2 of 2

৫.০৩ গান্ধী ও মাও

৫.৩ গান্ধী ও মাও

বুদ্ধ ও গান্ধীর নাম এদেশে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়ে থাকে। এতে গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশিত হলেও গান্ধীবাদের সমসাময়িক তাৎপর্য ঢাকা পড়ে যায়। জন্মান্তরের চক্র থেকে মানুষ কি করে মুক্তি পেতে পারে প্রাচীন ঋষিদের ভাবনা ছিল তাই নিয়ে। গান্ধীবাদের বিচার প্রয়োজন আজকের আর্থিক ও রাজনীতিক পরিস্থিতির পটভূমিকায়।

এযুগের সবচেয়ে বড় ঘটনা সম্ভবত এই যে, পৃথিবীর এক বৃহৎ অংশ জুড়ে প্রাচীন, কৃষিপ্রধান, অনুন্নত সমাজে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে আর তারই মাঝে শুরু হয়েছে বৃহদাকার শিল্প গঠনের উদ্যোগ। এমনই একটা ভাঙ্গাগড়ার ভিতর গান্ধীর জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় এক শতাব্দী পূর্বে।

গান্ধী লক্ষ করেছিলেন, সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে একটা প্রবল ঝোঁক। আধুনিক শিল্প ও বিজ্ঞান এই ঝোঁকটাকে আরও শক্তিশালী করেছে। আপাতদৃষ্টিতে গান্ধীকে শিল্প ও বিজ্ঞানের বিরোধী মনে হতে পারে, কিন্তু তাঁর আপত্তি ছিল মূলত আধুনিক শিল্পপ্রধান সমাজে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে।

এ যুগে বৃহৎ শিল্পের পরিচালকদের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা, পূর্বে কখনও তা দেখা যায়নি। আজকের রাষ্ট্র ও আমলাতন্ত্র সমস্ত সমাজকে যেমন সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে অতীতে কখনও তেমন সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্র যদি স্বৈরাচারী হয় তো সেই স্বৈরাচার আজ সহজেই সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। আধুনিক সমাজ যদিও নানাদিক থেকে প্রাচীন সমাজের তুলনায় উন্নত তবু আজকের নৈর্ব্যক্তিক, হৃদয়হীন, অতিকায় প্রতিষ্ঠানের অবিচার সংবেদনশীল মনের কাছে কম অসহনীয় নয় এই অবিচার প্রতিরোধের কোনো সহজ উপায় আমরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারিনি। সাম্যবাদের কথা আমরা বলি বটে, কিন্তু তার সফল রূপায়ণের সূত্র আমরা জানি না। শিল্প ও মূলধন রাষ্ট্রায়ত্ত করলেও রাষ্ট্র ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সর্বব্যাপী কর্তৃত্বের বাঁধন শিথিল হয় না বরং দৃঢ়তর হয়।

বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান্ধীর বিদ্রোহ অবাস্তব মনে হতে পারে। কিন্তু মনে রাখা ভালো যে, আজ চীন থেকে ফরাসীদেশ ও আমেরিকা অবধি ধনতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী বহুদেশ জুড়ে তরুণের যে বিদ্রোহ সেটাও মূলত এই আমলাতন্ত্র ও মানবতার স্পর্শহীন অতিক্ষীত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ। এই নতুন প্রতিবাদের ভাষা যাই হোক না কেন, এর সঙ্গে গান্ধীবাদ তথা নৈরাজ্যবাদের কোথাও একটা মর্মের যোগ আছে।

গান্ধী অবশ্য জানতেন যে, নিয়ম ছাড়া কোনো সুস্থ সমাজ অথবা প্রতিষ্ঠান চলে না; সাধারণ জীবনে নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করে চলবার শিক্ষাই তিনি দিয়েছেন। কিন্তু অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও মানুষের নৈতিক কর্তব্য। একথাটা গান্ধী অন্তরের অন্তস্তল থেকে অনুভব করেছিলেন। প্রতিবাদকে কিভাবে সার্থক করে তোলা যায় এই মূল প্রশ্ন নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তা করেছিলেন। এই চিন্তার ফলশ্রুতি স্বরূপ তিনি যে-সব প্রত্যয়ে উপনীত হন তারই গুণে গান্ধীবাদকে সমসাময়িক সমস্ত নৈরাজ্যবাদের ভিতর সবচেয়ে পরিণত বলা যেতে পারে। আধুনিক রাষ্ট্র ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীভূত বিপুল শক্তির তুলনায় ব্যক্তিকে অত্যন্ত দুর্বল মনে হয়। কিন্তু রাষ্ট্র যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যে-মানুষ নির্ভীক, ভয়ের বন্ধন থেকে নিজেকে যিনি মুক্ত করেছেন, তিনি সেই। মুহূর্তেই অন্তরে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। গান্ধী দর্শন এই অর্থে জড়বাদ থেকে স্বতন্ত্র। এই-যে আদর্শ সমাজে পৌঁছবার আগেই কল্পনায় আদর্শকে প্রত্যক্ষ করবার শক্তি, এই-যে বহির্জগতে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার পূর্বেই অন্তরে স্বাধীনতা অর্জনের সামর্থ্য, এরই জোরে মানুষ জড় জগতের অংশ হয়েও তার ঊর্ধ্বে। গান্ধী শিখিয়েছেন যে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রথম প্রয়োজন অভয়। আর অন্তরে নির্ভয় হবার পর দ্বিতীয় প্রয়োজন অন্যায়ের সঙ্গে অহিংস অসহযোগ।

এই দ্বিতীয় কথাটি নিয়ে খানিকটা আলোচনা আবশ্যক। “চার অধ্যায়” উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “গায়ের জোরে আমরা যাদের অত্যন্ত অসমকক্ষ তাদের সঙ্গে। গায়ের জোরের মল্লযুদ্ধ করতে চেষ্টা করলে আন্তরিক দুর্গতি শোচনীয় হয়ে ওঠে। “ গান্ধী যখন এদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন তখন আমরা যে গায়ের জোরে ইংরাজের অত্যন্ত অসমকক্ষ ছিলাম সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। গান্ধী এসে আমাদের নতুন। পথ দেখালেন। তিনি শেখালেন যে, অত্যাচারীর অত্যাচারও সম্ভব হয় না অত্যাচারিতের সমর্থন ছাড়া; অতএব অহিংস অসহযোগের সাহায্যে অত্যাচারের অবসান সম্ভব।

গান্ধীর এই শিক্ষা শুধু সেদিনের ভারতের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। মার্কিন দেশে ক্ষমতাবান শ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনে এই নৈতিক অসহযোগের শিক্ষাই দিয়েছেন মার্টিন লুথার কিং। আরও একটি উদাহরণ দিই। বাহুবলে বহুগুণে শক্তিশালী সোভিয়েত সৈন্যদল যে মুহূর্তে দুর্বল চেকোস্লোভাকিয়াতে প্রবেশ করেছে সেই মুহূর্তেই স্পষ্ট হয়েছে যে, অহিংস অসহযোগের পথেই আজ পূর্ব ইয়োরোপের মুক্তি সম্ভব।

শিল্পে অনুন্নত কোনো কোনো দেশে অবশ্য সংগ্রামের অন্য একটি পথও আছে। এই দ্বিতীয় পথের প্রধান ব্যাখ্যা বর্তমান যুগে চীনের নেতা মাও সে-তুং। মাও-এর বিপ্লবপদ্ধতি শিল্পোন্নত দেশগুলিতে প্রযোজ্য নয়। যে-দেশ গ্রামপ্রধান, যেখানে আধুনিক যানবাহনের ব্যবস্থা অসম্পূর্ণ, যেখানে সমাজজীবনে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে আর অসন্তুষ্ট কৃষকদের হাতে অস্ত্র পৌঁছে দেবার পথও খোলা আছে, সেখানে গ্রামে গ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবের প্রস্তুতি সম্ভব। গান্ধী ও মাও উভয়েই নগরে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ লক্ষ করেছিলেন। এর প্রতিকার হিসাবে গান্ধী চেয়েছিলেন গ্রামে গ্রামে স্বায়ত্ত শাসন ও আর্থিক উন্নতির পথ উন্মুক্ত করতে। আর মাও বিপ্লবীদের শিখিয়েছিলেন গ্রামের সশস্ত্র ফৌজের সাহায্যে নগর অবরোধ করে অবশেষে ক্ষমতার কেন্দ্রগুলি করায়ত্ত করতে।

গান্ধীবাদের সমসাময়িক মূল্যায়নে এই দুই পথের তুলনা মূল্যবান। মাও প্রদর্শিত পথের দুটি ভিন্ন পরিণাম সম্ভব। হয় “গ্রামের সশস্ত্র ফৌজ “শহরের সৈন্যের হাতে পরাজিত হবে, যেমন চীনের গৃহযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে চিয়াং কাইশেকের সৈন্যদের হাতে বিপ্লবী কম্যুনিস্ট ফৌজ পরাস্ত হয়েছিল, নয়তো গ্রামের ফৌজ শহর, অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্র, দখল করবার পরে তাদেরই হাতে রাষ্ট্র আবারও অত্যাচারের যন্ত্রে পরিণত হবে, বিপ্লবের আদি নেতা যদি ব্যর্থতা স্বীকার করতে না-চান তো আবারও তাঁকে বিপ্লব ঘোষণা করতে হবে নতুন আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে। চীনের বর্তমান ইতিহাসের শিক্ষা এই।

গান্ধী জানতেন যে, হিংসাত্মক বিপ্লবের পথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের অবসান ঘটবে না। তাই গঠনমূলক কাজ এবং অন্যায়ের সঙ্গে অহিংসা অসহযোগের পথই তিনি নির্দেশ করে গেছেন। যে উদ্যম ও সংগঠন শক্তি নিয়ে বিপ্লবীরা ভাঙ্গবার কাজে নেমেছেন তার অধাংশ গড়বার কাজে নিযুক্ত হলে সমাজের মুক্তির পথ অপেক্ষাকৃত সুগম হলে! এ যুগের ইতিহাসে একটি দুষ্ট চক্র বার বার আবর্তিত হয়ে চলেছে। স্বৈরাচার ও বিপ্লব, বিপ্লব ও স্বৈরাচার, জন্মান্তরের চক্রের মতোই এই বেদনাদায়ক ঘটনা পরিক্রমা থেকে কি করে সমাজ মুক্তি পেতে পারে গান্ধীজী সেই সমস্যা নিয়েই চিন্তা করে গেছেন। গান্ধীবাদের সমসাময়িক তাৎপর্য এখানেই।

প্রগতির পথ (১৯৬৮)

“গান্ধী ধাদের সমকালীন মূল্যায়ন” শীর্ষে বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত খণ্ডিত ভাষণের পূর্ণ পাঠ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *