1 of 2

৩.২৩ দুর্নীতি

৩.২৩ দুর্নীতি

(ক)

দুর্নীতির অর্থ নিয়ে একটা বিবাদ আছে। সেটা প্রথমেই পরিষ্কার করে নেওয়া যাক। বাড়ির মতের বিরুদ্ধে মেয়ে বিয়ে করে বসল ভিন্ন জাতের এক ছেলেকে। এটাকে অভিভাবকেরা অনেক সময় দুর্নীতির ভিতর ধরেন। আসলে এটা দেশীয় আচারের প্রশ্ন। নীতিবিচারকে নিছক দেশাচার থেকে পৃথক করে দেখা আবশ্যক, যদিও সেটা সহজ নয় সব সময়ে।

ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে রামমোহন রায় এটা লক্ষ করেছিলেন। শুদ্ধ নীতি আর আচার এক বস্তু নয়। বিভিন্ন ধর্মের ভিতর যেখানে মিল সেখানে পাই শুদ্ধ নীতি। এইরকম তাঁর মনে হয়েছিল। আর বিভিন্ন ধর্মের ভিতর অমিল দেখা যায় আচার নিয়ে। বিবাহের ব্যাপারটা আচারের প্রশ্ন, দেশে দেশে লক্ষ করা যাবে প্রচলিত রীতির ভিন্নতা। সত্যবাদিতা নীতির প্রশ্ন। মিথ্যে বলে স্বার্থসিদ্ধি করা দুর্নীতি, কোনো ধর্মেই এর সমর্থন নেই।

আচার জিনিসটা বাইরের, তার পরিবর্তন ঘটে সমস্ত সজীব সমাজে। কিন্তু নীতির মূল কথা আরও গভীর। আরও চিরন্তন। কথাটা এবার বলা যাক এইভাবে। আমরা প্রত্যেকেই নানাভাবে সমাজের কাছে ঋণী। আমরা যে অন্ন গ্রহণ করি, বস্ত্র পরিধান করি, নিত্য প্রয়োজনের আরও নানা সমগ্রী ব্যবহার করি, তার কতটুকু নিজে উৎপন্ন করি? যে ভাষা, যে সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে ব্যক্তি তার জীবন গড়ে তোলে, সে সবই বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর কাছ থেকে লব্ধ। এই ঋণ শোধ করবার চেষ্টা অথবা আগ্রহ যার ভিতর নেই সে পরশ্রমজীবী। পরজীবিতাই দুর্নীতি। সমাজের ঋণ কখনও সম্পূর্ণ শোধ হয় না। কিন্তু ঋণশোধের যথাসাধ্য চেষ্টার ভিতরই নীতির পরিচয়। এর অভাবকে বলি দুর্নীতি।

এদেশে দুর্নীতি আছে অনেকদিন থেকেই। তবে গত কয়েক বছরে এর প্রচণ্ডতা বেড়ে গেছে। চারিদিকেই এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। দেশের হিতাকাঙ্ক্ষী সকলের কাছেই এটা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। ১৯৮৩ সালে আমাকে একবার সুইডেন যেতে হয়েছিল, উদ্দেশ্য বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ গুন্নার মিরডালকে দেশিকোত্তম উপাধি অর্পণ করা। অতিবৃদ্ধ তিনি, কষ্টে চলাফেরা করেন, তাঁর পক্ষে তখন এদেশে আসা সম্ভব নয়। তবে ভারতে তিনি পূর্বে এসেছেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী উভয়েরই ছিল নেহরুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। মিরডাল ভারতবন্ধু, তাঁর লেখার সঙ্গে এদেশে অনেকেই পরিচিত। কথাবাতায় পরিষ্কার বোঝা গেল, ভারত সম্বন্ধে তাঁর আগ্রহ তখনও গভীর। অসুস্থ অবস্থাতে তিনি ঐ দূরের দেশে বসেও এদেশ সম্বন্ধে খোঁজখবর রেখেই চলেছেন। তাঁর নানা কথার ভিতর একটি কথা আমার বিশেষভাবে মনে আছে। ভারতে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ছে, তাকে রোধ করবার যথেষ্ট চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। এটা বড় বিপদের কথা, আমরা কেন সাবধান হচ্ছি না?

অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে তিনি আমাকে জানালেন তাঁর এই দুশ্চিন্তা। আজ সদ্যপ্রয়াত ঐ ভারতবন্ধুর সাবধানী বাণী কানে বাজে।

অভ্যস্ত দুর্নীতিকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে একরকমের আচার, তাকে বলে ভ্রষ্টাচার। ভ্ৰষ্টাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তাকে সরানো যায়নি। দুর্নীতি রোগটি অবশ্য ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। ওটা আজ নানাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি সাম্যবাদী দেশগুলিতেও। তবে আমাদের চিন্তা স্বভাবতই এদেশকে নিয়ে। রোগটি দূরারোগ্য, এর কারণ জানা থাকলেও প্রতিকার সহজ নয়। তবু চিকিৎসার আগে রোগের কারণ অনুসন্ধান করতে হয়। অনুসন্ধান শুরু হয় রোগের লক্ষণ থেকে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে।

দুর্নীতির নানা রূপ আছে। তার কিছু বা চমকপ্রদ, আবার কিছু প্রতিনিয়ত ঘটছে বলেই তাতে চমক নেই। আইনের সঙ্গে দুর্নীতির সম্পর্কটা খুব সরল নয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুয়ের ভিতর বিরোধ অত্যন্ত স্পষ্ট। কোথাও আবার আইনের চতুঃসীমার ভিতরই অথবা তার প্রত্যন্তে দুর্নীতির বাস। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

একটি রুগ্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পরিচালকের সঙ্গে কিছুদিন আগে কথা হচ্ছিল। তিনি কাজে যোগ দিয়েছেন বেশিদিন হয়নি। ঐ প্রতিষ্ঠানের হিসেবপত্র ঠিকভাবে পরীক্ষা করে, দেখা হয়নি অনেকদিন। নতুন পরিচালক প্রতিষ্ঠানটিকে ভিতর থেকে বুঝে নেবার জন্য নিজেই হিসেবের খাতা খানিকটা নেড়েচেড়ে দেখতে চাইলেন। তাই করতে গিয়ে কিছু আশ্চর্য ব্যাপার তাঁর কাছে উদঘাটিত হ’ল। ক্রয়বিক্রয়ের অনেকটাই ভুতুড়ে কাণ্ড। লক্ষাধিক টাকা অগ্রিম দেওয়া হয়েছে এমন এক যন্ত্র কিনবার নামে যেটা কখনও এসে পৌঁছয়নি। রুগ্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপন্ন মাল ক্রমাগত বিক্রয় করা হচ্ছে এক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে, সেখানকার ক্রেতা দাম চুকিয়ে দিচ্ছেন অবিলম্বে একের পর এক চেকে, আর সেই সব চেক ব্যাঙ্ক থেকে অবিলম্বে ফিরে আসছে, কারণ ক্রেতার নামে ব্যাঙ্কে টাকা নেই। ফেরত আসা চেক ড্রয়ারে জমছে। বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার অতি নিকট-আত্মীয় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিক।

এর পর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। সেখানে লক্ষ লক্ষ টাকার জিনিস কেনা হয়েছে ন্যায্য মূল্যের চেয়ে অনেক উঁচু দামে। ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবার পরও কিছু করা যাচ্ছে না কারণ বাড়তি টাকাটা ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে অনেক লোকের ভিতর, তাছাড়া কিছু রাজনীতিক জটিলতাও আছে।

দুর্নীতির আরও একটি নমুনা দিচ্ছি, এবার একটি হাসপাতাল থেকে। সেখানকার এক ডাক্তারের মুখে এইরকম শুনেছি। রোগী ভর্তি হচ্ছেন অস্ত্রোপচারের জন্য। কাউকে বেশিদিন ফেলে রাখা হচ্ছে, কেই বা যত্ন পাচ্ছেন অবিলম্বে। এটা নির্ভির করছে না রোগীর প্রয়োজনের ওপর, কে আগে ভর্তি হয়েছেন, কে পরে, তার ওপরও নয়। নির্ভর করছে ঘুষের ওপর। সেই ঘুষ দেওয়া হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণীর কিছু কর্মীকে। তারপর সেটা আরও উপরের স্তরের লোকের সঙ্গে ভাগ হচ্ছে কি না জানি না। তবে এটা ঠিক, অধস্তন কর্মীদের সংঘবদ্ধ শক্তিকে ঊর্ধ্বতন পরিচালকেরাও ভয়ের চোখে দেখেন। একবার এই ঘুষের ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেল যখন কোনো একজন রোগী টাকা দিয়েও কোনো কারণে প্রতিশ্রুত সেবা পেলেন না। কাকে তিনি টাকা দিয়েছেন সেই কথাটাও যখন তিনি জানিয়ে দিলেন তখন ঠিক হল যে একটা তদন্ত হবে। তারপরই এমন কিছু ঘটে গেল যার ফলে সেই রোগী তাঁর অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়াই সমীচীন বিবেচনা করলেন। কী ঘটেছিল সেটা অনুমানের ওপরই ছেড়ে দিতে হয়।

এইরকম নানা চাঞ্চল্যকর ঘটনার সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। আরও বহু দুর্নীতি কিন্তু আছে যাতে নাটকীয়তা নেই, আমাদের অভ্যস্ত কর্মজীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে যারা। এরা নিঃশব্দে চলে, কিন্তু সমাজের পক্ষে এদের ক্ষতিকর কম নয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এরা পঙ্গু এবং অবসন্ন করে দেয়। কর্মের প্রতি মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহকে এই দুর্লক্ষ্য দুর্নীতি প্রতিনিয়ত বিদ্রুপের বাণে বিদ্ধ করে, ব্যক্তির পৌরুষ খর্ব হয়, দেশ পিছিয়ে যায়।

কিছুকাল আগের কথা। আমার এক বন্ধুর ছেলে ব্যাঙ্কে কাজ নিয়েছে। তার কর্মজীবনের সেটা শুরু। স্বাভাবিক উৎসাহের সঙ্গে সে কাজ করে যাচ্ছে। কর্মচারী সমিতির এক নেতা একদিন তাকে ডেকে কৈফিয়ৎ চাইলেন, এত বেশি কাজ সে করছে কেন? আমার বন্ধুর ছেলে সরলভাবে বলল, সে তো নির্দিষ্ট সময়ের বাইরে কিছু করছে না, ঐ সময়ের ভিতর সহজেই যতটা কাজ করা যায় ততটাই করছে। তাকে জানিয়ে। দেওয়া হ’লএটা সমিতির নিয়মবিরুদ্ধ। কাজ জমতে দিতে হবে।

কাজ জমিয়ে রাখার রীতিটা ইচ্ছাকৃত। এটা চালু হয়েছে নানা কারণে। সারা সমাজের দিক থেকে দেখতে গেলে, সব কাজ এতে পিছিয়ে যায়। অনির্দিষ্ট অনিশ্চিত প্রতীক্ষার দণ্ড দিতে হয় দেশকে পারি কিন্তু করব না, এই কৌশলে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের চিন্তা বইছে অন্য এক খাতে। কাজ জমে উঠলে বাড়তি আয়ের পথ খুলে যায়। অনেকভাবে। যাঁদের কাজ আটকে আছে তাঁরা যদি পারেন তো বাড়তি পয়সা দিয়ে কাজটা করিয়ে নিন। কাজের যে সময়টা একবার বিক্রী হয়ে গেছে মাইনের বদলে সেটাই বে-আইনীভাবে আবার বিক্রী করা যাচ্ছে ঘুষের বদলে।

একই ব্যাপার হলে দুটো ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। আমার বন্ধুর ছেলে হয়তো ভাবছিল, যেদেশে বহু ছেলের চাকরি নেই সেখানে সে কাজ পেয়েছে, সমাজের কাছে সে ঋণী; যথাসম্ভব কাজ করে সেই ঋণ সে শোধ করবে। অন্য দৃষ্টিতে দেখলে কিন্তু চিন্তার। চরিত্রটা পালটে যায়। সমাজকে আমি যথাসাধ্য দিচ্ছি কিনা, এটা আর তখন প্রধান প্রশ্ন নয়। সমাজের কাছ থেকে যে কোনো উপায়ে কী করে আরও আদায় করে নেওয়া যায়, এটাই প্রধান কথা। সমাজের সেবার চেয়ে স্বার্থচিন্তা তখন বড় হয়ে দেখা দেয়, দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।

সেই পথ যাঁরা ধরেছেন তাঁরা আত্মসমর্থনে বললেন, আগে তো খেয়েপরে বাঁচি, তারপর সমাজের কথা ভাবা যাবে। বাস্তব অবস্থাটা কিন্তু এই বিবেকানন্দ যাদের বলেছিলেন দরিদ্র ভারতবাসী, মূর্খ ভারতবাসী, তাদের সামনে দুর্নীতির পথে অর্থলাভের পথ উন্মুক্ত নেই। ঐ পথে যাঁরা আজ স্বার্থসিদ্ধি করছেন তাঁরা দরিদ্রতমদের মধ্যে পড়েন না।

দেশের দীনতমদের সঙ্গে যখন আমরা নিজেদের তুলনা করি তখন নিজেকে অভাবগ্রস্ত মনে করা কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের তুলনাটা দেশের সেই অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে নয়। নিজেকে আমরা তুলনা করি সেইসব প্রতিবেশীর সঙ্গে যাঁরা কোনো না কোনোভাবে আমাদের চেয়ে আরও একটু ভাল আছেন। আমাদের অভাববোধের পিছনে আছে প্রতিবেশীর সঙ্গে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রতিদ্বন্দ্বী ও ভোগবাদী এক সমাজে আমরা বাস করছি। প্রতিবেশীর ঘরে যে ভোগের নতুন সামগ্রীটি আছে তাই দিয়ে নির্ধারিত হচ্ছে। আমারও অভাববোধ। সেটি আমার ঘরে না আসা পর্যন্ত আমার মনে সুখ নেই, মানসম্মান বাঁচে না। পাশের বাড়ির অপব্যয়ও মনে হয় অনুকরণের যোগ্য, যেমন বিয়ের বেলায়। সামন্ততান্ত্রিক মর্যাদাবোধের সঙ্গে যোগ হয়েছে কালোবাজারি বুদ্ধি। ধার করে আমরা মানসম্মান বাঁচাই। তারপর ধার শোধর জন্য প্রয়োজন হয় দুর্নীতির। একেই আমরা বাস্তববুদ্ধির সঙ্গে সমার্থক করে জেনেছি অথচ এই পথে প্রতিটি সাফল্য নিতান্ত সাময়িক। প্রতিটি জয়ের পিছনে উঁকিঝুঁকি মারে আর কারও পরাজয়।

এক অবাস্তব সুখকে আমরা সুখ বলে জেনেছি। আর তারই পিছনে ছুটছি নেশাগ্রস্তের মত। পশ্চিমী দেশে কোনো এক যুগে আশা করা হয়েছিল, এই সুখের অন্বেষণেই মানুষ পরিশ্রমী এবং উন্নতিশীল হয়ে উঠবে। পরিশ্রম করে আরও কিছু গড়া, আরও উপার্জন। করা, জীবনের মানবৃদ্ধির এটাই রাজপথ। এদেশে দেখছি, উপার্জনের অন্য এক গুপ্ত পথ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তার নাম দুর্নীতি। দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এর মারাত্মক আকর্ষণ।

ঋণ শোধ না করেই যত খুশি, যতদিন খুশি, ধার করা যেতে পারে সমাজের ভাণ্ডার থেকে, এ এক আত্মঘাতী চিন্তা। আমরা কী সৃষ্টি করছি, কতটা করছি, তারই ওপর নির্ভর করে পরস্পর নির্ভরশীল যৌথ জীবনের সমৃদ্ধি। সেবা নয়, সৃষ্টি নয়, শুধু পাওয়া অথবা পাইয়ে দেওয়াই যখন প্রধান হয়ে ওঠে বিভিন্ন দলে এবং প্রতিষ্ঠানে, তখন এটাই জানতে হবে যে, বৃদ্ধির পথে নয় বরং সমাজকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে ক্ষয়ের দিকে। পাইয়ে দিতে দিতেই আমরা সবাইকে নিয়ে অধঃপাতে যাই। দুর্নীতির এই এক আশ্চর্য লক্ষণ।

.

(খ)

সুনীতির কিছু মৌল ধারণা ঐতিহ্যের সূত্রে আমাদের মনে স্থান পেয়ে এসেছে। সেইসব ধারণার প্রধান আশ্রয় পরিবার। মানুষে মানুষে সমবেদনার প্রাথমিক ভিত্তি পরিবারে। এখানেই সেবা অথবা ত্যাগের মূল্য সহজে স্বীকৃত। বড়দের কর্তব্য ছোট ভাইবোনকে সাহায্য করা, একথা তর্ক করে বোঝাবার প্রয়োজন হয় না। যৌথ পরিবারেও মানুষ কিছুই না দিয়ে কিছু পাবার চেষ্টা করে বটে। তবু সেটা যে স্বার্থপরতা, কোনো সুস্থ পরিবারের ভিত্তি যে সেটা হতে পারে না, একথা মানুষ সহজ বুদ্ধিতে বোঝে। সামাজিক নীতির ভিত্তিতে পরিবারের একটা বড় স্থান আছে বহুকাল থেকে।

এই পারিবারিক নীতিবোধকে বৃহত্তর সমাজের এবং প্রতিষ্ঠানে কার্যকর করবার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেটা সহজ হয়নি। অসুবিধা দেখা দিয়েছে একাধিক।

পারিবারিক কর্তব্য আর জনসাধারণের প্রতি কর্তব্য এক বস্তু নয়। পারিবারিক আনুগত্যের অভ্যাস অনুযায়ী যদি কেউ জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানে চলতে শুরু করেন তবে পরিণতিতে দেখা দেয় স্বজনপোষণ। বৃহত্তর সমাজে আবশ্যক আত্মীয়তার অতিরিক্ত এমন এক নৈর্ব্যক্তিক বিচার যেটা পরিবারের ভিতর সচরাচর গঠিত হয় না।

আরও কিছু গুণ আছে, জনসাধারণের প্রতিষ্ঠানে যার বিশেষ প্রয়োজন। যেমন সময়নিষ্ঠা। এর অভাবে আধুনিক জগতে কার্যদক্ষতা কমে যায়। কিন্তু আত্মীয়বন্ধুদের ভিতর এই গুণটির তেমন চা দেখা যায় না। এইরকম আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। সমাজের অভিব্যক্তির ইতিহাসে কিছু মৌল নীতির আদি নিবাস পরিবার। কিন্তু আধুনিক জগতে এমন কিছু গুণেরও প্রয়োজন ঘটে যা পারিবারিক অভ্যাসের অতিরিক্ত।

অতএব সমস্যা দেখা দিয়েছে দুদিক থেকেই। পরিবারে আশ্রিত সদগুণ বাইরের প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত করা সম্ভব হয়নি। পারিবারিক বন্ধনও ইতিমধ্যে জীর্ণ ও দুর্বল হয়ে এসেছে। আবার নতুন যেসব গুণের প্রয়োজন আধুনিক জগতে, সেসবও আমাদের ভিতর বর্তায়নি। স্বীকার করা আবশ্যক, কোনো দেশেই এসব সহজে আয়ত্ত হয়নি। শিক্ষা, প্রচার ও দণ্ডনীতির সাহায্যে নতুন নীতিবোধ কোনো কোনো দেশে অল্প বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদেশে তার বনিয়াদ কখনও দৃঢ় হয়নি। আমরা স্বজনপোষণে অভ্যস্ত। এখন যোগ হয়েছে দলীয়তা। সেখানেও স্বার্থ এবং স্বজনপোষণ ফিরে এসেছে ভিন্ন রূপে।

প্রতিদিনের জীবনে সততা, সময়নিষ্ঠা ও কর্তব্যপরায়ণতার অভাবে সমাজের যতখানি ক্ষতি হয় কয়েকটি বড় বড় নাটকীয় দুর্নীতির ঘটনায় সম্ভবত ততখানি হয় না। এইসব গুণ আমাদের সমাজে এককালে যতটুকু দেখা গিয়েছিল বিগত কয়েক দশকে তাও অনেকটা ক্ষয় হয়ে গেছে। তার কিছু কারণ আছে। দুটি কারণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রথম কারণ মুদ্রাস্ফীতি। বেশ কিছুকাল যাবৎ দ্রব্যমূল্য বেড়ে চলেছে। বিশেষত ১৯৭৩ সালের পর দেশে দেশে মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে দ্রুততালে, ভারতেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। মূল্যস্ফীতির ফলে অভ্যস্ত জীবনযাত্রার মানের ওপর ক্রমাগত টান পড়ছে। যে কোন উপায়ে সেটাকে আমরা রুখবার চেষ্টা করছি। সদুপায় আর অসদুপায়ের ভিতর। পার্থক্য করবার ধৈর্য এই অবস্থায় দুর্বল হয়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি নিঃসন্দেহে দুর্নীতির এক সহায়ক শক্তি।

মুদ্রাস্ফীতির এক কুফল এই যে, আয়ের বণ্টনে অসাম্য এতে বেড়ে যায়। আমাদের চোখের সামনেই নতুন ধনী শ্রেণী ফেঁপে উঠেছে। যাঁরা চাকুরীজীবী, যাঁদের আয় নির্দিষ্ট, তাঁরা ফাঁপরে পড়েছেন। একদিকে আধুনিক জগতের নানা নতুন উপকরণে তাঁরা প্রলুব্ধ; অন্যদিকে মুল্যবৃদ্ধির ফলে অভ্যস্ত জীবনযাত্রা রক্ষা করাও তাঁদের পক্ষে সহজ থাকছে না। বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন চলছে সংঘবদ্ধ সমিতির ভিতর দিয়ে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট মনে হচ্ছে না। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত আয়ের চেষ্টা আছে অন্য নানা পথে। অফিসে হাতের কাজ ফেলে রাখাটা আয়বৃদ্ধির চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত। কিছু কিছু দুর্নীতি এসে যায়। এরই সঙ্গে। আরও তলে, দেশের যে স্তরে আয়বৃদ্ধির এইসব কোনো পথই খোলা নেই, মুদ্রাস্ফীতির আক্রোশটা সেইখানে আছড়ে পড়ছে সবচেয়ে নির্দয়ভাবে। এই আমাদের গত কয়েক বছরের পরিচিত দৃশ্যপট।

দুর্নীতির পক্ষে কাজ করছে গত কয়েক দশকে আরও একটি পরিস্থিতি।

এদেশে আমরা গ্রহণ করেছি মিশ্র আর্থিক ব্যবস্থা এবং পরিকল্পিত অর্থনীতি। এর পক্ষে অনেক যুক্তি আছে। সেইসব যুক্তির ভিতর সবিস্তারে যাওয়া এখানে নিষ্প্রয়োজন। আপাতত আমাদের আলোচ্য বস্তু দুর্নীতি।

সরকারি, বেসরকারি ও যৌথ উদ্যোগে এদেশে মূলধন বিনিয়োগ এবং অন্যান্য আর্থিক ক্রিয়াকর্ম চলে। উৎপাদন যাতে বেসরকারি উদ্যোগেও যথাসম্ভব জাতীয় পরিকল্পনার লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে সেজন্য সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেন। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ আছে। আর্থিক নানা ক্রিয়াকর্মের জন্য সরকারি অনুজ্ঞাপত্র এবং ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। এসবের ভিতর দিয়ে বেসরকারি শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, রাজনীতিক দল আর আমলাতন্ত্র এই তিন গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বিশেষ সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। নিয়মের নামে যেমন কাজে অনেক বাধা সৃষ্টি করা যায় তেমনি তদবির ও অবৈধ অনুতোষণের সাহায্যে বাধা দূর করাও যায়। ইংরেজিতে লাইসেন্স শব্দটির দুটো অর্থ আছে। প্রথমটি আইনসিদ্ধ, দ্বিতীয়টি আইনবিরুদ্ধ। এদেশে গত কয়েক দশকে যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে অনেকে নাম দিয়েছেন লাইসেন্সরাজ। অনেক জটিল নিয়মকানুন এখানে দুর্নীতির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি দুইই ক্রমে ব্যাপক ও অর্থক্ষয়ী হয়ে উঠেছে। নিয়মকানুন দরকার। বাধানিষেধের প্রয়োজন আছে। কিন্তু নিয়ম যদি শুধু নিয়মভঙ্গের সুযোগ সৃষ্টি করে তবে সেটা বিপদের কথা।

যে পরিস্থিতিতে এদেশে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেয়েছে তার কিছুটা পরিচয় দেওয়া গেল। তবে দুর্নীতির কারণ জানা গেলেও তার প্রতিকার করা সহজ নয়। জয়প্রকাশ নারায়ণ আন্দোলন শুরু করেছিলেন ভ্ৰষ্টাচারের বিরুদ্ধে। ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, জরুরী অবস্থা অথবা এমার্জেন্সি প্রয়োজন হয়েছিল দুর্নীতি বন্ধ করবার জন্য। দুর্নীতি কিন্তু কমেনি। এটা এমনি এক সমস্যা যার সমাধান কঠিন, কিন্তু যেটাকে উপেক্ষা করাও সম্ভব নয়।

আমরা যদিও সমাজতন্ত্রের কথা বলি, সাম্যবাদের নাম উচ্চারণ করি, তবু সমাজতন্ত্রের জন্য যে নীতিবোধ প্রয়োজন এদেশে তার অভাব ভয়ঙ্করভাবে চোখে পড়ে। জনসাধারণের সম্পত্তি রক্ষা করার জন্য কাউকেই বড় আগ্রহী দেখা যায় না। নিজের পকেট থেকে পয়সা খরচ করবার ব্যাপারে আমরা প্রত্যেকে সাবধানী। সরকারী পয়সার ব্যাপারে তার বিপরীতটাই লক্ষ করা যায়। সেখানে কেউ সতর্ক হতে গেলে তাঁকে তিরস্কার করা হয়, এমনকি তিনি হয়ে ওঠেন বিদৃপের পাত্র। সরকারি গাড়ির ব্যবহার এরই একটা সহজ উদাহরণ। সমাজতন্ত্রে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁদের পক্ষে এটা নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তার কথা, তা নইলে তাঁদের বিশ্বাস সম্বন্ধেই প্রশ্ন উঠতে পারে।

দুর্নীতির প্রতিকারের জন্য যদি কিছু করা যায় তবে সরকার এবং জনসাধারণের মিলিত চেষ্টাতেই সেটা সম্ভব। উপায় নিয়ে কয়েকটি মূল কথা সংক্ষেপে বলা যাক।

কারণ থেকেই প্রতিকারের কথা স্বাভাবিকভাবে এসে যায়।

মূল্যস্ফীতি যদি দুর্নীতির অন্যতম কারণ হয় তবে দ্রব্যমূল্যের অতিবৃদ্ধি বন্ধ না করা পর্যন্ত দুর্নীতি রোধ করা যাবে বলে মনে হয় না। বহির্বিশ্বের বাজারে যখন অস্থিরতা দেখা। দেয় তখন ভারতের বাজারে ‘স্থিরতা রক্ষা করা অবশ্য কঠিন। তবু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যে কী করে সুস্থিতি আনা যায় সরকারকে সেকথা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।

লাইসেন্সরাজের কথা আগেই বলেছি। সরকারি নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। কিন্তু আর্থিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে এই নিয়ন্ত্রণেরও প্রকারভেদ ঘটে। খাদ্যশস্যের ব্যাপারে ভারত। আজ মোটামুটি স্বয়ম্ভর। ভারি শিল্পেরও অনেকটা বিকাশ ঘটেছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণের ধরন এখন বদলানো সম্ভব। নিয়মকানুন কিছুটা সরল করে আনা যায়। সেইসব নিয়মই রাখা ভাল যেসব নিয়ম বলবৎ করা যাবে। এ কাজটা ভেবেচিন্তে শক্ত হাতে করতে হবে। অর্থাৎ, একদিকে দরকার অনাবশ্যক নিয়ন্ত্রণ বাতিল করা, অহেতুক জটিলতা দূরে সরিয়ে দেওয়া। এসব জটিলতা থেকে কতিপয় আইনজীবী আর কালোবাজারী ছাড়া আর কারো লাভ হয় না। অন্যদিকে চাই প্রশাসনিক দৃঢ়তা। আমাদের মত দেশে প্রশাসনে দৃঢ়তার অভাব নিয়ে মিরডালের সমালোচনা প্রসিদ্ধ, এশিয়ান ড্রামা’ গ্রন্থে। সবাই স্বীকার করবেন, নিয়ম রেখে নিয়ম ভঙ্গ করতে দিলে দুর্নীতিকেই প্রশ্রয় দেওয়া হয়। এতে সমাজের ক্ষতি, অর্থনীতিরও।

অতিকেন্দ্রিকতা আমাদের শাসনযন্ত্রের অন্য এক দোষ। অতিকেন্দ্রিক শাসনযন্ত্রের ডালপালায় দুর্নীতির ফল ফলে। বিকেন্দ্রীকরণে সমস্যা নেই এমন নয়। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে যখন ক্ষমতা আসে তখনও দেখা দেয় অন্য এক ধরনের দুর্বলতা এবং অনাচার। তবু বিকেন্দ্রীকরণের পথেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যেতে হবে। যাদের উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ হয়েছে, অর্থের ব্যবহারের উপর তাদের কর্তৃত্ব যাতে বাড়ে সেই চেষ্টা করা দরকার। এতে ভুলভ্রান্তি হবে। আশা রাখতে হবে, এই ভ্রান্তি থেকেও জনসাধারণ শিক্ষা লাভ করবে। এটাই গণতন্ত্রের মূল বিশ্বাস।

যে পারিবারিক মূল্যবোধের কথা শুরুতেই বলেছি সেটা স্বাভাবিকভাবে অর্থবহ হয় গ্রামীণ সমাজে। দুর্নীতির শক্তি অবশ্য সেখানেও উপস্থিত। তাছাড়া দলীয় দ্বন্দ্বকলহ সব গঠনমূলক কাজের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় জুলুমের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা আবশ্যক। গ্রামীণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকারের সঙ্গে নীতিবোধকে কী করে মেলানো যায়। সেই পথই খুঁজে নিতে হবে। আগামী পর্যায়ে এটাই দেশের সামনে একটা প্রধান কাজ।

দুর্নীতি রোধের জন্য কিছু আর্থিক ও প্রশাসনিক পূর্বশর্ত নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। দ্রব্যমূল্যের সুস্থিতি, সরকারি নিয়ন্ত্রণের জটিলতা হ্রাস, প্রশাসনিক দৃঢ়তা, এই সবই স্বীকার্য পূর্বশর্ত। আরও আবশ্যক বিকেন্দ্রীকরণ, কর্মসংস্থান, শিক্ষার সংস্কার। এর পরও কিন্তু চাই নীতি নিয়ে চেতনা। নীতিশিক্ষা নামে যে জিনিসটা প্রচলিত তাতে খুব বেশি কাজ হয় না। তবু আবশ্যক কিছু মূল্যবোধ, মৌলনীতির সপক্ষে জনমত গঠন। চীনে ও সোভিয়েত দেশেও আজ দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে, নীতিবোধের কথা নতুন করে বলা হচ্ছে। সাংগঠনিক পূর্বশর্তই যথেষ্ট নয়। নতুন চেতনা ছাড়া নতুন সমাজ গড়া যায় না।

এ কাজ কিন্তু হবার নয় শুধু সরকারি প্রচেষ্টায়। এদেশে নতুন চেতনার স্রষ্টা হবে না দলীয় রাজনীতি। গত চার দশকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে নবচেতনার পদধ্বনি শোনা গেছে। যেসব আন্দোলনে তার কোনোটিতেই নেতৃত্ব আসেনি প্রতিষ্ঠিত সরকার অথবা সংগঠিত রাজনীতিক দলের কাছ থেকে। পুরনো প্রতিষ্ঠানের বাইরে গড়ে ওঠে নতুন চিন্তা। বাঁধা বুলি আর অভ্যস্ত আওয়াজ নিয়ে চলে দল। নতুন ভাষা চাই। হিংসার ভাষা নয়। হিংসায় পুরনো শত্রুকে বধ করে আমরা জন্ম দিই নতুন শত্রুর। অতএব চাই সততার ভাষা। মানুষের মনকে বন্ধনমুক্ত করবার ভাষা।

প্রতিবেশী দেশগুলিতে একে একে গণতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। দুর্নীতি রোধ করা না গেলে হয়তো ভেঙে পড়বে এদেশেও। তাতেও সমস্যার সমাধান হবে না। সামরিক শাসনে সঙ্কট মোচন হবে না। প্রতিবেশী দেশগুলিতে হয়নি। সঙ্কট অতিক্রম করবার জন্য চাই প্রশাসনিক পুনর্গঠন, শিক্ষার সংস্কার, নতুন নীতিবোধ আর সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের সমবায়ী চেষ্টা। মহান পিতামহেরা বিদায় নিয়েছেন। আমাদের সকলেরই কিছু দায়িত্ব আছে।

সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)

.

উল্লেখপঞ্জী

১। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ট্রেভেলিয়ন লিখেছেন “It is a common error to rcgard the Eighteenth Century in England as irreligious. An ethical code based on Christian doctrine was a rule of life to a much larger proportion of the community than it had been in the late medieval and Tudor periods… English Eighteenth Century religion was of two schools, which we may call for brevity, the latitudinarian and the Methodist. The latitudinarian stood for the spirit of tolerance… Methodism…was a way of Sfe devoted not only to religious observance but to self-discipline and work for others. The coincidence in time of Wesley and the Industrial revolution had profound effects upon England for generations to come” (English Social History, তৃতীয় সংস্করণ পৃষ্ঠা ৩৫৩-৩৬২)

২। অধ্যাপক শিশিরকুমার ঘোষ “দেশ”-এর পাতায় (৩০ ফাল্গুন, ১৩৭৬) রাসেলের এই উক্তিটির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

৩। ঐতিহাসিক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ লিখেছেন।

“During the years 1757-85 the principal businessmen in Calcutta were mostly higher caste Hindus… This class of people disappeared from business by the beginning of the nineteenth century. Once again Indian business-whatever it was-fell into the hands of those who belonged to the trader caşte.” (Studies in the Bengal Ranaissance, ed. Atul Chandra Gupta, National Council of Education, Jadavpur, Calcutta, 1958, p. 7)

৪। দ্রষ্টব্য Anil Seal, The Emergence of Indian Nationalism, Cambridge University Press, Paperback edition, 1971, pp. 59, 61.

৫। এ যুগের ব্যঙ্গসাহিত্যে আক্রমণ চলেছে সমানভাবে প্রাচীন পন্থীদের কাপট্য ও নব্য সংস্কৃতির আতিশয্যের বিরুদ্ধে। দীনবন্ধু মিত্রের “সধবার একাদশী” (১৮৬৬) নাটকে প্রকাশ পেয়েছে ইংরেজী শিক্ষিতদের সংস্কারমুক্তির বিষয়ে তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ। “নিম (চাঁদ)। …আমি জানি হিন্দুরা যেমন প্রেজুডিসবশতঃ মদ খায় না তেমনি অনেক হাকিম প্রেজুডিসবশতঃ ঘুস খায় না। তুমি লেখাপড়া শিখেছ, তোমার প্রেজুডিস গিয়েছে, কেবল অর্ধচন্দ্রের ভয়েতে ঘুস খাও না।”…কলকাতার ভোগবাদী নাগরিকজীবনের বিরুদ্ধে নিদারুণ শ্লেষ নিয়ে রচিত হয়েছে ‘বাঙ্গাল’ রামমাণিকের করুণ একটি কাতরাক্তি, “রাম।…বাঙ্গাল কউশ ক্যান–এতো অকাদ্য কাইচি তবু কলকার মত হবার পারছি না? কলকত্বার মত না করচি কি? মাগীবারী গেচি, মাগুরি চিকোন দুতি পাইচি, গোরার বারীর বিকোট বক্কোন করচি, বাণ্ডিল খাইচি–এতো করাও কলকাত্বার মত হবার পারলাম না…(মাতাল হইয়া পপাত ধরণী তলে)।” কারো কারো মতে নিমচাঁদের চরিত্রের ভিতর দিয়ে মধুসূদন দত্তকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে; তবে এ বিষয়ে দীনবন্ধু মিত্রের উক্তি, মধু কি নিম হতে পারে! মধুসূদন মূলত মানবতাবাদী, নগরসংস্কৃতি ও বুদ্ধিমুক্তির সপক্ষে। বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০) প্রহসনের প্রধান চরিত্র, ভক্তপ্ৰসাদ, বৃদ্ধ ও কামাতুর অথচ বাহ্য দৃষ্টিতে অতি ধার্মিক। ভক্তপ্ৰসাদ ও আনন্দের ভিতর মহানগরীতে পাঠরত যুবক অম্বিকা সম্বন্ধে একটি কথোপকথন এই রকম

“ভক্ত।..অম্বিকা তো কোনো অধর্মাচরণ শিখছে না।

আন। আজ্ঞে, অধর্মাচরণ কি?

ভক্ত। এই দেবব্রাহ্মণের প্রতি অবহেলা, গঙ্গাস্নানের প্রতি ঘৃণা, এই সকল খ্রীষ্টিয়ানি মত—

আন। আজ্ঞে, এ সকল কথা আমি আপনাকে বিশেষ করে বলতে পারিনা।

ভক্ত।…আমি শুনেছি যে কলকেতায় না কি সব একাকার হয়ে যাচ্ছে? কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, কৈবর্ত, সোনার বেনে, কপালী, তাঁতী, জোলা, তেলী, কলু সকলই না কি একত্রে উঠে বসে, আর খাওয়া দাওয়াও করে? বাপু, এ সকল কি সত্য?

আন। আজ্ঞে, বড় যে মিথ্যা তাও নয়।” ৬। এই প্রসঙ্গে আরও পূর্ণাঙ্গ আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য David Kopf, The Brahmo Samaj and the Shaping of the Modem Indian Mind, Princeton University Press, 1979.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *