1 of 2

৩.২১ ইতিহাস চিন্তা

৩.২১ ইতিহাস চিন্তা

মানুষের সঙ্গে মানুষের তিন প্রকার সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। প্রথমটির নাম দেওয়া যেতে পারে আত্মীয় সম্পর্ক; দ্বিতীয়, ব্যবহারিক বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক; তৃতীয়, আগ্রাসী সম্পর্ক। প্রথমটির সহজ উদাহরণ, পিতামাতার সঙ্গে সন্তানসন্ততির সম্পর্ক। কিন্তু এটিকে রক্তের সম্পর্কের চেয়ে আরও ব্যাপক ও বৃহৎ অর্থে ধরা সম্ভব। যেখানেই আমরা অপরকে একটি সম্প্রসারিত ‘অহং’-এর অন্তর্ভুক্ত করি সেখানেই তার সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপিত হয়। আত্মীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা অপরের স্বার্থকে নিজের স্বার্থের অংশ হিসাবে গণ্য করি; অতএব অপরের আনন্দে আনন্দ এবং অপরের দুঃখে দুঃখ অনুভব করি, অপরের গর্বে গর্বিত ও অপরের অপমানে অপমানিত বোধ করি। ব্যবসায়িক। সম্পর্কের ক্ষেত্রে দুই পক্ষ নিজ নিজ স্বার্থ স্বতন্ত্রভাবে গণনা করে। নিজের স্বার্থেই ক্রেতা। ক্রয় করে ও বিক্রেতা বিক্রয় করে; নিজের ও অপরের সিদ্ধির যোগফলে কোনো পক্ষেরই মাথাব্যথা নেই। একপক্ষ যখন মনে করে যে এই সম্পর্কে তার কোনো স্বার্থ নেই তখন ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। আগ্রাসী প্রচেষ্টার বৈশিষ্ট্য এই যে, দুই পক্ষ এখানে স্বেচ্ছায় পারস্পরিক সম্বন্ধে আবদ্ধ নয়, বরং একপক্ষ উপস্থিত অন্য পক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। উদাহরণত, ডাকাত ও গৃহস্থের ভিতর সম্পর্কটা ব্যবসায়িক নয়; বরং আগ্রাসী নামেই একে চিহ্নিত করা চলে। বাস্তবজীবনে এই তিন সম্পর্কের নানাপ্রকার সংমিশ্রণ দেখা যায়। কিন্তু বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য এই পৃথকীকরণ প্রয়োজনীয়।

ইতিহাসের একটি পর্যায় ছিল যখন যুদ্ধে পটু যাযাবর গোষ্ঠীর আক্রমণে প্রাচীন সমাজ ও সভ্যতা বার বার পর্যুদস্ত হয়েছে। চীনে এই আক্রমণকারীরা এসেছে সাধারণত উত্তর দিক থেকে; ভারতে এদের আবির্ভাব হয়েছে উত্তর-পশ্চিমের গিরিপথ ভেদ করে; পশ্চিমী দেশগুলিতে আক্রমণ ঘটেছে উত্তর অথবা পূর্ব কোণ ধরে। আক্রান্ত সমাজ অনেক সময়েই সভ্যতার মাপে খাটো ছিল না। কিন্তু সেই সমাজের অভ্যন্তরে ঐক্য ছিল দুর্বল, ভেদাভেদ প্রবল; আর অভিজাতবংশীয় নেতারা ছিলেন বিলাসে ও পারস্পরিক অসূয়ায় শক্তিহীন। আক্রমণকারীদের সাহস ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী ইতিহাসে সুবিদিত; কিন্তু যে বৈশিষ্ট্যটি আরও মৌল তা হলো দল ও দলপতির ভিতর একটা প্রবল পারম্পরিক আনুগত্য বা আত্মীয়তাবোধের বন্ধন।

বাবরের আত্মজীবনী থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে তিনি একবার দলবল সহ পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে সবাই অবশেষে একটি গুহার মুখে এসে পৌঁছলেন। তখন ভয়ানক বরফ পড়ছিল। এর পরের ঘটনা বাবরের নিজের ভাষারই ইংরেজী অনুবাদে তুলে দিচ্ছি।

Some urged me to go into the caver, but I thought that I ought not to be in shelter and lie down at ease, while my men were in misery shivering in the drift…There is a Persian proverb, “Death in the company of friends is a feast.” (The Life of Babar, by R.M. Caldecott, 1844, p. 117).

এই-যে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়েও অনুগামীদের সঙ্গে মৃত্যুবরণকেই রমণীয় বোধ করা, এটাই উদ্ধৃত বাক্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এটিকে একটি অসাধারণ কাহিনীমাত্র মনে। করলে ভুল হবে। ইবন খালদুন তাঁর বৃহৎ ঐতিহাসিক গ্রন্থের ভূমিকায় আক্রমণকারী। উপজাতীয় গোষ্ঠীদের ভিতর সুদৃঢ় সংহতিবোধ ও তজ্জনিত শক্তির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগের ইতিহাসেও এর ছায়া পড়েনি এমন নয়।

রাষ্ট্রের গঠন, ক্ষমতার লড়াই ও আর্থিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক সব যুগেই ঘনিষ্ঠ। বিভিন্ন পর্যায়ে এই সম্পর্কের প্রকারভেদও লক্ষণীয়। ভারতের সঙ্গে বাবরের সম্পর্ক ছিল আগ্রাসী। কিন্তু রাজ্য স্থাপনের পর আগ্রাসী সম্পর্ককেও ধীরে ধীরে আইনকানুন ও প্রতিষ্ঠানের ভিতর রূপ দিতে হয়। ক্ষমতা রূপায়িত হয় বিধিবদ্ধ অধিকারে। এখানেই অবশ্য ক্ষমতার লড়াইয়ের অবসান নয়। শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন দেখা দিলে সেটাও আবার স্বীকৃত নিয়ম ও অধিকারে প্রতিফলিত হয়। যেমন ধরা যাক সম্রাটের সঙ্গে সুবেদারের সম্পর্ক; সম্রাট যতদিন ক্ষমতাবান সুবেদারও ততদিন তাঁর অনুগত। কেন্দ্রীয় শাসন কোনো কারণে দুর্বল হলেই সুবেদারের আনুগত্যও অনিশ্চিত। রাজায়-প্রজায় দ্বন্দ্ব এরই সঙ্গে জড়িয়ে আছে, যদিও সেটা অনেক সময়েই তুলনায় গৌণ। আবার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ও বহিঃশত্রুর আক্রমণে যাতায়াতের নিরাপত্তা যখন গুরুতরভাবে বিপন্ন হয়েছে তখন বাণিজ্যের পতন ঘটেছে। রাষ্ট্রের গঠনেও সেই সঙ্গে বড় রকমের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এই সব ঘটনাই প্রধান।

মধ্যযুগের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থানপতনের ভিতর দিয়ে আর্থিক উন্নতির কোনো স্পষ্ট রেখা লক্ষ করা কঠিন। আধুনিক যুগে অবস্থা ভিন্ন। উৎপাদন পদ্ধতির দ্রুত উন্নতি এ যুগের বৈশিষ্ট্য।

উৎপাদন পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে প্রতি যুগে কিছু সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় স্বভাবতই মানুষকে সহযোগিতার একটা বিশিষ্ট ধাঁচে সাজাতে হয়। সেই ধাঁচটা কখনও সরল, যেমন চার জন মিলে যখন একটা ভারী জিনিস বয়ে নিয়ে যায় আবার কখনও জটিল, যেমন আধুনিক পরিবহণ ব্যবস্থায় অথবা বড় কারখানায়। কিন্তু এও তো সহযোগিতার ওপরের স্তরের দৃশ্যমাত্র। উৎপাদন প্রক্রিয়াকে চালু রাখবার জন্য গভীরতর সামাজিক ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। বিনিময়ব্যবস্থাকেও উৎপাদনব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে ধরা যেতে পারে; আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যবিনিময়ের পরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তা ছাড়া যেহেতু উৎপাদন প্রক্রিয়ার মূলে আছে কারিগরী পটুত্ব ও দ্রব্যগুণ সম্বন্ধে জ্ঞান, অতএব তৎসংক্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থাও আর্থিক জীবনের অপরিহার্য পরিপূরক হিসাবে গণ্য। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিকাশের একটা অঙ্গাঙ্গি যোগ আছে।

আর্থিক উন্নতির জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন মূলধন ও ব্যবহারিক জ্ঞান। মূলধন গঠিত হয়েছে কিছুটা ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে, কিছুটা আবার আগ্রাসী সম্পর্কের পথে। মূলধনের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির যোগসাধন না হলে কোনো স্থায়ী উন্নতি ঘটে না। এক-পুরুষের ধন আর-এক-পুরুষ উড়িয়ে দেয়, অথবা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সেটা ক্ষয় হয়ে যায়। বিজ্ঞান ছাড়া আর্থিক উন্নতির স্থায়ী ভিত্তি নেই। আর্থিক বিবর্তনের ইতিহাসে উৎপাদনের সংগঠন, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার পারস্পরিক সম্পর্ক, ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া, বিশেষভাবে লক্ষণীয়।

বিজ্ঞান ও কারিগরীবিদ্যায় যে দেশগুলি তুলনীয়, উপরন্তু যেসব দেশের উৎপাদন পদ্ধতি মোটামুটি একই পর্যায়ের, তাদের সামাজিক জীবনের গঠনে অনেকটা সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। যেমন ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের ভিতর বৈসাদৃশ্যের চেয়ে সাদৃশ্যই ভারতীয় চোখে বেশী করে ধরা পড়ে। আজকের আমেরিকার সঙ্গে ইংল্যাণ্ডের ততটা পার্থক্য নেই যতটা আছে এ যুগের সঙ্গে উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের।

এসব কথা মেনে নেবার পরও স্বীকার করতে হয় যে, জ্ঞানবিজ্ঞান ও উৎপাদনপদ্ধতির দিক থেকে যেসব দেশ সমপর্যায়ভুক্ত তাদের ভিতরও রাজনীতিক ও সামাজিক জীবনে গুরুতর পার্থক্য থাকা সম্ভব। উৎপাদনপদ্ধতি কোন রাষ্ট্রিক কাঠামো ও সীমারেখার ভিতর সংগঠিত হবে সেটা উৎপাদিকা শক্তির অন্তর্নিহিত প্রভাব দ্বারা এককভাবে নির্ধারিত হয় না। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর রাজনীতিক ব্যবস্থায় আজ দুস্তর প্রভেদ। এই প্রভেদের কারণ কারও অজানা নেই। কোনো আর্থিক কারণে অথবা উৎপাদিকা শক্তির অন্তর্নিহিত গতির স্বাভাবিক ঝোঁকে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর বিভেদ নির্ধারিত হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে সোভিয়েত লাল ফৌজের গতি যেখানে থেমেছে সেখানেই দুই জামানী ও দুই আর্থিক ব্যবস্থার সীমানা চিহ্নিত হয়েছে। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি দ্বারা রাজনীতি নির্ধারিত হয়নি, বরং সামরিক ও রাজনীতিক কারণে অর্থনীতি নির্ধারিত হয়েছে।

জার্মানীর এই উদাহরণকে সাধারণ নিয়মের একটি অকিঞ্চিৎকর ব্যতিক্রম হিসাবে গণ্য করা ভুল হবে। বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থার আশ্রয়ে সমপর্যায়ের উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ সম্ভব। রুশ দেশে বলশেভিক বিপ্লবের পর আর্থিক উন্নতি এক পথে ঘটেছে; প্রতিবেশী জর্মানীতে বিপ্লবের চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর শিল্পোন্নয়ন ঘটেছে অন্য পথে। আজকের চীনে আর্থিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা যে পথে চলেছে তার একটা বড় নির্ধারক রাজনীতি। একথা মাও সে-তুং-এর চেয়ে স্পষ্টভাবে কেউ বলেননি; রাজনীতিকেই তিনি অর্থনীতির নিয়ন্তা হিসাবে বহাল রাখতে চেয়েছেন।

অসম উন্নতি অনেক সময় সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণ হয়। আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কোনো দেশ শক্তিমান হয়, আবার কোনো দেশ পিছিয়ে পড়ে। যে দেশ একবার পিছিয়ে পড়ে, এগিয়ে-যাওয়া দেশগুলির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া তার পক্ষে আরও কঠিন হয়ে ওঠে। একই দেশে বিভিন্ন অঞ্চলের ভিতরও উন্নতির তারতম্য ঘটে, যেমন ঘটেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ভিতর। আধুনিক যুগে আগ্রাসী অভিযানের বাস্তব রূপরেখা বহু পরিমাণে এই অসম উন্নতির ভৌগোলিক ও সামাজিক বিন্যাস দ্বারা নিধারিত হয়েছে। উন্নত দেশ বা অঞ্চলগুলি পশ্চাৎপদ অঞ্চলের ওপর আধিপত্য স্থাপন করতে যায়; ফলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভিতরও অনুরূপভাবে সম্পর্ক জটিল হয়ে ওঠে। সামাজিক দ্বন্দ্বের ব্যাখ্যায় শুধু শ্রেণীগত স্বার্থের সংঘাতই বিবেচ্য নয়, আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক অসাম্যের বিশ্লেষণও প্রয়োজন।

রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ে রাজনীতির কারবার। উৎপাদনপদ্ধতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা পরিবর্তন আবশ্যক হয়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন শ্রেণী ও গোষ্ঠীর ভিতর স্বার্থের দ্বন্দ্বের একটা বিশেষ ভূমিকা স্বীকার্য। উপর সংঘর্ষের এমন কারণও থাকে আর্থিক বিশ্লেষণে যা সম্পূর্ণ ধরা পড়ে না। অর্থনীতি ও রাজনীতির পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে হলে অবশেষে অর্থনীতি ও রাজনীতিকে ছাড়িয়ে দৃষ্টি বিস্তার করতে হয়। ইতিহাসের একটি অধসচেতন শক্তির বৃহত্তর পটভূমিকায় সচেতন স্বার্থগুলির। পারস্পরিক সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টা রূপায়িত হয়। এ বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দেওয়া প্রয়োজন।

আত্মীয়তার পরিধি, রাষ্ট্রের চৌহদ্দি এবং ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিস্তারের ভিতর প্রায়ই সাযুজ্য হয় না। কিন্তু এই তিনটিকে মেলাবার একটা অসম্পূর্ণ অথচ অদম্য চেষ্টাও। অবিরত চলেছে; এবং এই তিনের অসামঞ্জস্যে উদ্ভূত শক্তি ইতিহাসের একটি প্রধান নিয়ন্তা।

বাণিজ্যের পরিধির সঙ্গে রাজদণ্ডকে মিলাতে গিয়ে আগ্রাসী পথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পত্তন। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল অংশকে ধর্ম অথবা সংস্কৃতির একসূত্রে বাঁধা সম্ভব ছিল না। অথচ জাতীয় ঐক্যবোধের স্বাভাবিক গণ্ডিকে অমান্য করে সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন। আবার আত্মীয়তাবোধ যদি রাষ্ট্রের সীমানাকে অতিক্রম করে যায় তবে সেই সীমানাও শেষ অবধি মুছে যাবার সম্ভাবনা। পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানীর ভিতর আত্মীয়তার একটা স্বাভাবিক বন্ধন আছে। রাজনীতি যদি একদিন জামানীকে বিভক্ত করে। থাকে তো জাতীয়তাবোধ সম্ভবত তাকে পুনর্মিলিত করবে। এ বিষয়ে প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য স্বভাবতই অস্পষ্ট তবু অর্থব্যঞ্জক। বাণিজ্যের রেখা ধরে অগ্রসর হয়ে লুণ্ঠন ও রাজ্যজয়ের আঘাতে দিগবিজয়ী বীরেরা কখনও কখনও বাণিজ্যকে সংহার করেছেন বটে। কিন্তু সাম্রাজ্যই আবার শান্তির রক্ষক হিসাবে বাণিজ্যকে উজ্জীবিত করেছে। সেই সঙ্গে বিশাল সাম্রাজ্যকে একই ধর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করবার চেষ্টাও বার বারই দেখা গেছে। এমনি করে আত্মীয়শক্তি, আগ্রাসী শক্তি এবং ব্যবসায়িক ঘাতপ্রতিঘাতে ইতিহাসের পথ রচিত হয়েছে।

ভারতবর্ষের পুরাতন ইতিহাসকেও এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা সম্ভব। দিল্লী থেকে রাজ্যের সীমা বার বার ছড়িয়ে পড়েছে গুজরাত ও বাংলার উপকূল পর্যন্ত; আর বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনে সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে অনিবার্যভাবে এক নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বাবরের কথা আগেই বলেছি। তিনি যখন উত্তর ভারতে রাজ্যস্থাপন করেন তখন এ দেশের প্রতি তাঁর কোনো আত্মীয়তাবোধ ছিল না। এ দেশের জলস্থল ও মানুষ তাঁকে মুগ্ধ করেনি। এ দেশের ধর্মকে তিনি বিধর্ম বলে জানতেন; রানা সঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে তিনি অনুগামীদের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন তাতে এর প্রমাণ। পাওয়া যায়। এসব কথা তাঁর স্মৃতিচারণে লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু যে-সংকীর্ণ। আত্মীয়তাবোধ বাবরকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করেছে, সাম্রাজ্যকে স্থায়ী করবার পক্ষে সেটা যথেষ্ট ছিল না। আকবর বুঝেছিলেন যে, রাজশক্তিকে একটি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন। জিজিয়া করের বিলোপের ভিতর দিয়ে তিনি বিজয়ী ও বিজেতাদের ভিতর অপমানের ব্যবধান দূর করতে চেয়েছিলেন। রাজত্বকে আইনের শাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত করবার গুরুত্বও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। কিন্তু এও যথেষ্ট নয়। আকবর একথা জানতেন যে, বৃহত্তর ঐক্যবোধের জন্য আরও গভীর কিছু চাই। একটি সম্প্রসারিত ও সমম্বয়াকাঙ্ক্ষী ধর্মবোধের ভিত্তিতে তিনি ভারতের ঐক্যকে স্থাপন করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাঁর স্বপ্নসন্তানরূপে জন্ম নিয়েছিল একটি উপাসনাগৃহ, যেখানে সকল ধর্মমতের মানুষ হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনার জন্য স্বচ্ছন্দে সম্মিলিত হতে পারতেন।

আকবরের সেই উদারনীতি সফল হয়নি। শাহজাহানের সময় থেকেই স্রোত অন্য পথে বইতে লাগল। ধর্মসমম্বয়ের ভিত্তিতে ভারতে মহাজাতি গঠিত হলো না। এর পরিণাম ভারতবর্ষের পরবর্তী ইতিহাসে সুস্পষ্ট। কিন্তু পরিণাম স্পষ্ট হলেও এই ব্যর্থতার কারণ আমরা নির্মোহ মনে অনুসন্ধান করিনি।

আত্মীয়তাবোধের বিস্তৃতির পথে যেসব বাধা দেখা দেয় তাদের মূল অনেক সময়ে সুদূর অতীতে নিহিত থাকে। ব্যবসায়িক বুদ্ধির ঘোরফের বর্তমানকে নিয়ে; অতএব শুধু আর্থিক কারণ দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাখ্যা হয় না। ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই কথাটা মনে রাখা ভালো। ধর্ম একদিন বাণীরূপে আমাদের ক্ষুদ্রতা থেকে উদ্ধার করে; ধর্মই আবার আচাররূপে আমাদের ক্ষুদ্রতায় আবদ্ধ করে।

পৌত্তলিকতায় অভ্যস্ত আরবের বিভিন্ন উপজাতিকে মহম্মদের বাণী একদিন বৃহত্তর ভ্রাতৃত্বে উন্নীত করেছিল। ইসলামের অনমনীয় পৌত্তলিকতাবিরোধী চিন্তাই আবার হিন্দুধর্মের সঙ্গে সমন্বয়সাধনের পথে অন্তরায় হয়েছে। অথচ সাম্প্রদায়িক আনুগত্যকে সম্প্রীতির ওপরে স্থান দিলে সম্প্রদায়কেই ভগবানের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়; এবং এটাও গভীরার্থে পৌত্তলিকতারই ভিন্নরূপ। হিন্দুদের বিশুদ্ধ ধর্মচিন্তা উদার; কিন্তু আচারের ক্ষেত্রে কয়েকটি মারাত্মক বৈশিষ্ট্য আছে। দৈহিক পবিত্রতা সম্বন্ধে একটি বিশেষ ধারণা হিন্দু সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। এরই প্রভাবে অস্পৃশ্যতাবোধ হিন্দু মনের গভীরতম স্তরে পর্যন্ত প্রবেশ করেছে। মুসলমানকে হিন্দু দৈহিক অর্থে অপবিত্র জ্ঞান করে। হিন্দু ও মুসলমানের ভিতর প্রকৃত আত্মীয়তাবোধের পথে এটা সাংঘাতিক বাধা। এ বিষয়ে হিন্দুরা এমনই নির্বিকার যে, এই অমানুষিক অবস্থাটাকে তারা অমানুষিক বলে। চিনতেও প্রস্তুত নয়। যে জড় অপবিত্রতাবোধ আমাদের মানবিক ভ্রাতৃভাবকে আচ্ছন্ন ও খণ্ডিত করেছে তাকে আমরা নির্মম ও প্রশ্নাতীত প্রত্যয়ের সঙ্গে ধর্মের অঙ্গ বলে মেনে নিয়েছি।

সাম্প্রদায়িকতাকে আমরা যদি কায়েমী স্বার্থের প্রতিবিম্বমাত্র মনে করি তবে এর স্বরূপ বোঝা যাবে না; এর সমালোচনাও ব্যাপ্তি এবং গভীরতায় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। হিন্দু ও মুসলমানের ভিতর অস্পৃশ্যতার ব্যবধান যদি শুধু ব্যবসায়িক বুদ্ধির সৃষ্টি হতো তবে একে দূর করাও অপেক্ষাকৃত সহজ হতো এটা মনের আরও গভীরে প্রোথিত বলেই একে উম্মুল করা এত কঠিন। এ কথা শুধু হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ সম্পর্কেই সত্য নয়। শিল্পোন্নয়ন সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গবিদ্বেষ অব্যাহত। পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট দেশগুলিতেও সমাপ্ত হয়নি ইহুদীবিদ্বেষ। জাতি ও ধর্মকে কেন্দ্র করে মানুষে মানুষে পারস্পরিক আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বার বারই এমন আকার ও তীব্রতা লাভ করেছে, ব্যবহারিক যুক্তি দিয়ে যার অর্থ উদ্ধার হয় না। সংকীর্ণ আত্মীয়তাবোধ ও মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের মধ্যে যে অমিল তাকে অতিক্রম করবার জন্য প্রয়োজন চিন্তার যে বিপ্লব, সেটা কোনো আর্থিক পরিবর্তনের ফলমাত্র নয়।

.

দুই

মানুষের দুটি পরিচয়। একদিকে সে সামাজিক সম্পর্কে আবদ্ধ এবং এই সব সম্পর্ক দ্বারা তার সত্তা নির্ধারিত। তার একটি দ্বিতীয় পরিচয় আছে যা তাৎক্ষণিক সামাজিক সম্পর্ককে অতিক্রম করে যায়। কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানী ইতিহাসের ব্যাখ্যায় মানুষের এই দ্বিতীয় পরিচয়কে উপেক্ষা করেছেন। কিন্তু এটা ভুল। মানুষের গভীরতর আকাঙ্ক্ষা-আশা ও হতাশা-সামাজিক সম্পর্কের ভিতর সংক্রামিত, অথচ এই সব। সম্পর্ক দ্বারা সীমায়িত নয়।

মানুষের যে সত্তা সংগঠনের অতীত তাই আবার নিগূঢ়ভাবে সমাজে ও আত্মীয়তাবোধে প্রবিষ্ট। আত্মীয়তাবোধের দুটি বিপরীত মেরু আছে; জীবধর্ম ও আত্মজ্ঞান। জীবধর্মের স্বাভাবিক প্রকাশ পারিবারিক বন্ধনে। আত্মজ্ঞান বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। এ প্রসঙ্গে একটিমাত্র সূত্রই এখানে আলোচ্য। বৃহৎ সমাজ ও সংগঠনে ব্যক্তিকে। বিভিন্ন কর্ম ও পদে চিহ্নিত করা আবশ্যক হয়। বৃত্তি ও পদের দ্বারা সমাজে ব্যক্তির বিশেষ পরিচয়। এই সব বিশেষ চিহ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন করলে ব্যক্তির একটি সামান্য পরিচয় অবশিষ্ট থাকে। আমি অমুক অফিসের কেরানী, প্রহরী অথবা পরিচালক, এই বিশেষ পরিচয় আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া যায়। কিন্তু আমি বাঙ্গালী, ভারতীয় অথবা মানুষ এই পরিচয় আমার একান্ত অন্তরঙ্গ, এমন কি অবিচ্ছেদ্য। এই সামান্য পরিচয়েই গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তি বৃহৎ আত্মীয়তার সূত্রে বা আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ।

আত্মপরিচয়ের বিভিন্ন স্তর আছে, আত্মীয়তাবোধেরও তেমনই ক্ষুদ্র ও বৃহৎ বহু বৃত্ত আছে। শুদ্ধ জ্ঞানের দৃষ্টিতে আত্মীয়তাবোধের কোনো সীমা নেই। কিন্তু এই নিরাকার সাম্যবোধ সাধারণ ব্যবহারের সামগ্রী নয়। কর্মে ও অনুভূতিতে সত্য করে তুলতে হলে একে একটি আধারে স্থাপন করতে হয়, অতএব সীমায় বাঁধতে হয়। ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতির উপাদানে জাতীয়তাবোধের আধার রচিত হয়। ঐতিহাসিক আত্মীয়তাবোধ একদিকে স্থানে কালে সীমায়িত ও সংস্কারবদ্ধ, অন্য দিকে মানবিক ভ্রাতৃত্ববোধের অস্পষ্ট কল্পনায় অনুরঞ্জিত। সাধারণ অবস্থায় এই আত্মীয়তাবোধ সমাজের সংহতি রক্ষার সহায়ক। কিন্তু এই আধারেই আবার সেই আদর্শেরও উদ্ভব, যুগ-পরিবর্তনের সময় যাকে প্রাচীন সমাজের নিয়মবন্ধন ও পদবৈষম্যের বিরুদ্ধে অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হতে দেখি।

সমাজে নানা কারণেই সংঘর্ষ ঘটা সম্ভব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর কিছু আর্থিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অসন্তোষ যখন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত কলহের সীমা ছাড়িয়ে। যায় এবং নতুন সমাজগঠনের আন্দোলনে পরিণত হয়, সামাজিক দ্বন্দ্ব তখন ধর্ম ও মানবতাবোধের বিভিন্ন ধ্বজা নিয়ে সংঘাতের রূপ ধারণ করে। এটাকে নিছক ভণ্ডামি বিবেচনা করা ভুল। গৃহযুদ্ধে ব্যক্তির শুধু বিশেষ পরিচয়ই নয়, তার সামান্য পরিচয়ও বিপন্ন হয়–যেমন বিপন্ন হয় ভ্রাতৃহন্তার ভ্রাতৃপরিচয়। তখন আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য ব্যক্তিকে ধর্ম অথবা আদর্শের পতাকা নতুন করে তুলে ধরতে হয়, নয় তো সংকীর্ণ। সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিতে হয়। যুগ পরিবর্তনের মুখে শাসকগোষ্ঠীও দ্বিধা (অথবা বহুধা বিভক্ত হয়। সামাজিক বিপ্লব বিরাট পারিবারিক সংঘর্ষের আকারে দেখা দেয়। বিপ্লবের পর ব্যক্তিকে একটি সামান্য পরিচয়ের সূত্রে আবারও বৃহৎ সংহতিতে স্থাপন করতে হয়।

আর্থিক কারণে কখনও কখনও সামাজিক সংহতির পুরনো সীমারেখা অতিক্রম করা বাঞ্ছনীয় হয়ে ওঠে। যেমন হয়েছিল আরব দেশে মহম্মদের তৎকালীন সমাজে। কিন্তু শুধু স্বার্থবুদ্ধি দিয়ে বৃহত্তর ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করা যায় না। ব্যবসায়িক বুদ্ধির দ্বারা আরবের উপজাতিগণ ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়নি; মহম্মদের ধর্মের আহ্বানেই সেটা সম্ভব হয়েছিল। উদাহরণ ছেড়ে এবার তত্ত্ব হিসাবে কথাটা বলা যাক। আত্মীয়তাবোধের। সংকীর্ণ বৃত্ত থেকে কোনো সরল রেখা ধরে বৃহত্তর বৃত্তে প্রবেশ করা যায় না। সেজন্য প্রয়োজন প্রথমে স্বীকৃত সংস্কার থেকে ব্যক্তির পরিচয়কে মুক্ত করে শূন্যতায় আরোহণ, তারপর সেই শূন্য থেকে নতুন বিশ্বাসের রেখা ধরে সংসারে অবরোহণ। আমরা যখন শুধুই সংস্কারে আস্থা হারিয়েছি, নতুন কিছু লাভ করিনি, তখনকার সেই শূন্যতা কী ভয়ংকর, কত সহজে তা হতাশায় অথবা হিংসায় ভরে ওঠে, সেটা উপলব্ধি করা আজ কঠিন নয়। কিন্তু এর অতিরিক্ত প্রীতি ও বিশ্বাস সাধারণ অর্থে যুক্তি অথবা ব্যবসায়িক বুদ্ধি থেকে লাভ করা যায় না।

এ যুগে শিল্প, বাণিজ্য ও যানবাহনের উন্নতির ফলে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তাতে সারা পৃথিবী জুড়ে এক যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পক্ষে যুক্তি আজ প্রবল। অথচ জাতীয় সংহতির পুরনো সীমারেখা অতিক্রম করা কত যে কঠিন তাও এই মুহূর্তে আমাদের কাছে বেদনাদায়কভাবে স্পষ্ট। ধনতন্ত্রই জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষের মূল কারণ, এই অলীক ধারণা আজ ধূলিসাৎ। আণবিক বোমায় সর্বাত্মক ধ্বংসের ভয়কে সত্য জেনেও আমরা জাতীয় বিদ্বেষ অতিক্রম করে বৃহত্তর মানবতাবোধকে আত্মরক্ষার পথ বলে গ্রহণ করতে পারছি না। পৃথিবীর রাজনীতিতে মানুষের ধর্ম এখনও স্বীকৃত হয়নি। কখনও স্বীকৃত হবে কিনা আমরা জানি না।

ইতিমধ্যে ইতিহাস থেমে নেই, থেমে থাকবে না। আগেই উল্লেখ করেছি যে, শিল্প ও বাণিজ্য পৃথিবীকে একসূত্রে গেঁথেছে। একথা আজ নয়, গত শতাব্দীর প্রথম ভাগেই মার্ক্স লক্ষ করেছিলেন তাঁর তরুণ বয়সের ‘জামান আইডিওলজি’ গ্রন্থে। বাণিজ্য ও বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সারা পৃথিবীতে এক সরকার গঠনের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করবার। চেষ্টা শুরু হয়েছে বহুদিন থেকে। সাম্রাজ্যবাদকে কেউ কেউ বিশ্বরাষ্ট্রগঠনের দিকে পদক্ষেপ বলেছেন। কিন্তু কার্যত সাম্রাজ্যবাদ জাতীয়তাবাদকেই শক্তিশালী করেছে। গত অর্ধ শতাব্দীর অভিজ্ঞতার ফলে বিশ্বরাষ্ট্র গঠনের কয়েকটি শর্ত আজ আমরা আগের চেয়ে খানিকটা স্পষ্টভাবে জানি। দুর্বল জাতিসঙ্ঘ যুদ্ধ থামাতে পারেনি। যতদিন না মানুষের আগ্রাসী অর্থাৎ সামরিক শক্তি আরও বেশী পরিমাণে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, ততদিন পৃথিবীতে যুদ্ধের অবসান আশা করা যায় না। অপর পক্ষে সারা বিশ্বে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও মানুষের ছোট ছোট আত্মীয়তাবোধের বৃত্তগুলি মুছে ফেলা যাবে না; সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বহুত্ব ও বিকেন্দ্রিকতা রক্ষা করতে হবে। এ বিষয়ে ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করবার আছে। যুক্তি যদি-বা নিরাকার ব্রহ্মের ইঙ্গিত বহন করে, সংস্কৃতি মাত্রই ‘পৌত্তলিক। মানবতাবোধ এক হলেও তার প্রকাশ অনিবার্যভাবে বহুত্বে চিহ্নিত। অর্থনীতির স্থান এ দুয়ের মাঝামাঝি। এক জাতীয় উদ্যোগ আছে যার পরিধি প্রধানত স্থানীয়, সেখানে নিয়ন্ত্রণও স্থানীয় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আবার এমন উদ্যোগও আছে, যার পরিধি বিশ্বব্যাপী। অতএব আর্থিক ক্রিয়াকাণ্ডে সামরিক সংগঠনের তুল্য কেন্দ্রীকরণ সমর্থনযোগ্য নয়; আবার সম্পূর্ণ বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব নয়। তবে বিকেন্দ্রীকরণের দিকে ঝোঁক রেখেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

এই বাস্তব বিন্যাসের ভিতরই আশা করা যায়, মানুষ তার স্থানীয় পরিচয়ের সঙ্গে বিশ্বপরিচয়ের, আত্মীয়বোধের সঙ্গে বিজ্ঞান ও ব্যবহারিক বুদ্ধির, অবশেষে একটা সমন্বয় বিধান করতে পারবে। তা যদি না হয় তো আমাদের এই সর্বাধুনিক সভ্যতা বিগত সমস্ত সভ্যতাকে পরাভূত করবার পর আত্মঘাতে বিনষ্ট হবে।

পল্লী ও নগর (১৯৭৩)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *