1 of 2

৩.১৯ দ্বন্দ্বের রূপভেদ

৩.১৯ দ্বন্দ্বের রূপভেদ

মানুষে মানুষে বৈরসম্পর্কের মূল কোথায়? এ প্রশ্নের নানারকম উত্তর আছে। যে উত্তরটা সাম্যবাদী চিন্তার প্রভাবে অনেকের কাছে অল্পবেশি পরিচিত, সেটা সহজ ভাষায়। এইরকম। আমরা ইতিহাসের পাতায় যেসব সমাজের বৃত্তান্ত পড়ি সেসবই দুই শ্রেণীতে। বিভক্ত। একশ্রেণী প্রচলিত উৎপাদন ব্যবস্থায় কার স্থানে অধিষ্ঠিত, অন্যশ্রেণী কর্তার অধীনে কায়িক শ্রমে নিযুক্ত। বিরোধের মূল এইখানে। সারা ইতিহাস জুড়ে বিস্তৃত এই দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্ব। কথাটা আরো একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক।

জীবনধারণের জন্য মানুষের কিছু ভোগ্যবস্তু প্রয়োজন। শিকার অথবা গাছের ফল আহরণ করেই যখন জীবনধারণ করা যেত তখন ব্যাপারটা জটিল ছিল না। কিন্তু ক্রমে উৎপাদনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটল। আবশ্যক হল উৎপাদনের জন্য বিশেষ উপকরণ। এইসব উপকরণের ওপর যাদের কর্তৃত্ব বা মালিকানা তারাই মালিক-শ্রেণী। উৎপাদনের কাজে যন্ত্রপাতির গুরুত্ব গত কয়েক শ বছরে অনেক বেড়েছে। জমির ওপর মালিকানা আরো আগেই এসে গেছে। মূলধন ছাড়া উৎপাদনের সুযোগ সম্ভাবনা, আমাদের পরিচিত সমাজে, খুবই সংকুচিত। অথচ মূলধন অল্প কিছু মানুষের আয়ত্তে। অধিকাংশের মূলধন নেই, আছে শ্রমশক্তি। এরাই শ্রমিকশ্রেণী। মূলধনের মালিকানার জোরে ধনিক শোষণ করে শ্রমিককে। মানুষে-মানুষে বৈরসম্পর্কের মূল এইখানে। এই মতবাদ আজকাল আমাদের এতই পরিচিত যে অধিক ব্যাখ্যা সম্ভবত নিষ্প্রয়োজন।

একটা প্রশ্ন উঠতে পারে উৎপাদনের উপকরণের ওপর কিছু মানুষের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হল কী করে? নানাভাবেই সেটা ঘটেছে নানা যুগে। কোনো এক সময়ে অশ্বারোহী যোদ্ধারা নতুন দেশ জয় করে নিয়েছে; রাজত্ব স্থাপন করেছে; রাজস্বসংগ্রহের জন্য কোনো-না-কোনো প্রকারে ভূমির ওপর অধিকার কায়েম করে নিয়েছে। দস্যু হয়ে উঠেছে রাজা; বীরভোগ্যা বসুন্ধরা কথাটার পিছনে প্রচ্ছন্ন আছে এইরকমের কিছু ইতিহাস। অন্য এক যুগে বণিকেরা অর্থবান হয়েছে বাণিজ্যের পথে। আমরা জেনেছি, বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী। এইভাবে ধাপে-ধাপে ধনিকশ্রেণীর চরিত্রে ও গঠনে পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। আর সেই সঙ্গে শ্রেণীদ্বন্দ্বেরও আকৃতিপ্রকৃতি বদলে চলেছে। তবু দ্বন্দ্বটা সবসময়ই শোসক ও শোষিতের মধ্যে।

কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর শুরুতেই আছে এই দৃপ্ত ঘোষণা ‘The history of all hitherto existing society is the history of class struggles. Freeman and slave, patrician and plebian, lord and serf, guild-master and journeyman, in a word, oppressor and oppressed, stood in constant opposition to one another. …The modern bourgeois society that has sprouted from the ruins of feudal society has not done away with class antagonisms. It has but established new classes, new conditions of oppression, new forms of struggle in place of the old ones.’ এখানে ইতিহাসজোড়া দ্বন্দ্বের ছবি তুলে ধরা হয়েছে, তাতে শ্রেণীদ্বন্দ্বের মানেই হল শোষকের সঙ্গে শোষিতের সংগ্রাম। অতীতের বহু দ্বন্দ্বের উল্লেখের পর মাকস্ বলছেন, সামন্ততন্ত্র ধ্বংস হয়েছে, বুর্জোয়াসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু শ্রেণীসংগ্রামের অবসান। ঘটেনি। শোষণ ও দ্বন্দ্ব নতুন আকারে দেখা দিয়েছে।

একটা ব্যাপার লক্ষ করবার যোগ্য। বুর্জোয়া বা ধনতান্ত্রিক সমাজের দুই বিরোধী শ্রেণী হল, ধনিক ও শ্রমিক। এরাই শোষক ও শোষিত, প্রধান দ্বন্দ্বটা এদের মধ্যে। আর এই দ্বন্দের ভিতর দিয়েই জন্মলাভ করবে সমাজতন্ত্র, যা ক্রমে পরিণতিলাভ করবে পরিপূর্ণ সাম্যবাদী সমাজে। এই ছিল মার্কস্ ও মার্কপন্থীদের অনুভব ও আশা। সামন্ততন্ত্রে শোষক ও শোষিত শ্রেণীকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘লর্ড এবং ‘সার্ফ এই দুটি শব্দ দিয়ে, দেশী ভাষায় রাজা এবং প্রজা। তবে প্রজা শব্দটা বেশি ব্যাপকবশেষ অর্থে ভূমিদাস কথাটা ব্যবহার করা হয়। একদিকে ভূম্যধিকারী, অন্যদিকে ধূস। এই দুই শ্রেণীর ভিতর দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু এই দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই সামন্ততন্ত্র পরিণতিলাভ করেছে এমন ঠিক বলা যায় না। আরো একটা বিরোধ ঐ পালাবদলের পর্যায়ে বড়ো হয়ে দেখা দেয়। সেটা হল সামন্ততান্ত্রিক অভিজাতশ্রেণীর সঙ্গে উঠতি বণিকশ্রেণীর বিরোধ। এটাও শ্রেণীদ্বন্দ্ব বটে। কিন্তু এটা কি শোষক ও শোষিত শ্রেণীর দ্বন্দ্ব?

ভূম্যধিকারী ও ভূমিদাসের ভিতর সম্পর্কটা যেমন সোজাসুজি শোষক শোষিতের সম্পর্ক, রাজন্যবর্গের সঙ্গে বণিকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক সেইরকম নয়। বণিকের আয় বাণিজ্য থেকে, বড়ো বণিকের আয় অনেক সময় বহিবাণিজ্য থেকে, সরাসরি ভূমি থেকে নয়। ভূমিদাসকে কম দিয়ে ভূম্যধিকারী বেশি পায়। কিন্তু বণিকের আয় বেশি কিংবা কম হবে সেটা বহিবাণিজ্যের আরো অন্যান্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। আসলে অভিজাতশ্রেণীর সঙ্গে বণিকশ্রেণীর সম্পর্কটা অংশত বিরোধী, আবার অংশত পরিপূরক। রাজন্যবর্গ বণিকশ্রেণীকে বাড়তে দিয়েছে, আবার আটকেও দিয়েছে। বণিকের হাতে যে ধন সঞ্চিত হয় তার কিছুটা রাজার হাতে চলে আসে, এইখানে রাজার লাভ। আবার বণিক বেশি শক্তিশালী হলে রাজার শক্তি খর্ব করার আশঙ্কা দেখা দেয়। বণিক ও ভূম্যধিকারীর ক্ষমতা ও আয়ের উৎস এক নয়, যদিও তারা পরস্পর জড়িয়ে গেছে।

বাণিজ্য ক্রমে শিল্পের পথ উন্মুক্ত করেছে, বণিক হয়ে উঠেছে ক্ষেত্রবিশেষে শিল্পপতি। উৎপাদিকাশক্তির ঐতিহাসিক বিকাশে বণিকশ্রেণী দেখা দিয়েছে প্রাগ্রসর ভূমিকায়। সামন্ততন্ত্র এই আর্থিক বিকাশের পথে হয়েছে বন্ধনবিশেষ। পশ্চিম ইয়োরোপের ইতিহাসে সামন্ততন্ত্রকে ভাঙবার কাজে বণিকশ্রেণীর ভূমিকা এই দিক থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

আমরা তা হলে দুরকমের বিরোধের সন্ধান পাচ্ছি। এক হচ্ছে শোষক ও শোষিতের ভিতর বিরোধ, সামন্ততন্ত্রে যার প্রধান ও স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যাবে ‘লর্ড’ এবং ‘সার্ফ-এর ভিতর সম্পর্কে। দ্বিতীয় বিরোধ হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত উৎপাদনব্যবস্থার সঙ্গে বিকাশশীল উৎপাদিকাশক্তির। মার্কসের চিন্তাভাবনায় দুই ধরনের বিরোধের কথাই আছে। কিন্তু এরা বাস্তবে অভিন্ন নয়। সামন্ততন্ত্রের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ছিল; কিন্তু বিকাশশীল উৎপাদিকাশক্তির পতাকা ছিল না ভূমিদাসের হাতে, ছিল বণিক অথবা বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতে।

শোষিত শ্রেণীও অবশ্য অবস্থাবিশেষে আর্থিক বিকাশের সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাগ্রসর পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণীর এইরকম একটা ভূমিকার কথা চিন্তা করা হয়েছে। এটাই একমাত্র পথ এমন কথা ইতিহাসের বিচারে বলা যাবে না। তবুও মার্কসীয় ভাবনার আবেদন অস্বীকার করা যায় না। শোষিত শ্রেণীই প্রগতির যাত্রায় সবচেয়ে সার্থক ভূমিকা নির্বাহ করবে, এর চেয়ে তৃপ্তিদায়ক চিন্তা আর কী হতে পারে! তবে ঐ ভূমিকানিবাহের জন্য একটা সাংস্কৃতিক প্রস্তুতিপর্বের ব্যাপারও আছে। সেটা উপেক্ষা করলে ইতিহাস অনেক মূল্য আদায় করে ছাড়ে। বিল্পব জয়যুক্ত হয়; ধনিক সম্পত্তি হারায়; তবু সেই চেতনা অধরা থেকে যায় যাকে বাদ দিয়ে মুক্তসমাজ অসম্ভব।

.

(খ)

শ্রেণীদ্বন্দ্বই মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের একমাত্র রূপ নয়। “ভারতবর্ষের ইতিহাস চচা” প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন : ‘আমাদের প্রাচীন ভারতে অসামঞ্জস্য রাজায় প্রজায় ছিল না, সে ছিল এক জাতিসম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য জাতিসম্প্রদায়ের।’ স্বীকার করে নেওয়াই ভালো যে, অসামঞ্জস্য রাজায় প্রজায়ও ছিল। সব রাজাই প্রজাবৎসল এবং নায়পরায়ণ ছিলেন না, আর একথা রবীন্দ্রনাথও জানতেন। কিন্তু উদ্ধৃতিটি উল্লেখযোগ্য অন্য কারণে। ইতিহাসে–শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের ইতিহাসেই, আর ভারত তো একটি ছোটোখাটো বিশ্ববিশেষ–যেসব সংঘর্ষ আমরা দেখি তার অনেকটাই এক জাতিসম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য জাতিসম্প্রদায়ের। মানুষের সমাজে বিভেদ ও দ্বন্দ্ব আছে শুধু শ্রেণীতে শ্রেণীতে নয়, জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়েও বটে।

প্রাচীন সমাজে ব্যক্তির পরিচয় ছিল জাতি অথবা সম্প্রদায়ের অংশ হিসেবে। ভিন্ন ভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের আছে ভিন্ন ভিন্ন আচারবিচার সংস্কৃতি। এখনও বিশেষত পল্লীসমাজে ব্যক্তির এই জাতিগত পরিচয়টাই মুখ্য। শহরে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। পৃথিবীর সেইসব বড়ো নগরে যেখানে ব্যবসায় ও শিল্পই প্রধান, ব্যক্তির সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত পরিচয় হয়তো কিছু পরিমাণে তার গুরুত্ব হারায়। গড়ে ওঠে অন্য এক নাগরিক সংস্কৃতি, বহুজাতির মিশ্রণ ও দ্রুত কর্মপ্রবাহের ভিতর দিয়ে। ব্যক্তির জাতিগত পরিচয়কে অতিক্রম করে যাবে তার শ্রেণীগত পরিচয়, এই সম্ভাবনা পল্লীতে ততটা নয় যতটা নাগরিক পরিবেশে। অর্থাৎ, শ্রেণীপরিচয়কে প্রাধান্য দিয়ে ইতিহাস লিখবার ঝোঁকটা মিলে যায় নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। কিন্তু আজও সেটা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নয়। এমনকি নগরেও জাতীয়তাবাদ এক প্রবল শক্তি। আমাদের শতাব্দী জুড়ে এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। ফ্রান্স ও জার্মানির ভিতর যখন যুদ্ধ বাধে তখন, দীর্ঘ বৈল্পবিক ঐতিহ্য সত্ত্বেও, পারীর শ্রমিক হাত মিলায় না বের্লিনের শ্রমিকের সঙ্গে বরং জাতীয় সংহতিই প্রবলতর শক্তি হিসেবে কার্যকরী হয়। রুশ ও চীনদেশের ভিতর দ্বন্দ্বে মস্কো ও বেজিং জাতীয়তাবাদকে অতিক্রম করে যেতে পেরেছে কই?

মানুষের ইতিহাসে যত রক্তপাত ঘটেছে কিংবা তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে জাতিতে জাতিতে সংঘর্ষে, ধর্মযুদ্ধে’ আর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কিংবা বর্ণবিদ্বেষে, তার তুলনায় শ্রেণীসংগ্রামকে অতি বড়ো প্রাধান্য দিতে গেলে ঘটনার সঙ্গে থিওরির সঙ্গতি থাকে না। অবশ্য এক ‘জাতিসম্প্রদায়ের সঙ্গে অন্য জাতিসম্প্রদায়ের যে সংঘর্ষ তার পিছনেও কিছু আর্থিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব খুঁজে পাওয়া যায়। তবু রাজনীতির ভাঙাগড়া শুধু শ্রেণীতে-শ্রেণীতে দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে আর্থিক দ্বন্দ্বের অধিক আরো কিছু থাকে। শ্রেণীদ্বন্দ্বের সঙ্গে যখন মিশে যায় সাম্প্রদায়িকতা তখন তার ফলাফল হয় আরো বীভৎস, আর সেই সঙ্গে দ্বন্দ্বের গতিপ্রকৃতিও বদলে যায়।

যেমন ধরা যাক আমাদেরই জীবকালের কিছু কিছু ঘটনা, ভারতবিভাগ, পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ভিতর লড়াই ও তার পরিণতি, আরব-ইস্রায়েল যুদ্ধ। অবিভক্ত ভারতে হিন্দু ও মুসলমান মধ্যবিত্তের মধ্যে যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ছিল সেটা ভারতবিভাগের একটা কারণ বটে। কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের ব্যাপারটা যোগ না হলে ভারতবিভাগ হত বলে মনে হয়। না। ধর্মান্ধতাই শ্ৰেণীস্বার্থের দ্বন্দ্বকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত করেছিল। তা নইলে ইতিহাসের অন্য গতি হত।

জাতিগঠনে ভাষার প্রভাব বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। কোথাও সেটা গড়বার শক্তি, কোথাও ভাঙবার। আমাদের সাম্প্রতিক ইতিহাসের অভিজ্ঞতার অংশ এইসব। আসাম থেকে সিন্ধুদেশ পর্যন্ত এই উপমহাদেশে তার উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। ভালোমন্দ নিয়ে তর্ক সম্ভব, কিন্তু দ্বন্দ্বের ওপর ভাষাভিত্তিক সংহতিবোধের প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তান শোষণ করেছে পূর্ব পাকিস্তানকে। ভাষার ব্যবধান যদি না থাকত তবুও কি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ দাবি করত স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের অধিকার? ভাষাই কি বাংলাদেশের দাবিকে দেয়নি এক স্বতন্ত্র মর্যাদা ও প্রেরণা?

কিংবা ধরা যাক বর্ণবিদ্বেষের প্রশ্নটি। মার্কিন দেশে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় দরিদ্র। তবু বর্ণবিদ্বেষের একটা আলাদা চেহারা আছে, বিশেষ আকৃতিপ্রকৃতি আছে, যেটাকে কিছুতেই শ্রেণীসংগ্রামের সঙ্গে মেলানো যায় না। দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ ও দরিদ্র কৃষ্ণাঙ্গ তো বর্ণের বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় না। আসলে মানুষের মনের গভীরে আছে অন্য এক তামসিক শক্তি, আছে সাংস্কৃতিক সংহতিবোধও, পরস্পর যেসব জড়িয়ে যায় আর শ্রেণীস্বার্থের সাধারণ হিসেবকে ছাড়িয়ে যায়।

মানুষ যে স্বভাবত নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত সেকথা ভারতে বসে সহজে বোঝা যায় কারণ এটা বহুদেবদেবীর দেশ। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বিভিন্ন দেবতাকে প্রধান স্থান দিয়েছে। এইসব বহুত্বের পিছনেও ঐক্যের ধারণা আছে একথা আমরা জানি এবং মানি। তবু বহুত্বটা মিথ্যা নয়। সামাজিক জীবনে পদে পদে তার বাস্তবতা অনুভব করা যায়। গোষ্ঠীজীবনের চারধারে আচারবিচারসংস্কৃতির একটা সীমানা আঁকা হয়ে যায়। বিবাহ থেকে রাজনীতি অবধি সর্বত্র তার প্রভাব প্রশ্নাতীত। গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে বেষ্টন করে গড়ে ওঠে একটা সামাজিক সংহতি, সামূহিক “অহং”। তাত্ত্বিকভাবে মানুষের ঐক্য স্বীকৃত হলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যুথবদ্ধ “অহং” প্রবলভাবে উপস্থিত।

সম্প্রদায় থেকে সম্প্রদায় পৃথক। কিন্তু পার্থক্য মানেই অনিবার্য দ্বন্দ্ব নয়। দ্বন্দ্বের জন্য আরো কিছু শর্ত আবশ্যক। একাধিক গোষ্ঠী যখন এমন কিছু বস্তু আকাঙ্ক্ষা করে যার পরিমাণ সীমাবদ্ধ, অর্থাৎ কোনো একদল বেশি পেলে অন্যদলের জন্য কম অবশিষ্ট থাকে, আর এইসব গোষ্ঠী যখন একই ক্ষেত্রের ভিতর অবস্থান করে, তখনই এদের ভিতর দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা দেখা দেয়। আকাঙ্ক্ষার সীমাবদ্ধ বস্তু বলতে ধন, ক্ষমতা, খ্যাতি সবই বোঝাতে। পারে। ক্ষমতা অথবা খ্যাতি যদিও ধনের মতো জড়বস্তু নয় তবু তা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভব, কারণ একদলের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে অন্যদলের ক্ষমতা কমে। খ্যাতির আকাঙ্ক্ষাটাও ঐরকম, যদিও জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা ভিন্নরকম। আমার জ্ঞানবৃদ্ধিতে দ্বিতীয় কারো জ্ঞান কমে যাচ্ছে না। কিন্তু যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব প্রবল সেখানে একজনের খ্যাতির ছটায় অন্যের ঔজ্জ্বল্য কমে। পণ্ডিতদের মধ্যেও তাই দ্বন্দ্বের অভাব নেই।

যারা সমক্ষেত্রে আশ্রিত তাদের ভিতরই দ্বন্দ্ব সম্ভব। যদি একব্যক্তি আদার ব্যবসায়ী হয়, অন্যব্যক্তি জাহাজের, তবে তাদের ভিতর দ্বন্দ্বের সম্ভাবনা কম; দুজন জাহাজের ব্যবসায়ীর ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনা বেশি। যদি একজন হয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রে খ্যাতির আকাঙ্ক্ষী, অন্যজন শল্যচিকিৎসার ক্ষেত্রে, তবে বিরোধের প্রশ্ন ওঠে না; দুজন সঙ্গীতজ্ঞের মধ্যে কিন্তু পারস্পরিক ঈষা সম্ভব। রৌপ্যের সন্ধানে একাধিক ইয়োরোপীয় দেশ যখন একই পথে ধাবিত হয় তখন দ্বন্দ্বের আশঙ্কা বেড়ে যায়। ভিন্ন ভিন্ন দেশের যখন উৎপাদনের ক্ষেত্র ভিন্ন, বাজারও ভিন্ন, তখন সংঘর্ষের আশঙ্কা অপেক্ষাকৃত কম।

প্রাচীন কালে বিভিন্ন দেশের ভিতর দূরত্ব বেশি ছিল। ক্রমে পৃথিবীটা ছোটো হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে বিরোধী স্বার্থের ভিতর সামঞ্জস্যবিধানের সমস্যা কঠিন হয়েছে। কোনো এক সময়ে সমাজের ভিতর বিভিন্ন বর্গের আকাঙ্ক্ষার বস্তু বিভিন্ন ছিল, সামাজিক আচার ও ঐতিহ্যই তাদের ভিতর দূরত্ব রচনা করে দিয়েছে। ফলে তাদের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সচরাচর দেখা যেত না, যেমন ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের ভিতর প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব ছিল বিরল। ক্রমে সমাজের ভিতর এসব দূরত্ব ভাঙতে শুরু হল, সেই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তীব্র হল। ভৌগোলিক এবং সামাজিক দূরত্ব হ্রাস পাবার সঙ্গে সঙ্গে দ্বন্দ্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। সব রকমের বিরোধের ওপরই এর প্রভাব এসে পড়েছে। যে-বিরোধ একদিন ছিল উহ্য, আজ সেটা হয়ে উঠেছে ব্যক্ত এবং ক্রমপ্রসারী, এমনকি বিস্ফোটক।

.

(গ)

ক্ষমতার দ্বন্দ্বের গতিপ্রকৃতি ধর্মের মতোই সূক্ষ্ম। ক্ষমতাবান শ্রেণীর ভিতরে যে অন্তদ্বন্দ্ব চলে ইতিহাসে তার প্রভাব তুচ্ছ করবার মতো নয়। সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে যে বিরোধ তারও সহজ ব্যাখ্যা সব সময় খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্ধ সংস্কারের শক্তি কম নয়। রাজনীতি সম্পূর্ণ অর্থনীতির অনুসারী নয়। সম্পত্তি যেখানে আপাতদৃষ্টিতে বিরোধের কারণ সেখানেও বিদ্বেষের আরো গুপ্ত শিকড় থাকে অর্ধস্মৃতির অন্ধকারে। কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধের শেষে যখন কোনো পক্ষেরই উল্লসিত হবার মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তখন অগত্যা মেনে নিতে হয় যে, দ্বন্দ্বের উৎপত্তি ও পরিণতি কিছুই সম্পূর্ণ যুক্তির পথ ধরে ঘটে না। সব মিলিয়ে সামাজিক দ্বন্দ্ব এমন বৈচিত্র্যে চিহ্নিত যে তাকে একটা তত্ত্বের মধ্যে বাঁধা বড়ো কঠিন। অতি সরলীকরণে কিছু মিথ্যা প্রত্যাশা আর ভুল উৎসাহ জাগায়।

তবু সমাজবিজ্ঞানীর জন্য কার্যকারণ অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া গতি নেই। বহুমুখী ব্যাখ্যায় বাস্তবের খানিকটা কাছাকাছি আসা যায়। তা ছাড়া তত্ত্বকে বারবার পরিবর্তনশীল কালের সঙ্গে যুক্ত করে বদলে নেওয়া প্রয়োজন। সময়ে সামাজিক বন্ধনের প্রকারভেদ ঘটে, ক্ষমতারও চরিত্র বদলায়।

অল্প কিছু মানুষের অনেক মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণের একটি উপায়ের কথা মার্কসবাদে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, সেটা মূলধন অথবা উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিবিশেষের মালিকানা। কিন্তু অন্য উপায়ও আছে। ব্রাহ্মণের ক্ষমতা মূলধনের মালিকানার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। যে-অশ্বারোহীরা দেশজয়ে বেরিয়েছিল তাদের ক্ষমতার উৎস ছিল অস্ত্রশক্তি। এ যুগে বড়ো-বড়ো দল ও প্রতিষ্ঠানের নেতাদের ক্ষমতার মূলে দেখা যায় সাংগঠনিক শক্তি। ধনদৌলত মালিকানা সবই ক্রমে এসে যায়; কিন্তু শুরু সেখানে নয়। আরম্ভে আছে অন্য কোনো দক্ষতা। একবার সম্পত্তি লাভের পর কিছুদূর পর্যন্ত সম্পত্তির জোরেই সম্পত্তি রক্ষা করাও যায়। কিন্তু শক্তির অন্য কোনো উৎস না থাকলে সম্পত্তি হারাতেও খুব বেশি সময় লাগে না।

ব্যক্তিগত মালিকানাই সমাজে ক্ষমতার অসাম্যের মূল কারণ–এইরকম মতবাদ ধনতান্ত্রিক সমাজের বিশ্লেষণে কাজে লাগে। সেদিক থেকে এর মূল্য আছে। কিন্তু বিশ শতকরে অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে আরো কিছু জিজ্ঞাসা জাগে, যার উত্তর মার্কসবাদের পরিধির ভিতর খুঁজে পাওয়া কঠিন। বেট্র্যাণ্ড রাসেল অথবা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো মনীষীদের কথা এসে যায় এইখানে। এই শতাব্দীর সাম্যবাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঙ্গে এঁরা পরিচিত ছিলেন। সন্দেহ নেই যে, এঁদের কিছু প্রশ্নের উদ্ভব এই পরিচয়ের সূত্র ধরেই। প্রশ্ন শুধু এদেরই না, প্রশ্ন এই যুগের।

সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের নামে যে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবীর অনেকটা জায়গা জুড়ে গড়ে উঠেছে সেখানে আজও এত ক্ষমতার অসাম্য কেন? মানবিক অধিকারের সেখানে এত অভাব কেন? ব্যক্তিগত মালিকানার পুরনো লজ দিয়ে কি এর ব্যাখ্যা হয়? এদেশের সাম্যবাদীরা এসব প্রশ্নে তেমন পীড়িত নন, ধনতন্ত্রকে দোষ দিয়েই তাঁরা খালাস। কিন্তু বিচলিত সোভিয়েত দেশের নতুন প্রজন্মের ভুক্তভোগী মানুষ। চিন্তিত উনিশ শ’ আশির দশকে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত নেতা গর্বাচেভ। আলোড়িত চীনদেশের মানুষ। এঁরা কিন্তু বিদেশী ধনতন্ত্রের ওপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে আর নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না।

আজকের সাম্যবাদী দেশগুলিতে উৎপাদনের উপকরণের মালিক কারা? জনগণ? আমলাবর্গ? ব্যক্তিগত মালিকানা কথাটার একটা স্পষ্ট অর্থ ছিল। আমলাগোষ্ঠীকে মালিক বলা যাবে কোন্ অর্থে? সমাজকে মালিক বললেই বা কার্যত তার অর্থটা কী দাঁড়াচ্ছে? ক্ষমতার বিশ্লেষণে নতুন চিন্তার প্রয়োজন। আর তার মানে দ্বন্দ্বের বিশ্লেষণেও নতুন চিন্তা চাই। সাম্যবাদী সমাজের ভিতর দ্বন্দ্বের চরিত্র কী? সেখানেও দ্বন্দ্বের বাস্তবতা সম্বন্ধে অন্ধ থাকলেই তো আর দ্বন্দ্ব বন্ধ হয় না।

প্রত্যেক যুগই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে কিছু প্রশ্ন নিয়ে ইতিহাসের দিকে তাকায়। মার্কস্ তাঁর নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে এই কাজটা করেছিলেন। এযুগের প্রাগ্রসর চিন্তকেরাও তাই করবেন। তাঁরা ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়াবেন নতুন প্রশ্ন নিয়ে, আশা করবেন নতুন উত্তর। মার্কসের মানবতাবাদ আর নবমানবতাবাদ কি অভিন্ন?

.

(ঘ)

ক্রোধ দিয়ে যেমন ক্রোধকে জয় করা যায় না, শুধু দ্বন্দ্ব দিয়ে তেমনি অতিক্রম করা যায় না দ্বন্দ্বকে। ইতিহাস যদি মানুষকে শুধু দ্বন্দ্বেরই শিক্ষা দিত তবে তা থেকে বেরিয়ে আসার শিক্ষা পাওয়া যেত না ইতিহাসে। বাস্তবে দ্বন্দ্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে তার এক বিপরীত ভাব, দ্বন্দ্বেরও সীমানা টেনে দিয়ে।

জাতি ও সম্প্রদায়ের ভিতর বিরোধের পাশে পাশেই চলে সহযোগিতা। বিরোধ ও সহযোগিতা মিলেমিশে থাকে। কখনো একটার প্রাধান্য কখনো অন্যটার। এর স্পষ্ট উদাহরণ পাওয়া যাবে বাণিজ্যে। আন্তজাতিক বাণিজ্যে বিভিন্ন জাতির ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। কিন্তু বাণিজ্য একেবারে বন্ধ হয়ে গেলে দুই পক্ষেরই ক্ষতি। মানুষের অনেক কলহই এরকম। প্রতিবেশীকে ছাড়া চলে না, আবার তার সঙ্গেই ঝগড়া। কলহের কথাগুলি অনেক সময় বড়ো হয়ে ওঠে। সহযোগিতার সুবিধাগুলিতে আমরা নিঃশব্দে অভ্যস্ত হয়ে যাই। আর সেইজন্যই তার মূল্য সম্বন্ধে সব সময় সচেতন থাকি না।

শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্রে হঠাৎ মনে হতে পারে যে, দুই বিরুদ্ধ শ্রেণীর ভিতর স্বার্থের কোথাও মিল নেই। অথচ এই চিন্তাটা ভুল। এই মুহূর্তে সেই আবিষ্কারটা নতুন ভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে গর্বাচভের কিছু ভাবনাচিন্তায়। বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সত্য বিশেষ রূপ নিয়ে দেখা দেয়। বিশ্বের আজ পরম প্রয়োজন শান্তি। শেষ বিচারে এটা সকলের পক্ষেই কাম্য। বৃহৎ শক্তিদের ভিতর যতই দ্বন্দ্ব থাকুক না কেন, যুদ্ধবাজদের কাছে যুদ্ধ যতই আকর্ষণীয় মনে হোক না কেন, একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, বিশ্বযুদ্বের আজ পরিণাম হবে মানুষের সভ্যতার সার্বিক বিনাশ। এই সার্বিক বিনাশে কোনো শ্রেণীরই স্বার্থসিদ্ধির প্রশ্ন ওঠে না। আমরা যে যে-শ্রেণী অথবা সম্প্রদায়ের অনুগত হই না কেন, মানুষকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো সব মানুষেরই সাধারণ স্বার্থ। শ্রেণীসংগ্রামের নামেও এমন কোনো পদক্ষেপ যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না যার ফলে আন্তজাতিক শান্তি বিপন্ন হয়। উনিশ শতকে এই বিপদটা এত স্পষ্ট ছিল না, বিশ শতকের গোড়াতেও অবস্থা ঠিক এইরকম ছিল না। গর্বাচেভ আজ অহিংসার কথা যেভাবে বলছেন সেটা শ্রেণীসংগ্রামের পুরনো ভাষার সঙ্গে মেলে না। বৈপ্লবিক হিংসাই নতুন সমাজের ধাত্রী, এই রকমের কিছু ভাষা উত্তেজনার সঙ্গে উচ্চারণ করা তত অসঙ্গত ছিল না আগের দিনে। আজকের দিনে সব মানুষের সমস্বার্থের চিন্তাকে আরো স্পষ্ট করে স্থান দিতে হবে শ্রেণীসংগ্রামের পাশে পাশে। অপর পক্ষকে যুদ্ধবাজ বলাটাই যথেষ্ট নয়, আত্মসংযমের অভ্যাসটাও প্রয়োজন। তা নইলে শান্তিভাষণও রণহুঙ্কারের মতো শোনায়।

শান্তি চাই, কিন্তু নিষ্ক্রিয়তা নয়। সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন চাই। মানুষের ভিতর যে দ্বন্দ্ব আছে, দ্বন্দ্বের কারণ আছে, তাকে অস্বীকার করা নিবোধ সন্তুষ্টি। দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করবার চেষ্টাতেই সমাজেরও পরিবর্তন ঘটে। সমস্যা এই, বন্ধন ছিন্ন করতে গিয়ে নতুন বন্ধন সৃষ্টি হয়।

দ্বন্দ্বের নানা রূপ আছে। তবে অর্থ ও ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই প্রধান। আধুনিক সমাজের ঝোঁক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের দিকে। ধনতান্ত্রিক সমাজে ধনিকদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা কেন্দ্রীকৃত হয়েছে আমলাতন্ত্রের হাতে। নতুন সমাজে কোন্ পথে পৌঁছতে হবে আমরা স্পষ্ট জানি না। কিন্তু তার অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে মান্য, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। এই উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে উপায় উদ্ভাবন করতে হবে।

আধুনিক সমাজে ক্ষমতার যে কেন্দ্রীকরণ দৃশ্যমান, এ যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার সহায়ক হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণের জন্যও কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তাই চাই। কোথায় পাব তাকে? নবতম প্রযুক্তির কিছু নির্দেশ ইতিমধ্যেই বিকেন্দ্রীকরণের সপক্ষে। কিন্তু আরো গোড়ার কথাটা বলতে হয় অন্যভাবে। মানুষই স্রষ্টা, প্রযুক্তি তার সৃষ্টি, এই বোধ স্বাধীনতার শর্ত। অথচ মানুষের সভ্যতায় দেখেছি অন্য এক কাণ্ড, প্রযুক্তিই অন্ধভাবে চালিত করেছে মানুষকে, তার সমাজসংগঠনকে। এইখানে একটা পরিবর্তন চাই। মানুষের বুদ্ধিকে এমনভাবে সংগঠিত করা যাবে না কেন, যাতে মানুষের কাঙিক্ষত আদর্শের উপযোগী প্রযুক্তিই প্রাধিকার লাভ করে?

বলা বাহুল্য, সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার চরিত্রেরও পরিবর্তন আবশ্যক। আমাদের সমাজে ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে উচ্চাসন দেওয়া হয়েছে। এর ভিতর দিয়ে স্থাপিত হয় দক্ষতার নতুন নতুন রেকর্ড, কিন্তু বেড়ে ওঠে অমানুষিকতা। খুনে প্রবৃত্তি বলে একটা জিনিস খেলোয়াড়দের ভিতর পরিচিত, প্রতিপক্ষকে হারাবার জন্য নাকি এটার বিশেষ প্রয়োজন। মানুষের রক্তে যে আক্রমক তেজ সংক্রামিত, তার নিষ্কাশনের জন্য খেলাই অবশ্য উত্তম উপায়। তবু মনে রাখা প্রয়োজন, প্রতিপক্ষের পরাজয় নয়, শিক্ষার উদ্দেশ্য মনুষ্যত্বের গঠন আর তারই সঙ্গে সংস্কৃতির রূপান্তর।

শিক্ষাকে অতএব স্কুল-কলেজের ব্যাপার বলে আলাদা একটা প্রকোষ্ঠে সরিয়ে রাখা যাবে না। সংস্কৃতির রূপরে থাকে বহু মানুষের স্থান, যেমন শিল্পীর তেমনি। সমাজসেবকের। নতুন সংস্কৃতি গড়তে গিয়ে একবার তাকাতে হয় ভবিষ্যতের পানে, আবার ফিরে তাকাতে হয় পুরনো সংস্কৃতির দিকে, যার কিছুটা গ্রাহ্য। এই প্রেক্ষিতেই নববিচার ও রেনেসাঁসের কথা এসে যায়।

পুরনো সংস্কৃতিতে কেউ কেউ খুঁজে পান স্বর্ণযুগের আভাস, আবার কেউ কেউ দেখেন পরাক্রান্ত শোষক শ্রেণীর কপট স্বার্থের প্রতিবিম্ব। এসবই একতরফা বিচার। মানবেন্দ্রনাথ রায়ের একটি উক্তি এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি তখন মার্কসবাদী কিন্তু কট্টর মার্কসবাদের একদেশদর্শিতা থেকে তখনও অনেক পরিমাণে মুক্ত। ১৯৪১ সালে বোম্বাই রেনেসাঁস ক্লাবের এক সভায় মানবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, মানুষের চিন্তাভাবনার দুটি দিক আছে, একটি সাময়িক সময়ের সঙ্গে পরিত্যক্ত হয়, অন্যটি চিরকালীন। একই কথা দুবছর পর কলকাতা রেনেসাঁস ক্লাবের সভায় শুনি ‘There are two things in the past: the transitory values the glory of kings and monuments of ancient grandeur, traditions which persist as die-hard prejudices. On the other hand, there are the abiding, permanent human values which transcend time and space.’ বিল্পবোত্তর সমাজে, শ্ৰেণীযুদ্ধের অবসানের পর, মানবিক মূল্যবোধ হঠাৎ জন্মলাভ করে এমন নয়। মানবিক মূল্যবোধের একটা ধারা অতীত থেকে প্রবাহিত হয়ে ভবিষ্যতের দিকে চলেছে। অন্যায় অবিচারে অন্ধতায় যদিও সেই বোধ আচ্ছন্ন অথবা বিকৃত হয়, তবু লুপ্ত হয় না।

নানকের মতো কোনো ভক্ত সাধক যখন বলেন, না কোঈ বৈরী না কোঈ বেগানা। শগল জগৎ হমকো বন আঈ, তখন অতীত থেকে নিঃসৃত এমন একটি ভাবই আমাদের স্পর্শ করে যেটি সর্বমানবের ও সর্বকালের। ঐতিহ্যের নির্বিচার গুণগানে দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করা যায় না, কারণ ঐতিহ্যের ভিতরই আছে সেই প্রথাসিদ্ধ অবিচার, যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রয়োজন। আবার অতীতের সব চিন্তাভাবনাকে তুচ্ছ করে এগোবার চেষ্টাও বৃথা, কারণ উত্তরণের কিছু শর্ত, কিছু সহায়ক শক্তি, ঐখানে খুঁজে পাওয়া যাবে। এজন্য চাই গ্রহিষ্ণু জিজ্ঞাসু মন, দ্বেষহীন বিচার।

দ্বন্দ্বের পুরনো তত্ত্বে সমন্বয়ের পথ প্রশস্ত হয়নি। প্রতিপক্ষকে দোষী সাব্যস্ত করাই সেই তত্ত্বের প্রধান উদ্দেশ্য। সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে এটা স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে, শ্রেণীদ্বন্দ্বও ব্যতিক্রম নয়। দ্বন্দ্বের তত্ত্ব হয়ে উঠেছে দ্বন্দ্বের হাতিয়ার, যুদ্ধজয়ই লক্ষ্য। শিবিরবদ্ধ কার্যসিদ্ধিবাদ সংকটকেই স্থায়ী করে চলেছে। প্রতিটি যুদ্ধের ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অসহিষ্ণুতা, যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র। এই দুষ্টচক্র কী করে ভাঙা যায় সেটাই প্রশ্ন।

দ্বন্দ্ব ও উত্তরণ (১৯৮৯)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *