2 of 2

৫.০২ গান্ধীবাদ কি অচল?

৫.২ গান্ধীবাদ কি অচল?

সত্যের যেমন স্তরভেদ আছে গান্ধীজীর অহিংসাতত্ত্বেরও তেমনই ছিল। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী যুগে গান্ধীর শিক্ষা এ দেশের অধিকাংশ নেতা মেনে নিয়েছিলেন শুধু আংশিকভাবে ও কয়েকটি সহজ ব্যবহারিক কারণে।

এ শতাব্দীর গোড়ায় সন্ত্রাসবাদীদের আশা ছিল যে, তাঁরা বিদেশী শক্তির কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ভারতে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত হানবেন। কিন্তু জার্মানি বা জাপান কারও কাছ থেকেই আশানুরূপ সাহায্য পাওয়া গেল না। সে যুগে বিদেশী অস্ত্রসংগ্রহের চেষ্টা ও তাতে ক্রমাগত অসাফল্যের কথা মানবেন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে গভীর হতাশার সুরে লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর সন্ত্রাসবাদের ব্যর্থতা অনেকের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। একদিকে যেমন বিদেশ থেকে অস্ত্র সাহায্যের সম্ভাবনা ম্লান। হয়ে এল অন্যদিকে তেমনই ভারতীয় সৈন্যবাহিনীতে সন্ত্রাসবাদী চিন্তাকে উৎসাহিত করবার মতো ফাটল দেখা গেল না।

এ অবস্থায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পথে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করবার চিন্তার অবাস্তবতা অস্বীকার করা কঠিন ছিল। সশস্ত্র অভূত্থান সফল হবার সম্ভাবনা সে দেশেই বেশী যেখানে সৈন্যবাহিনীর একটি ক্ষমতাবান অংশের আনুগত্য থেকে দেশের সরকার। বঞ্চিত, অথবা দেশের শাসনযন্ত্র কোনো বড় যুদ্ধের ধাক্কায় ভেঙ্গে পড়ছে এবং বিপ্লবীরা। যথেষ্ট অস্ত্রসংগ্রহের পথ তৈরী করে নিতে পেরেছেন। প্রথম মহাযুদ্ধ থেকে ভারত যখন মোটামুটি অক্ষত অবস্থাতেই বেরিয়ে এল তখন দূর ভবিষ্যতে সম্ভাব্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের। দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ দেশের সন্ত্রাসবাদীদের বড় কোনো ভরসা অবশিষ্ট রইল না। এই অবস্থাতেই গান্ধী এলেন তাঁর অহিংস প্রতিরোধের প্রস্তাব নিয়ে। বাস্তব রাজনীতির বিচারে গান্ধীর সেই প্রস্তাবকে সেদিন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।

সেদিনের পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের খানিকটা মিল আছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আজও সরকারের প্রতি অনুগত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে আমাদের শাসনযন্ত্র এখনও মোটামুটি অটুট। অন্তত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় ভারতের। শাসনযন্ত্রের কাঠামো শক্ত। এ দেশে অতিবাম যে-সব রাজনীতিক দল সশস্ত্র অভূত্থানের অথবা গৃহযুদ্ধের পথে ক্ষমতা দখলের চিন্তা করেন, সীমান্তে একটি বৃহৎ যুদ্ধের সম্ভাবনাকে তাঁদের এখনও মনের আড়ালে লালন করতে হয়। নয়তো তাঁদের চিন্তা অবাস্তব। অরাজকতার পথে এ দেশে বিপ্লবী ও স্থায়ী সরকার গঠন করবার চিন্তায় বাস্তবুদ্ধির পরিচয় নেই, আছে শুধু দুর্মর বিপ্লববিলাস। গান্ধীনেতৃত্বের প্রথম যুগে যেমন নেহরু, আজাদ প্রমুখ নেতারা অহিংসাকে ধর্ম হিসাবে গ্রহণ না-করেও গান্ধীর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন আজও তেমনই হিংসাত্মক বিপ্লবের পথ বর্জন করবার জন্য কোনো ধর্মনীতি প্রয়োজন হয় না, বাস্তববুদ্ধির আলোতেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব।

.

গান্ধীর রাজনীতিক চিন্তার আরও একটি স্তর ছিল। ভারতের বিশেষ পরিস্থিতিতে হিংসাত্মক আন্দোলন ব্যর্থ হবে এই পরিসীমিত সিদ্ধান্তের ঊর্ধ্বে তিনি তাঁর বক্তব্য স্থাপন করেছিলেন। প্রসঙ্গত লক্ষ করা আবশ্যক যে, রাজনীতিক চিন্তাকে ছাড়িয়ে একটি তৃতীয় স্তর আছে যেখানে ব্যক্তির আত্মিক মুক্তির শর্ত গান্ধী আলোচনা করেছেন। কিন্তু এই শেষ স্তরের সমস্যা এখানে আমাদের বিবেচ্য নয়।

গান্ধী বিশ্বাস করতেন যে, অসত্যের ব্যবহারে কোনো মহৎ কল্যাণ সাধিত হতে পারে। অথচ হিংসাত্মক আন্দোলনের উপায় হিসাবে অসত্যের ব্যবহার অনিবার্য। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কার্যক্রম, যথা প্রতিপক্ষের সমালোচনা ও গণবিক্ষোভ, পরিচালিত হয় দিবালোকে ও সর্বজনসমক্ষে। হিংসাত্মক আন্দোলনের একটি বড় অংশ গড়ে ওঠে লোকচক্ষুর আড়ালে, অন্ধকার গোপন সুড়ঙ্গে। এই গোপন আন্দোলনে অসত্যকে গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই। অথচ মিথ্যাচারণই যেখানে আন্দোলনের ধর্মস্বরূপ সেখানে পারস্পরিক বিশ্বাসে একদিন ফাটল দেখা দেবেই, কারণ সত্য ছাড়া পারস্পরিক বিশ্বাসের কোনো ভিত্তি নেই। গান্ধী তাই তাঁর আন্দোলনে সত্যের প্রতি আগ্রহকে প্রধান স্থান দিয়েছিলেন। সত্যের প্রয়োজন শুধু পরকালের মুখ চেয়ে পুণ্যার্জনের জন্য নয়। সত্য। ছাড়া সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস সম্ভব নয়। হিংসা থেকে যে-মিথ্যার উদ্ভব এবং সেই জীবনবিপন্নকারী মিথ্যা থেকে আতঙ্কগ্রস্ত যে-অবিশ্বাস, তার ভয়াবহ বিষাক্ত বাষ্প কোনো সংগঠনে বা সমাজে ছড়িয়ে পড়লে যে-অবস্থার সৃষ্টি হয় তারই নাম সম্ভবত নরক। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ নানা বিষয়ে মতানৈক্য সত্ত্বেও এই একটি প্রশ্নে মতৈক্য খুঁজে পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শোচনীয় পরিণতি রবীন্দ্রনাথ ‘চার অধ্যায় উপন্যাসে তীক্ষ্ণ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন “মিথ্যাচারণ, নীচতা, পরস্পরকে অবিশ্বাস, ক্ষমতালাভের চক্রান্ত, গুপ্তচরবৃত্তি একদিন তাদের টেনে নিয়ে যাবে পাঁকের তলায়। এ আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।”

কথাটা অন্যভাবে বলা যাক। হিংসাত্মক আন্দোলন কোনো অবস্থায় ক্ষমতালাভে বা রাষ্ট্রযন্ত্র করায়ত্ত করার দ্বন্দ্বে সফল হতে পারে; কিন্তু সেই সাফল্যও ঝুটা সাফল্য। হিংসা। ও মিথ্যাকে আশ্রয় করে যে-সংগঠন গড়ে ওঠে তাতে অবিশ্বাস ও অত্যাচার এমনই অনিবার্য যে, বিপ্লবের মহৎ আদর্শকে পাঁকের তলায় টেনে নামিয়ে তবে বিপ্লবীরা ক্ষমতায় আসীন হন। গত পঞ্চাশ বৎসরের ইতিহাসে এই সিদ্ধান্তের সপক্ষে সাক্ষ্যের অভাব নেই। রুশদেশে ক্ষমতালাভের জন্য লেনিন এমন একটি দল গড়ে তুলেছিলেন যার গতিবিধি ছিল গুপ্তঘাতকের মতোই গোপন এবং যার অভ্যন্তরে গণতন্ত্র রক্ষার চেয়েও গোপনীয়তা রক্ষা লেনিনের নির্দেশ অনুসারে প্রধান স্থান লাভ করেছিল। এই নতুন দলের চরিত্র সম্বন্ধে লেনিন তাঁর একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে (“What Is To Be Done?”) স্পষ্ট ভাষায় লিখিয়াছেন

“Secrecy is such a necessary condition for such an organization that all other conditions must all be subordinated to it.” লেনিন ঠিকই বুঝেছিলেন। হিংসাত্মক আন্দোলনের অন্য সব শর্তের উপর প্রধান শর্ত গোপনীয়তা রক্ষা। এর পরিণাম আজ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ। লেনিনের দল রাষ্ট্রক্ষমতালাভের সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু স্তালিনী যুগে যদি বিপ্লবের সমস্ত মহৎ আদর্শকে ব্যঙ্গ করে পারস্পরিক অবিশ্বাস একটা বিভীষিকার মতো দল ও দেশকে গ্রাস করে থাকে তো গান্ধীবাদী বিচারে অন্তত সেটা অপ্রত্যাশিত নয়, বরং তার বিপরীত ঘটনাই হতো বিস্ময়ের। কারণ।

গান্ধীর অহিংসাতত্ত্বকে ‘অবাস্তব’ বলে যাঁরা বাস্তববুদ্ধির গৌরব দাবী করেন তাঁদের এই কথাগুলি ভেবে দেখা প্রয়োজন। সমালোচকরা বলেছেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন যদি-বা কিছু পরিমাণে সাফল্য অর্জন করে থাকে, হিটলারী। শাসনের বিরুদ্ধে তাও সম্ভব হতো না। অর্থাৎ শাসকগোষ্ঠীর ভিতর ন্যায় ও গণতন্ত্রবোধ। যেখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, হিংসার ব্যবহারে প্রতিপক্ষ যেখানে সম্পূর্ণ বিবেকবর্জিত, সেখানে অহিংস আন্দোলন ব্যর্থ হতে বাধ্য। গান্ধীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমালোচনার উত্তর আবারও সম্ভব দুটি ভিন্ন স্তরে।

অহিংস আন্দোলনের মূল কথা অন্যায়ের সঙ্গে অসহযোগ। শাসকের অন্যায় চেষ্টা যতই প্রচণ্ড হোক না কেন, সম্পূর্ণ অসহযোগের সম্মুখে শাসক অসহায়। কোনো অন্যায় ব্যবস্থাই কার্যকরী হতে পারে না যদি আপামর জনসাধারণ মৃত্যুপণ করে সমস্ত সহযোগিতা থেকে অহিংসভাবে বিরত থাকেন। আদর্শ অহিংসা সর্বজয়ী। যদি বলা যায় যে, আদর্শ অহিংসা সাধারণ মানুষের শক্তির অতীত, গান্ধীবাদী তা হলে তাঁর বক্তব্য রাখবেন একটি নিম্নতর স্তরে। গান্ধী বলেছেন অন্যায়ের বিরোধিতাই কর্তব্য; যদি অহিংস প্রতিরোধ সম্ভব না হয় তো অহিংসা থেকে বিচ্যুত হয়েও অন্যায়ের বিরোধিতা করা শ্রেয়। কিন্তু একথাটা বিস্মৃত না হওয়াই ভালো যে, হিংসাত্মক প্রতিরোধের কতকগুলি কুফল আছে এবং শুধু উদ্দেশ্যের মহত্ত্বে এই কুফল থেকে অব্যাহিত পাওয়া যায় না। এটাই বাস্তব কথা। এর বিপরীত চিন্তা খণ্ড দৃষ্টি বা সাময়িক উত্তেজনার প্রভাবে অবাস্তব। হিংসাত্মক উপায় অবলম্বন যদি অনিবার্য হয়ে ওঠে তবু এই সাবধানবাণী মনে জাগ্রত রাখাই ভালো যাতে যুদ্ধের ভিতর শান্তির শর্ত আমরা সততার সঙ্গে বারবার উচ্চারণ করে যেতে পারি। এটা বিশুদ্ধ অহিংসাতত্ত্ব নয়, বরং অসম্পূর্ণ জগতে সেই বিশুদ্ধ তত্ত্বের খণ্ডিত প্রতিফলন।

.

দলীয় রাজনীতির দৃষ্টিতে রাষ্ট্রক্ষমতার কর্তৃত্ব পরম অভীষ্ট। এই একটি অভীষ্টের কাছে মনপ্রাণ সমর্পণ করে রাজনীতিক দলগুলি অবশেষে বিশ্বাস করে বসেন যে, সমাজের সকল মঙ্গল সাধনের জন্য প্রথম প্রয়োজন দলের পক্ষ থেকে শাসনযন্ত্রের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন। এই কাজটি তাঁদের এমনই অত্যাবশ্যক মনে হয় যে, অন্য সকল নীতিকে বিপন্ন করে ক্ষমতার সংগ্রাম প্রধান হয়ে ওঠে। গান্ধী রাজনীতিতে ক্ষমতার সংগ্রামকে সংযত করতে চেয়েছেন গঠনমূলক কর্মের সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপন করে।

যুদ্ধের সময় জাতি যেমন একটি নিঃসংশয় লক্ষ্য খুঁজে পায়, অর্থাৎ শত্রুর সংহারই একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দেখা দেয়, সমাজকে ভাঙার নেশায় যাঁরা মাতেন তাঁদেরও দৃষ্টিতে তেমনই একটি আপাতস্বচ্ছতা প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। শেষ বিচারে এটি অবশ্য অলীক স্বচ্ছতা ভাঙবার উপায় উদ্ভাবনে যে-বিপ্লবীরা শাণিত বুদ্ধির পরিচয় দেন, বিপ্লবের পরবর্তী সমাজ সম্বন্ধে তাঁদেরই চিন্তা আবার অবাস্তব কল্পনায় মোহাচ্ছন্ন। হিংসাত্মক বিপ্লবের শেষ ফলাফলের সঙ্গে তাই আদি প্রত্যাশার মিল থাকে না। তবু একথা স্বীকার্য যে, বিপ্লবীর কাছে যতদিন ভাঙবার কাজটাই প্রধান ততদিন তার কর্মে ও বক্তব্যে এমন একটা দ্বিধাহীন ঐকান্তিক লক্ষ্য করা যায়, গণতান্ত্রিকের পক্ষে যেটা অনায়াসলভ্য নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এই দুর্বলতার প্রতিষেধক হিসাবে গঠনমূলক কর্মের একটি বিশেষ মূল্য আছে। এরই ভিতর দিয়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি সমাজের সঙ্গে যুক্ত হবার পথ খুঁজে পান। তাঁর নিজস্ব বক্তর্যটিও চেতনায় একটি বিশেষ রূপ ধারণ করে এবং বাস্তব ও। আদর্শনিষ্ঠার ভিতর কর্মের সেতু স্থাপিত হয়। গান্ধীজী সমাজসংগঠনে চরকাকে যে বিশিষ্ট স্থান দিতে চেয়েছিলেন তার সমর্থন নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এ ধারণা সম্ভবত অমূলক নয় যে, আমরা গঠনমূলক কাজকে যে পরিমাণে উপেক্ষা করেছি অবাস্তব বৈপ্লবিক। কল্পনাও সে পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশে আমরা সমবায়ে অপটু, সাম্যবাদী আন্দোলনে উৎসাহী।

গান্ধীর গঠনমূলক পরিকল্পনায় গ্রামের প্রতি একটা বিশেষ ঝোঁক ছিল। এতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। গান্ধী প্রত্যক্ষ করেছিলেন যে, দ্রুত শিল্পায়নের বিশেষত প্রথম যুগে আর্থিক সম্পদ ও রাজনীতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় নগরে নগরে! তিনি দেখেছিলেন যে, গ্রামে গ্রামে মানুষ তৃষ্ণার জল ও সামান্য শিক্ষা থেকে বঞ্চিত, ক্ষুধায় অবসন্ন পাখীর মতো অসহায়। যে-সমাজে একদিকে ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণ, আর অন্য দিকে কোটি কোটি মানুষ আত্মবিশ্বাস ও সংগঠনশক্তি থেকে এমন সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত, সেখানে স্বরাজ অথবা লোকরাজ সম্ভব নয়। শিল্পবিপ্লবের পর প্রবল কয়েকটি দেশ যেমন দুর্বল দেশের উপর তাদের শাসন ও শোষণ কায়েম করেছিল এবং এর একমাত্র স্বীকৃত প্রতিকার যেমন উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতার আন্দোলন ও আর্থিক উন্নতির উদ্যোগ, গান্ধীও তেমনই বিশ্বাস করতেন যে, দেশের ভিতর কলকারখানার কেন্দ্রগুলির শাসন ও শোষণ থেকে গ্রামকে রক্ষা করার একমাত্র পথ গ্রামোদ্যোগ ও গ্রামরাজ। আধুনিক নাগরিক সভ্যতায় যে-জাতের মানুষ সৃষ্টি হয় তিনি তাঁদের বোধ হয় একটু ভয়ের চোখেই দেখতেন। তাঁদের। যুক্তিবাদী মন অর্থ ও ক্ষমতাকেই জীবনে পরমলভ্য বলে সহজে গ্রহণ করে, আর যান্ত্রিক দক্ষতা ও ক্ষমতালিপ্সার যোগাযোগে সমাজের উপর তাঁদের একাধিপত্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। নগরভিত্তিক কোনো অর্থবান শ্রেণী অথবা প্রবল রাজনীতিক দলের পক্ষে সংগঠন শক্তিতে দুর্বল গ্রামের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন সহজ। এই বিপদের প্রতিকার সম্ভব গঠনমুলক কর্মের পথে। গ্রামে গ্রামে মানুষকে স্বায়ত্তশাসন ও আর্থিক স্বাবলম্বনে অভ্যস্ত করলেই গণতন্ত্রের দেশজোড়া ভিত্তি স্থাপিত হবে। গান্ধীর উক্তিতে কখনও কখনও কলকারখানার প্রতি বিরূপতা অতিরিক্ত জোরের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু তাঁর চিন্তা সমগ্রভাবে গ্রহণ। করা সম্ভব না হলেও একথা আজ আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে স্পষ্ট যে, গ্রামের অর্থনীতি সুস্থ না হলে দেশের অর্থনীতিও সুস্থ হবে না এবং গ্রামে স্বায়ত্তশাসনের প্রতিষ্ঠানগুলি নির্জীব থাকলে অতিস্ফীত আমলাতন্ত্রের নিষ্পেষণে অথবা ওপর থেকে চাপানো গণকমিটির অত্যাচারে দেশময় গণতন্ত্র বিপন্ন হবে।

.

নিয়ম ও শৃঙ্খলা ছাড়া গঠনমূলক কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় না। গান্ধী নিয়মের ভক্ত ছিলেন। আবার তিনিই ছিলেন আইন অমান্য আন্দোলনের মহান নেতা। নিয়ম পালন ও নিয়ম ভঙ্গের ভিতর সামঞ্জস্যবিধান গান্ধীর চিন্তার একটি অতি উল্লেখযোগ্য দিক।

নিয়ম পালনকে গান্ধী কতখানি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে ও মতবাদে তা সুস্পষ্ট। প্রশ্নটি একটি নৈতিক সমস্যার আকারে এখানে আলোচনা করা যেতে পারে। প্রতিশ্রুতি রক্ষা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু অতীতের কোনো প্রতিশ্রুতি যদি আজ আমার স্বভাব ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথে বাধা বলে আমি অনুভব করি তবে সেখানে আমার কর্তব্য কি? এই প্রশ্নের দু-দিক থেকে উত্তর সম্ভব। কেউ বলবেন, ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে নানা অপ্রত্যাশিত পথে; অতীতের কোনো অন্ধ প্রতিশ্রুতিকে জীবনে অগ্রগতির পথে অটল বাধা বলে মেনে নেওয়া যায় না। আবার কেউ বলবেন যে, প্রতিশ্রুতির মর্যাদা যদি রক্ষিত না হয় তো মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিশ্বাস ভেঙ্গে পড়ে, সমাজে সহযোগিতার ভিত্তি দুর্বল হয়। চিন্তা না করে প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হওয়া ভুল, কিন্তু একবার প্রতিশ্রুতি দানের পর আপন বাক্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকাই কর্তব্য। প্রথম মতের সমর্থনেও দু-একজন মহাপুরুষের নাম করা সম্ভব। কিন্তু গান্ধী ছিলেন ঐ দ্বিতীয় মতের মানুষ। বাংযম ও প্রতিশ্রুতি রক্ষা, সময়ানুবর্তিতা, সাংগঠনিক নিয়ম পালন–এই সবই ছিল তাঁর দৃষ্টিতে আদর্শ সত্যনিষ্ঠ জীবনের অঙ্গ। নিজের আশ্রমে তিনি নিয়মানুবর্তিতার উপর জোর দিয়েছেন; নিয় সে স্কুলে পুত্রকেও অব্যাহতি দেননি।

.

ব্যাক্তগত জীবনে প্রতিশ্রুতি রক্ষা বা আশ্রমের নিয়ম পালনের মতোই বৃহত্তর সমাজে আইনের প্রতি আনুগত্যও একটি মৌল নৈতিক প্রশ্ন। নিয়মের জোরে যে-সমাজ শাসিত হয় না গায়ের জোরেই তাতে পারস্পরিক দাবিদাওয়ার নিষ্পত্তি হয়। নিয়মের রাজত্ব চূর্ণ হলে প্রতিষ্ঠিত হয় গুপ্তার রাজত্ব। আইন অনেক সময় অন্যায় হয়; কিন্তু গুণ্ডার রাজত্বে নাগরিকের স্বাধীনতা রক্ষা পায় না। অতএব প্রশ্ন, যে-আইনকে আমি অন্যায় মনে করি। তার প্রতি আমার কর্তব্য কি? এই প্রশ্নটিরও দু-রকম উত্তর সহজেই মনে আসে। বলা যেতে পারে যে, যে-আইনকে আমি অন্যায় মনে করি সে আইন ভঙ্গ করাই আমার নিঃশর্ত কর্তব্য। কিন্তু এই মতের বিপদ আছে। সাধারণ মানুষ বহু পরিমাণে স্বার্থবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়। যেহেতু আত্মপ্রবঞ্চনায় আমরা অনেকেই অল্পবেশী অভ্যস্ত, অতএব যে-আইন আমাদের স্বার্থের বিরোধী তাকেই অন্যায় ভেবে নিতে আমাদের খুব বিলম্ব হবার কথা নয়। স্বার্থ ছাড়াও আছে নানা অন্ধ বিশ্বাস। প্রতিটি ব্যক্তিই যদি তাঁর স্বার্থ অথবা অন্ধ বিশ্বাসের সঙ্গে আইনের বিরোধ দেখা দিলেই আইন অমান্য শুরু করেন, তা হলে অনিয়মের রাজত্ব এবং তার ফলে আরও বহুগুণে বৃহত্তর অন্যায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবার সম্ভাবনা। অতএব দ্বিতীয় মত হিসাবে বলা যেতে পারে যে, আইন মেনে চলাই কর্তব্য, যদিও আইনের পরিবর্তনও আমরা আইনসঙ্গত উপায়ে দাবী করতে পারি। কিন্তু সর্বাংশে বা সর্বাবস্থায় এই মতও গ্রহণ করা কঠিন। যে নিয়মকে আমি সর্বান্তঃকরণে অন্যায় বলে জানি সে নিয়ম ভঙ্গ করবার কোনো নৈতিক অধিকারই কি আমার নেই? যে-সমাজে আইন পরিবর্তনের আইনসঙ্গত পথ খোলা নেই সেখানে কি কর্তব্য?

অর্থাৎ, ব্যক্তিকে আইনভঙ্গের নিঃশর্ত অধিকার দেওয়া নীতির দিক থেকে নিরাপদ নয়, আবার আইন মেনে চলবার নিঃশর্ত কর্তব্যও স্বীকার করা যায় না। এই নৈতিক সমস্যার সমাধান সহজ নয়। কিন্তু গান্ধীর সমাধান স্পষ্ট। তিনি বলেছেন যে, যিনি আইনভঙ্গ করতে চান আইনভঙ্গের দণ্ডও তাঁকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে হবে। এই একটি শর্তেই শুধু আইনভঙ্গের নৈতিক অধিকার তিনি দাবী করতে পারেন। রাষ্ট্রের রচিত আইন যিনি ভঙ্গ করতে চান তাঁকে নিজের বিবেক ও সমাজের কাছে এই প্রমাণ রেখে যেতে হবে যে, তিনি কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থ থেকে নয়, বরং দশের কল্যাণের জন্যই আইনভঙ্গে প্রবৃত্ত হয়েছেন। প্রেমের পরিচয় যেমন দুঃখবরণে, আইনভঙ্গকারীর কল্যাণবুদ্ধির প্রমাণও তেমনই স্বেচ্ছায় দণ্ডগ্রহণে। এই সূক্ষ্ম অথচ অল সিদ্ধান্তটি বর্তমান যুগের রাজনীতিক চিন্তায় গান্ধীবাদী বিচারের একটি মহৎ অবদান।

মার্ক্সীয় বিচারে অবশ্য এই গান্ধীবাদী সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য মনে না হওয়া সম্ভব। মার্ক্সবাদী বলবেন যে, রাষ্ট্রের বিধান শ্রেণীনিরপেক্ষ নয়। ধনিক ও শ্রমিক শ্রেণীর ভিতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব মৌলিক ও অনিবার্য। ধনতান্ত্রিক দেশে আইন প্রণীত হয় এবং রাষ্ট্রযন্ত্র চালিত। হয় ধনিক শ্রেণীর স্বার্থে। সর্বপ্রকারে এই আইনের বিরোধিতা করা শ্রমিকশ্রেণীর ঐতিহাসিক অধিকার। শ্রমিকশ্রেণীর এই বৈপ্লবিক অধিকারের উপর কোনো শর্ত আরোপ করা প্রকারান্তরে ধনিকশ্রেণীকে সমর্থনেরই তুল্য।

এই শব্দগুলির একটা মাদকতা আছে; কিন্তু মার্ক্সীয় মত সর্বাংশে সত্য নয়। সমাজে স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে, এ কথা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু যা-কিছুতে এক শ্রেণীর লাভ তাতেই অন্য শ্রেণীর ক্ষতি নয়। এমন কাজও আছে যাতে সারা সমাজই লাভবান হয়, আবার এমনও কিছু আছে যাতে সারা সমাজের, অর্থাৎ সমাজের অংশ হিসাবে ধনিক ও শ্রমিক উভয়েরই ক্ষক। বিজ্ঞান ও শিল্পের উন্নতিতে শুধু শ্রেণীবিশেষ লাভবান হয়নি। আজ থেকে একশত বৎসর আগে এক নতুন যুগের প্রভাতে জাপানের সম্রাট মেইজি শপথ গ্রহণ করেছিলেন যে, সমস্ত পৃথিবী থেকে জ্ঞানবিজ্ঞান আহরণ করে তাঁর দেশকে উন্নত করা হবে। তারপর জাপানী সরকারের অদম্য চেষ্টায় বিশ শতকের শুরুতেই দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর হয়, কৃষি ও শিল্পে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল দ্রুত প্রয়োগ হতে থাকে। উনিশ শ’ ত্রিশের যুগের জাপানী জঙ্গী নেতাদের ক্ষমা না করেও সম্রাট মেইজির সিংহাসনারোহণের শতবর্ষ পরে আজ বলা যায় যে, শিক্ষা বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রসারে জাপান তাঁর শপথ রক্ষা করেছে। জাপানী সরকার বিজ্ঞান ও শিল্পের প্রসারের জন্য যা করেছেন। তাতে ‘উন্নতি”হয়েছে শুধু শ্রেণীবিশেষের নয়, বরং সারা জাতির।

যে কথাটা সম্ভবত আরও স্পষ্ট তা হলো এই যে, এমন বিপদও আছে যাতে বিপন্ন হয় সমাজের অংশ বিশেষ নয় বরং সারা সমাজ। এই আণবিক যুগে দাঁড়িয়ে এ কথাটা বিস্মৃত। হবার মতো বড় ভুল আর নেই। ছোট ছোট যুদ্ধে ধনিকশ্রেণীর অংশবিশেষ কখনও লাভবান হয়েছে; কিন্তু তৃতীয় মহাযুদ্ধে যদি পৃথিবী ধ্বংস হয় তাতে লাভ কার? ক্ষতি নয় কার? কাজেই পৃথিবীকে সেই ধ্বংস থেকে রক্ষা করা শ্রেণী এবং জাতি নির্বিশেষে সকলের কর্তব্য। মজুরকে শুধুই মজুর হিসাবে দেখা তাঁকে ছোটো করা। তিনি পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, বন্ধু, এক কথায় মানুষ। এমন কিছু আদর্শ আছে যা শ্রেণীবিশেষের সম্পত্তি নয়। শ্রেণীর পরিচয়ে নয় বরং মানুষ বলেই তাকে আমরা মূল্য দিই, মানুষের উত্তরাধিকার বলেই তাকে বাঁচাতে চাই। এ কথাটা তথ্য হিসাবেও সত্য নয় যে, হিটলারী শাসনে লাভ অথবা ক্ষতি হয়েছিল শুধু ধনিকের অথবা শ্রমিকের। নাৎসীবাদের বীভৎসতাকে আমরা ঘৃণা করি মনুষ্যত্বের বিচারে!

গান্ধী অন্যায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি। শ্রেণী বিশেষের অন্যায়কে তিনি মেনে নিতেও বলেননি। বরং অন্যায়ের প্রতিরোধ না-করাটাই তিনি অন্যায় মনে করেছেন। তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের এটা মূল কথা। কিন্তু দ্বন্দ্ব যদি অনিবার্য হয় তবু সেই। দ্বন্দ্বের ভিতরও আমাদের উপায় সম্বন্ধে সাবধান হওয়া প্রয়োজন কি না সেটাই প্রশ্ন। সমাজকে সামগ্রিক বিনাশ থেকে বাঁচতে হলে, মনুষ্যত্বের আদর্শকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে হলে, বিপক্ষের প্রতি হিংসাই আমাদের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারে না। গান্ধী দ্বন্দ্ব অস্বীকার করেননি তিনি দ্বন্দ্বকে নীতি দিয়ে বাঁধতে চেয়েছেন। এ চেষ্টাকে যদি অবাস্তব বলা হয় তো আবারও স্মরণ করা ভালো যে, নীতিহীন দ্বন্দ্বে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে এ আশাও কাল্পনিক।

.

গান্ধী যুগধর্ম মেনে চলেননি। একথা বিশ্বাস করা কঠিন যে তাঁর মতো বুদ্ধিমান লোক বোঝেননি যে, এ যুগে শিল্পের দ্রুত প্রসার অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু নাগরিক সভ্যতার প্রসারের ফলে মানুষ যে সামাজিক ও আত্মিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে তার সম্বন্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করাই তিনি তাঁর কর্তব্য মনে করেছেন। যে-সুরে তিনি তাঁর কথা বেঁধেছেন তাতে যুক্তিবাদী মননশীলতা উৎসাহিত হয় না। যে-পৃথিবীতে একদিকে মানুষে মানুষে আত্মীয়তার বন্ধন শিথিল হবে আর অন্যদিকে বিজ্ঞান মানুষের হাতে এনে দেবে অপরিমিত শক্তি, সেই পৃথিবী সম্বন্ধে তিনি শংকিত ছিলেন। যে-যুগকে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি বহু সংকটের ভিতর দিয়ে সে-যুগে যেদিন অতীত হবে সভ্যতা যদি তখনও বাঁচে তবে গান্ধীর “অরণ্যে রোদন” আজকের বহু নাগরিক কোলাহলকে অতিক্রম করে সেদিনও মানুষের মর্মে একটি শাশ্বত বাণীর মতো ধ্বনিত হতে থাকবে। আর ইতিমধ্যে গান্ধীর দুয়েকটি নীতি সম্বন্ধে আমরা কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধা রক্ষা করলে সমাজে কল্যাণবৃদ্ধিরই সম্ভাবনা। প্রগতির পথ (১৯৬৮)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *