1 of 2

৩.২০ মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ

৩.২০ মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ

আমরা যখন মধ্যবিত্তের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করছি তখন নিজেদেরই বিষয়ে কথা বলছি। আপনি আমি, এই প্রবন্ধটির যাঁরা পাঠক তাঁদের অধিকাংশই, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। এর একটা সুবিধা আছে, আবার অসুবিধাও আছে। সুবিধা এই, আমরা বিষয়টা অনেকখানি ভিতর থেকে জানি। অসুবিধাটাও অগ্রাহ্য করবার মতো নয়। নিজের সম্বন্ধে নিরপেক্ষভাবে লেখা কঠিন। আমাদের চোখে নিজেদের দুঃখ ও ক্ষতি অতিরিক্ত বড় আকার নিয়ে দেখা দেয়, অন্যের দুঃখ কিংবা ক্ষতি তুলনায় ছোটো মনে হয়। অন্যের লাভ আমরা ঈষার চোখে দেখে থাকি, নিজের লাভটাকে লাভ বলে সহজে স্বীকার করতে চাই না। এই কথাটা মনে রেখে, এ বিষয়ে লিখতে গিয়ে, অনেকটা সাবধানতা প্রয়োজন হয়।

মধ্যবিত্ত সম্বন্ধে একটা কথা অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। মধ্যবিত্ত একটা ক্ষয়িষ্ণু শ্ৰেণী, মধ্যবিত্তের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। কথাটা কি সত্যি? কোন অর্থে এটা মান্য? এই সঙ্গে এসে যায় আরও গোড়ার একটা প্রশ্ন : মধ্যবিত্ত বলতে কাদের বুঝতে হবে? ভবিষ্যৎ নেই কাদের? এবং কেন?

পুরনো একটা সরলীকৃত তত্ত্ব এইখানে স্মরণ করা যেতে পারে। বিষয় ধনতন্ত্র। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে একদিকে আছে বড় পুঁজিপতি, যেমন বড় ব্যবসায়ী এবং বৃহৎ শিল্পের মালিকবৃন্দ আর অন্যদিকে বিত্তহীন শ্রমিক, সংখ্যায় যারা সমাজের গরিষ্ঠ অংশ। মাঝখানে ছোট ছোট ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক, অল্পস্বল্প পুঁজি নিয়ে যাদের কাজকারবার। তত্ত্বটা হল এই যে, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট শিল্পপতি এদের কোনও স্থায়িত্ব নেই, এদের ভিতর কয়েকজন হয়তো ক্রমে বড় ব্যবসায়ী, বড় শিল্পপতি হয়ে উঠবে, আর বাকি অধিকাংশ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব খুইয়ে বিত্তহীন শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে মিশে যাবে। এই অর্থে মধ্যবিত্তের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সমাজ ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত দুই শ্রেণীর ভিতর। যারা মাঝামাঝি আছে ইতিহাস শেষ অবধি ঠেলে দিচ্ছে তাদের এক প্রান্তে কিংবা অন্য প্রান্তে। অবশ্য এমন হতে পারে যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ছোট শিল্পপতি ও ছোট ব্যবসায়ী যেমন তলিয়ে যাচ্ছে তেমনি কিছু আবার ক্রমাগত জন্মলাভ করছে। কাজেই ব্যষ্টি হিসেবে স্থায়ী না হলেও সমষ্টি হিসেবে ছোট ব্যবসায়ীরা লোপ পাচ্ছে না। অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের আকার এবং প্রকার বদলে চলেছে, কিন্তু এরা টিকে আছে। যাই হোক, এই যে তত্ত্বের কথা বলা হল এটা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘ করা নিষ্প্রয়োজন। মধ্যবিত্তের গঠন সম্বন্ধে যে ধারণা অবলম্বন করে এই তত্ত্বের বিস্তার, আমাদের পরিচিত সমাজের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য নেই। এই সমাজের সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তার ছক তৈরি করা দরকার।

আমাদের পরিচিত সমাজে মধ্যবিত্তেরা অধিকাংশ চাকরিজীবী। অনেকেই সরকারী চাকরিতে নিযুক্ত। অনেকে শিক্ষক, ডাক্তার, উকিল, ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ব্যবসায়ী বা শিল্পপতি এখানকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গরিষ্ঠ অংশ নয়। এই সামাজিক বাস্তবের সঙ্গে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞাটা মিলিয়ে নেওয়া দরকার। তা ছাড়া, এটা একান্তভাবে আমাদের সমাজের কথাও নয়। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সব দেশেই একটা পেশাদারী মধ্যবিত্ত শ্রেণী প্রধান হয়ে উঠেছে, যাদের অবলম্বন প্রযুক্তিবিদ্যা ও কৃৎকৌশল কিংবা কোনও বিশেষ শাস্ত্রে দক্ষতা। সরকারের শাসনযন্ত্র এই শতাব্দী ধরে প্রধান প্রধান সব দেশেই বিশাল আকার ধারণ করেছে, সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা কোনও দেশেই নগণ্য নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল রেখে বৃহৎ শিল্প বিস্তার লাভ করেছে, এইসব শিল্পে নিযুক্ত নানা স্তরের অফিসার বা আধিকারিক ও কৃকুশলীদের সংখ্যাও বেড়ে চলেছে। আধুনিক শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকের স্থান কমছে, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত শ্রমিকের গুরুত্ব বাড়ছে। এইসবের ফলে আজকের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে বসেছে এক নতুন মধ্যবিত্ত, আর্থিক বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব লোপ পাবার কোনো আশু সম্ভাবনা নেই। এ ব্যাপারে আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়।

মাঝে মাঝেই অবশ্য রব শোনা যায়, মূল্যস্ফীতির ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী ভেঙে যাচ্ছে। আসলে মধ্যবিত্ত একইসঙ্গে ভাঙছে ও গড়ছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় সমাজে নিম্নমধ্যবিত্তের ভোগান্তির অন্ত নেই; কিন্তু মোটের ওপর মধ্যবিত্ত আকারে-প্রকারে বেড়েই চলেছে। যাদের আয় টাকার অঙ্কে প্রায় অনড়ভাবে বাঁধা, মূল্যস্ফীতির ফলে তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে। পেনসনভোগীরা এ কথাটা ভালোভাবেই জানেন। কিন্তু দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিটাই একমাত্র ঘটনা নয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আয়ও যে টাকার অঙ্কে বাড়ছে সেটাও প্রধান কথা নয়। প্রধান কথা এই যে, অর্থনীতির গঠনটাই বদলে চলেছে। সরকারী ও বেসরকারী সবরকম প্রতিষ্ঠানেই এমন সব পদ ও সুযোগ ক্রমেই সৃষ্টি হয়ে চলেছে যাতে মধ্যবিত্তের কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই গত তিরিশ বছরের উল্লেখযোগ্য মুদ্রাস্ফীতির পরও আমাদের সমাজে মধ্যবিত্ত আগের তুলনায় আরও বড় স্থান জুড়ে আছে। হাহাকারের কিছু কারণ অবশ্য আছে, সে বিষয়ে সামান্য আলোচনা পরে করা যাবে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতির ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিলুপ্তির পথে, এই কথাটা গত কয়েক দশকের ইতিহাসের সঙ্গে মোটের ওপর মেলে না।

আরও দীর্ঘ দৃষ্টি নিয়ে দেখলে অন্য একটা কথাও স্বীকার করে নিতে হয়। মধ্যবিত্তের সমালোচনায় মধ্যবিত্তই সবচেয়ে মুখর। সেই সমালোচনা ভিত্তিহীন নয়, তাকে উপেক্ষা করা যায় না। তবু স্বীকার করে নেওয়া ভালো, আধুনিক ইতিহাসের রচনায় মধ্যবিত্তের একটা স্মরণীয় ভূমিকা আছে।

.

(খ)

মধ্যবিত্তের প্রধান অবদান নতুন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। এই শ্রেণীটির জয়যাত্রা শুরু হয়েছে নগর থেকে, এ যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রধানত নগরভিত্তিক। নাগরিক সভ্যতা বিস্ময়ের পর বিস্ময় সৃষ্টি করে চলেছে। বিদ্যুৎকে সে ঘরে ঘরে টেনে এনেছে। পরমাণুর ভিতরের রহস্য উদঘাটন করে তাকে করে তুলেছে মানুষের ব্যবহার্য শক্তির এক বিস্ময়কর উৎস। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অক্লেশে উড়ে বেড়াবার উপায় উদ্ভাবন করবার পর এখন সে যাত্রা শুরু করেছে গ্রহে উপগ্রহে। মস্তিষ্কের গঠন ও গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞানসংগ্রহ করে সে তৈরি করেছে কিছু অভূতপূর্ব যন্ত্র, যার প্রাথমিক উদাহরণ নানা জাতের কম্পুটার। একদিন যন্ত্র ছিল প্রধানত পেশীশক্তির পরিপূরক, আজ সে মস্তিষ্কের শক্তিরও পরিপূরক। এই সবই নগরভিত্তিক মধ্যবিত্তেরই কীর্তি।

এই মধ্যবিত্তের অন্য এক সৃষ্টি আধুনিক গণতন্ত্র। সামন্ততান্ত্রিক মধ্যযুগীয় সমাজে সাধারণ মানুষের স্বাধীন চিন্তা ও সংগঠনের অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। সেই অধিকার ক্ৰমে প্রসারিত হয়েছে। সাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক বা না হোক, আর্থিক ও সামাজিক সাম্য সম্বন্ধে ধারণা এ যুগে উল্লেখযোগ্যভাবে বিস্তার লাভ করেছে। সামাজিক সাম্য নামক বস্তুটি মধ্যযুগে অক্লেশে অস্বীকৃত ছিল। আজ আর সে কথা বলা যাবে না। বৈষম্য এখনও আছে, লজ্জাজনকভাবেই আছে। তবু জাতি সম্প্রদায় অথবা লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকারের কথাটা যে আমরা সংবিধানে উচ্চারণ করি, এটাও প্রাচীন সংহিতার সঙ্গে তুলনায় উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক পরিবর্তন।

মানুষের ইতিহাসকে যদি সামাজিক মুক্তির ইতিহাস বলে বিবেচনা করা যায় তবে তাতে। এ যুগের মধ্যবিত্তের একটা বিশিষ্ট, যদিও বিতর্কিত, ভূমিকা উপেক্ষা করা যায় না। প্রাচীন সমাজে ব্যক্তিমানুষ ছিল পরিবার জাতি ও গ্রামসমাজের অবিচ্ছিন্ন অংশ। ক্রমে ব্যক্তির ওপর পরিবার জাতি ও গ্রামসমাজের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে। এটা ঘটেছে নাগরিক জীবনের প্রসার ও ক্ষমতাবৃদ্ধির ফলে। পুরনো ঐতিহ্যের বন্ধন ভেঙে মুক্তচিন্তা কিংবা। বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন শুরু হয়েছে। আধুনিক যুগের অন্যান্য লক্ষণের সঙ্গে এটা যুক্ত। বিজ্ঞান হোক, ব্যক্তিস্বাধীনতা অথবা গণতান্ত্রিক অধিকার হোক, মানুষের বুদ্ধির মুক্তির সঙ্গে এই সবকিছুরই যোগ আছে।

এ যুগের মধ্যবিত্ত যে নতুন সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে তার বহু গুরুতর ত্রুটি আছে। এই সভ্যতাকে যদি আমরা অতিক্রম করে যেতে না পারি তবে সর্বনাশ ঘটতে পারে। তবু মধ্যবিত্তের অবদান স্বীকার্য। একে অস্বীকার করে এগোবার। চেষ্টা করাটা ভুল। এর যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ তাকে রক্ষা করেই এগিয়ে যেতে হবে।

.

(গ)

মুদ্রাস্ফীতির ফলে নয়, মধ্যবিত্তের জীবনে আজ অভাব আর মেটে না ক্রমবর্ধমান ভোগবাদের ফলে। একটির পর একটি নতুন ভোগ্যবস্তু বাজারে এসে পৌঁছচ্ছে; জীবনের সুখ যে সেটি ছাড়া নিতান্তই অসম্পূর্ণ এ কথা বোঝাবার জন্য প্রচারযন্ত্র তৎপর হয়ে উঠছে; গৃহস্থও সেইরকম বুঝতে দেরি করছেন না। প্রাচীনেরা বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বরের জন্য আকাঙ্ক্ষাই উন্নতির উপায়। এ যুগের মানুষ বিশ্বাস করে, ভোগের আকাঙ্ক্ষাই উন্নতির উপায়।

ভোগবাদের সঙ্গে আধুনিক জগতের কিছু মূল বৈশিষ্ট্যের যোগ আছে। বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে শক্তি, বাহ্য প্রকৃতির ওপর কর্তৃত্ব। শিল্পবিপ্লবের ফলে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কের ভিতর একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। ক্রীতদাস যেমন মালিকের আজ্ঞাবহ ভোগের বস্তু, প্রকৃতির ওপর ঐরকমের একটা আধিপত্য স্থাপন করবার দিকে ঝোঁক নাগরিক সভ্যতার। প্রকৃতি দাস, মানুষ প্রভু, বিজ্ঞান সেই প্রভুত্ব কায়েম করবার উপায়। ভালোবাসা থেকে যা পাওয়া যায়, প্রভুত্ব থেকে তা পাওয়া সম্ভব নয়। প্রভুত্ব থেকে ভোগের তৃপ্তিই সম্ভব। সেটাই তখন হয়ে ওঠে লক্ষ্য। শেষ অবধি অবশ্য ভোগের তৃপ্তিও লাভ হয় না। দারিদ্র যেমন একটা বন্ধন, যেটা ভাঙা দরকার, ভোগস্পৃহাও তেমনি একটা বন্ধন। এটা ভাঙা কঠিন।

আধুনিক সমাজের আরেক লক্ষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রাধান্য। পুরনো যুগে রাজায় রাজায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। সাধারণ মানুষের জীবন ছিল গতানুগতিকায় বাঁধা, প্রায় গতিহীন। আজকের সমাজে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে। শুধু অর্থ নিয়ে নয়, ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মধ্যবিত্তের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। গৌরবে অগৌরবে মিশ্রিত সেই কাহিনী।

এ দেশের বিদেশী শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণী। আবার তারই সূত্র ধরে শুরু হয়েছে হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্তের ভিতর ক্ষমতার। দ্বন্দ্ব। দেশ দুই খণ্ড হল। স্বাধীনতা লাভের পর চার দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। মধ্যবিত্তের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ভিতর। অনুন্নত জাতিসম্প্রদায়ের ভিতর থেকে নতুন মধ্যবিত্ত ধীরে ধীরে গঠিত হচ্ছে, তাদেরও স্বাভাবিকভাবেই কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। চাকরি নিয়ে দ্বন্দ্ব, সরকারী শাসনযন্ত্রে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নতুন রাজ্য গঠনের দাবি নিয়ে লড়াই। এইসব দ্বন্দ্বেও নেতৃত্ব প্রধানত মধ্যবিত্তের।

এখানে দেখি অন্য এক অসঙ্গতি অথবা স্ববিরোধ। মধ্যবিত্তের এক প্রধান অবদান ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধের বিকাশ। অথচ মধ্যবিত্তই আবার নেতৃত্ব দিচ্ছে এমন সব দ্বন্দ্বে যেখানে সংঘবদ্ধ লোভ ও ক্ষমতাস্পৃহার কাছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পরাস্ত।

একদিকে পরিবার-জাতি-সম্প্রদায়ের বন্ধন শিথিল হচ্ছে। ব্যক্তি আত্মসচেতন হচ্ছে, বিশ্বে তার স্থান কোথায় সে চিন্তা তাকে নিজে করতে হচ্ছে। অন্যদিকে মানুষ পীড়িত তার একাকিত্বে। বন্ধনমুক্তিই যথেষ্ট নয়, সদর্থক কিছু চাই যা নিয়ে বাঁচা যায়। তার অভাবে মানুষ সহজেই ধরা দেয় অন্য কোনও উত্তেজক বন্ধনের হাতে।

এ যুগে এমন ঘটনা বারবার ঘটেছে। হয়তো যাত্রা শুরু হয়েছিল কোনও আদর্শের নামে, কিন্তু পরিণতি আদর্শের পরাজয়ে। অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের একটি কাহিনী এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে। জার্মানির এক প্রয়াত বিপ্লবী নেতার বৃদ্ধা স্ত্রী ক্লেয়ার থালহাইমারের সঙ্গে শিবনারায়ণের সাক্ষাৎ ঘটে। আউগুস্ত ও ক্লেয়ার দৃ’জনেই মানবেন্দ্রনাথ রায়ের বন্ধু ছিলেন। সাক্ষাৎকারের শেষে সেই বৃদ্ধা বিষণ্ণভাবে একটি প্রশ্ন করেন। এঁরা তো সবাই একটা আদর্শের জন্যই জীবন বিপন্ন করে কাজ করে গিয়েছিলেন, তবু পরিণামে প্রতিষ্ঠিত হল ভয়াবহ স্তালিনী সন্ত্রাসের রাজত্ব। কেন এমন হয়? তবে কি এঁদের জীবন ব্যর্থ? অধ্যাপক রায় এ প্রশ্নের পর নিরুত্তর ছিলেন।

.

(ঘ)

ভারতের অর্থনীতি “মিশ্র” অর্থনীতি। “মিশ্র মানে সরকারী নীতি ও নিয়ন্ত্রণের কাঠামোর ভিতর সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগের সহাবস্থান। জহরলাল নেহরুর আমলে ঘোষিত লক্ষ্য ছিল এই যে, সরকারী উদ্যোগের প্রাধান্য ক্রমে বাড়বে, এ দেশের অর্থনীতি ধীরে ধীরে হয়ে উঠবে সমাজতান্ত্রিক। গত দশ বছরে সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবার দিকে ঝোঁক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এতে অনেকে উল্লসিত, অনেকে বিষণ্ণ। তবে এটা বিশ্বব্যাপী একটা ঝোঁকের সঙ্গে মিলছে! চীনে ও সোভিয়েত দেশেও সরকারী নিয়ন্ত্রণ শিথিল হচ্ছে।

যদিও আমাদের সঙ্গে ওদের অবস্থা ঠিক তুলনীয় নয় তবু একটা কথা সাধারণভাবে লক্ষ করবার যোগ্য। এ যুগের অভিজ্ঞতা এইরকম। দ্রুত শিল্পোন্নয়নের প্রথম অবস্থায়, অল্প কয়েকটি বৃহৎ শিল্পোদ্যোগের যখন প্রাধান্য, সেই সময়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ শক্ত করা অপেক্ষাকৃত সহজ ও যুক্তিসঙ্গত। আরও অগ্রসর স্তরে, শিল্পের সংখ্যা ও ভোগ্যবস্তুর বৈচিত্র্যবৃদ্ধির পর, সরকারি নিয়ন্ত্রণ শিথিল করবার জন্য চাপ প্রবল হতে থাকে।

সরকারী নীতির হেরফেরে এদেশের মধ্যবিত্তের সামগ্রিকভাবে খুব বেশি ক্ষতিবৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। তবে মধ্যবিত্তের ভিন্ন ভিন্ন অংশের ওপর তার প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন হতেই পারে। আমাদের অর্থনীতির মতোই আমাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীও গঠনে মিশ্র। এই শতাব্দীর আরম্ভে সরকারী চাকরিতে বাঙালির ছিল বিশেষ স্থান, ব্যবসায়ে। মারোয়াড়ী-গুজরাতীর প্রাধান্য। ব্যবসায় থেকে বাঙালি যতই পিছিয়ে গেছে ততই মতাদর্শের দিক থেকে সে হয়ে উঠেছে বণিকবিদ্বেষী। গান্ধীজী সহজে বলতে পারতেন, তিনি বানিয়া। কোনও বাঙালি নেতার পক্ষে এ কথা বলা সহজ নয়। এখানকার ঐতিহ্য ভিন্ন রকম। এ থেকে কিছু বাস্তব সমস্যা দেখা দেওয়া অসম্ভব নয়। সরকারি চাকরি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে চলেছে, সেখানে নিম্নবর্ণের দাবি ক্রমে জোরালো হচ্ছে। এই ঝোঁকটা অনিবার্য। বাঙালি যুবকেরা শিল্পবাণিজ্যে আরও উদ্যেগী হয়ে উঠলে ভাল। তা নইলে এখানকার মধ্যবিত্তের সমস্যা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে। সেই সঙ্গে আবশ্যক পল্লীসংগঠনের কাজ।

কিছুদিন আগে পান্নালাল দাশগুপ্ত মহাশয় একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধটির শিরোনামা–রাজনীতি দূর হঠো। বিপ্লবী পান্নালাল একদিন বহু লোকের শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গেও তিনি পরিচিত। তাঁর আদর্শনিষ্ঠা অতুলনীয়। এমন এক ব্যক্তি যখন ওই কথা বলেন তখন সেটা উপেক্ষা করা যায় না। কথাটা অবশ্য বিচার করতে হবে দেশের সামনে যে-কাজ আছে তারই পরিপ্রেক্ষিতে।

আমাদের দেশ কোন পথে যাবে সেই সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব নয়। তবে এমন কিছু কাজ আছে, এমন কিছু পরিবর্তন প্রয়োজনীয়, যে সব সম্পন্ন করতে হবে। তা নইলে শান্তি নেই।

এ দেশের নেতৃত্ব ছিল বহুকাল অবধি উচ্চবর্ণের হাতে। এই উচ্চবর্ণের পরিধি অবশ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন। দক্ষিণ ভারতে উচ্চবর্ণ বলতে বুঝতে হবে প্রধানত ব্রাহ্মণ, আমাদের বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবৈদ্যকায়স্থ। তবে সর্বত্রই উচ্চবর্ণের প্রাধান্য। এই অবস্থাটার পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে। দক্ষিণে ব্রাহ্মণের সেই আধিপত্য আর নেই। উত্তর ভারতে, বিহার থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত, নিম্নবর্ণের সংগ্রাম চলছে। বাংলাদেশে বসে আমরা ব্যাপারটা তেমনভাবে বুঝি না। এটা না বুঝলে কিন্তু এ দেশকে বোঝা হয় না। প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত তথ্য মধ্যবর্ণের সঙ্গে নিম্নবর্ণের সংঘাত বেড়ে চলেছে। এই সংঘাতের যত শান্তিপূর্ণ মীমাংসা করা যায় ততই মঙ্গল।

প্রায় চল্লিশ বছর আগে এ দেশে পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। ক্রমে এ দেশে আর্থিক পরিকল্পনার যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাতে কেন্দ্রের প্রাধান্য। এর কিছু কারণ আছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য। বিকেন্দ্রীকরণের দিকে লক্ষ্য রেখে পরিবর্তন চাই। পরিকল্পনার রচনায় ও রূপায়ণে গ্রামপঞ্চায়েত এবং জিলাপরিষদকে আরও ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিতে হবে। সমাজবিন্যাসে যেমন নিম্নবর্ণের ক্ষমতাবৃদ্ধি বেশিদিন রোধ করা যাবে না, আর্থিক পরিকল্পনার বিন্যাসেও তেমনি বিকেন্দ্রীকরণই ভবিষ্যতের পথ। এই দুয়ের মধ্যে একটা যোগ আছে যেটা বোঝা কঠিন নয়।

মধ্যবিত্তের ভবিষ্যতের প্রধান নির্ধারক তার নিজেরই অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বের নানা রূপ আছে। এ দেশের মধ্যবিত্ত বহু জাতিতে, ভাষাগোষ্ঠীতে ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত। শহর ও গ্রামের ভিত্তিতে বিভেদও উল্লেখযোগ্য। এককালে শহরের মধ্যবিত্তের নিঃসন্দেহে প্রাধান্য ছিল। এখন গ্রামীণ মধ্যবিত্ত ক্রমে বড় হচ্ছে। সেই সঙ্গে মধ্যবিত্তের এই দুই গোষ্ঠীর ভিতর স্বার্থের সংঘাত বাড়ছে। রাজনীতিতে তার প্রতিফলন স্পষ্ট ও তীব্র হয়ে উঠছে।

এই দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই কিন্তু শহরের মধ্যবিত্তের কিছু বৈশিষ্ট্য গ্রামের মধ্যবিত্ত লাভ করছে। কিন্তু কোন বৈশিষ্ট্য? বিজ্ঞানমনস্কতা? ভোগবাদ? হয়তো দুইই। কিন্তু কতটা? এ সব প্রশ্নের কোনও পূর্বনির্ধারিত উত্তর হয় না। দ্বন্দ্বের মাঝখানে দাঁড়িয়েই সচেতনভাবে মূল্যবিচারের প্রয়োজন দেখা দেয়।

আরও একটা বিভেদ সম্প্রতি আমাদের সমাজে সমস্যার সৃষ্টি করছে, যে-বিষয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সেই বিভেদের যোগ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে।

এ দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ ইংরেজির মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা লাভ করছে, অপরাংশ ইংরেজিতে দুর্বল। ইংরেজি ও মাতৃভাষার এই বিরোধ দুঃখজনক, উভয় ভাষাতে যুগপৎ দক্ষতা অর্জনের সপক্ষে ভালো যুক্তি আছে। কিন্তু কার্যত তা হচ্ছে না। ছাত্রসমাজের দুই অংশের ভিতর বিরোধ শুধু ভাষাজ্ঞান নিয়ে নয়, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভেদটাই বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো। ইংরেজিতেই বেশি অভ্যস্ত যারা, তাদের ভিতর আধুনিক পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ তুলনায় বেশি। এদের অধিকাংশ নগরবাসী, অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। ইংরেজিতে যারা দুর্বল তারা যে সবাই মাতৃভাষা সযত্নে পড়েছে এমন নয়, তবে এদের অধিকাংশ তুলনায় নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান, অনেকের যোগ গ্রামীণ অথবা অপেক্ষাকৃত ছোট শহরের মধ্যবিত্তের সঙ্গে। এইভাবে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজটাই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ দুয়ের ভিতর যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য সেতু নেই।

এ দেশের সমাজের পক্ষে এটা এক সঙ্কটজনক অবস্থা! রামমোহন ও মাইকেল মধুসূদন থেকে আরম্ভ করে বিনয়কুমার সরকার ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পর্যন্ত অনেকেই তাদের ‘বিশ্বদক্ষতা’কে লাগিয়েছিলেন স্বদেশের কাজে ও মাতৃভাষার সেবায়। এ দেশের সমাজের জীর্ণতা তাদের দেশত্যাগী করেনি। আজকের অবস্থা ভিন্ন। উঠতি মধ্যবিত্তের একাংশ স্বদেশের ভাষা ও সংস্কৃতিতে বিশেষ আগ্রহী নয়। বিশ্বের বাজারের প্রতি আকৃষ্ট এদের বিশ্বদক্ষতা। অপরাংশ তারই প্রতিক্রিয়ায় হয়ে উঠছে সংকীর্ণ স্বাদেশিকতায় আক্রান্ত, মৌলবাদী। মধ্যবিত্তের যে সঙ্কট ও অন্তর্দ্বন্দ্ব ইরানে মুখবিকৃতি করে আছে, ভারত পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তা থেকে মুক্ত নয়।

কথাটা আবারও বলা যাক। সমস্যা এই নয় যে, মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব লোপ পেতে পারে। আজকের মধ্যবিত্তের গঠনই এমন যে তার লোপ পাবার আশঙ্কা কম। রাজনীতিতে এ-পক্ষ ও-পক্ষ দু’পক্ষেরই নেতৃত্ব মধ্যবিত্তের হাতে। সমস্যা অন্যত্র। প্রশ্ন এই যে, ইতিহাস আমাদের সামনে যে কর্তব্য স্থাপন করেছে, মধ্যবিত্ত তার জন্য তৈরি কি না? দলীয় রাজনীতি আমাদের বেশি দূর নিয়ে যেতে পারবে না। রাজনীতিকে দূর করে দেওয়া কঠিন, তবু তার সীমাবদ্ধতা দিনে দিনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আতঙ্কবাদী সন্ত্রাসকে। সে ঠেকাতে চায় রাষ্ট্রীয় হিংসার শক্তি দিয়ে। দুর্নীতিকে দুর্নীতি দিয়ে। ক্ষমতা নিয়ে লড়াই বাড়িয়ে তোলে দেশের ভিতর গৃহযুদ্ধ। এইখানে কোনও সবুজের লক্ষণ চোখে পড়ে না। নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতিময় যুবকযুবতীরা তাই আকৃষ্ট হয় না এই রাজনীতিতে। ব্যতিক্রম কিছু অভিনেতা, অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য। নতুন চিন্তা, নতুন উদ্যোগ ও সদর্থক আন্দোলন, এরপর শুরু হতে পারে বিভ্রান্তিকর দলাদলির বাইরে। সেইখানে সম্ভব নতুন ভবিষ্যতের সূচনা।

মধ্যবিত্তের বড় শত্রু অন্তর্দ্বন্দ্ব, জাতিসম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব। আজ দেশকে এই দ্বন্দ থেকে মুক্ত করা জরুরী কাজ। বিজ্ঞানচেতনার প্রতিনিধিত্ব করা যে-মধ্যবিত্তের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সে যদি জাতিসম্প্রদায়ের দ্বন্দ্বে যুক্তির শত্রু হয়ে ওঠে তবে সেটা অতি বড় দুভাগ্যের কথা হবে।

সন্দেহ নেই যে, দেশকে নতুন পথে নিয়ে যাবার কাজে আজকের প্রজন্মের কিছু বিশেষ সুবিধা আছে। বুদ্ধিমত্তায় ও স্বাভাবিক দক্ষতায় এরা আমাদের মুগ্ধ করে। প্রয়াত প্রজন্মের বহু কলহ থেকে এরা মুক্ত। নতুন চোখ নিয়ে সবকিছু দেখা এদের পক্ষে সহজ। এসব সুবিধা তুচ্ছ করবার মত নয়। এরা সাহস করে এমন ভবিষ্যৎ কল্পনা। করতে পারে বিদায়ী প্রজন্মের পক্ষে যেটা অসম্ভব।

মধ্যবিত্তের যে-নেতারা দেশবিভাগের জন্য দায়ী, তাঁরা আজ বহুদিন হল ইতিহাসের মঞ্চ থেকে অপসৃত। আমরা এখনো তর্ক করে যাচ্ছি, কে দোষী? নিষ্ফল সেই তর্ক। সেদিন দেশকে দুভাগ করা ছাড়া অন্য কোনও পথ ছিল কি না সেই বাগবিতণ্ডাতেও বিশেষ লাভ নেই। প্রশ্ন এই, আজ কী করা যায়? ভবিষ্যতে কী করা সম্ভব? পৃথিবীর দরিদ্রতম উপমহাদেশে কোটি কোটি মানুষকে অর্ধাহারে রেখে ভারত ও পাকিস্তান বহু অর্থব্যয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে দুই সৈন্যবাহিনীকে নব নব রণসজ্জায় সজ্জিত করে তুলছে, এই অমানবিক অসঙ্গতিকে কি চিরকালের মতো মেনে নিতেই হবে? এখন আবার চলছে দুই দেশের ভিতর পারমাণবিক যুদ্ধের ভীতিপ্রদ অর্ধগোপন প্রস্তুতি। এর শেষ কোথায়? এটাই আজকের জরুরী প্রশ্ন। এই উপমহাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি নতুন। প্রজন্ম কি গড়ে তুলতে পারে না অন্য এক জনমত, অন্য এক ভবিষ্যতের সূচনা? মৌলবাদের ব্যর্থতা এইখানে যে, সে অতীতের হাতে বন্দী। অতীত থেকে সে পায়নি ঔদার্যের শিক্ষা, পেয়েছে “দেয়াল তোলা”র শিক্ষা। সেই বন্দীদশা থেকে নিজেকে মুক্ত করে দেশের নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেওয়া–এই তো নতুন প্রজন্মের ঐতিহাসিক কর্তব্য ও অধিকার এই অধিকার কেউ কাউকে দান করতে পারে না, এটা অর্জন করবার বস্তু। আশা রাখতে হবে, নতুন প্রজন্মের সেই শক্তি আছে।

এদেশে মধ্যবিত্ত যুবকদের সামনে একটা বড় সমস্যা বেকারি, বেরোজগারি। এটা অবশ্য মধ্যবিত্তের একার সমস্যা নয়। এর প্রাদুর্ভাব সর্বত্র। আমাদের অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে এটা আছে বিভিন্ন রূপে। একে সামগ্রিক দৃষ্টিতে দেখা দরকার। তবে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ও সরব, কাজেই তার সমস্যার চেহারাচরিত্র ভিন্ন। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা এই প্রজন্মের মনে এমন একটা প্রত্যাশা জাগিয়েছে যেটা অতীতে ছিল না। সমাজের কর্তব্য প্রত্যেকের জন্য শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ করে দেওয়া, এই প্রত্যাশার প্রতিতুলনায়। এদেশে কর্মের অভাব শিক্ষিত যুবকদের কাছে আরো অসহ্য। শিল্পোন্নত দেশের জীবনযাত্রার ছবি এদেশে পৌঁছে গেছে, সেটা পাবার তৃষ্ণাও বেড়ে চলেছে। এইসব অসামঞ্জস্যের ফলে আজকের যুবকের ব্যর্থতা আরো বেশি মানসিক পীড়াদায়ক ও মূল্যক্ষয়ী।

কম বয়সে যে-ছেলেরা অতিবিপ্লবী, নকশালপন্থী, তারাই পরে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত, এমন উদাহরণ অল্প নয়। ব্যাপারটা একই সঙ্গে করুণ ও হাস্যাস্পদ মনে হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজের একটা প্রধান অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রতিফলিত। পৃথিবীর প্রায় দরিদ্রতম দেশের কৃষিঅর্থনীতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে বিশ্বসচেতন এক মধ্যবিত্ত। নকশাল ছেলেরা অন্তত একটা কথা মনে হয় অন্য অনেকের চেয়ে গভীরভাবে অনুভব করেছে। এদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে দারিদ্র ও বেরোজগারি। যতদিন এমন নির্মম ও ব্যাপকভাবে টিকে থাকবে ততদিন শহরেও বেকারি দূর করা যাবে না। গ্রামোন্নয়নের কাজটা কঠিন, তবু এর বিকল্প নেই।

অনেকে দুঃখ করে বলেন, পুরনো প্রজন্মের সমানে একটা গৌরবময় ঐতিহাসিক কাজ ছিল, জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, আদর্শবাদী যুবকদের যেটা আকৃষ্ট করেছে; কিন্তু আজকের যুবকদের উদ্বুদ্ধ করবার মতো বড় কাজ নেই। কথাটা মেনে নিলে আদর্শনিষ্ঠার শক্তিকে অস্বীকার করা হয়। একটা অতি জরুরী অতি মূল্যবান কাজ, এদেশের গ্রামে গ্রামেই সাজানো আছে। গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য গত দশ-বিশ বছরে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ অনেক বেড়েছে। সেই বরাদ্দ টাকার অনেকখানি নষ্ট হচ্ছে লোভী অথবা দায়িত্বহীন ব্যবসায়ী, আমলা ও অন্যান্য মধ্যবর্তীদের কার্যকলাপের ফলে। গ্রামোন্নয়নের জন্য যে কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন সেটা শুধু সরকারী উদ্যোগে টাকা ঢেলে সম্পন্ন করা যাবে না। সে জন্য আরো চাই, অন্য এক সমাজবোধ এবং স্থায়ী গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গী। অতীতের সব কাজের চেয়ে এটা আরো বড় কাজ, আদর্শনিষ্ঠার আরো বড় পরীক্ষা।

মধ্যবিত্তের সমস্ত শক্তি ও প্রতিশ্রুতি কি ভোগের আকাঙ্ক্ষা আর ক্ষমতার কলহেই নিঃশেষ হয়ে যাবে? প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে এসে বিজ্ঞানের কৃতী ছাত্র সুজিত সিংহ আটঘরা গ্রামীণ বিকাশকেন্দ্রের কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। এইখানে পাওয়া যেতে পারে অন্য এক সম্ভাবনার ইঙ্গিত। একদিকে পল্লীসংগঠন আর অন্যদিকে জাতপাতের সীমানা ভেঙে সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর মৌল পুনর্গঠন, এই দুটি কাজে নতুন প্রজন্মের জন্য এমন এক চ্যালেঞ্জ ইতিহাস স্থাপিত করেছে যেটা দুরূহ সুযোগ ও গৌরবে অতুলনীয়। মধ্যবিত্ত নিজেকে স্থায়ী মূল্য দিতে পারে শুধু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সীমানা ভেঙে ফেলে। দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *