থাক। ব্যস, এটুকুই।

আমার বন্ধুটির বুদ্ধির তারিফ করতেই হয়। সে নিজের ঘরে ঢুকেই ঝটপট পায়ে দড়ির বাঁধন আর হাতে বেড়ি দুটো গলিয়েনিল।

ইতিমধ্যে বেলা অনেকই হয়ে গেছে। ফাঁক ফোকর দিয়ে অনেক আগে থেকেই ক্ষীণ আলো ঢুকতে শুরু করেছে।

আমাদের ভাগ্যের জোর আছে বটে। সময়মতই আমরা, অগাস্টাস আর আমি উভয়েই নিরাপদ আশ্রয়ে ঢুকে যেতে পেরেছি। কারণ, আমার বন্ধু তার কামরাটায় ঢুকে দড়ির বাঁধন আর হাতকড়া পরে নিতে না নিতেই প্রথম মেট ডার্ক পিটার্সনিগ্রো পাচককে সঙ্গে নিয়ে তার ঘরে ঢুকল।

চারজন মিলে দীর্ঘসময় ধরে বহু আলোচনা করল।

আমি নিচে থেকে উৎকর্ণ হয়ে তাদের কথাবার্তা লক্ষ্য করতে লাগলাম। তারা কেউই গলা নামিয়ে কথা বলেনি। ফলে প্রতিটা কথাই আমার কানে এলো। ডাউস অন্তরীপ থেকে যাত্রা করে আসছে, এমন একটা জাহাজের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।

মিনিট কয়েক পরেই প্রথম মেট এবংনিগ্রো পাচক অনুচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে বলতে ওপরে উঠে এলো।

প্রথম মেট এতক্ষণ যে কাঠের বাক্সটার ওপরে বসেছিল সেখানে নিজে জায়গা থেকে উঠে এসে এবার বসল ডার্ক পিটার্স। তার নেশা ইতিমধ্যেই অনেকটা চটে গেছে, প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। সে বন্ধুর সঙ্গে চুটিয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। সে কথা প্রসঙ্গে বলল, তার বাবাকে অবশ্যই কোনো-না-কোনো জাহাজের নাবিকরা দেখতে পেয়ে তুলে নিয়েছে। তার এমন আশা করার পিছনে কারণও আছে যথেষ্টই। তার বাবাকে সেদিন সমুদ্রের পানিতে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল সেদিনই সে সমুদ্রের বুকে পাঁচ পাঁচটা পাল দেখতে পেয়েছিল। এমন আরও বহু যুক্তির উল্লেখ করে সে তাকে প্রবোধ দিতে লাগল।

সত্যি কথা বলতে কি, তার কথা শুনে আমার মনেও আশার সঞ্চার হল। আমি ভাবতে উৎসাহি হলাম, আমরাও হয়তো ডার্ক পিটার্সের সার্বিক-সহযোগিতায় আবার এ-জাহাজটার দখল ফিরে পাব।

আমার এ আশার কথা সুযোগ বুঝে আমার বন্ধু অগাস্টাসের কাছেও না বলে পারলাম না।

আমার মুখ থেকে আশার কথা শুনে সে-ও সমর্থন করল। সে আশান্বিত হয়ে বলল–তোমার সঙ্গে আমি একমত। আমারও বিশ্বাস, ডার্ক পিটার্সের সহায়তায় আমরা আজ না হোক কাল জাহাজের দখল ফিরে পাব।

আমার চোখমুখে হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল।

অগাস্টাস এবার বলল–একটা বিষয়ে আমাদের যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে আমাদের খুবই সাবধানে, আগে পিছু চিন্তা করে অগ্রসর হতে হবে।

‘হ্যাঁ, সে তো নিশ্চয়ই। তাড়াহুড়ো করতে গেলে সবকিছু বরবাদ হয়ে যাবে।

‘আরও আছে।

‘কী? কীসের কথা বলছ?

‘আরে একটা কথা তোমার মাথায় ঢুকছে না! সবার আগে ডার্ক পিটার্সের মতিগতি সম্বন্ধে নিশ্চিত ধারণা নিয়ে, তবে কাজে নামতে হবে। আসলে তার উদ্দেশ্যটাই তো আজ পর্যন্ত আমি তিলমাত্রও বুঝতে পারছি না। আর এ সঙ্কটজনক মুহূর্তে সে-ই তো আমাদের একমাত্র আশা ভরসা।

ঘণ্টা খানেক বাদে ডার্ক পিটার্স সে জায়গা ছেড়ে ওপরে উঠে গেল। দুপুরের দিকে একটা বেশ বড়সড় পোঁটলা নিয়ে আমাদের কাছে এলো। তাতে মাংস আর পুডিং রয়েছে। পোটলাটা আমার সামনে রেখেই সে আগের মতোই নীরবে ওপরে উঠে গেল।

বন্ধু অগাস্টাস আর আমি বহুদিন বাদে মুখোমুখি বসে পেট ভরে খেলাম।

খাওয়ার পাট মিটে গেলে আমি আবার বিড়ালের মতো পা টিপে টিপে ওপরে উঠে গেলাম।

সারাদিন আর কেউ আসা তো দূরের ব্যাপার এমনকি কারো পায়ের শব্দও কানে এলো না। তাই আমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবার অগাস্টাসের ঘরে গুটিগুটি হাজির হলাম। মৌজ করে দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে শরীর ও মনটাকে যথাসম্ভব চাঙা করে নিলাম।

পূব-আকাশে তখনও ভোরের আলো ভালোভাবে ফুটতে পারেনি। একটু আগেই আমার ঘুম ভেঙে গেছে। আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে দিয়ে বিছানা আঁকড়ে পড়ে রয়েছি। হঠাৎ একটা চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনে অগাস্টাস সজোরে একটা হেঁচকা টান দিয়ে একেবারে বসিয়ে দিল।

সে ওই হৈ হট্টগোলের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমরা উভয়েই উকৰ্ণ হয়ে অবাঞ্ছিত আওয়াজটার উৎস ও কারণ সম্বন্ধে ধারণা করে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। মোটামুটি অনুমান করলাম, ডেক থেকেই আওয়াজটা ভেসে আসছে।

আমি আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে তার কামরা থেকে বেরিয়ে আমার আশ্রয়স্থল অন্ধকার গর্তটায় গিয়ে আশ্রয় নিলাম। এ পরিস্থিতিতে গা-ঢাকা দিয়ে থাকাই বাঁচার একমাত্র উপায়, আমার ভালোই জানা আছে।

লক্ষ্য করলাম, টাইগার ইতিমধ্যেই বেশ চাঙা হয়ে উঠেছে। জলাতঙ্কের কোনো লক্ষণই তার মধ্যে নজরে পড়ল না।

আমি তার জলাতঙ্ক রোগ সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্য তার সামনে পানি-ভর্তি একটা পাত্র এগিয়ে দিলাম। আতঙ্কে সরে যাওয়া বা কোনোরকম অনীহাই তার আচরণে প্রকাশ পেল না। বরং সে আগ্রহের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে জিভ দিয়ে চেটে চেটে, চপ চপ আওয়াজ করে সবটুকু পানি সাবাড় করে দিল।

ভাগ্য ভালো যে, সময়মত বাঘাকে অন্ধকার খুপড়িটা থেকে বের করে এনেছিলাম। আর মাত্র দু-একদিন সেখানে থাকলে সে হয়তো পরপারেই পাড়ি জমাত।

ত্রিশে জুনের ঘটনাটা এখানে তুলে ধরলাম। ন্যান্টাকেট বন্দর থেকে জাহাজটা ছেড়ে আসার পর আজ ত্রিশতম দিন চলছে। আগামীকাল জুলাই মাস পড়বে।

জুলাইয়ের এক তারিখে বলার মতো তেমন কোনো ঘটনা ঘটল না।

জুলাইয়ের দুই তারিখের সকাল হল। বেলা একটু বাড়তেই প্রথম মেট আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সকালেই গলা পর্যন্ত মদ চাপিয়েছে। মদের ঘোরে একেবারে কুঁদ হয়ে যাবার জোগাড়। মদের নেশায় তার মেজাজ রীতিমত শরীফ।

প্রথম মেট কাটা-মারা বুটে গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলে আমার বন্ধুর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই মুখে খুশির ছাপ ফুটিয়ে তুলে বলল।

‘একটা কথা তোমার মুখ থেকে আমি শুনতে চাই।’

কপালের চামড়ায় বিস্ময়ের ছাপ একে বন্ধুটি হাসিখুশি মেজাজের প্রথম মেটের দিকে তাকাল। প্রথম মেট মুখে হাসির প্রলেপটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই বলল–‘শোনো, তুমি যদি আমাকে কথা দাও যে, এবার থেকে ভালোভাবে চলবে তবে তোমার জন্য আমি কিছু ভাবনা-চিন্তা করব, ভাবছি।’

আমার বন্ধু অগাস্টাস মুখ খোলার আগেই সে এবার সস্নেহে একটা মৃদু চাপড় দিয়ে বলল ‘আমি বলতে চাইছি, তোমাকে কথা দিতে হবে ভবিষ্যতে আর কোনোদিনই কেবিনে পা দেবে না, রাজি?’

বন্ধু ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে, নীরবে ঘাড় কাৎ করে তার বক্তব্যে সম্মতি জানাল।

হতচ্ছাড়াটা সন্তুষ্ট হয়ে তার পায়ের বাঁধন আর হাত থেকে হাত কড়া খুলে দিয়ে আমার বন্ধুকে মুক্ত করে দিল। তার দিলদরিয়া ভাব দেখলে মনে হয় আমার বন্ধুর ওপর খুবই প্রীত। আরও আছে, জ্যাকেটের পকেট থেকে রামের বোতল বের করে। তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল–‘গলাটা একটু ভিজিয়ে চাঙা করে নাও।

একটু বাদে তারা দুজনেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ধীর পায়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেল। তিন ঘণ্টা পর আবার সেখানে ফিরে এলো।

ফিরে এসে অগাস্টাস আমাকে বলল–একটা দারুণ সুসংবাদ আছে বন্ধু।

আমি উচ্ছ্বসিত আবেগের সঙ্গে বলে উঠলাম।–‘সুসংবাদ! সুসংবাদটা কি, জানতে পারি কী?

সে আবেগ-মধুর স্বরে বলল–‘অবশ্যই, অবশ্যই। ব্যাপারটা হচ্ছে, জাহাজের যে কোনো জায়গায়, যে কোনো সময় ঘোরাফেরা করার অনুমতি আমি পেয়েছি।

‘চমৎকার! চমৎকার!

‘আরও আছে, রাতে গলুইয়ের দিকে ঘুমাবার অনুমতিও আমাকে দেওয়া হয়েছে।

‘আরে বন্ধু, এ যে রীতিমত হাতে স্বর্গ পাওয়ার সামিল।

‘হ্যাঁ, ঠিক তাই।’

বন্ধু অগাস্টাস আমার জন্য ভালো ভালো রাতের খাবার আর পানীও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। জোর বন্দোবস্ত।

আমাদের নাবিকরা ডাউস অন্তরীপ থেকে আসা জাহাজটাকে তখনও হণ্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে এক সময় একটামাত্র পাশ চোখে পড়ল। ব্যাস, এ পর্যন্তই।

তারপর আট-আটটা দিন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আর আমার এ ঘটনার বিবরণের সঙ্গে তার কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্কও নেই। তা সত্ত্বেও সেগুলোকে কেটে হেঁটে একেবারে বাদ না দিয়ে একটা দিনলিপির মতো করে লিখলাম।

সেটা ছিল জুলাই মাসের তিন তারিখ। সেদিন বিকেলে অগাস্টাস আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। সঙ্গে করে আমার জন্য তিনটি কম্বল নিয়ে এসেছে। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিল।

আমার লুকিয়ে থাকার জায়গায় সেগুলো দিয়ে আরামদায়ক একটা বিছানা করে ফেললাম। একেবারে তোফা বন্দোবস্ত।

আমার বন্ধুবর অগাস্টাস ছাড়া সারাদিনের মধ্যে কেউ-ই ভুলে নিচে আসে না। বাঘা বার্থেই থাকে। সেখানেই ঘুমায়।

রাতে ভয়ঙ্কর ঝড় উঠল। যাকে বলে একেবারে প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড। তবে ভাগ্যগুণে বড় পালটা ছিঁড়ে ফেটে কয়েক টুকরো হওয়া ছাড়া জাহাজের আর কোনো অনিষ্ট হলো না।

আর এদিকে বন্ধু অগাস্টাসের প্রতি ডার্ক পিটার্স ক্রমেই সদয় হয়ে উঠছে। তার আচরণ উত্তরোত্তর ভালো হতে চলেছে। সময় সুযোগ পেলেই তাকে মুখোমুখি বসিয়ে সে তার সমুদ্রযাত্রার গল্প–প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে যে সব দ্বীপে সে গেছে সে সব গল্প রসিয়ে রসিয়ে গল্পাকারে শোনায়।

আবার কখনও বা ডার্ক পিটার্স গল্প থামিয়ে তাকে বলে–‘কি হে, দ্বীপগুলোর কথা শুনে চোখে দেখার জন্য মন চঞ্চল হয়ে উঠছে না? তুমি কি আমাদের সঙ্গে সে সব অঞ্চলে অভিযানে যেতে আগ্রহী।

আমার বন্ধুটি মুচকি হেসে নীরবে সম্মতি জানায়।

ডার্ক পিটার্স তাকে আরও জানায় দলের লোকজন ক্রমে মেটের দলের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। আর এরই ফলে তার পাল্লাই নাকি দিন দিন ভারী হচ্ছে।

জুলাইয়ের চার তারিখ। যে জাহাজটার একটামাত্র পাল নজরে পড়েছিল সেটা লিভারপুল বন্দর থেকে ছেড়ে আসছে। জাহাজটাকে চিনতে পেরে বিনা আক্রমণেই সেটাকে রেহাই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অগাস্টাস এখন দিনের একটা বড় অংশই ডেকের ওপর থাকে। তার উদ্দেশ্য খবরাখবর সংগ্রহ করা। বিদ্রোহীরা প্রায়ই নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা, কলহে লিপ্ত হয়।

বিদ্রোহীরা নিজেদের মধ্যে মতবিরোধের ফলস্বরূপ জিন বোনার নামে এক হারপুন নিক্ষেপকারীকে তো মারধোর করতে করতে জাহাজ থেকে ঠেলে ধাক্কা মেরে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। বেচারা ছিল নিগ্রো। পাঁচকের দলের লোক। ডার্ক পিটার্সও তাদেরই দলের। একের পর এক এমন ছোটখাট ঘটনা ঘটেই চলল।

পাঁচই জুলাইয়ের সকাল। ভোরের আলো ভালো করে ফুটতে না ফুটতেই পশ্চিম দিকের সমুদ্রের বুক থেকে দমকা বাতাস উঠে এলো। সেটা ক্রমেই প্রবল থেকে প্রবলতর হতে হতে দুপুরের দিকে প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের রূপনিল।

নিগ্রো পাঁচকের দলের সিমস নামক আর এক নাবিক সামনের দিককার বড় পালটার দড়িদড়া খুলে নামিয়ে আনার সময় মদের ঝোঁকে নিজেকে সামলাতে না পেরে আচমকা সমুদ্রে পড়ে গেল। ব্যস, চোখের পলকে একেবারে বেপাত্তা হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি, তাকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই হলো না।

এখন জাহাজের মোট লোকের সংখ্যা দাঁড়াল তের জন। তারা হচ্ছেনিগ্রো পাচক, সেমুর, ডার্ক পিটার্স, রোজার্স, জোন্স, হার্টম্যান, গ্রীলি আর উইলিয়াম এ্যালেন– এরানিগ্রো পাঁচকের দলভুক্ত; আর প্রথম মেটটার নামটা কিছুতেই আমার পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি, রিচার্ড পার্কার, এবং সালস্ হিকস, জন হান্ট এবং উইলসন–এরা সবাই প্রথম মেটের অধীনস্থ –আর আছি আমি ও বন্ধুবর অগাস্টাস। এভাবেই দুটো দল পৃথক পৃথক দলভুক্ত হয়ে একই জাহাজের যাত্রী হয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে চলেছে।

দেখতে দেখতে এসে গেল সাতই জুলাই। সমুদ্র দিনভর রুদ্ররূপ ধারণ করেই রইল। যাকে বলে রীতিমত উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্র। জাহাজের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে দাঁড়াল। মোচার খোলার মতো জাহাজটা অনবরত দোল খাচ্ছে। তোলপাড় হচ্ছে। টালমাটাল অবস্থায় পড়ে ওপরে-নিচের জিনিসপত্রে দুমদাম আছড়ে পড়ছে, ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হচ্ছে।

আমার দশা একেবারে বেহাল হয়ে পড়েছে। সামুদ্রিক পীড়ায় আমি একেবারে কাহিল হয়ে পড়লাম। ঘন ঘন বমিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ার উপক্রম হল।

এদিকে ডার্ক পিটার্সের সঙ্গে আমার বন্ধুবর অগাস্টাসের দীর্ঘ আলোচনা হল। ডার্ক পিটার্সের কথার মাধ্যমে সে জানতে পারল, এলোন আর গ্রালি তার দল ছেড়ে। মেটের দলে ভিড়েছে। ব্যাপারটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর অগাস্টাসকে সে এও বলল; মেট আর তার দলের সবাই জলদস্যুবৃত্তি গ্রহণ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সমুদ্রগামী জাহাজ আক্রমণ করে লুঠপাটে মেতে ওঠার জন্য তারা আদাজল খেয়ে লেগেছে।

উল্লেখযোগ্য না হলেও একের পর এক ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে এলো আটই জুলাইয়ের সকাল। পূব আকাশে সূর্য উঁকি দেওয়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই পূব দিক থেকে মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে আসতে লাগল।

মেট ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই জাহাজের মুখ দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে ঘুরিয়ে দিল। পরের অবশ্য বোঝা গেল, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে হাজির হওয়া। সে অঞ্চলের কোথাও জাহাজ নিয়ে গিয়ে লুঠপাটে মেতে যাওয়া; তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেও নিগ্রো পাচক বা ডার্ক পিটার্স কেউ তাকে বাধা তো দিলই না এমনকি কোনো আপত্তিও করল না। আর তারা যদি কোনোরকম আপত্তি করেও থাকে তবে তা আমার বন্ধু অগাস্টাস অন্তত কিছু জানতে পারেনি। ঘটনা থেমে নেই, ঢিমে তালে হলেও গুটি গুটি এগিয়ে চলেছে।

আটই জুলাইয়ের রাত পেরিয়ে এলো নয়ই আগস্টের সকাল। পূব-আকাশ জুড়ে সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মনোরম আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে জাহাজটা দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। কর্মীদের প্রায় সবাই জাহাজটাকে সারাই করার কাজে মেতে রয়েছে।

ডার্ক পিটার্স আবার আমার বন্ধু অগাস্টাসকে নিয়ে নিরালয় বসে জাহাজের পরিস্থিতি সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা করল। কথা প্রসঙ্গে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে সে বলল–‘আমি কিছুতেই মেটের উদ্দেশ্যকে মেনে নিতে পারছি না, পারবও না কোনোদিন। আর একটু সুযোগ পেলেই তার হাত থেকে জাহাজটাকে ছি নিয়ে নেব, দেখে নিও।

অগাস্টাসনিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগল।

ডার্ক পিটার্স এবার তাকে সরাসরিই জিজ্ঞাসা করল–‘তুমি মন খোলসা করে বল তো, যদি কোনোদিন তোমার সাহায্য-সহযোগিতা আমার দরকার হয়, তবে তুমি আমার পাশে দাঁড়াবে তো?

‘অবশ্যই। আমার সার্বিক সহযোগিতা তুমি অবশ্যই আশা করতে পার।’ ডার্ক পিটার্স তার কাছ থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়ে খুশিমনে বিদায়নিল।

ডার্ক পিটার্স বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর সারাদিন আর তার সঙ্গে অগাস্টাসের দেখা হয়নি। ডাক পিটার্স নতুন একটা কিছু করতে চলেছে জেনে তার মন-প্রাণ খুশিতে ভরপুর হয়ে উঠল।

.

০৭. ॥ সপ্তম অধ্যায় ॥

দশই জুলাইয়ের সকাল। ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই অগাস্টাস লক্ষ্য করছে। আবহাওয়া যেন হঠাৎ কেমন বদলে গেছে। আগের দিন যে মনোরম আবহাওয়া ছিল তা একরাতের মধ্যেই আমুল পরিবর্তন ঘটে বাতাস পূর্বদিকে থেকে বইছে আর তা খুবই উল্টাপাল্টা, কখন সে কেমন রূপ ধারণ করছে তা স্পষ্ট করে বোঝার উপায় নেই।

হার্টম্যান রোজার্স পরলোকে পাড়ি জমিয়েছে। মদই তার মৃত্যুর কারণ। আটই জুলাই ঠাণ্ডা মদ গলা পর্যন্ত খেয়েছে। ঠাণ্ডা মদ পেটে পড়তেই তার শরীর ক্রমে ঝিমিয়ে পড়তে থাকে। তারপরই শুরু হয়নিদারুণ অস্বস্তি অস্বাভাবিক কাঁপুনি আর খিচুনি। সে যে কী খিচুনি আর অবর্ণনীয় কষ্ট তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

সদ্য মৃত হার্টম্যান রোজার্সও ছিলনিগ্রো পাঁচকের দলের লোক।

হার্টম্যান রোজার্স-এর মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ডার্ক পিটার্স অগাস্টার্সকে বলেছে মেট-ই তাকে গোপনে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে। সে এও বলেছে, চারদিক চোখ কান খোলা না রাখলে সে তাকেও যে কোনো সময় বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে।

বর্তমানে সে নিজে, নিগ্রোপাচক, আর জোন্স, তার দলে রয়েছে–কেবলমাত্র এ তিনজন। আর বিপক্ষ দলে রয়েছে পাঁচজন।

বিকেলের দিকে জানা গেল নিগ্রো পাচকও তার দলে ভিড়ে গেছে। সে জোন্স। পিটার্সের সঙ্গে প্রথমে কথা কাটাকাটি তারপর তুমুল ঝগড়া করে সটকে পড়েছে।

সত্যি কথা বলতে কি, হাতে সময় খুবই কম। সময় নেই বললেই চলে।

ডার্ক পিটার্স কথা প্রসঙ্গে আমার বন্ধুর কাছে সরাসরি প্রস্তাব রাখল-শোন, তুমি যদি মনে-প্রাণে আমার পাশে দাঁড়াও সার্বিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও তবে আমি একবার চেষ্টা করে দেখতে চাই।’

বন্ধু অগাস্টাস স্লান হেসে বলল–‘চেষ্টা? কীসের চেষ্টার কথা বলছ? আমার দিক থেকে সাহায্যের এতটুকু ঘাটতি হবে না, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

‘জাহাজ দখলের চেষ্টার কথা বলছি। তোমার সাহায্য পেলে ঝুঁকিটা নেব ভাবছি।

বন্ধু আবারও তাকে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিল। আর মওকা বুঝে জাহাজে আমার উপস্থিতির কথাও তার কানে দিয়ে দিল।

জাহাজে আমার উপস্থিতির কথা শুনে ডার্ক পিটার্স ক্রোধান্বিত বা বিস্মিত হওয়ার চেয়ে অনেক অনেক বেশি খুশি হল। আসলে তার দলটা যে ভারী হলো এতে তো কোনো সন্দেহই নেই।

আমার উপস্থিতির কথা জানতে পারামাত্র ডার্ক পিটার্স লম্বা-লম্বা পায়ে সিঁড়ি-বেয়ে নিচে নেমে গেল।

জাহাজে আমার উপস্থিতির কথা জানতে পেরে ডার্ক পিটার্স অখুশি না হয়ে বরং খুশি হওয়ায় বন্ধু অগাস্টাস আমাকে তার কাছে নিয়ে গেল। আমার সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল। সে উল্লসিত হয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করল।

দীর্ঘ সময় ধরে জাহাজের পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ কর্তব্য সম্বন্ধে আমাদের তিনজনের মধ্যে গোপন আলোচনা হল। শেষপর্যন্ত স্থির হলো, সংকট বুঝে আমরা জাহাজটার দখল নিয়ে নেব।

যদি কোনোদিন আমার জাহাজটার দখল নিতে পারি তবে হাতের কাছে যে বন্দরই পাই না কেন সেখানেই জাহাজ ভেড়াব। তারপর বন্দর-কর্তৃপক্ষের হাতে জাহাজটাকে তুলে দিয়ে কর্তব্য পালন করব।

প্রশান্ত মহাসাগর অভিযানে সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেটা এখনকার মতো বাতিল করা হবে। অবশ্য প্রশান্ত মহাসাগরের ব্যাপারে ডার্ক পিটাসই বেশি উৎসাহি ছিল। তবে পরিকল্পনাটাকে মাথা থেকে সে পুরোপুরি বাতিলও করে দিচ্ছে না। ভবিষ্যতে যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তবে সেটাকে অবশ্যই বাস্তবায়িত করা হবে, এ সিদ্ধান্তও আলোচনার মাধ্যমে নেওয়া হল।

আমরা যখন গোপন বৈঠকে ব্যস্ত ঠিক তখনই তীব্র চিৎকার শোনা গেল ‘তাড়াতাড়ি। সবাই তাড়াতাড়ি পালের দড়িতে হাত লাগাও। সর্বশক্তি দিয়ে দড়িদড়া কষে ধর।

আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণে ছেদ পড়ল। মুহূর্তের জন্য উত্তর্ণ হয়ে শুনেই ডার্ক পিটার্স আমার বন্ধুকে নিয়ে পড়ি কি মরি করে ওপরে উঠে গেল।

নাবিকরা গলা পর্যন্ত মদ গিলে একেবারে পাঁড় মাতাল বনে রয়েছে। কাঁপা কাঁপা পায়ে দাঁড়িয়ে এলোমোলা টানাটানি করে পালটাকে গুটিয়ে ফেলার আগেই প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবে জাহাজটা আচমকা এক পাশে হেলে পড়ে আমাদের নাকানি চোবানি খাইয়ে দিল। সত্যি কথা বলতে কি মুহূর্ত আমাদের হাল একেবারে বেসামাল হয়ে পড়ল।

আমরা আকস্মিক পরিস্থিতিটা কোনোরকমে সামাল দিতে না দিতেই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে তীব্র গর্জন করতে করতে প্রলয়ঙ্কর ঝড় ছুটে এসে আমাদের অসহায় জলযানটার ওপর আছড়ে পড়তে লাগল। বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়।

রাত যতই বাড়তে লাগল, ঝড় ততই রুদ্ররূপ ধারণ করতে লাগল। আর সে সঙ্গে সমুদ্রও রুদ্ররূপ ধারণ করল। রীতিমত খেপে গেল।

জাহাজের সবার মুখ শুকিয়ে একেবারে আমচুর হয়ে এলো। ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে ডার্ক পিটার্স আমার বন্ধুটিকে নিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে গলুইয়ে হাজির হল।

ডার্ক পিটার্স আমাকে গলুইয়ের তলব করল। আমি আর নির্দেশে বন্ধু অগাস্টাসের সঙ্গে গলুইয়ে তার সামনে হাজির হলাম। এমন বিপদজনক পরিস্থিতিতেই সে আমাদের সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করল।

ডার্ক পিটার্সের বক্তব্য সমর্থন না করে আমরা পারলাম না। আসলে তো জাহাজটার দখল নেওয়ার এর চেয়ে ভালো আর মিলবে না। তার বক্তব্যের পিছনে ‘যুক্তিও রয়েছে পুরোপুরি। অন্যান্য সবাই যখন নিশ্চিত ধ্বংসের কবল থেকে জাহাজটাকে রক্ষা করার জন্য শরীর ও মন উভয় দিক থেকে ব্যস্ত তখন আকস্মিক আঘাত হানলে তাদের পক্ষে যথাযথভাবে মোকাবিলা করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। আসলে তো এরকম আশঙ্কাই কেউ করবে না।

তবে একটা ব্যাপার আমাদের সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলল। কি সে সমস্যা, তাই না? আমাদের উভয় দলের শক্তির ফারাকটুকুর কথা বলতে চাইছি। কেবিনে রয়েছে। তারা পাঁচজন, আর আমরা মাত্র তিনজন। পাঁচের বিরুদ্ধে তিন–বিস্তর ফারাক। অবাস্তব সিদ্ধান্ত বটে । আরও আছে–অস্ত্রশস্ত্র যা-কিছু সবই রয়েছে তাদের জিম্মায়। আর ডার্ক পিটার্সের লুকিয়ে রাখা দুটোমাত্র পিস্তল আমাদের সম্বল। আর যা আছে তানিছকই পাজামার ফিতার সঙ্গে বেঁধে-রাখা নাবিকদের ছুরি। ব্যস, এটুকুই।

ডার্ক পিটার্স তবু আপন সিদ্ধান্তে অটল-অনড়। আর কাজ হাসিল করতে যা-কিছু করা দরকার, যতশীঘ্র সম্ভব সেরে ফেলতে হবে। তবে ঝুঁকি তো নিতেই হবে। ঝুঁকি ছাড়া বড় রকমের কোনো কাজ হাসিল করা যায় না।

জাহাজ দখলের পরিকল্পনাটাকে বাস্তবায়িত করার কাজে হাত দিয়েই ডার্ক পিটার্স বলল–‘চল, আমরা সবাই সোজা ডেকের ওপরে চলে যাই।’

অগাস্টাস বলল–‘কিন্তু সেখানে এ্যালেন প্রহরায় নিযুক্ত।

‘হোক গে।’ আমি গিয়ে তার সঙ্গে গল্প জমাব। তারপর মওকা বুঝে তাকে সজোরে এক ধাক্কা দিয়ে উত্তাল সমুদ্রের বুকে ফেলে দেব।

‘তারপর? তখন আমার আর আমার বন্ধুটির কাজ কী হবে? অগাস্টাস আগ্রহান্বিত হয়ে বলল।

‘তোমরা দুজন সুযোগ বুঝে সোজা ওপরে চলে যাবে। ব্যস্ত হাতে যা-কিছু অস্ত্রপাতি, হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়বে।

‘সে ও না হয় করা গেল। কিন্তু তারপর আমাদের করণীয় সম্বন্ধে কী ভেবেছ?

‘আমরা সশস্ত্র হয়ে তিনজনই ছুটে যাব। কেউ বাধা দেবার আগেই আমরা গলিপথটা আগলে দাঁড়িয়ে পড়ব। তবে সবই ঝটপট ও সতর্কতার সঙ্গে সেরে ফেলতে হবে, মনে থাকে যেন।

‘তোমরা প্রস্তাবটাকে আমরা উভয়েই সর্বাক্তকরণে গ্রহণ করলাম বটে। কিন্তু এমন একটা পরিকল্পনাকে কাজের রূপদান করা কি সহজ হবে, তুমি কী বল?’ সবচেয়ে বড় সমস্যা সম্পূর্ণ সশস্ত্রদের বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র তিনজনের লড়াই।

বন্ধু অগাস্টাসের মুখের কথাটা শেষ হবার আগেই আচমকা আমার মাথায় একটা মতলব উঁকি দিল। আশা করি স্মরণে আছে, জাহাজের প্রধান নাবিক হার্টম্যান রজার্সের সকালেই মৃত্যু হয়েছে। মেট-ই তাকে বিষ খাইয়ে খুন করেছে। ডার্ক পিটার্সের মনে এটাই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছে। তার লাশটা এখনও ডেকের ওপর পড়ে রয়েছে। চেষ্টা চরিত্র করে কোনোক্রমে তার মধ্যে যদি আবার প্রাণের সঞ্চার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তবে কি মেটের অপরাধী বিবেকে ধাক্কা লাগবে না, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন সচকিত হয়ে উঠে সে নিজের প্রাণনাশে তৎপর উঠবে না। ভাবনাটা কি একেবারেই অমূলক, বাস্তবতায় পরিপূর্ণ হলেও অস্বাভাবিক কিছু না, ঠিক কিনা? আর এ কাজের মাধ্যমেই আমাদের চূড়ান্ত পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। আর সে পরীক্ষা আমাদের দেওয়া চাই-ই চাই। কথায় তো আছেই, কর্মের মাধ্যমেই মানুষকে সাফল্য অর্জন করতে হয়।

আমাদের মতলবটাকে বাস্তবায়িত করা সুবিধার্থে আমাদের সামনে একটা সুযোগ এসে গেল।

আমরা হার্টম্যান রজার্সের লাশটার কাছে গিয়ে রীতিমত চমকে উঠলাম। তারনিষ্প্রাণ দেহটা ইতিমধ্যে এমন কুৎসিত, বিকৃত হয়ে উঠেছে যা অতীতে আমি অন্তত কোনো মৃতদেহের মধ্যে দেখিনি।

হার্টম্যান রজার্সের মৃতদেহটার ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম, তার পেটটা ফুলে ফেঁপে কোলের মতো বললে কমিয়েই বলা হবে–জয়ঢাকের মতো হয়ে গেছে। চকের মতো সাদা মুখটা শুকিয়ে কুঁচকে এই এতটুকু হয়ে গেছে। হাত দুটো কিন্তু ফুলে-ফেঁপে প্রায় পেটটার আকৃতিই ধারণ করেছে।

আমরা অনুসন্ধিৎসু নজরে তার মুখটাকে দেখতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, চকের মতো সাদা মুখটার এখানে ওখানে লাল লাল ছোপ। এগুলোই তার মুখটাকে আরও বেশি করে কদাকার করে তুলেছে। এমন বিকৃতদেহ ও মুখমণ্ডলধারী হার্টম্যান রজার্সকে যখন কেবিন থেকে বের করে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য ডেকের ওপর নিয়ে আসা হয় ঠিক সে মুহূর্তেই তাকে দেখামাত্র নিজের কৃত অপরাধের অনুতাপ জ্বালায় জর্জরিত হয়েই হোক বা মৃতদেহটার ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়েই হোক মেট সঙ্গে সঙ্গে তার দলের লোকদের হুকুম দিল–লাশটাকে একটা বস্তার মধ্যে ভরে সামুদ্রিক সমাধির প্রথানুযায়ী অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হোক।

হুকুম বাক্য উচ্চারণ করেই মেট লম্বা লম্বা পায়ে সেখানে থেকে কেটে পড়ল। হয়তো বা ভয়ঙ্কর সে দৃশ্যটা তার চোখ দুটো বেশি সময় বরদাস্ত করতে না পারার জন্যই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়ে এ পথ বেছে নিয়েছে।

মেটের নির্দেশ অনুযায়ী লাশটার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য যখন তোড়জোড় চলছে ঠিক সে মুহূর্তেই বুক-কাঁপানো গর্জন করতে করতে ঘূর্ণিঝড় ছুটে এসে জাহাজটার ওপর যেন তীব্র আক্রোশে আছাড় খেয়ে পড়ল। ঠিক তখনই ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে জাহাজটাকে রক্ষা করার জন্য মেট গলা ছেড়ে সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করে দিল; দড়িদড়া আলগা করে পাল নামানোর জন্য। এমন সংকটজনক মুহূর্তে পাল নামিয়ে নিতে না পারলে জাহাজের ধ্বংস অনিবার্য।

আমাদের প্রতিপক্ষের সবাই প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে জাহাজটাকে রক্ষা করার কাজে মেতে গেল। আর এদিকে আমরা মওকাটাকে ব্যবহার করে উদ্দেশ্য সিদ্ধি। করার কাজে হাত দিলাম।

মুহূর্তমাত্রও সময় নষ্ট না করে ডার্ক পিটাস উদ্ধশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ডেকের উপরে উঠে গেল।

তাকে দেখেই প্রহরারাত এ্যালেন তাকে ডাক দিল।

ডার্ক পিটার্স অন্যমনষ্কতার ভান করে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল। আচমকা হাত দুটো বাড়িয়ে তার গলাটা শক্ত করে চেপে ধরল, সে মুখ খোলার আগেই ক্রোধোস্মত্ত সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে দিল। ব্যস সব শেষ।

ডার্ক পিটার্সের ডাকে আমি আর অগাস্টাস হন্তদন্ত হয়ে উপরে উঠে গেলাম। কিন্তু ভাগ্য মন্দ। পাম্প করে জাহাজের খোল থেকে পানি বের করে দেওয়ার দুটো পাম্পের। হাতল ছাড়া কোনো অস্ত্রশস্ত্রই পেলাম না।

উপায়ান্তর না দেখে আমরা দুজনে পাম্পের হাতল দুটোই হাতে তুলে নিলাম।

এবার অগাস্টাস আর আমি ব্যস্ত-হাতে মৃতদেহটার গা থেকে জামাটা খুলে নিলাম। অগাস্টাসকে ডেকে দাঁড় করিয়ে রেখে ডার্ক পিটার্স আর আমি যত দ্রুত সম্ভব সিঁড়ি-বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। এ্যালেন যে জায়গায় প্রহরায় নিযুক্ত ছিল ঠিক সে জায়গায়ই অগাস্টাস দাঁড়িয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য হঠাৎ কেউ এসে পড়লে ভাববে এ্যালেন বুঝি প্রহরায় নিযুক্ত।

আমার বন্ধু অগাস্টাস তো এ্যালেন ভূমিকায় অভিনয়ে নিজেকে লিপ্ত করল। আর আমি নিচে নেমেই নিজেকে আর্টান রজার্সের সাজে সাজিয়ে, ছদ্মবেশ ধারণ করতে ব্যস্ত হলাম। আমাকে দেখেই যাতে সবাই ভেবে নেয় সে-ই বুঝি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার গা থেকে যে জামাটা খুলে নিয়েছিলাম সেটাকে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। এবার মৃতদেহটার ফুলে ফেঁপে ওঠা আকৃতিটাকে তুলে ধরার জন্য বিছানার চাদর জড়িয়ে পেটটাকে ঢাকের মতো করে তোলোম। তারপর পশমের সাদা মোজা হাতে গলিয়ে হাত দুটোকেও যথেষ্ট ফুলিয়ে নিতে অসুবিধা হচ্ছে না। সব শেষে মুখটাকে ফ্যাকাসে বিবর্ণ করে নেওয়ার কাজে ডার্ক পিটার্স রঙ-তুলির টান দিয়ে আমাকে সাহায্য করে। তারপর নিজের একটা আঙুল কেটে সে রক্ত দিয়ে সাদা রঙের ওপর লাল লাল ছোপ এঁকে দিল। অন্য যে কেউ তো অবশ্যই, এমনকি আমি নিজের যদি নিজের মুখটা দেখতাম তবে আতঙ্কে শিউরে না উঠে উপায় ছিল না। আমাকে দেখে কে বলবে যে, আমিই হার্টম্যান রজার্স নই?

.

০৮. ॥ অষ্টম অধ্যায় ॥

আমি নিজেকে হার্টম্যান রজার্সের ছদ্মবেশ ধারণ করার পর কেমন মা নিয়েছে তা পরখ করে দেখার জন্য কেবিনেরে দেওয়াল আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বুকের ভেতরে আচমকা ধড়া করে উঠল।

না, অহেতুক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নষ্ট করার মতো একটা মুহূর্তও আমার নেই। মাথার ওপর গুরুদায়িত্ব রয়েছে। অভিষ্টসিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এতটুকুও স্বস্তি নেই।

ডার্ক পিটার্স আর আমি গুটি গুটি ডেকে উঠে গেলাম। জাহাজের অন্যান্য সবাই তো ঝড়ের কবল থেকে জাহাজটাকে রক্ষা করতে প্রাণান্ত প্রয়াস চালাচ্ছে। ফলে আমাদের দিকে নজর দেওয়ার মতো সময় ও মন কারোরই নেই, থাকার কথাও নয়।

ডেকের ওপর পৌঁছে দেখলাম, সবকিছুই ঠিক আছে। আমরা তিনজনই কিছুটা পথ হামাগুড়ি দিয়ে পাড়ি দিয়ে সরু পথটা পেরিয়ে গেলাম। এবার দরজার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরের পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে নেবার চেষ্টা করলাম।

না, যা ভেবেছিলাম তা নয়। দেখলাম, সবাই বেশ সজাগই আছে। একজন মাত্র গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে বন্দুকটাকে পাশে রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

আর বাকি সবাই মেঝেতে বসে কথাবার্তায় মগ্ন। হাবভাব দেখে মনে হলো তারা কেউ-ই মদ গিলে পাড় মাতাল হয়ে পড়েনি। সবাই হাতেই রয়েছে একটা করে চকচকে ঝকঝকে ছুরি। এমনকি দু-একজনের কোমরে পিস্তলও গোঁজা দেখলাম। আর বার্থের ওপরে বেশ কয়েকটি বন্দুকও সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

আমি মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে আঁচ নিয়ে নেবার চেষ্টা করলাম। ইতিমধ্যে আমার সঙ্গি দুজন বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভেতরে ঢুকে যেতে লাগল।

তারা ভেতরে ঢুকে যাওয়ার পর ডার্ক পিটার্স দরজাটাকে বন্ধ করে আগের মতোই পরিবেশ তৈরি করেনিল।

মেট তাদের সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহারই করল।

মেট মুখে হাসির প্রলেপ এঁকে আন্তরিকতার সঙ্গে অগাস্টাসকে বলল–শোন, ইদানিং তুমি ভালো ব্যবহার করছ লক্ষ্য করে তোমাকে এখন থেকে এ কেবিনে নামার অনুমতি দিচ্ছি। আর ভবিষ্যতে আমাদের দলেও তোমাকে টেনে নিতে পারি।

আমি তার সব কথা পরিষ্কার শুনতে পেলাম।

পাম্পের একটা হাতল আমার হাতে মুঠো করে ধরে রাখা আছে। এটাকে হাত থেকে নামালাম না। বলা যায় না, যে কোনো মুহূর্তে ব্যবহার করতে হতে পারে।

পূর্ব পরিকল্পনামাফিক আমি তৈরি হয়েই অপেক্ষা করতে লাগলাম। ডার্ক পিটার্সের নির্দেশ পেলেই ক্রোধোন্মত্ত বাঘের মতো শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।

ইতিমধ্যেই ডার্ক পিটার্স বিদ্রোহের রক্তাক্ত কাণ্ডকারখানার দিকে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিল। আর নাবিকরাও হরেক রকম কুসংস্কারের কাহিনী উল্লেখ করে গল্প ফেঁদে বসল। আবার কখনও বা তাদের মধ্যে উত্তেজনার জোয়ার বইতে লাগল। মেটকেই সবচেয়ে উত্তেজিত হতে দেখা গেল।

নাবিকদের মধ্যে একজন হার্টম্যান রজার্সের বিকৃত দেহ, বিশেষ করে মুখটার প্রসঙ্গ পাড়ল।

তাদের কথার মাঝখানেই ডার্ক পিটার্স প্রস্তাব দিল–‘ওই বিদঘুঁটে লাশটাকে আর মিছে জাহাজে রেখে দিয়ে ফায়দা কি হতে পারে আমার মাথায় ঢুকছে না। তার চেয়ে ওটাকে সাগরে ফেলে দেওয়াই উচিত।

ডার্ক পিটার্সের প্রস্তাব শুনে নচ্ছার মেট শয়তানের মতো পিট পিট করে নাবিকদের দিকে তাকাতে লাগল। সে মুখে কিছু বলল না, ইঙ্গিতে বুঝিয় দিল, লাশটাকে সাগরের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দাও।

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার তার ইঙ্গিতটাকে বাস্তবায়িত করতে কেউ উঠে যাওয়া তো দূরের ব্যাপার এমনকি সামান্যতম নড়াচড়াও করল না।

নাবিকদের নিরুৎসাহ ভাবটা দেখে আমি স্পষ্টই অনুমান করলাম, পুরো দলটাই মানসিক উত্তেজনার শিকার হয়ে পড়েছে। আর সে উত্তেজনা রীতিমত পঞ্চমে চড়ে গেছে। ঠিক সে মুহূর্তেই আমি ডার্ক পিটার্সের সংকেত পেয়ে আচমকা একেবারে তাদের দলের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম।

আমাকে দেখেই তারা ধরেই নিল অকস্মাৎ প্রেতাত্মার আবির্ভাব ঘটেছে।

ওরে ব্যস, চোখের সামনে ভুত! এ যে একেবারেই ভয়ঙ্কর, অপ্রত্যাশিত এক কাণ্ড।

আমার দিকে চোখ পড়তেই মেট অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করে তড়াক করে লাফিয়ে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। কেবল বিকৃত স্বরে দু-তিনবার গোঙানো ছাড়া আর কিছুই বলতে পারল না। পর মুহূর্তেই বিকট স্বরে আর্তনাদ করে ডেকের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ব্যস, একদম ঠাণ্ডা। তার প্রাণহীন দেহটা জাহাজের দোলায় বারবার ওদিক এদিক গড়াতে লাগল।

আর বাকি চারজন বজ্রাহতের মতো অপলক চোখে তাকিয়ে নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো ঠায় বসেই রইল। এখন কারো মুখে টু-শব্দটিও নেই। কেবলমাত্র আতঙ্কের শিকার হয়ে যে মানুষ এমন পৌনে মরা হয়ে পড়তে পারে আমি ইতিপূর্বে আর কোনোদিন দেখিনি, শুনিও নি কারো মুখে।

এরই মধ্যে রিচার্ড পার্কার এবং জন হান্ট রুখে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। পিটার্সের পিস্তলের গুলিতে দুজনেই নির্মমভাবে প্রাণ দিল।

এবার আমি পাম্প মেশিনের হাতলটা দিয়ে উন্মাদের মতো পার্কারের মাথায় সজোরে আঘাত হানলাম।

আমার আগেই সুচতুর ও কৃতী বন্ধুবর অগাস্টাস একটা বন্দুক টেনে নিয়ে উইলসনের বুকে একটা তপ্ত গুলি গেঁথে দিল।

আর বাকি তিনজন বিদ্রোহী মদের ঝোঁকটুকু কোনোক্রমে কাটিয়ে প্রাণান্ত লড়াইয়ে মেতে গেল।

তুমুল লড়াই শুরু হয়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি অমিত শক্তিধর পিটার না থাকলে বিদ্রোহীদের জয় অবশ্যম্ভাবী ছিল।

যে তিনজন বিদ্রোহীর কথা বললাম তারা হচ্ছে এবসালাম হিক্স, গ্রালি আর জোন্স।

মুহূর্তের মধ্যেই প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। জোন্স আচমকা এক ধাক্কা দিয়ে আমার বন্ধু অগাস্টাসকে মেঝেতে ফেলে দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে তার ডান বাহুতে ছুরির আচড় ও ঘা বসাতে লাগল। তাকে হয়তো খতমই করে দিত। আমরা টেরও পেতাম না।

কারণ ডার্ক পিটার্স আর আমি অন্য বিদ্রোহী শত্রুদের মোকাবিলায় ব্যস্ত। আমাদের অন্য হিতাকাঙ্খীটি যদি না থাকত তবে হয়তো আজ আর আমাদের মধ্যে অগাস্টাসকে পেতাম না। আমাদের এ হিতকরী বন্ধুটি আর কেউ নয় আমার প্রিয় কুকুর টাইগার।

অগাস্টাস যখন চরম সঙ্কটজনক মুহূর্তে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অক্ষম হয়ে মৃত্যুর হাতে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে ঠিক তখন টাইগার তীব্র হুঙ্কার দিয়ে সরাসরি জোন্সের ওপর লাফিয়ে পড়ে তাকে একেবারে ধরাশায়ী করে দেয়।

বন্ধুবর অগাস্টাস আহত হয়েছে, রক্তক্ষরণ ঘটছে। কিন্তু সবকিছু বুঝেও আমার কিছুই করার ছিল না। কারণ আমি তখন আমার ছদ্মবেশ সামলাতে ব্যস্ত ছিলাম।

আমার ইয়া তাগড়া কুকুর টাইগার ইতিমধ্যেই দু-পায়ের থাবা দিয়ে জোন্সের গাল চেপে ধরেছে।

এদিকে ডার্ক পিটার্স একটা টুল টেনে নিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে মাথার ওপর তুলে নিয়ে দুম করে গ্রীলির মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। ব্যস, চোখের পলকে তার মাথাটা একেবারে ঘেঁৎলে গেল। গল গল করে রক্ষক্ষরণ ঘটতে লাগল। টাইগার এবার হিক্সকে নিয়ে পড়ল। অনায়াসেই সে তার নিকেশ করে দিল। শেষ শত্রু হিকসও খতম হল।

এক-এক করে সব কয়টা শত্রু নিপাত করে আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। আমরাই এবার জাহাজটার মালিক হয়ে গেলাম। জাহাজটার মালিকানা পাওয়ায় আমাদের ডার্ক পিটার্স, বন্ধু অগাস্টাস আর আমার যে কী উল্লাস তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কাউকে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না।

আমরা, কেবল আমরা তিনজনই এতবড় একটা জাহাজের মালিকানা লাভ করলাম।

শত্রুপক্ষের মধ্যে একমাত্র রিচার্ড পার্কারের দেহে প্রাণের লক্ষণ রয়েছে। আমার পাম্পের হাতলের আগাতে সে সংজ্ঞা হারিয়ে দীর্ঘ সময় এলিয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা নিঃসন্দেহ হবার জন্য ডার্ক পিটার্স জুতোর ডগা দিয়ে খুঁকে দেওয়া মাত্র সে বিশ্রি স্বরে গুঙিয়ে বার বার ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল।

রিচার্ড পার্কারকে প্রাণে না মেরে শিকল দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হল।

আর আমার বীর কুকুর টাইগার তখনও জোন্সের বুকের ওপর গঁাট হয়ে বসে অনবরত গর্জে চলেছে। তার প্রাণবায়ু অনেক আগেই খাঁচাছাড়া হয়ে পরলোকের। উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। টাইগার কামড়ে কামড়েই তার দফা রফা করে দিয়েছে।

ইতিমধ্যে মাঝরাত পেরিয়ে রাত একটা বেজে গিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব সমান তালেই চলেছে। আর জাহাজটার পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে পড়ছে। মাস্তুলটা সেই তখন থেকে ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে চলেছে। এতক্ষণ টিকে রয়েছে। আর কতক্ষণ। নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে, কে জানে। ইতিমধ্যেই বার-কয়েক মড় মড় আওয় জে নিজের অক্ষমতার কথা ঘোষণা করেছে। যে কোনো মুহূর্তে সেটা হুড়মুড় করে পড়ে যেতে পারে।

আবার এক নতুন সমস্যা দেখা দিল। উন্মত্ত সমুদ্রের বল্গাহীন জলোচ্ছ্বাসের ফলে পানি ঢুকে ঢুকে জাহাজের খোলটা প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। এখনও সময় আছে, পানি সেঁচে বের করে দিতে পারলে তবেই জাহাজটাকে রক্ষা করা সম্ভব।

আমরা তিনজন ছাড়া জাহাজের পানি সেঁচে বের করার জন্য আরও লোক দরকার। তাই রিচার্ড পার্কার এর বাঁধন খুলে তাকেও পানি সেঁচার কাজে লাগিয়ে দেওয়া হল। একটা পাম্প মেশিনও সর্বক্ষণ চালু রাখা হল।

নিদারুণ উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা রাতটা কাটালাম। আর সে সঙ্গে দেহ ও মনের ক্লান্তি তো রয়েছেই।

পূব আকাশে রক্তিম ছাপ ফুটে উঠল। তবু ঝড়ের তাণ্ডব এতটুকুও কমল না। সমুদ্রও আগের মতোই রুদ্র রূপ ধরেই রইল। ঝড় কমে প্রকৃতি শান্ত হবার কোনো চিহ্নই নজরে পড়ল না।

আমাদের তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। লাশ কয়টার গতি করা দরকার। সেগুলোকে টেনে হিঁচড়ে ডেকের ওপরে নিয়ে গিয়ে মরা জন্তু জানোয়ারের মতো উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে মারতে লাগলাম।

এবার সবার আগে যা করার দরকার তা হচ্ছে মাস্তুলটাকে নামিয়ে ফেলা কিন্তু। সেটাকে খুলে নামিয়ে আনা সম্ভব নয় বুঝে ডার্ক পিটার্স একটা কুড়াল দিয়ে কেটে সেটাকে ধপাস্ করে জলে ফেলে দিল।

মাস্তুলটা কেটে পানিতে ফেলা দেওয়ায় জাহাজের কোনো ক্ষতি হলো না। তবে আচমকা জাহাজটা একদিক অস্বাভাবিক কাৎ হয়ে পড়ায় জাহাজের খোলটা আবার পানিতে বোঝাই হয়ে গেল। তবে পাম্প করে পানি বাইরে ফেলে দেওয়া সম্ভব হলো না। এভাবে বেশিক্ষণ চললে জাহাজটাকে রক্ষা করাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যে কোনো মুহূর্তে এটা ডুবতে আরম্ভ করবে। ক্রমে সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ল। তখন বিকেল চারটের কাছাকাছি। ঝড়ের তাণ্ডব কমল তো না-ই, বরং অনেকগুণ বেড়ে গেল। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে, ডেকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।

ক্রমে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার নেমে এলো। ঝড় আরও প্রলয়ঙ্কর রূপনিল। আমাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড় হল। সকল পর্যন্ত জাহাজটাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে কিনা সে বিষয়ে আমরা সন্দিহান হয়ে পড়লাম।

মাঝ রাত। জাহাজের খোলে হাঁটুসমান পানি দাঁড়িয়ে গেল। পাম্প করে এত পানি সেঁচে বাইরে ফেলা কি করে সম্ভব। তবে দাঁতে দাঁত চেপে আমরা জাহাজটাকে রক্ষা করার প্রাণান্ত প্রয়াস চালাতে লাগলাম।

হঠাৎ হ্যাঁ, একেবারেই হঠাৎ একটা পর্বত প্রমাণ ঢেউ এসে তীব্র আক্রোশে আমাদের জাহাজটার ওপর আছাড় খেয়ে পড়ল। জাহাজটাকে সম্পূর্ণরূপে পানির তলায় নিয়ে চলে গেল। সে যে কী অভাবনীয় মর্মান্তিক পরিস্থিতি সে কথা ভাবলে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়ে যায়।

.

০৯. ॥ নবম অধ্যায় ॥

এমন বেসামাল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ভয় আমরা আগেভাগেই করেছিলাম। এটাকে আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার বলেই মনে করা যেতে পারে। কারণ, রাতের অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমরা চারজনই ডেকের ওপর চলে গিয়েছিলাম। ডেকের ওপর পড়ে থাকা চড়কি যন্ত্রটার ভাঙা অংশের সঙ্গে নিজেদের শক্ত করে বেঁধে রেখেছিলাম। ফলে আমরা জাহাজ থেকে গড়িয়ে সমুদ্রে পড়ে যাইনি। আমরা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাই। আমরা যদি আগেভাগে সতর্কতা অবলম্বন না করতাম তবে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল।

জাহাজের পানি সরে গেল বটে। কিন্তু ইতিমধ্যে আমাদের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে যাবার জোগাড় হল। আমিই সবার আগে সঙ্গিদের গলা ছেড়ে ডাকাডাকি করলাম।

আমার ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে একমাত্র অগাস্টাসের গলা শোনা গেল– ‘আমাদের তো জীবন শেষ হতে চলেছে। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন।

পর মুহূর্তেই অন্য দুজনের গলাও কানে এলো–ভেঙে পপারো না। বুকে সাহস অবলম্বন কর। আশা এখনও আছে। হতাশ হবার কোনো কারণই নেই। এমন একটা জাহাজ কিছুতেই ডুবে যেতে পারে না। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের জন্য ব্যাপারটা আমার মাথা থেকে উবে গিয়েছিল।

নতুনতর আশার বশবর্তী হয়ে চড়কি যন্ত্রটার সঙ্গে নিজেকে আরও ভালো করে বেঁধে নিলাম।

আমার বাঁধাবাঁধি মিটতে না মিটতেই বুঝতে পারলাম, আমার সঙ্গিরাও চড়কি যন্ত্রটার সঙ্গে নিজেদের বাঁধতে শুরু করেছে।

চারিদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আর অন্ধকারটা এত গাঢ় যে, নিজের হাত দুটোও দেখা যায় না। আর ঝড়ের তাণ্ডব আর ঢেউয়ের ক্রোধোন্মত্ততা পরিবেশটাকে এমন ভয়ঙ্কর করে তুলেছে যা ভাষায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

আমাদের জাহাজের ডেকটা সমুদ্রের পানির সমতল হয়ে এগিয়ে চলেছে। শুধু কি এই? উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের ফেনারাশি থেকে থেকে জাহাজের ওপর উঠে আসছে, কখন বা কিছু অংশ আমাদের ওপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল।

এদিকে পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়ে পড়ল যে, আমাদের মাথাগুলো প্রতি তিন সেকেণ্ডে মাত্র একটা সেকেণ্ডের বেশি সময় পানির ওপরে জেগে থাকছে না।

ব্যাপারটা বাস্তবিকই অদ্ভুত, একেবারে অবিশ্বাস্য, আমরা চারজন এত কাছাকাছি, বলতে গেলে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে অবস্থান করছি তবুও কেবলমাত্র কণ্ঠস্বর শোনা ছাড়া কেউ, কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আর সে জাহাজের ওপর আমরা থেকে থেকে আছাড় খেয়ে পড়ছি তাকেও চোখে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।

রাতের অন্ধকার কেটে গিয়ে প্রকৃতির বুকে ভোরের আলো দেখা না দেওয়া পর্যন্ত ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেই আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত কাটাতে হল।

অন্ধকার কেটে গিয়ে দিনের আলো ফোঁটার পর ভয়ঙ্কর অবস্থাটা আরও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দিল। আমাদের জাহাজটা অবান্দিওতের মতো, এক টুকরো কাঠের পর মুহূর্তে আবার আছাড় খেয়ে নিচে পড়ছে। হয়তো একমাত্র ভাগ্যের জোরেই আমরা এখনও সমুদ্রের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাইনি।

ঝড়ের তাণ্ডব কমা তো দূরের কথা, বরং উন্মত্ততা উত্তরোত্তর বেড়েই চলল।

ঘূর্ণিঝড়। এটা যথার্থই ঘূর্ণিঝড়। এর কবল থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো আশাই নেই। তবে যতক্ষণ পিতৃদত্ত জীবনটাকে টিকিয়ে রাখতে পারি, এই যা।

আরও কয়েকটা ঘণ্টা সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যেই আমরা কাটিয়ে দিলাম। প্রতিটা মুহূর্তেই আমাদের ভয় এই বুঝি দড়িদড়া ছিঁড়ে গেল, চড়কি যন্ত্রটা বুঝি জাহাজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলল। আর আকাশ-ছোঁয়া ঢেউগুলো ক্রোধে তর্জন গর্জন করতে করতে আচমকা আমাদের পানির এত তলায় নিয়ে চলে যাবে যেখান থেকে আর কোনোদিন উঠে আসতে পারব না। দম বন্ধ হয়ে আমাদের ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। হায় ঈশ্বর! এ কী মহাসঙ্কটের মুখে ফেললে!

আর যা-ই হোক, ঈশ্বরের অসীম দয়ায় সে মহাসঙ্কট থেকে আমরানিষ্কৃতি পেয়ে গেলাম। ঝড়ের তাণ্ডব অনেক কমে গেছে। দুপুরের দিকে সূর্যের কিরণে চারদিক ঝলমল করতে লাগল।

সমুদ্রও অনেকাংশে শান্ত হয়ে এসেছে। তার সে ক্রোধোন্মত্ত ভাব স্তিমিত হতে হতে প্রায় স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে। প্রায়-শান্ত সমুদ্রের বুকে সূর্যের সোনালি আলো পড়ে যেন এক অনিবৰ্চনীয় শোভা ধারণ করেছে। সত্যি এ যেন এক অভাবনীয়, একেবারে ব্যাপার।

এর আগের সন্ধ্যায় অগাস্টাস তার পাশে অবস্থানরত ডার্ক পিটার্সের কাছে বলল–‘আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, আমাদের জীবন রক্ষা পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে, নাকি মৃত্যু অবধারিত?

ডার্ক পিটার্সের দিক থেকে হ্যাঁ বা না কোনো জবাব না পেয়ে নিঃসন্দেহই হলাম, লোকটা ডুবেই মরেছে।

অগাস্টাস আৎকে উঠে আবারও তার নাম ধরে বার-কয়েক ডাকল।

এবার দুর্বল, খুবই ক্ষীণকণ্ঠে সে কোনোরকমে সাড়া দিল। তার দিক থেকে সাড়া পাওয়ায় আমাদের মন যে কী আনন্দে নেচে উঠল তা আর বলার নয়।

দুর্বল গলায় কোনোরকমে সে বলল–‘দড়িগুলো আমার পেটের ওপর এমন আঁট হয়ে বসে গেছে যে, যন্ত্রণা সহ্য করাই দায় হয়ে পড়েছে! যদি পার আমার দড়ির বাধন আগা করে দাও, নইলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে শেষ করে দেবার ব্যবস্থা কর।’

তার পরিস্থিতি খারাপ বুঝেও সে মুহূর্তে আমাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব হলো । তাকে সাহায্য করতে না পেরে অগাস্টাস সমবেদনা প্রকাশ করে বলল–‘মি. পিটার্স, পরিস্থিতি তো বুঝতেই পারছেন। ধৈর্য্য ধরে, দাঁতে দাঁত চেপে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই, অনুগ্রহ করে আর একটু ধৈর্য্য ধরুন। সামান্যমাত্র মওকা পেলেই আমরা আপনাকে অবশ্যই সাহায্য করব, জীবনরক্ষার জন্য যা-কিছু করণীয় কোনোকিছুরই ত্রুটি রাখব না, নিঃসন্দেহ হতে পারেন।

চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ডার্ক পিটার্স বলল–‘কিন্তু, কিন্তু সে যে অনেক দেরি! সুযোগ আসতে আসতে যে আমি মরে হেজে যাব।

মিনিট কয়েক পরেই ডার্ক পিটার্সের কথা একেবারেই থেমে গেল। ফো-ফা কিছু শোনা গেল না। আমরা বাধ্য হয়ে নিঃসন্দেহ হলাম, তার মৃত্যু হয়েছে। সব দুঃখ যন্ত্রণা, হতাশা-হাহাকারের উর্ধে চলে গেছে।

এ-তো গেল গত রাতের ঘটনা। আজকের দিন পেরিয়ে নেমে এলো সন্ধ্যার অন্ধকার। সমুদ্রও অনেক শান্ত, ঝড়ও নেই বললেই চলে। জাহাজের খোলের ওপর দিয়ে ঢেউ বয়ে যাওয়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে সঙ্গিদের দিক থেকে কোনোরকম সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি কণ্ঠস্বরে উকণ্ঠা প্রকাশ করে বন্ধু অগাস্টাসের নাম ধরে বার কয়েক ডাকাডাকি করলাম।

সে এমনই দুর্বল গলায় আমার ডাকে সাড়া দিল যা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছল না।

অগাস্টাসের দিক থেকে সাড়া না পেয়ে আমার বুকের ভেতরে ধড়াস্ করে উঠল। আতঙ্কে গলা শুকিয়ে এলো। এবার কোনোরকমে ডার্ক পিটার্স আর পার্কারের নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম। না, এবারও আমাকে হতাশ হতে হল।

একটু পরেই আমি যেন একটু একটু করে কেমন এক সংজ্ঞাহীনতার মধ্যে তলিয়ে যেতে লাগলাম। হতাশা বা হাহাকার নয়–আমার কল্পনায় বহু আনন্দোচ্ছল ছবি একের পর এক ফুটে উঠতে লাগল। সে মুহূর্তে মন চাঙা-করা যেসব দৃশ্য দেখেছিলাম তাদের মধ্যে মুখ্য ছিল–গতি।

অবচেতন ভাবটা কেটে গিয়ে যখন আমার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে এলো তার অনেক আগেই সূর্য উঠেছে।

চারদিকে সূর্যের ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়লেও প্রকৃত পরিবেশটাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমার সামনে পিছনে–চারদিকে যা-কিছু রয়েছে সবই যেন অজানা অচেনা।

তখনও যেন বার বার আমার মনে হতে লাগল, আমি সেই জাহাজের খোলের অন্ধকার কুঠরিটার মধ্যেই রয়েছি। আর পার্কারের দেহটা আমার পোষা কুকুর টাইগার ছাড়া কিছু নয়। এ কী! এ কেমন দশা হলো আমার!

শেষমেশ যখন আমার অবচেতন ভাবটা পুরোপুরি কেটে গেল, স্বাভাবিকতা ফিরে পেলাম, তখন সমুদ্র উন্মাদনা হারিয়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে আর বাতাসের গতিও স্বাভাবিক।

দীর্ঘ নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতায় আমার বাঁ হাতের বাঁধন ঢিলে হতে হতে পুরোপুরি খুলেই গেছে। তবে কনুইয়ের কাছে বেশ কিছুটা কেটে গেছে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়েই চলেছে। আর ডান হাতটা চেতনা হারিয়ে ফেলেছে। দড়ি চেপে বসে থাকায় কবজি– পুরো হাতটাই ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। হাত দুটোর দিকে নজর যেতেই আমি চমকে উঠলাম।

এবার চারিদিক তাকিয়ে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিটা সম্বন্ধে ধারণা করে নেওয়া চেষ্টা করলাম। দেখলাম ডার্ক পিটার্সের মধ্যে তখনও প্রাণের লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু তার কোমরটা ঘিরে এমন পুরু একটা দাগ নজরে পড়ছে যা হঠাৎ করে দেখলে

স্পষ্ট মনে হচ্ছে কেউ যেন সেখান থেকে কেটে শরীরটাকে দুটুকরো করে দিয়েছে। তার অবস্থা দেখে আমি নিজের ব্যথা-বেদনার কথা ভুলে গেলাম।

আমাকে নড়াচড়া করতে দেখে ডার্ক পিটার্স অঙ্গুলি-নির্দেশ করে তার কোমরটা আমাকে দেখাল। আর সে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণার কথাও বুঝিয়ে দিল।

এদিকে বন্ধু অগাস্টাসের দিকে চোখ পড়তেই আমি সচকিত হয়ে তার দিকে। সাধ্যমত ঝুঁকলাম। আমার মধ্যে প্রাণের কোনো অস্তিত্বই আমার নজরে পড়ল না। সে ভাঙা চড়কি যন্ত্রটার সঙ্গে একেবারে জড়াজড়ি করে পড়ে রয়েছে।

খুবই ক্ষীণকণ্ঠে পার্কার আমাকে বলল–‘আমাকে এ কঠিন পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করার কোনোরকম শক্তি সামর্থ্য তোমার আছে কী?

আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম–মনকে শক্ত করে বাঁধুন। ধৈর্য্য ধরুন, সাহস অবলম্বন করুন। আমার দিক থেকে চেষ্টার কিছুমাত্রও ত্রুটি হবে না, কথা দিচ্ছি। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাজামার পকেটে হাতটা চালান করে দিয়ে ছোট ছুরিটা বের করে আনলাম।

দুর্বল হাত দুটো দিয়ে বার-কয়েক চেষ্টা করার পর তার সুতীক্ষ ফলাটা খুলতে পারলাম। এবার বাঁ হাতে ডান হাতে এবং অন্য দড়ি দড়ার বাঁধন খুলে কেটে ফেললাম।

হায়! আমার একী শোচনীয় অবস্থা হল। পা দুটো অবশ হয়ে গেছে। দাঁড়াবার মতো শক্তি-সামর্থ্যটুকু যে হারিয়ে বসেছি। আবার ডান হাতটাকেও নাড়াতে চাড়াতে পারছি না।

আমার অবস্থার কথা পার্কারকে বললাম। সে ধৈর্য্য ধরে সবকিছু শুনে ক্ষীণকণ্ঠে আমাকে উপদেশ দিল–এক কাজ কর। হাত-পা ছড়িয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থাক। শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তারপর দেখবে হাত-পায়ের হৃত বল অনেকাংশে ফিরে পেয়েছ।

তার পরামর্শ মতো কাজ করে ফল কিছুটা পেলাম বটে। সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বাভাবিকতা ফিরে পেলাম।

এবার হাতের ছুরিটাকে মুঠো করে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে, প্রায় বুকে হেঁটে পার্কারের দিকে এগোতে লাগলাম। তার কাছে পৌঁছেই ব্যস্ত হাতে তার যাবতীয় বাঁধন কাটতে আরম্ভ করলাম। বাঁধনমুক্ত হবার পর মিনিট কয়েকের মধ্যেই পার্কার হৃত শারীরিক বল ফিরে পেতে আরম্ভ করল।

তার কোমরে দড়ির বাধন এমনভাবে চেপে গেছে যে অনবরত চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে। দড়িটা ছিল জামা আর পাজামার ওপর দিয়ে, তাতেই এরকম ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নইলে তার শরীরটাই হয়তো বা দুটুকরো হয়ে যেত।

স্বীকার করছি, আমার বন্ধুবর অগাস্টাস যে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পাবে এরকম ধারণা আমার অন্তত ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি, তার ধড়ে জীবনের কোনো লক্ষণই আমার নজরে পড়েনি।

গুটি গুটি এগিয়ে বন্ধুর কাছে গিয়ে, অনুসন্ধিৎসু নজরে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বুঝতে পারলাম, খুব বেশি পরিমাণে রক্তক্ষরণের ফলেই তার শারীরিক পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়ে পড়েছে, সংজ্ঞা হারিয়ে এলিয়ে পড়েছে।

বন্ধুর হাতে একটা ব্যান্ডেজ করা ছিল। ক্রমাগত ঢেউয়ের ধাক্কা লেগে লেগে সেটা অনেক আগেই স্থানচ্যুত হয়ে পড়ে। আর সে যতটা দীর্ঘসময় ধরে নোনা পানির সংস্পর্শে থাকার ফলে পরিস্তিতি এমন হয়ে পড়েছে। তবে এও লক্ষ্য করলাম, তার শরীরের কোনো অংশের বাঁধনই চামড়া ও মাংস ভেদ করে বসে যায়নি।

আমরা দুজন তাকে ধরাধরি করে একটা শুকনো ফাঁকা জায়গায় শুইয়ে দিলাম।

আমি অনুসন্ধিৎসু চোখে তার এলিয়ে পড়ে থাকা সংজ্ঞাহীন দেহটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সমুদ্রের মুক্ত বাতাস পাওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই সে হৃত সংজ্ঞা ফিরে পেতে আরম্ভ করল। একটু পরেই সে প্রায় স্বাভাবিতা ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে উঠে বসল।

দড়িদড়ার বাঁধন ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে আমরা যে অবর্ণনীয় কষ্টের শিকার হয়েছিলাম তা থেকে মুক্ত হবার পর আমাদের যা-কিছু কষ্ট সবই ক্ষুধা ও তৃষ্ণাজনিত। কিন্তু হায়। যেদিকে, যতদুর নজর চলে কেবল পানি আর পানি। অকুল নোনা পানির ছড়াছড়ি। হাতের নাগালের মধ্যে এত পানি তবু পানি তৃষ্ণায় আমাদের ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম হল। এতই নোনা যে এর এক ফোঁটাও মুখে তোলার উপায় নেই।

মানুষ যত কঠিন সমস্যা সম্মুখীন, হোক না কেন তবু আশা ছাড়তে পারে না। আমাদের অবস্থাও হলো ঠিক তাই। আশায় বুক বেঁধে প্রতীক্ষায় রইলাম, ভাবলাম, হয়তো অচিরেই কোনো জাহাজ আমাদের পরিস্থিতির কথা সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করে এগিয়ে আসবে, আমাদের উদ্ধার করবে। আর পরম পিতার কাছে নতজানু হয়ে করজোড়ে প্রার্থনা জানালাম, তিনি যেন এ চরম সঙ্কটজনক পরিস্থিতি থেকে আমাদের উদ্ধার করেন। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর কথাই যে অন্তঃস্থলে সবার আগে জেগে ওঠে।