1 of 2

৩.১৭ নারী মুক্তি

৩.১৭ নারী মুক্তি

ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে, আমরা তা জানি না কিন্তু বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলনের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে এ যুগের নব প্রজন্মের আন্তরিক ঝোঁক ও আকাঙ্ক্ষা। এমন একদিন ছিল যখন এইসব উৎকাঙ্ক্ষার প্রভাব ছিল না ইতিহাসের গতির ওপর। কিন্তু এখনও কি তাই? যেমন ধরা যাক কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ মানুষের ভিতর সমান অধিকারের দাবী নিয়ে পৃথিবীর নানা অংশে, বিশেষত আফ্রিকায় ও মার্কিন দেশে, আজকের আন্দোলন। আর কতদিন একে অগ্রাহ্য করা। যাবে? অথবা বিশ্বশান্তির সপক্ষে বিশ্বজোড়া মানুষের আগ্রহ। শান্তিরক্ষা না পেলে সভ্যতাও টিকবে না। ভবিষ্যতের সমাজের পক্ষে এইরকমই গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। নারীমুক্তির আন্দোলন। এর ভিতর দিয়ে যে দাবী উচ্চারিত হয়েছে তাকে বেশিদিন উপেক্ষা করা যাবে না। সেটা যুদ্ধের মতো বিস্ফোরক নয়, কিন্তু অনেকদিনের সামাজিক ধ্যানধারণা ও অভ্যাসের সঙ্গে নতুন যুগের এই দাবীর বিরোধ আছে। সামঞ্জস্যের দিকে অগ্রসর হওয়া এক্ষেত্রে কঠিন তবু প্রয়োজন। তার আগে সমস্যাটা বুঝবার চেষ্টা করতে

নারীমুক্তি আন্দোলনে সাম্যের কথা বারবার শোনা গেছে, পুরুষের সঙ্গে সাম্য। কথাটার একাধিক অর্থে প্রয়োগ হয়েছে। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন অর্থ প্রধান হয়ে উঠেছে।

একটা সময় ছিল যখন মেয়েদের ভোটের অধিকার ছিল না। এই শতাব্দীর গোড়ায় নারী ও পুরুষের ভিতর সাম্যের দাবী বলতে এইটেই হয়ে উঠেছিল প্রধান কথা। এর ভিতর দিয়ে নারীর স্বতন্ত্র সত্তা একটা স্বীকৃতি পেল। এর আগে সমাজের ধারণা ছিল যে, পরিবারের পক্ষ থেকে গৃহকর্তা ভোট দিলেই তো হল, স্ত্রীর আলাদাভাবে ভোট দেবার প্রয়োজনটা কী? আজ এই প্রশ্নটা আর কেউ তোলে না। স্বাধীন ভারতে মেয়েদের ভোটের অধিকারের জন্য আলাদা আন্দোলনেরই প্রয়োজন হয়নি। সর্বসাধারণের জন্য ঐ অধিকার যেদিন প্রতিষ্ঠিত হল নারীও সেদিন থেকেই ভোটদানের অধিকারিণী বলে স্বীকৃত। শুধু ভোটের প্রশ্নেই নয়, এদেশের সংবিধানে আরো ব্যাপকভাবেই নারী ও পুরুষের ভিতর সাম্যের কথা আইনত স্বীকৃত হয়েছে। নাগরিক হিসেবে নারীর অধিকার পুরুষের সমান। নারী বলে কোনো ব্যক্তির অধিকার কেড়ে নেওয়া যাবে না, যদিও প্রয়োজনে নারীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া আইনবিরুদ্ধ নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রেও শুধু নারী বলেই কাউকে বঞ্চিত করা আইনসঙ্গত নয়। অর্থাৎ, মনুসংহিতায় যাই থাকুক না কেন, ভারতীয় সংবিধানে নীতিগতভাবে উভয় লিঙ্গের সমান অধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সংবিধান এক বস্তু আর সমাজের অভ্যস্ত আচরণ অন্য বস্তু। এদেশে এখনও বাপ-মা পুত্রসন্তান চায়, কন্যা চায় না। শুধু এদেশেই নয়, অন্যত্রও এটা দেখা গেছে। শিক্ষাদানের ব্যাপারে যদিও মেয়েদের সুযোগ ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে তবু এখনও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মেয়েদের ভিতর নিরক্ষরের সংখ্যা অনেক বেশি। অর্থাৎ বাপ-মা ছেলের সাক্ষরতাটাকেই বেশি জরুরী মনে করে। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পরিবারের ভিতর এমন কি খাদ্যের ব্যাপারেও ছেলেদেরই অগ্রাধিকার। চাকরির ক্ষেত্রে ও নিয়োগকতা অনেক সময় মেয়ে নিতে চায় না।

এ সবের পিছনে দুটি ধারণা প্রধানত কাজ করেছে। প্রথম কথা, পুত্ৰই পরিবারের প্রধান সহায়। বৃদ্ধ বয়সে ছেলের উপরই নির্ভর করতে হবে। মেয়ে তো অন্য বাড়ি চলে যাবে। পুত্রের ভিতর দিয়েই বংশ রক্ষা পায়। দ্বিতীয় কথা, সাধারণ মানুষ এখনও নারী ও পুরুষকে সামর্থ্যের দিক দিয়ে সমান মনে করে না। স্ত্রী যদিও আদ্যাশক্তি তবু পুরুষেরই সামর্থ্য বেশি। বাড়ির ভিতর গৃহিণী পটিয়সী, কিন্তু বাইরের বৃহত্তর জগতে পুরুষের যোগ্যতা বেশি। প্রকৃতিই নারী ও পুরুষকে অসমান করে গড়েছে। এই রকম ধারণা সমাজে প্রচলিত। আর এখান থেকেই তর্কের শুরু।

সামর্থ্যের দিক থেকে যদি নারী ও পুরুষ সমান না হয় তবে অধিকারের বেলাতেও শেষ অবধি তারা অসমানই থেকে যায়। অন্তত কাজেকর্মে সামর্থ্য কিংবা যোগ্যতার সঙ্গে অধিকারের সম্পর্ক স্বীকার করে নিতে হয়। প্ল্যাটোর যুগ থেকেই এইরকম একটা যুক্তির ভিত্তিতে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব, অতএব প্রাধান্য স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। দেহ যেমন আত্মার অধীন, দাস যেমন প্রভুর, নারীও তেমনি পুরুষের, প্লাতোনিক যুক্তিটা এইরকম।

অতএব নারীমুক্তির প্রবক্তাদের প্রত্যুত্তরটা শুরু হয় এইখান থেকেই। প্রকৃতির সূত্রে। নারী ও পুরুষের ভিতর কিছু পার্থক্য আছে ঠিকই। কিন্তু সেটাকে অযথা বাড়িয়ে দেখানো। হয়েছে। বৃহত্তর জগতের নানা কাজেকর্মে লিঙ্গভেদে যোগ্যতার কোনো স্বাভাবিক ভেদ নেই। সেখানে যে প্রভেদটা আমাদের চোখে পড়ে সেটা প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। সেটা সমাজের সৃষ্টি। দীর্ঘ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভেদে দেখা দিয়েছে নারী ও পুরুষের ভিতর। আপাতদৃষ্টিতে যোগ্যতার তারতম্য। যেহেতু দুই লিঙ্গের ভিতর এই তারতম্য প্রাকৃতিক নয় বরং সামাজিক, অতএব শিক্ষা ও সামাজিক সংগঠনের পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে ঐ অসাম্য দূর করা সম্ভব। যে কাজ পুরুষের পক্ষে সাধ্য নারীর পক্ষেও সেটা সাধ্যের অতীত নয়। এর বিপরীত ধারণার মূলে আছে শুধু রক্ষণশীল সমাজের বদ্ধ সংস্কার। নারী প্রবক্তাদের প্রত্যুত্তর শুরু হয় এইভাবে।

.

একথা স্বীকার্য যে, নারীকে যে রূপে আমরা পেয়েছি সেই নারী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, বরং বহু পরিমাণে সংস্কৃতির সৃষ্টি। মানুষমাত্রই তো তাই। সমাজ বস্তুটি সংস্কৃতি দিয়ে গঠিত। নারী ও পুরুষের তারতম্যের পিছনে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস যাকে উপেক্ষা করা যায় না। সমাজকে বদলাতে চাইলে তার ইতিহাস কিছুটা বুঝে নিতে হবে। নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা মানুষের পরিবারের ইতিহাস। এই প্রসঙ্গে দুচারটা কথা সংক্ষেপে স্মরণ করা যেতে পারে। এককালে খাদ্যের জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হত শিকারের উপর। দল বেঁধে পুরুষেরা শিকারে বেরোতো। পরে আরো বড় হয়ে উঠলো যুদ্ধ। সেখানেও পুরুষের ভূমিকাটাই প্রধান। স্ত্রীরা থাকতো ঘরে। ঘরে থাকবার কারণ সহজেই বোঝা যায়। অন্যান্য জীবের তুলনায় মানবীর গর্ভধারণের সময়টা দীর্ঘতর। মানব সন্তানের মাথার আয়তন দেহের তুলনায় বড়, ফলে মাতৃজঠর থেকে বেরোবার প্রক্রিয়া অন্যান্য জীবের চেয়ে একটু কঠিন। তা ছাড়া মানবশিশুর বড় হয়ে উঠতে সময় লাগে বেশি। অন্যান্য জীবের তুলনায় শিক্ষাকালটা চলে বেশিদিন ধরে। বানরের মস্তিষ্ক পূর্ণ আকার প্রাপ্ত হয় জম্মের ছ’মাসের ভিতর, মানুষের মস্তিষ্ক কিন্তু ছ’বছরেও পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। এইসব নানা কারণে প্রাচীন কাল থেকেই মানবজাতির স্ত্রীকে মাতৃত্বের দায় বহন করতে হয়েছে অন্যান্য জীবের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে।

এই যে পুরুষ শিকার আর যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত, স্ত্রীর প্রধান কাজ সন্তান পালন আর গৃহবিন্যাস, ইতিহাসের অতি দীর্ঘ যুগ ধরে এটা চলেছে। পুরুষ ও নারীর চেতনা ও। চরিত্রের গঠনের উপর এর প্রভাব পড়েছে অনিবার্যভাবে। পুরুষকে যে কাজটা করতে হয়েছে, যুদ্ধ ও শিকার, তাতে দয়ামায়ার স্থান কম। নারীকে যে কাজটা করতে হয়েছে, শিশুপালন, তাতে মায়া-মমতার স্থান বেশি। এরই ভিতর দিয়ে নারী ও পুরুষের চেতনা গঠিত হয়েছে, সংস্কৃতি রূপ লাভ করেছে। এ থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে বোঝা যায় না। দয়ামায়ার কথাটা বল হল উদাহরণ হিসেবে। নারীর ভিতর নির্দয়তা নেই এমন নয়। অবশ্যই আছে। কিন্তু যে কর্মবিভাগের কথা এইমাত্র বলা হল তে নারীর কর্মে দয়ার প্রয়োজন ছিল বেশি। তাই তার প্রকৃতির সেই দিকটা পুষ্টিলাভ করেছে, বেশি। যেমন দেহের যে পেশীটা ব্যবহার করতে হয় বিশেষভাবে সেটারই বৃদ্ধি ঘটে বেশি। মানুষের চিত্তবৃত্তির ক্ষেত্রেও সেইরকম একটা ব্যাপার আছে।

আরো কিছু নিয়ম ও নীতিবোধ একইভাবে গড়ে উঠেছে। পুরুষকে দিনের শেষে ঘরে ফিরতে হত। স্ত্রীর বিশ্বস্ততা তার কাছে দামী। ঘরে ফিরে স্ত্রীকে পাবে কিনা, না কি ইতিমধ্যে স্ত্রী অন্য কারো সঙ্গে প্রস্থান করেছে, এইরকম অনিশ্চয়তা থাকলে বাইরের কাজে মন দেওয়া পুরুষের পক্ষে কঠিন। পুরুষ খাদ্য নিয়ে বাড়ি ফিরবে। যুদ্ধে ও শিকারে। কিছুটা উজ্জ্বলতা থাকে। কিন্তু উচ্চুঙ্খল হলেও পুরুষকে শেষ পর্যন্ত বাড়িতেই ফিরতে হবে বিশ্রামের আশায়। সেখানে তার জন্য স্ত্রী অপেক্ষা করছে এইরকম একটা নিশ্চিত ছবি যদি পুরুষের মনের ভিতর রক্ষা পায় তবেই ঘরের এবং বাইরের কাজকর্ম ভালো চলে। সমাজে, পুরুষশাসিত সমাজে, এই ধারণাটাই ছিল স্বাভাবিক। নারীর কাছ থেকে সমাজের প্রত্যাশা এইভাবে গড়ে উঠেছে। ইতিহাসের ঐ পর্বটা সুদীর্ঘ। নারী ও পুরুষের চরিত্রের একটা রূপ আকার ধারণ করেছে ঐ পর্বে পুরুষ উদ্যোগী ও কিছুটা বর্বর, নারী মমতাময়ী ও সেবাপরায়ণা। ইতিহাস ও কল্পনায় আশ্রিত এই ধারণার সহসা পরিবর্তন ঘটে না। যে মমতা নারীর বৈশিষ্ট্য তার সঙ্গে শক্তির কোনো বিরোধ নেই, আমাদের পুরাতনী দেবী কল্পনায় সেটা স্পষ্ট। নারী কখনো অবলা, কখনো শক্তিরূপিনী।

শিকার পেরিয়ে এক সময়ে কৃষি ও কুটির শিল্প হয়ে উঠল জীবনধারণের প্রধান অবলম্বন। সেখানে ঘরের সঙ্গে বাইরের দূরত্বটা কম। কৃষিভিত্তিক সমাজের মাতৃতান্ত্রিক রূপ ধারণ করতে তেমন বাধা নেই। অবশ্য পিছনে ফেলে আসা শিকারের যুগটার ভূত অনেক সময় এখানেও তাড়া করে আসে, এই মুশকিলটা থেকেই যায়। যাই হোক, সমাজ যখন এইরকম একটা স্তরে এসে পৌঁছায় যেখানে কৃষি ও কুটিরশিল্পের বিস্তার ঘটেছে কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য আর্থিক জীবনের ওপর চেপে বসেনি তখন নারীর শক্তি স্বচ্ছন্দবিহারের একটা ক্ষেত্র পায়। তবে সেই পর্যায়েও নানা কারণে যুদ্ধ আর লুণ্ঠনের প্রাদুর্ভাব ঘটে। যদিও রণাঙ্গনে বীরাঙ্গনাদের ক্কচিৎ কদাচিৎ দেখা যায়, তবু যুদ্ধ আর লুঠতরাজে পুরুষের ভূমিকাই মুখ্য হয়ে ওঠে। নারী অপসৃত হয় অবগুণ্ঠনের পশ্চাতে। সে যুগের যুদ্ধের আর এক ফল ক্রীতদাস প্রথা। নারীকে সেই থেকে দেখি ক্রীতদাসী রূপে।

বাণিজ্যের প্রসার আর বাজারের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ঘর আর বাইরের দূরত্ব বেড়ে যায়। বাণিজ্যে পুরুষেরই প্রাধান্য। বাণিজ্যভিত্তিক শিল্পের ভিতর দিয়ে ধনোৎপাদনের ব্যবস্থা বিরাটভাবে পালটে যেতে থাকে। একদিকে বাড়ে ধনের পরিমাণ, অন্যদিকে ধন বণ্টনে অসাম্য। এই সঙ্গে আরো লক্ষণীয়, আমলাতন্ত্রের শক্তিবৃদ্ধি। সেকালে ছিল পুরোহিততন্ত্র একালে আমলাতন্ত্র। দুয়েতেই পুরুষের প্রাধান্য। আইনকানুন যতো জটিল হয়, ঘরের সঙ্গে বাইরের জগতের সাংস্কৃতিক দূরত্বও ততো দুর্লঙ্ঘ্য হয়ে ওঠে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি, দুয়ে মিলে গড়ে উঠেছে পুরুষের আলাদা জগৎ।

কৃষিভিত্তিক সমাজে মেয়েরাও মাঠে কাজ করবার সুযোগ পেয়েছে পুরুষের পাশে অর্থাৎ, আর্থিক উপার্জনে মেয়েরা সেখানে সক্ষম। বিয়ের সময় পাত্রপক্ষকেই অনেক সময় যৌতুক দিয়ে পাত্রীকে ঘরে আনতে হয়েছে, কারণ এতে করে ছেলের পরিবারে যোগ হত মাঠে কাজ করবার জন্য আরো এক জোড়া হাত। নাগরিক সভ্যতার প্রসারের ফলে অবস্থাটা পালটে গেল। এবার পণ দিয়ে কন্যার বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। কারণ মেয়ের ভরণপোষণের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাচ্ছে মেয়ের বাবা, সেই দায়টা গিয়ে পড়ছে বরের ওপর। এখনও আমাদের চোখের সামনেই দেখি, সাঁওতাল রাজবংশী মেয়েরা যারা মাঠে কাজ করে, তাদের বিয়েতে কন্যাপক্ষকে পণ দিতে হয় না। অবশ্য নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাবে তলার দিকের সমাজেও রীতিনীতির পরিবর্তন ঘটেছে। জাতে উঠতে গিয়ে মেয়েরা হয়ে পড়ছে আরো পরাধীন। তথাকথিত উঁচু জাতের মেয়েদের জন্য উপার্জনের পথ, আর্থিক স্বাবলম্বনের পথ খোলা নেই, আর্থিক দৃষ্টিতে তারা দায়বিশেষ। এইভাবেই অবস্থাটা চলছিল বহুদিন পর্যন্ত আমাদের পরিচিত মধ্যবিত্ত সমাজে।

কিছুকাল আগে এই অবস্থার পরিবর্তন শুরু হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে এক অদ্ভুত আধখেচড়া পরিস্থিতি। মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে যাচ্ছে, চাকরির জন্য। তাদের উপার্জনের পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট নয়, অর্থাৎ তাতে আত্মনির্ভর হওয়া যায় না, যদিও বাড়তি আয়টা সংসারের কাজে লাগে। আয়কতা মুখ্যত ছেলে। এর ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু সেটা সংখ্যায় অল্প। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা এখনও আর্থিকভাবে পরনির্ভর। কাজেই পণপ্রথা সমানে চলেছে, ব্যতিক্রম যৎসামান্য। নব্য মধ্যবিত্তের আয় আর আকাঙ্ক্ষার ভিতর ফারাক যত বাড়ছে পণপ্রথা ততই আরো নির্দয় কুৎসিত হয়ে দেখা দিচ্ছে। মেয়েদের যদিও বাইরের চাকরি হয়েছে, উৰু সংসার চালাবার কাজটা প্রায় পুরোপুরি তাদের উপরই থেকে গেছে। পুরনো ব্যবস্থায় যে অন্যায়টা প্রচ্ছন্ন ছিল, নতুন অবস্থায় সেটা হয়ে উঠেছে আরো প্রকট, আরো সমর্থনের অযোগ্য, অতএব অসহনীয়।

এই নতুন পরিস্থিতি এবং দেশেবিদেশে মেয়েদের উপর তার প্রভাব এবার আরো একটু তলিয়ে দেখা প্রয়োজন।

.

উনিশ শতকে রামমোহন অথবা বিদ্যাসাগর নারীর মুক্তির জন্য যে প্রচেষ্টা করেছিলেন তা থেকে আধুনিক নারীমুক্তি আন্দোলন জাতে আলাদা। এই আন্দোলন একটা নবপর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে, বিশেষত গত বিশ-তিরিশ বছরে। এর উদ্ভব পশ্চিমের শিল্পোন্নত দেশগুলিতে, যদিও এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে এদেশেও।

বাণিজ্যের বিস্তার, শিল্পবিল্পব, নাগরিক মধ্যবিত্তশ্রেণী আর প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় আর্থিক বিন্যাসের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নারীর স্বাধীনতা কীভাবে সঙ্কুচিত হল সে কথা আগেই আলোচনা করেছি। যে ছবিটা আমরা সেখানে তুলে ধরেছি সেটা মূলত মহাযুদ্ধের আগের যুগের। গত কয়েক দশকে অবস্থা অনেকটা পালটে গেছে, বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলিতে।

এই পরিবর্তনের পিছনে কিছু বড় বড় শক্তি কাজ করেছে। সংক্ষেপে তার উল্লেখ করা যেতে পারে।

আজকের যুগে যুদ্ধটা আর আগের মতো পুরুষদের একটা বিশেষ অংশের ভিতর আবদ্ধ থাকে না। যুদ্ধের একটা চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটেছে, এ যুগের যুদ্ধ “টোটাল ওয়ার”। মহাযুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজের পক্ষে একটা সামগ্রিক ব্যাপার। বড় সংখ্যায় পুরুষেরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে চলে যায় তখন দেশময় অতি প্রয়োজনীয় অফিস, কলকারখানা, আর সরবরাহ ব্যবস্থা চালাবার জন্যও নারীদের কাজে যোগ দিতে হয় বর্ধিত সংখ্যায়। মহাযুদ্ধের ভিতর দিয়ে মেয়েরা ঘরের বাইরে চলে এসেছে পুরনো অভ্যাসের বাধা অতিক্রম করে। যুদ্ধের শেষে সৈন্যরা যখন ঘরে ফেরে, তারা এসে দেখে যে সমাজ তাদের প্রায় অজ্ঞাতসারেই অনেকখানি বদলে গেছে। মহাযুদ্ধের বাইরে এদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনেরও একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল মেয়েদের ঘরের বাইরে টেনে আনবার কাজে। গান্ধীজীর নেতৃত্ব এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয়। এর পর মেয়েদের পুরনো অবস্থায় ফেরত পাঠানো আর সম্ভব নয়।

এই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য আধুনিক প্রযুক্তির একটা বিশেষ ভূমিকা। একদিন ছিল যখন ঘরের কাজ মেয়েদের সবটা সময় গ্রাস করে নিত। আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাবে শিল্পোন্নত দেশে অবস্থা অনেকটা বদলে গেছে। রান্না কিংবা কাপড় কাঁচা থেকে শুরু করে ঘরের আরো অনেক কাজই এখন আর ততটা সময় নেয় না। ফলে মেয়েদের হাতে সেই উদ্বৃত্ত অবসর থাকে যেটা তারা বাইরের কাজে দিতে পারে। যখন এটা সম্ভব ছিল না তখন সেই অবস্থাকেই মেনে নিতে হয়েছে। এখন ঘরের কাজের একঘেয়েমি অনেক মেয়ের পক্ষেই আর গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। প্রযুক্তি যে সমাজকে নানাভাবে প্রভাবিত করে, সমাজের। গঠনটাকেই বদলে দেয়, একথা আমরা জানি। গত কয়েক দশকে এটাই ঘটেছে একটা বিশেষ পথে, আগের যুগে যার তুলনা মেলে না। প্রযুক্তি নানা ধরনের হয়। যন্ত্রের। ব্যবহারের ফলে যখন শ্রমের প্রয়োজন কমে যায় তখন তাকে বলা যাক শ্রমসঙ্কোচক প্রযুক্তি। আধুনিক শিল্পে এর প্রয়োগ ক্রমশই বাড়ছে, গত শতাব্দী থেকেই এটা অনেকে লক্ষ করেছেন। এই শ্রমসঙ্কোচক প্রযুক্তি অনেকদিন অবধি আবদ্ধ ছিল মিলে, কারখানায়, ঘরের ভিতর প্রবেশ করেনি বড় আকারে। তাই শিল্প-বিল্পবের ফলে কলকারখানায় কাজের সংগঠনের যে পরিবর্তন ঘটে গেছে সেই রকম কিছু ঘটেনি গৃহস্থের ঘরসংসারে। এই দেয়ালটা এবার ভাঙতে আরম্ভ করেছে, কারখানা পেরিয়ে শিল্পবিল্পব ছড়িয়ে পড়েছে। রান্নাঘর অবধি। আর এরই ফলে সারা সমাজের সংগঠনে একটা অভূতপূর্ব ওলটপালটের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। একইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য আরো কিছু ঘটনা, যেমন মুদ্রাস্ফীতি। মুদ্রার মূল্যহ্রাসের ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের উপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেই অবস্থায় মহিলারা আরো অধিক সংখ্যায় অথথাপার্জনের পথে পা বাড়িয়েছেন। যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি আর নবযুগের প্রযুক্তি মিলে মেয়েদের আজ ঠেলে দিয়েছে অতি দ্রুত বাইরের সেই কর্মশালায় যেখানে বহুদিন পর্যন্ত একাধিপত্য ছিল পুরুষের। বাধা দিলে বাধবে লড়াই, অবস্থাটা এখন এইরকম।

চাকরির বাজারে লড়াই আমরা আগেও দেখেছি। পিছিয়ে-পড়া জাতি অথবা সম্প্রদায়ের মানুষ হঠাৎ যখন চাকরির সন্ধানে এগিয়ে আসে তখন পুরনো প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। একসময় মীমাংসার সূত্র খোঁজা ছাড়া উপায় থাকে না। কখনো কখনো পিছিয়ে-পড়া জাতি কিংবা সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত আসনের দাবী। মেনে নিতে হয়। দ্বন্দ্বটা শুধু কাজে নিয়োগের প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পদোন্নতির প্রশ্নটাও এসে যায়। আপত্তি ওঠে যে, তলার দিকের কিছু আসন ছেড়ে দিয়ে অগ্রগামী গোষ্ঠী দখল করে বসে আছে ওপরের দিকের অধিকাংশ আসন। এই সব কথা মেয়েদের আন্দোলনের ভিতর থেকেও শোনা যাচ্ছে। মেয়েরা আজ এগিয়ে আসছে যেন। পিছিয়ে-পড়া একটা বিরাট সম্প্রদায়ের মতো। পুরুষের সঙ্গে তাদের লড়াইয়ের চেহারা কিছুটা মিলে যায় একটা পুরনো পরিচিত ধাঁচের সঙ্গে। কিন্তু তুলনাটা বেশি দূর টানা যায় না। আসলে মেয়েদের দাবি কেবল চাকরি নিয়ে নয়। শুধু পদমর্দা নিয়েও নয়। অনিবার্যভাবেই এতে নিহিত আছে আরো অন্তরঙ্গ অনেক ব্যাপার। বহুদূর বিস্তৃত এর ফলাফল। সেটা আমাদের বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। অপেক্ষাকৃত সরল বিষয় থেকে। শুরু করে অগ্রসর হওয়া যাক আরো জটিল প্রশ্নের দিকে।

.

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী সারদা দেবী পনেরোটি সন্তানের জন্মদান করেন। সে যুগের মায়েদের অনেকেই বহু সন্তানবতী ছিলেন। আমাদের সময়ে দুটি অথবা তিনটির বেশি বালবাচ্চা হবে না এই রকমই সরকারী বিধি। চীন দেশে সংখ্যাটা দুই এমন কি আরো কমে সীমাবদ্ধ করার দিকে চেষ্টা চলেছে। ভারত অথবা চীনের মতো দেশে এই সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সরকারী নীতির পক্ষে মূল যুক্তি আর্থনীতিক। জনসংখ্যার অতিবৃদ্ধির ফলে এসব দেশে দারিদ্র্য দূর করা কঠিন হয়ে উঠেছে। শিল্পোন্নত দেশে সমস্যাটা ঐরকম। নয়। সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ সরকারী নীতির তেমন প্রয়োজন নেই। অথচ অপেক্ষাকৃত ধনী দেশগুলিতেও সন্তানের সংখ্যা দ্রুত কমে এসেছে। অনেক দেশেই জনসংখ্যা তেমন বাড়ছে না, কয়েকটি দেশে কমছে। যেমন ধরা যাক পশ্চিম জার্মানি। গত তিরিশ বছরে সেখানে আর্থিক উন্নতি ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত তালে। অথচ সেখানে জনসংখ্যা এখন আর বাড়ছে না।

গর্ভমোচন এবং গর্ভনিরোধের মৌল অধিকার নারীমুক্তি আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য দাবী। এই দাবীর একটা আর্থিক দিক আছে ঠিকই, কিন্তু দাবীটা আসেনি প্রধানত দরিদ্র পরিবারের পক্ষ থেকে। শিল্পে অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে যাই হোক না কেন, পাশ্চাত্ত্য সমাজে ঐ ভাবনাটা এসেছে উদরপূর্তির প্রয়োজনে নয়, বরং নারীর বৃহত্তর স্বাধীনতার স্বার্থে। আজকের দিনের মেয়ে চাইছে বাইরের জগতে আরো সক্রিয় ভূমিকা, আরো অবাধ বিচরণ। সন্তানের সংখ্যা বাড়লে সেই স্বাধীনতা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আজকের নারীমুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। আর্থিক স্বাধীনতা এবং বৃহত্তর সামাজিক স্বাধীনতার সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দাবী। নারী গর্ভধারণ করবে কি না অথবা কখন করবে এটা আর নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া চলবে না, নারী নিজেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারিণী।

কথাটা আরো একটু বিস্তৃত পটভূমিকায় বললে বোধ করি ভুল হবে না। নারীমুক্তির প্রবক্তাদের অনেকেই চাইছেন মেয়েদের জন্য সেই যৌন স্বাধীনতা যেটা ছেলেরা ভোগ করে আসছে সমাজের সম্মতিক্রমে বহুদিন থেকে। এটাকেও নারী-পুরুষের সাম্যের দাবীর অংশ বলে বিবেচনা করতে হবে। যতদিন মেয়েরা ঘরসংসারে আবদ্ধ ছিল ততদিন কতগুলি বাধানিষেধ তাদের ওপর একতরফা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তারা সেসব মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু বাইরের জগতে ছেলেদের পাশে পাশে যখন তাদের কাজ করতে হবে তখন পরস্পরের মেলামেশার ব্যাপারে ছেলেদের জন্য এক নিয়ম আর মেয়েদের জন্য অন্য নিয়ম, এই ভেদাভেদ মেয়েরা সানন্দে গ্রহণ করবে না।

পুরনো দুয়েকটা যুক্তি লোকমুখে কখনো কখনো শোনা যায়, কিন্তু তাদের বাস্তবভিত্তি দুর্বল হয়ে গেছে বলেই ওসব আর যুক্তি বলে তেমন গ্রাহ্য হয় না। বলা হয় যে, প্রকৃতিই মেয়েদের অসুবিধায় ফেলেছে, যৌন স্বাধীনতায় মেয়েদের বিপদের আশঙ্কা বেশি, কাজেই ওদের সাবধান হতে হবে নিজেদেরই স্বার্থে। নৈতিক যুক্তি হিসেবে খুব দাম দেওয়া যায় না এই কথাটাকে। সাবধানতা যদি প্রয়োজন হয় তবে তার দায়িত্ব দু’পক্ষেরই সমানভাবে ভাগ করে নেওয়াটা নীতির দিক থেকে শোভন। তাছাড়া বিজ্ঞানের নব নব উদ্ভাবনের ফলে বাস্তব বিচার-বিবেচনার ভিত্তিটা পালটে যাচ্ছে। জন্মনিরোধের উপায় ক্রমেই সহজ হয়ে আসছে। যৌন স্বাধীনতার সঙ্গে সাবধানকে মেলানো আজ কঠিন নয়। অর্থাৎ, মেয়েদের ওপর সংযমের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার সপক্ষে যে বাস্তব যুক্তিটা দুয়েক পুরুষ আগে বেশ জোরালো এমন কি ভীতিপ্রদ মনে হত, চলতি প্রজন্মে সেটা আর তেমন ধারালো যুক্তি নয়। যদি কেউ শুদ্ধ নৈতিক বিবেচনায় যৌনসংযমের পথ বেছে নেয় তবে সেই সিদ্ধান্তের অনুকূলে নিশ্চয়ই কিছু বলবার আছে। নৈতিক যুক্তি স্ত্রী পুরুষ উভয়ের পক্ষে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু বাস্তব প্রয়োজনের বাধ্যতাকে নারীর যৌন স্বাধীনতার বিপক্ষে একতরফা ব্যবহার করতে গেলেই মুশকিল, যুক্তিটাকে চট করে আর দাঁড় করানো যায় না। প্রশ্নটা কেবল সংযম নিয়ে নয়, স্ত্রী-পুরুষের ভিতর অসাম্য নিয়ে। যৌন স্বাধীনতার ব্যাপারে এই অসাম্য সমর্থন করা কঠিন হয়ে উঠছে। আধুনিক প্রযুক্তির এই আরেক ফল।

পুরনো ঐতিহ্যে অসাম্যের একটা উৎকট প্রকাশ দেখা গেছে বিবাহ বিচ্ছেদের নিয়মে। পুরুষের দিক থেকে বিবাহবিচ্ছেদ সহজ, তার উদাহরণ দেওয়া বোধ করি নিষ্প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মুসলমান রীতিপদ্ধতির সঙ্গে নানা কারণে অনেকেই অল্প-বেশি পরিচিত। পয়গম্বর নিজে বিবাহবিচ্ছেদ পছন্দ করতেন না, কিন্তু কার্যত পুরুষের পক্ষে স্ত্রীকে তালাক দেওয়া মোটেই কষ্টসাধ্য নয়। হিন্দুদের ভিতর স্বামী পরিত্যক্তা স্ত্রীর সংখ্যা দুঃখজনকভাবে বেশি। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র ঐতিহ্য এ ব্যাপারে পুরুষের পক্ষপাতী। নারীমুক্তির প্রবক্তারা দাবী করছেন সাম্য। নারী ও পুরুষ উভয় পক্ষ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ আরো সহজ করে তুলবার দিকে ঝোঁক আছে এ-যুগের চিন্তা-ভাবনায় বিশেষত উন্নত দেশগুলিতে। বিবাহবন্ধন যদি নারীর ব্যক্তিত্বের পক্ষে হানিকর অথবা অপমানজনক হয় তবে বন্ধন ভেঙে মেয়েরা যাতে সহজে বেরিয়ে আসতে পারে সেই পথ খোলা থাকুক, এই দাবী উচ্চারিত হয়েছে সঙ্গত কারণেই।

পাশ্চাত্য দেশে নারীমুক্তি আন্দোলনের যাঁরা নেতা তাঁরা সেই দেশের অধিকাংশ নারীর প্রতিনিধিস্থানীয় কি না এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। অধিকাংশ সাধারণ মেয়ের ধ্যানধরণা। নারীমুক্তির অগ্রগামী প্রবক্তাদের সঙ্গে মেলে না। এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। নারীমুক্তির নেতাদের অনেকেরই চিন্তার অবস্থান আন্তজাতিক বামপন্থী বিপ্লবীআন্দোলনের ধারেকাছে। সাধারণ মেয়েদের অধিকাংশের ভোট পড়ে অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল দলের পক্ষে এই রকম সংখ্যার বিচারে কিন্তু নারীমুক্তি আন্দোলনের গুরুত্ব ঠিকভাবে ধরা পড়বে না। এই আন্দোলনের মিল আছে এ-যুগের ইতিহাসের ধারার সঙ্গে। প্রযুক্তি ও সামাজিক সংগঠনের পরিবর্তন উন্নত এবং উন্নতিশীল দেশগুলিকে আধুনিককালে যে দিকে ঠেলে দিচ্ছে নারীমুক্তি আন্দোলনের গতি সেই দিকে। এইখানে পাওয়া যাবে ঐ আন্দোলনের বিশেষ তাৎপর্য আর অন্তর্নিহিত শক্তির পরিচয়।

আধুনিক নাগরিক সভ্যতার কিছু নিজস্ব বিচার ও আদর্শ আছে। মানুষের অধিকার আর সুখের পথ সম্বন্ধে তার কতগুলি নিজস্ব প্রত্যয় আছে। নাগরিক সভ্যতা ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের কিছু মৌল ধারণায় বিশ্বাস রাখে। কোনো এক যুগে বৃত্তি অথবা জীবিকা ছিল জন্মসূত্রে নির্ধারিত। অন্তত পুরুষের ক্ষেত্রে আমরা আজ এই রকম বিশ্বাস করি না। কিন্তু সমাজের একটা বড় অংশে আজও অধিকাংশ নারীর স্থান যেন জন্মসূত্রেই রান্নাঘরে নির্দিষ্ট। সংবিধানে মানুষের অধিকার বলে যেসব কথা স্বীকৃত সেসব যেন একমাত্র পুরুষেরই অধিকার। অধিকার জিনিসটা সংবিধানে স্বীকৃত হওয়াই যথেষ্ট নয়, সমাজের সংস্কৃতিতে তার সমর্থন থাকা চাই। প্রশ্নটা শুধু বৃত্তিনির্বাচন নিয়ে নয়, ব্যক্তিত্বের বিকাশ নিয়ে। ব্যক্তিত্বের বিকাশের সর্বক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের ভিতর যাতে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়, আইনের সঙ্গে সঙ্গে সমাজের বিচার ও সংস্কৃতি যাতে ঐ সাম্যের অনুকূল হয়, পুরুষের স্বাধীনতার ভিত্তিতে যেন না থাকে নারীর অধীনতা, নারীর মুক্তি আন্দোলনের এই লক্ষ্য। এই আন্দোলনের সক্রিয় অংশীদারদের সংখ্যা যাই হোক না কেন, সমাজের ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। নারীমুক্তির মৌল দাবিগুলি এদিক থেকেই বিচার্য। অথচ ইতিমধ্যেই কিছু গভীর সমস্যা দেখা দিয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনে যেসব দাবী তোলা হয়েছে তার সঙ্গে এইসব সমস্যার যোগ আছে। নারীমুক্তির নেতারা এইসব সমস্যা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারছেন না। এই দিকে এবার দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক।

.

আধুনিক নারীমুক্তি আন্দোলনে পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুরটাই প্রধান। এটা আশ্চর্য নয়। এদিক থেকে আন্দোলন কিছু সফল হয়েছে, এ-কথাও স্বীকার করতে হবে। এক কালে যে-সব বৃত্তিতে পুরুষের প্রায় একচেটিয়া অধিকার ছিল এখন সেখানে অন্তত উন্নত দেশগুলিতে মহিলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পলিসি রিভু’-তে প্রকাশিত এক বিবরণে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন দেশে মহিলা ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা ১৯৭০ সালে ছিল একুশ হাজার, পনের বছর পরে হয়েছে একশ’ এক হাজার মহিলা আইনজীবীর সংখ্যা এই সময়ে বেড়েছে তেরো হাজার থেকে একশ চার হাজারে। উদাহরণ বাড়ানো। নিষ্প্রয়োজন। বলা বাহুল্য, মহিলাদের পদবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাও। বাড়ছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের নেতারা বলছেন, ওপরের দিকে মহিলাদের যদিও অধিক সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে, নীচের দিকে কিন্তু মেয়েদের অধীন অবস্থা কাটেনি। তবু বাইরের কাজের জগতে মেয়েদের অগ্রগতি অস্বীকার করা যায় না। মনে রাখতে হবে যে, গত পনেরো বছরের সময়টাতে মোটের উপর মার্কিন সমাজ ও অর্থনীতি ছিল বর্ধিত হারে বেকার সমস্যা আর উপার্জনহীনতার দ্বারা আক্রান্ত। এ সময়ে চাকরির বাজারে মেয়েদের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া কঠিন হবার কথা। তবু যদি অগ্রগতি ঘটে থাকে তবে সেটা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মেয়েদের অন্যান্য অধিকারও শিল্পোন্নত দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠা পাবার পথে ঘরের কাজে পুরুষেরা অংশগ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা ক্রমে ক্রমে স্বীকৃতি পাচ্ছে। বিবাহবিচ্ছেদ আগের তুলনায় সহজ হয়ে এসেছে। পুরুষের ইচ্ছাতে শুধু নয়, মেয়েদের ইচ্ছাতেও বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে। শিল্পোন্নত দেশের বাইরে এইসব ধারা আমাদের মতো দেশেও সমাজের উপরতলায় খানিকটা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। আমাদের চোখের সামনেই সমাজ ও সংস্কৃতির পরিবর্তন প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে। এর বিরুদ্ধে নানা রকম সমালোচনা শোনা যাচ্ছে। এইসব সমালোচনার কিছুটা পুরনো রক্ষণশীল সংস্কৃতির প্রতিক্রিয়া বলে চিহ্নিত করা যায়। আবার কিছু সমালোচনার ভিত্তিতে আছে আরো মৌল বাস্তব সমস্যা। কাজেই তর্কটা জটিল।

সমালোচকদের কেউ কেউ বলছে যে, নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রভাবে মেয়েরা দুশ্চরিত্র হয়ে পড়ছে। এতে করে মেয়েদের ধী যদি-বা বাড়ছে, স্ত্রী আর শ্রী কমে যাচ্ছে। আসলে এই সমালোচকদের মনে আছে নারী প্রকৃতি সম্বন্ধে একটা পুরনো ঐতিহ্যাশ্রিত ধারণা, যা থেকে কোনো বিচ্যুতি কিংবা ব্যত্যয় তাদের আপত্তিজনক মনে হয়। এই পুরনো ধারণার ভিতর কিছু স্ববিরোধ রয়েছে। একদিকে নারীকে মনে করা হয় ছলনাময়ী, নারী পাপের পথ। অন্য দিকে নারী শুদ্ধ মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। এমনও একটা প্রচলিত ধারণা আছে যে, নারীর নিজস্ব কোনো যৌন আকাঙ্ক্ষা নেই, নিতান্তই পুরুষের আগ্রহে সে অনাসক্তভাবে মিলিত হয় বংশরক্ষার উদ্দেশ্যে অথবা পুরুষের কামনাতৃপ্তির জন্য। এই ছবিটা সত্য হতে পারে না। নারী ও পুরুষের যৌন আকাঙ্ক্ষার মানচিত্রে অবশ্য কিছুটা পার্থক্য আছে। কিন্তু সেই পার্থক্যের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ অন্যপ্রকার। প্রকৃতি লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ভিতর দিয়ে পুরুষকে গঠিত করেছে যৌন আকাঙ্ক্ষার আকর হিসেবে আর নারীকে সৃষ্ট করেছে যৌন আকর্ষণ তথা আনন্দের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করে, এ-কথা বিশ্বাস্য নয়। নারী প্রকৃতি সম্বন্ধে এই ধারণা যদি সত্য হত তবে নারীকে আবার ছলনাময়ী বলে চিত্রিত করার অর্থ কী? এ-বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক। সহজ দৃষ্টিতে বোঝা যায় যে, নারী-পুরুষের ভিতর আকর্ষণটা প্রকৃতির নিয়মেই পারস্পরিক; মানবিক ভালোবাসায় যৌনতার মিশ্রণ নারী ও পুরুষ উভয়ের পক্ষেই স্বাবাভিক; আধুনিক নারী যদি আজ শতাব্দীসঞ্চিত ভয় ও সঙ্কোচ থেকে মুক্ত হয়ে যৌনতাকে স্বীকার করে নিতে চায় তবে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই; আর নারী ও পুরুষের যৌথ দায়িত্বেই সেই সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যাতে প্রকৃতির দানকে মানুষ আতিশয্যের ক্রুরতা দিয়ে বিকৃত না করে বরং একটা কোমল সৌন্দর্য ও আনন্দের সার্থকতায় পৌঁছে দিতে পারে।

রক্ষণশীল সমালোচকের আপত্তি অগ্রাহ্য হতে পারে; তবু এর বাইরেও কিছু প্রশ্ন আছে। এই বিষয়টির সঙ্গে জড়িত সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা সম্বন্ধে আমাদের ভাবনাচিন্তা এখনও একান্ত অসমাপ্ত। এই সব নিয়ে খোলা মনে ভাবতে গেলেই বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য আমাদের নজরে আসে। প্রথমেই বিবেচনা করা আবশ্যক কিছু বাস্তব সমস্যা।

বিবাহবিচ্ছেদের প্রশ্ন দিয়ে পর্যালোচনা শুরু করা যাক। শিল্পোন্নত দেশে নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ রাখা কঠিন। বিবাহবিচ্ছেদের পথ সুগম হয়েছে। বিচ্ছেদ চাইতে পারে শুধু পুরুষ নয়, নারীও। নারীর সাম্য ও স্বাধীনতার সহায়ক হিসেবেই এটাকে মেনে নেওয়া হয়েছে। নারীমুক্তি আন্দোলনের পক্ষ থেকে সঙ্গত কারণেই এটা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে সমস্যা মেটেনি। এক ধরনের অসাম্য থেকেই গেছে। আইনের দিক থেকে বিবাহবিচ্ছেদ এবং পুনর্বিবাহ দুয়ের জন্যই পথ খোলা আছে! কিন্তু বাস্তবে পুনর্বিবাহের সুযোগ নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য সমান নয়। উন্নত দেশগুলিতেও নয়। চল্লিশ পেরিয়ে যাবার পর নারীকে বিবাহ অথবা পুনর্বিবাহের ততোটা যোগ্য মনে হয় না পুরুষকে যতটা মনে হয়। বিবাহবিচ্ছেদের পর, অন্তত একটা বয়স পেরিয়ে গেলে, বিচ্ছিন্না নারীর একাকিত্বের সম্ভাবনা পুরুষের চেয়ে বেশি।

এই অবস্থায় নারীর জীবনে দেখা দেয় এক উভয়সংকট। স্বামীর সঙ্গে যদি সন্তানকেও ত্যাগ করে চলে আসতে হয় তবে সেই একাকিত্ব হয় স্ত্রীর পক্ষে আরো অসহনীয়। আর সন্তানকে যদি প্রতিপালন করতে হয় তো বিচ্ছিন্না স্ত্রীর আর্থিক অবস্থা কঠিন হয়ে ওঠে। ধরে নেওয়া যাক মহিলাটি চাকরিতে নিযুক্ত, বিবাহবিচ্ছেদের আগেও এবং পরেও } অর্থাৎ, আর্থিক দিক থেকে মহিলাটিকে নিতান্ত অসহায় বলা যাবে না। অসহায় নয় বলেই সমাজের সহানুভূতি তার প্রতি তেমনভাবে আকৃষ্ট হবে না। একই কারণে তার ভরণপোষণের নৈতিক দায়িত্ব আগের স্বামীর ওপর সেই পরিমাণে বতাবে না, বিশেষত বিবাহবিচ্ছেদের দাবিটা যদি এসে থাকে স্ত্রীর পক্ষ থেকে। স্বামী-স্ত্রী আর ধরা যাক দুটি সন্তান, চারজন মিলে সংসার ছিল একটি। বিবাহবিচ্ছেদের পর একটি ভেঙে যখন দু’টি ঘর হল তখন দুই সংসারের মোট খরচ কিন্তু আগের একটির সমান রইল না। সন্তানের দায়িত্ব পিতা আর মাতার ভিতর যেমনভাবেই ভাগ করে দেওয়া যাক না কেন, দুই খণ্ড সংসারের মোট খরচ এক অখণ্ড সংসারের চেয়ে বেশি। অথচ বিবাহবিচ্ছেদের ফলে দু’জনের মোট আয়ের কোনো বৃদ্ধি ঘটেনি। এ অবস্থায় বিচ্ছিন্না মাকে সম্ভবত জীবিকার জন্য আরো কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, জীবনধারণ করতে হয় দুশ্চিন্তা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। পরিবার যদি বিত্তবান হয় তবে আর্থিক সমস্যাটা হয়তো তেমন বড় আকারে দেখা দেয় না। কিন্তু উন্নতদেশেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে বিবাহবিচ্ছেদের পর অনেক নারীকেই একটা কঠিন বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। নারীমুক্তি আন্দোলন এই সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। ঐ নামে যে আন্দোলনের সঙ্গে আমরা পরিচিত তার মাধ্যমে এর সমাধান আদৌ সম্ভব কি না এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা অযৌক্তিক নয়।

এই পরিস্থিতিতে অন্য একটা চিন্তা ক্রমশ আধিপত্য বিস্তার করে। যে নারী স্বাধীনতা চায়, বিবাহবিচ্ছেদের পথ খোলা রাখতে চায়, তার পক্ষে সন্তানের জননী হওয়াটাই একটা বিঘ্নস্বরূপ। সন্তান আর স্বাধীনতা এইভাবে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। বিবাহবিচ্ছেদ ওই সমস্যাকে আরো তীব্র করে তোলে, কিন্তু প্রশ্নটা এ ছাড়াই আধুনিক নারীর জীবনে উপস্থিত। কোনো এককালে নিঃসন্তান হওয়াটা ছিল নারীর পক্ষে বড় লজ্জা আর দুঃখের কথা। আজ যদি নারীকে বেছে নিতে হয় সন্তান আর স্বাধীনতার ভিতর একটিকে, তবে সেটা হবে না কি বড় বিষণ্ণ নির্বাচন?

এখানে একটি ছোটো ঘটনার উল্লেখ করছি, যে ঘটনার ভিতর দিয়ে সমস্যাটা আমার চেতনায় ধরা পড়ে। নিউ ইয়র্কে নারীমুক্তি আন্দোলনের এক নেতার সঙ্গে আমি এক সন্ধ্যা একান্তে কাটিয়েছিলাম। মেয়েটি বুদ্ধিমতী, প্রাণবন্ত, কথায় বাতায় কপটতা নেই। ওঁর একটা কথায় আমি একটু চমকে উঠেছিলাম; উনি বলেছিলেন, বোকা না হলে কোনো মেয়ে মা হতে রাজী হয় না। আমি উত্তরে বলেছিলাম, আপনার কথাই যদি ঠিক হয় তবে তো ভবিষ্যতে পৃথিবীতে অধিকাংশ শিশুর ভাগ্যে জুটবে নিবোধ মা। আমার উত্তরে উনি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু ওঁর কথাটা আমাকে ভাবিয়েছে। যে নারী বাইরের জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে অভিলাষী, আর যথাসম্ভব নিজের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখতে আগ্রহী, সন্তানের জন্মদান তার কাছে নিবুর্ধিতার সমান মনে হতেই পারে। আমার পরিচিত মহিলারা এই অবস্থায় একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সযত্নে থেমে যান। কিন্তু এটাও হয়তো প্রাচীন রীতির কাছে নতি স্বীকার করা বলে মনে হবে নতুন যুগের অনেক উন্নতিকামী নারীর দৃষ্টিতে।

সন্তানের জন্মদান যদি মুক্তিকামী নারীর চোখে অনভিপ্রেত হয় তবে অবশ্য বিবাহেরও বিশেষ অর্থ থাকে না। সন্তানকে নিয়েই পরিবার পূর্ণ হয়। নয় তো দু’জন মানুষ তো বন্ধুর মতো সাময়িকভাবে একসঙ্গে বাস করে আবার যখন খুশি অনায়াসে দূরে সরে যেতে পারে। সন্তান নয়, বিবাহের বন্ধনটাই, যেমন পুরুষ তেমনি সংখ্যায় ক্রমবর্ধমান নারীর বিচারেও স্বাধীনতার পথে প্রতিবন্ধক মনে হতে পারে।

নারীমুক্তি আন্দোলনের ভিত্তিতে যে-সব ধারণা উপস্থিত তার ভিতরই এইসব সম্ভাবনা নিহিত আছে। একথা সত্য যে এই মুহূর্তে অনেকেই চাইবে না এইসব ধারণাকে বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে। বস্তুত নারী আন্দোলনের কিছু নেতা নিজেরাই আজ ঐ অন্তর্নিহিত ঝোঁক সম্বন্ধে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করেছেন। কিন্তু ঐ ঝোঁকটাকে বাধা দেওয়া যাবে

শুধু সতর্কতার পুনঃপুনঃ উচ্চারণে। সেজন্য চাই অন্য এক সৃজনাত্মক ভাবধারা যাকে নিজ মূল্যে গ্রহণ করা যায়, যার প্রতিষ্ঠা নয় খণ্ড খণ্ড ব্যক্তি স্বার্থের হিসেবনিকাশে। নারী। ও পুরুষকে কেবলই প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করে, সাম্য ও মুক্তির দাবিকে সেই ধারণার ভিতর আবদ্ধ রেখে, আগামী দিনের সংকটমোচনের পথ বের করা যাবে না।

.

পরিবার বলে যে প্রতিষ্ঠানটি বহুযুগ ধরে মানুষের সমাজের ভিত্তিতে স্থান পেয়ে এসেছে তাকে নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রবক্তারা রক্ষা করতে চান কি না, কোন মূল্যে রক্ষা। করতে চান, এটা একটা বড় প্রশ্ন। এ বিষয়ে নিজেদের ভিতরই এদের ঝোঁকের পার্থক্য আছে; আর সেটাই স্বাভাবিক। আন্দোলনের দুই বিখ্যাত নেতা, Betty Friedan ও। Simone de Beauvoir, এঁদের ভিতর ১৯৭৫ সালে এক চিত্তাকর্ষক আলোচনা হয়, যা থেকে বোঝা যায় যে বেটি পরিবারকে যতোটা মূল্য দেন সিমন ততোটা দিতে রাজী নন। একথা স্বীকার্য যে প্রতিটি নারী অথবা পুরুষকেই যে পরিবারবদ্ধ জীবন যাপন করতে হবে। এমন কোনো কথা নেই। সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের স্থান প্রায়শ পরিবারের বাইরে, শুধু এদেশীয় সমাজেই নয়, ভিন্ন দেশে এবং সম্প্রদায়েও। এমন নারী ও পুরুষ আছে, ভবিষ্যতে বোধ করি আরো অধিক সংখ্যায় তারা থাকবে, যারা সন্ন্যাস গ্রহণ না করলেও পারিবারিক জীবনে আবদ্ধ হতে চাইবে না। সারা সমাজকে এক ছাঁচে ঢালা যাবে না। বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ ও বিভিন্ন জীবনযাত্রার জন্য স্থান রাখতে হবে। তবু প্রশ্ন থেকে। যায়, পরিবার একটি মূল প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজে মূল্য পাবার অধিকারী কি না? সনাতন সমাজে পরিবারের ভিতর দিয়ে বংশরক্ষা হয়েছে। আরো ব্যাপক দৃষ্টিতে দেখলে বলা চলে, এর আশ্রয়ে মনুষ্যজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে। বিজ্ঞানের শক্তিতে প্রজননের নানা নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবিত হবে। মানবীর গর্ভ নবজন্মের আধার রূপে আবশ্যক না হতে পারে। কিন্তু এক প্রজন্ম, যে বিশ্বাস করতে শিখেছে একটি জন্মের অধিকার নিয়েই মানুষ পৃথিবীতে আসে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কোন যুক্তিতে কোনো প্রকারের ত্যাগ স্বীকার করতে রাজী হবে, এ প্রশ্নটা একেবারে অবহেলা করবার মতো নয়। শিশু বড় হয়ে ওঠে শুধু যন্ত্রের সাহায্যে নয়, তার জন্য চাই স্নেহ ভালোবাসার উষ্ণ পরিবেশ। ভালোবাসার গুণেই অনেক ত্যাগও আনন্দের মতো মনে হয়। এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্ম অবধি প্রসারিত স্নেহ ভালোবাসার উপাদানে গঠিত উষ্ণ নীড়েরই অন্য নাম পরিবার। অন্তত সাধারণ মানুষের মানসিক সুস্থতার জন্য এই রকম একটি কুলায়ের এতোকাল প্রয়োজন ছিল।

বস্তুবাদ ও অধ্যাত্মবাদ দুই বিরোধী তত্ত্ব, এই যান্ত্রিক ধারণার জীবন্ত প্রতিবাদ পরিবারের ইতিহাস। সেই ইতিহাস একই সঙ্গে কঠিন বাস্তবতায় প্রোথিত আবার আদিম আধ্যাত্মিকতা থেকে উত্থিত। অপরের মধ্যে আপনাকে দেখা, এটাই আত্মিকতার মূল কথা। সন্তানের ভিতর মানুষ আপনাকেই দেখে। আধ্যাত্মিকতার যদিও আরো উদার ও পরিণত প্রকাশ আছে তবু এই আদিম রূপও উপেক্ষণীয় নয়। আমরা এ বিষয়ে সচেতন থাকি না যতদিন না সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার আত্মিক সংযোগ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। সংশয় যত গম্ভীর হয় ততই বিষয়টা বেদনার ভিতর দিয়ে চেতনায় ধরা পড়ে। যে স্নেহভালোবাসার গুণে আমরা ত্যাগের ভিতরও আনন্দ খুঁজে পাই তাকে অবাস্তব বলে উপেক্ষা অথবা উপহাস করবার প্রবণতা আমাদের এই যুগে অনুপস্থিত নয়। এর অসারতা প্রমাণিত হয় জীবনের অভিজ্ঞতায়। নিতান্ত আত্মকেন্দ্রিক সুখের অনুসরণ করতে গিয়ে মানুষ হঠাৎ আবিষ্কার করে, জীবনের স্বাদ আর সদর্থ হারিয়ে গেছে। যে সব উত্তেজক সুখ একদিন ডেকেছিল, তারাই অবশেষে জীবনকে অর্থহীনতায় ভরে তোলে।

পরিবারের ভিত্তিতে চাই স্নেহ ও শ্রদ্ধা। তাকে রক্ষা করা আজ আর সহজ নয়। শিকারী পুরুষ একদিন গৃহে বদ্ধ নারীর কাছে যে বিশ্বস্ততা দাবি করতে অভ্যস্ত ছিল সেই দাবি প্রত্যাহার করে নেবার দিন এসেছে। বন্ধুত্বের ভিতর থাকে যে বন্ধনহীন গ্রন্থি, আজ স্বামীস্ত্রীর ভিতর তার চেয়ে খুব বেশি চাইতে গেলে স্নেহ আর শ্রদ্ধাও রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। মুক্তি আন্দোলনে একটা পর্যায় থাকে যাকে বলা যায় ভয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর্যায়। তখন কিছু হঠকারিতাও ঘটে থাকে। কিন্তু ভয় দেখিয়ে তার যথার্থ প্রতিকার হয় না। সেজন্য চাই আরো বৃহৎ কোনো আহ্বান।

নারীমুক্তির প্রবক্তারা পুরুষের সঙ্গে সাম্য দাবি করেছেন। এটা স্বাভাবিক, একে অগ্রাহ্য করা যাবে না। কিন্তু একটা কথা মনে রাখা আবশ্যক। পুরুষ তার নিজের স্বার্থে, স্বাধীনতার নামে, যে সমাজ গড়েছে তাতে সে সুখ অথবা স্বস্তি পায়নি। অসুখের সাম্যে কোনো মহত্ত্ব নেই। আমাদের এই পীড়িত হতভাগ্য যুগের পুরুষ অথবা নারী কেউই এমন কিছু সমগ্রভাবে লাভ করেনি যা নিয়ে একে অন্যকে ঈর্ষা করতে পারে। নারী ও পুরুষ উভয়কেই এগিয়ে যেতে হবে সহযোগী হয়ে অন্য এক সার্থক লক্ষ্যের দিকে। সেই সহযোগিতার বোধেই আশ্রয় পেতে পারে, উজ্জীবিত হতে পারে, স্নেহ প্রীতি ভালোবাসা। পরিবার শেষ অবধি রক্ষা পাবে কি না বলা কঠিন। শুধু বলা যায়, পরিবারের আধারেই সৃষ্টি হয়েছে কিছু আদর্শ, কিছু মূল্যবোধ, যাকে বাদ দিয়ে সম্ভবত রক্ষা। পাবে না সমাজ। স্বাধীনতা কথাটার ভিতর একটা সমস্যা আছে। আমরা যখন বলি, স্বাধীনতা চাই, তাতে বলা হয় না কিসের জন্য চাই। যদি বলি, যা ভালো মনে করি তারই জন্য চাই, তবু বলা হয় না ভালো কাকে মনে করি। বাইরের অধীনতা থেকে মুক্তি নিশ্চয়ই কাম্য। কিন্তু সেই সঙ্গে চাই নিজের ভিতর শ্ৰেয় সম্বন্ধে একটা ধারণা, যার মূল্যে স্বাধীনতা হয়ে ওঠে বিশেষ মূল্যবান। নারীর ভিতর যা মূল্যবান তাকে আবিষ্কার করবার প্রশ্নও এই থেকে ওঠে।

প্রাচীন ঐতিহ্যে নারীচরিত্র নিয়ে দুই পরস্পরবিরোধী ধারণার কথা আগেই বলেছি। দু’টির কোনোটিই সম্পূর্ণ সত্য নয়, আবার দুটিতেই কোনো-না-কোনো অর্থে কিছু সত্য আছে। নারীকে যখন প্রাচীন শাস্ত্রে পাপের পথ বলা হয়েছে তখন তাতে প্রকাশ পেয়েছে নারীর প্রতি সাধুপুরুষদেরও যে প্রবল আকর্ষণ, তারই বিরুদ্ধে একটা সতর্কবাণী। অর্থাৎ, এই নারীনিন্দায় যে সত্য আছে সেটা প্রধানত পুরুষের প্রকৃতির দুর্বলতা সম্বন্ধে প্রযোজ্য। আবার যুগ যুগ ধরে শিল্পীরা নারীর যে সৌন্দর্য ও সুষমায় মণ্ডিত চিত্র অক্লান্ত নিষ্ঠায় তুলে ধরেছে, আজকের নারী আন্দোলনের নেতারা যখন তাতে শুধু কপটতাই দেখে তখন সেই দোষারোপে যতোটা ক্রোধ থাকে ততোটা বোধ থাকে না। নারীর এই ক্রোধ শুধু পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, নিজের প্রকৃতিরও বিরুদ্ধে। এতে একটা আতিশয্য আছে যেটা দুঃখজনক।

আজকের পুরুষশাসিত সমাজের বৃহৎ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে যেসব নারী উল্লেখযোগ্য সাফল্যের অধিকারিণী হয়েছে তাদের সঙ্গে প্রায়ই পুরুষের চরিত্রগত পার্থক্য লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পুরুষের সংস্কৃতি যেন তাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। সাম্যের ঝোঁকে নারী তার নারীত্বকে বর্জন করবার সাধনায় ব্যস্ত। অথচ এ বিষয়ে কি আর সন্দেহ আছে যে, এ যুগে পুরুষ যে সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি কিংবা চরিত্রবৈশিষ্ট্য গড়ে তুলেছে শুধু তার অনুকরণ করে সভ্যতার সংকট থেকে মানুষকে রক্ষা করা যাবে না?

নারীর মূল্য সম্বন্ধে রবীন্দ্রচিন্তার দুয়েকটি মূল কথা এখানে স্মরণ করবার যোগ্য। যেহেতু উনিশশতকী ব্রাহ্ম ঐতিহ্য থেকে কবির চিত্ত বিস্তার লাভ করেছিল একটা পেলব্ধ ঔদার্যে, অতএব তাঁর চিন্তায় পরিবর্তন ও গতিশীলতা প্রত্যাশিত। তবু সেই চিন্তার ভিত্তিতে কিছু স্থায়ী উপলব্ধি ছিল। সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে নারীকে তিনি চেয়েছেন, কিন্তু সে নয় পুরুষশাসিত সংস্কৃতির অনুকরণশীল নারী। নারীত্ব বলতে যা কিছু যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে তার সবই উপেক্ষার যোগ্য, সবই মূল্যহীন, সবই বর্জনীয়, এমন চিন্তায় সত্য। নেই। নারীত্বের ভিতরই এমন কিছু বিশিষ্টতা আছে জৈব স্তর থেকে যা উন্নীত হয়েছে সংস্কৃতিতে, মমতা শ্রী ধৈর্য, যাকে কবি বিশ্বের কাজে আহ্বান করেছেন।

এই কথাটা রবীন্দ্রনাথ নানা স্থানে নানাভাবে বলেছেন। নারী ও পুরুষের ভিতর যে ভেদ আমরা দেখি তার সবটাই যে সমান সত্য অথবা শ্রদ্ধেয় নয় একথাও অবশ্য তিনি জানতেন। ঐ ভেদ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, “মানুষ আপনার কল্পনা ও সংস্কারের দ্বারা তাকে অনেক দূর বাড়িয়ে তুলেছে।” (বিচিত্রা, ১৯২৮) তাই বলে নারী ও পুরুষ অভিন্ন, এমন চিন্তাও তাঁর আছে উপযোগী কিংবা গ্রহণীয় মনে হয়নি। নারী পুরুষের ভিন্নতা কিছুটা প্রকৃতির সৃষ্টি। কিছুটা ইতিহাসের। সেই ইতিহাসকে স্বীকার করে নিয়েই তার ভিতর থেকে একটা মহত্তর সমন্বয়ের ধারণা তিনি তুলে ধরেছেন।

ঐতিহ্যের সূত্রে নারী ও পুরুষ যা-কিছু পেয়েছে তার সবটাই সমান মূল্যবান নয়। ছোটো সীমার ভিতর নারীকে দীর্ঘদিন আবদ্ধ থাকতে হয়েছে বলেই তার চরিত্রে এমন কিছু সংকীর্ণতা এসে গেছে যাকে আজ সচেতনভাবে অতিক্রম করা আবশ্যক। অপর পক্ষে ক্ষমতার লড়াই ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিষ্ঠুরতার ভিতর দিয়ে পুরুষের চরিত্রে গভীরভাবে ঢুকে গেছে এমন একটা বর্বরতা, মানুষের সভ্যতায় যেটা বারবার বিপদ ডেকে আনছে।

কথাটা আরো একটু স্পষ্ট করে তোলা যাক। আজকের জগৎ যে-নীতিতে চলছে তার সবটাই কি সমর্থনযোগ্য নিছক প্রয়োজনের যুক্তিতে? ক্ষমতা যাদের হাতে তাদের ব্যাখ্যাটা অবশ্য ঐ রকমই। যুদ্ধ ঘোষণা করে বলা হয় সেটা প্রয়োজন ছিল। আমলাতন্ত্রের অনম্য স্তরভেদ আর অজস্র জটিলতা, সব কিছুর জন্যই আছে প্রয়োজনের যুক্তি। এই সব প্রচণ্ড ‘বাস্তব’ যুক্তির পিছনে উঁকিঝুঁকি মারছে একটা মূঢ় ঐতিহ্যের প্রকোপ। শিকারে অভ্যস্ত মানুষকে শিকারের সুযোগ খুঁজতে হয়, মাতাল যেমন খোঁজে মদ। প্রতিদ্বন্দ্বিতার নেশায় বাড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, হিংসায় হিংসা। নারীর ভিতর আছে অন্য এক তেজ, শতাব্দীসঞ্চিত মাতৃত্বের তেজ, অন্য এক লাবণ্য, প্রকৃতিসঞ্জাত, অগণিত শিল্পীর সাধনায় আর আত্মনিবেদনে স্বীকৃত। পৌরুষের যেমন একটা আদর্শ রূপ আছে তেমনি নারীত্বের। যাকে বাস্তব বলে আমরা চিনি শুধু তাই দিয়ে আমরা রক্ষা পাই না।

নিবেদিতার ভিতর রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন এক লোকমাতার ভাব। দুঃখী মানুষের প্রতি মাতৃস্নেহের প্রসার, নারীর আত্মার বিস্তারের, আত্মীয়তার প্রসারের, রূপ এই। কবি একে দিতে চেয়েছেন সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি। একে অস্বীকার করলে ঐতিহ্যের একটা শক্তিকে অযথা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। সংসারে এর প্রয়োজন আছে। আশা রাখতে হবে যে, নারীর এই শক্তি নিযুক্ত হবে সমাজের কর্কশতা ও উচ্চাবচতাকে একটা সমতার দিকে চালনা করবার প্রচেষ্টায়। এ দায়িত্ব অবশ্য শুধু নারীরই নয়, পুরুষেরও। তবু ঐতিহ্যই নারীকে দিয়েছে একাজে নেতৃত্বের বিশেষ যোগ্যতা। নারীর এই ছবিতে আছে বাস্তব ও আদর্শকল্পনার সমাবন্ধ। একেও ইতিহাসের কাজে লাগাতে হবে। নারী ও পুরুষের ভিতর জৈব স্তরে যেমন একটা পরিপূরকতা আছে তেমনি মানুষের সংস্কৃতির ভিতরও আছে পৌরুষ ও নারীত্বের দ্বৈতে বিধৃত ঐক্যের প্রতিশ্রুতি। সভ্যতার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে এরই প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ একটা নতুন আশার আলো দেখেছিলেন।

মেয়েরা যে বাইরের বিশ্বে আজ দলে দলে যোঙ্গ দিচ্ছে এই ঘটনাকে তিনি স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর শেষ জীবনের চিন্তায় এটা বিশেষভাবে স্পষ্ট। পঁচাত্তর বছর বয়সে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি বলছেন “ঘরের মেয়েরা প্রতিদিন বিশ্বের মেয়ে হয়ে দেখা দিচ্ছে। একা পুরুষের গড়া সভ্যতায় যে ভারসামঞ্জস্যের অভাব প্রায়ই প্রলয় বাধাবার লক্ষণ আনে, আজ আশা করা যায় ক্রমে সে যাবে সাম্যের দিকে।…আদিকাল থেকে পুরুষ আপন সভ্যতাদুর্গের ইটগুলো তৈরি করেছে নিরন্তর নরবলির রক্তে…এ সভ্যতা ক্ষমতার দ্বারা চালিত, এতে মমতার স্থান অল্প। সভ্যতাসৃষ্টির নূতন কল্প আশা করা যাক। এ আশা যদি রূপ ধারণ করে তবে এবারকার এই সৃষ্টিতে মেয়েদের কাজ পূর্ণ পরিমাণে নিযুক্ত হবে সন্দেহ নেই।” প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী’তে ১৯৩৬ সালে, ‘নারী’ শিরোনামে। যে সমাজকে মানুষ লাভ করেছে অতীত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে, নারী সেখানে স্থান করে নেবে শুধু পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়। কোনো এক যুগে স্ত্রী পুরুষের পরিপূরক রূপ নিয়েছিল ঘর ও বাইরের ভিতর বিচ্ছিন্নতায়। সে যুগের অবসান সূচিত হয়েছে। আজ “ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে বিশ্বের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে নারী ও পুরুষের স্থান হবে পাশাপাশি অন্য এক ঐতিহাসিক কাজের যুগ্ম সম্পাদনে। “অতি দীর্ঘকাল মানবসভ্যতার ব্যবস্থা ভার ছিল পুরুষের হাতে। এই সভ্যতা হয়েছিল একঝোঁকা।” সামঞ্জস্যস্থাপন ছাড়া এখন বিপর্যয় ঠেকাবার উপায় নেই, রবীন্দ্রনাথের এই বিশ্বাস। পরিবার পল্লী ও নগরসহ বৃহত্তর সমাজের নতুন বিন্যাসে নারীর সেবা ও কল্পনা, পরিচালিকা শক্তি ও সৃষ্টির তেজ যদি সভ্যতাকে নিয়ে যায় বৈষম্যমোচনের দিকে, নিযুক্ত হয় এক আশ্রয়দাত্রী আত্মীয়বুদ্ধির বিকেন্দ্রিত বাস্তব রূপায়ণে, তবেই নারীর মুক্তিতে উচ্চারিত হবে সমাজের সামগ্রিক মুক্তির আশ্বাস। সমাজকে মুক্ত করতে গিয়েই নারী অর্জন করবে তার নিজের মুক্তি। এই পথেই আশা করা যায় মনুষ্যত্বেরও ঐতিহাসিক রূপান্তর। সেটা নারী ও পুরুষ উভয়েরই ব্যক্তিসত্তার রূপান্তর। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বে কেউ কেউ লক্ষ করেছেন নারীত্বের আদল। অথচ তাঁর পৌরুষ ছিল উজ্জ্বল ও তেজস্বী। মনুষ্যত্বের পূর্ণতাকে আমাদের চিনে নিতে হবে একা পুরুষের ভিতর নয়, নারীর ভিতরও নয়, বরং অর্ধনারীশ্বরের সেই প্রাচীন প্রতিমায় মানুষের খণ্ডিত সংস্কৃতির ভিতরে যা সঞ্চার করতে পারে একটা প্রতীকী সার্থকতা।

.

ভবিষ্যতের সমাজের অন্য একটা ছবি কল্পনা করা কঠিন নয় আজকের দৃষ্টিতে যেটা। অদ্ভুত, অনেকের কাছে ভয়াবহ। বিয়ে ব্যাপারটা সেই সমাজে সাধারণ নিয়মের ভিতর নেই, সেটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। অধিকাংশ শিশুর জন্ম ঘটছে সেখানে বিবাহবন্ধনের বাইরে, মাতৃজঠরেরও বাইরে। একক পুরুষ অথবা নারী নিঃসঙ্গতা এড়াবার জন্য কোনো শিশুকে হয়তো গ্রহণ করছে নিজের রুচি অনুযায়ী, আবার যখন খুশি তাকে তুলে দিচ্ছে সরকারী কিংবা বেসরকারী সেবাপ্রতিষ্ঠানের হাতে। ছবিটাকে সম্পূর্ণ করবার প্রয়োজন নেই।

অনুমানের হাতে বাকিটা ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এটা যদিও কল্পনা তবু আজকের উন্নত সমাজের কিছু ঝোঁক অঙ্গুলিনির্দেশ করছে এই দিকেই।

এই সম্ভাব্য ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে যেসব আপত্তি উঠবে তার কিছুটা যে আমাদের পুরনো সমাজের অভ্যাসজাত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। দুয়েকটি গুরুতর সংশয় তবু থেকেই যায়।

যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে মানুষ এসেছে কিছুটা বাস্তব প্রয়োজনে, কিছুটা মনেরও প্রয়োজনে। বাস্তব প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে যন্ত্রেও, এ যুগে তারই প্রাধান্য। চেষ্টা চলছে মানুষের হৃদয়ের প্রয়োজনটাও যথাসম্ভব যন্ত্র দিয়েই মেটাবার। অর্থাৎ, মানুষকে যথাসম্ভব বাদ দিয়েই যাতে মানুষের কাজ চলে সেই চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। আমরা সাম্যের ইমারত গড়ে তুলবার চেষ্টা করছি এই রকমই একটা যান্ত্রিকতার ভিত্তিতে।

এতে একটা অসুবিধা আছে। ভালেবাসা শুধু পেতে চায় না, দিতেও চায়। যন্ত্র পাবার ইচ্ছেটাকেই প্রবল করে তোলে, দিতে শেখায় না। যন্ত্র মানুষকে করে তোলে ভোগবাদী, ত্যাগী করে না। যদিও যন্ত্র মানুষেরই সৃষ্টি তবু যান্ত্রিকতার গুণে অধিকাংশ মানুষ স্রষ্টার ভূমিকা থেকে নির্বাসিত। এক অসহনীয় একাকিত্বের দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে আধুনিক মানুষ। কিছু সুখকর উত্তেজনার সাহায্যে সেই কৃষ্ণ গহ্বর থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে চাইছে সে। কিন্তু এ পথে স্থায়ী উদ্ধার সম্ভব নয়।

সৃষ্টির কাজের মূলে আছে একটা যোগের আনন্দ। নারী ও পুরুষের ভিতর প্রকৃতি রচনা করেছে যোগের আনন্দের একটি স্বাভাবিক ক্ষেত্র। সে আনন্দ খণ্ডিত হয়েছে দীর্ঘকাল ধরে কখনো নারীর সামাজিক অধীনতার অবরুদ্ধতায়, কখনো ভোগলিপ্সু প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজের বিষাক্ত বাষ্পে, নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ভিতরও যার ব্যাপক প্রবেশ ঠেকানো যায়নি। যার অন্তর্নিহিত পরিণতি যোগের উত্তরণে, তাকে পরিপূর্ণ করা যাবে না করুণাহীন স্বাতন্ত্রের অহমিকায়। আমাদের যুগের পক্ষে এ এক কঠিন পরীক্ষা। ভবিষ্যতের সমাজ কেমন হবে আমরা জানি না। সে ____ ভিত্তিতে থাকবে কি না ভালোবাসা, রক্ষা পাবে কি না দেবার আর পাবার আনন্দ ____ প্রশ্ন। এরপর এটা আর নারীমুক্তির আলাদা প্রশ্ন থাকে না, হয়ে ওঠে এযুগের মানুষের সমস্যা, সমকালীন মানবসভ্যতারই দায়। নাগরিক সংস্কৃতির আধিপত্যের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠেছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র। আধুনিকতার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও বিশিষ্ট কীর্তি, তার পিছনে এই দৃষ্টিভঙ্গির দান অনেকখানি। কিন্তু এরই ফলে আবার একটা সংকট ক্রমে তীব্র হয়ে উঠছে। এযুগে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যবহারিক স্বার্থ। এটাই আধুনিক মানুষের আচরিত জীবনদর্শন। পুরুষ চলছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র ও উপযোগবাদের পথ ধরে। নারীমুক্তির নামে যে সব অধিকার আজ দাবি করা হচ্ছে তারও মূলে আছে একই কথা। নাগরিক আধুনিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয় বরং তার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি, এই আন্দোলন এবং তার বিবিধ দাবী। অথচ আজ সন্দেহ দেখা দিয়েছে ঐ জীবনদর্শনটা নিয়েই। ঐখানেই সংকটের মূল।

রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত হয়েছিলেন। ১৯৩০ সালে ইয়োরোপ থেকে ফিরে আসবার পর গ্রামবাসীদের কাছে এক ভাষণে এই দুশ্চিন্তার কথা তিনি নিবেদন করেছিলেন অতি সরলভাষায়। “একটি কথা তোমাদের কাছে বলা দরকার–অনেকেই হয়তো তোমরা অনুভব করতে পারবে না কথাটি কতখানি সত্য। পশ্চিমের দেশবিদেশ হতে এত দুঃখ আজ প্রকাশ হয়ে পড়ছে ভিতর থেকে–এরকম চিত্র যে আমি দেখব মনে করিনি। তারা সুখে নেই।” সেই অসুখ বেড়েই চলেছে। ব্যবহারিক সম্বন্ধ নয়, যাকে তিনি বিশেষ অর্থে ‘আত্মীয়সম্বন্ধ বলেছেন, যাতে আত্মার প্রকাশ, সমাজের মূলে তাকে রক্ষা করতে না পারলে মানুষের সমাজ সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পাবে না, এই ছিল সেদিন রবীন্দ্রনাথের সতর্কবাণী। তিনি পথ খুঁজছিলেন এক দ্বান্দ্বিক উত্তরণের। পৌরুষ ও নারীত্বের পরিপূরকতায় সেই উত্তরণ। যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন ব্যক্তিত্বের মূল্যেও বিশ্বাসী সেই কারণে এ বিষয়ে তাঁর উপলদ্ধি বিশেষ মূল্যবান। যুগচেতনার এক গভীর স্তর থেকে উত্থিত এই প্রশ্ন লিঙ্গের দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করে যায়। নারীমুক্তির নেতাদের চিন্তার পরিধির ভিতর এ প্রশ্নটাকে রাখা চাই। এছাড়া মনুষ্যত্বের মুক্তি কল্পনা করা কঠিন। সব সার্থক আন্দোলনই সার্থকতর হয়ে ওঠে নিজেকে অতিক্রম করার ভিতর দিয়ে। সমাজ সংস্কৃতি স্মৃতি (১৯৮৭)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *